1 of 3

১.৩৯ কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে

কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেই পিকলু দেখলো হেদো পার্কের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই ভাই-বোন। পিকলু শুধু চমকে গেল না, অস্বস্তি বোধ করলো। তার এখন বন্ধুদের সঙ্গে বসন্ত কেবিনে গিয়ে আড্ডা মারার কথা। বসন্ত কেবিনের একেবারে কোণের দিকের একটা টেবিল তাদের জন্য নির্দিষ্ট, সেখানে তাদের সাহিত্য বাসর হয়।

বাড়ির জগৎ আর বাইরের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। কলেজে কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সংসর্গে থাকার সময় হঠাৎ বাড়ির কেউ এসে পড়লে কেমন যেন অবান্তর লাগে। প্রতাপ একদিন এই কলেজে ইংরিজির অধ্যাপক মহীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্লাস রুমের বাইরে, সেদিন বাবাকেও খুব সাধারণ মনে হচ্ছিল পিকলুর। আজও বাবুলু আর তুতুলকে দেখে প্রথমেই ভাবলো, এরা এখানে বেমানান। এরা কেন এসেছে? তার পরেই তার বুকটা কেঁপে উঠলো। বাড়িতে কারুর কোনো বিপদ ঘটেনি তো? ওরা তাকে খবর দেবার জন্য ছুটে এসেছে?

বাবলুর সদ্য গলা ভাঙতে শুরু করেছে। সে খসখসে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, দাদা!

পিকলু তার বন্ধুদের বললো, তোরা যা, আমি একটু পরে আসছি! সে প্রায় ছুটে এলো। রাস্তার অন্য দিকে।

না, বাড়িতে কারুর কোনো বিপদ ঘটেনি। দুই ভাইবোন এসেছে দাদাকে চমকে দিতে। বুদ্ধিটা অবশ্য তুতুলেরই। তার পরীক্ষা হয়ে গেছে, বাড়িতে একটাও বই নেই পড়ার মতন। কিছুতেই তার সময় কাটে না। বাবলুরও আজ স্কুল ছুটি। মমতা আর সুপ্রীতি ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখতে গেছেন, ছবি বিশ্বাসের কোনো ফিল্ম এলে সুপ্রীতির দেখা চাই-ই। তুতুলকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তুতুল রাজি হয়নি। ওঁরা রিকশা ছাড়া যাওয়া-আসা করেন না, ওঁদের সঙ্গে গেলে তুতুলকে মা কিংবা মামিমার কোলে বসতে হয়, সেটাই তার বিচ্ছিরি লাগে। ওরা সিনেমায় চলে যাবার পর বাবলুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তুতুল।

পিকলু জিজ্ঞেস করলো, তোরা কী করে জানলি, আমার কখন ছুটি হবে?

তুতুল উত্তর না দিয়ে হাসলো। বাবলু বললো, দিদিটা কিছু জানে না, আমরা এক ঘণ্টা ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।

পিকলু ভুরু কুঁচকে বললো, হঠাৎ তোদের এই উটকো বুদ্ধি চাপলো কেন? আমি তো এখন বাড়ি ফিরতে পারবো না। আমার কাজ আছে। চল, তোদের বাসে তুলে দিই!

তুতুল আবদারের সুরে বললো, না, আমরা এখন যাবো না!

বাবলু বললো, দাদা, তোমাদের কলেজের ভেতরে আমাদের নিয়ে চলো একটু! আমি দেখবো!

পিকলু বললো, বাচ্চাদের কলেজের ভেতরে যেতে দেয় না!

তুতুল বললো, আহা, বাচ্চা মানে কী? আমার রেজাল্ট বেরুলে আমিও তো এই কলেজে ভর্তি হবো!

বাবলু বললো, আমিও এখানে পড়বো! বাবলুর থুতনিটা ধরে নেড়ে দিয়ে পিকলু বললো, তোর যা পড়াশুনোর ছিরি, তোকে আর কলেজ পর্যন্ত পৌঁছুতে হবে না। দ্যাখ, স্কুলটাই টপকাতে পারিস কি না!

তারপর সে তুতুলকে বললো, তুই পাশ করলে তোকে ভর্তি করে দেবো বেথুন কলেজে।

তুতুল জোর দিয়ে বললো, না, আমি এখানে পড়বো!

পিকলু বললো, আমি আর স্কটিশে থাকছি না, থার্ড ইয়ারে প্রেসিডেন্সিতে চলে যাচ্ছি।

তুতুল বললো, আমিও বুঝি প্রেসিডেন্সিতে যেতে পারি না?

বাবলু জিজ্ঞেস করলো, আমাদের তুমি কলেজের ভেতরটা দেখাবে না?

তুতুল পরে এসেছে হলুদ রঙের শাড়ি। খোলা চুল সন্ধেবেলার জলপ্রপাতের মতন ছড়িয়ে আছে পিঠে। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের তুলনায় তাকে বড়ই দেখায়। বাবলু ক্লাস নাইনে পড়লেও তার চেহারাও তেমন ছোটখাটো নয়।

গেটের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে বাবলু জিজ্ঞেস করলো, দাদা, তোমাদের কলেজে সাহেব আছে?

এতক্ষণে পিকলুর মুখে হাসি ফুটলো। সে খপ করে ছোট ভাইয়ের হাত চেপে ধরে বললো, হ্যাঁ আছে, আমাদের প্রিন্সিপালই তো সাহেব। চল, তোকে নিয়ে যাচ্ছি, তোকে ইংরিজিতে কথা বলতে হবে!

বাবলুর মুখ শুকিয়ে গেছে। সে বললো, থাক, আমি কলেজ দেখবো না।

পিকলু বললো, কেন? এই যে বললি, চল, আগে তো প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছ থেকে পারমিশান নিতে হবে!

তুতুল একা একাই এগিয়ে গেছে অনেকটা। স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আর স্কুলের বালিকা নেই। তার চলায় একটা ছন্দ এসেছে। পিকলু ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো কমনরুম, লাইব্রেরি, কেমিস্ট্রি লৈবরেটরি। বাবলু চুপ হয়ে গেছে। কেন যে তার এত সাহেব ভীতি, তা বোঝা যায় না। কটা সাহেবই বা সে দেখেছে? বাবার কাছে পরাধীন আমলের গল্প শুনেছে কিছু কিছু।

কলেজের বাড়িটা কত বড়, কত ঘর, তবু এর মাঝখান দিয়ে সচ্ছন্দ, সাবলীল ভাবে ঘুরছে পিকলু। যেন এটা তার নিজের জায়গা। এটাই বেশি আশ্চর্য করলো বাবলুকে। নিজেদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো বাড়িতে গেলে সবাই একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু কলেজটা আপন। করে নেওয়া যায়? বাইরের এই বড় জগটা একবার হাতছানি দিল বাবলুকে। কিন্তু মুশকিল এই, এখানে আসতে গেলে বড় বেশি বই পড়তে হয়। সেটাই যে তার ভাল লাগে না।

কলেজ সফর সাঙ্গ হবার পর বাইরে এসে তুতুল বললো, তুমি বলেছিলে হেদোতে ভালো ঘুগনি পাওয়া যায়? আমাদের খাওয়াও!

পিকলু বললো, আমার বন্ধুরা আমার জন্যে ওয়েট করে আছে, জরুরী কথা আছে ওদের সঙ্গে!

বসন্ত কেবিনে? তাহলে সেখানেই আমরা যাই?

বন্ধুদের কাছে ভাই-বোনদের নিয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু একা তুতুল থাকলে তবু কথা ছিল, বাবলুকে তত নেওয়া চলেই না। অগত্যা পিকলু ওদের নিয়ে গেল ঘুগনি খাওয়াতে।

হেদোর জলে সাঁতার কাটছে অনেকে। একদিকে মেয়েদের সাঁতারের কমপিটিশান হচ্ছে, সেখানে প্রচুর দর্শকের ভিড়। ওরাও দাঁড়িয়ে দেখলো খানিকক্ষণ। তুতুল আর বাবলু সাঁতার জানে না। পিকলু ছেলেবেলায় গ্রামে গিয়ে একটু একটু সাঁতার শিখেছিল, তারপর অনেক বছর প্র্যাকটিস নেই। মা আর পিসিমা মাঝে মাঝে গঙ্গা স্নান করতে যান, পিকলুকে যেতে হয় সঙ্গে। মেয়েদের ঘাট আর পুরুষদের ঘাট আলাদা, পিকলুর একা একা জলে নামতে ইচ্ছে করে না। প্রতাপ মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন, তাঁর ছেলেমেয়েরা কেউ সাঁতার শিখলো না।

বিকেলের রোদ পড়ে ঝকঝক করছে জল। কিশোরী মেয়েদের দাপাদাপিতে এই জলাশয়টি যেন খুশী হয়ে উঠেছে। প্রতিযোগীদের উৎসাহ দেবার জন্য চিৎকার করছে লোকেরা। দৃশ্যটি তুতুলের বড় সুন্দর লাগলো। বাড়ির বাইরের জীবনের এই প্রাণোচ্ছলতা তো সে বিশেষ দেখার। সুযোগ পায় না।

সে লাজুক ভাবে বললো, আমাদের বাড়ির কাছে যদি এরকম একটা পুকুর থাকতো, তাহলে আমিও সাঁতার শিখতাম।

পিকলু বললো, আমাদের দেশের বাড়িটা থাকলে আমরা সবাই এমনি এমনিই সাঁতার শিখে যেতাম। ওখানে পাঁচ বছরের বাচ্চাও সাঁতার জানে।

দেশের বাড়ির কথা তুতুলের ক্ষীণ মনে থাকলেও বাবলুর একটুও মনে নেই। সে বললো, আমি গঙ্গায় সাঁতার কাটবো!

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, পিকলুদা, মামাবাড়ির বড় উঠোনটায় একদিন একজন একটা মস্ত বড় সাপ গেঁথে রেখেছিল, তোমার মনে আছে?

পিকলু ভুরু কুঁচকে বললো, সাপ গেঁথে রেখেছিল? তার মানে?

তুতুল বললো, সেই যে একজন মাঠ থেকে একটা বড় সাপ ধরে এনেছিল দেখাবার জন্য? উঠোনের মাঝখানে সেটাকে বর্শা দিয়ে গেঁথে দেয়। সাপটা তখনও বেঁচে, ফোঁস ফোঁস করছিল অনকেক্ষণ!

পিকলু এবারে এসে বললো, তোর মনে আছে বুঝি? তুই দেখেছিলি?

তুতুল বললো, হ্যাঁ। স্পষ্ট মনে আছে!

তুই তা হলে জাতিস্মর!

কেন, তোমার মনে নেই? বাড়িতে গিয়ে মামিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখো!

পিকলু তবু হাসতে লাগলো। ঘটনাটা বাবলু-তুতুলের জন্মের আগে। পিকলুরই তখন মাত্র দেড় বছর বয়েস। প্রথম বাচ্চা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর মমতার সেই প্রথম সাপ দেখার অভিজ্ঞতা হল। মালখানগরের বাড়ির মাঝি মৈনুদ্দিন রান্নাঘরের পেছনের ছাইগাদায় একটা বিরাট শঙ্খচূড় সাপ দেখতে পেয়ে ল্যাজায় গেঁথে এনে ছিল শহুরে বউদিকে দেখাবার জন্য। সেই অবস্থাতেও সাপটা ফণা তুলে মাথা দোলাতে লাগলো। তা দেখে মায়া হয়েছিল মমতার, তিনি বলেছিলেন, আচ্ছা, ওকে ছেড়ে দাও। মমতার কাছেই সেই গল্প শুনেছে ছেলেমেয়েরা। অদূর অতীত কালের গল্প কয়েকবার শুনতে শুনতে মনের মধ্যে তলিয়ে যায়, তারপর একসময় মনে হয়, আমি নিজেই সেটা দেখেছি!

পিকলুর হাসি দেখে তুতুল রেগে গেল, সে হাঁটতে লাগলো উল্টো দিকে।

পিকলু কাছে এসে বললো, এবার তোরা যা! পাঁচটা প্রায় বাজে!

তুতুল দু দিকে মাথা নেড়ে দৃঢ়ভাবে বললো, না, আমি বাড়ি যাবো না!

বাবলু এতে মজা পাচ্ছে। সে প্রায় রোজই কোনো না কোনো কারণে বকুনি খায়। আজ তার শান্ত-শিষ্ট দিদিটি দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্য বকুনি খাবে। সে ষড়যন্ত্রের সুরে ফিসফিস করে বললো, দিদি, কানুকাকার বাড়ি যাবে?

তুতুল উৎসাহিত হয়ে বললো, হ্যাঁ, তাই চল, পিকলুদা, চলো!

মীজাপুরে কানু যে ঘরটি ভাড়া নিয়েছে সেই জায়গাটি ওদের বেশ পছন্দ হয়েছে। কানু নতুন সংসার পাতবার পর মমতা আর সুপ্রীতি দু’তিনদিন গিয়ে তার ঘর গুছিয়ে দিয়ে এসেছেন। কানু সঙ্গে কিছু নিয়ে যেতে চায়নি, মমতা জোর করে তাকে দিয়েছেন তোশক, বালিশ, কম্বল, সুজনি। এবং রান্নার জিনিসপত্র। কানু একটা খাট কিনে ফেলেছে। জানলায় নতুন পর্দা লাগিয়েছে। একটা চারতলা বাড়ির চিলে কোঠাটা ভাড়া নিয়েছে কানু, সামনে খোলা ছাদ। সেই ছাদ থেকে কলকাতার অনেকখানি দেখা যায়, হাওড়া ব্রীজ তো স্পষ্ট! সামনের রাস্তাটা দিয়ে অজস্র মানুষ যায় আর নানারকম শব্দ। একতলায় একটা দফতরিখানায় বই। বাঁধাই হয়, ডাঁই করা থাকে কত বই। মুটেরা ঝাঁকায় ভর্তি করে সেই বই নিয়ে যায়। আর এক। পাশে একটা বড় মুদির দোকান। প্রায়ই বিকেলের দিকে একটি বিরাট মোটা ষাঁড় এসে দাঁড়ায় সেই দোকানের সামনে। অতবড় হাতির মতন ষাঁড়টার কিন্তু একটা পা খোঁড়া, সে পা টেনে টেনে হাঁটে। ষাঁড়টি এসে দাঁড়ালেই মুদিখানার মালিক নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে কর্মচারিদের হুকুম করেন, অ্যাই, এক পো ছোলা দে! ষাঁড়টি নিচু হয়ে ছোলা খায় আর মুদিখানার মালিক তার গলকম্বলে হাত বুলিয়ে দেন।

এই সব দৃশ্যই বাবলু-তুতুলদের কাছে নতুন।

সেই ভবানীপুরে বিমান বিহারীদের বাড়িতে ন’মাসে ছ’মাসে একবার যাওয়া হয়, তাছাড়া ওদের আর প্রায় কোনো যাবার জায়গাই নেই। কানুর বাড়িটা একটা নতুন জায়গা হলো। কানু বাগবাজারের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে বলে ওদের একটুও দুঃখ হয়নি।

পিকলু বললো, কানুকাকার বাড়ি। আবার উল্টোদিকে বাসের ভাড়া লাগবে… আমার কাছে অত পয়সা নেই।।

বাবলু বললো, আমরা হেঁটে যাবো!

পিকলু আরও কিছু আপত্তি করতে যাচ্ছিল, তুতুল গাঢ় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পিকলু এইরকম দৃষ্টি দেখলে অস্বস্তি বোধ করে। এরকম দৃষ্টির মধ্যে তুতুলের যেন অনেক কিছু দাবি থাকে।

হেদোর একপাশ দিয়ে বেরিয়ে শর্টকাটে বিবেকানন্দ রোড। সেখান থেকে আমহাস্ট স্ট্রিট। দু’পাশে লোহা-লক্কড়ের দোকান। ফুটপাথের ওপর ছড়ানো রয়েছে লোহার শিক। বাবলু-পিকলু কোনোদিন এ পথে আসেনি।

পিকলু বললো, এই রাস্তাটা এখন এরকম দেখছিস, এককালে এখানে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর থাকতেন। ঘোড়ার গাড়ি চেপে শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন।

তুতুল বললো, তুমি তো ওঁদের দেখেছো, তাই না? এমন ভাবে বলছো!

পিকলু বললো, বই পড়লেই সব কিছু দেখা যায়। তুই এতটা হাঁটতে পারবি, তুতুল?

তুতুল বললো, যদি না পারি, তুমি আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়ে যাবে।

বাবলু বললো, দাদা, তুমি আমাদের ফুচকা খাওয়াও। ঐ দ্যাখো ফুচকাওয়ালা!

পিকলু পকেটে হাত দিল। মাসের শেষ, টিউশনি থেকে তার হাত খরচের টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ভাই-বোনকে নিয়ে সে বেড়াতে বেরিয়েছে, সামান্য ঘুগনি ছাড়া আর কিছু খাওয়াতে পারেনি। মানিকতলায় ভাল কচুড়ি-জিলিপি পাওয়া যায়, চোখের সামনে দিয়ে খালি ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে!

শুধু ফুচকা নয়, বাবলু দইবড়া, রসবড়াও খেল। তার যেন একেবারে রাক্ষুসে খিদে। পকেটের সব খুচরো পয়সা শেষ করে ফেললো পিকলু। ঝালে তার ঠোঁট জ্বলে যাচ্ছে। বাবলুটা ঠিক বাবার মতন ঝাল খেতে পারে, পিকলুর সহ্য হয় না।

তুতুল সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। সরল রাস্তাটির অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়, দুপাশের বাড়িগুলো যেন উদগ্রীব হয়ে আছে। কী যেন একটা টানছে তুতুলকে।

একটা গেটওয়ালা বড় বাড়ি দেখে পিকলু বললো, এইটা অনেকটা তোদের বরানগরের বাড়ির মতন না? তুতুল, ঐ বাড়িটার জন্য তোর মন কেমন করে?

তুতুল মুখে কোনো উত্তর দিল না, দু’দিকে মাথা নাড়লো। খুব ভালো লাগার অনুভূতি যখন হয়, তখন তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

সিটি কলেজ, সেন্ট পল্স কলেজ ছাড়িয়ে এসে পিকলু বললো, বাবা এইখানে কোনো একটা মেস বাড়িতে থাকতেন, কলেজে পড়ার সময়। তখন বাবার বয়েস আমারই মতন।

বাবলু জিজ্ঞেস করলো, তখন মা কোথায় থাকতো?

দূর বোকা! বাবার তখন বিয়ে হয়েছে নাকি? বললুম না, আমার মতন বয়েস!

মা তখন কোথাও ছিল না?

মা তখন মামা বাড়িতে তুতুলের চেয়েও একটা ছোট মেয়ে হয়ে ছিল! তখন তো আমাদের মা ছিল না। বাবা যদি অন্য একজনকে বিয়ে করতো, তা হলে মা আমাদের মা হতোই না!

বাবলু একটু চিন্তা করে বললো, আর মা যদি অন্য একজনকে বিয়ে করতো, তাহলে আমাদের অন্য বাবা হতো?

সশব্দে পিকলু আর তুতুল হেসে উঠলো একসঙ্গে। বিবাহ ও জন্মরহস্য এরা দু’জনে অনেকটা জেনে ফেলেছে, বাবলু এখনো জ্ঞানের সেই সীমায় পৌঁছোয় নি। এই বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার হলেই তার মাথাটা কেমন গুলিয়ে যায়। মেয়েরা বুকের জামা খুলে ফেললে তখন সেদিকে ছেলেদের তাকাতে নেই, তাকালে মেয়েরা বলে, অসভ্য! অলি একদিন বলেছিল তাকে। কী যে দোষ হয়েছিল, তা বাবলু বুঝতে পারেনি।

ওদের হাসি শুনে লজ্জিত হয়ে কথা ঘোরাবার জন্য বাবলু জিজ্ঞেস করলো, বাবা কোন্ বাড়িটাতে থাকতো?

পিকলু বললো, তা জানি না। বাবার কাছে শুনেছি, আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা মেস বাড়ি… এই তো এখানে দু’তিনটে রয়েছে, এর যে-কোনো একটা হতে পারে।

তারপর তুতুলের দিকে তাকিয়ে সে বললো, কী রকম অদ্ভুত ব্যাপার, তাইনা? এক সময়। বাবা আমার বয়েসী, এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন, তখন আমরা কোথাও ছিলুম না, আমরা নাও জন্মাতে পারতুম, এখন আমরা এই পথে হাঁটছি।

তুতুল তার বাঁ হাতটা একবার রাখলো নিজের বুকের মাঝখানে।

এইভাবে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতে লাগলো ওরা তিনজনে। তিনটি নবীন হৃদয়, সব কিছুতেই ওদের বিস্ময়, ওদের সামনে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ভরা জীবন।

কানুর বাড়িতে গিয়ে ওরা তাকে পেল না। ঘর তালাবন্ধ। সে একা মানুষ, চাবি সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। তাতে কিন্তু একটুও দুঃখিত হলো না ওরা। এই যে বেড়াতে বেড়াতে এতখানি আসা হলো, এটাই তো আনন্দের।

পিকলু বললো, ভালোই হলো, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, কানুকাকা থাকলে আরও দেরি হয়ে যেত। এতক্ষণে সিনেমা থেকে মা আর পিসিমনি বাড়ি ফিরে এসেছে!

ফেরার সময় ওরা বাস ধরার জন্য এলো কলেজ স্ট্রিটে। গোলদিঘির ভেতর দিয়ে এসে, সনেট হলের লম্বা লম্বা থামগুলো দেখিয়ে পিকলু বললো, এইটা ইউনিভার্সিটি, জানিস তো?

তুতুল আর পিকলু দু’জনেই মাথা নাড়লো, এই পথটা তাদের অচেনা নয়, বাবা-মাদের সঙ্গে এই পথ দিয়ে কয়েকবার যাতায়াত করেছে তারা। পিকলু হঠাৎ আঙুল তুলে বললো, একদিন আমি এই ইউনিভার্সিটিটা জয় করবো!

তুতুল বললো, তার মানে?

পিকলু বললো, আমি ঠিক করেছি, আমি অন্য কোনো চাকরি করবো না। আমি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার হবো। তারপর আমাদের দেশের এডুকেশন পলিসিটাই বদলে দেবো!

পরের রবিবার বিকেল বেলায় তুতুলকে নিয়ে পিকলু এলো তালতলায় মামার বাড়িতে। বাবলুকেও আনতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবলু ঘুড়ি ওড়ানো ছেড়ে আসতে চায়নি।

ত্রিদিবের নিজস্ব লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা প্রচুর। পিকলু প্রায়ই সেখানে পড়তে আসে। পিকলুর পড়ার আগ্রহ দেখে ত্রিদিব তাকে তাঁর লাইব্রেরি ব্যবহার করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন।

সুলেখা খুব খুশী হলেন দু’জনকে দেখে। তুতুলের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ইস, এই মেয়েটা দেখতে কী সুন্দর হয়েছে!

তুতুল খুব লজ্জা পেয়ে গেল। তার চোখে সুন্দরী শ্রেষ্ঠা বলতে সুলেখাই। অন্য যেকোনো নারীকে কখনো ভালো লাগলে তার সঙ্গে সে মনে মনে সুলেখার তুলনা করে। নিজেকে সে। একটুও সুন্দর মনে করে না।

সুলেখা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন্ কলেজে পড়বে, তুতুল? বেথুনে এসোনা। আমাদের আর্টস ডিপার্টমেন্ট খুব ভালো।

পিকলু হাসতে হাসতে বললো, আগে কী রকম রেজাল্ট করে দেখুন!

সুলেখা বললেন, তোর যে বড় গর্ব হয়েছে রে পিকলু!

বাড়িটি বেশ নিস্তব্ধ। ছুটির দিনের বিকেলে এ বাড়িতে এলে পিকলু বসবার ঘর ভর্তি দেখেছে, আজ একেবারে শুনশান। ত্রিদিবও বাড়িতে নেই।

পিকলু জিজ্ঞেস করলো, মামাবাবু কোথায়?

সুলেখা একটু রক্তিম ভাবে হাসলেন। আজ তাঁদের বিবাহবার্ষিকী, এই দিনটিতে তাঁরা কোনো অনুষ্ঠান করেন না, কলকাতার বাইরে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যান দু’জনে। কিন্তু এবারে তাদের বন্ধু শাজাহান সাহেব কী করে যেন তারিখটা জেনে ফেলেছেন, তাই চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন। ত্রিদিব একটা সেকেন্ড হ্যাঁন্ড গাড়ি কিনেছেন কিছুদিন আগে। গাড়িটার সেফে একটু গোলমাল করছে, ত্রিদিব সেটা ঠিক করিয়ে আনতে গেছেন। ত্রিদিব এসে পড়লেই সুলেখাকে বেরুতে হবে। এদিকে পিকলুর সঙ্গে তুতুল এসেছে, এই মেয়েটি এর আগে কোনোদিন এ বাড়িতে আসেনি। আজ ওদের ফেলে চলে যাওয়াটাই ভাল দেখায় না, অথচ যেতেই হবে, শাজাহান সাহেব অভিমানী ধরনের মানুষ।

তুতুলকে দেখে হঠাৎ হারীত মন্ডলের কথা মনে পড়লো সুলেখার।

তিনি অপ্রস্তুত অবস্থাটা লুকোতে পারলেন না, ওদের বসিয়ে রেখে জল খাবারের ব্যবস্থা। করতে উঠে গেলেন। ত্রিদিবের গাড়ির শব্দ শোনা গেল একটু বাদেই।

সুলেখা ফিরে এসে বললেন, পিকলু, তুই তো পড়াশুনো করতে এসেছিস। তুতুল কী। করবে? আমরা একটু বেরুবো, বুঝলি? তুই পড়াশুনো কর, আমরা তুতুলকে নিয়ে যাই, ঘণ্টা দু’একের মধ্যেই ফিরে আসবো!

তুতুল জলে-পড়া মানুষের মতন মুখ করে বললো, আমি কোথায় যাবো?

আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি। চলো না, তোমার ভাল লাগবে!

তুতুল অসহায় ভাবে পিকলুর দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যাবো না, আমি এখানেই থাকবো।

অচেনা বাড়িতে যেতে তুতুলের ভালো লাগবে না, এটা পিকলুও বোঝে। সে বললো, ও থাক এখানে। গল্পের বই-টই পড়বে। তোমাদের ফিরতে দেরি হবে?

ওরা দু’জনে চলে এলো লাইব্রেরি ঘরে। একটু পরে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন সুলেখা। আজ তিনি কিছুটা সাজগোজ করেছেন। একটা লাল সিল্কের শাড়ি, গলা থেকে ঝুলছে একটা লম্বা সোনার হার। দুটি তরুণ-তরুণীরই মনে হলো, সুলেখা মানবী নয়, দেবী। তাঁর মুখের মধুর হাসিটির কোনো তুলনা নেই।

একটা চাবি দেখিয়ে সুলেখা বললেন, এটা রেখে যাচ্ছি। সিঁড়ির গেটটা টানা রইলো। যদি আমাদের ফিরতে দেরি হয়, কিংবা তোরা ততক্ষণ না থাকিস, তাহলে ঐ গেটে তালা দিয়ে চাবিটা লেটার বক্সে ফেলে দিয়ে যাস, কেমন?

পিকলু বললো, আচ্ছা!

সুলেখা আবার লজ্জিত ভাবে বললেন, আমাদের চলে যেতে হচ্ছে, চা-টা যদি খেতে চাস, লজ্জা করবি না, নিচে ঠাকুর আছে, তাকে বলিস!

লাইব্রেরি ঘরটি প্রকাণ্ড। সমস্ত দেয়াল-জোড়া বইয়ের র‍্যাক। একটা ছোট মই আছে, তা দিয়ে ওপরের দিককার বই পড়তে হয়। একদিকের দেয়ালে একটি রবি বর্মার আঁকা রাবণ কর্তৃক জটায়ু বধের ছবি।

ঘরের মাঝখানে একটি বড় টেবিল ও গোটা চারেক চেয়ার। সাদা কাগজের প্যাড ও কয়েক রকমের কলম-পেন্সিল সাজানো আছে টেবিলের ওপর। পিকলু এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার দুটি ভল্যুম নামিয়ে এনে একটা চেয়ারে বসলো। সে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তার জ্ঞানের তৃষ্ণা অসীম। সে সব বিষয়ে জানতে চায়।

প্রথমেই বই না খুলে সে তুতুলের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে বললো, বাড়িতে কেউ নেই, এখন অনায়াসে সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। তুতুল, একটা জানলা খুলে দেতো!

সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সে বললো, কত বই দেখেছিস?

তুতুল কোনো কথা বললো না, শুধু মাথা নাড়লো।

আমি এখানে এলেই বিখ্যাত সব মনীষীদের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। বই মানে কি জানিস? বই হচ্ছে অভিজ্ঞতা। এতকাল ধরে মানুষের জ্ঞানের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা বইয়ের পাতায় লিখে রাখা হয়েছে আমাদের জন্য। ভবিষ্যতেও যারা আসবে, তাদের জন্য আমাদেরও কিছু রেখে যেতে হবে।

তুতুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিলুর দিকে।

তুই কী পড়বি, তুতুল? কিছু ইংরিজি উপন্যাস আছে, দ্যাখ যদি কোনোটা পছন্দ হয়। কিংবা, ঐ দিকটাতে আছে ছবির বই।

তুতুল জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

এই পাড়াটা এমনিতেই নির্জন, তাদের বাগবাজারের মতন গমগমে নয়। বাড়িটাতেও কোনো শব্দ নেই। সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। খানিক বাদে মুখ ফিরিয়ে তুতুল দেখলো পিকলু গভীর অধ্যয়নে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে নোট নিচ্ছে কাগজে। সে যেন এখন এই ঘরের মধ্যে উপস্থিত নেই।

গভীর কষ্টে বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে তুতুলের। দারুণ অপরাধবোধে সে যেন মরমে মরে যাচ্ছে। পিকলু তার দাদা, অথচ পিকলুর প্রতি তীব্র ভালোবাসা সে কিছুতেই সরিয়ে দিতে পারছে না। তার ইচ্ছে করছে, পিকলু বইপত্র রেখে শুধু তার সঙ্গে কথা বলুক, তার পিঠে হাত দিয়ে আদর করুক। এখানে এখন দেখতে আসার কেউ নেই, এখানে পিকলু তাকে একেবারে আপন করে নিতে পারতো!

এই চিন্তাটাও অন্যায় তা তুতুল জানে। পিকলু কত ভালো, তার এসব কথা মনে আসে না। মনটা ফেরাবার জন্য তুতুল একটা ছবির বই খুলে দেখতে লাগলো। তার আলো কম লাগছে। পিকলু এত কম আলোতে পড়ছে কী করে? ওখানে একটা টেল ল্যাম্প আছে সেটা জ্বালার কথাও মনে পড়েনি বাবুর।

টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে তুতুল জ্বেলে দিল আলোটা।

যেন ঘোর ভেঙে মুখ তুলে পিকলু বলল, অ্যাঁ? ও, থ্যাঙ্ক ইউ!

হঠাৎ ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো তুতুল।

পিকলু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তুতুলের হাত ধরে বললো, এই, তোর কী হলো? কাঁদছিস কেন? খারাপ লাগছে?

তুতুল মাথা নেড়ে বললো, না। তারপর পিকলুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, কিছু হয়নি। চোখ মুছে সে দূরে সরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *