পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট
ষাটের দশকের শুরুতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি গোপন প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে কথা না বললে আমি হয়তো বিষয়টি জানতেই পারতাম না। কেননা, এ ঘটনার উল্লেখ সিরাজুল আলম খান কিংবা আবদুর রাজ্জাকের মুখে কখনো শুনিনি।
আমি শুনেছিলাম, ছাত্ররাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের উত্থান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে। পঞ্চাশের দশকের শেষে এবং ষাটের দশকের শুরুতে আওয়ামী বৃত্তের তরুণদের মধ্যে শেখ মুজিবের পরই জনপ্রিয়তায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন তুঙ্গে। ২০১৪ সালে আমি আওয়ামী লীগ নিয়ে একটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিই। তো ওই সময়ের ইতিহাসের সন্ধানে ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর আমি একদিন হাজির হই তার গুলশানের বাসায়। আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাহ মোয়াজ্জেম ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় তুলে ধরেন।
পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে কত বেপরোয়া ছিলেন, তার আভাস পাওয়া যায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষ্যে। দিন-তারিখ মনে নেই শাহ মোয়াজ্জেমের। এতটুকু স্মরণ আছে যে। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি ছিল। আমার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ছিল এ রকম :
মহিউদ্দিন আহমদ : শেখ মুজিবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? তিনি কী চোখে দেখতেন আপনাকে?
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন : আমি থাকতাম নিমতলী, নিম ভিলায়। ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন একসময় ওখানে একটা হোটেল দিয়েছিলেন। ওটা ছেড়ে দিলেন আমাদেরকে। ওই যারা সিএসপি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেবে, ল পড়বে, হোস্টেলে জায়গা পায় না। বাড়ির অবস্থা ভালো, নিম ভিলায় একেকজন একেকটা রুম নিয়ে থাকে। থাকার ব্যবস্থা আছে, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। নাজিমউদ্দিন রোডে একটা ভালো খাবার দোকান ছিল। ওখানে গিয়ে বা ওখান থেকে খাবার আনিয়ে খেতাম। তখন আমি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি, রফিকুল্লাহ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট। রফিকুল্লাহ সিএসপি হয়ে গেল। আমি প্রেসিডেন্ট হলাম।
মুজিব ভাই তখন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি, আমার নেতা। উনি আমাকে এমএ পড়তে না করেছিলেন। বলেছিলেন, তুই ল পড়বি, আমার সঙ্গে রাজনীতি করবি। এমএ পড়ে লাভ কী?’ তো আমার এমএ পড়ার শখ। ওনাকে না জানিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। জেনারেল হিষ্ট্রি। এমএ পরীক্ষায় থার্ড হয়েছিলাম।
একদিন সকালে, কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে। মওলা ছিল আমার খেদমতগার। বললাম, মওলা, দেখ তো, এত কালে কে? পরে আসতে বল। মওলা দরজা খুলেই বলে, ‘নেতা, লিডার’, তাকিয়ে দেখি মুজিব ভাই। পেছনে গাজী গোলাম মোস্তফা। সঙ্গে একটা গ্রীন মডেল র্যালি সাইকেল। লিডার, আপনি এ সময়? উনি আমার কান চেপে ধরে বললেন, ‘তুই না জানায়া এমএতে ভর্তি হইছস, পরীক্ষা দিছস, আমি জানব না?’ আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। বললাম, মাফ করে দেন। মুজিব ভাই বললেন, ‘তুই খুব ভালো রেজাল্ট করছস। এই দেখ আমি তোর জন্য প্রেজেন্টেশন নিয়া আসছি, সাইকেল।’ আই ওয়াজ মোর দ্যান হ্যাপি।
মহি: আমরা শুনেছি ওই সময় দেশ স্বাধীন করার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন, বলবেন কি?
মোয়াজ্জেম : মুজিব ভাই একটা লিফলেট ভুফট করেছেন ‘পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট’ নাম দিয়ে। সাইকেল চালিয়ে নিজেই প্রেসে গিয়ে ছেপেছেন। আমাকে ডাকলেন। আমি ওই সাইকেল চালিয়েই গেলাম। উনি আমার হাতে এক বান্ডিল লিফলেট দিয়ে বললেন, ‘তোর বিশ্বস্ত লোক নিয়া এগুলি ডিস্ট্রিবিউট করবি।’ লিফলেটটি লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে। আমি এটা দেখালাম রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে। উনি লিফলেটটা দেখলেন। বললেন, ‘বানান ভুল আছে, টেনস কয়েক জায়গায় ভুল। বাট ইট ক্যারিজ দ্য মিনিং।
আমি পাঁচজনের একটা টিম করলাম। কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, ফরিদপুরের আনিস আর আমি নিজে। রাত ১২টার পর বের হতাম। ধরা পড়লে স্ট্রেট ফাঁসি। কিন্তু নেতার নির্দেশে আমরা এটা করেছি। চাদর গায়ে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন এমবাসির গেটের সামনে ফেলে দিয়ে চলে। আসতাম।
এখন অনেকেই স্বাধীনতার কথা নানাভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে বলে। বাট দিস ইজ দ্য ফ্যাক্ট। বাংলাদেশপন্থী কেউ ছিল না, আমরাই ছিলাম। শেখ সাহেবের অনুসারীরাই ছিলাম। বামপন্থীরা আমাদের বলত ইললিটারেট গ্র্যাজুয়েটের শিষ্য।
মহি : সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আপনার পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা হলো কীভাবে?
মোয়াজ্জেম : একদিন খবর পেলাম ফজলুল হক হলে নতুন একটা ছেলে এসেছে। সারা দিন তাস খেলে। তার পার্টনার বদল হয়। কিন্তু তার বদল হয় না। কী ব্যাপার? আমার কৌতূহল হলো। তাকে ডেকে পাঠালাম এবং মুহূর্তেই তাকে পছন্দ করে ফেললাম। তাকে রিকুট করলাম। এভাবেই সিরাজুল আলম খান আমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হলো। ও ছিল খুব ভালো, হার্ডওয়ার্কিং। দিন-রাত কাজ করত।
মহি : উনি তো বলছেন, উনি ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস তৈরি করেছেন ১৯৬২ সালে। তো আপনারা শেখ মুজিবের দেওয়া স্বাধীনতার লিফলেট একসঙ্গে বিলি করলেন তারও আগে। এদিকে উনি বলছেন, উনি এটা শুরু করেছেন। উনি তো আপনার কথা বলেন না। এটা কি ওনার মনের সংকীর্ণতা?
মোয়াজ্জেম : তা বলতে পারব না। হয়তো তার মেমোরিতে এটা নেই। মনের সংকীর্ণতাও হতে পারে। তবে ও আমার খুব আস্থাভাজন। ছিল। আমিই তো ওকে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বানিয়েছিলাম। [১]
তারিখটি শাহ মোয়াজ্জেমের মনে না থাকলেও এ ব্যাপারে কিছু তথ্য পাওয়া যায় আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে। ওই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকেন ফজলুল হক মুসলিম হলে। চট্টগ্রামের ইতিহাস। গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হককে ২০০৭ সালের ২২ মার্চ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সময়টির উল্লেখ করে বলেন :
১৯৬১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের কথা। একদিন মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) আমাকে ডেকে কাগজে মোড়ানো কতগুলো প্রচারপত্র দিয়ে বললেন, এগুলো রাত তিনটার দিকে ভার্সিটি এলাকার হলে হলে, ঘরে ঘরে খুবই সাবধানে বিলি করতে হবে।’ তিনি চলে যাওয়ার পর সেগুলো খুলে দেখে প্রথমে আমি ঘাবড়ে যাই। কারণ সেখানে যা লেখা–ধরা পড়লে ১৪ বছর জেল নির্ঘাত। শিরোনাম ছিল স্বাধীন-পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর। নিচে লেখা সংগ্রামী জনতা’। সেখানে বাঙালিদের ওপর পশ্চিমাদের শাসন শোষণ এবং সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনীতিতে কীভাবে বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তার বিবরণ দেওয়া ছিল। এসব শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য বাঙালি ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানো হয় ওই প্রচারপত্রে। আমার মনের ভেতর যেহেতু স্বাধীনতার চেতনাটা ছিল, তাই সাহস করে রাতের মধ্যে ফজলুল হক হলের বিভিন্ন ঘরে গিয়ে দরজার নিচ দিয়ে প্রচারপত্র ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসি। বাকিটুকু একটি টয়লেটের বেসিনের ওপর রেখে রুমে এসে। শুয়ে থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি। সকালে আমার রুমমেট বাইরে গিয়ে ফিরে এসে বলল, বাইরে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের লিফলেট পাওয়া গেছে। আমি কিছু না জানার ভান করে বললাম, এগুলো বিপজ্জনক, বাইরে ফেলে দে, কাউকে কিছু বলিস না। [২]
.
২
১৯৬১ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতার মধ্যে কয়েকটি গোপন বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে মণি সিংহ ও খোকা রায় উপস্থিত ছিলেন। প্রথম বৈঠকে তাঁরা জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হন। এসব বৈঠক সম্বন্ধে খোকা। রায় বলেছেন :
শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছিলেন যে পাঞ্জাবের ‘বিগ বিজনেস’ যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল, তাতে ‘ওদের সাথে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে, ইত্যাদি।
তখন আমরা (আমি ও মণিদা) শেখ মুজিবকে বুঝিয়েছিলাম যে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করে, কিন্তু সে দাবি নিয়ে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিস্থিতি তখনো ছিল না।
‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি নিয়ে ওই সব আলোচনার পরের বৈঠকে শেখ মুজিব আমাদের বলেছিলেন, ভাই, এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও (অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল। [৩]
‘স্বাধীন পূর্ববঙ্গ’ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে আলোচনা ছিল। ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে গৃহীত ‘কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্ট ও প্রস্তাবাবলি’তে বিষয়টির উল্লেখ আছে।
বিষয়টি নিয়ে আমি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। এত দিন শুনে এসেছি, তাঁরা তিনজন বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য নিজেদের মধ্যে একটি প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন ১৯৬২ সালে। অথচ এর আগের বছর তিনি নিজেই স্বাধীনতার দাবিতে লেখা একটা লিফলেট প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন, যা ছিল মুজিবের লেখা। বিষয়টি আমি ইতিমধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছ থেকে জেনেছি বলে তাঁকে জানালাম। এবার তিনি মুখ খুললেন।
সিরাজুল আলম খান : ঘটনা একটা আছে। একদিন দুপুরে মোয়াজ্জেম ভাই বললেন যে, রাত আটটার দিকে সেন্ট্রাল পার্কে তুই আর রাজ্জাক আসবি। মনিকেও আসতে বলেছি।
মহিউদ্দিন আহমদ : সেন্ট্রাল পার্ক কোনটা?
সিরাজ : ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে।
মহি : আচ্ছা, রমনা পার্ক।
সিরাজ : হ্যাঁ। রমনা পার্ক। সেখানে আসবি। গেলাম। আমরা পাঁচজন। আমাদের একটা লিফলেট দিল। বললেন, দেখো একটু। ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে দেখলাম। বানান ভুল! পড়লাম। একেক হলের জন্য একেকজনকে দায়িত্ব দিল। আমি ঢাকা হল। ফজলুল হক হল হলো রাজ্জাকের। জগন্নাথ কলেজ হলো মনির। রাতেই বিলি করে দিয়েছি। বিলি মানে রুমে রুমে। সামনে দেওয়ার মতো অত সাহস ছিল না।
মহি : এটা তো মার্শাল ল থাকার সময়?
সিরাজ : হ্যাঁ। ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট। একটা লিফলেট, ওয়ান-সিক্সটিনথ সাইজ।
মহি: আমি মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওনার বইয়ে উনি এটা লিখেছেন। উনি লিখেছেন–পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট।
সিরাজ : হতে পারে।
মহি: একটা লিফলেট। শেখ মুজিব তাঁকে দিয়েছেন। উনি আমাকে বলেছেন–আমি পাঁচজনের টিম করলাম–আমি, মনি, ওবায়েদ, সিরাজ আর ফরিদপুরের একজন, ছাত্রলীগের আনিস। এই পাঁচজন মিলে আপনারা বিভিন্ন এমবাসির সামনে ফেলে এসেছেন।
সিরাজ : এমবাসি না, হলে হলে।
মহি: কিন্তু লিফলেটটা তো তাঁকে দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। আমি ডেটগুলো চেক করেছি। এর আগে এবং পরে শেখ মুজিব ওয়াজ ইন দ্য প্রিজন। মাঝখানে দেড়-দুই মাসের একটা ফাঁক আছে। ওই সময় এদের সঙ্গেও শেখ মুজিবের একটা ডায়ালগ হয়েছিল। মণি সিংহ এবং খোকা রায়, মানিক মিয়াসহ।
সিরাজ : মানিক মিয়া কি না জানি না। কমিউনিস্টদের সঙ্গে…
মহি: শেখ মুজিব আর মানিক মিয়া, অন্যদিকে মণি সিংহ আর খোকা রায়, এই চারজন। এদের মিটিং হয়েছে কয়েক দিন।
সিরাজ : অ্যাবাউট…
মহি: খোকা রায়ের বইতে এ প্রসঙ্গটি আছে।
সিরাজ : আমাদের যেদিন লিফলেটটা দিলেন। এই পার্কে, সেন্ট্রাল পার্কে, রাত আটটার দিকে। মোয়াজ্জেম ভাই তো আছেনই–আমি, রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি…
মহি : ওবায়দুর রহমান?
সিরাজ : না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন, সৈয়দ আকবর। তাকে মেরে ফেলেছে একাত্তরে, মার্চের ২৬ বা ২৭ তারিখে। ছাত্রলীগের অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ছিল। আমি তো তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
মহি: সৈয়দ আকবর আপনার ব্যাচমেট?
সিরাজ : কনটেম্পোরারি। মনি, ওবায়দুর রহমান, সৈয়দ আকবর, আমি, আসমত আলী শিকদার–আমরা ব্যাচমেট।
মহি : এটা ইন্টারেস্টিং। আপনি আগে বলেননি। সিরাজ : আমাদের এই সাক্ষাটা আধা ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়েছিল। লিফলেটটা ছিল পরিষ্কারভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে লেখা। মোয়াজ্জেম ভাই বললেন, আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে হবে।
আমরা চার ভাগে ভাগ হয়ে রমনা পার্ক থেকে চলে গেলাম। যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী লিফলেট নিলাম। আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন ছাত্ররা ক্যানটিনে নাশতা খেতে যাওয়ার সময় একটা করে লিফলেট পড়তে পড়তে যাচ্ছে।
এর কয়েক দিন পর মোয়াজ্জেম ভাই, মনি এবং আমাকে মুজিব ভাইয়ের বাসায় রাত ১১টার দিকে আসতে বললেন। দেখলাম বাসায়। একটা জিপগাড়ি। মুজিব ভাই শার্ট-প্যান্ট পরা। আমাদের তিনজনের গলায় হাত দিয়ে বললেন, ভালো থাকিস। উনি জিপে উঠে চলে গেলেন।
আমাদের বুঝতে বাকি রইল না, মুজিব ভাই কিছু একটা করার জন্য আমাদের বিশেষভাবে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী। সময়ে মুজিব ভাইয়ের আগরতলা যাওয়ার ঘটনাটিতে আমি কাজের। একটা লিংক খুঁজে পাই। তখন থেকে ভারত মুজিব ভাইকে একধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করে।
১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধকালে আমাদের প্রধান কার্যালয় ছিল কলকাতার ভবানীপুরে ২১ রাজেন্দ্রপ্রসাদ রোড, অর্থাৎ চিত্তদার (চিত্তরঞ্জন সুতার) বাড়ি। আমরা ওখানেই থাকতাম। সে সময়। একদিন আলোচনাকালে চিত্তদা বলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে ১৯৬১ ৬২ সাল থেকেই আর্থিক সহযোগিতা দিতেন। সে সহযোগিতা স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। [৪]
.
৪
শাহ মোয়াজ্জেমের কথায় বোঝা যায়, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে শেখ। মুজিবের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য তিনি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালান। এর একটি বিস্ময়কর বিবরণ পাওয়া যায় ঢাকায়। নিযুক্ত ভারতের তৎকালীন উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির কাছ থেকে। ব্যানার্জি পুরান ঢাকায় চক্রবর্তী ভিলায় থাকতেন। পাশের বাড়িতেই ছিল ইত্তেফাক অফিস। ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মাঝরাতে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া একটি ছেলেকে পাঠিয়ে ব্যানার্জিকে ইত্তেফাক অফিসে ডেকে আনেন। মানিক মিয়ার সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিব। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তারা কথা বলেন। ব্যানার্জি দেখলেন, একপর্যায়ে। শেখ মুজিব ও মানিক মিয়ার কথাবার্তার ধরন বদলে গেল। তারা কিছু একটা। বলতে বা দেখাতে চাইছেন। ব্যানার্জি জানতে চান তারা উঁচুপর্যায়ের কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে চাচ্ছেন কি না। মুজিব মুখ খুললেন। বললেন, এই বৈঠক ডাকার উদ্দেশ্য হলো, তারা ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতের। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা গোপন চিঠি পাঠাতে চান। মুজিব চিঠিটা ব্যানার্জির হাতে দিলেন। তাঁর মধ্যে তাড়াহুড়ো ছিল। চিঠিটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন করে লেখা। ভূমিকার পর সরাসরি একটা কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। মুজিব বললেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করবেন। মানিক মিয়া ইত্তেফাক-এ লেখার মাধ্যমে প্রচারকাজ চালাবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের মধ্যে মুজিব লন্ডনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। করে প্রবাসী সরকার গঠন করবেন। চিঠির শেষ প্যারাগ্রাফে নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন এবং সাজসরঞ্জাম চেয়ে নেহরুকে অনুরোধ। জানানো হয়। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মুজিব গোপনে নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে চান। [৫]
চিঠি পাঠানো হলো। ভারত তখন চীনের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত। দিল্লি থেকে। খবর এল, মুজিবকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। মুজিব ভাবলেন, ঢাকায় ভারতীয় উপহাইকমিশনের আমলাদের কারণেই দেরি হচ্ছে। ধৈর্য হারিয়ে তিনি কৌশল পাল্টালেন। গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় গেলেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। আগরতলায় মুজিবকে রেখে শচীন্দ্রলাল সিংহ দিল্লি যান এবং নেহরুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর নেহরু আরেকটি ফ্রন্ট খুলতে চাননি। শচীন্দ্রলাল সিংহ আগরতলা ফিরে এসে মুজিবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাকে সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং তা ভারতের ঢাকা উপহাইকমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নেহরুর পরামর্শ ছিল, এরপর থেকে মুজিব যেন ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমেই যোগাযোগ করেন, আগরতলার মাধ্যমে নয়। [৬]
শচীন্দ্রলাল সিংহের ভাষ্যে এবং শেখ মুজিবের জীবনীকার এস এ করিমের বিবরণে জানা যায়, শেখ মুজিব আগরতলা গিয়েছিলেন ১৯৬৩। সালের জানুয়ারির শেষ দিকে। তিনি সেখানে ছিলেন ১৫ দিন। তার আগরতলা মিশন সম্বন্ধে দলের সহকর্মীরা এবং সরকারের গোয়েন্দারা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। [৭]
১৯৯১ সালে মফিদুল হক দিল্লিতে শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ঘটনাটি নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। সেই ভাষ্য ফয়েজ আহমদ উল্লেখ করেছেন তাঁর আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহবইয়ে। [৮]
এ প্রসঙ্গে একটি ভিন্নমত আছে। শেখ মুজিব ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ত্রিপুরা গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের ওই সময়ের নেতা রেজা আলী। শেখ মুজিবের ত্রিপুরা মিশনে তিনিও যুক্ত ছিলেন। তাঁর ভাষ্য এ রকম :
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ বা ২ তারিখের দিকে উনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, তুই আমার সঙ্গে একখানে যাবি। যত দূর মনে পড়ে, ৩ তারিখেই রওনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় যাব, আমাকে এ ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই বলা হয়নি। যাওয়ার আগের মুহূর্তে আমাকে তিনি বলেছিলেন একটা ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট ঠিক করতে। তখনকার দিনে কুপে হতো। দুজন থাকতে পারত। নারায়ণগঞ্জ থেকে দুজন কুপেতে উঠবে। এই অ্যাডভেঞ্চারমূলক কাজে তখন আমি মর্তুজাকেও (প্রকৌশলী গোলাম মর্তুজা) জড়িয়েছিলাম। আমি গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাই টঙ্গী স্টেশনে। গাড়ি চালিয়েছেন অন্য দুজন। স্টেশনের পেছন দিকে তখন অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আমরা দাঁড়িয়ে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা দুজন নেমে গিয়েছিল। আমি আর মুজিব ভাই ট্রেনে উঠে পড়ি।
আমার দায়িত্ব ছিল মুজিব ভাইকে নিয়ে সিলেটের ট্রেনে উঠে যাওয়া। উনি তখনো বলেননি কোথায় নামবেন। সারা রাত আমরা ট্রেনে বসে ছিলাম। রাত তিন-চারটার দিকে গাড়ি যখন শ্রীমঙ্গলে এসে থামল, তিনি তখন বললেন, ‘তুই দরজাটা খুলে একটু দাঁড়া। দরজা খুলেই দেখি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী। উনি ওখানে থাকবেন, সেটা আমি জানতাম না। তিনি সম্পর্কে আমার মামা হন। তো তাঁর হাওলায় মুজিব ভাইকে দিয়ে আমি সিলেটে চলে গেলাম। তখন আমার সন্দেহ হয়েছিল, কেন ওখানে যাচ্ছিলেন উনি। আমাকে যেহেতু কিছু বলেননি, সে জন্য আমি জিজ্ঞেসও করিনি কখনো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা তার ইন্ডিয়ায় যাওয়ার একটা উদ্যোগের অংশ। শুধু ফরহাদ ভাইকে বিশ্বাস করে বলেছিলাম যে মুজিব ভাই আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে বলেছিলেন। [৯]
শেখ মুজিবের এই ট্রেনভ্রমণের কোনো রেকর্ড রেলওয়ে বিভাগের কাছে ছিল না। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা গোলাম মর্তুজা ও তাঁর সঙ্গীর নামে কেনা টিকিটে শেখ মুজিব ও রেজা আলী ট্রেনে চড়েছিলেন। গোপনীয়তার ব্যাপারটিতে কোনো ফাঁক ছিল না। উল্লেখ্য, মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী কনভেনশন মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, শেখ মুজিবের একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল। এর সঙ্গে তার দলের সম্পর্ক ছিল না। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও গোপনীয়তার অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল এই নেটওয়ার্ক। একটা বিষয় এখানে পরিষ্কার, ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ছাত্রলীগের যত দ্বন্দ্ব-বিরোধ থাকুক না কেন, মুজিবের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বিষয়টি সিরাজুল আলম খান জানতে পারেন অনেক পরে। তখনই জানার কথা নয়। কেননা ওই সময় শেখ মুজিব তাঁকে খুব ভালো চিনতেন না।
রেজা আলীর বিবরণ এবং এস এ করিমের ভাষ্যে তারিখের ফারাক লক্ষ করা যায়। শেখ মুজিব যে ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ত্রিপুরা গিয়েছিলেন, তার একটা প্রমাণ মেলে ওই সময় ত্রিপুরার খোয়াই মহকুমার এসডিওর ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে। ১৯৬২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, ২২ মাঘ ১৩৬৮, সোমবার ডায়েরিতে তিনি ইংরেজিতে লেখেন :
আজ বেলা প্রায় একটার সময় জনৈক মি. মুজিবুর রহমান, আমির হোসেন এবং টি চৌধুরী এসেছেন আশ্রমবাড়ি হয়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অনুযায়ী তাদেরকে তেলিয়ামুড়া পাঠিয়ে
দেওয়া হয়েছে। ডায়েরির লেখা থেকে এটা স্পষ্ট যে তারা তিনজন সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরায় ঢুকেছিলেন। তাঁরা ধরা পড়েন। মহকুমা কর্মকর্তা তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবের এই মিশন সফল হয়নি। দিনটা ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। ওই দিনই তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। এই মহকুমা হাকিমের নাম সমরজিৎ চক্রবর্তী। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে তিনি অবসরে যান। এতে পরিষ্কার বোঝা। যায়, তার চাকরির মেয়াদকালেই, অর্থাৎ ১৯৬২ সালেই শেখ মুজিব ত্রিপুরা। গিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সে কথাই লিখেছেন তিনি। [১০]
এস এ করিম তার বিবরণের সূত্র হিসেবে মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরীর কথা উল্লেখ করেছেন। দেখা যাচ্ছে, ১৯৬২ সালের ত্রিপুরা মিশনেও মোয়াজ্জেম চৌধুরী যুক্ত ছিলেন। যদি এস এ করিমের ভাষ্য সত্য হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, মোয়াজ্জেম তাঁকে বাষট্টি সালের ঘটনাটির তথ্য দেননি।
দুটি ভাষ্যই যদি সত্য হয়, তাহলে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে একটা ঘটনাক্রম সাজানো যায়। শেখ মুজিব প্রথম ত্রিপুরা যান ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর সে মিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। তিনি বেপরোয়া হয়ে বাষট্টির ডিসেম্বরে ঢাকায় ভারতীয় উপহাইকমিশনের কর্মকর্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলেন। যে করেই হোক, তিনি ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, ভারত সরকার হয়তো তখনই বিষয়টি আগ্রহের সঙ্গে লুফে নেবে এবং তিনি ত্বরিত একটা জবাব পেয়ে যাবেন। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেও কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি অস্থির
হয়ে পড়েন। তাঁর মনে হলো, ঢাকায় ভারতীয় উপহাইকমিশনের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই দেরি হচ্ছে। ধৈর্য হারিয়ে তিনি ১৯৬৩ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে আবারও ত্রিপুরার উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর দ্বিতীয় মিশন কিছুটা সফল হয়। তিনি আগরতলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং দিল্লিতে বার্তা পাঠাতে সফল হন।
তারপরও সন্দেহ থেকে যায়। প্রশ্ন হলো, এখানে তারিখবিভ্রাট আছে কি না। খোয়াই মহকুমার এসডিওর ডায়েরি একটি প্রামাণ্য দলিল, যা রেজা। আলীর দেওয়া তথ্যকে নিশ্চিত করেছে। প্রশ্ন হলো, শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলা এবং তার মাধ্যমে নেহরুকে চিঠি পাঠানোর পর মুজিব অতি উৎসাহী হয়ে আবার কেন ত্রিপুরায় যাবেন? এখানে গোল বাধিয়েছে মফিদুল হককে দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের ভাষ্য, যা কিনা একধরনের প্রত্যয়নপত্র। শেখ মুজিবের মতো একজন অতি সাবধানী এবং বিচক্ষণ। রাজনীতিবিদ ভারতীয় উপহাইকমিশনের কর্মকর্তাকে না জানিয়ে বা ডিঙিয়ে আবার ত্রিপুরায় যাবেন, এটা কষ্টকল্পনা মনে হয়। একমাত্র শেখ মুজিবই এই ধাঁধার অবসান ঘটাতে পারতেন।
এ তো গেল শেখ মুজিবের উদ্যোগের কথা। এর মধ্যে সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস-তত্ত্ব কতটুকু প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ? সম্প্রতি তাঁর অনুসারীরা, বিশেষ করে তার অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত আ স ম আবদুর রব দাবি করেছেন, সিরাজুল আলম খানই সবার আগে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তিনিই স্বাধীনতার রূপকার। বিষয়টি তারা জেনে বলছেন, নাকি না জেনে শুধু সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য শুনে বলছেন? বোঝা যায়, শেখ মুজিবের লেখা স্বাধীনতার প্রচারপত্র বিলি করা এবং তাঁর ত্রিপুরা মিশন সম্পর্কে রব ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। সিরাজুল আলম খান তাঁকে যা বলেছেন, তিনি তা বিশ্বাস করে বসে আছেন এবং তা-ই প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।
তথ্যসূত্র
১. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন
২. হক, মুহাম্মদ শামসুল (২০১৮), আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দি। ইতিহাসের খসড়া, চট্টগ্রাম, পৃ. ৩৮-৩৯
৩. রায়, খোকা (১৯৮৬), সংগ্রামের তিন দশক জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ৭০-৭১
৪. সিরাজুল আলম খান
৫. Banarjee, Sashanka S. (2011), India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation and Pakistan, Aparajita Sahitya Bhaban, Narayanganj, p. 17; আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৬)। আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ১১৬-১১৭
৬. আহমদ (২০১৬), পৃ. ১১৬-১১৭
৭. Karim, S. A. (2009), Sheikh Mujib : Triumph and Tragedy. UPL, Dhaka, p. 108-109
৮. আহমদ, ফয়েজ (১৯৯৪), আগরতলা মামলা: শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পরিশিষ্ট ৭
৯. রেজা আলী, ‘আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ ফরহাদ ভাই, আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা: মোহাম্মদ ফরহাদ স্মারকগ্রন্থ, মোহাম্মদ ফরহাদ স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা পরিষদ, ঢাকা, পৃ. ২৩৪-২৩৫
১০. মানস পাল