বাল্যকাণ্ড
ঢোঁড়াইয়ের জন্ম
বুধনীর মনে আছে যে, ঢোঁড়াই যেদিন পাঁচদিনের সেদিন টৌনে [৩৯] ছিল একটা ভারী তামাসা। আর একদিন আগেই যদি ঢোঁড়াই জন্মায়, তাহলেই বুধনী ছদিনের দিন স্নান করে তামাসা দেখতে যেতে পারে; কিন্তু তা ওর বরাতে থাকবে কেন! কেবল খাও, রসুন গুড় আদবাঁটা একসঙ্গে সেদ্ধ করে সেইটা তেলে ভেজে! মরণ! বুধনী কাঁদতে বসে।
ওর স্বামীটা ভারি ভালমানুষ। অন্য তাৎমারা বলে হাবাগোবা, তাই রোজগার কম। বুধনীর নিজের রোজগার আছে বলেই, চলে যায় কোনোরকমে। তার স্বামীকে দিয়ে তাৎমার দল চাল ছাইবার সময় খাপরা বওয়ায়, খাপবার ঝুড়ি নিয়ে মইয়ে চড়ায়; পৌষে মাঘে কুয়ো পরিষ্কার করতে হলে, তাকেই জলের ভিতরে বেশিক্ষণ কাজ করায়।
বুধনীকে কাঁদতে দেখে বলে, তা এখন কাঁদতে বসলি কেন? ছেলেটার দিকেও দ্যাখ– ঘাড় কাত করে রয়েছে কেন। তোর জন্যে আবার দুপয়সার মসুরির ডাল কিনে আনতে হবে। কি গরম মসুর ডাল–না?
তার স্বামী কোনোদিন মসুর ডাল খায়নি। সে কেন, কোনো তাৎমাই খায় না। অত গরম জিনিস খেলে গায়ে কুষ্ঠ হয়ে যাবে সেই ভয়ে। খালি খাবে মেয়েরা, ছেলে পিলে হওয়ার পর কয়েকদিন, তখনি ওদের শরীরের রস শুকোনো দরকার সেইজন্যে। বুধনী বলে, হ্যাঁ, খেলেই যে গরম আগুন জ্বলে গায়ে। আমি তামাসা দেখে এসে তোকে সব বলব বুঝলি? কাঁদিস না। সেদিন টৌন থেকে বাড়ি ফিরবার সময় ঢোঁড়াইয়ের বাপের বুক দুর দুর করে ভয়ে। দুটো পয়সা ছিল তার কাছে। তামাসায় গিয়ে সে তাই দিয়ে এক পয়সার এক পাকিট বাত্তিমার [৪০] কিনেছে, আর এক পয়সার খয়নি। বাড়ি গিয়ে এখন কী বলবে বুধনীর কাছে মসুর ডালের সম্বন্ধে কী বলবে, সেই কথাই সে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে; যত বোকা তাকে সকলে ভাবে সে তত বোকা নয়।
কে আর দোকান খোলা রাখবে, ঐ রাজার দরবারের [৪১] জুলুস (মিছিল) দেখা ছেড়ে দিয়ে। এই কথা বলতে বলতে সে বাড়ি ঢোকে। বুধনী অনেকক্ষণ থেকে তারই অপেক্ষা করছিল, তামাসার খবর শোনবার জন্য। কার? কপিল রাজার নাকি? কপিল রেজা কুলের জঙ্গলের ঠিকাদার, লা-র ব্যবসা করে। তাকেই সকলে বলে কপিল রাজা। না রে না ওলায়তের (বিলাতের) রাজার। তার কাছে কলস্টর সাহেব, দারোগা পর্যন্ত থর থর থর থর [৪২]। দরবার কথাটার ঠিক মানে, ঢোঁড়াইয়ের বাপ নিজেই বুঝতে পারেনি। মনে মনে আন্দাজ করেছে যে বোধ হয় এই মিছিলেরই নাম দরবার। পাছে বুধনী ঐ কথাটার মানে জিজ্ঞাসা করে, সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি জুলুসের হাতি ঘোড়া উটের কথা বলতে আরম্ভ করে। সে কী বড় বড় হাতি! সোনার কুর্তা পরানো, ইয়া বড় বড় দাঁত, চাঁদি দিয়ে ঢাকা। সে যে কত চাঁদি, তা দিয়ে যে কত ঘুনসি হতে পারে, তার ঠিকানা নাই। একটা হাতি ছিল, সেটার আবার একটা দাঁত এই ছোট্ট কদুর মতো। উটগুলো চলেছে টিম-টাম টাম- টিম, সামনে পিছনে ঠিক খোঁড়া চথুরীটার মতো চলার ধরন। হাতির পিঠে চাঁদির হাওদায় কলস্টর সাহাব (কালেক্টর সাহেব) আর একটায় বুধ-নগরের কুমাররা, আরও কত সাহেব, কত হাকিম কে কে, সব কি অত চিনি ছাই! সাদা ঘোড়ার পিঠে ভাই চেরমেন সাহাব। কী তেজী ঘোড়া! টকস-টকস-টকস-টকস কী চাল ঘোড়ার! তার কাছে যায় কার সাধ্যি। ছত্তিসবাবুর [৪৩] দোকানের বারান্দায় বাঙালি মাইজীদের মিছিল দেখবার জন্য চিক টাঙিয়ে দিয়েছিল- ঘোড়াটা তার চার পা তুলে দিতে চায় সেই চিকের উপর। ইয়া তালের মতো বড় বড় খুব! বুধনী আঁতকে ওঠে ভয়ে গে মাইয়া! তাই নাকি।
আরও কত তামাসার খবর বুধনী শোনে। তার দুঃখের সীমা নেই। উট আর কলস্টর সাহাব দেখা তার পোড়া কপাল রামজী দেন নাই, সে আর কার দোষ দেবে।… ছেলেটা কেঁদে ওঠে। ঢোঁড়াইয়ের বাপ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নে, নে দুধ দে। অমন করে তুলিস না- ঘাড় মটকে যাবে বিলি বাচ্চাটার [৪৪] তারপর ঐ বিলি বাচ্চা ঢোঁড়াইয়ের দিকে মাথা নেড়ে, হাততালি দেয়।
এ নুনু! (ও খোকন) এত্তা ভাত খাওগে? (এতগুলো ভাত খাবে) বকড়ি চরাওগে? (ছাগল চরাবে)।
এত্তা ভাত খাওগে, বকড়ি চরাওগে। এত্তা ভাত খাওগে, বকড়ি চরাওগে।
ছেলেকে দুধ দিতে গর্বে বুধনীর বুক ভরে ওঠে। ছেলেপাগল লোকটার আদর করা দেখে হাসি আসে। তোমার বিলি বাচ্চা কি এখন শুনতে শিখেছে, এখনও আলোর দিকে তাকায় না, ওকে হাততালি দিয়ে আদর হচ্চে! পাগল নাকি!
ঢোঁড়াইয়ের বাপ বেঁচে গিয়েছে আজ খুব; তামাসার গল্পে আর ছেলে সামলানোর তালে মসুর ডাল না আনার কথা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু তার মনের মধ্যে খচ খচ করে- ছেলের তাকৎ মায়ের দুধে আর মায়ের দুধ হয় মসুর ডালে।
খানিক পরেই মহতোগিন্নী আসেন, প্রসূতির তদারক করতে। হাজার হোক ছেলে মানুষ তো বুধনী। মা হলে কি হয় পেটে থেকে পড়েই কি লোক আঁতুরঘরের বিধি বিধান শিখে যাবে। কাল স্নান করার দিন। মহতোগিন্নী না দেখাশুনো করলে পাড়ার আর কার গরজ পড়েছে বলো। মহতোগিন্নী হওয়ার ঝক্কি তো কম নয়। এসেই প্রথম জিজ্ঞাসা করলেন বুধনীকে মসুর ডালে রসুন ফোড়ন দিয়েছিলে না আদা ফোড়ন? দোকান বন্ধ ছিল। কে বলল! তোমার পুরুখ [৪৫] আমি নিজের চোখে দেখে এলাম খোলা রয়েছে। দেখে আসা কেন আমি নুন কিনে এনেছি।… তারপর চলে মহতোগিন্নীর গালাগালি ঢোঁড়াইয়ের বাপকে বুধনীও সঙ্গে সঙ্গে রসান দেয়। পাড়ায় অন্য কোনো বয়স্ক পুরুষকে এরকম ভাবে বকতে মহতোগিন্নী নিশ্চয়ই পারতেন না। কিন্তু এ মানুষটিকে সবাই বকতে পারে।
তারপর মহতোগিন্নী চলে গেলে ঐ পুরুখ বুধনীর কাছে সব কথা খুলে বলে নিজের দোষ স্বীকার করে।
বুধনী মনে মনে হাসে এমন পুরুখের উপর কি রাগ করে থাকা যায়। লোকের ঠাট্টাটা পর্যন্ত বোঝে না এ মানুষ; না হলে কাল হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে আমাকে খবর দেওয়া হল যে, রতিয়া ছড়িদার রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করেছে ওকে যে ছেলের রঙ মকসূদনবাবুর গায়ের রঙের মতো হয়েছে নাকি।
[৩৯. জিরানিয়া। ৪০. এক প্যাকেট লণ্ঠন মার্কা সিগারেট। সিগারেটটির নাম ছিল রেড ল্যাম্প। ৪১. দিল্লী দরবার(১৯১২)]। ৪২. তাৎমারা কথা বলবার সময় ধ্বনিপ্রধান শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করে। ৪৩. সতীশবাবু। ৪৪. বিড়ালের বাচ্চাটার (আদরে)। ৪৫. স্বামী।]
.
বুধনীর বৈধব্য ও পুনর্বিবাহ
ঢোঁড়াই হয়েছিল বেশ মোটাসোটা। রংটাও কালো না-মাজা মাজা গোছের-তাৎমারা বলে গরমের রং। তার বাপ সন্ধ্যার সময় কাজ থেকে এসেই ছেলে কোলে নিয়ে বসত। ছেলে হওয়ার পর থেকে সে রাতে পাড়ার ভজনের দলে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই নিয়ে পাড়ার লোকের কত ঠাট্টা। বুধনী উনুনের ধারে উঠনে বসে। আর সে বসে দরজার ঝাঁপের পাশে ছেলে কোলে নিয়ে বুধনীর সঙ্গে গল্প করতে।
বকড়-হাট্টা-আ-আ
বড়দ বাট্টা-আ-আ
সোজা পাঠঠা-আ-আ
(ছাগলের হাট, বলদের চলার পথ, শুয়ে পড় জোয়ান), ঘুমপাড়ানী গান শুনতে শুনতে ছোট্ট ঢোঁড়াই ঘুমিয়ে পড়েছে বাপের কোলে।
বুঝলি বুধনী এ ছোড়া বড় হয়ে আমার বংশের নাম রাখবে। একে লেখাপড়া শেখাব চিমনী বাজারের বুড়হা গুরুজীর কাছে। রামায়ণ পড়তে শিখবে, পাড়ার দশ জনকে রামায়ণ পড়ে শোনাবে; ধাঙরটুলি, মরগামা, কত দূর দূর থেকে লোক আসবে ওর কাছে, খাজনার রসিদ পড়াতে। ভারি তেজ ছোড়াটার; দেখিস না এই বয়সেই কোলে নিলেই ছোট ছোট আঙুল দিয়ে খাবলে ধরতে চায় আমার কান আর নাক। ঘুমন্ত ছেলের গাল দুটো টিপে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ওনামাসি ধং গুরুজী পড়হং;–কিরে পড়বি? পড়ে উড়ে খোকন আমার, ভিরগু তশীলদারের মতো জজ সাহেবের পাশে কুশীতে বসে সেসরী (দায়রা কোর্টের এসেসর) করবে। আমার সেসর সাহেব ঘুমুলো; আমার সেসর সাহেব ঘুমিয়েছে। নে বুধনী, চাটাইটা ঝেড়ে একে শুইয়ে দে। কিন্তু এত সুখ বুধনীর সইল না।
সেই যেবার কলস্টর সাহাব জিরানিয়ায় হাওয়া গাড়ি আনলেন, প্রথম, সেই-বারই ঢোঁড়াইয়ের বাপ মারা যায়। ঢোঁড়াই তখন বছর দেড়েকের হবে।
শহরে, দেহাতে, তাৎমাটুলিতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তামাম হল্লা-কলস্টার সাহেব হাওয়া গাড়ি এনেছেন অনেক টাকা দিয়ে। আপনা থেকে চলবে,- বিনা ঘোড়েকা-পানিতে আর হাওয়ায় চলবে। আজ প্রথম চলবে হাওয়া গাড়ি। কলস্টর সাহেব যাবেন চাঁদমারির মাঠে- যেখানে সাহেবো ফৌজের উর্দী পরে বন্দুক চালানো শেখে-দমাদ্দম, দমাদ্দম্। বড়া নিশানা ঠিক কলস্টরের হাতের; তার ধাঙড় মালী বড়কাবুদ্ধু বলে যে, মেসসোহেবের হাতে পেয়ালা রেখে নাকি গুলি মেরে চুরচুর করে দেয়। চাঁদমারীর মাঠে কাউকে যেতে দেয় না-ওটা পড়ে সাহেব পাড়ায়। কেউ গেলেই আর দেখতে হচ্ছে না; সোজা হিসাব নও দো, এগারহ (নয় আর দুয়ে এগারো) একেবারে সিধা ফাটক।
তাই লোকে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়েছিল কামদাহা রোডের দুপাশে-হাওয়া-গাড়ি দেখবার জন্য। ঢোঁড়াইয়ের বাপের হয়েছিল জ্বর কদিন থেকে। নিশ্চয় পেয়ারা খেয়ে, কেননা সেটা বাতাবি লেবুর সময় নয়। জ্বর কী জন্যে হয় তা আর তাৎমাদের বলে দিতে হবে না- সবাই জানে, আশ্বিনের পর জ্বর হয় বাতাবিলেবু খেয়ে, আর আশ্বিনের আগে জ্বর হয় পেয়ারা খেয়ে।
কলস্টর কখন যাবেন চাঁদমারীর মাঠে তা কেউ জানে না। সেই জন্য সকাল থেকে ঢোঁড়াইয়ের বাপ দাঁড়িয়েছিল রোদ্দুরে হাওয়া-গাড়ি দেখবার জন্য। ভয় ভয়ও করছিল- জিনে (ভূত) কলের ভিতর থেকে গাড়ি চালাচ্ছে সে ভেবে নয়-এত বোকা সে নয়,-ওসব ছেলেপিলেরা ভাবুক না হয় দেহাতী ভূতরা ভাবুক- সে ঠিকই জানে যে, হাওয়া-গাড়ি চলে পানি আর হাওয়াতে। তবে তার ভয় করছিল যে, গাড়িটা আবার তার গায়ের উপর এসে না পড়ে-কলকব্জার কম্ম, বলা তো যায় না। ঐ আসছে! আসছে!
শব্দ হচ্ছে রেলগাড়ির মতো। কেমন দেখতে কিছুই বোঝা যায় না, কেবল ধুলোয় না ধুলো কেন হবে, ধোঁয়া। ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার! আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ হাওয়া গাড়ির। দপ্ করে আগুন জ্বলে ওঠে-প্রথমে অল্প তারপরে হঠাৎ দাউ দাউ করে। কী হয়ে গেল হাওয়া-গাড়ির! হাওয়া আর পানির গাড়ি আগুন হয়ে গেল। অধিকাংশ লোকই যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে। কেউ কেউ আগুনের দিকে এগিয়ে যায়। জ্বর গায়ে ঢোঁড়াইয়ের বাপ পালাতে আর পারে না।
ধুঁকতে ধুঁকতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি যখন পৌঁছায় তখন ঢোঁড়াই ঘুমুচ্ছে। বুধনী আসছে জল নিয়ে ফৌজি ইঁদারা থেকে। ফৌজের লোকদের কোশী-শিলিগুড়ি রোড দিয়ে মার্চ করে যাওয়ার সময় দরকার লাগবে বলে, এই ইঁদারাগুলো পথের ধারে ধারে বানানো হয়েছিল একসময়ে। আগেই ইঁদারাতলায় হল্লা হয়ে গিয়েছে যে পানি ছিল না বলে হাওয়া-গাড়ি জ্বলেছে। তাই বুধনী হাঁকুপাঁকু করতে করতে এসেছে, খুটিয়ে আসল খবর নেওয়ার জন্য পুরুখের (স্বামীর) কাছ থেকে। মাই গে! এ আবার কী! এসে দেখে পুরুখ চাটাইয়ের উপর শুয়ে কাতরাচ্ছে। চোখ দুটো লাল শিমুল ফুলের মতো। গা পুড়ে যাচ্ছে। কলসী ভরা জল খেতে চায়! খাও আরও পেয়ারা! বাপের কাতারানির চোটে ঢোঁড়াই ওঠে। এদিকে বাপ চেচাঁয়, ওদিকে ঢোঁড়াই চেঁচায়। বাপে বেটায় চমৎকার! তারপর কদিন জ্বরে বেহুঁস। ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, জড়বুটি, টোটকা টাটকী অনেক হল। কিছুতেই কিছু নয়। জ্বরের ঘোরে গজর গজর গজর গজর কী সব বলে, কখনও বোঝা যায় কখনো ৰা যায় না। কখনোও ঢোঁড়াই, কখনও সেসর সাহেব, কখনও হাওয়া-গাড়ি। কদিন কী টানাপোড়েনই না গিয়েছে বুধনীর। তারপর তো শেষই হয়ে গেল সব।
একটা পয়সা নেই ঘরে। কিছুদিন আগে থেকেই রোজগার বন্ধ ছিল জ্বরের জন্য। বুড়ো নুনুলাল তখন মহতো। সে ছিল মহতোর মতো মহতো। পুলিশের হাত থেকে আসামী ছিনিয়ে নেবার তার নাকি একতিয়ার ছিল। সে পঞ্চায়তির জমা টাকা থেকে এক টাকা দশ আনা খরচ করে নাপিত, ঘাট কিরিয়াকরম (ক্রিয়াকর্ম) সব করিয়ে দেয়। দেড় বছরের ঢোঁড়াই মাথা নেড়া, হাসে, আর গাঁসুদ্ধ লোকের যে মাথা দেখে চেনা মুখকেও চিনতে পারে না। বুধনী কপালের মেটে সিঁদুর দিয়ে আঁকা চাঁদটা মুছে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে।
অভ্যাস মতো মহতো বলে
ছিতি জল পাবক গগন সমীরা
পঞ্চরচিত অতি অধম শরীরা। [৪৬]
ওঠ বুধনী। এখানে বসে বসে কাঁদলেই কি চলবে। কোলের ছেলেটার কথাও তো ভাববি?
বুধনী বিধবা ছিল প্রায় বছর দেড়েক। বর্ষা নামলেই শুকনো বকরহাটটার মাঠ নতুন ঘাসে সবুজ হয়ে যায়। এর পর মাস কয়েক বধুনী ঘাস বিক্রি করে টৌনে। অঘ্রাণে যায় ধান কাটতে পুবে। মাঘ মাসে বুনো কুল, ফাগুন চোতে শিমুল তুলো-আর কচি আম, বাবু ভাইদের বাড়ি বিক্রি করে। এ দিয়ে পেট চালানো বড় শক্ত। অন্য কোন রকম মজুরি করা তাৎমা মেয়েদের বারণ। তার উপর ঢোঁড়াইটাও আবার ভাত খেতে শিখল, আস্তে আস্তে। দু-দুটা পেট চালাতে বড় মেহনত করতে হয়। তাও চলে না। বাবুভাইয়ারা আনাগোনা আরম্ভ করেন; বাবুলাল ঘোরাঘুরি করে তার বাড়িতে। পাড়াপড়শী, নায়েব, মহতো সবই খোঁটা দেয়- মেয়ে মানুষ আবার বিধবা থাকবে কি!
বুধনীও ভাবে, যদি অন্যের পয়সাই নিতে হয়, তবে বয়স থাকতে তাকে বিয়ে করাই ভাল। তার বয়সও ছিল আর সিনুর লাগনোর [৪৭] সখ যে ছিল না তা নয়। বাবুলালটা আবার এরই মধ্যে ডিস্টিবোডে ভাইচেরমেন সাহেবের চাপরাসীর কাজ পেয়ে গেল। লোকটা বড় হিসেবী। সে নিজের বিড়িতে একসঙ্গে দুটোর বেশি টান দেয় না। তারপর নিবিয়ে কানে গুঁজে রাখে। বুধনীকে সে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু তিন বছরের ঢোঁড়াইয়ের ভার নিতে চায় না। চুমৌনা [৪৮] করতে ইচ্ছে হয় কর, না করতে ইচ্ছে হয় কোরো না; তা বলে পরের ছেলের ভার নিচ্ছি না।
অনেক গড়িমসি করবার পর বুধনী মন ঠিক করে ফেলে।
একদিন সকালবেলায় গোঁসাইথানে বৌকাবাওয়ার পায়ের কাছে ছেলেটাকে ধপ করে নামায়। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে নিজের দুঃখের কথা বলে। তারপর ঢোঁড়াইকে ঐখানে রেখেই বাবুলালের বাড়ি চলে যায়। ঢোঁড়াই তখন আঙুল-চোষা ভুলে বাওয়ার ত্রিশূলটা নিয়ে খেলা করছে। বাওয়া দেখে যে তার গভীর নাভিকুণ্ডের উপর তিনটে রেখা পড়েছে, ঠিক বালক শ্রীরামচন্দ্রজীর যেমন ছিল [৪৯]।
[৪৬. মাটি জল আগুন আকাশ বাতাস- এই দিয়েই নশ্বর দেহ রচিত। ৪৭. বিয়ে করবার। ৪৮. সাঙ্গা। ৪৯. কটি কিঙ্কিনী উদয় ত্রয় রো।]
.
বস্ত্রলাভের উপাখ্যান
বুধনীকে বৌকা বাওয়া দোষ দেয়নি, পাড়ার লোকেও দেয়নি। করতই বা কী বেচারি। বিয়ে বিধবাকে করতেই হবে-যদি ছেলেপিলে হবার বয়স না গিয়ে থাকে। রইল- ছেলের কথা। এখন বাবুলাল খাওয়াতে রাজী না, তা বুধনী কী করবে। মাকে ছেড়ে ছেলেটা কান্নাকাটি বিশেষ করেনি। প্রথম প্রথম যখন তখন মার কাছে পালিয়ে যেত। বাবুলাল বাড়িতে থাকলে বিরক্ত হয়ে ওঠে, তখন বুধনী কোলে করে ঢোঁড়াইকে থানে পৌঁছে দিয়ে যায়। দিনকয়েকের মধ্যে ছেলেটা বুঝে গেল যে, দুপুরবেলায় বাবুলাল থাকে না বাড়িতে। কিন্তু এই দুপুরবেলায় বুধনীর কাছে যাওয়ার অভ্যাসও দু-তিন মাসের মধ্যে আস্তে আস্তে কেটে যায়। ও যে ওখানে অবাঞ্ছিত, সেটা বুঝে না বন্ধুদের সঙ্গে খেলার টানে, বলা শক্ত। ছেলেটা কান্নাকাটি করে না, তবে দিন দিন রোগা হয়ে যায়। বাওয়া ব্যস্ত হয়ে ওঠে-দিব্যি দামাল ছেলে ছিল।
নাভি গঁভীর জান জিনহ দেখা ॥ তুলসীদাস : বালকাণ্ড।
একজন পশ্চিমা ফৌজের লোক বহুদিন আগে চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে না পেন্সন নিয়ে জিরানিয়ার বাজারে একটা রামজীর মন্দির বানিয়েছেলেন। সে যুগে তাঁকে লোকে বলত মিলিট্রি বাওয়া তার একটা পোষা চিতাবাঘ ছিল। তারই হাতে নাকি মিলিট্রি বাওয়ার প্রাণ যায়। মন্দিরের উঠোনে তাঁর বাঁধানো সমাধিস্থান আছে। আর এই মন্দিরের নাম হয়ে যায় মিলিট্রি ঠাকুরবাড়ি।
বৌকা বাওয়া রোজ যেত মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে নামে নারায়ণ শুনতে, আসলে গাঁজা খেতে।
বাওয়া দেখে যে, ঢোঁড়াই রোগা হয়ে যাচ্ছে; পাঁজরার হাড়গুলো গোনা যাচ্ছে, এই মায়ে-খেদানো বাপ মরা ছেলেটির। রামজীই পাঠিয়ে দিয়েছেন তার কাছে এখন তাঁর মনে কী আছে, কে জানে। রোগটা জানা রোগ; সবাই জানে যে ছেলেটার হয়েছে বাই উখড়ানোর [৫০] রোগ। এ রোগে পাত, শিকড়ে কিছু উপকার হয় না, তবে দুধে হয়। দুধ তো বাবু-ভাইয়াদের জন্য! তারা রাজা লোগ। পরমাত্মা তাদের দুধ খাবার সামর্থ্য দিয়েছেন। তবে বাইউখড়োলে শুষনির শাকটাও বেশ উপকার করে ভাত আর শুষনির শাক দুবেলা; না হয় শষনির শাক, আর কাঁচা চিড়ে না ভিজিয়ে। মুড়ি খবদ্দার না- পেট খারাপ করে মুড়ি, আর ঘর খারাপ করে বুড়ি…।
ভাবতে ভাবতে বাওয়ার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে; ঢোঁড়াইটাকে একটু দুধ টুধ খাওয়াবার এক উপায় করে দেখলে হয়।
সে ঢোঁড়াইটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে। এক মিনিটের মধ্যে ঢোঁড়াই মোহন্তজীর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিল। ল্যাংটা ঢোঁড়াইকে চিমটেটা দেখিয়ে মোহান্তজী বলেন, খবদ্দার পিসাব [৫১] করো না এখানে। ওই হাড়-জিলজিলে ছোড়া কোথায় একটু ভয় পাবে, তা-না খলখল করে হাসে। সেই দিন থেকেই রামায়ণ শুনলেই ঢোঁড়াইয়ের পাকা প্রসাদী (ভোগের প্রসাদ) মঞ্জুর হয়ে যায়। এইতেই বাইউখড়োনোর অসুখের হাত থেকে ছোঁড়াটার জান বেঁচে যায়।
না, না, এতে বাওয়ার কিছু কৃতিত্ব নেই। যিনি পাঠিয়েছিলেন ঢোঁড়াইকে তার কাছে, তিনিই ছেলেটাকে প্রসাদ দিচ্ছেন। তাঁরই কৃপাতে এ ছেলে বেঁচে বর্তে থাকলে সে বাওয়ার উপযুক্ত চেলা হবে। আবছা স্বপ্নরাজ্য বাওয়ার চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে… গোঁসাইথানে প্রকাণ্ড মন্দির হয়েছে মিলিট্রি ঠাকুরবাড়ির চাইতেও বড় বড় নৈবেদ্যর থালায়। মন্দিরের মতো করে চিনি আর পাকার করে পেঁড়া সাজানো। ঢোঁড়াইকে ঐ থানের পূজারী করে, না পূজারী কেন হবে, মোহান্তের চাঁদর [৫২] দিয়ে সে চলে গিয়েছে অযোধ্যাজী…
করউঁ কাহ মুখ এক প্রশংসা [৫৩]…মাত্র একটা মুখ, তাও কথা বলতে পারি না। …তা দিয়ে তোমার আর কতটুকু প্রশংসা করতে পারি রামজী!
তোমার কৃপা না হলে যেদিন মোহন্তজী সরকারকে লড়ায়ে জেতাবার জন্য যজ্ঞ করলেন মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে, সেদিন ঢোঁড়াইকে নিজে সামনে বসে পুরী হালুয়া খাওয়ালেন- যত খেতে পারে। সে কী হালুয়া! ঘিয়ে জবজব জবজব। যত না ঘি আগুনে ঢালা হয়েছিল তার চাইতেও বোধ হয় বেশি ঢালা হয়েছিল হালুয়ার প্রসাদে। চারিদিক থেকে সকলে ঢোঁড়াইয়ের খাওয়া দেখছে; ঢোঁড়াই য়ের কেমন যেন লজ্জা করে। মোহন্তজী ঢোঁড়াইয়ের পাতের একখানা পুরী দেখিয়ে বৌকা বাওয়াকে বুঝোন যে, পুরীর মোটা দিকটা এমন কড়া করে কোথাও ভাজে না, কেন ভাজে না। এ হচ্ছে সীতারামের খাওয়ার জন্যে, এতে কি ফাঁকি দেওয়া চলে।
তারপর মোহন্তজী বাওয়াকে কড়া পুরীর প্রসাদ চাখানোর জন্যে, বড় চেলাকে হুকুম দেন।
ঢোঁড়াই আর বাওয়ার চোখাচোখি হয়। বাওয়ার মনে হয় যে, ঐ একরত্তি ছোঁড়াটা যেন বুঝছে যে, বাওয়া যে পুরী পেল খেতে, সেটা মোহন্তজীর সঙ্গে ঢোঁড়াইয়ের এত আলাপ সেই জন্যে।…
হয়তো এটা বাওয়ার ভুল; কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরবার সময়, মোহন্তজী যখন বাওয়াকে একখানা কাপড় দিলেন, ছিঁড়ে লঙট আর গামছা করবার জন্য, তখন ঢোঁড়াইয়ের কী কান্না! কাপড়খানা যেন তারই পাওয়ার কথা ছিল।
এস, ডি, ও, সাহেব এসেছিলেন যজ্ঞ দেখতে সকালবেলায়। তিনিই খুশি হয়ে মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে যজ্ঞের জন্য তিনজোড়া লাটুমার রৈলী অর্থাৎ লাটু মার্কা র্যালি ব্রাদার্সের কাপড় সরকারী খাজনা [৫৪] থেকে দেন। তারই একখানা মোহন্তজী বাওয়াকে দিয়েছিল।
ঢোঁড়াইয়ের কান্না আর থামে না। বাওয়া বুঝোয় তোর জন্যেই তো নিয়ে যাচ্ছি, তোকেই তো দিয়েছেন মোহন্তজী।
না, আমি আর কোনদিন যাব না রামায়ণ শুনতে। আমাকে দিলে বড় কাপড় দেবে কেন?
বাবুলাল ঐ কাপড় দেখে বলে, বাওয়া তুমি পরতে লেঙট। তুমি এ পাড়ওয়ালা কাপড় নিয়ে করবে কী। সরকারী গিরানির [৫৫] দোকান আছে না, সেখানে থেকেই হাকিম, বাঙালিবাবু আর চাপরাসীদের শস্তায় কাপড় চাল দেয়, সেখানে থেকে আমি পেয়েছি খুব ভাল মার্কিন, জাপৈনী (জাপানী) আট আনা করে, পাঁচ-শ পঞ্চান্ন নম্বর থেকেও ভাল জিনিস। পাঁচ গজ তাই দিচ্ছি তোমাকে- এ ধুতি আমাকে দাও। বাওয়া খুশি। তা না হলে অতবড় কাপড় কি ঢোঁড়াই পরতে পারে।
এই মার্কিন ছিঁড়ে ঢোঁড়াইয়ের প্রথম কাপড় হল। লেঙট ছাড়া চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত সে এই কাপড়খানাই দেখেছে।
বাওয়া আবার কাপড়খানা নিয়ে যায় পাক্কীর ধারের কপিল রাজার বাড়িতে। কুলের ডালের পোকা থেকে গালার খুঁটে তোয়ের করে চালান দিত কপিল রাজা। তার উঠোনের গামলায় থাকে লাল রং গোলা। তাই দিয়ে বাওয়া ঢোঁড়াইয়ের ধুতি রং করে দেয়। এই ধুতি কোনো রকমে কোমরে বেঁধে ঢোঁড়াই পাড়াসুদ্ধ সকলকে দেখিয়ে আসে মিলিট্রি ঠাকুরবাড়ির মোহন্তজী দিয়েছে তাকে। কেউ বুঝুক আর নাই বুঝুক, সে সকলকে বোঝাতে চায় যে, মোহন্তজী এ কাপড় বাওয়াকে দেয়নি। পাঁচ বছর তো বয়েস হবে, কিন্তু তখনই সে কারও কাছে ছোট হতে চায় না-বাওয়ার কাছে পর্যন্ত না। তবে বাবুভাইয়ারা বড় আদমী, তাদের দেখলেই আদাব করতে হবে; আর সাহেব দেখলে কাছাকাছি থাকতে নেই, এ তাৎমাটুলির সব ছেলেই জানে। ওর মধ্যে ছোট হওয়ার প্রশ্ন নেই।
ঢোঁড়াইয়ের ইচ্ছে যে কাপড়খানা পরে থাকে,-তার কোনো বন্ধুর কাপড় নেই, ঐ কাপড়খানা দেখিয়ে তাদের চেয়ে একটু বড় হয়, কিন্তু বাওয়া কিছুতেই তাকে কাপড়খানা পরতে দেবে না; তুলে রেখে দেবে। লাল কাপড় পরে ভিক্ষে চাইতে গেলে লোকে এক মুঠিও চাল দেবে না। ও কাপড় পরে দেখতে যেতে হয় তামাসা, মেলা মোহরমের দুলদুল ঘোড়া। তবুও হারামজাদা ছেলেটা মুখ গোঁজ করে বসে থাকবে। ঢোঁড়াইকে ভয় দেখানোর জন্য বাওয়া চিমটে ওঠায়।
[৫০. বায়ু উপড়োবার রোগ। যে কোন অনিশ্চিত রোগকে এখানকার অশিক্ষিত লোকেরা বলে, বাই উখড়োনো ব্যারাম। ৫১. প্রস্রাব। ৫২. মহন্ত পদের নিদর্শন। ৫৩. একটিমাত্র মুখ দিয়ে তোমার আর কতটুকু প্রশংসা করিতে পারি?-তুলসীদাস থেকে। ৫৪. গভর্নমেন্ট ফাণ্ডা। ৫৫. গিরানির অর্থ আক্রা! গভমেন্ট স্টোর। প্রথম মহাযুদ্ধের পর শস্তায় কাপড় দেওয়া হত সেখান থেকে, সকলে পেত না এ কাপড়।]
.
ঢোঁড়াইয়ের মায়ের সন্তানবাৎসল্যের বিবরণ
ছোঁড়াটা বুধনীর কাছে যেতে চায় না, এর জন্য বাওয়া বুধনীকে দোষ দেয় না। বাওয়া যতদূর জানে বুধনী কোনো দিন ঢোঁড়াইকে হতশ্রদ্ধা করেনি। করবে কী, নিজে পেটে ধরেছে যে। আর একটা চুমৌনা করেছে বলে কি নিজের নাড়ীর সম্বন্ধটা ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে পারে। তা হয় না, তা হয় না। রামজী তেমন মানুষ গড়েননি। সময়ে অসময়ে বুধনী ঢোঁড়াইয়ের জন্য করেছে বইকি।
ঐ যখন জার্মানবালা রথ তারা হয়ে আকাশে ছুটে যেত;- সে রথ কোথায় নামে, কী করে, কেউ বলতে পারে না; বাওয়া অবশ্য সে রথ দেখেনি তবে তার চাকার কালো দাগ কচুর পাতার উপর তাৎমাটুলির সবাই দেখেছে; সেই সময় বুধনী কতদিন বাবুলালকে লুকিয়ে ঢোঁড়াইকে ভাত খাইয়েছে। তখন চালের দাম উঠেছে দু আনায় আধ সের। ঐ আক্রাগণ্ডার দিনে ভিক্ষে আর দিত কজন,–সে সাধুকেই হোক আর সন্তাকেই-হোক। তখন অফসর আদমীদের সরকারী দোকান থেকে শস্তায় চাল দিত! বাবুলালের বাড়িতে সেই জন্যে চালের অভাব ছিল না। তখন যদি বুধনী ঢোঁড়াই কে লুকিয়ে চুরিয়ে না খেতে দিত তা হলে সাধ্যি কি বাওয়ার, সে সময় ঐ ছেলে মানুষ করা। সে সময় অতটুকু ছেলে রামায়ণের চৌপই গেয়ে ভিখ মাঙলেও টৌনের কোনো গেরস্থ উপুড়হস্ত করত না।
আর কেবল খাওয়ানো কেন, ঢোঁড়াইয়ের উপর বুধনীর প্রাণের টান বাওয়া আরও একদিন দেখেছে। মিছে বলবে না। পাড়ার মেয়েরা যে যা বলুক। বাওয়া নিজের চোখে সাক্ষী, আর সাক্ষী ভূপলাল সোনার [৫৬]। ভূপলাল সোনারের নাও মনে থাকতে পারে, সে রাজা আদমী, তার গাহকীর ভরমার [৫৭]। ঢোঁড়াই তখন পাঁচ ছ সালের (বছরের) হবে। বাবুলাল গিয়েছে ভাইসচেরমেন সাহেবের সঙ্গে দেহাতে, দিন কয়েকের জন্যে। বুধনীর তখন দুখিয়া পেটে। এমনি তো বাবুলাল বৌকে বাড়ির কাজ করতে দেয় না; ইজ্জৎবালা আদমী [৫৮] সে। তাই বুধনী সেই ফাঁকে সাত আনা পয়সা রোজগার করেছিল। লগা দিয়ে শিমুল ফল পেড়ে, সঙ্গে সঙ্গে ফাটিয়ে, সেই ভিজে শিমুল তুলা বেচেছিল কিরানীবাবুর জানানার কাছে। [৫৯] কিরানীবাবু বাবুলের অফিসের মালিক। বুধনীর ভারি ইচ্ছে ঢোঁড়াইকে চাদির জেবর [৬০] দেয়- কোনো দিন তো কিছু দেয়নি। বুধনী বাওয়াকে বলে, দাও বাওয়া একটা চাদির সিকি কিনে ভূপলাল সেকরার দোকান থেকে ঢোঁড়াইয়ের ঘুনসিতে দেবার জন্য। বাওয়ার ভারি আনন্দ হয় কথাটা শুনে। একটু ভয় ভয়ও করে, চাঁদির ঘুনসিটা লেঙটের তলায় ঢেকে রাখতে হবে ঢোঁড়াইয়ের, না হলে ভিক্ষে জুটবে না। বাওয়ার সেদিনকার কথা সব মনে আছে, তার ঢোঁড়াই গয়না পাবে, আর তার মনে থাকবে না সেদিনকার কথা। সেদিন বাওয়া আর ঢোঁড়াই মিলিট্রি ঠাকুরবাড়ি থেকে রামায়ণ সেরে, যখন ভূপলাল সোনারের দোকানে আসে, তখন বুধনী ওকে একটা বিড়িও ধরিয়ে দিয়েছিল। ও ছেঁড়া তখনও কাশে। ভূপলাল সোনার তো শুনেই আগুন। ভারি আদমি (বড়লোক)- তার কথার ঝাঁঝ থাকবে না? সে বলে সিকির দামই তো হল আনা- তার উপর শালা পুলিশদের নজর বাঁচিয়ে দিতে হবে। বুধনী ভয় পেয়ে বলে যে ঘুনসি করলে যদি পুলিশে ধরে, তবে অন্য কিছু করে দাও সিকি দিয়ে। ভূপলাল হুংকার দিয়ে ওঠে- জাহিল আওরৎ, [৬১] কিছু বুঝবে না কথাটা, আরে করে দাও করে দাও। আমার কাছে সোজা কথা, সাত আনায় হবে না। সিকির উপর আবার ছেঁদা করার মেহনত না আছে।
সে অন্য খদ্দেরের সঙ্গে কথা আরম্ভ করে। তখন আর কী করা যায়। বাওয়া বুধনীকে নিয়ে যায় ছত্তিস বাবুর দোকানে সওদা করাতে। ঐ পুরো সাত আনা খরচ করে বুধনী সেখান থেকে কেনে কজরৌটি[৬২]-পেটের ছেলের জন্য। এর দেড় দুমাস পরে দুখিয়া আসে ওর কোলে। বাওয়ার সেদিন কী দুঃখই হয়েছিল। অমন একটা গয়না ছেলেটা পেতে পেতে পেল না। রাগ করবে সে কার উপর। ভুপলাল সোনারও অন্যায় কিছু বলেনি। বুধনীকেই বা কী বলা যায়। দেড় মাস পরই কাজললতাটার দরকার; ওর নিজের কামানো পয়সা; আর মায়ের মনের শখ। ভুপলাল দিলে কি আর ও ঘুনসির চাঁদি কিনত না।
ঢোঁড়াইটারও সেই সময় যেন একটু চোখ ছলছল করেছিল;–ও ছোঁড়া কাঁদতে তো জানে না।
বুধনী লোভে পড়ে ঝোঁকের মাথায় কাজললতাটা কিনবার পর নিজেকে একটু দোষী দোষী মনে করে। ভাবে ঢোঁড়াই আর বাওয়ার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে সে। তার পেটের ছেলের জন্য কাজললতা, বাবুলাল নিশ্চয়ই কিনে দিত। তবে নিজের রোজগার করা পয়সা ও কাজে খরচ করবার কী ছিল।
আসলে ঢোঁড়াইয়ের উপর টান তার একটু কমেছে। ঢোঁড়াই ঠিকই ধরেছে- ছোট ছিলেপিলের মতো এ জিনিস বুঝতে আর কেউ পারে না।
তাই মধ্যে মধ্যে বুধনী ঢোঁড়াইকে আর বিশেষ করে বাওয়াকে জানিয়ে দিতে চায় যে, তার ছেলের উপর ভালবাসা একটুও কমেনি- যেটুকু কম লোকে দেখে তা বাবুলালের ভয়ে। এইটা জানানোর জন্যই বুধনী বাওয়াকে নিয়ে গিয়েছিল ভূপলাল সোনারের দোকানে।
নিজের দোষ কাটানোর জন্যেই না কি সে দিনকয়েকের মধ্যেই ঢোঁড়াইকে ডেকে পেট ভরে মিঠাই খাওয়ায় একেবারে হঠাৎ। ভাইসচেরমেন সাহেব ডিস্টীবোডে লড়াই থামবার জন্য ভোজ আর দেওয়ালী করেছিলেন। সেদিন মশার ছবির তামাসা দেখিয়েছিল সেখানে। সারা দেওয়াল জোড়া অত বড় কখনও মশা হয়? ভাগ! ওসব দেহাতীদের বোঝাস! কিরানীবাবু মোচ মুড়িয়ে কিষণজী ভগবান [৬৩] সেজেছিলেন। সে দেখলে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়। কলস্টার সাহেব-তাকে ওখানে বলে চেরমেন সাহেব [৬৪] তিনি পর্যন্ত দেখেছিলেন। ভাইসচেরমেন সাহেব তাঁকে লাটক বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। সেইদিন বাবুলাল বাড়ি আসবার সময় ভাইসচেরমেন সাহেবের চিঠি রাখবার যে বেতের ঝুড়ি ভরে কত রঙবেরঙের মেঠাই এনেছিল, বুধনী সে সবের নামও জানে না। জানতে চায়ও না। তার বরাতই অমনি। সেবার দরবারের তামাসার সময় ও ছিল আঁতুড়ে; আবার, এবার যুদ্ধ থামবার সময়ও আঁতুড়ে। আঁতুড়ে তো মেয়েছেলেদের মিষ্টি খেতে নেই, তা এত মিষ্টি কী হবে। তাই ও নিজেই বাবুলালকে বলে, ঢোঁড়াইকে ডেকে নিয়ে আসতে। বাবুলালেরও মনটা খুশি ছিল- ছেলে হয়েছে নতুন। একটা দমকা উদারতার ঝেকে সে একখানা প্রকাণ্ড কচুরপাতা ভরে ঢোঁড়াইকে খাবার সাজিয়ে দেয়। বলে- বাওয়া যে গলায় তুলসীর মালা দেওয়া ভকত। না হলে তো তাকেও খাওয়াতাম।
বুধনী নতুন খোকাকে কোলে নিয়ে মাচার উপর বসে ছিল। সে বাবুলালকে বলে-তুমি একটু বাইরে বেরিয়ে এসো, তোমার সামনে ঢোঁড়াই খেতে পাচ্ছে না। লজ্জা আবার কিসের বলে একটু বিরক্ত হয়ে বাবুলাল চলে যায়।
ঢোঁড়াইয়ের খাওয়া হলে বুধনী ঢোঁড়াইকে কাছে ডাকে, একটু আদর করবার জন্য। অতটুকু কচি ছেলে কোলে নিয়ে উঠে আসতে পারে না।
ঢোঁড়াই গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্য দিকে তাকিয়ে। তার একটুও ভাল লাগে না এই লাল খোকাটাকে, আর তার মাটাকে; বাওয়ার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে। তার চোখ ফেটে কান্না আসবে বোধ হয়। রাম রাম্! সে কোনো কথা না বলে দৌড়ে পালিয়ে যায় থানের দিকে।
[৫৬. সেকরা। ৫৭. দোকান খদ্দেরে ভরা। ৫৮. সম্মানিত লোক। ৫৯. কেরানীবাবুর স্ত্রী। ৬০. রুপার গহনা। ৬১. নিরক্ষর স্ত্রীলোক। ৬২. কাজললতা। ৬৩. কেষ্ট ঠাকুর। ৬৪. তখন বেসরকারী লোক জেনাবোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারতেন না।]
.
রেবণগুণীর কৃপায় ঢোঁড়াইয়ের পুনর্জীবন লাভ
দুখিয়া হওয়ার পর থেকে বুধনী হয়ে যায় দুখিয়ার মা। পাড়ার সবাই তাকে ঐ নামেই ডাকতে আরম্ভ করে। আর সত্যি সত্যিই এর পর থেকে, ঢোঁড়াইয়ের কথা তার খুব সময়েই মনে পড়ে। একে ঢোঁড়াই মার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে চায়, আর এদিকে দুখিয়ার মারও সংসারের নানান লেঠা। দুখিয়ার মার ছোট্ট মনের প্রায় সমস্ত জায়গাটুকুই জুড়ে থাকে দুখিয়া। এ সোজা কথাটা বাওয়াও মর্মে মর্মে বোঝে, আর সেই জন্যই আজ দরকারে পড়েও তাকে ডাকতে ইতস্তত করছিল।
সেবার মাসখানেক থেকে তাৎমাটুলিতে চড়াইপাখি দেখা যাচ্ছে না। সবাই বলাবলি করে যে একটা বড় অসুখ শিগগিরই আসছে। তার উপর বাড়িতে নম্বর দিয়ে লোক গুণে গিয়েছে [৬৫] সকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে। তারপর যা ভাবা গিয়েছিল তাই। জিরানিয়ায়, তাৎমাটুলিতে, ধাঙড়টুলিতে, কী অসুখ! কী অসুখ! বাই উখড়োনোর ব্যারাম-বেহুঁশ জ্বর-ঝটদে বিমার পটদে খতম [৬৬]।
কপিল রাজার বাড়িসুদ্ধ সবাই উজাড় হয়ে যায় এই রোগে সেইবার। হবে না! বকরহাট্টার মাঠের সব শিমুল গাছ সে কাটিয়েছিল, চা চালান দেওয়ার বাক্স তৈরী করার জন্য। শিমুল তুলো যে তাৎমানীদের রুজী সে কথা একবার ভাবল না। কাটাচ্ছিলেন ওই নিরেট ধাঙড়গুলোকে দিয়ে। আহাম্মকগুলো বোঝে না যে ধাঙড়ানীদেরও শিমুল তুলো বেচে রোজগার হয়। সেই তো নির্ধ্বংশ হয়ে গেলি কপিল রাজা, কিন্তু যাওয়ার আগে ঝোটাহারদের রোজগার মেরে গেলি। থাকগে, সে যাদের স্ত্রী মেয়ে আছে তারা ভাবুগগে। কিন্তু তার তো সম্বল ঐ এক মাত্র ঢোঁড়াই।
সকালে ঢোঁড়াই ঘুম থেকে ওঠেনি। মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে রামায়ণ শুনতে যাওয়ার সময় হল, তবুও ওঠে না। বাওয়া ত্রিশূল দিয়ে খোঁচা মারে। হল কী ছোঁড়ার। বাওয়ার মনটা ছ্যাৎ করে ওঠে। কপিল রাজার বাড়ি থেকে একটার পর একটা মুর্দা বের করেছে-পর পর চারটে। নুনুলাল মহতো খতম হয়ে গিয়েছে গত সপ্তাহে….
গায়ে হাত দিয়ে দেখতে ভয় ভয় করে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে যা ভেবেছে তাই। ও ঢোঁড়াই কথা বল-চুপ করে কেন? ভিক্ষেয় বেরুনো, রামায়ণ শুনতে যাওয়া মাথায় চড়ে। এ কী করলে রামজী, আমার! এ রোগে তো ভাববার পর্যন্ত সময় দেয় না। দুখিয়ার মাকে খবর দেব কিনা, ডাকা উচিত হবে কিনা সেই কথাই বাওয়া ভাবছে। দুখিয়ার মা তো মনে হয় একেবারে ধুয়ে-মুছে ফেলে দিয়েছে ঢোঁড়াইকে মন থেকে। এক বছরের মধ্যে একটি দিন খোঁজ করেনি। বাওয়া ভেবে কূল-কিনারা পায় না। শেষ পর্যন্ত গিয়ে খবরই দেয়। তার পেটের ছেলে, কিছু একটা ঘটে গেলে, হয়তো সারাজীবন দুঃখ থেকে যাবে। আসতে ইচ্ছে হয় আসবে, মন না চায় আসবে না। বাওয়া নিজের কর্তব্য করবে না কেন।
খবর দিতেই দুখিয়ার মা আঁতকে ওঠে। দুখিয়াকে বাবুলালের কোলে ফেলে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আসে। আর যেন সে-মানুষই না। পুরনো বুধনী ফিরে এসেছে যেন। বাবুলাল পিছন থেকে হাঁ হাঁ করে। কে কার কথা শোনে। গোঁসাই নেমে এলেও তার পথ আটকাতে পারতেন না তখন। এসেই ওই নেতিয়ে পড়া ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। ঢোঁড়াই তখন বেশ বড়-বছর আষ্টেক বয়স হবে। ওই বুড়ো ধাড়ী ছেলেকে, কোলে নিয়ে ছোটে রেবণগুণীর বাড়ির দিকে। ওর গায়ে মহাবীরজী তাকৎ জুটোচ্ছেন। বাওয়া তো গুণীর বাড়ি যেতে পারে না; গেলে লোকে সে সন্নাসীকে মানে না। তাই সে খানিক দূরে সাথে সাথে গিয়ে পথের ধারে এক জায়গায় বসে পড়ে। সেখানে গিয়ে দুখিয়ার মা ঝাড়ফুঁকের কথা তুলতেই রেবণগুণী ফুঁ দিয়ে তামাক ধরাতে ধরাতে বলে,-তুই তো বাসি পেটে আসিসনি।
দুখিয়ার মা হকচকিয়ে যায়। সকালে কী খেয়েছে মনে করতে চেষ্টা করে। গুণী যখন বলেছে নিশ্চয়ই কিছু খেয়ে থাকবে। ওমা, সত্যিই তো! খয়নি তো সে খেয়েছে। ঐ যে তখন, বাবুলাল ডলে নিয়ে খাওয়ার সময় তাকেও একটু দিয়েছিল। উৎকণ্ঠায় জায়গায়–ভয়ের ছাপ পড়ে তার মুখে। রেবণগুণী তো চটে লাল। এই মারে তো এই মারে! তুই বুড়ো মাগী, জিন্দিগি গেল ছেলে বিইয়ে। সাতকাল তাৎমাটুলিতে কাটিয়ে তুই জানিস ঝাড়ফুঁক করতে আসতে হলে খালি পেটে আসতে হয়, ভোরবেলাতে আসতে হয়।
রেবণগুণীর নামে পাড়ার লোকে কাঁপে। তাৎমাটুলির আইবুড়ো মেয়েরা তাকে দূর থেকে দেখলে পালায়। মায়েদেরও মেয়েদের উপর সেই রকমই হুকুম। এক তো তুকতাকের ভয়; তার উপর থাকে চব্বিশ ঘণ্টা নেশা করে। পরপর ছটা বিয়ে করেছে, এখনও দুটোকে নিয়ে ঘর করে। গোঁসাই থানে যেদিন ভেড়া বলি হয়; সেদিন প্রতি বছর তার উপর গোঁসাই ভর করেন। সেই সময় সে ভেড়ার রক্ত কাঁচা খায়; মুখে গায়ে ভেড়ার রক্ত মেখে সে হুংকার ছাড়ে। সে কি আর করে? তার মধ্যে দিয়ে গোঁসাই কথা বলেন। তার হাতের বেতের ঘেরটা দিয়ে ছুঁয়ে সে যাকে যা বলবে, তা ফলবেই ফলবে। কুমারী মেয়েরা সে সময় পালায় সেখান থেকে। পাঁচবার সে একটা একটা একটা মেয়েকে ছুঁয়ে, তার সঙ্গে বিয়ের কথা বলছে। কোনও মা বাবার সাধ্যি নেই যে, সেই সময়কার গোঁসাইয়ের কথার নড়চড় হতে দেয়। পথে আসবার সময়ই দুখিয়ার মার এসব কথা মনে হচ্ছিল। কিন্তু গরজ বড় বালাই। ঢোঁড়াই টাকে বাঁচাতে হলে ঐ গুণী ছাড়া আর দ্বিতীয় লোক নাই। টোনের হাসপাতালে গেলে কোনো লোক আর বাড়ি ফিরেই আসে না। কপিল রাজা তো বাঙালি ডক্টর দিয়েও দেখিয়েছিল। কিছু কি হল?
রেবণগুণী গালাগালি দিয়ে চলেছে দুখিয়ার মাকে। ভরা দুপুরে কি মন্তরের ধক থাকে নাকি? বেরো শিগগির এখান থেকে। দুখিয়ার মা গুণীর পা জড়িয়ে ধরে, ডুকরে কাঁদে।–এটার বাবা নেই গুণী। তুমি একে পায়ে ঠেলো না।
গুণীর মেজাজ বোধ হয় গলেছে। বলে, কালই তো শনিবার। কাল আসিস। কাল তো আবার হাড়তাল না কী বলে, ওই কী একটা নতুন হয়েছে না আজকাল, গত বছরেও হয়েছিল একবার-দিনের বেলা সওদা মিলবে না, সাঁঝের পরে দোকান খুলবে, কাল আবার তাই আছে। সাঁঝের পর দোকান খুললে পান সুপারি কিনে নিয়ে রাতে আসিস। সিনুর তো তোর আছেই। ভানুমতীর [৬৭] দয়ায় সেরে যাবে এই বদমাসটা। বলে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে ঢোঁড়াইয়ের দিকে তাকায়। দুখিয়ার মার মনটা হাল্কা হয়ে ওঠে। রেবণগুণীর মন তা হলে গলেছে। সে বলেছে সেরে যাবে তার দুশ্চিন্তা অর্ধেক দূর হয়ে যায়। কিন্তু কাল রাত্তির পর্যন্ত দেরি করা কি ঠিক হবে? চিকিৎসা আরম্ভ করতে তার সবুর সয় না। কালই কি আবার ঐ কী যে বলে ছাই, হাড়তাল না কী না হলেই হত না। দুনিয়ার সকলের আক্রোশ কি তারই উপর? এখানে আসবার আগে রেবণগুণীকে যতটা ভয় ভয় করছিল, এখন কথাবার্তা বলার পর ততটা ভয় করে না। সাহসে বুক বেঁধে গুণীকে জিজ্ঞাসা করে- আচ্ছা আজকে পান সুপারি কিনে, কাল সকালে এলে হয় না। শনিবার আছে…
যা বললাম তাই কর-চিৎকার করে ওঠে গুণী, তোর বুদ্ধিতে আমি চলব, না আমার বুদ্ধিতে তুই চলবি?
দুখিয়ার মা ভয়ে কাঁপে- গুণীর মুখের উপর কথা বলা তার অন্যায়ই হয়েছে। গুণী একটু নরম সুরে বলে, আজকের কেনা পান সুপুরিতে মন্তর ধরবে না। আর ছেলেকে আনবার দরকার নেই। এখান থেকেই কাজ হয়ে যাবে। তুই একা এলেই চলবে। আজকের রাতে শোবার সময় ছেলেটার চোখে ধোঁধলের ফুলের রস দিয়ে দিস। আর মরণধারের এই মন্তর দেওয়া মাটি নিয়ে যা ওর কাঁপালে প্রলেপ দেওয়ার জন্যে। ঢোঁড়াই তখন দুখিয়ার মার কোলে নেতিয়ে পড়েছে। ঢোঁড়াই কে নিয়ে ফিরে আসবার সময় দুখিয়ার মার কানে আসে- রেবণগুণী আপন মনে বলছে…গত অমাবস্যাতে আদ্ধেক রাত্তিরে যখনই দেখেছি মুরবলিয়া [৬৮] ফৌজের দল পাক্কী দিয়ে গিয়েছে, তখনই বুঝেছি যে উজাড় হয়ে যাবে গাঁ। কাটা গলার উপর একটা করে পিদীপ জ্বলছিল।…ভয়ে তার প্রাণ উড়ে যায়।…যাক সে যাত্রা রেবণগুণীর কৃপায় ঢোঁড়াই বেঁচে যায়। ঝাড়ফুঁকের জন্য দুখিয়ার মাকে যে দাম দিতে হয়েছিল, তার জন্য সে কোনোদিন দুঃখিত হয়নি। ঐ রোগে কত লোক মরেছিল গাঁয়ে, শুধু রেবণগুণীরই মন্ত্রের জোরে ঢোঁড়াই বেঁচেছে, এ উপকার দুখিয়ার মা ভুলতে পারবে না। এমন শনিবার রাত্রের মন্তরের ধক যে, জ্বর ছাড়বার পরও যত বিষ শরীরে ছিল, কালো কালো রক্তের ছাপের মতো হয়ে, নাকের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে ছিল কদিন ধরে।
অসুখ সারবার পরও এক হপ্তা দুখিয়ার মা ঢোঁড়াইকে রেখেছিল বাড়িতে। এ ঢোঁড়াইয়ের এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার শরীর তখনও দুর্বল। বাতায় গোঁজা কাজল লতাটার দিকে শুয়ে কিছুক্ষণ দেখলেই চোখ টন টন করে, হাঁড়ি ঝোলানোর শিকেগুলো বিনা হাওয়াতেও মনে হয় কাঁপে, ভাত আনতে দেরি হলে কান্না পায়। বাঁশের মাচার উপর একদিকে শোয় ঢোঁড়াই, একদিকে দুখিয়া, আর মধ্যেখানে দুখিয়ার মা। দুখিয়ার মার গায়ের গরমের মধ্যে মুখ গুঁজে গল্প শোনে ঢোঁড়াই…রাজপুত্তর সদাবৃচ মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছেন রাজকন্যা সুরঙ্গার মহলে যাওয়ার জন্য; অন্ধকার ঘুরঘুট্টি সুড়ঙ্গ, পিছল দেওয়াল, তার মধ্য দিয়ে জল চুঁইয়ে টপ টপ করে [৬৯]…
ঢোঁড়াইয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে দুখিয়ার মার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। অন্ধকারে ভয় পাচ্ছে নাকিরে ঢোঁড়াই, এই তো আমি কাছে রয়েছি, কথা বলছি তবুও ভয় করছে। অসুখের পর এমনিই হয়।..
ওদিকে হিংসুটে দুখিয়াটা উঠে বসেছে হাতের মুঠো দিয়ে নাক রগড়াতে রগড়াতে। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুখান দিয়ে সে ঢোঁড়াইকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় আর ঢোঁড়াই বিরক্ত হয়ে ওঠে।
ছি দুখিয়া, ঢোঁড়াই ভাইয়ার যে অসুখ, দুখিয়া কান্না জুড়ে দেয়। বাবুলাল অন্য মাচা থেকে চেঁচায়, ও কাঁদছে কেন?- শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠে দুখিয়াকে নিয়ে যায় নিজের কাছে।
ঢোঁড়াই ছোট হলেও বোঝে যে, বাবুলাল রাগ করে দুখিয়াকে উঠিয়ে নিয়ে গেল, আর রাগটা বোধ হয় তারই ওপর। দুখিয়ার মা-ও চুপ করে গিয়েছে। তার চুলের গন্ধটা আসছে নাকে, বাওয়ার জটার গন্ধর মতো না, অন্য রকম। কোথায় ভেবেছিল যে, আজ বিজা সিং-এর গল্প শুনবে এর পর। বাবুলালটা সব মাটি করে দিল। ভারি ভাল লাগে বিজা সিং এর গল্পটা। ঘোড়া ছুটিয়ে, তরোয়াল নিয়ে যাচ্ছেন বিজা সিং-কার সাধ্যি তার সম্মুখে দাঁড়ায়-হাওয়া-গাড়ির চাইতেও কি বেশি জোরে তার ঘোড়া ছুটে। দুখিয়ার মাকে জিজ্ঞাসা করবে নাকি যে, এঞ্জিনের চাইতেও কি বিজা সিংয়ের গায়ে বেশি জোর। না দুখিয়ার মা টা এখন কথা বলবে না, তাই চুপচাপ শুয়ে রয়েছে।
কিরে ঢোঁড়াই ঘুমোলি নাকি?
ঢোঁড়াই উত্তর দেয় না। চুপচাপ চোখ বুজে পড়ে থাকে। এইবার দুখিয়ার মা ওঠে। ঢোঁড়াই জানে যে, তাৎমাটুলির প্রত্যেক মেয়েছেলেই রাত্রে পুরুষের পা টিপে দেয়–তেল থাকলে পায়ে তেল দিয়ে দেয়। তার বাওয়ার কথা মনে পড়ে। দুখিয়ার মা যদি বাওয়ার পায়ে তেল দিত, তাহলে বেশ ভাল হত। বাবুলালটাও ভাল না; দুখিয়ার মা টাও ভাল না, আর দুখিয়াটাও ভাল না। বাওয়া এখন কী করছে, কে জানে। আজও তো নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিল- দুখিয়ার মা যেতে দেয়নি। কালই সে চলে যাবে থানে বাওয়ার কাছে- বিজা সিং-এর ঘোড়ায় চড়ে। তরোয়াল হাতে নিয়ে রাজপুত্তুর সদাবৃচের মতো… ঢোঁড়াই ঘুমিয়ে পড়েছে।
[৬৫. আদম-শুমারি। ৬৬. লোকে অসুখে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে মরে। ৬৭. ভানুমতী যাদুবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ৬৮. কন্ধকাটা ভূত। ঐ সময় কন্ধকাটা মিলিটারী উদী পরা ভূতের দল গিয়েছিল কোশী-শিলিগুড়ি রোডের উপর দিয়ে। ৬৯. সুরঙ্গা সদাবৃচের রূপকথা জানে এখানে। কিন্তু এটা বলতে হয় গান করে, সেইটা সকলে পারে না।]
.
গুরু–শিষ্য সংবাদ
বৌকাবাওয়া ঢোঁড়াইয়ের কদর বোঝে। ছোঁড়া বেশ বুদ্ধিমান। বাওয়া যোবা। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে কথা বলতে তার একটুও অসুবিধে হয় না; চোখের ইশারাতেই সে সব মনের কথা বুঝে যায়। আর ওর জন্যে ভিক্ষেটাও পাওয়া যায় খুব, গলাটা ওর খুব ভাল কিনা। মাইজীরা ওকে বাড়ির মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে সীয়-রাম-পদ-অঙ্ক শোনেন। লক্ষ্মণু চলাই মগু দাহিন বাঁয়ে। [৭০] শোনেন। কিছুদিন থেকে বাওয়া দেখছে যে, ঐ গানটায় আর সেরকম ভিক্ষে পাওয়া যায় না। সে ও ছোঁড়াও বুঝেছে। এই যবে থেকে হাড়তাল টাড়ল আরম্ভ হয়েছে, তবে থেকে বটোহীর [৭১] গ্রাম্য গানের হাওয়া লেগেছে দেশে। কী যে গান বুঝি না– যে কোনো কথার শেষে রে বটোহিয়া জুড়ে দাও, আর অমনি গান হয়ে যাবে। যখন যে হাওয়া চলে আর কী! বাওয়া ঢোঁড়াই কে ইশারায় বলে, এই পাশের বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে চল্লি কোথায়? ও বাড়িতে অসুখ।
সব খবর ঢোঁড়াই রাখে। কোন বাড়িতে অসুখ, কোন বাসার মাইজীরা দেশে গিয়েছে দশহরার ছুটিতে, কোন কোন বাড়িতে দুপুর বেলায় যেতে হয় বাবুরা আপিস কাছারি গেলে, কোন বাড়িতে বিয়ে, পৈতে, পুজো সব ঢোঁড়াইয়ের দখদর্পণে। বাওয়াকে সে-ই চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। বাওয়ার ভিক্ষের অভিজ্ঞতা দুপুরুষের। তবুও এসব এতসব খুঁটিনাটি মনে থাকে না। ঢোঁড়াই গান গাইছে…
সুন্দর আ সু। ভুমি ভাইয়া-আ।
। ভারাতা-আ কে। দেশা-বাসে।
মোরা প্রাণা-আ। বসে হিম-অ!
! খোহরে বটোহিয়া-আ-আ…। [৭২]
বাওয়া বলে, চল এখান থেকে, কেউ সাড়া দেবে না কঞ্জুসের দল। এক দুয়োরে কতক্ষণ গলা ফাটাবি।
ঢোঁড়াই ভাবে, বাওয়া বোঝে না তো কিছুই, খালি চল চল। হড়বড় করলে কি ভিক্ষে পাওয়া যায়। মাইজী এখন বসেছে পূজোয়। বাবু অপিসে গেলে, তারপর স্নান পূজোয় বসে। এখুনি উঠবে।
যা ভেবেছে ঠিক তাই।
বুড়ি মাইজী মটকার থান পরে ভিক্ষা দিয়ে গেলেন, সঙ্গে আবার একটা বেগুন।
বাওয়া অপ্রস্তুত হলেও মনে মনে খুশি হয়- এ ছোঁড়া উপযুক্ত চেলা হবে বড় হলে। একটু খালি শাসনে রাখতে হবে। বড় দুরন্ত ছেলে, দিন রাত খেলার দিকে মন। রোজগারের দিকে মন বসে না। সকালবেলা ধরতে পারলে তো সঙ্গে আসবে। একটু নজরের বার করেছ কি ফুট করে কখন যে থান থেকে সরে পড়বে, তা কেউ বুঝতেও পারবে না। তারপর কেবল সারাদিন টো টো, আজ এর এঙ্গে ঝগড়া, কাল ওর সঙ্গে মারামারি। ঠিক যে সব কাজ বাওয়া পছন্দ করে না সেই সব কাজ। একদিন বাওয়া দেখে একটা গাধা ধরে তার পিঠে চড়েছে। ঐ খৃষ্টান ধাঙড়গুলোর ছেলেদের সঙ্গে পর্যন্ত ওর আলাপ। মহতো একদিন এ নিয়ে নালিশও করেছে তার কাছে। বুড়ো শুক্ৰা ধাঙড়, যে ওকিল সাহেবের বাগানে মালীর কাজ করে, সে আবার ঢোঁড়াইকে বলে সন বেটা (ধর্ম ছেলে)। রীতয়া ছড়িদার এই কদিন আগেও এসে বাওয়ার কাছে নালিশ করেছে ঢোঁড়াইয়ের নামে।
গিয়েছিলাম চিমনি বাজারে রাঙা আলু কিনতে। দেখি তোমার গুণধর ছেলে ঢোঁড়াই, গলায় একটা দড়ি জড়িয়ে বোবা সেজে, গেরস্থ বাড়িতে, গরু মরেছে বলে ভিক্ষা করছে। তাৎমাদের নাম হাসাল। তোমার সঙ্গে ভিক্ষায় বেরুলেই হয়–তাতে তো বেইজ্জতি নেই। এর বিহিত একটা করতেই হবে বাওয়া তোমাকে।
বাওয়া চটে আগুন হয়ে ওঠে। এর মধ্যে আলাদা রোজগার করতে শিখেছে লুকিয়ে। কী করেচিস সে চাল আর পয়সা বল। কল্কের তামাকটা পর্যন্ত শেষ করে টানি না, পাছে ঐ ছোঁড়াটা ভাবে যে, ওর জন্য রাখল না কিছু, আর এ তলে তলে রোজগার করে খরচ করে- নেমকহারাম হারামজাদা কোথাকার। আংটা পরানো ত্রিশূলটা নিয়ে সে ঢোঁড়াই কে তাড়া করে যায় মারতে। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে দৌড়ে পারবে কেন? অনেকদূর যাবার পর ঢোঁড়াই বাওয়ার নকল করে চলতে আরম্ভ করে- ঠিক যেন ত্রিশূল আর ঝোলা নিয়ে বাওয়া সকালে ভিক্ষেয় বেরিয়েছে। রতিয়া ছড়িদার হেসে ফেলে। বাওয়া আরও চটে যায়- হাসছ কী, তোমাদের ছেলেরা যায় রোজগারে খুরপি নিয়ে ঘাস তুলতে, না হয় ঝুড়ি নিয়ে কুল কুড়োতে। এ ছোঁড়া যাবে তাদের সঙ্গে সমানে তাল দিতে, কিন্তু রোজগারের কথাও ওর কানে এনো না, তবে থাকবেন খুশি। আমি এনে দেব তবে চারটি খেয়ে উপকার করবেন। না, ছোঁড়াটা দেখছি ধাঙড়টুলির পথ ধরেছে। যা তোর সাতজন্মের বাপদের কাছে!…তারপর রাগটা একটু কমে এল, বাওয়ার উৎকণ্ঠার সীমা থাকে না। বদরাগী পাগল ছেলেটা আবার কি না। করে বসে। মরণধারের ওপারে গোঁসাই (সূর্য) ডুবে যায়। বকরহাট্টার মাঠের তালগাছ কটার উপরের আলোর রেশ মুছে যায়। গোঁসাই-থানের অশত্থ গাছটির উপরের পাখির কাকলী বন্ধ হয়ে যায়। তবুও ঢোঁড়াই আসে না। অনুতাপে বাওয়ার চোখ ছলছল করে; তামাকে স্বাদ পায় না। সে কী গিয়েছে এখন। তখন গোঁসাই ছিল মাথার উপর। সে তালপাতার চাটাইটা ঝেড়ে অসময়ে শুয়ে পড়ে। খানিক পরে কাঠের বোঝা ফেলবার শব্দে বুঝতে পারে যে, ঢোঁড়াই জ্বলানী কাঠ কুড়িয়ে ফিরেছে। ঢোঁড়াই আগে কথা বলবে না, বাওয়াও ওর দিকে তাকাবে না। কোনোদিকে না তাকিয়ে ফুঁ দিয়ে উনুন ধরাবার চেষ্টা করে। বাওয়া শব্দ শুনে বোঝে যে এই মাটির মালসাতে জল চড়াল, এইবার ভিক্ষের ঝুলি থেকে চাল বের করছে। আর চুপ করে থাকা যায় না। বাওয়ার খাওয়ার জন্যে জিবছীর মা, গোটা কয়েক সুথনী [৭৩] দিয়ে গিয়েছে। এখনও মাথার কাছে রাখা রয়েছে। ঢোঁড়াইটা জানে না- এখন ভাতে না দিলে সিদ্ধ হবে কি করে। বাওয়া ত্রিশূলটি নেড়ে ঝমঝম শব্দ করে। এতক্ষণে ঢোঁড়াইয়ের অভিমান ভাঙে,-বাওয়া তাহলে তাকে ডেকেছে।
এত সকাল সকাল শুয়ে পড়লে কেন বাওয়া? খাবে না?
রাতে আবার ঢোঁড়াই বাওয়ার চাটাইয়ের উপর তার কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। বাওয়া তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। এর মধ্যে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারে না।
এই হচ্ছে আজকালকার নিত্য ঘটনা বাওয়ার। মধ্যে মধ্যে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আবার ভাবে যে অল্প বয়স। যে বয়সের যা। ওর সমবয়সীদের সঙ্গে না খেললে ধুললে কি ওর এখন ভাল লাগে। হাঁ তবে খেলবি খেল। নিজের রোজগারের কাজটা করে তারপর খেলা; আর ঐ দলের পাণ্ডামিটা ছেড়ে দে। এই এখনই থানে ফিরবে। আর কি ওর টিকি দেখবার জো থাকবে সেই গোঁসাই ডুববার আগে। আর কী জেদী, কী জেদী! বকে ঝকে কি ওকে সামলানো যায়। ঝোঁক একবার উঠলে হল। এখন এই ঝোঁক থানের দিকে আর ভিক্ষের দিকে গেলে হয়, বড় হলে। তবে না আমার উপযুক্ত চেলা হতে পারবে। রামজীর মনে যা আছে তাই তো হবে। সিয়ারাম। সিয়ারাম! ঢোঁড়াই গেয়ে চলেছে সেই বটোহর গান। বুকের জোর আছে ছোঁড়াটার। গানের শেষে বটোহিয়ার আ-ট-যা ছেড়েছে একেবারে ভাইসচেরমেন সাহেবের দরোয়ানের কুঠরির জানলা খুলিয়ে ছেড়েছে। ঐ যে তার বিজলী ঘরের মিস্ত্রীও জানলা দিয়ে তাকাচ্ছে দেখছি। ঝুলিটা ভরে গিয়েছে রে ঢোঁড়াই। চল, ফেরা যাক থানে। আবার সাওজীর দোকান থেকে একটু নুন নিতে হবে।
[৭০. রাম ও সীতার পায়ের দাগ এড়িয়ে লক্ষ্মণ একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে ফিরে রাস্তা চলছেন। ৭১. পথিক। এই নামের একটি গ্রাম্য সুর ১৯২০ সালের পর থেকে প্রচলিত হয়। এখন এ গান প্রায় লুপ্ত। ৭২. সুন্দর সুভূমি ভারত দেশটা, আমার প্রাণ থেকে হিমালয়ের গুহায়, রে পথিক… ৭৩. একপ্রকার কন্দ; কেবল গরীবরাই এই কন্দ খায়।]
.
গানহীবাওয়ার বার্তা
কপিল রাজার বাড়িটা ভূতের বাড়ির মত পড়েছিল একবছর থেকে। বাড়ির লোকেরা মারা যাবার পর, তার জামাই এসেছিল, বাড়িটা বিক্রি করতে। খদ্দের জোটেনি। বাড়ি তো তেমনিই, তার উপর শহর থেকে এতদূরে। জমির দাম এখানে নামমাত্র বললেই হয়। ঐ ভুতুড়ে বাড়ি, খড়ের চালা কিনাবার জন্য কে আর পয়সা খরচ করতে যাবে। কপিল রাজার জামাইটা আবার ফিরে এসেছে, দিনকয়েক হল। শোনা যাচ্ছে যে, চামড়ার ব্যবসা করবে। আজ বাদরা মুচির সঙ্গে নাকি সে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলেছে। কাল দুগাড়ি নুন এসেছে তার বাড়িতে। এই কথাই উঠেছিল সাঁঝের ভজনের আখড়ায়। ধনুয়া মহতো বলে তা কথাটা ভাববার বটে। তা বাবুলালকে আসতে দে। একে সে পাড়ার পঞ্চায়েতের একজন নায়েব, তার উপর অফসর আদমী; হাকিম হুকুমের সঙ্গে কথা বলেছে। তার উর্দি পাগড়ির রং বদলেছে কিছুদিন আগে কলস্টরের জায়গা নিয়েছে ওর ভাইসচেরমেন সাহেব সেইজন্য। বাবুলাল বলেছে যে, ওর ভাইসচেরমেন সাহেবকে এখন চেরমেন সাহেব বললে চটে- আচ্ছা বাবা মাইনে দিয়ে চাকর রেখেছে, যা বল তাই শুনতে রাজী আছি।
ঐ বাবুলালকে দিয়ে চেরমেন সাহেবকে বলাতে পারলে কপিল রাজার জামাইটার এ অনাছিষ্টি কাণ্ড বন্ধ করা যেতে পারে। বাদরা মুচিটাকেই যদি চেরমেন সাহেব একবার বকে দেয় তাহলেই এর চামড়ার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ছি ছি ছি, জাত-ধর্ম আর থাকবে না। দুর্গন্ধে পাড়ায় চেঁকা যাবে না, হাজারে হাজারে শকুন বসবে আমাদের ঘরের উপর। আর সেসব যা-তা চামড়া-নাম আনা যায় না মুখে। হ্যাক থুঃ থু:! সিয়ারাম!
কিন্তু বাবুলাল আজ আসেই না, আসেই না অফিস থেকে। চেরমেন সাহেবের বাড়িতে চিঠির ঝুড়ি পৌঁছে, তারপর হাট করে রোজ সন্ধ্যা লাগতে লাগতেই ফিরে আসে। আজ রাত দশটা বাজল। আরে দুখিয়ার মার কাছ থেকে খবর নে তো ঢোঁড়াই যে, বাবুলাল কিছু বলে গিয়েছে নাকি বাড়িতে।
আমি যাই না ও-বাড়িতে।
মহতো বলে যে, বাওয়া ছেলেটার মাথা একেবারে খেল; নেমকহারাম কোথাকার; গত বছরও তো অসুখ হয়ে অতদিন পড়ে থাকলি দুখিয়ার মার কাছে। আচ্ছা গুদর তুই-ই যা বাবুলালের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে আয়। তারপর বিকৃত উচ্চারণে ঢোঁড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-আমি যাব না ও-বাড়িতে। বদমাস কোথাকার।
কাহুহি বাদি ন দেহিয় দোষু [৭৪] –মিছে দোষ দিস না দুখিয়ার মায়ের আর বাবুলালের।
এরই মধ্যে বাবুলাল এসে পড়ে। সে আর কাউকে প্রশ্ন করার অবকাশ দেয় না যে, আজ দেরি কেন হল।
ভিস্টিবোড আপিসে আজ ভারি হল্লা ছিল। মাস্টার সাহেব নৌকরিতে ইস্তফা দিয়ে সব ছেলেদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। ছেলেরা ডিস্টিবোডের ঘড়িঘরের[৭৫] সম্মুখে সাভা[৭৬] করতে এসেছিল। মুফীলদ্দীন সাহেব মোক্তার আছে না, ঐ যে সব সময় আফিং খেয়ে ঢোলে, সে লাল কিতাব হাতে নিয়ে সদর[৭৭] হয়েছিল।
লে হালুয়া![৭৮] মাস্টার সাহেবের…
ছুট গয়ী নৌকরি, সটক গয়া পান[৭৯]।
কেন? মাস্টার সাহেবকে আবার পাগলা কুকুরে কামড়াল কেন?
নৌকরি থেকে সরকার নিশ্চয়ই বরখাস্ত করেছে। টাকাপয়সার ব্যাপার নিশ্চই কিছু আছে?
বাবুলাল সকলকে বুঝিয়ে দেয়- না না ওসব কিছু নয়, মাস্টার সাব গানহী বাবার চেলা হয়েছে।
গানহী বাবা কে? গানহী বাবা?
বড়া গুণী আদমী[৮০]। বৌকা বাওয়া আর রেবণগুণীর চাইতেও নামী। সিরিদাস বাওয়ার চাইতেও বড়, না হলে কি মাস্টার সাব চেলা হয়েছে। গানহী বাওয়া মাস মছলী, নেশা-ভাঙ থেকে পরহেজ[৮১]। সাদি বিয়া করেনি। নাঙ্গা থাকে বিলকুল।[৮২] বাঙ্গালী বাবু চংড়ী মছলী খাবু। এত তকলীফ কি সইতে পারবে?
জমি-জমা করে নিয়েছে বোধ হয়।
প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বাবুলাল অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বহু রাত পর্যন্ত নানারকম কথা হয়। বাঙালীরা বুদ্ধিতে এক নম্বরের; কিন্তু একটু পাগলাটে গোছের। ঠিক সাহেবদেরই মতো। তবে তার চাইতে একটু একটু কম বদরাগী। ভয় ভয়ই করে ওদের সঙ্গে কথা বলতে। বিজনবাবু ওকিলের ঘরের খাপড়া উল্টোবার সময় সেদিনও দেখেছি- জৈশ্রী চৌধুরী, ব্রাক্ষণ, অতবড় কিষাণ, বিজনবাবু ওকিল ছুঁড়ে ফেলেছে তার কাগজ। একবার বসতে পর্যন্ত বলল না ওকে। কী রাগ! কী রাগ। চাক তো দেখি টিকিটবাবু রেলগাড়িতে বাঙালীবাবুর কাছে টিকিট। তবে বুঝব। আর বাজা ছাজা কেস, তিন বাঙালা দেশ।[৮৩] আজ সভায় সরকারকে, লাটসাহেবকে, বাদশাকে অনেক কথা শুনিয়েছে মাস্টার-সাব।
ও কেবল কথার তুলো ধোনো, বলত দারোগা সাহেবের খেলাপে, তবে না বুঝতাম হিম্মৎ। বলত টমাস সাহেবের খেলাপে, তা গুলী মেরে উড়িয়ে দিত। চাঁদমারীতে মক্স করা হাত ওর।
চেরমেন সাহেব কলস্টর সাহেবকে খবর দিতে গেলেন যে তার হাতায় সাভা করছে লোকে, মানা করলেও শোনে না। তবে যে তুই বললি যে তোর চেরমেন সাহেব, কলস্টরের জায়গা নিয়েছে। বাবুলাল এই বোকাগুলোর মূর্খতার বিরক্ত হয়ে বলে আরে সে তো কেবল ডিস্টি বোডে। জেলার মালিক তো কলস্টরের আছেই। তাই তো বলি, কলস্টর জায়গা কী করে নেবে। কিন্তু চেরমেন সাহেব সেই যে গেলেন, আজও গেলেন কালও গেলেন। আর সন্ধ্যা পর্যন্ত এলেন না-না কলস্টর, না সেপাই, কেউ, আপিসের বাবুরা তাদেরই এন্তেজারিতে এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে আলো জ্বালিয়ে বসে। তাইতেই তো এত দেরি।
বাবুলালের খাওয়া হয়নি এখনও। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে গল্পে গল্পে। সকলে উঠে পড়ে, সে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে। ঢোঁড়াই বকুনি খাওয়ার পর থেকে এতক্ষণ এক কোণে চুপ করে বসে ছিল। কেবল সেই লক্ষ্য করে যে, যে চামড়ার নাম করতে নেই, সেই চামড়ার গুদাম পাড়ার কাছে হওয়ার কথাটা, এই গোলমালে একেবারে চাপা পড়ে গিয়েছে। ঐ বেড়ালের মতো গোঁফ বাবুলালটা কতকগুলো গল্প বলল তাতেই। গানহী বাওয়া রেবণগুণীর চাইতেও বড়, বৌকা বাওয়ার চাইতেও বড়, মিলিট্রি ঠাকুরবাড়ির মোহন্তর চাইতেও বড়, এক নম্বরের গল্পবাজ বাবুলালটা! ঝুটফুট[৮৪] বললেই হল।
[৭৪. কাহি বাদি না দেয় দোয়/ কাউকে মিছে দোষ দিও না-( তুলসীদাস)। ৭৫. ক্লক টাওয়ার। ৭৬. মিটিং, সভা। ৭৭. সভাপতি। ৭৮. আশ্চর্য। ৭৯. এটি একটি অতি চলিত কথা তামাদের মধ্যে। চাকরিও গেল, পান খাওয়াও শেষ হয়ে গেল। ৮০. গুণীর মানে যদুকর। ৮১. সংযমী। ৮২ উলঙ্গ থাকে একেবারে। ৮৩. বাজা ছাজা কেস, তিন বংগালাদেশ- বাদ্য, ঘরছাউনি, মাথায় চুল( মেয়ে মানুষের) এই তিনটি জিনিস বাংলাদেশের ভাল। ৮৪. বাজে মিথ্যা।]
.
গানহী বাওয়ার আবির্ভাব ও মাহাত্ম্য বর্ণন
পাক্কীর[৮৫] ধারের বটগাছে মৌমাছির চাক হয়তো কতকাল থেকে আছে, কেউ তাকিয়েও দেখেনি; কিন্তু একদিন যদি দেখে ফেলে সেটা, তাহলে তারপর কিছু ওখান দিয়ে যতবার যাবে, নজরে পড়বে। গানহী বাওয়ার খবরের বেলায়ও হল এই রকমই। এমনি কেউ নামই শোনেনি। ঐ যে সেদিন রাতে বাবুলালের কাছ থেকে শুনল, তারপর কিছু দিন চলল নিত্যি নূতন খবর। মাস্টার সাবকে মসজিদের সাভায় গ্রেপ্তার করেছে দারোগা সাব। গা ম্যাজ ম্যাজ করলেও গানহী বাওয়ার চেলাদের দৌরাত্ম্যে কালালীর[৮৬] দিকে যাওয়ার উপায় নেই। চেলারা আজ কাছারীতে, কাল ছত্তিসবাবুর দোকানের সম্মুখে, কী বলে কীকরে, কী চেঁচায় কিছু বোঝাও যায় না। কত জায়গা থেকে কত রকম আজগুবি খবর আসে। এ কান দিয়ে শোনে, ও কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। ব্যাপারটা মনের মতো ভাবে জমল একদিন হঠাৎ। ভোরে বৌকা বাওয়া সবে হাতের দাঁতনটা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ঢোঁড়াইটার ঘুম ভাঙিয়েছে, এমন সময় শোনা গেল রবিয়ার গলা ফাটানো চিৎকার। কী বলছে ঠিক বোঝা যায় না। বাওয়া ঢোঁড়াই বিয়ার বাড়ির দিকে দৌড়োয়। রবিয়া পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে, গানহী বাওয়া,-কুমড়োর উপর। পাগল হয়ে গেল নাকি, ভাঙের সঙ্গে ধুতরোর বীচি-টিচি খেয়ে। একদণ্ড দাঁড়িয়ে যে রবিয়া ঠান্ডা হয়ে কথার জবাব দেবে, তার সময় নেই ওর। রবিয়ার বাড়িতে ঢুকে দেখে যে, তার উঠন ভরে গিয়েছে পাড়ার লোকে। নিচু চালের ছাঁচতলা থেকে একটা বিলিতি কুমড়ো ঝুলছে। সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেই খানটায়।
ঠিকই। যা বলেছে তাই। বিলিতি কুমড়োর খোসায় গানহী বাওয়ার মূরত[৮৭] আঁকা হয়ে গিয়েছে। সবুজের মধ্যে সাদা রঙের। মুখের জায়গাটার মোচের মতনও দেখা যাচ্ছে। আর কোনো ভুল নেই। এখন কী করা যায়? এরকম করে তো গানহী বাওয়াকে হিমে রোদ্দুরে ফেলে রাখা যায় না। ঠাকুর দেবতার ব্যাপার। মহতো নায়েবরা বৌকা বাওয়াকেই সালিশ মানে। ঢোঁড়াইয়ের ভারি আনন্দ হয় যে, মহতো এসব ব্যাপারে বাওয়ার চাইতে ছোট। কুমড়োটার বোঁটা কাটার অধিকার বাওয়াই পেল; বাবুলালও না, মহতোও না। বোঁটাটা কাটবার সময় উঠন ভরা লোকের ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বাওয়ার হাত ঠক ঠক করে কাঁপে। ঢোঁড়াই ভাবে, সেদিন বাবুলাল মিথ্যে বলেনি, গানহী বাওয়া, বৌকা বাওয়ার চাইতেও গুণী। না হলে কুমড়োতে আসে।
থানে কুমড়োটার পূজো হয়, পান সুপুরি গুড় দিয়ে। সেদিন ঢোঁড়াইয়ের কী খাতির! বাওয়া পূজো নিয়েই ব্যস্ত। ঢোঁড়াইকেই করতে হল দৌড়োদৌড়ি পাড়ায়, বাজারে। সেদিন এরকম একটা মস্ত সুযোগ পেয়ে, বাওয়া সকলের সম্মুখে ঢোঁড়াই য়ের গলায় তুলসীর মালা পরিয়ে দিল। মালা গলায় দিলেই সে হয়ে যাবে ভকত। আর কেউ তাকে ঢোঁড়াই তাৎমা কিংবা ঢোঁড়াই দাস বলতে পারবে না। সে কেউকেটা এখন, তাঁকে বলতে হবে ঢোঁড়াই ভকত। বৌকা বাওয়ার সমান বড় হয়ে গিয়েছে সে, গানহী বাওয়ার আবির্ভাবের দিনেই। তাকে আজ থেকে প্রত্যহ স্নান করতে হবে। আর অন্য ছেলেদের মতো নয়, মাস মছলী থেকে পরহেজ।[৮৮] গুদরকে দেখে ঢোঁড়াইয়ের মায়া হয় সেদিন; বেচারার গলায় কণ্ঠি নেই।
তারপর সেই গানহী বাওয়ার মুরত বালা[৮৯] কুমড়োটা মাথায় করে ঢোঁড়াই নিয়ে আসে মিলিট্রি ঠাকুর বাড়িতে। পরণে সেই লাল কাপড়খানা। আগে আগে আসে ঢোঁড়াই আর পিছনে সব তাৎমারা। মহতো পর্যন্ত পিছনে।
ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছে তাদের সব উৎসাহ জল হয়ে যায়। মোহন্তজী বলেন, কী রে ঢোঁড়াই, তোর যে আর দেখাই নেই। যে ঠাকুরবাড়িতে রাম-সীতার মূরত আছে। সেখানে গানহী মহারাজের মূত রাখা ঠিক নয়। তুলসীদাসজী তাই বলে গিয়েছেন। চুথিয়া সরকার! ৯০…
তুলসীদাসজীর নির্দেশ পর্যন্ত তাৎমারা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু তার সঙ্গে চুথিয়া সরকারের কী সম্বন্ধ, তা তারা ঠিক ধরতে পারেনি।
মূরতটাকে নিয়ে মহাবিপদ। এখন কী করা যায়! কী করা যায় ওটাকে নিয়ে! এমন ভাবে মূরতের দর্শন পাওয়া গিয়েছে। রাম-সীতার পাশে যদি না রাখতে পারা যায়, তা হলে থানেই বা গোঁসাইয়ের পাশে কী করে রাখা যাবে? বাওয়া ঘাড় নাড়ে সে তো হতেই পারে না। তবে উপায়? এ কী পরীক্ষায় ফেললে রামজী। এত কৃপা করে, আমাদের ঘরে এলে গানহী মহারাজ, আর আমরা তোমাকে রাখবার জায়গা দিতে পাচ্ছি না। থাকত টাকা সাহেবদের মতে, বাবু-ভাইয়াদের মতো, রাজ দ্বারভাঙ্গার মতো, দিতাম একটা ঠাকুরবাড়ি বানিয়ে, গানহী বাওয়ার জন্যে। ঠিকই বলে গিয়েছে তুলসীদাসজী- নহি দরিদ্র সম দুখ জগমাহী[৯১]। বাওয়ার চোখের কোণ জলে ভরে ওঠে। সারা জীবন তার ভিক্ষে করে কেটেছে। জন্ম থেকে আজ। পর্যন্ত, কখনও দুবেলা ভাত খেয়েছে বলে মনে পড়ে না। একবেলা জলপান, একবেলা ভাত–তাও জুটলে, এই তো সব তাৎমাই খায়। এক বেল তার একার কথা নয়, তবুও নহি দরিদ্র সম দুখ জগমাহী এই আবছা কথাগুলোর মানে এই বিপদের ঝলকে হঠাৎ যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কপিলরাজার ঐ পাখণ্ডী, চামড়াবালা জামাই গানহী বাওয়ার নামে সিন্নি দেওয়ার জন্য যে গুড়, আটা আর কাঁচকলা পাকা পাঠিয়ে দিয়েছে, তা অমনিই পড়ে থাকে। এমন সময় রেবণগুণী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। আজকাল বিকালের দিকে গানহী বাওয়ার চেলারা কালালীতে বড় জ্বালাতন করে। তাই সে দুপুরের দিকেই কাজটা সেরে আসে। সেখান থেকে ফিরবার সময় হঠাৎ লোকমুখে গানহী বাওয়ার আবির্ভাবের কথা শুনেছে সে। তাই সে হাঁফাতে হাঁফাতে এসেছে। টোপা কুলের মতো চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, দৌডুবার মেহনতেও হতে পারে, আবার মদের জন্যও হতে পারে। সে এসে ঝুঁকে পড়ে কুমড়োটার উপর। অন্য কেউ হলে সকলে হাঁ হাঁ করে উঠে তাকে আটকাতে যেত; কিন্তু কার ঘাড়ে কটা মাথা যে মূরতটাকে একটা কিছু করে বসে- যা মেজাজ। তাৎমা মেয়েরা রেবণগুণীকে দেখে মাথায় কাপড় টেনে দেয়। ঠিকই তো। টৌনে যা শুনেছিলাম বিলকুল ঠিক। ঠিক! ঠিক! ঠিক! গানহী বাবা ফুটে বেরুচ্ছে কুমড়োটার গায়ে। কেবল হাত-পা-টা ওঠেনি- জগন্নাথজীর মতো। রেবণগুণী কুমড়োটাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে, তারপর চিৎকার করে ওঠে, লোহা মেনেছি;[৯২] লোহা মেনেছি আমি গানহী বাওয়ার কাছে।
অবাক হয়ে যায় সকলে। রেবণগুণী লোহা মেনেছে! চাকের মৌমাছি নড়ে বসার মতো একটা উত্তেজনার ঢেউ খেলে যায় দর্শকদের মধ্যে। রেবণগুণী যার লোহা মানে সে তো প্রায় রামচন্দ্রজীর সমান। অত বড় না হোক, অন্তত গোঁসাই কিংবা ভানুমতীর মত জাগ্রত দেবতা তো বটেই। মৃদু গুঞ্জন উঠবার আগেই গুণী আবার বলে ওঠে, আজ থেকে কোন হারামীর বাচ্চা কালালীতে গিয়ে গানহী বাওয়ার খেলাপ করে। আজকে যা করে ফেলেছি তার তো আর চারা নেই। কাল থেকে গানহী বাওয়া, পচই ছাড়া আর কিছু খাব না। সে কেঁদে ফেলল বুঝি এইবার। দেখে নিও মহতো।
এইবার মহতো বর্তমান সমস্যার কথাটা তোলে। গুণী যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়! গানহী বাওয়াকা জয় হো, বলে লাফিয়ে উঠে মাথার পাগড়িটা সামলে নেয়। বাওয়া ঢোঁড়াইকে বলে, যা তুই পৌঁছে দিয়ে আয় মূরতটা ওর বাড়িতে। সে ঠিক বিশ্বাস পাচ্ছে না গুণীটাকে। ঢোঁড়াইও সেই কথাই ভাবছিল। বাওয়া ঠিক তার মনের কথা বুঝতে পারে। সে রাত্রে রেবণগুণীর বাড়িতে ভজনের আসর জমে-যা গ্রামের ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। ঢোঁড়াই ভকত গানহী বাওয়ার সমান হয়ে গিয়েছে গানহী বাওয়ার দৌলতে। পরের দিন সকালে কুমড়োটাকে কাপড় ঢেকে গুণী চলে যায় মেলায়। অনেক দিনের মদের খরচ সে রোজগার করেছিল যাত্রীদের কাছ থেকে ঐ মূরতটা দেখিয়ে। একটা করে পয়সা দিলেই, কাপড়ের ঢাকা তুলে কুমড়োটাকে দেখতে।
[৮৫. কোশী-শিলিগুড়ি রোড। ৮৬. মদের দোকান। ৮৭. মূর্তি। ৮৮. সংযমী : মাছ মাংস ছেড়ে দিতে হবে। ৮৯- মূর্তি আঁকা। ৯০- পৃথিবীতে দরিদ্রের মতো দুঃখ আর নেই (তুলসীদাস)। ৯১. পাষণ্ড চামড়াওয়ালা। ৯২- পরাজয় স্বীকার করা।]
.
ঝোটাহা উদ্ধার
তাৎমাটুলির পঞ্চায়তিতে সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, আলবৎ উঁচুদরের সন্নাসী গানহী বাওয়া মুসলমানকেও পিয়াজ গোস্ত ছাড়িয়েছে। একবার কপিল রাজার জামাইটার সঙ্গে দেখা করাতে পারলে হয়, তাঁকে আনিয়ে। ওরে আসবে না রে আসবে না। মাস্টারসাবদের মতো বাবুভাইরা চেলা থাকতে, তোদের এখানে আসবে না, না হলে চালার উপর এসে রবিয়ার ঘরে ঢোকেনি। থানের মতো ঘর-দুয়োর-আঙ্গন সাফ সুত্রা রাখতে পারিস তবে না সাধুসন্ত এসে দাঁড়াতে পারে। এ একটা মার্কার [৯৩] কথা বলছিস বটে। সকলের কথাটা মনে ধরে। মরগামার গয়লারা রবিবারে গরু দেয় না। সেদিন তারা তাদের ঘর-বাড়ি সাফ করে, তারা সিরিদাস বাবাজীর চেলা কিনা। ধনুয়া মহতোর মাথায় ঢোকে যে আচ্ছা রবিবারে গানহী বাওয়ার নামে কাজে না গেলে বেশ হয়। রবিবার তৌহারের[৯৪] দিন। সরকার বাহাদুর পর্যন্ত কাছারী বন্ধ রাখে, চেরমেনসাহেব ডিস্টিবোভ বন্ধ রাখে, পাদ্রীসাহেব দুধ বিলোয়- খৃষ্টান ধাঙরদের। সকলেই এই বিষয়ে খুব উৎসাহ। রবিবারে কাছারী বন্ধ থাকায় বাবুভাইয়ারা বাড়িতে থাকে, অন্য কোন কাজ নেই তো ঘরামির পিছনেই লাগো। ঢোঁড়াইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বাঁধা ঘরগুলোতে রবিবারের দিনই ভিক্ষে দেয় বিশেষ করে যারা আধলা দেয় তারা। বৌকা-বাওয়া যে পঞ্চায়তিতে আসে না সে এলে এর প্রতিবাদ করতে পারত। ঢোঁড়াইয়ের কথা তো কারও মনেই পড়েনি। ছোকরা ঢোঁড়াই দূর থেকে বলে, আমাদের পেট কেটো না মহতো [৯৫]। রবিবারের রোজগারই আমাদের আসল রোজগার। অর্বাচীনের ধৃষ্টতায় নায়েব মহতোরা অবাক হয়। এতটুকু ছেলে পঞ্চায়তির মধ্যে কথা বলতে এসেছে। তুই আবার কষ্ঠি নিয়ে ভকত হয়েছিস না? গানহী বাওয়া বড় না তোর রোজগার বড়? কেনটা বড় ঢোঁড়াই সত্যিই এ প্রশ্নের জবাব ঠিক করতে পারে না। কাঁচুমাচু মুখ করে সে বসে পড়ে। তার আর বাওয়ার রোজগারের কথাটা মুখিয়ারা [৯৬] একবারও তো ভাবল না। গানহী বাওয়া তো তারই দলের লোক; কিন্তু নিজের পেট কেটে গানহী বাওয়া করা, এটা সে বুঝতে পারে না। রোজগারের কথাটা ঢোঁড়াই এই বয়সেই ঠিক বুঝেছে। বৌকা বাওয়া যতই ভাবুক না কেন যে ছোঁড়ার সেদিকে খেয়াল নেই।
ঢোঁড়াইয়ের সমস্ত আক্রোশটা গিয়ে পড়ে পঞ্চায়তির ধনুয়া মহতো, আর বাবুলালটার উপর। কিন্তু তার বিষয় ভেবে পঞ্চায়তি এক মিনিটও সময় বাজে খরচ করতে রাজী না। ততক্ষণে একটা অনেক বড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে সেখানে ঝোটাহাদের নিয়ে। খালি রবিবারে আঙ্গন সাফ করলেই হবে না। হাজার বলেও ওদের দিয়ে কিছু করাতে পারবে না।
কে কথা শুনবে না, কোন ঝোটাহা শুনি! মাসে একদিন করে সব ঝোটাহা- দের স্নান করে পাক সাফ [৯৭] থাকতে হবে। গাঁটের পয়সা খরচ করে বিয়ে করেছি না, না মাঙনা?
খোঁড়া চথুরী বসে ছিল দূরে। তার বৌ তার সঙ্গে থাকতে চায় না বলে মহতো নায়েবরা তার সাগাই [৯৮] করে দিয়েছে ইসবার সঙ্গে। সে বলে মহতো আর ছড়িদার ইসবার কাছ থেকে বেচাল হয়েছে কি…। আর একদিক থেকে চেঁচামেচি ওঠায় তার শেষের কথাগুলো বোঝা যায় না, তবে খোঁড়া চথুরীর ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো দেখে মনে হয় যে, সে একটা মারাত্মক রকমের ওষুধের কথা কিছু বলেছে। যেদিক থেকে গোলমালটা ওঠে, সেদিকে দেখা যায় কয়েকজন মিলে ইসরাকে ঠাণ্ডা করিয়ে বসাচ্ছে।
আরও কত রকমের প্রশ্ন ওঠে সেখানে। এত বড় একটা প্রশ্ন রেওয়াজের খেলাপ অমনি এক কথায় নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারে না। সবচাইতে বড় প্রশ্ন ঝোটাহাদের কাপড় শুকোবার। একখান করে তো কাপড়; গরমের দিন না হয় গায়ে শুকোতে পারে। কিন্তু শীতকালে?
শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়- মাসে একদিন স্নান মেয়েদের করতেই হবে। কোনো ওজর শোনা হবে না। গোঁসাই হু-উ উ, মাথার উপর আসবার পর, আর কোনো মরদ ফৌজ ইঁদারার উত্তরে বাঁশঝাড়টার দিকে যেতে পারবে না- ওখানে ঝোটাহাররা কাপড় শুকোবে। এরপর নিত্য নতুন কাণ্ড। আজব আজব খবর গানহী বাওয়ার। বৌকা বাওয়ারা দেখতে গেল কাব্য গণেশপুরে। ঢোঁড়াইকে সঙ্গে নিয়ে যাবে না- সে অনেক দূর, সাতকোশ- অতদূর যেতে পারবি না তুই। তারপর তারা যখন বনভাগের সাঁকো পার হয়েছে, তখন দেখে যে ঢোঁড়াই ভকত লাল কাপড় খান পরে ছুটতে ছুটতে আসছে পেছন থেকে। কী জেদী ছেলেরা বাবা! ঢোঁড়াইকে জিরোবার ফুরসত দেবার জন্য বাওয়াকে কুলগাছতলায় বসতে হয়। তারপর কাঝা গণেশপুরের বেলগাছটার তলায় পৌঁছ দেখে যে, যা শোনা গিয়েছিল তাই। প্রকাণ্ড বেলগাছের মগডালের পাতা তিরতির তিরতির করে নড়ছে- তিনটে করে পাতা একসঙ্গে। পাতাগুলোয় কী যেন লেখা লেখার মতোই লাগে। ঠিকই গানহী বাবার নাম। জয়, জয় হো! নয়ন সার্থক, জীবন সার্থক বাওয়ার আজ। ঢোঁড়াই-এর এত কষ্ট করে আসা সার্থক হয়েছে। জয় হো গানহী বাওয়া। তোমার নামের গুণেই না এত লোক বেলগাছটার-ডালে ডালে হুঁকো বেঁধে দিয়ে গিয়েছে। ঐ বেলতলার ধুলো ঢোঁড়াই লাল কাপড়ের খুঁটে করে বেঁধে নিয়ে আসে।
পরদিন ভারে থানে পৌঁছেই, না মুখ ধোয়া না কিছু, বাওয়া তার নিজের কল্কেটা ঢোঁড়াইকে চড়িয়ে দিল মহতোর বাড়ির পাশের বরহমভুতবালা [৯৯] বেলগাছটায়। ঢোঁড়াই বেলগাছে বাওয়ার হুঁকোকল্কেটা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে এল।
তামাক না খেয়ে সেদিন বাওয়ার কী ছটফাটানি। ঢোঁড়াই বুঝতে পেরে চুপটি করে বাওয়ার পাশে বসে থাকে। দুদিন রোজগার নেই, ঝুলি খালি। মেটে আলুর গাছের মতো এক রকম লতার, ওলের মতো কল ধাঙড়রা খায়। ঢোঁড়াই তাদের কাছ থেকেই শিখেছে যে, ওই আলুগুলোকে চুন দিয়ে ফুটিয়ে নিলেই তার তেতে কেটে যায়। ঢোঁড়াই অনেকক্ষণ ধরে ঐ আলু সিদ্ধ করে। সময় আর কাটতেই চায় না। অথচ আজকের মতো দিনে বাওয়াকে ছেড়ে দূরে থাকতে ঢোঁড়াইয়ের মন সরে না। বাওয়া ঢোঁড়াইকে ইশারা করে বলে- তোর ভালই হল,-আর আমার জন্য তোর তামাক সাজাতে হবে না। বাওয়া মড়ার মতো শুয়ে পড়ে থাকে। ঢোঁড়াইয়ের বড় মায়া হয় বাওয়ার উপর! নিশ্চয়ই গা হাত পা আনচান করছে। পা-টা একটু টিপে দি। বাওয়া আপত্তি করে না, বরঞ্চ বলে, গায়ের উপর উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিতে। বাওয়ার গা টিপে দিতে দিতে কেন যেন ঢোঁড়াইয়ের দুখিয়ার মার কথা মনে পড়ে। বেশ হত সে যদি বাওয়ার পা টিপে আরাম করে দিত। তার অসুখের সময়ের সেই রাত্রের কথা মনে আসে। দুখিয়ার মা, বাবুলালের মাচায়, ওই বিড়ালের মতো গোঁফওয়ালা বাবুলালের চায়, ওই বিড়ালের মতো গোঁফওয়ালা বাবুলালের পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছে- শালা নবাব…
পরণাম বাওয়া!
মহতো যে। হঠাৎ রাতে যে! ছড়িদারকেও সঙ্গে দেখছি।
এই সঙ্গত করতে এলাম। খুব ছেলের সেবা খাচ্ছ।
ঢোঁড়াই লজ্জিত হয়ে যায় বাওয়ার চাইতেও বেশি- বাওয়ার গায়ের উপর পা দিতে বাইরের লোকে দেখে ফেলেছে বলে। চেলাতে দেবে গুরুর গায়ে পা! কালই হয়তো মহতো এই নিয়ে দশ কথা বলবে লোকের কাছে।
বাওয়া লজ্জিত হয়ে উঠে বসে। ছড়িদার আর মহতো বিনা মতলবে থানে আসার লোক নয়।
ঢোঁড়াই লজ্জা কাটানোর জন্য বলে,-আজ তামাক না খেয়ে বাওয়ার শরীরটা অস্থির করছে। মহতো রসিকতা করে বলে, আর তোর?
আমি পেলে একটান মারতাম। না পেলে পরোয়া নেই।
মহতো দুঃখ করে বলে আমারই হয়েছে বিপদ। তামাক বিড়ি না খেলে এক ঘন্টাও চলে না। বুঝি অতি খারাপ জিনিস তামাক। তার উপর আজকাল আবার শুনছি অনেক জায়গায় গরুর রোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে তামাকে…বলেই সে বারকয়েক কেশে থুতু ফেলে
যেন তার গলায় একটা রোঁয়া তখনও লেগে রয়েছে…
ছড়িদার বলে বুঝি তো সব। রামজীর দেওয়া শরীর, তামাকের পাতা দিয়ে তৈরি কোনো রকম জিনিস, নিতে চায় না। খয়নি খাও-থু-থু-র সঙ্গে ফেলে দিতে হবে, নস্যি নাও, নাক ঝেড়ে ফেলতে হবে; জর্দা খাও, পানের পিচ ফেলতে হবে; তামাক সিগ্রেট খাও, ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দিতে হবে। এ হারামজাদার নেশা কিন্তু ছাড়তে-পারব না। বাওয়া, তোমারও আগে সাতদিন কাটুক তারপর বুঝব।
সুয়াজ (স্বরাজ-) অত সোজা না বলে মহতো তামাকের প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে দেয়।
তারপর মহতো আসল কাজের কথাটা পড়ে। তাদের ইচ্ছে ভকত হবার।
মহতো ভকত হওয়ার সুবিধে অসুবিধে বেশ ভাল করে খতিয়ে দেখেছে। প্রথম অসুবিধে মাছ মাংস খেতে পাবে না। মাংস তো এক ভেড়া বলির দিন খায়- মাছ নমাসে-ছ-মাসে মরণাধারে জল এলে হয়তো এক আধবার জুটে যায়। কাজেই ওটা বড় কথা নয়। প্রত্যহ স্নান করা- এটা একটু গোলমেলে ব্যাপার বটে, কিন্তু এ কষ্টটুকু সে স্বীকার করতে রাজী আছে। একমাত্র সত্যিকারের অসুবিধা যে, সে ভকত ছাড়া আর কারও বাড়ি ভেজে কাজে খেতে পারবে না। কিন্তু এর বদলে সে পাবে অনেক কিছু। লোকের চোখে সে বড় হয়ে যাবে। এমনিই মহতো, ছড়িদার, নায়েবদের সম্বন্ধে লোকে কিছুদিন থেকে অল্প অল্প স্পষ্ট কথা বলতে আরম্ভ করেছে। এ জিনিস আগে ছিল না। ঐ তো সেদিন খোঁড়া চথুরী পঞ্চায়তির মধ্যে চেঁচিয়ে কী সব বলে দিল। খারাপ হওয়ার দিন আসছে। মহতো নিজের জায়গা আরও একটুও মজবুত করতে চায়। বছরে একদিন মাছ খাওয়া ছেড়ে যদি লোকের মুখ বন্ধ করা যায়, তাহলে মহতোগিরি থেকে বেশ দুপয়সা রোজগার করে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে তার সমাজে পসার প্রতিপত্তি অনেক বাড়বে; চাইকি সে তার আগের মতো নুনুলালের সমান হয়ে যেতে পারে খ্যাতিতে।
তাই তারা এসেছে বাওয়ার সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে।
ঢোঁড়াইয়ের কথাটা একটুও ভাল লাগে না। এ যেন তাদের ঘরের জিনিসে বাইরের লোক হাত দিচ্ছে। রবিবারে রোজগার বন্ধ করবার সময় বাওয়ার সলার দরকার ছিল না, আর এখন নিজের গরজ পড়েছে, আর দরকার হয়েছে বাওয়ার সলার। বাওয়া যদি না বলে দেয় তো বেশ হয়।
বাওয়া আবার অদ্ভুত ধরনের জীব। সে খুব খুশি হয় ছড়িদার আর মহতোর প্রস্তাবে। তাদের পিঠ চাপড়ে হেসে অস্থির। আঙুলের কর গুনে, আকাশের দিকে দেখিয়ে, মাথার চুল দেখিয়ে, বুঝিয়ে দেয়, রবিবারে সকালে স্নান করে এলেই, বাওয়া তাদের গলায় তুলসীর মালা দিয়ে দেবে।
ঢোঁড়াই বাওয়ার উপর রাগে গজরায়; ওঁর আবার পা টিপে দেবে! মহতোর মতো লোক ভকত হলে আর সে চায় না ভকত থাকতে।
[৯৩. কথার মতো কথা। ৯৪. পর্বের দিন। ৯৫. রোজগার মেরো না। ৯৬. (মুখ্য শব্দ থেকে) মাতব্বর। ৯৭. পরিষ্কার ঝরিষ্কার। ৯৮. সাঙা। ৯৯. ব্রহ্মদৈত্য থাকেন যে গাছে।]
.
তাৎমা ধাঙড় সংবাদ
ঢোঁড়াই ঠিক বোঝে না গানহী বাওয়াকে। মহতো আর ছড়িদার ভকত হবার পরদিনই দেখা গেল, গানহী বাওয়া তাদেরই উপর সদয়, ঢোঁড়াইয়ের উপর নয়।
সকালে স্নান করেই মহতো আর ছড়িদার তাৎমাটুলির মোড়ের উপর খানিকটা জায়গা বেশ করে লেপতে বসে, গোবর দিয়ে। সেখানে রাখে একটা ঘটি। তারপর ঘটিতে খানিকটা জল ঢেলে দেয় মহতো। রতিয়া ছড়িদার ঘটির উপর গামছা ঢাকা দিয়ে তিনটে তুলসীপাতা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মহতো মনে মনে গানহী বাওয়ার মন্তর পড়তে থাকে।
প্রণাম করে গামছা সরানোর পর দেখা গেল যে, গানহী বাওয়া ঘটির জলে এসেছেন জল বেড়ে গিয়েছে; ঐ তো বেড়ে গিয়েছে চোখে দেখছিস না। দু-আঙুল তো জল ঢালা হয়েছিল মোটে। সত্যি তো! ছুঁস না ছুঁস না ঘটি; ও জল আবার সৌরা নদীতে দিয়ে আসতে হবে।
ঢোঁড়াইয়ের হিংসে হয় মহতো আর ছড়িদারের উপর। তারা ভকত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গানহী বাওয়াকে আনছে। সে নিজেও চুপি চুপি থানে চেষ্টা করে দেখে। কিন্তু তার ঘটিতে গানহী বাওয়া আসেন না- জল সেই যেমন তেমনই আছে। গানহী বাওয়ার এই একচোখোমি তার মনে বড় আঘাত দেয়। কিন্তু সে কথা প্রকাশ করতে পারে না কারও কাছে; তার ভকত গিরির তাকৎ নেই, একথা লোকে জানলে, সে ছোট হয়ে যাবে পাড়ার লোকের কাছে।
কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের সেদিনকার প্রার্থনা বোধহয় গানহী বাওয়া শোনেন। মহতো আর ছড়িদারকে ধাঙড়রা আচ্ছা রকম বেইজ্জত করে। রবিবারের দিন দুপুরে মহতোর দল গিয়েছিল নতুন তুলসীর মালা দেখাতে ধাঙড়টুলিতে! ধাঙড়দের সঙ্গে আসল ঝগড়া তাৎমাদের রোজগার নিয়ে। তারা সব কাজ করতে রাজী। তার উপর সাহেব পাত্রী, বাবুভাইয়ারা, কপিল রাজা সকলেই ছিল তাদের দিকে। কপিল রাজার জন্যে বড় শিমুলগাছগুলো একেবারে নির্মূল করে দিয়েছিল তারা। লড়ায়ের আমলে লা-র জন্য কুলের ডাল কাটত কপিল রাজার জন্য তারাই। শুয়ার-খোর মুগীয়োর লোকগুলোকে গানহী বাওয়ার নামে নিজেদের প্রতিপত্তি দেখাতে গিয়েছিল দুই নতুন ভকত, গিয়েই তাদের বলে যে তোদের শুয়োর-মুর্গী ছাড়তে হবে-গানহী বাওয়ার হুকুম মাস্টার সাবও সসুরার [১০০] থেকে বেরিয়ে বলেছে। জয়সোয়াল সোডা কোম্পানিতে কাজ করে বুড়ো এতোয়ারী। সে ফোকলা দাঁতে হেসেই কুটি কুটি। আরে গানহী বাওয়া তোদের খত [১০১] দিয়েছে নাকিরে? তাহলে ডাকপিয়ন এসেছে বল, তোদের পাড়ায়। শনিচরা ধাঙর বলে-লে ডিগি ডিগি! তাই বল! মহতো ভতক হয়েছিস। ছড়িদারও দেখছি তাই। বিলি ভকত আর বগুলা ভকত। [১০২] তাই গানহী বাওয়ার হুকুম ফলাতে এসেছিল। পরশুও তো ছড়িদারকে কলালীতে [১০৩] দেখেছি সাঁঝের পর।
মিছে বলিস না খবরদার! জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেব।
আয় না মরদ দেখি।
এতোয়ারী শনিচরাকে চুপ করতে বলে। তারপর মহতোকে পরিষ্কার বলে দেয় যে, সাহেব-মেমদের কাছে শুয়োরের মাংস, আর মুগীর ডিম বেচে তাদের পয়সা রোজগার হয়। গানহী বাওয়া যদি আমাদের পেট কাটেন, তাহলে তিনি তোমাদেরই থাকুন! আর পচই আমাদের পূজোয় লাগে;, ও ছাড়তে পারব না। মাস্টারসাব বাবুভাইয়া লোক। তাদের যা করা সাজে আমাদের তা করা সাজে না। ঐ যে সেবার টুরমন- এর তামারা [১০৪] হল ঝিকটিহার মাঠ ঘিরে, তাতে যে রংরেজ জার্মান লড়াই [১০৫] হল;– আমাদের ভিতরে যেতে দিয়েছিল? তোদের যেতে দিয়েছিল?
গিরানীরর দোকানের [১০৬] শস্তা চাল, তোদের দিত সে সময়? এস ডি.ও.সাহেবের সরকারী কাছারির নাট্টু মার, আর পেয়ারা মার্কা রৈলী [১০৭] তোদের দিয়েছে কোনোদিন? আর রোজ স্নান করা- তোরা আজ ভকত হয়ে করছিস। আমাদের মেয়েরা পর্যন্ত চিরকাল প্রত্যহ স্নান করে এসেছে। মহতো আর তার দল চটে আগুন হয়ে যায়। আমাদের মেয়েছেলেদের উপর ঠেস দিয়ে কথা। ঐ মেসোহেব ধাঙড়নীদের দিস পাঠিয়ে সাহেবটোলায়, আর ঐ মুসলমানদের বাড়িতে, যাদের সঙ্গে মিলে তোরা শিমুলগাছগুলো সাবড়ে দিয়েছিস। পাঠিয়ে দিস শনিচার বৌটাকে, মলি সাহেবের পাকা চুল তুলে দিতে।
তুলমারী কাণ্ড আরম্ভ হয়ে যায়। কারও কথা বোঝা যায় না হট্টগোলের মধ্যে। তাৎমাদের সজীব গালির তোড়ে ধাঙড়রা থই পায় না। শেষকালে একরকম দিশাহারা হয়েই তারা তাৎমাদের তাড়া করে। চিরকালের অভ্যাস মতো আজও তাৎমারা পালায়। সোজা পাক্কীর দিকে, লাঠি ফেলে, টিকি উড়িয়ে, পাক্কীর হোঁচট খেয়ে; পালা পালা! তারপর রাস্তা পার হয়ে, তারা পাক্কীর তাৎমাটুলীর দিকের গাছের সারির নিচে,-রাস্তার মাটি কাটার গতাঁর মধ্যে দাঁড়ায়। এখানে আবার নতুন মোর্চাবন্দী [১০৮] করে তারা গালাগালির লড়াই আরম্ভ করে। ধাঙড়রা হাসতে হাসতে ফিরে যায়। তাদের চিরকালের নিয়ম তারা পাক্কী পার হয়ে গিয়ে কখনও তাৎমাদের সঙ্গে মারপিট করে না। কেবল চিৎকার করে বলে যায় হাভেলী পরগণায় [১০৯] পৌঁছে দিয়েছিল সঙ্গে করে। সিনুর লাগাস সিনুর [১১০]। দুই ভকতে। বিল্লি ভকত আর বগুলা ভকৎ। দুজনের গলার হার দুটো দেখাতে ভুলিস না ঝোটাহাদের। তারপর ধাঙড়রা ফিরবার সময় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, শালাদের রক্তের ঠিক আছে? সন্ধ্যার সময় দেখিস না কত বাবুভাইয়ারা, তাৎমাটুলির আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি করে। সাহস আসবে কোথা থেকে? সব রক্ত পানি হয়ে যাচ্ছে। হত আমাদের টোলা, দিতাম বাবুদের মজা টের পাইয়ে। বাবুভাইয়ারা মিহি চালের ভাত খায়, গরু দেখলে ভয় পায়।
শনিচরা বলে, বিয়ের আগে আমিও তো কত বাবুভাইয়ার বাড়ি ভাত খেয়েছি। এত সাদা চাল! একদম মিঠা না। সেয়ভরের কম ও চালে পেটই ভরে না। তারপর এক লোটা জল খাও। আধ ঘণ্টার মধ্যে সব ফুস-সস। বলে সে একটি তুড়ি দেয়।
একমাত্র শুক্রা ধাঙড় এই অনধিকার চর্চার প্রতিবাদ করে। জানিস, মিহি চাল খেলে বুদ্ধি খোলে। ঐ মিহি চালের জোরেই বাবুভাইয়ারা গেলে হাকিম বসতে কর্সি দেয়। তোকে আমাকে দেয়? তাৎমাদের দেয়? এইসব টোলায় ডাকপিয়ন আসে চিঠি নিয়ে? যা রয় সয় তাই বলিস।
তাৎমা খেদানোর উল্লাসের মধ্যে শুক্রা কী সব বাবুভাইয়াদের কথা এনে সমস্ত জিনিসটাকে তেতো করে তুলেছে।
বুড়ো এতোয়ারী লাল চাল খেলেও বেশ বুদ্ধিমান। সে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে বলে, চল চল। সিঙ্গাবাদ থেকে শনিচরা নতুন মাদল এনেছে। মুচিয়ার মাদল কোথায় লাগে এর কাছে। চল শীগগির খেয়ে দেয়ে বাঙ্গা গাছের তলায়। ঘুঁটে ধরিয়ে আনতে ভুলিস না শনিচরা। শীগগির।
বিরৌলীকে হাটিয়া-আ
দৌড়ে নৌকানিয়া-আ
ঠস ঠস রে বোলে বুনিয়া-আ-আ-আ-আ-[১১১]।
জলদিরে জলদি।
[১০০. শ্বশুরবাড়ি; এখানে জেলখানা। ১০১. চিঠি। ১০২- বিড়াল তপস্বী আর বকধার্মিক। ১০৩- মদের দোকান। ১০৪. ১৯৪১ সালে কয়দিনব্যপী একটি উৎসব হয় জিরানিয়াতে যুদ্ধ-সংক্রান্ত প্রচারের জন্য। এর নাম ছিল ভিীক টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্ট থেকে প্রচুর অর্থ সংগৃহীত হয়। ১০৫. টুর্নামেন্ট ইংরাজ-জার্মানদের nouk light হয়েছিল। ১০৬ যুদ্ধের সর গভর্নমেন্ট স্টোরস: এখানে সস্তায় জিনিস পাওয়া যেত। ১০৭. লাট্ট মার্কা আর পেয়ারা মার্কা র্যালি ব্রার্সের কাপড়। ১০৮. ব্যুহ রচনা করে। ১০৯. রাস্তার ওপারটা পড়ে হাভেলী পরগণাতে: আর হাভেলী কথাটার অর্থ অন্দরমহল এই নিয়েই ধাঙড়রা বিদ্রূপ করে। ১১০. সির। ১১১. ধাঙড়দের দ্রুততালের গান। বিরৌলীর হাটে দৌড়চ্ছে দোকানদার, বোঁদে (মিষ্টান্ন) থেকে ঠস ঠস শব্দ হচ্ছে।]
.
সামুয়রের ভর্ৎসনা
ঢোঁড়াই বড় হয়ে উঠেছে। আর সে তাৎমাটুলির অলিতে গলিতে কনৈল খেলার ঘুচচী [১১২] কাটে না, বাঁশের চোঙের মধ্যে দরদময়দার ফল দিয়ে বন্দুক ফোঁটায় না, মোরব্বার [১১৩] পাতা দিয়ে ঘর ছাইবার খেলা খেলে না। ও সব বাচ্চারা করুক। সে এখন মোহরমের সময় ফুদীসিংহের দলে মাতুম যায় [১১৪] দুল দুল ঘোড়ার মেলায় হিন্দু মুসলমান ভাইয়া, জোরহুরে পীরিতিয়া রে ভাই, হায় রে হায়। [১১৫]
বর্ষা শেষ হলেও যেমন মরণাধারে জল থেকে যায়, গানহী বাওয়ার হাওয়া পড়ে আসবার পরও সেই সময়ের রেশ রেখে যায় এই মাতুলগানে।
মরগামার তাৎমাদের যুগিরা [১১৬] নাচের দলে তাকে নিয়ে টানাটানি। মরগামার ওরা মুঙ্গেরিয়া তাৎমা, আর তাৎমাটুলির তাৎমারা কনৌজিয়া তাৎমা। মুঙ্গেরিয়া তাৎমারা জাতে ছোট বলে, তাদের সঙ্গে এত মাখামাখি–তাৎমাটুলির লোকেরা পছন্দ করে না।
কিন্তু, ও ছোঁড়া কি কারও কথা শুনবে। ধাঙরটুলির কর্মধর্মায় নাচের মধ্যে পর্যন্ত গিয়ে বসে আছে। ধাঙরটুলিতে যাওয়াই ছাড়ল না- অন্য জায়গায় যাওয়া ছাড়ল কি না ছাড়ল- তাতে কী আসে যায়।
বাওয়া মনে মনে এক বিষয়ে খুশি যে, ধাঙরটুলি থেকে, আম, লিচু নানারকম ফল ঢোঁড়াই নিয়ে আসে- এমন জিনিস যা তাৎমারা কোনেদিন দেখেওনি। ধাঙড়রা সাহেবদের বাগান থেকে এই সব কলম চুরি করে এনে লাগিয়েছে। তারা তাদের সনবেটাকে [১১৭] খাওয়ার জন্য দেয়। ঢোঁড়াই আবার সে সব, পাড়ার তার দলের ছেলেদের এনে দেয়, বাওয়ার জন্য রেখে দেয়। কার সঙ্গে ঢোঁড়াইয়ের আলাপ না। কালো ঘাগরাওয়ালী পাদ্রী মেম যিনি ধাঙরটুলিতে আসেন, তার সঙ্গে পর্যন্ত ঢোঁড়াইয়ের আলাপ।
বাওয়া ঢোঁড়াইয়ের সব দোষ সহ্য করে যায়, কিন্তু ঐ রোজগারে বার হওয়ার সময় যে অধিকাংশ দিনই তার টিকি দেখার জো নেই, এ জিনিসটা সে সহ্য করতে পারে না। ভিক্ষের রোজগারে ঢোঁড়াইয়ের কেমন যেন একটু কুণ্ঠিত ভাব অন্যের কাছে, এটুকু বাওয়ার দৃষ্টি এড়ায়নি। সেইজন্যই বাওয়ার চিন্তা সবচাইতে বেশি! ভোরে উঠেই ছোঁড়া পালিয়েছে। তার বন্ধুরা তো সব রোজগারে বেরিয়েছে, ওটা কোথায় থাকে, কী করছে এখন, বাওয়া কিছুই ঠিক করতে পারে না। ঢোঁড়াইয়ের হয়তো তখন মরণাধারের কাঠের সাঁকোটির উপর পা ঝুলিয়ে বসে বকের পোকা খাওয়া দেখছে, মন উড়ে গিয়েছে কোথায় কোন স্বপ্নরাজ্যে…বিজা সিং চলেছেন…ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন কুয়াশার রাজ্যের মধ্য দিয়ে…অসংখ্য জোনাকী মিট মিট করে জ্বলছে অন্ধকারে…সে তার চাইতেও জোর চালাবে রেলগাড়ি…কোথায় চলে যাবে এঞ্জিনের সিটি দিতে দিতে। বাওয়ার দেখাশুনা করবে দুখিয়ার মা;-না ও মাগীর দায় পড়েছে।…বিজা সিং যদি তরোয়াল দিয়ে দুখিয়ার মা আর বাবুলালকে কেটে ফেলে।…
এমনভাবে বকগুলো পা ফেলে যে, দেখলেই হাসি আসে-বগুলা চুনি চুনি খায় [১১৮]…মরগামার লম্বী গোয়ারিন [১১৯] যাচ্ছে ঐ দূরে পাক্কীর উপর দিয়ে। শুটকো হাঁটুর উপর কাপড় তুলে দিয়েছে বোধ হয় রাস্তায় কাদা, ঠিক বকের চলার মতো করে চলেছে…গে-এএ…লম্বী গোয়ারিন! বগুলা চুনি চুনি খায়। বলে ঢোঁড়াই নিজেই হাসে। লম্বী গোয়ারিন এদিকে তাকায়- বোধ হয় কথাটা বুঝতে পারে না। হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে টৌনে…বকটা ঘাড় কাত করে অতি মনোযোগের সঙ্গে কী যেন একটা গর্ত না কী লক্ষ্য করছে। ভিক্ষা পাওয়ার পর চলে আসবার সময় বাওয়াও ঠিক অমনি করে, এক মুঠো চাল হাতে নিয়ে, ঘাড় কাত করে দেখে-চালটি ভাল না খারাপ। চাল খারাপ হলে বাওয়ার মুখ অমনি অন্ধকার হয়ে ওঠে। সে চাল কটিকে ঝুলির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে, জোরে জোরে পা ফেলতে আরম্ভ করে। ত্রিশূলের সঙ্গে লাগানো পিতলের আংটাটা ঝমড় ঝমড় করে বাজে। ঢোঁড়াইয়ের মুখ দুষ্টুমির হাসিতে ভরে ওঠে।
ছাই রঙের ডানাওয়ালা বকগুলিকে সাদা করা নিশ্চয়ই দেখতে পারে না। বাবু ভাইয়ারা কি তাৎমা ধাঙড়দের সঙ্গে থাকতে পারে। কিন্তু ছাই রঙের ডানা হয়েছে। বলে কি তার হুক্কা পানি: [১২০] একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। বগুলা ভকত [১২১] দেখতে ঐ ভাল মানুষ, কিন্তু তার পেটে পেটে শয়তানি।।
আরে বগুলা ভকৎ কী করছিস, বকের মতো ঠ্যাং ঝুলিয়ে?- সামুয়র হাসতে হাসতে ঢোঁড়াইকে জিজ্ঞাসা করে।
ঢোঁড়াই চমকে উঠেছে। সামুয়রটা কোন দিক থেকে এসে গেল, ঢোঁড়াই অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ! এই খাঁকির হাফপ্যান্টি পরা কিরিস্তান ধাঙড় ছেলেটা কি গুণ: [১২২] জানে নাকি। না হলে হঠাৎ তাকে বলা ভকৎ বলে ডাকল কেন? সেও যে ঠিক ভকতের কথাটাই ভাবছিল। ঐ পাত্রী সাহেবের টাটু [১২৩] সামুয়রটা কি তাকে এক দণ্ডও নিরিবিলিতে থাকতে দেবে না! তার আসল নাম স্যামুয়েল, বয়সে ঢোঁড়াই য়ের চেয়ে দু-এক বছরের বড়; ফুটফুটে ফরসা, নীল চোখ কটা চুল, মুখে বিড়ি, চোখেমুখে কথা, দরকারের চাইতে বেশি চটপটে; শুয়রের কুঁচির মতো খাড়া অবাধ্য চুলগুলিতে জবজবে সরষের তেল মেখে টেড়ি কেটেছে। জেমসন সাহেব নীলকুঠিবহুল জিরানিয়াতে, নীলকুঠির পড়তি যুগে একটা পাউরুটির কারখানা খুলেছিল। পরে সে সানের ঘরে, ক্ষুর দিয়ে নিজের গলা কেটে অত্মহত্যা করে। তার ভিটের মিষ্টি কুলের গাছটা তাৎমা আর ধাঙড় ছেলেদের লোভ আর ভয়ের জিনিস। মিষ্টি ফলের তুলনা দিতে গেলেই তারা বলে, গলাকাটা সাহেবের হাতার কুলের মতো মিষ্টি। দিনের বেলাতেও রাখাল ছেলেরা একলা সে গাছের তলায় বসতে ভয় পায়। সেই গলাকাটা সাহেবের মেমকে পাউরুটি তৈরি করতে সাহায্য করত, সামুয়রের দিদিমা। গলাকাটা সায়েব পান খেত, গড়গড়া টানত। সামুয়রের দিদিমার স্নানের জায়গার জন্য চুণার থেকে নৌকোয় করে পাথর এনে দিয়েছিল। সেটা এখনও পড়ে আছে সামুয়রদের বাড়ির উঠোনে। কালো ঘাগড়াওয়ালী পাদ্রী মেম, ধাঙড়টুলিতে এলে ঐ পাথরখানার উপরেই তাকে বসতে দেওয়া হয়।
আবলুসের মতো কালো সামুয়রের দিদিমার যখন ফুটফুটে মেমের মতো রঙের মেয়ে হয় তখন সেইজন্যে কেউ আশ্চর্য হয়নি।
সামুয়রও পেয়েছে মায়ের রঙ।
কিরে বগুলা ভগৎ, আজকে রবিবার। আজ যে বড় বৌকা বাওয়ার সঙ্গে ভিক্ষে করতে বেরুসনি?
প্রশ্নটিতে ঢোঁড়াইয়ের যেন একটু অপমান অপমান বোধ হয়।
কারও চাকরও না, কারও পয়সাও ধার করিনি! তোদের মতো তো নয় যে, আজকে গীর্জায় যেতেই হবে, নইলে পাত্রী সাহেব দুধ বন্ধ করে দেবে।
আরে যা যা! লবড় লবড় [১২৪] বলিস না। বাড়ি বাড়ি থেকে চাল ভিক্ষে করার চেয়ে পাত্রী সাহেবের দেওয়া দুধ নেওয়া ঢের ভাল।
মুখ সামলে কথা বলিস। চুকন্দর: [১২৫] কোথাকার। সাধু সন্তকে কি লোকে ভিক্ষে দেয় নাকি? ও তো গেরস্তরা রামজীর হুকুম মতো সাধুদের কাছে নিজেদের ধার শোধ করে। না হলে বাওয়া কি বরমভুতকে দিয়ে মরণাধারের নিচে থেকে আশরফির মড়া বার করতে পারে না।
থাক থাক, তোর বাওয়ার মুরোদ জানা আছে। সেবার যখন টোলায় পিশাচের উপদ্রব হল, কোথায় ছিল তোর বাওয়া। রেবণগুণী তুক করে যেই না বালি ছুঁড়ে বাণ মারা [১২৬] অমনি সেটা একটা বিরাট বুনো মোষ হয়ে কাশবনের মধ্যে থেকে মরণাধারে ঝাঁপ দিল। তার চোখ দুটো দিয়ে আগুন বেরুচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করিস তোদের মহতোকে।
এই অকাট্য যুক্তির সম্মুখে আর ঢোঁড়াইয়ের তর্ক চলে না, কিন্তু বাইরের লোকের মুখে বাওয়ার নিন্দা সে কখনই সহ্য করতে পারে না।
থাম থাম। ফের ছোট মুখে বড় কথা বলবি তো, পিটিয়ে তোর সাদা চামড়া আমি কালো করে দেব। গির্জেতে যে টুপিতে করে পয়সা নিস তার নাম কি? তুই নিজেই তো দেখিয়েছিস।
হ্যাঁ হ্যাঁ জানা আছে শালা তাৎমাদের।
বিল্লীর মতো চোখ, কিরিস্তান, তুই জাত তুলে গালাগালি দিস। ঢোঁড়াই সামুয়রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর বলবি? বল।
সামুয়রকে না বলিয়ে তবে ঢোঁড়াই তাকে ছেড়ে দেয়। সামুয়র যেতে যেতে গায়ের ধুলো ঝাড়ে- আর যাওয়ার সময় বলে যায় যে আজ রবিবার না হলে দেখিয়ে দিতাম।
এ ঢোঁড়াইয়ের জীবনে প্রতিদিনের ঘটনা; কিন্তু অন্য তাৎমার মতো সে গায়ে পড়ে ঝগড়া আরম্ভ করে না, আর ঝগড়া একবার আরম্ভ হয়ে যাবার পর সে পালায়ও না।
[১১২. কল্কে ফুলের বিচি দিয়ে খেলার জন্য গর্ত। ১১৩. aloe– আনারসের মতো পাতা দেখতে। ১১৪. মহরমের শোকের গীত-এর প্রতি লাইনের শেষে, হায়রে, কথা কয়টি থাকে। ১১৫. হিন্দু-মুসলমান ভাই, প্রীতির বন্ধনে, বাঁধোরে ভাই, হায়রে হায়। ১১৬. এক প্রকার গ্রাম্য গীতিনৃত্য। ১১৭. ধর্ম-ছেলে। ১১৮. বক বেছে খায়। ১১৯. লম্বা গয়লানী। ১২০. হুঁকো জল। এর অর্থ একঘরে করা। ১২১. বক ধার্মিক। ১২২. ইন্দ্রজাল। ১২৩. আদুরে গোলাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়। শব্দার্থ- টাটু ঘোড়া। ১২৪, বাজে বকা। ১২৫. বীট পালং। ১২৬- যাদুবিদ্যার প্রক্রিয়া বিশেষ।]