১.৩৬
আলফু বলল, ভোলে কইরা ভাত দেও।
কুট্টির চোখ দুইটা ফুলা ফুলা, সেই চোখে আনমনা চাউনি। মুখ থমথম, দুঃখি। তবু আলফুর কথা শুনে অবাক হল। ক্যা?
কুট্টির মুখের দিকে তাকাল না আলফু। বলল, এমতেঐ। ভাত সালুন যা দেওনের একবারে ভোলের মইদ্যে দিয়া দেও আমি রান্দনঘরের ওহেনে বইয়া খামু।
আলফু ভাত খায় দোতলা ঘরের সামনের বারান্দায় বসে। রান্না হয়ে যাওয়ার পর ভাত তরকারি সব দোতালা ঘরের বারান্দায় নিয়ে আসে কুট্টি। এই ঘরের ভিতর দিককার বারান্দাটা খোলা না। খাটালের মতোই আরেকটা অংশ। বাইরের দিককার দরজা বন্ধ করে দিলে বারান্দা ঢুকে যায় ঘরের ভিতর। বারান্দার পশ্চিম কোণে ভাত সালুনের হাঁড়ি কড়াই, থাল বাসন এসব রাখার ব্যবস্থা। সেই জায়গায় বসে মাত্র ভাত বাড়বে কুট্টি তখনই এই কথা বলল আলফু। কথা প্রায় বলেই না সে। ভাত বাড়া হলে কুট্টি ডাকে। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে বসে। যত দ্রুত সম্ভব খেয়ে, কোনওদিকে না তাকিয়ে চলে যায়। সেই আলফু আজ কুট্টি না ডাকতেই ঘরে এসে ঢুকেছে। তারপর ওই কথা। অন্যসময় হলে যতটা অবাক হত কুট্টি, বড়বুজানের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে আছে বলে অত অবাক সে হয়নি। টিনের মাঝারি গামলায় ভাত বাড়তে বাড়তে আনমনা গলায় বলল, সালুন আইজ ভাল না। শোলটাকি কুটছিলাম, দুই টুকরা খাইয়া হালাইছে বিলাইতে। রানও মনে অয় ভাল অয় নাই। বড়বুজানরে লইয়া কাম পইড়া গেছিল।
কুট্টি যখন এই ধরনের কথা বলে আলফু চুপ করে থাকে। আজ চুপ করে রইল না। কথা বলল। ঘোপায় মাছ আছিল না। রানবা কই থিকা! তয় ম্যালা মাছ ধরছি আইজ। ষোল্লডা এত বড় বড় কই। রয়না খইলসা ফলি, শোল টাকি, গজার টাকি। তিন ঘোপা ভইরা হালাইছি। রাইত্রে ভাল কইরা রাইন্দো।
আলফুর কথা শুনে খারাপ হয়ে থাকা মন কেন যেন একটু হালকা হয়ে উঠল কুট্টির। যেন আরও কথা বললে আরও হালকা হবে মন। এক সময় পুরাপুরি ভাল হয়ে যাবে।
আলফুর চোখের দিকে তাকিয়ে কুট্টি বলল, রান্ধনঘরের সামনে বইয়া খাওনের কাম কী! এহেনেঐ বহেন।
আলফু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, না থাউক।
ক্যা? রোজ তো এহেনেঐ বহেন।
আইজ বমুনা।
একথায় কুট্টি একটু ঠাট্টা করল। ক্যা আমার বোগলে (সামনে) বইয়া খাইতে শরম করে! আমার চেহারা খারাপ হেইডা আমি জানি। এই চেহারার সামনে বইয়াঐ তো আগে খাইতেন। আইজ আথকা কী অইলো! চেহারা কি বেশি খারাপ অইয়া গেছে আমার!
কুট্টির কথা শুনে পলকের জন্য তার দিকে তাকাল আলফু। বলল, এই হগল কথা কইয়ো না। যে তোমার চেহারা খারাপ কয় মাইনষের চেহারা হে বোজে না।
এ কথায় কুট্টির ভিতরটা কেমন করে উঠল! আলফুর দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। আশ্চর্য এক লজ্জায় গা কাঁটা দিয়ে উঠল। সেই যে সেদিন চালতাতলায় আলফুকে দেখে যেমন হয়েছিল, আজ ঘাটে দাঁড়িয়ে যেমন হয়েছিল ঠিক তেমন এক অনুভূতি শরীরের খুব ভিতরে এখনও হল। কিছুতেই আলফুর দিকে আর তাকাতে পারল না সে। দ্রুত হাতে ভাত সালুন বেড়ে, থাল দিয়ে গামলার মুখ ঢেকে আলফুর হাতে দিল। এলুমিনিয়ামের জগের একজগ পানি দিল, একটা মগ দিল। সেসব নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল আলফু।
আলফু চলে যাওয়ার পর নিজের জন্য ভাত বাড়বে কুট্টি, বাড়তে ইচ্ছা করল না। ক্ষুধা যেন নাই তার, ক্ষুধা যেন মরে গেছে। কেন যে আলফুর মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছা করতাছে, কেন যে ইচ্ছা করতাছে রান্ধনঘরের সামনে বসে কেমন করে ভাত খাচ্ছে আলফু একটু দেখে আসে। ভাত কম হল কিনা তার, তরকারি কম হয় কিনা দেখে আসে।
কিছু না ভেবে বাইরে এল কুট্টি। এসেই থতমত খেল! খান্দনঘরের সামনে আলফু নাই। ভাত পানি নিয়া কোথায় গেল! কোথায় বসে খাচ্ছে। এই বাড়ির অন্যকোনও ঘরও তো খোলা নাই যে সেই ঘরে বসে খাবে। ব্যাপার কী!
আলফুকে খুঁজতে আমরুজতলায় এল কুট্টি। না সেখানে কেউ নাই। ভর দুপুরের নির্জনতায় খা খা করতাছে আমরুজতলা। একটা শালিক টুকটুক করে লাফাচ্ছে সাদা মাটিতে। শালিকটা চোখে পড়ল না কুট্টির। তার মনে তখন একটাই চিন্তা। ভাত পানি নিয়া কোথায় উধাও হয়ে গেল একজন মানুষ!
পশ্চিম দক্ষিণের ঘর দুইটার মাঝখানকার চিকন রাস্তায় কুট্টি তারপর চালতাতলায় এল। এসেই থতমত খেল। চালতাতলায় সামনা সামনি বসে ভাত খাচ্ছে আলফু আর মাকুন্দা কাশেম। আলফু খাচ্ছে গামলায় করে, থাল দিয়েছে কাশেমকে। কোনওদিকে না তাকিয়ে গপাগপ গপাগপ খেয়ে যাচ্ছে কাশেম।
কিন্তু কাশেমের মুখটা এমন কেন? এমন হয়েছে কী করে!
কুট্টি যখন এসব ভাবছে তখন হঠাৎ করেই পিছন ফিরে তাকাল আলফু, তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল। খাওয়া ভুলে কুট্টির দিকে তাকিয়ে রইল।
.
***
১.৩৮
শীতের বিকাল দ্রুত পড়ে যায়। বিকালেই হয়ে যায় সন্ধ্যা। আজকের সন্ধ্যা যেন আরও তাড়াতাড়ি হয়েছে। কখন বিকাল হল কখন ফুরাল কুট্টি তা টেরই পেল না। দুপুরবেলা চালতাতলায় বসে ওইভাবে দুইজন মানুষকে ভাত খেতে দেখার পর মনটা কেমন হয়ে আছে। নিজের ভাগের ভাত আরেকজন মানুষের লগে ভাগ করে খেতে হবে দেখে কুট্টির লগে খুব ছোট্ট একখান চালাকি করল আলফু। কেন করল! কুট্টিকে তো বললেই পারত, ভাত সালুন ইট্টু বেশি কইরা দিও। আমার লগে আরেকজন মানুষ খাইবো।
যে মানুষটার জন্য চালাকি আলফু করল, মাকুন্দা কাশেম, তাকে কুট্টি জন্মের পর থেকেই চিনে। একই গ্রামের মানুষ। তার কথা শুনলে কি ভাত একটু বেশি করে দিত না কুট্টি, সালন দিত না! না হয় নিজে একটু কম খেত। একবেলা একটু কম খেলে কী হয়। প্রথমে বাপের ঘরে, পরে স্বামীর ঘরে কতদিন আধাপেট খেয়ে থেকেছে! কতদিন না খেয়ে থেকেছে। দুইদিন তিনদিন কেটে গেছে অনাহারে, একমুঠ ভাত জোটে নাই। কথাটা আলফু কেন বলল না কুট্টিকে! দিনভর যে রকম পরিশ্রম করে, ওইরকম পরিশ্রমের পর আধাপেট খেয়ে দিনটা তার কাটছে কী করে! তার ওপর একলা একটা চাক তুলেছে পুকুর থেকে। চাক তোলা যে কী পরিশ্রমের কাজ, যে না তুলেছে সে তা কখনও বুঝবে না। মাকুন্দা কাশেমের কথা যদি কুট্টিকে আলফু বলত তাহলে নিজের ভাগ থেকেও কিছুটা ভাত তাকে দিতে পারত কুট্টি। একজনের ভাগেরটা দুইজনে না খেয়ে দুইজনের ভাগেরটা খেতে পারত তিনজনে। তাতে পেট প্রায় ভরে যেত। কষ্টটা আলফুকে একা করতে হত না।
তবে মনের দিক দিয়ে আলফু যে খুব ভাল, মানুষের জন্য যে গভীর মায়া মমতা আছে তার আজ ওই দৃশ্যটা দেখার পরই কুট্টি তা টের পেয়েছে। মাকুন্দা কাশেম মেদিনীমণ্ডলের লোক আর আলফু পদ্মার মাঝখানে জেগে ওঠা কোথাকার কোন মাতবরের চরের লোক। দুইজন দুইবাড়ির গোমস্তা কিন্তু একজনের জন্যে কী টান আরেকজনের। মানুষের জন্যে মানুষের এই টানের নাম কী! এই টান থাকলে কি একজন আরেকজনের লগে ভাতের মতো ভাগ করে নিতে পারে জীবনের সবকিছু! সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, হাসি কান্না!
এইসব ভেবে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা তরি সময়টা যেন চোখের পলকে কেটে গেছে কুট্টির। চালতাতলা থেকে ফিরে এসে নিজে ভাত নিয়ে বসেছে ঠিকই খেতে ইচ্ছা করে নাই। বারবার মনে হয়েছে আরও কিছুটা ভাত সালুন দিয়ে আসে দুইজনকে। কিন্তু দিতে সে যায়নি। ভাত খেতে খেতে আলফু যেভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল, চোখে যে ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধী দৃষ্টি ছিল সেই দৃষ্টির সামনে আর যেতে ইচ্ছা করে নাই। শরম পাওয়া মানুষকে যে আবার শরম দেয় সে কোনও মানুষ না।
তবে শরমটা আলফু একটু বেশিই পেয়েছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে থাল গেলাস গামলা সে আর কুট্টির কাচ্ছে ফিরায়া দিয়া যায় নাই, রান্ধনঘরের ছেমায় (সামনে) রেখে মাকুন্দা কাশেমকে নিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল।
একটা কথা কিছুতেই কুট্টির মাথায় ঢুকছে না, মাকুন্দা কাশেম হঠাৎ করে আলফুর লগে এসে খেতে বসল কেন! মুখ চোখই বা অমন দেখাচ্ছিল কেন তার! কী হয়েছে! মান্নান মাওলানা কি মারধোর করেছে, বাড়ি থেকে খেদাইয়া দিছে!
ইচ্ছা করলে দুপুরবেলাই এই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেত কুট্টি, যদি আরেকটুক্ষণ চালতাতলায় দাঁড়াত, যদি আলফু আর নয়তো মাকুন্দা কাশেমের লগে কথা বলত। কিন্তু আলফুর শরম পাওয়া দেখে ওখানে আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করে নাই। ঘরে ফিরে এসেছিল। তারপর থেকে সময় কেটেছে ঘোরের মধ্যে।
আসলে একই দিনে দুই দুইটা ঘটনা আজ ঘটে গেছে কুট্টির জীবনে। দুপুরের মুখে মুখে চাক তুলতে নামা আলফুকে দেখে দ্বিতীয়বারের মতো শরীরের খুব ভিতরে হয়েছে এক অনুভূতি আর চালতাতলায় বসে মাকুন্দা কাশেমকে নিয়ে ভাত খেতে দেখে হয়েছে। মনের মধ্যে এক অনুভূতি। একই দিনে শরীর আর মনের অনুভব একজন মানুষকে তো বদলে দিবেই! আর যে অনুভব মানুষটার জীবনে এই প্রথম। কিছুকাল হলেও স্বামীর ঘর সে করেছে, খানিকটা হলেও পুরুষদেহ বুঝেছে। মন বোঝেনি একটুও। না নিজের পুরুষটার। সংসারের অভাব অনটন, সতীন, সতীনের এন্দাগেন্দা পোলাপান কুট্টিকে জীবনের স্বাদ পেতে দেয়নি। স্বামীর দেহ মন কোনওটাই সে ঠিকঠাক আবিষ্কার করতে পারে নাই। আবিষ্কার করবার সুযোগই পায় নাই। আজ পারল। তবে যারটা পারল সে স্বামী না, সে এক পরপুরুষ। সেই মানুষ উদিসই পাইলো না কুট্টি তার মনের কতখানি দেখে ফেলছে, কতখানি বুঝে ফেলছে।
অন্যদিকে কুট্টি যেন আজ নিজেকেও আবিষ্কার করল। নিজের দেহ মন আবিষ্কার করল। প্রথমে মিলতে হবে নারী পুরুষের মন। একজনের মন হবে আরেকজনের। মনের টানে একাকার হবে মন, তারপর দেহ। এই না হলে মানুষের জীবন জীবন হয়ে ওঠে না। নারীজন্মের আড়ালে লুকিয়ে থাকে যে পুরুষ আজ যেন সেই পুরুষটাকেই পেয়ে গেছে কুট্টি। বিহ্বল তো সে হবেই, সময় তো সে বুঝতেই পারবে না!
ঘরগুলির কোণাকানছিতে কালো ধুমার মতো জমতে শুরু করেছে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গলা খুলছে রাতপোকারা। ফলে সন্ধ্যাবেলাই শুরু হয়ে গেছে রাতের শব্দ। গাছপালার মাথার ওপর যে স্বচ্ছ নীল আকাশখান, কখন সেই আকাশ চারদিকে ঢেলেছে সাদা মশারির মতো কুয়াশা! হিমশীতল উত্তরের হাওয়াখান বইছে। ঠিক এ সময় দোতালা ঘরের খাটাল থেকে বড়বুজান ডাকলেন, কুট্টি লো ও কুট্টি কই গেলি তুই!
কুট্টি দাঁড়িয়েছিল দক্ষিণের দরজায় ঢেলান দিয়ে। বড়বুজানের ডাকে নড়ে উঠল। ধীর পায়ে খাটালে, বড়বুজানের পালঙ্কের সামনে এসে দাঁড়াল। কী অইছে?
চাইরমিহি এমুন আন্দার আন্দার লাগে ক্যা?
হাজ হইয়া গেছে।
কুপি বাত্তি আঙ্গাচ নাই?
না।
ক্যা?
অহন আঙ্গামু।
তারপর অন্যরকম একটা প্রশ্ন করলেন বড়বুজান। আমার মুখের সামনে এমুন পিরপির করে কী লো?
কুট্টি আনমনা গলায় বলল, মোশা।
মোশা খালি মুখের সামনেই পিরপিরায়নি? শইল দেহে না!
কেমতে দেকব! শইল তো আপনের লেপের ভিতরে।
একথায় বড়বুজান একটু শরম পেলেন। হ। লেপের ভিতরে মোশা হানবো (ঢাকা) কেমতে!
একথার কোনও জবাব দিল না কুট্টি।
বড়বুজান অবাক গলায় বললেন, ও কুট্টি মোশা তো খালি পিরপিরায়ঐ না, কামড়ও তো দেয়, আমি তাইলে উদিস পাইনা ক্যা?
কুট্টি নির্বিকার গলায় বলল, আপনের চামড়ায় জান নাই।
বড়বুজান চমকালেন। কী?
হ। শইল্লের য়োদবোধ (বোধ অর্থে) গেছে গা আপনের।
কচ কী তুই! তাইলে তো এই শীতটা আমি টিকুম না।
কুট্টি কোনও কথা বলল না।
বড়বুজান কথা বললে তার প্রায় প্রতিটি কথার পিঠেই কথা বলে কুট্টি। কারণ এই বাড়িতে আর কথা বলবার মানুষ নাই। কথা না বলে, সারাদিন বোবা হয়ে কি মানুষ থাকতে পারে। ফলে কথা যেটুকু হয় কুট্টির সেটা এই বড়বুজানের লগেই।
কিন্তু এখন কুট্টি তেমন কথা বলছে না কেন? কী হয়েছে?
লেপের ভিতর থেকে কাউট্টার মতন বেরিয়ে থাকা মাথাটা কাত করে কুট্টির দিকে তাকালেন বড়বুজান। চোখে কিছুই প্রায় দেখেন না তবু কুট্টির মুখটা দেখবার চেষ্টা করলেন। মায়াবি গলায় বললেন, কী অইছে লো তর?
এই কথায় কুট্টির বুকটা মোচড় দিয়া উঠল। মনে হল বহুকালের জমে থাকা গভীর গোপন একটা কান্না যেন এখনই বুক ঠেলে বের হবে। বুক ফেটে যাবে তার, চোখ ফেটে যাবে।
এরকম কান্নার অনুভূতি আজকের আগে কখনও হয় নাই তার। জীবনে কত দুঃখ কষ্ট পেয়েছে, কথায় কথায় কত মেরেছে স্বামী, কত অপমান করেছে, স্বামী সংসার ছেড়ে আসার পর বাড়িতে আশ্রয় দেয় নাই মা বা, কুত্তা বিলাইয়ের মতন দূর দূর করে খেদাইয়া দিছে তবু আজকের মত এমন কান্না কখনও পায় নাই কুট্টির। এ যেন সম্পূর্ণ অচেনা এক কষ্টের কান্না। এ যেন জীবনের কোনও কিছুকে না পাওয়ার কান্না, এ যেন জীবনের সবকিছু পেয়ে যাওয়ার কান্না।
কান্নাটা কুট্টি কাঁদতে পারল না। সেই উথাল দিয়ে ওঠা গভীর কান্না বুকে চেপে জড়ান গলায় বলল, কী অইব আমার! কিচ্ছু অয় নাই।
তয় এমুন চুপ কইরা রইছস ক্যা?
কথা কইতে ইচ্ছা করে না।
ক্যা?
এমতেঐ।
না লো ছেমড়ি কিছু একখান অইছে তর। তুই এমুন নুলাম গলায় কথা কওনের মানুষ না। মনডা ভাল তর, তয় কথা কচ চডর চডর কইরা। আইজ পয়লা দেকতাছি অন্য সুর। কী অইছে?
কুট্টি এবার গলা চড়াল। কইলাম যে কিছু অয় নাই।
মা বাপের কথা মনে অইছে, জামাইর কথা মনে অইছে?
না।
এবার স্বভাবে ফিরল কুট্টি। আপনে অহন চুপ করেন তো। এত প্যাচাইল পাইরেন না। আমার কাম আছে।
বড়বুজান দমলেন না। কী কাম?
কুপি বাত্তি আঙ্গামু না? মুশরি (মশারি) টাঙ্গামু না?
কুপি বাত্তি আঙ্গা। মুশরি না টাঙ্গাইলেও অইবো।
ক্যা? মুশরি না টাঙ্গাইলে মোশায় খাইবো না আপনেরে?
খাইলেঐ কী! উদিস তো পাই না।
উদিস না পান দেইক্কা মোশার আতে আপনেরে আমি ছাইড়া দিমু!
কুট্টি আর কোনও কথা বলল না। ম্যাচ জ্বেলে একই লগে দুইটা পিতলের কুপি জ্বালল। একটা খাটালের গাছার ওপর রেখে অন্যটা হাতে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসল। বারান্দার এককোণে রাখা আছে দুইটা হারিকেন। কেরাসিনের বোতল থেকে টিনের ছোট্ট চোঙা দিয়ে কেরাসিন ভরল হারিকেনে। তারপর চিমনি মুছতে লাগল।
এই বাড়িতে একখান হারিকেন সারারাত জ্বলে। সেটা থাকে খাটালের কোণায়। রাতে কখন কী অসুবিধা হয় বড়বুজানের! অন্ধকারে কে তখন ম্যাচ কুপি খুঁজবে। তারচেয় হারিকেন একখান জ্বালিয়ে রাখা ভাল।
এটা অবশ্য রাজা মিয়ার মায়েরই আদেশ। তাঁর আদেশ ছাড়া এই বাড়ির কোনও কাজ হয় না। সংসারের সব কিছুর নিখুঁত হিসাব আছে তাঁর কাছে। মাসে কতখানি কেরাসিন লাগে তিনি তা জানেন। একখান হারিকেন সারারাত নিভু নিভু করে জ্বললে তেল কতটা পুড়বে, সা সা করে জ্বললে পুড়বে কতটা, তার তা মুখস্ত। সুতরাং এই সংসারের কোনও কিছু এদিক ওদিক করা অসম্ভব।
তবে সন্ধ্যার মুখে মুখে হারিকেন জ্বালাতে হয় দুইটা। একটা খাটালে রেখে অন্যটা দিয়ে সংসারের টুকটাক কাজ চালাতে হয়। হারিকেন জ্বালাবার পর কুপি দুইটা রাখতে হয় নিভিয়ে। আজও সেই কাজগুলি করল কুট্টি। করুল আনমনা ভঙ্গিতে। কোনওদিকে খেয়াল নাই, যেন মৃতের মতো কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মনের ভিতর কুট্টির তখন একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা। মানুষটার মুখ দেখবার জন্যে অপেক্ষা। কই গেছেগা হেয়? হাজ আইয়া গেছে অহনতরি বাইরে আহে না ক্যা?
হারিকেন হাতে নিয়া খাটালের দিকে যাবে কুট্টি, দোতালা ঘরের সিঁড়ির সামনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল আলফু।
চোখ তুলে আলফুর দিকে তাকাল কুট্টি। বুকের অনেক ভিতর থেকে গভীর আবেগের গলায় বলল, আপনে আমারে কইলেন না ক্যা?
পলকের জন্য আলফুও তাকাল কুট্টির দিকে। মাথা নিচু করে বলল, কইলে তুমি আবার কী মনে করো এইডা মনে কইরা কই নাই।
আমি কী মনে করুম! আমি কি সংসারের মালিক?
মালিক অইলে কইতাম।
আলফুর কথাটা বুঝতে পারল না কুট্টি। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী কইলেন বোজলাম না।
আলফু মৃদু হাসল। এই সংসারে তোমার আর আমার দুইজনের দশা একরকম। বাড়ির চাকরবাকর আমরা। একজন আরেকজনরে কেমতে কই আমার একজন মেজবান আছে! দোফরে তারে খাওয়ান লাগবো!
কুট্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আপনে চিন্তা করতাছেন এক আমি করছি আরেক।
কেমুন?
সংসারের মালিক না অইতে পারি, আপনের ভাত থিকা যেমতে আপনে কাশেমরে ভাত দিলেন হেই ভাতের লগে আমার ভাগ থিকাও ইট্টু দিতে পারতাম।
তাইলে তোমার খাওনে টান পড়তো!
অহন যে আপনেরডায় টান পড়লো! টান যহন পড়ছিল দুইজনেরডায় পড়তো।
কুট্টির কথা শুনে ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অনুভূতি হল আলফুর। কথা বলতে যেন ভুলে গেল সে। কুট্টির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কুট্টি বলল, কাশেমের অইছে কী? মুখটা জানি কেমুন দেকলাম!
কেমতে দেকলা! তুমি তো ওহেনে খাড়ওঐ নাই!
যেডু খাড়ইছি হেতে দেকছি।
হুজুরে বেদম মাইর মারছে কাইশ্যারে। মাইরা বাইত থিকা বাইর কইরা দিছে।
ক্যা, ক্যা মারছে?
ঘটনাটা বলল আলফু। শুনে কুট্টি আকাশ থেকে পড়ল। মরা মাইনষের জানাজা পড়তে আইছে, মাডি দিতে গেছে, হের লেইগা মাইনষে মাইনষেরে মারবো! তাও মাওলানা সাবের লাহান মাইনষে!
হ। ছনুবুড়িরে দুই চোক্কে দেখতে পারতো না হুজুরে। কইছিলো চুন্নিবুড়ির জানাজা অইবো না, গোড় অইবো না। এর লেইগাঐত্তো খাইগো বাড়ির হুজুরে আইয়া বেবাক কিছু করলো।
হারিকেন হাতে কুট্টি তখন চিন্তিত হয়ে আছে।
ঘরের ভিতর অনেক দূর পর্যন্ত হারিকেনের আলো, বাইরেও অনেক দূর পর্যন্ত। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে আলফু বলল, বড়বুজানে কিছু উদিস পাইছে?
আনমনা হয়েছিল বলে কথাটা বুঝতে পারলনা কুট্টি। বলল, কী উদিস পাইবো?
কাইশ্যা যে এই বাইত্তে দুইফরে ভাত খাইছে!
কেমতে উদিস পাইবো! হেয় কি বিচনা ছাইড়া উঠতে পারেনি! চোক্কে দেহেনি!
আমি কইতে চাইলাম তুমি বড়বুজানরে কিছু কও নাই তো!
আলফুর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল কুট্টি। যা দেইক্কা আমি নিজে শরম পাইয়া চাউলতাতলা থিকা আইয়া পড়লাম, খাড়ইলাম না, হেই কথা আমি বড়বুজানরে কমু!
একথার বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল আলফুর। আনন্দের একটা শব্দ করল সে। সিঁড়িতে বসল।
খাটাল থেকে ভেসে এল বড়বুজানের গলা, ও লো কুট্টি, কই গেলি?
আলফুর অদূরে দাঁড়ান কুট্টি মুখ ঘুরিয়ে খাটালের দিকে তাকাল, এইত্তো আমি।
কো?
বারিন্দায়। হারিকল আঙ্গাই।
অয় নাই অহনতরি?
অইছে।
তয়?
একথার জবাব দিল না কুট্টি।
বড়বুজান বললো, কার জানি হাকিহুকি (ফিসফাস) হুনি! কেডা আইছে? কার লগে কথা কচ?
কুড়ি বিরক্ত হল। নতুন মানুষ কে আইবো? কার লগে কথা কমু? আপনে জানেন আপনে আর আমি ছাড়া এই বাইত্তে আর কে থাকে!
হ জানি! আলফু।
তয়?
আলফুর লগে কথা কচ?
হ।
কী কথা?
কুট্টি রাগি গলায় বলল, হেইডা আপনেরে কওন লাগবোনি!
বড়বুজান কাঁচুমাচু গলায় বললেন, চেতচ ক্যা! চেতিচ না বইন। আলফু জুয়ান মরদো বেডা। তুই যুবতী মাইয়া। তগো মইদ্যে এত কথা কওন ভাল না।
একথা শুনে ভারি একটা লজ্জা পেল কুট্টি। আলফুর দিকে আর তাকাতে পারল না। লাজুক মুখে খাটালের দিকে পা বাড়াল।
আলফু বলল, বুজানের লগে কথা কইয়া আবার আহো। কথার কাম আছে।
.
১.৩৯
অন্ধকার চালতাতলায় বসে আছে কাশেম। বিকাল হতে না হতেই গভীর অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল জায়গাটা। যখন চকেমাঠে, গিরস্ত বাড়ির উঠান আর গাছপালার মাথায় দিনের শেষ আলো ফুরাতে বসেছে তার অনেক আগেই মাথার ওপরকার ডালপালা ছড়ান প্রাচীন চালতাগাছের চওড়া গাঢ় সবুজ পাতার আড়াল থেকে তলায় বসা কাশেমের চারপাশে নিঃশব্দে নামতে শুরু করেছিল অন্ধকার। প্রথমে অন্ধকারের রং ছিল সবুজ। চালতাপাতা থেকে ঠিকরে নামছিল বলে এমন রং। তারপর সময় যত গেল রং বদলাতে শুরু করল। এখন অন্ধকারের রং পাকা পুঁইগোটার মতো। একহাত দূরে চোখ চলে না, এমন।
সন্ধ্যা হতে না হতেই ঠাকুর বাড়ির পুব উত্তর কোণের জঙ্গল পুকুর অতিক্রম করে মিয়াবাড়িতে এসে উঠেছে একটি কোক্কা। এই পাখিটা দেখতে চিলের মতো, গাঢ় খয়েরি রঙের। ক ক করে ডাকে। দিনেরবেলা দেখা যায় না। কোথায় কোন জঙ্গলের আন্ধারে পলাইয়া থাকে কে জানে। বের হয় সন্ধ্যার মুখে মুখে। তারপর সারারাত চড়ে গিরস্ত বাড়ির ছাইছে (ঘরের পিছনে)। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই আবার গিয়ে ঢেকে জঙ্গলে। আন্ধারের জীব কোক্কা। এই পাখির মাংস খেলে লোকে নাকি পাগল হয়ে যায়। কাশেম শুনেছে। দেশগ্রামে কত গল্প গাথা থাকে, কত কুসংস্কার, কত প্রচলিত বিশ্বাস। কোক্কার মাংস খেয়ে পাগল হওয়াটা হয়তো তেমন কোনও বিশ্বাস। কেউ খেয়ে দেখেছে কি না কে জানে! তবে এত কাছ থেকে এই পাখিটা আজকের আগে কখনও দেখে নাই কাশেম। নির্ভয়ে তার চারপাশে চড়ে বেডালো। এদিক গেল ওদিক গেল। মাটি থেকে খুঁটে খেল আধার। বার কয়েক ক ক করে ডাকল। একবার তো কাশেমের একেবারে গা ঘেঁষেই হেঁটে গেল। এমন নির্ভয়ে গেল, মানুষ দেখে পোষা পাখি ছাড়া কোনও পাখির এমন করার কথা না।
কাশেম বুঝেছিল পাখিটা তাকে মানুষ মনে করে নাই। মনে করেছে ঝোপঝাড় গাছপালা। লোকালয়ে থাকা পাখিরা মানুষের স্বভাব জানে। শীতকালের সন্ধ্যায় গিরস্ত বাড়ির ছাইছে অন্ধকার চালতাতলায় কোনও মানুষের বসে থাকবার কথা না।
পাখিটা তারপর ছোট্ট এক উড়ালে চলে গিয়েছিল সমেদ খার বাড়ির দিকে। তখন বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল কাশেমের। পাখিটা তাকে মানুষ মনে করে নাই। আসলেই তো, সে কি মানুষ! মানুষ হলে মানুষের হাতে এমন মার খায়! মানুষ হলে মানুষের বাড়ির ছাইছে এমন করে বসে থাকে! একজনের ভাত ভাগ করে খায় দুইজনে! তাও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে! কখন ধরা পড়ে, কখন দেখে ফেলে বাড়ির লোক! কখন খাওয়ার খোটা দেয়, কখন করে অপমান!
এইসব ভেবে কাশেমের বুক ঠেলে উঠেছিল কষ্টের পর কান্না। কান্নাটা তখন কাঁদতে পারে নাই। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার পর চারপাশ থেকে ঝাক দিয়ে বেরিয়েছে অন্ধকার রঙের মশা। বিনবিন শব্দে হেঁকে ধরেছে কাশেমকে। হাত পা নেড়ে, চড় চাপড় মেরে মশা তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেছে সে। তবে এই কাজটাও কাশেমকে করতে হয়েছে শব্দ বাঁচিয়ে। মশা মারার শব্দে বাড়ির লোক যেন টের না পায়, এখনও চালতাতলায় বসে আছে মাকুন্দা কাশেম, এখনও এ বাড়ি ছেড়ে যায় নাই। যদিও দুপুরবেলা কুট্টি তাকে দেখে ফেলেছে। আলফু অভয় দিয়েছে, ভয়ের কিছু নাই, কুট্টিকে যা বুঝাবার বুঝাবে সে। তবু ভয়টা কাশেমের রয়ে গেছে।
কিন্তু মশা মারতে মারতে অন্য একটা কথা ভেবে আনমনা হয়ে গিয়েছিল কাশেম। সন্ধ্যার এই সময়টায় গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে সে। গরু আথালে বাইন্ধা জাবনা দেয়। গরুরা খাদ্য নিয়া ব্যস্ত হয় আর সে ব্যস্ত হয় ধুপ নিয়া। ধুপের ধুমায় পালিয়ে বাঁচে মশা। দুইদিন হল বাড়িতে নাই কাশেম, ধুপটা কি ঠিক মতন দিচ্ছে কেউ! মশায় খেয়ে শেষ করতাছে না তো গরুগুলিকে! ধুপ না দিলে সারারাত জেগে থাকতে হবে গরুগুলির। লেজ। নেড়ে, গায়ের চামড়া কাঁপিয়ে মশা তাড়াতে হবে। আহা অবলা জীব! মুখ ফুটে বলতে পারবে না কিচ্ছু, মনে মনে শুধু কাশেমকে খুঁজবে।
তারপর থেকে শুধুই গরুগুলির কথা ভেবেছে কাশেম। সকালবেলা কে তাদের মাঠে নেয়, দিনের শেষে কে ফিরিয়ে আনে ঘরে! কে দুধ দোয়ায় (দোয়), কে দেয় জাবনা! গরম ফ্যানে মুখ পুড়ে গেলে কে দেয় আদরের গাল! সকালবেলা মাঠে যাওয়ার সময় কি গরুগুলি কাশেমকে খোঁজে না! ফিরে এসে বাড়ির চারদিক তাকিয়ে খোঁজে না! কান খাড়া করে রাখে না কাশেমের সেই গানটি শোনার জন্য।
গুরু
উপায় বলো না
জনম দুখি কপাল পোড়া গুরু
আমি একজনা।
আসলেই জনম দুখি এক মানুষ কাশেম। দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ নাই। আছে কয়েকটা গরু, আছে এই গ্রাম। দুইদিন হল গরুদের ছেড়ে আছে সে। কোনদিন যেন গ্রাম ছেড়েও চলে যেতে হয়!
এসব ভেবে অন্ধকার চালতাতলায় বসে গভীর দুঃখ বেদনায় কাঁদতে লাগল কাশেম। চারপাশে মশা বিনবিন করে, উদাম শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে শুষে নেয় রক্ত, কাশেম টের পায় না।
.
১.৪০
আলফু বলল, এতক্ষুণ কী করলা?
বলল এমনভাবে যেন বিরাট এক অধিকার আছে তার কুট্টির ওপর। সেই অধিকারের জোরেই যেন বলল। অন্তত কুট্টি তাই বুঝল। বুঝে বুকের ভিতর দুপুরবেলার মতন অনুভূতিটা আবার হল তার। এক পলক আলফুর দিকে তাকিয়ে নিজের পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে বলল, মুশরি (মশারি) টানাইলাম।
হাজ অইতে না অইতেই মুশরি টাঙ্গান লাগে?
লাগে। বড়বুজান অচল মানুষ, তার মোশায় খুব কামড়ায়।
এই বাড়িতে মোশা ইট্টু বেশি।
হ জঙলা বাড়ি তো! চাইরমিহি পুকঐর। পুকঐ ভরা কচুরি। কচুরিবনে মোশা তো থাকবই।
একটু থেমে কুট্টি বলল, কী কইবেন কন?
কোন ফাঁকে কোচড় থেকে বিড়ি বের করে ধরিয়েছে আলফু। কুট্টির কথায় বিড়িতে টান দিল। কেমতে যে কমু হেইডাঐ চিন্তা করতাছি।
আমার কাছে কথা কইতে এত চিন্তা কী আপনের!
আমার লেইগা তোমার যদি কোনও অসুবিদা অয়?
কী অসুবিদা অইব?
এই বাড়ির মানুষরা তো ভাল না। ধরো কাম থিকা ছাড়াইয়া দিলো তোমারে!
কে ছাড়াইয়া দিবো! অহন তো মাজারো বুজানে নাই।
বড়বুজানে তো আছে! হারাদিন বিচনায় পইড়া থাকলে কী অইবো বেবাক মিহি খ্যাল রাখে।
আমি যদি কিছু করি হেয় খ্যাল রাইক্কা কী করবো। বোজবঐত্তো না কিছু।
বোজবো। দেকলা না কইলো আলফু জুয়ান মরদো বেডা, তার লগে এত কী কথা!
একথা শুনে কুট্টি খুব লজ্জা পেল। এক পলক আলফুর দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। ব্যাপারটা খেয়াল করল না আলফু। বলল, আমারে আইজ অন্যমানুষ মনে অইতাছে না তোমার?
কথাটা বুঝতে পারল না কুট্টি। বলল, ক্যা অন্যমানুষ মনে অইবো ক্যা?
এই যে এত কথা কইতাছি তোমার লগে!
হেতে কী অইছে?
এত কথা কওনের মানুষ তো আমি না! আমি কথা কই কম।
ক্যা কম কন ক্যা?
কথা কম কওনঐ ভাল।
আপনে যত কম কন অত কম কওন ভাল না। এই যে অহন যেমুন কথা কইতাছেন, ভাল লাগতাছে।
তাইলে অহন থিকা এমুন কথাঐ কমু তোমার লগে।
কইয়েন। বাইত্তে মানুষ অইলাম তিনজন। তার মইদ্যে একজন অচল, বুড়া। তার লগে কত প্যাচাইল পাড়ন যায়! আপনে ইট্টু কথাবার্তা কইলে ভাল্লাগে।
কথাটা বলেই আবার লজ্জা পেল কুট্টি।
আলফু তখন কেমন চোখ করে তাকিয়ে আছে কুট্টির দিকে। হাতে বিড়ি জ্বলছে সেদিকে যেন খেয়াল নাই তার। নিঃশব্দে খানিকটা সময় কাটল। তারপর বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিল আলফু। বলল, একখান কাম করতে পারবা?
কুট্টি চোখ তুলে আলফুর দিকে তাকাল। কী কাম?
উত্তর নাইলে পশ্চিম কোনও ভিটির ঘরের চাবি দিতে পারবা?
কুট্টি অবাক হল। চাবি দিয়া কী করবেন?
ঘর খুলুম। আইজ রাইতটা কাইশ্যা আমার লগে থাকবো।
থাউক। হের লেইগা ঘর খোলতে অইবো ক্যা?
কুট্টির গলা বোধহয় সামান্য উঁচু হয়ে গিয়েছিল। আলফু সাবধানী গলায় বলল, আস্তে কথা কও। বড়বুজানে হোনবো।
কুট্টি হেসে বলল, হোনবো না। ঘুমাইয়া গেছে।
হাজ অইয়া সারলো না, ঘুমাইয়া গেল?
মুশরি টাঙ্গানের পর বুজানে অনেকক্ষুণ ঘুমায়।
একথা শুনে আলফু একটু নড়েচেড়ে বসল। স্বস্তির হাঁপ ছাড়ল। তাইলে ঠিক আছে। বুজানের বিচনার নিচে হাত দিয়া চাবিডা লইয়াহো।
কুট্টি আবার সেই প্রশ্নটা করল। কাইশ্যা থাকবো দেইক্কা ঘর খোলতে অইবো ক্যা?
শীতের দিন না অইলে খোলন লাগতো না। দুইজনে মিল্লা রান্দনঘরে হুইয়া থাকতাম।
অহন আপনে যেহেনে হোন কাইশ্যারেও ওহেনে হোয়ান। আমি তো হুই তুমি যেই বারিন্দায় খাড়ইয়া রইছো এই বারিন্দায়। এহেনে দুইজন হোয়ন যায় না? যায়।
তয়?
দুইজন মানুষ একলগে হুইলে কত সুখ দুঃখের কথা কয়, বড়বুজানে আমগো কথার আওজ পাইলে ঝামেলা অইবো।
হোনবো কেমতে! বারিন্দা আর খাটালের মইদ্যের দুয়ার বন্ধ থাকবো না! দরকার অইলে আস্তে কথা কইবেন আপনেরা।
ধুর অত ইসাব কইরা কথা কওন যায়নি!
কুট্টি খানিক কী ভাবল তারপর বলল, চাবি আপনেরে আমি আইন্না দিতে পারি, বড়বুজানে উদিস পাইবো না, তয় আপনে অন্যঘরে থাকলে ডরে হারা রাইত ঘুমাইতে পারুম না আমি।
আলফু খুবই অবাক হল। ক্যা?
দেশ গেরামে আইজকাইল ডাকাতি অয়। ডাকাইতরা করে কী, বড় গিরস্ত বাড়িতে ঢুইক্কা ঢেকিঘর থিকা ঢেকি উড়াইয়া আইন্না ঢেকি দিয়া পাড়াইয়া দুয়ার ভাইঙ্গা ঘরে ঢোকে।
হেইডা আমি এই ঘরে থাকলেও ঢোকতে পারে?
তাও পুরুষপোলা ঘরে থাকলে সাহস থাকে।
আমি থাকি বারিন্দায়। মইদ্যের দুয়ার বন্দ। খাটালের পালঙ্কে থাকে বড়বুজানে, নিচে থাকো তুমি। এমতে থাকন আর অন্যঘরে থাকন একঐ কথা!
কুট্টি মাথা নিচু করে বলল, না এক কথা না।
তাইলে তুমি অহন কী করতে কও?
কাইশ্যারে লইয়া এই ঘরের বারিন্দায়ঐ থাকেন।
আইচ্ছা।
কাইশ্যা অহন কো?
চাউলতাতলায় বইয়া রইছে।
ডাইক্কা লইয়াহেন। বুজানে ঘুমাইছে এই ফাঁকে খাওন দাওন সাইরা হালান।
রাইত্রে আমি আইজ খামু না। খালি কাইশ্যারে খাওয়াও।
ক্যা?
এমতেঐ।
এমতেঐ না। আমি বুজছি। আপনে মনে করতাছেন একজন বাড়তি মানুষ খাইলে ভাতে টান পড়বো। পড়বো না। কাইশ্যার ভাত আমি রানছি।
কও কী?
হ। আমি বুজছিলাম কাইশ্যা আইজ রাইত্রে এই বাইত্তে থাকবো।
কেমতে বোজলা?
হেইডা আপনেরে কইতে পারুম না। যান কাইশ্যারে ডাইক্কা লইয়াহেন।
কয়েক পলক কুট্টির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আলফু। তারপর উঠল। পশ্চিম দক্ষিণের ভিটার ঘরের কোণায় এসে ডাকল, কাইশ্যা, ঐ কাইশ্যা, এইমিহি আয়।
দুইবার তিনবার ডাকল আলফু। কিন্তু চালতাতলা থেকে কেউ সাড়া দিল না।