১.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মানবজাতির প্রগতির অনুপাত
বিভিন্ন জাতিতাত্ত্বিক যুগের শিল্প ও তাদের কীর্তির তুলনা ও শ্রেণীবিন্যাস করে অনুপাতের একটা ধারণা লাভ করা যায়। এতে আমরা আরো একটা জিনিস লাভ করি, এইসব যুগের সময়কাল। এর জোরালো দেখাতে গেলে ব্যাপারটা করতে হবে সাধারণভাবে এবং অনেকটা সংক্ষিপ্তবৃত্তির মতো। সেইভাবে প্রতিটি যুগের শুধু প্রধান প্রধান কর্ম ও কীর্তির হিসেব নেওয়া হবে।
মানুষ সভ্য যুগে পৌঁছানোর আগে সভ্য হবার সব উপাদানই তাকে সগ্রহ করতে হয়েছে। এতে বোঝায় অবস্থার একটা অদ্ভুত পরিবর্তন। প্রথমত আদিম অবস্থা থেকে বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছানো, তারপর সেখান থেকে গ্রিকদের হোমারীয় যুগ বা ইব্রাহীমের সময় হিব্রুদের অবস্থায় যাওয়া। সভ্য যুগের অগ্রগতির ধারা ইতিহাসে যেভাবে নথিভুক্ত হয়েছে সভ্য-পূর্ব যুগের ব্যাপারেও তা তেমনই সত্যি।
একটা যুগে একটা গোষ্ঠী যেসব প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকলা আবিষ্কার করেছে তা বাদ দিলেই বোঝা যাবে একটা পর্যায় কতটা উন্নতি করেছিল।
বর্তমান সভ্য যুগের প্রধান কীর্তি হল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি–টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎচালিত কাপড়ের কারখানা, স্টিম ইঞ্জিন, রেলগাড়ি, জাহাজ, মহাজগৎ সম্বন্ধে গবেষণা, ছাপাখানার আধুনিকতা, ইত্যাদি। এরই সাথে আধুনিক বিজ্ঞানকেও সরিয়ে আমরা দেখতে পাই ধর্মীয় স্বাধীনতা, একসাথে পড়াশোনার জন্যে বিদ্যালয়, গণতন্ত্র, রাজ্যপরিষদসহ সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, ইত্যাদি। সামন্ত রাজ্য, আধুনিক সুবিধাভোগী শ্রেণী, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক আইন—ইত্যাদি। মর্গান যখন এ বই লিখছেন তখন এ-সবই ছিল আধুনিকতার চরম বস্তু ও প্রতিষ্ঠান। এই বইয়ের প্রথম প্রকাশকাল ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ, পাঠক এই পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিকতার লক্ষণগুলো লক্ষ করুন।
আধুনিক সভ্যতা প্রাচীন ও মধ্য যুগের সভ্যতার সবকিছু গ্রহণ করে এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছয় এবং দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে যে এর তুলনায় আগের সমস্ত কীর্তিই নগণ্য।
মধ্য যুগের সার্থক স্থাপত্য, পূর্বপুরুষদের বংশধারা অনুযায়ী সামন্ত অভিজাতন্ত্র তারপর আসে পোপের শাসন—এ-সব ছাড়িয়ে আমরা রোম ও গ্রিসের সত্যতায় নামতে পারি। তাদের মধ্যে বিরাট যান্ত্রিক উদ্ভাবন বা আবিষ্কার আমরা দেখতে পাব না সত্যি, কিন্তু শিল্প সাহিত্য দর্শন ও সংগঠনের চরম উৎকর্ষ দেখতে পাব। এই সভ্যতাদ্বয়ের দান হল তার রাজকীয় সাম্রাজ্য গঠন–নাগরিক আইন–খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ (রোম সাম্রাজ্যে)–একজন সেনেট ও কয়েকজন কনসাল নিয়ে মিশ্র অভিজাততন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকার, জনসাধারণ নির্বাচিত পরিষদ–সামরিক বিভাগে সামরিক শৃঙ্খলার সাথে ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক সেনা গঠন–নৌসেনা বিভাগ গঠন ও জলযুদ্ধের মহড়া পৌর আইনসহ বিরাট বিরাট নগর স্থাপন–মুদ্রা ছাপানো এবং রাষ্ট্র সংগঠিত হয় অঞ্চল ও সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। উদ্ভাবনের মধ্যে ছিল পোড়া ইট, কপিকল[১] জল-চালিত মিল, পুল, পয়ঃপ্রণালী-খিলান ও সমতা রক্ষাকারী স্থাপত্যবিদ্যা–ধ্রুপদ যুগের শিল্প-বিজ্ঞান ও আরবি সংখ্যা পদ্ধতি গ্রহণ, সেই সাথে বর্ণমালার সাহায্যে লেখা।
এই সভ্যতা মূলতই তার পূর্ববর্তী বর্বর যুগের উদ্ভাবন আবিষ্কার রীতি ও প্রতিষ্ঠান উদ্ভূত। সভ্য মানুষের কীর্তি যতই বিপুল হোক, বর্বর যুগের মানুষের কীর্তিকে সে একেবারে ম্লান করে দিতে পারে না। কারণ শুধু লেখার ব্যবহার ছাড়া সভ্য অবস্থায় পৌঁছানোর সব কিছুর বীজই ছিল তার মধ্যে। মানবজাতির প্রগতির ধারায় সংযুক্ত করে বর্বর হিসেবে তাদের কীর্তি তাদের পরিপ্রেক্ষিতেই গ্রহণ করতে হবে। এমনকি আমরা মেনে নিতে বাধ্য যে তুলনামূলক গুরুত্বে তারা সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
লেখার ব্যবহার বা পাথরের ওপর হায়ারোগ্লাইফ পদ্ধতির লেখার চেষ্টা থেকেই সভ্যতার সূচনা ঘটে।[২] সাহিত্য বা লিখিত নথিপত্র ছাড়া ইতিহাস বা সভ্যতা দুয়েরই সত্যিকার অস্তিত্ব থাকত না। হোমারের কাব্য তা মৌখিকভাবে বা লিখিতভাবে এসে থাকুক এই সময় থেকেই গ্রিকদের মধ্যে সভ্যতার সূচনা ঘটে। জাতিতাত্ত্বিক পাঠের জন্য এই কবিতাগুলো চির নবীন আর অত্যাশ্চর্য জিনিস। তার অন্যান্য গুণকেও ছাপিয়ে যায় এই একটি বিষয়। বিশেষ করে ইলিয়াডের ক্ষেত্রে এটা বিশেষ করে খাটে–যা মানুষের ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন অবস্থার অনুলিপি এবং এ কাব্য লেখার সময় পর্যন্ত যে প্রগতি সাধিত হয় তার নজির স্পষ্ট করে তুলে ধরে। স্ট্রাবো হোমারকে বলেছেন ভৌগোলিক বিজ্ঞানের[৩] পিতা, কিন্তু এই মহান কবি তাঁর অগোচরেই আরো অফুরন্ত জিনিস দান করে গেছেন যা তার পরবর্তী পুরুষদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শিল্প, রীতি-নীতি, আবিষ্কার ও উদ্ভাবন এবং আদি গ্রিকবাসীদের জীবনধারার পূর্ণ চিত্র। এর মধ্যে আমরা আর্য সমাজের পূর্ণ চিত্র পাই। তারা অবশ্য তখনো বর্বর অবস্থায় ছিল, তবু তারা মানব-প্রগতিতে যে উপাদান সংযোগ করছে সে ধারণা পাবার জন্যে যথেষ্ট। এই কাব্যের সাহায্যেই আমরা সেই তথ্য পাই, সভ্যতায় প্রবেশ করার আগেই গ্রিকরা যেসব তথ্য সম্বন্ধে অবগত ছিল। তারা বর্বর যুগের মাঝে আলোকোজ্জ্বল বর্তিকা জ্বালিয়ে আমাদের বহু তথ্য জ্ঞাপন করে।
হোমারের কাব্যে বর্বর যুগের উচ্চ পর্যায়ের সব তথ্য পেয়ে আমরা একে পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেও পেছনে তাকিয়ে যদি একে বাদ দিই, আরো যা যা বাদ দিতে হয় তা হল প্রাচীন পুরাণ-কাহিনী ও স্বর্গীয় শক্তিসম্পন্ন অলিম্পিকের ধারণা–পূজা-আর্চার জন্যে স্থাপত্য-ভুট্টা ছাড়া অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্ৰ-চাষের জ্ঞান প্রস্তর-প্রাচীর দেওয়া শহর, তাতে বিরাট বিরাট ফটক ও বহিঃশত্রু পরিদর্শনের জন্যে মিনার সৃষ্টি স্থাপত্যে মার্বেল পাথরের ব্যবহার জাহাজ নির্মাণ, সম্ভবত তক্তা তৈরি করে ও পেরেকের সাহায্যে জুড়ে–ঠেলাগাড়ি জাতীয় যান ও রথ নির্মাণ–ধাতব বর্ম–রুপো বসানো বর্শা ও ঢাল-লৌহ-তরবারি– সম্ভবত মদ সৃষ্টির কৌশলও তারা জানত, স্কু ছাড়া অন্যান্য যান্ত্রিক কলাকৌশলও তারা আবিষ্কার করেছিল–কুমোরের চাক ও শস্য মাড়াইয়ের হাতে চালিত যন্ত্রপাতিও তারা তৈরি করেছিল, লিনেন ও পশমি বস্ত্রও বয়ন করত–হাতুড়ি ও বাটালির ব্যবহার হাপর ও কাটা-চামচ কাঁচা লোহা গালানোর জন্যে চুল্লি এবং তারা লোহার বিভিন্ন ব্যবহার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল, এসব বাদ দেবার পর থাকে একবিয়ে পরিবার সামরিক গণতন্ত্র–পরবর্তীকালের সংগঠন গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী সম্ভবত জনসাধারণের পরিষদ-বাড়ি এবং জমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা–এবং পৌর জীবনবোধ ও প্রাচীরবেষ্টিত শহরে নাগরিক বোধসম্পন্ন জীবন যাপন। যাদের মধ্যে এইসব গুণ ছিল সেই বর্বরদের উচ্চ পর্যায়ের এইসব গুণ বাদ দিলে তারা এর নিম্ন পর্যায়ে পড়ে যাবে।
এ অবস্থা থেকে আমরা যদি মধ্য-বর্বর যুগে অবতরণ করি তখন এদের গুণাবলি এত প্রকট হবে না–তাদের রীতি ও প্রতিষ্ঠানে, উদ্ভাবন ও আবিষ্কারে। কিন্তু এই আদি আর্য পরিবারদের সম্বন্ধে জানার জন্যে আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কিছু জ্ঞান যে একেবারে নেই তা নয়। আমরা আগেই বলে নিয়েছি আর্যদের তথ্য লাভের জন্য আমাদের অন্য জাতির খবর নিতে হবে।
ঠিক একইভাবে মধ্য-বর্বর যুগে আমরা বাদ দিতে পারি : ব্রোঞ্জের ব্যবহার, গৃহপালিত গরু-ছাগল পালনের জ্ঞান, যৌথ-সাম্প্রদায়িক ঘর, কাঁচা দেয়াল, আর তার সাথে হয়তো চুন বালির সাহায্যে পাথর বসানো উঁচু ভিটের ওপর ঘরবাড়ি নির্মাণ, কাঠ-কয়লার উত্তাপের সাহায্যে ধাতু[৪] জাতীয় জিনিস গালানোর জ্ঞান–রুপোর কুড়ুল এবং বাটালি–মাকু ও তাঁতের ব্যবহার জলসেচের সাহায্যে চাসবাস, নালা কাটা, জল ধরে রাখা–পাথর বাঁধানো রাস্তা গাছের ডাল দিয়ে পুল নির্মাণ নির্দিষ্ট পুরোহিত কর্তৃক ভগবানের পুজো–মানুষ বলি–আজটেকদের মতো সামরিক গণতন্ত্র-পশ্চিম গোলার্ধে সুতিবস্ত্র ও পূর্ব গোলার্ধে পশমি পোশাক নকশা কাটা মৃৎপাত্র–কাঠের তরবারিকে চকমকি পাথর দিয়ে ধারালো করা–চকমকি পাথরের ব্যবহার ও পাথরের অস্ত্র নির্মাণ–তুলো ও শণের ব্যবহার সম্বন্ধে পরিষ্কার জ্ঞান আর পশুপালন।
এর পূর্ববর্তী যুগের থেকে এর মোট কীর্তি বেশ কম, কিন্তু মানুষের মোট প্রগতির তুলনায় তা বিপুল। এই সময়েই পূর্ব গোলার্ধে পশু পোষ মানানো হয়, যার ফলে নিয়মিত মাংস ও দুধের সংস্থান হয়ে যায় এবং শেষে ক্ষেত্র-কৃষিতে নামতে সাহায্য করে। তা ছাড়া আঞ্চলিক কাঁচা ধাতু নিয়ে পরীক্ষা চালাতে থাকে, যার ফলে ব্রোঞ্জের[৫] আবিষ্কার ঘটে এবং লোহা গালানোর ব্যবস্থা করে। পশ্চিম গোলার্ধে ব্রোঞ্জ ছাড়াও অন্যান্য পদার্থও গালানো ও তার ব্যবস্থা মানুষের আয়ত্তে আসে। তা ছাড়া সেচের সাহায্যে ভুট্টা ও জনারের চাষ এবং কাঁচা ইট ও পাথরের সাহায্যে যৌথ তাঁবুর আকারে বাসভূমিও তারা করতে শিখেছিল।
আরো পিছিয়ে গিয়ে এখন আমরা নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগে প্রবেশ করে এই জিনিসগুলো বাদ দিতে পারি, গণ-ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠীর ভিত্তিতে মিত্রস, যেখানে সরকার ছিল প্রধানদের পরিষদ নিয়ে, এর আগে এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ ও সরকার মানুষের মধ্যে দেখা যায় নি। পশ্চিম গোলার্ধে ভুট্টার চাষ ও তামাক ও অন্যান্য শস্যের ব্যবহার, কাপড় বোনা, হরিণের চামড়া শুকিয়ে পায়ের আচ্ছাদন, আত্মরক্ষার জন্যে গ্রামীণ রক্ষীবাহিনী, গোষ্ঠীগত খেলাধুলা, পদার্থ পুজো, তা ছাড়া বিরাট ভৌতিক শক্তির পুজো, যুদ্ধের সময় নরখাদকতা, এ ছাড়া মৃৎশিল্প নির্মাণ পদ্ধতিও বাদ দিতে হবে।
মানুষের উদ্ভাবন ও অগ্রগতির ধারার আদিম পর্যায়ে আমরা যত নামতে থাকি দেখি মানুষের আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সহজ সরল পর্যায়ের এবং তাদের প্রাথমিক চাহিদার কাজে লাগার জন্যে সৃষ্টি হয়েছে। আর তাদের সংগঠনের দিকে তাকালে দেখব প্রাথমিক আকারের ‘গণ’, যা তাদের জ্ঞাতি-বিয়ের সাহায্যে গড়ে উঠেছে। এই গণের একজন প্রধান নিজেদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হয়। আর গোষ্ঠী গঠিত হয় আত্মীয় সম্পর্কযুক্ত গণ-এর সমষ্টি নিয়ে। গণ প্রধানদের নিয়ে একটা পরিষদও গঠন করা হয়। ইউরেশিয়া গোষ্ঠীদের এই অবস্থায় (আর্য ও সেমিটিক) আমরা পাই নি। তবে পশুপালন ও মৃৎশিল্পের ব্যবহার থেকেই আমরা তা কল্পনা করতে পারি। এ ছাড়া বাল্টিক সাগরের উপকূলে যে সমস্ত লোকেরা ঝিনুকের স্তূপ করেছে তাদেরও ধরতে হবে। তারা তখন শুধু কুকুরকে পোষ মানিয়েছিল, অন্য কোনো পশু পোষ মানাতে পারে নি।
বর্বর যুগের তিন পর্যায়ের কীর্তির হিসাব নিলে আমরা শুধু বিপুল আবিষ্কার বা উদ্ভাবনই দেখব না, এদের মূল্যও অপরিসীম–তা ছাড়া তারা নৈতিক ও মানসিক দিক থেকেও যথেষ্ট উন্নতি করেছিল।
এরপর সুদীর্ঘ আদিম যুগে প্রবেশ করে আমরা বাদ দেব মানুষের সংগঠন-জ্ঞান, গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী পদ্ধতি, জোড়-বিয়ে পরিবার, পদার্থ পুজো, শব্দঅংশ যুক্ত ভাষা, তীর ধনুক, পাথর আর হাড়ের অস্ত্র, বেত আর ডালের তৈরি ঝুড়ি, চামড়ার পোশাক, দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার, লিঙ্গভিত্তিক সংগঠন, গ্রাম, নৌকো বিশেষ করে ডিঙি, চকমকি, পাথর বাধা বর্শা ও সামরিক সমিতি, পাথরের অস্ত্র, ভাই-বোন বিয়ে পরিবার, নরখাদকতা, আগুনের ব্যবহার, সবশেষে ইশারায় বোঝানো ভাষা। এইসব বাদ দেবার কাজ শেষ হলে আমরা দেখব মানুষ একেবারে শৈশব অবস্থায় উপনীত হয়েছে : মানুষ এখন আগুনের ব্যবহার শেখার চেষ্টা করছে, যাতে বোঝা যায় মাছকে আহার্য হিসেবে তারা গ্রহণ করতে শিখছে এবং এই সময় তারা উচ্চারিত ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় মানুষ বাস্তবিকই তার অগ্রগতির নিম্ন ধাপে বিরাজ করছে, কিন্তু এমন এক মানসিকতার অধিকারী হয়েছে যার মধ্যে উপরোক্ত সব সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও উদ্ভাবনের বীজ সুপ্ত।
উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও সংগঠনের বিস্তৃতির ফলে মানুষের মস্তিষ্ক দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে মানুষের মস্তিষ্কের সম্মুখের অংশ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আদিম পর্যায়ে মস্তিষ্কের বিকাশের গতি ছিল ভীষণ শ্লথ, কারণ মানুষ তখন একেবারে শূন্য থেকে কোনো কিছু আবিষ্কার করতে শুরু করেছে বা মাত্র একটা কিছু থেকে মাথা খেলিয়ে আর একটা কিছু করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কোনো যথার্থ হাতিয়ার ছাড়াই সেই আদিম যুগে সমাজকে সংগঠিত করা খুব কম দুঃসাধ্যের কাজ ছিল না। প্রথম উদ্ভাবন ও প্রথম সামাজিক সংগঠন সৃষ্টি করা ছিল খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার, আর এই দুই অংশ পরস্পর পরস্পর থেকে বহু যুগ ধরে পৃথক হয়ে ছিল। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ হল তার পরবর্তী যুগের পরিবারের বিভিন্ন গড়ন। এই প্রগতির ধারার কাজ করছে জ্যামিতিক অনুপাতে।
মানুষের আদিম অবস্থা সম্বন্ধে এখন যা বলা হল তা কোনো আধুনিক মত নয়। বহু প্রাচীন কবি ও দার্শনিকও বুঝতে পেরেছেন যে মানুষের জীবন শুরু হয় খুবই একটা কঠোর অবস্থায়। তারপর তারা ক্রমশ ধাপে ধাপে অগ্রগতির দিকে পা বাড়িয়েছে। তারা আরো লক্ষ করছেন, প্রগতিমূলক উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ধারা-ক্রমে তাদের অগ্রগতি সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু তারা কেউ-ই সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের দিকটা লক্ষ করেন নি।
মানুষের অগ্রগতির ধারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনোই লাফিয়ে লাফিয়ে চলে নি বরং ধারাবাহিকভাবে প্রগতি সংঘটিত হয়েছে। যেসমস্ত উপাদান আমাদের হাতে আছে তা থেকে এই সিদ্ধান্তই টানা যায়।
বর্বর যুগের তিন পর্যায়ের চেয়ে গুণগত দৃষ্টিতে মোট কীর্তির বেশিটাই পড়বে আদিম যুগে। আর সেইভাবেই বলা যায় মোট বর্বর যুগে যে প্রগতি সংঘটিত হয়েছে গুণগত বিচারে তা সমস্ত সভ্যতার কীর্তির চেয়েও বেশি।
এই জাতিতাত্ত্বিক যুগবিভাগের মেয়াদ সম্বন্ধেও একটা পরিষ্কার ধারণা করা যেতে পারে। সঠিক মাপ অবশ্য পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু বেশ কিছুটা কাছাকাছি পৌঁছানো যেতে পারে। অগ্রগতির জ্যামিতিক ধারা আরোপ করলে আমরা দেখতে পাব আদিম পর্যায় বর্বর যুগ থেকে সুদীর্ঘকাল ধরে ছিল। ঠিক যেমন বর্বর যুগ ছিল সভ্য যুগ থেকে অধিককাল। মানুষ যদি এক লক্ষ বছর জগতে বাস করে থাকে, তা হলে ষাট হাজার বছরই তার কেটেছে আদিম পর্যায়ে। মানুষের সবচেয়ে অগ্রগতিসম্পন্ন অংশ প্রায় তিন-পঞ্চমাংশ কাটিয়েছে এই আদিম পর্যায়ে। বাকি এক-পঞ্চমাংশ বা কুড়ি হাজার বছর কাটিয়েছে প্রাচীন বা নিম্নবর্বর পর্যায়ে। মধ্য বর্বর যুগ কাটিয়েছে পনের হাজার বছর, বাকি পাঁচ হাজার বছর হল সভ্য যুগের।
আদিম যুগের মেয়াদ সম্বন্ধে ওপরে বলা হয়েছে। কোন যুক্তিতে এই মাপ করা হয়েছে সে সম্বন্ধে আলোচনা না করেও মন্তব্য করা যায় যে অগ্রগতির জ্যামিতিক ধারায় মানব প্রগতি ঘটলেও গাণিতিক ধীর গতিসম্পন্ন অগ্রগতিই বিশেষ করে চোখে পড়ে। জাতিতাত্ত্বিক পাঠে সিদ্ধান্ত হিসেবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষ আদিম পর্যায়েই সবচেয়ে বেশি সময় ছিল। মানুষের সভ্য জীবনকাল নগণ্য ভগ্নাংশ মাত্র।
মানবজাতির দুই প্রধান অংশ আর্য ও সেমিটিক জাতি খাদ্যদ্রব্য আহরণের উৎকর্ষের দরুন ও অন্যান্য সুবিধার জোরে বর্বর অবস্থা থেকে সভ্য যুগে পদার্পণ করে প্রথম। সভ্যতা স্থাপনে তারাই অগ্রণী।[৭] কিন্তু পৃথক পরিবার হিসেবে তাদের অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে পরবর্তী যুগের ঘটনা। তাদের পূর্বপুরুষরা বর্বর পর্যায়ে এক হয়ে মিশে রয়েছে, যাদের এখন আর চেনা যায় না। পশুপালনের জোরেই আর্য ও সেমিটিক জাতি বর্বর অবস্থা ছেড়ে আধুনিক যুগে পৌঁছয়।
মানুষের সবচেয়ে অগ্রগণ্য অংশ প্রগতির বিশেষ এক স্তরে এসে থেমে যায় যতক্ষণ না আর কোনো বিশেষ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সম্ভব হচ্ছে, উদাহরণত পশু গৃহপালিত করা বা লোহা পালানোর জ্ঞান নূতন শক্তি হিসেবে দেখা দেবার পর আবার অগ্রগতি সাধিত হয়। এইভাবে বাধা পেয়ে অন্যান্য নিম্ন পর্যায়ের গোষ্ঠীরা বিভিন্ন পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকে যতক্ষণ না এই বিশেষ পর্যায়ে এসে পৌচচ্ছে। মহাদেশীয় গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রগতির পথে কোনো কোনো আবিষ্কার একে অপরের কাছ থেকে নিয়েছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার বা উদ্ভাবনগুলো তারা নিজেরাই করেছে বলে বড়াই করে, কিন্তু ধরে নিতে হবে নিম্ন শ্রেণীর গোষ্ঠীরা সেই গুণ ধরার মতো ক্ষমতা নিশ্চয় অর্জন করেছে। মহাদেশীয় অঞ্চলে কোনো বিশেষ এক গোষ্ঠী হয়তো নেতৃত্ব দেয়, কিন্তু এই নেতৃত্ব প্রায়ই পরিবর্তিত হয়েছে জাতিতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগে। অনেক জায়গায় বাধা পেয়ে এই অগ্রগতি বিশেষ এক অবস্থায় ঘুরে মরেছে। বর্বর যুগের মধ্য। পর্যায়ে আর্য ও সেমিটিক গোষ্ঠীরা ছিল সবার ওপরে এবং তাদের কেন্দ্র করেই মানুষের অগ্রগতি সাধিত হচ্ছিল। সভ্য যুগে এই প্রগতিই দেখি কেবল আর্য পরিবারকেন্দ্রিক।
যখন প্রথম আবিষ্কৃত হয় আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে এই সত্য আরো পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। আমেরিকা মহাদেশে তারা আদিম পর্যায়েই জীবন শুরু করে যদিও তাদের মানসিক উৎকর্ষ ছিল আদিম পর্যায়ে, তবু তারা বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে উৎরায়। উত্তর ও দক্ষিণের গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানদের এক অংশ মধ্য বর্বর পর্যায়ে ওঠে। তারা শুধু লামা নামে এক প্রকার কুকুরকেই পোষ মানায়–তা ছাড়া ব্রোঞ্জ এবং রুপোর সাথে টিন মিশিয়ে এক প্রকারের মিশ্র ধাতুও তৈরি করতে শেখে। উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগে ওঠার জন্যে তাদের শুধু দরকার ছিল লোহা গালানোর বিদ্যা। এটা উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, পূর্ব গোলার্ধের সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেরাই আদিম পর্যায় থেকে বর্বর অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। যখন ইউরেশীয় গোষ্ঠীগুলো লোহার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে, আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করে এবং সময়ের অভিক্ষেপে এরপরই লোহা পাবার কথা। পূর্ব গোলার্ধে প্রগতি যখন আটকে রয়েছে, আমেরিকান আদিবাসীগণ উন্নতি করেই চলেছে। অবশ্য পূর্ব গোলার্ধের শেষ পর্যায়ের বর্বর অবস্থা বা সভ্য পর্যায়ের প্রথম চার হাজার বছরের পর্যায়ে তারা শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি। এতে সময়ের পার্থক্যের কিছুটা হদিস আমরা পাই আর্য পরিবার থেকে অন্যান্য পরিবার কতটা পেছনে ছিল : উদাহরণত শেষ পর্যায়ের বর্বর যুগের সাথে সভ্য যুগের সময়কেও যোগ করতে হবে। শেষ পর্যায়ের আদিম যুগের প্রথম কিছু অংশ বাদে আর্য এবং গ্যানোয়া পরিবারগণ উভয়ে মানুষের প্রগতির পাঁচটি স্তরই প্রদর্শিত করে।
আদিম পর্যায়ে মানুষ মাত্র মানুষ হবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য, তা ছাড়া আগুনের ব্যবহার জানে না, শব্দে তৈরি কোনো ভাষা নেই, অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে বিনা অস্ত্রেই প্রায় আমাদের আদি পুরুষগণ প্রকৃতির সাথে লড়েছে। এইসব বস্তু পাবার চেষ্টার ফলে তারা ক্রমশ এক প্রকারের ভাষা আয়ত্তে আনে এবং সারা পৃথিবীর কর্মশালায় কাজের জন্যে তৈরি হতে থাকে। কিন্তু সমাজ জীবন তখনো এর প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে, কোনোরকম সংগঠন তখনো দেখা দেয় নি। যখন মানবজাতির সবচাইতে অগ্রগণ্য অংশ আদিম অবস্থা থেকে নিম্ন বর্বর যুগে উন্নীত হয় তখন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা নিশ্চয় খুব অল্প ছিল। প্রথম দিকের উদ্ভাবনের ব্যাপারটা ছিল খুবই দুঃসাধ্য, কারণ তখন বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা ছিল নগণ্য। প্রতিটি জ্ঞানের বিষয়ই তখন পরবর্তী জ্ঞানের ভিত হিসেবে কাজ করত। আদিম যুগের আবিষ্কার ছিল নগণ্য ধরনের, কিন্তু উল্লেখযোগ্য ছিল মানুষের অসীম শ্রম ও উদ্যমের। এই ক্ষেত্রে তীর-ধনুককে এর একটা নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা যায়।
আদিম মানুষের মানসিক ও নৈতিক উন্নতি ঘটে খুবই নগণ্য পরিমাণে, তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল ভীষণভাবে শূন্য, তা ছাড়া আছে তার জান্তব কামনা-বাসনা ও খিদের তাড়না, এসবেরই নিদর্শন তার প্রস্তর ও অস্থি-নির্মিত সব আসবাব ও হাতিয়ারের মাঝ দিয়ে আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারি। তা ছাড়া বর্তমান জগতেও যেসব আদিবাসী বৃহত্তর জনসংযোগ থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে তারাও আমাদের কাছে অতীতের স্মারকস্তম্ভের মতো। তবু এই আদিম যুগেই ভাষার ভিত পত্তন হয়, পরে যা ধ্বনিগত স্তরে উন্নীত হয়। এই পর্যায়ে দুই প্রকারের পরিবারের পত্তন ঘটে, এমনকি সম্ভবত তৃতীয় প্রকারের পরিবারও দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া গণ’ সংগঠন সৃষ্টি হয় যাকে প্রথম সত্যিকার সমাজ নাম দেওয়া যায়। এসব সিদ্ধান্তের পূর্বেই আমরা বলে নিয়েছি মানুষ জীবন শুরু করেছিল একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে। মানুষ এবং তার কর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পাঠের ফলে আধুনিক বিজ্ঞান আজ তা-ই প্রমাণ করে।
এইভাবে বর্বর যুগে আমরা চারটে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের দেখা পাই : পশু গৃহপালিত করা, শস্যের চাষ, স্থাপত্যে পাথরের ব্যবহার এবং লোহা গালানোর বিদ্যা আয়ত্তে আনা। সম্ভবত শিকারের সাথী হিসেবে কুকুরকেই মানুষ প্রথম পোষ মানায়, তারপর অন্যান্য প্রাণীর বাচ্চা ধরে তাদের পালন করতে শুরু করে। পরে চেষ্টা করে কী করে তাদের সংখ্যা বাড়ানো যায় এবং এদের আহার হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে। প্রতিটি প্রাণীকে পোষ মানানোর ইতিহাস যদি পাওয়া যেত তা হলে চমকদার সব তথ্য আমরা পেতাম। এর ওপর মানুষের পরবর্তী ইতিহাস অনেক প্রভাবান্বিত হয়। দ্বিতীয়ত, চাষের সাহায্যে শস্য ফলন মানুষের প্রস্তুতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। পূর্ব গোলার্ধে এটা তত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দেয় নি, কিন্তু পশ্চিম গোলার্ধে আমেরিকান আদিবাসীরা চাষের জ্ঞান লাভ করে নিম্ন পর্যায়ের বর্বর যুগে ও কিছু অংশ বর্বর যুগের মধ্য পর্যায়ে উন্নীত হতে সক্ষম হয়। তৃতীয়ত, কঁচা ইট আর পাথরযোগে বাড়ি তৈরির ব্যাপারটা মানুষকে শিল্পের দিকে ঠেলে দেয়, ফলে মানুষ আরো উন্নতি করার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু সভ্যতায় পৌঁছানোর জন্যে তুলনামূলক হিসেবে চতুর্থ আবিষ্কার আরো গুরুত্ব নিয়ে দাঁড়ায় : বর্বররা ধাতু গালানোর ব্যবহার আয়ত্তে আনে এবং ছাঁচে ঢালার ব্যবস্থাও শেখে। টিন আর রুপো মিশিয়ে তারা ব্রোঞ্জ আবিষ্কার করে, আর সবশেষে চুল্লির সাহায্যে কাঁচা লোহা গালিয়ে ইস্পাত তৈরির ব্যবস্থা করে। ফলে, সভ্যতায় পৌঁছানোর নয়-দশমাংশ কাবার করে ফেলে।[৯] লোহার হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে মানুষ সভ্যতায় পৌঁছানোর জন্যে তৈরি হয়। লোহার আবিষ্কারকে বলা যায় মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের ঘটনার ঘটনা, যার কোনো সমকক্ষ আবিষ্কার নেই। অন্যান্য সব আবিষ্কারই এর নিচে। এর ফলেই আসে লোহার হাতুড়ি, কুড়ুল, নেহাই, বাটালি, লোহার ফলাযুক্ত লাঙল, তরবারি ইত্যাদি। এক কথায় আমরা বলতে পারি সভ্যতার তিতপওন ঘটে লোহার ব্যবহারে। লৌহ হাতিয়ারের অভাবেই মানুষ বর্বর যুগে আটকে ছিল। আজ পর্যন্ত তারা এই অবস্থায়ই থাকত যদি লোহার আবিষ্কার না করতে পারত। সম্ভবত লোহা গালানোর জ্ঞান একটি গোষ্ঠী পায়। কোন গোষ্ঠী লোহার ব্যবহার আয়ত্তে আনে সবার তা জানার বিশেষ কৌতূহল জাগতে পারে। আমরা তাদের কাছে ঋণী, কারণ সভ্যতার জন্ম দিয়েছে তারা। সেমিটিক পরিবার তখন আর্যদের চেয়ে উন্নত এবং মানবজাতিকে নেতৃত্ব দান করছে। তারাই ধ্বনিসম্মত অক্ষরমালা এবং সম্ভবত সেই সাথে লোহার ব্যবহারও শেখায়।
হোমারীয় যুগে গ্রিসের গোষ্ঠীরা বিপুল বস্তুগত প্রগতি সাধিত করে। সব ধরনের সাধারণ পদার্থ সম্বন্ধেই তারা ওয়াকিবহাল ছিল, তা ছাড়া লোহা গালানো, এমনকি লোহাকে। ইস্পাতে পরিণত করার পদ্ধতিও তারা জানত। সব ধরনের প্রধান শস্যও তারা ক্ষেত্র-কৃষির সাহায্যে তখন ফলাচ্ছে। গরু-ঘোড়া, কুকুর-ছাগল, মেষ-মহিষও তারা পোষ মানিয়ে বিভিন্ন কাজে লাগিয়েছে। গৃহকে মজবুত করে নির্মাণ করার সব চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং পৃথক এ্যাপার্টমেন্ট ও দোতলা বাড়িও[১০] নির্মিত হয়েছে, এবং কয়েক তলাবিশিষ্ট বাড়িও]১১] তৈরি হয়েছে। জাহাজ নির্মাণ, অস্ত্রশস্ত্র, সুতি কাপড়ের তাত, আঙুর থেকে মদ তৈরি ও আপেল, নাশপাতি, জলপাই, ডুমুর[১২] ইত্যাদির চাষ তখন তারা করছে। কিন্তু মানুষের প্রথম দিকের ইতিহাস কালের মহাগর্ভে তলিয়ে গেছে। বর্বর যুগের বহু ঐতিহ্যই দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে। আগে চিন্তাশক্তির এত বিপুল বিকাশ ঘটে নি, কিন্তু সভ্যতায় এসে লেখার শক্তির সাথে কাব্যশক্তি আর সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। সভ্যতায় এসে প্রতিভাধররাই সমাজের মূল কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়ায়। বাকি সব পাদপ্রদীপের আড়ালে চলে যেতে থাকে। বর্বর যুগ শেষ হয় উন্নত বর্বরদের হাতেই। পরবর্তী গ্রিক ও রোমান লেখকরা এই যুগের জীবন সম্বন্ধে ধারণা করেছে তাদের নিজস্ব জীবন থেকে। যেমন আমরা বর্তমান থেকে অতীত সম্বন্ধে ধারণা করি। তখন এমন কিছু নিদর্শন বর্তমান ছিল যা দেখে আদিম যুগ থেকে বর্বর যুগ ও বর্বর যুগ থেকে সভ্য অবস্থায় আসার যোগাযোগ ধরা সহজ হয়েছিল। হোমারীয় যুগ সম্বন্ধে ধারণা করা তাদের পক্ষে খুব অসুবিধার ছিল না। তবে শুধু কাল্পনিক যুক্তি মোটেই যথেষ্ট নয়।
—
১। সম্ভবত মিরবাসীরা কপিকলের আবিষ্কার করে হেরোডোটাস ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৫)। তাদের দাড়িপাল্লাও ছিল।
২। অন্যান্য উদ্ভাবনের মতো ধ্বনিসঙ্গত লেখাও প্রচুর চেষ্টার পর সৃষ্টি হয়। এই পর্যায়ে মিশরবাসীদের বিভিন্ন হায়ারোগ্লাই লেখার মধ্যে কিছুটা ধ্বনিসঙ্গত রূপও লাভ করে, যদিও তা হচ্ছিল খুব ধীর গতিতে। পাথরের ওপর বেশ স্থায়ীভাবে তারা লিখতে পারত। এরপর ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপার হোক বা যেভাবেই হোক ফিনিসীয়রা তাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে এবং মিশরবাসীরা যা ভাবছিল তা-ই বাস্তবে রূপ দেয় অর্থাৎ ধ্বনিগত লেখা আবিষ্কার করে। তারা মোলটি অক্ষরের মাধ্যমে একটি ভাষার জন্ম দেয়, যার ফলে মানবজাতি একটি লিখিত ভাষা পেল এবং সাহিত্য ও ঐতিহাসিক সব রচনা সম্ভব হল।
৩। স্ট্র্যাবে, ১, ২
৪। যেসব ধাতু পাওয়া গেছে হোমার তার নাম করেছে। এইসব ধাতুর নাম তার অনেক আগে জানা এবং এসবই লোহার আগের ব্যাপার। ওইসব ধাতু গালাবার জন্যে কাঠকয়লা আর ধাতু গলাবার মাটির মুচির ব্যবহার লোহা গালাবার রাস্তা তৈরি করে দেয়।
৫। বেকম্যানের গবেষণায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে যে গ্রিক ও ল্যাটিন লোহা গলানোর আগে ঠিক খাঁটি ব্রোঞ্জের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানত না। তার মতে ইলিয়াডে যাকে ইলেকট্রাম বলা হয়েছে তা সোনা ও রুপোর মিশ্রণ। আসলে তার অভিমত কেবল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জন্যে খাটে। অন্যান্য অঞ্চলে ব্রোঞ্জ পাওয়া গেছে এবং তা লোহার আগেই আবিষ্কৃত হয়।
৬। ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে বেশ গবেষণা হয়েছে, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান এখনো হয় নি। মানুষের উন্নয়নের সাথেই এর যোগাযোগ। লিউক্রেশিয়াসের মতে অঙ্গভঙ্গি ও কিছু ধ্বনির সাহায্যে মানুষ আদিম যুগে মনের ভাব প্রকাশ করত। তাঁর মতে চিন্তা ভাষার পূর্ববর্তী অধ্যায় এবং শব্দের আগে অঙ্গভঙ্গিই ছিল মূল। বর্বরদের মধ্যে শব্দ ও অঙ্গভঙ্গি দুই-ই আছে। মার্কিন আদিবাসীরা এর সাহায্যেই যোগাযোগ স্থাপন করে। এই ভাষা অনেকটা প্রাকৃতিক প্রতীক, তাই এর মধ্যে সর্বজনীনতা বিদ্যমান। লেখার সাথে ধ্বনি যোগ করা বেশ কঠিন ব্যাপার। এর ফলে কণ্ঠস্বরের উন্নতি ঘটে। যারা ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে জানতে চায় তারা এই ইশারা বা অঙ্গভঙ্গিগত ভাষার প্রতি লক্ষ করলে ভালো ফল পাবে।
৭। মিসরীয়রা পরোক্ষভাবে সেমিটিক পরিবারের সাথে যুক্ত।
৮। হুইটনি-র ‘প্রাচ্য ও ভাষাগত পাঠ’, পৃঃ ৩৪১।
৯। এম, কুইকেরেজ নামে একজন সুইস্ প্রকৌশলী বার্নে অঞ্চলে পাহাড়ের পাশে বেশ কিছু লোহা গালানোর ফার্নেস আবিষ্কার করে। কিছু যন্ত্রপাতি, লোহার টুকরো ও কাঠকয়লার নমুনাও দেখতে পায়। মাটি খুঁড়ে একটা তুন্দরের মতো পাওয়া গেছে, যাতে চিমনি ছিল, কিন্তু হাপরের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। কয়লা মনে হয় পাখা করে জ্বালানো হত। আর নরম হলে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হত। বিশ ফুট গভীর কাঠকয়লার একটা স্তর দেখা গেছে। সম্ভবত এটা লোহা গালানোর সমসাময়িক, তবে সম্ভবত এগুলো মূল ফার্নেসের নকল। ফিগাইর-এর “আদিম মানব” দ্রষ্টব্য, পৃঃ ৩০১।
১০। প্রিয়াম-এর প্রাসাদ–২য় খণ্ড, পৃঃ, ৪২২।
১১। ইউলিসিসের বাড়ি-অডিসি, ষষ্ঠদশ, পৃঃ ৪৪৮।
১২। অডিসি, সপ্তম খণ্ড, পৃঃ ১১৫।
[প্রথম খণ্ড সমাপ্ত]