প্রথম কাণ্ড। তৃতীয় প্রপাঠক
প্রথম অনুবাক
মন্ত্র- দেবস্য ত্বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুভ্যাম পুষ্ণো হস্তাভ্যামা দদে। অভ্রিরসি নারিরসি। পরিলিখিতং রক্ষঃ পরিলিখিতা অরাতয় ইদমহং রক্ষসসা গ্রীবা অপি কৃন্তামি যোহম্মান্দেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্ ইদমস্য গ্রীবা অপি কৃতামি। দিবে ত্বাহন্তরিক্ষায় ত্বা পৃথিব্যৈ ত্বা। শুন্ধতাং লোকঃ পিতৃদনঃ। যবোহসি ষবয়াম্মদদেষঃ যবয়ারাতীঃ। পিতৃণাং সদনমসি। উদ্দিবং শুভানাহন্তরিক্ষং পৃণ পৃথিবীং দৃংহ। দূতানা মারুতো মিনোতু মিত্রাবরুণয়োস্ত্রবেণ ধৰ্ম্মণা। ব্ৰহ্মবনিং ত্বা ক্ষত্রনিং সুপ্ৰজানিং রায়ম্পোষবনিং পর্যহমি। ব্ৰহ্ম দৃংহ ক্ষত্রং দৃংহ প্রজাং দৃংহ রায়ম্পোষং দৃংহ।। ঘৃতেন দ্যাবাপৃথিবী আপৃণেথা।। ইন্দ্রস্য সদোহসি বিশ্বজনস্য ছায়া। পরি ত্বা গির্বণে গির ইমা ভবন্তু বিশ্বততা। বৃদ্ধায়ুমনু বৃদ্ধয়ো জুন্তা ভবন্তু জুষ্টয়ঃ।। ইন্দ্রস্য সুরসীন্দ্রস্য ধ্রুবমস্যৈন্দ্রমসীায় ত্বা ॥১॥
মর্মার্থ- হে আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! দীপ্তিমান্ জ্ঞানপ্রদ ষড়ৈশ্বর্যশালী সকলের প্রসবিতা সবিতৃদেবের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আত্মবাহুকে দেবগণের অধ্বর্যস্থানীয় ভবব্যাধিনিবারক অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগলের মতো মনে করে, এবং আপন করযুগলকে দেবগণের পূজাংশভাগী হবির্ভাগপূরক পূষাদেবতার করস্তরূপ মনে, করে, সেই বাহুযুগলের ও করদ্বয়ের দ্বারা তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। (এর ভাব-সঙ্কর্ম সাধনের সময়ে আমি ভগবানের অংশ, এটি স্মরণ করা কর্তব্য। মনে মনে এইরকম বিচার করে যিনি কর্মে প্রবৃত্ত হন, তিনি কর্মে সফলকাম হয়ে থাকেন। ভগবানের শক্তি ভিন্ন সৎকর্মের সাধন সুদূরপরাহত। সেই হেতু, সৎকর্ম সম্পাদনের সময়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের প্রভাবে হৃদয়ে ভগবানের শক্তির বিকাশ অবশ্য কর্তব্য)। হে আমার মন! তুমি স্থির অবিচলিত হও। অতএব তুমি ভগবানের আরাধনার জন্য অথবা সৎকর্ম সাধনের নিমিত্ত শান্তভাব ধারণ করো। (ভাব এই যে,-সৎকর্মের সম্পাদনে আমার মন অবিচলিত এবং শান্ত হোক। মনই মূল। মনের স্থৈর্য-সম্পাদনে ভিন্ন সাফল্যলাভ সুদূরপরাহত। মন্ত্রে সেই মনস্থৈর্য-সম্পাদনের জন্য উদ্বোধনা রয়েছে)। হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমার দুর্বুদ্ধিরূপ শত্রু নাশপ্রাপ্ত হোক; এবং আমার সৎ-ভাব-অবরোধক রিপুশত্রু বিনাশিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। বহিরন্তঃ–সকল শত্রুনাশের প্রার্থনা মন্ত্রে বিদ্যমান)। এইরকম সৎকর্মের প্রভাবে আমি দুবুদ্ধিরূপ শত্রুর মূল পর্যন্ত ছেদন করছি। যে বাহিরের ও অন্তরের শত্রু সৎকর্মে প্রবৃত্ত আমাদের হিংসা করে এবং যে শত্রুর আমরা হিংসাকারী, এই উভয়বিধ শত্রুর মূল পর্যন্ত কর্মরূপ অস্ত্রের দ্বারা ছেদন করছি। (কর্মশক্তির প্রভাবে আমরা যেন সকল শত্রুকে নাশ করতে সক্ষম হই– এটাই ভাবার্থ)। হে আমার ভগবৎসম্বন্ধি সৎকর্ম! তোমাকে দুলোকে অবস্থিত দেবভাব-লাভের নিমিত্ত নিযুক্ত করছি। হে আমার ভগবৎসম্বন্ধি কর্ম! তোমাকে অন্তরিক্ষলোকে অবস্থিত দেবভাব-লাভের নিমিত্ত নিযুক্ত করছি। হে আমার সকর্ম! তোমাকে পৃথিবীলোকে অবস্থিত দেবভাব-লাভের জন্য নিযুক্ত করছি। হে ভগবন্! শুদ্ধসত্ত্ব-অবস্থায় উপনীত পিতৃদেবতাদের গৃহরূপ আমার হৃদয় বিশুদ্ধীকৃত হোক। অথবা–হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! তোমার প্রভাবে পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত সকল লোক অর্থাৎ পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত হৃদয় বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হোক অথবা পরিত্রাণ লাভ করুক। (এর ভাব,–যেমন আমার পৃতিপুরুষেরা শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবে উপনীত হয়েছিলেন, সেইভাবে আমিও সৎকর্মের দ্বারা হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের বিকাশ করছি)। হে ভগবন্! আপনি দ্রুতগামী হন। আপনি সৎকর্মকারক আমাদের নিকট হতে হিংসাদ্বেষ-কুপ্রবৃত্তিগুলিকে বিতাড়িত করুন; এবং আপনি অন্তঃশত্রু এবং বহিঃশত্রুদের নিবারণ করুন। (ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমার হৃদয়ে নিহিত কুপ্রবৃত্তিগুলিকে নাশ করুন)। অথবা,আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বরূপ হে হবিঃ! তুমি ভগবানের সাথে মিলন-সাধক অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে আত্মার মিশ্রণকারী হও। অতএব তুমি আমাদের থেকে আমাদের শত্রুদের পৃথক করো অর্থাৎ দুরে অপসারণ ও বিনাশ করো; অপিচ, দানের প্রতিবন্ধক অর্থাৎ সৎ-বৃত্তির নাশক শত্রুদের বিনাশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের অন্তর-বাহ্য সকল শত্রুকে বিনাশ করে আমাদের পরমাত্মার সাথে সম্মিলিত করুন)। হে আমার মন! তুমি পিতৃপুরুষদের গুণের আধার স্বরূপ হও। (ভাব এই যে,-পিতৃগুণের দ্বারা অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা আমার মন পরিপূর্ণ হোক)। হে ভগবন্! আমি হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বভাবের ভববন্ধনছেদক গুণগুলির উদ্ধোধন করছি। হে ভগবন্! তুমি আমার হৃদয়কে ভক্তির দ্বারা পূর্ণ করো। সৎ-বৃত্তির মূল জ্ঞান ও কর্মকে দৃঢ় করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা–হে ভগবন্! আমাকে রক্ষা করুন)। অথবা,হে আমার মন! তুমি দুলোককে অর্থাৎ দুলোক-সমন্ধি দেবভাবকে উৎকৃষ্টভাবে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ যাতে তা পরিক্ষীণ না হয়, সেইরকম ভাবে রক্ষা করো; এবং পৃথিবীতলে অবস্থিত অথবা ভূলোক-সম্বন্ধি সৎ-ভাবকে দৃঢ় করো। (ভাব এই যে,-সকল দেবভাব আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোক)। অথবা, হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আমার হৃদয়রূপ দেবস্থানকে অর্থাৎ পরমসুখমূলকে উন্নতভাবে বা প্রকৃষ্টরূপে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ পতন হতে রক্ষা করো; অন্তরিক্ষের মতো অনন্তপ্রসারিত আমার সৎকর্মের মূলকে অথবা সৎ-ভাবসমূহের সর্বব্যাপকত্বকে পরিপূর্ণ অর্থাৎ পরিবধিত করো; এবং সৎ ভাবসমুহের আধারক্ষেত্রকে অর্থাৎ আমার সৎ-বৃত্তির মূলকে দৃঢ় করো। (সৎ-ভাবের প্রভাবে ও শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমাতে সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য অবিচলিতভাবে অবস্থিতি করুক। তাতে পূর্ণজ্ঞান লাভ হবে এবং ভগবানকে প্রাপ্ত হতে পারব। হে আমার মন! দীপ্যমান পরমজ্ঞানময় মরুৎ-দেবতা বা বিবেক-অনুমত জ্ঞান অথবা প্রাণবায়ুরূপে সদা অধিষ্ঠিত ভগবান তোমাকে জ্ঞানভক্তিরূপে দেবতার সত্যধর্মপালনরূপ-বলের দ্বারা রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক) অথবা-হে আমার মন! দীপ্যমান পরমজ্ঞানময় মরুৎ-দেবতা বা বিবেকানুমত জ্ঞান অথবা প্রাণবায়ুরূপে অধিষ্ঠিত ভগবান্ তোমাকে অবিচলিত বা অবিচ্ছিন্ন রক্ষার দ্বারা রক্ষা বা পোষণ করুন; অপিচ, মিত্র-বরুণ দেবতা অর্থাৎ সকলের প্রতিসাধক ও অভীষ্টপূরক দেবতা অর্থাৎ মিত্রের ন্যায় হিতসাধক এবং বরুন বা অভীষ্টবষকরূপ শ্রেয়ঃ বিধায়ক দেবদ্বয় অবিচলিত অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন রক্ষার দ্বারা তোমাকে রক্ষণ ও পোষণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। দেবভাবের প্রভাবে মন চাঞ্চল্যরহিত ও ভগবৎপরায়ণ হোক,–মন্ত্রের এটাই প্রার্থনা)। হে মন! ব্রাহ্মণভাবাপন্ন অর্থাৎ সত্ত্বগুণোপেত ব্রহ্মস্বরূপ, ক্ষত্ৰভাবোপেত অর্থাৎ রজোভাবাপন্ন, পরমার্থরূপ ধনের পোষক তোমাকে প্রকৃষ্টরূপে স্থাপন করছি, অথবা পরমাত্মায় নিয়োজিত করছি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। মনই সকল সৎ-বৃত্তির মূল এবং সৎ-ভাবের পোষক। মন যাতে সর্বদা ভগবৎ-পরায়ণ হয়, তার পক্ষে চেষ্টান্বিত হওয়া কর্তব্য–এটাই ভাবার্থ)। হে আমার মন! তুমি ব্রাহ্মণ-ভাবকে অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব ভাবকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। হে মন! তুমি ক্ষত্র-ভাবকে বা রজোগুণকে অর্থাৎ কমর্সমর্থকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। হে মন! তুমি সৎ-ভাবকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। হে মন! তুমি পরমার্থ-ধনকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। [ এই চারটি মন্ত্র প্রার্থনামূলক। সকল সৎ-ভাব আমাকে প্রাপ্ত হোক; অপিচ, পরমার্থ-প্রাপ্তির পক্ষে তারা আমার সহায় হোক, এইরকম প্রার্থনার ভাব মন্ত্রে প্রকটিত]। হে মম মনোবৃত্তি! তোমার প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবির দ্বারা দ্যুলোক ভূলোক অর্থাৎ সর্বলোক পরিপূর্ণ হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–আমার অন্তরস্থিত সৎ ভাবরাজি সকল লোকে অবস্থিত হোক অর্থাৎ সকল লোকের প্রীতি-বর্ধন করুক)। হে মনোবৃত্তি! তুমি পরমেশ্বর্যশালী ভগবানের আশ্রয়-স্বরূপ অর্থাৎ আধারস্থানীয় হও। হে মনোবৃত্তি! তুমি নিখিল-ভূত-সমূহের অথবা নিখিল সৎ-ভাবের আশ্রয় বা ধারক হও। স্তুতিমন্ত্রসেবনীয় হে ভগব! সবরকমে সকল কর্মে প্রযুজ্যমান্ আমাদের এই স্তুতিবাক্যসমূহ সর্বতোভাবে আপনাকে প্রাপ্ত হোক। (তার দ্বারা) নিত্যসত্যস্বরূপ আপনার সন্তোষ সাধনেই আমাদের সন্তোষ হোক। (ভাব এই যে, হে ভগবন্! আমাদের বাক্যসমূহ আপনাকেই প্রাপ্ত হোক; আপনার সেবায় নিযুক্ত হয়েই আমার প্রীতি হোক)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের সীবনহেতুভূত অথবা গ্রন্থিস্বরূপ অর্থাৎ বন্ধন-হেতুভূত হও। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভক্তির ও শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। ভক্তি-সামর্থ্যের দ্বারা এবং সৎ-ভাবের দ্বারা আমি আমাকে ভগবানে লীন করি-মন্ত্রে এই ভাব পরিত্যক্ত)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের নিত্যসত্যস্বরূপ হও। (ভাব এই যে,-সত্যের দ্বারা এবং সৎ-ভাবের দ্বারাই সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। মোক্ষ-ইচ্ছু ব্যক্তি নিজের হৃদয়গত ভক্তিসুধারূপ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবাকে পূজা করেন। অতএব হে আত্ম! শুদ্ধসত্ত্ব-সঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হও)। হে, আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধি অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। ভক্তি-সামর্থ্যের দ্বারা এবং সৎ-ভাবের দ্বারা আমি আমাকে ভগবানে লীন করি-মন্ত্রে এই ভাব পরিত্যক্ত)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি পরমেশ্বর্যশালী ভগবানের নিত্যসত্যস্বরূপ হও। (ভাব এই যে,–সত্যের দ্বারা এবং সৎ-ভাবের দ্বারাই সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। মোক্ষ-ইচ্ছু ব্যক্তি নিজের হৃদয়গত ভক্তিসুধারূপ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে পূজা করেন। অতএব হে আত্ম! শুদ্ধসত্ত্ব-সঞ্চয়ে প্রবুদ্ধ হও)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধি অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পরমেশ্বর্যশালী ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োগ করছি। (ভাব এই যে, আমি যেন শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা পরম ঐশ্বর্যশালী ভগবানের প্রতি উৎপাদনে সমর্থ হই) ॥১॥
[প্রথম প্রপাঠকে সাধারণভাবে দর্শযাগের বিষয় উল্লিখিত। দ্বিতীয় প্রপাঠকে তার অন্তর্ভুত সোমযাগে সোমক্রয়ের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি প্রদর্শিত হয়েছে। সোমক্রয়ই দ্বিতীয় প্রপাঠকের প্রধান প্রতিপাদ্য। সোমক্রয় থেকে আরম্ভ করে হবির্ধানমণ্ডপ নির্মাণ পর্যন্ত কর্মর্জাত দ্বিতীয় প্রপাঠকে প্রতিপাদিত হয়েছে। এই তৃতীয় প্রপাঠকের প্রধান প্রতিপাদ্য-অগ্নিযোমীয় পশু। প্রথম অনুবাক থেকে আরম্ভ করে শেষ অনুবাক পর্যন্ত, সদ নাম মণ্ডপ-নির্মাণ ইত্যাদি প্রতিপাদিত হয়েছে।–কাষ্ঠনির্মিত খনন-সাধনোপযোগী তীক্ষাগ্র অস্ত্রবিশেষ অত্রি নামে অভিহিত হয়। বিনিয়োগ সংগ্রহের মতে দেবস্ব ত্ব প্রভৃতি মন্ত্রে সেই অভ্রি গ্রহণ করে অরিসি মন্ত্রে তাকে মন্ত্রপূত করে নিতে হবে; তারপর পরিলিখিত প্রভৃতি মন্ত্রে গর্ত খনন করে দিবে ত্ব প্রভৃতি মন্ত্রে ঔদুম্বরীর অগ্র মধ্যে ও মূল প্রেক্ষণ করে শুন্ধতাং প্রভৃতি মন্ত্রে সর্বশেষে সেই ঔদুম্বরীকে গর্তের মধ্যে অবনমিত করবার বিধি। তারপর যথাক্রমে যবোহসি প্রভৃতি মন্ত্রে যব নিক্ষেপ, পিতৃণাং প্রভৃতি মন্ত্রে দর্ভ আস্তীর্ণীকরণ, উদ্দিবং প্রভৃতি মন্ত্রে ঔদুম্বরী গ্রহণে দ্যুতানস্তাব প্রভৃতি মন্ত্রে তাকে অবটে অর্থাৎ সেই গর্তে প্রোথিত করবে। তারপর ব্রহ্মবনি প্রভৃতি মন্ত্রে গর্তকে দৃঢ় করতে হবে। তারপর ঘৃতেন প্রভৃতি মন্ত্রে ঔদুম্বরী হোম, ইন্দ্রস্য সদোহসি প্রভৃতি মন্ত্রে দিক অভিমন্ত্রণান্তর ছদিতে কর্তব্য সমাপন করে পয়িত্ব প্রভৃতি মন্ত্রে পরিশ্রঘণের বিধি সূত্র ইত্যাদিতে উক্ত হয়। তারপর ইন্দ্রস্য সরসি প্রভৃতি মন্ত্রসমূহে যজমান যথাক্রমে রঞ্জুগ্রহণ, গ্রন্থিবন্ধন এবং মণ্ডপনির্মাণ কার্য সম্পন্ন করবেন। প্রথম অনুবাকের কুড়িটি মন্ত্রে এইভাবে মণ্ডপ-নির্মাণের পদ্ধতি উক্ত হয়েছে এবং পূর্বোক্ত বিনিয়োগ অনুসারে ভাষ্যকার মন্ত্রের ব্যাখ্যানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রের অর্থ (ভাষ্যানুসারে)–সবিতৃদেবের প্রেরণায় অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগল এবং পূষাদেবতার হস্তের দ্বারা, হে অভি, তোমাকে গ্রহণ করছি। এই প্রথম মন্ত্রটি প্রথম প্রপাঠকে ষষ্ঠ অনুবাকে একটু রূপান্তরে দেখা যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী অর্থ-হে অত্রি! যদিও তুমি খনন-সাধন কর্মের উপযোগী, তথাপি তুমি আমাদের অশত্রু হও। এই অদ্রির দ্বারা আমি যজ্ঞের বিঘ্ন-উৎপাদনকারীদের কণ্ঠদেশ ছিন্ন করি। যারা আমাদের দ্বেষ্য এবং যারা আমাদের হিংসা করে, সেই সকল শত্রুর গ্রীবা ছিন্ন করি। (বাহু বলতে অংশ অর্থাৎ স্কন্ধদেশ থেকে মণিবন্ধ পর্যন্ত অংশকে বাহু এবং মণিবন্ধ থেকে পঞ্চাঙ্গুলি সমেত অগ্র-অংশকে হস্ত বলে। চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যন্ত মন্ত্র চারটি, ভাষ্যমতে ঔদুম্বরী শাখা অর্থাৎ যঞ্জ-দুম্বরের শাখা প্রোথিত করবার মন্ত্র। অষ্টম থেকে একাদশ পর্যন্ত চারটি মন্ত্রেও, ভাষ্যকারের মতে, ঔদুম্বরীর সম্বোধন আছে। যেমন অষ্টম মন্ত্রের অর্থ-হে ঔদুরি! তুমি দুলোককে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ ঊর্ধ্ব হতে পতিত না হয়, তা-ই করো। অন্তরিক্ষকে পূরণ করো; এবং পৃথিবীকে দৃঢ় করো। আবার ঔদুম্বরী শাখার চারদিকে মৃত্তিকা দৃঢ় করতে করতে অর্থাৎ পিটতে পিটতে একাদশ মন্ত্র পাঠ করবার বিধি। সে হিসাবে মন্ত্রের অর্থ-হে ঔদুম্বরী! ব্রাহ্মণজাতি, ক্ষত্রিয়জাতি, জীবন এবং পুত্র ইত্যাদিকে দৃঢ় করো। (আমাদের মতে মন্ত্র-কয়টি মন বা চিত্তবৃত্তির সম্বোধন-মূলক। মন বা চিত্তবৃত্তি পাপ-পুণ্য সৎ অসৎ–সকল ভাবেরই আধার। মন স্থির না হলে, পাপ বা অসৎ মন হতে বিদুরিত না হলে, পরিত্রাণের আশা অতি বিরল)। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ মন্ত্র দুটি আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে খুবই সরল। কিন্তু ভাষ্যের ভাব জটিল। ভাষ্যে মন্ত্রের সম্বোধ্য–ঔদুম্বরী, তৃণময় কট প্রভৃতি। ঔদুম্বরী শাখার যেখান থেকে দুটি ডাল বাহির হয়েছে, সেই স্থানে সূব বা ঘৃত ঢেলে দিতে হয়। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ–হুয়মান এই ঘৃতের দ্বারা, হে দাবাপৃতিবীরূপ ঔদুরি! তোমরা পরিপূর্ণ হও। ইত্যাদি। চতুর্দশ মন্ত্রের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ–হে গির্বণ ইন্দ্র! স্তোত্রশস্ত্ররূপা বা (বাক্য) তোমাকে সর্বদিকে বা সর্বভাবে কটরূপে পরিগ্রহণ করুন-ইত্যাদি। ভাষ্যমতে পঞ্চদশ মন্ত্রের তিনটি সম্বোধন পদ, যথা, রঞ্জু, গ্রন্থি ও সদ। কিন্তু এই তিনটি অধ্যাহৃত সম্বোধন পদের কোন চিহ্নই মন্ত্রের মধ্যে পাওয়া যায় না৷] ॥ ১।
.
দ্বিতীয় অনুবাক
মন্ত্র- রক্ষোহণণা বলহনো বৈষ্ণবা খনামি। ইদমহং তং বলগমুপামি যং নঃ সমাননা যমসমানো নিচখানেদমেনমধরং করোমি যো নঃ সমানো যোহসমানোহ রাতীয়তি গায়ত্রণ ছন্দমাহববাঢ়ো বলগঃ।। কিমত্র ভদ্রং তন্নৌ সহ। বিরাডসি সপত্নহা সম্রাডসি ভ্রাতৃব্যহা স্বরাডস্যভিমাতিহা বিশ্বারাডসি বিশ্বাসাং নাস্ত্রাণাং হস্তা। রক্ষোহণো বলগহনঃ প্রেক্ষামি বৈষ্ণবক্ষোহণণা বলগহনোহব নয়ামি বৈষ্ণবান। যবোহসি যবয়াস্মযো যবয়ারাতী রক্ষোহো বলগহনোহব সৃণামি বৈষ্ণবা। রক্ষোহণণা বলগহনোহভি জুহোমি বৈষ্ণবা রক্ষোহণৌ বলগহনাবুপ দধামি বৈষ্ণবী রক্ষোহণৌ বলগহনৌ পৰ্যহামি বৈষ্ণবী রক্ষোহণৌ। বলগহনে পরিণামি বৈষ্ণবী। রক্ষোহণৌ বলগহনৌ বৈষ্ণবী বৃহন্নসি বৃহগ্রাবা বৃহতীমিন্দ্রায় বাচং বদ ॥ ২॥
মর্মার্থ- হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! ভগবানের অংশসস্তৃত, সৎকর্মের বিঘাতকদের নাশয়িতা অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকারের নাশক, মোহজনক, অন্তর ও বাহ্য প্রবৃত্তির নাশকারী অর্থাৎ মায়ানমোহের নাশক তোমাদের হৃদয়ে স্থাপন করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। হৃদয়গত সৎ-ভাবরাজি ভগবানের প্রীতিসাধক। ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত সেই সৎ-ভাবসমুহকে বিনিযুক্ত করি,–এটাই সঙ্কল্প)। বর্তমান এই মন্ত্ররূপ বাকের দ্বারা অথবা আমাদের অনুষ্ঠিত সকর্মসমূহের দ্বারা অর্থাৎ হৃদয়সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সেই সকল মোহজনক অন্তর-বাহ্য-প্রকৃতিকে বিশেষভাবে বিনষ্ট করি। আমাদের সহাধিষ্ঠিত অন্তরস্থিত রিপুশত্রু, মোহজনক যে কুপ্রবৃত্তিসমূহকে উৎপন্ন করে অপিচ প্রলোভন ইত্যাদিরূপ বহিরাগত যে শক্র মোহজনক অন্তর্বাহ্য-প্রকৃতিকে উৎপাদিত করে, আমাদের বর্তমান সৎকর্মের প্রভাবে অর্থাৎ হৃদয়ে সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা সেই সকল মোহজনক আন্তরবাহ শত্রুকে আমি বিনাশ করি। আমাদের সহাধিষ্ঠিত যে শত্রু (মোহজনক কুপ্রবৃত্তি) এবং আমাদের বহিরাগত কুপ্রবৃত্তিরূপ যে শত্রু আমাদের হিংসা করে, সেই আন্তর্বাহ্যশত্রু গায়ত্রীছন্দোবদ্ধ ব্ৰহ্মমন্ত্রের দ্বারা নিবারিত (বিনাশিত) হোক। (ভাব এই যে, কর্মের প্রভাবে আমাদের কুপ্রবৃত্তিসমূহ দূরীভূত হোক)। হে ভগব! আপনার অনুগ্রহ (আমাদের) এই কর্ম-অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে যাতে আপনি নিত্যবর্তমান হন, আপনি আমাদের সেইরকম কল্যাণ (কর্মফল) বিধান করুন। হে ভগবন! আপনি সর্বব্যাপী হন। অতএব আমাদের অন্তরস্থিত সহাধিষ্ঠিত অর্থাৎ জন্মসহজাত শত্রুগণের বিনাশকারী হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের অন্তরের শত্রুকে বিনাশ করুন)। হে ভগবন্! আপনি সকলের অধিপতি স্বামী হন। অতএব আপনি আমাদের পুত্র-পৌত্র ইত্যাদি সম্পর্কিত স্নেহ-বন্ধনের অর্থাৎ সংসারবন্ধনের নাশকারী হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের ভববন্ধন নাশপ্রাপ্ত তোক)। হে ভগবন্! আপনি স্বয়ংই আপনাতে বিদ্যমান, দীপ্যমান ও প্রকাশমান হন। অতএব আপনি আমাদের অননুকূল মোহের উৎপাদক আন্তরবাহ্য শত্রুদের বিনাশকারী হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে ভগবন্! আপনি আমাদের শত্রুনাশ করবার সামর্থ্য প্রদান করুন)। হে ভগবন্! আপনি বিশ্বচরাচরে সকলের অন্তরে নিত্যবিরাজমান ও দীপ্তিসম্পন্ন হয়ে আছেন অথবা আপনি বিশ্বের সকলের প্রকাশক হন। অতএব আপনি বিশ্বের সর্বজনের রিপুশত্রুসমূহের নাশক হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপরবশ হয়ে আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলিকে নাশ করুন। হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! ভগবৎ-অংশভূত, সৎকর্মের বিঘাতকবৃন্দের নাশয়িতা অর্থাৎ অজ্ঞান-অন্ধকারনাশক, মোহজনক আন্তর্বাহ্য প্রকৃতিনাশকারী অথবা মায়ামোহ ইত্যাদির নাশক তোমাদের ভগবানে নিয়োজিত করি অথবা প্রকৃষ্টভাবে সুসংকৃত করি অর্থাৎ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত প্রকৃষ্টভাবে উৎকর্ষ সাধন করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। হৃদয়গত সৎ-ভাবরাজি ভগবানের প্রীতিসাধক! ভগবানের প্রীতির জন্য সেই সৎ-ভাবসমূহকে বিনিযুক্ত করি,-সাধকের এটাই সঙ্কল্প)। হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বভাব সমূহ! তোমরা যেন ভগবানের অংশভূত সৎকর্মের বিঘাতকদের বিনাশকারী অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকারের নাশক, মোহজনক আন্তর্বাহ্য-প্রবৃত্তিনাশক অথবা মায়ানমাহের বিনাশকারী হও, সেইভাবে তোমাদের অবনত অর্থাৎ ভগবানের প্রীতিসাধনের উপযোগীরূপে সুসংস্কৃত করছি। (এ মন্ত্রটিও সঙ্কল্পমূলক। আমার হৃদয়স্থিত সৎ-ভাবরাজি যাতে ভগবৎ-প্রীতি-সাধনসমর্থ হয়, তেমনভাবে উৎকর্ষসম্পন্ন করি)। হে আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! তুমি ভগবানের সাথে মিলনসাধক অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে আত্মার সংসোজক (মিশ্রণকারী) হও। অতএব আমাদের থেকে আমাদের শত্রুদের পৃথক অর্থাৎ দূরে অপসারণ ও বিনাশ করো; অপিচ দান-প্রতিবন্ধক অর্থাৎ সৎ-বৃত্তির নাশক শত্রুদের বিনাশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমাদের আন্তর্বাহ্য সকল শত্রুকে বিনাশ করে আমাদের পরমাত্মার সাথে সম্মিলিত করো)। হে আমার হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! ভগবৎ অংশভূত, সকর্ম-বিঘাতকদের বিনাশকারী অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকার-নাশক, মোহজনক আন্তর্বাহ্যপ্রবৃত্তিনাশক অথবা মায়ানমোহ-বিনাশকারী তোমাদের ভগবানে নিয়োজিত করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। সর্বকর্মফল ভগবানে সমর্পণের জন্য মন্ত্রে সঙ্কল্প বিদ্যমান। মন্ত্রটি নিষ্কাম-কর্মের মূলসূত্র প্রদর্শন করছে। ভাব এই যে, আমার সকল কর্মফল ভগবানে সমর্পিত হোক)। হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! ভগবানের অঙ্গীভূত সকর্ম-বিঘাতকদের বিনাশকারী অর্থাৎ অজ্ঞানরূপ অন্ধকার-নাশক, মোহজনক আন্তর্বাহ্য প্রবৃত্তিনাশক অথবা মায়ামোহ-বিনাশকারী তোমাদের পূজা করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–আমি ভগবানের অঙ্গিভূত শুদ্ধসত্ত্বভাবগুলিকে পূজা করি)। হে আমার জ্ঞানকর্ম! ভগবৎ-অঙ্গীভূত, সঙ্কৰ্ম-বিঘাতকদের বিনাশক অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকারনাশক, মোহজনক, আন্তর্বাহ্যবৃত্তিনাশকারী অথবা মায়া-মোহ ইত্যাদির বিনাশক তোমাদের প্রকৃষ্টভাবে স্থাপিত করি, অর্থাৎ শত্রুনাশের জন্য এবং ভগবানের প্রীতিসাধনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমার জ্ঞান ও কর্ম ভগবানের প্রীতিসাধনের যোগ্য হোক)। হে আমার জ্ঞানকর্ম! ভগবৎ-অঙ্গীভূত সৎকর্মবিঘাতকদের বিনাশক অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকারনাশক, মোহজনক আন্তর্বাহ্যবৃত্তিনাশকারী অথবা মায়ামোহ ইত্যাদির বিনাশক তোমাদের প্রকৃষ্টরূপে আচ্ছাদন করি অর্থাৎ ঔকষ্ঠসাধনের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত করি অর্থাৎ ভগবানের সাথে বিলীন করছি। (এই মন্ত্রটিও সঙ্কল্পমূলক। আমার জ্ঞান ও কর্ম এইরকমই হোক, যাতে আমার ভগবৎ প্রাপ্তি সুগম হয়)। হে আমার জ্ঞানকর্ম! ভগবানের অঙ্গীভূত সৎকর্ম-বিঘাতকদের বিনাশক অর্থাৎ অজ্ঞানরূপ অন্ধকার-নাশক, মোহজনক আন্তর্বাহ্যবৃত্তির নাশকারী অথবা মায়া-মোহ ইত্যাদি বিনাশক তোমাদের সংপাতিত করছি অর্থাৎ যাতে তোমরা ভগবানের প্রীতিসাধক হও, সেই রকমভাবে তোমাদের আস্তীর্ণ অর্থাৎ ঔৎকর্ষ সম্পন্ন করি। হে আমার জ্ঞানকর্ম! ভগবানের অঙ্গীভূত সৎকর্মের বিঘাতকদের নাশকারী, মোহজনক আন্তর্বাহ্যবৃত্তির নাশক (মায়া-মোহ ইত্যাদির নাশক) তোমরা আমার সম্বন্ধে ভগবৎ-প্রাপক হও অর্থাৎ ভগবানকে প্রাপ্ত করাও। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ তুমি মহান অনন্তস্বরূপ এবং মহৎ-ধ্বনিযুক্ত অর্থাৎ মহামহিমোপেত শব্দব্রহ্মরূপ হও। পরমেশ্বযুক্ত ভগবানের প্রীতির জন্য তুমি স্তোত্রলক্ষণযুক্ত বাক্য অর্থাৎ স্তোত্রমন্ত্র উচ্চারণ করো। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক)। ২।
[ভাষ্যানুক্রমণিকায় প্রকাশ, এই দ্বিতীয় অনুবাকের মন্ত্রগুলির দ্বারা উপরবাখ্য গর্ত খনন, করতে হয়। প্রথম অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে মহাবেদি নির্মাণকল্পে উত্তরবেদি হবিধান এবং সদস্ প্রভৃতি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেই মহাবেদীর উত্তর-দক্ষিণভাগস্থ আগ্নীপ্রীয় মার্জালীয় মন্ত্রগুলি উক্ত হয়নি। নির্মিত স্থানের অভ্যন্তরে অন্য যেসব প্রক্রিয়ার দ্বারা মন্ত্রের উচ্চারণে অন্যরকম সামগ্রী প্রস্তুত করতে হয়, সেই মন্ত্রগুলি এই অনুবাকে কথিত হচ্ছে। নির্মীতব্য সেইসব সামগ্রীর মধ্যে উত্তরবেদি সকলের আধারভূত বলে অভিহিত হয়; সেই হেতু তার অঙ্গীভূত হবির্ধানের অন্তর্গত উপরখ্য গর্তগুলি এই অনুবাকের প্রতিপাদ্য। পূর্বোক্ত বিধান অনুসারে (কর্মকাণ্ড অনুযায়ী) বিনিয়োগ-সংগ্রহে মন্ত্রগুলির যে প্রয়োগবিধি উক্ত হয়েছে, ভাষ্যকার সেইভাবেই মন্ত্রগুলির অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। এমনিতেই এই অনুবাকের মন্ত্রগুলি একটু জটিল ভাবাপন্ন। ভাষ্যকার মন্ত্রের যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, তা থেকে মন্ত্রের প্রকৃত ভাব পরিগ্রহণও সহজসাধ্য নয়। আমরা এই অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে যে আধ্যাত্মিক ভাব প্রাপ্ত হই, তা আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশিত)] । ২।
.
তৃতীয় অনুবাক
মন্ত্র- বিভূরসি প্রবাহণণা বহ্নিরসি হ্যবাহনঃ। স্বাত্রোহসি প্রচেস্তুথোহসি বিশ্ববেদা। উশিগসি কবিঃ। অরিরসি বারিঃ। অবস্যুরসি দুবস্বাঞ্ছন্ধ্যরসি মাজ্জালীয়ঃ। সম্রাডসি কৃশানু। পরিষদ্যোহসি পবমানঃ। প্রতাহসি নভ স্বানসংসৃষ্টোহসি হব্যসূদঃ। ঋতধামাহসি সুবর্জোতিঃ।। ব্ৰহ্মজ্যোতিরসি সুবর্ধমাহজোহস্যেকপাদহিরসি বুধিয়ঃ। রৌদ্রেণানীকেন পাহি মাইগ্নে পিপৃপি মা মা মা হিংসীঃ ॥ ৩৷৷
মর্মার্থ- হে ভগবন! আপনি নানারকম ভাবে প্রকাশশীল স্বপ্রকাশ অথবা সর্বব্যাপী অর্থাৎ বহুরূপ এবং প্রকৃষ্টভাবে বহনকর্তা অর্থাৎ মানুষ্যগণকে ভব-সমুদ্রের পারে নয়নকর্তা হন। (অতএব আমাকে উদ্ধার করুন এবং আমার ভব-বন্ধন ছেদন করে দিন)। অথবা,-হে ভগবন! আপনি স্বপ্রকাশ অথবা সকলের উদ্ধারকর্তা হন; অতএব আপনি আমাদের ভব-সমুদ্রের পারে আনয়নকর্তা অর্থাৎ সংসার-বন্ধনের নাশক হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক)। হে ভগবন্! আপনি সকর্মপূরক সৎকর্মময় বা যজ্ঞেশ্বর এবং আত্মি-উৎকর্ষ সম্পন্ন জনের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎ-ভাবের সংরক্ষক হন। (অতএব আমাতে শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎ-ভাব সংস্থাপিত করুন)। অথবা,–হে ভগবন্! আপনি সঙ্কর্মের পূরক অর্থাৎ কর্মফলদাতা হন; অতএব আপনি আমাদের পক্ষে কর্মফলরূপ হবিঃসমূহের গ্রাহক অথবা শুদ্ধ সত্ত্বরূপ হবির উৎপাদক হোন। হে ভগবন্! আপনি জগতের মিত্ৰভূত হিতসাধক ও অভীষ্টবর্ষক শ্রেয়ঃবিধায়ক এবং প্রজ্ঞানস্বরূপ অর্থাৎ প্রকৃষ্টজ্ঞানসম্পন্ন হন। (অতএব আমাকে প্রজ্ঞানসম্পন্ন করুন এবং আমার অভীষ্ট পূরণ করুন)। অথবা,- হে ভগবন! আপনি অভীষ্টপূরক ও. শ্রেয়ঃসাধক হন। অথএব আপনি আমাদের সম্বন্ধে প্রকৃষ্ট চৈতন্যসম্পাদক দিব্যজ্ঞানদায়ক হোন। হে ভগবন্! আপনি পাপীদের সন্তাপক পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ। সর্বধনোপেত এবং সর্বতত্ত্বজ্ঞ হন। (অতএব আমার অভীষ্ট পূরণ করুন এবং আমার পরমা-গতি বিধান করুন)। অথবা,–হে ভগবন্! আপনি পাপীদের উদ্ধারকারী অর্থাৎ পাপহারক হন। অতএব আপনি আমাদের সম্বন্ধে বিশ্বের সর্বভূতের প্রজ্ঞাপক অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানদাতা ও পরাগতি-বিধায়ক হোন। হে ভগবন্! আপনি সকলেরই কামনীয় এবং ক্রান্তদর্শন অর্থাৎ প্রজ্ঞানের আধার হন। (ভাব এই যে,-ভগবানের অনুগ্রহেই মানুষ প্রজ্ঞানসম্পন্ন হয়। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের প্রজ্ঞানসম্পন্ন করুন)। হে ভগবন্! সর্বপাপনাশক আপনি সকলের পালক বা ধারক হন। (ভাবার্থ-হে ভগব! সর্বপাপনাশক আপনি আমাদের সকল পাপ হতে রক্ষা করুন এবং পালন করুন)। হে ভগব! শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবির গ্রাহক অথবা সকলের রক্ষক আপনি শুদ্ধসত্ত্বের আধার হন। (ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব-সম্পন্ন করুন)। হে ভগবন্! বিশুদ্ধতাপ্রাপক নিত্যশুদ্ধ আপনি সকলের পরম পবিত্রতা-বিধায়ক হন। (ভাবার্থ-ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের সকলরকম কলুষ দুরীভূত হোক এবং আমাদের হৃদয় নির্মল হোক)। হে ভগবন্! সকলের অধিপতি–স্বামী আপনি, সকলের জীবনস্বরূপ হন অর্থাৎ ক্ষীণপাপ বা তপক্ষীণ ধর্মবুদ্ধি সম্পন্নদের রক্ষক হন। (ভাবার্থ-ভগবানই সকলের প্রাণ বা আয়ুঃ। তার অনুগ্রহেই সকলে জীবিত থাকে; অথবা আত্মজ্ঞানসম্পন্ন জনের হৃদয়ে ভগবান স্বতঃ-প্রকাশিত হন। হে ভগবন্! আপনি ভক্তের ভক্তির সাথে বর্তমান আছেন; অতএব আপনি পতিতের উদ্ধারক ও পুণ্যের বিধায়ক হন। (ভাবার্থ-ভগবান্ ভক্তির স্বরূপ। একমাত্র ভক্তির দ্বারাই তাঁকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক)। অথবা,- হে ভগবন্! আপনি ভক্তির দ্বারাই ভক্তের প্রাপ্তব্য হন। অতএব আপনি আমাদের পবিত্রতা সাধন করুন অর্থাৎ পাপমোহ হতে উদ্ধারকারী এবং ভক্তির উন্মেষকারী হোন।
হে ভগবন্! আপনি সকলের পরমাশ্রয় এবং আকাশরূপ বা বিরাটরূপ হন। (ভাব এই যে, একমাত্র ভগবানই পরমাশ্রয়। সেই ভগবান আমাদের পরমাশ্রয় দান করুন)। হে ভগবন্! পবিত্রকারক আপনি সৎ-ভাবের জনক হন। (ভাব এই যে,-ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের আন্তর বাহ্য পবিত্র হোক এবং আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশ হোক)। হে ভগব! সৎকর্মের কারণভূত আপনি বিশ্বের প্রকাশক ও সৎকর্মের প্রবর্তক হন। (ভাবার্থ, জ্যোতির আধার ভগবান্ জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণ করে আমাদের প্রদীপ্ত করুন)। হে ভগবন্! আপনি শুদ্ধসত্ত্বভাবের প্রকাশ এবং সুন্দরভাবে আমার হৃদয়রূপ গৃহের অধিষ্ঠাতা হন। (ভাব এই যে,হে শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবের প্রকাশক ভগবন! আপনি আমার হৃদয়ে আগমন করুন)। হে ভগবন! জন্মজরারহিত অথবা সকল ভূতে বর্তমান আপনিই একমাত্র ত্রাণকর্তা, অথবা সর্বভূতের পরমাশ্রয় বিশ্বমূলাধার হন। (ভাবার্থ,ভগবান্ বিশ্বমূলাধার পরমাশ্রয়। প্রার্থনা–তিনি আমাদের পরমাশ্রয় বিধান করুন)। হে ভগবন্! আপনি বিকাররহিত নির্বিকার অতএব জগৎ-কারণ হন; অথবা, হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি উৎকর্ষ-সাধক এবং কারণস্বরূপ ভগবান্ হতে সমুদ্ভূত হও। (নিত্যসত্যমূলক এই মন্ত্র ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎ-সম্বন্ধযুত হোক)। হে ভগবন! আপনি আমাকে শত্রুনাশক উগ্রবলের দ্বারা পালন করুন। (ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আপনি আমাদের শত্রুসম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করুন এবং ভগবৎসম্বন্ধযুত পরমসুখে বিধান করুন)। হে প্রজ্ঞানরূপ দেব! আপনি পরমধনদানের দ্বারা আমার অভীষ্ট পূর্ণ করুন। আমাকে পরিত্যাগ করবেন না অথবা আপনার কৃপা হতে বঞ্চিত করবেন না। (ভাব এই যে,-হে ভগবন্! পরমধনদানের দ্বারা আমার অভীষ্ট পূর্ণ করুন এবং আমাকে আপনার কৃপা থেকে বঞ্চিত করবেন না) ৷ ৩৷৷
[দ্বিতীয় অনুবাকে হবিধান-মণ্ডপ-নির্মাণ-কল্পে উপর বাখ্য গর্ত খননের প্রক্রিয়া-প্রণালী উক্ত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ অনুবাকে আগ্নীখ্রীয়সদ প্রভৃতি স্থানে ধিষ্ণ প্রভৃতির নির্মাণ-প্রথা পরিব্যক্ত। ভাষ্যকার এই অনুবাকের মন্ত্রগুলির বিভিন্ন সম্বোধ্য পদ অধ্যাহার করেছেন। আর সেই সম্বোধ্য-পদের উপযোগী মন্ত্রের অর্থ নিষ্পন্ন করে গেছেন। ভাষ্যকার মন্ত্রগুলির যে অর্থ পরিগ্রহ করেছেন, তা যথাক্রমে এই–(১) হে আগ্নীখ্রীয়! তুমি বিবিধরূপ হও। (২) হে হোত্ৰীয়! তুমি বহ্নি-হব্যবাহনের স্বরূপ হও। হবির প্রবাহক বলে হোত্রীয় প্রবাহন নামে পরিকল্পিত হয়। (৩) হে মৈত্রাবরুণীয় শত্র! তুমি মিত্র প্রচেতা ও বরুণের রূপ হও। (৪) হে ব্রাহ্মণাচ্ছংসিসম্বন্ধী ধিষ্ণ্য! দেবগণের দক্ষিণা-বিভাগকারী বিশ্বাভিজ্ঞ যে তুথ দেবতা, তুমি তার স্বরূপ হও। (৫) হে পোত্ৰীয়! তুমি কমনীয় কবি অর্থাৎ বিদ্বান্ হও। (৬) হে নেধিষ্ণ্য! তুমি সোমরক্ষক অঙ্ঘারি ও বম্ভারি দেবদ্বয়ের স্বরূপ হও। (৭) হে অচ্ছাবাকসম্বন্ধী ধিষ্ণ! তুমি দুবস্বত নামক বায়ু-বিশেষের স্বরূপ হও। (৮) হে মার্জালীয়! তুমি শোধক অর্থাৎ পাত্রপ্রক্ষালনের হেতু লেপমার্জনস্থানভূত হও। (৯) হে আহবনীয়! তুমি সম্যক্ রাজমান কৃশানু হও। (১০) হে আস্তাব স্তোত্রস্থান (বহিষ্পবমানদেশ)! তুমি সদনযোগ্য পূত হও। (১১) হে চাত্বাল! তুমি কৃষ্ণবিষাণত্যাগার্থ প্রকৃষ্টগমনবিষয়ীভূত এবং অন্তরবকাশবান্ হও। (১২) হে পশুশ্ৰপণদেশ! তুমি রাক্ষসের দ্বারা অসংমৃষ্ট এবং হৃদয়াদি হব্যপাঁচক হও। (১৩) হে ঔদুম্বরি! তুমি সাম-গানের অবশ্যম্ভাবী উপবেশন-স্থান-স্বরূপ অর্থাৎ তদনুরূপ উন্নতত্ব-হেতু স্বর্গ-প্রকাশিকা হও। (১৪) হে ব্ৰহ্মসদন! তুমি ব্ৰহ্ম নামক ঋত্বিকের সোক্ষণাদি-কার্যের অনুজ্ঞান জ্যোতিঃস্থান এবং স্বর্গসদৃশ স্থানের স্বরূপ হও। (১৫) হে নূতন গার্হপত্য! তুমি অজ একপাদ দেবতার স্বরূপ হও। (১৬) হে ত্যজ্যগাহপত্য! যে দেবতা ১ ভোষ্টপদা নক্ষত্র-সম্বন্ধী অহিবুর্ধ দেবতার স্বরূপ, তুমি তারই অংশভূত হও। (১৭) হে অগ্নি! আপনার রৌদ্রভাবাপন্ন সৈন্যগণের সাহায্যে রাক্ষসদের আক্রমণ হতে আমাকে পরিত্রাণ করুণ; এবং কর্মফল প্রদানে আমাকে পূর্ণমনোরথ করুন; অপিচ আপনি যেন আমার বিনাশরূপ হিংসা না করেন। যাই হোক, আমরা কিন্তু মন্ত্রগুলির এইরকম সম্বোধন পদ স্বীকার করি না। তবে, কর্মকাণ্ডের অনুসারী ভাষ্যানুগত সম্বোধন পদ ইত্যাদির বিরুদ্ধেও আমরা কিছু বলতে চাই না। আমাদের মতে, আধ্যাত্মিক বিচারে, অনুবাকের মন্ত্রগুলি ভগবৎ সম্বোধনে বিনিযুক্ত। আমরা সেইকরম সম্বোধন স্বীকার করেই মন্ত্রগুলির অর্থ নিষপন্ন করেছি। যেমন প্রথম মন্ত্রে,-বিভুঃ পদে আমরা প্রথম অন্বয়ে বিবিধরূপেণ প্রকাশণীলঃ স্বপ্রকাশঃ বা, যদ্ধা–সর্বব্যাপী বহুরূপঃ বা ইতি ভাবঃ, দ্বিতীয় অন্বয়ে স্বপ্রকাশঃ, যদ্বা–সর্বেষাং উদ্ধারকঃ ইতি ভাবঃ বলেছি। তেমনই প্রবাহণঃ পদটিতে যথাক্রমে প্রকৃষ্টরূপেণ বহনকর্তা, যদ্বা নরাণাং ভবান্ধিপিরনয়নকর্তা ইতি ভাবঃ এবং ভবাদ্ধিপারনায়কঃ ইত্যর্থঃ বলেছি। দ্বিতীয় মন্ত্রে আমরা বহ্নি পদে সৎকর্মপূরক, সৎকর্মময়ঃ, যজ্ঞেশ্বরঃ বা এবং সকর্মপূরকঃ-কর্মফলপ্রদাতা ইত্যর্থঃ; কিংবা হব্যবাহনঃ পদে আত্মোৎকর্ষ-সম্পন্নেষু জনেষু শুদ্ধসত্ত্ব-সদ্ভাব-সংরক্ষকঃ, যদ্বা সম্ভাবজনকঃ ইত্যর্থ এবং হবিষাং প্রবাহক, যদ্বা–শুদ্ধসত্ত্বরূপস্য হবিষঃ জনকঃ ইতি ভাবঃ বলেছি। আমরা শ্বত্র পদে জগতের মিত্রভূত, বা অভীষ্টপূরক, শ্রেয়ঃসাধক ভাব গ্রহণ করেছি। তুথঃ পদে পাপিদের সন্তাপক, বা পাপিদের উদ্ধারক ভাব গ্রহণ করেছি। আমাদের আরও কতকগুলি অর্থ, যথা–অঙরি–সর্বপাপনাশক; বম্ভারি–সকলের পালক বা ধারক; অবস্যুঃ শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হবিগ্রাহক বা সকলের রক্ষক; শুন্ধু।–পবিত্রতাসাধক নিত্যপূত নিত্যশুদ্ধ; মার্জালীয় পবিত্রতাসাধক, পাপনাশক; সম্রাট-সম্যাজমান, সকলের অধিপতি স্বামী; ঋতবীমা-সৎকর্মের কারণভূত; সুবজ্যোতিঃ–বিশ্বের প্রকাশক বা সৎকর্মের প্রকাশক; ব্রহ্মজ্যোতি;–শুদ্ধসত্ত্বভাবের প্রকাশক। শেষ মন্ত্রে, ভাষ্যকারও যে ভাব এনেছেন, সেই অনুযায়ীই আমরা (প্রজ্জ্বলন অগ্নির কাছে নয়) স্বয়ং সেই ভগবানের নিকটেই (অর্থাৎ অগ্নিরূপে যিনি প্রজ্ঞানরূপ দেবতা, তার কাছেই) প্রার্থনা জানিয়েছি মা মা হিংসীঃ অর্থাৎ আমাকে হিংসী করবেন না। এখানে প্রশ্ন হয়-দেবতা আমার হিংসা করেন কিভাবে? সে সমস্যার সমাধানে বলা যায়-যখন দেবগণ মানুষকে পরিত্যাগ করে যান, তখনই তাদের হিংসা প্রকাশ পায়। যখন অন্তর থেকে সৎ-ভাব সত্ত্বভাব অন্তর্হিত হয়, তখনই মানুষ দেবতাদের দ্বারা হিংসিত হয়! ফলতঃ, মন্ত্রগুলি যে ভগবানের বিভূতি-লাভের জন্য মানুষকে উদ্বোধিত করছে, প্রার্থনার ভাবে সেটাই বোঝ যায়] ॥ ৩॥
.
চতুর্থ অনুবাক
মন্ত্র- ত্বং সোম তনুকৃত্তো দ্বেষোভ্যোন্যকৃতেভ্য উরু যাহসি বরুথং স্বাহা। জুষাণো অপ্তরাজ্যস্য বেতু স্বাহাহয় নো অগ্নিৰ্ব্বরিবঃ কৃপোত্বয়ং মৃধঃ পুর এতু প্রভিন্দন। অয়ং শত্ৰুঞ্জয়তু জর্ষাণোহয়ং বাজং জয়তু বাজসাতে। উরু বিষ্ণ্যে বিক্রমম্বোরু য়ায় নঃ কৃধি। ঘৃত ঘৃতযোনে পিব প্র যজ্ঞপতিং তির। সোমো জিগাতি গাতুবিৎ দেবানামেতি নিষ্কৃমৃতস্য যোনিমাসদ। অদিত্যাঃ সদোহস্যদিত্যাঃ সদ আ সীদ। এষ বো দেব সবিতঃ সোমস্তং রক্ষধ্বং মা বো দভদ। এতত্ত্বং সোম দেবো দেবানুপাগা ইদমহং মনুষ্যো মনুষ্যাসহ : প্রজয়া সহ রায়ম্পোষেণ। নমো দেবেভ্যঃ স্বধা পিতৃভ্য ইদমহং নিৰ্ব্বরুণস্য পাশাৎ সুবরভি বি খ্যেষং বৈশ্বানরং জ্যোতিঃ। অগ্নে ব্রতপতে ত্বং ব্ৰাতানাং ব্রতপতিরসি যা মম তনূস্তুৰ্য্যভূদিয়ং সাময়ি যা তব তনুৰ্ম্মৰ্য্যভূদে সা ত্বয়ি যথাযথং নৌ ব্রতপতে ব্ৰতিনোব্রর্তানি । ৪।
মর্মার্থ- হে আমার হৃদয়নিহিত দেবভাব! ইহজন্মকৃত কর্মের দ্বারা সঞ্জাত, জন্ম সহ আগত অথবা পূর্বজন্মকৃত কর্মের সাথে জাত এবং অপরের কৃত অর্থাৎ বহিরন্তঃশত্রুর কৃত দুরিতসমূহের আপনি প্রভূতরকমে নিয়ন্তা অর্থাৎ বিনাশক হন। শত্রুগণ যাতে আমাদের কর্মের অনুষ্ঠানে আমাদের বাধা দিতে না পারে, সেইভাবে আপনি আমাদের সুরক্ষিত ভাবে প্রতিষ্ঠাপিত করুন; সেই ভাবেই আপনি তোকসমূহের অশেষ কল্যাণকারী হন। স্বাহা মন্ত্রে আপনাকে উদ্বোধিত করছি; আমাদের কর্ম সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাবার্থ এই যে, আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমাদের পরমমঙ্গল সাধিত হোক)। আমাদের সৎ-ভাব গ্রহণ করে (অথবা কর্মের দ্বারা) প্রিয়মাণ সর্বতোব্যাপ্ত ভগবান আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। সেই ভগবানকে স্বাহামন্ত্রে পূজা করি; আমাদের অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–ভগবান আমাদের কর্মের দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন; অপিচ আমাদের পরমমঙ্গল বিধান করুন)। আমাদের প্রার্থিত প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন। আরও, সেই জ্ঞানদেব শত্রুগণকে বিদূরিত করে আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। তারপর সেই ভগবান আমাদের পরমধনদানের জন্য শত্রুদের অথবা শত্রুসম্বন্ধী ধনসমুহকে জয় করুন এবং সেই ভগবান্ আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণে প্রীত হয়ে আমাদের সকর্মবিরোধী অন্তঃশত্রুকে বিনাশ করুন। স্বাহামন্ত্রে সেই ভগবানকে পূজা করি; আমার কর্মানুষ্ঠান সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে,ভগবান্ অশেষ প্রজ্ঞানের আধার। তার অনুগ্রহে আমাদের মধ্যে প্রজ্ঞান উপজিত হোক। সৎ-জ্ঞানদানে সেই ভগবান আমাদের শত্রুগণকে বিনাশ করুন এবং আমাদের পরম পদে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। মন্ত্রে এইরকম প্রার্থনা প্রকটিত)। বিশ্বব্যাপিন হে ভগবন্! আপনি অনন্ত সত্ত্বসমুদ্রের দ্বারা আমাদের ব্যাপ্ত করুন এবং অনন্তনিবাস বা শ্রেষ্ঠনিবাস লাভের জন্য আমাদের সামর্থ্যসম্পন্ন করুন। আরও, হে শুদ্ধসত্ত্বের আধার ভগবন্! আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব বা ভক্তিসুধা গ্রহণ করুন এবং সৎকর্মের অনুষ্ঠাতা আমাদের প্রকৃষ্ট ভাবে প্রতি করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বের সাথে আপনি আমাদের মধ্যে আগমন করুন; আমরা যাতে শ্রেষ্ঠ নিবাসভূত আপনাকে প্রাপ্ত হই, সেইভাবে আমাদের সামথ্যসম্পন্ন করুন; অপিচ, আপনার প্রদত্ত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমাদের উদ্ধার করুন এবং আপনাতে প্রতিষ্ঠাপিত করুন)। হে ভগবন্! দেবসম্বন্ধযুক্ত সঙ্কর্মের উৎপত্তিস্থান নানারকম গুণের অলঙ্কৃত আমার হৃদয়-গৃহে শুদ্ধসত্ত্ব আগমন করুক। (ভাব এই যে, আমার হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশ হোক। যেন আমার হৃদয় আমাকে ভাগবানের প্রীতির নিমিত্ত সৎকর্মে আমাকে নিয়োগ করতে পারে)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অনন্তস্বরূপ ভগবানের অধিষ্ঠান অর্থাৎ ধারক ও স্বরূপ হও। (ভাব এই যে, Aশুদ্ধসত্ত্বই ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। অতএব হে শুদ্ধসত্ত্বও তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধি স্থানকে অথবা নির্মল হৃদয়কে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হও অর্থাৎ সে হৃদয়ে উপবেশন করো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি)। স্বতঃপ্রকাশমান জ্ঞানপ্রেরক হে ভগবন্! আমাদের হৃদয়সঞ্জাত এই শুদ্ধসত্ত্ব আপনাকে সমর্পণ করছি। আমাদের সোম আপনারা গ্রহণ করুন। আমাদের প্রদত্ত শুদ্ধসত্ত্বকে হিংসা করবেন না অর্থাৎ পরিপোষণ করুন। (এই মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এস্থলে সাধক ভগবাকে শুদ্ধসত্ত্ব উৎসর্গ করছেন এবং প্রার্থনা করছেন–ভগবান্ যেন সদাই শুদ্ধসত্ত্বকে পালন করেন)। দীপ্যমান শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হে ভগবন! আপনি নিত্যকাল আপনা-আপনিই প্রকাশমান হয়ে দেবভাব সম্পন্নদের প্রাপ্ত হন অর্থাৎ দেবভাবসমুহের সাথে কিংবা দেবভাবসম্পন্নদের হৃদয়ে আগমন করেন। মরণধর্মাবলম্বী প্রার্থনাকারী আমি সৎ-ভাব ও শুদ্ধসত্ত্বরূপ পরমধনের সাথে মনুষ্যেচিত পৌরুষ কামনা করছি। (প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভগবান সৎ-ভাবসম্পন্নদের মধ্যে স্বয়ং প্রকাশমান হন। এখানে সাধক মানুষের উপযুক্ত পৌরুষ প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার ভাব-পরমধনদানে ভগবান আমাকে উদ্ধার করুন)। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ। দেবতাদের প্রীতিসাধনের নিমিত্ত তোমাদের নমঃমন্ত্রের (নমস্কর্মের দ্বারা নিয়োজিত করছি। এবং পিতৃপুরুষদের প্রীতিসাধনের নিমিত্ত তোমাদের স্বধা-মন্ত্রের দ্বারা নিয়োজিত করছি। আমি যেন নিত্যকাল কামনাবাসনা ইত্যাদি রূপ পাপসম্বন্ধের বন্ধন হতে অর্থাৎ ভববন্ধন হতে মুক্তি লাভ করতে সমর্থ হই। হে ভগবন্! সকল সৎকর্মেই যেন বিশ্বের হিতসাধক বিশ্বপ্রকাশক জ্যোতিঃস্বরূপ আপনাকে দর্শন করি। (ভাব এই যে, আমাদের অনুষ্ঠিত সবরকম কর্মেই ভগবানের অধিষ্ঠান হোক)। সৎকর্মের পালক অথবা সঙ্কৰ্মকারিগণের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ প্রজ্ঞানময় হে ভগবন! আপনি সত্যকারিদের প্রতি প্রীতি-আতিশয্য-মুক্ত অর্থাৎ তাদের মধ্যে সৎ-ভাবের সংরক্ষক হন। অতএব আমি আপনার শরণ গ্রহণ করছি। (প্রার্থনা–আপনি অনুগ্রহপরায়ণ হয়ে আমাকে সৎ-ভাবের অধিকারী করুন)। অতএব হে দেব! কলুষকলঙ্কপরিম্নান আমার পাপপঙ্কিল শরীর আপনার আত্মাতে অবস্থিত হোক; আপনার পবিত্রকারক শরীর আমাতে অবস্থিত হোক। এইরকমই, সৎকর্মের পালক আপনার পবিত্রতাসাধক পুণ্যময় যে শরীর আমাতে সংন্যস্ত বা বর্তমান ছিল, আপনার সেই পবিত্রকারক শরীর আপনাতেই বর্তমান থাকুক। আপনার ও আমার অভিন্ন শরীর হোক। (মন্ত্রের এই অংশটি প্রার্থনামূলক। এখানে প্রার্থনাকারী পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে,কলুষ-কলঙ্কে পরিলিপ্ত আমার এই ভৌতিক শরীর নাশ করে আমাতে আপনার পুণ্যপূত দেবদেহ স্থাপন করুন। মর্মার্থ এই যে, আমাকে পাপ হতে পরিত্রাণ করুন; আমাকে পবিত্র সত্ত্বসমন্বিত করুন। আপনাতে আত্মসম্মিলন করে আমি যেন পরাগতি লাভ করতে পারি, হে দেব, তা-ই বিহিত করুন)। এইরকম হলে, হে সৎকর্মপালক প্রজ্ঞানাধার ভগবন্! সঙ্কর্মের অনুষ্ঠাতা আমাদের অনুষ্ঠিত সকমণ্ডলি, আপনার ও আমার উভয়ের সাথে যথাক্রমে প্রবর্তিত হোক অর্থাৎ আমার কার্যে আমার মতো আপনারও আদর ও প্রীতি হোক ॥ ৪।
[এই অনুবাকের প্রথম অংশ সম-সম্বোধনে বিনিযুক্ত। আমরাও সে ভাব গ্রহণ করি। কিন্তু আমাদের সোম অন্যরকম। আমাদের সোম-পূর্বাপর সর্বক্ষেত্রেই-হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব, দেবভাব-সৎ-ভাবরাজি। ভাষ্যকারের অর্থেও সেই ভাবেরই আভাস পাই। বেদের বিভিন্ন স্থানে সোম শব্দের প্রয়োগ আছে। সে সকল স্থলে সোম শব্দে প্রায়ই সোম-রসরূপ মাদক দ্রব্য অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। কিবা ঋগ্বেদে, কিবা সামবেদে, কিবা এই যজুর্বেদে–সর্বত্রই এ ভাবের বিকাশ দেকতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানকার ভাব অন্যরকম বলেই মনে হয়। এখানে সোমকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে-হে সোম! তং তনুকৃদ্ভ্যো দ্বিযোভ্য অন্যকৃতেভ্য। যা অসি। ভাবার্থ–তাদৃশাঃ অম্মান মা বাধন্তে তথাস্মান সুরক্ষিত-প্রদেশে সংস্থাপ্য পালয়সীত্যর্থঃ।-শত্রুগণ আমাদের বাধা প্রদান করতে না পারে, সেইরকমভাবে আমাদের সুরক্ষিত-প্রদেশে স্থাপন করে পালন করুন। এখন, এ সোমকে কি বলব? শত্ৰু-সংহার করে সুরক্ষিত-প্রদেশে স্থাপন করে যে সোম, সে কোন্ সামগ্রী? তাকে কি মাদকদ্রব্য বলব? মাদকদ্রব্যের এমন কি সামর্থ্য আছে যে, সে শত্রু নাশ করে সুরক্ষিত প্রদেশে স্থাপন কবে? শত্রুনাশ করা দূরে থাকুক, মাদক দ্রব্য শত্রুকে বৃদ্ধি করেই থাকে। তাছাড়া তার সেবকদের তো সে সর্বনাশই সাধন করে। সুতরাং বক্ষ্যমাণ মন্ত্রে উল্লিখিত এ সোম যে মাদকতার সাধনকারী সোম নয়–এ সোম যে তার অতিরিক্ত কোনও শ্রেষ্ঠ সামগ্রী, তা সহজেই উপলব্ধ হয়। আমরা সোম শব্দে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব, ভক্তি-সুধা প্রভৃতি অর্ত পূর্বাপর পরিগ্রহণ করেছি। এখানেও আমরা সেই অর্থই সমীচীন বলে মনে করি। আমাদের মতে, ভাষ্যকারও এ ছাড়া অন্য কোনও অর্থই এখানে সোম শব্দের প্রয়োগে লক্ষ্য করেছেন। নচেৎ, মাদকতাবিশিষ্ট সোম হলে, ভাষ্যে তিনি তার আভাস প্রদানে বিরত থাকতেন না। অন্যত্র সোম-কে তিনি মাদক দ্রব্য রূপেই পরিচিহ্নিত করেছেন। সুতরাং এ সোম শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ ভিন্ন অন্য কিছু নয়–এটা সহজেই বোঝা যায়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই এই অনুবাকের মন্ত্রগুলির ভাষ্যকারকৃত অর্থের সাথে আমাদের মতান্তর ঘটেছে। যেমন পঞ্চম মন্ত্রের ভাষ্যকারের অর্থ–সোমদেব যেমন অন্যান্য দেবতার নিকট গমন করেন, মানুষ আমি, আমিও তেমনি মানুষের নিকট গমন করি। (আমাদের মর্মার্থ দ্রষ্টব্য)। আবার, সপ্তম মন্ত্রে ভাষ্যের সাথে সামান্য ইতর-বিশেষ লক্ষিত হলেও মূলতঃ কোনও পার্থক পরিদৃষ্ট হবে না। তবে ভাবপক্ষে আমরা যে তাৎপর্য গ্রহণ করি, ভাষ্যে তার অভাব দেখা যায়। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ–হে অগ্নে! তুমি স্বভাবতঃ সকল ব্রতের পালক হও। সেই কারণে ইদানীং তুমি আমার ব্রতের পালক হও। হে অগ্নি, ব্রতের প্রার্থনাকালে তোমার সম্বন্ধী যে তনু আমাতে অবস্থিত ছিল, তোমার সেই তনু তোমাতেই হোক। হে ব্রতপতে অগ্নি! আমাদের অনুষ্ঠিতব্য কর্মসমূহ যেন স্ব-সম্বন্ধ অতিক্রম না করে..ইত্যাদি।–(আমাদের মর্মার্থ দেখুন)]। ৪।
.
পঞ্চম অনুবাক
মন্ত্র- অত্যন্যানগাং নান্যানুপাগামৰ্বাক্তা পরৈরবিদং পরোহবরৈস্তং। ত্বা জুষে বৈষ্ণবং দেব্যজ্যায়ৈ।। দেবা সবিতা মধ্বাহনক্কোষধে ত্ৰায়স্বৈনম স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ। দিবমগ্ৰেণ মা লেখীরন্তরিক্ষং মধ্যেন মা হিংসীঃ পৃথিব্যা সং ভব। বনস্পতে শতবশো বি রোহ। সহস্রব বি বয়ং রুহেম। যং ত্বাহয়ং স্বধিতিস্তেতিজানঃ প্রণিনায় মহতে সৌভগায়। অচ্ছিন্নে রায়ঃ সুবীরঃ ॥ ৫৷৷
মর্মার্থ- হে ভগবন! এক এবং অদ্বিতীয় আপনি বিশ্বের সকলকে অতিক্রম করে রয়েছেন; অথবা আপনি বিশ্বের সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের অতীত হন। (ভাব এই যে, ভগবানই সর্বমূলাধার)। এটি জেনে, হে ভগবন্! আমি আপনার শরণ গ্রহণ করছি। আপনি আমাকে উদ্ধার করুন। আপনি ভিন্ন কারও শরণ গ্রহণ করছি না; কারণ আপনি ভিন্ন অন্য কেউই ত্রাণ করতে সমর্থ নন। [ মন্ত্র দুটিই ভগবানের মাহাত্ম্য-বিজ্ঞাপক। বিশ্বের সকলের অতীত অপিচ অবাঙ্-নসোগোচর সেই ভগবান্ আমাকে উদ্ধার করুন; আমি সেই ভগবানের শরণ গ্রহণ করছি। হে ভগবন্! আপনি ভিন্ন কেউই ভবসিন্ধুর পার করতে অর্থাৎ ত্রাণ করতে সমর্থ নয়। হে ভগবন্! আপনিই একমাত্র উদ্ধারকর্তা]। হে ভগবন্! আপনার নিকট আগমন করলাম। নিকটে, দূরে অথবা নিকট ও দূরের বাহিরে যে কোনও স্থানে আপনি থাকুন না কেন, সেই স্থানেই আমি আপনাকে প্রাপ্ত হই। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! এইভাবে ভগবানের অঙ্গীভূত আপনাকে হৃদয়ে সৎ-ভাব-জননের অর্থাৎ দেবভাব উন্মেষণের জন্য সেবা করি অর্থাৎ প্রীত করি। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। হে ভগবন্! পরমপদপ্রাপ্তির কামনায়, সৎ-ভাব লাভের জন্য এবং শুদ্ধসত্ত্ব-প্রজননের জন্য আমি যাতে আপনার সেবা করতে পারি, আপনি কৃপা করে তার বিধান করুন)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! জ্ঞান-প্রদায়ক ভগবান্ তোমাকে মাধুর্য রসের দ্বারা রঞ্জিত (সিঞ্চিত) করুন–পালক করুন। কর্মফলনাশকারি হে দেব! আমাকে অজ্ঞান-মোহ হতে উদ্ধার করুন। (ভাবার্থ-হে দেব! আমার কর্মফল ধ্বংস করুন)। হে ভববন্ধনছেদনকারী দেবতা! এই জনের (আমার) প্রতি প্রতিকূল বা বিরূপ হবেন না। (ভাব এই যে,আমাকে ভববন্ধন হতে মুক্ত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক)। [ভগবান আমাদের কর্মফল ও ভববন্ধন নাশ করে, আমাদের পরমপদে প্রতিষ্ঠিত করুন-মন্ত্রের তিনটি অংশেই এই রকম প্রার্থনা বিদ্যমান রয়েছে ]। হে ভগবন্! আমার হৃদয়রূপ দেবস্থানকে যেন একেবারে পরিত্যাগ করবেন না। অন্তরিক্ষের মতো অনন্ত-প্রসারিত সক্কর্মের মূলকে কৃপা-বিরামের দ্বারা পরিত্যাগ করবেন না অর্থাৎ আমার প্রতি বিরূপ হবেন না। পরন্ত সৎ-বৃত্তির মূল হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্রের সাথে সকলে এসে সঙ্গত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক)। দ্যোতমান স্বপ্রকাশ হৃদয়রূপ অরণ্যের অধিস্বামি হে ভগবন্! আপনি বহুরূপ হয়ে বিশেষভাবে আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন। তাতে, উপাসক আমরা, বহুসামর্থোপেত সৎ-ভাব ইত্যাদি সমন্বিত হয়ে, বিশেষ ভাবে প্রবৃদ্ধ হতে পারব। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে,-ভগবান্ আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের সৎ-ভাব-সমন্বিত করুন এবং পরমধন প্রদান করুন)। সংসারবন্ধননাশক সেই ভগবানই একমাত্র ভবসিন্দুর পারে নয়ন-সমর্থ। অতএব হে ভগবন্! ঐশ্বর্যসমন্বিত সৌভাগ্যলাভের জন্য অথবা শোভন সকর্ম-সাধনের নিমিত্ত তোমাকে ভজনা করি। (মন্ত্র প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে,–সেই ভগবানই একমাত্র ভবসমুদ্রপারের নায়ক। সংসার-বন্ধন মোচনের জন্য আমি সেই ভগবানকে পূজা করি। হে ভগব! আমার সংসার-বন্ধন ছেদন করুন)। হে ভগবন্! আপনার পরমার্থরূপ ধন অশেষ এবং মোক্ষপ্রদানকারক হোক ॥ ৫॥
[কর্মকাণ্ড অনুসারে এই অনুবাকের জটিল মন্ত্রগুলি যুপতক্ষণে প্রযুক্ত হয়। ভাষ্যে মন্ত্রগুলির যে প্রয়োগবিধির উল্লেখ আছে, তা-ই প্রথমে বিবৃত করছি। আজশেষ গ্রহণের পর তক্ষের অভিমুখে গমন করে অত্যন্যা মন্ত্রে যুপকে অভিমৰ্শন এবং পূর্বাভিমুখ হয়ে অভিমন্ত্রিত করা কর্তব্য। তারপর যূপাহুতি-শেষ আজ্য গ্রহণের পর যুপক্ষণের জন্য বনে গমন করে আবার ঘূপকে অভিমৰ্শন বা আমন্ত্রিত করবার বিধি সুত্রে উক্ত আছে। অনুবাকের মন্ত্রগুলি বনস্পতি দেবতা বিষয়ে বিনিযুক্ত। কোন্ বৃক্ষ যুপের উপযুক্ত এবং কোন্ বৃক্ষ যুপের উপযুক্ত নয়,ভাষ্যে তারও আভাস দেওয়া হয়েছে। সে সম্বন্ধে ভাষ্যকারের উক্তি; যথা–যাপ্যা ও অপ্যা ভেদে বৃক্ষ দুরকম। পলাশ, খদির ও বিশ্ব প্রভৃতি বৃক্ষ–যুপ্যা; আর নিম্ব-জম্বীর ইত্যাদি বৃক্ষ–অযুপ্যা। এইরকম সূচনার অবতারণা করে ভাষ্যকার মন্ত্রগুলির যে অর্থ প্রকাশ করেছেন; তা এই-হে পুরোবর্তী ঘূপবৃক্ষ! তুমি ভিন্ন, সমপ্রদেশে জন্ম ইত্যাদি লক্ষণ-বিরহিত অপর সকল ঘূপকেই আমি অতিক্রম করেছি। অন্যান্য যূপ-সমূহকেও আমি পরিত্যাগ করেছি। পর, অপর এবং দূরবর্তী বৃক্ষসমূহের নিকটস্থ তোমাকে আমি প্রাপ্ত হয়েছি। নিকট হতে পূর্ববর্তী তোমাকেই জেনেছি। হে বৃক্ষ, দেবযাগের নিমিত্ত এই হেন তোমাকে আমরা সেবা করি। (মার্থ-হে যুপবৃক্ষ যজ্ঞের নিমিত্ত তোমাকে স্পর্শ করি)। দেবযাগের নিমিত্ত দেবগণও তোমাকে সেবা করুন। ওষধে ত্ৰায়স্ব মন্ত্রে কুশতরুকে তিরস্কার করতে হয়। ঘূপবৃক্ষের কুশকে অপসারিত করবার সময় এই মন্ত্র পাঠ করার বিধি। (মার্ত-হে ওষধে! স্বাধিতি ভয় হতে আমাকে রক্ষা করো।স্বাধিতি প্রভৃতি মন্ত্রে পরশূনা-প্রহরণের বিধি। (মন্ত্রের অর্থ-হে স্বধিতি পরশু! এই ঘূপকে বধ করো না)।-যুপবৃক্ষের কাছে এমন অর্থহীন প্রার্থনায় ঐহিক বা পারাত্রিক কি সুফল লাভের সম্ভাবনা, বোঝা যায় না। কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা নেনে নিলেও, আমরা আধ্যাত্মিক বিচারে কোনক্রমেই ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারিনি। সুতরাং আমাদের ব্যাখ্যা ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থাই অনুসরণ করেছে। যেমন–অত্যন্যান মন্ত্রাংশের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ–হে ঘূপবৃক্ষ!–ইত্যাদি। কিন্তু বৃক্ষবাচক কোনও পদ বা অন্যান্য বৃক্ষকে অতিক্রম করে আসার ভাব মন্ত্রের কোথাও পরিদৃষ্ট হয় না; এমন কি, তার আভাস মাত্রও মন্ত্রের মধ্যে নেই। মন্ত্রে আছে মাত্র-অতি ও অন্যান দুটি পদ। এতে অঅমরা কেন বৃক্ষের সম্বন্ধ টেনে আনব? সকল ধর্মের উৎসস্থানীয় বেদে ভগবানের মাহাত্ম্যই পরিকীর্তিত। এটাই আমাদের বিশ্বাস। ভগবানের গুণগান, ভগবানের মহিমা কীর্তন, ভগবানের অনুস্মরণ–এটাই হলো বেদের মূল সুত্র। অপার্থিব সামগ্রীতে পার্থিব সামগ্রীর পার্থিব সম্বন্ধ খ্যাপন, নিত্যসামগ্রীর সাথে অনিত্য পৌরুষেয় সামগ্রীর সম্বন্ধ সূচনায়, বেদের নিত্যত্বে ও অপৌরুষেয়ত্বে বিঘ্ন ঘটে। আমরা তাই মনে করি, মন্ত্র ভগবানের উদ্দেশ্যেই প্রযুক্ত। ভগবানের মাহাত্ম্যই মন্ত্রে পরিব্যক্ত। অতি ও অন্যান পদ দুটি সেই উদ্দেশ্যেই প্রযুক্ত। তাই আমরা অতি পদের অর্থ করেছি–অতিক্রম্য বর্তসি; আর অন্যান্ পদের অর্থ করেছি-বিশ্বান্ সর্বান্। অর্থাৎ,-হে ভগবন্! আপনি বিশ্বের সকলকে অতিক্রম করে বিদ্যমান রয়েছেন অর্থাৎ আপনি সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অতীত। তার পরই, ভগবানের মহিমা অবগত হয়ে প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করেছেন;–অগাং অর্থাৎ আপনার নিকট আগমন করলাম আপনার শরণ নিলাম। কেন শরণ নিলাম?–ভবসমুদ্র উত্তরণের আশায়। আরও, আমি জানি আমার বোধগম্য হয়েছে,ন অন্যান অর্থাৎ আপনি ভিন্ন সংসারসমুদ্রপারের কাণ্ডারী অন্য কেউই নেই। তা জেনেই আপনার শরণ নিচ্ছি। আপনিই একমাত্র ত্রাণকর্তা। আশা করি, পাঠক-পাঠিকাগণ আমাদের এইরকম বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুধাবন করতে পারবেন । ৫।
.
ষষ্ঠ অনুবাক
মন্ত্র- পৃথিব্যৈ ত্বাহন্তরিক্ষায় ত্বা দিবে ত্বা। শুদ্ধতাং লোকঃ পিতৃষনো। যবোহসি যবয়াম্মদ্যো যয়ারাতীঃ পিতৃণাং সদনমসি। স্বাবোহস্যগ্রেগা নেতৃণাং বনস্পতিরধি ত্বা স্থাস্যতি তস্য বিত্তা। দেবস্থা সবিতা মধ্বাহন। সুপিম্পলাভ্যন্তোষধীভ্যঃ।। উদ্দিবং শুভানাহন্তরিক্ষং পৃণ পৃথিবীমুপরেণ দুংহ। তে তে ধামাশ্মসি গমধ্যে গাবো যত্র ভূরিশৃঙ্গা অয়াস। অত্রাহ তদুরুগায়স্য বিষ্ণোঃ পরমং পদমব ভাতি ভূরেঃ।। বিষ্ণোঃ কর্মাণি পশ্যত যত ব্ৰতানি পস্পশে। ইন্দ্রস্য যুজ্যঃ সখা। তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম। ব্রহ্মবনিং ত্বা ক্ষত্রনিং সুপ্ৰজানিং রায়ম্পোষবনিং পর্যহামি ব্ৰহ্ম দৃংহ ক্ষত্রং দৃংহ প্রজাং দৃংহ রায়ম্পোষং দৃংহ। পরিবীরসি পরি ত্বা দৈবীৰ্বিশশা ব্যয়স্তাম্ পরীমং রায়ম্পোষো যজমানং মনুষ্যা। অন্তরিক্ষস্য ত্ব সানাবর গুহামি ॥ ৬৷৷
মর্মার্থ- হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পৃথিবী-সংস্থিত ভূতসঙ্ঘের নিমিত্ত অথবা পৃথিবীর হিতকামনায় (অথবা হৃদয়ে পৃথিবী সম্বন্ধী দেবভাব সংজননের জন্য) তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! অন্তরিক্ষলোকস্থিত ভূতসঙ্ঘের উপকারের নিমিত্ত অথবা অন্তরিক্ষলোকের হিতসাধনের জন্য (অথবা হৃদয়ে অন্তরিক্ষলোকসম্বন্ধী দেবভাব সংজননের জন্য) তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! দুলোকস্থিত ভূতসঙ্ঘের প্রীতির জন্য অথবা স্বর্গলোকের হিতসাধনের জন্য (অথবা হৃদয়ে স্বর্গলোক-সম্বন্ধি দেবভাব-সংজননের জন্য) তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমার প্রভাবে পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত লোকসকল অর্থাৎ পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত হৃদয়, বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হোক অথবা পরিত্রাণ লাভ করুক। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের সাথে মিলনসাধক অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে আত্মার মিশ্রণকারী হও। অতএব তুমি আমাদের থেকে আমাদের শত্রুদের পৃথক অর্থাৎ দূরে অপসারণ ও বিনাশ করো; অপিচ, দান-প্রতিবন্ধক অর্থাৎ সৎ-বৃত্তি-নাশক শত্রুদের বিনাশ করো; অপিচ, দান-প্রতিবন্ধক অর্থাৎ সৎ-বৃত্তি-নাশক শত্রুদের বিনাশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে ভগবন্! আমাদের আন্তর্বাহ্য সকল শত্রুকে বিনাশ করে আমাদের পরমাত্মার সাথে সম্মিলিত করো)। হে আমার হৃদয়! তুমি পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত হও। অতএব তুমি বিশুদ্ধতা লাভ করো। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সুন্দরভাবে ব্যাপ্ত হও এবং সকর্মের পরিচালক সৎ-বৃত্তিগণের অগ্রগামী হও। তারপর সংসাররূপ অরণ্যের অধিকারী ভগবান, তোমাকে আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত অর্থাৎ সঞ্চারিত করুন, যেন আমি ভগবানের পরমধন অর্থাৎ মোক্ষলাভে বঞ্চিত না হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবান্ আমার হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করুন–এটাই প্রার্থনা)। হে মন হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! জ্ঞান-প্রদায়ক ভগবান্ তোমাকে মাধুর্যরসের দ্বারা রঞ্জিত করুন অর্থাৎ পালন করুন। হে মন চিত্তবৃত্তি! সুফল-সমন্বিত কর্মক্ষমের নিমিত্ত তোমাকে নিযুক্ত করছি। হে আমার মন! ১ তুমি দ্যুলোককে অর্থাৎ দ্যুলোক-সমন্ধি দেবভাবকে উৎকৃষ্টভাবে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ যাতে তা পরিক্ষীণ না হয়,সেইরকম ভাবে রক্ষা করো; অন্তরিক্ষলোকস্থিত দেবভাবকে সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করো; এবং পৃথিবীতলে অবস্থিত অথবা ভূলোক-সম্বন্ধি সৎ-ভাবকে দৃঢ় করো। (ভাব এই যে, সকল দেবভাব আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোক)। অথবা,-হে ভগবন্! তুমি আমার হৃদয়রূপ দেবস্থানকে অর্থাৎ পরমসুখমূলকে উন্নতভাবে বা প্রকৃষ্টভাবে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ পতন হতে রক্ষা করো; অন্তরিক্ষের মতো অনন্ত-প্রসারিত আমার সৎকর্মের মূলকে অথবা, সৎ-ভাব-সমূহের সর্বব্যাপকত্বকে পরিপূর্ণ অর্থাৎ পরিবর্ধিত করো; এবং সৎ-ভাব-সমূহের আধারক্ষেত্রকে অর্থাৎ আমার সৎ-বৃত্তিমূলকে দৃঢ় করো। (সৎ-ভাবের প্রভাবে ও শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাব আমাতে সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য অবিচলিতভাবে অবস্থিতি করুক। তাতে পূর্ণজ্ঞান লাভ হবে এবং ভগবানকে প্রাপ্ত হতে পারব)। হে ভগবন্! আপনার অধিষ্ঠিত স্থানে গমন করবার কামনা করি; অতএব আমাদের বিবেকবাণীরূপ জ্ঞানকিরণসমূহ বহু-দীপ্তিপূর্ণ এবং অবিনশ্বর হোক। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি এমন হও, যেন আমাদের হৃদয়ে নিত্যকাল সত্ত্বভাব-প্রদায়ক মহত্ত্বসম্পন্ন ভগবানের শ্রেষ্ঠ স্বরূপ প্রকাশিত হয়। (মন্ত্রটি সঙ্কল্প-মূলক)। হে আমার চিত্তবৃত্তি-সমূহ! তোমরা বিশ্বব্যাপক ভগবানের সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারচরিত কর্মসমূহকে অথবা তাঁর অলৌকিক শক্তিকে অবলোকন করো; সে শক্তিসমূহের দ্বারা ভগবান্ যে সৎকর্মসমূহ আমাদের সম্পাদনের নিমিত্ত সৃষ্টি করেছেন, সেই সৎকর্মসমূহ সম্পন্ন করো। তাহলে ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবানের উপযুক্ত বন্ধু বা প্রীতি উৎপাদক হতে পারবে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভগবানের নির্দিষ্ট কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা লোক তার প্রীতি উৎপাদন করতে সমর্থ হয়–এটাই ভাব)। অথবা,–হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! বিশ্বব্যাপী ভগবান বিষ্ণুর যে পালন ইত্যাদি কর্ম সকল তোমরা প্রত্যক্ষ করো–অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। সেই বিষ্ণু ইন্দ্রদেবের অভিন্ন সখা অর্থাৎ তার সাথে একাত্মক। (ভাব এই যে,ভগবান্ বিষ্ণুর অনুগ্রহে, হে মনুষ্যগণ, তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হও; দেবগণ যে অভিন্ন, তা স্মরণ রেখে)। আকাশে নিবারণে সূর্যের আলোক-লাভে চক্ষু যেমন অবাধে সমস্ত দৃষ্টি করে, সেইরকম জ্ঞানিগণ পরমেশ্বর্যসম্পন্ন সর্বব্যাপক ভগবান বিষ্ণুর পরমপদ (শ্রেষ্ঠ-স্বরূপ) সদাকাল প্রত্যক্ষ করে থাকেন। (ভাব এই যে-সূর্যের আলোকের সাহায্যে বাধা-বিরহিত আকাশে চক্ষু যেমন প্রকৃতিপুঞ্জুকে পর্যবেক্ষণ করে, জ্ঞানিগণ তেমনই জ্ঞানের প্রভাবে সকল কালেই ভগবানের তত্ত্ব অবগত হয়ে থাকেন)। হে মন! ব্রাহ্মণভাবাপন্ন অর্থাৎ সত্ত্বগুণেপেত ব্রহ্ম-স্বরূপ, ক্ষত্র-ভাববাপেত অর্থাৎ রজোভাবাপন্ন, সৎ-ভাব-সম্পন্ন, পরমার্থরূপ ধনের পোষক তোমাকে প্রকৃষ্টভাবে স্থাপন করছি অথবা পরমাত্মায় নিয়োজিত করছি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। মনই সকল সৎ-বৃত্তির মূল এবং সকল সৎ-ভাবের পোষক। মন যাতে সর্বদা ভগবৎপরায়ণ হয়, সেইরকমভাবেই বিহিত করো,–এটাই ভাবার্থ)। হে মন! তুমি সত্ত্বভাবকে দৃঢ় করো। তুমি ক্ষত্ৰভাবকে অর্থাৎ রজোভাবকে দৃঢ় করো, অর্থাৎ পোষণ করো; তুমি সৎ-ভাবকে দৃঢ় করো অর্থাৎ পোষণ করো; তুমি পরমার্থরূপ ধনকে দৃঢ় করো অর্থাৎ পোষণ করো। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি চতুর্দিকে সৎ-গুণের দ্বারা বেষ্টিত হও; দেব-সম্বন্ধি সৎ ভাবসমূহ তোমাকে বেষ্টন করুক; এবং পরমার্থরূপ ধন ইত্যাদি এবং মনুষ্যোচিত ধর্ম-কর্মসমূহ এইরকম সকর্মকারক আমাকে পরিবেষ্টন করুক। হে আমার শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে অন্তরিক্ষলোকে স্থিত দেবভাবের পার্শ্বে স্থাপন করি। (আমি শুদ্ধসত্ত্বকে দেবভাবের সাথে সম্মিলিত করি এটাই পূর্বের অনুবাকে যুপচ্ছেদ উক্ত হয়েছে; আর এই অনুবাকে ছিন্নকূপ স্থাপন করবার মন্ত্র কথিত হচ্ছে। কর্মকাণ্ডের পরিপোষক সেই ভাব গ্রহণ করে ভাষ্যকার অনুবাকের মন্ত্রগুলির অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন। — আমাদের মতে প্রথম চারটি মন্ত্রের সম্বোধ্য সেই শুদ্ধসত্ত্বভাব। এ হিসেবে প্রথম মন্ত্রটির প্রথম অংশের অর্থ হয়–হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পৃথিবী-নিবাসী ভূতসঙ্ঘের উপকারের নিমিত্ত অথবা পৃথিবীর হিতকামনায় অথবা পৃথিবী-সম্বন্ধী দেবভাব সমূহকে হৃদয়ে উন্মেষের জন্য তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি। এরকম প্রায় প্রত্যেক মন্ত্রেই আধ্যাত্মিক অর্থ দৃষ্ট হয়। এই মন্ত্রের কয়েকটি অংশে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রথম অংশের লক্ষ্য-স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বচরাচরের হিতসাধন। মন্ত্র কয়টিতে এক বিশ্বজনীন ভাবের বিকাশ হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের প্রথম অংশটি যেন বলে দিচ্ছে-চিত্রের বিক্ষোভ দূর করো; হৃদয় নির্মল করো; সৎ-ভাব আপনিই এসে তাতে আশ্রয় গ্রহণ করবে। ঐ মন্ত্রের পরবর্তী অংশের ভাবটি নিগূঢ় আখাত্মিক তথ্যে পরিপূর্ণ। তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্রেও শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধন করা হয়েছে। হৃদয়-নিহিত সমস্ত সৎ-গুণের শ্রেষ্ঠ যে শুদ্ধসত্ত্ব–এটা আমরা এই মন্ত্রে দেখতে পাই। পঞ্চম মন্ত্রটিতে ভক্তের কর্মক্ষমের নিমিত্ত প্রচেষ্টার ভাব দৃষ্ট হয়। ষষ্ঠ মন্ত্রে নিখিল দেবভাব আহরণ করে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার কামনা প্রকাশ পেয়েছে। এ মন্ত্রে দুরকম অর্থ সংসূচিত হতে পারে বলে দুটি অন্বয় অনুযায়ী অর্থ প্রকাশিত হয়েছে। সপ্তম মন্ত্রে ভক্ত ভগবানের সাযুজ্য সামীপ্য লাভ করতে ইচ্ছুক হয়ে বহুদীপ্তিসম্পন্ন ও অবিনশ্বর জ্ঞান প্রার্থনা করছেন। অষ্টম মন্ত্রের দুটি ভাবের মধ্যে প্রথমটিতে বোঝান হচ্ছে–ভগবানের নির্দিষ্ট কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা লোক তার প্রীতি উৎপাদন করতে পারে। দ্বিতীয় ভাবটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। সেখানে ভক্ত আপন মনোবৃত্তিনিচয়কে সম্বোধন করে পুণ্যের অনুষ্ঠানে উদ্বুদ্ধ করছেন। নবম মন্ত্রে ভক্তের দিব্য-দৃষ্টি লাভের প্রার্থনা,-মূঢ় অজ্ঞ আমি, আমার আননেত্র উন্মীলিত করে দিন। আমার সম্মুখের বাধা অপসারিত হোক;–আকাশের মতো নির্মল পথে আমি যেন আপনাকে সদাকাল সর্বত্র দেখতে পাই। দশম মন্ত্রের প্রথম অংশটি সঙ্কল্পমূলক। ভাষ্যকার মন্ত্রের অন্তর্গত ব্রহ্মবনিঃ ও ক্ষত্রবনিঃ পদ দুটির অর্থ করেছেন ব্রাহ্মণজাতির ও ক্ষত্রিয়জাতির প্রীণনকারী। কিন্তু এখানে বেদমন্ত্রে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতির সম্বন্ধ কিভাবে প্রখ্যাপিত হয়, তা আমরা অনুধাবন করতে পারলাম না। যাই হোক, আমরা এই মন্ত্রের অন্তর্গত ব্রহ্মবনিঃ ও ক্ষত্রবনিঃ পদ দুটিতে কোনও জাতির সম্বন্ধ স্বীকার করি না। এই দুই পদে সত্ত্ব-রজগুণ দুটির ব্যাখ্যান হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। সেইজন্য ব্রহ্মবনিঃ পদের ব্রহ্মস্বরূপং এবং ক্ষত্ৰবনি পদের ক্ষত্ৰভাবোপেতং রজোগুণসম্পন্নং অর্থ অধ্যাহার করেছি। এই মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে ভক্তের প্রার্থনা–হে মন! তুমি আমার হৃদয়ে সত্ত্ব, রজঃ এবং পরমার্থরূপ ধনকে পোষণ করো। (ভাব এই যে,–সত্ত্ব, রজঃ প্রভৃতি উচ্চ ভাব আমার হৃদয়কে অলঙ্কৃত করুক)। একাদশ মন্ত্রে ভক্ত তার হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব-বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সৎ-গুণের বিকাশও প্রার্থনা করছেন। শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যেন দেবভাবে হৃদয় পরিপূর্ণ হয় এবং তিনি (ভক্ত) যেন মনুষ্যোচিত সকর্মে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারেন। দ্বাদশ মন্ত্রটিতে শুদ্ধসত্ত্ব যে দেবভাবেরই অংশ তা-ই বোধগম্য হয়] ॥ ৬।
.
সপ্তম অনুবাক
মন্ত্র- ইষে তোপবীরপো দেবাবৈীৰ্ব্বিশঃ প্রাগুৰ্ব্বীরুশিজ্যে বৃহস্পতে ধারয়া। বসুনি হ্যাঁ তে স্বদন্তাম্ দেব ত্বসু রম্ব রেবতা মধ্ব। অগ্নে…নিত্ৰমসি বৃষণেী স্থ উর্বশ্যস্যায়ুরসি পুরূরবা ঘৃতেনাক্তে বৃষণং দধাথা। গায়ত্রং ছন্দোহনু প্র জায়স্ব ত্রৈম জাগতং ছন্দোহনু প্র জায়স্ব। ভবত নঃ সমনসৌ সমোকসাবরেপসৌ। মা যজ্ঞং হিংসিষ্টং মা যন্ত্রপতিম জাতবেদসৌ শিবৌ ভবতমদ্য নঃ। অগ্নাবগ্নিশ্চতি প্রবিষ্ট ঋষীণাং পুত্রা অধিরাজ এষঃ। স্বাহাকৃত্য ব্ৰহ্মণা তে জুহোমি মা দেবানাং মিথুয়া কর্ভাগধেয়ম ॥ ৭৷
মর্মার্থ- হে ভগবন! অভীষ্ট লাভের নিমিত্ত অর্থাৎ পরামুক্তিলাভরূপ অভীষ্ট-পূরণের জন্য আপনাকে আহ্বান করি-হৃদয়ে ধারণ করি। হে আমার মন! তুমি ভগবৎ-সমীপে গমনে অভিলাষী হও। (সাধনার প্রভাবে) তুমি ভগবানের সামীপ্য লাভের জন্য উদ্বুদ্ধ হও। তাহলে, দেবভাব সমূহ-শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি এবং দেবভাব-সমন্বিত চিত্তবৃত্তি-সমূহ সঞ্জাত হবে। অপিচ, তাতে তুমি সৎ-ভাব-সঞ্চারক জ্ঞানরশ্মি-সমূহ এবং কর্মক্ষয়কারী প্রবৃত্তি-সমূহ লাভ করতে পারবে। অশেষ প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! আপনি ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ নানা রত্নসমূহকে প্রদান করুন। অপিচ, আপনার সম্বন্ধী হবিঃসমূহ অর্থাৎ আমার জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি আপনার গ্রহণযোগ্য হোক। পবিত্ৰাতা সাধক দ্যুতিমান হে ভগবন্! আপনি রমণীয় পরমধন প্রদান করুন। পরমার্থযুত হে দেবতা। আপনারা আনন্দরূপে আমাদের হৃদয়ে বিরাজিত হোন। (ভাব এই যে,পরম ধনের অধিকারী দেবগণ আনন্দরূপে আমাদের মধ্যে সদা-সর্বদা বিরাজমান থাকুন)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি জ্ঞানময় ভগবানের প্রীণন-হেতুভূত অথবা প্রজনক অর্থাৎ প্রাপ্তির কারণ হও। (ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে এবং জ্ঞানের সাহায্যে ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত জ্ঞানকর্ম! তোমরা অভীষ্টবর্ধক সার্বাভীষ্টপূরক অথবা মোক্ষদায়ক হও। (ভাব এই যে, সৎ-জ্ঞান ও সৎ-কর্মের দ্বারা মানুষ অভীষ্ট লাভ করতে সমর্থ হয়)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি মহাদীপ্তি-বিশিষ্টা ষড়ৈশ্বর্যশালিনী–মহতের বশকারিণী হও। (তাৎপর্য এই যে, বিশুদ্ধা (অনন্যা) ভক্তির দ্বারা মহান-ঐস্বর্যসম্পন্ন ভগবান ও বশীভূত হন। অপিচ, ভক্তিতে তিনি ভক্তের সাথে মিলিত হয়ে তা উদ্ধার-সাধন করেন)। হে আমার হৃদয়াধিপতি শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আয়ুদাতা, অকাল-মৃত্যু-নিবারক অর্থাৎ সৎকর্মশীল জীবন-বিধাতা হও। (ভাব এই যে,–সম্ভবের প্রভাবে মানুষ পূর্ণ-আয়ুষ্কাল পর্যন্ত জীবিত থাকে, এবং সকর্ম-সাধনের সামর্থ্য প্রাপ্ত হয়। অতএব প্রার্থনা–আমাকে পূর্ণায়ুষ্কাল বা চিরজীবন অর্থাৎ সৎকর্মশীল জীবন প্রদান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভগবন্! আপনি বহুপ্রদাতা অর্থাৎ বহুরকম-ফলদান-হেতু অভীষ্ট-পূরক হন। অথবা সর্ব অভীষ্ট-দায়ক, সর্ব ফল-পুরক হন। অতএব প্রার্থনা–আপনি অভীষ্টফল মোফল প্রদান করুন। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত জ্ঞান-কর্ম! তোমরা ভক্তিরূপ ঘৃতের দ্বারা অভিষিক্ত হয়ে অভীষ্ট-পূরণে অভিবৃদ্ধ হও। হে শুদ্ধসত্ত্ব! গায়ত্রীছন্দোবদ্ধ ব্ৰহ্মমন্ত্র বা স্তুতি লক্ষ্য করে তুমি প্রদীপ্ত হও; অপিচ জগতীছন্দোবদ্ধ ব্ৰহ্ম-মন্ত্র বা স্তুতি লক্ষ্য করে উদ্দীপিত হও। (ভাব এই যে,নিখিল সৎ-ভাবমূলক সৎকর্মের দ্বারা অজ্ঞানতা দুর করে প্রজ্ঞানতা যেন লাভ করি; অপিচ শুদ্ধসত্ত্ব দেবভাব যেন সঞ্চয় করতে সমর্ত হই। সৎ-কর্ম-সঞ্জাত হে জ্ঞানভক্তিরূপী দেবদ্বয়! আমার হৃদয়-নিহিত এবং আমার হৃদয়-গৃহ-স্বামী অথবা হৃদয়রূপ গৃহের পালকরূপে বিদ্যমান। শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত হে জ্ঞানদেব! আপনারা উভয়ে আমাদের সাথে সমান-মননযুক্ত অথবা আমাদের প্রতি অতিশয় প্রীতিযুক্ত, পরস্পর সমান-মনোযুক্ত অথবা আমাদের প্রতি অতিশয় প্রীতিযুক্ত পরস্পর সমান-চিত্তযুক্ত অথবা আমাদের প্রতি অনুগ্রহের জন্য পরস্পর সখিত্ব-সম্পন্ন এবং পাপরহিত অনুষ্ঠানেও আমাদের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হোন। অপিচ, সৎকর্মকারী আমাকে এবং আমার অনুষ্ঠিত কর্মকে বিনাশ করবেন না। (অর্থাৎ আমাকে এবং আমার কর্মকে পরিত্যাগ করবেন না); পরন্তু অদ্য অর্থাৎ সর্বকালে আমাদের উপকারের জন্য আপনারা কল্যাণকারী ও মঙ্গলপ্রদ হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাবার্থ-আমাতে জ্ঞান ও ভক্তি অবিচলিত হোক; আর আমাদের কর্ম জ্ঞানানুসারী ও সৎ-ভাবমণ্ডিত হোক)। আত্ম-উল্কর্য-সম্পন্ন জনের অথবা অতীন্দ্রিয়দ্রগণের পুত্রস্থানীয় অর্থাৎ তাদের সৎকর্ম ইত্যাদি হতে সঞ্জাত, সর্বভূতে বিরাজমান অথবা সর্বভূতের অধিপতি প্রজ্ঞানস্বরূপ অথবা প্রজ্ঞানাধার ভগবান, হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বে তানুঃপ্রবিষ্ট হয়ে অর্থাৎ শুদ্ধসত্বকে প্রাপ্ত হয়ে পরিচর্যা করেন অর্থাৎ সেই শুদ্ধসত্ত্বনিহিত হবিঃ বা ভক্তিকে গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, সৎ-ভাব শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের প্রীতির সামগ্রী। তা ভগবানের তৃপ্তিসাধক এবং তার দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। প্রজ্ঞানাধার হে ভগব। স্বাহা-শব্দসহযুত স্তুতিরূপ মন্ত্রের দ্বারা আপনাকে অর্চনা করছি। দেবভাব সমূহের (শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদির) অংশভূত বা আধারস্বরূপ আপনাকে যেন কর্মবেগুণ্যে মিথ্যাভূত না করি । ৭।
[বিনিয়োগ-সংগ্রহের অনুসরণে এই অনুবাকের সকল মন্ত্রের বিনিয়োগ; যথা,-ইষে ত্বা প্রভৃতি মন্ত্রে বহি এবং উপ প্রভৃতি মন্ত্রে প্লক্ষশাখা গ্রহণের পর পুনরায় উপ প্রভৃতি মন্ত্রে পণ্ড হনন করে অগ্নে প্রভৃতি মন্ত্রে সেই পশুর অংশ বিশেষ দ্বারা হোম করতে হয়। বৃষণৌ স্থ প্রভৃতি মন্ত্রে দুটি দর্ভ স্থাপন, উর্বশী প্রভৃতি মন্ত্রে তার একটিকে অরণি-মধ্যে নিক্ষেপন এবং পুরূরবা প্রভৃতি মন্ত্রে দ্বিতীয় দর্ভকে তার উপরে স্থাপন করবার বিধি। ঘৃতেনাক্তে প্রভৃতি মন্ত্রে তারপর সেই দর্ভ দুটিকে এবং হত পশুর মেদকে অরণির দ্বারা মন্থন করে ভবতং নঃ সমানসৌ প্রভৃতি মন্ত্রে তার দ্বারা অগ্নিতে হোম করবার বিধি। ভাষ্যের প্রারম্ভে ভাষ্যকার বলছেন,-ষষ্ঠ অনুবাকে ঘূপস্থাপনের মন্ত্রগুলি উক্ত হয়েছে। সপ্তম অনুবাকে সেই যুপে পশু-বন্ধন এবং পশু-হনন প্রভৃতির এবং হোমের বিষয় উক্ত হচ্ছে। পূর্বোক্ত বিনিয়োগ অনুসারে। মন্ত্রগুলির অর্থ; যেমন, প্রথম মন্ত্রে–হে বহ্নি! পশুলক্ষণযুক্ত দেবগণের আগমনের আকাঙ্ক্ষায় তোমাকে ধারণ করছি। উপকরণ বা হননের জন্য গমন করে যে, তা-ই উপবী। হে প্লক্ষশাখে! তুমি উপবী হও। তোমাকে সমীপে প্রাপ্ত হয়েছে। কে প্রাপ্ত হয়েছে?–অর্থাৎ উপক্রিয়ামাণ পশু-সমন্ধী হৃদয় ইত্যাদি অবয়বসমূহ। কাদের প্রাপ্ত হয়েছে? না-দেবান্ অর্থাৎ অগ্নীষোম ইত্যাদি দেবসম্বন্ধিনী প্রজাদের। হে বৃহস্পতে! বসুনি অর্থাৎ হৃদয় ইত্যাদি দ্রব্যসমূহকে পোষণ করো। হে পশু! তোমার সম্বন্ধী হব্য-সমূহ স্বাদু হোক। হে স্বনামক দেবতা! তুমি পশুকে রমণীয় করো। হে রেবতী! ক্ষীরাদি-ধনবন্ত পশুসমুহ যজমানের গৃহে ক্রীড়া করুক। আমরা পুনঃ পুনঃ বলেছি,- ক্রিয়াকাণ্ডের অনুসরণে মন্ত্রে যে ভাব–যে অর্থই সূচিত হোক না কেন, আমরা তার বিরোধী নই। তবে আমরা যে পথের অনুসন্ধানে যে লক্ষ্যপথে ছুটেছি, তাতে ভাষ্যকারের পূর্বোক্ত অর্থের সাথে একমত হতে পারি না। আমাদের মতে মন্ত্রের সম্বোধন স্বতন্ত্র-মন্ত্রের ভাব স্বতন্ত্র। বহি বা প্লক্ষশাখা অথবা পশু আধ্যাত্মিক উন্নতি-বিধায়ক ৰা পারলৌকিক মঙ্গল-সাধক হতে পারে কিনা, সে বিষয়ে আমাদের বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। আমরা মন্ত্রটিকে ছয় ভাগে বিভক্ত করেছি। সেই ছয়টি বিভিন্ন বিভাগে ছয়টি বিভিন্ন সম্বোধন পদ পরিকল্পতি হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের বিভিন্ন অংশ অরণি সম্বোধনে বিনিযুক্ত। আমাদের মতে, প্রথম অংশ হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের অংশ জ্ঞানকর্মের, তৃতীয় অংশ ভক্তির, চতুর্থ অংশ শুদ্ধসত্ত্বের, পঞ্চম অংশ ভগবানের, ষষ্ঠ অংশ জ্ঞানকর্মের এবং শেষ অংশ ভগবানের সম্বোধনে প্রযুক্ত। মন্ত্রের অন্তর্গত বৃষণেী, উর্বশী, পুরূরবা ও আয়ু পদ চারটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেও গণ্ডগোল দেখা যায়। অনেকে এখানে পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে স্বর্গোপ্সরা উর্বশী ও নৃপতি পুরূরবার সহযোগে আয়ু নামক নরপতির উৎপত্তিকে টেনে আনেন। কিন্তু তাতে ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ হয়–সন্তান-উৎপাদনে মুম্বুদ্বয় যেমন বীর্যসেচক হয়, তেমনি হে দৰ্ভয়, অরণিদ্বয় মন্থনে অগ্নি-উৎপাদনে তোমরাও মুষ্কের মতো হও। আমরা কিন্তু বৰ্ষণাত্মক বৃষ ধাতু থেকে বৃষণ পদের উৎপত্তি বলে মনে করি। আর তা থেকেই বৃষণ পদের অর্থ করি–অভীষ্টবর্ধকৌ, সর্বাভীষ্টপূরকৌ বা মোক্ষপ্রদায়কৌ। এখানে আমাদের সম্বোধ্য–জ্ঞান ও কর্ম। উর্বশী শব্দ–উরু + বশ + অ (অ)। উরু শব্দে মহৎ এবং বশ অর্থে বশীভূত করা অর্থ বুঝিয়ে থাকে। তাতে উর্বশী পদের অর্থ হয়,-মহৎকে যিনি বশীভূত করতে সমর্থ। উরু–মহৎ শব্দে ভগবানকে বোঝায়। তাহলে, মহান, যে ভগবান, তিনি কিসে বশীভূত হন?-কে তাঁকে বশীভূত করতে সমর্থ হয়? একমাত্র ভক্ত ভিন্ন আর কে তাকে বশীভূত করতে পারে? আমরা এই ভাব উপলব্ধ করেই মন্ত্রের সম্বোধ্য-ভক্তিরূপিণী দেবীকে লক্ষ্য করেছি। পঞ্চম অংশের ঐ পুরূরবাঃ পদে, আমাদের মতে, পৌরাণিক নৃপবিশেষকে বোঝায় না। আমাদের মতে ঐ পদের অর্থ–বহুপ্ৰদাতা, যদ্বা– বহুবিধ ফলপ্রদাতৃত্বৎ অভীষ্টপূরকঃ। ভাষ্যমতে, মন্ত্রের সম্বোধ্য–উত্তরায়ণি। আমাদের মতে-শুদ্ধসত্ত্ব। আমরা মনে করি,-পুরূরাবা বা পুরূরাব শব্দ থেকে পুরূরবা পদ নিষ্পন্ন। তা থেকেই বহুফলপ্ৰদাতা এবং তা থেকেই অভীষ্টপূরক অর্থ অধ্যাহৃত হয়ে থাকে। চতুর্থ অংশের আয়ুপদের লক্ষ্য–পুরূরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভজাত পুত্র আয়ুকে নয়। তাতে পূর্ণ-আয়ুষ্কাল-বিধাতা মৃত্যুভয়নিবারণকারী হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্বকেই বোঝাছে। জীবের সংসারে অবস্থিতির বা জীবিতকালের একটা সময় নির্দিষ্ট আছে; কিন্তু মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট নেই। বিষয়টি একটু প্রহেলিকাময়। নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ না হলে যদি জীব দেহত্যাগ না করে, তাহলে মৃত্যুরও নির্দিষ্ট সময় থাকবে না কেন? তার কারণ এই যে,জীব যদিও নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল নিয়ে সংসারে উপস্থিত হয়, কিন্তু কৃতকর্মের দ্বারা–পাপের বা পুণ্যের অনুষ্ঠানে-স্বল্পায়ুঃ বা দীর্ঘজীবী হয়ে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য জীব যখন ইতস্ততঃ ধাবমান হয়, তখন মায়া বা অবিদ্যার সহচর পাপ এসে তার মোহ-উৎপাদনে প্রয়াস পায়। যদি পূর্বসুকৃতির বলে বা সৎ-ভাবের প্রভাবে হৃদয়স্থিত দেবভাব শুদ্ধসত্বের অনুকম্পায় সে, সেই প্রলোভনে বশীভূত না হয়, তবেই তার কল্যাণ সাধিত হয়; নচেৎ সে পাপের অতল তলে ডুবে মরে। সকর্মে সৎ-ভাবে মানুষ দীর্ঘায়ুঃ লাভ করে বা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল পর্যন্ত জীবিত থাকে। পাপকার্যে আয়ুক্ষয় হয়–অকালমৃত্যু ঘটে। এটাই শাস্ত্রমত-মহাজনের উক্তি। মন্ত্রের শেষাংশে ভক্তিসুধা- গ্রহণে অভীষ্টপূরণের নিমিত্ত ভগবানের নিকট প্রার্থনা জানান হয়েছে। এ পক্ষে কর্মই মূলীভূত। তৃতীয় মন্ত্রে গায়ত্রী ও জগতীছন্দোবিশিষ্ট স্তুতিমন্ত্র উচ্চারণে অন্তরে শুদ্ধসত্ত্বকে সন্দীপিত করবার অর্থাৎ নিখিল-সৎ-ভাব-সঞ্চয়ে এবং সঙ্কর্মের অনুষ্ঠানে ভগবানকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার সঙ্কল্প মন্ত্রের মধ্যে নিহিত রয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে জাতবেদসৌ পদে ভাষ্যকার নির্মন্থনে উৎপন্ন অগ্নিকে এবং আহবনীয় নামক অগ্নিকে–এই দুরকম অগ্নিকে লক্ষ্য করেছেন। ক্রিয়াকাণ্ডানুসারে তা হতে পারে; কিন্তু বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় গাহপত্যাগ্নি অর্থে আমরা হৃদয়রূপ গৃহের পালক জ্ঞানাগ্নি অর্থ অধ্যাহার করেছি। পঞ্চম মন্ত্রে অগ্নিকে ঋষিণাং পুত্র বলা হয়েছে। এর তাৎপর্য কি? ভাষ্যাভাষে বোঝা যায়–ঋত্বিক বেদপারগ ঋষিগণের উৎপাদিত বলে অগ্নি ঋষিপুত্র বলে পরিকল্পিত। আমাদের মতে, যাঁরা পরম ত্যাগশীল, যাঁরা জিতেন্দ্রিয়, যাঁরা অতীন্দ্রিয়দ্রষ্টা–যাঁরা সদা-সৎকর্মপরা আত্ম উৎকর্ষ সম্পন্ন, তারাই ঋষি-পদবাচ্য। এঁদের সকর্মের প্রভাবে, এঁদের চিত্তের উৎকর্ষতা হেতু, জ্ঞানবহ্নি আপনা-আপনিই সন্দীপিত হয়ে থাকে। এঁরাই জ্ঞানের জনক বলে, হৃদয়ের অন্তর্নিহিত জ্ঞানবহ্নিকে ঋষিণাং পুত্র বলা হয়েছে ॥ ৭৷৷
.
অষ্টম অনুবাক
মন্ত্র- আ দদ ঋতস্য ত্বা দেবহবিঃ পাশেনাহরভে ধর্ষা মানুষ। অত্ত্যৗষধীভ্যঃ প্ৰাক্ষামপাং পেরুরসি স্বাত্তম চিৎসদেবং হব্যমাপো দেবীঃ স্বতৈন। সং তে প্রাণে বায়ুনা গচ্ছতাং সং যজত্রৈরঙ্গানি সং যজ্ঞপতিরাশি। ঘৃতেনাক্তৌ পশুং ত্রায়েথাম্। রেবতীর্যজ্ঞপতিং প্রিয়ধাহবিশত। উরো অন্তরিক্ষ সজুৰ্দেবেন বাতেনাস্য হবিষনা যজ সমস্য তনুবা ভব বর্ষীয়ো বর্ষীয়সি যজ্ঞে যজ্ঞপতিং ধাঃ। পৃথিব্যাঃ সংপৃঃ পাহি। নমস্ত আতান। অনৰ্বা প্রেহি ধৃতস্য কুল্যামনু সহ প্রজয়া সহ রায়ম্পোষেণাহপো দেবীঃ শুদ্ধায়ুবঃ শুদ্ধা যুয়ং দেবাং উবং শুদ্ধা বয়ং পরিবিষ্টাঃ পরিবেষ্টানরা বো ভূয়াস্ম ॥ ৮।
মর্মার্থ- হে আমার কর্মফল! তোমাকে সম্যকরকমে ভগবানের উদ্দেশে সমর্পণ (উৎসর্গ) করছি। দেবগণের প্রীতি-সাধক হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তি! ভগবানের প্রীতিসাধক কর্মে সিদ্ধিলাভের জন্য (অর্থাৎ কর্ম সম্পূরণের জন্য) তোমাকে দৃঢ় বন্ধনে হৃদয়মূলে বন্ধন করি। হে ভক্তি! আপনি মনুষ্য-স্বভাবসুলভ উপদ্রব-সমূহকে অর্থাৎ কাম-প্রলোভন ইত্যাদির সৎ-ভাবের সংহারক প্রভাব-সমূহকে অভিভূত করুন। (সমগ্র মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। ভক্তি-সহযুত সৎকর্মানুষ্ঠানের দ্বারা ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করা যায়। বিশুদ্ধা ভক্তির দ্বারা শক্রসমূহও বিদুরিত হয়। অতএব অনন্যা ভক্তির সহযোগে ভগবৎ-কর্মসাধনার উদ্বোধনা এই মন্ত্রে বর্তমান)। হে আমার ভগবৎ-অনুসারী কর্ম! ভক্তি রসের দ্বারা এবং কর্ম ফলক্ষয়কারক দেবভাব সমূহের দ্বারা তোমাকে অভিষিঞ্চিত করছি। হে আমার কর্ম! তুমিই দেবভাব-সমূহের পালক বা পোষক হও। (অতএব আমাতে দেবভাব–সভাব পোষণ করো)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমিই নিশ্চয় (একমাত্র) ভগবানের গ্রহণযোগ্য হও। অতএব দেবগণের (ভগবানের) প্রীতি-সাধনের নিমিত্ত, হে জ্ঞানভক্তিরূপিণি দেবিদ্বয়! ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত আমার, কর্মকে স্বাদুভূত করুন অর্থাৎ ভক্তির প্রভাবে আমার অনুষ্ঠিত কৰ্ম ভগবানের প্রীতিসাধক হোক। [এই মন্ত্রের মধ্যে সঙ্কল্প এবং আত্ম-উদ্বোধন বর্তমান। সকর্মই সকল সৎ-ভাবের পোষক। পক্ষান্তরে শুদ্ধসত্ত্ব ব্যতিরেকে সৎকর্মের অনুষ্ঠান সম্ভবপর হয় না। কর্ম ভক্তি-সহযুত এবং শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত হোকমন্ত্রে এমনই উদ্বোধনা বর্তমান ]। হে মন (আত্মসম্বোধন)! তোমার প্রাণবায়ু বায়ুরূপী ভগবানের সাথে সংযুক্ত থোক। হে মন! তোমার বৃত্তিরূপ যাবতীয় অবয়ব বিভূতিসমুহের সাথে সম্মিলিত হোক। তাহলে, ভগবানের কর্মানুষ্ঠাতা আমি ভগবানের আশীর্বাদের সাথে গমন করতে পারব অর্থাৎ ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করতে পারব। (সমগ্র মন্ত্রটিতে পরমাত্মার সাথে আত্ম-সম্মিলনের সঙ্কল্প বর্তমান। আমার কর্ম এইরকমই হোক, যার দ্বারা আমি ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করতে পারব অর্থাৎ তাতে আত্মলীন করতে সমর্থ হবো)। হে আমার জ্ঞান-কর্ম! তোমরা অনন্যা-ভক্তিরসে অভিষিঞ্চিত হয়ে (অর্থাৎ আমার হৃদয়নিহিত ভক্তি-সুধাকে ভগবানে সমর্পন করে) আমার অন্তরস্থিত পশু-প্রবৃত্তি-সমূহকে বিনাশ করো। (ভাব এই যে, আমার জ্ঞান ও কর্ম ভগবানের প্রীতিসাধক এবং ভক্তিজনক হোক। হে পরমার্থযুক্ত দেবতা! আপনারা কর্মানুষ্ঠাতা আমার প্রতি প্রিয়সামগ্রীদাতা প্রীতি-অতিশয়-যুক্ত হোন; এবং আমাদের অনুষ্ঠিত কমে আগমন করুন। অন্তরিক্ষের মতো অনন্তপ্রসারিত হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি ভগবানের কর্মে নিয়োজিত আমাকে প্রাণবায়ুরূপে বর্তমান পরমাত্মা ভগবানের সাথে সংযোজিত করুন; অপিচ, সেই উদ্দেশ্যে হবিঃরূপ অন্ন অর্থাৎ ভক্তি-সুধা আমার হৃদয়ে সঞ্চার করে দিন। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সম্যকমে সকর্মের অনুষ্ঠাতা আমার পাশব-বৃত্তিনাশক ও দেবভাবজনক হোন। আরও, অন্তরিক্ষের মতো অনন্তপ্রসারিত হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের অনুষ্ঠিত ভগবৎ-প্রীতি-সাধক এই যজ্ঞ-কর্মে সৎকর্মের অনুষ্ঠাতা আমাকে প্রকৃষ্টভাবে স্থাপন করুন। হে ভগবন! পৃথিবীতে সম্ভাব্য পাপ-সম্পর্ক হতে (অর্থাৎ ইহজগতে অনুষ্ঠিত ভববন্ধনমূলক কর্ম-সম্বন্ধ হতে) আমাকে পরিত্রাণ করুন। (এই মন্ত্রে সংসার-বন্ধন ছেদনের প্রার্থনা রয়েছে। ভাব এই যে,–যে কর্ম সংসার-বন্ধন-মূলক, সেই কর্মের অনুষ্ঠানে আমাকে প্রতিনিবৃত্ত করুন)। যে ভগবান সর্বতোভাবে সর্বব্যাপী সর্বপ্রকাশক, সেই ভগবানকে নমস্কর্মের দ্বারা অর্চনা করি। হে আমার চিত্ত বৃত্তি! তুমি শত্রুরহিত হয়ে ভক্তি-রসের প্রবাহকে লক্ষ্য করে গমন করো। (ভাব এই যে,–তুমি ভক্তি-রসে আপ্লুত হও)। তাহলে, ধন-পুষ্টির সাথে এবং পরমধন ও সৎ-ভাব-পোষণের সাথে গমন করবে। (ভাব এই যে, ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে তুমি পরমধন এবং সৎ-ভাব লাভ করো)। হে ভক্তিরূপিণি দেবিগণ! স্বতঃ পবিত্রতাযুত আপনারা আমাকে দেবভাব-সমূহ প্রাপ্ত করুন। সৎকর্মের অনুষ্ঠাতা আমরা আপনাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ও শুদ্ধ হয়ে যেন আপনাদের সংরক্ষক হই ॥ ৮।
[সপ্তম অনুবাকে যজ্ঞীয় পশুর উপকরণ মন্ত্র কথিত হয়েছে। এই অষ্টম অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে উপকৃত সেই যাবতীয় পশুর বিশসনাভিধান উক্ত হচ্ছে। বিশসন শব্দে হত্যা, মারণ, বিনাশ প্রভৃতি বোঝায়। সুতরাং পশুহননের প্রাক্কালে, পশুকে বধ-যোগ্য করবার জন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়া অবলম্বিত হয়, এই অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে তা-ই কথিত হয়েছে। বিনিয়োগ-সংগ্রহে এই অনুবাকের মন্ত্রগুলির যেমন বিনিয়োগ পরিদৃষ্ট হয়; যথা,-আদদে মন্ত্রে রক্ষ্ম গ্রহণ করে, ঋতস্য মন্ত্রে যুপে পশুকে বন্ধন করবে। অদ্ভ্যঃ প্রভৃতি মন্ত্রে সেই পশুর গাত্রে জলে-পোক্ষণের পর অপাং পেরুঃ প্রভৃতি মন্ত্রে পশুকে জল পান করাবে।-ইত্যাদি। কর্মকাণ্ডের অনুসৃত এই বিনিয়োগ-পদ্ধতির অনুসরণে ভাষ্যকার মন্ত্রগুলির সেইরকমভাবেই সম্বোধন পদ আমনন করে মন্ত্র-ব্যাখ্যানে নিযুক্ত হয়েছেন। আমরা কোনও স্থলেই ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা অনুমোদন করিনি। ভাষ্যকার প্রথম মন্ত্রের তিনটি অংশের অর্থ করেছেন–হে রশনে! তোমাকে গ্রহণ করি। হে দেবহবি পশু! যসিদ্ধির জন্য তোমাকে রঞ্জুর দ্বারা বন্ধন করি। হে বিনিযুজ্যমান পশু! দেবত্ব প্রাপ্ত হয়ে, মনুষ্য কর্তৃক তাড়ন ইত্যাদি উপদ্রবকে অভিভূত করো। দ্বিতীয় মন্ত্রের বিভিন্ন অংশ ভাষ্যমতে যজ্ঞীয় পশুর গাত্রে জলপোক্ষণে বিনিযুক্ত। তাতে ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ হয়,-হে পশু। তোমাকে জলের দ্বারা এবং ওষধি-সমূহের দ্বারা পোক্ষণ করছি। যজ্ঞের নিমিত্ত আলভ্যমান পশু ইতিপূর্বে জলপান করেনি বলে, তাকে জল পান করবার বিধি। মন্ত্রের অর্থ–হে জল, তুমি নিশ্চিত স্বাদুভূত। দেবতার প্রীতির নিমিত্ত হোমযোগ্য এই পশুকে স্বাদু করো। তৃতীয় মন্ত্রে ভাষ্যের লক্ষ্য-যজ্ঞ; সুতরাং সেই যজ্ঞ-সাধনের উপযোগী রূপইে মন্ত্রের ব্যাখ্যান হয়েছে। ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ,-হে পশু! তোমার প্রাণ, বায়ুর সাথে মিলিত হোক। তোমার হৃদয় ইত্যাদি অঙ্গসমূহ যজত্র নামক যাগবিশেষের সাথে মিশে যাক। আর তাতে যজ্ঞপতি যজমান আশীষের সাথে সংযুক্ত থোক। আমরা চতুর্থ মন্ত্রে জ্ঞান ও কর্মের এবং পঞ্চম মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধন পরিকল্পনা করি। ষষ্ঠ মন্ত্রে ভাষ্যকারের লক্ষ্য-যজ্ঞসাধন। তাই তিনি উরো অন্তরিক্ষ পদ দুটির অর্থ করেছেন,–হে বিস্তীর্ণ ইন্দ্রিয়সমুদায়। বর্ষীয়া পদেরও তিনি ঐ একই অর্থ পরিগ্রহণ করেছেন। আমরা অন্তরিক্ষ পদে শুদ্ধসত্ত্বের অনন্তত্বের প্রতি লক্ষ্য রয়েছে বলে মনে করি। সেইভাবেই আমরা উরো অন্তরিক্ষ পদের অর্থ করেছি–অন্তরিক্ষবৎ অনন্তপ্রসারিত শুদ্ধসত্ত্ব। সপ্তম মন্ত্রে ভাষ্যে বৰ্হি সম্বোধন দেখা যায়। মন্ত্রের অর্থ-হে বহি! ভূসম্পর্ক হতে পরিত্রাণ করো। অষ্টম মন্ত্রে, ভাষ্যমতে, যজমান-পত্নী সূর্যের উপাসনা করবেন। সে মতে মন্ত্রের অর্থ–সমন্তাৎ ব্যাপ্তি যাঁর, সেই সূর্যরশ্মিকে নমস্কার করি। নবম বা শেষ মন্ত্রে যজমানপত্নী যজ্ঞশালায় গমন করে জল স্পর্শ করবেন। মন্ত্রের অর্থ-হে পত্নী! তুমি শত্রুরহিত হয়ে ঘৃত প্রবাহ লক্ষ্য করে ধনপুষ্টির এবং প্রজার সাথে গমন করো। (ঘৃতস্য কুল্যাং বাক্যে সর্ববস্তু সম্পূর্ণত্বের ভাব বুঝিয়ে থাকে)। হে আপদেবি! আপনারা যজ্ঞপ্রদেশ প্রাপ্ত করুন। আপনারা স্বতঃই শুদ্ধ। আমরাও যেন আপনাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে শুদ্ধ এবং আপনাদের পরিবেষ্টা হই। আমাদের মতে মন্ত্রে চিত্তবৃত্তির সম্বোধন আছে ]। ৮
.
নবম অনুবাক
মন্ত্র- বাক্ত আ প্যায়তাং প্রাণন্ত আ প্যায়তাং চক্ষুন্ত আ প্যায়ং শ্রোত্রং ত আ প্যায়তাম।। যা তে প্রাণাজগাম যা চক্ষুর্যা শ্রোত্রং যত্তে রং যদাস্তিতং তত্ত আ প্যায় তত্ত এতেন স্তুন্ধতা। নাভি আ প্যায়তাং পায়ুস্ত আ প্যায়তাং শুদ্ধাশ্চরিত্রাঃ শম্যঃ শমোষধীভ্যঃ শং পৃথিব্যৈ শমহোভ্যাম। ওষধে ত্ৰায়ম্বৈনং স্বধিতে মৈনুং হিংসীঃ। রক্ষাং ভাগগাহসীদমহং রক্ষোহধমং। তমো নয়ামি যোহম্মান্দেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্ম ইদমেনমধমং তমো নয়ামি। ইষে ত্বা গৃতেন দ্যাবাপৃথিবী প্ৰাৰ্বাথাম। অচ্ছিন্নে রায়ঃ সুবীর। উৰ্বন্তরিক্ষমম্বিহি। বায়ো বাহি স্তোকানা। স্বাহোনভসং মারুতং গচ্ছত। ৯।
মর্মার্থ- হে মানব (আত্মসম্বোধন)! ভগবানের গুণানুকীর্তন-শ্রবণে বিমুখ তোমার বাগিন্দ্রিয় ভগবানের কথামৃত পানের জন্য প্রবর্ধিত হোক; সংসারতাপে তপ্ত তোমার প্রাণবায়ু, বায়ুরূপে বর্তমান ভগবানের সাথে সঙ্গত হোক; অন্তদৃষ্টিহীন অর্থাৎ সৎ-বস্তু-দর্শনে বিমুখ তোমার দর্শনেন্দ্রিয় সর্বদ্রষ্টা ভগবানের স্বরূপদর্শনে প্রবর্ধিত হোক; অপিচ, ভগবানের কথামৃত শ্রবণে বিমুখ তোমার শ্রবণেন্দ্রিয় ভগবানের গুণানুকীর্তনের শ্রবণে প্রবর্ধিত হোক। হে মানব! তোমার প্রাণশক্তি সংসারতাপে যে বিদগ্ধতা প্রাপ্ত হয়েছে, অপিচ তোমার দর্শনেন্দ্রিয় অপ্রিয়বস্তুর দর্শনে যে শোক প্রাপ্ত হয়েছে এবং ভগবানের মাহাত্ম-শ্রবণে বিমুখ তোমার শ্রবণেন্দ্রিয় অনৃতশ্রবণে যে কলুষতা প্রাপ্ত হয়েছে, আরও তুমি প্রাণচক্ষুশ্রোত্র ইত্যাদির দ্বারা সংসারে বন্ধনমূলক যে দুঃখের কারণসমূহের সৃষ্টি করেছ এবং দুঃখমূলক যে অমৃতসমূহের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েছ, সে সবই (তোমার কর্মের প্রভাবে) সাম্য প্রাপ্ত হোক। আর, শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভক্তিবারিনিষেকে সে সকলই বিশুদ্ধতাপ্রাপ্ত হোক অর্থাৎ ভগবানের গ্রহণযোগ্য হোক। হে মানব (আত্মসম্বোধন)! তোমার বন্ধন মূলক জন্মকারণ, ভক্তিবারিনিষেকে প্রবর্ধিত হোক অর্থাৎ বিনষ্ট হোক। অপিচ, তোমার পাপকারণ–অমৃতমূল শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে প্রবর্ধিত হোক। (ভাব এই যে,-তোমার কর্ম জন্মকারণ- নিরোধক হোক)। পরন্ত তোমার চরিত্র (আচরণ বা কর্মসমূহ) শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত ও বিশুদ্ধ হোক। হে মানব! তোমার সম্বন্ধে শুদ্ধসত্ত্ব দেবভাবসমূহ সুখবিধায়ক হোক; কর্মফলের ক্ষয়কারক সৎ-ভাবসমূহ সুখদায়ক হোক, ইহলোকে সম্বন্ধযুক্ত দেবভাবসমূহ তোমার সুখমূলক অর্থাৎ জন্মগতিনিরোধক হোক; অপিচ, তোমার জ্ঞান ও কর্ম তোমার পরমসুখের সাধক হোক। কর্মক্ষয়কারক কর্মফলদায়ক হে দেবতা! সৎকর্মের অনুষ্ঠানকারী আমাকে অজ্ঞানমোহ হতে উদ্ধার করুন। (ভাবার্থ-হে দেব! সত্বর আমার কর্মক্ষয় করে দিন)। ভববন্ধনছেদনকারী হে দেব! এই জনের (আমার) প্রতি বিরূপ হবেন না; পরন্তু আমার ভববন্ধন মোচন করে দিন। অথবা হে দেব! পাপশত্রু যেন আমাদের কর্মের বিঘাতক হয়। হে আমার অন্তরিস্থত অসৎ-বৃত্তিনিবহ! তোমরা দেবভাবের বিরোধী অন্তঃশত্রুসমূহের অংশস্বরূপ হও। এই কর্মপ্রভাবে অনুষ্ঠানকারী আমি যেন দুবুদ্ধিরূপ শত্রুকে নীচ তমোময় প্রদেশে প্রাপ্ত করি অর্থাৎ নিঃশেষে অপনীত করতে সমর্থ হই। যে সকল বহিরন্তঃশত্রু অনুষ্ঠানপরায়ণ আমাদের হিংসা করে, এবং অর্চনাকারী আমরা যে সকল শত্রুকে হিংসা করি, আমাদের এই কর্মের প্রভাবে সেই উভয়রকম শত্রুকেই যেন নিঃশেষে অপনীত করতে সমর্থ হই। হে ভগবন্! অভীষ্টপূরণের নিমিত্ত–সর্বার্থিসিদ্ধির জন্য আপনাকে আহ্বান করছি– অর্চনা করছি। হে ভগবন! ইহলোক-পরলোকের অর্থাৎ ইহকালপরকালসম্বন্ধি বাধক শত্রুদের শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আচ্ছাদিত করুন। অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে শত্রুগণও শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত হোক। হে ভগবন! আমাদের সম্বন্ধে আপনার পরমার্থরূপ ধন অশেষ (অবিচ্ছিন্ন–শাশ্বত) এবং শোভনশক্তিসম্পন্ন অর্থাৎ মোক্ষপ্রদায়ক হোক। হে দেব! আপনি আমার কলুষক্লেদপরিশূন্য অর্থাৎ বিশুদ্ধ, অন্তরিক্ষের মতো অনন্তপ্রসারিত, শত্রুর উপদ্রবপরিশূন্য নির্মল হৃদয়কে লক্ষ্য করে আগমন করুন। (তাৎপর্যার্থ-বিশুদ্ধ হৃদয়ই ভগবানের নিবাস-স্থান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমি যেন সর্বদা আপনাকে হৃদয়ে রাখতে সমর্থ হই। অনুকম্পাপ্রদর্শনে আপনি তার বিহিত করুন)। হে প্রাণবায়ুরূপে নিত্যবিরাজমান সর্বগামী ভগব! হৃদয়ে সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বরূপ অপত্যক বিশিষ্টভাবে গ্রহণ করুন। হে আমার মন (আত্মসম্বোধন)! উন্নত দেশে স্থিত অর্থাৎ হৃদয়রূপ নভোমণ্ডলে অবস্থিত প্রাণবায়ুরূপে সর্বশুদ্ধিবিধায়ক ভগবানকে প্রাপ্ত হও। স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে উদ্বোধিত করছি, আমার অনুষ্ঠান সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক ॥ ৯
[এই অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে পশুর বপোৎখেদন উক্ত হয়েছে। ক্রিয়াকাণ্ড অনুসারে পশুকে অভিমন্ত্রিত করে রঞ্জুর দ্বারা যুপকাষ্ঠে আবদ্ধ করা হয়েছে। তার পরবর্তী ক্রিয়াগুলি এই নবম অনুবাকের প্রতিপাদ্য। পশুর বাগিন্দ্রিয়, প্রাণেন্দ্রিয়, শ্রবণেন্দ্রিয় প্রভৃতি গোলোক থেকে এসেছে, গোলোক পরিত্যাগের জন্য তারা শোক-সন্তপ্ত, এখন বলিদানের পর দেবত্ব-প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রিয়-সমূহের শোক অপনীত হোক, প্রথম মন্ত্রের প্রথম অংশের মধ্যে এই ভাবই পরিস্ফুট। এই ব্যাখ্যার সাথে প্রথমেই আমাদের মত-বিরোধ উপস্থিত হয়েছে–সম্বোধন পদ নিয়ে। আমরা এখানে পশুর পরিবর্তে আত্ম-সম্বোধনে মানুষকে লক্ষ্য করি। যুপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত পশুর যন্ত্রণার সমান সংসার-সুখ-প্রমত্ত অবিবেকী জনের জীবন-যন্ত্রণা। আমরা মনে করি, তাদেরই (সেই মানুষদেরই) বিবেক উন্মেষণের জন্য এ মন্ত্রের অবতারণা। দ্বিতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য ওষধি এবং স্বধিতি অর্থাৎ কুশ এবং পশুছেদনের যোগ্য অস্ত্র। আমাদের মতে ওষধে এবং স্বধিতে পদ দুটিতে এক ভগবাকেই বোঝাচ্ছে। ভাষ্যমতে, আস্তৃত শোণিতসিক্ত কুশের অগ্রভাগ ধারণ করে মধ্যভাগ আচ্ছাদনে তৃতীয় মন্ত্রটি পাঠ করতে হয়। আমাদের মতে মন্ত্রটি অসৎ-বৃত্তির সম্বোধনে বিনিযুক্ত। কিন্তু লক্ষ্য ভগবান। চতুর্থ মন্ত্রের অন্তর্গত ইষে ত্ব অংশটির ব্যাখ্যা প্রথম প্রপাঠকের প্রথম অনুবাক দেখলেই বোঝা যায়। পঞ্চম মন্ত্র এবং ষষ্ঠ মন্ত্রের ব্যাখ্যা যথাক্রমে পঞ্চম অনুবাকে এবং প্রথম প্রপাঠকের দ্বিতীয় অনুবাক দেখলেই বোঝা যায়। সপ্তম মন্ত্রের ক্ষেত্রে ভাষ্যকারের পরিগৃহীত অর্থ অন্যরকম। তার মতে,–দ্বিশুল শাখায় ধৃত পশুমেদের উপরিভাগে পোক্ষিত আজ্যের যে বিন্দুগুলি ইতস্ততঃ নিপতিত, সেই আজ্জ্যবিন্দু স্তোক নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বায়ুকে সম্বোধন করে মন্ত্রে বলা হয়েছে-হে বায়ু! সেই বিন্দুসমূহকে তুমি বিভক্ত করো অর্থাৎ পান করো। আমরা মনে করি,ভক্ত যিনি, তিনি তাঁর অন্তরের ভক্তি-সুধা তার প্রাণের দেবতাকে প্রদান করে পরিতৃপ্ত হন। এখানে সেই ভক্তিসুধা প্রদানেরই আকাঙ্ক্ষা প্রকটিত। অষ্টম বা শেষ মন্ত্র ভাষ্যমতে, বপা ও শ্ৰপনি সম্বোধনে বিনিযুক্ত। মন্ত্রের অর্থ-হে বপা এবং পণি! তোমরা ঊর্ধ্বনভঃসংজ্ঞক মরুৎপুত্রে গমন করো। আমাদের মতে, মারুত পদে এখানে প্রাণবায়ুরূপে বর্তমান ভগবানকে বোঝাচ্ছে। উর্ধ্বং নভসং পদ দুটিতে হৃদয়রূপ নভঃ-প্রদেশের প্রতি লক্ষ্য আছে। নভোমণ্ডল যেমন উন্নত দেশে অবস্থিত, সৎ-ভাব-সমন্বিত অন্তরও তেমনি নভোমণ্ডলের মতো সমুন্নত। সৎ-ভাবমণ্ডিত হৃদয়ে ভগবানের আসন বিস্তৃত। সেই হৃদয়েই তার অধিষ্ঠান ॥ ৯৷
.
দশম অনুবাক
মন্ত্র- সং তে মনসা মনঃ সং প্রাণেন প্রাণো জুষ্টং দেবেভ্যো হব্যঃ ঘৃতবৎ স্বাহা। ইন্দ্রঃ প্রাণো অঙ্গে অঙ্গে নি দেধ্যদৈন্দ্রোহপানো অঙ্গে অঙ্গে বি বোভুববে ত্বষ্টভূরি তে সং সমেতু বিষুরূপা যৎসলাগো ভবথ দেবত্ৰা যন্তমবসে সখায়োহনু ত্বা মাতা পিতরো মদন্তু। শীরস্যগ্নিস্তা শ্ৰীণাত্বাপঃ সমরিণন্বাতস্য ত্বা জ্যৈ পূষ্ণো রংহ্যাঁ অপমোষধীনাং রোহিষ্যৈ। ঘৃতং ঘৃতপাবানঃ পিবত বসাং বসাপানঃ পিবতান্তরিক্ষস্য হবিরসি স্বাহা ত্বাহন্তরিক্ষায় দিশঃ প্রদিশ আদিশো বিদিশ উদ্দিশঃ স্বাহা দিগভ্যো নমো দিভ্যঃ ॥ ১০৷
মর্মার্থ- হে মানব (আত্মসম্বোধন)! তোমার মননেন্দ্রিয় মনোরূপে বিরাজিত মনোময় ভগবানের সাথে সঙ্গত হোক। হে মানব (আত্মসম্বোধন)! তোমার শরীরান্তঃসঞ্চারী প্রাণবায়ু (জীবন) বিশ্বপ্রাণরূপে বিরাজিত অর্থাৎ জগতের প্রাণ-স্বরূপ ভগবানের সাথে সঙ্গত হোক। অপিচ, তোমার শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবনীয় ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত যাতে প্রীতিপ্রদ এবং ভক্তিজনক ও দেবভাবের উন্মেষক হয়, সেই রকমভাবে সুহুত অর্থাৎ ভগবানে সমর্পিত হোক। (সমগ্র মন্ত্রটি আত্ম-উদ্ভোধক ও সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনাকারী এখানে নিজেকে উদ্ভোধিত করছেন। আত্ম-সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষাও এখানে বর্তমান। ভাব এই যে,হে মানব! যদি কল্যাণ কামনা করো, ভগবানে আত্মসমর্পন করো। সৎ-ভাবে এবং ভক্তির প্রভাবে ভগবাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। সুতরাং শুদ্ধসত্ত্ব-লাভে ভক্তিরস-সঞ্চারে প্রবুদ্ধ হও। তাতেই তুমি আত্ম-সম্মিলনে পরাগতি লাভ করতে পারবে)। সর্ব-ঐশ্বর্যশালী ভগবান্ আমার প্রাণ-বায়ু বা জীবনকে তার আপন কায়ায় অর্থাৎ সেই সেই অঙ্গে বিশিষ্টরূপে স্থাপন করুন; এবং আমার প্রাণ-সংরক্ষক অপান-বায়ুকে তার আপন কায়ায় অর্থাৎ সেই সেই অঙ্গে বিশিষ্টভারে সঙ্গত করুন। দ্যোতমান্ সকল শক্তির আধার বিশ্বনির্মাতা হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ পরস্পর-বিরোধী আমার প্রাণমন ইত্যাদি আপনাতে সঙ্গত (সমবেত) হোক। অপিচ, আমার যে হৃদয় ইত্যাদি অবয়ব-সমূহ বিভিন্ন বিরুদ্ধ-প্রকৃতি সম্পন্নরূপে বর্তমান, আপনার অনুগ্রহে সেই সমস্ত সমান লক্ষণযুক্ত অর্থাৎ আপনাতে সন্নিবিষ্ট হয়ে সমানধর্মবিশিষ্ট এবং আমার গতিমুক্তিদায়ক হোক। হে মানব (আত্মসম্বোধন)! ভগবানে আত্ম সম্মিলনে উদ্বুদ্ধ তোমাকে পাপসংক্রমণ হতে রক্ষার জন্য, তোমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব তোমার সহায়ক অর্থাৎ সখার মতো প্রীতির আস্পদ এবং সৎ-ভাব-জনক ও ভক্তিরসের উৎপাদক অর্থাৎ পিতামাতার মতো রক্ষক ও পালক হোক। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি পরম-ঐশ্বর্যদায়ক হও। অতএব পরমৈশ্বর্য-সম্পন্ন ভগবান তোমাকে গ্রহণ করুন। স্নেহকারণ্যময় ভক্তাধীন ভগবান তোমাকে সম্যকরূপে প্রাপ্ত হোন। অপিচ হে শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছি। এইভাবে, প্রজ্ঞানময় ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ পরাজ্ঞান-লাভের নিমিত্ত তোমাকে ভগবানে নিয়োজিত করছি। অপিচ, সৎ-ভাব-সঞ্চয়ের নিমিত্ত এবং কর্মক্ষয়ের জন্য তোমাকে ভগবানে সংন্যস্ত করছি। শুদ্ধসত্ত্বগ্রাহী হে আমার হৃদয়নিহিত দেবভাব-সমূহ! আমার হৃদয়গত ভক্তি-সুধা গ্রহণ করুন; হে আমার হৃদয়গত ভক্তি-রসপানকারী, দেবগণ! আপনারা আমার হৃদয়-সঞ্জাত ভক্তি-রূপ সারসামগ্রী গ্রহণ করুন। হে আমার হৃদয়-নিহিত ভক্তি! তুমি অন্তরিক্ষের মতো সমুন্নত হৃদয়ে সভাবের সংরক্ষয়িত্রী হও। অতএব তোমাকে স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা ভগবানে সমর্পণ করছি। আমার এই দানকর্ম সুসিদ্ধ সুহুত হোক। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পূর্ব ইত্যাদি হতে আরম্ভ করে ঊর্ধ্ব-অধঃ পর্যন্ত সর্বদিক-রূপে বিরাজিত ভগবানের উদ্দেশ্যে তোমাকে স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা নিয়োজিত করছি। সর্বদিক-স্বরূপ ভগবানকে নমস্কর্মের দ্বারা পরিচর্যা করি ॥১০।
[ ভাষ্যানুক্রমনিকায় প্রকাশ,নবম অনুবাকে বপাপ্রয়োগ উক্ত হয়েছে, দশম অনুবাকে বসাহোম কথিত হচ্ছে। এই রকম অনুক্রমণে এবং বিনিয়োগ সংগ্রহের অনুসরণে ভাষ্যকার মন্ত্রের অর্থ-নিষ্কাশনে অগ্রসর হয়েছেন। সেই অনুসারে প্রথম মন্ত্রে অর্থ হয়েছে,-হে হৃদয়। তোমার মনঃস্থানীয় পৃষদাজ্যের দ্বারা দেবগণের মন সঙ্গত হোক। সেইরকম তোমার প্রাণও সঙ্গত হোক। হে হব্য! তুমি যাতে দেবগণের প্রিয় এবং ঘৃতের মতো হও, সেইভাবে তোমাকে স্বাহা-মন্ত্রে উৎসর্গ করছি। দ্বিতীয় অর্থাৎ ইন্দ্রদেবতা-সম্বন্ধী মন্ত্রের ভাষ্যমতে অর্থ হয়, ইন্দ্রদেবতা এই পশুর প্রাণকে আপন সেই সেই অঙ্গে স্থাপন করুন। পশুর অপান ইত্যাদিও সেইরকমভাবে স্থাপিত হোক। হে দেব তৃষ্টা! আপনার অনুগ্রহে ছেদন দ্বারা বিশ্লিষ্ট সমুদায় অঙ্গ সমবেত হোক। হে হৃদয় ইত্যাদি অবয়বসমূহ! তোমরা বিলক্ষণরূপ হলেও হবিষ্ট্রের দ্বারা সমান লক্ষণযুক্ত হও। হে পশু! দেবগণে গমনকারী তোমার সখীভূত অন্যান্য পশু এবং তোমার মাতা-পিতা সকলেই হৃষ্ট হোক। কি জন্য? তোমার মুখে স্বর্গপ্রাপ্ত হয়ে স্বকুল সকলকে সেবা করবার জন্য। আমরা এ মন্ত্রের প্রথম অংশে ইন্দ্রদেবতার সম্বোধনে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের সম্বোধন স্বীকার করি; আর পশুর পরিবর্তে আত্মসম্বোধন অধ্যাহার করি। তাতেই মন্ত্রের অর্থ সুস্পষ্ট হয়, এবং তাই-ই আমাদের পন্থার অনুসারী। শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাব ইত্যাদি যে পরম পথের সহায় হয়, তৃতীয় মন্ত্রে সেই ভাব পরিব্যক্ত। চতুর্থ মন্ত্রে অন্তরস্থিত দেবভাবসমূহকে ভক্তিরসে অভিসিঞ্চিত করে ভগবানে সমর্পণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ভাষ্যমতে মন্ত্রের সম্বোধ্যবসা। বসা বলতে মজ্জা, মেধ ও চর্বি প্রভৃতি বোঝায়। অর্থাৎ শরীরের যা সারসামগ্রী, তা-ই বসা। ভাষ্যকার মন্ত্রের অর্থ করেছেন-হে বসা! তুমি আয়নীয়া হও। অতএব আহবনীয় অগ্নি তোমাকে স্বীকার করুন। অপ তোমাকে সমভাবে প্রাপ্ত হোক অর্থাৎ যেন তোমার শোষ হয় অথবা তুমি যেন শুষ্ক না হও। হে বসা, তোমাকেও প্রদান করি। কি জন্য? বায়ুর গতির নিমিত্ত, আদিত্যের গমনের জন্য, এবং অপ সম্বন্ধী ওষধিসমূহের প্ররোহণের জন্য। তোমার পিধানের দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে এবং তোমার হোমসুকৃতির জন্য বায়ুগমন ইত্যাদি সুস্থিত হোক। মন্ত্রের শেষাংশে এক বিশ্বজনীন ভাব পরিব্যক্ত] ॥১০৷৷
.
একাদশ অনুবাক
মন্ত্র- সমুদ্রং গচ্ছ স্বাহাহন্তরিক্ষং গচ্ছ স্বাহা দেবং সবিতারং গচ্ছ স্বাহা অহোরাত্রে গচ্ছ স্বাহা মিত্রাবরুণেী গচ্ছ স্বাহা সোমং গচ্ছ স্বাহা যজ্ঞং গচ্ছ স্বাহা। ছন্দাংসি গচ্ছ স্বাহা দ্যাবাপৃথিবী গচ্ছ স্বাহা নভো দিব্যং গচ্ছ স্বাহাইগ্নিং বৈশ্বানরং গচ্ছ স্বাহাহভস্তৌষিধীভ্যো মনো মে হাদি যচ্ছ তনুং ত্বং পুত্রং নপ্তারমশীয়। শুগসি তমভি শোচ যোইপ্যান্বেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্মে ধাম্বো ধাম্বো রাজম্নিতা বরুণ নো মুঞ্চ যদাপো অগ্নিয়া বরুণেতি শপামহে ততো বরুণ নো মুঞ্চ ॥ ১১৷
মর্মার্থ- হে মম হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সত্ত্ব-সমুদ্রকে–ভগবানকে প্রাপ্ত হও অথবা অনন্তসত্ত্বসমুদ্র ভগবানে মিলিত হও। স্বাহামন্ত্রে তোমাকে উৎসর্গীকৃত করছি। আমার সঙ্কল্প সিদ্ধ হোক। হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তি! তুমি অন্তরিক্ষের মতো অনন্ত-প্রসারিত বিশ্ব-ব্যাপক ভগবানকে প্রাপ্ত হও। অর্থাৎ তার সাথে সঙ্গত হও। স্বাহামন্ত্রে তোমাকে ভগবানে নিয়োজিত করছি;–আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুসিদ্ধ হোক। হে আমার হৃদয়-সঞ্জাতি সৎ-জ্ঞান! তুমি দ্যোতমান স্বপ্ৰকাশ, জগৎ-প্রসবিতা (জগৎ-প্রকাশক) প্রজ্ঞানময় ভগবাকে প্রাপ্ত হও অর্থাৎ তাঁর সাথে সঙ্গত হও। স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে প্রেরণ করছি;–আমার সঙ্কল্প সুসিদ্ধ হোক। হে আমার সৎ-ভাব সমন্বিত সকর্ম! তুমি অহোরাত্রি-অভিমানী দেবতাকে অর্থাৎ অহোরাত্রিরূপে নিত্য-প্রত্যক্ষীভূত ভগবাকে প্রাপ্ত হও অর্থাৎ তার সাথে সঙ্গত হও। স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে ভগবানে নিয়োজিত করছি;–আমার অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক। (অথবা যে অহোরাত্রে আমার ভগবৎপ্রীণন-সাধক কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, সে সকল কালেই আমার অনুষ্ঠিত সেই কর্ম ভগবানের প্রীতিপ্রদ হোক; অপিচ, সেই কাল শুভদায়ক হোক)। হে আত্মা! তুমি মিত্রভূত এবং স্নেহকারুণ্যময় ভগবাকে প্রাপ্ত হও অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে সঙ্গত হও। স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা তোমাকে ভগবানে প্রেরণ করছি; আমার অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক। হে আমার মন! তুমি অন্তরে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন করে। অথবা হে আমার মন! তুমি সৎ-স্বরূপ ভগবাকে হৃদয়ে ধারণ করো। হে আমার মন! ভগবানের প্রীতি-হিতুভূত সঙ্কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা প্রবর্ধিত হও। অথবা হে আমার কর্ম! তুমি সৎকর্ম-স্বরূপ যজ্ঞেশ্বর ভগবানকে প্রাপ্ত হও। স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে ভগবানে নিয়োজিত করছি;–আমার সঙ্কল্প সুসিদ্ধ হোক। হে আমার কর্ম! তুমি গায়ত্রী-ইত্যাদি ছন্দে প্রকাশমান ভগবাকে সম্যকরূপে বরণ করো অর্থাৎ প্রকাশ ও পূজা করো। অথবা, হে আমার কর্মসমূহ! গায়ত্রী-ইত্যাদি ছন্দোবদ্ধ বেদমন্ত্রের দ্বারা সুষ্ঠুরূপে অনুষ্ঠিত হয়ে তোমরা ভগবানে নিয়োজিত হও। স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা তোমাদের প্রবর্তিত করছি; আমার সেই কর্মসমূহ সুসিদ্ধ অর্থাৎ সম্পূর্ণ হোক। হে আমার কর্মসমূহ! তোমরা ইহকাল-পরকালের মঙ্গল-সমূহ অর্থাৎ ঐহিক-আমুষ্মিক পরমার্থ সম্পাদন করে। স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা তোমাদের নিয়োজিত করছি। আমার সঙ্কল্প সুসিদ্ধ হোক। হে ভগবন্! আপনি দীপ্যমান অর্থাৎ জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হৃদয়রূপ নভঃস্থলে বর্তমান শুদ্ধসত্ত্বকে গ্রহণ করুন। আমার অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক অর্থাৎ স্বাহা-মন্ত্রে আমার হৃদয়নিহিত সেই শুদ্ধসত্ত্বকে আপনার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত করছি। হে মন! তুমি বিশ্ব-নেতা অর্থাৎ বিশ্বের হিতসাধক প্রজ্ঞানময় ভগবানকে প্রাপ্ত হও। স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে উদ্বোধিত করছি; আমার অনুষ্ঠান অর্থাৎ সাধনা সুসিদ্ধ হোক। হে আমার চিত্তবৃত্তি! সুফল-সমন্বিত কর্মক্ষয়ের নিমিত্ত তুমি প্রবৃদ্ধ অর্থাৎ উদ্বোধিত হও। স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা তোমাকে উদ্বোধিত করছি;–আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সম্পূর্ণ হোক। হে ভগব। আপনি আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হোন;–অপিচ, আমাতে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ স্থাপন করুন। আমি যেন তাতে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ রূপ চতুর্বর্গ-ধন প্রাপ্ত হতে পারি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি শত্রুদের সন্তাপক হও। অতএব যে বহিরন্তঃ শত্রু, ভগবানের পূজাপরায়ণ আমাদের হিংসা করে, অপিচ যে শত্রুকে প্রার্থনাকারী আমরা হিংসা করি, সেই শত্রুকে তুমি সস্তাপিত করো। স্নেহ-করুণাময় হে ভগবন! আমাদের শত্রুগণ আমাদের মধ্যে বর্তমান থেকে যে সকল স্থান হতে আমাদের হিংসা করে, সেই সকল স্থান হতে আমাদের শত্রুর উপদ্রব হতে মুক্ত করুন। স্নেহকরুণাময়, সৎ-ভাব-পোষক শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চারক পাপ-নাশক হে ভগবন্! এইভাবে শোকসন্তপ্ত আমরা অনিষ্ট-নিবারণে ইষ্ট-প্রাপ্তির নিমিত্ত যেন প্রবুদ্ধ হই। স্নেহ-কারুণ্যময় হে ভগবন্! আমাদের সংসার-পাশ মোহ-পাশ হতে পরিত্রাণ করুন । ১১।
[ এখানে এই মন্ত্রের দ্বারা উপষদ-হোম সম্পন্ন করতে হয়। উপষদের পূর্ববর্তী বসাহোমের বিষয় পূর্বের অনুবাকে উক্ত হয়েছে। ভাষ্য অনুসারে প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্য-হবিঃ, লেপ এবং সমুদ্র ইত্যাদি দেবতা; দ্বিতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য হৃদয়শূল ও বরুণ প্রভৃতি। ভাষ্যকারের মতে প্রথম মন্ত্রের অর্থ–হে হবিঃ! তুমি সমুদ্র ইত্যাদি নামক দেবতা-সমূহে গমন করো। স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা তোমাকে নিক্ষেপ করছি।–ইত্যাদি। ভগবানের অর্চনাকারী ভগবৎ-পূজায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম–সবই ভগবানের চরণে সমর্পণ করছেন। ভাষ্যকার বিভিন্ন প্রয়োজন সমুদ্র প্রভৃতি পদের প্রয়োগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু আমরা তার স্বীকার করি না। আমাদের মতে, ঐ সকল পদের লক্ষ্য–ভগবান্। ভগবান তেমনই শুদ্ধসত্ত্বের আধার, যেমন সমুদ্র জলের আধার। প্রার্থনাকারী সেই সত্ত্বসমুদ্র ভগবানে আত্ম-সম্মিলন করে পরমানন্দলাভের জন্য উদ্বোধিত হচ্ছেন। ক্রিয়াকাণ্ড অনুসারে ভাষ্যের মত হোক, আমরা দেখেছি–প্রথম মন্ত্রের শেষে বলা হলো–ভগবান্ হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। কিন্তু হৃদয় নির্মল না হলে তো সে হৃদয়ে ভগবানের অধিষ্ঠান হয় না। তাই দ্বিতীয় মন্ত্রে শত্রুনাশের (অর্থাৎ যে শত্রুর দ্বারা মনে মালিন্যের সৃষ্টি হয়-কাম-প্রলোভন ইত্যাদি সেই অন্তর ও বাহিরের শত্রদের ধ্বংসের কামনা প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রের শেষে প্রার্থনা জানান হয়েছে,-হে ভগব! হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে, আপনি আমার অন্তরিস্থত পাপ শত্রুগণকে বিনাশ করুন; আমার সংসার-বন্ধন টুটে যাক। আপনার অনুগ্রহে আমি যেন পরাগতি লাভে সমর্থ হই ] । ১১।
.
দ্বাদশ অনুবাক
মন্ত্র- হবিষ্মতীরিমা আপো হবিম্মান্দেবো অধ্বররা হবিম্মান আ বিসতি হবিম্মান অস্তু সূৰ্য্যঃ। অগ্নেৰ্বোহপন্নগৃহস্য সদসি সাদয়ামি সুম্মায় সুম্বিনীঃ সুমে মা ধওোগ্নিয়ো ভাগধেয়ীঃ স্থ মিত্রাবরুণয়োর্ভাগধেয়ীঃ স্থ। বিশেয়াং দেবানাং ভাগধেয়ীঃ স্থ যজ্ঞে জাগৃত ॥১২।
মর্মার্থ- আমার জন্মসহজাত সৎ-বৃত্তিনিবহ পরমজ্ঞানদায়ক ও পরমার্থপ্রকাশক হোক। দ্যোতমান স্বপ্ৰকাশ ভগবান্ (আমাদের কর্মের প্রভাবে) শুদ্ধসত্ত্বের গ্রাহক ও পরমার্থের প্রদায়ক হোক। আমাদের হিংসাবিরহিত কর্ম সুফলসমন্বিত, সৎ-ভাবজনক এবং ভগবৎপ্রকাশক হোক। অথবা, আমাদের অনুষ্ঠিত কর্ম যাতে সুফলসমন্বিত এবং ভগবানের প্রীতিপ্রদ হয়, সেইভাবে প্রবর্তিত হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পজ্ঞাপক)। জ্ঞান-সূর্য আমাদের হৃদয়ে অবির্ভূত হয়ে শুদ্ধসত্ত্বমণ্ডিত হোন। অথবা, স্বপ্রকাশ প্রজ্ঞানময় ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত করুন। সমগ্র মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক আত্ম-উদ্বোধক। আমাদের জ্ঞান কর্ম ও ভক্তি আমাদের পরমমঙ্গলদায়ক হোকমন্ত্রে এই ভাব প্রকটিত)। প্রজ্ঞানময় হে ভগবন্! আপনাকে আমাদের সৎ-ভাব-মণ্ডিত হৃদয়রূপ অবিনশ্বর-গৃহের আধারে স্থাপন (প্রতিষ্ঠা) করি। (মন্ত্রটি উদ্বোধনমূলক ও সঙ্কল্পজ্ঞাপক। ভাব এই যে, সৎ-ভাব-সমন্বিত হৃদয়েই ভগবানের অধিষ্ঠান হয়। অতএব হৃদয়ে সৎ-ভাবের জননের দ্বারা আমি যেন সে হৃদয়ে ভগবানকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হই)। হে শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি! তোমরা জগতের হিতসাধনের নিমিত্ত (সকলের মঙ্গলের জন্য) সর্বপ্রাণীর সুখের হেতু হও। এবং তোমরা ভগবৎকামী আমাকে পরমসুখে স্থাপন করো। হে শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি। তোমরা ইন্দ্রাগ্নীদেবতাদ্বয়ের অংশভূত হও; এবং তোমরা মিত্রাবরুণ দেবতার অংশভূত হও। আরও, তোমরা বিশ্বের সকল দেবভাবের অংশস্বরূপ হও। অতএব তোমরা আমার অনুষ্ঠিত সকল কর্মে সদা-জাগরুক থাকো, অথবা সকর্মে আমাকে সদা উদ্বোধিত করো। (সমগ্র মন্ত্রটি উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্ব সম্ভাবসমূহ আমার সকল কর্মে সদা বর্তমান থাকুক এবং তারাই আমার পরমার্থদায়ক হোক] । ১২।
[একাদশ অনুবাক পর্যন্ত তৃতীয় প্রপাঠকের মন্ত্রগুলি অগ্নিবোমিয় পশু সম্বন্ধে প্রযুক্ত। তার পরই সোম অভিষব। সোম-অভিষবের প্রথম এবং প্রধান উপাদান–বসতীবরী। দ্বাদশ অনুবাকে সেই বসতীবরী-সংজ্ঞক উপাদানের বিষয় কথিত হচ্ছে। বসতীবরী সম্বন্ধে একটি উপাখ্যান সূত্রগ্রন্থে পরিদৃষ্ট হয়। সেটি এই, পুরাকালে কোনও সময়ে দেবগণ, আগ্নী-মণ্ডলে অবস্থিত হয়ে, যজ্ঞশালার এটি আমার ইত্যাদি ভাবে বিভিন্ন অংশ বিভাগ করে নেন। এইভাবে দেবগণের নিজ নিজ বিভাগ-অনুসারে কতক অংশ অবশিষ্ট থাকে। তখন তারা সকলে স্থির করেন,–অবশিষ্ট অংশ আপাততঃ সাধারণ-সম্পত্তির মধ্যে পরিগণিত থাকুক। পরে প্রত্যুষে পুনরায় ঐ অবশিষ্ট অবিভক্ত অংশের বিভাগ করে নেওয়া যাবে। সেই অবশিষ্ট অংশ বসতু বলে দেবগণ কর্তৃক সেই সময়ে পরিত্যক্ত হওয়ায়, সেই অংশের নাম–বসতীবরী হয়। আর সেই শেষভূত অংশ-সম্পন্ন আপ বসতীবর্যাপঃ নামে অভিহিত। তারপর প্রাতঃকালে দেবগণ পুনরায় আগমন করে সেই অভিভক্ত অংশের বিভাগে প্রবৃত্ত হলেন। কিন্তু কিছুতেই তার বিভাগ-মীমাংসায় সমর্থ হলেন না। অবশিষ্ট অংশের অল্পতৃ-হেতু বহুর মধ্যে তার বিভাগ সম্ভবপর হলো না। সাধারণের সেই অংশের পরস্পর বিভাগে অসামৰ্থ-হেতু সেই অংশ জলে পরিত্যক্ত হলো। তা থেকে জলের নাম হলো– বসতীবঃ। যজ্ঞের অংশভূত বলে বসতীবরী গ্রহণীয়। বসতীবরী-গ্রহণে তার কাছে যজ্ঞ দৃঢ় স্থাপিত হয়–সূত্রকারবর্গের এটাই অভিপ্রায়। ভাষ্যকার তাই প্রথম মন্ত্রের অর্থ করেছেন,-এই গৃহ্যমাণ বসতীবরী সংজ্ঞক জল স্বসংস্কারে সোমের দ্বারা হবিঃসাংযুক্ত থোক। দেব ইন্দ্ৰ হবিঃসম্পন্ন হোন। যাগও হবিযুক্ত হয়ে প্রবর্তিত হোক। আর বসীতবরীসমূহের প্রকাশের দ্বারা সূর্যও হবিষ্মন্ হোন।-যজ্ঞকর্মের অনুকুল ক্রিয়াকাণ্ডের বিধি-পদ্ধতির অনুসরণে ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ নিষ্কাশনে প্রবৃত্ত হয়েছেন, সে সম্বন্ধে আমাদের কোনই বক্তব্য নেই। তবে পুনরায় বলি, ক্রিয়াকাণ্ডের অনুসরণে মন্ত্রের প্রয়োগে যা-ই থাকুক, বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যানে আমরা তার সাথে অল্পই সংসৃষ্ট। আমরা মন্ত্রের সাথে বসতীবরীর সম্বন্ধ উপলব্ধি করি না। আবার, এখানে অধ্বরঃ পদটি লক্ষ্য করার বিষয়। ঐ পদের আমরা অর্থ করেছিঅস্মাকং হিংসবিরাহিতং কর্ম। হিংসা বিরহিত কর্ম বলবার তাৎপর্য এই যে,-এ যজ্ঞে নরবলি নেই;–এ যজ্ঞ নরমেদ বা পশুমেদ যজ্ঞ নয়। স্থূলতঃ, এ যজ্ঞে কোনও প্রাণহানির সম্ভাবনা আদৌ নেই।–দ্বিতীয় মন্ত্রে ইন্দ্রাগ্নী মিত্রাবরুণ প্রভৃতি ভগবানের বিভিন্ন বিভূতিসমূহ মঙ্গলদায়ক হোন, তাদের অনুগ্রহে সৎ-ভাব-মণ্ডিত হয়ে বিশ্বজনকে সৎ-ভাবে অনুপ্রাণিত করি–এইরকম সঙ্কল্পের এবং উদ্বোধনার ভাব বর্তমান ] । ১২।
.
ত্রয়োদশ অনুবাক
মন্ত্র- হৃদে ত্বা মনসে ত্বা দিয়ে ত্বা সূৰ্য্যায় তামিমমরং কৃধি দিবি। দেবেষু হোত্রা যচ্ছ সোম রাজন্নেহ্যব রোহ মা ভেৰ্ম্মা সম্ বিথা মা ত্বা হিংসিষং প্রজামুপাববোহ প্রজাস্তামুপারোহ। শৃণোত্বগ্নিঃ সমিধা হবং মে শৃন্বত্ত্বাপপা ধিষণা দেবীঃ। শৃগোত গ্রাবাণে বিদুষো নু যজ্ঞং শৃণোতু দেবঃ সবিতা হবং মে। দেবীরাপো অপাং নপাদ্য ঊর্মিহবিষ্য ইন্দ্রিয়াবান্মদিন্তমস্তম। দেবেভ্যো দেবত্ৰা ধৰ্ত্ত শুক্রং শুক্ৰপেভ্যো যেষাং ভাগঃ স্থ স্বাহা।। কার্ষিরসাপাপাং মৃম্। সমুদ্রস্য বোহক্ষিতা উন্নয়ে। যমগ্নে পৃৎসু মৰ্ত্তমাবো বাজেযু যং জুনাঃ। স যন্তা শশ্বতীরিষঃ ॥ ১৩।
মর্মার্থ- হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমার অরণ্যের মতো হৃদয়ে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করছি। অথবা আমার সৎ-ভাব-মণ্ডিত হৃদয়ে অথবা হৃদয়ে সৎ-ভাব-সংজননের জন্য তোমাকে উদ্বোধিত বা উদ্দীপিত করছি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমার মনের চাঞ্চল্য নিবারণের জন্য অথবা অন্তরে সৎ-ভাব-সংজননের নিমিত্ত তোমাকে উদ্বোধিত অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করছি। হে মন! দ্যুলোকসম্বন্ধি দেবভাবসমূহের উদ্বোধনের জন্য-সত্ত্বভাবের সংজননের জন্য তোমাকে উদ্বোধিত করছি। হে চিত্তবৃত্তি! তোমাকে স্বপ্রকাশ জ্ঞানদেব ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ তার প্রীতির জন্য প্রেরণ বা নিয়োজিত করছি। হে ভগবন্! আমাদের অনুষ্ঠিত হিংসারহিত (বিনাশরহিত) সৎকর্ম আপনার প্রীতিসাধন করুন। আপনি, দিবিস্থিত দেবভাবসমূহে আমাদের প্রার্থনা স্থাপন বা প্রেরণ করুন। সকর্মসমূহে বিদ্যমান হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়ে বা কর্মে আগমন করো বা উদ্দীপিত হও। শত্রুর ভয়ে ভীতিবিহ্বল বা চঞ্চল হয়ো না। অন্তরস্থ শত্রুসমূহও যেন তোমাকে হিংসা করতে না পারে অর্থাৎ আমাদের বিপথে পরিচালিত না করে। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্ববাসী সকলকে প্রাপ্ত হও। (ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্ব সকল প্রাণীর অন্তরেই উপজিত হোক। সকল প্রাণীই শুদ্ধসত্ত্ব-সমন্বিত হোক)। অপিচ, বিশ্ববাসী সকল ব্যক্তিই শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হোক, অর্থাৎ হৃদয়ে উদ্দীপিত করুক। (ভাব এই যে,-হে দেব! আপনি এমন করুন,–যেন বিশ্ববাসী সকলেই আপনাকে হৃদয়ে ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়)। প্রজ্ঞানময় ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বরূপ সমিধ গ্রহণ করে হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমার প্রার্থনা গ্রহণ করুন। প্রজ্ঞান-স্বরূপ দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত স্নেহকরুণারূপী হে দেবতাগণ! আপনারাও আমার পূজা গ্রহণ করুন। জ্ঞানভক্তিদায়ক হে দেবগণ! আমার প্রতি প্রীতি-আতিশয্যযুক্ত হয়ে অথবা আমার প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হয়ে, আমার অনুষ্ঠিত সৎকর্ম গ্রহণ করুন অথবা সৎকর্ম-সমূহে নিত্যবিদ্যামান হোন। তাতে স্বপ্ৰকাশ জ্ঞান-প্রেরক ভগবান্ আমার পূজা প্রাপ্ত হোন বা গ্রহণ করুন। (হৃদয়ে জ্ঞান উপজিত হলে, কর্ম ভগবানের প্রতিদায়ক হয়; সেই কর্মই ভগবানে যুক্ত হয়ে থাকে। তমোভাবের নাশক হে শুদ্ধসত্ত্ব-স্বরূপ দেবগণ! দেবভাবজনক ভগবানের প্রীতিসাধক পরমানন্দদায়ক আপনাদের সম্বন্ধি যে প্রসিদ্ধ সত্ত্বের প্রবাহ বর্তমান, আপনারা সেই সত্ত্বের প্রবাহ, দেবগণের প্রীতি-সাধনের জন্য আমাদের অনুষ্ঠিত দেবভাবজনক সৎকর্মসমুহে স্থাপন করুন। অপিচ, আপনারা যে দেবভাবসমূহের অংশভূত হন, শুদ্ধসত্ত্বের গ্রাহক সেই দেবভাবের উদ্ভোধনের নিমিত্ত, সৎ-ভাবজনক সেই সত্ত্বের প্রবাহ আমাদের কর্মসমূহে স্থাপন করুন। স্বাহা-মন্ত্রে আপনাদের উদ্বোধিত করছি, আমার অনুষ্ঠান বা উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত বা সুসিদ্ধ হোক। হে চিত্তবৃত্তি! তুমি উৎকর্ষ-সাধনের যোগ্য হও। অথবা, হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি উৎকর্ষসাধক হও। অতএব তোমার সাহায্যে সৎ-ভাবের বিরোধীদের অপনীত করছি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! সমুদ্রের মতো তোমার অক্ষীণত্বের নিমিত্ত তোমার উৎকর্ষসাধন করছি। অথবা তমোভাবের বিনাশের নিমিত্ত তোমার উৎকর্ষসাধন করছি। হে জ্ঞানদেব! সংসাররূপ সমরক্ষেত্রে যে ব্যক্তিকে আপনি রক্ষা করেন, এবং যে ব্যক্তিকে আপনি পাপসহ-যুদ্ধে প্রবৃত্ত করেন, সে পুরুষ সর্বতোভাবে নিত্যধন প্রাপ্ত হয়ে থাকে। অথবা,–প্রজ্ঞানময় হে ভগবন্! সংসার-সংগ্রামে আপনি মরণধর্মা যে ব্যক্তিকে রক্ষা করেন; অপিচ, পাপশত্রুর সাথে সমরে যে ব্যক্তিকে আপনি নিযুক্ত করেন অথবা যে ব্যক্তিকে আপনি আশ্রয় করেন, সে ব্যক্তি অবিনশ্বর পরমার্থরূপ ধন প্রাপ্ত হয়। (ভগবান্ যে ব্যক্তিকে রক্ষা করেন, আর ক্ষয় নেই। ভগবানের কৃপায় সে ব্যক্তি পরাগতি প্রাপ্ত হয়)। ১৩
[কর্মকাণ্ডের অনুসরণে দ্বাদশ অনুবাকে সোম-অভিষবের নিমিত্ত বসতীবরী-গ্রহণের মন্ত্র ইত্যাদি এবং প্রক্রিয়া-পদ্ধতি পরিবর্ণিত হয়েছে। বক্ষ্যমান এই ত্রয়োদশ অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে অভিযোতব্য সোমের শকট থেকে অবরোহণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি কথিত হচ্ছে। তার জন্য মহারাত্র যাগে সোমপাত্র গ্রহণ করে সোম-অবরোহণ বিধি। বিনিয়োগ-সংগ্রহে এই মন্ত্রগুলির যেমন বিনিয়োগ আছে, ভাষ্যকার তেমনভাবেই। মন্ত্রগুলির অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। সেই অনুসারে, ভাষ্যকারের মতে প্রথম মন্ত্রের অর্থ,-হে সোম! তোমাকে হৃদয়বান মানুষের, মনস্বী পিতৃগণের, দ্যুলোকবাসী দেবতাগণের বিশেষতঃ সূর্যের নিমিত্ত গ্রহণ করছি। তুমি প্রবর্তমান এই যজ্ঞকে বিনাশরহিত, উন্নত এবং সমাপ্ত করো। দেবগণের মধ্যে আমাদের স্তোত্ররূপ আহ্বানসমূহ স্থাপন করো। হে সোম! অভিষবস্থানে সম্যভাবে আগমন করো-শকট হতে অবতরণ করো। ভয় করো না বা কম্পান্বিত হয়ো না। আমিও তোমাকে হিংসা করব না। অতএব তুমি দেবলোকে দেবি প্রজাকে প্রাপ্ত হও। প্রজাগণও তোমাকে প্রাপ্ত হোক।–বলাই বাহুল্য, সোম বলতে আমরা সাধারণ সোমলতা অর্থ গ্রহণ করি না। সোম শব্দে আমরা শুদ্ধসত্ত্ব–সৎ-ভাব প্রভৃতিকেই লক্ষ্য করি। আমরা মনে করি মন্ত্রের এই অংশে হৃদয়ে সৎ-ভাব সৎপ্রকৃতি সংজননের আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রের শেষাংশে এক সর্বজনীন ভাব প্রকাশিত। দ্বিতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ মতান্তর ঘটেনি। তবে আমরা মন্ত্রের সম্বোধন ইত্যাদি বিষয়ে ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারিনি। এখানে ভগবানের প্রীতিকর মানস-যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে। সেই যজ্ঞ যাতে সুচারু সম্পন্ন হয়, সেই জন্য প্রার্থনাকারী ভগবানের করুণা প্রার্থনা করছেন। তৃতীয় মন্ত্রের অপাং নপাৎ-ভাষ্যের মতে অর্থ–যিনি জলের মধ্যে গুপ্তভাবে অবস্থিত থেকেও জলকে বিনাশ করেন না। অপাং নপাৎ বহ্নিবিশেষের নাম। কিন্তু ঋগ্বেদের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকারই এই পদ দুটির অর্থ করেছেন,–জলের পালক নন, সন্তাপের দ্বারা জলের শোষক। ভাষ্যকার দুই স্থানে একই পদের দুরকম অর্থ আপন সুবিধামতো গ্রহণ করলেও, আমরা উভয় ক্ষেত্রেই অপাং নপাৎ পদ দুটির একই অর্থ পরিগ্রহণ করেছি-তমোভাবের বিনাশক। এইভাবেই অন্যত্রও ঘটেছে। যেমন ষষ্ঠ বা শেষ মন্ত্রে, আমরা দেখেছি, ভগবানের মাহাত্ম্য পরিব্যক্ত। সংসার–বিষম সংগ্রামের ক্ষেত্র। কত দিকে কত রকম শত্রু যে কত রকমভাবে বৃহবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে মানুষকে পর্যুদস্ত করবার জন্য অস্ত্র উত্তোলন করে আছে, তার ইয়ত্তা হয় না। পশু শত্রু আছে; মানুষ শত্রু আছে; কীট-পতঙ্ক শত্রু আছে; সরীসৃপ ইত্যাদি শত্রু আছে; দৃশ্য-শত্রু আছে; অদৃশ্য-শত্রু, অন্তঃশত্রু, বহিঃশত্ৰু-শত্রুর কি সংখ্যা করা যায়? সেই অসংখ্য অগণ্য শত্রুর সাথে সংগ্রামে কি সাধ্য মানুষ জয়লাভ করবে? সে ক্ষেত্রে ভগবান্ যদি তাকে রক্ষা না করেন, তার রক্ষার আর কি উপায় থাকতে পারে? তার পর পাপের সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া। সে প্রবৃত্তিই কি মানুষের সহজে আসে? ভগবান্ যদি সে প্রবৃত্তি প্রদান না করেন, মানুষ কখনও পাপ-প্রলোভন থেকে বিমুক্ত হতে পারে কি? অতএব, কিবা আত্মরক্ষার বিষয়ে, কিবা পাপের সাথে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার বিষয়ে, উভয় এই ভগবানের অনুকম্পা-লাভ প্রয়োজন। ফলতঃ, ভগবান্ যাকে রক্ষা করেন, তিনি যার সহায় হন, এ সংসারে তার ক্ষয় নেই–বিনাশ নেই–মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য)] ॥১৩৷৷
.
চতুর্দশ অনুবাক
মন্ত্র- ত্বমপ্নে রুদ্ৰো অসুরো মহো দিবং শর্পো মারুতম পৃক্ষ ঈশিষে। ত্বং বাতৈররুণৈর্যাসি শঙ্গয়ম পূষা বিধতঃ পাসি নু অনা। আ বো রাজানমধ্বরস্য রদ্রং হোতারং সত্যষজম্ লোদস্যোঃ। অগ্নিং পুরাতনয়িত্নোরচিত্তারিণ্যরূপমবসে রুণুধ্বম্। অগ্নিহোতা নি সাদা যজীয়ানুপন্থে মাতুঃ সুরভাবু লোকে। যুবা কবিঃ পুরুনিষ্ঠঃ ঋতাবা ধৰ্ত্তা কৃষ্টীনামুত মধ্য ইদ্ধঃ। সাধ্বীমকর্পেবীতিং নো অদ্য যজ্ঞস্য জিহ্বামবিদাম গুহ্যাম। স আয়ুরাহগাৎসুরভির্সনো ভদ্ৰামকৰ্দেবহুতিং যো অদ্য । অক্রন্দদগ্নিঃ স্তনয়ন্নিব দৌঃ ক্ষামা রেরিহীরুধঃ সমঞ্জন। সদ্যো জজ্ঞানো বি হীমিদ্ধো অখ্যদা রোদসী ভানুনা ভাত্যন্তঃ ॥ ত্বে বসুনি পূৰ্বণীক হোতৰ্দোষ বস্তোরেরিরে যজ্ঞিয়াসঃ। ক্ষামেব বিশ্বা ভুবনানি যস্মিসং সৌভগানি দধিরে পাবকে। তুভ্যং তা অঙ্গিরস্তম বিশ্বাঃ। সুতিয়ঃ পৃথক। অগ্নে কামায় যেমিরে। অশ্যাম তং কামমগ্নে তবোত্যশ্যাম রয়িং রয়িবঃ সুবীর। অশ্যাম বাজমভি বাজয়ন্তোহশ্যাম দ্যুম্মমজরাজরং তে। শ্রেষ্ঠং যবিষ্ঠ ভারতাগ্নে দুমস্তমা ভর। বসো পুরুস্পৃহং রয়িম্ ।। স শিতানস্তন্যতু বোচনস্থা অজরেভির্নানদ্ভিবিষ্ঠঃ। যঃ পাবকঃ পুরূতমঃ পুরূণি পৃথুন্যগ্নিরনুযাতি ভৰ্ব্ব। আয়ুষ্টে বিশ্বততা দধদরমগিরেণ্যঃ।। পুনস্তে প্রাণ আহতি পরা যক্ষ্মাং সুবামি তে । আয়ুৰ্দা অগ্নে হবিষো জুষাণে ঘৃতপ্রতীকো ঘৃতযোনিরেধি। ঘৃতং পীত্বা মধু চারু গব্যং পিতেব পুত্রমভি রক্ষতাদিম। তস্মৈ তে প্রতিহতে জাতবেদো বিচৰ্ষণে। অগ্নে জনামি সুষ্ঠুতিম্। দিবম্পরি প্রথমং জজ্ঞে অগ্নিরস্মদ্বিতীয়ং পরি জাতবেদাঃ। তৃতীয়মঞ্জু নৃমণা অজস্রমিন্ধান এনং জরতে স্বাধীঃ। শুচিঃ পাবক বন্দ্যোহগ্নে বৃহদি নোচসে। ত্বং ঘৃতেভিরাহুতঃ। দৃশানো রুক্স উল্কা ব্যদৌদুর্গমায়ুঃ শ্রিয়ে রুচানঃ। অগ্নির মৃততা অভবদ্বয়োভিঃ যদেনং দৌরজনয়ৎ সুরেতাঃ। আ যদিষে নৃপতিং তেজ আনশুচি রেতো নিষিক্তম দৌরভীকে। অগ্নিঃ সৰ্ধৰ্মনবদ্যাং যুবানং স্বাধিয়ং জনয়সূদয়। স তেজীয়সা মনসা হোত উত শিক্ষ স্বপত্যস্য শিক্ষোঃ। অগ্নে রায়ো নৃতমস্য প্রভৃতৌ ভূয়াম তে সুষ্ঠুতয়শ্চ স্বঃ। অগ্নে সহস্তমা ভর দ্যুম্নস্য প্রাসহ রয়িম্। বিশ্বা যঃ চর্ষণীরভ্যাসা বাজেযু সাসহৎ। তমগ্নে পৃতনাসহং রয়িং সহস্ব আ ভর। ত্বং হি সত্যো অদ্ভুত দাতা বাজস্য গোমতঃ। উক্ষান্নায় বোন্নায় সোমপৃষ্ঠায় বেধসে। স্তোমৈব্বিধেমাগ্নয়ে। বন্না হি সূনো অস্যসদ্বা চক্রে অগ্নির্জনুহজমান্ন। স ত্বং ন উজ্জন উর্জং ধা রাজেব জেরবৃকে ক্ষেষ্যন্ত। অগ্ন আয়ুংষি পবস আ সুবোর্জমিষং চ নঃ।। আরে বাধস্ব দুছুনা। অগ্নে পবস্ব স্বপা অস্মে বর্ডঃ সুবীর্য। দধৎ পোষং রয়িং মরি। অগ্নে পাবক রোচিষা মন্দ্রয়া দেব জিয়া। আ দৈবাক্ষি যক্ষি চ। স নঃ পাবক দীদিবোহগ্নে দেবান ইহাহবহ। উপ যজ্ঞং হবিশ্চ নঃ। অগ্নিঃ শুচিব্রততমঃ শুচির্বিপ্রঃ শুচিঃ কবিঃ। শুচি নোচত আহুতঃ। উদয়ে শূচয়স্তব শুক্রা ভ্রাজস্ত ঈরতে। তব জ্যোতীংষ্যéয়ঃ ॥ ১৪৷
মর্মার্থ- প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবান! আপনি লোকত্রয় (হৃদয়) হতে শত্রুদের নিরাশকারী এবং দুঃখমূলক পাপ ইত্যাদির দ্রাবয়িতা (নাশয়িতা) হন। অথবা, মানুষ যাতে দুঃখে পতিত না হয়, তার বিধায়ক এবং হৃদয়রূপ মহৎ দ্যুলোকে বল বা শক্তিদাতা বা জ্ঞানরূপী আদিত্যের প্রকাশক বা জ্ঞান-সুর্য হন। আপনি মরুৎ-গণরূপ বল বা বায়ুরূপ হন অথবা আপনার অনুগ্রহে মরুৎ-গণে বলের সঞ্চার হয়। হে ভগবন! অগ্নি-আদিত্য-বায়ু-রূপী আপনি পরমার্থরূপ অন্নের বা চতুর্বর্গরূপ পরমধনের ঈশ্বর (অধিপতি) হন। অতএব বায়ুর মতো গতিবিশিষ্ট অরুণবর্ণ অশ্বে অর্থাৎ জ্ঞান ভক্তি-সমন্বিত কর্মরূপ বাহকে সংবাহিত এবং সুখের আধারভূত অথবা সুখ-স্বরূপ হয়ে, আপনি প্রার্থনাকারীদের প্রাপ্ত হন (বা হোন)। অথবা অরুণবর্ণ জ্ঞান-ভক্তি-প্রদীপ্ত সকর্ম ইত্যাদির দ্বারা সংবাহিত হয়ে আপনি প্রার্থনাকারীদের হৃদয়ে গমন করেন। আপনি সকলের পোষাক বা পালক হয়ে, সত্বর আপনার অনুগ্রহ-বুদ্ধির দ্বারা আপনার পরিচর্যাপরায়ণ প্রার্থনাকারীদের পালন ও রক্ষা করুন অর্থাৎ তাদের সংসারসমুদ্র বা মোহ-সম্মোহ হতে উদ্ধার করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম-পরমার্থের সাধক। তার দ্বারা ভগবৎ-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মন্ত্রে প্রকটিত)। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! সৎকর্মরূপ যজ্ঞের অর্থাৎ মানসযজ্ঞের অধিপতি বা যজ্ঞেশ্বর, দেবগণের আহ্বানকারী অথবা দেবগণকে হবিঃ-প্রদনকারী অথবা শুদ্ধসত্ত্বরূপ দেবভাবের উৎপাদক অর্থাৎ অভীষ্ট ফলদানে ভক্তগণের উদ্ধারকারী, শত্রুদের সন্তাপক বা বল-সঞ্চারক, দ্যাবাপৃথিবীর অর্থাৎ সর্বপ্রাণীকে অভিমতফলদাতা অথবা ভগবানের পূজায় সর্বলোকে পথ-প্রদর্শক; অথবা সর্বলোক ব্যেপে বর্তমান অর্থাৎ সর্বলোকে অভিমতকর্মফলবিধায়ক, হিরণ্য-সদৃশ্য অর্থাৎ হিরণ্যের মতো শ্রেষ্ঠফলদায়ক, প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ অগ্নিদেবকে, তোমাদের রক্ষণের এবং পরিত্রাণের জন্য, শত্ৰুকর্তৃক সর্বেন্দ্রিয়-সংহার হতে অথবা শত্রুর আক্রমণে চিত্তবিভ্রমরূপ মরণের পূর্বেই শুদ্ধসত্ত্বরূপ সমিধের দ্বারা বশীভূত করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক ও সঙ্কল্পসূচক। যার অন্তরে সৎ-ভাবের সমাবেশ নেই অপিচ অসৎ-বৃত্তির পরিচালনে যে বিপথগামী হয়, সে তো জীবন্মাত। জ্ঞানের প্রভাবে অজ্ঞান-অন্ধকারের অপসারণে শত্রুর আক্রমণ হতে মানুষ পরিত্রাণ লাভ করে,-মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য)। অথবা,হে মনুষ্যগণ! তোমাদের রক্ষার জন্য, তোমরা সেই হিংসা-প্রত্যবায় ইত্যাদি রহিত কর্মের অধিপতি, দেব-ভাবের আহ্বানকারী, (আমাদের) শত্রুদমনে রুদ্রমূর্তিধর, দ্যাবাপৃথিবীর আনন্দসঙ্গময়িতা (চিদাননন্দপ্রদ), দিব্যজ্যোতির্ময়, জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবকে, অশনি পতনের মতো সহসা মৃত্যু আসবার পূর্বে, সম্যভাবে ভজনা করো। (বজ্রপতনের মতো হঠাৎ কখন মৃত্যু আসবে স্থির নেই; সুতরাং মুহূর্ত-কালক্ষয় না করে ভগবানের পূজায় প্রবৃত্ত হও-মন্ত্রের এটাই উপদেশ। হোমনিষ্পদক অর্থাৎ সৎকর্মের পূরক, সকলের আরাধনীয় প্রজ্ঞান-স্বরূপ ভগবান আধারস্বরূপ হৃদয়রূপ বেদীর নিকটে ভক্তি প্রভৃতির দ্বারা পবিত্ৰীকৃত স্থানে অধিষ্ঠিত হোন। অপিচ, নিত্যতরুণ অর্থাৎ চিরনবীন, ক্রান্তদর্শী, সর্বত্র বিদ্যমান, বিশ্বকর্মী সকলের ধারক সেই জ্ঞানদেব জ্ঞাতম-উৎকর্ষশীল জনগণের মধ্যে (অন্তরে) দীপ্ত হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং আত্ম উদ্বোধক। সৎ-ভাবসম্পন্নদের হৃদয়ে ভগবান্ নিত্য বর্তমান-মন্ত্র এই সত্য প্রকটিত করছে)। সেই জ্ঞানদেব নিত্যকাল (সর্বকালে) আমাদের দেব-উন্মেষক সৎ-ভাবজনক সৎকর্মকে ভগবানের গ্রহণযোগ্য করুন। তাহলে আমরা যজ্ঞেস্বর ভগবানের গুঢ়তত্ত্ব অবগত হতে সমর্থ হবো অথবা সকর্মের সাধন-পদ্ধতি, অর্থাৎ যজ্ঞেশ্বর ভগবানের স্বরূপ সম্যরকমে জানতে সমর্থ হবো। সেই জ্ঞানদেব ভগবান, জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা সুগন্ধযুক্ত অর্থাৎ পরমার্থপ্রাপক সৎকর্মশীল জীবন প্রদানের জন্য আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। তারপর অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে, আমাদের মঙ্গলের জন্য আমাদের অনুষ্ঠিত দেবভাবজনক বা ভগবপ্রাপক মানস-যজ্ঞকে নিত্যকাল কল্যাণদায়ক ও পরমার্থ-সাধক করুন। দীপ্ত অর্থাৎ বিদ্যুৎ-সমন্বিত পর্জন্য আকাশে মহৎ শব্দ করে যেমন শস্যনাশভীতি নিবারণ করে, সেইরকম জ্ঞানদেব ভগবান্ আমাদের বিরোধী শত্রুগণকে আপন জ্বালারূপ শক্তির দ্বারা সন্তপিত করে পুষ্পলতা ইত্যাদির তুল্য আমাদের অনুকুল সৎ ভাব-জনক সপ্রবৃত্তি-সমূহতে সম্যভাবে উৎপাদন করেন। আর তাতে সেই জ্ঞানদেব নিত্যকাল হৃদয়ে অধিষ্ঠিত এবং প্রদীপ্ত থেকে, নানা রকমে জগৎকে প্রকাশ করেন অর্থাৎ নানারকমে সাধকদের উৎকর্ষ সাধন করেন। অপিচ, দ্যুলোক-ভূলোকের মধ্যে অর্থাৎ ইহকাল-পরকালের মঙ্গল-সাধনের জন্য, আপন জ্যোতির দ্বারা আত্মজ্ঞানসম্পন্নদের হৃদয়ে প্রকাশিত হন। অনন্ত রশ্মিযুক্ত সৎকর্মপূরক কর্মফলদায়ক হে ভগবন্ জ্ঞানদেব! আপনার উদ্দেশ্যে দিবারাত্র সর্বকালে অথবা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে ভগবৎকর্মপরায়ণ সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ-সমূহ প্রেরণ (প্ৰদান) করেন অর্থাৎ আহুতি দেন। (মন্ত্রাংশ নিত্যসত্যমূলক)। অপিচ, বিশ্বের সবরকম ভুতজাত-সমূহ, সর্ব-ধারণক্ষম সর্ব-সংরক্ষক পৃথিবীর মতো পবিত্রকারক আপনাতে সৌভাগ্য-সমূহ নিহিত করে অর্থাৎ আপনা হতে প্রাপ্ত হয়। অতএব আপনি আমাকে অনুগ্রহ করুন। আত্মদর্শিগণের আরাধনীয় প্রজ্ঞানাধার হে জ্ঞানদেব! বিশ্বের সকল আত্মদর্শিগণের আরাধনীয় প্রজ্ঞানাধার হে জ্ঞানদেব! বিশ্বের সকল আত্মদর্শিজন নানাকামিতার্থ-সিদ্ধি-প্রদায়ক অথবা নিজেদের অভীষ্টপূরণের জন্য আপনাকে বিশেষভাবে আরাধনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। আত্মজ্ঞানসম্পন্ন সাধকেরা সম্যকমে ভগবানের পূজায় সমর্থ হন। তারাই ভগবানের পূজাপদ্ধতি অবগত আছেন। হে ভগবন্ জ্ঞানদেব! আপনার সম্বন্ধী রক্ষার দ্বারা যেন অভীষ্টফল প্রাপ্ত হই; আপনিই সকল অভীষ্ট পূরণ করেন। হে পরমধনবান্ পরমাদাতা জ্ঞানদেব! আপনার অনুগ্রহে শোভনধনযুক্ত অর্থাৎ পরমার্থরূপ ধন-সাধক চতুর্বর্গফল যেন প্রাপ্ত হই; কারণ, আপনিই চতুর্বর্গের সাধক। হে জ্ঞানদেব! আপনার অনুগ্রহে সৎ-ভাবকামী আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বরূপ ধনকে প্রাপ্ত হই। হে জরারহিত নিত্যতরুণ জ্ঞানদেব! আপনার প্রসাদে জরারহিত নিত্য অক্ষয় পরমধন যেন আমাদের অধিগত হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবান্ যাঁর সহায় হন, তাঁর ক্ষয় নেই। ভগবানের কৃপায় তিনি সর্ব-অভীষ্ট এবং পরাগতি প্রাপ্ত হন। অতএব আমরা যেন সেই ভগবানের শরণ গ্রহণ করি)। ভগবানের সাথে সংযোজক অথবা পাপের সম্বন্ধ হতে বিচ্ছিন্নকারি চিরনবীন জগৎ-ধারক সর্বতোব্যাপ্ত অথবা সকলের নিবাস হেতুভূত হে জ্ঞানদেব! পরমার্থ-প্রদায়ক দীপ্তিমান অর্থাৎ প্রজ্ঞানদায়ক সকলের আকাঙ্ক্ষণীয় চতুর্বর্গধন আমাদের প্রদান করুন। পরিত্রাণকারক যে জ্ঞানদেব অতিশয় প্রবৃদ্ধ হয়ে এবং প্রভূত দুর্দমনীয় পাপ-সমূহকে অথবা পাপজনক প্রবৃত্তি-সমূহকে নাশ করে নিত্যকাল সাধকের হৃদয়ে গমন করেন অর্থাৎ অধিষ্ঠিত হন; সেই জ্ঞানদেব, প্রবৃদ্ধ ও দীপ্যমান হয়ে অভীষ্টফল-সমূহের দাতা অর্থাৎ মোক্ষ-দায়ক, জ্ঞান-প্রদীপ্ত হৃদয়ে নিত্য-বর্তমান, অক্ষয় শত্রু-নাশক দেবভাবসমূহে যুক্ত হয়ে নিত্য-তরুণ (চিরনবীন) অথবা শত্রুগণের বিয়োগকারী রূপে বর্তমান হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রকাশক। ভগবান্ জ্ঞানদেব যে হৃদয়ে বর্তমান হন, সে হৃদয়ে সৎ-গুণসমূহ অক্ষয় হয়ে থাকে। হে মানব! সকলের আরাধনীয় প্রজ্ঞান-স্বরূপ সেই ভগবান্ তোমাকে সর্বতোভাবে (নানারকমভাবে) পূর্ণায়ুষ্কাল প্রদান করুন; পুনশ্চ, সেই ভগবানের অনুগ্রহে তোমাতে সৎকর্মশীল জীবন আগমন করুক; তোমার সৎ-ভাব-বিরোধী (সৎ-ভাবের নাশক) শত্ৰু-সমূহ নিঃশেষে বিনাশপ্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও সঙ্কল্প-জ্ঞাপক। সকর্মের সাধনের দ্বারা মানুষ পূর্ণ-আয়ুষ্কাল লাভ করতে সমর্থ হয়)। হে জ্ঞানদেব! আপনি পূর্ণায়ুষ্কাল-বিধাতা সৎকর্মশীল জীবনদাতা, শুদ্ধসত্ত্বের গ্রাহক অথবা শুদ্ধসত্ত্বের বা সৎ-ভাবের দ্বারা সদা-প্রবর্ধিত, ভক্তি-প্রভৃতির দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, শুদ্ধসত্ত্ব ও সৎ-ভাবের দ্বারা হৃদয়ে উৎপাদিত ও সংরক্ষিত হন। অথবা প্রজ্ঞানের আধার হে ভগবন্! আমাদের প্রদত্ত ভক্তি-সুধায় হৃদয়ে প্রদীপ্ত এবং ভক্তি প্রভৃতি সৎ-ভাবের দ্বারা সমুৎপন্ন হয়ে, আপনি আমাদের পূর্ণায়ুষ্কালের বিধাতা হোন। অপিচ, আমাদের প্রদত্ত পরমানন্দপ্রদ নির্মল দিব্যজ্ঞান-সমন্বিত ভক্তিসুধা গ্রহণ করে, পিতা যেমন পুত্রকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে তার পালন করেন, সেই রকমভাবে পিতার মতো, আপনার পূজা-পরায়ণ আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করে পালন করুন। সর্বতত্ত্বজ্ঞ, সকলের উৎকর্ষ-সাধন অর্থাৎ পরমপদে স্থাপয়িতা, আত্মদর্শিগণের অন্তরে নিত্য-বর্তমান হে জ্ঞানদেব! আপনার প্রীতির জন্য আপনার গ্রহণযোগ্য প্রার্থনা (যেন) করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভগবানের প্রতি সাধনের জন্য মন্ত্রে সঙ্কল্প বর্তমান। সাধক যেন ভগবানের প্রীতি উৎপাদন করতে সমর্থ হন; তাই তিনি মন্ত্রে নিজেকে উদ্বোধিত করছেন। প্রজ্ঞানের আধার সেই ভগবান্ সৃষ্টির প্রারম্ভে দ্যুলোকে আদিত্যরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তার পর, সৃষ্টির দ্বিতীয় অবস্থায় সেই ভগবান আমাদের পরিপালনের জন্য সর্বতত্ত্বজ্ঞ-রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপর, সৃষ্টির তৃতীয় অবস্থায় অর্থাৎ সংহার-কালে তিনি তমোরূপে আবির্ভূত হন। এই তিনরকম রূপেই, প্রার্থনাকারীদের মঙ্গল-সাধক অর্থাৎ অনুগ্রহকারক সেই ভগবানকে আত্ম-জ্ঞানসম্পন্ন সাধক, হৃদয়-কমলে সদা-প্রতিষ্ঠিত করে তার পরিচর্যা বা অর্চনা করেন। (সৃষ্টি-স্থিতি-লয়কালে ভগবান ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-রূপে মনুষ্যগণের কল্যাণ সাধন করেন। করুণাময় সেই ভগবানের পূজার সঙ্কল্প মন্ত্রে বর্তমান)। পরিত্রাণ-কারক, পাপিগণের উদ্ধারক, পবিত্রতা-সাধক, সকলের বন্দনীয় প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! আপনি সৎ-ভাব ও ভক্তি ইত্যাদির দ্বারা প্রবর্ধিত হয়ে সাধকদের (আমাদের হৃদয়ে আপনা-আপনিই প্রকাশিত হন (বা হোন)। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভক্তাধীন ভগবান্ সাধকদের ভক্তির প্রভাবে তাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন)। প্রিয়দর্শন, কান্তিমান্ (স্বপ্রকাশ) প্রজ্ঞানাধার সেই জ্ঞানদেব পরমার্থপ্রদ হয়ে, বিশেষভাবে প্রকাশমান হন। অপিচ, সাধকদের মধ্যে শাশ্বত আয়ুঃ অর্থাৎ সৎকর্মশীল জীবন বিদানের নিমিত্ত তাদের হৃদয়ে প্রকাশিত হন। অথবা উৎকর্ষশীল জীবনবিধাতা সেই জ্ঞানদেব, বিভূতির দ্বারা যাতে শত্রুর অনভিভূত হন, সেইরকম ভাবে সাধকদের হৃদয়ে স্বপ্রকাশ হন। সেই জ্ঞানদেব শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎ-ভাবের দ্বারা প্রবৃদ্ধ হয়ে, সাধকদের হৃদয়ে ক্ষয়-রহিত (অক্ষয়) হন। তার পর সেই জ্ঞানদেব শোভনরেতস্ক (সৎ-ভাব জনক) হয়ে, প্রাণ-সংরক্ষক সৎ-ভাব উৎপাদন করেন। বলপ্রাণ প্রদানের নিমিত্ত শ্রেষ্ঠ-জ্ঞান-কিরণ যখন সর্বতোভাবে ব্যাপ্ত হয়, তখন স্বর্গ-লোক হতে অনাবিল জ্ঞানরূপ জ্যোতিঃ নিকটে হৃদয়ে অভ্যন্তরে অথবা ইহলোকে নিয়ত প্রবাহিত বা বিচ্ছুরিত হয়ে থাকে; অথবা–তখন স্বর্গ ও স্বর্গবাসী দেবতা বিশুদ্ধ-জ্ঞান-জ্যোতিকে হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবাহিত বা বিচ্ছুরিত করেন। (ভাব এই যে, জ্ঞানের আধার ভগবানের কৃপায় হৃদয়ে নির্মল জ্ঞানের আবির্ভাব হয়)। জ্ঞান-দেবতা শক্তিমান অনিন্দিত চিরনবীন সঙ্কর্মপর, সুপ্রাজ্ঞ পুরুষকে উৎপন্ন করেন বা উৎপন্ন করুন, এবং তাকে সুকর্মপর করে থাকেন বা সৎকর্মে প্রেরণ করুণ। (ভাব এই যে, জ্ঞানের প্রভাবেই মানুষ অনিন্দিত সুকর্মপর চিরনবীন জীবন লাভ করে)। প্রজ্ঞানের আধার হে জ্ঞানদেব! যিনি আপনার দ্বারা রক্ষিত হন অর্থাৎ আপনি যাকে রক্ষা করেন, তিনি অতিশয় তীক্ষ্ণ অর্থাৎ সৎকর্মের বিষয়ে তীক্ষ্ণ-বুদ্ধিযুক্ত অন্তঃকরণের দ্বারা যুক্ত হন। অপিচ, আপনি তাঁকে শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদি রূপ শোভন-অপত্যযুক্ত ধন প্রদান করে থাকেন। অভীষ্টফলদাতা অতিশয়িতভাবে ধনের বিধাতা আপনার প্রভাবে অর্থাৎ আপনার ঐশ্বর্যে যেন আমরা যুক্ত হই। আরও, শোভন-স্তুতি-মন্ত অর্থাৎ সত্তর্মপরায়ণ আমরা যেন পরমধভাজন হতে পারি। অথবা, হে জ্ঞানদেব! সৎ-ভাব-যুক্ত ভগবৎ-পূজায় নিবিষ্টচিত্ত মানবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আত্মজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে আপনি পরমধন প্রদান করেন। অতএব, আপনার রক্ষণের দ্বারা অর্থাৎ আপনার রক্ষা প্রাপ্ত হলে, পরমধন-সমন্বিত শোভনকর্ম সম্পাদনের দ্বারা আমরা যেন পরমপদযুক্ত হতে পারি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। যে ব্যক্তি ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করেন, তিনি সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা যুক্ত হয়ে সৎকর্মের সাধনে মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন)। পরম প্রজ্ঞানের আধার হে ভগবান্ জ্ঞানদেব! আমাদের শুদ্ধসত্ত্বরূপ পরম ধনের অভিভবিতা অর্থাৎ বিরোধী বৈরিগণের অভিভবকারী ধনকে অর্থাৎ সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্যকে আমাদের প্রদান করুন। যে সামর্থ্য আপনার অনুগ্রহ লাভ করে রিপুর সাথে সংগ্রামে সবরকম শত্রুসেনাকে অভিভব করতে সমর্থ হয়। অথবা, প্রজ্ঞানাধার হে দেব! প্রকৃষ্ট বলের দ্বারা অভিভবকারী শুদ্ধসত্ত্বরূপ ধন-সমূহকে আমার পরমার্থ-প্রাপ্তির নিমিত্ত প্রদান করুন। শুদ্ধসত্ত্বরূপ যে ধন আমাদের সকর্মে স্থাপন করে রিপু-সংগ্রামে আমাদের অভিমুখে আগত সবরকম শত্রুকে অভিভব করতে পারবে–সেই ধন প্রদান করুন। সর্বশক্তির আধার প্রজ্ঞানময় হে জ্ঞানদেব! আপনি শত্রুগণের নাশক পরমধন প্রদান করুন। আপনিই একমাত্র পরমার্থরূপ সত্যভূত, বিচিত্র-কর্মা ও বিচিত্র-চরিত্র হন। অপিচ আপনিই পরাজ্ঞানদায়ক দিব্যজ্ঞানের আধার পরমার্থরূপ ধনের বিধাতা হন। মোক্ষমার্গ-প্রদর্শক সৎ-ভাব-বর্ধক বহু-অন্ন-সমন্বিত শুদ্ধসত্ত্বের গ্রাহক অভীষ্টপূরক প্রজ্ঞানাধার ভগবানকে (আমরা যেন) সৎ-ভাব-সমন্বিত সৎকর্মের দ্বারা পরিচর্যা করতে সমর্থ হই। সর্বশক্তির আধার, পুত্রের মতো অভীষ্ট-সম্পাদক অথবা সকলকে সৎকর্মে প্রেরক হে জ্ঞানদেব! আপনি সকলেরই বন্দনীয় হন। আমাদের মধ্যে সভাবে বর্তমান অথবা আমাদের শত্রুনাশের নিমিত্ত সৎ-ভাব-সমন্বিত হৃদয়রূপ গৃহে নিত্য-বিদ্যমান প্রজ্ঞানাধার সেই আপনি (ভগবান্ স্বভাবতঃ পরমাশ্রয় এবং পরমার্থরূপ ধন আত্ম-জ্ঞানসম্পন্নদের প্রদান করেন। অতএব, বল-প্রাণ-দাতা হে জ্ঞানদেব! সেইরকম আপনি আমাদের বল-প্রাণ প্রদান করুন অথবা আমাদের মধ্যে বল-প্রাণ স্থাপন করুন এবং রাজার মতো অর্থাৎ রাজা যেমন শত্রুকে জয় করে, সেইরকমভাবে আমাদের শত্রুদের জয় করুন। তার পর বাধক-বিযুক্ত অর্থাৎ হিংসা-দ্বেষ-রহিত ভক্ত আমাদের অন্তরে অধিষ্ঠিত হোন। (মন্ত্র প্রার্থনামূলক। অন্তঃশত্রুনাশে পরমার্থলাভের প্রার্থনা মন্ত্রে বর্তমান)। প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! আপনি আমাদের সকর্মশীল জীবনকে রক্ষা করেন অথবা সৎকর্মশীল জীবন যাতে প্রবর্ধিত হয়, সেইভাবে আপনি তার বিশুদ্ধতা সম্পাদন করুন। আপনি আমাদের বল-প্রাণ এবং অভীষ্ট পূরণ করুন। আরও, আমাদের থেকে শত্রুগণের উপদ্রব-সমূহ বিযুক্ত করে তাদের বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! সৎ-ভাবের বিরোধী অন্তঃশত্রুদের বিনাশ সাধন করে আমার অভীষ্ট পূরণ করুন।
প্রজ্ঞানের আধার হে ভগবন্! শোভন-কর্মা আপনি আমাদের মধ্যে শোভন-বীর্যোপেত সঙ্কৰ্ম-সাধন-সমর্থ–জ্ঞান জ্যোতিঃ প্রবর্ধিত করুন; এবং শত্রু-বিনাশে পুষ্টি এবং মোক্ষ-ধন প্রদান করুন। দিব্য-জ্যোতিঃসম্পন্ন পাপিগণের উদ্ধারকারক প্রজ্ঞানাধার হে জ্ঞানদেব! দিব্য-জ্যোতিঃসম্পন্ন, পরমানন্দদায়ক আপন প্রভাবের দ্বারা দেবভাবসমূহকে আনয়ন অর্থাৎ সৎকর্মে সৎ-ভাব উৎপাদন করুন এবং তার পরিচর্যা অর্থাৎ হৃদয়ে রক্ষা করুন। পবিত্রকারক পাপীর উদ্ধারকর্তা দিব্য-জ্যোতি সম্পন্ন প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! আমাদের পরিত্রাণের নিমিত্ত আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মে (মানস-যজ্ঞে) দেবভাব–সৎ-ভাবসমূহকে আনয়ন করুন অর্থাৎ আমাদের মধ্যে সৎ-ভাব উৎপাদন করুন। (ভাব এই যে, আমাদের কর্মের প্রভাবে আমাদের মধ্যে সৎ-ভাব উপজিত হোক)। অপিচ, আমাদের কর্ম এবং আমাদের প্রদত্ত ভক্তিরূপ হবিঃ দেবসামীপ্য প্রাপ্ত করুন। অতিশয় শুদ্ধব্রতচারী অথবা পবিত্ৰকার্যে মনুষ্যবর্গকে নিয়োগকর্তা, বিপ্রের মতো পবিত্র অথবা পবিত্রকারক ক্রান্তদর্শী মেধাবী জ্ঞানদেব যখন জ্ঞানিগণের দ্বারা হৃদয়ে প্ৰদ্দীপিত হন, তখন তিনি পাপিগণের পরিত্রাতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রজ্ঞানের আধার হে জ্ঞানেদেব! নির্মলতা-সাধক পাপ-নাশক আপনিই প্রকাশশীল আপনার দিব্যজ্যোতিঃসমূহ সাধকের হৃদয়ে আপনার তেজকে (শক্তিকে) প্রেরণ করে (অথবা করুক)। অথবা,–প্রজ্ঞানাধার হে জ্ঞানদেব! স্বতঃ নির্মলতাসাধক পাপসমূহের শুদ্ধিহেতু, আত্মদর্শিগণের হৃদয়ে স্বপ্ৰকাশসীল আপনার রশ্মিসমূহ প্রকাশমান হয়ে আপনা হতে দীপ্ত হয়। তখন সাধকগণ হৃদয়-উদ্ভাসক সৎ-ভাব-জনক কিরণসমূহ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন ॥ ১৪
[ চতুর্দশ অনুবাকের অর্থাৎ এই প্রপাঠকের শেষ অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে কর্মকাণ্ড অনুসারে যাজ্যা ও পুরোনুবাক্যা কমে কাম্যেষ্টি অভিহিত হয়েছে। সোম-অভিষবে এই মন্ত্রগুলি যজমান নিজের অভীষ্টপূরক হোমে পাঠ করে আহুতি প্রদান করবেন। পূর্ব-অনুবাকের মন্ত্রগুলির দ্বারা হবিধান শকট হতে অধিষবণ ফলকের উপরিভাগে সোম অবস্থাপিত হয়েছিল। তার পর এই চতুর্দশ অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে অভিষবের বিষয় উক্ত হয়েছে। কিন্তু পণ্ডিতগণের সিদ্ধান্ত–প্রপাঠকের উপসংহারে কামেষ্টির বিষয় অভিহিত। ঘোরতনুযুক্ত শত্ৰুসংহারক অগ্নি এখানকার লক্ষ্য। বিনিয়োগ-সংগ্রহে মন্ত্রগুলির যে প্রয়োগবিধি কথিত হয়েছে, ভাষ্যের উপসংহারে তা পরিদৃষ্ট হয়। যাই হোক,–ভাষ্যমতে প্রথম মন্ত্রটির অর্থ–হে অগ্নি! আপনি ঘোরতনুযুক্ত শত্রুগণের নিরসিতা। হবিবহনে উৎসবকারিত্বহেতু আপনি দুলোকের উৎসবস্বরূপ। আপনি মরৎসম্বন্ধি বল অর্থাৎ আপনার অনুগ্রহে প্রসিদ্ধ বলবান্ মরুৎ-গর্ণেরও বলসঞ্চার হয়। অতএব মরুৎ-গণের সাথে সংযুক্ত আপনার সৈন্যগণকে নিয়মিত করুন। অপিচ, আপনি সুখপ্রাপ্ত বায়ুবেগযুক্ত অরুণবর্ণ অশ্বে গমন করেন। হবির দ্বারা পরিচর্যাকারী যজমানকে পোষক আপনি স্বয়ংই পালন করেন। এখানে ভাষ্যকার রুদ্রঃ শব্দটি অসুর শব্দের সাথে অন্বিত করে রুদ্রঃ অসুরঃ শব্দ দুটির অর্থ করেছেন–ঘোরতরতনুযুক্তোহসুরঃ অর্থাৎ ঘোরদর্শন অসুররূপ শত্রুগণের নিরসিতা। কিন্তু আমরা অসুরঃ, রুদ্রঃ প্রভৃতি পদকে অগ্নিদেবের অর্থাৎ প্রজ্ঞানাধার ভগবানের এক একটি গুণপ্রকাশক বলে গ্রহণ করেছি। অবশ্য ভাষ্যকারের অর্থও অসঙ্গত নয়। কিন্তু পদ দুটিকে ভগবৎ-মাহাত্ম-প্রকাশক স্বস্ত্ৰ গুণ বিশেষণরূপে গ্রহণ করলে (আধ্যাত্মিক) ভাব অধিকতর পরিস্ফুট হয় বলেই মনে করি। (এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদ সংহিতার ২য় মশুলের ১ম সূত্রের ৬ষ্ঠ অ রূপেও পাওয়া যায়)।–দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ হে ঋত্বিগ যজমানগণ! তোমরা তোমাদের রক্ষার নিমিত্ত অগ্নিকে বশীভূত করো। কখন? তনয়িত্নোরচিত্তাৎ অর্থাৎ যে মরণে চিত্ত বিদ্যমান থাকে না অর্থাৎ শত্রুগণের বিস্তারিত তোমাদের মরণের পূর্বে। কি রকম অগ্নিকে বশীভূত করবে? যে অগ্নি যজ্ঞস্বামী, শত্রুদের প্রতি কুর, ফলদানের নিমিত্ত ভক্তগণের আহ্বতা, দ্যুলোক-ভুলোকে অবশ্যকর্মফলদাতা এবং হিরণ্যরূপ। আমরা এই মন্ত্রের দুরকম অন্বয় গ্রহণ করে দেখিয়েছি, দুটিতেই একই ভাব ব্যক্ত হয়। ভাষ্যকারের মতে তৃতীয় মন্ত্রের অর্থ,–এই অগ্নি বেদীর সমীপবর্তী সুরভিগন্ধযুক্ত আহবনীয়স্থানে উপবিষ্ট। কি রকম অগ্নি? দেবগণের আত্মাতা, অতিশয় যষ্টা, নিত্যতরুণ, মেধাবী, গার্হপত্য ইত্যাদিস্থানে স্থিত, সত্যবান্ মনুষ্যগণের পোষক এবং মনুষ্যদিগের উদরমধ্যে জাঠরাগ্নিরূপে দীপ্ত। ভাষ্যকারের লক্ষ্য-লৌকিক যজ্ঞ। তার লক্ষীভূত অগ্নি তাই লৌকিক বা পার্থিব অগ্নি। আমাদের অগ্নি পার্থিব অগ্নির অতীত–জ্ঞানাগ্নি। চতুর্থ মন্ত্রে, ভাষ্যকারের অর্থ,–এই অগ্নি, দেবগণের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রদত্ত পুরোডাশ আহুতি স্বাদু করুন। তারপর যজ্ঞের জিহ্বস্থানীয় গোপ্যা অগ্নিদেবতাকে যেন আমরা প্রাপ্ত হই। পুরোডাশ এবং আজ্য ইত্যাদির দ্বারা সুগন্ধোপেত সেই অগ্নি আমাদের আয়ুকে আচ্ছাদিত অর্থাৎ রক্ষা করে আগমন করুন। অদ্য তিনি দেবগণের উদ্দেশ্যে আমাদের অনুষ্ঠিত হোম যথাশাস্ত্র সম্পন্ন করুন। কিন্তু লৌকিক অগ্নির এমন সাধ্য কোথায়? আমরা বলি এ অগ্নি-জ্ঞানাগ্নি। জ্ঞানের প্রভাবে কর্মের স্বরূপ উপলব্ধ হলেই মানুষ ভগবানের প্রীতিসাধক কর্মের অনুষ্ঠানে সমর্থ হয়। (এই মন্ত্রটিও ঋগ্বেদ-সংহিতায় পাওয়া যায়)। ভাষ্যকার পঞ্চম মন্ত্রের অর্থ করেছেন–এই অগ্নি আমাদের অনিষ্ট নিবারণের জন্য গর্জন করুন। কি রকম? দ্যুলোকস্থ মেঘ যেমন গর্জন করে শস্যশোষিভীতি নিবারণ করে, সেই রকম ভাবে। কি করবার জন্য? আমাদের দাহক বিরুদ্ধেদের নাশ করে পুষ্পলতার মতো আমাদের অনুকূলগণকে সৃষ্টি করে। অগ্নি সদ্য উৎপন্ন এবং দীপ্ত হয়ে নানারকমভাবে জগৎকে প্রকাশিত করেন এবং দ্যাবাপৃথিবীর মধ্যে আপন রশ্মির দ্বারা স্বয়ং নিজেকে প্রকাশিত করেন। ভাষ্যকারের মতে ষষ্ঠ মন্ত্রের অর্থ হে অত্যন্ত বহুল! দেবগণের আহ্বতা। দিবারাত্রি যজ্ঞাই হবিঃ-সমূহ আগমন করুক। আপনার অনুগ্রহের পূর্বে দহ্মন্যায় বিশ্বভুবন নিঃসার হয়ে ছিল। আপনার অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়ে পরে, তারা সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়। সেই রকমভাবে আপনি আমাদের অনুগ্রহ করুন। ভাষ্যকারের মতে সপ্তম মন্ত্রের অর্থ-হে অতিশয় অঙ্গসারোপেত অগ্নি, বেদিরূপ শোভনভূমিযুক্ত বিশ্বের সকলেই নানা-কামিতার্থসিদ্ধির নিমিত্ত সিদ্ধিপ্রদ আপনাকে স্বীকার করে। অষ্টম–হে অগ্নি! আপনার রক্ষার দ্বারা সেই অভীষ্টফল যেন প্রাপ্ত হই। অপিচ, হে ধনবন্! শোভন-পুত্রপৌত্রোপেত ধন যেন প্রাপ্ত হই। অন্নকামী আমরা যেন সর্বতোভাবে অন্ন লাভ করি। হে অজর! আপনার প্রসাদে যেন অক্ষয় যশ প্রাপ্ত হই। নবম মন্ত্রের অর্থ,–হে অগ্নি! ধন প্রদান করো। অতিশয় বিয়োগকারিন, ঋত্বিকগণ কর্তৃক ভরণীয় আহুতি-নিবাসভূত আপনি প্রশস্ততম দীপ্তিমন্ত সকলের আকাঙ্ক্ষণীয় মণিমুক্ত ইত্যাদিরূপ ধন প্রদান করুন। ভাষ্যকারের মতে দশম ও একাদশ মন্ত্রের অর্থ, যথাক্রমে–যে অগ্নি শোধয়িতা, আহবনীয় গার্হপত্য ইত্যাদির দ্বারা বিশেষভাবে নানারকম বহুবিস্তৃত পুরোডাশ ইত্যাদি হবিঃ ভক্ষণ করে প্রতিদিন যজমানের গৃহে গমন করেন, সেই অগ্নি বক্ষ্যমাণ গুণোপেত দীপ্যমান ফল-সমূহের বিস্তারয়িতা দীপ্তিমান্ দেবযজন-সমূহে অবস্থিত। তিনি জরারহিত স্তুতিকারী দেবগণের সাথে সংযুত এবং অতিশয় বৈরি-বিয়োগকর্তা। এবং–হে যজমান! শ্রেষ্ঠ এই অগ্নি সর্বতঃ তোমাদের আয়ুঃ প্রদান করুণ। অপমৃত্যুর দ্বারা গৃহীত হলেও, তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের প্রাণ তোমাদের দেহে পুনরায় আগমন করুক। তোমার যক্ষ্ম-ব্যাধিকে বিনষ্ট করুক। দ্বাদশ মন্ত্রের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ-হে অগ্নি! আপনি যজমানগণের আয়ুষ্পদ হোন। কিরকম আপনি? আপনি পুরোডাশ সেবনকারী আঘারপ্রজাদি ঘৃতের দ্বারা আহুত। ঘৃতের দ্বারা উৎপন্ন অর্থাৎ ঘৃতই যার জন্মের কারণ সেইরকম আপনি স্বাদুতম শোধনহেতু নির্মল ঘৃত পান করে পিতা-পুত্রের মতো যজমানদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। (বোঝাই যাচ্ছে, এখানকার অগ্নি–জ্ঞানাগ্নি; এখানকার মৃত–অন্তরের ভক্তিসুধা সৎ-ভাব ইত্যাদি)। এয়োদশ মন্ত্রের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ–হে বিচৰ্ষণে, হে জাবেদ অগ্নি! প্রতিদিন যজমানের গৃহে গমনকারী আপনার উদ্দেশ্যে শোভন স্তুতি উৎপাদন করি। ভাষ্যকারকৃত এইরকমই চতুর্দশ মন্ত্রের অর্থ–অগ্নি প্রথমে দ্যুলোকের উপরিভাবে সূর্যরূপে উৎপন্ন হন। মনুষ্যলোকের উপরিভাগে তিনি প্রসিদ্ধ অগ্নিরূপে দ্বিতীয় জন্ম পরিগ্রহ করেন। সমুদ্রে বড়বানলরূপে তিনি উৎপন্ন হন। এই তিন জন্মেই তিনি যজমানদের মধ্যে অনুগ্রহবুদ্ধিযুক্ত হন। এই রকম অগ্নিকে পুরোডাশ ইত্যাদির দ্বারা দীপ্ত করে স্বায়ত্তচিত্ত ব্যক্তিরা জরা পর্যন্ত (মৃত্যুকাল পর্যন্ত) পরিচর্যা করেন। ভাষ্যমন্ত্রে পরবর্তী মন্ত্রের অর্থ–হে শোধনকারী অগ্নি! শুচি ও বন্দ্য আপনি ঘৃত প্রভৃতির দ্বারা হুত হয়ে, বৃহৎভাবে দীপ্ত বা প্রকাশিত হন। ষোড়শ মন্ত্রের অর্থে ভাষ্যকার বলছেন–দর্শনীয়রূপ সুবর্ণের মতো অগ্নি মহৎ দীপ্তির দ্বারা বিশেষভাবে দ্যোতিত হন। কি করবার জন্য? অতিরস্কার্য জীবন ও শ্রেয়ঃ বিধানের ইচ্ছা করে। সেইরকম অগ্নি অন্ন এবং হবির দ্বারা অমৃত বিধান করেন। দ্যুলোকবাসী দেবগণ সুরেতা হয়ে এই অগ্নিকে উৎপাদন করেন বলে অগ্নির অমৃতত্ব। সপ্তদশ মন্ত্রটির ক্ষেত্রে একরকম অর্থ নিষ্পন্ন করে ভাষ্যকার পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। অপিচ, অন্যান্য ভাষার ব্যাখ্যাকারেরাও ভাষ্যকারের কল্পিত পথ পরিত্যাগ করে অন্য পথে বিচরণ করেছেন দেখতে পাই। ভাষ্যের ভাবে প্রকাশ,অগ্নি রেতঃ-রূপে গর্ভে প্রবিষ্ট হয়ে যজ্ঞপরায়ণ সুপুত্ৰ উৎপন্ন করে। কেউ বা এই উপলক্ষে বৃষ্টিপাতের সম্বন্ধ ও মরুৎ-ইত্যাদির প্রসঙ্গ খ্যাপন করেছেন। সায়ণাচার্যের ভাষ্যের অনুসারী বঙ্গানুবাদটির রূপ–অগ্নির বিশুদ্ধ ও দীপ্তিমান্ তেজ অন্নলাভের জন্য মনুষ্যপালকে ব্যাপ্ত হোক; (সেই তেজের দ্বারা) অগ্নি গর্ভনিষিক্ত রেতঃ হতে বলবান্ অনিন্দনীয় যুবা ও শোভনকর্মা পুত্ৰ উৎপন্ন করুন ও যাগ ইত্যাদি কর্মে প্রেরণ করুন। অথবা,-মনুষ্যগণের রক্ষক ও দীপ্ত যে তেজ শস্য ইত্যাদির উৎপত্তির জন্য মেঘের দ্বারা বর্ষিত জলকে ব্যাপ্ত করে, সেই তেজোযুক্ত দীপ্তিমান্ অগ্নি যথাকালে উক্ত গুণযুক্ত পুত্র উৎপাদিত করুন ও যজ্ঞ ইত্যাদিতে প্রেরণ করুন। অষ্টাদশ মন্ত্রের ভাষ্যের অর্থ–সেই যজমান আপনার দ্বারা রক্ষিত। কি সাধনের দ্বার? অত্যন্ত তেজোযুক্ত মনের দ্বারা। হে অগ্নি! শোভন-পুত্রপৌত্র-ইত্যাদি-যুক্ত হবার অভিলাষী, মনুষ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যজমানের ধনসমূহ প্রদান করুন। আপনার অনুগ্রহে প্রভুত্ব প্রাপ্ত হলে আমরা বসুমত্তম শোভনস্ততিযুক্ত অর্থাৎ বহুগের দ্বারা স্তোত্রশস্ত্র-সমূহে প্রভূত হতে পারি। উনবিংশ মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী যে অর্থ প্রচলিত আছে, তা এই,-হে অগ্নি! তুমি দ্যুম্নকে একটি শবিজয়ী পুত্র প্রদান করো, যে পুত্র পরাক্রমের দ্বারা যুদ্ধে সকল লোককে পরাজিত করে, গৌরব লাভ করবে। এখানে ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা এবং ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের এয়োবিংশ সূক্তের প্রথমা ঋকের এই মন্ত্রেরই ভাষ্যকারকৃত ব্যাখ্যার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। এর বিংশ মন্ত্রটিও ঋগ্বেদে আছে (৫ম, ২৩, ২ঋ)। সেখানের সঙ্গে এখানেও পার্থক্য। এখানে ভাষ্যকারের ভাষ্যের ভাব এই-হে অগ্নে! হে সহস্বা বলব!–ইত্যাদি। একবিংশ মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। পরাজ্ঞান-লাভে পরাগতি-প্রাপ্তির প্রার্থনা মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে বলে আমরা মনে করি। ভাষ্যের ভাব অবশ্যই স্বতন্ত্র। ভাষ্যকার উক্ষা পদের বৃষভ অর্থ এবং বশা পদের বন্ধ্যা অর্থ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন,–এখানে দেবতা স্বতন্ত্র। কিন্তু তথাপি অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিতে হয় বলে উক্ষায় এবং বশান্ন পদে দুটিতে অগ্নিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। তিনি সোমযুক্ত পৃষ্ঠস্তোত্রযুক্ত–তাই তিনি সোমপৃষ্ঠ। তিনি আবার অনেক স্তোত্রসমন্বিত দেবতাসংযুত। তিনি অন্নের বিধাতা। এমন যে অগ্নি, সেই অগ্নিকে যেন আমরা স্তোবের দ্বারা পরিচর্যা করি। পরবর্তী মন্ত্রটির ভাষ্যমতের অর্থ-হে পুত্রবৎ অভিমতকারী অগ্নি! বাগভিমানী দেবতাস্থানীয় বলে আপনি সেইরকমই হন। সেই অগ্নি আমাদের জন্য অন্ন এবং গৃহ প্রদান করুন। বিবাহাগ্নি উৎপন্ন হয়ে গৃহাশ্রম বিধান করেন। আবার ভুক্ত অন্ন পরিপাকের জন্য জাঠরাগ্নিরূপে অবস্থিত হন। জন্মমাত্রেই গৃহের এবং অন্নের বিধান করেন। অতএব হে রসদ অগ্নি! আপনি আমাদের রস প্রদান করুন, রাজার মতো শত্রু জয় করুন এবং হিংসা ইত্যাদ দোষরহিত যজমানকে অনুগ্রহ করবার জন্য তাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন। (এই মন্ত্রটিও ঋগ্বেদে অন্যরকম ভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে)। এয়োবিংশ মন্ত্রটিও ঋগ্বেদে আছে। সেখানেও এর ব্যাখ্যা অন্যরকম। চতুর্বিংশ মন্ত্রটি ঋগ্বেদ ও সামবেদেও আছে। পঞ্চবিংশ মন্ত্রটিও ঋগ্বেদে আছে। এখানে অর্থাৎ এই যজুর্মন্ত্রে ভাষ্যকারের অর্থ-হে অগ্নি! শোধক দ্যোতনাত্মক দীপ্তমান শ্ল বাক্যের দ্বারা দেবগণকে আনয়ন করো এবং যজনা করো। ঋগ্বেদ-সংহিতায় মন্ত্রের যে একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ পরিদৃষ্ট হয়, তা এই,-হে দীপ্তিমান পবিত্রতাবিধায়ক অগ্নি! তুমি নিজে দীপ্তিমান প্রীতিকারী জিহ্বাদ্বারা দেবগণকে এস্থানে আনয়ন করো এবং পূজা করো। ষড়বিংশ মন্ত্রটি এবং সপ্তবিংশ মন্ত্রটি ঋগ্বেদ সংহিতায় আছে। সপ্তবিংশটি সামবেদের উত্তরর্চিকেও আছে। ষড়বিংশ মন্ত্রের অর্থে লৌকিক যজ্ঞপক্ষে যজ্ঞে সর্ব-দেবতাদের আনয়নের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং সেই দেবগণের নিকট হবিঃ ইত্যাদি পৌঁছিয়ে দেবার জন্য অগ্নির নিকট অনুরোধ প্রকাশ পেয়েছে। আধ্যাত্মিক যজ্ঞপক্ষে আমরা হৃদয়ে দীপ্তি-দান-ইত্যাদি গুণোপেত দেবভাবের যেন বিকাশ হয়, তেমনই প্রার্থনা লক্ষ্য করেছি। সপ্তবিংশ মন্ত্রে অগ্নিদেবের বিশেষণ পদ–শুচিঃ। বলা হয়েছে,–বিপ্রের ন্যায় শুচি–শুচির্বিপ্রঃ; বলা হয়েছে–তিনি কবির মতো শুচি–শুচিঃ কাব্য। সায়ণ ঐ শুচিঃ পদের অর্থ করেছেন,–অতিশয়েন শুদ্ধং। আমরা একটু অন্য ভাবে ভাবান্বিত হয়ে অর্থ বুঝেছি–অগ্নি কলঙ্কপরিশূন্য সৎস্বরূপ। ভগবানকে বিপ্রের ন্যায় পবিত্র এবং কবির ন্যায় শুচি বলার তাৎপর্য কি? বিপ্রঃ বলতে যিনি বি বিশিষ্ট প্রঃ প্রজ্ঞান সম্পন্ন, বোঝায়। যিনি ব্রহ্মকে জেনেছেন, সেই ব্রহ্মজ্ঞানসম্পন্ন জনই বিপ্রঃ পদবাচ্য। আবার, ক্ৰান্তদর্শী আত্মজ্ঞানসম্পন্ন যিনি, তিনিই কবিঃ। শুদ্ধসত্ত্বের উদয় হলেই–অন্তরে ভগবানের অধিষ্ঠান হলেই–পবিত্রতা লাভে সমর্থ হওয়া যায়। ফলতঃ, বিশেষণ দুটিতে, মন্ত্রে নিগুণকে গুণন্বিত করায়, সেই গুণে ভূষিত হবার উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে। অষ্টাবিংশ মন্ত্রটিও ঋগ্বেদ ও সামবেদে পাওয়া যায়। এই মন্ত্রে একটি অতি উচ্চ ভাব পরিস্ফুট দেখা যায়। আমার স্তুতি বা আমার পূজা যে তিনি গ্রহণ করবেন, সে স্পর্ধা করবার ক্ষমতা কি আমার আছে? তিনি যদি সে পূজা গ্রহণ করেন, সে তাঁর অনুগ্রহের লক্ষণ মাত্র। তার ভ্রাজঃ শুক্রা-সুবিমল আলোকে–জ্যোতির মধ্যে প্রতিভাত প্রতিবিম্বিত হয়–আমাদের সৎকর্ম-নিবহ। সৎস্বরূপ ভগবান্সৎকর্মে পরিতুষ্ট হন। তারপর সর্বদেব-আহ্বানকারী যে স্তোত্র–সে তো তারই–ভগবানেরই মুখ-নিঃসৃত। তারই প্রকাশরূপ ভিন্ন সে তো অন্য কিছুই নয়। সুতরাং তারই স্তোত্রমন্ত্রে তিনি তুষ্ট না হবেন কেন?–ভগবান্ করুণাময়। তিনি করুণার প্রস্রবণ উন্মুক্ত করে আছেন। তুমি সামান্য আয়াস স্বীকার করলেই নিঝরের মতো আপনা হতে নিঃসৃত সে অমৃতের ধারা পান করতে সমর্থ হবে। তারই জ্যোতিঃ তাঁর পথে তোমাকে পরিচালিত করবে। সুতরাং সেই জ্যোতি লাভ করতে তৎপর হও) ॥১৪৷৷