১.৩ বাঙ্গালায় প্রাচীন ভারতের ও মধ্য ভারতীয় আর্য্যভাষায় সাহিত্যসৃষ্টি

১৫৯ গুপ্তাব্দে অর্থাৎ ৪৭৮-৭৯ খ্রীষ্টাব্দে উৎকীর্ণ ও পাহাড়পুরের স্তূপমধ্য হইতে প্রাপ্ত অনুশাসনখানি(২) হইতে জানা যায় যে, খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকেও বরেন্দ্রভূমিতে জৈনমতাবলম্বী শ্রমণ-শ্রাবকের অসদ্ভাব ছিল না। ব্রাহ্মণ নাথশর্ম্মা ও তাঁহার ভার্য্যা রামী স্বগ্রাম বটগোহালী-স্থিত “কাশিক-পঞ্চ-স্তূপনিকায়িক-নির্গ্রন্থ-শ্রমণাচার্য্য-গুহনন্দি-শিষ্যপ্রশিষ্যাধিষ্ঠিতবিহারে” ভগবান অর্হৎদিগের উদ্দেশে গন্ধ, ধূপ, পুষ্প, দীপ প্রভৃতি পূজোপচার ও তলবাট (অর্থাৎ তৈলবট বা দক্ষিণা) রূপে দান করিবার উদ্দেশ্যে রাজকর্ম্মচারিগণের অনুজ্ঞা প্রার্থনা করায় পুণ্ডবর্দ্ধনস্থিত উচ্চরাজকর্ম্মচারিগণ ও স্থানীয় শাসনপরিষৎ যে অনুজ্ঞা প্রদান করিয়াছিলেন তাহাই এই অনুশাসনটিতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এই অনুশাসনখানিতে আমরা বাঙ্গালী ভদ্রলোকের নামের প্রাচীনতম উল্লেখ পাইতেছি। ব্রাহ্মণ নাথশর্ম্মা ও তাঁহার রামীর নাম পূর্ব্বে করিয়াছি। তাহা ছাড়া কয়েকজন ‘পুস্তপাল’ অর্থাৎ record-keeper বা নথীপত্র-রক্ষকের নাম পাওয়া যাইতেছে—দিবাকর-নন্দী (‘প্রথম পুস্তপাল’), ধৃতি-বিষ্ণু, বিরোচন, রাম-দাস, হরি-দাস, শশি-নন্দী। এই নামগুলি হইতে অনুমান হয় যে, ইঁহারা কায়স্থ ছিলেন। এই জাতীয় নাম ও পদবী (রামদাস ও হরিদাস ছাড়া) এখনও বাঙ্গালী-সমাজ ভিন্ন অন্যত্র প্রচলিত নাই।

দ্বাদশ শতকেও এই স্থানে একটি বৌদ্ধবিহার অবস্থিত ছিল। তখন ইহা সোমপুর বিহার নামে পরিচিত ছিল। আনুমানিক খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে রচিত নালন্দায় প্রাপ্ত বিপুলশ্রী-মিত্রের অনুশাসনে বাঙ্গাল সৈন্য কর্ত্তৃক এই বিহারের ধ্বংস এবং পরে বিপুলশ্রী-মিত্র কর্ত্তৃক সংস্কারের উল্লেখ আছে। বাঙ্গাল সেনা বিহারে অগ্নি প্রদান করে, তাহাতে গৃহাদির সহিত শ্রবণ করুণাশ্রী-মিত্রও বিনষ্ট হন। করুণাশ্রী-মিত্রের শিষ্য মৈত্রশ্রী-মিত্র, তৎশিষ্য অশোকশ্রী-মিত্র এবং তাহার শিষ্য বিপুলশ্রী-মিত্র।

অনুশাসনটির প্রথম দুই শ্লোক এই—

অস্তু স্বস্ত্যয়নায় বঃ স ভগবান্‌ শ্রীধর্ম্মচক্রঃ কিয়দ্‌
যন্নাম শ্রুতবান্‌ ভবোহস্থিরবপুর্নিব্যাজমুত্তাম্যতি।
তত্র শ্রীঘনশাসনামৃতরসৈঃ সংসিচ্য বৌদ্ধে পদে
তদ্‌ ধেয়াদপুনর্ভবং ভগবতী তারা জগত্তারিণী।।

শ্রীমৎসোমপুরে বভূব করুণাশ্রীমিত্রনামা যতিঃ
কারুণ্যাদ্‌গুণসম্পদো হিতসুখাধানাদপি প্রাণিনাম্‌।
যো বঙ্গাল্বলৈরুপেত্য দহনক্ষেপাজ্জ্বলত্যালয়ে
সংলগ্নশ্চরণারবিন্দযুগলে বুদ্ধস্য যাতো দিবম্‌।।(৩)

অনুমান হয়, করুণাশ্রী-মিত্র একাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে জীবিত ছিলেন। এই “বঙ্গালবল” তাহা হইলে কি হরিবর্ম্মদেবের অথবা ভোজবর্ম্মদেবের?

গুপ্ত সম্রাটদিগের সময় হইতেই ব্রাহ্মণ্যমত এদেশে প্রসার লাভ করিতে থাকে। এবং হয়ত এই সময়ের কিছু পূর্ব্ব হইতে বৌদ্ধ মহাযানমতেরও প্রাদুর্ভাব হয়। জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য এই তিন মত সমকালে প্রচলিত থাকিলেও বাঙ্গালা দেশে কখনও ধর্ম্মবিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। পাহাড়পুর অনুশাসনে দেখিতেছি যে, ব্রাহ্মণ নাথশর্ম্মা জৈনবিহারে অর্হৎদিগের পূজা চিরস্থায়ী করিবার জন্য ভূমিদান করিতেছেন। গুপ্তসম্রাটদিগের রাজত্বকালেও শাসনকর্ত্তৃপক্ষ জৈন ও বৌদ্ধ মঠে ভূমি ও ধন দান করিতেন। পালরাজগণ বৌদ্ধমতাবলম্বী হইলেও ব্রাহ্মণ্যমতের পোষকতা করিতে পরাঙ্মুখ ছিলেন না। বৌদ্ধমতাবলম্বী পালবংশের শেষ সম্রাট মদনপালদেবের মহিষী চিত্রমতিকা মহাভারত-শ্রবণের দক্ষিণাস্বরূপ পাঠক ব্রাহ্মণ বটেশ্বর-স্বামীকে ভূমিদান করিয়াছিলেন।

প্রথম বাঙ্গালী স্বাধীন রাজা হইয়াছিলেন শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত। ইনি গুপ্তবংশীয় ছিলেন বলিয়া অনেকে মনে করেন। ইঁহার রাজত্ব স্বল্পকালস্থায়ী হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালায় পালরাজারাই প্রথম স্বাধীন রাজবংশ স্থাপিত করেন। ইঁহাদের আমলে বাঙ্গালী নৃপতি সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ ভূখণ্ডের উপর আধিপত্য করিয়া গিয়াছেন, এবং ইঁহাদের রাজ্যকালে বাঙ্গালা দেশ আর্য্যাবর্ত্তের মধ্যে বিশিষ্ট দেশ হিসাবে প্রথম পরিগণিত হইয়াছিল। পাল নৃপতিরা বৌদ্ধমতাবলম্বী ছিলেন, পরে ব্রাহ্মণ্যমতের পক্ষপাতী হন। পালবংশের পরবর্ত্তী রাজাদিগের মধ্যে শুধু বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু এইস্থানে ইঁহাদের অব্যবহিত পরেই যে বর্ম্মরাজারা আসেন তাঁহারা সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী ছিলেন।

ব্রাহ্মণ্যমতাশ্রিতেরা পঞ্চোপাসক ছিলেন, ইঁহাদের ইষ্ট দেবতা বিষ্ণু, শিব, চণ্ডী। সেনরাজাদিগের কৌলিক ইষ্টদেবতা ছিলেন শিব। কিন্তু লক্ষ্মণসেনের সকল অনুশাসনই “ওঁ নমো নারায়ণায়” বলিয়া আরম্ভ করা হইয়াছে; তাহার পর অবশ্য শিবের বন্দনা-শ্লোক আছে। লক্ষ্মণসেন-দেবের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে খোদিত একটি চণ্ডীমূর্ত্তি ঢাকায় পাওয়া গিয়াছে।(৪) দেবী চতুর্ভুজা, সিংহোপরি আসীনা। দুই পাশে দুই সখী, সম্মুখে উপবিষ্ট তিন ভক্ত বা অনুচর। দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে যথাক্রমে পদ্ম ও জলপাত্র (কমণ্ডলু?) এবং বাম ঊর্দ্ধহস্তে কুঠার এবং নিম্নহস্তে বরাভয়মুদ্রা; দুই হস্তী শুণ্ডে কলস লইয়া দেবীকে অভিশেষ করিতেছে। পাদপীঠে এই লিপি আছে—
শ্রীমল্লক্ষ্মণ । সেন দেবস্য সংত । মালদেইসুত অধিকৃত শ্রীদামোদ্র- । ণ শ্রীচণ্ডীদেবী সমারব্ধা তভ্রাদকণা । শ্রীনারায়ণেন । প্রতিষ্ঠিতেতি ।।

লক্ষ্মণসেন, কেশবসেন ইত্যাদি সেনবংশীয় রাজা ও রাজপুত্রেরা শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা ও রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক বহু কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন।(৫)

মল্লিকার্জ্জুন-সূরী নামক একজন জ্যোতির্ব্বিদ ও গণিতজ্ঞ ১১০০ শকাব্দে অর্থাৎ ১১৭৮ খ্রীষ্টাব্দে লল্লাচার্য্য প্রণীত শিষ্যধীমহাতন্ত্রের একটি টীকা রচনা করেন।(৬) টীকার মঙ্গলাচরণে ইনি চণ্ডিকার বন্দনা করিয়াছেন—

শ্রীমৎসুরাসুরাধ্যচরণাম্বুরুহদ্বয়াম্‌।
চরাচরজগদ্ধাত্রীং চণ্ডিকাং প্রণমাম্যহম্‌।।

দ্বাদশ শতাব্দীতে দেখি, বাঙ্গালা দেশে বুদ্ধও বিষ্ণুর অবতারপদবীতে উন্নীত হইয়াছেন, জয়দেব দশাবতারবন্দনার মধ্যে বুদ্ধের উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও প্রাচীনকালে বাঙ্গালায় বৌদ্ধসমাজ আচারব্যবহারে ব্রাহ্মণ্যসমাজ হইতে অনেকটা স্বতন্ত্র ছিল। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাইতেছে।

———————–
২. Epigraphia Indica, XX, no. 5; ব-সা-প-প ৩৯ পৃ. ১৩৯-১৫২।
৩. Epigraphia Indica, XXI, পৃ. ৯৭-১০১।
৪. Inscriptions of Bengal, N. G. Majumdar, পৃঃ ১১৬-১৭।
৫. পালরাজাদিগের সময়ে খোদিত বিস্তর উৎকৃষ্ট বাসুদেব মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। পাহাড়পুরে এবং অন্যান্য শ্রীকৃষ্ণলীলাঘটিত প্রস্তরচিত্রাবলী পাওয়া গিয়াছে। নারায়ণপালদেবের মন্ত্রী গুরব ভট্ট গরুড় স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন।
৬. ব-সা-প-প ৪০, পৃ ৮৩-৯৪।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *