১-২. সত্যি কথা বলতে

চেকপোস্ট – উপন্যাস নিমাই ভট্টাচার্য         

০১.

সত্যি কথা বলতে কি এখানে টু পাইস উপরি আয় আছে ঠিকই কিন্তু বড্ড ঝামেলার কাজ। কখন যে কি ঘটে যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাই সব সময় টেনশনে থাকতে হয়। কথাগুলো বলে একটু শুকনো হাসি হাসে সামন্ত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। বোধহয় আমার কাছে সমর্থন বা সমবেদনা চায়।

এত বছর পর ওর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা। একেবারেই অভাবিত। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি হরিদাসপুর চেকপোস্টে ওর সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু সে যাই হোক ও নির্বিবাদে আমার সঙ্গে কথাগুলো বলল। আমি একটু অবাকই হলাম। তবু ভাল লাগল।

ঘরের বাইরে দরজার মাথায় কাঠের ফলকে লেখা আছে এন. সি. সামন্ত অফিসার ইন চার্জ, ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, হরিদাসপুর। এপার ওপারের কাস্টমস ও চেকপোস্টের কর্মী অফিসারদের কাছে ও সামন্ত বলেই পরিচিত। সাধারণ যাত্রীদের কাছে ও ওসি সাহেব, ছোট বড়-মাঝারি দালালরা ওকে বড়বাবু বলে। কেউ কেউ হয়ত ওর একটা নোংরা নামও দিয়েছে এবং তা খুবই স্বাভাবিক। বহু পুলিস অফিসারের অদৃষ্টেই এই বিশেষ নামকরণের সৌভাগ্য জুটে থাকে। শ্রীকৃষ্ণের শত নামের মত পুলিস অফিসারদের খ্যাতি-অখ্যাতি অনুসারে নানা নামকরণ হয়, তা আমি জানি।

দমদম থেকে উড়োজাহাজে উড়ে গেলে ঢাকা মাত্র আধঘণ্টার পথ। প্যান-অ্যাম, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, এয়ার ইণ্ডিয়া বা জাপান এয়ার লাইন্সের বিমানে লণ্ডন-নিউইয়র্ক মস্কো-প্যারিস হংকং-টোকিও যাত্রার মত বিমানে ঢাকা যাত্রায় আভিজাত্যও নেই, উত্তেজনাও নেই। শুধু তাই নয়। বিমানবন্দরে আত্মীয় বন্ধুদের উপস্থিতি, পুষ্প স্তবক প্রাপ্তি এবং সর্বোপরি আসন্ন বিদায়-ব্যথায় কাতর হয়ে প্রেয়সীর দুফোঁটা চোখের জলও দেখার সৌভাগ্য হবে না বলেই বিমানে ঢাকা গেলাম না।

আমি একাই যাচ্ছি কিন্তু ঠিক নিঃসঙ্গ নই। বনগাঁ লোক্যালের কামরাতেই কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। শিয়ালদ’ থেকে ট্রেন ছাড়ার সময় এত ভীড় ছিল যে মনে হলো, এবার বোধহয় কুম্ভমেলা বনগাঁতেই হবে। এই ভীড়ের মধ্যে মাত্র বত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি সম্বল করে টিকে থাকতে পারব কিনা এই দুশ্চিন্তাতেই বিব্রত ছিলাম। প্রায় অর্ধেক রাস্তা পাড়ি দেবার পর মনে হলো, বোধহয় বৈতরণী পার হতে পারব। একটা সিগারেট ধরিয়ে আশেপাশের যাত্রীদের দেখতেই বুঝলাম, এই কামরাতেই আমারই মত আরো দুচারজন বিদেশযাত্রী বনগাঁ চলেছেন। উপযাচক হয়ে আমার আলাপ করতে হলো না। ব্যাগ থেকে পত্রপত্রিকাগুলো বের করতেই সামনের ভদ্রলোক বললেন, তাড়াহুড়োর মধ্যে শিয়ালদ’তে কাগজ কিনতে পারিনি। আপনার একটা কাগজ দেখতে পারি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কথাগুলো বলতে বলতেই ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ইনি লোক্যাল ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী না। অতিরিক্ত লড়াই করার জন্য লোক্যাল ট্রেনের নিত্য যাত্রীদের মুখে যে রুক্ষতা ও ক্লান্তির ছাপ থাকে, তা ওঁর নেই। যাই হোক পত্র পত্রিকাগুলো ওর সামনে এগিয়ে ধরতেই উনি সেদিনের ইকনমিক টাইমস তুলে নিলেন। আমি একটু হেসে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই ইকনমিক্সের অধ্যাপক অথবা কোন চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে…

কথাটা শেষ করার আগেই উনি হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, আপনি দেখছি কিরীটি রায়। 

আমিও হাসি। বলি, আমি একজন তুচ্ছ সাংবাদিক মাত্র।

তাই বলুন। আমি অধ্যাপনা করি।

উনি মাঝারি সাইজের একটা ভি-আই-পি সুটকেস থেকে রিডিং গ্লাস বের করতেই আমি একটু হেসে বললাম, মনে হচ্ছে আপনিও আমারই মত বিদেশযাত্রী।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় হাসতে হাসতে বললেন, ভিআইপি সুটকেস দেখেই ধরে ফেলেছেন?

আমি শুধু হাসি।

হ্যাঁ, একটা সেমিনারে জয়েন করতে ঢাকা যাচ্ছি। একটু থেমে বললেন, আমার মামারা খুলনায় আছেন। তাই যাতায়াতের পথে খুলনায় কদিন কাটাব বলে এই পথে চলেছি।

-ও!

আমারই বেঞ্চের একটু ওপাশ থেকে হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শুনি, শুধু আপনারা না, আমিও পাসপোর্ট-ভিসা সম্বল করে এই লোক্যালে চড়েছি।

আমি ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বলি, তাহলে নারীভূমিকা বর্জিত নাটক নয়।

কথাটা বলেই ভীষণ লজ্জিতবোধ করলাম। ভাবলাম, বোধহয় অন্যায়ও হলো। হাজার হোক উনি যুবতী, এবং সুন্দরী। সুদর্শন যুবকদের চাইতে সুন্দরী যুবতীরা নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য সম্পর্কে অনেক সচেতন হন। এবং অহংকারী। ওঁরা মনে মনে আশা করেন, এ বিশ্ব-সংসারের সব পুরুষই ওঁদের রূপ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবেন এবং আরো কত কি! কিন্তু রূপ-সৌন্দর্যের তারিফ করা তো দূরের কথা, কোন পুরুষ কোন কারণে দু একটা কথাবার্তা বললেও সুন্দরী যুবতীরা অসন্তুষ্ট না হলেও অন্তত বিরক্তবোধ করেন। কথাটা নেহাতই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলেও মুহূর্তের জন্য ভয় হলো, হয়ত উনি একটা বিরূপ মন্তব্য করবেন; অথবা আমাকে উপেক্ষা করে অপমানিত করবেন।

তেমন কিছু ঘটল না। জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, শুধু নাটকে না, জীবনের কোন ক্ষেত্রেই আমাদের না হলে আপনাদের চলে না।

পাশ থেকে মাসীমা বললেন, ঠিক বলেছ মা।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় হাসতে হাসতেই বললেন, কোন পুরুষ কী কখনও বলেছে যে তাদের জীবনে মেয়েদের কোন ভূমিকা নেই?

আমি জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে চাপা হাসি হেসে বললাম, যাক, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে বেশ সময়টা কেটে যাবে।

উনি হাসতে হাসতেই বললেন, শুধু কাজকর্মে না, ঝগড়াঝাটির ব্যাপারেও মেয়েদের খ্যাতি অনেক খ্যাতি।

ওঁর কথায় আমরা সবাই হাসি।

বনগাঁ পৌঁছবার আগেই আমাদের কজনের মধ্যে বেশ আলাপ পরিচয় জমে উঠল। পার্ক সার্কাসের মাসীমা বললেন, বড্ড ভয়ে ভয়ে রওনা হয়েছিলাম। এখন আপনাদের পেয়ে একটু ভরসা পাচ্ছি।

আমি হেসে বলি, আপনি তো আচ্ছা লোক মাসীমা। আমাদের এতজনকে পেয়েও আপনার একটু মাত্র ভরসা হচ্ছে?

উনি লজ্জিত হয়ে বললেন, না, না, বাবা, তা না। সেই দেশ ছাড়ার পর তো আর যাই নি, তাই মনে মনে বড্ড ভয় ছিল। তাছাড়া আমরা দুই বুড়োবুড়ি যাচ্ছি তো..

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোথায় যাবেন?

মাসীমা আর মেসোমশাই প্রায় একসঙ্গে বললেন, আমরা যাব বরিশাল।

–খুলনা থেকে স্টীমারে যাবেন তো?

হ্যাঁ।

–আমি আপনাদের স্টীমারে চড়িয়ে দেব।

মাসীমা বোধহয় মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করেই বললেন যাক, তাহলে আর চিন্তা কী? বরিশালে তো মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনীরা স্টীমার ঘাটে থাকবে।

এবার জয়ন্তী ওদের জিজ্ঞেস করলেন, বরিশালে বেড়াতে যাচ্ছেন?

মাসীমা একটু হেসে বললেন, মেজ নাতনীর বিয়ে। বড় নাতির বিয়েও মাস দেড়েকের মধ্যে হতে পারে। তাই….

আমাদের নেমন্তন্ন করবেন না? জয়ন্তী হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেন।

চলো না মা, তোমরা সবাই চল। তোমরা সবাই গেলে ওরা খুব খুশি হবে। মাসীমা একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, আমার জামাইবাড়ির উপর লক্ষ্মী-সরস্বতী দুজনেরই কৃপা আছে। তোমরা গেলে ওদের কোন অসুবিধা হবে না।

পত্রপত্রিকাগুলো বের করলেও পড়া হয় না কারুরই। আমরা সবাই গল্পগুজবে মেতে থাকি। গল্পগুজব মানে নিজেদের আলাপ পরিচয়ই একটু ভালভাবে হয়। মেসোমশাই রেলের ডি. এস. হয়ে রিটায়ার করেছেন অনেকদিন আগে। কর্মজীবনে বহু বছর কাটিয়েছেন পূর্ববাংলায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাতেই অধিকাংশ সময় থাকলেও কয়েক বছর রংপুরেও ছিলেন। সব ছেলেমেয়েদের জন্মই ওদিকে। দুমেয়ের বিয়েও দিয়েছিলেন ঐদিকেই। বড় মেয়ে বরিশালে থাকে, মেজ মেয়েটি আছে ঢাকায়। বাকী সব এদিকে। বেশ সুখের সংসার ছিল কিন্তু গত বছর মেজ জামাইটির হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়ার পর মাস তিনেকও বাঁচল না। মাসীমা পাঁজর কাঁপানো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশী দিন বেঁচে থাকলে কপালে এসব দুঃখ থাকবেই। আবার কোনমতে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, কপালে আরো কত দুঃখ আছে, তা ঠাকুরই জানেন।

জয়ন্তী বললেন, ওকথা বলছেন কেন মাসীমা? অল্প বয়সে কি মানুষ দুঃখ পায় না?

পায় বৈকি মা! কিন্তু যত বেশী দিন বাঁচা যাবে, তত বেশী কষ্ট পেতে হবে।

আমি চুপ করে শুনি। আমি মাসীমা-মেসোমশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের বুকের ক্ষতের আন্দাজ করি।

জয়ন্তী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, মাসীমা, সুখ-দুঃখ বোঝার কি কোন বয়স আছে?

এতক্ষণ নীরব থাকার পর মেসোমশাই বললেন, ঠিক বলেছ।

বনগাঁ লোক্যাল এগিয়ে চলে। হকারের স্রোতে ভাটার টান হয়। আমি আর অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় সিগারেট ধরাই।

একটা স্টেশন আরো পার হয়। এবার মাসীমা জয়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাবে মা?

-আমি এখন রংপুর যাব।

–ওখানে তোমার কোন আত্মীয়-স্বজন আছেন?

–আমার বাবা ওখানেই থাকেন। এখন মাও ওখানে আছেন।

 -তাই নাকি?

—হ্যাঁ।

-তুমি কলকাতায় থাক?

–আমরা তিন ভাইবোন আর মা কলকাতায় থাকি।

 মাসীমা আবার প্রশ্ন করেন, বাবা মাঝে মাঝে আসেন?

–কোট বন্ধ থাকলেই বাবা কলকাতায় চলে আসেন।

উনি একলা একলাই ওখানে থাকেন?

না, না, আমার দুই কাকাও ওখানে আছেন। তাছাড়া মা মাঝে মাঝেই যান।

ওরা কথা বলেন। আমরাও আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বলি। হঠাৎ একবার কানে এলো মাসীমার কথা, স্কুলে পড়ান ভাল কাজ কিন্তু বিয়ে করবে কবে?

ইচ্ছা করল জয়ন্তীর দিকে তাকাই কিন্তু দ্বিধা হলো। লজ্জা করল। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে জয়ন্তীর উত্তর শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইলাম।

উনি জবাব দিলেন, সবাই কী বিয়ে করে?

ছেলেরা বিয়ে না করেও থাকতে পারে কিন্তু মেয়েদের কী তা সম্ভব?

বনগাঁ পৌঁছবার দশ-পনের মিনিট আগে আমি মাসীমাকে জিজ্ঞেস করি, কী মাসীমা, কেমন লাগছে?

মাসীমা খুশির হাসি হেসে বললেন, তোমাদের মত ভাল ছেলেমেয়ে পাবার পরও কী খারাপ থাকতে পারি?

তাই বলুন। আমি হাসি চেপে বলি, বিশেষ করে আমার প্রশংসা না করে উপায় নেই।

আমার কথায় শুধু ওঁরা না, আরো দুএকজন হাসেন। হাসি থামলে তির্যক দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার দেখে নিয়ে জয়ন্তী বলেন, সব চাইতে আমি ভাল, তাই না মাসীমা?

জয়ন্তীর প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ট্রেন বনগাঁ স্টেশনে ঢোকে। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় মাসীমাকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়েই বলেন, আমার মত ভাল মানুষ হয় না, তাই না মাসীমা?

এতক্ষণ নীরব থাকার পর মেসোমশাই বলেন, তোমাদের মাসীমার কাছে তোমরা কেউই ভাল না, শুধু আমি ভাল।

আমরা সবাই হো-হো করে হেসে উঠি।

.

০২.

দুই ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ও-সি সাহেবের নাম যাত্রীসাধারণের অবগতির জন্য কাঠের ফলকে অত সুন্দর করে লেখা থাকলেও আমার নজরই পড়েনি। ওসি সাহেবের নাম জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি। দারোগাবাবুরা কে কোথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, তা জানতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। চেকপোস্টে বড় দানোগা বাবু সম্পর্কে আমার সামান্যতম আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না বলেই বোধহয় অমন করে জড়িয়ে পড়লাম।

ভাগ্যবিধাতা সত্যি বড় রসিক। এ সংসারে কাছের মানুষই দূরে যায়, দূরের মানুষই আপন হয়। একদিন যাকে তুচ্ছ মনে হয়, যাকে অবজ্ঞা করি, সম্মান দিতে চাই না, সেই মানুষটাই একদিন মনের মন্দিরের পরম প্রিয় বিগ্রহ হয়ে ওঠেন। শুধু কী ব্যক্তির জীবনে? জাতির জীবনে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় এর অসংখ্য নজীর ছড়িয়ে আছে।

বনগাঁ লোক্যালের অসংখ্য অপরিচিত মানুষের ভীড়ের মধ্যে থেকেও যারা হঠাৎ আমার প্রিয়জন না হলেও পরিচিত হয়েছেন, তারা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি ওদের সবার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক দেখছি, এমন সময় হঠাৎ এক দারোগাবাবু আমার দিকে তাকিয়েই বললেন, আরে বাচ্ছ! তুমি?

অতীতে ছাত্রজীবনে আমি যে নিত্যচরণ সামন্তকে চিনতাম ও আজকের এন. সি. সামন্তর মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। নিত্যচরণ আগে ছিল মোগা, আজকের এন. সি. মোটা, অতীতে যার মাথাভর্তি চুল সব সময় বিশুদ্ধ সরিষার তৈলে তৈলাক্ত থাকত, এখন সে মাথায় তবলা বাজান যায়। নিত্য কলেজে পড়ার সময়ও শুধু শার্টের গলার বোজামটি বন্ধ করত না, ধুতির কেঁচাটি পর্যন্ত মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপর পর্যন্ত ঝুলে থাকত, সেই মানুষটি আজ দারোগাবাবুর পোশাকে সজ্জিত। সর্বোপরি সেদিনের সেই পাঁশকুড়া-মেচেদা লোক্যালের যাত্রী নিত্যর চোখে-মুখে যে অবিশ্বাস্য গ্রামীণ সারল্যের ছবি ফুটে উঠত, তা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। আজকের বড়বাবুর চোখে মুখে শিকারীর সুপ্ত হিংস্রতা ও ক্রুরতার চাপা ইঙ্গিত। তাই তো আমি ওকে চিনতে পারি না। অবাক হয়ে দারোগাবাবুর দিকে তাকাই।

না, দারোগাবাবু আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলেন না। একটু এগিয়ে এসেই হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আরে ভাই, আমি নিত্য! নিত্যচরণ সামন্ত।

এবার উনি দুহাত দিয়ে আমার দুহাত ধরে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, এবার মনে পড়ছে?

আমি প্রায় ভূত দেখার মত কোনমতে বিড়বিড় করে বলি, তুমি নিত্য! সেই মেচেদা-পাঁশকুড়া…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সেই নিত্য।

–তুমি দারোগা হয়েছ?

–দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না?

এবার আমি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে বলি, আগে তো চোরেরাই তোমাকে মারধর করতো; আর এখন তুমি চোর-ডাকাত ধরো?

আমার এ কথার জবাব না দিয়ে ও আমাকে টানতে টানতে ওর পাশের চেয়ারে বসিয়েই হুঙ্কার দিল, এই জগদীশ! নগেন! আর হাওয়া না খেয়ে একটু শুনে যাও।

বড়বাবুর হুঙ্কার শুনে প্রায় নেকড়ে বাঘের মত লাফ দিয়ে একজন কঙ্কালসার কনস্টেবল বলল, হ্যাঁ সার!

চোখ দুটো গোল গোল করে বেশ ধমক দেবার সুরেই নিত্য বলল, তোমরা সব কে কোথায় থাকো? দয়া করে একটু মিষ্টি-টিষ্টি আর স্পেশাল চা আনো। দেখছ না আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু এসেছেন?

আমি কনস্টেবলটিকে কিছু বলার আগেই সে আগের মতই এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হাতের পাসপোর্টগুলো দেখিয়ে এবার আমি নিত্যকে বলি, ভাই, আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন

হাজার হোক দারোগাবাবু। ওরা বুঝি হাঁ করলেই হাওড়া বোঝেন। আমার মুখের কথা শেষ হবার আগেই ও চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে আমাকে বলল, কই, তোমার ফ্যামিলির সব কোথায়?

ওঁরা সবাই একটু পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। আমি এগিয়ে ওদের কাছে যেতেই নিত্য ঢিপ ঢিপ করে পার্ক সার্কাসের মাসীমা মেসোমশাইকে প্রণাম করে হাসতে হাসতে বলল, আমি আর বাচ্চু একসঙ্গে পড়াশুনা করেছি।

মাসীমা-মেলোমশাই হতবাক হয়ে ওসি সাহেবের দিকে তাকাতেই নিত্য একবার সবাইকে দেখে নিয়েই অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়কে নমস্কার করে বলল, আমি আপনার ভাইয়ের ক্লাস-ফ্রেণ্ড!

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ও দারোগাবাবুর কাণ্ড দেখে অবাক কিন্তু এবারও উনি কিছু বলার আগেই জয়ন্তীকে নমস্কার জানিয়েই নিত্য একটু হেসে বলল, আপনি নিশ্চয়ই আমার বন্ধুপত্নী!

এ যেন এপ্লানেড ইস্টে পুলিস অ্যাকশান! সব পুলিস সবাইকে লাঠিপেটা না করা পর্যন্ত থামতে জানে না, থামতে পারে না।

আমি লজ্জায় বিস্ময়ে নির্বাক। বড়বাবুর সম্মানিত অতিথি হিসাবে সবাই ঘরে এসে বসার পর অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় একটু হেসে বললেন, আমরা কেউই কারুর আত্মীয় না। বনগাঁ লোক্যালে আলাপ। আমাদের একমাত্র মিল আমরা সব বাংলাদেশ যাচ্ছি।

নিত্য অধ্যাপকের বিবৃতির কোন গুরুত্ব না দিয়েই সন্ন্যাসীর ঔদার্য দেখিয়ে মাসীমাকে বলল, আপনি বাচ্চুর মা না হয় মায়ের মত তো!

সে তো একশ বার!

শুধু মাসীমাকেই তত্ত্বজ্ঞান দিয়ে নিত্য ক্ষান্ত হয় না; অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়কে বলে, আপনিও আমাদের ভাইয়ের মত! মুহূর্তের জন্য চোখের দৃষ্টি জয়ন্তীর দিক থেকে ঘুরিয়ে এনেই বলল, আর উনি এখন না হলেও ভবিষ্যতে আমার বন্ধুপত্নী

আঃ! নিত্য!

ইতিমধ্যে চা মিষ্টি এসে যায়। নিত্য প্রায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত মাসীমাকে বলে, নিন মাসীমা, একটু মিষ্টি খেয়ে যান।

-এই একটু মিষ্টি বাবা!

 মাসীমার কথা বোধহয় ওর কানেও ঢুকল না; অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় ও জয়ন্তীকে বলল, দাদা, একটু মুখে দিন। একটু মিষ্টি মুখ করে চা খান।

জয়ন্তী বললেন, এর সিকি ভাগ মিষ্টিও আমি খেতে পারব না।

ও সি সাহেব মাথা নেড়ে বলল, এ হতচ্ছাড়া জায়গায় তো ভাল দোকান বা হোটেল নেই যে আপনাদের ভালমন্দ দেব। যা সামান্য জিনিস দেওয়া হয়েছে, তাতে আর অমন করে লজ্জা দেবেন না।

যাই হোক, আমরা চা-জলখাবার খেতে খেতেই আমাদের পাসপোর্টগুলোয় ছাপ দিয়ে দিলেন ছোট দারোগাবাবু। আমরা বসে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম। এমন সময় বাংলাদেশ পুলিসের একজন সিপাই এসে নিত্যকে সেলাম করে একটা ছোট কাগজ দিয়ে বলল, ও সি সাহেব এটা পাঠিয়ে দিলেন।

কাগজের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিয়েই নিত্য একটু গলা চড়িয়ে এ-এস-আইকে বললেন, জগন্নাথবাবু, প্রশান্ত মুখার্জী নামে কেউ এলে বলবেন

নিত্যকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন, আমার নাম প্রশান্ত মুখার্জী।

নিত্য একটু হেসে বলল, ও! আপনি খুলনায় যাবেন?

–হ্যাঁ।

-খুলনা থেকে আপনার আত্মীয় গাড়ি নিয়ে ওপারে অপেক্ষা করছেন।

-তাই নাকি! অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় যেন আশাই করেন নি।

গাড়ি আসার খবর শুনেই যেন মাসীমা হতাশ হলেন। বললেন, আপনি তো গাড়িতে চলে যাচ্ছেন। আমাদের বোধহয় স্টীমারে চড়িয়ে দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না?

-না, না, তা কেন হবে না? তাছাড়া গাড়ি যখন এসেছে, তখন আপনাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব।

মেসোমশাই বললেন, কিন্তু গাড়িতে কী জায়গা হবে?

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বললেন, একজনের বেশী নিশ্চয়ই আসে নি। সুতরাং জায়গা না হবার কী আছে?

ওদের কথা শুনেই নিত্য অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়কে বলল, আপনি বরং একবার দেখে আসুন। ওকে এই কথা বলেই একজন কনস্টেবলকে বলল, নগেন, তুমি প্রফেসার সাহেবকে ওপারের ওসি সাহেবের কাছে নিয়ে যাও। আর বলবে, উনি ওঁর গাড়িটা দেখে ফিরে আসবেন।

দশ-পনের মিনিট পরই অধ্যাপক ফিরে এসে খুশির হাসি হেসে বললেন, অনেক দিন পর যাচ্ছি বলে আমার ছোট মামা আর দুই মামাতো ভাই আমাকে নিতে এসেছেন। এবার উনি মাসীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে গাড়ি এসেছে, তাতে আমরা তিনজন ধরে যাব বলেই মনে হয়।

মেসোমশাই বললেন, আমরা গেলে বোধহয় আপনাদের সবাইকেই কষ্ট দেওয়া হবে।

-কষ্ট আবার কী! মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের তো পথ।

জয়ন্তী বললেন, বনগাঁ লোক্যালের চাইতে বেশী কষ্ট কী হবে?

 ওর কথায় আমরা হাসি।

এবার নিত্য ওদের তিনজনের পাসপোর্ট কনস্টেবল নগেনের হাতে দিয়ে বলল, এদের তিনজনকে পৌঁছে দিয়ে এসো, আর বলো, এরা আমার লোক।

জয়ন্তী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও যাই।

নিত্য বলল, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান। এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? জলে তো পড়েন নি।

–কিন্তু..

 –কিছু কিন্তু করার কারণ নেই। বসুন বসুন।

আমি বললাম, নিত্য, আমি ওদের গাড়িতে চড়িয়ে দিয়ে আসতে পারি?

-কেন পারবে না? নিত্য সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো, আমিও যাই।

আমরা দুজনে পা বাড়াতেই জয়ন্তী বললেন, আমিও কী ওদের সী-অফ করতে যেতে পারি?

নিত্য এক গাল হাসি হেসে বলল, অধিকন্তু ন দোষায়।

হাজার হোক ও-সি সাহেব নিজে এসেছেন। নিমেষে কাস্টমস-এর বৈতরণী পার হলো এদিকে-ওদিকে। ওদিকের ও-সিও ছুটে এলেন কাস্টমস কাউন্টারে। নিত্যর সামনে এসে উনি বললেন, নগেন এলেই তো হতো। আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? তারপর ওসি মহীউদ্দীন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আপনি কী ভাবলেন, আপনার বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজনকে আমরা হ্যারাস করব?

নিত্য হাসতে হাসতে বলল, আপনাদের আত্মীয়-স্বজনকে যখন আমরা হ্যারাস করি, তখন আপনারাও ..

ওদের কথা শুনে কাস্টমস-এর তিন-চারজন ইন্সপেক্টর হো-হো করে হেসে উঠলেন।

হাসি থামলে নিত্য একজন কাস্টমস ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বৌমার তেল ফুরোবার আগেই আমাকে বলো।

ঐ ইন্সপেক্টর কিছু বলার আগেই অন্য একজন ইন্সপেক্টর নিত্যকে বললেন, স্যার, ইসাক নতুন বিয়ে করেছে বলেই ওর বউ জবাকুসুম মাখবে আর আমি দুবছর আগে ঘরে বউ এনেছি বলে

নিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকিয়ে বলল, শুনছ ইসাক তোমার বন্ধু কী বলছে? যে ছোট ভাই বিয়ের সময় বড় ভাইকে নেমন্তন্ন করতে ভুলে যায়, তার কী শাস্তি হওয়া উচিত?

এবারও ইসাক কিছু বলার আগেই ডানদিকের কোণা থেকে কাস্টমস-এর একজন মহিলা কর্মী মন্তব্য করলেন, পর পর সাত দিন পদ্মার ইলিশ খাওয়ানো।

মহা খুশি হয়ে নিত্য বলল, ঠিক বলেছেন আপা।

মাসীমা-মেসোমশাই, অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়, জয়ন্তী ও আমি অবাক হয়ে ওদের হাসাহাসি কথাবার্তা শুনছিলাম। এবার অধ্যাপক, মুখোপাধ্যায় দুদিকের দুই ওসিকে বললেন, আপনাদের মধ্যে যে এত ভাল সম্পর্ক তাতো আমরা ভাবতেও পারি না।

জয়ন্তী বললেন, সত্যিই তাই।

নিত্য কিছু বলার আগেই ওপারের ও.সি. বললেন, এই বর্ডারের পোস্টিং-এ যে কি ঝামেলা আর টেনশন, তা আপনারা ভাবতে পারবেন না। আমাদের সম্পর্ক ভাল না হলে তো আমরা কাজই করতে পারব না।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বললেন, তা ঠিক।

কাস্টমস-এর ঘর থেকে বেরুবার আগে নিত্য একটু চিৎকার করেই বলল, ইসাক, তোমার বন্ধুকে বলে দিও পদ্মার ইলিশ না খাওয়ালেও এবার থেকে ঠিক জায়গায় ঠিক সময় জবাকুসুম নিয়মিত পৌঁছে যাবে।

ঐ তরুণ ইন্সপেক্টরটিও সবাইকে শুনিয়ে বলে, ইসাক, তুইও তোর দাদাকে জানিয়ে দে, জবাকুসুম মেখে আমার বউয়ের মাথা ঠাণ্ডা থাকলে দাদা তার এই অধম ভাইয়েরই উপকার করবেন।

ওর কথায় এরের সবাই হেসে ওঠেন।

পার্ক সার্কাসের মাসীমা-মেলোমশাই ও অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের বিদায় সম্বর্ধনা ভালই হলো। মেসোমশাই দুদিকের দুই ওসিকেই বার বার ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, বর্ডার পার হওয়া নিয়ে সত্যি ভয় ছিল এবং এই ভয়ের জন্যই পার্টিশন হবার পর আর এদিকে আসিনি।

মেসোমশাই একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, এখন আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করতে পারি।

বেনাপোলের ওসি বললেন, একশ বার আসবেন। আপনাদের আসা-যাওয়ার জন্যই তো আমরা আছি। এবার উনি মাসীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যখন ইচ্ছে নাতি-নাতনীর কাছে যাবেন। কোন অসুবিধা হবে না।

–হ্যা বাবা, সত্যি আবার আসব।

গাড়িতে ওঠার আগে মাসীমা জয়ন্তীকে বুকের মধ্যে মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, সাবধানে যেও। আর এই মাসীমাকে ভুলে যেও না। আমরা কলকাতা ফিরে এলে মাঝে মাঝে চলে এসো। খুব খুশি হবো।

–আসব মাসীমা।

মাসীমা আমার মাথায় মুখে দশ বার হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, তোমাকে আর কী বলল বাবা! তুমি না থাকলে আমার এইসব ছেলেদের সঙ্গে আলাপই হতো না। তুমিও মাঝে মাঝে দেখা করো।

বললাম, হ্যাঁ মাসীমা, নিশ্চয়ই দেখা করব।

নিত্য বলল, মামীমা, আমিও আসব।

–একশ বার আসবেন। ছেলেমেয়েরা যদি মা-মাসীকে বিরক্ত না করে তাহলে কী মা-মাসী শান্তিতে থাকতে পারে?

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ও সবাইকে বার বার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গাড়িতে উঠলেন।

ওদের গাড়ি রওনা হবার পর এপারের দিকে দুএক পা গিয়েই জয়ন্তী আমাকে বললেন, মাত্র এই কঘন্টার পরিচয় কিন্তু তবু ওরা চলে যাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম, মানুষের মন নিয়ে এই ত বিপদ। সে যে মুহূর্তের মধ্যে কখন কাকে ভালবাসবে, তা কেউ বলতে পারে না।

জয়ন্তী একবার আমার দিকে তাকালেন। বোধহয় একটু হাসলেনও।

নিত্য বোধহয় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, এখানে যে কত মানুষের কত কি দেখলাম আর জানলাম, তা ভেবেও অবাক হয়ে যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *