1 of 3

১.৩৪ দেওঘরে প্রতাপকে থেকে যেতে হলো

দেওঘরে প্রতাপকে থেকে যেতে হলো পাঁচ দিন। পরদিন সকালেই অবশ্য একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে মমতাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অবস্থানের কথা।

এবারে প্রতাপ এখানে চলে এসেছেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পার হবার পরেই তাঁর মনে হলো, নিয়তিই যেন টেনে এনেছে তাঁকে। তিনি যদি কিছু না জানতে পারতেন তা হলে আর কিছুদিনের মধ্যেই একটা বড় রকম বিপর্যয় ঘটে যেত।

প্রথম রাতেই বিশ্বনাথ গুহ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রতাপের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ যে একবার উঠে গিয়েছিলেন, আর শয়নঘর থেকে বেরুলেন না, খাওয়ার সময়েও এলেন না।

মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে শুতে চলে এসেছিলেন প্রতাপ। মায়ের সব গল্পই পুরোনো কালের। সেই মালখানগরের বাড়ি, সেখানকার বষা, শীত; সে বাড়ির বাগান, পুকুর, গোরুর বাচ্চা হওয়ার সময় একটা গোখরো সাপের সেই গোরুর বাঁট থেকে দুধ খাওয়া, লক্ষ্মী পুজোর রাতে লক্ষ্মী প্যাঁচার আগমন, এই সবই প্রতাপ শুনেছেন অনেকবার, তবু মায়ের মুখে শুনতে ভালো লাগে। তবে মালখানগরের কুমড়ো যে এত বিখ্যাত তা প্রতাপ জানতেন না। দেওঘরে বেশ টাটকা তরিতরকারি পাওয়া যায়, কিন্তু কোনোটাতেই মা ঠিক মতন স্বাদ পান না। মালখানগরে মা যে কুমড়ো খেতেন, সে রকম মিষ্টি কুমড়ো নাকি ভূ-ভারতে আর কোথাও পাওয়া যায় না, কলকাতাতেও না, আর এই পাহাড়ী মাটির দেশে তো কথাই নেই। মালখানগরের বাড়ির গোয়ালঘর আর রান্নাঘরের খড়ের চালে কুমড়োলতা থাকতে প্রতি বছর, সেখানে পেল্লায় পেল্লায় সাইজের কুমড়ো ফলতো। প্রতাপ কুমড়ো পছন্দ করেন না, তাই। মালখানগরের বাড়ির কুমড়োর কথা তাঁর মনে নেই।

এ বাড়ির একখানা ঘর রাখা আছে প্রতাপদের জন্য। মমতা এ ঘরে কিছু কিছু জিনিস রেখে। গেছেন, বছরে একবার তো আসাই হয়। মা নাতি-নাতনীদের দেখতে চান। আগে এ বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, এবারেই এসে প্রতাপ দেখছেন ঘরে ঘরে আলো, এমনকি মায়ের ঘরে একখানা পাখাও দেওয়া হয়েছে।

প্রতাপ সবেমাত্র শুয়েছেন, এমন সময় শান্তি এসে বললো, তোর ঘরে মশারি টানিয়ে দেয়নি, খোকন? মশার জ্বালায় যে শতচ্ছিদ্র হয়ে যাবি। একটু ওঠ, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

শান্তি প্রতাপের চেয়ে মাত্র দেড় বছরের বড়। ছোড়দি বলে ডাকলেও প্রতাপ তাঁকে ছোট বোনের মতনই গণ্য করেন। দেশে থাকার সময় সুপ্রীতির সঙ্গেই বেশি ভাব ছিল প্রতাপের। শান্তি ছিল বড় বেশি মায়ের ন্যাওটা, সর্বক্ষণই প্রায় মায়ের ছায়া।

প্রতাপ আজ লক্ষ করলেন, শান্তির চেহারায় হঠাৎ যেন বয়েসের ছাপ পড়ে গেছে। মুখখানা ফ্যাকাসে, শরীরটা ঝরা ঝরা, শীতকালের পত্রমোচি গাছের মতন, কিন্তু মানুষের শরীরে তো প্রতি বছর শীতবসন্তের বিবর্তন হয় না। শান্তির তুলনায় সুপ্রীতির শরীর অনেক দৃঢ় আছে। এমনকি মাকেও এখনো বুড়ি মনে হয় না।

মশারি টানানো হয়ে যাবার পর শান্তি প্রতাপের দিকে ফিরে বললেন, সারাদিন ট্রেনে। এসেছিস, অনেক ধকল গেছে, তোর ঘুম পেয়েছে নারে খোকন?

প্রতাপ বললেন, না ঘুম পায়নি! তোর কী হয়েছে রে, ছোড়দি?

শান্তি ক্লান্তভাবে চোখ তুলে বললেন, কেন কী হবে?

প্রতাপ বললেন, তোকে, ইয়ে, এমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

শান্তি একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললেন, না, না,আমার কিছু হয়নি। তুই ভালো আছিস তো?

তোরা সব ভালো আছিস তো?

প্রতাপ মাথা নাড়লেন।

–তোর যদি ঘুম না পেয়ে থাকে, তুই একবার আয় না আমাদের ঘরে।

প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন। ওস্তাদজী কেমন আছেন একবার দেখে আসা উচিত ছিল, মায়ের সঙ্গে কথায় কথায় আর খেয়াল ছিল না।

দরজা পর্যন্ত গিয়েও প্রতাপ ফিরে এসে বেড সাইড টেবল থেকে সিগারেট-দেশলাই তুলে নিলেন। বাইরে এলেই তাঁর সিগারেট খাওয়া বেড়ে যায়।

শান্তির ঘরে আলো নেবানো ছিল, শান্তি সুইচ টিপে জ্বালালো। একটা বেশ বড় খাটের একপাশে কাৎ হয়ে শুয়ে আছেন বিশ্বনাথ গুহ। যে পা-জামা পাঞ্জাবি পরে তিনি সন্ধেবেলা বাইরে থেকে এসেছিলেন, সেগুলোই পরে আছেন। নেভানো চুরুটটা বিছানার ওপরেই রাখা। নাক দিয়ে ফিচ ফিচ শব্দ হচ্ছে। ঠোঁটের পাশে একটুখানি লালার দাগ।

শান্তির মেয়ে টুনটুনির বয়েস হয়েছে এগারো, সে দিদিমার সঙ্গে ঘুমোয়। বেশির ভাগ সময়ই সে দিদিমার কাছে থাকে। এ ঘরে তার জামাকাপড় বা বইপত্র কোনো কিছুরই চিহ্ন নেই। এটা একেবারেই স্বামী-স্ত্রীর ঘর। সব কিছুই এলোমেলো। দেওয়ালের এক কোণে দাঁড় করানো রয়েছে একটা তানপুরা, তার মাথায় অতি বেমানান ভাবে ঝুলছে একটা ল্যাঙোট। প্রতাপ সেদিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

শান্তি বললেন, খোকন, তুই ওকে ডাক।

প্রতাপ বললেন, ঘুমোচ্ছেন যখন, থাক না!

প্রতাপ এগিয়ে গিয়ে বিশ্বনাথের কপালে হাত রাখলেন। মানুষের বড় বড় অসুখের সঙ্গে জ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই, তবু শরীর খারাপের কথা শুনলে সবাই কপালে হাত দিয়ে দেখে।

বিশ্বনাথের কপাল ঠিক স্বাভাবিক ঠাণ্ডা নয়, সামান্য একটু ছ্যাঁকছেকে ভাব। সেটা এমন কিছু না। কিন্তু বিশ্বনাথের মুখের কাছাকাছি আসতেই প্রতাপ একটা দুর্গন্ধ পেলেন। প্রতাপ নিজে মদ না খেলেও মদের গন্ধ চেনেন, কিন্তু এ যেন অন্যরকম।

প্রতাপ সোজা হয়ে দাঁড়াতেই শান্তি বললেন, খোকন, তুই ওকে ডেকে তোল, তোর সামনে আমি ওকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

প্রতাপ তাঁর ছোড়দিকে এক ধমক দিয়ে বললেন, মানুষটা ঘুমোচ্ছে। এখন ডেকে কী হবে? আমি তো কাল সকালে আছিই, তখন কথা হবে।

প্রতাপ ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কলকাতায় প্রতাপ মাতালদের সংসর্গ বিশেষ করেন না, কচিৎ কখনো রাস্তায়ঘাটে অচেনা মাতাল দেখতে পান। কিন্তু চাকরি জীবনে টানা বারো বছর যখন বিভিন্ন মফঃস্বল শহরে বদলি হয়েছেন তখন নিজেরই সমপর্যায়ের কিছু কিছু অফিসারকে বিভিন্ন সময়ে মাতলামি করতে দেখেছেন। একবার এক এস ডি পি ও তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁধের ওপর বমি করে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনাটা মনে পড়লেই প্রতাপ নিজের গায়ে বমির গন্ধ পান। তিনি বুঝতে পারলেন, ওস্তাদজীর আজকের শরীর খারাপ মাতালের শরীর খারাপ, তাঁর ঘুম মাতালের ঘুম।

বাইরের বারান্দায় এসে প্রতাপ একটা সিগারেট ধরালেন। শান্তি তাঁর পেছন পেছন এসে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপ করে।

একটু বাদে শান্তি বললেন, দ্যাখ খোকন, এখানকার চাঁদটা কত সাদা! আর কত বড়! মালখানগরে আমরা কি কোনোদিন এত পরিষ্কার চাঁদ দেখেছি?

প্রতাপ এই কথায় বেশ বিস্মিত হলেন। শান্তির রুগ্ন চেহারা আর বিরস মুখ দেখে তিনি। আশঙ্কা করছিলেন, ছোড়দি তাঁকে নানা রকম অনুযোগ শোনাবেন! জীবন যাদের কাছে আর উপভোগ্য নয়, তারা অন্যের জীবন-উপভোগও পছন্দ করে না। শান্তির মুখে চাঁদ সম্পর্কে কথা খুবই অপ্রত্যাশিত।

এখানে বেশ শীত পড়েছে। কলকারখানা নেই বলে এদিককার আকাশ অমলিন, শীতকালে আরও বেশি ঝকঝকে থাকে। এত তারা, যেন আকাশে দেওয়ালি, কিংবা তার চেয়েও বেশি, আলোর বিকিরণে ছেয়ে আছে আকাশ, তার মাঝখানে চাঁদ একটা রুপোর থালা, জার্মান সিলভার বললে আরও উপযুক্ত হয়।

প্রতাপ সচরাচর চাঁদ দেখেন না, এখন এগিয়ে এসে দেখলেন। অনেকদিন পর দুই ভাইবোন। পাশাপাশি। শান্তি বরাবরই প্রতাপকে খোকন বলে ডাকেন, কিন্তু শান্তির কোনো ডাক নাম নেই।

প্রতাপ বললেন, জানিস ছোড়দি, মমতা মাঝে মাঝেই ছাদে উঠে যায় রাত্তিরে, একা একা।

শান্তি বললেন, মমতা বড় ভালো মেয়ে। তুই ওকে কষ্ট দিস না। তুই মমতাকে সঙ্গে আনলি না কেন এবার? ঝগড়া হয়েছে?

প্রতাপ উত্তর দেবার আগেই শান্তি বললেন, খোকন, চুপ করে শোন! কিছু শুনতে পাচ্ছিস?

শ্রবণেন্দ্রিয় তো মনকেই অনুসরণ করে। একবার চাঁদ, একবার মমতার প্রসঙ্গ উঠতে প্রতাপের মন দূরে চলে গিয়েছিল, কাছাকাছি কোনো ব্যাপারে খেয়াল ছিল না। তিনি কিছু শুনতে পাননি। এবারে কান খাড়া করে প্রথমে তিনি শুনতে পেলেন একটি টাঙ্গার চলে যাওয়ার শব্দ, তারপর একজন মানুষের গলার দমকা কাশি। দ্বিতীয় শব্দটি খুব কাছেই।

শান্তি বললেন, খোকন, তুই আর একবার আমার ঘরে আয়!

সেখানে ফিরে গিয়ে প্রতাপ দেখলেন, ঘুমের মধ্যেই কেশে চলেছেন বিশ্বনাথ, তাঁর মুখ দিয়ে লালা বা থুতু গড়াচ্ছে। সেই থুতুর মধ্যে থকথকে রক্ত।

প্রতাপ ভয় পেয়ে শান্তির দিকে ঘুরে তাকালেন, কিন্তু শান্তির মুখে কোনো রকম ভয় বা অভিমানের চিহ্ন নেই। নিরুত্তাপ গলায় শান্তি বললেন, ওর আর বেশিদিন নেই, বুঝলি খোকন, ওর এবার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে!

প্রতাপ ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, ছোড়দি? তুই একথা বলছিস কেন?

–ও তো আর থাকতে চায় না! যাক, যেতে চায় যাক। আমি আর শুধু শুধু ওকে কেন আটকাবো?

মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে দেখলে শুধু একটা রোগের কথাই মনে পড়ে। প্রতাপ ভয় পেলেন। বিশ্বনাথ এখানে ধনী টি বি রুগীদের বাড়িতে নিয়মিত গান শোনাতে যান, সেটাই তাঁর জীবিকা। সেই সংস্পর্শে তাঁরও ঐ রোগ ধরা খুবই সম্ভব। এ তো রাজরোগ, এর চিকিৎসায় অনেক খরচ!

শান্তির হাবভাব দেখেও প্রতাপ অবাক হয়ে গেলেন। শান্তি বরাবরই ভীতু ভীতু ধরনের, সামান্য কারণেই বিচলিত হয়ে ওঠেন। এখন এমন ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছেন কী করে?

–কতদিন ধরে এরকম হয়েছে? ডাক্তার দেখাসনি?

শান্তি একটা কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে বললেন, দ্যাখ, এই ওর ওষুধ।

প্রতাপের ভুরু কুঁচকে গেল। আলমারির একটা তাক ভর্তি কতকগুলো বড় বড় নোংরা নোংরা বোতল। প্রথমে মনে হলো কেরোসিনের বোতল, কিন্তু আলমারিতে কেউ কেরোসিনের বোতল সাজিয়ে রাখে না, প্রতাপ বুঝতে পারলেন ওগুলো দেশি মদের।

শান্তি বললেন, এইগুলোই ওর ওষুধ, বাইরে থেকে খেয়ে আসে, আবার রাত্তিরে ঘরে বসে বসেও খায়।

–তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে, ছোড়দি? তুই এইসব ওঁকে খেতে দিচ্ছিস? এখন ওর পক্ষে এ তো বিষ!

–আমি কী করবো বল?

–তুই কী করবি মানে? তুই আটকাতে পারিস না?

–তুই বুঝতে পারছিস না, খোকন, ও সব নিষেধের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে।

বিশ্বনাথের মুখ দিয়ে আর একবার কাশির দমক উঠতেই প্রতাপ কাছে গিয়ে তাঁর বুকে হাত দিয়ে ডাকলেন, ওস্তাদজী! ওস্তাদজী!

কয়েকবার ডাকাডাকির পর বিশ্বনাথ জড়িত গলায় বললেন, অ্যাঁ? কেন বিরক্ত করছো?

তারপর ঘোলাটে চোখ মেলে বললেন, চতুর্দিকে মাছি উড়ছে ভনভন করে। সব পচা জিনিস! মানুষের শরীরও পচে গেছে!

প্রতাপ বুঝলেন এখন কথা বলে লাভ নেই, বিশ্বনাথ পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত।

শান্তিকে তিনি আদেশ দিলেন, মুখটা মুছিয়ে দে! কাল সকালে আমি দেখছি!

ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে প্রতাপ আবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মা জানে?

শান্তি বললো, মা সবই জানে!

বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন পরিবেশে মানুষ বদলায় ঠিকই, কিন্তু তাঁর মায়ের স্বভাবের এতখানি পরিবর্তন একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হলো প্রতাপের। সুহাসিনী বরাবরই শিশুর মতন, সব সময় উতলা হয়ে থাকেন, তাঁর নিজের পারিবারিক গণ্ডির প্রত্যেকের ভালোমন্দের প্রতি সব সময় তাঁর মনোযোগ, যেন সেটাই তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য। সুহাসিনীর মাথায় বুদ্ধির বদলে সবটাই আবেগ, এরকমই প্রতাপ দেখে এসেছেন বরাবর। মা বিচলিত হয়ে পড়বেন বলে তাঁর কাছে অনেক ছোটখাটো দুর্যোগের কথা লুকিয়ে যান।

সেই সুহাসিনী তাঁর জামাইয়ের এমন অবস্থার কথা জেনেও একবারও তা উল্লেখ করলেন না। প্রতাপের কাছে? বরং আগের তুলনায় আজ যেন তিনি বড় বেশি শান্ত হয়ে ছিলেন। অতীতের। কথা, পূর্ব বাংলার সেই সুখের দিনগুলির কথা বলতে বলতে তিনি একেবারে বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর চোখ বুজে এসেছিল। যেন তিনি পুরোপুরি অতীতে ফিরে গেছেন, বর্তমানটা তার কাছে একেবারে তুচ্ছ হয়ে গেছে। তাই কোনো অভিযোগ নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এরকম হয়? প্রতাপ ধাঁধায় পড়ে গেলেন।

সে রাতে তাঁর ঘুম ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেতে লাগলো বার বার।

সেইজন্যই পরদিন তাঁর ঘুম ভাঙতে দেরি হলো। বিশ্বনাথ বেরিয়ে গেছেন তার মধ্যে। প্রতাপ বাজারে গেলেন তাঁকে খুঁজতে। দেখা পেলেন না। রেলস্টেশনেও নেই। দু’চারটি বাঙালি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। বিশ্বনাথ গুহকে এখানে অনেকেই চেনে, কিন্তু কেউ তাঁকে দেখেনি।

সন্ধের পর বিশ্বনাথ ফিরলেন পুরোপুরি মাতাল হয়ে। রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান গাইতে গাইতে ঢুকলেন গেট ঠেলে, তাঁর ধুতিটা আলগা হয়ে গেছে, কোমরের কাছে ধরে আছেন মুঠো করে, মুখে চুরুটের বদলে আদিবাসীদের লম্বা বিড়ি, কাঁচা তামাকে মাঝে মাঝে পট। পট শব্দ হচ্ছে আর আগুনের ফুলকি উড়ে এসে পড়ছে তাঁর লম্বা দাড়িতে।

প্রতাপ এগিয়ে এসে বিশ্বনাথের হাত ধরে কঠোরভাবে বললেন, এসব কী হচ্ছে ওস্তাদজী? সারাদিন কোথায় ছিলেন?

ঝটকা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে বিশ্বনাথ কর্কশ চিৎকার করে উঠলেন, চোপ শালা! তুই আমার হাত ধরবার কে রে?

সুহাসিনী আর শান্তি বসেছিলেন বারান্দায়, তাঁরা উঠে চলে গেলেন ভেতরে।

প্রতাপ নিথরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি খুব জোর আঘাত পেয়েছেন। খারাপ কথা, বর্বরদের মতন ভাষা তিনি সহ্য করতে পারেন না। বিশ্বনাথ গুহ বরাবরই মার্জিত স্বভাবের মানুষ। তাঁর কথাবার্তা সব সময়ই উঁচু তারে বাঁধা থাকে।

ধুতিটা সম্পূর্ণভাবে খুলে আবার পরলেন বিশ্বনাথ। তারপর টলতে টলতে গিয়ে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ে ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগলেন প্রতাপের দিকে চেয়ে।

বিড়িটাতে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে তিনি প্রতাপকে বললেন, কী ব্রাদার, রাগ করলে নাকি? অন্য কারুকে তো শালা বলিনি, তুমি আমার একমাত্র অরিজিন্যাল শালা, তোমাকে শালা বলেছি, তাতে রাগের কী আছে?

এক মুহূর্ত আগে প্রতাপ ঠিক করেছিলেম যে বিশ্বনাথের সঙ্গে তিনি জীবনে আর কখনো বাক্যালাপ করবেন না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে মত পাল্টাতে হলো, মায়ের জন্য, ছোড়দির জন্য।

বিশ্বনাথ আবার বললেন, এসো ব্রাদার, আমার পাশে এসে বসো। কী বকুনি দেবে দাও!

প্রতাপ কাছে এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললেন, আপনি কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?

বিশ্বনাথ চোখ বুজে মাথা নাড়লেন দুদিকে। তারপর কাশলেন কয়েকবার। তারপর বললেন, কী হবে ডাক্তার দেখিয়ে? ডাক্তার যা বলবে তা তো জানা কথা!

–ডাক্তার না দেখালে অসুখের চিকিৎসা হবে কী করে?

–চিকিৎসা তো আমি নিজেই করছি। আমার চুরুট ফুরিয়ে গেছে, তোমার একটা সিগারেট দাও তো!

–আপনার এত কাশি, এই সময় সিগারেট খাওয়া উচিত নয়।

বিশ্বনাথ এবার জোরে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, গম্ভীর গলায় বড়বাবু বড়বাবু ভাব করে কথা বলার অভ্যেসটা আর তোমার গেল না! সব সময় যেন ভারডিক্ট দিচ্ছো। আরে, এটা তোমার আদালত না কি? আমি তোমার আসামী?

–ওস্তাদজী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, জীবনটা নিয়ে আপনি কী করতে চাইছেন।

–আমি আর জীবন নিয়ে কী করবো, জীবনই আমায় নিয়ে খেলাচ্ছে। তবে, এ খেলা বোধহয় আর বেশিদিন…ঠিক কতদিন জানতে পারলে সুবিধে হতো।

–কাশির অসুখ, চিকিৎসা করলেই সারিয়ে ফেলা যায়।

–টি বি কথাটা উচ্চারণ করতে লজ্জা পাচ্ছো? প্রত্যেক দিন ঘুষঘুষে জ্বর, কাশি, তার সঙ্গে রক্ত…লক্ষণ সব মিলে যাচ্ছে। কী বলো? এর চিকিৎসা কী তাও সবাই জানে। ইঞ্জেকশান ফিঞ্জেকশান তো আছেই, তাছাড়া ভালো খাওয়া-দাওয়া, পরিপূর্ণ বিশ্রাম, হা-হা-হা-হা!

এই সময় মা আর ছোড়দি কাছাকাছি থাকলে কথা বলার সুবিধে হতো। প্রতাপ চেঁচিয়ে ডাকলেন, ছোড়দি, ছোড়দি!!

শান্তি কাছেই ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন বারান্দায়।

বিশ্বনাথ মুখ ঘুরিয়ে স্ত্রীকে দেখে সুর করে বললেন, এইবারে প্রধান সাক্ষী হাজির! কিন্তু আসামী ভাগলবা!

বিশ্বনাথ চট করে ওঠার চেষ্টা করে ঘুরে পড়ে গেলেন। কিন্তু কারুকে ধরে তোলার সুযোগ দিয়ে নিজেই আবার উঠে দৌড়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

শান্তি আর প্রতাপ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর প্রতাপ বললেন, কাল ওঁকে বেরুতে দিস না। আমাকে ডাকিস। আমি কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।

পরদিন সকালে বিশ্বনাথ পালালেন না। ভোর থেকে গলা সাধতে লাগলেন। নিজের ঘর থেকে শুনে প্রতাপ বুঝতে পারলেন, ওস্তাদজীর গলা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তারসপ্তকে ঠিক পর্দা লাগছে না, মীড়ের কাজ করতে গেলেই কেশে ফেলছেন।

প্রতাপ তৈরি হয়ে নিলেন। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে হলে টাকা লাগবে। প্রতাপের কাছে কিছু নেই। বাড়ি থেকে আসার সময় কেন বেশকিছু টাকা সঙ্গে আনেননি, সেকথা ভেবে প্রতাপের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হলো। ওস্তাদজীর এখন এই অবস্থা, তার কাছ থেকে এখন কিছুতেই টাকা চাইতে পারবেন না প্রতাপ।

মাকে খুঁজতে খুঁজতে প্রতাপ ওপরের ঠাকুর ঘরে চলে এলেন। সুহাসিনী জপে বসেছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অন্য সময়ে ছেলের উপস্থিতি টের পেলেই সুহাসিনী জপের মন্ত্র-ট ভুলে গিয়ে কথা বলতে শুরু করতেন। আজ তিনি নিমগ্ন।

সুহাসিনী মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম সারার পর প্রতাপ বললেন, মা, জামাইবাবুকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবো..আমি এবার সঙ্গে টাকা আনতে ভুলে গেছি…তোমার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে? আমি কলকাতায় ফিরেই পাঠিয়ে দেবো।

সুহাসিনী মুখে কিছু বললেন না। ঠাকুরের মূর্তির পাশ থেকে কড়ি বসানো লাল রঙের লক্ষ্মীর ঝাঁপিটি তুলে এনে দিলেন প্রতাপের হাতে।

প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, এটাই গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সুহাসিনীর খরচার হাত। কোনোদিন টাকা জমানো স্বভাব নয় তার। মাঝে মাঝে এই লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে আট আনা একটাকা ফেলে রাখেন। সব মুদ্রাগুলিতেই সিঁদুর মাখানো। লক্ষ্মীর ঝাঁপিটি উপুড় করে প্রতাপ মুদ্রাগুলো গুণলেন। সব মিলিয়ে একশো তেইশ টাকা, এর মধ্যে টাক মাথা পঞ্চম জর্জের মুখ আঁকা রূপোর মুদ্রাও রয়েছে কয়েকটা।

প্রতাপ মায়ের দিকে তাকালেন। সুহাসিনী বললেন, যা ঘুরে আয়।

হঠাৎ প্রতাপের কান্না পেয়ে গেল। তার মায়ের এই শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন ভাব তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। একটি দুরন্ত শিশু সব খেলাধুলো ভুলে গিয়ে মাটিতে চুপ করে শুয়ে আছে–এই দৃশ্য দেখলে যেমন লাগে! মা কি আর কোনোদিনও আগের মতন হবেন না?

মুখ ফিরিয়ে প্রতাপ দ্রুত নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।

বিশ্বনাথ প্রতাপের সঙ্গে বেরুতে আপত্তি করলেন না। পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবি পরলেন। তার হাতে চুরুট নেই। সিগারেটও চাইলেন না প্রতাপের কাছে। টাঙ্গায় উঠে বললেন, বম্পাস টাউনে ডাক্তার দুবের কাছে চলো, তার সঙ্গে আমার চেনা আছে। ভালো ডাক্তার।

খানিক দূর যাবার পর বিশ্বনাথ বললেন, ব্রাদার, ডাক্তারের কাছে যাবার আগে চলো কোথাও। বসে ভালো করে চা খাই। বাড়িতে বসে তো সব কথা বলা যায় না, তোমাকে আমার প্ল্যান-প্রোগ্রামটা জানানো দরকার।।

প্রতাপ বললেন, আগে ডাক্তারের কাছে ঘুরে আসি। তারপর আপনার কথা শোনা যাবে।

বিশ্বনাথ প্রতাপের পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, খুব রেগে আছো, আমার ওপর, তাই না? আমরা সবাই মিলে তোমার কাঁধে যদি ভূত হয়ে চাপি, তখন সহ্য করতে পারবে? আজকাল কাঁধে ভূত চাপার চেয়েও আত্মীয়-স্বজন চাপা অনেক বেশি ডেঞ্জারাস! ধরো, ডাক্তার স্পষ্ট রায় দিল যে আমার আর কোনো কাজ-কর্ম করা চলবে না। তখন আমার সংসারটাকে খাওয়াবে। কে? তুমি? তোমার কাঁধ কতখানি চওড়া? সামান্য মাইনের টাকা তো ভরসা!

প্রতাপ কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।

বিশ্বনাথ আবার বললেন, যৌবনকালটা গান-বাজনার চর্চা করে কাটিয়েছি, জীবিকা অর্জনের জন্য কিছু শিখিনি। গানবাজনাকে কমার্শিয়ালাইজড করতে গেলেও টেকনিক লাগে, সে যোগ্যতা আমার নেই, এই বয়েসে আর পেরে উঠবো না। আমরা ছিলাম ল্যান্ডেড জেন্ট্রি, হঠাৎ ডিক্লাসড হয়ে গেছি, তার মূল্য দিতে হবে না? নিজস্ব বাড়ি ছিল। জমি-জায়গা ছিল, তার থেকে আয় ছিল, সেই ভরসাতেই জীবনটাকে গঠন করতে চেয়েছিলাম যৌবন কালে। সব মানুষ কী আর জীবিকার ধান্ধায় ঘুরবে, কিছু কিছু মানুষ তো উৎকট খেয়াল নিয়েও থাকবে। এখন সেসব নেই, হঠাৎ সব খুইয়ে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়লে পিরবো কেন? আমাদের মতন কিছু কিছু মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে! এটাকে নিয়তি বলতে পারো।

প্রতাপ বললেন, তা বলে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে না?

বিশ্বনাথ মৃদু হেসে বললেন, শুধু বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়, বাঁচার একটা ডিগনিটি থাকা দরকার তো। আমি অশক্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবো, তুমি আমার ওষুধ কিনে দেবে, আমার বউ-মেয়েকে তুমি খাওয়াবে, পরাবে, এরকম একটা অপমানের অবস্থার মধ্যে তুমি আমাকে ফেলতে চাও? আমি কী প্ল্যান করেছি, সেটা শোনো। এখন আমি প্রাণপণে রোজগার বাড়াবার চেষ্টা করে যাচ্ছি, সে যেমন করেই হোক। বাড়িটাতে আরও দুখানা ঘর বাড়াবো। আমি হঠাৎ মরে গেলে, ঐ বাড়ির একটা পোরশান ভাড়া দিয়েও তোমার মা আর ছোড়দির কোনোক্রমে চলে যাবে। আমার মেয়েটা বড় হলে তুমি ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করে দিও। আর যে-কটা দিন বাঁচি আমাকে নিজের মতন বাঁচতে দাও।

–নিজের মতন বাঁচা মানে প্রত্যেকদিন মাতাল হওয়া?

–মদ খেলে শরীরটা কিছুক্ষণ চাঙ্গা থাকে। ধরে নাও, ওটাই আমার ওষুধ। তাছাড়া নেশা করলে আজেবাজে কাজকর্ম করার গ্লানি ধুয়ে যায়। আমি যা করছি, ভেবেচিন্তেই করছি।

প্রতাপ একটুক্ষণ চুপ করে থাকতে বিশ্বনাথ বললেন, তা হলেই বুঝলে, ডাক্তারখানায় গিয়ে কোনো লাভ নেই। টাঙ্গাটাকে অন্যদিকে যেতে বলি?

প্রতাপ এবার দৃঢ় গলায় বললেন, না, আমি আপনার যুক্তি মানি না। এরকম ভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া কাপুরুষতা। দরকার হলে ঐ বাড়ি বিক্রি করেও আপনার চিকিৎসা করাতে হবে। আমার যদি গুরুতর কোনো অসুখ হতো, আপনি সব দিয়ে আমাকে সাহায্য করতেন না?

ডাক্তারের কাছে গিয়ে যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল তার চেয়েও খারাপ কথা শোনা গেল। ডাক্তার দুবে টি বি বিশেষজ্ঞ, এ তল্লাটে অনেক টি বি রোগী আসে, তিনি মুখ দেখে রোগীর অবস্থা বলে দিতে পারেন। থুতু, রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে এসব করাতে হবে তো নিশ্চয়ই, কিন্তু বিশ্বনাথকে দেখেই তিনি ধমক দিয়ে বললেন, এত দেরি করে এসেছেন?

ডাক্তারখানা থেকে বেরুবার পর বিশ্বনাথই প্রতাপকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কী ব্রাদার, মন খারাপ করছো কেন? আমি সহজে যাচ্ছি না, আরও দু-এক বছর ফাঁইট করতে পারবো মনে হয়। চলো, যেখানে গেলে তোমার মন ভালো হবে সেখানে যাই। বুলার সঙ্গে দেখা করবে!

প্রতাপ একটু জোরে বলে উঠলেন, বুলা?

–হ্যাঁ, সে তো এখানেই আছে।

–জানি। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু এখন আমি বুলার বাড়িতে যেতে চাই না। বাজারে চলুন, আপনার ওষুধ-পত্তরগুলো কিনতে হবে।

–আরে ওষুধ পরে কিনলেও হবে। জানি, তোমার টাকা দিয়ে আমার জন্য কিছু ওষুধপত্তর কিনে না দিলে তোমার শান্তি হবে না। ঠিক আছে, সেইসব ওষুধ খাবো। কিন্তু এখন চলো। বুলার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যাক। তাকে আমার রোগের বিষয়ে যেন কিছু বলো না! বিশ্বনাথ প্রায় জোর করেই প্রতাপকে নিয়ে গেলেন বুলাদের বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *