১.২ প্রথম রক্তপাত

০২. প্রথম রক্তপাত

বাবর ঘোড়ার পিঠে বসে, ওয়াজির খানের মনোনীত আটজন প্রহরীকে কাঁধে করে ধূসর-সবুজ জেড পাথরের শবাধারে তার বাবার মরদেহ বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। ভারী পাথরের কাঠিন্যের জন্য তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ভেড়ার চামড়ার পুরু আস্তর দেয়া থাকলেও শবাধারটা অসম্ভব ভারী। তাদের বাতাসে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করা মুখ ঘামে ভিজে আছে এবং একজন হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলেই কাঁধ থেকে শবাধারটা ফেলে দিতো। উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস টানে শবাধারটা যদি মাটিতে আছড়ে পড়ে তবে সেটা একটা অশনিসঙ্কেত হিসাবে বিবেচিত হবে। বাবরের পাকস্থলীর কাছটা টানটান হয়ে যায় কিন্তু কামবার আলীর কচ্ছপের মতো মুখ নির্বিকার থাকে।

“হুঁশিয়ার, তোমরা আমাদের সুলতানকে বহন করছে।” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বরের তীব্রতায় প্রহরীটা নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কাঁধে শবাধারের ভার নেয় এবং শবাধারবাহীরা স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সমাধিকক্ষের দিকে ঢালু দরদালান বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে।

বাবরের পিতা মৃত্যুর অনেককাল আগেই নিজের সমাধিসৌধের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাবর যখন তার বিশাল-স্তনের দাইয়ের কোলে নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশু, সুলতান তখন ফারগানা আর ফারগানার বাইরে থেকে রাজমিস্ত্রী এবং অন্যান্য কারিগরদের ডেকে আনেন। তার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়নে আকশি দূর্গের দেড় মাইল পশ্চিমে জাক্সারটেস নদীর তীরে কারিগরের দল সমরকন্দে মহান তৈমূরের শেষ বিশ্রামস্থলের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ নির্মাণ করে। এখন ডিম্বাকৃতি গম্বুজের নীলাভ সবুজ টালির সাথে উজ্জ্বল বর্ণের রূপালি নীল টালির বিন্যাস জুন মাসের তীব্র সূর্যালোকে চোখ ধাধিয়ে দেয়। বাবর ভাবে, বাবা এসব দেখলে গর্ববোধ করতো এবং ভাবনাটা তার উত্তেজিত মুখমণ্ডলে আবছা একটা হাসির অভিব্যক্তির জন্ম দেয়।

 তার চোখের দৃশ্যপট থেকে শবাধারটা আড়াল হতেই, উপস্থিত জনগণের মাঝে বিলাপের ক্রন্দন ধ্বনি গমগম করে উঠে- যাদের ভেতরে রেশমের আলখাল্লা পরিহিত গোত্রপতি আর অভিজাতদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মামুলি পশুপালকও, যাদের গায়ে তাদের পালিত পশুর গন্ধ। পার্থিব জীবনের পরিস্থিতি যাই হোক, সব মানুষই তাদের পরণের আলখাল্লা টেনে ছিঁড়ে এবং মাথার পাগড়িতে কবরের মাটি ছিটায় যার রেওয়াজ চেঙ্গিস খানের অনেক আগে থেকে চলে আসছে। তাদের মনে তখন কি ভাবনা খেলা করছিলো? এখানে কতজন তারমতো শোকগ্রস্ত? বাবর ভাবে। এসান দৌলতের চিঠির কারণে গোত্রপতিরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে বটে, কিন্তু সময় যখন হবে সে তাদের কতজনের উপরে নির্ভর করতে পারবে?

 “যাদের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই এমন লোকদের থেকে সাবধান ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তার বাবা সবসময়ে তাকে এই উপদেশটা দিয়েছে। বাবর একবার ওয়াজির খানের দিকে আড়চোখে না তাকিয়ে পারে না, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেই লজ্জিত হয়। বাবা মারা যাবার পরে, আর নানীজান ছাড়া, লম্বা ঋজু-পৃষ্টদেশের এই সৈনিককেই পৃথিবীতে সে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক বলে জেনে এসেছে। কিন্তু ওখানে মুখে গুটিবসন্তের দাগভর্তি ধূসর দাড়িঅলা গোত্রপতি, পাহাড়ের সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে রাতের আঁধারে বেরিয়ে এতো দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে এসেছে যে তার গায়ের আলখাল্লা নিজের আর ঘোড়ার ঘামে মাখামাখি অবস্থা, তার কি মনোভাব? অথবা ঐ গাজরের মতো উঁচু-দাঁতঅলা, মোঙ্গলদের প্রাচীন রীতি অনুসারে যার মাথা পুরোটা কামান, যাকে তার মরহুম পিতা ষড়যন্ত্র, কপটতা আর লোভের কারণে একবার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সম্প্রতিই ফিরে আসবার। অনুমতি দিয়েছিলেন, সে কি ভাবছে? এসান দৌলতকে আমন্ত্রণপত্র পাঠাবার সময়ে এসব ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আশা করেছে যে কেবল মিত্রদেরই সে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু বাবর তার অল্প বয়সে একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানে, এদের ভিতরে অনেকেই অনায়াসে পিঠ দেখাতে পারে।

 কিন্তু এখন সেসবের সময় না। তার প্রথম কাজ এখন আব্বাজানকে সমাধিস্থ করা। ওয়াজির খান মাথা নত করে বাবরের ঘোড়ার অলঙ্কারখচিত মাথার সাজ শক্ত করে ধরতে সে ঘোড়া থেকে নামে। চোখের কোণের অশ্রু মুছে সে গভীর একটা শ্বাস নেয় এবং তার বাবার প্রিয় মোল্লা আর শোকার্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমাধিগর্ভে শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। এক মুহূর্তের জন্য সে তার মায়ের কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করতে লালায়িত হয়ে। উঠে। কিন্তু খুতলাঘ নিগার, তার বোন আর নানীজানের সাথে শাহী হারেমে অপেক্ষা করছেন, যা বিধিসম্মত। এসব অনুষ্ঠানে মেয়েদের উপস্থিত থাকবার রেওয়াজ নেই। সুলতানের মৃতদেহ নিয়ে অনুগমনকারী অনুচরবর্গ দূর্গ থেকে বের হয়ে চপল ছন্দে বহমান জাক্সারটাসের তীরের দিকে রওয়ানা হবার সময়ে তারা দেয়াল থেকে ঝুলতে থাকা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিরবে শেষ বিদায় জানিয়েছেন। সমাধিসৌধের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রবেশপথের দিকে বাবর এগিয়ে যেতে সে দেখে যে, কামবার আলী তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে, প্রথমে প্রবেশ করার বাসনায়। পরণের খয়েরী আলখাল্লা তার দেহের চারপাশে নিশানের মত উড়ছে। “উজির!” বাবরের কিশোর কণ্ঠ কঠোর শোনায়। মানানসই একটা কণ্ঠস্বর। থমকে থেমে পাশে সরে দাঁড়াবার সময়ে কামবার আলীর মুখে বিরক্তির সামান্য রেশ ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়।

“আমার বাবার শবানুযাত্রীদের নেতৃত্ব আমি দেব। সেটাই বাঞ্ছনীয়।” বাবর তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার সময়ে উজিরের পায়ের নরম চামড়ার নাগরা ভালো করে মাড়িয়ে দেয়। বেশ তৃপ্তিকর একটা অনুভূতি।

“অবশ্যই, শাহজাদা।”

বাবর যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক মোল্লাকে তার সাথে আসতে বলে। কামবার আলী দীর্ঘ অন্ধকার গলিপথে তাদের অনুসরণ করে। রাজদরবারের অন্য সদস্যরা, তাদের পদমর্যাদা অনুসারে বাবরের অনুবর্তী হয়। ইউসুফ, রাজকোষের কোষাধ্যক্ষ হবার। কারণে, মরহুম সুলতানের শবাধারের পাদদেশে রাখার জন্য একটা পাত্রে চকচক করতে থাকা সোনার আশরফি বহন করে আনে। বাবা কাশক, শাহী বাজারসরকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে লাল চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা খেরোখাতা বয়ে নিয়ে আসে। যেখানে মরহুম সুলতানের জীবদ্দশায় কৃত সমস্ত শাহী খরচের হিসাব লিপিবদ্ধ রয়েছে। খেরো খাতাটাও তার শবাধারে দেয়া হবে, যার মানে। সুলতান পরলোকে গমন করেছেন তার সমস্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন শেষ করে। বাকি বেগের হাতে শাহী জ্যোতিষবিদ হিসাবে একটা স্ফটিকের গোলক দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পরে, এই চকচকে গোলকের। গভীরতায় দৃষ্টিপাত করে, বিষাদ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে সে ঘোষণা করবে যে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে সুলতান হিসাবে বরণ করে নিতে তারকারাজির সম্মতি নেই। অমাত্যগণ ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষের সাতসেঁতে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে অন্যেরা ঢালু গলিপথে ঠাসাঠাসি করে। অভ্যন্তরের ভারী বাতাসে মানুষের ঘামের গন্ধ ভুরভুর করে। ভীড়ের চাপে বাবরের দু’হাত নাড়াবার জায়গা থাকে না। মোল্লা মৃদুকণ্ঠে মোনাজাত শুরু করে। কিন্তু শীঘ্রই তার কণ্ঠস্বর তীব্রতা লাভ করে সমাধিকক্ষের অভ্যন্তরে ভাসতে থাকলে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বাবরের মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। সে একটা বদ্ধস্থানে অবস্থান করছে। কোনো শত্রু যদি এখন হামলা করতে মনস্থ করে? সে তার মানসপটে নিজের দ্বিখণ্ডিত গলা থেকে রক্ত ছিটকে জেড পাথরের শবাধারের নার্গিস আর টিউলিপের জটিল অলঙ্করণে পড়তে দেখে। সে নিজেকে প্রাণপণে চিৎকার করতে শোনে, কিন্তু গলগল করে বের হতে থাকা রক্তে শ্বাসরুদ্ধ একটা ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসে।

 মূর্চ্ছাপ্রবণতা আর বিবমিষা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাবর চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিতে চায়। অল্পবয়সের অনভিজ্ঞতা আর এখনও অজাতশত্রু হওয়া সত্ত্বেও, তাকে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষের ভূমিকা পালন করতে হবে। ফারগানার মসনদ তার হবে যদি সে আগামী কয়েক ঘণ্টা, সাহসিকতার সাথে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। তৈমূরের রক্ত তোমার ধমনীতে বহমান। সে তার বাবার প্রায়শই অসীম গর্বের সাথে উচ্চারিত বাক্যটা নিরবে মনে মনে আউড়ায়। শব্দগুলো তার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকলে বহু বহুকাল পূর্বে সংঘটিত মহান গৌরবময় যুদ্ধের আর অনাগত অভিযানের ছবি তার মানসপটে ভেসে উঠে। স্থিরসংকল্পে জারিত মন তার রক্ত শাণিত করে তোলে- এর সাথে যুক্ত হয় কিছু মানুষ তার যুক্তিসঙ্গত দাবি আগ্রাহ্য করতে চায়, সেই ক্রোধ।

অন্তেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রা নিয়ে রওয়ানা হবার ঠিক আগমুহূর্তে খুতলাঘ নিগার বাবরের আলখাল্লার বেগুনী রঙের পরিকরে যে রত্নখচিত বাঁটযুক্ত খঞ্জরটা খুঁজে দিয়েছে সেটার ভার অনুভব করে এবং সেটার বাঁটে আঙ্গুল চেপে বসতে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে সে চারপাশে তাকায়। ওয়াজির খানের লোকেরা সমাধি গর্ভে উপস্থিত আছে। তারা নিশ্চয়ই আততায়ীর হাতে তাদের শাহজাদার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। নাকি তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? প্রহরীদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তাদের কারো সম্বন্ধেই তার কোনো ধারণা নেই। মাত্র গতকালও পরিবারের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টা তার কাছে ছিলো প্রশ্নাতীত। কিন্তু আজ পুরো বিষয়টাই পাল্টে গিয়েছে। তার আঙ্গুল খঞ্জরের বাঁট আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।

সে জোর করে তার মনোযোগ আবার মোল্লার উপরে নিবদ্ধ করে। যিনি তার গভীর, সুরেলা কণ্ঠে তেলাওয়াত করছেন: “আল্লাহ পরম করুণাময়। আমাদের সুলতান উমর-শেখের আত্মা যেন বেহেশতের উদ্যানে এখন অধিষ্ঠিত থাকে। আমরা যারা তার পেছনে রয়ে গিয়েছি তাদের বিষণ্ণতা যেন মুক্তোবিন্দু হয়ে ঝরে এবং আমরা যেন এটা ভেবে উল্লসিত বোধকরি যে আমাদের সুলতান এখন পরম প্রশান্তির বারিধারা পান করছেন।” সে মোনাজাত শেষ করে এবং হাত ভাঁজ করে নিয়ে শবাধার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঢালু করিডোর দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলে, দর্শনার্থীরা বহুকষ্টে দু’পাশে ভাগ হয়ে গিয়ে তাকে বাইরে যাবার পথ করে দেয়।

বাবর এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে এবং তার প্রিয় আব্বাজানকে নিরবে বিদায় জানায়। তারপরে কোনোমতে অশ্রু চেপে রেখে সে মোল্লাকে অনুসরণ করে চোখ পিটপিট করতে করতে সূর্যালোকে বের হয়ে আসে। বাম কান ঘেষে উড়ন্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ তাকে চমকে দিতে সে লাফিয়ে পেছনে সরে আসে। বাজপাখি দিয়ে কেউ এই অসময়ে শিকার করছে? সে চারপাশে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে চায় ফারগানার সুলতানকে তার সমাধিসৌধে অন্তিম শয়ানে শায়িত করার সময়ে বাজপাখি উড়ায়, কার এতবড় স্পর্ধা। বাঁকানো ঠোঁটে শিকারের খুবলে নেয়া অংশ এবং পায়ের নখে রেশমের বেণী করা ফিতে ঝোলানো, উজ্জ্বল চোখ আর গলায় অলঙ্কৃত কলারের কোনো পাখি সে দেখতে পায় না। তার বদলে নীল কালো পালকশোভিত, লম্বা শরযষ্টির একটা তীর বাবরের পায়ের কাছে মাটিতে গাঁথা অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। আর কয়েক ইঞ্চি তাহলেই তীরটা তার দেহে বিদ্ধ হতো।

উপস্থিত লোকজনের ভিতরে আতঙ্কিত শোরগোল শুরু হয় এবং হুড়োহুড়ি করে ঝোপঝাড় আর গাছের পেছনে আশ্রয় নিতে ছুটোছুটি আরম্ভ করার আগে, সবাই বিভ্রান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকায় যেন বিকেলের আকাশ অন্ধকার করে এক পশলা তীর তাদের এখনই বিদ্ধ করবে। গোত্রপতিরা নিজ নিজ অনুচরকে ঘোড়া আনতে বলে, ধনুক আর তূণীরের দিকে হাত বাড়ায়। ভোজবাজির মত ওয়াজির খান কখন যেন বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের দৃশ্যপট জরিপ করছে। আশেপাশের বিরান সমভূমিতে লুকিয়ে থাকার জায়গা অল্পই আছে, কিন্তু একটা নিঃসঙ্গ পাথর বা বিচ্ছিন্ন ঝোঁপের পেছনে সহজেই একজন আততায়ী ধনুর্ধর লুকিয়ে থাকতে পারে যার হাতে রয়েছে। কসাইয়ের নিপূণতা আর অন্তরের হত্যার জীঘাংসা। ওয়াজির খান তার দাস্তানা পরা। হাত দিয়ে জোরাল একটা ইঙ্গিত করতেই অশ্বারোহী প্রহরীদের একটা দল সম্ভাব্য আততায়ীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।

 “শাহজাদা, এই মুহূর্তে আপনার প্রাসাদে ফিরে যাওয়া উচিত।”

বাবর তখনও সম্মোহিতের দৃষ্টিতে তীরটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। “দেখো,” সে ঝুঁকে মাটিতে গেঁথে থাকা তীরটা তুলে নিয়ে বলে, “পালকের চারপাশে কিছু একটা আটকানো রয়েছে।” সে মোটা লাল সূতার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে যা পার্চমেন্টের একটা টুকরো তীরের সাথে আটকে রেখেছিল এবং সেটাতে লেখা হুমকির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাতৃভাষা তুর্কীতেই চামড়ার ফালিতে লেখা রয়েছে কিন্তু অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে লাফাতে থাকার কারণে তার এক মুহূর্ত সময় লাগে লেখাটার অর্থ উপলব্ধি করতে।

ওয়াজির খান পার্চমেন্টটা তার হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং তাতে যা লেখা রয়েছে সেটা উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনায়: “পৃথিবীর অধিশ্বর পরাক্রমশালী সাইবানি খান তার শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। তিন চন্দ্রমাসের সময় অতিক্রান্ত হবার আগেই তিনি ফারগানা নামে পরিচিত খোয়াড়ের দখল বুঝে নিয়ে এর সিংহাসন মূতে ভাসিয়ে দেবেন।”

“বেজন্মা উজবেক,” অবজ্ঞার সাথে একজন সৈনিক চেঁচিয়ে উঠলেও, বাবর তার চোখে আশঙ্কার মেঘ জমা হতে দেখে।

 “এসবের অর্থ কি?” শাহী জ্যোতিষী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে ওয়াজির খানের হাত থেকে চামড়ার টুকরোটা ছিনিয়ে নেয়। বাকী বেগ হুমকিটা পড়ে এবং বাবর তাকে আঁতকে উঠে সশব্দে শ্বাস নিতে শুনে। ছোটখাট মানুষটা পায়ের ডিমের উপরে দাঁড়িয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে সামনে পেছনে দুলতে শুরু করে এবং তার কীচকী কণ্ঠ থেকে একটা বিলাপ উথলে উঠে: “সাইবানি খান আসছে, সেই এলাচি খুনী…আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি…সে একটা বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে যার খুরের দাপটে মানুষের খুলি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।” তার বিলাপ এবার চিল চিল্কারে পরিণত হয়: “সাইবানি খান আসছে! তার পেছনে ধেয়ে আসছে মৃত্যু আর মহামারী!”

কামবার আলীও ইতিমধ্যে বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পেছনেই আছে শাহী কোষাধ্যক্ষ আর বাজারসরকার। তারা তিনজনই মাথা নাড়তে থাকে। “অন্তেষ্টিক্রিয়ার ভোজ শেষ হবার পরে আজ রাতেই শাহী পরামর্শকের দল বৈঠকে বসবে। সাইবানি খান মিথ্যা হুমকি দেবার পাত্র না,” উজির বলেন। ইউসুফ আর বাবা কাশক প্রবল বেগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। তাদের সাথে এবার বাকী বেগও তাল মিলিয়েছে।

ওয়াজির খান সম্মতি প্রকাশের কোনো ধরণের অভিব্যক্তি করা থেকে বিরত থাকে। তার বদলে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কামবার আলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে উজির বেচারা অস্বস্তির ভিতরে পড়ে। “শ্রদ্ধেয় উজির, জনগণকে শান্ত করতে আপনি নিশ্চয়ই তাদের উপরে আপনার সন্দেহাতীত প্রভাব খাটাবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমার সৈন্যরা আপনার তত্ত্বাবধায়নে সদা প্রস্তুত থাকবে।”

“তোমার কথা যুক্তিসঙ্গত, ওয়াজির খান। আবারও তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।” কামবার আলী তার পাগড়ী পরিহিত মাথাটা কাত করে কথাটা বলে দ্রুত বিদায় নিলে অন্যান্য অমাত্যরা পঙ্গপালের মত তাকে অনুসরণ করে। বাবর শুনতে পায় বাকী বেগ তখনও আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে বিড়বিড় করছে, দমকা হাওয়ার মত বিরক্তি তাকে ঘিরে ধরে। সে একবার শুধু মসনদে অধিষ্ঠিত হোক, এই মেরুদণ্ডহীন ক্লিবটাকে দূর করে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী হিসাবে নিয়োগ করবে। তার বাবা কেন এই লোকটাকে এত খাতির করতেন সেটা তার কাছে একটা রহস্য- আসলেই এত জ্যোতিষী থাকতে এই অপদার্থটাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন। বাকী বেগের পরিবার হয়ত কখনও তার উপকার করেছিলো, যার প্রতিদান দেয়াকে তিনি নিজের কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।

আপাতত আক্রমণের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায়, শবানুগামীরা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়ে আসে। সাইবানি খানের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই, বাবর তাদের কাউকে এমন আর্তস্বরে বিলাপ করতে শোনে, যেন তাদের ভবিতব্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের অজান্তে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে দিগন্তের উপর দিয়ে মেঘের দল উড়ে এসে মাথার উপরে জড়ো হয়েছে। নিজের ঊর্ধ্বমুখী কপালে সে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করে।

“শাহজাদা।” ওয়াজির খান আবার তাকে ধরে ঝাঁকি দেয় এবার এত জোরে যে তার মনে হয় কাঁধের কাছ থেকে পুরো হাতটাই খুলে আসবে। কণ্ঠস্বরে জরুরি ভাব ফুটিয়ে সে ফিসফিস করে কথা বলে: “সাইবানি খানের হুমকি। তার পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব? পাহাড়ের অন্যপ্রান্তে এত দ্রুত সুলতানের মৃত্যুর খবর সে কিভাবে পেলো। আমার মনে হয় এটা ভেতরের কারো কাজ, সম্ভবত কামবার আলীর যোগসাজশে এটা ঘটান হয়েছে। সে সম্ভবত আপনাকে খুন করার পায়তারা করছে। নিদেনপক্ষে, সে মানুষের মনে একটা আতঙ্কের জন্ম দিতে চায়, যাতে একজন কিশোরকে সুলতান হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের ভিতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতে আমাদের পরিকল্পনার কোনো হেরফের হবে না। দূর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথে কোনো কারণে বা কারো জন্য ঘোড়ার গতি হ্রাস করবেন না। আমি যতদ্রুত পারি আপনাকে অনুসরণ করছি।”

ওয়াজির খানের উদ্বেগ বাবরের ভিতরেও সংক্রামিত হয়। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং দ্রুত পর্যাণে উপবিষ্ট হয়। এক মুহূর্তের জন্য ওয়াজির খান তার ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে। “শাহজাদা, আর কয়েক ঘণ্টা তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে,” সে বলে। তারপরে, দেহরক্ষী বাহিনীর একটা দলকে বাবরের সাথে যাবার নির্দেশ দিয়ে সে ঘোড়ার মসৃণ পশ্চাদ্ভাগে একটা চাপড় বসিয়ে দিতে ঘোড়ার খুরে ছন্দের বোল উঠে।

 বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে শুরু করলে এবং বাড়ন্ত ঘাসের ঝোঁপের মাঝ দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে যাবার সময়ে, বাবর কাঁধের উপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। সে কামবার আলীকে উত্তেজিত জনতার মাঝে দু’হাত উঁচু করে এগিয়ে যেতে দেখে। সে আসলে কি চায়? তাদের শান্ত করতে না উত্তেজনা আরো উসকে দিতে? তার সহজাত প্রবর্তনা বলছে ওয়াজির খানের বিশ্লেষণে কোনো ফাঁক নেই: যে দুরাত্মার হাত তীরটা ছুঁড়েছে সেটা কোনো উজবেকের হাত হতে পারে না।

বাবর তার ফারের মোটা ওভারটিউনিকের পকেটের গভীরে হাত দিয়ে তীরটা বের করে নিয়ে আসে। ঘোড়ার লাগাম দাঁতে কামড়ে ধরে সে তীরটা দ্বিখণ্ডিত করে এবং চরম অবজ্ঞার সাথে সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। দ্বিখণ্ডিত তীরটা মাটিতে পড়ে থাকা ভেড়ার লাদির উপরে গিয়ে পড়ে।

***

“বাছা, কেমন অভিজ্ঞতা হল।” খুতলাঘ নিগারের চেহারায় পরিশ্রান্তভাব, অবিরাম কান্নার কারণে চোখ রক্তজবার মত লাল। হারেমের অনেক ভেতর থেকে বাবর চাপাকান্না ভেসে আসার শব্দ শোনে। মৃত সুলতানের জন্য হারেমের সবাই শোকের কৃত্যানুষ্ঠান পালন করছে। বিষাদের এই রোলের ভিতরে অদ্ভুত একটা ঐক্যতান রয়েছে, যেন কোনো মহিলাই সাহস পায় না প্রথমে কান্না থামাবার।

 “সবকিছু নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে।” সে সিদ্ধান্ত নেয় আম্মাজানকে তীরের কথা বলবে না- অন্তত এখনই না। জীবনে এই প্রথম সে মায়ের কাছে কিছু গোপন করলো। কিন্তু তার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিলো এটা জানতে পারলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন।

“আর তোমার মরহুম আব্বাজান। তিনি শান্তিতে সমাহিত হয়েছেন?”

“হ্যাঁ, মা। আমরা সবাই তার জন্য মোনাজাত করেছি, তাকে যেন বেহেশত নসীব করা হয়।”

 “এবার তাহলে দুনিয়াদারির কাজের তদারকি শুরু করতে হয়।” খুতলাঘ নিগার হাতে তালি দিলে, তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফাতিমা ছায়ার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তার হাতে হলুদ রেশমের উপরে সোনা আর রূপার জরি দিয়ে ফুলের নক্সা তোলা একটা আলখাল্লা আর একই কাপড়ের একটা পাগড়ি যার উপরে একটা ময়ূরের পালক গোঁজা রয়েছে। খুতলাঘ নিগার বিম্র চিত্তে আলখাল্লাটা তার হাত থেকে নেয়। “এটা ফারগানার সুলতানদের মসনদে অভিষেকের আলখাল্লা। এর আমেজ অনুভব করো, এটা এখন তোমার।”

 বাবর হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা চকচকে আলখাল্লাটা স্পর্শ করে এবং গর্বের একটা শিরশিরে অনভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে যায়। সুলতানের আলখাল্লা- তার আলখাল্লা। রেশমের শীতল পরশ তার আঙ্গুলের ডগায় ছড়িয়ে পড়ে।

তার স্বপ্নবেশের চটকা ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত বোলে ভেঙে যায়। বাবর জানালা থেকে নিচের বৃষ্টিস্নাত আঙ্গিনার দিকে তাকায়। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে এবং রাত্রির প্রস্তুতি হিসাবে ইতিমধ্যে মশাল জ্বালান হয়েছে। সে ওয়াজির খান আর মোল্লাকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় দূর্গে প্রবেশ করতে দেখে। তাদের ঘোড়াগুলো ঘন ঘন নাক টানে আর তাদের গা থেকে ভাপ বের হয়। শীঘ্রই বাকি শবানুগামীরা দূর্গে ফিরে আসবে আর তারপরেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাহেন্দ্রক্ষণ যা তাকে এই আলখাল্লা পরিধানের অধিকার দান করবে। বাবর মুখ তুলে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার চোখে শঙ্কার ছায়া ফুটে থাকলেও অভিব্যক্তিতে দৃঢ়তার ছাপ। “জলদি করো,” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমাদের হাতে সময় বড় কম। আলখাল্লাটা তোমার বড় হবে কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে।” তিনি ফাতিমার সাহায্যে বাবরের গায়ে আলখাল্লাটা পরিয়ে পরিকর দিয়ে সেটা শক্ত করে কোমরের কাছে বেঁধে দেন এবং তার পরে তার মাথার লম্বা কালো চুলে পাগড়িটা পরান। “দেখি আমার ছেলেকে? এই মুহূর্তে তুমি কেবল একজন শাহজাদা বটে, কিন্তু চাঁদ উঠার পরেই তুমি হবে ফারগানার সুলতান।” তিনি তার সামনে একটা চকচকে পিতলে বাঁধান আয়না তুলে ধরলে বাবর সেখানে নিজের। কঠোর, হয়তো সামান্য বিস্মিত মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখে।

“খানজাদা!” তার মা চেঁচিয়ে বাবরের বোনকে ডাকেন। মসনদের দাবি ঘোষণার সময়ে বাবরের পোশাক এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ কি হবে সে বিষয়ে স্পষ্টতই বোঝ যায় তিনি যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেছেন। তার বোন বাইরে অপেক্ষা করছিল এবং করিডোরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে মায়ের ডাকের প্রতীক্ষায় ছিল। সে দ্রুত কামরার ভিতরে প্রবেশ করে। সবুজ মখমলে মোড়ান একটা লম্বা, সরু বস্তু তার হাতে ধরা। যত্নের সাথে সে তার হাতের জিনিসটা নামিয়ে রেখে সামান্য নাটকীয় ভঙ্গিতে মখমলের ভাজটা সরিয়ে ভেতরের কোষ থেকে একটা বাঁকান তরবারি বের করে আনে।

 খুতলাঘ নিগার সেটা নিয়ে বাবরের দিকে বাড়িয়ে ধরেন। “ফারগানার প্রতীক, ন্যায়বিচারের তরবারি- আলমগীর।”

সাদা জেড পাথরের উপরে নানা দামী রত্নে খচিত ঈগলের মাথার মত বাঁটটা দেখামাত্র বাবর চিনতে পারে। পাখিটার বিস্তৃত ডানা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের বিভঙ্গ লাভ করেছে আর বাঁটের উপরে উঁচু হয়ে থাকা চুনির চোখ সম্ভাব্য আক্রমণকারীর দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার মৃত আব্বাজানের হাতে সে বেশ কয়েকবারই এটা দেখেছে তিনি অবশ্য তাকে এটা কখনও স্পর্শ করতে দিতেন না। “প্রথমবারের মত নিজের হাতে ধরতে পেরে বেশ ভাল লাগছে।” সে বাঁটটা ধরে অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে সেটা কয়েকবার বাতাসে আন্দোলিত করে।

“তোমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ভিতরে এটা অন্যতম। লোকে বলে চোখের চুনি দুটো তৈমূরের, তিনি দিল্লী থেকে পাথর দুটো নিয়ে এসেছিলেন। ফারগানার নতুন সুলতান হিসাবে এখন থেকে তুমি এগুলোর মালিক।” খুতলাঘ নিগার তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তরবারির মণিমুক্তা খচিত খাপটা তার কোমরের সাথে আটকে দেয়, যে ইস্পাতের শিকলের সাহায্যে সেটা ঝুলছে তার দৈর্ঘ্য ঠিক করে দেয়।

“নানিজান কোথায়?” এসান দৌলতকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায় না এবং বাবর এই সময়ে তার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করে। সে মনে মনে চায় তিনি তাকে সুলতানের এই বেশে দেখুক তাকে অবিকল সুলতানের মত দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করুক।

 “তিনি নামাজে বসেছেন। তিনি বলেছেন ফারগানার সুলতান হিসাবে তিনি তোমাকে স্বাগত জানাবেন।”

 এক মহিলা ভৃত্য ভিতরে প্রবেশ করে প্রণত হয়। “মালিক, ওয়াজির খান সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।”

খুতলাঘ নিগার মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিনি আর খানজাদা নেকাবের নিম্নাংশ দিয়ে মুখ ঢাকতে না ঢাকতে ওয়াজির খান ভিতরে প্রবেশ করে। বাবর খেয়াল করে, এইবার সে প্রণত হয় না- সময় এত গুরুত্বপূর্ণ যে সেসব সৌজন্য প্রকাশের আবশ্যিকতা নেই। দীর্ঘদেহী সেনাপতি শাহী আলখাল্লা পরিহিত বাবরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। “মহামান্য শাহী পরিবার, মোল্লা আর আমার সৈন্যরা কর্তব্য পালনে প্রস্তুত। কিন্তু, এই মুহূর্তে, কামবার আলীও অন্তে যষ্টিক্রিয়ার ভোজপর্ব শেষে উপস্থিত শোকাহত অভ্যাগতদের সামনে বক্তৃতা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাদের বলবে যে রাজ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন, আর এই বিপর্যয় সামাল দেবার পক্ষে আমাদের সুলতানের বয়স অনেক অল্প। সে তৈমূরের বংশের অন্য কোনো শাহজাদাকে রাজপ্রতিভূ হিসাবে মনোনীত করতে অনুরোধ করবে। গতরাতে মোঘুলিস্তানের খানের কাছে তার পাঠান একটা চক্রান্তপূর্ণ চিঠি আমার প্রহরীদের হস্তগত হয়েছে, যার বিষয়বস্তু তাকে মসনদে অধিষ্ঠিত করান, এছাড়াও উজিরের কুটিল ষড়যন্ত্রের অন্যান্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।”

 “কিন্তু আমাদের হাতে এখনও সময় আছে?” খুতলাঘ নিগার হারেমের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চান।

“আমাদের হাতে সময় আছে, কিন্তু শাহজাদাকে এখন আমার সাথে যেতে হবে নতুবা কামবার আলী আমাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝে ফেলতে পারে। সে ভেবে বসে আছে শাহজাদা দূর্গে ফিরে এসে আপনার সাথে বসে দোয়া’দরূদ পাঠ করছেন।”

সে এবার বাবরের দিকে তাকায়। “শাহজাদা, অন্য আরেকটা আলখাল্লা দিয়ে নিজেকে অনুগ্রহ করে আবৃত করে নিন।” সে তার হাতে ধরা বাবরের ঘোড়ায় চড়ার ধূলি ধূসরিত আলখাল্লাটা তার দিকে এগিয়ে দিলে বাবর দ্রুত সেটা গায়ে চাপিয়ে নেয়, আর তার আম্মিজান দক্ষ হাতে আলখাল্লার ধাতব বাকলেসগুলো আটকে দিয়ে অভিষেকের পাগড়ির ঢেউতোলা শোভাবর্ধক পালকটা শিরাবরণী দিয়ে ঢেকে দেয়।

তরবারির বাঁটে হাত রেখে ওয়াজির খান বাবরকে তার পেছনে পেছনে বাইরের করিডোরে আসতে ইঙ্গিত করে ঘুরে দাঁড়ায়। খানজাদার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে সে আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের চিবুকে হাত বুলিয়ে দেয়। তার বোনের চোখে আশঙ্কার ছায়া ভারী উপস্থিতি।

 আতপ্ত আর উল্লাসের যুগপৎ উপস্থিতি বাবর নিজের ভিতরে অনুভব করে। আজ সন্ধ্যার ঘটনাবলীর উপরে তার পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বৃদ্ধ উজিরের ধূর্ততা ছোট করে দেখবার কোনো অবকাশ নেই। ওয়াজির খান সম্ভবত তার এই আশঙ্কা টের পেয়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায়। “শাহজাদা, সাহস রাখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।” “সাহস।” বাবর শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করার ফাঁকে তরবারির অলংকৃত বাটে আঙ্গুল বুলায়।

 তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিপথ, তীক্ষ্ণ ধাপযুক্ত প্যাচান সিঁড়ির কুলঙ্গিতে রাখা তেলের প্রদীপের আলোয় কিম্ভুতকিমাকার ছায়ার জন্ম দিতে দিতে দ্রুত এগিয়ে যায়। দূর্গের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে মসজিদটা অবস্থিত, বাবরের পূর্বপুরুষদের আদেশে পেছনের পাথুরে পাহাড় খোদাই করে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। গুহা-সদৃশ্য পাথুরে প্রকোষ্ঠ কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে- রোদে পোড়ান মাটির ইটের তৈরি ছাদের মত ভঙ্গুর না, যা ধ্বসে পড়ে তার পিতাকে বেহেশতের পথে নিয়ে গিয়েছে।

 মসজিদের সামনের ছোট শান্ত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে সে উপস্থিত হয়। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে এবং মেঘের আড়াল ছেড়ে চাঁদ বের হয়ে এসেছে। চাঁদের শীতল খাপছাড়া আলোতে সে ওয়াজির খানের ছয়জন প্রহরীকে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তারা নিরবে তাদের সেনাপতিকে অভিবাদন জানায়।

 বাবরকে বাইরে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে ওয়াজির খান কোরানের আয়াত উত্তীর্ণ করা তীক্ষ্ণ শীর্ষদেশযুক্ত বাঁকান তোরণাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে। উল্কণ্ঠিত কয়েক মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার পরে সে বাইরে বের হয়ে আসে। “মহামান্য শাহজাদা,” সে মৃদু কণ্ঠে বলে, “আপনি এবার ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন।”

বাবর তার উপরের আলখাল্লা খুলে ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে। মক্কাশরীফের দিকে মুখ করা মিহরাবের দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব নিরবে নামাজ আদায় করছেন। আবছা আলোতে বাবর প্রায় বিশজনের মত গোত্রপতিকে আসনসিঁড়ি অবস্থায় বসে থাকতে দেখে, প্রতিটা লোক, গোত্রগত মৈত্রীর বন্ধন আর রক্তের সম্বন্ধের কারণে তার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করতে প্রস্তুত।

 মসজিদের ভিতরে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টি তার উপরে আপতিত, তাকে মাপছে বুঝতে পেরে, বাবর অতীতে- যারা ফারগানার সুলতান ছিলেন তাদের ওজন নিজের উপরে ভারী হয়ে চেপে বসছে অনুভব করে, মনে হয় তার কাঁধ সেই ভারের চাপে বেঁকে যাচ্ছে। বাবর মসজিদের মেঝেতে কালো পাথরে চিহ্নিত স্থানের দিকে এগিয়ে গিয়ে যেখানে তার পিতা ফারগানার মরহুম সুলতান নামাজ পড়তেন সেখানে আনত হয়ে পরম শ্রদ্ধায় পাথরের শীতল মেঝেতে কপাল স্পর্শ করে। বাইরের তারকাশোভিত আকাশে একটা প্যাচা তীক্ষ্ণ শব্দ করে উড়ে যেতে, ইমামসাহেব খুতবা পাঠ আরম্ভ করেন, যে নসিহতে বাবরকে আল্লাহতালা আর পৃথিবীর সামনে ফারগানার সুলতান হিসাবে অভিহিত করা হবে।

***

“আপনারা বুঝতেই পারছেন, সম্মানিত ভদ্ৰোমহোদয়গণ, এই বিষয়ে আমাদের বিবেচনার সামান্যই অবকাশ রয়েছে। কামবার আলী তার চেহারায় যথোচিত গম্ভীর হালছাড়া একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে। “এমন কি আজই, আমাদের মহামান্য মরহুম সুলতানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়েই, উজবেক হার্মাদ সাইবানি খান নরকে যেন স্থান হয় বেজন্মাটার- আমাদের হুমকি দেবার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কেবল কুটিল উজবেকরাই না, আমাদের রাজ্যের প্রতি আরও অনেকের লোলুপ দৃষ্টি আছে। এই রাজ্য পরিচালনা আর রক্ষা করতে চাইলে শাহজাদা বাবরের মত অল্পবয়সী কিশোরের পরিবর্তে পাশ্ববর্তী রাজ্যের কোনো অভিজ্ঞ শক্তিশালী ব্যক্তিকে আমাদের বেছে নিতে হবে। আমরা কাকে নির্বাচিত করবো সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না… আজ রাতের কোনো এক সময়ে শাহী মন্ত্রণা পরিষদ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হবে।”

 কামবার আলী তার চারপাশে তাকিয়ে বর্গাকার প্রস্তরখণ্ডের মেঝের উপরে নিচু কাঠের টেবিলের পেছনে তাকিয়ার উপরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা গোত্রপতিদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের ফিসফিস গুঞ্জন শোনে। কি পরিতাপের বিষয় তার বেল্লিক তীরন্দাজ বাবরকে শরবিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

শাহী দরবারের অন্য সদস্যরা, ইউসুফ, বাবা কাশক, এবং বাকী বেগও চুপ করে দেখে আর অপেক্ষা করে, তাদের সবাই নিজ নিজ পৃষ্ঠপোষককে রাজপ্রতিভূ হিসাবে নিয়োগ দিয়ে প্রাপ্ত উপঢৌকনের সম্ভাব্য পরিমাণ বিশ্লেষণের সুখস্বপ্নে বিভোর।

 “আল্লাহ সাক্ষী, এটা হতে পারে না!” ফারগানার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি আলী-দোস্তের কর্কশ কণ্ঠস্বর কামবার আলীর স্বপ্নচারিতায় বিঘ্ন ঘটায়। কাঠবাদামের সসে ঝলসানো আস্ত ভেড়া রাখা কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে আলী- দোস্ত সজোরে ঘুসি বসিয়ে দেয়। তার হাতে ধরা তেল চর্বি মাখান মাংস কাটার ছুরিটা সে বাতাসে আন্দোলিত করে। “শাহজাদার বয়স রাজ্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্তই অল্প কথাটা সত্যি, আর তাই বলে আগন্তুকের দ্বারস্থ হতে হবে। আমি তৈমূর বংশের সন্তান। আমার বাবা ছিলেন মৃত সুলতানের রক্ত-সম্পর্কের ভাই। আমি একজন পরীক্ষিত যোদ্ধা- গত শীতেই প্রথম তুষারপাতের পরে আমি নিজ হাতে বিশজন উজবেককে হত্যা করেছি আমাদের গবাদি পশুর পালে হামলা করার সময়ে…?! রাজপ্রতিভূ নিযুক্ত করতে হলে আমার চেয়ে যোগ্য কাউকে খুঁজে পাবে না ভেড়ার চর্বি লেপটানো আবেগে লাল হয়ে উঠা মুখে, সে গনগনে চোখে কামরায় উপস্থিত সবার দিকে তাকায়।

“ভাইয়েরা, শান্ত হোন।” বাকী বেগ হাত তোলে সবাইকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে কিন্তু কেউ তার বাক্যে কর্ণপাত করে না।

আলী-দোস্ত হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়াতে, তার লোকেরা ক্রুদ্ধ মৌমাছির মত বিড়বিড় করতে করতে তার চারপাশে এসে সমবেত হয়। কিছুক্ষণের ভিতরেই একের পর এক গোত্রপতি নিজের স্বপক্ষে অকাট্য দাবি আর মসনদে নিজের অধিকার জানিয়ে উঠে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। আলী-দোস্ত তার গামলার মত হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তাকে অপমান করেছে ভেবে নিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটা লোককে আঘাত করতে চেষ্টা করে এবং লোকটা উল্টে পরতে সে এবার অন্য হাতে ধরা মাংস কাটার ছুরির ডগাটা তার গলায় ঠেকায়। কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে কিছুক্ষণ আগে পরিবেশন করা ঘিয়ে ভাজা শুকনো বাদাম দিয়ে রান্না করা মুখরোচক বিরানী আশেপাশের তাকিয়ার উপরে ছিটকে পড়তে শুরু করে।

কামবার-আলী কামরার দূরবর্তী প্রান্তে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে কামরায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তার অভিব্যক্তিতে বিষণ্ণতার কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। এসব তথাকথিত যোদ্ধারা সব বাচ্চা ছেলের মত একটা ভেড়া- বা একটা মেয়ে মানুষের জন্য এরা খুন করতে পিছপা হয় না। ওয়াইনের মাদকতায় শুরু হওয়া এই বিশৃঙ্খলা শীঘ্রই প্রশমিত হবে এবং এর ফলে তার পরামর্শের যৌক্তিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে তাকিয়ে দেখে তালুকের মত এক গোত্রপতি আরেকজনের গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে তাকে ইঁদুরের মত ঝকাতে থাকে যতক্ষণ না ভরপেট খাওয়া লোকটা সবকিছু তার মুখে উগড়ে দেয়।

“ফারগানার সুলতানের নামে বলছি এসব বন্ধ করো!”

কামবার আলী চমকে ঘুরে তাকায়। বিশাল দরজার নিচে ওয়াজির খান দাঁড়িয়ে আছে আর তার পেছনে বর্ম-পরিহিত প্রহরীর দল। উজিরের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি, কামরার ভিতরে তাদের অবস্থান গ্রহণের সময়ে প্রহরীদের একজনের ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্রুদ্ধ দাঙ্গাকারীরা প্রথমে বুঝতে পারে না কি ঘটছে। প্রহরীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কোষমুক্ত তরবারি চামড়ার ঢালে আঘাত করতে, শাপশাপান্ত করে, ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা গোত্রপতিরা পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে যায়।

“নতুন সুলতানকে অভিবাদন জানাবার জন্য প্রস্তুত হও,” ওয়াজির খান কঠোর কণ্ঠে বলে।

 “পরিতাপের বিষয়, এটা আল্লাহর ইচ্ছা যে এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সুলতান নেই,” উজির মাটি থেকে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তার পরণের আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।

 ওয়াজির খান কামবার আলীর শীর্ণ কাধ বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে। “আমাদের সুলতান আছেন। মসজিদে তার নামে খুতবা পাঠ করা হয়েছে। উপস্থিত সবাই এখন মাথা নত কর।” মদের প্রভাবে বিভ্রান্ত লোকগুলো বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে। প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝে প্রবেশ করে জোর করে তাদের হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দেয় এবং যারা সামান্য গাইগুই করে তাদের হাতের তরবারির চ্যাপ্টা প্রান্ত দিয়ে লাঠির মত আঘাত করে।

 “ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, মির্জা বাবরের জয় হোক,” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠে ঘোষণা করে এবং দেহের মাপের চেয়ে বড় হলুদ আলখাল্লা আর লম্বা মখমলের পাগড়ি মাথায় বাবর ভিতরে প্রবেশ করতে সে নিজেকে তার সামনে প্রণত করে। গোত্রপতিদের যারা তার সালতানাত মেনে নিয়েছে তারা তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সবার চোখে সতর্ক দৃষ্টি, যদি প্রয়োজন পড়ে সেজন্য সবার হাত তরবারির বাঁটে।

 বাবরের মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে তারা তার প্রতি বিশেষ কোনো মৈত্রীর বন্ধন অনুভব করে কিনা সেটা নিয়ে। তারা কেবল একটা বাজি ধরেছে। কিন্তু এখন তারা বিজয়ী পক্ষে থাকতে ইচ্ছুক যাতে প্রতিশ্রুত প্রতিদান লাভ করতে পারে।

বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে বাবরের কাছে পুরো দৃশ্যটা হাস্যকর মনে হয়- ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে থাকা লোকেরা মাটিতে তাকিয়া, মাংসের ঝোল আর পোলাও এ মাখামাখি অবস্থায় পড়ে আছে এবং তাদের পোষা কুকুরের দল হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভোজের সম্মুখীন হয়ে নিজেদের ভিতরে কামড়াকামড়ি করছে। গড়গড় করতে থাকা কুকুরের দলের চেয়ে আন্তরিক বলা যাবে না কামবার আলীর অভিব্যক্তিকে যখন সে ধীরে বাবরের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায়।

“উজির, আর উপস্থিত সবাই এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সুলতান হিসাবে বাবর তার প্রথম আদেশ দেয়ামাত্র নিজের ভিতরে সে একটা আন্ত্রিক উত্তেজনা বোধ করে।

 কামবার আলী ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়, ভেতরের আতঙ্ক দমনের ব্যর্থ প্রয়াসের লক্ষণ তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে আছে। “সুলতান, আপনার দরবারের সদস্যরা আপনার আদেশ পালনে প্রস্তুত।”

“তাহলে তুমি এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবে- মোঘুলিস্তানের খানের কাছে পাঠান এই আমন্ত্রণপত্র?” বাবর হাত বাড়ালে ওয়াজির খান তার হাতে একটা চামড়ার বাক্স উঠিয়ে দেয়। বাবর ভেতর থেকে একটা কুণ্ডলীকৃত কাগজ বের করে উজিরের চোখের সামনে ধরতে তার ভিতরে কোনো বিকার দেখা যায় না।

“রাজ্যের ভালোর জন্য আমি এটা পাঠিয়েছিলাম।” উজিরের শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ দ্রুত হয়ে উঠেছে।

 “নিজের ভালোর জন্য এটা পাঠিয়েছিলে-” ওয়াজির খান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুরু করতে বাবর হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। শাসক হিসাবে এটা তার প্রথম পরীক্ষা এবং সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায় নতুবা আগামীকাল, আগামী মাসে বা আগামী বছর কোনো না কোনো সময়ে তাকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়য়ন্ত্র আবার শুরু হবে।

কামবার আলীর মুখে এখন ক্রোধের আভাস এবং বাবর ভয় আর ঘামের তিক্ত ঘ্রাণ উজিরের ভিতর স্পষ্ট টের পায়। কিন্তু তার মৃত আব্বাজানের কাছে যে লোকটা এত প্রশ্রয় পেয়েছে তার প্রতি সামান্যতম করুণা সে বোধ করে না। কেবল ক্রোধ আর প্রতিশোধের কামনা তাকে জারিত করে।

শাহী জ্যোতিষী, শাহী কোষাধ্যক্ষ আর শাহী বাজারসরকারকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং হতাশায় তাদের চোখ মুখ ঝুলে পড়েছে। তাদের নিয়ে যাও,” বাবর প্রহরীদের আদেশ করে। “আমি পরে তাদের বিষয় বিবেচনা করবো।” দেয়ালের অনেক উপরে স্থাপিত একটা ক্ষুদে জাফরীর দিকে তার নজর যায় এবং মনে হয় জাফরির পেছনে সে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করেছে। সেখানে বসেই রাজকীয় মহিলারা উৎসবে আর ভোজসভায় মার্জিতভঙ্গিতে সবার চোখের আড়ালে থেকে অংশগ্রহণ করেন। সহজাত প্রবত্তির বলে সে বুঝতে পারে সেখানে কারা রয়েছে তার আম্মিজান আর নানিজান সেখান থেকে সুলতান হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ দেখছে আর তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করছে।

তার নিজের কাছেই অবাক লাগে ভাবতে যে এখন সে মানুষের জীবন মৃত্যুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে বহুবার নিজের আব্বাজানকে দেখেছে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে। গত দু’এক বছরে সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেখেছে শিরোচ্ছেদ, চামড়া তুলে নেয়া, ঘোড়া দিয়ে টেনে দেহ টুকরো করে ফেলা। তাদের আর্তনাদ আর রক্তের গন্ধ এখনও তার গলায় সে অনুভব করে কিন্তু যতক্ষণ তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছে তার কখনও মনে হয়নি ব্যাপারটায় কোনো অসঙ্গতি রয়েছে।

 আর এখন সে নিশ্চিতভাবেই জানে তার মা আর নানীমা তার কাছে ঠিক কি প্রত্যাশা করছেন। তার নামের মানে “বাঘ” আর তাকেও সেই বিশাল মার্জারের দ্রুততায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছো আমাকে হত্যা করতে চেয়েছো, তাই নয় কি?” সে শীতল কণ্ঠে বলে। কামবার আলী তার চোখের দিকে তাকায় না। বাবর ধীরে ধীরে তার তরবারি কোষমুক্ত করে। “প্রহরী!” সে ওয়াজির খানের দু’জন লোকের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করতে তারা উজিরকে মাটিতে ঠেসে ধরে তার দু’হাত শক্ত করে দেহের পেছনে চেপে ধরে। তারপরে তারা তার মাথা থেকে পাগড়ি খুলে নেয় এবং আলখাল্লার পেছনটা ছিঁড়ে ফেলে তার গর্দানের পেছনের দিক উন্মুক্ত করে।

উজির গর্দান টান করে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও তোমাকে আমি দ্রুত মৃত্যু দান করছি।” বাবর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে, মায়ের কামরায় দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা আগে যেমন অনুশীলন করেছিলো তেমনিভাবে একবার তরবারিটা বাতাসে আন্দোলিত করে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ কাজটা করার শক্তি আমাকে দাও। মাথা যেন নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়। সৈন্যদের হাতের ভিতরে উজির ছটফট করতে থাকে তার চোখে বিষাক্ত দৃষ্টি। বাবর আর একমুহূর্তও ইতস্তত না করে, তরবারি উপরে তুলে ধরে ফলাটা সজোরে উজিরের ঘাড় লক্ষ্য করে নামিয়ে আনে। পাকা তরমুজ দ্বিখণ্ডিত করার মত তরবারির ফলা উজিরের ঘাড়ের শীর্ষ, কোমলাস্থির ভিতর দিয়ে কেটে বের হয়ে আসে। বর্গাকৃতি পাথরের মেঝে, উপর দিয়ে বিচ্ছিন্ন মুণ্ডটা হলুদ দাঁত বের হয়ে থাকা গড়িয়ে যায়, তরল চুনির মত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে।

বাবর ধীর গতিতে আতঙ্কিত লোকদের দিকে তাকায়। “আমি হয়ত কিশোর কিন্তু আমি তৈমূরের বংশধর আর তোমাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতান। উপস্থিত কারো মনে এ বিষয়ে দ্বিধার অবকাশ রয়েছে?”

 সারা ঘরে পরিপূর্ণ নিরবতা বিরাজ করে। তারপরে ধীরে ধীরে একটা আওয়াজ ভেসে উঠে। “বাবর মির্জা, বাবর মির্জা।” শব্দটা জোরাল হয়ে কামরায় ভাসতে থাকে এবং একটা সময় মনে হয় কেবল শব্দটা যেন পরিপূর্ণ করতে পারছে না পুরো ব্যাপারটা, লোকগুলো তাদের তরবারির চ্যাপ্টা দিক দিয়ে চামড়ার গোলাকৃতি ঢালে আঘাত করতে থাকে বা হাত মুঠো করে দেয়াল বা টেবিল চাপড়াতে শুরু করে, যতক্ষণ না পুরো কামরাটা তাদের আবেগে মথিত হয়ে উঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *