বর্বর যুগ
(ক) নিম্নস্তর—মৃন্ময়পাত্র প্রবর্তনের সঙ্গে সংগে এই স্তরের সূচনা। আগুনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রায়ই ঝুড়ি বা কাঠের পাত্রের গায়ে কাদা লেপা হতো। [প্রথম মৃন্ময়পাত্র এইভাবেই তৈরি হয়। নানাক্ষেত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এই প্রক্রিয়া যে সম্ভবও তাতে সন্দেহ করার বিশেষ কোন কারণ দেখা যায় না।] মোটের উপর, এইভাবে মানুষ আবিষ্কার করে যে, ভেতরে কোন পাত্র না থাকলেও মাটির ছাঁচেই বেশ কাজ চলে যায়।
এতক্ষণ আমরা ক্রমবিকাশের যে সাধারণ গতি ও ধারা নিয়ে আলোচনা করলাম, নির্দিষ্ট কোন যুগে, দেশ বা স্থান নির্বিশেষে এই গতি ও ধারা সমস্ত জাতির উপরেই প্রয়োগ করা চলে। বর্বর যুগের প্রারম্ভেই আমরা এমন একটা স্তরে পৌঁছি, যেখানে [পৃথিবীর] দুইটি মহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর পার্থক্য রীতিমত প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করে। পশুপালন, জনন এবং চাষ-আবাদ বর্বর যুগের প্রধান বিশেষত্ব। এই সময় পূর্ব-মহাদেশ, তথাকথিত প্রাচীন-জগত পালনের যোগ্য প্রায় সকলপ্রকার জীব-জানোয়ারের অধিকারী। এখানে কেবলমাত্র একটি ছাড়া সকল প্রকার খাদ্য-শস্যও জন্মায়। পাশ্চাত্য মহাদেশ—আমেরিকার লামা ছাড়া পালনের যোগ্য কোনো স্তন্যপায়ী পশু ছিল না। আর এই লামা প্রাণীরও অস্তিত্ব ছিল দক্ষিণ-আমেরিকার মাত্র একটি অঞ্চলে। চাষ-আবাদের যোগ্য খাদ্যশস্যগুলোর মধ্যে আমেরিকায় মাত্র একটি খাদ্যশস্যের অস্তিত্ব ছিল। এর নাম ভুট্টা। তবে এই শস্যটা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। প্রাকৃতিক অবস্থার এই সমস্ত রকমফেরে জন্য প্রত্যেক গোলার্ধের লোকজন সে থেকে চলে আপন-আপন পথে। ফলে, মহাদেশ দুটিতে বিভিন্ন স্তরে নানা প্রকার পার্থক্যের সৃষ্টি হয়।
(খ) মধ্যস্তর—পূর্ব-গোলার্ধে পশুপালন থেকে এই স্তর আরম্ভ হয়। পশ্চিম-গোলার্ধে পয়ঃপ্রণালীর সাহায্যে খাদ্য-শস্যের চাষ-আবাদ আর রোদে শুকানো ইট ও পাথর দিয়ে বাড়ি তৈরীর সঙ্গে এই স্তরের সূচনা।
পশ্চিম-গোলার্ধ নিয়েই এখন আলোচনা শুরু করা যাক। কারণ এখানে ইউরোপিয়ানদের অধিকার আরম্ভ হওয়ার পূর্বে এই স্তরটি মোটেই পরবর্তী স্তরটির দ্বারা স্থানচ্যুত হওয়ার অবকাশ পায় নি।
ইণ্ডিয়ানরা যখন আবিষ্কৃত হয়, তখন বর্বরযুগের নীচের ধাপের (মিসিসিপি নদীর পূর্বদিকের সমস্ত উপজাতি) ইণ্ডিয়ানরা ইতিপূর্বেই বাগানে ভুট্টার আবাদ আর সম্ভবত কুমড়া, শশা, খরমুজ প্রভৃতির আবাদেও অভ্যস্ত ছিল। এই সমস্ত ও ভুট্টা থেকে তাদের খোরাকের অধিকাংশ সংগৃহীতও হয়। বেড়া-দিয়ে-ঘেরা কাঠের বাড়িযুক্ত গ্রামে তারা বাস করে। উত্তর-পশ্চিমের, বিশেষত, কলম্বিয়া নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ইণ্ডিয়ানরা তখনও অ-সভ্যযুগের উচ্চ স্তরে। মাটির বাসন বা চাষ-আবাদ তাদের নিকট একেবারে অজ্ঞাত বস্তু। অপরদিকে, [ইউরোপিয়ানদের দ্বারা] অধিকৃত হবার সময় নিউ-মেক্সিকোর তথাকথিত পুয়েব্লো ইণ্ডিয়ান, মেক্সিকোবাসী, মধ্য-আমেরিকারবাসী ও পেরুবাসী ইণ্ডিয়ানরা ছিল বর্বরযুগের মধ্য স্তরে। এরা রোদে পোড়া ইট ও পাথরের তৈরী দুর্গসদৃশ বাড়িতে বাস করতো। স্থান ও আবহাওয়ার ব্যতিক্রম অনুসারে ভুট্টা ও আরও পাঁচটা গাছপালার চাষ-আবাদ জানত; কৃত্রিম জলসেচ দ্বারা এরা বিভিন্ন বাগানে বিভিন্ন অঞ্চল ও জলবায়ু অনুযায়ী এইসব চাষ-আবাদ করে; এইগুলোই ছিল তাদের প্রধান আহার্য। এরা সামান্য কিছুকিছু পশুপালনও করে। মেক্সিকোবাসীরা টার্কী ও অন্যান্য পাখী আর পেরুবাসীরা লামা পালনে অভ্যস্ত ছিল। ধাতুর ব্যবহারও তারা জানতো, তবে লোহা এদের কাছে ছিল অজ্ঞাত; সে জন্য পাথরের অস্ত্র ও হাল-হাতিয়ার ব্যবহার ত্যাগ করতে তারা সক্ষম হয় নাই। ঠিক এমনি সময়ে, স্পেনীয়েরা তাদের স্বাধীন ক্রমবিকাশের পথ চিরদিনের জন্য রুদ্ধ করে দেয়।
পূর্ব-গোলার্ধে দুধ ও মাংস-সরবরাহকারী পশু পালনের সঙ্গে সঙ্গে বর্বর যুগের মধ্যস্তর আরম্ভ হয়। কিন্তু এই যুগের শেষাশেষি চাষ-আবাদের সূচনা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় না। পশুপালন, পশু-জনন এবং বড় বড় পশুপালন সংগঠন আর্য ও সেমিটিক (semites) এবং অপরাপর বর্বরদের মধ্যে ভেদ্রেখা টেনে দেয়। ইউরোপীয় ও অসিয়াবাসী আর্যগণ গরুর একই রকমের নাম ব্যবহার করলেও চাষ-আবাদের অধিকাংশ শস্যের নামের মিল কদাচিৎ পাওয়া যায়।
সুযোগ-সুবিধামত কতকগুলি স্থানে পশুপালন সংগঠন পল্লি-জীবনে পরিণতি লাভ করে। ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিসের তীরবর্তী তৃণ-পূর্ণ সমতলভূমিতে সেমিটিকগণ এবং ভারতবর্ষ ও আল্পস ও জাক্সার্টেস (Jaxartes), তথা ডন, নীপার তীরবর্তী তৃণপূর্ণ সমতল ক্ষেত্রগুলির আর্যগণ পল্লি-জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। এইরূপ পশুচারণ-যোগ্য ভূমিসমূহের, সীমান্ত দেশেই সর্বপ্রথম পশুপালনের রেওয়াজ আরম্ভ হয়ে থাকে। কাজের পরবর্তী যুগগুলির লোকজনদের মনে এই ধারণা জন্মে যে, পশুপালক (pastoral) উপজাতিগুলো এমন-সব অঞ্চল থেকে এসেছে, যেগুলো মানবজাতির প্রসূতিগৃহ হওয়া দূরে থাকে, ঐসব উপজাতির অ-সভ্য পূর্বপুরুষ, এমন-কি সেইযুগের নিম্নস্তরের লোকজনদের কাছেও বাসের অযোগ্য বিবেচিত হয়েছে। আর নদীতীরবর্তী তৃণপূর্ণ সমতলভূমিতে পল্লিজীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার পর মধ্যযুগের এই সব বর্বরদের পক্ষে স্বেচ্ছায় আবার তাদের পূর্বপুরুষদের বনজঙ্গলে ফিরে যাওয়ার সম্ভবনার চিন্তা করাও কঠিন হয়ে উঠে। উত্তর ও পশ্চিমে সরে যাওয়ার প্রয়োজন উপস্থিত হওয়ার সময়ও সেমিটিক ও আর্যগণ পশ্চিম-এশিয়া ও ইউরোপের জঙ্গল সমাকীর্ণ অঞ্চলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেনি। খাদ্যশস্যের চাষবাস দ্বারা এই সব অসুবিধাজনক অঞ্চলে গৃহপালিত পশুগুলির আহার্য সরবরাহ এবং শীতকালেও উহাদের পালনের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তাদের পশ্চিম-এশিয়া ও ইউরোপে বসবাস সম্ভব হয়নি। যতদূর সম্ভব, পশু-খাদ্যের জন্যই এই সব উপজাতির লোকেরা খাদ্য-শস্যের চাষ-আআব্দ করে এবং পরে ঐসব ভোজ্যদ্রব্য মানুষের পুষ্টিসাধনে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে।
দুধ ও মাংসের প্রচুর সরবরাহ, বিশেষত, শিশুদের পুষ্টিবিধানে এই দু’’রকম খাদ্যদ্রব্যের অনুকূল প্রভাবের ফলেই আর্য ও সেমিটিক জাতিগুলো অন্যান্য জাতির তুলনায় উন্নততর মূল্য জাতি (Race) রূপে গণ্য হয়। বস্তুত নিউ-মেক্সিকোর পুয়েব্লো ইণ্ডিয়ানদের সম্পূর্ণরূপে নিরামিষভোজী বললেই চলে; সেই জন্য অধিকতর পরিমাণে মাছ-মাংস-ভোজী, বর্বরযুগের নিম্নস্তরে অবস্থিত ইণ্ডিয়ানদের তুলনায় পুয়েব্লো ইণ্ডিয়ানদের মগজটা আকারে অনেক ছোট দেখা যায়। যাই হোক, এই স্তরে নরমাংসভোজন-প্রথা ক্রমে একরূপ লোপ পেয়ে যায়। স্থানে স্থানে ধর্মকর্ম ও যাদুবিদ্যার জন্য নরমাংসভোজন-প্রথা কোনরকমে টিকে থাকে। ধর্ম-কর্ম আর যাদুবিদ্যা একই ধরনের চিজই বটে।
(গ) উচ্চস্তর—লৌহ-পিণ্ড ঢালাই করার সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরের উৎপত্তি; বর্ণমালার সাহায্যে লিখনপদ্ধতি আবিষ্কার আর সাহিত্যিক আলোচনা গবেষণাগুলির রেকর্ড রাখা সম্পর্কে বর্ণমালার প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে এই স্তর ক্রমশ সভ্যতায় পরিণতি লাভ করে। পূর্বেই বলা হয়েছে এই স্তরটা একমাত্র পূর্বগোলার্ধেই স্বাধীনভাবে ক্রমবিকাশ লাভের অবসর পায়; আর এর বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী স্তরগুলির সমবেত উৎপাদনের চেয়েও বেশি ধন-দৌলত এই স্তরটিতে উৎপন্ন হয়। পৌরাণিক যুগের (Heroci Age) গ্রীকগণ, রোমের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সামান্য-কিহচু পূর্বের ইতালীয় উপজাতিগণ, তাসিতুসের আমলের জার্মানগণ এবং জল-দস্যু যুগের (Viking Age) নরমানরা এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত।
সকলের উপর, এই স্তরে গো-মহিষ-পরিচালিত লোহার-ফলক-যুক্ত লাঙলের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এই লাঙলের কল্যানে জমিতে ব্যাপকভাবে চাষ-আবাদ সম্ভব হয়; ফলে, পূর্ববর্তী যে-কোন যুগের তুলনায় সীমাহীন আহার্য সরবরাহের সুযোগ উপস্থিত হয়। ক্রমে চাষের জমি ও চারন-ভূমির জন্য বন-জঙ্গল সাফ করা চলতে থাকে। লোহার কুড়ুল আর লোহার কোদাল ছাড়া যে বিস্তৃতভাবে বন-জঙ্গল সাফ করার সমস্যাটার আজও সমাধান হত না তা সহজেই অনুমেয়। সঙ্গে সঙ্গে লোকসংখ্যাও বেজায় বেড়ে যেতে আরম্ভ করে; ছোট ছোট অঞ্চলগুলো ঘন-লোক-বসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়। [মাঠে-ময়দানে] চাষ-আবাদের রেওয়াজ প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে পাঁচ-লাখ লোকেরও একত্র সমাবেশ অতি অনন্যসাধারণ ব্যাপাররূপে গণ্য হয়। যতদূরসম্ভব, এইরূপ লোক-সমাবেশ আদৌ ঘটে উঠেনি।
হোমারের কাব্য-সাহিত্যে, বিশেষত, ইলিয়াদ গ্রন্থে আমরা বর্বরযুগের উচ্চস্তর চরম সীমায় দেখতে পাই। পূর্ণবিকাশপ্রাপ্ত লোহার হাল-হাতিয়ার, কামারের জাঁতা, হাতে-চালানো মিল (hand-mill), কুম্ভকারের চাক, তেল ও মদ প্রস্তুতকরণ, সুকুমার-শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত ধাতুর কাজ, শকট ও যুদ্ধের রথ, কাঠের কড়ি ও তক্তার সাহায্যে জাহাজ প্রস্তুতকরন, কলা-বিদ্যা হিসাবে স্থাপত্য-শিল্পের প্রবর্তন, দুর্গচূড়া ও ফুকারযুক্ত দুর্গ-প্রাচীর সহ প্রাচীর-ঘেরা শহর, হোমারের মহাকাব্য ও পুরোপুরি পুরাবৃত্ত—গ্রীকগণ এই সমস্ত অমূল্য সম্পদ উত্তরাধিকার হিসাবে বর্বরযুগের আমল থেকে সভ্যতার যুগে আনয়ন করে। হোমার-যুগের গ্রীকগণ যখন কৃষ্টিস্তর (cultural stage) থেকে অগ্রগতির পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হয়, জার্মানরা তখন কৃষ্টি-স্তরের ঠিক গোড়াতেই দাঁড়িয়ে। সিজার এবং এমন-কি, তাসিতুস এই জার্মানদের সম্বন্ধে যে-সব বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন তার তুলনামূলক বিচার করে আমরা দেখতে পাই, বর্বরযুগের উচ্চ স্তরে ধন-সম্পদ উৎপাদন কী অদ্ভুত প্রগতিই না লাভ করে।
মর্গ্যানকে অনুসরণ করে মানবজাতির অ-সভ্য অবস্থা ও বর্বরযুগ থেকে সভ্যতার প্রারম্ভ পর্যন্ত ক্রমবিকাশের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেওয়া গেল, তা নিশ্চয়ই নতুন ও অকাট্য বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধি-সম্পন্ন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অনুসরণ করে প্রত্যক্ষভাবে এই সব তত্ত্ব স্থিত করা হয়; কাজেই এগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। তবুও আমাদের আলোচনার শেষ ভাগে যে আলেখ্য উন্মোচন করা হয়, তার তুলনায় এই বিবরণী নিতান্ত আটপৌরে ও সাদাসিধেই বিবেচিত হবে। তখনই বর্বর অবস্থা থেকে সভ্যতার ক্রমিক পরিবর্তনের ছবিটা সম্পূর্ণরূপে নিখুঁত অবস্থায় দেখা যাবে, আর বর্বর অবস্থা ও সভ্যতার পার্থক্যটাও ঝলমল হয়ে ফুটে উঠবে। আপাতত মর্গ্যানের শ্রেণী-বিন্যাসটা নিম্নলিখিতভাবে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা যাক : অ-সভ্য যুগ—এই আদি যুগে মানুষ প্রধানত প্রাকৃতিক অবস্থায় অবস্থিত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আহরণ করে; আর এই সমস্ত প্রাকৃতিক দ্রব্য আহরণের সহায়ক হাল-হাতিয়ারই মানুষের প্রধান কলা-সম্পদে পরিণত। বর্বর যুগ—এই যুগে মানুষ গৃহ-পালিত জীব-জানোয়ার পালন আর কৃষিকার্য শিক্ষা করে এবং মানবীয় শক্তির সাহায্যে প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়াগুলো আয়ত্ত করে। সভ্যতা—এই যুগে মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর বৃদ্ধির জন্য আরও বেশি উন্নততর কার্যপ্রণালী প্রয়োগ করতে শিক্ষা করে ও শিল্প ও কলাবিদ্যায় (art) জ্ঞান অর্জন করে।
Arr kotai porota chai Please , ASAP