ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
চারি দিকে মালঞ্চের বেড়া
অবিশ্বাসী পিতা আমার সহজে কিছু বিশ্বাস করতে চান না। আমাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললেন, যাক, বিনা পয়সায় ম্যাজিক দেখে এলেন। আধ্যাত্মিক ম্যাজিক।
বিশ্বাসী মাতামহের মনে বড় লাগল। তিনি বললেন, আচ্ছা, আমি না হয় বোকা বুড়ো। গাধাতে আর আমাতে কোনও তফাত নেই; কিন্তু আমার এই বুদ্ধিমান নাতিটিকে তুমি জিজ্ঞেস করো। এক তুড়িতে সে প্রায় ঘণ্টা আড়াই মৃতের মতো পড়ে রইল। দেহ রইল আশ্রমে, মন ছুটল ভুবন ভ্রমণে।
আরে মশাই, ওকে বলে সম্মোহন। ও বিদ্যে আমাদের পি সি সরকারও জানেন। তা হলে তো হুডিনিকে এনে গেরুয়া পরিয়ে আশ্রমে বসাতে হয়।
মাতামহ তর্কের হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি যখন বিশ্বাস করবে না তখন কার ক্ষমতা তোমাকে বিশ্বাস করায়! তুমি ভূত মানলেও ভগবানকে একেবারেই মানতে চাও না। ভগবানের কী যে খেলা!
বিশ্বাস অবিশ্বাস জানি না, আসলে আমার অত অবসর নেই। জীবন ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে, এখনও অনেক কাজ বাকি। যতটা পারা যায় ততটা সেরে যেতে হবে তো। কে জানে আর আসা। হবে কি না! আমি দুটো ঘটনা বিশ্বাস করি, জন্ম আর মৃত্যু, আর বিশ্বাস করি সময়ের গতি। সময়ের নদীতে, বিভিন্ন দূরত্বে বাঁশের খোটার মতো আমরা পোঁতা রয়েছি। হুহু করে জল ছুটছে উলটো দিকে। স্রোত কখনও প্রবল, কখনও মৃদু। টাইম টেকস অল।
তুমি প্রারব্ধ বিশ্বাস করো না? তুমি পুনর্জন্ম বিশ্বাস করো না?
আমি যা দেখি তাই বিশ্বাস করি। অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে চাই না। জন্ম দেখি, বিশ্বাস করি। সেটা পুনর্জন্ম কি না, অনর্থক সেই বিচারে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। মৃত্যু দেখি, বিশ্বাস করি। প্রকৃতিতে শক্তির খেলা দেখি, বিশ্বাস করি। ন্যাচারাল ফোর্সেস। বিশ্বাস করি নিজের শক্তিকে, মেধাকে। হু ইজ গড? ভগবান আবার কে?
মাতামহ ভীষণ আহত হয়ে বললেন, আমার আর কিছু বলার নেই।
কী করে বলবেন? ভগবানকে তো আপনি আর হাত ধরে আমার সামনে হাজির করতে পারবেন না। আমার মতোই একজন মানুষকে ভগবান বলে চালাতে চাইবেন।
তুমি আগুন খেতে পারবে?
চেষ্টা করলেই পারব। এত কিছু খেতে পারছি, অভ্যাস করলে আগুনও খেতে পারব।
অত সহজ নয়, হরিশঙ্কর।
বেশ, আপনি নাপ্পি খেতে পারবেন?
সে আবার কী?
বার্মিজদের প্রিয় খাদ্য। মাটির তলায় পুঁতে রাখা পোকা-ধরা পচা মাংস।
অসম্ভব, ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে।
ওরা কিন্তু সবচেয়ে বড় উৎসবের দিনে সম্মানিত অতিথিকে নাপ্পি পরিবেশন করে থাকে। সবচেয়ে বড়া খানা, আমাদের বিরিয়ানির মতো। সবই হল অভ্যাসযোগ। উট কাটাগাছ খায়। আপনি পারবেন। আমাদের ফকস সাহেবও আগুন খেয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে। গণপতি ম্যাজিশিয়ান, কাটা পেরেক, কাঁচ, অ্যাসিড মুড়িমুড়কি আর শরবতের মতো খেতে পারেন। এর মধ্যে ধর্ম নেই, ঈশ্বরও নেই। কৌশল।
তোমার কোনও কথাই আমি ঠিকমতো ধরতে পারি না। আজ এক রকম বলো, কাল এক রকম বলো। এই সেদিন বললে, ভূত আছে। ভূত থাকলে ভগবানও আছে। আজ বলছ কিছুই নেই। ঘুরঘুরে বাবা জাদুকর হলেও, তোমার ছেলে তো ম্যাজিশিয়ান নয়। ও তা হলে কীভাবে দেহমুক্ত হয়ে সারাভারত ঘুরে এল। শেষে সেই হৃষীকেশের এক আশ্রমে কনককে খুঁজে পেল।
এই ঘরে বসে আমিও সারাভারত এখুনি ঘুরে আসতে পারি। দেখবেন? আমি এক্ষুনি কন্যাকুমারী চলে যাব! কল্পনাপ্রবণ মানুষ অনেকরকম ধাপ্পা দিতে পারে। কাঞ্চীপুর বর্ধমান ছয় দিনের পথ, একদিনে উত্তরিল অশ্বমনোরথ।
কী তুমি বলছ হরিশঙ্কর! তোমার মতো কালাপাহাড় কেউ দেখেছে! আমার নাতি ধাপ্পা দেবে?
ধাপ্পা দেবে কেন? স্বভাবে দুর্বল শরীরে দুর্বল। সে পড়েছে বলিষ্ঠ মনের খপ্পরে। ওর। কল্পনাটাকেই তিনি সত্যির মতো করে দেখিয়েছেন। একে বলে সাজেশন। যেমন মায়ায় জগৎভ্রম। কোথাও কিছু নেই, অথচ আমরা ঘরবাড়ি দেখছি, পাহাড়পর্বত দেখছি, গাছ দেখছি, ফুল দেখছি। স্বপ্নই কেমন সত্য হয়ে উঠছে। আজ থেকে ছ’বছর আগে ও আমার সঙ্গে হৃষীকেশে গিয়েছিল। বম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি, কানপুর কোথাও গেল না ও গেল হৃষীকেশে। সেখানে সারদা ভবনের প্রেয়ার হলে কনককে দেখে এল। এর চেয়ে সহজ রচনা আর কী আছে!
রচনা?
হা রচনা। পরীক্ষায় দেয় না? তোমার জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, একটি দিন, ওই জাতীয় একটা কিছু। মেসোমশাই সর্দিতে ফেসর ফোঁসর করতে করতে ঘরে এলেন। ভদ্রলোকের মন আর শরীর দুটোই ভেঙে পড়েছে। মুকু এমনিই একটু অমিশুক ধরনের ছিল। দিদির অন্তর্ধানে আরও গম্ভীর হয়ে। গেছে। বেশির ভাগ সময়েই বারান্দায় বসে বসে উদাস চোখে আকাশ দেখে। কাছে গেলে সরে যায়।
মেসোমশাই চেয়ারে বসে বললেন, তা হলে আমরা কবে যাচ্ছি?
পিতা বললেন, কোথায় যাবেন?
কেন হৃষিকেশে? কনক যে-আশ্রমে আছে।
কী করে বুঝলেন কনক হৃষীকেশেই আছে?
এই যে ওঁরা বললেন।
ওঁরা কি দেখে এসেছেন?
না তা নয়, তবে দৈবপ্রভাবে দেখেছেন।
পিতা বললেন, আমার আর কিছু বলার নেই। তিনি উঠে চলে গেলেন। একেবারে ঘরের বাইরে। মাতামহ বললেন, এই একটা মানুষ! কখন যে কীরকম! বাঘকে বাগ মানানো যায়। আমার এই জামাইটিকে যায় না। আমিও চলি। হাওয়া বড় এলোমেলো বইছে।
মেসোমশাই অসহায়ের মতো বললেন, একটা সিদ্ধান্তে তো আসতে হবে!
তা হবে, তবে সিদ্ধান্তে আসার মালিক তো উঠে চলে গেল। সে দলে না ভিড়লে কিছুই তো করা যাবে না।
মেসোমশাই হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, উঃ কী ফাঁপরেই যে পড়া গেল!
মাতামহ সত্যিই চলে গেলেন। মেসোমশাই আমার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলেন না। অপরাধীদের তালিকায় আমি বোধহয় পয়লা নম্বরে আছি। আসামি নাম্বার ওয়ান।
কেউ কিছু না করুক, আমি করবই। প্রয়োজন হলে গৃহত্যাগেও প্রস্তুত। আমি কনককে স্বচক্ষে দেখেছি। চোখ কি চোখের! চোখ তো মনের। পিতা যাই বলুন, ঘুরঘুরে বাবার অসীম শক্তি। আমি আমার থেকে বেরিয়েছি, আবার আমাতে এসে ঢুকেছি। এমন অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়! ম্যাজিক বলে উড়িয়ে দিলেই উড়ে যাবে! জ্ঞান দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে কি সবকিছুর সমাধান হয়! তাই যদি হবে তা হলে মাঝরাতে ঘরে সেই জোড়া চামচিকি ঢুকলে, পিতা কেন রহস্যময় গলায় বলেন, চুপ, চুপ, এসেছে। সে তা হলে কীসের ইঙ্গিত!
দুপুরে সবে চান করে উঠেছি, কাকিমা ফিসফিস করে বললেন, তুমি আমার একটা উপকার করবে?
বেশ ভয় পেয়ে গেলুম, তবু বললুম, কী উপকার?
কাপড় ছেড়ে এসে তুমি আমার পুজোটা করে দেবে?
কী পুজো?
এমন কিছু না, ঠাকুরকে একটু ফুল, বাতাসা আর জল দিয়ে দেবে, আর একটা ধূপ জ্বেলে দেবে।
রোজ তো আপনি দেন, আজ আমি কেন?
মেয়েদের মাসে পাঁচ দিন ঠাকুর ছোঁবার উপায় থাকে না।
কেন?
উঃ আচ্ছা বোকার পাল্লায় পড়েছি! সব কেনর উত্তর দেওয়া যায় না। বুঝে নিতে হয়। পাঁচ দিন। মেয়েদের শরীর খারাপ থাকে। এত বড় ছেলে হলে, কত কী যে জানো না!
কাপড় ছেড়ে আবার নীচে নামতে হল। সেদিন অফিস থেকে একটা ফ্রিপ্যাকেট পেয়েছি। তাতে ছিল, গোটাকতক গায়েমাখা সাবান, দুটো কাপড় কাঁচার বড় বার সাবান, মাথায় মাখার দু’শিশি তেল, স্নো, সেন্ট, পাউডার। ঠিক করেছিলুম হাফ কাকিমাকে দোব, আর হাফ দেব মায়াকে। যতই হোক মায়া আমার প্রেমিকা। একটু পাগলি আছে। সেদিন একটা চিঠি লিখেছে। কী তার ভাষা! মনে হয় কোনও বই থেকে টুকে দিয়েছে। প্রিয়তম, জীবন বড় ছোট। একদিন ফুরিয়ে গেলে টের পাবে, তখন চোখের জল ফেললেও আমাকে আর পাবে না। তুমি বলেছিলে সাধু হবে, আমি হব তোমার ভৈরবী। তোমার একটা কথারও যদি ঠিক থাকত। শুনলুম চাকরি পেয়েছ? চলো এবার তা হলে পালাই। চিঠিটা গোল করে ঢোলের মতো একটা মাদুলির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। পিতৃদেবের হাতে পড়লেই হয়েছে আর কী!
তেল সাবান স্নো পেয়ে কাকিমা কী খুশি। একবার এর ছিপি খোলেন, ওর ঢাকনা খোলেন, গন্ধ শোকেন আর বারেবারে বলেন, এই সব তুমি আমাকে দিলে? তুমি আমাকে একেবারে দিয়ে দিলে? কখন মাখি বলো তো! একদিন এইসব মেখেটেখে, বেশ সেজেগুঁজে কোথাও গেলে হয়! যাবে একদিন?
কাকাবাবু রাগ করবেন।
তাও তো বটে! আমি এক ক্রীতদাসী, হেঁশেল ঠেলার জন্যেই জন্মেছি। জন্ম আঁতুড়ঘরে, মৃত্যু রান্নাঘরে। যাই বলল, তোমাকে আজ বেশ ঠাকুর ঠাকুর দেখাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি বলুন, কী করতে হবে। এখুনি ওপরে হাঁকাহাঁকি শুরু হয়ে যাবে।
তুমি ওই কুলুঙ্গির পরদাটা সরাও। ধূপ জ্বালো, বাসি ফুল ফেলে নতুন ফুল দাও, কৌটোয় বাতাসা আছে, পুজোর থালায় গোটাকতক সাজিয়ে দাও, ছোট এক গেলাস গঙ্গাজল ধরে দাও। পরদা টেনে চোখ বুজিয়ে আসনে বসে বলল, মা খাও, মা খাও।
কাকিমা বড় গোছানে। এই এঁদো ঘরেই কী সুন্দর আয়োজন! পরদাটি একপাশে সরাতেই তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতার বেশ কয়েকজনের দর্শন মিলে গেল। পরিচ্ছন্ন পটে হাসিহাসি মুখ মা কালী, দশভুজা দুর্গা, গণেশ, মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী, সুদর্শন চক্রধারী নারায়ণ, মাটির মহাদেব, পেতলের রাধাকৃষ্ণ।
চেয়ারের ওপর গোল করা ছিল কম্বলের আসন। মেঝেতে পেতে চোখ বুজিয়ে বসলুম। সবই মায়ের খেলা। কেমন ফাঁদে ফেলে দিলেন। কাকিমা না বললে, এমন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতো। আসনে বসতুম কি! কার পুজো কে করে! চোখ বুজোতেই, প্রথমে ভেসে উঠল কাকিমার মুখ। সেদিনের সেই ছবি, হাতে জবাফুল নিয়ে বেরোবার সময় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সে মুখ চোখের সামনে থেকে সরতেই চায় না। অতি কষ্টে যদিও বা সরানো গেল, সামনে এসে দাঁড়ালেন ঘুরঘুরে বাবা। আমি বললুম, বাবা খাও। কী আর করব, দেবী যখন দর্শনে দুর্লভ, দেবতার প্রতিনিধিকেই নৈবেদ্য নিবেদন করি।
বাবা হাসলেন। বলতে চাইলেন, সামান্য ফুল বাতাসা কী খাব রে শালা! আমার ভোগ আলাদা। বাবা দুই চোখের মাঝখানের অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। এসে দাঁড়ালেন ঊষাদি। বাঃ বেশ মজা! জয়ামাতার আসতে কী হয়েছিল! ঊষাদির হাতদুটো আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। এখুনি উঁচু করে তুলে ধরে ঠোঁটে ভিজেভিজে চুমু এঁকে দেবেন। শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছে। মনে মনে বললুম, না না, আর না।
ঊষাদি সরলেন বটে, এসে গেলেন চিত্রাদেবী। ঘনঘন রুমাল নাড়ছেন আর বলছেন, বাব্বা, কী গরম! ব্যর্থ চেষ্টা। কোনও দেবীই এই পোড়া চোখে আসবে না। দৃষ্টি দূষিত হয়ে গেছে। আসন। গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালুম। কাকিমা বললেন, ‘উঃ তোমার কী ভক্তি গো। খাড়া বসে আছ তো বসেই আছ। তোমার মতো ভক্তি পেলে আমি নির্ঘাত স্বর্গে যেতুম। নাও, প্রসাদ তুলে নাও। একটা বাতাসা মুখে ফেলো, আমি জল এনে দিচ্ছি।
ঝকঝকে মাজা গেলাসে জল খাচ্ছি, কাকিমা বললেন, আহা রে গরমে পিঠটা ঘেমে গেছে। মুক্তোর দানার মতো ঘাম ফুটেছে, এসো মুছিয়ে দিই।
শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার পিঠের ঘাম মোছাতে লাগলেন। এবার গায়ে কাঁটা দিল ভয়ে। পিতৃদেব একবার যদি দেখতে পান, বলবেন, যাও, চান করে এসো। আঁচলে অশুদ্ধ হয়েছে।
আমি তা হলে এবার আসি কাকিমা!
না, আর তোমাকে আটকাব না। কাল সকালে তুমি আমার পুজোটা করে দেবে!
সময় পাব! কাল তো আমার অফিস!
ওই তো চান করে ওপরে ওঠার আগে।
ঠিক আছে। কাকাবাবু কোথায় গেছেন?
কাকিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তবলা বাজাতে।
কোথায়? দূরে?
মহিষাদল রাজবাড়িতে।
কবে ফিরবেন?
যবে সেই মেয়েমানুষটা ফিরবে।
মেয়েমানুষ?
সে তুমি বুঝবে না। তুমি এখনও বড় সরল। মানুষের বয়েস বাড়লে তার সব চলে যায়। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব, একটু দাঁড়াও।
কাকিমা নিচু হয়ে চৌকির তলা থেকে একটা টিনের বাক্স বের করলেন। ডালা খোলার সময় কোচ করে একটা শব্দ হল। নাকে এসে লাগল অতি পরিচিত, সুখ-সুখ সঞ্চয়-সঞ্চয় সংসার-সংসার একটা গন্ধ। এ গন্ধে ত্যাগ নেই, সন্ন্যাস নেই, অনেকটা মেয়েদের অঙ্গের গোপন গন্ধের মতো। বহু দূর থেকে ভেসে আসা, বহু দূরে চলে যাওয়া। কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যা আমার কাছে ভারী অদ্ভুত। গোলাপি রং, বাক্সের ডালা খোলার শব্দ, ভেতরের ন্যাপথলিন আর সেন্ট মেশানো গন্ধ, ঝুলনের পুতুল, কালীয়দমন, বকাসুর বধ, উত্তরা অভিমন্যু, রথের চাকা বসে-যাওয়া বীর কর্ণ, সুভদ্রা হরণ, বর্ষাকাল, রথ, একই সঙ্গে পেঁয়াজি আর কঁঠালের গন্ধ। মনের ভেতর মঞ্জিল তৈরি হয়।
কী গো তোমার ঘোর লেগে গেল নাকি? কোন জগতে চলে গেছ? তখন থেকে তোমার পেছনে। দাঁড়িয়ে আছি।
আপনার বাক্স খোলার শব্দে ছেলেবেলায় চলে গিয়েছিলুম?
ইস, তুমি একেবারে ঠিক বলেছ। বাক্সটা খুললে আমারও তোমার মতোই মনে হয়। কোথায় যে চলে যাই। আর একবার মরে জন্মাতে ইচ্ছে করে।
আপনি এর মধ্যে কতবার মরেছেন কাকিমা?
ওই হল রে বাবা। বলতে গিয়ে গুলিয়ে গেছে। মরে আর একবার জন্মাতে ইচ্ছে করে। নাও। দেখো। সিল্কের সুতো দিয়ে বোনা গেঞ্জির মতো কী একটা জিনিস কাকিমা আমার হাতে তুলে দিলেন।
কী এটা? গেঞ্জি?
হ্যাঁ গো? কার বলো তো?
কার? কাকাবাবুর?
আজ্ঞে না মশাই। তোমার। কাউকে বলবে না। আর দু-এক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
এই সুতো পেলেন কোথায়?
সে খবরে তোমার দরকার কী? বড়াভাজা খাবে?
বড়া আমার বড় প্রিয়, না বলি কী করে?
তা হলে এসো, পিড়ে পেতে দিই, বোসো, গরম গরম ভাজি। বড়া ভাজতে ভাজতে কাকিমা বললেন, আমার বড় শখ ছিল।
কী শখ?
ওই সেই মাথা-খোলা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে সারা কলকাতাটা একবার ঘুরব।
ঠিক আছে, ঘোরাব।
আরও একটা আছে।
কী, বলে ফেলুন?
লাজুক-লাজুক মুখ করে বললেন, কাপের আইসক্রিম খাব।
ঠিক আছে খাওয়াব।
আর একটা ভীষণ ইচ্ছে ছিল।
বলুন?
নাঃ, সেটা আর তোমাকে বলব না। সে ভগবানকে বলার জিনিস।
বুঝেছি।
হাসতে হাসতে বললেন, বুঝেছ তো? বড় একা লাগে। আমার তো কেউ নেই।
ঘুরঘুরে বাবার কাছে যাবেন? তিনি সব পারেন।
একদিন নিয়ে চলো না গো!
ঠিক আছে, পরের অমাবস্যায় নিয়ে যাব। সারারাত কিন্তু থাকতে হবে!
ও বাব্বা, তা হলেই তো বিপদ!
খানকতক বড়াভাজা খেয়ে ওপরে উঠে এলুম। শুনলুম কাকিমা গান গাইছেন, ওই দেখা যায় বাড়ি আমার চারদিকে মালঞ্চের বেড়া। গলাটি বেশ সুন্দর। কোথা থেকে এই গানটি শিখলেন কে জানে! মুকু এসে গম্ভীর মুখে বললে, বাবা একবার ডাকছেন।
মেসোমশাই মেঝেতে মাদুরের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন, হাল-ভাঙা তলা-হ্যাঁদা নৌকোর মতো। ঘরে ঢুকতেই নরম গলায় বললেন, বোসো।
ভদ্রলোকের ব্যারিস্টারি সুর পালটে গেছে। আহা, মাটিতে কেন, মাদুরে উঠে বোসো।
মেসোমশাই শয়ান থেকে অর্ধশয়ান হলেন। আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, একটা কথা বলব?
হ্যাঁ বলুন না?
আমার আপত্তি নেই। বুঝলে, আমার আর কোনও আপত্তি নেই। তা ছাড়া তুমি চাকরিবাকরি করছ।
আপনি কী বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।
খুব পারছ বাবা। তুমি কি কম ছেলে, ওই যে মিটমিট করে, কলসা নাড়ায়, সে বড় সাংঘাতিক।
দেখুন, আমাদের এখন বিপদের দিন, দাগা মারা কথা নাই বা বললেন।
আমার মাথার ঠিক নেই বাবা, তুমি বাপ হলে বুঝতে। কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কীসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে! তুমি কনককে খুঁজে বের করো, আমি তোমার সঙ্গেই তার বিয়ে দেব।
আমার সঙ্গে? বোনের সঙ্গে ভাইয়ের বিয়ে?
আহা, তুমি তো সেরকম ভাই নও। রক্তের সম্পর্কে ভাই হলে কথা ছিল। তুমি তো ছেলে খারাপ নও। তা ছাড়া হরিদা, অমন মানুষ তুমি আর দুটি পাবে না। একজন মানুষের মতো মানুষ। অনেস্ট, সেনসিল, এ ম্যান অফ ক্যারেক্টার। যা শুনছি, তা ঠিক?
কী শুনছেন?
হরিদা একেবারে গঙ্গার ধারে একটা জায়গা কিনেছেন?
বোধহয়। আমি ঠিক জানি না।
চেপে যাচ্ছ?
সত্যিই জানি না। আমার সঙ্গে বৈষয়িক কথাবার্তা একেবারে হয় না।
আরে, তুমি বাপের এক ছেলে। সব খবর রাখবে। একটু একটু করে সব বুঝেসুঝে নেবে। মানুষের জীবন। কিছু বলা যায়? আজ আছে কাল নেই।
আর কিছু বলবেন?
কাছে সরে এসো, চুপিচুপি, বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি। কনককে কোথায় রেখেছ? ওয়ার্ড অফ অনার কাউকে বলব না।
আশ্চর্য মানুষ আপনি! আমাকে কী করে আপনি কিডন্যাপার ভাবলেন?
না, তোমার সঙ্গে বেশ একটু ইন্টিমেসি গড়ে উঠেছিল। আর আমি একটু অন্য রাস্তায় চলতে চাইলুম। যদি জানো, বলে ফেলো বাপু।
আমি জানি না। তবে জানার চেষ্টা করছি। আমি কনককে দেখেছি। সে আছে আশ্রমে। মনে হয় সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে। এখনও অবশ্য গেরুয়া পরেনি।
মাথা ন্যাড়া করেছে?
না, এখনও করেনি।
কতরকমের গল্প যে তোমরা বানাতে পারো!
আপনাকে তো আমি বিশ্বাস করতে বলিনি। আমার বিশ্বাস আমারই থাক।
তোমার স্বভাবটি বড় উদ্ধত। আর হবে না কেন? বাবার এক ছেলে। আদরে আদরে খাস্তা হয়ে গেছ!
তা হবে।
পিতা সকাল থেকেই এক যান্ত্রিক উদ্ভাবন নিয়ে বড় ব্যস্ত। কয়েক টিন রং এসেছে। যত বাক্সপ্যাটরা আছে, সব নতুন অঙ্গসজ্জায় ডোল পালটাবে। হলদে নীল হবে, নীল কমলা হবে, সবুজ লাল হবে। যে রং এসেছে, সে রং বুরুশে লাগানো যাবে না। রং বড় তাড়াতাড়ি উড়ে যায়। টানা যায় না। প্রেগান চাই। সেই স্পে-গানের উদ্ভাবনে সকাল গড়িয়ে গেছে। মনে হয় দুপুরও পার করে দেবেন। খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠল। কাপ কাপ চা চলছে। গোটা ছয়েক কাপ পড়েছে। সব। একবারে ধোয়া হবে।
রান্নাঘরের দিক থেকে তার কণ্ঠ ভেসে এল, যাঃ, হয়ে গেল। খেল খতম।
পেটামোটা গোলগলা একটা শিশির মুখে রবারের ছিপি। ছিপিতে দুটো গর্ত। একটা গর্তে সোজা একটি কাঁচের নল, অন্য গর্তে একটি বাঁকা নল। এই পর্যন্ত থিয়োরিতে কোনও গোলমাল ছিল না। সোজা নলে ফুঁ মারলেই বাঁকা নলে তরল পদার্থ তোড়ে বেরোবে। আধ শিশি রং ভরে পিতা যেই ফুঁ মেরেছেন, বাতাস ও তরল রঙের ঊর্ধ্বচাপে ফটাস করে ছিপি ছিটকে চলে গেছে। চতুর্দিকে রঙের স্রোত বইছে। মাতামহ দেখলেই গান গেয়ে উঠতেন, হোরি খেলত নন্দকুমার। সুপক্ক সিঙ্গাপুরি কলার ভুরভুরে গন্ধ বাতাসে। এই রঙে এমন একটা কিছু আছে, যার গন্ধটাই পাকা কলার মতো।
রঙের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে, পিতা নেপোলিয়ানের মতো মুখ করে বসে আছেন। নাকের ডগা লাল টুকটুকে। দাড়িতেও রং লেগেছে। ছিপিটা পড়ে আছে চিতপাত হয়ে। কলার গন্ধ পেয়ে বলাইবাবু ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কাকে সামলাই! রঙে ভাসমান পিতাকে না কচ্ছপটাকে! ওদিকে এই অবেলায় সিঁড়ি বেয়ে একটি কণ্ঠস্বর উঠে আসছে, হরি আছিস, হরি! পিতা বললেন, রিসিভ দেম, রিসিভ দেম।