সাইফুল্লাহ
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর যুগের ঐতিহাসিকদের রচনাবলীতে সাইফুল্লাহ নামক এক ব্যক্তির উল্লেখ এভাবে পাওয়া যায়, কেউ যদি সুলতান আইউবীর উপাসনা করে থাকে, তাহলে সে ছিলো সাইফুল্লাহ। সুলতান আইউবীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ডান হাত বলে খ্যাত বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ডাইরীতে যা আজো আরবী ভাষায় সংরক্ষিত আছে–সাইফুল্লাহর বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে কোন ইতিহাস গ্রন্থে এ লোকটির আলোচনা পাওয়া যায় না।
বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ডাইরীর ভাষ্যমতে সাইফুল্লাহ নামের এ লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ওফাতের পর সতের বছর জীবিত ছিলো। জীবনের এই শেষ সতেরটি বছর অতিবাহিত করেছিলো সে সুলতান আইউবীর কবরের পার্শ্বে। লোকটি অসিয়ত করেছিলো, মৃত্যুর পর যেন তাকে সুলতান আইউবীর পার্শ্বে দাফন করা হয়। কিন্তু সাইফুল্লাহ ছিলো একজন সাধারণ মানুষ। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার কোন বিশেষত্ব ছিলো না। তাই মৃত্যুর পর তাকে সাধারণ গোরস্তানেই দাফন করা হয়। অল্প কদিন পর-ই তার সমাধি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়; মানুষ তার কবরের উপর ঘর তুলে বসবাস শুরু করে।
রোম উপসাগরের ওপার থেকে সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে এসেছিলো সাইফুল্লাহ। তখন তার নাম ছিলো মিগনানা মারিউস। ইসলামের নামটাই শুধু শুনেছিলো সে। তার জানা ছিলো না ইসলামের আসল পরিচয়। ক্রুসেডারদের প্রোপাগাণ্ডায় বিভ্রান্ত মিগনানা মারিউসের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, ইসলাম একটি ঘৃণ্য ধর্ম, মুসলমানরা নারীলোলুপ ও নরখাদক এক হিংস্র জাতি। তাই মুসলমান শব্দটি কানে আসা মাত্র ঘৃণায় থু থু ফেলতো মিগনানা মারিউস। কিন্তু পরম সাহসিকতা প্রদর্শন করে সালাহুদ্দীন আইউবী পর্যন্ত পৌঁছার পর মৃত্যু হয়ে গেলো মিগনানা মারিউসের। তার নিষ্প্রাণ অস্তিত্ব থেকে জন্ম নিলো সাইফুল্লাহ্।
ইতিহাসের পাতায় এমন রাষ্ট্রনায়কদের সংখ্যা কম নয়, যারা শত্রুর হাতে যারা জীবন দিয়েছিলেন কিংবা আত্মঘাতী আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ইতিহাসের সেই গুটিকতক ব্যক্তিত্বের একজন, যাদেরকে বারবার হত্যা করার চেষ্টা যেমন করেছে শত্রুরা, তেমন করেছে মিত্ররাও। সুলতান আইউবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র শত্রুদের তুলনায় বেশী করেছে মিত্ররা। তাঁর কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে একজন ঈমানদীপ্ত জানবাজ মুমিনের পাশাপাশি একদল বে-ঈমান গাদ্দারের নিদারুণ কাহিনীও উল্লেখ করতে হয় সমান তালে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। তাই সালাহুদ্দীন আইউবী বলতেন–অদূর ভবিষ্যতে ইতিহাস এমন একটি সময় প্রত্যক্ষ করবে, যখন পৃথিবীর বুকে মুসলমান থাকবে ঠিক; কিন্তু ঈমান তাদের বিক্রি হয়ে থাকবে কাফিরদের হাতে, তাদের উপর শাসন করবে খৃষ্টানরা।
আমরা এখন ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকাল প্রত্যক্ষ করছি।
সালাহুদ্দীন আইউবী যখন ক্রুসেডারদের সম্মিলিত নৌ-বহরকে, রোম উপসাগরে আগুনে পুড়িয়ে, পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সাইফুল্লাহর কাহিনী শুরু হয় তখন থেকে। আইউবীর আক্রমণ থেকে ক্রুসেডারদের কয়েকটি জাহাজ রক্ষা পেয়েছিলো। সাগরতীরে নিজ বাহিনীর সঙ্গে উপস্থিত থেকে সালাহুদ্দীন আইউবী সেই জীবন্ত রক্ষা পাওয়া ক্রুসেডারদের গ্রেফতার করতে থাকেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলো সাতটি মেয়ে, যাদের বিস্তারিত কাহিনী ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
মিসরে বিদ্রোহ করেছিলো সুদানী বাহিনী। সেই বিদ্রোহ দমন করে ফেলেন সুলতান। অপরদিকে সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীও এসে পৌঁছে তাঁর নিকট । এবার ক্রুসেডারদের প্রতিরোধ-পরিকল্পনা তৈরিতে মগ্ন হয়ে পড়েন তিনি।
রোম উপসাগরের ওপারে শহরের উপকণ্ঠে এক নিভৃত অঞ্চলে বৈঠক বসেছে খৃষ্টান কর্মকর্তাদের। শাহ অগাস্টাস, শাহ রেমান্ড, শাহেনশাহ সপ্তম লুই-এর ভাই রবার্টও সভায় উপস্থিত। পরাজয়ের গ্লানিতে বিমর্ষ সকলের মুখমণ্ডল। আলোচনা চলছে। এ সময়ে সভাকক্ষে প্রবেশ করে এক ব্যক্তি। নাম এম্লার্ক। ক্ষোভে-দুঃখে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে যেন তার দু চোখ থেকে। খৃষ্টানদের যে সম্মিলিত নৌ-বহরকে মিসর আক্রমণে প্রেরণ করা হয়েছিলো, এম্লার্ক ছিলো তার কমাণ্ডার। কিন্তু আকস্মিক ঝড়ের ন্যায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন সালাহুদ্দীন আইউবী। বহরের একজন সৈনিককেও সমুদ্র থেকে কূলে পা রাখতে দিলেন না তিনি। মিসরের মাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয়েছিলো যেসব খৃষ্টসেনা, আইউবীর হাতে যুদ্ধবন্দীতে পরিণত হয় তারা।–সভাকক্ষে বসে আছে এম্লার্ক। ক্ষোভে থর থর করে কাঁপছে তার ওষ্ঠাধর। তার বহর ডুবে মরেছে আজ পনের দিন হলো। ভাসতে ভাসতে আজ-ই ইটালীর কূলে এসে পৌঁছেছে সে। সালাহুদ্দীন আইউবীর অগ্নিতীর নিক্ষেপকারী বাহিনী পাল-মাস্তুল জ্বালিয়ে দিয়েছে তার জাহাজের। ভাগ্যক্রমে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে প্রথমবারের মত জাহাজটিকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় তার নাবিক-সৈনিকেরা। পালবিহীন জাহাজ হেলে-দুলে ভাসতে থাকে মাঝ দরিয়ায়।
এক সময়ে দিক-চক্ৰবাল আচ্ছন্ন করে আকাশে জেগে উঠে ঘোর কালো মেঘ। শুরু হয় প্রবল ঝড়। ঝড়ের কবলে পড়ে অসংখ্য শিশু-কিশোর-নারীসহ পানির নীচে তলিয়ে যায় এম্লার্কের জাহাজটি। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় এম্লার্ক। প্রাণ নিয়ে পৌঁছে যায় ইটালীর তীরে।
বৈঠক চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, খৃষ্টান বাহিনীকে এত বড় ধোঁকা কে দিলো? কার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এত শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হলো তাদের? সংশয় ব্যক্ত করা হয় সুদানী সালার নাজির উপর। তার-ই পত্রের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিলো এ নৌ-অভিযান। নাজির সঙ্গে খৃষ্টানদের পত্ৰ-যোগাযোগ চলছিলো পূর্ব থেকেই। এ যাবৎ বেশ কটি পত্র দিয়েছে সে খৃষ্টানদের। খৃষ্টানরা নাজির সর্বশেষ যে পত্রটির উপর ভিত্তি করে এ অভিযানে নেমেছিলো, পূর্বের পত্রগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হলো সেটি। কিছুটা অমিল পাওয়া গেলো। নাজির প্রতি সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। কায়রোতে গুপ্তচরও ঢুকিয়ে রেখেছিলো তারা। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকেও কোন সংবাদ পায়নি খৃষ্টানরা। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে বিশ্বাসঘাতক নাজি ও কুচক্রী সালারদের গোপনে হত্যা করে রাতের আঁধারে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন, সে সংবাদ খৃষ্টানদের কানে পৌঁছানোর ছিলো না কেউ। খৃষ্টানদের সম্রাট-কর্মকর্তাগণ কল্পনাও করতে পারেননি, যে পত্রের উপর ভিত্তি করে তারা মিসর অভিমুখে নৌ-বহর প্রেরণ করেছিলেন, সে পত্রখানা নাজিরই ছিলো বটে; কিন্তু তার আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে অন্য তারিখ লিখে দিয়েছিলেন সুলতান আইউবী। এসব তথ্য সংগ্রহ করা ছিলো খৃষ্টান গোয়েন্দাদের সাধ্যের বাইরে।
দীর্ঘ আলাপ-পর্যালোচনার পরেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারলো না এ. বৈঠক। কথা সরছে না এম্লার্কের মুখ থেকে। পরাজয়ের গ্লানিতে লোকটি যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি ক্লান্ত। পরদিনের জন্য মুলতবী করে দেয়া হয় বৈঠক।
রাতের বেলা। মদের আসর জমে উঠেছে খৃষ্টান কর্মকর্তাদের। নেশায় বুঁদ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলতে চাইছে তারা। হঠাৎ সে আসরে আগমন ঘটে এক ব্যক্তির। রেমন্ড ছাড়া কেউ চেনে না তাকে।
লোকটি রেমন্ডের নির্ভরযোগ্য গুপ্তচর। হামলার দিন সন্ধ্যায় মিসরের তীরে এসে নেমেছিলো সে। তার-ই খানিক পর এসে পৌঁছে ক্রুসেডারদের নৌ-বহর। বহরটি সালাহুদ্দীন আইউবীর ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়েছিলো তার-ই চোখের সামনে।
বেশ কিছু তথ্য নিয়ে এসেছে লোকটি। রেমন্ড সকলের নিকট পরিচয় করিয়ে দেয় তাকে। রিপোর্ট জানবার জন্য তাকে ঘিরে ধরে সবাই। খৃষ্টান কর্মকর্তাগণ সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার জন্য রবিন নামক এক সুশিক্ষিত অভিজ্ঞ গুপ্তচরকে সমুদ্রোপকূলে প্রেরণ করেছিলো এবং তার সঙ্গে পাঁচজন পুরুষ ও সাতটি রূপসী যুবতাঁকে প্রেরণ করেছিলো, এ গুপ্তচর তাদের সম্পর্কে অবহিত।
আগন্তুক জানায়–রবিন জখমের বাহানা দেখিয়ে আহতদের সঙ্গে সালাহুদ্দীন আইউবীর ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছিলো। তার পাঁচ পুরুষ সঙ্গী ছিলো বণিকের বেশে। তাদের একজন ক্রিস্টোফর যার নাম–নেপথ্য থেকে তীর ছুঁড়ে আইউবীর গায়ে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তার তীর। ধরা পড়ে যায় পাঁচজনের সকলে। মেয়ে সাতটিকেও ধরে ফেলেন আইউবী। বেশ চমৎকার কাহিনী গড়ে নিয়েছিলো মেয়েরা। আইউবীকে শোনায় সে কাহিনী। মেয়েগুলোকে আশ্রয়ে রেখে পুরুষ পাঁচজনকে ছেড়ে দিয়েছিলেন আইউবী। কিন্তু তাঁর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান হঠাৎ এসে পড়ে গ্রেফতার করে ফেলেন তাদেরকে। পাঁচজনের একজনকে সকলের সামনে হত্যা করে অন্যদের থেকে কথা আদায় করেন তিনি।
গোয়েন্দা আরো জানায়, ধরা পড়ি আমিও। আইউবীর নিকট আমি নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেই। তাই তিনি আমার উপর আহতদের ব্যাণ্ডেজ চিকিৎসার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেই সুযোগে আমি জানতে পারলাম, সুদানীরা বিদ্রোহ করেছিলো বটে; কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী সে বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে ফেলেন। তিনি বিদ্রোহী অফিসার ও নেতাদের গ্রেফতার করেন।
রবিন, তার সহযোগী চার পুরুষ ও মেয়ে ছয়টি এখন আইউবীর হাতে বন্দী। তবে সপ্তম মেয়েটির–যে ছিলো সবচেয়ে বেশী বিচক্ষণ–তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিখোঁজ মেয়েটির নাম মুবিনা এরতেলাস, সংক্ষেপে মুবী।
গোয়েন্দা জানায়, বন্দী রবিন ও তার সহকর্মীরা এখনো উপকূলীয় শিবিরেই রয়েছে। আইউবী ক্যাম্পে নেই। তার গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানও অনুপস্থিত। আমি বড় কষ্টে ওখান থেকে বের হয়ে এসেছি। ঘাটে এসে একটি নৌকা পেয়ে গেলাম। দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে দ্রুত নদী পার হয়ে চলে আসি। রবিন ও তার সহকর্মী পুরুষ ও মেয়েরা মৃত্যুমুখে পতিত। পুরুষদের চিন্তা না হয় না-ই করলাম; কিন্তু মেয়েগুলোকে উদ্ধার করা তো একান্ত আবশ্যক। ওরা সকলেই যুবতী এবং আমাদের বাছা বাছা রূপসী মেয়ে। উদ্ধার করতে না পারলে মুসলমানরা ওদের কী দশা ঘটাবে, তাতে আপনারা বুঝতেই পারছেন।
এ ত্যাগ আমাদের দিতেই হবে। বললেন অগাস্টাস।
আপনি যদি আমাকে এ নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, সালাহুদ্দীন আইউবী আমাদের মেয়েদেরকে প্রাণে শেষ করেই ক্ষান্ত হবে; অন্য কোন নির্যাতনের শিকার তাদের হতে হবে না, তাহলে এ ত্যাগ স্বীকার করতে আমিও প্রস্তুত। কিন্তু এমনটি আশা করা বৃথা; মুসলমানরা ওদের সঙ্গে পশুর মত আচরণ করবে আর তাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মেয়েগুলো আমাদেরকে অভিসম্পাত করবে। আমি তাদেরকে মুক্ত করে আনার চেষ্টা করবো। বললেন রেমন্ড।
এমনও হতে পারে, মুসলমানরা মেয়েগুলোর সঙ্গে ভাল আচরণ দেখিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করবে। তখন আমাদের মারাত্মক, সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এ কারণে ওদেরকে মুক্ত করে আনা একান্ত আবশ্যক। এর জন্য আমি আমার ভাণ্ডারের অর্ধেক সম্পদও উজাড় করতে প্রস্তুত আছি। বললেন রবার্ট।
আমাদের এ মেয়েগুলো শুধু এ কারণেই মূল্যবান নয় যে, এরা নারী। এরা প্রশিক্ষিত গুপ্তচর। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এদের মত মেয়ে আর পাবো কোথায়? . এমন মেয়ে আমরা কোথায় পাবো, যারা জাতি ও ধর্মের স্বার্থে–ক্রুশের স্বার্থে নিজেকে দুশমনের হাতে তুলে দেবে, দুশমনের ভোগ-বিলাসিতার উপকরণে পরিণত হবে এবং গুপ্তচরবৃত্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকবে। এ মিশনে তাদের সর্বপ্রথম বিলাতে হয় সম্ভ্রম। তদুপরি গুপ্তচর হিসেবে ধরা পড়ে গেলে কঠোর নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন হারাবার ভয় থাকে পদে পদে। এ মেয়েগুলোকে আমাদের বিপুল অর্থের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। তারপর প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় কষ্টে মিসর ও আরবের ভাষা শেখানো হয়েছে। আমি মনে করি, এভাবে একত্রে সাতটি মেয়ে হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বললো আগন্তুক গোয়েন্দা।
আচ্ছা, তুমি কি নিশ্চয়তা দিতে পারো, মেয়েগুলোকে আইউবীর ক্যাম্প থেকে বের করে আনা যাবে? জিজ্ঞেস করেন অগাস্টাস।
যাবে। এর জন্য প্রয়োজন বেশ কজন দুঃসাহসী সৈন্য। তবে হয়ত দু-একদিনের মধ্যে রবিন এবং তার সহকর্মী পুরুষ ও মেয়েদেরকে কায়রো নিয়ে যাওয়া হবে। তা-ই যদি হয়, তবে সেখান থেকে তাদেরকে বের করে আনা কঠিন হবে। সময় নষ্ট না করে উপকূলীয় ক্যাম্প থেকে-ই তাদেরকে মুক্ত করে আনা দরকার। আপনি বিশজন লোক দিন; আমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো। কিন্তু তারা হতে হবে এমন লোক, যারা জীবন নিয়ে খেলতে জানে। বললো গোয়েন্দা।
যে কোন মূল্যে মেয়েগুলোকে উদ্ধার করে আনা দরকার। গর্জে উঠে বললো এম্লার্ক।
খৃষ্টান বাহিনী রোম উপসাগরে যে শোচনীয় পরাজয় ও মর্মান্তিক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছিলো, তার প্রতিশোধ-স্পৃহায় পাগলের মতো হয়ে গেছে এশ্লার্ক। লোকটি ক্রুসেডারদের সম্মিলিত নৌ-বহর এবং তার আরোহী সৈন্যদের সুপ্রীম কমাণ্ডার হয়ে এ আশা বুকে নিয়ে অভিযানে বেরিয়েছিলো যে, মিসর দখলের পর জয়-মাল্য তার-ই গলায় ঝুলবে। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের তীরে-ই ঘেঁষতে দিলেন না তাকে। বেচারা জ্বলন্ত জাহাজে জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েও পড়ে গেলো ঝড়ের কবলে। সেখান থেকে বেঁচে এসেছে মরতে মরতে। এখন কথা বলতে ঠোঁট কাঁপছে তার। কথায় কথায় টেবিল চাপড়িয়ে, নিজের উরুতে হাত মেরে মনের জ্বালা প্রশমিত করছে লোকটি। অবশেষে বললো
আমি মেয়েগুলোকেও মুক্ত করে আনবো, আইউবীকেও হত্যা করাবো। উদ্ধার করে এনে এ মেয়েগুলোকে মুসলমানদের সাম্রাজ্যের মূলোৎপাটনে ব্যবহার করবো।
আমি মনে-প্রাণে তোমাকে সমর্থন করি এম্লার্ক! এমন সুশিক্ষিত মেয়েদেরকে আমিও এত সহজে নষ্ট হতে দিতে চাই না। আপনাদের সকলেরই জানা আছে, সিরিয়ার হেরেমগুলোতে আমরা কি পরিমাণ মেয়ে ঢুকিয়ে রেখেছি। বেশ কজন মুসলমান গভর্নর ও আমীর তাদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। বাগদাদে আমাদের মেয়েরা আমীরদের হাতে এমন বেশ কজন লোককে হত্যা করিয়েছে, যারা ক্রুসেডের বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলেছিলো। নারী আর মদ দিয়ে মুসলমানদের খেলাফতকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছি, তাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছি। খেলাফত এখন ত্রিধাবিভক্ত। আমোদ-বিলাসিতায় ডুবে যেতে শুরু করেছেন খলীফারা। অবশিষ্ট আছে শুধু দুটি লোক। যদি তারা দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকে, তাহলে তারা আমাদের জন্য স্বতন্ত্র এক বিপদ হয়ে থাকবে। একজন সালাহুদ্দীন আইউবী, অপরজন নুরুদ্দীন জঙ্গী। এদের একজনও যদি বেঁচে থাকে, তাহলে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি সুদানীদের বিদ্রোহ দমন করে-ই থাকে, তাহলে তার অর্থ হলো, লোকটি আমাদের ধারণা অপেক্ষাও বেশী ভয়ঙ্কর। তার বিরুদ্ধে ময়দানে মোকাবেলা করার পাশাপাশি নাশকতামূলক কার্যক্রমও আমাদের চালু করতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ-দলাদলি এবং অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এ মেয়েগুলোকে আমাদের একান্ত প্রয়োজন। বললেন রেমন্ড।
আমাদের সকল অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। আমরা আরবে মুসলমানদের দুর্বলতা থেকে স্বার্থ উদ্ধার করেছি। মুসলমান নারী, মদ আর ঐশ্বর্য পেলে অন্ধ হয়ে যায়। মুসলমানদের নিঃশেষ করার উত্তম পন্থা হলো, এক মুসলমান দিয়ে আরেক মুসলমানকে হত্যা করানো। হাতে কটি টাকা গুঁজে দাও, দেখবে, অর্থের লোভে তারা তাদের সাধের দ্বীন ও ঈমান ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে না। চেষ্টা করলে তোমরা অতি অনায়াসে মুসলমানের ঈমান ক্রয় করতে পারো। বললেন রবার্ট।
মুসলমানদের দুর্বলতা নিয়ে আলাপ চলে দীর্ঘক্ষণ। তারপর বন্দী মেয়েদের মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে কথা ওঠে। শেষে সিদ্ধান্ত হয়, বিশজন দুঃসাহসী সেনা প্রেরণ করা হবে এ কাজে। আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত রওনা হয়ে যাবে তারা।
তৎক্ষণাৎ তলব করা হয় চারজন কমাণ্ডার। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাদের বলা হলো, তোমাদের সহযোগিতার জন্য বিশজন সৈনিক বেছে নাও।
আলোচনায় বসে চার কমাণ্ডার। এ অভিযানে তারা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। এক কমাণ্ডার বললো, আমাদের এমন একটি ফোর্স গঠন করতে হবে, যারা মুসলমানদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে কমাণ্ডে আক্রমণ চালাতে থাকবে এবং রাতে তাদের পেট্রোল বাহিনীর উপর হামলা করে তাদেরকে অস্থির করে রাখবে। এ ফোর্সের জন্য দক্ষ ও বিচক্ষণ লোক বেছে নিতে হবে।
কিন্তু তারা হতে হবে শতভাগ বিশ্বস্ত। এ ফোর্স আমাদের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করবে। এমনও হতে পারে, তারা কিছু-ই না করে ফিরে এসে শোনাবে আমরা অনেক কিছু করে এসেছি। বললেন অগাস্টাস।
এক কমাণ্ডার বললো, আপনি শুনে অবাক হবেন, আমাদের বাহিনীতে এমন কিছু সৈনিক আছে, যাদেরকে আমরা বিভিন্ন কারাগার থেকে এনে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করেছি। তাদের কেউ ছিলো ডাকাত, কেউ সন্ত্রাসী, কেউবা ছিলো ছিনতাইকারী। তারা দীর্ঘ মেয়াদী সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী ছিলো। ওরা কারাগারের । বদ্ধ প্রকোষ্ঠে-ই ধুকে ধুকে মরতো। আমাদের প্রস্তাব পেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ য়ছে। শুনলে হয়তো আপনি বিস্মিত হবেন, আমাদের ব্যর্থ নৌ-অভিযানে এই সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী সৈনিকরা বড় বীরত্বের সাথে আইউবীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কয়েকটি জাহাজকে রক্ষা করেছে। বন্দী মেয়েদেরকে মুক্ত করার অভিযানে আমি এদের তিনজনকে প্রেরণ করবো।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন–মুসলমানদের মধ্যে বিলাস-প্রিয়তা বেড়ে যায় এবং তাদের ঐক্য নিঃশেষ হতে শুরু করে। মুসলমানের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য খৃষ্টানরা তাদের ঘরে ঘরে বিলাস-সামগ্রী ঢুকিয়ে দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের মনে আশা জাগে, আর এক ধাক্কায়-ই তারা মুসলমানদের ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম হবে। এবার খৃষ্টানরা বিশ্বময় ইসলাম ও মুসলিম-বিরোধী ঘৃণা ছড়াতে শুরু করে এবং সকলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানায়। জবাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ খৃষ্টান বাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করে। পাত্রী থেকে আরম্ভ করে পেশাদার অপরাধীরা পর্যন্ত পঙ্কিল পথ ত্যাগ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। যেসব সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী দীর্ঘমেয়াদী সাজা ভোগ করছিলো, বিভিন্ন কারাগার থেকে এনে তাদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়। এ কয়েদীদের প্রতি খৃষ্টানদের বেশ আস্থা ছিলো। যার কারণে আইউবীর বন্দীদশা থেকে মেয়েদের মুক্ত করা এবং আইউবীকে। হত্যা করার জন্য এক কমাণ্ডার কয়েদী সৈনিকদের নির্বাচন করেছিলো।
সকাল পর্যন্ত অতীব দুঃসাহসী ও বিচক্ষণ বিশজন সৈনিক বেছে নেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। মিগনানা মারিউসও ছিলো তাদের একজন, যাকে বের করে আনা হয়েছিলো রোমের একটি কারাগার থেকে। যে গোয়েন্দা লোকটি ডাক্তার বেশে সুলতান আইউবীর ক্যাম্পে ছিলো এবং তথ্য সংগ্রহ করে পালিয়ে এসেছিলো, অভিযানের কমাণ্ডার নিয়োগ করা হলো তাকে।
এ বাহিনীর প্রথম দায়িত্ব হলো, মেয়েগুলোকে মুসলমানদের বন্দীদশা থেকে বের করে আনা এবং সম্ভব হলে রবিন ও তার চার সহকর্মীকেও মুক্ত করা। সহজে সম্ভব না হলে রবিনদের জন্য ঝুঁকি নিতে নিষেধ করে দেয়া হয় তাদের। দ্বিতীয় দায়িত্ব, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা।
এ বাহিনীটিকে নতুন করে প্রাকটিক্যাল কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি; শুধু মৌখিক জরুরী নির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি দিয়ে একটি পালতোলা নৌকায় করে মৎস শিকারীর বেশে রওয়ানা করান হয় সে দিন-ই।
***
যে সময়ে এ নৌকাটি ইতালীর সমুদ্রতীর থেকে পাল তুলে রওনা হয়, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ততক্ষণে সুদানীদের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দমন করে ফেলেছেন। অনেক সুদানী কমাণ্ডার তার বাহিনীর হাতে মারা গেছে, আহত হয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে অনেকে। অনেকে আবার দাঁড়িয়ে আছে গভর্নর হাউজের সম্মুখের চত্বরে। অস্ত্র ত্যাগ করে সুলতান আইউবীর আনুগত্য মেনে নিয়েছে তারা। এখন তারা সুলতানের নির্দেশের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান।
হাউজের ভেতরে বসে সালারদের নির্দেশনা দিচ্ছেন সুলতান। আলী বিন সুফিয়ানও তাঁর সামনে উপবিষ্ট। হঠাৎ সুলতান আইউবীর একটি বিষয় মনে পড়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ানকে উদ্দেশ করে বললেন–আলী! গ্রেফতারকৃত গোয়েন্দা মেয়েগুলো এবং তাদের সঙ্গীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা তো ভুলেই গেলাম! এখনো তো ওরা সমুদ্রোপকূলীয় কয়েদী ক্যাম্পে-ই রয়েছে। তুমি এক্ষুনি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো এবং পাতাল কক্ষে ফেলে রাখো।
ঠিক আছে, এক্ষুনি নির্দেশ পাঠিয়ে আমি তাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি সুলতান! আর সপ্তম মেয়েটির কথা বোধ হয় আপনি ভুলে গেছেন। মেয়েটি বালিয়ান নামক এক সুদানী কমান্ডারের নিকট ছিলো। কিন্তু বালিয়ান হাউজের বাইরে দণ্ডায়মান আত্মসমর্পণকারী কমাণ্ডারদের মধ্যেও নেই। আহতদের মধ্যেও নেই, নেই নিহতদের মধ্যেও। আমার সন্দেহ হচ্ছে, গোয়েন্দা মেয়েদের সপ্তম মেয়েটি–যার নাম মুবী-বালিয়ানের সঙ্গে কোথাও আত্মগোপন করে আছে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
ঠিক আছে, তোমার সন্দেহ দূর করুন আলী! আপাতত এখানে আপনাকে আমার প্রয়োজন নেই। বালিয়ান যদি নিখোঁজ-ই হয়ে থাকে, তাহলে বেটা রোম উপসাগরের দিকেই পালিয়ে থাকবে। খৃষ্টানদের ছাড়া তাকে আর আশ্রয় দেবে কে। এখানে নিয়ে সে তুমি গোয়েন্দাদের পাতাল কক্ষে আটকে রাখে এবং এক্ষুনি সমুদ্রোপকূল অভিমুখে গুপ্তচর প্রেরণ করো। বললেন সুলতান আইউবী।
মহামান্য সুলতান! আমার তো মনে হয়, আমাদের গুপ্তচরদেরকে নিজেদের-ই দেশে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। পরামর্শ দেন সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীর সালার। তিনি আরো বললেন–
খৃষ্টানদের দিক থেকে আমাদের ততো আশঙ্কা নেই, যতো আশঙ্কা আমাদের-ই মুসলিম আমীরদের পক্ষ থেকে। আমাদের গুপ্তচরদেরকে তাদের হেরেমে ঢুকিয়ে দিন, দেখবেন, বহু অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে, ফাঁস হয়ে যাবে অনেক ষড়যন্ত্র। এ বলে তিনি এই স্বঘোষিত শাসকরা কিভাবে খৃষ্টানদের হাতে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন এবং বলেন, সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী অনেক সময় ভেবে অস্থির হয়ে যান–কোষ্টা করবো? বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করবো, নাকি নিজ গৃহকে নিজের-ই প্রদীপের আগুন থেকে রক্ষা করবো!
জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীর এ সালারের বক্তব্য গভীর মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেন আইউবী। বললেন–যদি তোমরা অর্থাৎ যাদের কাছে অস্ত্র আছে, যদি তারা দ্বীন-ধর্মের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান থাকতে পারো, একনিষ্ঠভাবে যদি তোমরা ইসলাম, দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে যাও, তাহলে বাইরের আক্রমণ আর ভিতরের ষড়যন্ত্র কোনটি-ই জাতির এতটুকু ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা দৃষ্টিকে প্রসারিত করো, সীমান্ত ছাড়িয়ে দৃষ্টিকে নিয়ে যাও আরো অনেক দূরে বহু দূরে। মনে রেখো, সালতানাতে ইসলামিয়ার কোন সীমান্ত নেই। যেদিন তোমরা নিজেদেরকে এবং আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলামকে সীমান্তের বেড়ায় আটকে ফেলবে, সেদিন থেকেই তোমরা নিজেদের-ই কারাগারে বন্দী হয়ে যাবে। আর ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকবে তোমাদের তুনীরের সীমানা। রোম উপসাগর অতিক্রম করে তোমরা আরো দূরে দৃষ্টি ফেলো। সমুদ্র রোধ করতে পারবে না তোমাদের পথ। আর ঘরের আগুনকে ভয় করো না। আমাদের এক ফুৎকারে নিভে যাবে ষড়যন্ত্রের সব মশাল তার স্থানে আমরা ঈমানের আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ প্রজ্বলিত করবো।
আমরা আশাবাদী যে, আমরা বেঈমানদের প্রতিহত করতে পারবো মুহতারাম সুলতান! আমরা নিরাশ নই। বললেন সালার।
মাত্র দুটি অভিশাপ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো আমার প্রিয় বন্ধুগণ! এক. নৈরাশ্য। দুই, বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা। মানুষ প্রথমে নিরাশ হয়। তারপর বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতার আশ্রয়ে পালাবার পথ খুঁজে। বললেন সুলতান আইউবী।
ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছেন আলী বিন সুফিয়ান। তৎক্ষণাৎ তিনি নোম উপসাগরের ক্যাম্প অভিমুখে এ পয়গাম দিয়ে দূতকে রওয়া করিয়ে দেন যে, রবিন, তার চার সহযোগী এবং মেয়েদেরকে ঘোড়া কিংবা উটের পিঠে চড়িয়ে বিশজন রক্ষীর প্রহরায় রাজধানীতে পাঠিয়ে দাও।
দূতকে রওনা করিয়ে-ই আলী বিন সুফিয়ান ছয়-সাতজন সিপাহী নিয়ে কমান্ডার বালিয়ানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। তার আগে বাইরে দণ্ডায়মান সুদানী কমাণ্ডারদের নিকট বালিয়ান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানিয়েছিলো, লড়াইয়ের সময় তাকে কোথাও দেখা যায়নি এবং সুলতানের বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্য যে বাহিনীটিকে রোম উপসাগরের দিকে প্রেরণ করা হয়েছিলো, বালিয়ান তাদের সঙ্গেও যায়নি।
বালিয়ানের ঘরে যান আলী বিন সুফিয়ান। দুজন বৃদ্ধা চাকরানী ছাড়া আর কাউকে পেলেন না সেখানে। চাকরানীরা জানায়, বালিয়ানের ঘরে পাঁচটি মেয়ে ছিলো। তার নিয়ম ছিলো, যখন-ই কোন মেয়ের বয়স একটু বেড়ে যেতো, তাকে হাওয়া করে ফেলতো এবং তার স্থলে আসতো নতুন এক টগবগে যুবতী। তারা আরো জানায়, বিদ্রোহের আগে বালিয়ানের ঘরে একটি ফিরিঙ্গী মেয়ে এসেছিলো। মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনি বিচক্ষণ। দুদিন যেতে না যেতে বালিয়ান মেয়েটির গোলাম হয়ে গিয়েছিলো। বিদ্রোহের একদিন পরে যেদিন সুদানীরা অস্ত্রসমর্পণ করে, সেদিন রাতে বালিয়ান নিজে একটি ঘোড়ায় চড়ে এবং সেই ফিরিঙ্গী মেয়েটিকে অপর একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে অজানার উদ্দেশ্যে উধাও হয়ে যায়। সাতজন অশ্বারোহীও ছিলো তার সঙ্গে। হেরেমের মেয়েদের ব্যাপারে বৃদ্ধারা জানায়, যে যা হাতে পেয়েছে, তুলে নিয়ে সবাই চলে গেছে।
ফিরে আসেন আলী বিন সুফিয়ান। হঠাৎ একটি ঘোড়া দ্রুত ছুটে এসে থেমে যায় তার সামনে। ফখরুল মিসরী তার আরোহী। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নীচে নামে সে। হাঁফাতে হাঁফাতে কম্পিত কণ্ঠে বললো, আমিও আপনার-ই ন্যায় নরাধম বালিয়ান ও কাফির মেয়েটিকে খুঁজছি। আমি তার থেকে প্রতিশোেধ নেবো। এদের দুজনকে হত্যা না করা পর্যন্ত আমার মনে শান্তি আসবে না। আমি জানি, সে কোন দিক গেছে। আমি তাকে ধাওয়াও করেছি। কিন্তু সঙ্গে তার সাতজন সশস্ত্র রক্ষী। আমি ছিলাম একা। রোম উপসাগরের দিকে যাচ্ছে লোকটা। কিন্তু যাচ্ছে সে সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে।
আলী বিন সুফিয়ানের হাত চেপে ধরে ফখরুল মিসরী বললো, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি আমায় চারজন সিপাহী দিন; ধাওয়া করে আমি ওকে শেষ করে আসি।
আলী বিন সুফিয়ান তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, চারজন নয়, আমি তোমাকে বিশজন সিপাহী দেবো। এখনো সে উপকূল অতিক্রম করতে পারেনি। তুমি আমার সঙ্গে চলো। বালিয়ান কোনদিক গেলো সে ব্যাপারে নিশ্চিত হন আলী বিন সুফিয়ান।
***
মুবীকে নিয়ে বালিয়ান উপকূল অভিমুখে বহুদূর এগিয়ে গেছে। উপকূলগামী সাধারণ পথ ছেড়ে অন্য পথে এগুচ্ছে সে। এসব অঞ্চল-পথ-ঘাট বালিয়ানের চেনা। তাই নির্বিঘ্নে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে সে।
কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে আত্মসমর্পণকারী সুদানী সৈন্য ও কমাণ্ডারদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, বালিয়ান তা জানে না। বালিয়ান পালাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথমত তার আশঙ্কা, ধরা পড়লে সুলতান আইউবী তাকে খুন করে ফেলবেন। দ্বিতীয়ত মুবীর ন্যায় রূপসী মেয়েকে হাতছাড়া করতে চাইছে না সে। যে কোন মূল্যে নিজের জীবন রক্ষা করতে হবে এবং মুবীকেও হাতে রাখতে হবে, এই তার প্রত্যয়। বালিয়ান মনে করতো, জগতের রূপসী মেয়েরা শুধু মিসর আর সুদানে-ই জন্মায়। কিন্তু ইতালীর এই ফিরিঙ্গী মেয়েটির চোখ-ধাঁধানো রূপ তাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো। মুবীর জন্য নিজের মান-সম্মান, দ্বীন-ধর্ম ও দেশ-জাতি সব বিসর্জন দিয়েছে বালিয়ান। কিন্তু এখন মুবী যে তার থেকে মুক্তি লাভ করার চেষ্টা করছে, তা বালিয়ানের অজানা। যে উদ্দেশ্যে মুবীর এ দেশে আগমন, তা নস্যাৎ হয়ে গেছে সব। তবে মুবী তার কর্তব্য পালনে ত্রুটি করেনি বিন্দুমাত্র। লক্ষ্য অর্জনে নিজের দেহ ও সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছে মেয়েটি। এখনো নিজের দ্বিগুণ বয়সী এক পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে আছে সে।
বালিয়ান এই আত্মতৃপ্তিতে বিভোর যে, মুবী তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার প্রতি মুবীর প্রচণ্ড ঘৃণা। একাকী পালাতে পারছে না বলে বাধ্য হয়ে এখনো বালিয়ানের সঙ্গ দিচ্ছে মুবী। মনে তার একটি-ই ভাবনা, কী করে রোম উপসাগর পার হওয়া যায় কিংবা কিভাবে রবিনের নিকটে পৌঁছে যাওয়া যায়।
মুবী জানে না, রবিন এবং তার বণিকবেশী সঙ্গীরা এখন সুলতান আইউবীর হাতে বন্দী। মুবী বারবার বালিয়ানকে বলছে, দ্রুত চলো, পথে অবস্থান কম করো, অন্যথায় ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু বে-ঈমান নারীলোলুপ বালিয়ান কোথাও ছায়াঘেরা একটু জায়গা পেলে-ই থেমে যায়, বিশ্রামের নামে বসে পড়ে। তারপর মেতে উঠে মদ আর মুবীকে নিয়ে।
এক রাতে একটি কৌশল আঁটে মুবী। অতিরিক্ত মদপান করিয়ে অচেতন করে শুইয়ে রাখে বালিয়ানকে। রক্ষীরা শুয়ে পড়ে খানিকটা দূরে একটি গাছের আড়ালে। রক্ষীদের একজন বেশ টগবগে, সুঠাম সুদেহী এক বলিষ্ঠ যুবক। অত্যন্ত বিচক্ষণও বটে। পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলে মুবী। হাতের ইশারায় নিয়ে যায় খানিক দূরে অন্য একটি গাছের আড়ালে। বলে, তুমি ভালো করেই জান, আমি কে, কোত্থেকে এসেছি, কেন এসেছি। আমি তোমাদের জন্য সাহায্য নিয়ে এসেছিলাম, যাতে তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর মতো একজন ভিনদেশী শাসকের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারো। কিন্তু তোমাদের এই কমাণ্ডার বালিয়ান এত বিলাস-প্রিয় লোক যে, মদপান করে মাতাল হয়ে সর্বক্ষণ আমার দেহটা নিয়েই খেলা করতে ভালবাসে। আমার সহযোগিতায় বুদ্ধিমত্তার সাথে বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে বিজয় অর্জনের চেষ্টা করার পরিবর্তে লোকটি আমাকে হেরেমের দাসী বানিয়ে রেখেছিলো। তারপর নির্বোধের মতো বাহিনীটিকে দুভাগে বিভক্ত করে এমন বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করালো যে, এক রাতে-ই তোমাদের এত বিশাল বাহিনীটি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেলো!
তোমরা হয়তো জানো না, তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লেকটি-ই দায়ী। এখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে শুধু-ই ফুর্তি করার জন্য। আমাকে সে বলছে, আমি যেন তাকে সমুদ্রের ওপারে নিয়ে গিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীতে মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদ দিই আর আমি তাকে বিয়ে করি। কিন্তু ওসব হবে না; আমি ওকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। আমি স্থির করেছি, আমার যদি বিয়ে করতেই হয়, নিজের দেশে নিয়ে যদি কাউকে দেশের সেনাবাহিনীতে মর্যাদাসম্পন্ন স্থান দিতেই হয়, তবে তার জন্য আমার মনেঃপূত একজন লোক বেছে নিতে হবে। আর সে হলে তুমি। তুমি যুবক, সাহসী ও বুদ্ধিমান। প্রথমবার যখন আমি তোমাকে দেখেছি, তখন থেকেই আমার হৃদয়ে তোমার ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে আছে। তুমি এ বৃদ্ধের কবল থেকে আমাকে রক্ষা করো। আমি এখন তোমার। সমুদ্রের ওপারে চলো, মর্যাদা, ধনৈশ্বর্য আর আমি সব তোমার পদচুম্বন করবে। কিন্তু তার জন্য আগে এ লোকটিকে এখানেই শেষ করে যেতে হবে। লোকটি অচেতন ঘুমিয়ে আছে; তুমি যাও, ওকে খুন করে আসে। তারপর চলো, রওনা হই।
রক্ষীর ঘাড়ে হাত রাখে মুবী। মুবীর রূপের মোহ-জালে আটকা পড়ে যায় রক্ষী। দুবাহু দ্বারা জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। প্রেমের যাদু দিয়ে পুরুষ বশ করায় অভিজ্ঞ মুবী। পূর্বের অবস্থান থেকে সরে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটি। রক্ষীও অগ্রসর হয়ে হাত বাড়ায় তার প্রতি।
এমন সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে একটি বর্শা ছুটে এসে বিদ্ধ হয় রক্ষীর পিঠে। আহ! বলে চীৎকার করে ওঠে লোকটি। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। দূর থেকে ছুটে আসে একজন। রক্ষীর পিঠ থেকে বর্শাটি টেনে বের করতে করতে বলে বেটা নিমকহারাম, তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
চীৎকার দেয় মুবী। বলে, লোকটিকে তুমি খুন ……..। এর বেশী বলতে পারলো না সে। পিছন থেকে অপর একজন তার বাহু ধরে ঝটকা এক টান দিয়ে ছুঁড়ে মারে বালিয়ানের দিকে। বলে, আমরা তার পোষ্য বন্ধু। আমাদের জীবন তার উপর নির্ভরশীল। তোমরা আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। বিভ্রান্ত যে হয়েছে, সে তার প্রায়শ্চিত্ত পেয়ে গেছে।
মদের নেশায় অচেতন পড়ে আছে বালিয়ান।
তোমরা কি ভেবে দেখেছো, তোমরা কোথায় যাচ্ছো? জিজ্ঞেস করে মুবী।
যাচ্ছি সমুদ্রে ডুবে মরতে। তোমার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে নিয়ে যায়, আমরা সেখানেই–যাবো। এই বলে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ে তারা।
পরদিন বেশ বেলা হলে ঘুম থেকে জাগ্রত হয় বালিয়ান। রক্ষীরা রাতের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে তাকে। মুবী বলে, প্রাণের ভয় দেখিয়ে সে আমাকে, নিয়ে গিয়েছিলো। বালিয়ান শাবাশ দেয় তার রক্ষীদের। কোন ঘটনায় নিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক খুন হলো, তার জন্য কোন ভাবনা-ই জাগলোলা না তার মনে। মুবীর রূপ আর মদে বুঁদ হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মত হয়ে গেছে বালিয়ান। মুবী তাকে বলে, ওঠ, দ্রুত রওনা হও। কিন্তু বালিয়ানের কোন ভাবনা নেই। নিজেকে হারিয়েই ফেলেছে যেন সে। মুবী ভাবে, এরা কতো নির্দয়, কতো নির্বোধ জাতি; সামান্য কারণে, হীন স্বার্থে আপন লোকদেরও হত্যা করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয়না!
আলী বিন সুফিয়ান কেন যেন বালিয়ানের পশ্চাদ্ধাবন না করে ফিরে গেলেন। বিদ্রোহের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনিও।
***
সমুদ্রোপকূলের ক্যাম্প থেকে রবিন, তার চার সঙ্গী এবং ছয়টি মেয়েকে পনেরজন রক্ষার প্রহরায় কায়রো অভিমুখে রওনা করা হয়েছে। দূত রওনা হয়ে গেছে তাদেরও আগে। বন্দীরা সকলে উটের পিঠে আর রক্ষীরা ঘোড়ায়। তারা স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলছে এবং পথে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্রাম নিচ্ছে। তাড়া নেই, শঙ্কা নেই। পথে বিপদের কোন ভয় নেই। নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় পথ চলছে তারা। কয়েদীরা নিরস্ত্র, তদুপরি তাদের ছয়জন-ই নারী। কারোর পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।
কিন্তু রক্ষীরা ভুলে গেছে, তাদের কয়েদীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। তীর-তরবারী ব্যবহারে সকলেই অভিজ্ঞ। তাদের দলের যাদেরকে বণিকবেশে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা রীতিমত যোদ্ধা। আর মেয়েগুলোও সেই মেয়ে নয়, যাদেরকে মানুষ অবলা নারী মনে করে থাকে। তাদের দেহ ও রূপের আকর্ষণ, মধুভরা যৌবন আর চপলতা এমন এক অস্ত্র, যা প্রবল প্রতাপশালী রাজা-বাদশাহদেরও কুপোকাত করে ফেলতে, বড় বড় বীর যোদ্ধাকেও মুহূর্তে নিরস্ত্র করতে সক্ষম।
রক্ষীদের কমাণ্ডার মিসরী। তার নজরে পড়ে, মেয়ে ছয়টির একজন বার বার তার প্রতি চোখ তুলে তাকাচ্ছে। চোখাচোখি হয়ে গেলে মিষ্টি-মধুর হাসি ভেসে ওঠে মেয়েটির ঠোঁটে। মেয়েটি যাদুর মত আকর্ষণ করছে কমাণ্ডারকে। তার রাঙ্গা ঠোঁটের মুচকি হাসি মোমের মত গলিয়ে ফেলছে তাকে।
সন্ধ্যার সময় এই প্রথমবার একস্থানে যাত্রা বিরতি দেয় কাফেলা। খাবার দেয়া হয় সকলকে। কিন্তু খাবারে হাত দিল না মেয়েটি। কমাণ্ডারকে জানান হলো। কমাণ্ডার কথা বললো মেয়েটির সঙ্গে। খাবার না খাওয়ার কারণ জানতে চায় সে। জবাবে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার দুচোখ থেকে। কিছুক্ষণ নতমুখে দাঁড়িয়ে থেকে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে আপনার সঙ্গে আমি নিভৃতে কথা বলতে চাই।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসে। ঘুমিয়ে পড়ে কাফেলার সকলে। শুয়ে পড়ে কমাণ্ডারও। কিছুক্ষণ পর সে বিছানা থেকে উঠে মেয়েটিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। নিয়ে যায় আড়ালে। বলে, কি যেন বলবে বলেছিলে, এবার বলো। কাদ কাঁদ কণ্ঠে মেয়েটি বললো, আমি একটি মজলুম মেয়ে। আমাকে খুষ্টান সৈন্যরা অপহরণ করে একটি জাহাজে তুলে নিয়ে এসেছে। আমি এক অফিসারের রক্ষিতা হয়ে থাকতে বাধ্য হই।
অন্য মেয়েদের সম্পর্কে সে জানায়, তাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় জাহাজে। তাদেরকেও আনা হয়েছে অপহরণ করে। অগ্নিগোলার শিকার হয়ে জাহাজগুলো আগুনে পুড়তে শুরু করলে একটি নৌকায় তুলে আমাদেরকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ভাসতে ভাসতে আমরা কূলে এসে পৌঁছি। তারপর গুপ্তচর সন্দেহে বন্দী হই আপনাদের হাতে।
বণিকবেশী গোয়েন্দারাও মেয়েগুলোর ব্যাপারে সুলতান আইউবীকে এ কাহিনী-ই শুনিয়েছিলো। মিসরী রক্ষী কমাণ্ডারের জানা ছিলো না এ কাহিনী, এ-ই প্রথমবার শুনছে সে। তার প্রতি নির্দেশ, এরা ভয়ঙ্কর গুপ্তচর; কঠোর নিরাপত্তার সাথে এদেরকে কায়রো নিয়ে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা বিভাগের হাতে তুলে দিতে হবে। কাজেই মেয়েদের, বিশেষ করে এই মেয়েটির কোন সাহায্য করার সাধ্য তার নেই। তাই সে নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে দেয় মেয়েটিকে। তার জানা নেই, মেয়েটির নীরে আরো অনেক তীর অবশিষ্ট আছে। এক এক করে সেই তীর ছুঁড়তেই থাকবে সে।
এবার মেয়েটি বললো, আমি তোমার নিকট কোন সাহায্য চাই না। তুমি কোন সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেও আমি তা গ্রহণ করবো না। কারণ, তোমাকে আমার এতই ভালো লাগছে যে, আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তোমাকে ভালোবাসি বলেই আমি মনের বেদনার কথাগুলো তোমার কাছে। ব্যক্ত করেছি।, এমন একটি রূপসী মেয়ের মুখে এ জাতীয় কথা শুনে আত্ম-সংবরণ করতে পারে কোন পুরুষ! তাছাড়া কমাণ্ডারের হাতে মেয়েটি নিতান্ত অসহায়ও বটে। তদুপরি নিঝুম রাতের নির্জন পরিবেশ। ধীরে ধীরে বরফের মত গলতে শুরু করে মিসরী কমাণ্ডারের পৌরুষ। বন্ধুসুলভ প্রেমালাপ জুড়ে দেয় সে মেয়েটির সঙ্গে। এবার মেয়েটি নিক্ষেপ করে নীরের আরেকটি তীর। সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পূত-পবিত্র চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করতে শুরু করে। বলে–আমি তোমার গভর্নর সালাহুদ্দীন আইউবীকে আমার নির্যাতনের কাহিনী শুনিয়েছিলাম। আশা ছিলো, তার মত একজন মহৎ ব্যক্তি আমার প্রতি দয়াপরবশ হবেন। কিন্তু আশ্রয়ের নামে তিনি আমায় নিজের তাঁবুতে নিয়ে রাখলেন এবং মদপান করে হায়েনার মত রাতভর আমার সম্ভ্রম লুট করলেন। পশুটা আমার হাড়গোড় সব ভেঙ্গে দিয়েছে। মদপান করে তিনি এমনই অমানুষ হয়ে যান যে, তখন তার মধ্যে মানবতা বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।
মাথায় খুন চেপে যায় মিসরীর। দাঁত কড়মড় করে বলে ওঠে, এ্যা, আমাদের শোনান হয়, সালাহুদ্দীন একজন পাক্কা ঈমানদার, এক্কেবারে ফেরেশতা। মদ-নারীর প্রতি নাকি তাঁর প্রচণ্ড ঘৃণা। আর তলে তলে করে বেড়াচ্ছেন এসব, না?”
এখন তোমরা আমাকে তার-ই কাছে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যা বললাম, যদি তোমার বিশ্বাস না হয়ে থাকে, তাহলে রাতে দেখো, আমাকে কোথায় থাকতে হয়। তোমাদের সুলতান আমাকে কয়েদখানায় না রেখে রাখবেন তাঁর হেরেমে, সে কথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। লোকটার কথা মনে পড়লে আমার গা শিউরে ওঠে। বললো মেয়েটি।
এ জাতীয় আরো অনেক কথা বলে মিসরী কমাণ্ডারের মনে সুলতান আইউবীর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা সৃষ্টি করে মেয়েটি। মিসরী এখন সম্পূর্ণরূপে মেয়েটির হাতের মুঠোয়। সে তার মাথা কজা করে নিয়েছে। কিন্তু কমাণ্ডার জানেনা, এসব হলো গোয়েন্দা মেয়েদের অস্ত্র। সব শেষে মেয়েটি বললো–তুমি যদি আমাকে এ লাঞ্ছনার জীবন থেকে উদ্ধার করতে পারো, তাহলে আমি আজীবনের জন্য তোমার হয়ে যাবো এবং আমার পিতা বিপুল স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তোমাকে পুরস্কৃত করবেন।
তার পন্থাও জানিয়ে দেয় মেয়েটি। বলে, তুমি আমার সঙ্গে সমুদ্র পার হয়ে পালিয়ে যাবে। নৌকার অভাব হবে না। আমার পিতা বড় ধনাঢ্য ব্যক্তি। আমি তোমাকে বিয়ে করে নেবো আর আমার পিতা তোমাকে উন্নত একটি বাড়ি ও বিপুল ধন-সম্পদ প্রদান করবেন। নির্বিঘ্নে ব্যবসা করে আমাকে নিয়ে সুখে জীবন কাটাতে পারবে।
মিসরীর মনে পড়ে যায়, সে মুসলমান। বললো, কিন্তু আমি তো আমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারবো না। মেয়েটি কিছুক্ষণ মৌন থেকে ভেবে বললো ঠিক আছে, তোমার জন্য আমিই আমার ধর্ম বিসর্জন দেবো।
পলায়ন ও বিয়ের পরিকল্পনা তৈরী করে দুজনে। মেয়েটি বললো, তোমার উপর আমি কোন চাপ দিতে চাই না। ভালভাবে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও। আমি শুধু জানতে চাই, আমার মনে তোমার প্রতি যতটুকু ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে, ততটুকু হৃদ্যতা আমার প্রতিও তোমার অন্তরে জেগেছে কি না। আমাকে বরণ করতে যদি তুমি প্রস্তুত হয়েই থাকো, তাহলে চেষ্টা করো, যেন কায়রো পৌঁছুতে আমাদের সফর দীর্ঘ হয়। ওখানে পৌঁছে গেলে তুমি আমার গন্ধও পাবে না।
মেয়েটির উদ্দেশ্য, সফর দীর্ঘ হোক এবং তিন দিনের স্থলে ছয়দিন পথেই কেটে যাক। তার কারণ, রবিন ও তার সঙ্গীরা পালাবার চেষ্টা করছে। রাতে ঘুমন্ত রক্ষীদেরকে তাদের-ই অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে তাদের-ই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পালাবার পরিকল্পনা নিয়ে সুযোগের সন্ধান করছে তারা। এতো মাত্র প্রথম মযিল, প্রথম অবস্থান। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সফর, যাতে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে কাজ করা যায়।
এ উদ্দেশ্য সাধনে-ই মেয়েটিকে ব্যবহার করছে তারা। মিসরী কমাণ্ডারকে হাত করার দায়িত্ব অর্পণ করেছে তার উপর। মেয়েটি প্রথম সাক্ষাতেই ধরাশয়ী করে ফেলে মিসরী কমাণ্ডারকে।
মিসরী কমাণ্ডার তেমন ব্যক্তিত্ববান লোক নয়; একজন প্লাটুন কমাণ্ডার মাত্র। এমন সুন্দরী নারী স্বপ্নেও দেখেনি সে কখনো। অথচ এখন কিনা অনুপম এক অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী তার হাতের মুঠোয়। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তার হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে বসেছে মেয়েটি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কমাণ্ডার। ভুলে গেছে নিজের ধর্ম ও কর্তব্যের কথা। এখন সে ক্ষণিকের জন্যও মেয়েটি থেকে আলাদা হতে চাইছে না।
এ উন্মাদনার মধ্যে পরদিন ভোরবেলা কমাণ্ডার প্রথম আদেশ জারী করে, উট-ঘোড়াগুলো বেশ ক্লান্ত; কাজেই আজ আর সফর হবে না। রক্ষী ও উষ্ট্ৰচালকগণ এ ঘোষণায় বেশ আনন্দিত হয়। কারণ, রণক্ষেত্রে সীমাহীন পরিশ্রমে তাদেরও দেহ অবসন্ন। কায়রো পৌঁছবার কোন তাড়াও নেই তাদের।
বিশ্রাম ও গল্প-গুজবে কেটে যায় দিন। কমাণ্ডারও মেয়েটিকে নিয়ে উন্মাতাল। দিন গিয়ে রাত এলো। ঘুমিয়ে পড়লো সকলে। কমাণ্ডার মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল খানিকটা দূরে। সকলের দৃষ্টির আড়ালে মেয়েটি রঙ্গিন স্বপ্নের নীলাভ আকাশে পৌঁছিয়ে দিলো তাকে।
পরদিন তাঁবু তুলে যাত্রা করে কাফেলা। কিন্তু কমাণ্ডার সোজা রাস্তা ছেড়ে ধরে অন্য পথ। সঙ্গীদের বললো, এ পথে সামনে ছাউনি ফেলার জন্য বেশ মনোরম জায়গা আছে। একটি বসতিও আছে কাছে। ডিম-মুরগী পাওয়া যাবে। শুনে সঙ্গীদের আনন্দ আরো বেড়ে যায় যে, কমাণ্ডার আমাদের আয়েশের চিন্তা করছেন।
কিন্তু প্লাটুনের দুজন সৈনিক কমাণ্ডারের এসব আচরণের আপত্তি তোলে। তারা বলে, আমাদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর কয়েদী। লোকগুলো শত্রুবাহিনীর গুপ্তচর। যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছিয়ে দেয়া প্রয়োজন। অযথা সফর দীর্ঘ করা ঠিক হচ্ছে না। কমাণ্ডার তাদের এই বলে থামিয়ে দিলো যে, সে দায়িত্ব আমার। গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছবো না বিলম্বে, সে তোমাদের ভাবতে হবে না। জবাবদিহি করতে হলে আমাকেই করতে হবে; তোমাদের এত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তারা কমাণ্ডারের জবাবে চুপসে যায়।
এগিয়ে চলছে কাফেলা। দুপুরের পর কাফেলা যেখানে পৌঁছে, সেখানে আশপাশে অসংখ্য শকুন উড়তে ও মাটিতে নামতে-উঠতে দেখে তারা। বুঝা গেলো, মৃত মানুষের লাশ আছে এখানে। চারদিকে মাটি ও বালির টিলা, বড় বড় বৃক্ষও আছে। টিলার ভেতরে ঢুকে পড়ে কাফেলা। ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠে গেছে পথ। একটি উঁচু স্থান থেকে বিশাল এক ময়দান চোখে পড়ে তাদের। তার এক স্থানে বৃত্তাকারে উঠানামা করছে অনেকগুলো শকুন। শোরগোল করে কিসে যেন মেতে আছে শকুনগুলো । কিছুদূর অগ্রসর হলে চোখে পড়ে, সেখানে কতগুলো লাশ। পচা লাশের দুর্গন্ধে বিষিয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।
এগুলো সেই সুদানীদের লাশ, যারা নোম উপসাগরের তীরে অবস্থানরত সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে রওনা হয়েছিলো। সুলতান আইউবীর জানবাজ সৈনিকরা রাতের বেলা পেছন থেকে হামলা চালিয়ে এখানে-ই থামিয়ে দিয়েছে তাদের অগ্রযাত্রা, ব্যর্থ করে দিয়েছে তাদের অশুভ তৎপরতা। আরো সামনে মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সুদানীদের অসংখ্য লাশ। আইউবী বাহিনীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর নিহতদের লাশগুলো পর্যন্ত তুলে নেয়ার সুযোগ পায়নি তারা।
এগিয়ে চলছে কাফেলা।
নিহত সুদানীদের লাশের আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে তাদের অস্ত্র । তীর-কামান, বুর্শা-ঢাল ইত্যাদি। কাফেলার কয়েদীদের চোখে পড়ে সেগুলো। তারা পরস্পর কানাঘুষা করে। যে মেয়েটি রক্ষী কমাণ্ডারকে কজা করে রেখেছিলো, তার সঙ্গেও চোখের ইঙ্গিতে কথা বলে রবিন। লাশ ও অস্ত্র ছড়িয়ে আছে অনেক দূর পর্যন্ত।
ডান দিকে নিকটে-ই সবুজ-শ্যামল মনোরম একটি জায়গা। পানিও নজরে আসছে। এই সবুজের সমারোহ টিলাগুলোর চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মেয়েটি চোখ টিপে ইঙ্গিত করলো কমাণ্ডারকে। কমাণ্ডার চলে আসে মেয়েটির নিকটে। মেয়েটি বললো–জায়গাটি বেশ মনোরম, এখানেই তাঁবু ফেলল। রাতে বেশ মজা হবে।
কাফেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয় কমাণ্ডার। সবুজ-শ্যামল টিলার নিকটে পানির ঝরনার কাছে গিয়ে থেমে যায় সে। ঘোষণা দেয়, এখানে-ই রাত কাটবে। উট-ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে সকলে। পানির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে পশুগুলো। রাত যাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গার সন্ধান করে কমাণ্ডার। দুটি টিলার মাঝে প্রশস্থ একটি জায়গা, সবুজে ঘেরা। ছাউনি ফেলার নির্দেশ হয় এখানে।
গভীর রাত। চারদিক অন্ধকার। ঘুমিয়ে আছে সকলে। জেগে আছে শুধু দুজন। কমাণ্ডার আর মেয়েটি। কমাণ্ডারের ভাবনা এক, মেয়েটির মতলব আরেক। কমাণ্ডারের ইচ্ছা মেয়েটিকে ভোগ করে চলা আর মেয়েটির পরিকল্পনা কমাণ্ডারকে খুন করা।
নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে সবাই। কোন প্রহরা নেই। নিরাপত্তার কথা ভাববার-ই সময় নেই কমাণ্ডারের। শয়ন থেকে উঠে মেয়েটি। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় কমাণ্ডারের নিকট। মেয়েটিকে নিয়ে সকলের থেকে অনেক ব্যবধানে দূরে শুয়ে আছে কমাণ্ডার। মেয়েটি তাকে একটি টিলার আড়ালে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ কাটায় সেখানে। সে আরো একটু দূরে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। মিসরী কমাণ্ডার তার ইচ্ছার গোলাম। এ যে এক ষড়যন্ত্র, কল্পনায়ও আসছে না তার। মনে তার বেশ আনন্দ। সে মেয়েটির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। আরো তিনটি টিলা পেরিয়ে মেয়েটি একস্থানে নিয়ে যায় তাকে। এবার সে থামে। কমাণ্ডারকে দু বাহুতে জড়িয়ে ধরে মন উজাড় করে প্রেম-নিবেদন করে। নিজেকে প্রেম-সাগরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কমাণ্ডার।
রবিন দেখলো, কমাণ্ডার নেই। অন্য রক্ষীরাও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। শুয়ে শুয়ে-ই সে পাশের সঙ্গীকে জাগায়। পাশের জন জাগায় তার পরের জনকে। এভাবে জেগে উঠে তারা চারজন।
রক্ষীরা ঘুমিয়ে আছে তাদের থেকে একটু দূরে। কোন পাহারাদার নেই। বুকে ভর দিয়ে ক্রোলিং করে সামনে এগিয়ে যায় রবিন। রক্ষীদের অতিক্রম করে। চলে যায় অনেক দূর। পিছনে পিছনে এগিয়ে যায় তার তিন সঙ্গী। তারা টিলার আড়ালে গিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। চলে যায় মাঠের লাশগুলোর কাছে। কুড়িয়ে নেয় অস্ত্র । তিনটি ধনুক, তূনীর ও একটি করে বর্শা হাতে তুলে নেয়। এবার অস্ত্র নিয়ে একত্রে ফিরে আসে তিনজন।
সঙ্গীদের নিয়ে ঘুমন্ত রক্ষীদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রবিন। হাতের বর্শাটা শক্ত করে ধরে। তুলে ধরে চীৎ হয়ে শুয়ে থাকা এক রক্ষীর বুক বরাবর। অপর চারজনও এক একজন রক্ষীর নিকট দাঁড়িয়ে যায় পজিশন নিয়ে। মুহূর্ত মধ্যে জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে সুলতান আইউবীর চার রক্ষীর। এ চারজনকে খুন করে কেউ টের পাওয়ার আগে অপর এগারজনকেও শেষ করে ফেলা ব্যাপার নয়। চাল তাদের সফল। তারপর থাকে তিন উষ্ট্ৰচালক আর কমাণ্ডার। পনের রক্ষীর হত্যার পর তারা হবে সহজ শিকার।
রক্ষীর বুকে বিদ্ধ করার জন্য বর্শাটা আরো একটু উপরে তোলে রবিন। সে রক্ষীর বুকটা শেষবারের মত দেখে নেয়। আঘাতের জন্য হাতটা তার নীচে নেমে এলো বলে, হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসে রবিনের কানে। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখ দিক থেকে একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় রবিনের বুকে। ছুটে আসে আরেকটি তীর। বিদ্ধ হয় রবিনের এক সঙ্গীর বুকে। একই সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দুজন। অপর তিনজন দেখার চেষ্টা করছে, ঘটনাটা কী ঘটলো। ইত্যবসরে ধেয়ে আসে আরো দুটি তীর। আঘাত খেয়ে পড়ে যায় আরো দুজন। এখনো দাঁড়িয়ে আছে একজন। পালাবার জন্য পিছন দিকে মোড় ঘুরায় সে। অনি একটি তীর, এসে গেঁথে যায় তার এক পাজরে। তার দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে; পড়ে যায় মাটিতে।
ঘটনাটা ঘটে গেলো নিতান্ত চুপচাপ । একে একে পাঁচটি প্রাণী ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে; কিন্তু টের পেলো না কেউ। এখনো সবাই ঘুমুচ্ছে নাক ডেকে। যম এসে দাঁড়িয়েছিলো যাদের সামনে, টের পেলো না তারাও।
ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসে তীরন্দাজরা। আলো জ্বালায় তারা। তারা সেই দুই রক্ষী, যারা কমাণ্ডারের আচরণে আপত্তি তুলে বলেছিলো, গড়িমসি না করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছা দরকার । শুয়েছিলো তারা। চার কয়েদী যখন পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করছিলো, তখন চোখ খুলে যায় একজনের। সে সঙ্গীকে জাগিয়ে কয়েদীদের অনুসরণ করে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, কয়েদীরা যদি পালাবার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের তীর ছুঁড়ে খতম করে দেবে। তাই তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে তারা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে কয়েদীদের ফিরে আসতে দেখে একটি টিলার আড়ালে বসে পড়ে চুপচাপ। এবার যেইমাত্র কয়েদীরা রক্ষীদের বুক লক্ষ্য করে বর্শা তাক করে, অমনি রক্ষীরা তাদের প্রতি তীর ছুঁড়ে দেয়। খতম করে দেয় চার কয়েদীর প্রত্যেককে।
এবার কমাণ্ডারকে আওয়াজ দেয় রক্ষীরা। কিন্তু কোন শব্দ-সাড়া নেই তার। তাদের ডাকাডাকিতে জেগে ওঠে মেয়েরা। জেগে ওঠে অপর রক্ষীরাও। চারটি লাশ দেখতে পায় মেয়েরা। লাশগুলো তাদের-ই চার সঙ্গীর। তারা আঁৎকে উঠে। দেহে একটি একটি করে তীর নিয়ে শুয়ে আছে লাশগুলো। অপলক নেত্রে নিঃশব্দে লাশগুলোর প্রতি তাকিয়ে থাকে মেয়েরা। কী করতে এসে সঙ্গীরা লাশ হলো, তা বুঝতে বাকী রইলো না তাদের। আজ রাতের পরিকল্পনা সম্পর্কে তারাও অবহিত।
মিসরী কমাণ্ডার ছাউনীতে নেই। নেই একটি মেয়েও।
কয়েদী গোয়েন্দাদের বুকে যখন তীর বিদ্ধ হলো, ঠিক তখন রক্ষীদের মিসরী কমাণ্ডারের পিঠেও বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো একটি খঞ্জর। দুটি টিলার পরে তৃতীয় একটি টিলার নীচে পড়ে আছে তার লাশ। সে সংবাদ জানে না রক্ষীরা।
তাঁবু থেকে তুলে মেয়েটি বেশ দুরে তার পছন্দমত একটি স্থানে নিয়ে গিয়েছিলো কমাণ্ডারকে। রাতের আঁধারে মেয়েটিকে নিয়ে আমোদে মেতে উঠে কমাণ্ডার। একটি টিলার আড়ালে বসে আছে দুজন। সে টিলার-ই খানিক দূরে তাঁবু ফেলেছিলো বালিয়ান। মুবীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বালিয়ানও এগিয়ে আসে টিলার দিকে। হাতে তার মদের বোতল। নীচে বিছানোর জন্য মুবী হাতে করে নিয়ে আসে একটি শতরঞ্জি। একস্থানে শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে পড়ে মুবী। পাশে বসে মুবীকে জড়িয়ে ধরে বালিয়ান।
হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কারো কথা বলার শব্দ ভেসে আসে তাদের কানে। কান খাড়া করে শব্দটা কোন্ দিক থেকে আসছে, আন্দাজ করার চেষ্টা করে বালিয়ান। কী বলছে, তাও বুঝবার চেষ্টা করে সে। বুঝা গেলো কণ্ঠটি একটি মেয়ের। বালিয়ান ও মুবী উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সেদিকে। কাছে গিয়ে টিলার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে তাকায় দুজনে। দুটি ছায়ামূর্তি বসে আছে দেখতে পায় তারা। আরো গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। এবার পরিষ্কার বুঝতে পারে, ছায়ামূর্তি দুটির একটি নারী অপরটি পুরুষ। আরো নিকটে চলে যায় মুবী। সে গভীর মনে তাদের আলাপ বুঝতে চেষ্টা করে। মিসরী কমাণ্ডারের সঙ্গে মেয়েটি এমন স্পষ্ট ভাষায় কথা বলছিলো যে, মুবী নিশ্চিত হয়ে যায়, মেয়েটি তার-ই এক সহকর্মী। তারা আরো বুঝে ফেলে, কায়রো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেয়েটিকে।
মিসরী কমাণ্ডারের আচরণ ও কথোপকথনে মুবী নিশ্চিত বুঝে ফেলে, লোকটি এ মেয়েটিকে তার অসহায়ত্বের সুযোগে ভোগের উপকরণে পরিণত করে রেখেছে। মনে মনে ফন্দি আঁটে মুবী। পিছনে সরে গিয়ে বালিয়ানকে কানে কানে বলে–লোকটি মিসরী। সঙ্গের মেয়েটি আমার-ই সহকর্মী। বেটা জোরপূর্বক ফুর্তি করছে মেয়েটিকে নিয়ে। তুমি তাকে রক্ষা করো। এই মিসরী লোকটি তোমার দুশমন আর মেয়েটি আমার আপন। বালিয়ানকে উত্তেজিত করার জন্য মুবী আরো বলে–মেয়েটি বেশ সুন্দরী। মিসরীর কবল থেকে ওকে উদ্ধার করে আনো, এই সফরে ওকে নিয়ে বেশ আমোদ করতে পারবে।
একটু আগেই মদপান করেছিলো বালিয়ান। মাথাটা এখনো তার ঢুলুঢুলু করছে। এবার খুনের নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। সে মুবীর দেখানো লোভ সামলাতে পারলো না। কোমরবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করে হাতে নেয় বালিয়ান। বিলম্ব না করে দ্রুত এগিয়ে যায় মিসরীর প্রতি। খঞ্জরের আঘাত হানে তার পিঠে। পিঠ থেকে খঞ্জরটি টেনে বের করে মারে আরেক ঘা। লুটিয়ে পড়ে মিসরী।
মিসরীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। দৌড়ে আসে মুবী। সাংকেতিক শব্দে ডাক পাড়ে মেয়েটিকে। মেয়েটি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরে মুবীকে। অন্য মেয়েরা কোথায়, জিজ্ঞেস করে মুবী। সঙ্গী মেয়েরা কোথায় কিভাবে আছে, জানায় মেয়েটি। সে রবিন এবং তার সাথীদের কথাও জানায়।
পিছন দিকে দৌড়ে যায় বালিয়ান। ডেকে তুলে নিজের ছয় সঙ্গীকে। তাদের কাছে আছে ধনুক ও অন্যান্য হাতিয়ার।
ইত্যবসরে মুসলিম রক্ষীদের একজন কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে আসে এদিকে। তীর ছুঁড়ে বালিয়ানের এক সঙ্গী; খতম করে দেয় রক্ষীকে। মেয়েটি তাদের নিয়ে হাঁটা দেয় ছাউনির দিকে।
সর্বশেষ টিলাটির পিছনে আলো দেখতে পায় বালিয়ান। টিলার আড়ালে গিয়ে উঁকি দিয়ে তাকায় সে। বড় বড় দুটি মশাল জ্বলছে। মশালের দণ্ডগুলো লম্বা হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
বালিয়ান ও তার সঙ্গীরা যেস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, জায়গাটা অন্ধকার। কিন্তু যে স্থানে মশাল জ্বলছে, সেখানে একধারে পাঁচটি মেয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায় সে। রক্ষীরাও দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যখানে পড়ে আছে পাঁচটি লাশ। লাশগুলোর গায়ে তীরবিদ্ধ। মুবী ও অপর মেয়েটির কান্না এসে যায়। মুবীর উস্কানীতে এবার বালিয়ান রক্ষীদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার সঙ্গীদের বলে, এরা তোমাদের শিকার, তীর ছুঁড়ে বেটাদের শেষ করে দাও। সংখ্যায় এখন তারা চৌদ্দ। দুর্ভাগ্যবশত মশালের আলোতে তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শিকারীরা।
ধনুকে তীর সংযোজন করে বালিয়ানের সঙ্গীরা। একই সময়ে শো করে ছুটে আসে ছয়টি তীর। এক সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ছয়জন রক্ষী। বাকীরা কোত্থেকে কী হলো বুঝে উঠতে না উঠতে ছুটে আসে আরো ছয়টি তীর। মাটিতে পড়ে যায় আরো ছয় রক্ষী। এখনো বেঁচে আছে দুজন। অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায় তাদের একজন। পালাবার চেষ্টা করে অপরজনও। কিন্তু একত্রে তিনটি তীর এসে বিদ্ধ হয় তার পিঠের তিন জায়গায়। শেষ হয়ে যায় সে-ও। রক্ষা পেয়ে গেছে তিন উষ্ট্ৰচালক। ঘটনার সময় এখানে ছিলো না তারা। পরে দূর থেকে টের পেয়ে তারা অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো।
মশালের আলোতে এখন দেখা যাচ্ছে লাশ আর লাশ। প্রতিটি লাশ শুয়ে আছে একটি করে তীর নিয়ে। দৌড়ে এসে মেয়েদের সঙ্গে মিলিত হয় মুবী। এ সময় একটি ঘোড়ার দ্রুত ধাবন শব্দ শুনতে পায় তারা। শঙ্কিত হয়ে ওঠে বালিয়ান। বলো, এখানে বিলম্ব করা ঠিক হবে না। বেটাদের একজন জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে। লোকটা কায়রোর দিকে গেলো বলে মনে হলো। চল, জলদি কেটে পড়ি।
রক্ষীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজেদের ছাউনিতে চলে যায় তারা। গিয়ে দেখে, যিনসহ তাদের একটি ঘোড়া উধাও। বুঝতে বাকী রইলো না, রক্ষী-ই নিয়ে গেছে ঘোড়াটি। নিজেদের ঘোড়ার নিকট যেতে না পেরে লোকটা চলে আসে এদিকে। এখানে বাঁধা ছিলো আটটি ঘোড়া। যিনগুলো খুলে রাখা ছিলো পাশেই এক জায়গায়। একটি ঘোড়ায় যিন কষে পালিয়ে গেছে রক্ষী।
চৌদ্দটি ঘোড়ায় যিন বাঁধায় বালিয়ান। মাল-পত্ৰ বোঝাই করে দুটি ঘোড়ায়। অবশিষ্ট ঘোড়াগুলো সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়ে যায় একদিকে।
সুলতান আইউবীর রক্ষীদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনা গোয়েন্দা মেয়েরা মুবীকে তাদের ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনায়। রক্ষীরা তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলো, তাও জানায় সে। রবিন ও তার সঙ্গীদের ব্যাপারে বলে, পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মাঠ থেকে অস্ত্র কুড়িয়ে আনতে গিয়েছিলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, কিভাবে তারা মারা পড়লো।
মুবী বললো, আইউবীর ক্যাম্পে অকস্মাৎ আমার ও রবিনের সাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছিলো। সে বলেছিলো, আমি দেখতে পাচ্ছি, যীশুখৃষ্ট আমাদের সফলতা মঞ্জুর করেছেন। অন্যথায় এভাবে তোমার-আমার অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ ঘটতো না। আজ আমার-তোমাদের সাক্ষাৎ তেমনি অনাকাঙিক্ষতভাবেই ঘটে গেলো ঠিক; কিন্তু যীশুখৃষ্ট আমাদের কামিয়াবী মঞ্জুর করেছেন, সে কথা আমি বলবো না। আমার কাছে বরং যীশুকে আমাদের প্রতি রুষ্ট বলেই মনে হয়। যে কাজে আমরা হাত দিয়েছিলাম, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেলো, রোম উপসাগরে আমাদের বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। মিসরে আমাদের সহযোগী শক্তি সুদানীদের নির্মম পরাজয় হলো। এদিকে রবিন ও ক্রিস্টোফরের ন্যায় নির্ভরযোগ্য সাহসী ব্যক্তিদ্বয় এবং এতগুলো সঙ্গী মারা পড়লো! জানি না, আমাদের কপালে কী আছে।
বালিয়ান বললো, চিন্তা করো না, আমাদের জীবন থাকতে তোমাদের প্রতি কেউ হাত বাড়াতে পারবে না। আমার সঙ্গীদের কৃতিত্ব দেখলে-ই তো।
***
কয়েদীদের এ কাফেলা টিলায় যখন লাশের পার্শ্বে দণ্ডায়মান, ঠিক তখন সমুদ্রোপকূলে সুলতান আইউবীর ক্যাম্পে প্রবেশ করে তিনজন আগন্তুক। তাদের পরনে ইতালীয় বেদুঈনদের সাদাসিধে পোশাক। কথা বলতে শুরু করে ইতালী ভাষায়। কিন্তু তাদের ভাষা বুঝছে না ক্যাম্পের কেউ।
আগন্তুকদের পাঠিয়ে দেয়া হয় বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের নিকট। সুলতান আইউবীর অবর্তমানে তিনি এখন ক্যাম্পের কমাণ্ডার। আগন্তুকদের পরিচয় জানতে চান শাদ্দাদ। তারা ইতালী ভাষায় জবাব দেয়। তিনিও তাদের ভাষা বুঝছেন না।
বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ ইতালীয় এক যুদ্ধবন্দীকে ডেকে আনেন কয়েদখানা থেকে। মিসরী ভাষাও তার জানা। তিনি তার মাধ্যমে আগন্তুকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনজনের একজন মধ্য বয়সী। দুজন যুবক। তারা হুবহু একই কথা শোনায়। বলে, খৃষ্টানরা আমাদের তিনজনের তিনটি সুন্দরী বোনকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিলো। শুনেছি, ওরা নাকি খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আপনাদের ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে। আমরা বোনদের খুঁজে বের করতে এসেছি।
বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ জানান, এখানে সাতটি মেয়ে এসেছিলো। তারাও আমাদেরকে একই কাহিনী শুনিয়েছিলো। ছয়জন আমাদের হাতে বন্দী আছে; সপ্তমজন পালিয়ে গেছে। আমাদের জানা মতে ওরা গুপ্তচর। আগন্তুকরা জানায়, গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা নির্যাতিত গরীব মানুষ। একজন থেকে একটি নৌকা চেয়ে নিয়ে বোনদের সন্ধানে এতদূর এসেছি। আমাদের মত গরীবদের বোনেরা গুপ্তচর বৃত্তির সাহস করবে কিভাবে। আপনি যে সাত মেয়ের কথা বললেন, ওরা তাহলে আমাদের বোন হবে না। জানিনা ওরা কারা।
আমাদের নিকট আর কোন মেয়ে নেই। এই সাতজন-ই ছিলো, তাদেরও একজন লাপাত্তা হয়ে গেছে। অবশিষ্ট ছয়জনকে গত পরশু কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ওদের মধ্যে তোমাদের বোনরা আছে কিনা, দেখতে চাইলে কায়রো চলে যাও। আমাদের সুলতান হৃদয়বান মানুষ, বললে তিনি মেয়েদেরকে দেখাতে পারেন। বললেন বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।
না, আমাদের বোনরা গুপ্তচর নয়। ঐ সাতজন অন্য মেয়ে হবে। তারা হয়তো সমুদ্রে ডুবে মরেছে কিংবা খৃষ্টান সৈনিকরা তাদের কাছে আটকে রেখেছে। বললো আগন্তুকদের একজন।
বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ একজন সরল-সহজ দয়ালু মানুষ। তিনি আগন্তুক বেদুঈনদের সাজানো কাহিনীতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাদের বেশ খাতিরদারী করেন এবং স্বসম্মানে বিদায় করে দেন। আলী বিন সুফিয়ান হলে তাদেরকে এত সহজে ছেড়ে দিতেন না। চেহারা দেখেই তিনি বুঝে ফেলতেন, লোকগুলো গুপ্তচর, যা বলছে সব মিথ্যে।
বিদায় নিয়ে চলে যায় তিনজন। কোথায় গেলো তা দেখারও চেষ্টা করলো কেউ। ক্যাম্প থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটা দেয় একদিকে। একটানা চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারা ক্যাম্প থেকে বেশ দূরে নিরাপদ এক পাহাড়ী অঞ্চলে ঢুকে পড়ে।
সেখানে বসে তাদের অপেক্ষা করছিলো তাদের-ই আঠারজন লোক। এ তিনজনের মধ্য বয়সী লোকটির নাম মিগনানা মারিউস। গ্রেফতার হওয়া মেয়েদের মুক্ত করা এবং সম্ভব হলে সুলতান আইউবীকে হত্যা করার জন্য যে কমাখো পাঠানো হয়েছে, মিগনানা মারিউস সে বাহিনীর কমাণ্ডার।
এরা তিনজন সুলতান আইউবীর ক্যাম্প সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যও সংগ্রহ করে নিয়েছিলো। তারা জেনে যায়, সুলতান আইউবী এখন এখানে নেই, আছেন কায়রোতে। শাদ্দাদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারে, গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার করা মেয়েগুলোকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পাঁচজন পুরুষ বন্দীও আছে তাদের সঙ্গে।
বড় একটি নৌকায় করে এসেছে এ ঘাতক দলটি। সমুদ্রের পাড়ে এক স্থানে সরু একটি খাল। সেই খালে ঢুকিয়ে বেঁধে রেখে এসেছে তারা নৌকাটি। এখন তাদের কায়রো অভিমুখে রওনা হতে হবে। কিন্তু বাহন নেই।
যে তিনজন লোক ক্যাম্পে গিয়েছিলো, তারা ক্যাম্পের আস্তাবল ও উট বাঁধার স্থানটা দেখে এসেছে। তারা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে, ক্যাম্প থেকে পশু চুরি করে আনা সহজ নয়। প্রয়োজন তাদের একুশটি ঘোড়া বা উট। ক্যাম্প থেকে এতগুলো পশু চুরি করে আনা অসম্ভব।
ভোরের আকাশে নতুন দিনের সূর্য উদিত হতে এখনো বেশ বাকি। পায়ে হেঁটেই রওনা হয় কাফেলা। বাহন পেয়ে গেলে তারা মেয়েদেরকে পথে-ই গিয়ে ধরার চেষ্টা করতো। কিন্তু কায়রো না গিয়ে উপায় নেই তাদের। তারা জানে, তাদের এ মিশনের সফলতা জীবন নিয়ে খেলা করার শামিল। কিন্তু সফল হতে পারলে খৃষ্টান সেনানায়ক ও সম্রাটগণ যে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার পরিমাণও এত বেশী যে, অবশিষ্ট জীবন তাদের আর কাজ করে খেতে হবে না। গোষ্ঠীসুদ্ধ বেশ আরামে বসে বসে তারা খেয়ে যেতে পারবে। এ লোভ সামলানোও তো কষ্টকর। তাই তাদের এত ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে অবতরণ।
মিগনানা মারিউসকে বের করে আনা হয়েছিলো কারাগার থেকে। দস্যুবৃত্তির অপরাধে ত্রিশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিলো তাকে। তার সঙ্গে ছিলো আরো দুজন কয়েদী, যাদের একজনের সাজা ছিলো চব্বিশ বছর, একজনের সাতাশ বছর। সে যুগের কারাগার মানে কসাইখানা। আসামী-কয়েদীদেরকে মানুষ মনে করা হতো না। কয়েদীদের রাতের বেলাও এতটুকু আরাম করার সুযোগ ছিলো না। তাদের নির্মমভাবে খাটান হতো। পশুর মতো অখাদ্য খাবার দেয়া হতো। তেমন কারাভোগ অপেক্ষা মৃত্যু-ই ছিলো শ্রেয়।
এ তিন কয়েদীকে মহামূল্যবান পুরস্কার ছাড়া সাজা-মওকুফের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে খৃষ্টানরা। তাদের ক্রুশ হাতে শপথ করিয়ে এ মিশনে নামান হয়েছে। যে পাদ্রী তাদের শপথ নিয়েছিলেন, তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, তারা যুত মুসলমানকে হত্যা করবে, তার দশগুণ পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে পারলে মাফ হয়ে যাবে জীবনের সমস্ত গুনাহ আর পরজগতে যীশুখৃষ্ট তাদের দান করবেন চিরশান্তির আবাস জান্নাত।
প্রতিজ্ঞা তাদের দৃঢ় মনোবলও বেশ অটুট। ভাব তাদের, কাজের কাজ করে-ই তবে মিসর ত্যাগ করবে কিংবা ক্রুশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেবে।
অবশিষ্ট আঠার ব্যক্তিও খৃষ্টান বাহিনীর বাছাবাছা সৈনিক। তারা জ্বলন্ত জাহাজ থেকে জীবন রক্ষা করে এসেছে। তারা নোম উপসাগরে এই অপমানজনক পরাজয় বরুণের প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরস্কারের লোভ তো আছে-ই। প্রতিশোধ স্পৃহা আর পুরস্কারের লোভে-ই অদেখা এক গন্তব্যপানে তাদের এই পদব্রজে রওনা হওয়া।
***
বেলা দ্বি-প্রহর। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় এক ঘোড়সওয়ার। পা বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে ঘোড়ার গায়ের ঘাম। ভীষণ ক্লান্ত। কথা ফুটছে না আরোহীর মুখ থেকে। লোকটি ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করলে প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ঘোড়াটি। কোন দানা-পানি-বিশ্রাম ছাড়াই গোটা রাত এবং আধা দিন একটানা ঘোড়া দুটায় আরোহী। আরোহীকে ধরে নিয়ে একস্থানে বসায় সুলতান আইউবীর রক্ষীরা। সামান্য পানি পান করতে দেয় তাকে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর এবার বাক্শক্তি ফিরে পায় আরোহী। ভগ্নস্বরে বলে, একজন কমাণ্ডার বা সালারের সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। সংবাদ পেয়ে বেরিয়ে আসেন সুলতান আইউবী নিজেই। সুলতানকে দেখে উঠে দাঁড়ায় আরোহী। সালাম করে বলে–দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি আমি মহামান্য সুলতান! সুলতান তাকে কক্ষের ভিতরে নিয়ে যান এবং বলেন–জদি বলো, কী সংবাদ তোমার।
বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমাদের প্লাটুনের সব কজন রক্ষী মারা গেছে। পুরুষ কয়েদীদের আমরা হত্যা করেছি। বেঁচে এসেছি আমি একা। আক্রমণকারীরা কারা ছিলো, আমি তা জানি না। আমরা ছিলাম মশালের আলোতে আর তারা ছিলো অন্ধকারে। অন্ধকারের দিক থেকে তীর ছুটে আসে এবং সেই তীরের আঘাতে মারা যায় আমার সব কজন সঙ্গী। বলল আরোহী।
এ লোকটি কয়েদীদের রক্ষী প্লাটুনের সেই ব্যক্তি, যে আক্রমণের পর অন্ধকারে উধাও হয়ে গিয়েছিলো এবং সুদানীদের ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছিলো। কাফেলা ত্যাগ করে ঘোড়র পিঠে বসে লোকটি দ্রুত ছুটে চলে এবং পথে কোথাও মুহূর্তের জন্য না থেমে এত দীর্ঘ পথ অর্ধেকেরও কম সময়ে অতিক্রম করে চলে আসে।
আলী বিন সুফিয়ান এবং ফৌজের একজন সালারকে ডেকে পাঠান সুলতান আইউবী। তারা এসে পৌঁছুলে সুলতান আরোহীকে বললেন, এবার ঘটনাটা বিস্তারিত বলল। লোকটি ক্যাম্প থেকে রওনা হওয়ার সময় থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনায়। কমাণ্ডার সম্পর্কে বলে, কিছু পথ অতিক্রম করার পর থেকে তিনি একটি কয়েদী মেয়ে নিয়ে মনোরঞ্জনে মেতে ওঠেন এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সোজা পথ ত্যাগ করে তিনি এমন পথ ধরে চলতে শুরু করেন, যে পথে কায়রো পৌঁছুতে আমাদের অনেক বেশী সময় ব্যয় হতো। আপত্তি জানালে তিনি ক্ষেপে ওঠেন এবং এ ব্যাপারে কাউকে নাক গলাতে বারণ করে দেন। এভাবে একের পর এক পুরো ঘটনা আনুপুংখ বিবৃত করে আরোহী। কিন্তু একথা জানাতে সে ব্যর্থ হলো যে, হামলাটা–কারা করলো।
আলী বিন সুফিয়ান ও নায়েবে সালারকে উদ্দেশ করে সুলতান বললেন তার মানে মিসরে এখনো খৃষ্টান কমাপ্তে রয়ে গেছে।
হতে পারে, তারা মরুদ্য। এমন রূপসী ছয়টি মেয়ে দস্যুদের জন্য বেশ লোভনীয় শিকার। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
তুমি লোকটির কথা খেয়াল করে শোননি। ও বললো, পুরুষ কয়েদীরা ময়দান থেকে অস্ত্র কুড়িয়ে এনে রক্ষীদের হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো। টের পেয়ে দুজন রক্ষী তীরের আঘাতে তাদেরকে হত্যা করে ফেলে। হামলাটা হয় তার পরে। এতেই বুঝা যায়, খৃষ্টান গেরিলারা পূর্ব থেকেই কাফেলাকে অনুসরণ করছিলো।
মুহতারাম সুলতান! হামলাকারীরা যারা-ই হোক, এক্ষুনি আমাদের যে কাজটি করা দরকার, তাহলে পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য এ সৈনিককে সঙ্গে দিয়ে অন্তত বিশজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার তাদেরকে ধাওয়া করার জন্য প্রেরণ করা। তারা কারা, সে প্রশ্নের জবাব পরে খুঁজে বের করা যাবে। বললেন নায়েবে সালার।
আমি আমারএক নায়েবকেও সঙ্গে দেবো। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
এ সৈনিককে আহার করাও। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে দাও। এ সুযোগে বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলল। প্রয়োজন মনে করলে আরো বেশী সৈনিক দাও। বললেন সুলতান আইউবী।
যেখান থেকে আমি ঘোড়া নিয়ে এসেছি, সেখানে আরো আটটি ঘোড়া বাঁধা ছিলো। সেখানে কোন মানুষ দেখিনি। এ ঘোড়াগুলোর আরোহীরা-ই আক্রমণকারী হবে বোধ হয়। ঘোড়া যদি আটটি-ই হয়ে থাকে, তাহলে তারাও হবে আটজন। বললো আরোহী।
গেরিলাদের সংখ্যা বেশী হবে না। আমরা তাদের ধরে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। বললেন নায়েবে সালার।
মনে রাখবে, ওরা গেরিলা, আর মেয়েগুলো গুপ্তচর। তোমরা যদি একটি গুপ্তচর কিংবা একজন গেরিলাকে ধরতে পারো, তাহলে বুঝবে, তোমরা শক্রর দুশ সৈনিককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। একজন গুপ্তচর খতম করার জন্য আমি দুশ শত্রুসেনাকে ছেড়ে দিতে পারি। একজন সাধারণ নারী কারুর তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু একটি গুপ্তচর কিংবা সন্ত্রাসী মেয়ে একাই একটি দেশের সমগ্র সেনাবহর সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে সক্ষম। এই মেয়েগুলো বড় ভয়ঙ্কর। এরা যদি মিসরের অভ্যন্তরেই থেকে যায়, তাহলে তোমরা পুরো বাহিনী-ই ব্যর্থ হয়ে পড়বে। একটি পুরুষ কিংবা মেয়ে গুপ্তচরকে গ্রেফতার কিংবা খুন করার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের একশত সৈনিককে উৎসর্গ করে দাও। তারপরও আমি বলবো, এ সওদা অনেক সস্তা। গেরিলাদের ধরতে না পারলেও তেমন চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু যে কোন মূল্যে মেয়েগুলোকে ধরতে-ই হবে। যদি প্রয়োজন হয়, তীর ছুঁড়ে ওদের হত্যা করে ফেলো; তবু জীবিত পালাতে যেন না । পারে। বললেন সুলতান আইউবী।
এক ঘন্টার মধ্যে বিশজন দ্রুতগামী আরোহী প্রস্তুত করে রওনা করা হয়। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে এই রক্ষী। আলী বিন সুফিয়ানের এক নায়েব যাহেদীন হলেন বাহিনীর কমাণ্ডার।
আলী বিন সুফিয়ান ফখরুল মিসরীকে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করেন এ বাহিনীতে। ফখরুল মিসরীর একান্ত কামনা ছিলো, যেন তাকে বালিয়ান ও মুবীকে গ্রেফতার করার জন্য প্রেরণ করা হয়। এখন এ বাহিনী যাদেরকে ধাওয়া করতে যাচ্ছে, তারা-ই যে বালিয়ান আর মুবী, সে তথ্য না জানে ফখরুল মিসরী, না জানেন আলী বিন সুফিয়ান।
এদিক থেকে রওনা হলো বিশজন আরোহী। একুশতম ব্যক্তি তাদের কমাণ্ডার। টার্গেট তাদের কয়েকটি মেয়ে এবং যারা তাদেরকে ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। আবার অপর দিক থেকেও এগিয়ে আসছে খৃষ্টানদের বিশজন কমাণ্ডো, একুশতম ব্যক্তি তাদের কমাণ্ডার। তাদেরও লক্ষ্য সেই মেয়েরা। কিন্তু তাদের দুর্বলতা হলো, তাদের বাহন নেই। পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে তারা। মজার ব্যাপার হলো, দু পক্ষের কারুর-ই জানা নেই, যাদের উদ্দেশ্যে এ অভিযান, তারা কোথায়।
***
খৃষ্টানদের কমাণ্ডো দলটি পরদিন সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত অনেক পথ অতিক্রম করে ফেলে। এখন তারা যে স্থানে অবস্থান করছে, সেখানকার কোথাও চড়াই কোথাও উত্রাই। উঁচু-নীচু এলাকা। চড়াই বেয়ে উপরে আরোহণের পর তারা দূরবর্তী একটি ময়দানে কতগুলো উট দেখতে পায়। অসংখ্য খেজুর গাছসহ অন্যান্য গাছও আছে সেখানে। তারা দেখতে পায়, উটগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। বার-চৌদ্দটি ঘোড়াও আছে সেখানে। সেগুলোর আরোহীদেরকে সৈনিক বলে মনে হলো। আর যারা আছে, সবাই উষ্ট্ৰচালক। দেখে থেমে যায় এই একুশ কমাণ্ডোর কাফেলা। তারা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এ মুহূর্তে যা একান্ত প্রয়োজন, তা-ই পেয়ে গেছি এমন একটা ভাব ফুটে উঠেছে সকলের চোখে-মুখে। কাফেলাকে থামিয়ে কমাণ্ডার বললো–সত্যমনে ক্রুশের উপর হাত রেখে আমরা শপথ করে এসেছিলাম। ঐ দেখ, ক্রুশের কারিশমা। জাজ্বলমান অলৌকিক ব্যাপার। আকাশ থেকে খোদা তোমাদের জন্য সওয়ারী পাঠিয়েছেন। তোমাদের কারো মনে কোন পাপবোধ, কর্তব্যে অবহেলা কিংবা জান বাঁচিয়ে পালাবার ইচ্ছা থাকলে এ মুহূর্তে তা ঝেড়ে ফেলে দাও। খোদার পুত্র–যিনি মজলুমের বন্ধু, জালিমের দুশমন–আকাশ থেকে তোমাদের সাহায্যে নেমে এসেছেন।
ক্লান্তির ছাপ উবে যায় সকলের চেহারা থেকে। মুহূর্ত মধ্যে ঝরঝরে হয়ে উঠে অবসন্ন দেহগুলো। আনন্দের দ্যুতি খেলে উঠে সকলের চোখে-মুখে। কিন্তু সশস্ত্র সৈনিকদের মোকাবেলা করে এতগুলো উট-ঘোড়ার মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় বাহন ছিনিয়ে আনার প্রক্রিয়া কী হবে, তারা এখনো ভেবে দেখেনি।
প্রায় একশত উটের বিশাল এক বহর। যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ নিয়ে যাচ্ছে বহরটি। দেশের অভ্যন্তরে বর্তমানে শত্রুর আশঙ্কা নেই ভেবে কাফেলার নিরাপত্তার তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সঙ্গে দেয়া হয়েছে মাত্র দশজন সশস্ত্র অশ্বারোহী । উষ্ট্ৰচালকরা সকলে নিরস্ত্র । রাত যাপনের জন্য এখানে অবতরণ করে ছাউনি ফেলেছে তারা।
খৃষ্টান বাহিনীর কমাণ্ডার তার কমাণ্ডোদেরকে একটি নিম্ন এলাকায় বসিয়ে রাখে। কমাণ্ডার কাফেলায় কটি উট, কটি ঘোড়া, কজন সশস্ত্র মানুষ এবং আক্রমণ করলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে, তার তথ্য নেয়ার জন্য দু ব্যক্তিকে প্রেরণ করে। তারপর তারা রাতে আক্রমণ পরিচালনার স্কীম প্রস্তুত করতে বসে যায়। তাদের না আছে অস্ত্রের অভাব, না আছে আগ্রহ-শৃহার কমতি। যে কেউ নিজের জীবন নিয়ে খেলতে প্রস্তুত।
তথ্য সংগ্রহ করতে যাওয়া লোক দুটো ফিরে আসে মধ্য রাতের অনেক আগেই। এসে তারা জানায়, কাফেলায় সশস্ত্র আরোহী আছে দশজন। তারা এক স্থানে একত্রে ঘুমিয়ে আছে। ঘোড়াগুলো বাধা আছে অন্যত্র। উষ্ট্ৰচালকরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে শুয়ে আছে নানা জায়গায়। মাল-পত্র বেশীর ভাগ বস্তায় ভরা। উষ্ট্ৰচালকদের নিকট কোন অস্ত্র নেই। আক্রমণ করে সফল হওয়া তেমন কঠিন হবে না।
কাফেলার লোকেরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে খৃষ্টান কমাণ্ডো। চলে আসে একেবারে নিকটে। আগে আক্রমণ হয় ঘুমন্ত সৈনিকদের উপর। টের পেয়ে চোখ খুলতে না খুলতে পলকের মধ্যে অনেকগুলো তরবারী ও খঞ্জরের উপর্যুপরী আঘাতে লাশ হয়ে যায় সব কজন।
খৃষ্টান গেরিলারা তাদের এ অভিযান এত নীরবে সম্পন্ন করে ফেলে যে, অন্যত্র ঘুমিয়ে থাকা উষ্ট্ৰচালকরা টেরই পেলো না। চোখও খুললো না একজনেরও। যাদের চোখ খুললল, কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারলো না তারা। যার মুখে শব্দ বের হলো, তার সে শব্দ-ই জীবনের শেষ উচ্চারণ বলে প্রমাণিত হলো।
এবার, উষ্ট্ৰচালকদের সন্ত্রস্ত করার জন্য চীঙ্কার জুড়ে দেয় কমান্ডোরা। তারা জেগে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধড়মড় করে উঠে বসে বিহ্বল নেত্রে এদিক-ওদিকে তাকাতে শুরু করে। চেঁচামেচি করে ওঠে উটগুলো। এবার উষ্ট্ৰচালকদের কচুকাটা করতে শুরু করে খৃষ্টান কমান্তোরা। পালিয়ে যায় অল্প কজন। বাকীরা নির্মম গণহত্যার শিকার হয় খৃষ্টান কমাণ্ডোদের হাতে। খৃষ্টান কমাণ্ডার চীৎকার করে বলে–এগুলো মুসলমানদের রসদ, ধ্বংস করে দাও সব। উটগুলোকেও মেরে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তরবারীর আঘাত শুরু হয়ে যায় উটগুলোর পিঠে। পশুগুলোর করুণ চীৎকারে ভারী হয়ে উঠে নিঝুম রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঘোড়াগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ায় কমাণ্ডার। গুণে দেখে বারটি। দশটি আরোহণের যোগ্য হলেও অবশিষ্ট দুটি কাজের নয়। নয়টি উট আগেই সরিয়ে রেখেছিলো সে।
রাত শেষে ভোর হলো। পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হলো। এক বীভৎস ভয়ানক রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলো ছাউনি। অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে আছে এদিক-সেদিক। মারা গেছে অনেক উট। কোনটি এখনো ছটফট করছে। এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে কিছু। সবদিকে রক্ত আর রক্ত, যেন রাতে রক্তের বৃষ্টি হয়েছিলো এ স্থানটিতে। খুলে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে রসদের বস্তাগুলো। তছনছ হয়ে গেছে সব খাদ্যদ্রব্য। রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে সব। একজন জীবিত মানুষও নেই এখানে। বারটি ঘোড়াও উধাও। যে উদ্দেশ্যে খৃষ্টানদের এ অভিযান, এক প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে সে উদ্দেশ্য সাধন করে কেটে পড়েছে তারা। এবার তীব্রগতিতে শিকারের সন্ধানে এগিয়ে যেতে পারবে খৃষ্টান কমান্তোরা।
***
মুবীর রূপ-যৌবন আর মদ-মাদকতায় বালিয়ানের মন-মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে আছে। মুবী আর মদ, মদ আর মুবী এ-ই তার একমাত্র ভাবনা। তদুপরি এখন তার হাতে এসেছে আরো সাতটি পরমাসুন্দরী যুবতী। মুবীর চেয়ে এরাও কোন অংশে কম নয়। বিপদাপদের কথা ভুলেই গেছে সে। মুবী তাকে বারবার বলছে, এতো বেশী থেমে থাকা ঠিক হচ্ছে না। যতো দ্রুত সম্ভব আমাদের সমুদ্রের নিকট পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন। শত্রুরা আমাদের ধাওয়া। করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
কিন্তু বালিয়ান রাজার ন্যায় অট্টহাসির তোড়ে ভাসিয়ে দেয় মুবীর সতর্কবাণী। মুবী যে রাতে বালিয়ানকে দিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করিয়েছিলো, তার পরের রাতে এক স্থানে ছাউনি ফেলেছিলো বালিয়ান। সে রাতে সে মুবীকে বলেছিলো, আমরা সাতজন পুরুষ আর তোমরা সাতটি মেয়ে। আমার এ ছয়টি বন্ধু বড় বিশ্বস্ততার সাথে আমার সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। তাদের উপস্থিতিতে তাদের চোখের সামনে আমি তোমার সঙ্গে রং-তামাশা করছি। তারপরও তারা কিছু বলছে না। এবার আমি তাদেরকে পুরস্কৃত করতে চাই । অপর ছয়টি মেয়ের এক একজনকে আমার এক এক বন্ধুর হাতে তুলে দাও আর তাদের বলো, এ তোমাদের ত্যাগের উপহার।
এ হতে পারে না। আমরা বেশ্যা মেয়ে নই। আমি বাধ্য ছিলাম বলেই তোমার খেলনা হয়ে আছি। কিন্তু এ মেয়েগুলো তোমার কেনা দাসী নয় যে, ইচ্ছে হলো আর তাদেরকে বন্ধুদের মাঝে বণ্টন করে দেবে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো মুবী।
আমি তোমাদেরকে কখনো সম্ভ্রান্ত মনে করি না। তোমরা প্রত্যেকে আমাদের জন্য নিজ দেহের উপহার নিয়েই এসেছে। এই মেয়েরা না জানি কত পুরুষকে সঙ্গ দিয়ে এসেছে। তাদের একজনও মরিয়ম নয়। আবেশমাখা রাজকীয় ভঙ্গিতে বললো বালিয়ান।
আমরা কর্তব্য পালনের স্বার্থেই আমাদের দেহকে পুরুষের সামনে উপহার হিসেবে পেশ করে থাকি। আমোদ করার জন্য পুরুষের নিকট যাই না। আমাদের দেশ ও ধর্ম আমাদের উপর একটি দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে কর্তব্য পালনের নিমিত্ত আমরা আপন দেহ, রূপ ও সম্ভ্রমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। এ যাত্রা আমাদের অর্পিত কর্তব্য পূরণ হয়ে গেছে। এখন তুমি যা করছে ও বলছে, সব-ই নিছক বিলাসিতা, ধর্মহীন কাজ, যা আমাদের কাম্য নয়, কর্তব্যও নয়। আমরা বিশ্বাস করি, যেদিন আমরা বিলাসিতায় মেতে উঠবো, সেদিন থেকেই ক্রুশের পতন শুরু হবে। প্রশিক্ষণে আমাদের বলা হয়েছে, একজন মুসলিম কর্ণধারকে ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজনে দশজন মুসলমানের সঙ্গে রাত-যাপন করাও বৈধ এবং পুণ্যের কাজ। মুসলমানদের একজন ধর্মগুরুকে নিজের দেহের পরশে অপবিত্র করাকে আমরা মহা পুণ্যকর্ম মনে করি। বললো মুবী।
তার মানে তুমি আমাকে ক্রুশের অস্তিত্বের স্বার্থে ব্যবহার করছো! তুমি কি আমাকে ক্রুশের মুহাফিজ বানাবার চেষ্টা করছো? বললো বালিয়ান। ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করে বালিয়ানের অনুভূতি।
কেন, এখনো কি তোমার সন্দেহ আছে? একজন ক্রুসেডারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে কী উদ্দেশ্যে? বললো মুবী।
সালাহুদ্দীন আইউবীর শাসন থেকে মুক্তি অর্জন করার জন্য–ক্রুশের হেফাজতের জন্য নয়। আমি মুসলমান; কিন্তু তার আগে আমি সুদানী। বললো বালিয়ান।
আমি সর্বাগ্রে ক্রুশের অনুসারী–খৃষ্টান। তারপর আমি আমার দেশের একটি সন্তান। এই বলে মুবী বালিয়ানের ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে আবার বলে, ইসলাম কোন ধর্ম-ই নয়। সে কারণে তুমি দেশকে ধর্মের উপর প্রাধান্য দিচ্ছো। এটা তোমার নয়–তোমার ধর্মের দুর্বলতা। আমার সঙ্গে তুমি সমুদ্রের ওপারে চলো; আমার ধর্ম কী জিনিস, তোমাকে দেখাবো। তখন নিজ ধর্মের কথা তুমি ভুলে-ই যাবে।
যে ধর্ম তাঁর অনুসারী মেয়েদের পর-পুরুষের সঙ্গে রাতযাপন, নিজে মদপান করা এবং অন্যকে মদপান করানোকে পুণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি, হাজারবার অভিসম্পাত করি আমি সেই ধর্মকে। অকস্মাৎ জেগে উঠে বালিয়ান। তারপর বলে আমার কাছে তুমি তোমার সম্ভ্রম বিলীন করোনি, বরং তুমি-ই আমার ইজ্জত লুট করে নিয়ে গেছে। আমি তোমাকে নই, বরং তুমি-ই আমাকে খেলনা বানিয়ে রেখেছে।
একজন মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সম্ভ্রম তেমন বেশী মূল্য নয়। আমি তোমার সম্ভ্রম লুটিনি, লুট করেছি তোমার ঈমান। তবে এখন আমি তোমাকে ভবঘুরে অবস্থায় পথে ফেলে যাবো না। আমি তোমাকে নতুন এক আলোর জগতে নিয়ে যাচ্ছি, তোমাকে হীরা-মাণিক্যের ন্যায় চকমকে উজ্জ্বল এক জীবন দান করবো আমি। বললো মুবী।
আমি তোমার সেই আলোর জগতে যেতে চাই না। বললো বালিয়ান। “দেখ বালিয়ান! একজন লড়াকু পুরুষ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ না করে পারে । তুমি আমার সওদা বরণ করে নিয়েছে। তোমার ঈমানটা ক্রয় করে সেটি আমি মদের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছি; তোমার চাহিদা অনুপাতে আমি তোমাকে মূল্য দিয়েছি। এতটা দিন তোমার দাসী, তোমার স্ত্রী হয়ে রইলাম। তুমি এ সওদা থেকে ফিরে যেও না; একটি অবলা নারীকে ধোকা দিওনা। বললো মুবী।
সমুদ্রের ওপারে নিয়ে তুমি আমাকে যে আলো দেখাবার কথা বলছো, সে আলো আমাকে এখানেই তুমি দেখিয়ে দিয়েছে। আমার ভবিষ্যত, আমার শেষ পরিণতি এখন-ই তোমার হীরে-মাণিক্যের মতো চমকাতে শুরু করেছে। বললো বালিয়ান।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো মুবী। কিন্তু বালিয়ান গর্জে উঠে বললো, খামুশ মেয়ে! একটি কথাও আর তোমার শুনতে চাই না আমি। আমি মিসরের গভর্নর সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন হতে পারি; কিন্তু আমি সেই মহান রাসূলের শত্রু নই, যার আদর্শ রক্ষার জন্য সালাহুদ্দীন আইউবী তোমাদের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন। সেই রাসূলের নামে আমি মিসর-সুদানকে উৎসর্গ করতে পারি। আমি সেই মহান ও পবিত্র আদর্শের বদৌলতে সালাহুদ্দীন আইউবীর সামনে অস্ত্রসমর্পণও করতে পারি।
তোমাকে আমি কতোবার বলেছি, মদ কম পান করো। একদিকে অপরিমিত মদ, অপরদিকে সারাটা রাত জেগে আমার দেহটা নিয়ে খেলা করা; তোমার মাথাটা-ই খারাপ হয়ে গেছে দেখছি। তুমি একথাটাও ভুলে গেছো যে, আমি তোমার স্ত্রী। বললো মুবী।
আমি কোন বেশ্যা খৃষ্টানের স্বামী হতে চাই না। বললো বালিয়ান। বালিয়ানের নজর পড়ে মদের বোতলের উপর। অনি বোতলটি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারে দূরে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। বন্ধুদের ডাক দেয়। ডাক শুনে দৌড়ে আসে সকলে। সে বলে, এই মেয়েগুলো, বিশেষ করে এ মেয়েটি এখন থেকে । তোমাদের কয়েদী। এদের নিয়ে কায়রো ফিরে চলো। প্রস্তুত হও, জদি করো।
কায়রো! আপনি কায়রো যেতে চাচ্ছেন?
হ্যাঁ, আমি কায়রো-ই যেতে চাচ্ছি। অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই বালুকাময় মরু প্রান্তরে ভবঘুরের ন্যায় আর কতকাল ঘুরে বেড়াবোর যাবো কোথায়? চলো, ঘোড়ায় যিন বাধো। এক একটি মেয়েকে এক একটি ঘোড়ায় বসিয়ে বেঁধে নিয়ে চলো।
***
মরুভূমিতে ঘোড়া চলবার সময় তেমন শব্দ হয় না। উট চলে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। চোখে না দেখলে মরুভূমিতে উটের আগমন টের পাওয়া যায় না। বালিয়ান যখন মুবীর সঙ্গে কথা বলছিলো, তখন একটি উট ছোট্ট একটি বালির ঢিবির আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের গতিবিধি অবলোকন করছিলো। কিন্তু তা টের-ই পাইনি বালিয়ান। লোকটি খৃষ্টান কমাণ্ডো দলের একজন সদস্য। দলের কমাণ্ডার অত্যন্ত বিচক্ষণ লোক। বালিয়ানের তাঁবুর প্রায় আধা মাইল দূরে ছাউনি ফেলেছে সে। শিকার যে এতো কাছে, মাত্র আধা মাইল দূরে, তা বুঝতেই পারেনি কমাণ্ডার। বুদ্ধি করে সে আশপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিন কমাণ্ডোকে দায়িত্ব দেয়, উটে চড়ে তারা আশপাশে ঘুরে-ফিরে দেখে আসবে এবং আশঙ্কার কিছু চোখে পড়লে কমাণ্ডারকে অবহিত করবে। উট ছিলো এ। কাজের উপযুক্ত বাহন।
তিন আরোহী চলে যায় তিন দিকে। এখানকার সমগ্র এলাকাটিই এমন যে, গোটা এলাকা যে কোন কাফেলার অবস্থানের জন্য বেশ উপযোগী। তাই এখানে এসে-ই কমাণ্ডার ভাবলো, অন্য কোন কাফেলা এখানে ছাউনি ফেলে থাকতে পারে।
এক স্থানে আলোর মত কিছু একটা চোখে পড়ে এক আরোহীর। সেদিকে এগিয়ে চলে সে। বস্তুটি একটি মশাল; জ্বলছে বালিয়ানের অস্থায়ী তাঁবুতে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটি টিলার পিছনে দাঁড়িয়ে যায়। টিলাটি উচ্চতায় এতটুকু যে, উটের উপর বসে টিলার উপর দিয়ে সম্মুখে দেখা সম্ভব।
ক্ষীণ আলোতে কয়েকটি মেয়ে চোখে পড়ে তার। সংখ্যায় ছয়জন। কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে বসে গল্প করছে তারা। তাদের থেকে খানিক দূরে বসে আছে আরো এক জোড়া নারী-পুরুষ। কথা বলছে তারাও। একপাশে বাঁধা আছে কয়েকটি ঘোড়া।
খৃষ্টান আরোহী উটের মোড় ঘুরিয়ে দেয় পিছন দিকে। ধীর-সন্তর্পণে চলে কিছু পথ। তারপর এগিয়ে চলে দ্রুত। আধা মাইল পথ উটের জন্য কিছুই নয়। অল্পক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যায় ছাউনিতে, কমাণ্ডারের কাছে। সুসংবাদ জানায়, শিকার আমাদের হাতের মুঠোয়। সময় নষ্ট না করে অপারেশনের প্রস্তুতি নেয় কমাণ্ডার। ঘোড়র পায়ের আওয়াজে শিকার সতর্ক হয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কায় পায়ে হেঁটেই রওনা হয় তারা।
খৃষ্টান কমান্ডো দলটি যখন বালিয়ানের তাঁবুর নিকটে পৌঁছে, ততক্ষণে বালিয়ান নির্দেশ জারি করে ফেলেছে, এক একটি মেয়েকে এক একটি ঘোড়ায় বেঁধে ফেলো। বন্ধুরা বিস্মিত অভিভূতের ন্যায় তাকিয়ে আছে বালিয়ানের প্রতি। তাদের ধারণা, নোকটার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে হঠাৎ করে এমন খাপছাড়া কথা বলবে কেন! এ নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয় বন্ধুরা। অনেক সময় নষ্ট হওয়ার পর বালিয়ান তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়, সে যা বলছে, হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখে বুঝে-শুনেই বলছে এবং এ পরিস্থিতিতে কায়রো ফিরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করাই কল্যাণকর।
পান্ডুর মুখে অপলক নেত্রে ফ্যাল ফ্যাল করে বালিয়ানের প্রতি তাকিয়ে আছে মেয়েগুলো। ঘোড়ায় যিন কষে বালিয়ানের সঙ্গীরা। ধরে ধরে মেয়েগুলোকে ঘোড়ার পিঠে বাঁধবে বলে–ঠিক এমন সময়ে তাদের উপর নেমে আসে অভাবিত এক মহাবিপদ। চারদিক ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে বসে খৃষ্টান কমান্ডোরা। বালিয়ান বারবার চীৎকার করে উচ্চ কণ্ঠে বলছে–আমরা অস্ত্র ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা কায়রো রওনা হচ্ছি। আক্রমণ থামাও, আমাদের কথা শোন।
আক্রমণকারীদেরকে বালিয়ান সুলতান আইউবীর বাহিনী মনে করেছিলো। কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তাই কোন ফল হলো না বালিয়ানের ঘোষণায়। একটি খঞ্জর এসে ঠিক হৃদপিণ্ডে বিদ্ধ হয়ে স্তব্ধ করে দেয় তাকে। এ আকস্মিক আক্রমণের মোকাবেলা করতে পারলো না বালিয়ানের বন্ধুরা। নিজেদের সামলে নেয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় একে একে সকলে।
খৃষ্টান কমাণ্ডোদের অভিযান সফল। যাদের জন্য সমুদ্রের ওপার থেকে এসে তাদের এ ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ, তারা এখন মুক্ত। বিলম্ব না করে তারা নিজেদের ছাউনিতে নিয়ে যায় মেয়েগুলোকে।
কমাণ্ডারকে চিনে ফেলে মেয়েরা। সেও তাদের-ই বিভাগের একজন গুপ্তচর। সেখানেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পাহারার জন্য দাঁড়িয়ে যায় দুজন সান্ত্রী। তারা ছাউনির চার পাশে টহল দিচ্ছে।
সুলতান আইউবীর প্রেরিত বাহিনীটি এখনো এ স্থান থেকে বেশ দূরে, বালিয়ান কয়েদী মেয়েদেরকে যেখান থেকে মুক্ত করেছিলো সেখানে। অকুস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া রক্ষী তাদের রাহ্বর। যেখানে তাদের উপর আক্রমণ হয়েছিলো, বাহিনীটিকে সে আগে সেখানে নিয়ে যায়। তারা একটি মশাল জ্বালিয়ে জায়গাটা দেখছে। রবিন ও তার সঙ্গীদের লাশগুলো পড়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে। লাশগুলো এখন আর অক্ষত নেই। শৃগাল-শকুনেরা ছিঁড়ে-ফেড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে দেহগুলো। তখনো কাড়াকাড়ি চলছিলো লাশগুলো নিয়ে। মানুষ দেখে এইমাত্র কেটে পড়েছে হিংস্র পশুগুলো।
রক্ষী যেখান থেকে ঘোড়া নিয়ে পলায়ন করেছিলো, সে কমাণ্ডারকে সেখানে নিয়ে যায়। মশালের আলোতে মাটি পর্যবেক্ষণ করেন কমাণ্ডার। ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেলো। রবিন তার দলবল নিয়ে কোনদিকে গেলো, তাও অনুমান করা গেলো। কিন্তু রাতের বেলা সে পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলা তো সম্ভব নয়, কালক্ষেপণ করাও যাচ্ছে না। তবু তারা রাতটা সেখানেই অবস্থান করলো।
খৃষ্টান বাহিনীর ক্যাম্পের সকলে জেগে আছে। তারা সফলতার আনন্দে উফুল্ল। কমাণ্ডার সিদ্ধান্ত জানালো, আমরা শেষ রাতের আলো-আঁধারিতে রোম উপসাগর অভিমুখে রওনা হবো। শুনে মিগনানা মারিউস বললো, মিশন তো এখনো সম্পন্ন হয়নি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার কাজটা এখনো বাকি আছে। কমাণ্ডার বললো, মেয়েগুলোকে উদ্ধার করার জন্য যদি আমাদের কায়রো পৌঁছুতে হতো, তখন আমাদের এ কাজটাও করা সম্ভব ছিলো। এখন একদিকে আমরা কায়রো থেকে অনেক দূরে। অপরদিকে মেয়েদেরকে পেয়ে গেছি। এদেরকে নিরাপদে ওপারে নিয়ে যাওয়া-ই এ মুহূর্তে আমাদের মূল কাজ। তাছাড়া ওটা তো ছিলো একটা অতিরিক্ত বিষয়। কাজেই সে চিন্তা বাদ দিয়ে চলো, জলদি রওনা হই।
মিগনানা মারিউস বললো–এটা আমার পরম লক্ষ্য। যে কোন মূল্যে কাজটা আমার সমাধা করতেই হবে। মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু এ মিশন থেকে আমাকে হটাতে পারবে না। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার শপথ নিয়েছি। এ শপথ আমি বাস্তবায়ন না করে ক্ষান্ত হবো না। আমার প্রয়োজন একজন পুরুষ সঙ্গী আর একটি মেয়ে।
দেখ, মারিউস! আমি কাফেলার কমাণ্ডার। কী করবো আর কী করবো না, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আমার। তোমার কর্তব্য আমার আনুগত্য করা। বললো কমার।
আমি কারো হুকুমের গোলাম নই, আমরা সকলেই খোদার দাস। বললো মিগনান মারিউস।
ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে কমাণ্ডার। শাসিয়ে দেয় মারিউসকে। মিগনানা মারিউসের কাঁধে ঝুলানো তরবারী। সে-ও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঁধের তরবারীটা চলে আসে হাতে। উঁচিয়ে ধরে কমাণ্ডারের মাথার উপর। অবস্থা বেগতিক দেখে এক সঙ্গী এসে দাঁড়ায় মাঝখানে। নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে মারিউসকে। উধ্বে তুলে ধরা তরবারিটা নামিয়ে ফেলে সে। তার চোখ ঠিকরে আগুন ঝরছে যেন। মনে তার প্রচণ্ড ক্রোধ। বলে
আমি খোদার এক বিতাড়িত বান্দা। ত্রিশ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদী। চলে গেছে পাঁচ বছর। আমার মোল বছর বয়সের একটি বোন অপহৃতা হয়েছিলো । আমি গরীব মানুষ। বাবা বেঁচে নেই। মা অন্ধ। আমি ছোট ছোট কয়েকটি সন্তানের জনক। গতর খেটে তাদের ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতাম। আমি গীর্জায় ক্রুশের উপর ঝুলান যীশুখৃষ্টের প্রতিকৃতির কাছে বহুবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি.গরীব কেন? আমি তো কখনো পাপ করিনি। বিশ্বস্ততার সঙ্গেই তো আমি এত পরিশ্রম করি, কিন্তু সংসারে অভাব কেন? খোদা আমার মাকে অন্ধ করলেন কেন? কিন্তু যীশুখৃষ্ট আমার জিজ্ঞাসার কোন জবাব দেননি ।
যখন আমার কুমারী বোনটি অপহৃতা হয়ে গেলো, তখনও আমি গীর্জায় গিয়ে কুমারী মাতা মরিয়মের প্রতিকৃতির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমার কুমারী বোনের উপর এভাবে বিপদ নেমে এলো কেন? সে তো জীবনে কখনো অপকর্ম করেনি। তবে কি খোদা তাকে এভো রূপ দিয়ে তার প্রতি জুলুম করলেন? কিন্তু না, মা মরিয়মের পক্ষ থেকেও আমি কোন জবাব পেলাম না।
একদিন এক ধনাঢ্য ব্যক্তির এক চাকর আমাকে বললো, তোমার বোন আমার মনিবের ঘরে আছে। আমার মনিব বড় বিলাসপ্রিয় মানুষ। সে সুন্দরী কুমারী মেয়েদের অপহরণ করে আনে আর তাদের সঙ্গে কদিন ফুর্তি করে কোথায় যেন গায়েব করে ফেলে। রাজ দরবারে লোকটির যাওয়া-আসা, উঠা-বসা। মানুষ তাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। বাদশাহ তাকে একটি তরবারীও উপহার দিয়েছেন। এত পাপিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও খোদা তার প্রতি সন্তুষ্ট। দুনিয়ার আইন-কানুন তার হাতের খেলনা।
সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি তার ঘরে গেলাম এবং আমার বোনকে ফিরিয়ে দিতে বললাম। লোকটি ধাক্কা দিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। আমি আবারো গীর্জায় গেলাম। যীশুখৃষ্ট ও মা মরিয়মের প্রতিকৃতির নিকট দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করলাম। খোদাকে ডাকলাম। কিন্তু আমার আকুল আহ্বানে কেউ সাড়া দিলো না। আমি যখন সেদিন গীর্জায় প্রবেশ করি, তখন গীর্জায় আর কেউ ছিলো না। শেষে পাদ্রী আসলেন। তিনি আমাকে দেখে ধমক দিয়ে বাইরে বের করে দিলেন এবং বললেন–এখান থেকে দুটি মূর্তি চুরি হয়ে গেছে। তুমি জলদি চলে যাও, অন্যথায় তোমাকে আমি পুলিশের হাতে তুলে দেবো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন, এটা কি খোদার ঘর নয়? তিনি বললেন, আমাকে না বলে তুমি এ ঘরে ঢুকলে কেন? পাপের ক্ষমা-ই যদি চাইতে হয়, তাহলে আমার কাছে এসো; কি পাপ করেছে বলো, আমি খোদাকে বলবো তোমাকে ক্ষমা করে দিতে। খোদা সরাসরি কারো কথা শুনেন না। যাও, বের হও এখান থেকে। এই বলে তিনি খোদার ঘর থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন।
মিগনানা মারিউসের করুণ কণ্ঠের স্মৃতিচারণে সকলে অভিভূত হয়ে পড়ে। অশ্রু ঝরতে শুরু করে মেয়েদের চোখ বেয়ে। মরুভূমির রাতের নিস্তব্ধতায় তার কথাগুলো সকলের মনে যাদুর মতো রেখাপাত করে।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে মিগনানা আবার বলে, সেদিন আমি পাদ্রী, যীশু-খৃষ্ট, কুমারী মরিয়মের প্রতিকৃতি এবং খোদার প্রতি তীব্র সংশয় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মনে প্রশ্ন জাগলো, এরা যদি সত্য-ই হয়ে থাকে, তাহলে আমার প্রতি এতো অত্যাচার কেন? কেন এরা কেউ আমার আকুতিতে সাড়া দিলো না? বাড়ি গেলে অন্ধ মা জিজ্ঞেস করলেন, বাছা! আমার মেয়েকে নিয়ে এসেছো? স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, জিজ্ঞেস করলো সন্তানরা। যীশু-মরিয়ম-খোদার মত আমিও নীরব রইলাম, কথা বললাম না। কিন্তু আমার সহ্য হলো না। ভেতর থেকে একটি প্রচণ্ড ঝড় উঠে এলো। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম। জ্ঞানশূন্যের মত আমি সারাদিন ঘুরতে থাকি।
সন্ধ্যার সময় একটি খঞ্জর ক্রয় করলাম। সমুদ্রের কূলে গিয়ে পায়চারী করতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে রাতের আঁধার নেমে এলো। এবার আমি একদিকে হাঁটা দিলাম। আমার বোন যে গৃহে বন্দী, সে গৃহের আলো চোখে পড়লো। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। সতর্কপদে চলে গেলাম মহলের পিছনে। আমি স্বল্পবুদ্ধির হাবাগোবা ধরনের মানুষ। কিন্তু এক্ষণে এক বুদ্ধি খেলে যায় আমার মাথায়।
আমি মহলের পিছন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। একটি কক্ষ থেকে কোলাহলের শব্দ কানে ভেসে এলো। মদের আড্ডা বসেছিলো বোধ হয়। আমি একটি কক্ষে ঢুকতে চাইলাম। সামনে এসে দাঁড়ায় চাকর, বাধা দেয় আমাকে। তার বুকে খঞ্জর ধরে বোনের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, ও কোথায় আছে বল। চাকর সিঁড়ি বেয়ে আমাকে উপরে নিয়ে গেলো। আমাকে নিয়ে একটি কক্ষের দ্বারে দাঁড়িয়ে বললো, এখানে। আমি ভিতরে ঢুকে পড়লাম; অমনি বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে যায় কক্ষের দরজা। ভিতরটা শূন্য।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেলো। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত ঢুকে পড়লো কতগুলো মানুষ। হাতে তাদের তরবারী আর লাঠি। আমি কক্ষের জিনিসপত্র তুলে তুলে তাদের প্রতি ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। পাগলের মতো যেখানে যা পেলাম, ভেঙ্গে চুরমার করলাম। তারা আমাকে ধরে ফেললো, অনেক মারলো। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
আমার যখন জ্ঞান ফিরে এলো, তখন আমি হাতকড়া আর ডান্ডা-বেড়ীতে বাঁধা। আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হলো, আমি ডাকাতি করেছি, বাদশাহর একজন দরবারীর ঘরে ভাংচুর করেছি, হত্যা করার উদ্দেশ্যে তিনজনকে জখম করেছি।
আমার আর্জি-ফরিয়াদ, আকুতি-মিনতি কেউ শুনলো না। ত্রিশ বছরের। দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে আমি নিক্ষিপ্ত হলাম কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। কেটেছে মাত্র পাঁচ বছর। এতদিনে আমি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি। কারাজীবনের কষ্ট তোমরা জানো না। দিনে পশুর মত খাটান হয় আর রাতে কুকুরের মতো জিঞ্জির পরিয়ে ফেলে রাখা হয় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এ পাঁচ বছরে আমি জানতে পারিনি, আমার অন্ধ মা এবং স্ত্রী সন্তানেরা বেঁচে আছেন কি-না। ভয়ঙ্কর ডাকাত মনে করে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি কাউকে।
আমি সর্বক্ষণ ভাবতাম, খোদা সত্য না আমি সত্য। শুনেছিলাম, খোদ নিরপরাধ লোকদের শাস্তি দেন না। তাই প্রশ্ন জাগে, তিনি আমায় কোন্ পাপের শাস্তি দিলেন? কোন অপরাধের কারণে আমার নিষ্পাপ সন্তানদের তিনি অসহায় বানালেন?
পাঁচ পাঁচটি বছর এ ভাবনা আমার মাথায় তোলপাড় করতে থাকে। এই কিছুদিন আগে দুজন সেনা অফিসার যান কারাগারে। এখন আমরা যে মিশন নিয়ে এসেছি, তারা তার জন্য লোক খুঁজছিলেন। আমি প্রথমে নিজেকে পেশ করতে চাইনি। কারণ, এসব হল রাজা-বাদশাদের লড়াই। আর কোন রাজার প্রতি-ই আমার শ্রদ্ধা নেই। কিন্তু যখন আমি শুনলাম, কয়েকটি খৃষ্টান মেয়েকে মুসলমানদের কজা থেকে উদ্ধার করতে হবে, তখন আমার বোনের কথা মনে পড়ে যায়। আমাকে বলা হয়েছিলো, মুসলমান একটি ঘূণ্য জাতি। আমি মনস্থ করলাম, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমি এ অভিযানে অংশ নেবে। মুসলমানদের কবল থেকে খৃষ্টান মেয়েদের উদ্ধার করে আনবো। খোদা যদি সত্য হয়ে থাকেন, তাহলে এর বদৌলতে আমার বোনকে তিনি খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করে দেবেন। অফিসারদের কাছে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম। তারা আমাকে আরো বললেন, একজন মুসলমান রাজাকে হত্যা করতে হবে। আমি সে দায়িত্বও মাথায় তুলে নিলাম। নিজেকে পেশ করলাম তাদের হাতে। তবে শর্ত দিলাম, এর বিনিময়ে আমাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দিতে হবে, যা আমি আমার পরিবারের হাতে তুলে দেবো। তারা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। বললেন, যদি তুমি সমুদ্রের ওপারে মারাও যাও, তবু তোমার পরিবারকে আমরা এতে পরিমাণ অর্থ দেবো, যা তারা জীবনভর খেয়ে বাঁচতে পারবে, তাদের কারো কাছে হাত পাততে হবে না।
দুজন সঙ্গীর প্রতি ইঙ্গিত করে মিগনানা মারিউস বললো, এরা দুজনও আমার সঙ্গে কারাগারে ছিলো। এরাও নিজেদেরকে অফিসারদের হাতে তুলে দেয়। খুটিয়ে খুটিয়ে তারা আমাদের নানা কথা জিজ্ঞেস করে। আমরা নিশ্চয়তা দেই, নিজের জাতি ও ধর্মের সঙ্গে আমরা প্রতারণা করবো না। আমরা মূলত নিজেদের পরিবার-পরিজনের জন্য-ই জীবন বিক্রি করে দিয়েছি।
কারাগার থেকে বের হওয়ার প্রাক্কালে এক পাদ্রী আমাদেরকে বললেন, মুসলমান হত্যা কুরলে খোদা সব গুনাহ মাফ করে দেন। আর যদি তোমরা খৃষ্টান মেয়েদের মুক্ত করে আনতে পারো, তাহলে সোজা জান্নাতে চলে যাবে। আমি পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, খোদা আছেন কোথায়? জবাবে তিনি যা বললেন, তাতে আমি সান্ত্বনা পেলাম না। ক্রুশের উপর হাত রেখে আমি শপথ করলাম।
আমাদেরকে কারাগার থেকে বের করে আনা হলো। আমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার সামনে আমার পরিবারকে প্রচুর অর্থ দেয়া হলো। আমি । আশ্বস্ত হলাম। আমার বন্ধুরা! তোমরা আমাকে এখন সেই শপথ পূরণ করতে দাও। খোদা কোথায় আছেন, দেখতে চাই আমি। আচ্ছা, একজন মুসলমানকে হত্যা করলে আমি খোদাকে দেখতে পাবো তো?
তুমি একটা বদ্ধ পাগল। এতক্ষণ যা বব করলে, তাতে আমি বিবেক-বুদ্ধির গন্ধও পেলাম না। বললো কমাণ্ডার।
কেন, ইনি বেশ চমৎকার কথা বলেছেন। আমি এর সঙ্গে যাবো। বললো মিগনানার এক সঙ্গী।
আমার একটি মেয়ের প্রয়োজন–মিগনানা মারিউস মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললো–আমার সঙ্গে যে মেয়েটি যাবে, তার জীবন-সম্ভ্রমের দায়িত্বও আমার। মেয়ে ছাড়া সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট পৌঁছতে পারবো না। এসে অবধি আমি ভাবছি, আইউবীর সঙ্গে একাকী কিভাবে সাক্ষাৎ করতে পারি।
বসা থেকে উঠে মিগনানা মারিউসের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ায় মুবী। বলে–আমি যাবো এর সঙ্গে।
শোন মুবী! আমরা তোমাদের বড় কষ্টে মুক্ত করে এনেছি। এখন আমি তোমাকে এমন বিপজ্জনক মিশনে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারি না। বললো কমাণ্ডার।
আমাকে সম্ভ্রম হারাবার প্রতিশোধ নিতেই হবে। আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর শয়নকক্ষে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারবো। আমি জানি, মুসলমানদের মর্যাদা যতো উঁচু, সুন্দরী নারীর প্রতি তারা ততো দুর্বল। আমি এমন কৌশল অবলম্বন করবো, আইউবী বুঝতেই পারবে না, এ-ই তার জীবনের সর্বশেষ নারীদর্শন। বললো মুবী।
দীর্ঘ আলোচনা-তর্কের পর মিগনানা মারিউস তার এক সঙ্গী ও একটি মেয়েকে নিয়ে কাফেলা ত্যাগ করে রওনা হয়। তাকে দুআ দিয়ে সকলে বিদায় জানায়। দুটি উট নেয় সে। একটিতে সওয়ার হয় মুবী, অপরটিতে তারা দুজন। তাদের সঙ্গে আছে মিসরী মুদ্রা, সোনার আশরাফী। মিগনামা ও তার সঙ্গীর পরনে জুব্বা। এতদিনে মিগনানার দাঁড়িগুলো বেশ লম্বা হয়ে গেছে। কারাগারের অসহনীয় গরম এবং হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কারণে তার গায়ের রং এখন আর ইতালীদের মত গৌর নয়; অনেকটা কালো হয়ে গেছে। এখন তাকে ইউরোপিয়ান বলে সন্দেহ করার উপায় নেই। ছদ্মবেশ ধারণের জন্য আলাদা পোশাক দিয়ে পাঠান হয়েছিলো তাদের। কিন্তু সমস্যা হলো, মিগনানা মারিউস ইতালী ছাড়া আর কোন ভাষা জানে না। মিসরের ভাষা জানা আছে মুবীর। অপরজনও মিসরী ভাষা জানে না। এর একটা বিহিত না করলেই নয়।
তারা রাতারাতি-ই রওনা দেয়। অত্র অঞ্চলের পথ-ঘাট সব মুবীর চেনা। সে কায়রো থেকে-ই এসেছিলো। তার গায়েও একটি চোগা পরিয়ে দেয় মিগনানা। মাথায় পরিয়ে দেয় দোপাট্টার মত একটি চাদর।
***
ভোরের আলোতে সুলতান আইউবীর প্রেরিত বাহিনী ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে রওনা হয়ে পড়ে। খৃষ্টান কমাণ্ডোরা মেয়েদের নিয়ে রাত পোহাবার আগেই সমুদ্র অভিমুখে রওনা হয়ে যায়। তারা তীব্রগতিতে এগিয়ে চলছে।
সূর্যাস্তের এখনো অনেক বাকি। হঠাৎ এক স্থানে আইউবী বাহিনীর চোখে পড়ে কয়েকটি লাশ। আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব দেখেই বলে ওঠেন, এ-যে বালিয়ানের লাশ! মুখাবয়ব তার সম্পূর্ণ অবিকৃত। পার্শ্বেই এলোপাতাড়ি পড়ে আছে তার ছয় বন্ধুর মৃতদেহ। শকুন-হায়েনারা তাদের দেহের অনেক গোশত খেয়ে ফেলেছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে কাফেলা। বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছে না তারা। রক্ত বলছে, এরা মরেছে বেশীদিন হয়নি। লোকগুলো বিদ্রোহের রাতে মারা গিয়ে থাকলে এতদিনে রক্তের দাগ মুছে যেতো, থাকতো শুধু হাড়গোড়। বিষয়টি দুর্ভেদ্য ঠেকে তাদের কাছে।
অশ্বখুরের চিহ্ন ধরে আবার রওনা হয় কাফেলা। তীব্রগতিতে ঘোড়া হাঁকায়। আধ মাইল পথ অতিক্রম করার পর এবার উটের পায়ের দাগও চোখে পড়ে তাদের। এগিয়ে চলছে অবিরাম। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরও তারা থামেনি। এখন, তারা যে স্থানে চলছে, সেখান থেকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে উঁচু উঁচু মাটির টিলা। সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার আঁকা বাঁকা একটিমাত্র পথ।
খৃষ্টান কমাণ্ডোরাও এগিয়ে যাচ্ছে এ পথে-ই। বিস্তীর্ণ পার্বত্য এলাকার পরে বিশাল ধূ ধূ বালু প্রান্তর। পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করে-ই থেমে যায় পশ্চাদ্ধাবনকারী মুসলিম বাহিনী। রাত কাটায় সেখানে।
ভোর হতেই আবার রওনা দেয় তারা। পাড়ি দেয় বিশাল মরু এলাকা। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তারা সামুদ্রিক আবহাওয়া অনুভব করে। তার মানে সমুদ্র আর বেশী দূরে নয়। কিন্তু শিকার এখানেও চোখে পড়ছে না। পথে একস্থানে খাদ্যদ্রব্যের উচ্ছিষ্ট প্রমাণ দিলো, রাতে এখানে কোন কাফেলা অবস্থান নিয়েছিলো। ঘোড়া বাঁধার এবং পরে ঘোড়াগুলোর সমুদ্রের দিকে চলে যাওয়ার আলামতও দেখা গেলো। তারা মাটিতে ঘোড়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে আরো দ্রুত ঘোড়া হাঁকায়।
সম্মুখে এক স্থানে অবতরণ করে কাফেলা। ঘোড়াগুলোকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে, পানি পান করিয়ে আবার ছুটে চলে। সমুদ্রের বাতাসের তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সমুদ্রের লোনা ঘ্রাণ অনুভূত হচ্ছে নাকে। আস্তে আস্তে চোখে পড়তে শুরু করে উপকূলীয় টিলা।
ঘোড়া যত সামনে এগুচ্ছে, উপকূলীয় টিলাগুলো ততো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। একটি টিলার উপরে দুজন মানুষ নজরে পড়ে মুসলিম বাহিনীর। এক নাগাড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারা কাফেলার প্রতি। তারপর তীব্রবেগে নেমে পড়ে সমুদ্রের দিকে। পশ্চাদ্ধাবনকারী কাফেলার ঘোড়াগুলোর গতি আরো বেড়ে যায়। টিলার নিকটে এসে হঠাৎ থেমে যেতে হয় তাদের। কারণ, টিলার পিছনে যাওয়ার একাধিক পথ। উপরে উঠে সম্মুখে দেখে আসার জন্য প্রেরণ করা হয় একজনকে। লোকটি ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে যায় সেদিকে। একটি টিলায় উঠে শুয়ে শুয়ে তাকায় অপরদিকে। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে পেছনে। সেখান থেকেই ইঙ্গিতে সঙ্গীদের বলে, ঘোড়া থেকে নেমে জলদি পায়ে হেঁটে এসো। আরোহীরা নেমে পড়ে ঘোড়া থেকে। দৌড়ে এসে দাঁড়ায় টিলার নিকট। সর্বাগ্রে উপরে ওঠেন আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব। সম্মুখে তাকান তিনি। তৎক্ষণাৎ পিছনে সরে নেমে আসেন নীচে। মুহূর্তের মধ্যে তার বাহিনীকে ছড়িয়ে দেন তিন দিকে। এক একজনুকে পজিশন নিয়ে দাঁড়াতে বলেন এক এক স্থানে।
বিপরীত দিক থেকে অনেকগুলো ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি কানে আসছে। সুলতান আইউবীর গ্রেফতারকৃত গোয়েন্দা মেয়েদের ছিনিয়ে আনা খৃষ্টান কমান্ডো দল ঐখানে দাঁড়িয়ে। সমুদ্রের ওপার থেকে এসে তারা যে স্থানে নৌকা বেঁধে রেখে অভিযানে নেমেছিলো, এই সেই জায়গা। অভিযান সফল করে এখন তাদের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আপন দেশে ফিরে যাওয়ার পালা। তারা ঘোড়া থেকে নেমে এক এক করে নৌকায় উঠছে। ছেড়ে দিয়েছে ঘোড়াগুলো।
আচম্বিত তীরবর্ষণ শুরু হয় তাদের উপর। পালাবার পথ নেই। পাল্টা আক্রমণেরও সুযোগ নেই। তারা আত্মরক্ষার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কজন লাফিয়ে উঠে নৌকায়। তারা রশি কেটে দিয়ে শপাশপ দাঁড় ফেলতে শুরু করে। পিছনে যারা রয়ে গেলো, তারা তীরের নিশানায় পরিণত হলো। নৌকায় করে পলায়নপর কমাণ্ডোদের থামতে বলা হয়। কিন্তু তারা থামছে না। বাতাস নেই। ধীরে ধীরে মাঝের দিকে চলে যাচ্ছে নৌকা। শোঁ শোঁ শব্দ করে বেশ কটি তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় তাদেরও গায়ে। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় দাড়ের শব্দ। আরো এক ঝাক তীর ছুটে যায় নৌকায়। তারপর আরো এক ঝাঁক। গেঁথে গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে লাশগুলোর গায়ে। মাঝি-মাল্লাহীন নৌকা দুলতে দুলতে স্রোতে ভেসে অল্পক্ষণের মধ্যে কূলে এসে ঠেকে। মুসলিম বাহিনী পাড়ে এসে ধরে ফেলে নৌকাটি। নৌকায় কোন প্রাণী নেই। আছে প্রাণহীন: কতগুলো দেহ। তীরের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে মেয়েরাও। গোটা কমাণ্ডের বেঁচে নেই একজনও।
একটি খুটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো নৈৗকাটি। সাফল্যের গৌরব নিয়ে। উপকূলীয় ক্যাম্প অভিমুখে রওনা হয় মুসলিম সেনারা।
***
মুবী ও সঙ্গীকে নিয়ে কায়রোর একটি সরাইখানায় অবস্থান করছে মিগনানা মারিউস। এ সরাইখানাটি দু ভাগে বিভক্ত। একাংশ সাধারণ ও নিম্নস্তরের মুসাফিরদের জন্য, অপর অংশ বিত্তশালী ও উচ্চস্তরের পর্যটকদের জন্য। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাও এ অংশে অবস্থান করে। এদের জন্য মদ, নারী ও নাচ-গানের ব্যবস্থা আছে। মিগনানা মারিউসের এসে অবস্থান নেয় এ অংশে। এসে পরিচয় । দেয়, মুবী তার স্ত্রী আর সঙ্গের লোকটি তার ভৃত্য।
মুবীর রূপ-যৌবন সরাইখানার মালিক-কর্তৃপক্ষ এবং অবস্থানরত লোকদের মনে মিগনানা মারিউস এর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। এমন একজন সুন্দরী যুবতী যার স্ত্রী, তিনি অবশ্যই একজন বিত্তশালী আমীর। মিগনানাকে বিশেষ গুরুত্বের চোখে দেখতে শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর বাড়ী-ঘর ও দফতর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুবী। মুবী জানতে পায়, সুলতান আইউবী সুদানীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন ও সুদানী বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। মুবী আরো জানতে পারে, সুলতান আইউবী সুদানী সালার ও কমাণ্ডার শ্রেণীর লোকদের হেরেম থেকে ললনাদের বিদায় করে দিয়েছেন এবং আবাদী জমি দিয়ে তাদের পুনর্বাসিত করছেন।
মিসরের ভাষা জানে না মিগনানা মারিউস। তথাপি সে আগুন নিয়ে খেলার মত এই ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে অবতরণ করলো। এটি হয়ত তার অস্বাভাবিক দুঃসাহস কিংবা চরম নির্বুদ্ধিতর পরিচয়। এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটন এবং এতবড় মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের নিকটে পৌঁছার প্রশিক্ষণও তার নেই। তদুপরি সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারপরও সে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে আসলো! কমাণ্ডার বলেছিলো–তুমি একটি বদ্ধ পাগল; বুদ্ধি বিবেকের বাম্পও নেই তোমার মাথায়। বাহ্যত পাগল-ই ছিলো মিগনানা মারিউস।
এ এক ঐতিহাসিক সত্য যে, বড়দেরকে যারা হত্যা করে, তারা পাগল-ই হয়ে থাকে। বিকৃত-মস্তিষ্ক না হোক মাথার নাট-বোন্ট কিছুটা হলেও ঢিলে থাকে তাদের। ইতালীর এই সাজাপ্রাপ্ত লোকটির অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। তার কাছে এমন একটি সম্পদ আছে, যাকে সে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে শুধু। সে হলো মুবী । মুৰী শুধু মিসরের ভাষা-ই জানতো না, বরং তাকে এবং তার নিহত হয় সঙ্গী মেয়েকে মিসরী ও আরবী মুসলমানদের চলাফেরা, উঠাবসা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদি সব সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কেও দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সে মুসলমান পুরুষদের মনের যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। অভিনয় করতে জানে ভালো। মুবীর সবচে বড় গুণ, সে আঙ্গুলের ইশারায় পুরুষদের নাচাতে জানে। জানে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে যে কোন পুরুষের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে।
সরাইখানার রুদ্ধ কক্ষে মিগনানা মারিউস, মুবী ও তাদের সঙ্গী কী আলোচনা করলো, কী পরিকল্পনা আঁটলো, তা কেউ জানে না। সরাইখানায় তিন-চারদিন অবস্থান করার পর মিগনানা মারিউস যখন বাইরে বের হয়, তখন তার মুখে লম্বা দাড়ি, চেহারার রং সুদানীদের ন্যায় গাঢ় বাদামী। এই বেশ তার কৃত্রিম হলেও দেখতে কৃত্রিম বলে মনে হলো না। পরনে সাধারণ একটি চোগা, মাথায় পাগড়ী ও রোমাল। মুবী আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃত। তার শুধু মুখমণ্ডলটাই দেখা যায়। কপালের উপর কয়েকটি রেশমী চুল সোনার তারের মত ঝক ঝক্ করছে। রূপের বন্যা বইছে তার চেহারায়। মেয়েটির প্রতি রাস্তার পথিকদের যার-ই দৃষ্টি পড়ছে, তারই চোখ আটকে যাচ্ছে। সঙ্গের লোকটির পরণে সাধারণ পোশাক। দেখে লোকটাকে এদের চাকর-ভৃত্য বলেই মনে হলো।
বাইরে উন্নত জাতের দুটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। সরাইখানার কর্তৃপক্ষ মিগনানা মারিউসের জন্য ভাড়ায় এনে দিয়েছে ঘোড়া দুটো। সে স্ত্রীকে নিয়ে ভ্রমণে যাবে বলেছিলো। মিগনানা মারিউস ও মুবী দুজন দুটি ঘোড়ায় চড়ে বসে। অপরজন ভৃত্যের মত তাদের পিছনে পিছনে হাঁটছে।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কক্ষে উপবিষ্ট। তিনি সুদানীদের ব্যাপারে নায়েবদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। এই ঝামেলা অল্প সময়ে শেষ করে ফেলতে চান সুলতান। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সুলতান জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনী, মিসরের নতুন ফৌজ এবং ওফাদার সুদানীদের সমন্বয়ে একটি যৌথ বাহিনী গঠন করবেন এবং অতিসত্ত্বর জেরুজালেম আক্রমণ করবেন।
রোম উপসাগরে খৃষ্টানদের পরাজয়বরণের পর পরই সুলতান জঙ্গী রাজা ফ্রাংককে পরাজিত করেন। ফলে চরমভাবে বিপর্যস্ত খৃষ্টান বাহিনী দীর্ঘদিন পর্যন্ত আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আত্মসংবরণের আগে আগেই খৃষ্টানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করার পরিকল্পনা নেন সুলতান আইউবী। তিনি তারও আগে সুদানীদের পুনর্বাসনের কাজটা সম্পন্ন করে ফেলতে চাইছেন, যাতে তারা চাষাবাদ ও সংসার কর্মে আত্মনিয়োগ করে এবং বিদ্রোহের চিন্তা করার সুযোগ না পায়।
নতুন বাহিনীর পুনর্গঠন এবং হাজার হাজার সুদানীকে জমি দিয়ে পুর্নবাসিত করা সহজ কাজ নয়। সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এমন কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা মিসরের গভর্নর হিসেবে সুলতান আইউবীকে দেখতে চান না। সুদানী বাহিনীকে ভেঙ্গে দিয়েও সুলতান সমস্যার এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন। সুদানী বাহিনীর কয়েকজন পদস্থ অফিসার এখনো জীবিত। তারা বাহ্যত সুলতান আইউবীর আনুগত্য মেনে নিয়েছিলো ঠিক, কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের ইন্টেলিজেন্স বলছে, বিদ্রোহের ভস্মস্তূপে এখনো কিছু অঙ্গার রয়ে গেছে। সুদানীদের পুনর্বাসন এবং সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনে এ একটি মারাত্মক সমস্যা।
গোয়েন্দা বিভাগ আরো রিপোর্ট করে, নিজেদের পরাজয়ে এ বিদ্রোহী নেতাদের যতটুকু দুঃখ, তার চেয়ে বেশী দুঃখ খৃষ্টানদের পরাজয়ে। কারণ, তারা বিদ্রোহে ব্যর্থ হওয়ার পরও খৃষ্টানদের সাহায্য পেতে চাচ্ছিলো। এখন খৃষ্টানদের পরাজয়ে তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। মিসরের প্রশাসন ও ফৌজের । দু-তিনজন কর্মকর্তা সুদানীদের পরাজয়ে এজন্যেও ব্যথিত যে, তাদের বুকভরা আশা ছিলো, এ বিদ্রোহে সুলতান আইউবী হয়তো নিহত হবেন কিংবা মিসর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবেন।
এরা হলো ঈমান-বিক্রয়কারী গাদ্দার। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ঘটা করে তাদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশন নেননি। তিনি তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ-ই করতেন। কোন বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি। অধীন ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে কখনো তিনি একথা বলেননি যে, যারা আমার বিরোধিতা করছে, আমি তাদের দেখিয়ে ছাড়বো। তাদের ব্যাপারে ধমকের সুরে কথা বলেননি কখনো। তবে প্রসঙ্গ এলে মাঝে-মধ্যে বলতেন–কেউ যদি কোন সহকর্মীকে ঈমান বিক্রি করতে দেখো, তাহলে তাকে বারণ করো। তাকে স্মরণ করিয়ে দিও যে, সে মুসলমান। তার সঙ্গে মুসলমানদের মত আচরণ করো, যাতে আত্মপরিচয় লাভ করে সে দুশমনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে।
কিন্তু তিনি তাদের তৎপরতার উপর কড়া নজর রাখতেন। আলী বিন সুফিয়ানের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোও গুরুত্বের সঙ্গে তাদের গতিবিধির উপর নজরদারীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। বিশ্বাসঘাতকদের গোপন রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত হতেন সুলতান আইউবী।
আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব এখন বেড়ে গেছে আরো। রক্ষী ও উষ্ট্ৰচালকদের নিহত হওয়ার সংবাদ পৌঁছে গেছে কায়রো। এই রক্ষী ও উষ্ট্রচালকদের হত্যা এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা রক্ষীদের হাত থেকে গুপ্তচরদের ছিনিয়ে নেয়া প্রমাণ করলো, এখনো মিসরে খৃষ্টান গুপ্তচর এবং গেরিলা বাহিনী রয়ে গেছে। আর দেশের কিছু লোক যে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয় দিচ্ছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে সুলতান আইউবীর প্রেরিত বাহিনী যে ঠিক নৌকায় উঠে ওপারে পাড়ি দেয়ার সময় সেই গেরিলা বাহিনী ও গুপ্তচরদের শেষ করে । দিয়েছে, সে খবর কায়রো পৌঁছেনি এখনো। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি গেরিলাদের প্রতিহত করার জন্য প্রেরণ করেছেন দুটি টহল বাহিনী। জোরদার করেছেন গোয়েন্দা তৎপরতা।
বিষণ্ণতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সুলতান আইউবী। যে প্রত্যয় নিয়ে তিনি মিসর এসেছিলেন, তা কতটুকু সফল হলো, সে ভাবনায় তিনি অস্থির। তিনি সালতানাতে ইসলামিয়াকে জঞ্জালমুক্ত করে তাকে আরো বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ঝড় উঠেছে যেমন মাটির উপর থেকে, তেমনি নীচ থেকেও। সেই ঝড়ে কাঁপতে শুরু করেছে তার সেই স্বপ্নসৌধ। এ চিন্তায়ও তিনি অস্থির যে, মুসলমানদের তরবারী আজ মুসলমানদের-ই মাথার উপর ঝুলছে। নীলাম হচ্ছে মুসলমানদের ঈমান। ষড়যন্ত্রের জালে আটকে গিয়ে সালতানাতে ইসলামিয়ার খেলাফতও এখন খৃষ্টানদের ক্রীড়নকে পরিণত। নারী আর কড়ি প্রকম্পিত করে তুলেছে আরবের বিশাল পবিত্র ভূখণ্ড।
নিজেকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও সুলতান সম্পূর্ণ সচেতন। কিন্তু তার জন্য তিনি কখনো পেরেশান হননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন–জীবন আমার আল্লাহর হাতে। তাঁর নিকট যখন পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হবে, তখন তিনি আমাকে তুলে নেবেন।
তাই সুলতান আইউবী কখনো নিজের হেফাজতের কথা ভাবেননি। কিন্তু গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ। খৃষ্টানদের কোন ষড়যন্ত্র যেনো সফল হতে না পারে, তার জন্য তিনি সুলতান আইউবীর চারদিকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন করে রেখেছিলেন।
আজ কক্ষে বসে সুদানীদের ব্যাপারে নায়েবদের নির্দেশনা দিচ্ছেন সুলতান। হঠাৎ নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়িয়ে যায় দুটি ঘোড়া। আরোহী দুজন মিগনানা মারিউস ও মুবী। তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে অবতরণ করে। এগিয়ে এসে ঘোড়ার বাগ হাতে নেয় পিছনে পিছনে হেঁটে আসা আরেকজন লোক। নিরাপত্তা কমাণ্ডারের সঙ্গে কথা বলে মুবী। বলে, সঙ্গের লোকটি আমার পিতা। আমরা সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। মিগনামা, মারিউসের প্রতি দৃষ্টিপাত করে কথা বলে কমাণ্ডার। সে সাক্ষাতের হেতু জানতে চায়। না শোনার ভান করে নিপ দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি। পাশের থেকে মুবী বলে–ইনি বধির ও বোবা। এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য আমি সরাসরি সুলতানকে কিংবা ঊর্ধ্বতন অফিসারকেই জানাবো।
কক্ষের বাইরে টহল দিচ্ছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। মিগনানা মারিউস ও মুবীকে দেখে তিনি এগিয়ে আসেন। আসোলামু আলাইকুম বলে সালাম দিলে ওয়ালাইকুমুস সালাম বলে জবাব দেয় মুবী। কমাণ্ডার তাঁকে বললেন, এরা সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আলী বিন সুফিয়ান মিগনানা মারিউসকে সাক্ষাতের কারণ জিজ্ঞেস করেন। মুবী বললো, ইনি আমার পিতা। কানে শুনেন না, কথা বলতে পারেন না। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, সুলতান এ মুহূর্তে কাজে ব্যস্ত। অবসর হলে হয়তো সময় দিতে পারেন। তার আগে আমাকে বলল, তোমরা কেন এসেছে; দেখি আমি-ই তোমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি। কিনা। হোট-খাট অভিযোগ শোনবার জন্য সুলতান সময় দিতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট বিভাগ জনতার অনেক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে।
কেন, সুলতান কি একটি নির্যাতিত নারীর ফরিয়াদ শুনবার জন্য সময় দিতে পারবেন না? আমার যা কিছু বলার, তাঁর কাছে-ই বলবো। বললো মুবী।
আমাকে না বলে আপনি সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। বলুন, আপনার ফরিয়াদ আমি-ই সুলতানের কাছে পৌঁছিয়ে দেবো। প্রয়োজন মনে করলে তিনি-ই আপনাদের ডেকে নেবেন। একথা বলে-ই আলী বিন। সুফিয়ান তাদেরকে নিজের কক্ষে নিয়ে যান।
উত্তরাঞ্চলের একটি পল্লী এলাকার নাম উল্লেখ করে মুবী বললো–দু বছর আগে সুদানী বাহিনী এ অঞ্চল দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলো। তাদের দেখার জন্য মহল্লার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে আমিও বেরিয়ে আসি। হঠাৎ এক কমাণ্ডার ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে আমার নিকটে এসে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী? আমি আমার নাম জানালে তিনি আমার পিতাকে ডেকে পাঠান। আড়ালে নিয়ে গিয়ে বাবাকে কানে কানে কী যেন বললেন। দূর থেকে এগিয়ে গিয়ে একজন বললো, ইনি তো বোবা ও বধির। শুনে কমাণ্ডার চলে গেলেন। . সন্ধ্যার পর আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত হলো চারজন সুদানী সৈনিক। কোন কথা না বলে তারা আমাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে কমাণ্ডারের হাতে অর্পণ করে। কমাণ্ডারের নাম বালিয়ান। তিনি আমাকে সঙ্গে করে আনেন এবং তার হেরেমে আবদ্ধ করে রাখেন। আরো চারটি মেয়ে ছিলো তার কাছে। আমি তাকে বললাম, আপনি সেনাবাহিনীর একজন কমাণ্ডার। আমাকে যখন নিয়েই এলেন, তো বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিন। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না। বিয়ে ছাড়াই আমাকে স্ত্রীর মতো ব্যবহার করতে শুরু করলেন।
দুটি বছর তিনি আমাকে সঙ্গে রাখলেন। সুদানীদের সাম্প্রতিক বিদ্রোহের পর তিনি পালিয়ে গেছেন। পরে মারা গেছেন, না জীবিত আছেন জানি না। আপনার সৈন্যরা তার বাড়িতে প্রবেশ করে এবং আমাদের সব কটি মেয়েকে এই বলে বের করে দেয় যে, যাও তোমরা এখন মুক্ত।
আমি আমার বাড়িতে চলে গেলাম। আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিতে চাইলেন; কিন্তু কেউ আমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এলো না। মানুষ বলছে, আমি হেরেমের চোষা হাড়, চরিত্রহীনা, বেশ্যা। সমাজ আমাকে এক ঘরে করে রেখেছে। এখন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার।
নিরূপায় হয়ে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে ইনি আমাকে নিয়ে সরাইখানায় এসে উঠেছেন। শুনলাম, সুলতান নাকি সুদানীদের জমি ও বাড়ি দিয়ে পুনর্বাসিত করছেন। আমাকে আপনি আপনাদের-ই কমাণ্ডার বালিয়ানের রক্ষিতা বা স্ত্রী মনে করে একখণ্ড জমি এবং মাথা গোঁজার জন্য একটি ঘর প্রদান করুন। অন্যথায় আত্মহত্যা কিংবা পতিতাবৃত্তি ছাড়া আমার আর কোন পথ থাকবে না।
সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ছাড়া-ই যদি আপনি জমি-বাড়ি পেয়ে যান, তবু কি আপনার সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে হবে? বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
হ্যাঁ, তারপরও আমি সুলতানকে এক নজর দেখতে চাই। একে আপনি আমার আবেগও বলতে পারেন। আমি সুলতানকে শুধু এ কথাটা জানাতে চাই যে, তার সালতানাতে নারীরা তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিত্তশালী ও শাসক গোষ্ঠীর কাছে বিয়ে এখন প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি নারীর সম-সতীত্ব রক্ষা করুন এবং হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনুন। একথাগুলো সুলতানকে জানাতে পারলে হয়তো আমার মনে শান্তি আসবে।
মিগনানা মারিউস এমন নির্লিপ্তের মত বসে আছে, যেন আসলেই কোন কথা তার কানে ঢুকছে না। আলী বিন সুফিয়ান মুবীকে বললেন, ঠিক আছে, সুলতানের বৈঠক শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বৈঠক শেষ হলে আমি তার সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করবো। একথা বলেই তিনি দ্রুতপদে বাইরে বেরিয়ে যান।
ফিরে আসেন অনেক বিলন্থে। এসে বললেন, আপনারা আরেকটু বসুন, আমি সুলতানের নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আসছি। আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীর কক্ষে প্রবেশ করেন; কথা বলেন অনেকক্ষণ। তারপর বেরিয়ে এসে মুবীকে বললেন, ঠিক আছে, এবার পিতাকে নিয়ে আপনি সুলতানের কক্ষে চলে যান; সুলতান আপনাদের অপেক্ষায় বসে আছেন। বলেই তিনি তাদেরকে সুলতান আইউবীর কক্ষটা দেখিয়ে দেন। সুলতান আইউবীর কক্ষে প্রবেশ করার সময় তারা গভীর দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকায়। সুলতানকে হত্যা করার পর পালাবার পথটা-ই দেখে নিলো বোধ হয়।
***
কক্ষে সুলতান আইউবী একাকী দাঁড়িয়ে। তিনি মিগনানা মারিউস ও মুবীকে। বসালেন। মুবীর প্রতি তাকিয়ে বললেন–তোমার বাবা কি জন্মগতভাবেই বোৰা ও বধির?
জি, মুহতারাম সুলতান! এটা তার জন্মগত ত্রুটি। জবাব দেয় মুবী।
সুলতান আইউবী বসছেন না। কক্ষময় পায়চারী করছেন আর কথা বলছেন। তিনি বললেন–তোমার আর্জি-ফরিয়াদ আমি শুনেছি। তোমাদের ব্যথায় আমিও ব্যথিত। এখানে আমি তোমাদের জমিও দেবো, বাড়িও দেবো। শুনেছি, তুমি নাকি আরো কিছু বলতে চাও? বলল, কী সে কথা?
আল্লাহ আপনার মর্যাদা বুলন্দ করুন। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন যে, আমাকে কেউ বিয়ে করছে না। মানুষ আমাকে হেরেমের চোষা হাডিড আর নিংড়ানো ছোবড়া, চরিত্রহীনা, বেশ্যা বলে আখ্যা দেয়। তারা বলে, আমার পিতা নাকি আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন আপনি আমাকে জমি-ঘর তো দেবেন ঠিক, কিন্তু আমার একজন স্বামীরও প্রয়োজন, যিনি আমার ইজ্জত-সম্ভ্রমের সংরক্ষণ করবেন। অভয় দিলে আপনার নিকট আমি এ আর্জিও পেশ করবো যে, বিয়ের ব্যবস্থা করতে না পারলে আপনি-ই আমাকে আপনার হেরেমে রেখে দিন। আপনি আমার বয়স, রূপ-যৌবন ও দেহ-গঠন দেখুন। বলুন, আমি কি আপনার যোগ্য নই?
একথা বলেই মুবী এক হাত মিগনানা মারিউসের কাঁধে রেখে অপর হাত নিজের বুকে স্থাপন করে এবং চোখে সুলতান আইউবীর প্রতি ইঙ্গিত করে।
মিগনানা মারিউস দু হাত একত্র করে সুলতান আইউবীর প্রতি বাড়িয়ে ধরে, যেন সে বলছে, আপনি দয়া করে আমার মেয়েটাকে বরণ করে নিন।
আমার কোন হেরেম নেই বেটী! আমি রাজ্য থেকে হেরেম, পতিতালয় এবং মদ উৎখাত করছি। বললেন সুলতান আইউবী।
কথা বলতে বলতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের পকেট থেকে একটি মুদ্রা, বের করলেন এবং হাতে নিয়ে মুদ্রাটি নাড়াচাড়া করছেন আর আমি নারীর ইজ্জতের মুহাফিজ হতে চাই বলতে বলতে দুজনের পিছনে চলে যান এবং হঠাৎ মুদ্রাটি হাত থেকে ফেলে দেন। টন করে একটা শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে মিগনানা মারিউস চকিতে পেছন ফিরে তাকিয়েই অমনি মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের কোমরবন্ধ থেকে একটি খঞ্জর বের করে আগাটা মিগনানা মারিউসের ঘাড়ে তাক করে ধরে মুবীকে বললেন লোকটা আমার ভাষা বুঝে না। একে বলল, হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিতে। তোমার বাবাকে বলল, যেন একটুও নড়াচড়া না করে। অন্যথায় তোমরা দুজন এক্ষুনি লাশে পরিণত হরে।
ভয়ে-বিস্ময়ে মুবীর চোখ দুটো কোঠর থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারপরও মেয়েটি অভিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাবার চেষ্টা করে এবং বলে আমার বাবাকে ভয় দেখিয়ে আপনি আমাকে কজা করতে চাচ্ছেন কেন? আমি তো নিজেই নিজেকে আপনার সামনে পেশ করে দিলাম। ..।
সুলতান আইউবীর খঞ্জরের আগা মিগনানা মারিউসের ঘাড়েই ধরা। সে অবস্থায়ই তিনি বললেন–যুদ্ধক্ষেত্রে যখন তুমি আমার মুখোমুখি হয়েছিলে, তখন আমার ভাষা বলোনি। এখন এতো দ্রুত আমার ভাষাটা শিখে ফেললে তুমি ……….! একে এক্ষুণি অস্ত্র ফেলতে বলো।
মুবী তার ভাষায় মিগনানা মারিউসকে কি যেন বললো। সাথে সাথে সে চোগার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটি খঞ্জর বের করলো। লম্বায় ঠিক সুলতান আইউবীর খঞ্জরের সমান। সুলতান আইউবী হাত থেকে তার খঞ্জরটা নিয়ে নেন এবং ঘাড়ে তাক করে নিজের খঞ্জরটা সরিয়ে ফেলে বললেন–অপর ছয়টি মেয়ে কোথায়?
আপনি আমাকে চিনতে ভুল করেছেন মহামান্য সুলতান! আমার সঙ্গে আর কোন মেয়ে নেই। আপনি কোন্ মেয়েদের কথা বলছেন? কম্পিত কণ্ঠে বললো মুবী।
সুলতান আইউবী বললেন–আল্লাহ আমাকে চোখ দিয়েছেন, মেধাও দিয়েছেন। একবার কাউকে দেখলে তার চেহারাটা আমার হৃদয়পটে অঙ্কিত হয়ে যায়। অর্ধেকটা নেকাবে ঢাকা তোমার এই মুখাবয়ব এর আগেও আমি দেখেছি। তোমরা যে কাজে এসেছে, তার যোগ্যতা ও ক্ষমতা তোমাদের নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে সে মেধা দেননি। সরাইখানায় তোমরা দুজন ছিলে স্বামী-স্ত্রী। এবানে এসে হয়েছে পিতা-কন্যা। বাইরে ঘোড়ার নিকট দণ্ডায়মান তোমাদের সঙ্গীটিও তোমাদের ভৃত্য নেই। লোকটি এখন আইউবীর বন্দী।
কৃতিত্বটা আলী বিন সুফিয়ানের। মুবী তাঁকে বলেছিলো, তারা সরাইখানায় এসে উঠেছে। দুজনকে নিজের কক্ষে বসিয়ে রেখে বের হয়েই ঘোড়ায় চড়ে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। মুবী ও মিগনানা মারিউসের আকৃতির বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করলে কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী। সঙ্গের লোকটি তাদের ভূত্য। তারা আরো জানায়, এখানে উঠে লোক দুটো বাজার থেকে কিছু কাপড় ক্রয় করে এনেছিলো। তন্মধ্যে মেয়েটির বোরকার ন্যায় চোগা এবং জুতাও ছিলো।
এতটুকু তথ্য পাওয়ার পর আলী বিন সুফিয়ান আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন । তিনি কক্ষের তালা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করেন। তল্লাশী চালিয়ে এমন কিছু বস্তু উদ্ধার করেন, যা তাঁর সন্দেহকে দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত করে।
সুলতান আইউবীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের মতলব বুঝে ফেলেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি ফিরে এসে তাদের ঘোড়াগুলোকে নিরীক্ষা করে দেখে গিয়েছিলেন। বেশ উন্নত জাতের ঘোড়া। সরাইখানার কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করে আলী বিন সুফিয়ান জানতে পারেন, এরা তিনজন এসেছিলো উটে চড়ে। মেয়েটি। এই ঘোড়া দুটো সংগ্রহ করায়। বলেছিলো, আমাদের অতি উন্নত ও দ্রুতগামী দুটো ঘোড়ার প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ আরো জানায়, মেয়েটির স্বামী বোবা। ভৃত্যটিও বোধ হয় কথা বলতে পারে না। এখানে এসে অবধি দুজনের কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনি। যা বলেছে সব মেয়েটিই বলেছে।
আলী বিন সুফিয়ান যখন ফিরে আসেন, ততক্ষণে বৈঠক শেষ হয়ে গেছে। সোজা চলে যান তিনি সুলতানের কাছে। তাঁকে আগন্তুকদের প্রসঙ্গে অবহিত করেন, তারা তাঁকে যা বলেছে তা-ও শোনান এবং ইতিমধ্যে সরাইখানা থেকে যেসব তথ্য এনেছেন, তা-ও সুলতানের কানে দেন। তাদের কক্ষ তল্লাশী করে সন্দেহজনক যা যা পেয়েছেন, তা-ও দেখান এবং নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন যে, আমি নিশ্চিত, তারা আপনাকে হত্যা করতে এসেছে। সেজন্য-ই আপনার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করা তাদের এতো প্রয়োজন। আমার প্রবল ধারণা, তারা পরিকল্পনা করে এসেছে, আপনাকে খুন করে বেরিয়ে যাবে এবং অন্যরা টের পেতে না পেতে দ্রুতগামী মোড়ায় চড়ে ততক্ষণে শহর ত্যাগ করে চলে যাবে। এ-ও হতে পারে, এই সুন্দরী মেয়েটির ফাঁদে ফেলে আপনার শয়নকক্ষে-ই তারা আপনাকে হত্যা করতে চায়।
ভাবনায় পড়ে গেলেন সুলতান। ক্ষণকাল মৌন থেকে বললেন–এখনই ওদেরকে গ্রেফতার করো না; আগে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে সুলতানের কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে দরজা ঘেঁষে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর কমাণ্ডারকে ডেকে বললেন–ঐ ঘোড়া দুটোকে আমাদের ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে, যিনগুলো খুলে রাখ আর সঙ্গের লোকটাকে তোমাদের প্রহরায় বসিয়ে রাখো। তল্লাশী করে দেখো, লোকটার সঙ্গে অস্ত্র আছে কিনা। থাকলে নিয়ে নাও।
নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হলো। মিগনানা মারিউসের সঙ্গী গ্রেফতার হলো, তল্লাশী নেয়া হলো। পোশাকের মধ্যে লুকানো একটি খঞ্জর পাওয়া গেলো। ঘোড়া দুটোও জব্দ করা হলো।
সুলতান আইউবী তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে হাত থেকে একটি মুদ্রা নীচে ফেলে দিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, মেয়েটির সঙ্গের লোকটি বধির নয়। মুদ্ৰাপতনের শব্দ হওয়া মাত্র সে চকিতে পিছন ফিরে তাকিয়েছিলো ।
***
সুতান সালাহুদ্দীন আইউবী গম্ভীর কণ্ঠে মেয়েটিকে উদ্দেশ করে বললেন, তাকে বলল, আমার জীবন খৃষ্টানদের হাতে নয়–জীবন আমার খোদার হাতে।
মুবী তার নিজের ভাষায় মিগনানা মারিউসকে কথাটা বললে সে চমকিত হয়ে মুবীকে কী যেন বললো। মুৰী সুলতান আইউবীকে বললেন, ইনি জিজ্ঞেস করছেন, আপনারও কি খোদা আছেন, মুসলমানও কি খোদায় বিশ্বাস করে?
সুলতান আইউবী বললেন–তাকে বলো, মুসলমান সেই খোদাকে বিশ্বাস করে, যিনি নিজে সত্য এবং সত্যের অনুসারীদের ভালবাসেন। আমাকে কে বলে দিলো যে, তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছো? বলেছেন আমার খোদা। তোমার খোদা যদি সত্য হতো, তাহলে তোমার খঞ্জর আমাকে শেষ করে ফেলতো। কিন্তু আমার খোদা তোমার হাতের খঞ্জরটি আমার হাতে এনে দিয়েছেন। এই বলে তিনি পার্শ্ব থেকে একটি তরবারী ও কিছু জিনিসপত্র বের করে তাদের দেখিয়ে বললেন–এ তরবারী ও এই জিনিসগুলো তোমাদের । সমুদ্রের ওপার থেকে তোমরা এগুলো নিয়ে এসেছিলে । কিন্তু তোমার পৌঁছার আগেই এগুলো আমার কাছে পৌঁছে গেছে।
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মিগনানা মারিউস। চোখ দুটো কোঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে তার। এ পর্যন্ত যতো কথা হয়েছে, সব হয়েছে মুবীর মাধ্যমে। এবার নিজেই কথা বলতে শুরু করে সে। খোদা সম্পর্কে সুলতান আইউবীর কথাগুলো শুনে আবেগ্নাপুত কণ্ঠে নিজের ভাষায় বলে ওঠে–এ লোকটিকে সঠিক বিশ্বাসের অনুসারী বলে মনে হয়। আমি তার জীবন নিতে এসেছিলাম; কিন্তু এখন আমার-ই জীবন তার হাতে। তাকে বলো, তোমার বুকে যে খোদা আছেন, তাকে আমাকে একটু দেখাও, আমি তার সেই খোদাকে এক নজর দেখতে চাই, যিনি বলে দিয়েছেন, আমরা তাকে হত্যা করতে এসেছি।
এত দীর্ঘ আলাপচারিতার সময় নেই সুলতান আইউবীর; নেই প্রয়োজনও। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়াই ছিলো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু লোকটাকে বিধ্বস্ত ও বিভ্রান্ত বলে মনে হলো তার কাছে। সুলতানের কাছে মনে হলো, লোকটা পাগল না হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই মিগনানা মারিউসের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ কথা বলতে শুরু করেন তিনি।
ইত্যবসরে ভিতরে প্রবেশ করেন আলী বিন সুফিয়ান । সুলতান কি হালে আছেন, তিনি দেখতে এসেছেন। সুলতান আইউবী স্মিত হেসে বললেন–কোন অসুবিধা নেই আলী! তার থেকে আমি খঞ্জর নিয়ে নিয়েছি। প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে যান আলী বিন সুফিয়ান।
মিগনানা মারিউস মুবীকে বললো, সুলতানকে বলল, আমার দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করার আগে আমি তাকে আমার জীবন-কাহিনী শোনানোর একটু সময় চাই। অনুমতি পেয়ে মিগনানা মারিউস আগের রাতে তার কমাণ্ডার ও সঙ্গীদের যে আত্মকাহিনী শুনিয়েছিলো, সুলতান আইউবীকে আনুপুংখ তা শোনায়। সুলতান আইউবী তন্ময় হয়ে শ্রবণ করেন তার সেই করুণ কাহিনী। তারপর যীশুখৃষ্টের প্রতিকৃতির প্রতি, কুমারী মরিয়মের ছবির প্রতি এবং পাদ্রীদের মাধ্যম ছাড়া যে খোদার সঙ্গে কথা বলা যায় না, তার প্রতি তীব্র বিরাগ প্রকাশ করে সে বললো–আমার মৃত্যুর আগে আপনি আপনার খোদার একটি ঝলক দেখিয়ে দিন। আমার খোদা আমার পুত্র-কন্যাদের না খাইয়ে মেরে ফেলেছে, কেড়ে নিয়েছে আমার মায়ের দৃষ্টিশক্তি। মদ্যপ হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়েছে আমার নিষ্পাপ সুন্দরী বোনকে। আর ত্রিশটি বছরের জন্য আমাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সেখান থেকে বের হয়ে এখন
আমি নিপতিত হয়েছি মৃত্যুর মুখে। মহামান্য সুলতান! আমার জীবন এখন। আপনার হাতে। আমায় সত্য খোদাকে একটু দেখিয়ে দিন, আমি তাঁর সমীপে ফরিয়াদ জানাবো, ন্যায় বিচার প্রার্থনা করবো।
সুলতান আইউবী বললেন–তোমার জীবন আমার হাতে নয়–আমার আল্লাহর হাতে। অন্যথায় এতক্ষণে থাকতে তুমি আমার জল্লাদের কজায়। যে খোদা তোমার থেকে আমার তরবারীকে ফিরিয়ে রেখেছেন, তার দর্শন লাভে আমি তোমায় ধন্য করবো। কিন্তু তোমাকে সে খোদার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। অন্যথায় তিনি তোমার আকুতি শুনবেন না। ন্যায় বিচারও পাবে না কোনদিন।
সুলতান আইউবী মিগনানা মারিউসের খঞ্জরটি ছুঁড়ে মারেন তার কোলে। নিজে তার কাছে গিয়ে পিঠটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। মুবীকে উদ্দেশ করে বললেন–তাকে বলল, আমি আমার জীবনটা তার হাতে অর্পণ করছি। পিঠে খঞ্জর বিদ্ধ করে আমাকে হত্যা করতে বললো।–খঞ্জরটি হাতে তুলে নেয় মিগনানা মারিউস। নেড়ে-চড়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখে অস্ত্রটি। দৃষ্টি বুলায় সুলতান আইউবীর পিঠে। তারপর উঠে ধীরে ধীরে চলে যায় সুলতান আইউবীর সামনে। তাঁকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিরীক্ষা করে দেখে। হাতটা কেঁপে উঠে মিগনানা মারিউসের। হাতের খঞ্জরটি রেখে দেয় সুলতানের পায়ের উপর। বসে পড়ে হাটু গেড়ে। সুলতানের ডান হাতটা টেনে ধরে চুমু খেয়ে কেঁদে উঠে হাউমাউ করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুবীকে বলে, জিজ্ঞেস করো, ইনি নিজেই কি খোদা, নাকি নিজের বুকের মধ্যে খোদাকে বেঁধে রেখেছেন। তার খোদাকে আমায় একটু দেখাতে বলল।
মিগনানা মারিউসের দু বাহু ধরে তুলে দাঁড় করান সুলতান আইউবী। বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিজ হাতে মুছে দেন তার বিগলিত অশ্রুধারা।
***
মিগনানা মারিউস একজন বিভ্রান্ত মানুষ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার মনে ভরে দেয়া হয়েছিলো প্রচণ্ড ঘৃণা, ইসলামের বিরুদ্ধে ঢেলে দেয়া হয়েছিলো বিষ। কিন্তু অবস্থাবৈগুণ্যে সে নিজ ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে যে বিষয়টি তাকে এমনি এক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামিয়েছে, তা এক প্রকার পাগলামী ও তৃষ্ণা। সুলতান আইউবীর দৃষ্টিতে সে নিরপরাধ। কিন্তু তিনি লোকটাকে মুক্তি না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে মুবী রীতিমত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি মেয়ে, জঘন্য এক গুপ্তচর। যে সাতটি মেয়ে সুদানীদের নিকট, খৃষ্টানদের বার্তা নিয়ে এসেছিলো এবং সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে সুদানীদের বিদ্রোহে নামিয়েছিলো, মুবী তাদের একজন। মুবী ইসলামী সালতানাতের দুশমন, দেশের শত্রু। ইসলামী আইন তাকে ক্ষমা করে না।
মুবী ও মিগনানা মারিউসকে আলী বিন সুফিয়ানের হাতে সোপর্দ করেন সুলতান আইউবী। জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধ স্বীকার করেছে দুজন-ই। স্বীকার করেছে, তারা-ই রসদ কাফেলা লুট করেছে, বন্দী গুপ্তচর মেয়েদের তারা-ই মুক্ত করে নিয়েছে। রক্ষী বাহিনী এবং বালিয়ান ও তার সঙ্গীদেরও হত্যা করেছে তারা-ই।
জিজ্ঞাসাবাদ চলে একটানা তিনদিন। এ সময়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায় মিগনানা মারিউসের মস্তিষ্ক। সে সুলতান আইউবীকে জিজ্ঞেস করে–মুবীকে মুসলমান বানিয়ে আপনার হেরেমে স্থান দিয়েছেন কি? মানদীপ্ত দাস্তান
আজ সন্ধ্যায় আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দেবো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে জবাব দেন সুলতান আইউবী ।
সন্ধ্যার সময় সুলতান আইউবী মিগনানা মারিউসকে সঙ্গে করে খানিক দূরে একস্থানে নিয়ে যান। সেখানে পাশাপাশি বিছানো লম্বা দুটি তক্তা। সাদা চাদর দিয়ে কি যেন ঢেকে রাখা আছে তার উপরে। একটি কোণ ধরে টান দিয়ে চাদরটি সরিয়ে ফেলেন সুলতান আইউবী। অকস্মাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায় মিগনানা মারিউসের চেহারা। চোখের সামনে একটি তক্তায় মুবীর লাশ, অপরটিতে তার সঙ্গীর মৃতদেহ। সুলতান আইউবী মুবীর মাথা ধরে টান দেন সামনের দিকে। ধড় থেকে আলাদা হয়ে সরে আসে মাথাটা। তারপর মিগনানা মারিউসের প্রতি তাকিয়ে বলেন, আমি মেয়েটাকে ক্ষমা করতে পারিনি। তাকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, যাতে রূপের ফাঁদে পড়ে আমি আমার ঈমান হারাই। কিন্তু তার দেহটা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি । এ একটি অপবিত্র দেহ। তবে হ্যাঁ, এখন মেয়েটাকে বেশ ভালো লাগছে। আমি দুআ করি, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন।
কিন্তু আমাকে ক্ষমা করলেন কেন সুলতান! আবেগাপ্লুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে মিগনানা মারিউস।
কারণ, তুমি হত্যা করতে এসেছিলে আমাকে। আর ও এসেছিলো আমার জাতির চরিত্র ধ্বংস করতে। তোমার সঙ্গীটিও বুঝে-শুনে পরিকল্পনা মোতাবেক এসেছিলো মানুষ খুন করতে। আর তুমি এসেছে, আমার রক্ত ঝরিয়ে আল্লাহর দর্শন লাভ করতে। জবাব দেন সুলতান আইউবী।
অল্প কদিন পর-ই সাইফুল্লাহয় পরিণত হয় মিগনানা মারিউস। পরবর্তীতে সুলতান আইউবীর দেহরক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে সে। সুলতান আইউবীর মৃত্যুর পর সাইফুল্লাহ বাকী জীবনের সতেরটি বছর কাটিয়ে দেয় সুলতানের কবরের পার্শ্বে। আজ কেউ জানে না, সাইফুল্লাহর সমাধি কোথায়।