প্রথম অধ্যায় । নবি মুহাম্মদ । নবুওতির সমস্যা
ইদানীং প্রচুর বিদগ্ধজন ইসলামের উত্থান ও প্রসার নিয়ে সবিস্তারে অনুসন্ধান করেছেন। সেই-সাথে কোরানের আয়াতের অর্থ, বিন্যাস, প্রসঙ্গ এবং হাদিসের উদ্ভব নিয়েও হচ্ছে অনেক গবেষণা। পাশ্চাত্য পণ্ডিত যেমন জার্মান বংশোদ্ভূত প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ থিওদর নোলদেক(১৮৩৬-১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ), হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ইজহাক গোল্ডজিহার (১৮৫০-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ), অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত অধ্যাপক আলফ্রেড ভন ক্রেমার (১৮২৮-১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ), জার্মান বংশোদ্ভূত আরবি সাহিত্য বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম মেজ (১৮৬৯-১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ), ফরাসি বংশোদ্ভূত প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ এবং কোরানের ফরাসি অনুবাদক রেগিস ব্লাশের (১৯০০-১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ এ-ব্যাপারে তাঁদের গবেষণালব্দ কর্ম দিয়ে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখার মতো তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করেছেন ইসলাম, কোরান, হাদিস, আরব-ইতিহাসসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী। পর্যবেক্ষণ করেছেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। বরং তাঁদের গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য ইসলামি-নথিপত্র।
অবশ্য কোনো কোনো ইউরোপীয় লেখক নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গবেষণার কাজকে স্থিমিত করে ফেলেছেন। তারা মুহামদকে একজন স্রেফ অভিযাত্রিক ও ভণ্ড হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে কোরান হচ্ছে ক্ষমতালাভের একটি হাতিয়ার। অবশ্য কোরানের এই পশ্চিমা-সমালোচকেরা মুসা এবং যিশুকেও যদি সমালোচনা করতেন তবে হয়তো তাদের বক্তব্য কিছুটা বিবেচনাযোগ্য হতো (যদিও বিষয়টি এই বইয়ের আলোচনার বাইরে)। কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মুসা এবং যিশুকে ঈশ্বর স্বয়ং নিয়োজিত করেছিলেন, কিন্তু মুহামদকে নয়। তাঁদের এই বক্তব্যের সমর্থনে যৌক্তিকভাবে স্বীকৃত কোনো প্রমাণ নাই। এরকম ধারণা যারা পোষণ করেন তাঁদেরকে শুরুতেই নৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। নীতিগতভাবে তাঁদেরকে প্রথমেই নবুওতির বিষয়টি মেনে নিতে হবে। কারণ তারা একটি ক্ষেত্রে নবুওতির তত্ত্ব মানবেন, কিন্তু অন্যক্ষেত্রে মানবেন না, এটা যৌক্তিক আচরণ নয়।
আরবের প্রসিদ্ধ চিন্তাবিদ মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া’ এবং সিরিয়ীয় অন্ধকবি আবু আল আলা আল-মারিং নবুওতির দাবিকে স্বীকার করতেন না। তাঁদের মতে ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নবুওতি বা পয়গম্বরের দাবি অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য। ধর্মবিশ্বাসীরা বলেন স্রষ্টা অনুগ্রহপূর্বক কোনো ব্যক্তিকে নিয়োজিত করেন মানুষকে বিপথ এবং পাপ থেকে বিরত রাখার জন্য। যুক্তিবাদীরা বলেন স্রষ্টা যদি সৎকর্ম এবং মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক নিয়ে এতই চিন্তিত থাকেন তবে তিনি সবাইকে নিষ্পাপ এবং উত্তম করেই তৈরি করতেন। মানুষকে ঈশ্বরের মনমতো করে সৃষ্টি করলে কোনো পয়গম্বর বা তাঁর কোনো প্রতিনিধি পাঠানোর দরকার থাকত না। ধর্মবিশ্বাসীরা উত্তর দেন ভাল ও মন্দ ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়। ঈশ্বর নিজে থেকে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হলেও ভাল এবং মন্দ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ-থেকেও স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তুলেন যুক্তিবাদীরা – একজন ব্যক্তি কি ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ভালো বা খারাপ গুণের অধিকারী হতে পারেন?
একজন মানুষ তার বৈশিষ্ট্য লাভ করে পিতা-মাতা থেকে, গর্ভধারণের ক্ষণে। প্রত্যেক নবজাত শিশুই জন্মগ্রহণ করে কিছু শারীরিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এই বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে শিশুটির শারীরিক গঠনের উপর। কেউ ইচ্ছে করলেই যেমন পছন্দ করে নিতে পারে না তার চোখের রঙ, নাকের গঠন, হৃৎপিণ্ডের রক্তচাপ, দৈহিক উচ্চতা অথবা চোখের দৃষ্টিশক্তি, তেমনি কেউ ইচ্ছে করে তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা, স্নায়ুশক্তি এবং সহজাত প্রবৃত্তিকে বেছে নিতে পারে না। কেউ কেউ শান্ত এবং পরিমিত মেজাজের, আবার অনেকে উচ্ছঙ্খল, জেদি এবং চরমপন্থী। যারা সন্তোষজনক ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী তারা অন্য কারো স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে না। যারা আগ্রাসী তারা প্রায় হিংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হন।
বলা হয় যে, নবিদের পাঠানো হয় মানুষের চরিত্রের পরিবর্তনের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে একজন ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে কী পুরোপুরি সন্তোষজনক ভারসাম্যের ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করা যেতে পারে? মানবীয় আচরণের যে গুণাবলী বংশগত, সেগুলি কি অন্য ব্যক্তির সদুপদেশ দ্বারা পরিবর্তিত করা সম্ভব? আর তাই যদি সম্ভব হতো তবে মানব-ইতিহাসে ধর্মের আগমনের পরও কেন এতো হিংসা, নিষ্ঠুরতা, অপরাধপ্রবণতা বিরাজ করেছে এবং বিস্তার লাভ করেছে? ফলে আমরা বলতে বাধ্য হই যে, ঈশ্বর তাঁর প্রেরিত নবিদের দ্বারা মানবজাতির সকল নারী-পুরুষকে ভালো এবং সুখী বানাতে পারেননি। একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণকারী হিসেবে এই বিষয়ে মন্তব্য করা যেতে পারে যে, এর চাইতে সঠিক, সহজ এবং নিরাপদ ব্যবস্থা হতো যদি ঈশ্বর প্রথমেই সকল নারী-পুরুষকে ভালো বানাতেন।
ধর্মবিদদের কাছে এই সমালোচনার উত্তর প্রস্তুত আছে। তারা বলেন পার্থিব জীবন হচ্ছে একটা পরীক্ষা। ভালো ও মন্দ কর্তৃত্বপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। একজন নবি পাঠিয়ে ঈশ্বর চূড়ান্তভাবে ভালো কর্মের লোক, যারা ঈশ্বরের আদেশ পালন করবে, তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, ভবিষ্যতে তাদের জন্য রয়েছে স্বর্গের পুরস্কার। আর যারা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করবেন ভবিষ্যতে তাদের জন্য রয়েছে নরকের কঠোর শাস্তি।
নবুওতির অস্বীকারকারীরা বলেন ইহজীবন যে একটা পরীক্ষা এই যুক্তি অসার এবং অসমর্থনযোগ্য। যদি স্রষ্টা বা ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তবে তার বান্দাদের মনে যেসব গোপন চিন্তা আছে তা তো ঈশ্বর ঐ ব্যক্তির চাইতেও ভালো করে জানেন বা জানার কথা। তথাপি ঈশ্বর সবকিছু জেনেশুনে কেন তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নিবেন? তিনি কি আগে থেকেই জানেন না যে কে এই পরীক্ষায় কৃতকার্য হবে আর কে অকৃতকার্য হবে? ঈশ্বরের সবকিছুই কি পরিকল্পিত কিংবা এই মহাবিশ্বে ঈশ্বরের পরিকল্পনার বাইরে বা
কখনো নিজেদের কাজকে পাপ বলে মনে করবে না। ওরা যা করে তা ওদের মেজাজের বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্রের সাথে খাপ খায়। সবার যদি একই ধরনের সহজাত প্রবৃত্তি হতো তাহলে কেউ কেউ ঈশ্বরের আদেশ পালন করেন আর কেউ করেন না এর ব্যাখ্যা করা যায় না। সোজা ভাষায় বলা যায়, সবার মাঝে যদি ভাল মন্দ করার প্রবণতা সমানভাবে থাকতো তাহলে হয় সবাই ঈশ্বরের আদেশ পালন করবে, নয়তো সবাই ঈশ্বরের আদেশ পালন করবে না। সাধারণ এই বিবেচনার সাথে মুসলিম চিন্তাবিদদের এটাও মনে রাখা দরকার যে কোরানের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে, মানুষের ভ্রান্তি এবং সাধুতা নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার উপর। যেমন : ‘কাউকে প্রিয় মনে করলেই তুমি তাকে সৎপথে আনতে পারবে না; তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন,
আর তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে। (সুরা কাসাস ; আয়াত ৫৬)। আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতাম। (সুরা সিজদা ; আয়াত ১৩)। . . . আল্লাহ যাকে ইচ্ছা (উত্তম বাণীসংবলিত কিতাব) দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই। (সুরা জুমার ; আয়াত ২৩)। কোরানে এই ধরনের আয়াত এত অধিক যে এখানে সব উদ্ধৃত করা অসম্ভব। এই আয়াতগুলো এবং মানবকুলে মৌলিক পরিবর্তনে নবিদের অক্ষমতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধৰ্মজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী নবির প্রয়োজনীয়তার দাবি আসলে অর্থহীন।
ধর্মীয় পণ্ডিতদের অসার বক্তব্যগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়ে। তাঁদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে যে, সৃষ্টিকর্তা এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তা নবি এবং অবতার পাঠিয়ে থাকেন। এছাড়া ধর্মীয় পণ্ডিতরা মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা দ্বারা সৃষ্টির আগে মহাবিশ্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তিনি শূন্য হতে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এই ধরনের দাবি যাচাই-অযোগ্য। আমরা কেমন করে জানতে পারবো যখন ঈশ্বর অস্তিত্বশীল ছিলেন, অথচ মহাবিশ্ব, মহাকাশ কোনো কিছুই ছিল না। এটা সত্য যে, আজকের সৌরমণ্ডল ও তারকা, এবং নীহারিকার সর্বদা অবস্থিতি ছিল না। কিন্তু এগুলোর কোনো উপাদান মহাবিশ্বে বর্তমান ছিল না বরং হঠাৎ করে ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে এই মতবাদ যৌক্তিক নয়। ঈশ্বর মহাবিশ্বের সৃষ্টির উপাদানগুলো কোথা হতে কোন উপাদান দ্বারা সৃষ্টি করলেন? তারচেয়ে বরং পূর্ব থেকেই পরমাণুর অস্তিত্ব ছিল মেনে নেয়া যেতে পারে। পরমাণুর সংমিশ্রণে সূর্যের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু এখনো আমরা পরিষ্কারভাবে জানি না, কেমন করে পরমাণুর সংমিশ্রণ ঘটে এবং বস্তুর উদ্ভব হয়। তবে এই অনুকল্পের প্রমাণ দেখা যায় মহাকাশে অবিরামভাবে তারকাদের উদ্ভবে এবং তাদের মৃত্যুতে।
তাই বলা যেতে পারে যে সৃষ্টির সূচনা পদার্থ থেকে নয় বরং এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রূপান্তর। এই পরিস্থিতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দেখানো খুব কঠিন। আবার আমরা যদি ধরে নেই যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টির পূর্বে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল না তাহলে সমস্যা দেখা দিবে। সেই সমস্যা হচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ কী? আমরা চেষ্টা করেও দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। প্রশ্ন দুটি হচ্ছে ; বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আগে থেকে কেন ছিল না? আর ঈশ্বর কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন? প্রশ্নগুলোর কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর নেই ধর্মবিদদের কাছে। ফলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষেও কোনো যুতসই প্রমাণ দেখানো যাবে না।
এই রকম বিভ্রান্তির মাঝে আমাদের পার্থিব মনে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য জীবের সাথে একই শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে রাজি নই। মানুষ চিন্তাশীল প্রাণি এবং বহু পূর্ব থেকে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে এই বিশ্বমহাবিশ্বের সবকিছু কেউ না কেউ একজন শুরু করেছেন এবং তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন সকল শুভ এবং অশুভ প্রভাব। এই ধারণা যুক্তি দিয়ে হোক বা গর্ব অনুভবের জন্য অন্য প্রাণি থেকে মানুষকে পৃথক করে দেখার মানসিকতাই হোক, ধর্মগুলির উদ্ভব ঘটিয়েছে। আদিম অথবা প্রগতিশীল, সব সমাজে আমরা দেখি ধর্মের শক্তিশালী প্রভাব বিরাজমান। আদিম সমাজে আছে কুসংস্কার এবং মোহ। আধুনিক প্রগতিশীল সমাজে চিন্তাশীল ব্যক্তির প্রভাবে সভ্য এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। চিন্তাবিদরা আবির্ভূত হয়েছেন আইন প্রণয়নকারী, সমাজ সংস্কারক, অথবা দার্শনিকরূপে। যেমন হামুরাবি, কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, সক্রেটিস এবং প্লেটোসহ বিভিন্নজনের নাম উল্লেখ করা যায়। সেমিটিকদের মধ্যে সর্বদা এই ধরনের ব্যক্তিরা আবির্ভূত হয়েছেন নবি বা রসুল হিসেবে। অর্থাৎ তাঁরা স্বঘোষিতভাবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবি করেছিলেন।
মুসা সিনাই পর্বতে আরোহণ করে নিয়ে আসলেন লিপিফলক, যার ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করলেন ইসরাইলিদের সমাজব্যবস্থা সংস্কারের জন্য। যিশু দেখলেন ইহুদিরা অহংকার এবং মিথ্যা ধর্মানুরাগে নিমজ্জিত। তাই তিনি তাদেরকে উত্তম নৈতিকতা শিক্ষা দিতে উপস্থিত হলেন। তিনি ঈশ্বরকে তাঁর দয়াময় পিতা বলে প্রচার করলেন। তাই যিশু নিজস্ব বক্তব্যকে পিতা-পুত্রের বাণী হিসেবে প্রচার করলেন। অথবা যিশু এ-রকমটি না করে থাকলেও তাঁর ভক্তরা অলৌকিকতার প্রচার চালিয়ে যিশুর মহিমা প্রচার করলেন। ফলে এটা হতে পারে যে, নতুন বাইবেলের চারটি গসপেল যিশুর জন্মবৃত্তান্তকে বিকৃত করেছে অথবা তাঁর সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত গল্প সাজিয়েছে।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুহাম্মদের উত্থান ঘটে আরবের হেজাজে। তিনি সমাজ-সংস্কারের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানালেন। কিন্তু তিনি মুসা এবং যিশুর সাথে কীভাবে পার্থক্য সূচনা করলেন? সরলমনা ধর্মবিশ্বাসীরা অলৌকিক ঘটনার ভিত্তিতে নবুওতি বিশ্বাস করেন। এজন্য ইসলামি লেখকেরা শতাধিক অলৌকিক কাহিনী মুহাম্মদের ওপর আরোপ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে হাদাদ নামে একজন খ্রিস্টীয় আরব পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রচুর গবেষণা করে তিনি দ্যা কোরান অ্যান্ড দ্যা বাইবেল”নামে একটি বই রচনা করেছেন। কোরান থেকে প্রচুর উদাহরণ সংগ্রহ করে তিনি দেখিয়েছেন নবি মুহাম্মদ আসলে কোনো অলৌকিক কাজ করেননি। এরপর তিনি অর্বাচীনের মতো দাবি করেন যেহেতু অলৌকিক ঘটনা দিয়ে নবিদের মূল্যায়ন করা হয় তাই যিশু ও মুসার নবুওতি প্রমাণিত। আদতে সমস্ত অলৌকিক ঘটনাই অপ্রতিপাদনযোগ্য কল্পকাহিনী অথবা দৃষ্টিভ্রম। যিশু যদি সত্যি সত্যি কোনো মৃতব্যক্তিকে জীবিত করে ফেলতেন তবে ইহুদিদের মধ্যে একজনও থাকতো না যে যিশুর নবুওতিতে অবিশ্বাস করতো বা যিশুর প্রতি মাথা নত করতে দ্বিমত পোষণ করতো। ঈশ্বর যদি চাইতেন তাঁর প্রেরিত একজন রসুলের প্রতি সবাই বিশ্বাস আনুক এবং তাঁর শিক্ষা থেকে সবাই সুফল গ্রহণ করুক তবে ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক হচ্ছে সবাইকে ভালো এবং বিশ্বাসী বানিয়ে দেয়া। অথবা ঈশ্বর এটাও করতে পারেন যে, ঐ নবিকে মানুষের মনের উপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়ে দিতে পারতেন। এই প্রক্রিয়া একজন মৃতব্যক্তিকে পুনঃজীবিত করার ক্ষমতার চাইতে অনেক সহজতর। তখন সে নবির প্রয়োজন পড়তো না কোনো নদীর প্রবাহ বন্ধ করা বা আগুনকে প্রজ্জ্বলিত হতে বাধা দেয়া ইত্যাদি করতে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে নবুওতির সমস্যাকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করতে হবে। নবিকে দেখতে হবে একজন ব্যক্তি হিসেবে যাঁর রয়েছে অসাধারণ মানসিক এবং আধ্যাতিক প্রতিভা যা সচরাচর একজন সাধারণ ব্যক্তির মধ্যে নেই। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সামরিক নেতাদের মধ্যে আছেন সাইরাস, আলেকজান্ডার, সিজার, নাদির এবং নেপোলিয়ন। যুদ্ধ-পরিকল্পনায় এবং যুদ্ধে জয়ী হবার পদ্ধতিতে তাঁরা ছিলেন অসাধারণ কুশলী। কিন্তু জনসাধারণকে শিক্ষা দেবার মতো তাঁদের কিছুই ছিল না। শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানে আছেন অ্যারিস্টটল, ইবনে সিনা, নাসির উদ্দিন তুসি, টমাস অ্যাডিসন, আইনস্টাইন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, বিটোফেন, হোমার, ফেরদৌস, অন্ধকবি আবু আল আলা আল-মারি, হাফিজ, এবং আরও শতজন। তাঁদের আবিষ্কার, উদ্ভাবন, রচনা, এবং সেরা শিল্পকর্ম বিশ্বসভ্যতাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে। ফলে আধ্যাত্মিক জগতেও এই ধরনের ব্যক্তিত্ব থাকবেন না কেন? কোনো ব্যক্তি যদি গভীর ধ্যান বা চিন্তাশক্তি দ্বারা কোনো অসীম ক্ষমতাধরের ধারণা আবিষ্কার করেন এবং জনতাকে পথ-প্রদর্শনের জন্য সে ধারণা ধীরে ধীরে প্রেরিত বাণী বলে প্রচার করেন তবে তাঁর সেই ধারণা সহজে কোনো যুক্তি দিয়ে নাকচ করা যায় না।
বাল্যকালে মুহামদের মনেও একই ধরনের চিন্তা স্থান পায়। এজন্য সিরিয়া ভ্রমণকালে বাণিজ্যের কাজে ব্যস্ত না থেকে তিনি চট করে খ্রিস্টান সন্ন্যাসী এবং পাদ্রিদের সাথে আলাপে বসেন। ফেরার পথে মিদিয়ান, আদ এবং সামুদ সম্প্রদায়ের অনেক গল্প শোনেন। মক্কাতেও মুহামদ প্রায়ই ধর্মীয় ও আধ্যাতিক নেতা, সন্ন্যাসীদের সাথে আলাপ করতেন। তিনি মারওয়া পাহাড়ের নিকটে জাবর নামে এক ব্যক্তির দোকানে প্রচুর সময় কাটাতেন। সে-সময় খাদিজার চাচাতো ভাই হানিফ মতাবলম্বী ওয়ারাকা বিন নওফল নতুন বাইবেলের অংশবিশেষ আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। মুহাম্মদ ওয়ারাকার সাথেও প্রচুর সময় নিয়ে মতবিনিময় করতেন। এই আলোচনা-অভিজ্ঞতাগুলি মুহাম্মদের মনে দীর্ঘদিনের যে সুপ্ত চিন্তাভাবনা ছিল তা ঘূর্ণির মতো জেগে ওঠে।
জাবরের সাথে মুহাম্মদের ঘনঘন এবং দীর্ঘ আলোচনার কথা কোরানে উল্লেখ আছে। জাবর ছিলেন ভিনদেশি। তাই কুরাইশরা বলতেন, মুহাম্মদ কোরানের আয়াত পেয়েছেন এক বিদেশির কাছে। কোরানের সুরা নাহলে এ-বিষয়ে বলা হয়েছে : ‘আমি অবশ্যই জানি যে ওরা বলে, তাকে (মুহাম্মদকে) শিক্ষা দেয় এক মানুষ। ওরা যার প্রতি ইঙ্গিত করে তার ভাষা তো আরবি নয়, কিন্তু এ কোরান তো পরিষ্কার আরবি ভাষা।’ ( ১৬:১০৩)। মুহাম্মদের জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করার আগে অনেক ধর্মবিদ, সন্ন্যাসী-ঋষি এবং জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে ভাবের আদান-প্রদান করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছেন : হুয়ারিব গোত্রের সন্ন্যাসী আয়েশ, পারস্যের সালমান আল-ফার্সি এবং আবিসিনিয়ার (বর্তমান নাম ইথিওপিয়া) অধিবাসী বেলাল। এছাড়া আবু বকরও অনেক সময় মুহাম্মদের সাথে আলোচনা করে ধর্মীয় বিষয়ে একমত হন।
মুহাম্মদের জীবনী, হাদিস এবং কোরানের বেশকিছু আয়াতের ভিত্তিতে যে-কোনো অনুসন্ধানী ব্যক্তি প্রকৃত ঘটনা বের করে নিতে পারবেন। এই আলামতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় মুহাম্মদের ভাবুক মনের দুর্নিবার যাতনার ফলস্বরূপ তিনি এক অশরীর আত্মা বা দেবদূতের সাক্ষাৎ পান। কোরানের সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতে রয়েছে :
আরক্তি করে তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিও থেকে।
আবৃত্তি করো, তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত নাr( ৯৬১-৫) /
মুহাম্মদের নবুওতি প্রাপ্তির প্রথম সূরা। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। উচ্চতায় তিনি মাঝারি, শ্বেত বর্ণের ত্বক অনেক সময় লালাভ হয়ে যেত, কৃষ্ণকায় চুল ও চোখ। মুহাম্মদ কদাচিত কৌতুক করতেন বা হাসতেন। কখনো হাসলেও হাত দিয়ে হাসি চেপে রাখতেন। তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে স্বাচ্ছন্দে হাটতেন এবং হাঁটার সময় এদিক-ওদিক তাকাতেন না। কিছু লোকভাষ্য থেকে জানা যায় মুহাম্মদ কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কখনো কুরাইশ যুবকদের সাথে আমোদ-ফুর্তি বা লঘু কথাবার্তায় যোগদান করেননি। তিনি যৌবনে সততার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন, এমন-কী তাঁর শত্রুপক্ষ থেকেও। খাদিজাকে বিয়ের পর মুহাম্মদের আর্থিক চিন্তা দূরীভূত হয়। তখন তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক সময় ব্যয় করতেন। বেশিরভাগ হানিফ মতাদশীর মতো তিনিও নবি ইব্রাহিমকে নিখুঁতভাবে ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত মনে করতেন। আর এটা বলার অবকাশ থাকে না যে, তিনি তাঁর বংশের লোকদের পৌত্তলিকতাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন।
আধুনিক যুগের আরবের খ্যাতিমান পণ্ডিত তাহা হোসেনের মতে তখন বেশিরভাগ কুরাইশ নেতাও কাবার মূর্তিগুলোর উপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সম্মান দেখানোর বাহানা করতেন, কেননা বেদুইনদের মাঝে তখনও পৌত্তলিকতা শক্তভাবে বিদ্যমান ছিল। বেদুইনদের এই ধর্মীয় বিশ্বাস আর প্রথা পালন মক্কার কুরাইশদের জন্য নিয়ে আসতো আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা।
শব্দচয়নে মুহামদ ছিলেন সবসময় সুচিন্তিত এবং হুশিয়ার। একটি লোকভাষ্য অনুযায়ী মুহাম্মদ একসময় একজন কুমারী তরুণীর মতো লাজুক ছিলেন। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিল সুন্দর এবং তিনি কথা বলার সময় সর্বদা অর্থহীন পুনরাবৃত্তি এবং দীর্ঘ বক্তৃতা থেকে বিরত থাকতেন। তাঁর মাথার কেশ ছিল লম্বা এবং তা কানদ্বয়কে ঢেকে রাখত। মাথায় সচরাচর তিনি সাদা পাগড়ি পরতেন। মাথা এবং দাড়িতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন নিয়মিত। তিনি ছিলেন বিনয়ী এবং দয়ালু। করমর্দন করলে কখনোই তিনি নিজের হাত আগে ছাড়িয়ে নিতেন না। নিজেই নিজের পোশাক এবং জুতা মেরামত করতেন। তাঁর অধঃস্থ ব্যক্তিদের সাথে তিনি মেলামেশা করতে পারতেন অনায়াসে। একবার তিনি এক ক্রীতদাসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ক্রীতদাসের সাথে মাটিতে বসে খেজুর আহার করেন। ধর্মপ্রচারের সময় তিনি অনেকবার কণ্ঠ জোরালো করতেন বিশেষ করে যখন কোনো কাজের নিন্দা করতেন। এই সময় তাঁর চোখ দুটি এবং মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে যেত।
মুহাম্মদের চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর প্রচণ্ড সাহস। একবার এক যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি একটি ধনুকে হেলান দিয়ে মুসলমানদেরকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। যুদ্ধের সময় যখন মুসলমান যোদ্ধারা ভীত থাকতেন তখন মুহাম্মদ সমুখে হেঁটে শক্রর একেবারে কাছাকাছি চলে যেতেন, যা অন্য কেউ করতে পারতেন না। মুহাম্মদ মাত্র একজন ব্যক্তিকে স্বহস্তে হত্যা করেছিলেন। তাও হয়েছিল যখন সেই ব্যক্তি অসিযুদ্ধে মুহামদকে মারাত্মক আঘাত হানে। নবি মুহাম্মদের প্রচারিত কিছু বাণী হচ্ছে :
১. ‘কেউ যদি এক ব্যক্তিকে মন্দ জেনেও তার সাথে মেলামেশা করে এবং সে জানে যে ঐ ব্যক্তি মন্দ, তবে সে মুসলমান নয়।”
২. ‘পাশের ব্যক্তিটি ক্ষুধার্ত জেনেও যে ব্যক্তি একাকী আহার করেন তিনি মুসলমান নন।’
৩. ‘উত্তম নীতিমালা হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক।’
8. ‘সবচেয়ে উত্তম জিহাদ হচ্ছে একজন অনৈতিক ব্যক্তিকে সত্য জানিয়ে দেয়া।’
৫. ‘যে ব্যক্তি তার ক্রোধ সংবরণ করেন সেই-ই অধিক শক্তিশালী।’