1 of 3

১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে

খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
কাল হল তাঁতির হেলে গোরু কিনে

সন্ধে হয়েছে। মেঘ-থমকানো আকাশ। রাস্তার বাতি কেমন যেন মনমরা হয়ে জ্বলছে। দূর থেকে দেখছি বাড়ির সামনে বিদঘুঁটে চেহারার একটি লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইনি আবার কিনি? গায়ে একটা আদ্দির পাঞ্জাবি। ফিনফিন করছে। এমন কাপড়ের পাঞ্জাবি বিশেষ এক শ্রেণির লোকেরাই পরেন। পাঞ্জাবিটার ওপর যথেষ্ট অত্যাচার হয়েছে, তা না হলে এত কুঁচকে যেত না। তোবড়ানো গালের দু’পাশে গালপাট্টা নেমেছে। চোখদুটো ভেতরে ঢুকে গেলেও, মণিদুটো সাপের মতো জ্বলছে। পাকানো চেহারার অদ্ভুত একটি লোক, হেলে-পড়া ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গা-টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। কিছু কিছু মানুষের শরীর থেকে অদৃশ্য একটা তরঙ্গ বেরোতে থাকে, অনেকটা মৃত্যুরশ্মির মতো, ক্লোরোফর্মের মতো। শরীর অবশ করে দেয়।

লোকটিকে পাত্তা না দিয়ে সদরে এসে দাঁড়ালুম। কড়া নাড়তে যাচ্ছি, রাস্তার অপর পার থেকে লোকটি মিহি গলায় বললে, শুনছেন?

হাত যেন অবশ হয়ে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ স্যার আপনাকে। এই বাড়িতে থাকেন?

এগিয়ে গিয়ে লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে বললুম, কেন বলুন তো?

শরীর থেকে বাসি আতরের ঘিনঘিনে গন্ধ বেরোচ্ছে। মুখে অস্পষ্ট পেঁয়াজ আর রসুনের বাস।

প্রফুল্লবাবু এই বাড়িতে থাকেন?

হ্যাঁ থাকেন, এখন নেই।

তার স্ত্রী আছেন?

কেন বলুন তো?

খুকখুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে, সেই সন্দেহজনক লোকটি বললে, আমার একটু দরকার ছিল।

আপনি কে?

আমি একজন লোক।

একজন অপরিচিত মানুষ, হঠাৎ এই ভরসন্ধেবেলা কোনও ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে পারে?

তেমন কোনও খবর থাকলে পারে বই কী স্যার!

আমি তার ভাইপো, আমাকে বলতে পারেন।

তা স্যার রাস্তায় দাঁড়িয়ে তো সেসব কথা হতে পারে না। অনেকক্ষণ এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। দোতলার জানলায় একবার এক ভদ্রমহিলা এলেন, বেশ সুন্দরী, একবার চোখাচোখি হতেই সরে গেলেন। ভাবলেন কোনও খচ্চর লোক দাঁড়িয়ে আছে।

আঃ, কী যা-তা কথা বলছেন?

ভুল হয়ে গেছে স্যার। লাইনের লোক তো! ক্ষমাঘেন্না করে নেবেন। তা স্যার, একটু বসা। দরকার। এক গেলাস জল, এক কাপ চা।

চলুন, আমরা কোনও দোকানে গিয়ে বসি।

কোন দিকে? বলে, যেদিকে দোকান, লোকটি তার উলটো দিকে তড়বড় করে হাঁটতে লাগল। ডেকে বললুম, ও দিকে নয়, এই দিকে।

সন্ধে বলে এখনও পর্যন্ত বাড়ির কারুর নজরে পড়িনি। মেয়েরা মনে হয় গা ধুচ্ছে, নয়তো সন্ধে দেখাচ্ছে।

বিষ্টুদার চায়ের দোকানে এই সময়টায় তেমন খদ্দের থাকে না। দোকান জমবে রাত আটটার পর। দশটা বাজবে এগারোটা বাজবে, গুলতানি চলতেই থাকবে। শখের অভিনেতা বিশুদা এসে বসবেন এই এতখানি রাজপুত্রের মতো চেহারা নিয়ে। বড় মজার মানুষ।

লোকটি দোকানের বেঞ্চিতে বসেই অর্ডার দিলে, এক গেলাস জল দাও ভাই। জল শেষ করেই বললে, বাঃ, ভাল কেক রয়েছে। দেখি ভাই একটা কেকের মাথা দাও, একটা ডবল হাফ চা।

হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ল বোধহয়, আপনি কিছু খাবেন না স্যার?

চা খাব। বিদা, আমাকে শুধু চা।

বিষ্টুদা প্রথম থেকেই ভুরু কুঁচকে লোকটিকে দেখছে। কিছুতেই আমার সঙ্গে মেলাতে পারছে না। দোকানের একেবারে পেছন দিকে মুখোমুখি বসেছি। কী গেরো! লোকটির গায়ের গন্ধ অসহ্য লাগছে। এক মশারিতে এর সঙ্গে শোবে কে? কাকিমা সেদিন হঠাৎ একটা অসভ্য কথা বলে ফেলেছিলেন, সব হাঁড়িরই সরা জোটে পিন্টু? মহিলাদের মাঝে মাঝে মুখ বড় আলগা হয়ে যায়। আর এটা সাধারণত হয় হুহু দুপুরে। লাল মেঝেতে গা এলিয়ে দিয়ে, পান চিবোতে চিবোতে। মেঝে থেকে উঠে যাবার পর, পড়ে থাকে খোঁপার তেলের দাগ, শরীরের ঘামের ছাপ। সারাপৃথিবী জুড়ে মানুষের মন খারাপের কত আয়োজন। মন আকর্ষণের কতরকম ফাঁদ।

কেকের মুন্ডু থেকে একটা টুকরো ভেঙে নিয়ে মুখে পুরে ওস্তাদ বললে, কতদিন হল?

কী কতদিন হল?

প্রফুল্লবাবু কতদিন হল ফেরেননি?

বেশ কিছুদিন হল। দিন পনেরোকুড়ি তো হবেই।

এতদিন একটা লোক বাইরে, আপনারা কোনও খোঁজপাত করলেন না!

উনি মাঝে মাঝেই তো এইরকম বাইরে চলে যান, বেশ কিছুদিন পরে আবার ফিরে আসেন।

অ।

ওস্তাদ এবার আধখানা কেক মুখে পুরে চিবোতে লাগল। আয়েশে চোখ বুজে এসেছে। বিষ্টুদা দু’কাপ চা দিয়ে গেলেন। দেবার সময় লোকটির দিকে সেই সন্দেহের দৃষ্টি। কাছ থেকে বেশ ভাল করে মুখটা একবার দেখে নিলেন। দেখার মতোই জিনিস, এ পাড়ায় এই প্রথম আবির্ভাব। অনেকটা লটরপটর খায়ের মতো দেখতে। খয়ের খা-ও হতে পারে।

চায়ের কাপে ফড়ড় করে একটা চুমুক মেরে ওস্তাদ বললে, এবারে কি আর ফিরবেন?

কেন?

ওস্তাদ আর এক চুমুক চা সেরে বললেন, এসব কথা ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে হলেই ভাল হত।

আপনি কে বলুন তো?

লোকটি ভালমানুষের মতো মুখ করে বললে, মনে করুন, আমি স্যার একজন দালাল।

দালাল? কীসের? জমিজায়গার, ওষুধের?

না-আ স্যার। ওসব বড় ব্যাপার। মেয়েমানুষের দালাল। যাত্রা, থিয়েটারে, বিয়েবাড়ির নাচেটাচে অ্যাকট্রেস সাপ্লাই করি স্যার!

নিজেকে শামুকের মতো খোলে ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মেয়েমানুষ শব্দটাই কেমন যেন, তার আবার দালাল। তার পাশে বসে চা খেতে হচ্ছে। কী বলবে, তারই অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে থাকা।

বিষ্টুদাকে তাক করে বললে, চা-টা বেশ ভালই বানিয়েছ ওস্তাদ।

বিষ্টুদা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। চায়ের কারবার করলেও খুব ভদ্র মানুষ। যথেষ্ট লেখাপড়া করেন। থিয়েটারের ভীষণ ভক্ত। শরৎচন্দ্র সবচেয়ে প্রিয় লেখক। দোকানের দেয়ালে সার সার ছবি ঝুলছে, শরৎচন্দ্র, দুর্গাদাস, শিশির ভাদুড়ী, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস। একটা উটকো লোকের এই ধরনের আলটপকা কথা গায়ে ছুঁচের মতো বিধছে।

লোকটি আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ওস্তাদ আর নেই স্যার।

ওস্তাদ কে?

প্রফুল্লবাবুকে আমরা সবাই ওস্তাদ বলি স্যার! অমন হাত কোথায় পাবেন? তবলায় যেন খই ফুটিয়ে ছেড়ে দিতেন।

কী বলতে চান, একেবারে পরিষ্কার করে বলুন না।

আমি তো তাই বলতেই চাই। তবে দু’বার করে না বলে, একবারে বলতে পারলেই ভাল হয়। চলুন না, ওস্তাদের স্ত্রীর কাছে একবার যাই।

সে উপায় নেই, যা বলার আমাকেই বলুন।

হ্যাঁ, তা হলে বলেই ফেলি। একটা জায়গা থেকে আমরা বাসে করে ফিরছিলুম, আমাদের দলবল নিয়ে। দলে ছিল লক্ষ্মীবাই, উমাবাই, আমি, হীরাচাঁদ, আরও অনেকে। হীরাচাঁদের সঙ্গে ওস্তাদের একটা খটাখটি চলছিল। দুটো ওস্তাদের মধ্যে একটা মেয়েছেলে পড়লে যা হয়। আপনি স্যার ছেলেমানুষ, এসব যত কম শোনেন ততই ভাল। লক্ষ্মীবাই দু’জনকেই পুষছিল। দুটোরই যেন এঁড়ে লেগে গিয়েছিল। সেসব অনেক ব্যাপার। আপনি স্যার নাবালক, ওসব না জানাই ভাল। চন্দ্রকোনার কাছে বাস যখন এল তখন মাঝরাত। হীরাচাঁদ বললে গাড়ি থামাও। উমাবাই তামাক খাবে। রাস্তার পাশে বাস দাঁড়াল। তামাকচি তামাক সাজতে বসল। ওস্তাদজি আর ফটকে গেল জল ফেরাতে। গেল তো গেলই, তাদের আর আসার নাম নেই। বাস দাঁড়িয়ে রইল এক ঘণ্টা। হীরাচাঁদ আর আমি ঘুরে এলুম। দুজনেই বেপাত্তা।

গল্পটা বেশ ভালই কেঁদেছে অষ্টাবক্র। টেবিলে টকটক আওয়াজ করে বললে, আর এক কাপ চা ছাড়ো ওস্তাদ।

বিষ্টুদা মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন। কী করব, সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। চা এসে গেল। চুমুক দিয়ে, জিভে আর দাঁতে এক ধরনের গ্রাম্য শব্দ করে, গল্পের খেই ধরলেন, হীরাচাঁদ বললে, দাও গাড়ি ছেড়ে দাও, ও নিমকহারাম দুটো এখানেই পড়ে থাক। হীরাচাঁদ স্যার বেনারসের গুন্ডা, ও যা বলবে শুনতেই হবে। গাড়ি চলতে শুরু করল।

গল্পের সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে ঘটনা মেলাবার চেষ্টা করলুম। কোথায় চন্দ্রকোনা আর কোথায় কলকাতার মর্গ! আমি পুলিশ হলে, মারতুম ব্যাটার তলপেটে এক কোঁতকা, সত্যি কথা বেরিয়ে আসত হুড়হুড় করে।

সেই ফটকেকে সেদিন আমি গার্ডেনরিচে দেখলুম, বললুম, বল ব্যাটা, তুই আর ওস্তাদ সে রাতে কোথায় বেপাত্তা হলি? ফটকে আবোল তাবোল বকছে। কোনও কথার সঙ্গে কোনও কথার মিল নেই।

লোকটি চায়ে লম্বা এক চুমুক মেরে, কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। এই মুহূর্তে আমার সেই ভয়টা আবার চেপে এল। এ তো দেখছি পুলিশ কেস। খুনের মামলা। ব্যাপারটা এইভাবে চেপে রাখা যায় না। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোতে পারে।

আপনি হঠাৎ এখানে এলেন কেন, এতদিন পরে?

বাঃ, খবরটা জানাতে হবে না? এই তো আপনারা কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। কিছুই জানেন না।

বেশ, যা জানার তা তো জানা হল, ব্যবস্থা যা করার তা আমরাই করব। আপনি এখন আসুন তা হলে। লোকটি চোখমুখ কুঁচকে বললে, স্যার, এর মধ্যে একটা ছোট্ট ব্যাপার ছিল। ওস্তাদের কাছে আমি হাজার দুয়েক টাকা পেতুম। টাকাটা আমার ভীষণ দরকার স্যার। স্ত্রীর কাছে কিছু সোনাদানা থাকবেই। একটা হার, কি একটা বালা! যা হয় একটা কিছু পেলে, আমি নাচতে নাচতে চলে যাই।

আপনি যে টাকা পেতেন, তার তো কোনও প্রমাণ নেই ভাই।

খুব আছে। বলেন তো ফুলেশ্বরীকে নিয়ে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে পড়ব। আপনার বাবার সঙ্গেও তখন দেখা হয়ে যাবে।

ফুলেশ্বরীটা কে?

আজ্ঞে, সে এক ডাগর মেয়েছেলে। লাইনে সবে এসেছে।

শুনে, আমার মুখ শুকিয়ে গেল। এ যেন নরকের দূত! একের পর এক দাঁচ মেরে চলেছে। একে ছেড়ে দিলে, যা হবার তা তো হয়েইছে, এরপর ঘোলা জল আরও ঘোলা করে দিয়ে যাবে শয়তান! নিজের হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকালুম। এটা পেলে সন্তুষ্ট হবে কি?

শুনুন, এসব কথা ওঁর স্ত্রীকে এখন না বলাই ভাল। আপনি আমার এই ঘড়িটা বরং নিয়ে যান। এখনকার মতো কাজ চালান, পরে যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে।

লোকটি বেশ কায়দার গলায় বললে, কী ঘড়ি?

ওমেগা গোন্ড।

নামটা তো বেশ চেনাচেনা মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, দামি ঘড়ি। যা-তা নয়।

দিন তা হলে। গোন্ড মানে তো সোনা, আসল সোনা?

সামান্য একটু খাদ মেশানো আছে, তা না হলে ঘড়ির কেস হবে না যে।

ঘড়িটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখেই পাশ-পকেটে চালান করে দিলে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ঘড়িটা পইতের সময় মামা আমাকে দিয়েছিলেন। মাতুলের স্মৃতি আজ হাত থেকে খুলে চলে গেল। মানুষ কীভাবে উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে যায়! কোথাকার কে প্রফুল্লকাকা, হঠাৎ এলেন। এমন এক চরিত্রের মানুষ, যাবার সময় জল ঘোলা করে দিয়ে সরে পড়লেন। কোথাকার। জল এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে!

ওস্তাদ বললে, আমি তা হলে আবার কবে আসব স্যার?

আবার আসবেন কেন?

বাঃ এইতেই হয়ে যাবে নাকি! এটা বেচলে, ক’টা টাকাই বা আমার হবে! সাত দিন পরে আসি?

আপনাকে আসতে হবে না, ঠিকানাটা রেখে যান।

ঠিকানা! লোকটি ইস্পাতের মতো হেসে উঠল। আমার ঠিকানায় স্যার আপনি পৌঁছোতে পারবেন না। সে জায়গায় যেতে হলে আলাদা চরিত্র চাই। আপনি অতি নাবালক। আমিই আসব। জায়গাটা তো চেনাই হয়ে গেল। আসতে কোনও অসুবিধে হবে না। আচ্ছা আজ আসি। রাত হয়ে গেল।

আমাকে কোনও কথা বলার অবসর না দিয়ে লোকটি দোকান থেকে নেমে পড়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল। হাটার ধরনটা অনেকটা শিম্পাঞ্জির মতো। হাতদুটো সামনে মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুলছে।

লোকটি চলে যেতেই বিষ্টুদা বললে, আজকাল কী সব লোকের সঙ্গে মিশছ! চেহারা দেখলেই মনে হয় মাগির দালাল।

বিষ্টুদার মুখ ভীষণ গম্ভীর। মানুষটিকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। এ পাড়ার সেরা মানুষ। পরোপকারী। পরচর্চায় নেই। দোকানে বসে কেউ পরচর্চা করলে, সোজা হাত জোড় করে বলে দেয়, আপনি দয়া করে আসুন। এ পাড়ার সব ছেলে ভাল হোক, লেখাপড়া শিখে ভাল চাকরি পাক, সবসময় এই প্রার্থনা। দীনু যেবার লেটার পেয়ে পাশ করল, বিষ্টুদা সবার আগে এক বাক্স সন্দেশ নিয়ে দেখা করতে ছুটল। ফিরে এল, চোখের দু’কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। যেন নিজের ছেলে। লেটার নিয়ে পাশ করেছে। দোকানসুদ্ধ লোককে বিনা পয়সায় চা আর লেড়ো বিস্কুট খাইয়ে দিল। পরোপকারের শেষ নেই। মেনিদার মেয়ে বারান্দা থেকে ঝুঁকে পেয়ারা পাড়তে গিয়ে উলটে পড়ে গেল। দুপুরবেলা পাড়ায় কেউ নেই। বিষ্টুদা কোলে নিয়ে হাসপাতালে ছুটল। রক্তে সারাশরীর ভাসছে। বিভূতি মাস্টারমশাই ব্যাচেলার মানুষ। জগাদের বাইরের ঘরে জ্বরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছেন। বিষ্টুদা ছুটছে, একবার ডাক্তার নিয়ে, একবার ওষুধ নিয়ে, একবার সাবু নিয়ে। বয়স্ক মাননীয় মানুষ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, বিষ্টুদা ছুটে এসে পায়ের ধুলো নিচ্ছে। পিতা বলেন, এরা হল শাপভ্রষ্ট সাধক। বিষ্টুদা আর বিষ্টুদার স্ত্রীকে পাশাপাশি দেখলে আমার চোখে জল এসে যায়, যেন সাক্ষাৎ হর-পার্বতী! দোকানের দেয়ালে ঝুলছে হাসিহাসি মুখ একটি শিশুর ছবি। যার কথা বলতে বলতে বিষ্টুদার চোখ জলে ভেসে যায়। সাত বছরের ছেলে ম্যানেনজাইটিসে মারা গেল। হয়ে গেল প্রায় বছর বারো। কেন জানি না, সেই মুহূর্তে মনে হল, বিষ্টুদাকেই বলা যায় আমার চেপে রাখা গোপন কথা। হত্যাকারীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি দিনের পর দিন।

বিষ্টুদা বললেন, এইসব লোকের সঙ্গে মেশো কেন? তুমি কত বড় বংশের ছেলে জানো?

বিষ্টুদাকে হাত ধরে দোকানের পেছনে টেনে নিয়ে গেলুম। বুঝতে পারছেন না আমি কী করতে চাইছি। অবাক হয়ে গেছেন। দোকানে এখন একটিও খদ্দের নেই। এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।

এইখানে বসুন। ভীষণ জরুরি কথা আছে।

বিষ্টুদা বেশ ভয় পেয়ে গেছেন, কী ব্যাপার বলো তো!

খুব একটা সমস্যায় পড়ে গেছি। নিজের তৈরি ফঁদে নিজেই পড়ে গেছি।

পুরো ব্যাপারটা বিষ্টুদাকে বললুম। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। এমনকী এই লোকটির আসা, ঘড়ি খুলে দেওয়া সব বলতে পেরে মনটা বেশ হালকা হয়ে গেল।

সব শুনে বিষ্টুদা অ্যা হাঃ হাঃ, চুক চুক করে একটা আক্ষেপের শব্দ করলেন। তোমার মতো বোকা ছেলে পৃথিবীতে আর দুটো নেই। ঝট করে ঘড়িটা খুলে দিয়ে দিলে! আমাকে বলবে তো! মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।

কী করব? লোকটাকে থামাতে হবে তো। কাকিমাকে আমি জানতে দিতে চাই না।

শোনো শোনো, খবরটা চেপে রাখা খুব অন্যায় হবে। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকে বিধবা হতে হয়। শ্রাদ্ধশান্তি করতে হয়।

অপঘাতে মারা গেলে শ্রাদ্ধ হয় না।

বিধবা তো হতে হয়!

যিনি মারা গেছেন তিনি কি মানুষ ছিলেন? তেমন মানুষ হলে একশোবার বিধবা হওয়া চলে।

বিষ্টুদা জিভ কেটে বললেন, ছি ছি, সব মানুষই ভাল। বিচার করার অধিকার তোমার নেই। স্ত্রীর কাছে যে-কোনও স্বামীই দেবতা। তা যদি না হত, তোমার বউদি আমাকে লাথি মেরে চলে যেত। কত বড় ঘরের মেয়ে! গান শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। রূপও বড় কম ছিল না।

জহরবাবুর কথা মনে আছে, আজ বছর সাতেক বেপাত্তা। আপনার ধারণা সে বেঁচে আছে!

ধরলুম বেঁচে নেই, তাতে তোমারই বা কী, আমারই বা কী!

জহরবাবুর বউ বিধবা হয়েছেন? শাস্ত্রে আছে, কত বছর যেন অপেক্ষা করে তারপর শাঁখা সিঁদুর ছাড়তে হয়।

তুমি যখন জানোই তখন শুধু শুধু পাপের ভাগী হবে কেন?

আপনি এই মহিলাকে দেখেননি। দেখলে আমার মতো আপনারও একই ইচ্ছে হত। যিনি প্রতি মুহূর্তে সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখছেন, কী করে যমদূতের মতো তার সব স্বপ্ন চুরমার করে দেওয়া যায়, আপনিই বলুন! খেলা না ফুরাতে খেলাঘর ভেঙে যায়। যোলো-সতেরো বছর চলুক না এইভাবে।

তোমার বুদ্ধি এখনও বহুত কঁচা। তোমার কাকার কথা ভেবে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ এইভাবে চলে যাবে, কেউ একটু চোখের জল ফেলবে না? কেউ তার জন্যে সাদা কাপড় পরবে না? পৃথিবী কি এতই অকৃতজ্ঞ? আমাকে ভার দাও, আমি মর্গ থেকে লাশ খালাস করে আনি।

সে কি আর আছে নাকি!

ছি ছি, এ তুমি কী করলে পিন্টু? শেষ দেখা দেখতে দিলে না, শেষ কাজ করতে দিলে না। কেন বলো তো!

আমি এতক্ষণ আপনাকে কী বললুম!

তুমি নিজেকে এখনও ধরতে পারোনি পিন্টু। তুমি বিশ্রী একটা ঝামেলার ভয়ে এতদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালে। থানা, পুলিশ, মর্গ, শ্মশান, সৎকার, কান্নাকাটি এইসব এড়াবার জন্যে নিজের মতো একটা যুক্তি খাড়া করে নিজেকে ধাপ্পা দিলে। সংসারের সবকিছুকে কি ওইভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়? তুমি আমাদের সত্যেনের মতো করলে। বাপের শ্রাদ্ধের পর ফিরে এল। এসে বললে, টেলিগ্রাম চিঠি কিছুই পায়নি। আর দুম করে তুমি হাত থেকে ঘড়িটা খুলে দিয়ে দিলে! কী লোক, কোন লোক, কোথাকার লোক কিছুই দেখলে না! আমাকে একবার বলতেও তো পারতে!

ওর সামনে বলি কী করে?

যাক যা গেল তা গেল। খুব সাবধান! ও আবার আসবে, তোমার কাছেই আসবে। ও বুঝে গেছে, কোথাও একটা গোলমাল আছে। একে চাপ দিলেই মাল বেরোবে। তুমি সোজা বাড়ি যাও। প্রথমে তোমার বাবাকে সব খুলে বলল। তোমার কাকিমাকে তিনিই বলবেন। প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো। জানো তো চাপা জিনিস ফেটে বেরোয়।

বিষ্টুদা, আমি এখন বলতে গেলে সবাই বলবেন, তুমি তখন বললে না কেন? একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে। তার চেয়ে সাত দিন পরে ওই ব্যাটাই আসুক, এসে বলুক।

অ্যাঃ তুমি একটা অসৎ লোকের খপ্পরে চলে গেলে!

গেলুম কই? সোজা এসে এবার কাকিমার সঙ্গে দেখা করুক!

খবরদার না। এসব লোককে বাড়ির অন্দরমহলে একেবারে ঢুকতে দেবে না। এরা সব পারে। এরা ঘরের মেয়েকে বাইরে বের করে পেট চালায়। আমি যদি একবার টের পেতুম তোমাদের এইসব হচ্ছে, সোজা থানায় গিয়ে পুলিশ ডেকে আনতুম।

নীল লুঙ্গি পরে অঘোরবাবু দোকানে ঢুকলেন। বিষ্টুদা ঠোঁটে আঙুল রেখে বুঝিয়ে দিলেন, চুপ, আর একটাও কথা নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *