প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.৩১ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে

কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল বিনুরা। তারপর বলল, তুমি কখন এখানে এসেছ?

ঝিনুক বলল, ওই যে যুগলদাদা বলছিল যাত্রা শুনতে যাবে, বাড়ির পেছন দিকে নৌকো বাঁধা আছে। তাই শুনেই তো চলে এলাম।

একলা এসেছ?

হুঁ।

কী দুর্জয় সাহস মেয়েটার! এই নিশুতি রাতে ঝুমাদের বাড়ি থেকে নির্জন খালপাড়ে বিনু নিজেই কি একা একা আসতে পারত?

এইসময় যুগল ডেকে উঠল, ঝিনুকদিদি—

ঝিনুক তক্ষুনি সাড়া দিল, কী বলছ?

এত রাইত কইরা তোমারে সুজনগুঞ্জে যাইতে হইব না। শুইয়া থাকো গা। আরেক দিন তোমারে যাত্রা শুনাইয়া আনুম।

না না– জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নাড়তে লাগল ঝিনুক।

যুগল শুধলো, কী হইল?

আমি আজই যাব।

যুগল হয়তো ভাবল, খোলা নৌকোয় তিনটে বাচ্চাকে বসিয়ে জলপূর্ণ প্রান্তর পাড়ি দেওয়া খুবই বিপজ্জনক। বিনু ছাড়া আর কারোকেই নেবার ইচ্ছা ছিল না তার, ঝুমাটা নেহাত জোর করেই সঙ্গ নিয়েছে। সে বোঝাতে চেষ্টা করল, ঝিনুকদিদি, তুমি সুনা(সোনা) বইন তো–

যুগলের গলায় তোষামোদের সুর শুনে কিছু একটা আন্দাজ করল ঝিনুক। ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে সমানে বলতে লাগল, না না না না–

তারই ভেতর যুগল বলল, না না করে না। লক্ষ্মী বইন, তুমি পোলাপান মানুষ, রাইত জাগলে শরীল খারাপ হইব।

হঠাৎ মাথা ঝকানি বন্ধ করে ঝিনুক বলল, তা হলে ও যাচ্ছে কেন? ও কি বুড়োমানুষ?

কার কথা কও?

ঝিনুক কুমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল।

নিজের ফাঁদে এমন করে জড়িয়ে পড়বে, যুগল ভাবে নি। ছেলেমানুষ হলে যাওয়া যদি নাকচ হয়ে যায়, ঝুমা যাচ্ছে কী করে?

ঝিনুক বলল, ও গেলে আমিও যাব। আমাকে যদি না নাও—

যুগল শুধলো, না নিলে কী?

চেঁচিয়ে এক্ষুনি সবাইকে ডাকব। তোমাদের যাত্রা শোনা বেরিয়ে যাবে।

কাজেই ঝিনুককে নৌকো থেকে নামানো গেল না, তার সঙ্গে রীতিমতো সন্ধি করে নিতে হল।

যুগল বলল, বেশ, তোমারে লইয়া যামু। কিন্তুক দুষ্টামি করতে পারবা না।

যে কোনও শর্তেই এখন ঝিনুক রাজি। মাথা হেলিয়ে সে বলল, আচ্ছা।

আমি যা কমু হেই করতে হইব।

আচ্ছা।

যুগল এবার বিনুদের দিকে তাকাল, ওঠেন ছুটোবাবু, নায়ে ওঠেন।

নৌকোয় উঠতে উঠতে বিনুর মনে হল, ঝিনুকের চোখে ধুলো ছিটিয়ে কিছু করবার উপায় নেই, সে ঠিক ধরে ফেলবে।

সবাই উঠলে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না যুগল। নৌকো ছেড়ে দিল। গলুইর ওপর বসে সবল হাতে জোরে জোরে বৈঠা বাইছে সে, নৌকোটা যেন পাখির মতো ডানায় ভর করে উড়ে চলেছে।

চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে বিনুরা খাল পেরিয়ে পারাপারহীন প্রান্তরে এসে পড়ল।

আশ্বিনের শেষাশেষি এই নিশুতি রাতে বাতাস যেন কেমন কেমন, তাকে বুঝি বা ডাকিনীতে পেয়েছে। জলমগ্ন মাঠের ওপর দিয়ে নেশাপ্ৰমত্তের মতো দিগ্বিদিকে সেটা ছুটে বেড়ায়। বিনুরা যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেখানে কোথাও পদ্মবন, কোথাও শাপলাবন, মাঝে মাঝে ধানের খেত। পদ্মবনে শাপলাবনে কিংবা ধানের পাতায় হাওয়া লেগে শব্দ ওঠে সাঁই সাঁই।

চন্দনের ফোঁটার মতো আকাশময় যে কত তারা সাজানো! তার মাঝখানে একটুখানি চাঁদ। আশ্বিনের শেষাষেষি এই সময়টায় হিম পড়তে শুরু করেছে। ফলে কুয়াশার ভেতর দিয়ে যে চাঁদের আলোটুকু এসে পড়েছে তাতে কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। ধানখেত, দূরের বনানী, শাপলা-পদ্মের বন এই মুহূর্তে সব ঝাঁপসা, রহস্যময়, কুহেলিবিলীন।

সমুদ্রের মতো এই অথৈ অপার জলরাশির মাঝখানে বসে শীত শীত করে। হাওয়া লেগে গায়ে কাঁটা দেয়।

নৌকোর মাঝখানে বিনু ঝুমা আর ঝিনুক কুঁকড়ি মুকড়ি মেরে বসে ছিল। যুগল ডাকল, ছুটোবাবু–

বিনু বলল, কী বলছ?

শীত নি করে?

হ্যাঁ।

বুদ্ধি কইরা যদিন চাদর চুদর লইয়া আইতেন—

আমি কি জানি, এইরকম শীত করবে? তোমার বলা উচিত ছিল।

একটু নীরবতা।

তারপর যুগলই শুরু করল, আইজ জবর উলটা পালটা বাতাস। তা এক কাম করি ছুটোবাবু–

কী?

বাদাম খাটাইয়া দেই।

দাও।

সেদিন যা করেছিল, আজও তাই করল যুগল। পরনের কাপড়খানা ফস করে খুলে বাদাম খাটাতে খাটাতে বলল, এইবারে ছোত্ (চট) কইরা চইলা যামু।

বিনু কিছু বলল না।

বাদাম টাঙিয়ে বৈঠা নিয়ে হালে বসল যুগল। কিছুক্ষণ পরে বলল, চুপচাপ বইসা থাকতে ভালা লাগে না ছুটোবাবু–

তবে কী করতে চাও?

একখানা গীত গাই?

ঝুমা হঠাৎ বলে উঠল, গান?

যুগল বলল, হ ঝুমাদিদি–

তুমি গান জানো! ঝুমা অবাক।

ঝুমার গলায় এমন কিছু ছিল যাতে আহত হল যুগল। জানি কি না-জানি, ছুটোবাবুরে জিগাইয়া দেখ।

বিনু তাড়াতাড়ি সায় দিয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভাল গাইতে পারে। গাও যুগল, শুরু করে দাও–

ছোটবাবু তার গানের তারিফ করেছে, যুগল মনে মনে খুশি হল। একটু চুপ করে থেকে সুর ধরল :

বিদ্যাশেতে রইলা মোর বন্দুরে,
ও আমার পরান বন্দুরে–
বিধি যদি দিত রে পাঙ্খা,
উইড়া গিয়া দিতাম দেখা,
আমি উইড়া পড়তাম
সোনা বন্দুর দ্যাশে।
বন্দু যদি আমার হও,
নিজে আইসা দেখা দ্যাও,
আমার পরান—

গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গেল যুগল।

বিনুদের খুব ভাল লাগছিল। বিনু, ঝুমা, এমনকি ঝিনুক–তিনজনে একই সঙ্গে বলে উঠল, থামলে কেন? গাও–

যুগল কিন্তু আর গাইল না। আস্তে করে ডাকল, ছুটোবাবু—

বিনু তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, কী বলছ?

অহন আমরা কুনহানে আছি, কন তো?

বিনু জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছি?

যুগল বলল, ভাল কইরা ইট্টু ঠাওর করেন, বুঝতে পারবেন।

বিনু চারদিকে তাকাতে লাগল। আবছা আবছা চাঁদের আলো চোখের সামনের সব কিছু ঢেকে রেখেছে। দূরের ঝোঁপঝাড়, বনভূমি, ধানের খেত কিংবা অগাধ জলরাশি, সমস্ত একাকার হয়ে এই মুহূর্তে এক রহস্যময় স্বপ্নের দেশ।

এই আদিগন্ত রহস্যময়তার মাঝখানে তাদের নৌকোটা যে কোথায়, বিনু কিছুতেই ঠিক করতে পারল না।

যুগল আবার বলল, বুঝতে নি পারলেন ছুটোবাবু?

বিনু বলল, না।

আপনে কিন্তুক এইখানে আরেক দিন আইছিলেন।

তাই নাকি?

হ। যুগল মাথা নাড়ল, আমিই আপনেরে লইয়া আইছিলাম। দ্যাখেন দ্যাখেন, আবার ঠাওর করেন।

আরেক বার জায়গাটা দেখে নিল বিনু। আগের মতোই তা অচেনা থেকে গেল।

হালের বৈঠাটা এক হাতে চেপে, আরেকটা হাত এবার ডান দিকে বাড়িয়ে দিল যুগল। দূরে খানিকটা জায়গা জুড়ে ঝুপসি অন্ধকার। সেটা দেখিয়ে যুগল শুধলো, দ্যাখেন তো, উইটা চিনতে পারেন কিনা

বিনু বলল, না।

হায় রে আমার কপাল, দেখাইয়া দিলেও চিনতে পারে না।

কী ওটা?

বিনুর কৌতূহল শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছিল। এতক্ষণে বুঝি করুণা হল যুগলের। সে বলল, ওইটা টুনি বইনের বাড়ি।

এই অস্পষ্ট রহস্যের জগৎ থেকে টুনিদের বাড়িটা কেমন করে যে যুগল খুঁজে বার করল, কে বলবে। টুনিদের বাড়ি বলার সঙ্গে সঙ্গে বিনুর চোখের সামনে দ্বীপের মতো ভাসমান ক’টি ঘর, উঠোনের ওপর দিয়ে বাঁশের সাঁকো, ভাতের টোপ দিয়ে কালো ছেলেদের পুঁটি আর বাঁশপাতা মাছ ধরা–এমনি অসংখ্য ছবি মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়ল পাখিকে। উত্তরের ঘরের পাছ-দুয়ার থেকে ঝপাং করে জলে লাফিয়ে পড়েছিল পাখি। লালের ছোপ-দেওয়া হলুদ মাছের মতো সাঁতার কেটে কেটে যুগলের নৌকোয় এসে উঠেছিল। গাঢ় গলায় তার কানে কত কথা বলেছিল যুগল, একখানা গানও গেয়েছিল। তারপর যেমন এসেছিল আবার তেমন করেই কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলে সাঁতার কেটে কেটে ফিরে গিয়েছিল পাখি।

বিনু বলল, তোমার টুনি বোনের বাড়ি যাবে?

যুগল বলল, না। এত রাইতে মাইনষের বাড়ি যায়! অরা ঘুমাইয়া আছে না?

কথাটা ঠিক। মাঝরাত্তিরে ঘুম থেকে উঠিয়ে গল্প করতে যাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। বিনু চুপ করে থাকল।

যুগল আবার বলল, হে ছাড়া–

কী? বিনু উন্মুখ হল।

শুদাশুদি তাগো বাড়ি গিয়া কী লাভ? যার লেইগা যাওন হেয় তো নাই।

কার কথা বলছ?

পাখির।

বিনু কথাটা জানত না। অবাক হয়ে বলল, এখানে নেই তো কোথায় গেছে?

যুগল বলল, আপনের কিছুই মনে থাকে না ছুটোবাবু। হেই দিন গোপাল দাসেরে দেখলেন? উই যে আমাগো বাড়ি গেছিল–

বিনুর মনে পড়ে গেল। যুগলের বিয়ের কথাবার্তা বলতে লোকটা হেমনাথের কাছে গিয়েছিল। বিনু বলল, গোপাল দাস কী করেছে?

হে (সে) তো পাখির বাপ।

তা তো জানি।

পাখিরে লইয়া গোপাল দাস নিজের বাড়িত্ হেই ভাটির দ্যাশে গ্যাছে গা।

কবে?

হেই দিনই। কুন দিন বুঝছেন?

বিনু বলল, বুঝেছি। যেদিন গোপাল দাস আমাদের বাড়ি গিয়েছিল।

হ। যুগল বলল, কয়দিন আর মাইনষে কুটুমবড়ি পইড়া থাকে ক’ন! টুনি বইনেরে খালাস করতে আইছিল। খালাস হইয়া গ্যাছে। আর থাকনের কাম কী?

বিনু মাথা নাড়ল, কিছু বলল না।

যুগল বলতে লাগল, আইজ কাইল আমি আর টুনি বইনের বাড়ি যাই না ছুটোবাবু।

কেন? আগে তো রোজ যেতে।

পাখি নাই, গিয়া আর কী করুম! বুঝমান মানুষ হইয়া বোঝেন না ক্যান? আমি কি টুনি বইনের লগে প্যাচাল পারতে যাইতাম নিকি? যাইতাম পাখির লেইগা।

বিনু উত্তর দিল না।

হঠাৎ ঝুমা বলে উঠল, পাখি কে?

বিনু জানাল, যুগলের বউ।

যুগল তক্ষুনি শুধরে দিল, অহনও হয় নাই ঝুমাদিদি। কথাবারা চলতে আছে। মাঘ-ফাগুনে বিয়া হইব।

.

বিনুরা যখন সুজনগঞ্জে পৌঁছল, রাত ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই। যুগল তাদের নিয়ে সোজা নিত্য দাসের ধানচালের আড়তগুলোর কাছে চলে এল।

হ্যাজাক আর ডে-লাইটের আলোয় আলোয় জায়গাটা যেন দিন হয়ে উঠেছে। তার ভেতর দেখা গেল লাল শালুর প্রকান্ড শামিয়ানা খাটানো, তলায় যাত্রার আসর বসেছে। আসরটাকে ঘিরে কত যে দর্শক! দোকানদার-ব্যাপারি-পাইকার-আড়তদার থেকে শুরু করে সুজনগঞ্জের তাবত মানুষ এখানে ভেঙে পড়েছে। এত মানুষ, তবু এতটুকু শব্দ নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই পালা শুনছে।

বিনুদের সঙ্গে করে ভিড় ঠেলে একেবারে সামনে এসে বসল যুগল। এই মুহূর্তে আসরের মাঝখানে দুই রাজার যুদ্ধ চলছে। তাদের মাথায় রাংতার মুকুট, গায়ে ঝলমলে পোশাক, কাঁধে তুণীর, হাতে টিনের তলোয়ার। তাদের বুকে আবার অনেকগুলো করে জাপানি সিলভারের মেডেল আঁটা, আলো পড়ে সেগুলো ঝকমকিয়ে উঠছে। রণাঙ্গনটাকে বাস্তব করে তুলবার জন্য কয়েকটা মৃত সৈনিকও ইতস্তত শুয়ে আছে।

আসরের একধারে বসেছে বাজনদাররা। কত রকমের যে বাজনা তার হিসেব নেই। কনেট, ফুটবাঁশি, ক্ল্যারিওনেট, হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা, খঞ্জনি ইত্যাদি ইত্যাদি। পালাগানের তালে তালে কখনও টিমে সুরে, এখনও দ্রুত লয়ে কনসার্ট বেজে চলেছে।

বাজনদারদের ঠিক পাশেই একটা লোক বসে। মোটাসোটা গোলগাল চেহারা, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় ঢেউ-খেলানো বাবরি, জুলপি দু’টো গালের মাঝামাঝি নেমে এসেছে। লোকটা বেশ শৌখিন। পরনে তার ধুতি আর হাফ-হাতা পাঞ্জাবি। গলায় চুনোট করা চাদর, ফাঁক দিয়ে সোনার মফচেন দেখা যাচ্ছে। দু’হাতে পাঁচ-সাতটা আংটি। মস্ত বড় দুই চোখ ঈষৎ আরক্ত। ঠোঁটের ওপর পাকানো গোঁফ। সব মিলিয়ে তার সর্বাঙ্গে নিদারুণ এক ব্যক্তিত্বের আভাস রয়েছে।

লোকটার হাতে একখানা বই ছিল। মাঝে মাঝে সেটা থেকে সে প্রম্পট্‌ করে যাচ্ছে, আর আসরের দুই রাজা কণ্ঠস্বর সপ্তমে তুলে চেঁচিয়ে চলছে :

রে রে রক্ষোকুলাধম
পামর রাবণ,
তোরে আজ বধিব পরানে।

শুধু প্রম্পটই নয়, অঙুল নেড়ে নেড়ে বাজনদারদের নির্দেশও দিচ্ছে। তার সামান্য আঙ্গুলি হেলনে এতগুলো লোক যন্ত্রের মতো গাইছে, বাজাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে। দেখেশুনে মনে হল, এই লোকটাই আসল অর্থাৎ অধিকারী।

ইতিমধ্যে দর্শকদের কারোর কাছ থেকে খবর যোগাড় করে যুগল বিনুকে জানাল, আজ ‘রাবণ বধ’ পালা চলছে এবং এটাই শেষ দৃশ্য।

বিনুর কোনও দিকে লক্ষ্য নেই। যুগলের কথা হয়তো শুনতেই পেল না। একদৃষ্টে পলকহীন আলোকোজ্জ্বল আসরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। জীবনে এই তার প্রথম যাত্রা দেখা। রাম-রাবণের ঝলমলে পোশাক, ঝকমকে মেডেল, কনসার্টের উত্থান-পতন, সব একাকার হয়ে এই আসরটা যেন আশ্চর্য এক মায়ালোক। ঝুমা এবং ঝিনুকও সবিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল।

লড়াইটা হচ্ছিল খুব নিরীহ রকমের। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রাম-রাবণ এমনভাবে কনসার্টের তালে তালে তলোয়ার চালাচ্ছিল যে, হাজার বছর যুদ্ধ চললেও কারোর গায়ে সামান্য আঁচড়টুকু লাগার সম্ভাবনা নেই। তবু ভাল লাগছিল বিনুর, মুগ্ধ বিস্ময়ে সে দেখেই যাচ্ছিল। বাজনার সুরে সুরে তার বুকের ভেতরটা যেন দুলছিল।

আধ ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ চলবার পর হঠাৎ রাম করল কি, ঈষৎ ঝুঁকে সেই লোকটাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আর কতক্ষণ চালামু অধিকারীমশই?

অধিকারী চট করে শামিয়ানার বাহিরে আকাশটাকে একবার দেখে নিয়ে বলল, অহনও আন্ধার আছে, ভোর তরি চালাইয়া যা। দিনের আলোও ফুটব, রাবণও মরব। তার আগে থামন নাই। থামলে চাইর দিকের মাইনষে আমারে খাইয়া ফেলাইব। বলেই বাজনদারদের দিকে ফিরে দ্রুত আঙুল নাড়তে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে চড়া সুরে কনসার্ট বেজে উঠল, রাম-রাবণের তলোয়র জোরে জোরে ঘুরতে লাগল। নিস্তেজ আসর নিমেষে সজীব হল।

আরও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলল। তারপর আবার এক কান্ড। ঘুরতে গিয়ে অসাবধানে রাবণের পা গিয়ে পড়ল এক মৃত সৈনিকের ঘাড়ে। বেচারা নিঃসাড়ে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। একে শেষ রাত, তাতে নদীপাড়ের আরামদায়ক জলো হাওয়া, ঘুমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক।

ঘাড়ে পা পড়তে খুব সম্ভব তার ঘুমে বিঘ্ন ঘটে থাকবে, তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ছোকরা। গালাগাল দিয়ে কটু গলায় বলল, হারামজাদা বান্দর, তগো লেইগা কি ইট্টু ঘুমাইতেও পারুম না?

নিস্তব্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ জনতার মধ্যে হাসির রোল উঠল, শালার কাটা সৈন্য লম্ফ দিয়া উইঠা দেহি কথা কয়!

ওদিকে লালচে চোখ পাকিয়ে বাঘের মতো গলা করে হুমকে উঠেছে অধিকারী, কুত্তার ছাও, বাপের জমিন্দারি পাইছ? শুইয়া থাকতে কইছিলাম, নোয়বের পোলা ঘুমাইয়া পড়ছ! শুলি কুত্তা, শুলি! পালা একবার ভাঙ্গুক, জুতাইয়া পিঠের ছাল তুইলা ফেলামু আইজ।

বিমূঢ়, মৃত সৈনিক একটুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। তারপর কাটা কলাগাছের মতো ধপাস করে আসরে শুয়ে পড়ল, আর নড়ল না।

তাল কেটে গিয়েছিল। কাজেই একটানা কিছুক্ষণ ঝড়ের বেগে কনসার্ট বাজিয়ে বেসুরো অবস্থাটা কাটিয়ে নেওয়া হল। তারপর আবার শুরু হল সম্মুখসমর। এবার আর কোনও ব্যাঘাত ঘটল না।

ভোর পর্যন্ত নিরাপদ যুদ্ধ চালিয়ে, যখন পুব দিকটা ফরসা হতে শুরু করেছে, সেই সময় টিনের তলোয়ারের সামান্য একটু খোঁচা খেয়েই রাবণ বধ হয়ে গেল।

.

যাত্রা শুনে পরের দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা দুপুর। তেমন হাওয়া থাকলে বাদাম খাঁটিয়ে ঢের আগে পৌঁছনো যেত। কিন্তু আশ্বিনের এই দিনটা একেবারেই বুঝি বায়ুশূন্য। সারাটা পথ যুগলকে নিতান্ত হাতের জোরে বৈঠা বেয়ে আসতে হয়েছে।

রাজদিয়ায় পা দিতেই টের পাওয়া গেল, চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। থানায় থানায় খবর পাঠানো হয়েছে। তাদের খোঁজে সারা শহর তোলপাড় করে ফেলা হয়েছে। এখন কান্নাকাটি চলছে।

সোজা ঝুমাদের বাড়িতেই চলে এসেছিল বিনুরা। হেমনাথরা এখন ওখানে আছেন। বিনুদের দেখামাত্র তারা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর বাকি দিনটা সমানে বকুনি, শাসানি আর শাসন চলল। সব চাইতে বড় ঝড়টা গেল যুগলের ওপর দিয়ে।

.

অষ্টমীর পর নবমী। নবমীর পর দশমী। রাজদিয়ার পুজোমন্ডপগুলো শূন্য করে সন্ধেবেলায় প্রতিমাগুলোকে হাজারমণী মহাজনী নৌকোয় ভোলা হল, তারপর অনেক রাত পর্যন্ত নদীতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিসর্জন দেওয়া হল। তারও পর হেমনাথের সঙ্গে রাজদিয়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়া করার সে কি ধুম! শুধু কি বিনুরাই গেছে, রাজদিয়ার সব মানুষ তাদের বাড়ি এসেও বিজয়া করে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *