1 of 2

১.৩১ পরবর্তী সম্মোহন আদেশ

একত্রিংশ পাঠ
পরবর্তী
সম্মোহন আদেশ (Post-hypnotic Suggestion)

যে আদেশের দ্বারা পাত্রকে ভবিষ্যতে কোন নির্ধারিত সময়ে বা কোন এক সময় হইতে কোন নির্দষ্ট সময় পর্যন্ত কোন কাৰ্য্য করিতে বাধ্য করা যায়, ইংরাজিতে উহাকে “পোষ্ট-হিপ্নোটি সাজ্জসসান” (Post-hypnotic Suggestion) বলে। কেহ কেহ এই আদেশকে “ডেফার্ড সার্জেনসান” (Deferred Suggestion) বলিয়া ও অভিহিত করিয়া থাকেন। বাঙ্গলায় উহাকে “পরবর্তী-সম্মোহন আদেশ” বলা যাইতে পারে। মোহিতাবস্থায় কোন পাত্রকে যদি এরূপ আদেশ প্রদান করা যায় যে, সে আগামী মাসের ১ তারিখে (কিম্বা ছয় মাস বা দুই বৎসর পরে, কোন নির্দিষ্ট তারিখে) রাত্রি ২টার সময় শ্যামের বাড়ী যাইয়া তাহার সদর দরজায় তালা বন্ধ করিয়া আসিবে, অথবা সে আগামী কল্য হইতে তাহার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যহ নিয়মিতরূপে ৮ ঘণ্টা কাল পাঠ অভ্যাস করিবে, তবে সে তাহাই করিতে বাধ্য হইবে। মোহিতাবস্থায় এরূপ আদেশ প্রদান পূৰ্ব্বক পাত্রকে প্রকৃতিস্থ করিয়া দিলে উক্ত আদেশ সম্বন্ধে তাহার কিছু মাত্র ধারণা থাকিবেনা; কিন্তু যখন সেই আদিষ্ট কাৰ্য্যটি সম্পন্ন করিবার সময় উপস্থিত হইবে, তখন সে উহার অনিবার্য শক্তি প্রভাবে মোহিত হইয়া একটা তালা ও চাবি সংগ্রহ পূর্বক মন্ত্রমুগ্ধ ব্যক্তির ন্যায় শ্যামের বাড়ীর দিকে ছুটিবে এবং সেখানে পৌঁছিয়া তাহার সদর দরজায় তালা বন্ধ করিয়া আসিবে; কিম্বা সে ঐ আদেশের প্রভাবে উক্ত নির্ধারিত দিবস হইতে তাহার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ না হওয়া পৰ্যন্ত, প্রতিদিন নিয়মিতরূপে আট ঘণ্টা পাঠাভ্যাস করিতে বাধ্য হইবে। সম্মোহনবিৎ নিজের ইচ্ছামত এই আদেশ দ্বারা পাত্রকে উক্তরূপ বহু প্রকার কার্যে বাধ্য করিতে পারে। যযোপযুক্তরূপে প্রদত্ত হইলে, এই আদেশ বহু দিন পরেও নিশ্চিতরূপে কাৰ্যকর হইয়া থাকে। এই আদেশের প্রভাবে এক ব্যক্তি সুদীর্ঘ ২৬ বৎসর পরেও একটি আদিষ্ট কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে বাধ্য হইয়াছিল।

সম্মোহন বিজ্ঞানের এই অংশ অত্যন্ত গোপনীয়। কিন্তু আমি শিক্ষার্থীকে এই বিদ্যা সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতি আছি বলিয়া অন্যান্য বিষয়ের সহিত এই গুপ্ত অংশও প্রকাশ করিলাম। তজ্জন্য বর্তমান পাঠে যে বিষয়গুলি সন্নিবিষ্ট করিয়াছি, উহাদের প্রকৃত মূল্য এই পুস্তকের মূল্য অপেক্ষা বহুগুণ অধিক হইবে। অজস্র অর্থ ব্যয়েও যে সকল কার্য সম্পন্ন হওয়া কঠিন, এই পুস্তকের সাহায্যে সে, উহাদিগকে স্বল্পায়াসে সম্পাদন করিতে সমর্থ হইবে।

পরবর্তী-সম্মোহন আদেশ দ্বারা যেমন মানুষের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রভূত মঙ্গল সাধন করা যায়, সেইরূপ আবার উহার সাহায্যে তাহার অনেক প্রকার অনিষ্টও করা যাইতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থী ইহার সাহায্যে কদাপি কাহার কোনরূপ অপকারের প্রয়াস পাইবেনা। সে নিজের ও অপরের মঙ্গলার্থ যত বেশী পরিমাণে ইহা নিয়োগ করিবে, সে তত অধিক শক্তিশালী কাৰ্যকারক হইয়া লোকের শ্রদ্ধা ও ভক্তি আকর্ষণ করিতে পারিবে। আর যে, কোন মন্দ উদ্দেশ্যের বশবর্তী হইয়া ইহা প্রয়োগ করিবে, সে সকলের নিলা ভাজন ও সন্দেহের পাত্র হইয়া দিন দিন শক্তিহীন হইতে থাকিবে। এজন্য আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ এই যে, সে যেন কোন প্রলোভনের বশেই ইহার অপব্যবহার না করে। যদি কেহ পুনঃ পুনঃ এই নিষেধ সত্ত্বেও ঐরূপ কোন কাৰ্য্য করে, তবে তাহার ফলাফলের জন্য আমি দায়ী হইবনা।

এই আদেশ মোহিত ব্যক্তির মনে স্থায়ীরূপে কাৰ্য্য করিতে সমর্থ; এজন্য ইহার সাহায্যে অনেক প্রকার শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক রোগ চিরস্থায়ীরূপে আরোগ্য করিতে পারা যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে যে, যে সকল বালক অলস, অবাধ্য, দুর্দান্ত, মিথ্যাবাদী, দুর্বল স্মরণশক্তি বিশিষ্ট, লেখাপড়ায় অনিচ্ছুক, তামাক-সিগারেট খায়, চুরি করে, কু-অভ্যাস রত এবং যে সকল যুবক কৰ্তব্য ভ্রষ্ট, মন্দ সংসর্গ লিপ্ত, নেশাখোর, ব্যভিচাপরায়ণ-বেশ্যা-সক্ত হইয়া স্বীয় বিষয় সম্পত্তি নষ্ট করিতেছে, তাহাদিগকে চিরকালের নিমিত্ত সংশোধন করিতে পারা যায়। যাহার কোন রোগ না হওয়া সত্ত্বেও রোগ হইয়াছে বলিয়া একটা ভ্রান্ত ধারণা হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়াছে, কিম্বা যে কোন মন্দ লোকের বশীভূত হইয়া তাহার ক্রীড়নক রূপে পরিণত হইয়াছে, তাহার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করিতে পারা যায় এবং ন্যায়সঙ্গতরূপে কোন বিশেষ স্ত্রী বা পুরুষের স্নেহ-ভালবাসা-বন্ধুত্ব লাভ করিয়া তাহাকে আয়ত্তাধীন রাখিতে পারা যায়। ইহার সাহায্যে এরূপ বহু কাৰ্য্য সম্পাদন করা যাইতে পারে।

এই আদেশ অল্প নিদ্রায় তেমন কার্যকর হয়না। সুতরাং যাহাকে ইহা প্রদান করিতে হইবে, তাহাকে অগ্রে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত করিবে। তাহার নিদ্রা যত বেশী গাঢ় হইবে, ইহা তাহার মনে তত দৃঢ়রূপে কাৰ্য্য করিবে। যে সকল পাত্র মায়া ও ভ্রমের আদেশের খুব তাড়াতাড়ি সাড়া (response) দেয় এবং জাগ্রত হওয়ার পর,উক্ত মায়া ও ভ্রম সম্বন্ধে যাহাদের সমস্ত স্মৃতি লোপ পায়, বিশেষ ভাবে তাহাদের মনেই এই আদেশ খুব শী ও দৃঢ়ভাবে কাৰ্য্য করিয়া থাকে।

এই আদেশ প্রদান করিবার পূর্বে পাত্রকে সাধারণ নিয়মে গভীরু নিদ্রায় নিদ্রিত করিবে। বলা বাহুল্য যে, অল্প নিদ্রায় পাত্রকে কিছুক্ষণ ঘুমের আদেশ ও পাস দিলেই, তাহার নিদ্রা গাঢ় হইয়া থাকে। যখন সে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছে, তখন সম্মোহনবিৎ তাহার নাসিকামূলে প্রখর দৃষ্টি স্থাপন করতঃ, ডান হাত দ্বারা তাহার (পাত্রের বাম হাতের অঙ্গুলিগুলিকে শক্তরূপে চাপিয়া ধরিয়া, বাম অঙ্গুলিগুলির অগ্রভাগ দ্বারা তাহার (পাত্রের) মস্তকের উপর (ব্ৰহ্মতালুতে) আস্তে আস্তে তালে তালে আঘাত (stroke) করিবে এবং সেই সঙ্গে অভীষ্ট সিদ্ধির উপযোগী আদেশ দিবে। সম্পূর্ণ আদেশটি খুব দৃঢ়তার সহিত আট-দশ বার প্রদান করিবে এবং তাহা করিবার সময় মনে এরূপ বিশ্বাস রাখিবে যে, পাত্র আদিষ্ট কাৰ্যটি অবশ্য সম্পাদন করিবে। যতক্ষণ অভীষ্ট বিষয়ে আদেশ দিতে থাকিবে, ততক্ষণ কথিত নিয়মে বাম আঙ্গুলগুলির অগ্রভাগ দ্বারা পাত্রের মস্তকের উপর আস্তে আস্তে এমন ভাবে আঘাত করিবে যেন, সে উহাতে ব্যাথা না পায়। আদেশ প্রদত্ত হইবার পর, তাহাকে সাধারণ নিয়মে জাগ্রত করিয়া দিবে; অথবা তাহার নিদ্রা স্বতঃ স্বাভাবিক নিদ্রায় পরিবর্তিত হইবার নিমিত্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিবে। বলা বাহুল্য যে, ঐ নিদ্রা স্বাভাবিক নিদ্রায় পরিবর্তিত হইলে পাত্র যথা সময়ে নিজেই জাগ্রত হইয়া উঠিবে এবং তজ্জন্য আর কাৰ্যকারকের সাহায্য আবশ্যক হইবেনা।

এই আদেশের সাহায্যে কাহারও কোন রোগ আরোগ্য কিম্বা কোন মন্দ অভ্যাস বিদূরিত করিতে রোগীকে প্রত্যহ নিয়মিতরূপে এক দুইবার করিয়া বাঞ্ছিত বিষয়ে আদেশ দিবে। তাহার একাধিক রোগ (বা মন্দ অভ্যাস) বর্তমান থাকিলে, উহাদিগকে একটি একটি করিয়া আরোগ্যের প্রয়াস পাইবে; এক সময়ে কখনও দুই-তিনটি লইয়া চেষ্টা করিবেনা। যেহেতু একটি রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য না হইতে, অপর একটিতে হস্তক্ষেপ করিলে উভয় চেষ্টাই বিফল হইতে পারে। সম্মোহনবিৎ এই উপদেশগুলি যথাযথভাবে অনুসরণ করিতে পারিলে তিন-চার দিনের মধ্যেই এক একটি বিষয়ে কৃতকাৰ্যতা লাভে সমর্থ হইবে। কিন্তু সে সর্বদা রোগ কিম্বা অভ্যাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করতঃ কাৰ্য্য করিবে, অর্থাৎ উহা সহজ হইলে অল্প দিন আর পুরাতন বা কঠিন হইলে আরোগ্যের জন্য বেশী দিন আদেশ দিতে হইবে। পাত্র স্বভাবতঃ সংবেদ্য হইলে, কঠিন ক্ষেত্রেও এক বা দুইবার আদেশ দিয়াই বাঞ্ছিত ফল লাভ করা যায়। কাৰ্য্যকারক অভীতি কার্য সম্পাদনের নিমিত্ত পাত্রকে যে আদেশ দিতে ইচ্ছা করিবে, তাহা সে পূৰ্বেই স্থির করিয়া লইবে। উহা (স্পষ্টার্থ বোধক) সংক্ষিপ্ত অথচ সম্পূর্ণ অভিপ্রায় প্রকাশক ও কৰ্ম্ম-প্রবৃত্তি উত্তেজক হইবে। এস্থলে নিম্নে কয়েকটি বিভিন্ন প্রকার আদেশের দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হইল।

(১) অবাধ্য বালককে বাধ্য করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“সতীশ, তুমি বড় অবাধ্য, কিন্তু আজ হইতে তুমি আর তোমার পিতা মাতার অবাধ্য থাকিবেনা,-তুমি আর কখনও তাহাদের অবাধ্য হইবেনা; তুমি আজ হইতে সকল সময়ে ও সকল বিষয়ে তাহাদের একান্ত বাধ্য ও অনুগত হইবে; তোমাকে জাগ্রত করার পর হইতেই তুমি একটি সম্পূর্ণ বাধ্য ও অনুগত বালকে পরিণত হইবে। তোমার চরিত্র হইতে অবাধ্যতা দোষ সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হইয়া গিয়াছে।” (২) অত্যধিক ক্রীড়াশীলতা দোষ দূর করিবার জন্য নিম্নলিখিতরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“ধীরেন, তুমি বড় বেশী খেলা কর। কিন্তু আজ হইতে তুমি আর এত বেশী খেলা করিবেনা; তুমি এখন হইতে আর কখনও দিনে দুই ঘণ্টার বেশী খেলিবেনা; তুমি আর কখনও বেশী খেলা করিবেনা।

(৩) লেখাপড়ার অনিচ্ছুক বালককে মনাযোগী করিতে নিম্নলিখিতরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“সুরেন, তুমি লেখা পড়ায় বড় বেশী অনিচ্ছুক; কিন্তু তুমি আজ হইতে আর লেখা পড়ায় অনিচ্ছুক বা অমনাযোগী হইবেনা। তুমি কাল হইতে নিয়মিতরূপে স্কুলে যাইবে এবং প্রতিদিন খুব মনোযোগের সহিত ৭ ঘণ্টা সময় পাঠ অভ্যাস করিবে। তুমি প্রত্যহ নিয়মিতরূপে স্কুলে না গেলে এবং ৮ ঘণ্টা সময় পাঠাভ্যাস না করিলে তোমার শরীর ও মন ভাল থাকিবেনা—যখন তুমি পাঠ অভ্যাস করিবে, তখন খুব মনোযোগের সহিত পড়িবে এবং পড়িবার সময় কখন কাহারও সঙ্গে বাজে কথা-বাৰ্তা কহিবেনা এবং অন্য কোন বিষয় চিন্তাও করিবেনা। মনে রাখিও, কাল হইতেই তোমাকে প্রতিদিন নিয়মিতরূপে স্কুলে যাইতে এবং ৭ ঘন্টা সময় পড়িতে হইবে।”

(8) ধূমপানের অভ্যাস দূর করিতে নিম্নলিখিত আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি আজ হইতে আর কখনও তামাক খাইবেনা, তুমি আর কখনও তামাক খাইবেনা;তুমি আজ হইতে আর তামাক খাইতে পারিবেনা; তামাক খাইলে তমার কাশি ও বমি হইবে; তুমি আজ হইতে উহার গন্ধও শুকিতে পারিবে না। তামাক না খাওয়ার দরুণ তোমার কোন কষ্ট হইবেনা,বরং উহা না খাইলেই তুমি শরীর ও মনে বেশ সুস্থতা ও ফুৰ্ত্তি বোধ করিবে; তুমি এখন জাগ্রত হইয়াই প্রতিজ্ঞা পূর্বক তামাক ছাড়িয়া দিবে এবং জীবনে আর কখনও তামাক খাইবেনা।”

(৫) মদ্যপানের অভ্যাস দূর করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি আজ হইতে আর মদ খাইবেনা, তুমি আজ হইতে আর কখনও মদ খাইতে পারিবেনা,কারণ মদের গন্ধে তোমার বমি হইবে—অত্যন্ত অসুখ করিবে। মদ না খাওয়ার দরুণ তোমার কোন কষ্ট হইবেনা, মদ না খাইলেই বেশ সুস্থতা বোধ করিবে। আর খাইলে তোমার ভয়ঙ্কর বমি হইবে;-তমার অত্যন্ত অসুখ করিবে। তোমাকে জাগ্রত করিবার পর তোমার মদ্যপানের স্পৃহা সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হইয়া যাইবে এবং তুমি আর কখনও মদ স্পর্শ করিবেনা।”

(৬) দুই ব্যক্তির ভালবাসা বা বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ জন্মাইতে তাহাদের একজনকে গভীর নিদ্রায় অভিভূত করিয়া নিম্নলিখিতরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“যোগেশ, তুমি আজ হইতে আর গোপালকে ভাল বাসিবেনা, তুমি আর কখনও তাহার নিকট যাইবেনা এবং তাহাকেও তোমার নিকট আসিতে দিবেনা। তাহার প্রত্যেক কথা এবং কাৰ্য তোমার মনে বিরক্তি উৎপাদন করিবে,—অত্যন্ত বিদ্বেষ উৎপাদন করিবে এবং প্রতিদিনই তাহার প্রতি তোমার বিদ্বেষ ও ঘৃণা বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। সুতরাং আজ হইতে তুমি আর তাহাকে কখনও ভাল বাসিবেনা,তুমি “আর কখনও তাহাকে ভালবাসিতে পারিবেনা,-তুমি আজ হইতে তাহাকে শত্রু মনে করিয়া তাহার প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠর ব্যবহার করিবে এবং তুমি জাগ্রত হইবার পর শত্রু মনে করিয়া তাহাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করিবে।” যদি অপর ব্যক্তিকেও (গোপালকেও) মোহিত করিয়া উক্তরূপ আদেশ দেওয়া যায়, তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাঞ্ছিত ফল লাভ হইবে। এই আদেশ কদাপি কাহারও অপকারার্থে প্রয়োগ করিবেনা।

[৭] কোন বিশেষ ব্যক্তির ভালবাসা লাভ করণ।—এই আদেশের দ্বারা কোন বিশেষ পুরুষ বা স্ত্রীর ভালবাসা লাভ করিয়া তাহাকে বশীভূত রাখিতে পারা যায়। কিন্তু যে স্থলে ইহা হইতে অভীষ্ট ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক বা নৈতিক অনিষ্টের সম্ভাবনা নাই, সে ক্ষেত্র ব্যতীত, কদাপি ইহা প্রয়োগ করিবেন। বিধিসঙ্গত স্থল ব্যতিরেকে ইহা প্রয়োগ করিলে কাৰ্যকারকের সমূহ বিপদ ঘটিবে। যে পুরুষ বা স্ত্রীর ভালবাসা লাভ করিতে ইচ্ছা করিবে, তাহাকে গভীর নিদ্রায় অভিভূত করিয়া নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি আজ হইতে আমাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিবে; আজ হইতে তোমার মন আমাকে ভালবাসিবার জন্য লালায়িত হইয়া উঠিবে। আমার প্রত্যেক কথা এবং প্রত্যেক কাৰ্য তোমাকে আনন্দ দান করিবে, –তোমার অত্যন্ত ভাল লাগিবে। তুমি আমাকে যত বার দেখিবে, তুমি ততই অধিকতর রূপে আমার প্রতি আকৃষ্ট হইবে। তুমি সমস্ত প্রাণ ভরিয়া আমাকে ভালবাসিতে না পারিলে, তোমার জীবন ব্যর্থ বলিয়া মনে করিবে। তুমি দিন দিনই আমার প্রতি অধিকতর রূপে আকৃষ্ট হইয়া গভীর ভাবে আমাকে ভালবাসিতে থাকিবে।” কথিত নিয়মে আট-দশ বার এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়া,অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত পুনৰ্বার বলিবে–“আমি তোমাকে যাহা বলিলাম, তুমি জাগ্রত হইয়া উহার এক বর্ণও মনে: রাখিতে পারিবেনা, তুমি জাগ্রত হইবা মাত্র সব ভুলিয়া, যাইবে, কিন্তু আমি তোমাকে যাহা যাহা করিতে আদেশ করিলাম, তাহা তুমি যথাযথরূপে পালন করিবে। গভীর নিদ্রায় কোন আদেশ প্রদত্ত হইলে পাত্রের মনে সাধারণতঃ উহার কোন স্মৃতি থাকে না; তথাপি উক্ত বিষয়ে অধিক নিশ্চিত হইবার নিমিত্ত তাহাকে কথিত রূপ আদেশ দিবে।

[৮] ভবিষ্যতে কোন নির্দিষ্ট পাত্রকে সহজে মোহিত করিবার নিমিত্ত নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিয়া তাহাকে পূৰ্ব্বে তৈয়ার করিয়া রাখিবে। তাহাকে গভীর নিদ্রায় অভিভূত করিয়া বলিবে—“ভবিষ্যতে যখন আমি তোমাকে মোহিত করিতে চেষ্টা করিব, তখন তুমি খুব শীঘ্র শীঘ্ৰ নিদ্রিত হইয়া পড়িবে,-তুমি তিন-চার মিনিটের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হইয়া পড়িবে, তখন তুমি কিছুতেই

অধিক সময় জাগিয়া থাকিতে পারিবেনা” ইত্যাদি।

[৯] একখানা কার্ডের সাহায্যে মোহিত করণপোষ্টকার্ডের অর্ধ আকারের এক খান সাদা কার্ডে বড় ও সুস্পষ্ট অক্ষরে “ঘুম” এই শব্দটি লিখিয়া লইবে। তৎপরে পাত্রকে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত করিয়া বলিবে—“তুমি জাগ্রত হওয়ার পর আমি তোমাকে একখানা সাদা কার্ড দেখাইব। ঐ কার্ডখানায় কেবল ‘ঘুম’ শব্দটি লেখা আছে—আর কিছুই লেখা নাই। তুমি জাগ্রত হওয়ার পর আমি যখন তোমাকে ঐ কার্ডখানা দেখাইব, তখনই তুমি গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িবে;-ঐ কাৰ্ডখানার দিকে কাইবা মাত্র তোমার গাঢ় নিদ্রা হইবে। দুইদিন পরে হউক কিম্বা এক সপ্তাহ পরে হউক, আমি যখনই তোমাকে, ঐ কার্ডখানা দেখাইব, তুমি তৎক্ষণাৎ গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িবে। তুমি তখন যে অবস্থায় থাক, সেই অবস্থাতেই ঘুমাইয়া পড়িবে।” এইরূপ আদেশ দিয়া তাহাকে জাগ্রত করার পর, ঐ কাৰ্ডখানা তাহার সম্মুখে ধরিয়া বলিবে—“দেখত ইহাতে কি লেখা রহিয়াছে?” পাত্র উহার প্রতি তাকাইয়া আদেশ মত নিদ্রিত হইয়া পড়িলে, তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিয়া দিবে। পরে সম্মোহনবিৎ যখন ইচ্ছা করিবে তখনই তাহাকে উহার সাহায্যে মুহূৰ্ত্ত মধ্যে নিদ্রিত করিতে সমর্থ হইবে; কিন্তু সে উহা দ্বারা তাহাকে যখন-তখন বিরক্ত করিবেনা। ইহার সাহায্যে অতি সহজে নিদ্রাল্পতা রোগ (Insomnia) আরোগ্য করা যায়। উক্ত রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে মোহিত করণান্তর ঐরূপ একখানা কার্ড দিলে, যখন তাহার ঘুমের আবশ্যক হইবে, তখন ঐ শব্দটির প্রতি একটু সময় তাকাইলেই তাহার গাঢ় নিদ্রা হইবে। কয়েকদিন ঐরূপ করিলেই তাহার রোগ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়া যাইবে।

[১০] তোতলামি অবোগ্য করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি কথা কহিবার সময় আর তোতলামি করিবে না,-কথা বলিবার সময় তোমার জিহ্বায় আর কোন কথা আটকাইবে না, তুমি আমাদের মত সুস্পষ্টরূপে সকল কথা উচ্চারণ করিতে পারিবে;-তুমি আর কখনও তোতলামি করিবে না, তোমার তোতলামি সম্পূর্ণরূপে সারিয়া গিয়াছে।”

[১১] বালক-বালিকার বিছানায় প্রস্রাব করা অভ্যাস বদূরিত করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি আজ হইতে আর কখনও ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় প্রস্রাব করিবে না;-ঘুমন্ত অবস্থায় যখন তোমার প্রস্রাবের বেগ হইবে, তখনই তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং তুমি বাহিরে যাইয়া প্রস্রাব করিবে। আজ হইতে তুমি আর বিছানায় প্রস্রাব করিবে না,কখনও করিবেনা।”

[১২] সম্মোহন শক্তি পাত্ৰান্তর করণ :সম্মোহনবিৎ ইচ্ছা করিলে স্বীয় শক্তি অল্প বা অধিক সময়ের জন্য, তাহার কোন বন্ধুকে প্রদান করিতে পারে, অর্থাৎ সে কোন নির্দিষ্ট পাত্রকে তাহার কোন বন্ধু দ্বারা পরিচালিত হইতে বাধ্য করিতে পারে। সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত করিয়া বলিবেতুমি জাগ্রত হইবার পর রামবাবু (যে বন্ধুর দ্বারা তাহাকে চালিত করিতে ইচ্ছা করিবে তাহার নামোল্লেখ করিবে) তোমাকে যাহা করিতে আদেশ করিবেন, তুমি সেই আদেশকে আমার আদেশের ন্যায় মান্য করিয়া তাহা পালন করিবে। তিনি তোমাকে যাহা করিতে আদেশ করিবেন, তুমি ভাল-মন্দ বিবেচনা না করিয়া তাহাই করিবে,তুমি অবশ্য তাহার আদেশ পালন করিবে।” বলা বাহুল্য, যেরূপ কাৰ্যে পাত্রের কোনরূপ অনিষ্টের সম্ভাবনা আছে, কাৰ্যকারকের বন্ধু কদাপি তাহাকে সেরূপ কোন কাৰ্য্য করিতে আদেশ দিবেনা।

[১৩] কোন সম্মোহনবিৎকে কাৰ্যকারকের নিজের পাত্র মোহিত করিতে অসমর্থ করণ : কাৰ্যকারকের নিজের কোন পাত্র অপর কোন সম্মোহনবিৎ কর্তৃক মোহিত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে, কিম্বা কোন সম্মোহনবিৎকে শিক্ষার্থীর নিজের কোন পাত্র সম্মোহনে অসমর্থ করিতে ইচ্ছা করিলে, সেই পাত্রকে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত করিয়া বলিবে—“তুমি অপর কোন সম্মোহনবিৎ কর্তৃক কখনও মোহিত হইবেনা। যখন তোমাকে কেহ মোহিত করিতে চেষ্টা করিবে, তখন তুমি কিছুতেই তোমার মন একাগ্র করিতে সমর্থ হইবেনা; আমি ভিন্ন তুমি অপর কোন ব্যক্তি কর্তৃকই মোহিত হইবেনা; আমি ভিন্ন অপর কেহই তোমাকে মোহিত করিতে পারিবেনা”।

[১৪] কাহারও বক্তৃতা-শক্তি বৃদ্ধি করিতে নিম্নোক্তরূপে আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি আজ হইতে তোমার বক্তৃতা-শক্তি বৃদ্ধি করিবার জন্য অত্যন্ত যত্নবান হইবে—তুমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইবে। তুমি আজ হইতে নিয়মিতরূপে বক্তৃতা দেওয়া অভ্যাস করিবে এবং ইহা সম্যক্‌রূপে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত উহাতে বিরত থাকিবেনা। এই শক্তি বিকাশের জন্য তুমি যযোপযুক্ত যত্ন, চেষ্টা ও পরিশ্রম করিতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করিবেনা।”

(১৫) কাহারও রচনা-শক্তি বৃদ্ধি করিতে—নিয়োক্তরূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“আজ হইতে তুমি প্রবন্ধাদি বচনা-কার্যে অধিক সময় ব্যয় করিবে;—আজ হইতে তোমার মন প্রবন্ধ লেখার শক্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিবে। আজ হইতে তুমি প্রতিদিন নিয়মিতরূপে প্রসিদ্ধ লেখকদের মৌলিক প্রবন্ধাদি পাঠ করিবে এবং চিন্তাশীলতার সহিত প্রবন্ধাদি লিখিবার জন্য যত্নবান হইবে। তুমি এই শক্তি বৃদ্ধির জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকিবে।”

(১৬) কাহাকেও ধৰ্ম প্ৰবণ করিতে নিম্নোক্তরূপ আদেশ দিবে! বলিবে—“তুমি এখন হইতে খুব ধৰ্ম্মশীল হইতে চেষ্টা করিবে। তুমি এখন হইতে অসৎ কাৰ্যগুলি অন্তরের সহিত ঘৃণা করিবে এবং সৎকাৰ্য গুলিকে প্রাণের সহিত ভালবাসিবে ও সর্বদা উহাদের অনুষ্ঠানে যত্নবান থাকিবে। তুমি এখন হইতে সত্যবাদী, দয়াশীল, পরোপকারী ও ভগবানের প্রতি দৃঢ় ভক্তিমান হইবে।”

(১৭) কাহাকেও ইষ্ট দেব-দেবী দর্শন করাইতে নিমোক্ত রূপ আদেশ দিবে। বলিবে—“তুমি আজ হইতে তোমার ইষ্ট দেবতাকে সুস্পষ্টরূপে দর্শন করিতে সমর্থ হইবে। যখন তুমি নীরব স্থানে শান্তভাব অবলম্বন পূর্বক চক্ষু বুজিয়া একাগ্রমনে ১০৮ বার তোমার ইষ্ট দেবতার নাম জপ করিবে, তখনই ভক্তবৎসল যশোদানন্দন শ্রীকৃষ্ণ (অথবা অসুরমর্দিনী, নৃমুণ্ডমালিনী, বরাভয়করা শ্যামা মা) তোমার মুদিত চক্ষের সম্মুখে আসিয়া উদয় হইবেন এবং তুমি প্রাণ ভরিয়া সেই অতুল রূপমাধুরী দর্শন করিয়া তোমার নয়ন ও মন পরিতৃপ্ত এবং জীবন সার্থক করিবে। তুমি কেবল তাঁহাকে ১৫ মিনিটের জন্য সুস্পষ্টরূপে দর্শন করিতে পারিবে, পরে তিনি অন্তর্হিত হইবেন।”

সম্মোহনবিৎ পাত্রকে যাহা দেখিতে আদেশ করিবে, সে এই বিদ্যার প্রভাবে তাহাই দেখিতে বাধ্য হইবে। বলা বাহুব্য যে, উহা যথার্থ নয়—পাত্রের কল্পিত ভ্রম মাত্র! দীর্ঘকালের জন্য কাহাকেও কোন ভ্রমের অধীন রাখা উচিৎ নয়; কিন্তু এই বিষয়ের ভ্ৰম কদাপি অনিষ্টকর নয়; পরন্তু ইহা দ্বারা তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতিরই বিশেষ সম্ভাবনা রহিয়াছে। কারণ উক্তরূপে কেহ তাহার ইষ্ট দেবতাকে দর্শন করিতে পারিলে যে, তাহার একাগ্রতা এবং ভক্তি অতিশয় বর্ধিত হইবে, তাহাতে কোন সন্দেহ আছে কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *