দশমীর পর একাদশী।
একাদশীর দিন তখনও ভাল করে সকাল হয় নি, লারমোরের জীর্ণ ফিটন গাড়িটা এসে হাজির। বিনুর তখনও ঘুম ভাঙে নি। হেমনাথ ডাকতে লাগলেন, ওঠ দাদাভাই, ওঠ। লালমোহন দাদুর। ওখানে যাবি না? সে ফিটন পাঠিয়ে দিয়েছে।
চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল বিনু। মনে পড়ল, আজ তাদের লারমোরের গির্জায় যাবার কথা। আজ আর না গিয়ে উপায় নেই। পাছে অবনীমোহনরা ভুলে যান, তাই এই ভোর বেলাতেই ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন লারমোর। চালক সেই বুড়ো রুগণ কাদের।
বাড়িতে ঢুকেই কাদের তাড়া দিতে শুরু করেছে, চলেন হ্যামকত্তা, চলেন।
হেমনাথ বললেন, তুই যে একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছিস কাদের! এতখানি পথ এলি, দু’দন্ড জিরিয়ে নে, কিছু খা। তারপর তো যাবার কথা
না। কাদের ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল।
না কেন?
হুকুম নাই।
হেমনাথ ঈষৎ অবাক, কিসের হুকুম?
কাদের বলল, পা পাইতা বসনের, জিরানের, খাওনের।
হেমনাথ কৌতুক বোধ করছিলেন। চোখ কুঁচকে বললেন, তবে কী হুকুম আছে শুনি?
আমারে এক দন্ড দেরি করতে নিষেধ করছে লালমোহন সাহেব। আইসাই আপনাগো গাড়িতে তুইলা নিয়া যাইতে কইছে।
জোর তলব দেখছি।
হ। কাদের হাসল।
হেমনাথ বললেন, তা হলেও কিছুক্ষণ তোকে বসতে হবে।
ক্যান?
বা রে, আমাদের এখনও মুখটুখ ধোয়া হয় নি। তা ছাড়া বাচ্চাগুলো অতখানি রাস্তা যাবে, যেতে যেতে খিদে পেয়ে যাবে। ওরা কিছু খেয়ে নিক।
উঁহু, উহুঁ– প্রবলবেগে মাথা ঝাঁকাতে লাগল কাদের।
হেমনাথ শুধোলেন, আবার কী হল রে?
হুকুম নাই। লালমোহন সাহেব কইয়া দিছে, খালি মুখ ধোওনের সময় দিতে। খাওন দাওন হগল কিন্তুক আমাগো গির্জায় গিয়া।
চোখ বড় বড় করে হেমনাথ বললেন, বাব্বা!
হেমনাথের মনোভাব খানিক আন্দাজ করতে পেরেছিল কাদের। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, লালমোহন সাহেব যা কইয়া দিছে তাই কইলাম।
বেশ বাবা, বেশ। হিজ ম্যাজিস্টি যখন হুকুম দিয়েছেন তখন তো নড়চড় হবার জো নেই। মুখ ধুয়েই তোমার পুষ্পক রথে উঠছি।
এ বাড়ির সবার এখনও ঘুম ভাঙে নি। যারা ঘুমোচ্ছিল তাদের জাগিয়ে মুখটুখ ধুয়ে নিতে বললেন হেমনাথ। নিজেও ধুয়ে নিলেন, দেখাদেখি ঝিনুক বিনুও ধুলো। তারপর হেমনাথ ওদের দু’জনকে নিয়ে সূর্যবন্দনা সেরে নিলেন।
এদিকে সারা বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সুধা-সুনীতি-অবনীমোহন, প্রায় সকলেই জামাকাপড় পরে বেরুবার জন্য তৈরি। স্নেহলতা অবশ্য যাবেন না। সপ্তমী অষ্টমী, পর পর দুদিন থিয়েটার আর নৃত্যনাট্য দেখতে গিয়েছিলেন। বাড়ির কর্ত্তী তিনি, সর্বময় ঈশ্বরী। রোজই যদি সবার সঙ্গে নাচতে নাচতে বেরিয়ে পড়েন, এত বড় সংসার চলে কী করে? সবে নতুন পাট উঠেছে, সেগুলো দেয়ার ব্যাপার আছে। শুকোবার ব্যাপার আছে। শ্রাবণ ভাদ্র মাসের ডোল বোঝাই আউশ ধান ভানিয়ে রাখতে হবে। তা ছাড়া, কদিন পর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। খই ভাজতে হবে, মুড়ি ভাজতে হবে। পঞ্চাশটা নারকেলের নাড় পাকানো আছে, চন্দ্রপুলি, ছাপা সন্দেশ বানানো আছে, মুড়কি বানানো আছে। চিড়ে কোটা আছে। খই-মুড়ি-চিঁড়ে দিয়ে তিন রকমের মোয়া বানানো আছে। কাজ কি তার এক-আধটা? দায়িত্ব কি সামান্য? কোন দিকে তার নজর না দিলে চলে!
স্নেহলতা যাবেন না। কাজেই শিবানী জানিয়ে দিলেন, তিনিও যাবেন না। সম্পর্কটা যদিও ননদ ভাজের, আসলে তারা যেন অভিন্নহৃদয় দুই সখী। স্নেহলতা না বেরুলে কার সাধ্য শিবানীকে নড়ায়।
দু’রাত গায়ে মাথায় হিম লেগে শরীর খারাপ হয়েছে সুরমার। তিনিও বেরুবেন না।
যাবার মধ্যে সুধা-সুনীতি-অবনীমোহন-ঝিনুক আর বিনু। দেরি না করে তাদের নিয়ে ফিটনে উঠলেন হেমনাথ। ওঠার শুধু অপেক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে দিল কাদের।
স্টিমারঘাট, তারপর বরফ কল, মাছের আড়ত, সেটেলমেন্ট অফিস, আদালত পাড়া পর্যন্ত বিনুর দৌড়। সে সব পেছনে ফেলে ফিটন আরও অনেক দুরে এগিয়ে গেল। জায়গাটা ক্রমশ সরু হয়ে যেখানে শেষ হয়েছে সেটাই গির্জা। তারপর থেকে জল। খুব সম্ভব স্টিমারঘাটের কাছের বড় নদীটা ঘুরে গির্জার পেছনে চলে এসেছে।
গির্জার সব চাইতে বড় বিস্ময় তার তীক্ষাগ্র চুড়োটা, ধীরে ধীরে সরু হয়ে অনেক উঁচুতে আকাশের গায়ে সেটা বিঁধে রয়েছে। সেদিন স্নেহলতার সঙ্গে পুজোর কাপড় বিলোতে বেরিয়ে দুর থেকে চুড়োটা দেখতে পেয়েছিল বিনু।
গির্জার সামনের দিকে খানিক ফাঁকা জমি সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে। কাদের ফিটন নিয়ে সোজা সেখানে চলে এল।
লারমোর বোধহয় দেখতে পেয়েছিলেন, গির্জার ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলেন। তার নীলাভ চোখদুটো খুশিতে আলো হয়ে উঠল। ব্যস্তভাবে বলতে লাগলেন, হেম এসেছে। অবনী এসেছে। আমার দাদা দিদিরা এসেছে। কী আনন্দ যে হচ্ছে!
হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ, আমরা এসেছি। সারাদিনের জন্যে নিজেদের তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। এখন যা ইচ্ছে কর।
লারমোর কী যে করবেন, ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না। ছেলেমানুষের মতো লাফ দিয়ে ফিটনের পাদানেই উঠে পড়লেন। গাড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে অস্থির গলায় বললেন, কী!
কী হল?
রমু কোথায়।
নিচে দাঁড়িয়ে গাড়ির ভেতরকার সবটুকু দেখতে পান নি লারমোর। পাদানে উঠতেই কারা এসেছে আর কারা আসে নি, বুঝতে পারলেন।
হেমনাথ বললেন, রমুটার শরীর ভাল না। আসতে অবশ্য চেয়েছিল, আমিই বারণ করেছি।
লারমোর বললেন, হঠাৎ শরীরটা খারাপ হল যে?
নাটক টাটক দেখে হিম লাগিয়েছিল, তাই—
রমু না হয় আসতে পারে নি। বৌঠাকরুন? শিবুদিদি?
স্নেহলতা শিবানী কেন আসেন নি, হেমনাথ বললেন।
লারমোর বললেন, আনন্দর অর্ধেকটাই মাটি।
একটু নীরবতা। তারপর হেমনাথ তাড়া দিলেন, কী ব্যাপার, গাড়ি থেকে নামতে দেবে না? রাস্তা ছাড়–
লারমোরের খেয়াল ছিল না, রাস্তা জুড়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। বিব্রতভাবে পাদান থেকে তাড়াতাড়ি নিচে নামলেন। হেমনাথরা আর অপেক্ষা করলেন না, দরজা খুলে নেমে পড়লেন।
লারমোর বললেন, এস—
তার সঙ্গে যেতে যেতে হেমনাথ বললেন, আমাদের আনবার জন্যে ভাল লোক পাঠিয়েছিলে বটে।
হেমনাথ কী বলতে চান, বুঝতে না পেরে সন্দিগ্ধ গলায় লারমোর শুধোলেন, কী ব্যাপার বল তো? কাদের অন্যায় কিছু করেছে। কিন্তু ও তো সেরকম লোক না।
হেমনাথ বললেন, আরে না না, শুধু শুধু অন্যায় করতে যাবে কেন? তুমি তো ধরে আনতে বলেছিলে। ও একেবারে আমাদের বেঁধে এনেছে।
কিরকম?
কিরকম আবার, ঘুম থেকে উঠবার পর মুখটা খালি ধুতে পেরেছি। তারপর আর দাঁড়াতে দেয় নি কাদের। নিশ্বাস ফেলতে দেয় নি। টেনে তোমার ওই গাড়িটায় তুলে ফেলেছে।
একটু আগে সংশয় ছিল। দেখতে দেখতে লারমোরের চোখমুখের চেহারা বদলে গেল। নিশ্চিন্ত উৎফুল্ল সুরে তিনি বললেন, যাক, তা হলে যা বলে দিয়েছিলাম তাই করেছে কাদের।
হেমনাথ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, জানো, খেয়ে পর্যন্ত আসতে দেয় নি।
আমি তাও বলে দিয়েছিলাম।
যেমন মনিব তেমনি তো তার কর্মচারী হবে।
লারমোর উত্তর দিলেন না, সকৌতুকে হাসতে লাগলেন।
হেমনাথ বললেন, হেসো না তো। ছেলেমেয়েগুলো এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে আছে। ওদের কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।
আড়ে আড়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে লারমোর বললেন, আর তোমার?
আমারও।
সেই কথাটাই বল। এই জন্যেই এত রাগ?
হেমনাথ হেসে ফেললেন।
হাসতে হাসতে লালমোর বললেন, চল। গিয়েই খেতে দিচ্ছি।
ঘাসের জমিটার পরই চার্চ। এটুকু পথ লারমোরের পিছু পিছু সবাই সেখানে চলে এল।
গির্জাটা কত কালের, কে জানে। তার বয়সের বুঝি আদি-অন্ত নেই। দেওয়ালের গা থেকে বালির আস্তর খসে খসে নানা জায়গায় ইট বেরিয়ে পড়েছে। সে ইটও নোনা-ধরা। শীত-গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ মৌসুমি বাতাসের আঘাতে আঘাতে আর জলের ঘাটে ঘাটে কত জায়গা যে ভেঙেচুরে ক্ষয়ে গেছে! দরজা-জানালাগুলোও আস্ত নেই, উইদের দাঁতে তারা নিশ্চিহ্ন হবার পথে। অশ্বত্থেরা ভিতের তলায় তলায় শিকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে।
গির্জাবাড়িটা কতকাল যে সারানো হয় নি, কতকাল যে তার কলি ফেরানো হয় নি!
ভেতরের চেহারাও বাইরের মতোই। দেওয়ালের কোণে কোণে বছরের পর বছর ঝুল জমছে, মাকড়সার জালের পর জাল বুনে যাচ্ছে। ঘুলঘুলিতে পায়রা আর চড়াইরা বংশপরম্পরায় বাসা বাঁধছে। দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে এ বাড়িতে তাদের স্বত্ব কায়েম হয়ে গেছে যেন।
গির্জায় ঢুকলেই প্রথমে যা চোখে পড়ে তা হল প্রকান্ড বেদির ওপর যিশু-মূর্তি। মানবপুত্র ওখানে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আছেন। সর্বাঙ্গে কোথাও যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, ক্ষমাসুন্দর চোখে মূঢ় অন্ধকার জগতের দিকে তিনি যেন তাকিয়ে আছেন। তাকে ঘিরে স্নিগ্ধ এক জ্যোতির্বলয়।
মূর্তিটির দিকে তাকালে স্বর্গীয় সুষমায় মন ভরে যায়, উত্তেজিত রিপুতাড়িত স্নায়ুর ওপর প্রশান্তি নেমে আসে।
লারমোরের সঙ্গে আসতে আসতে খ্রিস্টমূর্তির কাছে কিছুক্ষণ সবাই থমকে দাঁড়াল।
ভক্তিপূর্ণ মুগ্ধ স্বরে অবনীমোহন বললেন, চমৎকার মূর্তি। তাকালেই প্রাণ ভরে যায়।
হেমনাথ আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। আমি মাঝে মাঝে এসে ওই মূতিটার সামনে বসে থাকি। কী মনে হয় জানো অবনী? মনে হয়, পৃথিবীতে কোনও হীনতা নেই, নীচতা নেই, নোংরামি নেই। এখানে এলে নিজের ভেতর অনেকখানি শক্তি পাওয়া যায়।
অবনীমোহন উত্তর দিলেন না, একদৃষ্টে মানবপুত্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
লারমোর ডাকলেন, এস।
যিশুমূর্তির পেছন দিকে খানিকটা গেলে দু’খানা বড় বড় ঘর। লারমোর একটা ঘরে অবনীমোহনদের নিয়ে এলেন। এক ধারে ছোট্ট তক্তপোশ, তার ওপর এলোমেলো ময়লা বিছানা। আরেক ধারে হাতলভঙ্গ ক’খানা বেতের চেয়ার, একটা মাঝারি টেবিল, দু’টো আলমারি বোঝাই বই আর গদিমোড়া একখানা ইজিচেয়ার। আরেক কোণে দেওয়ালে পেরেক পুঁতে দড়ি খাটানো রয়েছে, তাতে খানকতক ক্ষারেকাঁচা ধুতি এবং ফতুয়া ঝুলছে। এখানে ওখানে এক আধটা বাক্স, মাটির একটা কলসি, দু’টো চীনে মাটির গেলাস, কালি-পড়া হারিকেন ইতস্তত ছড়াননা।
লারমোর বললেন, এই আমার সাম্রাজ্য। বসসা তোমরা, বসো–
সবাই বসলে লারমোর দরজার দিকে মুখ করে ডাকতে লাগলেন, পরানের মা, পরানের মা–
ওদিকের কোত্থেকে সাড়া এল, যাই–
একটু পর একজন বিধবা মধ্যবয়সিনী এ ঘরে এসে দাঁড়াল। নাক পর্যন্ত তার ঘোমটা টানা। লারমোর শুধোলেন, রান্নাবান্নার কতদূর?
মৃদু গলায় বিধবাটি বলল, বসাইয়া দিছি।
মাছ-তরকারি ভাতটাত তুমি রাঁধে। পায়েসটা আমি করব। গোরুগুলো দোয়ানো হয়েছে?
না।
ঠিক আছে, আমি দুইয়ে নিচ্ছি। এখন আমাদের খেতে টেতে দাও। কাল রাত্তিরে পাতক্ষীর আর চমচম এনে রেখেছিলাম। সে সব দিও।
মেয়েমানুষটি স্বল্পভাষিণী। এত লোকজন দেখে সে জড়সড় হয়ে গেছে। ঘোমটার ভেতর মাথা নেড়ে জানাল, লারমোর যেমন বলছে, ঠিক তেমন তেমনই দেবে।
লারমোর আবার বললেন, ডাল হবে, ভাত হবে, বেগুন ভাজা আলু ভাজা, পাঁচ রকমের মাছ এত সব হবে। রান্না শেষ হতে বেলা হেলে যাবে। এখন পেট ভরে না খেলে বাচ্চারা খিদেয় কষ্ট পাবে। যাও যাও, বেশি করে খাবার নিয়ে এস–
লারমোরের কথায় হেমনাথ সায় দিলেন।
বিধবাটি চলে গেল।
একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন হেমনাথ। বললেন, একে কোথায় পেলে লালমোহন? কাজির পাগলার সনাতনের বউ না, যে গেল বছর বর্ষাকালে উদরীতে মরেছে?
হ্যাঁ। লারমোর বলতে লাগলেন, স্বামী মরবার পর থেকে মেয়েটার দুর্গতির শেষ নেই। শরিকেরা যা করবার করেছে, ঠকিয়ে সর্বস্বান্ত করে ওকে রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তারপর দু মুঠো ভাতের জন্যে আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি করে বেড়াচ্ছিল। উদয়াস্ত খাটত। তবু যদি কেউ একটু ভাল মুখে কথা বলত! উঠতে বসতে খালি লাথি আর ঝাটা। এভাবে কি মানুষ বাঁচতে পারে?
তারপর–
তারপর আর কি, পরশু দিন রোগী দেখতে কাজির পাগলা গিয়েছিলাম, সনাতনের বউ এসে আমাকে ধরল। বলল, আমি তার ধর্মবাপ। তাকে আমার কাছে আশ্রয় দিতে হবে। এ অবস্থায় তো ফেলে আসতে পারি না, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তুমিই বল হেম, ঠিক করি নি?
ঠিকই করেছ। আচ্ছা–
বল– লারমোর উন্মুখ হলেন।
হেমনাথ বললেন, পরান বলে ওর একটা ছেলে ছিল না?
ছিল তো। সে মানুষ হলে তার মায়ের দুঃখ তত ঘুচেই যেত।
সে ছোকরা কোথায়?
বছর তিনেক আগে এক ঢপের দলে গিয়ে জুটেছিল, তারপর থেকে তার পাত্তা নেই।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
লরমোর অবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, পরানের মা বেতের সাজিতে চিড়ে-মুড়ি-ক্ষীর-চমচমের ফলার সাজিয়ে নিয়ে এল। সবার হাতে একটা করে সাজি দিয়ে নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিল সে, লারমোর ডাকলেন, তুমি খেয়েছ?
পরানের মা উত্তর দিল না, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
লারমার বললেন, এখন গিয়ে খেয়ে নেবে, বুঝেছ? মোটে লজ্জা করবে না। এখন থেকে এটা তোমার নিজের বাড়ি।
আধফোঁটা বিব্রত স্বরে পরানের মা বলল, আইচ্ছা। বলে আর দাঁড়াল না।
খাওয়া দাওয়ার পর লারোর বললেন, এতখানি বেলা হল, গোরুগুলো গোয়ালে আটকে রয়েছে। দুধ দুয়ে ওদের ছেড়ে দিই গো যাবে না কি তোমরা? বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন।
অবনীমোহন বললেন, ঘরে বসে থেকে আর কী করব? চলুন আপনার দুধ দোয়া দেখি গে–
এইসময় সুধা বলে উঠল, আপনি সত্যিই দুধ দুইতে পারেন লালমোহন দাদু? সে ভারি অবাক হয়ে গেছে।
মধুর হেসে লারমোর বললেন, গাই দোয়া কি খুব কঠিন কাজ রে দিদি? আমি না পারি কী?
কী কী পারেন তার একটা লিস্ট দিন দেখি– ঘাড় বাঁকিয়ে ভুরু নাচিয়ে সুধা বলল।
সব পারি রে দিদি, সব পারি। ধান ভানতে পারি, চিড়ে কুটতে পারি, জলসই-এর গান গাইতে পারি, আবার পায়েসও রাঁধতে পারি।
সে পায়েস খাওয়া যাবে তো?
খেয়েই বলিস। ওটা তো আজ আমিই রাঁধব।
একটু ভেবে নিয়ে সুধা বলল, আমার মতো নাচতে পারেন আপনি?
মাথাটা সামনের দিকে অনেকখানি নিচু করে লারমোর বললেন, ওইখানটায় তোর জিত দিদিভাই। এই বয়েসে কোমর আর ঘোরে না। যদি সেই বয়েসে তোর সঙ্গে দেখা হতো রে–
সুধা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, তা হলে কী হত শুনি?
সে কথা কি হাটের মাঝখানে বলা যায়?
তবে কোথায় বসে বলা যায়?
নির্জনে দুজনে—
লারমোরের কথা শেষ হবার আগেই হেমনাথ হুঙ্কার দিলেন, অ্যাইও–
লারমোর ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, কী হল হে? অমন হুমকে উঠলে? ল্যাজে পা পড়েছে মনে হচ্ছে।
‘একশ’ বার পড়েছে। আমার হেড বেগমের কানে নির্জনে কী বলতে চাও হে বেয়াদপ? জানো তোমার গর্দান চলে যেতে পারে।
দুঃখিত, দুঃখিত। একে যে তোমার হেড বেগম করে বসে আছ, বুঝতে পারি নি। বলতে বলতে করুণ চোখে সুধার দিকে তাকালেন লারমোর। হেমনাথকে দেখিয়ে বললেন, ওই কালো কষ্টিপাথরটাকে মন প্রাণ সঁপে না দিয়ে–
সুধা ভেংচে উঠল, আহা-হা–
লারমোর এবার নিজের বুকে আঙুল রেখে আবেগপূর্ণ গলায় বললেন, এই গোরাদের গলায় যদি বরমাল্য দিতিস রে সুধারানী–
সুধা আগের মতোই ভেংচাতে লাগল, অসভ্য কোথাকার—
সবাই হাসছিল। হাসাহাসির ভেতর একসময় লারমোর গির্জার পেছন দিকে এসে পড়লেন।
গির্জার পর অনেকখানি ফাঁকা মাঠ, তারপর নদী। মাঠটার এক ধারে সারি সারি খানকতক টিনের ঘর। একটা ঘরে দেখা গেল অনেকগুলো ধানের ডোল, আরেক ঘরে চার পাঁচটা গোরু বাঁধা। এটাই সম্ভবত গোয়াল।
গোয়ালঘরের কাছে এসে লারমোর ডাকতে লাগলেন, কাদের, কাদের–
তৃতীয় ঘরখানা থেকে কাদের বেরিয়ে এল। কখন কোন পথ দিয়ে সে এখানে এসে ঢুকেছিল, কেউ টের পায় নি।
লারমোর বললেন, দুধ দোয়াব, পেতলের দু’টো বলতি আর তেলের বাটি নিয়ে আয়।
কাদের চলে গেল।
বিনু হঠাৎ বলে উঠল, কাদের তো আপনার কাছে থাকে, না লালমোহনদাদু?
হ্যাঁ। যে ঘরটা থেকে কাদের বেরিয়ে এসেছিল সেটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে লারমোর বললেন, ওটা কাদের আর চম্পকের ঘর।
চম্পক কে?
ওই যে ঘোড়াটা, যেটা আমাদের ফিটন টানে। ওর আরেকটা নামও আছে–গোপাল। বিনু অবাক। ওই রোগা চেহারার বুড়ো হাড্ডিসার ঘোড়াটার যে নাম থাকতে পারে, তাও এরকম চমকপ্রদ শৌখিন নাম–কে ভাবতে পেরেছিল! গোপাল না হয় মেনে নেওয়া যায় তাই বলে চম্পক! বিমূঢ়ের মতো বিনু তাকিয়ে থাকল। অনেকক্ষণ পরে বলল, ঘোড়াটা আর কাদের এক ঘরে থাকে!
হ্যাঁ।
অন্য সকলেও অবাক হয়ে গিয়েছিল। সমস্বরে তারা বলল, কেন?
আর বলল না– লারমোর বলতে লাগলেন, চম্পককে ছাড়া এক মুহূর্ত সে থাকে না। ঘোড়ার জন্যে আলাদা ঘর করে দিতে চেয়েছিলাম, কাদের রাজি না। ওই চম্পকের সঙ্গেই তার ওঠা বসা, চলা ফেরা। এমনকি ওটার সঙ্গে কথাও বলে সে। পনের বছর আগে ঘোড়াটা কেনা হয়েছিল। তখন থেকেই সে কাঁদেরের বন্ধু, সঙ্গী।
বালতি আর তেলের বাটি নিয়ে কাদের ফিরে এল। তার সামনে ঘোড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ আর কিছু বলল না।
দুধ দোয়াবার সরঞ্জাম এসে গেছে। লারমোর গোয়ালে ঢুকলেন। তার পিছু পিছু বিনুরাও গেল।
গোরর বাঁটে তেল মেখে দুই হাঁটুর ফাঁকে বালতি নিয়ে নিপুণ হাতে দুইতে শুরু করলেন লারমোর। পাঁচটা গরুর দুধে দু’টো বালতি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল।
দুধটা কাদেরকে দিয়ে পরানের মায়ের কাছে পাঠিয়ে গোরুগুলোকে ছেড়ে দিলেন লারমোর। তারা ছুটে গিয়ে সামনের মাঠে শরতের কোমল, সজীব ঘাসে মুখ ডুবিয়ে দিল।
লারমোর বললেন, একটা বড় কাজ হল। চল, জায়গাটা তোমাদের ভাল করে ঘুরিয়ে দেখাই।
গির্জার চারধার, এখানকার নদীতীর, একটু দূরের ঝাউবীথি–দেখতে দেখতে বেলা বেড়ে গেল। ঝকঝকে নীলাকাশের খাড়া পাড় বেয়ে বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে।
আশ্বিন যায় যায়। তবু এখনও রোদে বেশ ধার আছে। সবার কপালে ঘামের দানা জমেছে। হেমনাথ বললেন, আর না, এবার ফেরা যাক।
গির্জায় ফিরে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর অবনীমোহন বললেন, আচ্ছা লালমোহন মামা–
বল– লারমোর উন্মুখ হলেন।
এই গির্জায় আপনি কতদিন আছেন?
মনে মনে হিসেব করে লারমোর বললেন, প্রায় চল্লিশ বছর। এইটিন নাইনটি নাইনে এখানে এসেছিলাম, আর এটা হল গিয়ে নাইনটিন ফরটি।
হঠাৎ কী মনে পড়তে অবনীমোহন বললেন, একটা কথা জানবার খুব ইচ্ছে আমার। যত বারই জানতে চেয়েছি, বলেছেন, পরে বলবেন। আজ কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না।
কী কথা বল তো?
আপনার জীবনের কথা।
স্নিগ্ধ হেসে লারমোর বললেন, শোনাবার মতো কথা কিছুই নেই। অতি তুচ্ছ জীবন আমার।
অবনীমোহন বললেন, তুচ্ছ কিনা, সে আমরা বুঝব। আপনি বলুন—
বেশ, তোমার যখন এত আগ্রহ, শোন লারমোর নিজের জীবনকথা শুরু করলেন।
জন্মসূত্রে লালমোর আইরিশ। ওই পর্যন্তই। আয়ার্ল্যান্ডের কথা আজকাল তার বিশেষ মনেও পড়ে না।
জন্মভূমির নামে মানুষের বুকে আবেগের নদী দুলতে থাকে। তেমন কোনও অনুভূতি লারমোরের মধ্যে অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ।
থাকবেই বা কী করে? সেই কবে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছেন লারমোর, সে কি আজকের কথা! একটা শতাব্দীর প্রায় আধাআধি তো তার এ দেশেই কেটে গেল।
এসেছিলেন যৌবনের শুরুতে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখন তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন। এখানে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরলে জন্মভূমির সেই দেশটাকে ধুধু স্বপ্নের মতো মনে হয়।
লারমোরের স্মৃতি থেকে কত কিছুই তো মুছে গেছে। তবু মনে পড়ে, খুব ছেলেবেলাতেই বাবা মাকে হারিয়েছেন। তারপর খুব দূর সম্পর্কের এক কাকা তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের কাছে বলতে চার্চে।
কাকা বিয়েটিয়ে করেন নি। তিনি ছিলেন গির্জাবাসী সন্ন্যাসী–সেবাব্রতী এবং ধর্মযাজক। বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় তাঁর জীবন উৎসর্গ করা।
লারমোরের দিকে তাকাবার সময় কাকার ছিল না। চার্চের নানা দায়িত্বপূর্ণ কাজে সর্বক্ষণ তাকে ব্যস্ত থাকতে হতো। চার্চে একটা অরফানেজ ছিল, কাকা তাকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। অনেকগুলো অনাথ পিতৃপরিচয়হীন শিশুর সঙ্গে লারমোরের প্রথম জীবন কাটতে শুরু করেছিল।
মনে পড়ে, অরফ্যানেজে ভর্তি করে দিয়েই কাকা তার কর্তব্য শেষ করে ফেলেন নি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু’চার মাস পর পর এসে লারমোরের খোঁজও করতেন। বলতেন, বাবা-মা নেই বলে দুঃখ করো না, প্রভুর হয়তো এটাই ইচ্ছে।
সেই বয়সে লারমোর এসব বুঝতে পারতেন না; বড় বড় অবোধ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেন।
কাকা আবার বলতেন, চারদিকে তাকিয়ে দেখ, জগতে কত ছেলে অনাথ। তোমার তো তবু বলবার মতো একটা পিতৃপরিচয় আছে, ওদের তা-ও নেই। প্রভু করুণাময়, তার উপর বিশ্বাস রাখো। সব দুঃখ ঘুচে যাবে।
সেদিন না হলেও, বড় হয়ে কাকার কথাগুলো বুঝতে পেরেছিলেন লারমোর।
ছাত্র হিসেবে চিরদিনই তিনি অসাধারণ মেধাবী। স্কুলের জীবন শেষ করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। চাচই তার পড়ার খরচ চালাত।
জগতে এত শাস্ত্র থাকতে কেন লারমোর চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুরাগী হয়েছিলেন তার কারণ আছে। কারণটা তার পরিবেশ। ছেলেবেলা থেকেই লারমোর তাঁর চারধারে যা দেখেছেন তা হল কল্যাণময় সেবার জগৎ। দেখেছেন সুখ-সাধকামনা-বাসনা, নিজেদের বলতে যা কিছু সব বিসর্জন দিয়ে সর্বত্যাগী মিশনারির দলকে পরার্থে জীবন সঁপে দিতে। পবিত্র গির্জা, কল্যাণব্রতী ফাদারের দল এবং কাকা এঁরা সবাই মিলে তার অস্তিত্ব যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। তাদের প্রভাব এত বিপুল, এমন সর্বব্যাপী যে তার বাইরে পা বাড়াবার উপায় ছিল না লারমোরের। অমোঘ নিয়তির মতো তারা যেন লারমোরের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করেছিলেন।
লারমোর তখন ভাবতেন ডাক্তার হতে পারলে মানুষের যতখানি সেবা করা যায়, আর কিছুতেই তা সম্ভব নয়। তাই স্কুলের পড়া শেষ করেই মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছিলেন। সেই বয়সেই নিজের ভবিষ্যৎ মোটামুটি স্থির করে ফেলেছিলেন লারমোর।
চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে পড়তে হঠাৎ আরেক দিকে চোখ পড়েছিল তার। চার্চে ভারতবর্ষের ওপর লেখা কিছু বই ছিল। নিতান্ত কৌতূহলের বশে একদিন সেগুলো নিয়ে পাতা ওলটাতে শুরু করেছিলেন। ওলটাতে ওলটাতে কখন যে ইন্ডোলজির বইগুলো তাকে একেবারে কুহকিত করে ফেলেছে, লারমোর নিজেই জানেন না।
ভারতবর্ষের মানুষ, তার গাছপালা, তার দারিদ্র্য, তার পরাধীনতা, তার রূপকথা, সামাজিক রীতিনীতি–সব মিলিয়ে ইন্ডিয়া যেন এক বিচিত্র স্বপ্নের দেশ। পড়তে পড়তে কখনও ব্যথিত হয়েছেন লারমোর, কখনও অস্থির, কখনও বিহ্বল, কখনও বা মুগ্ধ।
চার্চে ক’খানাই বা বই ছিল! যেখান থেকে পারতেন ইন্ডোলজির আরও বই যোগাড় করে পড়তেন লারমোর। পূর্ব গোলার্ধের এক অজানা দেশ তার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল যেন। কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে ভারতবর্ষ তাঁকে অবিরত হাতছানি দিয়ে যাচ্ছিল।
ভবিষ্যৎ আগেই স্থির হয়ে ছিল। কাকা তখনও জীবিত। মেডিক্যাল কলেজের রেজাল্ট বেরুবার পর লারমোর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
কাকা বললেন, তুমি পরীক্ষার ফাস্ট হয়েছ। আই অ্যাম ভেরি হ্যাঁপি মাই বয়। অরফানেজে থেকে কষ্ট করেছ। প্রভু করুণাময় আজ সে কষ্টের পুরস্কার দিয়েছেন। এখন তোমার কাছে সুখ অর্থ-প্রতিষ্ঠা, সব কিছুর দরজা খোলা। জীবনে উন্নতি কর, তাই আমি চাই।
মৃদু গলায় লারমোর বলেছিলেন, অর্থ সুখ-প্রতিষ্ঠায় আমার লোভ নেই। আমি—
তুমি কী?
আমি আপনার মতো মিশনারি হতে চাই।
এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কাকা লারমোরকে বুকের ভেতর টেনে নিয়েছিলেন। আবেগের সুরে বলেছিলেন, গড ব্লেস ইউ মাই বয়। প্রার্থনা করি, জগতের সব চাইতে শ্রেষ্ঠ আনন্দ তুমি লাভ কর।”
লারমোর তার বুকের ভেতর থেকে বলেছিলেন, একটা কথা—
বল।
মিশনারি হয়ে আমি এদেশে থাকতে চাই না।
তবে কোথায় যাবে?
ইন্ডিয়ায়।
দু’চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন কাকা, ইন্ডিয়া!
লারমোর বলেছিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি আমাকে অনুমতি দিন।
কিন্তু–
বলুন—
দ্বিধান্বিত সুরে কাকা বললেন, নিজের দেশ থাকতে ইন্ডিয়া কেন? সেখানকার কতটুকু জানো তুমি?
লারমোর বলেছিলেন, ওরা বড় দুঃখী, বড় গরিব আর পরাধীন। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যা জানতেন সব বলে গিয়েছিলেন তিনি।
কাকা অবাক হয়ে বলেছিলেন, এত সব কী করে জানলে?
বই পড়ে।
একটু নীরব থেকে কাকা বলেছিলেন, যদি মনে করো, ভারতবর্ষের কিছু ভাল করতে পারবে, যাও। আমার আপত্তি নেই। কে কোন জাত, কার গায়ের রং কী, কে কোথাকার বাসিন্দা–এ সব বড় কথা নয়। আসল কথা হল মানুষের কল্যাণ, মানুষের সেবা।
কাকার সম্মতি পাওয়া গেছে, আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছাও তিনি জানিয়েছেন। কাজেই কোথাও কোনও বাধা ছিল না। মিশনারি হয়ে সোজা ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলেন লারমোর।
ভারতবর্ষের আর কোথাও নয়, প্রথমেই তিনি এসেছিলেন কলকাতায়। সেখানে দিন তিন চারেক থেকে পূর্ব বাংলায়-এই রাজদিয়াতে।
আজ রাজদিয়ার এই গির্জাটার জরাজীর্ণ করুণ দশা, সেদিন কিন্তু এরকম ছিল না। চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝক তকতক করত। দেওয়ালগুলোর পলেস্তারা এমন করে খসে পড়েনি। নতুন কলিতে গির্জাবাড়িটাকে চমৎকার দেখাত।
তখন এখানে ছিলেন ফাদার পারকিন্স। পারকিন্সের যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। এদেশে থাকতে থাকতে একখানা খানদানী ম্যালেরিয়া বাধিয়ে ফেলেছিলেন, তার ওপর ছিল বাত। বার মাসই অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হতো। ফলে মিশনের কাজ প্রায় বন্ধ হবার দাখিল। ফাদার পারকিন্সকে সাহায্য করবার জন্যই লারমোর রাজদিয়া এসেছিলেন।
এখানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ফাদার পারকিন্স জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইস্ট বেঙ্গলে আগে কখনও এসেছ?
আজ্ঞে না। লারমোর জানয়েছিলেন, ইস্টবেঙ্গল কেন, ইন্ডিয়াতেই এই আমার প্রথম আসা।
এখানে আসার আগে বাংলা ভাষাটা নিশ্চয়ই শিখে ফেলেছ?
না।
এখানকার হালচালও নিশ্চয়ই জানো না?
না।
এবার স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছিলেন ফাদার পারকিন্স, এদেশের কিছুই জানা নেই, এমন আনকোরা সব ছেলে ধরে ধরে পাঠাবে! এদের দিয়ে যে কী করে কাজ চলবে।
লারমোর উত্তর দেন নি।
ফাদার পারকিন্স আবার বলেছিলেন, এসে যখন পড়েছই তখন কী আর করি। প্রথমে বাংলা ভাষাটা শেখ। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বেরুতেও হবে।
আচ্ছা– তক্ষুনি ঘাড় কাত করেছিলেন লারমোর।
ফাদার পারকিন্স আর দেরি করেন নি; সেদিন থেকেই তালিম দিতে শুরু করেছিলেন।
মাসখানেকের ভেতর বাংলা ভাষাটা কাজ চালাবার মতো শিখে ফেলেছিলেন লারমোর। এর মধ্যে বারকয়েক তাকে বেরুতেও হয়েছিল। যেদিন জ্বরটা নতুন করে আসত না কিংবা বাতের ব্যথাটা ঝিমিয়ে থাকত, সেদিন ফাদার পারকিন্স তাকে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে অথবা দূরের কোনও হাটে পাড়ি জমাতেন। একদিন বলেছিলেন, আমার শরীরের অবস্থা তো দেখছি।
ফাদার পারকিন্স কী বলতে চান বুঝতে না পেরে লারমোর বলেছিলেন, আজ্ঞে
বয়েস হয়েছে। রোগে দুর্বল হয়ে পড়েছি। একদিন ভাল যায় তো তিনদিন বিছানায় পড়ে থাকি। আমি একরকম খরচের ঘরেই চলে গেছি। আমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে চারদিক ভাল করে দেখে নাও। রাজদিয়া গির্জার সব ভার তোমাকেই নিতে হবে।
এ দেশের ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি জেনে না আসার জন্য প্রথম দিন বিরক্ত হয়েছিলেন ফাদার পারকিন্স। তাতে মনে মনে দমে গিয়েছিলেন লারমোর। কিন্তু মাসখানেক নিরন্তর মেলামেশার ফলে বোঝা গিয়েছিল, ফাদার পারকিন্স মানুষটি বেশ সজ্জন, বিবেচক, হৃদয়বান। কোনও ব্যাপারে লারমোরের অসুবিধা হচ্ছে কিনা, আস্বাচ্ছন্দ্য ঘটছে কিনা–সে সব দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ লক্ষ্য। ধীরে ধীরে মানুষটিকে ভালই লেগেছিল লারমোরের।
সেদিন কথার উত্তরে লারমোর বলেছিলেন, এ আপনি কী বলছেন?
কী বলছি?
আপনি থাকতে গির্জার ভার আমি নেব! আমি জানিই বা কী, বুঝিই বা কী?
ফাদার পারকিন্স হেসেছিলেন, আমি তো চিরকাল থাকব না। শরীরের যা আবস্থা তাতে আজ আছিঃ কাল নেই। আমি যখন থাকব না তখন কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হবে।
লারমোর ব্যথিত সুরে বলেছিলেন, মৃত্যুর কথা এখনই ভাবছেন কেন? অত বয়েস আপনার। হয়নি।
তার পিঠে হাত রেখে ফাদার পারকিন্স বলেছিলেন, যতই তুমি কমাতে চাও না, যথেষ্ট বয়েস আমার হয়েছে। বয়েসটা বড় কথা নয়, শরীর যদি ভাল থাকত! অসুস্থ রুগণ দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা বিড়ম্বনা। সে যাক গে, যতদিন বাঁচব রাজদিয়াতে আছি, ততদিন তোমার চিন্তা নেই।
হাটে-গঞ্জে কি সুদূর নদীর চরে গিয়ে ফাদার পারকিন্স কিছুক্ষণ জিরোতেন। জিরোতে জিরোতে বলতেন, আমার দেশ ব্রিটেন, তোমার আয়াল্যান্ড। জন্মভূমি ছেড়ে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে কেন আমরা এত দূরে এসে পড়ে আছি, বল তো?
লারমোর বলতেন, আজ্ঞে আমরা মিশনারি। মানুষের কল্যাণের জন্যে, তাদের সেবা করতে–
বাধা দিয়ে ফাদার পারকিন্স বলতেন, সেবা টেবা তো আছেই। আরও একটা বড় ব্যাপার আছে।
কী?
প্রিচিঙ। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে অন্ধকারের বাসিন্দারা কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। তাদের আলোকমন্ত্রে দীক্ষা দিতে হবে। সেই জন্যেই আমরা মিশনারিরা সারা ওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে পড়েছি। যেখানে যতদূরে যে মানুষই থাক, প্রভুর বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াতেন ফাদার পারকিন্স, দেখে কিভাবে প্ৰিচ করতে হয়, কিভাবে সন্স অফ সিনারদের আলোকের মাঝখানে নিয়ে আসতে হয়। দেখে দেখে শেখো। এরপর তোমাকেও এভাবে প্রিচ করতে হবে।
লারমোর কিছু বলতেন না; অসীম কৌতূহলে তাকিয়ে থাকতেন।
এবার আর লারমারের দিকে নজর থাকত না ফাদার পারকিন্সের। নদীর চর কিংবা হাটের জনতাকে ডেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেন, আইস আইস পাপাচারীর সন্তানেরা, তোমাদের আমি আলোকের পথে লইয়া যাইব। প্রভু যিশুই সেই আলোক, যিশুই পথ। নিজের রক্তে তিনি এই জগৎকে শুচি করিয়া গিয়াছেন। এইভাবে অনেকক্ষণ চেঁচাবার পর হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়তেন। লারমোরকে বলতেন, দেখলে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। লারমোর মাথা নাড়তেন।
আমার বয়েস হয়েছে, বেশিক্ষণ চেঁচাতে পারি না। বাংলা ভাষাটা তো কাজ চালাবার মতো শিখেছ। এবার তোমাকেই কিন্তু প্ৰিচ করতে হবে।
আচ্ছা–
আসার সময় থলে বোঝাই করে মথি আর লুক লিখিত সুসমাচার আনা হতো, নির্দেশমতো হাটুরে অথবা চরের মানুষদের হাতে হাতে বিলিয়ে দিতেন লারমোর।
এইভাবে মাস পাঁচেক কাটল। তারপর ফাদার পারকিন্স নিজের সম্বন্ধে যা আশঙ্কা করেছিলেন তা-ই ঘটল। তিনদিনের ধুম জ্বরে মারা গেলেন।
ফাদার পারকিন্সের মৃত্যুর পর রাজদিয়া গির্জার সব দায়িত্ব এসে পড়ল লারমোরের হাতে। পারকিন্স যেমন যেমন শিখিয়েছিলেন, প্রথম প্রথম তাই করতেন লারমোর। চার্চের সম্পত্তি দুটো নৌকো আর একখানা ফিটন ছিল। ফিটন চালাত কাদের। এখানে আসা থেকেই কাদেরকে দেখেছেন লারমোর, সে তার দীর্ঘকালের সহচর। খরার দিনে ফিটন, নইলে নৌকো করেই প্রচার করতে বেরুতেন লারমোর। সুজনগঞ্জে, কমলাঘাটে কি রসুলপুরের হাটে কিংবা নদীর চরে চরে ঘুরে তিনি চেঁচাতেন, ওই মহাপ্রলয় আসিল, ওই ঘন ঘন বজ্রপাত হইতে লাগিল। আইস আইস’
চিৎকারের পর সুসমাচার বিতরণ। তারপর চার্চে ফিরে আসা।
এই নিয়মেই দিন যাচ্ছিল, দিন আসছিল। এর মধ্যে হঠাৎ একটা মজার ব্যাপার ঘটল।
সেদিন সুজনগঞ্জে প্ৰিচ করছিলেন লারমোর। কৌতূহলী জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল।
যথারীতি আলোকমন্ত্রে দীক্ষার কথা বলে সুসমাচার বিলি করতে শুরু করলেন লারমোর। লালচে কাগজে ছাপা চার পৃষ্ঠার পুস্তিকাগুলো প্রতি হাটেই তিনি নিয়ে যান। সবাই হাত পেতে নেয়, কিছু বলে না। সেদিন কিন্তু কালো দোহারা চেহারার একটি যুবক, তারই সমবয়সী হবেন, সুসমাচারটা নিয়ে বললেন, আপনি বুঝি এখানে নতুন?
থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন লারমোর। ছ’আট মাস প্ৰিচ করছেন, সুজনগঞ্জের হাটে তার চারধারে যারা ভিড় জমায় তাদের সকলেই তার মুখচেনা। জনতার মধ্যে যুবকটিকে আগে আর কখনও দেখেন নি।
লারমোর বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমি নতুন। ক’মাস হল, এ দেশে এসেছি।
তাই হবে। মাসকয়েক আমি এখানে ছিলাম না। থাকলে আগেই আপনার সঙ্গে আলাপ হতো। আপনি নিশ্চয়ই রাজদিয়ার চার্চে আছেন?
হ্যাঁ।
তা একা প্ৰিচ করতে বেরিয়েছেন যে? ফাদার পারকিন্স কোথায়?
ফাদার পারকিন্সকে আপনি চেনেন!
চিনি বৈকি। আমাদের অনেক দিনের পরিচয়। উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন।
একটু চুপ করে থেকে লারমোর বলেছিলেন, ফাদার পারকিন্স নেই।
যুবকটি যেন চকিত হয়ে উঠেছিলেন, মানে!
মাস চারেক হল মারা গেছেন।
আক্ষেপের সুরে যুবক বলেছিলেন, উনি মারা গেলেন, অথচ আমি জানতেই পারি নি। ওঁর কাছে কত আবদার করেছি, কত উৎপাত করেছি– বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর লারমোরই জিজ্ঞেস করেছিলেন, এখানে আপনি কোথায় থাকেন? রাজদিয়ায়। রাজদিয়ার দক্ষিণ দিকের শেষ বাড়িখানা আমাদের।
তবে তো ভালই হল। মাঝে মাঝে চার্চে আসবেন।
নিশ্চয়ই আসব।
একটু ভেবে লারমোর বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে আলাপ টালাপ হল। নামটাই কিন্তু জানা হয় নি ভাই–
যুবক বলেছিলেন, আমার নাম হেমনাথ মিত্র।
আরেকটা কথা—
বলুন–
তখন বললেন না মাঝখানে কমাস আপনি এখানে ছিলেন না—
হ্যাঁ।
কোথায় ছিলেন তবে?
ঢাকায়। ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষাটা বাকি ছিল। সেটা দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে এলাম।
কী সাবজেক্ট ছিল আপনার?
দর্শন–
আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভাল লাগল। আসবেন কিন্তু চার্চে। আপনার জন্যে আমি অপেক্ষা করে থাকব।
সেদিন ওই পর্যন্ত।
পরের হাটে আবার হেমনাথের সঙ্গে দেখা। ওই জলপ্রলয় আসিল, ওই ঘন ঘন বজ্রপাত হইতে লাগিল– বলে কণ্ঠস্বর যখন শীর্ষবিন্দুতে তুলেছেন লারমোর সেই সময় চোখে পড়েছিল, হাটুরে জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন হেমনাথ, ঠোঁট টিপে টিপে হাসছেন।
অমন হাসির কারণ কী থাকতে পারে? মনে মনে অস্বস্তি বোধ করেছিলেন লারমোর।
প্রিচিঙের পর সুসমাচার বিতরণ টিতরণ হয়ে গেলে লারামোর, হেমনাথের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ভাল আছেন?
হেমনাথ ঘাড় কাত করেছিলেন আছি। আপনি?
ওই একরকম। আপনাকে কিন্তু চার্চে খুব আশা করেছিলাম। রোজই ভেবেছি, আসবেন। আসেন নি।
বিব্রতভাবে হেমনাথ বলেছিলেন, বাড়ির ক’টা কাজে আটকে গিয়েছিলাম। দু’একদিনের ভেতর ঠিক যাব।
লারমোর বলেছিলেন, বুঝতেই পারেন, এদেশে নতুন এসেছি। আপনজন কেউ নেই। ফাদার পারকিন্স ছিলেন, তিনি তো মারাই গেছেন। চার্চে যতক্ষণ থাকি একরকম মুখ বুজে থাকতে হয়। আপনাকে কেন জানি সামান্য আলাপেই বন্ধু বলে ভাবতে শুরু করেছি।
নিশ্চয়ই ভাববেন। দেখবেন, এরপর থেকে চার্চে এতবার হানা দেব যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবেন।
দেখা যাবে।
একটু চুপ। তারপর সামান্য দ্বিধার সুরে লারমোর বলেছিলেন, একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছে।
স্বচ্ছন্দে।
আমি যখন হাটের লোকগুলোর কাছে প্রভু যিশুর কথা, বাইবেলের কথা বলছিলাম তখন হাসছিলেন কেন?
এমনি।
না, এমনি না। কারণ আছে।
হেমনাথ স্বীকার করেছিলেন, আছে।
কী সেটা? জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিলেন লারমোর।
তার আগে বলুন আপনি এদেশে কী করতে এসেছেন?
ধরুন প্ৰিচ করতেই।
তাহলে বলব আপনার আসাটা পুরোপুরি বিফলে যাবে।
কেন? লারমোরের চমক লেগেছিল।
হেমনাথ বলেছিলেন, যে ভাষায় আপনি ওদের বোঝাতে চাইছেন সেটা ওদের ভাষা নয়। ওরা তা বোঝে না।
কিন্তু–
বলুন।
এটা তো বাংলা ভাষাই।
একশ’ বার।
তবে?
হেমনাথ বলেছিলেন, তাহলে পরিষ্কার করেই বলি। ধরুন আমি বাঙালি। এই হাটে যত মানুষ। আছে তারাও বাঙালি। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। যতখানি ভাবতে পারি, বুঝতে পারি, ওরা নিশ্চয়ই তা পারে না। সাধারণ মানুষের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের বোঝাতে হলে সেটা জানা দরকার। সেটা না জানলে ওদের কাছে পৌঁছনো যাবে না।
কিন্তু–
কী?
শুনেছি, ফাদার পারকিন্সও এখানে কুড়ি বছরের মতো কাটিয়েছেন। তিনিও ওই ভাষাতেই প্ৰিচ করতেন। আপনার কি ধারণা, কুড়ি বছর ধরে তিনি ভুল করে গেছেন?
উত্তর না দিয়ে একটা হাটুরে লোককে ডেকে এনেছিলেন হেমনাথ। জিজ্ঞেস করেছিলেন, পাদ্রীসাহেব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যা বলছিলেন, বুঝতে পেরেছি?
লোকটা মাথা নেড়েছে, আইজ্ঞা না। বড় পাত্রীও (পারকিন্স) এইরকম খটর মটর কইরা কী জানি কইত। কার বাপের সাইধ্য বোঝে।
আচ্ছা, তুমি যাও।
লারমোরের চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গিয়েছিল যেন। লোকটা চলে গেলে বলেছিলেন, এই জন্যেই বুঝি তখন মিটিমিটি হাসছিলেন।
হেমনাথ ঘাড় হেলিয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ।
কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাষা শিখব কী করে?
তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। তাদের প্রতিদিনের সুখদুঃখের ভাগীদার হতে হবে। তবেই শেখা যাবে।
লারমোর এবার নীরব থেকেছেন।
হেমনাথ আবার বলেছিলেন, ফাদার পারকিন্স সম্বন্ধে আমার কী ধারণা জানেন?
কী?
কুড়ি বছর প্ৰিচ করেও খুব একটা কিছু উনি করতে পারেন নি।
লারমোর চুপ।
হেমনাথ থামেন নি, এই প্রিচিঙের ব্যাপারে আমার একটা কথা মনে হয়।
কী কথা?
বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলেন হেমনাথ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে সবে আলাপ হয়েছে, এক্ষুণি বললে আপনি আহত হবেন, ভুলও বুঝতে পারেন। তাই এখন নয়, তেমন বুঝলে পরে বলব।
পরেই বলেছিলেন। ততদিনে লারমোরের সঙ্গে বন্ধুত্বের রং পাকা হয়ে গিয়েছিল। ভুল বোঝার অবকাশ আর ছিল না। দিনে তিন বার করে তখন তিনি চার্চে আসতেন। আপনি’ থেকে কবে যে সম্বোধনের ভাষাটা তুমি’তে নেমেছিল, নিজেদেরই খেয়াল নেই।
হেমনাথ বলেছিলেন, আমার কী মনে হয় জানো, এই প্রিচিঙের কোনও প্রয়োজন নেই।
ভ্রূ ছোট করে লারমোর শুধিয়েছিলেন, কেন?
এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে নিয়ে মানুষের এক উপকার করা যায় বলে আমার মনে হয় না।
কিন্তু–
কী?
খ্রিস্টধর্ম জগতের সব চাইতে সেরা ধর্ম, এটা তো তুমি মানবে।
খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে আমার অসীম শ্রদ্ধা। কিন্তু কোনও ধর্মের চাইতে কোনও ধর্ম খাটো, এ আমি মানি না।
অনেক তর্কাতর্কির পর হেমনাথ বলেছিলেন, তুমি অন্য ধর্ম সম্বন্ধে কতটুকু জানো?
কিছু কিছু জানি।
আমার কাছে অনেক বই আছে, ভাল করে পড়ে দেখ। দেখবে কোনও ধর্মই অ্যান্টি-হিউম্যান নয়।
বেশ, বইগুলো দিও।
অন্য ধর্ম সম্বন্ধে লারমোরের ধারণা ছিল ভাসা ভাসা, অস্বচ্ছ। বইগুলো পড়বার পর তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আলোড়ন শুরু হয়ে গিয়েছিল। চোখের মণিতে নতুন ছটা এসে লেগেছিল যেন। মনে হয়েছিল, প্রিচিঙ নিরর্থক। যুগযুগান্ত ধরে আপন পিতৃপুরুষের ধর্মবোধ নিজের অস্তিত্বে ধারণ করে মানুষ হয়তো পরম শান্তিতে আছে, তাকে উন্মুল করে অন্য মাটিতে স্থাপন করতে যাওয়া ঠিক নয়। সম্ভবত তা নিষ্ঠুরতাও। লারমোর স্থির করেছিলেন, আর প্রিচিঙ করবেন না। অন্যভাবে মানুষের কল্যাণের কথা ভাববেন। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, আলাদা কথা।
সিদ্ধান্তটা নেবার সঙ্গে সঙ্গে বিপদ ঘটেছিল। কলকাতার মিশন এখানকার গ্রান্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। সে কথা হেমনাথকে বলতেই একখানা উষ্ণ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার বাবা তখনও জীবিত। বাবাকে বলে চার্চের নামে পাঁচিশ বিঘে জমি লিখে দিয়েছিলেন। ওই জমি থেকেই চার্চের খরচ চলবে।
লারমোর বলেছিলেন, খাওয়া-পরার ব্যাপারে তো নিশ্চিন্ত করলে। কিন্তু আরেক দিক থেকে যে ভাবনা বাড়ল। প্রিচিঙ ছিল, তবু একটা কাজের মধ্যে থাকতাম। এখন থেকে যে একেবারে নৈষ্কর্ম ব্রত।
হেমনাথ বলেছিলেন, কে বললে? এখন থেকেই তো আসল কাজ শুরু।
কিরকম?
তুমি ডাক্তার তো?
হ্যাঁ।
এ দেশ বড় গরিব। বিনা চিকিৎসায়, বিনা ওষুধে ভুগে ভুগে কত মানুষ যে প্রতিদিন মরে যাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে হাটে-হাটে ঘুরে তাদের সেবা শুরু কর। দেখবে কাজের অন্ত নেই।
ঈশ্বরের নির্দেশ যেন হেমনাথের মধ্যে দিয়ে এসে গিয়েছিল। লারমোর তার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।
তারপর কত বছর কেটে গেছে। পূর্ব বাংলার গাছপালা, শস্যপূর্ণ মাঠ, নদী, বন, মনোহর পাখির ঝাক, এখানকার মানুষ, তাদের সুখদুঃখ, শোক-উৎসব–সমস্ত একাকার হয়ে লারমারকে যেন মগ্ন করে রেখেছে।
কাহিনী শেষ করে লারমোর হাসলেন, এই আমার জীবন। অতি সামান্য, অতি তুচ্ছ। নিশ্চয়ই তোমাদের ভাল লাগল না।
কেউ কোনও কথা বলল না, অভিভূতের মতো সবাই বসে থাকল
এদিকে সূর্যটা কখন যে খাড়া মাথার ওপর এসে উঠেছে সেদিকে চোখ পড়তেই লারমোর চঞ্চল হলেন, চল চল। ঢের বেলা হয়ে গেছে। চান টান সেরে নেওয়া যাক।