১.২ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

‘যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি’

সব মানুষের বোধহয় ভেতর ভেতর চেষ্টা থাকে তার মনের অতলে ডুব দেবার। সকলেই কি তাই ভালবাসে তার আত্মনিঃসঙ্গতার স্বাদ? সকলে কি সেইজন্য ভিড়ের কথা বলে, কাজের চাপের কথা বলে? খুলতে চায় কাজের জট, এড়াতে চায় ভিড়ের জটিলতা। বহুজনতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা খুঁজতে চায় নিঃসীম একাকিত্ব। অথচ কতবার এর উলটোটাই দেখেছি। সাধক যারা, যারা দেহাত্মবাদী, চলতি কথায় যাদের বলে আউল বাউল দরবেশ, তাদের গভীর নির্জন সাধনায় কেমন করে যেন চিরকালের নিঃসঙ্গতা কায়েম হয়ে যায়। ভিড়ে তাদের ভয় থাকে না নিজেকে হারাবার। বোধহয় সেইজন্যেই তাদের সারাবছর ধরে এত মেলা আর মহোৎসব, দিবসী আর পার্বণ। কতবার সোৎসাহ আমন্ত্রণ পেয়েছি এ সবে। ‘আসবেন ১৪ই ফাগুন মচ্ছবে, আমার গুরুর আখড়ায়। খুব আনন্দ পাবেন।’ আসলে আনন্দ সবচেয়ে বেশি আমন্ত্রণকর্তার। এ তো আমাদের শহরের ক্লিষ্ট কর্তব্যতাড়িত সমাবেশ নয়। কোথায় একটা প্রাপ্তির সানন্দ বিস্তার আছে দেহতত্ত্ববাদীর ডাকে। বহুসময় জিজ্ঞেস করেছি: কী আনন্দ পান? খরচও তো প্রচুর।

: হিসেবের বাইরে একটা আনন্দ আছে যে! মানুষ দেখার আনন্দ। অনেক মানুষ আসবে। অনেক মানুষের সেবা দেওয়া যাবে। সব জাত সব বর্ণের মধ্যে সেই মানুষকে, সেই আসল মানুষকে দেখা যাবে।

: অত মানুষের ভিড়ে আসল মানুষকে চিনবেন কী করে?

: সে চেনা যায় আজ্ঞে। চকমকি দেখেছেন? লোহা আর পাথরের ঘর্ষণে সত্যিকারের আগুন এসে যায়। তেমনই মানুষে মানুষে মেশামেশি থেকে আসল মানুষ ভেসে ওঠে। এ আমরা কত দ্যাখলাম। ও সব হিমালয় টিমালয় গেলে কিস্যু পাবেন না। লালন বলে ‘মানুষ ধরলে মানুষ পাবি/ও সব তীর্থব্রতের কর্ম নয়’। তাই আপনাকে বলছি, এ সব বাউল ফকিরদের পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করবেন না। মেলায় মিশবেন।

রয়েল ফকিরের কাছ থেকে এ সব আমার শোনা, তা অনেক বছর তো হল। রয়েল ফকির। নামটার মতো মানুষটার মধ্যে ছিল রাজকীয়তা। লম্বা সুগঠিত চেহারা। আমাকে খুব সহজে বুঝিয়েছিল: বাবু, আসল মানুষ কাছে পিঠেই নড়ে চড়ে কিন্তু খুঁজলে জনমভর মেলে না। দুই ভুরুর মাঝখানে যে সূক্ষ্ম জায়গা তাকে বলে আরশিনগর। সেইখানে পড়শী বসত করে। পড়শী মানে মনের মানুষ। আরশি ধরলে পড়শী আর পড়শী ধরলে আরশি, কিছু বুঝলেন?

: অন্তত এইটুকু বুঝলাম যে আরশিনগরে পৌঁছোতে গেলে মানুষকে এড়ালে চলবে না, পড়শী ধরতে হবে।

: বিলক্ষণ। বাবু, আপনার আসল কথাটা বোঝা সারা। এবারে ক্রিয়া আর করণ।

: সেটা কী বস্তু?

‘সেটাই আসল’ রয়েল ফকির বলে, ‘মনে মনে জানা, ধ্যানে জ্ঞানে জানা, এবারে তাকে দেহ দিয়ে কায়েম করা, সেটাই আসল। যেমনধারা আপনি শুনলেন গাছে সুন্দর ফল পেকেচে। শুনলেই তো হবে না। দেখতে হবে, খুঁজতে হবে, গাছে উঠতে হবে এবং সবশেষে খেতে হবে। তবে সাঙ্গ হল। তা অত কথায় কাজ কী? আপনি আমাদের বড় বড় ক’টা বিখ্যাত মেলায় যাবেন, আচ্ছা আমার সঙ্গেই যাবেন। আমি সব বুঝিয়ে দেব। তা হলে সেই কথাই রইল। আপনি প্রথমে যাবেন দোলের সময় ঘোষপাড়ায়। সতীমার মেলায়। দোলের আগের দিন প্রভাতে আমার আখড়া থেকে রওনা। চলে আসবেন তৈরি হয়ে। থাকতে হবে তেরাত্তির। ব্যাস পাকা কথা।’

আমি বললাম: কথা পাকা। কিন্তু ওই মেলা সম্পর্কে আগে বইপত্তর থেকে আমি একটু লেখাপড়া করে নেব। খুব বিখ্যাত মেলা তো। দুশো বছরের মতো প্রায় বয়েস। মেলাটা সম্পর্কে একটু খুঁটিনাটি জেনে নেব।

: সে সব জেনে নেবেন বইকী। আপনারা জ্ঞানের পথের লোক তো। সব বাহ্য বিষয়ে নজর তাই। তবে আমরা হলাম ভাবের পথের লোক। আমাদের চলতে চলতেই সব বোঝা হয়ে যায়।

: কতদিন ধরে যাচ্ছেন ঘোষপাড়ার মেলায়?

‘সে কি আজ থেকে গো?’ রয়েল ফকির তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সে আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক। অর্থাৎ আমার দাদু-গোঁসাইয়ের কাল থেকে।’

: দাদু-গোঁসাই মানে?

: কথাটা ধরতে পারলেন না বুঝি? আমার যিনি বাবা আবার তাঁর যিনি বাবা তিনি আমার কে? না, দাদু। তেমনই আমার যিনি গুরু তিনি আমার গোঁসাই। আর আমার গোঁসাইয়ের যিনি গুরু তিনি আমার দাদু-গোঁসাই। এবারে বুঝলেন?

: বুঝলাম। কিন্তু এইটে বুঝলাম না যে যারা বৈরাগ্যের পথে নেমেছে তারা সব সংসারী লোকের মতো দাদু-নাতি সম্বন্ধ পাতায় কেন?

: শুধু দাদু-নাতি নয়। গুরু পিতা শিষ্য সন্তান। গুরুপত্নীকে শিষ্য বলে মা-গোঁসাঞি। আমাদের চলতি কথায় শিষ্যসেবক না বলে বলে শিষ্যশাবক। সব সম্পর্কে বাঁধা। আমাদের পথ যে রসের পথ বাবা। তালগাছ দেখেছেন? খেজুর গাছ? সব খাড়া উঠে গেছে মাটির দিকে ফেরে না আর। কামিনীকাঞ্চনত্যাগী ধর্ম ওইরকম—মাটি আর মানুষের দিকে নজর নেই। আর আমাদের সতী মার ধর্ম হল গৃহীধর্ম। বটগাছের মতন। কেবলই ঝুরি নামছে। ছেলেপুলে নাতিপুতি রস টানছে মাটি আর মানুষের কাছ থেকে। গোঁসাঞি, মা-গোঁসাঞি, দাদু-গোসাঞি সব নিয়ে আমাদের চলা।

: এই সতী মার ধর্ম বা কর্তাভজা মতের শুরু কোথা থেকে?

: কেন? আউলচাঁদ থেকে।

: আউলচাঁদ কে?

: আউলচাঁদ গোরাচাঁদের অবতার। শ্রীক্ষেত্রে গোপীনাথের মন্দিরে গোরাচাঁদ হারিয়ে যান। তারপরে আউলচাঁদের রূপ নিয়ে এই ঘোষপাড়ায় তাঁর উদয়। এবারে তাঁর জন্ম হয়েছে গৃহীদের জন্যে কর্তাভজা ধর্মের পথ তৈরি করার কারণে। তিনিই আদিকর্তা। তাঁর থেকেই এই মত।

: তাহলে সতী মা কে?

‘তা হলে শোনেন সবিস্তারে’ রয়েল বেশ ভব্যিযুক্ত হয়ে বসে ভক্তিমানের মতো বলে; ‘আউলচাঁদের ছিলেন বাইশজন শিষ্য। তাদের মধ্যে প্রধান হলেন রামশরণ পাল। সাকিন ঘোষপাড়া মুরতীপুর, জাতি সদ্‌গোপ। তাঁর পরিবারের নাম সরস্বতী। সেই সরস্বতী থেকে সতী। বুঝলেন?’

আমি তর্ক তুললাম: তা কী করে হয়? সরস্বতী থেকে সতী? কেমন করে?

‘হয়, হয়’ রহস্যের হাসি রয়েল ফকিরের মুখে, ‘আপনি ধৰ্ম্মের ভেতরকার সুলুক জানেন না, তাই এমন ধন্দ। আচ্ছা, আপনারে বোঝাই। সরস্বতীর আদ্যক্ষর ‘স’ আর শেষঅক্ষর ‘তী’ হল? এই দু’ই মিলে সতী। এবারে বুঝলেন?’

আমতা আমতা করে বলতেই হল, ‘ব্যাপারটা বেশ মজার। এ রকম আরও নমুনা আছে নাকি?’

: বিলক্ষণ। এই যেমন ধরুন রামশরণ আর সতী মার একমাত্র সন্তান হলেন রামদুলাল ওরফে দুলালচাঁদ। তো সেই দুলালের ‘লাল’ আর চাঁদের বদলে ‘শশী’ বসিয়ে তিনি নাম নিলেন লালশশী। এই লালশশীকে আমরা বলি ‘শ্ৰীযুত’। তাঁর লেখা গানই আমাদের ধর্মসংগীত। সে গানের বইয়ের নাম ‘ভাবের গীত। তাকে আমরা বলি আইনপুস্তক। শুক্কুরবারে সন্ধেবেলা আমরা একসঙ্গে বসে শ্ৰীযুতের আইনপুস্তক থেকে গান করি।

: শুক্কুরবার কেন? ওটা তো মুসলমানদের জুম্মাবার। তবে কি আউলচাঁদের সঙ্গে মুসলমান বা ফকিরিধর্মের কোনও যোগ ছিল?

রয়েল ফকির বললে, ‘আজ্ঞে সে সব গুহ্যকথা আমার গোঁসাই আমারে বলেন নি কিছু। তবে লালশশীর গানে যা বলেছে তা গাইতে পারি। শুনুন—

তার হুকুম আছে শুক্রবারে সৃষ্টির উৎপত্তি

সেই দিনেতে সবে হাজির হবে

যে দেশেতে আছে যার বসতি।

আছে যে দেশেতে যে মানুষ সবে হাজির হন

পরস্পর সেই অষ্টপ্রহর পরেতে স্ব স্ব স্থানে যান।

এই শুক্রবারে প্রহর রাত্রে লয়ে আশীর্বাদ।

যার মনে যা বাঞ্ছা আছে পূর্ণ হয় সে সাধ।

রয়েল ফকিরের সঙ্গে আমার যখন এ সব কথা হয় তখনও বিখ্যাত লেখক কমলকুমার মজুমদার বেঁচে ছিলেন। কে না জানে এ দেশের নানা বিদ্যা ও দেশজ সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। প্রথমবার ঘোষপাড়ার মেলায় যাবার আগে তাই কমলকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: ঘোষপাড়ার মেলা সম্পর্কে কিছু জানেন? আমি সামনের পূর্ণিমায় সেখানে যাব।

কমলকুমার প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপরে নাক কুঁচকে বললেন, ‘সে তো এক অসভ্য জায়গা মশাই। যাবেন না। শেষকালে কি এক বিপদ আপদে পড়বেন।’

তাঁর কথায় অবাক লেগেছিল। কথা হচ্ছিল এক প্রকাশকের ঘরে বসে। এক গবেষক ফস করে তাক থেকে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ খুলে কয়েক জায়গা পড়ালেন। দেখা গেল সহজিয়া এই প্রকৃতিভজা ধর্মের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণ নানা বিদ্বেষ প্রকাশ করে গেছেন। আবার শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বই থেকে সেকালের বাবুসমাজের বিবরণ পড়ে তিনি শোনালেন। বাবুরা নাকি ‘খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা ও মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতি সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইত।’

যেন মৌচাকে ঢিল পড়েছে। গবেষক অনর্গল বলে যান অক্ষয়কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে নাকি কর্তাভজাদের সম্পর্কে গালমন্দ আছে। যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘হিন্দু কাস্টস অ্যান্ড সেক্টস’বইতে ঘোষপাড়াকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছেন সেই ১৮৯৬ সালে। ওয়ার্ড সাহেব বা উইলসন সাহেবও নাকি রেয়াৎ করেননি। ‘এই তো’ ‘এই তো’ বলে ভদ্রলোক শেষমেষ বিনয় ঘোষের বই খুলে একটা জায়গা পড়তে লাগলেন:

এ বৎসর দোলে প্রায় ৬৫ হাজার লোকের সমাগম হইয়াছিল। যাত্রীদিগের মধ্যে চৌদ্দ আনা স্ত্রীলোক। কুলকামিনী অপেক্ষা বেশ্যাই অধিক; পুরুষদিগের সকলেই প্রায় মূর্খ।

দেখিলাম জনা ২০ রোগী আরোগ্যলাভ করিবার আশায় দাড়িম্বতলায় হত্যা দিয়া পড়িয়া রহিয়াছে। অন্য অন্য ধর্মাবলম্বিদিগের ন্যায় ইহাদিগের বুজরুকীও অল্প নয়। কোন পরিচিত ব্যক্তিকে বোবা সাজাইয়া ‘বোবার কথা হউক’ প্রভৃতি বলিয়া রোগ আরাম করিতেছে।

অনেক লোকের মুখে শুনিয়াছি এই ধর্মাবলম্বিদিগের মধ্যে শ্রীবৃন্দাবনের প্রকৃত কৃষ্ণলীলাটাই অনুষ্ঠিত হয়।

আমি জানতে চাই এ বিবরণ কবেকার? জানা যায় ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৩ চৈত্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’ কাগজের ২১ সংখ্যা থেকে প্রতিবেদন খুঁজে পান বিনয় ঘোষ। আশ্চর্য হই। একটা গ্রাম্য লৌকিক ধর্ম সেকালে কলকাতার এত মানুষের বিদ্বেষ সয়েছিল? কর্তাভজাদের আচরণ সকলের এত খারাপ লেগেছিল? নীতিবাদী ব্রাহ্ম অক্ষয়কুমার কিংবা নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ যোগেন্দ্রনাথ না হয় খানিকটা ধর্মান্ধ হয়ে কর্তাভজাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, কিন্তু উদার সমন্বয়বাদী শ্রীরামকৃষ্ণ? তিনি কেন এঁদের ভুল বুঝেছিলেন? কমলবাবুও কি রামকৃষ্ণপন্থী বলেই ওঁদের বিষয়ে অসহিষ্ণু?

পরদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা স্বস্তিকর তথ্য মিলল নবীনচন্দ্র সেনের ‘আমার জীবন’বইয়ের চতুর্থভাগে। ১৮৯৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল ঘোষপাড়ার মেলার তত্ত্বাবধান। সরেজমিন সেই মেলা দেখে নবীনচন্দ্র লেখেন:

আমার বোধ হইল ‘কর্তাভজা’ রূপান্তরে হিন্দুদের ‘গুরুপূজা’ মাত্র। তাহাদের ধর্ম বেদান্তের মায়াবাদের প্রতিবাদ। যে-রামশরণ পাল বেদ-বেদান্ত প্লাবিত দেশে এরূপ একটা নূতন ধর্ম প্রচার করিয়া এত লোকের পূজাৰ্হ হইয়াছিলেন, তিনি কিছু সামান্য মানুষ ছিলেন না। যথার্থই কাল্পনিক মূর্তির পূজা না করিয়া এরূপ পূজনীয় ব্যক্তির পূজা করিলে ক্ষতি কি? এখন যে harmony of scripture বা ধর্মের সামঞ্জস্য বলিয়া একটা কথা শুনিতেছি, দেখা যাইতেছে, এই রামশরণ পালই তাহা সর্বপ্রথম অনুভব করিয়াছিলেন। সকল ধর্ম, সকল আচার সত্য—এমন উদার মত এক ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কোনও ধর্মসংস্থাপক প্রচার করেন নাই। অতএব রামশরণ পাল, আমি তোমাকে নমস্কার করি। আমি এতদিনে কর্তাভজা ধর্ম কি বুঝিলাম, এবং ভক্তিপূর্ণ-হৃদয়ে আমার শিবিরে ফিরিলাম।

পরিষদ পাঠাগারেই দেখা হয়ে গেল এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে। উনিশ শতকের বাঙালিসমাজ নিয়ে তাঁর কাজ। আমার সমস্যা তাঁর কাছে ব্যক্ত করতেই দিলেন একগাদা বইয়ের ফর্দ। সেসব বই ঘেঁটে দেখা গেল: উনিশ শতকের গোড়ায় কর্তাভজাদের নিয়ে কলকাতার ব্রাহ্ম খ্রিস্টান আর হিন্দুধর্মের মানুষদের খুব মাথা-ব্যথা ছিল। প্রথমে ‘ইতরলোকদের ধর্ম’, ‘ওদের জাতপাঁত নেই’, ‘ওরা কদর্যভক্ষণ করে’, ‘মেয়েমানুষ নিয়ে ওরা গোপনে রাসলীলা করে’—এ সব কথা খুব রটানো হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ আর জাত-বৈষ্ণবদের মধ্যে থেকে বহুলোক ভেতরে ভেতরে কর্তাভজা ধর্মে আকর্ষণ বোধ করছিলেন। সেকালের কলকাতার কৈবর্ত তিলি গন্ধবণিক শাঁখারী বেনে তাঁতি এইসব নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে বা নবশাখদের কাছে ‘ঘোষপাড়ার মত’ বা সত্যধর্ম খুব সহজ সরল সাদাসিধা বলে মনে হতে লাগল। তাঁরা নিজের নিজের এলাকায় ‘আসন’ বানালেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় শুরু হল সমাবেশ। প্রথমে গোপনে পরে সগর্বে। বর্ণহিন্দুদের মধ্যে অনেকে, এমনকী অনেক বড় মানুষ কর্তাভজাদের ব্যাপারে ক্রমে উৎসাহ দেখালেন। যেমন ভূকৈলাসের মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল। ১২২১ সালে তিনি বেনারসে ‘করুণানিধানবিলাস’নামে যে বিরাট কৃষ্ণলীলার কাব্য লিখেছিলেন তাতে রামশরণ পালকে উল্লেখ করেছিলেন অবতার বলে।

কর্তাভজাদের ভক্তি আর বিশ্বাসের তীব্রতা বিপ্লব এনেছিল সেকালের ব্রাহ্ম সেবাব্রতী শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে। তাঁর জীবনীকার কুলদাপ্রসাদ মল্লিক লিখেছেন:

শশিপদবাবুর সময়ে বরাহনগরে ‘কর্তাভজা’ নামক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনেকগুলি উপাসনাস্থল ছিল। বনহুগলীতে নিমচাঁদ মৈত্রের বাগান এই সমস্তের মধ্যে অন্যতম। এইস্থানে সপ্তাহে একদিন করিয়া নিম্নজাতীয় হিন্দুগণ সম্মিলিত হইত এবং তাহাদের সাম্প্রদায়িক বিশেষ পদ্ধতি অনুসারে স্তোত্রপাঠ ও আরাধনা করিত। শ্রীযুক্ত শশিপদবাবু সময়ে সময়ে এই স্থানে যাইতেন। তিনি স্বীকার করেন যে, তাহাদের উপাসনার ঐকান্তিকতার দ্বারা তিনি সেই দলে মিশিয়া বিশেষরূপে উপকৃত হইতেন।

কর্তাভজাদের সত্যধর্মযাজন এবং জাতিপঙ্‌ক্তিহীন উদার সমন্বয়বাদ সেকালে খুব সাধারণ মানুষদেরও কতখানি দ্বিধায় ফেলেছিল তার নমুনা মেলে ১২৫৪ বঙ্গাব্দে ১৮ চৈত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ ছাপা জনৈক পত্রদাতার বক্তব্যে। ঘোষপাড়ার মেলা স্বচক্ষে দেখে তিনি লেখেন:

ঐ বহুসংখ্যক কর্ত্তামতাবলম্বিরা কেবল যে ইতর জাতি ও শাস্ত্রবিধিবর্জ্জিত মনুষ্য তাহা নহে তাহাদের মধ্যে সৎকুলোদ্ভব মান্য, বিদ্বান, এবং সূক্ষ্মদর্শিজন দৃষ্ট হইল।…

যেহেতু ব্রাহ্মণ, শূদ্র, যবন প্রভৃতি জাতি নীচেদের অন্নবিচার না করিয়া এরূপ ক্ষেত্রে ভোজন ও পান করে ইহা কুত্রাপি কোন স্থানে দেখি নাই ও শুনি নাই, বিশেষ আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে যদবধি আমরা উক্ত পল্লীতে উপস্থিত ছিলাম তদবধিক্ষণ মাত্র কাহাকেও অসুখি দেখি নাই, সকলেই হাস্যাস্যে সময়ক্ষেপ করিতেছিল, বোধহয় রাসের তিন দিবস তথায় আনন্দ বিরাজমান থাকে, সম্পাদক মহাশয়, ঘোষপাড়ার বিষয়ে নানা মহাশয়ের নানা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, কিন্তু আমরা অল্পবুদ্ধিজীবী মনুষ্য হঠাৎ কোন বিষয়ে কোন মত প্রকাশ করিতে সাহসিক হই নাই, ঘোষপাড়া ধৰ্ম্মের নিগূঢ় তথ্য যে পর্য্যন্ত আমরা না জানিতে পারি সে পর্য্যন্ত তদ্বিষয়ে আমরা কিছুই স্থির করিতে সক্ষম হইব না, যদিও এ ধৰ্ম্ম শাস্ত্রসম্মত নহে ও ইহার বাহ্যপ্রকরণ সমস্ত অনাচারযুক্ত, কিন্তু যখন বহুলোকের ঐ মতের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা এবং ইদানীন্তন বিদ্যার স্রোত প্রবল হইয়া হ্রাস না হইয়া উন্নতি হইতেছে তখন ইহার অন্তরে কিছু সারত্ব থাকিবেক, এরূপ অনুমান করা নিতান্ত অসম্মত নহে।

নবীনচন্দ্র সেন যখন ১৮৯৫ সালে ঘোষপাড়ার মেলায় যান তখন সকালবেলা কয়েকজন ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁরা ‘সকলেই প্রায় গ্র্যাজুয়েট, সুশিক্ষিত ও পদস্থ। সকলেই কর্তাভজা’। এ সব বিবরণ পড়ে জানতে ইচ্ছে করে কতসংখ্যক মানুষ না জানি আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিলগ্নে কর্তাভজা ধর্মে যোগ দিয়েছিল যাতে নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণরা বার করেছিলেন জেলেপাড়ার সং তাদের গালমন্দ করে কিংবা নবদ্বীপের পণ্ডিতদের মদতে দাশু রায় লিখেছিলেন কর্তাভজা পাঁচালী। তার ব্যঙ্গ বড় নির্মম আর অশালীন। যেমন:

কর্তাভজা করতে যাই চলো সকলে।

বজায় করবি যদি দুকুলে

কেন যাস হয়ে ব্যাকুলে

হারিয়ে দুকূল কুল তেজে অনন্ত কুলে।

এতে করতেছে মজা কতজন

করিয়ে পূজা আয়োজন

যাবো নির্জন স্থানে প্রতি শুক্রবারে হ’লে।

বৃক্ষে উঠি হবেন মুরলীধর

আমরা করে ঢাকিব পয়োধর

হেসে আধা করিব অধর

তখন কত সুখ পাবে।

হবে ব্রজের লীলা শুন বলি।

কেউ বৃন্দে কেউ চন্দ্রাবলী

ললিতে আদি কেউ হবে শ্রীরাধা

লেগে যাবে ভারি চটক

কেউ কারে করিবে না আটক

কর্মে দিবে না কেউ বাধা।

এত যে প্রতিরোধ, এমন যে বিদ্রুপ তার মূলে শুধুই ভ্রষ্টাচার আর ধর্মীয় বিরোধ? আমার তো মনে হয়, কর্তাভজাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা আর সংঘবদ্ধতা ভাবিয়ে তুলেছিল হিন্দু আর ব্রাহ্মদের। কিন্তু কত শিষ্য ছিল এঁদের? তাঁদের সংগঠিত করলেন কে?

নিঃসন্দেহে দুলালচাঁদ ওরফে লালশশী। উনিশ শতকীয় শিক্ষিত যুবা। বাংলা সংস্কৃত ইংরাজি পারসি চারটি ভাষাই ভালমতো জানতেন। ১৭৮৩ সালে যখন রামশরণের মৃত্যু ঘটে তখন দুলালচাঁদের বয়স মাত্র সাত। তাঁর মা সরস্বতী দেবী (পরে তিনি বিখ্যাত হন ‘সতী মা’ নামে) কিছুকাল কর্তাভজাদের নেতৃত্ব দেন। তারপরে দুলালের ষোলো বছর বয়স হতেই তাঁর হাতে নেতৃত্ব আসে। কিন্তু অপরিণত বয়সে দুলাল মারা যান ১৮৩৩ সালে। এই ক্ষণজীবী মানুষটি কর্তাভজাদের আচরণবিধি ও সংগঠন চিরকালের মতো সুদূঢ় করে গেছেন। রয়েল ফকিররা একশো বছর ধরে এঁর লেখা আইনপুস্তক ‘ভাবের গীত’ গায়, বুকে ভরসা জাগে। সে গানগুলি নাকি মুখে মুখে বলে যেতেন দুলাল আর লিখে নিতেন রামচরণ চট্টোপাধ্যায়। রামচরণ মূলে ছিলেন বেলুড়ের এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। তিনি ছাড়া দুলালের ঘনিষ্ঠ পার্ষদ ছিলেন বাঁকাচাঁদ, কাশীনাথ বসু, শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য, রামানন্দ মজুমদার আর নীলকণ্ঠ মজুমদার। ১৮৪৬ সালের ‘ক্যালকাটা রিভিয়্যু’-এর ষষ্ঠ খণ্ডে দুলাল সম্পর্কে একটি বর্ণনা রয়েছে। তাতে দেখা যায় ১৮০২ সালে মার্শম্যান আর কেরি দুলালের কাছে গিয়েছিলেন সর্বেশ্বরবাদ নিয়ে তর্ক করতে। তাতে দুলালের চেহারার বর্ণনায় বলা হয়েছে ‘he was no less plump than Bacchus’। মানুষটি কি উনিশ শতকীয় রীতিমাফিক খুব ভোগীও ছিলেন? একজন লিখেছেন:

কর্তাভজা সম্প্রদায় সর্বজাতের মিলনক্ষেত্র রচনায় দুলালচাঁদ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র জাতীয় চারিটি কন্যাকে বিবাহ করেন। চারিটি স্ত্রীর গর্ভে পাঁচটি পুত্রসন্তান হয়।

কর্তাভজাদের সম্পর্কে সাহেবদের উৎসাহ ও সতর্কতা লক্ষ করবার মতো। কেরি, মার্শম্যান ও ডাফসাহেব খুব নজর রাখতেন ঘোষপাড়ার দিকে।* ১৮১১ সালে ডব্লিউ. ওয়ার্ড দুলালের জীবিতকালে যে প্রতিবেদন লিখে গেছেন তাতে বলেছেন:

Doolalu, the son, pretends that he has now 400000 disciples spread over Bengal.

ওয়ার্ড অবশ্য ১৮১৮ সালে তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে এই চার লক্ষ শিষ্যসংখ্যা কমিয়ে এনেছেন কুড়ি হাজারে।

রয়েল ফকিরের দলের সঙ্গে আমি যখন ঘোষপাড়ায় যাচ্ছিলাম তখন তার দলবল গাইছিল এক আশ্চর্য কোরাস:

দিলে সতীমায়ের জয় দিলে কর্তামায়ের জয়

আপদখণ্ডে বিপদখণ্ডে খণ্ডে কালের ভয়।

দিলে মায়ের দোহাই ঘোচে আপদ বালাই

ছুঁতে পারে না কাল শমনে।

এই সতী মা যে কেমন করে ক্রমে ক্রমে কর্তা মা হয়ে উঠেছিলেন সেও এক রহস্য। কেননা ১৮১১ সালে এবং ১৮২৮ সালে ওয়ার্ড সাহেব এবং পরে হোরেস হেম্যান্‌ উইলসন তাঁদের লেখায় রামশরণ ও দুলালচাঁদের সুবিস্তৃত উল্লেখ বারবার করলেও এক জায়গাতেও সতী মা-র কথা লেখেননি। বরং ওয়ার্ড সাহেব ঐশীক্ষমতা ও রোগ আরোগ্যের মিথ তৈরি করেছেন আউলচাঁদ ও রামশরণের নামে। আউলচাঁদ সম্পর্কে বলেছেন: ‘It is pretended he communicated his supernatural powers’ এবং রামশরণ পাল সম্পর্কে, ‘He persuaded multitudes that he could cure leprosy and other diseases’। এই রোগারোগ্যের কৌশলে অসহায় মানুষকে ঠকিয়ে রামশরণ যে বিপুল অর্থ সম্পত্তি বানিয়েছিলেন ওয়ার্ড সে ইঙ্গিত গোপন রাখেননি। তাঁর মতে ‘By this means, from a state of deep poverty he became rich and his son now lives in affluence’।

সমস্যাটা এইখানে। রোগ সারাবার গল্প কিংবা কল্পকাহিনীগুলি সতী মা-র নামে রটল কেমন করে? ‘সহজতত্ত্ব প্রকাশ’ নামে একটা বইয়ে সমস্যাটার জবাব আছে। মনুলাল মিশ্র নামে এক কর্তাভজা এ বইয়ে লেখেন:

তাঁহার [অর্থাৎ রামশরণ] তিরোধানের পর মহাত্মা দুলালচাঁদের চেষ্টায় সুষ্ঠুভাবে প্রচারিত সতী মায়ের অলৌকিক শক্তির কাহিনী কর্তাভজন ধর্মকে জগতে প্রচারিত হইতে সাহায্য করিয়াছিল।

রয়েল ফকিরের তো এ সব কথা জানা নেই। সে শুধু বিশ্বাস করে। তার পায়ের তলার মাটিতে নেই সংশয়ের ফাটল। সে জানে এবং মানে যে ঘোষপাড়ার ডালিমতলার মাটি গায়ে মেখে হিমসাগরের জলে স্নান করে সতী মায়ের নাম ভক্তিভাবে নিলে সব রোগ সেরে যায়। ঘোষপাড়ার মেলার আগের দিন সেই ভরদুপুরে অগণিত ভক্ত মানুষদের মাঝখানে আসন পেতে বসে ডালিমতলার দিকে তাকাই। এই মাটিতে সব রোগ সারে? এত হাজার হাজার মানুষ সেই বিশ্বাসের জোরে এখানে এসেছে? রয়েল ফকির আমার সংশয়ী চোখে চোখ রেখে হেসে বলে, ‘বাবা বিশ্বাস করো, বিশ্বাসে মুক্তি।’ তারপরে তার দলের দীনুরতন দাসীকে বলে, ‘দীনু, সতী মায়ের মাহিত্ম্য তুমি বাবুরে একটু শোনাও দিনি। উনি শান্তি পাবেন।’

দীনুরতন দাসী ঊর্ধ্ব করে অলক্ষ সতী মাকে প্রণতি জানিয়ে পাঁচালীর সুর করে বলে।

সতী মা উপরে যেবা রাখিবে বিশ্বাস।

সেরে যাবে কুষ্ঠ ব্যাধি হাঁপ শূল কাশ॥

কৃপা হলে ভবে তাঁর ঘটে অঘটন।

অন্ধ পায় দৃষ্টিশক্তি বধিরে শ্রবণ॥

চিত্ত যেবা রাখে পায় বিত্ত পায় ভবে।

বন্ধ্যানারী পুত্র পাবে তাঁহার প্রভাবে॥

সতী মার ভোগ দিতে হবে যার মতি।

সকল বিপদে সেই পাবে অব্যাহতি ॥

কথাগুলো রয়েল ফকিরের দলের সকলেরই খুব মনোমত সে কথা বোঝা যায় তাদের মাথার দুলুনিতে। রয়েল ফকির বলেন: আমরা এইরকম শুনেচি যে আউলচাঁদ ফকির, রামশরণ আর সরস্বতীর সেবাধর্মে অনেকদিন ধরে খুব তুষ্ট হয়ে শেষে একদিন বললেন, ‘এবারে আমি চলে যাব।’ ‘না না’ সরস্বতী কেঁদে পড়লেন তাঁর পায়ে। অনেক কান্নাকাটির পরে শেষমেশ রফা হল আউলচাঁদ জন্মাবেন তাঁর গর্ভে সন্তান হয়ে। সেই সন্তানই হলেন আমাদের এই লালশশী। তিনিই নিরঞ্জন। গোকুলে যেমন যশোদার দুলাল কৃষ্ণ, অযোধ্যায় যেমন কৌশল্যার দুলাল রামচন্দ্র, নবদ্বীপে যেমন শচীমার দুলাল গোরাচাঁদ, আমাদের এই ঘোষপাড়ায় তেমনই সতী মায়ের দুলালচাঁদ। এই চারেই এক, একেই চার। বুঝলেন?

বুঝলাম, কর্তাভজা ধর্মে রয়েছে এক মেধাবী বিন্যাস, যার মূলে দুলালচাঁদের কল্পনাগৌরব আর বুদ্ধির কৌশল। একদিকে অবতারত্ত্ব আরেকদিকে রোগ আরোগ্যের উপাখ্যান। একদিকে সহজসাধন আরেকদিকে ভাবের গান। একদিকে আসন-গদি-অর্থাগম আরেকদিকে বিধবা ও পুত্রহীনাদের সান্ত্বনা। শিক্ষিত মানুষের কাছে যা সমন্বয়বাদের কারণে আকর্ষণীয়, অশিক্ষিতদের কাছে তা সতী মা-র মাতৃতান্ত্রিকতায় ভরপুর ও মোহময়। অবশ্য দুলালচাঁদের ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তিগত এলেমও কম ছিল না। জানালেন সত্যশিব পাল দেবমহান্ত অর্থাৎ দুলালের উত্তরপুরুষ অন্যতম কর্তা। সুবিনয়ী শিক্ষিত মানুষ সত্যশিব বাবু দুলালের প্রশস্তি করতে গিয়ে আমাকে চমকে দিয়ে জানালেন, ‘১৮৯৩ সালে শিকাগোর রিলিজিয়াস কংগ্রেসে রামদুলাল পাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। সে চিঠি আমার কাছে আজও আছে। চিঠির তারিখ ১৭ এপ্রিল ১৮৯৩। কিন্তু তার অনেক আগেই তো দুলালচাঁদ দেহ রেখেছেন। তাই তাঁর নাতি সত্যচরণ দেবমহান্তকে ওই পদ দেওয়া হয়।’

‘এই দেবমহান্ত ব্যাপারটি কী?’ আমি জানতে চাই।

সত্যশিব পাল দেবমহান্ত দুলালচাঁদের চতুর্থ পুরুষের উত্তরাধিকারী। শালপ্রাংশু চেহারা। বললেন: দেবমহান্ত একটি টাইটেল। আমাদের বংশে রামদুলাল এই উপাধি পান নদীয়ার মহারাজার কাছ থেকে।

:কী কারণে টাইটেলটা পান তিনি?

: ব্যাপার কী জানেন, বৈশাখী পূর্ণিমাতে ঘোষপাড়ায় রথযাত্রা হত, এখনও হয়। নদীয়ার মহারাজা একবার বললেন বৈশাখ মাসে রথ অশাস্ত্রীয়, কাজেই তা বন্ধ করতে হবে। তিনি জোর করে রথযাত্রা বন্ধের আদেশ দেন। তখন ভক্তরা দুলালচাঁদকে রথে বসায় আর বিনা আকর্ষণে রথ চলতে থাকে। সেই ঘটনায় দুলালচাঁদ দেবমহান্ত হন।

কিংবদন্তির ধোঁয়াশা কাটাতে আমার ঝটিতি জিজ্ঞাসা ‘ঘোষপাড়ার এরিয়া কতটা?’

: দক্ষিণে কল্যাণী উপনগরী, উত্তরে চরবীরপাড়া, পূর্বে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমে চরসবাটি এই হল সীমা। এখন আমাদের ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন জমির পরিমাণ ৬.২৯ একর। আগে ঘোষপাড়ার মেলা ৬০০ বিঘা আমলিচুর বাগান সমেত জমিতে বসত। প্রায় সাড়ে তিন হাজার গাছ ছিল। একেক গাছের তলায় একেক ‘মহাশয়’ তাঁর দল নিয়ে বসতেন। তারপরে গত যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার জমি নিয়ে নেন। যুদ্ধের পরে সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ মেলার জন্যে ওই ৬০০ বিঘা ছেড়ে দেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেলার জন্যে মাত্র ৩০ একর জমির সংরক্ষিত রাখেন। তারমধ্যে আবার জবরদখল ঘটেছে। গড়ে উঠেছে কলোনি। মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে।

রয়েল ফকিরের সঙ্গে প্রথম যাওয়ার পর অবশ্য আরও অন্তত দশবার গেছি ঘোষপাড়ার মেলায়। শুধুই মনে হয়েছে মেলায় দিনে দিনে যত লোক বাড়ছে ততই জায়গা কমছে। কিন্তু সে কথায় যাবার আগে রয়েল ফকিরের ঘটনাটা শেষ করি। দোলের আগের দিন সকালে ফকির আমাকে নিয়ে বিরাট মেলা চত্বরের নানাদিকে ঘোরালেন আর চেনালেন সবকিছু। ‘এই হল হিমসাগর, এখানে কাল চান করবে ভক্তবৃন্দ’ আর ব্যাধিগ্রস্তরা।’ ‘ওই দেখুন ডালিমতলা। এখানকার মাটি মাখলে আর খেলে সব রোগের মুক্তি।’ ‘চলুন একটু পুবদিকে যাই, ওখানে অনেক বাউল ফকির দরবেশ আসেন।’ হঠাৎ রয়েল ফকির বলে বসেন, ‘এই এই তো শিবশেখরের আসন। আসুন বাবা, এখানে বসুন।’

শিবশেখর হলেন এক চুল কোঁকড়ানো সুগঠন যুবা। ভক্তিমানের মতো মাথা নিচু করলেন। রয়েল বললে, ‘এঁদের এক মস্ত “মহাশয়” বংশ মুর্শিদাবাদ জেলার কুমীরদহ গ্রামে।’ সবাই বসলে আমি বললাম, ‘এই “মহাশয়” ব্যাপারটি কী বলুন তো?’

শিবশেখর বললেন, ‘এখানে ঘোষপাড়ায় নিত্যধামে আমাদের মূল “আসন”। এখানকার যাঁরা প্রত্যক্ষ শিষ্য তাঁদের মধ্যে যাঁরা ভক্তিমান ও অবস্থাপন্ন তাদের বাড়িতে “আসন” থাকে। তাঁরা দীক্ষা দেন। এঁদের বলে “মহাশয়”। আর মহাশয়রা যাঁদের শিষ্য করেন তাঁদের বলে “বরাতি”।’

: আপনারা ক পুরুষের মহাশয়?

: আমাকে নিয়ে ছয় পুরুষ চলছে। ছ পুরুষ আগে আমাদের পূর্বপুরুষ নফর বিশ্বাস, ভোল্লাগ্রামের মহাভারত ঘোষ আর হরিহর পাড়া-মালোপাড়ার তেঁতুল সেখ এই তিনজন ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে দীক্ষা দেন। তারিখ ছিল ২৮শে কার্তিক। সেই থেকে ২৮শে কার্তিক আমাদের কুমীরদহ গ্রামে মহোৎসব হয়। আপনি এবারে যাবেন। খুব জাঁক হয়।

: আপনার ছ পুরুষের নাম বলতে পারেন?

: আজ্ঞে হ্যাঁ। লিখে নিন। আমার নাম শিবশেখর মণ্ডল। আমার বাবা যদুলাল মণ্ডল, তাঁর বাবা দুকড়ি, তাঁর বাবা চাঁদ সিং, তাঁর বাবা ফতে সিং, তাঁর বাবা নফর বিশ্বেস।

জবাব শুনে আমি তো অবাক! বিশ্বাস থেকে মণ্ডল, মাঝখানে আবার সিং? খানিকটা সংকোচ নিয়েই বলি: আপনারা কি তবে মাহিষ্য?

: আমরা মুসলমান।

বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়। নাম শিবশেখর, পিতা যদুলাল অথচ জাতে মুসলমান? দেখি, রয়েল ফকির মিটিমিটি হাসছে। ভাবখানা যেন, ‘বাবু এই মজা দেখাতেই তো আপনাকে আনা।’ ‘মানুষের কারবার দেখলি আপনি তাজ্জব হয়ে যাবা।’

শিবশেখর বলে, ‘বাবু জন্মে আমরা মুসলমান তবে কর্মে এই সতী মার দোরধরা।’

: মুসলমান ধর্ম পালন করেন না?

: বাড়িতে ঈদ্‌গাহ আছে। দুই ঈদ পালন করি। মসজিদে যাই না। বাড়িতে ছ পুরুষের পুজো করা আসন আছে। সতী মার ঘটে প্রত্যেক শুক্রবার উপাসনা সিন্নিভোগ হয়।

: খাওয়া-দাওয়ার কোনও বিধি আছে নাকি?

: তেমন আর কী? শুধু সম্বৎসর নিরামিষ খাই বাড়ির সকলে।

নিরামিষভোজী মুসলমান তায় আবার নাম শিবশেখর! এমন একটা বিস্ময়ের ধাক্কা সামলানো কঠিন বইকী। জাতাজাতির সংস্কার এমন বদ্ধমূল এই উচ্চশিক্ষিত মনেও সে অঙ্ক মেলে না। আমার বিপন্নতা দেখে রয়েল ফকির শিবশেখরের আখড়ার গাহককে রহস্যময় হেসে কানে কানে কী একটা গান গাইতে বলে। সে সঙ্গে সঙ্গে একতারা বাজিয়ে গান ধরে:

জাত গেল জাত গেল ব’লে

এ কি আজব কারখানা।

সত্য কথায় কেউ রাজি নয়

সবই দেখি তা না না না॥

কী আশ্চর্য, রয়েল ফকির কি তবে আমাকে তা না না না-র দলে ফেলে দিল? ততক্ষণে সেই অজানা গ্রাম্য গায়ক ভ্রূকুটি করে সরাসরি আমাকেই যেন জিজ্ঞেস করে বসে তার গানের অন্তরায়:

এই ভবেতে যখন এলে

তখন তুমি কী জাত ছিলে?

যাবার সময় কী জাত হবে

সে কথা তো কেউ বলে না॥

ব্রাহ্মণ চাঁড়াল চামার মুচি

এক জলে হয় সবাই শুচি

দেখে কারও হয় না রুচি

শমনে কাউকে থোবে না॥

এ ভর্ৎসনা কি আমাকেই? ভাববার আগেই গ্রাম্য গানের দারুণ লজিক আমাকে আঘাত করে এইখানে যে,

গোপনে যদি কেউ বেশ্যার ভাত খায়

তাতে জাতির কি ক্ষতি হয়?

ফকির লালন বলে জাত কারে কয়

এ ভ্রম তো আমার গেল না॥

রয়েল বলে উঠল, ‘বাবা জাত বলে কিছু নেই। সব কর্তাবাবার সন্তান তাই লালশশী বলেন—ভেদ নাই মানুষে মানুষে/খেদ কেন করো ভাই দেশে দেশে।’

আমি চেয়ে থাকি শিবশেখরের দিকে। তার মুখে লাজুক হাসি। ভাবলাম, খুব শিক্ষা হল যা হোক। সে আমার অবস্থা বুঝে হঠাৎ উঠে হাত দুটো চেপে ধরে বললে, ‘বাবু মনে কিছু করবেন না। এখানে সতী মা-র থান, শান্তির জায়গা। মনের মধ্যে দুঃখ রাখবেন না। রয়েল, তোমার মনে বড় প্রতিহিংসা।’

রয়েল বলল, ‘প্রতিহিংসা নয়। বাবুকে পেরথমেই একটা ঝাপটা মেরে সঠিক পথে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ওঁর আর ভ্রম হবে না। তাই না বাবু?”

সঠিক পথ কোথায়, কোন্‌খানে? বছরের পর বছর এই যে আমার ঘোষপাড়ায় আসা তার পিছনে কীসের টান? ঘোষপাড়া জায়গাটাই কি অবিতর্কিত? সেই আঠারো শতকে এখানে যে-কর্তাভজা ধর্ম গড়ে উঠেছিল তা গোড়াতে ছিল আউলচাঁদের সুফিমত। ওয়ার্ড সাহেব আউলচাঁদের বর্ণনা দিয়েছিলেন এইরকম:

About a hundred years ago another man rose up, as the leader of a sect, whose cloth, or dress of many colours, which he wore as a voiragee, was so heavy that two or three people can now scarcely carry it.

বিশাল ভারী এই আলখাল্লাধারী মানুষটি তাঁর সুফিধর্মের ছাঁচে যে গৌণ ধর্মটির পত্তন করেছিলেন তাতে কালে কালে অনেক প্রতিভার উজ্জ্বলতা মিশেছে। সবশেষে উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলন, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে উত্থান, বেদবিরোধী মনোভাব আর জাতিবর্ণহীন সমন্বয়বাদ সবই ঢুকে গেছে এ ধর্মে। কিছুটা ইসলামি বিশ্বাস আর কিছুটা খ্রিস্টধর্মের ক্রিয়াকাণ্ডও জুড়ে গেছে তার মর্মে। সুফিদের ব্যক্তিগত দেবতা যাঁকে তাঁরা বলতেন ‘হক’ বা সত্য—কর্তাভজারা সেই সত্যকে ভজনা করেন। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল কর্তাভজা শব্দটা বোধহয় কেউ ব্যঙ্গ করে বানিয়েছিল। কিন্তু ভাবের গীতের একটি পদে দুলালচাঁদের একটি দর্পিত উক্তি থেকে সে ধারণা পালটালো। দুলাল বলেছিলেন:

আমি আপ্ত খোদে মেয়ে মরদে

কর্তা ভজাবো

কর্তাভজার কাছে তোদিকে

মূর্খ বানাবো।

বলাবাহুল্য এই ‘তোদিকে’ বলতে দুলালের লক্ষ্য ব্রাহ্মণ্যবাদ। সেই ব্রাহ্মণ্যবাদকে খর্ব করতে দুলালের সগর্ব উচ্চারণ।

আছে কর্তাভজা আর এক মজা

সত্য উপাসনা।

বেদ বিধিতে নাইকো তার ঠিকানা

এ সব চতুরের কারখানা।

কিন্তু চতুর মানুষটি কি শেষরক্ষা করতে পেরেছিলেন? দেখা যাচ্ছে দুলালের জীবিতকালেই কর্তাভজাদের একটা উপদল গজিয়ে ওঠে, তাদের নাম রামবল্লভী। অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’বইতে রামবল্লভীদের কথা প্রথম উল্লেখ করে জানান: বাঁশবেড়িয়ার শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণকিঙ্কর গুণসাগর আর মতিলালবাবু ঘোষপাড়ার পালেদের নেতৃত্ব অগ্রাহ্য করে ‘কালী কৃষ্ণ গড খোদা’ উপাসনা শুরু করেন। এ খবর পড়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে আমি হাজির হই বাঁশবেড়িয়ায়। বাঁশবেড়িয়া আর ঘোষপাড়া বলতে গেলে গঙ্গার এপার আর ওপার। বাঁশবেড়িয়ায় গিয়ে দেখি কোথায় কী? সব শুনশান। কৃষ্ণকিঙ্কর বা শ্রীনাথ মুখুজ্যের ভিটে বা বংশ আর নেই। একজন বৃদ্ধ সব শুনে বললেন, ‘মনে পড়েছে। খুব ছোটবেলায় শুনেছি ওই যেখানে বাঁশবেড়ের পাবলিক লাইব্রেরি তার নীচে গঙ্গার ধারে রামবল্লবীদের আখড়া ছেল তা সে কি আর আচ্যা?’ পাবলিক লাইব্রেরির নীচে গঙ্গার ভাঙা পাড়ে যখন ঘুরছি, পুলিশ-কুকুরের মতো, তখন উদ্ধার করলেন আরেক বৃদ্ধ। জানালেন রামবল্লভীদের আসল কাণ্ডকারখানা ছিল ওপারে অর্থাৎ কিনা কাঁচড়াপাড়ার কাছে পাঁচঘড়া গ্রামে। খুঁজতে খুঁজতে বাঁশবেড়িয়ার গ্রন্থাগারে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ ১৮৩১ সালের একটি উদ্ধৃতি মিলল ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ বইতে। জগচ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী পাঁচঘরা গ্রামে রামবল্লভীদের এক সমাবেশের ভারী চমৎকার বর্ণনা করে লিখেছেন:

এই ক-একজন বাবু একত্র হইয়া মোর কাঁচড়াপাড়ার অন্তঃপাতি পাঁচঘরা সাকিনে একজন পোদের ভবনে এক ইস্টকনির্ম্মিত বেদি তদুপরি চৌকী এবং তদুপরি কুসুমমাল্য প্রদানপূর্ব্বক পরম সুখে পরম সত্য নামক বেদি স্থাপন করিয়া বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য আয়োজনপূর্ব্বক বিবিধবর্ণ প্রায় পঞ্চসহস্র লোক এক পংক্তিতে বসিয়া অন্নব্যঞ্জনাদি ভোজন করিয়াছেন এবং ত্রিবেণী ও বাঁশবেড়িয়া ও হালিসহর নিবাসী একশত ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হইয়া এক এক পিত্তলের থাল ও সন্দেশাদি বিদায় পাইয়াছেন এবং তৎস্থানে ফিরিঙ্গিতে বাইবেল পুস্তক পাঠ করিয়াছে এবং মুসলমানে কোরাণ পাঠ করিয়াছে এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিত গীতা পাঠ করিয়াছেন।

পড়তে পড়তে কি মনে হয় না ধর্মসমন্বয়ের একটা তাপ এঁদেরও মধ্যে লুকানো ছিল? মনে না হয়ে কি পারে যে দুলালচাঁদ যতখানি ব্যক্তি তার চেয়ে অনেকখানি তাঁর যুগের সৃজন? এঁদের সাফল্যে যে সমসাময়িক গাঙ্গেয় অঞ্চলের ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মণসমাজ কেঁপে উঠেছিল তাতে আর সন্দেহ কী? অক্ষয়কুমার তো এতদূর অসূয়াসম্পন্ন ছিলেন যে রামবল্লভীদের গোমাংস ভক্ষণের অপবাদও দিয়েছিলেন।

ঘোষপাড়ায় দাঁড়িয়ে অনেকবার আমার মনে হয়েছে সর্বধর্মসমন্বয়ের এমন অপরূপ পীঠস্থান কেমন করে সতী মা-র মহিমায় আবিষ্ট হয়ে গেল? সে কি দুলালচাঁদের অকালমৃত্যুতে পরবর্তী যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে? ১৮৩৩ সালে দুলালচাঁদের প্রয়াণ ঘটে। সতী মা সম্প্রদায়ের কর্ত্রী হন। তাঁরও দেহাবসান ঘটে ১৮৪০ সালে। তারপর গদিতে বসেন দুলালের পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৮২ সালে ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যু এবং শরিকদের মধ্যে গদির লড়াই।

সেই গদির লড়াই এখনও মেটেনি।

১৮৯৫ সালে নবীনচন্দ্র সেন যখন ঘোষপাড়ায় গিয়েছিলেন তখন সতী মা জীবিত নেই, রামদুলালের ছেলে ঈশ্বরচন্দ্রও দেহ রেখেছেন। তাঁদের পরবর্তী দুই বংশধর তখন দুই শরিক হয়ে দুই গদি দখল করেছিলেন। মেলায় তাঁদের দেখে নবীনচন্দ্র লেখেন:

এখন রামশরণ পালের দুই বংশধর আছেন। দুইটিই মহামূর্খ। তথাপি ইঁহারা উভয়ই বর্তমান ‘কর্তা’।…

দেখিয়াছি, মূর্খ কর্তা দুজন দুই ‘গদি’তে বসিয়া আছেন এবং সহস্র সহস্র যাত্রী তাঁহাদের ভক্তিভরে নমস্কার করিয়া এবং প্রণামি দিয়া পদধূলি গ্রহণ করিতেছে।

এখন, এই বিশ শতকের শেষ অংশে ঘোষপাড়ার মেলায় গেলে একই দৃশ্য দেখা যাবে। ঠাকুরবাড়ির ভেতরে আর বাইরে হাজার হাজার ভক্ত, পা ফেলার জায়গা নেই। বেশির ভাগ অজ্ঞ মূর্খ গ্রামবাসী। হুগলী নদীয়া মুর্শিদাবাদ বর্ধমানের কৃষিজীবী মানুষ। তাদের মধ্যে বারো আনা স্ত্রীলোক। দুই গদির বদলে এখন চার গদি। তার মানে চার কর্তা। এঁরা শিক্ষিত তবে প্রণামী নিতে ও পদধূলি দিতে খুবই আগ্রহী। গোমস্তা জাতীয় একজন লোক খেরোর খাতায় মহাশয় আর বরাতিদের খাজনা আদায় করছেন। সামনে আবির রাঙানো প্রাক্তন কর্তাদের আলোকচিত্র। একজন গোমস্তাকে আমার সঙ্গী বন্ধু জিজ্ঞেস করল, ‘খাজনা আদায় করছেন? কীসের খাজনা?’

আমি তাকে একপাশে সরিয়ে এনে নোটবই খুলে কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’ থেকে টোকা একটা অংশ পড়ালাম। তাতে লেখা আছে:

পালবাবুদের ত্রিবিধ প্রকারে আয় হইয়া থাকে। ১) খাজনা ২) ভোগ ৩) মানসিক। অর্থাৎ উহাদের মতে প্রত্যেকের দেহের মালিক কর্তা, সুতরাং তুমি যে উহাতে বাস করিতেছ তজ্জন্য কর্তাকে তোমার খাজনা দিতে হয়।

বন্ধুটি বদমেজাজি। গজগজ করতে লাগল। এক যুবক এগিয়ে এসে আমাদের কাছে একটি বই দেখাল। ‘ঘোষপাড়ার কর্তাভজা সম্প্রদায়’ লেখক অদ্বৈতচন্দ্র দাস। নগদ সাতটাকা দিয়ে বইটি কিনে বন্ধু এক জায়গায় বসে পাতা উলটোতে লাগল। হঠাৎ শেষ প্যারাগ্রাফে এসে আমাকে বলল, ‘দেখেছ দেখেছ কাণ্ড। পড়ো পড়ো।’ পড়লাম, লেখা রয়েছে:

ব্যক্তিগত আত্মপ্রচারে মুগ্ধ না হয়ে, তুচ্ছ দ্বেষাদ্বেষি ও অর্থলোলুপতায় আকৃষ্ট না হয়ে, সতীমার দুই শরিক ট্রাস্টিগণসহ একযোগে ঠাকুরবাড়ির তথা কর্তাভজা ধর্মের উন্নতিসাধনে ব্রতী হন এই প্রার্থনা জানাই শ্রীশ্রীসতীমার শ্রীচরণকমলে।

বন্ধু বললেন, ‘দেখেছ, শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। রেজিসটেন্স।’

প্রতিবাদ কোথায়? বছরের পর বছর সতী মা-র মেলায় একই দৃশ্য দেখে গেছি। হাজার হাজার মানুষ, অশিক্ষিত অসহায় রোগগ্রস্ত, হত্যা দিয়ে পড়ে আছে। ডালিমতলায় সতী মা-র নামে লালপেড়ে কাপড় শাঁখা লোহা সিঁদুর ছুড়ছে, গাছে বাঁধছে ঢিল। ডালিমতলার মাটি মেখে, খেয়ে, হিমসাগর নামে নোংরা একটা ঘুলিয়ে-ওঠা পুকুরের জলে স্নান করে, সেই জল খেয়ে, তারা ভাবছে তাদের রোগবালাই সেরে যাবে। বোবা কথা বলবে, খোঁড়া হাঁটবে, বাঁজার ছেলে হবে, অন্ধ পাবে দৃষ্টি। প্রতিবন্ধিতায় ভরা এই দেশে, অজ্ঞতায় মোড়া আমাদের গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোপনে কত ধর্মব্যবসায়ী দালাল। তারাই এ সব অসহায় মানুষদের আনে এখানে ভুজুং ভাজুং দিয়ে। তার ফলে হিমসাগর থেকে ডালিমতলার দীর্ঘ পথ কাদায় কাদা। ভোর থেকে অগণিত অন্ধবিশ্বাসী আর কুসংস্কারঘেরা পুরুষ আর নারী দণ্ডী খাটছে। চোখে তাদের জল। মুখমণ্ডলে তাদের গভীর বিশ্বাসের দ্যুতি। বেশবাস ভিজে, অসম্বৃত। আত্মজের রোগ নিরাময়ের আশায়, স্বামীর পক্ষাঘাত সারাতে, সন্তানকামনার অতলটানে কত লজ্জাশীলা গ্রাম্যবধূ এখানে আত্মজ্ঞান হারিয়ে লজ্জা ভুলে দণ্ডী খাটছে। তাদের স্নানচিকণ দেহ সিক্তবসনের বাধা মানছে না। তার ওপর পিছলে যাচ্ছে লম্পট আর লুম্পেনের চোখ। সতী মার নাম মাহাত্ম্যে মহিমময় এমন এক জায়গায় মাতৃজাতির এতখানি অবমাননা সওয়া যায় না।

কোথায় প্রতিবাদ?

হিমসাগরের পাড়ে এসে দাঁড়াই। স্নানের জন্যে কী উদ্দাম লড়াই। ওইটুকু পুকুর পাঁকে আর কাদায় আবিল হয়ে উঠেছে কয়েক হাজার মানুষের দাপাদাপিতে। ধর্মীয় দালাল কোমরজলে দাঁড়িয়ে বোবা বালককে চুলের ঝুঁটি ধরে জলে চোবাচ্ছে আর গালে মারছে চড়। বলছে, ‘বল, সতীমা বল।’অক্ষম নির্বাক বালক খাচ্ছে চড়ের পর চড়। তার অরুন্তুদ যন্ত্রণার প্রতিরোধ কই? তার রাঙা চোখের পার-ভেঙে-আসা অশ্রু আর পারে-দাঁড়িয়ে-থাকা তার অভিশপ্ত গর্ভধারিণীর চোখের জল মিশছে হিমসাগরের ঐশী সলিলে। কে প্রতিবাদ করবে?

মাইকে মেলা কর্তৃপক্ষ গজরাচ্ছেন: আপনারা সংযত থাকুন। নারীজাতির সম্ভ্রম রক্ষা করুন। কেউ মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন না।

‘তার মানে?’ আমার বন্ধুটি গর্জে ওঠে। ‘এখানে এ সব কী শুনছি, দেখছি? এ কি আমাদের দেশ? আমরা যে সবাইকে বলি ধর্মের উগ্রতা নেই পশ্চিমবঙ্গে। সে কি তবে ভুল? এর প্রতিকার নেই?’

হঠাৎই একজন যুবক আমাদের হাতে গুঁজে দিল একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘শাব্দ’। ‘পড়ুন, পড়ে দেখুন’ আবেদন শুনে বন্ধু বললেন, ‘ভাই এখানেও পদ্য আসছে তোমাদের? রুখে দাঁড়াতে পারো না এ সব বুজরুকির বিরুদ্ধে?’

ছেলেটি বলল, ‘এটাই প্রতিবাদ। পড়ুন।’

দুজনে একটা গাছতলায় বসে প্রথমে ‘শাব্দ’ থেকে পড়ি ‘উৎসমানুষ’ কাগজের একটা পুনর্মুদ্রণ ‘কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় সতী মায়ের মেলা, যা দেখেছি যা বুঝেছি।’ প্রথমেই পুরনো বছরের একটা প্রতিবেদন, বক্সে।

এবারেও (১৯৮০) ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে ঘোষপাড়ার বিরাট মেলা বসেছিল।…একটি শিশুকন্যাকে নিয়ে তার মাসী হাওড়ার দানসাগর থেকে এসেছিল সতী মায়ের মেলায়। ছোট্ট মেয়েটি ঝড়বাদলে অসুস্থ হয়ে পড়লে সমবেত অনেকের পরামর্শে মাসী মেয়েটিকে হিমসাগরে (একটা এঁদো পুকুর যার নোংরা জলে হাজার লোকে স্নান করে পুণ্যলোভে) স্নান করিয়ে সতী মায়ের থানে ডালিমতলায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে রাখে। মেলাতে ডাক্তার ছিল কিন্তু দৈবশক্তির ওপর ভরসা ছিল অনেক বেশী। ফলত শিশুটি মারা যায়। মাসীর বুকফাটা আর্তনাদে মেলার বাতাস ভারী হয়। জলকাদার মধ্যে সে মৃত শিশুকে আঁকড়ে বসে ছিল।

পড়ায় বাধা পড়ল। এক ভদ্রলোক এসে বললেন, “আচ্ছা ব্যান্ডেল প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্রের স্টল কোথায় জানেন?’

: না তো। কী ব্যাপার? এখানে এই মেলায় স্টলটা আছে?

: হ্যাঁ। মাইকে শুনলাম। আমার ছেলে বোবা কালা। ওই দেখুন।

দেখলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে ম্লানমুখে মার কোলে ভদ্রলোকের একমাত্র সন্তান। বছর আট-দশ বয়স। প্রচণ্ড আক্রোশে পা দাপাচ্ছে। ক্ষীণস্বাস্থ্যের মা তাকে সামলাতে পারছেন না। হতাশ ভঙ্গিতে ভদ্রলোক বললেন, ‘ছেলেটা ভয়ানক টারবুলেন্ট। গত তিনবছর এখানে আনছি। ডালিমতলার মাটি খাইয়েছি, হিমসাগরে চান করিয়েছি। কিন্তু কিছু হল না। কী করি বলুন তো?’

: আপনি থাকেন কোথায়? করেন কী?

: বেলেঘাটা। একটা কারখানায় কাজ করি।

: লেখাপড়া জানেন? তো এখানে এসেছেন কেন?

অসহায় ভঙ্গিতে জবাব এল, ‘সবাই বলল। ওর মা কান্নাকাটি করতে লাগল। একজন বলল পরপর তিনবছর আসতে হয়। তাই আসলাম। তা হল কই? কিচ্ছু হল না। যে এনেছিল সে অনেক পয়সা খেঁচল মশাই। ধ্যুস, সব বাজে। এখন বলছে আপনি ভক্তিভরে সতী মাকে ডাকেননি। যাক গে বাদ দিন সব বুজরুকি। কল্যাণকেন্দ্রটা দেখি।’

প্রতিবন্ধী কল্যাণ-কেন্দ্র তো আমাদেরও দেখা দরকার। পায়ের তলায় আমাদেরও মাটি চাই। অসহায় পিতা মাতা আর প্রতিবন্ধী সন্তানের পেছন পেছন আমরা এগোই। খানিক যেতেই কানে আসে মাইকের উচ্চারণ: এখানে আসুন, এই প্রতিবন্ধী কল্যাণকেন্দ্রে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পরীক্ষা করুন আপনার সন্তানকে। হিমসাগরের জল আর ডালিমতলার মাটিতে কিছু সারতে পারে না।

এসে দাঁড়াই সেই স্বস্তিকর মানবতার আহ্বানকেন্দ্রে। ছোট্ট স্টল। ভেতরে পাতা বেঞ্চিতে বসে আছে অনেক অসহায় ভাগ্যহীন মা-বাবা, তাদের হরেক প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে। বোবা-কালা-অন্ধ-জড়বুদ্ধি-পঙ্গু। কয়েকটি উজ্জ্বল যুবক তাদের পরীক্ষা করছেন যন্ত্রপাতি দিয়ে। নির্দেশ দিচ্ছেন। একটি টেবিলে মাইক্রোস্কোপে দেখানো হচ্ছে হিমসাগরের জলে কত বীজাণু।

‘আপনারা এখনও মারধোর খাননি?’ আমার এ প্রশ্নে হাসির পায়রা উড়ে গেল যেন একঝাঁক। একজন যুবক বললেন, ‘বছর দুই ধরে আমরা আসছি ব্যান্ডেল থেকে। অন্ধবিশ্বাস আর এই সব কুসংস্কারের একটা প্রতিবাদ করা দরকার। কী বলেন?’

সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লাম কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। কেবল মনে হতে লাগল গভীর নির্জন পথের প্রান্তে হয়তো আমার প্রাপ্তি ঘটবে না তেমন কিছু। তবে পথের দুধারেই তো পেয়ে যাচ্ছি অনেক দেবালয়। মনের মানুষ খোঁজার গহন সাধনা আমার কই? আমি তো ভিড়ের মধ্যে, দলিত মনুষ্যত্বের মধ্যে, অবমানিত মূল্যবোধের পুঞ্জীকৃত শবের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে দেখছি জীবনের উদ্ভাসন। শেষপর্যন্ত মানুষকেই, মানুষের মুক্তবুদ্ধিকেই জাগতে দেখছি। এ পথেই আলো জ্বেলে তবে ক্রমমুক্তি? ভাবলাম, মনের মানুষ না মিললেও মনের মতো মানুষ তো মিলে যায়। যেমন এই ব্যান্ডেলের চারটি যুবক, কিংবা সেই ছেলেটি যে আমাদের হাতে গুঁজে দেয় ‘শাব্দ’। এদের বিবেচনা আর প্রতিরোধে ভর দিয়ে দাঁড়ায় আমাদের প্রহৃত মনুষ্যত্ব। আবার নতুন উদ্দীপনায় বুক বেঁধে মেলার ভেতরে এগোই। মধ্যদুপুর। রোদ গনগনে। চারদিকের অগণন আখড়ায় রান্নাবান্না চলছে। চাপ চাপ ধোঁয়া আর সেদ্ধভাতের গন্ধ। তারই মধ্যে কোথাও কোথাও গান হয়েই চলেছে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে গুপ্‌গুপ্‌ গুম্‌গুম্‌ আওয়াজ। গানের তালবাদ্য। গুটি গুটি একটা আখড়ার সামনে দাঁড়াই। একজন গ্রামীণ গাহক গাইছে শব্দগান

মানুষ হয়ে মানুষ মানো

মানুষ হয়ে মানুষ জানো

মানুষ হয়ে মানুষ চেনো

মানুষ রতনধন।

করো সেই মানুষের অন্বেষণ॥

আখড়ার মধ্যে ভাল করে নিরিখ করে দেখা গেল যেন একটা বিস্তৃত তাঁবু। পাটি আর পলিথিন পেতে অন্তত পঞ্চাশ ষাটজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছে। তাঁবুর বাইরে রান্নাকাজ চলছে। মস্ত বড় একখানা কড়াইতে খিচুড়ি ফুটছে। আখড়ার মধ্যে একটা জলচৌকি আসন। তাতে একখানা সতী মা-র ছবি। তামার ঘটে জল। ফুল পাতা আবির ফাগ মাখানো। আমি বন্ধুকে বললাম: একেই বলে আসন। মাঝখানে ওই যে সাদা আলখাল্লা পরা জটাজূট মানুষ ঘুমোচ্ছেন উনিই হলেন ‘মহাশয়’। আর এরা সব ‘বরাতি। বুঝলে?

একজন বরাতিকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের মহাশয়ের নাম কী? নিবাস কোথায়?

: মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গার নাম শুনেছেন? সেই বেলডাঙ্গার ভেতরে ব্যান্যাডা গ্রাম। আমাদের গুরুপাট ওখানেই। আমাদের ‘মহাশয়’ ত্রৈলোক্য মহান্ত। ওই যে ঘুমিয়ে আছেন। পাশে আমাদের মা-গোঁসাই। মাটির মানুষ।

বন্ধুকে বললাম: ভেতরে ঢুকবে নাকি? এদের ওপর ভর করেই কিন্তু সারাবছর চলে সতী মার সংসার। এঁরাই মহাশয় আর বরাতি। এঁরাই দেন খাজনা আর প্রণামী। নতুন বরাতি এই সব গ্রাম্য মহাশয় রিক্রুট করেন।

বন্ধু বললেন: বুঝেছি এরাই গ্রাসরুট লেবেলের ক্যাডার। আর মহাশয় হলেন ল্যাডার। এদের ডেপুটি কালেকটারও বলা চলে কী বলো? কিন্তু এরা সব মহা ঘাঘু নয় কি? তোমার নোটবই এঁদের সম্পর্কে কী বলে?

আপাতত মহান্ত মহাশয় ঘুমোচ্ছেন তাই তাঁর সামনে বসে সাইড ব্যাগ থেকে নোটবই বার করে বলি, ‘এদের সম্পর্কে একটু মতামত আছে যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বইতে। ১৮৯৬ সালে তিনি লেখেন,

The agents of the Karta are required to pay over their collections to him, at a grand levy held by him at his family residence in the month of March.

তার মানে এই দোলের মেলা। এর পরের অংশটা শোনো:

Each agent of the karta is generally on very intimate terms with a child- less and friendless widow in the village or group of villages entrusted to his charge, and through the instrumentality of this women he is able to hold secret meetings which are attended by all the female votaries with- in his jurisdiction and in which he plays the part of Krishna.’

: এ সব তুমি বিশ্বাস কর?

আমি বললাম, ‘যোগেন্দ্রনাথের আমলে হয়তো এ সব হত। কে জানে? আমার তো কোনও উলটোপালটা চোখে পড়েনি কখনও। আসলে গুরুবাদের ব্যাপারটা সবাই ঠিক বোঝেন না। তা ছাড়া এখানে তুমি কী দেখছ? শুধুই কি স্ত্রীলোক? কতই তো পুরুষ বরাতি রয়েছেন এ আখড়ায়। সবাই বিকৃত হতে পারে? আমি অনেক শুদ্ধ মহাশয় দেখেছি।’

কথার মাঝখানে উঠে বসলেন ত্রৈলোক্য মহান্ত। মাথায় ঝুঁটি, গালে দাড়ি গোঁফ, সিঁথিতে অজস্র আবির। মধ্যবয়সী অর্ধশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষ। ভক্তিমান সেবাপরায়ণ। প্রথমেই আমাদের পরিচয় নিয়ে মিষ্টিজল খাওয়ালেন। বোধহয় আমাদের কথা কিছু কানে গিয়েছিল। তাই তারই রেশ ধরে বলে উঠলেন, ‘গুরু আর শিষ্যের সম্পর্ক আসলে পুরুষ আর নারীর মতো। সেইজন্য বলেছে,

প্রকৃতি স্বভাব না নিলে হবে না গুরুভজন।

আগে স্বভাবকে করো প্রকৃতি

গুরুকে পতি স্বীকৃতি।

তবে হবে আসল করণ॥

এ কথার মানে হল নিজের অহং ত্যাগ করে গুরুর পায়ে সব ছেড়ে দিতে হবে। কাজটা কঠিন।’

মহান্ত কথা বলে চলেছেন অনর্গল আর আমি অবাক হয়ে দেখে চলেছি আন্তরিক ও আত্মনিবেদিত সেবাধর্ম। একজন শিষ্যা প্রথমে পরম মমতায় মহান্তর কপালে জল চাপড়ে ধুয়ে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয়। তারপরে একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে তেল মাখিয়ে ঝুঁটি বেঁধে দেয়। তার মুখে সে কী আকুতি আর স্নেহের তাপ! যেন মা জননী। তারপরে গুরুর সারা মুখের ঘাম আঁচল দিয়ে মুছিয়ে পাশে বসে পাখার বাতাস করতে লাগল আর তাঁর প্রত্যেকটা কথা যেন গিলতে লাগল গভীর আগ্রহে। এমন দৃশ্য খুব বেশি তো দেখিনি জীবনে। আমার শিক্ষিত মগজ গুজবে উৎসুক, পর্নোগ্রাফিতে পোক্ত, খবরের কাগজে আইন-আদালতের পাতা-পড়া শহুরে বিকৃত মন। এমন অমলিন সম্পর্ক দেখলে অস্বস্তি হয় কোথায় একটা। অঙ্ক মেলে না।

ফস করে বলে বসলাম: আমাদের মন চট করে সব জিনিসে খারাপ দেখে কেন বলুন তো? একেই কি পাপী মন বলে?

সর্বজ্ঞের মতো হেসে মহান্ত বললেন, ‘তা হলে একটা গান শুনুন:

পাপ না থাকলে পুণ্যির কি মান্য হত?

যমের অধিকার উঠে যেত।

যদি দৈত্য দুশমন না থাকত

কামক্রোধ না হ’ত

মারামারি খুনখারাপি জঞ্জাল ঘুচিত।

সবাই যদি সাধু হ’ত

তবে ফৌজদারি উঠে যেত॥

গান থামিয়ে মহান্ত ক্ষণিক আমাদের দিকে চেয়ে নেন। সে কি আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখতে? কী জানি? তারপরে হঠাৎ যেন একটা গিটকিরি মেরে গেয়ে ওঠেন:

দোষগুণ দুইয়েতে এক রয়

কর্মক্ষেত্রে পৃথক হয়।

পৃথক পৃথক না থাকিলে

দোষগুণ কেবা কয়।

যদি অমাবস্যা না থাকিত

পূর্ণিমা কে বলিত?

গ্রাম্যগানের এই বিন্যাস এই ন্যায়ের ক্রম আমার বরাবর খুব ভাল লাগে। যেন বক্তব্যের ব্যাখ্যার মতো গান এগিয়ে চলে। মনের মধ্যেই পাপপুণ্য, কামপ্রেম, প্রবৃত্তিনিবৃত্তি। কর্মক্ষেত্রে কেবল তারা পৃথক। এ পর্যন্ত বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মহান্ত-র চোখের ইঙ্গিতে তাঁর পাশের সেই সেবাতৎপর শিষ্যাটি এবার অতি মধুর তারসপ্তকে গেয়ে উঠল:

গুরু মূল গাছের গোড়া

আছে ত্রিজগৎ জোড়া।

কীটপতঙ্গ স্থাবর জঙ্গম

কোথাও নেই ছাড়া।

লঘু যদি না থাকিত

গুরু কে বা বলিত?

গানের এই অংশ যতক্ষণ হল ততক্ষণ গুরু ত্রৈলোক্য ছিলেন মুদিতচোখ। হঠাৎ চোখ খুললেন। সে চোখভরা একবিশ্ব জল। বললেন, বড় কঠিন প্রশ্ন তুলেছিলেন বাবাজি। তার জবাবে গৌর গোঁসাইয়ের এত অকাট্য গানখানা অন্তর থেকে উঠে এল।

: অকাট্য গান?

: হ্যাঁ এক একটা গান কাটান দেওয়া যায় না। তার মানে এ-গানের মধ্যে যে-তত্ত্ব যে-সত্য তা চিরকালের মতো নির্ণয় হয়ে গেছে। মহতের লেখা পদ। এ তো বানানো গান নয়।

আমার বন্ধুর বস্তুবাদী মনেও খানিকটা অভিভব জেগেছিল বুঝি। সে তাই বলে বসল, ‘সকাল থেকে অনেক মিথ্যা আর বুজরুকি দেখে দেখে মনটা খুব দমে গিয়েছিল। আপনার এখানে এসে মনটা শান্ত হল। আচ্ছা বলুন তো, এ সব হিমসাগর ডালিমতলার ব্যাপারগুলোর মধ্যে কোন সত্য আছে?’

মহান্ত মৃদু হেসে বললেন: সত্য না থাকলে আপনারা এই ভরদুপুরে এখানে এলেন কেন? ব্যাধি না থাকলে কি কেউ বৈদ্য ডাকে? তবে সবচেয়ে বড় শক্তি হল নামের শক্তি। সেইজন্যে লালশশী বলে গেছেন:

চতুর্বর্গ ফলের অধিক ফলে

যদি থাকে বাসনা

নামরস পানেতে মত্ত

হওরে রসনা।

তার মানে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষেরও ওপরে হল নামের শক্তি। তবে নাম জপলেই কি শুধু হয়? ব্যাকুলতা চাই। তার ওপরে আবার অধিকারীভেদ আছে। আমাদের মতে বলে ‘মেয়ে হিজড়ে পুরুষখোজা তবে হয় কর্তাভজা’। মানে বুঝলেন?

: না, প্রহেলিকার মতো লাগল।

: কিছুই প্রহেলিকা নয়। বৈদিক পথ ছাড়তে হবে। বৈদিক পথ বলতে বোঝায় ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বানপ্রস্থ আর সন্ন্যাস। এর কোনওটাতেই ঈশ্বর মিলবে না। সব কিছুর মধ্যে থাকতে হবে নির্বিকার হয়ে। যেন মেয়ে হয়েও হিজড়ে, পুরুষ হয়েও খোজার মতো। এই অবস্থা এলে তবে মাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে হবে। সেইজন্যে ভাবের গীতে বলেছে:

মায়ের যোগ্য হলে মায়ের কৃপা হয়।

মা বলা বোল সত্য হলে সকলি মা-ময়॥

সেইজন্যে আমরা সব জায়গায় সতী মাকে দেখতে পাই। ডালিমতলাতেও তিনি হিমসাগরেও তিনি। তিনি সর্বত্র রয়েছেন, তবে কর্মভেদে কেউ তাঁকে দেখে কেউ দেখতে পায় না।

আমি দেখলাম মহান্ত-র আলোচনা ক্রমেই ভাববাদী হয়ে যাচ্ছে। তাঁর বরাতিরা ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে তাঁর কাছে পিঠে। তাদের চোখে মুগ্ধতা আর সমর্পণ। এ অবস্থা চলতে দিলে বিপদ। এ সব ক্ষেত্রে আমি ঝপ করে একটা উলটো কথার টান মারি। এবারেও তাই সবাইকে সচকিত করে বলে বসলাম, ‘আচ্ছা অনেকে যে বলে খাদ্যের সঙ্গে শরীরের যোগ আছে তা মানেন? কুমীরদহ গাঁয়ের শিবশেখর বললেন তিনি নিরিমিষ খান। আপনিও তাই? মাছ মাংস খান না?’

মহান্ত-র ভাবের ঝিম এই এক প্রশ্নেই কেটে গেল। মানুষটি পড়ে গিয়েছিলেন কথার কুম্ভীপাকে। সেখান থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আঁশ নিরিমিষ বলে কিছু নেই। সবই তাঁর সৃজন। তবে শরীরের মধ্যে খাদ্যের ক্রিয়া আছে বইকী। তার কাজ তাপ বাড়ানো। তাই সাধক মানুষ তাপ এড়াতে চান। শুধু তো ত্রিতাপ নয়। দেহের তাপও বিঘ্ন ঘটায় জপে তপে। আমি নিরিমিষ আমিষ বাছি না। তবে মাছ খাই কিন্তু মাংস খাই না।’

: কেন? কোনও কারণ আছে? নাকি রুচি হয় না?

: সাধক কখনও কারণ ছাড়া কাজ করে? সে তো অনেক বুঝে, অনেক নেড়েচেড়ে, অনেক দেখেশুনে, তবে খাঁটিপথে দাঁড়ায়। মাছ খাই কেন জান? মাছের মধ্যে কাম নেই। কামে তাদের জন্ম নয়।

দুই বন্ধু কানখাড়া করি। লৌকিক মানুষ অদ্ভুত কতকগুলো লজিকে চলে। তার খানিক মনগড়া, খানিক গুরুর বানানো। মাছের মধ্যে কাম নেই, কামে তাদের জন্ম নয়, কথাটার মধ্যে অভিনবত্ব আছে বেশ। তাই বলি, ‘মাছের কাম নেই? তা হলে সৃষ্টি হয় কেমন করে?’

মহান্ত বললেন, ‘মাছের যোনি লিঙ্গ নেই। তাই কথায় বলে: মাছের মাছা নেই। ঘর্ষণে তাদের সৃষ্টির বীজ। যাকে বলে রতি। রতি বা তাপ থেকে ডিমের সৃষ্টি। তাই মাছ খেলে মানুষের কামপ্রবৃত্তি আসে না। কী বলো গো তোমরা?’

সবাই তারিফচোখে মাথা নাড়ে। একজন শিষ্য বলে, ‘আমরা আর কী বলব? গৈ-গেরামের মুরুখ্যু মানুষ। কি জানি বলো? তাই তোমারে গুরু মেনেছি? তুমি যা বলাও তাই বলি। তুমি যা জানাও তাই জানি। তুমি ছাড়া আমাদের তিলার্ধ চলে না।’

মহান্ত বললেন, ‘মাছ হল সবচেয়ে সাত্ত্বিক প্রাণী। তার মধ্যে সাধক লক্ষণ। দেখেছেন মাছের চোখে পলক নেই, চোখ স্থির? তার মানে সদাই ধ্যানস্থ। আমি তো তাই কাঁদি: সতী মা কেন পলক দিলে? কেন মীনের মতো নয়ন দিলে না? তা হলে অপলক তোমার লীলা দেখতাম।’

কাণ্ড দেখে আমি তো থ। সেবিকা শিষ্যা আঁচল দিয়ে গুরুর চোখ মোছায়, জোরে জোরে পাখার বাতাস করে। মা-গোঁসাই ভেতর থেকে বলে ওঠেন, ‘মানুষটার মনে বড় তাপ।’

মহান্ত-র ক্রন্দনপর্ব খানিক ধাতস্থ হলে জিজ্ঞেস করলাম: মাংস খেলে কি কাম বৃদ্ধি হয়?

: শুধু কাম নয়, সব প্রবৃত্তিই বাড়ে। রাগ দ্বেষ হিংসা। আবার বিবেচনা নষ্ট হয়। কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না।

: তাই নাকি? কেন?

: কী বোঝাই আপনাকে বলুন তো দেখি? আপনি শিক্ষিত মানুষ। কোন মাংস খাবেন? পাঁঠা? তাদের সঙ্গম দেখেছেন? মা-মাসি জ্ঞান আছে তাদের? সে মাংস খেলে মানুষের কী দশা হয় বোঝেন না?

বাপরে। কথার কী ঝাপট। বাক্যের কী শক্তি। সংকোচে কারুর দিকে তাকাতে পারি না। লজ্জা এড়াতে বলি, ‘এত সূক্ষ্ম চিন্তা তো করিনি কখনও। তাই আপনাকে নেড়ে বসেছি। মাপ করবেন।’

ততক্ষণে মানুষটা শান্ত, জল। প্রসন্ন হেসে বললেন, ‘জানতে চাওয়ায় ভুল কোথায়? তবে সব জানার জবাব নেই। কেননা সব কিছুর নামভেদ আছে রূপভেদ আছে। রকম আলাদা স্বাদ আলাদা। যেমন ডাব আর নারকেল, যেমন মুড়ির চাল আর ভাতের চাল। যেমন বেণু মুরলী বংশী বাঁশি…’

মহান্তর কথা থামিয়ে বলে বসি, ‘কী বললেন? বেণু মুরলী বংশী বাঁশি কি এক নয়? তফাত কীসে?’

: অনেক তফাত। বেণুর পাঁচ ছিদ্র। মুরলীর তিন ছিদ্র। বাঁশি সাত ছিদ্র। বংশী নয় ছিদ্র। তফাত নেই? আকারে তফাত প্রকারে তফাত। বুঝলেন না?

বুঝলাম বইকী মনে মনে। খুব ছিদ্রান্বেষী নই অবশ্য। তবু মহান্তর কথায় কী একটা ধন্দ আছে। সবটাই তার বানানো না বাগ্‌বিভূতি। এই কথার পাকেই লোকটা শিষ্য বানায় নাকি? তবে এলেম আছে। লোকটার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত। কিন্তু ততক্ষণে মহান্ত এক রাউন্ড জিতে আমাকে আবার পেড়ে ফেলে বলেন, ‘আধারে ছিদ্র না থাকলে আসা-যাওয়া হবে কোথা দিয়ে? মানুষের দেহে কটা ছিদ্র বলুন তো?’

আঃ, খুব কমন কোশ্চেন পেয়ে গেছি এবারে। মৌজ করে বলি, ‘মানুষের শরীরে নটা ছিদ্র। যাকে বলে নবদ্বার। দুই চোখ দুই নাক দুই কান আর মুখ পায়ু উপস্থ। ঠিক বলেছি?’

: পুরুষের ক্ষেত্রে ঠিক। নারীর তা ছাড়া আছে যানি। তাকে বলে দশমীদ্বার।

এত সোজা কোশ্চেনেও পুরো নম্বর না পেয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকলাম। তখন মহান্ত বললেন, ‘মানুষের সাধন যখন হয় তখন একেক অবস্থার একেক নাম। এই যে বাঁশি বংশী মুরলী আর বেণু। এ সব সাধকের এক এক অবস্থাকে বলে। শুনবেন?’

: নিশ্চয়ই। এমন সব কথা কখনও শুনিনি।

: শুনবেন কী করে? ঘরে বসে তো শোনা যায় না। বেরিয়ে পড়তে হয়। মেলা মচ্ছবে মিশতে হয়, মিলতে হয় মানুষের সঙ্গে। মানুষের কাছেই সর্ব জিনিস বাবাজি। মানুষের বাইরে কোনও প্রাপ্তিবস্তু নেই।

খেই ধরিয়ে দেবার জন্যে আমি বলি, ‘বেণু মুরলী বংশী বাঁশি সম্পর্কে কী যেন বলবেন?’

‘হ্যাঁ বলব। সেইটাই সবচেয়ে নিগূঢ় কথা’ ত্রৈলোক্য মহান্ত গলাটা খুব খাদে এনে সোজা চাইলেন আমার দিকে অন্তর্ভেদী চোখে তারপর বললেন, ‘মানুষের চেতনা যখন থাকে নিদ্রিত তখন তিন ছিদ্রে বাজে, তাকে বলে মুরলী অবস্থা। তিন ছিদ্র হল সত্ত্ব রজ তম। এরপরে সত্তার ঘটে উত্থান! তাকে বলে বেণু। তার পাঁচ ছিদ্র। মন, দুই নাসিকা আর দুই চোখ—এই পাঁচ। এর পরে বাঁশি অবস্থা যখন মানুষ সচৈতন্য হয়। তখন সাত ছিদ্রে বাজে। তার মানে বেণুর পাঁচ ছিদ্রের সঙ্গে তখন যোগ হয় দুই কর্ম অর্থাৎ মনকর্ম আর কায়কর্ম। ব্যাস্‌ সবসুদ্ধ সাত। মানুষের চতুর্থ অবস্থার নাম বংশী। তখন নয় ছিদ্র। অর্থাৎ বাঁশির সাতের সঙ্গে তখন যোগ হয় পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ। এই হল সাধকের চরম অবস্থা।’

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম মহান্ত-র বাক্যের বিন্যাসে। খানিক পরে কথার ঘোর কাটলে জিজ্ঞেস করলাম: আপনাদের ধর্ম স্বকীয়া না পরকীয়া?

: স্বকীয়া আর পরকীয়া বলতে কী বোঝেন? নিজের স্ত্রী আর সাধনসঙ্গিনী?

: হ্যাঁ। তাই তো শুনি।

: সবটাই ভুল। আমাদের আইনপুস্তকে বলে:

সতীনারী ব্যভিচারী দুয়ের কর্ম নয়।

সহজ দেশে করণ করা দেশ আলাদা হয়॥

তার মানে নিজের স্ত্রী বা অন্যের নারী কেউই নয়। স্বকীয়া কথার মানে একেবারে আলাদা। আমরা মনে করি, দেহের মধ্যেই নারী-পুরুষ—তারই রমণকে বলে স্বকীয়া। তার বাইরে সব সঙ্গমই পরকীয়া। কর্তাভজা ধর্মে এই স্বকীয়া সাধনা। এবারে বলুন এ ধর্মে কি কাম থাকতে পারে? আমাদের মত আলাদা।

: তা বুঝলাম। কিন্তু আউল বাউল সাঁই দরবেশ—আপনারা কোনটা?

মহান্ত বললেন: ও সব একেবারে অন্য রাস্তা। ফকিরি তত্ত্বের ব্যাপার। এসাহক তুমি কিছু জানো নাকি?

আখড়ার মধ্যে থেকে গুঁড়ি মেরে সামনে উঠে এল এক মাঝবয়সী মুসলমান। এরই নাম এসাহক। জানা গেল সে কর্তাভজা নয়। তবে ব্যানাডার দলের সঙ্গে এসেছে মেলায়। ত্রৈলোক্য মহান্তকে খুব খাতির করে। এগিয়ে এসে সবিনয়ে বলল, ‘আমি সব তেমন জানি না। তবে একবার ছেঁউরের লালনের আখড়ায় গিয়েলাম। সেখানে একটা শ্লোক শুনে মনে মনে গেঁথে নিয়েছি সেটা বলতে পারি। বলব?’

: বলো।

আউলে ফকির আল্লা

বাউলে মহম্মদ

দরবেশ আদম সফি

এই তক্‌ হক্‌।

তিনমত একসাথ

করিয়া যে আলী

প্রকাশ করিয়া দিলো

সাঁইমত বলি॥

আমি থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে মহান্তকে বললাম, ‘কিছুই তো বুঝলাম না। এ যে কেবলই পাকে পাকে জড়িয়ে পড়ছি। সব কিছু জানতে চাই ঠিকই কিন্তু আমার কি অত সামর্থ্য আছে? আপনি কী বলেন?’

মহান্ত বললেন, ‘মানুষের সামর্থ্যের কি সীমা আছে? তবে গুরুর কৃপা লাগে। যাইহোক, দুঃখ করবেন না। আপনাকে একটা আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে একজন ফকির আছেন। সতী মা-র মেলায় তিনি বরাবর আসেন। বেনোয়ারি ফকির। আমাদের ঘরের মহাশয় নন। তবে আসেন প্রতিবার।’

: মহাশয় নন তবু আসেন কেন?

: এটা একটা সিদ্ধপীঠ তো? তাই অনেকে আসেন। মেলামেশা হয়। ভাবের লেনদেন হয়। চেনাজানা হয় পাঁচজনে। চলুন দেখি যদি পেয়ে যাই।

অনেক ঘুরেও বেনোয়ারি ফকিরের দেখা মিলল না। তবে একজন জানাল ফকির অসুস্থ তাই আসেননি এবার। আমি বললাম: অসুখ? ফকিরের অসুখ হয় না শুনেছি যে?

লোকটা নির্বিকারভাবে বলল: আজ্ঞে, গা থাকলেই ঘা হবে।

কী চমৎকার এইসব লৌকিক বুলি। ‘গা থাকলেই ঘা হয়’। হঠাৎ মনে পড়ল রয়েল ফকিরের কথা। সেই তো বলেছিল মেলা-মচ্ছবে গেলে অনেক মানুষ অনেক অভিজ্ঞতা হয়। সে-ই তো প্রথম হাতে ধরে অনেকগুলো মেলা ঘুরিয়েছিল। মানুষটা আজ মাটির তলায় ঘুমোচ্ছে বটে, তার কথাগুলো কিন্তু জেগে আছে। তার কাছ থেকে ঘোষপাড়ায় যে সব ফকির ও মহাশয়দের পরিচয় পেয়েছিলাম তা জীবনের অক্ষয় সম্পদ। আজ শেষবারের মতো ঘোষপাড়ার মেলা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আউলাচাঁদ-রামশরণ রামদুলাল-সতী মা সবাইয়ের কথা মনে পড়লো। একদল ক্লিষ্ট অবমানিত মানুষকে তাঁর শাস্ত্রবর্ণকলঙ্কিত ধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন উদার মানুষ ভজনের অসীম সম্ভাবনায়। তাঁদের উত্তরপুরুষরা যদি সে-ধর্মে এনে থাকেন লোভের কলঙ্ক, দ্বেষের কালিমা আর শোষণের নিষ্ঠুরতা তবুও তো মূলধর্মের মহিমা অমলিন থেকে যায়। থেকে যায় তার শুদ্ধ বিধান আর ভাবের গীত। গ্রাম থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত জনপদে কর্তাভজা ধর্মের বিশ্বাসী মানুষগুলির আকুতি আর উৎসর্জন তো সত্যি। নিজের চোখে দেখেছি এই আবেগের টানে এমনকী বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে আসে কত মহাশয় আর বরাতি। আজও।

সারাদিনের সমস্ত ক্রিয়াকরণ সমাপনের পর মেলা তখন খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। আখড়াগুলোয় জ্বালা হচ্ছে সাঁঝবাতি। ক্লান্ত দণ্ডীখাটা মানুষগুলো অপরিসীম শ্রমের শেষে নিঃশেষে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রতিবন্ধী বালক বালিকাগুলি মুখ গুঁজেছে মা-বাবার সন্তপ্ত বুকে। শুধু এক একটা সমাবেশে একটানা চলছে ভাবের গান। সে গানে আত্মধিক্কারের আর অনুতাপের সুর:

অপরাধ মার্জনা কর প্রভু।

এমন মতিভ্রম জন্মজন্মান্তরে তোমার সংসারে

হয় না যেন কভু

বিকলে করলে বড় কাবু।

আমার ত্রুটি কত কোটিবার

লেখাজোকায় লাগে ধোঁকা সংখ্যা হয় না তার।

গভীর নির্জন পথ নয়, অসংখ্য সহস্র মানুষের উদ্বেল উপস্থিতিতে ভরা, কত সশঙ্ক ভরসা আর বিশ্বাস, কত সুগভীর আশা-ঘেরা আত্মনিবেদন এ মেলায় দুশো বছর আছড়ে পড়েছে। চারদিকের অজস্র মানুষ আর তাদের সম্মিলিত ভক্তিকে আলোকিত সম্মান জানাতেই আজ যেন উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। সেই উদ্দীপ্ত প্রান্তর আর চঞ্চল জনস্রোত দেখে লালশশীর মতো আমারও মনে হয় ‘রাস্তার ওপর বাসাঘর নাগর দোলনা’। মনে হল, লালশশী বাউলদের মতো মনের মানুষ খুঁজে সারাজীবনের কান্না গেঁথে রাখেননি তাঁর গানে। মনের মানুষ ছিল তাঁর ভেতরেই। শুধু মনে হয়েছিল তাঁর ‘কাজ কি সেই মনের মানুষ বাইরে বার করে?’

*

কলকাতার নামকরা খবরের কাগজে খবরগুলো বেরোয় না কিন্তু মফস্বলের চার পাতার ছোট কাগজে মাঝে মাঝে হেডলাইন হয়: বাউল নিগ্রহ। আমি এমনতর অনেক খবর কেটে ক্লিপিং করে রাখি। খবরের ধরনটা প্রায় একরকম। অর্থাৎ নদীয়া বা মুর্শিদাবাদের কোনও গ্রামে এক বা একদল বাউল কিংবা মারফতি ফকিরের মাথার ঝুঁটি চুল দাড়ি কেটে, একতারা ভেঙে দিয়ে, মারধোর করেছে কট্টর ধর্মান্ধরা। কাগজের খবরটা ওইখানেই শেষ হয়। জানতে মন নিশপিশ করে যে তারপর কী হল? ব্রাত্য বাউল-ফকিররা কি এ নিগ্রহ বারে বারে মেনে নেয় না প্রতিরোধ গড়ে? প্রশাসন কী করে? গ্রামের রাজনীতিকরা কি এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে? জানা যায় না।

কিন্তু আমার নিজস্ব সূত্রে কেবলই খবর আসে বেনোয়ারি নামে একজন ফকির সদাসর্বদা এমন ঘটনা ঘটলেই বাউলদের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মোল্লাদের সঙ্গে ধর্মীয় ‘বাহাস’ অর্থাৎ বিতর্কে নামেন। প্রায় সব জায়গাতেই শেষপর্যন্ত বেনোয়ারির জিত হয়। অনেকবার ভেবেছি যাব বেনোয়ারির কাছে। হাল হদিশ পাইনি তেমন কোনও। মানুষটা কি তবে অরণ্যদেবের মতো নেপথ্য থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন—এমন পরিহাসভরা চিন্তা করে নিজেই হেসেছি। শেষমেশ এবারের সতী মার মেলায় ত্রৈলোক্য মহান্ত মানুষটির ঠিকানা দেন। নদীয়া-মুর্শিদাবাদ বর্ডারে ধরমপুরের কাছে মাঠপুকুর গ্রামে বেনোয়ারি ফকিরের স্থায়ী সাকিন। মানুষটার সম্পর্কে কিছু খবর বাতাসে ওড়ে শিমুলতুলোর মতো। ফকিরের কোরান আর হাদিস নাকি কণ্ঠস্থ। মানুষটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাকি স্টেনগান ধরতেন। এ দিগরের সমস্ত বাউল ফকির নাকি বেনোয়ারির গোলাম।

কী দরকার এ সব গুজবে ভর করে? মানুষ তো? একদিন দেখে আসলেই হবে। হাড়িরামের একটা গান মনে আসে, ‘মানুষ মানুষ সবাই বলে/কে করে তার অন্বেষণ?’ তা মানুষের অন্বেষণে আমার তো অন্তত কোনও ক্ষান্তি নেই। একদিন চালচিড়ে বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। মাঠপুকুর খুব একটা তেপান্তর নয়, তবে আমার ডেরা থেকে সেখানে যাবার রাস্তাটা খুব ঘুর পাকের। তবু শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাই বেলা বারোটায়। আগে একটা আন্দাজি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলাম অবশ্য। ডাক বিভাগের প্রসিদ্ধ তৎপরতায় ফকির তা পাননি। তাতে ক্ষতি নেই। বিশাল লম্বা একবগ্‌গা চেহারার শক্ত কাঠামোর মানুষটার মধ্যে একজন নরম লোক বাস করে। হই হই করে সংবর্ধনা করলেন: আরে আসুন আসুন। চিঠি পাইনি তো কী হয়েছে? আপনার মনের চিঠি এই তো পেলাম, তাতে খোদ খোদার শিলমোহর। বাস্ তা হলেই হল। উঠুন দাওয়ায়। বসুন গরিবের এবাদতখানায়। হ্যাঁ হ্যাঁ আপনার নাম শুনেছি বইকী! শুধু চেহারাটা মেলানো বই তো নয়। চেহারায় তো মানুষের আদলই দেখছি। হাঃ হাঃ। গরিবের কুঁড়েয় দুটো সেবা হবে তো? ওহে সহিতন বিবি, এ বাবুর জন্যে দুটো চাল লাও।

নজর করে দেখি উঠোনে একজন অল্পবয়সী মুসলমান বউ গাঢ় বেগুনফুলি শাড়ি পরে উনুন ধরাচ্ছে কাঠকুটো নারকেল পাতা দিয়ে। বিরাট এজমালি উনুন। তাতে একটা শানকি চাপা দেওয়া থাকে সাধারণত। হঠাৎ অতিথ-পথিক এসে পড়লে চট করে দুটো রেঁধে দেওয়া যায়। আপাতত জ্যৈষ্ঠের খরতাপে সহিতন বিবির গৌরী তনু ঘামে সারা। ভাবলাম, তার দিকে চেয়ে, বেনোয়ারি ফকির বেশ কমবয়সী বিবি জোগাড় করেছেন। বেনোয়ারি ঘর থেকে এক মস্ত খেজুরপাতার পাটি এনে দাওয়ায় পাতলেন। দুটো হাতপাখা জোগাড় হল। সহিতন বিবিকে বেশ হেঁকে তিনি এক প্রস্ত চা আর মামলেটের হুকুম দিয়ে যেন অন্তর্যামীর মতো আমার মন পড়ে নিয়ে বললেন, ‘যা ভাবছেন তা নয়। সহিতন বিবি আমার মাইনে-করা কাজের লোক। একা মানুষ তো আমি। বয়সও হয়েছে। দানাপানি ফুটিয়ে দেয় আর আমার ওই ঘরের দাওয়ায় পড়ে থাকে একটা বাচ্চা নিয়ে। বরে তালাক দিয়েছে। আশ্চর্য হবেন না। গ্রামদেশের গরীব মুসলমান ঘরে তালাক-খাওয়া মেয়ে দুটো-একটা সর্বদা মজুত থাকেই।’

কথাটা খুব নির্বিকারভাবে বললেও বেনোয়ারির গলার স্বরে একটা মর্মজ্বালা, একটা গাঢ় বেদনা যেন মেদুর হয়ে ওঠে। আমি অবস্থাটা সামলাতে বলে বসি, ‘একেবারে একা থাকেন। সময়কালে বিয়েয় বসেননি কেন? তখন থেকে ফকিরির নেশা?’

‘আরে না না’ মানুষটা খুব দেল্‌খোলসা ভঙ্গিতে জোরে হেসে বলেন, ‘ফকিরি নিই অনেক পরে। আসলে কী জানেন? বাড়ির গাছে কুমড়ো কি লাউ প্রথম যেটা ফলে সেটা হয় ঠাকুরসেবায় লাগে নয়তো বীজ করে। তো আমি হলাম পিতামাতার জ্যেষ্ঠ ছেলে, তাঁরা আমাকে বিয়ে সাদি না দিয়ে বীজ করে গেছেন। হাঃ হাঃ। কারুর ভোগে লাগলাম না। কী বলেন?’

মানুষটা তো ভারী চকচকে! সঙ্গে সঙ্গে বেনোয়ারি ফকিরকে ভালবেসে ফেললাম। বললাম, ‘বীজই তো আসল। তবে সে বীজ কোথায় পড়ছে সেটাই মূল কথা, মাটিতে না পাষাণে। মনে হয় আপনার বীজে অরণ্য হয়ে যাবে। ঠিক নয়?’

‘বিলকুল ঠিক’ দাড়িতে আঙুলের চিরুনি চালিয়ে ফকির বললেন, ‘হ্যাঁ, শিষ্যশাবক চাড্ডি আছে বটে আমার। এখনই সব আসবে। জলিল, মানউল্লা, আবু বক্কর, অমরেশ, উমিদ। ওই দেখুন বলতে বলতে আবু বক্কর হাজির। যাক, আপনার কপাল ভাল। বক্কর ভাল গাহক। আজ কটা গান শুনতে পাবেন।’

সাদা ধুতি লুঙ্গি করে পরা, সাদা আলখাল্লা, একটা সাদা ঘেরাটোপে মোড়া দোতারা। আবু বক্করের শুভ্র মূর্তি দাওয়ায় উঠে নতজানু হল বাবু-হয়ে-বসা বেনোয়ারির সামনে। বক্কর তার মুখখানি একেবারে ডুবিয়ে দিল গুরুর কোলে। গুরু তার ঝুঁটি বাঁধা চুলে বিলি কাটলেন, পিঠে দিলেন হাতের উষ্ণতা। প্রণাম-পর্ব শেষ হল গুরুর পায়ের দুটো বুড়ো আঙুলে যখন শিষ্য চুম্বন করল।

প্রণামের পদ্ধতিটা ভারী নতুন ধরনের। জিজ্ঞেস করলাম, ‘একেই কি আপনারা বলেন সেজদা?’

বেনোয়ারি বললেন, ‘সেজদা বা অভিবাদন নিয়ে তর্ক আছে। আমাদের মুসলমান আলেমগণ বলেন একমাত্র আল্লা ছাড়া আর কাউকে সেজদা হারাম। তারা বলেন, তবে কেন ফকিররা মানুষ হয়ে মানুষকে সেজদা করে? এ ব্যাপারে আমাদের জবাব সাফসুফ। সেজদা করি মানুষে খোদা আছে বলে। এ জবাবে ওরা খুশি হয় না। আমাদের সঙ্গে এই নিয়ে বেধে যায় মাঝে মাঝে। না না দাঙ্গাহাঙ্গামা নয়। শুধু বাহাস অর্থাৎ তর্ক।’

আমি বললাম, ‘একটা গানে শুনেছিলাম—যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।’

: ‘গান আপনি এখন চোপরদিন শুনবেন কত। আবু বক্কর এসে গেছে। ও হল গানের পাখি। ও হ্যাঁ ভালকথা, পাখি কোথায় গেল বলো তো বক্কর?’

বক্কর বলল, ‘পাখি? আবার উড়েছে? দেখি কমন্‌দিকে গেল; নড়া ধরে ধরে আনি।’

আমি বললাম, ‘এ কী? আপনি ফকির মানুষ পাখি পুষেছেন? সে তো বন্ধন?’ বেনোয়ারি আপন মনে হাসেন আর দাড়িতে আঙুল বোলান। হঠাৎ বাড়ির কানাচ থেকে আবু বক্করের গানের টুকরো ভেসে এল:

আমি একটা পাখি ধরেছি।

যতই করে ঝটর পটর

পোষ মানাবো দিয়ে মটর

শিকলি দিয়ে আটকে রাখার

ফন্দি করেছি।

ধরেছি ধরেছি পাখি ধরেছি॥

কী কাণ্ড! সত্যিই আবু বক্করের হাতে-ধরা এক কিশোরীর বিনুনি। সবুজ শাড়ি জড়ানো তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে আর আবু বক্করকে ঘুঁষি মারছে। তার ফরসা মুখখানা রাগে গনগনে। মাথা নিচু করে জেদি ভঙ্গিতে মেয়েটা দাওয়ার সামনে দাঁড়াল। বক্কর বলল, ‘ছাঁচতলায় বসে লুকিয়ে আচার খাচ্ছিল। এই দেখুন আমার আলখাল্লায় আচার মাখিয়েছে, আমাকে খামচে দিয়েছে, ঘুঁষি মেরেছে। এর প্রিতিকার নেই? আমি বিচার চাই।’

‘বিচার কাঁচকলা’ মেয়েটা বুড়ো আঙুল দেখাল জিভ ভেঙিয়ে।

বেনোয়ারি বললেন, ‘বিচার হয়ে গেছে। সে ছোঁড়া আজ তোকে নিতে এলে যেতে দেব না। বাস।’ মেয়েটি পা দাপাতে দাপাতে মল বাজিয়ে সারা উঠোনে ঘুরে ঘুরে একসা। বেনোয়ারি বললেন, ‘আমিও বিয়ে সাদি করিনি আবু বক্করও না, দ্যাখো একবার ঐহিকের মায়া। হ্যাঁরে, ইয়াকুব তোকে এত ভালবাসে?’ মেয়েটি পালাল।

সংসার বিরাগী ফকিরের বাড়িতে এমন মধুর জীবনের ছবি দেখে খানিকটা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ফকির সে অবস্থা থেকে উদ্ধার করে বললেন, ‘ভাইপোর মা-মরা মেয়ে। নাম পাখি। ওকে এনে পুষেছিলাম পাঁচ বছর বয়সে। টিয়ে পাখির মতো ঘুরত ফিরত, দানাপানি খেত। ঠুকরিয়েও দিত খুব। তারপরে সবে পোষ মানছে এমন সময় আমারই এক শিষ্যের জ্যাঠা পাখিকে পছন্দ করে তার ছেলে ইয়াকুবের সঙ্গে সাদি দিয়েছে। বাস। ভাবলাম মায়া কাটল। কোথায় কী? রোজ পালিয়ে আসে। পাখি তো পাখিই।’

ইতিমধ্যে চা ডিমভাজা এল। পাখিই এনেছে। যেন কত নম্র শান্ত এখন। লাজুকলতা। খাবার নামিয়ে দিয়েই দৌড়।

খাওয়া-দাওয়া চুকলে আমি বললাম,‘তখন সে সেজদার কথা বলছিলেন। ইসলামি শাস্ত্রে এ বিষয়ে কী বলে?’

: দেখুন অত শাস্ত্রপ্রমাণ দিয়ে কি সব কিছু হয়? আমরা তো শাস্ত্ৰছুট। আমরা ফকির। আমরা বলি ‘খদ’ মানে ব্যক্তি বা মানুষ। ‘সেই মানুষ না ধরিলে/খোদা কভু না মিলে।’ আবু, তোমার সেই আর্জান শাহ ফকিরের গানটায় কী বলে যেন?

খদ আর খোদা উভয়ে একজন।

খদকে ধরে করো ভজন॥

একেবারে হক্‌ কথা। তা খদকে যদি মানি তবে তার মধ্যে খোদাকেও মানি। নয়কি? তা হলে খোদাকে যদি সেজদা করি তবে খদকে সেজদা করতে আর বাধা কী? আসলে কি জানেন? সেজদা দু’রকমের। ‘সেজদা অবুদিয়ত’ বা এবাদত আর ‘সেজদা-এ তাহিয়া’ বা তাজিম। কী আবু বক্কর বাবুকে বোঝাতে পারবে? বোঝাও দেখি। আমিও বুঝে নিই তোমার এলেম কতটা বাড়ল।

আবু বক্কর বলল, ‘মুর্শেদের কৃপায় যেটুকু বুঝেছি আপনাকে বলছি। বাবা, ভুল হলে শুধরে দিবা কিন্তুক। শুনুন বাবু। ‘সেজদা অবুদিয়ত’ শুধু আল্লার উদ্দেশে যে প্রণাম তাকে বলে। তার বহু নিয়ম আছে। আর ‘সেজদা-এ তাহিয়া’ বা ‘তাজিম’ আলাদা জিনিস তাজিম মানে হল গিয়ে সম্মান। তার মানে সম্মান করে সেজদা সকলকেই করা যায়। আমরা ফকিররা সেইজন্য সেজদা করি সব মানুষকে।’

আমি বললাম, ‘আমি যখন কুবির গোঁসাইয়ের গান সংগ্রহ করতাম তখন তাঁর একটা গানে সেজদার কথা পেয়েছিলাম কিন্তু মানে বুঝিনি! এখন যেন বুঝতে পারছি।’

: কী বলুন তো গানখানা?

নামাজ পড়ো যত মোমিন মুসলমানে।

আল্লাজী সদর হন না দিদার দেন না

সেজদা করি কার সামনে?

হয় আপনি আল্লা আপন মনে।

বেনোয়ারি একেবারে হই হই করে উঠলেন, ‘আরে এ তো খাঁটি মারফতি গান। ‘আল্লাজী সদর হন না দিদার দেন না’ ঠিকই তো। আল্লা সামনে আসেন না, দর্শন দেন না। তা হলে কাকে সেজদা করি? কাজেই আপন মনে বসতি যে আল্লার তাকেই সম্মান করো। সব খদের মধ্যেই যে খোদা তাকেই দাও সম্মান। বাঃ বাঃ। মনটা ভাল হয়ে গেল।’

এদিকে জ্যৈষ্ঠের তাপ বাড়ছে। গরম ভাতের গন্ধ উঠছে। চুপিসারে ফকিরের আর ক’জন শিষ্য কখন সামিল হয়ে গেছে দাওয়ায়, কথায় কথায় খেয়াল হয়নি। খেয়াল হল যখন পাখির ধমকানি শুরু হল, ‘তোমরা ছ্যান করবা না? খাবা না? বেলান্ত বসে বসে গজালি করলেই চলবে?’

আবু বক্কর বলল, ‘উঠুন বাবাসকল। পেছনে ছাতারে পাখির খ্যাচর ম্যাচর শুরু হয়েছে। এ না ঠুকরে থামবে না।’ অচিরে তার ঝুঁটি ধরে টান মারল পাখি। ‘বাপরে’ বলে খুব মায়ালি হেসে বক্কর উঠল। পেছনে আমরা। তেল গামছা তৈরি। ঝাঁপিয়ে পড়া গেল আখড়া সংলগ্ন ঠাণ্ডা পুকুরে। স্নান করে এসে দেখি দাওয়ায় ভোজনপর্ব সাজানো। তবে শুধু ফকির আর আমার। ভাত, ডাল, ভাজা, পটলের তরকারি আর পাকা আম। সামনে বসে থাকল চার শিষ্য। খেতে খেতে একসময় হঠাৎ দেখি চারশিষ্য মেটে দাওয়ায় উটপাখির মতো নাক ডুবিয়ে ডান হাত প্রসারিত করে দিল গুরুর দিকে। গুরু তাদের চারখানি অঞ্জলিতে দিলেন চারগ্রাস অন্নপ্রসাদ। ভক্তিভরে প্রসাদ খেয়ে তারা মাথায় হাত মুছল।

ফকিরদের আচরণবিধি একটু অন্য রকম। সারাদিনে আরও কত কী দেখব না জানি। খাওয়া শেষ হতে আমরা শুলাম দুদণ্ড খেজুর পাটিতে। কথা চলতে লাগল। ওদিকে হেঁসেলের দাওয়ায় শিষ্যশাবকরা খাচ্ছে। সঙ্গে পাখির কিচির মিচির। আমি বেনোয়ারিকে বললাম, ‘এখন ফকিরিতন্ত্রে কি নতুন নতুন মানুষ আসছে? বেশির ভাগ গৌণ সম্প্রদায় তো পড়তির দিকে।’

ফকিরির পথে চিরকাল মানুষজন কম। এখন আরও কম। পথটা কঠিন তো। ক্রিয়া-করণের চেয়ে এতে উপলব্ধির দিক বেশি, দমের কাজ আছে। শ্বাসের কাজ। ভুল হলে শরীর ভেঙে যায়। এ পথে দাঁড়ানো কঠিন, ধরে রাখাও কঠিন। আমাদের একটা গানে বলেছে;

ফকিরিতে ফিকিরি করলে

নরকপুরী যেতে হবে ভাই।

সেই নরক ভক্ষক জনার

নরকেতেই ঠাঁই॥

গানটা বুঝলেন তো? ফকিরিতে ফিকিরি চলবে না। ফিকিরি মানে ভুয়োতাল, ফাঁকি। মিথ্যে কথা। কাম-লোভ-হিংসা-দ্বেষ একেবারে ত্যাগ করতে হয়।

: আচ্ছা, আপনি তো বিয়ে করেননি। সব ফকিরই কি তাই?

: না সংসারী ফকিরও আছে। তবে তারা গৃহীদের মতো কামের বশীভূত নয়। বীর্যরক্ষা আমাদের প্রধান কাজ। আমরা বলি বিন্দু। এই বিন্দু বা কীটকে বলে শুক্র। আমরা বলি নফ্‌স্‌। এই নফস বা কামকে সর্বদা শাসনে রাখতে হয়।

: আপনাদের ফকিরি মতে তাহলে শারীরবিদ্যার স্থান খুব বেশি।

: মারফৎ কথার একটা মানে তো সেইটাই। একে বলে ‘এলমে তশরীহ’, মানে শারীরস্থান বিদ্যা। যাকে বলে অ্যানাটমি।

আমার মনে হতে লাগল যেন এই মধ্যদুপুরের মায়ায় কোন একটা অজানা রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। তার দারুণ আকর্ষণ। সামনে আমার যিনি শুয়ে শুয়ে অবহেলে জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ঘটাচ্ছেন তিনি যেন বেনোয়ারি নামে কোনও মনুষ্যদেহধারী নন, যেন ফেরেশ্‌তা। স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষ অথচ শাস্ত্রজ্ঞান আর তার ভাষ্যরচনায় ওস্তাদ। তার চেয়েও বেশি আত্মজ্ঞানে যাকে বলে খুব মজবুত ইনটেলেকচুয়াল। পাশাপাশি যেন তাঁর জ্ঞানের রাজ্যে আমি নিতান্ত পাথর-খোঁজা নিউটন। সেই কথা মনে রেখে অজ্ঞানতার নিম্নদেশ থেকে আমি জানতে চাইলাম এই এলেমদার ফেরেশতার কাছে, ‘দেহের খবর কিছু বলবেন?’

: বলবার কথা তো অনেক। দেহের একটা অংশ তো ধড়। অনেকটাই দেল্‌। আসল পড়া পড়তে হয় দেল্‌কেতাব থেকে। আর মানুষের এই শরীরের সবচেয়ে বড় জিনিস হল বিন্দু। পথে নামলে যেমন পথিকের সঙ্গে দেখা হয়, আমাদের মারফতি পথেও তেমনই নানা মত এসে মেলে। সে সব জানতে বুঝতে হয়। তবে জ্ঞানের পথে বেশিদূর যায় না ফকিররা। তাদের পথ দেলের। দেলই আল্লার ঘর।

বেনোয়ারির কথায় একটা গভীরতর টান আছে। সে টান কেবলই ভেতরদিকে আরও টান দেয়। মনে হয় মানুষটির কাছে যেন আমার সব জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ঘটবে। কিন্তু তাই কি হয়? হতে পারে? আমার জিজ্ঞাসা তো অসীম নয়। কথার টানে যে কথাটুকু জাগছে, কথার আভা যে প্রশ্নকে আলোকিত করছে আমি শুধু সেটুকুই জানতে চাইতে পারি তাঁর কাছে। কিন্তু জ্ঞানী মানুষটার কাছে আমি একটানা মূর্খের মতো প্রশ্ন করছি না তো? বেনোয়ারির উত্তরে রয়েছে গহন গভীরতা কিন্তু আমার প্রশ্নগুলোর মান নিতান্ত শিশুসুলভ হচ্ছে কি? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি এবারে, ‘ফকির সাহেব, আমি নানা আনশান প্রশ্ন করছি না তো? আপনি হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন।’

: মোটেই না। আরে আমার কারবার সব মূর্খ চাষাভুষোদের নিয়ে। তাদের জ্ঞান খুব বেশি হলে ছাত্রবৃত্তি পর্যন্ত, আপনি তো জ্ঞানের পথ সেরে এসেছেন। আর শুনেছি আপনি বেশ কিছু সাধু সন্ন্যেসী নাড়াচাড়া করেছেন। আপনার কথাতেও তা ধরা পড়ছে। আমরা ফুট দেখলেই বুঝি মিরগেলের ঝিম।

: শেষ কথাটার মানে বুঝলাম না।

: কথাটা বোঝা কঠিন নয়। তবে আপনার পথ আলাদা তো তাই বুঝলেন না। ব্যাপারটা হল জলের খুব ভেতর দিকে থাকে মিরগেল মাছ। তাদের নিশ্বেস থেকে জলের ওপরে যে বুজগুরি বা ফুট ওঠে তাই দেখে জেলেরা বুঝে নেয় কোথায় মিরগেল আছে, সেইখানে জাল ফেলে। তেমনই আপনার কথাতেই আপনার নিশানা ধরা পড়ছে। আপনি কোথায় আছেন। কত ভেতরে।

এবারে সাহস পেয়ে আমি পুরনো ফেলে-আসা প্রসঙ্গটায় ফিরতে চাই। তাই বলে বসি, ‘আপনি বলছিলেন ফকিরিতত্ত্বের মূল কথা বিন্দুধারণ। তো এই বিন্দু বা শুক্রের সূচনা কীভাবে, পরিণতিই বা কী?’

: তা হলে শুনুন। আমাদের মারফতি মতে বলে, দেহের ওপরে হল চামড়া, চামড়ার মধ্যে রক্ত, রক্তের মধ্যে মাংস, মাংসের মধ্যে মেদ, মেদের মধ্যে অস্থি, অস্থির মধ্যে মজ্জা আর সেই মজ্জার মধ্যে শুক্র। এখন বুঝুন শরীরের পঞ্চদশ বস্তুর মধ্যে শুক্রই প্রধান। সেই শুক্রের মধ্যে আছে প্রাণের পুষ্প, বীজ। এবারে বুঝে নিন সেই প্রাণের মধ্যে আছে আত্মারাম, আত্মারামের মধ্যে পুষ্প, পুষ্পের মধ্যে কলি, কলির মধ্যে চিৎশক্তি, চিৎশক্তির মধ্যে মন, মনের মধ্যে ভাব, ভাবের মধ্যে রস, রসের মধ্যে প্রেম। আর সেই প্রেমের মধ্যে আছে সহজবস্তু। আমরা শেষপর্যন্ত সেই সহজবস্তুর সন্ধানী তাই প্রেম আমাদের অবলম্বন। এ সব কিছুর মূলে শুক্র, তাই শুক্র রক্ষা করতে হবে। শুক্রহানি ঘটলেই তাই সহজের পথ টলে যাবে।

চমৎকার যুক্তির বুনোট। প্রায় মেনে নিতে সাধ যায়। বেনোয়ারির বলবার ক্ষমতা যেমন, তেমনি তারিফ করবার মতো স্মৃতিশক্তি। হয়তো বিন্দুধারণ থেকে এ সব ক্ষমতা আসে। কে জানে? আপাতত তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির শস্ত্রে ধরাশায়ী হতে হতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুক্রই যদি প্রধান উপাদান তো সেই শুক্রের উৎপত্তি কোথা থেকে? সেও কি রক্ত মাংস মেদ মজ্জার মতো মানুষের জন্মগত অর্জন?’

: জন্মগতই যদি হবে তা হলে যৌবনের আগে বিন্দু আসে না কেন?

পরাজয় মেনে নিয়ে বলি, ‘আপনিই বুঝিয়ে দিন।’

বেনোয়ারি হেসে বলেন, ‘ভাববেন না আমি পয়গম্বর পীর। অনেকদিন ধরে বহু গুরু মুর্শেদের সঙ্গ তারপর অনেক কামেল ফকিরের বাহাস শুনে তবে এ সব মনের মধ্যে গেঁথেছে। যাই হোক, এখন প্রশ্ন হল, বিন্দুর উৎপত্তি যদি জন্মগত নয় তবে আসে কোথা থেকে? এ প্রশ্নের এককথার জবাব, পঞ্চভূত হতে। অর্থাৎ পঞ্চভূতের প্রভাবে জন্মায় খাদ্যশস্য দানাপানি। সেই থেকে তৈরি হয় জীবাহার। মানুষ সেই আহার্য থেকে রস টানে। সেই রস চামড়া থেকে শেষপর্যন্ত বিন্দুতে তৈরি হয়। সেইজন্য বারো চৌদ্দ বছর লাগে মানুষের দেহে বিন্দু সৃজন হতে।’

মানি আর না মানি লোকধর্মের এই এক সবল দিক। এরা আমাদের মতো কথায় কথায় শাস্ত্র দেখায় না। এদের আছে এক নিজস্ব বিশ্বাসের জগৎ। কোনও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মৌলানা বা উলেমা সে জগৎ বানাননি। এঁরা নিজেরাই দিনে দিনে বানিয়েছেন। তাতে আছে জৈবনিক দৃঢ় কাঠামো। কাম আর স্খলন তাতে একভাবেই স্বীকৃত ও ধিক্কৃত। প্রেম মহিমময়। লোকধর্মের তত্ত্বে আবেগের চেয়ে লজিক বেশি তার কারণ এ-ধর্মে যারা আছে তাদের অনবরত যুক্তি-তর্ক দিয়ে নিজের মতামত পোক্ত করতে হয়। এ ধর্মে যাদের ছিনিয়ে আনা হয় তাদেরও বোঝাতে হয় যুক্তি তর্ক দিয়ে। গ্রামের লোক ভাষণে বড় একটা মজে না কিন্তু যুক্তিতে ভেজে। তাদের জীবন যে যুক্তির শৃঙ্খলে বাঁধা। বীজ পুঁতলে শস্য হয়, বৃষ্টি পড়লে শস্য দানা ভাল ফলে, সার দিলে আবাদ ফলন পরিমাণে বাড়ে। আবার উলটো যুক্তিতে বীজ খারাপ থাকলে আর সব কিছু ভাল হলেও ফসল কেঁচে যাবে। সব কিছু ঠিকঠাক হলেও বন্যা বা খরা হলে সে বছর নির্ঘাত মরণ। সেই লজিকের জগৎ থেকেই বেনোয়ারিকে খোঁচা মারি, ‘বিন্দুরক্ষা করতে গেলে তো দমের কাজ জানতে হয়। সবাই তো তা জানে না। গৃহীরা কি স্ত্রীসঙ্গ করবে না তবে?’

‘কেন করবে না’ বেনোয়ারি বোঝান, ‘সন্তান চাইলেই সঙ্গম। তবে স্বসুখ বাসনার জন্যে কাম হল পাপ। আমাদের একটা চলিত গ্রাম্য কথা আছে—

মাসে এক বছরে বারো

তার কমে যতটা পারো।

বুঝলেন?’

: বুঝলাম। সেইজন্যেই কি আপনি বিয়েই করলেন না? সকালে যে লাউ কুমড়োর বীজ রাখার কথা বললেন, সে তো নিতান্ত পরিহাস। আসল ব্যাপারটা কী?

‘আসল ব্যাপার জন্মদ্বারে ঘৃণা’ নরম মানুষটি হঠাৎ কঠিন হয়ে গেলেন। টানটান হয়ে বললেন, ‘স্ত্রীজাতিকে যদি মা ভাবি তবে কাউকেই কি কামনা করা যায়? যেখান দিয়ে আমার জন্ম সে স্থান তো আমার বাবার। তা হলে সব নারীতেই তো রয়েছে আমার জন্মচিহ্ন। আমি কেমন করে নিজের মাকে কামনা করি? আমি কি পশু?’

ব্যথায় টনটন করে উঠল আমার মন। ঝিমঝিম করতে লাগল সারা শরীর। কী জমাট নীরবতা। কী গুমোট। বেনোয়ারির মুখ ক্ষোভে ধিক্কারে জর্জরিত। দুচোখে টলটল করছে জল। হঠাৎ গম্ভীর স্বরে হাঁকলেন, ‘আবু বক্কর। সেই গানটা শোনাও এঁকে। বুঝেছ?’

আবু বিনয়ে মাথা নেড়ে বসল। ঘেরাটোপ খুলে দোতারা বাঁধল। তারপর চোখ বুঁজে তীব্র তারসপ্তকের পঞ্চমে তার ক্ষুব্ধ কণ্ঠকে বাজিয়ে তুলে গাইল:

কেন ঝাঁপ দিলিরে মন

বাবার পুকুরে।

কামে চিত্ত পাগলপ্রায় তোরে॥

এ সব গানের কী শক্তি। যেন ঝাপটের মতো আমার কানে এবং সেখান থেকে সোজা মনকে বিদ্ধ করল। কী স্পষ্টতা অথচ কতখানি ব্যঞ্জনা। গান তো নয়, যেন কামী মানুষের পরিতপ্ত আর্তনাদ। আবু বক্কর যত গাইছে তত কাঁদছে। জলিল, মানউল্লা সবাইয়ের চোখে জল। আবু বক্কর অনায়াসে পৌঁছে গেল অন্তরা থেকে আরেক অন্তরাতে:

কেনে রে মন এমন হলি?

যাতে জন্ম তাইতে মলি?

ও তোর ঘুরতে হবে লক্ষ গলি

হাতে পায়ে বেড়ি সার করে॥

দীপের আলো দেখে যেমন

উড়ে প’লো পতঙ্গজন

অবশেষে হারায় জীবন

তাই করলি হা রে॥

ততক্ষণে বেনোয়ারি অনেকটা আত্মস্থ হয়েছেন। তাই দেখে আমারও খানিকটা স্বস্তি হয়। পরিবেশের গুমোট কাটে। ‘আহা’, ‘বেশ বেশ’ এ সব তারিফের ধ্বনি ওঠে ফকিরের গলা থেকে। ব্যাপার দেখে পাখিও এমনকী সাহস করে উঁকি মারে ঘরের চৌকাঠ থেকে। আবারও ভাবি, এ সব গানের কী শক্তি! মনের তাপও গানে গলে গলে পড়ে সবদিক শীতল করে। আবু বক্কর এবারে গানের ভণিতায় এসে পড়ে:

সিরাজ শা দরবেশে তাই কয়

শক্তিরূপে ত্রিজগৎময়

কেন লালন ঘোরে বৃথাই

আপ্ততত্ত্ব না সেরে॥

বেনোয়ারি আমার পাশে উঠে এসে বসেন। আমার হাঁটুতে হাত রেখে বলেন, ‘মন হঠাৎ বড় চঞ্চল হয়ে গেল। শক্তিরূপে ত্রিজগৎময় সেই সহজবস্তু মনের মানুষ তো মনের মধ্যেই রয়েছে। তাইলে তাকে আর কেন নারীর মধ্যে আলাদা করে খোঁজা? কেন বন্ধন? কেন মায়া?’

আবু বক্কর গান থামিয়ে আরক্ত চোখে নেহার করল তার গুরুর দিকে। ‘গান চলুক’ নির্দেশ এল। হেসে সে আবার দোতারা বাঁধে। সেই সুযোগে মানউল্লা বলে ওঠে, ‘বাবুকে হাতির গানডা শোনাও দিকি বক্কর।’ পাখি হাততালি দিয়ে সায় দেয়।

হাসিমুখে বক্কর গায়:

বাজারে হাতী দেখা হয়েছে।

চার কানায় দেখে এসে

আপন আপন বলতেছে॥

বাইরে একটু কি হালকা হাওয়া উঠেছে দিনশেষে? ঘরে অন্তত মানুষগুলির মনে একটু ঝিরঝিরে বাতাসের ছোঁওয়া লাগে। ফকিরের চোখ নিমীলিত, মুখে হাসি৷ জলিল বলে, আমার কানে, ‘বাবার দশা হয়েছে। মনের ব্যথা গলে গিয়েছে।’

আবু বক্কর গায়:

একজন বলে ‘কই সবার কাছে

হাতী দেখা হয়েছে—

নরম নরম সুপারির গাছ খাড়া রয়েছে।

তার উপর মোটা নীচে সরু

মাথা কুমড়োর মত ঝুলতেছে’।

আর একজন কয় ‘তোমার কথা নয়

আমি ঠিক বলি তোমায়—

চারদিকে কাঁথা ঝোলে কুলোখানির প্রায়’।

যত অজ্ঞানেতে গল্প করে

তাতো সব দেখি মিছে।

আর একজন কয় ‘শোনো বিবরণ

তোমরা যা বলো এখন,

একটি কথা নয়কো সাচ্চা বলো অকারণ।

হাতী পাকাঘরের থাম্বা যেমন

খাড়া হয়ে রয়েছে’।

গেল্লা ক’রে আরেকজনা কয়,

‘বড় অসইলো তো হয়

দেখলাম হাতী আখ একগাছি

নীচে পাতা রয়’।

গোপাল কয় খেদেতে

চার কানাতে আচ্ছা মজা লাগিয়েছে॥

গান শেষ হতে খুশিতে হাততালি দিল পাখি। মানউল্লা বলল, ‘পাখির মনে এখনও বালিকাভাব, তাই এতবড় ভাবের গানখানা শুনেও মজা পেয়েছে।’

‘এ গানখানার মধ্যে খুব বড় ভাব আছে নাকি?’ আমার মুখ ফসকে কথাটা বার হয়ে গেল।

বেনোয়ারি বললেন, ‘আল্লার চেহারা কেমন? ভগবানের রূপ কেউ কি জানে? একেক জন একেক রকম বর্ণনা করে বলে তার আন্দাজি মতে, যেমন ওই কানার হাতি দেখা। সাধনা অনুযায়ী স্তরে স্তরে তাঁর সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত ভগবান সম্পর্কে আর রূপের ধারণা থাকে না। একাত্ম হয়ে যেতে হয়। এটাই সুফিমত।’

: সুফিমতের ওই স্তরগুলো বিষয়ে আর একটু বলবেন?

ফকির বললেন, ‘জলিল বল দেখি সুফিমতের তরিকা। দেখি কেমন শান আছে।’

জলিল বলল, ‘বেল গায়েব একিন পেরথমে। তারপরে এল্‌মেল্‌ একিন। তারপরে আয়নুল একিন। তারপর হাক্‌কুল একিন। ওই যাঃ বাবা শেষডা আর স্মরণ নেই যে!’

মানউল্লা বলল, ‘তোর বড্ড বিস্মরণ হয়। শুনে নে। সবশেষে হলো হুয়াল একিন।’

জলিল লজ্জায় মাথা নিচু করে। বেনোয়ারি বলেন, ‘সুফিমতে, নিজে না দেখে পরের মুখে শুনে আল্লার অস্তিত্ব বিশ্বাস করাকে বলে, ‘বেলগায়েব একিন’। তারপরে জ্ঞানের দ্বারা আল্লাকে বিশ্বাস করাকে বলে ‘এল্‌মেল্‌ একিন’। চোখে দেখে বিশ্বাস করাকে বলে ‘আয়নুল একিন’। এর চেয়ে বড় স্তর আছে। সত্য জেনে পরিচয় করে বিশ্বাস করাকে বলে ‘হাক্‌কুল একিন’। আর সব শেষ স্তরে হল ‘হুয়াল একিন’। তার মানে আল্লার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। এবারে বুঝলেন তো হাতির গানের মূল্য। আল্লার সামনে আমরা সবাই কানা।’

শেষ জ্যৈষ্ঠের সায়াহ্নে আমি জ্ঞানী মানুষটার দিকে শ্রদ্ধায় বিনতিতে নীরবনত হয়ে সেজদা জানাই। অন্তর্যামীর মতো তা বুঝে মানুষটি বলেন, ‘সেজদা দিন নিজের ভেতরের খদকে।’

পরদিন ভোর হতেই ফিরে আসি নিজের ডেরায় কিন্তু অচিরে আবার যাই মাঠপুকুর গ্রামে বেনোয়ারি ফকিরের কাছে। কেননা মাথায় ছিল বাউল ফকির নিগ্রহের প্রসঙ্গ। সে সম্বন্ধে তো কিছুই জানা হয়নি সেদিন। এবার তাই মাঠপুকুর পোঁছে, চা-জলখাবার খেয়েই কথাটা তুলে বসি। কে জানে বেলা বাড়লে শিষ্যরা এসে পড়বে হয়তো। ফকিরি গান হবে। তারপর পাঁচতালে আসল কথাটা ভুলে যাব। সরাসরি বলি, ‘মাঝে মাঝে খবর পাই নদীয়া-মুর্শিদাবাদে নাকি বাউল ফকিরদের নিগ্রহ হয়। কী ধরনের নিগ্রহ? কেন হয়? কারা করে বলুন তো?’

: নিগ্রহ মানে প্রথমে শাসানি চোখ রাঙানি, তারপরে মারধোর, একতারা বাঁয়া ভেঙে দেওয়া। সবশেষে ঝুঁটি কেটে দাড়িগোঁফ জোর করে কামিয়ে দেয়, এই আর কী। শেষেরটাই সবচেয়ে অপমান।

: কেন?

: বাউলদের ধর্মই হল সর্বকেশরক্ষা।

: কিন্তু যারা এ অত্যাচার করে তারা কারা? সাধারণ মানুষ?

: আলেমরা এ কাজ করে। এলেম মানে জ্ঞান। যারা এ কাজ করে তাদের আমি বলি বেআলেম অর্থাৎ অজ্ঞানী। এ কাজ বহুদিন থেকে হচ্ছে। কয়েকশো বছর। শুনেছি লালন ফকির বা পাঞ্জুশাহ ফকিরের সময় কুষ্টিয়া যশোর রংপুরে বাউলদের ওপর ধ্বংসের ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। বহু লোক মার খায়, পালায়, লুকিয়ে থাকে। এ তো নতুন কিছু নয়। আমি এ সব প্রতিরোধের চেষ্টা করি। প্রতিবাদ জানাই সাধ্যমতো।

বেনোয়ারির দিকে শ্রদ্ধার চোখে তাকাই। এঁদের কথা কোনওদিন সভ্য সমাজ জানবে না। মনের মানুষ সন্ধান করতে এঁরা গভীর নির্জন পথ বেছে নেন বটে তবে মাঝে মাঝে সেই পথ ছেড়ে এঁদের বাধ্য হয়ে সন্তপ্ত অত্যাচারিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হয়। সেটাও মনুষ্যত্বের টানে। অনেকদিন আগে ‘এক্ষণ’ পত্রিকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস কাঙাল হরিনাথের ডায়েরির কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, একবার নাকি কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাঠিয়ালরা প্রজাদের ওপর অত্যাচার করছিল। তাই শুনে লালন ফকির তাঁর আশ্রম থেকে ভক্তদের নিয়ে লাঠিসোঁটাসহ বেরিয়ে এসে লেঠেলদের ফিরিয়ে দেন। সেই বিবরণ পড়ে লালন ফকিরের ওপর আমার শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। সেই রকম শ্রদ্ধা বেনোয়ারি ফকিরকে দেখে আমার মনে জাগল। লোকধর্ম তা হলে অনেকটা নৈতিক শক্তি আনে মানুষের মনে। প্রতিবাদের প্রতিরোধের। হঠাৎ মনে হল, লোকধর্মের জন্মই তো প্রতিবাদ থেকে। এ কথাও মনে হল যে, আমার ধর্ম আমাকে কোনও প্রতিবাদের শক্তি দেয়নি, প্রতিরোধের শস্ত্র দেয়নি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম: নিগ্রহের ঘটনা কেন ঘটে বলুন তো?

: মূল কারণ ধর্মান্ধতা। বেশির ভাগ মানুষ অসহিষ্ণু অজ্ঞান মূর্খ। শাস্ত্র নিয়ে লড়াই করে কিন্তু শাস্ত্রই পড়েনি। আসল ব্যাপার হল বাউল ফকিরদের বেশির ভাগ আমাদের মুসলমান সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে গজিয়ে ওঠে। সেটা বেশ কিছু মোল্লা মৌলবীরা ভাল চোখে দেখে না। এই নিয়ে শুরু। আরও ব্যাপার আছে।

: আরও ব্যাপার বলতে শরিয়তের সঙ্গে মারফতের লড়াই, তাই তো?

: খুব সংক্ষেপে তাই। আর একটা ব্যাপার হল আমাদের এই গানবাজনা করা। সেটা নাকি হারাম, নিষিদ্ধ। সেবার খুব মজা হয়েছিল। চণ্ডীপুরের মোল্লার সঙ্গে আমার বাহাস হচ্ছে ওই গান গাওয়া নিয়ে। আশপাশের দশ-পনেরোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। আমি আবু বক্করকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাকে বললাম, ‘বক্কর, আমাদের মুসলমান ভাইদের দুদ্দুশা’র গানটা শোনাও তো।’ সে গান ধরল:

গান করিলে যদি অপরাধ হয়

কোরান মজিদ কেন ভিন্ন এলহানে গায়।

রাগ রাগিণী সুর

রাহিনী বলিয়া মশহূর

এত আলাপন আছে নিরাপন তাতে কেন হারাম নয়।

আরবী পারসি সকল ভাষায়

গজল মরসিয়া সিদ্ধ হয়

নবীজী যখন মদিনায় যায় ‘দফ’ বাজায়ে মদীনায় নেয়।

বেহেস্তের সুর নাজায়েজ নয়

দুনিয়ায় কেন হারাম হয়

দুদ্দু কয়, শুনি কোথায় গানের ফতোয়া কোথা পায়॥

বাস্‌। একগানে ফৌৎ। গানের সার কথাটা হল, স্বর্গে যদি গান অবৈধ না হয় তবে মর্তে কেন গান হারাম হবে? অকাট্য গান। আর তার সঙ্গে বক্করের গলা। মৌলানার দল পালাল। হাজার হাজার লোক বলে ‘গান চলুক চোপর রাত।’ সে এক কাণ্ড বটে।

আমি বললাম, ‘গান দিয়েই তো আপনাদের সব কথা বলা অভ্যাস। কিন্তু সব জায়গায় তো গান দিয়ে জেতা যায় না। তখন কী করেন?’

: বেশির ভাগ বাহাসে কোরান শরীফ হাদিস থেকে ব্যাখ্যা নিয়ে তর্ক হয়। যেমন ধরুন আমরা মারফতি ফকির, আমরা বিশ্বাস করি আল্লার চেহারা আছে তাঁকে দেখা যায়। মুসলমান মৌলানারা সে কথা মানেন না। তাঁরা বলেন আল্লার রূপ নেই। আমি তখন বলি, হজরত মহম্মদ মোস্তাফা বলেছেন—

ইন্নাকুম সাত্তারুনা রাব্বেকুম কামা

তারা উনা হাজল কামার *

এ কথার অর্থ—পূর্ণিমার চাঁদের মতো আল্লাহকে স্পষ্ট দেখা যাবে। তা হলে? তবে এখানে কথা আছে।

: কী রকম?

: এই যে বলা হয়েছে আল্লাহকে পূর্ণিমার চাঁদের মতো স্পষ্ট দেখা যাবে, তা কি সবাই দেখতে পাবে? না। এ দেখতে গেলে আমাদের মারফতি পথ নিতে হবে। এ পথ অজানা, তাই একজন পথপ্রদর্শক চাই। তিনিই পীর মুর্শিদ। একজন জাননেওয়ালা (জ্ঞানী) কামেল পীরের কাছে বায়েত (শিষ্য) হয়ে তাঁর কাছে গোলামি খৎ লিখে তাঁর মন জয় করতে পারলে তবে সেই পথ দেখা যাবে।

আমি যেন একটা নতুন জগতে ঢুকে পড়েছি। এ জগতের বিষয় যেমন ধূসর ভাষাও তেমনই ধূপছায়া। তবে শেষপর্যন্ত ভাবটা বোঝা যায়। তবু একটু খটকা থাকে। যেমন মুর্শিদ কি শুধুই পথপ্রদর্শক? তিনিই তো অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। যেমন লালন ফকির একটা গানে বলেন—

যেমন মুর্শিদ তেমন খোদা

মনে কেউ করোনা দ্বিধা।

তবে? মুর্শিদকে দেওয়া এতখানি বড় আসন? হতেই তো পারে গোলমাল। ঔদার্য তো সার্বজনীন হতে পারে না। কিন্তু বেনোয়ারি ফকিরকে সে তর্কে না নিয়ে গিয়ে একটা সামাজিক প্রশ্নে টেনে আনলাম এই বলে যে, ‘এই যে আপনি বা জলিল বা মানউল্লা মাঠপুকুর গ্রামে বসে মারফতি সাধনা করছেন তাতে গ্রামসমাজে গোলমাল হয় না? একদিনও মসজিদে যান না তাই নিয়ে ঝঞ্ঝাট হয় না?’

বেনোয়ারি হাসেন। বলেন, ‘আপনি একেবারে মোক্ষম জায়গাটা ধরেছেন। হয়, মাঝে মাঝে মন কষাকষি হয়। তবে আমরা তো কাউকে যেচে আনছি না আমাদের পথে। তা ছাড়া বাহ্য আচরণে সবাইকে বলি ‘নামাজ পড়ো’ ‘মসজিদে যাও’। আসলে আমরা নিজেদের মতো গ্রামের একটি টেরে পড়ে আছি। কাউকে ঝামেলায় ফেলি না। গান বাজনা করি। দল বেঁধে সবাই শুনতেও আসে।’

: কিন্তু বিয়ে থা? সমাজ?

: অসুবিধে নেই। আমাদের ঘরে অনেক মুসলমানই মেয়ে দিতে চায়। গরজ করেই দেয়। কেন বলুন তো?

: কেন?

: তালাকের ভয় নেই। ফকিরদের সন্তান হয় শান্তিপ্রিয়। তালাক তো ধর্মীয় অত্যাচার। আমরা ঘৃণা করি তালাক প্রথাকে। আমরা মানুষ ভজি। তা হলে মানুষের অপমান কেমন করে করি?

: আর আপনাদের ঘরের মেয়েদের মুসলমান সমাজ বউ করতে চায়?

: যেচে নেয়। দেখেননি আমার পাখিকে? ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে? জোর করে মেগে নিয়ে গেল আমার এক শিষ্যের জ্যাঠা। সে অথচ খানদানি মুসলমান, পঞ্জবেনা মেনে চলে রীতিমতো।

‘পঞ্জবেনা আবার কী?’ আমি বলি। ‘পাঁচ ছশো বছর মুসলমানদের পাশাপাশি বাস করেও তাদের অনেক কিছুই জানলাম না, শিখলাম না। এমনকী জানতে চাইলামও না। এর কারণ কী?’

: আপনাদের নাক সিঁটকানো আর আমাদের রক্ষণশীলতা দুটোই দায়ী। যাই হোক, পঞ্জবেনা সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। পঞ্জবেনা হল শরিয়তি মতে খাঁটি মুসলমানের জীবনে পাঁচটি অবশ্যকৃত্য। একেই বলে আরকানে ইসলাম।

: কী কী?

: কল্‌মা, রোজা, হজ, জাকাত আর নামাজ।* এর নানান খুঁটিনাটিও আছে অবশ্য।

: যেমন?

: যেমন মূলে নামাজ দু রকম। জাহেরা নামাজ আর বাতুনে নামাজ। বাতুনে নামাজের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সর্বদাই সে নামাজ চলে, শয়নে স্বপনে সর্বত্র। আর জাহেরা নামাজ পড়তে হয় পাঁচবার বা পাঁচরোক্ত। পাঁচবারের নাম আর সময় আলাদা আলাদা। শুনবেন?

: বলুন। কিছুই তো জানি না। শুধু খানিকটা বাজে লেখাপড়া শিখেছি। এখুনি আপনাকে বলে দিতে পারি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কতখানি সাংবিধানিক ক্ষমতা, মারাদোনার হাঁড়ির খবর কিংবা বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে ভারতের ঋণ কত। অথচ…

‘বেশ বলেছেন’ ফকির বলেন। ‘যে কথা জানতে চাইছিলেন। খুব ভোরবেলা যে-নামাজ তাকে বলে “ফজর”। বেলা বারোটা-একটা নাগাদ যে-নামাজ তার নাম “জোহর”। “আসর” হল বেলা তিনটে-চারটে নাগাদ যে-নামাজ। সন্ধেবেলার নামাজকে বলে “মগরেব”। আর রাতের নামাজ “এয়েসা”। কী মনে থাকবে? লিখে নিন। আর সেইসঙ্গে এই কথাটা মানে লালনের এই কথাটাও লিখে নিন যে—

পাঁচরোক্ত নামাজ পড়ে

শরা ধরে কে পায় তারে?’

: তার মানে আপনি বলতে চান নামাজ বাজে? তার কোনও মূল্য নেই?

‘তা বলি না’ বেনোয়ারি ব্যাখ্যা করে বোঝান, ‘আমরা বলতে চাই লোকদেখানো নামাজ দিয়ে কী হবে? মসজিদে গেলেই কি ধর্ম? আসল নামাজ তো মনে। তার চেয়েও বড় কথা হল কার নামাজ? তাঁকে কি জানি? অন্যায় পাপ চুরি করে তারপরে নামাজ পড়া চলে কি? আল্লা বলছেন, আমি তোমাতে আছি তুমি কই আমাকে দেখছ না? অফি আন ফোসেকুম আফালা তোফসেরূন।’

‘বুঝলাম যে আপনাদের ধর্মসাধনা অনেকটা সহজিয়াদের “বর্তমান” সাধনার মতো’ আমি বেনোয়ারিকে বোঝাতে চাইলাম। ‘ওরাও বলে অনুমানে ধর্ম হয় না। কোথাকার কৃষ্ণ রাধা মথুরা বৃন্দাবন—চোখেই দেখিনি কোনওদিন। তার চেয়ে অনেক চাক্ষুষ হল মানুষ, তাকে ধরো। তার মধ্যেই খুঁজে নাও মথুরা বৃন্দাবন রাধাকৃষ্ণ। আপনাদেরও তেমনই মনে হচ্ছে।’

: হ্যাঁ অনেকটা তাই। তবে শরিয়তের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে তফাত এইখানে যে ওটা আচরণগত আর আমাদের উপলব্ধি। ওদের বাহ্যধর্ম আমাদের অন্তরধর্ম। জলিলকে দেখেছেন তো? সাধারণ মূর্খ কিষাণ, অবসরে ঘরামির কাজ করে। ও যখন কুড়ি বছর আগে আমার কাছে দীক্ষা শিক্ষা নেয় তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘শরিয়তি ধর্মে মন ভরল না তোমার?’ ও বলল, ‘গুরু, ওই আন্দাজি ধর্মে আমার মন ভরল না, আমি মানুষ ধরে সাধন করতে চাই।’তখন দীক্ষা দিলাম।

: তবে কি শরিয়ত ভুল?

: কে বলল ভুল? শরিয়ত কায়েম না হলে কি মারফত হয়? লালন ফকির একবার বাহাসে কী বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন—

শরিয়ত ঘরের সিঁড়ি

ঘর মারফৎ।

চড়িয়া সিঁড়ির পরে

খাড়া থাকি যদি

না হেঁটে কেমনে ঘরে যাই বলো দেখি?

শরিয়ত হইলে হাসিল মারফতে যাবো।

কী বুঝলেন? আমরা কি শরিয়ত বিরোধী?

:না। বুঝলাম মারফত হল শরিয়তকে এড়িয়ে যাওয়া নয়, পেরিয়ে যাবার ধর্ম। শরিয়ত না হলে মারফত হয় না। কিন্তু মারফত হলে আর শরিয়তে ফেরে যায় না। ঠিক বুঝেছি কি?

: একদম স্পষ্ট বুঝেছেন। শরিয়ত আর মারফত যেন দুধ আর মাখন। দুটোই মিলেমিশে আছে। কিন্তু মাখন বার করে নিলে ঘোল পড়ে থাকে। তাতে আর কাজ কী? সেইজন্যেই বলা হয়েছে—

মারফতের পথিক যারা

শরার কেতাব নেয় না তারা।

তা হলে আমাদের হজ রোজা জাকাত নামাজ কী হবে আর? আমরা অনেক ভেতরে চলে গেছি। আর তো লোক দেখানো কাজ করতে পারি না। তাই আমরা দেল-কেতাব পড়ি। খুঁজি সেই মনের মানুষ। যাকে পেলে আর কিছু চাইতে হয় না। থাকে শুধু হকিকত অর্থাৎ হকের পথে চলা। আর তরিকত অর্থাৎ বিচার। কীসের বিচার? না আমি কী করেছি, আমি কী করছি। তাকেই বলে দরবেশ যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন।

ক্ষণিকের বিরতি ঘটল। কেননা জলিল এসেছে আমাদের নিতে। আজ তার বাড়িতে আমাদের দুপুরের খাওয়া দাওয়া।

জলিলের বাড়ি নিতান্ত গরিবগুরবোর কুঁড়ে। তবে সেবাধর্মের আন্তরিকতার ত্রুটি নেই। এই বসাচ্ছে, এই পাখার বাতাস করছে, এই ঠাণ্ডা জল তালশাঁস দিচ্ছে, সঙ্গে গুড়।

বেনোয়ারি বলেন, ‘গরিবদের বাহ্য চমকটা নেই তো, তাই ভগবান ওখানে আটকে থাকেন। আর ধনীর ঘরে নানা জেল্লা কারদানি আর কেরামতি। তার ফাঁক দিয়ে ভগবান কেটে পড়েন। এ নিয়ে কত বাহাস হয় আমার সঙ্গে আলেমদের। যেমন ধরুন এই হজ। হজ কি গরিবদের সাধ্য? সেইজন্যে আমাদের একটা গানে বলে—

এখানে না দিদার (দর্শন) হলে

সেখানে পাবে না গেলে।

হজ করিতে মন তুই যাবি কোন্‌ কাবায়?

হজের ঠিকানা না জেনে

দৌড়াদৌড়ি যাস্‌ কোথায়?

হজ মানে কী জানেন? মনকে বাইরে থেকে টেনে এনে অন্দরে বসানো। জলিল, তুমি বাবুকে সেই প্রকৃত হজের গল্পটা বলো তো।’

জলিল বলল, ‘একজন অবিবাহিত সৎ ধর্মভীরু মুসলমান ঠিক করল তার গ্রামের কজনের সঙ্গে হজ করতে যাবে মক্কায়। যেতে তো অনেক টাকা লাগে। তা আল্লার কৃপায় সে টাকা জোগাড় হল। যাবার আগে ভাবল শহরে গিয়ে প্রাণের দোস্তকে একবার দেখে আসি। কী জানি হজ করে ফিরতে পারব কি না। পৃথিবীতে তার মায়ার টান বলতে ছিল সেই বন্ধুর ওপর। বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখে বন্ধু ক’মাস আগে মারা গেছে। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে বন্ধুর বউ অভাবে পড়ে নাকানি চুবানি খাচ্ছে। টাকা পয়সার অভাবে হাঁড়ি চড়ে না এমন অবস্থা। কিন্তু হঠাৎ বাড়ির রসুইখানা থেকে মাংস-রান্নার গন্ধ লাগল তার নাকে। সে ভাবল, তবে কি বন্ধুর অভাবের কথা বানিয়ে বলল? অভাবী মানুষ মাংস রাঁধে কী করে? খোঁজ করতে বন্ধুর বউ বলল কাঁদতে কাঁদতে, তিনদিন ধরে ছেলেমেয়েদের কিছু খেতে দিতে না পেরে আজ গো-ভাগাড় থেকে মরা গোরুর রাং এনে পাক করছে। সেকি? আমার বন্ধুর বউ মরা গোরু বেঁধে খাচ্ছে গো-ভাগাড় থেকে এনে আর আমি যাব অনেক টাকা খরচ করে মক্কা? ছিঃ। মাথায় থাক আমার হজ। বাঁচলে কত হজ হবে। এই ভেবে তার সব টাকা তাদের দিয়ে গ্রামে ফিরে হজ যাত্রীদের বলল এবারে তার কোনও কারণে হজ হল না। ইনসাল্লা আসছে বছর যাবে।

‘এদিকে তার গ্রামের সেই মানুষগুলো তো হজে গেল। সেখানে গিয়ে সব জায়গাতেই সেই মানুষটাকে দ্যাখে আর ভাবে, কেমন হল? সে যে আসবে না বলল? তবে কি অন্য দলের সঙ্গে এল? ফিরে এসে খবর নিয়ে জানল লোকটা সত্যি সত্যিই হজে যায়নি। তারা তখন তার কাছে গিয়ে বলল, ভাই তোমারই সত্যিকারের হজ হয়েছে, আমাদের হয়নি।’

বেনোয়ারি বললেন, ‘এই হল হজের সত্যিকারের মর্ম। আন্তরিকভাবে খোদার কাজ করলে তবে হজ হাসিল হয়। ওই যে গরিবের পাশে দাঁড়ানো, ওই যে মানুষের দুঃখ ঘোচানো, যে তা করে সেই ন্যায্য হাজী। এই গোলমালটা আমাদের জাকাত নিয়েও হয়। জাকাত মানে দান। কিন্তু বেশির ভাগ মুসলমান জাকাতে জাঁক করে বেশি। আরে, আল্লা তোমাকে দিয়েছেন তাই তো তুমি দিচ্ছ। তা হলে তোমার অত জাঁক কীসের? নিজেকে দাও তাঁর সেবায়।’

আমি বললাম, ‘কট্টর ইসলামি নীতিনির্দেশ আর আপনাদের মারফতি চিন্তা দুয়ের মূলে কোনও বিরোধ নেই যা বুঝলাম। বিরোধ শুধু ব্যাখ্যায় আর আচরণে, তাই নয়?’

: ঠিক তাই। তবে আমাদের চোখে আগে মানুষ আর তার মনের ময়লা মোচানো। এই জাকাতের ব্যাখাই ধরুন। জাকাত* দুরকম—‘বাতুনী’ আর ‘জাহেরী’। বাতুন মানে গোপন। নিজের প্রিয় বস্তু আল্লার রাহে জাকাত দিতে হবে। নিজের প্রিয় বস্তু কি বলুন তো?

: তার কি কিছু ঠিক আছে? এক এক জনের এক এক রকম। যেমন ধরুন আমাদের হিন্দুদের একটা সংস্কার আছে যে কাশী পুরী হরিদ্বার পুষ্কর এ সব তীর্থে গেলে নিজের কোনও লাভের জিনিস গঙ্গা বা সমুদ্রে ফেলে আসতে হয়। কেউ ফেলল আম, কেউ ফেলল কলা। সারা জীবন আর সে জিনিস খাবে না। অবশ্য এ নিয়ে মজার কথাও শুনেছি। যেমন একজন তেঁতুল বা আমড়ার টক সহ্য করতে পারত না। সে কাশীর গঙ্গায় তেঁতুল আর আমড়া ফেলে এসে বললে, ‘বাবা বাঁচলাম।’ আমাদের হিন্দুধর্মে এই এক সমস্যা। তাতে গাম্ভীর্য কম। ধর্ম নিয়েও আমাদের মজা করা স্বভাব। আসলে এগুলো তো ধর্মপালন নয়, কতকগুলো আচার পালন। আমাদের কোনও আচার জোর করে চাপালেই তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হবেই। সেইজন্যে আমাদের সব বাড়ির অন্দরে সর্বদা খটাখটি। মেয়েরা বলে এইটা করতে হয়, আমরা বলি তা হলে করব না। কিন্তু আপনার জবাবটা বোধহয় ঠিক দিতে পারিনি। সত্যি সত্যি আমাদের প্রিয় বস্তু কী বলুন তো?

: আমাদের স্বসুখ বাসনা। যাকে বলে আত্মসুখ। বিচার করে দেখবেন আমরা যাই করি তার মূলে আত্মসুখ। একজন ভিখিরিকে যদি একটা পয়সাও দিই তাতেও আত্মসুখ থাকে। লোভ, ভোগ, কাম, ঐশ্বর্য এ সব তো স্বসুখ বাসনা বটেই, এমনকী ত্যাগও একটা সুখ। স্বসুখ ত্যাগ খুব কঠিন। সেইজন্যে বলেছে—

থাকিলে স্বসুখ বাসনা

রাগের উদ্দীপন হবে না।

আবার বলছি সবরকম স্বসুখ বর্জন করা খুব কঠিন। কেন না কেউ কেউ কষ্টভোগ করেও সুখ পায়। এমনকী বৈরাগ্যেও আত্মসুখ থাকতে পারে। অর্থাৎ দ্যাখো, আমি কেমন সব ত্যাগ করেছি। এ নিয়ে একটা গল্প আছে খুব চমৎকার। শুনবেন?

: সব কিছু শুনব বলেই তো আসা।

মৌজ করে বেনোয়ারি বললেন, ‘তা হলে শুনুন। জলিলও শোন। এ কিস্যা তোকে আগে বলিনি। একবার হজরত মোহম্মদ ধ্যানে বসেছেন। বহুক্ষণ ধ্যানের শেষে, আল্লাতালা তাঁকে তিনটে বস্তু দিলেন—জহর, মধু আর আতর। জহর মানে বিষ, সাংঘাতিক বিষ। তো তিনি শিষ্যদের বললেন, ‘এই নাও আল্লাতালা তোমাদের জন্যে পাঠিয়েছেন মধু আর আতর। খাও মধু প্রাণ ভরে, আর আতরের খোশবু তোমাদের জীবন মাত করে দিক।’ কিন্তু তিনি নিজের জন্যে রাখলেন জহর। সেইটাই তো ঠিক। কিন্তু তাতেও সমস্যা।’

জলিল বলল, ‘সমস্যা কীসের? হজরত মোহম্মদ তো ঠিকই করেছেন। নিজের জন্যে খারাপটা রেখে ভালটা দান করেছেন।’

: আরে ব্যাপারটা আমি আগে বুঝিনি। আমি যৌবনে যখন মোহম্মদ শাহর কাছে সুফিমতে কলমা সাবেদ (দীক্ষা) নিই তখন এই গল্পটা একদিন ওঠে। গল্পের শেষে মোহম্মদ শাহ বললেন, হজরত মোহম্মদ ওই যে জহরটা নিজে নিলেন, তাতে পরে শিষ্যরা বলেছিল, তিনি নিজে কষ্টটা নিলেন আর আমাদের দিলেন আনন্দ। সেটা কি ঠিক হল? কষ্ট করতে যে আমাদেরও ইচ্ছে হয়। হজরত আমাদের কষ্ট পাওয়া থেকে বঞ্চিত করলেন। কষ্ট না করলে কি আল্লাতালাকে কোনওদিন পাওয়া যায়? এ ব্যাখ্যা মহম্মদ শাহ-র কাছে শুনে আমি তো অবাক। সেই থেকে বুঝলাম কাকে বলে আত্মসুখ। নিজে কষ্ট পাওয়াও একটা বড় সুখ। আল্লার এ কি তাজ্জব বন্দোবস্ত।

আমি বললাম, ‘চমৎকার এই কাহিনী। আত্মসুখের সংজ্ঞাটাও বেশ নতুন। তা হলে বোঝা গেল বাতুনী জাকাতের মানে হল নিজের প্রিয় বস্তু দান করা। কিন্তু জাহেরী জাকাত মানে কী?

: জাহেরী মানে আমরা বলি চল্লিশ ভাগের এক ভাগ দান। দেখবেন জুম্মার নামাজের পর মসজিদের বাইরে সার-দিয়ে-বসে-থাকা গরিব দুঃখী অনাথ আতুরকে ভক্ত মুসলমানরা দান খয়রাত করছে। সে তো খুব ভাল কাজ। কিন্তু শুধু দান করলেই হবে না। আসলে জাহেরী জাকাতের একটা অন্য মানে আছে। আমরা বলি, আল্লা আমাদের দেহভাণ্ডারে চল্লিশগঞ্জ মালসহ আমাদের পয়দা করেছেন। মুর্শিদ ধরে, মুরিদ ধরে, নিজের খাস মহব্বতের যে মাল আমাদের শরীরে আছে তার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ আল্লার রাহে জাকাত দাও।

আমি বেনোয়ারি ফকিরের কথা শুনে বুঝলাম ধর্মের ব্যাখ্যায় একটা সমান্তরাল চিন্তা লোকধর্ম সর্বদাই করে চলে। শাস্ত্ৰ আপ্তবাক্য পুরোহিতের নির্দেশের বাইরে একটা ব্রাত্য কিন্তু বলিষ্ঠ জীবনভাবনা লোকধর্মের মর্মমূলে প্রাণসঞ্চার করে। আন্দাজি কথাবার্তার অন্তঃসারশূন্যতা তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সঠিক পথটা ধরতে চায়। এ পথে বহু মানুষকে আকৃষ্ট করা যায় না। কিন্তু যে কজন এতে আসে তারা বুঝে শুনে যাচাই করে আসে। আর তারা টলে না। ‘আপনাকে আপনি ভুলে পশ্চিম তরফ খাড়া হলে’-ই যে নামাজ হয় না দুদ্দু শাহ-র এই কথা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। ‘না দেখে রূপ করে সেজদা, অন্ধ তারে কয়’ দুদ্দুর এই কথাটা প্রকাশ্যে বললে লাঠি পড়বে মাথায়। বেনোয়ারিদের গহন পথ তাই কয়েক শতাব্দী ধরে হৃদয়বান মানুষের বোধ আর মুক্তবুদ্ধির দ্বারে মিশতে চায়। প্রতিহত হয় বারে বারে। অপমান নামে। আঘাত আসে। ক্লান্ত তবু ক্লান্তিহীন সেই মানবিক যাত্রা। সত্যিই এ পথ বড় নির্জন। আজকের এই মাঠপুকুর গ্রামের দুপুরের মতো। সমস্ত গ্রামটা যেন ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কেবল একটা দুটো ঘু ঘু ডাকছে।

বিশ্রাম আধোনিদ্রা অনুচিন্তা আর টুকরো ভাবনায় কেটে গেল একটা পুরো দিন। পাশের ঘরে বেনোয়ারি তাঁর বিশ্রামের শেষে আমার দাওয়ায় এসে বসলেন। প্রশান্ত ধ্যানমৌন আনন। চোখ দুটির দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী। বোঝা যায় কী একটা অন্তঃশীল মনের ক্রিয়া চলছে। ফকিরিতত্ত্বের খুব গূঢ় অন্তঃপুরে নাকি সুফিচিন্তাধারা মিশে আছে। সাতগেছিয়ার জাহান ফকির আমাকে একবার বলেছিল, ‘যে আল্লাহ আমাদের সৃজন পালন ধ্বংস করেন তার তত্ত্ব বা সত্য অনুসন্ধানই সুফিদের প্রধান কাজ।’ এই মুহূর্তে বেনোয়ারি কি সেই চিন্তায় অন্তর্মগ্ন? নইলে দৃষ্টি কেন এত সুদূর?

আমি জলিলকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার গুরু যেন এ জগতেই নেই। কীসের ধ্যান করছেন?’

জলিল খুব নিচু স্বরে আমাকে বলল, ‘বাবা রোজায় রয়েছেন তো। এটা যে রমজান মাস।’

চমকে গেলাম একেবারে। এত সব কথাবার্তা, শরিয়ত নিয়ে বাহাস আর শেষকালে রোজা? তা ছাড়া এ কেমন রোজা? এই তো দুপুরে আমার সঙ্গে ভাত খেলেন দিব্যি। তা হলে? মনটা খুব সংশয়ী হয়ে ওঠে। খানিক পরে বিরাট এক রেচক বায়ু ত্যাগ করে জিকির দিয়ে বেনোয়ারি জপ শেষ করে আমার দিকে সপ্রশ্ন তাকালেন। অর্থাৎ ভাবটা যেন, আপনার কি কোনও বিশেষ জিজ্ঞাসা আছে? জিজ্ঞাসা তো আছেই তবে আপাতত কাদেরিয়া ফকিরদের দমের প্রক্রিয়া দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা কাটিয়ে উঠে একটু পরে বললাম, ‘আপনি রোজায় বিশ্বাসী?’

প্রসন্ন হেসে বেনোয়ারি বললেন, ‘কলমা-রোজা-হজ-জাকাত-নামাজ সবেতেই আমার বিশ্বাস কিন্তু তার আচরণ আলাদা। আমাদের কাজ ভেতরে ভেতরে। আমাদের অন্দরের মণিকোঠায় আল্লার বারামখানা। সেখানে যাওয়াই আমার হজ, সেখানে আমার বিশ্বাসই কলমা, সেখানে আমার সর্বদা চলছে বাতেনী নামাজ সেখানে আমার নফ্‌স্‌কে জাকাত দিয়েছি, সেখানে আমার রোজার ছিয়াম।’

: ছিয়াম মানে কি উপবাস?

উপবাসের সঙ্গে সংযম। নফ্‌স্‌কে শাসনে রাখাই রোজা। দিনে উপোস রাতে খাওয়া ও তো বাদুড়ের ধর্ম। মুখে রোজা রেখে অন্তরে কাম সেটা রোজা নয়। কিছু খেলাম না অথচ একজনকে চড় মারলাম তাতে হাতের রোজা নষ্ট। সারাদিন উপোস দিলাম অথচ মনে রইল হিংসা অসূয়া দ্বেষ তা হলে মনের রোজা নষ্ট। রোজা মানে আমরা বলি আত্মশাসন।

স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটির দিকে বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। যেন চেতনার প্রজ্ঞার কোনও জটিল উৎস থেকে উঠে আসছে কথাগুলো। যেন আল্লার সেই আর্তি ফকিরের মুখে, যার ভাষ্য হল, ‘আমি তোমাতে আছি, তুমি কই আমাকে তো দেখছ না?’ মানুষটা আমারই পাশে বসে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনেক দূরে। কী আশ্চর্য, এই কি সেই পাখিপোষা মায়ালি মানুষটা? ধ্যানের অন্তর্নিবিষ্টতার এতটা শক্তি? একেই বোধহয় বলে সিদ্ধাবস্থা। জলিল কানে কানে গাঢ় স্বরে বলল, ‘বাবু, এনার শরিয়ত হাসিল হয়ে গেছে। উনি এখন মারফতের পাকা রাস্তার সোজা সরানে উঠে পড়েছেন। ওঁকে সেজদা দিন।’

সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াই। অভিবাদন করি।

সূর্য পাটে বসেছে। রাগরক্তিম মাঠপুকুর গ্রাম থেকে এবার বিদায়লগ্ন। শেষবারের মতো বেনোয়ারি ফকিরকে বিনতি জানিয়ে বলি, ‘চলে যাচ্ছি এবার। আবার কবে আসব জানি না। শেষ কথাটা বলুন আপনার। কী পেলেন? কী বুঝলেন? মনের মধ্যে কোন কথাটা ভরে নিয়ে বাড়ি ফিরব?’

যেন ফেরেশ্‌তার মতো মহামহিমাময় উঠে দাঁড়িয়ে বেনোয়ারি বললেন, ‘তাঁকে জানা যায় না এইটে জানাই চরম জানা। চিরপবিত্র আল্লাহ্‌ তাঁর কাছে পৌঁছোবার রাস্তাটাই তাঁর তৈরি মানুষের সামনে খোলা রাখেননি। একটা রাস্তাই খোলা আছে শুধু—সেটা হচ্ছে তাঁকে জানা যায় না এই কথাটা জানার পথ।’

অনেকটা রাস্তা গিয়ে, প্রায় মাঠপুকুর গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে, একবার ফিরে তাকালাম জলিলের বাড়ির দিকে। দিগন্তবিসারী ধানক্ষেত পেরিয়ে একটা কুঁড়েঘর। তার সামনে দুটো মানুষের স্পষ্ট সিল্যুয়েট।

* নজর রাখতেন, কারণ তাঁরা জানতেন যারা হিন্দুধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড ত্যাগ করে জাতিবর্ণহীন কর্তাভজা হয়েছে তাদেরই পরে খ্রিস্টান বানানো সহজ হবে। ১৮৯৯ সালে লন্ডন থেকে ছাপা Eugena Stock তাঁর The History of the Church Missionary Society, its Environment, its men and its work বইয়ের প্রথম খণ্ডে দিয়েছেন কর্তাভজাদের গ্রামকে গ্রাম খ্রিস্টধর্মগ্রহণের বৃত্তান্ত। সময় ১৮৩৯ সালের আশেপাশে। উৎসাহী পাঠক পড়ে নিন ‘সাহেবধনী সম্প্রদায় তাদের গান’সুধীর চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলিকাতা, ১৯৮৫ বইয়ের ২৬-২৭ পৃষ্ঠা।

* এ কথার শাস্ত্রীয় অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের দোষগোপনকারী প্রভুকে দেখতে পাবে (কেয়ামতের দিন) যেমন এই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। [ লেখক ]

* উৎসাহী পাঠক পড়ে নিন ‘বাউল মতবাদ ও ইসলাম’ বইয়ের ‘বাউল সাধনার পদ্ধতি ও ইসলামী শরিয়ত’ অধ্যায়। লেখক এ এইচ এম, ইমামদ্দিন। বাংলাদেশ। ১৯৬৯

* জাকাত বলতে বোঝায় আয়ার পবিত্রতা সাধন করা, ধুয়ে মুছে সাফ করবার ক্রিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *