সুভাষচন্দ্র এগিয়ে এলেন। তাঁর ভাবভঙ্গীতে বেশ ব্যস্ততা ফুটে উঠেছে, দীপা মা, আমরা অনেকক্ষণ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। দ্যাখো, কে এসেছেন?
অনুমান তীব্রতর হচ্ছিল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না দীপা। সুভাষচন্দ্র তার দিকে তাকিয়ে কি বুঝলেন তিনিই জানেন, বললেন, আচ্ছা! আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা না বলে যদি ভেতরে গিয়ে গেস্টরুমে বসি তাহলে কি অসুবিধে হবে?
আসুন। দীপা মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকল। গেস্টরুমে আর একটি মেয়ের বাড়ির লোকেরা এসেছেন। এ কেমন আছে ও কি বলল সেসব কথা চলছে। দীপা কোণের দিকে তিনটে চেয়ার টেনে নিল। সুভাষচন্দ্র ভদ্রলোককে নিয়ে তার দুটিতে বসলেন। দাঁড়িয়ে রইল দীপা। সুভাষচন্দ্র বললেন, তোমার মায়ের সঙ্গে এর আগের দিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি তোমাকে নিতে যেদিন এসেছিলেন সেদিনই কলকাতায় গোলমাল শুরু হয়েছিল। তারও পরে দুবার এসে তিনি তোমার দেখা পাননি।
দীপা মাথা নাড়ল, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। হঠাৎ সেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর দুটো হাত দীপার দিকে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এল, মা গো! গলায় জমাট কান্না যা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারছে না। ঘরের ওপাশে যাঁরা কথা বলছিলেন তাঁদের সংলাপ আচমকা থেমে গেল। দীপা চাপা গলায় বলল, আপনি এমন করছেন কেন?
সঙ্গে সঙ্গে কান্নার সঙ্গে মিশে শব্দগুলো বেরিয়ে এল, ওরে, আমাকে তুই তুমি বল। আমি তোর জন্মদাতা বাবা। সারাজীবন জ্বলোপুডে মরছি পরিতাপে।
এখন আর কিছু করার নেই। এই শব্দগুলো গেস্টরুমে বসে থাকা হোস্টেলের মেয়েটির কানে না যাওয়ার কোন কারণ নেই। অতএর আজ রাত্রে হোস্টেলে যে গল্প চালু হবে তা কাল ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত কলেজে। দীপা নিজেকে গুটিয়ে নিল, আপনি বসুন, নইলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে গেলেন। কিছু বুঝতে না পেরে সুভাষচন্দ্রের দিকে তাকালেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর হাত ধরে আবার বসিয়ে দিলেন। জামার হাতায় চোখ মুছলেন ভদ্রলোক, আমি যে কিভাবে তোমার কাছে মুখ দেখাবো ভাবতে পারিনি।
আপনি যখন এসে গিয়েছেন তখন আর এসব কথা কেন? সুভাষচন্দ্ৰ বাধা দিলেন, মানুষ যা ভুল করে তা যদি নিজেই সংশোধন করে নেয় তাহলে সব সমস্যা মিটে যায়। আপনি সংশোধন করুন।
তা করতেই তো এলাম। তুই আমার সঙ্গে চল মা।
কোথায়।
আমার বাড়িতে। রাজকন্যার মত রাখতে পারব না হয়তো কিন্তু যত্নের অভাব হবে না।
আমি তো এখানেই ভাল আছি।
হোটেল মেসে কি ভাল থাকা যায়? তার ওপর পাঁচ জগতের মেয়ের সঙ্গে থাকা। কে একজন খুন হয়েছে বেলেল্লাপনা করতে গিয়ে তার জন্যে নাকি তোকে পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। না, না, এখানে থাকার দরকার নেই। পড়াশুনা করতে হয় আমার কাছে থেকে নিশ্চিন্তে করব। খুব আন্তরিক গলায় কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক।
আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি।
কিন্তু আমি যে তোর বাবা। বাবার মনের অতৃপ্তি দূর করবি না মা?
কিছু যদি মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করব?
একটা কেন? তুই মা আমাকে হাজারটা প্রশ্ন কর।
আজ মামা যদি আপনাকে না নিয়ে আসতেন তাহলে আমি কি করে বুঝতে পারতাম আপনি আমার বাবা? রাস্তায় দেখা হলে কি আপনি চিনতে পারতেন?
থমকে গেলেন ভদ্রলোক। অবাক হয়ে তিনি সুভাষচন্দ্রের দিকে তাকালেন। তারপরে হঠাৎই কথা খুঁজে পেলেন, আমি চিনতে পারতাম। তোর মুখে তাঁর মুখ বসানো। চোখ পড়লে আমার কিছুতেই ভুল হত না। এমনকি চাহনিটাও তোর মায়ের কাছ থেকে পেয়ে গেছিস।
কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারতাম না। দীপা হাসার চেষ্টা করল, আজ আপনি এসেছেন। নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে না। আমার। মাঝে মাঝে দেখা করতে যাব। কিন্তু আমি এখন যে জীবনযাপন করছি তা থেকে সরে যেতে বলবেন না আমাকে।
তুই বাবার প্ৰাণে শান্তি দিবি না মা?
শান্তি? আমার অবস্থাটা বুঝুন। আপনাবু আজ এতদিন বাদে এসে বলছেন বলে আমি জানছি আপনি আমার জন্মদাতা। জ্ঞান হবার পর কেউ সে-কথা বলেনি। হতে পারে এটা সত্যি। আমি তো আপনোক কখনও চোখে দেখিনি।
সুভাষচন্দ্ৰ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার বললেন, একি কথা বলছি দীপা মা। সস্তােন কি কখনও জন্মদাতা বাবার পবিচয় নিজে জানতে পারে?
দীপা মাথা নাড়ল, সে জেনে নেয়। এই শিক্ষা সে অনুভূতি দিয়ে আবিষ্কার করে। এত বছর পরে হঠাৎ চাপিয়ে দিলে–।
সুভাষচন্দ্ৰ থামিয়ে দিলেন, তুমি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না যে তমি জানো না তোমার মা জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছেন, তোমার বাবা বিবাগী হয়ে গিয়েছিলেন। অঞ্জলি আর অমরনাথ তোমাকে সেইদিন থেকে পালন করেছিল?
হ্যাঁ। আমি জানি। কিন্তু অনেক পরে আমি জেনেছি।
তাহলে? এর কষ্ট তুমি বুঝতে পারছি না কেন?
পারছি না। কারণ আমি মনে করি শুধু জন্ম দিলেই বাবা বা মা হওয়া যায় না। একদিনের শিশুকে যিনি ফেলে চলে গিয়েছিলেন তাঁকে আমি শুধু ওই কারণে বাবা বলে ডাকতে পারব না। সন্তানকে যিনি লালন করেননি, তার বোধ-বুদ্ধির উদয়ের সময়ে যিনি নিজের অভিজ্ঞতা দান করেননি। তিনি কিছুতেই সেই সন্তানের বাবা হতে পারেন না। আমার কাছে অন্তত নয়।
তুমি খুব পাকা পাকা কথা বলছি দীপা! সুভাষচন্দ্র বিরক্ত হলেন।
কথাগুলো বলার জন্যে আমি আপনার কাছে যাইনি মামা, আপনারা এসেছেন বলেই বলতে বাধ্য হচ্ছি। হতে পারেন ইনি আমার জন্মদাতা কিন্তু একে দেখে আমার মনে একটাই প্ৰতিক্রিয়া হচ্ছে। দীপা ঠোঁট কামড়াল।
সুভাষচন্দ্র ভদ্রলোকের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। কিন্তু কোন শব্দ উচ্চারণ করলেন না। দীপা সামান্য অপেক্ষা করে বলল, ইনি হয়তো আমার জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু সেই আমি যে এই আমি তাও ইনি জানতেন না। একে আমি কি করে বাবা বলব? বাবা হবার জন্যে ইনি কি করেছেন? আমি যাঁকে বাবা বলে মনে করি তিনি কিন্তু সেই কাজটা করে গিয়েছেন।
সুভাষচন্দ্ৰ কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ঠিক কথা। একশবার ঠিক কথা।
তখন বুঝিনি। কিন্তু এখন স্বীকার করতে লজ্জা নেই। আমি অত্যন্ত গৰ্হিত কাজ করেছি। তোমার জননী মারা যাওয়ামাত্ৰ মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব আলো মুছে গিয়েছে। কোনরকম ভাবনা চিন্তা না করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কিভাবে ভাসতে ওভাসতে আবার ঈশ্বরের ইচ্ছায় নতুন জীবন শুরু করলাম সেটা অন্য কথা। কিন্তু যা সত্যি তা হল আমি আমার কর্তব্য করিনি। মা, এব। জন্যে তুমি যে শাস্তি দেবে তা আমি মাথা পেতে নেব। ভদ্রলোকের গলার স্বরে কান্না জমছিল।
নিজেকে সংযত রাখা দীপার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। সে বলল, আপনি এভাবে কথা বলবেন না। আমি তো একটু আগে বললাম, কলকাতায় যতদিন আছি মাঝে মধ্যে দেখা করব।
তুই আমাকে বাবা বলে ডাকবি না মা?
আমাকে ক্ষমা করবেন। দ্বিতীয় কোন মানুষকে আমি বাবা বলতে পারব না।
ও ভদ্রলোক থতমত হয়ে গেলেন। কিন্তু সেটা সামলে নিলেন চটপট, বেশ তাহলে তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা কবি। অমরনাথ কি পিতার কর্তব্য করেছে?
নিশ্চয়ই। এই আমি এখানে পৌঁছেছি। ওঁরই সাহায্যে।
হুঁ। কিন্তু ওই অল্প বয়সে নিজের ঘাড় থেকে নামাতে তোর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল অমরনাথ। আমি পারতাম? সত্যিকারের কোন বাবা পারত?
উনি নিশ্চয়ই আমার ভাল করতে চেয়েছিলেন। জেনেশুনে আমার ক্ষতি করেছেন এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারব না।
হোমাব হোস্টেলে পিতৃপরিচয় না। শ্বশুরবাড়ির পবিচয় দিয়েছ?
কেন? দীপা অবাক হল।
সেইটো জানা দরকার।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমার উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায়। বিয়ের আগে আমি মুখোপাধ্যায় ছিলাম। বাবা হয়তো সংস্কারের জন্যেই বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবহার করেছেন আমার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এ-বিষয়ে আপনার কৌতূহল কেন?
যদি বন্দ্যোপাধ্যায় লেখ তাহলে তো চুকেই গেল-। মিথ্যে কিছু লিখছি না! তুমি কেন কোনদিন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেনি, বুঝতে পারছি না। আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী বলে মনে হচ্ছে তোমাকে। অমরনাথের পদবাঁ ছিল মুখোপাধ্যায়। সে ছিল আমার ভায়বাভাই। আমার পদবাঁ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার মেয়েকে পালন করেছিল অমরনাথ। কিন্তু জন্মসূত্রে যাব পদবাঁ হওয়া উচিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে সে কোন সাহসে মুখোপাধ্যান্য করে দেয়। আমি জানি না। তোমাকে নিশ্চয়ই দত্তক নেয়নি। অমরনাথ? জন্মসূত্রে বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বিয়ের পরেও তাই। তোমার পদবাঁ বদল হয়নি। কি বল?
অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল দীপা। এবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি চান?
বাবা মেয়ের কাছে কি চাইতে পারে মা? তুই আমার কাছে চল, ওখানে গিয়ে থাকবি।
অসম্ভব।
কেন?
আমার এখানে কোন অসুবিধে হচ্ছে না।
পড়াশুনা থাকার খরচ কে চালাচ্ছে? যা শুনলাম তাতে অমরনাথের পক্ষে তো এত সব দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব ছিল না। অঞ্জলির অবস্থাও এখন ভাল নযা। তুই কি শ্বশুরবাড়ির টাকা পেয়েছিস হাতে?
আপনি এ ব্যাপারে অযথা চিন্তা করছেন।
এবার সুভাষচন্দ্ৰ কথা বললেন, প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন বলি। তোমার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর শুনেছি ওঁর কোন আপনজন বিষয়সম্পত্তি দখল করতে পারেনি। যদ্দিন তুমি বেঁচে থাকবে তদ্দিন আইনসঙ্গত অধিকার তোমার থাকবে। হয় তোমাকে লিখিত ভাবে কাউকে দান করতে হবে নযা নিজেই ভোগ করবে। এ নাহলে পড়ে থাকতে থাকতে একসময় সবকিছু সবকালের হয়ে যাবে। তোমার কি মনে হয়। সেইটে খুব কাজের কাজ হবে।
মামা, এ ব্যাপারে বাবার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। আমি আর ও বাড়ির কিছুতেই একদম আগ্রহী নই। দীপা গম্ভীর মুখে জানাল।
কিন্তু সে-সব তো তোমরাই। আচ্ছা, তুমি আমাকে একটা লিখিত অধিকার দাও যাতে আমি সেখানে গিয়ে সব কিছুর সুন্দর বিলিব্যবস্থা করে আসতে পারি।
তার মানে?
সরকারি গহ্বরে না গিয়ে জমি টাকা গয়না যা যেখানে আছে সব যাতে যোগ্য পাত্রে পড়ে তার আয়োজন করি আর কি।
যোগ্য পাত্র মানে?
যাদের কাছে তোমার কোন ঋণ আছে যা চেষ্টা করলেও শোধ করা যায় না। যেমন ধর অঞ্জলি আর আমরানাথের মা। ওরা তোমাকে পরম মমতায় মানুষ করেছে। সেই সময় যদি ওরা না এগিয়ে আসত তাহলে তোমার কি হত কে বলতে পারে! চোখ বন্ধ করলেন সুভাষচন্দ্ৰ, অঞ্জলির কাছে তোমার এক মাস্টারের কথা শুনেছিলাম। খুব সাহায্য করেছেন ভদ্রলোক। তিনি কি মারা গিয়েছেন।
হ্যাঁ। দীপা ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতেই পারছিল না।
গরীব মাস্টারের স্ত্রী তো আছেন। তোমার গুরুপত্নী। তাঁকে কিছুটা দিতে পার। তাছাড়া তোমার জন্মদাতার পবিবারে, যাদের রক্ত তোমার শরীরে বয়েছে, যে ঋণ হাজার চেষ্টা করেও কখনও শোধ করা যায় না, তাঁদের দিলে ভগবান খুশি হবেন।
সুভাষচন্দ্ৰ থামতেই ভদ্রলোক বললেন, না, সুভাষ, এখানে থেমো না। মামা হিসেরে তুমি কম করোনি। তাছাড়া এই বিলিব্যবস্থা করতে তোমারও কম পরিশ্রম হবে না। দীপা মায়ের উচিত তোমাকেও কিছু দেওয়া।
সুভাষচন্দ্র একটু লজ্জিত ভঙ্গী নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেলেন। তাঁর মুখভাবে ফুটে উঠল, সবাই মিলে তাঁকে নিতে অনুরোধ করলে তিনি আর কিভাবে না বলতে পারেন। এতক্ষণে দীপা একটু স্বস্তি পেল। যে সম্পত্তি তার নয় তা দান করবার অধিকার সে পারে কি করে—এমন কথা বললে এরা শুনবেন না। কিন্তু এটাও ঠিক অঞ্জলি, মনোরমা প্ৰচণ্ড অর্থকষ্টে আছেন। মনোরমার চিঠির প্রতিটি শব্দ তার মনে আছে। এসব করলে যদি ওঁরা একটু ভাল থাকেন তাহলে তার কি ক্ষতি।
দীপা চুপ করে আছে দেখে সুভাষচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে, প্রতুলবাবুর স্থাবব-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ কত তা কি তুই জানিস?
না। কখনও আগ্রহ বোধ করিনি।
দশ বারো লক্ষ টাকা বলে শুনেছিলাম। সুভাষচন্দ্ৰ তাঁর ভগ্নিপতির দিকে তাকালেন।
ওরে বাবা। ভদ্রলোক বললেন, এত?
হুঁ। সুভাষচন্দ্র মাথা নাড়লেন, তাহলে তুই কি বলিস?
আমার তো কিছু বলার নেই। যা বলার আপনারাই বলছেন।
তুই বড্ড ক্যাট ক্যাট করে কথা বলিস। আমরা ছাড়া তোর আর কে আছে? আচ্ছা, ধরে নিলাম অমরনাথ তোর কাছে বাবার মত ছিল। কিন্তু এখন তো নেই। এখন আমরাই তোর নিকট আত্মীয়। আমরা যদি তোকে ভাল উপদেশ না দিই কে দেবে?
দীপা হাসল, আমাকে কি করতে হবে?
সুভাষচন্দ্ৰ খুশি হলেন, আমি একটা ওকালতনামা নিয়ে আসব তাতে তুই সই করে দিবি। আমি জলপাইগুড়িতে গিয়ে সব কিছু উদ্ধার করার। তাবপাব না হয় ডিড অফ গিফট তৈরী হবে।
ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, উকিল জানাশোনা আছে?
প্রচুর। আমি উকিলকে দিয়েই কাগজপত্র করিয়ে নেব।
তাহলে চার ভাগ হবে?
চার? না, না, মাস্টারেব বউকে সমান সমান ভাগ কেন দেওয়া হবে। এই ধরুন, তিরিশি। তিরিশ তিরিশি। আর দশ। এইরকম! কি বোন দীপা?
দীপা চুপ করে রইল। সেইটে দেখে সুভাষচন্দ্র বললেন, ওই যা! বন্যস হলে মানুষের মাথা ঠিক কাজ করে না। ভাগ হওয়া উচিত, চারটে সাড়ে বাইশ করে আর একটা দশ। তাহলেই যুক্তিযুক্ত কাজ হবে।
ভদ্রলোক বিস্মিত হলেন, চাবটে সাড়ে বাইশ কেন?
আমরা দুজন, অঞ্জলি আর দীপা। ওর নিজের জন্যে তো একটা অংশ থাকা দাবকাব। পরে ও তাই নিয়ে যা খুশি করতে পারে। যদি কাউকে দিয়ে দিতে হয় ওই দেবে। আমার কাছে কোন অবিচার পারেন না। সুভাষচন্দ্ৰ মাথা দোলালেন।
দীপা হাসল, আপনি মিছিমিছি। এত চিন্তা করছেন। আমার জানো কোন ভাগ রাখতে হবে না। মা-ঠাকুমার জন্যে যে ভাগটা করছেন সেটাই বাড়িয়ে দিন। এবার যা করণীয্য করে আমার কাছে নিয়ে আসবেন আমি সই করে দেব।
ও। তুই যা ভাল মনে করছিস তাই হবে : অমরনাথের কাছে দেখছি তুই এইটে পেয়েছিস। নিজের ভবিষ্যতের কথা একদম ভাবিস না। হিন্দুঘরের বিধবা, টাকা পয়সা থাকলে তারা দুর্গে বাস করে। কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। যাক, যা ভাল বুঝবি তাই করবি। আমরা তোর ভাল চাই বলেই বললাম। ও হ্যাঁ, অঞ্জলির কাছে শুনেছিলাম বন্যাতে নাকি প্রতুলবাবুর বাড়িঘর ধসে পড়েছে। কিছু কি আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই?
কি আছে কি নেই তা আমি জানি না।
সেই মেয়েছেলেটাও তো মরে গেছে বন্যার সময়?
দীপা জবাব দিল না। আনার মুখ মনে পড়ল। হরদেবকে আনা সবসময় শেয়াল শকুনের সঙ্গে তুলনা করত। হরদেবও কি তার সঙ্গে বাড়ি চাপা পড়ে বন্যার সময় মরে গিয়েছে। কিন্তু কখনও কি হরদেবরা মারা যায়?
ভদ্রলোক বললেন, আমরা অনেকক্ষণ দীপা মাকে বন্দী করে রেখেছি সুভাষচন্দ্র। এবার ওঠা যাক। তা দীপা মা, মানলাম তুমি এখানে থাকবে, কিন্তু কথা দিতে হবে নিয়মিত আমায় দেখতে যাবে।
দীপা উঠে দাঁড়াল, আপনারা এখানে এসে আমায় অনেক কথা বললেন। আমি বোধ হয় তার অনেকটাই মেনে নিয়েছি। তাই না?
সুভাষচন্দ্ৰ চেয়ার ছেড়ে সোজা হলেন, হ্যাঁ, কিন্তু নিজের জন্যে কিছু রাখলে না ভাবতে আমাব মোটেই ভাল লাগছে না।
আপনি তো বললেনই, বাবার কাছ থেকে স্বভাবটা পেয়েছি। যা হোক, প্ৰতুল বন্দ্যোপাধ্যাযেব বিষয় সম্পত্তি আপনারা ভাগাভাগি করে নিন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এ ব্যাপারে আমার যা করণীয় বললে নিশ্চয়ই করব। কিন্তু এর পরে আমার একটা অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে।
ভদ্রলোক বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। নিঃসঙ্কোচে বল মা।
আমি আপনাদের কথা রেখেছি। যা চেয়েছেন মেনে নিয়েছি। কিন্তু তার বদলে আমি আপনাদের কাছে একটা কথা চাইছি।
বল।
আপনারা আর আমায় বিরক্ত করবেন না। এত বছর যখন আমাকে না দেখে আপনার চলে গিয়েছিল তখন বাকি জীবন স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারবেন। আপনার বাড়িতে যাওয়ার কোন আগ্রহ আমার নেই। আমি তো মামার বাড়িতেও যাইনি। আজ যে প্রয়োজনে আপনা্রা আমার কাছে এসেছিলেন আমি সেটা মিটিয়ে দিয়েছি। এবার আমাকে আমার মত থাকতে দিন। মামা, শুধু আপনি কাগজপত্র তৈরী করে আমার কাছে আসুন আমি সই করে দেব। দীপা কথা শেষ করেই উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল। দুই প্রৌঢ় বিস্ময়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে যে পারছেন না। তাও দেখার প্রয়োজন সে অনুভব করল না। তার কেবলই মনে হচ্ছে সে মুক্ত, একদম মুক্ত। নিজের বিছানায গিয়ে উপুড় হতেই তার বুক খালি করে বাতাস বেরিয়ে এল।
বিষয় সম্পত্তি মানুষকে নির্লজ্জ। করে। বিশেষ করে আর্থিক দুরবস্থায় পড়লে এবং সামনে কোন নির্দিষ্ট উপায় না থাকলে সে অসহায় হয়ে পড়ে। তরুণী বয়সে যা সহনীয় হয় যৌবন পেরিয়ে তা হয়ে দাঁড়ায় পীড়াদায়ক। তখন ড়ুবন্ত মানুষের পায়ের মত মানুষের মন কিলবিল করতে থাকে একটু শক্ত জমির জন্যে। ন্যায় নীতি স্নেহ ভালবাসা ইত্যাদির ওপর নিজেকে স্তোক দেওয়া পোশাক পরিয়ে দিতে সে মোটেই দেবি করে না। সুভাষচন্দ্ৰের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু তিনি কখনই সেই অর্থে ডাকাবুকো ছিলেন না। উৎসাহ পেতে শুরু কবায তিনি হয়ে উঠলেন বেপরোয়া। মুখে ভদ্রতার বুলি রেখে দীপাকে দিয়ে সেই-সব কাগজে সই করিয়ে নিয়ে গেলেন যার জোরে তিনি জলপাইগুড়িতে গিয়ে লাঠি ঘোরাতে পারবেন। যা ছিল চার বছর আগে দশ বারো লাখ তা নিশ্চয়ই এতদিনে বেড়ে গিয়েছে অনেক এমন ভাবনায় তিনি বুদ হয়ে রইলেন। অথচ মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না। ভঙ্গীটা ছিল যা করছেন তা পাঁচজনের উপকারের জন্যেই।
জন্মদাতা আর আসেননি। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে! এসে বলেছেন, কি কথা হয়েছে গো তোমাদের মধ্যে জানি না। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার পর থেকেই ওঁর কেবলই দীর্ঘশ্বাস বেরুচ্ছে, খেতে বললে খাচ্ছেন না, রাত্রে ঘুম নেই। মাঝরাত্রে উঠে দেখি জানলা দিয়ে আকাশ দেখছেন।
ওঁকে ডাক্তার দেখিয়েছেন?
ডাক্তার? ডাক্তার কি করবে? তুমি ওঁকে এখানে আসতে নিষেধ করেছ, আমাদের বাড়িতে যাবে না বলেছ। তাই বুকে দুঃখ বেজেছে। আমি কিন্তু তোমাকে জোর করব না। মহিলা হাসলেন, তবে আমি যদি মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে দেখা করি তাহলে কি রাগ করবে? এই হাতিবাগানের দিকে মাঝেমাঝেই সিনেমা দেখতে আসি তো।
দরকার থাকলে আসবেন।
এবার ওঁরা বেশী সময় নেননি। কিন্তু দীপা বুঝে গিয়েছিল দানপত্র। সই না করা অবধি একটা না একটা অজুহাত দেখিয়ে ওরা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে যাবে। কিছু করার নেই। কিন্তু দীপা ঠিক করল নিজের জায়গা থেকে তার সরে আসার কোন কারণ নেই। যে যার ইচ্ছে করে যাক।
একমাত্র পড়াশুনা ছাড়া যার অন্যকিছু করার ছিল না। তাকে আজকাল দুটো চিন্তা নিয়ত খুঁচিয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে অজান্তেই অসীমের মুখ কারণে অকারণে ভেসে উঠছে। সামনে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে নাকি শুধু ভাল অথবা কেবলই মন্দের স্থান নেই। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এমনটা হচ্ছে কেন? চারপাশের মানুষগুলোর হিসেব করল সে। অমরনাথ এবং মাস্টারমশাই ছাড়া প্ৰত্যেকেই যে ব্যবহার করেছেন তা ভাল ব্যবহার বলা যায় কি? অঞ্জলি এমন পাল্টে গেল যে মনেই হয় না। এত বছর সে তাকে মা বলে ডেকে এসেছে। মনেই হয় না। ওই মহিলা তাকে পড়াশুনা করানোর জন্যে অনেক ত্যাগ করেছে। তার পরীক্ষার সময় জলপাইগুড়িতে গিয়ে থেকেছে। কিন্তু যেই স্বার্থে সংঘাত লাগল। তখন সম্পর্কটা মুচড়ে গেল এক পলকেই। প্রতুলবাবু, তাঁর স্ত্রী, আনা, হরদেব থেকে আরম্ভ করে সুভাষচন্দ্র অথবা জন্মদাতার চেহারা নিয়ে যিনি এলেন প্ৰত্যেকেই নিজের আখেব গোছাতে আগ্ৰহী। এতগুলো মুখ অথচ মুখোস এক। একটি মানুষের জীবনে শুধুই স্বাথাম্বেষীদের ভিড, নিঃস্বাৰ্থ বন্ধুর এত অভাব হবে? মাঝে মাঝে তার সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ে মনোরমার ওপর। এত সব কাণ্ড হয়ে গেল। অথচ তিনি কোন প্ৰতিবাদ করলেন না। একবারও দীপার পক্ষ নিয়ে অঞ্জলির মুখোমুখি হলেন না। এরা একটিই কারণ। মনোরমা অঞ্জলির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চান না। এই মুহূর্তে তাঁর নিজস্ব কোন জায়গা নেই, অঞ্জলির আশ্রয়েই তাঁকে থাকতে হবে। এটাও তো এক ধরনের স্বাৰ্থ। আর এই সব সময়েই মনে পড়ে অসীমের কথা। ওই একমাত্র মানুষ যে নিঃস্বার্থে তার সঙ্গে মিশেছিল। জলপাইগুড়িতে যাওয়ার সময় ওর সঙ্গ দেবার কোন কারণ ছিল না। ওর কাছে অকপটে সব কথা বলা যেত। ও বিশ্বাস করেনি। প্ৰথমে যে সে বিধবা, পরে বিশ্বাস হওয়ায় দূরে সরে গিয়েছে। এ কারণে ওকে দোষী ভাবতে ভাল লাগত একসময়। মানুষের মনে যদি ঔদার্য না থাকে তাহলে সে কিসের মানুষ? কিন্তু এখন মনে হয় তার নিজের তরফ থেকেও কিছু ত্রুটি ঘটেছিল। অসীমকে যদি বন্ধু বলে মনে হয়েই থাকে তাহলে এত বেশী সময় নিল কেন ওকে জানাতে নিজের কথা। সে জানে না হয়তো এটাই অসীমের মনে অভিমান তৈরী করেছে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় অসীম কি সত্যিই নিঃস্বাৰ্থ ছিল? ওর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ওর ইচ্ছেটা বুঝতে অসুবিধে ছিল না। অথাৎ সেখানেও তো বিশেষ চাওয়া কাজ করছিল। চাওয়া মানে স্বাৰ্থ মেটানো। তাহলে? আজ মনে হচ্ছে ভালবাসার মানে নানান ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি ছেলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কোন মেয়ে যদি প্রেমে নিমজিত হয় তাহলে লোকে তাকেই দায়ী করে। কিন্তু বেচারার তো কিছুই করার নেই। তার হৃদয়ে যে প্রেম ছিল এটাই হয় তো সে জানত না। ছেলেটি এসে সেখানে স্পর্শ করল বলে জেগে উঠল। এবং সেই ছেলেটি অবলীলায় তা নিয়ে চলে গেল। কেউ যদি কিছু নিয়ে যায় তাহলে আকৃতি ফুটে উঠবেই। আজ মনে হয় অসীম কি তার মন নিয়ে গিয়েছে। নইলে এত মনে পড়ায় কেন?
এসবের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় চিন্তাটাও মাথা তুলছে। বিলিব্যবস্থা মত যে টাকা সে নিয়ে এসেছিল তাতে কয়েকরছর টেনেন্টুনে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনোরমার চিঠি পাওয়ার পর সে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আজ না হলেও কাল তাকে আর্থিক সমস্যায় পড়তেই হবে। এর একমাত্র সমাধান কিছু রোজগার করা। কিন্তু কিভাবে সেটা করবে? কাজের জন্যে বেশী সময় কলেজ করার পর দিতে গেলে পড়াশুনা হবে না। সে একই সঙ্গে গ্রাজুয়েশন আর আই এ এসের কোর্স ফলো করছে। কোথাও কোথাও মিল থাকলেও তৈরী হতে হচ্ছে আলাদা ভাবে। রাধাকে সে সমস্যাটা খুলে বলল।
রাধার ইতিমধ্যে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। পূর্ববঙ্গের শব্দ সে সচেতনভাবে বর্জন করতে আরম্ভ করেছে কলেজে কথা বলার সময়। শুনে বলল, তুমি তো বিকেলবেলায় টিউশনি করতে পার। তোমাদের নর্থ ক্যালকাটায অনেক বাড়িতে মাস্টার হিসেরে ছেলেদের ঢুকতে দেয় না। মেয়ে মাস্টারনি পেলে সঙ্গে সঙ্গে পড়াতে ডাকবে।
কিন্তু আমি তো কখনও কাউকে পড়াইনি।
কোন প্ৰব্লেম হবে না! একটু চোখ বুলিয়ে নিলেই পড়াতে পারবে। রাধা আজকাল কিছু কিছু বাংলা শব্দের বদলে ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করছে। মায়া বলে এটা নাকি পূর্ববঙ্গেব মানুষদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এতে ওরা স্বচ্ছন্দ বোধ করে। দীপা জিজ্ঞাসা করল, মুশকিল হল আমি তো কাউকে চিনি না, আমাকে কে পড়াতে বলবে?
রাধা হাসল, তাবও একটা উপায় আছে। চল, এখনই সেটা করে ফেলি।
দীপা দেখল বাধা তাক লম্বা খাতার মাঝখানের পাতা পিন থেকে সাবধানে খুলে বের করে নিল। তারপরে কলম দিয়ে মোটা করে লিখতে লাগল, গাহশিক্ষিকা। উত্তব কলকাতায় মেধাবী এবং মাঝারি মানের ছাত্রীদের সপ্তাহে তিনদিন যতু লইয়া পড়াইব। ছাত্রীব পিতা বা মাতা যোগাযোগ করুন। শ্ৰীমতী দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, ডানডাস হোস্টেল, স্কটিশচার্চ কলেজ। বিকাল চারটে হইতে পাঁচটা।
এটা কি হবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল দীপা।
আঠা যোগাড় করতে হবে। চল, অফিসে পেয়ে যাব। রাধার সঙ্গে কলেজের অফিসকমে এসে কিছু গদের আঠা যোগাড় হয়ে গেল। দীপা তখনও বুঝতে পারছিল না। রাধার মতলব। এবার রাধা জিজ্ঞাসা করল, বেথুনে তো স্কুলও আছে, না?
হ্যাঁ। কলেজ। আর স্কুল একসঙ্গে।
চল। বেথুনে গিয়ে গেটের ওপর এই কাগজটাকে আটকে দিই। ছুটির সময় গার্জেনরা যখন মেয়েদের নিতে আসবে তখন দেখতে পারে। নিশ্চয়ই এতে কাজ হবে। দীপা উৎসাহী হল রাধার কথা শুনে। এভাবে বিজ্ঞাপন করা যায় তা তার জানা ছিল না। কিন্তু তার পরেই এক ধরনের সংকোচ হল। পাঁচজনে তার নাম জানবে, সে কাজ চাইছে টাকা রোজগারের জন্য এটা চাউব হয়ে যাবে। ব্যাপারটা শুনে রাধা বলল, তাতে কি হয়েছে? তোমার যখন অভাব হবে তখন তো কেউ এক পয়সা সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। যদি কেউ কিছু বলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বের করে দেবে। প্ৰথমে যখন এই কলেজে পড়তে এসেছিলাম তখন কত মেয়ে আমাকে বাঙালি বিফুজি বলে খোঁটা দিত। আমি যদি কেয়ার করতাম তাহলে আর আমার পড়াই হত না। কই, এখন তো কেউ আর আগের মত বলে না।
দীপার মনে হল রাধা ঠিক কথাই বলছে। সে তো অন্যায় পথে টাকা রোজগার করতে যাচ্ছে না। টাকার প্রয়োজন তার হবেই। কিন্তু গেটের ওপর কাগজটা সেঁটে দিলে তো অনেক আজেবাজে ছেলে দেখে এসে তাকে বিরক্ত করতে পারে। দীপা রাধাকে এটা বলতে সে মাথা নাড়ল, তা হতে পারে। তুমি হোস্টেলের দারোয়ানকে বলবে কোন অল্প বয়সী। ছেলে যদি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তবে তাকে ঢুকতে না দিতে।
কিন্তু গেটের বদলে একটা ভাল জায়গা পাওয়া গেল। গেট পেরিয়ে বা দিকে বাড়িটার পাশে একটা দেওয়াল পেয়ে গেল। সেখানে ইতিমধ্যেই অনেক বিজ্ঞপ্তি টাঙানো আছে। কারও কলুম হারিয়েছে, কেউ বই খুঁজে পাচ্ছে না। আবার কোন মেয়ে একটা পার্স খুঁজে পেয়ে অফিসে জমা দিয়ে গিয়েছে। রাধা তাদেরই একপাশে এই বিজ্ঞপ্তিটা সেঁটে দিয়ে বলল, এখানে সবার নজরে পড়বে, কি বল? সাতদিন অপেক্ষা কর, তাতেও যদি কোন কাজ না হয় তাহলে আর একটা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া যাবে। তুমি খোঁজ নিয়ে রেখ এদিকে আর কোন ভাল স্কুল আছে।
বেশ উত্তেজনা নিয়ে ফিরে এসেছিল দীপা। রাধাকে অনুরোধ করেছিল প্রথমদিন চারটে থেকে পাঁচটা ওর সঙ্গে হোস্টেলে থাকতে। দারোয়ানকে বলে রেখেছিল। কেউ যদি ওই সময়ের মধ্যে তার খোঁজ করে তাহলে গেস্টরুমে পাঠিয়ে দিতে।
যেটা নিয়ে সমস্যা হল সপ্তাহে তিনদিন পড়ানোর জন্যে দীপা কত টাকা চাইতে পারে। রাধা বলল, আমি কলোনি এলাকার মেয়েদের পড়াই। দশ টাকা দিতে তাদের বাবার খুব অসুবিধে হয়। বেথুনে যেসব বাবা মেয়েকে পড়াচ্ছে তাদের ক্ষমতা নিশ্চয়ই ভাল।
কিন্তু যখন জিজ্ঞাসা করবে। কত দিতে হবে তখন কি জবাব দেব?
রাধা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, পঞ্চাশ টাকা বলে।
দূর! হেসে ফেলল দীপা, পঞ্চাশ টাকা কি মুখের কথা? আমাকে অত দেবে কেন? তার জন্যে স্কুলের মাস্টার কলেজের প্রফেসার আছে।
রাধা বোঝালো, ঠিকই। কিন্তু তারা পুরুষ। তাদের তো অন্দরমহলে ঢোকাবে না। ঘটিরা। এই জন্যেই তোমাকে দেবে।
কিন্তু প্ৰথম দিন কেউ এল না খোঁজ করতে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলে রাধা চলে গেল। দুজনেরই মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়া যে এমন হবে তা দুজনেই ভাবতে পারেনি। পরদিন কলেজে রাধা বলল, বেথুনের মেয়েদের গার্জেনরা বোধহয় খুব কৃপণ, পড়াশুনার জন্যে বাড়তি খরচ করতে চায় না। আজ আমার টিউশুনি আছে তাই পারব না, কাল অন্য স্কুলে যেতে হবে।
কিন্তু পরদিন দীপার মাথা খারাপ হবার উপক্রম এল। প্ৰায় একই সঙ্গে চার পাঁচজন চলে এলেন। প্রত্যেকেই দীপার ঠিকুজি জানতে চান। তাঁদের মেয়েরা কেউ ওয়ান টু বা ফাইভে পড়ে। বাড়িতে পুরুষ শিক্ষক রাখতে অসুবিধে আছে। কিন্তু হোস্টেলের মেয়ে বলে মহিলারা দ্বিধা করছেন। তাই পুরো বৃত্তান্ত জানতে চাইছেন তাঁরা। পরপর তিনজনকে খুব বিরক্ত হয়েই দীপা জানিয়ে দিল, হোস্টেলের মেয়ে সম্পর্কে এই ধরনের মানসিকতা থাকলে তার পক্ষে পড়ানো সম্ভব নয়। চতুৰ্থজনকে জিজ্ঞাসা করল, আমার সম্পর্কে কি জানতে চান?
আপনার বাড়ি কোথায়, কে কে আছেন, তাঁরা কি করেন?
এগুলোর সঙ্গে পড়ানর কি সম্পর্ক? তাঁরা তো পড়াতে আসবেন না।
না, না। আসলে অজ্ঞাতকুলশীল কাউকে অন্দরমহলে—।
আমি তো বানিয়ে বলতে পারি।
ভদ্রলোক এমন আশা করেননি। পঞ্চমজনের ক্ষেত্রে সমস্যা কম হল। তিনি শুধু দীপার বাড়ি কোথায় জানতে চাইলেন। বললেন, আমরা খুব রক্ষণশীল পরবারের মানুষ। মেয়েরা এর আগে পড়াশুনা করেনি। আপনি কত নেবেন?
দীপার বিরক্তি তখন আকাশছোঁয়া। বলল, পঞ্চাশ।
যেন ভূত দেখলেন ভদ্রলোক। তারপরে বললেন, ঠিক আছে। পরে খবর দেব।
ঠিক পাঁচটার সময় এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধা, এলেন গায়ে চাদর জড়িয়ে। এই প্রথম কোন মহিলাকে আসতে দেখে দীপা আরও কঠিন অভিজ্ঞতার জন্যে তৈরী হল। বৃদ্ধ বেশ সংকোচ নিয়ে বললেন, আমার নাতনি ক্লাশ ফোরে পড়ে। তাকে কি তুমি পড়াবে?
পড়াতে চাই বলেই তো বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।
ও। কিন্তু আমার একটা সমস্যা আছে।
বুঝতে পেরেছি। আপনি আমার ঠিকুজি চাইবেন?
অ্যাঁ? না না। সেসব কেন জানতে চাইব। তুমি যখন কলেজের হোস্টেলে থাকো তখন তো পডোবাব জন্যে যোগ্যতা আছেই।
এবার অবাক হল দীপা, তাহলে সমস্যাটা কি? দ্যাখো, আমার বা আমার মেয়ের পেটে বিদ্যে নেই। তবে পড়তে পারি চিঠিপত্তর লিখতে পারি। কিন্তু নাতনিকে পড়াশুনা শেখাতে চাই।
খুব ভাল কথা।
তোমাকে কি করে বলি। আসলে আমার ইতিহাস ভদ্রলোকের মেয়ের নয়। আমি থাকি সোনাগাছিব মুখের বাড়িতে।
সোনাগাছি? সেটা কোথায়?
ও। তোমার বাড়ি নিশ্চয়ই অনেক দূরে?
হ্যাঁ। জলপাইগুড়িতে।
সোনাগাছি হল সেই জায়গা যেখানে ভদ্রমানুষেরা তাঁদের প্রবৃত্তি মেটাতে যান। আমার বয়স বুঝতেই পারছ। এক বাবু আমাকে যৌবনে বাড়িটা দিয়েছিলেন। আমার মেয়ে এই লাইনেই ছিল। বাচ্চা হবার সময় মারা যায়। ওই নাতনিকে আমিই বড় করছি। নিজে তো, ব্যবসা ছেড়েছি অনেককাল কিন্তু প্ৰাণ থাকতেও নাতনিকে আমি ব্যবসায় নামাবো না। তাই ওকে লেখাপড়া করাতে চাই।
দীপা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে ভেসে উঠল খান্না সিনেমার পাশে রঙ মেখে দাঁড়ানো মেয়েগুলোর মুখগুলো। অসীমের সঙ্গে সেদিন সে তর্ক করেছিল খুব। তাকে কথা না বলতে দেখে বৃদ্ধ বললেন, অনেকেই এসব শুনলে ঘেন্না করবে। নাতনিকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি মিথ্যে কথা বলে। বাবা মা মরে গেছে বলেছি। কেউ জানে না, জানলে স্কুল কি করবে। কে জানে। কিন্তু ওকে ভাল লেখাপড়া শেখাতে হলে বাড়িতে পড়ানো দরকার। কিন্তু ভাল মাস্টার হয়তে চাইলে পাওয়া যায়, মেয়ে মাস্টার কোথায় পাব? শুনলে কেউ যাবে না ওখানে।
মাস্টার রাখছেন না কেন?
প্ৰথম কথা পাড়াটা তো ভাল না। সেন্ট্রাল অ্যাভিন্নুর ওপর হলেও। তাছাড়া আমি চাই মেয়েটা একটি শিক্ষিতা মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকুক। তাতে পরিবেশ অন্যরকম হবে। আর ওর মনটাও ভাল থাকবে। বৃদ্ধা দীপার হাত জড়িয়ে ধরলেন, তোমার কখনও অসম্মান হবে না। তুমি কি রাজি হবে?
প্ৰথমে দীপা বুঝতে পারছিল না কি করবে। হঠাৎ তার মনে হল অনেক বছর আগে মালবাজারে তাকে জন্ম দিয়ে এক ভদ্রমহিলা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সেদিন যদি ওই ঘটনা না ঘটত তাহলে হয়তো ঈশ্বর তার কপালে অন্য কিছু লিখতে বাধ্য হতেন। সে নড়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ, আমি আপনার নাতনিকে পড়াব।