গন্তব্য যাত্রা
লাহোরের মূল শহর থেকে একটু দূরে বিশাল ময়দান। হাজার হাজার তাঁবু, গাড়ী, ঘোড়া, সৈন্য ও সাজ সরঞ্জামে ঠাসা ময়দান। একটা তাবুর সাথে লাগানো আরেকটি তাঁবু। রাজ্যের হিন্দু প্রজারা নিজেদের সঞ্চিত সব ধন-সম্পদ অকাতরে রাজার সামরিক ভাণ্ডারে জমা করেছে। হিন্দু পণ্ডিত ও রাজার লোকেরা হিন্দু প্রজাদের মনে মুসলিম বিদ্বেষী উন্মাদনা ছড়িয়ে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ক্ষেপিয়ে তুলেছে গজনীর সৈনিকদের বিরুদ্ধে। হাজারো গরুর গাড়ী বোঝাই করা হয়েছে যুদ্ধযাত্রী সৈনিকদের পানাহার ও যুদ্ধসামগ্রী পরিবহণ করতে। আসবাব পত্রের বিরাট আয়োজন স্তূপাকারে রাখা হয়েছে ময়দানে। দু’ মাইল ব্যাসার্ধের গোটা এলাকাটি যুদ্ধ সরঞ্জাম ও তাবুতে ছেয়ে গেছে। দিনরাত টহল দিচ্ছে সশস্ত্র প্রহরী।
রাজা জয়পাল শীঘ্রই গজনী আক্রমণে প্রস্তুত। তাই যুদ্ধ সরঞ্জামকে বাইরে রাখা হয়েছে। সৈন্যদের বলা হয়েছে বাকী প্রস্তুতি দ্রুত সম্পন্ন করতে। তাবুর বাইরে পাহারার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বটে তবে তেমন কঠোর নয়। রাজার সেনা ছাউনী কিংবা যুদ্ধ সরঞ্জামে হাত দেবে এমন দুঃসাহস কারো ছিল না। এসব ক্ষেত্রে চুরির ঘটনাও কখনো ঘটেনি। তাই অশ্বারোহী প্রহরীরা মনের আয়েশে তাবুর চারপাশে ঢিলেঢালা টহল দিচ্ছে। রাজার এবারের যুদ্ধযাত্রা নিয়ে বেশির ভাগ সময়ই তারা আড্ডায় মতে থাকছে। লাহোরের মুসলিমদের পক্ষ থেকে দুস্কৃতির আশঙ্কাও তেমন ছিল না জয়পালের। কেননা, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ লাহোরে নামমাত্র কিছু সংখ্যক মুসলমানের বসবাস থাকলেও তারা অনুন্নত এলাকায় দীনহীন জীবন যাপন করতো। রাজার সময়োজনের বিরুদ্ধে কোন দুষ্কৃতির সাহস তাদের মোটেও ছিল না।
অবশ্য রাজার জানা ছিল, তার এলাকায় গজনীর গোয়েন্দা রয়েছে কিন্তু এরা তার বিশাল সমরায়োজনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে ঘুর্ণাক্ষরেও রাজা তা ভাবতে পারেনি। তাই বিশাল সমরায়োজনের প্রতি যতটুকু সতর্ক নজরদারী : দরকার ছিল ততটুকু ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি জয়পাল।
পণ্ডিতেরা সাধারণ হিন্দু প্রজাদের মধ্যে গজনীর সুলতান ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমনই ঘৃণা ও প্রতিহিংসা ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, হিন্দুরা রাজার আগ্রাসনকে ধর্মযুদ্ধ বলে বিশ্বাস করছিল। হিন্দু মহিলারা গায়ের অলংকার, জমানো টাকা আর বাজারে এটা ওটা বিক্রি করে যা-ই পাওয়া যেতো রাজার ভাণ্ডারে জমা করতো। প্রজাদের মনে বিশ্বাস ছিল, এবার ঠিকই রাজা গজনীর মুসলিম শাসককে পরাজিত করে সব মুসলিম প্রজাকে গোলাম-বাদী বানিয়ে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করবে। আর দেবদেবীদের জয়গান,ভারতের সীমানা পেরিয়ে গজনী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। মূলত রাজার এই বিশাল সাজ-সরঞ্জামের ভাণ্ডার স্ফীত হয়েছে সাধারণ প্রজাদের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে। অতএব, হিন্দুপ্রজাদের পক্ষ থেকে দুস্কৃতির আশঙ্কা মোটেও নেই।
অথচ জয়পালের বিশাল আয়োজন পর্বও খর্ব করে দেয়ার জন্যে গজনীর শার্দুলেরা পৌঁছে গিয়েছিল লাহোরে। শাহীনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, চিতার মতো ক্ষীপ্র, বিদ্যুতের গতি ও সিংহ শক্তির অধিকারী এরা। এরা ইসলামের জন্যে নমরুদের আগুনে আত্মাহুতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা শুধু এতটুকুই যাচাই করে, কাজটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের অনুকূলে কিনা। এরা বিশ্বাস করতো, শক্রর সিংহাসন উল্টে দেয়ার জন্যে কোন রাজশক্তির দরকার হয় না। রাজকীয় সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে সমান শক্তির সেনাবাহিনীর দরকার হয় না। এরা বিশ্বাস করতো, ঈমান শক্তিশালী হলে দুর্গের মহাপ্রাচীরও বালির বাঁধের মতো ধসিয়ে দেয়া যায়। যে মুহাম্মদ বিন কাসিম উপমহাদেশে। ইসলামের ঝাণ্ডা গেড়েছিলেন এরা ছিল সেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের উত্তরসূরী। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এরা এ অঞ্চলের নিবু নিবু ইসলামের প্রদীপকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন হাজারো জীবন।
এরা এসেছে ঘোড়ায় চড়ে। এদেরই দু’জন এখানকার সব চেয়ে দায়িত্ববান গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইমরানের সাথে দেখা করে তাদের উপস্থিতির কথা এখানে কর্মরত সহকর্মীদের জানিয়ে দেয়ার জন্য গিয়েছিল। আর অন্যরা ফাটা-ছেঁড়া, ময়লা পোষশাকে ঠিকানা অন্বেষে মুসাফির বেশে শহরের মধ্যে ঘুরাফেরা করে বিকেলেই শহরের বাইরে চলে গিয়েছিল। রাতে যখন শহরবাসী ঘুমের কোলে অচেতন, তখন এরা শহরের বাইরে এক নির্জন জায়গায় একত্রিত হয়ে উর্দিষ্ট বাস্তবায়নে জীবনবাজী রাখতে হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার করছে। পরস্পরে মুসাফা ও কোলাকোলি করে শেষবারের মতো এরা সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে হয় কার্যোদ্ধার নয়তো মৃত্যু- এই ছিল তাদের প্রতিজ্ঞা। এদের পরস্পরের আবার দেখা হবে এ প্রত্যাশা মন থেকে বিদায় করে দিয়েছিল গোয়েন্দারা। আবার জীবিত দেশে ফিরে যাওয়ার আশা এরা ত্যাগ করেই নেমেছিল এই কঠিন যুদ্ধে। নিরাপদ দূরত্বে ঘোড়া বেঁধে রেখে বিভিন্ন দিক থেকে দু’জন দু’জন করে তাবুর দিকে অগ্রসর হল। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটি করে পানিবহনের কৌটা। সাধারণ মুসাফির যেসব পাত্রে পানি বহন করে এরা এগুলোতে জ্বালানী নিয়ে এসেছে। সাথে রেখেছে দ্রুত আগুন জ্বালানোর সরঞ্জাম।
তাবুর বাইরে প্রহরীদের প্রতি তাদের সতর্ক দৃষ্টি। এক জায়গা দিয়ে দু’প্রহরী কিছু দূর চলে গেলে এই সুযোগে দু’জন ক্রোলিং করে মাটির সাথে শরীর মিশিয়ে দ্রুত দুটি তাঁবুর মাঝখানে গিয়ে থেমে গেল। কৌটা খুলে তাবুতে তেল ছিটিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। কিন্তু এখানে পৌঁছার আগেই আরো চার-পাঁচ জায়গায় আগুন জ্বলে উঠল। চার জানবাজ মালভর্তি গরুর গাড়ীতে জ্বালানী তেল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। প্রহরীরা হঠাৎ কয়েক জায়গায় একই সাথে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে কোনটা রেখে কোনটা নিভাবে দিশা পাচ্ছিল না। দ্রুত তাবুর ভেতরের লোকেরা আগুন নিভাতে বেরিয়ে আসল। কিন্তু এর আগেই গজনীর গায়েন্দারা চিতার ন্যায় ক্ষিপ্র গতিতে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। রাতের বাতাসে দেখতে দেখতে আগুনের লেলিহান শিখা সারা ময়দান গ্রাস করে নেয়। আগুনে আকাশ লাল হয়ে গেল। আলো ছড়িয়ে পড়ল বহুদূর পর্যন্ত।
আগুনের তাণ্ডবে ঘুমন্ত সৈন্যরা জেগে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করল। কে কার আগে জীবন বাঁচাবে- হুড়োহুড়ি করে অনেকেই আহত হল। গোলাবারুদের ডিপোতে আগুন ধরলে বিকট শব্দে সারা মাঠ কেঁপে উঠে। বাধা ঘোড়া ও গরুগুলো আগুনে দগ্ধ অর্ধদগ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করছিল আর ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদে গোটা ময়দান বিভীষিকাময় হয়ে উঠল। শহরের সকল বাসিন্দা জেগে উঠল আগুনের আলো ও মানুষের চিৎকারে। রাজার সব সৈন্য আগুন নেভানোর জন্যে ময়দানের দিকে দৌড়াল কিন্তু ততক্ষণে দু’মাইল ব্যাসার্ধের গোটা তাবু ঘেরা চত্বর আগুনে গ্রাস করে ফেলেছে। তাজা গাছপালায় পর্যন্ত ধরে গেছে। আগুনের তীব্র তাপের কারণে সৈনিকদের পক্ষেও তাবুর দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কর্মকর্তারা নির্দেশ দিচ্ছিল, এখনও যে সব। আসবাব পত্রে আগুন ধরেনি সেগুলো বাঁচাও কিন্তু কারো পক্ষেই আগুনের বেষ্টনি ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছিল না।
শহরের মজলুম মুসলিম অধিবাসীরা রাজার সমর সরঞ্জামে আগুন লাগায় স্বস্তিবোধ করছিল। কিন্তু হিন্দুরা এটাকে অগ্নিদেবতার অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ হিসেবে চিহ্নিত করে আহাজারি আর মাতম শুরু করে দিল। মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল। বড় পণ্ডিত সরস্বতির সামনে দু’হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি শুরু করল। সব হিন্দু কিশোরী মহিলা মন্দিরে জমায়েত হয়ে ভজনা গাইতে লাগল। আর সকল পুরুষ বাসিন্দাদের সৈন্যরা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল কুয়া থেকে পানি তুলে আগুন নেভানোর জন্যে। ঘোড়ার গাড়ী দিয়ে দূরের পুকুর ও নদী থেকে বড় মটকায় করে পানি এনে আগুন নেভানো তো দূরে থাক আধা মাইল দূর পর্যন্ত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব ছিল না।
“সকল প্রহরীকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে ফেল।” বলল রাজা। রাজা জয়পাল সর্বগ্রাসী আগুনে সকল যুদ্ধ সরঞ্জাম পুড়তে দেখে দিশেহারা হয়ে যায়। রাজা চিৎকার, চেঁচামেচি করে আগুনের চতুষ্পর্শ্বে ঘুরছিল আর অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিল। রাজার ভয়ে তার উজীর, নাজির ও জেনারেলরাও শহরবাসী ও সাধারণ সৈনিকদের গালিগালাজ করছিল আর কঠিন ভাষায় কাজের নির্দেশ দিচ্ছিল। রাজা যে ঘোড়ায় সওয়ার ছিল কাকতালীয়ভাবে সেই ঘোড়াটিও বিকট আওয়াজে হ্রেষাব করছিল।
অনেক চেষ্টায় সামান্য কিছু সরঞ্জাম রক্ষা করা সম্ভব হয়। অসহায়ের মতো এক পর্যায়ে রাজা, মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা দূরে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত লেলিহান অগ্নিশিখার দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল।
“কিভাবে আগুন লেগেছে তা বলা কঠিন।” বলল রাজা। যতো প্রহরী কাজে নিয়োজিত ছিল ওদের সবাইকে কয়েদখানায় পা উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখ। যদি কেউ আগুন সম্পর্কে সত্য তথ্য দেয় তবে তাকে মুক্তি দিবে, অন্যথায় তাদের এভাবেই ঝুলিয়ে রাখবে। আর আগামী পনের দিনের মধ্যে পুড়ে যাওয়া সকল সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আমাকে শীঘ্রই গজনী আক্রমণ করতে হবে। সুবক্তগীনের মৃত্যুর পরই দ্রুত গজনী আক্রমণ করা উচিত ছিল। এখন যত দেরী হবে তার স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি ততই প্রস্তুতির সময় পাবে।”
“এটা নিশ্চয়ই মুসলমানদের অপকর্ম।” বলল উজির উদয় শংকর। “মহারাজের কি স্মরণ নেই দু’কয়েদী যে পালিয়ে গেছে। হতে পারে ওরাই এই সর্বনাশের হোতা।”
“মুসলমানদের ঘরে ঘরে তল্লাশী কর। এদের ঘরে নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ রূপা আর খাদ্যদ্রব্য যা পাবে সব নিয়ে আসবে। কোন মুসলমানের প্রতি সন্দেহ হলে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো। কিন্তু আমার মনে হয় না তারা এমন অপকর্মের দুঃসাহস দেখিয়েছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল রাজা।
“এই অস্পৃশ্য জাতি এর চেয়েও জঘন্য কাজ করতে পারে।” বলল এক জেনারেল।
মহারাজ! আপনি গজনীর বন্দীদের কাছ থেকে বিজয়ের যে রহস্য উদঘাটন করছিলেন, আসলে এদের রহস্য এমনই। এদের দুঃসাহস আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। আমাদেরকে এদের দুঃসাহসের চরম শিক্ষা দিতে হবে। অবশ্য আমি এ দুর্বলতা স্বীকার করছি যে, আমাদের সৈনিকদের মনে এমন সাহস নেই। একথাও ঠিক যে, আমাদের যে সব সেনা সদস্য গজনী থেকে পালিয়ে এসেছে এদের মনে এখনও মুসলিম সৈন্যদের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
“তোমাদের সৈন্যদের বল, এ লড়াই আমাদের দেবতা ও মুসলমানদের পয়গম্বরের মর্যাদা রক্ষার লড়াই।” বলল রাজা। বলে দাও, এ লড়াইয়ে যদি কোন হিন্দু নিহত হয় তবে পরজনমে সে সুন্দর পাখি হয়ে পুনর্জন্ম লাভ করবে। উন্মুক্ত আকাশে আর সাজানে বাগানে সে মন মাতানো গান গেয়ে মাতিয়ে রাখবে।”
রাজা জয়পালের মাথা বিগড়ে দিয়েছিল পণ্ডিতেরা। তাই পণ্ডিতদের যাদুকরী প্রভাবে রাজা বাস্তবতা ভুলে ওদের মতোই দেবদেবীর অলীক শক্তি ও বিশ্বাসে আকতক্ষা পূরণের ও ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ফেলার স্বপ্নে উন্মাদ ছিল।, রাজা বলল, “তোমারা জান না, দেবী আমাদের উপর রুষ্ট হওয়ার কারণেই এসব হচ্ছে। আর পনের দিনের মধ্যেই দেবীর জন্যে কুমারী বলীদান করা হবে। তখন সব বিছুই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
“মহারাজ! আমার কথা আপনার ভাল নাও লাগতে পারে। এজন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।” বলল জেনারেল। একটি অবলা কুমারীকে বলী দিয়ে বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। বিজয়ের জন্যে আমাদের প্রত্যেকটি সৈনিককে জীবন বলীদানের অঙ্গীকার করতে হবে। এমনকি আমার আপনার জীবনও জাতির জন্যে উৎসর্গ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে এমন সন্তানের সংখ্যা না বাড়বে ততদিন পর্যন্ত বিজয়ের মুখ দেখা স্বপ্নই থেকে যাবে। যারা আমাদের সেনাবাহিনীর এক বছরের রসদ এক রাতে ধ্বংস করে দিয়েছে এরা কতটুকু জাতির জন্যে নিবেদিত প্রাণ তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে”।
“তোমার কি দৃঢ় বিশ্বাস, এই আগুন মুসলমানরা লাগিয়েছে?” জেনারেলের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রাজা।
“জী হ্যাঁ মহারাজা! জবাব দিল জেনারেল। আমি সেনাপতি। একজন সৈনিকের পরাজয় আমারই পরাজয়। আমি বাস্তববাদী। বাস্তবতাকে যাচাই করে সিদ্ধান্তে পৌঁছা আমার কর্তব্য। কোন সেনাপতি ধারণা আর অন্ধবিশ্বাসে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে না। আমি ভৌতিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করলে আপনার রাজমহল মসজিদে পরিণত হবে আর আপনার রাজত্ব অল্প দিনের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।
আমি আপনাকে বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত করছি। এটাই সত্য, আগুন মুসলমানরাই লাগিয়েছে। আমি নিরীক্ষা করে দেখেছি; আগুন এক জায়গায় লাগেনি। একই সাথে দশ পনের জায়গায় আগুন জ্বলে উঠে। যদি প্রহরীদের ভুলের কারণে আগুনের সূত্রপাত ঘটত তাহলে আগুন এক জায়গা থেকে জ্বলতো, একই সাথে ভিন্ন স্নি জায়গায় জ্বলতো না। এক জায়গায় থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে প্রহরীরা আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হতো।”
“তার মানে কি এখানে আগুন দেয়ার জন্যে গজনী থেকে সৈন্য এসেছিল? না শহরের সব মুসলমান এসে দশ পনের জায়গা আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে?” ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রাজা।
“একথা আমি হলফ করে বলতে পারি, এ আগুন শহরের মুসলমানরা লাগায়নি। গজনী থেকেও আগুন লাগাতে সৈন্য আসেনি। তবে যারাই আগুন লাগিয়ে থাকুক, এদের সংখ্যা কুড়ি পঁচিশ জনের বেশি ছিল না। আর এরা শুধু আগুন জ্বালাতে আসেনি, নিজেরাও জ্বলতে এসেছিল। এ ধরনের কাজ যারা করে এরা এমনই দুঃসাহসী হয়ে থাকে।
আমরা এদের পাকড়াও করে জীবিত জ্বালিয়ে দিলে কি হবে? এদের জায়গা আরো একশ’ জনে পুরো করে ফেলবে। আমাদেরকে এদের বুকের আগুন নিভাতে হবে। আর এ আগুন হলো তাদের ঈমান ও বিশ্বাসের আগুন। গাছের পাতা ঝরে পড়লে গাছ মরে না, গাছের শিকড় কেটে দিতে হয়।
আগুন জ্বেলে আগুন নেভানো যাবে না। আগুন নেভাতে হলে পানি ঢালতে হবে। আপনাকে আগুনের মতো তপ্ত মাথায় নয় ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে হবে।” বলল উজির উদয় শংকর।
এখানকার মুসলমানদের উপর জুলুম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এখানকার মুসলিম নেতাদের পুরস্কার-উপঢৌকন দিয়ে বাগে আনতে হবে। তাদের ইজ্জত-ইকরামের রাতের দরবার ও সুরা-গানের আসরে দাওয়াত করে মদ-সুরা ও নারীর সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ঈমানের জ্যোতি হৃদয় থেকে নিভিয়ে দিতে হবে। অতীতের কথা আমার মনে পড়ে। মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতের পশ্চিম-উত্তর প্রান্তে ইসলামের বীজ বপন করেছিলেন। তার আগমনে ভারতের অসংখ্যা হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ফলে আমাদের দেব-দেবীদের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসে। বিন কাসিমের অবর্তমানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে পদানত করতে চেষ্টা করেছে। পক্ষান্তরে বিন কাসিমের অনুসারীরা কৌশল প্রয়োগ করে তাদের সংস্কৃতিতে আমাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। দেখা গেছে, সাংস্কৃতিক কৌশলটাই শক্তি প্রয়োগের চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। অভিজ্ঞতা বলছে, মদ, নারী, আর ভোগ-বিলাসিতা মুসলিম নেতৃবর্গকে না প্রকৃত মুসলিম থাকতে দিয়েছে না হিন্দুয় রূপান্তরিত করেছে।
এক পর্যায়ে মুসলমানদের ইমলাম মসজিদের চার দেয়ালে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে গেছে। এদের শারীরিকভাবে শাস্তি দিয়ে বাগে আনা যাবে না। আত্মিকভাবে এদের হত্যা করতে হবে। প্রেম, মহব্বত ও ধোকা দিয়ে এদের সংস্কৃতি বিকৃত করে দিতে হবে। এদের হৃদয়ের ক্যানভাসে আঁকতে হবে আমাদের ভোগবাদী সংস্কৃতির রঙিন ছবি।
“রাজা জয়পাল আগুনের দিকে তাকিয়ে হতাশ ও ভগ্ন হৃদয়ে কথা বলছিল। এ জয়পালের গজনী অভিযান কিছু দিনের জন্যে মূলতবি হয়ে গেল। গজনীবাসীরা সেনা অভিযান ছাড়াই সফল আক্রমণ করে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে ফেলেছিল। অগ্নিকান্দ্রে উপস্থিত সুফল পাওয়া গেল। রাজার স্মৃতি থেকে কয়েদী কাসেম ও নিজামের ফেরার হওয়ার ব্যাপারটি হারিয়ে গেল।
এদিকে ঋষিকে পণ্ডিতেরা বলীদানের জন্য প্রস্তুত করতে পাহাড়ের উপর স্থাপিত মন্দিরে নিয়ে যায়। পাহাড়ের উপরের মন্দিরটিতে কোন স্থাপত্য নেই। অনেক আগে রাভী নদীর গতিধারা ভিন্ন ছিল। নদীর কূল ঘেঁষেই ছিল ঘন বন-জঙ্গল আর উঁচু উঁচু টিলার সমাহার। বর্তমানে যেটি বুড়ী নদী সেটিই আগে রাভী নদী ছিল। অসংখ্য পাহাড় ও টিলায় ঘেরা জায়গাটির মাটি পিচ্ছিল ও আগুনে পোড়ানো ইটের মতো শক্ত। জয়পালের আগের কোন রাজার আমলে হিন্দু কারিগররা টিলাগুলোকে কেটে চারদিকে দেয়ালের মতো করে গড়ে তোলে। তারা পাহাড় কেটে ভেতরে বালাখানার মতো অনেক কুঠরী বানায় এবং এসবের দেয়ালে দেবদেবীদের মূর্তি অংকন করে । পাথর কেটে মূর্তির অবয়ব তৈরি করে গোটা এলাকাটিকে মন্দিরে রূপান্তরিত করে ফেলে।
বাইরে থেকে কোন মানুষ সেখানে গিয়ে বুঝতেই পারতো না যে, এটি কি প্রকৃতই পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে, না মোটা দেয়াল তুলে এ মন্দির তৈরি করা হয়েছে। “ ওখানে সাধু সন্ন্যাসী ও মন্দিরের পণ্ডিত ছাড়া সাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। জায়গাটি যেমন দুর্গম, পথও ছিল জটিল। একটু পর পরই রাস্তার বাঁক ছিল এবং এক একটি রাস্তা কিছুদূর গিয়ে শেষ হয়ে যেতো। অভিজ্ঞতা ও– জ্ঞাত লোকছাড়া ওখানে কারো সাধ্য ছিল না যাওয়া এবং বেরিয়ে আসা। তা ছাড়া সাধারণ কোন পূজা অর্চনা ওখানে হতো না। শুধু বলীদান অনুষ্ঠানগুলো লিরার মন্দিরে সম্পাদিত হতো। জায়গাটি যেমন ছিল ভয়াল ড্রপ দুর্গম। পণ্ডিতেরা ছাড়া ওদিকটা মাড়োনোর সাহস করতে না কেউ। সবাই বিশ্বাস করত, ওখানটায় দেবদেবী ও ভূত-পেত্নীর আবাসস্থল। এজন্যই ওখানে বলীদানপর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
জয়পালের পর সুলতান মাহমূদ যখন ভারত অভিযান শুরু করেন তখন আল্লাহর অপার কৃপায় বুড়ী নদীর গতিপথ বদলে যায় এবং অসংখ্য কুমারী ও নারীর সম্ভ্রমহানী ও রক্তে রঞ্জিত টিলার মন্দিরের দেবদেবীর চিহ্নও নদীর পানি ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে টিলার অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে হিন্দুদের ইতিহাসে আর মুখে মুখেই শুধু সেই মন্দিরের কথা শোনা যায়। বাস্তবে ওখানে এখন টিলা ও মন্দিরের কোন নামগন্ধও নেই।
যে রাতে গজনীর গোয়েন্দা শার্দুলেরা জয়পালের যুদ্ধ সরঞ্জামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সে দিন বিকেলেই তাদের দু’জন ইমরানকে তাদের আগমনের ও অপারেশনের কথা জানাতে হাজির হয়েছিল ইমরানের ঘরে। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পরই আবার গেটে কড়া নাড়ার শব্দ হল। ইমরান গেট খুলে দিতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো জামিলী। ইমরান গেট বন্ধ করে রাগতস্বরে জামিলাকে বলল- “আমার ঘরে আসতে তোমাকে নিষেধ করেছিলাম, তারপরও আসলে কেন? ‘
জবাব না দিয়ে তার পার জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল জামিলা। কান্নাজড়িতকণ্ঠে বলল, “আমাকে পাপ থেকে বাঁচাও ইমরান। আমি ঘুমাতে পারি না। আমার চোখের সামনে সব সময় দৈত্যের মতো কি যেন এসে তয় দেখাতে থাকে। ইমরান! তুমি আমাকে রক্ষা কর।”
গভীর রাত। ইমরান জামিলাকে ঘরে নিয়ে যেতে দ্বিধা করছিল। কারণ, ঘরে কাসেম নিজাম অবস্থান করছে। জামিলাকে সে তাদের অবস্থান জানতে দিতে চায় না আর ওদেরকেও এটা বুঝতে দিতে চায় না যে, সে গোয়েন্দা কর্ম ছেড়ে নারী নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। জামিলার সাথে সে কথা বলতেই প্রস্তুত ছিল না কিন্তু ওর অবস্থান এতই বিপর্যস্ত ছিল যে, তাকে আর ধমকানো উচিত মনে করলো না ইমরান।
‘দেও-দৈত্যের কথা কি বলছ! ওসব কিছুই না। তোমার অপরাধই ডাইনী হয়ে তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে।”
“না ইমরান! ঋষি আমার চোখে ভাসতে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না। ওর চিৎকার আমার আত্মা কেঁপে ওঠে। চল ইমরান, ঘরে বসে কথা বলি।”
“না, ঘরে যাওয়া যাবে না। যা বলার এখানেই বল। আমার পাশে এসে দাঁড়াও।”
“আমি দাঁড়াতে পারছি না। আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমাকে বাঁচাও ইমরান। এত নিষ্ঠুর হয়ো না।”
জামিলার কাছে মেঝেতে বসল ইমরান। জামিলা তার শরীর ঘেঁষে বসল। সে ভয়ে কাঁপছে।
“আমি চোখ বন্ধ করলেই ঋষি চিৎকার করে আমাকে জাগিয়ে দেয়। ও আমাকে অভিশাপ দিতে থাকে, ভয়ে আমার আত্মা কেঁপে উঠে। আমি কিছুই বলতে পারি না। অন্ধকারেও আমি ঋষিকে দেখি। তবে সেটি সুন্দর ঋষি নয়, ইয়া লম্বা লম্বা দাঁত, বিরাট নখ আর কাঁটাভরা শরীর নিয়ে দৈত্যের মতো আমার দিকে তেড়ে আসে। কিন্তু কাছে এস বাতাসে মিলিয়ে যায়। গতরাতে এ দৈত্য থেকে বাঁচার জন্যে আমি ঘরের কোণে কোণে দৌড়াদৌড়ি করে কাটিয়েছি। সারাটা দিন আমি ঘুমাতে পারিনি। দিনের বেলায় ওকে দেখতে না পেলেও ওর চিৎকার শুনতে পাই। আমার মনে হয়, ঋষি আমার কামরাতেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পাই না। আমাকে মেরে ফেলবে, ইমরান! আল্লাহর দোহাই! তুমি আমাকে ঋষির প্রেতাত্মা থেকে বাঁচাও!”
বস্তৃত জামিলা ছিল মজলুম তরুণী। তার মা-বাবা টাকার লোভে মোটা অংকের পণ নিয়ে জামিলার চেয়ে তিনগুণ বেশি বয়সের এক বুড়োর সাথে তাকে বিয়ে দেয়। অথচ জামিলা পরমা সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী ও টগবগে তারুণ্যদীপ্ত রমণী। বণিকের ঘরে সে তৃতীয় বউ। মাসান্তে সফর থেকে বাড়ি ফেরা বণিকের ক্ষণিকের বিনোদন সঙ্গীনীমাত্র। জীবনের স্বাদ ও যৌবনের আহ্লাদ থেকে সে বঞ্চিতা, নিপীড়িতা। তাই তার হৃদয়ে এই অনাচার ও অতৃপ্তির যন্ত্রণায় জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের সর্বনাশা আগুন। এই প্রতিশোধ বিত্তের বিরুদ্ধে বিকৃতির বিরুদ্ধে, সর্বোপরি অসচেতন বাবা-মার আত্মমর্যাদাহীনতার বিরুদ্ধে।
জামিলা যখন বাড়ির বারান্দা থেকে প্রতিদিন এই পথে সুদর্শন ইমরানকে । যেতে দেখত আর ওর হাঁটাচলা, ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যে যে ছন্দময় ব্যঞ্জনা ফুটে উঠতো তা দেখে জামিলার হৃদয়ের বঞ্চনার হাহাকার আরো উথলে উঠতো, শুরু হতো দগ্ধ হৃদয়ে কামনার অগ্ন্যুৎপাত।
দেখতে দেখতে ইমরানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সে ইমরানের খোঁজ খবর নিয়ে তার ঠিকানা উদ্ধার করে। দৃষ্টি রাখতে ইমরানের প্রতি। একদিন ইমরানের ঘরে প্রবেশ করে পরিচিত হয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করল। ইমরান তার প্রতি আকৃষ্ট না হলেও জামিলা আশা ছাড়েনি। কিন্তু ঋষিকে ওর ঘরে আসতে দেখে জামিলা ঋষির প্রতি ইর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। ইমরানকে পাওয়ার পথে ঋষিকে কাটা মনে করে। তাই ঋষিকে সরিয়ে দিয়ে জামিলা ইমরানকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে যখন দেখল, উদ্দিষ্ট অর্জন তো দূরে থাক তার জীবনই দুর্বিসহ হতে চলেছে, তাই সে এখন বিভীষিকাময় জীবন থেকে বাঁচার জন্যে ইমরানের দারস্থ হয়েছে। তবুও সে আশাবাদী, ইমরান তাকে সাহায্যে করবে। প্রয়োজনে সে কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে। ইমরানের সব কথা মেনে নিবে।
মূলত জামিলা দুশ্চরিত্রা ছিল না। কিন্তু ইমরানের প্রেম প্রত্যাখ্যান ও তাকে পাওয়ার আশঙ্কা তাকে ভয়াবহ অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। সে মন্দিরের বড়। পণ্ডিতকে থলেভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ঋষিকে বলীদানে প্ররোচিত করে এখন বিবেকের দংশনে ভুগছে। সে নিজেকে ঋষির ঘাতক.ভাবছে। তার সরলমন এই মহাপাপ থেকে মুক্তি চাচ্ছে। তাই ইমরানের পায়ে ধরে এর প্রতিকার ভিক্ষা করছে জামিলা।
“গত রাতে তোমাকে আমি বলেছিলাম, পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর, নইলে, পাপের আগুনে তুমি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।” বলল ইমরান। “এখনও ঋষি জীবিত। যে দিন তাকে হত্যা করা হবে সেদিন থেকে ওর প্রেতাত্মা তোমার ঘাড়ে সওয়ার হবে। যতদিন তুমি জীবিত থাকবে ওর প্রেতাত্মা তোমাকে তাড়াতে থাকবে। তুমি রাতে ঘুমাতে পারবে না, পাগল হয়ে যাবে, নয় তো আত্মহত্যা করবে। অথবা রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে ভূতে পাওয়া মানুষের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করবে। মানুষ তোমাকে দেখে ভয়ে পালাবে। লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দিবে।”
“জামিলা ভয়ে জড়সড় হয়ে ইমরানের শরীরের সাথে মিশে যেতে চাইল। কাঁপছে থরথর করে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, বল, এখন আমাকে কি করতে হবে! আর এক রাত এভাবে কাটালে আমি পাগল হয়ে যাবো।
“ঋষিকে পণ্ডিতদের কজা থেকে মুক্ত করে দাও।” বলল ইমরান। সে ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছে, জামিলা ঋষিকে মুক্ত করার ব্যাপারে কাজে লাগতে পারে।
“আমি কিভাবে ওকে মুক্ত করবো?”
“সে কাজ আমি করব। তুমি শুধু আমার সহযোগিতা করবে। এতেই তোমার মুক্তি। ঋষি খুন হলে সে দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে কিন্তু তোমার যে কী ভয়াবহ অবস্থা হবে সে কথা তোমাকে আমি বলেছি।”
“তুমি যা-ই বল আমি তা-ই করব।”
“উঠ! ভেতরে চল।” ইমরান জামিলাকে ভেতরে নিয়ে গেল। ইমরান জামিলাকে অন্য একটি কামরায় বসাল। কাসেম ও নিজামের কামরায় একে নেয়া উচিত মনে করেনি। ঘরে বাতি জ্বালিয়ে ইমরান জামিলাকে বলল, “একাকী একটু বসো, ভয় নেই। এখানে ঋষির প্রেতাত্মা আসবে না।”
কাসেম ও নিজামের ঘরে গিয়ে ইমরান জামিলা ও ঋষির ঘটনা জানিয়ে । বলল, সে ঋষিকে মুক্ত করতে জামিলাকে ব্যবহার করতে যাচ্ছে।
“মনে হচ্ছে তুমি আমাদের ফেরার করিয়ে এখানে এনে আরেক মুসিবতে ফেলে দিলে। তুমি এখানে প্রেম-প্রীতি নিয়ে মেয়েত থাকো, আমরা নিজেরাই বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।” বলল নিজাম।
“আমি ইক ও প্রেম-প্রিয়ার ফাঁদে আটকাবো না। আগেই আমি তোমাদের বলছি, ঐসব কৃচক্রী পণ্ডিতদের আমি জানিয়ে দিতে চাই, ওদের কাদা মাটির তৈরি মূর্তিগুলো মুসলমানদের কোনই ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। আমি ওদের আখড়া থেকে ঘোড়ার ব্যবস্থা করে ছিনিয়ে এনে এদের বুঝিয়ে দেবো, কাদের ধর্ম সত্য। আমি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে রেখেছি। আজ রাতেই যদি আমি মেয়েটিকে মুক্ত করতে পারি তবে আর এখানে ফিরে আসব না। তোমাদেরকেও সাথে নিয়ে যাবো এবং ওখান থেকেই গজনী রওয়ানা হবো।” বলল ইমরান।
“তুমি কি ভেবেছো?” বলল কাসেম বলখী। “কিসের ভিত্তিতে এতো দৃঢ়তার সাথে বলছো যে মেয়েটিকে তুমি মুক্ত করতে পারবে?”
ইমরান তার পরিকল্পনার কথা সব খুলে বলল কাসেম ও নিজামকে। ইমরানের পরিকল্পনা শুনে উভয়েই সম্মত হল। এরপর তিনজন পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত অপারেশনের ফয়সালা করে ফেলল। এদের এ ঘরে রেখে ইমরান জামিলার-কামরায় গেল।
“এখানে কি ঋষির প্রেতাত্মা দেখা যায়”? জামিলাকে জিজ্ঞেস করল। ইমরান।
“না! কিন্তু ভয় লাগে।”
“তুমি পণ্ডিতদের কজা থেকে ঋষিকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এজন্য ওর প্রেতাত্মা আর তোমাকে ভয় দেখাবে না। ঋষি মুক্ত হয়ে গেলে তোমার পেরেশানীও থাকবে না।”
“আমাকে তো বলবে, কি করতে হবে আমার” অনুযোগের সুরে বলল। জামিলা।
“তোমাকে আমি একথাও বলে দিচ্ছি, যদি সফল হও, তবে আর এ বাড়িতে তোমাকে ফিরে আসতে হবে না।” বলল ইমরান। “আমার সাথে তোমাকে গজনী নিয়ে যাব।”
“সত্য বলছো!” হতাশার সাগরে আশার ঝিলিক দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল জামিলা।
“আমি কখনও কাউকে ধোঁকা দেই না। তোমাকেও ধোকা দেবো না।” • বলল ইমরান।
“এখন তুমি পণ্ডিতের আখড়ায় যাবে। গিয়ে বলবে, তুমি ঋষিকে স্বচক্ষে দেখতে চাও। এজন্য তোমাকে টিলার মন্দিরে নিয়ে যেতে বলবে। তোমাকে থলে ভর্তি আশরাফী দিচ্ছি, এগুলো পণ্ডিতকে দেবে। আশা করি, এসব পেয়ে পণ্ডিত রাজী হয়ে যাবে। এছাড়া ও পণ্ডিত যা দাবী করবে রাজী হয়ে যাবে। ভয় পেয়ো না। আমি তোমার পিছনেই থাকছি। তোমার কাজ শুধু পণ্ডিতকে টিলার মন্দির পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। কারণ, সেখানে সাধু-পণ্ডিত ছাড়া সাধারণ মানুষ যাওয়ার রাস্তা জানে না। সেখানে কারো যাওয়ার অনুমতিও নেই।”
“পণ্ডিত যদি আমাকে নিয়ে যেতে রাজী না হয় তবে কি করব?”
যেতে না চাইলে তুমি ছলে বলে তাকে মন্দিরে নিয়ে আসবে। আমি তাকে মন্দির যেতে বাধ্য করব। তাও যদি না যেতে চায় তবে এটিই হবে ওর জিন্দেগীর শেষ রজনী।”
“তাহলে আমার কি হবে?” উদ্বেগ কণ্ঠে বলল জামিলা। “আমি তো বলেছি, তোমাকে আর ঐ বুড়োর ঘরে যেতে হবে না। তুমি এখন আমার জিম্মায়। মন থেকে সব সন্দেহ-সংশয় ঝেড়ে ফেলে দাও। তুমি এখনই পণ্ডিতের আখড়ায় চলে যাও। আমি পেঁচার আওয়াজে তোমাকে সংকেত দিলে পণ্ডিতকে বাইরে নিয়ে আসবে।” বলল ইমরান।
জামিলাকে আশ্বস্ত করার জন্য ইমরান তাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করল। শেষে করেকটি থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে বিদায় করল । জামিলাকে বিদায় করেই ইমরান ঋষির ভাই জগমোহনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। জগমোহন খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরে বসেছিল। এমনিতেই মোহনের মন পৌত্তলিক ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল। একমাত্র বোন ঋষিকে পণ্ডিতেরা দেবীর চরণতলে বলীদানের নামে হাইজ্যাক করায় পৌত্তলিক ধর্মের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেছিল জগমোহন।
ইমরান! পণ্ডিতেরা আমার ছোট বোনটিকে বলী দিতে নিয়ে গেছে।
আমি কোন পণ্ডিতকেই জ্যান্ত ছাড়ব না। কেউ জানবে না কে পণ্ডিতদের হত্যা করেছে।… তুমি কি করে আসলে?
“ওখানে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ইমরান। ঋষিকে তারা টিলার মন্দিরে নিয়ে গেছে। আমরা ওখানে গেলে পথ খুঁজে পাব না। পণ্ডিতেরা আমাদের ওখানে দেখলে খুন করে আমাদের মরদেহ মাটিতে পুতে রাখবে। ওখানে যাওয়ার চিন্তা করো না ইমরান!”
“চিন্তা আমি অনেক করেছি। তোমার মন যদি তোমাদের ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে তবে তোমাদের উচিত এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। আমি তোমাকে আর তোমার বোনকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।”
“ঋষি! ঋষি কোথায় এখন?” বসা থেকে লাফিয়ে উঠে ইমরানের কাছে নিয়ে আসে জগমোহন। তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। এ মুহূর্তে আমার কাছে আর কিছু জানতে চাইবে না। যদি সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে আমি না পৌঁছি তাহলে বুঝবে. আমি আর বেঁচে নেই।”
অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল মোহনের। কিন্তু ইমরান যখন নিষেধ করল, তখন আর জিজ্ঞেস করেনি। ইমরানের উপর জগমোহনের অগাধ আস্থা। সে চারটি ঘোড়া নিয়ে রাভী নদীর পাড়ে অপেক্ষার প্রতিশ্রুতি দিল এজন্যে যে, ইমরান তার বোনকে মুক্ত করে নিয়ে আসবে। এরপর বোন-ভাই ও ইমরান এক সাথে এদেশ ছেড়ে চলে যাবে। ইমরানের ব্যাপারে সে মনের মধ্যে কোন সংশয়কে প্রশ্রয় দিল না। তার মনে পণ্ডিতদের অপকর্মের প্রতিশোধ গ্রহণে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ইমরানের কথায় মোহনের হৃদয়ে নতুন জীবনের আলোক জ্বলে উঠল।
রাতের প্রথম প্রহরেই মন্দিরের বাইরে একটি ঝোঁপের আড়ালে নিজাম, কাসেম ও ইমরান লুকিয়ে রইল। ওদের পাশ দিয়ে একটি ছায়ামূর্তি চলে গেল।
“আমি তোমার পাশেই আছি জামিলা! তোমার কোন ভয় নেই।”
ইমরানের কণ্ঠ শুনে ছায়ামূর্তি থেমে গেল।
ইমরান এগিয়ে গেল। ইমরান জামিলাকে জানাল, সে একা নয়। তার সাথে আরো দু’জন রয়েছে। সামনে কি ঘটতে পারে সে ব্যাপারে ইমরান অনিশ্চিত। তাই জামিলার কাছ থেকে কাসেমও নিজামকে আড়াল করে রাখাটাই যৌক্তিক মনে করছে ইমরান। জামিলা চলে গেলে কিছুক্ষণ পর ইমরান সাথীদের নিয়ে এগিয়ে গেল।
“আমি বুঝতে পারছি না, এ কঠিন অপারেশনে তুমি কীভাবে সফল হবে?” ইমরানের প্রতি প্রশ্ন ছেড়ে দিল নিজাম।
“আমি যা কিছুই করছি আল্লাহর উপর ভরসা করে করছি। আমি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে সাফল্যের দু’আ করেছি। মনে আল্লাহর রহমতের বিশ্বাস নিয়ে তাঁর নামে এ কাজে নেমেছি। আমি যদি সত্য পথে থাকি তবে আমার বিশ্বাস, আল্লাহ তাআলা আমাকে সফল করবেনই।”
রাতের অন্ধকারে মন্দিরটাকে একটা বড় ভূতের মতো দেখাচ্ছিল। জামিলাকে সাহস দেয়ার জন্য একটু পর পর জোরে কাশি দিচ্ছিল ইমরান। পণ্ডিতের ঘর থেকে জানালার ফাঁক দিয়ে আলো দেখতে পেল ইমরান। জামিলা মন্দিরে প্রবেশ করে পণ্ডিতের ঘরের দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে গেল। ইমরান দেখতে পেল, জামিলা ঘরে ঢুকেছে।
সাথীদের নিয়ে আরো এগিয়ে গেল ইমরান। মন্দিরের কাছে গিয়ে সাথীদের একটি গাছের আড়ালে দাঁড় করিয়ে সে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে পণ্ডিতের দরজার কাছে চলে গেল। দরজার ফাঁক গলিয়ে সামান্য আলো বাইরে পড়েছে। মাত্র তিন চারটি সিঁড়ি দূরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বুঝে সে আরো সতর্ক পায়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে একেবারে দরজার সাথে মিশে দাঁড়াল।
“আমি বুঝতে পারছি না, তুমি ছোট্ট শিশুর মতো মেয়েটিকে দেখার জেদ ধরেছো কেন? ওখানে কোন হিন্দুও যেতে পারে না, আর তুমি তো মুসলমান!” বলল পণ্ডিত।
“আমি এই প্রেতাত্মাটাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে চাই। দূর থেকে দেখেই চলে আসব।”
“আমার অবশ্য আজ রাতে ওদিকে যাওয়ার কথা আছে। তবে আমি যাবো রাতের দ্বিপ্রহরে। তুমি কি এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে?”
“এখনই একটু চলুন না।” অনুনয়ের সুরে বলল জামিলা। আপনার পাওনা আপনার সামনেই পড়ে আছে। না চাইতেই আমি আপনার ধারণার চেয়েও বেশি পুরস্কার দিয়েছি। আমি জানি, আপনারা কুমারী বলীদানের নামে যা করছেন সবই প্রতারণা। আমি ইচ্ছে করলে এখন আপনার ভণ্ডামীর মুখোশ জনসমক্ষে উন্মোচন করে দিতে পারি। আমি আপনার জালে আটকা পড়িনি, এখন আপনি আমার জালে আটকা। আমার এতটুকু আশা আপনি পূর্ণ না করতে পারলে, বলতে পারি না, আপনার ভবিষ্যত পরিণতি কি হবে।”
জামিলা পণ্ডিতকে যাদুকরের মতো প্রভাবিত করে ফেলেছিল। একেতো ছিল থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা আর অপরদিকে জামিলার হুমকির ভূমিকাও কম ছিল না।
একটু পরই পণ্ডিত আড়মোড়া ভেংগে বসল।
“আমি তোমাকে দূর থেকে দেখিয়েই চলে আসব, চল।” পণ্ডিতের কণ্ঠ শোনা গেল।
ইমরান সতর্ক পায়ে দরজার কাছ থেকে আড়াল হয়ে গেল। পণ্ডিত ও জামিলা কামরা থেকে বের হল। দরজা বন্ধ করে পণ্ডিত হাঁটতে লাগল। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ইমরান সাথীদের নিয়ে পণ্ডিতের পিছু পিছু অগ্রসর হল । এলাকাটি ছিল অনাবাদী ও জঙ্গলাকীর্ণ। ইমরানের আশঙ্কা হল, পণ্ডিত হয়তো।
তাদের হাঁটার শব্দ শুনে ফেলবে। কারণ, শুকনো পাতা আর লতাগুল্মে ড্রা উঁচু নীচু পথে পা ফেলতেই’শব্দ হচ্ছিল। কিন্তু কোন কিছুর প্রতি লক্ষ্য ছিল না পণ্ডিতের। সে জামিলাকে জড়িয়ে ধরে নানা কেলি করতে করতে মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। জগতের অন্য কিছুর খেয়ালই ছিল না পণ্ডিতের।
কিছুক্ষণ পর উঁচু নীচু পাহাড়সম টিলায় চলে এলো তারা। জামিলা ও পণ্ডিত দুটি টিলার মাঝখান দিয়ে যেতে লাগল। ওদের অনুসরণ করে ইমরানও সাথীদের নিয়ে টিলার মাঝপথে ঢুকে পড়ল। কিন্তু সমস্যা হলো, কিছুক্ষণ পরপরই পথ বাঁক নিয়েছে। ঘন অন্ধকার। কোন দিকে বাঁক নিতে হবে তা অনুমান করা মুশকিল। জামিলা ও পণ্ডিতের আওয়াজ অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছিল ইমরান। তবুও তারা পথ ভুল করে বসল। এরই মধ্যে দুটি সুড়ং অতিক্রম করে এসেছে তারা। অল্পক্ষণ অগ্রসর হওয়ার পরই তারা বহু নারী কণ্ঠের কোরাস শুনতে পেল। পণ্ডিত ছাড়া একা এলে হয়তো প্রেতাত্মাদের গান মনে করে ভয়ে তারা ফিরে যেতো। তবে ইমরান পণ্ডিতদের স্বভাব সম্পর্কে জানতো। এ জন্য তার কাছে এ নারী কণ্ঠের আওয়াজ অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি।
সামনে রাস্তা এতো জটিল হয়ে উঠল যে, ইমরান ও তার সাথীদের পক্ষে জামিলা ও পণ্ডিতের অনুসরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ইমরান শঙ্কিত হলো, তারা পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। কাজেই পণ্ডিত ও তাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে তার একটু দ্রুত পায়ে হাঁটল। কিন্তু বিধি বাম। পায়ের আওয়াজ পেয়ে থমকে গেল পণ্ডিত। কে পিছনে পণ্ডিত কয়েক কদম পিছিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল। এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে কাউকে দেখতে পেল না পণ্ডিত। ইমরান খাপ থেকে খঞ্জর বের করে পণ্ডিতের বুকে ঠেকিয়ে দিল।
“এখানেই দাঁড়াও। একটুও নড়বে না। খুন হবে, না আমাদেরকে ছিনিয়ে আনা মেয়েটির কাছে নিয়ে যাবে? এই মুসলিম মহিলার কাছ থেকে যে মূল্য তুমি নিয়েছে তা আমি জানি। আজও ওর কাছ থেকে যে থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা তুমি নিয়েছ তাও আমরা দেখেছি। জীবিত থাকতে চাইলে আমাদেরকে মেয়েটির কাছে নিয়ে যাও।” ভয়ে শঙ্কায় কাঁপতে লাগল পণ্ডিত। জামিলাও এসে দাঁড়াল তাদের পাশে। পণ্ডিত কাঁপা কাঁপা আওয়াজে বলল, “জামিলা! তুমি আমাকে ধোকা দিলে!”
“তুমি আমার জন্য যা করেছে, আমি তার চড়া মূল্য শোধ করেছি। আমি তোমাকে মুদ্রা দিয়েছি, শরীর দিয়েছি। আজ এখানে কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি। তুমিও তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে নাও।” পণ্ডিতের প্রতি তীর্যক ভাষায় বলল জামিল।
আরো দুটি খঞ্জরের আগা পণ্ডিতের শরীর স্পর্শ করল। ভয়ে হীম হয়ে গেল পণ্ডিত। সে থর থর করে কাঁপতে লাগল। টিলার উপর থেকে সম্মিলিত নারী কণ্ঠের কোরাস পাহাড় ও টিলায় প্রতিধ্বনিত হয়ে মনোমুগ্ধকর এক সুর সৃষ্টি করেছিল। মনে হচ্ছিল যেন অন্য জগত থেকে ভেসে আসছে অপার্থিব এই সুর সঙ্গীত।
“আওয়াজ অনুসরণ করে আমরাই ঋষি পর্যন্ত যেতে পারব।” পণ্ডিতের উদ্দেশে বলল ইমরান। “আমরা শুধু তিনজন নই, গোটা টিলা ঘিরে রেখেছে আমাদের লোকেরা। আমাদের কথা মতো কাজ না করলে কোন পণ্ডিতকে আমরা জ্যান্ত রাখবো না। আজ একজন একজন হত্যা করে বন্দী মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তবে আমরা খুনখারাবী চাই না। আমরা এসেছি, যে মেয়েটিকে তোমরা বলী দিতে এনেছে, শুধু ওকে নিয়ে যেতে। ইচ্ছে হলে, তোমাদের পাথরের তৈরি দেবদেবীদের ডাকতে পার কিন্তু ওইসব পাথরের মূর্তি তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারবে না। চল! আমাদের তাড়া আছে।”
নিঃশব্দে আগে আগে চলল পণ্ডিত। পণ্ডিত এত ভীত হয়ে পড়েছিল যে, সে ইমরানকে বলার সাহস পাচ্ছিল না যে, তোমাদের কথা মতোই যাব কিন্তু হতিয়ার ফেলে দাও।
ইমরান ও তার সঙ্গীদের সামনের পথ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। তারা শুধু শুনতে পাচ্ছিল মেয়েলী কণ্ঠের সঙ্গীত। পণ্ডিত কয়েকবার পথ বাঁক নিয়ে কয়েকটি সুড়ং অতিক্রম করে এসেছে। হুশিয়ার হয়ে গেল ইমরান। পঞ্জিত না আবার ওদের ধোকা দিয়ে কোথাও আড়াল হয়ে যায় আর ওর লোকেরা তাদের ঘিরে ফেলে। তাই সে খুবই সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল।
পথ একটি খোলা জায়গায় এসে শেষ হয়ে গেল। দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৫০ x ৪০ হাত হবে। এর পরই পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে মন্দির। অনেকগুলো কামরা। দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, পাথর কাটা মূর্তি। একটি শতরঞ্জি বিছানো। সামনে একটি বড় তশতরিতে প্রসাদ জাতীয় দ্রব্য। কুড়ি পঁচিশজন সাধু ধরনের লোক বসা। প্রত্যেকের বাহুবন্ধনে একেকটি তরুণী। তারা তরুণীদের নিয়ে হাসি-তামাশায় মত্ত। আর খোলা জায়গাটিতে দশ পনের জন তরুণী বৃত্তাকারে নেচে নেচে গীত গাইছে। এদের বৃত্তের ভেতরে বসা আরেকটি তরুণী। তাদের চারপাশে অসংখ্যা প্রদীপ জ্বলছে। সবাই অর্ধ উলঙ্গ।
থেমে গেল পণ্ডিত। সে অসহায়ভাবে তাকালো তিন মুসলমানের দিকে।
“মেয়েটিকে আমাদের হাতে তোলে দাও।” পণ্ডিতের পাঁজরে খঞ্জরের আগা স্পর্শ করে বলল ইমরান।
বড় পণ্ডিত গলা চড়িয়ে হাঁক দিল, ‘থামো সবাই।‘
নর্তকীরা নাচ থামিয়ে একদিকে সরে গেল। সাধুরা দাঁড়িয়ে গেল। ঋষি যেভাবে বসেছিল সেভাবেই ভাবলেশহীন বসে আছে। ইমরান ও তার সাথীরা পাগড়ী দিয়ে চেহারা ঢেকে রেখেছিল। তারা দ্রুত খাপে ভরা তরবারী কোষমুক্ত করল। বড় পণ্ডিতকে আরো এগিয়ে দু’উক্ত তরবারীর মাঝে দাঁড় করানো। ইমরান ঋষিকে ধরে উঠাল। ঋষি চোখ বড় করে তাকে দেখছিল, যেন সে তাকে চিনতে পারছে না। ইমরান তাকে ডাকল, হাতে ঝাঁকুনি দিল, কিন্তু ঋষি তার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে নিস্পলক তাকিয়ে রইল। পরিষ্কার বোঝা গেল তাকে এমন কিছু পানাহার করানো হয়েছে যার প্রভাবে তার স্বাভাবিক স্মৃতিবোধ রহিত হয়ে গেছে।
ইমরান তাকে বগলদাবা করে রওয়ানা হল। ঋষিও কোন বিরূপতা না, দেখিয়ে সহগামী হল। পিছনে ফিরে সব সাধু পণ্ডিতকে লক্ষ্য করে ইমরান বলল, “যদি কেউ জায়গা থেকে একটু নড়াচড়া কর তবে সবাইকে হত্যা করে ফেলব। তোমাদের সবাইকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে।”
এর উপর তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাব কতক্ষণ থাকবে?” বড় পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করল ইমরান।
“সকাল পর্যন্ত কেটে যাবে।” জবাব দিল বড় পণ্ডিত। “যাও, ওকে তোমরা নিয়ে যাও।”
“তোমাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে। রাস্তা খুব জটিল। আমাদের পুরো খেয়াল নেই।” বলে বড় পণ্ডিতের ঘাড়ে তরবারীর ফলা ছোঁয়াল ইমরান।
“আমাদের আগে আগে চলো।”
কেনা পশুর মতো পণ্ডিতকে আগে আগে হাঁকিয়ে নিয়ে গেল ইমরান।
সে ভয়ে আতঙ্কে জড়সড়। ফেরার পথে পণ্ডিত যখন দু’পাহাড়ের সুড়ং পথে। ঢুকল, তখন গোয়েন্দারা রাজার যুদ্ধ সরঞ্জামে আগুনে ধরিয়ে দিয়েছে। ইমরান ও তার সাথীরা তরবারী উন্মুক্ত করে পণ্ডিতের পিছে পিছে আসছে। জামিলাও তাদের সাথেই হাঁটছে। ঋষি অচেতনের মতো হাঁটছিল তাদেরই সাথে।
একটু সামনে এগুতে তাদের চোখে পড়ল শহরের দিকে আসমান ছোঁয়া আগুনের লেলিহান শিখা। ইমরান আগুন দেখে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল।
“আল্লাহু আকবার।” সাথীদের বলল, “দেখ, বাঘের বাচ্চারা রাজার কোমর ভেঙে দিয়েছে। গজনী আক্রমণে প্রস্তুতি গ্রহণকারীদের আল্লাহ এখানেই পরাজিত করে দিলেন।”
“হায়! একি, আমাদের শহরে এতো আগুন! হায় ভগবান! গোটা শহর জ্বলছে!” ভয়ার্ত আওয়াজ শোনা গেল পণ্ডিতের কণ্ঠে।
“এটা আমাদের প্রভুর গযব । তোমাদের উপর আমাদের প্রভু গযব নাযিল করেছেন। তোমাদের মন্দিরগুলোকেও নারীভোগ ও বেলেল্লাপনা থেকে মুক্ত রাখনি তোমরা। এই নিরপরাধ মেয়ের আহাজারি আর তপ্ত নিঃশ্বাসে তোমাদের শহরে আগুন ধরে গেছে। তোমাদের এই কুমারী বলীদান সম্পূর্ণ ধোকাবাজী। আমরা জানি, কিভাবে এবং কোন মতলবে অবলা মেয়েটিকে তোমরা তুলে এনেছিলে।
তোমাকে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, জীবিত ছেড়ে দেবো। তাই জীবিত ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আমরা ঋষিকে নিয়ে গেছি এটা ঘুণাক্ষরে যেন কেউ জানতে না পারে। তোমাদের রাজা এই মেয়েকে এখনও দেখেনি। এর স্থলে অন্য কোন মেয়েকে ধরে এনে বলী দিবে।
এরপরও যদি দেখি, তুমি আমাদের কথার ব্যতিক্রম কিছু করছে, তাহলে জেনে রেখো, যে আগুনের তোমাদের রাজার সব যুদ্ধ সরঞ্জাম জ্বলছে, সেই আগুন সব পণ্ডিতকেও জ্বালাবে।” . পণ্ডিত জ্বলন্ত আগুন আর মানুষের শশারগোল ও চিৎকার শোনে হতভম্ব হয়ে গেল। পণ্ডিত তার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। ইমরান,দ্রুত নদীর দিকে চলল। জগমোহন ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিল তাদেরই জন্য। এক রকম দৌড়ে পৌঁছল তারা নদীর পাড়ে।
“গোটা শহর জ্বলছে। মনে হয় আমাদের বাড়িতেও আগুন লেগেছে। এ আগুন কিভাবে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল!” ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল জগমোহন।
“জ্বলতে দাও। তোমরা আর ঘরে ফিরে যাচ্ছে না। আমার সাথে যাচ্ছে। কাজেই তোমাদের নিজেদেরকে আর হিন্দু মনে করা ঠিক হবে না। আমাদের ধর্মের সত্যতা দেখ। তোমার বোনকে পণ্ডিতেরা বলী দিতে নিয়ে গিয়েছিল, আমি দু’আ করেছিলাম, হে খোদা! আমাকে সাহায্য করুন যাতে আমি এই নিরপরাধ মেয়েটিকে উদ্ধার করতে পারি। তিনি আমার দুআ কবুল করেছেন। আমাদের মা’বুদই সত্য। দেখ রাজার সব যুদ্ধ সরঞ্জাম পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আর তোমার বোন- যার বলী হওয়ার কথা ছিল সে এখন আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তোমাদের অসংখ্য দেবদেবীর সামনে থেকে ওকে আমরা ছিনিয়ে এনেছি, ওরা কিছু করতে পারল?”
ঋষি! বলে মোহন বোনকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু ঋষি মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। ইমরান বলল, পণ্ডিতেরা ওকে ওষুধ খাইয়ে বিগড়ে দিয়েছে। সকাল পর্যন্ত এর রেশ থাকবে। এখন আমাদের হাতে সময় নেই। বোনকে তোমার ঘোড়ায় তুলে নাও।
ঋষিকে জগমোহন আর জামিলাকে ইমরান তার ঘোড়ায় তুলে নিল। কাসেম ও নিজাম অন্য দুটি ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা হলা গজনীর পথে। এদিকে শুরু হল রাজা ও পণ্ডিতদের নতুন চক্রান্ত।