১.৩ সম্রাট ক্লীয়ন

১১.

সম্রাট ক্লীয়ন ডেমারজেলকে সবসময়ই দেখেন, কিন্তু এম্পায়ারের জনগণ তাকে দেখার সুযোগ বলতে গেলে পায়ই না। এভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখার অনেক কারণ। একটা কারণ হলো যে সময় অনেক গড়িয়েছে, কিন্তু তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় নি।

প্রায় বছরখানেক হলো তার সাথে সেলডনের দেখা সাক্ষাৎ হয় না, আর ট্র্যানটরে আসার প্রথম কয়েকটা মাসের পর এভাবে মুখোমুখী বসে একান্তে আলাপ করার সুযোগও হয় নি।

লাসকিন জোরানিউম এর সাথে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের পরিপ্রেক্ষিতে সেলডন এবং ডেমারজেল দুজনেই বুঝতে পারে যে তাদের সম্পর্কটা প্রচার করা উচিত হবে না। আবার ফার্স্ট মিনিস্টারের সাথে হ্যারি সেলডনের সাক্ষাৎ গোপনও রাখা যাবে, আর তাই নিরাপত্তার খাতিরে দুজনেই প্যালেস গ্রাউন্ডের ঠিক বাইরে ডোমস এজ হোটেলের ভাড়া করা একটা বিলাসবহুল কামরায় দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ডেমারজেলকে দেখেই পুরনো স্মৃতিগুলো একসাথে ভিড় জমাল। এখনো ডেমারজেলের চেহারা একই রকম বিষণ্ণ এবং গম্ভীর। তার মুখের সেই পৌরুষ দীপ্ত বলিরেখা এখনো বিদ্যামান। এখনো সে আগের মতোই লম্বা এবং বলিষ্ঠ, একই রকম হালকা লাল চুল। সে ঠিক সুদর্শন নয়, কিন্তু তার গাম্ভীর্য এবং ব্যক্তিত্ব অদ্বিতীয়। সাধারণ মানুষের মনে একজন আদর্শ ফাস্ট মিনিস্টারের যে ছবি আঁকা আছে সে ঠিক তাই, সবার সেরা। সেলডনের মতে তার এই ব্যক্তিত্বই সম্রাটের উপর অর্ধেক কর্তৃত্ব বিস্তার করে রেখেছে, আর এই কারণেই সে প্রভূত্ব বিস্তার করে রেখেছে ইম্পেরিয়াল কোর্ট, এম্পায়ারের উপর।

ডেমারজেল তার দিকে এগিয়ে এল, মুখের গাম্ভীর্যের সামান্যতম বিচ্যুতি না ঘটিয়েই মুখে মৃদু একটা হাসি ধরে রেখেছে।

“হ্যারি,” সে বলল, “তোমাকে দেখে খুশী হয়েছি। ভয় পাচ্ছিলাম তুমি হয়তো আর আসবেই না।”

“আমি আরো বেশী ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আসবেন না, ফার্স্ট মিনিস্টার।”

“ইটো–যদি আসল নাম বলতে তোমার সমস্যা হয়।”

“আমি পারব না। আমার মুখ দিয়ে বেরোবে না। আপনি জানেন।”

“সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। বল। তোমার মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগবে।”

ইতস্ততঃ করতে লাগলেন সেলডন। বিশ্বাস হচ্ছে না যে তার ঠোঁট এবং কণ্ঠ থেকে শব্দগুলো বেরোবে। “ডানীল,” অবশেষে বললেন তিনি।

“আর, ডানীল অলিভো,” ডেমারজেল বলল। “হ্যাঁ, তুমি আমার সাথে ডিনার করবে, হ্যারি। যদি আমি তোমার সাথে ডিনার করি তাহলে আমাকে কিছু খেতে হবে না, যা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক।”

“আনন্দের সাথে, যদিও এরকম মুহূর্তে একা ডিনার করাটা আমার ঠিক মনঃপুত নয়। সামান্য কিছু “

“যা তোমার ভালো লাগে–“

“ঠিক আছে। না করা যাবে না কিন্তু ভাবছি এখানে দুজনের এক সাথে থাকাটা কি ঠিক হবে।”

“হবে। ইম্পেরিয়াল আদেশ। হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি চেয়েছেন বলেই আমি এসেছি।”

“কেন, ডানীল?”

“দুবছর পরে দশ বাৎসরিক গণিত সম্মেলনটা আবার অনুষ্ঠিত হবে। তোমাকে অবাক দেখাচ্ছে। ভুলে গেছো?”

“না, ভুলি নি। তবে আমি ভাবিও নি।”

“এবার অংশ নেবে না? গতবারেরটায় তুমি সবাইকে চমকে দিয়েছিলে।”

“হ্যাঁ, সাইকোহিস্টোরি দিয়ে কিছুটা চমক তৈরি করতে পেরেছিলাম।”

“তুমি সম্রাটকে আগ্রহী করে তুলেছিলে। আর কোনো গণিতবিদ পারে নি।

“সম্রাট নয়, তুমি আগ্রহী হয়েছিলে। তারপর আমাকে ইম্পেরিয়াল ফোর্স এর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাকে নিশ্চিত করতে পেরেছি যে আমি অন্তত এবার সাইকোহিস্টোরি নিয়ে গবেষণা শুরু করতে পারব, তারপরেই তুমি আমাকে এখানে গোপনে কাজ করার সুযোগ করে দাও।”

“গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে তেমন গোপনীয়তা থাকছে না।”

“হ্যাঁ, থাকছে কারণ দায়িত্বটা সাইকোহিস্টোরি আড়াল করে রেখেছে।”

“আহ্, খাবার চলে এসেছে। কিছুক্ষণের জন্য পুরনো বন্ধু হিসেবে অন্য কোনো প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। ডর্স কেমন আছে?”

“চমঙ্কার। আদর্শ স্ত্রী। আমার নিরাপত্তার জন্য তার দুঃশ্চিন্তা নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত আমার সাথে থাকবে।”

“ওটা তার দায়িত্ব।”

“কথাটা আমাকে সে বারবারই মনে করিয়ে দেয়। সত্যি, ডানীল, আমাদের দুজনকে একসাথে থাকার সুযোগ করে দেয়ার জন্য শুধু মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ যথেষ্ট হবে না।”

“ধন্যবাদ, হ্যারি, তবে সত্যি কথা বলতে কি, তোমরা দুজন যে সুখী দম্পতি হতে পারবে আমি তা অনুমান করি নি, বিশেষ করে ডর্স

“তারপরেও যে উপহার দিয়েছ সে জন্য ধন্যবাদ, আসল পরিস্থিতি নিয়ে তোমার আশা যতই সংকীর্ণ হোক না কেন।”

“খুশী হলাম। তবে আরেকটা পুরস্কারের কথা বোধহয় তুমি ভুলে গেছ যার পরিণতি আরো বেশী সন্দেহভাজন–আমার সাথে তোমার সম্পর্ক।”

সেলডন কোনো জবাব দিলেন না, তাই ডেমারজেল তাকে খেতে শুরু করার জন্য ইশারা করল।

কিছুক্ষণ পরে ফর্ক দিয়ে এক টুকরা মাছ উঠিয়ে বললেন, “জিনিসটা কি আমি বুঝতে পারছি না তবে রান্নাটা মাইকোজেনিয়ান।”

“হ্যাঁ, আমি জানি তোমার খুব পছন্দ।”

“মাইকোজেনিয়ানদের অস্তিত্ব এই কারণেই আজও টিকে আছে। একমাত্র কারণ। তবে তোমার কাছে ওদের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। আমার সেটা ভোলা। উচিত নয়।”

“বিশেষ গুরুত্বটাও এখন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওদের পূর্বপুরুষ অনেক অনেক দিন আগে অরোরা গ্রহে বাস করত। ওখানে তারা তিনশ বছরেরও বেশী সময় বাস করে এবং গ্যালাক্সির পঞ্চাশটা গ্রহের লর্ড ছিল। একজন অরোরানই প্রথম আমার ডিজাইন করে আমাকে তৈরি করে। আমি ভুলি নি; সব পরিষ্কার মনে আছে কোনোরকম বিকৃতি ছাড়া তাদের বংশধর মাইকোজেনিয়ানদের চাইতেও নিখুঁত ভাবে। কিন্তু অনেক দিন আগে আমি ওদেরকে ছেড়ে চলে আসি। আমি নিজেই বেছে নেই মানবজাতির জন্য কোন পথটা ভালো হবে এবং আজও সেই পথ অনুসরণ করে চলেছি, যতদূর সম্ভব।”

সেলডন হঠাৎ সচকিত হয়ে বললেন, “আমাদের আলোচনা কেউ শুনে ফেলবে না তো?”

ডেমারজেল কৌতুক বোধ করল, “এখন ভেবে কোনো লাভ হবে না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই। আমি সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করেছি। যখন এসেছ তখন খুব বেশী মানুষ তোমাকে দেখে নি, যাওয়ার সময়ও দেখবে না। যারা দেখবে তারাও অবাক হবে না। গণিত বিষয়ে আমার আগ্রহের কথা সবাই জানে। ইম্পেরিয়াল কোর্টে যারা আমার বন্ধু নয় তারা এই ব্যাপারটাতে ভীষণ মজা পায়। যাই হোক সবাই ধরে নেবে যে আমি আগামী দশবাৎসরিক সম্মেলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি সারার জন্যই এসেছি। সম্মেলন নিয়েই আমি তোমার সাথে আলোচনা করতে চাই।”

“মনে হয় না তোমাকে সাহায্য করতে পারব। শুধুমাত্র একটা বিষয়ই আমি উপস্থাপন করতে পারব–যদিও তা সম্ভব নয়। অংশ নিলেও তা হবে দর্শকদের সারিতে। নতুন কোনো গবেষণা উপস্থাপন করার ইচ্ছা নেই।”

“বুঝতে পেরেছি। তারপরেও একটা কথা শুনলে হয়তো তুমি আগ্রহী হবে, হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি এখনো তোমাকে মনে রেখেছেন।”

“কারণ তুমি তাকে আমার কথা ভুলতে দাও নি।”

“না, আমি সেরকম কিছু করি নি। তবে হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি মাঝে মাঝেই আমাকে অবাক করে দেন। আগামী সম্মেলনের কথা তিনি জানেন এবং গত সম্মেলনে তুমি যা করেছ সেটাও মনে রেখেছেন। সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে তিনি এখনো আগ্রহী। আরো বড় কিছুও ঘটতে পারে, তোমাকে জানিয়ে রাখা উচিত। হয়তো তোমাকে সাক্ষাতের জন্য ডাকবেন, সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোর্ট এটাকে বিরল সম্মান হিসেবে গণ্য করবে–এক জীবনে দুদুবার সম্রাটের সাক্ষাৎ লাভ।”

“ঠাট্টা করছ। সম্রাটের দেখা পেয়ে কি লাভ হবে?”

“যাই হোক না কেন, সাক্ষাতের জন্য ডাকা হলে তুমি প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।–তোমার দুই শিষ্য ইউগো আর রাইখ কেমন আছে?”

“সবই তো জানো। আমার ধারণা আমার উপর সব সময় নজর রাখ তুমি।”

“হ্যাঁ, তা রাখি। তোমার নিরাপত্তার জন্যই কিন্তু তোমার জীবনের খুঁটিনাটি সব বিষয়ের খবর রাখি না। আসলে কঠিন একটা দায়িত্ব পালন করতেই সময় ফুরিয়ে যায় আর আমি সর্বদ্রষ্টাও নই।”

“ডর্স রিপোর্ট করে না?”

“বড় ধরনের সমস্যা হলে তবেই করে, অন্যথায় করে না। সে তার মূল দায়িত্ব। পালন করতেই বেশী সচেষ্ট।”

সেলডন মুখ দিয়ে শব্দ করলেন। “আমার ছেলেরা ভালোই করছে। ইউগোকে। সামলানো দিনে দিনে আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। সে আমার চাইতেও বেশী, সাইকোহিস্টোরিয়ান এবং সম্ভবত তার ধারণা আমি তাকে পিছনে টেনে ধরে রেখেছি। আর রাইখ এমন এক দস্যি ছেলে যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না সবসময়ই তাই ছিল। যখন সে রাস্তার ভবঘুরে ছোকরা ছিল তখন থেকেই সে আমার স্নেহ-মমতা জয় করে নেয় এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যে ডর্সেরও মন জয় করে নিয়েছে। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি ডর্স যদি কখনো আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় শুধুমাত্র একটা কারণেই সে আমাকে ছেড়ে যাবে না–রাইখের প্রতি তার ভালোবাসা।”

সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল ডেমারজেল আর সেলডন আবার বলা শুরু করলেন, “যদি ওয়ির রিশেলি তাকে পছন্দ না করত তাহলে আমি আজকে এখানে থাকতাম না। তখনই মরে যেতাম-” তার দৃষ্টিতে অস্বস্তি ফুটে উঠল। “ঘটনাটা ভাবতে আমার ভালো লাগে না, ডানীল। পুরোপুরি একটা দুর্ঘটনা এবং যার কোনো পূর্বানুমান সম্ভব নয়। সাইকোহিস্টোরি কিভাবে আমাদের সাহায্য করবে?”

“তুমিই তো বলেছিলে যে সাইকোহিস্টোরি কেবল সম্ভাবনা যাচাই করতে পারবে এবং জনগোষ্ঠীর আয়তন হতে হবে অনেক বড়। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির আচরণ বিশ্লেষণ করতে পারবে না।”

“কিন্তু সেই একজন ব্যক্তি যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়–“

“আশা করি তুমি বুঝতে পারবে যে একজন মানুষ কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। এমন কি আমিও না–তুমিও না।”

“হয়তো তোমার কথাই ঠিক। একটা জিনিস অবশ্য বুঝতে পেরেছি যে আমি নিজেকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ মনে করি নি, বোধ বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে দেয়ার মতো করে নিজেকে কখনো অতিমানব ভাবিনি। কিন্তু তুমি গুরুত্বপূর্ণ আর এই বিষয়েই আমি কথা বলতে এসেছি। যতদূর খোলাখুলি আলোচনা করা যায় ততই ভালো। আমাকে জানতেই হবে।”

“কি জানতে হবে?” বেয়ারা এসে টেবিল পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। একই সথে কামরার আলোও কমে গেল। মনে হলো যেন দেয়ালগুলো আরো কাছে চলে এসেছে। নিরাপত্তার অনুভূতিটা আরো প্রখর করে তোলার জন্য যথেষ্ট।

“জোরানিউম,” দাঁতের ফাঁক দিয়ে শব্দগুলো সেলডন এমনভাবে বললেন যেন শুধু নামটা বলাই যথেষ্ট।

“ও, হ্যাঁ।”

“তুমি ওর কথা জানো?”

“অবশ্যই। না জানলে চলবে?”

“বেশ, আমিও জানতে চাই।”

“কি জানতে চাও?”

“ডানীল, শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না। ও কি বিপজ্জনক?”

“অবশ্যই বিপজ্জনক। তোমার কোনো সন্দেহ আছে?”

“আমি বলতে চাই তোমার জন্য? তোমার ফার্স্ট মিনিস্টারশিপের জন্য?”

“আমি ঠিক সেটাই বোঝাচ্ছি। এই কারণেই সে বিপজ্জনক।”

“এবং তুমি তাকে থামাচ্ছ না।”

সামনে ঝুকল ডেমারজেল, টেবিলের উপর দুজনের মাঝখানে বাঁ হাতের কনুই রাখল। “হ্যারি, অনেক ঘটনাই ঘটার জন্য আমার অনুমতির অপেক্ষা করে না। এই বিষয়ে আমরা দার্শনিক হতে পারি। হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি প্রথম ক্লীয়ন ক্ষমতায় এসেছেন প্রায় আঠার বছর হয়ে গেল। শুরু থেকেই আমি ছিলাম তার চীফ অব স্টাফ, তারপর হয়েছি ফার্স্ট মিনিস্টার। এর আগে তার বাবার শাসনামলের শেষ বছরগুলোতেও আমি দায়িত্বে ছিলাম যদিও এতটা ব্যাপকভাবে তা পালন করতে হয় নি। দীর্ঘ সময় এবং কোনো ফার্স্ট মিনিস্টারেরই এতো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকার নজির নেই।”

“তুমি সাধারণ কোনো ফাস্ট মিনিস্টার নও, ডানীল, এবং কথাটা নিজেও জানো। সাইকোহিস্টোরি যখন বাস্তবে পরিণত হওয়ার পথে সেই সময় তোমাকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। হাসবে না, এটাই সত্যি, আমাদের যখন প্রথম দেখা হয়, আট বছর আগে, তুমি বলেছিলে এম্পায়ারে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই মনোভাব কি এখন পাল্টে গেছে?”

“না, অবশ্যই না।”

“বরং ভাঙ্গন এখন আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ঠিক?”

“হ্যাঁ, ঠিক, যদিও আমি তা ঠেকানোর চেষ্টা করছি।”

“এখন তুমিই যদি না থাকে, তাহলে কি হবে? জোরানিউম তোমার বিরুদ্ধে এম্পায়ারকে খেপিয়ে তুলছে।”

“ট্র্যানটর, হ্যারি, ট্র্যানটর। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো এখনো শান্ত এবং আমার আদেশ মেনে চলছে। এমন কি বিপর্যস্ত অর্থনীতি এবং হ্রাসপ্রাপ্ত বাণিজ্য সত্ত্বেও।”

“কিন্তু ট্র্যানটরেই ছোট বড় সব ঘটনা হিসাবে রাখতে হয়। ট্র্যাটর ইম্পেরিয়াল ওয়ার্ল্ড যেখানে আমরা বাস করছি, এম্পায়ার এর রাজধানী, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রহ, প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং এই গ্রহই তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। যদি ট্র্যানটর তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তুমি কোনো ভাবেই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না।”

“আমি একমত।”

“তাহলে তুমি চলে গেলে কে দায়িত্ব নেবে আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোকে সামলানোর, কে পতনের গতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠা এবং এম্পায়ারে চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঠেকাবে?”

“নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়।”

“কাজেই তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করছ। ইউগোর দৃঢ় বিশ্বাস তুমি ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি এবং নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। ইউগোর অন্তর্জান তাকে এই কথা বলছে। ডর্স ঠিক একই কথা বলেছে এবং যুক্তি হিসেবে আমাকে বুঝিয়েছে তিনটা বা চারটা–চারটা–“

“রোবটিক্স আইন,” সেলডনের মুখে কথা যুগিয়ে দিল ডেমারজেল।

“তরুণ রাইখ জোরানিউমের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট–যেহেতু সে একজন ডাহুলাইট। আর আমি–আমি দ্বিধাগ্রস্ত, তাই তোমার কাছে আশ্বাস পাব বলে এসেছি। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রণে।”

“তাহলে তো চিন্তার কিছু ছিল না। যাই হোক আমি তোমাকে আশ্বাস দিতে পারছি না। আমি সত্যিই ভয়ংকর বিপদে আছি।”

“তুমি কিছুই করছ না?”

“না। আমি জনগণের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং জোরানিউমের বক্তব্য গুরুত্বহীন প্রমাণের চেষ্টা করছি। তা না হলে এতদিনে আমাকে হয়তো ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হতো। কিন্তু যা করছি তা যথেষ্ট নয়।”

সেলডন খানিকটা ইতস্ততঃ করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, “আমার বিশ্বাস জোরানিউম আসলে মাইকোজেনিয়ান।”

“তাই নাকি?”

“আমার ধারণা। তথ্যটাকে তার বিরুদ্ধে কাজে লাগাব ভেবেছিলাম, কিন্তু একটা অন্ধবিশ্বাসে ইন্ধন যোগাতেও আমার রুচিতে বাধছে।”

“তা না করে খুবই বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। অনেক পদক্ষেপই নেয়া যায়, কিন্তু তার পাশাপাশি যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে সেগুলো আমরা চাই না। সত্যি কথা বলতে কি, হ্যারি, দায়িত্ব ছেড়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই–যদি উপযুক্ত একজন উত্তরসূরি পাওয়া যায় যে ঠিক আমার মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে পতনের গতিটাকে যতদূর সম্ভব ধীর করে দিতে পারবে। অন্যদিকে যদি জোরানিউম আমার স্থলাভিষিক্ত হয় সেটা হবে আমার মতে চরম সর্বনাশ।”

“সেক্ষেত্রে তাকে থামানোর জন্য যা করব তার সবই ঠিক।”

“পুরোপুরি ঠিক নয়। জোরানিউমকে থামিয়ে আমি ক্ষমতায় টিকে থাকলেও এম্পায়ারে অরাজকতা শুরু হতে পারে। কাজেই আমি এমন কিছু করব না যাতে জোরানিউম এর আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে, আমি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারব কিন্তু তার ফলে এম্পায়ারের পতন ত্বরান্বিত হবে। আমি এমন কোনো উপায় এখনো খুঁজে পাই নি যাতে জোরানিউম ধ্বংস হবে এবং এম্পায়ারে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়বে না।”

“মিনিমালিজম,” ফিস ফিস করে বললেন সেলডন।

“মাফ করবে?”

“ডর্স বলছিল তুমি ও মিনিমালিজম দ্বারা সীমাবদ্ধ।”

“আসলেই তাই।”

“তাহলে আজকের সাক্ষাৎকার পুরোপুরি ব্যর্থ, ডানীল।”

“অর্থাৎ তুমি আমার কাছে আশ্বাস পেতে এসেছিলে কিন্তু পাও নি।”

“বোধহয় তাই।”

“কিন্তু আমি তোমার সাথে দেখা করেছি কারণ আমিও আশ্বাস পেতে চেয়েছিলাম।”

“আমার কাছ থেকে?”

“সাইকোহিস্টোরি থেকে, যা একটা নিরাপদ উপায় তৈরি করে দিতে পারে, আমি যা করতে পারি নি।”

বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সেলডন। “ডানীল, সাইকোহিস্টোরি এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায় নি।”

ফার্স্ট মিনিস্টারের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, “তুমি আট বছর সময় পেয়েছ, হ্যারি।”

“আট বছর কেন আটশ বছর পরেও হয়তো সাইকোহিস্টোরি এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। এটা একটা দুঃসাধ্য কাজ।”

“একটা নিখুঁত কৌশল তৈরি করে ফেলেছ তা আমি আশা করি নি, কিন্তু তুমি হয়তো কিছু প্রাথমিক ধারণা, কাঠামো বা মূলনীতি তৈরি করতে পেরেছ যা আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। হয়তো নিখুঁত হবে না কিন্তু অনুমানে কাজ করার চেয়ে তো ভালো।”

“আট বছর আগে যা ছিল তার চেয়ে একটুও বেশী না,” কাতর স্বরে বললেন সেলডন। “সমস্যাটা এখানেই। তোমাকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে এবং জোরানিউমকে দমন করতে হবে এমন উপায়ে যেন এম্পায়ারের স্থিতিশীলতা যতদিন সম্ভব ধরে রাখা যায়। যেন সাইকোহিস্টোরির জন্য আমি পর্যাপ্ত সময় পাই। এখন সাইকোহিস্টোরি ছাড়া এই কাজটা করা যাবে না, তাই কি?”

“তাই তো মনে হচ্ছে।”

“তাহলে আমরা একটা সমস্যার চক্র নিয়ে আলোচনা করছি। আর এদিকে এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”

“যদি না অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে। যদি না তুমি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটাও।”

“আমি? ডানীল, সাইকোহিস্টোরি ছাড়া আমি কি করব?”

“আমি জানি না, হ্যারি।”

চরম হতাশা নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন সেলডন।

.

১২.

পরের কয়েকটা দিন ডিপার্টমেন্টের কাজ থেকে বিরত থাকলেন হ্যারি সেলডন। খবর সগ্রহের জন্য কম্পিউটারটাকে তিনি নিউজ গ্যাদারিং মোড এ সেট করে রাখলেন।

পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের দৈনিক খবরগুলো সামলানোর মতো উন্নত কম্পিউটারের সংখ্যা খুবই কম। ইম্পেরিয়াল হেডকোয়ার্টারে অনেকগুলো আছে কারণ ওখানে থাকাটা জরুরী। অল্প কয়েকটা আউটার ওয়ার্ল্ডের রাজধানী গ্রহে এই ধরনের কম্পিউটার থাকলেও বেশীরভাগই ট্রানটরের কেন্দ্রীয় বার্তাসংস্থার সাথে হাইপার কানেকশন নিয়েই সন্তুষ্ট।

গুরুত্বপূর্ণ গণিত বিভাগের একটা কম্পিউটার যদি যথেষ্ট আধুনিক হয় তাহলে সেটাকে খবর সংগ্রহের স্বাধীন উৎসে পরিণত করা কোনো ব্যাপার না এবং সেলডন অত্যন্ত কৌশলে নিজের কম্পিউটারে এই ব্যবস্থাটা তৈরি করে নিয়েছেন। তার সাইকোহিস্টোরির জন্য এটা প্রয়োজন, যদিও যথার্থ কারণেই ব্যাপারটা অন্যদের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন তিনি।

এম্পায়ারের কোনো গ্রহে অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে কম্পিউটার সেটা রিপোর্ট করবে। নিষ্প্রভ একটা সাংকেতিক আলো জ্বলে উঠবে এবং সেলডন সহজেই খবরটা বের করে নিতে পারবেন। সাংকেতিক আলোটা কালে ভদ্রে হয়তো একবার জ্বলে উঠে কারণ ‘অস্বাভাবিক’ শব্দটার সংজ্ঞা অত্যন্ত সীমিত করে রাখা হয়েছে, অথচ অনুসন্ধানের পরিধি অনেক ব্যাপক।

এই ব্যবস্থাটা না থাকলে ক্রমাগত বিভিন্ন গ্রহের খবরগুলোতে চোখ বুলাতে হতো–অবশ্যই পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের না হয়তো বা মাত্র কয়েক ডজন গ্রহের। চরম হতাশাজনক এবং জঘন্যরকম বিরক্তিকর একটা কাজ, কারণ এমন একটাও গ্রহ নেই যেখানে প্রত্যহ হাজারো রকমের ঘটনা ঘটছে না। অগ্ন্যুৎপাত, বন্যা, কোননা ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং অবশ্যই দাঙ্গা। গত এক হাজার বছরে এমন একটা দিনও বের করা যাবে না যেদিন কমপক্ষে একশটা বা আরো বেশী গ্রহে দাঙ্গা হয় নি।

স্বাভাবিক ভাবে এই বিষয়গুলো বিবেচনা না করলেও হয়। অগ্ন্যুৎপাত নিয়ে মানুষ যতটুকু উদ্বিগ্ন হয় দাঙ্গা নিয়ে তার বেশী উদ্বিগ্ন হয় না যেহেতু দুটো ঘটনাই প্রতিটি গ্রহে নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। বরং যদি এমন দিন আসে যেদিন একটা। গ্রহেও দাঙ্গার কোনো খবর নেই তাই হবে অস্বাভাবিক ঘটনা এবং সেটার প্রতিই গভীর মনযোগ দিতে হবে।

মনযোগের বড় অভাব বোধ করছেন সেলডন। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোর দুর্ভোগ এবং প্রাত্যহিক ঘটনা অঘটনা শান্ত মহাসমুদ্রের বুকে অতি ক্ষুদ্র একটা স্রোতের মতো–তার বেশী কিছু না। গত আট বছর কেন আশি বছরের ইতিহাস ঘেঁটেও এম্পায়ার ভেঙ্গে পড়ার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ বের করতে পারেন নি সেলডন। অথচ ডেমারজেল (ডেমারজেলের অনুপস্থিতিতে সেলডন তাকে ডানীল নামে ভাবতে চান ) বলে যে ভাঙ্গন চলছেই এবং এমন এক কৌশলী স্পর্শে সে এম্পায়ারের নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করে চলেছে যা সেলডন অনুকরণ করতে পারবেন না। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সাইকোহিস্টোরি তৈরি করতে পারছেন।

ব্যাপারটা হয়তো এমন যে ভাঙ্গনের গতিটা অত্যন্ত ধীর হওয়ার কারণে একটা বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া তা বোঝা যাবে না। অনেকটা বলা যায় যে একটা আবাস স্থল ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে অথচ ক্ষয়ে যাওয়ার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই শুধু একদিন হঠাৎ করে সেই আবাসস্থলের ছাদ ভেঙ্গে পড়বে।

আবাসস্থলের ছাদটা কখন ভেঙ্গে পড়বে? এটাই হচ্ছে আসল সমস্যা এবং সেলডনের কাছে কোনো উত্তর নেই।

মাঝে মাঝে সেলডন ট্র্যানটরের খবরগুলোতে চোখ বুলান। এখানের খবরগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কারণ, গ্যালাক্সিতে ট্রানটরের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশী, চল্লিশ বিলিয়ন। দ্বিতীয় কারণ, এই গ্রহ তার আটশ সেক্টর নিয়ে নিজেই একটা মিনি এম্পায়ার। তৃতীয় কারণ, সরকারের প্রশাসনিক কার্যাবলী এবং ইম্পেরিয়াল পরিবারের কার্যাবলীর বিষয়ে অবশ্যই নজর রাখতে হবে।

যাই হোক, যে খবরটা সেলডনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেটা ডাহল সেক্টরের। ডাল সেক্টর কাউন্সিলের সর্বশেষ নির্বাচনে পাঁচজন জোরামাইট নির্বাচিত হয়েছে। সাংবাদিকের ভাষ্যমতে এই প্রথম জোরানুমাইটরা কোনো সেক্টরের প্রশাসনিক ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত হলো।

অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডাহল জোরানুমাইটদের এক নম্বর ঘাঁটি। কিন্তু সেলডন উদ্বিগ্ন হলেন কারণ ঘটনাটা উঁইফোড়ের মতো গজিয়ে উঠা নতুন রাজনীতিবিদের ক্রমশ: সবল হয়ে উঠার সুস্পষ্ট নিদর্শন। খবরটার একটা মাইক্রোচিপ তৈরি করার নির্দেশ দিলেন এবং সন্ধ্যায় সেটা নিয়েই বাড়ি ফিরলেন।

তিনি ঢুকতেই কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো রাইখ এবং একটা ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল। “মায়ের কিছু রেফারেন্স ম্যাটেরিয়াল তৈরি করে দিচ্ছিলাম।” সে বলল।

“তোমার নিজের কাজের কি খবর?”

“শেষ, বাবা। সব শেষ।”

“চমৎকার।–এটা দেখ।” চিপটা মাইক্রো প্রজেক্টরে ঢোকানোর আগে রাইখকে দেখালেন তিনি।

চোখের সামনে বাতাসে ঝুলে থাকা খবরটা কয়েক পলক দেখল রাইখ। তারপর বলল, “আমি জানি।”

“তুমি জানো?”

“অবশ্যই। আমি ডাহুলের সব খবরই রাখি। হাজার হোক আমার হোম সেক্টর।”

“তোমার কি মত?”

“আমি অবাক হই নি। ট্র্যানটরের বাকী সবার ধারণা ডাল নোংরা আবর্জনা। তাহলে ওরা জোরানিউমকে সমর্থন দেবে না কেন?”

“তুমিও সমর্থন কর?”

“আসলে–“ মুখ বাঁকা করে কিছুক্ষণ ভাবল রাইখ। “স্বীকার করছি যে জোরানিউম এর কিছু বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে। সে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে। তাতে দোষের কি হলো?”

“কিছুই না–যদি সে আসলেই তা চায়, যদি সে এই ব্যাপারে সৎ হয়। যদি না সে শুধুমাত্র ভোট আদায়ের জন্য এই কথাগুলো বলে থাকে।”

“তোমার কথায় যুক্তি আছে, বাবা, কিন্তু অধিকাংশ ডাহ্‌লাইট সম্ভবত এটাই ভেবেছে যে : তাদের হারানোর কিছু নেই। আইনে বলা থাকলেও এই মুহূর্তে তারা সমান অধিকার ভোগ করছে না।”

“ব্যাপারটা আলোচনা সাপেক্ষ।”

“যে মানুষগুলোর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে তাদেরকে তুমি এই কথা বলে শান্ত করতে পারবে না।”

দ্রুত চিন্তা করছেন সেলডন। খবরটা দেখার পর থেকেই ভাবছেন। বললেন, “রাইখ, আমাদের সাথে চলে আসার পর তুমি আর কখনো ডালে যাও নি, গিয়েছ?”

“অবশ্যই গিয়েছি, পাঁচ বছর আগে তোমার সাথে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” হাত নেড়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন সেলডন। “ওটা হিসাবের বাইরে। আমরা একটা ইন্টারসেক্টর হোটেলে উঠেছিলাম যা মোটেই ডাহ্‌লাইট ছিল না। আর যতদূর মনে পড়ে তোমার মা তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যও রাস্তায় বেরোতে দেয় নি। তখন তোমার বয়স ছিল পনের। এখন ডাহলে যেতে তোমার কেমন লাগবে, একা, পুরোপুরি নিজ দায়িত্বে তোমার বয়স এখন বিশ?”

জিভ বের করে ঠোঁট ভেজালো রাইখ। “মা যেতে দেবে না।”

“আমিও হাসিমুখে কথাটা তাকে বলতে পারব না, আবার তার কাছে অনুমতি চাওয়ারও ইচ্ছা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে : তুমি কি আমার জন্য কাজটা করবে?”

“অবশ্যই। পুরনো জায়গাটার এখন কি অবস্থা সেটা দেখা হবে আবার কৌতূহলও নিবৃত্ত হবে।”

“সময় বের করতে পারবে? পড়ালেখার ক্ষতি হবে না?”

“কোনো সমস্যা নেই। হয়তো একটা সপ্তাহ মিস্ করব। আর তুমি আমার জন্য লেকচারগুলো রেকর্ড করে রাখলে ফিরে এসে পুষিয়ে নিতে পারব। যত যাই হোক আমার বাবা ফ্যাকাল্টির সদস্য–অবশ্য যদি ওরা তোমাকে এরইমধ্যে বরখাস্ত না করে থাকে।”

“এখনো করে নি। তবে আমার মনে হয় না এটা তোমার জন্য আনন্দ ভ্রমণ হবে।”

“সেরকম ভেবে থাকলে আমি সত্যিই অবাক হব। আমার মনে হয় না, বাবা, তুমি আসলে জান আনন্দ ভ্রমণ কি জিনিস। শব্দটা যে বলেছ তাতেই ভীষণ অবাক হয়েছি।”

“মশকরা করো না। আমি চাই ওখানে গিয়ে তুমি লাসকিন জোরানিউমের সাথে দেখা করবে।”

রাইখের দৃষ্টি কেঁপে উঠল। “তা কি করে সম্ভব। সে কখন কোথায় থাকবে আমি কিভাবে জানব।”

“সে ডাহুলে যাচ্ছে। নতুন জোরামাইট সদস্যদের নিয়ে ডাল সেক্টর কাউন্সিলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সঠিক দিন তারিখটা আমরা জেনে নেব। তোমাকে তার দুএকদিন আগে গেলেই চলবে।”

“তারপর ওর সাথে কিভাবে দেখা করব? আমার তো মনে হয় না দেখা করার সুযোগ সে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখবে।”

“আমারও তা মনে হয় না, কিন্তু ব্যাপারটা আমি তোমার উপর ছেড়ে দিচ্ছি। এই কাজগুলো কিভাবে করতে হয় সেটা বারো বছর বয়সে খুব ভালো করেই জানতে। আশা করি আরামে থেকে থেকে কৌশলগুলো ভুলে যাও নি।”

হেসে ফেলল রাইখ। “বোধহয় ভুলি নি। যাই হোক, দেখা করতে পারলাম। তারপর?”

“যতটুকু পারো তথ্য বের করবে। ওর আসল পরিকল্পনা কি। কি করতে চাইছে।”

“তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর সে আমাকে সব কথা বলবে?”

“বললে অবাক হব না। তুমি এমন এক বদমাশ ছেলে যে খুব সহজেই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার কৌশলটা জানেনা। এই ব্যাপারেই কথা বলা যাক।”

দুজনে অনেকবার পুরো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করল।

বিষণ্ণ বোধ করছেন সেলডন। বুঝতে পারছেন না এই পরিকল্পনা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু এই বিষয়ে ইউগো, ডেমারজেল বা (সবচেয়ে বড় কথা) ডর্সের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই। তারা হয়তো বাধা দেবে। হয়তো তাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে এই পদক্ষেপ চরম বোকামী এবং তিনি এই প্রমাণ চান না। তার কাছে মনে হচ্ছে যে পরিকল্পনা তিনি করেছেন সেটাই বিপদ থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ। তিনি তাতে কোনো বাধা বিপত্তি মেনে নেবেন না।

কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো পথ কি আসলেই আছে? সেলডনের দৃঢ় বিশ্বাস একমাত্র রাইখই জোরানিউম এর বিশ্বাস অর্জন করে তার কাছাকাছি যেতে পারবে, কিন্তু রাইখকে নির্বাচন করা কি ঠিক হয়েছে? সে একজন ডালাইট এবং জোরানিউমের প্রতি তার সমব্যদনা রয়েছে। তাকে সেলডন কতখানি বিশ্বাস করতে পারবেন?

এগুলো তিনি কি ভাবছেন! রাইখ তার সন্তান এবং রাইখকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটে নি।

.

১৩.

নিজ ধারণার ফলপ্রসূতা নিয়ে সেলডনের মনে যতই সন্দেহ থাকুক না কেন, যতই ভয় পান না কেন যে এতে হয়তো পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠবে, রাইখের বিশ্বস্ততা নিয়ে তার মনে কষ্টদায়ক যত সন্দেহই থাক না কেন, একটা বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই–সেটা হলো যে কাজটা তিনি করে ফেলেছেন সেটার ব্যাপারে ডর্সের মনোভাব।

তিনি হতাশ হলেন না–বোধহয় এই শব্দটাই তার মনের প্রকৃত অনুভূতি প্রকাশের জন্য সঠিক।

অন্যদিকে কিছুটা হতাশ তাকে হতেই হলো, কারণ ডর্স রেগে চীৎকার বা উগ্র ধরনের কিছু করল না। কেন যেন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে ডর্স হয়তো ঠিক সেরকমই কিছু করবে এবং তার জন্য মনে মনে প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন।

কিন্তু তিনি কিভাবে জানবেন? ডর্স অন্য মেয়েদের মতো নয় এবং তিনি তাকে কখনো সত্যিকার অর্থে রাগতে দেখেন নি। বোধহয় রাগ বলতে কোনো বস্তু তার ভেতরে নেই–অথবা তার কোন আচরণটাকে তিনি সত্যিকার রাগ বলে ধরে নেবেন।

বরং সে নিচু কণ্ঠে শীতল দৃষ্টিতে তার মনোভাব ব্যক্ত করল। “তুমি রাইখকে ডালে পাঠিয়েছ? একা?” ধীরে ধীরে, প্রশ্নবোধক ভঙ্গীতে।

শীতল কণ্ঠস্বরের সামনে মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন সেলডন। তারপর দৃঢ়তার সাথে বললেন, “বাধ্য হয়েই পাঠিয়েছি। প্রয়োজন আছে।”

“আমাকে বুঝতে দাও। তুমি ওকে এমন জায়গায় পাঠিয়েছ যেখানে সব চোর, গুন্ডা, খুনে বদমাশ, সব দাগী আসামী।”

“ডর্স! তুমি যখন এভাবে কথা বল তখন আমি রাগ সামলে রাখতে পারি না। এই বিশেষনগুলো ব্যবহার করে শুধু অন্ধ বিশ্বাস ছড়ানো যায়।”

“তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে যে বর্ণনা দিয়েছি ডাল তার চেয়ে ভালো?”

“অবশ্যই। ডাহলে দাগী আসামী আছে, বস্তি আছে। সেটা আমি ভালো করেই জানি। আমরা দুজনেই জানি। কিন্তু ডালের সবাই তো এক রকম নয়। সব জায়গাতেই অপরাধী আর বস্তি আছে। এমন কি ইম্পেরিয়াল সেক্টর আর স্ট্রিলিংয়েও।”

“কিন্তু তার একটা সীমা আছে, আছে না? প্রতিটি গ্রহেই ব্যাপকহারে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, প্রতিটি সেক্টরেই হচ্ছে, এর মধ্যে ডাহল হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ, অস্বীকার করতে পারবে? কম্পিউটারে পরিসংখ্যানটা তুমি নিজেই দেখে নিতে পার।”

“কোনো দরকার নেই। ডাহ্ল ট্রানটরের দরিদ্রতম সেক্টর। দারিদ্র, দুর্ভোগ আর অপরাধের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

“অথচ ছেলেটাকে তুমি একা পাঠিয়েছ? তুমি ওর সাথে যেতে পারতে, আমাকে বলতে পারতে, ওর স্কুলের বন্ধুদের বলতে পারতে। ছেলেগুলো ছুটি কাটানোর সুযোগ পেলে খুশি হতো।”

“যে কাজে ওকে পাঠিয়েছি তার জন্য একা যাওয়াই দরকার।”

“কি কাজে পাঠিয়েছ?”

সেলডন মুখ গোমড়া করে রাখলেন। জবাব দিলেন না।

“ব্যাপারটা তাহলে শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াল? তুমি আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?”

“আমি একটা জুয়া খেলছি। আমাকে একাই ঝুঁকি নিতে হবে। তোমাকে বা অন্য কাউকে এতে জড়ানো যাবে না।”

“কিন্তু তুমি কোনো ঝুঁকি নিচ্ছ না, নিচ্ছে রাইখ।”

“সেও কোনো ঝুঁকি নিচ্ছে না,” বিরক্ত সুরে বললেন সেলডন। “ওর বয়স এখন বিশ, তরুণ, শক্তিশালী এবং গাছের গুঁড়ির মতো সবল। আমি এখানে গম্বুজের নিচে যে ধরনের দুর্বল গাছ জন্মানো হয় তার কথা বলছি না, বলছি হ্যাঁলিকনের জঙ্গলে যে শক্তিশালী গাছ জন্মায় সেগুলোর কথা এবং সে একজন টুইস্টার।”

“তুমি আর তোমার টুইস্টিং,” আগের মতোই ঠান্ডা সুরে বলল ডর্স। “তুমি কি মনে কর এতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। ডাহ্‌লাইটদের কাছে ছুরি থাকে। প্রত্যেকের কাছেই। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ওরা ব্লাস্টারও রাখে।”

“ব্লাস্টারের কথা আমি জানি না। এই ক্ষেত্রে আইন অত্যন্ত কড়া। কিন্তু ছুরির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে রাইখের কাছেও একটা আছে। সে এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়েও পকেটে ছুরি নিয়ে চলাফেরা করে যেখানে আইন আরো বেশী কড়া। তোমার কি মনে হয় ডাহলে যাওয়ার সময় সে নিজের কাছে কোনো ছুরি রাখবে না?”

ডর্স কোনো জবাব দিল না।

সেলডন নিজেও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর ডর্সের মনগলানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, “শোনো, তোমাকে আমি এইটুকুই বলতে পারি। জোরানিউম ডাহুলে যাচ্ছে এবং আশা করছি রাইখ তার সাথে দেখা করতে পারবে।”

“ওহঃ রাইখের কাছ থেকে তুমি কি আশা কর। জোরানিউমকে ভ্রষ্ট রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান দেবে তারপর তাকে মাইকোজেনে ফিরে যেতে রাজী করাবে?”

“ডর্স, এভাবে রাগ করলে আলোচনা করা বৃথা।” মুখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। জানালা দিয়ে বাইরে গম্বুজের নিচের ধূসর-নীল আকাশে চোখ রাখলেন। “আমি আশা করি–“ কণ্ঠস্বর খানিকটা ম্লান হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য–“যে সে এম্পায়ার রক্ষা করবে।”

“সত্যি কথা বলতে কি এই কাজটা অনেক সহজ।”

সেলডন আবার দৃঢ়তা ফিরে পেলেন। “এটাই আমি আশা করি। তোমার কাছে কোনো সমাধান নেই, ডেমারজেলের কাছে নেই। বরং সে দায়িত্বটা আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। আমি একটা সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করছি আর এই কারণেই রাইখকে ডাহুলে যেতে হয়েছে। তুমি তো জানো খুব সহজেই যে কোনো মানুষের স্নেহ মমতা এবং বিশ্বাস অর্জন করে নিতে পারে রাইখ। ওর এই গুণটা আমাদের উপর কাজ করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জোরানিউমের উপরেও করবে। আমার ধারণা সঠিক হলে অচিরেই সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে।”

ডর্সের চোখদুটো খানিকটা বড় হলো। “তাহলে কি এখন এই কথা বলবে যে তুমি সাইকোহিস্টোরির সাহায্য নিয়ে কাজ করছ।”

“না। তোমাকে মিথ্যে কথা বলব না। এখনো আমি সাইকোহিস্টোরি প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা মোকাবেলার মতো পর্যায়ে পৌঁছাই নি, কিন্তু ইউগো অনবরত ইনটুইশন এর কথা বলে এবং আমারও তা আছে।”

“ইনটুইশন! সেটা কি? বুঝিয়ে বল।”

“খুব সহজ। ইনটুইশন এক ধরনের শিল্প, একেক মানুষের ইনটুইশন একেক রকম হয়। মূলত: এটা একটা প্রক্রিয়া যার সাহায্যে অপরিমিত তথ্য বা সম্পূর্ণ বিপথগামী তথ্য থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।”

“তুমি তাই করেছ?”

দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলেন সেলডন, “হ্যাঁ।”

কিন্তু মনের কোণে যে আশংকা তৈরি হচ্ছে সেটা তিনি ডর্সের সাথে আলোচনা করতে সাহস পেলেন না। মানুষের বিশ্বাস অর্জনের যে ক্ষমতা রাইখের আছে যদি তা নষ্ট হয়ে যায়? অথবা যদি সবচেয়ে খারাপটাই ঘটে, সে একজন ডালাইট এই বোধটাই যদি তার ভেতর প্রবল হয়ে উঠে?

.

১৪.

বিলিবটনের তুলনা শুধু বিলিবটন–নোংরা, অগোছালো, অন্ধকার, কুটিলতাপূর্ণ বিলিবটন। চারপাশে অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ একই সাথে প্রাণশক্তিতে ভরপুর। রাইখের বিশ্বাস এমন বৈসাদৃশ্য ট্র্যানটরের আর কোথাও মিলবে না। সম্ভবত এম্পায়ারের আর কোথাও মিলবে না, যদিও সে কখনো ট্র্যানটর ছাড়া অন্য কোনো গ্রহ দেখে নি।

এই শহরটাকে শেষবার দেখেছে যখন তার বয়স বারো বছরের বেশী হবে না, অথচ মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে আগের মতোই আগের মতোই লাজুক এবং বেপরোয়া; মিথ্যে অহংকার এবং একই সাথে বাকী সবকিছুর প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে চলেছে; পুরুষদের বৈশিষ্ট্য ঘন কালো গোফ আর মেয়েদের বস্তার মতো এক ধরনের পোষাক যা রাইখের বর্তমান অভিজ্ঞ চোখে অনেক বেশী নোংরা মনে হলো।

এই পোষাকে মেয়েরা কেমন করে ছেলেদের আকৃষ্ট করে?-বোকার মতো প্রশ্ন। মাত্র বারো বছর বয়সেই রাইখের পরিস্কার ধারণা ছিল পোষাকগুলো কত সহজে এবং দ্রুত খুলে ফেলা যায়।

অলস পায়ে ফুটপাতের পাশে সারিবদ্ধ দোকানগুলোর জানালার সামনে দিয়ে হাঁটছে রাইখ। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে এই জায়গাটা সে চিনত, আশে পাশে যে মানুষগুলো আছে তাদেরকে হয়তো সে চিনতে পারছে যাদের বয়স আরো আট বছর বেড়েছে। এদের কেউ কেউ হয়তো তার ছোটবেলার বন্ধু ছিল, দুএকজনের নাম ও মনে পড়ল। আসল নাম নয়, প্রত্যেকেরই একটা করে ডাক নাম। দেয়া হতো। সেই নামগুলো। একজনেরও আসল নাম মনে করতে পারল না।

সত্যি কথা বলতে কি তার স্মৃতির ব্যবধান অনেক বিশাল। আট বছর যে খুব বেশি সময় তা নয় কিন্তু তা বিশ বছর বয়সী কোনো তরুণের জীবনের পাঁচ ভাগের দুই অংশ। তাছাড়া বিলিবটন ছাড়ার পর জীবনটা এমনভাবে বদলে গেছে যে পুরনো স্মৃতিগুলো অনেক দিন আগে দেখা কোনো স্বপ্নের মতো বিবর্ণ মনে হয়।

তবে গন্ধটা এখনো আছে। অত্যন্ত নোংরা এবং নিচু মানের একটা বেকারীর সামনে থামল সে, বাতাসে ছড়ানো কোকোনাট-আইসিং এর গন্ধটা প্রাণ ভরে উপভোগ করল। আর কোথাও ঠিক এই ঘ্রাণটা সে পায় নি, পাবে না। যতই আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করুক না কেন ডালের মতো কোকোনাট-আইসিং আর কেউ বানাতে পারে না।

নিজেকে সামলাতে পারল না রাইখ। দরকারই বা কি। তার কাছে ক্রেডিট আছে এবং সাথে ডর্স নেই। থাকলে হয়তো নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, অরুচিকর এসব বলে মাথা খারাপ করে দিত। পুরনো দিনগুলোতে পরিষ্কার পরিচ্ছনতা নিয়ে কে মাথা ঘামাত?

দোকানের ভেতরে নিষ্প্রভ আলো, কিছুটা সময় লাগল চোখ সইয়ে নিতে। কিছু নিচু টেবিল এবং নোংরা চেয়ার, চারপাশে ছড়ানো, কোনো একটা পানীয় নিয়ে খানিকটা অলস সময় কাটানোর উপযুক্ত পরিবেশ। একজন মাত্র তরুণ একটা টেবিলে বসে আছে, সামনে একটা খালি কাপ। পরনে সাদা টি শার্ট যা এক সময় হয়তো সাদা ছিল এবং নিঃসন্দেহে পরিষ্কার আলোতে আরো বেশী নোংরা মনে হবে।

একমাত্র কর্মচারী এবং সম্ভবত এই লোকটাই দোকান মালিক কোণার এক কামরা থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয় প্রচলিত ভাষায় জিজ্ঞেস করল, “কি লাগব?”

“কোক-আইসার,” স্মৃতি হাতড়ে ঠিক একই ভাষায় জবাব দিল রাইখ। (দ্রতা দেখালে নিজেকে বিলিবন্টনার হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে না।)

খাবারটার যে নাম সে বলেছে তা এখনো প্রচলিত, কারণ দোকানদার তার নোংরা হাতে সঠিক জিনিসটাই পরিবেশন করল। বালক রাইখ হয়তো নোংরা হাতের পরিবেশনের ব্যাপারে মাথা ঘামাত না কিন্তু তরুণ রাইখ কিছুটা হলেও অস্বস্তি বোধ করল।

“ব্যাগ লাগব?”

“না, এইহানেই খামু,” দাম চুকিয়ে দিয়ে দোকানদারের হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে ছোট একটা কামড় দিল রাইখ, তৃপ্তিতে চোখ দুটো অর্ধেক বুজে এল। ছোট বেলায় এটা ছিল তার সবচাইতে পছন্দের বস্তু। পকেটে কিছু ক্রেডিট জমা হলেই কিনে খেত, হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য বড়লোক হয়ে উঠা বন্ধুর কাছ থেকেও দুএক কামড় ভাগ পেত, আর নয়তো সুযোগ পেলেই চুরি করে খেত। এখন সে যতগুলো ইচ্ছা কিনে খেতে পারবে।

“ওই,” একটা কণ্ঠস্বর তার আমেজে বাধা দিল।

চোখ খুলল রাইখ, টেবিলের লোকটা তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

“আমারে কইতাছ?”

“হ। কি করস?”

“কোক–আইসার খাই। তর কি?” স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রাইখের মুখ দিয়ে বিলিবন্টনারদের ভাষা বেরিয়ে এল। কোনো সমস্যা ছাড়াই।

“বিলিবটনে কি করতে আইছস?”

“এইহানেই জন্ম, বড় হইছি এইহানে, এই হানেই বিছানায় ঘুমাইছি। তর মতো রাস্তায় ঘুমাই নাই।” তার কথা শুনে কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে বিলিবন্টন ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

“তাই? কাপড় চোপড় তো বিলিবন্টনারদের মতো না। খুব চমকদার। কাছে গেলে মনে অয় সেন্টের গন্ধও পামু।” ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে সে দুর্গন্ধ ঢাকার অঙ্গভঙ্গীও করল।

“তর গায়ের দুর্গন্ধ নিয়া আমি কিছু কমু না। আমি এইখান থিকা বাইরে চইলা গেছলাম।”

“বাইরে চইলা গেছলি? বাহ্ বাহ্ বাহ্।” আরো দুজন লোক দোকানে ঢুকল। সামান্য ভুরু কুঁচকালো রাইখ, কারণ নতুন দুজন নাক গলাবে কিনা বুঝতে পারছে না। টেবিলে বসা লোকটা বলল, “এই ব্যাটা অন্য জায়গায় চইলা গেছল। কইতাছে হে নাকি বিলিবন্টনার।”

নতুন আগম্ভকদের একজন ঠাট্টা করে স্যালিউট করল সেই সাথে হাসল দাঁত বের করে, তাতে কোনোরকম আন্তরিকতা নেই। “কি চমৎকার তাই না? একজন বিলিবটনার বড়লোকগর দেশে চইলা গেছে হুনলেই ভালো লাগে। সেক্টরের গরীব মানুষগুলানরে সাহায্য করার একটা সুযোগ পায়। যেমন ক্রেডিট। গরীব দোস্তগোর লাইগা কিছু ক্রেডিট তো দিয়া যাইবা, ঠিক না?”

“তর কাছে কত আছে?” এবার দ্বিতীয়জন জিজ্ঞেস করল, মুখের হাসি অদৃশ্য হয়ে গেছে।

“অই,” দোকান মালিক ধমক লাগালো। “সব বাইর হ আমার দোকানতে। এইহানে কোনো ঝামেলা করবি না।”

“কোনো ঝামেলা অইব না,” রাইখ বলল। “আমি চইলা যাইতাছি।”

যাওয়ার জন্য ঘুরল সে, কিন্তু বসে থাকা লোকটা তার পথের উপর একটা পা বাড়িয়ে দিল। “যাইঅনা দোস্ত। আমরা মনে কষ্ট পামু।”

(দোকান মালিক ঝামেলার গন্ধ পেয়ে পিছনের কামরায় ঢুকে গেল।)

রাইখ হাসল। বলল, “বিলিবটনে থাকবার সময় একবার আমার বাপ, মা আর আমারে দশটা গুন্ডা আটকাইছিল। দশটা, আমি শুইনা দেখছি। ওগোরে আমরা সামলাইছি।”

“সত্যি?” প্রথম গুন্ডাই এখনো কথা বলছে। “তর বুড়া বাপ দশটা গুন্ডারে সামলাইছিল?”

“আমার বুড়া বাপ? আরে না। আমার বুড়ি মায়ে সামলাইছিল। আমি হার চাইতে আরো ভালোভাবে সামলাইতে পারমু। আর তরা মাত্র তিনজন। কজেই পথ ছাইড়া দে।”

“দিমু। ক্রেডিট সবগুলা এইহানে রাইখা যা, আর কিছু কাপড় চোপড়।” টেবিলে বসা লোকটা উঠে দাঁড়াল, তার হাতে একটা ছুরি শোভা পাচ্ছে।

“এই যে,” রাইখ বলল। “এহন তুই আমার সময় নষ্ট করতাছস। কোক আইসার শেষ করে অর্ধেক ঘুরল সে। চোখের পলকে বসে পড়ল টেবিলে, ডান পা। দিয়ে ছুরি হাতে লোকটার কুঁচকিতে বেদম জোরে আঘাত করল।

তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা। রাইখ ড্রাইভ দিয়ে দ্বিতীয় গুন্ডার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ঠেসে ধরল দেয়ালের সাথে। একই সাথে ডান হাতে তৃতীয় জনের কণ্ঠনালীতে জোরে আঘাত করল।

ছোট একটা কাশি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল লোকটা।

পুরো ঘটনাতে সময় লেগেছে মাত্র দুই সেকেন্ড। রাইখ দাঁড়িয়ে আছে অক্ষত অবস্থায়, তার দুহাতেই ছুরি। হিসহিসিয়ে বলল, “আর কার শখ আছে?”

তিনজনের দৃষ্টিতেই আগুন ঝরে পড়ল কিন্তু নড়ার চেষ্টা করল না। “বেশ,” রাইখ বলল, “আমি এইবার যামু।”

কিন্তু দোকানদার সম্ভবত গা বাঁচানোর জন্য নয়, সাহায্যের জন্য পিছনের কামরায় চলে গিয়েছিল। কারণ সাথে আরো তিনজনকে নিয়ে আবার ফিরে এল সে। অনবরত বিড়বিড় করছে “বদমাইশ! সবগুলা বদমাইশ!”

নতুন আগন্তুকদের পোশাক নিঃসন্দেহে ইউনিফর্ম–কিন্তু রাইখের অচেনা। ট্রাউজারের নিচের দিকটা বুটের ভেতর গোজা, সবুজ রং এর ঢিলা টি-শার্ট বেল্ট দিয়ে কোমরের কাছে আটকানো। মাথায় অদ্ভুত ঢং এর অর্ধবৃত্তাকার টুপি। সব মিলিয়ে হাস্যকর। টি শার্টের সামনের দিকে বাম কাঁধের উপর জে এবং জি এই দুটো বর্ণ লেখা।

লোকগুলো ডালাইট হলেও তাদের গোঁফ ডাহ্‌লাইটদের মতো নয়। কালো এবং ঘন কিন্তু নিখুঁতভাবে ছাটা। মনে মনে খানিকটা অবজ্ঞা প্রকাশ করল রাইখ, কারণ ওদের গোঁফ তার নিজেরটার মতো প্রবল প্রতাপ ছড়াতে পারছে না। তবে স্বীকার করতেই হলো যে ওরা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

তিনজনের যে নেতা সে জিজ্ঞেস করল, “আমি কর্পোরাল কুইনবার। কি হয়েছে এখানে?”

পরাজিত তিন বিলিবটনার হাচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল, জবাব দেয়ার মতো অবস্থা নেই কারো। একজন এখনো গোঙাচ্ছে, একজন গলা মালিশ করছে আরেকজনের ভাব দেখে মনে হলো তার কাঁধ ভেঙ্গে গেছে।

কর্পোরাল আহত তিনজনকে দার্শনিক সুলভ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করল, তার সঙ্গী দুজন বেরোবার দরজাটা পাহারা দিচ্ছে। তারপর সে একমাত্র অক্ষত ব্যক্তি রাইখের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বিলিবন্টনার, খোকা?”

“এখানেই জন্ম। তবে গত আটবছর অন্য সেক্টরে বাস করছি। আপনারা কি সিকিউরিটি অফিসার? ইউনিফর্মটা চিনতে পারছি না।”

“আমরা সিকিউরিটি অফিসার নই। বিলিবটনে তুমি ওদেরকে খুঁজে পাবে না। আমরা জোরানিম গার্ড। এই এলাকার শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত। এই তিনটাকে ভালো করেই চিনি এবং ওদেরকে সতর্কও করেছিলাম। যাইহোক ওদের ব্যবস্থা হবে। আসল সমস্যা তুমি। নাম, রেফারেন্স নাম্বার।”

নাম এবং রেফারেন্স নাম্বার বলল রাইখ।

“এখানে কি হয়েছে?”

খুলে বলল রাইখ।

“তুমি এখানে কেন এসেছ?”

“দেখুন, এভাবে প্রশ্ন করার অধিকার কি আপনার আছে? আপনারা যদি সিকিউরিটি অফিসার না–“

“শোনো,” কঠিন গলায় বাধা দিল কর্পোরাল। “অধিকার আছে কি নেই সেই প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। বিলিবটনে আমরাই সব। ওই তিনজনকে তুমি পিটিয়ে সোজা করে দিয়েছ কথাটা বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি আমাদের কিছু করতে পারবে না। যদিও সাথে ব্লাস্টার রাখার নিয়ম নেই–“ কথা শেষ না করেই পকেট থেকে একটা ব্লাস্টার বের করে আনল সে।

“এবার বল, এখানে কেন এসেছ?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাইখ। যদি সরাসরি সেক্টর হলে চলে যেত সেটাই হতো উচিত কাজ, যদি বিলিবটন এবং কোক-আইসার নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে না পড়ত

“আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মি. জোরানিউম এর সাথে দেখা করতে এসেছি। যেহেতু আপনারা তার সংগঠনের “

“লিডার এর সাথে দেখা করতে এসেছ?”

“হ্যাঁ, কর্পোরাল।”

“সাথে দুটো ছুরি নিয়ে?”

“আত্মরক্ষার জন্য। মি. জোরানিউম এর সাথে দেখা করার সময় ওগুলো সাথে রাখতাম না।”

“শুধু মুখের কথায় হবে না। তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আসল ঘটনাটা আমরা বের করব। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু বের করব ঠিকই।”

“কিন্তু আপনাদের সেই অধিকার নেই। আপনারা বৈধ–“

“পারলে গিয়ে অভিযোগ কর। তার আগ পর্যন্ত তুমি আমাদের বন্দী।”

.

১৫.

হলোগ্রাফে যে পোর্টট্রেইট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, ক্লীয়নকে এখন আর সেইরকম তরুণ সুদর্শন রাজপুরুষ বলা যাবে না। হয়তো হলোগ্রাফে–তিনি আগের মতোই আছেন–কিন্তু তার আয়নাটা অন্য কথা বলছে। তার সাম্প্রতিক জন্মদিনটা পালিত হয়েছে একই রকম আনন্দ উৎসব আর জাকজমকের মাধ্যমে, কিন্তু সেটা ছিল তার চল্লিশতম জন্মদিন।

চল্লিশ বছরে পা দেয়া সম্রাটের মতে দোষের কিছু নয়, তার স্বাস্থ্য চমৎকার। দেহের ওজন খানিকটা বেড়েছে। হয়তো মুখে বয়সের ছাপও পড়েছে।

ক্ষমতায় বসেছেন আঠার বছর হয়ে গেল–যা এরই মধ্যে পরিণত হয়েছে এই শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘ শাসনকালগুলোর একটায় এবং আরো চল্লিশ বছর শাসন কার্য পরিচালনায় কোনো সমস্যা দেখছেন না তিনি, ফলশ্রুতিতে হয়তো তার শাসনকালটাই ইম্পেরিয়াল ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ শাসনকালে পরিণত হবে।

পুনরায় আয়নার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো যে ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব নিখুঁত না করে তুললে বরং আরো ভালো দেখাবে।

ডেমারজেলের কথা ধরা যাক বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য, কাজের লোক, অপ্রতিরোধ্য ডেমারজেল। তার কোনো পরিবর্তন নেই। সে এখনো আগের মতোই আছে এবং ক্লীয়ন যতদূর জানেন তার চেহারাতেও কোনো মাইক্রো অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হয় নি। অবশ্য ডেমারজেল সব ব্যাপারেই কথা কম বলে। আর সে বোধহয় কখনো তরুণ ছিল না। ক্লীয়ন যখন ছিলেন বালক ইম্পেরিয়াল প্রিন্স তখন তার বাবার অধীনেও কাজ করেছে ডেমারজেল। তখনো তার চেহারাতে তারুণ্যের কোনো নিদর্শন ছিল না, এখনো নেই। ভবিষ্যতে কোনো রকম পরিবর্তন না হয়ে শুরু থেকেই চেহারাতে বয়সের ছাপ থাকাটাই কি ভালো?

পরিবর্তন।

এই শব্দটাই তাকে মনে করিয়ে দিল যে ডেমারজেলকে তিনি ডেকেছেন এবং সম্রাট যতক্ষণ স্মৃতি রোমন্থন করবেন ততক্ষণ সে হয়তো আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকবে। পুরনো দিনের নিদর্শন এইসব নীতিগুলো ডেমারজেল ভীষণভাবে মেনে চলে।

“ডেমারজেল,” তিনি ডাক দিলেন।

“সায়ার?”

“জোরানিউম, এই লোকটার কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।”

“আপনাকে সব কথা শুনতে হবে তার কোনো প্রয়োজন নেই, সায়ার। সে হচ্ছে এমন একটা ঘটনা যা কিছুদিনের জন্য সংবাদের শিরোনাম হয়, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়।”

“কিন্তু এখনো অদৃশ্য হয় নি।”

“কখনো কখনো সময় লাগে, সায়ার।”

“ওর ব্যাপারে তোমার কি ধারণা, ডেমারজেল?”

“বিপজ্জনক এবং খানিকটা জনপ্রিয়তা রয়েছে। আসলে ওর জনপ্রিয়তাটাই বিপদ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।”

“যদি তোমার কাছে ওকে বিপজ্জনক মনে হয়, আমার কাছে মনে হয় বিরক্তিকর, তাহলে অপেক্ষা করছি কেন? কেন লোকটাকে গ্রেপ্তার করছি না, বিচার করে শাস্তি দিচ্ছি না?”

“ট্র্যানটরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সায়ার, ভীষণ জটিল–“

“সবসময়ই ছিল। তুমি আমাকে কখন বলেছ যে জটিল ছিল না?”

“আমরা একটা জটিল সময় পার হচ্ছি, সায়ার। ওর বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিলে জটিলতা আরো বৃদ্ধি পাবে।”

“আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমি হয়তো খুব বেশী পড়াশোনা করি না–একজন সম্রাটের অতো সময় থাকে না। কিন্তু ইম্পেরিয়াল ইতিহাস বেশ ভালো করেই জানি। ইতিহাসে বেশ অনেকগুলো প্রমাণ আছে যে এই রকম হঠাৎ গজিয়ে উঠা জনপ্রিয় মানুষগুলো তৎকালীন সম্রাটদের ক্ষমতা সংকুচিত করে দিয়ে তাদেরকে শুধুমাত্র ফিগারহেডে পরিণত করেছিল। আমি সেরকম ফিগারহেড হতে চাই না, ডেমারজেল।”

“আপনি তা হবেন সেটা অকল্পনীয়, সায়ার।”

“তুমি যদি কিছু না কর তখন আর অকল্পনীয় থাকবে না।”

“আমি চেষ্টা করছি, সায়ার, কিন্তু বেশ সতর্কতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে।”

“আমার জানা মতে অন্তত একজন আছে যে সতর্কতার ধার ধারে না মোটেই। একমাস বা তার বেশ কিছুদিন আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসর–একজন প্রফেসর–একাই একটা সম্ভাব্য জোরামাইট রায়ট থামিয়ে দিয়েছিল।”

“জি, সায়ার। আপনি কার কাছে শুনেছেন?”

“কারণ এই প্রফেসরের ব্যাপারে আমি আগ্রহী। তুমি আমাকে জানাও নি কেন?”

ডেমারজেল অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করে জবাব দিল, “গুরুত্বহীন বিষয়গুলোও কি আপনাকে জানানো ঠিক হতো, সায়ার?”

“গুরুত্বহীন? ওই লোকটা ছিল হ্যারি সেলডন।”

“ওটাই তার নাম।”

“এবং নামটা পরিচিত। সে সর্বশেষ গণিত সম্মেলনে তার গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেছিল যা আমাদের আগ্রহী করে তোলে, ঠিক?”

“জি, সায়ার।”

ক্লীয়ন খুশী হলেন। “কাজেই, বুঝতে পারছ যে আমারও অনেক কিছু মনে থাকে। সবকিছুর জন্য আমাকে কর্মচারীদের উপর নির্ভর করতে হয় না। আমি এই সেলডনের সাথে তার গবেষণা পত্র নিয়ে কথা বলেছিলাম, তাই না?”

“আপনার স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি নির্ভুল, সায়ার।”

“ওর সেই ধারণাটার কি হলো? সম্ভবত ভাগ্য গণনার কোনো এক ধরনের কৌশল। সে কৌশলটার কি নাম বলেছিল তা মনে নেই।”

“সাইকোহিস্টোরি, সায়ার। ঠিক ভাগ্য গণনার কৌশল নয় বরং মানব জাতির ভবিষ্যৎ ইতিহাসের সাধারণ গতিপথ অনুমান করার তত্ত্ব।”

“কতদূর অগ্রগতি হয়েছে?”

“কিছুই না, সায়ার। তখন যাই বলে থাকি না কেন, আসলে ধারণাটা অবাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। চমৎকার ধারণা কিন্তু অকার্যকর।”

“অথচ সে একটা সম্ভাব্য দাঙ্গা থামাতে সক্ষম। যদি আগে থেকেই না জানত যে সে সফল হবে তাহলে কি এই কাজ করার সাহস তার হতো? এতেই কি প্রমাণ হয় না যে–কি যেন বলে?–সাইকোহিস্টোরি কাজ করছে?”

“শুধু এটাই প্রমাণ হয় যে হ্যারি সেলডন জেদী প্রকৃতির মানুষ। এমন কি সাইকোহিস্টোরির ধারণা বাস্তব হলেও তার সাহায্যে মাত্র একজন মানুষ বা মাত্র একটা কাজের ফলাফল বিশ্লেষণ করা যাবে না।”

“তুমি গণিতবিদ নও, ডেমারজেল। হ্যারি সেলডন গণিতবিদ। বোধহয় ওর সাথে আবার কথা বলার সময় এসেছে। তাছাড়া আগামী সম্মেলনেরও খুব বেশী দেরি নেই।”

“সেটা অপ্রয়োজনীয়–“

“ডেমারজেল, এটা আমার ইচ্ছা। ব্যবস্থা কর।”

“জি, সায়ার।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *