‘পৃথক, আর এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী’
যারা দেহাত্মবাদী সহজিয়া তাদের সাধনার স্থূল কথা হল মানুষভজন। তারা কথায় কথায় বলে ‘মানুষ ধরা’। প্রশ্ন হল কোন মানুষকে ধরা যায়, কেই বা যথার্থ মানুষ? তারা রহস্য করে বলে মানুষের আবার বাছাবাছি কী? সব মানুষই সমান। কার মধ্যে যে কখন কী পাওয়া যাবে তা নাকি আগে থেকে বলা যায় না। কথাটার একটা লৌকিক উপমা দিয়েছিল, জেহান বলে এক দরবেশ। পরনে তার এক বর্ণরঙিন আলখাল্লা, মাথায় এক অদ্ভুত টুপি। গলায় একগাছা পাথর আর কী সবের মালা। হাতে খেলকা, করোয়া কিস্তি আর চিমটে। চোখদুটি নিমীলিত করে সে ধ্যানস্থ ছিল কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ার লালন ফকিরের মাজারে। সন্ধে হয়ে আসছে তখন। মাজার শরীফের বড় বড় থাম আর গম্বুজ-ঘেরা সৌধ ভেদ করে শেষ সূর্যের একটা দ্যুতিহীন আলো সমস্ত এবাদতখানায় এক আধোছায়ার ম্লানতা এনেছিল। আলো কমে এলে যেমন রঙিন পাখির রং মরে আসে তেমনই জেহান দরবেশের আলখাল্লা আর কণ্ঠ-মালার বহুবর্ণদ্যুতি এক মলিন সিল্যুয়েটে জেল্লা হারাচ্ছিল ক্রমশ। ধীরে নেমে আসছিল শীত সন্ধ্যার কালিমা। সেই সময় জেহান দরবেশ তার আশ্চর্য লৌকিক চিন্তার মৌলিক উদ্ভাবন থেকে বলেছিল, ‘সুতোর ফুঁপি দেখেছেন তো? সেই রকম সব জিনিসের ফুঁপি থাকে। কোনও জিনিস ফুরোয় না। টান দিলেই পরেরটুকু এসে যায়। তেমনই মানুষ। কার টানে যে কোন মানুষের খবর আসে কে বলতে পারে?’
ভাবলে এখন অবাক লাগে যে দরবেশের কথার প্রমাণ মিলল কত দিন পরে গাইঘাটা থানার মোড়লডাঙার পৌষসংক্রান্তির মেলায়। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে বেশ চন্মনে খিদে পেয়েছে। দেখি একটা বিরাট মিষ্টির দোকানে গরম গরম ঢাকাই পরোটা আর অমৃতি জিলিপি ভাজা হচ্ছে। টেম্পোরারি দোকান। নড়বড়ে হাইবেঞ্চ আর কাঠের চেয়ার। টিনের গেলাসে জল আর পদ্মপাতায় করে খাবার দেওয়ার চল। আমার নাক-বরাবর বিরাট উনুনের সামনে বসে মোটা মার্কিনের ন্যাকড়া টিপে টিপে অদ্ভুত শিল্প গড়ছিল অমৃতি জিলিপির কারিগর। মাঝবয়সী মানুষ, গালে পাঁচ-ছ দিনের না-কাটা পাকা দাড়ির কদমফুল। মানুষটা যে রকম একাগ্র নিষ্ঠায় জিলিপির প্যাঁচ বানাচ্ছিল তাই দেখেই কথা বলতে ইচ্ছে হল। ব্যাস, বেরিয়ে পড়ল ফুঁপি। হরিণঘাটার নগর উখরা গ্রামে থাকে এই মন্মথ অধিকারী। ভেকধারী বোস্টম। বাড়িতে পরিবার বলতে বিধবা এক বোন আর তিন ছেলেমেয়ে। ‘বিয়ে-থাওয়া করিনি বাবু, বর্ষার কালটা বাদ দিলে সম্বৎসর মেলা থেকে মেলা এই কাজে ঘুরি। মানুষজন দেখি। বেশ কেটে যায়। আর বর্ষার সময় হরিণঘাটার আশপাশে হালুইকরের কাজ করি। বিয়ে পৈতে শ্রাদ্ধ যা জোটে। এখন আবার নতুন দুটো ভোজকাজ হয়েছে, আপনাদের ওই যাকে বলে, বিবাহবার্ষিকী আর জন্মদিন। এইসব করে টেনেটুনে চলে যায়।’
এই হল, যাকে বলে, খাঁটি প্যারাম্বুলেটিং ট্রেড। একটা থোক মূলধন জোগাড় করে জনকয়েক কর্মচারী, বাসন-কোসন, বেঞ্চি-চেয়ার, বাঁশ আর ত্রিপল নিয়ে কেবলই ঘোরাঘুরি। এক মেলা থেকে আরেক মেলা। সব চান্দ্রমাসের হিসেবে। মালিক বরিশাল থেকে আসা যোগেশচন্দ্র দেবনাথ। ফতুয়া পরা ষাট-বয়সী, ঝানু আর ধূর্ত। জিজ্ঞেস করতেই ঝটিতি মেলার নামাবলী পেশ করলেন, ‘প্রথমে ধরেন এই গাইঘাটার পৌষসংক্রান্তি মেলা। চলবে একমাস। সেখান থেকে মাঘী পূর্ণিমায় স্বরূপনগর থানায় দেওরার মেলা বা যমুনার মেলা। সেখান থেকে ঠাকুরনগরে চৈত্র একাদশীতে বারুণীর মেলা। সেখান থেকে গাইঘাটা থানার জলেশ্বরে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। এইভাবে চলতে চলতে শেষ হবে বানপুর মাটিয়ারিতে অম্বুবাচীর মেলা আষাঢ় মাসে। বর্ষার দুমাস বাদ দিয়ে আবার আশ্বিন থেকে শুরু হবে সিজন।’
মন্মথ অধিকারী আমার হাতে-ধরা পদ্মপাতায় দুখানা সদ্য-ভাজা গরম জিলিপি দিয়ে বলল, ‘বাবু, গৌরাঙ্গের কৃপায় আমি এই কাজে গত বিশ বছর নানা মালিকের দোকানের সঙ্গে অন্তত সত্তর-আশিখানা মেলা দেখেছি। কত মানুষ। কত কাণ্ড! কত ব্যাপারী। কত কেলেঙ্কারী। কত ঝড় জল। কত উটকো হাঙ্গামা। কিন্তু সব মিলিয়ে ভারী আনন্দ, যাই বলুন সবই গৌরাঙ্গের খেলা।’
এইভাবে ‘গৌরাঙ্গের কৃপা’ আর ‘গৌরাঙ্গের খেলা’ শব্দ দুটিকে অনর্গল অব্যয়ের মতো ব্যবহার করে মন্মথ অধিকারী আমার সঙ্গে জমিয়ে নিল। কথায় কথায় প্রসঙ্গের ফুঁপি বেরোয়। প্রসঙ্গ থেকে স্বচ্ছন্দে আরেক উলটো প্রসঙ্গে যেতে পারে মানুষটা। সেই সুযোগে আমি আমার মনে-পুষে রাখা অনেক দিনের একটা প্রশ্ন খালাস করে ফেলি; ‘এই যে পাঁচ-ছ মাস ধরে সব বাড়িছাড়া। সবাই কি সংযম করে থাকে নাকি? শরীরের ব্যাপার-স্যাপার আছে তো, না কি?’
জিভ কেটে মন্মথ বলে, ‘বিলক্ষণ। গৌরাঙ্গের খেলায় এই দেহ নিয়েই যত গোলমাল। আছে, তারও ব্যবস্থা আছে। সব মেলাতেই উস্কো মেয়েছেলে থাকে বইকী। তারা চোখে সুর্মা টেনে, পায়ে মল বাজিয়ে আমাদের জানান দিয়ে যায় সময়মতো। যার দরকার যোগাযোগ করে নেয়। সব মেলাতেই এসব চোরাগোপ্তা ব্যবস্থা থাকে। এক অগ্রদ্বীপের মেলা বাদে।’
:হঠাৎ ওই মেলাটা বাদ কেন?
:গৌরাঙ্গের কৃপায় ওই মেলা সবচেয়ে সাত্ত্বিক আর পবিত্র। ওখানে গিয়ে কুচিন্তা কি কাম একেবারে ত্যাগ করতে হবে। ও মেলার খুব মাহিত্ম্য। শুনতে চান কী রকম মাহিত্ম্য? তবে শুনুন। গৌরাঙ্গের খেলায় অগ্রদ্বীপের মেলার তিন দিনে লক্ষ লোক আসে কিন্তু দেখবেন একটাও কাক নেই, একটাও কুকুর নেই, কখনও ঝড় বৃষ্টি হয় না। আরও নিগূঢ় ব্যাপার আছে। সে সব স্বয়ং গেলে বোঝা যায়। আপনি যাবেন? তা হলে আপনাকে নিশানা দিয়ে দেব সব-কিছুর। অগ্রদ্বীপের মেলা সবচেয়ে পুরনো মেলা বাবু।’
আমি বললাম, ‘গৌরাঙ্গের কৃপায় অগ্রদ্বীপের মেলা চালু করেছিলেন কে?’
মন্মথ শূন্যে হাত ছুড়ে বলল, ‘আরে গৌরাঙ্গের খেলা। অগ্রদ্বীপের মেলা তো গৌরাঙ্গেরই তৈরি। তা হতেই সূচনা।’
চমকে বলি, ‘সে কী? গৌরাঙ্গই অগ্রদ্বীপের মেলা শুরু করেছেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ’, মন্মথ বিনয়নম্র বৈষ্ণবের মতো বলে, ‘গৌরাঙ্গের খেলায় আমি লেখাপড়া শিখিনি। মুরুখ্যু মানুষ। তবে আমার গুরুপাট পাটুলীতে ‘অমিয়নিমাইচরিত’ পাঠ হয়। সেখানে আর শ্রীগুরুর শ্রীমুখে শুনেছি স্বয়ং শ্রীগৌরাঙ্গ তাঁর পরিকর গোবিন্দ ঘোষকে দিয়ে ওখানে গোপীনাথ জিউ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই গোপীনাথ মন্দিরকে ঘিরে তিন দিন মেলা বসে অগ্রদ্বীপে বারুণীর সময়ে। যাকে বলে আম-বারুণী। আমি কতবার গেছি দোকানের সঙ্গে।’
: আম-বারুণী কোন সময়ে হয়?
: আজ্ঞে ওই মধুকৃষ্ণাতিথি। তার মানে গৌরাঙ্গের খেলায় যাকে বলে বসন্তকাল। অর্থাৎ যাকে বলে চৈত্র মাসের কৃষ্ণাতিথির একাদশীতে মেলা শুরু।
: কেমন করে যেতে হয়?
: নবদ্বীপধাম স্টেশন থেকে রেলে চেপে কাটোয়ার দিকে যেতে হবে। কাটোয়ার আগের স্টেশন দাঁইহাট। তার আগের স্টেশন অগ্রদ্বীপ। স্টেশন থেকে পুব দিকে মাইল দুই গেলে গঙ্গা। গঙ্গা পেরোলে গোপীনাথের মন্দির। তা গৌরাঙ্গের খেলায় একটু পথশ্রম আছে। তিনি ভক্তকে একটু বাজিয়ে নেন বইকী। তবু যাবেন।
যাবার আগে একটু তথ্যসংগ্রহ করে নেওয়া আমার রীতি। ১৯১০ সালে বেরোনো পিটারসন সাহেবের লেখা বর্ধমান জেলা গেজেটিয়ারের লেখাটুকু বড় নিষ্প্রাণ:
Agradwip is a famous place of pilgrimage and contains a temple of Gopinath at which some ten thousand pilgrims gather every April.
এর চেয়ে একটু সজীব বর্ণনা জোটে বিজয়রামের লেখা ‘তীর্থমঙ্গল’ কাব্যে। ১১৭১ বঙ্গাব্দে, তার মানে দুশো বছরেরও আগে, ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষালের বাবা কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের সঙ্গে তীর্থভ্রমণ করছিলেন বিজয়রাম। সেই সময় ত্রিস্থলী থেকে ফেরার পথে তাঁরা অগ্রদ্বীপে নামেন। গোপীনাথের মন্দির দেখে তাঁদের মন ভরে যায়। বিজয়রাম লেখেন:
অগ্রদ্বীপে আসি হৈল উপস্থিত।
সেইখানে গোপীনাথ ঠাকুরের ঘর।
অপূর্ব নির্মাণবাটি দেখিতে সুন্দর ॥
ইতিহাস বলছে, অগ্রদ্বীপের মূল মন্দির এখন গঙ্গাগর্ভে। এখনকার মন্দিরটি তৈরি করে দেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তার মানে বিজয়রাম যে অপূর্ব নির্মাণ বাটি দেখেছিলেন সেটি কৃষ্ণচন্দ্রের তৈরি।
কিন্তু নদীয়ারাজা কৃষ্ণচন্দ্র খামোখা বর্ধমান জেলার এই মন্দিরটি বানালেন কেন? এ প্রশ্নের ফুঁপি থেকে উঠে আসে আরেক মজার কাহিনী। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাবা রাজা রঘুরামের আমলে একবার অগ্রদ্বীপের মেলায় হয়েছিল প্রচণ্ড দাঙ্গাহাঙ্গামা। দু-চার জন মারাও গিয়েছিল। খবর পেয়ে নবাব আলীবর্দীর প্রতিনিধি তখন মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠালেন বর্ধমানরাজ, নদীয়ারাজ আর পাটুলীর জমিদারকে। যে যার প্রতিনিধি পাঠালেন। দারুণ রেগে নবাবের পক্ষ প্রথমেই জানতে চাইলে অগ্রদ্বীপ কার এক্তিয়ারে? ভয়ের চোটে বর্ধমান আর পাটুলীর লোক মুখে কুলুপ আঁটল। সেই সুযোগে নদীয়ার ধূর্ত প্রতিনিধি বললে, ‘অগ্রদ্বীপ নদীয়া রাজেরই এক্তিয়ারে। এবারে নানা কারণে গাফিলতি হয়ে গেছে। আর কখনও এমন হাঙ্গামা হবে না হুজুর।’
ব্যাস। অপরাধ মকুব। সঙ্গে সঙ্গে অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ চলে এলেন রাজা রঘুরামের দখলে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত গোপীনাথ কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে বছরে অন্তত ছ মাস থাকেন। সেবা পূজা শেতল হয়। অবাক কাণ্ড। এমনই নাকি ছিল সেকালের নবাবি প্রশাসন?
অগ্রদ্বীপের বেশ প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায় ওড়িয়া কবি দিবাকর দাসের ‘জগন্নাথ চরিতামৃত’ বইতে। বইটি সতেরো শতকে লেখা। ওই বইতে ওড়িয়া ভাষায় লেখা আছে—
অগ্রদীপ ঘাট যা কহি।
তঁহিরে শ্রীঘোষ গোঁসাই।
এই শ্রীঘোষ গোঁসাই মানে গোবিন্দ ঘোষ। যাঁর নামে এই মেলার নাম এখনও অনেকে বলেন ‘ঘোষ ঠাকুরের মেলা।’
ঘোষপাড়ার কর্তাভজাদের বিখ্যাত নেতা দুলালচাঁদ ওরফে লালশশীর মতো মান্যগণ্য লোকও যে অগ্রদ্বীপ গিয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁর গানের এই উক্তিতে ধরা আছে যে,
একবার অগ্রদ্বীপের মহোৎসবে দেখতে গেলাম একা
আখড়াধারী কত পুরুষ-নারী হয় না লেখা জোখা।
এ বিবরণ থেকে অগ্রদ্বীপের মেলায় আখড়াধারী অনেক সহজিয়াদের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর চেয়েও স্বাদু বর্ণনা মেলে সাহেবধনী-গীতিকার কুবির গোঁসাইয়ের লেখায়—
যত নেড়ানেড়ি ঘোষের বাড়ি
প্রসাদ মারে রোজ দুবেলা।
রামাতনিমাত ব্রহ্মচারী
আউল বাউল কপ্নিধারী
যত শুদ্ধাচারী জপে মালা।
উদাসীন দরবেশ গোঁসাই
ফুৎকার অবধৌতি নিতাই
উন্মত্ত সদাই গেঁজাডলা।
এর পাশে সহজিয়া নাগর-নাগরীর প্রেমচিত্রও কম আকর্ষণীয় নয়। সেখানে দেখা যায়—
নাগরী চারিদিকে বেড়াচ্ছে পাকে পাকে
দ্যাখে যারে তাইরে ডাকে ‘এসো প্রাণবন্ধু’ বলে।
এই মনের মতো হলে পরে
নামের মালা দেয় তার গলে।
বলিতেছে ‘ধরো ধরো’, ধরো ভাই যত পারো,
প্রেমসেবা যদি করো মনের সাধে সকলে।
অবশ্য অগ্রদ্বীপের মেলা নিয়ে যে খারাপ কথাও চালু আছে তা আমি জানতাম না। জানালেন এক বহুদর্শী ফকির। বললেন, ‘মেলায় নানা রকম মানুষ আসে নানান তালে। সবাই তাদের মধ্যে ভাল নয়। ঠগ, জোচ্চোর, দেহব্যবসায়ী, কামপাগল, শয়তানও থাকে বইকী। আমাদের চলতি কথায় ওইজন্যে অগ্রদ্বীপের মেলা সম্বন্ধে বলে: অগ্রদ্বীপের মেলা/ কে কার পাছায় মারে ঠেলা। তার মানে জায়গাটায় অশৈল কাজটাজও হয়। আমি ওই জন্যে অগ্রদ্বীপে আর যাই না। আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা আজকাল মেলায় এসে নোংরামি করে। ও মেলার মর্যাদা চলে গেছে।’
বাংলার মেলা নিয়ে তেমন সমাজতাত্ত্বিক কাজ হয়েছে বলে শুনিনি। হলে, মেলার আকার প্রকার স্বভাবের বিবর্তন থেকে সমাজ-বিবর্তনের একটা ছক পাওয়া যেত। যেমন দেখা যায় আশি বছর আগে মুরুটিয়ার স্নানযাত্রার মেলা দেখে যে বিবরণ দীনেন্দ্রকুমার রায় এঁকেছিলেন তাঁর ‘পল্লীচিত্র’ বইতে তার সঙ্গে এখানকার মেলার মিল বেশ কম। তিনি লিখেছেন:
বারবিলাসিনীগণের ‘দোকান’-এ অঞ্চলের মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। মেলায় ইহাদের সমাগম যত অধিক হয় জমিদারদের লাভও তত অধিক হইয়া থাকে; এইজন্য তাঁহারা মেলাক্ষেত্রের একটি অংশ ইহাদের জন্য ঘিরিয়া রাখেন। ইহারাই মেলার কলঙ্ক। ইহাদের প্রবেশাধিকার না থাকিলে, শুনিয়াছি, মেলা জমে না! এক একটি রূপজীবিনী তিন চারি হাত লম্বা ‘টোঙ্গে’ রূপের দোকান খুলিয়া বসিয়াছে। মেলার একপ্রান্তে এরূপ শত শত ‘টোঙ্গ’! অর্থোপার্জনের আশায় এখানে নানা পল্লী হইতে তিন শতাধিক রূপজীবিনীর সমাগম হইয়াছে।….শিকারের সন্ধানে অনেকে চারিগাছা মলের ঝনঝনিতে গ্রাম্য চাষীদের ও পাইক পেয়াদা নগদীগণের তৃষিত চিত্ত উদভ্রান্ত করিয়া মেলার মধ্যে বিচরণ করিতেছে। জনারণ্যে নারীদেহে যেন সাপ, বাঘ!
জমিদারতন্ত্রের প্রশ্রয়ে গড়ে-ওঠা দেহব্যবসা এখন অনেক মেলাতেই নেই। দেহব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা এখন মেলায় থাকে না। টোঙ্গ আর শত শত স্বৈরিণী এখন কল্পনাতীত। তার কারণ শরীরী ব্যবসা এখন শহরকেন্দ্রিক এবং অনতিপ্রকাশ্য। অথচ আগেকার দিনে কৃষিভিত্তিক গ্রামদেশের মানুষের যৌনতার দীক্ষা হত সম্ভবত মেলাখেলায়। সেই জন্যে শিষ্ট সমাজে আজও গ্রাম্যমেলা সম্পর্কে একটা সশঙ্ক ধারণা আছে। সেকালের কত মেলায় যে কত মেয়ে হারিয়ে যেত।
সে কথা থাক। কিন্তু আমার যে কথাগুলো জানা ছিল না তার মধ্যে বড় কথা হল গোপীনাথকে সবাই বলে ‘গুপিনাথ’। স্বরসঙ্গতির ব্যাপার। এ কথাটাও জানতাম না যে অগ্রদ্বীপের উচ্চারণ অঞ্চলবিশেষের গ্রাম্যতায় দাঁড়াতে পারে ‘রগ্গদ্বীপ’। জানলাম প্রথম যেবার অগ্রদ্বীপে যাই সেবার ট্রেনে উঠে সহযাত্রী দলের বৈরাগী একজন আমাকে বললে: বাবু কি আমাদের মতোই রগ্গদ্বীপে যাচ্ছেন? চলুন। অন্য বার আমরা নদীপথে যাই এবারে যাচ্ছি এলে চড়ে।
‘এল’ মানে রেল। আশ্চর্য বর্ণবিপৰ্যায়। রেল হল এল, কিন্তু অগ্রদ্বীপ হল রগগদ্বীপ।
যাই হোক, প্রথম বারে আমার রগ্গদ্বীপের গুপিনাথ দেখতে যাওয়া ‘এলে চড়ে।’ ‘এল’ যে স্টেশনে থামল তার নাম অগ্রদ্বীপ। যদিও জায়গাটার নাম অগ্রদ্বীপ নয়। জায়গাটার নাম বহড়া। অগ্রদ্বীপ বহড়া গ্রাম থেকে আড়াই মাইল পুবের একটা গ্রাম। দুইগ্রামকে ভাগ করেছে গঙ্গা। আড়াই মাইল দূরের গ্রামের নামে স্টেশন? একেই বোধ হয় বলে অগ্রদ্বীপের মাহিত্ম্য।
চৈত্রের মাঝামাঝি সময়, কাজেই মাটিতে তাত উঠছে বেলা দশটাতেই। তার উপর গঙ্গার মস্ত চড়া আর বালিয়াড়ি। অন্তত একমাইল চড়া পেরোতে গৌরাঙ্গের কৃপায় বেশ ভালরকম ভক্তির পরীক্ষা ঘটে যায়। তবে ক্লান্তি লাগে না, কেননা সঙ্গে চলে অনেক মানুষজন, তাদের কলকাকলি। খুব তেষ্টা লাগলে কিনে খাওয়া যায় টাটকা তালের রস। কিংবা চড়ায় মাঝে মাঝেই কিনতে পাওয়া যায় ‘বাখারি’ অর্থাৎ এক রকমের লম্বাটে কাঁকুড়। সরস স্নিগ্ধ। কেউ চলেছে মাথায় করে একটা মিষ্টি কুমড়ো নিয়ে। ‘বিক্রি করবা নাকি কুমড়ো?’ জবাবে সে বলে ‘না গো, গাছের প্রথম ফল গুপিনাথকে দেব।’ যত মানুষ চলেছে তার বারো-আনাই মহিলা। বেশির ভাগ মানুষের ভাষা থেকে মালুম হয় যে তারা পূর্ববঙ্গের মানুষ। ব্যাপারটা কী? পুর্ববঙ্গের এত মানুষ এই রাঢ়ের অগ্রদ্বীপে কেন?
কীভাবে?
এ কৌতূহলের ফুঁপি থেকে আরেকটা রহস্যের জট খুলে যায়। পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্গের বেশির ভাগ মানুষ গৌরভক্ত। দেশ ভাগের সময় তাদের অনেকে পুনর্বসতির জন্যে তাই বেছে নেয় ‘গৌরগঙ্গার দেশ’ অর্থাৎ নবদ্বীপ আর তার আশপাশ। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের যে-সব গ্রামীণ মেলায় কৃষ্ণের অনুষঙ্গ আছে সেগুলি বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে এ ব্যাপারটা অনেকে খেয়াল করেননি। সেই সঙ্গে এটাও লক্ষ করা হয়নি যে বেশির ভাগ অন্যান্য মেলার নাভিশ্বাস উঠেছে। কেননা গ্রামে গ্রামে এখন সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা টেমপো আর ম্যাটাডোরের কল্যাণে এত সুনিশ্চিত যে মেলায় গ্রামীণ মানুষের কেনার সামগ্রী অনেক কম। মেলা এখন শুধুই বিনোদন আর প্রচল। শীর্ণ প্রথা কিংবা নৈমিত্তিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অগ্রদ্বীপের রমরমাই আলাদা। মানুষ, শুধু মানুষ। দশটা খেয়া নৌকো মানুষ পারাপারে কিছুতেই সামলে দিতে পারে না।
পথে যেতে লক্ষ করা যায় সকলেরই কেমন যেন একটা পৌঁছবার তাড়া রয়েছে। যেন ছুটছে। ‘ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারব তো?’ দেরি ‘হয়নি তো?’ কীসের ঠিক সময়? দেরিই বা কেন? এক জনকে জিজ্ঞেস করতে বলে, ‘এগারোটার মধ্যে তো শ্ৰাদ্ধ হয়ে যাবে। তাই এত তাড়াতাড়ি।’
: শ্রাদ্ধ? কার শ্রাদ্ধ?
: আপনি কোনওদিন আসেননি বুঝি? শ্রাদ্ধ মানে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধ।
: ঘোষঠাকুর মানে গোবিন্দ ঘোষ? তার শ্রাদ্ধ কে করে?
: কে আবার করবে? করেন স্বয়ং আমাদের গুপিনাথ। আজকে আম-বারুণীর একাদশী। আজ গুপিনাথ কাছা পরে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধ করবেন। চলুন, পা চালান।
উর্ধ্বশ্বাসে চলমান এই বাহিনীর সঙ্গে আমি তাল রাখতে পারি না বোধহয় চাইও না। আমার মনে এ সব ঘটনা বড় জোর কৌতূহল আর কৌতুক জাগায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি যে মধুকৃষ্ণা একাদশী তা কি আমার কোনওভাবেই খেয়াল থাকে? আম-বারুণীর কোনও আহ্বান কি আমার জীবনে থাকতে পারে? অথচ আমার সঙ্গে দ্রুত ধাবমান এই ভক্ত-জনতা প্রতি বছর সে সব তিথি আলাদা করে মনে রাখে আর দিন গোনে। ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধ দেখার জন্যে তাদের এই মুক্তকচ্ছ দৌড় আর খেয়া নৌকোয় বিপজনক লাফ দেওয়া, তার পিছনে যে-মনের টান, হিসেব করে দেখি, তার একটা অণুকণা আমার মনের অতলে জমা নেই। এরা কি তবে জীবনানন্দ-কথিত ‘পৃথক, আর এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী?’ পৃথক তো বটেই। কেননা এই বিরাট সৌর পৃথিবীর অন্তর্গত আমাদের প্রতিদিনের যে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই-করা জীবন তার সঙ্গে এদের অটল ভক্তিবিশ্বাসের জীবন একেবারে পৃথক। স্পষ্ট, কেননা এদের লক্ষ্য স্থির, বিশ্বাস ধ্রুব, আচরণ সুনির্দিষ্ট, চলাচল ভক্তির পথে। সেখানে তাদের সংশয় সন্দেহ নেই। আমার পিছন পিছন দুই মাঝবয়সী বিধবা যাচ্ছিলেন বহু রকম কথা বলতে বলতে। তাঁদের আলোচনার একটা গুরুতর প্রসঙ্গ হল সঠিক গুরুনির্বাচন। চলার পথে গুরুনির্বাচনে ভুল হলে নাকি সমূহ সর্বনাশ। একজন আর একজনকে বলছেন, ‘আমি ওই কালোর দিদির মতো নাপিয়ে নাপিয়ে গুরুসঙ্গ করতে পারব না।’ এ কথা শুনে মনে হল ‘নাপিয়ে নাপিয়ে’ শব্দটার মানে যদি হয় উল্লম্ফন তবে কালোর দিদির মনের চাঞ্চল্য বোঝা যায়। অর্থাৎ তিনি কেবলই গুরু পাল্টান। সেটা খারাপ।
এ কথার জবাবে অন্য মহিলা বললেন, ‘গুরু পাওয়া কি সোজা কথা? পেরথমে লোকের মুখে সাধু কথা শুনে জন্মায় ছেদ্দা। পরে সাধুদর্শনে লোভ জাগে। সেই লোভ থেকে হয় সাধুসঙ্গ। সেই সাধুতে আসে গুরুজ্ঞান। এ সবের মূলে থাকে গুরুর কথা। আমার গুরুলাভ হয়েছে। হ্যাঁগো, তোমার গুরুলাভে শান্তি হয়েছে?’
: খুব শান্তি। নইলে তাঁর কাছে এত ব্যগ্র হয়ে ছুটে যাচ্ছি কীসের জন্যে? আমার তো অত গুপিনাথ দেখার লোভ নাই। সেখানে গুরু গেছেন, তাঁর আদেশ হয়েছে, তাই আমার যাওয়া। আমার মনের দুঃখ কী জানো? গুরুকে আমি তেমন আপন করে নিতে পারিনি এখনও। তিনি কিন্তু আমাকে আপন করে নিয়েছেন।
এ সব শুনতে শুনতে এদের স্পষ্ট পৃথক অস্তিত্ব আবার টের পাই। পিছিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে বসি, ‘আপনাদের গুরু কে? থাকেন কোথায়?’
‘ও বাবা। তুমি বুঝি আমাদের কথা শুনে ফেলেছ? কী লজ্জা। তা যাকগে। বাবা আমাদের গুরুর নাম গগন বৈরাগ্য। গুরুপাট বামুনডাঙ্গা। এখানে তিনি এসেছেন মচ্ছব দিতে। তুমি যেয়ো আমাদের আখড়ায়। খুব শান্তি পাবে। গুরু আমাদের মাটির মানুষ। কী করে আখড়া চিনবে? লোকজনকে জিজ্ঞেস কোরো, চরণ পালের আখড়া কোথায়। এখানে চরণ পালের আখড়া তো খুব নাম করা। তারি পশ্চিমে আমার গুরুর আখড়া পিটুলি গাছতলায়। হ্যাঁগো ছেলে, যাবা তো?’
কথা দিয়ে এগিয়ে চলি। বেশ পরিশ্রান্ত লাগে। একটু বসতে পারলে বেশ হত। কিন্তু তপ্ত বালির চড়ায় বসি কোথায়? শেষপর্যন্ত পৌঁছানো গেল গঙ্গার ধারে। এবারে এই ধারের পথ ধরে অন্তত সিকি মাইল হাঁটা রাস্তা শেষ হলে খেয়াঘাট। আপাতত গঙ্গার ধারে বহুলোক স্নান করছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। চোখে পড়ে এক বৈষ্ণবী স্নান সেরে, গৈরিক বাস পরে, আপন মনে একটা ছোট আয়না মুখের সামনে ধরে বসে বসে মুখে নাকে কপালে রসকলি আঁকছে। পাশে তার প্রৌঢ় বৈষ্ণব বাবাজি বসে গাঁজা সেবা করছেন। পৃথক এই মানুষটার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে জাগল। বাবাজি খাতির করে তাঁর শতরঞ্চির একটা কোণে বসতে বললেন। আঃ কী শান্তি।
এবারে শুরু হয় আমার শহুরে নির্বোধ প্রশ্নমালা। আপনারা কোন সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব? আপনাদের কোন ধারা? মাধবাচার্য না নিম্বার্ক না রামানুজ? কোথায় থাকেন? গুরুপাট কোথায়? মানুষটা গোঁফদাড়ির ফাঁকে আমার জন্যে ভরে রাখেন এক করুণার হাসি। বলেন, ‘বৈষ্ণব কি এক রকম? আমরা রাতটহলিয়া। কিছু বুঝলেন?’
: রাতটহলিয়া? মানে কী?
: মানে আমাদের কাজ হচ্ছে সারা রাত টহল দিয়ে নামগান করা।
: এমন কথা আগে শুনিনি। শুনেছি বৈষ্ণব দু রকম। নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব আর সহজিয়া বৈষ্ণব। আরও অনেক বৈষ্ণব আছে নাকি?
: আছে বইকী? আমার অজানা অনেক আছে। আর জানা বোষ্টমদের কথা শুনলেই ভিরমি খাবেন। শুনুন। জাত বৈষ্ণব আর সহজিয়ার বাইরে আমার জানিত সম্প্রদায় হল রাধাশ্যামী, রূপকবিরাজী রাধাবল্লভী, হরিবোলা, গুরুদাসী বৈষ্ণব, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, কিশোরীভজনী, গৌরবাদী আর আমাদের রাতটহলিয়া।
: এরা সব কোথায় থাকেন? চেনেন কী করে?
: লক্ষণে চেনা যায়। ক্রিয়াকরণ আলাদা। বীজমন্ত্র আলাদা। মেলা মহোৎসব আলাদা আলাদা স্থানে। যেমন ধরুন আমাদের দীক্ষামন্ত্র আর কণ্ঠিবদল হয় মোহনপুর কেঁদুলিতে।
ততক্ষণে বৈষ্ণবীর রসকলি পরা এমনকী সর্বাঙ্গে গৌর ছাপ দেওয়া সারা। কুচকুচে কালো গায়ের চামড়ায় সেই তিলক-মাটির রং ক্যাঁট ক্যাঁট করছে। তিনি আমার দিকে এক মোহিনী কটাক্ষ করলেন। আমার জানাচেনা সমাজের বাইরে এক স্পষ্ট পৃথক পারমিসিভ সোসাইটির রূপরেখা ওই কটাক্ষে আঁকা ছিল। আমি চট করে উঠে পড়ে বললাম, ‘আপনাদের কণ্ঠি বদল কত দিনের?’
বৈষ্ণবী তার আতার বিচির মতো মিশিমাখা দাঁত বার করে বললে, ‘এবারেই পৌষ মাসে আমাদের কণ্ঠিবদল হয়েছে গো। দেখে বুঝছেন না আমাদের নবীন নাগরালি? বসুন বসুন। সকালে একটু জল-বাতাসা সেবা করুন। ঘেমে তো নেয়ে গেছে অঙ্গ।’
প্রৌঢ়ের সঙ্গে যুবতীর এই নবীন নাগরালি সুস্থ মনে সওয়া কঠিন। এ মেয়ে নিশ্চয়ই. অনেক বোষ্টমকে ঘোল খাইয়েছে। আমি অবশ্য আপ্ত সাবধান আছি। বৈষ্ণব বাবাজি খুব নির্বিকার উদাসী ভঙ্গিতে গাঁজায় দম মারছেন। এ জগতের কোনও ইশারা আপাতত তাঁর কাছে খুবই মূল্যহীন। পেতলের রেকাবিতে বাতাসা আর কদমা, ঘটিতে গঙ্গাজল। বৈষ্ণবী ভক্তিভরে আমাকে নিবেদন করে এবারে চুল বাঁধতে বসলেন। সঙ্গে গানের গুনগুনুনি। সে গানের বাণী শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম:
সখি পিরিতি আখর তিন।
পিরিতি আরতি যেজন বুঝেছে সেই জানে তার চিন।
নয়নে নয়নে বাণ বরিষণে।
তাহাতে জন্মিল ‘পি’
অধরে অধরে সুধা পরশনে
তাহাতে জন্মিল ‘রি’
আর হৃদয়ে হৃদয়ে ভাব বিনিময়ে
তাহাতে জন্মিল ‘তি’।
গানের শেষে আর-এক মোক্ষম কটাক্ষ। সেই বাণ কোনওরকমে সামলে আমি উঠে পড়ি। খেয়াঘাট অদূরে। এখুনি পার হতে হবে।
মন্দিরে পৌঁছে দেখা গেল শ্রাদ্ধ শেষ। একজন বললে, ‘দেরি করে ফেললেন গো। ছেরাদ্দ এবারের মতো শেষ। আপনার দেখা হল না। গুরুবল নেই। তা কী আর করবেন? আজ তো চিঁড়ে-মচ্ছব। বসুন আমাদের আখড়ায়। দই চিঁড়ে খান।’
গোপীনাথের মন্দির-চত্বরের পাশে ঘোষঠাকুরের সমাজ ঘর। তার মানে গোবিন্দ ঘোষের সমাধি। সেখানে নাকি শ্রাদ্ধের সকালে গোপীনাথকে আনা হয় কাছা পরিয়ে। তার হাতে দেওয়া হয় পিণ্ড আর কুশ। খানিক পরে তা স্খলিত হয়ে পড়ে মাটিতে। হই হই করে ওঠে ভক্তজন। প্রধানত গোপসম্প্রদায়। মেলাচত্বরের চার দিক মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে।
সেখান থেকে এগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে মন্দিরে উঠে ভেতরে তাকাই। অপরূপ কৃষ্ণমূর্তি কষ্টিপাথরের। খুব নিপুণভাবে কাছা পরানো। এক অভিনব দৃশ্য বইকী। সারা ভারতবর্ষে কৃষ্ণমন্দির তো অজস্র। কিন্তু কোথাও কৃষ্ণ কাছা পরে তার ভক্তের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন এমন কেউ শোনে নি। পূজারি মন্দিরের একপাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আপন মনে। তাঁকে বিরক্ত করলাম নানা প্রশ্নে। জবাব এল সোজাসুজি; ‘এ হল ভগবানের ভক্তবাৎসল্যের পরাকাষ্ঠা। জগতের কোথাও এমন ঘটে নি। এই যে মূর্তি দেখছেন এ স্বয়ং বিশ্বকর্মার নিজের হাতে তৈরি। কষ্টিপাথরের মূর্তি। চোখ দুটো শাঁখের।’
বিশ্বাসী জগতের মানুষটিকে আঘাত করতে ইচ্ছে করল না আজকের দিনে। তাই প্রসঙ্গ পালটে বলি, ‘আপনারা কি বংশানুক্রমে গোপীনাথের পূজারি?’
: ঠিক তা নয়। যদ্দুর খবর শুনেছি, রাজা রঘুরামের আমলে প্রথম পূজারি ছিলেন অগ্রদ্বীপের নিত্যানন্দ ভটচাজ্জি। তাঁর হাত থেকে আমাদের বংশে পৌরোহিত্য আসে। আমরা নদীর ওপারে বহড়ার লোক। আমাদের বংশে গোপীনাথের প্রথম পুরোহিত হন মধুসূদন। তাঁর ছেলে ত্ৰয়োনিধি, তাঁর ছেলে ত্রিলোচন। তাঁর ছেলে তারাপদ। তাঁর ছেলে শ্যামাপদ। তাঁর ছেলে আমি। তা হলে ক’পুরুষ হল? ছ’পুরুষ? এই ছ’পুরুষ ধরে আমরা গোপীনাথের পূজা করছি।
: আপনার ছেলেও কি গোপীনাথের পূজারি হবেন মনে হয়?
‘কী করে বলি বলুন তো?’ পৃজারি বলেন, ‘আমার নিজেরই তো এ কাজ করার কথা নয়। আমি তো চাকরি করতাম বেঙ্গল পটারিতে। কোনওদিন কি ভেবেছি এখানে এই ফাঁকা মাঠে মন্দিরে পড়ে থাকব?’
: কীভাবে পূজারি হলেন?
: বাবাই বরাবর পুজো করতেন। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাকে তার করলেন। আমি ছুটি নিয়ে এসে কদিন সেবাপুজো চালালাম। কিন্তু বাবা আর তেমন সুস্থ হলেন না। তখন বললেন, ‘পুজোর দায়িত্বটা তুইই নে। হাজার হলেও গুপিনাথ আমাদের বাড়ির ছেলের মতো!’ কথাটা ফেলতে পারলাম না। রয়ে গেলাম। তা চার-পাঁচ বছর তো হয়ে গেল।
: কেমন লাগে?
: প্রথম প্রথম খুবই খারাপ লাগত। কলকাতার জীবনের জন্যে মন টানত। এখানটা একটা ফাঁকা মাঠ বই তো নয়। মানুষজন কোথাও নেই আশেপাশে। আমি আর গুপিনাথ পড়ে থাকি। ক্বচিৎ কদাচিৎ যাত্রী বা ভক্ত আসে। নইলে সারা দিন একা। রাতেও। ভোগ রাগ দিই, পুজো করি, বৈকালী আর সন্ধেবেলার শেতল দিই। তা ছাড়া বাল্য ভোগ। মাসে একদিন হয়তো বাড়ি যাই। ওই আছি আর কী!
: এখন আর খারাপ লাগে না তা হলে?
: গুপিনাথ রয়েছেন তো। এখন মন বসে গেছে। একটা টানই বলতে পারেন। কোথাও গিয়ে শান্তিও পাই না। ভাবি তাঁর হয়তো অযত্ন হচ্ছে। কেবল ভাবি কখন ফিরব। একটু দেখব গুপিনাথকে।
: এর কারণ কী মনে হয়?
: কারণ আর কি? গুপিনাথের মায়া সব। সাংঘাতিক মানুষ তো৷ ঈশ্বরের নরলীলা। তাঁর শক্তি কি কম? মাঝে মাঝে যেমন রাতে ঘুম ভেঙে দেখি চার দিক ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা। অথচ ফুল কই? কখনও কখনও অনেক রাতে গুপিনাথের ঘরের দরজার খিল খোলা বা বন্ধের আওয়াজ পাই। মনে হয়, রাতের দিকে উনি কোথাও যান, আবার ভোরের দিকে ফেরেন। টের পাই।
পৃথক এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী পূজারির দিকে চেয়ে বিস্ময়ের আর তল পাই না। তাঁকে এ কথা আর জিজ্ঞেস করতে পারি না যে সর্বশক্তিমান সর্বব্যাপী দেবতার কোথাও যেতে কেন খিল খুলতে হয়? বরং জানতে চাই, ‘ঈশ্বরের নরলীলার শক্তির কথা বলেছিলেন, সেটা কী ব্যাপার?’
‘আপনি ঘোষঠাকুরের ঘটনা জানেন না দেখছি’ পূজারি খানিকটা করুণা মিশিয়ে বলেন, ‘তবে শুনুন। উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশের সন্তান ছিলেন গোবিন্দ, বাসুদেব আর মাধব ঘোষ এই তিন ভাই। কাটোয়ার কাছে অজয় নদীর পারে কুলাই গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। শ্রীগৌরাঙ্গের পার্ষদ ছিলেন তাঁরা। চৈতন্য চরিতামৃতের আদিখণ্ডে লেখা আছে:
গোবিন্দ মাধব বাসুদেব তিন ভাই।
যা সবার কীর্তনে নাচে চৈতন্য গোঁসাই৷৷
তো সেই গোবিন্দ ঘোষ আর অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে একবার প্রভু চলেছেন রামকেলির দিকে। পথে যেতে যেতে যে গ্রামে দুপুর হয়ে যেত সেখানেই হত মধ্যাহ্ন ভোজন। এক গ্রামে সেদিন খাওয়া-দাওয়া সেরে মহাপ্রভু বললেন ‘একটু মুখশুদ্ধি পেলে হতো।’ সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দ গ্রাম থেকে এক টুকরো হত্তুকি জোগাড় করে তাঁকে দিলেন, আর এক টুকরো নিজের কাছে রেখে দিলেন। পরদিন মহাপ্রভুর দল পৌছাল এই অগ্রদ্বীপে। এখানে দুপুরের খাওয়া শেষ হতেই গোবিন্দ এগিয়ে দিলেন বাকি হত্তুকিটুকু। প্রভু তো অবাক। ‘কোথায় পেলে হত্তুকি?’যখন শুনলেন গতদিনের অংশ এটা, বললেন, ‘হল না। গোবিন্দ তোমার সন্ন্যাস হল না। তোমার আজও সঞ্চয় বাসনা যায়নি। তুমি গৃহস্থ হও। বিবাহ করো। থাকো এখানেই।’
‘কী আর করেন। প্রভুর আদেশ। রয়ে গেলেন। এক দিন গঙ্গায় স্নান করছেন গোবিন্দ। গায়ে কী যেন একটা ভেসে এসে ঠেকল। শ্মশানের পোড়া কাঠ নাকি? না। মনে প্রত্যাদেশ পেলেন ওটা ব্রহ্মশিলা। ওটাকে ধরো। বাড়ি নিয়ে যাও। প্রভু এলেন আবার। ওই ব্ৰহ্মশিলা দিয়ে বিগ্রহ বানাল ভাস্কর। গোবিন্দের চালাঘরে মহাপ্রভু নিজে বসালেন গোপীনাথকে। এই সেই গোপীনাথ।’
পূজারি থামলেন। আমি বললাম, কিন্তু আপনি যে তখন বললেন এ মূর্তি বিশ্বকর্মার গড়া?’
বিরক্ত পূজারি বললেন, ‘বিশ্বকৰ্মাই তো। মানুষরূপী বিশ্বকর্মা। জানেন না গোপীনাথ গড়েছিল বলে আজও দাঁইহাটের ভাস্করদের কত সম্মান? যাই হোক। গোবিন্দ তো তার. পর বিয়ে করলেন। সেবাপুজো করেন। ক্রমে পুত্র সন্তান হল একটি। ইতিমধ্যে হঠাৎ স্ত্রী মারা গেল। মহা মুশকিল। একদিকে সন্তান পালন অন্য দিকে গোপীনাথের পুজো। কোনওটাই ভাল করে পারেন না। গোলমাল হয়ে যায়। এদিকে পাঁচ বছর বয়স হলে ছেলেটি মারা গেল। গোবিন্দ শোকে পাগলমতো হয়ে গেলেন। ভাবলেন সন্ন্যাস হল না। গোপীনাথকে বললেন, ‘তোমার কথায় সংসারী হলাম। স্ত্রী নিলে, একমাত্র সন্তানকেও নিলে? যাও তোমার সেবা পুজো বন্ধ। তোমাকেও খেতে দেব না। নিজেও খাব না। আত্মঘাতী হব। দেখি তোমার বিচার।’ তখনই ঘটনাটা ঘটল।’
: কী ঘটনা?
: গোপীনাথ বললেন, ‘তোমার কি দয়ামায়া নেই? একটা ছেলে যদি দৈবগতিকে মরেই থাকে তাই বলে আর এক ছেলেকে তুমি না খেতে দিয়ে শুকিয়ে মারবে?’সটান উঠে বসে গোবিন্দ। বলে, ‘তুমি আমার ছেলে? তুমি ছেলের কাজ করবে আমার?’ কী কাজ?’ গোপীনাথ জানতে চান। গোবিন্দ বলেন, ‘শ্রাদ্ধ। ছেলে থাকলে আমার শ্রাদ্ধ করত। তুমি তা করবে?’ ‘করব। কথা দিলাম।’ সেই থেকে এই ঘোষ-ঠাকুরের শ্রাদ্ধ চলছে। প্রতি বছর তিন দিন কাছা পরে থেকে তিনি একাদশীতে শ্রাদ্ধ করেন।
: তিন দিন কেন? আমি জানতে চাই।
: বৈষ্ণবদের শ্রাদ্ধ তো তিন দিনেই হয়। কিন্তু আসল কথাটা কী ধরতে পারলেন? ভক্তবৎসল ঈশ্বরের আসল মহিমাটা খেয়াল করলেন?
: কী বলুন তো?
: নিজের ছেলে যদি বেঁচে থাকত গোবিন্দ ঘোষের তবে বড় জোর সে যে-ক’বছর বেঁচে থাকত সে-ক’বছর শ্রাদ্ধ করত বাবার। কিন্তু ভক্তবৎসল প্রভু যে এখানে পাঁচশো বছর ধরে শ্রাদ্ধ করছেন। যতদিন সৃষ্টি থাকবে ততদিন এখানে এই ঘোষ-ঠাকুরের শ্রাদ্ধ আর পিণ্ডদান করবেন গুপিনাথ। এ কী সোজা কথা? সেইজন্যে এখানকার এত মাহাত্ম্য। এত মানুষ। সব রকমের সাধু সন্ন্যেসী বাউল বৈরাগী দরবেশ অবধূত এখানে আসেন। এখানে এসেই চরণ পাল তাঁর দীনদয়ালকে পেয়েছিলেন। সেইজন্যে ওই উত্তর দিকে, চরণ পালের ‘আসন’ বসে প্রত্যেক বছর। যান দেখে আসুন।
উত্তর দিকে এগিয়ে যাই। সত্যিই নদীর ধারে চরণ পালের আসন। বসে আছেন এক ফকির। তাঁর সামনে রক্তাম্বরধারী এক সাধক। অগণিত নরনারী আসনে নিবেদন করছে দই চিঁড়ে কলা মুড়কি। আজ যে চিঁড়ে মহোৎসব।
যদিও এ সবই জানি, তবু সুযোগ পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে এসে চরণ পাল তাঁর দীনদয়ালকে পেয়েছিলেন সেই বৃত্তান্ত কী জানেন? দীনদয়ালই বা কে?’
লোকটি বলল ‘দীনদয়াল দীনবন্ধু আমাদের সাহেবধনীদের উপাস্যের নাম। আর চরণ পাল আমাদের গুরুবংশের একজন আদিগুরু। তাঁর নিবাস নদে জেলার দোগাছিয়ায়। জাতে গোপ। তিনি একদিন মাঠে গোরু চরাচ্ছিলেন, এমন সময় এক উদাসীন এসে দুধ খেতে চাইলে। গোরুর পালে বেশিরভাগ এঁড়ে আর বলদ। কেবল একটা বাঁজা গাই ছিল। চরণ তাই বললেন: ‘দুধ কোথায় পাব?’ উদাসীন বললেন, ‘ওই বাঁজা গাইতেই দুধ দেবে।’ কী কাণ্ড, সত্যিই তাই। চরণ পাল কেঁড়ে ভর্তি দুধ দুইয়ে চেয়ে দেখেন উদাসীন কোত্থাও নেই। এই যে ছিল, তবে হঠাৎ মানুষটা গেল কোথায়? খোঁজ খোঁজ। হাতে দুধের কেঁড়ে নিয়ে চরণ পাল ছোটে। দৃষ্টি এলোমেলো। কোথায় গেল উদাসীন? মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে ভর-সন্ধেবেলা এই অগ্গদ্বীপে এসে তাঁকে এই গাছতলায় পেলেন। উদাসীন সেই দুধ খেয়ে বললেন, ‘যাঃ তোর মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। তুই দীনদয়াল পেয়ে গেছিস। আজ থেকে তুই বাক্সিদ্ধ। তোর পরের ছ’পুরুষ থাকবে বাক্সিদ্ধ।’ তো বাবু, এই তো বিত্তান্ত।’
আমি বললাম, ‘বাক্সিদ্ধ কাকে বলে?’
: আজ্ঞে, যাঁর বাক্য ফলে যায়। এই যেমন ধরুন বাক্সিদ্ধ বললেন, ল্যাংড়া সেরে যাবে, বোবায় কথা বলবে, অন্ধ চোখে দেখবে, বাঁজার সন্তান হবে, তো তাই হবে। তিনি পশ্চিমে সূর্য উদয় দেখাতে পারেন। বাক্যের বলে লক্ষ লোককেও অন্ন-মচ্ছব করাতে পারেন। এই যেমন ধরুন, এখানে চরণ পালের হুকুম আছে তাই কোনওদিন এ মেলায় ঝড়জল হয় না, গাছে একটা কাকপক্ষী নেই, নেই কুকুর শেয়াল। এ সব বাক্সিদ্ধ সাধকের হেকমৎ।
: বাক্সিদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও রকম সিদ্ধপুরুষ হয় নাকি?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। তাকে বলে সাধনসিদ্ধ। আমাদের চরণ পালের শিষ্য কুবির গোঁসাই ছিলেন সাধনসিদ্ধ। তার একটা গান আছে—
সাধনেতে সিদ্ধ হয়েছি।
ভক্তিভাবেতে কেঁদে প্রেমের ফাঁদে
অধর চাঁদকে ধরেছি।
অতি যত্ন করে রত্ননিধি।
হৃদয়মাঝে রেখেছি।
ঘুচায়ে মলামাটি হয়েছি পরিপাটি
করিনে নটিখটি
খাঁটি পথে দাঁড়িয়েছি॥
বাবু, এই অগ্গদ্বীপ খুব পবিত্র স্থান। এখানে ঘোষ ঠাকুরকে নিয়ে গুপিনাথের লীলা, এখানেই চরণচাঁদ তার দীনদয়ালকে পেয়ে হন বাক্সিদ্ধ, এখানেই কুবিরের সাধনসিদ্ধি।
আমি সেই ঐশী মাটিতে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবাহিনী গঙ্গার দিকে চাইলাম। অস্তরাগবিধুর অপরাহ্ণ। সেই ম্লানতায় বর্ণরঞ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেঙেপড়া অগ্রদ্বীপের বিখ্যাত জমিদার হরি মল্লিকের বাড়ি। সে বাড়িও অস্তমুখী। আমি মনে উচ্চারণ করলাম দাশরথি রায়ের পদ:
ধরাধামে হরি মল্লিক বংশ ধন্য!
অগ্রদ্বীপ অগ্রগণ্য
যেথায় গোপীনাথের লীলা ॥
হঠাৎ অন্ধকার নেমে এল। আখড়াগুলোয় জ্বলে উঠল সাঁঝবাতি, লণ্ঠন আর হ্যাজাকের আলো। চারিদিকে অসংখ্য মানুষের কথা বলার শব্দ, একতারা দোতারা গুপিযন্ত্র আর বাঁয়ার শব্দ, মেলার ব্যাপারীদের চিৎকার, বাউল ফকিরদের শব্দগানের তান। কেবলই মনে হয়, এখন, এই অগ্রদ্বীপে প্রায় লক্ষ লোকের বসত, আর কাল বাদে পরশু সকালে আম-বারুণীর স্নান সেরে সবাই ফুরুৎ। শুধু পড়ে থাকবে এই বিরাট মাঠের শূন্যতা, পশ্চিমের গঙ্গা, কয়েকটা গাছ, ভেঙে পড়া মল্লিক বাড়ির উদাসী রিক্ততা আর পাঁচশো বছরের কিংবদন্তি-পুরুষ গুপিনাথ।
একটা আখড়ার আলোকে নিশানা করে এগোই। অন্ধকারে আর মানুষের চলমানতায় ভাল করে এগোনোও যায় না। এখনও একাদশীর চাঁদটুকু ওঠেনি। রাত বাড়বার আগে একটা জুতসই আখড়া খুঁজে না নিলে সারা রাতের খাওয়া শোওয়ার খুব দিগদারি হবে। দেখা যাক সামনের আখড়ায় একটু নাক গলিয়ে, এই ভেবে ভিড় ঠেলে মানুষের কাঁধ ডিঙিয়ে ভেতরে তাকাই। ভেতরে গানের লড়াই হচ্ছে। আমি সোজা সেঁধিয়ে যাই একেবারে আসরের মাঝখানে। ভব্যিযুক্ত চেহারা দেখে একজন বলে; ‘বাবু বসুন।’ আড় চোখে আমাকে দেখে নিয়ে গায়ক গেয়ে চলে:
জগতে ব্রহ্ম বস্তু সার।
এই ব্রহ্মা হতেই সৃষ্টি সবার।
তোমরা অন্য তত্ত্ব খুঁজো না ॥
গানটা যখন সাঙ্গ হয়ে আসে তখন এই গায়কের যে প্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক সে ধীরে সুস্থে পায়ে ঘুঙুর বাঁধে। তারপরে গান শেষ হতেই সবাই বলে, ‘কী গানের তত্ত্ব কাটান দেবে নাকিন?’
‘দেব বইকী। এ সব গানের তত্ত্ব তো আমার কাছে শিশু। হাড়িরামের কৃপায় আমার ঝুলিতে গান কি একটা?’ মানুষটা সদর্পে বলে।
হাড়িরামের কৃপা? একেবারে যাকে বলে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি বুঝলাম নিশ্চিন্দিপুরের বিপ্রদাসের বাইরেও তা হলে হাড়িরামের গাহক আছে। ‘কী নাম গাহকের?’ ‘বাড়ি কোন গ্রামে?’ আমার প্রশ্নের জবাবে গাহক বলে: ‘আজ্ঞে নিবাস বেতাই জিৎপুর। হাড়িরামের এই অধম সেবকের নাম রামদাস সরকার।’
এবারে একতারা কানের কাছে ধরে হেঁকে বলে রামদাস:
বলরামচন্দ্র হাড়ি গোঁসাই।
হাড় হাড়ডি মণি মগজ
তারকব্রহ্ম রামনারায়ণ।
জগৎপতি জগৎপিতা
হেউৎ মউতের কর্তা।
তুমি আমায় রক্ষা কর ॥
রামদাস এর পর আসরের সবাইকে উদ্দেশ করে বলে:
‘রসিক শ্রোতাগণ আর আমার মরমী পাল্লাদার গাহক বন্ধু, আমি এবারে যে গানের তত্ত্ব করব তা আমাদের হাড়িরামের নিগূঢ় তত্ত্ব। এ আসরে এতক্ষণ তত্ত্ব করা হল যে ব্ৰহ্মাই আসল। আর আমরা বলি,
আরে তা না না না না না না না না।
শুনি এক ব্রহ্মা দ্বিতীয় নাস্তি
সে কী কথার কথা হয়?
হাড়িরাম অন্য কথা কয়।
শুনি ব্রহ্মা হন সৃজনকর্তা
বিষ্ণু হন পালনকর্তা
আর শিব হন সংহারকর্তা
তবে এক ব্রহ্মা কীসে কয়?
গানটি আরও যুক্তির পথে এগিয়ে যখন শেষ হল তখন সবাই বললে, ‘বলিহারি। এ যে অকাট্য গান।’
রামদাস বললে, ‘গান অকাট্য নয়। এ গানেরও কাটান আছে। তবে সে গান গেয়ে আমি নিজের গানের কাটান তো দেব না। আমি শুধু বলি আমাদের হাড়িরামের তত্ত্ব অকাট্য। তাই বলেছে—
হাড়িরামের তত্ত্ব নিগূঢ় অর্থ
বেদবেদান্ত ছাড়া।
এ তত্ত্ব জেনে নিমাই সন্ন্যাসী
এ তত্ত্ব জেনে শিব শ্মশানবাসী।
শ্রোতাগণ, তোমরা হাড়িরামের নামে বলিহারি দাও।’
সবাই বললে, ‘বলিহারি বলিহারি বলিহারি।’
এ সব সুযোগ সাধারণত আমি ছাড়ি না। আসর থেকে রামদাস যেই বাইরে বেরিয়েছে ধূমপান করতে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ি। ইতিমধ্যে আকাশে একাদশীর চাঁদ দেখা দিয়েছে। তার আলোয় রামদাস মানুষটার স্পষ্ট নিরিখ হয়। সরু খড়েগর মতো নাক, নির্মেদ চেহারা, মাঝখানে সিঁথিকাটা চুল, চোখ দুটি সুন্দর। এ-সব মানুষের শরীর সম্পর্কে দুর্বলতা থাকেই। কথাটা তাই সেদিক থেকেই তুললাম, ‘নাকটা তো তোমার বেশ লক্ষণযুক্ত। তোমার তো এত নীচে পড়ে থাকার কথা নয়।’
কথায় চিঁড়ে ভেজে। লাজুক হেসে রামদাস বলে, ‘বাবু তবে ধরেছেন ঠিক। সবাই বলে আমার মধ্যে সাধক লক্ষণ আছে। এই গরুড় নাসা ঐহিক মানুষের হয় না। আমাদের হাড়িরামের প্রধান শিষ্য তনু, তার এমন নাক ছিল। আপনি তনুর সম্পর্কে বাঁধা গান শুনেছেন?’
‘শুনিনি তো?’ আমি বললাম; ‘আমি মেহেরপুরে গেছি, নিশ্চিন্দপুরে গেছি। বিপ্রদাসের কাছে অনেক গান শুনেছি।
‘নিমেষে রামদাস গাইল;
ত্রেতাযুগে ছিল হনু
মেহেরাজে তার নাম তনু
পেয়ে পায়ের পদরেণু
চার যুগে সঙ্গে ফেরে।
হঠাৎ গান থামিয়ে রামদাস আকাশের দিকে চেয়ে প্রণাম সারল। তারপর বিড় বিড় করে বলতে লাগল—
হাড়িরাম হাড়িরাম
স্বয়ং রামচন্দ্র পূর্ণ ব্ৰহ্ম সনাতন।
সীতাপতি হনুমানকে যেমন করে
করিলেন উৎপত্তি—
তেমনই নিজগুণে কৃপাদানে
এ অধমের করো গতি।
তুমি আমার মাতাপিতা তুমি আমার পতি
শ্রীচরণে করি এই মিনতি।
জয় হাড়িরামের জয়। জয় হাড়িরামের জয়
জয় হাড়িরামের জয়।
আমি এত দিন এত লোকধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশেছি কিন্তু কারুদেরই প্রায় পুরোপুরি বাংলা মন্ত্র নেই। সব হ্রীং ক্লিং শ্লিং বোঝাই মন্ত্র। কেবল এই হাড়িরামের মন্ত্র সব দিক থেকে ব্যতিক্রম। এরা চলতি বাংলা ভাষায় মন্ত্র বানিয়েছে। তার উচ্চারণে তাই বিশ্বাসের জোরটাও শোনবার মতো। আমি রামদাসকে এই কথা ভেবে বললাম, ‘তোমাদের মন্ত্রে সংস্কৃত নেই কেন?’
: এটা বুঝলেন না। সংস্কৃত তো বৈদিক ধর্মের ভাষা। আর হাড়িরামের তত্ত্ব বেদবেদান্ত ছাড়া। তার বাদে আরও যুক্তি আছে।
: কী রকম?
: আমরা তো অনুমানের সাধনা করি না। আমাদের সব বর্তমান। তো বাংলা ভাষা তো বর্তমান। এই তো আপনি-আমি তাইতেই কথা কইছি, নাকি বলেন? আর সংস্কৃতে কি কেউ কথা বলে? ওটা অনুমানের ভাষা।
চমৎকার অনুমান-বর্তমান তত্ত্বের একটা নতুন ভাষ্য পাওয়া গেল যা হোক। হাড়িরামের লোকেরা বেশ মেধাবী আর বিচারশীল দেখছি। তার একটা কারণ হল এ সম্প্রদায় বহু দিন ধরে বৈষ্ণব আর বাউলদের থেকে আলাদা পথে চলেছে। পদে পদে তাদের সঙ্গে তাত্ত্বিক লড়াই করে তবে হাড়িরাম তত্ত্বকে টেকাতে হয়েছে। এই যেমন আজকের শব্দগানের আসরে ‘এক ব্রহ্ম দ্বিতীয় নাস্তি’ তত্ত্বটা রামদাস তাদের গানে চমৎকার কাটান দিল। অবশ্য আমি রামদাসকে সত্যি কথাটা বললাম না যে, ব্ৰহ্ম আর ব্রহ্মা এক নয়। লৌকিক গাহকের অতখানি জ্ঞান থাকে না। তারা খানিকটা শব্দের ফেরে বা বাক্যের ধন্দেও পড়ে যায় কখনও কখনও। যাই হোক, আমার কাজ এখন রামদাসের পেট থেকে কথা বার করা। তাই প্রশ্ন তুললাম, ‘রামদাস, তোমাদের ধর্মে তো গুরু নেই।’
কথা শেষ হবার আগেই রামদাস বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের গুরু নেই বাউল বোষ্টমদের মতো। আমাদের এক তত্ত্ব হাড়িরাম। সে আবার—
কোটি সমুদ্র গভীর অপার
যে জানে সে নিকট হয় তার
কলমেতে না পায় আকার
শুদ্ধ রাগেই করণ ॥
তো সেই হাড়িরামের তত্ত্ব রাগের পথে জানতে হয়। বুঝতে হয় তিনিও যা আমিও তা। তবে তফাত আছে। তিনি কিঞ্চিৎ ঘন/আমি কিঞ্চিৎ কণ।’
: তার মানে?
: তার মানে তিনি কিছুটা ঘন-গভীর আর আমি তার কণ মানে কণা। তবে তাই বলে নিতান্ত ফেলনা নই। হাড়িরামের মহিমা যে জেনেছে সে কি ফেলনা হতে পারে?
আমি বললাম, ‘তোমাকে যে কথাটা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম তা এই যে, তোমার তো গুরু নেই তা হলে এত কথা শিখলে কোথায়?’
: আজ্ঞে হাড়িরামই বলাচ্ছেন। তাঁরই হেকমৎ। তবে হ্যাঁ, সঙ্গও করেছি বইকী। আপনি তো নিশ্চিনপুরে গেছেন, সেখানে পূর্ণদাস হালদারকে দেখেছেন?
: হ্যাঁ, দেখেছি বইকী। অবশ্য তখনই তার অনেক বয়েস।
: তিনি দেহ রেখেছেন। তো সেই পূর্ণ হালদারের সঙ্গে আমি অনেক ঘুরেছি সেই কোথায় কোথায়। ধাপাড়া, ধোপট, পলশুণ্ডো, কোমথানা, হাঁসপুকুর, বান্নে, ফুলকলমী। সব ঘুরে ঘুরে কত তক্ক-বিতক্ক শুনেছি বোষ্টমদের সঙ্গে বাউলদের সঙ্গে। তার থেকেই আপ্তজ্ঞান হয়েছে। এখন আমিই বেশ তক্ক করতে পারি। একটা ঘটনা শুনবেন?
: বলো।
: সাহেবনগরের ফণী দরবেশের নাম শুনেছেন তো? তার ঘটনা। সেই সাহেবনগরের কাছেভিতে এক বোষ্টমদের আখড়া আছে। সেখানে একদিন তারক ব্রহ্ম নাম হচ্ছে। আমি তখন ফণী জ্যাঠার বাড়ি কদিন রয়েছি। তো জ্যাঠা বললে, ‘চল নাম শুনে আসি। নামেই তো মুক্তি।’ গেলাম দুজনে। নাম শুনলাম। তারপর বোষ্টমরা সব নিতে বসল সার বেঁধে, মালসাভোগ। আমরা তো বোষ্টমদের মালসাভোগ নেব না।
‘কেন?’ আমার খটকা লাগল ‘প্রসাদে আপত্তি কী?’
‘ও, আপনি বুঝি নিষেধবাক্য জানেন না?’ রামদাস খুব আত্মপ্রসাদ নিয়ে বলল, ‘তবে খেয়াল রেখে শুনুন:
না করিব অন্যদেবের নিন্দন বন্দন।
না করিব অন্যদেবের প্রসাদ ভক্ষণ ॥
বাস। সাফ কথা।
: তখন কী হল?
: যতই ওরা মালসাভোগের সেবা নিতে বলে ততই ফণী জ্যাঠা না না করে। আসল কথাটা, মানে হাড়িরামের নিষেধের কথা তো বলতে পারে না। পাছে ওরা আঘাত পায়। কিছুতেই শেষপর্যন্ত পার পাই না আমরা। একজন বোষ্টম হুল ফুটিয়ে বললে, ‘সেবা ধর্মে আপত্তি কীসের? আমাদের ঘেন্না কর?’ জ্যাঠা আর সামলাতে না পেরে বললে, ‘কথাটা কি তুমি না বলিয়ে ছাড়বে না বাবাজি? তবে শোনো। প্রশ্ন হল, সে তো নেব কিন্তু দেব কাকে?’ শুনে তো বাবাজি থ। বলে, “বাপরে, তোমার কথার তো খুব ভাঁজ আছে? চলো তোমাকে মোহান্তের কাছে নিয়ে যাই।’ নিয়ে গেল আমাদের দুজনকে মোহান্তের কাছে। বাবু, মোহান্ত বোঝেন তো?
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। তা বুঝি। মানে ওই আখড়ার যিনি প্রধান বৈষ্ণবগুরু।’ রামদাস বললে, তাঁর কিন্তু খুব মান্যতা! তেমনই চেহারা। একেবারে যাকে বলে কি না ঘৃতপক্ক। সংসারের আঁচ তার গায়ে লাগেনি। তাঁকে বাবাজি সব সাতকাহন করে তো বলল। তিনি সব শুনে হাসলেন, তারপর চাঁদির চশমা পরে খানিকক্ষণ জ্যাঠাকে নিরীক্ষণ করে পরিহাস করে বললেন, ‘সাধনার পথে তুমি খানিক কাঁচা রয়েছ দেখছি। তা এই যে আমরা দুজন বসে আছি, আমাদের তফাত কোথায়? দুজনেই তো মানুষ, ভক্ত, সেবক। তা হলে?’
: তখন ফণী দরবেশ কী জবাব দিলে?
: ও, সে মোক্ষম জবাব। বললে, ‘আপনাতে আমাতে বসে আছি বটে, তবে অনেকটাই তফাত। কেমন তফাত শুনবেন? আপনি বসে আছেন যে পাটিতে, তার ওপর রয়েছে ধোকরা, তার ওপরে কাঁথা, তার ওপরে চাদর। এত সব কিছুর ওপরে আপনি। আর আমি মাটিতে জন্মে এই মাটিতেই তো বসে আছি। আপনাতে আমাতে তফাত নেই?’
: তারপর কী হল?
: মোহান্ত চুপ মেরে বসে রইলেন খানিক। তারপরে একটু পরে বললেন, ‘যাই হোক, সেবা নেবে না কেন? সেবা দেবার লোক পাচ্ছ না? কেন? পরমাত্মাকে সেবা দাও। কী? জবাব নেই যে? হেরে গেলে তো এবার?’ জ্যাঠা আমাকে টোকা মেরে বললে, ‘কী রামদাস? এ কথার কী জবাব হবে বলো দেখি?’ আমি হাড়িরামকে স্মরণ করে বললাম, ‘মোহান্তজি, এই মালসাভোগ তো আপনার পরমাত্মাকে উৎসর্গ করেছেন, তো সেই এঁটো জিনিস কেন আমার পরমাত্মার সেবায় দেব বলুন?’ মোহান্ত চুপ। জ্যাঠা বললে, ‘সাবাস রামদাস। বলিহারি। তুই হাড়িরামের মুখ রেখেছিস।’
একাদশীর রাতে এমন একটা মোক্ষম তর্কসভার বিবরণ শুনে আমি তো রীতিমত শিহরিত। সত্যি কথা, কোন ফুঁপি থেকে কোন কথা যে এসে পড়ে। হাড়িরামের সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈষ্ণবদের যে এত আড়াআড়ি তা জানতাম না। ব্যাপারটা কৌতূহলজনক। আর একটু গভীরে যাবার জন্যে আমি রামদাসকে উস্কে দিয়ে বললাম, ‘তোমার জ্ঞানবুদ্ধি তো ফণী দরবেশের চেয়েও পাকা মনে হয়। বলো দেখি বৈষ্ণবদের সঙ্গে তোমাদের প্রধান তফাত কী?’
রামদাস বলে, ‘ওদের পঞ্চতত্ত্ব, জপতপ আর তুলসীমালা। আমাদের ও সব নেই। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আখড়াধারী বোষ্টমদের যা নিয়ে বাধে তা এই যে ওরা প্রকৃতির ছায়া মাড়ায় না আর আমরা গৃহী।’
আমি বললাম, ‘প্রকৃতি সাধনা না করলে ক্ষতি কী? নিষ্কাম ধর্ম নেই?’
: আজ্ঞে, প্রকৃতিকে কি এড়ানো যায়? নিষ্কাম বৈষ্ণবের কি স্বপ্নদোষ হয় না? সে স্বপ্নদোষ কি প্রকৃতি দেখে হয়, না পুরুষ দেখে? বাবু, আপনি কিন্তু আমাকে চটিয়ে পেটের কথা বার করছেন। আমি এবারে আপ্ত সাবধান হব কিন্তু।
আমি হেসে বললাম, ‘যাঃ। বুঝে ফেলেছ। তা হলে এখন আর কথা নয়। কথা হবে আবার রাতে। এখন একটা গান শোনাও। কিন্তু তোমাদের হাড়িরামের গান নয়। ও গানে বড় তত্ত্বের কচকচি। তুমি অন্য গান গাও।’
রামদাস বলল, ‘এমন একটা গান গাইছি যাতে আপনি বোষ্টমদের স্বরূপ বুঝে ফেলবেন খুব সহজে। শুনুন। এ গান আমাদের নয়, তবু আমরা গাই—
নদের গোরা চৈতন্য যারে কয়
সে শাক্ত ভারতীর কাছে শক্তি মন্ত্র লয়।
পরে গিয়ে রামানন্দের কাছে
বাউল ধর্মের নিশানা খোঁজে
তবে তো মানুষ ভজে পরমতত্ত্ব পায়।
বাউল এক চণ্ডীদাসে।
মানুষের কথা প্রকাশে
সেই তত্ত্ব অবশেষে বৈষ্ণবেরা নেয়।
মর্কট বৈরাগী যারা
এক অক্ষরও পায় না তারা
গীতা ভাগবত শাস্ত্র পড়া পণ্ডিত সবায়।
তিলক মালা কৌপীন আঁটার দল
জানে শুধু মালসা ভোগের ছল
দিন রাত কিছু না বুঝে মালা জপে যায় ॥
রামদাসের সঙ্গে আবার হাড়িরাম-বৈষ্ণব বিরোধের কথা তুললাম রাতের খাওয়া দাওয়ার অনেক পরে। তখন সমস্ত মেলাটা ঝিমিয়ে পড়েছে। রাত এগারোটা হবে। অত্যুৎসাহী কয়েকটা আখড়ায় শুধু গান হচ্ছে। ও সব বেশির ভাগ গেঁজেলদের আসর। তাদের গানে মাথামুণ্ডু থাকে না—অভিজ্ঞতায় দেখেছি। আসলে নিশি পোহালেই সব আখড়ায় অন্ন-মচ্ছব হবে। তার ব্যবস্থা করা কি চাট্টিখানি কথা? তাই সবাই যথাসম্ভব বিশ্রাম আর ঘুম সেরে নিচ্ছে। আমার ঘুম নেই। মেলায় আমি ঘুমোতে পারি না। অগত্যা রামদাসকে ভর করি। সে বসে বসে হাড়িরামের নাম জপ করছে। সরাসরি বলি ‘তোমার পেট থেকে কথা বার করবার জন্যে নয়, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি জানতে চাই বৈষ্ণবদের সঙ্গে তোমাদের এত বিরোধ কেন? বোধহয় হিংসে, নয়? ওরা যে সংখ্যায় বেশি। তোমরা আর কজন?’
রামদাস খুব বেদনাহত মুখে বলল, ‘বাবু, আপনি জ্ঞানী মানুষ। সংখ্যা দিয়ে কি সত্য-মিথ্যার বিচার হয় কোনওদিন? হয়তো মূলে কর্তা হাড়িরাম চন্দ্রের সঙ্গে সেকেলের বোষ্টমদের বেধেছিল। কোনও বিরোধ কি বাধতে পারে না?’
‘হ্যাঁ, তা হতে পারে’ আমি ভেবে বলি, ‘প্রথমত বৈষ্ণবেরা দ্বৈতবাদী, তারা শ্রীকৃষ্ণকে সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ বলে মানে, নিজেরা থাকে ভক্ত হয়ে। আর তোমাদের ধর্ম অনেকটাই অদ্বৈতবাদী। হাড়িরাম তো নিজেকেই স্রষ্টা বলেছেন। এটা বৈষ্ণবেরা মানবে কেন? তারা তো মানুষ ভজে না। তারা অবতারতত্বে বিশ্বাসী। তারা কিছুতেই হাড়িরামকে অবতার বলে মানবে না?’
‘তবে আমরাও তাদের মানব কেন?’ রামদাস যেন বিদ্রোহীর মতো ফুঁসে ওঠে। ‘ওসব তিলকমালা রসকলি চন্দনের ছাপ আর ডোর কৌপীনে কী ভগবান থাকে? ওদের কাণ্ড তো জানি। মুখে বলে সব জাতি এক এদিকে বামনাই কি কিছু কম? ওদের সব ভাগ আছে তা জানেন? ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব, চামার বৈষ্ণব, নেমো বৈষ্ণব, টহলিয়া নানান ভাগ। তবে গৌরাঙ্গের মূল কথাটার মানে দাঁড়াল কী? আচণ্ডাল কি ওদের এক? তা হলে সহুজে বোষ্টমদের ওরা মানে না কেন? আসল ব্যাপারটা কী জানেন, সব বিটলে বামুনদের কারসাজি।
রামদাস গায়:
মানুষ মানুষ সবাই বলে
ও ভাই কে করে তার অন্বেষণ?
পঞ্চম স্বরে মনের সুখে ডাকেন তারে ত্রিলোচন।
বাধা দিয়ে আমি বলি, ‘এ গান আমি বিপ্রদাসের গলায় শুনেছি। এতে আর গোলমাল। কোথায়? এর তত্ত্ব খুব সোজা।’
অভিমানভরে রামদাস বলে, ‘তবে ওই গানের এ জায়গাটা শুনুন:
রাসলীলা হয় বৃন্দাবনে
জানে কোন ভাগ্যবানে
রাধাকৃষ্ণ নাহি জানে
নাহি জানে গোপীগণ ॥
কিছু বুঝলেন?’
: আলাদা করে কিছু বোঝবার আছে নাকি এখানে?
আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে রামদাস বলে, ‘এইখানটায় আসল তত্ত্ব। বৈষ্ণব কীর্তন করে বৃন্দাবনলীলা। তাতে কৃষ্ণ রাধা গোপীগণ থাকে। কিন্তু কৃষ্ণ মূলে যে বৃন্দাবনলীলা করেনই নি।
: সে কী?
: হ্যাঁ। ভেবে দেখুন, ব্রহ্মা সৃজনকর্তা। তাঁর স্থান আমাদের মস্তকে। বিষ্ণু হলেন পালনকর্তা। তাঁর স্থান বক্ষে। শিব হলেন সংহারকর্তা। তাঁর স্থান লিঙ্গে। বৃন্দাবনলীলা কী বলুন তো বাবু?
: সে কি যোনি-লিঙ্গে সঙ্গম?
: বিলক্ষণ। তা হলে বক্ষস্থলে থেকে কৃষ্ণ কী করে বৃন্দাবনলীলা করেন? করেন না। বৃন্দাবনলীলার আস্বাদ বা রূপ তবু কিঞ্চিৎ জানেন মহেশ্বর। কিন্তু কৃষ্ণ রাধা গোপীগণ বৃন্দাবনলীলার কী জানেন? এইখানে বোষ্টমদের মস্ত বড় ভুল। সে ভুল ধরিয়ে দেন আমাদের হাড়িরামচন্দ্র। কে বুঝিবে হাড়িরাম এ ভুবনে তব মহিমে?
মাঝরাতের ভাঙা চাঁদ যেমন অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে অগ্রদ্বীপের এই মেলার মাঠের দিকে, আমি তেমনই অবাক হয়ে রামদাসের দিকে চেয়ে রইলাম। এতগুলো নির্বাচন, সবুজ বিপ্লব, পঞ্চায়েত, পারমাণবিক সন্ত্রাস, বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশল, জন্মনিয়ন্ত্রণ, বিশ্বায়ন, দূরদর্শনের সাম্রাজ্যবাদ এদের বিশ্বাসকে এতটুকুও টলাতে পারেনি? মেলার এতগুলো মানুষের গাঢ় ঘুমন্ত শরীরে এমন গভীরভাবে মনও রয়েছে ঘুমিয়ে? আমার তুলনায় এরা এতটাই স্পষ্ট আর পৃথক আরেক জগতের অধিবাসী? সকাল হলেই এই বিপুল সংখ্যাধিক্য মানুষের জেগে ওঠার পর তাদের স্থির বিশ্বাসের অভিঘাতে আমি কতটা বিধ্বস্ত হয়ে যাব সেই আশঙ্কিত ভাবনায় মেলা ছেড়ে পালাই। কেবলই পালাই।
*
সেই পালানো আর এবারের এই গত চৈত্রে অগ্রদ্বীপ যাওয়া, মাঝখানে দশ বছর কখন খেয়ে গেছে। অবশ্য মাঝখানে একবার এসে দু রাত্তির কাটিয়ে গেছি শরৎ ফকিরের সঙ্গে এই মাঠেই। কিন্তু এবার এসে কী দেখলাম? চরণ পালের ঘরসমেত সেই বিরাট কদমগাছ আর তার চারপাশের অন্তত চল্লিশ বর্গগজ এলাকা একেবারে গঙ্গাগর্ভে।
হঠাৎ দেখলে একটু ধন্দ লাগে। ঠিক যে চত্বরে আগে এসে বসেছিলাম, যেখানটায় রামদাস বুঝিয়েছিল বৃন্দাবনলীলার রহস্য, সেখানটা জলের তলায়? সাহেবধনী মত বা বলা হাড়ির ঘরও এই রকম করে সমাজের অতল তলে সুনিশ্চিতভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বোধ হয়। তার মানে ক্রমশ মানুষ থেকে মানুষের ফুঁপি বার করা কঠিন হয়ে যাবে। ভাঙা মন জোড়া লাগিয়ে তবু আবার খুঁজি মানুষেরই সূত্র। প্রথমে এসে দাঁড়াই চরণ পালের আস্তানায়। ঘরটা তো নেই। করোগেটের টিন আর পলিথিনের ত্রিপল টাঙিয়ে টেম্পোরারি আস্তানা গেড়েছেন এবারকার সাহেবধনী ফকির। শরৎ ফকির দেহ রাখায় ইনিই এখন নতুন ফকির। বসেছেন ফকিরি দণ্ড বুকে নিয়ে সাদা চাদরের ঘোমটা টেনে, যা নিয়ম। বসেছেন নতুন কেনা পাটিতে। তাতে জমছে ভক্তদের ছুড়ে দেওয়া টাকা আধুলি সিকি দশ পয়সা আর নোটের রাশি। সম্বৎসরের রোজগার। হঠাৎ সেই করোগেটের টিনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসেন সুতোষ পাল। পুরনো আলাপী। ইনি চরণ পালেরই বংশ। তবে ফকিরি পথে নামেননি। সাহেবধনীদের মূল আসন বৃত্তিহুদাতেও থাকেন না। থাকেন নতুনগ্রামে। সেখানে দীনদয়ালের পূজা হয় বংশানুক্রমিক।
সুতোষবাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার? হঠাৎ এত বছর পরে? নতুন কোনও গবেষণার সুত্র পেলেন বুঝি?’
আমি বলি, ‘লোকধর্মের গবেষণা তো অন্তহীন। এবারে এসেছি দেখতে অগ্রদ্বীপের মেলা দশ বছরে কতটা পালটালো। এখানে এসেই তো ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি। গঙ্গার ভাঙন এতটা?’
: ফরাক্কার জল ছাড়ার ফল। ওপারে আরও বেশি ভাঙন হয়েছে বলে শুনেছি। আসুন। আমার তাঁবুতে জিনিসপত্র রাখুন। এখানেই দুটো সেবা হোক। কী রাজি? বেশ বেশ।
অবশ্য তখনও তাঁবু তৈরি হয়নি। নিমেষে চারজন গ্রামীণ মানুষ চারটে বাঁশ পুঁতে তাতে পলিথিন শিট বেঁধে আচ্ছাদন করল। এবারে বসা দরকার। কিন্তু কীসে বসা হবে? সঙ্গে সঙ্গে বাবুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে একজন কিনে আনল একটা মাদুর। তাতে বসে আমার মনে হল অগ্রদ্বীপে বেশ একটা বাউণ্ডুলে বোহেমিয়ান ভাব আছে। অর্থনীতিতে যাকে বলে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ফেসিলিটি’ তা এখানে কিছু নেই। শুধু কিছু মাটির হাঁড়ি কলসি আর জ্বালানির ডালপালা ছাড়া আর কিছু মেলে না। সবই তাই বয়ে আনতে হয়। অবস্থাটা বেশ মজার। যেমন সুতোষ পালের তাঁবুতে মাদুর পেতে বসেই বললাম, ‘খুব জল তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল পাওয়া যাবে?’
সঙ্গে সঙ্গে একজন ছুটল টাকা নিয়ে। ফিরে এল একটা কলসি আর সরা কিনে। তাতে জল আনা হল গঙ্গা থেকে। জল খেয়ে প্রাণটা বাঁচল। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ সামনের মানুষটি, যার নাম রমজান, এগিয়ে দিল একখানা সদ্য কেনা হাতপাখা। বলল, ‘এটা হুকুম হবার আগেই কিনে আনলাম। আপনি যা তোয়াজি মানুষ।’ লজ্জা পেলাম। সুতোষবাবু বললেন, “আজ অন্ন-মচ্ছব। তার এখন অনেক দেরি। কিছু খেতে হবে আপাতত, কী বলেন?’
কী আর বলি? মুখ ফুটে সে কথা কি জানান দেবার বয়স আছে আমার?
‘ওহে, মোজাম্মেল, কিছু আছে নাকি তোমার?’ সুতোষ পাল হাঁকলেন, ‘দাও দেখি কিছু খেতে।’
: আজ্ঞে, আছে বইকী। বাড়ি থেকে এনেছি টাটকা মুড়কি বানিয়ে আর চেঁকিতে কোটা চিঁড়ে। সেবা হোক বাবুদ্বয়।
আমি বললাম, ‘বাঃ, দীনদয়াল ভালই জোটালেন।’
শুকনো চিড়ে-মুড়কি খেয়ে তারপর একপেট গঙ্গাজল। আঃ, খুশির উদ্গার উঠল একটা। রমজান বলল, ‘বাবু যা খেলেন একেবারে সিমেন্টের ছল্যাব ঢালাই হয়ে গেল পেটের মধ্যে। বেলা দুটো পজ্জন্ত নিশ্চিন্তি।’
আমি হেসে তাদের কাজ দেখতে লাগলাম। চারজন মানুষ। রমজান, মোজাম্মেল, ফড়িং আর বদন। সুতোষ পালের নতুনগ্রামের ধান-পাটের জমি ভাগে চাষ করে। এখানে তাদের না-আসলেও চলে। তবু আসে কেন? আমাকে চুপিসারে বলে মোজাম্মেল, ‘বাবু কেনাকাটায় গেছেন, এই ফাঁকে বলি, আসি বাবুর টানে। না এলে উনি তো এখানে খেতে শুতে বসতে পাবেন না। তাই আসা। এ তো এক পুরুষের নয়। ওঁর বাবা তার বাবা সব আমলেই কেউ-না কেউ আসবেই। আমার বাবা চাচারাও আসত। সেটাই নিয়ম।
: উনি যেখানেই যান সেখানেই তোমরা সঙ্গে যাও নাকি?
জিভ কেটে ফড়িং বলে, ‘সব জায়গায় যাওয়া আর রগ্গদ্বীপ কি এক? এ হল সিদ্ধ জায়গা। এখানকার মহিমে মাহিত্ম্য আলাদা। সত্যি কথাটা তবে বলি বাবু। আমরা এই সুযোগে এসে দীনদয়ালের অন্ন-মচ্ছবও একটু ভোগ করে যাই। এখানে তো হিন্দু মুসলমানে কোনও তফাত নেই। রগ্গদ্বীপে সবাই সমান। তুমি সব আখড়া ঘুরে ঘুরে দ্যাখো। হিন্দু রাঁধছে বা মুসলমানে রাঁধছে আর সবাই গোল হয়ে বসে খাচ্ছে।’
: তোমাদের দুজনের নামে তো বোঝা যাচ্ছে মুসলমান। আর দুজন কি হিন্দু?
: আজ্ঞে ফড়িংটা হিদুঁ আর বদনটা মুসলমান। বদন বিশ্বেস। ভাল কথা হ্যাঁরে ফড়িং, তোর ভাল নামডা কী রে?
ফড়িং জাঁক করে বলে, ‘আমার নাম গোবিন্দচন্দ্র মণ্ডল।’
‘বাপরে, নামের দাপ আছে’ বদন বলে, ‘তোর ফড়িং নামটাই ভাল। যেমন ধারা চেহারা তেমন নাম।’
ফড়িং বলল, ‘ বদ্না, তোর বাপের নাম মদনা। তুই আমার মাঠে যাবার বদনা।’
‘এই এখানে অশৈল কথা রাখ,’ মোজাম্মেল বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই শাসন করে, ‘কাজ কর। হাত চালা। তোদের কোনও কাঁক কাঁকর জ্ঞেয়ান নেই। রগ্গদ্বীপে এসেও মুখখিস্তি। মাটি কাট।’
বসে বসে দেখি, কোদাল দিয়ে প্রথমে লম্বা করে ড্রেনের মতো মাটি কাটা হল। তাতে পাশাপাশি তিনটে নতুন হাঁড়ি বসিয়ে দেখে নিল ঠিকমতো কাটা হয়েছে কি না। রমজান বলল, ‘বাবু, একে বলে জোল। ওপরে হাঁড়ি থাকবে, নীচ থেকে অড়র গাছের পালা দিয়ে জ্বাল হবে।’
আমি বললাম, ‘একটা জোল কত বড় হতে পারে? মানে সবচেয়ে বেশি কটা হাঁড়ি ধরে?’
: ধরুন দশটা। সারা দিনমান আছেন তো? একটু পরেই দেখতে পাবেন চরণ পালের আখড়ার জোল কাটা হবে। পর পর চারখানা পাশাপাশি। একেবারে চল্লিশখানা হাঁড়ি বসবে। দীনদয়ালের অন্ন-মচ্ছব। তার প্রসাদ এখানকার সব্বাই এটুখানি পাবে। সে পেসাদ রান্নার সাহিত্যও আলাদা। আমরা পারব না।
: কেন?
: শরীলে শক্তি চাই। মনে ভক্তি চাই। চাই দীনদয়ালের কৃপা।
: কারা রাঁধবে?
: সেই চরণ পালের আমল থেকে হয়ে আসছে একই ধারা। দেবগ্রামের কাছে একটা গেরাম আছে কমলবাটি। সেখানকার ভক্তরা দীনদয়ালের অন্ন-মচ্ছব পাক করে চিরকাল। ওদের ওপর দীনদয়াল গোপ্ত বাবাজির কৃপা আছে।
: কী রকম?
: বাবু, বললে বিশ্বাস করবেন না। এই সব পাঁচ সের চালের বড় বড় গরম ফুটন্ত হাঁড়ি ওরা কোনও ন্যাকড়া ন্যাতা না নিয়ে শুধু হাতে নামিয়ে ফেলে।
: গরম তাত ছ্যাঁকা লাগে না?
: আশ্চর্যি। একটুও গরম লাগে না। অথচ দেখবেন আমরা যখন এখানে রাঁধব, মেটে হাঁড়ি তেতে একসা হয়ে যাবে।
অবাক লাগে শুনে। এর আগে অগ্রদ্বীপ এসেছি অথচ এ সব শুনিনি। শুনিনি, কেননা তখন ছিলাম শরৎ ফকিরের অভিজাত সঙ্গসুখে। একেবারে মাটির মানুষের সঙ্গে না মিশলে তো মাটির খবর মেলে না। এই যে চারটে অর্জ্ঞমূর্খ কৃষিজীবী আমার সামনে কথা বলে যাচ্ছে আবার হাতের নিপুণতায় কেটে যাচ্ছে জোল, আরও নানা গর্ত, সানুপুঙ্খ নানা নেপথ্য বিধান নীরবে ঘটাচ্ছে এই সব দীনদয়ালের দীনাতিদীন সেবকদের অংশগ্রহণেই আসল মেলা জমে ওঠে। দেখছি তিনটে গর্ত কেটে তারা নিকিয়ে নেয় সুন্দরভাবে। আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই, তিনটে গর্ত কী হবে?
: আজ্ঞে, একটায় ভাত, একটায় তরকারি।
সে কী? গর্তে রাখবে? কাদা লেগে যাবে না?
: কিচ্ছু হবে না। এ তো রাঢ়ের মাটি। একেবারে পাথর। তার ওপর দীনদয়ালের মাহিত্ম্য। খাওয়ার সময় ধরতেই পারবেন না।
বদন গর্ত তিনটে নিকোয়। ফড়িং তাতে হলুদ গুঁড়ো ছিটোয়। হলুদ গুঁড়ো কেন? বদন বলে, মাটির দোষ কেটে যাবে।
শ্রমক্লান্ত মানুষগুলি এবার একটু বসে। তাদের গা দিয়ে কুল কুল করে ঘাম ছোটে। গামছা দিয়ে মোছে আবার গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খায়।
গঙ্গার দিকে মুখ করে দুজনে বসি এক অতি প্রাচীন বটগাছ তলায়। এদিকটায় মেলায় যাত্রী বেশ কম। একটু ফাকা ফাকা। আমি সুতোষ পালকে বললাম, ‘আপনি তো উচ্চশিক্ষিত মানুষ। এখানে বছর বছর আসেন কীসের টানে?’
: বলতে পারেন এটা আমাদের পারিবারিক দায়িত্ব। আমরা সরাসরি চরণ পালের বংশ। এখানকার অন্ন-মচ্ছবে থাকাটা আমাদের কর্তব্য। যাতে সুষ্ঠুভাবে ভোগরাগ হয়, সবাই সেবা পায়, এ সব তো দেখতে হবে? তা ছাড়া আমার বাবার আদেশ। বাবা তো আসতেন! তাঁর অবর্তমানে আমিই আসি। মনে খুব শান্তি পাই। আবার মোজাম্মেল রমজানরাও খানিকটা তাড়িয়ে আনে। ওরা চোতমাস পড়লেই ভ্যানর ভ্যানর করতে থাকে। বাবু, যাবেন তো রগ্গদ্বীপ?
: আচ্ছা, ওদের এত কেন উৎসাহ বলুন তো? ওরা তো আপনাদের মতো দীনদয়ালের সাধক নয়, শিষ্যও নয়।
: এ রহস্য বোঝা শক্ত। এখানে কী একটা আছে। একটা টান। ধর্ম টর্মের ব্যাপার খুব গৌণ। ওরা দারুণ কষ্ট করে আসে। ভূত-খাটুনি খাটে। জোল কেটে রান্না করে। আবার সব গুছিয়ে-গাছিয়ে নিয়ে ফেরে। তবু আসে। বলে, ‘বাবু দীনদয়ালের অন্ন-মচ্ছব না সেবা করলে মনটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে।’ এ সব কি যুক্তি দিয়ে বোঝা যাবে?
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনাদের বাড়িতে তো দীনদয়ালের আসন আছে। তার পুজো কে করে?’
: সাধারণত দাদা করেন। ছুটিছাটায় স্কুল বন্ধ থাকলে আমিও করি। তবে বেস্পতিবারে আমাদের বিশেষ পুজো। আর দশুই চৈত্র আমাদের দীনদয়ালের বিশেষ প্রসাদ ভোগ। সেদিন তাকে পাঁচ সিকের মিষ্টি নিবেদন করি। সেটাই নিয়ম। পাঁচ সিকে, তার বেশিও নয় কম নয়।
: আচ্ছা কোনও শিষ্য যদি কোনওদিন কিছু নিবেদন করে?
: হ্যাঁ, তার মান্সার জিনিস আমরা নিবেদন করে দিই।
: সাধারণত কী তারা দেয়?
: জল মিষ্টি কি পায়েস। কি সাধারণ চিঁড়ে দই সন্দেশ। হ্যাঁ, ভাল কথা মনে পড়েছে। কেউ কেউ মাংস পরোটাও দেয়।
: ‘মাংস পরোটা’? আমার অভিজ্ঞতাও এবারে টাল খায়। কোনও লৌকিক দেবতাকে মাংস পরোটা উৎসর্গ করার কথা কখনও শুনিনি। তবে কি এর পিছনে কোনও ইসলামি বিশ্বাস কাজ করে? সাহেবধনীর ‘সাহেব’ তো স্পষ্টই ইসলামি অনুষঙ্গ আনে। সন্দেহটা সুতোষবাবুকে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘মুসলমান ধর্মের ভালমতো প্রভাব আছে আমাদের ঘরে। মুসলমান শিষ্যও তো আমাদের ঘরে বহুজন। আসলে এ সব হিন্দু-মুসলমানে মিলে গড়েছিল মনে হয়।’
আমি জানতে চাই, ‘আচ্ছা, আপনাদের নিত্যপুজোয় এমনকী কিছু লক্ষ করেছেন যা মুসলমানদের ধর্মাচরণের সঙ্গে মেলে?’
: তা হলে শুনুন। আমাদের ঠাকুরঘরে দীনদয়ালের শয্যা আছে। তাতে মশারিও থাকে। দীনদয়ালের সব কিছু দক্ষিণমুখো আর আমরা তাঁর পুজো করি পশ্চিম দিকে মুখ করে। এ রীতি কি মুসলমানি নয়?
: হ্যাঁ। ঠিক তাই। আচ্ছা, আপনাদের রোজকার কৃত্য কী কী? ঠাকুরঘরে?
: প্রতিদিন দীনদয়ালের হুঁকো আর লাঠি তেল জল মাখিয়ে স্নান করাতে হয়। দীনদয়ালের নিত্যভোগ হল চাল মিষ্টি পান আর জল। তারপরে কলকেতে তামাক ধরিয়ে হুঁকোয় করে নিবেদন। ঠিক যেমন একজন মানুষকে দেওয়া হয় আর কী! তবে কলকের আগুন ধরাবার সময় ফুঁ দিতে মানা।
আলোচনার মাঝখানে বদন এসে বলল, ‘বাবু, আপনার ডাক পড়েছে। যান।’
: কীসের ডাক?
: চলুন। ওই দিকে ওই চরণ পালের আখড়ায় যে জোল কাটা হয়েছে তাতে আগুন জ্বালা হবে এবার। আমাদের গিয়ে দাঁড়াতে হয়। সেটাই রীতি।
সত্যি দেখবার মতো দৃশ্য। পর পর চারটে লম্বা জোল কাটা। তাতে চল্লিশটা হাঁড়ি বসানো। পাল বংশের নানা শরিকের যে কজন অগ্রদ্বীপে আছেন সবাই দাঁড়ালেন পর পর। কমলবাটির রাঁধুনিরা হাত জোড় করে দীনদয়ালের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ চাইলেন। তাদের হাতে দেওয়া হল পান সিঁদুর তেল সন্দেশ। সেগুলো জোলের পাশে রেখে সবাই জোলকে গড় হয়ে প্রণাম জানাল। একজন চেঁচিয়ে উঠল:
প্রেম কহে রাধাকৃষ্ণ বলিয়ে।
প্রভু নিতাই চৈতন্য অদ্বৈত
শ্রীরূপ রঘুনাথ কবিরাজ গোঁসাই
অটলবিহারী করোয়াধারী কইয়ে সাধু
মধুরস বাণী। দীনদয়ালের নামে একবার হরি হরি বলো।
সমস্বরে সবাই বলল: ‘হরিবোল’।
বাবা চরণ পালের নামে একবার।
হরি হরি বলো
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘হরিবোল’।
ব্যাস। অগ্নি সংযোগ হল চারটে জোলে। শুরু হল অন্ন-মচ্ছব। ‘যাতে কোনও বিঘ্ন না হয়। যাতে ঝড় জল না হয়ে সবাই অন্ন-মচ্ছব সেবা করে। যাতে পাক ঠিক হয়। এই-সব ভেবে এই অনুষ্ঠান। বুঝলেন তো?’ সুতোষ পাল বোঝালেন।
আমি বললাম, ‘এ সব রান্না শেষ হয়ে অন্ন-মচ্ছব হবে কখন?’
: বেলা গড়াবে। তার আগে আমার তাঁবুতে দুটো মাছ-ভাত খেয়ে নেবেন সকাল সকাল।
‘তার আগে আমি বরং একটু চারদিক ঘুরে আসি’, আমি বললাম, ‘চিঁড়ে মুড়কির স্ল্যাব একটু তাতে যদি কমে!’
ঘুরতে ঘুরতে দেখি এক এক গাছতলায় এক এক আখড়া। কোথাও গান হচ্ছে। কোথাও কুটনো কোটা আর রান্নার আয়োজন। কোথাও খাঁটি বৈষ্ণব মতে চার দিকে কাপড় ঘিরে মালসা ভোগ নিবেদন হচ্ছে, বাইরে চলছে কীর্তন। কোথাও মানুষজন অঘোরে ঘুমোচ্ছ। একটা আখড়ার বাইরে ছোট কাঠের উনুনে একজন মধ্যবয়সী বিধবা হাঁড়িতে কী রাঁধছে আর বাঁখারি দিয়ে নাড়ছে। আমি তাকে বললাম, ‘বাখারি কেন গো মাসি, হাতা নেই?’ স্নেহের তিরস্কার কণ্ঠে ঢেলে মাসি বললে, ‘ও ছেলে, তুমি রগ্গদ্বীপের নিয়ম জানো না বুঝি? এখানে হাতাখুন্তি চলে না। বাঁখারি নিয়ে নাড়াঘাঁটা আর মুচি কি ভাঁড় দিয়ে পাতে দেওয়া।’ হাঁড়িতে কী রান্না হচ্ছে বোঝা শক্ত। টগবগ করে ফুটছে। ফোটার চাপে হাঁড়ির মুখে উঠে আসছে চাল ডাল বেগুন কুমড়ো আলু মুলো পটল। আশ্চর্য ব্যাপার তো? ‘কী রান্না এটা?’ মাসিকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
: ও ছেলে, তুমি তো শিক্ষিত মানুষ। দেখে বুঝলে না? একে বলে জগাখিচুড়ি।
এই নাকি জগাখিচুড়ি? কখনও চোখে দেখি নি, শুধু নাম শুনেছি। জগাখিচুড়ি তা হলে একটা ‘ব্যাপার’ নয় রীতিমতো একটা খাদ্য? মাসিকে বলি, ‘তোমাদের নিবাস কোথায়?’
: ভোলাডাঙা চেনো? সেখানে নেমে যেতে হয় নাংলা পোমে। সেখানে আমাদের গুরুপাট। গুরুর নাম রাখাল ফকির। ওই দ্যাখো বসে রয়েছেন।
ফকিরের কোঁকড়া চুল। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। পরনে ধুতি আর টেরিকটনের শার্ট। মৌজ করে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আমাকে অপাঙ্গে দেখে নিয়ে আবার সিগারেট টানতে লাগলেন। আমি আখড়ার বাইরে যেখানে অন্য একদলের রান্না হচ্ছে এক বিরাট কড়ায়, সেখানে দাঁড়াই। কড়াতে করে খিচুড়ি পাক করছে যে বলিষ্ঠ মানুষ তার মাথায় বাবরি আর পরনে ঘন নীল ফতুয়া। সারা মুখ পান খেয়ে লাল। নাম জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘সতীশ ভুগলে।’
: ভুগ্লে আবার কী পদবি?
: আজ্ঞে আমরা জাতে গোয়ালা। আমাদের অনেক খারাপ নামে ডাকে লোকে। কেউ বলে ভেমো গোয়ালা, কেউ বলে ভুগ্লে।
: কী করো? জাত ব্যবসা?
: আজ্ঞে না, আমি গো-বদ্যি।
: অগ্রদ্বীপে কি সব জাত, সব বৃত্তির লোকই আসে নাকি?
: আজ্ঞে। ছত্রিক জাত আর সব ব্যবসার মানুষ। ওই দেখুন ওই পাশের আখড়ার মনিষ্যিরা মাছ-মারা জেলে আর নিকিরি।
: জেলে আর নিকিরি আলাদা নাকি?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। দুজনরাই মাছ ধরে। তবে জেলেরা হিন্দু আর নিকিরি মুসলমান।
ভাবলাম, শেখবার কি শেষ আছে? এ সব মেলায় কত কী দেখা কত কী জানা। সভ্যতার ঊষাযুগে মানুষ বোধহয় জোল কেটে রাঁধত, এমনই গর্ত কেটে তাতে খাদ্য রাখত। ষোড়শ শতকে লেখা মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতু-ফুল্লরার যে অন্ত্যজ জীবনের খবর আছে তাতে পড়েছি-‘আমানি খাবার গর্ত দ্যাখো বিদ্যমান। গরিব মানুষ বাড়ির দাওয়ায় গর্ত খুঁড়ে তাতে ভাত আমানি খেত। তারই একটা ধারা হয়তো অগ্রদ্বীপের মেলায় ভিন্ন রূপে রয়ে গেছে। এ মেলার বয়স তো কিংবদন্তি অনুসারে পাঁচশো বছর। খুব কঠোরভাবে ইতিহাস মানলেও তিনশো বছরের কম নয়।
চিন্তায় বাধা পড়ল, কেননা মাথায় পাতার মুকুট গলায় ফুলের মালা পরা এক মহিলা আচম্বিতে আমার সামনে এসে গালে মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ওরে আমার সোনামানিক, ওরে আমার আসমানের তারা। তারপরেই রীতিমতো সুরেলা গলার গান:
বাহারে খবর আসে তারে তারে তারেতে
এ তার নহে সে তার ভাই যে তার মিশে তারেতে।
পুবে মুগুর মারলে তারে পশ্চিমে এসে উত্তর করে
সে কি তারের তার তারে কহ শুধায় তারেতে।
এমন আকস্মিকতায় খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মহিলা যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন। তবে যাবার সময় পাছা দোলালেন এতটাই অভব্য রকমের যে বোঝা গেল তার মাথার গণ্ডগোল আছে। সেটা জানতেই অস্বস্তি কেটে গেল। গো-বদ্যি সতীশ বললে, ‘উনি হলেন নছরত বিবি। ফাজিলনগরে ওনার সাকিন। মাথার ব্যামো।’
: তুমি চিনলে কী করে?
: আমি গো-বদ্যি, মানুষ চিনব না?
কথার বৈপরীত্যে হাসি এসে গেল আমার। গো-বদ্যির কাজ কি মানুষ চেনা না গোরু চেনা? আমার হাসিতে কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে সতীশ বলল, আপনি হাসছেন কিন্তু কথাটা সইত্যি। গো-বদ্যিকে কাঁহা কাঁহা যেতে হয় আপনা ভাবতে পারেন? যেখানে গো-মাতার ব্যাধি সেখানেই ডাক পড়ে। মানুষজন ওই জইন্যে আমার অত চেনা। আসল বিত্তান্ত হল, গো-বদ্যি চেনে মানুষ আর শকুন চেনে গো-বদ্যিকে। একা পেলেই ঠোকল মারে। গো-বদ্যির সঙ্গে শকুনের চের জীবনের আড়াআড়ি।’
ভারী অদ্ভুত কথা যা তোক। তাই বিস্ময় মেনে জানতে চাই, ‘ব্যাপারটা তো ঠিক বুঝলাম না শকুন কেন তোমায় ঠোকরাবে?
: এডা আর বুঝলেন না? খুব সরল কথা। ধরেন। মরা গোরু হল শকুনের আহার। তো গো-বদ্যির চিকিচ্ছেয় যদি গোরু ভাল থাকে, ব্যাধি সেরে যায়, তবে শকুনের খাদ্যে টান পড়ে। সে তাই গো-বদ্যি দেখলেই ঠোক্কর দেয়। মাথার ওপরে বেলান্ত পাক মারে। এবারে বুঝলেন?
বুঝলাম, এরা নয়, হয়তো আমিই এক স্পষ্ট পৃথক জগতের অধিবাসী। সে কি আমার একার মুদ্রাদোষে? এমন কেন হয়। কেন কেবলই শুদ্ধ যুক্তি মানি? কেন সব তাতে আনন্দ খুঁজে পাই না? সেই জন্যে হয়তো লৌকিকের মধ্যে কখনও অলৌকিক পাব না আমি। এক দমবন্ধ করা অসহায়তা থেকে বাঁচতে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘সতীশ, ওই নছরত বিবির মাথা খারাপ হল কেন?’
: বাবু, সে খুব দুঃখের কথা। নছরত এক ফকিরকে ভালবাসত। সেই ফকির ছিল ভণ্ড। তার ছিল গুপ্ত রোগ। সেই রোগ থেকে নছরত পাগল হয়ে গেছে।
মনে পড়ল বাউল-ফকিরদের জীবনের এই দিকটা সম্পর্কে এলা ফকির আমাকে প্রথম অবহিত করেছিল বহুদিন আগে। তাদের মধ্যে সফলতা নাকি খুব কম। বেশির ভাগ বাউল ফকির ভ্রষ্ট কিংবা ভণ্ড। প্রকৃতিজনে একটু এদিক-ওদিক হলেই পতন। তাকেই বলে ‘দশমীদ্বারে কুলুপ।’ এলা ফকির বুন্ধু শা-র একটা মারফতি গানের দু লাইন শুনিয়েছিল:
কলেমার তালায় বন্ধ এ ঘর
খুলবে না চাবি বেগড়
খুলেছে যে বুদ্ধু দুয়ার
গুরুজির চাবিতে।
গানটা শুনিয়ে এলা বলেছিলেন, ‘কলেমা বা শরিয়তি মতে আবদ্ধ থাকলে তবু মুক্তি ঘটতে পারে গুরুকৃপায় মারফতি পথে। কিন্তু দশমীদ্বারে কুলুপ পড়লে সে আর খোলে না। এর বাইরে আর এক পতন দমের কাজে ভুল হলে।’
‘সেটা কেমন ভুল?’ আমি জানতে চেয়েছিলাম।
এলা বলেছিলেন, ‘কাদেরিয়া সুফিঘরের ফকির যারা তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের অনেক কাজ শিখতে হয়। তাকে বলে দমের কাজ। ঠিকমতো জান্নেওয়ালা মুর্শিদ না ধরে দমের কাজ করলে মাথা খারাপ হবেই। কেননা বায়ু ঠিক জায়গায় না গিয়ে মাথায় ভর করবে। বায়ুর দাপ খুব সাংঘাতিক জিনিস।’
এলা ফকিরের এই কথা মিলিয়ে দেখেছি পরে। একেবারে হাদিস বাক্যের মতো নির্ভুল। সেবার পলাশীপাড়ায় জীবন ফকিরের বাড়ি মচ্ছব হচ্ছিল পয়লা বৈশাখ। রাতে বসল মারফতি গানের আসর। কুলগাছি গ্রামের তরুণ গায়ক সুকুরুদ্দি আর মুর্শিদাবাদ জেলার একচেটিয়া গায়ক বিখ্যাত ইয়ুসুফের গানের পাল্লাপাল্লি। দারুণ ফকিরি তত্ত্ব। ইয়ুসুফ মধ্যরাতে গাইলে:
একে শুন্যি দিলে দশ হয়,
এ কথা তো মিথ্যা নয়।
দুয়ে আটে মিলন হলে
নোক্তা পরে দশ হয়।
সেই মোক্তা দশ ঠাঁই।
হয়ে আছে আটে তারাই
আট আর দশে আঠারো ভাই।
মোকাম করে খোদায়।
গান শেষ হলে সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। কেননা সুকুরুদ্দি পায়ে ঘুঙুর বাঁধেনি। অর্থাৎ সে আর আসরে উঠবে না। কেননা ইয়ুসুফের এ গানের কাটান সে দিতে অক্ষম। লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল। মারফতি গায়কের কাছে এ হারের বেদনা বড় গভীর। তার সাধন পথের ভিত যে কাঁচা রয়ে গেছে আসরের সবাই তা জানল। তবে সুকুরুদ্দিনের একমাত্র সান্ত্বনা যে যোগ্যতমের কাছে হেরেছে। তবু তো হার?
‘আসরে কেউ আছ নাকিন যে এ গানের জবাব দেবে?’ একজন হাঁক পাড়ল।
আসরের মাঝখানে বসা বৃদ্ধ জীবন ফকির বলল, ‘এ দিগরে এমন গানের জবাব একমাত্র দিতে পারত এজমালি শা। তা ওই দ্যাখো তার দশা।’
ফকির আবু তাহের আমার পাশে বসেছিলেন। তিনি আঙুল দিয়ে দেখালেন ব্যথাতুর মুখে। দেখলাম আসরের ঠিক বাইরে, যেখানে হ্যাজাকের আলো ভালমতো যাচ্ছে না, সেই প্রায়ান্ধকারে খাড়া ছ’ ফুট এক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দাড়িগোঁফ। মাথায় টুপি। আর বুকে ঝোলানো অন্তত কুড়িখানা মেডেল। শুধু চোখ দুটি শূন্য। হাতে একখানা ভাঙা একতারা। মর্মন্তুদ দৃশ্য।
আবু তাহের বললেন, ‘এজমালি শা। এত বড় এলেমদার গাহক আমরা কেউ দেখিনি। ওদিকে মুর্শিদাবাদ-রাজশাহী, এদিকে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদ কাঁপিয়ে দিত গানে। কেউ পারত না গানের পাল্লাদারিতে। শুধু লালনের গান নয়, এজমালি জানত পাঞ্জু শা-র গান, হাউড়ের গান। জানেন তো সে সব গানের তত্ত্ব কত কঠিন?’
: কী করে মাথার গোলমাল হল?
: ছিল আমাদের মতো বুদ্ধ শা-র ঘরের মারফতি। যশোরে গিয়ে পড়ল এক কাদেরিয়া সুফির পাল্লায়। তাদের সব কঠিন কঠিন দমের কাজ। এখানে বসে নিশিরাতে একা একা সে সব দমের কাজ অব্যেস করত আর জিকির দিত। ব্যস, বায়ু সব মাথায় উঠে গেল। নিশ্চয়ই কায়দার ভুল ছিল কোথাও। তাল রাখতে পারল না। একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে গেল। আমাদেরই বয়সী। দোস্ত। এখন আর গান মনে করতে পারে না। কেবল ফকিরি গানের আসর বসলে বুকে ওই সব মেডেল ঝুলিয়ে গিয়ে হাজির হয়। আমরা সইতে পারি নে।
আমার মনটা ব্যথায় ভরে গিয়েছিল এ সব শুনে। ওই মেডেলগুলো সে রাতে কঠিন অভিশাপের মতো ঝকঝক করছিল। মনের মানুষ খোঁজার নিঃসঙ্গ পথটি অনেক সময় প্রতারণা করে তা হলে এমন ভাবেও?
খানিকটা বিষাদ নিয়েই যেন সুতোষ পালের তাঁবুতে ফিরলাম। নছরত বিবিকে চাক্ষুষ দেখে আর এজমালি শা-র কথা মনে পড়ায় হঠাৎ অগ্রদ্বীপের সমস্ত আয়োজন, উল্লাস, উদ্দীপনা খুব ম্লান হয়ে এল যেন। এমনই হয়। সফলতার সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তে সবচেয়ে করুণ ঘটনাটি মনে পড়ে যায়। তবু কী আশ্চর্য, মনের ম্লানতা আসে মানুষের কথা ভেবে, অথচ সে স্নানতা কাটিয়ে দেয় অন্য এক মানুষ। যেমন ঘটাল মোজাম্মেল, রমজান, বদন আর ফড়িং। এরা কেউ এলেমদার নয়। লেখাপড়াই জানে না। ‘মুরুখ্যু চাষা’ নিজেরাই নিজেদের বলে। অথচ জীবনের কবোষ্ণ তাপে ঝকমক করছে। একটু আগে গয়না আর খুঁদকুঁড়োর গান কেমন নেচেকুঁদে গেয়েছিল আর এখন তিন পদ আহার্য বেঁধে ফেলেছে দিব্যি। আমি তাঁবুতে ঢুকতেই সব হইচই ফেলে দিল। খাওয়ার জন্য উপরোধ। পাটির ওপর কলার পাতা, মাটির গেলাসে জল। গরম ভাত, ডাল আর পটল দিয়ে চারাগাছের ঝোল। ধোঁয়া উঠছে। সুতোষবাবু খেতে শুরু করলেন। আমার তখনও গুমোট কাটেনি। দু দণ্ড বসে নিচ্ছি। মোজাম্মেল বলল, ‘বাবুর কি ভাব নেগেছে? লক্ষণে যেন তাই মনে নেয়? নেশা তো নেই। নইলে বলতাম একটা বিড়ি ধরাতে। এ সময় বিড়ি খেলে ঝিম কেটে যায়।’
রমজান বললে, ‘তুই তো সব তাতে বিড়ির সালিশ করিস। বিড়ি কি তোর কব্বরেও যাবে নাকি?’
মোজাম্মেল বলে, ‘বাবু, একবার কী হয়েছিল জানেন? কব্বর বলতে মনে পড়ল। তখন আমার সবে নিকে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি গেচি। সম্পর্কে আমার এক দাদাশ্বশুরের এন্তেকাল হয়েছে। সবাই গেছি কব্বরস্থানে। হঠাৎ আমি বলে বসলাম, ‘লাসের সঙ্গে দু তাড়া বিড়ি দিয়ে দাও। মানুষটা খাবে কী?’ কী কাণ্ড। বলে ফেলেই কী লজ্জা। দিলাম ছুট।’
রমজান বলল, ‘বাবু, মোজাম্মেল যখন দুঃখ্যু পায় মনে, তখন কী বলে জানেন? বলে হে ধরণী দ্বিধা হও, দু তাড়া বিড়ি নিয়ে ঢুকে যাই। ব্যাটা মহা রসকে।’
আনন্দ করে রসিকতা করে রমজানরা কখন আমার মনের বাষ্প কাটিয়ে দিল কে জানে? খাওয়া-দাওয়ার শেষে মনটা বেশ হালকা বোধ হল। আমি তাঁবুর বাইরে রমজানদের খাওয়া দেখতে লাগলাম একটা ছালায় বসে। ‘কেমন খাচ্ছ?’ প্রশ্নের জবাবে ফড়িং বলল, ‘চালটা বড় চিকন। এ হল বাবুদের চাল, এ সব আমাদের মতো কাবুদের চলে না।’ রমজান বলল, ‘বাবু আমাদের মুসলমানি রান্না। ঝাল বেশি। কেমন খেলেন?’ বদন বললে, ‘হেঁদুরা খাবার কী বোঝে? তাই জিগাও। ওরা খায় শুক্তো ঝোল আর সেদ্ধ। থোড়, কচু আর ডুমুর। গোস ছাড়া খাওয়া হয়? মশল্লা ছাড়া রান্নার সুতার হয়?’ ফড়িং বলে ‘সেই হেঁদুর রান্না খাবার জ্বালায় তো মরিস। আমার মা ভাল কিছু রাঁধলেই, বুঝলেন বাবু, বলে ‘আহা থাক এট্টু, বদনা মাঠ থেকে এসে ফড়িঙের সঙ্গে দুটো খাবে। শালা নেমকরহারাম।’
দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে গেল। সুতোষ বাবুর বোধহয় একঘুম সারা। বাইরে এসে বললেন চরণ পালের আখড়ায় যেতে। সকলে মিলে গেলাম। সেখানে সব জাত সব বর্ণ বসে একসঙ্গে অন্নসেবা করবার জন্যে হাজির। ভাত ডাল তরকারি। দেখলাম, অন্তত কয়েক হাজার নরনারীর দাপাদাপি, চিৎকার আর তাদের পায়ে পায়ে ছেটানো ধুলো নিমেষে অন্ন-মচ্ছবকে ধূসর না করে রঙিন করে দিল। রবীন্দ্রনাথের গানে কতবার শুনেছি ‘পথের ধুলোয় রঙে রঙে আঁচল রঙিন’ করার কথা। এ যে সেই জিনিস একেবারে চাক্ষুষ দেখা! বিরাট বিরাট গর্তে ভর্তি-ভর্তি ভাত ব্যঞ্জন। সরায় করে সবাইকে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুও দিচ্ছে মুসলমানও দিচ্ছে। সেই পূত খাদ্য নিয়ে এবং খেয়ে রমজানও নাচে, ফড়িংও নাচে। খবরের কাগজে নিত্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর পড়ি, শহুরে হিন্দু-মুসলমানের বানিয়ে তোলা অসহিষ্ণুতা আর অভিমানের কথা শুনি। উর্দুস্থানের দাবি তোলে মূঢ়তার ভেদবুদ্ধি, ঝলকিয়ে ওঠে শিবসেনা ও হিন্দুত্ববাদীরা। কই, কোথাও কখনও তো দীনদয়ালের অন্ন-মচ্ছবের খবর পড়ি না?
তবে কি আমরাই, শিক্ষিতরাই স্পষ্ট পৃথক এক অহংকারের জগৎ বানালাম? তার দ্বিধা তার দ্বিচারিতা তার স্ববিরোধ শেষে কি আমাদেরই কুরে কুরে খাবে? এই সব ভাবছি আমার শীর্ণ অহমিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন সময় একজন বয়স্কা বিধবা এসে আমার দুখানি হাত চেপে ধরে মিনতি মাখা কণ্ঠে বলল, ‘ও ছেলে, তুমি আমায় চেনা দাও। আমি যে অনেক সময় ধরে তোমার পানে তাকিয়ে আছি। ভাবছি, দেখি গোপাল আমায় চেনে কি না! তা চিনলে কই? শেষে আমি নিজেই ধরলাম তোমার হাত দুখানা। এবারে চিনবা তো?’
অসহায় চেয়ে থাকি। একদম চিনি না। কোথায় দেখেছি? কোন মেলায়? কোন বা আখড়ায়? কী বিপদ।
বুড়ি বললে, ‘লজ্জা পেয়োনা গোপাল। ভ্রম মানুষেরই হয়। অনেকদিন আগে, তা দশ বছর তো হবেই, তোমার সঙ্গে কথা হয়েছিল এই রগ্গদ্বীপ আসবার পথে ওই গঙ্গার চড়ায় হাঁটতে হাঁটতে, তোমার মনে পড়ে? এক সঙ্গে হাঁটছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার সই। আহা গো, সে দেহ রেখেছে। বড় পুণ্যবতী। এবারে চিনেছ তো বাপ?
চিনেছি এবারে। বললাম, ‘হ্যাঁ মাসি এবারে চিনেছি। তোমার একটা কথা আমার মনে গেঁথে আছে আজও।’
: কী কথা গো ছেলে?
: বলেছিলে, ‘গুরুকে আমি তেমন আপন করে নিতে পারিনি এখনও। তিনিই আমারে আপন করে নিয়েছেন।
: বলেছিলাম বুঝি? আহা। সেই মুরুখ্যু মেয়েমানুষের কথা আজও মনে করে রেখেছ সোনা? এ কি মহতের কথা যে ধরে রাখবা? তা শোনো বাপ। সে কথাডা আজ আর সত্যি নয়। এখন গুরুকে আমি আপন করে নিতে পেরেছি। বাড়িঘর ছেড়ে আমি এখন গুরুর চরণ ধরে গুরুপাটেই আশ্রয় নিয়েছি। সেই আমার গুরু শ্রীমৎ গগন বৈরাগ্য বামুনডাঙার। তোমাকে এখনই যেতে হবে আমার গুরুর আখড়ায়। সেখানে আমার গোঁসাই আছেন। দাদু গোঁসাইও এয়েচেন। চলো চলো গোপাল।
দুটি হাত ধরে এমন মিনতিভরা টানাটানি, আমার অন্তরের মধ্যে উষ্ণতা টনটন করে ওঠে। ভাবি, কে এই অনাত্মীয়া ‘মুরুখ্য মেয়েমানুষ’ এমন ভালবাসার মাধুরীক্ষরণ ঘটিয়ে দেয় এমন করে? তবে কি অগ্রদ্বীপে সকলেই কিছু পায়? গোবিন্দ গোঁসাই পায় গুপিনাথকে, চরণ পাল পায় দীনদয়াল আর আমি পাই এই স্নেহরিত মানবিকতার তুলনাহীন অভিজ্ঞান? মনে হল নাসির হাত দুখানি অমন তপ্ততাতেই ধরে বলি ‘নিয়ে চলো সংসর্গে, সমন্বয়ে। আমার স্পষ্ট পৃথক শীর্ণ অনান্তরিক জগৎ থেকে ছিন্ন করে, বড় করে, সংলগ্ন করে দাও তোমাদের বিশ্বাসের বিশাল বিশ্বে।’ বলতে পারি না। কিন্তু আমার না-বলা কথার আভাটুকু কি ধরা পড়ে মাসির চোখে?
সমস্ত মানুষকে এড়িয়ে পেরিয়ে পশ্চিমদিকে একটা নাবাল জমিতে একটি টেরে গগন বৈরাগ্যের আখড়া পিটুলি গাছতলায়। সেখানে সন্ধে নামছে দারুণ রাজসিকতার গন্ধ মেখে। ধূপ আর নানা রকম গন্ধদ্রব্য মাতোয়ারা করে রেখেছে পরিবেশ। বসেছে গানের আসর সান্ধ্যাহ্নিক। একজন গাহক গাইছে আর শুনছে অন্তত দুশো ভক্ত মানুষ। প্রৌঢ় গগন বৈরাগ্য আর তাঁর বৃদ্ধ জটাজুটধারী গুরু পাশাপাশি বসে আছেন পদ্মাসন করে। নিমীলিত চোখ। মুখ প্রশান্ত। গাহক গাইছে গুরুতত্ত্ব:
গুড়ের মতন যে দেখছি গুরুধন
ভিয়ান না করিলে গুড়ে সন্দেশ হয় না মন।
যেমন গুড় ভিয়ান করে
তেমনই গুরু সেবার তরে
ময়রা হয়ে থাকে পড়ে
সেই তো রসিকজন।
সেবায় রাজা ভিয়ানে খাজা
যে করে সেই মারে মজা
করতে নারলে থাকে প্রজা
বুন্ধুর মতন ॥
গান শেষ হলে দাদু গোঁসাই তাঁর শিষ্য গগনকে বললেন, ‘শ্রীগুরুতত্ত্ব পাঠ করো।’ গগন একটা পুঁথি, লাল খেরো বাঁধানো, বার করে পড়তে লাগলেন:
শ্রীহরি-বৈষ্ণবের অচিন্ত্যভেদাভেদ প্রকাশই শ্রীগুরুদেব। দাদু গোঁসাই ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘ওই জন্যেই বলা হয় গুরু-কৃষ্ণ-বৈষ্ণব তিনে এক, একে তিন। তারপর কী বলছে গগন? পড়ো তো?
গগন পড়লেন:
অভেদ-বিচারে তিনি উপাস্য, পরাকাষ্ঠা-‘সাক্ষাদ্ধরিত্বেন
সমস্ত শাস্ত্রৈরুক্ত।’
তথাপি শ্রীপ্রভু ভগবানের নিত্য প্রেষ্ট।
দাদু গোঁসাই বললেন, ‘তোমরা সাধারণ মানুষ। এত বড় শাস্ত্রের উক্তি তোমরা বুঝবে না তাই সরল করে বলি, শ্রীগুরু আশ্রয়জাতীয় তত্ত্ব আর শ্রীকৃষ্ণ বিষয়বস্তু। তাই শ্রীগুরুদেবের ভগবান হয়েও সেবক। তোমরা সেই সেবকের সেবক।’
এ যে রীতিমতো ইনটেলেকচুয়াল ব্যাপার-স্যাপার। আমি গুঁড়ি মেরে আসরের মধ্যে টুক করে সেঁধিয়ে যাই। সম্রম করে অনেকে আমাকে জায়গা করে দেন। বুঝতে পারি এখানে দাদু গোঁসাই একতরফা বক্তা। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেবে কে?পাল্লা দিলে এক গগন বৈরাগ্য দিতে পারে কিন্তু এত শিষ্য-সেবকের মধ্যে তিনি নিজের গুরুকে খণ্ডন করতে যাবেন কেন?
দাদু গোঁসাই এবারে বলেন, ‘গুরু কেমন জান। যেমন নৌকোর হাল। নৌকো পৌছবে ঘাটে অর্থাৎ ভগবানের কাছে। নিজে নিজে নৌকো যেতে পারে না। হাল চাই। হাল ঠিক থাকলে তবে নৌকো ঘাটে পৌছবে, নইলে ভেসে যাবে।’
গগন বৈরাগ্য একজন গ্রাহককে বললেন, ‘তোমাদের গানে কী বলছে গো? গুরু কেমন? গুরুকে বাদ দিয়ে কি সাধন হয়?’
গাহক মুখে মুখে খালি গলায় গায়:
যারা গুরুকে ভুলে
‘হরি হরি’ বোল বলে
তারা গাছের গোড়া কেটে
যেমন আগায় জল ঢালে ॥
‘বেশ বেশ’ উদ্দীপ্ত হয়ে দাদু গোঁসাই বলেন, ‘খুব হক কথা। আগে গুরু পরে হরি। আগে পথ তবে মন্দির। আগে সাধন পরে প্রাপ্তি।’ গগন বৈরাগ্য আবার বললেন গাহককে, আর কী বলছে গুরুতত্বে?’
গাহক গাইল:
গুরু রূপ ধরে সদয় হন তিনি
মন্ত্রদান করেন শিষ্যের শ্রবণে।
যদি গুরু চেনো মন
পাবে কৃষ্ণ দরশন
পরম সুখে রয়ে যাবে
বৈকুণ্ঠ ভবন।
হলে গুরুত্বে মনুষ্যবুদ্ধি
সাজা দেবে শমনে ॥
দাদু গোঁসাই বললেন, ‘এই শেষের কথাটা জরুরি। গুরুকে কখনও মানুষ ভাববে না। তিনি অনেক বড় অনেক উঁচু। তাই বলছে: গুরু ছেড়ে গোবিন্দ ভজে সে পাপীর জায়গা হয় নরকমাঝে। তোমরা শ্রীগুরুর নামে একবার হরি হরি বলো।’
সবাই হরিধ্বনি দিল। আসর ভাঙল। দাদু গোঁসাই গেলেন তাঁর নিজের আখড়ায়। আসর এখন ফাঁকা। বসে আছি আমি আর মাসি। অনেকটা চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে সামনে এসে বসলেন গগন বৈরাগ্য। পরিচয় হল পরস্পরের। মাসি যেন কৃতার্থ। গগন বললেন, ‘কেমন লাগল আমাদের সান্ধ্য গুরুবন্দনা? এর আগে গুরুবন্দনা শুনেছেন?’
বললাম, ‘ সত্যিই আগে শুনিনি। এমন গুরুবন্দনার আসর আগে তো কোনও আখড়ায় দেখিনি।’
: বোধ হয় মারফতি ফকির আর দীনদয়ালের ঘরে আপনার বেশি গতায়াত। আমাদের মত ও পথ কিছু ধরতে পারলেন?
: মত আর পথ জানতে গেলে দেখতে হয় করণ-কৌশল। আপনাদের করণ তো কিছু দেখিনি এখনও। আপনাদের কোন ঘর?
: আমাদের পাটুলি স্রোত।
: তার মানে সহজিয়া ধারা। কিন্তু আপনাদের গুরুবন্দনার আসর বড় কৃত্রিম বলে মনে হল। ওতে কি মন ভরে?
: ও তো বাহ্যের করণ। সাধারণ ভক্তদের জন্যে দায়সারা অনুষ্ঠান। এ থেকে মূল কথা কিছু ধরতে পারবেন না। আসল কথা আপনাকে পরে বলব। রাতে থাকবেন? বেশ। তখন খানিকটা বুঝিয়ে বলব। এখন শুনুন নিগূঢ় গানের এই কথা কটা:
ভয় করে না তাতে
যার আছে গুরু প্রতি নিষ্ঠারতি।
হেলায় পারে সাঁতার দিতে
রসিক সেকি পড়ে পাঁকে?
ডুবে সে রত্ন মিলায় সে বাঁকেতে ।।
মানে বুঝলেন?
মনে হল বুঝলাম না। তবে এ কথা স্পষ্ট হল যে গানের ধূপছায়ার আড়ালে আছে গাঢ় জীবনসত্যের আগুন। গুরুতত্ত্ব যত সহজ ভাবছিলাম তত হয়তো নয়। এখানে ‘ভয় করে না তাতে কথাটায় ‘তাতে’ মানে কী হতে পারে? ‘সাঁতার দেওয়া’ এই ইঙ্গিত কীসের? ‘বাক’ মানে কী বোঝাচ্ছে? ‘রত্ন’ কী? বুঝতে পারছি খুব সুনিশ্চিতভাবে তত্ত্বের গভীরে যাচ্ছি। যেন খুলে যাবে সেই স্পষ্ট কিন্তু পৃথক বিশ্বের চাবি এবারে। মনের মধ্যে জাগছে একটা নতুন ভাবনা।
এদিকে চার দিকে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। দ্বাদশীর চাঁদ হিসেবমতো আজ উঠবে আরও একটু রাতে। মাসি কোথায় চলে গেছে। গগন বৈরাগ্য হঠাৎ রহস্যজনকভাবে সামনে এসে আমার মাথাটা জোরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সব ভুলে যান। যা জেনেছেন সব ভুল। গুরু মানে নারী। সাধনসঙ্গিনী।’
তাঁর আচম্বিত ব্যবহারে চমকে গিয়েও আমি প্রতিবাদে মাথা নাড়ি ঘন ঘন। ‘তা কি হয়, আমরা জানি পতি পরম গুরু। সেকি তবে ভুল?’
: তবে সত্য কী?
:সত্য নারীদেহ। সেই সবচেয়ে বড় গুরু। তার কাছে ইঙ্গিত নিয়ে তার সাহায্যে তবে সাঁতার দিতে হবে। তার শরীরের বাঁকে মানে দশমীদ্বারে লুকিয়ে আছে মহারত্ন। আলগা স্রোতে ডুবে না গিয়ে ডুবতে হবে তলাতল অতল পাতালে। তবে মিলবে রত্নধন। সেই বাঁকে মাসে মাসে বন্যা আসে। তাকে বলে গভীর অন্ধকার অমাবস্যা। নারীর ঋতুকাল। সেই বাঁকা নদীর বন্যায় মহাযোগে ভেসে আসে মহামীন অধরমানুষ। তাকে ধরতে হবে। তার সঙ্গে মিলনে অটল হতে হবে। তাকেই বলে গুরুপ্রাপ্তি। আর ভুল হবে কোনওদিন?
গগন বৈরাগ্যের কঠোর কঠিন মুখখানি পাথরের মতো স্থির। তার সাঁড়াশির মতো দুটো হাত আমার হাতকে যেন চিরবন্ধনে বেঁধে রাখবে, এত তার জোর। আমি ছটফট করে উঠে বললাম, ‘ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি কিছুই জানতে চাই না। আমি সাধন-ভজন করি না। ক্রিয়াকরণ জানি না। বিশ্বাস করি না এ পথে।’
গগনের রক্তচক্ষু আমার দু চোখে নিবদ্ধ। আমার কাঁধে ঘন ঘন ঝাঁকুনি দিয়ে তার ব্যাকুল কণ্ঠের আর্তি ঝরে পড়ল সেই নিঃসীম অন্ধকারে, ‘তবু শুনতে হবে। জানতেই হবে। আমি এতদিন ধরে সাধনা করে যা জেনেছি তা কি কাউকেই বলতে পাব না আমি?’ হঠাৎ দারুণ কান্নায় ভেঙে পড়ে অমন শক্ত মানুষটা আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, আমি আজ পর্যন্ত একটা মানুষ পাইনি। সব মুর্খ। সব বাহ্য। তাদের মন-রাখা কথা বলে বলে আমি আর পারি না। আমার কথা তুমি শুনবে না?’
রাজি হলাম। তবে কথা হল আমার যেখানে ডেরা সেখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসব এখন গিয়ে। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক রাতে নিভৃতে কথা হবে। মনে হল আশ্বাস পেয়ে মানুষটা বাঁচলেন যেন। কী আশ্চর্য অভিজ্ঞতা! সন্তপ্ত একজন মানুষ যেন সান্ত্বনা পেল অনেকটা। আমার কেবলই মনে হতে লাগল রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের সেই উক্তি:
জান কি একেলা কারে
বলে?
জানি। যবে বসে আছি ভরা মনে—
দিতে চাই, নিতে কেহ নাই!
আমি জানতাম না যে, কোনও জিনিস নিঃশেষে জানার পর তা মনের মধ্যে পুঞ্জিত করে রাখার যন্ত্রণা এত মর্মান্তিক। আমি স্পষ্ট বুঝলাম লালন, পাঞ্জু শা, দুদ্দু শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, লালশশী, কুবির গোঁসাই কেন এত অন্তহীনভাবে গান লিখে গেছেন। তাঁদের জানার যন্ত্রণা এভাবেই ব্যক্ত করে গেছেন তাঁরা। লোকধর্মে কি তাই গানের এত বিপুলতা? বুঝলাম গগন বৈরাগ্যের যন্ত্রণা কোনখানে। সে তো গান লিখতে জানে না। তার চারপাশে মূর্খ আর মুমুক্ষু কতকগুলো মানুষ সব সময়ে শরণ চায়। তাদের দিতে হয় বাহ্য করণ, লৌকিক আচার। মাসির মতো ভজনবিহীন নির্বোধ ভক্তরা গগন বৈরাগ্যকে আঁকড়ে ধরে আছে প্রাপ্তির আশায়। এ কি বৈদিক ধর্ম যে শাস্ত্র আর আচারে সব শান্তি আসবে? এ যে পদে পদে জীবন-সংসক্তির ধর্ম। মল মূত্র রজ বীর্য কিছুই যাদের ত্যাজ্য নয় তাদের বাইরের থেকে বোঝা কি খুব সহজ? এদের নিঃসঙ্গতা তাই নানা ধরনের। একে তো প্রচলিত ধর্মের পথ ছেড়ে নির্জন নিঃসঙ্গ পথে সাধনা। তারপরে সমাজ বিচ্ছিন্ন ঘৃণিত হয়ে থাকা। তারও পরে সব কিছু জানার পর, উপলব্ধির কথাগুলো কাউকে বলতে না-পারার গভীর নিঃসঙ্গ সন্তাপ। গগন বৈরাগ্য তো লিখতে পারেন না। লালন খুব ভাল লিখতে পারতেন তবু তাঁকে বলতে হয়েছিল: ‘কারে বলব আমার মনের বেদনা/এমন ব্যথায় ব্যথিত মেলে না।’ কুবির বলেছিলেন; ‘দুঃখের দুখী পেলাম কই/দুটো মনের কথা কই?’ কীসের এই নিগূঢ় ব্যথা?
এই ব্যথাই সাধকের ব্যথা। মধ্যযুগের ভারতের সন্ত সাধকেরা কিংবা রূমীর মতো সুফি সাধক এ সব ব্যথা থেকে সত্যকে পেয়েছিলেন। ‘যাঁকে জানার পর আর কিছু জানা বাকি থাকে না’ এমন উক্তির পাশে খুঁজে পাই এমনতর উলটো উক্তিও যে ‘তাঁকে জানলে তবে সব জানার শুরু।’ ‘তিনি তাঁকে জানার পথ রুদ্ধ করে রেখেছেন’ এই সদুক্তির পাশে জ্বলজ্বল করছে এই বাণী যে ‘তাঁকে জানার পথ জীবনের সব দিকে ছড়ানো।’ কোনটা সত্য এর মধ্যে? অথবা হয়তো এর সব কটা কথাই সত্য, সাধনার এক এক স্তরে।
আমি বেশ বুঝতে পারি মানুষের ফুঁপি ফুরোয় না। আমি মানুষের সেই অনন্ত ফুঁপি ধরে ধরে কেবলই ঘুরি। স্বজনে নির্জনে। নইলে এই পাঁচশো বছরের উৎসবসেবিত অগ্রদ্বীপে আমার কী এমন কাজ? আর পাঁচজন ভক্তিমান যাত্রীর মতো মন্দিরে গিয়ে গোপীনাথের দর্শনের পাট চুকিয়ে একটা বৎসরান্তিক প্রণাম নিবেদন করলেই তো চুকে যেত। ঘোষ-ঠাকুরের কিংবদন্তিতে গভীর আস্থা রেখে গোপীনাথের পাথুরে মূর্তি দেখে আমিও তো বিশ্বাস করতে পারতাম যে শ্রাদ্ধের পিণ্ডদানের সময় গোপীনাথ কাঁদেন। তার বদলে গোপীনাথ আমাকে দেখান মানুষের কান্না-হাসি। রমজান মোজাম্মেলের নর্তনানন্দের পাশে এজমালি ফকিরের জড়বৃদ্ধি স্তব্ধতা নিঃসাড়ে এসে দাঁড়ায়। অবিরল তর্কমুখর রামদাসের পাশে গভীর সন্তপ্ত মুখখানি ভেসে ওঠে নির্জন গগন বৈরাগ্যের।
এইসব ভাবনার ফাঁকে যন্ত্রের মতো কখন আসা যাওয়া খাওয়া সব সাঙ্গ হয়ে গেল। মধ্যরাতে জ্বলজ্বল করছে দ্বাদশীর চাঁদ। অসংখ্য যাত্রী চারি দিকে শুয়ে নিদ্রায় অসাড়। অন্ন-মচ্ছবে পরিতৃপ্ত ভক্তদের আমরা কেবলই পেরিয়ে যাচ্ছি। আমি আর গগন। একসময়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা মল্লিক-বাড়ির ভগ্নাংশের কাছে পৌঁছুই। সেখানে একটা উঁচু ভূমিখণ্ডে বসি। খানিকটা দূরে মানুষের গলার আওয়াজ শুনে চেয়ে দেখি অনতিম্লান চাঁদের আলোয় দুটো মানুষ মুখোমুখি বসে উত্তপ্ত আলোচনা করে যাচ্ছে। ‘ওরা কারা’ আমার এই প্রশ্ন মুখরতা পাবার আগেই গগন জানিয়ে দেন ওরা চিসতিয়া খানদানী। মধ্যরাতে ওরা ‘বাহাস’ বা তর্ক করে আল্লাহর স্বরূপ নিয়ে।
গগন বৈরাগ্য খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। হু হু করে গঙ্গার বাতাস ঝাপট মারছে মধ্য চৈত্রের রাত্রিকে। হঠাৎ গাঢ় মন্ত্রের মতো গগন বললেন,
শুভাশুভ কর্মে মতি সদা রহে যার।
কৃষ্ণভক্তি কখনই না হয় তাহার ॥
আমি বললাম, ‘এ কথা বলছেন কেন? এখন এইখানে এই রাতে?’
চোখ বন্ধ করে গগন বললেন, ‘আমি এখন অনেকগুলো কথা বলে যাব। বাধা দেবেন না। আমাকে বলতে দিন। আমি বলতে চাই।’
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আমি চুপ করে বসলাম।
গঘন বলে চলেন অনর্গল: জীবনের সবচেয়ে বড় ফাঁদ হল জ্ঞান আর কর্ম। এখানে জ্ঞান বলতে বোঝায় জন্ম মৃত্যু সম্পর্কে জ্ঞান। সেই জ্ঞান থেকে আসে মৃত্যুভয়। যে-জ্ঞান মৃত্যুভয় আনে তাতে কাজ কী? তাতে সাধনায় বিঘ্ন আনে। জ্ঞানের খারাপ দিকটা এবারে বুঝলে?
আমি বলি: কথাটা নতুন। অন্তত আমাদের পক্ষে। আমরা জ্ঞান বলতে বুঝি শাস্ত্রজ্ঞান। শাস্ত্র মন্ত্র পুঁথি আর উপদেশ থেকে জ্ঞানের জন্ম। তারপর আসে বস্তুজ্ঞান আর ব্রহ্মজ্ঞান। ব্রহ্মজ্ঞানের কাছে আর সব জ্ঞান তুচ্ছ।
: তুমি কাঁচকলা বুঝেছ। ওসব বৈদিকের ধোঁয়া। আসল জ্ঞান আপ্তজ্ঞান। সেই জ্ঞান থাকলে অন্যসব জ্ঞান মেকি হয়ে যায়। আপ্ত না জেনে কি ব্ৰহ্মকে জানা যায়? এই গানটা শুনেছ?
যারো তারো মুখে শুনি বলে ‘আমি’ ‘আমি’
আমি না পাইনু আমায় খুঁজে দেখলাম আমি।
এই নিজে জানা, নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া একেই বলে আপ্তজ্ঞান। বুঝেছ? তা হলে একটু আগে যে বললাম জীবনের সবচেয়ে বড় ফাঁদ জ্ঞান আর কর্ম তার মানে কী দাঁড়াল। এখানে বুঝতে হবে কর্মের দ্বারা জ্ঞানের মিথ্যা ত্যাগ করে আপ্তজ্ঞান পেতে হবে। তা হলে জন্ম মৃত্যুর ভয় কেটে যাবে।
আমি ভাবলাম গগনের ধারণা ভারী অন্য রকমের। দেখা যাক তার মতে কর্মের সংজ্ঞা কোন রকম?
গগন উচ্চারণ করেন:
এক বেদগুহ্য কথা কহিবার নয়
বেদ ধর্ম কর্মভোগ জানিও নিশ্চয়।
এই কথাটা এবারে বোঝ বৈদিক ধর্ম আমাদের কর্মভোগ করায় শুধু। আমাদের মুক্ত সুস্থ থাকতে দেয় না। জ্ঞান থেকে আসে জন্ম মৃত্যুর ভয়। সেই ভয় থেকে বাঁচতে পুনর্জন্ম এড়াতে আমরা কর্ম করি, মন্ত্র পড়ি, পুতুল পূজা করি, হোম যজ্ঞ করি। সব বৃথা কর্ম। উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম করা পাপ। কর্ম হল মুক্ত। তাকে স্বার্থে জড়াতে নেই। তোমরা কেবলই কর্মকে জড়িয়ে ফেল।
আমি বললাম, ‘কথাটা খুব নতুন। কিন্তু কেন আমরা এমন করি? তার থেকে বাঁচার পথ কী?’
‘এই, এতক্ষণে তোমাকে পথে এনেছি’ গগন বলেন, ‘তোমরা এমন কেন করো জানো? তার কারণ তোমরা পিতা-মাতাকে গুরুজ্ঞান করো। বাপ মা কখনও গুরু হতে পারে? তারা তো মায়াবদ্ধ, অষ্টপাশে বাঁধা। কামসর্বস্ব। তারা কী করে গুরু হবে?’
কামসর্বস্ব শব্দটি যেন বজ্যের মতো কানকে ধাঁধিয়ে দেয় আমার। এই মধ্যরাতের নির্জন নদীতীরে আর ভগ্নপ্রায় মল্লিক-বাড়ির সামনে বসে কেবলই মনে হতে লাগল হয়তো আমার চেতনাও ভেঙে পড়বে এবার। আমার নির্জিত সত্তাকে আরেকটু কোণঠাসা করতেই বুঝি গগন বৈরাগ্য বলে ওঠে, ‘পিতা-মাতা কী করে আমাদের? শোনো তবে—
কামে মাতি উভয়েতে শৃঙ্গার করিল।
সৃষ্টিকালে ভালোমন্দ নাহি বিচারিল ॥
ক্ষণিকের তৃপ্তি হেতু হয়ে মাতোয়ারা।
মারিল আমারে আর নিজে মরে তারা ॥
‘চুপ করুন, চুপ করুন আপনি’ আমি অসহায়ভাবে ককিয়ে উঠলাম, ‘এ সব কোথা থেকে কী সব বলে যাচ্ছেন।’
‘চুপ করব না। তোমরা ব্রাহ্মণরা আমাদের বহুদিন টুঁটি টিপে রেখেছ। আর নয়’ বৈরাগ্যের মুখে প্রতিহিংসা ঝলসে ওঠে, ‘তোমাদের তো খুব শাস্ত্রে বিশ্বাস। শাস্ত্র কি শুধু তোমরা লিখতে পার? আমরা পারি না? এ শাস্ত্র আমরা লিখেছি। সহজিয়া পুঁথি। চুপ করে শোনো—
ক্ষণিকের তৃপ্তি হেতু হয়ে মাতোয়ারা।
মারিল আমারে আর নিজে মরে তারা ॥
মধ্যে পড়ি আমি যবে ভাসিয়া বেড়াই।
উদ্ধার করিতে মোরে আর কেহ নাই॥
কিছুকাল কষ্টভোগ করি গর্ভমাঝে
আইলাম অবনীতে দোঁহার গরজে॥
আমি দুহাতে কান ঢাকি। প্রতিবাদে মাথা ঝাঁকাই। গগন জোর করে দু হাত সরিয়ে দেয় আমার কান থেকে। বাতাস কাঁপিয়ে বলে:
আমার আসার গরজ কিছু নাহি ছিল।
দুজনার ইচ্ছায় আমায় আসিতে হইল॥
অসম্ভব এই শাস্ত্র। অসহ্য একে মেনে নেওয়া। আমি মুহুর্তে উঠে পড়ি। ছুটে পালাব? অন্ধকারে সব দিক তো চিনি না। উঁচু-নিচু হয়ে আছে ভগ্ন প্রাসাদের এলোমেলো শান-বাঁধানো চত্বর। তবু জোরে খুব জোরে পা চালাই। গগন বৈরাগ্য তার খোলা চুলে উদ্ভ্রান্ত হাওয়ায় ওড়া দাড়ি নিয়ে উন্মাদ কাপালিকের মতো ছুটে আসে দ্রুততর। কিন্তু পারে না। উত্তেজিত স্থলিত তার পা গর্তে পড়ে। সে সটান মাটিতে পড়ে উপুড় হয়ে। আর উঠতে পারে না। আমি তাকে পরিহার করে পালাই, মানুষ যেমন দুঃস্বপ্নকে পরিহার করে। একেবারে একদমে অনেকটা গিয়ে বসে পড়ি নদীর ঘাটে।
আস্তে আস্তে রাত কেটে আসছিল। প্রথমে জাগল পাখি, তারপরে মানুষ। দলে দলে মানুষজন ছায়ার মতো এগিয়ে আসছে আবছা অন্ধকার ভেদ করে। আজ বারুণী স্নানলগ্ন। ব্রহ্ম মুহুর্ত সবচেয়ে প্রশস্ত সময় সে কর্মের। আমার মনে হল স্পষ্ট পৃথক আর এক জগতের এই অধিবাসীদের সংসর্গ ছেড়ে আমাকে এখনই পৌছতে হবে স্বাভাবিক মানবসমাজে। যে-সমাজ জন্ম মৃত্যুকে মেনে নেয়। মেনে নেয় দেহের বাসনা। পিতা-মাতার পবিত্র মিলনে যেখানে কামনা করে সন্তানকে আহ্বান করা হয়। প্রতিদিন যেখানে জীবনের প্রমত্ত ছন্দে জীবন জায়মান।
না, এখানে আর নয়। আজ সবচেয়ে আগে একা আমি অগ্রদ্বীপ ত্যাগ করব। খুব দ্রুত খেয়া পার হয়ে ওপারে পৌঁছাই। অর্ধস্ফুট ভোর। যাত্রী পারাপারের বিরাম নেই। তবে সবাই এখন এ পারের টানে বারুণীর স্নানে। নৌকো থেকে আমি তাই একা ওপারে নামি। নির্জন বালিয়াড়ির পথ বহড়া গ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে। আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কখন আলো ফোটে। চোখে পড়ে শস্যকীর্ণ মাঠ, সূর্যসনাথ আকাশ। হঠাৎ খেয়াল হল অনেকটা আগে আগে আরেকটা মানুষ যাচ্ছে না? হ্যাঁ, যাচ্ছে আর নদীর দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে বার বার। তার দাঁড়িয়ে পড়ার টানে আমি পৌঁছে যাই তার কাছে। নিতান্ত সাধারণ একজন রুখোসুকো গ্রাম্য মানুষ। বললাম, বারুণীর স্নান করলেন না?’
লোকটা ফুঁসে বলল, ‘তুমিও তো কর নি।’
আমি বললাম, ‘আমি ও সব মানি না। বিশ্বাস করি না।’
: আমি বিশ্বাস করতাম। আর করি না। তাই আজকের মতো গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছি। আজকে সবাই গঙ্গায় ছ্যান করবে। শুধু আমি করব না। আমি এই গঙ্গাকে সইতে পারি না।
: কেন?
লোকটা সেই অপরূপ ভোরে পুণ্যতোয়া গঙ্গার একটা দিকে আঙুল দেখিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, ‘ওইখানে আমার জমি আর বসত ছিল। রাক্ষুসী সব গিলেছে।’ আমি মানুষটার হাত চেপে ধরি। পৃথক আর এক স্পষ্ট জগতের নয়, এ মানুষটা আমার। একেবারে আমার মনের মানুষ। একেই তো এতদিন ধরে খুঁজছি আমি। শেষ পর্যন্ত আজ তাকে পেয়েছি। ধরেছি দুই হাতের উষ্ণতায়। মনে হল বারুণীর ভোরে পেলাম, আমার একান্ত অর্জন, গভীর নির্জন পথে।