1 of 2

৩১. বাড়িটা শুধু পুরনো নয়

বাড়িটা শুধু পুরনো নয়, গঠনেও আজকের দিনের সঙ্গে কোন মিল নেই। সিঁড়িগুলো সরু এবং হঠাৎ হঠাৎ বাঁক নেওয়া। কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ বেরিয়ে আসছে দাঁত দেখানো ইটের শরীর থেকে। দীপার মনে হল এই বাড়ি যে-কোন মুহুর্তে ভেঙে পড়তে পারে। কথাটা বলতে মায়া মাথা নাড়ল, না, এদেশের সংস্কারের মত এ বাড়ি সহজে ভেঙে পড়বে না।

চার শরিকের বাড়ি, মায়াদের ভাগে পড়েছে তিনখানা ঘর। সেদিকে পা বাড়ানো মাত্র একটা সুন্দর মোলায়েম গন্ধ নাকে এল। দরজা খোলাইছিল, ভেতরে ঢুকে জুতো একপাশে খুলে রেখে মায়া বলল, ছোট মামা তামাক খাচ্ছে। ওইটে আর বেহালা বাজানো তার শখ। জুতোটাকে ওখানে রাখার নির্দেশ মায়ের। আমারও মন্দ লাগে না।

এই সময় এক প্রৌঢ়া মহিলা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। লম্বা, গৌরবণা দেহ, পরনে সাদা শাড়ি, ঘোমটা মাথার মাঝ বরাবর, কানের ওপরকার চুলে সামান্য পাক ধরেছে, চোখে চশমা। মায়া বলল, এর নাম দীপাবলী, জলপাইগুড়ির চা-বাগানে থাকত, ডানডাস হোস্টেলে, থেকে পড়ছে। তারপর দীপার দিকে ঘুরে বলল, ইনি হাই হাইনেস লেট নবীনচন্দ্রের স্ত্রী, আমার জননী।

ভদ্রমহিলা অল্প হাসলেন, এসো। ভেতরের ঘরে এসো।

মায়া বলল, খুব খিদে পেয়ে গেছে। রাধা কোথায়?

রান্নাঘরে। যা গিয়ে বল। মায়া চলে যেতে তিনি দীপকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একটা পালঙ্ক, দেওয়ালে অজস্র মানুষের ছবি এবং সেগুলো প্ৰায় বিবৰ্ণ হয়ে এসেছে। কিছু আদ্যিকালের আসবার, মায়ার মা মুখোমুখি দুটো চেয়ারে দীপাকে নিয়ে বসলেন, কোন চা-বাগান?

দীপা নাম বলে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ওদিকে গিয়েছেন?

মাথা নাড়লেন, ভদ্রমহিলা, অনেক কাল আগে। আমার দাদু ছিলেন স্টেশন মাস্টার। মালবাজার নামে একটা জায়গা আছে তোমাদের ওদিকে, সেখানে পোস্টেড ছিলেন। মায়ের সঙ্গে সাত বছর বয়সে তাঁর কাছে গিয়ে কিছুদিন ছিলাম। এত সবুজ আর এত নীল আকাশ, আজও ভুলতে পারি না?

আপনারা তো এই কলকাতারই মানুষ?

হ্যাঁ, আমার দুকুলই কলকাতার। একেবারে সুতানটী, কলকাতার

মায়াকে দেখে কিন্তু সেটা মনে হয় না।

বুঝলাম না।

না, মানে, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলতে পারি।

তুমি নিঃসঙ্কোচে বলতে পার।

মায়া যেরকম সাহসী মেয়ে, যেভাবে ও ইউনিয়নের কাজ করে, নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত, কোন মিথ্যে সংস্কারকে আঁকড়ে নেই, এমন মেয়ে উত্তর কলকাতার পুরনো পরবারে বড় একটা দেখা যায় না। জানেন, এখনও আমাদের কলেজে মেয়েদের অভিভাবকেরা ছাতার আড়ালে করে নিয়ে যায়।

এই ব্যাপার কি মফস্বলের কলেজে হয় না?

স্কুল থেকে পাস করার পর প্রথম দু-একদিন হয়তো যেত। পরে, জলপাইগুড়ির মেয়েরা একাই যেত। ক্লাসের একটি মেয়ে বলছিল দক্ষিণ কলকাতার কলেজগুলোতে মেয়েরা একাই যাতাযাত করে।

ভদ্রমহিলা হাসলেন, এখানকার অভিভাবকরা বোধ হয় একটু বেশি সতর্ক। আর মায়া কিন্তু নতুন কোন কাজ করছে না। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা গান গাইতেন, নাটক অভিনয় করতেন ছেলেদের সঙ্গে। রবীন্দ্ৰনাথ তো নিজেই নাটক পরিচালনা করেছেন। আমি জানি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় গান্ধীজীর ডাকে অনেক মেয়ে সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টিকে যখন নিষিদ্ধ করা হল তখন অনেক মেয়ে সেই দলে কাজ করত।

দীপা অবাক হয়ে বলল, আপনি তো অনেক খবর রাখেন!

কি আশ্চর্য। চোখ কান খোলা রাখলেই তো এসব জানা যায়। তোমাকে তোমার বাবা জলপাইগুড়ি থেকে টাকা পয়সা খরচ করে কলকাতায় লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছেন। তুমি রাসাসুন্দরী দেবীর নাম শুনেছ?

না। রবীন্দ্রনাথের কেউ হন?

ন গো সেইটেই অবাক কাণ্ড। তাঁর সঙ্গে ঠাকুরাড়ির তিন কুলেও কোন সম্পর্ক ছিল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে লেখাপড়া শিখেছিলেন। তারপর বাঙালি মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম লিখলেন আত্মজীবনী। তাই দেখে এদেশের পুরুষরা বলেছিল, ঘোর কলিকাল চলছে। এখন মেয়েছেলেরা পুরুষদের কাজ করবে। এখন মিনসেরা জড়ভরত হয়ে থাকবে মনে হচ্ছে। কত কষ্ট করে সবাই পড়াশুনা করত। সত্যেন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী রাত্রে ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়তেন। তখন তো লেখাপড়া শেখা, জামা জুতো পরা, বাইরে বের হওয়া, গান গাওয়া, পুরুষদের সঙ্গে কথা বলা অপরাধ হিসেরে গণ্য হত। মেয়েদের কাজ ছিল রাধার পর খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধা। এরপর কলকাতার কিছু সম্রান্ত মানুষ বাড়ির মেয়েদের জন্যে আনলেন ইংরেজ গৃহশিক্ষিকা, হিন্দু ফিমেল স্কুল তৈরি হল আঠারোশ উনপঞ্চাশ সালে। তখন কত আপত্তি মেয়েরা স্কুলে গেলে কামাতুর পুরুষরা তাদের বলাৎকার করবে। হয়তো সেই ধারণা এখনও অনেক অভিভাবক লালন করেন। তবে তোমরা যে সুযোগ পাচ্ছ তা ওই সময়ের মেয়েরা পায়নি। এখনও যদি তোমার মনে হয়। উত্তর কলকাতার মেয়েরা অন্ধকার থেকে খুব একটা সরে আসেনি তাহলে তখন কেমন ছিল বুঝতেই পারছি।

দীপা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। মায়ার মা চুপ করতেই সে বলল, আমার খুব ভাল লাগছে। একথা শুনতে। আর একটু বলুন না।

মায়ার মা বললেন, আমি তো মায়াকে বলি তোরা পুরুষদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা বলিস। অথচ কাজটা করে দেখিয়ে দিয়েছেন দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী। খবর পেলেন দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে নাকি মদের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। খুব ধামিক মহিলা ছিলেন। নিজে যাচাই করতে গেলেন কয়েকজন জন সঙ্গিনীকে নিয়ে। সেই প্ৰথম ঘরের বউ অতি সাহস দেখাল। সাহেব মেমদের সঙ্গে মত্ত দ্বারকানাথকে দেখেও ভেঙে পড়লেন না। বোঝাতে চেষ্টা করেও যখন পারলেন না। তখন নিজের কর্তব্য করে গিয়েছেন আমৃত্যু কিন্তু আর কখনও স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় শোননি। অবশ্য দ্বারকানাথও এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভেবে দ্যাখো, ওই সময় বেশীরভাগ মেয়ে হয় আত্মহত্যা করত, নয় মেরুদণ্ডহীন হয়ে বেঁচে থাকত। দিগম্বরী প্ৰথম প্রতিবাদ করলেন আত্মমযাদা নিয়ে। হাসলেন ভদ্রমহিলা।

এই সময় মায়া ফিরে এল দুটো প্লেট নিয়ে। এসে বলল, চটপট হাত চালাও, আমাদের এখনই বেরুতে হবে।

প্লেট নিয়ে দীপা বলল, তোমার মায়ের মুখে পুরনো দিনের গল্প শুনছিলাম।

ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে?

নিশ্চয়ই। জানেন মাসীমা, জলপাইগুড়িতে কলেজ হোস্টেলে আমার রুমমেট ছিল মায়া নামে একটি মেয়ে। তোমার নামে নাম।

মায়া বলল, আমার ড়ুপ্লিকেট?

উল্টো। সে তার প্রাইভেট টিউটারকে ভালবাসত। হোস্টেলে এসে কি কান্নাকাটি। তারপর যেই তার বাবা ভাল সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দেবে বলে স্থির করল অমনি সেটা মেনে নিয়ে খুশি মনে বিয়ের পিড়িতে গিয়ে বসল।

মায়া বলল, এটাই এদেশের নবাবুইভাগ মেয়ের ধরন।

মায়ার মা বললেন, তোমাদের খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু এধরনের কাজের একটা ভাল দিক আছে। আমাদের দেশে কোন মেয়ে যদি প্ৰেমে পড়ে তাহলে তার আবেগটাই মুখ্য ভূমিকা নেয়। ছেলেটির সঙ্গে ভাল করে কথা বলার সুযোগ যে পায় না। তার জীবন এবং মানসিকতা সম্পর্কে জানবে কি করে? যদি বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলেটিকে বিয়ে করে তাহলে হয়তো কিছুদিনের মধ্যে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। তখন তার ফেরার কোন উপায় নেই। জোর করে বাপ মা যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছে সেখানে আর যাই হোক সারা জীবনের জন্যে একটা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকছে।

মায়া ফুঁসে উঠল, মা, তুমি এটা কি বললে? অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে পেতে হবে?

মায়ার মা হাসলেন, তুই কি জানিস না। এদেশের বেশীর ভাগ মেয়ের মনে আত্মসম্মান বোধই নেই। আমি বঞ্চিত, আমাকে অবহেলা করছে, এমন একটা জ্বালা নিয়ে বসে থাকে সবাই। অর্জনের জন্যে নিজেকে যোগ্য করে তোলে না। আমি সেইসব মেয়েদের কথা ভেবে ওটা বললাম। দিগম্বরী দেবীর মত মনের তেজ আজকে কটা বাঙালি মেয়ের আছে?

দীপা না বলে পারল না, কিন্তু মাসিমা দিগম্বরী দেবী সেটা করতে সক্ষম হয়েছিলেন কারণ দ্বারকানাথ মেনে নিয়েছিলেন। ধরুন, দ্বারকানাথ ওটা মানতে চাইলেন না, জোরজবরদস্তি করলেন, দিগম্বরী দেবী তখন কি করতেন?

মায়া বলল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন।

বাঃ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া খুব সোজা ব্যাপার। সেই সময়ে বাড়ির বউ যদি রাস্তাষ নামে তাহলে কেউ তাকে থাকতে দেবে?

তাহলে তুমি বলছি পুরুষদের সাহায্য ছাড়া মেয়েরা আত্মসম্মান বজায় রাখতে পারবে না? মায়া ফুসে উঠল।

মায়ার মা বললেন, ইতিহাস কিন্তু তাই বলে। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে যিনি প্ৰথম স্ত্রী-স্বাধীনতার হাওয়া আনলেন তাঁর নাম জ্ঞানদানন্দিনী, সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী। মাত্ৰ সাত বছর বয সে পায়ে গুজবি-পঞ্চম আর একগালা ঘোমটা দিয়ে শ্বশুরবাড়িরে এসেছিলেন তিনি। স্বামী সত্যেন্দ্ৰনাথ বিলেতে পড়তে গিয়ে চক্ষুষ্মান হলেন। তাঁর মনে হল, তারা বিয়ে করেননি, তাঁদের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঠাকুর বাড়িতে মেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছেন তখন মহর্ষি দেবেন্দ্ৰনাথ। সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথের সামনে ঘোমটা টেনে বউরা প৬তে বসত। জ্ঞানদোনন্দিনী এমনি করেই পড়ে ফেললেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সত্যেন্দ্ৰনাথ বিলেত থেকে ফিরে চাকরি পেলেন মহারাষ্ট্রে। নিয়ে যেতে চাইলেন স্ত্রীকে। চারদিকে ছিছি শুক হয়ে গেল। বাঙালি দূরদেশে চাকরি করতে গেলে বউকে মায়ের কাছে রেখে যায়। কিন্তু বিদ্রোহ করলেন সত্যেন্দ্রনাথ, জোর করে বাবার অনুমতি আদায় করলেন। কিন্তু কি পারে জ্ঞানদানন্দিনী বাড়ির বাইরে যাবেন? বাঙালি বউয়ের ইজত নষ্ট হবে পরপুরুষেব নজর পড়লে। শাড়ির ওপর চাদর জড়িয়ে যাওয়াটাও চলবে না। ঘর থেকে বেরিয়ে পালকিতে ওঠা নয়, সত্যেন্দ্ৰনাথ চেয়েছিলেন দেউড়ি পেরিয়ে গাড়িতে উঠতে। দেবেন্দ্রনাথের এ প্রস্তাব খারাপ লাগল, এতে কর্মচারিরা ঘরের বউকে দেখে ফেলবে। তাই পালকি গিয়ে তুলে দিয়ে এল বোম্বের জাহাজে, জ্ঞানদানন্দিনীকে ফরাসী দোকানে আডাব দিয়ে বানানো ওরিয়েন্টাল ড্রেস পরিয়ে। সেই কিন্তুতি পোশাক পরে অস্বস্তিতে ভুগতে ভুগতে জ্ঞানদানন্দিনী স্থির করলেন বাঙালি মেয়েদের জন্যে রুচিশীল সাজি বের করা দরকার।

মায়া বলল, মা তুমি কিন্তু প্ৰথম থেকে সরে যাচ্ছ!

যাচ্ছি না, আসছি। দুবছর স্বামীর সঙ্গে একা বোম্বাইতে থেকে জ্ঞানদানন্দিনী অনেক জানলেন। যেদিন ফিরে এলেন কলকাতায় সেদিন হুলুস্কুল পড়ে গেল। ঘরের বউকে মেমসাহেরের মত গাড়ি থেকে নামতে দেখে হাহাকার উঠল। তিনি ঠাকুরবাড়ির ভেতরেই একঘরে হলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বালক, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়েরাত ওঁর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন না। বাইরের বঙ্গসমাজের অবস্থা তো আরও করুণ। জ্ঞানদানন্দিনী দুঃসাহস দেখালেন। লাটসাহেবের নিমন্তান্ন পেয়ে তিনি স্বামীর সঙ্গে চললেন সেখানে। সবার চোখ বড় হল। ঘরের বউকে সাহেব মেমদের সঙ্গে ভোজসভায় দেখে পাথুরেঘাটায় প্ৰসন্নকুমার ঠাকুর লজ্জায় মরে গেলেন যেন। কিন্তু এই প্রথম বাইরের হাওয়া এসে লাগল বাঙালির অন্তঃপুরে। জ্ঞানদানন্দিনী আর এক ধাপ এগোলেন। তিনি বিলেতে পাড়ি দিলেন পুরুষসঙ্গী ছাড়া। অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছায়। সে সময় বাঙালিরা বিলেতে যেত না কালাপানি পার হবার ভয়ে। যারা যেত তারা ফিরত না, ফিরলেও বাঙালিয়ানা ছেড়ে সাহেবিপনা দেখাত। স্ত্রী-স্বাধীনতার সঙ্গে পরিচিত হতে কয়েকটি ইংরেজি বাক্যের পুঁজি নিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী বিলেত গিয়েছিলেন। ভাবতে পারো তোমরা? এই যে আজ তোমরা যে ভাবে শাড়ি পরো তার প্রথম ধাপ চালু করেছিলেন জ্ঞানদোনন্দিনী। সেই সঙ্গে সায়া-সেমিজ-জ্যাকেট-ব্লাউজ। লোকে বলত ঠাকুরবাড়ির সাজ। পরে ময়ূরভঞ্জের মহারাণী সুচারু দেবী মেয়েদের শাড়ি পড়ার আধুনিক ঢঙটি প্রবর্তন করেন। এই যে জন্মদিন পালন করা, এদেশে সেটা জ্ঞানদানন্দিনী প্রথম শুরু করেন। যৌথ পরবারের অসুবিধা বুঝতে পেরে জ্ঞানদানন্দিনী স্বামীপুত্ৰ কন্যাকে নিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠে যান। সেটাও তো এদেশে প্রথম। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেননি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবার উপকারে লেগেছেন। এরপর ঠাকুরবাড়িতে অভিনীত হল রাজা ও রাণী। বিক্রম রবীন্দ্রনাথ আর সুমিত্ৰা জ্ঞানদানন্দিনী। ভাবতে পারো, সেই সাত বছর বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েটি শেষপর্যন্ত কোথায় পৌঁছেছিলেন। আর এ সবই সম্ভব হয়েছিল তাঁর পাশে সত্যেন্দ্রনাথের মত স্বামী ছিলেন বলে। ওই পুরুষটি যদি এই নারীর হৃদয়ে জ্ঞানেব আলো না জ্বালিয়ে দিতেন তাহলে তিনি বাঙালি মেয়েদের বন্ধ দরজায় আঘাত করতে–পারতেন। কি না সন্দেহ আছে।

মায়া বলল, তুমি সত্তর আশি বছর আগের কথা বলছি। কিন্তু এখন তো সময় পাল্টে গিয়েছে। এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের—।

তাকে থামিয়ে দিলেন প্রৌঢ়া, শোন, প্রত্যেক বছর কিছু না কিছু মেয়ে গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে। লেখাপড়া যারা করতে পারে না তাদের কথা ছেড়ে দে। তা এই গ্র্যাজুয়েট মেয়েগুলোর কজন চাকরি করে? স্কুল কিংবা কলেজে সুযোগ না পেলে বাড়িতে বসে থাকে, বিয়ে-থা করে লেখাপড়া ভুলে যায়।

মায়া কথাটা মানল। মানল বলেই চুপ করে রইল। খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুটো প্লেট তুলে সে চলে গেল ভেতরে। দীপা বলল, মাসীমা, আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। যদি আপনার কাছে মাঝে মাঝে আসি তাহলে আপত্তি করবেন?

ওমা, আপত্তি করব কেন? নিশ্চয়ই আসবে। কলকাতায় তোমার কেউ নেই?

মামা মামী আছেন।

তাঁদের বাড়িতে কি জায়গা কম?

হ্যাঁ। তাছাড়া, মামীমাকে আমি এই প্রথম দেখলাম।

পড়াশুনা শেষ করে তুমি কি করতে চাও?

চাকরি।

তোমার বাবা আপত্তি করবেন না?

না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।

তুমি মায়ার মত কলেজে রাজনীতি করা?

না। আমার পছন্দ হয় না।

কেন?

আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তাছাড়া আমার ভালও লাগে না।

মায়া নাটক করে। তুমি কি সেখানে যাচ্ছ?

এখনও যাইনি।

তুমি ঠিক কি করতে চাও?

আমি নিজেকে বুঝতে চাই। কারো ওপর নির্ভর করতে চাই না।

একসময় তো করতেই হবে।

কেন?

বাঃ, তোমাকে তো সংসার করতেই হবে।

কেন?

এটা একটা সামাজিক এবং প্রাকৃতিক নিয়ম।

দীপা কথা বলল না। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এই ভদ্রমহিলাকে নিজের জীবনের সব কথা খুলে বলে। সে নিজেকে সামলে নিল প্রথম আলাপে অত অকপট হওয়া উচিত নয়। কিন্তু এই মহিলাকে তার ভাল লাগছে। ইনি অঞ্জলির বিপরীত আবার রমলা সেনের ৬ সঙ্গেও কোন মিল নেই। অনেকটা গাছের মতন। মাটির গভীরে শিকড় ছড়িয়ে যেমন রস টেনে নেয় শরীরে তেমনি আকাশেব দিকে ডালপালা উচিয়ে বাতাসের স্বাদ নেয় প্রতিটি রন্ধ্রে।

দীপা বলল, মাসিমা, মায়া যে এসব করছে এটা আপনি চেয়েছিলেন?

ভদ্রমহিলা হাসলেন, আমি ওকে বলেছি যেটা স্বাভাবিকভাবে আসবে সেটাই করবে। এই নিয়ে তো এ বাড়িতে কম জল ঘোলা হল না। ইউনিয়ন করে, রাত নটায় ট্রামে চেপে বাড়ি ফেরে। এককালে ব্ৰাহ্মসমাজের মেয়েরা যা করত তাও ভুলে যেতে চায় সবাই। মায়ার বাবা যা রেখে গিয়েছেন তা ভাঙিয়ে চলে যাচ্ছে কোনমতে। আমি যা পারিনি মেয়ে যদি তা করে আপত্তি করব কেন?

আচ্ছা, ব্ৰাহ্মসমাজের মেয়েরা খুব গালাগাল খেত, না?

খুব। সেই গল্পটা শোননি? নীরদ চৌধুরীর নাম শুনেছ?

দীপা মাথা নাড়ল, না।

ভদ্রমহিলা বললেন, উনি খুব পণ্ডিত মানুষ। লেখালেখি করেন। তল ওঁর বাবা-মাকে নিয়ে ট্রামে উঠেছিলেন। ভদ্রমহিলার পায়ে মোজা জুতো ছিল। ট্রামের কয়েকজন যাত্রী নিজেদের মধ্যে ঠারে ঠুরে কথা বলছিলেন। ওইদিকে তাকিয়ে। নীরদবাবুর বাবার কানে এল একজন বলছেন, এ বেবুশ্যে না হয়ে যায় না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রতিবাদ করলেন, না মশাই, ইনি আমার স্ত্রী। তাই শুনে যাত্রীটি বলল, ও, আপনারা তাহলে ব্ৰাহ্ম।

দীপা হেসে ফেলল, কি অবস্থা।

ভদ্রমহিলা বললেন, এখন, এতদিন বাদে কোন মেয়ে যদি রাত দশটায় ধর্মতলা থেকে এক ট্রামে ওঠে তাহলে যাত্রীরা তাকে প্রথমটাই ভাববে।

পাশের ঘর থেকে তোমাকের গন্ধ আর তেমন তীব্র হয়ে আসছিল না। মায়ার মামাকে এর মধ্যে একবারও দেখতে পায়নি দীপা। তিনি ওই ঘরেই রয়ে গেছেন। মায়া এসে তাড়া লাগাতে সে উঠে পড়ল, এলাম মাসিমা।

মাঝে মাঝে এস।

মাথা নেড়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে মায়ার সঙ্গে নামতে লাগল দীপা। সেই সাঁতসেঁতে গন্ধ, অন্ধকার অন্ধকার সিঁড়ি। একটা চত্বরে পা দিতে গিয়ে মায়া ইশারা করে তাকে থামাল, দাঁড়াও।

কি হল? দীপা অবাক হয়ে সামনে তাকাল। সম্ভবত এটি আর এক শরিকের অংশ। তাদের ঘর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। ওপাশের দরজায় শব্দ হল। এক প্ৰবীণা মহিলা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দ্রুত হেঁটে গেলেন সামনে দিয়ে। দীপা হকচকিয়ে গেল। মায়া ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করে থাকতে বলল। কয়েক সেকেন্ড বাদে ওপাশেই কোন দরজা শব্দ করে বন্ধ হতেই সে বলল, চল, এবার যাওয়া যেতে পারে।

সিঁড়িগুলোয় যেন বাতাস নেই। বাড়ির বাইরে পা দিতে স্বস্তি পাওয়া গেল। এই সময় ডানদিকের রকে বসা কয়েকটি বৃদ্ধের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করল, কোথায় চললে হে? রিহার্সাল নাকি?

হ্যাঁ। মায়া ঘুরে দাঁড়াল।

এবারে কি প্লে ধরেছ?

পিরানদোল্লার ভারতীয় কাপ।

ভাল ভাল। বিদেশের ভাল জিনিস নিতে কোন আপত্তি নেই। বিদ্যাসাগর। মশাই সেক্সপীয়ার সাহেব থেকে লিখলেন ভ্ৰান্তিবিলাস। লেখেননি? এটি কে?

আমার সঙ্গে পড়ে।

প্লে করে?

না। প্ৰণাম। মায়া দাঁড়াল না। খানিকটা এগিয়ে বলল, বুড়ো ভাম।

কে? দীপা জানতে চাইল।

আমার দুঃসম্পর্কের এক জ্যোঠা। তিন তিনটি বউ। রোজ একই প্রশ্ন করে। আমাকে দেখলেই যেন ঠোঁট চুলবুল করতে থাকে। অন্যেরা মজা পায়।

বল না কেন কিছু?

বললেই তো শত্ৰু হয়ে যাবে। এমন ভাব দেখায় যেন নাটকের কি সমঝদার। অথচ শাজাহান সিরাজদৌল্লার বাইরে কোন নাটক দেখেননি।

এখন সন্ধে নেমে গিয়েছে। দীপা একটু শঙ্কিত হল। মায়া যদি সঙ্গে না যায় তাহলে সে হোস্টেলের পথ চিনবে তো? মায়া জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি হোস্টেলে ফিরবে না। আমার সঙ্গে গ্রুপে যাবে।

গ্রুপে?

আমাদের নাটকের দলে।

আজ থাক। দীপা মাথা নাড়ল।

কেমন লাগল আমাদের বাড়ি?

তোমার মা অপূর্ব। আচ্ছা, ওই ভদ্রমহিলা অমনভাবে গেলেন কেন? বাইরের লোক তো না জেনে এসে পড়তে পারত।

উনি তখন দৌড়াতেন। চোঁচাতেন। সে চেচনি তো কখনও শোননি!

কিন্তু কেন?

শুচিবায়ুগ্ৰস্ত। চারবেলা স্নান করবেন। বাথরুমে পরিষ্কার কাপড় নিয়ে যাবেন না। শুধু নিজে নয় ওর মেয়েদেরও তাই করতে হবে। তারা অবশ্য একটা গামছা জড়ায়। মায়ের কাছে শুনেছি জ্যাঠামশাই যখন বেঁচে ছিলেন তখন মাঝরাত্রে বিছানা থেকে নেমে আধঘণ্টা ধরে স্নান করতেন।

ট্রাম স্টপে এসে মায়া দাঁড়াল, তুমি এখান থেকে হোস্টেলে যেতে পারবে? ডানডাস হোস্টেলের সামনে দিয়ে ট্রাম লাইন চলে গিয়েছে। সোজা হেঁটে গেলে না পৌঁছানোর কোন কারণ নেই। সে বলল, কাল কলেজে দেখা হবে।

হ্যাঁ। কাল তাড়াতাড়ি যেও, কলেজ থেকে ফান্ড কালেকশনে বের হব।

কেন?

ওঃ, তুমি কোন খবরই রাখো না। আসামে মারাত্মক বন্যা হয়েছে। ইউনিয়ন থেকে বন্যার্তদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দীপা মাথা নেড়ে হাঁটতে লাগল। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল সে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে গাড়ি বাস অথবা ট্রাম হুস হাস বেরিয়ে যাচ্ছে। দীপা তাকিয়ে দেখল রাস্তায্য একটিও মেয়ে নেই। কিন্তু কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। ওর মায়ার মায়ের কথা মনে এল। যে বাড়িতে ভদ্রমহিলা বাস করেন। সেই বাড়ির অন্য শরিকের স্ত্রীমেয়েরা ওইভাবে বাথরুম থেকে বের হয়? তিনি কেন ওঁদের বোঝাতে পারেননি?

হোস্টেলটা যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে দীপা ভাবতে পারেনি। চেনা গেট দেখে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। গেট পেরিয়ে দোতলার সিঁড়িতে পা দিয়ে স্বস্তি এল। গ্লোরিয়া ঘরে নেই। আলো জেলে ওর বিছানার দিকে তাকাতেই মন বিকাপ হল। মেয়েটা অস্তবসি ছেড়ে রেখে গিয়েছে বিছানায। ওকে কি কেউ শেখায়নি। এগুলো আড়ালে রাখা উচিত। গ্লোরিয়ার গায়ে দেবার চাদরটা ওগুলোর ওপর চাপা দিয়ে দিল দীপা।

হাত মুখ ধুয়ে আলো নিবিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। হঠাৎ চোখের সামনে দিগম্ববাঁ দেবী চলে এলেন। একশ পচিশ বছর আগের। সেই মহিলা দেখতে কিরকম ছিলেন? দীপা কল্পনা করল, খুবই সাধারণ স্বতাবের ছোটখাটো মানুষ। অবশ্যই সুন্দরী, নইলে দ্বাবকানাথ তাঁকে বিয়ে করতেন না। কিন্তু সেই মহিলা এত তেজ পেলেন কোথায়? ডলস হাউসের নোরা প্রতিবাদ করতে বেরিয়ে এসেছিল ঘর ছেড়ে কারণ তার বেরুবার উপায় ছিল। কিন্তু দিগম্ববাঁ দেবী ঘরে থেকেই সারাজীবন প্ৰতিবাদ করে গেলেন স্বামীকে স্পর্শ না করে। এটা কি একটা বিরাট বিপ্লব নয়? চোখের সামনে চলে এলেন জ্ঞানদোনন্দিনী দেবী। এই মহিলার ছবি মনে মনে আঁকতে লাগল দীপা। চোখদুটো নিশ্চয়ই ছিল খুব স্বপ্ন ভরা। মাথার চুল নিশ্চয়ই টান টান করে আচডাতো, সিঁথি মাঝখানে সরল ভাবে উঠে গিয়েছে।

দরজায় টোকা পড়তেই চোখ মেলল দীপা। গ্লোরিয়া ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, আলো জ্বালাতে পারি?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। উঠে বসল দীপা।

আলো জেলে গ্লোরিয়া বিছানায় বসল। ওর পরনে লাল স্কট আর কালো জামা। কোন কালো মেয়ে এমন অদ্ভুত রঙ পরে? কিন্তু গ্লোরিয়া একটুও অস্বচ্ছন্দ নয়। হেসে জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছি আমার দিকে তাকিয়ে?

তোমার পোশাক। কোথায় গিয়েছিলে?

নিউ মার্কেটে। তুমি বিকেলে হোস্টেলে ফিরে আসনি না?

হ্যাঁ, এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম।

তোমার জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। আমার দেশের দুটো ছেলে এখানকার ওয়াই এম সি এ-তে থাকে। ওরা একজন বেঙ্গলি গার্লের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। তোমার কথা বলেছিলাম ওদের, ওরা এসেছিল।

দীপা বলল, আমি হয়তো ইন্টারেস্টেড নাও হতে পারি।

তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। গ্লোরিয়া জামার বোতাম খুলতে লাগল। এই দৃশ্যটি মোটেই পছন্দ হয় না দীপার। সে মেয়ে হলেও মানুষ। গ্লোরিয়ার ভঙ্গী দেখে মনে হয়। সে এই ঘরে একা আছে। কিন্তু কিছু বলল না দীপা। তার মনে পড়ল মা ভাইদের সামনে কাপড় ছাড়ত না কিন্তু সে থাকলে কোন সঙ্কোচ হত না। ঠাকুমার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখেছে সে। গ্লোরিয়া না হয়। আর এক ধাপ এগিয়েছে। মায়ার জেঠিমা কি আরও আধুনিক? বিবস্ত্র হওয়া যদি আধুনিকতা হয়!

বেলা বারোটায় ছুটি হয়ে গেল। কারণ ছাত্রছাত্রীরা আসামের বন্যার্তদের সাহায্যার্থে চাঁদা তুলতে বের হবে। তিনটে ট্রাক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে ইউনিয়নের ছেলেরা। মাইকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বারংবার আবেদন জানাচ্ছে এই অভিযানে শামিল হতে। বেশীরভাগ মেয়েই এখন কমনরুমে বসে আছে। যারা ব্যাপারটা জানত তাদের অনেকেই আজ কলেজে আসেনি। ব্যস্ত মায়া কমনরুমে এসে দীপাকে ধরল, তুমি যাচ্ছ তো?

অরাজনৈতিক ব্যাপারে যখন তখন আমি আছি।

বিধান রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে তুমি নেই?

তার মানে আমি বিধান রায়ের দলেও নাই।

ঠিক আছে, যারা যেতে চায়, মানে যাদের মানবিকতাবোধ আছে তাদের নিয়েই এখনই চলে এস। ছেলেরা জড় হয়ে গিয়েছে। কথাগুলো মায়া বলল বেশ গলা তুলে যাতে কমর রুমের সবাই শুনতে পায়। বলে চলে গেল সে। দীপা মেয়েদের দিকে তাকাল। তারা গল্প করছে এমন ভঙ্গীতে যেন কোন কথাই কানো যায়নি। শুধু মানসী নামের একটি মেয়ে এগিয়ে এল, চল, আমিও যাব। মানসী ফোর্থ ইয়ারে পড়ে, হোস্টেলে থাকে। ওর বড়ি আসামের হাইলাকান্দি শহরে। আসলে সিলেটের লোক ছিলেন ওর বাবা। এদেশীয় মেয়েদের আড়ষ্টত্ব–ওর মধ্যে নেই। মানসী বলল, আর কেউ যাবে বলে মনে হচ্ছে না। সিঁড়ির মুখে গোটা তিনেক মেয়ে বেশ সেজেণ্ঠজে দাঁড়িয়েছিল। তাদের দেখলে মনে হয় না। পড়তে এসেছে। দীপা লক্ষ্য করল ট্রাকের সামনে দাঁড়ানো কয়েকটা ছেলের সঙ্গে ইশারায় কথাবার্তা চলছে। এরা ইন্টার মিডিয়েট ক্লাসের ছাত্রী। তিনটে ছেলে শেষ পর্যন্ত সাহস করে ওদের সামনে দাঁড়াল। কি কথা হল দূর থেকে শোনা গেল না। কিন্তু অনেকখানি ন্যাকামো করে তিনটি মেয়ে সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে গেল ট্রাকের দিকে। এই সময় গ্লোরিয়া চিৎকার করে ডাকল, হ্যালো, দীপাবলী।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হেলেরা এদিকে তাকাল। অথাৎ সমস্ত কলেজ জেনে গেল তার নাম দীপাবলী। ভাগ্যিস মেয়েটা আজ সাদা জামা সবুজ স্কার্ট পরেছে। গ্লোরিযাব সঙ্গে তার বান্ধবীরাত ছিল। গ্লোরিয়া বলল, ওরা আমাদের ডাকছে না কেন?

মানসী বলল, সব ছেলে মেয়েকেই তো ডাকছে।

তাহলে আমরাও যেতে পারি?

দীপা বলল, স্বচ্ছেন্দে।

এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সিলিকরা কৌটোর মাঝখানে এক ইঞ্চি ফুটো। মায়া তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে একটা করে। ট্রাকে চেপে শহর পরিভ্রমণ শুরু হল। মাঝে মাঝে ট্রাক থামলে রাস্তায় নেমে পথচারিদের আসামের বন্যার কথা বলে কোটো তুলে ধরছে ওরা। কেউ সেখানে পয়সা কিংবা টাকা ফেললে খুব আনন্দ হচ্ছে। দোতলা তিনতলা থেকে পুরনো জামাকাপড় ছুঁড়ে দিচ্ছে কেউ কেউ ট্রাকের ওপরে। মাইকে বারংবার আবেদন জানানো হচ্ছে সাহায্য করার জন্যে। দীপা লক্ষ্য করল গ্লোরিয়ারা সোৎসাহে লেগে পড়েছে অর্থ সন্ধানে। যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে, হেল্প হেল্প, আওয়ার ব্রাদার্স সিস্টার্স আর ইন ডিসট্রেস। প্লিজ হেল্প দেম। কলকাতার রাস্তায় তিনজন আফ্রিকার কালো মেয়ে কৌটো হাতে আসামের বন্যার্তদের জন্যে চাঁদা তুলছে, এ দৃশ্যে পুলকিত হচ্ছে সবাই। এমন কি তারা যেকটি বাঙালি মেয়ে এই অভিযানে নেমেছে তারাত দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসময় একটি সুদৰ্শন ছেলে দীপার সামনে এসে দাঁড়াল, কিছু মনে করবেন না, এখানে গাড়ি কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। আপনি যদি আমার সঙ্গে আসেন তাহলে বাড়িগুলোর ভেতরে গিয়ে মেয়েদের কাছে সাহায্য চাইতে পারি।

আপত্তি করার কিছু দেখল না দীপা। মানসী এখন অন্য ফুটপাথে। তাকে ডাকার অবকাশ নেই। দীপা ছেলেটার সঙ্গে পা বাড়াল। সামনের বাড়ির দরজা খোলাই ছিল। কয়েকজন ভদ্রলোক সেখানে দাঁড়িয়ে। সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি হোস্টেলে থাকেন।

দীপা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনি তো দীপাবলী, আমি অসীম অসীম চক্রবর্তী। মায়ার কাছে আপনার কথা শুনেছি। আমি এবার ইকনমিক্স নিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে দেখে আমার খুব সহজ মনে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *