১.৩ বিয়ে করে নিয়ে এল

বিয়ে করে নিয়ে এল সোনাদুলির চরের মেয়েকে। চরের মেয়েদের একটু দুনাম আছে। বিশেষ বিক্রমপুরের বর্ণহিন্দুরা চরের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাতে অনেক সময়েই অনিচ্ছুক। কারণ। সম্ভবত, চরে যারা বাস্তু স্থাপন করে, তাদের বংশের প্রাচীনত্ব গৌরব ও অবস্থা একটা সন্দেহ জাগায়। হা-ঘরে মানুষেরাই শুধু চরে ছুটে যায়, জীবনে যাদের স্থিতি নেই। চর-সমাজে বিশ্বাস ও সংস্কৃতির শিকড় বড় আলগা। জীবন উদ্দাম, ভয়হীন। চরের প্রকৃতির মধ্যে আছে একটা উদ্ধৃঙ্খলতা। চরবাসীদের রক্তধারার মধ্যেও সেই প্রকৃতিই প্রবাহিত। চর-সমাজে উত্থান ও পতন বড় দ্রুত। রূপান্তর নিয়ত।

মেঘনাদ বৰ্ণহিন্দু নয়। তা ছাড়া, চর-সমাজের ভাল মন্দ ভাববার অবকাশও ছিল না তার। বিয়েটাই তার কাছে অদ্ভুত অপূর্ব কোনও রূপ ধরে দেখা দেয়নি। প্রয়োজন সম্পর্কেও ধারণা বড় ক্ষীণ। একটা চলতি ব্যবস্থার কাছে স্বাভাবিকভাবে মাথা নোয়ানোর মতো ব্যাপার।

বিয়ের আগের দিনও জিজ্ঞেস করল লালমিঞা, মেঘু ভেবে দেখ। লক্ষ্মণ সা’র নাতনিকে বিয়ে করাই তোর ভাল, আমার মতে।

মেঘু বলল, তা হয় না চাচা।

কিন্তু, সোনাদুলির মেয়ের বাপ বড় গরিব। তোকে একটা সোনার আংটি ছাড়া সে আর কিছু দিতে পারবে না। আর সামান্য দান-সামগ্রী। তবে গরিব হলেও লোকটা ভাল।

মেঘু বলল, সেই ভাল। পরের পয়সায় বাবুগিরি করতে চাইনে।

কথাটা আসলে কোনও বড় আদর্শ-জ্ঞান থেকে মেঘনাদ বলেনি। বলেছে তার নিজের বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে।

বিয়ে করে উঠে এল নতুন বাড়িতে। ফরিদপুরে বোনের বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিল। বোন তখন আঁতুড়ে, আসতে পারেনি। তবু, বউ-ভাতের বাড়িতে লোকের অভাব হয়নি। মাসি পিসি খুড়ি এল অনেক। সেই সঙ্গে সম্পর্কে ভাই বোনেরও ছাড়াছড়ি।

নিমন্ত্রণ রক্ষা করেনি শুধু লক্ষ্মণ সা এবং তার বাড়ির মেয়েপুরুষেরা। উপরন্তু রটনা হল সোনাদুলি চরের এক মুসলমানের মেয়েকে নাকি বিয়ে করে এনেছে মেঘু। ব্যবস্থা করেছে লালমিঞা। মেঘু বিয়ে করেছে টাকার জন্য।

যাক ও সব কথা। বিয়ে সম্পর্কে যে অস্পষ্ট ধারণা ছিল মেঘুর, সেটা কিছুটা পরিষ্কার হয়ে উঠল বউ-ভাতের রাত্রে লীলার সঙ্গে কথা বলে।

মেঘুর জীবনে ছিল অনেক ভাবনা, অনেক চিন্তা। নিয়ত সমস্যায় মন তার ভারাক্রান্ত। কিন্তু সে ভাবনা, চিন্তা ও সমস্যা মাত্র একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। সে তার ব্যবসা ও বাণিজ্য। তার ধ্যান জ্ঞান, তার জীবন মরণ, তার আশা ভরসা। সাফল্য মানুষকে আশা জোগায়। গত বছরগুলিতে যে সংগ্রাম মেঘু করে এসেছে, সে সংগ্রাম তার আজও শেষ হয়নি। সংগ্রামের চেহারাটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। ঘর গদি, যা কিছু সে করেছে, সেটা ব্যবসার জন্য করেছে। বিয়ে ব্যাপারটাকেও সে তার জীবনের কোনও নিভৃত সুখ রহস্য হিসাবে জ্ঞান করেনি। যাদের ঘিরে তার কাজ, তাদের সকলের অভিপ্রায় অনুযায়ী একটা কাজ করেছে সে।

কিন্তু নিজের কারবারের কাছে তার কোনও ফাঁকি নেই, থাকবেও না। যদি সেই ফাঁকি নিয়ে কেউ আসে, তা সে সহ্যও করবে না।

তার প্রেম ভালবাসা সোহাগ, এমনকী, মনের সঙ্গে একটু নিভৃত আলাপ এ সব কিছুই তার  ব্যবসাকে ঘিরে। সে নিজেই একজন কারখানার কর্মী। বিপিনের সঙ্গে নেশা করে সে চিৎকার করে বলে, কলা বিস্কুটের রং দেখেছিস বিপনে, শালা মেমসাহেবের গালের চেয়ে সুন্দর। লোকে খাবে আর মেঘনাদের নাম করবে। নেশা না করেও বলে চিড়িতন মাকা ঝুড়ি বিস্কুট দেখিয়ে, ঠিক যেন একটা ছোট খুকির মুখ। হেসে ফেলবে এক্ষুনি না?

মানুষের যেখানে প্রকৃত প্রেম, সেখানেই প্রকৃত সংগ্রাম। সেখানেই তার প্রকৃত সততা, ধ্যান ও জ্ঞানের স্ফুরণ। ভক্তি শ্রদ্ধাও আসে সেখানেই। মেঘনাদেরও তাই। এখানে তার হৃদয় অমলিন সোনা। এ সোনার হৃদয় পাতে কারুর ছায়া পড়ে না। ভাগ বসাতে পারেনি কেউ। ভাগ দিতেও নারাজ সে।

কিন্তু তার এই ধ্রুবতারাগামী মনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল লীলা। ওই সোনার পাতে ভাগ বসাতে চায় সে। সওদাগর যে লক্ষ্মীর সাধক, সেই লক্ষ্মীর সঙ্গেই লীলার প্রথম বিবাদ। সে যেন চ্যাং মুড়ি কানী মনসার মতো লকলকে জিভে ফোঁস করে উঠল। যে হৃদয় ও মন সঁপে দিয়েছে গদি কারখানার উপর, ভাগ চাই সেই হৃদয় ও মনের।

লীলার পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক নয়, অসুন্দরও নয়। কিন্তু এত অস্বাভাবিক ও অসম্ভব আর কিছু মনে হয়নি মেঘনাদের কাছে।

বউভাতের রাত দুপুর পর্যন্ত সে বিপিনের সঙ্গে এক গুঢ় আলোচনায় ব্যস্ত রইল। বউ-মেয়েরা এসে তাড়া দিয়েছে ঘরে ঢোকার জন্য। বলেছে, নতুন বউ একলা রয়েছে ফুলশয্যার ঘরে, এ কী করছে মেঘনাদ। বিপিনও বারবার উঠে যেতে চেয়েছে রাত্রের মত। মেঘনাদ ছাড়েনি। সে এক বিশেষ আলোচনায় মত্ত।

সে বলল বিপিনকে, জানিস, বিয়ের দিন রাত্রে যখন আমাকে মালপো খেতে দিল, তখন সেই মালপো খেতে খেতে আমার এই নতুন মশলাটার কথা আপনি মাথায় এসে পড়ল। যদি কাজ হয়, তবে এ মিষ্টি বিস্কুটে ঢিঢি পড়ে যাবে সারা দেশে, দেখিস।

অর্থাৎ একটা নতুন মাল তৈরির প্ল্যান ঘুরছে তার মাথায়। এই নতুন মাল যতক্ষণ না সে নিজের হাতে কারখানায় তৈরি করছে, ততক্ষণ তার বিয়ে, বউ, সবই মিথ্যে।

তবু রাত্রি দুটোর পর ঘরে ঢুকল সে। এসে দেখল, লীলা ঘুমোচ্ছ। নতুন কেনা জার্মানি টেকো হ্যারিকেনের উজ্জ্বল আলো সারা ঘরে। ঘরখানি সাজানোও হয়েছে মন্দ নয়।

কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার মুহূর্তেই মেঘুর মনে পড়ে গেল বদরুদ্দিনের মনোহরের কথা। বাতিটা কমাবে মনে করেছিল। কমানো হল না। মনোহরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তার মেঘনাদ মাকা, বিজয়ের কোন উচ্চ শিখরে উঠবে ! সে ভাবনায় ডুবে গেল সে।

মনোহরকে একদিন সে নিয়ে এসেছিল তার কারখানায়। ফিরিয়ে দিয়েছে আবার লালমিঞার কথায়। সেদিন জীবনে আর একটা পাঠ গ্রহণ করেছিল সে লালমিঞার কাছ থেকে। সমব্যবসায়ীকে হিংসা করতে পারবে না কোনওদিন।

এর নাম হিংসা কিনা কে জানে। কিন্তু মনোহর কাঁটার মতো খচ খচ করে তার মনে। বদরুদ্দিনের মনোহর বলতে সকলে অজ্ঞান। মেঘনাদও তেমনি কিছু দিতে পারে না।

আশ্চর্য ! সামনে তার নতুন বিয়ে করা বউ। সে সম্পর্কে যেন সে এখনও অবহিত নয়। হয়তো অবহিত আছে কিন্তু অবকাশ পায়নি এই দিকটির কথা ভাববার।

লক্ষও করল না, ঘরের বাইরে কাদের ফিসফিসানি, দুপদাপ পদশব্দ। বাইরে কাদের চাপা হাসির ঝঙ্কার এই রাত্রিকে এক নতুন রহস্য ও মোহে আচ্ছন্ন করে তুলছে। নতুন ঘরের নতুন বেড়া বড় আঁটসাঁট। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ফাঁক করতে চাইছে কারা। একটি সামান্য ছিদ্র। সে ছিদ্রের ভিতর দিয়ে বিশ্বরহস্যের এক গোপন ও বিচিত্র দৃশ্য ফুটে উঠবে চোখের সামনে। সেই ষড়যন্ত্রের ফিকিরে ঘুরছে একদল নরনারী। সমাজের প্রচলিত এক অদ্ভুত আনন্দ। প্রথম প্রেম ও মিলনের তারা গোপন সাক্ষী হতে চায়। এক দিনের জন্য। প্রথম দিনের জন্য।

শুক্লপক্ষের রাত। কিন্তু বর্ষাকাল। বৃষ্টি নেই, আছে আকাশ জুড়ে ছেঁড়া মেঘের ভিড় আর পুবে হাওয়ার মাতামাতি। পূবালি ঝাপটার শব্দ কী! ধলেশ্বরী তীরের বনপালা মাতিয়ে ঘরের টিনের চালার কানাতে লেগে কেটে খান খান হয়ে যাচ্ছে হাওয়া। পাগলা বাঁশির শেষ রেশের মতো এক বিচিত্র শব্দ উঠছে হাওয়ার। ধলেশ্বরীর বুকে গান ধরেছে কোনও ঘরছাড়া জোয়ান মাঝি। কথা শোনা যায় না, শুধু হাওয়ার বুকে ব্যথিতের তীব্র আর্তনাদের মতো ছুটে চলেছে সে শব্দ গ্রাম গ্রামান্তরের উপর দিয়ে।

সারাদিন ধরে গান করেছে এয়োরা। এ দেশে এয়োদের বলে নাইয়র। তারা গান করেছে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বিবাহ-রাত্রির উপাখ্যান, শিব ও সতীর মিলন কাহিনী।

তাদেরই সুন্দর হাতের আঁকা পিটুলির আলপনা সারা বাড়ির উঠোন ও ঘরের মেঝে ছেয়ে আছে। মাঙ্গলিক মানসিক ব্রত ও পূজার ধান সিঁদুরে ছড়াছড়ি চারদিক।

উৎসরের চিহ্ন সারা বাড়িতে। উৎসবের আলোড়ন সকলের বুকে। বউ-ভাতের উৎসব। মেঘনাদের বুকেও উৎসব জেগেছে। কিন্তু সে অন্য উৎসব, যার এখনও শুরু হয়নি। পূবাইল হাওয়ার শনশন তারও বুকে। কিন্তু সে শনশন কোনও প্রেমোন্মাদ মিলনাকাঙ্ক্ষীর নয়।

মেঘনাদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে উঠেছে সারা মুখ। আর ধীরে ধীরে একটি সূক্ষ্ম হাসির ঢেউ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার মুখে।

আচমকা দমকা নিশ্বাস, রিনিঝিনি ও খস খস শব্দ শুনে মুখ তুলল মেঘু। দেখল, বেড়া কাটা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে রক্তাম্বরী শাড়িতে ঢাকা লীলা। ফিরে দেখল, বিছানা শূন্য।

দেখা মাত্র মনে তার নতুন জোয়ার এল। এক সুখের চিন্তার সঙ্গে, আর এক সুখের অনুভূতি দ্বিগুণ আনন্দে ভরে দিল তার মন। মনে তার কোনও অপরাধ ছিল না। তিন দিন ধরে সে লীলাকে দেখছে। দেখে, কী যে মনে হয়েছে, সে জানে না। মাঝে মাঝে হঠাৎ চাপা অথচ তীব্র একটা অনুভূতি ঝলকে উঠেছে মনের মধ্যে। কিন্তু সে এত সামান্য যে দাগ কাটেনি।

এখন তার নিজের ভাবনার অকূল পাথারে একটা কিনারা পেয়েছে সে। সেই আনন্দেই লীলা তার কাছে বাস্তব মূর্তিতে দেখা দিল। দুই আনন্দ ধারায় পুবে বাতাসের চেয়েও বেশি মাতন ধরিয়ে দিল তার বুকে। বাতি না নিভিয়েই লীলার কাছে এগিয়ে গেল সে।

প্রেমের পাঠ পড়া ছিল না মেঘুর জীবনে। মন ভোলানো কথা জানে না বলতে। পিরিতির রীতিনীতি ও আইনকানুনের নেই অধ্যবসায়। সামনে গিয়ে বড় বড় থাবায় টেনে ধরল লীলার বলিষ্ঠ সুঠাম দুটি হাত। (না ধরাটাই নিষ্ঠুরতা ও প্রেমহীনতা বলে জানে সে ধরল, ধরে কাছে আকর্ষণ করতে গিয়ে দেখল, মানুষ নয়, মূর্তি পাথরের। তাকে নড়ানো-চড়ানো যায় না।

কেন? ওহো, লজ্জা হয়েছে নতুন বউয়ের ! এই স্বাভাবিক ধারণা ও অভিজ্ঞতা-ই বোধ হয় প্রথম সঞ্চয় করল সে নারী সম্পর্কে। হেসে কথা বলতে গিয়ে কথা ফুটল না তার গলায়। নীরবে, আরও জোরে আকর্ষণ করল সে লীলাকে।

কিন্তু না, পাথর তো নয়। লীলা আচমকা হাত ছাড়িয়ে নিল ঝটকা দিয়ে। মেঘু বুদ্ধিমান নয়। কিন্তু ঝটকার মধ্যে লীলার বিরাগ ও বিতৃষ্ণার আঁচ পেল সে। বিস্ময়ে হেসে জিজ্ঞেস করল, কী হল?

লীলার অত ঘোমটার বালাই ছিল না। আশ্চর্য ! নতুন বউয়ের লজ্জার জড়তাও নেই তার ব্যবহারে। সে ফিরে তাকাল মেঘনাদের দিকে।

সে চোখে আগুনের ফুলকি। সোনাদুলির চরের শুকনো বনে জ্বালানো আগুনের লকলকে শিখা জ্বলছে তার চোখে। পরনে তার রক্তাম্বরী শাড়ি। সর্বাঙ্গ ঘিরেই তার সেই অগ্নিশিখা। এক মুহূর্ত মেঘুকে দেখে, অন্যদিকে সরে গেল সে।

মেঘু তাকিয়ে দেখল। মুখের হাসিটি তার যাই যাই করেও যায় না। বউ তার কেন রাগ করল, কিছু বুঝতে পারল না সে। কিন্তু রাগ করেছে, এটা বুঝেছে। হয়তো কোনও কারণ ঘটেছে তার। কিন্তু প্রেমের কুঁড়ি ফুটছে তার বুকে। লীলার রাগ ঘোচাবার জন্য আবার তার কাছে গিয়ে হাত দুটি টেনে ধরল। বলল, কী হয়েছে তোমার?

লীলা ফিরে তাকাল। চোখের আগুন একটু যেন স্তিমিত হল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল স্বামীকে। তারপর আবার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। ৪৬

মেঘু ছাড়ল না। বলল, কী হয়েছে, বললে না?

সে কথা কি বলতে হয়?

বলতে হয়। মেঘনাদের মতো মানুষকে বলতে হয় সে কথা। কিন্তু সোনাদুলির উনিশ কুড়ি বছরের মেয়ে লীলা সে কথা বোঝে না। জীবনের অভিজ্ঞতা তার সম্পূর্ণ আলাদা। সে আলাদার মধ্যেও আছে একটু বিশেষ রকম।

তা হলে মেঘনাদের অতীত রোমন্থনের আড়ালে সংক্ষেপে বলে নিতে হয় লীলার কাহিনী।

চরে মানুষ থাকে দু রকম। এক দল দিবানিশি তেলহীন প্রদীপের মতো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে সে প্রাণকে। আর মুষ্টিমেয় কয়েকজন ওই প্রদীপ থেকেই শুষছে তেল। এর মাঝখানে যারা, জমিহীন সেই এক দরিদ্র দোকানদারের মেয়ে লীলা। চর-জীবনের উদ্দামতার মধ্যে সে মানুষ হয়েছে।

ঘরে তাদের লক্ষ্মী গণেশের পূজা, লৌকিক অলৌকিক আচার অনুষ্ঠান ছিল প্রায় সবই। কিন্তু চরের ঝোড়ো হাওয়ায় আচার অনুষ্ঠান, বাঁধন বড় শিথিল। জৈবিক তাড়না হল সবচেয়ে বড়, মুখোমুখি ও অঙ্গাঙ্গী। প্রকৃতির সঙ্গে হাতাহাতি করে জীবনধারণ।

 লীলা দেখেছে, একটু বড় হতে না হতে তার দাদারা ঘর ছেড়ে চলে গেছে বিদেশে। যে সব ভাইয়েরা আছে, তারা কেউ লক্ষ্মীর সেবা করে না। চাষি ও জেলেদের সঙ্গেই কাটে তাদের জীবন।

চরের হাওয়ায় শুধু ক্ষুধা। দিবানিশি জঠর ও বুক খা খা করে। সেই ক্ষুধা থেকে লীলা রেহাই পায়নি। ছোটবেলা থেকে পায়নি পেট ভরে খেতে। তবুও চরের জল বাতাসে লকলক করে বেড়ে উঠেছে দেহ। বাপের ঘরের ভাঙা গৃহস্থালীর উপর কোনওদিন নির্ভর করতে পারেনি। আটোল নিয়ে ঘুরেছে জলে জলে। ঘুরেছে জঙ্গলের বুকে, চরাশ্রয়ী অতিকায় গোসাপের সঙ্গে সঙ্গে। কোঁচড় ভরে এনেছে জীবন্ত কাঁচা মাছ, আর মাথায় করে শাকের বোঝ। সে জন্য চেলা কাঠের এলোপাথাড়ি মার খেয়ে পড়ে থেকেছে উঠোনে। তবু, ঘরের সবাই মিলে খেয়েছে ওই শাক মাছ-ই। দোকান তো নামে মাত্র। ধানচালের সংস্থানটা হত কোনও রকমে।

পনেরো থেকে ষোলোয় পড়তে না পড়তে ঝুমির দিকে তাকানো যেত না আর। পেটের সঙ্গে দেহের আর একটা ক্ষুধাও ঝুমির মনে নতুন আকাঙক্ষার সৃষ্টি করছিল। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা ছিল সুন্দর। চোখেমুখে তার এক বিচিত্র ভাবের সুষমা। উদ্দামতা ঘোচেনি, প্রকৃতির সঙ্গে তার এক অদ্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠছিল।

কিন্তু চরের মাঝে লুকিয়ে বুকে হাঁটে যে গোসাপ, গহন অরণ্যের অন্ধকার থেকে তার কুটিল দৃষ্টি এড়ায়নি লীলাকে। লীলা নয়, মুদি নকুড় সা’র মেয়ে ঝুমি। চরের ঘন সবুজ অরণ্যের মতো কালো ঝুমি। তার বলিষ্ঠ উদ্ধত দেহ, মেঘরাশির মতো চুল, তার ঔদাসীন্য, ঝড়ের মতো হাসি গোপনে বয়ে নিয়ে এল আর এক ঝড়, অদৃশ্যচারী কামার্তের বুকে।

সেই দিন ! কী ভয়াবহ, কী বীভৎস দিন। দুপুরের চরে এলোমেলো ঝড়। মানুষের চোখে ঘুম।

চরের বনের ভেতরে প্রবাহিত শীর্ণকায়া লতাই খাল। ঝুমি কচ্ছপের ডিমের সন্ধানে রত। টের পেল না, কে এসে বাঁধল মুখ। টেনে নিয়ে গেল ঝোঁপের অন্ধকারে। অঙ্গ বিবসনা। দেহের উপরে তার হিংস্র জানোয়ার।

আশেপাশের আস্তানার গোসাপকুল তাদের অপলক, বিস্মিত চোখে আর লকলকে জিভ বার করে দেখল এই দৃশ্য। দেখল, তাদের চেয়েও দীর্ঘাকৃতি, শক্তিশালী হিংস্র দুটি জীব পরস্পর হাতাহাতি দাপাদাপি করছে। তাদের নিজেদের ল্যাজের ঝাপটায় মানুষের অঙ্গ পচে যায়। কামড়ে ধরলে ছাড়ে না মেঘের গুরু গুরু ধ্বনি না শোনা পর্যন্ত। সেই গোসাপেরা লাঙ্গুল গুটিয়ে পালাল এই বিরাটকায় পশু দেখে ।

মানুষটাকে চিনল ঝুমি কিন্তু তার কুমারী জীবন ও যৌবনের এই ভয়ঙ্কর আক্রমণকে পারল না। বাধা দিতে। মনে তো কোনও পাপ ছিল না। অপমানে বেদনায় যন্ত্রণায় সমস্ত কথা বলেছিল মাকে। মা বলল বাপকে। বাপ কাটারি নিয়ে এল ছুটে খুন করতে। পালাবার মুখে কোপটা লেগেছিল পিঠে। আজও আছে সেই দাগ।

তারপরেই প্রতীক্ষা এর পরিণতির জন্য। কিন্তু সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত করল সে বাপ মাকে। গর্ভসঞ্চার থেকে বেঁচে গেছে ঝুমি। তবে চরের বুকে রাষ্ট্র হয়েছে এই কথা। এমনকী দাবি করা হল ঝুমিকে দিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ঝুমি রাজি ছিল না।

ফলে প্রতি মুহূর্তে আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু উদ্দামতার সঙ্গে ভয়ঙ্করী হয়ে উঠেছিল ঝুমিও। সে ভয় পায়নি সেই সব অদৃশ্যচারী পশুদের। ভয় পায়নি, কিন্তু জীবনের বিশ্বাস ও সংস্কার গেল ভেঙে। যে দেহকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই দেহকে ঘিরে গঠিত হল মন ও চরিত্র। পুরুষকে। দেখল সর্বভুক কাকের মতো ঘৃণা ও করুণা নিয়ে। করুণাটা নারী হিসাবে নয়, ভাত ছড়িয়ে নয়, শুধু দেখিয়ে, লোভী কাকের খেলা দেখার মতো। একদিকে ঘরে বাইরের ধিক্কার ও ঘৃণা, আর একদিকে আবার অধিকাংশের লোলুপ দৃষ্টি তাকে নির্লজ্জ করে তুলল। দূর করে দিল মনের ভয় ও শ্রদ্ধা।

এর মাঝে, দেহকে যে সে সর্বস্ব জ্ঞান করেছে, সে সর্বস্বতার মধ্যে নিজের প্রতি গড়ে ওঠেনি। কোনও মমত্ববোধ। বোধ হয়, গড়ে ওঠাই সম্ভব নয়। এই অকল্পিত কলঙ্ক মনে তার কিছু বিকারের সৃষ্টি করেছে। উদ্দামতার মধ্যে যে কোমলতাটুকু ছিল, নতুন যৌবনের ভারে যে ভরা গাঙ্গের শান্তভাব ফুটে উঠেছিল, সেটুকু গেল দূর হয়ে।

আগুন লেগেছে তার সর্বাঙ্গে। তার চোখে মুখে, তাকে কথায় হাসিতে শুধু আগুন ঝরে পড়ে। কলঙ্ক তার অন্ধকারে ফেলেনি মুখ খুঁজড়ে। বোধ হয় পরিবেশও দায়ী ছিল সে জন্য অনেকখানি। এই আগুনে তার জীবনের প্রতি ভালবাসার সোনার কাঠিটি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল অনেকটা। অভাবগ্রস্ত জীবনে ছিল না তার স্বার্থপরতা। এখন অঙ্কুরিত হল তার মনে স্বার্থপরতার একটি নতুন বীজ।

ঘর ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে উদিত হয়েছে তার। কিন্তু আশ্চর্য ! এই মন নিয়েও পারেনি সে ঘর ছাড়তে। তার চেয়ে বিস্ময়ের কথা, হৃদয় ও মনের এই সব পোড়ানোর আগুনের মাঝেও ছিল তার একটি সামান্য ব্যথার অনুভূতি। সে ব্যথা এক বিচিত্র বিরহের। ভাল না বেসে, প্রেম না করে, এ বিরহ কার জন্য তা সে জানত না। কখনও কখনও আচমকা ব্যাকুল হয়ে উঠত তার মন। বুকের মধ্যে দুটি অন্ধ চোখ হাতড়ে ফিরত যেন কাকে, কোন বস্তুকে।

এর তিন বছর পর হল তার বিয়ে। মনে তার যা-ই থাক, বিয়ের প্রতি যে তার কোনও বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা নেই, এটা ফুটে উঠল তার হাসি ও কথার মধ্যে।

কিন্তু সোনাদুলির এই কলঙ্কবতীর সৌভাগ্যে বিস্মিত ঈষা হয়েছিল অনেকের মনে। মেঘনাদ দাসের মতো গদির মালিকের ঘরণী হতে চলেছে ঝুমি, এ বড় অভাবিত। এমনকী বাদ্যবাজনা শুধু নয়, ঝুমির বিয়েতে পদ্য-উপহার ছাপা হয়ে এল ঢাকা শহর থেকে।

এ বিয়ের যোগাযোগকারী লালমিঞা বা অন্যান্য দু একজন যে কলঙ্কের কথা না শুনেছে তা নয়। লালমিঞা গ্রাহ্য করেনি ব্যাপারটাকে। কুৎসা রটনার ব্যাপারটা সে চিরকাল বড় ঘৃণা করেছে। উপরন্তু লীলার বাবাকে সে তার ক্ষুদ কুড়োটুকু দিয়েও সাহায্য করেছে বিয়ের জন্য। সেটা বোধ হয় মেঘুর কথা ভেবেই।

মেঘনাদের কানে অনেকে তুলতে চেয়েছে কথাটা। কিন্তু মেঘুর দেহটা শুধু উঁচু নয়, মনটা তার এত নাগালের বাইরে যে, সেখানে পৌঁছুতে পারল না কেউই। সুতরাং বিয়ে হল নির্বিঘ্নে।

ঝুমির মনের যে দিকটা চাপা ছিল তার নিজের কাছে, বউভাতের রাত্রে সেটুকু ধরা পড়ে গেল। অর্থাৎ, মেঘুর কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছিল সে। কাককে ভাত ছড়াবার মতো নয়, মরেও না মরা তার কুমারী মন নিবেদন করতে চাইছিল পুরুষকে। একটি নতুন দিক উন্মেষের অপেক্ষায় ভয়ে ও আনন্দে কাঁপছিল তার বুক। বিদ্রূপ, ঘৃণা ও লজ্জাহীন বহ্নিশিখা ছিল তার চোখেমুখে কথায়, তা শান্ত হয়ে আসছিল।

কিন্তু সারা বাড়ি, আত্মীয় কুটুম্ব, এয়ো নারী ও সে নিজে যখন ব্যাকুলভাবে প্রতীক্ষা করছে, তখন তার স্বামী কারখানার একটা মজুরের সঙ্গে হেসে হেসে কথায় ব্যস্ত। ৪৮

ছেঁড়া মেঘের আড়াল থেকে অনেকবার উঁকি মেরে গেছে চাঁদ। পাগলা পুবে-হাওয়া আকুল করেছে মন। প্রহরের মনে কেটে গেছে প্রহর। সে আসেনি।

যখন এল, তখন অপমানে সেই আগুনের হলকা লেগেছে আবার ঝুমির মনে। এ শুধু অবহেলা বলে মনে হল না। সংশয় হল, মেঘনাদ অন্য কোথাও হৃদয় ও মন বাঁধা রেখেছে কিনা।

.  

মেঘনাদ আবার বলল, কী হয়েছে বললে না?

প্রথম রাত্রির প্রেমের মতো লজ্জা ভয় ও নম্রতা ছিল না লীলার। সে বলল তীব্র গলায়, যেখানে থেকে আসা হয়েছে সেখানে গেলেই হয়।

মেঘনাদ বলল সরলভাবেই, কোথাও নয় তো। বিপিনের সঙ্গে কথা বলছিলাম।

অবলীলাক্রমে লীলা বলল, আজকের রাতেও? এত কী কাজের কথা?

মেঘনাদ ভেসে গেল নিজের স্রোতে। ভাবল, তার নবপরিণীতাই হবে আসল শ্রোতা।

উৎসাহে হেসে উঠে বলল, তোমাকে তা হলে বলি শোনো। কাউকে যেন বোলা না এখন।

এই মুহূর্তে লোকটিকে খুব মন্দ মনে হল না ঝুমির। কৌতূহলও হল খানিকটা। সে নীরবে তাকিয়ে রইল মেঘুর দিকে।

মেঘু বলল, বদরুদ্দিনের মনোহর বিস্কুটের নাম শুনেছ তো?

লীলা শুধু শোনেনি, খেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু তার সঙ্গে আজ রাত্রির, ফুলশয্যার কী সম্পর্ক।

মেঘু বলল, আমার মাথায়ও একটা নতুন বিস্কুটের মশলা ঘুরছে। যদি ঠিকমতো কাজটা হয়, তা হলে আর শালা দেখতে হবে না, মাইরি বলছি। কী নাম দেব জানো? মেঘনাদের মালপো।

বলে তার এই পরিকল্পনায় ও অনাগত সাফল্যের আনন্দে হেসে উঠল। আবার বলল, লোকে বিস্কুটের মধ্যে মালপোর স্বাদ পাবে। দেখব শালা, মনোহরকে ছাড়ানো যায় কিনা। তারপরে আর একটা মাল বের করে ছাড়ব তোমার নামে, কী রকম হবে, আঁ?

 অপমানটা আরও বেশি বাজল লীলার মনে। তার অভিশপ্ত জীবনের চাপা-পড়া বুকে যে আকাঙক্ষাটুকু ছিল নিজেরই অজান্তে, মেঘনাদের সরল হাসিটি তাকে উঠল ব্যঙ্গ করে। তার লাঞ্ছিত জীবনের সুর্যোদয়ের মুখে এ কোন পুরুষ। হৃদয়ে যার মেঘনাদের মালপোর ভাবনা। বিতৃষ্ণায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আজকেও সেই ভাবনা?

মেঘনাদ দেখল তার বউয়ের চোখ দপদপ করছে। ফুলে উঠেছে নাকের পাটা। তবু বলল, ভাবনা এসে পড়ল তো, কী করব। মাইরি, হাত নিশপিশ করছে কখন কাজে হাত দেব। বলে সেই আনন্দেই দুহাত বাড়িয়ে সোহাগভরে জড়িয়ে ধরল লীলাকে।

লীলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এ ছাড়া কি আর কিছু জানো না?

আর কী জানব?

 তবে চিরকাল ও-ই করোগে।

মেঘু অবাক হয়ে বলল, তা ছাড়া আর কী করব আমি? এই তো আমার চিরকালের কাজ।

চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছা করল লীলার। দূরে সরে গিয়ে চাপা তীব্র গলায় বলে উঠল, তবে বিয়ে করলে কেন?

মেঘু আরও অবাক। বলল, বাঃ, বিয়ে তো সবাই করে।

না। তোমার মতো মানুষ মালপো বিস্কুটকে বিয়ে করে।

মেঘুর ইচ্ছা হল হেসে বলে, ঠিক বলেছ। কিন্তু এত রাগারাগি হলে কী করে বলা যায়। কী বলবে ভেবে না পেয়ে সে নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল লীলার দিকে।

কিছুক্ষণ পর লীলা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, এ সব বুঝি তোমার আমার চেয়েও বড়?

মন কিছুটা উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। একেবারে সত্য কথাটাই বেরিয়ে পড়ল তার মুখ দিয়ে, সব কিছুর চেয়ে বড়।

চকিত দোলানিতে রক্ত শাড়ি গলিত আগুনের মতো ঢেউ দিয়ে উঠল। লীলা বলল, ইস! কেন হবে তা?

কথার আর ধৈর্য ছিল না মেঘুর। এ কি নতুন বউ? লজ্জা ভয়, কিছুই নেই। সে চুপ করে রইল তবু।

তারপর এক সময়ে লীলার কান্নার শব্দে চমকে উঠল। কাছে গিয়ে তুলে নিল লীলাকে নিজের দুই হাতে। মেঘুর শক্তির কাছে লীলা একেবারেই তুচ্ছ। চেষ্টা করেও ছাড়াতে না পেরে ভেঙে পড়ল তার দেহলতা।

তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মেঘু বলল, তুমি পাগল! বলতে বলতে আবেগপ্রবণ মেঘু দু হাতে বুকের কাছে টেনে নিল তাকে।

ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়ল মেঘু। কেবল বৃথা আক্রোশে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল লীলা তার সারা বিছানাটা জোড়া মস্ত বুকটার দিকে।

পোহাল ফুলশয্যার কালরাত্রি। বউয়ের মুখ কালো। আর ঝকমকে পোশাক ছেড়ে, তেলচিটে ন্যাকড়া পরে মেঘু ছুটে গেল গদিতে।

কিন্তু এর পরের জীবনে মেঘুর বাসনা ও কামনার পথে লীলা একটা বাধার মতো দাঁড়াল। মেঘনাদের মালপো বিস্কুট নাম কিনল দেশ জুড়ে। সবাই ভাবল, নতুন বউয়ের আগমনে নতুন করে লক্ষ্মীলাভ ঘটল মেঘুর। এ রকম একটা চাপা বিশ্বাস মেঘুরও হল। কিন্তু সে জানত, তার জীবনের এ সাফল্যকে ঘৃণা করে ঝুমি। অভিশাপ দেয়, যেন ঘুচে যায় এ সব।

এদিকে হল না যখন, লীলা অন্য মূর্তিতে দেখা দিল অন্য দিকে। ঘরে সে পরবাসিনী। আজ যায় শ্রীনগরের রথের মেলায়। কাল যায় ঢাকা শহরে টকি দেখতে। কোনও কোনও সময় মেঘনাদকেও যেতে হয় বইকী । মেঘনাদের হৃদয়ের একটি চাবিকাঠি বাঁধা পড়েছিল তার আঁচলে। সে চাবি মেঘুর নিভৃত যৌবনদ্বারের। দ্বার উন্মোচনের দক্ষিণা আদায় করতে ছাড়েনি লীলা।

কিন্তু ঘরে কোনও শ্রী নেই। কেন না, এ ঘর কোনও মায়া দিয়ে বাঁধতে পারল না সোনাদুলির মেয়েকে। এ ঘরে মেঘুর জন্য রচিত হল না কোনও সুপ্ত শান্ত সুন্দর ও প্রেম দিয়ে ঘেরা একটি সুখের কোণ। ছুতোরের ঘরে একটি বদনাম আছে।

ছুতোরের তিন মাগ,
ভানে কোটে খায় দায়,
থাকে থাকে যায় যায়।

এ ঘরের রূপ হল তেমনি। কারটা কে দেখে? এমনকী, সংসার চালাতে সামান্য যে রান্নাখাওয়া, সে নিয়মেও ব্যতিক্রম দেখা দিত কোনও কোনও সময়। লীলা তখন হয়তো কোনও বাড়িতে গোলোকধাম পেতে খেলতে বসেছে।

দুর্নাম রটেছে লীলার নামে। তবু চরিত্রের গতি বদলাল না তার। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে বিবাদ হয়েছে অনেক। বছর কয়েক পরে আর হয় না। একই ঘরে তাদের পরস্পরের বিসুখী জীবন।

সেটা সয়ে গেল মেঘনাদের। কেন না, তার জীবনের পনেরো আনা জুড়ে ছিল যে গদি ও কারখানা, সেখানকার শ্রীবৃদ্ধিই তার হাসি আনন্দ সান্ত্বনা । লীলার খেয়ালের জন্য অর্থ দিয়ে সে খালাস। আর সে অর্থ দিতে কার্পণ্য করেনি সে।

কিন্তু লীলা সব সময় এতেই তুষ্ট নয়। তার অনেক খেয়ালের সঙ্গী হিসাবে সে চায় মেঘনাদকে। তখনই লাগে সংঘর্ষ। বিশেষ কারখানা ও গদি যখন ছেড়ে আসতে হয় তাকে।

দিনে দিনে শুধু লক্ষ্মীলাভ নয়, কারখানার অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। সেই কারখানা গদিতে পর্যন্ত লীলার গতিবিধি। এমনকী কারখানার কর্মীদের মধ্যে কত্রী হিসাবে নিজের প্রতাপ খাটাতে চায় সে। ফলে তার প্রতি একটা বিদ্বেষ ছিল সকলের। শুধু বিদ্বেষ নয়, তার নির্লজ্জ ব্যবহার কারখানার মধ্যে একটা আলোচনার বিষয়বস্তু। অনেকের অশ্লীল গল্পের খোরাক।

কারখানার প্রতি কর্তৃত্ব সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর করেছে মেঘনাদকে। তীব্র ঘৃণায় নিজের জীবন থেকে সে দূর করে দিতে চেয়েছে ঝুমিকে। আঘাতের পর করেছে আঘাত। কিন্তু ঝুমি কখনও দূর হয়নি। সে ক্ষমতা আর ছিল না ঝুমির। মনের গভীরে কিছু ছিল কিনা কে জানে কিন্তু তার রক্তস্রোতের মুখে একটা বাঁধ খাড়া হয়েছে। স্রোত গতিহারা হয়েছে। এখন শুধু বদ্ধ জলার আবর্ত।

এ অবস্থার একটা পরিসমাপ্তির আশা করা গিয়েছিল লীলার সন্তান হওয়ার পর। কিন্তু সন্তান হতেও যা ছিল, মরে যাবার পরেও তাই।

তবে ঝুমির আসায় মেঘনাদের কিছু বুদ্ধি লাভ ঘটেছে। তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত বুদ্ধি। সে বুঝল, ছোটকাল থেকে রক্তক্ষয়ী পরিশ্রমে যে রক্তস্তম্ভ সে গড়েছে এবং গড়ছে, তার চরম শত্রু ঝুমি চিরকালই থাকবে তার কাছে। প্রতিমুহূর্তে একে দাবিয়ে রেখেই, তাকে অগ্রসর হতে হবে তার পথে।

 তাই তার জীবনে এই লীলার পরিচ্ছেদ শুধু দীর্ঘ নয়। এর বোধ হয় আর শেষ নেই।

তবুও লীলা যখন তারই সামনে খিলখিল করে হেসেছে কারখানার লোকের সঙ্গে, বিপিনকে রক্ষী হিসাবে নিয়ে নৌকায় ভেসে গেছে দূর দূরান্তের মেলায় কিংবা শহরে, তখন তার বুকের মধ্যে উঠেছে টন টন করে। এই টনটনানির আর এক নাম যে ভালবাসা, তা সে জানত না। আর স্বীকারও করত না কোনওদিন। কেন না নিজের কাছে এই অসহ্য বেদনাদায়ক সত্যটিকে স্বীকার করলে বুঝি সে ভেঙে পড়ত।

তবে কারখানার কারিগরদের সে বিশ্বাস করত। সে মালিক বটে, কিন্তু এখনও সে পরিচয়টা বড় নয়। কারণ, সে নিজে একজন কারখানার কর্মী। এই লোকগুলির হৃদয় ও মনের চেয়ে পরিচিত তার কাছে লালমিঞাও নয়। আপন হতে পারে অবশ্য।

আর বিপিন। তাকে অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্ন নেই। তাকে সবাই বলে হেড মিস্তিরি। তা ছাড়া মেঘুর সে বন্ধু। তার চেয়েও বড় কথা, এই বিপিনই, ঝুমিরও খুব প্রিয়পাত্র। কাজে অকাজে সে ডেকে পাঠাবে বিপিনকে। খবর নেবে সব বিপিনের কাছ থেকে। এমনকী বিপিনের খবরও। বিপিন যে বাজারের মেয়েমানুষটির কাছে যায়, তার সংবাদও। শুধু দুটি ব্যাপারে বিপিনের আপত্তি ছিল। ঝুমি যখন তাকে প্রলুব্ধ করতে চাইত। যে প্রলোভনের মধ্যে ছিল না কোনও প্রেম। প্রেম তো নয়ই, প্রলোভনের অর্থই অস্পষ্ট। আর যখন ঝুমি মেঘুকে ও মেঘুর চেহারাকে নিয়ে, বোকা নিষ্ঠুর বলে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করত তার কাছে। কিন্তু এখন সেটা গা-সওয়া হয়ে গেছে তার। যেমন মেঘুর সয়ে গেছে অনেক কিছু।

মেঘু ও ঝুমির চেয়ে বিপিন অনেক বড়। তবু এ দুজনের মাঝখানে সে একটি সেতুর মতো। তাদের দু জনেরই হৃদয়তলের সে সাক্ষী। মেঘুর সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে বিপিনের মতভেদ ছিল। সত্য, এ ব্যবসা বড়, কিন্তু ঝুমিকে এত দূরে সরিয়ে কেন রেখেছে কর্তা।

মনে আছে মেঘুর, বিপিন তাকে একদিন বলেছিল সেই কাহিনী। গত বছর নারায়ণগঞ্জের ব্রহ্মপুত্রে লাঙ্গলবন্ধ স্নানে গিয়েছিল ঝুমি বিপিনকে সঙ্গে করে। নৌকায় করে গিয়েছিল। সারারাত্রি ধরে ঝুমি কথা ও ভাব-ভঙ্গিতে বিপিনকে নানারকম ইঙ্গিত করেছে। বিপিন জানত, ওটা তার কী ছুঁড়ির খেলা মাত্র। তাকে নিয়ে একটু খেলা করতে চায় সে। রাগ হয়েছিল বিপিনের। ইচ্ছা হয়েছিল, জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কর্তীর খেলার সাধ মিটিয়ে দেয়। মনে হয়েছিল, কিন্তু নারী-ভুখ সেই জানোয়ারটা ছিল না তার মধ্যে। সে বলেছিল, দেখো ঠাকরুন ঠিক বয়সে বে করলে তোমার মতো একটা মেয়ে আমাকে বাপ বলে ডাকত। শুধু শুধু আমাকে ব্যস্ত কোরো না।

ঝুমিও বিপিনকে বলে বিপিন-দা। বলেছিল, ঠাকুরদার বয়সী পুরুষ আমাকে দেখলে দাড়ি ঘষে, তুমি তো বাপের বয়সী গো বিপিন-দা। বাজার ঘুরে ঘুরে চোখ তোমার খারাপ হয়ে গেছে।

বিপিন জানত ঝুমির সঙ্গে কথায় এঁটে ওঠা দায়। আর পাত্ৰাপাত্র জ্ঞান ও রুচিবোধেরও ধার ধারে না সে কথায়। সে বলেছিল, একটা কথা বলব ঠাকুরুন?

 একটা কেন, দশটা বলো না।

কর্তার পরে কি তোমার একটুও দয়া মায়া নাই। অমন সোনার মানুষ

সোনার মানুষ তো তোমাদের কাছে। মাস গেলে মাইনে পাও। ইচ্ছে করলে ঠকাতেও পারো। মাথায় হাত বুলিয়ে নিতে পারো দু পয়সা বেশি। তাতে আমার কী?

বলতে বলতে ঝুমির চোখে দেখা দিয়েছিল আগুনের ফুলকি। বিপিন বলেছিল, কেন, কর্তা তো তোমাকে কোনওদিক থেকে বঞ্চিত করেনি?

তীব্র ঘৃণায় জ্বলে উঠে বলেছিল ঝুমি, বেশ্যার ঘর করো, তুমি বুঝবে কী করে? পয়সা ছাড়া আর বঞ্চনার কারণ বোঝো না। মেয়েমানুষ পড়ে থাকবে, তোমরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারপর ফিরে যাবে নিজের কাজে, না? কাজে যদি অত মন প্রাণ ঢেলে থাকো, তবে মেয়েমানুষ ঘরে আনার শখ। কেন? ওটাও বাজারে সেরে এলেই হয়?

গৃহস্থ মেয়ের মুখে এ সব কথা শোনা বিপিনের অভ্যাস নেই। কষ্ট হচ্ছিল তার। তবু শুনতে হচ্ছিল। কেন না, ঝুমির এমন মূর্তি সে দেখেনি কোনওদিন। ঝুমি আরও বলেছিল, তোমার কতা একটা কারখানার পোকা। মরলে ওকে গুঁড়িয়ে ময়দা করে তোমরা বাজারে ছাড়তে পারবে মেঘনাদের মালপো বলে। গদি ওর প্রাণ। মনে নেই, ফুলশয্যার ঘরে পড়েছিলুম একলা, আর তোমাদের কতা রাত কাবার করে এসে শোনাতে এল নতুন মশলার কথা আর মালের কথা। ও-ই কি বিয়ে আর ও-ই কি পুরুষ? প্রাণের ভাগ নেই, মায়া মমতা কীসের? মেয়েমানুষ তোমাদের চেয়ে বুঝি খাটো? কোন বিষয়ে? তোমরা ঠকাতে পারো, আমরা পারিনে? আমরা পারিনে লণ্ডভণ্ড করতে সব? বিনা পুজোয় তুষ্ট কে? তা নয়, তোমরা কী রকম জানো? তোমরা পারো, মেয়েমানুষকে যা করে হোক, ঘাটে অঘাটে, যে কোনও সুযোগে তার সব চুরি করে নিতে। চোরের দল।

কর্ত্রী নয়, তণ্ডলের অগ্নিশিখা। এত জ্বালা কীসের? কথা বলতে পর্যন্ত ভয় হয়েছিল বিপিনের। বাপরে বাপ ! মারবে নাকি? কিন্তু কী কি তার ঠিক তাই? লোকটি তো সে রকম হৃদয়হীন নয়। দেখলে অবশ্য মনে হয় তাই। সন্দেহ নেই, কারখানার পোকা ভেবে ভুল করেছে কর্তী। কীর নিজের মনে কোথায় ফাঁকি আছে। কতাকে চিনতে পারেনি।

তারপরেই তীব্র হেসে বলেছিল ঝুমি, আমি তোমার কর্তার বউ, তাই। নইলে, একলা পেয়ে তুমি কি আমাকে আজ ছেড়ে দিতে বিপিন-দা? দেখো, আমার দিকে তাকিয়ে দেখো একবার।

বিপিন তাকিয়েছিল। ধকধক করে জ্বলে উঠেছিল তার চোখ। জ্বালা ধরে গিয়েছিল শরীরে। বিস্রস্ত বসনা ঝুমি। এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর দেহ কোনওদিন দেখেনি সে। পরমুহূর্তেই উঠে গিয়েছিল সে সেখান থেকে, নৌকা থেকে নেমে যাওয়ার জন্যে।

ঝুমি বলেছিল, কোথায় যাও?

বাড়িতে?

কেন?

আমি থাকব না।

তুমি থাকবে না, আর দশ জন আসবে। লাভ কী তাতে?

তুমি সেইটাই চাও।

ঝুমি এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলেছিল, ভিতু কোথাকার!–বেশ, যাও।

নৌকা থেকে নেমেছিল, তবে যেতে পারেনি বিপিন। কিন্তু, ঝুমির কথায় একটা যুক্তি ছিল। যুক্তি নয়, একটা দাবি। একটা বিচিত্র দুর্বোধ্য দাবি। লীলার মতো মেয়ের এই অদ্ভুত অজানা দাবিটাই বোঝাবার চেষ্টা করেছিল সে মেঘনাদকে। বলেছিল, কর্তা যদি একটু ঘরের অর্থাৎ বউয়ের দিকে মন না দেয়, তা হলে ফ্যাসাদ কাটবে না।

মেঘু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, মন আর কেমন করে দেব, বলতে পারিস বিপিনদা? আমি তো জানি না। যাক, ও সব কথা আর বলিসনে।

জীবনের এ অভিশাপকে স্বতঃসিদ্ধভাবে মেনে নিয়েই মেঘনাদ জীবনের পথে চলবে নিয়ত। ওটাই তার বিধি বলে সে জানে। একদিন সে হরিনামের কণ্ঠী ছিঁড়ে ফেলেছিল তার গলা থেকে। মরবার সময় ছিঁড়েছিল তার বাপ। আর কোনওদিন সে ওই কণ্ঠী গলায় পরেনি। সাহা-গদির মালিকদের মতো সকাল সন্ধ্যায় জপে না মালা। ভিক্ষা করে না হরিভক্তি। নিজের শ্রম ও চিন্তার উপরই সে নির্ভরশীল। সুতরাং, ঝুমির কাছে তার কিছু প্রাপ্তির আশা নেই। সে যা আছে তাই থাকুক।

এই ঝুমির নামের নতুন ঝুমির ঝুড়ি বলে বিস্কুট বের করেছে সে। সারা দেশে এই নিয়ে কত হাসাহাসি, গান বাঁধাবাঁধি পর্যন্ত হয়েছে।

মেঘার মালপো ঝুমির ঝুড়ি।
খেলে পাবে ঝুমি এক কুড়ি ॥
অথবা
ঝুমির ঝুড়ি মেঘনাদে খায়।
মেঘার মালপো দিল্লিতে যায় ॥

বদরুদ্দিনের মনোহর টিকে আছে। কিন্তু তার যৌবন গেছে চলে। সেটা ছিল তার জীবনে ছোট একটা কাঁটা। কিন্তু ঝুমির মতো এত বড় অভিশাপ আর কী আছে? যে তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে নিয়ত। ফিরবে তো চিরজীবন ধরেই। ছিল, এর চেয়ে বড় অভিশাপও ছিল তার ভাগ্যে। তাই তাকে আজ এই গাড়িতে উঠতে হয়েছে। তাই বেজেছে স্মৃতির সেই বিষের বাঁশি। তাই এক সংশয়াম্বিত অজানার উদ্দেশে অবিরাম ছুটে চলেছে সে এই মেল গাড়িতে।

ঝুমিকে বুকে মাথা রাখতে বাধা দেয়নি সে। দিলও না আর। ঝুমি আরও লেপটে এসেছে তার গায়ে। তার খেয়াল নেই যে, লোকে তাদের এরকম ভাবে দেখলে কী ভাবতে পারে। সেই ছেলেটা কী বিচিত্র ! কখন বেঞ্চ বদলে লীলার পাশে পায়ের কাছে বসে ঢুলতে আরম্ভ করেছে।

হুইশলের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে ছুটে চলছে গাড়িটা। এ রাত্রি কি পোহাবে? যেন না পোহায়। এই গাড়ি যেন কোনও দিন গন্তব্যে না পৌঁছায়। মেঘ ফুঁড়ে যেন হেসে না ওঠে চাঁদ। দিগন্ত যেন পরিষ্কার ভেসে না ওঠে চোখের সামনে। মেঘনাদ জানতে চায় না, দেখতে চায় না কোথায় এসেছে। সে।

অভিশাপের সেই স্মৃতি ফুটে উঠল তার মনে।

বিয়ের বছর কয়েক পরেই এল যুদ্ধ। একটা আঘাতের সম্ভাবনা দেখা দিল। ময়দা অদৃশ্য হল বাজার থেকে।

তাও উদ্ধার করল লালমিঞা। একদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল ঢাকা শহরে। ধানমণ্ডাইয়ের এক বিরাট প্রাসাদে হাজির। ছোটখাটো অফিস। নোকর আর্দালির ছুটাছুটি।

সেখানে মেঘুকে সঙ্গে করে লালমিঞা দেখা করল এক সাহেবের সঙ্গে। সাহেব মুসলমান। মেঘু দেখল, লালমিঞাকে খুব খাতির করে বসালেন তিনি। শুনলেন সব কথা। শুনে তিনি তাকিয়ে দেখলেন মেঘনাদকে।

তারপরে একটা কাগজ টেনে লিখলেন মেঘনাদের নাম ও ঠিকানা। জিজ্ঞেস করলেন, সপ্তাহে কী পরিমাণ ময়দা তার চাই। পরিমাণ শুনে বললেন, সপ্তাহে একবার করে আপনাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে মালটা নিয়ে যেতে হবে। নৌকায় করে নিয়ে যেতে পারেন। ওদিকে ময়দা পাওয়া যাবে না। সিরাজদিঘার দিকে কোনও গোডাউন নেই, পারবেন তো?

মেঘু বলল, পারব।

সাহেব বললেন, আপনার কারখানা আছে কি না, সেটা দেখতে লোক যাবে।

কাগজে একটা সই চাইলে দেবেন। টিপসইও দিতে পারেন। ওদের কিছু টাকা দেবেন জল খাওয়ার জন্য। পারবেন না দিতে?

জবাব দিল লালমিঞা, নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু কত টাকা?

শ পাঁচেক।

লালমিঞা বলল, পারবে।

কিন্তু পাঁচশোতে হল না। দিতে হল হাজার টাকা। কোনও অপরাধ না করে দিতে হল মেঘুকে। এ কাজটি তার জীবনে নতুন। অনেক অবিচার সে সয়েছে জীবনে। এ সংসারে অবিচারের নিয়মকানুনের কথা শুনেছে তার চেয়েও বেশি। বিস্মিত হল না সে, কিন্তু রক্তের টাকার জ্বলুনিটা কাটল না। লেখাপড়া-জানা চাকুরে লোকগুলি কী সর্বনেশে ! দুটি কলমের খোঁচা দিয়ে পথে বসাতে পারে মানুষকে। নইলে জল খেতে হাজার টাকা!

লালমিঞা বলল, ওটা তোর নসিব, কিন্তু ওদের টাকা থাকবে না। ওর জন্য দুঃখ করিসনে ব্যাটা।

তবে একটা কথা। মাইল বিশেকের মধ্যে বদরুদ্দিন সহ প্রায় সকলের বিস্কুটের কারখানাই লাটে উঠে গেল। লালমিঞার পরামর্শতমতো মেঘু বদরুদ্দিনকে ময়দা দিয়ে সাহায্য করতে চাইল। বদরুদ্দিন তা প্রত্যাখ্যান করল।

তারপরে লালমিঞার মৃত্যু। মৃত্যুর কিছুদিন আগে লালমিঞা মেঘুকে নিয়ে আর একবার গিয়েছিল সদরে। ঢাকায় উঁকিলের সঙ্গে বসে লেখাপড়া করে উভয়ে দিল টিপসই। তারপরে একটা কাগজ তুলে দিল লালমিঞা মেঘুর হাতে।

মেঘু জিজ্ঞেস করল, কীসের কাগজ চাচা?

লালমিঞা বলল, বিক্রি কবালা।

বিস্মিত মেঘু বলল, কীসের বিক্রি?

হেসে বলল লালমিঞা, বোকা কোথাকার। গদি আর কারখানার জমি বাড়ি এত দিন আমার নামে ছিল। তোরটা এবার তোর নামে করে দিলাম। নইলে আমার ভাইয়েরা এসে দখল চাইতে পারে।

মেঘু আরও অবাক হয়ে বলল, কিন্তু বিক্রি করলে, তোমার টাকা নিলে না যে?

লালমিঞা বলল চোখ কুঁচকে, তোর কাছে অনেক দেনদার আমি। সেইটে শোধ দিলাম। মরবার সময় দেনা রেখে গেলে মুসলমান নরকে যায়। তাই যাব বুঝি আমি?

মেঘু নির্বাক। শুধু চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। ফিরে যাবার পথে, নৌকার পাটাতনে নামাজ পড়ল লালমিঞা। বুড়িগঙ্গার পশ্চিম আকাশ তখন লাল। লালমিঞা বলল, মেঘু, আমার বিবি তোকে ছাওয়াল বলে জানে।

বলতে হল না। মেঘুর হৃদয়ে যে এমন একটি নরম দিক আছে, তা ভাবাও দুষ্কর। তার চোখে জলের ফোঁটা দেখা দিল।

লালমিঞা বলল, কাঁদিসনে মেঘু। আমারও ছাওয়াল তুই। শুধু আমার বিবির পেটে হোসনি। তোর মতো খাঁটি ছেলে কজনার থাকে। আমি মরে যাব শিগগিরই। তোর চাচিকে তুই দেখবি তো বেটা?

মেঘুর হৃদয় তার জিভে কথা যোগাল, সে কথা কি তোমাকে বলতে হবে চাচা?

সে মরলে কবর দিস আমারই পাশে।

মেঘু দেখল, লালমিঞার বৃদ্ধ চোখেও জল। সে খালি বলল, আর বলল না চাচা। বলে সে মুখ ঘুরিয়ে বসল। ওই মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকা, তার কথা শোনা আর সহ্য হয় না মেঘুর। লালমিঞা আপন মনে বলে গেল অনেক কথা। সে কথা, ধলেশ্বরীর একটানা ছলছল শব্দের মতো।

মহেশ্বরদী পরগনায় মাঝেরচর গ্রাম। ভৈরবের পথে নৌকায় যাচ্ছিলাম মেঘনা গাঙ্গের উপর দিয়ে। তখন আমি মস্ত সওদাগর। দেখলাম, মেটে কলসি কাঁখে দাঁড়িয়ে আমার দিল দৌলত। দৌলতোন্নিসা। নৌকা বাঁধলাম ঘাটে। মেয়ের পেছনে পেছনে গেলাম তাদের ঘর। দেখলাম বাপ হাল চাষি। বললাম, গোলামকে মাফ করেন বাপজান। বিক্রমপুরের অমুক মিঞার বেটা অমুক মিঞা আপনার বেটিকে শাদি করতে চায়। বেটার আছে সামান্য গদি। আর বলতে হল না। বুঝে নিল সব। না খাইয়ে ছাড়ল না। নকশি কাঁথা পেতে মাটির সানকিতে দিল ভাত। হিদুর বাড়ির ঝাঁঝালো কাসুন্দি, গণ্ডা কয়েক কাঁচালঙ্কা, কুড়িখানেক খয়রা মাছ ভাজা আর দু বাটি দুধ। শাদি না। করেও মনে হল শাদি করেছি। আসবার সময় চৌকাঠের কাছে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়েছিল এক ফোঁটা দৌলত–দলুবিবি। চোখ কী ! সেই চোখ দিবানিশি না দেখলে মেজাজ ঠিক থাকে ! মেঘনার জল কালো। কিন্তু তলা দেখা যায়, এমন কালো। মেঘনার মতো তার চোখ। সেই চোখের তলায় দেখলাম, একখানা কাঁচা টসটস দুর্বাঘাসের মতো প্রাণ। মহব্বতের বাতাসে কাঁপছে থরথর করে।

একটু চুপ করে আবার বলল, শাদি হল। মেঘনা জীবন কাটিয়ে দিলে এই ধলেশ্বরীর পাড়ে । মেঘু কিছু বলব না আর। কিন্তু তোকে আর দলুবিবিকে ছেড়ে যেতে হবে, সে ভাবনা বড় তখলিফ দেয় রে।

মেঘু বলল, যাবে কেন?

লালমিঞা হাসল। বলল, যাক ও সব কথা। যে সাহেবের কাছে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সে এক গরিব মুসলমানের ছেলে ছিল। আমি টাকা দিয়েছিলাম, তাইতে লেখাপড়া শিখে অত বড় হয়েছে। বিপদে পড়লে ওর কাছে যাস, বলে রাখলাম।

এর তিন মাস পরে মারা গেল লালমিঞা। জীবনে মেঘুর আপনজন হারানোর শোক এই প্রথম। তারপরের বছরগুলি মেঘুর কেটেছে একেবারে নিছক কারখানা আর গদি নিয়ে। ঢাকা শহরে তার কারখানাকে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা সেটাই তার ভাবনা। ইচ্ছাটা, ইংরেজদের মতো নতুন মেশিন কিনে সে বড় কারখানা করবে।

কিন্তু সময় বসেছিল না তার জন্য। ছেচল্লিশে নেমে এল ভয়াবহ দাঙ্গা। তার দু জন কারিগর ভিন্ন আর কেউ মরেনি। মেঘুর গদি কারখানা জ্বালিয়ে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কার্যকরী হয়নি। দেশ অরাজক। কারখানা বন্ধ। তারপর শোনা গেল হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানের ভাগাভাগির কথা। জুন মাসের শেষের দিকে আলোচনা এত দ্রুত হল যে, মেঘু পাগল হয়ে যাবে মনে হল। দূর্বলতাবশে, ঢাকেশ্বরী, বুড়োশিব, সব জায়গায় মানত করল, যেন দেশ ভাগাভাগি না হয়। কেন না, দাঙ্গা-তো চিরকাল চলবে না। কালকেই আবার সবাইকে ক্ষতির খতিয়ান খুলে বসতে হবে।ৎ

তবু আশ্চর্য! এতে কোনও দুঃখ দেখা গেল না লীলার। সে বোধ হয় ভাবছিল, এবার তার গর্বিত স্বামীর অহঙ্কারের চূড়া পড়বে ভেঙে। মন্দ কী, মানুষটা একটা অমানুষিক পরিশ্রম ও ভাবনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। হয়তো মনটা অন্য আর একদিকে সুস্থির হয়ে বসবে।

জুলাই মাসের প্রথমে সে আর চুপ করে থাকতে পারল না। এই তো আসল বিপদ? লালমিঞার কথা মনে পড়ল। গেল ঢাকা ধানমণ্ডাইয়ের প্রাসাদে। সেখানে তখনও সেই সাহেব।

শিষ্ট আচরণ করে বসালেন মেঘুকে। শুনলেন সব কথা। তারপরে বললেন, যত দূর বিশ্বাস, দেশবিভাগ হবেই। কলকাতায় আপনার কেউ আছে?

চকিতে একবার মেঘুর মনে পড়ল তার শ্বশুরের কথা। কিন্তু সে কলকাতায় নয়। কলকাতা থেকে বিশ পঁচিশ মাইল উত্তরে শহরতলীতে। বলল, কলকাতায় নেই, একটু দূরে আছে।

সাহেব একটু ভেবে বললেন, সে-ই ভাল। কলকাতার বাইরেই কারখানা করতে হবে। আপনি সেখানে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

চলে যাওয়ার ব্যবস্থা ! পায়ের তলায় মাটি কেঁপে উঠল। উৎকণ্ঠায় উদ্দীপ্ত চোখের সামনে নেমে এল অন্ধকার। তার তিলে তিলে গড়া রক্তস্তম্ভটার গোড়ায় শাবলের ঘা পড়ল। এর মধ্যেই চলে যাওয়ার ব্যবস্থা ! জীবনের আকাঙক্ষা, যৌবনের উন্মাদনা যে মহলের পর মহল গড়ছে, তুলতে গেলে সে যে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কুটিল সন্দেহে ভূ-আড়াল দিয়ে দেখল সে সাহেবের দিকে তাড়িয়ে দিতে চায় নাকি তাকে মুসলমান সাহেব।

মেঘুর বাঁকা ভ্রূর ওঠানামায় ভুক্ষেপ নেই সাহেবের। বললেন, দিনকাল ভাল বুঝছি না। ভরসা দিতে পারলে আপনাকে থাকতে বলতাম। আপনি আমার ইষ্টজনের দোসর। আপনি আর আমি যা পেয়েছি, মুলে সেই মোল্লার মোল্লা লালমিঞা। আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই। বড় খারাপ দিন সামনে। কখন কী হয় বলা যায় না। আমার পরামর্শ যদি চান তবে চলে যান আগেই। গিয়ে, সেখানে কারবার খোলার চেষ্টা করুন। এখন থেকে চেষ্টা করলে একটা কিছু হতে পারে। অবস্থা ভাল হলে ফিরে আসতে কতক্ষণ !

না, সাহেবকে সন্দেহ করতে পারল না মেঘু। কেবল মাথার মধ্যে দুর্ভাবনা একটা চড়ইয়ের মতো উড়ে বেড়াতে লাগল ফরফর করে। সে তাকিয়ে ছিল একটা বোবা পাগলের মতো। সাহেব তার হাত ধরলেন, এই-ই সময়। লালমিঞার সতাতো দু ভাইয়ের এবার নজর পড়বে আপনার উপর।

খুব সাবধান। সেদিকে নজর রাখবে আমার লোক। শয়তান তো সুযোগেরই সন্ধান করে। আঁধার হলে শেয়াল গাঁয়ে ঢোকে। দাঙ্গা থেমেছে লাগিয়ে দিতে কতক্ষণ।

সে বিষয়ে আর সন্দেহ কি? বুকে ফিক ব্যথা নিয়ে মেঘনাদ তাই তো দেখল। দাঙ্গা বরাবর ঢাকা শহরেই হয়েছে। ঢাকা শহর থেকে কালেভদ্রে দাঙ্গা ছড়িয়েছে চাঁদপুর কিংবা চাটগাঁ শহরে। দূরে গ্রামে হাটে কিংবা বাজারের মানুষেরা খালি গুজব শুনেছে, ঢাকার শহর থেকে দাঙ্গাবাজরা নাকি আসছে। আসেনি। ভয়ে ভয়েই কেটে গেছে দুর্দিনের মেঘ।

এবার কাটল না। এবারে অন্য রকম। তার চেহারাই আলাদা। নিদারুণ সর্বনাশের সমারোহ নিয়ে এসেছে সে। ভয় অবিশ্বাস সংশয়, রাগ ও ঘৃণা এবার দূর গাঁয়েও এসেছে। পাশাপাশি, মুখোমুখি বিদ্বেষ ও আস্ফালন। মেঘনাদ কবে ভেবেছিল, তার কারখানা জ্বালিয়ে দেওয়ারও আবার ষড়যন্ত্র হতে পারে। তাও হয়েছে।

সাহেব বললেন, আপনার টাকাপয়সা কি ব্যাঙ্কে থাকে?

মেঘনাদ বলল, না। ঘরেই থাকে।

খুব খারাপ। তা ছাড়া টাকা কখনও ফেলে রাখতে নেই। ব্যাঙ্কে থাকলে সুদ পেতেন। ক্যাশ টাকা আর গহনা, সবই নিয়ে যাবেন। এই নিন আমার ঠিকানা। আমাকে চিঠি দেবেন। বাকি সম্পত্তির ব্যবস্থা করার আগে আমাকে জানাতে পারেন। এই আমার পরামর্শ। এখন আপনার ইচ্ছা।

ফিরে এল মেঘু। মিছিল বেরিয়েছে শহরের পথে পথে। পাকিস্তান চাই। নবাবপুর, ইসলামপুর, বাবুবাজার, চকবাজার, সমস্ত পথগুলি হেঁটে হেঁটে পার হয়ে এল সে। কোথাও দাঁড়াল। বসল একটু। কী খবর, কী রকম মনে হচ্ছে? হতাশা। শুধু হতাশা, অবিশ্বাস, সংশয় ও বিদ্বেষ। পাকিস্তান দাও, হিন্দুস্থান দাও। এই সব পথে পথে ঢাকার ব্যবসাকেন্দ্র। উঠতে বসতে সকলের একই আলোচনা। গত বছরের দাঙ্গার দাগ রয়েছে এখনও এখানে সেখানে। ভাঙা পোড়া। মহাতাণ্ডবের নখাঘাতে শহর জুড়ে ক্ষত। দগদগে ঘা।

এ পথে সে পথে বেকারি। শহরের বড় বড় সব বেকারি কারখানা। শহর ছাড়িয়ে দূর গ্রামে এদের অপ্রতিহত গতিকে বোধ করেছে মেঘনাদ। বুড়িগঙ্গার ওপারের বিশাল এক অঞ্চলে, ঢাকা শহরকে বুক দিয়ে ঠেলে রেখেছে সে। আশা ছিল, একদিন খাঁটি আর নতুন জিনিস দিয়ে সারা মুন্সীগঞ্জ মহকুমার চাহিদা মেটাবে।

মিছিল। শুধু মিছিল। কে বার করতে বলেছে, কারা বের করেছে, সব যেন একটা দুর্বোধ্য বিষয়ের মতো জট পাকাচ্ছে মাথায়। হাজার হাজার লোক মেতে গেছে। হাজার হাজার লোকের লাভ। সকলের লাভ, ক্ষতি শুধু মেঘনাদের?

হাতের মধ্যে সাহেবের ঠিকানাটা চটকাতে চটকাতে সে বাদামতলির ঘাটের দিকে এগুল। সেমিজ অথবা শুধু সায়া পরে ঢুলুঢুলু চোখে দিনের বেলাও দাঁড়িয়ে আছে মেয়েগুলি। শহরের বাউণ্ডুলে আর লোচ্চাদের জটলা। মেঘনাদের বিরাট চেহারাটা নিয়ে অনেকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করল। দিনের বেলাতেই নাগর হতে চায় নাকি? জিজ্ঞেস করল কেউ কেউ।

মেঘনাদ তাকিয়ে দেখল। বাদামতলির ঘাটে এসে দেখল অনেক চালের আড়ত। ঝাঁপ বন্ধ। কিছু কিছু ভাঙ্গাচোরা পোড়া। ধুলোয় ছড়ানো চাল। ঘাটে স্টিমার। কুলিরা তুলছে মাল। পশ্চিমে নবাব বাড়ি।

সব আছে অথচ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে সব কোথায়। দেখা যায় না। পা টলে খালি। নৌকায় গেল না মেঘু। সন্ধ্যাবেলা বসে রইল ঘাটে। সন্ধ্যারাত্রি না নামতেই ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা। ঝিমিয়ে গেল শহরটা। বুড়িগঙ্গার জলে দেখল, লালমিঞা যেন ঢেউয়ে বসে নামাজ পড়ছে। দু চোখে জল। নামাজ পড়ে কাছে এসে বলল, ভেবে কী হবে মেঘু। থেমে থাকিসনে। একবার থামলে সর্বনাশ। সাহেব যা বলেছে, তাই কর। বেরিয়ে পড়। দিন কখনও সমান যায় না। পথে অনেক কাঁটা। কিন্তু ভয় করলে তো চলবে না বাপ। আজ দেশ জুড়ে সবাই লালমিঞা হয়ে গেছে রে। সকলের সর্বনাশ, তোর একলার নয়। সাহা ঘরের ছেলে তুই। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়।

বাঁধানো পোস্তার গায়ে আছড়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গা। জল ছিটকে লাগছে গায়ে। ধনপতি সওদাগরের ঝিমুনো রক্তধারায় মৃদু জোয়ারের আভাস দেখা দিল। ঠেকে যাওয়া চার সপ্তডিঙ্গা দুলে উঠল। সামনে রক্তনদী, তারপরে আগুনের সমুদ্র। সমুদ্রের স্রোতে তরল আগুন আর ঢেউয়ে ঢেউয়ে লেলিহান অগ্নিশিখা। ও সবই তো অপদেবতার মায়া। আকাশের বুকে পিশাচী অট্টহাসি হেসে বলছে, যাসনি। রক্তনদী গিলবে, অগ্নিদেবের ক্ষ্যাপা বাহন পুড়িয়ে মারবে। ওরে যাসনি, যাসনি। এই তো মায়া। প্রেতিনীর খেলা।

উঠে দাঁড়াল মেঘু। এক দিন তার বাবা এসে এমনি করে বেরিয়ে পড়তে বলেছিল তাকে। অনন্তির ঘাটে গহনার নৌকায় বেরিয়ে পড়েছিল সে। আজ লালমিঞাও বেরিয়ে পড়তে বলছে।

 স্টিমার ভোঁ ভোঁ করে উঠল। ছাড়বার সময় হয়েছে। টিকিট কেটে স্টিমারে উঠল মেঘু। মধ্যরাত্রে তালতলায় নেমে গেল। স্টিমার অন্যপথে ভেসে গেল বরিশালের দিকে। মেঘু নৌকায় করে ভোরবেলা এসে পৌঁছল সিরাজদিঘায়। ঘাট যেন ছন্নছাড়া। ভাঙা হাট। বন্ধ কারখানা। বন্ধ গদিঘর।

মেঘু গেল লালমিঞার বাড়ি। লালমিঞার দলুবিবি পিড়ি পেতে বসাল। মিঞাসাহেবের বেশি বয়সের বিবি। মধ্যঋতু আশ্বিনের মতো ঢলোঢলো। টাবুটুবু গাঙ্গের বুকে ধীরগতি ভাঁটার টান লেগেছে। প্রতিবেশীদের একরাশ ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার সাজিয়ে বসে আছে। ব্যথাচাপা হাসি মুখে লেগে আছে সর্বক্ষণ ! মেঘুর মুখে সব শুনে বলল, এর উপরে কথা নেই। সাহেব যা বলেছে, তাই করুক মেঘু। দৌলতন্নেসার জন্য ভাবনা নেই, ধানী জমি আছে কিছু। গাছগাছালি আছে দুচারটে। রাখালটা ভাল ছেলে। জীবন কেটে যাবে। মেঘু বেরিয়ে পড়ুক। তবে, খবরটা যেন দেয়। নইলে চাচি বড় ভাববে।

বাজারের ভেতরে বিপিনকে খুঁজে পেল মেঘু সেই মেয়েমানুষটির ঘরে। কারখানা বন্ধ। কাজ নেই। দুমনি ময়দার ড্যালা নিয়ে মাখবে, তন্দুরের আগুনে পুড়বে। তবেই মেজাজ ঠিক থাকে। কাজের মানুষ, এখন সর্বক্ষণ নেশা করে পড়ে আছে। বোধ হয়, এই তার শেষ পড়ে থাকা। মেয়েটিকে খাওয়াতে পরাতে না পারলে ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে।

বিপিনকে সব কথা বলল মেঘু। শুনে বিপিন বলল, চলে যাও।

মেঘু বলল, তুই যাবিনে বিপিনদা।

বিপিন বলল, আমি কোথায় যাব? তোমার গলায় ঝুলে থাকব না শুধু শুধু। এখানকার লোক মারে মারবে, রাখে রাখবে। এটা তো দেশ। এ জায়গা ছাড়তে হবে বলে নিজের দেশ চাটগাঁয়ে মন টেকেনি কোনওদিন। তুমি যাও। গিয়ে কাজ কারবার আরম্ভ করো। হালচাল দেখো। তারপরে যেতে হয় যাব। বলে দু জনে দাঁড়াল মুখোমুখি। টনটন করে উঠল বিপিনের বুকের মধ্যে। এত বড় চেহারাটা তার মনিবের। বাদার বাঘের মতো গোঁফ। কিন্তু এত অসহায়। তারপর হঠাৎ ভয় করে উঠল বিপিনের। মনিব-গিন্নির কথা মনে পড়ল। বিদেশ বিভুঁই জায়গা। মেঘু খাঁটি মানুষ। পরিশ্রমীও বটে। কিন্তু সকলে মিলে ওর পেছনে লাগে যদি !

 আর বিপিন যেতে চায় না শুনে, মেঘুর যে মুখের চেহারা হল, বিপিন তাতে আরও ঘাবড়ে গেল। টাকা থাকলে শত্রু থাকে। ওর শত্রু অনেক। মনিবগিন্নি শত্ৰু না হোক, এক সংসার-ছাড়া মেয়ে। এ মানুষটিকে ডুবিয়ে দেওয়া তেমন শক্ত নয়। লালমিঞা বুঝত সেটা ভাল। সে মেঘুর হাত ধরে বলল, আমি যাব, তুমি ভেবো না কত্তা। এখন যাব না। তুমি যাও। যেদিন তোমার ডাক আসবে, সেইদিনই চলে যাব।

তবু মেঘুর মুখের ভাবের পরিবর্তন হল না। রাজ্যহারা ছদ্মবেশী রাজার মতো সে এসে দাঁড়াল কারখানার সামনে। কারখানার ঢেউখেলানো টিনের বেড়ায় লেখা রয়েছে, মেঘনাদের রুটি বিস্কুটের কারখানা। নীচে, ঝুমির ঝুরি পাওয়া যায়। খাইতে মজা লাগে। আরও নীচে, মেঘনাদের মালপোয়া, খাঁটি ছাড়া নয় ভুয়া । তন্দুরে পোড়াবার কাঠ ভূপীকৃত রয়েছে সামনেই, কালো অঙ্গারের ছাই জমেছে।

ফিরে এল মেঘু। তারপর চিঠি লেখালেখি চলল। দিনক্ষণ বাছাবাছি চলল।

এরই মধ্যে একদিন বাজার দিয়ে আসতে শুনল একটি কচি গলা। সেই কচি গলা দোকানিকে বলছে, চার পয়সার ঝুমির ঝুরি দেও না!

মেঘু থমকে দাঁড়াল। দোকানি তাকে দেখতে পায়নি। বলল, মেঘু সা’র বাড়ি যা। ওইখানে ঝুমির ঝুরি আছে কাঁড়ি কাঁড়ি। মেঘু সা’র বউ একবার আঁচল ঝাড়লেই হয়।

বলে হেসে উঠল। মেঘু উঁকি দিয়ে দেখল একটি ছোট মেয়ে। তাকে ডেকে নিয়ে এল গদিতে। মালখানায় মাল নেই। সব শুন্য। গদিতে থাকে কিছু নমুনার জন্য। সেই নমুনার জিনিসই কিছু পড়েছিল তখনও, সব উপুড় করে সে ঢেলে দিল মেয়েটির পাঁচহাত শাড়ির আঁচলে। দিয়ে বলল, ঝুমির ঝুরি উঠে গেল। আর পাওয়া যাবে না, বুঝলি?

মেয়েটি হতাশ গিন্নির মতো বলল, আমার ছোট ভাই যে তা হলে কাঁদবে খালি। বলে নিজে বিস্কুটগুলি লুব্ধ দৃষ্টিতে দেখে ঢোক গিলল।

মেঘনাদ বলল, কাঁদবে? সে যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি ভাবল, লোকটা রাগ করেছে বুঝি। সে পেছন ফিরে, ভয়ে ভয়ে চলে গেল। জিভে জল এসে পড়েছে বেচারির। তবু একটা মুখে দিতে পারল না।

মেঘনাদ অথর্ব, শক্তিহীন, বোবা। কোনও এক ছেলে কাঁদবে তার ঝুমির ঝুরির জন্য। যেন সে এক কী বিচিত্র ব্যাপার। অর্থ বুঝল না। অনুভব হল না যেন কথাটির মর্ম। তবু কোনও ছেলের ট্যা ট্যা করে কান্না বাজতে লাগল তার বুকে।

আর ঝুমি হাসতে লাগল খিলখিল করে। লীলা লীলায়িত হয়ে উঠল নতুন ছন্দে ছন্দে। সে কিছু চেয়েছিল। নতুন কিছু। এই নিটোল ছন্দে বয়ে-চলা ব্যবসা কারখানা ও গদি জীবনের ভাঙন। মেঘনাদের জীবনে একটা আঘাত। ভয়ঙ্কর আঘাত। সে আঘাতে গোঁ ধরে বয়ে-চলা স্রোতের ধারা অন্যদিকে ছুটে যাবে। কিন্তু সে যে একেবারে এই পথে ছুটবে, সে ভাবেনি। নতুন প্রতিষ্ঠার কথা সে চিন্তা করে না। যাযাবরীর মতো সে শুধু পথের মোড়ে নতুন জগত দেখতে চায়। নতুন নতুন জগতে সে হেসে বেড়াতে চায়। যেমন চায় ওই ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা।

কিন্তু তার গোছানো দেখলে হাসি পায়। সে এ ঘর থেকে ও ঘর করল ছুটে ছুটে। বোঁচকা পুঁটলি বাঁধল, ট্রাঙ্ক গোছাল, হেসে হেসে, গড়িয়ে গড়িয়ে। যেন তার মুক্তির ডাক এসেছে। আড়াল থেকে দেখল মেঘনাদকে। ভু তুলে, ঠোঁট বাঁকিয়ে ভাবল, হল তো? এবার ভূত নামবে ঘাড় থেকে। যেন সেই ভূত নামানোর জন্যই মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ আসছে। কংগ্রেস আর লিগ দেশময় নেমেছে কোদাল কুড়োল হাতে। নয়া সেটেলমেন্টের নতুন কানুনগো-এর দল।

লীলা জানে না, কার পরামর্শে, কোন পরামর্শে দেশত্যাগ করছে মেঘনাদ। সে শুধু জানে, দেশ ভাগাভাগি হবে। হিন্দু থাকবে এক দেশে, আর এক দেশে মুসলমান। সেই জন্য চলেছে তারা। এইবার তার স্বামী অবকাশ পাবে, লীলার দিকে ফিরে তাকাতে। পাবে নাকি?

কিন্তু ফিরে তাকাল না মেঘু। যে বস্তু থাকতে তাকাতে পারেনি, সেই বস্তু ধ্বংস হওয়ার দিনে সে একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে।

দিন এল। নৌকা করে এল তারা ভাগ্যকূল জাহাজঘাটায়। সঙ্গে পৌঁছে দিতে এল বিপিন। স্টিমার থাকে প্রায় মধ্যনদীতে। নৌকায় করে উঠতে হয়। নৌকায় করে দোকানিরা পশরা নিয়ে যায় স্টিমারের গায়ে। কলা, রসগোল্লা, মোহনভোগ, বিস্কুট!

কে একজন টিন বাজিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এই যে বাবু, আসেন, সিরাজদিঘার মেঘার মালপো। খেলে আর ভুলতে পারবেন না।

স্টিমারে উঠতে গিয়ে থমকে গেল মেঘনাদ। প্রথম চোখাচোখি হল বিপিনের সঙ্গে। বিপিনও তার দিকেই তাকিয়েছিল। দুজনেই তাকিয়ে দেখল সেই লোকটির দিকে। দেখল, মেঘার মালপো নয়, অন্য বিস্কুট। বিক্রি করছে ওই নাম দিয়ে।

হেসে উঠল লীলা। বিপিনকে বলল, ঝুমির ঝুরি অমুকে খায়, অমুকের মালপো দিল্লিতে যায়। কই হে হেড কারিগর, বলে দেও, মালপো এবার দিল্লি যাচ্ছে। ৫৮

অমুক অর্থাৎ মেঘনাদ। স্বামীর নাম নিতে পারে না। বলে বিপিনের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তুলে দেও স্টিমারে।

চকিতের জন্য বিপিনের পেশি শক্ত হয়ে উঠল। তরঙ্গায়িত পদ্ম। কুল কিনারা নেই। নিরন্তর বর্ষা বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে, পাক দিয়ে উঠছে ঘূর্ণি। টুক করে লীলাকে ফেলে দিলে, খানিকটা। জল ছিটকে উঠবে। তারপর সব শেষ।

মেঘনাদ উঠে গেল। লীলাকেও উঠিয়ে দিল বিপিন। লীলা হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, আমি সোনাদুলির চরের মেয়ে। গায়ে ব্যথা দিলে কী হবে। সাঁতরে ঠিক পারে উঠতে পারতাম। মনিবের পয়সা চুরি তো আর হবে না। মনিবের সুখ আর দেখতে হবে না। পায়রা তো নিজে ডুবে। মরো।

বিপিন ভীত বা লজ্জিত হল না একটুও। সে খালি দেখল মেঘনাদের দিকে। মেঘনাদ তাকিয়েছিল তীরের দিকে।

স্টিমার ছেড়ে গেল। সিরাজদিঘার লোক বলাবলি করল, মেঘনাদ অনেক জলের মাছ। মতলব করে সরে পড়ল আগে থেকেই। বড় কিছু ফাঁদবে এবার। বিপিন মনে মনে বলল, তাই যেন হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *