শেষ রাত
হাজেব আবদুল করীম যখন ঘুম থেকে গাত্রোত্থান করেন তখন সহসা কেউ তার দরজায় করাঘাত করল। তিনি খুলে দেখলেন তাঁর জনৈক চাকর দণ্ডায়মান। সে বলল, বাইরে যমী একলোক আপনার অপেক্ষায়। আবদুল করীম দৌড়ে বেরোলেন। দারোয়ান যমীকে শুইয়ে দিয়েছে। রহীম গাযালীই সেই যখমী। তার কাপড় রক্তে লাল। জীবনের আখেরী দম নিচ্ছিলেন তিনি। ত্বরা করে হেকিম ডাকতে নির্দেশ দিলেন তিনি, কিন্তু রহীম তাকে বারণ করলেন।
হেকিম আসা পর্যন্ত বোধ হয় আমি জীবিত থাকব না। রহীম গাযালী কাতরাতে কাতরাতে বললেন, আমার আখেরী কথাগুলো শুনুন। আমার কোন সাথী ফিরে এলে মনে করবেন সকলেই শাহাদাঁতের সুমিষ্ট শরাব পান করেছে। বাস্তবিকই ওটা ছিল ভেল্কিবাজি। ওদের দুএকজন হয়ত বেঁচে আছে। আপনি ফরান গির্জায় যান। ওখানে লাশের দেখা পাবেন। গোটা রহস্য ওখানে গেলেই উদ্ধার করতে পারবেন।
তিনি অতি কষ্টে কথাগুলো আওড়ান। এ সময় তিনি দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছিলেন। এই খাস এক সময় গোঙানীতে পরিণত হল। হেকিম এসে পৌঁছালেন, কিন্তু তার আগেই রহীম তার আখেরী শ্বাস টেনে প্রভুর দরবারে চলে গেলেন। হাজেব মনে মনে বললেন, না এদের খুন বৃথা যেতে দেব না।
শিরা-উপশিরার খুন তাঁর টগবগিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষলেন তিনি। কর্মচারীরা বললেন, সালার আবদুর রউফকে ডেকে পাঠাও। তাকে যে অবস্থায় পাও এখানে নিয়ে এসো।
আবদুর রউফ খুব একটা দুরে ছিলেন না। তিনি এসে গেলেন। তিনি রহীম গাযালীর আখেরী কথাগুলো তাকে শোনালেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ২০/২৫ জন ফৌজ প্রস্তুত করলেন। তিনি ও উজিরে আলা পৃথক দুটি ঘোড়ায় চাপলেন। যেহেতু তখনও আঁধার তাই সাথে মশাল নিলেন। সাথে এমনও এক লোককে নিলেন যে ওই এলাকাটা চিনত।
বিরান গির্জায় গিয়ে তারা দেখলেন, আলো জ্বলছে তখনও। জ্বলছে ঝাড়-ফানুসও। কোন লোকজনের দেখা নেই। দেয়ালের পাশে একটি কাষ্ঠলক পতিত। ওতে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিচ্ছায়া। প্রতিচ্ছায়া ওই আলোতে চমকাচ্ছে। বাইরে বৃক্ষের তলে বিক্ষিপ্ত লাশ। মুসলিম-খ্রিস্টান সবারই লাশ। তারা লাশ শনাক্ত করতে পারলেন। আচমকা একটি মুসলিম লাশকে নড়তে দেখা গেল। সালার আবদুর রউফ তার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন ও বললেন, ভয় নেই তোমাকে চিকিৎসা করলে সেরে উঠবে। তার পেট ফাড়া। সালারকে দেখে তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু কথা বলার শক্তি তখন তার নেই। তিনি আস্তে আস্তে উপরে হাত ওঠালেন। তর্জনী বৃক্ষের দিকে। আবদুর রউফ বললেন, ওখানে কি? ওদিকে আবারো তর্জনী উঁচিয়ে তিনি ঢালে পড়লেন। পরে প্রতিটি লাশই পরীক্ষা করা হলো, কিন্তু কারো দেহে প্রাণ ছিল না।
গির্জা থেকে কারো দৌড়ানোর আওয়াজ শোনা গেল। সেপাইরা সেদিকে তাকাল। তারা দেখল, ঈসা (আ)-এর প্রতিচ্ছবি সম্বলিত কাষ্ঠলক নিয়ে দুখ্রিস্টান পালাচ্ছে। মুসলিম সেপাইদের আগুয়ান দেখে তারা দ্রুত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে লাগল, কিন্তু পারল না। মাঝপথেই হোঁচট খেল। এদের পাকড়াও করা হোল। গির্জায় তখনও ধোঁয়া উড়ছে। ফওরান ফানুস দেখে আলোক উদগীরণ হচ্ছে। গির্জার ছাদ কাঠের। আড়া ও বেড়াও কাঠের। সবগুলোতেই আগুন লেগেছে, ভয়াবহ এ আগুন নিভানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না, নেভানোর জরুরতও ছিল না।
***
কাষ্ঠ নিয়ে পলায়নকারীদের গির্জার পাশে নিয়ে আসা হোল। দরজা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। পুরোটা গির্জা তখন অগ্নিকুণ্ডে রূপান্তরিত।
এই রহস্যের দ্বারোম্মোচন করলে তোমাদের মুক্তি দেব। উজির বললেন, এটা তোমাদের ধর্মীয় ব্যাপার। কাজেই তোমাদের কারাগারে রাখব না। যে ভেল্কিবাজি দেখিয়েছে এর প্রতিও আমাদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু বলতে হবে এটা কি? নয়তো তোমাদের জ্বলন্ত গির্জার ইন্ধন বানাব। উভয়কে আগুনের এত কাছে আনা হলো যাতে তাদের চেহারায় তাপ লাগছিল। আগুনের তাপে ওদের চেহারা ঝলসে যাবার উপক্রম। ওরা দূরে সরতে চাচ্ছিল। দূরে সরানো হলো। ওদেরই একজন বলল, এর পেছনে কার হাত রয়েছে তা আমরা আপনাদের বলব না। জবরদস্তি করার চেয়ে আমাদের এই আগুনে ফেলে দেয়াই ভালো। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ধর্মের জন্য তারা জীবন দেবে।
ধর্ম সেখানেই গতিশীল যেখানে ধার্মিকরা তাদের নবীর নামে জ্বলতে পারে। ওদের অপরজন বলল,ইসলামী তরী ডুবন্ত, খ্রিস্টবাদ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। আমরা আমাদের টার্গেটে পৌঁছবই।
এ কথার জন্য ওদের ওপর কোন প্রকার শাস্তি না দিয়ে ধন্যবাদ জানানো হলো। এতে কোন সন্দেহ নেই, ওরা ছিল খুবই বুদ্ধিমান ও চৌকস। ওদের কথা হেলায় ফেলে দেবার মত নয়। ওরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, সামনের প্রান্তরের ঘন বৃক্ষের তীব্র রশ্মিসম্পন্ন ফানুস জ্বালানো হত। এর ওপর গোলাকার প্লেট রাখলে আলো চারদিকে না ছড়িয়ে কেবল সম্মুখ দিকেই আছড়ে পড়ত। গাছে গোলাকার কাঠের রক রাতের আঁধারে ওই আলোতে চমকাত। যেহেতু ওই ব্লক সুতায় লটকানো, তাই বাতাসে হেলাদুলা করত। হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে প্রচলিত ছিল যে, তার নূর গাছে চমকায়, এই আকীদা অবলম্বনে তারা চলচ্চিত্র বানায়। সেটাই হচ্ছে আপনাদের জিজ্ঞাসার সদুত্তর। এই গির্জায় আমরাই আগুন লাগিয়েছি তাই এই কাষ্ঠলক নিয়ে পলায়ন করছি।
যে মুসলিম মুমূর্ষ সেপাই তর্জনী দ্বারা বৃক্ষের দিকে ইশারা করেছিলেন এই কাষ্ঠখণ্ডকেই বুঝিয়েছেন তিনি, যার ওপর ছায়া পড়ে। ওই সেপাই-ই রাতের বেলা এক লোককে গাছে ওঠানামা করতে দেখেছেন। সেই কাষ্ঠপ্লেট এখনও গাছে ঝুলছে। ওটি নামানো হলো। সামনের প্রান্তরে ফানুস নিতে গিয়েছিল। ওটি প্রজ্বলনকারীরা মরে পড়েছিল ওখানেই।
আমরা যা কিছু করেছি তা ধর্মের খাতিরেই। দুজনার একজনে বলল, আমাদের লোকেরা ইশারায় কথা বোঝে, তারা ইশারায় আমাদের বুঝিয়েছিল যে, জীবন গেলেও সত্যের দ্বারোদঘাটন করবে না। আপনাদের সাথে আমাদের কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। এটা দুধর্মের দ্বন্দ্ব। ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে-খ্রিস্টবাদ একে প্রতিহত করবেই। প্রতিহত করতে গিয়ে আমরা বৈধ-অবৈধ সবই করে যাব, আমাদের আগুনে ফেলে দিন। আমাদের ছাই ভষ্ম থেকে এমনও লোক জন্মাবে যারা আমাদের পথে চলবে।