ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে।
তখনই তা মোছে ঠোঁটেরই হাসির ঘায়ে ॥
এক চামচে দই, এক চামচে মধু, এই হল হরিদ্বারের সন্ন্যাসীর সারাদিনের আহার! কী করে শরীর থাকে! আমরা এত খেয়েও বলছি, খাওয়া ঠিক হচ্ছে না, শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। প্রোটিন চাই, ভিটামিন চাই। পিতৃদেবের প্রশ্নে মাতামহ মৃদু হাসলেন।
বুঝলে শঙ্কর, এই হল সাধনা। ক্ষয় নিবারণের জন্যেই আহার। যার ক্ষয় নেই তার আর আহারের কী প্রয়োজন বলো?
বড় হলঘরে কাকিমা ভেলভেটের আসন পেতে দিয়েছেন। চকচকে ঝকঝকে গেলাসে গেলাসে জল। পঙ্কজবাবু স্নান করে আরও যেন ঝকঝকে হয়েছেন। গুরুজি চলে যাওয়ায় মাতামহ একটু শোকার্ত। আবার কবে দেখা হবে, কে জানে। ছোড়ো এ সংসার। ঝুটি মায়া, ঝুটা কায়া। মাংসের গন্ধে বাড়ি মম করছে। কাকিমার রান্নার হাত সাংঘাতিক। কেবল একটাই যা দুঃখ, অতি বড় ঘরনি ঘর না পায়, অতি বড় যোগী দর্শন না পায়।
পিতা বললেন, বসার ঘরে এমন সুন্দর এক অতিপ্রাকৃত গন্ধ বেরুচ্ছে! জীবনে বহু সেন্ট নাড়াচাড়া করেছি, এমন গন্ধ কখনও নাকে আসেনি।
মাতামহ বললেন, কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে এমনই গন্ধ বেরোয়। মৃগের যেমন কস্তুরী, সাধকের তেমনি কুণ্ডলিনী।
পিতা বললেন, আমি আর মাংস খাব না। আজ থেকে মাংস খাওয়া ছাড়লুম।
পঙ্কজবাবু বললেন, সেকী! খাওয়ার সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই, হরি। ধর্ম হল মনের জিনিস। ঠাকুর বলেছেন মনে, বনে আর কোণে।
দেখ পঙ্কজ, জীবনে যত পাঁঠা আর মাছ খেয়েছি, সব যদি লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, সেই ফোর্ট পর্যন্ত চলে যাবে।
তুই দেখছি বার্নার্ড শ’র মতো কথা বলছিস। আর বাবা, বছর পাঁচেক অপেক্ষা কর, অটোমেটিক মাংস ছাড়তে হবে। দাঁতই বলবে, ছোড়ো মুসাফির, মায়া নগরকো। যদ্দিন আছ তদ্দিন খেয়ে নাও। আপনি কী বলেন?
প্রশ্নটা মাতামহকে।
মাতামহ কী এক ধরনের ভাবে ঝুঁদ হয়ে বসে আছেন। এত সুন্দর দেখাচ্ছে! সারা ঘরটাকেই বড় সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। সব অমাত্যদের মতো চেহারা। কাকিমা সবে একটি পাটভাঙা সাদা শাড়ি পরেছেন। কপালে সিঁদুরের টিপ আঁচলের আর হাতের ঘষায় এপাশ ওপাশ হয়ে, এই মায়ার সংসারকে যেন আরও মায়াময় করে তুলেছে। আজ থেকে আমি কাকিমাকে মনে মনে মা বলব। কাকিটা খুব আস্তে, মা-টা খুব জোরে। অপর্ণাও খুব খাটছে, নুন, লেবু, জল আসছে যাচ্ছে। শাড়ির শব্দ হচ্ছে। চুড়ি বেজে উঠছে। অবেলায় যে-হাট ভেঙেছিল, অবেলাতেই সে হাট যেন জমে উঠেছে। সবই নিখুঁত। কেবল মুকু যদি যোগ দিত। মেসোমশাই যদি সুস্থ থাকতেন।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুকু বললে, বাবা ভীষণ ঘামছেন।
পিতা লাফিয়ে উঠলেন, জ্বর ছাড়ছে। জয় রাম! চলো দেখি।
কাকিমা হাতায় করে গরম ভাত তুলছিলেন। পিতাকে উঠতে দেখে বললেন, আপনি বসুন, আমরা দেখছি। ভাতটা দিয়ে নিই।
না না, আগে দেখাই ভাল। ওনার জন্যে মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে আছে। যদি ছেড়ে গিয়ে থাকে, জয় রাম, জয় রাম!
পিতার কী সুন্দর ভক্তি এসে গেছে। অপর্ণার হাতে হাতা ধরিয়ে দিয়ে কাকিমা উঠে গেলেন। মেয়েটিও কম কাজের নয়! পঙ্কজবাবু বলতে লাগলেন, বুড়ি, গাদা গাদা দিসনি। বেলা হয়ে গেছে। কম কম দে।
মাতামহ বললেন, আমাকে মা যা দেবার তাই দিয়ো। খাওয়ার ব্যাপারে আমার বেলা-অবেলা নেই। পারলে একদিনেই দু’দিনেরটা মজুত করে নোব। কাল কী জুটবে কালই জানে।
অপর্ণা বললে, আপনি বাবার কথায় লজ্জা করে কম খাবেন কেন? বাবা তো পাশেই রয়েছেন, শেষে দু’জনে না কমপিটিশন লেগে যায়!
কাকিমা দরজার কাছে এসে বললেন, বটঠাকুর, একবার আসবেন?
পিতা উঠে গেলেন উদ্বিগ্ন মুখে। আমার পক্ষেও আর বসে থাকা সম্ভব হল না। মেসোমশাই মানে কনক। কনক সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। মেয়েটা গেল কোথায়? কনক সত্যিই কি আর পৃথিবীতে নেই? হঠাৎ একেবারে উবে না গিয়ে, সে তো স্পষ্ট বললেই পারত, না বাবা, প্রতাপকে আমি বিয়ে করব না। মেসোমশাই কি জোর করে, নিজের কথায় মেয়ের বিয়ে দিতে পারতেন! এর পেছনে গভীর কোনও রহস্য, গভীর কোনও পাপ আছে। আমি গোয়েন্দা হলে নিজেই লেগে পড়তুম।
মানুষ যে এমন করে ঘামতে পারে আমার দেখা ছিল না। জ্বর তো আমাদেরও হয়, ঘাম দিয়েই ছেড়ে যায়। এ যেন এক অদ্ভুত ব্যাপার! মেসোমশাইকে কে যেন বিছানায় ফেলে চান করিয়ে দিয়েছে। কাকিমা একটা পাখা নিয়ে মাথার কাছে দাঁড়িয়েছেন। মুকু একেবারেই ছেলেমানুষ। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
পিতা বললেন, এখন একেবারেই হাওয়া করা চলবে না। কপালে একবার হাত দিয়ে দেখো তো!
কাকিমা বললেন, বরফ।
পায়ের চেটো?
বরফ।
তোয়ালে আনো, তোয়ালে আনন। শিগগির একটা হ্যারিকেন জ্বালার ব্যবস্থা করো।
তোয়ালে এনে পিতার হাতে দিতেই কাকিমা বললেন, আমার হাতে দিন, আমি জানি, কী করতে হবে। আপনি চট করে যা হয় দুটি খেয়ে আসুন। ওঁরা সব বসে আছেন।
তুমি পারবে সব? গা মোছাতে হবে, পায়ে সেঁক দিতে হবে।
সব পারব। আমাতে, মুকুতে সব করতে পারব। অপর্ণাকে বলবেন, ও যেন পরিবেশন করে। আমি তো এদিকে আটকে গেলুম।
পিতা যেতে যেতে বললেন, সেই অতিপ্রাকৃত গন্ধে ঘর ভরে আছে। সেই স্বর্গীয় গন্ধ।
সত্যই তাই। সেই সন্ন্যাসী যে যে ঘরে ছিলেন, সেই সেই ঘরে, সেই সেই জিনিস যা তিনি স্পর্শ করেছিলেন, সবেতেই এমনি এক ঈশ্বরীয় গন্ধ। কেমন করে এসব হয়! বিজ্ঞান কী বলে? অবিশ্বাসী কী বলেন!
অপর্ণা পাকা গৃহিণী। ওদিকে অসুস্থ মানুষ, তবু ভেবে হাসি পাচ্ছে, বিয়ের আগে অনেক মেয়েই অনেক ভাবে দেখা দেয়, এমন হাতেনাতে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে আসরে নামে ক’জন! প্রতিটি ব্যাপারেই ফুলমার্ক পাচ্ছে। হাত একটুও কাঁপছে না। যেখানকার জিনিস ঠিক সেইখানেই পড়ছে। জাপানি বিমান যেন পার্লহার্বারে বোমা ফেলছে! বুঝেছি, এ মেয়ে এ বাড়ির জন্যেই তৈরি।
মাতামহ বললেন, দেখো তো মা, একটুকরো মেটে পাও কি না! নীচের বউমা যা বেঁধেছে না, একেবারে মাতোয়ারা করে দিয়েছে। এমন হাতে পড়ার ভাগ্য হলে, পাঁঠা হয়ে জন্মেও সুখ!
পঙ্কজবাবু বললেন, আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। সবাই আমার মাংসের তারিফ করে, এ রান্না খেলে তারা আমার রান্না ছোঁবে না। হরি!
বল?
ভদ্রলোক সুস্থ সবল হয়ে উঠুন, তারপর আবার একদিন সাংঘাতিক ভাবে হবে। কী বলিস?
বেশ, তাই হবে। একেবারে মোলোকলা পূর্ণ করে হবে।
সেদিন কালীঘাট থেকে মাংস আনব।
মাতামহ আহার করেন চোখ বুজিয়ে। মাঝে মাঝেই একটি গান করেন, সেই গানের একটি লাইন হল, আহার করো মনে করো আহুতি দিই শ্যামা মাকে। চোখ বুজিয়ে বললেন, সে ভার আমার। আমি এনে দোব।
চাটনি মুখে দিয়ে পঙ্কজবাবু আহা, আহা করে উঠলেন। এমন চৌকস হাত খুব কম দেখা যায়। একেবারে আলাউদ্দিন খাঁ সায়েব, যেমন সেতারে, তেমনি সরোদে, তেমনি বেহালায়। এনার ট্রেনিং-এ বুড়িকে কিছুদিন রাখতেই হবে। মেয়েছেলে যদি রাঁধতে না জানে, তা হলে শি ইজ অ্যান ইনকমপ্লিট ওম্যান।
ওদিকে কাকিমা একেবারে পাকা নার্সের মতো কাজ করে বসে আছেন। মেসোমশাইয়ের গা। মুছিয়ে দিয়েছেন। গেঞ্জি বদলে দিয়েছেন। বিছানার চাদর পালটে দিয়েছেন। তিন থাক বালিশে পিঠ দিয়ে ক্লান্ত, শ্রান্ত মেসোমশাই বসে আছেন সামনে পা ছড়িয়ে। হ্যারিকেন জ্বলছে। সেঁক চলছে। তার আগে পাউডার দিয়ে পা ঘষা হয়েছে।
পিতা স্নেহমাখানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, বিনয়দা, কেমন বুঝছেন এখন?
ক্ষীণ গলায় মেসোমশাই বললেন, এত ঝরঝরে মনে হচ্ছে, জীবনে কখনও এত সুস্থ বোধ করিনি। আর তেমনি খিদে। জ্বরের ঘোরে, বুঝলেন হরিদা, কত কী যে দেখলুম! দেখলুম মহাদেব। এসে মাথার সামনে দাঁড়িয়েছেন। হাতে ইয়া বড় এক ত্রিশূল। ত্রিশূলটা কপালে ঠেকিয়ে কী যেন সব বললেন। কিছুই আর মনে নেই। সারাশরীর যেন চড়চড় করে পুড়ে যেতে লাগল। মনে হল আমি যেন আগুনে শুয়ে আছি। এখন নিজেকে মনে হচ্ছে, যেন হোমের পোড়া কাঠ। হরিদা, সে আমি। আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। মনে হল শরীরে হাই ভোলটেজ ইলেকট্রিসিটি খেলে যাচ্ছে।
পিতা বললেন, জয় রাম, জয় রাম।
মাতামহ শব্দ করে হাসলেন, যার অর্থ, জানতুম, জানতুম এইরকমই হবে।
মেসোমশাই কাকিমাকে দেখিয়ে বললেন, আর করলেন বটে ইনি! মাকেও হার মানিয়েছেন। আর কি সেঁকের দরকার হবে?
চেটো গরম হয়েছে?
কাকিমা বললেন, হ্যাঁ হয়েছে।
ব্যস, তা হলে ছেড়ে দাও। তোমরা খাওয়া সেরে নাও। বিনয়দাকে এখন একটু গরম দুধ খাওয়াতে হবে।
আমার কিন্তু বেশ ঝাল ঝাল একটা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।
না, আজ না, আজ আর অত্যাচারী কিছু চলবে না। আজ সব হালকা। সন্ধে হয়ে আসছে, তা না হলে ফলের রস দেওয়া যেত। আপনি খাবেন পরেশের বিখ্যাত নরমপাক, থিন অ্যারারুট আর গরম। দুধ। রাতে জ্বর না এলে, কাল সকালে মাছের ঝোল আর ভাত।
মাতামহ বললেন, জীবনে আর জ্বর হবে না। শেষ জ্বর হয়ে গেল।
মুকু আর অপর্ণাকে খেতে বসিয়ে কাকিমা এক অদ্ভুত কথা বললেন, তোমরা বসে বসে খাও। ভাই, ওদিকে আমার ভাত আর পুঁইডাটা কড়কড়িয়ে গেল।
অপর্ণা বললে, তার মানে? আপনি আমাদের সঙ্গে বসবেন না? তা হলে আমরাও উঠে পড়লুম।
কাকিমা বিব্রত মুখে বললেন, আমি যে ভাই আগেই আমার মতো বেঁধে ফেলেছি। না খেলে যে সব নষ্ট হয়ে যাবে।
পিতার প্রবেশ হল। জিজ্ঞেস করলেন, কী তোমাদের সমস্যা! সব হাত গুটিয়ে বসে আছে এখনও?
অপর্ণা বললে, ইনি খেতে চাইছেন না।
কেন? কেন বউঠান, তুমি খাবে না! আমি তোমাকে বলিনি বলে! যাও, বসে পড়ো। তুমি আমাকে দুঃখ দিতে চাও? তুমি আমাকে বিব্রত করতে চাও? আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন। উৎসবের দিন। বিনয়দা তিনঘণ্টায় সেরে উঠলেন। কত বড় একজন মহাপুরুষ পায়ের ধুলো দিয়ে গেলেন। তুমি জানো না বউঠান, আজকের দিনটার কী অর্থ। এ এক দিন-ছাড়া দিন। আনন্দ করো আনন্দ করো। জীবন বড় ছোট, বড় দুঃখে ভরা। ওই যে মেয়েটি, ওর দিকে আমি তাকিয়ে আছি। জয় রাম, জয় রাম।
কাকিমার চোখে জল গড়াচ্ছে।
একী, তুমি কাঁদছ? দুঃখে, না আনন্দে!
কাকিমা ফিসফিস করে বললেন, আনন্দে। আমাকে কেউ কখনও এতটুকু স্নেহ করেনি। আপনি করলেন। আপনার কাছে কাছে সারাজীবন যদি থাকতে পারতুম!
পিতা চমকে উঠলেন, না না, খবরদার ও কামনা কোরো না। আমাকে যে চায় তাকে চলে যেতে হয়। এই আমার ভাগ্য, এই আমার গ্রহ।
কাকিমা এবার বেশ জোরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন। মেয়েদুটি হাত গুটিয়ে আসনে বসে আছে হাঁ করে। বড়দের আবেগ বোঝার বয়স ওদের হয়নি। দু’জনেই সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। দুঃখ কাকে বলে জানা হয়নি। পিতা ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। আমার মনে পড়ছে। নৌকোয় দেখা সেই সতীমার কথা। বলেছিলেন, কিছু মানুষ আসে যারা কিছু পায় না। আগুনের গোলার মতো। তারা যে জায়গা দিয়ে যায়, সবকিছু পোড়াতে পোড়াতে যায়। তারা হল মানুষ-উট। মরুভূমিতেই যার চলাফেরা। এতটুকু ছায়া নেই। দগ্ধ, তাম্রবর্ণ, ধুধু বালির বিস্তার। যত দূরে তাকাও, মৃত্তিকা নেই, জল নেই, বৃক্ষরাজি নেই।
মাতামহ একটি সোফায় বুকের কাছে মাথা ঝুলিয়ে ঝিম মেরে বসে আছেন। পঙ্কজবাবু আর একটিতে বেশ আয়েশ করে বসে, সেদিনের খবরের কাগজটি পড়ার চেষ্টা করছেন। পিতা বসেছেন হোমিওপ্যাথি গৃহচিকিৎসার বই খুলে। মেসোমশাই উষ্ণ দুগ্ধপান করে অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। কাকিমা উত্তরের বারান্দায় মুকুকে নিয়ে বসেছেন চুল বেঁধে দিতে। অপর্ণা বারান্দার রেলিং-এ কনুইয়ের ভর রেখে আকাশ, বাতাস, গাছ, পাখি দেখছে। যত বেলা বাড়ছে, রূপ যেন ততই খুলছে। মুখটা সিঁদুরপানা হয়ে উঠেছে।
আর আমি? দেয়ালে হিমালয়ের একটা ছবি ঝুলছে। সেই দিকে তাকিয়ে ভাবছি, কাল আবার বেরোতে হবে। ঢুকতে-না-ঢুকতেই চাকরিতে অরুচি ধরে গেল। সামনে পড়ে আছে। সারাটা জীবন! যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে বারান্দার একান্ত দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। মুকু দু’হাত দিয়ে চেপে চেপে ঢাউস খোঁপা সঠিক স্থানে ঝোলাবার চেষ্টা করছে। কাকিমা চিরুনি থেকে চুল ছাড়াচ্ছেন। অপর্ণা একইভাবে স্বপ্ন দেখছে। মেয়েটি সুন্দরী, তবে স্বভাবটি কেমন বোঝা গেল না।
কাকিমা দরজার সামনে এসে ইশারায় আমাকে ডাকলেন। অবেলায় খেয়ে শরীরটা বেশ ভারী হয়ে উঠেছে। বারান্দায় যেতেই কাকিমা বললেন, বুড়োদের দলে বসে বসে কী করছ! তোমার ভীষণ বুড়োটে স্বভাব হয়ে যাচ্ছে। মাদুরটা নিয়ে চলো ছাতে যাই। একটু পরেই তো চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি মাদুর পাতো গে যাও, আমি নীচে থেকে লুডোটা নিয়ে আসি। চারজন আছি, এক চাল খেলা যাক।
সেরেছে! তিনজন মেয়ে, একজন ছেলে। ভাবতেও আতঙ্ক হচ্ছে। এদিকে বলাইবাবু বিকেলের বারান্দায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন। কাকিমা তো লুডো খেলবেন বললেন, মুকু কি রাজি হবে!
অপর্ণা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, আপনাদের ছাদে অনেক ফুলগাছ আছে তাই না?
হ্যাঁ, অনেক গাছ। বাবা একেবারে নার্সারি বানিয়ে ফেলেছেন।
চলুন যাই, বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।
ভেতরটা কেমন যেন ছলাক করে উঠল। অপর্ণা এইভাবে যেচে ছাদে উঠতে চাইবে, ভাবাই যায় । এ যেন সেই মেঘ না চাইতেই জল, নাকি, জল না চাইতেই মেঘ। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরীদের সাধারণত বড় তোষামোদ করতে হয়।
যা ভেবেছিলুম তাই হল, অপর্ণা আগে আগে উঠতে লাগল। পেছনে মাদুর বগলে আমি এক মাধাই। এইরকম পরিস্থিতিতে অল্পবয়সি মানুষদের বড় কষ্ট হয়। ভেতরটা হাঁপাঁক করতে থাকে। সিঁড়ি থেকে সিঁড়িতে পা তোলার সময় শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পায়ের গোছ প্রকাশিত হয়। মাথা খারাপ হয়ে যায়। ধর্ম, দেবতা, বেদ বেদান্ত সব ভেসে যায়। হাত পা ছুঁড়ে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, বীরেনদার সেই গানের মতো, ভেসে যায় ভাসিয়ে নে যায়।
সিঁড়ির বাঁকের বড় ধাপে, পিতৃদেবের সেই তুলোধোনা যন্ত্র প্রহরীর মতো খাড়া। এটাকে দেখলেই আমার কনকের কথা মনে পড়ে যায়। যে-রাতে এটা এল সে রাতে শিল পড়েছিল। কনক পাঁপড় ভেজে মাতামহকে খাইয়েছিল। সেই রাতেই প্রথম আমার বুকে এসেছিল নারী নয়, নারীর পরিধেয় বস্ত্র। সেই রাতেই উচ্ছ্বসিত পিতা বলেছিলেন, তোমার মতো একটা মেয়ে পেলে এই সংসারে আবার আমি ফুল ফুটিয়ে ছেড়ে দিতুম। সুখের দিন যেন স্রোতের ভাসমান ফুলের মতো। এক ঘাট থেকে আর এক ঘাট হয়ে, ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে যায়।
অপর্ণা সেই তুলোধোনা যন্ত্র দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল, এটা কী? বাজনা? বাজিয়ে দেখব!
তাতে টুসকি মারতেই, বুং করে খুব বোকাবোকা, বোদা একটা শব্দ হল। তাতটা মনে হয় বোকাপাঁঠার ছিল।
অপর্ণার খুব আনন্দ হয়েছে, আর একবার বাজাব?
বাজাও! অ্যায় তুমি বলে ফেলেছি। খেয়াল করেনি। যন্ত্রে বিভোর। করলেও কিছু করার নেই। এত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, আপনি বলতে পারছি না। সবকিছুর একটা সীমা আছে। আমি তেমন বকাটে ছেলে হলে, যা-তা কিছু একটা করে ফেলতে পারতুম। যা ভাবা যায়, তা করা যায় না বলেই আমরা মানুষ। একে বলে চরিত্র। একে বলে সংযম।
আবার একবার বুং করে শব্দ হল। অপর্ণার খুব মজা। খিলখিল করে হেসে বললে, কেমন একটা শিং শিং আওয়াজ। এ যন্ত্র মনে হয়, সিঙ্গিমামার আসরে বাজে।
ধরেছ ঠিক। নাও চলো।
দাঁড়াও না।
বলেই অপর্ণা জিভ কাটল। আমার চোখে তার স্থির চোখ। মোটেই বিব্রত নয়। আদৌ লজ্জা পায়নি। শুধু মনে মনে একটু কাছাকাছি সরে আসার দুষ্টুমি। জিভ ঢুকিয়ে নিয়ে একেবারে ছেলেমানুষের মতো বললে, কী বলে ফেললুম?
বেশ করেছ। এখন ওপরে চলো। ওরা আসছে।
এটা কী বলো না? চেনাচেনা মনে হচ্ছে।
এ হল তুলোধোনা যন্ত্র। লেপ তোশক তৈরির সময় লাগে। ধুনুরির কাঁধে কাঁধে ঘোরে। কাকিমা মুকুকে নিয়ে পেছনে এসে পড়েছেন।
বাবা, কতক্ষণ ধরে তোমরা এই ক’ধাপ মাত্র উঠেছ? শাবাশ, নওজোয়ান!
এই গানটা এখন খুব শোনা যায়। আমরা নওজোয়ান। কাকিমাও শুনে থাকবেন। অপর্ণা বুং করে একটা শব্দ তুলে, উদ্ভাসিত মুখে বললে, কী সুন্দর!
কাকিমা বললেন, হ্যাঁ, তোমার বিয়েতে নবতের সঙ্গে বটঠাকুরকে এসরাজ ছেড়ে বাজাতে বলব। দুটিতে তো বেশ জোড়ে দাঁড়িয়েছ। কত্তাকে একবার ডেকে দেখাব?
অপর্ণা দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে বলতে লাগল, না না লক্ষীটি না।
কাকিমা বলতে লাগলেন, ওরে পাগলি, কাপড় জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবি। কী ডাকাত মেয়ে রে বাবা! ছাতে উঠে অপর্ণা হাঁপাচ্ছে। ভারী বুক উঠছে আর নামছে। মেয়েটার তো খুব প্রাণ আছে। কনকের মধ্যে একটা বড়দি-বড়দি ভাব ছিল। এ একেবারে ভিন্ন জাতের টগবগে মেয়ে।
ন্যাড়া ছাদের আলসেতে শাড়ি গুটিয়ে বসে অপর্ণা বললে, উঃ হাঁপিয়ে গেছি। এক গেলাস জল খেয়ে আসি।
কাকিমা বললেন, দয়া করে তুমি ওই আলসে থেকে নেমে বোসো। মাথা ঘুরে টাল খেয়ে ওপাশে পড়ে গেলে সর্বনাশ হবে, মা।
হ্যাঁ পড়লেই হল। আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি? আঃ কী সুন্দর ছাদ!
হ্যাঁ, সুন্দর ছাদ। তুমি নেমে মাদুরে বোসো।
অপর্ণা আলসে থেকে নেমে মাদুরে পা ছড়িয়ে বসল রানির মতো। কাকিমা বললেন, এমন টুকটুকে পা, একটু আলতা পরো না কেন?
অপর্ণা নিজের পা দুটো ভাল করে দেখতে দেখতে বললে, বড় ছটফটে, বড় অবাধ্য।
আপনারা বসুন, আমি এক গেলাস জল নিয়ে আসি।
কাকিমা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিয়ে এসো, সেবা করতে শেখো।
অপর্ণা বললে, না না, আমি নীচে গিয়ে খেয়ে আসছি।
তুমি চুপ করে বোসো তো। একদম ছটফট করবে না।
তা হলে আমি একটু শুয়েই পড়ি।
অপর্ণা মাদুরে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। চারপাশে কড়ার মতো উপুড় হয়ে পড়েছে ঘন নীল আকাশ। কসমস গাছে অজস্র ফুল এসেছে, সাদা, বেগুনি। অপর্ণার হলদে শাড়ির জমিতে খয়েরি ডুরে। ওপর-বাহুর তলার দিক, কোমরের কিছু অংশ, আর দুটো পা, নতুন আবিষ্কারের মতো মাদুরে সাজানো রয়েছে। মেয়েরা জানে না, মেয়েদের কোন কোন জিনিস কতটা মারাত্মক! বহু উঁচুতে আকাশের চাঁদোয়ায় চিল ঘুরপাক খাচ্ছে। রায়সায়েবদের বাড়ির এরিয়েলের তারে বসে দুটো দোয়েল খুব শিস দিচ্ছে, আর ন্যাজ নাচাচ্ছে। মুকু গোবদা মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
কাকিমা বললেন, এসো, একপাশে বোসো। মহারানি তিন কাঠা জায়গা নিয়ে শুয়েছেন। অবেলায় আলসে লেগেছে। ভাব এসে গেছে।
মুকুর মনে হয় হিংসে হয়েছে। মেয়েদের হিংসে কি ছেলেদের চেয়ে বেশি?
জল আনতেই অপর্ণা উঠে বসল। আলগোছে কলকল করে জল খাচ্ছে। মুখের হাঁ ছোট্ট এতটুকু। ভেতরটা লাল টকটকে। ইঁদুরের মতো ছোট্ট ছোট্ট সাজানো দাঁত। জিভটা যেন সাপের মতো হিলহিল করছে। এ সাপ অন্য সাপ, বড় অমৃত, বড় অমৃত।
খুব ভাল করে ভেবে দেখো তুমি, এখনও রয়েছে
ফিরিবার অবসর,
শুধু নিমিষের ভুলের লাগিয়া
কঁদিবে যে তুমি,
সারাটি জনম ভর।
কাকিমা বললেন, রানি এইবার এক-এক খিলি পান। ঠোঁটদুটো লাল টুকটুকে হবে। টুকটুকে লাল ঠোঁট চুষে চুষে খাই।
যাঃ অসভ্য, বলে অপর্ণা কাকিমাকে ঠেলা মারল। আমি ভালমানুষের মতো মুখ করে, আকাশের চিল দেখতে লাগলুম, যেন আমি চিল-বিশারদ। মনে ভাবছি একটি লাইন, ঘঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে, তখনই তা মোছে ঠোঁটেরই হাসির ঘায়ে।
লুডোর ছক পড়েছে। চারটে মাথা চারদিক থেকে সামনে ঝুঁকে আছে। ঘাড়ের কাছে খোঁপা লদলদ করছে। ছক নাড়ার খুড়শুড় শব্দ হচ্ছে। অপর্ণার এন্তার ছয় পড়ছে। সব খুঁটি বেরিয়ে ছকের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে চলেছে। অপর্ণার লাল। কাকিমার নীল। আমার সবুজ। মুকুর হলদে। কাকিমার কেবল এক পড়ছে নয়তো তিন। আমার যেমন বরাত, বলে ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছেন। আমার তিনটে বেরিয়েছিল। দুটোকে অপর্ণা পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। মুকুর দুটো বেরিয়েছে। বেরোলে কী হবে? অপর্ণার নাগালের মধ্যে। ও তো বলে বলে কাটছে। ছককা যেন ওর হাত ধরা! পড় পাঁচ তো পাঁচই পড়ল। আর কচাত করে মুকু উড়ে গেল। অপর্ণার গলায় গান গুনগুন করছে, মায়াবন বিহারিণী হরিণী, গহন স্বপন সঞ্চারিণী।
কানের পাশ দিয়ে বাতাস ঢালছে ফুরফুরিয়ে। লম্বা লম্বা চুল উড়ছে দিশাহারা হয়ে। আমার একপাশে অপর্ণা, আর একপাশে কাকিমা। অপর্ণার দিক থেকেই বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে চুল উড়ে এসে আমার গালগলা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
পড় তো তিন। ব্যস, আমার একটা খুঁটিই বাইরে ছিল, ঘরে ফিরে গেল। অপর্ণা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, কী, মন খারাপ হয়ে গেল!
বলতে পারতুম, তোমার কাছে পরাজয়, সে তো আমার জয়। বড় বেশি নাটকীয় হয়ে যাবে। বীরের উক্তি, আবার আমি শুরু করছি, তোমায় নতুন করে পাব বলে, হারাই বারেবারে।
অপর্ণা বললে, সে কি লুডোর খুঁটি? সে তো ভালবাসার ধন!
কাকিমা বললেন, হ্যাঁ রে বুড়ি, সে তো ভালবাসারই ধন।
মুকু দান ফেলছে, চাল দিচ্ছে, কিন্তু কেমন যেন অন্যমনস্ক! পশ্চিম আকাশে সূর্যদেব পাটে নেমেছেন। আকাশ একেবারে কুমকুম-লাল। তালচটকা পাখি উড়ছে নেচে নেচে। কাকিমা বললেন, চায়ের সময় হল। যাই ব্যবস্থা করি। বটঠাকুর আবার চা-খোর মানুষ।
অপর্ণা বললে, আমার বাবাও তাই। মাঝে মাঝেই মায়ের সঙ্গে লেগে যায়। চা নিয়ে দক্ষযজ্ঞ। ছক গুটিয়ে কাকিমা নীচে চললেন। মুকু আর অপর্ণা বসে রইল মুখোমুখি। মুকুর মনে হয় অপর্ণাকে খুব ভাল লেগে গেছে। দু’জনেই ছাত্রী।
নীচের ঘরে বিশেষ একটা কিছু নিয়ে তিনজনেই ভীষণ ব্যস্ত। টেবিলে ল্যাম্প জ্বলে উঠেছে। তার আলোয়, ছড়ানো খবরের কাগজের পাতা। তিনটে মাথা তিন দিক থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। যা কথা হচ্ছে, সবই ফিসফিস করে। তিন মেজর জেনারেল যেন, রাতের আক্রমণের পরিকল্পনায় মশগুল।
পায়ের শব্দে তিনজনেই চমকে ফিরে তাকালেন। আমাকে দেখে বললেন, অ, তুমি? তাও ফিসফিস করে।
পিতা ফিসফিস করে ডাকলেন, এদিকে এসো।
আলোর বৃত্তে কাগজের যে-অংশ, সেই অংশে একটি ছবি।
দেখো তো। ভাল করে দেখো।
পুলিশের বিজ্ঞাপন, অশনাক্ত মৃতদেহ। ধেবড়ে কালো হয়ে আছে। একটি মেয়ে।
পিতা খুব চাপা স্বরে বললেন, সেই নাক, সেই কপাল, অনেকটা সেইরকমেরই মুখ। কী, তাই না?