সামবেদ-সংহিতা — ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়) [৩য় অধ্যায়]
প্রথমা দশতি
ছন্দ আৰ্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র (৯ম ঋকের দেবতা মরুদগণ)৷৷
ছন্দ বৃহতী।
ঋষি : ১।৬।৯ বশিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ২ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য (ঋগ্বেদে শংযু বার্হস্পত্য, ৩ প্রস্কণ্ব কাণ্ব (বালখিল্য সূক্তমন্ত্র), ৪ নোধা গৌতম, ৫ কলি প্রাগাথ, ৭ মেধাতিথি কাণ্ব, ৮ ভর্গ প্রাগাথ, ১০ প্রাগাথ ঘৌর কাণ্ব৷৷
অভি ত্বা শূর নোনুমোহদুগ্ধা ইব ধেনবঃ। ঈশানমস্য জগতঃ স্বর্দশমীশানমি তন্তুষঃ৷৷ ১৷৷ জ্বামিদ্ধি হবামহে সাতৌ বাজস্য কারবঃ। ত্বাং বৃত্ৰেম্বিন্দ্র সৎপতিং নরস্ত্রাং কাষ্ঠাস্বতঃ৷৷ ২৷৷ অভি প্র বঃ সুরাধসমিমর্চ যথা বিদে। যো জরিতৃভ্যো মঘবা পুরূবসু সহস্রেণব শিক্ষতি৷৷ ৩৷৷. তং বো দম্মমৃতীষহং বসোর্মন্দানমন্ধসঃ। অভি বৎসং ন স্বসরেষু ধেনব ইন্দ্রং গীর্ভিনর্বামহে৷৷ ৪৷৷ তরোভির্বো বিদদ্বসুমিং সবাধ উতয়ে৷ বৃহদ গায়ন্তঃ সুতসোমে অধ্বরে হুবে ভরং ন কারিণ৷৷ ৫৷৷ তরণিরিৎ সিষাসতি বাজং পুরন্ধ্যা যুজা। আ ব ইন্দ্রং পুরুতং নমে গিরা নেমিং ষ্টেব সুদ্ৰব৷৷ ৬৷৷ পিবা সুতস্য রসিনো মৎস্য ন ইন্দ্র, গোমতঃ। আপির্নো বোধি সধমাদ্যে বৃধে৩হম্ম অবন্তু তে ধিয়ঃ৷৷ ৭৷ ত্বং হেহি চেরবে বিদা ভগং বসুয়ে। উদ্বৃ স্বমঘব গবিষ্টয় উদিভ্রামিষ্টয়ে৷৷ ৮৷৷ ন হি বশ্চমং চ ন বসিষ্ঠঃ পরিমংসতে। অস্মাকমদ্য মরুতঃ সুতে সচা বিশ্বে পিবন্তু কামিনঃ ॥ ৯৷৷ মা চিদন্য বি শংসত সখায়ো মা বিষণ্যত। ইন্দ্রমিৎ স্তোতা বৃষণং সচা সুতে মুহুরুথা চ শংসত৷৷ ১০।
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। শৌর্যসম্পন্ন হে ভগবন ইন্দ্রদেব! দৃশ্যমান জঙ্গমের ঈশ্বর এবং স্থাবরের ঈশ্বর সর্বদ্রষ্টা আপনাকে লক্ষ্য করে, ভক্তিসহযুত জ্ঞানিগণের ন্যায় অথবা ভক্তিশুন্য বৃথা তর্কপরায়ণগণের ন্যায় (অর্থাৎ চার্বাক-ধর্ম-অনুসারিগণের ন্যায়) আমরা আরাধনা করছি। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। মন্ত্রের ভাব এই যে, স্থাবর-জঙ্গমাত্মক-চরাচর বিশ্বের অধিপতি ভগবানকে আরাধনা করতে মূঢ় আমরা সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি)। [উত্তরার্চিক ১অ-৪খ-১১সূ-১সা দ্রষ্টব্য]। [এখানে এর গেয়গানের নাম ভরদ্বাজস্যার্কৌ দ্বৌ]।
২। হে ভগবন! এই স্তোতৃগণ আমরা সৎকর্মেই (সৎকর্মসাধন-সামর্থ্যের) সম্ভজনার জন্য, আপনাকে যেন নিশ্চয় আরাধনা করি। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সাধুগণের পালক আপনাকে নেতৃস্থানীয় জ্ঞানিগণ অর্থাৎ সাধুগণ অজ্ঞানতারূপ শত্রুসমূহের মধ্যে (আপনাদের চারিদিকে) প্রতিষ্ঠাপিত রাখেন। [এই মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। এখানকার ভাব এই যে, -রিপুগণের প্রভাব অপসারণের নিমিত্ত সাধুগণ যেমন সদাকাল ভগবানের আরাধনা করেন, সৎকর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত আমরা যেন তা-ই করি]। [এর গেয়গানের নাম–ইন্দ্রস্য ভারদ্বাজে দ্বে]।
৩। পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন বহুধনবিশিষ্ট (বহুত্র বিদ্যমান অথবা বহু-রকমে আশ্রয়দাতা) যে দেবতা স্তোতৃগণকে (আমাদের) অশেষরকমে শিক্ষাদান করেন অর্থাৎ সত্যতত্ত্ব জ্ঞাপন করেন (আমাদের মঙ্গলসাধন করেন); হে আমার মন! তোমাদের জন্য অর্থাৎ আমাদের নিজেদের হিতসাধননিমিত্ত, পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেবের অভিমুখ্যে যথাশাস্ত্র (স্বধর্ম-অনুসারে) প্রকৃষ্টরূপে পূজা কর–সম্যকরূপে তার আরাধনা কর। [ভাব এই যে, ভগবান্ অশেষ-রকমে আমাদের শিক্ষাদান করছেন; যথাযথ উপদেশ অনুসারে তার আরাধনায় আমাদের প্রবৃত্ত হওয়া কর্তব্য]। [এর গেয়গান সান্নতে দ্বে ও শ্যৈতম্]।
৪। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ অথবা হে আমার মন! তোমাদের জন্য অর্থাৎ আমাদের নিজেদের মঙ্গল-সাধনের জন্য, সত্যপ্রদর্শক, শত্রুনাশক, নিজের প্রীতিকর শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণে আনন্দিত, সেই ইন্দ্রদেবকে লক্ষ্য করে (তার অভিমুখে) একান্ত-অনুরাগী ভক্তিমানের ন্যায়, আত্মহৃদয়ক্ষেত্রে তাঁকে স্থাপন-পূর্বক, স্তুতিমন্ত্রের দ্বারা আহ্বান করছি। [আত্ম-উদ্বোধন-মূলক এই মন্ত্রের ভাব এই যে, নিজের মঙ্গল-সাধনের জন্য ভগবানের আরাধনা কর্তব্য। সেই বিষয়ে সকলেরই সঙ্কল্পবদ্ধ হওয়া উচিত।]। [এর গেয়গানগুলির নাম–প্রজাপতেঃ নাবিকম, অভীবৰ্ত্তস্য ইন্দ্রস্য বা, অভীবৰ্ত্তম, অভীবৰ্ত্তস্য ভাগম, অভীবৰ্ত্তঃ এবং নোধসম্]।
৫। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমাদের হিতসাধনের জন্য (আমাদের আত্মমঙ্গল-সাধনের জন্য) বাধাপ্রাপ্ত হয়েও (রিপুগণ কর্তৃক আক্রান্ত তোমরা) আত্মরক্ষার জন্য বিশুদ্ধ সত্ত্বসমন্বিত সৎকর্মে (হিংসারহিত্যাগে) সৰ্বৰ্থা স্তোত্রপরায়ণ হয়ে পরমার্থ তত্ত্ব জ্ঞাপক ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে অবিলম্বে (সত্বর) পূজা কর; তার জন্য উপাসকগণের পালক সেই ভগবানকে আমি আহ্বান করছি। [সেই এ ভগবান্ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন, আমাদের চিত্তবৃত্তিগুলিকে তাঁর অনুসারী করুন–এটাই ভাবার্থ]। [গেয়গান–কালিয়ানি ত্রীণি, লৌশে দ্বে, ধানকম্, ইত্যাদি]।
৬। সংসার-সাগরে তরণীর ন্যায় উদ্ধারকারী কর্মনিবহ অর্থাৎ সংসারসাগর-ত্রাণ-কারক ভগবান, মহতী বুদ্ধির সাথে নিত্যকাল আমাদের কল্যাণ-সাধনের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বের সাথে সম্মিলিত হয়ে অথবা আমাদের শুদ্ধসত্ত্বের সাথে সংযোজিত করে অর্থাৎ আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন করে, অভীষ্টফল প্রদান করেন; পরিত্রাণকারী দেবতার ন্যায়, সেই সৎকর্মনিবহ আমাদের পরিত্রাণ-সাধক জ্ঞানভক্তি সহযুত যানকে প্রাপ্ত করুন অর্থাৎ প্রদান করুন। আরও, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ (আত্মসম্বোধন)! তোমাদের হিতসাধনের জন্য অর্থাৎ আত্মার পরিত্রাণসাধনকল্পে, অখিল-ব্রহ্মাণ্ডের আরাধ্য জগৎপূজ্য সেই পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে ভক্তিসহযুত স্তুতির দ্বারা এবং সৎকর্মের দ্বারা, তোমাদের অর্থাৎ আমাদের মধ্যে অবনমিত করছি অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত করছি। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক ও আত্ম-উদ্বোধক। সংসার-সমুদ্রে সৎকর্মরূপ ভগবানই একমাত্র পরিত্রাণকারক। সৎ-ভাবে ও সৎকর্মের দ্বারাই তিনি একমাত্র প্রাপ্তব্য। তার অনুগ্রহ-লাভের জন্য আমরা যেন সৎ-ভাবসম্পন্ন এবং সৎকর্মপরায়ণ হই]। অথবা–হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! সংসার-সাগর-ত্রাণকারক অর্থাৎ সদা-সৎ কর্মপরায়ণ জনই মহতী পরমার্থবুদ্ধি-সহযুত হয়ে, অভীষ্টফলকে সম্ভজনা করেন অর্থাৎ প্রাপ্ত হন। পরিত্রাণকারক দেবতা যেমন জ্ঞানভক্তিসহযুত সৎকর্মরূপ যানকে প্রাপ্ত করান, তেমনই তোমাদের জন্য অর্থাৎ তোমাদের উৎকর্ষ সাধনের অথবা আমাদের নিজেদের মঙ্গল-সাধনের জন্য, জগৎপূজ্য। পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে ভক্তিসহযুত স্তুতির দ্বারা যেন আহ্বান করতে সমর্থ হই। [ভাব এই যে, সৎকর্মপরায়ণ সাধকের মতো আমি যেন ভগবানের অনুসরণে সঙ্কল্পবদ্ধ হই)। [গেয়গানগুলির নাম–ঐশির ও গৌশৃঙ্গ]।
৭। হে ইন্দ্র! ভক্তিরসযুত জ্ঞানকিরণসমন্বিত, আমাদের সৎকর্ম ইত্যাদির দ্বারা সুসংস্কৃত শুদ্ধসত্ত্বকে পান (গ্রহণ) করে আনন্দিত অর্থাৎ আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন; আরও, হে ইন্দ্র! আমাদের অনুষ্ঠিত সৎকর্মে বন্ধুরূপে সহায় হয়ে, আমাদের অভীষ্টপূরণের জন্য প্রবুদ্ধ হোন; আরও, হে ইন্দ্র! আপনার সম্বন্ধীয় পরমার্থ বুদ্ধি আমাদের রক্ষা করুক অর্থাৎ পাপের প্রভাব হতে আমাদের রক্ষা করুক। মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমাদের ভক্তিসুধা এবং শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে, সেই ভগবান্ আমাদের অভীষ্ট ফল প্রদান করুন এবং আমাদের পাপের প্রভাব থেকে পরিত্রাণ করুন]। [গেয়গান পৃষ্ঠং, শ্লৌকং, জমদগ্নেঃ বা অমীবৰ্ত্তঃ]।
৮। হে ইন্দ্র! আপনি (আমাদের এই অনুষ্ঠিত সৎকর্মে অথবা হৃদয়ে) আগমন করুন; এবং মোক্ষকামী সদাসৎকর্ম-পরায়ণ অর্চনাকারী আমার জন্য পরমধন প্রদান করুন। হে মঘবন ইন্দ্র। প্রজ্ঞানকামী আমাকে প্রজ্ঞান প্রদান করুন। হে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেব! অশ্বের ন্যায় ত্বরিতগতিবিশিষ্ট সৎকর্ম-সাধনসামর্থ্য কাময়মান অথবা সর্বব্যাপক ভগবানকে প্রাপ্তকামী আমাকে সকৰ্ম-সাধনসামর্থ্যকে এবং ভগবানকে প্রদান করুন। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এখানে সাধক পরমধন প্রজ্ঞান এবং সত্যৰ্ম-সাধনের সামর্থ্য লাভের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান আমাদের সৎকর্মপরায়ণ করুন। দিব্যজ্ঞান এবং পরমধন (মোক্ষ) প্রদান করুন]। [এর গেয়গানের নাম–কৌল্মলবর্হিষ]।
৯। বিবেকরূপী হে দেবগণ! আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধক চরম অবস্থাতেও অর্থাৎ কঠোর এ পরীক্ষাতেও কখনও আপনাদের পরিত্যাগ করেন না, অর্থাৎ, কখনও বিবেকহারা হন না; সেই। দেবগুণ, অর্চনাকারী আমাদের সত্ত্বভাবে সম্মিলিত থেকে অথবা আমাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করে। সত্ত্বকাময়মান অর্থাৎ সত্ত্বপ্রবর্ধক সকল দেবভাবের সাথে নিত্যকাল সেই সত্ত্ব গ্রহণ করুন– আমাদের মধ্যে অবস্থিত থাকুন। [বিবেকের উদয়ে আমাদের মধ্যে দেবভাবসমূহের বিকাশ হোক]। অথবা-হে জীবগণ! আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধক অথবা কালচক্রে চিরবর্তমান বশিষ্ঠ-নামক ঋষি তোমাদের মধ্যে অতিহীন দুষ্কৃতপরায়ণকেও পরিত্যাগ করেন না; (অর্থাৎ তারা নিজেদের আত্ম উৎকর্ষের প্রভাবে পাপীদেরও উদ্ধার করেন)। মরুৎ-গণ অর্থাৎ বিবেকরূপী দেবগণ প্রার্থনাকারী আমাদের শুদ্ধসত্ত্বে অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করে, শুদ্ধসত্ত্ব–কাময়মান সকল দেবতার বা দেবভাবের সাথে আগমন করে, নিত্যকাল তা পান করুন অর্থাৎ গ্রহণ করুন। [ভাব এই যে, আমাদের মধ্যে দেবভাব উপার্জিত হোক; বিশ্বের সকল দেবতারা আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে প্রীত হোন এবং আমাদের উদ্ধার করুন। সোম শব্দে সর্বদা শুদ্ধসত্ত্ব ভক্তিসুধা সর্বত্রই নির্দিষ্ট। দেবতার পূজায় ভক্তির উপচারই সাধকের প্রধান অবলম্বন। মোক্ষকামী জন শুদ্ধসত্ত্ব-দানেই (মাদকের দ্বারা নয়) দেবতার পরিতৃপ্তিসাধন করে থাকেন। মন্ত্রটির প্রথমাংশে সাধুগণের চরিত্রের প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে-সৎসঙ্গী সাধুগণ হীনতাসম্পন্ন দুষ্কৃত-পরায়ণকেও রক্ষা করেন। তাছাড়া চরম দুঃখের অবস্থায় ভীষণ পরীক্ষা-পারাবারে পতিত হয়েও তারা বিবেকহারা হন না। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে নিজেকে বিবেকের অনুবর্তী করার জন্য উদ্বোধনা প্রকাশ পেয়েছে। [এর গেয়গানের নাম–বশিষ্ঠস্য জামিত্রে দ্বে]।
১০। মিত্রভূত হে দেবগণ বা দেবভাবসমূহ! আপনারা আমাদের চরম দশায়ও অর্থাৎ কঠোর পরীক্ষায়ও কখনও বিরুদ্ধাচারের দ্বারা আমাদের শাসন করবেন না এবং আপনাদের হিংসক হবেন অর্থাৎ আমাদের পরিত্যাগ করবেন না; (কঠোর পরীক্ষাতেও যেন আমরা সৎ-ভাব-পরিশূন্য না হই, এটাই অভিপ্রায়)। হে দেবগণ! আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করে আপনারা তার সাথে সম্মিলিত হোন এবং সর্বাভীষ্টপূরক একমেবাদ্বিতীয় ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান ইন্দ্রদেবকে অর্চন করবার জন্য আমাদের নিত্যকাল উদ্বুদ্ধ করুন; আরও, ভগবৎ-বিষয়ক স্তোত্রসমূহ গান করতে শিক্ষা প্রদান করুন। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক; শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে যেন সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হতে পারি এই প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। অথবা–মিত্রভূত হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা কখনও ভগবৎ সম্বন্ধ-পরিশূন্য বাক্য উচ্চারণ করো না বা কর্ম অনুষ্ঠান করো না; এবং নিজেদের হিংসক হয়ো না, অর্থাৎ ভগবৎ-বিদ্বেষী (বা নাস্তিক) চার্বাকধর্ম-অবলম্বিদের অনুষ্ঠিত অসৎ-অনুষ্ঠানের দ্বারা নিজেদের উপক্ষয়িতা হয়ো না; [মন্ত্রের এই অংশটি আত্ম-উদ্বোধক; ভগবানের প্রতি অবিচলিতমন হবার জন্য এখানে সাধক নিজেকে উদ্বুদ্ধ করছেন)। আরও, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! শুদ্ধসত্ত্ব (হৃদয়ের ভক্তিসুধা) সুসংস্কৃত হলে অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয় করে, তোমরা অনন্যমন হয়ে অর্থাৎ একাগ্রভাবে সকল কামনার বর্ষক অর্থাৎ সর্বাভীষ্ট-পূরক চতুর্বর্গফল-প্রদাতা পরমৈশ্বর্যশালী অদ্বিতীয় ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে স্তুতি অর্থাৎ অর্চন কর; আরও, তোমরা সর্বকাল ভগবৎসম্বন্ধযুত স্তোত্রসমূহ সদাকাল উচ্চারণ কর; [মন্ত্রের এই অংশটিও আত্ম-উদ্বোধক; ভগবৎ-সম্বন্ধমূলক কর্মানুষ্ঠান সুফলপ্রদ। ভক্তিসহযুত মনে একাগ্রচিত্তে ভগবৎকর্ম-সাধনের জন্য সাধক নিজেকে উদ্বোধিত করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, –ভক্তির দ্বারা এবং নির্মল চিত্তের দ্বারা ভগবানের কর্মসম্পাদনে ভগবানের এ প্রীতি-সাধনে আমরা যেন সমর্থ হই; তিনি যেন কৃপাপূর্বক তারই বিহিত করেন]। [এর গেয়গানের নাম–মেধাতিথং দেবাতিথং বা]।
.
দ্বিতীয়া দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র।
ছন্দ বৃহতী৷৷
ঋষি : ১ পুরুহন্মা আঙ্গিরস, ২।৩ মেধাতিথি ও মেধ্যাতিথি কাণ্ব, ৪ গাথি বিশ্বামিত্র, ৫ গোতম রাহুগণ, ৬ নৃমেধ ও পুরুমেধ আঙ্গিরস, ৭-৯ মেধাতিথি বা মেধ্যাতিথি কাণ্ব (ঋগ্বেদে মেধাতিথি), ১০ দেবাতিথি কাণ্ব৷৷
নকিষ্টং কৰ্মণা নশদ যশ্চকার সদাবৃধ। ইন্দ্রং ন যজ্ঞেবিশ্বপূর্ত-মূত্বসমধৃষ্টং ধৃষ্ণুমোজসা৷৷ ১। য ঋতে চিদভিশিষঃ পুরা জঞভ্যঃ। জাতৃদঃ সন্ধাতা সন্ধিং মঘবা পুরূবসুনিষ্কর্তা বিহুতং পুনঃ৷৷ ২ আ ত্বা সহস্রমাশতং যুক্তা রথে হিরণ্যয়ে। ব্ৰহ্মযুজো হরয় ইন্দ্র কেশিনো বহন্তু সোমপীতয়ে৷৷ ৩৷৷ আ মন্দৈরিন্দ্র হরিভির্যাহি ময়ুররোমভিঃ। মা ত্বা কে চিন্নি যেমুরিন্ন পশিনোহতি ধম্বেব তা ইহি৷৷ ৪। ত্বমঙ্গ প্রশংসিষো দেবঃ শবিষ্ঠ মর্ত্যম্। ন হৃদন্যো মঘবঃস্তি মর্জিতেন্দ্র ব্রবীমি তে বচঃ। ৫৷৷ মিন্দ্র যশা অস্যজীষী শবসম্পতিঃ। ত্বং বৃত্রাণি হংসপ্রতীনেক ইৎ পুর্বত্তশ্চর্ষণীধৃতিঃ। ইন্দ্ৰমিদ দেবতাতয় ইন্দ্রং প্রত্যধ্বরে। ইন্দ্রং সমীকে বনিনো হবামহ ইন্দ্রং ধনস্য সাতয়ে৷ ৭৷ ইমা উ ত্বা পুরূবসে গিরো বর্ধন্তু যা মম৷ পাবকবর্ণাঃ শুয়ো বিপশ্চিতোহভিস্তোমৈরনূষত৷৷ ৮৷৷ উদু ত্যে মধুমত্তমা গিরঃ তোমাস ঈরতে। সত্রাজিত ধনসা অক্ষিতোতয়ো বাজয়ন্তো রথা ইব৷৷ ৯৷৷ যথা গৌরো অপা কৃতম্ তৃষ্যন্নেত্যবেরিণম্। আপিত্বে নঃ প্রপিত্বে তৃয়মা গহি কথেষু সু সচা পিব৷৷ ১০৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১। যে ব্যক্তি আপন কৃতকর্মের অথবা ভগবানের প্রীতিসাধক কর্মের দ্বারা নিত্যবর্ধমান চিরনবীনত্বসম্পন্ন অথবা প্রার্থনাকারিদের নিত্যবৰ্ষক, জগৎ-আরাধ্য, মহান, শত্রুগণের ধর্ষক, বলের এর দ্বারা অনভিভব্য অর্থাৎ অজেয়, পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানকে নিজের অনুকূল করেছেন; তিনি ভিন্ন অন্য, কেউই আপন কৃতকর্মের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হন না, অথবা তিনি কখনও নিজের কৃতকর্মের দ্বারা। নিজেকে বিনাশ করেন না। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধন-মূলক এবং নিত্যসত্যপ্রকাশক। যে ব্যক্তি সৎকর্ম সাধনের দ্বারা ভগবানের প্রীতি উৎপাদন করতে পারেন, একমাত্র তিনিই ভগবানকে প্রাপ্ত হন; আরও, নিজের কর্মের দ্বারা তিনি নিজে বিনষ্ট হন না। প্রার্থনার ভাব এই যে, -সৎকর্মের দ্বারা ভগবানকে পাবার জন্য আমি সঙ্কল্পবদ্ধ হই]। [এর গেয়গানের নাম–বৈখানসম্, পৌরুহম্মনম অথবা প্রাকর্ষং]।
২। যে ভগবান ইন্দ্রদেব, সংযোজনসাধক জ্ঞানভক্তিকর্মরূপ সন্ধানদ্রব্য ব্যতীত অর্থাৎ জ্ঞানভক্তিকর্মহীন-জনেও, হৃদয়-রূপ সন্ধিস্থান হতে সারভূত জন্মগত স্নেহকরুণা-শুদ্ধসত্ত্ব প্রভৃতির নিঃসারণে হৃদয়ের পীড়া জন্মাবার পূর্বেই সেই হৃদয়-রূপ সন্ধিস্থানের অর্থাৎ ভগবৎসম্মিলন-স্থানের সংযোজক হন; অর্থাৎ তাতে উপজিত সংক্ষোভের উপশমকারী (নাশক) হন; ধর্ম অর্থকাম-মোক্ষ চতুর্বর্গধন-প্রদাতা বহুধনযুক্ত পরমেশ্বর্যচ্যুতসম্পন্ন সেই ইন্দ্রদেব বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ ভগবানের সম্বন্ধ অথবা ভগবান হতে দূরে নিপতিত হৃদয়ের সংস্কর্তা অর্থাৎ সৎপথে নিয়ামক অর্থাৎ আপনাতে সংযোজক হন। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনামূলক। ভাব এই যে, ভগবানের করুণা অপার। পতিত জনও তাঁর করুণায় পরাগতি লাভ করে থাকে। প্রার্থনা এই যে, –সেই ভগবান্ কৃপাপূর্বক এই আমাকে উদ্ধার করুন–যে আমি পতিত, তাঁর করুণাপ্রার্থী, তার থেকে দূরে পতিত হয়ে রয়েছি]। [গেয়গানের নাম–সাত্যম]।
৩। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণের নিমিত্ত অথবা আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চার করবার জন্য অর্থাৎ আমাদের কর্মসমূহের সাথে শুদ্ধসত্ত্বভাবের সম্মিলন জন্য, জ্ঞানরশ্মিযুক্ত অর্থাৎ সৎপথপ্রদর্শক, ব্রহ্মের দ্বারা যুক্ত অর্থাৎ ভগবানের সংন্যস্ত, নিখিল জ্ঞানকিরণ-সমূহ, হিরণ্যের ন্যায়, আকাঙক্ষণীয় সৎকর্মরূপ রথে যুক্ত হয়ে, আমাদের হৃদয়ে অথবা আমাদের অনুষ্ঠিত সক্কর্মে আপনাকে প্রকৃষ্টরূপে আনয়ন করুক। [প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটির ভাব এই যে, আমাদের কর্ম জ্ঞানভক্তি-সহযুত ও শুদ্ধসত্ত্ব সমন্বিত হোক; আরও, তেমন কর্ম আমাদের ভগবানে নিয়োজিত করুন]। [এর গেয়গানগুলির নাম–ভরদ্বাজম, কৃণ্ববৃহৎ, ভারদ্বাজ ইত্যাদি]।
৪। পরমৈশ্বর্যশালিন হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সৎকর্মসাধক সদানন্দদায়ক ময়ূর-রোমের ন্যায় বিচিত্ৰদৰ্শন অর্থাৎ চিত্তাকর্ষক অথবা বিচিত্ৰসামর্থ্যোপেত অর্থাৎ নানা রকমে অসৎবৃত্তির নাশক জ্ঞানকিরণ-সমূহের দ্বারা যুক্ত আপনি আমাদের কর্মে অথবা হৃদয়ে আগমন করুন; [প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! নিখিলজ্ঞান-কিরণ-সমূহ আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করুক। আপনার কৃপায় যাতে প্রজ্ঞানসম্পন্ন হতে পারি এবং সেই প্রজ্ঞানের প্রভাবে যাতে আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তা বিহিত করুন]। হে ইন্দ্র! পাশহস্ত ব্যাধ যেমন বন্ধনসাধক পাশের দ্বারা পক্ষিগণের গমন প্রতিবন্ধক জন্মিয়ে তাদের নিহত করে, তেমন কোনও শত্রই যেন আপনার গমন প্রতিবন্ধক উৎপন্ন করে নিহত না করে; পরন্তু, মরুপ্ৰদেশ প্রাপ্ত হলে পান্থ যেমন শীঘ্র তা অতিক্রম করে আগমন করে, তেমনই আপনি গমনপ্রতিবন্ধক শত্রুগণকে অতিক্রম (অর্থাৎ পরাভূত) করে, আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মে, অথবা হৃদয়ে শীঘ্র আগমন করুন। [এই মন্ত্রাংশে অন্তঃশবহিঃশত্রু-নাশের কামনা ব্যক্ত হয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই দেবতা আমাদের সকল শত্রুকে নাশ করে তার সাথে সম্মিলিত করুন এবং আমাদের উদ্ধার করুন]। [এর গেয়গানগুলির নাম-সম্বন্ধে অগ্নেঃ বাম্রাণি ত্ৰীণিঃ উক্ত হয়]।
৫। হে বলবত্তম! দ্যোতমান্ স্বপ্রকাশ আপনি, এই মানুষকে-অর্চনাপরায়ণ আমাকে–ত্বরায় আপনার উপাসনাপরায়ণতা হেতু প্রশংসনীয় করুন; [প্রার্থনা এই যে আমি যেন আপনার উপাসনায় নিয়োজিত হয়ে প্রশংসনীয় শ্রেষ্ঠ-গতি প্রাপ্ত হই]। হে পরমধনশালিন্ ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনার অপেক্ষা অন্য কেউই সুখদাতা নেই; অতএব, আপনার উদ্দেশে স্তোত্র উচ্চারণ করছি। [ভাব এই যে, ভগবৎ-পরায়ণ হয়ে আমি যেন প্রশংসনীয় হই এবং ভগবানের উপাসনার প্রভাবে যেন সুখশান্তি, লাভ করি। সেই ভগবান্ তেমনই বিধান করুন]। [গানের নাম–গুঙ্গোঃ সাম অথবা গৌঙ্গরং]।
৬। পরমৈশ্বর্যশালিন হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি অশেষকীর্তি-সম্পন্ন, শুদ্ধসত্ত-সঞ্চারক ও সকল শক্তির আধারভূত হন। আপনি অপ্রতিহত (অবাধগতি), অন্যের অপরাজেয়, নিখিলজ্ঞানের আবরক অজ্ঞানতারূপ শত্রুগণকে সম্যকরূপে বিনাশ করেন। আত্ম-উৎকর্ষ সম্পন্ন সাধকগণের নানারূপে ধারণকর্তা অর্থাৎ রক্ষক আপনি অদ্বিতীয় হন। [মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম্য-প্রকাশক ও প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, অদ্বিতীয় (একমেবাদ্বিতীয়ম) ভগবান্ আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করুন, অসৎ বৃত্তির প্রভাব নাশ করুন এবং আমাদের আত্ম-উৎকর্ষসাধনের দ্বারা আমাদের রক্ষা করুন]। [এর গেয়গানগুলির নাম–ঐন্দ্রস্য যশঃ সাম, ইন্দ্রস্য যশঃ সাম, যৌক্ত প্রচম ইত্যাদি]।
৭। দেবপূজন-জন্য অর্থাৎ সকল সৎকর্মে, অদ্বিতীয় ভগবানকে আহ্বান করি; সৎ-অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে অর্থাৎ সৎকর্মসাধনের কল্পনায় ভগবানকে আহ্বান করি; আরও, সৎ-অসৎবৃত্তির পরস্পর সংঘর্ষে অথবা কর্ম-সম্পূর্ণ সৎকর্মে ব্ৰতী আমরা ভগবানকে আহ্বান করি (হৃদয়ে ধারণ করি); এবং সৎকর্মের ফল চতুর্বর্গরূপে পরমধন লাভের নিমিত্ত ভগবানকে আহ্বান করি। [মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক ও প্রার্থনাজ্ঞাপক। সকল কার্যেকর্মের প্রারম্ভে কর্মের সম্পাদনকালে এবং কর্মসমূহের সম্পূর্ণে– সকল সময়ে ভগবানের অনুস্মরণ কর্তব্য। ভগবানে সংন্যস্তচিত্ত হলে সুফললাভ অবশ্যম্ভাবী। আমাদের অনুষ্ঠিত সকল কর্মে আমরা ভগবানের প্রতি যেন সম্যকরূপে চিত্তকে ন্যস্ত করতে পারি এমন সঙ্কল্প এখানে বিদ্যমান আছে। [এর গেয়গানের নাম-যাতস্রুচং]।
৮। হে পরমৈশ্বর্যশালিন; হে বহুজনের আশ্রয়স্থল ভগবন! আমার (উচ্চারিত) এই প্রসিদ্ধ বেদমন্ত্ররূপ বাক্যসকল আপনাকে তৃপ্ত করুক অর্থাৎ আমার হৃদয়ে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করুক। আত্ম উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা অগ্নির ন্যায় তেজোযুক্ত শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত জ্ঞানিগণ স্তুতিরূপ বাক্য দ্বারা আপনার স্তব করে থাকেন অর্থাৎ কোন্ কর্মের দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তার উপদেশ প্রদান করেন। [বিশুদ্ধভাবে অথবা সৎকর্মের অনুষ্ঠানের সাথে উচ্চারিত বেদ-মন্ত্ৰসমূহই ভগবানকে প্রাপ্ত হয়। অতএব প্রার্থনা–সেই ভগবান্ আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করুন এবং সৎ-বৃত্তির উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা আমাদের তাতে সম্মিলিত করুন]। [গানের নাম–বাস্রাণি ত্ৰীণি বাসিষ্ঠানি বা]।
৯। হে ভগবন! ভগবৎ-পরায়ণ সাধকগণ অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন অতিশয়-মধুর অর্থাৎ অত্যন্ত প্রীতিদায়ক বেদমন্ত্ররূপস্তুতিসমূহ উচ্চারণ করেন; সেই স্তুতিমন্ত্রসকল সদাশত্রুনাশক, শ্রেষ্ঠধনসাধক অর্থাৎ শ্রেষ্ঠধনসমূহের প্রেরক, অখণ্ড-আশ্রয়দাতা অর্থাৎ সর্বদা রক্ষাকারী, শুদ্ধসত্ত্বের সংবাহক রথসমূহের ন্যায় অর্থাৎ রথ যেমন অভীষ্টকে প্রাপ্ত করায় বা আনয়ন করে, তেমনই অভীষ্ট প্রাপ্ত করায়। [মন্ত্রটি স্তোত্রমাহাত্ম্য প্রকাশক ভাবার্থ সুবুদ্ধির এবং সৎকর্মের দ্বারা যখন আমরা ভগবানের অনুসারী হই, তখন আমাদের অশেষ শ্রেয়ঃ সাধিত হয়; তখন আমাদের কর্মসমূহ আমাদের ভগবৎসামীপ্য লাভ করায়]। [গেয়গানগুলি সম্বন্ধে উক্ত আছে–বাসিষ্ঠানি ত্রীণি, আত্রাণি বা]।
১০। গৌরমৃগ পিপাসিত হয়ে জলপরিপূর্ণ তড়াগের প্রতি যেমনভাবে শীঘ্ৰ প্ৰধাবিত হয়; তেমনভাবে আপনার সাথে বন্ধুত্বে মিলনের জন্য অর্থাৎ আপনাতে আমাদের সন্ন্যস্ত করবার জন্য, হে ভগবন! আপনি আমাদের নিকট শীঘ্র আগমন করুন; এবং আমাদের ন্যায় অকিঞ্চনের সাথে অভিন্নভাবে অর্থাৎ অভিন্ন হয়ে প্রকৃষ্টরূপে আমাদের হৃদয়সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভক্তি-সুধা পান করুন। অর্থাৎ গ্রহণ করুন। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; অকিঞ্চন আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব বা ভক্তি-সুধা গ্রহণ করে আমাদের আপনার সাথে সম্মিলিত করে নিন]। অথবা–চন্দ্র তৃষ্ণার্ত হয়ে অর্থাৎ সূর্যরশ্মিতে সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষী হয়ে, যে রকমে অপগবরক অর্থাৎ তেজসমূহের দ্বারা পরিপূর্ণ পূর্ণতেজঃ সম্পন্ন সূর্যরশ্মির প্রতি গমন করে; তেমনই, আপনার সখিত্বে অর্থাৎ আপনাতে সন্ন্যস্তচিত্ত হলে, হে ভগবন! আপনি আমাদের হৃদয়ে শীঘ্র আগমন করেন অর্থাৎ আবির্ভূত হন; এবং আমাদের ন্যায় অকিঞ্চনের মধ্যে অভিন্নভাবে প্রকৃষ্টরূপে সম্মিলিত হয়ে আমাদের হৃদয়-সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্বকে গ্রহণ করেন। [প্রার্থনা-পক্ষে মন্ত্রটির ভাব, –আমাদের মতো অকিঞ্চনের শুদ্ধসত্ত্বকে বা ভক্তিসুধাকে গ্রহণ করে আমাদের আপনাতে সম্মিলিত করুন, অথবা আমাদের মধ্যে অবস্থিতি করুন। চন্দ্র যেমন কখনও সূর্যরশ্মির সম্বন্ধকে পরিত্যাগ করেন না, সেই ভগবানও তেমনভাবেই আমাদের সাথে চিরসম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকুন] [এর গেয়গানের নাম সম্বন্ধে উক্ত হয়েছে-গৌরাঙ্গিরসস্য সামনী দ্বে; গোতমস্য মনোজ্যে বা]।
.
তৃতীয়া দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র; ৩য় মন্ত্রের দেবতা মিত্রাবরুণ ও আদিত্যগণ৷৷
ছন্দ বৃহতী৷
ঋষি : ১ ভর্গ প্রাগাথ, ২।৮ রেভ কাশ্যপ, ৩ জমদগ্নি ভার্গব, ৪।৯ মেধাতিথি কাণ্ব (ঋগ্বেদে মেধ্যাতিথি কাণ্ব), ৫।৬ নৃমেধ ও পুরুমেধ আঙ্গিরস, ৭ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ১০ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য (ঋগ্বেদে শংবু বার্হস্পত্য)।
শগধ্যওষু শচীপত ইন্দ্র বিশ্বাভিরাতিভিঃ। ভগং ন হি ত্বা যশসং বসুবিদমনু শূর চরামসি৷৷ ১৷ যা ইন্দ্র ভুজ আভরঃ স্বৰ্বাং অসুরেভ্যঃ। স্তোতারমিন্মঘবন্নস্য বর্ধয় যে চ ত্বে বৃক্তবহিষঃ ॥২॥ প্র মিত্রায় প্রাণে সচথ্যমৃতাবসসা। বরুথোবরুণে ছন্দ্যং বচঃ স্তোত্রং রাজসু গায়ত৷ ৩৷৷ অভি ত্বা পূর্বপীয় ইন্দ্র স্তোমেভিরায়বঃ। সমীচীনাস ঋভবঃ সমস্বর রুদ্রা গণন্ত পূর্ব ৪ প্র ব ইন্দ্রায় বুহতে মরুততা ব্রহ্মার্চত। বৃত্ৰং হনতি ঘৃণহা শশক্রতুর্বক্রেণ শতপর্বণা৷ ৫৷৷ বৃহদিন্দ্রায় গায়ত মরুততা বৃহত্তমম্। যেন জ্যোতিরজনয়ম্ভূতাবৃধধা দেবং দেবায় জাগৃবি। ৬। ইন্দ্র তুং ন আ ভর পিতা পুত্রেভ্যো যথা। শিক্ষা পো অস্মিন্ পুরুত যামনি জীবা জ্যোতিরশীমহি। ৭. মা ন ইন্দ্র পরা বৃণ ভবা নঃ সধমাদ্যে। ত্বং ন উতী মিন্ন আপ্যং মা ন ইন্দ্র পরাবৃণ। ৮ বয়ং ঘ ত্বা সূতাবন্ত আপো ন বৃক্তবহিষঃ। পবিত্র প্রস্রবণেষু বৃত্ৰহন পরি স্তোতার আসতে৷ ৯৷৷ যদিন্দ্র নাহুষীদ্য ওজো নৃণং চ কৃষ্টি। যদ বা পঞ্চক্ষিতীনাং দ্যুম্নমা ভর সত্রা বিশ্বানি পৌংস্যা৷৷ ১০৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। নিখিল-কৰ্ম্মাধার হে পরমৈশ্বর্যশালিন্ ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি সকলরকম রক্ষার সাথে অভীষ্টফল পরমার্থ রূপ ধন প্রদান করুন। হে সর্বশক্তির আধার ইন্দ্রদেব! ধনের ন্যায় অর্থাৎ রজত কাঞ্চন ইত্যাদি ধনসমূহ যেমন লোকের অতি প্রিয় এবং কামনার সামগ্রী; আরও, লোকে সেই রজতকাণ্বন ইত্যাদি যেমন ভজনা করে–তেমনই, অশেষ-মহিমান্বিত অর্থাৎ সকলরকম যশের আধার এবং নিখিল ধনের প্রাপক আপনাকে যেন পরিচর্যা করি–অনুসরণ করি। [মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক আত্ম-উদ্বোধক ও প্রার্থনা-জ্ঞাপক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের রক্ষা করুন, আমাদের পরম মঙ্গল বিধান করুন, এবং আমাদের পরমার্থ ধন প্রদান করুন]। [এই ইন্দ্রদেবতার গানের নাম হারয়ণানি হারায়ণানি বা ত্রীণি]।
২। হে পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন ইন্দ্রদেব! সর্বসুখনিলয় অর্থাৎ সর্বসুখাত্মক আপনি অসুরগণকে নিহত করে যে ধনসমূহ আহরণ করেন অর্থাৎ অন্তরের আসুরভাব নাশ করে, শুদ্ধসত্ত্ব রূপ যে ধন উৎপাদন করেন; হে সর্বধনাধার! সেই ধনের দ্বারা অর্চনাকারী আমাদের বর্ধিত করুন; আরও, যাঁরা আপনার প্রীতিসাধনের নিমিত্ত আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন, তাঁদেরও সেই ধনের দ্বারা বর্ধিত করুন। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সেই দেবতা আমাদের আসুরভাব নাশ করে আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত করুন; আর তার দ্বারা যাতে আমরা তাতে সন্ন্যস্তচিত্ত হতে পারি, তার বিধান করুন। [এর গেয়গানগুলি সম্বন্ধে উক্ত আছে–বাম্রাণি ত্ৰীণি]।
৩। হে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা মিত্ররূপে প্রকটিত সুহৎস্বরূপ দেবতার উদ্দেশে পরমপ্রীতিপ্রদ অভীষ্টসিদ্ধির অনুকূল অবশ্য উচ্চারিতব্য নিত্যসত্য বেদমন্ত্র উচ্চারণ কর। মোক্ষসান্নিধ্যে গতিকারক দেবতার উদ্দেশে এবং সৎকর্মে সদা বিদ্যমান অর্থাৎ সৎকর্মের আধারভূত অভীষ্টবর্ষক দেবতার উদ্দেশ্যে স্তুতিসমূহ উচ্চারণ কর। হৃদয়ে দীপ্তিমান সুপ্রকাশ মিত্র ইত্যাদি দেববর্গের উদ্দেশে, অভীষ্ট স্থান প্রাপ্তির নিমিত্ত স্তুতি কর। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, সকল দেবভাব আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের অভীষ্টস্থান প্রাপ্ত করুক এবং পরমার্থ প্রদান। করুক]। [এর গেয়গানগুলি সম্বন্ধে উক্ত হয়েছে–বরুণসামাণি ত্রীণি]।
৪। হে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবন ইন্দ্রদেব। শ্রেয়ঃকামী অর্থাৎ দেবত্ব-অভিলাষী সাধুগণ চিরকাল ভক্তিসুধা গ্রহণের নিমিত্ত স্তোত্রের দ্বারা আপনাকে অনুসরণ করছেন। সম্যক্ জ্ঞানবান অর্থাৎ আত্মতত্ত্বদর্শী মেধাবিগণ অর্থাৎ সংসার-সাগর-উত্তীর্ণ নরদেবগণ সম্যকরূপে আপনার স্তুতি করেছেন–অনুসরণ করেছেন; রৌদ্রভাবাপন্ন দেবগণ অর্থাৎ বিবেকরূপী দেবগণ (বিবেক-অনুসারী জনগণ) আদি-অন্তরহিত চিরনূতন আপনাকে স্তব করছেন। অতএব, হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরাও ভগবৎপরায়ণ হও। [ভাব এই যে, ভগবানের আরাধনা সকলেরই সুখদায়ক। অজ্ঞানতার দূরীকরণে জ্ঞানীকে, সৎপথ-প্রদর্শকে ধর্মমার্গ-অনুসারিগণকে, করুণা-বিতরণে নিরহঙ্কার জনগণকে এবং কর্মসামর্থ্যহীন জনগণের পরিচালনায়, ভগবান্ সর্বদা নিরত আছেন। অতএব হে জীব! শেয়ঃ লাভের জন্য সদাই ভগবানের আরাধনা-পরায়ণ হও]। [এর গেয়গানের/নাম–প্রজাপতেঃ, বষট্কারনিধনম]।
৫। বিবেকরূপী হে দেবগণ! আপনাদের সম্বন্ধীয় অর্থাৎ আপনাদের সাথে অভিন্নভাবে স্থিত, মহামহিমোপেত, পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের প্রীতির জন্য, ভগবনদনুগ্রহপ্রাপক অর্থাৎ পাপ-ইত্যাদি নাশক স্তোত্রকে প্রকর্ষের সাথে উচ্চারণ করুন, অর্থাৎ সৎকর্মের সাথে অনুধ্যান করুন। (ভাব এই যে, –অজ্ঞ বিমূঢ় আমরা যে কর্মের দ্বারা মতিমান এবং বিবেকমার্গের অনুসারী হয়ে সেই ভগবানকে পেতে পারি, হে দেবগণ আপনারা তার বিধান করুন)। অজ্ঞানতারূপ শত্রুর অর্থাৎ পাপের নাশক, বহুকর্মা অর্থাৎ অশেষ সৎকর্মস্বরূপ অশেষজ্ঞ বা প্রজ্ঞানস্বরূপ ইন্দ্রদেব, বহুমুখী অর্থাৎ পাপের বিবিধ প্রাধান্যনাশক আপন বজ্ৰায়ুধের দ্বারা অর্থাৎ তার শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে অজ্ঞানতারূপ অসুরকে অর্থাৎ পাপকে নিঃশেষরূপে বিনাশ করুন অর্থাৎ সর্বতোভাব বিদূরিত করুন। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! কঠোর বজ্রের দ্বারা পাপকে বিচ্ছিন্ন করুন, আমাদের অজ্ঞানতা বিদূরিত করুন। তাতে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের প্রবাহ প্রবাহিত হোক; এবং তার দ্বারা মহতী সিদ্ধি হোক, এবং আমাদের মধ্যে পরমার্থের সমাবেশ হোক)। [এখানে মরুত পদে বিবেকরূপিণঃ দেবাঃ, বৃত্রং পদে অপামাবরকং বৃত্ৰাখ্যমসুরং। শতপর্বণা বজ্রেণ পদে শতসখ্যাকধারেণ বজ্রেণ এতন্নামকেনায়ুধেন অর্থাৎ শতধারযুক্ত বজ্রনামক অস্ত্র ইত্যাদি অর্থ গৃহীত হয়েছে। মন্ত্রটির দ্বিতীয়াংশ নিত্যসত্যতত্ত্বজ্ঞাপক]। [আরণ্যকে ১ম-২য়ে, ৫-৬, ৩য়ে, চ ২৭-২৮ দ্বে। সাম-মন্ত্রের গেয়গানের নাম ধৃষতো মারুতস্য সাম]।
৬। সত্ত্বভাবপ্রবর্তক সৎকর্মসমূহের প্রবর্তক অর্থাৎ সদা সৎকর্মপরায়ণ সাধুগণ, প্রাণশক্তি-সঞ্চারক যে স্তোত্রের বা কর্মের দ্বারা, দেবনশীল অর্থাৎ দেবভাবসমূহের আধার, সকর্মে সদাপ্রবুদ্ধ, জ্ঞানকিরণকে বা কর্মসামর্থ্যকে উৎপাদন করেন; বিবেকরূপী হে দেবগণ! দেবভাবসমূহের প্রকাশের জন্য অর্থাৎ আমাদের মধ্যে সত্ত্বভাব উৎপাদনের জন্য, সর্বথা পাপবিনাশক অজ্ঞানতানাশক প্রাণশক্তিসম্পন্ন সেই স্তোত্রকে বা কর্মকে আমাদের মধ্যে ঝঙ্কৃত করুন, অর্থাৎ প্রকৃষ্টরূপে আমাদের, এ দ্বারা সম্পাদিত করুন। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক বা প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, –সৎকর্মের প্রভাবে এ আমরা হৃদয়ে জ্ঞানসঞ্চয়ে যেন প্রবৃত্ত হই; অপিচ, জ্ঞানের প্রভাবে যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই, এমন, সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি]। [আরণ্যকে প্র-১৬(দ্বি)। গেয়গান–সংশ্রবসঃ বিশ্রবসঃ সত্যশ্রবসঃ শ্ৰবসঃ বা এবং বাপ্যানাম, ইন্দ্রস্য বা নামে অভিহিত]।
৭। হে পরমৈশ্বর্যশালি ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি আমাদের প্রকৃষ্ট জ্ঞান অথবা সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করুন। অপিচ, যে প্রকারে পিতা পুত্রদের জন্য অর্থাৎ তাদের মঙ্গলের জন্য বিদ্যা এবং ধন প্রদান করেন, তেমনই আপনি আমাদের সৎপথ প্রদর্শনের দ্বারা পরমধন ও পরাজ্ঞান প্রদান করুন। হে সকলের আকাঙক্ষণীয় ইন্দ্রদেব! আপনার উদ্দেশে অনুষ্ঠিত সংকর্মে প্রাণশক্তির অভিলাষী আমরা যেন প্রাণশক্তি-স্বরূপ জ্ঞানকিরণকে প্রাপ্ত হই। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন৷ পিতার মতো আপনি আমাদের সৎপথে নিয়ে চলুন; প্রজ্ঞানে উদ্ভাসিত সদ্ভাবমণ্ডিত চিত্তের দ্বারা যাতে আমরা পরমধন লাভ করতে পারি, আপনি তা বিধান করুন]। অথবা–হে ভূতগণের প্রকাশক, সর্বভূতাত্মন্ ভগবন ইন্দ্রদেব! পিতা যেমন আপন সন্তানবর্গের মঙ্গল কামনায় তাদের সৎপথ প্রদর্শন করেন, বিদ্যা এবং ধন প্রদান করেন, তেমনই আপনি আমাদের মঙ্গলের জন্য আমাদের পরমজ্ঞান প্রদান করুন এবং আমাদের সৎপথে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করুন। সকলের পূজনীয় বা সকলের আকাঙক্ষণীয় হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সকলের অভিলষিত বা প্রাপ্তব্য প্রকৃতি-ব্ৰহ্মে অর্থাৎ আপনাতে স্থিত জীবনীশক্তির অভিলাষী আমরা যেন অহরহ প্রজ্ঞানরশ্মি অর্থাৎ পরম-জ্যোতিঃ সেবা করি অর্থাৎ প্রাপ্ত হই। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এখানে পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের জন্য সাধক-গায়ক উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। যে কর্মের দ্বারা, যে জ্ঞানের দ্বারা, আত্মতত্ত্ব ভগবনতত্ত্ব অধিগত হয়, সেই পরাজ্ঞান ও পরাতত্ত্ব লাভের জন্য সাধক-গায়ক প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে সবর্ভূতাত্মন। আপনি পিতার ন্যায় আমাকে সৎপথে নিয়ে চলুন এবং আমাকে আত্মজ্ঞান পরাজ্ঞান প্রদান করুন। তাহলেই আমি পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনে সমর্থ হবো]। [গেয়গানের নাম–ব্যাপানাম্ ইন্দ্রস্য বা; সংশানানি, ব্রাম্রাণি বাসিষ্ঠানি বা]।
৮। হে পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন ইন্দ্রদেব! আপনার অনুগ্রহপ্রার্থী আমাদের আপনি পরিত্যাগ করবেন না; পরন্তু আপনার অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী আমাদের আপনার প্রতিদায়ক (আমাদের পরমানন্দপ্রদ) কর্মে। নিয়োজিত রেখে সর্বথা বিদ্যমান থাকুন, –আমাদের ভক্তিসুধাগ্রহণের জন্য আমাদের অনুষ্ঠিত সকল কর্মের সাথে অবস্থিতি করুন। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি আমাদের রক্ষক ও প্রতিপালক হন; অথবা, আপনি আমাদের আপনার সম্বন্ধযুত রক্ষাসমূহে স্থাপিত করুন; অর্থাৎ; আমাদের রক্ষা করুন। আপনিই আমাদের বন্ধু ও আকাঙক্ষণীয়; অথবা, আপনাকেই আমরা প্রার্থনা করি। অতএব হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী আমাদের পরিত্যাগ করবেন না; পরন্তু আমাদের উদ্ধার করুন। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের নিকট আগমন করুন এবং আমাদের সর্বথা রক্ষা করুন। অপিচ, আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন করে আমাদের সাথে মিলিত হোন। অথবা, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চার করে আমাদের সকল কর্মে অধিষ্ঠিত থাকুন। যাতে আপনার সাথে সখিত্ব সংস্থাপিত হয় এবং পরাজ্ঞানপ্রভাবে যাতে আপনার স্বরূপ জানতে পারি, হে ভগবন, কৃপাপূর্বক তার বিধান করুন]। [ঋগ্বেদ; গেয়গান সম্বন্ধে উক্ত আছে–আঞ্জিগস্য অঞ্জিগস্য বা সামনি দ্বে]।
৯। বহিরন্তঃ শত্রুনাশক (অসুর বা বহির্ব্যাধি এবং কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তরের শত্রুনাশক) হে ভগবন! আপনার প্রীতি-সাধনের জন্য আপনার অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী আমরা শুদ্ধসত্ত্বকে (ভক্তিসুধাকে) ও নিশ্চিত যেন অভিযুত করি অর্থাৎ সঞ্চিত করি; সাগরগামী জলের ন্যায় অর্থাৎ জলসমূহ যেমন জলধারা বারিনিধির সাথে মিশবার জন্য তার অভিমুখে প্রধাবিত হয়, তেমনই, আমাদের হৃদয়ে, উপজিত শুদ্ধসত্ত্ব (ভক্তিসুধা) শুদ্ধসত্ত্বাধার আপনার সাথে সম্মিলিত হোক; (ভাব এই যে, –সেই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে, আমরা সাগরগামী জলের ন্যায় যেন আপনার সাথে সম্মিলিত হই;-জল যেমন আপনা-আপনিই সাগর-সঙ্গম অভিলাষ করে, আমাদের কর্মসমূহ তেমনই ভগবৎপরায়ণ হোক এটাই আকাঙ্ক্ষা)। আপনার সাথে সম্মিলনের আশায়, বিশুদ্ধ শুদ্ধসত্ত্বের বা ভক্তিসুধার প্রস্রবণের মতো আপনা-আপনি প্রবহমান ও অপ্রতিহতগমন স্রোতের অভিমুখসমূহে আত্ম-উৎকর্ষের দ্বারা বন্ধনমুক্ত অর্থাৎ পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের অভিলাষী সাধকগণ বা উপাসকগণ আপনাকে অর্চনা করছেন–আপনাকে পাবার কামনায় নিজেদের প্রেরণ করছেন। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক; ভাব এই যে, –বিশ্ববাসী সকলেই আত্ম-উৎকর্ষ-লাভের জন্য ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণত হচ্ছে। হে আত্মা! বিশ্বের অন্তর্গত তুমিও তেমনই হও। নদীসমূহ যেমন বারিনিধির সাথে মিশবার জন্য আপন জলরাশি রূপ আত্মাকে প্রেরণ করে; তেমন ভগবানে আত্মসম্মিলনের জন্য তুমিও তোমার নিজেকে নিয়োজিত কর]। [গানের নাম–আষকারনিধণং কাণ্ব, মহাবৈষ্টতং, আতিনিধনং কাণ্বং]।
১০। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনি নিত্যকাল নিখিল পৌরুষ-সামর্থ্যের দ্বারা মনুষ্য-সমূহে শ্রেষ্ঠ বল ও হিতৈশ্বর্য প্রদান করুন। ইহলোকসম্বন্ধীয় বন্ধনমূলক কর্ম-সমূহে সম্ভাবনাশক অন্তরস্থিত কামাদি রিপুশত্রুগণের প্রভাবকে এবং ঐহিক সুখমূলক পারত্রিক অমঙ্গলসাধক বিত্তৈশ্বর্যের আকর্ষণকে সংহরণ করুন; অপিচ, হে ভগবন ইন্দ্রদেব! সকল জীবের শ্রেয়ঃসাধক যে প্রসিদ্ধ দ্যোতমান্ জ্ঞানরূপ অন্ন সে সকল আমাদের প্রদান করুন; অথবা, বহিরাগত নানামুখী সৎ-বৃত্তিনাশক শত্রুর প্রভাবকে সংহার বা নষ্ট করুন। [এখানে দু’রকমের প্রার্থনা বিদ্যমান আছে। লৌকিক-পক্ষে ভোগৈশ্বর্য লাভের জন্য এবং আধ্যাত্মিক-পক্ষে ভোগৈশ্বর্য-পরিহারের জন্য কামনা এখানে পরিদৃষ্ট হয়। লৌকিক-পক্ষে প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! ইহজগতে আমাদের দারিদ্রনাশ করুন, আমাদের সমৃদ্ধিসম্পন্ন করুন। আর আধ্যাত্মিক-পক্ষে সাধক-গায়ক প্রার্থনা করছেন, –হে ভগবন! আমাদের অন্তঃশত্রু ও বহিঃশত্রু নাশ করুন এবং আমাদের নিজপদে (সাধক বা পুণ্যাত্ম শ্রেণীতে) প্রতিষ্ঠিত করুন]। অথবা-হে ভগবন ইন্দ্রদেব! মনুষ্যত্বসম্পন্ন অর্থাৎ সত্ত্বভাবসমন্বিত বন্ধনমুক্ত আত্ম উৎকর্ষ-সম্পন্ন জনসমূহে যে মোক্ষপ্রাপক শক্তি বা কর্মসামর্থ্য এবং পরমার্থ-প্রাপক শুদ্ধসত্ত্ব রূপ ধন বিদ্যমান আছে; অপিচ, পরমার্থপ্রাপক ক্ষিতি-অপ-তেজঃ–মরুৎ-ব্যোম-সম্বন্ধীয় শ্রেয়ঃসাধক প্রজ্ঞানরূপ দ্যোতমান্ যে অন্ন; সে সকলই আমাদের প্রদান করুন; অপিচ, হে ভগবন! আমাদের শত্রুনাশের জন্য নিখিল পুরুষ সামর্থ্য বা শক্তিসমূহ আমাদের সর্বদা প্রদান করুন। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সাধক-গায়ক সৎকৰ্ম সাধনের সামর্থ্য এবং পরমার্থ-ধন (মোক্ষ) প্রার্থনা করছেন। হৃদয়ে সঞ্জাত শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎ-সম্বন্ধযুত হলে পরমাত্মার স্বরূপজ্ঞানরূপ তত্ত্বজ্ঞান জন্মে। জ্ঞান উদ্দীপিত হলে এবং হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত হলে, জ্ঞানময় ভগবান্ সেখানে আপনিই আবির্ভূত হন। প্রার্থনার ভাব এই যে, –যাতে আমাদের মধ্যে কর্ম-সামর্থ্য উপজিত হয়, যাতে কর্মপ্রভাবে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের এবং তত্ত্বজ্ঞানের সঞ্চার হয়, অপিচ, তার দ্বারা যাতে আমরা পরমার্থ লাভ করতে পারি, হে ভগবন, কৃপা করে আপনি তার বিধান করুন]। [এই গানটির ঋষি-ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য]।
.
চতুর্থী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র৷৷
ছন্দ বৃহতী৷৷
ঋষি : ১ মেধাতিথি কাম্ব (ঋগ্বেদে মেধ্যাতিথি কাণ্ব), ২ রেভ কাশ্যপ, ৩ বৎস (ঋগ্বেদে অশ্বপুত্র বশ), ৪ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, (ঋগ্বেদে শংযু বার্হস্পত্য), ৫ নৃমেধ আঙ্গিরস, ৬ পুরুহম্মা আঙ্গিরস, ৭ নৃমেধ ও পুরুমেধ আঙ্গিরস, ৮ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৯ মেধাতিথি ও মেধ্যাতিথি কাণ্ব, ১০ কলি প্রাগাথ৷৷
সত্যমিখা বৃষেদসি বৃষজুতিনোহবিতা। বৃষাত্মগ্র সৃঘিষে পরাবতি বৃষো অর্বাবতি শ্ৰতঃ৷৷৷৷৷ যচ্ছাসি পরাবতি যদবাবতি বৃত্ৰহন। অতত্ত্বা গীর্ভিদ্গদিন্দ্র কেশিভিঃ সুতাবাঁ আ বিবাসতি৷৷ ২. অভি বো বীরমন্ধুসো মদেষু গায় গিরা মহাবিচেতসম্। ইন্দ্রং নাম ত্যং শাকিং বচো যথা৷৷ ৩৷৷ ইন্দ্র ত্রিধাতু শরণং ব্রিবরূথং স্বস্তয়ে। ছর্দির্যচ্ছ মঘবদভ্যশ্চ মহ্যং চ যাবয়া দিদ্যুমেভ্যঃ ॥ ৪৷ শ্রায়ন্ত ইব সূর্যং বিশ্বেদিন্দ্রস্য ভক্ষত। বনি জাতত জনিমানন্যাজসা প্রতি ভাগং ন দীধিম৷৷ ৫৷৷ ন সীমদেব আপ তদিষং দীর্ঘায়ো মর্ত্যঃ। এতদ্যা চিদ্য এতশো যুযযাজত ইন্দ্রো হরী যুযোজতে৷৷ ৬ ৷ আ নো বিশ্বাসু হব্যমিং সমসু ভূষত। উপ ব্ৰহ্মাণি সবনানি বৃহন্ পরমজ)। ঋচীষ৷৷ ৭. তবেদিন্দ্রাবমং বসু ত্বং পুষ্যসি মধ্যম। সত্রা বিশ্বস্য পরমস্য রাজসি নকি গোষু বৃতে৷৷ ৮৷৷ কেয়থ দেসি পুরুত্ৰা চিদ্ধি তে মনঃ। অলর্ষি যুধম খজকৃৎ পুরন্দর প্র গায়ত্ৰা অগাসিমুঃ ৯৷৷ বয়মেনমিদা হ্যোপীপেমেহ বর্জিণম্। তস্মা উ অদ্য সবনে সুতং ভরা নূনং ভূষত শুতে৷৷ ১০৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। হে প্রভূতবল ইন্দ্র! আপনি সর্বাভীষ্টপূরক, এটা সত্য; আপনি ইষ্ট কাময়মান আমাদের রক্ষক হোন। আপনি সত্যই সকল কামনার বর্ষণকারী (পূরক) বলে বিদিত আছেন; যে পরলোকে ও ইহলোকে আপনি অভীষ্টবর্ষণশীল মঙ্গলবিধায়ক বলে বিদিত হয়ে থাকেন; প্রার্থনা উভয়লোকেই আপনি আমাদের রক্ষক হোন। [মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক ভগবৎ-মাহাত্ম্যপ্রকাশক। ভগবান্ সৎ-ভাবসম্পন্ন জনের রক্ষক; তিনি ইহকালে ও পরকালে অভীষ্টপূরক ও মঙ্গলবিধায়ক। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! আমাদের সৎ-ভাবসম্পন্ন করুন এবং ইহকালে ও পরকালে আমাদের মঙ্গল-বিধান করুন]। অথবা–হে প্রভূতবল ইন্দ্র! সৎস্বরূপ আপনি সকল অভীষ্ট-পূরক হন; এমন যে আপনি, শুদ্ধসত্ত্ব-অভিলাষী আমাদের রক্ষক হোন। আপনি অভীষ্টবর্ষণশীল বলে বিদিত; সম্ভাবসমন্বিত হৃদয়ে আপনি সর্বার্থসাধক এ তো স্বতঃসিদ্ধ (চিরপ্রমাণিত); কিন্তু সত্ত্বসংশ্রবশূন্য হৃদয়েও আপনি বর্ষণশীল অর্থাৎ সৎ-ভাবের জনয়িতা। [এই মন্ত্র ভগবানের মাহাত্ম্যজ্ঞাপক ও নিত্যসত্যপ্রকাশক। অতি অকিঞ্চন জনও যদি ভগবানে সংন্যস্তচিত্ত হয়, সর্বার্থদাতা ভগবান্ তাকে উদ্ধার করেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, –হে ভগবন! অতি অকিঞ্চন আমি আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। অশেষ করুণাধার আপনি আমাকে সৎ-ভাবসমন্বিত ও সৎকর্মপরায়ণ করুন, তার দ্বারা আমাকে উদ্ধার করুন]। [গেয়গানের নাম ইন্দ্রস্য, বৃষকং]।
২। শত্রুগণের নাশক হে ভগবন! যদিও আপনি দূরে-হৃদয়ের বহিঃপ্রদেশে বিদ্যমান হন; অথবা, জ্ঞানাবরক শত্রুগণের নাশক আপনি নিকটে হৃদয়-দেশে অবস্থিত হন; হে পরমৈশ্বর্যশালিন্ ইন্দ্রদেব! সেই সকল স্থান থেকে, সকল অবস্থাতে, সকলের উদ্ভাসক জ্ঞানভক্তিসহযুত সৎপথপ্রদর্শক স্তোত্রকর্মের দ্বারা, শুদ্ধসত্ত্ব-সমন্বিত আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন সাধক, আপনাকে অনুষ্ঠিত সৎকর্মে আনয়ন করেন–আকর্ষণ করেন। [মন্ত্রটি নিত্যসত্য প্রকাশক ও আত্ম-উদ্বোধক। সৎ-ভাব-সমন্বিত ব্যক্তিই ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করে থাকেন। তিনিই কেবল ভগবানের প্রীতিসাধক কর্মানুষ্ঠানের দ্বারা ভগবানকে পূজা করতে সমর্থ হন। উপাসক তাই আত্মাকে উদ্বোধিত করে বলছেন–হে আত্মন! তুমি ভগবানকে পূজা করবার উপযোগী সৎকর্মপরায়ণ হও]। [এর গেয়গানের নাম–দ্যৌতে দ্বৈগতে বা]। [গেয়গানের ঋষি– রেভ কাশ্যপ]।
৩। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমাদের হিতের জন্য, তোমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপাদন বা সঞ্চার করে, শত্রুগণের, নাশক, রিপুগণের দমনকারী, বিশিষ্টপ্রজ্ঞ–চৈতন্যস্বরূপ, জগৎ-আরাধ্য, শক্তিমন্ত–সকল শক্তির আধার, পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে, তার প্রীতিসাধক স্তুতি অথবা তার প্রতিসাধক কর্ম সমর্পণ কর; এবং যে রকমে বিহিত আছে সেই রকমে মহৎ স্তোত্রের দ্বারা তার মহিমা-গান কর–তার অনুসরণ কর। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। ভাব এই যে, ভগবৎপ্রীতিসাধক কর্ম যে রকমে অনুষ্ঠিত হয়, হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ, তোমরা তেমনই অনুষ্ঠান কর]। [গেয়গানের নাম–কার্ত্তযশং অথবা কাৰ্ত্তবেশাং]।
৪। হে ভগবন! আপনি আমাদের অবিনাশী অর্থাৎ মঙ্গলের জন্য, কাম-ক্রোধ-লোভ ইত্যাদি পরিশূন্য (অথবা বায়ু-পিত্ত-শ্লেষ্মা ত্রিধাতু-সম্বন্ধবিরহিত, অথবা–আধ্যাত্মিক–আধিভৌতিক আধিদৈবিক ত্রিবিধ দুঃখনাশক, অথবা–সত্ত্ব রজঃ-তমঃ ত্রিগুণ-সাম্য-সাধনভূত) এবং জন্ম-জরা মরণরহিত পরম সুখ ও পরমাশ্রয় আমাকে প্রদান করুন; অপিচ, শুদ্ধসত্ত্বকাময়মান এই আমাদের নিকট হতে শত্রুগণের প্রেরিত শাণিত অস্ত্রকে দূরীভূত করুন। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব, র। হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহে যেন আমরা পরম সুখ ও পরম আশ্রয় প্রাপ্ত হই]। [গেয়গানের নাম: ইন্দ্রস্য শরণং]।
৫। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেবতার সমগ্র বিভূতিসকলকে, জ্ঞানাধিষ্ঠাতা দেবতাতে সদাশ্রিত নিজনের মতো অথবা সূর্যরশ্মিসকল যেমন সূর্যকে আশ্রয় করে অবস্থিতি করে তেমন, ভজন কর–অনুসরণ কর; (ভাব এই যে, জ্ঞানিজন যেমন জ্ঞানের ভজনা করে, তেমন বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেবের বিভূতিসকলকে ভজনা কর); সেই শক্তির দ্বারা ধর্ম-অর্থ কাম-মোক্ষরূপ ধনসমূহকে প্রাপ্ত হয়ে, পিতৃসম্পত্তির মতো যেন অধিকারী হই; (ভাব এই যে পিতৃসম্পত্তিতে যেমন পুত্রের অব্যাহত অধিকার, ভগবানের বিভূতি সমূহে আমরা যেন তেমন অধিকারী হই)। [গেয়গামের নাম–শ্ৰায়ন্তিয়ং; বিবরণ-কারের মতে এই মন্ত্রের ঋষি-নৃমেধ নন–তৃমেধস্]।
৬। হে সনাতন পুরুষ! সত্ত্বভাববিরহিত অতএব আপনার অনুগ্রহবর্জিত মনুষ্য আপনার সম্বন্ধীয় শ্রেষ্ঠ বলৈশ্বর্য রূপ ধনকে কিঞ্চিৎ মাত্রও প্রাপ্ত হয় না; (ভাব এই যে, –সৎকর্মহীন মানুষ ভগবানের অনুকম্পা-লাভে সমর্থ হয় না); যে সাধক বহুশক্তিসম্পন্ন জ্ঞানজ কর্মকে নিজেতে যুক্ত করে অর্থাৎ একান্তে জ্ঞানযোগের দ্বারা ভগবানের কর্ম করতে প্রবৃত্ত হয়; বলৈশ্বর্যের অধিপতি ইন্দ্রদেব বলৈশ্বর্য রূপ নিজের দুই বিভূতিকে সেই সাধকে যোজনা করে দেন; (ভাব এই যে, সৎকর্মের দ্বারা মুক্তিমার্গ প্রশস্ত হয়ে আসে)। [এর গেয়গানের নাম–বাম্রং আক্ষীলং বা]।
৭। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুসমূহের সাথে সকল রকম যুদ্ধে, সাধকগণ কর্তৃক আত্মরক্ষার্থ আহ্বানযোগ্য বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেবকে উদ্দেশ করে, আমাদের হৃদয় প্রদেশে শুদ্ধসত্ত্বভাবসকলকে সঞ্চয় কর। হে স্তবনীয়, হে শত্রুঘাতক, হে পাপবিধ্বংসি! আপনি আমাদের ত্রৈকালিক কর্মসমুদয়কে সত্ত্বসমন্বিত করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের অনুষ্ঠেয় কর্মসমূহকে দোষশূন্য করুন)। [কাম ইত্যাদি রিপুবৃন্দ সর্বদাই যজ্ঞধ্বংসী রাক্ষসের মতো অন্তরের শুদ্ধানুষ্ঠানগুলিকে গ্রাস করবার জন্য বীভৎসরূপে মুখব্যাদান করে আছে। শুদ্ধসত্ত্বভাব হৃদয়ে উপচিত কেমন ভাবে হতে পারে? তাই ভগবানের বিশেষ বিভূতিস্বরূপ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হবার জন্য আপন অন্তরের কাছে সাধক-গায়কের প্রার্থনা-যদি অন্তর্যজ্ঞে জয়ী হতে ইচ্ছা কর, তাহলে শকুলের সব রকমের যুদ্ধে ইন্দ্রদেবের সাহায্য প্রার্থনা কর। তিনি বিশ্বাসু সমৎসু আহব্যং, সবরকম অসুরযুদ্ধে আহ্বানযোগ্য। আবার ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা–আপনি আমাদের যজ্ঞকর্মসকলকে দোষশূন্য করুন। এক কথায় বলতে গেলে, এই পরিদৃশ্যমান্ চরাচর ব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা কিছু সৎকর্ম অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা সমস্তই যজ্ঞ। সৎকর্মমাত্রই যখন যজ্ঞ, তখন যজ্ঞপতি ইন্দ্রদেবকেই তা রক্ষার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। [এর গেয়গানের নাম–শাক্রাণি বা, বাসিষ্ঠানি বা, বৈযশ্বানি বা, শৌল্কানি বা, আশ্বানি বা, সুম্নানি বা, দ্যুম্নানি বা, পৃষ্ঠানি বা, যৌক্তাশ্বানি বা, সোমসামানি বা, ইমানি ত্রীণি]।
৮। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে ভগবন ইন্দ্রদেব! তমোগুণজাত বল ও ঐশ্বর্যের একমাত্র আপনিই কর্তা; আপনিই রজোগুণ উৎপন্ন বলৈশ্বর্যের পালক; এবং সমগ্র উৎকৃষ্ট সত্ত্বগুণজাত বলৈশ্বর্যসমূহেরও আপনিই ঈশ্বর; এমন যে আপনাকে বলৈশ্বর্য-জ্ঞানাদি-বিষয়ে কাম ইত্যাদি রিপুগণ কেউই বাধা প্রদান করতে সমর্থ হয় না, –এটাই সত্য। (ভাব এই যে, সকল বলৈশ্বর্যের আপনিই প্রতিদ্বন্দ্বিরহিত প্রভু; অতএব আমাদের পরিত্রাণ-সাধক বলৈশ্বর্য আপনি আমাদের প্রদান করুন–এই প্রার্থনা)। [এর এ গেয়গানের নাম–প্রজাপতেঃ নিধনকামং]।
৯। রিপুগণের সাথে যুদ্ধের কর্তা, রিপুকুলের পুরবিদারক অর্থাৎ রিপুমূলবিধ্বংসী হে ভগবন! আপনি কোথায় গমন করেন, –কোথায়ই বা থাকেন! আপনার অন্তঃকরণ বহুবিষয়ে পরিব্যাপ্ত এটা আমরা জানি; কিন্তু অধুনা, আপনার স্তুতিগানশীল অর্থাৎ আপনার অনুসরণপরায়ণ আমাদের চিত্তবৃত্তিসকল, আপনাকে স্তব করছে–আপনার অনুসারী হয়েছে; আপনি আগমন করুন। (ভাব এই যে, –যদিও দেবতার দৃষ্টি বিশ্ববাসী সকলের প্রতি বিন্যস্ত; ক্ষুদ্র আমাদের প্রতি তার দৃষ্টি সঞ্চালিত হোক–এটাই আকাঙ্ক্ষা)। [এর গেয়গানের নাম–ইন্দ্রস্য, বশিষ্ঠস্য বা প্রিয়াণি।
১০। প্রার্থনাকারী আমরা, শত্রুনাশের নিমিত্ত বজ্রধারী এই প্রসিদ্ধ: শ্রেষ্ঠ দেবতাকে, ইদানীং অর্থাৎ তার মাহাত্ম্য অবগত হয়ে, এই যজ্ঞে (সকল সৎকর্মে) নিশ্চয়ই যেন আপ্যায়ন করি–অনুসরণ করি। হে আমার মন! সেই দেবতার জন্য, এই যজ্ঞে–নিত্যানুষ্ঠিত সকর্মে, সর্বতোভাবে সত্ত্বভাবকে সঞ্চয় কর; আর হে আমার কর্মনিবহ! তোমরা অধুনা, দেবতত্ত্ব পরিজ্ঞাত হয়ে, বিখ্যাত সেই দেবতার উদ্দেশ্যে–দেবতার অনুগ্রহ লাভের জন্য, সত্ত্বভাবের দ্বারা নিজেদের অলঙ্কৃত কর। [এই মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধক; এই মন্ত্রে উপাসক নিজেকে ভগবানের অনুসারী সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করছেন]। [ঋগ্বেদের সাথে, অবশ্য পাঠের কিঞ্চিৎ বিভিন্নতা আছে। এর গেয়গান সম্বন্ধে ইন্দ্রস্য বসিষ্ঠস্য বা বৈরূপে এবং ইদঞ্চেন্দ্রস্য বসিষ্ঠস্য বা বৈরূপং–এমন উক্তি পাওয়া যায়]।
.
পঞ্চমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র (৩ মন্ত্রের দেবতা ইন্দ্র বা বাস্তোষ্পতি; ৪ সূর্য, ৯ ইন্দ্রাগ্নী)৷
ছন্দ বৃহতী৷
ঋষিঃ ১।৬ পুরুহন্মা আঙ্গিরস, ২ ভর্গ প্রাগাথ, ৩ ইরিম্বিঠি কাণ্ব, ৪ জমদগ্নি ভার্গব, ৫।৭ দেবাতিথি কাণ্ব, ৮ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৯ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য, ১০ মেধ্য কাণ্ব।
যো রাজা চর্ষণীনাং যাতা রথেভিরড্রিগুঃ। বিশ্বাসাং তরুতা পৃতনানাং জ্যেষ্ঠো যো বৃত্ৰহা গৃণে৷৷ ১৷৷ : যত ইন্দ্র ভয়ামহে তো নো অভয়ং কৃধি। মঘবন্ধি তব তন্ন উতয়ে বি দ্বিমো বি মৃধো জহি৷৷ ২৷৷ বাস্তোতে বা স্থূণাংসং সোম্যানা। দ্রঃ পুরাং ভেত্তা শশ্বতীনামিন্দ্রো মুনীনাং সখা৷ ৩৷৷ বন্মহা অসি সূর্য বলাদিত্য মহা অসি। মহস্তে সততা মহিমা পনিষ্টম মহাদেব মহা অসি৷৷ ৪৷৷ অশ্বী রথী সুরূপ ইদ গোমান্ যদি তে সখা। শাত্ৰভাজা বয়সা সচতে সদা চর্যৈাতি সভামুপ৷৷ ৫৷৷ যদ দ্যাব ইন্দ্র তে শতং শতং ভূমীরুত স্যুঃ। ন ত্বা বজিৎসহস্রং সূর্যা অনু ন জাতমষ্ট রোদসী৷৷ ৬ ৷৷ যদি প্রাগপাগুদংন্যা হুয়সে নৃভিঃ। সিমা পুরু নৃততা অস্যানবেইসি প্রশর্ধ তুর্বশে৷৷ ৭ কস্তমিন্দ্র ত্বা বসবা মা দধর্ষতি। শ্রদ্ধা হি তে মঘবন্ পায়ে দিবি বাজী বাজং সিষাসতি৷৷ ৮৷৷ ইন্দ্রাগ্নী অপাদিয়ং পূর্বগাৎ পদ্বতীভ্যঃ। হিত্বা শিরো জিয়া রারপচ্চরৎ ত্রিংশৎ পদা ন্যক্রমীৎ৯৷৷ ইন্দ্র নেদীয় এদিহি মিতমেধাভিরাতিভিঃ। আ শন্তম শমাভিরভিষ্টিভিরা স্বাপে স্বাপিভিঃ। ১০।
মন্ত্ৰার্থ— ১। যে দেবতা আত্মোৎকর্ষসম্পন্ন সাধকগণের পালক রক্ষক হন, এবং যে দেবতা সৎকর্ম-রূপ যান-সমূহের দ্বারা সংবাহিত হন, এবং অপর অপকর্ম পরায়ণ জনগণের দ্বারা অপ্রাপ্য হন; আর যে দেবতা সকল রিপু-রূপ শত্রুসেনাগণের তারক নাশক হন; অপিচ, যে দেবতা অজ্ঞানতানাশকারী হন; সেই মহান্ শ্রেষ্ঠ দেবতাকে আমি স্তব করি–স্তব করতে (অনুসরণ করতে) সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছি। [এই মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক; ভাব এই যে, সাধুগণের পালক পাপিগণের বিমর্দক সেই ভগবানকে অনুসরণ করতে আমি যেন সঙ্কল্পবদ্ধ হই। যঃ পদে দেব, রাজা পদে রক্ষক পালক ধরা হয়েছে। প্রচলিত ব্যাখ্যায় চষণীনাং পদে কৃষকদের বুঝিয়ে থাকেন; এখানে যথার্থভাবে আত্মোৎকর্ষ সম্পন্ন সাধক ধরা হয়েছে। –ইত্যাদি)। [এর গেয়গানের নাম পৌরুহম্মনং ও প্রকার্যং]।
২। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! যা হতে আমরা ত্রাস প্রাপ্ত হই, সেই ত্রাসের কারণ হতে আমাদের ভয়শূন্য করুন-অভয়-দান করুন; হে পরমধনশালিন্! আপনি অশেষ সামর্থ্যযুক্ত হন; অতএব, আমাদের যারা দ্বেষ করে, সেই দ্বেষ্টৃগণকে অর্থাৎ রিপুশত্রুদের বিনাশ করুন, এবং আমাদের হিংসাকারী অপকর্মসকলকে নাশ করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আমাদের অভয় প্রদান করুন এবং আমাদের শত্রুগণকে নাশ করুন]। [গেয়গানের নাম–ইন্দ্রস্য, অভয়ঙ্করং]।
৩। হে গৃহস্পতি (হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সংরক্ষক হে দেব)! আমাদের হৃদয়-রূপ গৃহের আশ্রয়তাকে অর্থাৎ জ্ঞানযুত কর্মকে আপনি অবিচঞ্চল সত্যময় করুন; এবং সত্ত্বভাবসমন্বিত সাধকগণের সম্বযুত পরিত্রাণসাধক বলকে আমাদের প্রদান করুন; সত্ত্বাপহারী কামাদি-রিপুবর্গের অপকর্ম রূপ আশ্রয়স্থানকে বিদারণকারী যে ভগবান্ ইন্দ্রদেব নিত্যসত্যের সম্বন্ধযুত আত্মদ্রষ্টা ঋষিগণের সখা হন, সেই তিনি আমাদের পরিত্রাণকারী সখা হোন–এই প্রার্থনা। [ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মশীল হয়ে সাধতোচিত শক্তি প্রাপ্ত হই, এবং ভগবানের সখিত্ব লাভ করতে সমর্থ হই]। [গেয়গানের নাম– কাবষে দ্বে]।
৪। হে জ্ঞানধার! আপনি মহত্ত্বসম্পন্ন অর্থাৎ জ্ঞানরূপ শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যের অধিকারী হন–এটা সত্য; এ অনন্তের অঙ্গীভূহ হে দেব! আপনি মহত্ত্বসম্পন্ন অর্থাৎ অনন্ত-সৎকর্ম রূপ শ্রেষ্ঠ বলের অধিকারী হন–এটা সত্য; মহৎ সৎস্বরূপ আপনার বলৈশ্বর্যপ্রদ মহত্ত্ব সাধকগণ কর্তৃক পরিদৃষ্ট হয়; হে দীপ্তিদানাদিগুণান্বিত আপনি মহত্ত্বের দ্বারাজীবের হিতসাধনের দ্বারা–মহান্ প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠ হয়ে আছেন। [মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম্য-খ্যাপক; এর অন্তর্নিহিত প্রার্থনা–হে ভগবন আমাদের প্রতি আপনার সকল মহিমা প্রকট হোক]। [এর গেয়গানের নাম-সূর্যসাম]।
৫। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যখন কোনও ব্যক্তি আপনার অনুসরণকারী হন, তখন তিনি ব্যাপক জ্ঞানবিশিষ্ট, সৎকর্মসম্পন্ন এবং শোভনান্তঃকরণ হন; সর্বদা জ্ঞানসম্পন্ন ও পরমধনযুক্ত হয়ে, তিনি আত্মশক্তিতে ভগবানের সমীপে গমন করেন; এবং পরমানন্দযুক্ত হয়ে দীপ্তি (জ্ঞানসঙ্গ) প্রাপ্ত হন। [ভাব এই যে, দেবতার অনুসারী জন জ্ঞান ও সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য এবং পরমানন্দ লাভ করেন। [গেয়গানের বিষয়ে উক্ত আছে–বৈশ্বদেবে, আনূপে, বাধ্র্যশ্চে বা ইমে দ্বে]।
৬। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যদি দ্যুলোক অসংখ্য হয় এবং পৃথিবী অসংখ্যা হয়, তথাপি তারা আপনার পরিমাণ করতে অসমর্থ; হে বজ্ৰধারিন্! অসংখ্য সূর্যও আপনাকে প্রকাশ করতে পারে না; পূর্বে উৎপন্ন কিছুই এবং স্বর্গমর্তও আপনার পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হয় না। [ভাব এই যে, ভগবান্সকল হতে শ্রেষ্ঠ; তার সৃষ্ট কোনও বস্তু তাকে পরিমাণ করতে পারে না]। [এর গেয়গানের নাম–বৈরূপং]।
৭। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যদ্যপি আপনি সর্বত্র নেতা মনুষ্যগণ কর্তৃক পূজিত হন; তথাপি ঐকান্তিকতার সাথে সৎকর্মের দ্বারা সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হলে, আপনি সাধকের হৃদয়ে রিপুগণের প্রাধান্য-বারকরূপে প্রাদুর্ভূত হন; এবং সৎকর্মের প্রভাবে ভগবৎ-আশ্রয়প্রাপ্ত জনের হৃদয়ে রিপুবিমর্দক রূপে প্রাদুর্ভূত হয়ে থাকেন। [ভাব এই যে, –যদিও বহুজন কর্তৃক আরাধিত হন, তথাপি ভগবন সৎকর্মান্বিত সাধককে শীঘ্র রিপুবর্গের কবল থেকে উদ্ধার করেন]। অথবা–বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! সর্বত্র আপনি নেতৃস্থানীয় লোকগণ কর্তৃক পূজিত হন; কিন্তু যখন ঐকান্তিকতার সাথে সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হন, তখন রিপুবশকারক হে দেব! সৎকর্মের প্রভাবে ভগবৎ-আশ্রয়-প্রাপ্ত জনের হিতের জন্য আপনি তার রিপুবিমৰ্পর্ক হয়ে থাকেন। [ভাব এই যে, বহুজন কর্তৃক আরাধিত হলেও ভগবান্ সৎকর্মান্বিত সাধককে শীঘ্র রিপুকবল হতে উদ্ধার করেন]। [গেয়গানের নাম নৈপাতিথে দ্বে]।
৮। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! ভগবৎগতপ্রাণ সাধককে কোন্ শত্রু পীড়া দিতে পারে? [ভাব এই যে, ভগবৎ-পরায়ণ ব্যক্তিকে কেউই পীড়া দিতে পারে না]। পরমধনশালী হে দেব! সৎকর্মসম্পন্ন ব্যক্তি আপনার প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে, রিপুনাশের জন্য এবং মোক্ষ-প্রাপ্তির জন্য (দ্যুলোকে) সৎকর্মসাধন করেন। [ভাব এই যে, –সাধক-গায়ক রিপুনাশের ও মোক্ষলাভের জন্য সর্বত্র সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। –এই মন্ত্রের প্রচলিত কোন কোনও ব্যাখ্যায় সোমরসের কথা টেনে আনা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এখানে সোমরসের গন্ধও নেই]।
৯। হে বলৈশ্বর্যাধিপ (ইন্দ্র) ও জ্ঞানদেব (অগ্নি)! আপনাদের কৃপায় নিরবয়বহেতু পদবিহীনা হয়েও চিরন্তনী সৎ-বৃত্তি জীবগণের উদ্ধারের জন্য হৃদয়ে আবির্ভূতা হন। [ভাব এই যে, –দেবতা জীবগণের উদ্ধারের জন্য হৃদয়ে সৎবৃত্তি প্রদান করেন]। নিরবয়বহেতু অশিরস্ক হয়েও সেই সৎবৃত্তি জীবমধ্যস্থিত বাক্-যন্ত্রের সাহায্যে ভগবানের আরাধনা করেন; মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করেন; এবং অসংখ্য রিপুকে পরাজিত করেন। [ভাব এই যে, –হৃদয়স্থিতা সবৃত্তির দ্বারা মানুষেরা সৎপথে অনুবর্তন করেন এবং রিপুদের পরাজিত করতে সমর্থ হন]। অথবা-বলৈশ্বর্যাধিপতি হে জ্ঞানদেব! নিত্যা চিরন্তনী জ্ঞানবৃত্তি অস্থিরচিত্ত লোকগণের উদ্ধারের জন্য তাদের হৃদয়ে প্রাদুর্ভূতা হন; সেই জ্ঞানবৃত্তি লোকগণের সত্ত্বভাবকে বর্ধিত করে, স্তোত্রের দ্বারা ভগবানকে আরাধনা করেন; চিত্তচাঞ্চল্যকারক অসংখ্য রিপুকে জ্ঞানকিরণের দ্বারা পরাজয় করেন। [ভাব এই যে, –দেবতা কৃপা করে লোকগণের হৃদয়ে জ্ঞান প্রদান করেন, সেই জ্ঞানের দ্বারা মানুষেরা মোক্ষসাধনভূত সৎকর্ম সম্পাদন করতে সমর্থ হয়। এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে–হে ইন্দ্র ও অগ্নি! পাদরহিতা এই ঊষা (প্রাণিবর্গের) শিবরাদেশ উত্তেজিত করে এবং তাদের জিহ্বা দ্বারা শব্দ করিয়ে পাদযুক্ত নিদ্রিত জীবগণের অভিমুখবর্তিনী হচ্ছেন এবং এইভাবে ত্রিশপদ (ত্রিংশৎমুহূর্ত) অতিক্রম করছেন। –এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, মন্ত্রটি ব্রাহ্মমুহূর্তে রচিত হয়েছিল, অথবা এটি প্রাতঃকালীন স্তোত্ররূপে পঠিত হতো। কিন্তু সূর্য ও ইন্দ্রকে লক্ষ্য করে ঊষার মহিমা কীর্তন করা হয় কেন, –এ প্রশ্নের উত্তর ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাকার দেননি। এখানে প্রকৃতার্থে বোঝানো হয়েছে জ্ঞান ও সৎবৃত্তি মানুষকে নিজের চরম লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দিতে পারে। আর, এই জ্ঞান ও সৎ-বৃত্তি– ভগবানের অসীম কৃপার দান। তাই দেবতাকে সম্বোধন করে জ্ঞানের ও.সৎবৃত্তির মহিমা খ্যাপিত হয়েছে। এখানে ভগবানেরই দয়ার মাহাত্ম্য খ্যাপন করা হয়েছে। [এর গেয়গানের নাম–বাচঃ সাম]।
১০। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! জ্ঞান ও সৎকর্মযুক্ত রক্ষা কার্যের সাথে আমাদের হৃদয়ে আগমন। করুন; সুখদাতা হে দেব। প্রার্থনীয় সুখদানের জন্য আগমন করুন; বন্ধুভূত হে দেব! আমাদের মোক্ষদানের জন্য আগমন করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন এবং আমাদের পরমমঙ্গলজনক মোক্ষ দান করুন। –ঈশ্বরকে পাওয়ার এই যে আকাঙ্ক্ষা, তা চিরন্তন নিজস্বধন। ঐশ্বর্যের মধ্য দিয়ে, মহিমার মধ্য দিয়ে, তাকে পেয়ে সাধক তৃপ্তিলাভ করতে পারেন না; বরং ঈশ্বরের বিরাটত্ব ও সাধকের ক্ষুদ্ৰত্বের ব্যবধান সাধককে ভীত ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাই তাকে বন্ধুরূপে সখারূপে আহ্বান–সকল ব্যবধানকে ঘুচিয়ে সাধক-গায়ককে। ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যায়]। [এর গেয়গান সম্বন্ধে উক্ত আছে–বাম্রে, আশীলে বা ইমে দ্বে]।
.
ষষ্ঠী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র (৫ মন্ত্রের দেবতা অশ্বিদয়)৷
ছন্দ বৃহতী।
ঋষি– ১ নৃমেধ আঙ্গিরস, ২।৩ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৪ ভরদ্বাজ বার্হস্পত্য (ঋগ্বেদে শংযু বার্হস্পত্য), ৫ পরুচ্ছেপ দৈবদাসি, ৬ বামদেব গৌতম, ৭ মেধ্যাতিথি কাণ্ব, ৮ ভর্গ প্রাগাধ, ৯।১০ মেধাতিথি ও মেধ্যাতিথি কাণ্ব।
ইত উতী বো অজরং প্রহেরমপ্রহিতম্। আশুং জেতারং হোতারং রথীতমমতৃতং তুগ্রিয়াবৃধ৷ ১. মো মু ত্বা বাঘতশ্চ নারে অন্নি রীরম। আরাত্তাদ বা সধমাদং ন আ গহীহ বা সনুপ শ্রুধি। ২। সুনোত সোমপানে সোমমিন্দ্রায় বহ্রিণে। পচতা পক্তীরবসে কৃণুধ্বমিৎ পৃণনিৎ পৃণতে ময়ঃ ৩ যঃ সত্ৰাহা বিচৰ্ষণিরিং তং হূমহে বয়ম্। সহমন্যো তুবি সৎপতে ভবা সমসু নো বৃধে৷৷ ৪। শচীভিনঃ শচীব দিবা নক্তং দিশস্যতম্। মা বাং রাতিরূপ দসৎ কদাচনাস্মদ্রাতিঃ কদাচন। ৫৷ যদা কদাচ মীঢ়ষে স্তোতা জরেত মর্ত। আদি বন্দেত বরুণং বিপা গিরা ধর্তারং ব্রিতানা৷৷ ৬। পাহি গা অন্ধসসা মদ ইন্দ্রায় মেধ্যাতিথে। যঃ সম্মিশ্লো হর্যোর্যো হিরণ্যয় ইন্দ্রো বজ্ৰী হিরণ্যয়ঃ ৭। উভয়ং শৃণবচ্চ ন ইন্দ্রো অর্বাগিদং বচঃ। সত্ৰাচ্যা মঘবাৎ সোমপীতয়ে ধিয়া শবিষ্ঠ আ গমৎ। ৮। মহেচ ন ত্বদ্রিবঃ পরা শুল্কায় দীয়সে। ন:সহায় নাযুতায় বজিবো ন শতায় শতামঘ। ৯. বস্যাং ইন্ড্রাসি মে পিতুরুত ভ্রাতুরভুঞ্জতঃ। মাতা চ মে ছদয়থঃ সমা বসো বসুত্বনায় রাধসে৷৷ ১০৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। হে মম চিত্তবৃত্তিসমূহ! পাপকবল হতে তোমাদের রক্ষার জন্য, জরারহিত নিত্য, অপ্রতিহতভার স্বাধীন, রিপুবিমর্দক, আশুশত্রুজয়ী, মুক্তিদাতা, শ্রেষ্ঠ সৎকর্মপ্রাপক, অজাতশত্রু, লোকহিতসাধক ভগবানের শরণ তোমরা গ্রহণ কর। [ভাব এই যে, –পাপকবল হতে রক্ষার জন্য এবং মুক্তিলাভের জন্য আমি যেন ঐকান্তিকতার সাথে সর্বশক্তিমান্ ভগবানের শরণ গ্রহণ করি। [গেয়গানের নাম–গৌরীবীতে প্রহিতৌ দ্বৌ; বাসুক্রে বা ইমে দ্বে]।
২। হে ভগবন! আপনার উপাসকগণও যেন আমাদের নিকটে সুষ্ঠুভাবে আনন্দ উপভোগ করেন। [ভাব এই যে, আমরা যেন সদা ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করি); এবং দূর স্বর্লোক হতে আপনি আমাদের হৃদয়-রূপ যজ্ঞস্থলে আগমন করুন, এবং আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে প্রার্থনা বিশেষভাবে শ্রবণ করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে। আবির্ভূত হয়ে আমাদের প্রার্থনা পূরণ করুন। –এই মন্ত্রে ভগবানের প্রতি সাধকের অপূর্ব প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। সাধক-গায়ক ভগবানের প্রেমে বিভোর হয়ে, ভগবানকে যারা ভালবাসেন। তাদেরও কাছে–আত্মীয়রূপে পেতে চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রেমাস্পদকে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁরাও, নিশ্চয়ই ভক্তিপাত্র। তাদের সান্নিধ্যও সেই পরম প্রেমাস্পদের অনুভূতি হৃদয়ে জাগিয়ে দেয়]। [এর ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিদের এবং আমাদের হৃদআেমাদের হৃদয়ে করুন। প্রার্থনায় আগমন করুন, নিধ্য লাভ করি। গেয়গানের নাম-আত্রে দ্বে]।
৩। হে মম চিত্তবৃত্তিসমূহ! রক্ষাস্ত্রযুক্ত সত্ত্বভাবদাতা বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য সত্ত্বভাবের উদ্বোধন কর; পাপ হতে রক্ষার জন্য সৎকর্মসাধন কর; কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর; তার দ্বারা প্রীত হয়ে দেবতা উপাসকদের পরমধন প্রদান করেন, এবং সাধকদের অভীষ্টপূর্ণ করেন। [ভাব এই যে, –সৎকর্মসাধনের দ্বারা ও সত্ত্বভাবের দ্বারা মানুষ মুক্তিলাভ করে; আমি যেন হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উদ্বোধন ও সৎকর্ম সাধনের দ্বারা মুক্তিলাভ করতে পারি–মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক]। [এর গেয়গানের নাম–গৌরীবীতে দ্বে]।
৪। যিনি মহারিপুগণের নাশকারী, সর্বদর্শী সেই বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবকে আমরা যেন অনুসরণ করি। [ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের অনুসরণপরায়ণ হই]; শত্রুবিমর্দক মোক্ষদাতা সকলের পালনকারী হে দেব! আপনি রিপুসংগ্রামে আমাদের জয় প্রদান করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপা করে আমাদের রিপুনাশ করুন এবং আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন]। [এর গেয়গান-বামদেব্যম্]।
৫। সৎকর্ম ও পরমার্থ রূপ হে দেবদ্বয় (অথবা, জ্ঞান-ভক্তি রূপ হে দেবদ্বয়)! আমাদের সৎকর্ম সাধন-সমর্থ করে, নিত্যকাল আমাদের অভীষ্ট ধন প্রদান করুন। আপনাদের দান কখনও যেন ক্ষীণ হয়; আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রূপ (অথবা–সর্বজীবকে সেবা রূপ) দান আমাদের মধ্যে কখনও যেন ক্ষীণ না হয়। [প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমরা যেন জ্ঞান-ভক্তিযুত হয়ে আপনারই নির্দেশিত কর্মে সদাব্রতী হই; তাতে আপনার কৃপায় আমরা যেন মোক্ষলাভে সমর্থ হই। — প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রের প্রথম ভাগে নিত্যকাল সকল লোককেই মোক্ষ-প্রদানের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা আছে, দ্বিতীয় অংশে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, ভগবানের এ দান যেন অপ্রতিহত-ভাবে আমাদের উপর বর্ষিত হয়। তৃতীয় অংশে, আমরা যাতে মোক্ষলাভের উপযুক্ত হতে পারি, তারই জন্য ভগবানের চরণে প্রার্থনা জানানো হয়েছে)। [এর গেয়গানের–অশ্বিনোঃ সামঃ]।
৬। যখনই প্রার্থনাকারী জ্ঞান-বর্ষণের অর্থাৎ জ্ঞান-লাভের জন্য স্তুতি করবেন, তখনই তিনি আত্মরক্ষাত্মক প্রার্থনা দ্বারা সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য-প্রদাতা অভীষ্টবষক দেবকেই আরাধনা করে থাকেন। [ভাব এই যে, ভগবানই সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য এবং জ্ঞান প্রদান করেন, সুতরাং একমাত্র তিনিই আরাধ্য। –মানুষ যে দিক দিয়ে যে উপায়ে যে দেবতারই উপাসনা করুক কেন, সেই পূজা বিশ্বাত্মা ভগবানেরই চরণে পৌঁছায়। …বহুত্বের মধ্যে একের এই অনুভূতি আর্যধর্মের বিশেষত্ব]।
৭। হে জ্ঞানাধিপতি! বলৈশ্বর্যাধিপতি ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য, সত্ত্বভাবের আনন্দের মধ্যে আমাদের জ্ঞানসমূহকে প্রতিপালন করুন। [ভাব এই যে, ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের জ্ঞান শুদ্ধ সত্ত্বসমন্বিত হোক]। যে ভগবান্ জ্ঞানভক্তির আধারভূত, তিনি আমাদের হিতকারী ও রমণীয় হোন; যে ভগবান্ রিপুবিমর্দনের জন্য বজ্রধারী, তিনি আমাদের নিকট হিরণ্যের ন্যায় আকর্ষণীয় হোন। [ভাব। এই যে, –জ্ঞানভক্তিপ্রদ রিপুবিমর্দক ভগবান্ সকল রকমে আমাদের প্রিয় ও আকর্ষণীয় হোন]। [সামবেদে মেধ্যাতিথি ঋষিআর ঋকবেদ সংহিতায় কম্বগোত্রীয় প্রিয়মেধ ঋষি এই মন্ত্রের ঋষি বলে উক্ত হয়েছেন। এই মন্ত্রের গেয়গানের নাম–সৌভরে দ্বে]।
৮। বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা আমাদের অভিমুখী হয়ে, আমাদের কর্মবাক্যাত্মক এই প্রার্থনা শ্রবণ, করুন; এবং সর্বশক্তিমান শ্রেষ্ঠধনসম্পন্ন দেবতা আমাদের সৎকর্ম সাধক করে আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করবার জন্য আগমন করুন। [ভাব এই যে, আমাদের সৎকর্ম সহযুত প্রার্থনা শ্রবণ করে আমাদের সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য এবং শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রদান করুন। ভগবান্ আমাদের বাক্যাত্মিকা অর্থাৎ হৃদয় হতে উৎসারিত স্তুতিবাক্য শ্রবণ করুন। তিনি আমাদের কর্মাত্মিকা প্রার্থনাও শ্রবণ করুন; হৃদয়কে নির্মল করবার জন্য, রিপুদের পরাজিত বা দমন করবার জন্য, যে সকল সৎকর্মের অনুষ্ঠান করা হয়, তা-ই কর্মাত্মিকা প্রার্থনা। এই কর্মাত্মিকা ও বাক্যাত্মিকা প্রার্থনার পর সাধক-গায়ক সোমপীতয়ে অর্থাৎ তার হৃদয়সঞ্জাত সত্ত্বভাব বা শুদ্ধসত্ত্বময় ভক্তিরস আস্বাদনের জন্য প্রার্থনা জ্ঞাপন করছেন। সাধনার এই ক্ৰমটিই এই মন্ত্রে পরিস্ফুটিত]। [এর গেয়গানের নাম–ইন্দ্রস্য, বৈরশ্বম্]।
৯। পাপনাশে পাষাণকঠোর হে দেব! মহৎ পার্থিব সম্পদলাভ করার জন্য আপনি আপনাকে পরিত্যাগ না করান, অর্থাৎ আপনাকে যেন আমি পরিত্যাগ না করি; শত্রুনাশে বজ্রধারী হে দেব! সহস্ৰসংখ্যক ধনের জন্য এবং অযুতসংখ্যক ধনের জন্যও আমি যেন আপনাকে পরিত্যাগ না করি; হে বহুধনশালী দেব! আমি আপনাকে পার্থিব অপরিমিত ধনের জন্যও যেন পরিত্যাগ না করি। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –জগতের যা কিছু কাম্য, যা কিছু সুন্দর সৎ মূল্যবান, সমস্ত তো সেই শ্রীভগবানের চরণ থেকেই এসেছে। তবে মানুষ সামান্য কাঁচের জন্য কাণ্বন ত্যাগ করবে কেন? মোহ আসে, মায়া জ্ঞানকে আবৃত করে রাখে; তাই সাধক-গায়ক প্রার্থনা করছেন, –যেন কোনও প্রলোভনই তাকে ভগবানের চরণ থেকে বিচলিত করতে না পারে]। [এর গেয়গান-সহস্ৰমুভিয়ে, প্রজাপতেঃ মহোবিলীলে বা]।
১০। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! সত্ত্বসম্বন্ধরহি এই আমার পিতা হতে এবং সহোদর হতে আপনি অধিকতর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী; আশ্রয়দাতা হে দেব! আপনি আমার জননী-সমান স্নেহশীল হয়ে, মোক্ষলাভের জন্য–পরাজ্ঞান লাভের জন্য, আমাকে কৃপা করুন অর্থাৎ আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন। [ভাব এই যে, সর্বাপেক্ষা মানুষের অধিকতর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ভগবান্ মাতৃরূপে আমাদের তার স্নেহশীল ক্রোড়ে আশ্রয় দিন, পিতৃরূপে তিনি আমাদের পালন করুন, রক্ষা করুন, পাপ-সংস্পর্শে এলে শাসন করুন, ভ্রাতৃরূপে সখা-রূপে মোহ-বিভ্রান্ত আমাদের হাত ধরে তিনি যেন নিয়ে যান]। [এর গেয়গান–ইন্দ্রান্যাঃ সাম]।
.
সপ্তমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র (৭ মন্ত্রের দেবতা বহু)৷৷
ছন্দ বৃহতী৷
ঋষি– ১ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ২।৬।৭ বামদেব গৌতম, ৩ মেধাতিথি ও মেধ্যাতিথি কাণ্ব অথবা বিশ্বামিত্র, ৪ নোধা গৌতম, ৫ মেধাতিথি কাণ্ব (ঋগ্বেদে মেধ্যাতিথি), ৮ শ্ৰুষ্টিগু কাণ্ব (বালখিল্য), ৯ মেধ্যাতিথি বা মেধাতিথি কাণ্ব, ১০ নৃমেধ আঙ্গিরস।
ইম ইন্দ্রায় সুম্বিরে সোমাসো দধ্যাশিরঃ। তা আ মদায় বজ্রহস্ত পীতয়ে হরিভ্যাং যাহোক আ৷৷ ১৷৷ ইম ইন্দ্র মদায় তে সোমাশ্চিকিত্ৰ উথিনঃ। মধোঃ পপান উপ নো গিরঃ শৃণু রাস্ব স্তোত্রায় গির্বণঃ। ২। আ ত্বা৩দ্য সবর্দুঘাং হুবে গায়ত্ৰবেপস। ইন্দ্রং ধেনুং সুদুঘামন্যামিযমুরুধারামরত৷ ৩৷ ন ত্বা বৃহতো অদ্রয়ো বরন্ত ইন্দ্ৰ বীডবঃ। যচ্ছিসি স্তবতে মাবতে বসু ন কিষ্টদা মিনাতি তে৷৷ ৪৷৷ ক ঈং বেদ সুতে সচা পিবন্তং ক বয়ো দধে। অয়ং যঃ পুরো বি ভিনত্যোজসা মন্দানঃ শিপ্রন্ধসঃ ৷৷ ৫৷৷ যদিন্দ্রা শাসো অব্রতং চ্যাবয়া সদসম্পরি। অস্মাকমংশুং মঘব পুরুস্পৃহং বসব্যে অধি বহয়৷৬৷৷ তৃষ্টা নো দৈব্যং বচঃ পর্জন্যো ব্ৰহ্মণস্পতিঃ। পুত্ৰভ্রাতৃভি রদিতির্ন পাতু নো দুষ্টরং ত্ৰামণং বচঃ। ৭৷৷ কদাচন স্তরীরসি নেন্দ্র সসি দাশুযে। উপোপেম্ন মঘব ভূয় ইনু তে দানং দেবস্য পৃচ্যতে। ৮। যুঙ্ক্ষা হি বৃহত্তম হরী ইন্দ্র পরাবতঃ। অর্বাচীন্যে মঘবৎ নোম পীতয় উগ্র ঋঘেভিরাগহি৷৷ ৯। জ্বামিদা হো নরোহপীপ্য বজ্বিন ভূৰ্ণয়ঃ। স ইন্দ্রস্তোমবাহস ইহ শুধপ স্বসরমাগহি৷৷ ১০
মন্ত্রার্থ— ১। বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য আমাদের অন্তর্নিহিত সত্ত্বভাবসমূহ ভক্তিরসবিমিশ্রিত এবং অনন্যভাবাশ্রিত হোক; রক্ষাস্ত্রধারী হে দেব! সত্ত্বভাব সমূহকে গ্রহণ করবার জন্য এবং আমাদের পরমানন্দ দানের নিমিত্ত আপনি জ্ঞানভক্তির সাথে আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। [প্রার্থনা ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ কৃপা করে আমাদের অন্তর্নিহিত সত্ত্বভাবকে রক্ষা করুন এবং আমাদের জ্ঞান-ভক্তি প্রদান করুন। –এই মন্ত্রের মধ্যে ভগবানের সান্নিধ্যলাভের হৃদয়ে তার অনুভূতি-লাভের ব্যাকুল কামনা দেখতে পাওয়া যায়]। [এর গেয়গান–সৌভরম্।
২। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনার প্রদত্ত আমাদের হৃদয়স্থিত প্রশংসনীয় সত্ত্বভাবসমূহ পরমানন্দ দানের জন্য আমাদের জ্ঞানদায়ক হোক; অমৃতের পানকারী–সত্ত্বভাবের গ্রহণকারী স্তবনীয় হে দেব! আমাদের প্রার্থনা বিশেষভাবে শ্রবণ করুন, এবং উপাসককে অভীষ্ট ধন (মোক্ষ) এ প্রদান করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ আমাদের অন্তর্নিহিত সত্ত্বভাবসমূহকে এ জ্ঞানসমন্বিত করে তুলুন, এবং আমাদের পরমধন প্রদান করুন। –সোমঃ পদে পূর্বাপর সত্ত্বভাব অর্থই গ্রহণীয়, সোমরস বা মদ্য নয়। মধোঃ পপান অর্থে অমৃতের পানকারী অর্থই শ্রুতি-সঙ্গত]। [এর গেয়গান–গৎ সমদম]।
৩। হে দেব! সত্ত্বভাবপ্রদাতা আশুমুক্তিদায়ক আপনাকে আমি যেন এখন আরাধনা করতে পারি, অর্থাৎ আপনার অনুসরণ পরায়ণ হই; বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব। মুক্তিদানসমর্থ শুদ্ধসত্ত্বভাবযুক্ত জ্ঞান এবং বিশুদ্ধীকৃত (অথবা প্রভূতপরিমাণ) সৎকর্মসাধনসামর্থ্য আমাকে প্রদান করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ কৃপা করে আমাকে মোক্ষদান-সমর্থ জ্ঞান প্রদান করুন। –মন্ত্রটির প্রথম অংশ আত্ম-উদ্বোধনমূলক এবং অপরাংশ প্রার্থনাময়]। [এর গেয়গানের নাম–বাচঃ সাম]।
৪। বলৈশ্বর্যাধিপতে হে দেব! বলবান্ পাষাণকঠোর দৃঢ় শত্রুগণ আপনাকে পরাজিত করতে পারে না। [ভাব এই যে, ভগবান্ অপরাজেয়]। প্রার্থনাকারী আমাকে যে পরমধন আপনি প্রদান করেন, আপনার সেই ধন কেউই যেন হিংসা না করে। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবানের প্রদত্ত পরমধন কোন রিপুর আক্রমণে যেন ক্ষয় না হয়। মন্ত্রের প্রথমে একটি, নিত্যসত্য প্রকাশিত–ভগবান অপরাজেয়। তাঁর বিশ্বমঙ্গল নীতি অনন্তকাল প্রবর্তিত থাকবে। জগতে পাপের যে প্রাধান্য তা পাপের ক্ষণিক জয়। তা ধ্বংস হবেই। ভগবানের মঙ্গলময় বিধানই পূর্ণতেজে কাজ করেছে, করছে এবং করবে। তাই সাধক-গায়কের প্রার্থনা–আমি দুর্বল, আমি অজ্ঞান, তোমার দয়ার মর্যাদা যেন রক্ষা করতে পারি প্রভু। ….তোমার মঙ্গলময় নীতি আমার প্রতি কার্যকর হোক। আমি রিপুগণের আক্রমণ থেকে মুক্তি লাভ করে তোমার দেওয়া অর্ঘ্যে তোমারই সেবায় যেন আত্মনিয়োগ করতে পারি। আমার জীবন ধন্য হোক]। [এর গেয়গান-বার্হদুকথম। ঋগ্বেদে এই মন্ত্রের বীড়বঃ পদের অন্তর দেখা যায়]।
৫। এই যে দেবতা আপন তেজে রিপুগণের আশ্রয়কে অর্থাৎ মোহপাপকে ধ্বংস করেন; সত্ত্বভাব সন্নিধানে আনন্দবর্ধক এবং জ্যোতির্ময়, অর্থাৎ জ্ঞানদাতা হন, বিশুদ্ধ সৎকর্মে সম্মিলিত জ্ঞান-পানকারী অর্থাৎ জ্ঞানের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট সেই দেবতাকে কে জানতে সমর্থ হয়? কোন্ দেবতাই বা সৎকর্মসাধনসামর্থ্য প্রদান করেন? [ভাব এই যে, ভগবানের কৃপা ব্যতীত কেউই তাঁকে জানতে সমর্থ হয় না। মন্ত্রে বলা হয়েছে–কঃ বেদ? তাকে কে জানতে পারে? আবার পরক্ষণেই সেই জ্ঞেয় বস্তুর সম্বন্ধে নানা বিশেষণ সংযোগ করা হয়েছে। অনেকে আপত্তি তুলেছেন–অজ্ঞেয়কে জ্ঞেয়ত্বের মধ্যে আবার তাকে অজ্ঞেয়রূপে কল্পনা করায় স্ববিরোধিতা দোষলক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তা হয়নি। এখানে এই জিজ্ঞাসার অর্থ এই যে, কে সেই অনন্ত বিরাটু পুরুষ পরব্রহ্মকে পূর্ণরূপে জানতে পারে? অর্থাৎ কেউই পারেন না–যে পর্যন্ত না জ্ঞাতা সেই জ্ঞেয়ের সমভাবাপন্ন না হয়েছেন, যে পর্যন্ত না তিনি নিজের অসীমত্বের ও অনন্তত্বের পূর্ণবিকাশ সাধন করেছেন]। [এর গেয়গানের নাম বাশম্। সামবেদ-সংহিতায় মেধাতিথি এবং ঋগ্বেদ-সংহিতায় কণ্বগোত্রীয় প্রিয়মেধ এই মন্ত্রের ঋষি বলে উক্ত আছে]।
৬। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যেহেতু আপনি, রিপুবিমর্দক, সেই হেতু আমাদের হৃদয়স্থিত সৎকর্মবিরোধী রিপুদের দূরীভূত করুন; পরমধনশালী হে দেব! সর্বলোক-প্রার্থনীয় আমাদের জ্ঞানকিরণনিবহকে আপনি আমাদের হৃদয়ে প্রবর্ধিত করুন। [প্রার্থনার.ভাব এই যে, –সেই ভগবান। আমাদের রিপুসমূহকে বিনাশ করুন এবং আমাদের জ্ঞান প্রদান করুন। প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রের প্রথম ভাগে মানুষের হৃদয়স্থিত কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুদের বিনাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, এবং অপরাংশে জ্ঞানবর্ধনের জন্য প্রার্থনা আছে। [এর গেয়গানের নাম–তৌঃ শ্ৰবসম্]।
৭। সর্বজনতৃপ্তিদায় পরিত্রাণকারী জ্ঞানদেব আমাদের দেবভাবপ্রদ প্রার্থনাত্মিক সৎকৰ্মনিবহকে প্রবর্ধিত করুন; অখণ্ডনীয় অনন্তরূপ দেব নিত্যকাল সর্বগণের সাথে (অন্তরঙ্গ দেবভাব-সমূহের সাথে) আমাদের শত্রুগণ কর্তৃক অপরাজেয়, পরিত্রাণকারী, প্রার্থনাত্মিক সৎকর্মগুলিকে (সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্যকে–ভগবৎ-অনুসরণকে) প্রবর্ধিত করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ কৃপা করে আমাদের মধ্যে দেবভাবপ্রদ সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রবর্ধিত করুন। প্রথম অংশের প্রার্থনাতে ভগবানকে কয়েকটি বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে। এখানেই জ্ঞান-দেবকে পরিত্রাণকারী বলা হয়েছে, কারণ জ্ঞানদেবতার কৃপায় জ্ঞানলাভ না করলে মুক্তি সুদূরপরাহত। দ্বিতীয় অংশে ভগবানকে। অনন্তদেবরূপে বিশেষিত করে নিত্যকাল আমাদের পরম-মঙ্গল বিধানের জন্য প্রার্থনা দেখা যায়। অর্থাৎ সমগ্র মন্ত্রের মধ্যে পরোক্ষভাবে জ্ঞানলাভের, মুক্তিলাভের ও রিপুনাশের জন্যই প্রার্থনা ধ্বনিত হয়েছে। দেবতা ও প্রার্থনীয় বস্তুর বিশেষণগুলি লক্ষ্য করলেই এ বিষয় জানা যায়]। [এর গেয়গানের নাম ত্বাষ্ট্রীসাম]।
৮। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনি কখনও আমাদের প্রতি–এই জীবগণের প্রতি–স্নেহশূন্য হন না; আপনি ত্যাগশীল সৎকর্ম-সাধককে মোক্ষ প্রদান করেন; পরমধনশালী হে দেব! জ্যোতির্ময় রূপ আপনার প্রদত্ত প্রকৃষ্ট জ্ঞান-রূপ দান ত্বরায় নিশ্চিতরূপে আমাদের প্রাপ্ত হোক। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান্ আমাদের জ্ঞান প্রদান করুন। আমাদের হৃদয়ের পাপমোহের অন্ধকার তার কৃপার দান জ্ঞানের জ্যোতির সাহায্যেই দূরীভূত হবে]। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম–অদিতে সাম]।
৯। অজ্ঞানতানাশক (পাপনাশক) বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনিই জ্ঞানভক্তি রূপ আপনার বাহনদ্বয়কে আমাদের হৃদয়ে সংযোজিত করুন; বীর্যবান পরমধনশালী হে দেব! সেই দূরদেশ হতে–দুলোক হতে–আমাদের অভিমুখী হয়ে আমাদের সত্ত্বভার গ্রহণের জন্য-আমাদের মধ্যে সম্মিলনের জন্য–জ্ঞানকিরণ সমূহের সাথে আগমন করুন, অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্ত হোন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –ভগবান্ কৃপা করে আমাদের সত্ত্বভাব ও জ্ঞানভক্তি প্রদান করুন]। [এর গেয়গানের নাম–আজীগর্তং]।
১০। রক্ষাস্ত্রধারী হে দেব! আপনার পূজাপরায়ণ সৎকর্মান্বিত সাধকগণ নিত্যকাল আপনাকে (আপনার সম্বন্ধীয় দেবভাবসমূহকে) প্রাপ্ত হন। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! শ্রেষ্ঠ সেই আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের স্তোত্রসমূহ শ্রবণ করুন এবং আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই ভগবান আমাদের হৃদয়ে তার বিভূতিময় দেবভাব উপজন করুন। ভগবান্ মানুষকে নিরপেক্ষভাবেই শক্তিদান করেন সত্য, কিন্তু মানুষের কর্মও এই শক্তিলাভের কারণ। ভগবানের নিয়ম মান্য করে তাঁর বিধিনিষেধ অনুসারে কর্ম করবার অধিকার তিনিই মানুষকে দিয়েছেন। সুতরাং তার দেওয়া এই অধিকারের সৎ-ব্যবহার না করে ফলের আশা করা বৃথা। তাই বেদ বলছেন–ভূৰ্ণয়ঃ নরঃ ত্বাং অপীপ্যন্। সাধকেরাই ভগবানকে উপভোগ করতে পারেন। — মন্ত্রের শেষাংশে ভগবানকে হৃদয়ে পাবার আকাঙ্ক্ষা ধ্বনিত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সর্বথা সর্বত্র চা বিরাজমান হলেও আমরা যেন আমাদের হৃদয়ে তার অনুভূতিকে কখনই না বিস্মৃত হই]। [ঋগ্বেদ; উত্তরার্চিকেও মন্ত্রটি দ্রষ্টব্য। এর গেয়গানের নাম–মাধুচ্ছন্দসং]।
.
অষ্টমী দশতি
ছন্দ আৰ্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ১ ঊষা; ২-৩ অশ্বিদ্বয়; ৪-১০ ইন্দ্র (ঋগ্বেদে ৪ মন্ত্রের দেবতা অশ্বিদ্বয়)৷৷
ছন্দ বৃহতী।
ঋষি : ১।২।৭।৮ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৩ বৈবস্বত অশ্বিদ্বয়, ৪ প্ৰস্কণ্ব কাণ্ব, ৫ মেধাতিথি-মেধ্যাতিথি কাণ্ব, ৬ দেবাতিথি কাণ্ব, ৯ নৃমেধ আঙ্গিরস, ১০ নোধা গৌতম৷৷
প্রত্যু অদর্শায়৩চ্ছন্তী দুহিতা দিবঃ। অপো মহী বৃণুতে চক্ষু তমো জ্যোতিষ্কৃণোতি সুনী। ১৷৷ ইমা উ বাং দিবিষ্টয় উত্সা হবন্তে অশ্বিনা। অয়ং বামহেইবসে শচীবসূ বিশং বিশং হি গচ্ছথঃ। ২৷৷ কুষ্ঠঃ কো বামশ্বিনা তপাননা দেবা মর্ত্যঃ। ঘুতা বামশয়া ক্ষমাণণাংশুনেখমু আদ্বন্যথা৷৷ ৩৷৷ অয়ং বাং মধুমত্তমঃ সুতঃ সোয়মা দিবিষ্টিযু। তমশ্বিনা পিবতং তিরো অহ্নং ধং রত্নানি দাশুষে৷৷ ৪৷৷ আত্বা সোমস্য গদ্য়া সদা যাচহং জ্যা। ভূৰ্ণিং মৃগং ন সবনেষু চুধং ক ঈশানং ন যাচিষৎ৷৷ ৫৷৷ অধ্বর্যো দ্রাবয়া ত্বং সসামমিন্দ্রঃ পিপাসতি। উপো নূনং যুযুজে বৃষণা হরী আ চ জগামি বৃত্ৰহা৷৷ ৬৷৷ অভীষতস্তদা ভরেন্দ্র জ্যায়ঃ কনীয়সঃ। পুরূবসুর্যি মঘব বভূবিথ ভরেভরে চ হব্যঃ৷৷ ৭ যদিন্দ্র যাবতত্ত্বমেবদহমীশীয়। স্তোতারমিদ দধিষে রদাবসোন পাপত্বায় রংসিষ৷৷ ৮৷৷ ভূমি প্রতৃর্তিঘভি বিশ্বা অসি স্মৃধঃ। অশস্তিহা জনিতা বৃত্ররসি ত্বং তূর্য তরুষ্যতঃ। ৯৷ প্র যো রিরি ওজসা দিবঃ সদোভ্যস্পরি। ন জ্বা বিব্যাচ রজ ইন্দ্র পার্থিবমতি বিশ্বং ববক্ষিথ। ১০৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। জ্ঞানবৃত্তি আমার অজ্ঞানতা দূর করে অজ্ঞান আমার প্রতি আগমন করুন, অর্থাৎ এ আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সেই জ্ঞানবৃত্তি জ্যোতিঃ দান করে অজ্ঞানান্ধকার দূর করুন, সেই মোক্ষপথপ্রদর্শয়িত্ৰী (ঊষা) আমাকে পরাজ্ঞান প্রদান করুন। [প্রার্থনার ভাব এই যে, সূর্যের উদয়ে, যেমন অন্ধকার দূরে পলায়ন করে, জ্ঞানের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তেমনই অজ্ঞানতা তমঃ প্রভৃতি বিনষ্ট হয়। মানুষ ও অন্য সৃষ্ট পদার্থে সবচেয়ে বড় পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে–এই জ্ঞান নিয়ে। মানুষ দেবত্বের–অমৃতের অধিকারী। ভগবানের কৃপায় মানুষ জ্ঞানের সাহায্যে সেই অমৃত লাভ করে। তাই, অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন এই আমি, আজ জ্ঞানবলে মোক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষী হয়েছি। সেই ভগবান্ আমার মধ্যে বিরাজিত অথচ সুপ্ত চৈতন্য-সত্ত্বাকে জাগ্রত করুন। তারই ফলে আমি পরাজ্ঞান লাভ করে মোক্ষলাভের অধিকার অর্জন করব]। [এর গেয়গানের নাম–উষসঃ]।
২। আশ্রয়দাতা আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয় (অশ্বিনীকুমারদ্বয়)! আমাদের হৃদয়স্থিত সৎ বৃত্তিসমূহ নিত্যকাল আপনাদের অনুসরণ করে। [ভাব এই যে, এরপর আমাদের সৎবৃত্তিগুলি ক্রিয়াপর হোক–এই আকাঙ্ক্ষা]। সৎকর্মসাধনসামর্থ্য-প্রদাতা হে দেবদ্বয়! আপনারা নিশ্চয়ই সমস্ত প্রার্থনাকারিদের নিকট গমন করেন, অর্থাৎ তাদের প্রাপ্ত হন; পাপ হতে আমাকে রক্ষা করবার জন্য, পাপী আমি আপনাদের আহ্বান করছি। [যেহেতু জগতে সেই একমেবাদ্বিতীয়ং পরমব্রহ্ম ব্যতীত আর দ্বিতীয় উপাস্য নেই, সুতরাং সব রকম সাধকের, নানা উপায়ের সাহায্যে যে পূজা, তা তিনিই পান। হৃদয়স্থিত সৎবৃত্তিই সেই উপাসনার প্রবর্তক। আবার, তিনি অসীম করুণাময়। তিনি নিজেই মানুষের দুয়ারে এসে–হৃদয় দ্বারে–আঘাত করেন। যারা তার আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাদেরই কাছে তিনি গমন করেন। তিনি যে বিশ্বের পিতা ও মাতা। এই ভরসাতেই সাধক-গায়কের প্রার্থনা–তিনি অশ্বিনীকুমারদ্বয়রূপে এসে কৃপা করে আমাকে পাপ থেকে রক্ষা করুন]। [এর গেয়গানের নাম আশ্বিনোঃ সাম]।
৩। আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয় (অশ্বিনীকুমার-যুগল)! কোন্ পৃথিবীতে বর্তমান কোন্ মনুষ্য আপনাদের প্রকাশয়িতা হতে পারে? অর্থাৎ কেউই সমর্থ হয় না। পাপের দ্বারা ক্ষীয়মান পতিত ব্যক্তি যেমন পাপবিনাশক সত্ত্বভাবের দ্বারা উদ্ধার প্রাপ্ত হয়, আপনারা তেমনভাবেই পাপী আমাদের এই অবস্থা হতে উদ্ধার করুন। [অশ্বিনীকুমারদ্বয় স্বয়ং ভগবানেরই বিভূতিধারী (অন্তর্ব্যাধি ও মহিব্যাধির নিবারক দুই শক্তি বিশেষ)। সুতরাং সেই ভগবান, যিনি জগৎকে ধারণ করে আছেন, যাঁর মধ্যে এই জগৎ-সংসার অবস্থিত, যাঁর মহিমা এই বিশ্ব গাইছে, সেই মহান্ বিরাট পুরষকে কে প্রকাশিত করতে পারে? তিনি আপনিই প্রকাশমান্। যাঁর দ্বারা জগৎ শক্তি লাভ করে, কে তাকে শক্তি দিতে পারে? সেই অনন্ত মহান পুরুষের মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে বাক্য প্রতিহত হয়, চিন্তাশক্তি মূঢ় হয়ে যায়। অথচ, তিনিই আবার জীবের উদ্ধারের জন্য তাদের দ্বারে এসে উপস্থিত হন–পাপীর পাপের কালিমা মুছিয়ে দিয়ে তাকে আবার নবজীবন দান করেন, –পতিত হতভাগ্যকে হাতে ধরে তোলেন। তাই সাধক-গায়কের প্রার্থনা–তুমি কি পাপী বলে আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হবে না? তুমি দয়া করে আমার হৃদয়ে তোমার আসন তৈরী করে নাও–আমাকে জ্ঞানকর্ম-শক্তি প্রদান কর]। [এই মন্ত্রের গেয়গানের নাম–অশ্বিনোঃ সংযোজনং]।
৪। আধিব্যাধিনাশক হে দেবদ্বয়! অমৃতোপম, সৎকর্মসঞ্জাত বিশুদ্ধ আমাদের যে সত্ত্বভাব, দিনকৃত পাপনাশক সেই সত্ত্বভাবকে আপনারা গ্রহণ করুন, অর্থাৎ আপনাদের সাথে আমাদের মিলন হোক; আমাদের ন্যায় প্রার্থনাকারীকে পরমধনরূপ রত্ন প্রদান করুন। সেই ভগবান্ যেন তাকেই প্রাপ্তির জন্য আমাদের পরমার্থ-রূপ জ্ঞানভক্তি ও সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন। তাতেই আমরা মানবজীবনের পরম কাম্য–মোক্ষ অথবা নিঃশ্রেয়স লাভ করতে পারব]। [দিবিস্টিযু স্থলে ঋগ্বেদে ঋতাবৃধা পাঠ আছে। এর গেয়গানের নাম–অশ্বিনোঃ সাম]।
৫। হে দেব! জয়প্রদানকারিণী স্তুতি দ্বারা সত্ত্বভাবপ্রদাতা পরমপালক তোমাকে সর্বদা কাময়মান হয়ে, প্রার্থনাকারী আমি, সৎকর্মসাধনের দ্বারা তোমার প্রসন্নতা যেন লাভ করতে পারি; কোন্ মনুষ্য পরমেশ্বরকে না কামনা করে? অর্থাৎ সকল লোকই ভগবানের করুণা কামনা করে। [এখানে সাধক গায়কের প্রার্থনার ভাব এই যে, আমি যেন সেই ভগবানের চরণে পৌঁছাবার উপযোগী সকর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারি। তিনি সত্ত্বভাবদাতা–আমাকে সত্ত্বভাব প্রদান করুন। কর্মশক্তি দান, করুন–অর্থাৎ আমাকে তার মঙ্গলময় ক্রোড়ে স্থান দান করুন]। [এর গেয়গানের নাম–সোমসাম। ঋগ্বেদ-সংহিতায় এই মন্ত্রের জ্যা স্থলে গিরা পাঠ দেখা যায়]।
৬। হে আমার মন! সৎকর্মের নেতা! তুমি আমাতে সত্ত্বভাব উপজন কর; বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা তা গ্রহণ করতে নিত্য ইছুক, অর্থাৎ তার সাথে মিলনাভিলাষী রয়েছেন; অজ্ঞানতানাশক দেবতা আমাতে আগমন করুন; নবজীবন দানকারী জ্ঞানভক্তি রূপ বাহকদ্বয় নিশ্চিতরূপে আমাদের সাথে মিলিত হোন, অর্থাৎ আমরা যেন জ্ঞানভক্তি লাভ করি। [প্রার্থনার ভাব এই যে, –পাপনাশক দেবতা আমাদের জ্ঞানভক্তি প্রদান করে নবজীবনসম্পন্ন করুন]। অথবা-বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনি আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করুন–সৎকর্মান্বিত ব্যক্তি যা গ্রহণ করতে নিত্যকাল ইচ্ছুক রয়েছেন; পাপবিনাশক দেবতা আমাদের প্রাপ্ত হোন; এবং অভিমত ফলবর্ষক তাঁর বাহনদ্বয় (জ্ঞানভক্তি) ক্ষিপ্র আমাদের সাথে মিলিত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, সত্ত্বভাবপ্রদানকারী সেই ভগবান কৃপা করে আমাদের জ্ঞানভক্তি প্রদান করুন)। [দুটি অনুবাদেই সোমং পদে যথারীতি সত্ত্বভাব ধরা হয়েছে, সোমরস বা মদ্য নয়। প্রথমে অধ্বৰ্য্যো ত্বং অর্থে সৎকর্মের নেতা এবং দ্বিতীয়ে অধ্বৰ্য্যো অর্থে সকর্মাঞ্চিতজন ধরা হয়েছে। বৃত্ৰহাঅর্থে যথাক্রমে অজ্ঞানতা নাশক দেব এবং পাপবিনাশক দেব ধরা হয়েছে। ইত্যাদি]। [এর গেয়গানের নাম–আজমাষ্ববং]।
৭। শ্রেষ্ঠ পূজার্হ বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! প্রার্থনাকারী দুর্বলাত্মা আমাদের পরমার্থরূপ ধন প্রদান করুন; পরমধনসম্পন্ন হে দেব! আপনিই সর্বার্থপ্রদায়ক, এবং রিপুসংগ্রামে আপনিই শরণগ্রহণযোগ্য। [ভাব এই যে, -দেবতা আমাদের পরমার্থ-ধন প্রদান করুন এবং রিপুকবল হতে আমাদের রক্ষা করুন। –এখানে দুর্বল মানুষ সবল ঈশ্বরের কাছে, নির্ধন মানুষ অনন্ত ধনের অধীশ্বর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে। কিছুটা যেন দাবী, কিছুটা যেন আবদার। বিরাট ঈশ্বরের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের এই যে আত্মবোধ বা অনুভূতি, তা-ই মানুষকে তার চরণে প্রার্থনায় নিয়োজিত করে, –সেই অসীমের মধ্যে নিজের ক্ষুদ্র তুচ্ছ সসীম সত্তাকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছে। [এর গেয়গানের নাম সমুদ্রপ্রৈষমেধং]।
৮। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনি যে পরমধনের অধিকারী, প্রার্থনাকারী আমিও সেই ধনের অধিকারী যেন হই; পরমধনদাতা হে দেব! প্রার্থনাকারী আমাকে আপনি যে জ্ঞান প্রদান করেন, তা যেন আমি পাপকার্যে কিছুই ক্ষয় না করি, অর্থাৎ পাপীর সাথে যেন আমার কোনও সম্বন্ধ না, হয়। [প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপা করে আমাকে পরমধনের পূর্ণ অধিকারী করুন; আমি যেন পাপসম্বন্ধশূন্য হই]। [এর গেয়গানের নাম–বৈরূপে দ্বে]।
৯। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! পূজ্য আপনি রিপুসংগ্রামে আমাদের সকল রিপুগণকে বিনাশ করেন; পাপবারক হে দেব! শ্রেষ্ঠ আপনি অমঙ্গল নাশক, মঙ্গলময় এবং শত্রুগণের নাশক হন। (ভাব এই যে, –মঙ্গলময় ভগবান আমাদের অন্তরের ও বাহিরের সকল রিপুকে নাশ করেন; এবং মোক্ষবিঘসমূহকে নিবারণ করেন)। [এই মন্ত্রে ভগবানের দুটি রূপ যুগপৎ প্রকাশিত। তার এক হাতে অগ্নি, অন্য হাতে জল; এক হাতে ধ্বংস অন্য হাতে সৃষ্টি। রুদ্ররূপে তিনি পাপের অমঙ্গলের নাশয়িতা, আবার শান্তরূপে তিনি মঙ্গলের জনক–তিনি মঙ্গলময়]। [এর গেয়গানের নাম–বৈশ্বদেবং]।
১০। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! পূজ্য যে আপনি আপন তেজে দ্যুলোক অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ হন; ইহলোকে সঞ্জাত অহঙ্কার ইত্যাদির মূল আপনাকে ব্যাপ্ত করতে অর্থাৎ স্পর্শ করতে পারে না; আপনিই সমস্ত লোককে প্রকৃষ্টরূপে রক্ষা করেন। (ভাব এই যে, –ভগবান্ সকল অপেক্ষাই শ্রেষ্ঠ; তিনিই লোকগণকে রক্ষা করেন; প্রার্থনা–কৃপা করে আমাদের তিনি পরিত্রাণ করুন)। [মন্ত্রটি এক দৃষ্টিতে ভগবানের মাহাত্ম্য-খ্যাপক; পক্ষান্তরে প্রার্থনামূলক। সে দৃষ্টিতে মন্ত্রের অন্তর্নিহিত প্রার্থনা মহান্ তিনি, বিরাট তিনি, আমাদের রক্ষা করুন। মহতো মহীয়ান্ তিনি বিশ্বের আশ্রয়দাতা তিনি, আমাদের রক্ষা করুন। বিনাশ থেকে, অধঃপতন থেকে তিনি আমাদের উদ্ধার করুন। তিনি আমাদের এমনভাবে তার কাছে নিয়ে যান–যেন আর কখনও পাপমোহ দুঃখতাপের কবলে পড়ে যন্ত্রণা পেতে হয়। (প্র রিরিক্ষ–প্রকৃষ্টরূপে রক্ষা করুন)–চিরশান্তিবিধান করুন, মোক্ষ প্রদান করুন]। [এর গেয়গানের নাম-পূরীষং]।
.
নবমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা : ইন্দ্র (ঋগ্বেদে ৫ মন্ত্রের দেবতা ইন্দ্ৰবৈকুণ্ঠ; ৮ মন্ত্রের দেবতা বেন)।
ছন্দ ত্রিষ্টুপ৷
ঋষি : ১।২।৬ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি ৩ গাতু আত্রেয় অথবা গৃৎসমদ, ৪ পৃথু বৈন্য, ৫ সপ্তগু আঙ্গিরস, ৭ গৌরিবীতি শাক্ত্য, ৮ বেন ভার্গব, ৯ বৃহস্পতি বা নকুল, ১০ সুহোত্র ভারদ্বাজ।
অসাবি দেবং গোঋজীকমন্ধো নম্মিন্নিন্দ্রো জনুষেমুবোচ। বোধামসি ত্বা হর্যশ্ব যজ্ঞের্বোধা ন স্তোমমন্ধসো মদেষু৷৷ ১৷৷ যোনিষ্ট ইন্দ্র সদনে অকারি তমা নৃভিঃ পুরূহূত প্র যাহি। অসো যথা নোহবিতা বৃধশ্চিদো.বসূনি মমদশ্চ সোমৈঃ। ২৷৷ অদৰ্দরুৎসমসৃজো বি খানি ত্বমৰ্ণবা বদ্ধধান অরণাঃ। মহান্তমিন্দ্র পর্বতং বি যদ বঃ সৃজধারা অব যদ দানবান হ৷৷ ৩৷৷ সুম্বাণাস ইন্দ্র স্থমসি ত্বা সনিষ্যন্তশ্চিৎ তুবি বাজ। আ নো ভর সুবিতং যস্য কোনা তনা অনা সহ্যামধ্যেতাঃ ৪৷৷ জগৃহমা তে দক্ষিণমিন্দ্র হস্তং বসূয়বো বসুপতে বসুনাম্। বিদ্যা হি ত্বা গোপতিং শূর গোনামমুভ্যং চিত্ৰং বৃষণং রয়িং দাঃ ৷৷ ৫৷৷ ইন্দ্রং নরো নেমধিতা হবন্তে যৎপার্যা যুনজতে ধিয়স্তাঃ। শূরো নৃতা শ্ৰবসর্শ কাম আ গোমতি ব্ৰজে ভজা ত্বং নঃ৷৷ ৬৷৷ বয়ঃ সুপর্ণা উপ সেদুরিং প্রিয়মেধা ঋষয়গা নাধমানা। ধ্বান্তমূর্ণহি পূর্ধি চক্ষুম্নমুগ্ধাতস্মন্ নিধয়েব বদ্ধান্৷৷ ৭৷৷ নাকে সুপর্ণমুপ যৎ পতন্তং হৃদা, বেনন্তো অভ্যচক্ষত ত্বা। হিরণ্যপক্ষং বরুণস্য দূতং যমস্য যোনৌ শকুনং ভুরণ৷৷ ৮। ব্রহ্ম জজ্ঞানং প্রথমং পুরস্তাদবি সীমতঃ সুরুচো বেন আবঃ। স বুধ্যা উপমা অস্য বিষ্ঠাঃ সতশ্চ যোনিমসতশ্চ বিবঃ ॥৯॥ অপূর্বা পুরুতমানস্মৈ মহে বীরায় বসে তুরায়। বিপশিনে বজ্বিণে শম্ভমানি বচাংস্যস্মৈ স্থবিরায় তক্ষুঃ৷ ১০।
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। দীপ্তিদানসম্পন্ন (দেবত্বপ্রাপক) জ্ঞানযুক্ত শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন হোক; বলৈশ্বর্যাধিপতি দেব আপনা-আপনিই সেই সত্ত্বের সাথে মিলিত হন; জ্ঞানভক্তিদাতা হে দেব! সৎকর্মসাধনের দ্বারা আমরা যেন আপনাকে প্রাপ্ত হই; সত্ত্বভাবের পরমানন্দ আমাদের দান করবার জন্য আমাদের প্রার্থনা আপনি শ্রবণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -দেবতা কৃপা করে আমাদের জ্ঞানভক্তি ও সত্ত্বভাব প্রদান করুন)। মন্ত্রটিতে নিত্যসত্য-খ্যাপন ও প্রার্থনা মিশ্রিতভাবে আছে। নিত্যসত্য-খ্যাপনে বলা হয়েছে-ভগবান্ আপনা থেকেই জ্ঞানের সাথে মিলিত হন। তার অর্থ এই যে, ভগবান্ জ্ঞানময়; জ্ঞানাত্মিকা বৃত্তি তার নিত্যশক্তি। তিনি সত্যং জ্ঞানং অনন্তং–তিনি জ্ঞানময়। মন্ত্রের প্রার্থনাংশে বলা হয়েছে-দীপ্তিসম্পন্ন জ্ঞানযুক্ত সত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে উৎপন্ন হোক। জ্ঞানযুক্ত সত্ত্বভাব-দীপ্তিসম্পন্ন, দেবং-দেবতাপ্রাপক, কেমন করে হয়? মানুষ জ্ঞানবলেই দেবত্বের দাবী করতে পারে, জ্ঞানবলেই মানুষ ভগবানের সামীপ্য লাভ করে। যা মানুষকে দেবতার আসন প্রদান করতে পারে, তা-ই দেবভাব-প্রাপকদেবং। সুতরাং সত্ত্বভাবই দেবত্বপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্বভাব তো দেবতাদেরও কাম্যবস্তু। এমন সত্ত্বভাব জ্ঞানের সাথে মিশ্রিত হলে, দেবতারও বাঞ্ছিত হয়ে দাঁড়ায়। তাই সাধকের প্রার্থনা–দেবং গো-ঋজিকং: অন্ধঃ অস্মিন্ অসাবি। ইত্যাদি প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, প্রচলিত ব্যাখ্যায় সোমরস ও ইন্দ্রের হরি নামক অশ্বদ্বয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তা সঙ্গতভাবেই গ্রহণ করা হয়নি]। [গেয়গানের নাম–প্রাকর্ষং এবং নিহসঃ]।
২। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনার জন্য হৃদয়ে যেন স্থান করতে পারি; সর্বলোকবরেণ্য হে দেব! সৎকর্মসাধন সামর্থ্যের সাথে আমাদের হৃদয়ে আপনি আগমন করুন, যে রকমে অর্থাৎ যে কৃপা-প্রদর্শনে, আমাদের প্রবর্ধনের জন্য (আমাদের মোক্ষ-প্রদানের জন্য) আপনি আমাদের রক্ষক হন, , সেই কৃপায় আমাদের পরমার্থ-রূপ ধন প্রদান করুন; এবং সত্ত্বভাব দান করে আমাদের পরমানন্দিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! অপার করুণায় আপনি আমাদের রক্ষা ও পালন– করছেন; কৃপা করে আমাদের মোক্ষলাভের জন্য সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য এবং সত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটি চারভাগে বিভক্ত। প্রত্যেক ভাগেই বিভিন্ন প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রত্যেক অংশের প্রার্থনার শব্দ পৃথক হলেও তাদের অন্তর্নিহিত ভাব এক। প্রত্যেক অংশেই মানুষের চরম কাম্য বস্তুর জন্য–মোক্ষলাভের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রার্থনা করা হয়েছে]। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম-যোনিনী দ্বে]।
৩। হে দেব! আপনি রিপুগণকে বিনাশ করুন; (আমাদের হৃদয়ে জ্ঞানভক্তি প্রভৃতি রত্ন উৎপাদন করুন; অপরিস্ফুট সত্ত্বভাবসমূহকে পরিস্ফুট করুন;বলৈশ্বর্যাধিপ্রতি হে দেব! আপনি যখন আমাদের হৃদয়স্থিত রিপুসমূহকে বিনাশ করেন, তখন সেই কঠোর পাষাণের ন্যায় আমাদের হৃদয়কে ভেদ করে ভক্তি-প্রবাহ নির্গত হয়। (ভাব এই যে, –হে দেব! কৃপা করে আমাদের জ্ঞানভক্তি প্রদান করুন, আমাদের রিপুনাশ করুন)। [এই মন্ত্রের মধ্যে প্রার্থনা ও নিত্যসত্য প্রখ্যাপন আছে। আমাদের হৃদয় খনির মধ্যে জ্ঞানভক্তি, সৎ-বৃত্তি প্রভৃতি রত্নরাজী বর্তমান আছে। এই সমস্ত রত্নের ব্যবহার করতে পারলেই মানুষ পরমধনের অধিকারী হতে পারে। ভগবান সেই খনির মালিক। সুতরাং খনি হতে রত্ন উদ্ধারের জন্য তার কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। এর পরই তাঁর কাছে অপরিস্ফুট সত্ত্বভাব প্রভৃতিকে পরিস্ফুট করে প্রদান করার প্রার্থনা। (যেমন, খনি মধ্যে স্থিত রত্নরাজি ধূলায় কাদায় মাখামাখি হয়ে অপরিষ্কৃত অবস্থায় থাকে)। এই অংশের মধ্যে প্রার্থনা ও নিত্যসত্যও মিশ্রিতভাবে আছে। ভগবান্ শক্তি না দিলে সেই রত্নরাজীকে পরিষ্কৃত করে ব্যবহার করা যায় না]। [এর গেয়গানের নাম–ঔরুক্ষরে দ্বে]।
৪। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! ভক্তিপরায়ণ হয়ে আমরা আপনাকে আরাধনা করছি। পরমৈশ্বর্যশালী হে দেব! আপনার কর্তৃক জ্ঞান ও সাধনমার্গের অনুকূল সামর্থ্য আমাদের প্রদত্ত হোক। [ভাব এই যে, -হে দেব! আপনি আমাদের জ্ঞান ও সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য প্রদান করুন। আমাদের পরমার্থ প্রদান করুন; মোক্ষলাভের জন্য আমরা যে ধনের প্রার্থী, আপনার কর্তৃক রক্ষিত হয়ে পরমার্থ রূপ সেই ধন আমরা নিজেরাই যেন আপনার প্রসাদে লাভ করতে পারি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! পরমার্থ-রূপ (মোক্ষ) আমাদের প্রদান করুন এবং আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করুন)। [এই প্রার্থনামূলক মন্ত্রটির প্রার্থনার মধ্যে বিশেষত্ব এই যে, এটির শেষভাগে প্রার্থনা করা হয়েছে তনাত্মনা সহ্যাম বোতাঃ–আমরা যেন আপনার প্রসাদে নিজেরাই ধনলাভ করতে পারি; আপনি
আমাদের রক্ষা করবেন মাত্র। এখানেই ভগবৎ-প্রাপ্তির চাবিকাঠিটি আছে। এখানে সাধকের নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম কেউ কাউকে দান করতে পারে না, এটা প্রত্যেকের নিজস্ব জিনিষ। নিজের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ভক্তির স্রোত প্রবাহিত না হলে কেউ বাহির থেকে ভক্তি দিতে পারে না। ভগবানের কাছে আমরা যে প্রার্থনা করি, তার অর্থ এই নয় যে, ভগবান এসে আমাদের পাকা-ফলটির মতো মুক্তি বা মোক্ষ প্রদান করবেন। ঐ সমস্ত প্রার্থনার মূলে রয়েছে–প্রবল আত্ম-উদ্বোধনের ভাব। সাধক, নিজশক্তিকে জাগাবার চেষ্টা করেন আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, –যেন তিনি তাকে তার অভিলষিত মোক্ষপথে চলবার শক্তি দেন। তাই প্রত্যেক মানুষেরই এ প্রধান প্রার্থনা–যস্য কোনা তনাত্মনা সহ্যাম ত্বোতাঃ–আমরা আপনার কর্তৃক রক্ষিত হয়ে নিজেরাই এ যেন সেই পরমধন লাভ করতে পারি]। [এর গেয়গানের নাম–পার্থে দ্বে।
৫। পরমধনদাতা বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! পরমধনকামী আমরা মোক্ষলাভের জন্য আপনার মঙ্গলস্বরূপকে যেন উপলব্ধি করতে পারি; বীর্যবান্ হে দেব! জ্ঞানলাভের জন্য আমরা আপনাকেই জ্ঞানপ্রদায়ক জানি; আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ অভীষ্টপ্রদ পরমধন প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমরা আপনার মঙ্গল স্বরূপ যেন উপলব্ধি করতে পারি; কৃপা করে আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [ভগবানকে কেউ সত্যরূপে, কেউ শিবরূপে, কেউ সুন্দররূপে–নানা ভাবের মধ্য দিয়ে–পাবার চেষ্টা করেন। এখানে শিবপন্থী সাধক, ভগবানকে শিবভাবে পাবার জন্য প্রার্থনা, জানিয়েছেন]। [এর গেয়গানের নাম–সৌপর্ণে দ্বে এবং বাণপ্রাণি ত্রীণি]।
৬। রিপুসংগ্রামে যখন রিপুনাশক প্রসিদ্ধ সৎকর্মসমূহ প্রয়োগ করা হয়, তখন সাধকগণ বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে আহ্বান করেন, অর্থাৎ তার সাহায্য প্রার্থনা করেন; হে দেব! বীর্যবান্ মানুষের পরমার্থদাতা আপনি, আমাদের পরম মঙ্গলের কামনাকারী হয়ে জ্ঞানসমন্বিত পথে আমাদের নিয়ে যান, অর্থাৎ আমাদের জ্ঞানসমন্বিত করুন। [ভাব এই যে, –ভগবানই সর্বতোভাবে রিপুসংগ্রামে মানুষের সহায় হন; তিনি রিপু-বিনাশ করে আমাদের পরাজ্ঞান (মোক্ষলাভের উপায়ভূত জ্ঞান) প্রদান করুন]। [এর গেয়গান-গৌরীবিতম]।
৭। মোক্ষাভিলাষী, ভগবৎ-পরায়ণ, সৎকর্মসমন্বিত, প্রার্থনা-পরায়ণ জ্ঞানিগণ বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, –সৎকর্মান্বিত জ্ঞানীব্যক্তি মোক্ষলাভ করেন)। হে দেব! আমাদের অজ্ঞানতা দূর করুন; জ্ঞান-দৃষ্টি উন্মীলিত করুন; মায়ামোহ-পাশের দ্বারা বজ্রতুল্য প্রার্থনাকারী আমাদের মুক্ত করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! কৃপা করে আমাদের মোক্ষলাভের উপায়স্বরূপ জ্ঞান প্রদান করুন)। [মন্ত্রের প্রথমাংশে নিত্যসত্য-খ্যাপনে–মুক্তিলাভের অধিকারী কে, তাই ব্যক্ত হয়েছে। শেষাংশের প্রার্থনাও সত্য-খ্যাপনের অনুরূপ। সেই ভগবান্ ব্যতীত আমাদের অজ্ঞানতা কে দূর করবে, কে জ্ঞানদৃষ্টি উন্মীলিত করবে, কে মায়ামোহের বন্ধন থেকে আমাদের মুক্ত করবে?] [এর গেয়গানের নাম—বৈদন্বতম]।
৮। হে দেব! সর্বান্তঃকরণে আপনাকে কাময়মান সাধকগণ যখন মুক্তিদাতা, শুদ্ধসত্ত্বনিলয়ে নিবাসকারী, সর্বশক্তিমান্, দেবভাবপ্রদায়ক, সাধকদের আত্ম-উন্নয়নকারী, জগৎপালক, সর্বনিয়ন্তা, আপনাকে আরাধনা করেন, তখন আপনি–সেই সাধকদের প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, ভগবৎ পরায়ণ সাধকগণ মোক্ষলাভ করেন)। [পূর্ব মন্ত্রে মুক্তিলাভের অধিকারীর সংজ্ঞা পাওয়া গেছে। এখানে ভগবানের কয়েকটি বিশেষণও রয়েছে। তিনি সুপর্ণ–ঊর্ধ্বগমনই যাঁর প্রকৃতি, যিনি সাধকদের ঊর্ধ্বে নিয়ে যা। তিনি হিরণ্যপক্ষ–হিতকারক ও রমণীয় শক্তির অধিকারী তিনি। তিনি বরুণের দূত-দেবভাবের মিলন-সাধক। তিনি শকুন–সাধকদের আত্ম-উন্নয়ন-বিধায়ক। তিনি ভুরণ্যু–জগৎপালক। তিনি যমস্য যোনৌ–সর্বনিয়ন্তা, বিশ্বের নিয়ামক; সেই পরমদেবতাকে কামনাকারী সাধকগণই তাকে প্রাপ্ত হন]। [এর গেয়গানের নাম—যামম]।
৯। জ্ঞানসমন্বিত সত্ত্বভাবযুক্ত ভগবৎ-অভিলাষী সাধক নিত্যকাল অনাদিদেব জ্ঞানস্বরূপ পরমব্রহ্মকে পূজা করেন; জগতের উপাদানভূত মূলকারণসমূহ, সেই পরম দেবতা নির্মাণ করেছেন, ৷ এবং বিদ্যমান ও অবিদ্যমান অর্থাৎ সমস্ত বস্তুর মূল-উপাদান সৃজন করেছেন। (ভাব এই যে, ভগবানই জগতের আদিকারণ, জ্ঞানিগণ তাঁকে পূজা করেন; আমরাও যেন তাকে পূজা করতে পারি)। [যেদিক দিয়েই দেখি না কেন, উৎপত্তির মূলে আমরা সেই অনন্ত ঈশ্বরকেই পাই। প্রচলিত ব্যাখ্যায় বেন নামক এক গন্ধর্বের আখ্যায়িকার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সেরকম অর্থের মর্ম ভাষ্যকার বা ব্যাখ্যাকার নিজেরাই উদ্ধার করতে পারেননি]। [অথর্ববেদ, –এর গেয়গানের নাম–ঋত সামনী দ্বে]।
১০। মহৎ রিপুনাশক, সর্বশক্তিমান, আশুমুক্তিদায়ক, সর্বলোক-আরাধ্য আদিভূত, রক্ষাস্ত্রধারী, পরমদেবতার জন্য অর্থাৎ তাকে পাবার জন্য, সাধকগণ অপূর্ব, প্রভূতপরিমাণ, সুখদায়ক, প্রার্থনা-রূপ বাক্যসমূহ উচ্চারণ করেন, অর্থাৎ প্রার্থনা করেন। (ভাব এই যে, সাধকগণ ভগবানকে পাবার জন্য সর্বতোভাবে প্রার্থনা করেন)। [ভগবান্ সম্বন্ধে ধারণা না থাকলে, তাকে পাবার জন্য প্রার্থনা করা যাবে না বলেই এখানে তার স্বরূপ ব্যাখ্যাত হয়েছে। তিনি মহৎ–মহতো মহীয়ান। তিনি রিপুনাশক মানুষের অন্তরের ও বাহিরের শত্রুকে বিধ্বংস করেন। তিনি সর্বশক্তিমান; যেখানে যা কিছু শক্তি দেখা যায় তা তারই শক্তির প্রকাশ মাত্র। তিনি আশুমুক্তিদায়ক। সর্বলোকের আরাধ্যঅর্থাৎ যখনই যেখানে যে দেবতারই আরাধনা করা হোক, তা তাতেই বর্তায়। তিনি স্থবির–জগতের আদিকারণ। তিনি রক্ষাস্ত্রধারী–জগতের পাপ-তাপের আক্রমণ থেকে মানুষের রক্ষাকারী। –ইত্যাদি]। [এর গেয়গানের নাম—বারবন্তীয়ম্]।
.
দশমী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা : ইন্দ্র৷৷
ছন্দ ১-৫, ৭-৯ ত্রিষ্টুপ, ৬ বিরাট৷৷
ঋষি : ১। ২। ৪ দ্যুতান মারুত (ঋগ্বেদে তিরশ্চী আঙ্গিরস), ৩ বৃহদুকথ, বামদেব্য, ৫ বামদেব গৌতম, ৬।৮ বশিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি, ৭ গাথি বিশ্বামিত্র, ৯ গৌরিবীতি শাক্য।
অব দ্রপসো অংশুমতীমতিষ্ঠদীয়ানঃ কৃষ্ণো দশভিঃ সহঃৈ। আবত্তমিঃ শচ্যা ধমন্তমপ মীহিতিং নৃমণা অধদ্রাঃ । ১। বৃত্রস্য ত্বা শসথাদীষমাণা বিশ্বে দেরা অজহুর্ষে সখায়ঃ। মরুদ্ভিরিন্দ্র সখ্যং তে অস্ত্রথেমা বিশ্বাঃ পৃতনা জয়াসি৷৷ ২৷৷ বিধুং দদ্রাণং সমনে বহুনাং যূবানং সন্তং পলিতো জগার। দেবস্য পশ্য কাব্যং মহিত্বদ্যা মমার স হ্যঃ সমান। ৩৷ ত্বং হ ত্যৎ সপ্তভ্যো জায়মানো শত্রুভ্যো অভবঃ শরিন্দ্র। গৃহে দ্যাবাপৃথিবী অন্দবিন্দো বিভুমভ্যো ভুবনেভ্যো রণং ধাঃ ৷৷ ৪৷ মেডিং ন ত্বা বজ্বিণং ভৃষ্টিমন্তং পুরুধম্মানং বৃষভং স্থিরপ। করোষ্যযুক্তরুষীদুর্বসুরিন্দ্র দ্যুক্ষং বৃত্ৰহণং গৃণীষে৷৷ ৫৷৷ প্র বো মহে মহে বৃধে ভরধ্বং প্রচেতসে প্র সুমতিং কৃণুধ্বম্। বিশঃ পুর্বীঃ প্র চর চর্ষণিপ্রাঃ৷৷ ৬৷৷ শূনং হুবেম মঘবানমিন্দ্রমস্মিন্ ভরে নৃতমং বাজসাতে। শৃন্বন্তমুগ্ৰমূতয়ে সমৎসু ঘুন্তং বৃত্রাণি সঞ্জিতং ধনানি৷৷ ৭৷৷ উদু ব্রহ্মাণ্যেরত অবস্যেন্দ্রং সমর্যে মহয়া বসিষ্ঠ। আ যো বিশ্বানি শ্ৰবসা ততানোপশ্রোতা ম ঈবতো বচাংসি৷ ৮। চক্রং যদস্যাপস্বা নিষত্তমুততা তদস্মৈ মধ্বিচ্চচ্ছদ্যাৎ। পৃথিব্যামতিষিতং যদুধঃ পয়ো গোম্বদ ঔষধীষু৷৷ ৯৷
মন্ত্রাৰ্থ–১। দ্রুত-অধঃপতনকারক জগৎ আক্রমণকারী অজ্ঞানান্ধকার অসংখ্য পাপ-অনুচরগণের সাথে জ্ঞানী ব্যক্তিকেও আক্রমণ করে; সর্বলোককর্তৃক বরণীয় বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা প্রজ্ঞাবলে জগৎবিনাশক সেই অজ্ঞানান্ধকারকে বিনাশ করেন, এবং হিংসাকারী তার সৈন্যগণকে বিনাশ করেন– দূরীভূত করেন। (ভাব এই যে, ভগবান্ জগতের হিতের জন্য অজ্ঞানতা দূর করেন)। [অজ্ঞানতা যেখানে, পাপ সেখানে। পাপের অবশ্যম্ভাবী ফল–পতন। তাই অজ্ঞানতা দ্রুত-অধঃপতনকারী। অজ্ঞানতা–জগৎ আক্রমণকারী। পৃথিবীর সর্বত্রই অজ্ঞানতা তার প্রভাব বিস্তার করে আছে। অজ্ঞানতা অনুচর অসংখ্য। কাম-ক্রোধ ইত্যাদি, মিথ্যাজ্ঞান, ভ্ৰম, সৎ-অসৎ-বিচারের অভাব, আত্মম্ভরিতা বা অহঙ্কার ইত্যাদি অজ্ঞানতারই সঙ্গী। অজ্ঞানতা জগৎ-বিনাশক। জ্ঞানেতে জগতের উৎপত্তি–অজ্ঞানেতে সংহার। এই ভীষণ অজ্ঞানতা থেকে জগৎকে রক্ষা করেন–মানুষকে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে অজ্ঞানতার আধিপত্য বিনাশ করেন]। [এর গেয়গানের নাম–ক্ষুরপবিণী দ্বে এবং স্যৌমরশমে দ্বে]।
২। হে আমার মন! অজ্ঞানতা-রূপ অসুরের প্রভাবে সকল দেবভাবসমূহ যখন তোমা হতে বিনির্গত হয়ে তোমাকে রিপুসংগ্রামে পরিত্যাগ করে যান, তখন বিবেকরূপী দেবগণের সাথে তোমার সখ্যতা হোক অর্থাৎ তুমি বিবেকের অনুবর্তী হয়ো; তারপর অর্থাৎ বিবেকরূপী দেবগণের সাথে মনের সম্বন্ধ স্থাপিত হলে, হে বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেব! আপনি আপনা-আপনিই হৃদয়ে উপস্থিত হয়ে, এই সকল অজ্ঞানতা-সহচর অসৎবৃত্তিসমূহকে অভিভব করেন। (ভাব এই যে, অজ্ঞানতার প্রভাবে বিভ্রান্তি এলে, বিবেকের অনুবর্তিতা প্রয়োজন; তাতে ভগবৎ-প্রভাবেই রিপুগণ বিমর্দিত হয় এবং হৃদয়ে দেবভাব উপজিত হয়ে থাকে)। [এখানেও বৃত্রস্য পদে অজ্ঞানতারূপস্য অসুরস্য, বিশ্বেদেবাঃ, পদে সর্বে দেবভাবাঃ, মরুদ্ভিঃ পদে বিবেকরূপৈঃ দেবৈঃ সহ ইত্যাদি অর্থ যথাযথভাবেই গৃহীত হয়েছে]।
৩। রিপুসংগ্রামে অসংখ্য শত্রুর পরাজয়কারী জগতের (অথবা সৎকর্মের) বিধাতা নিত্যপুরুষকে পাপবশতঃ জীর্ণাত্মা আমি যেন আরাধনা করতে পারি; হে আমার মন! ভগবানের মহত্ত্বপূর্ণ সৃজন ও রক্ষাসামর্থ্য উপলব্ধি কর; যে জন এই মুহূর্তে পাপবশতঃ পতিত হয়, সে ভগবানের কৃপায় ॥ পরমুহূর্তে পাপ হতে মুক্ত হয়ে নবজীবন লাভ করে। (ভাব এই যে, ভগবানকে যেন আমি আরাধনা ই করি; তার কৃপায় পাপীও পুণ্যজীবন লাভ করে; আমিও পাপ হতে মুক্তি প্রার্থনা করছি)। অথবা র এ সংগ্রামে অসংখ্য শত্রুর পরাজয়কারী শক্তিমান্ যৌবনসম্পন্ন পুরুষকেও বার্ধক্য গ্রাস করে; হে আমার এ মন! ভগবানের মহত্ত্বযুক্ত সামর্থ্য উপলব্ধি কর; সেই যুবা নিত্যকাল মরছে ও পুনরায় প্রাদুর্ভূত হচ্ছে। (ভাব এই যে, –এই জীবন যৌবন চঞ্চল; কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর হন)। [অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের বীজ আমরা এই মন্ত্রে পাই। মানুষের মনের চিরন্তন প্রশ্ন–কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব, এই জীবনই বা কেন? আমরা কি তবে দুদিনের জন্য এসে কালসাগরে জলবুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যাব? আমি কি শুধু এই দেহ-প্রাণ-মন মাত্র? মানুষের অন্তরস্থ অমৃতের বীজ তাকে বলে দিলনা, তুমি অমৃতের অধিকারী, অনন্তের সন্তান। তোমার ক্ষয় নেই। মরণ নেই, ধ্বংস নেই–তুমি অজর, অমর; শাশ্বত, নিত্য। অনুসন্ধান কর, সেই অমৃতের সন্ধান পাবে। আত্মার এই অবিনশ্বরত্ব অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের গোড়ার কথা। মন্ত্রের প্রথম অর্থের (বঙ্গানুবাদে) তাই ব্যক্ত হয়েছে–আত্মা মরণহীন, ধ্বংসহীন। মন্ত্রের দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় (বঙ্গানুবাদে) পাপীকে উদ্ধারের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। যত বড় পাপী হোক না কেন– ভগবান্ কৃপা করলে সে-ও উদ্ধার পায়–চিরশান্তি লাভ করে]। [এর গেয়গানের নাম–সোমসামনী দ্বে]।
৪। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনিই পরমবহ্ম; সপ্তলোকের সাধকগণের জন্য আপনি প্রকটীভূত হন; আপনি তাদের রিপুনাশক হন; অজ্ঞান-অন্ধকারে আবৃত দ্যুলোক ও ভূলোকে আপনি জ্যোতিঃ রূপে প্রকাশিত হন, অর্থাৎ জ্ঞানের আলোক বিকীর্ণ করেন; মহত্ত্বযুক্ত লোকসমূহের জন্য আপনি আনন্দ প্রদান করেন। (ভাব এই যে, -সাধকদের হিতের জন্য ভগবান্ তাঁদের রিপুনাশ করেন; তিনি জগতে জ্ঞানের আলোক প্রদান করেন)। [মন্ত্রে সেই বহুধা বিভক্ত এককে–মূলতঃ এক কিন্তু অবস্থাভেদে বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে বিরাজিত পরমদেবতাকে দর্শন করা হয়েছে। আপনিই সেই পরমব্রহ্ম–ত্বং হ ত্যৎ]। [এর গেয়গানের নাম–ইন্দ্রবজ্রে দ্বে]।
৫। হে দেব! লোকে যেমন বৃষ্টির জন্য বৃষ্টিপ্রদ বাক্যের স্তব করে, রক্ষাস্ত্রধারী, মহোচ্চ, বহুশত্রুনাশক, অভীষ্টবর্ষক, নিত্য, দ্যুলোকে বর্তমান, পাপনাশক, আপনাকে আমি যেন তেমনই আরাধনা করি। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনি আমাদের শত্রুজয়ী করুন। [ভাব এই যে, –সেই ভগবান কৃপা করে আমাদের এমন সামর্থ্য দান করুন, যাতে আমরা শত্ৰুজয়ী অর্থাৎ পাপজয়ী হয়ে উঠতে পারি]।
৬। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা পরমধনদাতা মহত্ত্বসম্পন্ন দেবতার জন্য অর্থাৎ তাকে পাবার জন্য, আরাধনা প্রকৃষ্টরূপে সম্পাদন কর; পরাজ্ঞান লাভের জন্য সকর্মাত্মিকা প্রার্থনা বিশেষরূপে সম্পন্ন কর; হে দেব! সাধকদের আত্ম-উন্নয়নকারী আপনি, প্রার্থনাকারী আমাদের প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানকে প্রাপ্ত হবার উদ্দেশ্যে আমরা যেন সৎকর্মসাধনে সমর্থ হই; তিনি কৃপা করে আমাদের প্রাপ্ত হোন)। [মন্ত্রটির তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগে আত্ম-উদ্বোধন এবং শেষ ভাগে প্রার্থনা আছে। প্রকৃষ্টরূপে ভগবানের আরাধনা অর্থ, চিত্তবৃত্তিসমূহকে ঈশ্বরাভিমুখী করা। ভগবানকে পাবার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় পরাজ্ঞান লাভ। সুতরাং তারই উপায়ভূত সৎকর্মাত্মিকা প্রার্থনায় আত্মনিবেশ। আর এর পিছনে থাকা চাই–সৎসঙ্কল্প, সাধু উদ্দেশ্য ও হৃদয়ের পবিত্রতা]। [এর গেয়গানের নাম–অঙ্কুশে দ্বে]।
৭। আমাদের হৃদয়স্থিত, আত্মশক্তিবিধায়ক, রিপুসংগ্রামে, –সুখদায়ক সৎপথে পরিচালক, পরমধনদাতা বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে আমরা যেন আহ্বান করি অর্থাৎ তার সাহায্য প্রার্থনা করি; আমাদের পাপ কবল হতে রক্ষা করবার জন্য, লোকদের প্রার্থনা শ্রবণকারী রিপুসংগ্রামে শত্ৰুজয়ী অজ্ঞানতা ইত্যাদি পাপনাশক পরমধনদাতা আপনাকে, আমরা যেন আরাধনা করি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপা করে আমাদের রিপু কবল থেকে রক্ষা করুন, এবং সৎপথে পরিচালিত করুন)। [এখানে বৃত্ৰাণি ঘন্তং পদদ্বয় লক্ষণীয়। বৃত্রাসুর অর্থে, অজ্ঞান বা পাপ, ঘন্তং অর্থে বিনাশকং]। [গেয়গানের নাম–ভারদ্বাজম]।
৮। হে মম চিত্তবৃত্তিসমূহ! রিপু-সংগ্রামে আত্মশক্তি লাভের জন্য বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতার প্রতি স্তোত্রসমূহ উচ্চারণ কর, অর্থাৎ তার সাহায্যলাভের জন্য প্রার্থনা কর; জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি প্রার্থনা দ্বারা দেবতাকে প্রাপ্ত হন; যে দেবতা আপন শক্তিতে সকল লোক ব্যাপ্ত করে আছেন, তিনি প্রার্থনাকারী আমার প্রার্থনার শ্রবণকারী হোন; অর্থাৎ তিনি প্রার্থনা শ্রবণ করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, রিপুসংগ্রামে জয়লাভ করবার জন্য ভগবানকে যে আমি আরাধনা করি, তিনি কৃপা করে আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন)। [আত্ম-উদ্বোধন ও প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটির মধ্যে, সাধনার ও সিদ্ধিলাভের একটা ক্রম দেখা যায়। প্রথমে নৈতিক-জীবনে প্রতিষ্ঠা ও পরে তাকে ধর্ম-জীবনে পরিণত করণ, এবং সবশেষে ভগবানের চরণে আশ্রয় লাভ–সাধনার এই ক্রমই এই মন্ত্রের মধ্যে ব্যক্ত]। [এর গেয়গানের নাম–বৈশ্ব দৈবং]। [এই সামমন্ত্রের ঋষি বশিষ্ঠ]।
৯। ভগবানের যে রক্ষাশক্তি দ্যুলোকে সর্বতোভাবে মোক্ষদানের জন্য ব্যাপ্ত আছে, সেই রক্ষাশক্তি এই জগতের লোককেও মোক্ষ প্রদান করে; জগতে জ্ঞানে ও মোক্ষে যে অমৃত বর্তমান আছে, সেই অমৃত ভগবান প্রদান করেন। (ভাব এই যে, ভগবানের রক্ষাশক্তি সর্বত্র বিদ্যমান, তিনিই কৃপা করে লোকদের মোক্ষ প্রদান করে থাকেন]। [মোক্ষাভ প্রকৃতপক্ষে অমৃতত্ব লাভ। মোক্ষলাভের অর্থ ভগবানের চরণে আত্ম-বিসর্জন–সেই অমৃত-সাগরে তলিয়ে যাওয়া]। [এর গেয়গানের নাম পুরীষম। এর ঋষি-গৌরিবীতি]।
.
একাদশী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবত্য ১ তার্ক্ষ্য, ২-৬।৮ ১০ ইন্দ্র, ৭ পর্বত ও ইন্দ্র, ৯ যম বৈবস্বত৷
ছন্দ ত্রিষ্টুপ৷
ঋষিঃ ১ অরিষ্টনেমি তার্ক্ষ্য, ২ ভরদ্বাজ (ঋগ্বেদে গর্গ ভারদ্বাজ), ৩ বিমদ ঐন্দ্র, বসুকৃৎ বা বাসুক (ঋগ্বেদে প্রাজাপত্য), ৪–৬।৯ বামদেব গৌতম (ঋগ্বেদে ৯ যম বৈবস্বত), ৭ গাথি বিশ্বামিত্র, ৮ রেণু বৈশ্বামিত্র, ১০ গোতম রাহুগণ।
ত্যমু যু বাজিনং দেবজুতং সহোবানং তরুতারংরথানা। অরিষ্টনেমিং পৃতনাজমাশুং স্বস্তয়ে তাক্ষ্যমিহা হুবেম৷ ১। ত্রাতারমিন্দ্রমবিতারমিং হবেহবে সুহবঃ শুরমিন্দ্র। হুবে নু শক্ৰং পুরুহুতমিমিদং হবির্মঘবা বেত্বিঃ । ২ । যজামহ ইন্দ্রং বজ্রদক্ষিণং হরীণাং রথ্যাংবিব্রতানাম্। প্র শ্মশ্রুভিদোধুবদূর্ধ্বয়া ভুবদ বি সেনাভির্ভয়মাননা বি রাধসা। ৩ সত্ৰাহণং দাবৃষিং তুমিং মহামপারং বৃষভং সুবর্জ। হন্তা যো বৃত্ৰং সনিতোত বাজং দাতা মঘাত্রি মঘবা সূরাধাঃ। ৪৷৷ যো নো বনুয্যন্নভিদাতি মর্ত উগণা বা মন্যমনস্তুরো বা। ক্ষিধী যুধা শবসা বা তমিন্দ্রাভী শ্যাম বৃষমণস্তোতাঃ ॥ ৫৷৷ যং বৃত্ৰেযু ক্ষিতয় স্পর্ধমানা যং যুক্তেষু তুরয়ন্তো হবন্তে। যং শূরসাতৌ যমপামুপজমন্ যং বিপ্রাসো বাজয়ন্তে স ইন্দ্রঃ। ৬৷৷ ইন্দ্রপর্ব বৃহতা রথেন বামীরিষ আবহতং সুবীরাঃ। .. বীতং হ্যাঁন্যধ্বরেষু দেবা বর্ধেথাং গীর্ভিরিলয়া মদন্তা৷ ৭৷৷ ইন্দ্রায় গিররা অনিশিতসৰ্গা অপঃ রৈয়ৎ সগরস্য বুধা। যো অক্ষেণেব চক্রিয়ৌ শচীভির্বিক্তস্তম্ভ পৃথিবীমুত দ্যাম্৷৮৷৷ আ ত্বা সখায়ঃ সখ্যা বৃত্যুস্তিরঃ পুরূ চিদৰ্ণবা জগম্যাঃ। পিতুনপাতমাদধীত বেধা অস্মিন্ ক্ষয়ে প্রতরাং দীধ্যানঃ ৯৷৷ কো অদ্য যুক্তে ধুরি গা ঋতস্য শিমীবততা ভামিনো দুর্থণায়ুন। আসন্নেষামপসুবাহো ময়োভূন্য এষাং ভৃত্যামৃণধৎস জীবাৎ৷ ১০৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ— ১। সৎকর্মবিধায়ক, সর্বশক্তিমান, দেবভাবপ্রদায়ক, সৎকর্মসাধনসামর্থ্য-প্ৰদাতা, রিপুবিমর্দক, আশুমুক্তিদায়ক, জ্যোতির্ময়, সেই অনন্তস্বরূপ দেবতাকে আমরা পরম, মঙ্গল-লাভের জন্য আমাদের হৃদয়ে যেন আহ্বান করি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [এর গেয়গানের নাম–তার্ক্ষ্য সামনি দ্বে। ঋষির নাম–তার্ক্ষ্যপুত্রে অরিষ্টনেমি]।
২। রিপুকবল হতে অথবা সংসার-সাগর হতে উদ্ধারকারী বলৈশ্বর্যাধিপতি ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে l আমি যেন আহ্বান করি–অনুসরণ করি; অভীষ্টপূরক ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে আমি যেন অনুসরণ করি–আহ্বান করি; রিপুসংগ্রামে জয়প্রদাতা শক্তিদায়ক ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে সর্বথা আমি যেন অনুসরণ করি; সর্বলোকের আরাধ্য সর্বশক্তিমন্ত ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে আমি যেন আহ্বান করি; আমার এই পূজা (সর্বকর্ম) পরমধনদাতা ভগবান্ ইন্দ্রদেব গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে, আমি সর্বাভীষ্ট পূরক ভগবানকে অনুসরণ করতে যেন সমর্থ হই; তিনি আমার পূজা গ্রহণ করুন)। [মন্ত্রটির বিশেষত্ব এই যে, এখানে পুনঃপুনঃ ইন্দ্র (ভগবানের বলৈশ্বর্যের বিভূতিধারী দেবতা) শব্দ ব্যবহারের দ্বারা সাধক-গায়কের হৃদয়ে আগ্রহাতিশয্য ও ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। যাতে জীবনের প্রত্যেক কার্যে, — প্রত্যেক পদক্ষেপে, প্রত্যেক চিন্তায় ভগবানেরই চিন্তা জাগে, তার জন্যই সাধকের ব্যাকুলতা]। [এর গেয়গানের নাম–ইন্দ্ৰস্প চ তাতম]।
৩। বিবিধ সৎকর্মের ও জ্ঞানভক্তি প্রভৃতির পালয়িতা, অর্থাৎ জ্ঞানভক্তি ও সৎকর্ম-সাধনসামর্থ্য প্রদাতা রক্ষাস্ত্রধারী বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে আমরা যেন পূজা করি; তিনি লীয়মান অনিত্যবস্তুসমূহ দূর করে পূর্ণ দেব-মহিমায় আমাদের হৃদয়ে প্রাদুর্ভুত হোন; বিবেকজ্ঞান প্রভৃতি দ্বারা রিপুগণকে পরাজিত করে প্রার্থনাকারী আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা ভগবানকে যেন অনুসরণ করি–সৎপথাবলম্বী হওয়াই ভগবানের অনুসরণ; তিনি আমাদের পরমধন প্রদান করুন–মোক্ষই পরমধন)। [মন্ত্রটির মধ্যে দেবতাকে আহ্বান করার পরই তার কাছে বর প্রার্থনা করা হয়েছে–সেনাভিঃ ভয়মানঃ রাধসা বি–তোমার সৈন্য দ্বারা (অন্তর ও বাহিরের) শত্রুদের দূরীভূত কর, আমাদের পরমধন দান কর। ভগবানের সৈন্য যারা পাপ-মোহ ইত্যাদি অসুরগণকে বিনাশ করে। বলা বাহুল্য, জ্ঞান বিবেক বৈরাগ্য প্রভৃতিই সেই সৈন্য–এই মন্ত্রের সমস্যামূলক পদ শ্মশ্রু। ভাষ্যের ভাবে ও প্রচলিত ব্যাখ্যায় তার অর্থ করা হয়েছে–গোঁপদাড়ি। ইন্দ্র যেন গোঁপ কাঁপতে কাঁপাতে বিস্তর নো ও অস্ত্র নিয়ে বিপক্ষ সেনা সংহার করতে উর্ধ্বে গমন করছেন। হাস্যকর ভ্রান্তিমূলক এই অর্থের চেয়ে শ্মশ্রুভিঃ পদে শ্মশ্রন, লীঘমানানি, অনিত্যবস্তুনি অর্থ গ্রহণই সমীচীন ও নিরুক্তসম্মত]। [এই সাম মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–বার্ত্রাতুরং]।
৪। নিঃশেষে রিপুনাশক, রক্ষাস্ত্রধারী, রিপুবিমর্দক, মহান, নিত্য, শত্রুনাশক, অভীষ্টবর্ষক, বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে যেন আমরা আরাধনা করি; যে দেবতা অজ্ঞানতানাশক, শক্তিপ্রদাতা, অপিচ, পরমধনদাতা, সেই পরমধনশালী সুষ্ঠুধনসম্পন্ন দেবতা আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে অনুসরণ করি; তিনি আমাদের মোক্ষ প্রদান করুন)। এই মন্ত্র যেন বলছেন-ভয় নেই মানব! ভগবান্ অসুরদলন, তোমাদের মঙ্গলের জন্য, তোমাদের বিপদ থেকে-সকল রকম শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবার জন্য তিনি রক্ষাস্তু-হাতে বিরাজিত আছেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা কর, তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করা; পরমধর্নলাভে–অনন্ত ঐশ্বর্য লাভে ধন্য হবে, কৃতার্থ হবে–সর্বাভীষ্ট লাভ করতে পারবে]। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম ধৃষতো মারুতস্য সামনী দ্বে]।
৫। যে শত্রু আমাদের অধঃপতন কামনা করে আমাদের আক্রমণ করে, অথবা যে আত্মাভিমানী বা শক্তিশালী হিংসক অধঃপতনকারক উপায়ের দ্বারা এবং বলের সাথে আমাদের আক্রমণ করে, বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! আপনার কর্তৃক রক্ষিত হয়ে, শক্তিলাভ করে, আমরা যেন সেই রিপুকেই অভিভব করতে পারি। (ভাব এই যে, হে ভগবন! রিপুজয়ের জন্য আমাদের সকল রকম শক্তি প্রদান করুন)। [প্রকৃত সাধকের এটাই প্রার্থনা। শক্তি ভগবানের কাছ থেকেই পাব; কিন্তু নিজে সেই শক্তির অধিকারী না হলে, সেই শক্তির চালনা না করলে, আমি তো মুক্তি পাব না–নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য। তাই সাধকের প্রার্থনা–ইন্দ্র, দ্যোতাঃ বৃষমণঃ অভীষ্যাম। দুর্বল আমি, আমাকে শক্তি দাও, আমি যেন নিজে শক্ৰজয় করতে পারি]। [এই মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–আত্রং এবং ঋষির নাম—বামদেব]।
৬। অজ্ঞানতার মধ্যে অর্থাৎ রিপুকবলগত ব্যক্তিগণ জয়াভিলাষী হয়ে যে দেবতাকে আরাধনা না করেন; রিপুনাশকামনাকারী ব্যক্তিগণ সংগ্রামে যে দেবতাকে আহ্বান করেন, রিপুসংগ্রামে মানুষ যে ও দেবতাকে আহ্বান করে অর্থাৎ তার সাহায্য প্রার্থনা করে, জ্ঞানবারিলাভের জন্য যে দেবতার সমীপে মানুষ প্রার্থনা করে, জ্ঞানিগণ যে দেবতাকে মোক্ষলাভের জন্য আরাধনা করেন, তিনি বলৈশ্বর্যাধিপতি ইন্দ্রদেব। (ভাব এই যে, –ভগবান্ সর্বলোকের আরাধ্য; তিনি মানুষের, রিপুনাশক এবং অভীষ্টপূরক)। [এই মন্ত্র যেন বলছেন–মানুষ, সাবধান! তাকে ভুলো না, তার অসীম স্বরূপ সম্বন্ধে ও তোমার নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শক্তি সম্বন্ধে পূর্ণরূপে অবহিত থেকো। এই ধারণার কোন বিভ্রান্তি রেখো না। নিজের ভাগ্যে অহঙ্কার বিমূঢ়াত্মার শোচনীয় পরিণাম ডেকে এনো না। মনে রেখো, আপাতঃদৃষ্টিতে তুমিই কাজ করছ বটে, তুমি শক্তিলাভের অধিকারীও বটে, কিন্তু পশ্চাতে শক্তির : আধার সেই ভগবান্ না থাকলে তুমি কিছুই করতে সমর্থ নও]। [এই মন্ত্রটির গেয়গানের নাম গাং সমদে সাম। এর ঋষি-বসিষ্ঠ]।
৭। বলৈশ্বর্যাধিপতি ও অভীষ্টপূরক হে দেবদ্বয়! মহৎ সৎকর্মের সাথে আমাদের সম্বন্ধযুত করে, প্রার্থনীয় রিপুনাশসমর্থ সিদ্ধি প্রদান করুন; পরমানন্দদায়ক হে দেবদ্বয়! আপনারা সৎকর্ম-রূপ আরাধনা গ্রহণ করুন; এবং আমাদের স্তুতিসমূহে বা অনুসরণে প্রীত হয়ে আত্মশক্তি দান করে আমাদের প্রবর্ধিত করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের জ্ঞান ও আত্মশক্তি প্রদান করুন; অজ্ঞান আমাদের পূজা গ্রহণ করুন)। [ইন্দ্রাপবর্তা অর্থাৎ ইন্দ্র ও পর্বত দেবতা-বলৈশ্বর্যাধিপতি তথা অভীষ্টপূরক দুই দেবতা–ভগবানের বিশেষ বিভূতিময় দুই দেবসত্তা। পর্বত-শব্দের ব্যুৎপত্তি ধরে (পৰ্ব্ব-পূরণ করা) অর্থ ধরলে অভীষ্টপূরক দেব বোঝা যায়]। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম–বৈশ্বামিত্রং]।
৮। হে মম মন! বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতাকে প্রাপ্তির জন্য, ঐকান্তিকতার সাথে প্রার্থনা কর; ভগবান স্বর্গ হতে অমৃত আমাদের জন্য প্রেরণ করুন; অক্ষ যথা রথচক্রকে ধারণ করে, তেমনই যে দেবতা আপন শক্তিতে সর্বতোভাবে দ্যুলোক ও ভূলোক ধারণ করে আছেন, সেই দেবতা আমাদের অমৃতত্ব প্রদান করুন এবং আমাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -ভগবান্ আমাদের অমৃত্ব প্রদান করুন এবং আমাদের সর্বতোভাবে রক্ষা করুন)। [এর গেয়গানের নাম সাবিত্রং। মন্ত্রটির গেয়গানের ঋষি–রেণু]।
৯। হে দেব! সখ্যভাবাপন্ন উপাসকগণ অর্থাৎ একনিষ্ঠ সাধকগণ সখিত্বের দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হন; পরিত্রাতা আপনি তাদের অসীম জ্ঞানসমুদ্র প্রাপ্ত করান; জ্যোতির্ময় সর্বনিয়ন্তা দেব ভগবৎ সম্বন্ধীয় অর্থাৎ আপনার সম্বন্ধীয় প্রকৃষ্ট জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের কৃপা করে পরাজ্ঞান দান করুন)। [প্রার্থনার দ্বারাই মানুষ দেবতার সখ্যতা অর্জন করে। এই প্রার্থনার জন্ম হয়–মনুষ্যত্বের স্ফুরণে। পরাজ্ঞান-প্রকৃষ্ট জ্ঞান–দেবত্ব]। [এই সাম মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–কুতীপাদ বৈরূপস্য সাম। এর ঋষি বামদেব]।
১০। সত্যের বা সৎকর্মের সম্পাদনে, কোন্ জন, নিত্যকাল প্রতিপাল্য কর্মসমূহের দ্বারা যুক্ত, তেজঃসমন্বিত, রিপুগণের লজ্জাদ, এই হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবসমূহের বাহক সত্যবাক্যবিশিষ্ট, সুখসাধক অদৃষ্টের কারয়িতা, জ্ঞানকিরণসমূহকে হৃদয়ে সংযুক্ত করতে সমর্থ হয়? (ভাব এই যে, –স্বয়ং ভগবান্ ভিন্ন কোনও মনুষ্যই হৃদয়ে প্রজ্ঞান সঞ্চরণে সমর্থ হয় না)। যে জন জ্ঞানকিরণ-সমূহের অনুসরণ করে নিজেতে তাদের উৎকর্ষসাধন করে, সেই ব্যক্তিই জীবিত থাকে অর্থাৎ পরাগতি লাভ করে। (ভাব এই যে, –জ্ঞানের অনুসারী জনই চতুর্বর্গ ফলের অধিকারী হয়)। [প্রচলিত ভাষ্যে বা ও এ ব্যাখ্যায় যুঙক্তে ও ধুরি পদ দুটির সাথে গাঃ শব্দের প্রয়োগ উপলক্ষে শকট ইত্যাদির যে অংশের দ্বারা গরুর বা ঘোড়ার সংযোজনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এইভাবে আরও কতকগুলি পদে ভিন্নতর অর্থ করায় মন্ত্রটিকে প্রহেলিকাময় করে তোলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গাঃ পদে জ্ঞানকিরণসমূহকে লক্ষ্য করে। ধুরি অর্থে নির্বাহে বা সম্পাদনে, যুঙক্তে অর্থে শক্লোতি, –হৃদি ইতি শেষঃ এরকম ব্যাখ্যাই যুক্তিগ্রাহ্য]।
.
দ্বাদশী দশতি
ছন্দ আর্চিক। কৌথুমী শাখা। ঐন্দ্র পর্ব (দ্বিতীয়)। তৃতীয় অধ্যায়।
দেবতা ইন্দ্র৷৷
ছন্দ অনুষ্টুপ৷৷
ঋষি ১ মধুচ্ছন্দা বৈশ্বামিত্র, ২ জেতা মাধুচ্ছন্দস, ৩।৬ গৌতম রাহুগণ, ৪ অত্রি ভৌম, ৫।৮ তিরশ্চী আঙ্গিরস, ৭ নীপাতিথি কাণ্ব, ৯ বিশ্বামিত্র গাথিন, ১০ শংযু বার্হস্পত্য অথবা তিরশ্চী আঙ্গিরস৷৷
গায়ন্তি ত্বা গায়ত্রিশোহচন্ত্যকর্মর্কিণঃ। ব্ৰহ্মাণা শতক্রত উদ্বংশমিব যেমিরে৷৷ ১। ইন্দ্ৰং বিশ্বা অবীবৃধৎসমুদ্রব্যচসং গিরঃ। রথীতমং রথীনাং বাজানাং সৎপতিং পতি৷ ২৷৷ ইমমিন্দ্র সুতং পিব জ্যেষ্ঠমমং মদ। শুক্ৰস্য ভ্যক্ষর ধারা ঋতস্য সাদনে৷ ৩৷৷ যদিন্দ্র চিত্র ম ইহ নাস্তি দ্বাদামদ্রিবঃ। রাধস্তন্নে বিদদ্বস উভয় হস্ত্যাভর৷.৪৷৷ শ্রুধী হবং তিরশ্চ্যা ইন্দ্র যা সপতি। সুবীর্যস্য গোমতো রায়ম্পূর্ধি মহা অসি৷৷ ৫৷৷ অসাবি সোম ইন্দ্র তে শবিষ্ঠ ধৃষ্ণবা গহি। আ জ্বা পূণত্বিন্দ্ৰিয়ং রজঃ সূর্যো ন রশ্মিভিঃ ৷৷ ৬৷৷ এন্দ্র যাহি হরিভিরুপ কথস্য সুষ্ঠুতিম্। দিবো অমুষ্য শাসততা দিবং য্য দিবাবসো৷৷৷৷ আ ত্বা গিররা রথীরিবাস্তুঃ সুতেষু গির্বণঃ। অভি ত্বা সমনূষত গাবো বৎসং ন ধেনবঃ ॥ ৮৷৷ এত ন্বিন্দ্ৰং স্তবাম শুদ্ধং সুদ্ধেন সান্না। শুদ্বৈরুক্থৈর্বাবৃধ্বংসং শুদ্ধৈরাশীর্বান্ মমতু৷৷ ৯৷৷ যো রয়িং বো রয়িন্তমো যো দ্যুদ্বৈত্তমঃ। সোমঃ সূতঃ স ইন্দ্র তেহস্তি স্বধাপতে মদঃ। ১০৷৷
মন্ত্ৰার্থ— ১। প্রজ্ঞাস্বরূপ হে ভগবন! সামগায়িগণ সামগানে আপনারই মহিমা গান করেন, ঋক্ মন্ত্র উচ্চারণকারী হোতৃগণ আপনারই অর্চনা করেন, স্তোত্রপাঠক ঋত্বিকগণ উচ্চবংশের ন্যায় আপনাকেই উন্নত করেন অর্থাৎ উচ্চৈঃস্বরে আপনার গুণগান করেন। (ভাব এই যে, সামগানে, ঋক্-মন্ত্রে এবং সব রকম স্তোত্রে সেই একমেবাদ্বিতীয় ভগবানেরই মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়)। [যে কোন মন্ত্রে বা স্তোত্রে, যেখানে যে নামে যে ভাবে ভগবানের অর্চনা করা যাক না কেন, সে সব অর্চনাই সর্বস্বরূপ সেই একেরই উদ্দেশ্যে বিহিত হয়। [এই মন্ত্রটির গায়ক-ঋষি-মধুচ্ছন্দা]।
২। সেই সমুদ্ৰব্যাপক অর্থাৎ সর্বব্যাপী, যোদ্ধৃশ্রেষ্ঠ, ধনাধিপতি, সজ্জনরক্ষক, ভগবান্ ইন্দ্রদেবের প্রতি প্রযুক্ত বিশ্ববাসী জনগণের উচ্চারিত সকল স্তোত্রমন্ত্র, লোকসমূহকে বর্ধিত করে থাকে, অর্থাৎ তার দ্বারা মনুষ্যের শ্রেয়ঃ সাধিত হয়। (ভাব এই যে, –সেই সর্বব্যাপী সৎ-জন-পালক ধরাধিপতি ভগবানের সম্বন্ধে প্রযুক্ত স্তোত্রমন্ত্রে মানুষ শুভফল প্রাপ্ত হয়ে থাকে)। [এর গেয়গান সাতটি; তার মধ্যে প্রথম তিনটি শৈখণ্ডিনানি ত্ৰীণি, চতুর্থটি পূর্বনাদংষ্ট্রম, পঞ্চমটি উত্তরসাদংষ্ট্র এবং ষষ্ঠ ও সপ্তমটি মহাবশ্বামিত্রে দ্বে নামে প্রখ্যাত। এর গেয়গানের ঋষি—জেতা মাধুচ্ছন্দস]।
৩। হে ভগবান্ ইন্দ্রদেব! এই প্রশংসনীয় (সকলের শ্রেষ্ঠস্থানীয়) অমারক অর্থাৎ আমাদের রক্ষাকর, আনন্দপ্রদ, শুদ্ধসত্ত্বকে আপনি গ্রহণ করুন, সত্যের (সৎকর্মের) অনুষ্ঠান-স্থানে দ্যোতমান শুদ্ধসত্ত্বের ধারা (প্রবাহ) আপনাকে লক্ষ্য করে গমন করে আপনাকে প্রাপ্ত হয়। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের মধ্যে সেই রক্ষাদ পরমানন্দদায়ক আপনার প্রতি আপনা-আপনিই প্রবাহিত শুদ্ধসত্ত্বকে সঞ্চার করে দিয়ে তা গ্রহণ করুন)। [মন্ত্রের প্রথম চরণে সুতং ও মদং এবং দ্বিতীয় চরণে ধারাঃ ও অক্ষর পদ থেকে প্রচলিত ব্যাখ্যায় মন্ত্রের ভাব দেখানো হয়েছে–হে ইন্দ্র! তুমি মদকর সোমরস পান কর; সোমরসের ধারাসমূহ যজ্ঞক্ষেত্রে ক্ষরিত হচ্ছে। এইভাবে কল্পনা অবশ্যই বিভ্রান্তিমূলক এবং অপব্যাখ্যা। মদং অর্থে আনন্দপ্রদ, সুতংঅর্থে শুদ্ধসত্ত্ব, ধারা অর্থে প্রবাহ ইত্যাদির প্রয়োগ কত যথার্থ তা বিবেচনা করলেই বোঝা যায়]। [এর গেয়গানের নাম বসিষ্ঠস্য প্রিয়াণি চত্বারি। এর ঋষি গৌতম]।
৪। পাপবিনাশে পাষাণকঠোর, মহনীয়, বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! ইহজগতে আপনার কর্তৃক দান ৪ করবার যোগ্য যে পরমধন আমি পাইনি; পরমধনশালী হে দেব! প্রভূত-পরিমাণ সেই পরমধন পরাজ্ঞান, আমাদের প্রদান করুন। (ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের পরাজ্ঞান প্রদান করুন)। [মন্ত্রের মধ্যে যে প্রার্থনা রয়েছে, তা অনাদি অনন্ত ব্যক্তিত্বের সীমার অতীত। মানুষের অন্তরস্থ। অনন্তের ব্যাকুল ক্রন্দন–যা এই জগতে পাওয়া যায় না, যার অধিকারী কেবলমাত্র তুমি, সেই পরমধন পরাজ্ঞান আমি তো পাইনি। আমাকে দাও, তৃষ্ণার্ত আমাকে তোমার অনন্ত ভাণ্ডারের একবিন্দু। অমৃতবারি দানে–চরম দানে–আমাকে ধন্য কর]। [এর গেয়গানের নাম–বীকে দ্বে, আকুপার মনা দেশম ও বীঙ্কম। এই গানের ঋষি অত্রি]।
৫। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! দিগ্ভ্রান্ত (বিপথগামী) আমার প্রার্থনা শ্রবণ করুন; যে জন আপনাকে আরাধনা করে আপনার অনুসরণ করে, আত্মশক্তি এবং পরাজ্ঞান দান করে আপনি তাকে প্রবর্ধিত করেন; আপনি মহান্ হন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! এই প্রার্থনাকারী দিগভ্রান্ত (পতিত) আমাকে গোমতঃ রায়ঃ–পরাজ্ঞান-দাও, যা পেলে আমি আমার গন্তব্যস্থলের পথে চলতে পারব। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম–তৈরশ্চে দ্বে]।
৬। হে ভগবন ইন্দ্রদেব! আপনার জন্য আমাদের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপন্ন বা সঞ্চিত হোক। অতিশয় বলব শত্রুধর্ষণকারী হে ভগবন! আসুন–আমাদের প্রাপ্ত হোন; আমাদের সকল ইন্দ্রিয় সকল শক্তি, সূর্য যেমন রশ্মিসমূহের দ্বারা অন্তরীক্ষকে ব্যাপ্ত করে তেমন (অথবা জ্ঞানদেবতা (সূর্য) যেমন নিজের জ্যোতির দ্বারা রজোভাবকে–অহঙ্কার ইত্যাদি জন্মকারণকে নাশ করেন, তেমন) সর্বতোভাবে আপনাকে প্রাপ্ত হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের সকল শক্তি আপনাতে বিনিবিষ্ট হোক–আমাদের হৃদয় শুদ্ধসত্ত্বে পূর্ণ থাকুক; আর আপনি আমাদের মধ্যে বিরাজমা থাকুন)। [এখানেও প্রচলিত ব্যাখ্যার বিভ্রান্তি কাটিয়ে সোমঃ পদে মাদক-লতা সোম না ধরে সঙ্গতিপূর্ণ শুদ্ধসত্ত্ব-কে গ্রহণ করা হয়েছে। সূৰ্য্য যে ভগবানের জ্ঞানদায়ক বিভূতি তা তো গৃহীত হয়েছেই]। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম–মহা বৈশ্বামিম্]।
৭। বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! জ্ঞানভক্তি ইত্যাদির সাথে অজ্ঞানান্ধ আমার প্রার্থনার প্রতি আপনি আগমন করুন, অর্থাৎ প্রার্থনাকারী আমাকে প্রাপ্ত হোন বা আমার নিকট আপনি প্রাপ্ত হোন; দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন হে দেব! স্বর্গলোকের রক্ষক আপনার দেব-ভাব আমাকে প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! অজ্ঞান আমার প্রার্থনা আপনি শ্রবণ করুন, আমাকে সকলরকমে সত্ত্বভাব, প্রদান করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় কঞ্চস্য পদে মন্ত্রের ঋষি কথকেই নির্দেশ করা হয়েছে। এখানে সবদিক বিচার করে কথ পদে অতি ক্ষুদ্র অভাজনঅর্থ গৃহীত হয়েছে। এছাড়াও প্রচলিত ব্যাখ্যায় কতকগুলি পদের বিভক্তি-ব্যত্যয় স্বীকার করেও দুরকম অর্থ কল্পনা করা হয়েছে। ফলে ঐসব ব্যাখ্যায় খুব অর্থ-সঙ্গতিও রাখা যায়নি]। [এর গেয়গানের নাম-কাণ্বে দ্বে]।
৮। স্তবনীয় হে দেব! সৎকর্মান্বিত জন যেমন আপনাকে প্রাপ্ত হয়, তেমনই হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব উৎপন্ন হলে প্রার্থনা আপনার অভিমুখে গমন করে; হে দেব! মোক্ষপ্রাপক জ্ঞানকিরণসমূহ যেমন ভগবানের অনুসারী জনকে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হয়, তেমনই ভাবে আপনাকে পাবার জন্য সাধকগণ সম্যক রূপে প্রধাবিত হন। (ভাব এই যে, –শুদ্ধসত্ত্বভাব ও সৎকর্মের দ্বারা সাধক ভগবানের কৃপা এ লাভ করেন; সর্বতোভাবে ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য সাধকগণ প্রধাবিত হন)। [মন্ত্রটিতে নিত্যসত্য খ্যাপিত হয়েছে। সৎকর্মের দ্বারা যেমন ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের উপজন হলেও তেমন ভগবৎ প্রাপ্তি ঘটে। সৎকর্ম ও শুদ্ধসত্ত্বভাব–এই দুটিই ভগবৎ-প্রাপ্তির উপায়। আবার একটি অন্যটির অনুসঙ্গীও বটে। -সুতেষু পদে প্রচলিত ব্যাখ্যায় সোমরসে্যু বলা হলেও এখানে যথাযথ শুদ্ধসত্ত্বভাবেষু অর্থই গৃহীত হয়েছে)। [এই সাম-মন্ত্রটির গেয়গানের নাম–বৈশ্বামিত্রং]।
৯। হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! শীঘ্র জাগরিত হও। অপাপবিদ্ধ বলৈশ্বৰ্য্যাধিপতি দেবতাকে পবিত্র স্তোত্রের দ্বারা আমরা যেন আরাধনা করি; বিশুদ্ধ স্তোত্রসমুহের দ্বারা মহান্ দেবতাকে আমরা যেন আরাধনা করি; পবিত্র অপাপবিদ্ধ সে দেবতা শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহের দ্বারা আমাদের পরমানন্দ প্রদান করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানকে আরাধনা করি; তিনি আমাদের সকল রকম শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় অবান্তরভাবে কোনরকমে সোমরসকে টেনে আনা হয়েছে। সেইসঙ্গে আবার একটা আখ্যায়িকার অবতারণা করে ভ্রান্তিমূলক কল্পনাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার রয়েছে। [এর গেয়গানের নাম-শুদ্ধাশুদ্ধীয়ম এবং শুদ্ধাশুদ্ধীয়োত্তরং]।
১০। বলৈশ্বর্যাধিপতে হে দেব! যে শ্রেষ্ঠধনসম্পন্ন, যে আপন তেজে প্রকাশমা, সেই সত্ত্বভাব আপনার স্তোতৃগণকে (আমাদের) পরম ধন মোক্ষ প্রদান করুক; সত্ত্বভাবপ্রদাতা হে দেব! আপনার প্রদত্ত বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের পরমানন্দদায়ক হোক। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! আমাদের পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [এখানে সত্ত্বভাবকে তথা শুদ্ধসত্ত্বভাবকে কয়েকটি বিশেষণের দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে। সত্ত্বভাব–শ্রেষ্ঠধনসম্পন্ন; যে ধনের দ্বারা মানুষের আধ্যাত্মিক সকল অভাব নিঃশেষে দূরীভূত হয়–যার দ্বারা মানুষ মোক্ষলাভের অধিকারী হয়। মোক্ষ অর্থে নিঃশ্রেয়স্ নির্বাণ মুক্তি ইত্যাদি। যার অপেক্ষা শ্রেয়ঃসাধক আর কিছু নেই, –তা-ই নিঃশ্রেয়। নির্বাণ লাভের অর্থও আদি শুদ্ধ অবস্থায় ফিরে আসা। সত্ত্বভাব আপন তেজে প্রকাশমান্; অর্থাৎ সূর্যের যেমন অন্য কোন আলোক-উৎসের সাহায্য ব্যতিরেকেই দীপ্তি দান করে। তেমনই সাধকের হৃদয়ে সত্ত্বভাব আবির্ভূত হলে তার হৃদয়ে আপনা-আপনিই পাপমলিনতা দূরীভূত হয়। সাধক-গায়ক এই সত্ত্বভাব পাবার জন্যই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছেন]। [ঋগ্বেদ; এর গেয়গানের নাম–রয়িষ্ঠে দ্বে। সাম-মন্ত্রের ঋষির নাম–শংযুবাৰ্হস্পত্য।
— তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত —