১-২. বাঁকা বাগদি

বাঘিনী – উপন্যাস – সমরেশ বসু

০১.

দু’বছর আগে বাঁকা বাগদি যেদিন মারা গিয়েছিল, সেদিন এ সংসারের অমোঘ নিয়মের কোথাও কোনও ত্রুটি ঘটেনি।

মানুষ ধরিত্রীর সন্তান। পাপী-তাপী, পুণ্যবান, সব মানুষই নাকি। একটি করে মানুষের মৃত্যু পৃথিবীর অদৃশ্য গায়ে একটি করে বয়সের রেখা। একটি হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ, জঙ্গম পৃথিবীর এক মুহূর্তের স্তব্ধতা, এ সব কথা শোক-গাথায় মানায়।

বাঁকা বাগদির জন্য শোক, নীতিবিরুদ্ধ ও অসম্মানকর। মানুষের দূরের কথা স্বয়ং ধরিত্রীরও। কারণ বাঁকা বাগদি ছিল ঘোর পাপী।

তাই সেদিন পাখি ডেকেছিল। বাতাস বয়েছিল। আকাশের নীলিমায় ছিটেফোঁটা স্পষ্ট মেঘের ছায়াও পড়েনি। জীবজগৎ কিংবা জড়জগতের কোথাও কোনও ত্রুটি ঘটেনি নিত্য অনুষ্ঠানের।

কেঁদেছিল একজন। বাঁকা বাগদির মেয়ে দুর্গা। যার একটি পোশাকি নামও আছে, পারুলবালা। বিহানবেলা ঘুম ভেঙে যাদের লজ্জা নিবারণ রোজের চিন্তা, তোলা কাপড়ের হিসেব তারা পাগল না হলে করে না। বাঁকা বাগদির ঘরে মেয়ের তোলা-নামও সেই রকম হিসেবের পাগলামি বলেই মনে হয়! বাপ ডাকত ছুঁড়ি বলে। লোকে ‘বাঁকার মেয়ে’। আর যে সব নাম ছিল, সেগুলি গালাগালির বিশেষণ।

পোশাকি নাম শুধু একটি কথাই প্রমাণ করে। বাঁকা বাগদির ঘরে কোনও এক কালে কিছু শখের অবকাশ ছিল।

দুর্গা কেঁদেছিল অসহায় হয়ে। কারণ বাপ ছাড়া আর তার কেউ ছিল না। সংসারে অনেক মেয়ের বাপ থাকে না। কিন্তু সংসারে যে মেয়ের বিয়ে হয়নি, তবু আঠারো বর্ষার প্লাবনে দেহের দরিয়া অকূল, সে মেয়ের একটি বাপ দরকার ছিল। সে বাপ যেমনই হোক। ভবঘুরে বাউণ্ডুলে ভিখিরি কিংবা কানা খোঁড়া অথর্ব। সংসারে এটা একটা নিয়মের সামিল।

তার ওপরে, সে মেয়ের যদি গায়ের রং কটা হয়, চুল পড়ে কোমর ছাপিয়ে, চোখ হয় নিশিন্দা পাতার মতো আয়ত; আর সেই চোখ যদি দীঘির কালো জলে সূর্য-ছটা চলকানো-ঝলকানো হয়। যদি, ভাদরের থির নয়, শাওনের অথই জলস্রোতের বেগে মেয়ের যৌবন একূলে ওকূলে যায় ভাসিয়ে। তারও পরে অভাগি সেই মেয়ের বিষকটু চোপা শুধুমাত্র স্ফুরিত ঠোঁটের গুণেই যদি উলটে মিঠে নেশার আমেজ ধরায়। তারও চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য যদি সে মেয়ে হয় মৃত কুখ্যাত বাঁকা বাগদির মেয়ে, তবে সেই মেয়ে কেন শুধুমাত্র শব-ভুক শকুনের তীক্ষ্ণ বাঁকা চঞ্চুর এক্তিয়ারে নয়?

এ কথার জবাব দেবার দায়িত্ব কেউ নেবে না এ-দেশে, একথা জানত দুর্গা। পোশাকি পারুলবালা, যদিও সাত ভাই চম্পার রূপকথার দেশেরই মেয়ে সে।

তাই দুর্গা কেঁদেছিল। কাছে হোক, দূরে হোক কু হোক, সু হোক, ওঝার তুকের সীমানায় ছিল দুর্গা। ওঝা মারা গেছে। চ্যাংমুড়ি কানি বাঁকা গ্রীবা নিষ্ঠুর অপলক চোখ তুলে আসছে দিগদিগন্ত ঘিরে। দুর্গা কেঁদেছিল অসহায় ভয়ে।

বাগদিপাড়ায় দুর্গার অভাব ছিল না। মেলা-ই না হোক, কয়েকজন ছিল। আইবুড়ো উঠতি বয়সে যারা বাপ-মা হারিয়েছিল। স্বামী হারিয়েছিল যারা অথই বয়সে। বাঁকা বাগদির মতো তাদের হয়তো কানাকড়ি ফোঁকা অবস্থাও ছিল না। ছিল হয়তো ছিটেফোঁটা জমি, জলে ভেসে-যাওয়া পিঁপড়ের তৃণকুটোর মতো। কিন্তু মেয়ে বলে কথা। মেয়েই বা কেন শুধু। মেয়ে কি মানুষ নয়?

মানুষ-ই। কিন্তু পুরুষমানুষ নয়। এ-দেশে এটা শুধু কথার কথা নয়, বড় কথা। কপালের লিখন মন্দ থাকলেই নাকি সংসারে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাতে হয়। মেয়ের ধর্ম নাকি সে যেচে করে না, কেঁদে করে। তাই কপাল কোটা শেষ হয় না তার কোনওদিন।

কলকাতায় নাকি মেয়েরা অফিস-আদালত চালায়। আরও অনেক দূর দূর মুলুকে নাকি তারা যুদ্ধ করে। উড়োজাহাজে উড়ে বোমা মারে। কত কী করে। হুগলি জেলার এক পাড়াগাঁয়ের বাগদিপাড়ায় বসে, কান পাতলে নিঝুম সন্ধ্যায় নতুন বিজলি রেলগাড়ির বাঁশি শোনা যায় দূর থেকে। কিন্তু সংবাদ, সংবাদ থেকে যায়। এখানে মেয়ে জীবনের কপাল কোটার শেষ হয় না।

নগরে আছে জাঁদরেল কোটাল। লস্করের ছড়াছড়ি। দেউড়িতে আছে বাঘা সেপাই। গায়ে সোনা নেই, দানা নেই, হিরে নেই, জহরত নেই। পুরুষহীনা রাজ্যেশ্বরী তবু অরক্ষণীয়া। শক্ত করে কপাট বন্ধ করেও রাজ্যেশ্বরীর বুকে ত্রাস। ফুঁ দিয়ে বাতি নেভাতে তার দমে কুলোয় না। সারাদিনের এত যে শাসন, কত কষণ, বহু পালন, সে সব কোথায় যায়। যার চোখের খরায় দুর্জন পোড়ে, সুজন সুখী স্নেহে, রাজ্যেশ্বরীর কীসের ভয়, কপাট বন্ধ একলা ঘরে?

রাজ্যেশ্বরীর ভয়, সে মেয়েমানুষ। দিন যায়, রাত্রি আসে। এ-ঘর তার দরবার নয়, অমাত্য-আমলার ভিড় নয়, কুর্নিশ নয়। এ-ঘর তার শয়নকক্ষ। রাজ্যেশ্বরী এই ঘরে মেয়েমানুষ। যখন সে এই ঘরে, তখন সেও কপাল কোটে মেয়েমানুষ হয়ে।

শুধু কি মানুষেরই ভয়? নিজের প্রকৃতিতেই যে তার বুকের মধ্যে কত ভয়ের লীলা সাজিয়ে রেখেছে থরে থরে।

তাই বাগদিপাড়ার লোকেরা বলে, মেয়ে বলে কথা।

আরও কথা আছে। শুধু ভয় ত্রাসের কথা নয়। মেয়ে হওয়া যে কত বড় কথা, সেকথা বলেছে মহাভারতের সেই রাজা। না, মেয়েমানুষকে খোশামোদ-তোষামোদের কথা নয়! মেয়ে হওয়ায় কত সুখ, সে কথা বলে গেছে সেই রাজা।

রাজাটার মনে সুখ ছিল না। রাজ রাজ্যপাট ধনরত্ন, রাজমহিষী সব আছে। রাজার ছেলে নেই। হয় না। রাজা যজ্ঞ করলে, পুজো দিলে আগুনকে। অগ্নিদেবতার বরে রাজার ছেলে হল একশো। কিন্তু ইন্দ্ররাজ গেল ক্ষেপে। আগুনের পুজো হল, আর ইন্দ্র গেল বাদ? মায়া দিয়ে ছলনা করল রাজাকে। সে-মায়ায় রাজা পাগলের মতো ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে রাজা পথ হারালে। তেষ্টায় বুক ফাটতে লাগল। তখন সামনে পেল এক সুন্দর টলটলে সরোবর। রাজা ঝাঁপ দিয়ে পড়ল সেই সরোবরের জলে। তেষ্টা মিটল। কিন্তু হায়! রাজা আর রাজা রইল না। জল থেকে উঠল রাজা এক রূপসী মেয়ে হয়ে। সে রূপ, সে যৌবন মুনির ধ্যান ভাঙতে পারে।

দুঃখে রাজার মুখ অন্ধকার। রাজ্যে ফিরে গিয়ে, রানিকে আর ছেলেদের ডেকে সে বললে, রাজ্য পালন করো, আমি বনে চললুম।

রাজা বন-গমন করলে। আশ্রয় নিলে এক মুনির আশ্রমে। কিন্তু রাজা তো আর রাজা নেই। রূপসী যুবতী মেয়েমানুষ। রূপ দেখে তার মুনির মন টলে গেল। মুনি তাকে ভালবাসল। সেই ভালবাসায়, মুনির ঔরসে মেয়েরূপী রাজার গর্ভে আরও একশো ছেলে হল। রাজা তখন সেই ছেলেদেরও রাজ্যে নিয়ে গেল। নিজের ঔরসজাত ছেলেদের বললে, এই একশো জনও তোমাদের ভাই, আমার পেটের সন্তান। সবাই মিলে রাজত্ব করো সুখে।

দুশো ভাইয়ে সুখে রাজত্ব করতে লাগল। রাজা ফিরে গেল তার প্রেমিক ঋষির কাছে। ইন্দ্র ভাবলে, হল তো ভাল। অপকার করতে গিয়ে উপকার করে বসে রইলুম? তবে লাগ ভেল্কি ভাল হাতে।

ইন্দ্র ছলনা করে, দুশো ভাইকে লড়িয়ে দিলে। বললে, তোমরা একদল রাজার ছেলে, আর একদল ঋষির ছেলে। একত্রে তোমরা রাজ্যভোগ করছ কেন? যে-কোনও একদল ভোগ করো।

শুনে ছেলেদের ভেদবুদ্ধি জাগল। তারা লড়ালড়ি শুরু করলে। লড়ে, সকলেই মারা পড়ল। তখন রূপসী মেয়ে-রাজা মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে বসল। সদয় হয়ে দেখা দিল ইন্দ্র। বললে, তোমার দুঃখের কারণ আমি। যজ্ঞে তুমি আমার স্তুতি করনি, খালি আগুনকেই করেছ।

রাজা মাপ চাইলে। ইন্দ্র খুশি হয়ে বললে, বর চাও।

রাজা বললে, ছেলেদের ফিরিয়ে দাও।

ইন্দ্র বললে, তা দেব। কিন্তু সকলকে নয়। একশো ছেলে ফিরে পাবে। কিন্তু কোন একশোকে চাও? বাপ হয়ে যাদের পেয়েছিলে, তাদের? না, মা হয়ে যাদের পেটে ধরেছিলে, তাদের?

তখন রূপসী মেয়েরাজা বললে, ভগবান! মায়ের চেয়ে বেশি স্নেহ আর কার কাছে আছে। আমাকে আমার পেটের সন্তানদের ফিরে দাও।

ইন্দ্র চমৎকার মনে করে, সেই বরই দিল। তারপর ইন্দ্র বললে, তোমার রূপ বদলের বর চাও রাজা।

মেয়ে রাজাটি বললে, হ্যাঁ, বর দাও ভগবান, যেন আমি মেয়েমানুষ হয়ে সারাজীবন কাটাতে পারি।

ইন্দ্র অবাক হয়ে বললে, কেন?

নারীরূপিনী রাজা জবাব দিলে, স্বর্গরাজ! মেয়েমানুষই শুধু জানে, পুরুষের সঙ্গে প্রেমে ও মিলনে, মেয়েদের সুখ অনেক বেশি।

ইন্দ্র আবার চমৎকার ভেবে সেই বরই দিলে রাজাকে।

কালের কথা কাল খায়। মহাভারতের কালে, পুরুষেও মেয়ে হওয়ার বর চাইতে পেরেছে। আর একালে হুগলির এক দূর-গাঁয়ের বাগদিপাড়ার মেয়েরা, মেয়ে-জন্মের জন্য কপালের লিখন মন্দ বলে জানে। তাদের কপাল কোটা শেষ হয় না।

দুর্গার মতো মেয়ে ছিল পাড়ায়। দুর্গা তাদের দেখেছে আজন্ম। ভরাবয়সে আইবুড়ো মেয়ে বাপ-মা হারিয়েছে। নই-বাছুরের মতো মেয়ে স্বামী হারিয়েছে। হারিয়ে কপাল কুটে কুটে কেঁদেছে। দাপাদাপি করে মরেছে। তাদের কারুর কারুর তবু ছিটেফোঁটা জমি ছিল। তবু তারা কেঁদে-কেটে একসা।

কিন্তু কেঁদে কদিন চলে? পৃথিবী বর্ষায় চিরদিন ভেজে না। টানে শুকোয় আবার। রোদ হাসে ঝিকিমিকি করে।

দুর্গা দেখেছে, সেই মেয়েরাও হেসেছে। শোকের স্যাঁতস্যাঁতানি শুকিয়ে, প্রত্যহের জীবনে আবার ঝরঝরে হয়ে উঠেছে তারা। কিন্তু ঘর তারা করেছে, ঘর না বেঁধে। মাঝি নেই, তবু খেয়া নৌকার মতো। পারাপারের যাত্রীরা যে যখন আসে, পার হয়ে যায়। ফিরে চেয়ে দেখে না আর, সে নৌকো ডোবে কি ভাসে। ফাটে কি ফুটো হয়?

কী ভয়! বড় ঘৃণা। তাই কেঁদেছিল দুর্গা। কাঁদবার সময় শোকটাই বড় হয়ে ওঠার কথা। তখন আর অন্যদিকে চোখ পড়ে না মানুষের। কিন্তু বাঁকা বাগদির মৃতদেহ তখনও উঠানে। উথালি-পাথালি কান্নায় দাপাদাপি করতে গিয়েও দুর্গা টের পেয়েছিল, লোকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বাঁকার জন্য কেউ কাঁদেনি। কারণ কাঁদতে নেই। বাঁকার ভাসিয়ে রেখে যাওয়া মেয়েটার দিকেই তাকিয়েছিল সবাই।

জন্মকালে মরতে হয়। অথচ এই দিনটিকেই মানুষ ভুলে থাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করে ভুলে থাকতে। তা-নইলে বুঝি বাঁচা যায় না। সংসারের নিয়মের মতই সেটা ভুলেছিল দুর্গা। বাপ যে চিরদিন থাকবে না, সেটা বুঝি তার মনে ছিল না। বাঁকা বাগদিরও বোধহয় মনে ছিল না, এ দিন যাবে, থাকবে না।

তখন কী হবে?

 দুবছর আগে সেই ‘তখনের’ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুর্গা দেখেছিল, সংসার তাকে ছেড়ে কথা কইবে না। আর আর মেয়েদের যা হয়েছিল, তার জন্যও অপেক্ষা করছিল সেই একই ভাগ্য।

তাই দুর্গা কেঁদেছিল। বাপের জন্য কাঁদতে গিয়ে, আসলে নিজের জন্য কেঁদেছিল।

অথচ, লোকে বলত, যেমন বাপ তেমনি মেয়ে। ডাকাতে বাপের ডাকাতে মেয়ে। শেষদিকে বাপ চিরকাল রস গাঁজিয়ে গেল। মেয়ের চোপায় ছিল গোটা গাঁ তটস্থ। এবার?

চোপা ছিল দুর্গার। আছেও। এমনি হয়নি। জীবনের তাগিদে তার চোপা তৈরি হয়েছিল। দপদপানি খরাশনী দুর্গা আপনি আপনি হয়নি। চারপাশে চিলের উড়োউড়ি, পাখা ঝাপটা গোত্তা খাওয়া। ঠাণ্ডা মিঠেটি হলে, কবে ইঁদুরের মতো ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যেত তাকে চিলেরা।

বাপ হয়েও বাঁকা বাগদি বাড়ি থেকেছে ক’রাত? দুপুরে ভাত খেয়েছে কদিন মেয়ের হাতে?

দেখে-শুনে মনে হত, বাঁকা যেন ঝাড়া হাত-পা। গলায় কাঁটা সোমত্ত মেয়ে নেই ওর ঘরে। পাড়ার লোকেরা মরেছে হায় হায় করে। মরবেই। একে, বাঁকার মতো মেয়ের গড়ন-পিটন। তায় মেয়েমানুষের বাড়। যেন পাড়ার লোকের বুকে পা দিয়ে, দ্যাখ দ্যাখ করে গতরে জোয়ার এসেছে মেয়েটার। দেখতে দেখতে মেয়ের কোমর ভার হয়ে উঠল। পায়ের গোছা হয়ে উঠল শক্ত নিটোল। গোটা অঙ্গ পুষ্ট নিটুট উদ্ধত। পুরুষদের সামনে দাঁড়ালেও মাথা ছাড়িয়ে উঠতে চায়, এত বাড়ন্ত। তার ওপরে কটা রং। এক মাথা কালো চুল। বাঁকা বাগদির মাকে যারা দেখেছে, তারা বলছে, সে-ই ফিরে এসেছে আবার।

যারা হায় হায় করেছে, তাদের মনে হয়েছে, মেয়ে নয়, জানাশোনা গর্ত থেকে সদ্য খোলস-ছাড়ানো বিষধর সাপ বেরিয়ে এসেছে। হায় হায়-এর রকমফের আছে। আরও এক দল হায় হায় করেছে তাদের নয়া পাখা ঝাপটে ঝাপটে। সেগুলি বাতির চারপাশে ঘোরা বাদলা পোকার মতো।

জীবন মানুষকে শিক্ষা দেয়। দুর্গা তাই বাপের অনুপস্থিতিতে রাত্রে পাড়ার মাসি পিসিদেরও সঙ্গে নিয়ে শোয়নি। কারণ, তার মতো মেয়েদের জীবনে একটি সময় আসে, যখন সবাই তার কানে কানে মন্ত্র পড়ে ফিসফিসিয়ে। মাসি পিসিরা পড়ে, বকুলফুল গঙ্গাজলেরাও পড়ে।

তার জন্যে ঘরের কোণে বসে কাঁদা যায় না। ধরেও রাখা যায় না এ-শরীরে রূপান্তর। শক্ত পায়ে, শক্ত হয়ে না চললে, পায়ের তলে মাটিও কোনদিন না জানি বিশ্বাসঘাতকতা করে বসবে।

তাই মেয়ের হাসিতেও আগুন, চোপাতেও আগুন। মনে হয় দপদপানি, খরাশনী। কোথা যাচ্ছিস জিজ্ঞেস করলে, আগে কেনর জবাব দিতে হবে। অর্থাৎ কেন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। এইটুকু অসহজ করেছে তাকে তার সমাজ ও পরিবেশ।

যদি বলো, রাতে একলা শুতে তোর ভয় করে না লো?

জবাব দেয়, ভয় কেন করবে? ডাইনির হাড় থাকে যে শিয়রে।

শোনো কথা। ডাইনির হাড় নাকি থাকে ছুঁড়ির শিয়রে। মিছে নয়, থাকতে পারে। যা মেয়ে! বাগদি বামুন বেণীঠাকুর তো শুনেছে দুর্গার অন্ধকার একলা ঘরে হাসি। অত রাতে, একলা আইবুড়ো মেয়ে কখনও হাসতে পারে খিলখিলিয়ে। বেণী দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, বাঁকা আছিস নাকি ঘরে?

জবাব দিয়েছিল দুর্গা-ই। বেণীঠাকুরের গলা চিনতে পেরে, দরজা খুলে ধরেছিল।

 জিজ্ঞেস করেছিল, রাত দুপুরে বাপের খোঁজ কেন ঠাকুরদা। তুমিও ভিড়েছ নাকি?

 ভিড়ব আবার কীসে লো?

 আমার বাপের কারবারে।

বেণীঠাকুর মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, মাথা খারাপ। ও সব পাপে আমি নেই। ঘরে কি তবে তুই একলা?

–দোকলা কিনা, দেখে যাও এসে।

–না, তা নয়। এই আঁধারে যেতে যেতে তোর হাসি শুনতে পেলুম কিনা, তাই।

 বেণীঠাকুরের চোখে পলক ছিল না। অলৌকিক ভয় ভয় চোখে সে তাকিয়ে দেখেছিল দুর্গাকে। দেখছিল, চুল বাঁধা নেই, এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলিয়ে আছে। মুখখানি যেন ঘুম-ঘুম ফোলা-ফোলা, কিন্তু চোখ দুটি চকচক করছে। দুর্গা জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ হাসছিলুম। একটা কথা মনে পড়ে আর হেসে বাঁচিনে।

বলতে বলতে আবার হেসেছিল দুর্গা। বাতাস ছিল না একটুও। তবু বেণীঠাকুরের মাথার ওপর সজনেগাছটা দুলে উঠছিল। কাঁপুনি লেগেছিল একটা বেণীঠাকুরের শিরদাঁড়ায়।

শুয়ে পড়, শুয়ে পড়।

 বলতে বলতে চলে গিয়েছিল বেণীঠাকুর।

তবু তো বেণীঠাকুর একলা ঘরে শুয়ে দরজায় নিত্য নূতন ঢঙের টোকা শুনতে পায়নি। তার ঘরের বেড়া ধরে কেউ নাড়া দেয়নি রাতদুপুরে। অদূরে ওই সরোবরের অশ্বত্থের ঝুপসিঝাড় থেকে মাতাল পুরুষের অট্টহাসি শুনতে হয়নি। নিস্তব্ধ অন্ধকারে উঠোনে পায়ের শব্দ পায়নি শুনতে। পেলে শিরদাঁড়া কেঁপে স্থির থাকত না। মটাস্ করে ভেঙে পড়ে যেত।

এই মেয়ে ড্যাকরা পুরুষের নির্লজ্জ চোখের সামনে, কোমরে হাত দিয়ে বেঁকে দাঁড়াবে না তো কে দাঁড়াবে? চলতে-ফিরতে আর কার হাতের কবজির জোর এতখানি যে, বলবে, নোড়া দিয়ে বুকের পাঁজরা থেতলে দেব। বেশি এদিক-ওদিক কোরো না।

হাসতেও যতক্ষণ, রাগতেও ততক্ষণ। অন্য লোক তো পরের কথা। বাঁকা বাগদির মতো অমন বাঘা মানুষকেও তো নাকাল হতে দেখেছে পাড়ার লোকে। উঠোনে সারবন্দি দাঁড়িয়ে দেখেছে যাবৎ মেয়ে-পুরুষেরা। যে বাঁকা বাগদির জন্য মহকুমা পুলিশেরও মাথা দপদপ করে।

লোকে দেখেছে, উঠোনের একদিকে বেটি, আর একদিকে বাপ। দুজনেরই চোখে আগুন ঝরছে। দুজনেই তাগ করছে দুজনকে। ঘাৎ পেলেই কোপ।

লাগত অবশ্য দুর্গার চোপার জন্যেই। বাঁকা একবার বাড়ি ঢুকলেই হত। অমনি দুর্গার গলা রননিয়ে উঠত, এই যে, লাগর এসেছ?

শোনো কথা। যা-ই হোক, বাঁকা বাপ। বাপকে কেউ ওকথা বলে? বলে, দুর্গা বলে।

অমনি বাঁকার গর্জন শোনা যেত, চোপরাও হারামজাদি। মুখ তোর ছিঁড়ে ফেলব আজ।

আর যায় কোথায়। কোমরে আড়াই প্যাঁচ আঁচল জড়িয়ে, দু চোখে আগুন দিয়ে দুর্গা একেবারে দশহাত। গলা ওর চিলের মতো তীক্ষ্ণ নয়, তার সঙ্গে একটু কষে বাঁধা-তারের ঝঙ্কার মেশানো। বলত, মুখ ছিঁড়বে? এসো দেখি, কত ক্ষ্যামতা তোমার গায়ে আছে, দুগগার মুখ ছিঁড়বে? ওই হাত তা হলে কেটে কুচিকুচি করব না। পোকা পড়বে না হাতে? ওই হাতে তোমার রস গাঁজানো জন্মের মতো খেয়ে দেব আজ, এসো।

ততক্ষণে পাড়া ঝেঁটিয়ে লোক জমত এসে উঠোনে।

বাঁকার রাগের চেয়ে বিস্ময়ের মাত্রাই বোধ হয় বেশি থাকত। সে না এগিয়েই চিৎকার করত, খবরদার বলছি হারামজাদি, এখনো সরে যা আমার সামনে থেকে! নইলে তোর কোনও বাপ এসে রক্ষে করতে পারবে না। হ্যাঁ বলে দিলুম।

মানুষ রাগলেও যে একরকমের ভয়ঙ্কর হাসি হাসে, সেটা দুর্গার খ্যাপা হাসি না দেখলে বোঝা যায়। সে বিষের মতো হেসে বলত, মাইরি। বলে দিলে? আবার বাপের খোঁটা দেওয়া আমাকে? এসো আগে তোমাকেই দেখি। তা পরে অন্য বাপদের দেখা যাবে।

বাঁকার সারা গায়ে পেশি ফুলতে থাকত। যেন একটা অসহায় অজগরের মতো গর্জাতে থাকত সে। উঠোনের মানুষদের দিকে ফিরে বলত, এ-মেয়েকে সামলাও তোমরা। লইলে আজ মেয়ে হত্যে দেখতে হবে তোমাদের।

দুর্গা আরও গলা চড়াত, হ্যাঁ হ্যাঁ দেখবে। মেয়ে হত্যে দেখবে কি পিত্তি হত্যে দেখবে, পরে দেখা যাবেখনি। এখন চোলাইয়ের গরম কতখানি হয়েছে, তাই দেখাও। এসে সিটিয়ে থাকত পাড়ার লোকে। কী একটা সর্বনাশ না জানি ঘটে। মেয়েদের মধ্য থেকেই কেউ হয়তো বলে উঠত, এই দুর্গা তুই চুপ যা। বাপের সঙ্গে অমন করে না, যা।

দুর্গার হাতে একটা-না-একটা অস্ত্র থাকতই। কাটারি, বঁটি কিংবা খ্যাংরা। ভেংচে উঠে বলত, ইস্! বাপ! আমার বাপ! এটা একটা বাপ! ঘোর পাপ জুটেছে আমার কপালে!

বাঁকার আর সহ্য হত না। সে একেবারে ঘরের চালা সমান লাফিয়ে গর্জে উঠত, দ্যাখ তবে দ্যাখ।

কিন্তু আশ্চর্য! বাঁকা দু’পায়ের বেশি এগোত না। বরং দুর্গাই তার জায়গায় স্থির। উপরন্তু বাঁকার বুকের আগুনকে আরও উসকে দিয়ে বলত, মুরোদ বড় মান। এই লাফানি-ঝাঁপানি দেখে লোকে আর পুলিশ ভুলবে, দুগগা সে বাপের বেটি নয়কো। লজ্জা করে না রোখপাক করতে। আজ কদিন থেকে গা ছেড়ে দেয়া বাসি ভাত আমি কুকুরকে গেলাচ্ছি। খাবার লোক ভাগাড়ে গে রস গাঁজাচ্ছেন। মরণ! মুখে আগুন!

এসময়ে কি দুর্গার গলা একটু ধরে আসত? কে জানে। সহসা টের পাওয়া যেত না। চোখে তো এক ফোঁটা জলও দেখতে পেত না কেউ। কিন্তু দুর্গা থামত না, সমানেই চলতে থাকত তার গলা, আবার কত কথা। হ্যাঁ মা, না মা, অমুক সমমে আসব মা। ঘরে চাল নেই? আচ্ছা, আজ রাত্রেই পাটঠে দেবখনি। নিজে না পারি লোক দে পাটঠে দেব। খালি কাঁড়ি কাঁড়ি কথা। খ্যাংরা মারি অমন কথার মুখে।

বাঁকা আবার লোকজনের দিকে ফিরে বলত, চুপোয় তোমরা রাককুসীটাকে, না ঘেঁটিটা মুচড়ে দেব, বল তোমরা।

তা কেউ কেউ ঘেঁটি মোচড়ানো দেখতে চাইত বইকী। চুপিচুপি চাইত, কথা না বলে।

দুর্গা সমানে বলেই চলত, কার ঘেঁটি কে ভাঙে দেখি। নিজের কীর্তি কাহিনী শুনে বড় জ্বালা লাগছে এখন গায়ে। মনে করেছ, দশটা মদো মাতাল চোলাইওলা তোমাকে মাথায় করে রেখেছে বলে আমিও বাপ বলতে অজ্ঞান হব, না? থুঃ থুঃ। বলে, রাত জেগে জেগে–আমার বাতির তেল ফুরিয়ে যায়, শ্যালের পায়ে শব্দে ভাবি, আমার বাপ আসছে। ওমা! কার কে? সব ফককিকার। কেন, জন্মে দেবার কালে মনে ছিল না। আমি কি তোমার মেয়ে নই, না ঘরে বেওয়ারিশ এনে পুষেছ?

হারামজাদি পাপিষ্টি!

হাতের কাছে যা পেত, ছুঁড়ে মারত বাঁকা। দুর্গাও মারত সমানে সমানে। দুজনেই এ তা ছুঁড়ে মারত আর ছুটোছুটি করত। লোকজনেরা শঙ্কিত হয়ে উঠত। তারাই ছুটোছুটি করত নিজেদের প্রাণের ভয়ে।

কিন্তু দুর্গা মুখ থামাত না।– দাওয়ায় মাটি নেই, ঘরে চাল নেই, ন্যাকড়া পরে পরে দিন কাটাচ্ছি। আবার বলে, তুই আমার মা-মরা একটা মেয়ে। মেয়ের সঙ্গে ফেরেব্বাজি? মুখে পোকা পড়বে না? হোক আজকে এসপার নয় ওসপার। তা’পরে নিজে যাব দারোগার কাছে। তোমার এই চোলায়ের জ্বালা নিজে ধরিয়ে দে আসব।

ততক্ষণে বাঁকা একটা সিদ্ধান্তে আসত! সারা জীবনে, দুর্গার সঙ্গে ঝগড়ায় ওই একটি সিদ্ধান্তই জানা ছিল বাঁকার। সে হেঁকে-ডেকে সরে পড়ত। লোকজন সাক্ষী রেখে কাউকে শাসানোর পাত্র ছিল না বাঁকা বাগদি। কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে তাকে রাখতে হত। সবাইকে উদ্দেশ করে করে বলত, এই তোমরা সবাই শুনে রাখ, ও মেয়ের আমি আর মুখ দশশন করব না। ও মরে গেলেও আমি আর আসব না। চললুম, দেখি তোর কত তেজ।

দুর্গাকে তখন আরও ভয়ংকরী মনে হত। তুমি বলতেও ভুলে যেত সে তখন। চিৎকার করে বলত, যা, যা, না। ওই চোলাইয়ের আরকে ডুবে মরগে যা।

–আচ্ছা লো হারামজাদি, আচ্ছা।

চলে যেত বাঁকা। যে-সে লোক নয়, বাঁকা বাগদি। সজনে গাছের ডালে যার মাথা ঠেকে যায়, এত উঁচু। বয়স সম্ভবত বছর পঞ্চাশ। কিন্তু এখনও পাঁচটা জোগানের মহড়া নিতে পারে। সারা গায়ে এখনও সাপের মতো চকচকে সর্পিল পেশি। কোথাও এতটুকু শৈথিল্য নেই। রং কালো। চুলেই যা কিছু পাক ধরেছে। খালি গায়ে দেখা যায়, বুকের লোমও পেকে উঠেছে কিছু কিছু। দাঁতও বোধহয় খানকয়েক নিশ্চিহ্ন। সব কটাই যে বয়সে খেয়েছে, তা নয়। এদিক-ওদিক করতে গিয়ে এক আধখানা কি যায় নি? তাও গেছে। দৌড়তে দেখলে, প্রাণভয়ে পালানো শেয়ালও থ মেরে যাবে। তাও খালি হাত পায়ে নয়। ঘাড়ে বোঝা নিয়ে। হাতে একটি লাটি থাকলেই হল। নইলে, তিরিশ সের এক মণ ওজন নিয়ে কেউ বটের উঁচু ডালে থাকতে পারত না। উঠে সারা রাত নিঃশব্দে কাটাতে পারে না। বাঁকা বাগদি পারে। আবগারি দারোগাবাবু আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে বাঁকা ঘুংড়ি বান। পলক পড়ে না, জলের পাকে মানুষ হারিয়ে যায়। পনেরো হাত দূর থেকে বাঁকা ছায়ার মতো অদৃশ্য। শরীরটা যেন হাড়-মাংসের নয়, শুধু ছায়া মাত্র। এই আছে, এই নেই।

দারোগাবাবুর নামের আর মানের জ্ঞান থাকে না। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, শালা চিতাবাঘ নাকি? ও কখখনও মানুষ নয়।

বাঁকাকে নিয়ে সদরের আবগারি বিভাগও আলাপ করত।

সেই বাঁকা বাগদিও হাঁক-ডাকের আড়ালে আসলে, দুর্গার কাছে হার মেনে পালাত। দুর্বলের পরাজয় নানান রূপে হয়। মেয়ের কাছে বাঁকা সব দিক দিয়ে দুর্বল।

দুর্গা গিয়ে দরজা বন্ধ করত ঘরে। লোকজন যে যার ঘরে যেত মজা দেখে। কিন্তু লোক-মনের অন্তর্যামী এমনি বিচিত্র, তাদের মনে হত, দুর্গা-ই দোষী। ছেলেমানুষের নাকি অমন চোপা, অত বুকের পাটা ভাল নয়।

তারপরে দেখা যেত, নিঃশব্দ পায়ে বাঁকা বাগদির চোরের মতো প্রবেশ। খালি হাতে নয়, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে। বন্ধ দরজায় কাছে গিয়ে ধাক্কাধাক্তি নয়। একগাল হেসে বাঁকা ডাকত, দুগগা, অ মা দুগগা, দরজাটা খোল।

সাড়া পেত না। অনেকক্ষণ ধরে ডাকতে হত। নককী মা আমার, দরজা খোল। অনেকক্ষণ ধরে সাধাসাধি করতে হত। কখনও কখনও ঘণ্টা কাবার হয়ে যেত। সেই সময়টা ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যেত বাঁকার। কিছুতেই নড়ত না সে। বসে বসে অন্যায় স্বীকার করত। মেয়েকে যে সে কষ্ট দিয়েছে তাতে তার পাপ হয়েছে। নরকেও নাকি তার ঠাঁই হবে না। কিন্তু দুর্গা কতক্ষণ এরকম করবে। বাঁকার যে বড় ক্ষিদে পেয়েছে।

খোল মা পেটে বড় জ্বালা লেগেছে।

দরজা যখন খুলত, তখন আর দুর্গা সে মেয়েটি নয়। সারা চোখে মুখে এলো চুল। চোখ ফুলে লাল। আঁচল ভিজত, মাটি ভিজত। দরজা খুলে দিয়ে, আবার বসে থাকত হাঁটুতে মুখ ঢেকে। চোখের জল ফেলে ফেলে, সবটুকু শেষ হত না। তখন শরীর ফুলে ফুলে উঠত। কেঁপে কেঁপে নিশ্বাস পড়ত বড় বড়।

বাঁকা নামিয়ে দিত সামনে চাল ডাল তেল নুন। তা ছাড়াও একটি না একটি বিশেষ জিনিস থাকত দুর্গার জন্য। হয় কাপড়, না হয় ব্লাউজের ছাপা ছিটের টুকরো। নিদেন এক শিশি আলতা, অন্যথায় শস্তা স্নো, কপালের টিপ, কাঁচের চুড়ি।

তখন বাঁকাও আর সে বাঁকা থাকত না। মুখে একটি অপরাধীর অমায়িক হাসি লেগেও থাকত ভাঙা দাঁতে। তারপর হাতখানি সন্তর্পণে বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় রাখত। বলত রাগ করিস না মা। আমি তোর বাপের যুগ্যি লই।

এতক্ষণ একলা কাঁদতে হয়েছিল। বাপের ছোঁয়ায় ও কথায়, কান্নাটা আর একবার উথলে উঠত তখন।

বাঁকার মুখে অপরাধী হাসিটুকুও আর থাকত না তখন। মুখখানি ভার হয়ে উঠত। তার যেন নিশ্বাস পড়ত না। শক্ত বুকটা যেন ফাটবার জন্যেই টাটাতে লাগত। সে চাপা চাপা ভারী গলায় বলত, আমি জানি নরকে আমার ঠাঁই হবে না দুগগি। জমি বিকিয়ে যেদিন আমাকে পেটের জ্বালা জুড়োতে হল, সেদিনই বুঝেছি, আমার মরণ ধরেছে। কপালে তোর ভোগ ছিল, তাই আমার ঘরে এসেছিলি।

দুর্গার ফোঁপানি ততক্ষণে থেমে আসত।

বাঁকা বলতেই থাকত, জন খাটার আকাল হল। কত জন খাটাবে লোকে আর? বারোমাস না কাজ হয় মাটিতে, খেটেও কুলোয় না। আর মানুষ তো গাদাগাদি খাটবার জন্যে। ই পাপের টাকা ধরেও রাখতে পারি না। তোর আমি একটা গতি করতে পারি না মা। বাড়ি আসব কী, তোকে দেখলে আমার বুকের মধ্যে শুলোয়। ওসব নে ভুলে থাকি, সে আমার এক পেকার ভাল। বাঁকা বাগদি তোর বাপের যুগ্যি লয়।

ততক্ষণে দুর্গাকে উঠতে দেখা যেত। মুখ নামিয়ে চাল ডাল দেখত। উঠে রান্নার আয়োজন করত। কিন্তু বাঁকা বকেই চলত, যাও বা চাঁপদানিতে গে কলেতে কাজ নিলুম। তা শালারা নয়া মেশিন বসিয়ে দিলে বিদেয় করে। এখন আর হট বলতে কারখানায় গে কাজ পাওয়া যায় না। গাঁয়ে রিলিফের কাজ, তা বা কদিন হয়। ঘরে ঘরে যা করছে, আমিও তাই করছি, কী করব? কিন্তু তোর কী করব দুগগো।

এদিকে বকবক, ওদিক ততক্ষণে হয়তো দুর্গার ভাতের হাঁড়িতে টগবগ। সে বলত নাইতে যাও।

নাইতে যাব?

–হ্যাঁ। ভাত ফুটে গেছে।

বোঝা যেত, বাঁকার প্রাণে একটু বুঝি বাতাস লেগেছে। মেয়ে কথা বলছে যে? বলত, না দুগগো, এবার একটা ব্যওস্থা আমি না করে আর ছাড়ছি না।

শুকনো কাঠের দাউদাউ আগুনের ঝিলিকে, দুর্গার কেঁদে ফোলানো ঠোঁটে বুঝিবা একটু হাসির আভাস দেখা দিত। ভেজা চোখ শুকিয়ে উঠত আঁচে। জানত কীসের ব্যবস্থার কথা বলছে। তবু সে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করত, কীসের ব্যওস্থা?

বলতে আটকাত বাঁকার গলায়। বলত, এই তোর একটা বে’র। ভাবছি, নগিনের মেঝ ছেলেটার সঙ্গেই লাগিয়ে দেব।

ততক্ষণে দুর্গার হাসি আর বাধা মানত না। বদ্ধ জলস্রোত সহসা বাঁধ-ভাঙা হয়ে উঠত। কলহ কান্নার থমথমে আবহাওয়ায়। পচা গুমসোনির মাঝে দমকা হাওয়ার একটা চকিত উচ্ছ্বাসের মতো হঠাৎ উচ্চ হাসির রোল পড়ে যেত। বাঁধা তারের চড়া ঝঙ্কারের মতো, সেটা যেন একটা নতুন রকমের আলাপ শুরু।

হাসিটা বাঁকার বদ্ধ প্রাণের আনাচে-কানাচেও বাতাস বইয়ে দিত। বলত, হাসছিস যে?

 হাসবে না। বছর ভরে কত যে ছেলের নাম করেছিল দুর্গার বাপ দুর্গার কাছে, তার লেখাজোখা নেই। যেন বাপেরা আর ছেলেরা হাত ধুয়ে বসে আছে, দুর্গাকে নেবে বলে আর দুর্গাও যেন বসে আছে সেজেগুজে।

দুর্গা বলত, হাসব না তো কাঁদব?

বাঁকা বলত মাথা ঝাঁকিয়ে, না এবার আর কথাটি নয়, লাগিয়ে দেবই। শালার দিনকাল গেছে খারাপ হয়ে। চেরকাল বাপ পিতামর মুখে শুনে এলুম, মেয়েকেই পণ দিয়ে নিতে লাগে। এখন শুনি ছেলে পণ হাঁকছে! সব বামুন কায়েতগিরি ফলাচ্ছে।

দুর্গা বলত মুখের কথা কেড়ে নিয়ে, ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো।

–আঁ?

বলছি ঝাঁটা মারো।

কাকে?

 –তোমার ওই নগিনের ব্যাটাকে।

-কেন?

বলতে বলতে মেয়ের কাছে উঠে আসত বাঁকা।

 দুর্গা বলত, কেন আবার? যেমন ন্যাংলা-প্যাংলা, তেমনি চোখ দুখানি। এমনি।

বলে নিজের চোখ ট্যারা করে দেখাত।

বাঁকার যেন ভারী কৌতুক লাগত। সে আবার বলত, কেমন, দেখি দেখি।

দুর্গা আবার দেখাত।

বাঁকার এই দুর্দশাগ্রস্থ উচ্ছৃঙ্খল প্রাণে শুধু যে একটি বিচিত্র শিশুরই বাস ছিল, তা, নয়। বোঝা যেত, মেয়ের সঙ্গে তার একটি হাসি-খুশির খেলার ভাবও ছিল। দুর্গার ভেংচানো দেখে, সেও আর হাসি চাপতে পারত না। সে হাসিও যেমন-তেমন নয়, অট্টহাসি। বলত দূর পোড়ারমুখী। দেখি দেখি আবার।

দুর্গা শুধু সেইটুকুই দেখাত না। নগিনের ন্যাংলা-প্যাংলা ছেলে আবার কেমন বকের মতো চলে, সেইটুকুও দেখাত হেঁটে হেঁটে।

তখন বাপ-বেটির উঁচু গলার মিলিত হাসিতে চমকে উঠত পাড়া। হাসতে-হাসতেই বলত বাঁকা, তা মুখপুড়ি, তোর জন্যে আমি রাজপুতুর পাব কোথা, আঁ?

মরণ! তার চে চেরকাল আইবুড়ো হয়ে থাকব। আবার এদিক নেই, ওদিক। ভদ্দরনোক হয়েছে নিকি। ফিনফিনে জামা গায় দেয়, আর ঘাড়ে খড়ি মাখে। বাইরে কোচার পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন। আবার গান নিকি করে, বায়স্কোপের গান।

–শুনিছিস?

 –শুনিনি? কেঁদে ফেলে একেবারে।

 বলে, নগিনের ছেলের গানের অনুকরণে, দুর্গা প্রায় হুলো বেড়ালের মতো ডেকে উঠত। আবার বাপ-বেটির হাসি পাড়ার আকাশ দিত ভরিয়ে।

পাড়ার লোকেরা বলত, অই, অই, শোনো এবার। এই মারামারি, কাটাকাটি, আবার কেমন হেসে মরছে। ওদের কথায় যাবে কথা বলতে? মরণ নেই আমাদের, তাই।

তা বটে। মরণ না থাকলে কখনও কেউ এমন বাপ-বেটির ব্যাপারে কথা বলে বেকুব হয় না।

হাসির পরে নাওয়া-খাওয়া। বাপকে খাইয়ে, মাটির কলসিটি নিয়ে দুর্গা যেত সরোবরে। ভর দুপুরের সরোবর, নিরালা। একলা ঘাট, সরোবর যেন একাকিনী মেয়েটির মতো বাতাসের দোলায় একটু একটু দুলত। তার বুকের কোথাও বটের ছায়া, কোথাও দেবদারুর। ছোট ছোট দোলায় এক পাশ থেকে কুঁড়ি ও ফোঁটা পদ্মফুলেরা মাথা দুলিয়ে হাসত। পানকৌড়িটাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত সরোবর। নীল পানকৌড়ি, লাল ঠোঁট আর কালো চোখ দুটি নিয়ে বিবাগির মতো বসে থাকত কদমের ডালে।

জলে পা ডুবিয়ে বসত দুর্গা। কলসি কোলে নিয়ে, বুকে চেপে গলা জড়িয়ে ধরে, সরোবরের জলের দিকে তাকিয়ে দেখত। দেখতে দেখতে সে হাসত। সেই হাসি দেখে হাসত জলের ছায়া। জিজ্ঞেস করত, আ মরণ! হেসে মরছ কেন?

দুর্গা বলত, নগিনের ছেলের কথা মনে করে।

তখন ছায়াটিও হাসত। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠত ছায়া, তীক্ষ্ণ চোখে তাকাত দুর্গার চোখের দিকে। দুর্গার বুঝি রাগ হত। বলত, কী দেখছিস লো?

ছায়া বলত, দেখছি তোকে।

কী দেখছিস?

ছায়া হাত বাড়িয়ে দিত দুর্গার গায়ে। আঁচল সরিয়ে নিতে চাইত বুক থেকে। ছি! ছি ছি ছি! ছায়া তোর মরণ নেই।

ছায়া বলত, আমার তো মরণ নেই। নিজের মরণ দ্যাখ একবার। ছ বছর আগে তো খুব দেখতিস। নতুন নতুন সময়ে। আজ যে আঠারো ছুঁতে চললি, আজ বুঝি ভুলে মেরে দিয়েছিস, কী বয়ে বেড়াচ্ছিস সারা অঙ্গে। তোর বয়সী একটা মেয়েও সারা গাঁয়ে আইবুড়ো আছে? তাও বাগদির ঘরে? তুই কি আর এখন মেয়ে আছিস? কয়েক বছর আগে ছিলি। এখন তুই মাগি হয়ে গেছিস, সেকথাটা মনে রাখিস।

-মনে রেখে কী করব?

–নগিনের ব্যাটার কথা ভেবে অত হাসি কীসের। এত হেনেস্থা কেন?

 -মরণ!

 –কেন? তবে কাকে তোর মনে ধরে?

ভেবে পাইনি কো।

–পেতে হবে না? সেই কদমাকে নয় তো?

–কে কদমা?

–আহা! মনে নেই যেন। ভুলে গেলি এর মধ্যেই? সেই তিন বছর আগে, খাল ধারের জঙ্গলে, কদমা তোর গায়ে হাত দেয়নি?

-সে তো ভুলিয়ে-ভালিয়ে, জোর করে।

ছায়াকে জবাব দিতে দিতে দুর্গার চোখে আগুন জ্বলে উঠত। বলত, ওকে এখন পেলে আমি ছিঁড়ে ফেলে দেব।

ছায়া বলত ভ্রূ কুঁচকে, একে দেখে রাগ, তাকে দেখে হাসি। এমনি করে দিন যাবে?

 দুর্গার দু চোখে সরোবর টলটলিয়ে উঠত। বলত, বলো না। আমার কান্না আসছে।

 ছায়া বলত, হ্যাঁ কাঁদ। এই কান্নাটুকু কাঁদবি বলেই তো এসময়ে সরোবরের ধারে এসেছিস। সব কান্না লোকে দেখবে। শুধু এইটুকুই আমি ছাড়া আর কেউ দেখবে না! কাঁদ, কেঁদে ভাব!

কলসির মুখে মুখ দিয়ে কাঁদত দুর্গা। বিবাদ নয়, অভিমান নয়, সেটা ছিল দুর্গার আপনি-আপনি কান্না।

জীবনের এই রঙ্গ দেখে, সরোবর আরও দুলে উঠত। এই কদম দেবদারুর ছায়ারা অনড় স্নেহশীল বৃদ্ধের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যেন বিষণ্ণভাবে হাসত। তারা বাতাস দিয়ে জুড়িয়ে দিতে চাইত দুর্গাকে।

বোধ হয় সেই কান্নাটুকুই ছিল তার সেই গহিন অন্ধকার ভাবনার প্রকাশ, বাবা একদিন মারা যাবে। এদিন থাকবে না।

ওদিকে বাঁকার অবস্থাও তেমনি। হাসি হত, খাওয়া হত, শান্ত হত, দুর্বাসা মেয়ে। তবু, গা এলিয়ে শুতে গিয়ে পুরোপুরি শুতে পারত না। আড়ষ্ট হয়ে থাকত। চোখ বুজতে গিয়ে ঘুম আসত না। কোথায় একটা অস্বস্তি, একটি নাম-না-জানা ভয় তার বুক জুড়ে পাষাণ ভারে চেপে থাকত। সে জীবন পরিক্রমা করত আবার। সেটা কি জীবন। কাকের আবার বাসা। আজকে এ-গাছ, মানুষ কাটল তো, কাল ও-গাছে। কাল ও-গাছ কাটল তো পরশু ওই ফোকরে। মানুষ হয়ে, সে শুধু জীবনধারণের গ্লানি সামান্য এই ভিটেটুকুও রোজ যাই-যাই করে।

জীবনে এখন শুধু কাঁটা-ঝোপ, জঙ্গল, অন্ধকার। আর একদিকে অথৈ পারাবার। জঙ্গলটাকেই বেছে নিতে হয়েছিল বাঁচার জন্যে। গোটা তল্লাটের সে আদর্শ বে-আইনি মদ চোলাইকর। দুর্ধর্ষ চোলাই-চালানদার। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ভদ্র-অভদ্র, সকলের ঘরে ঘরে চোলাই। কে চোলাই করে, আর কে করে না, বুঝে ওঠা দায়। চালান যায় দূর দূরান্তে। দূরের মধ্যে প্রধানত কলকাতায়, কাছাকাছি চন্দননগর।

মাথার ঘা’য়ে কুকুর পাগলের মতো অবস্থা আবগারি বিভাগের। এই তল্লাট নিয়ে তাদের বিস্ময়ের ও ক্রোধের শেষ নেই। এখানে চোলাই আর চোরাচালান যেন অদৃশ্য ভুতুড়ে কারবার।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে নাম বাঁকা বাগদির। কিন্তু তার মূলধন ছিল না। চিরদিন পরের কারবার করে গিয়েছে।

মনে মনে জীবনের দিগন্ত ঘুরেও, একটি অসহায় ভয়ের কাছে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে থাকত বাঁকা। বোধ হয়, কাঁটা-ঝোপ জঙ্গলের পাশে অথই পারাবার তার মরণের প্রতীক হয়ে থাকত।

দুবছর আগে, সেই বাঁকা বাগদি যেদিন মারা গেল, সেদিন বোঝা গেল, তার সেই অথই পারাবার মরণেরই প্রতীক। সেই অকূল পারাবার দুর্গার সামনে। মরণের আবর্ত তার চারপাশে পাক খেয়ে আসছিল।

লোকে বলত, এমন বাপ থাকা না থাকা সমান। কথাটা যে মিথ্যে, সেটা বাঁকা বাগদি মরে প্রমাণ করেছিল। সে না থাকাও যে কতখানি থাকা, বাপের মরণের মুহূর্তেই বুঝতে পেরেছিল। বাঁকা বাগদির অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবীতে, এটা যতদিন জানা ছিল, ততদিন সেই সাপেরা গর্ত ছেড়ে বেরুতে পারেনি, সেই সব নখালো থাবারা এগিয়ে আসতে পারেনি দুর্গার দিকে। কুটিল মত্ত চোখের পাতা ওঠেনি সহজে।

দুর্গা দেখতে পেয়েছিল, তাদের সাজো-সাজো রব পড়েছে।

বাপকে তাই সে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি। শ্মশানে গিয়েছিল। বাঁকা বাগদির সাঙ্গপাঙ্গর অভাব ছিল না। অনেক শাকরেদ তার। কাঁধে নেবার, শ্মশানে যাবার লোকের অভাব ছিল না।

শ্মশানের বেদো ডোম শুধু আফশোস করে বলেছিল, বাঁকা-দাদার হাতে রস অমর্ত হয়ে উঠত। অমন তাগবাগ করে আর কেউ চোলাই করতে পারবে না।

কথাটা মিথ্যে নয়। বাঁকার মদের নামও ছিল। এই তল্লাটের চোরাই খরিদ্দারেরা যাচিয়ে নিত, মালটা কার? বাঁকার হাতের তো? দেখো, মিছে বলো না বাবা। তোমাদের জলো হাতের হলে হবে না। কড়া ধাতের জিনিস চাই, যেন ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যায়।

আর একটি লোক এসেছিল সাইকেল চালিয়ে। ফিনফিনে কাচির ধুতি, কিন্তু হাঁটু অবধি তোলা। পাতলা কাপড়ের জামা। চিতনো বোতাম পটিতে, চেন-দেওয়া সোনার বোতাম। লাগানো নেই, খোলা। ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে নেমেছিল সাইকেল থেকে। সকলের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কথা বলছিল গুজুগুজু ফিসফিস করে।

লোকটিকে চিনত দুর্গা। নাম ওকুর দে। অর্থাৎ অক্রূর দে। গাঁয়ের তিলিপাড়ায় বাড়ি। নানান কারবারের কারবারি। এখানেও স্টেশনের ধারে, হাটে আছে কাপড় আর রিকশা সাইকেল ইত্যাদি বেচা-কেনা মেরামতির দোকান। মহকুমা শহরেও ব্যবসা আছে, বাড়ি আছে। একটা মোটরগাড়িও নাকি আছে। গাঁয়ে সেটাকে আনা হয় মাঝে মাঝে।

ওকুর দুর্গাদের বাড়িও এসেছে কয়েকবার। কিন্তু দুর্গার দেখা পায়নি। ওকুর তার বাবার মহাজন, কারবারের কারিগর ছিল। বাবাকে খাতির করে চলত। কেউ কারুর মাথায় চড়তে পেত না বিশেষ, কারবারের ধরনটা এমনি। তবু ওকুর দে’র টাকা ছিল। সেটাই তো জীবনের দুর্ভেদ্য বর্ম।

তারপরেই একজনের কথায়, ওকুর দে ফিরে তাকিয়েছিল দুর্গার দিকে। বাপের চিতা সাজানোর দিকে চোখ থাকলেও, দেখতে ভুল করেনি। ওকুর রোদের দাপটে মুখ কুঁচকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল তার দিকে। তারপর পকেটে হাত দিয়েছিল।

একটু পরেই তার বাপের শাকরেদ ভোলা এসে দাঁড়িয়েছিল দুর্গার কাছে। বলেছিল হাত বাড়িয়ে, এই নাও ওকুরবাবু দিলেন। বললেন, শ্মশানেই দিলুম, আবার কবে দেখা হবে না হবে। বাঁকার মেয়েকে না দিলে আমার পাপ হবে।

দুর্গা ভ্রূ কুঁচকে দেখছিল পঞ্চাশটি টাকা। বলেছিল ভোলাকে, এখন তোমার কাছে রেখে দাও। বাড়ি গে আমাকে দিয়ো।

হয়তো ওকুর চলে যেত। তার আগেই আরও তিনটি সাইকেল এসেছিল। আবগারি পুলিশের নর্থ মহকুমার অফিসার-ইন-চার্জ, সাব-ইনস্পেক্টর আর জমাদার। তিনজনকেই চিনত দুর্গা। এক-আধবার নয়, অনেকবার বাড়িতে এসেছে তারা। বাঁকা বাগদি থাকতে এসেছে, না থাকতেও এসেছে। ঘর-দোর দেখে, দুর্গাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যেত।

ওকুর হাত তুলে নমস্কার করে ছুটে গিয়েছিল, আরে বাপরে বাপ, আপনারা?

অফিসার-ইনচার্জ সুরেশবাবু, চকিত ধূর্ত চোখ, মোটা মানুষ বলেছিলেন, আপনি কেন?

 ওকুর বলেছিল, যাবার পথে খবর পেলুম। চেনা লোক, তাই আসা।

 সুরেশবাবু বলেছিলেন, ও! আমরা অফিসে বসেই খবর পেয়েছি, বাঁকা বাগদি নাকি মারা গেছে। বাঁকার ব্যাপার তো, দেবা না জানন্তি। ব্যাটা সত্যিই মরল, না, না-মরে মরল একবার না দেখতে এসে পারলুম না।

-কেন?

–বলা তো যায় না। এও আবার বাঁকার কোনও চালাকি কি না কে জানে?

তারপরে হঠাৎ একটি নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, যাক, তবু মনে মনে একটা সান্ত্বনা থাকবে, ব্যাটা মরেছে। যদিও ভুলতে অনেক দিন সময় লাগবে। এত কষ্ট আমাকে আজ পর্যন্ত আর কেউ দিতে পারেনি। শেয়ালের চেয়ে ধূর্ত বললে ভুল হবে, তার চেয়ে কয়েক কাটি সরেস ছিল।

এগিয়ে এসে দেখছিলেন বাঁকার শব। পুলিশ দেখে আরও অনেক লোক এসেছিল। শ্মশানে সচরাচর এত লোক হত না। আশেপাশের তেমন তেমন মানুষই মরলেই একমাত্র ভিড় হত শ্মশানে।

কোনও একজনের ওপর নয়, পুলিশ কিংবা ওকুরের ওপর শুধু নয়, গোটা সংসারটার প্রতি যেন দু চোখভরা আগুন দিয়ে তাকিয়ে ছিল দুর্গা। ইচ্ছে করছিল, বাপের মরা শরীরটা বুকে নিয়ে কোথাও ছুটে চলে যায় সে।

পারেনি। শুধু তাকিয়ে ছিল খালের জলের দিকে।

সুরেশবাবু বাঁকার মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠেছিলেন। ঘাড় নেড়েছিলেন নিঃশব্দে।

কেবল বেদো ডোম বলে উঠেছিল, অই, অই ঠিক বলেছেন বাবু।

সুরেশবাবু অবাক হয়ে বলেছিল, কী আবার বললাম হে?

বেদো হেসে বলেছিল, বলবেন কেন, অই যে ঘাড় লাড়লেন, অই ঠিক। কিছু বলবার নেই বাবু। দেখুন, মরে গেছে, আর কিছু নেই।

সুরেশবাবু বেদোর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, হুঁ। সকালেই পেটে পড়েছে দেখছি।

ভুল বলেছিলেন। বেদোর পেটে কিছুই পড়েনি, এক ডোমনীর দেওয়া চা ছাড়া। সে একটা গুরুগম্ভীর সত্য বলবার চেষ্টা করেছিল মাত্র দারোগাবাবুকে।

সুরেশবাবু ওকুরের দিকে ফিরে বলেছিলেন, বাঁকা বাগদি তো মরে জুড়োল। কিন্তু আপনার ডান হাত খসে গেল যে?

ওকুর দে বিগলিত হেসে জবাব দিয়েছিল, কী যে বলেন স্যার।

খসেনি বলছেন। তা হলে এরকম আরও আছে বলুন। ওকুর দে তেমনি হেসে জবাব দিয়েছিল, আমার কিছুই নেই স্যার।

হুঁ!

সুরেশবাবু চারদিক তাকিয়ে বলেছিলেন, বাঁকা বাগদির দেখছি অনেক দোসর বান্ধব। তল্লাট ঝেটিয়ে এসেছে শ্মশানে।

আজ্ঞে না, সব আপনাদেরই দেখতে এয়েছে।

 তারপর পুলিশের সঙ্গে ওকুর দে-ও চলে গিয়েছিল।

বাপকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফিরে এসেছিল দুর্গা খালে ডুব দিয়ে। সকলেই ফিরে এসেছিল তার সঙ্গে সঙ্গে। ফিরে যে যার কাজে গিয়েছিল। সকলে যায়নি। কয়েকজন সব সময়েই ছিল। মেয়েদের মধ্যে বিন্না বুড়ি আর প্রৌঢ়া মাতি মুচিনী সঙ্গ ছাড়েনি।

গাঁয়ে ফিরে এসে আর একবার ডুব দিতে গিয়েছিল দুর্গা সরোবরে। সময়ে-অসময়ে সরোবরে ডুবতে সে ভালবাসত। সেদিন আবার না ডুব দিলে তার প্রাণ জুড়োবে কেন।

যেমনি ডুব দিয়েছিল, তেমনি শুনতে পেয়েছিল দুর্গা, তার সখী ছায়া এসে বলছে, আর ডুব দিয়ে উঠে কাজ নেই।

–মরে যাব যে?

–ঘাটের ওপরে, এ সোমসারেই বা তোর কোন বাঁচনদারেরা আছে। দেখিসনি, চিনিসনেকো, কারা আছে ওপরে।

–জানি। কিন্তু ডুবে মরা যায় কেমন করে, জানি না যে?

–জোর করে ডুবে থাক।

–আপনি আপনি ভেসে উঠছি যে?

ছায়ার টানা-টানা নিশিন্দাপাতার মতো চোখের কোণ দুটি কুঁচকে উঠেছিল। বলেছিল, ও, সাধ আছে, সাহসও আছে বেঁচে থাকবার। তাহলে ভাল।

ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করেছিল দুর্গা। বিন্না আর মাতি অনেক রাত্রি অবধি ছিল। ফিরে গিয়েছিল এক সময়। না, এ মেয়ের কোনও দিশা পাওয়া যায়নি।

মধ্য রাত্রে ঘরের বাইরে এসে বসার ইচ্ছে হয়েছিল দুর্গার, দরজা খুলে দেখেছিল, দাওয়ার ওপরে লোক। পুরুষমানুষ।

–কে?

–আমি ভোলা।

ওকুরের দেওয়া টাকা ছিল ভোলার কাছে। সেই অধিকারেই বুঝি সে দাওয়ায় বসে ছিল। কিন্তু সজনেগাছের গোড়ায় ওটা কার ছায়া?

কেষ্টর। কেউ-ই অচেনা নয়। আশেপাশেরই চেনাশোনা লোক সব, আর তার বাপেরই শাকরেদ। উদ্দেশ্য বুঝি গুরুকন্যার ভালমন্দ দেখা। কিন্তু ভোলা কেষ্ট, কাউকেই তো চিনতে বাকি ছিল না দুর্গার। সেদিন দুর্গার ভালমন্দ দেখার সাহস পেয়েছিল ওরা, অনেক দিন থেকে দেখতে চেয়েছিল, পারেনি।

ফিরে এসে দরজা বন্ধ করেছিল দুর্গা। চোখ বুজে দেখতে পেয়েছিল আরও অনেক এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। একদিন দুদিন, সপ্তাহের মধ্যেই সবাই আসবে না। আযৌবন আসতে থাকবে, আসতেই থাকবে।

পরদিন ভোলার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল দুর্গা। রান্না করেছিল, খেয়েও ছিল। মাঝরাত্রে আবার বাইরে আসবার জন্য দরজা খুলে দেখছিল, ভোলা বসে আছে। কেষ্টর ছায়াটা আরও কাছে এগিয়ে এসেছিল সেদিন।

দুর্গা দরজা বন্ধ না করেই ঘরে ঢুকেছিল। বেরিয়ে যখন এসেছিল, হাতে ছিল তখন বাঁকা বাগদির সেই আঁশ কাটা সড়কি! সড়কির চেয়েও বেশি ধার ছিল দুর্গার চোখে। অন্ধকারেও চাপা ছিল না সেই চোখের আগুন।

মূর্তি দেখেই ভোলা নেমে দাঁড়িয়েছিল দাওয়া থেকে। ‘তুমি’ও আসেনি দুর্গার মুখে। চাপা গর্জন বেরিয়ে এসেছিল, এই হারামজাদা, বাড়ি যা। ফাঁসি যাব, কিন্তু তোকে যেন আর কোনওদিন আমার উঠানে না দেখি। ওই কেষ্টা-পাঁটাকেও নিয়ে যা।

স্বয়ং ভগবতীও অমন রুদ্রাণী বেশে হঠাৎ দেখা দিলে বোধ হয়, কেষ্ট আর ভোলা অত অবাক হত না। দু জনেই ওরা ভোজবাজির ছায়ার মতো পালিয়েছিল।

কিন্তু গর্ত থেকে বেরিয়ে-আসা সারি সারি পিঁপড়ের মতো ব্যাপার। সেই গর্তের মুখ যে কোথায়, কত লম্বা, কত সর্পিল সারি, সহসা টের পাওয়া যায় না। সেই সারির সামনের দুটি ভোলা আর কেষ্ট। বাকিদের পায়ে পায়ে আসার কামাই ছিল না। কত তার রূপ, রঙ্গ, বিচিত্র বেশ, কত রকমারি ছল-চাতুরি।

বিন্না মাতিও সেই সারিরই মানুষ। সরাসরি প্রস্তাব এনেছিল। মাঝখান থেকে মাতি গাল দিয়েছিল বাপ-ভাতারি বলে। মার খেয়ে মরেছিল সরোবরের ধারে। শহর যাওয়া-আসা কুটনীর ফুলেল তেল-মাখা চুলের গোছা উপড়ে নিয়েছিল দুর্গা।

কিন্তু দিন যাপন? আশ্রয়? সংসারে মানুষ না থাকলে ছেলের বিয়ে হতে চায় না। মেয়েকে বিয়ে করবে কে? যেচে বিয়ে করতে চাইত হয়তো নগিনের ছেলে। তবে বাপ বেঁচে থাকতেই করেনি কেন? শাক বেচতে যাবে? ধান ভানতে যাবে? কিন্তু ভবী ভোলে না কই। পিঁপড়ের সারি যে সঙ্গ ছাড়ে না!

পাড়ায় লোক ছিল না? তাদের স্নেহ ছিল না?

ছিল। যাদের স্নেহ ছিল, তাদের সংস্থান ছিল না। যাদের সংস্থান ছিল, তাদের কাছে ভরসা ছিল না। যারা দায় নিতে চেয়েছিল, তাদের দায়িত্ব ছিল না।

এইটাই কি জীবনের নিয়ম? এ-কী বিড়ম্বনা। শুধু দিন চলে যাচ্ছিল, কিন্তু জীবন আগেও যাচ্ছিল না, পিছনেও ফিরছিল না। দিনে দিনে শুধু দুর্গার ঠোঁটের কোণ দুটি ঘৃণায় ও শ্লেষে বেঁকে উঠেছিল। চোখের চাউনি হয়ে উঠেছিল কঠিন। জ্বালা জুড়োবার ছিল সরোবরের শীতল জল। কথা বলার ছিল সেই ছায়া! সেই ছায়া দুর্গার সঙ্গে কী একটা বিচিত্র বাজি ধরে বসেছিল যেন।

.

মাস ছ-এক হয়েছিল তখন, বাঁকার মরণের পর। সেই সময় ঘটনা ঘটেছিল একটা।

 সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছিল। সবে ঘোর হয়ে আসছিল অন্ধকার। যমুনা মাসির দিয়ে-যাওয়া চাল কটা ফোঁটাচ্ছিল দুর্গা। শুকনো পাতা জ্বেলে টিমটিমে লণ্ঠনের চেয়ে পাতার আগুনের আলো-ই বেশি ছিল। দুর্গার গায়ে কাঁপছিল সেই আগুনের শিখা। তার আকাশ-পাতাল ছিল না ভাবনার। যথানিয়মে ডাঁই-করা পাতা থেকে থাবায় থাবায় আগুনে দিচ্ছিল। চুল বাঁধেনি, চিরুনি দিয়েছিল। কপালটা একেবারে খালি রাখতে নেই, একটি বিন্দু ছুঁইয়ে রেখেছিল খয়েরি রঙের। হাওয়ায় শীতের আমেজ। বাপের শেষ কিনে-দেওয়া লাল জামাটি ছিল গায়ে। পুরানো ডুরে শাড়িটি ছিল পরা।

কিছুক্ষণ আগেও চাঁদু ঘরামির বউ যমুনা-মাসি বকর বকর করছিল। ওরকম কয়েকজন ছিল, যারা রোজই আসত বসত গল্প করত। যমুনা-মাসি চলে গিয়েছিল। পাখিরা চুপ করেছিল। অনেকক্ষণ ঝিঁঝিরা ডাকাডাকি করছিল।

সেই সময়ে, শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে, মাটি কাঁপিয়ে ঝড়ের বেগে এসে উঠেছিল লোকটা। এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি। তার মধ্যেই চকিতে একবার দেখে নিয়েছিল দুর্গা, মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা, বোতাম-খোলা নীল হাফশার্ট। ছেলে একটা। লম্বা, একহারা চকচকে দুটি চোখ।

সরাসরি ঘরে ঢুকেছিল দুর্গার। ঢুকতে ঢুকতে বলেছিল, দুর্গা তোর ঘরে লুকোলুম, চেপে যাস।

 দুর্গা জায়গা ছেড়ে ওঠেনি। উঠোনের কোণে, ঢেঁকির ছাউনির ধারে, উনুনের পাশেই বসে, ভ্রূ কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল দাঁত দিয়ে। নাম ধরে ডাকতে শুনে অবাক হয়েছিল। তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল, অবলীলাক্রমে ঘরে ঢুকতে পড়ে দেখে। কে? কে হতে পারে? পরমুহূর্তেই বোধ হয় চিনে ফেলেছিল মনে মনে।

আর সেই চেনা-চেনা ভাবের মুহূর্তেই আরও কয়েকটি পায়ের শব্দ ছুটে আসছিল এদিকে। শুনতে পেয়েই দুর্গা হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলতে আরম্ভ করেছিল, মরণ! মুখে আগুন অমন মিনসেদের। অমন শ্যাল কুকুরের মতন যদি ছুটেই মরতে হয়, অমন কুকাজ করতে যাওয়া কেন?

তার কথা শেষ হতে না হতেই আবগারি জমাদার নামকরা সাহসী ও ধূর্ত কাসেম দুজন সঙ্গীসহ সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

কাসেম জিজ্ঞেস করেছিল, কাকে বলছ?

দুর্গা মুখ না তুলে, উনুনে পাতা ছুঁড়তে ছুঁড়তেই বলেছিল, অই যমকে। বাঁশঝাড়ের দিকে দৌড়ে পালাল। মড়াদের কি চিনি। আনজাদেই বুঝেছি, এসবই কিছু হবে। এমন চমকে উঠেছি শব্দ শুনে। কীরে, বাবা, বাঘ-ভালুক নিকি। তা পরে দেখলুম, না, মানুষ। তাই বলছিলুম, অমন আঁদাড়ে-বাঁদড়েই যদি ছুটে মরতে হবে তো, ওসব করা কেন?

কাসেম ততক্ষণে সঙ্গীদের হুকুম দিয়েছিল, যা যা, দ্যাখ, বাঁশঝাড়টার দিকে যা। ও শালা সব্বেনেশে মাল। ওকে মানুষে ধরতে পারবে না।

বাপের আমলের পুরনো সম্বন্ধটাই টেনে এনেছিল দুর্গা। বলেছিল, কার কথা বলছ চাচা?

কাসেম বলেছিল, ইটি নতুন, কিন্তু ভারী ধড়িবাজ। চিরঞ্জীব বাঁড়ুজ্জে, বামুনপাড়ার ছেলে। কলেজের বিদ্যেও কিছু আছে তো পেটে। দল পাকাচ্ছে।

দুর্গা চোখ কপালে তুলেছিল। শুধু তার সেই ছায়া কানে কানে বলেছিল, আ পোড়ারমুখী ঢঙ্গি, কত ছলা-কলাই জানিস। বলেছিল, সে কী গো চাচা। তিন বছর আগে না চিরোঠাকুর স্বদেশি করে জেল খেটে এল।

কাসেমের দৃষ্টি অন্ধকারে। অন্যমনস্কের মতো বলেছিল, অই বলে কে?

একটু পরে কাসেম দুর্গার দিকে তাকিয়েছিল। কাসেম বাঙালি মুসলমান, বাড়ি মুর্শিদাবাদ। বদরাগি জমাদার বলে নাম আছে। সাহসও খুব। আবগারি জমাদার না হলে নাকি ভয়ঙ্কর ডাকাত হতে পারত সে। কিন্তু মানুষ বড় ভাল। তার সম্পর্কে কেউ কোনওদিন বিশেষ মন্দ কথা বলতে পারেনি। দোষ বলা যায়, একটিই আছে। অনেকদিন রয়েছে এখানে বিবি বাচ্চা ছেড়ে। বিধবা চানি মুচিনীর সঙ্গে একটু গোপন বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে।

কাসেম লুঙ্গি-পায়জামার ধার ধারে না। চিবুকে গুচ্ছের দাড়িও নেই। কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখদুটির কোলে নিয়মিত সুর্মার টান আর রং মাখিয়ে লালচে গোঁফ জোড়া তার নাম জাত ও চরিত্রের একটি সার্থক রূপ দিয়েছে। বয়স বছর পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে।

দুর্গার দিকে তাকিয়ে, তার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু চাউনি কোমল হয়ে এসেছিল। বোধ হয় আসামির আশা ছেড়ে দিয়েছিল সে। বলেছিল, তোমার চলছে কী করে গো বেটি?

ভাল-মন্দর তল্লাশিদার অনেক। দেখে দেখে দুর্গাও ভাল-মন্দ চিনতে শিখেছিল অনেকদিন। বলেছিল, ভিখ মাগার চেয়েও খারাপ চাচা।

-কেন মায়ি?

বেপরোয়া হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিখ মাগতে পারলে তবু বুঝতুম, ভিখিরি হয়েছি। তাও পারি না। খেটে খাবারও তো জো দেখি না এ-পোড়া দেশে।

কাসেম অভিজ্ঞ। এ-পোড়া দেশে দুর্গার খেটে খাবার অসুবিধা কোথায়, সেটা অনুমানে অপারগ ছিল না সে। কিন্তু শুধু মিঠে কথায় চিড়ে ভেজে না। কাসেম তো কোনও উপকার করতে পারবে না দুর্গার। একটা দমকা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, ঠিক বলেছ বেটি। দুনিয়ায় আর ইমান কথাটার দাম নাই। তোমার কথা ভাবলে আমাদেরও বুক শুকিয়ে ওঠে। কোনও পথ দেখাতে পারি না।

দুর্গা চুপ করেছিল। কাসেমের স্নেহে, নিজের কষ্টটা যেন হঠাৎ বড় বেশি আতুর করে দিয়েছিল তাকে। তারপর পাতা নিভে আসতে দেখে, তাড়াতাড়ি শুকনো পাতা উনুনে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল, চাচা, আমার বাপ নিকি চেরটাকাল পাপ করে গেল। নিজেও অনেক গালমন্দ করেছি, কিন্তুন কেউ তো কোন পথ দেখাতে পারেনি। ভাল মানুষটি হয়ে বাপ-বেটিতে মরবার পথ ছেল। আমার লুভিষ্টি বাপ সেটুকুন সামলাতে পারেনি। কাকা চার সন আগে ধান কাটার গোলমাল নে যখন পুলিশ ছাউনি ফেলেছিল এই গাঁয়ে। গুলি মেরেছিল, লাঠি মেরেছিল, তখন আমাকেও ধরে নে গেছল মহকুমায়। তখনও নেকচার শুনিচি। কিষেনেরা অন্যায় করেছে। যারা নেকচার দেয়, তারা বড় ভাল। বাঁকা বাগদিরা মন্দ, ওরা নেকচার মানে না। তাঁরাই পারেন না, তুমি কী করে পথ দেখাবে কাকা?

কাসেম বিব্রত হয়ে বলেছিল, আমি তোমার বাপের বিষয় কিছু বলি নাই গো মায়ি।

হেসে বলেছিল দুর্গা, তা জানি কাকা। এতটুকু তুমি বলেছ, সেটুকুনই আমার অনেকখানি।

কাসেম নিশ্চিন্ত হেসে বলেছিল, এবার সেইটে বাকি আছে। তবে, কে করছে না বল? ভদ্দর-অভদ্দর, কাউকে তো বাকি দেখছি না। এখন যে কোন মোকামে রান্না হয়, আর কোন মোকামে চোলাই হয়, তাই ধরতে পারি না। ইনফর্মাররা যে সব ঘরের সংবাদ আনে, তোবা, তোবা, ও সব মোকামে আবগারি পুলিসের ঢুকতে নিজেদেরই শরম লাগে।

কাসেমের লোকেরা ফিরে এসেছিল হতাশ হয়ে। পাওয়া যায়নি।

কাসেম হঠাৎ হেসে উঠেছিল সঙ্গীরা আসার পর। বলেছিল, আমরা কিন্তু আসলে বোকা বনেছি। ওর পেছনে ছোটার কোনও দরকার ছেল না।

–কেন?

লোকটা যদি চিরঞ্জীবই হয়, হাতে কি ওর মাল ছিল? কই, কিছুই চোখে পড়েনি তো? ও ছুটল দেখে আমরাও ছুটলুম। আসলে মাল নিয়ে দোসরা লোক দোসরা রাস্তায় গেছে। ও আমারে ছুটিয়ে এনেছে অন্যদিকে।

সঙ্গীদের যেন দিব্যদর্শন ঘটেছিল, এমনিভাবে তাকিয়েছিল তারা। তারপরে তারা দুর্গা আর কাসেমের দিকে তাকিয়েছিল, দুজনের মধ্যে কিছু আছে কিনা।

চলে গিয়েছিল তারা।

পাশাপাশি সব বাড়ি। অনেকেরই লক্ষ পড়েছিল কাসেমের আসা। পলাতককে কেউ দেখতে পায়নি। দু-এক জন এদিক-ওদিক থেকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল রে দুগগা, যমেরা কাকে খুঁজছে?

দুর্গা জবাব দিয়েছিল, মরণকে।

একেবারে নিশ্চিন্ত মনে দুর্গা পাতা পোড়াচ্ছিল। যেন খেয়ালও নেই, ঘরে কেউ ঢুকে বসে আছে। কিন্তু মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছিল, চোখে তার রাগ ও হাসির একটি যুগপৎ খেলা চলছিল। রাগটা বোধ হয় নিজের ওপর। হাসিটা পলাতকের কথা ভেবে।

 ভাত হয়ে গিয়েছিল। একেবারে ফ্যান ঝরিয়ে হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সে। ঢুকে দেখেছিল, অন্ধকারে বিড়ির আগুন জ্বলছে এক কোণে। বেরিয়ে, গিয়ে দুর্গা লম্ফটা নিয়ে আসছিল। সেই চিরোঠাকুরই বটে।

চিরঞ্জীব উঠে দাঁড়িয়েছিল। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করছিল, কাছাকাছি কোথাও ওত পেতে নেই তো?

দুর্গা স্বভাবমত আঁচলটা তুলে নিয়ে এসেছিল ঠোঁটের ওপর। মনের বিস্ময়টুকু সে মুখে ফুটতে দেয়নি। সে দেখছিল চিরঞ্জীবকে। এই তো সেদিন স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ঢুকেছিল। স্বদেশি করেছিল, জেলে গিয়েছিল চিরোঠাকুর। এর মধ্যেই সোঁ সোঁ করে বিড়ি ফুঁকছে। চোখে মুখে পাকা-পাকা ভাব। দুর্গার চেয়ে ছোট না হোক বড়ই-বা কতটুকু।

দুর্গা শুধু বলেছিল, বীরপুরুষ!

 চিরঞ্জীব সেদিকে কান না দিয়ে নিজেই অন্ধকারে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিয়েছিল। বলেছিল আপন মনে, মালটা ফেলে এসেছি সরোবরের জঙ্গলে, হাতছাড়া না হয়ে যায়।

দুর্গা বেশ পাকা পাকা গলায়, একটু শ্লেষের ঝাঁজ মিশিয়ে বলেছিল, এ সব বিদ্যে আবার কবে থেকে ধরলে?

চিরঞ্জীব আবার আপন মনে বলেছিল, আর একটু বাদে বেরুব। কাসেমের ব্যাপার তো।

 দুর্গা ভ্রূ কুঁচকে বলেছিল, কালা নাকি?

চিরঞ্জীব বলেছিল, কী, বলছিস্ কী?

কথার স্বরে একটু তীক্ষ্ণতা ছিল চিরঞ্জীবের। লোকটা রাগ করেছে কিনা বুঝতে চেয়েছিল দুর্গা।

একই গ্রামের ছেলে-মেয়ে। এ-পাড়া আর ও-পাড়া। তবে ব্যবধানটা ছিল দুস্তর। শত হলেও বামুন আর বাগদি। জাতমানের আঁটনবাঁধন তো চিরদিনই আর আজকের মতো জলে ধুয়ে যায়নি। স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে হত।

তবু চেনা-পরিচয় ছিলই। যেমন থাকতে হয়। পুরুষেরা তাকিয়ে চলে যায়। মেয়েরা চোখ নামিয়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে পাশ দেয়। গাঁয়ের লোক কে কাকে না চেনে?

দুর্গা বলেছিল, বলছি, এ-সব আবার কবে থেকে ধরেছ?

চিরঞ্জীব জবাব দিয়েছিল, এই সবে।

চিরঞ্জীবের গাম্ভীর্য দেখে, সহসা আর কোনও কথা বলতে পারেনি দুর্গা। কিন্তু চিরঞ্জীব যেন হঠাৎ তখন চোখ তুলে দুর্গার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। ছেলেমানুষের মতো বিস্মিত গলায় বলেছিল, তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস দুর্গা।

দুর্গা একেবারে চোখ নামায়নি এতক্ষণ। ওকথা শুনে নামিয়েছিল। আবার একবার তাকিয়েছিল, চিরঞ্জীবের কথা ও চাউনির অর্থ বোঝবার জন্যে। বলেছিল, তা বয়স কি কারুর হাত ধরা? চেরকাল তো আর মানুষ ছোট থাকে না।

–তা বটে।

 একটু হেসে বলেছিল, কাসেমের সামনে খুব একচোট শ্যাল-কুকুর বলে নিলি আমাকে।

 দুর্গা চমকে উঠে বলেছিল, ও মা! সে কি সত্যি-সত্যি নাকি?

-না, তুই খুব ভান করতে জানিস। অন্য মেয়ে হলে কী বলতে কী বলত কে জানে।

 কিন্তু দুর্গা আবার, জিজ্ঞেস না করে পারেনি, কিন্তুন, তুমি এ সব পথ ধরলে কেন?

চিরঞ্জীব ভ্রূকুটি করে জবাব দিয়েছিল, সে কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে নাকি!

শুনে দুর্গারও ভ্রূ কুঁচকে উঠেছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার আঁচলঢাকা ঠোঁটে একটু সূক্ষ্ম হাসি খেলে গিয়েছিল। চিরোঠাকুর আসলে কাঁচা, পুরোপুরি পাকেনি। এসমাগলার না কী বলে, সে সব নতুন তো! জিজ্ঞেস করলে রাগ হয়।

তারপরেই চিরঞ্জীব জিজ্ঞেস করেছিল, তোর মুখে কি ঘা হয়েছে নাকি?

–কেন?

–আঁচল চেপে আছিস যে?

আঁচলটা আপনি খসে পড়েছিল। ঘা নয়, অক্ষত রক্তাভই। দুর্গা বাগদিনীর ঠোঁট শুধু ঠোঁট নয়। বিম্বোষ্ঠ।

তারপরেই আবার একটা বিস্মিত প্রশ্ন ছুঁড়ে মেরেছিল চিরঞ্জীব, এ-কী, তোর বে হয়নি নাকি?

লজ্জা পাওয়াই বোধহয় উচিত ছিল দুর্গার। কিন্তু সে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। চিরঞ্জীবের চোখে অনেক কথাই ফুটে উঠেছিল দুর্গার হাসি-টলমল শরীরের দিকে তাকিয়ে। সে সব কথা অধিকাংশই সন্দেহ ও অবিশ্বাস। বলেছিল, হুঁ! কী করে তোর চলে?

চিরঞ্জীবের মতো অতটা ঝাঁজ না হোক দৃঢ়স্বরেই বলেছিল দুর্গা, সে কথা তোমাকে বলতে যাচ্ছি কেন? নাও, এবার সরে পড়ো দিকিনি।

কিন্তু চিরঞ্জীব তাকিয়েছিল দুর্গার দিকে। না, না, পিঁপড়ের সারি থেকে উঠে আসা চাউনি ঠিক ছিল না সেটা। বলেছিল, তুই-ও তো চোলাই কারবার করতে পারিস।

–সত্যি?

দুর্গার ঠোঁট হাসিতে বাঁকা হয়ে উঠেছিল। চিরঞ্জীব তখন ফেরবার উদ্যোগ করেছিল।

দুর্গা বলেছিল, সময় হলে তোমাকে খবর পাঠাব।

বলে হেসেছিল। চিরঞ্জীব ততক্ষণে অন্ধকারে অদৃশ্য।

দুর্গাও মুখ বাড়িয়েছিল অন্ধকারে। চিরঞ্জীবকে দেখা যায়নি আর। কিন্তু আর একটি ছায়া এগিয়ে এসেছিল তার দিকে। দুর্গা ঘরের ভিতর সরে এসে লম্ফর আলোর দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। ছায়াটি দুর্গার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, অনেকক্ষণ মিটি মিটি করে হেসেছিল দুর্গার দিকে তাকিয়ে। তারপর শ্লেষ মিশিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, সরোবরে ডোবার চেয়ে কি এটা ভাল হল তোর?

দুর্গা বলেছিল, কী হল?

–এই যে এমনি ডোবা?

 –ও মা! ডুবলুম কোথা?

–একে ডোবা বলে না তো কী বলে? এখনও ছলনা?

দুর্গা হাসতে গিয়ে, মুখখানি করুণ করে, চকিত চোখে আবার অন্ধকারে ফিরে তাকিয়েছিল। ছায়া হেসে উঠেছিল তার বুকের মধ্যে। একটি দীর্ঘ হুঁ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, একবার দেখা একবারেই মরা। এমনি করেই সবাই মরে। কিন্তু কোথায় মরলি একবার ভেবে দেখলি না?

না, ভাবনা নয়, চিন্তা নয়, শুকনো পাতার মড়মড়ানি শুনবার জন্যে কান পেতেছিল। তারপর যে হাসিটি কোনওদিন হাসা হয়নি, সেই হাসিটি টুকটুক করে উঠেছিল দুর্গার ঠোঁটে।

ছায়া শুধু বলেছিল, পথ চেয়ে কাল কাটুক। চিরোঠাকুর কি আর কোনওদিন আসবে আশ্রয় নিতে তোর কোটরে?

রাঁধা ভাত পাতে না দিয়েই আলস্যে শুয়ে পড়েছিল দুর্গা।

.

তারও পরে দিন গিয়েছিল। এক মাস, দু মাস।

শেষে যমুনা-মাসিকেও একদিন বলতে হয়েছিল, রাগ করিসনে দুগগো। ওকুর দে মশাই বলেছিলেন, বাঁকা বাগদির মেয়ে, আমাদের ঘরের মেয়ের মতো। আমাদের শহরের বাড়িতে গিয়ে থাকুক, সোমসারের ফাইফরমাশ খাটুক। জাতের ছেলে দেখে এ্যাট্টা বে-থা আমি দিয়ে দেব।

দুর্গা কিছু না বলে, যমুনা-মাসির মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়েছিল।

.

কয়েকদিন পর, ঘনায়মান সন্ধ্যায় দুর্গা দাওয়ায় বসেছিল।

দূরের গাছগাছালি পেরিয়ে, স্টেশনের ধারে নতুন গড়ে-ওঠা শহরের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছিল। নতুন হাসপাতালের লাল রঙের টুকরো। নতুন বিজলিবাতির আকাশ-খোঁচানো পোস্ট। আলো জ্বলে উঠেছিল একে একে। ওই হাসপাতালেরই আলো। কয়েকটি দোকানেও বিজলিবাতি নিয়েছিল। স্টেশনেও বিদ্যুতের আলো হয়েছিল নতুন। ওদিককার আকাশটা আলোকময় দেখাচ্ছিল। হাট এখন রোজের হাট। রোজ ভিড়। অনেক নতুন দোকান। বিজলি রেলগাড়ির বাঁশির স্তিমিত শব্দ যেন মেয়েগলার ডাকের মতো আসছিল ভেসে।

সব নাকি বদলে যাবে। বিজলি-তার নাকি আসবে এদিকে, আলো জ্বলবে। শহর বাড়বে। বলদ-মোষের গাড়িগুলি মাটিতে ঘাড় গুঁজে নাকি পড়ে থাকবে না। সাইকেল-রিকশা আগেই ছিল। মোটরগাড়িও আসবে।

বাগদিপাড়ায় বসে দুর্গা এমনি করে বসে থাকবে গালে হাত দিয়ে? কিন্তু অন্ধকারে যদি না থাকে, বিজলি আলোয় এমন করে থাকার লজ্জা ঢাকবে কী দিয়ে?

পায়জামা আর শার্ট গায়ে দেওয়া ঝোড়ো কাকের মতো একটি ছেলে এসে দাঁড়িয়েছিল দুর্গার সামনে। চিরঞ্জীবের দলের ছেলে। বলেছিল, চিরঞ্জীবদাকে ডেকে পাঠিয়েছিলে?

চেনা ছেলে, নাম গুলি। হেঁটো পেড়ে কাপড় পরার কথা। কিন্তু ওরা আজকাল নতুন পোশাক ধরেছে।

-হ্যাঁ।

 –কেন?

তোকে বললে হবে?

–আমাকে পাঠিয়ে দিলে জানতে।

দুর্গা এক মুহূর্ত চুপ করেছিল। তারপর বলেছিল, চিরোঠাকুরকে বলিস, আমি গুড় আর মশলা চেয়েছি তার কাছে। কয়লাও যেন পাঠায় পরিমাণ বুঝে।

গুলি কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়েছিল। তারপরে ঘাড় কাত করে আচ্ছা বলে চলে গিয়েছিল।

দুর্গা দাওয়ার খুঁটিতে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছিল। সে যে বলেছিল, কোনওদিন চোলাই করলে চিরোঠাকুরকে খবর দেবে।

তাই বাঁকা বাগদির মেয়ে দুর্গা খবর পাঠিয়েছিল, চোলাই করবে সে।

.

০২.

খবরটা রটেছিল আগেই।

প্রায় মাসখানেক আগে সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল, রাঢ়ের এই অঞ্চলে তরাইয়ের একটা বাঘ আসছে। বাঘটা নতুন, কিন্তু ঝানু। অব্যর্থ শিকারের একটি স্বাভাবিক এবং সাংঘাতিক প্রবৃত্তি নিয়ে বাঘটা এসে পৌঁছুচ্ছে। এই অব্যর্থ শিকারী প্রবৃত্তিটার কথা সবাই বলছিল বোধ হয়, বিশেষ করে তরাইয়ের শ্বাপদ হিংস্র অরণ্য পার হয়ে বাঘটা আসছে, তাই। আসছে এই জঙ্গলের আড়াল-আবডালের চেয়ে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠই যেখানে বেশি। যেখানে জটিলকুটিল অন্ধকার অরণ্যে দৃষ্টি আটকাবার কোনও উপায় নেই। আর যে বাঘ অরণ্যেরই জটে পাকে শিকারে অভ্যস্ত, এই খেত-খামার জনপদ বিস্তৃত খোলা জায়গায় তার মৃগয়া-উৎসব অবাধ হয়ে উঠবে।

আর তরাই মানে শুধু গভীর বন নয়। উঁচু-নিচু অসমতল। চড়াই আর উতরাই। বাঘটা আসছে সেই অরণ্যসঙ্কুল চড়াই-উতরাইয়ের দেশ থেকে। পলকহীন খপিশ চোখ যার উঁচুতে-নিচুতে সমান দেখতে পায়। রাঢ়ের এই আদিগন্ত সমতলে দৃষ্টি তার বাধাহীন সুদূরে ছুটে যাবে। খাদের অন্ধকার যার অজানা নয়। খাল আর নালা তার নখেই ভাসবে। মরণের মতো সর্পিল বাঁকে ঘোরাফেরা তার। সমতলের সহজ বাঁকে ক্ষিপ্রগতি পদক্ষেপ কোনও সমস্যাই নয়।

সুতরাং সাবধান! তরাইয়ের বাঘটা আসছে। আর বাঘটা অনেক বড় শিকার ধরেছে।

রাঢ়েরা শিকারেরা নিশ্চয় আজ প্রহর গুনছিল।

.

বাঘটা এল আজ। মহকুমার উত্তর বিভাগের কর্তা সুরেশবাবু সদরে এলেন তাকে রিসিভ করতে। কারণ তরাইয়ের বাঘ, অর্থাৎ বলাই সান্যাল সুরেশবাবুর জায়গাতেই প্রমোশন পেয়ে এসেছে। মহকুমা হেড কোয়ার্টারে অপেক্ষা করছিল বলাই সান্যাল। পরিচয় করতে গিয়ে সুরেশবাবু অবাক হলেন। বললেন, একী, আপনি তো ছেলেমানুষ মশাই।

পুলিশের লোক বলেই সন্দেহ হয়, কথাটা মাৎসর্যের। প্রৌঢ় সুরেশবাবুর জায়গায় একেবারে নওজোয়ান। যেমন তেমন নওজোয়ান নয়, একেবারে ছেলেমানুষ। আপনি করে যাকে বলাই যায় না বোধহয়।

খাকি ফুল প্যান্ট আর সাদা হাফশার্ট পরা ছিল বলাইয়ের। রংটা একটু মাজা-মাজা কালো বলেই বোধহয় চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল। ফরসা হলে লোকটাকে জলো আর পানসে মনে হতে পারত। কারণ বলাইয়ের চোখ দুটি বড় ভাসা ভাসা বলা যায়। তার ওপরে হাসিটি মিষ্টি। যদিও রাত্রি জেগে ট্রেনে আসার জন্য চুল উশকো-খুসকো, তাতে কিছু ঢেউ লক্ষ পড়ে। সব মিলিয়ে, চেহারায় তথাকথিত দারোগার সার্টিফিকেট না-পাওয়াই তার উচিত। বলাই হাসল সুরেশবাবুর কথায়। বলল, আমরা যাব কখন?

সুরেশবাবু বললেন, এখুনি। আপনার সঙ্গে মালপত্র?

–আছে–একটা ছোট বেডিং, সুটকেশ একটা, আর

ক্যাম্বিশের খাপে ঢাকা পয়েন্ট টু রাইফেলটা তুলে নিল বলাই।

সুরেশবাবু বললেন, একি সরকারি অস্ত্র নাকি?

–না নিজেরই। একটু-আধটু শিকারের নেশা আছে কিনা। সঙ্গে নিয়ে আসার অন্য কোনও কারণ নেই। শখের জিনিস, কে কী ভাবে হ্যান্ডেল করবে, তাই কাঁধে ফেলে চলে এসেছি।

–বেশ বেশ। ভায়ার পরিবার-টরিবার হয়েছে তো?

বিয়ে করেছি।

কদ্দিন?

 বছর পাঁচেক।

–আচ্ছা? দেখে তো মনে হচ্ছে না। ছেলেপুলে?

বলাই হাসছিল। হাসির মধ্যে কোথাও একটি ছায়া পড়ল টের পাওয়া গেল না। বলল, আসেনি।

সুরেশবাবু বললেন, বাঃ! কাজের ছেলে দেখছি। আজকালকার দিনে না আসতে দেওয়াটাই কাজের ছেলের লক্ষণ।

বলাই কী একটা বলতে যাচ্ছিল। সুরেশবাবু তার আগেই হা হা করে হেসে উঠে বললেন, তা হলে এখনও বেশ জমজমাটি-ই চলছে অ্যাঁ!

বলাইয়ের বলতে যাওয়া কথা বলা হল না। একটু বিষণ্ণ আড়ষ্ট হাসি ছুঁয়ে রইল তার ঠোঁটের কোণে।

দুজন সেপাই এগিয়ে এল বেডিং আর সুটকেশ স্টেশনে তুলে দেবার জন্যে। কাছেই স্টেশন। হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট। প্ল্যাটফরম এখান থেকেই দেখা যায়।

যেতে যেতে সুরেশবাবু বললেন, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এলেই হত। ঘর তো খালি করাই আছে। আমার ফ্যামিলি আমি শিফট করে দিয়েছি আগেই।

–হঠাৎ উপশাস্ত্র আপনাদের ঘাড়ে এসে পড়ব তাই আনিনি। কথা আছে, ব্যবস্থা হয়ে গেলেই সবাই এসে পড়বেন।

সবাই মানে। মা-বাবা আসবেন নাকি?

–মা নেই, বাবা আছেন। তবে তিনি আসবেন না। মালবাজারেই থাকবেন ভাই-বোনদের নিয়ে। এখন শুধু

–ও, গৌরবে বহুবচন। খালি স্ত্রী আসবেন। বেশ বেশ।

জংশন স্টেশন। হাওড়া থেকে মেইন লাইন এখন ইলেকট্রিফিকেশন হয়ে গেছে। ব্রাঞ্চ লাইনটা বাঁক নিয়েছে উত্তর-পশ্চিমে। দুটি লাইন পাশাপাশি গিয়ে, খানিকটা দূরে এক হয়ে হারিয়ে গিয়েছে গাছগাছালির আড়ালে। বিজলি নয়, শাখা লাইনে এখনও কয়লার ঝকঝকানি আছে বলেই বোধহয়, প্ল্যাটফরমটা নিচু। পুরনো ভাঙা ময়লা। দাঁড়িয়ে-থাকা লোকাল গাড়িটারও সেই অবস্থা। একদিকে বিদ্যুতের সমারোহ আছে বলেই হয়তো অতটা নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। আগে দেখাত না।

ফার্স্টক্লাশের একটি নির্জন কামরায় উঠলেন সুরেশবাবু বলাইকে নিয়ে। বসে বললেন, ভায়ার লেটেস্ট কেসটা আমরা খবরের কাগজে আগেই পড়েছি। বড় জবর কেস। রীতিমত থ্রিলিং অ্যাডভেঞ্চার।

ভায়া মানে বলাই। আপনি কিংবা তুমি কোনওটাই নয়। তুমি বলবার ইচ্ছেটাই টের পাওয়া যাচ্ছে।

সুরেশবাবু আবার বললেন, মেয়েটি খুব সাংঘাতিক, না?

বলাই হেসে বলল, না খুব সাধারণ।

 –দেখতে নাকি বেশ সুন্দর ছিল?

যুবতীও বটে। সে হিসেবে সাংঘাতিক। তবে মেয়েটা মোটামুটি চেনাই ছিল। বাঙালি, সুন্দরী যুবতী, অথচ অভিভাবক নেই, কিন্তু এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, এমনিতেই সন্দেহজনক মনে হত। থাকত শিলিগুড়িতেই। দুএকজন সামাজিক নামকরা ভদ্রলোকেদেরও তার কাছে পিঠে দেখা যেত। ধরা পড়েছিল নিজের দোষেই।

ধরা সবাই নিজের দোষেই পড়ে।

বলাই হেসে বলল, এ ক্ষেত্রে অন্যরকম হয়ে গেছল। গাড়িটা আসছিল আসাম থেকে। আমার যাবার দরকার ছিল কিষেনগঞ্জ পর্যন্ত। যে কামরাটায় উঠেছিলাম, সেই কামরাতেই মেয়েটি ছিল। আমি জানতাম না মেয়েটি ওই কামরায় আছে। কেবল একবার লক্ষ পড়েছিল, একটি লোক মালপত্র নিয়ে নেমে গেল ওই ফার্স্টক্লাশ থেকে, আর কে একটি মেয়ে উঠল আর তাদের মধ্যে যেন কী দুএকটা কথা হল। তারপরে লক্ষ করে দেখলাম, যে-লোকটি নেমে গেল, তাকে যেন কোথায় দেখেছি। পলকের জন্য মনে হল, তারপরেই আবার ভুলে গেছি। গাড়ি ছাড়ল, আমি কিছু না ভেবে হঠাৎ ওই ফার্স্টক্লাশেই উঠলাম। চোখোচোখি হতেই মেয়েটি যেন কেমন একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমিও একটু অবাক হলাম, বিশেষ করে সেই মেয়েটাকেই দেখে। মেয়েটি একটি গোটা গদি জুড়ে বসেছিল। চোখোচোখি একবারই হয়েছিল প্রথমে। তারপরেই সে চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। বেলা সাড়ে তিনটে চারটে বোধ হয় বেজেছে। কিন্তু মেয়েটির আড়ষ্টতা আমার লক্ষ এড়ায়নি। কেমন যেন স্টিফ। এমনকী হাতের চেটোয় রুমালটা যে-ভাবে ধরা ছিল, সেইভাবেই ছিল বেশ খানিকক্ষণ। আমি নেমে-যাওয়া লোকটার কথা তখন ভাবলাম। কিন্তু সন্দেহটা তখনও অন্যরকম ছিল। অন্য লাইনের। ভাবলাম, যাকগে, কী হবে এ সব ভেবে? মেয়েটা মিছেই আড়ষ্ট হয়ে আছে। পথে কোনও লোক উঠে যদি ওর কোলে মাথা রেখে শোয়, আমি কিছুই মনে করব না।

কিন্তু মেয়েটি নিজের থেকেই গর্তে পা দিল। আমারও সন্দেহের কুণ্ডলী পাক খুলতে লাগল। ও আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, কদ্দূর যাবেন আপনি?

দেখলাম ওর মুখের রং-এর মধ্যেই সাদা হয়ে এসেছে। সত্যি জবাব দিতে বাধল। দেখাই যাক না, কী হয়। একটু নিস্পৃহ ভাবেই ঠোঁট উলটে জবাব দিলাম, ঠিক নেই। দেখি কদ্দূর যেতে হয়। বলে ইচ্ছে করেই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কোথায় পৌঁছতে হবে?

প্রশ্নটা কাজে লেগে গেল। ও ভাবল, আমি ওকে কোনও জিনিস পৌঁছুবার কথা বলছি। ভয়ে গলা চেপে বলল, কী পৌঁছুতে হবে? বললাম, আপনাকে কোথায় যেতে হবে তাই জিজ্ঞেস করছি। কেমন যেন থিতিয়ে গেল মেয়েটা। বলে ফেলল, আমিনগাঁ। আমিনগাঁ? আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম ওর দিকে। ও তাড়াতাড়ি ভুল শুধরে বলল, না না, মণিহারি ঘাট পর্যন্ত। বললাম, তাই বলুন। দুটো একেবারে দুদিকে। বলে হাসলাম। তারপরে খুব নির্বিকার ভাবে চোখ বুজে ফেললাম। কিন্তু ততক্ষণে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি, গণ্ডগোল একটা আছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? এত ঘাবড়াচ্ছে কেন ও?

পরের স্টপেজে গাড়ি দাঁড়াতেই দেখলাম, মেয়েটি ছটফট করছে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। প্রায় জুয়া খেলার মতো ভাগ্যের উপর নির্ভর করে, শিলিগুড়িতে ফোন করে দিলাম একটা। আবার যখন এলাম, তখনও মেয়েটি দরজার কাছে। গাড়ি প্রায় ছাড়ে। আমাকে ফিরে আসতে দেখে, মেয়েটি পা-দানিতে পা নামিয়ে দিল নামবার জন্য। আমিও পা-দানিতে উঠে, দুদিকের হাতলে হাত রেখে বললাম, এখন নামতে চেষ্টা করবেন না, পড়ে যাবেন। ভেতরে চলুন।

ব্যাপারটাকে ও চরম বলে মনে করল, আর দাঁড়িয়ে রইল আমার দিকে তাকিয়ে। আমি দরজাটা বন্ধ করে, লক করে দিলাম। তারপর

সুরেশবাবু প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, থামলে কেন ভায়া, বলো।

বলাইয়ের মুখে একটু লজ্জার আভাস। বলল, মেয়েটি সুন্দরী। তাই ও হঠাৎ অন্য পন্থা ধরল। যাকগে, আমি সে সব বাদ দিয়েই যাচ্ছি।

না না তা হবে না। তবে আর মজা রইল কোথায়? রসিয়ে রসিয়ে বলতে হবে তোমাকে। তারপর? তোমার গায় পড়ল বুঝি?

সুরেশবাবু ঈষৎ রক্তাভ চোখে এই ঈপ্সিত কাহিনীটিরই আলো। বলাই হেসে বলল, আজ্ঞে না। আপনাকে আগেই বলেছি খুব সাধারণ মেয়ে। আসলে বোকা। গায়ে পড়ল না, গায়ে পড়ার ভাব করতে লাগল।

সুরেশবাবুর লাফিয়ে উঠে বললেন, আগেই বলেছি। বাবা, চেহারাখানিও সেই রকম বাগিয়েছ, হুঁ হুঁ! বুঝিনে কিছু? কী রকম ভাব করতে লাগল?

বলাই সলজ্জ গলায় বলল, মেয়েদের একটি চাউনি আছে, করুণ অথচ আরও কিছু থাকে যেন। সেই ভাবে চেয়ে রইল মেয়েটি। বেশবাসও আলুথালু। অথচ আমার অবস্থানটা ভাবুন। আমি তখনও অপরাধটাই আবিষ্কার করতে পারিনি। শুধু একটাই গ্যারান্টি, সামথিং রং। মেয়েটি একেবারে সরাসরি আমার নাম ধরেই ডাকলে, বলাইবাবু। আমি, তেমনি নির্বিকার জবাব দিলাম, বলুন। দেখলাম, ওর করুণ চাউনির অতলে একটি বিশেষ আবেদন। প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমাকে ছেড়ে দিবার কি কোনও উপায় নেই? আমি খুব ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম। কেন ছাড়ব? কী করেছে ও? যে-ভাবে শুরু হয়েছিল সেই ভাবেই প্রসিড করলাম। বললাম, কী উপায়ে বলুন?

মেয়েটি জিজ্ঞেস করলে, আমার সঙ্গে টাকা নেই। দেখতে পারেন সার্চ করে। আর যা চান, তাই দেব।

আমার চোখ তুলতে লজ্জা করছিল। যা চান, মানে যে কী, সেটা চাপা ছিল না। অথচ ও যদি শয়তান হত, তা হলে ওর ধরা পড়ারও কোনও চান্স তো ছিলই না। উপরন্তু, একলা মেয়ে ফার্স্ট-ক্লাশে ট্রাভেল করছে, আমাকে ফাঁসাবার সব রকম রাস্তাই খোলা ছিল ওর। কথা শুনে রাগ করার আমার উপায় ছিল না। কারণ তখনও আমার কার্যসিদ্ধি হয়নি। বললাম, আমি কিছুই চাইনে আপনার কাছ থেকে। আপনি শুধু– কথা শেষ করতে আমার ভয় করছিল। যদি ভুল ঢিল মারা হয়ে যায়। তবে সব বানচাল। মেয়েটি বলল, শুধু কী? আমি তখন কামরাটা ভাল করে লক্ষ করছি। ভাবছি, আমার নাম জানে, পেশাও জানে। সুতরাং সঙ্গে কিছু আছে বলেই কাণ্ডটা ঘটতে পারছে। বলে ফেললাম, আপনি আমাকে মালটা সারেন্ডার করে দিন।

মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, সারেন্ডার করে দিলেই ছেড়ে দেবেন তো? তখন আমার জোর বাড়ল। তা হলে মাল আছে। বললাম, সেটা আমি বিবেচনা করব।

মেয়েটি আমাকে গদির নীচে আঙুল দেখিয়ে দিল। আমি গদির তলায় হাত দিলাম। তারের জাল ঠেকল আমার হাতে। মনে হল, তারের জাল দিয়ে নারকেলের ছোবড়া আটকানো আছে। জালের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে চিমটি কেটে যেটুকু নিয়ে এলাম, সেইটুকুই ছোবড়া। মেয়েটি বললে, এক পাল্লা ছোবড়ার ভেতরে আছে। ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম জাল। ছোবড়া সরিয়ে, আরও ভেতরে হাত দিয়ে পেলাম গাঁজা। বুঝলাম, গোটা গদিটাই গাঁজা। যেমন ছিল, তেমনি রেখে নিজের সিটে এসে বসে বললাম, আর কোথায় আছে?–আর নেই। কোথায় পৌঁছুবার কথা? মণিহারি ঘাটে। তারপর? মেয়েটি বলল, তারপর, সারাদিন গাড়িটা সাইডিং-এ থাকবে। সেই ফাঁকেই সরানো হবে। আমাকে আবার চালাকি করতে হল। বললাম, কিন্তু আপনি কার এনতেজারিতে ছেড়ে দেবেন? সে কোথায় থাকবে? কাটিহার। চেনা? হ্যাঁ। সহজভাবে কথা বলতে বলতে মেয়েটি ততক্ষণ আমার সিটে এসে বসেছে। হঠাৎ একটি হাত তুলে দিল আমার হাতে। চোখে তার সেই করুণ চাউনি। জলেরও আভাস ছিল।

সুরেশবাবু চিৎকার করে বললেন, এইবার জমেছে। আমাদের এই ছাকড়া লোকাল গাড়িও সেইজন্য নড়ল বোধ হয়। তারপর?

গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। বলাই বলল, আমি বললাম, হাতটা সরান। হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, পরের স্টপেজে আমাকে নেমে যেতে দেবেন তো? বললাম, না। আপনাকে ছেড়ে দিলে অন্য আসামিরা ধরা পড়বে না। আপনাকে আমি আটকাব না। কিন্তু কাটিহারের লোকটাকে আমি চিনতে চাই। সেইজন্য আপনাকে মণিহারি ঘাট পর্যন্ত যেতেই হচ্ছে আমার সঙ্গে, অবশ্যই অপরিচিতার মতো। আর একটা কথা। আসছে কোত্থেকে মালটা? মেয়েটি বলল, বোধ হয় আসাম থেকে। আমার সীমানা ছিল শিলিগুড়ি থেকে মণিহারিঘাট। শিলিগুড়ি পর্যন্ত কে ছিল? ভবানী তরফদার।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল মুখটা। তাই কেবলি মনে হচ্ছিল, মুখখানি চেনা চেনা। জলপাইগুড়ির পুরনো আসামি।

বলাই একটি ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু মেয়েটি তবু ধরা পড়ল।

–কী করে?

–আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ, কাটিহারের আসামিটাকে ধরেছিলাম ঠিক। কাটিহারে ফোন করে আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। কাটিহারের লোকটাই শুধু ফাঁসত। কিন্তু ওদের সন্দেহ হয়েছিল মেয়েটিকে। তাই মেয়েটাকেও প্রমাণ দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল।

সুরেশবাবু চোখ কুঁচকে বললেন, রাতটা নির্বিবাদেই কেটেছিল তো?

বলাই বলল, আজ্ঞে না। একটু ভয় ভয় করছিল।

সুরেশবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, সংবাদপত্রের রিপোর্টার কিন্তু মেয়েটার স্বীকারোক্তিই তুলে দিয়েছিল। —কাগজের হেডিংটা দেখেছিলে তো? দারোগা দর্শনেই মেয়ে স্মাগলার কুপোকাৎ।

আর একদফা হেসে দিয়ে সুরেশবাবু বললেন, ওদিকে ইল্লিসিট লিকারের বহর কী রকম?

বড় রকমের কিছু নয়।

তাই নাকি?

–হ্যাঁ। কারণ অধিকাংশই পাহাড়ি কুলি-কামিনের বাস। তারা নিজেদের খাবার জন্য প্রায় রোজই চোলাই করে। তবু বে-আইনি চোলাই তো বিক্রি না করলেও, দোকান থেকে কিনে খাওয়াই আইন সিদ্ধ। সরকার দুটো পয়সা পায়। সেজন্যেই মাঝে মাঝে গিয়ে কেড়ে নিতে হয়, ফেলে দিতে হয়, কেসটেস করে দিই। কিন্তু ওরা দোকানেরটা খাবে না কিছুতেই। বলে, বাবু, ওগুলো আমাদের ইচ্ছে যায় না খেতে। পয়সাকে পয়সা যায়, নেশাও হয় না। লিকারের কেস ও অঞ্চলে তেমন কিছু নয়।

সুরেশবাবু বললেন, এখানে কিন্তু ভায়া গাঁজা আফিম বিশেষ পাবে না। পাবে। লিকারের চেয়ে কম। কিন্তু লিকার যা আছে, তার ঠ্যালাতেই অন্ধকার। একেবারে প্রলয় বন্যা ইল্লিসিট লিকারের। একেবারে খুঁগড়ো বান দেখিয়ে ছাড়ে।

-তাই নাকি?

 –হ্যাঁ। এসেছ যখন, নিজেই দেখতে পাবে।

বলে, সুরেশবাবু নির্জন কামরাটার চারপাশে একবার দেখে নিলেন। তারপর পকেট থেকে বার করলেন ছোট একটি ফরাসি ব্র্যান্ডির বোতল। ছিপি খুলে, ঢকঢক করে কয়েক ঢোক কাঁচা-ই গিলে ফেললেন।

বলাই অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সুরেশবাবুর দিকে। সুরেশবাবু ঝাঁজটা সামলাতে সামলাতেই নিঃশব্দে হাসলেন। তাঁর মাংসলো ফরসা মুখে রক্ত ছুটে এল। চোখ দুটি লাল হয়ে উঠল কোকিলের মতো। জিজ্ঞেস করলেন, ভায়ার চলে নাকি?

বলাই একটু হেসে বলল, না।

সে পকেট থেকে সিগারেট বার করল। সুরেশবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, দাও, একটা সিগারেট দাও, খাই।

সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়া দেখেই বোঝা গেল ধোঁয়ার চেয়ে জলেই ওঁর দখল বেশি। বললেন, কী ভায়া, রাগ করলে?

রাগ করার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আবগারি বিভাগে কাজ করলে মদ্যপান চলবে না, এরকম কোনও আইন নেই। নীতিও নেই। বলল, না না, রাগ করব কেন?

–খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই?

–তা-ই বা কেন? ও জিনিসটা আমি পছন্দ করিনে।

 –আমিও অপছন্দ-ই করতাম। ব্যাপারটা কী রকম হয়েছে জানো?

 সুরেশবাবু ফুলে ফুলে হাসলেন। বললেন, চোর ধরতে ধরতে চোর হয়ে গেছি। মানে, চুরি করে চোলাই করিনে, চোরাই মদ ধরতে ধরতে মদ ধরেছি। কবে ধরেছিলাম, সেটা আর এখন খেয়াল নেই। একটা জবর লড়াইও করেছিলাম মনে মনে। ছি ছি, চোরাই মদ ধরে আমি অপরাধীদের সাজা দিই, আর আমিই নেশা করছি? তা ভায়া কী বলব, মদ জিনিসটি সহজ বস্তু নয়। সে যুক্তিহীনকে যুক্তি জোগায়। ব্যাটা আমার কানে কানে বললে, অপরাধীদের সাজা দাও, চোরা-চোলাইয়ের জন্য। মদ্য নিবারণের দারোগা তো তুমি নও। অপরের নেশা নিবারণ করতে গিয়ে যদি তুমি নেশা করতে, তবে তোমার অ-মহম্মদী দোষ হত।

বলাই অবাক হয়ে বলল, অ-মহম্মদী দোষটা কী?

–কেন, ছেলেবেলায় পড়নি? গরিবের ছেলের মিষ্টি খাওয়ার জ্বালায় বাপ-মা ছেলেকে নিয়ে এল মহম্মদের কাছে। হেই গো বাবা, ব্যাটার মিঠাই জোগাতে জোগাতে হারলাখ হো গয়া। লড়কার এ মিঠায়ী রোগ তুমি সারিয়ে দাও বাবা। মহম্মদ তোবা তোবা করলেন। তিনি নিজেই মিঠাইখোর। বললেন, কয়েকদিন বাদে ছেলেকে নিয়ে এসো, তখন ছাড়িয়ে দেব। মিঠাই খাওয়া ছাড়লেন মহম্মদ, তারপর সেই ছেলেকে বললেন, ছোড় দো বেটা মিঠাই। ব্যাটার ঘাড় থেকে মিঠায়ের ভূত নেমে গেল। মানে কী হল?

বলে বলাইয়ের দিকে তাকালেন।

বলাই হেসে বলল, বোধহয় আপনি আচারি ধর্ম পরকে শিখাও।

সুরেশবাবু বলাইয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, গুড! এই না হলে আর বুদ্ধিমান ছেলে। সেই জন্যেই লড়াইয়ে হেরে গেলুম মদের কাছে। তাই তো, আমি তো মদ নিবারণের দারোগা নই। গভর্নমেন্টকে ফাঁকি দিয়ে খাওয়ার দারোগা আমি। আর একটা লড়াই হয়েছিল স্ত্রীর সঙ্গে। সেটাও জবর লড়াই। প্রায় রোজ মারামারি ধরাধরি।

বলাই না হেসে পারল না। সুরেশবাবুর বলার ধরনটাই সেরকম। বললেন, আরে না না, হাসি নয় ভায়া। সে আমার এমন কুচ্ছো গাইতে লাগল। বললে, এই না হলে আর আবগারি দারোগা। উপযুক্ত চাকরিই জুটেছে মাতালের। আর আমার স্ত্রী নাকি জানত একদিন আমার পরিণতি এই দাঁড়াবে। বলে, এত চোরাই মদ যে ধরে, সে মদ না ধরে পারে? ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো অমন চাকরির কপালে। বোঝো ভায়া, চাকরিটাই খারাপ হয়ে গেল।

সুরেশবাবু দেখতে পেলেন না, বলাইয়ের হাসিতে আবার একটি বিষণ্ণ ছায়া খেলে গেল। তিনি আর একবার বোতল বার করে গলায় ঢেলে বললেন, এ সময়টা রোজ ভুতে পায়। একটু না খেলে পারিনে। আর এখন, জানলে ভায়া, মদ না খেলে মদ দেখতেই পাইনে। মানে চোরাই মদ।

বেলা পড়ে আসছে। পশ্চিম দিগন্তের নিয়ত সয়ে-যাওয়া সূর্য গ্রামটার গাছের কোলে ঢলে পড়েছে। যেন নির্মেঘ ফরসা আকাশটার টুটি টিপে ধরেছে কেউ, আর তার সারা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। কিংবা আকাশটা সুরেশবাবুর মতো কাঁচা মদ গিলছে ঢোকে ঢোকে, তাই রক্তাক্ত হয়ে উঠছে।

গাড়ির জানালা দিয়ে রক্তাভা এসে পড়েছে। সুরেশবাবুর মাথাটা বাইরের দিকে এলানো। ওঁর মদরক্ত মুখে আকাশের লালিমা যেন দগদগে হয়ে উঠেছে।

দিগন্ত জুড়ে বৈশাখের মাঠ। রিক্ত দীর্ণ খরো। সারাদিনের দগ্ধানিতে এখনও পাঁশুটে হয়ে আছে। গোরুর পালেরা ফিরে চলেছে। পাখিরা উড়ে চলেছে দল বেঁধে। তাদের ডাক শোনা যায় না রেলের শব্দ ছাপিয়ে।

সুরেশবাবু একটু শব্দ করে হাসলেন আবার। বললেন, সত্যি, কেন যে নেশা ধরলুম, আজও ঠিক জানিনে। আসলে কী ব্যাপার জানো ভায়া, কীসের জন্য কী, আজও তার মানে জানলুম না। বুকে ক্রশ বেল্ট ঝুলিয়ে চিরদিন নেকড়ের মতো ছুটে বেড়ালুম।

বলতে বলতেই হঠাৎ থামলেন সুরেশবাবু। ঝপ করে পিঠ চাপড়ালেন বলাইয়ের। বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার! বাজে কথা বকতে আরম্ভ করে দিয়েছি আর তুমি তো দিব্যি শুনে যাচ্ছ। ভাবছ, কোথায় নতুন জায়গায় নতুন উৎসাহ নিয়ে কাজে যোগ দিতে আসছ। আর বুড়ো তোমাকে হতাশ করে দিচ্ছে। তা কিন্তু দিইনি। নিতান্তই নিজের কথা বললুম। বরং তুমি আসছ বলে, গোটা এরিয়া দম বন্ধ করে আছে।

বলাই অবাক হয়ে বলল, কেন?

–আরে তবে আর তোমাকে বলছি কী? ইল্লিসিট লিকারের দৌরাত্ম্য কত দূর হতে পারে, সেইটে দেখতে পাবে এখানে। কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে, সেইটাই সমস্যা হয়ে উঠবে। এখানে ঘরে ঘরে চোলাই। ভদ্র-অভদ্রের কোনও বাছাবাছি নেই। স্টেশনে আর পথে তোমাকে দেখবার জন্যে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে লোকেরা।

লোকেরা?

–হ্যাঁ, মানুফ্যাকচারারস্ আর স্মাগলারস্। দেখে তুমি কাউকেই চিনতে পারবে না।

দেখে তো কোনও স্মাগলারকেই চেনা যায় না।

তাই কি?

 সুরেশবাবু ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।

বলাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না একেবারে চেনা যায় না, তা বলিনি। অনেক সময় দেখলেই বোঝা যায়। মন আপনা থেকেই বলে ওঠে, সন্দেহ ঘনিয়ে আসে।

সুরেশবাবু হেসে বললেন, একে বলে ইনস্টিংক্ট। তোমার ইনস্টিংক্ট তোমাকে বলে দেয়, এই লোকটা হতে পারে। তোমার মনে সন্দেহ এনে দেয়। তার মানে তুমি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটা আয়ত্ত করেছ দেখছি। তা হলে দেখছ, দেখেই চেনা যায়।

-না, আমি বলছিলাম, এমনি পোশাক চেহারায় কাউকেই চেনা যায় না।

সুরেশবাবু বললেন, এখানে সে ভাবে চেনবার তো কোনও উপায় নেই-ই। তোমার ইনস্টিংক্ট হয়তো ফেল করবে। হয়তো বলছি এ জন্যে, তুমি যেখান থেকে আসছ, সেটাও মারাত্মক জায়গা। কিন্তু এ অঞ্চলটা তার চেয়ে কিছু কম নয়। তুমি হয়তো সুবিধে করতে পারবে এখানে। তুমি আসছ তরাই থেকে। তরাইয়ের বাঘ তুমি।

–তরাইয়ের বাঘ?

হ্যাঁ। তোমার ওই নাম আমি রেখেছি। আর ওই নামটাই রটিয়ে দিয়েছি এখানে। তাতে একটা ফল হয়েছে। চোলাইকর আর স্মাগলারদের মধ্যে বেশ একটা সাড়া পড়ে গেছে। দে আর অ্যাফ্রেড অব দি নিউকামার। তাই বলছিলুম, তোমাকে সবাই দেখতে আসবে।

বলাই হেসে ফেলল। বলল, তার মানে, আপনি আগেই বাজার গরম করে রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, ফেইলিউর।

সুরেশবাবু বাইরের দিকে একবার দেখে নিয়ে শিশিটা আবার ঠোঁটে চেপে ধরলেন। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে যখন খুললেন, তখন মনে হল, চোখে ওঁর জল আসছে। বোঝা গেল, ক্রমেই রক্তের ঘূর্ণি বাড়ছে। ব্যাং-ঘ্যাংগানি স্বরে বললেন, তাতে অবাক হব না ভায়া। দেখো, তোমাকে আনতে যাচ্ছিলুম। পথে একবার ফরেন লিকার শপে ঢু মেরে গেলুম। ওরা এই কনিয়াকের শিশিটা প্রেজেন্ট করলে। এদের বুঝতে পারি। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড দেম। দোকান সার্চ করতে গেলেই, ওদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা ভদ্রলোক, পলিশড। চোরাই মালের জন্য ওদের ইনভেস্টমেন্ট আছে, গর্ব করে ওরা বলে সে কথা। পোর্ট থেকে দোকান পর্যন্ত একটা চেন বেঁধে এদের কারবার। নাড়া দেবার সাহস-ই বা আমাদের কোথায়। কোথায় কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে বাবা। শেষে চাকরি নিয়ে টানাটানি। কৈফিয়ত দিতে দিতে জান বেরিয়ে যাবে। তা ছাড়া ভদ্রলোকের কারবার, গণ্ডগোলের মধ্যে কেউ নেই। চুপ! চুপ! চেপে যাও সব, চেপে যাও। মিষ্টি করে হাসো। চেয়ার এগিয়ে দিয়েছে, বসো। প্রেজেন্টেশন নাও। অনেকদিন পরে এসেছে ফরাসি কনিয়াক। আসারই কথা নয়। এসে গেছে কয়েক বোতল। রসিকেরা এর স্বাদ না নিলে, বোতলগুলোরই জীবন বৃথা। নিয়ে যান আপনি একটা। আসতে-না-আসতেই সব লুটেপুটে নিয়ে যায়। ধরে রাখা যায় না। একটা রেখে দিয়েছিলুম আপনার জন্য। নিয়ে যান স্যার। তুমি একটু ন্যাকামি করবে, সত্যি! ওয়ান্ডারফুল! অনেকদিন টেস্ট করা হয়নি। কিন্তু নগদমূল্য কত? ছি ছি, কী যে বলেন। মা কালী হার মেনে যাবে জিভ কাটা দেখে। তবে দামটা শোনাবে বইকী। নইলে কয়েক বোতল চোরাই মালের জন্য তোমার দক্ষিণা তুমি কত পেলে, সেটা অজানা থেকে যাবে যে? আইবুড়ো বয়স থেকে যে শুনে আসছ বিশেষ প্রশংসা, ছেলের উপুরি আয় আছে ভাল! বুড়ো বয়সেও পরিবার ভেবে খুশি, আমার স্বামীর উপুরি আয় আছে। সেই উপুরি আয়টার কথা দোকানদার না-শুনিয়ে পারে কখনও? বিগলিত হয়ে বলবে, যারা কিনেছে, তারা পঁচাত্তর টাকায় বোতল কিনেছে। ইচ্ছে করলে আরও বেশি নেওয়া যেত। তবে সকলেই তো চেনাশোনা খদ্দের। আর তাদের খুশি করবার জন্যেই এ-সব রিস্ক নিতে হয়। সামান্য প্রফিটেই ছেড়ে দিই। সে সব হচ্ছে পরের কথা, আপনাকে তা বলে দাম দিতে হবে নাকি! এটা আপনাকে আমরা প্রেজেন্ট করছি। …এদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা যায়। কিন্তু ইল্লিসিট কান্ট্রিলিকার ম্যানুফ্যাকচারারস্ , এদের সঙ্গে বোঝাপড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। অথচ এদের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে ওঠা যাচ্ছে না। এদের ধারাটাও বিরক্তিকর। আনন্দ তো নেই-ই, কোনও সান্ত্বনা পর্যন্ত পাইনে ভায়া। কিন্তু এদের না ধরতে পারলেও মাথার চুল ছিঁড়তে হয়। আমার ক্রশ-বেল্ট আমারই টুটি টিপে ধরতে আসে। হেল! হেল! এরা আমার লাইফটাকে হেল করে দিলে।

পাশ ফিরে বসলেন সুরেশবাবু। কালচে সবুজ রঙের মোটা গদিটা একটা বাঁধা মোষের মতো ছটফটিয়ে উঠল ওঁর বিরাট শরীরের চাপে।

বলাই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এ যে শুধু মাতালের মাতলামি নয়, তা বুঝতে পারছিল বলাই। এ বয়স্ক অভিজ্ঞ ইনস্পেক্টরের জীবনে কোথায় একটি বিশেষ অশান্তি হতাশা আর ক্লান্তি জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সবটুকু বোঝবার যোগ্যতা বোধহয় তার ছিল না। খানিকটা সহানুভূতির সুর বলল, এ অঞ্চলটা আপনাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, না?

কষ্ট?

 সুরেশবাবু যেন খেপে উঠলেন। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, পাগল করে দিয়েছে। কয়েক লাখ টাকা বলতে পারো, এই সামান্য একটি জায়গা থেকে ফাঁকি যাচ্ছে। সরকারি ভাটিখানা তুচ্ছ এদের কাছে। কে তার ধার ধারে? তুমি ভাবতে পারবে না, একটা শুণ্ডিনী গোটা এলাকাটা তোলপাড় করে তুলেছে।

বলাই ঠিক ধরতে পারেনি। বলল, শুণ্ডিনী কী?

–সে কী ভায়া। তুমি আবগারির লোক। শুণ্ডিনী না বুঝলে চলবে কেমন করে? মেয়ে-শুণ্ডিকে শুণ্ডিনী বলে। যারা মদ চোলাই করে, তাদের তো শুঁড়িই বলে, না কি?

বলাই বলল, সংস্কৃত বলছেন আপনি!

–তা বটে। শুণ্ডিনী সংস্কৃতই বটে। শুণ্ডিনীর কথাই বলছিলুম তোমাকে। একটা মেয়ে-চোলাইকারিণী। সে স্মাগলারনীও বটে। গোটা মহকুমাটাকে সে উদ্ব্যস্ত করে তুলেছে। আমি তার নাম দিয়েছি বাঘিনী। একটুও বাড়িয়ে নাম দিইনি। তার চেয়েও মারাত্মক যদি কিছু থাকে, তবে সে তাই। এত চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত তাকে আমি ধরতে পারিনি। মেয়েটা, মেয়েটা সত্যি একেবারে সর্বনাশী।

বলাই অবাক হল সুরেশবাবুর বিস্ময় দেখে। বাঘিনীর কথায়ও সে কম অবাক হয়নি। বলল, বলেন কী? একটা মেয়ে এত কাণ্ড করছে?

করছে। কিন্তু সে মেয়ে নয়, বাঘিনী। এ অঞ্চলে এখন সে কিংবদন্তির নায়িকা। মেয়েটার বাপও সাংঘাতিক লোক ছিল। নাম ছিল ব্যাটার বাঁকা বাগদি। আমি বলতুম, বাঘ। সবাইকে হয়রান করে মেরেছে। লোকটা যেদিন মরল, ভেবেছিলুম, যাক ব্যাটাদের একটা লিডার মরেছে। কিছুদিন শান্তি পাওয়া যাবে। মাস ছয়েক। তারপরেই এই বাঘিনীর আবির্ভাব। তিন বছর আগে, মেয়েটাকে পলিটিকাল অ্যাফেয়ার্সে তিন দিন হাজত বাস করতে হয়েছিল। মহকুমা জুড়ে বিরাট কৃষক হাঙ্গামা হয়েছিল, সেই সময়। চার্জ ছিল, পুলিশকে খুন করবার জন্য আক্রমণ।

বলাইয়ের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বয়স কত?

–কোয়ায়েট ইয়ং। আমাদের মেয়েদের মতো ওদের বয়স কমাবার ভানটুকু নেই যত দূর জানি। বছর বাইশ বয়স হতে পারে। ওপরে নয়, কমের মধ্যে কুড়ি।

–খুবই অল্প বয়স তো?

ইয়েস, অ্যান্ড হ্যান্ডসাম, বুঝলে ভায়া। মাথা ঘুরে পড়ে না গেলেও, মাথা ঘুরে যেতে পারে। তোমার কথা বলছি না অবিশ্যি। কেননা মাথা ঘুরে যাবার মতো মেয়ে রেহাই পায়নি তোমার হাত থেকে। কিন্তু সে তোমার করুণা চেয়েছিল। এ তোমার করুণাও চাইবে না। সে যেদিন থেকে শুরু করেছে, সেইদিন থেকেই আমাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রেখেছে। আর মিথ্যে চ্যালেঞ্জ সে জানায়নি। আমাদের ইনফর্মাররা তো এ বেলা ও বেলা ধোঁকা খাচ্ছে। রুরাল ইনফর্মাররা বলে, বাবু ছুঁড়িটা জাদু জানে। আমাদের চোখে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। বাঁকার মেয়ে আমাদের ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। আসলে কী ব্যাপার জানোনা ভায়া। এব্রি বডি ইজ ইন লাভ উইথ হার।

বলাই হেসে বলল, লাভ?

সুরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ, ভালবাসা। সকলেই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে মনে হয়। তাই সবাইকে সে জাদু করেছে। বোধ হয় আমিও তার প্রেমে পড়েছি, তাই আমার চোখেও সে চিরদিন ধুলো দিল।

বলে সুরেশবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন। হাসির উচ্ছ্বাসে তাঁর লাল মুখটা প্রকাণ্ড হয়ে, দলা পাকিয়ে উঠল। হাসতে হাসতেই বললেন, খুব সাবধান ভায়া, তোমাকে যেন জাদু করতে না পারে মেয়েটা। আমাদের রুরাল ইনফর্মাররা তো গন্ধ শুঁকলে নাকি বলে দিতে পারে, ওই মেয়েটার মদ কিনা। আর সেই মদ তোমার মালখানায় তোলবার আগেই ইনফর্মাররা অনেকখানি সাবড়ে দেবে। সবাই দুর্গার হাতে চোলাই রস খেতে ভালবাসে।

–দুর্গা?

মেয়েটার ওই নাম। কিন্তু ভায়া, তুমি যা ভাবছ, তা কিন্তু মোটেই নয়।

বলাই বলল, আমি আবার কী ভাবলুম?

সুরেশবাবু ফোলা ফোলা লাল চোখে তাকিয়ে বললেন, মেয়েটার সম্পর্কে হয়তো তুমি ভাবছ, সেই শিলিগুড়ির মেয়েটার মতোই।

বলাই বলল, কই না তো, সে রকম কিছু ভাবিনি আমি।

ভাবোনি? কেন ভাবোনি, সেইটাই আশ্চর্য। কিন্তু কি রেসপেটেবল্ কি লোফার, মেয়েটার বাড়িতে কিন্তু কাউকে ভিড় করতে দেখা যায়নি।

বলাই হেসে বললে, তাতে কী এসে যায়?

সুরেশবাবু চোখ ঘুরিয়ে বললেন, ও বাবা! ওকে খারাপ বলবার জো নেই কারুর। আমাদের স্টাফের লোকেরা পর্যন্ত মুখ আলো করে বলবে, মেয়েটার চরিত্র-দোষ দেওয়া যাবে না।

এবার বলাই হা হা করে হেসে উঠল। বলল, মদ চোলাই করে তার আবার চরিত্র নিয়ে ভাবতে হবে নাকি?

তাই তো জানতুম এতদিন। তা হলে আর তোমাকে কিংবদন্তির নায়িকা বলছি কেন। মেয়েটি একলা নয়, তার সঙ্গে আবার একটি ছেলেও আছে। লেখাপড়া-জানা শিক্ষিত ব্রাহ্মণের ছেলে হে। নাম চিরঞ্জীব ব্যানার্জি। দুর্গা যদি বাঘিনী হয়, তবে চিরঞ্জীব নির্ঘাত বাঘ। এখানকার লোকেরা বলে, ওদের দুজনের মধ্যে ‘আছে’।

আছেটা এমন ভাবে বললেন, বলাই না হেসে পারল না আবার। বলল, রীতিমত নভেল বলুন।

রিয়্যালি। চিরঞ্জীবের সঙ্গে তোমার আলাপ হবে নিশ্চয়। সেও এ তল্লাটের ফেমাস বয়। তুমি বুঝতে পারবে।

মনে মনে যে একটু বিস্ময়ের ছোঁয়া না লাগছিল, তা নয়। তবু সমস্ত ব্যাপারটা শুনে বলাইয়ের হাসিই পাচ্ছিল।

সুরেশবাবু বললেন, তবে, চিরঞ্জীব হচ্ছে নিচু বাংলার বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তুমি তরাইয়ের বাঘ। লড়ে যাও ভাই, আমরা হারজিতের সংবাদ শোনবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকব।

বলাই সিগারেট বার করে বলল, ওইটুকু আর বাদ দিচ্ছেন কেন যে, মাঝখানে রইল সেই বাঘিনী, লড়াইয়ে যার জিত, সে তারই।

–বেশ বলেছ ভায়া।

 দুজনের উচ্চ গলার হাসি জানালার বাইরে ছড়িয়ে গেল। গাড়ি এসে দাঁড়াল গন্তব্যে।

সুরেশবাবু বলাইকে নিয়ে নামলেন। কাসেম এগিয়ে এল সেলাম করে। নতুন অফিসারকে দেখছে সে।

সুরেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, খবর সব বহাল কাসেম?

–হ্যাঁ স্যার!

 সুরেশবাবু চারদিক তাকিয়ে বললেন, ব্যাটাদের ভিড় কেমন কাসেম?

কাসেম জবাব দিল, শয়তানগুলো সব এসেছে স্যার। দুগগা চিরো ওরা আসেনি অবিশ্যি। তবে দলের লোকেরা অনেক এসেছে।

সুরেশবাবু বললেন, বলেছি তো আগেই। কী বলছে সব?

কী আর বলবে, বলছে, কী গো কাসেম-চাচা, আমাদের অন্ন নিকি ঘুচল? তা আমিও শালাদের জবাব দিয়েছি। বলেছি, ইমানের ভাত খাবি ঘরে, তার আবার ঘোচাঘুচির আছে কী? বে-ইমানের অন্ন হলে ঘুচবে।

বলাইয়ের পছন্দ হল কাসেমকে।

 সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অন্ধকারটা ঘন হয়ে আসেনি এখনও।

স্টেশনের বাইরে এলে, চোখের সামনে প্রথম যেটুকু চোখে পড়ে, তাতে মনে হয়, যেন একটি মফস্বল শহরের শুরু। আসলে হুগলি জেলার একটি গ্রাম। শহর হয়ে ওঠার তাগিদটা লক্ষণীয়। যদিও লক্ষণটা স্টেশনের কয়েক শো গজের মধ্যেই ইতি টেনে দিয়েছে। পুনশ্চের আভাস যেটুকু আছে, তা সামান্য।

গায়ে যদিও লেখা নেই কোথাও, তবু একটি প্রাচীনতম ছাপ আছে গ্রামটায়। বোঝা যায়, আগে ছিল বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এককালে ছিল এটি ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত। বনস্পতির তলায় নানান নামী-অনামী। বনের মতো ছিল কিছু হাড়ি বাগদি ডোম। অবশ্যই বনস্পতির দূর সীমানায়। কাছাকাছি মাঝখানটা রক্ষা করতেন কিছু কায়স্থ আর বৈদ্য। আর ছিল একটি বড় হাট-সংলগ্ন এই রেল-স্টেশন।

হাওড়া থেকে মেইন লাইন দিয়ে বেরিয়ে প্রায় মাইল পনেরো এসে ব্রাঞ্চ লাইনটা চলে এসেছে এই পশ্চিমে। পশ্চিমোত্তর কোণ বলা যায়। লাইনটা চলে গেছে আরও ভিতরে। হাওড়াকে মহীরুহ বললে এই লাইনগুলিকে সুদূর ব্যাপ্ত শিকড়ের মতো বলা যায়।

গ্রামটার গ্রামীণ চেহারায় ভাঙন ধরেছে যুদ্ধের পর থেকেই। জীবনের ভাঙনটা তো চলে আসছে শতাব্দী ধরেই। চেহারায় টিকে থাকতে চেয়েছিল। সেটাও আর সম্ভব হয়নি।

বামুন-শুদ্দুরের, জাতাজাতের বিচার অনেকদিন গেছে। অনেক পুরনো হয়ে গেছে। নতুন আসছে একটু একটু করে। বুধবার-রবিবারে হাট বসে এখনও। কিন্তু প্রত্যহের বাজার হিসেবেও এখন বেশ তেজি। এখন শুধু বুধ রবির হাটের সওদায় দিন কাটে না। লোক বেড়েছে প্রধানত দেশ-বিভাগের কল্যাণেই। পশ্চিম বাংলার কোথায় বাড়েনি। সরকারি একটি বড় হাসপাতাল হয়েছে। একটি রিসার্চ ব্যুরো আছে ছোটখাটো। আর দুচারটে নতুন বাড়ি উঠেছে হাল আমলের মতো। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা রাস্তাটা অ্যাসফল্টের। দক্ষিণে বাঁক নিয়ে ঘুরে গিয়েছে মহকুমা শহরে। উত্তরে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে চন্দননগরের দিকে। সব নদী এক জায়গায় ধায়। এখানকার বড় বাঁধানো সড়কেরা সবাই যায় জি, টি, রোডে।

বৈদ্যুতিক আলো এসেছে বটে। নিতান্তই স্টেশনে, স্টেশনের কাছে আর অ্যাসফল্টের রাস্তার ওপরে কয়েকটি দোকানে, এক-আধটি বাড়িতে আলো পৌঁছেছে। বিজলি স্থির আলো জ্বলছে সেখানে। সবচেয়ে বেশি আলোকিত করে জ্বলছে হাসপাতালে, রিসার্চ ব্যুরোর কম্পাউন্ডে। কিন্তু আলো জ্বলেনি এখানে রাস্তায়। অর্থাৎ নেই। বাকি সবখানেই এই সন্ধ্যার বৈশাখী বাতাসে অস্থিরভাবে কাঁপছে চিমনিবন্দি কেরোসিনের আলো। হ্যাজাকের সবজোট আলো এখনও বিদায় নেয়নি সব দোকানপাট থেকে।

টাইপ মফস্বল শহরের এগুলি প্রাথমিক লক্ষণ। কাপড়, মনিহারি, ময়রা আর মুদি দোকানের এপাশে-ওপাশে কয়েকটি চায়ের দোকান। চণ্ডীমণ্ডপের আধুনিক সংস্করণ। সকালে বিকালে সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে আড্ডা বসেই। যদিও সাইকেল-রিকশার আমদানি হয়েছে এখানেও, তবু এখানে গোরুর গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। বাজারের ধারে লাইনবন্দি গোরুর গাড়ি ঘাড় গুঁজে পড়ে রয়েছে। পড়ে রয়েছে আরও স্টেশন-প্রাঙ্গণে।

গাড়িগুলি ভোরবেলা থেকে সারাদিনই পড়ে থাকে। সন্ধ্যা থেকে গ্রামে ফিরতে আরম্ভ করে, আবার মাঝরাত্রি থেকেই স্টেশনে আসতে আরম্ভ করে। ভোর চারটের প্রথম গাড়িটা ধরতে আসে সবাই মালপত্র নিয়ে। তরিতরকারি সবজির একটি বড় কেন্দ্র বলা যায় অঞ্চলটাকে। আশেপাশের সবগুলি স্টেশন থেকে তরকারি বোঝাই হয়ে কলকাতায় ছোটে। হুগলি জেলার এ ব্রাঞ্চ লাইনটাকে সবজির লাইন বললেই চলে।

গ্রামের ভিতর দিকে, দুদিক থেকে দুটি রাস্তা চলে গেছে। একটি কাঁচা, আর একটি পাকা। পাকা অর্থে, খোয়া দুরমুশ করা রাস্তা। সেটা খানিকটা গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাঁচা সড়কের সঙ্গেই একাত্ম হয়েছে। বলতেই পাকা। আঁকাবাঁকা গভীর লিক্ রেখা তার দুপাশে। এবড়ো-খেবড়ো গর্তও কিছু কম নেই। কারণ যানবাহনের মধ্যে গোরুর গাড়িই আছে। কয়েক মাস সাইকেল-রিকশা চলে। তাও সারাদিনে একবার কি দুবার। কারণ রিকশায় চাপবার লোকেরও অভাব। গ্রামের বাসিন্দারা রিকশায় চেপে গ্রামে ঢুকলে সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আলোচনা তো হয়ই। তবু কেউ কেউ চাপে। যারা তাকানো কিংবা কথাকে গ্রাহ্য করে না। তা ছাড়া মানুষের সময়-অসময় আছে বইকী।

বনজঙ্গলের আশেপাশে এখানে, পথের ধারে ধারে বট-অশত্থের ছড়াছড়ি। শতায়ু গাছগুলি হাতির শুঁড়ের মতো ঝুরি নামিয়েছে, শিকড় ছড়িয়েছে কাঠা কাঠা জমি নিয়ে। বুড়ো গাছগুলির বাড়টা এখন উঁচুর চেয়ে নিচুর দিকেই বেশি। তাই ঝুরিনামা গাছগুলিকে এখন বেঁটে আর ঝাড়ালো দেখায়। এখানে-ওখানে ভাঙা বটের শিকড়ে ঘাড়-মোচড়ানো মন্দিরের ছড়াছড়ি। সেকালের পুরনো বড় বড় বাড়িও যে চোখে না পড়ে তাও নয়। সেগুলি এখন ভুতুড়ে বাড়ির মতো। লোক যদি বা আছে টের পাওয়া যায় না। রাত্রি হলে বাতির অভাব। ঘরে ঘরে জ্বালবার মতো বাতি নেই।

বলাই দেখল সুরেশবাবু মিথ্যে বলেননি। বাজারে দোকানে পথের ধারের সব লোক যেন তাকেই গিলছে দুচোখ দিয়ে। কিন্তু সুরেশবাবু যে-জন্য বলছেন, সেই জন্যেই কি? গাঁয়ে নতুন মানুষ এলে তো লোকে এমনি করেই তাকিয়ে থাকে বোধহয়।

কেউ কেউ নমস্কার করল সুরেশবাবুকে। দুএকজন বড় দোকানদার তারা। সবচেয়ে বড় করে নমস্কার করলে ওকুর দে। শেয়ালের মতো নজর তার বলাইয়ের দিকে। কথা সুরেশবাবুর সঙ্গে বলল, সদরে গেছলেন নাকি স্যার?

সুরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার দ্বারা তো আপনাদের সজুত করা গেল না। বুড়ো হয়েছি। এইবার আগে থেকেই সাবধান।

ওকুর দে তার সেই পেটেন্ট হাসি হেসে বলল, কী যে বলেন স্যার!

বলাইকে হাত জোড় করে নমস্কার করল সে। আপনি এলেন বুঝি স্যার? নমস্কার।

ওকুর দে কোনওকালে বোধহয় স্কুলে পড়ত। সেই থেকেই সে স্যার স্যার শিখেছে, সেটার উচ্চারণ আর সুর আজও ভুলতে পারেনি।

বলাইয়ের অস্বস্তি শুধু নয়। সুরেশবাবুর সঙ্গে এদের এত মাখামাখি কথা শুনে মনে মনে যেন বিরক্তও হল। সে ওকুর দে-কে কোনও জবাব দিল না।

ওকুরের মুখের হাসিটা একটু নিষ্প্রভ হল। কুঁচকে উঠল চোখের কোণ দুটি।

গ্রামের ভিতরে যাবার পাকা সড়ক ধরে অগ্রসর হলেন সুরেশবাবু! কাসেম যার মাথায় বলাইয়ের মাল চাপিয়ে দিয়েছিল সে আগেই চলে গেছে। বলাইয়ের চোখে কলাবাগানের আধিক্য চোখে পড়ল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার আগেই, কলাবাগানের মধ্যে, গাছের ঝুপসিঝাড়ে দলা বেঁধে উঠেছে।

হঠাৎ কাসেম থমকে দাঁড়াল। বাঁদিকে বটগাছের তলায় ভাঙা পুরনো শিবমন্দির। চারপাশে আসশেওড়ার জঙ্গল।

কাসেম বলল, কে রে ওখেনে?

কোনও জবাব নেই। কিন্তু কাসেমের দৃষ্টি সরল না। শিকারি কুকুরের মতো তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। ফুলে উঠল নাকের পাটা। সে চিৎকার করে হাঁক দিল, কে ওখানে?

-কেন?

পালটা প্রশ্ন শুনে কাসেম কয়েক পা এগিয়ে গেল আসশেওড়ার জঙ্গলে। বলাইও দাঁড়িয়ে পড়েছিল সুরেশবাবুর সঙ্গে। মন্দিরের কাছে জঙ্গল থেকে কেন শব্দটা পুরুষ গলায় নয়।

পরমুহূর্তেই কাসেমের বিস্মিত গলা শোনা গেল, তোবা তোবা দুগগা নিকি?

 বলতে বলতেই কাসেম আরও এগিয়ে গেল। আর কাসেমকে লক্ষ করে সুরেশবাবুর চোখে পড়ল খয়েরি রঙের ওপর কালো কালো ডোরাকাটা শাড়ি। তিনি বলাইকে ফিসফিস করে বললেন, ওই, ওই দেখো ভায়া, বটগাছটার কোল আঁধারে, মন্দিরের সিঁড়ির কাছে সেই বাঘিনীটা। যার কথা তোমাকে আসতে আসতে বলেছি। বোধ হয় তোমাকে দেখে রাখছে।

বলাইয়েরও তখন চোখে পড়েছে। সন্ধ্যার ঝাপসা আলোয় সে অবাক হয়ে দেখল সেই ডোরাকাটা মূর্তি। চোখে পড়বার কথা নয়। কাসেমের ওপর আর এক প্রস্থ বিস্মিত বিশ্বাস স্থাপিত হল তার। সে দেখল, দুটি আয়ত চোখ, কিন্তু আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। আর অদ্ভুত বলিষ্ঠতা তার ছিপছিপে শরীরের উজ্জ্বল ডোরায় ডোরায়। খোলা চুলের রাশি তার ছড়িয়ে আছে কাঁধের দুপাশে। গায়ের রং কটাসে না হলে, মূর্তিটা সম্পূর্ণ মিশে থাকতে পারত অন্ধকারে।

বৈশাখের বাতাস ঝাপটা খাচ্ছে ভাঙা মন্দিরটার গায়ে। বাতাস যেন শাসাচ্ছে বটের ডালে ডালে।

কাসেমের রুক্ষ গলা শোনা গেল, এখানে কী হচ্ছে?

জবাব শোনা গেল, যা হয় এখেনে, তাই হচ্ছে।

গলার স্বরে ঝংকার। নির্ভয় ও শ্লেষের আভাস। আবার শোনা গেল, ঠাকুরের থানে আবার কী হয়?

বলাইয়ের মনে হল, তীক্ষ্ণ চোখ দুটি তার দিকেই। কাসেম ততক্ষণ আসশেওড়ার জঙ্গলের চারপাশে পা দিয়ে লাথি মেরে মেরে যেন কিছু খুঁজতে আরম্ভ করেছে। সে বলল, তা এখেনে কেন? গাঁয়ের মধ্যে আর ভাল মন্দির নাই?

–থাকলেও বা এখেনে আসতে মানা আছে নিকি? আবগারির এমন আইন তো শুনিনি বাবা।

বলতে বলতেই মূর্তি অদৃশ্য হল অন্ধকারে। কাসেম মন্দিরের চারপাশটা দ্রুত একটা পাক খেয়ে নিল। সুরেশবাবু ডাকলেন, চলে এসো কাসেম। তুমি যা ভাবছ, তা নয়। মাল পাচারের উদ্দেশ্যে আসেনি ও। বলাই-ভায়াকেই দেখতে এসেছিল।

কাসেমের সুরমা-টানা শিকারি চোখে তখন আর রাগের কোনও আভাস নেই। বরং একটি অবাক বিষণ্ণতা তার চোখে। বলল, দুনিয়াটা সত্যি আজব কারখানা।

সুরেশবাবু বললে, দেখলে তো ভায়া। শুধু বাঘিনী নয়, চিতাবাঘিনী!

বলাই হেসে বলল, তাই দেখছি।

সামনের অন্ধকারে একটি আলোর বিন্দু দুলে উঠল। তারপরেই একটি চিৎকার ভেসে এল, হেই শালা, দেখতে পাস না। কানা নিকি রে মামদোটা।

বোঝা গেল, গোরুর গাড়ি আসছে একটা।

রাস্তাটা দুদিকে বাঁক নিয়েছে। একটি গ্রামের অভ্যন্তরে। সেটা বাঁয়ে। ডাইনের রাস্তার মোড় ফিরলেই চোখে পড়ে, অন্ধকারের বুকে বিরাট সিংহদরজাওয়ালা দোতলা প্রাসাদপুরী। সিংহদরজার খিলানে একটি টিমটিমে লণ্ঠন ঝুলছে। বাতাসে কাঁপছে আলো। আলোটা কাঁপছে সামনেই একটি গাছের অন্ধ ঝুপসিতে ; যে-গাছটি বাড়িটির মাথা ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি। আলো যেটুকু পড়েছে, তাতে দরজার সামনেটা কোনও রকমে একটু দেখা যায়। বাদবাকি বাড়িটা কালো দৈত্যের মতো যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। দোতলার একটি জানলায় সামান্য আলো দেখা যায়। বাড়িটা পুবে-পশ্চিমে লম্বা। কিন্তু পশ্চিমের শেষটা দেখা যায় না। গাছের আড়ালে হারিয়ে গেছে। অলিন্দে অলিন্দে ঘা খেয়ে বাতাস যেন মোটা স্বরে ডাক ছেড়েছে।

প্রাসাদপুরী নয়, বাড়িটা প্রেতপুরীর মতো। সামনে-পিছনে যেন অনেকগুলি চোখ আছে।

 বলাই বলল, সব জায়গায় একই ব্যাপার?

কীসের?

 –এই একসাইজের অফিসবাড়ি।

কথাটা মিথ্যে নয়। মফস্বলের অধিকাংশ একসাইজ ডিপার্টমেন্টের বাড়িই প্রায় এরকম বিরাট আর সেকালের। কারণ বোধহয় এত বড় নতুন বাড়ি পাওয়া দুঃসাধ্য। পুরনো কাছারি বাড়ি, বাগানবাড়ি কিংবা পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি চিরকাল এ ভাবে কাজে লেগে এসেছে। আসলে অফিস, হাজত, কোয়াটার কর্মচারীদের বাসস্থান, সেপাইদের আস্তানা, সব একটি বাড়িতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

সুরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই একটি ব্যাপারে সরকারের নট নড়নচড়ন। আমাদের সঙ্গে বোধহয় পোস্টঅপিসেরও আত্মীয়তা আছে। তাদের কপালে চিরদিন এরকম পুরনো বাড়ি।

বলাইয়ের নাসারন্ধ্র ফুলে উঠল। মুখ তুলে বলল, লিকারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

জবাব দিল কাসেম, মালখানা থেকে বাস ছেড়েছে। পড়ে-উড়ে গেছে বোধহয়।

সিংহদরজা দিয়ে ঢোকবার মুখে ছোট গলি। গলির দুপাশে খিলেন করা বেঞ্চ। সেকালের বাড়ির মতো। সেখানে শুয়েছিল দুটি লোক। সুরেশবাবুকে দেখেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোয়াল ঢাকা কালো কালো মুখ, লোক দুটির লাল চোখগুলি ঠিক শ্মশানের কুকুরের মতো ঢুলু ঢুলু। তবু সেই ঢুলু ঢুলু চোখে তাদের তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা। একটা কদর্য সন্দেহের স্থায়ী ছাপ তাদের চোখে। মুখে হালকা মদের গন্ধ।

সুরেশবাবু সামনের হ্যাজাক-আলোকিত ঘরটায় ঢুকলেন বলাইকে নিয়ে। কাসেম থমকে দাঁড়াল। তার সুরমা-টানা চোখ যেন দপদপিয়ে উঠল। চাপা গলায় বলল, শালারা মাল টেনে এসেছিস।

দুজনেই হাসল। সলজ্জ বিব্রত পোষা জন্তুর হাসি। অপরাধী পোষা কুকুর ধমক খেলে বোধ হয় এরকমভাবে হাসে। যে-হাসি দেখলে রাগ থাকে না।

কাসেম বলল, আর আমার কাছে গাওয়া হল, একজনের পিছু ধাওয়া করছি, এ্যাটটা কেস ধরা পড়তে পারে।

একজন বলল, তাই তো গেছলুম চাচা। এই সবে ফিরছি। সেই ডিটট্যান সিনগাল অবধি ধাওয়া করেছিলুম রেল নাইন ধরে। পাত্তা করতে পারলুম না।

ডিটট্যান সিনগাল নিশ্চয় ডিসট্যান্ট সিগন্যাল। ভুল ধরার কিছু নেই। ওই হল আর কী!

কাসেম ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কীসকে পিছু ধাওয়া করতে গেছিলি।

 দ্বিতীয় জন, লাল ঢুলুঢুলু চোখে, বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিল। ঘড়ঘড়ে গোঙা স্বরে বলল, কার আবার। যার পিছু ধাওয়া করতে এ নাইনে এয়েছি তার।

প্রথম জন বসে পড়ে বলল, হ্যাঁ। যার জন্যে ফেউ হয়িচি।

 দ্বিতীয়টিও এবার তার পাশে বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে। দুজনেই যেন মার-খাওয়া পশুর মতো পঙ্গু হয়ে বসে রইল। অনুভূতিহীন ভাবশূন্য।

কাসেমের গোঁফের কোণে শ্লেষ দেখা গেল। বলল, বাঁকার বেটির পিছু ধাওয়া করেছিলি বুঝিন?

 দুজনে প্রায় একই সঙ্গে গুঙিয়ে উঠল, হঁ!

কার কাছে খবর পেলি যে সে ওই পথে গেছে।

–পাড়ার নোকের কাছে।

কাসেম মুখখিস্তি করে বলল, যেমন তোরা, তেমনি তোদের পড়শি। তোরা গেছিস রেল লাইনে, তাকে দেখে এলুম আমি টিশানের রাস্তায়, ভাঙা মন্দিরের জঙ্গলে। ধুর শালারা।

কাসেম ঢুকে গেল অফিস ঘরে।

 লোক দুটি অথর্বের মতো অনড় হয়ে রইল। ফাঁসির লাশের মতো লাল উদ্দীপ্ত চোখে তারা তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে।

যেন স্বপ্নের ঘোরে একজন বলল, তা হবে বা।

আর একজন তেমনি ভাবেই বলল, হুঁ। সোনার হরিণের মতন। প্রথম জন আবার বলল, মায়াবিনী।

দ্বিতীয় জন বড়বাবু বলে, চিতানী।

অর্থাৎ চিতাবাঘিনী।

 হয়তো আরও কথা তারা বলত। সহসা একটা দমকা বাতাস সিংহদরজার খিলানে ধাক্কা খেয়ে চাপা শোর তুলে দিল। ঝুলানো লণ্ঠনটা দুলে উঠল জোরে। তারা দুজনেই বাইরের দিকে ফিরে তাকাল। লণ্ঠনের আলোর একটি রেশ দুলে দুলে তাদের গায়ে পড়তে লাগল। পড়তে লাগল, সরতে লাগল।

ওরা দুজনেই আবার হাঁটু-মাথা এক করে বেঁকে দুমড়ে শুয়ে পড়ল।

লোক দুটি কেষ্ট আর ভোলা। বাঁকা বাগদির দলের লোক ছিল এক সময়ে। ওরা দুজনেই বাঁকা বাগদির মেয়ের প্রেমপ্রার্থী ছিল। দুর্গা হবে বীর্যশুল্কা, ওরা মরবে, এই ছিল ওদের মনে। কিন্তু দুর্গা দুজনকেই নিরাশ করেছে।

তারপর দুর্গা একদিন চোলাই শুরু করলে। ওদের সাধ ছিল, চিরদিন দুর্গার আজ্ঞায়, দুর্গার কাছে থেকে তার কাজ করে দেবে। কিন্তু দুর্গা ওদের বিতাড়িত করেছে।

দুর্গা তাড়িয়েছে তো, আর কারুর সঙ্গে ওরা কাজ করতে পারেনি। মন বলে নাকি একটা কথা আছে। এত হেনস্থা-ই বা কেন? মানুষের মন পোড়ে না।

পোড়ে। পোড়ে তাই ওদের চোখ দপদপিয়ে উঠেছিল। তাই ওরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। চ্যাংমুড়ি কানি মনসার মতো ওরা দুর্গার পিছু পিছু ছুটবে। দিনে রাত্রে, ঝড়ে জলে রোদে, আকাশে পাতালে, সাপের মতো সঙ্গে সঙ্গে ফিরবে। তারপর একদিন ধরবে।

ওরা দুজনে শুয়ে শুয়ে বোধ হয় কল্পিত ছবিই দেখতে লাগল, অসহায় দয়াপ্রার্থিনী দুর্গা তাদের বন্দিনী। বোধ হয় তারা স্বপ্ন দেখতে লাগল, আহা! এমন সুন্দর মনের মতো পাখিটিকেও খাঁচায় পোরা যায়। ওকে ছেড়ে দেব আমরা।

অফিস-ঘরে যারা ছিল, তাদের সকলের সঙ্গেই বলাইয়ের আলাপ করিয়ে দিলেন সুরেশবাবু। এস-আই অখিল গাঙ্গুলি, ছোট জমাদার ধীরেন পালিত। দুজন বাঙালি সেপাইও ছিল।

হ্যাজাকের উত্তাপে ঘরটা গরম হয়ে উঠেছে। টেবিল চেয়ার ছাড়া, এক পাশে দুটি খাটিয়া রয়েছে। দেয়ালে টাঙানো রয়েছে দুটি থ্রি পয়েন্ট থ্রি জিরো জিরো রাইফেল।

সুরেশবাবু বসে পড়েছিলেন। বলাইকেও বসতে অনুরোধ করলেন অখিলবাবু।

অখিলবাবু সুরেশবাবুরই সমবয়সী প্রায়। গোলগাল নাদুসনুদুস কালো আর বেঁটে মানুষ। খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা চুল। থ্যাবড়া নাকের ওপর কামড়ে বসেছে মোটা লেন্সের চশমা। হাফশার্টের ওপর প্যান্টের মতো করে, মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা। বাঁ-হাতের মণিবন্ধে একটি পুরনো রিস্টওয়াচ।

পরিবার-পরিজন কেউ নেই এখানে। বাঙালি সেপাইদের মেসেই খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। আমুদে লোক বলে খ্যাতি আছে। একটু মুখ খারাপ করা অভ্যাস। কিন্তু এমনিতে খুব বিনয়ী। মোটাসোটা মুখখানি দেখে মনে হয়, অখিলবাবু ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানেন না।

একমাত্র সুরেশবাবু ওকে তুমি বলেন। অখিলের কথায় বাধা দিয়ে সুরেশবাবু বললেন, না, না, এখন আর এখানে বসতে বোলোনা অখিল। সেই কাল দুপুরে বেচারি বেরিয়েছে, এখনও রেস্ট পায়নি। চণ্ডীটা বেরোয়নি তো আবার?

চণ্ডী সুরেশবাবুর চাকর এবং রাঁধুনি ব্রাহ্মণ, দুই-ই।

ধীরেন বলল, না স্যার, বাড়িতেই আছে।

সুরেশবাবু বললেন বলাইকে, তা হলে ওঠো ভায়া। চার্জ তোমাকে কাল বোঝাব। এখন একটু রেস্ট নেবে চলো।

তাই চলুন।

সুরেশ উঠে ঘর থেকে বেরুবার উদ্যোগ করতেই অখিল বললেন, স্যার কাল কিন্তু কোর্টে কেস আছে।

সুরেশ থমকে দাঁড়ালেন। প্রায় ভেংচে বললেন, দেখো অখিল, তুমি সব সময় বাগড়া দিয়ো না। কোর্টে কি ঘুম-চোখেই যেতে হবে? কাল সকালে কথা বলা যাবে না?

বোঝা যায়, এ শুধু পদমর্যাদার ধমক নয়। তা সম্ভবও নয়। পদমর্যাদার অন্তরালে একটি অকথিত বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে অনেকদিন ধরে।

উভয়েই সেটা জানেন। তাই অখিল ভারী একটা অপ্রস্তুতের ভঙ্গিতে, গাল ফুলিয়ে বললেন, তাই বলছিলুম। যদি মনে থাকে, তাই আর কী।

সুরেশ আর একপ্রস্থ ধমকালেন। প্রায় খিঁচিয়েই বললেন, খালি তোমারই মনে থাকে, না? লোকটা একটা যাচ্ছেতাই রকম কর্তব্যপরায়ণ। কিছু খায়-টায় নাকি কে জানে? এসো হে ভায়া।

বলেই বেরিয়ে গেলেন।

বীরেন হাসতে যাচ্ছিল। তার আগেই অখিল পাখার বাঁট দিয়ে টেবিলের ওপর মেরে বললেন, থাক, আর রসিকতা করতে হবে না। কমলাপুরের কেসের ফাইলটা বার করো দয়া করে।

ধমক খেয়ে হাসির অট্টরোলটা ফেটে পড়ল না বটে, অন্তর্স্রোতে চাপা রইল না কৌতুকের বান। সুরেশবাবু বললেন, সাবধানে এসো ভায়া, বড় পেছল।

মিথ্যে নয়, বলাইয়ের রবার শোল বারে বারে পিছলে যেতে চাইছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কোন অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার হচ্ছে তারা। দুদিকে চাপা ঘর, মাঝখানে সরু গলি। কাসেম আগেই সেখানে হ্যারিকেন বসিয়ে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু হ্যারিকেনের আলোয় এই মান্ধাতা আমলের গলিটার চেপে বসা অন্ধকার তাতে ঘোচেনি। শুধু ব্যস্ত হয়ে উঠেছে চামচিকেরা।

বোধহয় একটি মহল পার হয়ে এল ওরা। একটি বাঁক নিতেই, সামনে উঠোন। উঠোনের চার পাশেই ঘর। সংলগ্ন বারান্দা। ভিতর-মহলের এই উঠোন যেন একটা হাড়ল কুয়োর গর্ত। আলো-বাতাস এখানে নিষিদ্ধ। ওপর দিকে তাকালে একখানি চৌকো আকাশের টুকরো দেখা যায়। বোঝা যায়, অন্দরমহলের অতীত অধিবাসীরা সারাদিন ওই চৌকো আকাশটুকুর দিকে ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকত। কখন সূর্য ওই চৌকো জায়গাটুকুতে উঁকি দিয়ে পালাবে। বোঝা যায়, বাতাস এখানে একবার কোনওরকমে ঢুকে পড়লে সহজে বেরোতে পারে না। বন্দি বাতাস এখানে ঢুকে ফোঁসে, আবর্তিত হয়, চাপা গর্জনে শাসায়। হয়তো হা হা শব্দে কাঁদেও।

আজকের বৈশাখী বাতাসও নোনা ইটের বদ্ধ কারায় মাথা কুটছে। যেন চাপা স্বরে শাসাচ্ছে। দুটি হ্যারিকেন দুদিকের বারান্দায় রাখা আছে। ঢুকে-পড়া বাতাসের আবর্তে চিমনি বন্দি শিখা কাঁপছে থরো থরো।

বারান্দা পেরিয়ে প্রশস্ত দালানেও আলো দেখা যায়। গলার স্বর শোনা যাচ্ছে মানুষের। শিলের বুকে নোড়ার পাথুরে পেষণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে রান্নার।

–সুরেশ আঙুল দেখিয়ে বললেন, যে-দিকটা অন্ধকার দেখছ, ওদিককার ঘরগুলি লোহার শিক ঘিরে। আমি হাজত করে নিয়েছি। ওপাশের দিকটায় আছে মালখানা। কাল সকালে তোমাকে দেখাব। আর এদিকটায় মোটামুটি রান্নার কাজ হয়। ঘর অনেকগুলি। একটাতে স্টাফ মেসের কিচেন, আর একটা আমার। এর পরে আমার কিচেনটাই তোমার কাজে লাগবে। ওদেরটা ওদেরই থাকবে। অবিশ্যি, ইচ্ছে করলে তোমারটা ওপরেই ব্যবস্থা করে নিতে পারো। দোতলার রাজ্যটা পুরোপুরি তোমারই থাকবে। তবে জল টানাটানি করাই মুশকিল।

বলাই বলল, নীচে যদি আপনার চলে থাকে, তবে আমারও চলবে।

সুরেশ দালানে ঢুকে বললেন, সেটা আপাতত গিন্নির বিচারের ওপর ছেড়ে রেখে দাও। কারণ, ম্যান পোপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস। তুমি করবে এক, ভগবতী দেবী এসে করবেন আর। এক। নইলে ওঁরা আর ওঁরা কেন, বলো?

এমন মোক্ষম যুক্তির ওপরে কথা চলে না। বলাই হেসে, সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে অবাক হল। একমাত্র দোতলায় উঠতেই সিঁড়ির চারটে বাঁক। সে বলল, এ যে প্রায় রিভলভিং স্টেয়ার কেস।

সুরেশ বললেন, প্রায় তাই। সেকেলে বাড়ি তো। ডাকাতের ভয় ছিল। এ বাঁকগুলো হচ্ছে বাধা। নয়তো বলতে পারো লড়াইয়ের বাঁক। এই সব বাঁকের মুখে মুখে ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই হয় গৃহস্থের।

বদ্ধ সিঁড়িতে পুরনো ইটের গন্ধ। দেয়ালে হাত দিতে ভয় করে চুনকামের এই আপাত পালিশ বোধ হয় খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভয় হয়, ঝুরঝুর করে সব ঝরে পড়বে।

দোতলায় এসে পাওয়া গেল হ্যাজাকের আলো। কাসেম সেখানে উপস্থিত।

কাসেম সুরেশকে বলল, বিছানা পেতে দিয়েছি আপনার পাশের ঘরে। আলো দিয়ে দিয়েছি, হাত মুখ ধোবার জল রাখা আছে পেছনের বারান্দায়। চণ্ডী চা-জলখাবার নিয়ে আসছে।

সুরেশ বললেন, বটে? তবে আর কী। যাও হে ভায়া, এক হাতে জলখাবার নাও, অন্য হাতে মুখ ধোও, ওর মধ্যেই একটু বিছানায় আরাম করেও নাও।

কাসেম অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তোব তোবা! তা বলি নাই। ধীরে-সুস্থে সব হোক। সব তৈয়ারি আছে, সে খবরটা জানিয়ে দিলাম স্যার।

বলাইয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতে কাসেম একটু হাসল। বোঝা গেল, সুরেশবাবুর এই চরিত্রের সঙ্গে সকলেই পরিচিত। সকলের সঙ্গেই সুরেশবাবুর সৌহার্দ্য।

সুরেশ মুখ বিকৃত করে বললেন, সব অখিলের চেলা, এত বেশি কর্তব্যপরায়ণ দেখলে যে গা জ্বালা করে। বসো ভায়া বসো, ওই ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে একটু বসো।

বলাই প্রায় ভয়ে ভয়ে বলল, আর বসব না, ভাবছি একেবারে গা হাত পা ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়ে বসব।

সুরেশ আরক্ত চোখে তাকালেন বলাইয়ের দিকে। তারপর ঘুরিয়ে ঘাড় নেড়ে হতাশ গলায় বললেন, বুঝেছি। তুমিও একই দলের দলী। যাও তা হলে।

বলাই ঘর দিয়ে পেছনের বারান্দায় গেল। সব দিক অন্ধকার। বাতাস শোঁ শোঁ শোর তুলেছে। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটু দূরে অন্ধকারে কী একটা দুলছে। চকচক করছে। বলাই ভাল করে লক্ষ করল। দেখল, একটি পুকুর। চারপাশেই যেন ঘন অরণ্যের জটলা। সহসা মনে হয়, এবাড়িটা যেন শূন্যে উড়ে চলেছে। আশেপাশে যেন বাড়ি নেই একটিও। নোনা ইট আর মালখানার মদের গন্ধে বাতাস ভারী। দূরে কোথায় শেয়াল ডাকছে। বোধহয় প্রথম প্রহরের শুরু হল।

যেখানে দাঁড়িয়েছিল বলাই, সেখান থেকে বাড়িটার পিছনের অনেকখানি অংশ দেখা যায়। বোঝা যায়, ছাদের আলসে ভেঙেছে কয়েক জায়গায়। ফাটল ধরেছে নানানখানে। শ্যাওলা জমেছে গায়ে গায়ে। অশত্থের চারা গজিয়েছে ফাটলে। আর সর্বত্র বাতাস যেন কখনও শাসাচ্ছে। কখনও দীর্ঘশ্বাসের মতো হাহাকার করছে।

স্ত্রীর কথা মনে পড়ল বলাইয়ের। মলিনা এসে থাকবে কেমন করে এখানে। যদিও মলিনা ভিড়ের মধ্যে থেকে কখনওই অভ্যস্ত নয়, তবু, এই নির্জন পুরনো রাক্ষুসে বাড়িটার কোটরে থাকতে তার কষ্ট হবে।

কষ্ট হবে মলিনার। সেজন্যে বলাইয়েরও মনে মনে কষ্ট হবে। কিন্তু চিন্তা করা নিরর্থক। কোনও উপায় নেই। চাকরি ছাড়া যায় না। মলিনাকে ছেড়ে থাকা আরও দুঃসাধ্য।

বলাই চা-জলখাবার খেল। সুরেশবাবু কিছুই খেলেন না। গোঙা স্বরে বললেন, লাইট, টেলিফোন কিছুই নেই। থানাও এখান থেকে অনেক দূর। সৌভাগ্য তোমার মাত্র একটিই। যদিও থানার আন্ডারেই আছে, তবু একটি জিপগাড়ি তুমি প্রায় সর্বক্ষণের জন্যেই পাবে।

বলাই মনে মনে ভাবল, আপাতত সেটা হলেই চলবে।

.

নীচে দেউড়ির গলিতে, কেষ্ট হঠাৎ উঠে বসল। ভোলার নাকে শব্দ হচ্ছে। ঠিক নাক-ডাকার শব্দ বলা যাবে না সেটাকে। নিশ্বাস চাপা পড়ে যেন হিস হিস করছে।

কেষ্ট তাকে ঠেলা দিয়ে ডাকল, হেই ভোলা, ভোলা।

ভোলা ধড়মড় করে উঠে বসল, বলল, অ্যাঁ, কী?

কেষ্ট বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, না কিছু লয়। তুই তো শালা খালি ঘুম মারছিস পড়ে পড়ে।

ভোলা বলল, ঘুমুই নাই, এটটু ঘোরে আছি।

–তোর কি মনে লয় না, দুৰ্গা নিচ্চয় কোথাও বেরিয়েছে?

–মনে লয়।

 –তবে চ যাই, গাঁয়ের মধ্যে। খবর-টবর কিছু মেলে কি না।

–চ, মাতি মুচিনীর কাছে যাই।

ওরা দুজনই দুদণ্ড নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না। বিভোর হয়ে ঘুমোতে পারে না পুরো রাত্রিটুকু! শয়নে স্বপনে ওরা দ্যাখে, বাঁকা বাগদির মেয়ে যেন ওদেরই আনাচে-কানাচে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। তাই ওরা ঘুমন্তও চমকায়।

মানুষের অনেক রকম শত্রু। কিন্তু ভোলা আর কেষ্টর জীবনে যে-রকম শত্রু জুটেছে, এমন শত্রু বোধ হয় মানুষের জোটে না। ওরা ছিল বাঘের সঙ্গী, এখন হয়েছে ফেউ! কিন্তু ওঁদের জাত গেছে, পেট ভরেনি। জীবন নিশ্চিন্ত হয়নি। সরকারের চাকুরে নয় ওরা। পেট চলে খবর বেচে। তাও সঠিক খবর। যা তা খবর হলে চলবে না। সত্য-মিথ্যা প্রমাণ হওয়া দরকার। একদিন যে কাগজ দুটি নিয়ে ওদের অহঙ্কার ছিল, সে কাগজ দুটি এখন ওদের ট্যাঁকে কিংবা পকেটে তেলচিটে হয়ে গেছে! কাগজ দুটি হল লোকাল আবগারি বিভাগ থেকে দেওয়া স্বেচ্ছা-সংবাদদাতার স্বীকৃতিপত্র। ওগুলি ওদের কাছে কেউ যেচে দেখতে চায়নি। ওরা নিজেরাই সবাইকে ডেকে দেখিয়েছে। আজকাল আর দেখায় না। কারণ ওরা যে ফেউ, সেটা কাগজ না দেখালেও লোকে এখন জানে।

ভোলা বলল, কিন্তুন, মুচিনী বুড়িটা নিকি দুগগার দলে ভিড়েছে আজকাল।

কেষ্ট বলল, তবু চ একবার দেখি।

ওরা দুজনে বেরিয়ে এল দেউড়ির বাইরে। মাথার ওপর লণ্ঠনটা তেমনি দুলছে। ভোলা-কেষ্টর দুটি অমানুষিক ছায়া লণ্ঠনের তালে তালে কাঁপতে লাগল মাটিতে। অন্ধকার কোলে, জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চোখ! নাকের পাটা উঠল ফুলে ফুলে।

ভোলা বলল, রসের গন্ধ।

 কেষ্ট জবাব দিল, মালখানা থেকে বাস ছাড়ছে।

–দুগগার হাতের রসও আছে মালখানায়।

 তাই বোধহয় অমন কড়া বাস।

-শুঁকেই নেশা ধরে যায়।

–আর শালা খোয়ারি কাটতে চায় না।

কথাগুলি ওদের চাপা গোঙানির মতো। ওরা ছাড়া, সে কথা বোধহয় কেউ বুঝতে পারবে না। গোদা গোদা ফাটা পায়ে ওরা নিঃশব্দে গ্রামের দিকে অগ্রসর হল।

তিন দিন পর বলাই চিঠি লিখতে বসল মলিনাকে! লিখল—

মলিন,

সবচেয়ে জরুরি সংবাদ যেটা, সেটা হল, কাজে জয়েন করেছি। এবং ততোধিক জরুরি, তুমিও পত্রপাঠ জয়েন করতে চলে এসো। ওদিককার ব্যবস্থা তো সব ঠিকই আছে। এদিককার ব্যবস্থা জানিয়ে চিঠি দেবার কথা ছিল আমার। এদিককার ব্যবস্থা সব ঠিক আছে অবশ্যই আমার মতে। এখন তুমি এলেই হয়। কারণ বয়স্ক সুরেশবাবু (আমি যাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছি) একটি মহাজন বাক্য শোনালেন, ম্যান প্রোপোজেস অ্যান্ড গড ডিসপোজেস। সুতরাং বর্তমান ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরে নিজের মতো করে নেওয়া তোমার জন্য রইল। যদিও বিভাগটা সেই আবগারি-ই, স্বামী তোমার আবগারি দারোগা-ই। পুলিশের লোক তোমার স্বামী, ও-দুঃখটা কোনওক্রমেই আমি ঘোচাতে পারব না। দোহাই, রেগে যেয়ো না যেন, এ কিন্তু খোঁটা নয়।

বর্তমান বাসস্থানের বিবরণ দিয়ে আগেই তোমার ভাললাগা মন্দলাগার ভাবনা চাপাতে চাইনে। এসে নিজের চোখেই দেখবে। সুরেশবাবু থাকতে থাকতে এলেই ভাল হয়। তোমার খুব ভাল লাগবে ওঁকে। ভয় নেই, বয়স অনেক। আমাদের পিতৃতুল্য। অবশ্য নারী এবং পুরুষের শুনেছি মাঝে মাঝে তৃতীয় নয়ন খোলে। আর সে নয়ন খুললে নাকি রূপ গুণ বয়স সব গৌণ হয়ে যায়। সে সব থাক, আমি তা বলছিনে। লোকটি এক কথায় চমৎকার। আমার খুব ভয় করে ওঁকে। উনি যে-সব কথা বলেন চাকরি ও জীবন সম্পর্কে, সে কথা শুনলে আর চাকরি করা যায় না। অন্তত দারোগার চাকরি। ওঁর সঙ্গে কথা বললে তুমি নিশ্চয়ই খুশি হবে। তোমাদের মতের মিল হবে।

চিঠি যখন যাবে, তোমার হাতে তখন নিশ্চয় বাংলা সাহিত্যের রসের জোয়ার খেলছে। এরকম অক্লান্ত পাঠিকার অবশ্য এ-পত্র পড়তে বিরক্তি লাগবে। তবু আজ সন্ধেবেলাতেই আমার ধরা প্রথম কেস ও আসামির কথা তোমাকে না লিখে পারলাম না। অবশ্যই এটা কোনও সাহিত্য-পদবাচ্য নয়। তবে অবাক হতে হবে। তার সঙ্গে আরও কিছু ভাবনা মনে আসতে পারে। আর সেই সঙ্গেই আমার নতুন কর্মস্থানের কিঞ্চিৎ চারিত্রিক পরিচয় মিলতে পারে।

নতুন জয়েন করেছি, সুতরাং এখনও সব হালচাল এখানকার বুঝিনে। বিকেলবেলার দিকে সুরেশবাবু কাছে না থাকায়, অগত্যা একটু স্টেশনেই গিয়েছিলাম বেড়াতে। এখনও অনেকেই অচেনা। যদিও সুরেশবাবু এবং সাবর্ডিনেটসদের কাছে শুনতে পাই, এখানে প্রথম যেদিন এসেছি, সেইদিনই আমাকে সবই চিনে রেখেছে।

যাই হোক, প্ল্যাটফর্মেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। সন্ধ্যা তখন হব হব। এখন কথা হচ্ছে, আমি যে ঘুরেই বেড়াচ্ছিলাম, একথা বিশ্বাস করবে কে? সংসারে অনেক লোকই বিকেলে বেড়াতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো লোক যে ঘুরে বেড়ায়, এ সব কথা অচল টাকা চালাবার মতো বাটপাড়ি ছাড়া আর কী? এ শুধু তোমাকে বলেই লিখতে সাহস করছি, কথাটা সত্যি। আমি আমার মলিনের কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, আজ মলিনকে একটি চিঠি লিখতে হবে।

দুটি প্ল্যাটফর্মেই কিছু কিছু লোক ছিল। সকলেই আপ-ডাউনের যাত্রী। আমার মতো কেউ ছিল কি না জানি না। বেড়াতে বেড়াতে মনে মনে যখন স্থির করে ফেলেছি, তোমাকে কী কী লিখব, তখন বাসায় ফেরার জন্যে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরুতে গেলাম। ঠিক সেই সময়, সেই দুটি চোখের সঙ্গে আমার দু চোখের মিলন হল। যাকে বলে একেবারে চারি চক্ষুর মিলন।

রোসো, ভয় পেয়ো না। ভাবছ নিশ্চয়, শিলিগুড়ির সেই দাদার দোকানে যে-সব বই পাওয়া যায়, যেগুলি কলকাতার বটতলা থেকে ওখানকার পাইনতলায় গেছে, সে-সব বইয়ের কাহিনী ছাঁকা ঝেড়ে দিচ্ছি। তা কিন্তু মোটেই নয়।

কেন যে চোখে চোখ পড়ল, ভেবে আমার নিজেরই তারপর রাগ হচ্ছিল। প্রথমবারে নিতান্তই চোখে চোখ পড়েছিল। পৃথিবীর কত লোকের সঙ্গেই চোখাচোখি হয়। সেই ভেবেই চোখ ফিরিয়ে চলে আসছিলাম। কিন্তু আমার ভিতরে কী ঘটে গেল। ওই চোখ দুটি আমাকে দুর্নিবারভাবে আকর্ষণ করল। আমি আবার ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য! সেই চোখ দুটিও আমার চোখের ওপরেই। আবার তাকাতেই চকিতে দৃষ্টি বিনিময় এবং চোখ দুটি দ্রুত অন্যদিকে ফিরল।

কিন্তু আমার দুটি পায়ে যেন তখন কে স্ক্রু এঁটে দিয়েছে। আমি ফিরে দাঁড়ালাম। সরে যেতে যেতেও সেই চোখদুটির সঙ্গে আবার আভাসে একবার দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। সেই চোখ দুটির দিকে খুব ধীরে অগ্রসর হলাম। বুঝতে পারলাম না, আমার চোখেই পাপ, না পাপ ওই চোখ দুটিতে?

নিশ্চয়ই ব্যস্ত হয়ে উঠছ? চোখ দুটির মালিকের একটু পরিচয় প্রয়োজন, না? অন্তত নারী না পুরুষ, সেটা বলা দরকার। এ-ক্ষেত্রে তোমার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে, চোখ দুটির মালিক যিনি তিনি নারী। জমেছে নিশ্চয়? উঁহু, নীচের লাইন পড়বে না! যেমন যেমন লিখছি, তেমনি পড়ে যাও।

তারপর, আমি যেমন বেড়াবার ছলে একটু একটু করে অগ্রসর হই, সেই চোখ দুটিও তেমনি আড়ে আড়ে চেয়ে, যেন বসবার একটি জায়গা খুঁজছে এমনিভাবে এগুতে লাগল। আমি ভাবলাম, কী কুক্ষণেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল। আমার ভিতরে একটি বিশেষ প্রবৃত্তি আছে। সেই প্রবৃত্তি ক্রমেই নিষ্কুণ্ডল হতে লাগল। দৃঢ় হতে লাগল সন্দেহ।

কিন্তু এও কি সম্ভব? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? স্টেশনের লোকেরা বলবে কি আমাকে? ওইরকম একজন ভদ্রমহিলার যাকে বলে পশ্চাদ্ধাবন করলেই হল নাকি? যা দিনকাল দারোগারই চামড়া খুলে নেবে লোকে।

কারণ ভদ্রমহিলার বয়স ষাটের কাছকাছি নিশ্চয়। ভদ্রঘরের বিধবা এবং তাঁর আধময়লা থানের পুরনো ক্ষারে কাচা গরদের চাদরখানি যত ছেঁড়াই হোক, আমাদের মা-দিদিমায়ের চেয়ে তাঁকে কোন অংশেই কম সম্রান্ত মনে হচ্ছিল না। তিনি ধনী নন, কিন্তু মানী, এটুকু তাঁর চেহারায় চোখে মুখে সর্বত্র বর্তমান। হাতে একখানি পুরনো ছোট টিনের সুটকেশ। গলায় ছোট ছোট রুদ্রাক্ষের মালা। ওঁকে যদি সন্দেহ করতে হয়, তবে নিজের মা-দিদিমাদেরও করতে হয়।

কিন্তু আমি নাচার। যে আমাকে প্রথম স্ক্রু এঁটে দিয়েছিল পায়ে, সে-ই টেনে নিয়ে চলল আমাকে। তখন আর কোনও উপায় নেই। টিকিট কাটা হয়ে গেছে, ঘোড়া ছুটবেই। তারপর কপালে যা থাকে।

আমি হঠাৎ তাড়াতাড়ি পা চালালাম। ভদ্রমহিলাও ততোধিক তাড়াতাড়ি। শুনতে পেলাম উনি বিড়বিড় করে বলছেন, হে মধুসূদন! হে নারায়ণ! হে জগন্নাথ!

তারপর দেখলাম, উনি দৌড়বার তাল করছেন। আমি ডাকলাম, শুনুন, দাঁড়ান

কিন্তু তিনি দাঁড়ালেন না। চলতেই লাগলেন। উদ্দেশ্য, প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে যাবেন। আমি গলা তুলে বললাম, দাঁড়ান বলছি।

ভদ্রমহিলা ফিরে প্রায় কেঁদে উঠে করুণভাবে বললেন, কেন? কে বাবা তুমি? তোমাকে তো আমি চিনিনে।

বললাম, না চিনলেন। আপনি দাঁড়ান।

কিন্তু পা তাঁর থামল না। একটু গলা তুলেই বললেন, কেন? একী কথা? ভদ্দরলোকের মেয়েছেলের সঙ্গে একী ব্যাভার বাপু তোমার?

–আপনি দাঁড়ান, নইলে আমি ছুটে ধরব।

এইবার ভদ্রমহিলা ধপাস করে বসে পড়লেন। লোকজন লক্ষ করছিল ব্যাপারটা। তারা এসে জড়ো হল তাড়াতাড়ি।

ভদ্রমহিলা অসহায় চোখে তাকালেন আমার দিকে। মলিন! আমি তো জানি, এবার তুমি আমার ওপর রাগ করবে। কারণ আমি ভদ্রমহিলার চোখে যেন পরিষ্কার এই অনুনয় দেখতে পেলাম, লক্ষ্মী বাবা, আমাকে ছেড়ে দাও এবারটি। কিন্তু তা আমি পারিনে। এই লোকেরা আমাকে ছাড়বে কেন? এটা একটা অলিখিত নিয়মের মতো। তাদের সামনেই প্রমাণ হওয়া দরকার।

ভদ্রমহিলা বললেন, কী চাও বাবা তুমি আমার কাছে।

বললাম, আমি আপনার সুটকেশটা দেখব।

-কেন বাবা! গরিব বামুনের বিধবার বাসকো আর কী দেখবে বাবা?

কিছুতেই দেখাবেন না।

বললাম, খুলুন, খুলতেই বা আপত্তি করছেন কেন?

ইতিমধ্যে আমাদের জমাদার কাসেম এসে উপস্থিত। সে একেবারেই হতবাক। বুঝলাম, ভদ্রমহিলাকে দেখে, আমাকেই সে সন্দেহ করছে।

উনি তখনও বলছিলেন, বাসকোয় কী থাকতে পারে? বড় মেয়ে পোয়াতী, তাকে দেখতে যাচ্ছি। ছোট মেয়ে বাসকো সাজিয়ে দিয়েছে। দেখবার কী আছে?

এবার আমার হয়ে কাসেম তার বাজখাই গলায় হুকুম দিল, বুড়ি বাজে বকে মরবে, না খুলবে? খোলো জলদি জলদি।

সুটকেশ খোলা হল। দেখলাম, ভদ্রমহিলার গায়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল একটি পরিচ্ছন্ন থান কাপড়ের ওপর রুদ্রাক্ষের বড় একগুচ্ছ মালা। তার নীচে আর একটি পুরনো গরদের থান। তার নীচে, চারটি চোলাই মদ ভরা বোতল।

মলিন! তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, সেই মুহূর্তে আমি আমারই পরাজয় কামনা করছিলাম। তাতে আমার অহঙ্কার কমত কি না জানিনে, মলিনা সান্যালের স্বামী সুখী হত।

আমি আশা করলাম, ভদ্রমহিলাকে কেউ তখুনি জামিনে খালাস করতে আসবে। কিন্তু, এখন রাত অনেক, এখনও পর্যন্ত কেউ আসেনি। আমি ওঁকে হাজতেই রেখে দিয়েছি।

নাম হেমাঙ্গিনী দেবী। এই অঞ্চলেই বাড়ি। ইনি নিজের মনেই কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, এক মুঠো চাল নেই, এক ফোঁটা কেরোসিন তেল নেই ঘরে। উপোস করে আমার সোমত্ত মেয়েটা আঁধারে ভয়ে ভয়ে রাত কাটাবে।

তারপরে বললেন, যাক! আমাকে বাসকো থেকে ওই রুদ্রাক্ষের মালাটি দাও বাবা, বসে একটু জপ করি।

মলিন, শুনে তুমি রাগ করবে, আমি মালাখানি দিইনি। অবিকল ওইভাবেই ওটা আমি কোর্টে প্রডিউস করতে চাই। তুমি নিশ্চয় বিদ্রূপ করে হাসছ আর এই বৃদ্ধার ভবিষ্যৎ বিচারের কথা ভেবে, আমাকেই ধিক্কার দিচ্ছ। কিন্তু কী করব, আমি এইটাই পারি।

তবু, এমন আসামি আমি আর পাইনি। কারণ এই বৃদ্ধা ছদ্মবেশিনী নন। সেই জন্যে আমি আমার এই নতুন অঞ্চলটার দিকে অবাক আর বোবা হয়ে তাকিয়ে আছি। এ আবার কেমন দেশ?

যাকগে এ-সব কথা। প্রথম কেস ধরার কাহিনী শোনালাম তোমাকে। আরও শোনাব, একটা দারুণ প্রেমের গল্প, অবশ্যই সেটা এখনও সুরেশবাবুর ভাষ্য। কিন্তু সাক্ষাতে শোনাব।

জানো তো, সরকারি চাকুরিতে ঝড়-জল বলে কোনও কথা নেই। ঠিক সময়ে হাজিরা দিতে হবেই হবে। অতএব পত্রপাঠ জানাও, কবে রওনা হচ্ছ, স্টেশনে হুজুরে হাজির থাকব। অন্যথায় ভিতরদুয়ারের অফিস লণ্ডভণ্ড!

বড়দের প্রণাম, ছোটদের স্নেহ জানাই। সঙ্গে তোমাকেও। ইতি–বলাই।

চিঠি দেবার পাঁচ দিন পরেই মলিনার জবাব এল। বলাইয়ের বাবার চিঠিও এল এক দিনেই। মলিনা আসছে তিন দিন পরেই, কলকাতায় আগত একটি পরিচিত পরিবারের সঙ্গে। বলাই যেন উপস্থিত থাকে স্টেশনে।

যথা দিনে ও যথা সময়ে মলিনাকে শিয়ালদা থেকে নিয়ে এল বলাই। তারপর হাওড়া। হাওড়া থেকে হুগলির ব্রাঞ্চ লাইন।

পথে জিজ্ঞেস করছিল মলিনা, সে ভদ্রমহিলার কী হল?

বলাই জবাব দিয়েছিল, জামিন পেয়েছেন। কেস চলবে।

মলিনা আবার জিজ্ঞেস করেছিল, সুটকেশটা কোর্টে প্রডিউস করতে চেয়েছ কেন।

বলাই দেখছিল, যা ভেবেছিল তাই, মলিনার ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের হাসি। বলাই সবে বলতে যাচ্ছিল যাতে–

মলিনা যেন মুখিয়ে ছিল। বলে উঠল, যাতে বিচারক অনুভব করেন, কী নিদারুণ অভাব ও দারিদ্র এ অঞ্চলের ভদ্র পরিবারগুলিকে ধ্বংস করছে, না?

-হ্যাঁ।

–আর সমাজের গভীর স্তরে পাপ আজ প্রবেশ করেছে, সেটাও বোঝা যাবে আসামিকে দেখে, কী বলো?

–হ্যাঁ।

–আর বিচারক শুধু সাজার খাতায় সই করে দেবেন।

বলে খিল খিল করে হেসে উঠেছিল মলিনা।

বলাই বলেছিল, আসতে না আসতেই ঝগড়া শুরু করে দিলে?

মলিনা বলেছিল, ঝগড়া আবার কোথায় করলাম? তোমার কথা শুনে হাসলাম।

হাসবার কী আছে?

–তোমার সদিচ্ছা দেখে।

 বলাই চুপ করেছিল। মলিনা যে-নামে স্বামীকে আদর করে ডাকে, সেই নামে ডেকে বলেছিল, রাগ করলে বলাইবাবু?

রাগ করেনি, কিন্তু মন ভার হয়েছিল বইকী। বলেছিল, না।

 মলিনা বলেছিল, তোমাকে কিন্তু কিছু বলিনি।

বলাই বলেছিল, জানি।

তারপর মলিনাও ঠিক বলাইয়ের মতোই আবগারির ভুতুড়ে গর্ভে এসে প্রথম অন্ধকারে ঢুকেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *