1 of 2

৩২. উত্তর কলকাতার পথে পথে

একটা দুপুর এবং বিকেলের অনেকটা সময় ধরে ওরা উত্তর কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াল। এই একদিনেই উত্তর কলকাতার রাস্তাঘাট মোটামুটি চেনা হয়ে গেল দীপার। একটা লরিব অর্ধেকটা জনসাধারণের দানে ভরে উঠেছে। সম্ভবত তাঁদের কাছেও কোনদিন ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এসে এভাবে কোন দুর্গতদের জন্যে সাহায্য চায়নি।

দীপার একটুও ক্লান্তি লাগছিল না বিবেকানন্দ রোড ধরে ওরা এখন চিৎপুরের দিকে বাঁক নিয়েছে। মায়া বলল, আর একটু এগোলেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।

দীপা উত্তেজিত হল, ওখানে গিয়ে সাহায্য চাওয়া যায় না?

অসীম বলল, ট্রামরাস্তা থেকে অনেক ভেতরে। বিকেলও হয়ে গিয়েছে।

দীপা বলল, ওখানে কিন্তু সাহায্য পাওয়া যেতই।

মানসী জানতে চাইল, এত জোর দিয়ে বলছি কি কবে?

বাঃ, ওই বাড়ি থেকেই এক সময় বাংলাদেশের মানুষ নবজাগরণের শিক্ষা পেয়েছে। ওখানে ববীন্দ্ৰনাথ জন্মেছিলেন। ভাবতে পারো?

অসীম হাসল, সে তো অনেক আগের কথা। তারপর সময় বয়ে গিয়েছে। সময় আমার সময়। যে-মাথায় শৈশব থেকে যৌবনে কাজল কালো চুল, সেই একই মাথায় বার্ধক্যে কাশফুল ছড়িয়ে থাকে, না ঝরে গেলে?

আপনি না জেনে মন্তব্য করছেন! দীপা প্ৰতিবাদ করল।

আমি জীবনের সত্যি বলছি। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্ৰনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ এবং খুব অল্প হলেও রথীন্দ্রনাথ-কিন্তু তার পরে আর কোন মানুষ ওই বাড়িতে জন্মায়নি। যাঁকে নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। জন্মানোটা যেমন বিস্ময়ের হতে পারে না জন্মটা কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যাওয়া হল না দীপার। কিন্তু এর মধ্যে দুটো কাণ্ড সে দেখতে পেল। প্ৰায় জনা পঞ্চাশেক ছেলেমেয়ে কলেজ থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল সাহায্য সন্ধানে। এখন তিরিশজনও আছে কিনা সন্দেহ। সেই দুটি মেয়ে এবং তাদের দুই ছেলে বন্ধু কখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। দীপা ভেবে পাচ্ছিল না। ওরা কোথায় যেতে পারে! কোন রেস্টটুরেন্টে বসে গল্প করবে? অসম্ভব। কেউ যদি সেখানে দেখে ফেলে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পার্কে বসে কথা বলার সুযোগই নেই। অথচ কলেজ থেকে বেরুবার সময় এবং রাস্তায় বেরিয়ে ওদের চোখে মুখে যে মতলব খেলে যেতে সে দেখেছে তা জলপাইগুড়িতে একমাত্র মিতার মুখেই সে দেখেছিল। ছেলেদের সঙ্গ মানেই একটা গোপন পাপ—যা করার জন্যে কিছু মেয়ে চাপা উৎসাহ বোধ করে। যেমন মীজাপুর স্ট্রিটের সেই ভাড়াটেদের মেয়েটি। সে সাহসী ছিল কারণ তার অভিভাবকরা জীবনধারণের সরঞ্জাম জোগাতে এমন ব্যস্ত থাকেন যে তার ওপর নজর দেওয়ার সময় পান না। ব্যাপারটা সে মায়াকে বলল। মায়া হাসল, তুমি লক্ষ্য করেছ?

হ্যাঁ। ওরা তো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের মত গল্প করতে পারত।

তাতে ওদের মন ভরত না। মায়া আর কথা বাড়াল না।

গ্লোরিয়া লুসাকা খুব উৎসাহিত। ওদের সঙ্গে অসীমের আলাপ করিয়ে দিল দীপা। অসীম বলল, ভাবতে খুব ভাল লাগছে, কোথায় জাম্বিয়া আর কোথায় আসাম, তবু আপনারা আসামের মানুষদের সাহায্য করতে আমাদের সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছেন।

গ্লোরিয়া প্ৰতিবাদ করল, এ কি কথা বলছেন? এখন আমরা এক কলেজের ছাত্রছাত্রী। মানুষের বিপদে মানুষ হিসেরে যেটুকু করা উচিত। তাই করছি।

ওরা কলেজে ফিরে এসেছিল। লুসাকা বলল, চল আমরা সবাই মিলে কফি খাই।

অসীম বলল, কফি খেতে হলে কফি হাউসে যেতে হবে। কলেজ স্ট্রিটে।

এখনকার রেস্টুরেন্টে কফি পাওয়া যায় না? গ্লোরিয়া জানতে চাইল।

না। পেলেও ভাল না। চা খেলে বসন্ত কেবিনে যাওয়া যেতে পারে।

দীপার বেশিদূরে খাওয়ার বাসনা ছিল না। ওরা বসন্ত কেবিনের দিকে এগোল। কিন্তু মানসী ওদের সঙ্গে গেল না। ওর শরীর নাকি ভাল লাগছে না। তাই হোস্টেলে ফিরে গেল। দীপার মনে হল মানসী সঠিক বলল না। একসঙ্গে সাহায্য চাইতে রাস্তায় নামা যায়। কিন্তু রেস্টটুরেন্টে ঢুকে চা খাওয়ায় বোধ হয় ওর মন সায় দিল না।

বসন্ত কেবিনে ঢোকামাত্র যাঁরা বসেছিলেন অবাক হয়ে তাকালেন। কালো বিদেশিনী মেয়ে দুরের কথা বাঙালি মেয়েরা বড় একটা রেস্টটুরেন্টে খেতে আসে না। দীপার একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল। সে এই প্ৰথম রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। কোণার দিকের একটা খালি টেবিলে ওরা পাঁচজনে বসল। অসীম চাপা গলায় বাংলায় বলল, এদের আমারই খাওয়ানো উচিত। প্ৰথম দিন তো!

দীপা বলল, আপনি একা খাওয়াবেন কেন? আমিও দেব।

ছেলে হিসেরে সেটা আমার ভাল লাগবে না। হেসে ফেলল অসীম।

গ্লোরিয়া বাংলা কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, কি বলছি তোমরা?

দীপা বলল, অসীম দাবি করছেন তিনি একজন ছেলে।

গ্লোরিয়া অবাক হল, সেটা দাবি করার কি আছে? দেখলেই তো বোঝা যাচ্ছে?

অসীম এবার এমন শব্দ করে হেসে উঠল যে বসন্ত কেবিনের ম্যানেজার পর্যন্ত হ্যাঁ করে তাকাল। টেস্ট আর চা বলা হল। মায়া আসেনি। তার অনেক কাজ। সংগৃহীত জিনিসপত্র সঠিক জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে তাকে। দীপার মনে হয় এই মেয়ে সময় এবং সমাজ ছাড়া। ও যে কাজ করে যাচ্ছে তা কাউকে তোয়াক্কা না করেই করছে। এবং কেউ তো ওর সামনে এসে বলছে না তোমার করা চলবে না। এটা কলকাতা বলেই সম্ভব হয়েছে। জলপাইগুড়ি হলে হুলুস্থূল পড়ে যেত। কলেজের ওপর চাপ আসতো এমন ছাত্রীকে ছাড়িয়ে দেবার। তাই যদি হয়, কলকাতার মানুষ যদি এত উদার তাহলে অন্য মেয়েরা কেন এখনও এত আড়াল আরডাল খোঁজে?

হঠাৎ অসীম বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার প্ৰিয় কবি কে?

দীপা দেখল গ্লোরিয়ারা নিজেদের ভাষায় গল্প করছে। অসীম কিংবা দীপা একা থাকলে ওরা নিশ্চয় ইংরেজিতে কথা বলত। সে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বাংলাতেই বলল, এর চেয়ে কঠিন প্রশ্ন আপনার পায়ের তলায় কি?

উত্তরটা কি হবে?

আপনি নিশ্চয়ই জুতো বলবেন না।

না, মাটি।

ঠিকই। যে কোন বাঙালির প্ৰিয় কবি হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথ।

কেন? অসীমের মুখে কৌতুক।

আপনার সঙ্গে বোধ হয়। আর কথা না বলাই আমার উচিত।

সুন্দর। আপনি জীবনানন্দ দাশ পড়েছেন।

পড়েছি।

তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে আপনার পছন্দ? জীবনানন্দ কি অনেক আধুনিক নন?

দেখুন, জীবনানন্দ আমার চেতনার কাছে আবেদন করেন। তাঁকে বুঝতে গেলে বুদ্ধি এবং আগ্রহ দুই রাখতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, জীবনানন্দ আমাকে বড় একা করে দেন। একা এবং নিঃসঙ্গ। তিনি বড় কবি। তাঁকে পড়লে নিজের সম্পর্কে একধরনের বিভ্ৰম জাগে। শব্দের খেলায় তিনি এক লৌকিক এবং অলৌকিক জগতের মাঝখানে আর একটি জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমার বোধে আমার অস্তিত্বে প্ৰাণদান করেন। আমার মনের গা ঘেঁষে বন্ধুর মত এসে বসেন।

কথাগুলো বলতে বলতে দীপা এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্য করেনি যে গ্লোরিয়া চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে থেমে যেতে গ্লোরিয়া জিজ্ঞাসা করল, তুমি এত উত্তেজিত কেন?

লুসাকা হাসল, রাগ তো অনুরাগের দ্বিতীয় স্তর।

দীপা হতভম্ব, মানে?

লুসাকা বলল, প্ৰথমে আলাপ হবার সময় একধরনের মুগ্ধতা কাজ করে। তারপর কোন ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি হলে রাগারাগি হয়। সেই স্টেজটায় যাদের সম্পর্ক না কেটে যায় তাহলে অনেকদিন তারা একসঙ্গে এগোতে পারে।

অসীম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমাদের কিন্তু সেসব কিছুই হচ্ছে না। দুই বড় কবি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল।

বিতর্ক যে-কোন বিষয় নিয়েই হতে পারে। লুসাকা মাথা নাড়ল।

দীপা একটু উষ্ণ হল, লুসাকা, আমাদের আজই আলাপ হয়েছে।

এবার গ্লোরিয়া চোখ বড় করল, সত্যি? আমি তো ভাবছিলাম অসীম তোমার বয়ফ্রেন্ড। ওয়েল, অসীম, দীপাবলীকে তোমার কেমন লাগে?

অসীম গম্ভীর হল, খুব জটিল প্রশ্ন। কয়েক ঘণ্টার আলাপে কি বলা যায়?

অসীম এমন ভঙ্গীতে কথাগুলো বলল যে গ্লোরিয়ারা শব্দ করে হেসে উঠল। বেশ রাগ হয়ে গেল দীপার। সে ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি অভিনয় করেন নাকি?

জবাব দিতে গিয়ে আচমকা থেমে গেল অসীম। তার চোখে মুখে বিস্ময়। দৃষ্টিটা এত অস্বস্তিকর যে চোখে চোখ রাখতে পারল না দীপা। লুসাকা জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

অসীম ইংরেজিতেই বলল, আমাদের এখানে একজন জনপ্ৰিয় অভিনেত্রী আছেন যিনি অনেকের বুকের শব্দ বাড়িয়ে দেন। আমার তাঁর কথা মনে পড়ল।

দীপা এবার ফোঁস করে উঠল, মানে?

অসীম ইংরেজিতেই বলল, আপনি যখন ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকালেন তখন যেন অবিকল সুচিত্রা সেনকে দেখতে পেলাম।

অদ্ভুত? সমস্ত শরীর ঝিনঝিন করতে লাগল দীপার।

এরপর আড্ডা জমল না। অসীম রাজি হচ্ছিল না। তবু জোর করে অর্ধেক দাম দিয়ে দিল দীপা। বসন্ত কেবিন থেকে ওদের হোস্টেল খুব বেশিদূর নয়। অসীমের সঙ্গে হাঁটতে একদম ইচ্ছে করছিল না দীপার। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল অসীম ক্রমাগত তাকে দেখে যাচ্ছে। হোস্টেলের গেট পর্যন্ত এল সে। গ্লোরিয়ারা যখন বিদায় জানিয়ে ঢুকে যাচ্ছে তখন অসীম কেমন অদ্ভূত গলায় ডাকল, দীপাবলী, শুনুন!

উপেক্ষা করতে চেয়েও পারল না দীপা। কোন জবাব না দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অসীম বেশ দুঃখিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি রাগ করেছেন। আমি কিন্তু স্রেফ বসিকতা করতে চেয়েছিলাম। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।

দীপা এড়াতে চাইল, ঠিক আছে।

অসীম তাড়াতাড়ি বলল, আর একটা কথা—।

বলুন!

আমি, আমি আপনার বন্ধুত্ব চাইছি।

এবার না হেসে পারল না দীপা।

আপনি হাসছেন যে?

বন্ধুত্ব কি দেওয়া যায়? বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আপনার সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য থাকলে সেটা গড়বে কি করে। এলাম। সে আধা ভেজানো গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। নিজের ঘরে পৌঁছে দেখল গ্লোরিয়া তখনও সেখানে পৌঁছায়নি। হয়তো লুসাকাদের ঘরে আড্ডা মারছে। দীপার মনে হল স্নান করতে পারলে ভাল লাগবে। সারাদিনের পরিশ্রম তো ছিলই, অসীম তার মেজাজ খারাপ করে দিল। খামোক কিছু তরল রসিকতা—। আচ্ছা সেকি একটু বেশি মাত্রায় বয়স্ক হয়ে যাচ্ছে! বয়সের তুলনায় নিজেকে কি বেশি গভীর করে ফেলছে। এবং তখনই তার মনে পড়ল। সেই কোন বালিকা বয়সে এক আলো ফুটতে শুরু হওয়া ভোরে চা-বাগানের বাড়ির সামনে শিশিরভেজা শিউলি ফুল তোলার সময় মালবাবুর বাড়িতে আসা এক শহুরে ছেলে তাকে বলেছিল, তোমাকে ঠিক সুচিত্রা সেনের মত দেখতে। সেই মুহুর্তে ছেলেটিকে তার খারাপ লেগেছিল। সেই খারাপ লাগাটা নিশ্চয়ই মনের আনাচে কানাচে এতকাল লেগেছিল, আজ অসীম বলামাত্র সেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আজকের এই অস্বস্তিটা সেই ছেলেটির কারণে। বোধ শুরু হবার আগেই তার মনে বিরাপত্তা জন্মেছিল। যদি কেউ কখনও তাকে কিছু না বলত, কথাটা যদি অসীমের মুখে আজ প্রথম শুনতো তাহলে খুব বেশি হলে সে বলত, আপনার চোখে ন্যাবা হয়েছে অথবা হেসে উড়িয়ে দিত। এত কাণ্ড করে ফেলত না। স্নান করে তাজা হয়ে দীপার মনে হল সে একটু বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু অসীম তা সত্ত্বেও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইল। সে কোন ছেলেমেয়েকে এমন প্রকাশ্যে বন্ধুত্ব আকাঙক্ষা করতে শোনেনি। ছেলেমেয়ের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক মানেই একটি পরিণতি এমন ধারণাই তৈরি আছে। শেষের কবিতার লাবণ্য এবং অমিত রায় যতই বন্ধুত্বের কথা বলুক সেটা কখনই ছেলেয় ছেলেয় অথবা মেয়েতে মেয়েতে বন্ধুত্ব নয়। হে বন্ধু বিদায়, শব্দ তিনটির মধ্যে আর একধরনের আর্তি না-পূরণ হওয়ার কান্না আছে।

স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াশুনার একটা চমৎকার আরহাওয়া আছে কয়েকজন অধ্যাপক তো। রীতিমত বিখ্যাত। যেমন কনক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সুদৰ্শন মিষ্টভাষী প্রৌঢ়কে খুব ভাল লাগে দীপার। এখন তো পড়াশুনা রীতিমত মাঝপযায়ে। হোস্টেল আর কলেজ ছাড়া কোন কিছুতেই মন দিতে সে নারাজ। নিজেকে দাঁড় করাতে হবে। অনেক ওপরে উঠতে হবে। এ ধরনের প্রতিজ্ঞা প্ৰতিনিয়ত করে চলেছে দীপা। বি.এ. পরীক্ষা দেবার পর এম.এ. না পড়ার সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলেছে এর মধ্যে। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসলে আরও বেশি কাজ হবে। এম.এ. পাস করে কোন স্কুল অথবা কলেজে চাকরির জন্যে ঘুরে বেড়ানোবা কোন মানে হয় না। মায়া অবশ্য ইংরেজি নিয়ে এম.এ. পড়বে। এত কাণ্ড করেও মেয়েটা ভাল ছাত্রী হিসেরে ঘোষাল স্যার কিংবা সুশীল মুখোপাধ্যায়ের খুব প্ৰিয়। মায়ার আকাঙক্ষা ইংরেজিতে অধ্যাপনার সঙ্গে নাটক করে যাওয়া। ওদের দলে বেশ কয়েকবার যাওয়ার জন্যে বলেছিল। মায়া। দীপাই আগ্রহ দেখায়নি। গ্লোরিয়ারা সব করছে। শুধু পড়াশুনা ছাড়া। মেয়েটা বই নিয়ে বসতেই চায় না। ওদের ছেলে বন্ধুর সংখ্যা এত যে পড়াব সময় পায় না। অনেক রাত্রে ফেরার জন্যে এর মধ্যে দু-দুবার সুপারের কাছে ওয়ানিং খেয়েছে।

আপাতত যে সমস্যাটা বড় হচ্ছে তা হল পুজোর ছুটি আসছে। এই সময় একমাত্র বিদেশিনী ছাড়া হোস্টেলে কোন ছাত্রী থাকে না, থাকার কথাও নয়। দারোয়ান ছাড়া ঠাকুর চাকরীরাত ছুটিতে যায় পালা করে। কিন্তু দীপা এবার কি করবে? কলকাতায় পড়তে আসার পর থেকে অঞ্জলি তাকে কোন চিঠি লেখেনি। মাঝে একবার মনোরমা আশীর্বাদ জানিয়ে একটা পোস্টকার্ড লেখেন। অমরনাথের শেষ চিঠি এসেছিল মাসখানেক আগে। হাতের লেখা বেশ কাঁপা কাঁপা। চাকরিতে জয়েন করে তিনি আবার ছুটি নিয়েছেন। এভাবে চললে আর কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে উইদাউট পে হতে হবে। সেখানে সংসার চালানোর দুশ্চিন্তা প্রবল হয়ে উঠেছে। তবে এসব ব্যাপার নিয়ে দীপা যেন কোন চিন্তা না করে। ওঁরা কেউ জানতে চাননি করে দীপার পুজোর ছুটি শুরু হচ্ছে এবং সে করে আসছে!

দীপা জানে সুর কেটে গিয়েছে। মূলত অঞ্জলির ব্যবহারেই এটা ঘটেছে। এতদিনের সম্পর্ক হঠাৎ কি করে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়? মানুষের কোন সম্পর্কই কি শিকড় ধরে উঠে আসা নয়? নাকি শিকড়গুলোও সময় বুঝে আলগা হয়ে যায়? কিন্তু এসব সত্ত্বেও যেটা সত্যি পেছন ফিরে তাকালেই দীপার বুকের ভেতর টনটনানি শুরু হয়ে যায়। কত সুন্দর স্মৃতি, অঞ্জলি মনোরমার কত মেহের ছবি, আদুরে ভঙ্গী, রেজাল্ট বেরুবার পর অমরনাথের তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠা—এসব যখন বুকের ভেতরে ছটফট করে তখন আজকের অভিমান ধুয়ে মুছে একসা হয়ে যায়। দীপা ঠিক করল, শেষবার যদি হয় হোক তবু সে এবার চা-বাগানে যাবে। একাই।

সুভাষচন্দ্র অবশ্য প্রতি মাসে একবার আসেন খোঁজখবর নিতে। আশ্চর্যের ব্যাপার যে তিনি কখনও দীপাকে তাঁর বাড়িতে যেতে বলেন না। তাঁর কথাবার্তাও মোটামুটি একই ধরনের থাকে। পড়াশুনায় যেন ফাঁকি না দেওয়া হয়, এমএ পাস করে স্কুলের শিক্ষিকা না হলে সারাজীবন কষ্টে থাকতে হবে। সে যে সুযোগ পাচ্ছে তা বাংলাদেশের খুব কম ছেলেমেয়েই পায়। পরে অমরনাথের প্রসঙ্গে চলে যান তিনি। এত বছর চাকরি করেও তিনি নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেননি। ছেলেদের অথবা স্ত্রীর কথা ভাবেননি। তার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে তাঁকে। সুভাষচন্দ্রের ধারণা চিরকালের জন্যে অমরনাথ অকৰ্মণ্য হয়ে গেলেন। এত দূর থেকে তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয় বলে তিনি জানিয়ে গেলেন।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিল দীপা। আগামী আড়াই বছরের মধ্যে, বড় জোর তিন বছর সে সময় নেবে একটা চাকরির জন্যে উপযুক্ত হতে। এই তিন বছরে বড় জোর ছয় হাজার টাকা তার নিজস্ব খরচ হবে। এবার পূজোর ছুটিতে গিয়ে ওই টাকাটা বাদ দিয়ে ব্যাঙ্কের বাকি টাকা সে অমরনাথের হাতে তুলে দিয়ে আসবে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে শেষ পর্যন্ত যে টাকাটা তার জন্যে খরচ হবে তা সুদে-আসলে ফেরত দেবে অঞ্জলিকে চাকরিটা পেয়ে গেলে। জীবনের এই ঋণ সে কখনও বহন করবে না।

অসীমের সঙ্গে কলেজে তার প্রায়ই দেখা হচ্ছে। কোন ছেলের সঙ্গে কোন মেয়েকে নিয়মিত কথা বলতে দেখলেই গল্প চালু হয়। কিন্তু যেহেতু অসীমকে এখন খারাপ লাগছে না। তাই গল্পের ব্যাপারটাকে সে কেয়ার করছে না। অসীম তার সঙ্গে হোস্টেল পর্যন্ত প্রায়ই হেঁটে আসে। ছুটির দিন দশেক আগে হঠাৎ কলেজ ছুটি হয়ে যাওয়ায় দীপা ঠিক করল শিয়ালদা স্টেশনে যাবে টিকিট কাটতে। যাদবপুর থেকে রাধা নামের একটি মেয়ে শিয়ালদা স্টেশনে আসে ট্রেনে চেপে। ওর তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। শাড়ি জমা দেখলে বোঝা যায় অবস্থা তেমন ভাল নয়। দীপার সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছে। কথায় এখনও পূর্ববঙ্গেব টান আছে। দীপা রাধাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি বাড়িতে ফিরছি?

রাধা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। দীপা জিজ্ঞাসা করল, বাসে যাবে?

বাসে অনেক পয়সা লাগে। আমি ইস্টিশন পর্যন্ত হেঁটে যাই, সেখান থিকা ট্রেনে।

ভালই হল। আমি তোমার সঙ্গে : শিয়ালদা পর্যন্ত যাব। আপত্তি আছে?

রাধা যেন খুশি হল, কিন্তু আমি হেঁটে যাই!

দীপা হাঁটতেই চাইল। কলেজের গেটের বাইরে অসীম দাঁড়িয়েছিল। ওদের উল্টো দিকে হাঁটতে দেখে জিজ্ঞাসা করল দূর থেকেই, ওদিকে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

দীপা বলল, স্টেশনে।

মানে?

টিকিট কাটবো।

ও। একটু হকচকিয়ে গেল যেন অসীম। দীপা কথা না বাড়িয়ে রাধার সঙ্গে হাঁটতে লাগল। সে প্রশ্ন করল, তুমি যাদবপুরে থাক, এতদূরে পড়তে এলে কেন?

এই কলেজে নাকি বিবেকানন্দ পড়ছিলেন তাই বাবা এইখানেই ভর্তি করলেন।

তোমার বাবা কি করেন?

কাটা কাপড়ের ব্যবসা। হাটে হাটে।

হাট? কলকাতায় আবার হাট বসে নাকি?

রাধা হাসল, তুমি জানো না, কলকাতায় অনেকগুলো হাট বসে।

তোমরা কবে এসেছ পূর্ববঙ্গ থেকে?

আমরা বলি পাকিস্থান। যে সালে ইন্ডিয়া স্বাধীন হইল তার পরের সালে। নাইনটিন ফরটি এইট। বাবায় আসতে চায় নাই, কিন্তু আর একদিন থাকলে আমরা সব খতম হইয়া যাইতাম। আসার সময় যে কি কষ্ট তা তোমরা বুঝবা না।

এখানে কি বাড়ি ভাড়া করে আছ?

নাঃ। কলোনি। যে যার মত জমি দখল কইর‍্যা বইস্যা পড়ছে।

তুমি এখানকার স্কুলে পড়েছ?

হ। কলোনির স্কুল। এইরে, আমি একদম দ্যাশের ভাষা কইয়া ফেললাম।

তাতে কি? চা-বাগানে আমার একজন মাস্টারমশাই ছিলেন, তিনিও তাঁর দেশের ভাষায় কথা বলতে ভালবাসতেন। মাতৃভাষায় কথা বলতে তো আরাম লাগেই।

তুমি অন্যরকম।

আচ্ছা, এই যে তুমি যাদবপুর থেকে শিয়ালদায় ট্রেনে আসো, সেখান থেকে হেঁটে কলেজে, এত কষ্ট করো কেন?

করি কারণ পয়সা নাই। বাবায় তো কিছু দিতে পারে না। আমরা অনেকগুলান ভাই বুন। সকালে আর সন্ধ্যায় আমি দুটা মেয়েরে পড়াই। তা বিশ পঁচিশ টাকা হয়। জানো, কলেজের অন্য সবাইকে দেইখ্যা ভাবি ভগবান তাদের কত সুখে রাখছেন।

দীপা অবাক হয়ে তাকাল। একই কলেজে। গ্লোরিয়ারা পড়তে এসেছে আবার রাধার মত মেয়েও। কেউ সেন্টের দাম শাড়ির রঙ নিয়ে কথা বলে, কেউ খিদে চেপে থাকে। সে জিজ্ঞাসা করল, এই যে তুমি একা আসো, তোমার মা-বাবা বাড়ির লোকজন এতে কখনও আপত্তি করেনি?

প্ৰথম প্রথম কেউ কেউ করত এখন করে না। কলোনিতে এখন সবার উনুন ধরাবার চিন্তা, এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? আমি যদি বি.এ পাস করে একটা চাকরি পেয়ে যাই তাহলে আমাদের পবিবারটা বেঁচে যাবে। সবাই যখন এটা জানে তখন বাধা দেবে কেন? রাধা হাসল।

ওরা শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকল। নিত্য আসা-যাওয়া করলেও রাধা মেইন স্টেশনের অনেক কিছুই চেনে না। জিজ্ঞাসাবাদ করে জলপাইগুড়ির টিকিট কাটল দীপা। তারপর বলল, চল, কিছু খাই।

না। থাক। মাথা নাড়ল রাধা।

কেন? কি খেয়ে বেরিয়েছ তুমি?

রাধা ঠোঁট কামড়ালো। চোখে চোখ পড়তে দৃষ্টি সরিয়ে নিল দীপা। তবু জিজ্ঞাসা করল, ভাত খেয়ে আসনি?

আজ আমাদের ভাত হয় নাই। হয়তো এখন হবে।

ও। তাহলে তো তোমার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

থাক। ভাইবুনের বোধ হয় খাওয়া হয় নাই, আমি খাই কি করে! মাঝে মাঝেই রাধা সতর্ক হয়ে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে। দীপা আর কথা বাড়াল না। সে অন্তত দশটা টাকা রাধাকে দিতে পারত। কিন্তু সেটা দিতে কুষ্ঠা এল। এরকম একটা লড়াই করা মেয়েকে সাহায্য করতে চাইলে সে অপমানিত বোধ করতে পারে।

রাধা জিজ্ঞাসা করল, তুমি এক ফিরতে পারব? কোন অসুবিধা নাই, একদম সুজা রাস্তা, মানিকতলা পর্যন্ত।

দীপা মাথা নাড়ল। এক গাল হেসে রাধা তার ট্রেন ধরতে গেল। মাথার ভেতর এখন চিন্তার টানাপোড়েন। রাধা কি বাংলাদেশের মেয়ে নয়? এখন এই সময়েও যে দেশের পুরুষেরা মেয়েদের ঘরের বাইরে একা যেতে দিতে চায় না, যে দেশের মেয়েরা পুতুল খেলে সুখ পায় সেই দেশের মেয়ে রাধা? ও নিশ্চয়ই এক নয়। বাধাদের মত মেয়েরা কি দিন দিন বেড়ে যাবে বাংলাদেশে? সেই প্লাবন এলে এইসব ঘরকুনো ভীতু। মেয়ের দল কি আগল ভেঙে বেরিয়ে আসবে?

অন্যমনস্ক ছিল দীপা। প্লাটফর্মের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সে। হঠাৎ লক্ষ্য করল দুজন লোক তার খুব কাছ ঘেঁষে বিড়বিড় করে কিছু বলে চলে গেল। ব্যাপারটা ভালমতন বোঝার আগেই আবার একজন ফিরে এল। আকাশের দিকে তাকিয়ে এবার স্পষ্ট গলায় কথা বলল হাঁটতে হাঁটতে, চল, পেছন পেছন এসো। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকুনি খেল সে। লোকটার স্পদ্ধা কি? একটা মাঝবয়সী মানুষ তাকে কি ভেবেছে? যারা ডাকলেই পেছন পেছন যায় তাদের সঙ্গে কি কোন মিল আছে তার? দীপার ইচ্ছে করছিল লোকটাকে ডেকে কৈফিয়ত চায়। কিন্তু নিজেকে সামলালো সে। লোকটা এবার খানিক দূরে চলে গিয়ে উদ্বিগ্ন চোখে তাকে দেখছে। দীপা ডানদিকে এগিয়ে গেল। আপার সার্কলার রোড ধরে হাঁটবে। আর তখনই পেছন থেকে চিৎকার ভেসে এল, এই দীপাবলী, এক মিনিট।

অবাক দীপা মুখ ফিরিয়ে দেখল। অসীম প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে বেকচ্ছে স্টেশন থেকে। কাছে এসে হাসল, সারাটা স্টেশন খুঁজে কোথাও পাইনি। টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে?

দীপা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ।

মানে, শুনলাম স্টেশনে আসা হচ্ছে তাই চলে এলাম। সেই মেয়েটা কোথায়?

ওর বাড়ি চলে গিয়েছে।

ও। হোস্টেলে তো?

ইদানীং অসীম কথা বলছে এভাবেই। তুমি বা আপনি এড়িয়ে যাচ্ছে। দীপা হাসল, হোস্টেলে তো ফিরতেই হবে।

হাতে সময় থাকলে কফি হাউসে যাওয়া যেতে পারে।

কফি হাউস?

এই তো কলেজ স্ত্রীটে। হেঁটে গেলে দশ মিনিটও নয়।

নামটা এর মধ্যে অনেকবার কানে এসেছে। কলকাতার সমস্ত বুদ্ধিজীবাঁ শিল্পীদের নাকি সেখানে জমজমাট আড্ডা বসে। আগ্রহটা পেয়ে বসল। সে বাজি হল।

হ্যারিসন রোড ধরে অসীমের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল দীপা, কফি হাউসে মেয়েরা যায়? আমি একা হয়ে পড়ব না তো!

আমি তো আছি। মেয়েরাত যায়। তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। অসীম কথা ঘোববাল, করে জলপাইগুড়িতে যাওয়া হচ্ছে?

যেদিন ছুটি হবে।

কালীপুজোর পরে ফেরা।

হ্যাঁ।

ও।

কেন?

নাঃ, এমনি।

আমি ফিরতে নাও পারি।

মানে?

জন্মাবার পরে আমি যাঁকে বাবা বলে এসেছি তিনি খুব অসুস্থ।

বাবা বলে এসেছি মানে?

কারণ তিনি আমার জন্মদাতা বাবা নন। মা মারা গিয়েছিলেন আমায় জন্ম দিয়েই। আমি মাসি মেসোমশায়ের কাছে মানুষ। তাঁদেরই মা-বাবা বলি।

ও। অসীমের মুখ গম্ভীর হল, ওঁর কি হয়েছে?

বুকের অসুখ, সেই সঙ্গে ব্লাড প্রেসার।

কিন্তু তোমাকে তো পড়াশুনা শেষ করতেই হবে। বেশ জোরের সঙ্গে বলল অসীম।

দেখি। ইচ্ছে করেই নিজের গল্পের খানিকটা দীপা বলল। কিন্তু সেটা শুনে অসীম যে অসতর্ক হয়ে তুমিতে নেমে আসবে বুঝতে পারেনি।

আশ্চর্য! দেখি মানে? দীপাবলী, তুমি আর পাঁচটা মেয়ের মত নাও! তুমি একদম তোমার মত আলাদা। পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়া তোমার পক্ষে অসম্ভব।

আমি আলাদা কেন? আলাদা বলেই। তুমি মায়ার মত বেপরোয়া নাও। আবার অন্য মেয়েদের মত বোকা ভীরু মোটা দাগেব কিছু তোমার চরিত্রে নেই। আর এই জন্যেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে, তোমার সঙ্গ পেতে আমার ভাল লাগে।

কিন্তু জীবনানন্দ দাশকে আমি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি বলতে রাজি নই।

আমি তর্ক করব না। কিন্তু জীবনানন্দ সত্যিকারের কবি।

তা নিয়ে তো কোন দ্বিমত নেই।

হ্যারিসন রোড থেকে সংস্কৃত কলেজের রাস্তায় ঢোকার সময় অসীম বলল, তুমি কিন্তু আমায় খুব ভাবনায় ফেলে দিলে! সত্যি পড়া ছেড়ে যাবে?

আমার জন্যে এত ভাবনা হচ্ছে কেন?

অসীম একটু হকচকিয়ে গেল। কিছু ব্যাখ্যা করার জন্যে ভাবতে গিয়েও সে হাল ছেড়ে দিল। দীপা ততক্ষণে একটা বাইরে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িসেছে। যেসব বই ডিসপ্লের জন্যে রাখা আছে তার একটির দাম জিজ্ঞাসা করল। অসীম পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কি ব্যাপার? আই এ এসের কোয়েশ্চন পেপার কিনছো?

উল্টে পাল্টে দেখব বলে। দাম দিয়ে দিল সে। হাতে আর বেশি পয়সা রইল না। এখন। অসীম বলল, আপনাকে আমি মোটেই বুঝতে পারি না।

হাঁটা শুরু করে দীপা বলল, বোঝার কি দরকার?

আমার নিজের প্রয়োজনেই বুঝতে চাই।

মানে?

দীপাবলী, আপনাকে আমি বন্ধু হিসেরে পেতে চাই।

ওমা, বন্ধু না হলে এতটা পথ একসঙ্গে হেঁটে আসতাম নাকি? ডানদিকের একটা বাড়ির সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠে এল দীপা অসীমের সঙ্গে। আর ওঠামাত্ৰ যেন বাজারেব শব্দ পেল। কানে তালা লাগার যোগাড়। বিশাল হলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে হতভম্ব। এত টেবিল এত চেয়ার এবং সেগুলো জুডে বসে বিভিন্ন বয়সেব মানুষেরা একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আলাদা আলাদা কথা বলে যাচ্ছে। তাকে দেখামাত্র কাছাকাছি টেবিলের ছেলেরা কথা থামিয়ে উৎসুক চোখে তাকাল। দীপা দেখল। অসীমই অস্বস্তিতে পড়েছে। সে বলল, চল, ওপরে যাই। ওখানে খালি টেবিল পাওয়া যেতে পারে।

অতএর তিনতলায়। ইউ প্যাটার্নে বসার ব্যবস্থা। বাঁদিকের হাতায় খালি টেবিল পাও! যেতে সেখানেই বসল। ওরা। এখান থেকে ডান দিকে মুখ কুঁকিয়ে দোতলার ভিড়টাকে স্পষ্ট দেখা যায়। দীপা দেখল দোতলার অনেকেই মুখ উঁচু করে তাকে দেখার চেষ্টা করছে। এইসময় অসীম জিজ্ঞাসা করল, কি কফি খাবে? ঠাণ্ডা না গরম?

কফি খাওয়ার চল উত্তরবঙ্গে একদমই নেই। দীপার মনে হল ঠাণ্ডা কফির দাম নিশ্চয়ই বেশি হবে। ধরন দেখে মনে হচ্ছে অসীমই দাম দেবে। সে বলল, গরম।

অনেক ডাকাডাকির পর বেয়ারাকে অর্ডারটা দিতে পারল অসীম। দীপা জিজ্ঞাসা করল, এত লোক একসঙ্গে কথা বলে, ওদের মাথা ধরে যায় না?

অভ্যেসের ব্যাপার। অসীম হাসল।

অভ্যোস করতে হলে রোজ আসতে হয়। ওদের অন্য কাজকর্ম নেই?

নিশ্চয়ই আছে। তবে আলোচনা করাত কারো কারো কাজ। তুমি আই এ এস দেবে?

ইচ্ছে তো আছে।

তাহলে তো গ্র্যাজুয়েট হতে হবে।

নিশ্চয়ই। উত্তরটা শোনামাত্র অসীমের মুখে হাসি ফুটল। দীপা জিজ্ঞাসা করল, আমার কথা থাক। তুমি যখন শেষপর্যন্ত তুমিতে নামলে আমিও তুমি বলছি। পড়াশুনা শেষ করে কি করবে। ঠিক করেছ?

এম.এ. করে পড়াব। আমাদের বাড়িতে সবাই ব্যবসাদার।

বাঃ। দীপা হাসল, এ তো গোত্ৰছাড়া ব্যাপার।

আমরা তিনভাই। বাবা তিন বছর হল মারা গিয়েছেন। বড়বাজারে বড় ব্যবসা আছে। দাদারা দ্যাখে। ব্ল্যাকে প্রচুর টাকা জমাচ্ছে। আমার ওসব ভাল লাগে না। আমি জীবনটাকে অন্যরকম ভাবে দেখতে চাই। রুচি, শিক্ষা, সৌজন্য দিয়ে গড়া একটা জীবন। অসীম হাসল, বাড়িতে আমার পজিশন তাই ভাল নয়। ব্যবসায় আমার আইনত অংশ আছে বলে কেউ কিছু বলতে পারে না।

কলেজ স্ট্রিট থেকে হেঁটে এল দীপা। হাঁটতে কোন অসুবিধে হল না। অসীম কিন্তু সারাটা পথ প্রায় চুপচাপই ছিল। কথা না বলায় অসীমকে বেশ ভাল লাগছিল দীপার। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় অসীমকে ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছিল। একটা তিরতিরে অনুভূতি মনের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। চেষ্টা করেও তা থেকে পরিত্রাণের পথ নেই। আর এই সময় অসীম একদম চুপচাপ পাশে হেঁটে এসেছে বলেই তা আরও দ্রুতগামী হয়েছে। কলেজের গেটে পৌঁছে অসীম জানতে চাইল কাল দেখা হবে?

হবে। ছোট্ট শব্দটা উচ্চারণ করে দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল দীপা। কান গরম, শরীরে অদ্ভুত উষ্ণতা। ঘরের ভেজানো দরজা খুলে শুয়ে পড়তে গিয়ে থমকালো সে। নিজের খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে গ্লোরিয়া চাপা কাঁদছে। দীপা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

মুখ তুলল গ্লোরিয়া, আই অ্যাম ফিনিশড়। ও আমাকে বিট্রে করেছে।

কে? দীপা হতভম্ব।

আমার বয়ফ্রেন্ড। হি ইজ এ চিট। অল দ্য বয়েস আর চিট। কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা, তবু কেন যে ওদের প্রেমে আমাদের পড়তে হয়! ঈশ্বর?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *