অন্দরমহল – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
শৈবালের ফিরতে রোজই বেশি রাত হয়। অফিস থেকে সোজাসুজি বাড়ি ফেরার ধাত নেই। বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি কিংবা দু-একটা ক্লাব ঘুরে আসে। যেদিন তাসের আড্ডায় জমে যায়, সেদিন এগারোটা বেজে যায়।
এজন্য তার প্রত্যেক দিনেরই একটা বকুনির কোটা আছে। প্রমিতা তার জন্য জেগে বসে থাকে। ঝি-চাকরদের বেশি খাটাবার পক্ষপাতী নয় প্রমিতা। রান্নার লোকটিকে সে রোজ রাত দশটার সময় ছুটি দিয়ে দেয়। শৈবাল তারও পরে ফিরলে প্রমিতা নিজেই তার খাবার গরম করে দেবে, পরিবেশন করবে আর সেইসঙ্গে চলতে থাকবে বকুনি।
শৈবাল তখন দুষ্টু ছেলের মতন মুখ করে শোনে।
প্রত্যেক দিনই সে প্রতিজ্ঞা করে যে, কাল আর কিছুতেই দেরি হবে না। এক-একদিন মেজাজ খারাপ থাকলে সে অবশ্য উলটে কিছু কড়াকথা শুনিয়ে দেয় প্রমিতাকে। সাধারণত তাসে হারলেই তার এ-রকম মেজাজ খারাপ হয়।
ওদের দু-টি ছেলে-মেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে দশটার মধ্যে। সুতরাং, বাবা-মায়ের ঝগড়া তাদের শুনতে হয় না। শৈবাল প্রমিতাও প্রাণ খুলে চোখাচোখা বাক্য বিনিময় করে যেতে পারে।
সেদিন রাত্রে শৈবাল খাবার টেবিলে বসে মাছের ঝোল পর্যন্ত পৌঁচেছে, ঝগড়াও বেশ জমে উঠেছে, এইসময় সে দেখল, সতেরো-আঠেরো বছরের একটি সম্পূর্ণ অচেনা মেয়ে তাদের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে, লাজুক ভঙ্গিতে মুখ নীচু করে হেঁটে বারান্দার দিকে চলে গেল।
বিস্ময়ে ভুরু উঁচু হয়ে গেল শৈবালের।
প্রমিতা ফিসফিসিয়ে বলল, ও আজই এসেছে। তোমাকে একটু পরে বলছি ওর কথা।
তবু শৈবালের বিস্ময় কমে না। ব্যাপার কী? বাড়িতে একটা অনাত্মীয় যুবতী মেয়ে রয়েছে এত রাত্রে, অথচ এর কথা প্রমিতা এতক্ষণে একবারও বলেনি।
এই উপলক্ষ্যে ঝগড়াটা থেমে গেল এবং শৈবাল নির্বিঘ্নে বাকি খাওয়াটা শেষ করল।
এরপর সাধারণত শৈবাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট শেষ করে। সারা দিন-রাতের মধ্যে এইটুকুই তার প্রকৃতি উপভোগের সময়।
কিন্তু অচেনা মেয়েটি রয়েছে বারান্দায়। সুতরাং শৈবাল সিগারেট ধরিয়ে শোয়ার ঘর আর খাওয়ার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। আড়চোখে দু-একবার মেয়েটির দিকে না তাকিয়ে পারল না। সে পুরুষমানুষ, এটুকু কৌতূহল তার থাকবেই।
মেয়েটির মুখ ভালো করে দেখতে পায়নি শৈবাল। এখনও তার মুখ অন্ধকারের দিকে ফেরানো। সুন্দর ছাপা শাড়ি পরে আছে সে! কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয়া? প্রমিতার কোনো বান্ধবীর বোন? পাড়ার অন্য কোনো বাড়ি থেকে রাগ করে পালিয়ে আসা কোনো মেয়ে? প্রমিতার নানারকম বাতিক আছে, সেরকম কোনো মেয়েকেও আশ্রয় দিতে পারে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
প্রমিতা টুকিটাকি কাজ সারছে রান্নাঘরে। খাওয়ার পর সাধারণত আধঘণ্টার মধ্যে শুতে যায় না শৈবাল। কিন্তু আজ একটা বই খুলে বিছানায় গিয়ে বসল।
মোট আড়াইখানা ঘরের ছোটো ফ্ল্যাট। রান্নাঘরের সামনে একটুখানি জায়গায় খাবার টেবিল পাতা। আর একটা বারান্দা। এক ঘরে ছেলে-মেয়েরা শোয়, আর এক ঘরে ওরা দুজন। বাকি আধখানা ঘরটি ওদের বসবার ঘর। খুবই সংক্ষিপ্ত ব্যাপার সেটি।
সল্টলেকে খানিকটা জমি কেনা আছে, কিন্তু সেখানে বাড়ি করার ব্যাপারে শৈবাল বা প্রমিতার কারোরই বিশেষ আগ্রহ নেই। শৈবালের মত বাড়ি বানানো মানেই ঝামেলা। আর প্রমিতা অত দূর যেতে চায় না। তার সব চেনাশুনো, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এদিকে থাকে।
অন্য দিনের চেয়ে খানিকটা দেরি করে এল প্রমিতা। শোয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করল। এবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার ক্রিমমাখা ও চুল আঁচড়ানোর পর্ব শুরু হবে। তাতে সময় লাগবে মিনিট কুড়ি। বাকি কথাবার্তা এই সময়েই সেরে নিতে হয়।
শৈবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তারপর।
প্রমিতা মুখ ঘুরিয়ে বলল, আস্তে, একটু আস্তে কথা বলো।
শয়নকক্ষে কেউ চিৎকার করে না। বিশেষত শান্তির সময়ে। অন্য দিন যে স্বরগ্রামে কথা বলে শৈবাল, আজও সেইভাবেই বলছিল, হঠাৎ তাতে আপত্তি দেখা দিল কেন?
প্রমিতা বলল, মেয়েটি এই বারান্দাতেই শুয়েছে!
এ ঘরের পাশেই বারান্দা। সেখান থেকে সব কথা শোনা যাবে। কিন্তু মেয়েটি বারান্দায় শোবে কেন? হঠাৎ কোনো অতিথি এলে তো বসবার ঘরটাতেই বিছানা করে দেওয়া হয়। এখন প্রায়ই শেষরাতের দিকে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।
প্রমিতা বারান্দার দিকের জানলাটা বন্ধ করে দিল।
ক্ষীণ প্রতিবাদ করে শৈবাল বলল, এই গরমের মধ্যে…
খানিকটা পরে আবার খুলে দেব!
অর্থাৎ তাদের কথাবার্তা শেষ হলে, আলো নেভাবার পর জানলা আবার খোলা হবে।
বারান্দায় শোবে? যদি বৃষ্টি আসে?
বলে দিয়েছি, বৃষ্টি এলে বিছানাটা টেনে নিয়ে যাবে রান্নাঘরের সামনে।
কেন, বসবার ঘরটায়?
প্রমিতা চোখের ভঙ্গিতে জানাল, তার দরকার নেই।
মেয়েটি কে?
ওকে আজ অরুণরা দিয়ে গেছে।
তার মানে?
অরুণরা বলে গেল ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে…
অরুণরা এক পাগলের জুটি। অরুণ আর তার বিদেশিনি স্ত্রী মার্থা। ওদের জীবন সাংঘাতিক বৈচিত্রপূর্ণ। প্রত্যেক দিনই ওদের জীবনে একটা-না-একটা কান্ড ঘটে।
ওর বাড়ি কোথায়? সেখানে আমরা কেন ওকে পাঠাব!
শোনো, তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি..সেই যে, সত্যানন্দ একটা বাচ্চামেয়েকে আমাদের বাড়িতে এনে দিল, তোমার মনে আছে? রেণু নাম ছিল, দু-তিন দিন কাজ করেছিল এখানে…
এসব শৈবালের মনে থাকার কথা নয়, জানারও কথা নয়। যাই হোক, সে কোনো মন্তব্য করল না।
সেই রেণু কিছুদিন আগে অরুণদের ওখান থেকে ছুটি নিয়ে দেশে চলে গিয়েছিল–জান তো ওদের ব্যাপার, সাত দিন বাদেই ফিরবে বলে যায়, কিন্তু কক্ষনো ফেরে না। একুশ দিন বাদে সেই রেণু নিজে না ফিরে ওর দিদিকে পাঠিয়েছে…বলছে তো যে রেণুর অসুখ, সে আর কাজ করবে না, তার বদলে তার দিদি, ওর নাম হেনা।
শৈবাল আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঝি-চাকরের ব্যাপার? প্রমিতার এইসব ব্যাপারে দারুণ উৎসাহ। কতবার যে বাড়ির কাজের লোক আর রান্নার লোক বদলায়!
কিন্তু এই মেয়েটি ঝি? এত ঝলমলে শাড়িপরা, মোটামুটি দামিই তো মনে হল শাড়িটা। যুবতী মেয়ে, দামি শাড়ি অথচ ঝিয়ের কাজ করে–ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
শৈবালের চোখের ভাষা পড়ে নিয়েই বোধ হয় প্রমিতা বলল, এমন ঝুলিঝুলি নোংরা একটা শাড়ি পরে এসেছিল যে, দেখেই ঘেন্না করছিল আমার। সেইজন্য আমার একটা শাড়ি দিলাম ওকে।
তোমার শাড়ি? তাই বলো। সেইজন্যেই চেনা চেনা লাগছিল।
তুমি আমার সব শাড়ি চেনো? ছাই চেনো! আচ্ছা, অরুণরা কী বলো তো, ওইরকম একটা ছেঁড়া নোংরা শাড়ি দেখেও সেই অবস্থায় আমাদের বাড়ি রেখে গেল? একটু চক্ষুলজ্জা নেই?
মার্থা তো শাড়ি পরে না, সে আর তোমার মতন হুট করে একটা শাড়ি দেবে কী করে? স্কার্ট বা ফ্রক দিতে পারত অবশ্য, কিন্তু স্কার্টপরা ঝি ঠিক আমাদের দেশে চলবে কি?
আহা হা, একটা শাড়ি কিনেও তো দিতে পারত! এদিকে তো গরিব-দুঃখীদের সম্পর্কে কত বড়ো বড়ো কথা বলে…একটা উঠতি বয়েসের মেয়ে…।
সেকথা থাক। কিন্তু অরুণা ওকে আমাদের বাড়িতে রেখে গেল কেন?
অরুণরা যে ইতিমধ্যে আর একটা লোক রেখে ফেলেছে। তা ছাড়া মার্থা বলেছে, বাড়িতে আর কোনো মেয়ে রাখবে না, ছেলে কাজের লোক রাখবে।
কেন, মেয়ে রাখবে না কেন?
রাখবে না। কোনো অসুবিধা আছে নিশ্চয়ই!
মার্থা কি তার স্বামীকে সন্দেহ করে নাকি?
এই, বাজে কথা বোলো না!
তাও না হয় বুঝলাম। কিন্তু সেজন্য মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে রেখে যাওয়ার কারণ কী?
ওই যে, রেণুকে আমরাই জোগাড় করে দিয়েছিলাম।
সেইজন্য তার দিদি আমাদের বাড়িতে ফেরত আসবে? আমাদের বাড়িতে কত-জন লোক লাগবে?
এ ফ্ল্যাটে একজন ঠিকে ঝি এসে বাসনপত্র মেজে দিয়ে যায়। আর একটি রান্নার লোক রাখতে হয়েছে। শৈবাল গোড়ার দিকে ক্ষীণ আপত্তি করেছিল এ ব্যাপারে। সে বলেছিল আমরা বরাবর মা-ঠাকুমার হাতের রান্না খেয়েছি। বাইরের লোকের রান্না তো দোকানে টোকানে গিয়েই খেতে হয়। আজকালকার মেয়েরা কি একদম রান্না ভুলে যাবে? তোমার তো হাতে অনেক সময় থাকে।
প্রমিতা ফোঁস করে উঠে বলেছিল, তুমি বুঝি রান্না করার জন্য আমায় বিয়ে করেছিলে। সারাদিন আমি উনুনের আঁচের সামনে থাকব আর তুমি বাইরে গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াবে?
মেয়েদের ধারণা, পুরুষরা যে অফিসে চাকরি করে বা টাকা রোজগার করে, সেটা কোনো পরিশ্রমের ব্যাপার নয়। যত খাটুনি শুধু বাড়ির মেয়েদের।
প্রমিতা আরও বলেছিল, আমি যদি রান্না করি, তা হলে ছেলে-মেয়ে দুটোকে পড়াবে কে? বেশ, তাহলে আমি রান্না করছি, তুমি ওদের পড়াবার জন্য মাস্টার রাখো!
এ যুক্তি অকাট্য। প্রমিতা বি এসসি পাস। তাকে রান্নার কাজে নিযুক্ত রেখে ছেলে মেয়েদের জন্য অন্য মাস্টার আনা মোটেই কাজের কথা নয়। তা ছাড়া মাস্টার রাখার খরচ বেশি। সুতরাং রান্নার জন্য ঠাকুর বরাদ্দ হল।
কিন্তু এই বারো বছরের বিবাহিতজীবনে অন্তত ন-বার রান্নার ঠাকুর বদল করেছে প্রমিতা। কখনো স্ত্রীলোক, কখনো পুরুষ। এরা প্রত্যেকেই যখন প্রথম এসেছে, তখন প্রমিতা এদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রত্যেকবার প্রমিতা বলেছে, এবার যে-লোকটি পেয়েছি, ঠিক এইরকম একজনকে চাইছিলাম।
শৈবাল মুচকি হেসেছে শুধু।
দু-তিন দিন পরই প্রমিতা সেই লোককে অপছন্দ করতে শুরু করে। একটা-না-একটা খুঁত বেরোয়।
শৈবাল প্রমিতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে, ঝি-চাকর তো আর দর্জির কাছে অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো যায় না। সুতরাং ঠিকঠাক মাপমতন হয় না। ওরই মধ্যে যতদূর সম্ভব মানিয়ে নিতে হয়। প্রথম দিন যাকে দেখে প্রমিতার খুব মায়া পড়ে যায়, মাসখানেক পরেই তাকে তাড়াবার জন্য সে একেবারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কত রকম দোষ বেরিয়ে পড়ে তাদের।
প্রত্যেক বার রান্নার লোককে বিদায় করে দিয়ে প্রমিতা মন খারাপ করে থাকে কয়েকদিন, তার মনটা এমনিতে নরম, হুট করে বাড়ি থেকে একজন লোককে তাড়িয়ে দিয়ে সে মোটেই খুশি হয় না। অথচ রাগের মাথায় তাদের ছাড়িয়েও দেয়।
এখন যে ছেলেটি রান্না করছে, সে প্রায় দেড় বছর টিকে আছে। এরও অনেক দোষ বার করেছে প্রমিতা, কিন্তু এর একটি প্রধান গুণ, শত বকুনি খেলেও কক্ষনো মুখে মুখে কথা বলার চেষ্টা করে না। অপরাধীর মতন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিছক বকুনি সহ্য করার ক্ষমতার জন্যই সে এখনও চাকরি হারায়নি। নইলে, রান্না অবশ্য সে মোটামুটি খারাপই করে। তার রান্না শৈবালের পছন্দ না হলেও সে ঘুণাক্ষরে কোনোদিন সেকথা জানায়নি।
অথচ প্রমিতা মোটেই ঝগড়াটি নয়, বকাবকি করা স্বভাবও নয় তার। বাইরের সবাই প্রমিতার স্বভাবের খুবই প্রশংসা করে। শুধু প্রমিতার আছে পরিষ্কার বাতিক। তার সঙ্গে ঝি চাকর কিংবা রান্নার লোকেরা পাল্লা দিতে পারে না।
কিন্তু আমাদের তো এখন লোক দরকার নেই। অনন্তকে তুমি ছাড়িয়ে দিতে চাও নাকি?
প্রমিতা বলল, সেকথা আমি বলেছি? আমাদের এখানে রাখবার কোনো প্রশ্ন উঠছে না। অরুণরা বলেছে, ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে।
সে-ব্যবস্থা অরুণরা করতে পারেনি? আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে কেন?
তোমারই তো বন্ধু। তুমি জিজ্ঞেস কোরো!
তুমি রাখলে কেন?
বাড়িতে এনে ফেলেছে, তাড়িয়ে দেব?
কোথায় বাড়ি ওর?
বনগাঁর দিকে, কী যেন স্টেশনের নাম বলল।
ঠিক আছে, কাল অনন্তকে বোলো ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে
প্রমিতার রাত্রির প্রসাধন শেষ হয়ে গেছে। পোশাকও বদলে নিয়েছে। এবার সে আলো নিভিয়ে শুতে আসবে। এক-একদিন প্রমিতা শুতে আসবার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে শৈবাল। আজ প্রমিতার গল্প করার ঝোঁক এসেছে।
বিছানায় উঠে এসে প্রমিতা বলল, মেয়েটার সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম…শুনলে বড় কষ্ট হয়…দেশে ফিরে যাবে, কিন্তু সেখানে গিয়ে কী খাবে তার ঠিক নেই…একদম নাকি খাওয়া জোটে না…ওরা সাত ভাই-বোন, ওর বাবা নাকি বলেছে, নিজেরা যেমন করে পারে খাবার জোগাড় করে নিক! লোকটা মানুষ না পশু? বাবা হয়ে একথা ছেলে-মেয়েদের বলতে পারে?
শৈবাল একটা রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ার উদ্যোগ করেও থেমে গেল। শুরু করলে অনেকক্ষণ সময় লাগবে।
প্রমিতা বলল, আমি ভাবছি।
ওকে আমাদের এখানেই রেখে দেবে?
না না, এত লোক রেখে আমরাই বা চালাব কী করে? আমার দিদি একজন কাজের লোকের কথা বলেছিল…জানি না পেয়েছে কিনা..কাল দিদির কাছে একবার খবর নেব, ওকে যদি রাখে।
শৈবাল গোপনে হাসল। ঝি-চাকরের ব্যাপারে প্রমিতা যেন একটা এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের যার যখনই কাজের লোকের দরকার হয়, অমনি তারা ফোন করে প্রমিতাকে। প্রমিতারও এব্যাপারে প্রবল উৎসাহ, অন্য কারুর অসুবিধে হলে তারই যেন বেশি দুশ্চিন্তা। শৈবাল এজন্যই বাড়িতে নিত্যনতুন ঝি-চাকর দেখতে পায়।
একবার প্রমিতা তার ছোটোমাসির বাড়িতে একটা চাকর পাঠিয়েছিল। সাত দিনের মধ্যেই সে-চাকরটা, সে-বাড়ি থেকে ঘড়ি, রেডিয়ো, প্রচুর জামাকাপড় আর কিছু টাকাপয়সা চুরি করে পালায়।
খবর শুনে প্রমিতা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল।
ছেলেটিকে প্রমিতা জোগাড় করেছিল মুড়িওয়ালার কাছ থেকে। সেই লোকটি তিন-চার বছর ধরে ওদের বাড়িতে নিয়মিত মুড়ি দিয়ে যায়। সেই লোকটিকে বেশ বিশ্বাসী ধরনেরই মনে হত। এর আগেও সে গ্রাম থেকে দু-তিনজন ছেলে-মেয়েকে এনে দিয়েছে ঝি-চাকরের কাজের জন্য।
এই ঘটনার পর সেই মুড়িওয়ালার আর পাত্তা নেই।
প্রমিতা এমনভাবে হা-হুতাশ করতে লাগল যেন তার নিজের বাড়ি থেকেই চুরি গেছে। সারাদিন শৈবালকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিল না।
শৈবাল শেষপর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, চুরি হয়েছে তো কী আর করা যাবে? কলকাতা শহরে সব বাড়ি থেকেই একদিন-না-একদিন চুরি হয়। কলকাতায় থাকতে গেলে এ-রকম একটু সহ্য করতেই হবে।
তা বলে আমার জন্য ছোটোমাসির এত ক্ষতি হয়ে গেল?
তোমার জন্য?
তা নয় তো কী? আমি লোকটাকে দিলাম।
কেন দিতে গিয়েছিলে? তোমার কী দরকার, এইসব ঝামেলায় যাওয়ার? কে তোমায় মাথার দিব্যি দিয়েছে?
আমার ছোটোমাসির অসুবিধে হলে আমি কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব না? ছি ছি, এতগুলো টাকা!
শৈবাল রেগে উঠে বলেছিল, তাহলে কী বলতে চাও, ছোটোমাসিদের যত টাকা ক্ষতি হয়েছে, সব আমাকে দিতে হবে?
শেষপর্যন্ত ছোটোমাসি প্রমিতাকে এত অস্থির হতে দেখে নিজেই এসে বলেছিলেন, তুই এত ভাবছিস কেন? যা গেছে তা তো গেছেই। ছেলেটাকে দেখে তো আমারও ভালো মনে হয়েছিল প্রথমে।
তারপর শৈবাল প্রমিতাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল, সে আর ভবিষ্যতে অন্য কারুর বাড়ির ঝি-চাকর সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সে-প্রতিজ্ঞা প্রমিতা একমাসও রাখতে পারেনি। আবার সব ঠিক আগের মতন চলেছে।
হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে দিয়ে শৈবাল জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে?
না বোধ হয়। মাথায় সিঁদুর তো দেখলাম না।
এত বড়ো মেয়ে, বিয়ে হয়নি? ওদের তো কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়!
ওর বাবা খেতে দিতেই পারে না তো বিয়ে দেবে কী করে?
তোমার দিদির ছেলেটি বেশ বড় হয়েছে, ওবাড়িতে এ-রকম একটা যুবতী ঝি রাখা কি ঠিক হবে?
চুপ করো, অসভ্যের মতন কথা বোলো না।
যা সত্যি তাই বলছি। উঠতি বয়েসের ছেলেদের সামনে…
আঃ কী হচ্ছে কী? আস্তে কথা বলো না! পাশেই বারান্দায় রয়েছে মেয়েটা, সব শুনতে পাবে।
শৈবাল চুপ করে গেল। বারান্দাটা ঘরের একেবারে লাগোয়া। ওখান থেকে কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যেতে পারে ঠিকই। জানলাটা বন্ধ রাখলে অবশ্য হয়। কিন্তু এই গরমে জানলা বন্ধ রাখার কথা ভাবাও যায় না।
আজ আর প্রমিতাকে আদর-টাদর করাও যাবে না। নিজের বাড়িতে থেকেও সব কিছু নিজের ইচ্ছেমতন করা যায় না। এই কথা বুঝে নিয়ে শৈবাল ঘুমিয়ে পড়ল।
অনেক রাত্রে কীসের আওয়াজে যেন শৈবালের ঘুম ভেঙে যেতে লাগল এক-একবার। বাইরে যেন খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগছে শৈবালের গায়ে।
সেই ঘুমের মধ্যেই তার মনে হল, মেয়েটি শুয়ে আছে বাইরের খোলা বারান্দায়, ঝড়ের মধ্যে সে কী করবে?
কিন্তু শৈবাল উঠল না। ওটা প্রমিতার ব্যাপার, সেই এখন ঠ্যালা সামলাক, তার কিছু করার নেই, এই ভেবে সে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
.
০২.
সকাল বেলা বাড়িতে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দুই ছেলে-মেয়ের স্কুল, শৈবালের অফিস। মেয়ে যাবে সাড়ে আটটায়, ছেলে ন-টায় আর সাড়ে নটায় শৈবালের অফিস। এর মধ্যে এক মিনিট কারুর নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
সেই মেয়েটি কখনো বারান্দায়, কখনো রান্নাঘরের সামনে, কখনো বাথরুমের পাশে বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকছে। প্রথম দিন সবাই এসে ওইরকম বোকা হয়ে যায়। ঠিক বলে না দিলে বুঝতে পারে না কোন কাজটা তাকে করতে হবে। তা ছাড়া এবাড়িতে একজন কাজের লোক আছে আগে থেকেই। মেয়েটি নিজে থেকে কিছু করতে গেলে সে রেগে যেতে পারে। সে ভাববে, এই মেয়েটি বেশি কাজ দেখিয়ে তার চাকরিটা খাওয়ার চেষ্টা করছে।
রান্নাঘর থেকে শোয়ার ঘরে আসবার সময় প্রমিতা বলল, এই হেনা, ওরকম দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়াসনি। মাথার তেল লেগে দেয়ালে দাগ ধরে যায়।
মেয়েটি অপরাধীর মতন সরে এল সঙ্গে সঙ্গে।
প্রমিতা বলল, তুই বরং বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাক।
কাল রাত্তিরের ঝড়-বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই এখন আকাশে। এই সকালেই গনগন করছে রোদ। পাখার নীচে বসেও স্বস্তি নেই।
মেয়েটার স্কুলের গাড়ি এসে গেছে। ছেলেও বেরিয়ে গেল একটু পরে। এবার শৈবাল খেতে বসবে।
বাথরুমের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হতেই শৈবাল স্ত্রীর দিকে তাকাল। প্রমিতা অবাক হয়ে বলল, কে গেল বাথরুমে? অনন্ত, অনন্ত
শৈবাল বলল, অনন্ত নয়।
ও মা, ওই মেয়েটা বাথরুমে গেল নাকি?
সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে গিয়ে বাথরুমের দরজায় খট খট করে বলল, হেনা, এই হেনা, শিগগির খোল।
শৈবাল মুচকি মুচকি হাসছে।
বাথরুমের দরজা খুলল হেনা। প্রমিতা বলল, তুই বাথরুমে যাবি, সেকথা আমাকে বলবি তো। এই বাথরুমে নয়। নীচে আলাদা বাথরুম আছে। জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস না করেই হুট করে ঢুকে পড়লি এখানে?
অপরাধীর মতন মাথা নীচু করে রইল হেনা।
অনন্তকে ডেকে বকুনির সুরে প্রমিতা বলল, তুই ওকে নীচের বাথরুমটা দেখিয়ে দিসনি কেন? তোর এইটুকু আক্কেল নেই?
অনন্তর একটা বড়ো গুণ সে প্রতিবাদ করে না। সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, এসো
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রমিতা আবার খাবার টেবিলে ফিরে এসে বলল, আমার বাথরুমে ঝি-চাকররা ঢুকলে আমার বড় গা ঘিনঘিন করে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে দেখতে পেয়েছিলাম।
শৈবাল হাসিমুখে চুপ করে রইল।
সকাল নটা পর্যন্ত মেয়েটি প্রকৃতির ডাক অগ্রাহ্য করে চেপে থেকেছে কী করে, সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার!
প্রমিতা একটু অনুতপ্ত গলায় বলল, অবশ্য ও বেচারা জানে না, ওর দোষ নেই। সকাল বেলা আমারই মনে করে বলে দেওয়া উচিত ছিল অনন্তকে! নানা ঝঞ্ঝাটে ভুলে গেছি।
শৈবাল জিজ্ঞেস করল, কাল রাত্তিরে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল?
দারুণ ঝড়-বৃষ্টি। জলের ছাঁট এসে ঢুকেছিল ঘরে!
তখন ওই মেয়েটি কী করল?
আমি উঠে ওকে ভেতরে নিয়ে এলাম। অনন্তকে পাঠিয়ে দিলাম সিঁড়ির নীচে, হেনা খাবার ঘরেই শুল। তুমি তো কিছুই দেখোনি। ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিলে। সব আমাকেই করতে হয়।
আমি জেগে উঠেছিলাম, ইচ্ছে করেই কিছু বলিনি।
কেন?
বলে বিপদে পড়ি আর কী! যুবতী ঝি সম্পর্কে সমবেদনা দেখালেই বিপদ।
তোমার খালি বাজেকথা।
বাজে কথা? আমাদের অফিসের নীহারদার কী অবস্থা হয়েছিল জানো?
নীহার দাসের বাড়িতে এইরকম বয়েসের একটি মেয়ে কাজ করত। স্বাস্থ্য-টাস্থ্য ভালো। নীহারদা একদিন বউদিকে বললেন, মেয়েটাকে একটা শাড়ি কিনে দাও বড় ছেঁড়া একটা শাড়ি পরে থাকে, উঠতি বয়সের মেয়ে-বড্ড চোখে লাগে। ব্যাস, বউদি অমনি দপ করে জ্বলে উঠলেন।–উঠতি বয়েসের মেয়ে, ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকে, তুমি বুঝি সবসময় ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখ? বড্ড যে দরদ ওর জন্য! শাড়ি কিনে দাও! তুমি আমার একটা শাড়ি কেনার কথা তো কখনো মুখে আনো না।
প্রমিতাকে হাসতে দেখে শৈবাল বলল, হাসছ কী? ব্যাপার কতদূর গড়িয়েছিল জানো? ওই একটা কথার জন্য নীহারদার প্রায় বিবাহবিচ্ছেদের উপক্রম! যাই হোক, শেষপর্যন্ত সেই মেয়েটিকে তো সেইদিনই ছাড়িয়ে দেওয়া হল বটেই, তা ছাড়াও বউদির মেজাজ ঠাণ্ডা করার জন্য নীহারদা তাঁকে কাশ্মীর বেড়াতে নিয়ে গেলেন সেই মাসেই। পরে নীহারদা আমাদের কাছে আফশোস করে বলেছিলেন ভাই, একটা কথার জন্য সাত হাজার টাকা খরচ! নাক কান মুলেছি। আর কখনো বাড়িতে কমবয়েসি ঝি কিংবা রাঁধুনি রাখব না।
প্রমিতা বলল, যেমন তোমার নীহারদা, তেমন তোমার বউদি! আজকাল কেউ এত মাথা ঘামায় না এসব নিয়ে। যেসব মেয়েরা স্বামীকে সন্দেহ করে, তারা কখনো জীবনে সুখী হয় না।
খুব ভালো কথা। তা বলে ও মেয়েটিকে যেন আমাদের বাড়িতে রেখো না।
কেন, তোমার ভয়ে? তোমার ওপর এটুকু অন্তত আমার বিশ্বাস আছে।
শুনে খুব খুশি হলাম। কিন্তু বাড়িতে ক-জন লোক রাখবে?
না, ওকে রাখব না। বললাম তো, ওকে দিদির বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। দিদির খুব অসুবিধে হচ্ছে।
শৈবাল বেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত প্রমিতার অখন্ড অবসর। মেয়ে স্কুল থেকে ফেরে সাড়ে তিনটের সময়। তার আগে পর্যন্ত আর প্রমিতার কিছু করবার নেই। এক-একদিন সে নিজেও বেরিয়ে পড়ে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শৈবাল চট করে প্রমিতার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, আজ তা হলে তোমার অ্যাডভেঞ্চার দিদির বাড়িতে?
প্রমিতা হাসল।
.
অফিস থেকে ফিরে শৈবাল দেখল, ঠিক আগের দিনের মতনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটি।
শৈবাল প্রমিতার দিকে প্রশ্নসূচক ভুরু তুলল।
হল না!
কেন?
প্রমিতা বলল, দিদি ঠিক কালই একজন লোক পেয়ে গেছে। একজনকে বলে, একটি ছেলেকে আনিয়েছে ক্যানিং থেকে। হুট করে তো আর তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া যায় না ।
তাহলে?
বাবারে বাবা! তোমাকে অত চিন্তা করতে হবে না। আমি দেখছি একটা কিছু ব্যবস্থা করছি।
আমাকে চিন্তা করতে হবে না তো? বেশ ভালো কথা!
হাত-মুখ ধুয়ে জলখাবার-টাবার খেয়ে শৈবাল আবার অফিসের কাগজপত্র নিয়ে বসেছে, এই সময় প্রমিতা বলল, এখনও অফিসের কাজ? বাড়িতে এসেও নিস্তার নেই? অফিস কি তোমাদের মাথাটাথা সব কিনে রেখেছে নাকি?
কাগজগুলো মুড়ে শৈবাল বলল, ঠিক আছে, সব সরিয়ে রাখলাম। সত্যিই এত কাজ করার কোনো মানে হয় না।
তোমার সঙ্গে আমার একটু আলোচনা আছে।
বলো—
মেয়েটাকে নিয়ে কী করি বলো তো? দিদির বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনার পর খুব কান্নাকাটি করছিল। দেশে গেলে খেতে পাবে না। ওর বাবা ওকে বাড়িতে জায়গা দেবে না, তাহলে ও যাবে কোথায়?
এই যে, তখন বললে, আমাকে এ নিয়ে কিছু চিন্তা করতে হবে না?
তা বলে তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শও করা যাবে না?
অর্থাৎ আমাদের বাড়িতেই রাখতে চাইছ?
একটা দুঃখী মেয়ে, তাকে তাড়িয়ে দেব?
দেশে এ-রকম লক্ষ লক্ষ গরিব-দুঃখী আছে। তাদের সবাইকে কি আমরা সাহায্য করতে পারব?
তুমি এ-রকম নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ কেন? লক্ষ লক্ষ মানুষের কথা কী বলেছি? অন্তত যেটুকু আমাদের সাধ্য।
একটা ছেলে হলে বলতাম রেখে দাও। কিন্তু একটা মেয়ে, দেখতে খুব খারাপ নয়! এদের নিয়ে ঝামেলা আছে। শেষে তোমার সঙ্গে আমার না ঝগড়া বেধে যায়।
আ হা হা হা! ওকথা বার বার বলছ কেন, বলো তো? তোমাকে আমি খুব ভালোই চিনি। তোমার অনেক সুন্দরী সুন্দরী বান্ধবী আছে। তুমি মোটেই একটা ঝি-মেয়ের ওপর নজর দেবে না, আমি জানি।
বেশ, ভালো কথা। তাহলে তোমার যা ইচ্ছে করো!
যা ইচ্ছে করো মানে?
রাখতে চাও রাখো, না রাখতে চাও ট্রেনে চাপিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও!
আমি ওকে রাখার কথা ভাবছি না অবশ্য। শুধু যে ক-দিন অন্য কোথাও কাজ না পায়। আশ্চর্য ব্যাপার! এক-এক সময় কতজন যে কাজের লোক চেয়ে আমাকে বিরক্ত করে। অথচ এখন একজনও ওকে নিতে চাইছে না।
বোধ হয় মেয়েটা অপয়া।
যাঃ, বাজেকথা বোলো না। মেয়েটাকে দেখে আমার খুব মায়া হল।
শোনো প্রমিতা, তোমাকে কয়েকটা সত্যিকথা বলব? মেয়েটাকে দেখলে তোমার মায়া হয়, কিন্তু ও তোমার বাথরুমে ঢুকলে তোমার গা ঘিনঘিন করে। তোমাদের মায়া-দয়াগুলো একটুখানি গিয়েই দেয়ালে ধাক্কা খায়। যদি সত্যিই তোমায় মায়া হয় মেয়েটাকে দেখে, তাহলে ওকে ঝি-গিরি করতে পাঠানো কেন? তোমার গয়না বিক্রি করে কিংবা আমার অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ধার করে ওর একটা বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত-না? তাহলেই ও ভালোভাবে বাঁচতে পারবে।
তোমার যতসব অদ্ভুত কথা। আমরা ওর বিয়ে দিতে যাব কেন? কাজের জন্য এসেছে, কাজ জুটিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে পারি বড়োজোর।
তাহলে তাই করো। এতে তো আমার কাছে পরামর্শ চাইবার কিছু নেই।
প্রমিতা উঠে যেতেই আবার অফিসের কাগজপত্র খুলে বসল শৈবাল।
আরও দু-দিন মেয়েটা থেকে গেল এবাড়িতে। কাপড় কেচে দিয়ে, ঘরের ঝুল ঝেড়ে টুকিটাকি সাহায্য করতে লাগল প্রমিতাকে। মেয়েটি লাজুক, কথা খুব কম বলে।
তৃতীয় দিনে ঠিক দেববাণীর মতন এল প্রমিতার বান্ধবী ইরার টেলিফোন। সেদিন শৈবালের ছুটি, সে-ই ধরেছিল টেলিফোনটা। দু-একটা কথা বলেই ইরা জানাল–দেখুন-না, এমন মুশকিলে পড়ে গেছি, আমাদের রান্নার মেয়েটি হঠাৎ দেশে চলে গেল, আর ফেরার নাম নেই।
শৈবাল হাসতে হাসতে বলল, সেইজন্যই মনে পড়েছে তো আমাদের কথা? আমাকে রাখবেন? আমি কিন্তু মন্দ রান্না করি না।
ইয়ার্কি করছেন! আপনারা তো করবেনই, আপনাদের তো চিন্তা করতে হয় না, বাড়ির খাওয়া-দাওয়া কী করে চলবে!
বুঝতে পেরেছি, আমাকে আপনার পছন্দ নয়। কিন্তু আজ আমরাই আপনার মুশকিল আসান।
তার মানে?
আপনাকে আমরা আজই রেডিমেড রান্নার লোক দিতে পারি। ধরুন, আমি প্রমিতাকে ডাকছি!
প্রমিতা টেলিফোন ধরে বলল, হ্যাঁ, তোকে দিতে পারি একটা মেয়ে। কিন্তু এ বাড়ির কাজ টাজ করে, রান্নার কাজ ঠিক পারবে কি না জানি না।
ওপাশ থেকে ইরা বলল, ওতেই হবে। মেয়ে যখন কিছু-না-কিছু রান্না নিশ্চয়ই জানে। মেয়েটা তোদের বাড়িতেই আছে, ধরে রাখ, কোথাও যেতে দিস না, আমি এক্ষুনি আসছি।
প্রমিতা হাসতে হাসতে বলল, ধরে রাখতে হবে না। ক-দিন ধরে আমার বাড়িতেই আছে।
ইরা বলল, না বাবা, বিশ্বাস নেই। কতজনই তো লোক দেবে বলে কিন্তু শেষপর্যন্ত কী যেন গোলমাল হয়ে যায়। আমার ভীষণ দরকার, বাড়ি সামলাতে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। এদিকে আমার গাড়িটাও ক-দিন ধরে খারাপ। আমি এক্ষুনি তোর বাড়িতে আসছি ট্যাক্সি নিয়ে।
ইরার স্বামী অফিসের কাজে কুয়ালালামপুর গেছে ছ-মাসের জন্য। ইরা নিজেও একটা কলেজে পড়ায়। বাড়িতে একটা বাচ্চা। রান্নার লোক না থাকলে তার অসুবিধে হয় খুবই। ওদের বাড়িটাও খুব বড়ো। অত বড়ো বাড়ি রোজ ধোওয়া-মোছা করাও সহজ কথা নয়।
আধঘণ্টার মধ্যে এসে হাজির হল ইরা। তারপর শুরু হল ইন্টারভিউ।
মিনিট দশেক জেরার পর ইরা জিজ্ঞেস করল শেষ প্রশ্নটি : কত মাইনে নেবে?
হেনা মুখ নীচু করে চোখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, সে আপনি যা দেবেন।
ইরা প্রমিতাকে জিজ্ঞেস করল, হাউ মাচ শি এক্সপেক্টস?
প্রমিতা বলল, ঠিক আছে, হেনা তুই একটু রান্নাঘরে যা। আমি দিদিমণির সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।
হেনা চলে যেতেই প্রমিতা তার বান্ধবীর কানে কানে বলল, মেয়েটার সব ভালো, কিন্তু ভাত খায় বড্ড বেশি। এই অ্যা-ত্ত-খা-নি!
ইরা হেসে বলল, তা খাক-না যত খুশি ভাত। আমাদের চারখানা রেশন কার্ড। আমরা তো রেশনের চাল খাই না, সেসব ও একাই খেতে পারবে। তাতে আর কত খরচ! কত মাইনে দেওয়া যায় বল তো?
মেয়েটি দারুণ অভাবে পড়ে এসেছে। যা পাবে তাতেই খুশি হবে।
কুড়ি?
কুড়িটা বড্ড কম হয়ে যায়, আজকাল অত কম দিলে লোক টেকে না।
আমি আর একটু বেশি দিতে রাজি আছি। কিন্তু কাজ না দেখে, প্রথম থেকেই বাড়ালে
আর কম দিলে কী হবে জানিস, অন্য বাড়ি থেকে ভাঁড়িয়ে নিয়ে যাবে। ঝি-চাকররা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে ঠিক জেনে যায়, কোন বাড়িতে কে কত মাইনে দেয়?
তবে কত দেব, পঁচিশ?
আমরা অনন্তকে পঁয়তাল্লিশ দিই।
তোদের ছেলেটা তো হিরের টুকরো…চমকার রান্না করে, সেই যে সেবার খেয়ে গেলাম। ওকে পেলে আমি তো এক্ষুনি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিয়ে যেতে রাজি আছি। তোরা মেয়েটাকে রাখ, আমি অনন্তকে নিয়ে যাই
আ-হা-হা! না রে ইরা, আমি বলছি, এও বেশ কাজ করতে পারবে, চটপটে আছে, কথা শোনে।
খুব একটা রোগাপাতলা নয়, খাটতে পারবে আশা করি।
শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে।
আমার যে ছাই শেখাবার সময় নেই। সামনের মাসে দিল্লিতে একটা সেমিনারে যাব, তার জন্য পেপার লেখা এখনও শেষ হয়নি…সেটা লিখব, না বাড়ির রান্নার কথা ভাবব।
শেষপর্যন্ত ইরা পঁয়তিরিশ টাকা দিতে রাজি হল।
চোখের সামনে একটা খবরের কাগজ মেলে পাশে বসে সব শুনছিল শৈবাল। তার মনে হচ্ছিল, ওই হেনা মেয়েটি যেন ক্রীতদাসী, ইরা যেন ওকে কিনতে এসেছে। দরদাম করছে প্রমিতার সঙ্গে। এ ব্যাপারে হেনার যেন কিছুই বক্তব্য নেই।
প্রমিতা হেনাকে ডেকে বলল, এই দিদিমণি তোকে পঁয়তিরিশ টাকা দিতে রাজি হচ্ছেন। দিদিমণি খুব ভালো, নিজের বাড়ির মতন থাকবি। কেমন?
হেনা ঘাড় হেলাল।
ইরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল, আজ থেকেই শুরু করতে হবে। বাড়িতে রান্নাবান্না কিছু হয়নি। রান্নাগুলো প্রথম দু-একদিন আমি একটু দেখিয়ে দেব। শিখে নিতে পারবি তো?
হেনা আবার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ওরা চলে যাওয়ার পর শৈবাল বলল, যাক নিশ্চিন্ত!
প্রমিতা বলল, ইস তোমার যেন কতই-না দুশ্চিন্তা ছিল!
ছিল বই কী! দু-দিন ধরে আমাদের অনন্তকে কীরকম যেন গম্ভীর দেখছি! ও বোধ হয় বাড়িতে অন্য একজন কাজের লোকের উপস্থিতি পছন্দ করছে না।
মোটেই না, আমাদের অনন্ত খুব ভালো ছেলে! কাল মাছ একটু কম পড়েছিল, অনন্ত নিজে না খেয়ে, হেনাকে এক টুকরো মাছ দিয়েছে।
শৈবাল ভুরু তুলে সকৌতুকে বলল, তাই নাকি?
কিন্তু ঠিক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল না। দু-দিন বাদেই সকালে ফোন করল ইরা। সকাল বেলা, প্রমিতার দারুণ ব্যস্ততা, ফোন ধরারও সময় নেই।
ইরা বলল, তুই কী একটা গাঁইয়া মেয়েকে দিয়েছিস? গ্যাসটা পর্যন্ত নেভাতে জানে না।
প্রমিতা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তুই তো ভালো করে জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে দেখে-শুনে নিলি। আমি কি তোকে জোর করে দিয়েছি?
এরা যে, এত বোকা হয়, কে বুঝবে বল? আমি কত করে সব দেখিয়ে-শুনিয়ে কলেজে চলে গেলাম। বিকেলে ফিরে এসে দেখি, গ্যাস জ্বলছে। বোঝো, সারাদিন গ্যাস জ্বলছে। এ রকম হলে তো দু-দিনেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাব।
আমি তো বলেই দিলাম, মেয়েটা রান্নার কাজ ঠিক জানে না।
এত বড়ো একটা বুড়ো ধাড়ি মেয়ে, বাড়িতে কি ও কখনো রাঁধেনি? জানে না যে, উনুন নেভাতে হয়?
খাবার টেবিল থেকে শৈবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি কতক্ষণ ফোনে এইসব গল্প চালাবে? আমাকে খেতে-টেতে দেবে না?
প্রমিতা সে-কথা শুনতেই পেল না। মানুষের দুটো কান থাকলেও অনেক সময়ই মানুষ একসঙ্গে দু-রকম শব্দ শুনতে পায় না। তা ছাড়া প্রমিতার মনটা একমুখী। একটা দিকে যখন সে মন দেয় তখন অন্যদিকে হঠাৎ আগুন লেগে গেলেও সে ফিরে তাকাবে না।
অনন্তর কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিয়ে শৈবাল যখন প্রায় শেষ করে এনেছে সেই সময় প্রমিতা ফিরে এল খাবার টেবিলে। শৈবাল খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল, তাহলে মেয়েটা আবার আমাদের এখানে ফিরে আসবে?
কোন মেয়েটা?
ওই তোমার হেনা–যাকে তোমার বান্ধবীর বাড়িতে কাজ দিয়েছ?
না, না, ফিরে আসবে কেন? ইরার ভীষণ কাজের লোক দরকার।
তাহলে হেনার কাজের যাবতীয় সমালোচনা তোমাকে শুনতে হবে কেন? ও কাজে ভুল করলে সে-দায়িত্ব কি তোমার?
সে-কথা কে বলেছে?
তোমার বান্ধবী তো এতক্ষণ যাবতীয় অভিযোগ তোমাকেই শোনাচ্ছিল। যে রান্না করতে জানে না; তাকে দিয়ে জোর করে রান্না করাবে, আবার অভিযোগও করবে?
তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
আমার এসব একদম পছন্দ হয় না। গ্রামের মেয়ে, কোনোদিন গ্যাসের উনুন চোখে দেখেনি, এক দিনেই সব শিখে যেতে পারে? আমরা আমাদের অফিসের কাজ একদিনে শিখি?
ইরা ঠিক অভিযোগ করেনি, এমনি মজা করে বলছিল।
গরিবদের নিয়ে মজা করাটাও আমার ভালো লাগে না। আমি বলে রাখছি দেখো, ওই মেয়েটি আবার ফিরে আসবে এখানে।
তোমার বান্ধবী ইরার বাড়িতে কোনো লোক টেকে না।
ব্যাপারটা হল অবশ্য তার ঠিক বিপরীত। রাত্রি বেলা ফিরে শৈবাল দেখল অন্য দৃশ্য। রান্নাঘরের দরজা খোলা। কোমরে আঁচল জড়িয়ে সেখানে মহাউৎসাহে রান্নায় মেতে আছে প্রমিতা, তার সারামুখে চন্দনের ফোঁটার মতন ঘাম।
শৈবাল উঁকি দিয়ে বলল, কী ব্যাপার?
প্রমিতা বলল, আজ তোমার জন্য চিলি চিকেন রান্না করেছি। দেখো, দোকানের চেয়েও ভালো হয় কি না?
বিয়ের পর প্রথম দু-এক বছর প্রমিতা মাঝে মাঝে নিজের হাতে কিছু কিছু রান্না করেছে। তার রান্নার হাতটা ভালোই। কিন্তু সেসব শখের রান্না। ঠিক গিন্নিবান্নিদের মতন সে নিয়মিত রান্না করতে ভালোবাসে না। সে ভালোবাসে রবীন্দ্রসংগীত, এখানে-সেখানে বেড়াতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে হইচই, বাংলা গল্পের বই এবং ঘুম। ঘুমের মতন প্রিয় আর কিছুই নেই প্রমিতার কাছে।
প্রমিতা বলল, আজ বিশেষ কিছু নেই- ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ আর চিলি চিকেন।
শৈবাল বলল, চমৎকার। আর কী চাই? একেবারে চীনে-বাংলা সংমিশ্রণ।
খেতে বসেও যখন দেখা গেল, প্রমিতাই পরিবেশন করছে, তখন শৈবাল জিজ্ঞেস করল, অনন্ত কোথায়?
প্রমিতা বলল, অনন্তর জ্বর হয়েছে। দুপুর থেকেই হঠাৎ খুব জ্বর এসেছে।
ও, সেইজন্যেই বাধ্য হয়ে তোমাকে রান্না করতে হয়েছে? তাই বলো।
মন্দ লাগল না। মাঝে মাঝে রাঁধতে ভালোই লাগে। মাঝে মাঝে অভ্যেসটাও রাখা ভালো।
ভাগ্যিস আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিলাম। আজ দেরি করে ফিরলে নিশ্চয়ই একটা কেলেঙ্কারি হত।
আজ তুমি রাত বারোটা বাজিয়ে ফিরলে এইসব রান্নাবান্না ফেলে দিতুম আস্তাকুঁড়ে।
সেটা দেশের পক্ষে খুবই ক্ষতি হত! একে তো দেশে খাদ্যাভাব, তার ওপর এত ভালো রান্না…
তোমার পছন্দ হয়েছে?
দারুণ! হঠাৎ যদি এ-রকম সারপ্রাইজ দাও, তাহলে রোজই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব।
আহা হা-হা।
অনন্তকে কোনো ওষুধ দিয়েছ?
একদিনের জ্বর, কী আর দেব? বোধ হয় ঠাণ্ডা লেগেছে, সেদিন ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাইরে শুয়েছিল তো।
শৈবাল বলল, সত্যি তোমার রান্না খুব ভালো হয়েছে। দোকানের চেয়ে অনেক ভালো। তোমাকে এজন্য একটা প্রাইজ দেওয়া দরকার।
রান্নার প্রশংসা শুনলে সব মেয়েই খুব খুশি হয়। প্রমিতা বেশ ভালো মেজাজে অনেকক্ষণ গল্প করল খাওয়ার পর। তারপর বিছানায় শুয়ে সে-রাতটা এদের বেশ ভালোই কাটল।