প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

১.২ মা বড় উদ্বিগ্ন

বহুদিন আগে এঁর মৃত্যু হয়েছে।

একদিন বিকেলে আপিস থেকে ফেরার সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পরও বাবা এলেন না দেখে মা বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। আমাদের খেলা-টেলা বন্ধ হয়ে গেল। মুখ কাঁচুমাচু করে মার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগলুম। মা বলতে লাগলেন, দেখ, আবার কি কাণ্ড করে আসেন! আমার বাপু ভালো লাগছে না।

একটা কিছু হাঙ্গামার সম্ভাবনায় মনের মধ্যে আনন্দও যে হচ্ছিল না, তা নয়। কারণ সন্ধেবেলায় কিছু ঘটলে আর পড়তে বসতে হবে না। এমনই সময়ে ঠিক ভর-সন্ধেবেলা কয়েকজন লোক ধরাধরি করে বাবাকে দোতলায় নিয়ে এল। বাবা তখন অর্ধমূর্ছিত, সামান্য জ্ঞান আছে। দোতলার চওড়া বারান্দায় বিছানা করে তখুনি তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হল। বাবা বুকের দিকে হাত দেখিয়ে একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।

আমরা এতখানি কল্পনা করিনি। মার চেঁচামেচি শুনে আমরাও কাঁদতে লাগলুম। দাদা গিয়ে পিসিমাকে ডেকে নিয়ে এল। তাঁর ছেলেরা এসে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। বাবার কয়েকজন বন্ধুর কাছে খবর পাঠানো হল। দেখতে দেখতে আট-দশজন স্ত্রী-পুরুষ বাড়িতে এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণ পরিচর্যার ফলে বাবার জ্ঞান ফিরে এল।

বাবাকে যাঁরা ধরে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দুজন তাঁর আপিসের বন্ধু। তাঁদের মুখে জানতে পারা গেল যে, রাস্তায় এক জুড়িঘোড়া ক্ষেপে দৌড় মেরেছিল, সামনে একটি ছোট ছেলে পড়ে যায়-যায়, এমন সময় উনি ফুটপাথ থেকে লাফিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে বুকে ঘোড়ার বোম লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। কোচুয়ানটা খুব সামলে নিয়েছিল, নইলে আর ওঁর কিছু থাকত না।

ওরই মধ্যে বাবা মিনমিন করে বলতে লাগলেন, ছেলেটাও খুব বেঁচে গেছে, তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কি?–

এই কাহিনি শুনেই মা একেবারে জ্বলে উঠলেন। তিনি একাধারে বাবাকে গালাগাল, নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার, বাবার পরিচর্যা ও সঙ্গে সঙ্গে অভ্যাগতদের আপ্যায়ন–আশ্চর্যভাবে এতগুলি কর্তব্য সামলাতে লাগলেন। একটু নমুনা দিই।

–বাবা শুয়ে আছেন চিত হয়ে, ডাক্তার বুকে পট্টি বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন। মা মাথায় বরফ দিচ্ছেন আর অনর্গল বকে যাচ্ছেন,–আমার যেমন কপাল! এই সেদিন এমন হাঙ্গামা বাধালেন যে, আমাদের প্রাণটুকু শুধু আছে, আর সবই গিয়েছে। এখনও পাঁচ বছর যায়নি–আপনি তো জানেন দিদি! স্টিমার থেকে একজুন জলে পড়ে গেল, উনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন; তারপর প্রোপেলারের ধাক্কা লাগে–ছ-মাস ধরে যমে-মানুষে টানাটানি। হে ভগবান! আমাকে নিয়ে যাও, শুধু ছেলেগুলোকে তুমি দেখো–

হঠাৎ তিনি মাটিতে ঠকাঠক মাথা কুটতে আরম্ভ করে দিলেন।

তিন-চারজন মহিলা ‘হাঁ হাঁ, করেন কি’ বলতে বলতে ছুটে এসে তাঁকে নিরস্ত করলেন।

ইত্যবসরে বাবা আবার মিনমিন করে কি বললেন। মা মুখ নীচু করে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলছ? অ্যাঁ? জল দোব? একটু বরফ দিয়ে দিই, গলাটা তো কাঠ হয়ে উঠেছে।

মা উঠে কুঁজোর দিকে যেতে একজনকে দেখে বললেন, ধীরুর মা, দাঁড়িয়ে কেন ভাই?

আমি সামনে দাঁড়িয়ে ছিলুম। আমাকে বললে, যাও না, একটা মাদুর নিয়ে এসে মাসিমাকে বসতে দাও না পোড়ারমুখো, হাঁ করে দেখছ কি?

তারপর সবার দিকে ফিরে বললেন–

আবাগীর তিনটি পুত
দুটি কন্দকাটা একটি ভূত।

সভাস্থ সকলের মৃদু হাস্য। উচ্চহাস্য আমাদের সমাজের মহিলাদের মধ্যে তখন প্রচলিত ছিল না। তাঁদের সামনে অনেক পুরুষও উচ্চহাস্য করতেন না।

মার মুখের বিরাম নেই। জল গড়াতে গড়াতে বকে চললেন। বাবার জল খাওয়ার পর গেলাসটা রেখে মা একটু চুপ করতেই একজন প্রস্তাব করলেন, অস্থিরের মা, আসুন, আমরা ঈশ্বরের নাম করি। আপনিই প্রার্থনা করুন।

প্রস্তাব হতে-না-হতে সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে বসলেন। একটি মহিলা গান গাইলেন। সঙ্গীতান্তে মা প্রার্থনা করলেন।

মার প্রার্থনার মধ্যে ঈশ্বরের স্তুতিস্তব প্রায় থাকতই না, তিনি অত ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে না গিয়ে সোজা ব্যবহারিক প্রার্থনা করতেন। অর্থাৎ–হে ভগবান! তুমি আমাদের দারিদ্র্য মোচন কর। আমার ছেলেদের স্বাস্থ্যবান কর, তাদের বিদ্যা দাও–তারা যেন সুখে থাকে। আর এসব যদি কিছু না দাও, তবে দোহাই তোমার, আমার স্বামীকে সুমতি দাও।

.

এই সময়, বোধ হয় ১৮৯৭ ক্রিশ্চান শতাব্দীতে টালার দাঙ্গা বেধেছিল। দাঙ্গার কারণ তখন যা শোনা গিয়েছিল তার বিবরণ হচ্ছে–টালায় মহারাজা সার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের এক জমিতে মসজিদ ছিল। সেই মসজিদ তুলে দেওয়া নিয়ে জমিদার আর মুসলমানদের মধ্যে হাঙ্গামা বাধে। মুসলমানদের ধারণা যে, পুলিশ জমিদারকে সাহায্য করেছিল।

আজকাল যেমন টালা টালিগঞ্জ সবই কলকাতার হুদ্দোর মধ্যে এসে গিয়েছে, তখন তা ছিল না। টালা ছিল শহরের বাইরে। তাই নিজ-কলকাতাবাসীরা প্রথমটা জানতেই পারেনি যে, সেখানে একটা হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। আসল মারপিট হয়ে যাবার পর শহরবাসীরা জানতে পারলে যে, টালায় একটা বড় রকমের কিছু হয়ে গিয়েছে।

মসজিদ ভেঙে দেওয়ার সহায়তা করার জন্য মুসলমানেরা সরকারের ওপর চটে গেল। গবর্মেন্ট বলতে তারা বুঝলে পুলিশ। আর পুলিশ মানে রাস্তার কনস্টেবল।

একদিন সকালবেলা দেখলুম, দলে দলে নিম্নশ্রেণীর মুসলমান লাঠি হাতে নিয়ে শহরের উত্তর দিকে ছুটেছে। কনস্টেবলগুলো তাদের দেখলেই ভয়ে লুকিয়ে পড়ছে। গুজব-সম্রাটের রাজত্ব চিরদিনই অপ্রতিহত। তখনও যেমন ছিল, আজও তেমনই। আমরা অদ্ভুত ও অসম্ভব সব গুজব বাড়িতে বসেই শুনতে লাগলুম। দাদা ইস্কুল থেকে নানা রকমের গুজব সংগ্রহ করে আনতে লাগল। নতুন একটা উত্তেজনা আসায় বেশ স্ফূর্তিতেই দিন কাটতে লাগল।

সে সময় দাঙ্গা বাধলে মুসলমানদের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুদের কোনো সংঘর্ষই হত না। দাঙ্গা সম্বন্ধে বাঙালিরাই থাকত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। হিন্দু বলতে মুসলমানেরা ভিন্নপ্রদেশীয় হিন্দুদের বুঝত। অন্তত সেদিন পর্যন্তও অর্থাৎ ১৯২৬/২৭ অব্দে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের যে বড় দাঙ্গা বেধেছিল, তার আগের দাঙ্গা পর্যন্ত কলকাতাতে এই ধারাই প্রচলিত ছিল।

একদিন সকালবেলা আমাদের রাস্তায় চাঞ্চল্য ও চেঁচামেচি যেন বেশি হতে লাগল। বেলা তখন প্রায় নটা হবে–খুব একটা হৈ-হৈ শব্দ শুনে আমরা বারান্দায় গিয়ে দেখি, একদল ফিরিঙ্গি যুবক একটা ভাড়াটে ফিটনে চড়ে ছুটছে–ঘোড়া দেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে, আর ফিটনের পেছনে বোধ হয় জন পঞ্চাশেক লোক হৈ-হৈ করতে করতে ছুটে আসছে। গাড়ি চালাচ্ছিল ও একজন ফিরিঙ্গি। আমাদের বাড়িটা ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়েই তারা গাড়িখানাকে থামিয়ে ফেললে। পেছনে যারা ছুটে আসছিল, তারা একটু দূরে পড়ে গিয়েছিল। গাড়িখানা হঠাৎ থেমে যেতেই তারা কাছে এসে গেল। গাড়ির ফিরিঙ্গিরা প্রায় সকলেই দাঁড়িয়ে ছিল। দেখলুম, তাদের মধ্যে একজন বন্দুক তুলে দুম্ দুম্ দুটো আওয়াজ করলে। তখুনি সবাই চেঁচিয়ে উঠল। বেশ বুঝতে পারা গেল, একজন পড়ে গিয়েছে ও তাকে তোলবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফিরিঙ্গিরা সেই অবসরে জোরে গাড়ি চালিয়ে সোজা চলে গেল।

যে পড়ে গিয়েছিল, সবাই তাকে তুলে, আমাদের বাড়ির সামনেই রাস্তায় জল দেবার একটা দমকল ছিল, সেখানে এনে শুইয়ে দিলে। আমরা ওপর থেকে দেখতে লাগলুম, জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু দেহের কোনখান দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে তা বুঝতে পারলুম না।

যাকে এনে শুইয়ে দেওয়া হল, তার বয়স বোধ হয় ষোল-সতেরো হবে। রোগা–অত্যন্ত রোগা, ডান হাতে একটা শুকনো গাছের ডাল-গোছের কি তখনও ধরা রয়েছে।

সে একবার হাঁ করতেই তার মুখের মধ্যে দমকল থেকে সেই ময়লা জল আঁজলা করে করে দেওয়া হতে লাগল। একটু পরেই সবাই বলতে লাগল, মর গিয়া–মর গিয়া–

লোকেরা তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। তোলবার সময় দেখলুম, সেই ভাঙা ডালখানা তার হাত থেকে খসে রাস্তায় পড়ে গেল।

এই মৃত্যুকে দেখলুম, একেবারে চোখাচোখি–মুখোমুখি। এই মৃত্যু দুবার আমার অতি নিকটে এসেছিল, তখন তাকে চিনতে পারিনি।

এই দৃশ্য আমার সত্তাকে নাড়া দিয়ে এমন বিচলিত করে দিলে যে, আমি সেই জায়গা থেকে এক পা-ও নড়তে পারলুম না। মৃত ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে চলে গেছে, কিন্তু তার হস্তচ্যুত সেই দণ্ড, যা দিয়ে তার গর্বোদ্ধত ধর্মবুদ্ধি অপরকে আঘাত করতে এসেছিল–সেটা যেন একখণ্ড চুম্বক। তারই আকর্ষণে অনড় হয়ে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমার পাশে অস্থিরও দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলুম, তার মুখখানা তুবড়ে-তাবড়ে অদ্ভুত এক রকমের দেখতে হয়েছে। অন্য সময় সে রকম মূর্তি দেখলে হয়তো হেসে ফেলতুম। কিন্তু তখন আর হাসি ফুটল না। আবার রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হল।

মা এসে একবার বলে গেলেন, আজ কি আর নাইতে খেতে ইস্কুলে যেতে হবে না? অস্থিরও সে বছর ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল। দুই ভাই নীরবে স্নান করে খেয়ে ইস্কুলে যাত্রা করলুম। বাড়ির পাশেই ইস্কুল, তবুও একবার কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সেই মৃত ব্যক্তির হস্তচ্যুত লাঠিটার কাছে গেলুম। দেখলুম, অজস্র গাড়ির চাপে চাপে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে সেটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। দুজনে পাশাপাশি ইস্কুলে ঢুকে যে-যার ক্লাসে চলে গেলুম। একটা বাক্য-বিনিময়ও হল না।

ইস্কুলে পড়াশুনো কতদূর কি হল জানি না; কিন্তু সমস্ত দিনটা ধরে সেই মৃত লোকটির মুখ চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সমস্তক্ষণ মৃত্যুর চিন্তাই আমার মনকে আঁকড়ে ধরে রইল। মনে হতে লাগল, মরে গেলে আর সে ফিরে আসে না। আরও মনে হল, মরণ যে কখন কি ভাবে আসে, তা আগে কেউ বুঝতে পারে না। এই যে লোকটা, সে কি জানতে পেরেছিল যে, এক্ষুনি মরে যাবে! তার মুখখানা চোখের সামনে মাঝে মাঝে ভেসে উঠতে লাগল, আর ভাবতে লাগলুম, আজ কাল পরশু এমনই করে যতদিন যাবে, তার বাবা মা ও আপনার জন যারা তারা তাকে ভুলে যাবে।–এইসব নানা চিন্তা মনের মধ্যে তাল পাকাতে আরম্ভ করলে। ইস্কুল, শিক্ষয়িত্রী, পড়া, খেলা কিছু ভালো লাগছিল না, লোকের সঙ্গ অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল, মনে হতে লাগল, কতক্ষণে নিজেকে একটু একলা পাব–প্রাণ ভরে মৃত্যুর কথা ভাবতে পারব।

ছুটির পর বাড়িতে এসে খেয়ে-দেয়ে ছাতে গিয়ে বসলুম। অস্থিরও এসে আমার পাশে বসল। সন্ধেবেলা পড়ার আসরে বাবার শাসনগুলো বৃথাই গেল। রাত্রে তাড়াতাড়ি বিছানায় পড়ে মনের বল্গা ছেড়ে দিলুম।

বালকের চিন্তাসাগর মথিত হয়ে সেদিন কি সত্য উঠেছিল, তার সব আজ মনে নেই, তবে তিনটি কথা আজও ভুলিনি।

প্রথম সত্য হচ্ছে, একদিন আমাকেও মরতে হবে।

দ্বিতীয় সত্য, ছাত থেকে পড়ে আর জলে ডুবে আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি।

তৃতীয় সত্য হচ্ছে, মন্দির ও বাড়িতে উপাসনার সময় চোখ বুজে যাকে এত স্তুতি করা হয়, তার সঙ্গে মৃত্যুর কোথাও একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। পৃথিবীতে মৃত্যু যদি না থাকত, তা হলে সেই দুর্বোধ্য অদৃশ্য শক্তিকে লোকে এত স্তবস্তুতি করত না।

রাত্রি প্রায় দুটো-তিনটের সময় রোজই আমাদের বাইরে যাবার দরকার হত। যার আগে ঘুম ভাঙত, সে অন্যজনকে জাগিয়ে তুলে নিয়ে যেত। সে রাত্রে আমারই আগে ঘুম ভেঙেছিল। অস্থিরকে তুলে বাইরে নিয়ে গেলুম। নর্দমার সামনে বসেই অস্থির ফিসফিস করে আমাকে ডাকলে, স্থরে।

ফিসফিস করে উত্তর দিলুম, কি রে?

আবার সে ফিসফিস করে প্রশ্ন করলে, তুই মরে গিয়ে কি করে ফিরে এলি রে?

আমিও সেই রকম করে জবাব দিলুম, আমি তো মরিনি, জলে ডুবে বেঁচে গিয়েছি।

.

এই সময় কলকাতায় বড় ভূমিকম্প হয়। কলকাতায় অনেক লোক, অনেক বাড়ি, এইজন্যে হৈ-হৈ এখানে খুব বেশি হয়েছিল বটে–কিন্তু ধরিত্রীদোলার বিষম ধাক্কাটা লেগেছিল আসামের বুকে। ভূমিকম্পের ফলে সেখানে নাকি অনেক প্রাকৃতিক পরিবর্তনও হয়ে গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, যে ব্রহ্মপুত্রের স্রোত এক জায়গায় ঘুরে অন্য দিকে ‘প্রবাহিত হয়েছিল।

কলকাতায় ভূমিকম্প হয় এই বিকেল নাগাদ। আমরা ক’ভাই সে সময় একটা টেবিলের চারিদিকে বসে ছিলুম, বোধ হয় বাবা আমাদের অঙ্ক কষাচ্ছিলেন। হঠাৎ দুদ্দাড় করে বাড়িঘর কেঁপে উঠতেই মা চিৎকার করে উঠলেন, ভূমিকম্প হচ্ছে।

তাড়াতাড়ি ছুটে সব রাস্তায় বেরিয়ে পড়া গেল। পৃথিবী যেন টলতে আরম্ভ করে দিলে, তারই মাঝে মাঝে এক-একটা জোর ধাক্কা আসতে লাগল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! রাস্তার লোকগুলো উন্মত্তের মতন ব্যবহার করতে লাগল। কেউ প্রাণপণে দৌড়চ্ছে, কেউ বা একবার একদিকে খানিকটা দৌড়ে, আবার হঠাৎ ফিরে বিপরীত দিকে দৌড় দিচ্ছে। অদ্ভুত তাদের ভয়ার্ত মুখ দেখে আমরা তিন ভাই হাসতে আরম্ভ করে দিলুম।

আমাদের বাড়ির ঠিক নীচেই একটা টিন-মিস্তিরির দোকান ছিল। সে টিনের পাত কেটে বাক্স বানাত। মধ্যে মধ্যে লোকটা মাতাল হয়ে সারা রাস্তা তোলপাড় করতে থাকত। অতি শৈশবে আমরা কখনও উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে সে তার প্রকাণ্ড টিন-কাটা কাঁচি বের করে আমাদের অঙ্গচ্ছেদের ভয় দেখাত। এইজন্যে সে বয়স পেরিয়ে গেলেও লোকটার প্রতি আমাদের মনোভাব বিশেষ অনুকূল ছিল না। পাড়ার সবাই যখন ভয়ে আঁতকে ‘নারায়ণ’ ‘নারায়ণ’ চিৎকার করে আকাশ ফাটাতে লাগল, এই লোকটা তখন চিৎকার করে বলতে লাগল, এলি মা, এতদিনে এলি? ডুবিয়ে দে, ডুবিয়ে দে, সব শালা ভণ্ড, লণ্ডভণ্ড করে দে মা, লণ্ডভণ্ড করে দে।

পাড়ার এক হিন্দুস্থানী ময়রার দোকানের লোকেরা ‘রাম’ ‘রাম’ বলে পরিত্রাহি চিৎকার করছিল। তাদের অবস্থা দেখে টিন-মিস্তিরি বললে, চোপ শালা, যখন ঘিয়ের বদলে চর্বি দাও, তখন মনে থাকে না?

শাঁখ, ঘণ্টা, মানুষের চিৎকার ও টিন-মিস্তিরির উল্লাসধ্বনি মিলিয়ে এক বিষম হট্টগোল আরম্ভ হয়ে গেল। হঠাৎ ইস্কুলের বড় বাড়িটার এক কোণ–তেতলার ছাদ থেকে একতলা অবধি–ভয়ানক শব্দ করে ভেঙে পড়ল। এইবার দস্তুরমতন ভড়কে গেলুম, একটা সাংঘাতিক কিছু যে হচ্ছে, আর সেটাকে নিবারণ করা যে মানুষের সাধ্যাতীত–এই কথা বুঝতে পেরে ভয় করতে লাগল।

ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর আমরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখি যে, আমাদের বাড়িখানা ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে গেছে। বাবা তখুনি আমাদের নিয়ে বেরুলেন শহরের অবস্থা দেখতে। যে রাস্তাতেই যাই, দেখি, একটা-না-একটা বাড়ি কাত হয়েছে। সেবারকার ভূমিকম্পে কলকাতা, শহরতলি ও আশেপাশের জায়গার মতো লোকের যে সর্বনাশ হয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই।

.

টালার দাঙ্গা ও ভূমিকম্প হবার কিছু আগে থেকেই আমরা শুনতে পাচ্ছিলুম, বোম্বাই অঞ্চলে প্লেগ নামে এক সাংঘাতিক ব্যামোর আবির্ভাব হয়েছে। সেখান থেকে রোগটা বনবন করে কলকাতার দিকে দৌড়ে আসছে। কলকাতায় মহা আতঙ্কের সঞ্চার হল।

ইতিমধ্যে একদিন শোনা গেল যে, হাওড়ার একটি স্ত্রীলোক বোম্বাই মেলে এসে হাওড়া স্টেশনে একখানা ঠিকে-গাড়ি ভাড়া করে কলকাতার দিকে আসছিল। হ্যারিসন রোডে এসে গাড়োয়ান তাকে জিজ্ঞাসা করলে, কোথায় যাবেন?

স্ত্রীলোকটা উত্তর দিলে, আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি প্লেগদেবী।–এই বলেই সে গায়েব হয়ে গেল।

ব্যস্! আর যাবে কোথায়! শহরময় রব উঠল–পেলে গো–পালা গো। গুজববিলাসী বাঙালি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। বাপ রে বাপ! সে কি ত্রাসের ঘটা।

আজ এই যুদ্ধের ডামাডোলের বাজারে কানের পাশে বোমা ফাটছে, দিবারাত্রি মাথার ওপরে পিংপিং করে বিমান উড়ছে দেখেও বাঙালিরা তা গ্রাহ্যই করছে না, সেদিন কিন্তু প্লেগের নাম শুনে শহরসুদ্ধ লোক উঠি-কি-পড়ি ভাবে পালাতে আরম্ভ করে দিয়েছিল।

ইতিমধ্যে একদিন শোনা গেল, শহরে প্লেগ হতে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। কর্পোরেশন থেকে ঢেঁড়া পিটতে আরম্ভ করে দিলে, বোম্বাইসে আদমি আনেসে থানামে খবর দেনে হোগা।

আর যায় কোথা! দু-দিনে কলকাতা শহর খালি হয়ে গেল। নেহাৎ আমাদের মতন, অর্থাৎ যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই, তারাই পড়ে রইল। ইস্টিশানে পৌঁছবার জন্যে ঠিকেগাড়ির গাড়োয়ানেরা অসম্ভব দর হাঁকতে লাগল। তখনকার দিনে অশ্বের শক্তিক্ষয় নিয়ন্ত্রণের আইনকানুন ছিল না, তাই যার মাত্র একখানা ভাড়াটে গাড়িও ছিল, সে বেশ দু-পয়সা কামাতে লাগল।

কর্পোরেশন শহরবাসীদের প্লেগের টিকে নেবার জন্যে অনুরোধ করতে লাগল। কিন্তু টিকে সম্বন্ধে সাধারণের মধ্যে এমন সব সাংঘাতিক গুজব রটতে লাগল যে, এ যুগের লোক তা শুনলে হেসেই ফেলবে।

কেউ বললে, টিকে নেবার দশ ঘণ্টার মধ্যেই মানুষ কাবার হয়ে যায়।

কেউ বললে, পেট থেকে এক-পয়সা মাপের মাংসের বড়া তুলে তার ভেতর প্লেগের বীজ পুরে দেওয়া হয়।

এদিকে আবার স্বাস্থ্যরক্ষকেরা জানিয়ে দিলেন, যে টিকে নেয়নি, এমন কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।’

অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। প্লেগের হাসপাতাল তৈরি হল আবার মেছোবাজারের মার্কাস স্কোয়ারে। সোনায় সোহাগা হল–শহরের নিম্নশ্রেণীর লোকদের মধ্যে চাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেল, আর একটা দাঙ্গা বাধে আর কি!

ইতিমধ্যে একদিন বিকেলবেলা আমি, অস্থির ও দাদা ফুক করে একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দূর থেকে মেছোবাজারের হাসপাতাল দেখে এলুম।

তখন শহরের স্বাস্থ্যরক্ষকদের মাথা ছিলেন একজন ইংরেজ আধা-ডাক্তার। তাঁর নাম ছিল কুক। শোনা যেতে লাগল যে, কুক সাহেবকে রাস্তায় পেলে লোকে মারবে।

শহরের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে উত্তেজনা আর অন্য শ্রেণীর মধ্যে ত্রাস–এইরকম তালবেতালের নাগরদোলা ঘুরছে, এমন সময় কর্পোরেশনের কর্তারা একটি প্যাঁচ লাগালেন। তাঁরা দেখলেন যে, ভদ্রলোকেরা যদি টিকে না নেয়, তা হলে প্লেগের টিকের চলন হওয়া মুশকিল হবে। তাঁরা ভদ্রশ্রেণীর মধ্যে সাহস করে টিকে নিতে পারে, এমন লোকের সন্ধান করতে লাগলেন। ব্রাহ্মরা ছিল তখন সব কাজে অগ্রণী–ভারত মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কয়েকজন ব্রাহ্ম সপরিবারে টিকে নিতে রাজি হলেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে আমার পিতার পরিবারটিও এই দলে ভেড়ায়, একদিন বিকেলবেলায় কুক সাহেব আমাদের হাত ফুঁড়ে প্লেগের বীজ দেহের মধ্যে পুরে দিলেন। বাবা আমাদের দু-বছরের একটি ভগ্নীকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ডাক্তারদের মতে নেহাৎ বাচ্চা সাব্যস্ত হওয়ায় সে বেচারি রেহাই পেয়ে গেল।

টিকে নেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এল জ্বর। তারপরে চব্বিশ ঘণ্টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, তা জানতেও পারিনি।

মাস-দুয়েক বাদে কর্পোরেশন থেকে আমাদের নামে একখানা কার্ড এল। সেগুলো হল সার্টিফিকেট, অর্থাৎ প্লেগ হলে সেগুলো দেখালে আর ‘কোয়ারেন্টাইন’-এ ধরে নিয়ে যাবে না।

কিন্তু আমাদের এই অসমসাহসিকতার দৃষ্টান্ত শহরের ভদ্রশ্রেণীর মনে কোনো রেখাপাতই করলে না। প্লেগের টিকে এ দেশে তেমন চলল না। অবিশ্যি এজন্যে তাদের বিশেষ দোষ দিতে পারি না, কারণ বাংলার জমিতে প্লেগই তেমন চলল না তো তার টিকে চলবে কেমন করে!

.

সেদিন ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুদিন। প্রবাদ আছে, এক যুগে দুজন মহাপুরুষ থাকেন না। বোধ হয় সেইজন্যেই আমি ধরাধামকে ধন্য করার সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যাসাগর মশায় ইহলোক থেকে চলে গিয়েছিলেন।

জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে যে মহামানবের কীর্তিকথা আমাদের কল্পনাপ্রবণ শিশুচিত্তকে আকৃষ্ট করেছিল, তাঁর নাম হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাড়িতে মা-বাবার মুখে দিনরাতই বিদ্যাসাগর মশায়ের নাম শুনতুম। ইস্কুলে মাস্টারদের কাছে শুনতুম –বিদ্যাসাগর মশায়এই করতেন। বাড়িতে বাবা ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের কথার মাত্রা ছিল–বিদ্যাসাগর মশায় বলতেন, ইত্যাদি।

এই বিদ্যাসাগর মশায়কে বোধ হয় কলকাতার লোক চেনে না। ইনি মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাল্যে কলকাতায় এসে অশেষ কষ্টে বিদ্যাশিক্ষা করেছিলেন। রাজনীতির আলোচনা ও আন্দোলন না করেও তাঁর জীবন ছিল স্বাধীনতার প্রতীক। মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মাত্র, কিন্তু কলকাতা ছিল তাঁর কর্মভূমি এবং এইখানে তাঁর সারাজীবন অতিবাহিত হয়েছে। এরই ধূলায় তাঁর দেহাবশেষ মিশিয়ে আছে। বাংলা দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজ তাঁর কাছে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ। তাঁর জীবিতাবস্থায় বাংলা দেশের, বিশেষ করে কলকাতা শহরের, কত লোক কত পরিবার যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তাঁর কাছে উপকৃত, তার সংখ্যা নির্ণয় করা যায় না। মেদিনীপুরের লোকেরা তাঁর স্মৃতিগৃহ তৈরি করেছেন, কিন্তু কলকাতায় তাঁর বাসগৃহ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে। তাঁর বাড়ির সামনেই যে সরকারি বাগান, তার নাম হয়েছে ‘হৃষীকেশ পার্ক’।

ঈশ্বরের চাইতে হৃষীকেশের প্রতিই এখানকার লোকের আকর্ষণ যে বেশি, এই তার জ্বলন্ত নিদর্শন। তবুও বাংলার সাহিত্যিক, মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর-স্মৃতি-সংরক্ষণ-সমিতি ও বঙ্গীয়- সাহিত্য-পরিষৎকে ধন্যবাদ, তাঁরা যথাসাধ্য বিদ্যাসাগর মশায়ের স্মৃতিরক্ষার চেষ্টা করেছেন।

যা হোক, সেদিন ছিল এই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিন। কলকাতার ছোট-বড় সমস্ত বাঙালি-ইস্কুলের ছুটি সেদিন। যেদিন আমাদের ইস্কুলে ছুটি থাকত, সেদিন বাড়িতে আহারের কিছু ইতর-বিশেষ হত। বাবা সেদিন স্পেশাল বাজার করতে বেরুতেন। বাড়ির কাছে সিমলের বাজারে না গিয়ে এইসব দিনে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন মাধববাবুর বাজারে। উদ্দেশ্য থাকত, বাজার কিরকম করে করতে হয় তাই শিক্ষা দেওয়া। গোলদিঘির সামনে আজ সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ-ভবন হয়েছে, সেই জমিতে ছিল মাধববাবুর বাজার।

সেদিন বাবার কি খেয়াল হল, আমাদের কারুকে না নিয়ে একাই চলে গেলেন মাধববাবুর বাজারে। আমরা বাড়িতে বসেই জিভে শান দিতে লাগলুম।

বেলা বাড়তে লাগল,–নটা দশটা। বাড়ির সামনেই বিদ্যাসাগর মশায়ের ইস্কুল-কলেজে লোক-জমা ও চেঁচামেচি বাড়তে লাগল–সেখানে হবে কাঙালি-ভোজন। ওদিকে এগারোটা বেজে গেল, বাবার দেখা নেই। খিদেয় নাড়ি সত্যিকারের বাপান্ত আরম্ভ করে দিলে। অবশেষে মা আমাদের যা-তা দিয়ে খাইয়ে দিলেন।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দু-এক বাড়িতে খবর গেল। দু-চারজন বাড়িতে এসে জমতেও লাগলেন। বেলা দুটো নাগাদ দেখে তিন-চারজন লোক ছুটল তিন-চার থানায়। কেউ কেউ হাসপাতালেও ছুটল।

এদিকে বেলা তখন প্রায় চারটে হবে। বাড়িতে ছোটখাটো বেশ একটু জনতা হয়েছে। মা বক্তৃতা দিচ্ছেন। বিষয় অবশ্য বাবা। সবাই শুনছেন, এমন সময় বাবার আবির্ভাব।

বাবার সে-সময়কার চেহারা একেবারে ভয়াবহ। মাথার চুলগুলো ঊর্ধ্বমুখী, রোদে পুড়ে রঙ তামাটে। ডান হাতে শিলংমাছের একটা বড় টুকরো। মাটি মাখলে যেমন হাত নোংরা হয়, সেইরকম দুই হাতের প্রায় কনুই অবধি শুকনো কাদা। জামার জায়গায় জায়গায় মাছের রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। সর্বাঙ্গ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে।

তাঁর সেই চেহারা দেখে তো সবাই আঁতকে উঠল। এমনকি, মা পর্যন্ত হাঁ হয়ে গেলেন। প্রকাশ পেল যে তিনি বাজার করে ফিরছিলেন, এক হাতে বাজারের ঝুলি আর অন্য হাতে সের দেড়েক শিলংমাছের টুকরো, এমন সময়ে হেয়ার সাহেবের ইস্কুলের সামনে একটা চিল কোথা থেকে ছোঁ মেরে তাঁর হাত থেকে মাছ নিয়ে উধাও হল। চিলের আচমকা এই অভদ্র ব্যবহারে প্রথমটা তিনি একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তখুনি কর্তব্য স্থির করে নিয়ে চিলের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। দেড় সের ওজন নিয়ে চিল বেশি দূর উড়তে পারে না। একটু উড়েই কোনো ছাতে গিয়ে বসে, আর তিনি ইট ছুঁড়ে তাকে উড়িয়ে দেন। কলকাতা শহর, রাস্তায় বেকার লোকের অভাব নেই। অনেকে মজা পেয়ে লেগে গেল তাঁর সঙ্গে চিলকে ইট মারার কাজে। শ্রাবণ মাসে লোকে বড় জোর শিলাবৃষ্টি আশঙ্কা করে থাকে। বিনা কারণে ছাতে লোষ্ট্রবৃষ্টি হতে থাকায় অনেক বাড়িওয়ালা আপত্তি করায় দু-একটা খণ্ডযুদ্ধ বাধতে বাধতে থেমে গিয়েছে। কারণ চিলকে দৃষ্টির বাইরে না যেতে দিতে তিনি বদ্ধপরিকর। এই রকম তাড়া খেতে খেতে চিলের-পো শেষকালে তিলজলার মাঠে মাছ ফেলে দিয়ে পালিয়ে বাঁচে। :

একটা জোর নিশ্বাস ফেলে জামা ছাড়তে ছাড়তে বাবা বললেন, ব্যাটা আমার হাত থেকে মাছ ছোঁ মেরে নিতে এসেছিল! বাঙালকে চেনে না।

চিলের ঔদ্ধত্য দেখে তার প্রতি সম্মানে আমাদের বুক ভরে উঠতে লাগল।

এতক্ষণে মা কথা বললেন, বাজারের থলিটা কোন মাঠে ফেলে আসা হল, শুনি?

এই-ই-ই-ই!–বলে বাবা আবার তাড়াতাড়ি জামা পরতে আরম্ভ করলেন। আগন্তুক যাঁরা বাড়িতে তখনও ছিলেন, তাঁরা বাবাকে বলে-কয়ে তখনকার মতন নিরস্ত করলেন।

জানতে পারা গেল, তালতলায় একজনদের রকে পরিপূর্ণ বাজারের থলিটি পড়ে আছে।

এতক্ষণ বাদে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

মা বললেন, না, তোমার জন্যে সব বসে আছে।

তাহলে মাছটার যা হোক একটা ব্যবস্থা কর।

ও-মাছের আবার কি ব্যবস্থা হবে শুনি? ওই চিলে-খাওয়া মাছ! দেখুন তো দিদি!

পিসিমা কাছেই বসে ছিলেন।

বাবা একবার করুণ চোখে চারদিকে চেয়ে মাছ নিয়ে একতলায় নেমে গেলেন। তারপরে উনুনে আগুন দিয়ে মাছ ধুতে বসলেন। উনুনে আগুন ধরার পর ভাত চড়িয়ে মাছ কুটতে লাগলেন। প্যাজ কুটলেন একরাশ। মশলাও কিছু কিছু বাটা হল। ভাত নামিয়ে দু-তিন রকমের তরকারি হল। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্ষুধার আধিক্যও কিঞ্চিৎ হয়েছিল। স্নান সেরে একহাঁড়ি ভাত ও সেই দেড়সেরটাক চিলে-মারা মাছ উদরস্থ করে ওপরে এসে আপিসে ছুটির দরখাস্ত করে একখানা পোস্টকার্ড লিখলেন।

বাবা বারান্দায় একটা পাটি পেতে তাতে আধ-শোওয়া হয়ে রয়েছেন। মা একটা ঘরের চৌকাঠে বসে আছেন–সারাদিন তাঁর পেটে অন্ন নেই। স্বামী যে একটা হাঙ্গামা বাধিয়ে বাড়ি ফেরেননি, এজন্যে মনে মনে তুষ্ট, কিন্তু মুখখানা ঘিরে মহা অসন্তোষ বিরাজ করছে। পিসিমা মার কাছ থেকে একটু দূরে বাবার প্রায় কাছেই বসে আছেন। আমরা ফুডুক-ফাঁড়াক করে সন্তর্পণে এ-ঘর ও-ঘর করছি। একবার সামনে পড়তেই তিনি বললেন, স্থবির একটা ঝিনুক নিয়ে এসে আমার পিঠের ঘামাচি মার।

ঝিনুক নিয়ে রাবার পিঠের ঘামাচি মারতে লাগলুম। খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। শেষকালে বাবাই কথা আরম্ভ করলেন। পিসিমার উদ্দেশে বললেন, দিদি, কিছু বলছেন না যে?

মা (পিসিমা) যেন এই কথাটা শোনবার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধীরপ্রকৃতির লোক। বাবার কথা শুনে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, কি বলব ভাই? তোমার আক্কেল দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। চিলে ছোঁ মেরে হাত থেকে মাছ ছিনিয়ে নিয়ে গেল আর তুমি সারাদিন সেই চিলের পেছনে পেছনে ছুটে বেড়ালে? এ যে গল্প-কথা হয়ে গেল। আমি আর কি বলব বল?

বাবা চুপ করে চোখ বুজে ঘামাচি মারার আরাম উপভোগ করতে লাগলেন। পিসিমার কথার কোনো জবাবই দিলেন না।

ব্যাপারটার মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিকত্ব বা আতিশয্য আছে বলে তিনি ধারণাই করতে পারছিলেন না। সত্যি কথা বলতে কি, এই ব্যাপারটার সঙ্গে বাবার চরিত্রের এমন সামঞ্জস্য ছিল যে, আমাদের মনেও এটা খুব বেখাপ্পা ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল না।

কিছুক্ষণ আবার সব চুপচাপ। পিসিমা আরম্ভ করলেন, লোকের উপকারের জন্যে জীবন বিপন্ন কর–যদিও সেটা তোমার করা উচিত নয়, কারণ তোমার মাথার ওপরে এই সংসারের দায়িত্ব রয়েছে–তার একটা মানে বুঝি। কিন্তু এ কি উঞ্ছবৃত্তি!

বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এতেও লোকের উপকার হবে, আপনি দেখে নেবেন দিদি।

পিসিমা বললেন, এতে লোকের কি উপকার হবে তা আমি বুঝতে পারি না, অবিশ্যি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি–

বাবা তেড়ে-ফুঁড়ে উঠে বসে বললেন, এই চিল কোনো জন্মে মানুষের হাত থেকে আর কিছু ছোঁ মারবে না, এতে লোকের কম উপকার হবে না দিদি?

মা এতক্ষণ চৌকাঠে বসে বসে গজরাচ্ছিলেন। এবার তিনি এগিয়ে এসে পিসিমার কাছে বসে বলতে আরম্ভ করলেন, জানেন দিদি, ইল্লৎ যায় না মলে, স্বভাব যায় না ধুলে! এ ওর স্বভাব। জানেন দিদি, একবার পদ্মা দিয়ে নৌকো করে যাচ্ছি, ছেলেপুলে তখনও কেউ হয়নি। নৌকো গুণ টেনে চলেছে, নৌকোর ওপর শুধু মাঝি বসে আছে হাল ধরে। আমি ছইয়ের মধ্যে বসে তরকারি কুটছি আর উনি তোলা-উনুনে বাইরে ইলিশমাছ ভাজছেন একবার পেছনে ফিরে দেখি, লোক নেই; দু-একবার ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলুম, চিনি কিনা!

মাঝিকে জিজ্ঞাসা করি, ও মাঝি, বাবু কোথায়?

মাঝি তো একেবারে থ! এই জলজ্যান্ত লোকটা কোথায় উধাও হয়ে গেল! এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে নজর পড়ল, সেই দূরে জলের মধ্যে উনি একবার করে উঠছেন আর ডুবছেন।

থামা থামা, নৌকো থামা। কিন্তু দাঁড়িরা তখন গুণ টেনে চলেছে, তারা কি শুনতে পায়! অনেক কষ্টে মাঝি তাদের থামালে, উনি সাঁতরে এসে নৌকোয় উঠলেন।

ব্যাপার কি?

শুনলুম, খুন্তিটা কি করে জলে পড়ে যাওয়ায় উনি লাফিয়ে পড়েছিলেন।

আচ্ছা বলুন তো দিদি, সেই খুন্তিটা উদ্ধার করে উনি কোন লোকের উপকারটা করলেন? ও স্বভাব, যার যা স্বভাব!

বাবা চোখ বুজেই বললেন, সেটা ছিল আসামের খুন্তি, দাম তিন পয়সা।

মা রেগে সেখান থেকে উঠে গরগর করতে করতে নীচে নেমে গেলেন।

সেদিনকার হাঙ্গামাটা যদি আর একটু সন্ধে ঘেঁষে হত, তা হলে জমত ভালো; কিন্তু আমাদের বরাতে তা হল না। সন্ধে অবধি একটি ঘুম দিয়ে নবীন উৎসাহে বাবা আমাদের পড়াতে বসলেন। সেদিনকার চাঁটি-গাঁট্টাগুলোর মধ্যে মাধুর্যরসের পরিমাণ কিছু বেশি বলে বোধ হতে লাগল।

.

আমার বাবা গাইয়ে ছিলেন। শুধু গাইয়ে ছিলেন বললে তাঁর সম্যক পরিচয় দেওয়া হয় না। অদ্ভুত ছিল তাঁর সঙ্গীত-প্রতিভা। আমি জীবনে অনেক সঙ্গীতজ্ঞ গায়ক-গায়িকা দেখেছি। তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একসঙ্গে বসবাসও করেছি; কিন্তু এক বিষয়ে বাবার মতন গুণী আমার চোখে পড়েনি। অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল তাঁর কণ্ঠের। সন্ধের সময় পড়ার আসরে তাঁর হাঁকডাকের চোটে প্রায় প্রতিদিনই রেড়ির তেলের প্রদীপ অকালে নির্বাপিত হত, এমনকি হ্যারিকেনের আলোও দপদপ করতে থাকত। সাধারণ-ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক প্রকাশিত যে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ তখন পাওয়া যেত, তখনকার দিনেও তাতে নানা রাগ-রাগিণীর প্রায় পাঁচশো গান থাকত। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় তিনি বইখানি নিয়ে ব্রহ্মোপাসনায় বসতেন। উপাসনার আগে একটি এবং পরে একটি গান হয়ে পালা শেষ হত। ব্রহ্মসঙ্গীতের গোড়ার পাতা থেকে ধরে প্রতিদিন তিনি নতুন গান গাইতেন। গান নতুন হলেও সুর সম্বন্ধে তাঁর অমানুষিক একনিষ্ঠতা ছিল এবং যে-কোনো গানকে যে-কোনো সুর ছন্দ ও লয়ের মধ্যে ফেলে ভক্তিভাবে অক্লেশে তাঁকে গেয়ে যেতে দেখেছি। বাবার এই সঙ্গীতপ্রতিভা বংশানুক্রমে তাঁতে বর্তেছিল কি না জানি না, তবে তাঁর বংশধরদের মধ্যে যাতে তাঁর এই শক্তি অপ্রতিহতরূপে সঞ্চারিত হতে পারে, সে সম্বন্ধে তিনি মোটেই অমনোযোগী ছিলেন না। কাজেই আমাদের তিন ভাইকেও বাবার সঙ্গে সেই গানে যোগ দিতে হত। আজ সেই অপূর্ব কণ্ঠকন্‌সার্টের কথা মনে হলে ভগবানের দয়া ও প্রতিবাসীদের সহ্যশক্তির তারিফ না করে পারি না।

আমাদের ছেলেবেলায় বাড়িতে পরিবারের মধ্যে নিশিদিন উপদেশ শুনতে হত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর মশায়–এঁদের সমস্ত গুণাবলী যাতে প্রত্যেকেই আমরা আয়ত্ত করতে পারি, সে-বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বিধিমতো কড়া নজর রাখতেন। পাঠ্যপুস্তকগুলি ছিল উপদেশ পরিপূর্ণ। গারফিল্ড, গ্যারিবল্ডি, থিয়োডোর পার্কার, মার্টিন লুথার, জর্জ ওয়াশিংটন বা নেলসনের মুখ দিয়ে কখন কি বেদবাক্য বেরিয়েছিল, প্রশ্ন করা মাত্র তা উদ্গার করতে না পারলে পরীক্ষা পাসের সম্ভাবনা ছিল অতি অল্প। এ ছাড়া মাতৃভাষায় যেসব লিরিকস পড়ানো হত, তারও একটু নমুনা দিই–

এই ভূমণ্ডল দেখ কি সুখের স্থান
সকল প্রকারে সুখ করিতেছে দান।
জীবন ধারণ কিংবা আরাম কারণ
যে যে বস্তু আমাদের হয় প্রয়োজন–ইত্যাদি

এ ছাড়া প্রতি শনিবারে ইস্কুলে এক ঘণ্টা করে ‘মর‍্যাল ট্রেনিং’ দেওয়া হত।

এইসব ডাহা মিথ্যে কথা ও তার চাইতে সাংঘাতিক অর্ধসত্যের ওপর পালিশ চড়াবার জন্যে প্রতি রবিবারে আর একটি প্রতিষ্ঠানে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হত। এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল রবিবাসরীয় নীতি-বিদ্যালয়। ব্রাহ্মদের সামাজিক ব্যাপারগুলো, উপাসনা থেকে বিয়ে পর্যন্ত, ছিল ক্রিশ্চানঘেঁষা। বোধ হয় ক্রিশ্চানদের ‘সানডে-ইস্কুলের অনুকরণেই এই রবিবাসরীয় নীতি-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আমাদের সানডে-ইস্কুলটি ছিল একটি ‘চালের জায়গা। ইস্কুলে যাবার কাপড়চোপড় সম্বন্ধে বাড়িতে তেমন কড়াকড়ি নিয়ম আমাদের কিছু ছিল না বটে কিন্তু সানডে-ইস্কুলে যাবার কাপড়চোপড়ের ব্যবস্থা করতেন মা নিজে। সজ্জার সমারোহ না থাক, আভিজাত্যটা যাতে পারিপাট্যের দিক দিয়ে কিছু ফুটে ওঠে, তার ত্রুটি হত না। আমার কোঁকড়া চুল শুকনো থাকলে টেরি হত না বলে রবিবার ভোরে উঠেই আমাকে স্নান করতে হত চুল নরম করার জন্যে।

সমাজের অনেক ধনী লোকের ছেলেমেয়ে আসত এখানে নীতি শিক্ষা করতে। তারা এখানে শিখত নীতি, আর তাদের কাছ থেকে আমরা শিখতুম দুর্নীতি। অদ্ভুত ছিল তাদের হালচাল। ছেলেরা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের ছাত্র আর মেয়েরা লোরেটো বা অন্য কোনো ফিরিঙ্গি ইস্কুলে পড়ত। তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলা কথা কিরকম এড়িয়ে এড়িয়ে বলত, বাংলা রঙ্গমঞ্চে সাজা-ইংরেজ যেমন বাংলা বলে। ইংরেজি যে তারা কিরকম বলত, তা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদের ছিল না। তবে একটা কথা আজও বেশ মনে আছে যে, এদের অধিকাংশই ‘ড়’-এর পরিষ্কার উচ্চারণ করতে পারত না। আমাদের তারা অতি তুচ্ছ জ্ঞান করত। আমরাও তাদের তুচ্ছ জ্ঞান করতুম; কিন্তু সে মুখে মুখে; মনে মনে তাদের সম্ভ্রমই করতুম। নিজেদের মধ্যে যখন তারা–Shan’t, Can’t, Aren’t, Oh My! — বলে কথা বলত, তখন আমরা অবাক হয়ে যেতুম।

এই শ্রেণীর লোকের অস্তিত্ব বাংলাদেশ থেকে প্রায় লোপ পেয়েছে।

একদিন, আমি ও অস্থির তখনও সানডে-ইস্কুলে ভর্তি হইনি, শুধু দাদাই নীতির নিদিধ্যাসন করছে–দাদা সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে এল। তখন বোধ হয় বেলা নটা হবে। সানডে-ইস্কুল শেষ হত দশটায়। দাদা তাড়াতাড়ি চলে আসায় বাবার কিরকম সন্দেহ হল। তিনি তাকে ডেকে তাড়াতাড়ি আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। দাদা প্রথমটা লুকোবার চেষ্টা করলে, কিন্তু জেরায় প্রকাশ হয়ে পড়ল, গানের ক্লাসে যোগ না দিয়েই সে পালিয়ে এসেছে।

সঙ্গীতের বরপুত্রের ঘরে এতখানি কালাপাহাড়ি বাবা সহ্য করলেন না। তিনি দাদাকে সেদিন এমন দক্ষিণা দিলেন যে, নিতান্ত অকৃতজ্ঞ না হলে কোনো মানুষই জীবনে তা ভুলতে পারে না।

আমি ও অস্থির দুজনে পরামর্শ করে স্থির করে ফেললুম, গানের ক্লাসে কখনও ফাঁকি দেওয়া হবে না।

এইসব ব্যাপারের দু-তিন সপ্তাহ পরেই আমাকে ও অস্থিরকে নীতি-বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। প্রথম দিন, কি জানি কেন গানের ক্লাস হল না। পরের রবিবার ইস্কুলের অন্যান্য কাজ হয়ে যাবার পর গানের ক্লাস শুরু হল। দুই ভাই আগে-ভাগে গিয়ে সেখানে জুটলুম। ইস্কুলের ছোটবড় সমস্ত ছেলে-মেয়েকে এক-এক করে পাইকারি হিসাবে গান শেখানোর ব্যবস্থা।

গান শুরু হল। সকলে সমস্বরে গেয়ে উঠল—”অদ্ভুত প্রকাণ্ড কাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড কি চমৎকার!”

আহা, হৃদয় একেবারে উপচে উঠল! কি কবিত্ব, কি অনুপ্রাস! শিশুচিত্তকে আকর্ষণ করবার জন্যে এর চেয়ে মধুময় সঙ্গীত জগতে আর কোথাও বোধ হয় রচিত হয়নি। অক্ষয়কুমার দত্ত মশায় তখন পরলোকে, নইলে তাঁর চারুপাঠের মধ্যে এমন উচ্চাঙ্গের সঙ্গীতের বীজ লুকিয়ে আছে দেখলে তিনি পুলকিত হতেন নিশ্চয়।

ঘরে ও বাইরে গান শেখবার এত সুযোগ পেয়েও আমি একটা ‘কালে খাঁ’ হয়ে উঠতে কেন যে পারিনি, রসিকেরা এর মধ্যে তার সন্ধান নিশ্চয় পাবেন।

সানডে-ইস্কুলের প্রত্যেক ছেলেমেয়েরই একখানা করে ‘চরিত্র-পুস্তক’ রাখতে হত। এই পুস্তকের পৃষ্ঠায় রবিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত সাত দিনের ‘ব্যবহার’ এবং ‘পাঠ’ কে কিরকম করেছে, তা বাড়ি থেকে অথবা যে-সব মেয়ে বোর্ডিংয়ে থাকত, তাদের সাময়িক অভিভাবকদের কাছ থেকে লিখিয়ে এনে দেখাতে হত। প্রায় সব ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকেরাই লিখতেন ‘পাঠ’ ভালো, ‘ব্যবহার’ ভালো। অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ না-করলে ব্যবহার সম্বন্ধে ‘মন্দ’ মন্তব্য কেউ করতেন না।

আমাদের বেলায় কিন্তু এ নিয়ম খাটত না। গুরুতর রকমের ভালো ব্যবহারের পরিচয় না পেলে আমাদের চরিত্র-পুস্তকে বাবা চোখ বুজে ‘পাঠ’ মন্দ এবং ‘ব্যবহার’ও মন্দ লিখে দিতেন। পাঠ ও ব্যবহারের মধ্যে তিনি কোনো প্রভেদ রাখতেন না। পাঠ খারাপ হলে ব্যবহার সুদ্ধু তাঁর কাছে খারাপ হয়ে যেত এবং ব্যবহার মন্দ হলে পাঠও মন্দ হত। আমরাও ‘পাঠ’ ও ‘ব্যবহার’ এই দুই তালবেতালকে একসঙ্গে কিছুতেই সামলাতে পারতুম না। ফলে, নীতি-বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না।

আমাদের নীতি-শিক্ষাদাত্রীরা,–এখানে একজন কি দুজন পুরুষ ছাড়া আর সকলেই ছিলেন মহিলা এবং সকলেই ছিলেন অবৈতনিক–তাঁরা আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে হিমসিম খেতে লাগলেন। তাঁদের অধ্যবসায়কে ধন্য। প্রতি সপ্তাহের সাত দিনই ‘পাঠ’ ও ‘ব্যবহার’ মন্দ দেখেও আমাদের সম্বন্ধে তাঁরা হতাশ হতেন না। অত্যন্ত সহিষ্ণুতার সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে আমরা ভালো ব্যবহার করি, সে বিষয়ে উপদেশ দিতেন। পাঁচ-সাত সপ্তাহের মধ্যেই ইস্কুল-সুদ্ধু ছেলেমেয়ে টের পেয়ে গেল যে, আমরা এক-একটা ডাকসাইটে দুষ্টু ছেলে।

চরিত্র-পুস্তকে মন্তব্য লেখা সম্বন্ধেও বাবার মৌলিকতা উল্লেখযোগ্য। ছাতের ওপরে লাট্টু ঘোরাচ্ছি, একবার এক ‘ওড়ন গচ্চায় লাট্টু হাত থেকে উড়ে একেবারে নীচের উঠোনে গিয়ে পড়ল। উঠোনের এক কোণে আমাদের বুড়ি ঝি শরতের মা বাসন মাজছে, লাট্টুটা ঠক করে তার গায় লেগে মার পায়ে গিয়ে লাগল, ঘটনাটি এই।

চরিত্র-পুস্তকে সেদিনকার ব্যবহারের সামনে বাবা মন্তব্য লিখলেন, ‘এই ব্যক্তি অত্যন্ত আত্মসুখপরায়ণ দুর্বৃত্ত। ক্ষণিক আত্মসুখের জন্য নারীহত্যা, এমনকি মাতৃহত্যায়ও পরাঙ্মুখ নহে।

এইরকম সব মন্তব্য পড়ে ইস্কুলময় হৈ-হৈ হুল্লোড় লেগে যেত। তবুও সানডে-ইস্কুল আমাদের এভরি-ডে ইস্কুলের চাইতে অনেক ভালো ছিল। সেখানে লেখাপড়ার বালাই ছিল না। শিক্ষয়িত্রীদের সত্তায় দশমহাবিদ্যার অংশ ছিল অপেক্ষাকৃত অল্প। মাঝে মাঝে ইস্কুল-সুদ্ধু শিবপুরের বাগানে কিংবা আলিপুরের চিড়িয়াখানায় যাওয়া হত চড়ুইভাতি করতে। এসব ছাড়া প্রায়ই কোনো-না-কোনো নামজাদা লোক এসে ছেলেমেয়েদের গল্পচ্ছলে নানা উপদেশের কথা শোনাতেন। রবিবারের সকালটা দিব্যি কাটত। সপ্তাহের ছটা দিন যদি সাড়ে-ইস্কুল আর একদিন যদি আসল ইস্কুল বসততা, তাহলে আমি অন্তত কিছু লেখাপড়া শিখতে পারতুম।

এই সানডে ইস্কুলের সঙ্গে আমার জীবনের দুটি বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি এখানে ভর্তি হবার বোধ হয় বছরখানেক পরে একটি নতুন মেয়ে আমাদের ক্লাসে এল। সে থাকত বেথুন বোর্ডিংয়ে। বেথুন বোর্ডিংয়ের প্রায় সব মেয়েই সান্‌ডে-ইস্কুলে আসত। এই নতুন মেয়েটি শিশু বললেই হয়। আমার তখন বছর সাতেক বয়েস হবে, সে ছিল আমার চাইতেও ছোট। ছোট্টখাট্ট ফুটফুটে মেয়েটি, চোখ-মুখ দিয়ে বুদ্ধি ফুটে বেরুচ্ছে, কথা বলছে–যেন খই ফুটছে। ফ্রক-পরা মেয়েটি ক্লাসে এসেই ছোট-বড় সবার সঙ্গেই ভাব জমিয়ে ফেললে। প্রথম দিনই কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন মেয়ে বলে আর তাকে মনে হল না। মেয়েটির নাম ছিল নন্দা।

পরের রবিবারে নন্দা আমার পাশেই বসেছিল। দুই ভাই আমসত্ত্ব চুরি করে খাওয়ার অপরাধে বাবা চরিত্র-পুস্তকে মন্তব্য করেছেন, ‘এ ব্যক্তি অতি চতুর তস্কর। শুধু তাহাই নহে, অন্যকেও তস্করবৃত্তি অবলম্বন করিতে প্রলুব্ধ করে।’

শিক্ষয়িত্রীরা বোধ হয় বাবার এই মন্তব্যগুলোকে বিশেষ গ্রাহ্য করতেন না। নইলে নিশ্চয় তাঁরা আমাকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দিতেন, না হয় পুলিশের হাতে সমর্পণ করতেন। তাঁরা আমাকে সামান্য একটু ধমক-ধামক দিয়ে ভবিষ্যতে সাবধান হবার উপদেশ দিতেন মাত্ৰ।

সেদিন বাবার মন্তব্য শুনে ক্লাসসুদ্ধু ছেলেমেয়ে হেসে উঠল; আমি একটা চোর সাব্যস্ত হয়ে ক্ষুণ্ন মনে বসে আছি, নন্দা আমার পাশেই বসে। সে খুব আস্তে আস্তে যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়, আমায় বললে, তুমি খুব দুষ্টু, না?

মেয়েদের কাছে দুষ্টু ছেলে বলে বাহাদুরি নেবার মতন মনস্তত্ত্ব তখনও আমার তৈরি হয়ে ওঠেনি। নন্দার কথার কি জবাব দোব ভাবছি, এমন সময় সে বললে, দুষ্টু ছেলেদের আমি বড্ড ভালোবাসি। আমার দাদারা যা দুষ্টু, তুমি আর কি দুষ্টু!

নন্দার সঙ্গে ভারি ভাব হয়ে গেল। সে বললে, তোমার নামটি কিন্তু ভাই বেশ মজার।

নামটি যে আমার অসাধারণ, সে বিষয়ে আমি বিশেষ সচেতন ছিলুম। এ নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা হলেই আমি যেতুম দমে। অথচ সর্বত্রই আমার নাম নিয়ে আলোচনার অন্ত ছিল না।

নন্দার কথা শুনে চুপ করে রইলুম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললে, আমার কথায় রাগ করলে ভাই?

এমন মিষ্টি কথা এর আগে আর শুনিনি। সেই এক দিনেই নন্দার সঙ্গে আমার খুব ভাব জমে গেল।

একদিন নন্দাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এই বয়সে সে বোর্ডিংয়ে এল কেন?

নন্দা বললে, তার মা মারা গেছেন, সেইজন্যে বাবা তাকে বোর্ডিংয়ে রেখে দিয়েছেন। বাবা সরকারি বড় চাকুরে। তিনি বিলেত থেকে পাস করে এসেছেন। তাঁকে মফস্‌সলে থাকতে হয়। তার আর একটি বোন আছে, তার বয়েস মাত্র দেড় বছর, সে মাসির কাছে মানুষ হচ্ছে বাবা তার দাদাদের নিয়ে থাকেন। পুজোর ছুটির সময় বাবা কলকাতার বাড়িতে আসবেন, সেই সময় নন্দাও বাড়ি যাবে। বাবার গরমের ছুটি নেই, সেজন্য গ্রীষ্মের ছুটির সময়ে সে বাবার কাছে গিয়ে থাকবে।

.

কারুর মা নেই শুনলে, কি জানি, আমার মনে ভারি কষ্ট হত। এই সহমর্মিতার আকর্ষণে নন্দা আমার একান্ত আপনার জন হয়ে উঠল। ছুটির সময় আমাদের পত্র-বিনিময় চলত। তাতে যে কত মনের কথা সে আমায় লিখত ও আমি তাকে লিখতুম, তার আর ঠিকানা নেই।

তখন পোস্টকার্ডের দাম ছিল এক পয়সা আর খামের দাম ছিল দু-পয়সা।

বছর-পাঁচেক বেশ কাটল। এক রবিবার নন্দা আমাকে বললে, এবার ভাই, আমাকে বাবার কাছে গিয়ে থাকতে হবে। বোর্ডিং ছেড়ে দিতে হবে।

মনের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করলুম। নন্দা চলে যাবে!

জিজ্ঞাসা করলুম, কেন ভাই?

নন্দা ফিসফিস করে বলল, মামারা বলছে, আমি বড় হয়ে গিয়েছি, এবার আমার বিয়ের সম্বন্ধ হবে, আর বোর্ডিংয়ে রাখা চলবে না।

নন্দার বয়েস তখন বোধ হয় এগারো হবে। তার বাবা বিলেত-ফেরৎ এবং সু-উচ্চশিক্ষিত, কাল ১৯০২।

বিদায়ের সময় নন্দা বললে, স্থবির, কাঁদিসনি ভাই। আবার দেখা হবে–নিশ্চয় দেখা হবে।

.

এই ঘটনার বোধ হবে সাত-আট বছর পরে, আমি তখন ভবঘুরে। বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে মধ্যপ্রদেশের এক শহরে এসে পড়েছি। শহরের ধার দিয়ে নর্মদা বয়ে চলেছে। নদীর ধারে বড় বড় উঁচু বাঁধানো ঘাট। ওপারে সাতপুরা গিরিশ্রেণী একেবারে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াই, সন্ধে ঘনিয়ে এলে নদীর ধারে নির্জন ঘাটে এসে বসি। লোকজনের চেঁচামেচিতে দিনের বেলায় নদীর আওয়াজ কিছুই শুনতে পাওয়া যায় না। কিন্তু রাত্রে সে কি কলরোল! কত বিচিত্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি। যাই যাই করেও জায়গাটা ছাড়তে পারছিলুম না। সঙ্গীতময়ী চপলা নর্মদা কি মায়ার বাঁধনেই আমায় বেঁধেছিল!

সে এক কোজাগর-পূর্ণিমা-রাত্রি। জনশূন্য ঘাটে একলা বসে আছি। আমার কি জানি মনে হতে লাগল, দূরে রহস্যময় নিদ্রিত সাতপুরা শৈলমালা ধীরে ধীরে যেন জেগে উঠছে। যেন তার প্রত্যেকটি বৃক্ষলতা, পশুপক্ষী, পতঙ্গ বিচিত্র সুরে কলরব করতে আরম্ভ করে দিলে। স্পষ্ট দেখতে লাগলুম, যেন, সেই মহাকায় অতি ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নদীর কিনারায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর অদ্ভুত এক ভাষায় আমাকে কি যেন বলতে আরম্ভ করে দিলে–কত যুগ-যুগান্তের কাহিনি, কত দুর্লভ সংবাদ, তার মধ্যে নর্মদার কলধ্বনি কোথায় ডুবে গেল।

হঠাৎ আমার তন্মনস্কতায় আঘাত দিয়ে যেন, পাহাড় ভেদ করে আমারই মাতৃভাষায় বাগীশ্বরীর মূর্তি ফুটে উঠল সঙ্গীতের প্রস্রবণে। চমকে ফিরে দেখলুম, দূরে অন্ধকারে বসে কে গান গাইছে–

অনন্ত সাগর মাঝে দাও তরী ভাসাইয়া,
গেছে সুখ গেছে শান্তি গেছে আশা ফুরাইয়া।

মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে, রাত্রি দ্বিপ্রহরে মাতৃভাষার সে সঙ্গীতে আমার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। বাগেশ্রীর উদাস অন্তরা পরতে পরতে চড়তে লাগল উদাত্ত স্বরে–

সম্মুখে অনন্ত রাত্রি
আমরা দুজন যাত্রী–

উঠে লোকটির কাছে গিয়ে বসলুম। গান শেষ হয়ে গেল। গানের সুরে ও ভাষায় আমার মনের মধ্যে যে সুর জেগে উঠেছিল, তারই সঙ্গে মিলিয়ে নর্মদা তুললে তার কলতান।

গায়ককে বললুম, বাঃ, কি চমৎকার!

দেখলুম, গায়ক প্রায় আমারই বয়সি, হয়তো দু-এক বছরের বড় হতে পারে। আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললে, আপনি বাঙালি! নতুন এসেছেন বুঝি?

বললুম, এখানে আমি আগন্তুক, দুদিনের জন্য এসেছি। আবার চলে যাব।

প্রশ্ন হল, কাদের বাড়িতে আছেন?

কোনো বাঙালি বাড়িতে উঠিনি শুনে সে অবাক হয়ে গেল। বললে, তা হবে না। আমরা বাঙালিরা থাকতে আপনি এখানে-সেখানে থাকবেন, তা হবে না।

পরিচয় বাড়তে লাগল। শুনলাম, তারা দু-পুরুষ ধরে এ-দেশে বাস করছে। তারা ব্রাহ্মণ। তার বাবা এখানকার মস্ত উকিল। সে নাগপুরে বি.এ. পড়ে। তার দাদার সাংঘাতিক ব্যামো, আজ যায় কাল যায়–এমন অবস্থা। সেই জন্যে তাকে এই সময় এখানে আসতে হয়েছে। দাদা ব্যারিস্টার, তার হয়েছে রাজযক্ষ্মা। দাদার কথা বলতে বলতে সে চোখ মুছতে লাগল।

আমি বললুম, ভাই, আমি তোমার কোনো উপকার করতে পারি কি? আমি উদাসীন লোক, যক্ষ্মারুগির সেবার ভার আমায় দিতে পার।

সে বললে, যখন ‘ভাই’ বলেছ, তখন আর ছাড়ছি না। ভাইয়ের বাড়ি থাকতে অন্য জায়গায় থাকবে, সে হবে না।

তার কথাবার্তার মধ্যে এমন আন্তরিকতা ছিল যে, বেশিক্ষণ তাকে দূরে রাখা সম্ভব হল না। সে বলতে লাগল, কিছুতেই তোমাকে এখানে-সেখানে থাকতে দোব না। আমাদের বাড়ি চল, যতদিন খুশি সেখানে থাকবে। ইচ্ছে করলে সারা জীবন সেখানে থাকবে। আমি বলছি, কখনও যদি কোনো অসুবিধে হয় তো চলে যেয়ো।

এই বলে সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি দু-হাত দিয়ে তার হাতখানা চেপে ধরলুম।

সেই রাতেই সে আমায় তাদের ওখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, অনেক চেষ্টা করে তখনকার মতো অব্যাহতি পেয়ে গেলুম।

পরদিন সকালে ওদের ওখানে গিয়ে হাজির হলুম। আমার নতুন বন্ধু তার ছোট ভাইদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে। প্রতিদিন সন্ধেবেলা তিন-চার ঘণ্টা করে সেখানে কাটতে লাগল। অতি ভদ্র ও শিক্ষিত পরিবার তারা। প্রাসাদের মতো বাড়ি। লোকজন, চাকর-বাকর, গাড়ি-ঘোড়া জমজম করছে সংসার। কিন্তু সবাই ম্রিয়মাণ। ছোট ছেলেরা পর্যন্ত আস্তে কথা কয়, কারুর গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না–কি যেন বিপদের শঙ্কায় সকলেই অবসন্ন।

তারপর একদিন সেই দিন এল। সকাল থেকেই বাড়িতে ঘন ঘন ডাক্তার-বদ্যি যাওয়া-আসা করতে লাগল। সন্ধেবেলায় আমার বন্ধু বললে, আজ রাতে আর তোমার যাওয়া হবে না, এখানেই থেকে যাও। সকাল থেকেই দাদার অবস্থা খুব খারাপ। রাত্রে সেখানেই থেকে গেলুম। ধবধবে সাদা নরম বিছানা দেখে অতি দুঃখেও হাসি পেল। প্রায় দুমাস ভূমিতলে হাতে মাথা রেখে কেটেছে। বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লুম।

তখন সবেমাত্র ভোর হয়েছে। অন্দর-মহলে নারীকণ্ঠে কান্নার রোল উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে এলুম, বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতেই সে বললে, দাদা চলে গেল এই মিনিট পনেরো হবে। যেয়ো না কিন্তু, শ্মশানে যেতে হবে। চা খেয়েছ?

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে দলে দলে লোক আসতে লাগল–বাঙালি, হিন্দুস্থানী, মারাঠি। বজ্রাহত বনস্পতির মতন গৃহকর্তা একটা ঘরে চেয়ারে বসে আছেন, আর তাঁকে ঘিরে যত মুরুব্বি মক্কেল–কেউ বা বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে। কারুর মুখেই সান্ত্বনার ভাষা নেই। অন্তঃপুরে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল।

শব বাইরে একটা উঠোনের মতন জায়গায় এনে রাখা হল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলি নারী ও ছোট ছেলেমেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। তার মধ্যে মাকে দেখেই চিনতে পারলুম। সকলেই কাঁদছে, ঝি-চাকর সবাই। বাহকেরা শব তুলব তুলব করছে, এমন সময় ভেতর থেকে ভিড় ঠেলে একটি নারী এসে পড়ল শবের বুকের ওপর, যেন উন্মূলিত তড়িল্লতা।

এই দৃশ্য দেখে ভিড়ের সবাই আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মানুষের এই নিষ্ফল অভিযোগ কত বন্ধুর গৃহপ্রাঙ্গণে ধ্বনিত হতে দেখেছি, তবুও অশ্রুবরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল।

কিছুক্ষণ পরে আমার বন্ধু মেয়েটির কাছে গিয়ে বললে, বউদি, ওঠ, এবার আমরা নিয়ে যাই।

এই বলে সে তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলে। এবার তার মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পেলুম। রোরুদ্যমানা সেই নারী–নন্দা! আমার বাল্যসখী!

বাহকেরা শব তুলে নিয়ে চলে গেল। আমার আর তাদের সঙ্গে যাওয়া হল না। নন্দা আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলে, কে, স্থবির!

হ্যাঁ।

দেখলি, আমার কি সর্বনাশ হয়ে গেল!

আমার জীবনপাত্র কোন অপূর্ব রসে পরিপূর্ণ করে দেবার জন্যে নর্মদা তার কুহকজাল বিস্তার করেছিল, এবার বুঝতে পারলুম।

বন্ধু, তার মা, বাবা আর নন্দা–কেউ আমাকে ছাড়লে না। শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাবার পরদিনই নন্দার দাদা এল তাকে বাবার কাছে নিয়ে যাবার জন্যে।

আমিও তাদের সঙ্গে ট্রেনে চড়লুম। ট্রেনে চার ঘণ্টার মধ্যে তার সাত-আট বছরের জীবনকাহিনী আমাকে শোনালে। আমার এই সময়টা কেমন করে কেটেছে আর কাটছে, তন্ন তন্ন করে তার সন্ধান নিয়ে যথোপযুক্ত উপদেশ দিলে।

একটা বড় স্টেশনে আমরা নামলুম। এইখানে ট্রেন বদলে তারা অন্য গাড়ি ধরবে।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই তাদের ট্রেন এসে গেল। বিদায়ের সময় নন্দা বললে, স্থবির, গেল-জন্মে নিশ্চয় তুই আমার ভাই ছিলি, তা না হলে কোথা থেকে কি দিনেই আবার দুজনে দেখা হল!

প্রথম ঘণ্টা পড়ল। নন্দা জিজ্ঞাসা করলে, আবার কবে দেখা হবে ভাই?

তারপর নিজেই ম্লান হেসে নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললে, বেঁচে থাকলে নিশ্চয় দেখা হবে, কি বলিস?

গার্ড হুইসল দিলে ট্রেন চলে গেল।

সেই থেকে নন্দার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আমি তো বেঁচেই আছি, নন্দা বোধ হয় চলে গিয়েছে।

.

সানডে-ইস্কুলের দ্বিতীয় স্মৃতি হচ্ছে আমার বন্ধু শচীন। শচীনও ছিল মাতৃহীন। নন্দার কিছুদিন আগে সে সেখানে ভর্তি হয়। প্রথম দিন থেকেই তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব জমে গেল। শচীনের দিদি আগে থাকতেই সানডে-ইস্কুলে আসত এবং আমি যে একটা সাংঘাতিক চরিত্রের লোক, সে কথা জানত। তাই আমার সঙ্গে তার অতখানি বন্ধুত্ব সে বিশেষ সুনজরে দেখতে না। দিদি আমার কীর্তিকাহিনি বাড়িতে বলে দেওয়ায় শচীনের বাবা তাকে আমার সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিলেন! এতেও আমাদের বন্ধুত্ব ছুটল না দেখে বাড়িতে তার ওপরে অত্যাচার শুরু হল। আমরা শেষকালে ইস্কুলে দুজনের মধ্যে কথা বন্ধ করে দিলুম। ইস্কুল ছুটি হওয়ার পর সেখান থেকে বেরিয়ে একজনদের রকে বসে দুজনে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে যে যার বাড়ি চলে যেতুম। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বও বেড়ে উঠল। অনেক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করেও আমাদের বন্ধুত্ব টিকে ছিল। এই সেদিন মৃত্যু এসে আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে।

শচীনের কথা এই জাতকের অনেক জায়গায় উল্লেখ আছে।

.

একদিন শুনতে পেলুম, আমাদের ইস্কুলের বাড়িওয়ালা নোটিস দিয়েছে–বাড়ি ছেড়ে উঠে যেতে হবে। ইস্কুলের কর্তৃপক্ষ খুঁজে খুঁজে সেই শিয়ালদার কাছে একটা বড় বাগানবাড়ি ঠিক করলেন ইস্কুলের জন্যে। আমাদের বাড়ি থেকে সে বাড়িটা মাইল-দেড়েক দূরে হবে। রোজ এতটা রাস্তা আমরা দু-ভাইয়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে লাগলুম। আমাদের এক সঙ্গীও জুটল। আমাদের কাছেই তাদের বাড়ি। ইস্কুলে যাবার মুখে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে আমরা তিন মূর্তিতে রাস্তা আবিষ্কার করতে করতে আধ ঘণ্টার জায়গায় ঘণ্টা-খানেক ঘুরে ইস্কুলে গিয়ে পৌঁছতুম।

আমাদের এই নতুন বন্ধুটির নাম প্রকাশচন্দ্র। খুবই দরিদ্র ছিল তারা। তার বাবা সামান্য কাজ করতেন। একজনদের একতলায় দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে কায়ক্লেশে তাঁরা দিনাতিপাত করতেন। প্রকাশের আর দুটি বোন ছিল, তারা আমাদের চাইতে অনেক বড়। বোনদের মধ্যে যে ছোট, ‘সে আমার সঙ্গে পড়ত। এই পরিবারের সঙ্গে আমার ও অস্থিরের খুবই অন্তরঙ্গতা হয়ে গেল। প্রকাশের যে দিদি আমার সঙ্গে পড়ত, তার নাম ছিল অলকা। তাকে সবাই ‘লোকা’ বলে ডাকত।

একদিন ক্লাসে আমার হাতের ধাক্কা লেগে লোকার একটি বাহারী কালির দোয়াত মাটিতে পড়ে গেল। লোকাদের অবস্থার কথা আমি ভালো করেই জানতুম। তার অমন সুন্দর দোয়াতটা ভেঙে ফেলে আমার ভারি দুঃখ হতে লাগল। লোকা বেচারি করুণ চোখে একবার দোয়াতের দিকে আর একবার আমার দিকে চাইতে লাগল। ইতিমধ্যে লোকার দুটি মেয়ে-বন্ধু মহা গরম হয়ে আমার ওপর তম্বি জুড়ে দিল এবং হেডমাস্টারকে বলে দেব বলে শাসাতে লাগল।

কিছুক্ষণ তাদের কথা শুনে লোকা হঠাৎ বলে উঠল, বেশ করেছে ও ভেঙেছে, তোমাদের দোয়াত তো ভাঙেনি–ও আমার ভাই হয়।

লোকার মুখে এই কথা শুনে তারা একদম চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরে লোকা আবার বললে, ও তো ইচ্ছে করে ভাঙেনি।

সেইদিন থেকে আমি লোকার এমন অনুগত হয়ে পড়লুম যে, ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ঠাট্টা করতে আরম্ভ করে দিলে। এই ঘটনার বোধ হয় মাস দুয়েকের মধ্যে লোকার মা কলেরায় মারা গেলেন। মা মারা যেতেই তাদের সংসার অচল হয়ে পড়ল। কে রাঁধে, কেই বা গৃহস্থালি দেখে। লোকা ও তার দিদির ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মাসকয়েক যেতে-না-যেতে লোকার দিদির বিয়ে হয়ে সে অন্যত্র চলে গেল।

লোকা হয়ে পড়ল একা। দরিদ্র সংসারের সব ভার তার কাঁধের ওপর। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তুম তাড়াতাড়ি রাস্তায় ঘোরবার জন্যে। প্রকাশকে নিতে গিয়ে প্রায়ই দেখতুম, তখনও তাদের চাল জোগাড় হয়নি কিংবা সবেমাত্র লোকা ভাত চড়িয়েছে। এই সময়টুকুর মধ্যে সে আমায় ইস্কুলের সব কথা জিজ্ঞাসা করত। বান্ধবীদের চিঠি আমাকে দিত, তাদের কাছ থেকে জবাব নিয়ে আমি আবার. লোকাকে দিতুম।

লোকা বলত, আমার অদৃষ্টে এই ছিল! এক বছর আগেও বুঝতে পারিনি, এমন করে ইস্কুল-টিস্কুল ছেড়ে ভাত রাঁধতে রাঁধতে জীবন কাটবে! ইস্কুলের জন্যে এমন মন কেমন করে যে, কি বলব!

লোকার তখন আঠারো-উনিশ বছর বয়েস। অটুট স্বাস্থ্য ও লম্বা-চওড়া তার চেহারা, দেখলে মনে হত বাইশ-তেইশ বছর বয়েস হবে। জীবনে হঠাৎ এই পরিবর্তন আসায় সে বেচারি একেবারে মুষড়ে পড়ল। সে বলত, তোরা ইস্কুলে চলে গেলে সারাদিন যে কি করে কাটে তা আমিই জানি।

এই বলে সে কাঁদতে থাকত। আমি, অস্থির ও প্রকাশ তার সঙ্গে কাঁদতে থাকতুম। লোকা আমাদের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলত, যা, তোরা স্কুলে যা, আমার দিন এক রকম করে কেটে যাবে। আর কদিনই বা বাঁচব!

সমস্ত দিন অশ্রুমুখী লোকার মুখ মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করত।

একদিন প্রকাশদের ওখানে গিয়ে দেখি, লোকা তখন সবেমাত্র উনুনে আগুন দিচ্ছে। মহা মুরুব্বির মতো তাকে বললুম, লোকা, তুই মজালি! রোজই কি দেরি করবি?

আমার বয়েস তখন নয়, লোকার বয়েস আঠারো।

লোকা আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে মুচকে হেসে উনুনে খুব জোরে পাখা করতে লাগল।

প্রকাশের খাওয়া শেষ হতে সেদিন প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। লোকা বললে, আজ আর এত বেলায় ইস্কুলে গিয়ে কি হবে! এখানে চারটে অবধি থেকে বাড়ি চলে যাস।

সারা দুপুর খুব হুল্লোড়ে কাটল। বেলা প্রায় দুটোর সময় ওদের বাড়িতে দু-তিনজন যুবক এল, তারা প্রকাশের দাদার বন্ধু। দেখলুম, লোকার সঙ্গে তাদের ভারি ভাব।

আমরা ছাড়া আবার অন্য লোকের সঙ্গে লোকার এতখানি ভাব দেখে মনে মনে ঈর্ষা জাগতে লাগল।

যা হোক, কিছুক্ষণ পরেই তারা চলে গেল। বেলা চারটে বাজতে আমরাও বাড়ি ফিরে গেলুম।

সেদিন প্রথম ইস্কুল পালালুম।

কিছুদিন চলল। একদিন, সেদিন আমাদেরই দেরি হয়ে গিয়েছিল, প্রকাশের ওখানে গিয়ে দেখি যে, লোকার অসুখ, সে বিছানায় শুয়ে আছে, আর প্রকাশ রান্না করছে। রান্না মানে–ভাত চড়িয়ে দিয়ে লোকা শুয়েছে, প্রকাশ শুধু উনুনের কাছে বসে আছে।

অস্থির রান্নাঘরে প্রকাশের সঙ্গে গল্প করতে লাগল, আমি গিয়ে বসলুম লোকার পাশে।

জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছে লোকা?

লোকা দু-হাতে মুখ ঢেকে শুয়ে ছিল। হাত-দুটো নামাতেই দেখলুম, তার দুই চোখ দিয়ে জল ঝরছে। কিসের যন্ত্রণায় তার মুখখানা থেকে থেকে বিকৃত হয়ে উঠছে। লোকার রঙ ছিল ময়লা, কিন্তু মুখ-চোখ বেশ সুশ্রীই ছিল। আমার চোখে লোকা দেখতে বেশ ভালোই ছিল; কিন্তু যন্ত্রণায় তার মুখখানা এমন বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল যে কি বলব!

লোকা কাঁদতে কাঁদতে বললে, স্থবির ভাই, আমার সর্বনাশ হয়েছে, আমি আর বাঁচব না।

আমার মনে হল, লোকার কলেরা হয়েছে। সেদিন তার মা ওই রোগে মারা গিয়েছেন, আজ আবার তাকেও ওই রোগে ধরল! ভয় হতে লাগল, কিন্তু কিছুদিন আগেই বাবা আমাদের কলেরার টিকেও দিইয়ে আনিয়েছিলেন, মনে মনে একটু ভরসা ছিল যে, কলেরা হবে না!

লোকার যন্ত্রণা ক্রমে বাড়তে লাগল। সে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, মা গো, তুমি কোথায় আছ, আমায় নিয়ে যাও। তুমি গেলে, আমায় এমন অসহায় ফেলে গেলে কেন?

তার কান্না দেখে আমরাও কাঁদতে আরম্ভ করে দিলুম। তাদের বাড়িতে তখন কেউ নেই। কি হবে, কাকে ডাকতে হবে–কিছুই জানি না। এদিকে লোকার যন্ত্রণা ও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার বেড়ে চলেছে, এমন সময় সে আমাদের বললে, স্থবির, তোরা ইস্কুলে চলে যা, প্রকাশ আজ আর যাবে না। যদি মরে যাই, লোকাকে ভুলিস না।

ক্ষুণ্ণমনে আমরা দুজনে ইস্কুলে চলে গেলুম। পথে যেতে যেতে অস্থির বললে, লোকা বড় ভালো, বড় হয়ে আমি ওদের টাকা দোব, বেচারিরা খেতে পায় না।

লোকার অসুখের কথা বাড়িতে কিছুই বললুম না–কলেরা-রুগির বিছানায় বসে তার মাথায় হাত বুলিয়েছি জানলে মা অনর্থ বাধাবেন এই ভয়ে। পরের দিন তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে লোকাদের বাড়িতে গিয়ে দেখলুম, তাদের দরজায় তালা লাগানো, কেউ কোথাও নেই।

রোজই যাই, দেখি লোকাদের ঘরে তালা বন্ধ। বোধ হয় পাঁচ দিন বাদে তাদের ঘর খোলা দেখে ঢুকে পড়লুম!

ভেতরে গিয়ে দেখি, ঘরের এক কোণে লোকার বাবা বসে একতারা বাজিয়ে চোখ বুজে গান করছেন–

গাও রে তাঁহারি নাম
রচিত যাঁর বিশ্বধাম

আমরা দুজনে দূরে দাঁড়িয়ে রইলুম। গান শেষ হতে তিনি চোখ খুলে আমাকে দেখে বললেন, কে রে? স্থবির? ওরা তো সব মামার বাড়ি চলে গেছে। প্রকাশ কাল আসবে।

দারুণ উৎকণ্ঠায় হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলুম, লোকা কেমন আছে?

বৃদ্ধ বললেন, লোকা! লোকা ভালো আছে।

পরের দিন দেখি, প্রকাশ তৈরি হয়েই আছে, তার বাবা রান্নাঘরের কাজকর্ম দেখছেন, লোকা নেই।

রাস্তায় বেরিয়ে প্রকাশকে জিজ্ঞাসা করলুম, লোকা কেমন আছে রে?

প্রকাশ বললে, ভালো আছে।

জিজ্ঞাসা করলুম, লোকার কি হয়েছে রে?

প্রকাশ অকুণ্ঠিতভাবে বললে, লোকার ছেলে হয়েছে।

স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। কুমারী মেয়ের ছেলে হওয়া যে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার–সে তথ্য আমরা সেই বয়সেই জেনেছিলুম। বোধ হয় পাঁচ-সাতখানা উপন্যাস তখন আমাদের মুখস্থ। কুমারী মাতার দুর্দশার গুটিকয়েক কাহিনিও পড়া ছিল। লোকার শেষকালে এই হল!

প্রকাশ বলতে লাগল, লোকাকে আর বাড়ি ফিরিয়ে আনা হবে না, তার যেখানে খুশি সেখানে চলে যাবে। বাবা বলেছেন, আর তার মুখ দেখবেন না। লোকা দিনরাত কাঁদছে–

কঠিন সংসারের সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয় হল। লোকা, যে তাদের ছোট্ট সংসারের সর্বময় কর্ত্রী ছিল, তার এ কি হল! প্রকাশ, তার দাদার ও বাবার জন্যে কোন ভোরে উঠে সে সংসারের কাজ শুরু করত, তারপর সেই রাত্রি দশটা এগারোটা অবধি তাদেরই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তার খাটুনির অন্ত ছিল না, সেই লোকা এমন অপরাধ করলে যে, তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। কোথায় যাবে সে?

প্রকাশ বলতে লাগল, বাবা তাকে ছেলে-সমেত তাড়িয়ে দেবেন, ছেলে নিয়ে তাকে পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে।

ছেলে কোলে নিয়ে অনেক ভিখারিনিকে রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতে দেখেছি। কল্পনায় দেখতে লাগলুম, লোকাও তার ছেলেটিকে বুকে জুড়িয়ে ধরে ডান হাতখানা পথচারীদের দিকে এগিয়ে দিয়ে কাতরস্বরে বলছে, একটা পয়সা দাও বাবা!

প্রকাশের মুখের দিকে আর চাইতে পারলুম না। লোকার সেই শেষ মিনতি–যদি মরে যাই, লোকাকে ভুলিসনি–কানের কাছে বাজতে লাগল।

আমি আর সহ্য করতে পারলুম না, কেঁদে ফেললুম। আমার কান্না দেখে অস্থির ও প্রকাশ ও কাঁদতে লাগল। লোকার শেষকালে এই হল! তার সঙ্গে বসে বসে আমরা কল্পনায় ভবিষ্যৎ জীবনের যে কত প্রাসাদ তৈরি করেছিলুম, একমুহূর্তে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

পথের ধারে একটা রকে বসে আমরা তিনজনে প্রাণ খুলে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলুম। কোথায় রইল ইস্কুল, পড়াশুনা! কোথায় গেল বাবার প্রহারের ভয়!

আমাদের চারদিকে লোক জমা হতে লাগল। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতে লাগল, খোকা, তোমাদের কি হয়েছে?

শেষকালে সেখান থেকে উঠে আমরা গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলুম। সারাদিন সেখানে বসে বসে প্রায় সন্ধের সময় বাড়ি ফিরলুম।

মা জিজ্ঞাসা করলেন, এত দেরি হল কেন রে?

বললুম, ছোটলাট এসেছিল ইস্কুল দেখতে, তাই আজ দেরিতে ছুটি হয়েছে।

সেদিন থেকে উপরি-উপরি বোধ হয় পাঁচ-ছ দিন আমরা ইস্কুলে না গিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। মধ্যে মধ্যে গড়ের মাঠে গিয়ে নির্জনে বসে লোকা ও তার ছেলের সম্বন্ধে আলোচনা হতে লাগল। লোকাকে যখন বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে, তখন তাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে রাখা হবে, কি করে তার খরচ চলবে, সে সম্বন্ধে গভীর গবেষণা চলতে লাগল।

বেশ মনে পড়ে, সেদিনটা রবিবার। কদিন ইস্কুলে না গিয়ে মনের মধ্যে ভয়ানক একটা নির্বেদ চলেছে। কাল থেকে নিয়মিত ইস্কুলে যেতে হবে–এরকম একটা সঙ্কল্পও দুই ভাইয়ে করে ফেলেছি। সেদিন সন্ধেবেলায় কোথায় একটা নেমন্তন্ন ছিল, দুজনে মিলে মহা উৎসাহে জুতো বুরুশ করছি, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রাঘাত–

মেঘ-গর্জনের মতো বাবা চিৎকার করে ডাকলেন, স্থবির, অস্থির, শিগগির এস। বাবার কাছ অবধি যাবার আর তর সইল না। তিনি একরকম দৌড়ে এসে প্রথমেই আমাকে ধরলেন–বাঘে যেমন হরিণ ধরে।

তার পরে, আহা-হা মধু মধু মধু! আজও সে কথা স্মৃতিপটে উদিত হলে রোমাঞ্চ উপস্থিত হয়।

দশ-পনেরো জন প্রতিবেশী সদর-দরজা ভেঙে সন্ধেবেলা যখন আমাদের দুই ভাইকে বাবার হাত থেকে উদ্ধার করলে, তখন আমি অর্ধমৃত, অস্থিরের মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত উঠছে।

নিজ অঙ্গের বেদনায় লোকার ব্যথা ভুলে গেলুম।

.

লোকাদের বাড়িতে অনেকগুলি যুবক আসা-যাওয়া করত। এদের মধ্যে একজনের সে নাম করলে। এই ব্যক্তি জেরায় প্রকাশ করতে বাধ্য হল যে, লোকার সঙ্গে তার যৌন সম্বন্ধ হয়েছিল। এই ব্যক্তি ভদ্রলোকের সন্তান বলে পরিচিত ছিল এবং ছিল অবিবাহিত, তবুও লোকাকে বিয়ে করতে সে রাজি হল না। এর দুটি-তিনটি ভাই ব্রাহ্মসমাজে বেশ নামজাদা লোক; কিন্তু তারা তাদের ভাইকে এমন কিছু চাপ দিলে না, যার জন্যে লোকাকে ‘বিয়ে করতে সে বাধ্য হয়, বরং তারা বিরোধিতাই করলে। অসহায়া মাতৃহীনা দরিদ্রের সন্তান কুমারী-মাতা লোকাকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হল না।

এসব কথা অবিশ্যি আমরা প্রকাশের কাছে শুনতে পেতুম, কারণ লোকাকে সেই যে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, আর তাকে ফিরিয়ে আনা হয়নি।

এই ঘটনার বছর-দশেক পরে একবার প্রকাশের মুখে শুনলুম, একজন লোকাকে বিয়ে করেছে, তার আরও ছেলেপিলে হয়েছে, বেশ সুখেই আছে সে।

লোকার সঙ্গে আর আমাদের দেখা হল না। যে লোকা একদিন আমাদের এত আপনার ছিল, ক্রমে তার স্মৃতি মন থেকে একেবারেই মুছে গেল।

সেই ব্যাপারের প্রায় পনেরো-ষোলো বছর পরে একটা বড়রকমের অস্ত্রোপচারের জন্যে বাবাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। রোজ বিকেলে বাবাকে দেখতে যাই। একদিন, সেদিন আমার শরীরটা নিতান্ত খারাপ, আস্তে আস্তে হাসপাতালের দীর্ঘ সোপান অতিবাহিত করে উঠে দম নেবার জন্যে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় নারীকণ্ঠের আহ্বানে চমকে উঠলুম।

কি রে স্থবির, কেমন আছিস?

মুখ তুলে দেখলুম, লোকা সামনে দাঁড়িয়ে। তার অটুট স্বাস্থ্য জরায় একেবারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। চোখ-দুটো ফোলা ফোলা–সে এক অদ্ভুত চেহারা! তবুও প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে চিনতে পারলুম।

আমি চুপ করে আছি দেখে সে বললে, কি রে, লোকাকে ভুলে গেছিস?

লোকাকে ভুলব কি করে! কিন্তু এ কি চেহারা হয়েছে তোর?

লোকা একটু হেসে বললে, আয়, ভেতরে আয়।

ঘরের মধ্যে লোকার বিছানার পাশে একটা টুলের ওপরে গিয়ে বসলুম। জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছে তোর?

লোকা বললে, হার্টের অসুখ। ডাক্তার বলেছে, যে-কোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারি। ছেলে হয়ে হয়ে শরীর ফোঁপরা হয়ে গেছে। আবার একটা পেটে এসেছে, এইটে হতেই মরে যাব।

ঘরের মধ্যে আরও দশ-পনেরোটি নারী, কেউ-বা বিছানায় শুয়ে, কেউ-বা এর তার সঙ্গে গল্প করছে। সকলের চেহারাই জরাজীর্ণ–ফোলা ফোলা চোখে এক অলৌকিক দীপ্তি, মুখমণ্ডল ঘিরে করুণ বৈরাগ্য। তাদের প্রশান্ত উদাসীনতায় মৃত্যুর জয়ধ্বনি যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে! সে আবহাওয়া অসহনীয় হলেও পুরুষের কাছে সেস্থান তীর্থভূমি।

তাদের কথা জিজ্ঞাসা করাতে লোকা বললে, ওই একই অসুখ–ছেলে হওয়ার ব্যামো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লোকা বললে, রোজই তোকে দেখি, কিন্তু ডাকবার অবসর আর পাই না। আজ তোকে ধরব বলেই দরজার কাছে গিয়ে বসেছিলুম।

একটু হাঁপিয়ে নিয়ে সে বললে, রোজ তুই আসিস, অস্থির আসে না?

অস্থির মারা গেছে শুনে সে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। দেখতে দেখতে তার দুই চোখ জলে ভরে উঠল। তার মুখের দিকে আর চেয়ে থাকতে পারলুম না, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলুম।

আর আমাদের কোনো কথা হল না। একবার মুখ ফিরিয়ে দেখলুম, লোকা আস্তে আস্তে যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। শেষকালে সে শুয়ে পড়ল। ক্রমে তার চোখ-দুটোও বন্ধ হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ বসে থেকে আমি বললুম, লোকা, এবার চলি ভাই, আবার কাল দেখা হবে। এদিকে দেরি হয়ে গেল এরা আবার বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না।

লোকা চোখ চেয়ে বললে, চললি? আচ্ছা।–এই বলে সে আবার চোখ বুজে ফেললে।

বাড়িতে এসে সেই রাত্রেই খুব জ্বর এল। জ্বরের ধমকে কেবল লোকার মুখই মনে জাগতে লাগল।

দিন পনেরো বাদে হাসপাতালে বাবাকে দেখতে গিয়ে লোকার খোঁজ নিয়ে জানলুম, কদিন আগে সে মারা গিয়েছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই সে বিদায় নিয়েছে।

ছেলে হওয়া নিয়েই লোকার জীবনে দুঃখের সূত্রপাত হয়েছিল এবং তাতেই সে-জীবনের অন্ত হল।

.

যতদিন ইস্কুলে ভর্তি হইনি, ততদিন বাড়ির ও বাইরের লোকেদের মুখে শুনতুম, আমি বড় বুদ্ধিমান ছেলে। নিজেকেও মনে মনে খুবই বুদ্ধিমান বলে বিবেচনা করতুম। কিন্তু সত্যিকারের লেখাপড়া আরম্ভ করতে-না-করতেই আমার বুদ্ধিভ্রংশ হল। ইস্কুলে তো কথাই নেই, বাড়িতেও পদে পদে প্রমাণিত হতে লাগল যে, আমার ভাইদের বুদ্ধি আমার চেয়ে তীক্ষ্ণতর। প্রহার, ধমকানি ও অন্য নানাপ্রকার শাস্তি ও হাঙ্গামার ভয়ে পড়াশুনো ব্যাপারটাকে মোটেই সুনজরে দেখতে পারতুম না। কিছুদিনের মধ্যে এটাও বেশ বুঝতে পারলুম যে, ইস্কুল জিনিসটাই যত নষ্টের গোড়া, যত দুঃখের উৎপত্তিস্থল ওই ইস্কুল। বাবাকে যমের মতো ভয় করতুম, আর বাবাই আমাকে বাড়িতে পড়াতেন। খাঁচার সামনে বেড়াল বসে থাকলে যত বড় পড়িয়ে পাখিই হোক না কেন, তার বুলি যে বন্ধ হয়ে যায়, আমি তার জীবন্ত প্রমাণ। তার ওপরে আমার মনটা ছিল অত্যন্ত ভাবপ্রবণ। বাইরের সামান্য একটু তরঙ্গ লাগলেই মনের মধ্যে এমন আলোড়ন ও বিক্ষোভ উপস্থিত হত যে, কিছুতেই লেখাপড়ায় মন বসাতে পারতুম না। আমার ছোট ভাই অস্থিরের বুদ্ধি খুবই তীক্ষ্ণ ছিল। প্রতিবৎসর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সে প্রাইজ পেত, আর আমি অতি কষ্টে কখনও প্রমোশন পেতুম, কখনও-বা পেতুম না। আমাকে সাজা দেবার জন্যে ইস্কুলের শিক্ষয়িত্রীরা একটা নতুন খেলা আবিষ্কার করেছিলেন। কোনো প্রশ্নের ঠিকমতো উত্তর দিতে না পারলে তাঁরা নীচের ক্লাস থেকে অস্থিরকে ডেকে এনে তার মুখ দিয়ে সঠিক উত্তরটা আমায় শুনিয়ে দিতেন। অস্থিরকে আমি খুব ভালোবাসতুম বলে তার ওপরে কিছু রাগ হত না বটে, কিন্তু মনে মনে ভারি অপমানিত বোধ করতুম।

অঙ্ক জিনিসটাকে দু-চক্ষে দেখতে পারতুম না। আমার মগজ এমন অদ্ভুত উপাদানে তৈরি ছিল যে, সংখ্যার রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারতুম না। মাস্টাররা বোঝাতে বোঝাতে শ্রান্ত হয়ে পড়লে না-বুঝেই বলে দিতুম, এবার বুঝতে পেরেছি।

এমনই করে আমার বিদ্যাশিক্ষা অগ্রসর হতে লাগল। আস্তে আস্তে লেখাপড়া থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগলুম। ইস্কুল ও ইস্কুলের পড়ার প্রতি সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে যেতে লাগল। আমি অনুভব করতুম, আমার চারপাশের সকলেই যেন অন্য জগতের লোক। আমার চেয়ে সকলেই শ্রেষ্ঠ ও সুখী, আমি যেন একটা সৃষ্টিছাড়া জীব। মনের মধ্যে নিজের রাজ্য তৈরি করতুম বটে, কিন্তু সেখানে রাজত্ব করতে পারতুম না। কারণ সেখানে এমন কিছু পেতুম না, যা নিয়ে জীবন কাটানো যেতে পারে। এই মানসিক একাকিত্ব মাঝে মাঝে আমাকে এমন পীড়া দিত যে, কতদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে কেঁদেছি–কতদিন স্বপ্নে কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে গেছে তার ঠিকানা নেই।

আমার বাবার কাঠের আসবাবপত্র কেনবার বাতিক ছিল। পুরনো চেয়ার টেবিল আলমারি বেঞ্চি সস্তায় পেলেই কিনে ফেলতেন, তা সে জিনিসের দরকার থাক আর নাই থাক। এ সম্বন্ধে মার যতই আপত্তি থাকুক, তাঁর যুক্তি ছিল এই যে, চিরকাল তো আর এমন অবস্থা থাকবে না। অবস্থা ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন বড় বাড়ি হবে, তখুনি সমস্ত ঘরের আসবাবপত্র কোথায় পাওয়া যাবে? সেজন্য আস্তে আস্তে সেগুলো এখন থেকে জোগাড় করে রাখাই হচ্ছে বুদ্ধিমান গৃহস্থের কর্তব্য।

ভবিষ্যৎ-সুদিন-সম্ভাবনার রঙিন ফানুসে চড়ে যারা বর্তমান দুর্দিনের তহবিলে অনধিকার-প্রবেশ করেছে, তাদের ওপরে মা মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। সেইজন্য এইসব কাঠের আসবাবগুলো একতলায় একটা অন্ধকার ঘরে অনাদৃত অবস্থায় পড়ে থাকত। অন্যান্য আরও অপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে এই ঘরে কতকগুলো বড় টিনের বাক্সও থাকত। বাক্সগুলোর মধ্যে যে কি রত্ন ভরা আছে, তা জানবার কৌতূহলও আমাদের কোনোদিন হয়নি। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দুপুরবেলায় এই বাক্সগুলো খুলে দেখলুম, দুটি বাক্স একেবারে বইয়ে ভরা। ওপরেই একখানা ছোট্ট বই ছিল, সেখানা তুলে দেখলুম–কবিতার বই। নাম–’ফুলের মালা’।

‘ফুলের মালা’ কার কাব্য, তা আজ মনে নেই। অবিশ্যি মনে রাখবার মতো কবিতাও তাতে ছিল না। তবুও আমাদের যেসব কবিতা ইস্কুলে পড়া হত ফুলের মালা’র কবিতা তার চেয়ে ভালো লাগল। পরের দিন লোভে লোভে নির্জন দুপুরে সেই ঘরে হানা দিয়ে আবার বাক্স খুললুম। এই দিন রত্ন আবিষ্কার করলুম। এই বাক্সের মধ্যে থেকে বার করলুম বৃঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’ প্রথম সংস্করণ, রমেশ দত্তের ‘মাধবীকঙ্কণ’, আর একখানা উপন্যাস-নাম তার ‘পল্লীগ্রাম’, পাতা ছেঁড়া থাকায় লেখকের নাম পাইনি। অবনীন্দ্রনাথের একখানা ‘ক্ষীরের পুতুল’, মাইকেল ও হেমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও শশিশেখরের ছেঁড়া কবিতা-সংগ্রহের বই।

কবিতার প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকায় কবিতার বইগুলো আগে পড়তে আরম্ভ করে দিলুম। যদিও সে বয়সে কবিতার সম্পূর্ণ রস অনুভব করা সম্ভব নয়, তবুও আমার রসানুভূতি হয়েছিল–এ কথা জোর করে বলতে পারি।

সেই আমার নিঃসঙ্গ একক মানস-জীবন হঠাৎ একটা নতুন চেতনায় সচকিত হয়ে উঠল। অতি দুঃখময় দৈনিক ব্যবহারিক জীবনকে অতিক্রম করে আমি একটা আনন্দময় রাজ্যে প্রবেশ করলুম। তার তুলনায় ইস্কুলের শাস্তি, বাবার প্রহার ও অন্যান্য কঠোর নিয়ম, যা দিয়ে আমাদের দেহ-মনকে সংযত করবার চেষ্টা করা হত, তা অতি হীন ও অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হতে লাগল। কোথাও কিছু কষ্ট পেলে তখুনি আমার মনে হত এই কবিতার বইগুলোর কথা, কষ্টের কথা আর মনে থাকত না। কতদিন কত দুঃখে যে আমায় সান্ত্বনা দিয়েছে এই কাব্যগুলি, তার আর শেষ নেই। তারা না থাকলে আমি যে কি করতুম, তা আজ ভেবে পাই না।

সেই বাল্যকাল থেকে আজ অবধি এই কাব্যলক্ষ্মীই আমার উপাস্য। পাছে আমার মানসীর মর্যাদা রক্ষা করতে না পারি, সেজন্য কবিতা লেখবার চেষ্টা কখনও করিনি। আমার অন্তরের অক্ষয় কাব্যকুঞ্জে নিরন্তর যে কবিতা-কুসুম ফোটে, অতি সন্তর্পণে সেগুলি চয়ন করে কাব্যলক্ষ্মীর চরণে নিবেদন করি। সে ফুল দিয়ে মালা গাঁথবার সাহস হয় না, পাছে অনিপুণ সূচীর আঘাতে তারা ম্লান হয়ে যায়।

তার পরে ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘মাধবীকঙ্কণ’ আমার সে রাজত্বের মধ্যে সমারোহ এনে দিলে। কখনও গঙ্গার অগাধ জলে শৈবলিনীর সঙ্গে সাঁতার কাটি আর বলি, শৈবলিনী সই!

শৈবলিনীর অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ শুনতে পাই–প্রতাপ, আজি এ মরা গঙ্গায় চাঁদের আলো কেন?

–চাঁদের না সই, সূর্য উঠিয়াছে–

আবার কখনও চলে যাই রাজপুতানার মরূদ্যানে একলিঙ্গের মন্দিরে, সুন্দরী জ্বলেখ আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে, কখনও বা হেমলতার করুণ অনুনয় কানে এসে বাজতে থাকে–নরেন্দ্র, ওটি উন্মোচন কর। চণ্ডীদাসের শ্রীমতী থেকে আরম্ভ করে জ্বলেখ অবধি সকলকেই ভালোবাসি,–কারুকে ছাড়তে পারি না, সবাই আমার প্রিয়তমা।

কাব্যের রাজত্বে এসে আমি যেন বেঁচে গেলুম। বাঁদরের কিচিমিচিকে ইংরেজিতে কি বলে তা শিখতে পারলুম না বটে, কিন্তু কত লোকের, কত দেশের, মানব-হৃদয়ের কত বিচিত্ৰ অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হতে লাগল, যার তুলনায় ইস্কুলের পড়া অতি তুচ্ছ মনে হতে লাগল।

এই বইগুলি ছিল আমার মার। কেমন ভাবে কি করে তিনি এগুলিকে সংগ্রহ করেছিলেন, তা জানি না। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের ওপরেই এগুলিকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি।

উত্তরকালে নিজে বহু অর্থব্যয়ে অনেক বই কিনেছি। ধ্বংসের দূতেরা নানা মূর্তিতে এসে তাদের নষ্ট করে দিয়েছে, তার জন্যে মনে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু শৈশবে সেই আলো-আবছায়াপূর্ণ ঘরের একটি কোণে একদিন যাদের সঙ্গে আমার হঠাৎ পরিচয় হয়েছিল, যাদের সঙ্গীত আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে প্রথম ঝঙ্কার জাগিয়ে তুলেছিল, আজ বিদায়বেলায় তাদের স্মৃতি আমাকে আকুল করে তোলে।

.

একবার, তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। ইস্কুল পুরনো হয়ে গিয়েছে। সেখানকার শাস্তি-টাস্তিগুলোও ধাতস্থ হয়ে এসেছে। সত্য-মিথ্যাতে ভেদাভেদ প্রায় ঘুচে গিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের আরও কয়েকখানা উপন্যাস শেষ করে ফেলেছি। কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাওয়ানো বঙ্কিমচন্দ্রের উচিত হয়েছে কি না, তাই নিয়ে প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে গোপনে আলোচনাও হয়। আমার এই বন্ধুটির নাম প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। প্রভাত হচ্ছে বিখ্যাত ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘ভারতসভা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র। আমার বয়েস তখন নয়, প্রভাত আমার চেয়ে আট-ন মাসের ছোট। কিন্তু এসব বিষয়ে সে আমারই মতন পরিপক্ক ছিল। সে যে সেই বয়সেই কত লোক ও বইয়ের নাম জানত, তা ভাবলে এখন বিস্মিত হই। প্রভাতের মা ছিলেন সে যুগের বিলেত-ফেরৎ ডাক্তার। এই সবের জন্যে সে-সময়ে তাদের বাড়িতে একটা উঁচু সংস্কৃতির আবহাওয়া ছিল। সে তাদের বাড়ি থেকে সব বই নিয়ে আসত, আর আমরা দুই বন্ধুতে লুকিয়ে এক জায়গায় বসে পড়তুম আর মশগুল হয়ে যেতুম।

দিনগুলি বেড়ে কাটছে, এই রকম একটা সময়ে একদিন ইস্কুলে গিয়ে খেলছি, এমন সময় একটি মেয়ে আমার কাছে এসে বললে, তুমি অমুকের যে তিন পয়সা নিয়েছ, দিয়ে দাও।

কি সর্বনাশ! চার বছর ইস্কুলে পড়েছি, এই চার বছরের মধ্যে আমার নামে সত্য-মিথ্যা সম্ভব-অসম্ভব অনেক রকমের অভিযোগই এসেছে, কিন্তু এটা একেবারেই নতুন।

আমি তো তার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম।

বললুম, আমি তো ওর পয়সা নিইনি।

নাওনি কিরকম! আমি নিজের চোখে দেখেছি, ওর খাতা থেকে তুমি পয়সা বের করে নিলে।

রেগে-মেগে বললুম, নিয়েছি তো নিয়েছি, বেশ করেছি। যাও, কি করবে কর গে।

ক্লাস বসামাত্র মেয়ে-দুটি গিয়ে শিক্ষয়িত্রীকে আমার নামে পয়সা-চুরির নালিশ করলে।

শিক্ষয়িত্রী আমাকে ডাকলেন। ইনি ছিলেন বিধবা, ঘাড়-ছাঁটা চুল। কথা একরকম চুষে চুষে উচ্চারণ করতেন, যা আজ পর্যন্ত কারুর মুখে শুনিনি। তাঁর মুখনিঃসৃত প্রতি বাক্যে দুটি ‘ভগবান’ ও তিনটি ‘ঈশ্বর’-এর উল্লেখ থাকত।

আমি পয়সা নিয়েছি কি না, সে কথা একবার জিজ্ঞাসা করবার প্রয়োজনও তিনি বোধ করলেন না। কাছে যেতেই শুরু করলেন, ঈশ্বর তোমার সুমতি দিন। স্থবির, আমি নিয়ত তোমার জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি, তিনি তোমাকে সুমতি দিন। সেদিন তুমি মিথ্যে কথা বলে ধরা পড়লে, আজ আবার চুরি করে ধরা পড়েছ। আমি দিব্যচক্ষে দেখছি, তোমার জন্য ফাঁসিকাঠ তৈরি হচ্ছে। চুরির পরেই নরহত্যা এবং নরহত্যার পরই ফাঁসি। আমাদের দেশে আগে এবং সেদিন পর্যন্তও বিলেতে চুরি করলে ফাঁসি হত। যাও, গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক, আর ওর পয়সা ফেরত দিয়ে দাও।

আমি বললুম, ওর পয়সা আমি নিইনি, ওর পয়সা কোথায় ছিল, তাও আমি জানি না। আমি ইস্কুলে এসে ক্লাসে বই রেখেই খেলতে চলে গিয়েছিলুম।

আমার নামে যে মেয়েটি নালিশ করেছিল, তার নাম করে শিক্ষয়িত্রী বললেন, অমুক কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারে না।

আমি বললুম, আমি পয়সা নিইনি।

শিক্ষয়িত্রী ছাড়লেন না। তিনি সমস্ত ঘণ্টা ধরে আমাকে নিয়ে সেই তিন পয়সা চুরি কবুল করাবার চেষ্টা করতে লাগলেন ও যার পয়সা তাকে ফেরত দেবার জন্যে জেদ করতে আরম্ভ করে দিলেন।

আমি পয়সা নিইনি তো ফেরত দোব কোথা থেকে? কাছে পয়সা ছিলও না, আমি পকেট দেখালুম।

কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। ঘণ্টা কাবার হয়ে যাওয়ায় অন্য একজন শিক্ষক এলেন পড়াতে। তিনি তাঁকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে চললেন বাইরে। ইস্কুলের এক নির্জন কোণে আমাকে নিয়ে গিয়ে কবুল করাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

ওই মহিলাটি ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ-ঘরের বিধবা। স্বামীটি বোধ হয় এঁরই জেরার ঠেলায় কিংবা অশেষ পুণ্যবলের অধিকারী হওয়ায় এঁর হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। অভাগার সে পুণ্যবল ছিল না বলেই এই কাহিনি লিখতে হচ্ছে।

চার ঘণ্টা ধরে সমানে সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি আমায় কবুল করাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। লন্ডনের বিখ্যাত ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে’ যেসব দুর্ধর্ষ বদমাশ কিছুতেই অপরাধ স্বীকার করে না, তাদের আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে এইভাবে কবুল করাবার চেষ্টা করা হয়। সাংঘাতিক চরিত্রের ঘাগী লোকেরা এই প্রণালীর চাপে কাবু হয়ে পড়ে। আমার ওপর চার ঘণ্টা এই ‘থার্ড ডিগ্রি’ প্রয়োগ করার পর স্রেফ তাঁর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে বলে ফেললুম, হ্যাঁ নিয়েছি।

এ পয়সা কিন্তু আমি নিইনি। তার অস্তিত্ব ও লয় সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞান তখনও ছিল না, আজও নেই।

রুশোর মতো আমিও বলতে পারি, মহাবিচারের পরমক্ষণে এই জাতক আমি ঈশ্বরের সামনে ফেলে দিয়ে বলব, হে, সৃষ্টিকর্তা, এর মধ্যে কার্যে কিংবা মনে কোনো মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি কি না, তা তুমি জান। কিন্তু রুশোর ধর্মশাস্ত্রে মহাবিচারের দিন আছে, আমার ধর্মে তা নেই। সে আমার প্রাপ্য কর্মফল। আমাকে যারা লাঞ্ছিত করেছিল, তাদের জন্যে সেই ফল তোলা রইল।

আমার কবুলতি শুনে তাঁর মুখে সে কি খুশির হাসি! সে হাসি এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে। তিনি বললেন, আজ বাড়ি যাও। কাল তিনটে পয়সা এনে ওকে দিয়ে দিয়ো।

সমস্ত দিন মনের ওপর এই অত্যাচারে আমি একেবারে ঝিমিয়ে পড়লুম। বাড়িতে এসে কোনোরকমে নাকে-মুখে চাট্টি গুঁজে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম কাব্যলক্ষ্মীর পায়ে।

কবিতার পর কবিতা পড়ি আর কাঁদতে থাকি। এমন সময় অস্থির এসে জিজ্ঞাসা করলে, কি হয়েছে রে?

অস্থিরকে সব বললুম। সে বেচারি কি করবে! আমার গা ঘেঁষে চুপ করে বসে রইল।

পরের দিন ইস্কুলে যেতেই শিক্ষয়িত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, পয়সা এনেছ?

পয়সা আনিনি শুনে তিনি আমাকে সব ঘণ্টা অর্থাৎ এগারোটা থেকে সাড়ে তিনটে অবধি দাঁড়িয়ে থাকবার হুকুম দিলেন। সে দিনটা ইস্কুলে সমস্তক্ষণ দাঁড়িয়েই কাটল।

পরের দিনও পয়সা নিয়ে যেতে পারলুম না। ইস্কুলময় চোর বদনাম হয়ে গিয়েছে, সেজন্যে আগে না গিয়ে ইস্কুল বসবার পর ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত হলুম। ক্লাসে উপস্থিত হতে-না-হতে শিক্ষয়িত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, পয়সা এনেছ?

পয়সা আনিনি শুনে তিনি আমায় সারাদিন বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবার হুকুম দিলেন। অস্থিরের সঙ্গে রোজই পরামর্শ করি, কি করে তিনটে পয়সা জোগাড় করা যায়! মার কাছে চাইলে তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করবেন। ইদানীং দাদা একদিন ‘বার্ডসাই’ খেয়ে ধরা পড়ায় বাবা কড়া হুকুম দিয়েছিলেন, আমাদের হাতে পয়সা যেন না দেওয়া হয়। বাবার কাছে পয়সা চাওয়া মানে স্বেচ্ছায় আকাশের বজ্রকে মাথার ওপরে নিয়ে আসা। দাদা তখন মুরুব্বি হয়ে গিয়েছে, তাকেও কিছু বলতে পারি না। ইস্কুলময় ছোট-বড় সকলের কাছেই চোর বদনাম হয়ে গিয়েছে। সেখানে গেলেই নিত্য নতুন অত্যাচার। একদিন শিক্ষয়িত্রী আমাকে বললেন, কাল পয়সা না নিয়ে এলে তোমাকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

ইস্কুলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে বাড়তে আমার মনের অবস্থা এমন হয়ে উঠল যে, সেদিন বাড়িতে এসে ঠিক করে ফেললুম, কাল ইস্কুল থেকে বাড়িতে না ফিরে হেদোয় গিয়ে লাফিয়ে পড়ব। মনের এই সংকল্প অস্থিরকে: পর্যন্ত জানালুম না, কি জানি সে যদি কান্নাকাটি করে!

কিন্তু তেতলার ছাত থেকে পড়বার সময় যে নিজের দেহ দিয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছিল, অগাধ জলে ঢেউ হয়ে আমার দেহকে দোলা দিতে দিতে যে আমায় অকূল থেকে কূলে এনে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গিয়েছিল, এবারেও সে অভাবনীয়রূপে আমাকে নিশ্চিত মরণ থেকে বাঁচিয়ে দিলে।

পরের দিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই শুনতে পেলুম, আমাদের চাকরটার এক চুরি ধরা পড়ায় মা খুব বকাবকি শুরু করেছেন। আমি সেখানে যেতেই মা চাকরকে বললেন, আজ থেকে আর তোমাকে বাজারে যেতে হবে না।

চা খেতে খেতে মা বললেন, স্থরে, আজ তুই বাজারে যেতে পারবি?

আচ্ছা মা।

আমার গলা থেকে অত্যন্ত ক্ষীণ আওয়াজ বেরুল। কাল সারা রাত ভালো করে ঘুমুতে পারিনি। ইস্কুল থেকে তাড়িত হওয়া ও তার পরে হেদোয় লাফ খাওয়া, এইসব চিন্তায় মন একেই দমে ছিল, তার ওপরে শোবার আগে মাইকেলের ‘আত্মবিলাপ’ অন্তত পঁচিশ বার পড়া হয়েছে। মাথার মধ্যে পাগলের করুণ কান্না চলেছে– ‘জীবন প্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায় ফিরাব কেমনে।’ নিরাশায় দেহ-মন অবসন্ন, কথাবার্তা বলতে আর ভালো লাগছিল না।

মা আমার মুখের দিকে চেয়েই বললেন, কি রে, তোর অসুখ করেছে নাকি? দেখি, এদিকে আয় তো।

কাছে যেতেই মা মুখে বুকে হাত দিয়ে দেখে বললেন, কই না, গা তো হিম!

তারপর আমার মুখের দিকে স্নেহসিক্ত নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আমায় জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, মাঝে মাঝে তোর কি হয় বল তো, কি ভাবিস?

মার কাছ থেকে এমন আদর অনেক দিন পাইনি। ঠিক সেইতালে তিন পয়সা কেন, হয়তো তাঁর কাছ থেকে তিন আনা আদায় করে নিতে পারতুম। কিন্তু সেই মুহূর্তটা আমার মনে এমন একটা অনির্বচনীয় আনন্দের আভাস নিয়ে এল যে, পয়সা চাওয়ার কথা মনেই এল না। উদ্‌গত অশ্রুকে প্রাণপণে রুদ্ধ করে গায়ের জোরে মাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বললুম, আমার সঙ্গে অস্থিরও যাবে মা বাজারে?

মা বললেন, বেশ তো, দু-ভায়ে যা।

পড়াশুনো তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলা গেল।

বাজারে কি কি জিনিস কিনতে হবে, তারই একটা ফিরিস্তি লিখে হিসেব করে মা পয়সা দিলেন।

বাজারের দিকে চলতে চলতে অস্থির বললে, স্থবরে!

কি রে?

কিছু ভাবিসনি। তিন-পয়সা যোগাড় করে ফেলেছি।

কোত্থেকে রে?

দেখ না তুই।

বাজারে ঢোকবার আগেই অস্থির দু-পয়সার ফলসা কিনে ফেললে। তার অর্ধেক আমাকে দিয়ে বাকি অর্ধেক নিজে খেতে আরম্ভ করে দিলে।

অস্থিরের অসমসাহসিকতা দেখে বিস্ময় ও আনন্দে মন ভরে উঠতে লাগল। তারপরে সমস্ত বাজার শেষ করে হিসাব নিয়ে দেখা গেল, পাঁচটি পয়সা লাভ হয়েছে। দু-পয়সা আগেই ফলসা খাওয়া হয়েছে, তিনটি পয়সা আমায় দিয়ে সে বললে, দিয়ে দিস ইস্কুলে।

সে যাত্রা বেঁচে গেলুম। শুধু তাই নয়, সেই দিন থেকে অনেক দিন পর্যন্ত আমরা দু-ভায়ে চাকরবাকর দিয়ে বাজার করানোর ঘোর বিরোধিতা করেছি। আমাদের চাইতে চাকরেরা ঢের সস্তায় ঢের ভালো জিনিস আনতে পারে, তা হাতে হাতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বাজার করবার গুরু কর্তব্যভার দুই ভাই নির্বিকারচিত্তে বহন করেছি।

এই সূত্রে আর একটি দিনের কথা মনে পড়েছে। তখন ইউরোপে সবেমাত্র মহাসমর শুরু হয়েছে। একদিন শুনলুম, আমাদের একটি চেনা ছেলে ‘অ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ নাম লিখিয়েছে। খবরটা সত্য কি না জানবার জন্যে এক রবিবারে সকালবেলা তাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছি, এমন সময় নারীকণ্ঠের আহ্বান শুনতে পেলুম, স্থবিরবাবু, স্থবির, ওরে স্বরে, শুনছিস? ওরে, শুনতে পেলি?

যে বাড়ি থেকে ডাক আসছিল, সে আমার চেনা বাড়ি হলেও এমন করে ডাকবার সেখানে কেউ থাকত না। আমি খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়েছিলুম, ফিরে এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে খুঁজছি, এমন সময় একতলার জানলার গরাদে মুখ দিয়ে একটি নারী বললে, কি রে, এই যে আমি, ভেতরে আয়।

আমি রকের ওপরে উঠে জানলার কাছে গিয়ে দেখলুম, সে সুবর্ণ। এরই পয়সা-চুরির মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে একদিন আমাকে নাজেহাল হতে হয়েছিল।

আমি কাছে যেতেই সে চিৎকার করে বলতে লাগল, কি রে, আমায় চিনতে পারছিস না? আমি সুবর্ণ। তুই স্থবির তো, কেমন আছিস?

বললুম, ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?

এই ভাই, আমাকে এরা দরজা বন্ধ করে রেখে দিয়েছে, খেতে দেয় না। রোজ মারে আমাকে। তুই ভেতরে আয় না, অনেক কথা আছে।

সুবর্ণর কণ্ঠস্বরের উচ্চতা ও কথাবার্তার হালচাল দেখে বেশ বুঝতে পারলুম, তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। যে বাড়ির ঘরে সে ছিল, তারা আমার পরিচিত লোক, তাদের সঙ্গে সুবর্ণদের যে আত্মীয়তা আছে তাও আমি জানতুম। আমি রকে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলুম, কি করা যায়!

ভেতর থেকে সুবর্ণ চিৎকার করতে লাগল, কি দাঁড়িয়ে আছিস উল্লুকের মতো! ভেতরে আয়।

বাল্যসখীর এমন আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলুম না, বললুম, দাঁড়া, যাচ্ছি।

দরজা বন্ধ ছিল। কড়া নাড়তেই বাড়ির কর্তা এসে দরজা খুলে দিলেন। সুবর্ণ ওদিকে সমানে চেঁচিয়ে যেতে লাগল, ওদের সঙ্গে কথা বলিসনি, ওরা সব শত্রু, তুই সোজা ভেতরে চলে আয়।

আমি বললুম, সুবর্ণর সঙ্গে একবার দেখা করব।

তিনি আমাকে ইশারায় জানালেন যে, সুবর্ণর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

তা হোক। আমার ভয় নেই, আমরা ছেলেবেলায় একসঙ্গে পড়েছি, আমায় কিছু বলবে না।

কর্তা ভালোমানুষ। চাবি নিয়ে এসে সুবর্ণের দরজার তালা খুলে চাবিটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, যাবার সময় দরজায় তালা দিয়ে চাবিটি ভেতরে দিয়ে যেয়ো।

আমি ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সুবর্ণ দরজায় খিল লাগিয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, ওখানে বোস।

বসতে বসতে বললুম, রল, কি বলবি? ডাকছিলি কেন?

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার চাউনি দেখে আমার ভয় হতে লাগল। মনে হল, পাগলের ঘরে বাহাদুরি করে ঢুকে একটা হাঙ্গামায় পড়লুম নাকি?

সুবর্ণ বললে, এরা আমার কি দুর্দশা করেছে, দেখেছিস?

তার কথার মধ্যে উন্মত্ততার লেশমাত্র ছিল না। ছেলেবেলায় দেখতে সে সুন্দরই ছিল। রঙ ছিল বেশ ফরসা, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল। বাপের অবস্থা বেশ ভালো। একটু খামখেয়ালি ছিল বটে, তবে আমরা সেটা বড়লোকী চাল বলে মনে করতুম। তার সেই রঙ মলিন হয়ে গেছে, মাথায় চুল রুক্ষ, স্নানাভাবে প্রায় জটা বেঁধে গেছে। তাকে দেখে আমার দুঃখ হতে লাগল। পনেরো-ষোলো বছর আগের ইস্কুলের জীবন মনের মধ্যে ঝকমক করে উঠল। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমার জীবনে কত অভিজ্ঞতা, কত দুঃখ বিপদ এসেছে, আমি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত আছি। আমার বাল্য সঙ্গী ও সঙ্গিনীদের কথা তো কখনও মনে হয় নি! তারা কি সকলে সুখে আছে?

সুবর্ণ বলে যেতে লাগল, রাশি রাশি অভিযোগ। তাকে খেতে দেওয়া হয় না, পরতে দেওয়া হয় না, এমনকি তাকে বিয়ে পর্যন্ত করতে দেয় না।

একটু রসিকতা করবার প্রলোভন সামলাতে পারলুম না। বললুম, বিয়ে করিসনি সুবর্ণ। দেখছিস না, আমিও বিয়ে করিনি।

সুবর্ণ বললে, তোকে আর কে বিয়ে করবে বল?

একটা জিনিস আমি বরাবর লক্ষ করেছি যে, মস্তিষ্কবিকৃতি না ঘটলে লৌকিকতার কোনো মর্যাদা না রেখে বেপরোয়াভাবে সত্য প্রকাশের ক্ষমতা হয় না।

সুবর্ণ বললে, তুই আমায় উদ্ধার করে নিয়ে চল।

বললুম, আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবি?

না, কারুর বাড়িতে থাকব না।

তবে?

আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া কর। একটা ঠাকুর ও একটা ঝি থাকবে। আর কেউ না। সে যা হিসাব দিলে, তাতে মাসে তখনকার দিনে দু’শো টাকার কম হবে না। বললুম, কিন্তু আমি অত টাকা পাব কোথায়? আমি সামান্য রোজগার করি। তোর অত খরচ চালাব কি করে?

সুবর্ণ জিজ্ঞাসা করলে, তুই কত টাকা রোজগার করিস?

তখন আমি চৌরঙ্গীর একটা দোকানে ফুটবল পাম্প করি, খদ্দেরদের পায়ে ফুটবলের জুতো পরানো ও ফিতে বাঁধবার চাকরি। সকাল সাড়ে নটা থেকে রাত আটটা অবধি এই কাজ করি। মাইনে ত্রিশ টাকা। সাহেব খদ্দের বলে কোটপ্যান্ট পরতে হয়, তার খরচ মাসে পনেরো টাকা, ট্রামের খরচ পাঁচ টাকা আর দশ টাকা সিগারেট-খরচ। খাওয়া-শোওয়া চলে বাপের হোটেলে। তবুও লৌকিকতা রক্ষার খাতিরে সুবর্ণকে বললুম, একশো টাকা মাইনে পাই।

সুবর্ণ বললে, মোটে একশো! তা হলে তো তোর বড় কষ্ট! আচ্ছা, তা হলে আমিই খরচ দোব, তুই আমায় নিয়ে চল। কত খরচ হবে?

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তোর কাছে কত টাকা আছে?

আমার কাছে অনেক টাকা আছে।

কথাটা বলেই সে দৌড়ে আমার কাছে চলে এল। আমি যে চেয়ারে বসে ছিলুম, ঠিক তার পাশেই ছোট চার-কোনা টেবিলের ওপরে একটা ছোট্ট হাতবাক্স ছিল। টপ করে সেটা তুলে নিয়ে সে খাটের ওপরে গিয়ে বসে বললে, আর একটু হলেই গিয়েছিল আর কি! তুই তো আবার চোর কিনা! মনে আছে, আমার পয়সা চুরি করেছিলি?

বিস্মৃতির প্রলেপে যে ক্ষত শুকিয়ে গিয়েছিল, এই অপ্রত্যাশিত আঘাতে আবার তা থেকে রক্তধারা ছুটল। মুহূর্তের মধ্যে মন আমার ফিরে গেল বাল্যের সেই অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতামণ্ডিত দিনগুলোর মধ্যে। সেদিনকার সেই অসহায় স্থবির শর্মার ওপর বর্তমান স্থবির শর্মার সহানুভূতি হতে লাগল।

সুবর্ণ জিজ্ঞাসা করলে, কি রে, রাগ করলি? তুই কাঁদছিস বুঝি?

না, কাঁদছি না, কিন্তু সেই যে তোর তিন পয়সা-আমি নিইনি।

তবে কে নিলে?

তা আমি জানি না। তবুও তোরা মিছিমিছি চোর বদনাম দিয়ে আমাকে কি নাকাল করেছিলি, মনে আছে?

সুবর্ণ হো-হো করে হেসে উঠল। একেবারে পাগলের হাসি।

মনে পড়ল, সুবর্ণ তো পাগল হয়ে গিয়েছে, তবে আর তার সঙ্গে এসব আলোচনায় লাভ কি?

সুবর্ণ বললে, তুই নিজেই তো স্বীকার করেছিলি যে, পয়সা তুই নিয়েছিস।

সে তোদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। আর আমি তো তোকে তিনটে পয়সা দিয়ে দিয়েছিলুম। কেন, সে কথাটি মনে নেই বুঝি?

মনে আছে।–বলেই সুবর্ণ বাক্সটা খুলে তিনটে পয়সা বের করে আমার কাছে এসে বললে, নে তোর পয়সা।

রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল। সুবর্ণর হাতখানা দৃঢ়ভাবে সরিয়ে দিয়ে বললুম, যা যা,

যে পয়সা দিয়ে দিয়েছি, তা ফিরিয়ে নিয়ে কালীঘাটের কুকুর হতে চাই না।

সুবর্ণ স্থির হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর অতি করুণ সুরে বললে, তবে?

আমার রাগ তখনও যায়নি। মুখ তুলে বললুম, তবে কি?

তবে তুই এখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবি নি?

দেখলুম, তার দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে।

আহা! পাগলের চোখে জল যে দেখেছে, সেই জানে। বললুম, না রে না, আমি এতক্ষণ চালাকি করছিলুম। দেখ না, ঠিক তোকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব। বাড়িটা আগে ঠিক করি।

সুবর্ণ ফিসফিস করে বললে, তা হলে রাত্রিবেলা এসে চুপিচুপি ওই জানলায় আমায় ডাকবি, আমি পালিয়ে যাব। চাবিটা তোর কাছে আছে তো?

পরদিন থেকে এক নতুন খেলা শুরু হল। রোজ রাত্রি আটটা-নটার সময় একবার সুবর্ণর জানলায় গিয়ে তাকে বলে আসতে লাগলুম, বাড়ি ঠিক হয়ে গিয়েছে, কাল আসবাবের অর্ডার দোব, ভালো রাঁধবার লোক পাচ্ছি না, ইত্যাদি।

আমাদের উদ্ধার-উদ্ধার খেলা যখন বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় উদ্ধারের পরমকর্তা একদিন এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে চলে গেল।

কথা দিয়ে সুবর্ণকে উদ্ধার করতে পারিনি, এবারের যাত্রায় তার কাছে অপরাধীই হয়ে রইলুম।

.

প্রতি বছরের শেষে ইস্কুল থেকে দু-চারটি করে ছেলের বয়স হয়ে যাওয়ার জন্যে ছেলেদের ইস্কুলে চলে যেত। এদের অভাবে দুঃখ হত বটে, তবুও নিজের জীবনের এই দিনটিকে অত্যন্ত আকুলভাবে ধ্যান করতুম। দাদা বলত, ছেলেদের ইস্কুলে না এলে হাতের জল শুদ্ধ হয় না।

.

ভাবতুম, কবে সেদিন আসবে, কবে হাতের জল শুদ্ধ হবে!

ছ’বছর পরে একদিন সেই শুভমুহূর্ত এল। ‘ট্রান্সফার’ নিয়ে আসবার জন্যে বাবা হেডমাস্টারকে চিঠি দিলেন। মাস্টারমশাইয়ের হাতে চিঠি দিয়ে ইস্কুলের প্রত্যেক ঘরে, প্রতি আনাচে-কানাচে, প্রত্যেক বড় বড় গাছের কাছে গিয়ে বিদায় জানালুম। শেষকালে এক জায়গায় এক কোণে গিয়ে বসে রইলুম। এইখানে বসে আমি ও প্রভাত প্রায়ই কাব্যচর্চা করতুম। সে মাস ছয়েক আগেই অন্য ইস্কুলে চলে গিয়েছিল।

সেখানে বসে বসে ছ’বছর ইস্কুল-জীবনের কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার ছবি মনের মধ্যে ফুটে উঠতে লাগল। এখানে দুঃখ পেয়েছি বটে, কিন্তু সুখও পেয়েছি কম নয়। আস্তে আস্তে উঠে দেওয়ালের গায়ে পেনসিল দিয়ে লিখলুম–

হে ইস্কুল, তোমায় জন্মের মতো ছাড়িলাম। বন্ধুকে মনে রেখো ভাই। ইতি––স্থবির। নামটা লেখা তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় একজনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলুম, এই, ওখানে কি লিখছিস?

মুখ ফিরিয়ে দেখলুম, সুলতা।

সুলতা সুন্দর দেখতে ছিল। আমার চেয়ে বছর দুয়ের বড় হবে। ছ’বছর আমরা একসঙ্গে পড়েছি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে খুব বেশি ঝগড়া বা খুব বেশি ভাব কখনও হয়নি। তার কাছে আমি ছিলুম ক্লাসের একটা ছেলে, সেও আমার কাছে প্রায় তাই ছিল বটে, তবে কাব্যচর্চার সময় কল্পনায় কদাচিৎ তার সুন্দর মুখ যে আমার মনে ছায়া ফেলত না, এমন কথা হলপ করে বলতে পারি না। কারণ ইস্কুলের ছোট-বড় সব সুন্দর মুখই আমার কল্পলোকে সাজানো থাকত স্তরে স্তরে, যখন যাকে খুশি তাকে নিয়ে কল্পনার পাখায় চড়ে চলে যেতুম রামধনুর দেশে।

সুলতা বোধ হয় মনে করেছিল, ইস্কুলের দেওয়ালে আমি কোনো খারাপ কথা কিংবা কোনো শত্রুর উদ্দেশে গালাগালি লিখছি। কঠিন মুখ করে এগিয়ে এসে সে লেখাটা পড়তে লাগল।

লেখা পড়েই তার মুখ একেবারে নরম হয়ে গেল। সে বললে, তুই বুঝি ইস্কুল ছেড়ে দিচ্ছিস?

হ্যাঁ।

সত্যি ভাই, এতদিন এক জায়গায় বেশ ছিলুম। কোথায় চলে যাবি, আর বোধ হয় আমাদের কথা মনেও থাকবে না।

সুলতা আমাকে যা বললে এবং যে ভাবে বললে, কোনো বড় মেয়ের মুখে এর আগে আর শুনিনি। বড় মেয়ে মানে তার বয়স তখন বছর তেরো কি চোদ্দ হবে। কথাগুলো আমার কানে যেন মধুবর্ষণ করলে।

সুলতার কথার কি জবাব দোব, তা বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। তখন আমরা মাইকেল হেম নবীন বঙ্কিমচন্দ্র রমেশ দত্ত, হরিদাসের গুপ্তকথা, মেরী প্রাইস ও বৈষ্ণব কবিদের ‘অথরিটি’। মনের মধ্যে কাব্যসমুদ্র থইথই করছে।

সুলতাকে বললুম, তোমাদের কখনও ভুলব না। সেই ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে যে আনন্দে এতদিন কাটল, তা কি ভোলবার? আমি ভুলব না, কিন্তু তোমরা বোধ হয় ভুলে যাবে আমাকে।

সুলতার চোখে ততক্ষণে জল এসে গেছে। আবেগে সে আমার একখানা হাত ধরে বললে, আমি তোকে কক্ষনো ভুলব না, তুই আমাকে ভুলে যাবি।

আমি বললুম, কক্ষনো না, তোকে আমি কক্ষনো ভুলব না।

সুলতা বললে, ইস্কুল ছেড়ে দিচ্ছিস তো কি হয়েছে? কাল থেকে রোজ আমাদের বাড়ি আসবি। বল, আসবি?

বললুম, আসব।

প্রতিজ্ঞা কর।

প্রতিজ্ঞা।

প্রথম জ্ঞানের আলো যেখানে পেয়েছি, কত দুঃখ-আনন্দের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় আমার জীবন-নাট্যের প্রথম অঙ্ক যেখানে অভিনীত হয়েছে, সেই ইস্কুল, বিদায়, চির-বিদায়!

.

মেয়েদের ইস্কুল ছেড়ে আমি আর অস্থির ভর্তি হলুম ডফ সায়েবের ইস্কুলে। নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে যে থামওয়ালা বাড়িতে এখন জোড়াবাগান পুলিশ-ঘাঁটি হয়েছে, সেই বাড়িতে ছিল ডফ কলেজ। হেদোর ধারের জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন ও ডফ কলেজ মিলে হয়েছে এখনকার স্কটিশ চার্চ কলেজ।

আমাদের সমাজের এক ভদ্রলোক এখানকার শিক্ষক ছিলেন। এঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা থাকায় বাবা আমাদের ডফ ইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন।

মেয়েদের ইস্কুল থেকে এখানে এসে একেবারে হকচকিয়ে গেলুম। সেখানে যতই অত্যাচার হোক, তার মধ্যে কেমন একটা ঘরোয়া আবহাওয়া ছিল। এখানে তার ঠিক উল্টো। এখানে প্রকাণ্ড বাড়ি, বড় বড় ঘর, এক এক ক্লাসে একশো দেড়শো ছেলে। আর সে-সব কি ছেলে! খারাপ কথা আমরা দুটো-চারটে শিখেছিলুম, কিন্তু ন’মাসে ছ’মাসে অতি সন্তর্পণে বন্ধুমহল ছাড়া তা উচ্চারণ করতে সাহস হত না। এখানে দেখলুম, ছেলেরা দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে একতলার বন্ধুদের সঙ্গে সেই ভাষায় আলাপচারী করছে। তার ওপরে নানা মেজাজের মাস্টার, এক-একটি যেন যমদূত। ঠেঙিয়ে মেরে ফেললেও ‘আহা’ বলবার কেউ নেই।

দেখে-শুনে এমন ভড়কে গেলুম যে, মাস-দুয়েক মুখ দিয়ে আর বাক্যি বেরুল না। ইস্কুলে গিয়ে একটি কোণে চুপ করে বসে থাকতুম আর ছুটি হলে গুটিগুটি বাড়ি চলে আসতুম।

আমাদের সময়ে ইস্কুল একটা বিষম স্থান ছিল। মফস্‌সলের অনেক ইস্কুলের সুনাম তখন ছিল বটে, কিন্তু• সে সম্বন্ধে ‘ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার নেই। কলকাতার পাঁচ-ছটি ইস্কুলে বিদ্যাভ্যাস করবার সুযোগ আমার হয়েছে, এ সম্বন্ধে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে।

আজকাল যেমন ইস্কুলে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ হয়েছে তেমনই আমাদের সময়ে এক-একটি শ্রেণীকে ‘ক্লাস’ বলা হত। সর্বোচ্চ শ্রেণী ছিল ফার্স্ট ক্লাস’ ও ‘সর্বনিম্ন শ্রেণী ছিল নাইস্থ ক্লাস’। এই নবম শ্রেণী আবার A B C এই তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। অর্থাৎ যদি কোনো ছেলে নবম শ্রেণীর C বিভাগে ভর্তি হত, তা হলে তার প্রথম শ্রেণীতে আসতে এগারোটি বছর লাগত। এর মধ্যে আমরা শিখতুম কতকগুলো ইংরেজি কথার মানে, তৃতীয় শ্রেণীর কয়েকজন ইংরেজের বানানো জীবন-কথা, ইংল্যান্ডের ইতিহাসের খানিকটা, অর্ধেক মিথ্যে ও অর্ধেক ভুলে ভরা একখানা ভারতবর্ষের ইতিহাস, কিছু ভূগোল, ইউক্লিডের জ্যামিতির চার ভাগ, অ্যালজেব্রার কিছু, এরিথমেটিকের কিছু, বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্রের কয়েকটি গল্প। আমাদের সময়ে ছেলেদের ইস্কুলে বাংলা পড়ানো হত না বললেও অত্যুক্তি হয় না।

জীবনের এই এগারোটি বছর ছাত্রদের কি মাঠেই মারা যায়, তা বোঝবার মতন অবস্থাও এ শিক্ষায় হয় না। না হলে কবে এই নীতির প্রচলন বন্ধ হয়ে যেত। এই দশ-এগারো বছর সময়ের মধ্যে যে-কোনো ছেলে, যে-কোনো একটা বিশেষ বিদ্যা অনুশীলন করলে, সে বিষয়ে সে পণ্ডিত হয়ে যেতে পারে। অন্য যে-সব জ্ঞান না থাকলে সংসারে চলা অসম্ভব, সে শিক্ষা তারা কানে শুনে আয়ত্ত করতে পারে। মহামহোপাধ্যায় নৈয়ায়িক বা দার্শনিক যিনি–তিনি নিশ্চয় জানেন পৃথিবী গোল এবং হিসাবেও যে তাঁরা নিতান্ত কাঁচা নন, তার প্রমাণ দিলে বড় বড় অঙ্কশাস্ত্রবিদ্‌ লজ্জায় মাথা হেঁট করবেন।

কোথায় কোন দেশে জর্জ ওয়াশিংটন তার বাপকে কি সত্য কথা বলেছিল, নেসন নামক এক ইংরেজ বীর বালককালে তার ঠাকুরমার মুখের ওপর কি জ্যাঠামো করেছিল, তার সঠিক বিবরণে ভুল করলে এদেশের বালকদের পৃষ্ঠ বেত্রাঘাতে জর্জরিত হতে থাকল কোন ন্যায় বা যুক্তি অনুসারে? অথচ শঙ্কর, কুমারিল, কহুন বা বাচস্পতি মিশ্র কে ছিল জিজ্ঞাসা করলে দেশে হাহাকার উঠবে, এই বা কোন ন্যায় বা যুক্তি অনুসারে?

পরাধীনতা-কীট যে আমাদের জাতীয় জীবনের মূল জর্জরিত করেছে, কাকে দোষ দিই! জাতক শুরু করা যাক।-

মেয়েদের ইস্কুল যখন ছাড়ি, তখন দুঃখ হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পেছনে একটু আনন্দ ও ছিল–এতদিন বাদে হাতের জল শুদ্ধ হবে, আর কেউ বলতে পারবে না যে, ছেলেটা মেয়েদের স্কুলে পড়ে। নিঃসঙ্কোচে বলতে পারব, ডফ কলেজে পড়ি। কিন্তু এখানে এসেই বুঝতে পারলুম, সে ইস্কুল ঢের ভালো ছিল। যদিও এখানে পড়াশুনার বালাই মোটেই ছিল না, সেদিক দিয়ে একেবারে নিরঙ্কুশ ছিলুম বললেই হয়।

আমাদের ক্লাসে ছিল একশোর চেয়ে বেশি ছেলে। সকলের পড়া নেওয়া রোজ সম্ভব হত না, পঁচিশ-ত্রিশজনের পড়া হতে না হতেই ঘণ্টা কাবার হয়ে যেত। পাঁচ ঘণ্টায় পাঁচজন মাস্টার আসতেন, তাঁদের এক এক জনের মেজাজ এক এক রকমের। এঁদের দু-একজন মধ্যে মধ্যে এমন সব কথা বলতেন, যা শিক্ষক তো দূরের কথা, সেরকম অসভ্য কথা, এ পর্যন্ত আমার শ্রুতিগোচর হয়নি। কথায় কথায় বেত্রাঘাত এবং মাঝে মাঝে ক্লাসসুদ্ধ ছেলেকে পাইকারি হিসাবে ঠেঙানো হত–সে ঘণ্টায় শুধু হুল্লোড়, পড়াশুনা কিছুই হত না। এর ওপরে আবার সপ্তাহে দু-তিন দিন করে আসতেন টমরী সায়েব। এই টমরীর পুরো নাম ছিল অ্যালেকজান্ডার টমরী। লোকটা জাত্যংশে বোধ হয় ইহুদী ছিলেন, কিন্তু বিলিতি। বেঁটেসেঁটে দেখতে, দু-গালে গালপাট্টা। এ ব্যক্তি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ ছিলেন। ডফ কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা ছিল তাঁর ব্যবসা। টমরী ক্লাসে ঢুকেই বাংলাভাষায় জিজ্ঞাসা করতেন, মাস্টার মহাশয়, কোনো বদমাশ ছেলে আছে, যাকে বেত্রাঘাত করা প্রয়োজন?

সেই মাস্টারের যে যে ছেলের ওপর রাগ থাকত, তাকে তাকে সায়েবের সঙ্গে যেতে হত। টমরী এইরকম ক্লাসে ঘুরে ছেলে জোগাড় করে নিয়ে হলঘরে গিয়ে তাদের বেত্রাঘাত করতেন। তাদের চিৎকার ক্লাসে বসে শুনতুম আর আমাদের অঙ্গে কালঘাম ছুটত।

ইস্কুলের ছাত্ররা প্রায় সকলেই টমরীকে যমের মতন ভয় করত! এখানকার অন্যান্য প্রত্যেক শিক্ষকই, এমনকি যিনি বাইবেল পড়াতেন তিনি পর্যন্ত, টমরী সায়েবের এক-একটি ছোট সংস্করণ ছিলেন। আর টমরীর অবতার যিনি ছিলেন, তিনিই হচ্ছেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু–যিনি আমাদের সেখানে ভর্তি করিয়েছিলেন। এখানেও কাঞ্চন-কৌলীন্য প্রথা খুবই প্রবল ছিল। আমাদের সঙ্গে কলকাতার নামজাদা বড়লোক-ঘরের দশ-বারোটি ছেলে পড়ত! এরা মাস্টারদের মুখের ওপরেই বলত, টমরী সায়েব একবার আমাকে মেরে দেখুক না, কত বড় বাপের ব্যাটা একেবারে বুঝিয়ে দোব।

বেশ বোঝা যেত, শিক্ষকরা তাদের কথা শুনেও শুনতেন না।

আমাদের এই পারিবারিক বন্ধুটির নাম ছিল শ্যামবাবু। ইনি সারাদিন ক্লাসে ক্লাসে অর্থাৎ নিজের ক্লাস ছেড়ে অন্য মাস্টারদের ক্লাসে ছেলে ঠেঙিয়ে বেড়াতেন। এইরকম ঠেঙাতে ঠেঙাতে মধ্যে মধ্যে তাঁর খুন চেপে যেত। এঁর হাতে মার খাওয়ার ফলে অনেক ছেলেকে দু-চারজন বন্ধুর ওপরে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছি।

আমাদের ক্লাসে জ্ঞান ঘোষ আর সুরেশ্বর মুখুজ্জের মধ্যে একদিন টিফিনের ছুটির সময় মহা ঝগড়া বেধে গেল। তারা দুজনেই ছিল আহিরীটোলার ছেলে। আহিরীটোলার ছেলে বলতে কি বোঝায়, এখনকার লোকেদের কাছে সেটা পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন।

আমাদের ছেলেবেলায় নিজ কলকাতার শহর ও তার আশপাশের হুদ্দোর মধ্যে বোধ হয় ছয় লক্ষের বেশি লোক বাস করত না। নিজ শহর কতকগুলো পাড়ায় বিভক্ত ছিল। খানিকটা করে জায়গা নিয়ে হত এক-একটা পাড়া, যেমন– আহিরীটোলা, জোড়াসাঁকো, বাগবাজার, বেনেটোলা, নেবুতলা, চোরবাগান,ঝামাপুকুর, দর্জিপাড়া, কাঁসারীপাড়া, জানবাজার, শুঁড়িপাড়া, ঢুলিপাড়া, মুচিপাড়া, গড়পার ইত্যাদি। পাড়ার প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা ‘বাধ্যতামূলক’ সম্প্রীতি থাকত। এক পাড়ার লোক অন্য পাড়ায় গিয়ে প্রহৃত বা অপমানিত হলে সমস্ত পাড়ার লোক অপমানিত বোধ করত। এই নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা খুন-জখম পর্যন্ত প্রায়ই হতে থাকত। পাড়ার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখবার চেষ্টা যে না করত, পাড়ার মধ্যে সে ব্যক্তি প্রায় অপাঙ্ক্তেয় হত। প্রত্যেক পাড়াতেই একটা করে কুস্তি ও জিমন্যাস্টিকের আখড়া, থিয়েটারের একটি ক্লাব, আর যেখানে শৌখিন বড়লোক থাকত, সেখানে একটি শখের যাত্রার দল থাকত। একটি করে হরিভক্তিপ্রদায়িনী সভাও অনেক পাড়ায় ছিল। সে-সময় আহিরীটোলার খুবই নামডাক ছিল। শুনতুম, আহিরীটোলায় নাকি এমন পাঁচ-সাতজন আছে, যারা বেমালুম ছুরি মারতে পারে। বেমালুম ছুরি মারা মানে–ছুরি যখন মারা হবে, তখন কিছুই জানতে পারা যাবে না! মারামারির পর বাড়ি ফিরে গিয়ে টের পাওয়া যাবে। অনেকটা স্নান করতে গিয়ে হাঙরে পা কেটে নেওয়ার মতন।

জ্ঞান আর সুরেশ্বরে যখন ঝগড়া লাগল, তখন আহিরীটোলার অন্য যেসব ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত, তারা থামাবার চেষ্টা করলে। পাড়ার বদনাম হবে ভয় দেখানোতে সুরেশ্বর চুপ করে গেল, কিন্তু জ্ঞান তাকে শাসাতে লাগল, তোমায় এক্ষুনি মজা দেখিয়ে দিচ্ছি।

জ্ঞান ঘোষকে কেউ থামাতে পারলে না, সে সুরেশ্বরকে শাসাতে শাসাতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।

টিফিনের ছুটি শেষ হয়ে যাবার পর পণ্ডিতমশায় আমাদের সংস্কৃত পড়াচ্ছেন, এমন সময় শ্যামবাবু ক্লাসে ঢুকলেন, হাতে তাঁর আড়াই হাত লম্বা একখানা বেত, পেছনে জ্ঞান ঘোষ।

শ্যাম মাস্টার ঘরে ঢুকেই দাঁতে দাঁত চেপে এক বিকট চিৎকার করে হাঁকলেন, কোথায় সুরেশ্বর, এদিকে এস।

সুরেশ্বর উঠে দু-এক পা অগ্রসর হতে-না-হতে শ্যামবাবু একরকম ছুটে এসে গায়ের জোরে তাকে এক ঘা বেত মারলেন। শ্যামবাবু লোকটা ছিলেন আকাট যণ্ডা।

হঠাৎ ওইভাবে আক্রান্ত হয়ে সুরেশ্বর প্রথমটা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপরে সে তারস্বরে চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিলে। শ্যামবাবু বেত চালাতে লাগলেন সাঁই সাঁই সাঁইসাপের নিশ্বাসের মতন, আর সুরেশ্বর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চিৎকার করতে লাগল, মাস্টারমশায়, আল লা,–মাস্টারমশায়, আল লা- আপনার পায়ে পড়ি, আল লা!

ক্লাসসুদ্ধ ছেলের মুখ বেদনায় বিকৃত হয়ে উঠল।

শ্যামচন্দ্রের বিরাম নেই। তিনি সমানে বেত চালাতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, থিয়েটার করা হয়, কেমন? এই যে থিয়েটার হচ্ছে, কেমন পার্ট হচ্ছে? কেমন গান গাইছ?

এরকম নিষ্ঠুর পরিহাস জীবনে অল্পই দেখেছি। মার খেতে খেতে সুরেশ্বর যখন বেদম হয়ে পড়ল, তখন শ্যামবাবু জ্ঞান ঘোষকে বললেন, আবার যদি কখনও থিয়েটার করে তো আমায় বলে দেবে।

জ্ঞান ঘাড় নাড়লে।

শ্যামচন্দ্র গটগট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। দু-তিনটি ছেলে সুরেশ্বরকে মাটি থেকে তুলে তার জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলে। সুরেশ্বর পাশ ফিরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদতে লাগল।

অন্য মাস্টারের ক্লাসে ঢুকে শ্যামবাবু এই কীর্তি করে গেলেন, কিন্তু তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন বোধ করলেন না! পণ্ডিতমশায়ের আত্মসম্মানে এজন্য বোধ হয় কিঞ্চিৎ আঘাত লাগল।

শ্যাম মাস্টার চলে যাবার পর ক্লাসের থমথমানি ভাবটা যখন একটু কেটেছে অর্থাৎ ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস করে শ্যাম মাস্টারের বংশবৃদ্ধি করছে, এমন সময় পণ্ডিতমশায় প্রায় সুর করে ডাক ছাড়লেন, জ্ঞান ঘোষ!

আজ্ঞে স্যার?

এদিকে এস।

জ্ঞান নিজের জায়গা ছেড়ে গটগট করে পণ্ডিতমশায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পণ্ডিতমশায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পদবী ঘোষ না?

হ্যাঁ স্যার।

কি ঘোষ তোমরা? গয়লা ঘোষ, না কায়েত ঘোষ?

কায়েত ঘোষ, স্যার।

কায়েতের তো বাপু এমন ব্যবহার হয় না। বাড়িতে একটু ভালো করে জিজ্ঞাসা কোরো তো। আমার মনে হচ্ছে, তোমরা গয়লা ঘোষ।

আমাদের সঙ্গে তিন-চারটে গয়লা ছেলে পড়ত। তাদের মধ্যে সত্যকিঙ্কর ঘোষদের বড় দুধের কারবার ছিল। সত্যকিঙ্করও আহিরীটোলার ছেলে। সেই বয়সেই কুস্তি-টুক্তি করে ঘি-দুধ খেয়ে চেহারাখানাকে দেখবার মতন করে তুলেছিল। পণ্ডিতমশায়ের কথা শুনে সত্যকিঙ্কর তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, আমাদের জাতে অমন ছেলে হলে একবার দেখিয়ে দিতুম স্যার।

পণ্ডিতমশায় আর কথা না বাড়িয়ে জ্ঞানকে বললেন, যাও নিজের জায়গায়।

তারপরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শ্যাম মাস্টারের উদ্দেশে বললেন, বেম্ম কিনা, থিয়েটারের নাম শুনলেই লাফিয়ে ওঠে।

ব্যাপারটা কিন্তু এইখানেই শেষ হল না। সপ্তাহের মধ্যে অন্তত একদিনও শ্যাম মাস্টার কোনো-না-কোনো ছুতোয় আমাদের ক্লাসে এসে সুরেশ্বরকে পিটে যেতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে এক শনিবারে কি একটা উপলক্ষে সুরেশ্বরদের পাড়ায় অভিনয় হওয়ায় সে অভিনয় করেছিল। শ্যাম মাস্টার অন্য ক্লাসের আহিরীটোলার ছেলেদের কাছে নিত্য সুরেশ্বরের খবরাখবর করতেন। এদের কাছ থেকেই বোধ হয় সেদিনের অভিনয়ের খবর পেয়ে প্রথম ঘণ্টাতেই এসে তিনি সুরেশ্বরকে প্রহার আরম্ভ করলেন। সুরেশ্বর প্রথম দু-চার মিনিট চিৎকার করলেন, মাস্টারমশায়, আল লা। তারপর মাটিতে পড়ে গোঁ-গোঁ করতে লাগল।

তার ওপরেই বেত চলতে লাগল সপাসপ।

আমাদের সঙ্গে সূর্যকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি ছেলে পড়ত। বেশ গোলগাল প্রিয়দর্শন ছেলেটি, গলায় বাবুদের মতন চাদর ঝুলিয়ে, কোঁচার খুঁটটি উল্টে কোমরে গুঁজে সে মুরুব্বির মতন ইস্কুলে আসত। এখনকার মতন কুঁচকি অবধি তোলা হাফ-প্যান্ট, হাতকাটা শার্ট ও পায়ে চপ্পল পরে ইস্কুলে যাওয়া আমাদের কল্পনার বাইরের ছিল। যাক, আমাদের এই সূর্যির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা তার সবরকম মুরুব্বিয়ানাই সহ্য করতুম। কিন্তু ওই বয়সে বিয়ে হওয়ার জন্যে বাল্যবিবাহবিরোধী ব্রাহ্ম শ্যাম মাস্টার সূর্যির ওপরে হাড়চটা ছিলেন। সেদিন সূর্যির ওপরে বোধ হয় রাহুর দৃষ্টি পড়েছিল, তাই সুরেশ্বরের দুর্দশা দেখে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সহপাঠীর সেই মর্মভেদী চিৎকার শুনে আমাদের সবার চোখই জলে ভরে উঠেছিল, তবে সূর্যির গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতেই শ্যাম মাস্টারের নজর পড়ল তার দিকে। বেত আপসাতে আপসাতে তিনি সূর্যির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, তোমার কি হল? বন্ধুর দুঃখে একেবারে গলে গিয়েছ, না? বিদ্যেসাগর মশায় হয়েছ, কেমন?

এই বলেই সূর্যির ওপর সপাসপ বেত হাঁকড়াতে আরম্ভ করে দিলেন। সূর্যি বেচারা অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রান্ত হয়ে প্রথমটা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, তারপরে পরিত্রাহি চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শ্যামও চিৎকার করতে লাগলেন, বিয়ে করা হয়েছে, কেমন? বন্ধুর জন্যে বড় দরদ, না? বন্ধুর দুঃখের ভাগ একটু নাও, কেমন লাগছে? যে মাস্টারের ঘণ্টায় এই পাশবিক জলসা চলছিল, তিনি শেষকালে আর সহ্য করতে না পেরে মাঝে পড়ে বললেন, শ্যামবাবু যেতে দিন, খুব শিক্ষা হয়েছে।

সে-সময়ে আমাদের ইস্কুলে প্রত্যেক ঘণ্টার শেষে পাঁচ মিনিটের জন্যে ছুটি হত। এই পাঁচ মিনিটের অবকাশ কেন যে দেওয়া হত জানি না, কিন্তু এর জন্যে অশান্তির সীমা ছিল না। ঘণ্টা বাজা-মাত্র ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেই হৈ-হৈ করে বেরিয়ে যেত, কেউ কেউ মাঠে গিয়ে খেলাও জুড়ে দিত। ক্লাসে যারা থাকত, তারা চিৎকার করে গল্প, তর্ক অথবা ঝগড়া করতে থাকত। পাঁচ মিনিট পরে যখন ক্লাস বসবার ঘণ্টা বাজত, তখন সব ছেলে ক্লাসে এসে জুটতে ও ছেলেদের তর্ক বা ঝগড়া থামতে, যেত পনেরো মিনিট সময়। এজন্যে প্রায় প্রতিদিনই প্রত্যেক ঘণ্টা আরম্ভের সময় ছিল একটা সঙ্কটকাল। প্রায় সব মাস্টার, জনদুয়েক ছাড়া, পাইকারি হিসাবে সব ছেলের ওপর দিয়েই এলোপাতাড়ি একবার বেত চালিয়ে যেতেন। পরে সবাই প্রকৃতিস্থ হলে তবে পড়া শুরু হত।

ঘণ্টা বাজতেই মাস্টার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুরেশ্বর তখনও মেঝেয় পড়ে গোঁ-গোঁ করছে, আহিরীটোলার ছেলেরা, বোধ হয় দশ-বারোজন হবে, তার মধ্যে সুরেশ্বরের পরম শত্রু জ্ঞান ঘোষও ছিল, সবাই মিলে সুরেশ্বরকে তুলে বাইরে নিয়ে গেল।

সেদিন সুরেশ্বর ফিরলই না। তার বন্ধুদের মধ্যে তিন-চারজন সেই শেষের ঘণ্টায় এসে সবার বই নিয়ে চলে গেল।

পরের দিনও সুরেশ্বর এল না। সত্যকিঙ্করকে তার কথা জিজ্ঞাসা করায় সে বললে, সুরেশ্বর কাল আসবে, আজ একটা মজা হবে কিনা!

কি মজা হবে রে?

আজ শ্যাম মাস্টারের বাপের বিয়ে দেখানো হবে।

সে কি রে?

দেখিস না আজ ছুটির পর।

ছুটি অবধি আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলুম। ইতিমধ্যে ইস্কুলময় রটে গেল, আজ আহিরীটোলার ছেলেরা শ্যাম মাস্টারকে মারবে। শ্যাম মাস্টারও নিশ্চয় সে কথা শুনেছিলেন, কিন্তু বিশেষ কিছু গ্রাহ্য করলেন না। তাঁর শরীরে শক্তিও ছিল, সাহসও ছিল।

চারটের সময় ইস্কুলের ছুটি হয়ে গেল। ইস্কুল থেকে ছেলেরা বেরিয়ে অনেকেই অপেক্ষা করতে লাগল, ব্যাপারটা কি হয় দেখবার জন্যে। মিনিট পাঁচেক বাদে শ্যাম মাস্টার ইস্কুল থেকে গটগট করে বিডন স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চললেন। তখনও বোধ হয় গেট থেকে পঞ্চাশ গজ দূরেও যাননি, এমন সময় একটা গলি থেকে গোটা-আষ্টেক জোয়ান জোয়ান লোক বেরিয়ে তাঁর সামনে এসেই নাকে মারলে এক ঘুষি।

শ্যামবাবুর নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে লাগল। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোঁচাটা তুলে নাকে চেপে ধরতেই একজন বললে, শালা, সুরেশ্বরকে অমন করে ঠেঙিয়েছিস কেন রে?

বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তাঁর গালের এক খামচা দাড়ি শক্ত করে ধরে টানতে আরম্ভ করে দিলে। শ্যামবাবু তখুনি তাকে জাপটে ধরলেন, তারপরে দুজনে লেগে গেল ঝুল-পিটোপিটি। হঠাৎ লোকটা কি এক প্যাঁচ মারলে, যাতে শ্যামবাবুর সেই পৌনে তিন মণ দেহখানা শূন্যে একবার ডিগবাজি খেয়ে রাস্তার ওপরে চিত হয়ে পড়ল। তারপরে সবাই মিলে তাঁকে এলোপাতাড়ি পিটতে আরম্ভ করে দিলে।

যা হোক, সেই অসম যুদ্ধের নিখুঁত বিবরণ দেবার দরকার নেই, এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে মিনিট পনেরোর মধ্যেই শ্যাম মাস্টারকে একেবারে রাম মাস্টারের মতন দেখাতে লাগল। আততায়ীরা মারধর করে বেশ ধীরে সুস্থে চলে গেল। যাবার সময় একজন চেঁচিয়ে তাঁকে বললে, ফের যদি কোনোদিন শুনি যে সুরেশ্বরকে মেরেছ, তা হলে বাপের বিয়ে দেখিয়ে দোব!

আমরা তো শুনে চমকে উঠলুম, বাবা! আজকের উৎসবটি তা হলে আইবুড়োভাত, বিয়েতে এর চেয়েও সমারোহ হবে!

আমরা তিন ভাই ও আমার বাল্যবন্ধু পরিতোষ (ব্রাহ্ম হওয়ায় ও শ্যামবাবুর সঙ্গে তাদের পরিবারেরও ঘনিষ্ঠতা থাকায়, সেও ডফ কলেজে পড়ত) এই চারজনে শ্যামবাবুকে সাহায্য করতে লাগলুম। তাঁর সে-সময়কার অদ্ভুত চেহারার একটু বর্ণনা করি। তাঁর ডান চোখটা একেবারে বুজে গেছে, ভুরু ফুলে কি রকমে চোখের ওপরে এসে ঝুলে পড়েছে, ডান গালের বেশ খানিকটা জায়গায় দাড়ি নেই, উপড়ে দেওয়ার দরুন লোমকূপসমূহে রক্তবিন্দু জমাট হয়ে আছে। নাকটা এমন ফুলেছে যে, নাসারন্ধ্র দুটি তির্যকভাবে ঠোঁটের ওপরে এসে পড়েছে। মিনিট কয়েকের মধ্যে তারা শ্যাম মাস্টারের নলচে খোল একেবারে বদলে দিয়ে তো চলে গেল, আমরা চারজনে তাঁকে তুলে ধরে একখানা থার্ড ক্লাস গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি পৌঁছে দিলুম।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে চারজনেই একবাক্যে সুরেশ্বরকে বাহবা দিয়ে মতপ্রকাশ করলুম, বেশ হয়েছে।

শ্যামবাবুর কাছে চোরের মার খেয়ে সুরেশ্বরের অভিনয়প্রীতি ছুটে গিয়েছিল কি-না, অথবা সুরেশ্বরের নিযুক্ত লোকদের হাতে সাতচোরের মার হজম করে অভিনয়ের প্রতি শ্যামের অনুরাগ বেড়েছিল কি-না, তা জানি না। তবে সেদিন তো মনে হয়েইছিল এবং সেই ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর পর আজও মনে হচ্ছে, সুরেশ্বর ঠিকই করেছিল। সে যদি নিজে শ্যামবাবুকে প্রহার দিত কিংবা তার পাড়ার ছেলেরা যখন তাঁকে ঠেঙাচ্ছিল সে-সময় অন্তত সে যদি উপস্থিত থাকত, তা হলে ব্যাপারটি সর্বাঙ্গসুন্দর হত! ঘটনাস্থলে সুরেশ্বরের অনুপস্থিতিতে ঘটনাটির অঙ্গহানি হয়েছিল।

শ্যাম-সুরেশ্বর কাহিনিটি পূর্বাপর বিচার করে দেখলে মন্দ হয় না।

শ্যামবাবু সুরেশ্বরের সম্পর্ক গুরুশিষ্যের। অবশ্য গুরুশিষ্য বলতে আমাদের মনে স্বতঃই যে ছবি ফুটে ওঠে, সে সম্পর্ক নিশ্চয় তাঁদের মধ্যে ছিল না। সুরেশ্বর শ্যামের বাড়িতে বাস করত না অথবা তাঁর অন্নও সে খেত না। সুরেশ্বরের সুখদুঃখ–ভবিষ্যতের কোনো চিন্তাই শ্যামবাবু নিশ্চয়ই করতেন না। সুরেশ্বর পড়ত এক ক্রিশ্চান ইস্কুলে দেড়টাকা মাইনে দিয়ে, শ্যামবাবু সেখানে ষাট টাকার বেতনভোগী শিক্ষক ছিলেন। উভয়ের মধ্যে এই সূক্ষ্ম গুরুশিষ্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও সুরেশ্বর যে শ্রেণীতে পড়ত, শ্যামবাবু সে শ্রেণীতে অধ্যাপনা করতেন না। কাজেই গুরুশিষ্য সম্পর্কের কোনো প্রশ্নই এক্ষেত্রে উঠতে পারে না।

ইস্কুলের বিধি অনুসারে পড়া না করে এলে, শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে ছাত্রকে দণ্ডভোগ করতে হত। ইস্কুলের হুদ্দোর মধ্যে অথবা ক্লাসের মধ্যে কোনো অশিষ্টাচরণ করলে ছাত্রদের প্রতি শাস্তিবিধান করা হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিম্নশ্রেণীর ছাত্ররা ইস্কুলের বাইরেও সিগারেট খেলে ইস্কুলে তাদের শাস্তি দেওয়া হত এবং তাদের বাড়ির অভিভাবকদের জানানো হত। যদিও শিক্ষকেরা প্রায় প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো প্রকার ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলেন। ধূমপান করা, পরস্ত্রী অপহরণ অথবা ইস্কুলের বিবেচনায় অন্যান্য পাপকার্যের মতন যে মনে করা হত না, তার প্রমাণস্বরূপ ইস্কুলের কর্তৃপক্ষই শিক্ষকদের ধূমপান করবার জন্যে একটা আলাদা ঘর নির্দেশ করে দিয়েছিলেন।

ইস্কুলের দণ্ডবিধির মধ্যে পড়তে পারে এমন কোনো অপরাধে সুরেশ্বর সেক্ষেত্রে অপরাধী ছিল না। সুরেশ্বর ছিল হিন্দু এবং সে পড়ত ক্রিশ্চানদের ইস্কুলে। হিন্দু অথবা ক্রিশ্চান কোনো সম্প্রদায়ের নীতিশাস্ত্রে অভিনয় করায় বাধা নেই। সুরেশ্বর যে অভিনয় করে, সে-কথা তার অভিভাবকেরা জানত, শুধু অভিভাবকেরা নয়, তাদের থিয়েটারের ক্লাব পাড়াতেই ছিল, অর্থাৎ তার প্রতিবেশীরাও জানত। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি যে, এ বিষয়ে তার বাড়ির লোকদের সম্পূর্ণ মতও ছিল। ভালো অভিনয় করতে পারত বলে নিজের বাড়িতে, পাড়ায় এবং ইস্কুলে তার খাতির-প্রতিপত্তিও ছিল।

সে-সময়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে একদল লোক ছিলেন, যাঁরা থিয়েটারের নাম শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন। শ্যাম মাস্টার ছিলেন এই দলের লোক। প্রত্যেক ব্যক্তিরই অভিনয় করা সম্বন্ধে মতামত পোষণ করবার অধিকার আছে। এই সম্পর্কে শ্যাম মাস্টারের মতামতের সঙ্গে সুরেশ্বরের মতামতের অনৈক্য থাকায় শ্যামবাবুর ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিল।

এখন দেখা যাক, রাগ হয় কেন? আমাদের দর্শন এক জায়গায় বলছেন যে, ইচ্ছার বিরোধিতা ঘটলেই ক্রোধের সঞ্চার হয় এবং ক্রোধের উৎপত্তি হলেই বিরোধিতার কারণের প্রতি দ্বেষ জন্মে এবং দ্বেষ হলেই সেই কারণের প্রতি প্রতিহিংসা নেবার প্রবৃত্তি জাগে। এই প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই শ্যাম মাস্টার সুরেশ্বরকে প্রহার দিয়েছিলেন।

ছাত্রকে নিমর্মরূপে প্রহার করার প্রথা ক্রিশ্চান-কালের মধ্যযুগে বর্বরদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। অন্যান্য অনেক বর্বর প্রথার মতো এই প্রথাও দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে এসেছে বটে, কিন্তু বিবেকী লোক নির্বিচারে সকল প্রথা গ্রহণ করেন না। এই হিসাবে শ্যামবাবু অবিবেকী ও বর্বর ছিলেন।

শ্যামবাবু যখন সুরেশ্বরকে মেরেছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয় জানতেন যে সুরেশ্বর উল্টে তাঁকে মারতে পারবে না। যেমন অনেক মনিব চাকর ঠেঙায় এই ভেবে যে, চাকর উল্টে তাকে ঠেঙাতে পারবে না। এই মনোভাব কাপুরুষের। এই দিক দিয়ে শ্যামবাবু ছিলেন কাপুরুষ।

প্রহারের আবার তারতম্য আছে। শ্যামবাবু সপ্তাহে অন্তত একদিন এসে সুরেশ্বরকে ঠেঙিয়ে যেতেন এবং শেষদিনে তাকে অমানুষিক আঘাত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বারো-তেরো বছর বয়সের সুরেশ্বর যখন যন্ত্রণায় আর্তনাদ করেছিল, শ্যামবাবু তখন নির্দয় শ্লেষবাক্যে তাকে জর্জরিত করেছিলেন। এই দিক দিয়ে শ্যামবাবু ছিলেন অমানুষ ও নির্দয়।

তার ওপরে ব্যবহারতত্ত্বের একটি প্রধান সূত্র হচ্ছে নির্যাতনকারীকে দণ্ড না দিলে নির্যাতন করার প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি বর্বর, কাপুরুষ, নির্দয় ও অমানুষ, তাকে সিধে করতে হলে উঠতে-বসতে প্রহার দেওয়া উচিত। সুরেশ্বর হৃদয়বান, তাঁকে একদিন মেরেই ছেড়ে দিয়েছিল।

পরের দিন শ্যামবাবু ও সুরেশ্বর উভয়েরই অন্তর্ধান। তার পরের দিন সুরেশ্বর এল ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে। দ্বিতীয় ঘণ্টায় টমরী সাহেব নিজে এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমরা ভাবলুম, সুরেশ্বরের সুরলীলা বুঝি আজই শেষ হল। কিন্তু আধ ঘণ্টা পরে সে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে আবার ক্লাসে ফিরে এল।

শুনলুম, তাদের পাড়ার কে কে শ্যামকে পিটেছিল, টমরী তাদের নাম জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সুরেশ্বর বলেছে, সেদিনকার সে ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও সে জানে না। দু-দিন সে শয্যাশায়ী ছিল, তার পায়ের একখানা হাড় ভেঙে গিয়েছে, এজন্যে তার বাবা ইস্কুলের কর্তৃপক্ষের নামে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মকদ্দমা রুজু করবেন।

সুরেশ্বরের মুখে এই কথা শুনে টমরীর চক্ষু চড়কগাছে উঠে গিয়েছে। টমরী তাকে অনেক মিষ্টি কথা বলে সমস্ত ব্যাপারটার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে তার বাবাকে চিঠি দিয়েছেন।

সে পকেট থেকে বার করে একখানা খামে ভরা চিঠি আমাদের দেখালে।

পরের দিন শ্যামবাবু ইস্কুলে এলেন। তাঁর ভুরুর ফুলোটা অনেক কম, নাক স্বাভাবিক আকার, ডান গালের মাঝখানে খানিকটা জায়গায় দাড়ি নেই, সেখানে লাল-মতন কি লাগানো।

সত্যকিঙ্কর বললে, ব্যাটা গালে টিরেনচ্যান্ডাইন লাগিয়েছে।

শ্যাম-সুরেশ্বরের কাহিনি শেষ হল। সে বছর শ্যামবাবু আর আমাদের ক্লাসে পদার্পণ করেননি। এবার মধুসূদন-কথা শুরু করি।

আমাদের ক্লাসে অনেক ছেলে নর্ম্যাল পাস করে ইংরেজি ইস্কুলে ভর্তি হত।

নর্মাল পাস করতে যতদিন সময় যেত, ততদিনে ইংরেজি ইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হত না। বেচারারা সব বিষয়ই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানত, শুধু ইংরেজি কম জানত বলে তাদের প্রতি এই শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। নর্মাল-পাস করা এমন অনেক ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত, যাদের বয়েস পনেরো-ষোলো কিংবা তার চাইতেও বেশি। মধুসূদন ছিল এই দলের।

মধু করত কুস্তি। ওই বয়সেই তার চেহারাটি একটি ছোটখাটো পালোয়ানের মতন দেখতে ছিল। মেজাজ ছিল তার অতি অমায়িক। কোনো ছেলের সঙ্গে তার অবনিবনা ছিল না। আমরা তিন-চারজন মিলে তার হাতের গুলিতে ঘুষো মারতুম আর সে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাসতে থাকত। মধুসূদনের আর একটি মহৎ গুণ ছিল যে, সে সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি—সপ্তাহে এই চারদিন নিয়ম করে ইস্কুল কামাই করত। শুক্রবার ইস্কুল বসলেই মধুসূদনের বিচার হত এবং তার ফলে সেদিন হয় ক্লাসের মাস্টারের কাছে, নয় তো টমরীর কাছে থেকে তাকে ঘা তিনেক বেত্রাঘাত সহ্য করতে হত। এ ব্যাপারে আমাদের ক্লাসে একটা নিয়মের মতন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

মধুকে আমরা জিজ্ঞাসা করতুম, এমন করে ইস্কুল পালাস কেন?

মধু বলত ধূর, রোজ ইস্কুলে আসতে কি ভালো লাগে! দুপুরবেলা বেড়ে ঘুরে বেড়াই, কোনোদিন চলে যাই সেই মেটেবুরুজের লবাব-বাড়ি, কোনোদিন যাই নতুন খাল পেরিয়ে বাদায়–দিব্যি শালতি চড়ে বেড়ানো যায়।

ইস্কুলে পালিয়ে ঘুরে বেড়ানোর নানারকম গল্প বলে সে আমাদের তাক লাগিয়ে দিত। সত্য-মিথ্যায় মিলিয়ে কত রকমের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প যে সে করত, তার ঠিকানা নেই। এইভাবে তার গল্প শুনতে শুনতে আমাদের জনকয়েক ছেলের সঙ্গে মধুর ভারি ভাব জমে গেল। মধুর নির্দেশমতো আমরা বাড়িতে ডনবৈঠক করতে শুরু করে দিলুম। মাস তিন-চারেকের মধ্যে শরীরের বেশ উন্নতিও দেখা যেতে লাগল, মধু একরকম আমাদের মুরুব্বিই হয়ে দাঁড়াল। সে মাঝে মাঝে আমাদের হাতের গুলি টিপে টিপে দেখত আর বলত, এবার যেদিন অমুক পাড়ার সঙ্গে মারামারি হবে তোদের নিয়ে যাব।

আমাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হবার কিছুকালের মধ্যেই স্রেফ মুরুব্বিয়ানা আর গল্প করবার লোভে মধু ইস্কুল পালানো ছেড়েই দিলে।

একদিন আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক প্রিয়বাবুর ঘণ্টায় মধু বেশ গল্প জমিয়েছে, এমন সময় মাস্টারমশায় তাকে কি একটা প্রশ্ন করলেন। বলা বাহুল্য, মধু সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। প্রিয়বাবু বললেন, বৃথাই বাপে তোমার নাম দিয়েছেন মধুসূদন।

একটু চুপ করে থেকে মাস্টার বললেন, মধুসূদন নামে আমাদের দেশে একজন খুব বড় পণ্ডিত ছিল। লোকটা নাটক লিখে একসময় খুব নাম করেছিল।

একজন ছেলে বললে, মধুসূদন ক্রিশ্চান হয়েছিল স্যার।

হ্যাঁ, ক্রিশ্চান হলে কি হবে! শেষকালে সেই হিদুর দেবদেবীর ওপরেই তো কবিতা লিখতে হল!

মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, ক্রিশ্চান কেন হল স্যার?

প্রিয় মাস্টার বলতে লাগলেন, মোদো তো ক্রিশ্চান হয়ে দেশে গেল! পড়শিদের ডেকে বললে, আমি তোদের জাত ছেড়ে ক্রিশ্চান হয়েছি।

প্রতিবেশীরা বললে, বেশ করেছ বাপ মোদো, জিতা রহো।

কথাটা কানাঘুষো হতে হতে মোদোর মায়ের কানে গিয়ে পৌঁছল। মা বললেন, হ্যাঁ রে মোদো, এ কি শুনছি রে?

মোদো বললে, কি শুনছ মা?

তুই ক্রিশ্চান হলি কেন রে?

মোদো বললে, মা, আমার ফেৎ (faith) হয়েছে।

প্রিয় মাস্টারের কথা শেষ হতে-না হতে আমাদের মধুসূদন তড়াক করে উঠে বললে, আমারও একটু একটু ফেৎ হচ্ছে স্যার।

ক্লাসসুদ্ধ ছেলে হো-হো করে হেসে উঠল। প্রিয় মাস্টার ‘সাইলেন্স’ ‘সাইলেন্স’ বলে বার কয়েক চেঁচাতেই ঘর ঠান্ডা হয়ে গেল। তারপরে ধীর গম্ভীর স্বরে মধুসূদনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? তোমারও ফেৎ হচ্ছে?

হ্যাঁ স্যার।

প্রিয় মাস্টার মধুরকণ্ঠে ডাকলেন, মনিটার!

সে-সময়ে অক্ষয় নামে একটি ছেলে ছিল মনিটার। অক্ষয় দাঁড়াতেই তিনি হুকুম করলেন, ম্যাপ-পয়েন্ট।

অক্ষয় ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।

এই ‘ম্যাপ-পয়েন্ট’ ও ‘মনিটার’ সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ক্লাসের মধ্যে পাঁচ-ছয়টি ছেলেকে ভালো ছেলে বলে বিবেচনা করা হত। এদের মধ্যে দুটি ছেলে সত্যিই ভালো ছিল, কিন্তু বাকিগুলি লেখাপড়া ও অন্যান্য বিদ্যায় আমাদের দলের হওয়া সত্ত্বেও কেন যে তারা ভালো ছেলে বলে বিবেচিত হত, তা জানি না। এদের মধ্যে পালা করে এক-একজন ‘মনিটার’ হত। মনিটারের কাজ ছিল বোর্ডের খড়ি ঠিক রাখা, রেজেস্টারি এলে চিৎকার করে নাম ডাকা, মাস্টার আসবার আগে যারা গোলমাল করেছে তাদের নামে নালিশ করা, ভূগোল পাঠের সময় ম্যাপের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেরা ঠিক ম্যাপ দেখাতে পারছে কি-না তা শিক্ষককে জানানো ইত্যাদি। ব্রিটিশ গবর্মেন্টের কনস্টেবলদের মতন এরাও ছিল ক্লাসের কনস্টেবল। অর্থাৎ এরা কোনো ছেলের নামে নালিশ করলে বিপক্ষ তরফের আর কোনো কথাই শোনা হত না। এজন্য কোনো কোনো মনিটারকে মধ্যে মধ্যে ছেলেদের কাছে চাঁটি গাঁট্টা ইত্যাদি খেতে হত।

‘ম্যাপ-পয়েন্ট’ বস্তুটি হচ্ছেন বাঁশের লম্বা চেলা, প্রায় তিন সাড়ে তিন হাত লম্বা। সেটিকে বেশ চেঁচে-ছুলে পরিষ্কার করা, একটা দিক ছুঁচলো। মানচিত্রের বরাঙ্গে আঙুলের খোঁচা কর্তৃপক্ষ সহ্য করতে পারতেন না বলে এই বাঁশের খোঁচা দিয়ে ম্যাপ দেখানো ছিল সেখানকার রীতি। মনিটার ম্যাপের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকত, আর ছাত্রেরা দূর থেকে ম্যাপ-পয়েন্টের খোঁচা মেরে দেখিয়ে দিত। ঠিক জায়গাটা দেখানো হচ্ছে কি না, তা ধরবার ভার থাকত মনিটারের ওপরে। আমরা ম্যাপ-পয়েন্ট ধরে মানচিত্রের যেখানে-সেখানে একটা খোঁচা দিয়ে দিতুম আর মনিটার বলত, ঠিক হয়েছে স্যার।

কেন জানি না, কোনো কোনো মাস্টার বেতের চাইতে ম্যাপ-পয়েন্ট দিয়ে প্রহার করতে স্ফূর্তি পেতেন বেশি। প্রিয় মাস্টার ছিলেন এই দলের।

অক্ষয় তো হুকুম পেয়ে তড়াক করে লাইব্রেরি থেকে একটা ম্যাপ-পয়েন্ট নিয়ে এল। প্ৰিয় মাস্টার তাই দিয়ে মধুসূদনের ফেৎ ছোটাতে আরম্ভ করলেন। ঘা পাঁচ-সাত মারতে-না-মারতে ম্যাপ-পয়েন্ট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। প্রিয় মাস্টার হাঁপাতে হাঁপাতে হুঙ্কার ছাড়ছেন, অ্যানাদার ম্যাপ পয়েন্ট।

অক্ষয় দৌড়ে আর একটা ম্যাপ-পয়েন্ট নিয়ে এল, কিন্তু ঘা-কয়েক দিতে-না-দিতে সেটাও ভেঙে গেল। মধু বললে, কেন ইস্কুলের লোকসান করছেন স্যার? হাত দিয়েই মারুন।

মধুর কথা শুনে মাস্টার বেরিয়ে গেলেন। শোনা গেল, মধুর নামে টমরীর কাছে লাগাতে গেলেন।

সে দিনটা এমনই গেল, কারণ প্রিয়বাবু একলাই ফিরে এলেন। পরের দিন ক্লাস বসতে-না-বসতেই টমরী এসে হাজির। তাঁর পেছনে বুড়ো রাজপতি দরোয়ান, তার হাতে দুই মোটা মোটা বেত। মালাক্কা দ্বীপের যেরকম মোটা বেতের লাঠি এ দেশে পাওয়া যায়, সেইরকম এক-মানুষ লম্বা বেত, দেখেই তো ভয়ে আমাদের বুকের মধ্যে ঢেঁকি পড়তে লাগল।

টমরী মিনিট দুয়েক ছাত্রদের সবার ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে হাঁক ছাড়লেন, মধুসূদন মুখার্জি!

মধু আমাদের কাছেই বসে ছিল। ডাক শুনে উঠে দাঁড়াতেই টমরী বললেন, আমার সঙ্গে এস। মধুসূদন সুড়সুড় করে তাঁর পেছনে পেছনে চলে গেল।

মিনিট পনেরো বাদে মধুসূদন ফিরে এল। তার ধুতি ও জামায় রক্তের দাগ, চোখ দুটো লাল টকটকে, কিন্তু তাতে এক ফোঁটাও অশ্রু নেই। সে ডান হাতের তেলোটা আমাদের দেখালে। মনে হল কে যেন ছুরি দিয়ে হাতের তেলোটা আড়াআড়িভাবে কেটে দিয়েছে। সে ক্লাসে চিৎকার করে বললে, শালা টমরীকে আমি দেখে নেব।

ক্লাসে সে-সময় যে শিক্ষক পড়াচ্ছিলেন, মারণ-বিদ্যায় তিনিও কিন্তু কম ছিলেন না। কথাটা তাঁর কানে যেতেই তিনি মধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বকছিস রে মধু?

মধু মাস্টারের কাছে গিয়ে হাতটা দেখিয়ে বললে, দেখুন স্যার, টমরী আমার কি করেছে! আমি ওকে ছাড়ব না, আমার বাড়ি আহিরীটোলায়!

মধুর সাহস দেখে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠলুম, আবার না মার খায়! কিন্তু মাস্টারমশায় তাকে ধমক পর্যন্ত দিলেন না, শুধু বললেন, যা যা, পাগলামি করে না।

প্রথম ঘণ্টা শেষ হতেই মধু বই নিয়ে দুড়দাড় করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে চলে গেল। সেদিন ইস্কুলের ছুটি হওয়ার পর রাস্তায় গিয়ে দেখি, গেটের সামনে বোধ হয় দু-তিনশো লোক দাঁড়িয়ে। মধু তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ইস্কুলের দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে বীভৎস ভাষায় টমরীর চতুর্দশ পুরুষের শ্রাদ্ধের মন্ত্র আওড়াচ্ছে, তার ডান হাতখানা ব্যান্ডেজ-করা, গলায় ঝোলানো।

রাস্তায় ইস্কুলের ছেলেরা ও পথচারী লোক সব দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগল। নিমতলা ঘাট স্ট্রিট দিয়ে সে-সময় দিনরাত গরুর গাড়ি আর মোষের গাড়ি চলাচল করত। ভিড়ের দুপাশে সারবন্দি হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।

ইস্কুলের মাস্টাররা ভয়ে কেউ বেরুতে পারেন না। টমরী ইত্যাদি সাদাচামড়াওয়ালা মাস্টাররা দোতলায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন; আর মধু, গলায় একটা হাত ঝোলানো, আর একটা হাত তুলে তাঁদের ডেকে বলতে লাগল, নেবে আয় কে বাপের ব্যাটা আছিস–

মধুর হালচাল দেখে আমাদেরও ভয় করতে লাগল। এ যেন একেবারে অন্য লোক। সেই শান্ত অমায়িক মধু, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে নিঃশব্দে বেত্রাঘাত সহ্য করেছে, হঠাৎ তার এই অদ্ভুত পরিবর্তন আমরা চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারলুম না। তার কোমরে একখানা একহাত-লম্বা চামড়ার খাপ গোঁজা, তার মধ্যে ছোরা। হাতকাটা গেঞ্জি গায়ে, কোমর বেঁধে ধুতি পরে, খালি পায়ে তড়াক তড়াক করে লাফাচ্ছে ও অনর্গল চিৎকার করে গালাগালি দিয়ে যাচ্ছে। সাপে-নেউলে যুদ্ধের সময় নেউলটা যেমন দেখতে দেখতে ফুলে উঠতে থাকে, প্রত্যেক লম্ফের সঙ্গে মধুও যেন তেমনই ফুলতে লাগল। কতবার আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি হল কিন্তু সে গ্রাহ্যই করলে না।

মধুর সঙ্গে মারপিট করার জন্যে প্রায় জন পঁচিশ লোক এসেছিল। ইস্কুলের সামনে একটা বাড়ির রকে দেখলুম, দুটো লোক বসে আছে, তাদের সামনে এক পাঁজা তিন-হাতি বাঁশের পাকা লাঠি। শুনলুম; তাদের সবার কাছেই ছুরি ছোরা আছে।

ওদিকে ইস্কুলের শিক্ষকরা দোতলায় ও তেতলায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছেন, নামবার সাহস নেই কারুর, এমন সময় দেখা গেল স্টিফেন সায়েব রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। স্টিফেন সায়েব ছিলেন স্বনামধন্য পুরুষ, ইস্কুল ও কলেজের সমস্ত ছাত্র, শিক্ষক, এমনকি চাকররা পর্যন্ত তাঁকে ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। সেই সেদিন পর্যন্তও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ইস্কুলের গেটের সামনেই অমন যে একটা কাণ্ড চলেছে, সে সম্বন্ধে কোনো কৌতূহলই তাঁর মনে জাগল না। একবার বাইসাইকেলে ওঠবার চেষ্টা করে বুঝতে পারলেন যে, সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো অসম্ভব। টপ করে গাড়ি থেকে নেমে অত্যন্ত অবহেলাভরে একেবারে চারদিকে চেয়ে টপ করে বাইসাইকেলটা তুলে বগলদাবা করে সেই ভিড় কাটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে চলে গেলেন।

দার্শনিকদের হালচালই আলাদা।

স্টিফেন সায়েব চলে যেতেই মধু আবার চিৎকার শুরু করলে। ওদিকে বেলা বাড়ছে, অথচ হাঙ্গামা তেমন জমবার আশু কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে আমরা একরকম ক্ষুণ্ণ হয়েই যে যার বাড়ি চলে গেলুম।

পরদিন ইস্কুলে গিয়ে দেখি, গেটের সামনে লালপাগড়ি একেবারে গিজগিজ করছে। ক্লাসে গিয়ে শুনলুম, বেলা পাঁচটা অবধি টমরী রাস্তায় নামলেন না দেখে মধুরা চলে গিয়েছিল। মধুরা চলে যাবার পর পুলিশে খবর দেওয়া হয়। সন্ধের সময় পুলিশ এসে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।

সেদিন টিফিনের ছুটির পরের ঘণ্টায় ইস্কুলে সারকুলার বেরুল—”সাংঘাতিক অপরাধের জন্য পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মধুসূদন মুখোপাধ্যায় ইস্কুল হইতে বিতাড়িত হইল।”

হজরত মুসার পুণ্যবলে টমরী প্রাণে বেঁচে গেলেন, আর মহাবীরের মাথায় দু-বেলা ফুল চড়িয়েও মধু ইস্কুল থেকে বিতাড়িত হল।

এই সঙ্গে আর একটি নীতিও সুপ্রতিষ্ঠিত হল যে, শ্যামকে সাত-চোরের মার মারলেও নিষ্কৃতি আছে, কিন্তু টমরীকে মারবার উদ্যোগ করলেই ইস্কুল থেকে বিতাড়িত হতে হবে।

কিন্তু মাসখানেক বাদে আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারলুম যে মধুর বাবা নালিশ করবার ভয় দেখানোতে ইস্কুলের কর্তৃপক্ষ তাকে প্রথম শ্রেণীর ছাড়পত্র দিয়েছে। ইস্কুলের ইজ্জৎ রক্ষার জন্যে মধুর নামে সেই সারকুলার বের করা হয়েছিল, আসলে মধুর নাম কাটা যায়নি।

ইস্কুলে এইরকম সব হাঙ্গামার কথা হয়তো অনেকের কাছে অদ্ভুত ও অসম্ভব বলে মনে হতে পারে; কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় মাস্টার-ঠেঙানো, ক্লাসে ক্লাসে মারামারি, ইস্কুলে ইস্কুলে খুনোখুনি–এসব তো আকচার হতই। তা ছাড়া আরও এমন সব সাংঘাতিক মারামারি খুনোখুনি হত, যার কারণ বর্ণনা করতে গেলেই আইনের খপ্পরে পড়তে হবে, বিবরণ তো দূরের কথা।

কালধর্মে এখনকার ছেলেরা এ-বিষয়ে অনেক ভদ্র হয়েছে বটে, কিন্তু তারা অনেক নতুন গুণের অধিকারী হয়েছে, দাঁড়িপাল্লা সমানই আছে। ভল্টেয়ার ঠিকই বলেছেন– ‘We shall leave the world as foolish and wicked as we found it.”

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *