১-২. স্বভাব যায় না মলে

চীনাবাজার — উপন্যাস — নিমাই ভট্টাচার্য

কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে, ইল্লত যায় না ধুলে। বৃদ্ধ অঘোর বাঁড়ুজ্যেরও হয়েছে তাই।

সেই কবে কোন কালে ছোটদাদু শিখিয়েছিলেন, আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস্ এ মান হেলদি…! তখন ওঁর কত বয়েস? বড় জোর পাঁচ-সাত। আর এখন এই বিরাশি বছরেও সে অভ্যেস ছাড়তে পারলেন না। জল-ঝড় শীত-গ্রীষ্ম যাই হোক, ভোর সাড়ে চারটেয় ওঠা চাই-ই চাই। মুখ-হাত ধুয়ে, বাথরুম পর্ব শেষ করে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে পাঁচটার মধ্যে প্রাতঃভ্রমণে বেরুতেই হবে।

সেই পুরনো অভ্যেস এখনও আছে; তবে এখন আর বাইরে যান না। অঘোরনাথ ছাদেই পায়চারি করেন। কার সঙ্গে বেড়াতে যাবেন? বন্ধুবান্ধব তো দূরের কথা, এ পাড়াতে এখন একজন পরিচিত মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ এই ভবানীপুরেই একদিন ওঁর জন্ম হয়; এখানেই শৈশব-কৈশোর-যৌবন কাটিয়েছেন। তখন কত অসংখ্য বন্ধুবান্ধব, পরিচিত ছিল চারদিকে।

ছোটদাদুর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে কি দারুণ রোমাঞ্চ ছিল; বাড়ি থেকে বেরিয়েই ছোটদাদু ওঁকে বলতেন, দাদুভাই, কুইক মার্চ।

ব্যস! শিশু অঘোরনাথ প্রায় দৌড়তে শুরু করতেন আর ছোটদাদু লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতেন। বড় রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে থাকতেন স্বয়ং রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়! অঘোরনাথ প্রায় ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন। স্যার আশুতোষ ওঁর মাথায় এক হাত রেখেই অন্য হাত দিয়ে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে বলতেন, ত্রিদিব, আজও তুমি এক মিনিট দেরিতে এলে।

ছোটদাদু সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, দাঁড়াও, ঘড়িটা মিলিয়ে দেখি। তারপর নিজের ঘড়িটা দেখেই বলতেন, তাই অ্যাম স্যরি আশুতোষ।

ছোটদাদু এইটুকু বলেই থামতেন না। বলতেন, আমি কথা দিচ্ছি আশুতোষ, কাল থেকে আর দেরি হবে না।

সেই সব দিনের কথা আজ যেন স্বপ্ন মনে হয়। ছোটদাদু ত্রিদিবনাথ বাঁড়ুজ্যে ছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক আর স্যার আশুতোষ ছিলেন প্রখ্যাত বিচারপতি। কলকাতা ইউনিভারসিটির ভাইস-চ্যান্সেলার। রোজ সকালে অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে দুই বন্ধুর তর্কাতর্কি দেখে অঘোরনাথ ঘাবড়ে যেতেন। ভয় পেতেন। মনে মনে ভাবতেন, হয়তো দুই বন্ধুর আর মুখ দেখাদেখিও হবে না। হা ভগবান! পরের দিন সকালবেলায় ঐ মোড়ের মাথায় পৌঁছেই দেখতেন, বাংলার বাঘ দাঁড়িয়ে আছেন। অত বড় গোঁফের তলা দিয়েও ওঁর মুখের হাসিটি দেখে শিশু অঘোরনাথও হেসে ফেলতেন।

দুই বন্ধুর একসঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বেরুতেও হবে, আবার তর্ক-বিতর্কও হবে। অঘোরনাথ কিছুই বুঝতে পারতেন না। কিছু যে জিজ্ঞেস করবেন, তাও সাহসে কুলোতে। তবে একটু বড় হবার পর উনি একদিন সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না–আচ্ছা ছোটদাদু, রোজ সকালে আপনারা দুই বন্ধু ঝগড়া করেন কেন?

ত্রিদিবনাথ এক গাল হাসি হেসে আদরের নাতিকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, না দাদুভাই, আমরা ঝগড়া করি না; তর্ক করি।

অঘোরনাথ অবাক হয়ে ছোটদাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ছোটদাদু একটু থেমে আবার বলেন, আমি শুধু অঙ্ক শাস্ত্র নিয়ে একটু-আধটু পড়াশুনা করেছি আর আশুতোষ যে কোন শাস্ত্রে মহাপণ্ডিত না, তা ভগবানই জানেন। একটু তর্ক বিতর্ক না করলে কি ওঁর কাছ থেকে কিছু জানার উপায় আছে?

এই ছাদে পায়চারি করতে করতে বৃদ্ধ অঘোর বাঁড়ুজ্যের চোখের সামনে যেন সেইসব দিনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি ভেসে ওঠে। একদিনের কথা ওঁর স্পষ্ট মনে আছে। কলেজ থেকে ফেরার পরই ছোটদাদু বললেন, দাদুভাই, আজ সন্ধেবেলায় আশুতোষের বাড়ি যেতে হবে।

সন্ধেবেলায়? কিশোর অঘোরনাথ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ দাদুভাই, আজ ওকে অভিনন্দন জানাতে যাব। উনি একটু থেমে বলেন, আশুতোষের জন্যই এবার থেকে তোমরা ইউনিভারসিটিতে এম. এ. এম. এস-সি পড়তে পারবে। ও যে বাঙালির কি উপকার করল, তা এখন তুমি বুঝবে না। বড় হলে বুঝবে।

বিরাট দুহাঁড়ি রসগোল্লা আর বেশ কিছু বই নিয়ে সেদিন সন্ধেয় ত্রিদিবনাথ বন্ধু স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন। সেদিন ওখানে কত বিখ্যাত পণ্ডিতের ভিড় দেখেছিলেন অঘোরনাথ, সে স্মৃতি কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?

এই ভোরবেলায় পায়চারি করতে করতেই আরো কত কথা মনে পড়ে! এই ভবানীপুরে তখন কত বিখ্যাত জজ-ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, উকিল আর ডাক্তার থাকতেন। ছোটদাদুর সঙ্গে টাউন হল বা অ্যালবার্ট হলের সভায় গেলে ভবানীপুরের কত মানুষকে দেখা যেত! আর এখন? প্রত্যেকটা বাড়ি বদলে গেছে। বদলে গেছে বাড়ির চেহারা, বদলে গেছে বাড়ির বাসিন্দারা! পাড়াটা দেখে যেন আর চেনা যায় না। অতীতের চিত্তচাঞ্চল্যময়ী উনযৌবনা নায়িকা যেন জরাগ্রস্তা, বিধবা! নাকি মানস-মন্দিরের সেই প্রতিমা কুলত্যাগিনী কলঙ্কিনী! দীর্ঘনিঃশ্বাসের ভারে অঘোরনাথ আর পায়চারিও করতে পারেন না, থমকে দাঁড়ান।

.

নামের ডাকে গগন ফাটে, ঢেঁকিশালে কুঁড়ো চাটে। সরকারদের বাড়িটাও হয়েছেই তাই। ঐ হতচ্ছাড়া আজ আবার সাত সকালে মুকুন্দর সঙ্গে ঝগড়া করছে। নিশ্চয়ই বউ বলেছে, চা-চিনি নেই। তাই মুকুন্দর দোকান থেকে চা নিতে গেছে। এই সাত সকালে কোন দোকানদার ধার দেবে? তার উপর বিনুর মতো খদ্দেরকে। সঙ্গে সঙ্গে বাবুর কি রাগ! দেখ মুকুন্দ, ভুলে যাস নে আমি সরকারবাড়ির ছেলে! তাছাড়া তুই আমাদের জমিতে আমাদের কৃপায় দোকান করেছিস।

না, মুকুন্দ চুপ করে থাকেনি, থাকবে কেন? বিনু সরকারের কছে তো ও মাথাবিক্রি করেনি! মুকুন্দ ওকে সোজাসুজি বলেছে, চুপ করো, চুপ করো। বেশি ওস্তাদি দেখিও না। তুমি যে বুড়ির কৃপায় এই বাড়িতে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকো, আমি সেই বুড়ির ভাড়াটে। তোমার কৃপায় ব্যবসা করার আগে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব।

–ওরে যে বুড়ির কথা বলছিস, সে আমার ঠাকুমা; তোর কে?

শুধু মুকুন্দ না, দোকানের দুতিনজন খদ্দেরও ওর কথায় হাসে। হাসবে না কেন? মুকুন্দ ওর কথার জবাব না দিয়ে অন্য খদ্দেরদের দিকে নজর দেয়।

বিনু একটু চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে মুকুন্দ, চা দিবি কি?

–যে খদ্দের তিরিশ-বত্রিশটা টাকা ছমাসের মধ্যে দিতে পারে না, তাকে ধারে

 ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বিনু বলে, ঠিক আছে। তোকে কি করে টাইট দিতে হয়, তা আমি জানি।

কবে কোনকালে বাড়িটায় গোলাপী রং করা হয়েছিল, তার ঠিক নেই। জল-ঝড় রোদ-বৃষ্টিতে সে রং কবে ধুয়ে-মুছে উঠে গেছে; একটু-আধটু ছাপ লেগে আছে এখানে ওখানে কিন্তু তবু পাড়ার সবাই বলে, গোলাপী বাড়ি। এ পাড়ার পুরনো বাসিন্দারা অবশ্য বলেন সরকারবাড়ি। তবে নামেই সরকারবাড়ি। এ বাড়িতে কত রকমের কত ভাড়াটে যে আছে, তা শুধু ভগবানই জানেন। আড়াই বিঘে জমির উপর বিরাট চারতলা বাড়ির মধ্যে মাত্র দুখানা ঘর এখনও ঐ বুড়ি কামিনীবালা দাসীর দখলে। বাকি সব ঘরদোর ভাড়াটেদের দখলে। এই বুড়ি যেদিন চোখ বন্ধ করবে, সেইদিন এই দুখানা ঘরও কোন ভাগ্যবান ভাড়াটের হাতে চিরকালের জন্য চলে যাবে। ব্যস! সেইদিন থেকে এই বাড়িতে সরকারদের নাম চিরকালের জন্য মুছে যাবে।

বুড়ি কামিনীবালার দিনও শুরু হয় এই সাত সকালেই। ইচ্ছা হয় আরো একটু শুয়ে থাকতে কিন্তু দেরি হলে তো পোড়া কয়লাগুলো বেছে কে যে নিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। তাই ঘুম থেকে উঠেই চোখে-মুখে জল দিয়ে একটা ভাঙা কড়া হাতে নিয়ে শিউলিতলায় চলে যান।

এই বিরাট শিউলিগাছের চারপাশে এখন ছাইয়ের পাহাড়। হবে না! যদি তিন শ পঁয়ষট্টি দিন সাত গুষ্টির উনুনের ছাই এখানে ফেলে, তাহলে আর কি হবে? একটুকরো পাথরের উপর আধপোড়া কয়লার টুকরোগুলো ঠুকঠুক করে ঠুকতে ঠুকতে বুড়ি অজান্তেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, জম্মো জম্মো ধরে কি পাপই যে করেছিলাম!

সত্যিই তাই। এককালে ঠিক এই জায়গায় কি সুন্দর বাগান ছিল! ছোটকর্তা নিজে কত জায়গা থেকে কত ভাল ভাল ফুলের গাছ এনে এই বাগান সাজিয়েছিলেন। চাঁপা, চামেলি, গন্ধরাজ, গোলাপ! কত রকমের গোলাপ! দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। তাছাড়া বিলিতি ফুলের কত গাছ ছিল। সন্ধেবেলায় ছাদে গেলেও এইসব ফুলের গন্ধে মন ভরে যেত।

কী একটা শব্দ হতেই কামিনীবালা মুখ তুলে এদিক-ওদিক দেখেন। কাউকে না দেখে দৃষ্টিটা গুটিয়ে আনতে গিয়েও আনতে পারেন না। ডানদিকের ঐ টিনের ঘরখানা দেখেই বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে। ওখানেই তো ছিল আস্তাবল। বাপরে বাপ! ঘোড়াগুলো কি বিরাট ছিল! দেখতেও কি সুন্দর ছিল। ছোটকর্তার ঘোড়াটা আবার সাদা-কালো রংয়ের ছিল। ওকে দেখতে সব চাইতে ভাল ছিল। তাছাড়া ছুটত কি জোরে! ওর গাড়ি চড়লে যেন মনে হতো উড়ে যাচ্ছি। ছুটবে না? ঘোড়াগুলোর কি যত্ন করা হতো। ছজন তাগড়া পশ্চিমী হিমশিম খেয়ে যেত ওদের দেখাশোনা করতে। ছোটকর্তার গাড়ি চড়ে কামিনীবালা কতদিন কত জায়গা বেড়াতে গিয়েছে। কালীঘাট থেকে আহিরীটোলা-শোভাবাজার-বাগবাজার এমনি বরানগর-দক্ষিণেশ্বরেও গিয়েছেন কতদিন। আর আজ? সেই আস্তাবলের পাশে ছাইয়ের ঢিপির উপর বসে পোড়া কয়লা বাছতে হচ্ছে! একেই বলে, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন!

.

কয়লা বাছতে বাছতে বুড়ি কামিনীবালার কত কি মনে পড়ে। রোজ মনে পড়ে। কি ছিল না এই সরকারবাড়িতে? দাস-দাসী ঠাকুর-চাকর দারোয়ান-কোচোয়ান থেকে বাজার সরকার-ম্যানেজারবাবু পর্যন্ত। হাঁচি-কাশি দেবার আগে দাস-দাসীরা ছুটে আসতো। বাড়ির কর্তা-গিন্নিদের হুকুম তামিল করে ওরা কৃতার্থবোধ করতো। বিশেষ করে ছোটকর্তার জন্য ওরা কি না করতে পারতো?

হঠাৎ কামিনীবালার চোখে-মুখে একটু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। ছোটকর্তা কি রসিকই ছিলেন! কি আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ই না করতে পারতেন! অথচ এই মানুষটাকেই ফুলশয্যার রাত্তিরে দেখে কি ভয়ই পেয়েছিলেন!

সেদিন ফুল দিয়ে কি সুন্দর সাজানো হয়েছিল ছোটকর্তার ঘর। যেদিকে তাকাও সেদিকেই শুধু ফুল। আর কি সুন্দর আতরের গন্ধ! আঃ! এখনও যেন নাকে লেগে আছে। বারান্দার বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজতেই বড়গিন্নি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললেন, কি হলো ছোটবউ? কর্তা আসছে না দেখে মন খারাপ লাগছে নাকি?

কিশোরী কামিনীবালা কোনো জবাব দেননি, দিতে পারেননি।

বড়গিন্নি এবার বললেন, ছোটকর্তা হচ্ছেন এ বাড়ির সবচেয়ে রসিক মানুষ। তিনি ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে আড্ডায় একটু আটকে পড়েছেন বলেই..

ঠিক এমন সময় কে যেন ঘরে ঢুকেই বলে গেল, ছোটকর্তা আসছেন। ব্যস! এক মুহূর্তের মধ্যে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু টলতে টলতে মুখে হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকেই ছোটকর্তা বললেন, শুদ্দু তোমার জন্য এই সন্ধেবেলায় ছোট্ট খোকাবাবুর মতো বাড়ি ফিরে এলাম।

ছোটকর্তার কথা শুনে কামিনীবালার মাথা ঘুরে যায়। লোকটা বলে কী? এই ওর সন্ধেবেলা? নববধূ দুর্গানাম শরণ করেন।

ছোটকর্তা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে কামিনীবালার মুখের সামনে মুখ নিতেই উনি কি একটা বিচ্ছিরি গন্ধে মুখ ঘুরিয়ে নেন। ছোটকর্তা এক গাল হাসি হেসে বললেন, ভয় পেয়োনা ছোটগিন্নি। আজ শুভদিন বলে ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে বসে একটু সিদ্ধি খেয়েছি। কিচ্ছু ভয় পাবার নেই।

ওর কথা শুনে কামিনীবালার রক্ত প্রায় জল হয়ে যায়। জিভ তো শুকিয়ে কাঠ।

আবার ছোটকর্তার মুখে সেই হাসি। উনি বলেন, হাজার হোক আমি সরকারবাড়ির ছোটকর্তা। এমনি সিদ্ধি তো মুখে রোচে না; তাই বিলিতি সিদ্ধি খেয়েছি।

.

দত্তদের ঐ পুরনো বাড়িটার সামনে দুতিনটে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে পাঁচ সাতজন নেমে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখাতে দেখাতে আলাপ-আলোচনা করছেন। এই গাড়িগুলি চেপে এঁরাই আরো কয়েকবার এসেছেন। মাসখানেক আগে এক রবিবার সকালে দুএকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে তিন-চারজন বয়স্কা মহিলাও এসেছিলেন। ঐ মহিলারা বাড়ির চারদিক ঘুরে-ফিরে দেখার পর ভিতরেও গিয়েছিলেন।

ভদ্রলোকেরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর একটা গাড়ির বনেটের উপর একটা বিল্ডিং প্ল্যান রেখে কত কি কথাবার্তা বললেন। প্রায় আধঘণ্টা আলাপ-আলোচনার পর এক ভদ্রলোক বাড়ির পিছন দিকের দোতলা থেকে বিশুবাবুকে ডেকে আনলেন।

কোনো ভূমিকা না করেই কেশব আগরওয়াল ওঁকে প্রশ্ন করলেন, বিসুবাবু, আপনি কবে শিফট করছেন।

বিশুবাবু লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বললেন, শিফট তো আমি কালই করতে পারি, কিন্তু সোনারপুরের স্কুলে ছেলে দুটোকে ভর্তি না করা পর্যন্ত…

-কিন্তু আমরা তো কাল থেকেই বিল্ডিং ভাঙা শুরু করছি।

কাল থেকেই?

হাঁ, কাল থেকেই। কেশববাবু সিল্কের পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রুপোর কৌটো বের করতে করতে বলেন, এখন আর ভবানীপুরে দো-তিনতলা বাড়ি বানিয়ে পোসাবে না। কমসে কম ছতলা না হলে পরতায় পোসাবে না। কিন্তু সামনের দেওয়ালীর আগে, এই ছতলা কমপ্লিট না করতে পারলে আমাদের মিনিমাম চালিস লাখ টাকা লুকসান হবে।

বিশুবাবু ওঁর কথা শুনে চুপ করে থাকেন।

কেশববাবুর রুপোর কৌটো থেকে পান-জর্দা মুখে দিয়ে বলেন, আপনি রবিবারের মধ্যে পজিটিপলি চলে যাবেন।

কেশববাবুর বড়ছেলে কিশোরবাবু এই কলকাতা শহরেই জন্মেছেন। প্রথমে দয়ানন্দ সরস্বতী স্কুলে ও পরে সিটি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাপের ব্যবসায় নিত্য যাতায়াত করে এই চল্লিশ বছর বয়সেই পাকা ব্যবসাদার হয়েছেন। এই দত্ত পরিবারের এক আত্মীয়ের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব আছে এবং সেই সূত্রেই এই সম্পত্তি ওঁরা কিনতে পেরেছেন। এই পরিবারের সবকিছুই উনি জানেন এবং ওঁর উপর কেশববাবুর ষোল আনা আস্থা আছে। তাই তো উনি সোজাসুজি বিশুবাবুকে বললেন, দেখুন বিশুবাবু, আপনার সঙ্গে এই দত্ত ফ্যামিলির কোনো ডাইরেক্ট সম্পর্কও নেই; অথচ একটি পয়সা ভাড়া না দিয়ে সারাজীবন এই বাড়িতে বেশ কাটিয়ে দিলেন। আমরা নিছক ভদ্রলোক বলে আপনাকে কিছু টাকা দিয়েছি। যাই হোক, আপনি রবিবারের মধ্যেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।

বিশুবাবু এদের নতুন দেখছেন না। সবই জানেন, সবই বোঝেন। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেদেরই যখন চলে যেতে হয়েছে, তখন ওঁকেও যে যেতে হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবু উনি বললেন, যদি কাইন্ডলি আরো একটা সপ্তাহ টাইম দেন, তাহলে…

–অসম্ভব।

ইতিমধ্যে পাড়ার কয়েকজন ভদ্রলোক ওঁদের আশেপাশে জড়ো হয়েছেন। এঁদেরই একজন বললেন, বিশু, তুমি বিনা ভাড়ায় এত বছর কাটাবার পর এঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও বাড়ি ছাড়ছ না?

কিশোরবাবু বেশ রাগ করেই বললেন, আই হ্যাভ পেড হিম ফাইভ থাউজ্যান্ত রুপিজ।

–পাঁচ হাজার! ভদ্রলোক এবার হেসে বিশুবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো আচ্ছা ওস্তাদ লোক! ফোকটে পাঁচ হাজার পেয়েও বাড়ি ছাড়তে ….

পিছন দিক থেকে একটি ছোকরা বলল, বিশুদা, ক্লাবের পুজোর চাঁদা না দিয়ে কেটে পড়ো না।

এবার বিশুবাবু বললেন, ঠিক আছে, রবিবারের মধ্যেই আমি চলে যাব।

কিশোরবাবু মুখ ঘুরিয়ে এক ভদ্রলোককে বললেন, মিঃ ঘোষ, তাহলে কাল থেকেই কাজ শুরু করে দিন।

মিঃ ঘোষ বললেন, হ্যাঁ, কালই শুরু করব। বর্ষার আগে রিইনফোর্সড কনক্রিটের কাজ শেষ না করতে পারলে ভীষণ মুশকিলে পড়ব।

কাম হোয়াট মে, বর্ষার আগেই এই কাজ শেষ করতে হবে।

–সে তো একশবার। মিঃ ঘোষ এবার পিছন দিক ফিরে বললেন, মুখার্জিবাবু, মানিককে সব কথাই বলা আছে; তবু এখুনি একবার ওর অফিসে গিয়ে আরেকবার বলে আসুন কাল সকাল থেকেই কাজ শুরু হবে।

কিশোরবাবু ড্রাইভারকে বললেন, চন্দনকো জলদি বুলাইয়ে।

দুপাঁচ মিনিটের মধ্যেই চন্দন হাজির হয়েই বলল, কিশোরদা, আপনি আমাকে ডেকেছেন?

–শোন, কাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু হচ্ছে। সুতরাং…

ব্যস ব্যস আর বলতে হবে না। এখান থেকে যদি একটা ইটও এদিক-ওদিক হয়, তাহলে চন্দন মুখুজ্যেকে জুতো পেটা করবেন।

কিশোরবাবু ওর পিঠে একটা চড় মেরে বললেন, তুই বড্ড বকবক করিস।

চন্দন চলে যেতেই মিঃ ঘোষ একটু হেসে বলেন, ছেলেটি বেশ গুণী মনে হলো।

কিশোরবাবু হেসে বলেন, খুব গুণী কি না জানি না; তবে পাতালরেলের লোহালক্কড় সিমেন্ট চুরির জন্য উইকে অন্তত একবার ওকে ভবানীপুর থানায় যেতেই হয়। মাত্র বার চারেক জেলও খেটেছে।

মিঃ ঘোষ হো হো করে হেসে ওঠেন। তারপর হাসি থামলে বলেন, এর চাইতে গুণী ছেলে আমাদের দরকার নেই।

কিশোরবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, অথচ হি কামস ফ্রম এ ভেরি ভেরি গুড ফ্যামিলি, আর ছেলেটাকে প্রপারলি ডিল করলে দেখবেন, হি ইজ নট এ ব্যাড এলিমেন্ট।

.

উনুনে ডাল বসাতে বসাতেই মালতী দেবী ডান দিকে মুখ করে একটু গলা উঁচু করে বলেন, হ্যাঁগো, বাজার যাবে না?

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রামপ্রসন্ন মিত্তির পুরনন ফিল্ম ম্যাগাজিনে ডিম্পলের একটা সুন্দর ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময় বাজার যাবার কথা শুনে ওঁর মেজাজ বিগড়ে গেল। বললেন, এত বেলায় বাজার যাবার কথা বলছ?

মালতী দেবী উঁকি দিয়ে একবার টাইমপিস দেখেই বলেন, মোটে তো সাতটা বাজে। এর আগে আবার কবে তুমি বাজারে যাও?

ডিম্পলের ছবি দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যান রামপ্রসন্নবাবু। তাই স্ত্রীর কথা শুনেও যেন শুনতে পান না। একটু পরে বলেন, মন্টুকে বলো না, একটু বাজার যেতে।

তাকে পাব কোথায়? তিনি রাজ্যসম্মেলন নিয়ে এতই ব্যস্ত যে ভোর ছটায় বেরিয়ে গেছেন।

রেখা-হেমা মালিনী-শ্রীদেবীর নানা ভঙ্গিমার ছবি দেখতে দেখতেই উনি বলেন, ছেলেকে বলে দিও, মিছিল-মিটিং করে পেটও ভরবে না, দেশেরও কিছু হবে না।

-তুমি বলে দিও। মালতী দেবী তরকারির ছোট্ট ঝুড়িটা একবার দেখে নিয়েই আবার বলেন, কিগো, বাজার যারে না?

–ডিম নেই?

 –আছে।

-তাহলে ঐ ডিম দিয়েই আজ চালিয়ে নাও।

–কিন্তু যা ডিম আছে, তা দিয়ে তো দুবেলা সবার হবে না। এবার মালতী দেবী ঘরে ঢুকে স্বামীকে দেখে একটু হেসে বলেন, সিনেমা ম্যাগাজিন আনার জন্য খুকির উপর রাগ করো, কিন্তু আমি তো দেখি এইসব বই পড়তে তোমারই আগ্রহ সব চাইতে বেশি।

.

অবস্থার গুরুত্ব মালতী দেবী খুব ভালভাবেই বোঝেন এবং জানেন। যেদিন ভবানীপুরের দেবীপ্রসন্ন মিত্তিরের পুত্রবধূ হয়ে এই বাড়িতে প্রথম আসেন, সেদিন ওঁর মনে কত স্বপ্ন, কত আনন্দ! স্বামী তখনও কলেজের ছাত্র কিন্তু তবুও স্থির জানতেন এত বড় পরিবারের ছেলে কিছু না কিছু হবেই। তাছাড়া শরৎ বোসের পরম স্নেহভাজন আস্থাভাজন উকিল দেবীপ্রসন্ন মিত্তিরের ছেলে হয়তো ব্যারিস্টারও হতে পারেন। অন্ততপক্ষে নামকরা উকিল নিশ্চয়ই হবেন, কিন্তু হা ভগবান! কি ভেবেছিলেন আর কি হলো!

একটা ছেলেমেয়েকে নিয়েও শান্তি পেলেন না মালতী দেবী। পাঁচজনের একজনও মনের মতো হলো না। বড় ছেলে দুর্গাপুরে ইলেকট্রিকের মিস্ত্রীর কাজ করছে, একথা লোককে বলতেও ঘেন্না হয়। মন্টুও যেভাবে রাজনীতিতে মেতেছে, তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর ভবিষ্যও বিশেষ উজ্জ্বল না। আর তিনটি মেয়ে তো তিনটি অবতার! ছোটটিকে নিয়ে এখনও তেমন কোনো ঝামেলা ভোগ করতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু ও যে দুই দিদির মতো যন্ত্রণা দেবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে?

দুটি মেয়ের এমনই খ্যাতি ছিল যে তাদের পার করতে খেসারত দিতে হয়েছে অনেক। না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। বড় খুকির বিয়ের সময়েই তো দোতলাটা গুপ্তাজিদের দিয়ে যে টাকা অ্যাডভান্স পাওয়া গেল, তাই দিয়ে কোনমতে মান রক্ষা হলো। মেজ খুকির বিয়ের সময় কার কাছে হাত পাততে হয়নি? এ পাড়ায় যে কঘর পুরনো বাঙালি আছেন, তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি সাহায্য করেছিলেন এবং স্বেচ্ছায়। কারণ রামপ্রসন্ন মিত্তিরের অবস্থা কে না জানেন? কে না জানেন দেবী মিত্তিরের মৃত্যুর পর রাম মিত্তির রেস খেলে সব উড়িয়েছেন? তাই তো পাড়ায় কারুর কাছে ওঁর মুখ দেখাবার উপায় নেই। এমনকি মেয়ের বিয়ের সময়েও উনি পুরনো প্রতিবেশীদের বাড়ি যাননি।

.

মালতি দেবী অঘোর বাঁড়ুজ্যেকে প্রণাম করে কার্ডটা হাতে দিতেই উনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, বৌমা, কার বিয়ে?

–মেজ মেয়ের।

বাঃ! খুব আনন্দের কথা। উনি সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাইপো নীতীশের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ছোট মা, বৌমা এসেছে মেজ মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে।

নীতীশবাবুর স্ত্রী কণিকা একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ আমি জানি।

–আজকালকার দিনে মেয়ের বিয়ে দেওয়া তো সহজ ব্যাপার না।….

–সে তো একশবার।

বৃদ্ধ অঘোরনাথ কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচশ টাকার চেক কেটে নীতুকে দিয়ে বলবে, ও নিজেও যেন শআড়াই দেয়। তারপর তুমি বৌমার সঙ্গে পরামর্শ করে ঐ সাড়ে সাতাশ দিয়ে বিয়ের কিছু জিনিসপত্র কিনে দিও।

কণিকা দেবী একটু হেসে বলেন, ছোট কাকা, আপনি রিটায়ার্ড হয়ে যদি পাঁচশ দেন, তাহলে আপনার ছেলে আড়াইশ দেবে কেন? তারও অন্তত পাঁচশ দেওয়া উচিত।

মালতী দেবী অবাক হয়ে ওঁদের দুজনের কথা শোনেন।

অঘোরনাথ একটু মধুর হাসি হেসে বলেন, আমার যা কিছু দরকার তা সবই তো তোমরা দাও; আমার আর খরচা কোথায়। তোমাদের তো এখনও অনেক দায়-দায়িত্ব পড়ে আছে।

–নাতি-নাতনীদের জন্য আপনার খরচ কম?

 –ওদের জন্য আবার কোথায় খরচা করি?

কণিকা দেবী একগাল হাসি হেসে মালতী দেবীকে বলেন, জানো মেজদি, ছোট কাকার সব টাকাকড়ি আমার নামেই ব্যাঙ্কে জমা আছে। দুদিন পর পরই উনি বলবেন, ছোট মা, হাত একেবারে খালি। কিছু টাকা তুলে দেবে?

মালতী দেবী মুগ্ধ হয়ে ওঁর কথা শোনেন।

নীতুবাবুর স্ত্রী বলেন, নাতি-নাতনীদের বাঁদরামির জন্য ছোট কাকা কীভাবে জলের মতো টাকা খরচ করেন, তা তুমি ভাবতে পারবে না।

বৃদ্ধ অঘোরনাথ কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলেন, কি যে বলো ছোট মা? আমি আবার ওদের জন্য খরচ করলাম কবে?

কণিকা হাসতে হাসতে বলেন, এই দিন দশেক আগে পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টে ডিনার দিলেন কাদের জন্য?

ওঃ! অঘোরনাথ হেসে বলেন, বাপের বিয়ের পর ঐ তো প্রথম ঢোলে কাঠি পড়ল! তাছাড়া ওটা খুবই স্পেশাল ব্যাপার ছিল।

নাতি-নাতনীদের সবকিছুই স্পেশাল।

অঘোরনাথ মালতী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আচ্ছা তুমিই বলল বৌমা, নাতির সঙ্গে যাদবপুরে একটি মেয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মেয়েটি রূপে-গুণে কথায়-বার্তায় এত ভাল যে তোমাকে কি বলব। বৃদ্ধ একটু হেসে বলেন, মেয়েটির সঙ্গে আমার আবার খুবই ভাব-মানে ভেরি স্পেশাল ভাব। এখন ঐ মেয়েটির সঙ্গে জন্মদিনে আমি নাতি নাতনী আর তাদের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে কি অন্যায় করেছি?

ঘটনাটা শুনেও মালতী দেবীর মন খুশিতে ভরে যায়। বলেন, না, না, অন্যায় করবেন কেন।

–ঐ শোনো ছোট মা, বৌমা কি বলছেন।

কণিকা হেসে বলেন, মেজদি, তোমাকে পরে আমি সব বলব।

যাই হোক, এই বাঁড়ুজ্যে বাড়ি থেকেই ওঁদের মেজ মেয়ের বিয়ের সময় পুরো এক হাজার টাকার জিনিসপত্র কিনে দেন। এমনকি ঐ সরকার বাড়ির বুড়ি কামিনীবালা পর্যন্ত একটা নাকছাবি মালতী দেবীর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বৌমা, আমার তো আর সেদিন নেই; তাছাড়া যা সামান্য কিছু ছিল, তাও হতভাগা নাতিদের কল্যাণে শেষ হয়েছে। এটা ছাড়া আর কিছু নেই! তুমি এটা ভেঙেচুরে ওকে যা হয় করে দিও।

.

স্বামীর কল্যাণে মালতী দেবী কার কাছে হাত পাতেননি? বাইরের দরজা থেকে রান্নাঘরে ফিরে আসতে আসতেই এইসব মনে পড়ে ওঁর। এমন সময় সিঁড়িতে চটির আওয়াজ শুনেই পিছন ফিরে দেখেন, সন্তোষ নামছে।

ওকে দেখেই মালতী দেবী বলেন, সন্তোষ, বাবা একটা কথা শুনবে?

সন্তোষ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে, হ্যাঁ কাকিমা, বলুন।

–এখানে না, ঘরে এসো।

সন্তোষ ওঁর পিছন পিছন ঘরে ঢুকতেই মালতী দেবী বলেন, তুমি যদি রাগ না করো, তাহলে একটা কথা বলতাম।

সন্তোষ একগাল হাসি হেসে বলে, আপনি কি যে বলেন! আমি আপনার উপর রাগ করতে পারি? আপনি বলুন কি বলবেন।

বাবা, কিছু টাকার দরকার কিন্তু..

কাকিমা, আপনি আমার মায়ের মতো। আপনি আমাকে বেশি বললে লজ্জা পাব।

–কিন্তু বাবা।

 –আপনার কত টাকার দরকার?

–হাজার খানেক হলে খুব ভাল হয়; আর তা না পারলে…

সন্তোষ বলল, আমি দোকানে বেরুবার সময় আপনাকে দিয়ে যাব।

না, না, তখন কাকা থাকবেন। ওঁর সামনে দিও না। মালতী দেবী লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, উনি টাকার কথা জানতে পারলেই হয়তো অফিস কামাই করে রেসের মাঠে বসে থাকবেন।

-তাহলে দুপুরবেলায় কোনো এক সময় আমি আসব।

–হ্যাঁ, সেই ভাল।

-তবে কাকিমা, এই টাকার কথা যেন কেউ না জানে। মানে আমি আর আপনি ছাড়া কেউ জানবে না।

–আচ্ছা বাবা, তাই হবে।

সন্তোষ ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরে এস বলে, আর একটা কথা কাকিমা; আপনার যখন যা দরকার আমাকে বলবেন। একটুও লজ্জা করবেন না।

মালতী দেবী দুহাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলেন, তুমি সুখী হও বাবা। এমন কথা আমার স্বামী বা ছেলেরাও কোনোদিন বলেনি, বলবেও না।

–এই পটল, তোর দাদুকে বলে দে, এই বারান্দাটা পেচ্ছাব পায়খানা করা বা মুখ ধোবার জায়গা না।

বারান্দায় এক কোনায় বসে রান্না করতে করতেই আড় চোখে মেজ শ্বশুর অমূল্যচরণকে বারান্দার অন্য দিকের কোনায় বসে মুখ ধুতে দেখেই বন্ধু বসুর বউ শুধু ঐটুকু বলেই থামেন না। আরো অনেক কথা বলার পর শ্রীমতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, পোড়া কপাল করে এসেছি বলেই এইসব জংলিগুলোকে নিয়ে সংসার করতে হচ্ছে।

অমূল্যচরণ এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেন। বন্ধুর বউয়ের কথাবার্তার ধরনই এইরকম বলে উনি বিশেষ পাত্তা দেন ন। এই মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ের সম্বন্ধ হবার সময়ই উনি বড়ভাইকে বলেছিলেন, দাদা, যে লোকটা এককালে আমাদের পাশের দোকানের কর্মচারী ছিল ও পরে মালিককে ঠকিয়ে দোকানটা নিজের করে নেয়, তার মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিও না।

প্রফুল্লচরণ বলেছিলেন, কিন্তু মেয়েটিকে যে আমার বড় পছন্দ হয়েছে।

মেয়েটি যত সুন্দরই হোক, ওর শরীরে তো ঐ বেইমান যতীন সরকারের রক্ত আছে। এই বেইমানের মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনলে কি তুমি খুব সুখী হবে?

-কোন মেয়েকে ঘরে এনে যে সুখী হবে, তা তো শুধু ভগবানই জানেন। প্রফুল্লচরণ একটু থেমে বলেন, তাছাড়া আমাদের পরিবারের কথা জানে বলেই যতীন একশ ভরি সোনা, এগারো হাজার টাকা নগদ আর মণ পাঁচেক কাঁসার বাসন দিচ্ছে।

অমূল্যচরণ গম্ভীর হয়ে বলেন, এই যুদ্ধের বাজারে জোচ্চুরি করে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে বলেই..

মেজভাইকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রফুল্লচরণ বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বলেন, এই যুদ্ধের বাজারে কোন ব্যবসাদার জোচ্চুরি করে পয়সা কামাচ্ছে না? আমরা খদ্দেরদের ঠকিয়ে বেশি কামাচ্ছি না? যত দোষ যতীন সরকারের?

না, এর পর অমূল্যচরণ আর তর্ক করেন নি। যথারীতি মাঘ মাসের এক শুভদিনের শুভলগ্নে স্বর্গীয় রায়সাহেব সারদাচরণ বসুর প্রপৌত্র, স্বর্গীয় বরদাচরণ বসুর পৌত্র ও শ্ৰীযুত্তবাবু প্রফুল্লচরণ বসুর একমাত্র পুত্র পরম কল্যাণীয় শ্রীমান বঙ্কিমচরণের সহিত উলুবেড়িয়ার লাটবাড়ি খ্যাত সরকার পরিবারের পরম শ্রদ্ধেয় উত্তরাধিকারী শ্ৰীযুক্তবাবু যতীন্দ্রনাথ সরকার মহোদয়ের তৃতীয়া কন্যা পরম কল্যাণীয়া শ্রীমতি উমারানীর শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হইল।

এই বিয়ের আগেই নিমন্ত্রণপত্র পাবার পরই বসু পরিবারের আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীদের মধ্যে সে কি হাসিঠাট্টা! করবে না কেন? বসু পরিবারের অর্ধেক আত্মীয় স্বজনই তো চীনাবাজার-কলুটোলা-মুগীহাটা-স্ট্রান্ড রোডের আশেপাশেই ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন কয়েক পুরুষ ধরে। এছাড়া বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজন ক্লাইভ স্টিট-ক্যানিং স্ট্রিট ডালহৌসির নানা সওদাগরী অফিসে চাকরি করেন। এঁরা কাজে-অকাজে হরদম আত্মীয়দের দোকানে যান। সুতরাং উলুবেড়িয়ার লাটবাড়ি খ্যাত সরকার পরিবারের পরম শ্রদ্ধেয় উত্তরাধিকারীকে অনেকেই চেনেন। খুব ভাল করেই চেনেন।

প্রফুল্লচরণে মাসশ্বশুর ও বার্ড কোম্পানির ছোট ক্যাশবাবু হীরেন্দ্রনাথ নেমন্তন্নর চিঠিটা পড়েই নিকেলের চশমাটা একটু তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি লাট্ট সরকারের নাতনীর সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

হাজার হোক বার্ড কোম্পানির ছোট ক্যাশবাবু! উঠতে-বসতে খাস বিলিতি সাহেবদের সঙ্গে কাজ-কারবার। ধুতির মধ্যে শার্ট খুঁজে উপরে কোর্ট ও পায়ে কালো বুট পরে অফিস যান। বৈঠখানায় কুইন ভিক্টোরিয়ার বিরাট ছবি। এক কথায় আত্মীয় স্বজন মহলে পাক্কা সাহেব বলেই খ্যাত। ইংরেজদের মতো কম কথার মানুষ। তবু উনি দুচারটি কথা জিজ্ঞেস না করে পারেন না। হীরেন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে বলেন, তার মানে। তোমার ভাবী পুত্রবধূ ঐ স্কাউন্ড্রেল যতের মেয়ে?

কথাটা শুনেই প্রফুল্লচরণের পিঠে একটা চাবুকের ঘা পড়ল। সারা শরীর-মন জ্বলে ওঠে কিন্তু বার্ড কেম্পানির ছোট ক্যাশবাবুর সামনে প্রতিবাদ করার সাহস হয় না। শুধু বলেন, তাঁ, যতীনবাবুর মেয়ের সঙ্গেই বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছি।

–ঐ অশিক্ষিত মুখ জোচ্চর ছোটলোকটা এখন তোমার কাছে যতীনবাবু হয়েছে?

. প্রফুল্লচরণ মাথা নিচু করে থাকেন।

-তোমরা সুখে থাকো। কিন্তু ঐ ছোটলোকের বাড়িতে আমি বরযাত্রী যেতে পারব না।

 প্রফুল্লচরণ অত্যন্ত বিনম্রভাবে নিবেদন করেন, দয়া করে অহীন্দ্রবাবুকে যাবার অনুমতি দেবেন।

–ভুলে যেও না প্রফুল্ল, অহি আমার ছেলে এবং বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ওভারসিয়ার। তারও একটা মান-মর্যাদা আছে।

-বৌভাতে…

–সে ভেবে দেখব।

একমাত্র ছেলের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়ে অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনের কাছেই প্রফুল্লচরণকে এই ধরনের কথা শুনতে হয়েছে।

চীনাবাজারে ভোলনাথ মুখার্জি অ্যান্ড সন্সের দোকানের ঠিক উল্টোদিকেই প্রফুল্লচরণের বড় শালার দোকান। সে তো নেমন্তন্ন চিঠি পড়ে হেসেই খুন।–সত্যি প্রফুল্ল, তুমি এই মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছ?

তবে কি আমি বিয়ে করছি? প্রফুল্লচরণ একটু রেগেই জবাব দেন।

বড় শালা নিবারণবাবু এবার বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, ভুলে যেও না প্রফুল্ল, বন্ধু শুধু তোমার ছেলে না, আমার ছোটবোনেরও ছেলে এবং আমি তার বড় মামা। চীনাবাজার-ক্যানিং স্ট্রিটের সবাই জানে, ভোলা মুখুজ্যের মতো শিবতুল্য মানুষটাকে যতে সকার চক্রান্ত করে একটা বেশ্যার কাছে ভিড়িয়ে দিয়ে তার ব্যবসাটা নিজের করে নেয়।

প্রফুল্লচরণ মাথা হেঁট করে বড় শালাবাবুর কথা শোনেন।

তুমি কি ভেবেছ, তুমি হয়তো কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঐ হতচ্ছাড়া ছোটলোকটার মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছ বলে আমি আনন্দে ধেই ধেই করে নাচব?

না, প্রফুল্লচরণ এবারও কোনো কথা বলেন না।

বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সঙ্কোচ না করে নিবারণবাবু সব শেষে বলেন, তোমাকে আমি সাফ জানিয়ে দিচ্ছি প্রফু, এই বিয়েতে আমাদের পরিবার থেকে কেউ যেতে পারবে না।

যতীন সরকারের মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দেবার জন্য সবাই একটু অবাক না হয়ে পারলেন না। অনেকেই সন্দেহ করলেন, য়তে সরকার নিশ্চয়ই এমনভাবে প্রফুচরণকে হাত করেছে যে এই বিয়ে না দিয়ে উপায় নেই। সে কি শুধু একশ ভরি সোনা আর এগারো হাজার টাকা নগদ? নাকি আরো কিছু?

নিবারণবাবুর স্ত্রী সব শুনে একটু মুচকি হেসে বললেন, একাদশীর ঠাকুরানী, ডুব দিয়ে খান পানি। ঠাকুরজামাই ভাবেন, আমরা আর কিছু বুঝি না। ওঁর নিজের কোনো স্বার্থ বা দুর্বলতা না থাকলে ঐ ঘরের মেয়েকে উনি পুত্রবধু করে আনেন?

নিবারণবাবুর ছোটভাই পঞ্চানন বললেন, ঠিক বলেছে বৌঠান! আমাদের এই দাদাবাবুটি যে অতীব ঘোড়েল, তা আর জানতে কারুর বাকি নেই।

বড় বৌঠান একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, ঠাকুরপো, আমি বাগনানের মেয়ে। আমার দিদি বিয়ে হয়েছে উলুবেড়ে। লাটবাড়ির ইতিহাস আমার জানতে বাকি নেই।

–শুধু আপনি কেন বৌঠান, দুনিয়ার সবাই জানে যতে সরকারের ঠাকুরদাদা লাটসাহেবের বাড়ির ডাকঘরের পিয়ন ছিল বলেই উলুবেড়ের লোক ঠাট্টা করে ওদের বাড়ির নাম দিয়েছিল লাটবাড়ি।

.

উলুবেড়ের এই লাটবাড়ি ইতিহাস সত্যি বিচিত্র। যতে সরকারের ঠাকুরদাদা গিরীন সরকার লাটসাহেবের বাড়ির ডাকঘরের পিয়নগিরি করেই পাকা সাহেব হয়ে ওঠেন। নেড়িকুকুরের মতো কিছু সাহেবকে খুশি করার জন্য উনি কোর্টে গিয়ে হলফনামা করে। নিজের নাম বদলে হন মিস্টার গ্রীন সোরকার। শুধু তাই নয়। দেশী পোশাক ত্যাগ করে কোটপ্যান্ট ধরলেন। বউ গাউন পরতে রাজি না হওয়ায় মিস্টার গ্রীন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছুঁড়িকে বিয়ে করে বৌবাজারে নতুন সংসার পাতলেন। সন্ধের পর একটু বিলিতি ওষুধের সঙ্গে সোডা মিশিয়ে দুচার গেলাস পেটে না পড়লে ওঁর কিছুতেই ঘুম আসতো না।

এইসব খবর উলুবেড়ে পৌঁছবার পর ঘরে ঘরে সে কি হাসিঠাট্টা আর আলোচনা। কেদার মিত্তিরের বৈঠকখানায় সেদিন কেউ দাবা না খেলে শুধু মিস্টার গ্রীন সোরকারকে নিয়ে হাসাহাসি করেই কাটিয়ে দিলেন। যদু মোক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমার ঠাকুমা বলতেন–

ধানের ব্যাপারী এল আফিঙের ভাউ জানতে
ঘুঁটে কুড়ানীর বেটা এল ধুতি-উড়ানি কিনতে।

উনি একটু থেমে বলেন, গিরীন হারামজাদারও হয়েছে তাই। লাটের বাড়ির ডাকঘরের পিয়ন যদি কোট-প্যান্ট পরে আর মদ খেয়ে সাহেব হতে পারতো তাহলে আর দুঃখ কি ছিল?

শুধু কর্তাদের আড্ডায় নয়, ঘোষেদের পুকুরঘাটে সারা পাড়ার বউ-ঝিদের মধ্যেও কি কম হাসাহাসি! নন্দ বোসের বউ হাসতে হাসতে বলেন–

মনে করছেন ছিদাম ঘোষ কোলে করবেন নাতি।
সে আশ্বাসে পড়ল ছাই, বউ নয় পোয়াতি।

ওঁর কথা শুনে অন্য সবাই হেসে ওঠেন। তারই মধ্যে নন্দ বোসের বউ বলেন, সরকার বাড়ির কর্তা বোধহয় ভেবেছিলেন উনি ফিরিঙ্গি মাগী নিয়ে ঘর করছেন বলে উলুবেড়ের বউঝিরা আনন্দে গাউন পরে নাচতে শুরু করবে। আঁটা মারো অমন মিনসের কপালে!

তবে উলুবেড়ের লোকজন যে যাই বলুন, গ্রীন সোরকারও কম হুঁশিয়ার ছিলেন না। ঐ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছুঁড়িকে দেখিয়ে আর লর্ড কার্জনের এক বিশ্বস্ত কর্মচারী ক্যাপ্টেন বেলকে তৈল মর্দন করে সরকারবাড়ির ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

গ্রীন সোরকার উলুবেড়ে না গেলেও তার প্রথম পক্ষের ছেলেরা নিয়মিত ওঁর বৌবাজারের বাড়িতে যাতায়াত করতেন।

–গুড মর্নিং স্যার ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন বেলকে আসতে দেখেই গ্রীন সোরকার ছত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে ডান হাত মাথায় তুলে সেলাম দেন।

–ইয়েস গ্রীন, এনি লেটার?

–স্যার ক্যাপ্টেন, নো লেটার টু-ডে বাট মাই এক্স ইন্ডিয়ান ওয়াইফ সন স্যালুট ইউ।

 ক্যাপ্টেন বেল মুচকি হেসে বলেন, কোথায় তোমার ছেলেরা?

-স্যার ওয়ান মিনিট কামিং।

একটু পরেই গ্রীন সোরকার তার ভূতপূর্ব ভারতীয় স্ত্রীর তিন পুত্রকে নিয়ে ক্যাপ্টেন বেল এর ঘরে ঢুকেই ছেলেদের বলেন, ক্যাপ্টেন স্যারকে স্যালুট কর।

ছেলেরা পিতৃ-আজ্ঞা পালন করে। তারপর গ্রীন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একে একে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দেন, স্যার, নাম্বার ওয়ান সন সতীশ ওয়ারশিপ কিংকুইন এভরিডে; নাম্বার টু সন গিরীশ পাক্কা সাহেব, রিড ইংলিশ, হেট সংস্কৃত অ্যান্ড বেঙ্গলি; ফাঁইনাল সন নীতীশ নট গো কালী মন্দির, ওয়ারশিপ গ্রেট জেসাস।

গ্রীন এখানেই থামেন না। সাহেবকে খুশি করার জন্য বলেন, স্যার অল সনস্ হেট সুরেন বাঁড়ুজ্যে অ্যান্ড পোয়েট্রি রাইটার রবীন্দ্রনাথ টেগোর।

.

বাংলাদেশে তখন হই হই ব্যাপার। আই-সি-এস পাস করা সুরেন বাঁড়ুজ্যে থেকে প্রিন্স দ্বারকানাথের নাতি রবিবাবুর কি মাথা খারাপ হয়েছে? ওঁদের মতো লোক পর্যন্ত কার্জনের মতো একজন পরম ভারত-হিতৈষীর বিরুদ্ধে সমস্ত বাঙালি জাতটাকে খেপিয়ে তুলল? যাই হোক, তখন মহানুভব সরকারের কিছু বেইমান বাঙালির দরকার। এইসব বেইমান বাঙালিদের বিচারবুদ্ধি না থাকলে আরো ভাল। সুতরাং ক্যাপ্টেন বেলএর অনুগ্রহে গ্রীন সোরকারের থ্রি সনএর রাজপূজা করার দুর্লভ সুযোগ এলো। সতীশ আর গিরীশ বেঙ্গল পুলিশে ও নীতীশ কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল হওয়ায় উলুবেড়ের লাটবাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। গ্রীন সোরকারও অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। নগদ বত্রিশ টাকায় এক ডজন স্যাম্পেনের বোতল কিনে ক্যাপ্টেন বেলএর কোয়ার্টারে হাজির হয়ে বললেন, স্যার লঙ লঙ স্যালুট টু ইউ। স্যার, ইউ গড! মাই সনস স্যালুট ইউ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাইমস্!

না, গ্রীন সোরকারের তিন ছেলেও বেইমানি করেননি, তারা ইংরেজ সরকারের সেবায় মন-প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন এবং তিনজনেই যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সতীশ কুষ্ঠিয়া বোমার মামলার এক আত্মগোপনকারী বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে এ এস আই পদে উন্নীত হয়ে মেদিনীপুরে বদলি হন। মেদিনীপুরের যেসব আদর্শভ্রষ্ট যুবকরা মহামান্য ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন, তাঁদের বিভীষিকা ছিলেন সতীশ সরকার। বিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে তার জুড়ি ছিল না সারা মেদিনীপুরে। শুধু মহিষাদল আর তমলুকেরই পাঁচজন বিদ্রোহীকে ইনি গুলি করে হত্যা করে স্বয়ং মহামান্য লাটসাহেবের হাত থেকে প্রশংসাপত্র ও পদক লাভ করেন। উলুবেড়ের লাটবাড়ির সামনের ঘরে এই অবিস্মরণীয় ঘটনার ছবি বহুকাল শোভা পেয়েছে। এখনও বোধহয় ভিতরের কোনো ঘরে সে ছবি টাঙানো আছে। মেদিনীপুরের বিপ্লবীরাও অকৃতজ্ঞ ছিলেন না।

.

সেদিন ছিল দুর্গাপূজার মহাষ্টমী। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হিংসা-দ্বেষ ভুলে মহিষাদল-তমলুকের সমস্ত মানুষ পূজার আনন্দে মেতে উঠেছেন। জেলা পুলিশের ঝান গোয়েন্দারা নিশ্চিতভাবে জেনেছিলেন, না, এখন কয়েকদিন কোনো গণ্ডগোল হবে না। সতীশ সরকার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের আগেই উলুবেড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উনি তিন দিনের ছুটি নিয়ে মহাষ্টমীর দিন সকালবেলায় তমলুক থেকে বাসে মেচেদা স্টেশনে এসে উলুবেড়ের ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেন আসার তখনও আধ ঘন্টা দেরি। তাছাড়া মহাষ্টমীর দিন! কোন বাঙালি সেদিন ঘর ছেড়ে বেরুবে? প্লাটফর্মে দু একজন যাত্রী এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। একটু পরে দুজন মাঝারি বয়সী বৈষ্ণব খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন গাইতে গাইতে প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির। কীর্তন শুনিয়ে দুএকজন যাত্রীর কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে ওঁরা সতীশ সরকারের কাছে এসেই খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন শুরু করে দিলেন।

–আঃ! কীর্তন-টির্তন বন্ধ করো। আমি ভিক্ষে দিই না। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সতীশ সরকার এই কথা বলে ডান হাত নেড়ে চলে যেতে বলেন।

বাবু, এমন দিনেও একটা পয়সা ভিক্ষে দেবেন না?

 সতীশ সরকার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, বলছি চলে যাও।

ব্যস! এক পলকের মধ্যে দুটি বৈষ্ণবের হাতে দুটি পিস্তল একসঙ্গে পরপর কয়েক বার গর্জে উঠল!

গুলির আওয়াজ শুনে রেলের বাবুরা যখন প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলেন, তখন শুধু সূতীশ দারোগার মৃতদেহ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না। হীরেন বেরা ও নগেন সামন্ত পরে প্রেপ্তার হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সে অন্য মামলায়।

এই বেইমান সর্বজনঘৃণ্য সতীশ দারোগার একমাত্র পুত্র যতীন সরকার।

.

বন্ধুর বউ-এর কথাবার্তা শুনলে এইসব ও আরো কত কি মনে পড়ে বৃদ্ধ অমূল্যচরণের।

ওঁরা তিন ভাই ছিলেন কিন্তু ছোট ভাই খুব অল্প বয়সেই মারা যান। বড় ভাই প্রফুল্লচরণের একমাত্র সন্তান এই বন্ধু। অমূল্যচরণের দুই মেয়ে কিন্তু কোনো ছেলে নেই বলে বন্ধুকেই নিজের পুত্রতুল্য স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে বড় করেছেন। বন্ধুর যত দোষই। থাক, মেজকাকা বা কাকিমাকে কোনোদিনই কোনো অপমানজনক ব্যবহার করে না এবং করবেও না। কিন্তু বেচারীর কোনো ব্যক্তিত্ব নেই বলে স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে। উমারানী মেজকাকাকে যত অপমানই করুক, তাকে একটি কথা বলারও সাহস নেই বন্ধুর।

তবে অমূল্যচরণের স্ত্রী উমারানীর বেয়াদপি একদম বরদাস্ত করেন না। উনি স্পষ্ট বলে দেন, বৌমা, ভুলে যেও না বন্ধু শুধু তোমার স্বামী না, সে আমাদেরও ছেলে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়, তাও কি বাবা-মা শেখাননি?

উমারানীও যুদ্ধ না করে পরাজয় বরণ করার পাত্রী না। উনি রান্না করতে করতেই জবাব দেন, ভুলে যাবেন না আমি উলুবেড়ে লাটবাড়ির মেয়ে। আপনাদের মতো জংলিদের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় তা সত্যি শিখিনি।

–বৌমা, আর হাসিও না। এমন বিখ্যাত বাড়িরই মেয়ে তুমি যে ঘেন্নায় কোনো আত্নীয়-স্বজন বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গেলেন না।

-তাতে আমাদের বয়েই গেছে।

–এত অহঙ্কার বা মেজাজ কোনোটাই যে ভাল না, তা কি এখনও বুঝতে পারছো না? বাপ আর মেয়েতে মিলে এই সোনার সংসারটা ছারখার করে দিলে!

একটু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুকুন্দর চায়ের দোকালে এক দল ছেলেছোকরার আড্ডা জমে উঠেছে। হঠাৎনন্দু দোকানে ঢুকতেই পটল জিজ্ঞেস করল, কিরে চাঁদুকাল সন্ধেবেলায় কোথায় ডুব দিয়েছিলি?

ঘোড়ায় চড়ার মতো বেঞ্চির দুপাশে পা দিয়ে বসে নন্দু ভুরু নাচিয়ে বলল, মাইরি, রেখা আমাকে পাগল করে দেবে। আর অমিতাভ শালা কি অ্যাকটিংই করেছে মাইরি!

কচি মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, ম্যাটিনি দেখে কী তোরা ইডেন গার্ডেনে আড্ডা দিলি?

–তোরা মানে? নন্দুও একটু মুখ টিপে হেসে বলল, তাছাড়া ম্যাটিনিতে গিয়েছি। তোকে কে বলল?

তুই বেড়াস ডালে ডালে, আমি বেড়াই পাতায় পাতায়। কচি একটু থেমে বলল, পৌনে দুটোর সময় ল্যান্সডাউন মার্কেটের ওখানে তোর কারেন্ট হিরোইনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই…

পটল হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ক্যাকটুকট! মুকুন্দদা, নন্দুর অ্যাকাউন্টে তিনটে ডবল ওমলেট আর তিনটে ডবল-হাফ চা!

–ডবল ডিমের ওমলেট না চিকেন কাটলেট খাওয়াবো! মুকুন্দদা, তিনটে ডবল হাফ চা দাও!

মুকুন্দ এক মিনিটের মধ্যে তিনটে চা ওদের সামনে দিয়ে বলে, আচ্ছা, তোরা কি এইভাবে চ্যাংড়ামি ফাজলামি করেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি?

পটল দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, জয় মা পাতালরেল!

 মুকুন্দ ওর কাণ্ড দেখে একটু না হেসে পারে না।

কচি বলল, দ্যাখো মুকুন্দদা, তুমি আর ভবানীপুর থানার লোকজন আমাদের রিয়েল ফ্রেন্ড! তোমাকে খেলাখুলি বলছি, যতদিন পাতালরেলের পুরোটা পাতালে চালু না হবে আর চন্দনদা আছে, ততদিন..:

–ওরে, চোরের দশ দিন, গেরস্থর একদিন! সেদিন কি করবি?

নন্দু চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, রামকেষ্ট-বিবেকানন্দ যা পারেনি, আমরা তাই পেরেছি। হোল বাঙালি জাতিটা ধম্মোকে ভুলে গিয়েছিল কিন্তু এই আমরাই আবার বাঙালির ধম্মা ভাব জাগিয়ে তুলেছি।

পেটল বলল, ঠিক বলেছিস! ও মুকুন্দর দিকে তাকিয়ে বলে, আগে বাঙালি দুর্গাপূজা আর কালীপূজা ছাড়া কোন পূজা করতো?

সঙ্গে সঙ্গে কচি বলল, আর স্কুল কলেজে সরস্বতী পূজা!

নন্দু একটু গম্ভীর হয়ে বলে, গুপ্তপ্রেস পাঁজিতে যত রকমের পূজার কথা আছে, সব রকম পূজা হচ্ছে শুধু আমাদেরই জন্য। এবার নন্দু একটু হেসে বলে, তুমি তো ভাল করেই জানো মুকুন্দদা, শনিঠাকুরের কৃপাতেই আমরা হেসেখেলে সপ্তাহের চার-পাঁচটে দিন কাটিয়ে দিতে পারি। আর শনিবার অমাবস্যা হলে তো পুরো মাসটাই ঠাকুরের কৃপায় কেটে যায়।

মুকুন্দ কাপ-ডিশ ধুতে ধুতেই বলে, তোদের কেলোর কীর্তি সব জানি। আমাকে আর নতুন করে বলতে হবে না। একটু নিঃশ্বাস নিয়ে ও যেন আপন মনেই বলে, তোরা কোন সব ফ্যামিলির ছেলে আর কি করে জীবন কাটাচ্ছিস!

কচি দপ করে জ্বলে ওঠে, রেখে দাও ফ্যামিলির কথা! সব ফ্যামিলির কীর্তিই আমাদের জানা আছে।

.

০২.

দত্তদের বাড়িটা সত্যি সত্যি ভাঙা শুরু হয়েছে। প্রায় শখানেক কুলি-মজুর বিরাট হাতুড়ি পিটিয়ে ভাঙছে আর ইট-কাঠ-পাথর সাজিয়ে রাখছে। চার-পাঁচজন বাবু গোছর লোক ওদের কাজ-কর্ম তদারক করছেন। কখনও কখনও মোটর হাঁকিয়ে এঞ্জিনিয়ার সাহেব মিঃ ঘোষ ঐসব বাবুদের কি সব বুঝিয়ে যাচ্ছেন। কোনদিন বিকেলের দিকে দুধের মতো সাদা ধবধবে মোটর চড়ে স্বয়ং কিশোর আগরওয়াল এসে বেশ কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটান। দুপাঁচ দিন পরপর বৃদ্ধ কেশব আগরওয়ালও একবার চক্কর দিয়ে যান।

রোজ বিকেলের দিকে দুতিনটে লরি এসে দত্ত বাড়ির ইট, দরজা-জানলা,কড়ি-বরগা আর পাথর নিয়ে চলে যায়। একদল মেয়ে-পুরুষ ছেলে-ছোকরা হাঁ করে এইসব দেখে। দেখে মুকুন্দর দোকানের খদ্দেররাও। পঞ্চু মিস্ত্রি চা খেতে খেতে বলে, জামিস মুকুন্দ, আমাদের পুব্বোপুরুষ বলাগড় ছেড়ে চলে আসে শুধু এই দত্তবাবুদের বড়ির কাজে করার জন্যি।

মুকুন্দ অন্য খদ্দেরদের চা তৈরি করতে করতেই জিজ্ঞেস করে, দত্তবাবুদের আদি বাড়ি ছিল কাটোয়ায়, তাই না?

পঞ্চু মিস্ত্রি একটা ছোট্ট চ্যাপ্টা ওষুধের কৌটো থেকে বিড়ি বের করতে করতে একটু হেসে বলে, দত্তবাবুরা আসলে অয়োরদীপের লোক; ঐ কাটোয়ার পাশেই আর কি!

মুকুন্দও এই ভবানীপুরেরই ছেলে। এইখানেই ছিল ওর পূর্ব-পুরুষের বাস। গাঁজা পার্কের পাশের রাস্তায় যেখানে ব্রাহ্মরা উপাসনা করতেন, তার কাছেই ছিল বামনদাস ঘোষের বিরাট দোতলা বড়ি। ক্লাইভ স্ট্রিট-ক্যানিং স্ট্রিটের মোড়ের কাছেই ছিল বামনদাস ঘোষের লোহা-লক্কড়ের দোকান।

বামনদাস যেমন কর্মবীর ছিলেন, তেমনই ধার্মিক ও বিনয়ী ছিলেন। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস তিনশ পয়ষট্টি দিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরেই গীতার এক অধ্যায় পাঠ না করে উনি জলগ্রহণ করতেন না। ব্রাহ্মণদের কি ভক্তিই করতেন! ভ্যাবলা বসিরহাটের রাজেন মুখুজ্যে ওঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন এবং এঁরই অনুপ্রেরণায় বামনদাস গ্রাম ছেড়ে কলকাতা এসে চিৎপুরের একটা দোকানে তিন টাকা মাইনের কর্মচারী হন। পরবর্তী জীবনে বামনদাস ওঁর ছেলেমেয়েদের বলতেন, ওরে, মার্টিনবার্নের মালিক হয়েছে বলে এখন আমাদের ভ্যাবলার রাজেনকে নিয়ে সবাই নাচানাচি করে। শেরিফ আর স্যার উপাধি পাবার পর তো ইংরেজি খবরের কাগজেও ওর ছবি ছাপা হচ্ছে কিন্তু লোকে তো জানে না অভাবের জন্য ছেলেটাকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

ছেলেমেয়েরা এ গল্প বহুবার শুনেছে। আবার শুনতে ভালও লাগে না কিন্তু তবু চুপ করে বাবার কথা শোনে।

রাজেন তখন ঠিকাদারী করে। একদিন আমাকে বলল, বামন, তোমাকে ব্যবসা বাণিজ্য করতে হবে এবং তার জন্য অভিজ্ঞতা চাই। তাই তো আমি চিৎপুরের দত্ত কোম্পানির তিন টাকা মাইনের চাকরি নিলাম।

বামনদাস একবার বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, হাজার হোক বামুনের ঘরের ছেলের রাজেনের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।

এই স্যার আর. এন. মুখার্জির উৎসাহে ও পরামর্শে বামনদাসও ব্যবসা-বাণিজ্য করে রীতিমত ধনী হন কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাঁরই ছোট নাতি মুকুন্দ এখন চায়ের দোকান চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে। তা হোক। কিন্তু ও ছোটবেলায় কয়েকটা বছর বাড়িতে ম্যানেজারবাবু না দেখলেও বাজার সরকার দেখেছে, একটা লম্বা মোটরগাড়ি দেখেছে। বাড়িতে দুর্গাপূজা হবার কথাও একটু একটু মনে পড়ে। সে যাই হোক, মুকুন্দর স্পষ্ট মনে আছে, বাজার সরকার শ্রীহরিবার থেকে শুরু করে ঝি-চাকরদেরও বাড়ি ছিল। বসিরহাটে। ভবানীপুরের লোকজন তো ওদের বাড়ির নামই দিয়েছিল বসিরহাটি ঘোষের বাড়ি। তাই পঞ্চু মিস্ত্রির কথা শুনে ও অবাক হয় না।

পঞ্চু বিড়ি ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলে, ঠাকুমার কাছে শুনেছি, এই দত্তবাড়ি তৈরি হবার সময় এক কর্তা শুধু পছন্দমতো কাঠ কেনার জন্য জাহাজে চড়ে বার্মা মুল্লুকে চলে গিয়েছিলেন। আরেক কর্তা পাথর কেনার জন্য গেলেন উত্তর না পুবে।

ওর পিছন দিক থেকে কার্তিক বলে, তখনকার দিনের কর্তাদের ব্যাপারই ছিল আলাদা।

-সত্যিই তাই। পঞ্চু খুব জোরে বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বলে, ঐ ঠাকুমার কাছেই শুনেছি, দত্তবাড়ির বউরা দুগ্নপূজার সময় রোজ এক একখানা নতুন বেনারসী পরতেন।

মুকুন্দ কথাটা শুনে আপনমনেই হাসে।

পঞ্চু একটু থেমে আবার বলে, তবে হ্যাঁ, মিথ্যে কথা বলব না। দত্তবাড়ির কর্তাবাবুরা আমাদের মতো দেশের লোকজনকেও যথেষ্ট দেখাশুনো করতেন। ঐ বাড়ির খেয়েপরেই তো বাপ-ঠাকুদ্দার সংসার চলেছে।

.

দুপুরবেলার দিকে বুড়ি কামিনীবালা মুকুন্দকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, হারে নাতি, দত্তদের বাড়িটা নাকি ভাঙছে?

-হ্যাঁ, ঠাকুমা।

–ঐ বিনু হতচ্ছাড়াটা তো সত্যি কথা বলতে শেখেনি, তাই শুনে ভাবলাম তোকে জিজ্ঞেস করলে খাঁটি খবরটা জানা যাবে।

–হ্যাঁ ঠাকুমা; ওরা পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ওখানে নতুন করে বড় বাড়ি তৈরি করবে।

কামিনীবালা অবাক হয়ে বলেন, অমন সুন্দর বাড়িটা ভাঙারই বা কী দরকার আবার নতুন করে তৈরিই বা করবি কেন?

মুকুন্দ বলে, ঠাকুমা, আজকাল তো ঐ ধরনের বাড়ি কেউ তৈরি করে না, নতুন ধরনের….

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বুড়ী দুহাতের দুটো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেন, আজকালকার লোকদের মুরোদ থাকলে তো ঐ ধরনের বাড়ি বানাবে! 

মুকুন্দ এন্টু হেসে বুড়িকে সমর্থন জানায়।

-বুঝলি নাতি, ঠাকুরের কাছে শুনেছি, আমাদের এই বাড়ি আর দত্তদের বাড়ি একই বিলেত-ফেরত ইঞ্জিন-ইয়ার বানায়। এই দুই বাড়ির জানলা-দরজা কড়ি-বরগার কাঠ কেনার জন্য ঐ বাড়ির এক কর্তা জাহাজে করে বার্মা দেশে যান, আর পাথরটাথর কেনার জন্য এই বাড়ির এক জামাইকে বিলেতে পাঠানো হয়।

–দুই বাড়ির তো দারুণ ভাব ছিল!

বুড়ি চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, ভাব ছিল মানে — দারুণ ভাব। উনি এক থেমে বলেন, ঠাকুরের কাছেই শুনেছি..

মুকুন্দ কথার মাঝখানেই কথা বলে, শুনেছি, আপনার শ্বশুর এখানে থাকতেন না

আমার বিয়ের দশ বারো বছর আগেই ঠাকুরের স্ত্রীবিয়োগ হয়। কামিনীবান এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু চাপা গলায় বলেন, উনি গলায় দড়ি দিয়ে মারা যান বুঝলি?

-তাই নাকি?

–হ্যাঁরে, মনের দুঃখে উনি গলায় দড়ি দেন।

মুকুন্দ মুখে কিছু বলে না। শুধু ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।

কামিনীবালা মুখ নেড়ে চোখ বড় বড় করে বলেন, ঠাকুর কদাচিৎ কখনও কলকাতা আসতেন; তা নয়ত সারা বছরই কাশীর বাঈজীকে মানে একটা মেয়েছেলে নিয়ে থাকতেন।

শুনে মুকুন্দ অবাক হয় না। ও মনে মনে বলে, তখন তো অনেক বাড়ির অনেক কর্তারই এই গুণ ছিল!

শুধু কী তাই? ঠাকুর নেশা-টেশা করে এলেই স্ত্রীকে নাকি খুব মারধর করতেন। বুড়ি কোনোমতে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, এই গোলাপী বাড়ির কোনো পুরুষ তো আমার কর্তার চাইতে বেশি আমোদ-আহ্লাদ করেনি কিন্তু যত নেশা করে যত রাত্তিরেই বাড়ি ফিরুন উনি আমার সঙ্গে কি অসম্ভব ভাল ব্যবহার করতেন, তা তোরা ভাবতে পারবি না।

মুকুন্দ খুব ভাল করেই জানে, বুড়ি যখন পুরনো দিনের কথা বলেন, তখন চট করে থামেন না। থামতে পারেন না। থামবেন কি করে? সেই পুরনো দিনের কিছু ধূসর স্মৃতি ছাড়া ওঁর আছে কী?

কামিনীবালা একটু থেমে মুখ-চোখ নেড়ে বলেন, মাথার উপর ঠাকুর আছেন মিথ্যে বলব না। আমরা বউরা যখন কাশী যেতাম, তখন ঠাকুর আমাদের জন্য কি না করতেন! পুত্রবধূদের উনি সত্যি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন।

সব মানুষেরই কিছু গুণ তো থাকে। এতক্ষণ পর মুকুন্দ প্রথম কথা বলে।

–সে তো একশবার। বুড়ি মায়া নেড়ে সমতি জানিয়ে বলেন, দত্তবাড়ির মেজ কর্তার কত দুর্নাম ছিল। তবে উনি এই বাড়ির ছোটকর্তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন–যাকে বলে হরিহর আত্মা……

কথাটা শুনে মুকুন্দ একটু না হেসে পারে না।

–হাসছিস কিরে! এবার বুড়ি একটু হেসে বলেন, কখনও কখনও দুজনে মিলে কি কাণ্ডটাই না করতেন। কিন্তু দুজনেই কী উদার ছিলেন। ওঁদের কৃপায় অনেক ঝি চাকররাও এই কলকাতা শহরে বাড়ি-ঘর বানিয়ে নিয়েছে।

না, কামিনীবালা মিথ্যে বলেননি। তবে সে ঔদার্যের পিছনেও একটা কারণ ছিল। স্বার্থ ছিল। বিকৃত চিত্তবিনোদনের উপকরণ ছিল।

.

সে যাই হোক, বনবিহারী দত্ত কত শখ করে ভবানীপুরের বনেদী পাড়ায় যে ছোটোখাটো প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেই বাড়ি এখন ভাঙা হচ্ছে। নতুন মালিক এখানে নাকি আধুনিক ও আরো বড় বাড়ি তৈরি করবেন। সত্যি মানুষ ভাবে। এক, হয় এক। এমন দিন যে কখনও আসবে, তা কে ভেবেছিলেন।

কেউ না। পরিবারের লোকজন তো দুরের কথা, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীদের সবাই বলাবলি করতেন, দামোদর দত্ত ও তার পুত্র বনবিহারী দত্ত তাদের পারিবারিক যে ব্যবসা বাণিজ্য ধন-সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন, তা দশ পুরুষেও শেষ করতে পারবে না। তবে কথায় যে বলে, মানুষই লক্ষ্মী, মানুষই ঝক্কি। এই একটা পরিবারে কত অঘটনই ঘটল!

.

অগ্রদ্বীপের দত্ত পরিবারের সৌভাগ্যের প্রথম বুনিয়াদ রচনা করেন-নীলমণি দত্ত। কোম্পানির আমলের শেষ অধ্যায়ে বন্ড সাহেবের উনি সরকারবাবু ছিলেন; অর্থাৎ বন্ড সাহেবের সংসারের খানসামা, বাটলার, রাঁধুনি, ধোপানাপিত, ঝি-চাকর, দারোয়ান কোচোয়ান, বেয়ারা, খিদমতগার থেকে মালি ভিত্তি পর্যন্ত সব কর্মচারীর সর্বময় অধিকর্তা ছিলেন। কোম্পানির আমলে অন্যান্য সাহেবদের মতো বন্ড সাহেবও ব্যবসা বাণিজ্য জাল জুয়াচুরি করে দশ হাতে আয় করতেন। অন্য সাহেবদের মতো ইনিও মেমসাহেবকে এ দেশে আনেননি, মেমসাহেবও এই মশা-মাছি ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের দেশে আসতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাননি। তাই তো কোম্পানির অন্য সাহেবদের পদাঙ্ক ও দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বন্ড সাহেবও দেহ ও মনের দাবি মেটাবার জন্য দুটি নেটিভ রক্ষিত রেখেছিলেন। এই তিনটি সংসারের চেয়ার-টেবিল খাট-বিছানা থেকে শুরু করে শেরি-স্যাম্পেন-হুঁইস্কি মাছ-মাংস তরিতরকারি কেনার সব দায়িত্বই এই নীলমণির উপর ছিল। এবং প্রতিটি জিনিস কেনার জন্যই সরকারবাবু দোকানদারদের কাছ থেকে ভালরকম দস্তুরি পেতেন। এমন কি কোন ফেরিওয়ালা সাহেবের কুঠিতে ঢুকলেও ওর কিঞ্চিৎ প্রাপ্তিযোগ ঘটত। মাইনে আর কমিশন ছাড়াও চুরি-চামারি করে নীলমণি ভাল আয় করতেন।

কিন্তু বেচারা নীলমণি চিনির বলদের মতো সারাজীবন এই দস্তুরি আর চুরি চামারির নেশায় এমনই মশগুল ছিলেন যে উপভোগ করার সুয়োগ ও মন দুটোই হারিয়ে ফেলেন। নীলমণি দত্তর চোদ্দটি সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন দামোদর এবং ইনি একদিন ভাগ্যের সন্ধানে হাজারখানেক ভরি সোনা নিয়ে কলকাতা চলে আসেন।

.

দামোদর যেমন কর্মবীর তেমনই বুদ্ধিমান ছিলেন। উনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। তাই তো উনি কিছুকাল কলকাতার বাজারে ঘোরাঘুরি পর একদিন সমস্ত সোনা বিক্রি করে থলিভর্তি টাকা নিয়ে সাসেক্স এঞ্জনিয়ারিংকোম্পানির বড় সাহেবের কাছে হাজির হয়ে সবিনয়ে নিবেদন করলেন, স্যার, আমি আপনার কোম্পানির মালপত্র বিক্রি করতে চাই।

সাহেব ওঁকে প্রশ্ন করলেন, টুমি বিজনেস করতা হ্যায়?

-নো সাহেব, নো। দিস মানি স্টার্ট বিজনেস।

বাট….

 দামোদর সোজাসুজি বললেন, স্যার নো বাট। আই গুড ম্যান, ইউ মাই গড।

 সাহেব একবার ওর দিকে তাকিয়ে একটু ভাবেন। তারপর একটু হেসে বললেন, অল রাইট ডামোডর, ইউ স্টার্ট বিজনেস, হাম মদত কোরবে।

সেই শুরু! দামোদর তার নিষ্ঠা, সততা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা এক বিরাট সম্ভাবনার ভিত্তি রচনা করেন। দামোদরের এগারটি সন্তানের মধ্যে মাত্র তিনটি পুত্র ছিল। এবং এই তিনটির মধ্যে একটি পুত্র কৈশোরেই মারা যায়। নিজের সংসারে দায়-দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও ইনি বিডন স্ট্রিটের সাড়ে তিন কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। শুধু তাই নয়। অগ্রদ্বীপেও বিরাট পাকাবাড়ি তৈরি করে দেন। উনি ষে পূজামণ্ডপ তৈরি করেন, সেখানেই পরবর্তীকালে পোস্ট অফিস হয়। পোস্ট অফিস নতুন বাড়িতে উঠে যাবার পর এই পূজামণ্ডপকে গুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়া শুরু হয়।

 দুঃখের বিষয়, দামোদরের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই তাঁর দুই ছেলের বিবাদ চরমে ওঠে। বিশিষ্ট উকিল ও প্রতিবেশী অমৃতবাবুর মধ্যস্থতায় সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়। এই ভাগাভাগির ফলে বনবিহারী পান ক্লাইভ স্ট্রিটের ব্যবসা আর মাত্র পনের হাজার টাকা। বাকি সব-স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পান তার ভাই রাসবিহারী।

বনবিহারীও তার বাবার মতোই সৎ, নিষ্ঠাবান ও সর্বোপরি অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। বড় বড় কোম্পানির সাহেবরা সত্যি ওঁকে খুব পছন্দ করতেন।

স্বামী ও ছেলেমেয়ে বেরিয়ে যাবার পরও কণিকা দেবীকে সংসারের টুকিটাকি কাজে ঘণ্টাখানেক ব্যস্ত থাকতে হয়। অঘোরনাথ হঠাৎ ভিতর এসে বলেন, কী ছোট মা, তুমি খাওয়া-দাওয়া করবে না?

–হ্যাঁ ছোটকাকা, এখনি খাবো; আপনি বসুন। কণিকা এবার রান্নাঘরের দিকে মুখ করে বললেন, সরলা আমাকে খেতে দাও।

অঘোর বাঁড়ুজ্যে অত্যন্ত নিয়মকানুন মেনে চলেন। পৌনে আটটা থেকে আটটার মধ্যে উনি ব্রেকফার্স্ট খান। ব্রেকফার্স্ট মানে অবশ্য এক গেলাস দুধ আর একটা শশা। শশা না পাওয়া গেলে অন্য কোনো ফল। তবে অন্য কিছু নয়। কখনই নয়।

অঘোরনাথের দীর্ঘ কর্মজীবন কেটেছে বাংলার বাইরে। মিলিটারি অ্যাকাউন্টসএর কৃপায় উনি ঘুরছেন পেশোয়ার থেকে এলাহাবাদের মধ্যবর্তী এলাকায়। পেশোয়ার, আম্বালা, মীরাট, দিল্লি প্রভৃতি শহরে। এরই মধ্যেই কয়েক বছর কাটিয়েছেন পুনা আর বোম্বতে। উনি বাংলাদেশের বাঙালিদের মতো শুধু অসুখ বিসুখ হলেই ফল খান না। উত্তর ভারতের লোকজনদের মতো প্রতিদিন ওঁর ফল খাওয়া চাই-ই। নীতীশ জানেন, ছোটকাকা ফল খেতে ভালবাসেন; তাই উনি অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায় নিয়মিত কিছু ফল কিনে আনেন। তবে অঘোরনাথের পাল্লায় পড়ে এখন এ বাড়ির সবাইকে রোজ একটু-আধটু ফল খেতে হয়। নীতীশ অফিস বেরুবার আগেই উনি কণিকা দেবীকে রলেন, ছোট, মা নীতুর ব্রিফকেসে একটা আপেল দিয়েছ?

-হ্যাঁ ছোটকাকা, দিয়েছি।

নীতু, বাবা আপেলটা খেতে ভুলে যাস না।

না, না ভুলব না ছোটকাকা।

কণিকা একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলেন, জানেন ছোটকাকা, ও মাঝে মাঝেই ফল খেতে ভুলে যায়।

কদাচিৎ কখনও ভুলে…

না, নীতীশকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অঘোরনাথ বলেন, না বাবা, ভুলে যাস না। রোজ একটু আধটু ফল খেলে দেখবি, অসুখ-বিসুখ হবে না।

অবশ্য নীতীশের ছেলেমেয়ে-সন্দীপন আর শর্বরীর মাথায় ওদের ছোটদাদু ঢুকিয়েছেন, ফল খেলে চেহারা সুন্দর হয়। ফল আর দুধ খাওয়ার জন্যই তো মুনি ঋষিদের দেখতে এত সুন্দর ছিল। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একটা বয়স আসে যখন সে সুন্দর হতে চায়, আরো সুন্দর হতে চায়। এ বাড়িতে একমাত্র কণিকাই ফল খেতে পছন্দ করেন না কিন্তু অঘোরনাথের পাল্লায় পড়ে তারও মুক্তি নেই।

কণিকার ব্রেকফাস্টের সময় অঘোরনাথ রোজ ওঁর পাশে বসবেন এবং কিছু ফল ওঁকে খেতেই হবে। শর্বরী বাড়ি থাকলে ও মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলে, জানো দাদু, তুমি সামনে না থাকলে মা কোনো ফল মুখে দেয় না।

কণিকা হাসিমুখেই মেয়েকে বকুনি দেন, তুই চুপ কর বাঁদর মেয়েএবার উনি গম্ভীর হয়ে বলেন, তোর দাদুকেই জিজ্ঞেস কর, আমি ওঁর কোনো কথা অমান্য করি কি না।

অঘোরনাথ দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, আমি কার দলে যাই? একদিকে আমার মা, অন্যদিকে আমার চিরজীবনের জীবনসঙ্গিনী!

সে যাই হোক, কণিকার ব্রেকফার্স্ট করার সময় অঘোরনাথ রোজ এক কাপ কফি খান এবং দুজনে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেন। নানা বিষয়ে ওঁদের কথাবার্তা হয়! অঘোরনাথের ছেলেবেলায় গল্প, কর্মজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা, নীতীশের ছাত্রজীবনের কাহিনী। আরো কত কি! কখনও কখনও সন্দীপন আর শর্বরীকে নিয়েই ওঁদের কত আলোচনা হয়।

আজ ডাইনিং টেবিলে বসেই অঘোরনাথ বললেন, জানো ছোট মা, দত্তদের বাড়িটা ভাঙছে দেখে মনে মনে খুশিই হচ্ছি।

-খুশি! কণিকা অবাক হয়ে বলেন।

-দেখ ছোট মা, এ সংসারের সবকিছুরই কারণ থাকে। মানুষের উন্নতিরও যেমন কারণ থাকে, অবনতিরও কারণ থাকে।

এবার কণিকা মাথা নেড়ে বলেন, সে তো বটেই!

-কনবিহারী দত্ত আমার জন্মের বহু আগেই এই বাড়ি তৈরি করেন। শুনেছিলাম, সরকারদের বাড়ি আর এঁদের বাড়ি একই এঞ্জিনিয়ার তৈরি করেন। আমি ছোটবেলায় বনবিহারী দত্তকে বেশ বৃদ্ধই দেখেছি কিন্তু ঐ বয়সেও উনি যা পরিশ্রম করতেন তা তুমি ভাবতে পারবে না।

ছোট কাকার গল্প শুনতে কণিকার ভালই লাগে। কত কি জানা যায়! তাছাড়া বৃদ্ধ হলেও বেশ আধুনিক মনের মানুষ।

অঘোরনাথ বলে যান, ঐ বৃদ্ধের মধ্যে একটা সাধনা ছিল, প্রতিজ্ঞা ছিল। ক্লাইভ স্ট্রিটের একটা ছোট্ট দোকান থেকে উনি কি বিরাট ব্যবসা গড়ে তোলেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।

–উনি নাকি লেখাপড়া বিশেষ জানতেন না? এতক্ষণ পর কণিকা প্রশ্ন করেন।

–আগে উনি সত্যি বিশেষ লেখাপড়া জানতেন না। এমন কি ইংরেজিতে নিজের নাম পর্যন্ত সই করতে পারতেন না কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য একটু গুছিয়ে নেবার পর উনি ছোটদাদুর কাছে পড়াশুনা শুরু করেন।

দুজনেই কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দেন। কণিকা জানতে চান, পড়াশুনা শুরু করেন মানে?

অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, সে এক মজার ঘটনা। ছোটদাদুই একদিন ওঁকে বলেন, বনবিহারী, ব্যবসা-বাণিজ্য তো ভালই করছ কিন্তু একটু লেখাপড়া না শিখলে যে বেশি উন্নতি করতে পারবে না।

কণিকা আবার একটু জিজ্ঞেস করেন, শুনেছি, ওঁর নাকি বাতিক ছিল সবাইকে লেখাপড়া শেখানো?

–বাতিক মানে? প্রচণ্ড বাতিক।

–আপনাদের এক বুড়ো চাকরকেও নাকি উনি নিজে পড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট…

অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, না, না, তুমি একটু ভুল শুনেছ। রামদুলাল বলে আমাদের বাড়ির এক চাকরকে ছোট দাদু নিজে পড়িয়ে ম্যাট্রিক পাস করান। তারপর ওকে ইউনিভারসিটিতে একটা চাকরি দেবার জন্য ছোটদাদু স্যার আশুতোষকে ধরেন।

উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, স্যার আশুতোষ ওকে চাকরি দিয়েছিলেন এই শর্তে যে ও গ্র্যাজুয়েট হবে।…

–রামদুলাল কি শেষ পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েট হন?

–রামদুলাল বোধহয় একবারেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে কিন্তু একবার বা দুবার ফেল করার পর বি. এ. পাস করে।

বনবিহারী দত্তকেও উনি ম্যাট্রিক বা…

কণিকাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই উনি বলেন, না, না, উনি ম্যাট্রিক পাস করেননি, গ্র্যাজুয়েট ও হননি; তবে উনি রোজ সকালে ছোটদাদুর কাছে পড়তে আসতেন।…

–তখন ওঁর কত বয়স?

হবে চল্লিশ-পঞ্চাশ।

–আচ্ছা!

অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, উনি শেষ পর্যন্ত এত ভাল ইংরেজি শিখেছিলেন যে বড় বড় সাহেবরাও অবাক হয়ে যেতেন। শেক্সপিয়র-মিলটন-বায়রন তো ওঁর কণ্ঠস্থ ছিল।

-বলেন কী?

–বলছি তো ছোট মা, ওঁর মধ্যে একটা নিষ্ঠা ছিল, সততা ছিল, যা ওকে বড় করেছিল। অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, শুধু বদমাইশি আর চালিয়াতি করে ওঁর নাতি-নাতনীরা সব ধ্বংস করে দিল।

–ওঁর ছেলেমেয়েরা ব্যবসা নষ্ট করেননি?

না, না, ওঁর ছেলেরা কিছু নষ্ট করেননি; ওঁর নাতি-নাতিরাই সব উড়িয়ে দিল।

তবে যে শুনি, বনবিহারী দত্তর এক ছেলে বাঈজীবাড়িতেই পড়ে থাকতেন।

অঘোরনাথ একটু মুচকি হেসে বলেন, শ্মশানে যাঁরা পড়ে থাকেন, নেশা করেন, তাঁদের মধ্যে দুএকজন তো তান্ত্রিকও থাকতে পারেন।

 -সে তো একশবার।

বনবিহারী দত্তর ছোট ছেলে শুধু বাঈজীবাড়ি যেতেন না, বাড়িতেও বাঈজী নিয়ে আসতেন; তবে তিনি চরিত্রহীন ছিলেন না। গান-বাজনার জন্যই বাঈজী বাড়ি যেতেন, গান-বাজনা শোনার জন্যই তাদের মজলিশ বসতো এই দত্তবাড়ির ছাদে।

উনি একটু থেমে বলেন, তবে বনবিহারী দত্তর ছেলেরা ইন্টারেস্টিং মানুষ ছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের পক্ষে যত সর্বনাশেরই হোক, বনবিহারী দত্ত এই যুদ্ধের কৃপায় রাজা হয়ে যান। শুধু অর্থই না, যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্র নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করার জন্য বড় বড় ইংরেজ আমলাদের বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেন। বনবিহারী সম্রাটের যুদ্ধ তহবিলেও মোটা টাকা দান করেছিলেন বলে স্বয়ং লাটসাহেব ওঁকে ধন্যবাদ জানান। পরের বছরই উনি রায়বাহাদুর খেতাব পান।

এই রায়বাহাদুর খেতাব পাবার পরই উনি একটু বদলে যান। ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে নতুন মোটরগাড়ি কিনলেন। ছেলেদের উপর ব্যবসা-বাণিজ্যের ভার দিয়ে নিজে সাহেব সুবাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করলেন। শুধু তাই নয়। দেশি পোশাক ছেড়ে সাহেবি পোশাক ধরলেন। তবে হ্যাঁ, ছেলেরা কে কী করছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে কোথায় কী হচ্ছে, তার উপর যোল আনা নজর রাখতেন রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত।

বনবিহারী পাঁচটি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে ছিল। এ ছাড়া তিনটি সন্তান শৈশবেই মারা যায়। পাঁচটি মেয়ের ও তিনটি ছেলের বিয়ে আগেই দিয়েছিলেন। রায়বাহাদুর খেতাব পাবার পর চতুর্থ পুত্রের বিয়ে দেন। সে এক এলাহি ব্যাপার! বিয়েব এক মাস আগে ইম্পিরিয়্যাল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সব চাইতে দামী রং দিয়ে পুরো বাড়ি নতুন করে বং করা হলো। পাড়ার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছাড়াও কলকাতা শহরের প্রত্যেকটি গণ্যমান্যবরেণ্য ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করলেন রায়বাহাদুর। তারপর বিয়েব কদিন আগে রটে। গেল, স্বয়ং লাটসাহেব আসবেন বৌভাতের নেমন্তন্ন খেতে। পরের দিন থেকেই পুলিশ আর কর্পোরেশনেব বড়কর্তাদের আসা-যাওয়া শুরু হলো। লাটসাহেবের সম্মানে ভবানীপুরের সুন্দর রাস্তাগুলোকে আরো সুন্দর ঝকঝকে করে তুলল কর্পোরেশনের লোকজন। লাটসাহেবের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কোচবিহার কাশিমবাজার-নাটোর-দীঘাপতি প্রভৃতির রাজারাও ঠিক করলেন, রায়বাহাদুরের পুত্রের বৌভাতে উপস্থিত থাকবেন।

হ্যাঁ, সেই উৎসবের দিনে ওঁরা সবাই রায়বাহদুরের বাড়িতে এসেছিলেন।

ঐ উৎসবের বাড়িতেই লাটসাহেব এ কথা-সে কথার পর বনবিহারী দত্তকে বললেন, বাই দ্য ওয়ে রয় বাহাদুর, আপনি তো তিন জেনারেসন ধরে বহু বিখ্যাত ব্রিটিশ এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির মেসিনারি বিক্রি করছেন আর এখানে নিজেও অনেক জিনিস তৈরি করছেন।

–আপনার আশীর্বাদে ইয়েস ইওর একসেলেনসি!

–আজ গভর্নমেন্ট হাউসে একটা মিটিং-এ ঠিক হয়েছে আমরা অল ওভার বেঙ্গল কয়েকটা ব্রিজ তৈরি করব।

–ইওর একসেলেনসি, ভেরি গুড ডিসিসন।

লাটসাহেব একটু মাথা দুলিয়ে বললেন, সো আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং আপনার মত এক্সপিরিয়েন্সড ফার্ম যদি দুচারটে ব্রিজ তৈরি করে তাহলে তো ভালই হয়। হিজ একসেলেনসি এক মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলেন, সোকন্ড কন্ট্রাকটরকে দিয়ে আমি এই ব্রিজ তৈরি করাতে চাই না।

সকৃতজ্ঞ রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত একগাল হাসি হেসে সবিনয়ে নিবেদন করলেন, হিজ একসেলেনসি দয়া করে যে দায়িত্ব দেবেন, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব।

বনবিহারী দত্ত রায়বাহাদুর খেতাব পাবার পর সাহেবি পোশাক পরে মোটরগাড়ি চড়ে সাহেব-সুবা রাজা-মহারাজাদের পার্টিতে যেতেন বলে কত লোক হাসাহাসি করেছে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অনেকেই বলাবলি করতেন, এবার চালিয়াতি করেই বনবিহারী দত্ত সব উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু ওঁরা জানতেন না, বনবিহারী দত্তর রক্তের মধ্যে ব্যবসা ছিল। উনি শয়নে-স্বপনেও শুধু ব্যবসার কথাই ভাবতেন।

উনি মারা যাবার পর ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ওঁর সম্পর্কে নানা কাহিনী সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলতেন, উনি ফুলশয্যার রাত্তিরে স্ত্রীকে নিয়ে শুতে যাবার আগে বিয়ে-বৌভাতের খরচপত্তর হিসেব করতে বসেছিলেন।

এ কাহিনীর সত্যাসত্য কেউ সঠিকভাবে বলতে না পারলেও একথা সর্বজনবিদিত ছিল যে হিসেব নিকেশ না করে বোধহয় বনবিহারী দত্ত হাঁচি-কাশিও দিতেন না।

একবার নাকি ওঁর স্ত্রী মানদাসুন্দরী স্বামীর কাছে আর্জি পেশ করেছিলেন, ভগবান তো আপনাকে এত দিচ্ছেন, বাড়িতে একটা রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করুন না।

বনবিহারী বুঝি জবাব দিয়েছিলেন, গিন্নি, বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলে আমার শুধু খরচই বাড়বে, কোনো আয় হবে না। তার চাইতে দুর্গাপূজা করা। এমন দুপাঁচশ লোককে নেমন্তন্ন করা যাবে, যারা আমার ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারেও সাহায্য করবেন।

–আপনি জানেন না, আমাদের চোদ্দপুরুষ রাধাকৃষ্ণের চরণাশ্রিত? মানদাসুন্দরী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, আমি কি শক্তিপূজা কবার কথা বলতে পারি?

.

সরকারবাড়ির বড় গিন্নিমা কুসুমকুমারী দাসী ছিলেন মানদাসুন্দরীর সই। খুব ভাব ছিল দুজনের। রোজ একবার করে দুজনের দেখা না হলে রাত্তিরে কারুরই ঘুম আসতো না। সে সময় একবার নাকি দুতিনটে খারাপ গ্রহ-নক্ষত্রের যোগাযোগে সারা বাংলাদেশে প্রবল বন্যা হয়েছিল। সাহেব-মেমসাহেবরা পর্যন্ত চৌরঙ্গিতে নৌকো চড়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশেষ করে একদিন এমন দুর্যোগ দেখা দিল যে সেদিন দত্তবাড়ি থেকে সরকারবাড়ি যাওয়া অসম্ভব অকল্পনীয়। মাঝরাত্তিরে মানদাসুন্দরী হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বড়, ছেলের কাছে এসে বললেন, বড়, আজ সারাদিনে একবারও তোমার সইমার মুখ দেখতে পাইনি বাবা। তুমি যেভাবেই পারো আমাকে এবার ওর কাছে নিয়ে চলো।

মানদাসুন্দরীর মৃত্যুর বহু বছর পর কুসুমকুমারী নাতি-নাতনীদের কাছে সে রাত্তিরের গল্প করতে করতে একগাল হাসি হেসে বলেন, জানিস সে রাত্তিরে সই কীভাবে আমার কাছে এসেছিল?

কীভাবে?

সরকারবাড়ির বড় গিন্নি হাসতে হাসতে বলেন, দত্তবাড়ির পশ্চিমী দারোয়ানদের ঘর থেকে একটা চৌকি বার করে তার উপর সইকে বসিয়ে ছাতি নিয়ে ওর ছেলে পাশে বসেছিল। তারপর চারজন পশ্চিমী লোক সে চৌকি মাথায় করে নিয়ে এসেছিল এ বাড়িতে।

-বলো কী ঠাকুমা?

-ওরে হ্যাঁ, ঐভাবেই ও এসেছিল। আমাকে না দেখলে কি ওর ঘুম হতো? নাকি দেখে আমি ঘুমুতে পারতাম? কুসুমকুমারী লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, শুধু সই এর জন্যই তো আমি মরতে পারিনি।

নাতি-নাতনীদের মধ্যে কে একজন বলল, তার মানে?

না, কুসুমকুমারী ওদের কিছু বলেননি। বলতে পারেননি। হাজার হোক স্বামীর নিন্দা কি করা যায়? কথায় বলে, পতি দেবতা। স্ত্রীলোকের সাক্ষাৎ ভগবান! তার নিন্দা করলে জিভ খসে পড়বে না! উনি কোনোদিন কাউকেই কিছু বলেননি। পতিদেবতার নিন্দা নয়, নিজের মনের দুঃখের কথা উনি শুধু সইকেই বলতেন। না বলে থাকতে পারেননি। মানুষ তার সুখ-দুঃখের কথা কাউকে না কাউকেই বলবেই। না বলে থাকতে পারে না।

-জানিস সই, দুঃখের কথা তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলব? ফিসফিস করে কুসুমকুমারী বলেন, কর্তা কাশীতে যে বাঈজীকে নিয়ে থাকেন, সে আসলে আমার বড় বউয়ের বড় বোন।

–সেকি সই? মানদাসুন্দরী চমকে ওঠেন।

তবে আর বলছি কী সই? কুসুমসুন্দরী একবার বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমি আর কর্তা গিয়েছিলাম শ্রীরামপুরে বড়ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে। মেয়েটির রূপ গুণের কথা অনেক দিন ধরেই আমরা শুনেছিলাম কিন্তু মেয়েটিকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে আমরা একেবারে থ!

-কেন?

–ওর যে রূপ-গুণের কথা শুনেছিলাম, তার চাইতে হাজার গুণ ভাল ওকে দেখতে। গুণের কথা আর কী বলব সই?

মানদাসুন্দরী চোখ বড় বড় করে বলেন, ও এত সুন্দরী?

–হ্যাঁ সই। লক্ষ্মী-সরস্বতী তো দূরের কথা, স্বয়ং মা দুর্গাও ওর রূপের কাছে হার মানবেন। কুসুমকুমারী ঠোঁট উল্টে বলেন, আর কি গড়ন ভাই! সারা অঙ্গ দিয়ে মধু ঝরছে।

-তারপর?

–তারপর আবার কী? ওকে দেখে তো কর্তার মাথা ঘুরে গেল।

–ইস! কী কেলেঙ্কারি!

 কুসুমকুমারী সইয়ের মুখে পান দিয়ে নিজেও একটা পান মুখে নেন। তারপর দোক্তা মুখে দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে বলেন, অত রূপ-গুণ থাকলে কী হয়, শুধু অভাবের জন্য মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছিল না ওর বাপ!

-তাই নাকি?

–গরিব না হলে কি ওর বাপ কর্তার খপ্পরে পড়তো?

–তা ঠিক। মানদাসুন্দরী একবার পানের পিক ফেলে একটু মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, তারপর কর্তা কী করে মেয়েটিকে হাত করলেন?

-কর্তা ওর বাপকে বললেন, কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার এ মেয়ের সঙ্গে আমি ডেপুটির বিয়ে দেব; তবে থাকে পশ্চিমে। হয়তো মেয়েকে ওখানে নিয়ে গিয়েই বিয়ে দিতে হবে কিন্তু তার জন্য ঘাবড়াবেন না। আমি বিয়ের সব খরচপত্তর দেব। আর আপনার দ্বিতীয়া কন্যাকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। তার জন্যও আপনাকে এক পয়সা ব্যয় করতে হবে না।

মানদাসুন্দরী অতি দুঃখেও একটু না হেসে পারেন না। জিজ্ঞেস করেন, তারপর কর্তা কী করে মেয়েটিকে হাত করলেন?

কুসুমকুমারী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, আগে নিজের ছেলের বিয়ের দিন-টিন স্থির করে আশীর্বাদপর্ব চুকিয়ে ওর বাপের হাতে কয়েক হাজার টাকা খুঁজে দিয়ে একদিন ঐ বড় মেয়েটাকে নিয়ে পশ্চিমে রওনা হলেন পাত্রপক্ষকে দেখাবার কথা বলে।

-তারপর?

আর তারপর! কর্তা একা ফিরে এসে বললেন, মেয়েটিকে ওদের এতই পছন্দ হলো যে তিন দিনের মধ্যে গোধূলি লগ্নে বিয়ে হয়ে গেল। তবে হ্যাঁ, ওরা আপনাদের জন্য প্রণামী পাঠিয়েছে।

এইবার মানদাসুন্দরী একটু ম্লান হেসে হাসি হেসে বলেন, এই বলে বুঝি ওই গরিব লোকটার হাতে আরো কিছু তুলে দিলেন?

–তবে কী?

মেয়েটি তারপর আর বাপের বাড়ি আসেননি?

কুসুমকুমারী এবার একটু জোরেই হাসেন। বলেন, কর্তার কথা আর বলো না। এই ঘটনার মাসখানেক পরই ওদের বাড়িতে একটা তার এলো, হরিদ্বারের গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মেয়েটি হঠাৎ ডুবে মারা গেছে। ব্যস! আর কী চাই?

.

সারা ভবানীপুর পাড়ার কেউ বনবিহারী দত্তর ছেলেদের নাম জানতেন না। জানার দরকারও হতো না। দুনিয়ার সবাই ওঁদের জানতেন দত্তবাড়ির বড়বাবু, মেজবাবু, সেজবাবু, ন’বাবু ও ছোটবাবু বলে। এমন কি বাড়ির বউ-ঝিরাও ঐ বলেই কথাবার্তা বলতেন। অপরিচিতদের কানে খটকা লাগতো। অনেকে ঠাট্টা করে বলাবলি করতেন, ও বাড়ির বউ-ঝিরাও বোধহয় বনবিহারী দত্তর কোনো না কোনো কোম্পানির কর্মচারী। পাড়ার দুচারজন রসিক লোক পিতৃভক্ত এই পাঁচ ভাইকে পঞ্চপাণ্ডব বলে উল্লেখ করতেন। এই পিতৃভক্ত পুত্ররা যেভাবে পিতৃশ্রাদ্ধ করেছিলেন, তা দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যান। শোনা যায়, একশ একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও পণ্ডিত ব্রাহ্মণ গীতা পাঠ করেছিলেন। নিয়মভঙ্গের দিন কত হাজার লোককে যে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তার হিসেব নাকি কেউ জানতেন না।

যাই হোক, এই সব মিটে যাবার কয়েক দিন পর বড়বাবু একদিন সকালে সব ভাইদের ডেকে বললেন, পিতৃদেব ঠাকুর্দার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী পেয়েছিলেন, তা তোমরা সবাই খুব ভাল করেই জানো এবং আমাদের পিতৃদেব আমাদের জন্য কী রেখে গেছেন, তা তোমাদের বলি…

চার ভাই অবাক হয়ে বড় ভাইয়ের দিকে তাকান।

অনেক দলিল-দস্তাবেজ ও কাগজপত্তরের মাঝখানে বসে বড়বাবু চোখে চশমা, লাগিয়ে একটা কাগজ তুলে নিয়ে একবার ভাল করে চোখ বুলিয়ে ভাইদের দিকে। তাকিয়ে বললেন, আমাদের চারটি কোম্পানির খবর তোমরা সবাই জানো এবং মোটামুটিভাবে প্রত্যেকটি কোম্পানি থেকেই বছরের সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা লাভ হয়। অর্থাৎ বছরে পৌনে দুলাখ।

সবাই চুপ।

বড়বাবু এবার অন্য একটা কাগজ হাতে তুলে নিয়ে বলেন, অগ্রদ্বীপের সম্পত্তির কথা বাদ দিয়ে পিতৃদেব স্থাবর যে সম্পত্তি রেখে গেছেন তা হচ্ছে, ভবানীপুরের এই বাড়ি, স্ট্রান্ড রোডে আড়াই বিঘে জমির উপর গুদামঘর, মানিকতলায় সাড়ে তিন একর জমি, মধুপুর-গিরিডিতে মোট সাত বিঘে জমি ও ছোট্ট ছোট্ট দুটি বাড়ি।

বড়বাবু এবার হাতের কাগজ থেকে মুখ তুলে বলেন, এইসব সম্পত্তির দলিল ও খাজনা-ট্যাক্সের রসিদ সবই ঠিক আছে। তবে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখছি, পুরীতে দুবিঘে জমির উপর একটি দোতলা বাড়ির জন্যও বাবা একজনকে বছর পাঁচেক আগে পাঁচ হাজার এক টাকা অগ্রিম দেন কিন্তু সেই অগ্রিম দেবার রসিদ ছাড়া আর কোনো কাগজপত্র এখনও পর্যন্ত পাইনি। এ বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে হবে; কারণ বাবা অগ্রিম দিয়ে চুপ করে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না।

চার ভাই নীরবেই সম্মতিতে মাথা নাড়েন।

বড়বাবু এবার অন্য একটি কাগজ হাতে তুলে নিয়ে বলেন, আমাদের চারটি কোম্পানির নামে ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কে যে চারটি অ্যাকাউন্ট আছে, তাতে এখন মোট জমা আছে সড়ে তিন লাখের কিছু বেশি। এই ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কেই বাবার নিজস্ব অ্যাকাউন্টে আছে পাঁচ লাখ এবং আমাদের প্রত্যেক ভাইয়ের নামে বাবা রেখে গেছেন পঞ্চাশ হাজার করে।

এতক্ষণ পর ভাইদের মধ্যে প্রথম কথা বলেন মেজকর্তা। উনি একটু খুশির হাসি হেসে বললেন, বাবা যে আমাদের এক একজনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখে গেছেন, তা তো আগে জানতে পারিনি।

বড়বাবুগস্ত্রীর হয়ে বললেন, আরো দুএকটা খবর আছে, যা আমরা আগে জানতে পারিনি।

 সেজবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেও কি বিষয়-সম্পত্তির…।

বড়বাবু ওঁর কথায় কান না দিয়েই বলেন, খবরগুলি গুরুতর। ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার সাহেবকে বাবা লিখিতভবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার অ্যাকাউন্টের পাঁচ লাখ টাকা থেকে এক লাখ পাবেন মানিকতলার জগত্তারিণী দাসী, এক লাখ টাকা দিতে হবে মিসেস উইলিয়ামকে…

দুতিন ভাই প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করেন, এরা কারা?

–আগে আমাকে সব কথা বলতে দাও; তারপর তোমরা প্রশ্ন করো।

না, কোনো ভাইয়ের মুখে আর একটি কথা নেই।

বড়বাবু বিন্দুমাত্র ভাবাবেগ প্রকাশ না করে বলে যান, ঐ জগত্তারিণী দাসীর দুই কন্যার বিবাহের জন্য এক লাখ দিতে হবে এবং বাকি দুলাখ মানিকতলার জমিতে জগত্তারিণী দাসীর বাড়ি তৈরি হবে।

এইবার উনি ভাইদের দিকে তাকিয়ে বলেন, বলল, কী জানতে চাও।

মেজবাবু আর সেজবাবু প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করেন, কে এই জগত্তারিণী দাসী?

ন’বাবু একটু মুখ টিপে হেসে প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করেন, নিশ্চয়ই আমাদের খুব আপনজন!

বড়বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, জগত্তারিণী দাসী বাবার রক্ষিতা ছিলেন এবং দুই কন্যার জন্মদাতাও তিনি।

বড় ভাইয়ের কথা শুনে অন্য ভাইদের হৃৎপিণ্ডের ওঠানমা বন্ধ হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য। কারুর মুখ থেকে কোনো কথা বেরোয় না। তারপর মেজবাবু জিজ্ঞেস করেন, আপনি এই জগত্তারিণী দাসীর খবর আগেই জানতেন?

বড়বাবু জবাব দেন, হ্যাঁ, জানতাম।

–এ খবর তো আগে কোনোদিন আমাদের বলেননি।

–বাবার রক্ষিতাকে নিয়ে আলোচনা করার রুচি হয়নি। উনি একটু থেমে বলেন, বাবা নিজের জীবিতকালেই যদি এইসব টাকা ওদের দিয়ে যেতেন, তাহলে আজকে আমাকে এই অপ্রিয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হতো না।

এবার ন’বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করেন, আচ্ছা বড়দা, এই ইংরেজ মহিলাটিও কি পিতৃদেবের রক্ষিতা ছিলেন?

–আংশিক।

বড়বাবুর উত্তর শুনে সব ভাইরা একসঙ্গে হেসে ওঠেন। ওঁদের হাসির জন্য বড়বাবুও একটু না হেসে পারেন না।

সেজবাবু চাপা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন, আংশিক মানে?

–কেন তোমরা আমাকে এইসব অপ্রিয় প্রশ্ন করছ? দুদিন পর তোমরা নিজেরাই সবকিছু জানতে পারবে। বড়বাবু খুব জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ওসব কথা বাদ দাও। এখন তোমরা আমাকে একটি কথার জবাব দাও।

সবাই গম্ভীর হয়ে বড়বাবুর দিকে তাকান।

–এখন সব চাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি যৌথ পরিবার থাকবো নাকিআলাদা হবো? আমরা সবাই মিলেমিশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবো, নাকি তাও ভাগবাটোয়ারা করে আলাদা করে নেব?

নবাবু প্রশ্ন করেন, হঠাৎ আলাদা হবার কথা বলছেন কেন? কেউ কি আলাদা হতে চেয়েছে?

আরো দুএক ভাই বললেন, আলাদা হবার কথা উঠছে কেন?

বড়বাবু বললেন, আমি তোমাদের আলাদা হতে বলছি না বা আমি নিজে আলাদা হতে চাইছি না। উনি একটু থেমে বললেন, তবে একথা আমাদের ভুললে চলবে না যে বাবা আর বেঁচে নেই। তিনি থাকতে সবকিছুই তার ইচ্ছামত হয়েছে এবং আমরা মেনে নিতেও বাধ্য হয়েছি।

একই নিঃশ্বাসে উনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, অবশ্য একথা হাজার বার মানতে হবে পিতৃদেব সংসার ও ব্যবসার অকল্পনীয় উন্নতি করছেন।

মেজবাবু বললেন, সে তো একশবার।

–তবুও তো তোমরা স্বীকার করবে বাবার বহু কাজ আমরা মেনে নিতে পারিনি। তখন বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছি কিন্তু এখন তো আর সেই বাধ্যতা থাকছে না।

অন্য সব ভাই চুপচাপ করে থাকলেও ছোটবাবু বললেন, বাবা যখন নেই তখন আপনিই সব সিদ্ধান্ত নেবেন এবং আপনার সিধান্ত মেনে নিতে তো আমাদের আপত্তি থাকতে পারে না।

–তুমি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও সবাই মানবে কেন? প্রত্যেকেরই তো নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকে। তাছাড়া এ বিষয়ে বৌমাদের সঙ্গেও তোমাদের পরামর্শ করা উচিত।

সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে বড়বাবু মনে মনে একটু হেসে বলেন, আজ এখনই তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বলছি না কিন্তু সাত দিন, দশ দিন বা বড়জোর মাসখানেকের। মধ্যে একটা কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে। সব শেষে উনি বললেন, আর হ্যাঁ, ঐ পাঁচ লাখ টাকা বাবা কাকে কীভাবে দিতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তা দশ জনে জানলে বোধহয় আমাদেরই ক্ষতি হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *