মুক্তপুরুষ – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রাত্তির পৌনে দশটার সময় আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম মানিকতলার মোড়ে। আমার কপালে বেশ জ্বর এসেছে।
এক-একদিন সবই ভুল হয়ে যায়। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় ছোটখাটো বাধা এসে পড়ে, অযথা দেরি হয়। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে পকেটে রুমাল কিংবা ঠিকঠাক পয়সা নিতে মনে থাকেনা। ন’নম্বর বাসে গেলেই সব চেয়ে সুবিধে, কিন্তু ন’নম্বর বাস সে-দিন কিছুতেই আসবে না। ট্রামের কন্ডাক্টর অনেক লোকের মধ্যে বেছে বেছে ঠিক আমাকেই বিনা কারণে অপমান করে। যার সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য এত ব্যস্ততা, তার সঙ্গে দেখা হয় না। অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু উদাসীন ভাব দেখায়। রাস্তায় এক জন চেনা মানুষ চট করে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় অন্য দিকে।
এক-একটা দিন এই রকম ভুলভাবে কাটে।
শুধু জ্বর নয়, আমার মাথার মধ্যে দপদপ করছে ব্যথা। চোখে ঘোর ঘোর লাগছে। ইচ্ছে করছে এই রাস্তার ওপরেই শুয়ে পড়ি। বাতাস বইছে বেশ। কিন্তু সে-বাতাস এমন গরম যেন তার আঁচে ঝলসে যাচ্ছে আমার গা।
হঠাৎ আমি মনে মনে বলে উঠলাম, সাত্যকি বসুমল্লিক। নামটা মনে পড়ছিল না…হুঁ। তোমাকে আমি দেখে নেব এক দিন।
একটা দোতলা বাস আসছে। নিশ্চয়ই এটা আমার নয়। আমার জন্য আজ কিছু ঠিকঠাক আসবে না। তবু দু’পা এগিয়ে গেলাম। বাসটা একদম খালি, দরজায় দাঁড়িয়ে এক জন হাত নেড়ে বলছে, যাবে না, যাবেনা।
যে যাবে না যাবেনা বলে, সে-ও কিন্তু কোথাও যায়।
আমার মনে হল, বাসের দরজার ওই লোকটা ঠিক আমার দিকেই আঙুল তুলে বলছে, নেবনা। তোমাকে নেবনা।
এই যদি আমার বদলে সাত্যকি বসুমল্লিক এখানে থাকত, তাহলে ওই লোকটাই হাত জোড় করে বিগলিত গলায় বলত, আসুন স্যার, উঠে আসুন।
এই অবস্থাতেও আমার একটু হাসি পেল। সাত্যকি বসুমল্লিকের মতো মানুষ এই রকম রাত্তিরে দোতলা বাসে চাপতে যাবেই-বা কেন?
বিড় বিড় করে বললাম, ওহে নীললোহিতচন্দর, এখন কী করবে? মনে তো হচ্ছে, ট্রাম-বাসের কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আজ তো হবেই, জানা কথা। এখন বাড়ি ফিরবে কী করে? নাকি আজ ফুটপাথেই শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবে?
পাশেই এক জন লোক দাঁড়িয়ে, সে আমার দিকে বেশ একটা খটকাপূর্ণ দৃষ্টি দিল। আমার স্বগতোক্তিটা বেশ জোরেই হয়ে গেছে? যাক, আমি গ্রাহ্য করি না।
সাত্যকি বসুমল্লিক এমনই যথার্থ ধরনের মানুষ যে, আমার ধারণা, কোনও দিন স্নান করার সময় তার হাত থেকে সাবান মাটিতে পড়ে যায় না। রাস্তায় কোনও দিন সাত্যকি বসুমল্লিকের চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যায়নি। পাজামা পরার সময় যদি দেখা যায় এক দিকের দড়ি অনেকখানি ভিতরে ঢুকে আছে, তাহলে বেশির ভাগ মানুষকেই কিছুক্ষণের জন্য ব্যক্তিত্বহারা হতে হয়। সাত্যকি বসুমল্লিক কখনও সেই রকম অবস্থায় পড়েননি। একজন নিখুঁত ঝকঝকে মানুষ। সদ্য মহাভারত পড়ার জন্য আমার আরও মনে হয়, সাত্যকি নামের লোকদের বাল্যস্মৃতি থাকে না।
আমিহঠাৎ আমার বাসস্টপ-প্রতিবেশির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি সাত্যকি বসুমল্লিককে চেনেন?
লোকটি বুঝতে না পেরে বলল, কী বলছেন? আমাকে বলছেন?
আজ কি ট্রাম-বাসের কোনও গোলমাল হয়েছে?
কী জানি!
লোকটি আমার পাশ ছেড়ে একটু দূরে চলে গেল। আমাকে বোধহয় নেশাখোর-টোর ভেবেছে। আমার এখন জ্বরের নেশা।
সারা দিন যে কোথায় কোথায় ঘুরেছি, কী করেছি, কিছুই মনে পড়ছে না। কিন্তু সাত্যকি বসুমল্লিকের কথা এত মনে পড়ছে কেন এখন? ফর্সা দোহারা চেহারা, খাঁটি আর্যবংশদ্ভূত নাক। ভুরু দুটি যেন কাজল দিয়ে আঁকা।
সাত্যকি বসুমল্লিক যে-বৃত্তে মানুষ তার থেকে আমার বৃত্ত অনেক দূরে। আমাদের মধ্যে কোনও যোগসূত্র স্থাপিত হবার কথা নয়। তবু একটা উল্কা যেমন চলে আসে কোন গ্রহের কাছে, সেই রকম একটা কিছু হয়েছিল। দেখা হয়েছিল নেতারহাটে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বাংলোতে গত মাসে।
প্রবাসে এক ধরনের ঝটিতি ঘনিষ্ঠতা হয়। তবু সে রকম কিছুও হবার কথা ছিল না, এক বাংলোতে কত রকম মানুষ যাবে, তাছাড়া আমি একটু একচোরা টাইপের। কিন্তু একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমি তখন ছিলাম সেখানে একলা একখানা ঘর নিয়ে। কেন গিয়েছিলাম নেতারহাটে? কেনই বা যাবনা, নেতারহাট কি কারুর বাবার সম্পত্তি।
বিকেল থেকেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তারই মুখে সন্ধের মুখে একটা স্টেশন ওয়াগন নিয়ে সাত্যকি বসুমল্লিক সেখানে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গের চার পাঁচ জন নারী পুৰুষ শিশু। ওদের দু’টি ঘর চাই। সে-রকম বুকিং-ও ওদের ছিল। তা তো থাকবেই, এই সব লোকেরা তো ঝুঁকি নেয় না কখনও। আমি আজ পর্যন্ত আগে থেকে বাংলো বুক করে কোথাও যাইনি। এমনি গিয়ে হাজির হই, তারপর চৌকিদারকে বলেকয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যায়। ঘর না পাওয়া গেলে বারান্দায় শুয়ে থাকতেই বা আপওি কী?
এই অবস্থায় সাত্যকি বসুমল্লিক তার ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে আমার ঘর থেকে বার করে দিতে পারতেন। সেটাই স্বাভাবিক ছিল, তাহলে আমি ব্যাপারটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতাম। আর কিছু না পারি, চার পাঁচখানা বিদ্রূপের দৃষ্টি তো ছুঁড়ে দিতে পারতাম লোকটার দিকে। কিন্তু অ্যারিস্টোক্র্যাসির যত দোষই থাক, এক ধরনের ভদ্রতা তারা শৌখিন জামাকাপড়ের মতো প্রতিটি ব্যবহারের গায়ে মুড়ে রাখে। অত্যন্ত পম্পাস গলায় তিনি বলেছিলেন, না না, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ভদ্রলোক যাবেন কোথায়? আমরাই কষ্ট করে থাকি। তবে উনি যদি অনুমতি করেন, ওর ঘরে তো দুটো খাট আছে, তার একটাতে আমাদের দু’জন শুতে পারে।
শুধু তাই নয়, পরের দিনও সাত্যকি বসুমল্লিক আমাকে স্থান ত্যাগ করতে দিলেন না। আবার সেই কৃত্রিম উদার গলায় বললেন, আরে, আপনি চলে যাবেন কেন? আমরা এসে পড়ে আপনার কোনও অসুবিধে ঘটালাম? আপনি থেকে গেলে আমরা খুবই খুশি হব, গল্প-টল্প করা যাবে।
তিন দিন ছিলেন এক সঙ্গে। মাঝে মাঝে কথা হয়েছে, আমি সাত্যকি বসুমল্লিকের ব্যবহারে সামান্যতম খুঁতও পাইনি। তবুও অদৃশ্য ভাবে উনি যে সব সময় আমার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন, সেটা ঠিকই টের পেতাম। ওঁর সঙ্গের মহিলারা কেউ একটাও কথা বলেননি আমার সঙ্গে। মেয়েরা এক নজরেই বুঝে যায়, কে হেলাফেলার যোগ্য।
সাত্যকি বসুমল্লিক বার বার বলেছিলেন কলকাতায় ফিরে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। ঠিক আমার মতো এক জন ছেলেকেই নাকি উনি খুঁজছিলেন। তিনটি কোম্পানির ডিরেক্টর হলেও উনি ঠিকানা দিয়েছিলেন বাড়ির। রেইনি পার্কে বসুমল্লিক হাউস। গত বুধবার ছিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বলাই বাহুল্য, আমি যাইনি। কেউ কেউ উপকার করার প্রস্তাব দিয়ে আনন্দ পেতে চায়। আমি উপকার প্রত্যাখ্যান করে আনন্দ পাই।
যদি কোনও দিন রেইনি পার্কের বসুমল্লিক হাউসে আগুন লেগে যায়, আমি সেই আগুনের আঁচে একটা কচি ভুট্টা পুড়িয়ে খাব।
এ-সব বাজে কথা! পলাতক মানুষের গাঢ় সন্ধ্যার প্রলাপ-স্বপ্ন।
কিন্তু মানিকতলার মোড়ে বাসস্টপের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি শুধু শুধু সাত্যকি বসুমল্লিকের কথা ভেবে মরছি কেন? আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে না? লোকটির চেহারা যতবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ততই রাগ বাড়ছে। অথচ লোকটি আমার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে এক বিন্দু খারাপ ব্যবহার করেনি। তাহলেও সাত্যকি বসুমল্লিককে যদি এখন কাছাকাছি পেতাম, ওর মসৃণ গালে একখানা চড় কষিয়ে দিতাম।
নাঃ ট্রাম-বাসের নিশ্চয়ই কিছু বড় রকমের অসদ্ভাব হয়েছে আজ। হয়তো শিয়ালদা বা শ্যামবাজারে গুলি চলেছে। একটা ট্যাক্সি এসে থামতেই হুড়মুড় করে অনেক লোক ছুটে গেল সে-দিকে। ওই রকম ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে ট্যাক্সি চড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার পকেটে আছে শুধু কিছু খুচরো পয়সা, সব মিলিয়ে এক টাকা চল্লিশ, অনেক বার গুনে দেখেছি। এখন মওকা বুঝে শেয়ারের ট্যাক্সিতেও তিন-চার টাকা চাইবে। মানুষ বিপদে পড়লে মানুষই তার বেশি সুযোগ নেয়।
এরপর টেম্পো আসবে, ভ্যান, লরি, ঠ্যালাগাড়ি করেও মানুষ ফিরবে। অনেক লোক জমে গেছে। যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, সে কী করে বাড়ি যাবে?
আমি উবু হয়ে বসে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে বমি করলাম। আমার কাছের লোকেরা দূরে সরে গেল। কেউ একটা প্রশ্নও করল না আমাকে। এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। জ্বর খুব ভাল জিনিস, কিন্তু জ্বরের সঙ্গে বমি খুব খারাপ অসুখ না? কলেরা? আমার বরাবর ধারণা ছিল, প্রকৃত ভদ্রলোকের কখনও কলেরা হয় না। আজ কি কারুর সঙ্গে অভদ্রতা করেছি? সে-রকম কিছু মনে পড়ল না। শুধু সাত্যকি বসুমল্লিককে বিনা দোষে থাপ্পড় কষাতে চেয়েছিলাম, তা-ও মনে মনে।
উলটো দিকের ফুটপাথে একটা টিউবওয়েল আছে। ধীরেসুস্থে সে-দিকে হেঁটে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলাম। এক-এক সময় বড় অন্যায় আরদার করতে ইচ্ছে করে। যেমন, এখন আমার ইচ্ছে হচ্ছে, কেউ যদি আমার জন্য টিউবওয়েল পাম্প করে দিত। এক হাতে পাম্প করে আর এক হাতে মুখ ধুতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। এলিয়ে পড়তে চাইছে শরীরটা। এ কী হল আমার!
কলকাতার রাস্তা যারা নোংরা করে, আমি আজ তাদের মধ্যে এক জন। এরপর ফুটপাথে শুয়ে থাকার তো আমার ন্যায্য অধিকার আছে। কিন্তু তার আগে ওষুধ খেতে হবে। জ্বরের সঙ্গে বমি, এবার আবার বেশ পেটব্যথা করছে। না না, এখন ইয়ার্কির সময় নয়, বেশ গুরুতর ব্যাপার, পট করে মরে যাবার কোনও মানে হয় না।
ঝড়ের মতো একটা বাস এসে থামল। হই হই রই রই করে উঠল একদল মানুষ। তাদের সঙ্গে আমিও বাসের দরজার দিকে ছুটতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হল, এটা তো উলটো দিকে যাবে। এটাই তো স্বাভাবিক, আজ আমার জন্য কোনও কিছুই ঠিকঠাক হবে না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার জন্যই এই বাসটা এসেছে।
কিন্তু এটা সত্যিই কি উলটো দিক? মানিকতলা মোড়ের কোন দিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি? কোন দিকে শ্যামবাজার, কোন দিকে শেয়ালদা? সব গুলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার আলো এত কম কেন? মানিকতলা বাজারটা কোথায় গেল?
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
আমার দিক ভুল হচ্ছে, এটা বিকারের লক্ষণ। আর এই অবস্থায় বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে লাভ নেই। কাছাকাছি চেনাশুনো কারুর বাড়িতে… কে থাকে কাছাকাছি? কারবালা ট্যাঙ্ক লেনে দিলীপ দত্ত, হ্যাঁ, দিলীপের কাছে গেলে…কিন্তু কী যেন, কী যেন… ওঃ। ঠিক তো, দিলীপরা এখন আর কারবালা ট্যাঙ্ক লেনে থাকে না, সল্টলেকে বাড়ি করেছে। বিবেকান্দ রোডে ডাক্তার সলিল পাঁজা… এক দিন নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম… তিনি আমাকে চিনতে পারবেন? মাত্র এক দিন দেখা… তাছাড়া এই অবস্থায়…। রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে আমার এক মাস্টারমশাই, …খুব ভাল লোক, কিন্তু রামদুলাল সরকার স্ট্রিট বেশ দূরে, অতটা কি হেঁটে যেতে পারব?
হঠাৎ মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি কি একটা গাধা, আমহার্মস্ট্রিটের মুখেই তো নিলয়দার বাড়ি, সেটা এতক্ষণ মনে পড়েনি? নিলয়দা প্রায়ই কলকাতায় থাকে না অবশ্য, কিন্তু রূপাবউদিও আমার সঙ্গে যথেষ্ট ভাল ব্যবহার করে। আগে ঠিক করে নেওয়া যাক, আমহার্স্ট স্ট্রিটটা কোন দিকে?
কয়েক পা হাঁটার পরেই আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। সমস্ত অনুভূতিবোধ এমন তীব্র হয়ে গেছে যে নিলয়দার বাড়ি চিনতে একটুও অসুবিধে হল না। এক তলাতেই বসবার ঘর। আলো জ্বলছে। একটু ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল, কেউ নেই ভেতরে, কেমন যেন খাঁ-খাঁ করছে ঘরটা।
ভেতর দিকে একটা ছোট উঠোন, তার দু’পাশে বারান্দা। সেই দু’দিকের বারান্দায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে নিলয়দা আর রূপাবউদি, উত্তেজিত ভাবে কিছু কথা বলছিল বোধহয়, আমি উঁকি মারতেই চিত্রার্পিত। আমাকে দেখার পরও বেশ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল, ওরা কোনও কথা বলল না।
গরজ আমারই বেশি। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, নিলয়দা, আমি হঠাৎ এসে পড়লাম একটু…।
অপ্রত্যাশিত রূঢ়তার সঙ্গে নিলয়দা বলল, তা তো দেখতেই পাচ্ছি!
অপ্রত্যাশিত হলেও খুব একটা আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আজ তো সারা দিন এই রকমই চলছে। একটা সম্পূর্ণ ভুল দিন। কিন্তু আমি যে আর পারছি না।
নিলয়দা আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে, খুব জ্বর রাস্তায় বমি করলাম, বাড়ি ফিরতে পারিনি, তাই তোমার এখানে চলে এলাম। তোমার চেনা কোনও ডাক্তার আছে?
মঞ্চাভিনেতার মতো অত্যন্ত জোরে হা-হা শব্দে হেসে উঠল নিলয়দা। তারপর বলল, এ-দিকে আমি একটা পাগলকে নিয়ে কী করব তার ঠিক নেই, তার ওপর আর এক জন অসুস্থ রুগী এসে হাজির হলেন। আমার ভাগ্যটাই এই রকম, দেখলে তো রূপা! হা-হা-হা!
এখন হাস্য পরিহাসে যোগ দেবার মতো অবস্থা আমার নেই। আমি কাতরভাবে বললাম, এক তলার বাথরুমটা কোন দিকে বউদি?
বউদি আঙুলটা তুললেই আমি খ্যাপা মোষের মতো সোজা ঢুকে গেলাম।
.
০২.
বিকেলবেলা লায়নস্ রেঞ্জে ফুটপাথের দোকান থেকে টোস্ট আর ঘুগনি খেয়েছিলাম। ঘুগনির স্বাদটা তখনই যেন কেমন কেমন লেগেছিল, কিমাটা ইঁদুরের মাংসের ছাঁটের মতো, যদিও ইঁদুরের মাংস আমি কখনও খাইনি, কিন্তু ওই রকম হবার কথা। সেই ঘুগনি খেয়েই আমার ফুড পয়জনিং।
সারা রাত ভাল করে ঘুমোত পারলাম না, সকালবেলা আমার অবস্থা রীতিমতো কাহিল। গলার আওয়াজ চিঁ-চিঁ হয়ে গেছে।
ডাক্তার ডাকা হয়নি, নিলয়দা নিজেই দিয়েছে ওষুধ। রূপাবউদির বাবা ছিলেন একজন নামকরা ডাক্তার, সেই সুবাদে রূপাবউদিরও ওষুধপত্র সম্পর্কে জোর দিয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যাই হোক, ন’টার সময় চায়ের কাপে সভয়ে চুমুক দিতে দেখলাম চা-টা বেশ ভালই লাগছে। তাহলে এ-যাত্রা আর বোধহয় আমার মরে যাবার চান্স নেই।
তখন ফিরে এল অভিমানবোধ। কাল রাত্তিরে নিলয়দা আমাকে দেখে কিংবা অসুখের কথা শুনে প্রথমে ও-রকম হেসে উঠলেন কেন? নিলয়দা আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল? অথচ নিলয়দার সঙ্গে আমার সে-রকম সম্পর্ক নয়। নিলয়দার সঙ্গে কতবার কত জায়গায় বেড়াতে গেছি, একবার একটা ছোট্ট খাটিয়াতে দুজনে ঠাসাঠাসি করে শুয়ে কাটিয়েছি সারা রাত।
অবশ্য রাত্তিরে যত্ন করেছে নিলয়দা আর রূপাবউদি। একবার ঘরের মধ্যেই বমি করে ফেলেছিলাম, নিলয়দা আমার মুখমুছিয়ে দিয়েছিল। এটা নিলয়দার ছেলে পাপুন-এর ঘর। দেয়ালে একটা বেশ বড় করে ব্রুস লি’র পোস্টার ছবি। আর একটা ছবি কার চিনতে পারলাম না।
রূপাবউদি এসে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে? উঠতে পারবে? পাপুন স্কুলে যাবে, ওর বই-টই নেবে, অবশ্য তোমার অসুবিধে হলে এখানেই শুয়ে থাকো।
আমি মিন মিন করে বললাম, না না, বউদি, আমি এবারে বাড়ি যাব। বাড়িতে কোনও খবর দেওয়া হয়নি।
এক তলায় কে যেন বিকট গলায় চিৎকার কবে উঠল, অত সোজা নয়। আমাকে বোঝানো অত সোজা নয়। আমার তিনটে চোখ আছে।
আমি চমকে উঠলাম। নিলয়দার গলার আওয়াজ তো নয়। নিলয়দা খুব নম্র গলায় কথা বলেন। তাহলে কে চেঁচাচ্ছে? আমি বউদির চোখের দিকে তাকালাম।
বউদি ও-দিকে মন না দিয়ে বলল, বাড়িতে খবর দাওনি, তাই তো, তোমার মা খুব চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই।
আমি আস্তে আস্তে উঠে বসে বললাম, মা এখানে নেই। আর কেউ বিশেষ চিন্তা করবে না। ভাববে, আমি বাইরে কোথাও চলে গেছি।
রূপাবউদি, তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি কাল রাত্তিরে।
রূপাবউদি বিচিত্র ভাবে একটু হেসে বলল, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি খুব মদ খেয়েছ। তারপরে বুঝলাম… বেশ খানিকটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। অত বমি করেছ বলেই বেঁচে গেলে।
নিলয়দা কি বেরিয়ে গেছেন?
না। সিংহের খাঁচায় ঢুকে এখন সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে। তুমি তাহলে উঠে পড়ো, আমি বিছানা তুলব।
তোমারও তো আপিস আছে, বউদি?
আছে তো, কিন্তু যাব কী করে? বাড়িতে এই সব কাণ্ড!
আমি পরে আছি প্যান্ট আর গেঞ্জি। জামাটা কখন কে খুলে দিয়েছে, খেয়াল নেই।
উঠে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, আমার একটা জরুরি কাজ আছে, মনে ছিল না। এক্ষুনি যেতে হবে। বউদি, আমার জামাটা?
সেটা খুব নোংরা হয়ে গেছে। ও পরে বাড়ি যেতে পারবে না। তুমি বরং নিচে গিয়ে বসো একটু, তোমার দাদার একটা জামা দিচ্ছি।
নিচ থেকে আবার সেই চিৎকার শুনতে পেলাম, অত সোজা নয়, আমার তিনটে চোখ আছে। আমি কে তুমি জানো? হায়, মাধুরী।
এবারে আমি জিজ্ঞেস করলাম, নিচে কে চেঁচাচ্ছে, বউদি?
ওই যে বললাম, সিংহের খাঁচা? সেই সিংহ! তোমার নিলয়দার নতুন খেয়াল। এবারেও ও আমাকে মারবে।
রূপাবউদির মুখে এরকম হেঁয়ালি ধরনের কথাবার্তা আমি আগে কখনও শুনিনি। রূপাবউদি বরং বেশ খটখটে ধরনের মহিলা, মানুষটা খারাপ নয়। কিন্তু কথাবার্তা বলে সোজাসুজি চাছাছোলা ভাষায়। রূপাবউদি প্রায় আমার সমান লম্বা, সেই জন্য একটা অতিরিক্ত ব্যক্তিত্ব আছে।
আমার চটিটা নিশ্চয়ই নিচে পড়ে আছে। খালি পায়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে নামতে লাগলাম। মাথাটা বেশ টনটন করছে এখনও। এক দিনের অসুখে অতটা কাবু হইনি কখনও আগে।
বারান্দার কোণে একটা ঘরের দরজা বন্ধ। তার পাশের জানলায় দাঁড়িয়ে পাপুন উঁকি মারছে ঘরের মধ্যে।
আমার পায়ের শব্দ শুনে পাপুন মুখ ফিরিয়ে ঝকঝকে একটা কৌতুকের হাসি দিল। তারপর জানলা থেকে নেমে এসে বলল, জানো নীলুকাকা, পাগলটা কিছুতেই খাচ্ছে না।
কোন পাগলটা?
বাবা যাকে রাস্তা থেকে ধরে এনেছে।
এইবার আমার মনে পড়ল, কাল রাত্তিরে নিলয়দা পাগল সম্পর্কে কী যেন বলেছিল।
রাস্তা থেকে একটা পাগল ধরে আনা নিলয়দার পক্ষে আশ্চর্য কিছুনা। নিলয়দার এ-রকমই সব অদ্ভুত খেয়াল।
গত বছর শীতকালে নিলয়দার সঙ্গে আমি কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলে একটানা দশ দিন ধরে ঘুরেছি। একটা বুড়ো নেকড়ে বাঘের সন্ধানে। একটা ইংরেজি কাগজে খবর ছাপা হয়েছিল যে, কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলে নাকি একটি নেকড়ে বাঘের দেখা পাওয়া গেছে। বাঘটি খুব বুড়ো, মাঝে মাঝে লোকালয়ের কাছাকাছি চলে আসে। দুদিন বাদেই অবশ্য প্রতিবাদ ছাপা হয়েছিল সেই খবরের। একজন লিখেছিল যে, নেকড়ে বাঘ বা উলফ বা Canis Lupus নাকি উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অনেক দিন। পশ্চিমবাংলায় নেকড়ে বাঘ এখন কারুর পক্ষে দেখতে পাওয়া অসম্ভব।
তবু প্ৰথম খবরটি পড়েই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল নিলয়দা। আমাকে বলেছিল, নীলু, যাবি নাকি? চল না, বাঘটাকে খুঁজে আসি, যদি দেখা পেয়ে যাই, ছবি তুলে আনব। একটা দারুণ ব্যাপার হবে।
কোনও জঙ্গলে একটা নেকড়ে বাঘ আছে কি নেই, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। নেকড়ে বাঘ লুপ্ত হতে হতে একটা যদি এখনও থেকেই যায়, তাহলেই বা তাকে অযথা বিরক্ত করার কী দরকার? বরং তার কাছাকাছি না যাওয়াই ভাল। একদম একলা হয়ে পড়ায় সেই নেকড়েটার মেজাজ বেশ খারাপ থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার যে-কোনও একটা উপলক্ষ পেলেই আমি নেচে উঠি। নিলয়দাকে আমি তাল দিয়ে বলেছিলাম, চলুন, চলুন, অন্য কেউ যাবার আগে আমরা গিয়ে নেকড়েটাকে ধরে ফেলি।
রূপাবউদি ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ধরতে পারলে কলকাতায় নিয়ে এসো। আমাদের বাড়িতে পুষব। নেকড়ে বাঘকে তো প্রায় অ্যালসেশিয়ানের মতোই দেখতে।
সেই সূত্র ধরেই রূপাবউদি এবারে সিংহ ধরে আনার কথা বলছেন!
কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলে আমরা শেষ পর্যন্ত নেকড়ে বাঘটার দেখা পাইনি বটে, কিন্তু ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল খুব। জঙ্গলের আদিবাসী, ফরেস্ট গার্ড, বিট অফিসার, বাংলোর চৌকিদার অনেকেই নাকি নেকড়েটাকে দেখেছে। বিট অফিসার বলেছিল যে, একদিন সন্ধেবেলা সে জিপে করে ফিরছিল গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। জিপের পেছনে পেছনে একটা ধূসর রঙের প্রাণীকে সে অনেকক্ষণ দৌড়ে আসতে দেখেছিল, সেই প্রাণীটা নেকড়ে না হয়ে যায় না। জঙ্গলের সেই জায়গাটায় আমরা পর পর দু’দিন ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাটিয়েছি। নিলয়দার দারুণ উৎসাহ, আমাকে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, একদম একলা একটা নেকড়ে, কোনও বন্ধু নেই, সঙ্গিনী নেই, সে কী করে বেঁচে আছে বল তো? মনে কর, পৃথিবীর মানুষের কোনও জাতির আর সবাই মরে গেল, শুধু এক জন বেঁচে রইল।
পাপুন বলল, জানো নীলুকাকু, ওই পাগলটা না মাকে কামড়ে দিতে এসেছিল।
আমি দ্রুত বসবার ঘরের দিকে চলে এলাম। জঙ্গলের বাঘ-ভাল্লুকের চেয়েও আমি পাগলদের বেশি ভয় পাই। হয়তো ছেলেবেলায় কোনও দুঃসহ অভিজ্ঞতা আমার মনের মধ্যে ছাপ ফেলে গেছে। পাগলদের চোখের দিকে তাকালেই আমার গা ছম ছম করে।
দুর্বল শরীরে কোনও অ্যাডভেঞ্চারের স্পৃহা জাগে না। নিলয়দা কোন শখে রাস্তা থেকে একটা পাগলকে ধরে এনেছে কে জানে! এখন আমার কেটে পড়া দরকার। নিলয়দার কাছ থেকে বিদায় নেবারও প্রয়োজন নেই।
পাপুন জিজ্ঞেস করল, তুমি কী খুঁজছ?
আমি বললাম, চটিটা খুঁজে পাচ্ছি না। এইখানেই কোথাও আছে। পাপুন, লক্ষ্মীছেলে, ওপরে গিয়ে মার কাছ থেকে একটা জামা চেয়ে আনবে?
তোমার জামা কী হল?
আমার জামাটা, ইয়ে, ভিজে গেছে। তোমার বাবার একটা জামা চেয়ে নিয়ে এসো।
তোমার জামাটা ভিজল কী করে?
ছোট ছেলে মেয়েদের কৌতূহল প্রবৃত্তি থাকা ভাল। যত বেশি কৌতূহলী হবে, তত জ্ঞান বাড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তে পাপুনের জ্ঞান বৃদ্ধি করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই।
একটু কড়া গলায় বললাম, বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল। তুমি যাও পাপুন, মা’র কাছ থেকে চট করে একটা জামা নিয়ে এসো।
পাপুন ফিক করে হেসে ফেলে বলল, বাবার একটা জামা ওই পাগলটাকে দিয়েছে। তুমিও আর একটা জামা নেবে?
পাপুনকে অন্য দিন আমার কত ভাল লাগে। মাথার রেশমি নরম চুলে হাত বুলিয়ে আদর করি। এখন পাপুনের সঙ্গে আর আমার কথা বলতেই ইচ্ছে করল না।
মুখের মধ্যে জল জল ভাব হচ্ছে। আবার বমি আসবে নাকি? আমি প্রাণপণে একটা বমি প্রতিরোধ শক্তি তৈরি করে খুঁজতে লাগলাম চটি জোড়া।
পাপুন বলল, তোমার চটি কোথায় আছে, আমি জানি। বলব না, ব-ল-ব-না।
গেঞ্জি গায়ে খালি পায়ে বেরিয়ে গেলেই-বা ক্ষতি কী আছে? এ-দেশে শতকরা ঊনসত্তর জন লোক পায়ে কখনও জুতো পরেনা আর শতকরা তিয়াত্তর জন লোক কোনও দিন একটা গেঞ্জি পর্যন্ত গায়ে দেয়নি। আমার খুচরো পয়সাগুলোও শার্টের পকেটেই ছিল, রূপাবউদি তা কোথায় রেখেছে কে জানে! পকেটে একটা রুমাল ছাড়া আর কিছু নেই।
তবুও বেরিয়ে পড়ব ঠিক করতেই বাইরে দরজার সামনে এক রমণীমূর্তির আবির্ভাব হল। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়স, বেশ উদ্ধত-যৌবনা, গায়ের শাড়িখানা যেন মাকড়সার জাল দিয়ে তৈরি। আমি চিনি এই মেয়েটিকে, রূপাবউদির ছোট বোন, এ বাড়িতেই দেখেছি এক দিন, এর নাম স্বর্ণ।
মেয়েটিরও আমাকে চেনা উচিত, কিন্তু সে-রকম কোনও ভাবই দেখাল না। বরং থমকে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন মুখখানা শুকিয়ে যেতে লাগল ওর। আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে?
কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, এই পাপুন, দিদি কোথায়?
আমার মেজাজ খুবই খারাপ হয়ে গেছে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি দরজার দিকে এগোতেই স্বর্ণ ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার করে উঠে অদ্ভুত কায়দায় একটা দৌড় লাগাল, একবার আমার বাঁ-পাশ, একবার আমার ডান পাশ ঘুরে উলটো দিকে চলে গিয়ে পাপুনকে জড়িয়ে ধরল।
এরকম অবস্থায় চলে যাওয়া যায় না। আমি মুখ ঘুরিয়ে আহত ভাবে স্বর্ণর দিকে তাকালাম।
পাপুন খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, ও পাগল নয়! ও পাগল নয়! কী মজা! ছোটমাসি, ও তো নীলুকাকু! পাগলটা ভেতরে আছে!
এই কথা শুনেই স্বর্ণ আধুনিকা-সুলভ দাম্ভিক ভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ময়না পাখির মতো তীক্ষ্ণ সুমিষ্ট স্বরে বলল, আপনি খালি গায়ে কেন? তাই আমি বুঝতে পারিনি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, চোখ দুটো কেমন কেমন।
এই সময় রূপাবউদি একটা জামা নিয়ে উপস্থিত হল। আমাকে বাইরের দরজার কাছে দেখে বলল, এ কী, কোথায় যাচ্ছ? জামা এনেছি। পাপুন বলল, মা, জানো তো, ছোটমাসি না, হি-হি-হি!
স্বর্ণ জিজ্ঞেস করল, দিদি, নিলয়দা নাকি রাস্তা থেকে একটা পাগল ধরে নিয়ে এসেছে?
তুই কোথা থেকে শুনলি?
আমাকে জয়নন্দন বলল। ও দেখেছে, কাল বিকেলবেলা নিলয়দা একটা পাগলকে ধরে… রাস্তার লোকেরা পাগলটাকে মারছিল।
তোর বন্ধু জয়নন্দন তো আচ্ছা ছেলে! সে দেখেছে, তবু তোর নিলয়দাকে সাহায্য করতে আসেনি?
ভেতর থেকে জলদগম্ভীর স্বরে সেই পাগল চেঁচিয়ে উঠল, আমাকে কেউ চেনে না, আমিও কারুকে চিনি না। এই হল সোজা কথা।
হায়, মাধুরী!
গলার আওয়াজ শুনে মোটেই পাগল বলে মনে হয় না। যেন কেউ যাত্রার পার্ট করছে।
আমি রূপাবউদির কাছ থেকে জামাটা নিয়ে পরে ফেললাম। নিলয়দার হাওয়াই শার্ট আমার গায়ে বেশ ফিট করে। স্বর্ণ এসে পড়ে যে কাণ্ডটি করল, সেই উত্তেজনায় আমার বমি বমি ভাবটা কেটে গেছে। একে বলে প্রাকৃতিক চিকিৎসা। এখন চটি জোড়া ও খুচরো পয়সাগুলো পেলে আমি অনায়াসে চলে যেতে পারি।
বউদি, পাপুন আমার চটি লুকিয়ে রেখেছে, ওকে বার করে দিতে বলুন। আর আমার পকেটে কিছু পয়সা ছিল।
পয়সা ছিল? তা তো আমি জানি না। দেখো তো, বাথরুমে জামাটা রয়েছে। ক’টাকা ছিল? সব ভিজে গেছে নিশ্চয়ই।
বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই পাগলের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল নিলয়দা। এক হাতে একটা বাটি, অন্য হাতে একটা বালতি। সেগুলো নামিয়ে রেখে দরজাটা বন্ধ করে হুড়কো টেনে দিল। তারপর বলল, নীলু, বডি ফিট হয়ে গেছে? কাল রাত্তিরে খুব ঝামেলা করেছিলি, উফ। শোন, তোর সঙ্গে আমার কাজের কথা আছে।
বাথরুমে আমি চটি আর জামাটা পেয়ে গেলাম। জামাটা বমিতে মাখামাখি। ও জামা কেউ কাচবে না, ফেলেই দিতে হবে। নিজের বমিতেও হাত দিতে ঘেন্না লাগে, তবু পয়সা বলে কথা, কোনওক্রমে সেই জামার বুকপকেট থেকে পয়সাগুলো বার করে ভাল করে জল দিয়ে ধুয়ে নিলাম।
বাইরে এসে বললাম, নিলয়দা, আমার বাড়িতে কোনও খবর দেওয়া হয়নি।
নিলয়দা বললেন, তোদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা ফোন আছে না? আমার ফোনটা খারাপ, আমি অফিসে গিয়ে তোদের পাশের ফ্ল্যাটে ফোনে খবর দিয়ে দিচ্ছি।
শরীরটা এখনও পুরো ঠিক হয়নি, মাথা ঘুরছে, বাড়ি গিয়ে –।
এখানে শুয়ে থাক। বিশ্রাম নে। তোকে আমার আজকে খুব দরকার।
তুমি একটা পাগল ধরে এনেছ?
চুপ! শুনতে পাবে, পাগলকে কখনও পাগল বলতে নেই, ওরা ওই কথাটা ঠিক বুঝতে পারে।
আমাকে কী করতে হবে, নিলয়দা?
তুই আজকের দিনটা বাড়িতে থেকে ওকে পাহারা দিবি। অফিসে জরুরি কাজ আছে, আমার আজ না গেলেই নয়। কাল থেকে ছুটি নেব!
আমি পাগল পাহারা দেব?
আবার? বললাম না, ওই কথাটা উচ্চারণ করবি না! এখন থেকে বলবি রাস্তার ভদ্রলোক। উঃ, কাল রাত্তিরে কী ঝকমারি গেছে। এক দিকে ওকে সামলানন, তারপর আবার তুই এসে বমি-টমি শুরু করলি। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তোকে আর ওকে, দু’জনকেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলাম।
খুব দুঃখিত, নিলয়দা। তোমাকে আর বউদিকে খুব কষ্ট দিয়েছি, হঠাৎ এমন শরীরটা খারাপ হল। রাস্তার একটা দোকানের ঘুগনি খেয়ে– ।
রাস্তার দোকানে ঘুগনি খুব টেস্টফুল হয়। আমারও মাঝে মাঝে খেতে ইচ্ছে করে।
নিলয়দা, বলছিলাম কী, আজকের দিনটা যদি বাড়িতে ফিরে রেস্ট নিতে পারি– ।
শোন, ব্যাপারটা তোকে বুঝিয়ে বলছি।
বসবার ঘরে স্বর্ণ উচ্চহাস্য করে উঠল। রূপাবউদি বলল, তুই হাসছিস? আমার এই বাঁ-হাতের সব কটা আঙুল কামড়ে ধরেছিল।
দুই বোন বেরিয়ে এল উঠোনে।
রূপাবউদি বলল, আমার রান্নার লোকটা ছুটি নিয়েছে। একহাতে সামলাতে হচ্ছে সবকাজ, এর মধ্যে আবার বাড়িতে একটা বদ্ধ পাগল এনে হাজির করেছে!
নিলয়দা বলল, ছিঃ রূপা! ওই রকম চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাগল পাগল বলছ কেন? এক জন মানুষ, সে অসুস্থ।
রূপাবউদি বেশ কড়া গলায় ধমকে দিয়ে বলল, পাগলকে পাগল বলব না কি ছাগল বলব? তা-ও আবার ভায়োলেন্ট পাগল, আমাকে কামড়ে দিতে আসে!
বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এল, আমি সব জানি, আমি সব বুঝি! আমার তিনটে চোখ।
রূপাবউদি তর্জনী তুলে বলল, ওকে তুমি এক্ষুনি বিদায় করে দাও! যথেষ্ট হয়েছে।
নিলয়দা বলল, শোনো রূপা, ও ঠিক তোমাকে কামড়ে দিতে চায়নি, মানে একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডি হয়েছিল, অসুস্থ তো! এই যে নীলু কাল তোমার গায়ে বমি করে দিল, স্বাভাবিক অবস্থায় কি আর করত?
সীতার মতো আমার বলতে ইচ্ছে হল, মা ধরণী, দ্বিধা হও! কাল রাত্তিরে আমি এমন কাণ্ডও করেছি! রূপাবউদির সামনে আর কক্ষনও মুখ তুলে কথা বলা যাবেনা।
কিন্তু রূপাবউদি তক্ষুনি আমার গ্লানি কাটিয়ে দিল। বলল, নীলু আমাদের চেনা, তার এক দিন হঠাৎ অসুখ করেছে, সে-কথা আলাদা। আর একটা রাস্তার লোক, চিনি না, শুনি না, আমাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।
বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ঠিক যেন এরই উত্তর ভেসে এল, আমাকেও কেউ চেনে না, আমিও কারুকে চিনি না। এই হল সোজা কথা! হায়, মাধুরী! কেউ কিছুই জানল না!
স্বর্ণ ফিস ফিস করে চোখের ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, নিলয়দা, একটু দেখব? কামড়ে দেবে?
পাপুন বলল, এসোনা, এসো, আমি জানলা দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি!
নিলয়দা বলল, না না স্বর্ণ, জানলার কাছে যেও না। ও মেয়েদের সহ্য করতে পারে না।
তারপর আমাকে বলল, তুই একটু দেখ তো, নীলু! তোর চেনা কিংবা কোথাও আগে দেখেছিস কি না! আমার কিন্তু মুখটা খুব চেনা চেনা লাগে।
আমি খুব সন্তর্পণে জানলার কাছে গিয়ে উঁকি দিলাম। আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো স্বর্ণ।
ঘরের মধ্যে খাটের ওপরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এক জন লোক। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা, পঁয়তিরিশেক বয়স। পরনে একটা অতি নোংরা খাকি প্যান্ট, আর একটা পরিষ্কার পাঞ্জাবি, সেটা নিশ্চয়ই নিলয়দার। লোকটির মুখে খোঁচা দাড়ি, মাথার চুলে জট। লোকটি এক সময় বেশ সুপুরুষ ছিল। গালে, কপালে, অনেকগুলো ক্ষততে স্টিকিং প্লাস্টার লাগান।
আমাদের দিকে পেছন ফিরে বসেছিল লোকটি। হঠাৎ এক সময়ে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। আমাকে নয়, স্বর্ণকে দেখতে পেয়েই যেন চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল তার। হুঙ্কার দিয়ে বলল, অত সোজা নয়, আমার তিনটে চোখ আছে।
সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে সরে এলাম আমরা। না, এই লোকটিকে আমি আগে কোনও দিন দেখিনি!