০৩. প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রভাবনা এবং ভৌগোলিক সীমানা
মুসলিম শাসন দেখব। কিন্তু শাসন দেখার আগে সেই সময়কার দেশ বা দেশের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা না থাকলে শাসনের ইতিহাসকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যাই হোক, ভারতে দেখব কেমন ছিল মুসলিম শাসন। মন্দির না-ভেঙে, হত্যা না-করে, অমুসলমানদের ধর্মান্তরিত না-করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? তৎকালীন আঞ্চলিক শাসকরা ইসলামিদের ভালোবেসে রাজ্যপাট বিলিয়ে দিয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিল? তখনকার রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন হওয়ার কথাও নয়। ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে এমন কোনো অংশ পাচ্ছি না, যেখানে। মুসলমান শাসকরা হামলা-আক্রমণ করেনি। এমন কোনো অংশ পাচ্ছি না, যেখানে শান্তিপূর্ণ বিজয়াভিযান হয়েছে। প্রাচীনকালে রাজারা তাঁর নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য প্রাণ পর্যন্ত বাজি রাখত। যাঁর সাম্রাজ্য জয়ের নেশা নেই সে দুর্বল বলে গণ্য হত। তাঁর রাজ্যও অচিরেই দখল হয়ে যেত এবং বহিঃআক্রমণে তাঁর মৃত্যু ঘটত। অতএব সুশাসন আর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যেভাবে একের পর এক দেশ দখল করেছিল তা বিনা রক্তপাতে হয়নি। সুশাসন আর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে এখন যেমন আমেরিকারা করেন। মধ্য প্রাচ্যও এইভাবেই ইসলামের দখলে চলে এসেছিল একদা এবং ইসলাম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সমগ্র আফ্রিকা, স্পেন, ইরাক, ফ্রান্স –এইভাবে প্রায় ৫৭টি দেশ ইসলামের দখলে চলে এসেছিল। এ প্রসঙ্গে এটাও বলে নেওয়া প্রয়োজন, সে যুগ ছিল জোর যার মুলুক তাঁর। যাঁর সাহস আর সামরিক শক্তি যত বেশি সে তত বেশি খুনোখুনি করে রাজ্য বা ভূখণ্ড দখল করতেন। সেখানে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-ইহুদি বলে কোনো কথা হয় না। শাসকের হিন্দু-মুসলমান বলে কিছু হয় না, শাসক শাসকই। ভারতের বিভিন্ন হিন্দু-সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়, তাঁরা কীভাবে সাম্রাজ্য বা রাজ্যের সীমানা বাড়িয়েছেন। আর সেটা বিনা রক্তপাত হয়নি। প্রাচীন যুগে তো ভারতের কোনো অঞ্চলের রাজা তো চ্যালেঞ্জ স্বরূপ অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে দিতেন। একে বলে নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য পায়ে পা বাধিয়ে যুদ্ধ বাধানো।
মুসলমান শাসকরাও বিজয় অভিযান করতে পেরেছেন বিনা অস্ত্রে নয়! অস্ত্র বিনা রাজ্য জয় করা যায় এমন আজগুবি গপ্পো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। ইসলামের বিজয় অভিযান হজরত মোহাম্মদই শুরু করে দিয়ে যান। মোহাম্মদ ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম সুসংহত প্রশাসক এবং সর্বাধিনায়ক। তিনি ইসলাম শুধু আরবভূমিতেই প্রতিষ্ঠা করেননি, আরবের সীমানা পেরিয়ে বহুদূর পর্যন্ত ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। সন্নিহিত অনেক অঞ্চলের উপর তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক অঞ্চলের শাসক তাঁর আনুগত্য (ভয়ে অথবা সমীহে) স্বীকার করে নিয়ে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল। ইসলামের ভারত অভিযান গ্রন্থে কঙ্কর সিংহ লিখেছেন, “বিজয়ীরা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনও ধর্ম বা মতবাদকে মান্যতা দেয় না, তাদের সামনে তাই ইসলামকে গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না। ইসলামের কাছে অন্য সব ধর্ম কুফরি, তাই তাঁরা সব কাফের মুসলিমদের কাছে। কাফেরদের সাথে সম্পর্ক রাখার অর্থ আল্লাহর নির্দেশকে অস্বীকার করা। কাফেররা অবশ্যই নিধনযোগ্য, তাঁদের সংহার করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করাই হল সেই নির্দেশের অঙ্গ।”
ইসলাম ধর্মকে বুকে আঁকড়ে মুসলমানরা কীভাবে ক্রমে ক্রমে তিনটি মহাদেশে বিজয় অর্জন করেছিল এবং প্রসারিত করেছিল সে বিষয়ে লেখার উদ্দেশ্য এ গ্রন্থ নয়। কেবলমাত্র ভারতে মুসলমানের আগমন এবং ৮০০ বছরের রাজ্যশাসন কীভাবে সম্ভব হয়েছিল সেটাই আলোচনা করার চেষ্টা করব। যে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে ২০০ বছরও টিকতে পারল না, সেখানে ওই একই উপমহাদেশে মুসলমান শাসকরা কীভাবে প্রায় দীর্ঘ ৮০০ বছর রাজত্ব করে গেল বিনা সংঘাতে? কীভাবেই-বা এই মুসলমান শাসকরাই পরবর্তী সময়ে একে একে রাজ্য হারাল? শুধুমাত্র খুনোখুনি করে যুগের পর যুগ টিকে থাকা কি সম্ভব? ভারতের অমুসলিমরা কি এই ৮০০ বছর ভয়ে কাঁটা হয়েছিল? জবুথবু অথর্ব হয়ে গিয়েছিল নাকি? নাকি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল? ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগ না-হলে তো ভারত পুনরায় মুসলিমশাসক পেত হয়তো। মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলিম শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে বড়ো আকারের কোনো বিদ্রোহ ভারতের অমুসলিম জনগণ করেছেন এমন ইতিহাস তো কোথাও পাইনি। তখন কোথায় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীরা? ইসলামী শাসনে একজন বিপ্লবীকে পাওয়া গেল না যাঁরা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন করেছে। অথচ ব্রিটিশদের মাত্র ২০০ বছরের রাজত্বে ঘরে ঘরে সশস্ত্র বিপ্লবীরা জন্ম নিয়ে নিল!
আসলে সেসময় ভারত তখন একটি রাষ্ট্র নয়, অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ধারণা নিয়েই এটি উপমহাদেশ। এক জাতি এক দেশ জাতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠেনি মানুষের মধ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যেই কলহ সংঘর্ষ করে টিকে থাকত। যাঁর ক্ষমতা বেশি সে অন্য রাষ্ট্র দখল এবং তাঁর রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার বদল ঘটাত। কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো রাষ্ট্রের সখ্যতা ছিল না। ছিল না দেশাত্মবোধ।
বিষ্ণুপুরাণে উল্লেখ আছে –“যে দেশ হিমাদ্রির দক্ষিণে এবং সমুদ্রের উত্তরে অবস্থিত, যে ভরতের সন্ততি বাস করে এবং যাহা ভারতবর্ষ বা ভারত নামে খ্যাত। বায়ুপুরাণেও এই প্রাচীন ভারতীয় সীমারেখা সমর্থিত হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ভারতীয় উপমহাদেশ পাঁচটি ভৌগোলিক ভাগে ভাগ করা হয়েছে– ধ্রুবা-মধ্যমা প্রতিষ্ঠা-দিশ (যে অঞ্চলটি পরে ব্রহ্মাবর্ত, আর্যাবর্ত ও মধ্যদেশ নামে পরিচিত হয় ), প্রাচী-দিশ বা পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণা-দিশ বা দক্ষিণাঞ্চল, প্রতীচী-দিশ বা পশ্চিমাঞ্চল এবং উদীচী-দিশ বা উত্তরাঞ্চল। বৌদ্ধ অঙ্গুত্তরনিকায়ে মোট ষোলোটি মহাজনপদের কথা জানা যায় –(১) অঙ্গ (বর্তমান ভাগলপুর ও মুঙ্গের জেলা), (২) কাশি, (৩) কোশল (বর্তমান অযোধ্যা অঞ্চল), (৪) বৃজি (মজঃফরপুর জেলার কিছু অংশ), (৫) মল্ল (কুশীনগর ও পাবা সংলগ্ন এলাকা), (৬) চেদি (যমুনা অঞ্চল, কুরু ও বৎসের মধ্যবর্তী), (৭) বৎস (যমুনা অঞ্চল), (৮) কুরু (বর্তমানের দিল্লি অঞ্চল), (৯) পাঞ্চাল (বুদায়ুন, ফারুখাবাদ ও সংলগ্ন অঞ্চল), (১০) মৎস্য (বতর্মান আলোয়ার ও ভরতপুর ), (১১) শূরসেন (মুথরা অঞ্চল), (১২) অশ্যক (গোদাবরী নদী অঞ্চল), (১৩) অবন্তী (মধ্যপ্রদেশের নিমার, মালব প্রভৃতি অঞ্চল), (১৪) গান্ধার (রাওয়ালপিণ্ডি ও পেশোয়ার জেলা), (১৫) কম্বোজ (উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশের হাজার জেলা থেকে কাফিরিস্তান পর্যন্ত), (১৬) মগধ (দক্ষিণ বিহার)। আবার জৈন ভগবতীসূত্রে আমরা কিছু রাষ্ট্রের নাম পাই, যেমন –অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, মলয়, মালব, অচ্ছ, বচ্ছ, কোচ্ছ, পাড়, লাঢ় (রাঢ়), বজ্জি, মোলি, কাশি, কোশল, অবাহ ও সদ্ভুত্তর প্রভৃতি।
পুরাণগুলিতেও অসংখ্য জনপদের কথা জানতে পারি। যেমন –মধ্যদেশের কুরু, পাঞ্চাল, শা, জাঙ্গল, শূরসেন, ভদ্রকার, বোধ, পটচ্চর, মৎস্য, কিরাত, কুল্য, কুন্তি, কাশি, কোসল, অবন্তি, ভূলিঙ্গ, মগধ ও অন্ধক। উত্তরাপথ বা উদিচ্যের জনপদগুলি হল– বাহীক, বাটধান, আভীর, কালতোয়ক, অপরীত, শূদ্র, পদুব, চর্মখণ্ডক, গান্ধার, যবন, সিন্ধু, সৌবীর, মদ্রক, শতদ্রুজ, কুনিন্দ, পারদ, হারহুনক, রমঠ, রুধকটক, কৈকেয়, দশমানক, কাম্বোজ, দরদ, বর্বর, অঙ্গলৌকিক, চীন, তুখার, ক্ষত্রি, ভারদ্বাজ, প্রস্থল, দসেরক, লম্পাক, তলগান, চূলিক, জগুড়, ঔপথ, অনিভদ্র, তোমর, হংসমার্গ, কাশ্মীর, তঙ্গন, কুলুত, আহুক, ঊর্ণ, দার্ব। প্রাচ্যদেশের জনপদগুলি হল– অঙ্গ, বঙ্গ, মুগরক, অন্তর্গিরি, বহির্গিরি, বহির্গিরি, প্ৰবঙ্গ, বাঙ্গেয়, মলদ, মল্লবর্তক, ব্রহ্মোত্তর, প্রবিজয়, ভার্গব, আঙ্গেয়, মল্লক, প্ৰাগজ্যোতিষ, পৌ, বিদেহ, তাম্রলিপ্তক, মল্ল, মগধ, গোনর্দ প্রভৃতি। দক্ষিণাপথ দেশের অন্তর্গত জনপদগুলি হল –পাণ্ড্য, কেরল, চোল, কুল্য, সেতুক, মুষিক, কুমার, বনবাসক, মহারাষ্ট্র, মহিষক, কলিঙ্গ, কাবের, ঐষিক, আটব্য, শবর, পুলিঙ্গ, বিন্ধ্যমৌলেয়, বিদর্ভ, দণ্ডক, পৌরিক, মৌলিক, অশ্যক, ভোগবর্ধন, নৈষিক, কুন্তক, অন্ধ্র, উদ্ভিদ, নল, কালিক প্রভৃতি। অপরান্ত বা পশ্চাদ্দেশের অন্তর্গত জনপদগুলি– সুপারক, কোলবন, দুর্গ, তালিকট, পুলেয়, সুরল, রূপস, তামস, তুরমিন, কারস্কর, নাসিক্য, উত্তর নর্মদা, ভারুকচ্ছ, মাহেয়, সরাস্বত, কচ্ছীয়, সুরাষ্ট্র, আনত, অবুদ প্রভৃতি। বিন্ধ্যপৃষ্ঠ বা বিন্ধ্যাঞ্চলের অন্তর্গত জনপদগুলি হল— মলদ, কারুষ, মেকল, উৎকল, উত্তমর্ণ, দশার্ণ, ভোজ, কিষ্কিন্ধক, তোশল, কোশল, ত্রৈপুর, বৈদিশ, তুম্বর, তুমুর, পটু, নিষধ, অনুপ, তুণ্ডিকের, বীতিহোত্র, অবন্তী প্রভৃতি। পর্বতাশ্রয় বা হিমালয় অঞ্চলের অন্তর্গত জনপদগুলি হল– নিরাহার, হংসমার্গ, কুরু, তঙ্গন, খশ, কর্ণপ্রাবরণ, হূণ, দার্ব, হুহুক, গির্ত, মালব, কিরাত, তামর প্রভৃতি।
এই যে প্রাচীন অঞ্চলগুলির নাম উল্লেখ করলাম, এগুলির ভৌগোলিক সীমানা বা আয়তন বা নাম সবসময়ই এক থাকত না। (এই কয়েক বছর আগেও মাদ্রাজ নামে একটি রাজ্য ছিল, সেটা হয়ে গেল তামিলনাড়, বদলে গেল ভৌগোলিক সীমানা। মাদ্রাজ নাম বদলে হল চেন্নাই, চেন্নাই হল তামিলনাড়ুর রাজধানী। অনুরূপ বোম্বাই ছিল রাজ্য, এখন বোম্বাই নাম বদলে মুম্বাই, মুম্বাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী, বদলে গেল ভৌগোলিক সীমানা, বোম্বাই ভেঙে নতুন রাজ্যের সৃষ্টি হল গুজরাট। এইভাবে আমরা আরও কয়েকটি নতুন নামে নতুন রাজ্য পেলাম অন্য রাজ্য ভেঙে। যেমন –হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি। আগামীদিনে হয়তো আরও নতুন নতুন নামে নতুন নতুন প্রদেশ পেতে পারি। বদলে যাবে ভৌগোলিক সীমানাও। কিছু কিছু রাজ্য তো ভারতের একেবারে বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র দেশই হয়ে গেল –পাকিস্তান, বাংলাদেশ।) প্রাচীন ও মধ্যযুগে কখনো কোনো অঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধি পেত তো কখনো-বা কোনো অঞ্চলের আয়তন হ্রাস পেত, আবার কোনো কোনো অঞ্চল অন্য অঞ্চলের সঙ্গে বিলীন হয়ে সার্বভৌমত্ব হারাত। মূলত এ অঞ্চলগুলি ছিল এক একটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ধারণা। এইসব রাষ্ট্রের ছিল স্বাধীন রাজা বা শাসক। নিজের রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর জন্য এরা সর্বদা যুদ্ধরত থাকত। পরাজিতরা বশ্যতা স্বীকার করত। যেহেতু সেসময় যুদ্ধ মানেই সম্মুখ সমর, তাই পরাজিত হলে হয় মৃত্যুবরণ করতে হত শাসকদের, নচেৎ হারার মুখে আত্মসমর্পণ করে দাসত্ব গ্রহণ করত বিজয়ী রাজারা। আসলে কেবল ভারত উপমহাদেশই নয়, সারা পৃথিবীই এরকম যুদ্ধরত ছিল, চলছিল সামন্ততান্ত্রিক যুগ। অস্ত্র আর সৈন্যদল নিয়ে সাম্রাজ্য দখলের লিপ্সাই ছিল তখনকার যুদ্ধবাজ শাসকদের নেশা। এটা প্রাচীন থেকে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত ছিল। এরপর শুরু হয়। উপনিবেশ যুগ।
আমরা যদি ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটি, তাহলে দেখব প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রই ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। ঋগবেদে বর্ণিত ভরত জনগোষ্ঠীর নামানুসারে যে ভারতবর্ষের কথা বলা হয়েছে, তা মূলত যমুনা ও সরস্বতীর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে, সমগ্র ভারত উপমহাদেশে নয়। এই অঞ্চলেই ভরত জনগোষ্ঠীরা বসবাস করত। তাঁরা তৃসু নামে অপর একটি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, যাঁরা পরুষণী (পরে ইরাবতী নামে পরিচিত হয়) নদীর পূর্বতীরে বসতি স্থাপন করেছিল। ঋগবেদে উল্লিখিত অপরাপর জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সৃঞ্জয়, যাঁদের এলাকা ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল; পুরু ও যদু (রামায়ণ ও মহাভারতে এঁদের পেয়েছি) যাঁদের বাস ছিল সরস্বতীর উভয়কুলে; সিন্ধু ও চন্দ্রভাগার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করেন কৃবি জনগোষ্ঠী; চন্দ্রভাগা ও ইরাবতীর মধ্যবর্তী মৎস্য (বর্তমানে আলোয়ার-ভরতপুর ) অঞ্চলে দ্রু, তুবশ, অনু জনগোষ্ঠী বাস করত; যমুনা-সরস্বতী অঞ্চলে অজ, শিগ্রু ও যক্ষু জনগোষ্ঠীর এলাকা ছিল; উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পকথ, ভলানস, বিষাণী, অলিন ও শিব জনগোষ্ঠীর এলাকা ছিল; যমুনার দক্ষিণাঞ্চল ছিল চেদি জনগোষ্ঠীর; যমুনার পূর্বে ছিল উশীনর ও বশ জনগোষ্ঠীর এলাকা। স্পষ্ট করে বললে ঋগবেদের যুগে ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে গান্ধারি, পকথ, অলিন, ভলানস, বিষাণী প্রভৃতি জনগোষ্ঠীরা বাস করত। সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলের জনজাতি ছিলেন শিব, প, কেকয়, বৃচীবন্ত, যদু, অনু, তুবশ দ্রুহু জনগোষ্ঠী। মৎস্য ও চেদিরা বাস করত। পাঞ্জাবের দক্ষিণে।
ঋগবেদের যুগে প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা দাশরাজ্ঞ নামে পরিচিত, যা ছিল তৃৎসু-ভরতদের সঙ্গে পুরু, যদু, তুবশ, অনু দ্রুহু এই পাঁচটি সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর যুদ্ধ। শেষোক্ত দলে আরও পাঁচটি ছোটো জনগোষ্ঠী বা ট্রাইব সেই যুদ্ধে সামিল হয়েছিল, তাঁরা হল –অলিন, পকথ, ভলানস, শিব ও বিষাণী। এই যুদ্ধে তৃৎসু-ভরতরাই জয়ী হয়, যাঁদের সেনাপতি বা নেতা ছিলেন সুদাস। সুদাসের নেতৃত্বে তৃৎসু-ভরতরা অজ, শিগ্রু ও যক্ষু জনগোষ্ঠীরাও পরাস্ত হয়েছিল। দিবোদাস ও পিজনব নামে দুজন পূর্বতন নেতাকেও আমরা পাই তৃৎসু-ভরতদের মধ্যে। দিবোদাস পুরু, যদু ও তুবশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এছাড়া তাঁরা অবৈদিক দাস দলপতি সম্বর ও পণিদেরও পরাস্ত করেছিলেন। পুরোনো আমলের অনেক জনগোষ্ঠী যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তেমনি বহু নতুন জনগোষ্ঠী উদ্ভূত হয়েছে। পুরু, অনু, দ্রু, যদু ও তুবশ জনগোষ্ঠীর অবলুপ্তি ঘটেছে। আবার কোনো জনগোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। যেমন– পুরু জনগোষ্ঠী ভরত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে কুরু নামে নতুন এক জনগোষ্ঠী গঠন করেছে, কৃবি ও সৃঞ্জয়রা পঞ্চাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিলীন হয়েছে ইত্যাদি। এই কুরু ও পঞ্চালরা মধ্যদেশ বা আর্যাবর্ত অঞ্চলে প্রভূত প্রভুত্ব অর্জন করেছিল। এছাড়া আরও জনগোষ্ঠীর কথা জানা যায়। যেমন –শাল্ব (বর্তমানে আলোয়ার অঞ্চল); ইক্ষাকু (রামায়ণে উল্লিখিত অযুদ্ধ বা অযোধ্যা অঞ্চল); কোশল (পূর্ব অযোধ্যা); মগধ (দক্ষিণ বিহার); বিদেহ (তিরহুত ও সংলগ্ন অঞ্চল); কাশী (বারাণসী অঞ্চল); অঙ্গ (ভাগলপুর অঞ্চল); বঙ্গ (বঙ্গদেশ বা গঙ্গারিডি অঞ্চল); বিদর্ভ, নিষধ ও কুন্তি (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র দুটি রাজ্য একত্রে); সত্বন্ত (প্রথমে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে, পরে আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে); নীচ্য, অপাচ্য, বাহীক ও অম্বষ্ঠ (ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, যা সামগ্রিকভাবে প্রতীচ্য হিসাবে পরিচিত); উত্তর কুরু, উত্তরমদ্র, মুজবন্ত, মহাবৃষ, গান্ধারি, বাহ্বীক, কেশি, কেকয় ও কম্বোজ (উত্তরাঞ্চল, যাঁরা উদীচ্য নামে পরিচিত); অন্ধ্র (যাঁরা কৃষ্ণা ও গোদাবরীর মধ্যাঞ্চলে বাস করত); পু (উত্তরবঙ্গ); শবর (ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশে); মুতিব (হায়দ্রাবাদের কাছে মুসি নদীর তীরবর্তী )। এঁরা কেউই নিজেদের ভারতবাসী বলে পরিচয় দিত না। এ সময়টা ছিল কৌমসমাজ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্দার যখন ভারতীয় উপমহাদেশ সশস্ত্র অভিযান করেন, তখন তিনি উত্তর-পশ্চিমে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যাঁদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলেন, তাঁরা ছিলেন মূলনিবাসী– অর্থাৎ ট্রাইব বা কৌমজনপদভুক্ত। গ্রিক-লেখকরা সেই জনপদভুক্ত গোষ্ঠীদের একটা তালিকাও তৈরি করেছিলেন। দেখি কেমন সেই তালিকা– (১) অশ্বক (আস্পাসিওই), যাঁরা আলিসাঙ্গ-কুনার-রাজাউর উপত্যকায় বাস করত। (২)। গৌরী, যাঁরা পাঞ্জকোরা উপত্যকায় বাস করত। (৩) আসোকেনোই, এঁরা সোয়াট ও বুনের অঞ্চলে বাস করত এবং এঁরাই ছিল পূর্বে উল্লিখিত অশ্বক গোষ্ঠীর পরাজিত শাখা। (৪) চুকায়নক (গ্লৌগানিকোই), এঁরা চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাস করত। (৫) গান্ধারি (গান্ধারিওই), চন্দ্রভাগা ও ইরাবতীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এঁরা বসবাস করত। (৬) অদৃষ্ট (আদ্রাইস্তাই), এঁরা ইরাবতী নদীর দুই তীরের বাসিন্দা। (৭) কঠ (কাথাইওই), এঁরা বাস করত গুরুদাসপুর-অমৃতসর অঞ্চলে। (৮) শিবোই বা শিবি গোষ্ঠী, এঁরা বাস করত সোরকোট অঞ্চলে। (৯) আগালাসসোই, এই গোষ্ঠীর মানুষরা শিবোইদেরই প্রতিবেশী ছিল। (১০) ক্ষুদ্রক (ওক্সিড্রাকোই), এঁরা বর্তমান পাঞ্জাবের অন্তর্গত মন্টোগোমারি অঞ্চলে বসবাস করত। (১১) মাল্লোই বা মালব, এঁরা চন্দ্রভাগা ও ইরাবতীর সংযোগস্থলে বাস করত। (১২) অম্বষ্ঠ (আবাস্তোনোই) গোষ্ঠী, এঁরা বাস করত নিম্ন চন্দ্রভাগা অঞ্চলে। (১৩) ক্ষত্রি বা ক্ষাত্রোই ও ওসসাদি বা বসাতি, এরা বাস করত ইরাবতী ও সিন্ধুর সংযোগস্থলের কাছে। (১৪) সোদ্রাই ও মাসসানোই, এঁরা উত্তর সিন্ধু অঞ্চলে বাস করত। উত্তর ভারতের প্রদেশগুলোকে বলা হত ভুক্তি। অপরদিকে দক্ষিণ ভারতের প্রদেশগুলোকে বলা হত মণ্ডল। এগুলি এক একটি রাষ্ট্র বা দেশ সম্পর্কে প্রযোজ্য হত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি আক্রমণকারী আলেকজান্দার বাধাপ্রাপ্ত হন মূলনিবাসী তথা ট্রাইবদের দ্বারা, যাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে প্রচণ্ড ঘৃণ্য ছিল। সেদিন যদি এই উপজাতিরা আলেকজান্দারকে প্রতিহত না করত, তাহলে সারা ভারতীয় উপমহাদেশ গ্রিকদের কবজায় চলে যেত। তারপর কী কী হত তা হলে মানুষ টের পেত। তবে যে কথা না বললেই নয়, সে কথা হল– গ্রিকরা যেমন ট্রাইবদের দ্বারা বাধা পেয়েছিলেন, তেমনি পাশাপাশি ওই অঞ্চলগুলির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজশক্তিগুলির সাহায্য-সহযোগিতাও পেয়েছিলেন। সেইসব সহযোগীরা ছিলেন অভিসাররাজ ও পুরু (পুরু শুরুতে সশস্ত্র প্রতিরোধ করলেও পরে আলেকজান্দারের ফেভারে চলে এসেছিল), শশিগুপ্ত, তক্ষশিলার রাজা অম্ভি, সৌভূতি, ভগলা প্রভৃতি। এইসব রাজাদের বিদেশি শক্তির কাছে সমর্পণের মূল কারণ –তাঁরা জানতেন যে তাঁদের নিজেদের যা শক্তি মজুত আছে সেই শক্তি দিয়ে তাঁদের প্রতিবেশী প্রবল শক্তিশালী উপজাতিদের পরাস্ত করে তাঁদের এলাকাগুলি নিজ নিজ রাজ্যের অঙ্গীভূত করতে পারবেন না। কাজেই যদি ভিনদেশি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে পরাস্ত করা যায়, তাহলে আখেরে সুফল ভোগ করতে পারবে সহযোগীরাই। তার ফলে যা হওয়ার তাই-ই হল, আলেকজান্দারের ভারত অভিযানের ফলে পূর্বে উল্লিখিত কৌমজনপদগুলি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। যদিও ওই প্রতিবেশী এলাকাগুলি যাঁরা দখল নিয়ে সাম্রাজ্য বাড়িয়েছিলেন, সেইসব ধান্দাবাজ সহযোগী গোষ্ঠীরা বেশিদিন সেই মালিকানা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ ক্ষুদ্র শক্তির পক্ষে বৃহৎ শক্তিকে এড়িয়ে টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অতএব সেইসব অঞ্চলগুলিও পরবর্তী সময়ে আত্মসমর্পণেই হোক বা পরাজিত হয়েই থোক মৌর্য সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। এই ঘটনার অনুরূপ পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মুসলিম শাসনকালেও, ব্রিটিশ শাসনকালেও। স্থানীয় শক্তির সাহায্য-সহযোগিতা না-থাকলে কখনোই বাইরের শক্তি খুঁটি গাড়তে পারে না। অনুরূপ মুসলিম আক্রমণকারীরাও যেসময় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে, তখনও স্থানীয় রাজশক্তি ও সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা পুরোদস্তুর ছিল। তাই একটা জাতি দীর্ঘ ৮০০ বছর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছিল। এই সাহায্য-সহযোগিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল ভারতে ব্রিটিশদের উপনিবেশের সময়কালে। উপরতলায় থাকা মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া ব্রিটিশরা ভারতশাসন করতে সক্ষম হত না। সেইসব উপরতলার মানুষগুলো ব্রিটিশদের প্রায় গোলামে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
প্রাচীন যুগে বর্তমান ভারত বা অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে না-উঠলেও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে আমরা যে সমস্ত রাষ্ট্রের সন্ধান পাই, সেগুলি হল– কপিলাবস্তুর শাক্য, রামগ্রামের কোলিয়, পাবা, ও কুশীনারার মল্ল, বৈশালীর লিচ্ছবি, মিথিলার বিদেহ, অল্লকল্পের বুলি, কেশপুত্তের কালাম, পিপ্পলিবনের মোরিয়, সুংশুমার পাহাড় অঞ্চলের বন্ধু প্রভৃতি। এছাড়া ষোড়শ মহাজনপদের অন্তর্গত বৃজি বা বজ্জি ও মল্ল সাধারণতন্ত্রী সংযুক্ত রাষ্ট্র হিসাবে ছিল। বৃজি বা বজ্জি সংযুক্ত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিদেহ, জ্ঞাতৃক ও লিচ্ছবি। মল্লদের নয়টি শাখা ছিল। এগুলির মধ্যে শাক্য ও লিচ্ছবিদের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে।
তবে বোঝাই যায় ধীরে ধীরে কৌম সমাজব্যবস্থা ভেঙে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। কীভাবে কৌমসমাজ ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব হতে শুরু করেছিল, তা বৈদিক সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকেও অনুধাবন করা যায়। সেই ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস। এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। এটা পরিষ্কার যে, ঋগবেদের যুগের শেষ পর্যায় থেকে ভারত উপমহাদেশের সর্বত্র নানাস্থানেই পৃথক পৃথক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তন, সম্পত্তিবোধের বিকাশ, রাজকরের ধারণা, বিভিন্ন পেশাদার শ্রেণির উদ্ভব, সামাজিক শ্রেণিভেদ ও বর্ণবিভাগ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থারই সাক্ষ্য দেয়। রাষ্ট্র শব্দটি ঋগবেদ, অর্থববেদ, বাজসনেয় সংহিতা, তৈত্তিরীয় সংহিতা, মৈত্রায়ণী সংহিতা, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে পাওয়া যায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ‘রাষ্ট্রগোপ’ শব্দটি দ্বারা রাষ্ট্রের রক্ষক হিসাবে রাজপুরোহিতকে বুঝিয়েছে। পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে রাষ্ট্রকে বোঝাতে ‘রাজ্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। রাজ্য ছাড়াও সাম্রাজ্য’ শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় শতপথ ব্রাহ্মণে। এছাড়া রাষ্ট্র বোঝাতে স্বরাজ্য, ভৌজ্য, বৈরাজ্য, পারমেষ্ঠ্য ও মাহারাজ্য প্রভৃতির পরিচয়ও পাওয়া যায় ঐতরেয় ব্রাহ্মণে। এক একটা জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে এক একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠত। সেই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর প্রধানকে বলা হত রাজা বা রাজন। পরবর্তীকালে কৌমজীবনের ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাতিভিত্তিক কৌমতন্ত্রের বদলে মিশ্র জনসমাজ অবলম্বনে প্রাথমিক ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং দলনেতাবাচক ‘রাজা’ শব্দটি কালক্রমে রাজতন্ত্রের প্রধানকে সূচনা করতে শুরু করে। যদিও বৈদিক যুগে প্রাচীন কৌমসমাজগুলি ভেঙে রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, এই ব্যবস্থা গড়ে উঠতে এবং রাজার চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছিল অনেক পরে এবং তা নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই হয়েছিল। বৈদিক যুগের মধ্যপর্বেই যে রাজা সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে সর্বপ্রধান হয়ে উঠেছিল, তার স্বপক্ষে পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে অনেক বক্তব্য আছে। পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে যুগের রাজনৈতিক অবস্থায় যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল– (১) সংহত রাজকীয় কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা, যা একটি সামরিক সম্ভ্রান্ত শ্রেণি ও পুরোহিততন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত, রাষ্ট্রের কাঠামোগত ও পরিচালনাগত বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে আচার-অনুষ্ঠানগত ও ধর্মীয় বিধিব্যবস্থার সমন্বয়ে রাজনৈতিক সংহতি, (৩) সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী হিসাবে ক্ষমতার তাত্ত্বিক ও প্রয়োগের ক্ষেত্রের চিহ্নিতকরণ, (৪) সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রের প্রসার ও বিস্তীর্ণ এলাকার উপর আধিপত্যের ধারণা। বৈদিক সাহিত্যে রাজতন্ত্রের উদ্ভব সংক্রান্ত যে মতবাদগুলির উল্লেখ আছে, সেখানে বলা হয়েছে, রাজতন্ত্রের উদ্ভব নির্বাচনমূলক, যার গোড়াতেই ছিল একজাতীয় সামাজিক চুক্তি। এই সামাজিক চুক্তির কারণ ছিল দুটি– প্রথমটি অরাজকতা ও নৈরাজ্যের হাত থেকে মুক্তি এবং দ্বিতীয় হল যুদ্ধজয়ের প্রয়োজন। যুদ্ধের প্রয়োজন রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ানো। সীমানা বাড়াতে চাইলে অবশ্যই প্রয়োজন হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত। তাই বলে সব রাজাই যুদ্ধ করে সাম্রাজ্য বাড়াতে উৎসাহী ছিলেন, তা কিন্তু নয়। উদাহরণ হিসাবে দেখতে পারি অযোধ্যা বা অযোদ্ধা (যে রাজ্যে কোনো যুদ্ধ হয়নি) রাজা দশরথকে। দশরথ যে যুদ্ধবাজ ছিলেন না, তা বোঝা যায় মাত্র ৪৯৫ বর্গমাইল ভূখণ্ড নিয়ে তাঁর খুশি থাকায়। দশরথ এবং শ্রীরামচন্দ্র দুজনেই ছিলেন শান্তিকামী মানুষ। অযোধ্যা একটি অতি ক্ষুদ্র রাজ্য বা দেশ ছিল, যার আয়তন ৭৪৩ বর্গমাইল। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল আরও কম, মাত্র ৪৯৫ বর্গমাইল। দশরথের সাম্রাজ্যকে ‘নগররাষ্ট্র’ বলা হত। দশরথ আটজন মন্ত্রী এবং ঋত্বিক, বামদেব বশিষ্ঠের সাহায্যে তাঁর স্বাধীন রাজ্য চালাতেন। সে যুগে এমন নগররাষ্ট্র অসংখ্য ছিল এই উপমহাদেশে। রামায়ণের যুগে তো বটেই, মহাভারতের যুগেও এমন ‘নগররাষ্ট্রের সংখ্যা প্রচুর পাওয়া যায়। সমগ্র ভারতীয় মহাদেশের সঙ্গে এদের কোনো লেনাদেনা ছিল না। অযোধ্যার বাইরে দশরথরা ভিনদেশিই। ভুলে গেলে চলবে না ব্রিটিশরা ভারতের (বর্তমান ভারতের রূপ পেয়েছে স্বাধীনতার অনেক পরে। তবুও ভারত একটি দেশ নয়, সংযুক্ত রাষ্ট্র। অনেকগুলি প্রদেশ নিয়ে সংযুক্ত হয়ে আছে শর্তসাপেক্ষে।) আগে একটি দেশমাত্র ছিল না, ছিল সুবিস্তৃত মহাদেশ। এই উপমহাদেশ দীর্ঘ সময়কালে কখনোই একজন রাজা বা শাসকের অধীনে ছিল না। মোগল শাসকরা চেষ্টা করেছিলেন সমগ্র ভারত মহাদেশ নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করতে। তাঁরাও পারেনি। গোটা ভারত উপমহাদেশের একক শাসক কেউই ছিলেন না। এই মহাদেশ খণ্ড খণ্ড প্রদেশ বা রাজ্যে (রাজার অধীন, তাই রাজ্য) বিভক্ত থেকে পৃথক পৃথক রাজা-বাদশা কর্তৃক শাসিত হত। নিজের রাজ্যের বাইরে রাজা ও তাঁর প্রজারা ভিনদেশি। প্রত্যেক রাজা-বাদশারা নিজ নিজ রাজ্য অপ্রতিহতভাবে শাসনদণ্ড পরিচালনা করতেন। প্রতিটি রাজ্যের ছিল পৃথক আইন, পৃথক সেনাবাহিনী, পৃথক মুদ্রা, পৃথক পতাকা। পাশের রাজ্যের (দেশ) রাজা-বাদশাদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সদ্ভাব ছিল না। পরস্পর পরস্পরকে হিংসা ও বিদ্বেষের চোখে দেখত। যুদ্ধ লেগেই থাকত। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য বা প্রদেশের রাজা-বাদশারা গোটা উপমহাদেশের শান্তিরক্ষার জন্য পরস্পরের মধ্যে কোনোরূপ সন্ধিস্থাপন করতেন না। ফলে রাজপথে পথিকদের গতায়াত মোটেই নিরাপদ ও উপদ্রপশূন্য ছিল না। অল্প হলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদেশগুলিকে জুড়ে একই সাম্রাজ্যভুক্ত করার কাজ সর্বপ্রথম মুসলিম শাসকরাই করতে শুরু করেন। এহেন ভারত ভূখণ্ডের ইতিহাসই এই গ্রন্থের ভারত, ইসলাম এবং মুসলিম।
ঐতিহাসিক যুগে বিভিন্ন সময়ে ভারতের রাজনৈতিক সীমারেখা সংকুচিত হয়েছে, আবার প্রসারিতও হয়েছে, অসংখ্যবার সেটা হয়েছে। বৈদেশিক জাতি কখনও গান্ধার, কাশ্মীর সিন্ধু অঞ্চল জয় করে ভারতের রাজনৈতিক সীমা সংকুচিত করেছে। অপরদিকে কখনও ভারতীয়রা ব্রহ্ম, শ্যাম ও ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ জয় করে ভারতের সীমারেখা প্রসারিত করেছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই গান্ধার ভারতের অংশ ছিল। তুর্ক-আফগান আক্রমণের সমকালে গান্ধার ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুনরায় মোগল যুগে বাবরের সময় গান্ধার ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নাদির শাহের সময়ে আফগানিস্তান পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্ৰহ্মদেশ ব্রিটিশ শাসনামলে কিছুকাল ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়। শিখ সর্দার রঞ্জিৎ সিংহ কাবুল জয় করেছিলেন। পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, বাংলার পূর্বাংশ ও আসামের শ্রীহট্ট অঞ্চল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। মূলত ভারতবর্ষের ইতিহাস স পাকিস্তান ভারতবর্ষেরই ইতিহাস। তবে ভারতের ইতিহাস নয়, ভারতের ইসলাম ধর্মের প্রসারণ এবং মুসলিম শাসকদের শাসনই আমার এই গ্রন্থের উপজীব্য।