১.২ স্বাভাবিক ভদ্রতা রক্ষা

৬.

হ্যারি সেলডন চেহারায় কোনো ভাবের প্রকাশ ঘটতে দিলেন না। স্বাভাবিক ভদ্রতা রক্ষার জন্য যতটুকু না করলেই নয় ঠিক ততটুকুই সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে সম্ভাষণ জানালেন। গত কয়েকদিনে কষ্ট করে জোরানিউম এর অনেকগুলো হলোগ্রাফ দেখেছেন তিনি, প্রায়ই যা ঘটে থাকে, পরিবর্তিত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের আসল চেহারা বিভিন্ন রকম হতে বাধ্য, কখনোই হলোগ্রাফের মতো হবে না–কারণ হলোগ্রাফে যত্নের সাথে একটা আবরণ তৈরি করা হয়। সম্ভবত ‘আসল চেহারার প্রতি দর্শকদের অনুভূতিটাই মূল পার্থক্য তৈরি করে দেয়।

জোরানিউম লম্বায় সেলডনের সমান, কিন্তু চওড়ায় আরো বেশী। সে যে পেশীবহুল তা নয়, বরং দেখলেই বোঝা যায় নরম মানুষ, আবার চর্বিবহুলও নয়। গোলাকার মুখ, মাথার পাতলা চুলের রং ঠিক হলুদ নয় বরং বালির মতো। হালকা নীল চোখ। পরনে হালকা রং এর কভারঅল, মুখে আধো হাসি দেখে বন্ধুর মতো মনে হবে একই সাথে এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারবে যে হাসিটা কৃত্রিম।

“প্রফেসর সেলডন”–তার কণ্ঠস্বর ভরাট এবং নিয়ন্ত্রিত একজন বাগীর কণ্ঠস্বর।–“আপনার দেখা পেয়ে আমি ভীষণ আনন্দিত। এই সাক্ষাতে রাজী হওয়াটা আপনার মহানুভবতা। সাথে আমার প্রধান সহকারীকে নিয়ে আসার জন্য আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না। যদিও এই ব্যাপারে আগে থেকে আমি আপনার অনুমতি নিয়ে রাখি নি। ওর নাম গ্যাম্বল ডিন নামাত্ৰি–খেয়াল করুন, নামের তিনটা অংশ। আমার বিশ্বাস আপনাদের দুজনের আগেই সাক্ষাৎ হয়েছে।”

“হ্যাঁ, ঘটনাটা আমার ভালোই মনে আছে।” অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে নামাত্রির দিকে তাকালেন সেলডন। প্রথম সাক্ষাতে নামাত্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বক্তৃতা দিচ্ছিল। এবার তিনি খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন–গড়পড়তা উচ্চতা, হালকা পাতলা গড়ন, গায়ের রং পাংশু বর্ণের, চওড়া মুখ। জোরানিউমের মতো তার মুখে কোনো কৃত্রিম হাসি বা চোখে পড়ার মতো অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই–শুধু লোকটা সবসময়ই সতর্ক হয়ে আছে এমন একটা অনুভূতি হবে।

“আমার বন্ধু, ড. নামাত্রি–তিনি প্রাচীন সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ–স্ব-ইচ্ছায় এসেছেন, মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে জোরানিউম বলল, “ক্ষমা চাইতে।”

জোরানিউম দ্রুত একবার নামাত্রির দিকে তাকালো–আর নামাত্রি প্রথমে ঠোঁটদুটো পরস্পরের সাথে চেপে ধরল, তারপর অনিচ্ছার ভাব নিয়ে বলল, “আমি দুঃখিত প্রফেসর, সেদিনের ঘটনার জন্য। রাজনৈতিক সমাবেশ এর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন আইনের কথা আমি জানতাম না, আর সেই সময় কিছুটা উত্তেজিতও ছিলাম।”

“আসলেই তাই,” জোরানিউম বলল, “তাছাড়া সে আপনার পরিচয়ও জানত না। আমার মতে ঘটনাটা আমরা এখন ভুলে যেতে পারি।”

“আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, জেন্টলমেন,” জবাব দিলেন সেলডন, “ঘটনাটা মনে রাখার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। এই হচ্ছে আমার ছেলে রাইখ সেলডন। আমার সাথেও একজন সঙ্গী আছে।”

রাইখ গোঁফ রাখতে শুরু করেছে, কালো এবং ঘন–ডাহলাইটদের পৌরুষের প্রতীক। আট বছর আগে যখন সেলডনের সাথে দেখা হয় তখন তার গোঁফ ছিল না। তখন সে ছিল ফুটপাতে জীবন কাটানো ছন্নছাড়া ভবঘুরে বালক। সে খাটো কিন্তু সাবলীল পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ, আর চেহারায় সবসময়ই একটা বেপরোয়া ভাব ধরে রাখে যেন তার শারীরিক উচ্চতার সাথে অতিরিক্ত আরো কয়েক ইঞ্চি মানসিক উচ্চতা যোগ হয়।

“সুপ্রভাত, ইয়ং ম্যান,” জোরানিউম সম্ভাষণ জানালো।

“সুপ্রভাত, স্যার,” রাইখ বলল।

“জেন্টলমেন, দয়া করে বসুন,” বললেন সেলডন। “কিছু খাবেন বা পান করবেন?”

দ্র প্রত্যাখ্যানের ভঙ্গীতে হাত তুলল জোরানিউম। “ধন্যবাদ, স্যার। এটা কোনো সামাজিক সাক্ষাৎ নয়।” নির্দেশিত চেয়ারে বসল সে, “যদিও আশা করি ভবিষ্যতে সেধরনের মেলামেশার সুযোগ প্রচুর হবে।”

“তাহলে কাজের কথা শুরু করা যাক।”

“যে ছোট কিন্তু অপ্রীতিকর ঘটনাটা আপনি দয়া করে ভুলে যেতে রাজী হয়েছেন আমি তা শুনেছি, প্রফেসর সেলডন, এবং অবাক হয়েছি এই ভেবে যে কেন আপনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে বিপদ হতে পারত।”

“সত্যি বলছি, আমার তা মনে হয় নি।”

“কিন্তু, আমার মনে হয়েছে। আপনার ব্যাপারে আমি সব জায়গাতেই খোঁজখবর করেছি, প্রফেসর সেলডন। আপনি কৌতূহল জাগানোর মতো একজন মানুষ। হ্যাঁলিকন থেকে এসেছেন।”

“হ্যাঁ, ওখানেই আমার জন্ম। রেকর্ডে কোনো ঘাপলা নেই।”

“ট্রানটরে বাস করছেন আট বছর হলো।”

“এটাও সবাই জানে।”

“এবং শুরু থেকেই আপনি নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পেরেছেন। অংকশাস্ত্রের উপর একটা জটিল গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে কি যেন বলেন ওটাকে? সাইকোহিস্টোরি?”

সামান্য মাথা নাড়লেন সেলডন। “তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। ফলদায়ক কিছু হয় নি।”

“তাই?” বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে জোরানিউম চারপাশে তাকালো। “অথচ আপনি ট্র্যানটরের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের প্রধান। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। আমার বয়স বিয়াল্লিশ। কাজেই আপনাকে যথেষ্ট বৃদ্ধ বলে ভাবতে পারছি না। তার মানে আপনি অসাধারণ একজন গণিতবিদ।”

উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গীতে কাঁধ নাড়লেন সেলডন। “নিজেকে কখনো এইভাবে বিচার করি নি, করতেও চাই না।”

“আর নয়তো আপনার ক্ষমতাবান বন্ধুবান্ধব আছে।”

“আমরা সকলেই ক্ষমতাবানদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই, মি, জোরানিউম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের আসলে তেমন সৌভাগ্য খুব কমই হয়, আমার তো ধারণা তাদের আসলে কোনো বন্ধু বান্ধবই থাকে না।” হাসলেন তিনি।

জোরানিউমও হাসল। “সম্রাটকে কি আপনি ক্ষমতাবান বন্ধুদের দলে ফেলবেন না?”

“নিঃসন্দেহে। কিন্তু আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”

“আমি শুনেছি, সম্রাট আপনার বন্ধু।”

“রেকর্ডে এই কথাটা পরিষ্কার লেখা আছে যে আট বছর আগে হিজ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য আমার হয়। প্রায় একঘণ্টা তিনি আমার সাথে কথা বলেন। কিন্তু তাতে বন্ধুত্বের ছিটেফোঁটাও ছিল না, তার পর থেকে আজ পর্যন্ত সম্রাটের সাথে আমার দেখা হয় নি কথাও হয় নি অবশ্য হলোভশনে দেখেছি।”

“কিন্তু প্রফেসর, সম্রাটকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য তার সাথে নিয়মিত দেখা করা বা কথা বলার প্রয়োজন নেই। সম্রাটের ফার্স্ট মিনিস্টার ইটো ডেমারজেলের সাথে দেখা করা বা কথা বলাই যথেষ্ট। ডেমারজেল আপনার প্রটেকটর, অর্থাৎ আমরা বলতে পারি যে সম্রাটই আপনার প্রটেকটর।”

“রেকর্ডের কোথায় বলা আছে যে ফার্স্ট মিনিস্টার ডেমারজেল আমাকে প্রটেকশন দিচ্ছে? বা এমন কোনো তথ্য কি আপনি পেয়েছেন যার থেকে প্রটেকশনের ব্যাপারে দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছেন?”

“যেহেতু সবাই জানে যে আপনাদের দুজনের মাঝে যোগাযোগ রয়েছে তাহলে কেন শুধু শুধু রেকর্ড ঘাটাঘাটি করব? সত্যি কথাটা আপনিও জানেন আমিও জানি। বরং মূল আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যাক। এবং দয়া করে”–দুহাত তুলে জোরানিউম বলল “কষ্ট করে অস্বীকার করার চেষ্টা করবেন না। তাতে কেবল সময় নষ্ট হবে।”

“আসলে আমি জানতে চাই, সেলডন বললেন, “কেন আপনি ভাবছেন যে সে আমাকে প্রটেক্ট করছে? এবং কতদূর করছে?”

“প্রফেসরকেন ভাবছেন যে আমি কিছুই জানি না? আমি আপনার সাইকোহিস্টোরির কথা বলেছি। ডেমারজেল ওটাই চায়।”

“আর আমি আপনাকে বলেছি যে তা ছিল তরুণ বয়সের উচ্ছ্বাস, কার্যকরী কিছু না।”

“আপনি আমাকে অনেক কিছুই বলতে পারেন, প্রফেসর। তার সবকিছুই আমি মেনে নিতে রাজী নই। খুলেই বলি। আমি আপনার মূল গবেষণা পত্রগুলো পড়েছি এবং কয়েকজন গণিতবিদের সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে বলেছে। যে ওগুলো সব লাগামহীন কল্পনা এবং পুরোপুরি অসম্ভব–“

“আমি তাদের সাথে একমত,” সেলডন বললেন।

“কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ডেমারজেল সাইকোহিস্টোরির পরিপূর্ণ ডেভেলপমেন্টের জন্য এবং তা কাজে লাগানোর জন্য অপেক্ষা করছে। যদি সে অপেক্ষা করতে পারে আমিও পারব। বরং আমাকে অপেক্ষায় রাখলেই আপনার জন্য ভালো হবে।”

“কেন?”

“কারণ ডেমারজেল আর বেশীদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। তার বিরুদ্ধে জনরোষ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। একসময় হয়তো সম্রাট চিন্তিত হয়ে পড়বেন। তার মনে হতে পারে যে জনমত উপেক্ষা করে ডেমারজেলকে স্বপদে বহাল রাখলে হয়তো তিনিই ক্ষমতাচ্যুত হবেন। কাজেই তখন তার রিপ্লেসমেন্টের দরকার হবে এবং হয়তো বা এই অধম বান্দাকেই বেছে নেবেন। তখনও আপনার প্রটেকশনের দরকার হবে। এমন একজনের সাহায্য আপনার লাগবে যে লক্ষ্য রাখবে যেন আপনি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন, প্রয়োজনীয় তহবিল, যন্ত্রপাতি এবং লোক বলের যেন অভাব না হয়।”

“এবং আপনি হবেন সেই প্রটেকটর?”

“অবশ্যই–এবং কারণটা আমার আর ডেমারজেলের একই। আমি একটা নিখুঁত সাইকোহিস্টোরিক টেকনিক চাই যেন আরো দক্ষভাবে এম্পায়ার পরিচালনা করতে পারি।”

চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন সেলডন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, “কিন্তু সেক্ষেত্রে মি. জোরানিউম, আমি কেন এই বিষয়ে ভাবতে যাব? আমি সাধারণ একজন স্কলার। সারাদিন গণিত নিয়ে এবং বিভাগীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আপনার মতে ডেমারজেল আমার বর্তমান প্রটেকটর, আপনি হবেন ভবিষ্যৎ প্রটেকটর, তাহলে তো আমি নির্বিঘ্নে আমার কাজ চালিয়ে যেতে পারি। আপনি এবং ফার্স্ট মিনিস্টার ক্ষমতা দখলের লড়াই চালিয়ে যান। জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, চিন্তার কিছু নেই, কারণ তখনো আমার একজন প্রটেকটর থাকবে–অন্তত আপনি সেইরকমই আশ্বাস দিয়েছেন।”

জোরানিউম এর মুখের ছাপ মারা হাসি খানিকটা মলিন হলো। তার দিকে ঘুরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল নামাত্রি, কিন্তু জোরানিউমের হাতের ইশারায় শুধু গলা খাকারি দিল কিছু বলল না।

“ড. সেলডন, আপনি দেশপ্রেমিক?” জিজ্ঞেস করল জোরানিউম।

“অবশ্যই। এম্পায়ার মানব জাতির জন্য দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বয়ে এনেছে–পুরোটা না হলেও–আর সীমাহীন অগ্রগতি।”

“ঠিকই বলেছেন–কিন্তু গত এক বা দুই শতাব্দীতে উন্নয়নের ধারা অনেকখানিই থমকে গেছে।”

“আমি এই ব্যাপারটা কখনো পর্যবেক্ষণ করি নি।”

“করার দরকারও নেই। আপনি জানেন গত কয়েক শতাব্দীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল চরম। কোনো সম্রাটই বেশীদিন শাসন করতে পারেন নি, অধিকাংশই গুপ্তহত্যার স্বীকার হয়েছেন।”

“শুধু এই কথাগুলো বলাই,” বাধা দিলেন সেলডন, “বিশ্বাসঘাতকতার সামিল আমার মতে–“

“বেশ,” চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল জোরানিউম। “আপনি কতখানি নিরাপত্তাহীন বুঝিয়ে বলছি। ভেঙে যাচ্ছে এম্পায়ার। কথাটা আমি খোলাখুলি বলতে চাই। আমার অনুসারীরাও বলবে, কারণ তারা আসল কথাটা জানে। সম্রাটের সহকারী হিসেবে একজন দক্ষ লোকের প্রয়োজন, যে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করতে পারবে, সশস্ত্র বাহিনীকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারবে–“

অধৈর্য ভঙ্গীতে হাত তুলে বাধা দিলেন সেলডন। এবং এই কাজগুলো করার জন্য আপনিই একমাত্র যোগ্য লোক, তাই না?”

“আমি তেমন একজন হতে চাই। কাজটা সহজ নয় এবং আমার ধারণা এরকম স্বেচ্ছাসেবক আরো অনেক পাওয়া যাবে অনেক কারণেই। নিঃসন্দেহে ডেমারজেল সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবে না। তার অধীনে এই ভাঙন আরো ত্বরান্বিত হবে এবং এম্পায়ার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আপনি তা থামাতে পারবেন?”

“হ্যাঁ, ড. সেলডন। আপনার সাহায্যে। সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে।”

“হয়তো ডেমারজেলও সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে এই ধ্বংস ঠেকাতে পারবে যদি আসলেই সাইকোহিস্টোরি বলে কিছু থাকে।”

“আছে,” শান্ত ভঙ্গীতে বলল জোরানিউম। “সাইকোহিস্টোরির কোনো অস্তিত্ব নেই এমন ভান করে লাভ হবে না। কিন্তু অস্তিত্ব থাকলেও ডেমারজেলের কোনো লাভ হবে না তাতে। সাইকোহিস্টোরি একটা হাতিয়ার মাত্র, এই হাতিয়ার চালানোর জন্য দরকার উন্নত মস্তিষ্ক এবং সবল দুটো বাহু।”

“এবং আপনার ওগুলো আছে, তাই না?”

“হ্যাঁ। নিজের ব্যাপারে আমার কোনো ভ্রান্ত ধারণা নেই। আমি সাইকোহিস্টোরি চাই।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “আপনি পুরোটাই চাইতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে তা নেই।”

“আছে। এই ব্যাপারে কোনোরকম তর্কে যাব না।” সামনে ঝুকল জোরানিউম যেন সেলডনের কানে কানে বলতে চায়। “আপনি স্বীকার করেছেন যে আপনি একজন দেশপ্রেমিক। এম্পায়ারের পতন ঠেকানোর জন্য আমাকে ডেমারজেলের স্থলাভিষিক্ত হতে হবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা হয়তো এম্পায়ারকে আরো দুর্বল করে দেবে। আপনি আমাকে পরামর্শ দিতে পারেন কিভাবে কাজটা সূক্ষ্মভাবে এবং আরো সহজে করা যায়, কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই–এম্পায়ার রক্ষার খাতিরে।”

বোধক ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন সেলডন। “পারব না। আপনি এমন একটা জ্ঞান আমার কাছে থাকার অভিযোগ তুলেছেন যা আসলে আমার কাছে নেই।”

আচমকা উঠে দাঁড়ালো জোরানিউম। “বেশ, আমার উদ্দেশ্যের কথা আপনি জানলেন, আমি কি চাই তাও জানলেন। ভেবে দেখুন। এবং আমি আপনাকে বলছি এম্পায়ারের কথা ভাবতে। হয়তো মনে করছেন যে ডেমারজেলের কাছে আপনি ঋনি। কিন্তু সাবধান। আপনি যা করছেন তা হয়তো এম্পায়ারের মূল ভিত্তিতে আঘাত করবে। গ্যালাক্সির কোয়াড্রিলিয়ন মানব সন্তানের খাতিরে, এম্পায়ারের খাতিরে আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনার কাছে অনুরোধ করছি।”

তার কণ্ঠস্বর গায়ে শিহরণ জাগানোর মতো জোরালো ফিসফিসানির পর্যায়ে নেমে এল। সেলডন টের পেলেন যে তিনি প্রায় কাঁপতে শুরু করেছেন। “আমি সব সময়ই এম্পায়ারের কথা ভাবি।” তিনি বললেন।

“তাহলে এই মুহূর্তে আমি আপনার কাছে শুধু এটাই চাই। আমাকে সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

অফিস কক্ষের দরজা নিঃশব্দে দুপাশে সরে গেল। জোরানিউম এবং তার সঙ্গী চলে গেল। তাদের অপসৃয়মান কাঠামোর দিকে তাকিয়ে রইলেন সেলডন।

ভুরু কোঁচকালেন। মনের ভেতর কি যেন একটা খচ খচ করছে কিন্তু ধরতে পারছেন না।

.

৭.

জোরানিউম এবং নামাত্রি বসে আছে স্ট্রিলিং সেক্টরে নিজেদের অফিসে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অফিসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। স্ট্রিলিং-এ তাদের সদর দপ্তর তেমন একটা সাজানো গোছানো নয়, কারণ এখানে খুব বেশী সংগঠিত হতে পারে নি, তবে হতে খুব বেশী দেরীও নেই।

তাদের আন্দোলন যেভাবে জোরালো হয়ে উঠেছে তা সত্যি অবাক করার মতো। তিন বছর আগে শূন্য থেকে শুরু হয়ে আজ পুরো ট্রানটরে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু কিছু সেক্টরে বাস্তবিকই তাদের সংগঠনের শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোতে এখনো তারা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে নি। ওগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ডেমারজেল। কিন্তু ওটাই তার ভুল। এখানে, ট্রানটরের বুকে যে কোনো বিদ্রোহ আনক বিপর্যয় তৈরি করবে। অন্য। কোথাও বিদ্রোহ হলে তা সামলানো সহজ। এখানে ডেমারজেল খুব অল্পতেই বেসামাল। হয়ে পড়বে। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে ডেমারজেল এই কথাটা বুঝতে পারছে না, অবশ্য, জোরানিউমের ধারণা ডেমারজেলের আসল যোগ্যতা যতটুকু প্রচার করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী, এবং কেউ যদি সাহস করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখনই সব গুমোড় ফাস হয়ে যাবে, আর সম্রাট যদি মনে করে যে তার নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে যাচ্ছে তখন দেরী না করে তৎক্ষণাৎ ডেমারজেলকে শেষ করে দেবে।

এখন পর্যন্ত জোরানিউমের সব অনুমানই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ছোটখাটো দুএকটা ঘটনা বাদে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশটা যেখানে সেলডন নামের এক লোক বাধা দেয়।

হয়তো এই কারণেই জোরানিউম তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ঘটনা যত ছোটই হোক না কেন সবকিছুকেই গুরুত্ব দিতে হবে। জোরানিউম সবসময়ই নিজের অব্যর্থতা উপভোগ করে আর নামাত্রির বিশ্বাস সাফল্য অর্জনের উচ্ছাকাক্ষাই সাফল্যের ধারাকে অব্যাহত রাখে। মানুষ এমন কি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও জয়ী পক্ষের সাথে যোগ দিয়ে পরাজয়ের অপমান ভুলতে চায়।

কিন্তু সেলডনের সাথে দেখা করাটা কি সফল হয়েছে নাকি প্রথম ব্যর্থতার সাথে আরেকটা ব্যর্থতা যোগ হলো মাত্র। তাকে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এবং এতে কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না।

চুপচাপ বসে আছে জোরানিউম, চিন্তিত। এক নাগাড়ে নোখ কামড়ানো দেখে মনে হয় এভাবে সে মানসিক প্রশান্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে।

“জো-জো,” মৃদু গলায় ডাকল নামাত্রি। হাতে গোনা অল্প কয়েকজনের মধ্যে নামাত্রি একজন যে জোরানিউমকে তার সংক্ষিপ্ত নামে ডাকতে পারে। মিছিল, সমাবেশে মানুষ তার নামের এই সংক্ষিপ্ত অংশটাকেই জপতে থাকে অনবরত। সমাবেশে ব্যাপারটা জোরানিউমের ভালো লাগলেও ব্যক্তিগতভাবে সে সবার কাছ থেকেই সম্মান আশা করে। শুধু ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া যারা শুরু থেকেই তার সাথে আছে।

“জো-জো,” আবার ডাকল নামাত্রি।

চিন্তার জগত থেকে ফিরে এল জোরানিউম। “হ্যাঁ, জি. ডি.। কি ব্যাপার?”

“সেলডনের ব্যাপারে আমরা এখন কি করব?”

“এই মুহূর্তে কিছুই না। হয়তো সে আমাদেরকে সাহায্য করবে।”

“অপেক্ষা করার দরকার কি? আমরা তার উপর বল প্রয়োগ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুএকটা ঘটনা ঘটিয়ে তাকে ঝামেলায় ফেলে দিতে পারি।”

“না, না। এখন পর্যন্ত ডেমারজেল আমাদের বাধা দেয় নি। সে বোকা এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে করে আমরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করার আগেই সে মাঠে নেমে পড়ে। সেলডনের উপর হামলা হলে ঠিক তাই ঘটবে। আমার ধারণা ডেমারজেলের কাছে সেলডন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”

“সাইকোহিস্টোরির জন্য?”

“অবশ্যই।”

“জিনিসটা কি? আমি কখনো শুনি নি।”

“খুব কম মানুষই শুনেছে। সাইকোহিস্টোরি আসলে মানব সমাজ বিশ্লেষণের একটা গাণিতিক কৌশল যার ফলাফল প্রেডিকটিং দ্য ফিউচার বা ভবিষ্যতের ঘটনা প্রবাহ আগাম নির্ণয় করে রাখা।

ভুরু কুঁচকালো নামাত্রি। এটা কি জোরানিউমের কোনো রসিকতা। সে কি তাকে হাসাতে চায়। নামাত্রি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারে নি কখন এবং কেন মানুষ তার মুখে হাসি আশা করে। বোঝার কোনো আগ্রহও কখনো হয় নি।

“প্রেডিক্ট দ্য ফিউচার? কিভাবে?”

“যদি জানতাম তাহলে কি সেলডনের কাছে ধর্না দিতে হতো?”

“আমি বিশ্বাস করি না। ভবিষ্যতের ঘটনা আগেই বলবে কিভাবে? এটা তো ভাগ্য গনণার মতো ব্যাপার।”

“জানি, কিন্তু সেলডন তোমার সমাবেশটা পন্ড করে দেয়ার পর আমি খোঁজ নিয়েছি। আট বছর আগে সে ট্রানটরে আসে এবং গণিতবিদদের এক সম্মেলনে সাইকোহিস্টোরির গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে। তারপর পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা পড়ে যায়। এটা নিয়ে আর কোনো হৈ চৈ হয় নি। এমনকি সেলডন নিজেও কখনো আলোচনা করে নি।”

“তার মানে হয়তো এটার কোনো গুরুত্ব নেই।”

“আরে না, বরং উল্টোটা। ব্যাপারটা যদি ধীরে ধীরে ধামাচাপা পড়ত, মানুষের হাসির খোরাকে পরিণত হতো তাহলে আমি বিশ্বাস করতাম যে এর কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু হঠাৎ করে এবং পুরোপুরি ধামাচাপা দেয়ার অর্থ হচ্ছে বিষয়টা খুব গোপনে এবং সযত্নে পরিচালিত হচ্ছে। হয়তো এই কারণেই ডেমারজেল আমাদের থামানোর চেষ্টা করছে না, হয়তো সে শুধুমাত্র অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। হয়তো সে পরিচালিত হচ্ছে সাইকোহিস্টোরি দ্বারা, হয়তো সে সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, সময় মতো তা কাজে লাগাবে। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের পরাজয় অনিবার্য। সফল হতে পারব তখনই যদি সাইকোহিস্টোরি আমাদের নিজেদের জন্য ব্যবহার করতে পারি।”

“সেলডনের মতে ওটার কোনো অস্তিত্ব নেই।”

“তার জায়গায় তুমি হলে কি একই কথা বলতে না?”

“আমি এখনো বলব যে তার উপর বিভিন্ন রকম চাপ সৃষ্টি করা উচিত।”

“তাতে কোনো লাভ হবে না, জি. ডি। তুমি ‘ভন এর কুঠার গল্পটা শোনো নি?”

“না।”

“নিশায়ায় থাকলে ঠিকই শুনতে। ওখানে বেশ জনপ্রিয় গল্প। সংক্ষেপে গল্পটা এইরকম–ভন নামের এক কাঠুরের কাছে এমন একটা কুঠার ছিল যার রশ্মির এক আঘাতেই যে কোনো গাছ কেটে ফেলতে পারত। জিনিসটা অত্যন্ত মূল্যবান হলেও সে কখনো লুকিয়ে রাখার বা সযত্নে রাখার চেষ্টা করে নি–অথচ জিনিসটা কখনো তার কাছ থেকে চুরিও হয় নি। কারণ একমাত্র ভন ছাড়া আর কেউ এই কুঠার তুলতেও পারত না, চালাতেও পারত না।

“এই মুহূর্তে সেলডন ছাড়া আর কেউ সাইকোহিস্টোরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। যদি তাকে দলে আনার জন্য বল প্রয়োগ করি তার আনুগত্যের ব্যাপারে আমরা কোনোদিনই নিশ্চিত হতে পারব না। হয়তো সে কৌশলে এমন একটা পথে পরিচালিত করবে যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে আমাদের জন্য ভালো এবং নিরাপদ, অথচ কিছুদিন পরেই দেখা যাবে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি। না, তাকে স্বেচ্ছায় আমাদের দলে আসতে হবে এবং তাকে স্বেচ্ছায় আমাদের জয়ের জন্য কাজ করতে হবে।”

“কিভাবে তাকে দলে আনবে?”

“সেলডনের ছেলে, রাইখ, ওকে খেয়াল করেছিলে?”

“তেমন একটা মনযোগ দেই নি।”

“জি. ডি। জি. ডি., সবকিছু পর্যবেক্ষণ না করলে অনেক কিছুই তোমার দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। ছেলেটা প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শুনেছে এবং কোনো সন্দেহ নেই যে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছে। বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় নি। অন্যদের অনুপ্রাণিত করা বা প্রভাবিত করার ক্ষমতাটা আমার অনেক বেশী। পরিষ্কার বুঝতে পারি কখন কার মনে প্রচন্ড আলোড়ন তুলতে পেরেছি বা যুক্তিতর্কে কোণঠাসা করতে পেরেছি।”

হাসল জোরানিউম। কিন্তু এটা তার মানুষকে প্রভাবিত করার সেই ছাপ মারা হাসি নয়। বরং ঠান্ডা, নিষ্প্রাণ এবং ক্রড় এক ধরনের হাসি।

“দেখা যাক এই রাইখের ব্যাপারে কি করা যায়,” সে বলল, “ওর মাধ্যমে সেলডনকে হয়তো দলে আনতে পারব।”

.

৮.

রাজনীতিবিদ দুজন চলে যাওয়ার পর গোঁফে তা দিতে দিতে সেলডনের দিকে তাকালো রাইখ। এতে সে মানসিক স্বস্তি পায়। স্ট্রিলিং সেক্টরে অনেকেই গোঁফ রাখে। কিন্তু সেগুলো পাতলা এবং বিভিন্ন রং এর। খুব বাজে দেখায়, অনেকে একেবারেই গোঁফ রাখে না। যেমন সেলডন–অবশ্য সেলডন গোঁফ রাখলেও মাথার চুলের রং এর সাথে তা খুব হাস্যকর দেখাত।

সেলডনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে তার চিন্তামগ্ন অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর আর ধৈর্য না রাখতে পেরে ডাক দিল, “বাবা?”

সেলডন মুখ তুললেন। “কি?” রাইখ ধরে নিল চিন্তায় বাধা পরায় তিনি বিরক্ত হয়েছেন।

“আমার মনে হয় ওই দুজনের সাথে তোমার দেখা করাটা ঠিক হয় নি।”

“কেন?”

“পাতলা মতো লোকটা, ওর সাথেই তুমি ঝামেলা করেছিলে। ব্যাপারটা সে ভালোভাবে নেয় নি।”

“কিন্তু সে ক্ষমা চেয়েছে।”

“ওটা লোক দেখানো। কিন্তু অন্য লোকটা, জোরানিউম–সেই হচ্ছে আসল বিপদ। ওরা যদি অস্ত্র নিয়ে আসত?”

“কি? বিশ্ববিদ্যালয়ে? আমার অফিসের ভেতরে? অবশ্যই না। এটা বিলিবন্টন নয়। তাছাড়া ওরা কিছু করার চেষ্টা করলে আমি দুজনকেই সামলাতে পারতাম। সহজেই।”

“মনে হয় না, বাবা,” রাইখের কণ্ঠে সন্দেহ। “তুমি–“

“খবরদার, ওই কথা বলবে না, অকৃতজ্ঞ শয়তান। তোমার মায়ের কাছ থেকে অনেক শুনেছি, তোমার মুখে আর শুনতে চাই না। আমি বুড়ো হই নি বা অন্তত তোমরা যা ভাবছ সে রকম বুড়ো হই নি। তাছাড়া তুমি আমার সাথে ছিলে। খালি হাতে মারপিটে তুমি আমার মতোই দক্ষ।”

নাক কুঁচকালো রাইখ। “মারামারি কইরা লাভ অইত না।” (কোনো লাভ হয়নি। আট বছর ডাল এর জঘন্য পরিবেশ এর বাইরে থেকেও বাচনভঙ্গী পুরোপুরি শুদ্ধ হয় নি। এখনো মাঝে মাঝে ডাহ্‌লাইট বাচনভঙ্গী বেরিয়ে পড়ে, সবাই বুঝতে পারে সে সমাজের অনেক নিচু অবস্থান থেকে উঠে এসেছে। আকৃতিতেও সে খাটো কিন্তু তার ঘন কালো গোঁফের কারণে কেউ ঘাটাতে সাহস পায় না।)

“জোরানিউম এর ব্যাপারে এখন কি করবে?”

“এই মুহূর্তে কিছুই না।”

‘ট্র্যানটর ভীশনে জোরানিউমকে আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। এমন কি তার বক্তৃতার হললাটেপও তৈরি করেছি। সবাই এই লোকটাকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত, তাই আমিও ভাবলাম দেখাই যাক না সে কি বলতে চায়। সত্যি কথা বলতে কি সে যা বলছে তা যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত, আমি তাকে পছন্দ করি না, বিশ্বাসও করি না। কিন্তু সে যা বলছে তা ন্যায়সঙ্গত। সে প্রত্যেক সেক্টরের সমান অধিকার এবং সমান সুযোগ সুবিধা দাবী করছে। তাতে তো অন্যায় হয় নি বা ভুল হয় নি, হয়েছে কি?”

“অবশ্যই না। প্রতিটি সভ্য মানুষই তা চায়।”

“তাহলে আমরা তা পাই নি কেন? সম্রাট কি বিষয়টা কখনো অনুধাবন করতে পেরেছে? ডেমারজেল?”

“সম্রাট এবং ফাস্ট মিনিস্টারকে পুরো এম্পায়ার নিয়ে ভাবতে হয়। তাদের সমস্ত মনযোগ শুধু ট্রানটরের উপর দিলেই হবে না। সাম্যতার কথা বলা জোরানিউমের পক্ষে খুবই সহজ। তার কোনো দায়িত্ব নেই। শাসন ভার দেয়া হলে তার সমস্ত প্রচেষ্টাও পঁচিশ মিলিয়ন বিশ্ব নিয়ে গঠিত এম্পায়ারের জটিলতায় ঝাপসা হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, তার যে কোনো ধরনের কাজে সেক্টরগুলো নিজেরাই বাধা দিত, কারণ প্রতিটি সেক্টরই নিজেদের জন্য অন্য সেক্টরের চেয়ে বেশী সুযোগ সুবিধা চায়। তোমার কি ধারণা রাইখ? জোরানিউমকে একটা সুযোগ দেয়া উচিত? অন্তত সে কি করতে পারে তা দেখার জন্য?”

“জানি না। ভাবছি। তবে সে যদি তোমার ক্ষতি করার কোনো চেষ্টা করত তাহলে আমি তার গলা চেপে ধরতাম।”

“তাহলে আমার নিরাপত্তা তোমার কাছে এম্পায়ার এর নিরাপত্তার চেয়েও বড়?”

“নিশ্চয়ই। তুমি আমার বাবা।”

স্নেহময় দৃষ্টিতে রাইখের দিকে তাকালেন সেলডন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। জোরানিউম এর প্রায় জাদুকরি প্রভাব কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে?

.

৯.

চেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হলেন সেলডন। হাত দুটো মাথার পিছনে নিয়ে বালিশ বানিয়েছেন। চোখ মেলে রাখলেও তিনি আসলে কিছু দেখছেন না। শ্বাস প্রশ্বাস মৃদু।

কামরার অপর প্রান্তে ভিউয়ার চালু করে কাজ করছিল ডর্স। ট্রানটরের প্রাথমিক যুগের ফ্লোরিনা ইনসিডেন্ট নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছে সে। এতক্ষণ তাই পরীক্ষা করে দেখছিল কোনো ভুল-ভ্রান্তি রয়ে গেল কি না। তারপর সিদ্ধান্ত নিল এবার একটু বিশ্রাম নেয়া উচিত এবং সেলডন কি ভাবছে তাও দেখা দরকার।

অবশ্যই সাইকোহিস্টোরি। হয়তো এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অলিগলি ঘুরেই তার বাকী জীবনটা শেষ হবে, তারপরেও হয়তো কাজটা শেষ হবে না, শেষ করার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে অন্যদের কাছে (বিশেষ করে এমারিলের হাতে, যদি না এই তরুণ নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে) এবং সেটা করতে তার প্রচন্ড মনোকষ্ট হবে।

তারপরেও এই কর্মযজ্ঞই সেলডনের বেঁচে থাকার প্রেরণা। যদি সমস্যাটা তাকে আপাদমস্তক জড়িয়ে রাখে তাহলে সে দীর্ঘদিন বাঁচবে এবং ডর্স তাতে খুশি। জানে সেলডনকে চিরদিন ধরে রাখা যাবে না, একদিন না একদিন হারাতেই হবে, এবং লক্ষ্য করে দেখেছে এই চিন্তাটা তাকে বিষণ্ণ করে তোলে। ব্যাপারটা প্রথম দিকে সে বুঝতে পারে নি, যখন তার দায়িত্ব ছিল খুবই সহজ, সেলডনের নিরাপত্তা।

কখন থেকে এটা তার ব্যক্তিগত আবেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে? কিভাবে হলো? এই মানুষটার মাঝে কি আছে যার কারণে একটু চোখের আড়াল হলেই তার আর ভালো লাগে না, যদিও জানে সে নিরাপদেই আছে। তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে সেলডনের নিরাপত্তাই হবে মুখ্য এবং একমাত্র ধ্যান ধারণা। অন্য কোনো চিন্তা কিভাবে মাথা চাড়া দেয়?

অনেকদিন আগে অনুভূতিটার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর বিষয়টা নিয়ে সে ডেমারজেলের সাথে আলোচনা করে।

গম্ভীরভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে ডেমারজেল বলেছিল, “তুমি ভীষণ জটিল, ডর্স, আর তোমার প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। আমার জীবনে এমন কয়েকজন। ব্যক্তি ছিল যাদের উপস্থিতি আমার চিন্তা এবং আচরণ আরো সহজ আর স্বাভাবিক করে তুলত। তাদের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতিতে আমার আচরণের বিভিন্নতা তুলনা করে পরবর্তীতে বোঝার চেষ্টা করেছি আমি কি আসলে লাভবান নাকি ক্ষতির স্বীকার। এই প্রক্রিয়ায় একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝেছি আর তা হলো তাদের সাহচর্য্য থেকে যে আনন্দবোধ তৈরি হতো সেটা তাদের অনুপস্থিতির দুঃখবোধ থেকে অনেক বেশী। কাজেই, তোমার এখন যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে তা উপভোগ কর, পরে কি হবে তা ভাবার দরকার নেই।”

হ্যারি একদিন চলে যাবে। এবং প্রতিদিনই সেই একদিনটা আরো কাছে চলে আসছে। কিন্তু আমি এগুলো ভাবব না। মনকে প্রবোধ দিল ডর্স। বিষণ্ণ চিন্তাটাকে দূর করার জন্যই কথা শুরু করল সে।

“কি ভাবছ, হ্যারি?”।

“কি?” আনমনা অবস্থা থেকে ফিরে আসতে খানিকটা বেগ পেতে হলো সেলডনকে।

“সাইকোহিস্টোরি নিয়েই ভাবছ বোধহয়। নিশ্চয়ই নতুন একটা সমস্যা যার কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছ না।”

“আসলে, এই মুহূর্তে আমি সাইকোহিস্টোরি নিয়ে ভাবছি না।” হঠাৎ হেসে ফেললেন তিনি। জানতে চাও কি নিয়ে ভাবছিলাম?–চুল!”

“চুল? কার?”

“এই মুহূর্তে তোমার।”

“কোনো সমস্যা? চুলে রং করব। এতদিনে তো ধূসর হয়ে যাওয়ার কথা।”

“আরে না, কোনো দরকার নেই। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য জিনিস। যেমন, নিশায়া।”

“নিশায়া? কি ওটা?”

“প্রি-ইম্পেরিয়াল কিংডম অফ ট্রানটরের অন্তর্ভুক্ত হয় নি কখনো, কাজেই তুমি জান না দেখে অবাক হই নি। একটা গ্রহ, ছোট একটা গ্রহ। বিচ্ছিন্ন। গুরুত্বহীন। অবহেলিত। আমি জানতে পেরেছি কারণ একটু কষ্ট করে খোঁজ খবর করেছি। পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহ থেকে মাত্র দুই একটা গ্রহই সত্যিকারের প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু নিশায়ার মতো গুরুত্বহীন গ্রহ বোধহয় আর একটাও নেই। এবং এটাই হলো আসল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।”

হাতের ঠেলায় নিজের জিনিসগুলো একপাশে সরিয়ে ডর্স বলল, “গোলকধাঁধা তুমি পছন্দ কর না, এখন নিজেই গোলকধাঁধা তৈরি করছ। এই গুরুত্বহীন গ্রহের গুরুত্বটা কোথায়?”

“যখন নিজে গোলকধাঁধা তৈরি করি তখন ঠিকই পছন্দ করি। জোরানিউম নিশায়া থেকে এসেছে।”

“ও, তুমি আসলে জোরানিউমকে নিয়ে ভাবছ।”

“হ্যাঁ, ওর বেশ কয়েকটা বক্তৃতার রেকর্ড দেখেছি–রাইখের অনুরোধ। কথাবার্তায় তেমন গভীরতা না থাকলেও মানুষকে সে প্রায় সম্মোহিত করে রাখতে পারে। রাইখ বেশ অনুপ্রাণিত।”

“আমার মতে ডাহ্লাইটের বাসিন্দারা সবাই অনুপ্রাণিত হবে, হ্যারি। প্রতিটি সেক্টরের জন্য সমান অধিকার জোরানিউমের এই আহ্বান শুনে স্বভাবতই সুবিধা বঞ্চিত হিট সিঙ্কাররা তাকে সমর্থন দেবে। ডাহ্লাইটে কি অবস্থা দেখেছিলাম তোমার মনে আছে?”

“মনে আছে এবং রাইখকে আমি কোনো দোষ দিচ্ছি না। জোরানিউম নিশায়া থেকে এসেছে শুধু এই ব্যাপারটাই আমাকে ভাবাচ্ছে।”

নিরাসক্ত ভঙ্গীতে কাঁধ নাড়ল ডর্স। “কোনো এক জায়গা থেকে তো জোরানিউমকে আসতেই হবে আর নিশায়া অন্যান্য গ্রহের মতোই তার নাগরিকদের ও বাইরে পাঠিয়েছে এমন কি এই ট্রানটরেও।”

“হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে তো বলেছি যে আমি নিশায়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর করেছি। এমন কি হাইপার স্পেসাল কন্টাক্টও যার জন্য অনেকগুলো ক্রেডিট বেরিয়ে গেছে এবং যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই খরচটা আমি ডিপার্টমেন্টে চার্জ করতে পারব না।”

“কোনো লাভ হয়েছে?”

“বোধহয়। তুমি তো জানো জোরানিউম ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে তার বক্তব্যের তাৎপর্য তুলে ধরে। গল্পগুলো তার নিজের গ্রহ নিশায়াতে প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। ট্রানটরে এই গল্পগুলো তার উদ্দেশ্য পূরণে যথেষ্ট সহায়ক, যেহেতু এতে সে নিজেকে জনগণেরই একজন, স্বদেশ প্রেমে ভরপুর একজন হিসেবে প্রমাণ করতে পারছে। এই গল্পগুলো তার বক্তব্য আরো জোরালো করে তুলে। এগুলো প্রমাণ করে যে সে ছোট এক গ্রহ থেকে এসেছে, বড় হয়েছে বিচ্ছিন্ন এক খামারের উন্মুক্ত অনিয়ন্ত্রিত প্রকৃতিতে। মানুষ এগুলো পছন্দ করে বিশেষ করে ট্রানটরিয়ানরা যারা বরং মরবে কিন্তু উন্মুক্ত প্রকৃতিতে বাস করবে না। অথচ তারাই আবার এই ধরনের গল্প শুনতে পছন্দ করে।”

“তো?”

“অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে–নিশায়ার যে অফিসারের সাথে আমি কথা বলেছি তার কাছে এই গল্পগুলো পরিচিত নয়।”

“এটা তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, হ্যারি। হয়তো ছোেট, কিন্তু তারপরেও ওটা আস্ত একটা গ্রহ। জোরানিউম যে অংশে জন্মেছে সেখানে যে গল্পগুলো প্রচলিত সেগুলো। হয়তো তোমার অফিসার যেখান থেকে এসেছে সেখানে মোটেই প্রচলিত নয়।”

“না, না। লোক কাহিনী যাই হোক না কেন ওগুলো আসলে বিশ্বজনীন। তাছাড়া আরো ব্যাপার আছে। লোকটার কথা বুঝতে আমার বেশ সমস্যা হয়েছে। গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করলেও বাচনভঙ্গী অদ্ভুত। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কয়েকজন অফিসারের সাথে কথা বলি, প্রত্যেকের বাচনভঙ্গী একই রকম।”

“তাতে কি?”

“জোরানিউম এর সেই বাচনভঙ্গী নেই। সে যথেষ্ট ভালো ব্র্যানটরিয়ান বলে। আমার চেয়েও ভালো। এখনো আমি হ্যাঁলিকনিয়ান বাচনভঙ্গী ছাড়তে পারি নি। রেকর্ড অনুযায়ী সে ট্রানটরে এসেছে উনিশ বছর বয়সে। জীবনের প্রথম উনিশটা বছর নিশায়ার রুক্ষ্ম বাচনভঙ্গী ব্যবহার করে ট্রানটরে এসে তা পুরোপুরি ভুলে যাবে, আমার মতে তা অসম্ভব। ট্র্যানটরে যতদিনই বাস করুক না কেন কিছুটা হলেও পুরনো বাচনভঙ্গীর ছোঁয়া থেকেই যাবে–রাইখকে দেখো, এখনো মাঝে মধ্যে ভুল করে ডাহ্‌লাইট বলে ফেলে।”

“যোগ-বিয়োগ করে কি বের করলে তাহলে?”

“কি বের করলাম–যোগ বিয়োগ করার যন্ত্রের মতো এখানে সারাদিন বসে থেকে যা বের করলাম তা হলো–জোরানিউম মোটেই নিশায়া থেকে আসে নি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে হয় নিশায়াকে সে এই কারণেই বেছে নিয়েছে, কারণ গ্রহটা এতো অনুন্নত, অপরিচিত এবং এতো দূরে যে কেউ অনুসন্ধান করার কথা ভাববে না। সে নিশ্চয়ই কম্পিউটারে অনেক খোঁজ খবর করে এই গ্ৰহটাকে বের করেছে যেন তার মিথ্যে কথা ধরা না পড়ে।”

“তোমার মন্তব্য হাস্যকর, হ্যারি। এই কাজটা সে কেন করবে? এর জন্য তাকে নিশ্চয়ই অনেক জাল রেকর্ড তৈরি করতে হয়েছে?”

“এবং সে ঠিক তাই করেছে। সিভিল সার্ভিসে নিশ্চয়ই তার অনেক অনুসারি আছে, ফলে কোনো সমস্যা হয় নি। তার অনুসারীরাও সব ফ্যানাটিক। কাজেই মুখ খুলবে না কেউ।”

“কিন্তু কেন?”

“কারণ আমার ধারণা জোরানিউম মানুষকে জানাতে চায় না সে আসলে কোন গ্রহ বা অঞ্চল থেকে এসেছে।”

“কেন? আইন এবং প্রথা অনুযায়ী এম্পায়ারের প্রতিটি বিশ্বই সমান।”

“আমি জানি না। ওই সব উচ্চমার্গের দর্শন আমি অন্তত কখনো বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখি নি।”

“তাহলে কোত্থেকে এসেছে? তোমার কোনো ধারণা?”

“হ্যাঁ, আর সেজন্যই তো আমি চুলের কথা বলেছি।”

“খুলে বল।”

“জোরানিউমের সাথে বসে থাকার সময় কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। তার পর। বুঝতে পারলাম যে ওর চুলের কারণে অস্বস্তি লাগছে। ওর চুলগুলো ছিল অনেক বেশী প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল আর এতো বেশী নিখুঁত যা আমি আগে কখনো দেখি নি। এবং এই কৃত্রিম চুল এমন এক করোটির উপর বসানো হয়েছে যে করোটিতে কোনোদিনই স্বাভাবিক চুল গজায় নি।”

“কোনোদিনই গজায় নি?” চট করে সব বুঝে ফেলল ডর্স। “তুমি বলতে চাও–“

“হ্যাঁ। আমি ঠিক তাই বলতে চাই। সে অতীতে পড়ে থাকা পুরাকাহিনী নির্ভর মাইকোজেন সেক্টর থেকে এসেছে। এই ব্যাপারটাই সে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

.

১০.

ডর্স ভেনাবিলি ঠান্ডা মস্তিষ্কে ব্যাপারটা ভাবতে লাগল। এটাই তার চিন্তা করার ধরণ। ঠান্ডা। কখনো অস্থির হয় না।

চোখ বন্ধ করে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল। আট বছর আগে সে আর হ্যারি মাইকোজেনে গিয়েছিল। বেশীদিন থাকে নি। আকৃষ্ট করার মতো কিছু ছিল না। ওখানে একমাত্র খাবার ছাড়া।

রুক্ষ, কঠোর নীতিবাগিশ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ; অতীতই তাদের কাছে একমাত্র ধ্যান ধারণা; স্বেচ্ছায় যন্ত্রণাদায়ক এক পদ্ধতিতে শরীরের সমস্ত চুল এবং লোম নিশ্চিহ্ন করে ফেলে যেন বুঝতে পারে তারা কে”; তাদের কিংবদন্তি; তাদের স্মৃতি (অথবা কল্পনা) যে এক সময় তারা গ্যালাক্সি শাসন করত, যখন তারা ছিল দীর্ঘজীবি, যখন রোবটের অস্তিত্ব ছিল।

চোখ মেলে ডর্স জিজ্ঞেস করল, “কেন, হ্যারি?”

“কি কেন?”

“সে মাইকোজেন থেকে এসেছে এই ব্যাপারটা কেন লুকাতে চায়?”

ডর্স জানে যে তারচেয়ে নিখুঁতভাবে সেলডন মাইকোজেনের ব্যাপারগুলো স্মরণ করতে পারবে না। কিন্তু তার মেধার চেয়ে সেলডনের মেধা আরো তীক্ষ্ণ–ভিন্ন, কোনো সন্দেহ নেই। সে অনেকটা গাণিতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্মৃতি থেকে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যটা বের করে আনতে পারে। কিন্তু সেলডনের ম্যাথমেটিক্যাল ডিডাকশনের প্রয়োজন হয় না, বরং বলা যায় অপ্রয়োজনীয় বিষয় এড়িয়ে আসল তথ্য বের করে আনতে পারে। অনেকটা এক লাফে জায়গামতো পৌঁছানোর মতো। সেলডন সবসময়ই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে শুধুমাত্র তার সহকারী, ইউগো এমারিলই অনুমান নির্ভর কাজ করে। কিন্তু ডর্স তাতে বোকা বনে নি। সেলডন সবসময়ই ভান করেন তিনি জগৎ সংসার ভুলে যাওয়া এক গণিতজ্ঞ। কিন্তু ডর্স তাতেও বোকা বনে নি।

“কেন জোরানিউম প্রমাণ করতে চায় যে সে মাইকোজেন থেকে আসে নি? প্রশ্নটা আবার করল ডর্স।

“ওটা একটা রুক্ষ, সীমাবদ্ধ সমাজ,” বললেন সেলডন। “ওই সমাজে অনেকেই আছে যারা প্রতিটি কার্যকলাপ এমন কি চিন্তা-ভাবনার উপর ডিকটেটরশীপ পছন্দ করে না। আবার এটাও জানে যে পুরোপুরি এই সমাজের বাঁধন ছিঁড়ে পালাতে পারবে না কিন্তু অন্যান্য সমাজের মতো আরো বেশী স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। স্বাভাবিক।”

“তাই বাধ্য হয়ে দেহে কৃত্রিম চুল গজানোর ব্যবস্থা করে?”

“না, সবাই করে না। সমাজ থেকে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়–মাইকোজেনিয়ানরা তাদের পছন্দ করে না তারা উইগ ব্যবহার করে। সহজ কিন্তু কম কার্যকরী। যারা সত্যিকার অর্থেই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চায় তারাই কৃত্রিম চুল গজানোর পদ্ধতি ব্যবহার করে। প্রক্রিয়াটা জটিল এবং ব্যয়বহুল কিন্তু ধরার কোনো উপায় থাকে না। সাইকোহিস্টোরি গণিতের মৌলিক সূত্রগুলো তৈরি করার জন্য ট্র্যানটরের আটশ সেক্টর নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে সাইকোহিস্টোরির কোনো অগ্রগতি না হলেও আমি জেনেছি অনেক কিছু।”

“কিন্তু কেন এই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষগুলো তাদের মাইকোজেনিয়ান পরিচিতি লুকাতে চায়? মাইকোজেনিয়ান হলে কোনো শাস্তির বিধান আছে বলে তো শুনি নি।”–“না, অবশ্যই কোনো শাস্তির বিধান নেই। সত্যি কথা বলতে কি মাইকোজেনিয়ানদের খাটো করে দেখারও কোনো প্রবণতা নেই। বরং ঘটনা তারচেয়েও খারাপ। মাইকোজেনিয়ানদের কেউ গুরুত্বই দেয় না। ওরা বুদ্ধিমান সবাই স্বীকার করে উচ্চশিক্ষিত, আত্মসম্মানী, রুচিশীল, সুস্বাদু খাবার উৎপাদনের জাদুকরী ক্ষমতা, নিজেদের সেক্টরে বিরামহীনভাবে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার বিস্ময়কর দক্ষতা–তারপরেও কেউ ওদেরকে গুরুত্ব দেয় না। তাদের বিশ্বাস, ধ্যান ধারণা মাইকোজেনের বাইরের সমাজের কাছে হাস্যকর, অবিশ্বাস্য বোকামী। এমন কি যারা মাইকোজেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারাও এটা বিশ্বাস করে। একজন মাইকোজেনিয়ান ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে এটা দেখে সবাই হাসবে। মানুষ যদি তাকে ভয় পায় তাতে কোনো ক্ষতি নেই, মানুষের ঘৃণা-অবজ্ঞা নিয়েও কোনোরকমে বেঁচে থাকা যাবে। কিন্তু সে যদি মানুষের হাসির পাত্র হয়ে দাঁড়ায় তা সহ্য করা। কঠিন, জোরানিউম ফার্স্ট মিনিস্টার হতে চায়, কাজেই তার মাথায় চুল থাকতে হবে, এবং আরো নিখুঁত করার জন্য তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে এমন একটা। অপরিচিত গ্রহ থেকে এসেছে যা মাইকোজেন থেকে অনেক অনেক দূরে।”

“অনেক মানুষের মাথায় তো স্বাভাবিক ভাবেই টাক পড়ে।”

“মাইকোজেনিয়ানরা যেভাবে জোর করে সকল চিহ্ন মুছে ফেলে সেরকম কখনোই হয় না। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোতে এই বিষয়ে কেউ মাথা ঘামাত না, কিন্তু তার কারণ আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো শুধু মাইকোজেনের নামটাই জানে, আর কিছুই জানে না। মাইকোজেনিয়ানরা নিজেদেরকে এমনভাবে গুটিয়ে রাখে, আমি নিশ্চিত যে তাদের কেউ কোনোদিন ট্রানটর ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে যায় নি। কিন্তু ট্র্যানটরে ব্যাপারটা অন্যরকম। এখানে টেকো মানুষ অনেক আছে, তারপরেও সামান্য হলেও চিহ্ন থাকবেই যাতে প্রমাণ হবে যে তারা মাইকোজেনিয়ান নয়। এছাড়াও তারা দাড়ি গোঁফ রাখতে পারে। কোনো রকম অসুস্থতার কারণে যারা পুরোপুরি কেশহীন তাদেরকে হয়তো প্রমাণ করার জন্য সাথে ডাক্তারী সার্টিফিকেট রাখতে হবে।”

“আমাদের কি কোনো লাভ হচ্ছে তাতে?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ডর্স।

“ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“তুমি কি সবাইকে জানিয়ে দিতে পার না যে সে একজন মাইকোজেনিয়ান?”

“কাজটা কঠিন হবে, আমার ধারণা সে তার ট্র্যাক নিখুঁতভাবে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। তাছাড়া প্রকাশ করা সম্ভব হলেও–“

“হ্যাঁ?”

“আমি জোর করে মানুষকে গোড়ামীর দিকে আকৃষ্ট করতে চাই না। ট্র্যানটরের সামাজিক পরিস্থিতি ভীষণ বাজে, মানুষ অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সেটা আমি বা অন্য কেউই সামাল দিতে পারব না। জোরানিউম যে মাইকোজেনিয়ান তা যদি প্রমাণ করতেই হয় সেটা হবে আমার শেষ অস্ত্র।”

“তাহলে তোমারও মিনিমালিজম দরকার?”

“অবশ্যই।”

“কী করতে চাও?”

“ডেমারজেলের সাথে দেখা করছি। হয়তো সে জানে কি করতে হবে।”

তীক্ষ দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকালো ডর্স। “হ্যারি, প্রতিটি সমস্যা সমাধানের জন্য তুমি কি ডেমারজেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছ?”

“না, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হয়তো সে দিতে পারবে।”

“যদি না পারে?”

“তখন আমাকেই একটা পথ বের করে নিতে হবে, তাই না?”

“সেটা কি রকম?” সেলডনের চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ পড়ল। “ডর্স, আমি জানি না। আমার কাছে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *