১.৩ সেই বড় ঘরটায়

১.৩

লক্ষ্মীমণিকে আগেই সেই বড় ঘরটায় এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে বসে আছে দেয়াল ঘেঁষে, মেঝেতে। গতকালও প্রথমে সে চেয়ারে বসতে চায়নি। বারবার বলছিল চেয়ারে তো বাবু-বিবিরা বসে। গরিব মানুষদের জন্য নয়।

হুমায়ুন ঘরে ঢুকেই বললেন, লক্ষ্মীমণি, ওঠো। আমাদের সামনের এই চেয়ারটায় বসো।

আজও সে আপত্তি করতে যাচ্ছিল, হুমায়ুন আবার হুকুমের সুরে বললেন, ওঠো, ওঠো

 লক্ষ্মীমণি শরীর মুচড়ে, খুবই আড়ষ্টভাবে বসল সেই চেয়ারে।

এবারে হুমায়ুন নরম ভাবে বললেন, এটা সরকারি অফিস। সরকারের চোখে সবাই সমান। তুমি গরিব কি বড়লোক, তাতে কিছু আসে যায় না। সেইজন্য আমাদের মতন তোমারও চেয়ারে বসার অধিকার আছে।

বিনায়ক আপন মনে হাসলেন। সে হাসিতে বিদ্রুপের সামান্য চিহ্ন আছে।

হুমায়ুন জিগ্যেস করলেন, কাল তোমাকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানে তোমার কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

লক্ষ্মীমণি বলল, অসুবিধা? ছি ছি ছি। কিসের অসুবিধা। একখান বিছানা ছিল। মাঝ রাইতে কেউ ঘরে আসে নাই।

–ঠিক মতন খাবারটাবার দিয়েছিল? কী খেয়েছ?

–রুটি দিছিল, পাঁচখান। আর মাংস, চাইর টুকরা, বেশ বড়-বড় টুকরা। কাঁচা পেঁয়াজ চাইছিলাম, তা দেয় নাই। রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ পাইলে বেশি ভালো লাগে। প্যাট ভইরা খাইছি।

মাংস দিয়েছিল? তবে তো ভালো কথা।

বিনায়কের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন বললেন, কাস্টোডিতে রাখার সময় পুলিশ মাংসও দেয়!

লক্ষ্মীমণির দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, এই যতদিন তুমি বাড়ির বাইরে ছিলে, সেই সময়ে কখনও মাংস খেয়েছ?

লক্ষ্মীমণি বললেন, খাইছি। স্যাসের দিকে। প্রায় হার রোজ।

–আচ্ছা, থাক, শেষের দিকের কথা এখন বলতে হবে না। তুমি কঁসি থেকে পালাবার কথা বলছিলে। আগে বলো তো আঁসিতে ঠিক কোথায় ছিলে?

জায়গা তো আমি চিনি না। নামও জানি না।

নাম বলতে হবে না। থাকার জায়গাটা কেমন ছিল? বড় ঘর, এক ঘরে কজন মেয়ে?

–একখান খুব ভাংগা বাড়ি। মস্তবড় ঘর, কিন্তু একদিকে দেয়াল নাই। চ্যাটাই পেইত্যে শোয়া। সারাদিন দরজা বন্ধ থাকত, সন্ধ্যার পর খুইলা দিত একবার। তখনি একসঙ্গে সকলের পায়খানায় যাওয়া।

–এই যে বললে একদিকে দেয়াল নাই। তবে আবার দরজা বন্ধ থাকে কী করে?

–দেয়াল নাই, মানে, উচা দেয়াল, ওর উপরের দিকটায় অনেকখানি ভাংগা, পুরটা ভাংগা না।

–সেই ঘরে মোট পাঁচজন ছিলে?

 –জি।

–খুব ভালো করে মনে করে দ্যাখো তো, তাদের মধ্যে সরিফন নামে কেউ ছিল?

সরিফন? না তো? নাম কইতেছি, বোলবুল, পুন্নিমা, সালেহা, আমি আর পদ্মা, এই পদ্মাই নেপালি আর অল্প বয়েস। খুব ফরসা!

রিপোর্টে দেখছি এগারোজন। তা হলে কি অন্য কোনও ঘর ছিল?

–থাকতেও পারে, সাহেব। আমাগো তো কিছু দ্যাখতে দিত না। তবে মাঝে-মাঝে অইন্যদের নামার আওয়াজ পাইতাম।

–তোমাদের খাবার দিত একজন স্ত্রীলোক? তার চেহারা কীরকম?

অনেক কাচের চুড়ি ছিল দুই হাতে।

 –সে কথা তো শুনেছি। চেহারা কীরকম, রোগা না মোটা?

 –মোটা। তা ছাড়া তার হাতের একখান থাবড়া খাইলে কান ঝাঁঝাঁ করত।

–কেন, মারত কেন?

সাহেব, মানুষে-মানুষরে কেন মারে, তা কি বোঝা যায়? কেউ-কেউ মেরেই আনন্দ পায় বোধহয়। মেয়েমানুষও মেয়েমানুষকে মারে, কোনও দয়া-মায়া নাই। ভগবান জানেন, আমি তার কাছে কোনও দোষ করি নাই, তবু একদিন যেই হিন্দিতে একটা গালি দিয়েছি আমার মুখে থাবড়া মেরেছে। একবার তার হাতের এক খান চুড়ি ভেংগে আমার গালে ফুইটে গেল।

–তার কি একটা চোখ নষ্ট ছিল?

–ঠিক। আপনে জানলেন কী করে সাহেব? ঘোলা-ঘোলা চক্ষু একটা।

–তার নাম জানকী। ফাইলে লেখা আছে। সে ধরা পড়েছে। তোমাদের সে মারত বটে, কিন্তু সে আসলে খুব ভীতু। পুলিশ তাকে ধরার পর একটু ভয় দেখাতেই সে সব স্বীকার করেছে। সে কয়েকজনের নামও বলল, তাদের মধ্যে সরিফনের নামও আছে। কিন্তু তোমার নাম নেই।

আমারে ভুলে গেছে?

–আমি চেষ্টা করছি ওই জানকী বাই-কে কলকাতায় আনাবার। তখন তুমি ওকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে। ওঃ হো, তুমি তো আগেই পালিয়েছিলে। তাই বোধহয় ও তোমার নাম বলেনি। পালাবার কথা তোমার মনে এল কী করে?

–যেদিন ওই মাগিটা অমনভাবে মারল, সেইদিনই মনে হল, এই ভাবে বাঁচার চেয়ে মরাও ভালো। যেমন ভাবেই হোক এখান থিকা পলাব। পলাতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি, তখন যদি একেবারে মাইরা ফেলায় তো ফেলুক। সেইদিন আবার সন্ধ্যা থেকে খুব বৃষ্টি।

–তুমি কী করে পালালে, পাহারা ছিল না?

দুপুরবেলা, চম্পা, সে আমার পাশে শুইত, সে কইল, দিদি আর পারতেছি না, যেমন ভাবে তোক আমি পালাবই পালাব। আমি তো সঙ্গে-সঙ্গে উঠ্যে বসে কইলাম, যাবি? আর কেউ বাংগালি ছিল না, তাই আমাদের বাংলা কথা বোঝে নাই। দুই জনে শলা করলাম। সন্ধ্যার সময় যখন একবার বাইরে আনল, তখন তো অত বৃষ্টি, আমি ভিতরে না গিয়া গোসল ঘরেই বসে রইলাম। পাহারাদারনি খেয়াল করে নাই।

–সেই গোসলঘর থেকেই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল।

–চম্পারে তো ভিতরে ঢুকায়ে দিয়েছে। তারে তো নিতে হবে। আমি মড়ার মতন নিশ্বাস বন্ধ করে খাড়ায়ে ছিলাম। সেখানে আবার বড়-বড় ব্যাঙ, থপথপ করে লাফায়। প্রথমে ভেবেছিলাম সাপও আছে বুঝি। যখন আর কোনও শব্দ শুনি না বাইরে, তখন চম্পারে বাইর করলাম ঘর থেকে। শেষ রাত্তিরে। সবাই যখন ঘুমায়ে। দরজায় তালা, কিন্তু চাবি কোথায় থাকে জানতাম। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার রাস্তা। ঘেউ-ঘেউ করে কুকুর ডাকে। তার মধ্যেই দৌড়, দৌড়। চম্পা একবার আছাড় খেয়ে পড়ল, আমি হাত ধরে উঠালাম। অনেকখানি দৌড়াবার পর দেখি একটা বড় রাস্তা। আলো জ্বলে, গাড়ি চলে। অত রাত্তিরেও মোটা-মোটা গাড়ি যায়। একটা-দুইটা দোকানও খোলা। আলো দেখে ধড়ে যেন প্রাণ এল। আমরা মুক্ত হয়ে গেলাম।

তোমরা মুক্তি পেয়ে গেলে?

জি, মুক্তিই তো। কেউ আমাদের ধরতে আসে নাই। একটা দোকানে জিলাপি ভাজা হচ্ছিল, আমরা জিলাপি খেলাম। কেউ কিছু বলল না। কী অপূর্ব সোয়াদ সেই জিলাপির।

পয়সা পেলে কোথায়? তোমাকে ওরা টাকাপয়সা কিছু দিত?

না। কিন্তু চম্পার কাছে লুকানো কিছু টাকা ছিল। দলা পাকানো কাগজের টাকা। আমরা প্যাট ভরে খেলাম। পানি খেয়ে প্রাণ জুড়াল। তখন কী করি? ভোর-ভোর টাইম, সেই দোকানের সামনেই একটা বাস থামল। উঠে পড়লাম সেই বাসে। আর ভয় নাই।

সেই বাসে আরও লোক ছিল?

অনেক মানুষ। মানুষ ওঠে, মানুষ নামে। আস্তে-আস্তে সকাল হয়ে গেল বাসের টিকিটওয়ালা টিকিট কাটতে কইলে চম্পা দিল একটা দশটাকার নোট। সে আরও দুই টাকা চাইল। আরও কী সব কইল বুঝি নাই। তারপর সেই বাস একখানে থামতেই টিকিটওয়ালা আমাদের কইল, উতারো, উতারো। আমরা নেমে গেলাম। সেটা একটা বাজার। সেখানে এক দোকানে আবার আমরা পুরি আর হালুয়া খাইলাম।

বেশ। অনেকদিনের খিদে জমে ছিল। তখন কি তোমরা বাড়ি ফেরার কথা ভেবেছিলে?

বাড়ি ছাড়া আর কোথায় যাওয়ার কথা ভাবব? লাখু আর বেলির কথা মনে পড়ছিল সর্বক্ষণ।

তারা কে?

আমার ছেলে আর মেয়ে।

আগে যে বলেছিলে, তাদের নাম, এই যে লেখা আছে রতন আর সরস্বতী?

সে তো ভালো নাম। ডাকনামই মনে আসে। মনে আসতেই কান্না পায়। জিলাপি খাওয়ার সময়েও ওদের মুখ মনে করে কান্না পেয়েছিল।

বাড়ি ফেরার কথা ভেবে ভয় করেনি?

কেন, ভয় করবে কেন? নিজের সোয়ামির বাড়ি যাব, তাতে ভয় কীসের? কতক্ষণে পৌঁছব। এইসময় সাহেব একটা অদ্ভুত প্রাণী দেখলাম। অমন আগে জীবনে কখনও দেখি নাই। গাড়ি টানে, গরুও না, ঘোড়াও না। লম্বা গলা, মুখোন ছোট্ট, এদিক-ওদিক ঘুরায়।

বুঝেছি। উট। ওই সব অঞ্চলে এখনও উটে গাড়ি টানে। হাতি দ্যাখোনি? ওসব দিকে রাস্তা দিয়ে পোষা হাতিও যায়।

উট? ওরা মানুষকে কামড়ায়?

না! বাড়ি যাওয়ার কথা যে ভাবলে, একবারও কি মনে হল না যে ফিরতে পারলেও বাড়িতে তোমাদের আর ঠাঁই হবে না। এতগুলো দিন বাড়ির বাইরে ছিলে, পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়েছ, তারপর কি বাড়ির লোক ফেরত নেয়?

কেউ তো কিছু জানে না।

জানার দরকার হয় না। বাড়ির বাইরে এক রাত্তির থাকলেই মেয়েদের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। পুরুষরা মাঝে-মাঝেই বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে পারে। তাতে তাদের দোষ হয় না।

এটা ভগবানের কী রকম বিচার?

তা তো আমি বলতে পারব না। ভগবানের সঙ্গে যদি তোমার কখনও দেখা হয়, তাঁকে তুমিই জিগ্যেস কোরো।

হা আমার পোড়া কপাল! আমার মতন অভাগিনীর কাছে কি আর ভগবান দেখা দেবেন! আমি যে পাপ করেছি।

কী পাপ করেছ?

আপনিই যে বললেন, বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছি, তাতে আমার পাপ হয়েছে। জীবন নষ্ট হয়ে গেছে।

না, আমি তোমার পাপের কথা বলিনি। পাপ-পুণ্যের বিচার করার অধিকার আমার নেই। আমি শুধু বলেছি, আমাদের দেশের মেয়েরা বাড়ির বাইরে রাত কাটালে সমাজ তা মেনে নেয় না। মেয়েদের কোনও দোষ না থাকলেও বিবাহিত মেয়েদের স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আর তাকে ক্ষমা করে না।

ওগো বাবু, তোমায় পাড়ে পড়ি, আমাকে একবার আমার সোয়ামির কাছে ফিরিয়ে দাও। তিনি ভালোমানুষ, তিনি আমায় ঠেলবেন না। তিনি তো আমার ছেলেমেয়েদেরও বাপ।

সে ব্যবস্থা করব নিশ্চয়ই। মুনসিগঞ্জে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তুমি তোমার স্বামীর নাম বলতে পারোনি। বিরাজ নামেও কারুর সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। জলিল শেখের বউ সরিফন বিবির কথা সেখানকার লোক জানে। আর কার বউ হারিয়ে গেছে জানা যাচ্ছে না।

আমারেও সেখানে নিয়া চলেন। আমি বাড়ি চিনি, একটা মস্ত বিশাল অশত্থ গাছ, যার মগডালে শকুন বসে, সেইখানে পুকুড়ের পাড়ে…।

ব্যস্ত হোয়ো না। সেখানে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে নিশ্চিত। আগে ভালো করে সব খবরটবর নেওয়া হোক। কঁসি থেকে তোমরা তো পালালে, আবার ধরা পড়ে গেলে কী করে?

ধরা ঠিক পড়ি নাই। আমরা দুইটি মেয়ে, কিছুই চিনি না, ওইখানকার ভাষাও ঠিক ঠিক বুঝি না, কোথায় আছি তাও জানি না। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। দিনের বেলা, ঠিক ভয় লাগে না। সব মানুষ তো আর খারাপ না। সেইজন্যেই তো চন্দ্র-সূর্য এখনও ঘোরে। অনেককে জিগ্যেস করি, কেউ কিছু বোঝে না। একটা দিন কেটেই গেল।

রাত্তিরে থাকলে কোথায়?

একটা মন্দিরের চাতালে। আরও মানুষ শোয় সেখানে। ভয়ের কিছু নাই। খুব নিকটেই একটা নদী। ছোট নদী। অনেকখানি শুকনা। সেখানেই গোসল করলাম সকালে।

ওখানে বৃষ্টি পড়েনি?

মাঝে-মাঝে পড়তেছিল, ভিজেওছি।

পরপর কয় রাত্তির তো ঘুমালাম সেই মন্দিরের চাতালে। দিনের বেলা এদিক-ওদিক যাই, নদীর ধারে বসে থাকি। সময় আর কাটে না।

–খাবার পেতে কোথায়?

সন্ধ্যার সময় মন্দিরে প্রসাদ দিত। সেই প্রসাদ খাওনের লোভেই অনেক মানুষ আসত সেখানে।

কী ছিল প্রসাদ।

–চিড়া কিংবা খই, দই আর কলা দিয়ে মাখা। তাই দিত এক দলা। খুব ভালো সোয়াদ। আর কয়েকখান বাতাসা।

–শুধু একবেলা ওই প্রসাদ খেয়ে পেট ভরত?

–তা কি আর ভরে? পোড়া প্যাট! প্যাটের জ্বালাতেই তো এত কাণ্ড! চম্পার কাছে আরও কিছু পয়সা ছিল। দিনের বেলা কেনতাম কয়েকখান রুটি। সন্ধ্যাবেলা প্রসাদের সঙ্গে যে বাতাসা দিত, তাই জমাইয়া রাখতাম আঁচলে বেন্ধে, দিনের বেলা সেই বাতাসা দিয়া রুটি খাইতাম। পানি তো বিনা পয়সাতেই পাওয়া যায়।

–এইভাবে আর কতদিন চলে?

–ছিলাম মন্দ না। একটা কোনও কামকাজ পাইলে বড় ভালো হত, কিন্তু দু-একটা দোকানে গিয়া জিজ্ঞাসা করেছি, পাত্তা দেয় নাই। তা ছাড়া সেই মন্দিরের চাতালও আমাদের ছাড়তে হল।

–কেন?

–বাবু, কী কবো লজ্জার কথা। বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, কত পবিত্র স্থান, দিনমানে কত মানুষ এসে ভক্তিভরে পেন্নাম করে। আর রাত্তিরে সেখানেই ছিছি, কত পাপ হয়। যাদের বাড়ি-ঘর নাই, সেরকম কয়েকজন পুরুষ সেখানের চাতালে শোয় রাত্তিরে, আমাদের মতন কয়েকজন অভাগিনীও শোয় একটু দূরে। তাও বাইরে থেকে পুরুষরা এসে আমাদের টানাটানি করে। উঠানে নিয়ে যেতে চায়। তারা ফিসফাস করে, জোরে কথা কয় না। আমরা ভাগ যাও বললে পলায়। শিয়ালের মতন। দুই-তিন রাত্তির তো গেল এমন ভাবে। পরের মাঝ রাইত্তে হঠাৎ ঘুম ভেংগে দেখি, চম্পা আমার পাশে নাই। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়ল। কী কবো আপনারে বাবু, এমন অসহায় লাগতে ছিল। দুইজনে এক সঙ্গে থাকলে মনে তবু বল-ভরসা থাকে। কিন্তু একা! দুই চক্ষু ফেটে কান্না এসে গেল। অনেকক্ষণ বসে-বসে কান্দলাম। শ্যাস রাত্তিরে চম্পা ফিরে আসল। চুপিচুপি শুয়ে পড়ল আমার পাশে।

চম্পা একাই ফিরে এল? কেউ তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়নি?

না। ওই যে কইলাম, কেউ এসে ডাকে। ও যখন ফিরে আসল, আমি তো তখনও জেগেই আছি। আমি তারে কইলাম, হারামজাদি, তুই কোথায় গেছিলি? সে বলল, দিদি, আমরা তো নষ্ট হয়েই গেছি। আমাগো জাত-ধর্ম সব গেছে, আমরা পতিতা। এখন আর চক্ষুলজ্জা করে লাভ কী? কোনওরকমে ক্ষুধার জ্বালা তো মিটাতে হবে? আমার কাছে যা টাকা আছে, তাতে আর কয়দিন চলবে? টাকা রোজগার ছাড়া উপায় নেই। এক লোকের সঙ্গে গেলাম, সে আমারে কুড়ি টাকা দিছে।

একথা শুনে আমার গা জ্বলে গেল! আমরা নষ্ট হয়েছি, সে কি নিজের ইচ্ছায়? শিবঠাকুরের কিরে আমি একবারও সাধ করে কোনও পর পুরুষের পাশে শুই নাই। পুরুষ যদি জোর করে, আমরা মেয়েমানুষ, গায়ের জোরে তো পারি না, তখন বাধ্য হয়েই…। নিজে ইচ্ছা করে যে মেয়েমানুষ অন্য পুরুষ মানুষের কাছে যায়, সেই তো বেবুশ্যে। আমি মরে গেলেও তা হতে পারব না।

চম্পা কী বলল?

কিছুক্ষণ তর্ক হল তার সঙ্গে। শেষে আমি কইলাম, তোর যা ইচ্ছা কর। আমি আর তোর টাকায় খাব না। আমি ভিক্ষে করে খাব, তাই সই। তুই আর আমার সঙ্গে কথাও কইবি না।

চম্পা কিন্তু আমাকে ছাড়তে চাইল না। সে বলল, ঠিক আছে, আমারে মাপ করে দাও। আমি আর যাব না কাউর সঙ্গে। পয়সা ফুরায়ে গেলে আমরা দুইজনেই ভিক্ষা করব।

অবশ্য ওই মন্দিরের চাতালে শোওয়ার পাটও আমাদের চুকে গেল পরদিনই। আবার রাত্তিরে এসে যে-ই শুয়েছি, অমনি লাঠি হাতে একজন পাহারাদার এসে চক্ষু রাঙিয়ে বলল, হেই, তোরা উঠে যা। তোদের এখানে শোওয়া চলবে না। রেন্ডিদের এখানে জায়গা নেই। কী আর করি, সে রাত আমরা কাটালাম নদীর ধারে।

পরের দিন থেকে আবার কোথায় গেলে?

আবার পথে-পথে ঘুরি। তারপর আশ্চর্য না আশ্চর্য। সেই বিভূঁইয়ে এক দিদিকে পাইলাম, সেই দিদি একটু-একটু বাংলা জানে। ট্যাপাটুপা চেহারা, খুব ফরসা রং, মাথার চুল কেঁকড়া, চোখে সোনার চশমা, খুব লিখাপড়া জানে মনে হয়। হাতে দুইখান মোটা বই। আমাদের কথা শুনে বললেন, বাঙালি? এখানে কী করছ? আমি কলকাতায় চাকরি করেছি অনেকদিন। আমি খুব ব্যস্ত আছি, এখনি দিল্লি যেতে হবে, নাহলে তোমাদের নিয়ে যেতাম আমার বাড়িতে। জানেন সাহেব, সেই দিদি যদি সেইদিনই দিল্লি না যেতেন, আর একটা দিনও থাকতেন, নিশ্চয়ই সাহায্য। করতেন আমাদের। তা হলে আমাদের জীবনটাই অন্যরকম হতে পারত। একটা গাড়িতে ওঠার সময় দিদি কইলেন, কইলকাতায় ফিরতে চাও তো রেল স্টেশানে যাও, কিংবা এই রাস্তার ডাইনদিকে একটুখানি গ্যালেই থানা, সেই থানায় গিয়া সাহায্য চাও। তারা সাহায্য করবে। আমরা রেল স্টেশানেই গেলাম।

থানায় গেলে না কেন?

ছোটবেলা থেকেই তো পুলিশের নাম শুনলে ভয় করে। পুলিশ তো খালি পয়সা চায় কিংবা মারে। পুলিশ কি কারুরে সাহায্য করে?

সব পুলিশই পয়সা চায় না, মারেও না। মানুষকে সাহায্যও করে।

তবু স্যার পুলিশ দেখলেই ভয় লাগে।

আমাকে দেখেও ভয় পেয়েছ নাকি?

 আপনিও পুলিশ?

হ্যাঁ, পুলিশই তো!

 ভদ্দরলোক বাবুদের মতন পোশাক পরে আছেন যে!

পুলিশের পোশাক দেখলেই তা হলে ভয় লাগে? আসলে কিন্তু পুলিশরাও মানুষ। সব মানুষের মধ্যেই তো ভালো আর খারাপ আছে। থানায় গেলেও হয়তো তোমাদের জীবনটা বদলে যেতে পারত। যাই হোক, রেল স্টেশানে গিয়ে কী হল?

রেলের তো টিকিট কাটতে হয়। কইলকাতার টিকিট কাটতে গিয়ে শুনি যে চারশো টাকা লাগবে। দুইবার বদল করতে হবে। চম্পার কাছে ছিল মোটে সাতাশ টাকা। আমার সোয়ামি আমাকে পাঁচ টাকা দিয়েছিল, সে টাকাও কখন কে নিছে জানি না। অত টাকা নাই, কী করে যাব? কী করি, চক্ষে পানি এসে গেল।

রেল স্টেশানে দাঁড়িয়ে দুজনে কাঁদতে আরম্ভ করলে?

চম্পা কাঁদে নাই। সে শক্ত মেয়ে। আমিই পারি না।

ভিড় জমে গিয়েছিল?

জি। তখন সাফলদির মতন একজন মেয়ে মানুষ বলল, এখানে কেন্দে কী করবে? রেল। তো কান্না দেখলে দয়া করে না। আমার সঙ্গে চলো, আমি একটা ব্যবস্থা করে দেব।

বাংলায় বলল?

না, হিন্দিতে। একটু-একটু বুঝেছি। সে আমার হাত ধরে বলল, বহিন, বহিন, চলো। কয়েক পা গেছি, কয়েকজন পুরুষমানুষ বলল, এই এই, ওর সঙ্গে যেও না। আরও বিপদে পড়বে। ওর মতলব ভালো না।

অনেক রেল স্টেশানেই দালাল ঘুরে বেড়ায়।

দালাল কী?

যারা মানুষ কেনাবেচা করে।

একজন পুরুষমানুষ এসে বলল, ওর সঙ্গে যেও না। কাজ করে টাকা রোজগার করো। সেই টাকায় রেলের টিকিট কাটতে পারবে। নইলে এমনি-এমনি তোমাদের টাকা কে দেবে? চম্পা তখন কইল, আমরা কাজ করতে রাজি আছি। যে-কোনও কাজ। সে লোকটি বলল, চলো আমার সঙ্গে।

কী কাজ দেবে, জিগ্যেস করোনি?

ইটভাটার কাজ। খাওয়া দিবে, থাকার জাগা দিবে, আর বিশ টাকা রোজ। তাই গেলাম। মানুষটা সত্যিই ভালো। সেখানে কেউ আমাদের কষ্ট দেয় নাই। খাওন-দাওন ভালো ছিল।

কী খেতে দিত?

একবেলা ছাত্ত্ব আর একবেলা রুটি। ওরা ভাত খায় না। পাকা কলা দিত, আর গুড়, এক একদিন দই। মাছও খায় না। আচার খায়, মরিচের আচার।

থাকার জায়গা, ওই ইটভাটার মধ্যেই? তোমার আর চম্পার এক ঘর?

না, চম্পার ঘর একটু দূরে। মস্ত বড় জাগা, চতুর্দিকে শুধু ইট।

কত টাকা পেতে কাজের জন্য?

টাকা দিত। চাইরশো পাঁচ টাকা জমেছিল।

দুজনের?

না, আমার একার।

তাতেই তো রেল ভাড়া কুলিয়ে যেত। তখনই চলে এলে না কেন?

ওই ইটভাটার কাজ বর্ষা পর্যন্ত চলে। কাজ শেষ না হলে আসতে দেবে না। হাতে হাতে টাকা পেতাম, ভালো লাগছিল সাহেব।

হুঁ, টাকা পেয়ে ভালো লাগছিল। তখন আর ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়েনি। একটা গণ্ডগোল না হলে ওখানেই আরও অনেকদিন থেকে যেতে, তাই না?

না, না, সাহেব, বাড়ির জন্য সব সময় মনটা ছটফট করত। রোজ বিকালে রোদ্দুর পড়ে এলেই মনে হত, কবে বাড়ি যাব, কবে বাড়ি যাব!

বাড়ির জন্য মন কেমন করে, আবার অন্য একটা জায়গায় থাকতেও ভালো লাগে। দুটোই একসঙ্গে হতে পারে। তা ছাড়া লোকটি ভালো ছিল। অত্যাচার করত না, তাই না? লোকটির নাম মনে আছে?

এই কয়মাসে কত মানুষই তো দেখলাম অনেকেরই নাম জানি না। এই লোকটির নাম মনে আছে, সূরয। লম্বা-চওড়া মানুষ, গলার আওয়াজ বাঘের মতন, কিন্তু মনটা নরম।

তাকে তোমার বেশ পছন্দ হয়েছিল মনে হচ্ছে। তোমার স্বামীর চেয়েও সে পুরুষমানুষ হিসেবে ভালো?

ছি-ছি, একী কথা বলছেন সাহেব! নিজের সোয়ামির সঙ্গে কি অন্য কোনও পুরুষের তুলনা হয়? তার সঙ্গে তো আমার সেরকম কোনও সম্পর্ক ছিল না।

এই তো আবার মিথ্যে কথা শুরু করলে। ওই সূযের সঙ্গে প্রতিটি রাত তুমি একসঙ্গে কাটাতে। প্রথম দু-একদিন কান্নাকাটি করেছিলে বোধহয়? তারপর মেনে নিয়েছিলে? ভালো লাগতে শুরু করেছিল, তাই না? জীবনে যদি একজনের বেশি পুরুষ আসে, তা হলে মনে মনে একটা তুলনাও তো আসবে। সূর্যকে কি তোমার বেশি ভালো লেগে গিয়েছিল? হঠাৎ কাঁদছ কেন, এরমধ্যে কান্নার কী আছে?

সূরয সত্যিই ভালো, কিন্তু সে তো আমার ছেলেমেয়ের বাপ নয়। ধর্ম সাক্ষী করে সোয়ামি হয়।

সূরযের সঙ্গে তুমি আরও কিছুদিন থাকতে রাজি ছিলে। সেখানে সুখী ছিলে সবদিক দিয়ে। কিন্তু নিয়তি তোমাকে থাকতে দিল না।

আপনে জানলেন কী করে?

তুমি যেখানে ছিলে, যেখানে ইটভাটা, সে জায়গাটার নাম ওরছা। সেখানে কয়েকমাস আগে একটা বড় রকমের দাঙ্গা হয়েছিল। পাঁচজন মারা যায়। দাঙ্গার পর পুলিশ ডিটেইলড তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে। মধ্যপ্রদেশ সরকার সেই তদন্ত রিপোর্টের কপি পাঠিয়েছে আমাদের। কাছে, ইটভাটার মধ্যে প্রত্যেক দিন সন্ধের পর মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি আর মদ্যপান হত। সূর্য তোমাকে আলাদাভাবে রক্ষিতা করে রেখেছিল, কিন্তু অন্য মেয়েরা আসত। তোমার সেই চম্পার কী হল?

জানি না, আর তাকে দেখি নাই।

সেই দাঙ্গার রাত্তিরে তুমি কী করলে?

সাহেব, ভাবতে গেলেই আমার এখনও শরীর কাঁপে। এই দেখেন। উফ! আমি ঘরে বসে ছিলাম। একসময় শুনি খুব চাঁচামেচি। ওরা এক জায়গায় আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে। ওইসব মদ-মুদ খায়। আমাকে দু-একবার জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু গন্ধেই আমার বমি আসে। খাই নাই কখনও। আমি ঘরে বসে রুটি পাকাচ্ছিলাম, অন্যদিনও চিল্লামিল্লি হয়, সেদিন যেন খুব বেশি। ঘর থেকে মুখ বার করে দেখি, ওরে সব্বনাশ, লোকজন মশাল নিয়ে ছুটাছুটি করছে, কয়েকজনের হাতে খোলা তরোয়াল, কতকগুলোন মেয়ে ভয়ে চিল- চিৎকার করছে। মা গো মা। আমি আবার ঘরের মধ্যে সিঁধোতে যাব, দেখি যে সেদিকেই ছুটে আসছে সূর্য। কী যেন বলছে আমাকে, আমি হঠাৎ বুঝিনি। খুব কাছে আসার পর হঠাৎ পিছন থেকে দুইজন শয়তান লাফিয়ে পড়ল তার ওপরে, তার ঘাড়ে কোপ মারল। আমি তখন ছুটে গিয়ে দেখি, সূর্য মাটিতে পড়ে কাটা পাঁঠার মতন ছটফট করছে। আমার তো দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আমি মাটিতে বসে পড়ে সুরযের মাথাটা কোলে তুলে নিলাম। তখনও সে বেঁচে আছে কি না জানি না। এইসময় কেউ আমার মাথায় মারল। আমি চক্ষে অন্ধকার দেখলাম। আর কিছু মনে নাই।

রিপোর্টে সূরয সিং-এর নাম আছে। সে ওখানেই মারা গেছে। তার নামেও একটা খুনের অভিযোগ ছিল।

জলজ্যান্ত মানুষটা আমার চোখের সামনে..উঃ উঃ, এখনও যেন বিশ্বাস হয় না। তাগড়া জওয়ান ছিল মানুষটা। আচ্ছা, ওরা আমাকেও এক্কেবারে মেরে ফেলল না কেন?

এইসব হাঙ্গামার সময় মেয়েদের পারতপক্ষে খুন করে না। ধর্ষণ করে, লুঠ করে নিয়ে যায়। তোমার ক্ষেত্রে কি দুটোই হয়েছিল?

জানি না।

তোমার বয়েসি মেয়েদের, যদি স্বাস্থ্য-টাস্থ্য ভালো হয়, বাজারদর আছে, চাহিদা আছে। তোমার বয়েসি পুরুষদের তো চাহিদা নেই, তাই তারা খুন হয়। মরে কিংবা মারে। সমাজের নীচের তলায় এটা অনবরত চলছে। ওপর তলায় তা ঠিক বোঝা যায় না। তারপর তোমার জ্ঞান হল কোথায়?

একটা ঝুপড়ির মধ্যে। মাথায় কী ব্যথা, কী ব্যথা। সারা গায়ে ব্যথা। চোখ মেলেই আমি ব্যথার চোটে মা, মাগো বলে কান্দতে লাগলাম।

তোমার মা মারা গেছেন অনেকদিন আগে, তাই না? তবু দুঃখের সময় মায়ের কথাই মনে পড়ে। তোমার বাবা কোথায়?

বাবাও চলে গেছেন অনেকদিন আগে।

ভাইবোন কে কোথায় জানো?

একখান ভাই আর ছয় বোন। জানি না, একটা বোন সাপের কামড়ে মরেছিল, কিংবা মরেনি, তাকে কলার ভেলায় জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হয়তো সে বেঁচে উঠেছে, কোথাও সে আছে।

সেই ঝুপরিতে কতদিন রইলে?

একদিন না দুইদিন। কিছু খেতে দেয় নাই। বৃষ্টির পানিতে ঘর ভেসে গেল, কেউ আসে নাই। তারপর আমার জ্বর হল। ধুম জ্বর। ঘরের মধ্যে ভিজা চটের ওপর শুয়ে-শুয়ে কোকাই, কেউ শোনে না। খালি ভাবতাম, আমার মরণ হয় না কেন? সাহেব, মেয়েমানুষের জান, সহজে যায় না। আবার ভাইগ্যও এমন, এই কয়দিন মাথার যন্ত্রণা আর জুরে কষ্ট পাই, পেটে ভাত নাই, আর তার পরের দিনই কারা যেন আমায় গাড়ি করে নিয়ে গেল, ওষুধ দিল, দুধ-পাউরুটি খেতে দিল। কত খাতির! নতুন শাড়ি-বেলাউজও দিল।

অর্থাৎ তুমি অন্য জায়গায় বিক্রি হয়ে গেলে। এক হিসেবে তোমার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, কারণ আঁসিতে যে ডেরায় মেয়েদের রাখা হয়েছিল, তারা সবাই পাচার হয়ে গেছে আরব দেশে। তুমি আর চম্পা পালিয়ে গিয়েছিলে বলে বেঁচে গেলে। আরব দেশে একবার পাচার হলে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। চম্পার আর খোঁজ পাওনি?

না, সাহেব।

 এবার তোমায় কোথায় নিয়ে গেল, জানো না?

না।

এর পরের রিপোর্টে সেসব স্পষ্ট করে লেখাও নেই। তোমার পেটে যে বাচ্চাটি এসেছিল, সেটা কোথায়? ওই সূরয সিং-এর সঙ্গে থাকার সময়? অ্যাবরশানের সময়, মানে গর্ভপাত, গণ্ডগোল হওয়ায় খুব খারাপ অবস্থায় একটি মেয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল, নাম দেওয়া হয়েছিল কমলা, সে আবার দুদিন পরে ভালো করে সুস্থ হওয়ার আগেই হাসপাতাল থেকে পালায়। আমি ধরে নিচ্ছি, লক্ষ্মী আর কমলা একই। সূরযই তোমাকে ভরতি করা আর পালাবার সাহায্য করেছিল?

সূরয আমায় খুব যত্ন করত।

 অর্থাৎ বাকিটা স্বীকার করবে না। সূর্য তোমাকে কী বলে ডাকত?

লছমী। আবার এক এক সময় নেশা করে নাম ভুলে গিয়ে বলত কমলা।

তা হলে তো ঠিকই আছে। এরপর তোমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হল, সে জায়গাটারও তুমি নাম জানো না? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলে। দিনের বেলা? আবার পান খেয়েছিলে?

রাগ করবেন না সাহেব। সূরয আমাকে গাঁজার নেশা ধরিয়েছিল। গাঁজা খেলে সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতাম। কেউ গাঁজা দিলে না বলতাম না।

গাঁজা খেয়েছিলে। তারপর যে বাড়িতে উঠলে, সে বাড়িটা কেমন?

ওরে বাপ রে, অমন ভালো বাড়িতে জীবনে থাকি নাই। তিনতলা। সাদা পাথরের মেঝে। কত রকমের বাতি। পাখা ঘোরে। ঠান্ডা মেশিন। ফ্রিজ বলে, তাই না?

সেখানে একটা ঘর পেলে?

নিজের ঘর না। একতলার একটা লম্বা ঘরে পাঁচজন। দুতলা আর তিনতলার এক একখানা ঘরে যারা থাকে, তারা সব বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতন। ফরসা ফরসা, চুল ছোট, ভুরু আঁকা। কেউ আবার গানও গায়। আর নীচের তলায় আমরা পাঁচজন উনাদের এক-একজনের দাসী। আমাকে যেনার সঙ্গে জুতে দিল, তার নাম জানেমন। এক্কেবারে হুরী-পরির মতন রূপ। টানা টানা চোখ। কিন্তু ম্যাজাজটা খুব খারাপ। মাঝে-মাঝে আমার পাছায় লাথি মারত। প্রথম দিনই আমার লক্ষ্মী নামটা শুনে মুখ ভেটকি দিয়ে বলেছিল, এখানে ও নাম চলবে না। তোর নাম, তোর নাম হল পিয়ারা। তারপর থেকে সবাই সেই নামেই ডাকত। সে বাড়িতে কয়েকজন বাঙালিও ছিল।

সেখানে তোমার কাজটা কী ছিল?

দিনের বেলা জানেমনদিদির গতর টিপে দিতাম। চুল বেঁধে দিতাম। পান সেজে…আর সন্ধেবেলা ঘরে বাবুরা এলে গেলাস দিতাম, সোটা আর পানি, কিছু খাবারও এনে দিতে হত। এইসব…

অর্থাৎ খিদমদগারি ছাড়া আর কিছু করতে হত না?

 না।

ঠিক বলেছ?

 জি।

শরীর ব্যবহার করতে হয়নি?

না।

বলেছি না, আমার কাছে মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই। এখন আর লুকিয়ে কী হবে? পুরুষের সঙ্গে শুতে হত না?

দুইটা তাগড়া জোয়ান পাহারাদার ছিল, একটার নাম বাঘা। সে এক-একদিন নেশার বেঁকে তার ঘরে জোর করে টেনে নিয়ে যেত। আর দিদির ঘরে যেসব বাবুরা আসত, তাদের মধ্যে দুই-তিনজন, এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করত, ছি-ছি-ছি, সেসব কথা আমি মুখে উচ্চারণ করতে পারব না, আমারে মাপ করেন সাহেব।

ঠিক আছে, বলতে হবে না। সেখানে মোটকথা খেয়েপরে ভালোই ছিলে?

খাওয়া-পরা ভালো, কিন্তু সবসময় মন উচাটন করত ছেলেমেয়ের কথা ভেবে।

এই সময় ছলছল করে উঠল লক্ষ্মীমণির চোখ।

 চোখে আঁচল চাপা দিয়ে সে থেমে রইল একটুক্ষণ।

তারপর আবার ধরা গলায় বলল, ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়লে আত্মাটা বড় ছটফট করে গো বাবু! টনটন করে। সে বাড়িতে প্রায় দিনই মাংস খেতাম। জানেমন দিদির ঘরে যে সব বড়-মানুষরা আসত, তারা প্রায় দিনই পকেট থেকে ফসফস করে বড়-বড় টাকার নোট বার করে হুকুম দিত, দোকান থিকা মাংস আনাও। কাবাব লাও! বিরিয়ানি লাও! অনেক মাংস আনানো হত। আর সেই বাবুরা বোতল-বোতল মদ খেয়ে লটপটিয়ে যেত, সেই মাংস আর তাদের মুখে রোচত না। ঠেলে সরিয়ে দিত। পরে আমরাই তো খাইতাম সেই মাংস-টাংস। যেমন সোন্দর গন্ধ আর তেমন সোয়াদ। খাইতাম আর চক্ষে জল আসত। মনে হইত, আমার ছেলেমেয়ে দুটা কী খায় কে জানে! তারা কি কখনও মাংস…বাবু, নিজের আপন মানুষজনের সঙ্গে বসে যে খাইদ্যাই একসঙ্গে ভাগ করে খাওয়া যায়, সে-ই তো অমৃত। তা নুন-পান্তা হলেও যথেষ্ট।

তা ঠিক। শোনো, একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝেনি। দিল্লিতে তোমরা যে বাড়িটায় থাকতে, সেটা একটা তিনতলা বাড়ি। তার দোতলা, তিনতলায় এক-একখানা ঘরে থাকত এক-একজন দামি স্ত্রীলোক। বাবুরা আসত তাদের কাছে। আর তোমরা কয়েকজন থাকতে একতলায়। তোমাদের মোটামুটি চাকরানির কাজ করতে হত। এই তো?

না, সাহেব। একটু ভুল বলেছি। ওই পাকা বাড়ির নীচের তলায় আমরা থাকতাম না। বাড়ির সঙ্গে একটুখানি বাগান ছিল, সেই বাগানের মধ্যে দুই-তিনখান টালির ঘর। আমি আর দুই-তিনজন চাকরানি সেই টালির ঘরে থাকতাম। আসল বাড়িটার অনেক ঘরই খালি থাকত। এর একতলার ঘরগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারতাম না। দুপুর বেলা তো বেশি কাজ থাকত না। আমরা কয়েকজন একটা ঘরে তাশ খেলতাম। ওরা আমারে তাশ খেলা শিখায়ে নিয়েছিল।

সে বাড়িতে সরিফন বলে কেউ ছিল?

 জি, ছিল তো?

ছিল? আগে যে বলেছিল, সরিফন বলে কাউকে চেনো না?

আগে তো তারে দেখি নাই। এই খানেই প্রথম দেখলাম। তার ডাকনাম ছিল মুন্না, একবারই শুধু শুনেছিলাম, তার পুরা নাম সরিফনবাই।

সে কি দোতলা, তিনতলার ঘরে থাকত?

না, না, সে আমাগো মতনই চাকরানি, এর একজন দারোয়ানের সঙ্গে তার পাকাপাকি আশনাই, তাই চোপার জোর বেশি। ধরে ন্যান, সে ছিল হেড চাকরানি।

ফাইলে মুন্নারও নাম আছে। তা হলে মুন্না আর সরিফন আলাদা-আলাদা দুজন নয়?

জি না।

এই সরিফনের সঙ্গে তোমার ভাব ছিল? তোমাদের নিজেদের দেশ-গ্রামের কথা হত না কখনও?

ভাব হবে কেমন করে? আমার থিকা তার বয়েস কম। আটা-ময়দার মতন গায়ের রং। তাই জেল্লা বেশি, তার খাতিরও বেশি। সে আমারে পাত্তা দিত না।

এই সরিফন কি মারা গিয়েছিল, মানে খুন হয়েছিল?

তা আমি জানি না? কইতে পারব না?

তোমরা একই বাড়িতে ছিলে, তার কিছু হলে জানবে না কেন?

 আমি তো শ্যাস পর্যন্ত থাকি নাই!

শেষপর্যন্ত মানে, কিসের শেষপর্যন্ত?

আমার সব কথা মনে নাই, স্যার।

এইরকম আবার তুমি কিছু লুকোচ্ছো মনে হচ্ছে! সে বাড়িটায় একসময় একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়েছিল, সে তো আমরা জানিই। ফাইলে সব লেখা আছে। তুমি তখন কী করছিলে?

সাহেব, আমারে মাপ করেন, আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। আজ আমারে ছুটি দ্যান।

না, আজই শেষ করতে হবে। ঠিক আছে, তোমাকে আমি চাপ দিচ্ছি না। তুমি যেমনভাবে বলছিলে, সেরকম ভাবেই বলো।

পালাবার চেষ্টা করোনি?

হাতে পয়সা দিত না একটাও। কড়া পাহারা ছিল। যাবই বা কোথায়? অত যে বাঙালি মেয়েরা ছিল, তাদের কাছে পালাবার জন্য শলা করতে গেলে তারা বলত, খবর্দার, ও চেষ্টা করিস না। ঠিক ধরা পড়ে যাবি। খুব মার খাবি।

তবু পালালে কী করে?

ঠিক পলাই নাই। এক রাত্তিরে হল কী, জানেমনদিদির ঘরে দুইটা বাবু এসেছিল, আমিও সেদিন ঘরের মধ্যে বাবু দুইটা বোতলের পর বোতল শেষ করে, জানেমনদিদিরে নাচতে বলে। দিদি নাচ ভালো জানে না, আমিও জানি না, একজন বাবু একেবারে টইটুম্বুর মাতাল, আমাদের টানাটানি করে, অন্য বাবুটা হাসে, পাগলের মতন হাসে। হঠাৎ হল কী, বেশি মাতাল বাবুটা তার বন্ধুরে মারল একখান থাপ্পড়, অমনি অন্য বাবুটা পকেট থেকে ফস করে বার করল একটা ছোট্ট বন্দুক। কী সব গালাগালি দিতে-দিতে দুমদুম করে গুলি চালিয়ে দিল বন্ধুটার মাথায়। রক্ত, ফিনকি দিয়া রক্ত, বন্দুক হাতে বাবুটা বাইরে বেরিয়ে আসল, সিঁড়ির কাছে বাঘা তার। মাথায় মারল একটা লাঠির বাড়ি, তখন আবার দুমদুম করে গুলি, আর চিৎকার, সবকই কো মার ডালুঙ্গা! আমরা যে যেমন ছিলাম দৌড় দিলাম, দিক-বিদিক জ্ঞান নাই। একসময় একটা পুলিশের গাড়ি আমারে থামাল। তখন ভাবলাম খাইসে, এবার পুলিশের পাল্লায় পড়ছি, আর বাঁচুম না।

কিন্তু এবার পুলিশই তোমায় বাঁচিয়েছিল!

সে ঠিক কথা।

 থানায় কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল?

না, সাহেব। শুধু একটা সেপাই মাঝে-মাঝে, কিন্তু বড় দারোগা মাটির মানুষ, আমাকে বহিনজি, বহিনজি বলে ডাকছিল।

তা হলে সব পুলিশই খারাপ নয়। তুমি যেখানে ছিলে, সেটা দিল্লি। সেখানে বাঙালি মেয়েদের বেশ চাহিদা আছে। দিল্লি পুলিশ কিছুদিন তোমাকে হাজতে রাখে। তারপর সব খোঁজখবর নিয়ে এখানে পাঠিয়ে দেয়। আর তোমার ভয় নেই।

আমি বাড়ি ফিরে যাব না?

বাড়ি, হ্যাঁ, আগে আরও খোঁজখবর নিতে হবে। একটা মুশকিল হয়েছে কী জানো, রিপোর্টের এক জায়গায় লেখা আছে, লক্ষ্মীমণি পাড়ুই বেঁচে নেই, খবরের কাগজে দিল্লির ওই ঘটনা বেরিয়েছিল, তাতেই ছিল যে লক্ষ্মীমণি পাড়ুই নামে একজনের পেটেও গুলি লাগে। মুন্সিগঞ্জের সরিফন বিবির নাম নিরুদ্দেশ লিস্টে আছে। তুমি সরিফন বিবি হলে ঝঞ্ঝাট ছিল জনা। তুমি কি সত্যিই লক্ষ্মীমণি পাড়ুই?

আমি বেঁচে নাই। সাহেব, এই যে আমি আপনার সামনে বসে আছি, আমি বেঁচে নাই? হি হি হি হি। আমি মরে গেছি! তা ভালোই তো। আমার আর বেঁচে থাকার কী দরকার! মরণেই সব জ্বালা জুড়োয়। মরলে আমি পেত্নি হব নিশ্চয়ই। হি হি হি হি। পেত্নি হলে এবার সবকটার গলা টিপে মারব। সব কটার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *