প্রথম কাণ্ড। দ্বিতীয় প্রপাঠক
প্রথম অনুবাক
মন্ত্র- আপ উন্তু জীবসে দীর্ঘায়ুত্বায় বচ্চস।. ওষধে ত্ৰায়স্বৈনং স্বধিতে মৈনং হিংসীদেবরেতানি প্রবপে। স্বস্ত্যত্তরাণ্যশীয়া। আপো অম্মান্মাতরঃ শুন্ধত্ত ঘৃতেন নো ঘৃতপুবঃ পুনন্তু বিশ্বমস্মপ্র বহন্তু রিপ্রম। উদাভ্যঃ শুচিরা পূত এমি।। সোমস্য তনুরসি তনুবং মে পাহি। মহীনাং পয়োহসি বচ্চোধা অসি বর্ডঃ ময়ি ধেহি। বৃত্রস্য কনীনিকাহসি চক্ষুষ্প অসি চক্ষুৰ্ম্মে পাহি। চিৎপতিত্ত্বা পুনাতু বাপতিস্তা পুনাতু দেবা সবিতা পুনাত্বচ্ছিদ্রেণ পবিত্রেণ বসোঃ সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। তস্য তে পবিত্রপতে পবিত্রেণ যস্মৈ কং পুনে তচ্ছকেয়ম্।। আ বো দেবাস ঈমহে সত্যধৰ্ম্মাণো অধ্বরে যঘোত দেবাস আগুরে যজ্ঞিয়াসসা হবামহ। ইন্দ্রাগ্নী দ্যাবাপৃথিবী আপ ওষধী। ত্বং দীক্ষাণামধিপতিরসীহ মা সন্তং পাহি ॥১॥
মর্মার্থ- হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহে কর্ম-শক্তি প্রাপ্তির জন্য, সৎকর্মশীল জীবন-লাভের নিমিত্ত এবং বিশ্ব-হিতসাধনের উদ্দেশে, দেব-বিভূতি-সমূহ আমাদের অভিষিঞ্চত করুক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামুলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সৎ-ভাবের প্রভাবে আমরা যেন অক্ষয়-জীবন লাভ করতে পারি)। হে কর্মফলপ্ৰদনকারি! আমাকে অজ্ঞানতা হতে উদ্ধার করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! শীঘ্র আমরা কর্মফল ধ্বংস করুন)। হে ভব-বন্ধনছেদনকারী দেব! এই জনের (আমার) প্রতি প্রতিকুল হবেন না। (ভাব এই যে, আমার সংসার-বন্ধন মোচন করুন)। অথবা,-হে দেব! পাপ-শত্রু যেন আমাদের কর্মের বিঘাতক না হয়। অপিচ, হে ভগবান! আপনার অনুগ্রহে দেবভাব-পোষণকারী শরণাগত আমি যেন কর্মফলসমূহ আপনাতে সমর্পণ করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমার কর্মফল যেন ভগবান প্রাপ্ত হন)। পরমার্থসাধক আমার কর্মসমূহ সিদ্ধিপ্রাপ্ত হোক অর্থাৎ সম্পূর্ণ হোক। (ভাব এই যে, আমাদের কর্ম-সমূহ আমাদের ভগবানের সাথে সম্মিলিত করুক)। মাতৃ-স্থানীয় (মায়ের মতো করুণাপরায়ণ) দেববিভূতি-সমূহ আমাদের বিশুদ্ধতা সাধন করুন। ঘৃতের মতো পবিত্রতাসম্পন্ন অর্থাৎ বিশুদ্ধতাসাধক সেই দেব-বিভূতিসমূহ সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা আমাদের অভিষিঞ্চিত করুন। অপিচ, সেই দেব-ভাবসমূহ আমাদের সকল রকম পাপ অপনীত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। পাপ-নাশে সৎ-ভাবের উদয়ে পরমানন্দলাভের প্রার্থনা এখানে বর্তমান রয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের মধ্যে সৎ-ভাবের সৃষ্টি করে আমাদের পরমপদে প্রতিষ্ঠাপিত করুন)। অথবা, জগতের নির্মাণকত্রী (অথবা মায়ের মতো পালনকর্তী), সত্ত্বভাবের দ্বারা পবিত্ৰকারিণী এবং দ্যুতিশালিনী জলের অধিষ্ঠাত্রী দেব-বিভূতিগণ, আমাদের পাপ-সমূহকে অপনীত করুন; সত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের পবিত্র করুন; এবং এই জন্মজরামৃত্যুরূপ সংসার হতে (অথবা অজ্ঞান আমাদের) উদ্ধার করুন। (ভাব এই যে,-দেব-বিভূতিগণ আমাদের পাপসমূহকে বিনষ্ট করে সত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের এই সংসার হতে উদ্ধার করুন,–এই প্রার্থনা)। দেব-বিভূতিসমূহের স্নেহ-ধারা-সমূহে অভিষিঞ্চিত হয়ে সর্বতোভাবে বাহিরের ও অন্তরের বিশুদ্ধতা-সম্পাদনে যেন সমর্থ হই। অথবা, –আমরা জলের অধিষ্ঠাত্রী দেব-বিভূতি হতে স্নানের দ্বারা (বহিঃশুদ্ধ) এবং আচমনের দ্বারা (অন্তঃশুদ্ধ) শুদ্ধসত্ত্বভাবাপন্ন হয়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে,–দেববিভূতির প্রসাদে বাহির ও অন্তর শুদ্ধ হয়ে আমরা যেন ব্রহ্মলোক অর্থাৎ মুক্তিপ্রাপ্ত হই,–এই প্রার্থনা)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সৎস্বরূপ ভগবানের শরীর, অর্থাৎ প্রকাশরূপ বা ধারক হও। অতএব সৎ-ভাব-অবরোধ শত্রুর উপদ্রব হতে আমাকে রক্ষা করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমার হৃদয়ের সৎ-ভাবকে যেন আমি নষ্ট না করি)। হে মন! তুমিই বিশ্ববাসীর অমৃতস্বরূপ হও। অর্থাৎ আমাদের মন সকল সঙ্কর্মের সাধক হোক–সঙ্কল্পের এটাই তাৎপর্য। হে জ্ঞানস্বরূপ দেব! আপনি তেজের (শক্তির) ধারক হন; অতএব আমাকে তেজঃ (কর্মশক্তি) প্রদান করুন। অথবা,–হে দেব! আপনি এই ভূমির অর্থাৎ এই মর্ত্য লোকের জল-রূপ (জ্ঞান-ভক্তি রূপ) হন; (ভাব এই যে,জল যেমন ভূমির আদ্রর্ভব জন্মায়, তেমনই আপনি মর্ত্যলোকের রসাদ্রভাব অর্থাৎ ভক্তি ও জ্ঞান জন্মিয়ে থাকেন); এবং আপনি জ্ঞানতেজঃপ্রদ হন। অতএব আমাকে (জ্ঞানতেজোহীনকে) জ্ঞানরূপ তেজঃ বিতরণ করুন। হে দেব! আপনি অজ্ঞানরূপ অথবা বাহ্য ও আন্তর শত্রু-রূপ অসুরের নাশে শক্তি-স্বরূপ হন; (ভাব এই যে,–যেমন কনীনিকা অর্থাৎ চোখে তারা দৃষ্টিশক্তির মূল কারণ, সেইরকম আপনি অজ্ঞান-নাশের অথবা বাহ্য ও আন্তর সকল শত্রুনাশের মূল কারণ। হে দেব! আপনি সকলের দর্শনেন্দ্রিয়ের পালক অর্থাৎ দূরদৃষ্টি ও অন্তঃদৃষ্টি বিধায়ক অথবা অজ্ঞানতারূপ শত্রুনাশক বলে জ্ঞান-দৃষ্টিপ্রদ হন। অতএব আপনি আমার জ্ঞান-চক্ষু অর্থাৎ আত্ম-উৎকর্ষসাধন-সমর্থ দূর-দৃষ্টি বা অন্তদৃষ্টি সংরক্ষণ অর্থাৎ প্রদান করুন। (ভাব এই যে, –হে দেব! আপনি অজ্ঞানতানাশক ও বহিঃশত্ৰু-নাশক। অতএব আপনি আমাদের অজ্ঞানতা প্রভৃতি বিনাশ করে আমাদের জ্ঞান-চক্ষু প্রদান করুন)। হৃদয়-স্বামী সেই ভগবান তোমার পরিত্রাণ সাধন করুন; জীবন-স্বামী সেই ভগবান তোমাকে পরিত্রাণ করুন। হে আমার ভগবৎ-সম্বন্ধযুত কর্মসমূহ! জগৎপ্রসবিতা জগতের আদিকারণ স্বপ্ৰকাশ ভগবান বিশুদ্ধ পবিত্রকারক বায়ুরূপে জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা এবং সকলের নিবাসহেতুভূত প্রজ্ঞানময় বিশ্বপ্রকাশক ভগবানের বিশ্বপ্রকাশক জ্যোতিঃনিবহের দ্বারা তোমাদের উৎকর্ষসাধনে পবিত্রতা সম্পাদন করুন। অথবা তোমরা জ্ঞানপ্রদ সবিতা দেবতার প্রেরণায়-অনুকম্পায়-ত্রুটি-পরিশূন্য বায়ুর মতো পবিত্রকারক ও সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ হয়ে আমাদের উৎকর্ষসাধনে আমাদের পবিত্র করো। (বায়ু ও সূর্যরশ্মি শুদ্ধিসম্পাদক। তাদের প্রভাবে আমাদের সৎ ও অসৎ কর্মসমূহ পবিত্রতা প্রাপ্ত হোক,–এটাই প্রার্থনা)। হে জ্ঞানাধিপতে! আপনি জ্ঞানপূত (জ্ঞানময়) ও প্রসিদ্ধ; (সাধকগণ কর্তৃক অনুভূত) আপনার যে স্বরূপ (জ্ঞানময়–জ্ঞান) আমি কামনা করছি, সেই স্বরূপ-জ্ঞান যেন পেতে পারি; এবং তার দ্বারা পূত হতে সমর্থ হই। (ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমি তত্ত্বজ্ঞানের অভিলাষী। যাতে সেই বস্তু প্রাপ্ত হয়ে পূত পবিত্র হতে পারি, আপনি তার বিধান করুন)। হে দেব-বিভূতিসমূহ! আমাদের অনুষ্ঠিত সত্যের ও ধর্মের বিজ্ঞাপক এই অন্তর্যজ্ঞে (ভগবৎ-কার্যে) আমরা আপনাদের অনুকূল্য প্রার্থনা করি। আর হে দেব-বিভূতিগণ! এই যজ্ঞসম্বন্ধী আশীবাণী (অর্থাৎ এই যজ্ঞের শুভফল) পাবার জন্য আপনাদের আহ্বান করছি। (ভাব এই যে,–হে দেবগণ! আমাদের এই মানসযজ্ঞে অথবা আমাদের এই উদ্বোধন যজ্ঞে আপনাদের অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। আপনারা এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে দিন এবং সৎকর্মের শুভফল প্রদান করুন)। আমার সেই উদ্বোধনযজ্ঞ জ্ঞানশক্তি প্রদান করুক; ইহকাল-পরকালের মঙ্গলবিধান করুক এবং সৎ-ভাবের সঞ্চার করে আমাদের কর্মফল সাধন করুক। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ ভগবন্! আপনি সৎকর্মের স্বামী হন। এই সঙ্কর্মে প্রবৃত্ত আমাকে রক্ষা করুন অর্থাৎ কর্ম পূর্ণ করে কর্মফল প্রদান করুন। ১।।
[ভাষ্যানুক্রমণিকা অনুসারে প্রথম প্রপাঠকে দশপূর্ণমাস ইষ্টির বিষয় কথিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রভৃতি তিনটি প্রপাঠকে সোম-যাগের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি এবং সেই সংক্রান্ত মন্ত্র ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। যাই হোক, ভাষ্যকার দ্বিতীয় প্রপাঠকের অন্তর্গত অনুবাকগুলির প্রয়োগবিধি বিনিয়োগ সংগ্রহ থেকে প্রদর্শন করে, প্রথম অনুবাকের মন্ত্র-ব্যাখ্যানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। সেই অনুসারে মন্ত্রগুলির প্রয়োগ এইরকম প্রদর্শিত হয়েছে; যথা–প্রথম অনুবাকের মন্ত্র ইত্যাদি পাঠে, ক্ষৌর ইত্যাদির দ্বারা সংস্কৃত যজমান প্রাচীন-বংশ নামক যজ্ঞশালায় প্রবেশ করবেন। সেই অনুসারে আপ উদন্তু প্রভৃতি ক্ষৌর-মন্ত্র বলে অভিহিত। ক্ষৌর কার্যের পূর্বে শালানির্মাণের বিধি। বংশ-নির্মিত (বাঁশের তৈরী) সেই যজ্ঞ-শালার মন্মুখভাগ উন্নত এবং পশ্চাদ্ভাগ নিম্ন অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত অনুন্নত হয়–এইরকম ভাবে যজ্ঞশালা নির্মাণ করতে হয়। পূর্বভাগে আয়ত সেই গৃহ প্রাচীন-বংশ নামে অভিহিত। সেই শালায় সোম-যাগের বিধি সূত্র-গ্রন্থ ইত্যাদিতে নিবদ্ধ আছে। যজ্ঞ নিরুপদ্রবে সম্পন্ন হলে স্বর্গসুখ লাভ হয়, এটাই শাস্ত্রের অভিমত। মস্তক-মুণ্ডনে প্রথমতঃ জলের দ্বারা মস্তক ইত্যাদি আর্দ্র করবার সময় প্রথম মন্ত্র আপ উদন্তু ইত্যাদি পাঠ করতে হয়। দ্বিতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য–ক্ষুর। যজ্ঞ-যোগ্য হয়ে অর্থাৎ কেশ, শ্মশ্রু, নখ প্রভৃতি কর্তনের পর তৃতীয় মন্ত্রে বলা হয়ে-নির্বিঘ্নে যেন উত্তর কর্মগুলি প্রাপ্ত হই। মুণ্ডিত মস্তক হয়ে অবগাহন স্নানের পর যজমান চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্র পাঠ করবেন। সেখানে জলদেবতার নিকট ক্ষৌর-কর্মের জন্য অপকার নিবারণ এবং স্নান ও আচমনের দ্বারা বহিরন্তঃশুদ্ধির প্রার্থনা রয়েছে। ষষ্ঠ মন্ত্রে ক্ষৌরবস্ত্রের সম্বোধন আছে। সপ্তম মন্ত্রে নবনীত বা ঘৃতকে লক্ষ্য করা হয়েছে। এই মন্ত্রের সাথে পরবর্তী অষ্টম মন্ত্রের সম্বন্ধ সূচনা করা হয়। অর্থাৎ এই মন্ত্রে চক্ষু দুটিতে অঞ্জন (কাজল) গ্রহণ করার বিধি আছে। নবম ও দশম মন্ত্র যে কোন কার্যে বিনিযুক্ত ভাষ্যে তার স্পষ্টতঃ উল্লেখ নেই। তবে কল্প অনুসারে বোঝা যায়, একুশটি দর্ভপুঞ্জলি (কুশের আঁটি) এই মন্ত্র দুটির দ্বারা পবিত্ৰীকৃত করা হয়। একাদশ মন্ত্রটি অধ্বর্য (ঋত্বি-বিশেষ) যজমান পড়াবেন। ভাষ্যমতে দ্বাদশ মন্ত্র ইন্দ্রাগ্নী সম্বোধনে এবং এয়োদশ বা শেষ মন্ত্র আহবনীয় সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে বলে বোঝা যায়। বিনিয়োগ সংগ্রহ অনুসারে দ্বাদশ মন্ত্র-হে ইন্দ্রাগ্নি দেবদ্বয় আপনারা একে (যজমানকে) অবগত হোন। এই মন্ত্র পাঠ করতে করতে দক্ষিণ দিকে গমন করে শেষ মন্ত্র পাঠ করতে হয়; যথা,–হে আহবনীয়! তুমি দীক্ষারূপ নিয়মসমূহের পালক হও। অতএব তোমার সমীপে স্থিত আমাকে পালন করো।–যাই হোক, আমাদের অর্থে (আধ্যাত্মিকতার বিচারে) যে স্বতন্ত্র পন্থা অবলম্বন করেছে, তা আমাদের মর্মার্থেই বিধৃত] ॥১॥
.
দ্বিতীয় অনুবাক
মন্ত্র- আক্ত্যৈ প্ৰযুজেহগেয়ে স্বাহা। মেধায়ৈ মনসেহগ্নয়ে স্বাহা। দীক্ষায়ৈ তপসেহগ্নেয় স্বাহা। সবস্বত্যৈ পূষ্ণেগ্নয়ে স্বাহা। অপো দেবীবৃহতীৰ্বিশ্বশংভূবো দ্যাবাপৃথিবী উবন্তরিক্ষং বৃহম্পতিনো হবিষা বৃধাতু স্বাহা। বিশ্বে দেবস্য নেতুর্মর্তো বৃণীত সখ্যং বিশ্বে রায় ইযুধ্যসি দ্যুম্মং বৃণীত পুষ্যসে স্বাহা। ঋময়োঃ শিল্পে স্থস্তে বামারভে তে মা পাতমাহস্য যজ্ঞস্যোদৃত। ইমাং ধিয়ং শিক্ষমাণস্য দেব তুং দক্ষং বরুণ সং শিশাধি যযাহতি বিশ্বা দুরিতা তরেম সুতর্মাণমধি নাবং রুহেম। উর্গস্যাঙ্গিরসূর্ণদা ঊর্জং মে যচ্ছ। পাহি মা মা মা হিংসীঃ।। বিষ্ণোঃ শৰ্মাসি শৰ্ম যজমানস্যশৰ্ম মে যচ্ছ। নক্ষত্রাণাং মাহতীকাশাৎ পাহি। ইন্দ্রস্য যোনিরসি মা মা হিংসীঃ। কৃষ্যে ত্বা সুসস্যায়ৈ।। সুপিপ্ললাভ্যৗেষধীভ্যঃ।। সুপস্থা দেবী বনস্পতি রূৰ্দ্ধো মা পায্যোদৃচঃ। স্বাহা যজ্ঞং মনসা স্বাহা দ্যাবাপৃথিবীভ্যাম্। স্বাহোরোরন্তরিক্ষাৎ স্বাহা যজ্ঞং বাতাদা ব্ৰভে ॥২৷৷
মর্মার্থ- আত্মার উদ্বোধন-যজ্ঞ করব–এমন সঙ্কল্প-সিদ্ধির জন্য (আমার অনুষ্ঠিত মানস যজ্ঞ পরিপূরণের জন্য) সঙ্কল্প-সিদ্ধির প্রযোজক (অথবা সিদ্ধিদাতা) সেই জ্ঞান-দেবের উদ্দেশে আমার এই সত্ত্ব-ভাব সমর্পিত হোক। (আমার সেই উদ্বোধন-যজ্ঞ সুসিদ্ধ ও সুহুত হোক)। ভগবৎ-বিষয়ে ধারণা-শক্তি-লাভের জন্য, মনের অধিষ্ঠাতা সেই জ্ঞান-দেবের উদ্দেশে (আমার) এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। (আমার সেই উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত ও সুসিদ্ধ হোক)। ব্রত-নিয়ম অর্থাৎ সকর্ম-সমূহ সিদ্ধির জন্য তপঃ-স্বরূপ সেই জ্ঞানদেবতার উদ্দেশে (আমার) এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। (আমার সেই উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত ও সুসিদ্ধ হোক)। বাক্-সিদ্ধির জন্য, বাক্-ইন্দ্রিয়ের পোষক সেই জ্ঞান-দেবতার উদ্দেশে (আমার) এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। (আমার সেই উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত ও সুসিদ্ধ হোক)। হে জলের অধিষ্ঠাত্রী! হে স্বর্গ-মর্তের অধিষ্ঠাত্রী! হে অন্তরিক্ষের অধিষ্ঠাত্রী! হে মহা! হে বিশ্বব্যাপক! হে সকল সুখের জনয়িতা দেব-বিভূতিসমূহ! আপনারা আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবকে প্রবর্ধিত (উদ্বোধিত) অথবা গ্রহণ করুণ। দেবাধিদেব ভগবান আমাদের (আমাদের সৎ-ভাব ও ভক্তি-সুধা) প্রবর্ধিত করুন–গ্রহণ করুন। সেই শুদ্ধসত্ত্ব-সৎ-ভাবসমূহ ভগবানের প্রীতি উৎপাদন করুক। স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা সেগুলির সবই ভগবানে সমর্পণ করছি। (আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত হোক)। [উপরোক্ত পাঁচটি মন্ত্রই প্রার্থনামূলক] সকল মনুষ্য ফলদাতা সেই ভগবানের সাহায্য (আনুকূল্য) প্রার্থনা করেন। সকলেই ধনের জন্য অর্থাৎ জ্ঞান-ধনের জন্য (পরমধন-লাভের জন্য) দীপ্তিশালী যশঃ অন্ন অথবা সত্ত্বভাব প্রার্থনা করেন। পুষ্টির জন্য (সত্ত্বভাব লাভের নিমিত্ত) দীপ্তিশালী যশঃ অন্ন অথবা সত্ত্বভাব প্রার্থনা করেন। স্বাহা অর্থাৎ আমাদের প্রার্থনা সিদ্ধ হোক (অথবা আমাদের অনুষ্ঠিত কর্ম সুসম্পন্ন হোক)। হে অন্তব্যাধি-বহির্বাধি-নাশক দেববিভূতিদ্বয় (অশ্বিনীদ্বয়)! আপনারা ঋক্ ও সাম বেদের (অথবা নিখিল শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবের শিল্পী অর্থাৎ অভিব্যঞ্জক হন; সেই প্রসিদ্ধ (সাধকগণের অনুভূত) আপনাদের দুজনকে আরাধনা করি। আপনারা আমাদের এই আরব্ধ আত্ম-উদ্বোধন যজ্ঞের পরিসমাপ্তি কাল পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করুন। (ভাব এই যে,-দেবতা আর দেববিভূতি অভিন্ন! সুতরাং আপনারা দুজনও বেদের অভিব্যঞ্জক; অর্থাৎ নিখিল শুদ্ধসত্ত্ব-প্রদাতা আপনারা আমাদের দ্বারা আরাধিত হয়ে আমাদের রক্ষা করুন)। দ্যোতমান জ্ঞানদায়ক স্নেহ-কারুণ্যময় হে ভগবন্ বরুণদেব! সকর্ম সাধনে ইচ্ছুক অৰ্চনাকারীর (আমার) সৎকর্ম-বিষয়ক বুদ্ধি উৎপাদকের জন্য সকর্মবেত্তা আপনি (আমার) সেই কর্মকে সম্যক্-রকমে সাধন করুন অর্থাৎ আমাকে কর্ম-বিষয়ক জ্ঞান প্রদান করে সেই কর্মের পূর্ণতা সাধনে সুফল প্রদান করুন। অপিচ, হে দেব! যে কর্মের দ্বারা সবরকম পাপ (দূরিত) হতে প্রকৃষ্টভাবে উত্তীর্ণ হতে পারি, সুখে-ত্রাণকারী (অথবা সুখ-সাধক পরিত্রাণ-বিধায়ক) সেই কর্মরূপ তরণী যেন প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি সঙ্কল্প-মূলক। আত্যন্তিক দুঃখ-নিবৃত্তিতে পরমসুখ সাধনের আকাঙ্ক্ষাই এই মন্ত্রের অন্তর্গত সঙ্কল্পের লক্ষ্য)। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি অঙ্গিরস ঋষিদের অর্থাৎ সমস্ত মানবের অন্নরসরূপ অর্থাৎ সত্ত্বভাবরূপ এবং উর্ণাতন্তুর (মাকড়সার জালের) মতো মৃদুস্বভাবা হন। সুতরাং আমার মতো অকিঞ্চন দীনজনে অন্নরস অর্থাৎ সত্ত্বভাব প্রদান করুন। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি আমাকে রক্ষা (পরিত্রাণ) করুন। আমাকে হিংসা করবেন না অর্থাৎ আমার প্রতি কুটিল বা বিরূপ হয়ে আমাকে পরিত্যাগ করবেন না। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি বিশ্বব্যাপক সৰ্কৰ্ম-সমূহের অর্থাৎ সেই নিমিত্তক সুখের প্রাপ্তিহেতুভূত হন; অপিচ, আপনি সকর্মকারীর পরম আশ্রয় হন। অতএব আমাকে আশ্রয়-পরমসুখ প্রদান করুন। তার পর অক্ষীয়মান সৎ-ভাবসমূহের ক্ষয় হতে আমাকে রক্ষা করুন অর্থাৎ আমার সৎ-ভাবসমূহ যেন বিনষ্ট বা ক্ষয়প্রাপ্ত না হয়। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি পরম-ঐশ্বর্যশালী ভগবানের প্রাপ্তির কারণ হন। অতএব আপনি আমার প্রতি বিরূপ হবেন অর্থাৎ আপনি আমাকে পরিত্যাগ করবেন না। হে আমার চিত্তবৃত্তি! সুকর্ষণের অর্থাৎ উৎকর্ষসাধনের নিমিত্ত এবং সুশস্য-লাভের অর্থাৎ সৎ-ভাব-রূপ সুবাস্য-প্রাপ্তির জন্য তোমাকে ১(এই কর্মে) নিযুক্ত করছি। হে আমার চিত্তবৃত্তি! সুফলসমন্বিত কর্মক্ষয়ের নিমিত্ত তোমাকে (এই কর্মে নিযুক্ত করছি। সৎকর্মের সুষ্ঠুসম্পাদক সংসার-অরণ্যের অধিপতি স্বপ্রকাশ ভগবান (আমাদের প্রতি) অনুকূল হয়ে (আমাদের) আরব্ধ কর্মের উত্তরা (শেষ) ঋক্ পর্যন্ত অর্থাৎ পরিসমাপ্তি পর্যন্ত আমাকে (পাপ হতে) রক্ষা করুন। (ভাব এই যে, সমস্ত পাপ হতে বিমুক্ত করে আমাকে সকর্মের শুভফল প্রদান করুন)। চিত্তের উদ্বোধনযজ্ঞকে যেন স্বাহার (স্বাহা নামক অগ্নির) মতো প্রাপ্ত হই। অর্থাৎ, সে যজ্ঞ যেন সুহুত ও সুসিদ্ধ হয়। অথবা চিত্তের দ্বারা দশপৌর্ণমাস ইত্যাদি রূপ সৎকর্ম যেন প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে, আমার মানস-যজ্ঞ যেন সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়)। সেই উদ্বোধনরূপ যজ্ঞ বা সৎকর্ম যেন ভূলোক ও স্বর্গলোক ব্যেপে প্রকাশ পায় (পেয়ে থাকুক)। (ভাব এই যে,–সকর্মের প্রভাবে দেব-বিভূতিসমূহ অধিগত হয়)। সেই উদ্বোধনরূপ যজ্ঞ (মানস-যজ্ঞ) অথবা সৎকর্ম যেন মহৎ-অন্তরিক্ষলোক (বিশ্ব) ব্যেপে প্রকাশ পায় (পেয়ে থাকুক)। (ভাব এই যে-সকর্মের দ্বারা হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপজিত হলে সেই বিরাট বিশ্বময়ের স্বরূপ অবগত হওয়া যায়)। সেই উদ্বোধন-যজ্ঞকে অথবা সৎকর্মকে যেন আমি সত্ত্বভাব হতে আরম্ভ করি অর্থাৎ সত্ত্বভাব সহযুত হয়ে আমি যেন সেই কার্যে প্রবৃত্ত হতে পারি। (অথবা সত্ত্বভাবের প্রভাবে আমার সেই উদ্বোধন-যজ্ঞ যেন সুসিদ্ধ হয়। সেই কার্য (আমার মানস-যজ্ঞ) সিদ্ধ হোক। স্বাহা মন্ত্রে তাকে উদ্বোধিত করছি। (ভাব এই যে,-যে জ্ঞানময় দেব উদ্বোধনরূপে বিরাজ করেন, যিনি স্বর্গ অন্তরিক্ষ মর্ত–এই ত্রিলোক ব্যেপে আছেন, তাঁকে যেন সত্ত্বভাবের দ্বারা অধিগত করতে সমর্থ হই)। ২।
[এই দ্বিতীয় অনুবাকে দীক্ষা-বিধি কথিত হচ্ছে। দীক্ষা-নিয়মরূপ তপের দ্বারা পূর্বোক্ত অনুবাকের অনুসারে প্রাচীনবংশ-শালায় প্রবিষ্ট দীক্ষাভিলাষী ব্যক্তির শরীর-শুদ্ধি সংসাধিত হলে, দেবজনে তার অধিকার জন্মায়। তারপর তার দীক্ষা-বিধি। সুতরাং কর্মকাণ্ড অনুসারে দীক্ষণীয়-ইষ্টিতে মন্ত্রগুলির অতিদেশ প্রযুক্ত দীক্ষাহুতি বিষয়ক মন্ত্রগুলি এই দ্বিতীয় অনুবাকে উক্ত হয়েছে। ভাষ্যকার এইরকম অনুক্রমণ করে অনুবাকের মন্ত্রগুলির অর্থ-নিষ্কাশনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। বিনিয়োগ-সংগ্রহে যে মন্ত্রে যে প্রক্রিয়া উপলক্ষিত, ভাষ্যে সেই মন্ত্রে তারই সাধন-উপযোগী সেই সামগ্রীই লক্ষিত হয়েছে এবং সেই ভাবেই ভাষ্যকার মন্ত্রের সম্বোধন ইত্যাদি অধ্যাহার করে নিয়েছেন। প্রথম দৃষ্টিতে এই অনুবাকের প্রথম পাঁচটি মন্ত্র সহজবোধ্য বলে প্রতীত হলেও ভাব-উদ্ধারে বড়ই প্রয়াস পেতে হয়। এই পাঁচটি মন্ত্র শুক্লযজুর্বেদে মহীধরকৃত ভাষ্যে কিরকম অর্থ পেয়েছে তা উপলব্ধ করা যায়–যথা,–(১) যজ্ঞ করব-এইরকম মানস-সিদ্ধির জন্য সেই সঙ্কল্প সিদ্ধির প্রয়োজক অগ্নিদেবের উদ্দেশে এটি সুহুত হোক। (২) মন্ত্রে ও ধারণাশক্তি-সিদ্ধির জন্য মনঃ অভিমানী অগ্নিদেবের উদ্দেশে (এটি) সুহুত হোক। (৩) ব্রত-নিয়ম-সিদ্ধির জন্য আমার শারীর-তপঃ অভিমানী অগ্নিদেবের উদ্দেশে (এটি) সুহুত হোক। (৪) মন্ত্র উচ্চারণের শক্তি-সিদ্ধির জন্য বাক্-ইন্দ্রিয় পোষক অগ্নিদেবের উদ্দেশে (এটি) সুহুত হোক। (৫) হে জলরাশি! হে দ্যাবাপৃথিবি! হে বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ! তোমাকে এবং বৃহস্পতিকে হবিঃ দান করছি। তা সুহুত হোক। কিরকম জলরাশি? দ্যোতমানা, প্রভূত। এবং জগতের সুখজনিকা। বলা বাহুল্য সায়ণের ভাষ্যও কম-বেশী একই ধারায় বাহিত। ষষ্ঠ মন্ত্রে ভাষ্যকার বলছেন–বিশ্বাত্মক জগৎ-নির্বাহক দেবতার সখ্য মরণবান যজমান সহসা কামনা করেন। এইরকম স্তোত্রের দ্বারা সেই সখিত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায়। বিশ্বাত্মক ধন ও যশ তার নিকট প্রাপ্ত হয়। আর যজ্ঞপোষণের নিমিত্ত তাঁর নিকট ধন প্রার্থনা করে। এই হবিঃ সুহুত হোক। এই মন্ত্রই শুক্লযজুর্বেদের চতুর্থ অধ্যায়ে মহীধরকৃত ভাষ্যে যে ভাব উপলব্ধ করে, তা এই,-সকল মনুষ্য ফলপ্রাপক ও দান ইত্যাদি গুণযুক্ত সবিতার সখিভাব (সখ্য) প্রার্থনা করেন; এবং সকল ব্যক্তিই ধনের জন্য সবিতাকে প্রার্থনা করেন ও যশ বা অন্ন তার নিকট কামনা করেন। কি জন্য? প্রজাপলিনের জন্য। যিনি এমনই সবিতা, তার উদ্দেশে এটি সুহুত হোক। কর্মকাণ্ডের অনুসরণে সপ্তম মন্ত্রের ভাষ্যে বোঝা যায়, এই মন্ত্র উচ্চারণে কৃষ্ণাজিনদ্বয়ের সন্ধিস্থান স্পর্শ করতে হয়। তাই মনে হয়–মন্ত্রটি কৃষ্ণাজিন সম্বন্ধে পঠিত হয় বলেই ভাষ্যকার সম্বোধনরূপে কৃষ্ণাজিন পদ অধ্যাহৃত করেছেন। অষ্টম মন্ত্রটির ভাষ্যানুসারী অর্থ-হে বরুণদেব! অগ্নিষ্টোম বিষয়ক ধী-শক্তি লাভেচ্ছু যজমানের সম্বন্ধী সমৃদ্ধ অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের বিষয়ে সম্যক উপদেশ প্রদান করে তাকে যজ্ঞের পারে নিয়ে যাও অর্থাৎ যজ্ঞ সম্পাদন করে। যে নৌকার দ্বারা বিঘ্নরূপ দূরিত হতে উত্তীর্ণ হতে পারি, সুখে তারণসমর্থ এই কৃষ্ণজিনরূপ নৌকায় আমরা পারে গমনের জন্য অধিরোহণ করছি। আমরা তো এই মন্ত্রে সংসার-সমুদ্র উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাই দেখেছি এবং মর্মার্থে তা-ই প্রকাশ করেছি। নবম থেকে ত্রয়োদশ পর্যন্ত পাঁচটি মন্ত্র কর্মকাণ্ডানুসারে বিনিয়োগগ্রন্থের মতে এবং তার অনুসরণে ভাষ্যমতে যা অর্থ হয়েছে তা এই (৯)-হে মেখলে! তুমি অঙ্গিরস নামক ঋষিদের সম্বন্ধে অন্নরসরূপে প্রকটিত হয়ে থাক এবং কম্বলের মতো মৃদু হয়ে থাক। এইরকম তুমি আমাকে অন্নরস প্রদান করো। (১০)-হে মেখলে! তুমি আমাকে রক্ষা করো। হিংসা ও বন্ধনের দ্বারা বেদনা উৎপাদন করো না। (১১)–হে বস্ত্র! তুমি বিষ্ণুর সুখপ্রদ হও। তুমি যজমানকে সুখ প্রদান করো। অতএব তুমি আমারও সুখের বিধান করো। হে বস্ত্র! নক্ষত্রপ্রকাশ থেকে আমাকে রক্ষা করো। (১২)–হে কৃষ্ণবিষাণ! তুমি যেমন ইন্দ্রের যোনি (উৎপত্তিকারণ) হও, সেইরকম এই যজমানেরও (উৎপত্তির কারণ) হও। (১৩)–হে লোষ্ট! শোভনশস্য সম্পাদনের উপযোগী কর্ষণের জন্য তোমাকে ধারণ করছি অর্থাৎ নিয়োজিত করছি।–ভাষ্যে দ্বাদশ মন্ত্রের সাথে একটি উপাখ্যানের সমাবেশ দেখা যায়। সেই উপাখ্যানটি এই,–যজ্ঞদেবের সাথে দক্ষিণাদেবীর মিলন হলে ইন্দ্র জানতে পারেন, দক্ষিণাদেবীর গর্ভস্থ সন্তান ত্রিভূবনের ঐশ্বর্যপতি হবেন। সুতরাং ইন্দ্র স্বয়ং দক্ষিণাদেবীর যোনিপথে তার উদরে প্রবিষ্ট হন। এই ভাবে দক্ষিণাদেবীর গর্ভে ইন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন এবং ভবিষ্যতে আর কেউ যাতে দক্ষিণাদেবীর গর্ভে না জন্মাতে পারে, সেই হিংসার বশবর্তী হয়ে তিনি মাতা দক্ষিণাদেবীর যোনি-দেশ ছিন্ন করেন। বিযযানিত্বের জন্য দক্ষিণাদেবী বন্ধ্যা হলেন; কিন্তু সেই যোনি ইন্দ্রের হস্ত বেষ্টন করে রইলো। তখন ইন্দ্র বলিসমূহযুক্ত সেই যোনি কৃষ্ণমৃগে স্থাপন করলেন। সেইজনই কৃষ্ণবিষাণ যজ্ঞের ভোগ্যা দক্ষিণার অবয়বভূত এবং ইন্দ্রের কারণভূত যোনিস্বরূপ বলে কথিত হয়। যাই হোক, ভাষ্যকার এই অলৌকিক বেদমন্ত্রের সাথে যে লৌকিক মেখলা, বস্ত্র, কৃষ্ণবিষাণ প্রভৃতির যে সম্বন্ধ টেনে এনেছেন, তার বিশেষ কোনও সৎ-যুক্তি পাওয়া যায় না। উক্ত মেখলা প্রভৃতি সম্বন্ধে মন্ত্রের প্রয়োগ দেখে ভাষ্যকার ঐরকম কল্পনা করেছেন বলেই মনে হয়। ভাষ্যানুসারে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ মন্ত্র মস্তক-কণ্ডুয়ণ এবং দণ্ড-পরিগ্রহ কার্যে বিনিযুক্ত বলে নির্দেশিত হয়েছে। সেই অনুসারে মন্ত্রের লক্ষ্য–শির বা মস্তক; এবং পঞ্চদশ মন্ত্রের সম্বোধন-বৃক্ষাবয়ব দণ্ড। এই অনুবাকের শেষ মন্ত্রের প্রথম অংশ পাঠ করে দুই হস্তের দুই কনিষ্ঠা অঙ্গুরীকে সঙ্কুচিত করতে হবে এবং অন্য তিন অংশ উচ্চারণে অন্য অঙ্গুলি সঙ্কুচিত করতে হবে। শেষে পুনরায় শেষ অংশ পাঠে মুষ্টিদ্বয় বদ্ধ করতে হয়। কর্মকাণ্ডের স্বার্থে প্রচলিত ভাষ্যের অনুসরণে যে অর্থ প্রতীত হয়, তা এই,–(ক) চিত্তের দ্বারা আমি যজ্ঞে অভিগত হচ্ছি; (খ) বিস্তীর্ণ অন্তরীক্ষে যজ্ঞ আশ্রিত; (গ) স্বর্গ ও পৃথিবীতে যজ্ঞ আশ্রিত অর্থাৎ যজ্ঞ ত্রিলোকব্যাপী; (ঘ) বায়ুর (বায়ু সর্বকর্ম-প্রবর্তক বলে) প্রসাদে যজ্ঞে প্রবৃত্ত হয়েছি। সেই যজ্ঞ এইভাবে সিদ্ধ হয়।–এই মন্ত্রগুলির আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে কি রকম সঙ্গতিপূর্ণ অর্থ হয়, তা আমরা আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশ করেছি] । ২।।
.
তৃতীয় অনুবাক
মন্ত্র- দৈবীং ধিয়ং মনামহে সুমৃড়ীকামভিষ্টয়ে বéোধাম যজ্ঞবাহসং সুপারা নো অসদ্বশে। যে দেবা মনোজাতা মনোযুজঃ সুদক্ষা দক্ষপিতারস্তে নঃ পান্তু তে নোহবন্তু তেভ্যো নমস্তেভ্যঃ স্বাহা। অগ্নে ত্বং সু জাগৃহি বয়ং সু মন্দিযীমহি গোপায় নঃ স্বস্তয়ে প্ৰবুধে নঃ পুনঃ । ত্বমশ্নে ব্রতপা অসি দেব আ মর্ত্যেম্বা। তং যজ্ঞেধীড্যঃ। বিশ্বে দেবা অভি মামাহববৃত্র। পূষা সন্যা। সোমো রাধাসা। দেবঃ সবিতা। বসোৰ্ব্বসুদাবা রায়েৎ। সোমাহভূয়ো ভর মা পৃণ পূৰ্ত্তা। বি রাধি মাহহমায়ুষা। চন্দ্রমসি মম ভোগায় ভর। বস্ত্রমসি মম ভোগায় ভব। উম্ৰাহসি মম ভোগায় ভব। হয়োহসি মম ভোগায় ভব। ছাগগাহসি মম ভোগায় ভব। মেযোহসি মম ভোগায় ভব। বায়বে ত্বা বরুণায় ত্বা নিঋত্যৈ ত্বা রূদ্ৰায় ত্বা। দেবীরাপো অপাং নপাদ্য উম্মাহবিষ্য ইন্দ্রিয়াবাদিমশুম্ বো মাহৰ ক্ৰমিষমচ্ছিন্নং তন্তুং পৃথিব্যা অনু গেষম। ভদ্ৰাদভি শ্রেয়ঃ প্রেহি বৃহস্পতিঃ পুরতা তে অথেমিব স্য বর আ পৃথিব্যা আরে শত্ৰু কৃণুহি সৰ্ববীরঃ। এদমগন্ম দেবযজনং পৃথিব্যা বিশ্বে দেবা যদজুযন্ত পূর্ব ঋমাভ্যাং যজুষা সন্তরন্তা রায়পোষেণ সমিষা মদেম ॥৩৷৷
মর্মার্থ- হে ভগবন্! দেবকার্যে স্বতঃপ্রবৃত্তা পরম-সুখদায়িকা, তেজের ধারয়িত্রী (তেজোময়ী), সকর্মর্সাধয়িত্রী, বুদ্ধি (প্রজ্ঞা) আমরা প্রার্থনা করছি; সুখলভ্যা হয়ে, সেই বুদ্ধি (প্রজ্ঞা) আমাদের বশতাপন্ন হোক। (ভাব এই যে, আমরা যেন সর্বসিদ্ধিপ্রদা সুবুদ্ধির অধিকারী হই; হে ভগব, আপনি তা-ই বিধান করুন)। হৃদয়ে উৎপন্ন, হৃদয়ের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট, সৎকর্মসাধক, সৎ-ভাব-উৎপাদক সকলেরই অনুভূত যে দেবভাবসমূহ, তারা সকলে আমাদের (পাপ হতে) পরিত্রাণ করুন এবং রক্ষা করুন। সেই পরিত্রাণকারী দেবতাগণকে নমস্কর্মের দ্বারা পূজা করি এবং স্বাহা-মন্ত্র-সহযোগে হবিঃ ইত্যাদি অর্পণ করছি; আমার কর্ম সুহুত হোক–আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হোক; সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সকল কর্ম তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হোক, অর্থাৎ তার ভাবে বিভাবিত হোক)। হে জ্ঞানময় দেব! আপনি আমাদের হৃদয়ে চিরজাগরুক থাকুন; আপনার প্রার্থনাকারী শরণাগত আমরা মোহঘঘারে সংজ্ঞারহিত হয়ে আছি। (ভাব এই যে,অজ্ঞানতার কারণে অথবা মোহের বশে আমরা যদি বিপথগামী হই, হে জ্ঞানময়, বিবেকরূপে হৃদয়ে উদিত হয়ে আমাদের সৎপথ প্রদর্শন করুন)। হে ভগবন্! আপনি আমাদের পরিত্রাণ করুন। আর সৎ-বুদ্ধি দানে রক্ষার নিমিত্ত এবং অবিনাশী সৎকর্মশীল জীবনের জন্য, পুনশ্চ জাগরণের অর্থাৎ সৎকর্মসমন্বিত ও সৎ-ভাবসহযুত করে উদ্বোধিত করবার নিমিত্ত, আমাদের ধারণ করুন অর্থাৎ আমাদের প্রমাদ-পরিহারে সৎ-কর্মান্বিত করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে-হে ভগবন্! আপনার কৃপায় সৎ-উপদেশ লাভ করে আমরা যাতে সৎপথ-অবলম্বী হতে পারি, তা-ই বিহিত করুন)। হে জ্ঞানময় দেব! দ্যোতমান স্বপ্রকাশ আপনি, মনুষ্য পর্যন্ত সকল প্রাণীর সৎকর্মের পালক হন; আর সকল যজ্ঞেসকল সৎকর্মের অনুষ্ঠানে আপনি সর্বতোভাবে (সম্পূজিত) পূজনীয় হন। (ভাব এই যে,-সকল কর্মেই জ্ঞানদেবের প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে)। দেববিভূতিসমূহ সকলে শরণাগত আমাকে সর্বভাবে আবৃত করে অবস্থান করুন অর্থাৎ আমাকে রক্ষা করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে,-দেবভাবসমূহ হৃদয়ে সম্যভাবে উপজিত হোক)। সৎ-ভাব-পোষক সেই ভগবান, পরমধনের সাথে (আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। পরমপদপ্রদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব, শ্রেষ্ঠধনের সাথে আগমন করুন এবং হৃদয়ে অধিষ্ঠান করুন। দ্যোতমান স্বপ্ৰকাশ পরমাশ্রয় সৎকর্মের প্রেরক অথবা সৎকর্মের নিয়োজক সৎপথ-প্রদর্শক ভগবান অভীষ্টপূরক পরমধনদায়ক হয়ে আগমন করুন–হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি এই কর্মে শ্রেষ্ঠ ধন অর্থাৎ কর্মের অপেক্ষিত ফল প্রদান করুন অর্থাৎ সৎকর্মের সুফল প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এখানে সঙ্কর্মের সুফল-লাভের প্রার্থনা বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, সৎ-ভাবের প্রভাবে আমরা যেন কর্মফল ভগবানে সমর্পণ করতে প্রবুদ্ধ হই)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমার সকর্মকে পূর্ণফলের দ্বারা পূর্ণ করে অথবা ফলসমন্বিত করে, পুনরায় আমাকে সেই কর্মের সুফল প্রদান করুন অর্থাৎ ধনদানে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করুন। তা হলে হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভগবন্! আমি যেন সকর্মসাধক জীবনের দ্বারা বিযুক্ত না হই, আপনি তা-ই সাধন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমাকে যেন পাপ স্পর্শ না করে এবং তার জন্য আমি যেন সৎপথ-ভ্রষ্ট না হই)। শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন্! আপনি আহ্লাদক অর্থাৎ পরমানন্দ-প্রদায়ক হন। অতএব আপনি এই শরণাগত প্রার্থনাকারী আমার পরমসুখ-হেতুভূত হন; এইভাবে আমাকে অনুগৃহীত করুন অথবা হৃদয়ে প্রদীপ্ত হোন। শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন্! আপনি সৎ-ভাব-রূপে শরণাগতের ব্যাপক হন। অতএব এই শরণাগত প্রার্থনাকারী আমার সৌভাগ্যের অর্থাৎ পরমসুখের নিমিত্ত আপনি সেইভাবে আমার অন্তর ব্যাপ্ত করুন। শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন্! আপনি জ্ঞানজ্যোতিঃ-সমুহের উৎসারক হন। (অথবা, পয়স্বিনী গাভী যেমন পয়ঃনিঃসারণের দ্বারা লোকসমূহকে রক্ষা করে, সেইভাবে জ্ঞানধনদানে আপনি পাপনিঃসারক ও লোকসমূহের রক্ষক হন)। অতএব আপনি এই শরণাগত প্রার্থনাকারী আমার সৌভাগ্যের নিমিত্ত (অর্থাৎ সৎ-ভাবের দ্বারা পরমসুখ-সাধনের জন্য) জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা হৃদয়কে পরিব্যাপ্ত করুন। শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন্! আপনি অভীষ্টপ্রাপক হন। অতএব আপনি এই শরণাগত প্রার্থনাকারীর (আমার) অভীষ্টপ্রাপ্তির হেতু হোন অর্থাৎ সেইভাবে জাগরুক থাকুন। শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন্! আপনি ভববন্ধনের ছেদক হন। অতএব আপনি এই শরণাগত প্রার্থনাকারী আমার সৌভাগ্যের অর্থাৎ ভববন্ধনছেদনরূপ পরমসুখের নিমিত্ত হোন অর্থাৎ অনুগ্রহ করুন। শুদ্ধসত্ত্বরূপিন্ হে ভগবন! আপনি সৎ-বৃত্তি-সমূহের উন্মেষক হন। অতএব আপনি এই শরণাগত প্রার্থনাকারী আমার পরমসুখের নিমিত্ত অনুগ্রহ করুন অর্থাৎ সৎ-বৃত্তির উন্মেষণে, সহায় হোন। হে আমার মন! বায়ুরূপে বর্তমান বিশ্বের জীবনস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার মন! বরুণরূপে বর্তমান স্নেহকারুণ্যময় ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার মন! দিপালরূপে বর্তমান জগতের পালক ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার মন! শাসকরূপে বর্তমান সর্বসংহারক ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত দেবীস্বরূপ হে শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! তমোভাবের শোষক তোমাদের যে প্রসিদ্ধ সত্ত্বপ্রবাহ বিদ্যমান, ভগবানে স্থাপনযোগ্য, শক্তিদায়ক এবং পরমানন্দপ্রদ সেই সত্ত্বপ্রবাহকে যেন আমি অতিক্রম করে যাই (অর্থাৎ তাকে যেন বিনষ্ট করি)। অপিচ, সেই সত্ত্বপ্রবাহ লাভ করে ইহলোকসম্বন্ধি দুচ্ছেদ্য বন্ধন বিমুক্ত করতে যেন সমর্থ হই। হে মন! সঙ্কর্মে সমুদ্ভূত কল্যাণ কামনা করো অর্থাৎ সকর্মের সুফলোভের জন্য প্রবুদ্ধ হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক)। অপিচ, হে মন! প্রজ্ঞানের আধার ভগবান্ তোমার অগ্রে গমন করুন। (ভাব এই যে,–প্রজ্ঞানের আধার ভগবান তোমার পথপদর্শক হোন)। অনন্তর (সৎপথ অবগত হয়ে) হে মন! ইহজগতে শ্রেষ্ঠ পদে গমন করো। অর্থাৎ সৎপথে গমন করে শ্রেষ্ঠ পরমস্থান প্রাপ্ত হও। সর্বশক্তির আধার হে ভগবন্! আপনি বাহিরের ও অন্তরের শত্রুদের (হৃদয়রূপ যজ্ঞ-স্থান থেকে দূরে স্থাপন করুন। যে হৃদয়-প্রদেশে (অথবা যে যজ্ঞভূমিতে) নিখিল সত্ত্বভাব (দেববিভূতি) নিত্যকাল অবস্থান করেন, হে ভগবন্! এইরকম হৃদয়-প্রদেশ (যজ্ঞভূমি) এই মর্ত্যলোকে (সংসারে) থেকেই আমরা যেন প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে,–এই সংসারে অবস্থিত থেকেই আমরা যেন সত্ত্বভাব-সমন্বিত হতে পারি)। অজ্ঞানতার সমুদ্র উত্তীর্ণ হতে ইচ্ছুক আমরা (যেন) ঋক্ সাম ও যজুমন্ত্র-রূপ স্তবের দ্বারা এবং পরমধন তত্ত্বজ্ঞানের পোষক সত্ত্বভাবের দ্বারা সম্যকমে হৃষ্ট হই। (ভাব এই যে, ভগবানের উপাসনায় অজ্ঞানতার বিনাশে আমরা যেন প্রজ্ঞান লাভ করি) ॥ ৩৷৷
[কর্মকাণ্ডানুযায়ী তৃতীয় অনুবাকে দীক্ষিত কর্তৃক দেবযজন বা দেবপূজার অধিকারের বিষয় পরিবর্ণিত। কিন্তু সেই সম্পর্কেও এক বিশেষ বিধি আছে। দেবযজনে অধিকার লাভের পূর্বে দীক্ষিত ব্যক্তিকে ব্রতপালন দ্রব্য সম্পাদন করতে হয়। এ ছাড়া, দীক্ষিত হলেও, তার দেব্যজনে অধিকার জন্মায় না। তাই এই অনুবাকের প্রথম কয়েকটি মন্ত্রে, সোমযাগ সম্পাদনে সোম-ক্রয়ণ ইত্যাদির পূর্বেই ব্রতপান ইত্যাদির বিষয় অভিহিত হয়েছে। এই অনুবাকের মন্ত্রগুলির বিনিয়োগ পরিদৃষ্ট হয়;-দৈবীং ধিয়ং প্রভৃতি মন্ত্রে হস্ত ইত্যাদি প্রক্ষালন; তারপর আচমন ইত্যাদি ক্রিয়া সম্পাদনের পর যে দেবা প্রভৃতি মন্ত্রে ব্রতপয়ঃ পান করণীয়। অগ্নে ত্বং প্রভৃতি মন্ত্রে অগ্নি প্রজ্বালিত করে, ত্বমগ্নে প্রভৃতি মন্ত্রে সেই অগ্নির উদ্দেশে জপ করবার বিধি। বিশ্বে দেবা পুষা সন্যা প্রভৃতি মন্ত্রে সনিহারানুশাসন, দেবঃ সবিতা, বসো চন্দ্রমসি প্রভৃতি ছয়টি মন্ত্রে পরিগ্রহ। তারপর বায়বে ত্বাং প্রভৃতি চারটি মন্ত্রে গরুকে স্পর্শ করতে হয়। দেবীরাপঃ প্রভৃতি মন্ত্রে জলের মধ্যে লোষ্ট নিক্ষেপ করে, সেই লোষ্টকে জলের দ্বারা বিমর্দন এবং পরিশেষে ভদ্রাদভি প্রভৃতি মন্ত্রে রথে গমন করে এদং প্রভৃতি মন্ত্রে যাগভূমিতে অবস্থিতি। বলা বাহুল্য, বিনিয়োগ সংগ্রহের উল্লিখিত বিনিয়োগ অনুসারে ভাষ্যকার মন্ত্রের ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিষ্কাশন করেছেন। আর সেই বিনিয়োগ অনুসারেই ভাষ্যে মন্ত্রের ভাব প্রকটিত হয়েছে।–ক্রিয়াকর্মে মন্ত্রগুলি যে ভাবেই প্রযুক্ত হোক, সে বিষয়ে আমাদের কিছু বক্তব্য নেই। আমরা কেবল আধ্যাত্মিক বিচারে মন্ত্রের নিগুঢ় ভাব লক্ষ্য করে তা মর্মার্থে প্রকাশ করেছি। তাই আমাদের অর্থ অনেক স্থলে ভাষ্য থেকে স্বতন্ত্র বলে উপলদ্ধ হবে। কয়েকটি স্থলে অবশ্য ভাষ্যকারের সাথে আমাদের মন্ত্রার্থে বিশেষ মতদ্বৈষ হয়নি । ৩।
.
চতুর্থ অনুবাক
মন্ত্র- ইয়ং তে শুক্র তনুরিদং বচ্চস্তয়া সং ভব ভ্ৰাজং গচ্ছ। জ্বরসি ধৃতা মনসা জুষ্টা বিষ্ণবে তস্যান্তে সত্যসবসঃ প্রসবে বাচো যন্ত্রমশীয় স্বাহা। শুক্রমস্যামৃতমসি বৈশ্বদেবং হবিঃ। সূর্যস্য চক্ষুরাহরুহমগ্নেরক্ষঃ কনীনিকাং যদেতশেভিরীয়সে ভ্ৰাজমানো বিপশ্চিতা। চিদসি মহসি ধীরসি দক্ষিণা অসি যজ্ঞিয়াহসি। ক্ষত্রিয়াহস্যদিতিরস্যুভয়তঃ শীষ্ণী। সা নঃ সুপ্রাচী সুপ্রতীচী সং ভব মিত্ৰস্তা পদি বধাতু পুষাহধ্বনঃ পাত্বিায়াধ্যক্ষায়। অনু ত্বা মাতা মনতামনু পিতাহনু ভ্রাতা সগর্ভোহনু সখা স্যুথ্যঃ। সা দেবি দেবমচ্ছেহীন্দ্রায় সোমং রুদ্রপ্তাহবৰ্তয়তু মিত্রস্য পথা স্বস্তি সোমসখা পুনরেহি সহ রষ্যা ॥৪॥
মর্মার্থ- হে শুক্ল, হে জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেব! আমার এই দেহলক্ষণে বিদ্যামানতাই (শরীরই) আপনার আশ্রয়স্থান; সকলের অনুভূয়মা শুদ্ধসত্ত্বই আপনার তেজঃ অর্থাৎ প্রকাশ-রূপ; আমার এই দেহের সাথে একীভূত হোন, (অথবা-একীভূত হয়ে) আপনি শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আপনি জ্ঞানরূপে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে, আমার হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বের সাথে মিলিত হোন)। হে শুদ্ধসত্ত্বের অঙ্গীভূত ভক্তি! আপনি আমার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত থেকে বিশ্বব্যাপী সেই ভগবানের প্রতি প্রীতিযুক্ত হয়ে, আমার শক্তিবর্ধক হোন। (ভাব এই যে, ভগবৎ-প্রীতিসাধিকা ভক্তি আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমার প্রাণশক্তি বর্ধন করুন–এই আকাঙ্ক্ষা)। পূর্বোক্ত গুণে অন্বিতা সত্যসহজাতা ভক্তির অনুবর্তী হলে, আমি আমার এই জীবনের দৃঢ়তা প্রাপ্ত হতে পারি। সেই সঙ্কল্পে স্বাহামন্ত্রে হবিঃ-অর্পণ করছি। আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে, আমার হৃদয় ভগবৎ-ভক্তিতে পূর্ণ হোক)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি তেজঃস্বরূপ হও, পরম আনন্দদায়ক হও, মরণরহিত নিত্য হও, সর্ব-দেবভাবের প্রাপক হও। (ভাব এই যে, সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাতে জাগরিত হোক)। হে আমার মন! জ্ঞানাধারের দৃষ্টিকে প্রাপ্ত হও, এবং জ্ঞানদেবের নেত্রের তারকাকে প্রাপ্ত হও; (ভাব এই যে,জ্ঞানের দৃষ্টি তোমার প্রতি পতিত হোক অর্থাৎ তুমি একান্তে জ্ঞানের অনুসারী হও)। যে অবস্থায় গমনের জন্য তুমি জ্ঞানীর সাথে দীপ্যমান অর্থাৎ সম্মিলিত হও, ত্বরিৎ-সৎকর্মর্তার দ্বারা সেই অবস্থায় অগ্রসর বা উপনীত হও। (ভাব এই যে, –জ্ঞানীকে অনুসরণ করে সৎকর্মের অনুষ্ঠানে তুমি জ্ঞানবান্ হও)। হে শুদ্ধসত্ত্বের অঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিনি দেবি! আপনি চিৎস্বরূপা চৈতন্যরূপা চিন্ময়ী অথবা অচেতনে চেতনা-সম্পাদয়িত্রী হন; আপনি মনঃস্বরূপা সর্বজ্ঞা অথবা সঙ্কল্প-বিকল্প-বিরহিতা নির্বিকল্পরূপা হন; আপনি নিশ্চয়রূপাত্মিকা প্রজ্ঞানস্বরূপা হন। আপনি সঙ্কৰ্ম-সমূহের পূর্ণর্তাসাধনকী অথবা অভীষ্টপূরণ কত্রী হন; আপনি অমিতেজা অজেয় হন; আপনি যজ্ঞস্বরূপা অথবা সকলের বন্দনীয়া ও নিখিল প্রাণিগণের হৃদয়ে ধারণযোগ্যা হন; আপনি আদি-অন্ত-রহিতা অনন্তরূপা হন; (অতএব আপনি আদি-অন্ত সর্বত্র সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠা অথবা সকলের বরণীয় হন। (এই মন্ত্রাংশে দেবী ভগবতীর স্বরূপ ব্যক্ত হয়েছে। ভাব এই যে,-হে দেবি! আপনি সর্বাত্মিকা সৎ-চিৎ-আনন্দরূপা ষড়েশ্বর্যশালিনী। অতএব, আপনি সকলেরই বরণীয়া পূজা। বিশ্বের সকল লোকই আপনাকে কামনা করে। আমরাও আপনার করুণা প্রার্থনা করছি। কৃপা করে, আপনি আমাদের নিকট আপনার মহিমা ব্যক্ত করুন এবং আমাদের আপনার সাথে সংযুক্ত করুন। মন্ত্রে এইরকম প্রার্থনার ভাব প্রকাশ পেয়েছে)। হে দেবি! পূর্বোক্ত-গুণোপে আপনি, আমাদের পরিত্রাণের জন্য সুষ্ঠুভাবে আমাদের অভিমুখী অর্থাৎ আমাদের সহজপ্রাপ্ত হোন; অথবা, প্রথমতঃ আমাদের সত্ত্বসমন্বিত করুন, পরে আমাদের সম্যকরকমে আপনার অভিমুখী করুন; অথবা, আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব নিয়ে আমাদের হৃদয়ে আপনি অধিষ্ঠিত হোন। প্রজ্ঞানরূপী সেই মিত্রদেব, আপনাকে শ্রেষ্ঠপ্রদেশে বন্ধন করুন অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করুন। সর্বদশী সঙ্কর্ম স্বামী ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত সৎ-ভাব-পোষক সর্বসংরক্ষক পূষা দেবতা (আমাদের ) অসৎ-মার্গ হতে রক্ষা করুন। (মন্ত্রের এই অংশের প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে দেব! আপনি আমাদের সত্ত্ব-সমন্বিত করুন, আর সেই সত্ত্বভাব-সহযুত হয়ে আপনি আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হোন। যেন অকিঞ্চন আমরা ভগবৎ-প্রীতির সাধনে সমর্থ হই এবং মোক্ষ লাভ করি)। ভক্তিরূপিণি হে দেবি! সন্তানের হিত-অভিলাষিণী সকল জননীই আপনাকে অনুস্মরণ করুন; (অর্থাৎ, ইহজগতে সকল জননীই ভগবানে ভক্তিপরায়ণা হোন); সেইরকম, সন্তানহিতকামী সকল জনকই আপনাকে অনুস্মরণ করুন; (অর্থাৎ-সংসারের সকল পিতাই ভগবানে ভক্তিপরায়ণ হোন); এইভাবে, সমানগর্ভস্যুত অর্থাৎ মনুষ্যপর্যায়ভুক্ত সকল ভ্রাতাই আপনাকে অনুস্মরণ করুন (অর্থাৎ ভগবৎ-ভক্তি-সমন্বিত হোন); এইরকম স্বদলভুক্ত সকল মিত্রজন আপনাকে অনুস্মরণ করুন;(অর্থাৎ, সকল মনুষ্যই ভগবানে ভক্তিপরায়ণ হোন)। হে দ্যোতমান-আত্মনে! অশেষ-হিতসাধিকা সেই আপনি, আমাদের দেবভাব প্রদান করুন। আর, ভগবান্ ইন্দ্রদেবের নিমিত্ত আমাদের শুদ্ধ সত্ত্বকে বহন করে নিন; রুদ্রভাবাপন্ন দেব (অর্থাৎ দেবতার কঠোর ভাব) আপনাতে অবস্থিত হোন, অর্থাৎ আপনাকে পেয়ে আমাদের প্রতি রোষ প্রকাশে প্রতিনিবৃত্ত হোন; আর, শুদ্ধসত্ত্বভাব-সহযুতা হয়ে, আপনি আমাদের হৃদয়ে চিরবিদ্যমানা থাকুন। (মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে,সংসারের সকলেই ভগবৎ-ভক্তি-পরায়ণ হোক; ভগবৎ-ভক্তিই মানুষকে পরমপদ প্রদান করে)। ৪।
[ভাষ্যের মত এই যে,–এই অনুবাকের প্রথম মন্ত্রটি অগ্নিকে অথবা হিরণ্যকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রটি সোময়নি-রূপা বাক-সম্বোধনে প্রযুক্ত। কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মন্ত্রের প্রয়োগ অনুসারে প্রথমটির অর্থ-হে শুক্ল অর্থাৎ দীপ্যমান হিরণ্য! এই দৃশ্যমান আজ তোমার শরীর, আর এই আজ্যে প্রক্ষিপ্যমাণ হিরণ্য তোমার বর্চঃ অর্থাৎ তেজঃ। হে অগ্নি! তোমার এই আজ্যরূপ তনুতে তুমি একীভূত হও এবং তার পর ভ্ৰাজকে অর্থাৎ স্বর্ণের দীপ্তিকে তুমি প্রাপ্ত হও। আর একরকম অর্থে ভ্ৰাজং পদে সোমং অর্থ গ্রহণ করায় ভাব এসেছে-তুমি সোমকে প্রাপ্ত হও। এইভাবে ভাষ্য-অনুসারে, দ্বিতীয়, মন্ত্রের অর্থ হয়েছে-হে বাক্! তুমি বেগযুক্ত আছ। তুমি কেমন? না–মনের দ্বারা নিয়মিতা আর যজ্ঞার্থে প্রীতিযুক্তা। শুক্লযজুর্বেদে উবটের ব্যাখ্যায় বিষ্ণবে পদের প্রতিবাক্যে বিষ্ণো সোমস্য অর্থ গৃহীত হয়েছে। সেই অনুসারে ভ্ৰাজং পদেও সোম বোঝায়, বিষ্ণু পদেও সোম বোঝায়। হায় সোম!-বেদের অঙ্গে যে তুমি কত মূর্তিতেই বিচরণ করছি, কে তার ইয়ত্তা করবে! সোম যে হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব-ভাব সেটা বুঝতে কষ্ট কোথায় তা আমরা বুঝি না। তৃতীয় মন্ত্রটি–কেন হিরণ্যের সম্বোধনে প্রযুক্ত হবে? আমাদের মতে বিষ্ণবে জুষ্টা ভক্তির সাহায্যে যে শুদ্ধসত্ত্বভাব সঞ্জাত হয়, এখানকার সেটিই লক্ষ্যস্থল। চতুর্থ মন্ত্রের, ভাষ্যমতে, সম্বোধন হিরণ্য, সূর্য এবং অগ্নি। আমরা কিন্তু মন্ত্রটি হিরণ্য, সূর্য, অগ্নি অথবা কৃষ্ণাজিন সম্বন্ধে প্রযুক্ত না হয়ে মনঃ-সম্বন্ধে প্রযুক্ত বলে মনে করি। ভাষ্যকার বলেন, পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্র দুটিতে বাক্ দেবতারূপ সোমক্রয়ণীকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকারের অধ্যাহৃত সম্বোধন পদ মন্ত্রের মধ্যে দেখা যায় না। মন্ত্রে সোমক্রয়ণি বা গবাদি কিছুরই উল্লেখ নেই। আমরা মনে করি, পূর্ব পূর্ব মন্ত্রের সাথে এই উচ্চভাবে ভাবান্বিত মন্ত্র দুটির সম্বন্ধ সূচিত হয়েছে। পঞ্চম মন্ত্রে দেবতার স্বরূপ-তত্ত্ব এবং ষষ্ঠ মন্ত্রে দেবতার নিকট প্রার্থনার বিষয় পরিব্যক্ত হয়েছে। সপ্তম ও অষ্টম মন্ত্রেও, আমরা এক উচ্চ ভাব প্রকটিত দেখি। অথচ ভাষ্যে মন্ত্র দুটির যে অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে, তার মর্ম এই যে,-হে সোমক্রয়ণি গো! সোম-আহরণে প্রবৃত্ত তোমাকে তোমার মাতা অনুমতি দান করুন, তোমার পিতা অনুজ্ঞা করুন, তোমার সহোদর ভ্রাতা এবং তোমার সমান গৃহে জাত তোমার সখা তোমায় অনুমতি দিন। হে সোময়নি দেবি! তুমি ইন্দ্রদেবের জন্য সোম (অবশ্যই মাদক-দ্রব্য) আনয়ন করতে যাও। সোমগ্রহণ পূর্বক অবস্থিত তোমাকে রুদ্রদেব আমাদের প্রতি নিবর্তন করুন, অথবা প্রবর্তন করুন। সোমদেব যার সখা, সেরকম সোমসখা অর্থাৎ সোমের সাথে তুমি সুমঙ্গলের সাথে পুনরায় আমাদের নিকট আগমন করো। রুদ্রের পথে যেও না; মিত্রের পথে যেও। তাহলেই তুমি স্বস্তি পাবে।–কর্মকাণ্ডের দিক থেকে এমনই অর্থ সমীচীন। কিন্তু এই মন্ত্রগুলির আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে কি রূপ পেতে পারে, আমাদের মর্মার্থেই তা প্রকাশিত] । ৪
.
পঞ্চম অনুবাক
মন্ত্র- ব্যসি রুদ্ৰাহস্যদিতিরস্যাদিত্যাহসি শুক্রাইসি চন্দ্রাহসি।। বৃহস্পতিস্তা সুম্নে রথতু। রুদ্ৰো বসুভিরা চিকেতু। পৃথিব্যাস্তা মূর্ধন্না জিঘর্মি দেবযজন ইড়ায়াঃ পদে যুবতি স্বাহা। পরিলিখিতং রক্ষং পরিলিখিতা-অরাতয়। ইদমহং রক্ষসসা গ্রীবা অপি কৃামি। যোহপ্যান্বেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্ম ইদমস্য গ্রীবাঃ অপি কৃতামি। অম্মে রায়ত্তে রায়স্তোতে রায়ঃ। সং দেবি দেব্যোরশ্যা পশ্য। ষ্টীমতী তে সপেয় সুরে রেতো দখানা বীরং বিদেয় তব সদৃশি। মাহহং রায়ম্পোষেণ বি যোষম্ ॥ ৫॥
মর্মার্থ- হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনি বসুরূপা অর্থাৎ পৃথ্বীরূপা হন, আপনি অনন্তরূপা অর্থাৎ অশেষরূপধারিণী হন, আপনি অনন্তের অংশীভূতা অর্থাৎ দেবস্বরূপা হন, আপনি রুদ্রারূপা অর্থাৎ কঠোরতাময়ী হন, আপনি চন্দ্ররূপা হন, অর্থাৎ হ্লাদিনী কোমলতাময়ী হন। (এই মন্ত্রাংশ, ভক্তিরূপে অবস্থিত দেবীর স্বরূপ পরিকীর্তন করছে। সেই দেবী পৃথ্বীরূপে বিরাজিতা, সেই দেবীই সমষ্টিভূতা, সেই দেবীই অংশরূপা, সেই দেবীই সংহারমূর্তিধারিণী, সেই দেবীই আনন্দরূপিণী। কোমল-কঠোর সকল ভাব এবং ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল রূপ সেই দেবীতেই যুগপং বিদ্যমান আছে। জ্ঞানী (জ্ঞানদেব) সংসারের সুখের নিমিত্ত আপনাকে সংযমন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত করুন; (ভাব এই যে, জ্ঞানিগণের সহায়তায় আপনার প্রসাদে ইহলোক পরমানন্দ লাভ করুক)। কঠোরভাব (রুদ্রদেব) সর্বংসহা ধরিত্রীর সাথে আপনাকে রক্ষা করবার কামনা করুন; অর্থাৎ আপনার প্রভাবে সৃষ্টি সংহারমূর্তি রুদ্রের রোষ হতে রক্ষা-প্রাপ্ত হোক। (মন্ত্রের তাৎপর্যার্থ এই যে,-ভগবৎ-ভক্তিই সকল সুখের মূলীভূতা। তার কৃপাতেই মানুষ রক্ষাপ্রাপ্ত হয়)। হে ভক্তিরূপিণি দেবী! পৃথিবীর (অর্থাৎ বিশ্বের শীর্ষস্থানে দেব-যজন-প্রদেশে অবস্থিতা আপনাকে, অনুক্রমে আমি আমার প্রতি ক্ষরণ প্রবহণ বা আকর্ষণ করছি। (মন্ত্রাংশ সঙ্কল্পমূলক আত্ম-উদ্বোধক)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধযুত কর্মের অবলম্বন হও। অথবা হে আমার কর্ম! তুমি ভক্তিযুতা স্তুতির আশ্রয় হও; (ভাব এই যে, আমার কর্ম ভগবানে ভক্তিযুত হোক)। ভক্তিসহযুতা করে, হে আমার কর্ম, স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে আমি ভগবানে সমর্পণ করছি। (আমাদের) দুবুদ্ধিরূপ শত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হোক; সৎ-ভাবের প্রতিবন্ধক রিপুশত্রুগণ বিতাড়িত ও বিনাশিত হোক। (ভাব এই যে,-ভক্তির প্রভাবে আমাদের সকল শত্রু বিনষ্ট হোক। এই সৎকর্মের প্রভাবে আমি যেন দুবুদ্ধিরূপ শত্রুর মূলোচ্ছেদ করতে সমর্থ হই। যে সকল বহিঃ ও অন্তঃশত্রু প্রার্থনাকারী অনুষ্ঠানপরায়ণ আমাদের হিংসা করে, সেই উভয়রকম আধিভৌতিক শত্রু আমাদের এই কর্মরূপ আয়ুধের দ্বারা সমূলে বিনষ্ট হোক। (ভাব এই যে, আমাদের কর্মের দ্বারা আমরা যেন সকল শত্রুকে নাশ করতে সমর্থ হই)।
হে ভক্তিরূপিণি দেবি! পরমার্থ ধন আমাদের দান করুন–এই প্রার্থনা। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনাতে পরমার্থরূপ ধনসমূহ আছে। সেই ধন আপনি সকল লোকে স্থাপন করুন। (ভাব এই যে, –আমরা পরমধন প্রার্থনা করি। কেবল আমাদের নয়; পরন্তু বিশ্বের সকলকেই পরমধন প্রদান করুন। সকলের জন্য মঙ্গল-কামনা এখানে স্পষ্টরূপে স্বীকৃত)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনি পরম শক্তিসম্পন্ন সকলের বশীভূতকারী শক্তির দ্বারা আমার প্রতি সম্যক্ করুণাপরায়ণ হোন। হে ভক্তিরূপিণি দেবী! আপনার অনুগ্রহে শোভন-কর্মশক্তি-সম্পন্না আপনাকে যেন প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে,ভগবৎ-ভক্তি আমার সাথে চিরসম্বন্ধযুত হোক)। অপিচ, শোভনশক্তিসম্পন্ন, শক্তির আধারভূতা হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনার সন্দর্শন লাভ করে যেন সৎকর্মের সাধন-সামর্থ্য লাভ করতে পারি। (ভাব এই যে, আপনার প্রসাদে ও সহচারিত্বে সঙ্কৰ্ম-সাধনে সামর্থ্য পাবার কামনা করছি)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! অর্চনাকারী আমরা সেই ধনসঞ্চয়ে অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব-সঞ্চয়ে যেন বিমুখ না হই; (অর্থাৎ আমাদের পরমার্থরূপ ধন-সঞ্চয়ে যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে, তা-ই করুন)। ৫
[পঞ্চম অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে, সোমক্রয়ণি সংগ্রহে যাওয়ার সময়ে যে যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতির অনুসরণ করতে হয়, তা-ই উক্ত হয়েছে। সে হিসেবে, কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে, সোময়ণিই অনুবাকের মন্ত্রগুলির লক্ষ্য। প্রথম মন্ত্রে শুক্র শব্দে দীপ্তিমান্ সোম বিবক্ষিত। চন্দ্র শব্দে আহ্লাদকারী সুবর্ণ উপলক্ষিত। মন্ত্রের অর্থ-হে সোমক্রয়নি! তুমি বসু প্রভৃতি দেবতার অপেক্ষিত সোম-যাগসাধক বলে ঐ সকল দেবতার স্বরূপ হও। শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতা-য়ও এই মন্ত্র দৃষ্ট হয়। সেখানে উবটের ও মহীধরের ভাষ্যে একটু অর্থান্তর পরিদৃষ্ট হয়। সে অর্থ এই–হে গো! তুমি বসুরূপা হও, তুমি দ্বাদশ আদিত্যরূপা হও। তুমি একাদশ রুদ্ররূপা হও, তুমি চন্দ্ররূপা হও। বৃহস্পতি সুখে তোমায় রমণ করুন অথবা সংযমন করুন। রুদ্র, বসুগণ প্রভৃতি অষ্ট দেবতার সাথে তোমাকে রক্ষা করবার কামনা করুন। এই গৌঃ সম্বোধনে গাভীকে কি অন্য কোনও অপার্থিব বস্তুকে সম্বোধন করা হয়েছে, তা বোঝবার উপায় নেই। কর্মকাণ্ডে গৌঃ অর্থে গাভী থাকুক, তাকে বৃহস্পতি সুখে রমণ করুন, তাতে আমাদের কিছু বলবার নেই। তবে আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে আমরা ঐ সম্বোধনে জ্ঞানকে বা জ্ঞানস্বরূপিণী দেবীকে আহ্বান করা হয়েছে বলে মনে করেছি। গো অর্থে জ্ঞানরশ্মি–আমরা সঙ্গত ভাবেই সর্বত্রই তা উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় মন্ত্রটিও সোমক্রয়ণি সম্বোধনে বিনিযুক্ত। আমাদের মতে, মন্ত্রের সম্বোধ্য–সেই ভক্তিরূপিণী দেবী। মন্ত্রের বৃহস্পতি পদে আমরা জ্ঞানীকে বা জ্ঞান দেবতাকে লক্ষ্য করেছি। তৃতীয় ও সপ্তম, অষ্টম ও নবম মন্ত্রে হোম সম্পাদন করতে হয়। ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রের সম্বোধ্য আজ্য! আমরা পূর্বাপর সঙ্গতির প্রতি লক্ষ্য রেখে, যে অর্থ পরিগ্রহণ করেছি তার যৌক্তিকতা যথেষ্ট আছে। সপ্তম থেকে নবম পর্যন্ত মন্ত্রের আধ্যাত্মিক ভাব মর্মার্থে প্রকাশিত। চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ মন্ত্র তিনটিতে আমরা অন্তঃশত্রু-নাশের আকাঙ্ক্ষা ও সঙ্কল্প পরিব্যক্ত বলে মনে করি। ভাষ্যমতে দশম মন্ত্রের সম্বোধ্য সোমক্রয়নি। আমাদের মতে পূর্ব পুর্ব মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রেরও সম্বোধ্য ভক্তিরূপিণী দেবী। উর্বশী পদে ভাষ্যকার উর্বশী দেবী অর্থ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমাদের অভিপ্রায়-উর্বশী পদে সকলের বশকারী শক্তিকে বোঝাচ্ছে। একাদশ মন্ত্রে ভাষ্যকার প্রথমে যজমানকে এবং পরে সৌময়ণিকে সম্বোধন করেছেন। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ হয়েছে-হে যজমান! তোমার সাথে যেন গমন করি। অথবা হে সোময়নি! তোমার অনুগ্রহে আমি যেন পতির সাথে গমন করতে পারি। ত্বষ্টা–স্ত্রীপুরুষ মিথুন ক্রমে পশু ও মনুষ্যগণের শরীর নির্মাতা। সেই ত্বষ্টার অনুগ্রহে, হে সোময়নি! তোমার মতো বীর পুত্র যেন লাভ করতে সমর্ত হই। আমাদের মতে, পূর্ব পূর্ব মন্ত্রের মতো এ মন্ত্রেরও সম্বোধন-ভক্তিরূপিণী দেবী। লৌকিক যাগযজ্ঞের প্রয়োগ বশতঃ ভাষ্যকারের বক্তব্য বা বিশ্লেষণ অসম্ভব নয়। কিন্তু আধ্যাত্মিক যজ্ঞে কোন্ উক্তির কি সার্থকতা তা আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশিত] ॥ ৫৷
.
ষষ্ঠ অনুবাক
মন্ত্র- অংশুনা তে অংশুঃ পৃচ্যতাং পরুষা পরুর্গন্ধস্তে কামমবতু মদায় রসো অচ্যুতোহমাত্যোহসি শুক্ৰস্তে গ্রহঃ। অভি ত্যং দেবং সবিতারমুণ্যোঃ কবিক্রমামি সত্যসবসং রত্নধামভি প্রিয়ং মতি। ঊর্ধ্বা যস্যামতির্ভা অদিতৎ সৰীমনি হিরণ্যপাণিরমিমীত সুতুঃ কৃপা সুবঃ। প্রজাভ্যা। প্রাণায় ত্বা ব্যানায় ত্ব। প্রজাতৃমনু প্রাণিহি প্রজান্তামনু প্রাণন্দু ॥৬॥
মর্মার্থ- হে দেব! আমার সূক্ষ্ম-অবয়ব আপনার সূক্ষ্ম-অবয়বের সাথে মিলিত হয়ে বিলীন হয়ে যাক। অপিচ, আমার স্কুল-অবয়ব আপনার স্কুল-অবয়বের বা অংশের সাথে সম্মিলিত হোক। আপনার করুণা আমাদের অভীষ্ট পুরণ করুন। (অর্থাৎ আপনি কৃপা করে আমাদের অভিষ্ট পুরণ করুন)। আপনার স্নেহ-অনুরাগ অথবা আপনার অংশভূত শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের পরমানন্দ-দানের নিমিত্ত বিনাশরহিত ও ক্ষয়রহিত হোক। হে দেব! আপনি সকলের সখিভূত হন অর্থাৎ বিশ্বের জড় অজড় সকল পদার্থে নিত্যবিদ্যমান রয়েছেন। আপনার সম্বন্ধি প্রকৃষ্ট জ্ঞান একমাত্র শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই অধিগত হয়। জ্ঞানই সকলের মূল। জ্ঞান ভিন্ন ভগবানের স্বরূপ জানতে পারা যায় না। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং ভগবানের স্বরূপ বিজ্ঞাপক। মন্ত্রে আত্মার আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবানের সাথে সম্বন্ধ আমাদের অবিচ্ছিন্ন হোক; অপিচ, তার সাথে সম্মিলন-সাধনে আমাদের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব হোক)। দ্যাবাপৃথিবীর অভ্যন্তরে সর্বত্র বর্তমান অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী, মেধাবী অর্থাৎ সৎকর্মের ক্রমবেত্তা অথবা অশেষ-প্রজ্ঞানসম্পন্ন, সত্যস্বরূপ অথবা অর্চনাকারিদের সৎপথে নয়নকর্তা, সঙ্কর্মের ফলস্বরূপ রত্নধারণকারী অথবা মোক্ষফল-রূপ শ্ৰেষ্ঠরত্নের ধারক বা পোষক, সকলের প্রীতির সামগ্রী অথবা সকলের প্রতি প্রীতিসম্পন্ন-নিখিল বিশ্বের প্রতিস্থানীয়, মননযোগ্য অথবা অর্চনাকারিদের সুমতি বিধায়ক, ক্রান্তদর্শী (সর্বদশী) সেই প্রসিদ্ধ সবিতৃদেবকে (জ্ঞানপ্রেরক দেবতাকে) প্রকৃষ্টভাবে (কায়মন ও বাক্যের দ্বারা) অর্চনা করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। (এই মন্ত্রাংশ সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধনসূচক)। যে সবিতৃদেবের ১(জ্ঞানদেবতার) অপরিমেয় অর্থাৎ সর্বপ্রকাশশীল দীপ্তি জ্ঞানকিরণ, নিখিল সৎ-ভাব বিধানের জন্য (নিখিল সৎ-ভাব-জনন বা সৎকর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত) গগনমুখী অর্থাৎ সাধকদের উচ্চ হৃদয়-অভিমুখী হয়ে, সকল বস্তুকে দীপ্তিশালী করে অর্থাৎ ইহজগতে সত্ত্বভাব ইত্যাদি উৎপন্ন (প্রেরণ) করে; জ্ঞানপ্রদ অর্থাৎ হিরণ্যের মতো জ্ঞানধন-প্রদানে মুক্তহস্ত, শোভনক্রতুসম্পন্ন অথবা সৎকর্মের আধার, সেই সবিতৃদেব, লোকসমূহের হিতসাধনে অসীম শক্তিসম্পন্ন হন, অর্থাৎ কল্পনাতেও তার শক্তির শেষ জানা যায় না। (এই মন্ত্রাংশে ভগবানের গুণ এবং তার স্বরূপ পরিব্যক্ত হয়েছে)। হে দেব! নিখিল জনগণের শ্রেয়ঃ সাধনের জন্য অথবা সৎকর্মশীল জীবনের জন্য অর্থাৎ হিতের নিমিত্ত আপনাকে অর্চনা অর্থাৎ পূজা করছি। হে দেব! প্রাণবায়ু-সংরক্ষণের অর্থাৎ সকর্মশীল জীবন লাভের নিমিত্ত আপনাকে অৰ্চনা (আরাধনা) করছি। হে দেব! ব্যানবায়ু সংরক্ষণের নিমিত্ত অর্থাৎ শরীরবল-রক্ষায় কর্মশক্তি-লাভের জন্য আপনাকে অর্চনা (আরাধনা) করছি। হে দেব! বিশ্ববাসী সকলকে আপনি অনুপ্রাণিত করুন অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বদানে জীবনদান করুন। (এই মন্ত্রাংশও প্রার্থনামূলক। প্রাণিগণের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবান্ জ্ঞানকিরণের দ্বারা তাদের শুদ্ধসত্ত্ব সমন্বিত সৎ-মার্গগামী করুন, অপিছু তাদের মৃত্যুতুল্য অজ্ঞান-আবরণ অপসারিত করুন– এটাই প্রার্থনা। হে দেব! সকল প্রজা (অর্থাৎ বিশ্ববাসী সকলে) আপনাকে জীবিত অর্থাৎ হৃদয়ে উদ্দীপিত করুক। (ভাব এই যে, বিশ্বের সকলে যাতে আপনাকে হৃদয়ে ধারণে উদ্বুদ্ধ হয়, আপনি তা করুন) ॥ ৬৷৷
[এই অনুবাকের মন্ত্রগুলি সোম-ক্রয় বিষয়ক। সোম পরিমাণ কালে যেমন প্রক্রিয়া ইত্যাদি অবলম্বিত হয়, মন্ত্রে তা-ই উল্লিখিত হয়েছে। বিনিয়োগ সংগ্রহে যেমন ক্রমে মন্ত্রগুলি নির্দেশিত সেইরকম ক্রমেই ভাষ্যকার মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। প্রথম মন্ত্রটি সোম সম্বোধনে বিনিযুক্ত। সেই অনুযায়ী ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রের অর্থ হয়েছে-তোমার এক অংশের সাথে অপর অংশের সংযোগ-সাধন করো। তোমার কোনও অংশই যেন বায়ু প্রভৃতির অভিঘাতে বিযুক্ত না হয়। তোমার এক পর্বের সাথে অন্য পর্ব সংযুক্ত হোক। তোমার গন্ধ যজমানের কামকে পালন করুক, দেবগণের হর্ষের জন্য তোমার রস বিনাশরহিত হোক। হে সোম! তুমি অমাত্য তুমি যজমান এবং দেবগণের সাথে সর্বদা বর্তমান আছ। তোমার স্বীকার হিরণ্যসাধ্য অর্থাৎ হিরণ্য বা স্বর্ণের দ্বারাই সোম ক্রয় করতে পারা যায়। বলা বাহুল্য, ভাষ্যকারের এই অর্থ কর্মকাণ্ডের অনুসারী। ভাষ্যকার এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ পর্যন্ত মন্ত্র পাঁচটির ভাষ্যও রচনা করেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রের ভাষ্যে তিনি সবিতৃদেবের (সূর্য বা কোন্ দেবতা ঠিক বোঝা যায় না) গুণমহিমার বিষয় উল্লেখে ব্যাখ্যা করেছেন। চতুর্থ পঞ্চম ও ষষ্ঠ-মন্ত্রের ব্যাখ্যা-ব্যপদেশে ভাষ্যকার যে ভাব ব্যক্ত করেছেন, তাতেও সোম-সম্বোধন প্রযুক্ত। চতুর্থ মন্ত্রে সোমকে উষ্ণীষের দ্বারা বন্ধন করতে হয়। তাতে মন্ত্রের অর্থ হয়,-হে সোম! প্রজাগণের উপকারের জন্য তোমাকে বন্ধন করি। অঙ্গুলির মধ্যে বিবর করে পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। চতুর্থ মন্ত্রে উষ্ণীষের মধ্যে যে সোমদেবতাকে বন্ধন করা হয়েছে, তার শ্বাসরোধ না হয়, এই জন্য পূর্বোক্ত বিবর করবার প্রয়োজন–সূত্রে এমনই উক্ত হয়েছে। তাতে পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্রের যে অর্থ হয়, যথাক্রমে তা এই,-হে সোম! প্রাণার্থ তোমাকে গ্রহণ করি, প্রাণার্থ তোমাকে ক্ষরিত করি। হে সোম! প্রজাগণ তোমার শ্বাস করুক, অর্থাৎ তোমাকে অনুসরণ করে প্রজাগণ শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে তোমাকে জীবিত রাখুক এবং তুমি শ্বাসকারী প্রজাকে অনুসরণ করে শ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত করো। তোমার এবং প্রজাদের কখনও শ্বাসরোধ না হয়,–এইরকম ভাবে পরস্পর পরস্পরকে অনুসরণ করে জীবিত থাকো। আমাদের আধ্যাত্মিক-ব্যাখ্যার সাথে এই ব্যাখ্যার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আমাদের মত ভগবান যেমন প্রজ্ঞানস্বরূপ, সাধকও যেন সেইরকমই প্রজ্ঞানসম্পন্ন হোন; তিনি যেমন সকর্ম-মণ্ডিত, সাধকও তেমনই সৎকর্মপন্ন হোন। হোন-জ্ঞানবান, হোন-সৎকর্মসাধক; সঞ্চয় করুন–জ্ঞান-কিরণ, সম্পন্ন করুন–সকর্ম। তাহলে প্রজ্ঞানরূপী সৎকর্ম-মণ্ডিত ভগবানের করুণা-কণা-লাভে সমর্থ হবেন;–ততে সাধকের গতিমুক্তির পথ সুগম হয়ে আসবে] ॥ ৬।
.
সপ্তম অনুবাক
মন্ত্র- সোমং তে ক্ৰীণামর্জং পয়স্বয়ং বীৰ্য্যাবন্তমভিমাতিষাহম। শুক্রং তে শুক্রেণ ক্ৰীণামি চন্দ্রম চন্দ্রেণামৃতমমৃতেন সমাত্তে গোঙ। অস্মে চন্দ্রাণি। তপসস্তনুরসি প্রজাপতেৰ্বর্ণস্তস্যাস্তে সহস্রপোষ পুষ্যস্ত্যাশ্চরমেণ পশুনা ক্ৰীণামি।। অম্মু তে বন্ধুময়ি তেরায়ঃ শ্ৰয়স্তাম্। অস্মে জ্যোতিঃ। সোমবিক্রয়িণি তমো। মিত্রো ন এহি সুমিত্রধা ইন্দ্ৰমস্যারুমা বিশ দক্ষিণমুশনুশম্ভং স্যোনঃ স্যোন। স্বান ভ্ৰাজারে বম্ভারে হস্ত সুহস্থ কৃশাণবেতে বঃ সোময়ণাস্তানক্ষধ্বং মা বো দভ ॥৭॥
মর্মার্থ- হে আমার মন (আত্মসম্বোধন)! তোমার মঙ্গলের জন্য বলপ্রাণপ্রদ, জ্ঞানদায়ক অর্থাৎ অমৃতপ্রদ, কর্মশক্তিদায়ক এবং পাপরূপ অন্তঃশত্রুর হন্তারক শুদ্ধসত্ত্বকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। হে আমার মন! তোমার কল্যাণের নিমিত্ত তেজঃস্বরূপ জ্যোতির্ময় অথবা সৎস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বকে তেজের বা জ্ঞানের সাহায্যে অথবা শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি; পরমানন্দদায়ক বা কমনীয় শুদ্ধসত্ত্বকে কমনীয় শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা অর্থাৎ পরমানন্দদায়ক ভক্তি-প্রবাহের দ্বারা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি; অপিচ, অক্ষর, ক্ষয়রহিত শুদ্ধসত্ত্বকে ক্ষয়রহিত সৎকর্মের প্রভাবে বা ভক্তির প্রভাবে ক্রয় করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধনসূচক। ভাব এই যে, অক্ষর অব্যয় সেই ভগবাকে জ্ঞানভক্তিবিমিশ্র শুদ্ধসত্ত্বের বা সৎকর্মের দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়। অতএব সেই শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবানের অনুগ্রহ লাভ করতে হলে শুদ্ধসত্ত্ব-সঞ্চয় এবং সৎকর্ম অনুষ্ঠান একান্ত কর্তব্য)। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ দেব! আপনার সম্বন্ধি যে জ্ঞান সেই জ্ঞান আমাতে অবস্থিত হোক। (ভাব এই যে, হে দেব! আপনি প্রজ্ঞানের আধার। কৃপা করে আপনার অনন্ত প্রজ্ঞানের কণামাত্রও আমাদের প্রদান করুন)। শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ হে দেব! (আপনার সম্বন্ধি), পরমানন্দদায়ক সৎ-ভাবগুলি আমাদের মধ্যে অবস্থিত হোক। (ভাব এই যে,হে দেব! আপনি সৎ-ভাবের আধার। আপনাতে যে সকল সৎ-ভাব বিদ্যমান আছে, তাদের কিঞ্চিৎ আমাদের প্রদান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সঙ্কর্মের অথবা সৎকর্মপরায়ণ জনের আধারস্বরূপ অথবা শরীরের মতো অঙ্গী অর্থাৎ প্রধানস্থানীয় হন। (ভাব এই যে,-তপের প্রভাবে সঙ্কর্মের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হয়)। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি ভগবানের আধারস্বরূপ অথবা শরীরের মতো অঙ্গীভূত হয়। (ভাব এই যে,-ভগবান শুদ্ধসত্ত্বে চিরঅবস্থিত)। তথাবিধ আপনার প্রসাদে সংসারের লোকসকলের পালন কার্যের দ্বারা পরিতুষ্ট হয়ে অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ লোকপালক হয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের দ্বারা যেন আপনাকে অধিগত করতে পারি। (ভাব এই যে,শ্রেষ্ঠ-জ্ঞানের দ্বারাই শুদ্ধসত্ত্ব অধিগত হয়। তার দ্বারা যাতে বিশ্ববাসিগণের পরিপুষ্টি সাধিত হয়, আমি তা-ই করব; অর্থাৎ জনহিতসাধন যেন আমার জীবনের একমাত্র ব্রতের মধ্যে গণ্য হয়)। [বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের এমন দৃষ্টান্তই হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য]।
অথবা,–হে শুদ্ধসত্ব! আপনি বহু আয়াসে অধিগত হন; আপনার সাহায্যে আমি সংসারের লোকসকলের পালনকার্যে যেন পরিপুষ্ট অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ লোকপালক হতে পারি। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার মিত্রস্বরূপ সেই ভগবান আমাদের মধ্যে ক্রীড়াপর হোন; অর্থাৎ, আপনার সাথে আমাদের মধ্যে এসে বিরাজমান থাকুন। তাহলে, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার সম্বন্ধি অর্থাৎ আপনাতে যে পরমার্থরূপ ধন আছে, তা আমাকে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা যেন মোক্ষধন প্রাপ্ত হই)। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগব! আপনি আমাদের মধ্যে জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণ করুন। অপিচ, সৎ-ভাব-প্রতিবন্ধক শত্রুদের মধ্যে অজ্ঞান-অন্ধকার বিস্তার করুন; অর্থাৎ অন্ধকারে আবৃত করে তাদের বিনাশ করুন। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবান্! আপনি সুমিত্র অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সুহৃৎ হন। মিত্রভূত সহায়ক-রূপে আপনি আগমন করুন; অথবা জ্ঞানজ্যোতিঃরূপে আপনি আগমন করুন; অথবা জ্ঞানজ্যোতিরূপে আমাদের প্রতি অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন, অর্থাৎ জ্ঞানজ্যোতিঃ দ্বারা আমাদের হৃদয় আলোকিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা আমাতে শুদ্ধসত্ত্ব অবিচলিত হোক)। হে হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! ভগবানের কামনাপরায়ণ অথবা ভগবানের প্রীতিপ্রদ সুখহেতুভূত অর্থাৎ পরমসুখনিদান তুমি, ভগবানের অঙ্গীভূত সুখস্বরূপ পরমানন্দপ্রদ বিশ্বের আধারস্বরূপ অনন্ত সত্ত্ব-সমুদ্রে প্রবেশ করো, অর্থাৎ অনন্ত সত্ত্ব-সমুদ্রে মিশে যাও। (মন্ত্রে প্রার্থনাকারীর আত্ম-সম্মিলনের কামনা সুচিত হচ্ছে। ভাব এই যে, আমাতে শুদ্ধসত্ত্বের সাথে ভগবানের সম্মিলন ঘটুক)। হে নাদরূপ! হে দীপ্তিমান স্বপ্রকাশ! হে পাপহারক! হে বিশ্বপালক! হে সদানন্দরূপ! হে সকলের পোষক! হে সকলের জীবন অথবা আত্ম উক্তসম্পন্ন জনের প্রাণস্বরূপ! হে আপনারা সপ্তদেবগণ! আপনারা সম্মুখে বর্তমান অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত, সোমক্রয়ের জন্য আনীত অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব-ধারণে উদ্বোধিত, সমসামর্থক বা সৎ-ভাব ইত্যাদিকে পোষণ করুন (রক্ষা করুন); অপিচ, আপনারা আমাদের হিংসা করবেন না অর্থাৎ আমাদের সৎসম্বন্ধচ্যুত করবেন না, অথবা আমাদের পরিত্যাগ করে যাবেন না। অথবা শত্রুগণ যেন আপনাদের হিংসা না করে; অর্থাৎ হে দেবগণ! আপনারা এমন করুন, আমাদের হৃদয়ের অন্তঃশত্রুগণ যেন আমাদের হৃদয় হতে আপনাদের অপসারিত করতে সমর্থ না হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা এই যে,-হে দেবগণ! আপনারা এমন করুন, যেন আমাতে সকর্মের সামর্থ্যগুলি এবং সৎ-ভাব-সমূহ অবিচলিত থাকে; তাতেই আমি শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হবো) । ৭৷
[ষষ্ঠ অনুবাকে ক্রয়ের জন্য সোমের ওজন-পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে; এখন এই সপ্তম অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে হিরণ্য-বিনিময়ে সোম-ক্রয় কার্যের পরিসমাপ্তির বিষয় উল্লিখিত হচ্ছে। সায়ণাচার্যের মতে প্রথম মন্ত্রে সোমূ-বিক্রেতাকে সম্বোধন করে মন্ত্রের বিভিন্ন অংশে বলা হচ্ছে,-হে সোম-বিক্রেতা! আমি তোমার সোম ক্রয় করব। সে সোম কেমন? উর্জন্তং অর্থাৎ শারীরবলপ্রদ, পয়স্বন্তং অর্থাৎ প্রভূতরসোপেত এবং অভিমাতিষাহং অর্থাৎ পাপরূপ বৈরিগণের হন্তা। শুক্র এবং চন্দ্র পদ দুটিতে অমৃত পদের সহযোগে অবিনাশী তেজ এবং সুখের কামনা করা হয়েছে; আর তার দ্বারা সোম-বিক্রেতাকে জানান হচ্ছে, তোমার সোম এবং আমার হিরণ্য উভয়ই তুল্য-মূল্য। অতএব, আমার এই হিরণ্য তোমার সোমকে কিনতে সমর্থ। আমি তোমাকে কেবলমাত্র হিরণ্য প্রদান করছি না; অধিকন্তু তোমাকে সমীচীন একটি গাভী পূর্বেই প্রদান করেছি। অতএব, এখন তোমাকে যে হিরণ্য প্রদান করছি, তা তোমার অধিক লাভ বলে মনে করবে। শুক্লযজুর্বেদ-সংসিতায় প্রথম মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ সম্বন্ধে ভাষ্যকার মহীধরের মন্তব্যের মর্ম এই, হে সোম! দীপ্যমান্ তোমাকে দীপ্যমান্ হিরণ্যের দ্বারা ক্রয় করি। তুমি (সোম) কেমন? ফলহেতু-প্রযুক্ত আহ্লাদকর, স্বাদুত্বে অমৃতের সমান।–ইত্যাদি। দ্বিতীয় মন্ত্রের কর্মকাণ্ডানুসারী অর্থ–হে সোম-বিক্রেতা। তোমাকে যে হিরণ্য প্রদান করা হলো, সেই সকল হিরণ্য প্রত্যাবৃত্ত হয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠিত হোক; অর্থাৎ, সোমের মূল্যস্বরূপ তোমার গাভী তোমার থাকুক; আমাদের হিরণ্য আমাদের প্রত্যর্পণ করো। তৃতীয় মন্ত্র পাঠ করবার পূর্বে একটি অজা বা ছাগকে পূর্বমুখে স্থাপন করে বলতে হয়–হে অজা! তুমি পুণ্যের দেহ হও। অপিচ,-হে অজ! তুমি প্রজাপতির দেহ হও। প্রজাপতি যেমন সকল দেবতার প্রিয়, অজাও সেইরকম সর্বদেবপ্রিয়। এরপর সোম-সম্বোধন। বলা হয়–হে সোম! উত্তম অজা-লক্ষণ-বিশিষ্ট এই পশু সম্বন্ধি অন্যান্য সহস্র পশুর দ্বারা তোমাকে ক্রয় করছি। অর্থাৎ অন্যান্য পশুর দ্বারা তুমি ক্রীত হয়েছ, কিন্তু তোমার নিজের দ্বারা নয়। অতএব তোমার বন্ধুত্ব প্রাপ্ত সোমের কর্মে প্রবৃত্তি বলে তোমার প্রসাদে তোমার অপত্যরূপ ধনসমূহের দ্বারা এবং পুত্র-পশু ইত্যাদি সহস্বরূপ পুষ্টির দ্বারা পুষ্ট হবো। হে অজা! প্রজাপতি তপস্বরূপ; তুমি তা থেকে উৎপন্ন হয়েছ, অতএব তুমি তাঁর সেই রূপ। অপিচ, তুমি প্রজাপতির স্বরূপ। এইভাবে কর্মকাণ্ডের পরিপুষ্টি-কল্পে অপরাপর সব মন্ত্রেরই ভাষ্য-প্রণোদিত অর্থের সমীচীনতা স্বীকৃত হলেও, আধ্যাত্মিক পক্ষে ভাষ্যের ভাব বড়ই বিসদৃশ বলে মনে হয়। কর্মকাণ্ডে প্রয়োগ-বিধি-সম্বন্ধে অবশ্য আমরা ভিন্নমত পরিপোষণ করি না; কিন্তু কতকগুলি ব্যাপারে আমাদের সংশয় রয়েছে। যেমন, মন্ত্রের মধ্যে সোমবিক্রেতার বা অজার সম্বোধন-মূলক পদ খুঁজে পাওয়া যায় না। মন্ত্রে পশুনা পদ আছে। সম্ভবতঃ তাই দেখেই ভাষ্যকার অজা সম্বোধন-পদ অধ্যাহার করেছেন।-ইত্যাদি। আমরা মনে করি, মন্ত্র কটি শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবানের এবং শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধনে প্রযুক্ত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মন্ত্রে ভগবানের নিকট প্রার্থনা জানান হয়েছে। সেখানেও সম্বোধন শুদ্ধসত্ত্বই। ষষ্ঠ এবং সপ্তম মন্ত্র কিছুটা দুর্বোধ্য। সূত্রাকারে গ্রথিত মন্ত্রদুটিতে কার প্রতিলক্ষ্য আছে, বোঝা কঠিন। ভাষ্যমতে মন্ত্রদুটির অর্থ হয়,–অবিরোম নির্মিত তন্তু উর্ণাস্তুক। সেই উর্ণাস্তুক শুকু–জ্যোতিঃ-স্বরূপ। সেই জ্যোতিঃ আমাদের মধ্যে অবস্থিত হোক। আর সোম-বিক্রেতা অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হোক। আমরা এই মন্ত্রদুটিতে ভগবৎ-সম্বোধন লক্ষ্য করি। ভগবৎ অনুগ্রহে অজ্ঞান-অন্ধকার দূরীভূত হয়ে হৃদয়ে দিব্য জ্ঞান-জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হোক–মন্ত্র দুটিতে এই ভাবই প্রকাশিত। অষ্টম মন্ত্রের কর্মকাণ্ডানুসারী অর্থ-হে সোম! তুমি আমাদের প্রতি আগমন করো। তুমি কেমন? অর্থাৎ সখা বা প্রীতিযুক্ত অথবা রবিরূপ এবং শোভন মিত্রের পালক।–ইত্যাদি। নবম মন্ত্রে ভাষ্যমতে সোমের রক্ষাকারী সাতটি দেবতার সম্বোধন আছে। মন্ত্রের অর্থ-হে শব্দকারী, হে শোভমান, হে পাপারি, হে বিশ্বপোষক, হে সদাহৃষ্টরূপ, হে শোভনহস্ত, হে দুর্বলরক্ষক, হে দেবতাসপ্তক। আপনাদের আশ্রিত এই সোমক্রয়কারীর হিরণ্য ইত্যাদি পদার্থ রক্ষা করুন। বৈরিগণ যেন আপনাদের হিংসা না করে।–আমরা মনে করি, মন্ত্রে যে সোমরক্ষক সপ্তদেবতার বিষয় উল্লেখ আছে, সেই সপ্ত দেবতা সপ্তলোক-পালক। ভুঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ ও সত্য–এই সপ্ত লোক। এই সপ্তলোকের যাঁরা অধিপতি, তাঁরাই সপ্তলোকপাল, তারাই পূর্বোক্ত সপ্তোকে সোম বা শুদ্ধসত্ত্ব রক্ষা করেন। এঁরা নামে স্বতন্ত্র হলেও একই ভগবানের সপ্ত-বিভূতি মাত্র। অগ্নি, বায়ু, সূর্য, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও বরুণ–এঁরাই সেই সপ্তলোক-পালক]। ৭।
.
অষ্টম অনুবাক
মন্ত্র- উদায়ু স্বায়ুযোদোষধীনাং রসনোৎপজ্জন্যস্য শুষ্মেণোস্থামমৃতাং অনু। উৰ্বন্তরিক্ষমন্বিহি।। অদিত্যাঃ সদোহস্যদিত্যাঃ সদ আ সীদ অন্তর্ভুদ্দ্যামৃষভো অন্তরিক্ষমমিমীত বরিমাণাং পৃথিব্যা। আহসীদদ্বিশ্বা ভুবনানি সম্রাড়বিশ্বেত্তানি বরুণস্য ব্ৰতানি। বনেষু ব্যন্তরিক্ষং ততান বাজমৰ্ব্বসু পয়ো অগ্নিয়াসু হৃৎসু তুং বরুণো বিষ্ণুপ্নিং দিবি সূৰ্য্যমদধাৎ সোমমদ্রৌ। উদু ত্যং জাতবেদসং দেবং বহস্তি কেতঃ।। দৃশে বিশ্বায় সূৰ্য্যম। উস্রাবেতং ধুর্যাহাবন অবীরহণৌ ব্ৰহ্মচোদ্দনৌ। বরুণস্য স্তম্ভনমসি বরুণস্য স্তম্ভসৰ্জনমসি। প্রত্যস্তো বরুণস্য পাশঃ ॥৮॥
মর্মার্থ- সৎকর্ম-সাধন-সমর্থ অক্ষয় জীবন-লাভের জন্য যেন আমি উদ্বুদ্ধ হই। (আত্মজ্ঞান-লাভে সৎকর্মশীল জীবন-প্রাপ্তির উদ্বোধনা মন্ত্রে বিদ্যমান)। অথবা, অক্ষয় জীবন লাভের জন্য যেন উদ্বুদ্ধ হই। অপিচ, সৎকর্ম-সাধন ইত্যাদির দ্বারা শোভন-জীবন-ধারণের জন্য যেন আমি উদ্বুদ্ধ হই। কর্মফল-ক্ষয়কারক কর্মের সারভূত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা যেন আমি উদ্বোধিত হই। সৎ-ভাবের বর্ধক স্নেহকারুণ্য-স্বরূপ ভগবানের স্নেহ-করুণার দ্বারা অথবা তেজের দ্বারা ও জ্ঞান-দীপ্তিতে যেন আমি উদ্বুদ্ধ হই। তার পর শুদ্ধসত্ত্বের অনুসরণে (অর্থাৎ, তাদের হৃদয়ে ধারণের নিমিত্ত) আমি যেন প্রবুদ্ধ হই। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক ও সঙ্কল্পসূচক। ভাব এই যে, হে দেব! আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনে ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য যাতে প্রবুদ্ধ হই, সেই ভাবে আপনি আমাদের অনুগ্রহ করুন। হে দেব! আপনি আমার কলুষ-ক্লেদ-পরিশূন্য শত্রুর উপদ্রবরহিত সুনির্মল হৃদয়রূপ আরাধ্য-ক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে আগমন করুন। (তাৎপর্যার্থ-বিশুদ্ধ নির্মল হৃদয়ই ভগবানের নিবাস-স্থান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমি যেন সর্বদা আপনাকে হৃদয়ে রাখতে সমর্থ হই। অনুকম্পা-প্রদর্শনে আপনি তার বিহিত করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অনন্ত-স্বরূপ ভগবানের অধিষ্ঠান অর্থাৎ ধারক ও স্বরূপ হও। (ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বই ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। অতএব হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধি স্থানকে অথবা নির্মল হৃদয়কে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হও অর্থাৎ সেই হৃদয়ে উপবেশন করো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্ব অধিগত করে আমরা যেন ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারি)। অভীষ্টবর্ষণকারী অথবা সকলের বরণীয় সেই ভগবান্ দ্যুলোককে এবং অন্তরিক্ষ-লোককে (ব্যোমকে অর্থাৎ সর্বলোককে) স্তম্ভিত করেন অথবা ব্যেপে আছেন। অপিচ, এই পৃথিবীতে সেই ভগবানের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহিমা অপরিমেয়। (ভাব এই যে,-ভগবান আপন প্রভাবের দ্বারা সর্বলোক ধারণ করে আছেন। কিন্তু তার মহিমার সীমা কেউই অবগত নন। প্রার্থনা–সেই ভগবান্ আমার হৃদয় অধিকার করুন)। সম্যক্ রাজমান অথবা সকলের স্বামী সেই ভগবান্ নিখিল বিশ্বভূবন ব্যেপে আছেন। বিশ্বের সকলেই সর্বশক্তিমান অথবা করুণাপরায়ণ সেই ভগবানের কার্য অর্থাৎ মহিমা ঘোষণা করে। (প্রার্থনার ভাব এই যে, বিশ্বব্যাপকতাই ভগবানের কর্ম বা ধর্ম। সেই ভগবান আমার হৃদয় ব্যেপে অবিচলিত ভাবে অবস্থিতি করুন)। যে ভগবান বনানীর অগ্রভাগে অন্তরিক্ষকে পুরুষগণের মধ্যে বীর্যকে এবং গাভীগণের মধ্যে দুগ্ধকে বিস্তারিত করে রেখেছেন; সেই করুণার আধারই অন্তরের মধ্যে সকর্ম-সাধনের সঙ্কল্পকে, লোকসমূহের মধ্যে জ্ঞানাগ্নিকে, স্বর্গলোকপ্রাপ্ত সাধুগণের হৃদয়ে জ্ঞানসূর্যকে বা পূর্ণজ্ঞানকে এবং পাষাণের মতো কঠোর আমাদের এই হৃদয়ের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বকে স্থাপন করেছেন। (ভাব এই যে,–সকল বস্তরই শ্রেষ্ঠ বা সার অংশ ভগবানের করুণা-সাপেক্ষ। সেই ভগবানই বিশ্বের অধিপতি)। অথবা,–যে করুণাধার ভগবান্ অরণ্য-সদৃশ্য হৃদয়ের মধ্যে অন্তরিক্ষের মতো অনন্ত-প্রসারিত স্নেহ-কারুণ্যকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন জনগণের মধ্যে সৎকর্মের সাধন-সামর্থ্যকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং জ্ঞানের অভ্যন্তরে ভক্তিকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং ভগবানকে প্রাপ্তির অভিলাষী অন্তরের মধ্যে সৎকর্ম-সাধনের সঙ্কল্পকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং লোকসমূহের মধ্যে জ্ঞানাগ্নিকে বিস্তৃত করে রেখেছেন; সেই ভগবানই স্বর্গে জ্ঞান-সূর্যকে (পূর্ণজ্ঞানকে) এবং পাষাণের মতো কঠোর আমাদের হৃদয়-মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বকে স্থাপন করেছেন। (ভাব এই যে,ভগবানের কৃপাতেই আমাদের মধ্যে সত্ত্বভাবের উন্মেষ হয়)। জ্ঞানরশ্মিসমূহ সমস্ত দেবভাবের দর্শনের নিমিত্ত, সেই প্রসিদ্ধ সর্বজ্ঞ অথবা ধনপতি দ্যোতমান্ জ্যোতিঃস্বরূপ পরব্রহ্মকে সাধকের সহস্রার পদ্মে প্রকাশিত করে থাকে। বৃষের ন্যায় বলবীর্যসম্পন্ন জ্ঞানভক্তিরূপ অথবা সকাম-নিষ্কাম-রূপ হে বাহকদ্বয়! শকটধুর অথবা ভারবহনসমর্থ অথবা দেবতা বা সংবহন উপযোগী দেব-ভাব (অর্থাৎ বৃষদ্বয় যেমন শকটের ধূর বা ভার বহন করতে পারে, সেইভাবে জ্ঞান ও ভক্তি রূপ বাহকদ্বয় দেবভাবসমূহকে নরহৃদয়ে বহন করে আনে; অপিচ, অকিঞ্চন জনকে ভগবৎসমীপে নিয়ে যায়), ক্লান্তিরহিত অর্থাৎ সদানন্দরূপ, দুর্বলের অহিংসাকারী অথবা অজ্ঞানজনকে সৎপথে নয়নকারী, অৰ্চনাকারীদের সঙ্কৰ্ম-সাধনের অথবা ভগবানের প্রতি প্রেরণকারী,–এইরকম তোমরা (আমাদের হৃদয়ে) আগমন করো, আমাদের মনোরথে স্বয়ং যুক্ত হও এবং মঙ্গলপ্রদ হয়ে সৎকর্ম-সাধনে প্রবৃত্ত জনের অর্থাৎ আমাদের হৃদয়রূপ যজ্ঞাগার প্রাপ্ত হও অর্থাৎ সেখানে প্রবেশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম-উদ্বোধনসূচক। দেবগণের আনয়ন-উপযোগী সংবাহন করে জ্ঞান এবং ভক্তিকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি-মন্ত্রে এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে)। হে মম হৃদয়নিহিত সৎ-বৃত্তি! তুমি স্নেহকরুণার আধার ভগবানকে উন্নত প্রদেশে অর্থাৎ আমাদের কর্মরূপ যানে প্রতিষ্ঠা করে থাক। (প্রার্থনার ভাব এই যে-কর্মের প্রভাবে যেন আমরা শুদ্ধসত্ত্ব এবং ভগবাকে প্রাপ্ত হই। আমাদের কর্মসমূহ ভগবৎসম্বন্ধযুত হোক। হে আমার সৎ-অসৎ-বৃত্তি অথবা জ্ঞানভক্তি! তোমরা আমাদের হৃদয়ে অথবা কর্মরূপ যানে স্নেহকরুণার আধার ভগবানকে অচঞ্চলভাবে স্থাপনকর্তা হও। (প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের কর্মের সাথে ভগবৎসম্বন্ধ অবিচ্ছিন্ন হোক)। হে ভগবন্! আমাদের হৃদয়ে যে অজ্ঞানতার আবরণরূপ মোহপাশ বিস্তৃত হয়েছে, তা অপসারিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের সংসার-বন্ধন ছেদন করে আপনি আমাদের আপনাতে বিলীন করে নিন) । ৮।
[কর্মকাণ্ড অনুসারে ভাষ্যানুক্রমণিকায় প্রকাশ,-ক্রীত নোম প্রাচীনবংশ-শালায় সংবাহনের সময়ে কি ভাবে কিরকম প্রক্রিয়া-পদ্ধতির অনুসরণে সেই সোম শকটের উপরে স্থাপন করতে হবে, এই অষ্টম অনুবাকে, তা-ই উল্লিখিত। বিনিযোগ-সংগ্রহ গ্রন্থে সেই প্রক্রিয়া-পদ্ধতি যে ভাবে পরিবর্ণিত আছে, ভাষ্যকার তারই অনুসরণ করেছেন। প্রথম মন্ত্রের অর্থসম্বন্ধে ভাষ্যের মত এই যে,-অমৃত-স্বরূপ দেবতাকে লক্ষ্য করে আয়ুঃ ইত্যাদি বিশেষে বিশিষ্ট সোমের সাথে আমি উখিত হই।–ইত্যাদি। দ্বিতীয় মন্ত্র, ভাষ্যকারের মতে–উত্থান থেকে আরম্ভ করে পুনরায় ভূমিতে সোমস্থাপন পর্যন্ত সোমের আধার অন্তরিক্ষ। সেই হেতু সোম অন্তরিক্ষ-দেবতা বলে কথিত হয়।–ইত্যাদি। ভাষ্যের বিভাগ অনুসারে তৃতীয় চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্র তিনটি একমন্ত্ররূপে পরিগৃহীত হয়েছে। ভাষ্যমতে তৃতীয় মন্ত্রটির প্রথম অংশটির সম্বোধ্য কৃষ্ণাজিন; দ্বিতীয় অংশটির সম্বোধ্য-সোম। চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রে ক্রীত সোমের বরুণ-দেবতাত্ব-নিবন্ধন বরুণকে ব্রহ্মরূপ জ্ঞানে তাঁর স্তুতি করা হয়েছে। ষষ্ঠ মন্ত্র করুণাময় ভগবানের মাহাত্ম্য প্রখ্যাপক। ভাষ্যেও সেই ভাবই প্রকাশিত। তবে তার মধ্যে যে একটু নিগূঢ় তত্ত্বের সন্নিবেশ আছে, আমরা তা মর্মার্থে লিপিবদ্ধ করেছি। আমাদের দুরকম অন্বয়ে একই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। সপ্তম মন্ত্র, ভাষ্যমতে, শকটের উপরে বিস্তৃত কৃষ্ণসার মৃগের কর্মের দ্বারা বস্ত্রে আবদ্ধ সোমকে বন্ধন করতে হয়। মন্ত্রটি সুর্য-মন্ত্র। ভাষ্যের অর্থ-সকল জগতের বেত্তা সূর্যকে রশ্মিসমূহ ঊধ্বদেশ প্রাপ্ত করায়। কি জন্য?–সকল জগতের দর্শনের জন্য। মন্ত্রটি সামবেদ-সংহিতার আগ্নেয় পর্বে পরিদৃষ্ট হয়। সামবেদের আগ্নেয় পর্বে এই সূর্য-মন্ত্র কিভাবে সুসঙ্গত হয়, এ বিষয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করে থাকনে। সায়ন তার উত্তরে ন্যায় অনুসারে সূর্যাত্মক মন্ত্রকেও আগ্নেয় বলে প্রতিপন্ন করেছেন। অষ্টম মন্ত্রের, ক্ষেত্রে ভাষ্যকার বক্ষ্যমান মন্ত্রে বৃষের সম্বন্ধ খ্যাপন করে, পূর্ব পূর্ব মন্ত্রের সাথে অর্থসঙ্গতি রক্ষা করেছেন। নবম মন্ত্রের ভাষ্য-আভাষে বোঝা যায়, শকটের উপরে সংস্থাপিত সোমকে এবং শকট-সংবদ্ধ প্রায় প্রত্যেক বস্তুকে লক্ষ্য করেই যেন এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়ে থাকে। সেই অনুসারে শকট-সংলগ্ন নানা সামগ্রী মন্ত্রগুলির সম্বোধ্য। শেষ মন্ত্রে, ভাষ্যমতে শকটের উপরিভাগে যে দীর্ঘক্ষ্ম প্রসারিত থাকে তাকে পাশ বলে। মন্ত্রের অর্থ–সেই পাশ বা রঞ্জু শকটের উপরে প্রসারিত হোক। আমরা তো এই পাশ পদে মোহপাশ অর্থ গ্রহণ করেছি।আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে এই অনুবাকের মন্ত্রগুলি কিরকম হওয়া উচিত তা আমরা আমাদের মর্মার্থেই প্রকাশিত করেছি] ॥ ৮।
.
নবম অনুবাক
মন্ত্র- প্র চ্যবস্ব বুবম্পতে বিশ্বানভি ধামানি। মা ত্বা পরিপরী বিদন্মা ত্বা পরিপন্থিনো বিদম্মা ত্ব বৃকা অঘায়বো মা গন্ধর্বো বিশ্বাবসুরা দঘচ্ছ্যেনো ভূত্বা পরা পত যজমানস্য নো গৃহে দেবৈঃ সংস্কৃতং। যজমানস্য স্বস্ত্যয়নসি। অপি পন্থামগম্মহি স্বস্তিগামনেহসং যেন বিশ্বাঃ পরি দ্বিযো বৃণক্তি বিন্দুতে বসু। নমো মিত্রস্য বরুণস্য চক্ষুসে মহো দেবায় তদৃত সপৰ্য্যত দূরেদৃশে দেবজাতায় কেতবে দিবপুত্ৰায় সূর্যায় শংসত। বরুণস্য স্কনমসি বরুণস্য স্তম্ভসৰ্জনমসি। উম্মুক্তো বরূণস্য পাশঃ ॥৯॥
মর্মার্থ- হে ভূতসমূহের অধিপতি বা পালক! আপনি নিখিল সৎকর্মের আগারকে অথবা ভগবৎ-নিবাসযোগ্য সকল হৃদয়কে লক্ষ্য করে প্রকৃষ্টভাবে গমন করুন এবং সেখানে অধিষ্ঠিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমাদের মঙ্গলের জন্য মোক্ষবিধায়ক সেই ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন, এই মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত হয়েছে)। হে ভগব! সর্বতঃসঞ্চারী সৎ-ভাব-নাশক বহিঃশত্রু যেন আপনাকে জানতে অর্থাৎ হিংসা করতে না পারে; অপিচ, সৎকর্মের প্রতিষেধক কাম ইতাদি অন্তঃশত্রুও যেন আপনাকে জানতে অর্থাৎ হিংসা করতে সমর্ত না হয়; বিকর্তনশীল অর্থাৎ সৎসম্বন্ধ-ছেদনকারী পাপশত্রুরাও যেন আপনাকে জানতে না পারে এবং সৎমার্গে গমন প্রতিরোধক হিংসক বহিঃ ও অন্তঃ শত্রুও যেন হিংসা করতে না পারে! (এ মন্ত্রটিও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে দেব, আপনি এমন ভাবে আগমন করুন, যেন কিবা অন্তঃশত্ৰু কিবা বহিঃশত্ৰু কেউই আপনার আগমন-বার্তা জানতে সমর্থ না হয় এবং আমাদের সাথে আপনার সম্বন্ধ ছিন্ন করতে না পারে। অর্থাৎ আপনার প্রভাবে আমাদের সকল শত্রু বিনষ্ট হোক)। অপিচ, হে ভগবন্! আপনি শত্রুনাশের দ্বারা বিশ্বের যাবতীয় শ্রেষ্ঠধন আমাদের প্রদান করুন। অপিচ, আপনি শ্যেনপক্ষীর মতো ক্ষিপ্রগামী হয়ে আগমন করুন। তার পর, সৎকর্ম-সাধনে প্রবৃত্ত জনের (আমাদের) গৃহে অর্থাৎ হৃদয়রূপ যজ্ঞের আগারে গমন (প্রবেশ) করুন। আপনার এবং সৎকর্মসাধনরত আমার অর্থাৎ আপনার গ্রহণযোগ্য এবং আমার মঙ্গলপ্রদ সেই গৃহ (সেই হৃদয়) সুসংস্কৃত অর্থাৎ ক্লেদ-কলঙ্ক-পরিশূন্য নির্মল হয়ে আছে। (এ মন্ত্রে ভগবানের সন্নিকর্ষ লাভের জন্য প্রার্থনাকারীর প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের ত্বরায় পরিত্রাণ, করুন)। হে ভগবন্! আপনি সাধনরত আমার কর্মফল প্রাপক হোন। অর্থাৎ আমার কর্মফল আপনি গ্রহণ করুন। যে প্রসিদ্ধ পথে গমন করলে নিখিল শত্রুদের অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি পাপসম্বন্ধ সমূহকে সর্বতোভাবে বর্জন করা যায়, হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার প্রসাদে সেই সুখে গমন-যোগ্য অর্থাৎ সৎসম্বন্ধমণ্ডিত ও পাপসম্বন্ধরহিত (অথবা যে পথে গমন করলে, গমনকারীকে কোনও অপরাধ স্পর্শ করতে পারে না) সেই পথকে আমরা প্রাপ্ত হবো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম উদ্বোধনসূচক। ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সৎকর্ম ইত্যাদির দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায়; অতএব, সৎকর্মের দ্বারা সৎপথ আশ্রয় করে আমরা ভগবৎ-অভিমুখী হবো)। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! জ্যোতীরূপ পরব্রহ্মকে নমস্কার (স্তুতি) করো। সকলের মিত্রভূত অপিচ স্নেইকারণ্যরূপ অথবা জগতের হিতকারী, সকল জগতের (নিখিল বিশ্বের) দ্রষ্টা অথবা সকল দ্যাবাপৃথিবীনিবাসী লোকের দ্রষ্টা, তেজো রূপে দ্যোতমান, অতীত-অনাগত-বর্তমান-ত্রিকালভূত প্রাণিদের দ্রষ্টা, (সর্বদ্রষ্টা বা ত্রিকাল-অভিজ্ঞ), দেবগণের অনুগ্রহের জন্য জাত অথবা দেবগণের জন্মকারণ, প্রজ্ঞানস্বরূপ অথবা বিজ্ঞান-ধন-আনন্দস্বভাব, দ্যুলোকের পুত্রের মতো প্রিয় অথবা বিশ্বের উৎপত্তি-হেতুভূত, জ্যোতীরূপ পরব্রহ্মকে–তিনিই সত্য জেনে, পূজা করো, অপিচ তাঁকে স্তুতি করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। বিশ্বহেতুভূত সর্বদ্রষ্টা জ্যোতীস্বরূপ পরব্রহ্মকে যেন আমরা অর্চনা করি–এইরকম সঙ্কল্প মন্ত্রের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে)। হে মম হৃদয়নিহিত সবৃত্তি! তুমি স্নেহকরুণার আধার ভগবানের উন্নতপ্রদেশে অর্থাৎ আমাদের কর্মরূপ যানে অথবা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করে থাকো। (প্রার্থনার ভাব এই যে,-কর্মের প্রভাবে যেন আমরা শুদ্ধসত্ত্ব এবং ভগবান্কে প্রাপ্ত হই। আমাদের কর্মসমূহ ভগবানের সম্বন্ধযুত হোক)। হে আমার সৎ-অসৎ-বৃত্তি অথবা জ্ঞানভক্তি! তোমরা আমাদের হৃদয়ে অথবা কর্মরূপ যানে স্নেহকরুণার আধার ভগবান্কে অচঞ্চলভাবে স্থাপন করো। (প্রার্থনা–আমাদের কর্মের সাথে ভগবৎ-সম্বন্ধ অবিচ্ছিন্ন হোক)। হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমাদের (অজ্ঞানতার আবরণরূপ) মোহপাশ অপসারিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! কৃপাপূর্বক আমাদের সংসারবন্ধন ছেদন করে আমাদের আপনাতে বিলীন করে নিন) ॥ ৯।
[অষ্টম অনুবাকে শকটে সোম-আরোপণের পর এই নবম অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে শকট-চালনার বিষয় উক্ত হয়েছে। ভাষ্যমতে, প্রথম মন্ত্র সোম সম্বন্ধে প্রযুক্ত। শকটে কৃষ্ণাজিন বিস্তৃত রয়েছে। তার উপরে সোম, স্থাপিত হয়েছে। শকটের বাহক বৃষ দুটি শকষ্টধূরে সংযোজিত হয়েছে। এখন শকট সংবাহিত হয়ে সোমক্রয়কারী যজমানের গৃহে গমন করবে। এই রকম অনুক্রমণে সোমকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, হে ভূপতি (অর্থাৎ ভূমিতে স্থিত ভূতসমুহের অর্থাৎ যজমান অধ্বর্য প্রভৃতির পালক)! হে সোম! তুমি প্রাচীনবংশ হবিধান প্রভৃতি স্থানসমূহ লক্ষ্য করে প্রকৃষ্টভাবে গমন করো। দ্বিতীয় মন্ত্রে বলা হয়েছে, তোমার গমনকালে, সর্বত্রবিচরনশীল বাধক তস্কর-প্রভু যেন তোমার গমন-বার্তা জানতে না পারে, তার যাগ-প্রতিষেধক ভৃত্যগণও যেন তোমার গমন-বার্তা জানতে না পারে; বৃক অর্থাৎ অরণ্যচারী শ্বাপদ প্রভৃতি যেন তোমাকে না জানে। পাপরূপ বধ-কর্তাও যেন তোমাকে জানতে না পারে। অপিচ, স্বর্গমার্গে সোমের অপহর্তা বিশ্বাবসু নামক গন্ধবও যেন তোমার প্রতি দৃষ্টি সঞ্চালন না করে। তৃতীয় মন্ত্রে বলা হচ্ছে-হে সোম! তুমি যাবতীয় শত্রুকে নাশ করে শ্রেষ্ঠ ধন প্রদান করো এবং শ্যেনপক্ষীর মতো শীঘ্রগামী হয়ে যজমান-গৃহে উপস্থিত হও। সেখানে তোমার ও আমার জন্য সর্ব-উপকরণ-সংযুক্ত স্থান আছে। সেখানে দেবসদৃশ অধ্বর্য প্রভৃতি তোমার উপবেশনের জন্য আসন্দী-রূপ স্থান সংস্কৃত করে রেখেছেন। চতুর্থ মন্ত্রে, আমরা মনে করি, ভগবানে কর্মফল-প্রদানের বিষয় প্রখ্যাপিত। কর্মকাণ্ড অনুসারে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন–স্বস্তি অর্থাৎ শ্রেয়ঃরূপ যজ্ঞের অয়নঃ অর্থাৎ প্রাপ্তি যার আছে; অর্থাৎ তুমি যজমানের যজ্ঞপ্রাপক হও। এ মন্ত্রটির সোম-সম্বোধনে প্রযুক্ত। ভাষ্যমতে পঞ্চম মন্ত্র পথিদেবতার সম্বোধনে প্রযুক্ত। ক্রীত সোম মস্তকের উপরে গ্রহণ করে, হস্তের দ্বারা সোম-পাত্র ধারণ করে, শকটের প্রতি লক্ষ্য করতে করতে, এই মন্ত্র উচ্চারিতব্য। ষষ্ঠ মন্ত্রের প্রয়োগ বিষয়ে ভাষ্যকারের মত এই যে,–এই মন্ত্রে সোমকে সূর্য স্বরূপ কল্পনা করে স্তুতি করা হয়েছে। এই অনুবাকে সপ্তম বা শেষ মন্ত্র এবং অষ্টম অনুবাকের শেষ দুটি মন্ত্র প্রায়ই অভিন্ন। প্রভেদ মাত্র ক্রিয়াপদ নিয়ে। অষ্টম অনুবাকের প্রত্যস্ত পদের পরিবর্তে নবম অনুবাকে উন্মুক্ত পদ রয়েছে। তাছাড়া অন্য কোনও পার্থক্য নেই] ॥ ৯৷
.
দশম অনুবাক
মন্ত্র- অগ্নেরাতিথ্যমসি বিষ্ণবে ত্বা। সোমস্যাহতিথ্যমসি বিষ্ণবে ত্ব। অতিথেরাতিথ্যমসি বিষ্ণবে ত্বা।। অগ্নয়ে ত্বা। রায়ম্পোষদারে বিষ্ণবে ত্বা শ্যেনায় ত্বা সোমভৃতে বিষ্ণবে ত্বা। যা তে ধামানি হবিষা যজন্তি তা তে । বিশ্বা পরিভূরস্তু যজ্ঞং। গয়স্ফানঃ প্রতরণঃ সুবীরোহবীরহা প্র চরা সোম দুর্যা। অদিত্যাঃ সদোহস্যদিত্যাঃ সদ আ সীদ। বরুণোহসি ধৃতব্রতো বারুণমসি শংযোবোনাম সখ্যাম্মা দেবানামপসচ্ছিৎস্মৃহি।। আপতয়ে ত্বা গহ্নামি পরিপতয়ে ত্বা গৃহ্নামি তনপুত্রে ত্বা গৃহ্নামি শারায় ত্বা গৃহ্নামি শক্মন্নোজিষ্ঠায় ত্বা গৃহ্নামি। অনাধৃষ্টমস্যনাধৃষ্যং দেবানামোজোহভিশস্তিপা অনভিশস্তেন্যা। অনু মে দীক্ষাং দীক্ষাপতিৰ্ম্মন্যতামনু তপস্তপস্পতিরঞ্জসা সত্যমুপ গেষং সুবিতে মা ধাঃ ॥১০।
মর্মার্থ- হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অতিথির মতো:সকলের আকাঙ্ক্ষাণীয় এবং প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের তুষ্টি সম্পাদনকারী অর্থাৎ প্রকাশক হও। অতএব, বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে নিয়োজিত (উৎসর্গ) করছি। (ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ; শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সৎস্বরূপ ভগবানের প্রীতিহেতুভূত হও। অতএব তোমাকে বিশ্বব্যাপী ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত উৎসর্গ করছি। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক ও সঙ্কল্পমূলক। একমাত্র সত্যের এবং শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই সৎস্বরূপ ভগবাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। অতএব শুদ্ধসত্ত্বের এবং সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা যাতে ভগবানের সন্নিকর্ষ লাভ করতে পারা যায়, সে বিষয়ে চেষ্টান্বিত হবে)। হে আমার শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত কর্ম! তুমি অতিথিরূপে জগৎপ্রীতিকর (অথবা অতিথিরূপে সকলের নমস্য পূজ্য) ভগবানের প্রীতিহেতুভূত এবং তুষ্টিসম্পাদক হও। অতএব, বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে উৎসর্গ করছি। (ভাব এই যে,-ভগবান্ অতিথিরূপে জগতের আরাধনীয়। তাঁর আরাধনার প্রধান উপকরণ সৎ-ভাব ও শুদ্ধস্তত্ত্ব। মন্ত্রে তাই সঙ্কল্প–ভগবানের প্রীতির জন্য হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবকে নিয়োজিত করছি)। অপিচ, হে আমার শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত কর্ম! প্রজ্ঞানরূপ ভগবানের অর্থাৎ পরব্রহ্মের উদ্দেশে তোমাকে নিয়োজিত করছি। হে আমার শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত কর্ম! তোমাকে ধনপুষ্টিদায়ক অর্থাৎ পরমধন প্রদায়ক সৎ-ভাব-জননকারী সর্বব্যাপী ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত নিয়োজিত (উৎসর্গ) করছি। অথবা,-[উপরোক্ত চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্র] হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পরমার্থ-ধনসমুহের পুষ্টিদানকারী জ্ঞানজ্যোতিঃ-লাভের জন্য তোমাকে উদ্বুদ্ধি করছি। অপিচ, বিশ্বব্যাপী ভগবানের উদ্দেশ্যে, তার প্রীতির জন্য, তোমাকে সমর্পন করি। (ভাব এই যে,–জ্ঞানই পরমার্থপ্রদ। শুদ্ধসত্ত্বের সাহায্যে জ্ঞানকিরণ আহরণ করে ভগবৎ-প্রাপ্তির নিমিত্ত তাকে নিয়োজিত করি)। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! সোম-আনয়নকর্তা অথবা হৃদয়ে সৎ-ভাবের সংজনয়িতা, ভক্তিমান অর্চনাকারিদের প্রতি শ্যেনের মতো ক্ষিপ্রগমনকারী ভগবানের প্রীতির জন্য অথবা সকর্ম-সাধনের নিমিত্ত, তোমাকে আহরণ করছি; এবং বিশ্বব্যাপক ভগবানের উদ্দেশে অথবা তাঁকে লাভ করবার জন্য তোমাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করছি। (সঙ্কর্মের এবং সৎ-ভাবের দ্বারা পরিতুষ্ট হয়ে ভগবান্ ত্বরায় ভক্তের উদ্ধার-সাধন করেন। অতএব সঙ্কল্প-সৎ-ভাবের উন্মেষে সৎকর্মের সাধনে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব আহরণ করে মোক্ষলাভের নিমিত্ত তাকে নিয়োজিত করি)। হে ভগবান্! আপনার সম্বন্ধি যে সকল স্থান বা নাম অবলম্বন করে জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা মানুষ যজ্ঞ করে অথবা আপনার অর্চনা করে, আপনার সম্বন্ধি সেই যজ্ঞ বা অর্চন আপনার যাবতীয় স্থানে বা নামে আপনি সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হোন। (ভাব এই যে,-হে ভগব! যে জন যেখান হতে যে নামেই আপনাকে জ্ঞান ও ভক্তি সহকারে অর্চনা করে, আপনি সেই স্থান হতে সেই নামেই পরিতুষ্ট হয়ে তাকে উদ্ধার করেন)। হে ভগব! আপনি গৃহ-অভিবর্ধক অর্থাৎ শ্রেয়ঃসাধক, প্রকৃষ্ট ভাবে বিপদ-উদ্ধারকারী অথবা সংসার-পারে, নয়নকর্তা, শোভনবীর্যসম্পন্ন এবং বীরবর্গের পরিপালক অর্থাৎ অজ্ঞান অকিঞ্চন জনের আশ্রয়দাতা। আপনি আমাদের হৃদয়রূপ যজ্ঞের আগারে অধিষ্ঠিত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,আপনি অকিষ্ণন আমাদের আশ্রয় দান করুন এবং সংসার-সমুদ্র হতে পরিত্রাণ করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অনন্ত-স্বরূপ ভগবানের অধিষ্ঠান অর্থাৎ ধারক হও। (ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বই ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। অতএব হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধি স্থানকে অথবা নির্মল হৃদয়কে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হও, অর্থাৎ সে হৃদয়ে উপবেশন করো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি যজ্ঞের ধারক অর্থাৎ সৎকর্মে সকলের প্রেরক এবং স্নেহকরুণার আধার ভগবানের স্বরূপ হও। অপিচ, তুমি ভগবানের সাথে দেবভাবসমূহের সুষ্ঠু-মিশ্ৰয়িতা এবং ভগবানের প্রীতিসাধক স্নেহকরুণা-রূপ হও। অতএব যাতে আমি দেবভাবসমূহের সখিত্ব এবং কর্মসামর্থ্য হতে বিচ্ছিন্ন না হই, তার বিধান করো। (ভাব এই যে, আমার কর্মবিচ্ছেদ এবং সৎ-ভাবচ্যুতি যেন না ঘটে)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! সতত সর্বত্র গমনশীল অথবা জগতের প্রাণস্বরূপ ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমায় উৎসর্গ অথবা নিয়োজিত করছি। সেইরকম, হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! সর্বব্যাপী অথবা বিশ্বের সকলের মনন-অধিষ্ঠাতা ভগবানের উদ্দেশ্যে তোমাকে উৎসর্গ অথবা নিয়োজিত করছি। অপিচ, হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সংরক্ষক অথবা জন্মকারণবিনাশকারী ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত–তাকে লাভ করবার জন্য, তোমাকে তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করি বা উৎসর্গ করি। (ভগবান মঙ্গল বিধান করুন)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! প্রভূতশক্তিসম্পন্ন সকল শক্তির আধারভূত সেই ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তোমাকে নিয়োজিত করছি। (আমি যেন কায়মনোবাক্যে ভগবানের সেবা করি)। অপিচ, বিশ্বকর্মী, জগতের যাবতীয় প্রাণীর শক্তিবিধায়ক অথবা সৎকর্মের সাধনে শক্তিপ্রদানকারী হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে প্রভূত তেজোবীর্যসম্পন্ন অথবা অনাধৃষ্টবল ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত উৎসর্গ অথবা নিয়োজিত করছি। সমগ্র মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক এবং সঙ্কল্পসূচক। মন্ত্রে ভগবানের কাছে নিখিল সৎ-ভাব প্রদানের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমার হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণে পরিতুষ্ট হয়ে আমাতে সৎ-ভাব সংরক্ষণ করুন এবং আমার জন্মকারণ নিবারণ করুন। হে আমার হৃদয় অধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সদা অতিরস্কৃত অর্থাৎ প্রমাদ পরিশূন্য অহিংসিত ও হিংসা ইত্যাদি রহিত, অপিচ সর্বসাফল্য প্রদ। (অতএব আমাতে অথবা আমাদের সম্বন্ধে তুমি তেমনই অহিংসিত ও অতিরস্কৃত হিংসাপ্রবৃত্তি দূর করে অন্তরের বিশুদ্ধতা সম্পাদন করো)।
সেই রকমেই, হে আমার হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি নিখিল সৎ-ভাবসমুহের অথবা সৎ ভাবসম্পন্ন জনের বল-শক্তি-স্বরূপ অর্থাৎ সারভূত এবং পাপ হতে পরিত্রাণকারক এবং আনন্দিত পরমলোকে নয়নক্ষম অর্থাৎ ভগবৎ-প্রাপক হও। দীক্ষারূপ সৎকর্মের পালক ভগবান্ আমার দীক্ষারূপ শোভন অনুষ্ঠান বা সৎকর্ম স্বীকার অর্থাৎ গ্রহণ করুন। আমার শারীর বাঁচিক মানস অথবা সাত্ত্বিক রাজস তামস তিনরকম তপঃকর্মের পালক (রক্ষক) ভগবান, আমার উক্তরূপ তিনরকম তপঃকর্ম স্বীকার করুন অর্থাৎ গ্রহণ করুন। সেই ভগবানের অনুগ্রহে নির্মলচিত্তে জ্ঞানদৃষ্টি লাভ করে সৎ-মার্গ-গমনে সত্যমূর্তি ভগবানের স্বরূপ আমি যাতে দর্শন করতে সমর্থ হই অর্থাৎ ভগবানকে প্রাপ্ত হতে পারি, সেইভাবে শোভনমার্গে বা সৎপথে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করুন। সমগ্র মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থী বিশুদ্ধচিত্তে সৎকর্ম-সাধনে সৎপথে গমন করে ভগবৎ-প্রাপ্তির কামনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমার অনুষ্ঠিত কর্ম সৎ-ভাব সম্পন্ন করুন। অপিচ আমাতে অনুগ্রহপরায়ণ হয়ে আমার পূজা গ্রহণ করুন ] । ১০।
[সমীপে আনীত অতিথিরূপ সোমের সকারের জন্য এই অনুবাকে আতিথ্যেষ্টির বিষয় কথিত হয়েছে। সোম ক্রয় করা হলো, যাজ্ঞিক যজ্ঞশালায় প্রবেশ করলেন এবং সোম যজ্ঞশালায় সংবাহিত হলো। এখন সেই সোম পরিশোধিত হয়ে যজ্ঞে প্রযুক্ত হবে। তাই এই মন্ত্রের অবতারণা। এই দশম অনুবাকের মন্ত্রগুলিতে এক নবভাবের বিকাশ হয়েছে; মন্ত্রগুলি যাজ্ঞিককে এক অভিনব পন্থা প্রদর্শন করছে। কল্প অনুসারে প্রথম ছটি মন্ত্রের এক একটি উচ্চারণ করে এক একটি পদবিক্ষেপের বিধি। এই রকম পদবিক্ষেপ-ক্রমে সোম নিয়ে যজ্ঞশালায় প্রবেশ করতে হয়। এই ছটি মন্ত্রই বিষ্ণুদেবতাত্মক; মন্ত্রের সম্বোধ্য হবিঃ। অগ্নি ইত্যাদি বিষ্ণুর অনুচর। যিনি সর্বদা গমন করেন, তিনিই অতিথি। সেই অতিথির সত্ত্বাররূপ যে কর্ম সম্পন্ন হয়, তা-ই আতিথ্য। লৌকিক-ব্যবহারে প্রভুকে কোনও সামগ্রী প্রদান করা হলে, প্রভুর অনুচরেরাও সেই উপঢৌকনে পরিতোষ লাভ করে। সেই অনুসারে এখানে বিষ্ণুর উদ্দেশে প্রদত্ত হবিঃ অগ্নির তুষ্টির হেতুভূত হওয়ায়, তা-ই অগ্নির অতিথ্যের মধ্যে পরিগণিত হয়ে থাকে। মন্ত্রার্থের অবতরণিকা এমনই। মন্ত্রগুলিতে অগ্নি ছাড়াও সোম, শ্যেন প্রভৃতি যে সব পদ পরিদৃষ্ট হয়, ভাষ্যমতে তারা সোমরাজার বিভিন্ন-নামধেয় ভৃত্যকে বোঝাচ্ছে। (আমাদের মতে মন্ত্রগুলির সম্বোধ্য, সোমরাজা-হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব। অগ্নি–প্রজ্ঞানরূপ ভগবান্ বা ভগবানের বিভূতি; বিষ্ণু–বিশ্বব্যাপক ভগবান্ বা ভগবানের বিভূতি; শ্যেন–শ্যেনায়–শ্যেনের মতো ক্ষিপ্রগামী; ইত্যাদি)। কৃষ্ণযজুর্বেদের এই ছটি মন্ত্রের কতক-অংশ শুক্লযজুর্বেদে পরিদৃষ্ট হয়। সেখানে মন্ত্রগুলির একটু রূপান্তরও দেখতে পাওয়া যায়। ভাষ্যমতে সপ্তম মন্ত্রের দুটি অংশই সোম-সম্বোধনে বিনিযুক্ত। (আমরা এই দুটি অংশই ভগবৎ-সম্বন্ধে বিনিযুক্ত বলে মনে করি। এই অনুবাকের অষ্টম মন্ত্র এবং অষ্টম অনুবাকের প্রথম মন্ত্রের প্রথমাংশ অভিন্ন। ভাষ্যমতে নবম-মন্ত্রটি সোম-সম্বোধনে প্রযুক্ত। এই মন্ত্রে বস্ত্রের দ্বারা সোমকে আচ্ছাদন করতে হয়। সেই অনুসারে মন্ত্রের অর্থ–হে সোম! তুমি বরুণ-পাশ নিবারক হও। যজ্ঞরূপ ব্রতকে যিনি ধারণ করেন, তিনিই ধৃতব্রত। হে সোম! উপসদস্বরূপ বলে তুমি বরুণ-সম্বন্ধি হও। সেইরকম বলে তোমার সুখমিশ্রণহেতু বরুণ-ইত্যাদি দেবগণের সখ্যদ্বয় যেন আমি ছিন্ন করি। অর্থাৎ আমাদের কর্মবিচ্ছেদ যেন সংঘটিত না হয়। (আমাদের মতে, মন্ত্রটি শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের প্রজ্ঞাপক; অপিচ শুদ্ধসত্ত্বের উদয়েই তো সৎকর্মে প্রবৃত্তি জন্মে। বারুণ্যং পদে আমরা বরুণদেবতার পরিবর্তে ভগবানের প্রীতিসাধক স্নেহকারুণ্যরূপ অর্থই সঙ্গত মনে করেছি)। ভাষ্যমতে দশম ও একাদশ মন্ত্র আজ্য-সম্বোধনে বিনিযুক্ত। দশম মন্ত্রের সঙ্গে একটি উপাখ্যানের সম্বন্ধ দেখা যায়। সেটি এই দেবাসুরের সংগ্রাম-কালে দেবগণ আপন আপন শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য-খ্যাপনের জন্য পরস্পর পরস্পরের বিরোধী হন। তারা সেইমতো পরস্পর বিরোধী পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে পাঁচটি স্বতন্ত্র ব্যুহ রচনা করেন। অগ্নি ইত্যাদি পঞ্চদেবতা সেনানী এবং বসুদেবগণ সৈন্যসামন্তরূপে সেই পাঁচটি বহে প্রতিষ্ঠিত হন। পরে তারা বিচার করে দেখেন, যদি তারা পরস্পর এইভাবে আত্মকলহে নিযুক্ত থাকেন, তাহলে তারাই অসুরবর্গের জয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। তখন পরস্পর বিরোধ পরিহারের জন্য, তারা পুত্র-ভার্যা ইত্যাদি সহ পরস্পর সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে, আমাদের মধ্যে যিনিই বিরুদ্ধাচরণ করবেন, তিনিই স্বর্গভ্রষ্ট হবেন, পুত্র-কলত্র ইত্যাদি পরিত্যাগ করে স্থানান্তরে বিনষ্ট হবেন। মন্ত্রের অঙ্গীভূত এই উপাখ্যানের অবতারণা করে সূত্রকার বলেছেন,-দেবগণের অনুসরণে মন্ত্রে মনুষ্যগণের সেইরকম শপথের বিষয় উপলব্ধি হয়। মনুষ্যগণের মধ্যে যে প্রথমে বিদ্রোহী হবে, সেই বিনাশপ্রাপ্ত হবে, এটাই তাৎপর্য। (আমরা মন্ত্রের মধ্যে এমন কোনও উপাখ্যানের অবতারণা করবার হেতু দেখিনি)। দ্বাদশ মন্ত্রের প্রথমাংশে কোনও সম্বোধন পদের উল্লেখ নেই; তবে শেষে তনুনস্ত্রে আজ্য সম্বোধন ভাষ্যপাঠে উপলব্ধ হয়। দ্বাদশ মন্ত্রটির ভাষ্যানুসারী অর্থ–দীক্ষণীয়েষ্টির অধিপতি যে দেবতা, সেই দেবতা দীক্ষাপতি। দীক্ষাপতি আমার এই দীক্ষা জ্ঞাত হোন। তপ অর্থাৎ উপসদের অধিপতি দেবতা আমার তপ অবগত হোন। আমি আর্জবের দ্বারা তনুন-স্পর্শনরূপ শপথ প্রাপ্ত হই। হে তনুনস্ট্রে! আমাকে শোভনমার্গে-যজ্ঞকর্মে স্থাপন করো।–তনু বা শরীরকে যিনি বিনাশ করেন না, তিনিই তনুনগ্রা বা জঠরাগ্নি। সেই জঠরাগ্নি-দেবতার প্রীতির জন্য তোমাকে গ্রহণ করছি–এই অর্থ। এছাড়াও তনুন✉ পদটির আরও নানা অর্থ ভাষ্যে দেখা যায়। আমরা মনে করি, যিনি প্রাণবায়ুরূপে জগতের সর্বত্র সর্বজীবে বিরাজমান, তনুনত্ত্ব পদে সেই বিশ্বব্যাপী ভগবানকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। তার কাছে কর্ম নবকলেবর প্রাপ্ত হয় বলেই তিনি তনপাৎ তউন+প+অ–এই চারটি পদাংশ্যের সমাবেশে তনপাৎ পদ সিদ্ধ হয়। তারই চতুর্থীর একবচনে তনুনে পদ পাওয়া যায়। অর্থ হয়–উন (অসম্পূর্ণ, ক্ষীণ), তনু (দেহের), প (পালক, পূর্ণতাসাধক) যে সামগ্রী, তা যিনি অৎ (ভক্ষণ) করেন, তাঁকেই তনুনপাৎ বলে। কর্মকে বিশুদ্ধ ভাব দান করে, তার স্থূলভাব ক্লেদরাশি ভস্মসাৎ করেন বলেই শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ তনুনপাৎ বলে পরিকীর্তিত। আমাদের মর্মাথে আমরা এইভাবেই আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ সম্পন্ন করেছি] ১০।
.
একাদশ অনুবাক
মন্ত্র- অংশুরংশুন্তে দেব সোমাহপ্যায়মিন্দ্রায়ৈকধনবিদ আ আ তুভ্যমিঃ প্যায়োমা কৃমিন্দ্রায় প্যায়স্বাহপ্যায়য় সখীৎসন্যা মেধয়া স্বস্তি তে দেব সোম সুত্যামশীয়। এষ্টা রায়ঃ প্রেষে ভগায়ত্তমৃতবাদিভ্যো নমো দিবে নমঃ পৃথিব্যা। অগ্নে ব্রতপতে ত্বং ব্ৰতানাং ব্রতপতিরসি যা মম তনুরেষা সা ত্বয়ি যা তব তনুরিয়ং সা ময়ি সহ নৌ ব্রতপতে ব্ৰতিনোব্রর্তানি। যা তে অগ্নে রুদ্রিয়া তনূস্তয়া নঃ পাহি তস্যাস্তে স্বাহা। যা তে অগ্নেহয়াশয়া রজাশয়া হরাশয়া তন্ব্বর্ষিষ্ঠা গহুরেষ্ঠোগ্রং বচো অপাবধীং বেষং বচোত অপাবধীং স্বাহা ॥১১।
মর্মার্থ- হে দ্যোতমান দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত আমার জন্মসহজাত অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমার সকল অবয়ব অর্থাৎ উৎকর্ষপ্রাপ্ত ও হীনতেজঙ্ক সকল অংশ, একধনবিৎ অর্থাৎ মোক্ষধন-প্রদায়ক পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের প্রীতির বা সেবার নিমিত্ত নিবেদিত অর্থাৎ উৎসর্গীকৃত হোক। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক ও সঙ্কল্পসূচক। ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত হৃদয়গত সৎ ভাবসমূহকে নিয়োজিত করবার সঙ্কল্প মন্ত্রে বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমার হৃদয়ে বর্তমান সকল রকম সৎ-ভাবসমূহ ভগবানের সন্নিকর্ষ প্রাপ্ত হোক অর্থাৎ আত্ম-উন্নতি হোক)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে গ্রহণের জন্য (তোমার বিশুদ্ধতা সম্পাদনের উদ্দেশ্যে) পরমেশ্বর্যশালী ভগবান অভিবৃদ্ধ হোন অথবা তোমাকে অভিবৃদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ হোন! অপিচ, তুমিও ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত অথবা তার জন্য অভিবৃদ্ধ অথবা উৎকর্ষসম্পন্ন বা পবিত্রতা-প্রাপ্ত হও। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক। এখানে ভগবানকে পাবার জন্য সাধক আপন চিত্তের উৎকর্ষ প্রার্থনা করছেন)। হে দ্যোতমান দেব! সখির মতো প্রীতির সামগ্রী অথবা তোমার প্রতি প্রীতি-আতিশয্যযুক্ত, সাধনসম্পন্ন বা ভক্তিযুক্ত সাধকদের (অর্চনাকারী আমাদের) পরমধনদানে এবং আপনাকে হৃদয়ে ধারণযোগ্য শক্তির দ্বারা প্রবর্ধিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এখানে হৃদয়ে ভগবাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য এবং মোক্ষলাভের জন্য ভক্ত সাধক প্রার্থনা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন। আমাকে মোক্ষের অধিকারী ও মেধাবী করুন)। হে দ্যোতমান শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবন্! তোমার সম্বন্ধি মঙ্গল আমাদের মধ্যে অবিনাশী হোক। তোমার অনুগ্রহে আমরা যেন বিনাশরহিত হয়ে ভগবৎ-প্রাপ্তি রূপ কর্মফল প্রাপ্ত হই; অথবা তোমার কার্য (সৎকর্ম) সম্পাদনে ব্যাপৃত থাকি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমাতে সৎ-ভাব ও শুদ্ধসত্ত্ব অবিচলিত ভাবে অবস্থিতি করুক; এবং তার দ্বারা সস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। হে ভগবন! আমাদের অভিলক্ষিত পরমেশ্বর্য (মোক্ষরূপ ঐশ্বর্য) লাভের নিমিত্ত, আমাদের সকল কর্মফল (নিখিল শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাব ইত্যাদি) আপনাকে সর্বতোভাবে আমাদের দ্বারা প্রদত্ত হচ্ছে; প্রার্থনা–আপনার প্রসাদে আমাদের অভিলক্ষিত মোক্ষধন অধিগত হোক। সৎকর্মকারী আমাদের কর্মফল অর্থাৎ মোক্ষফল প্রদান করুন। (ভাবার্থ-আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্ম সুফলমণ্ডিত এবং মোক্ষফল-সমন্বিত হোক)। দ্যুলোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে নমস্কার করছি; ভুলোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে নমস্কার করছি। তাদের অনুগ্রহে আমাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ হোক। অথবা আমার নমস্কাররূপ সৎকর্ম দুলোক ব্যেপে প্রকাশ পাক; এবং আমার নমস্কার রূপ কর্ম ভূলোক ব্যেপে প্রকাশ পাক। (ভাবার্থ–আমার সঙ্কর্ম সর্বলোকে ব্যাপ্ত হোক)। সকর্মপালক অথবা সৎকর্মকারিগণের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ প্রজ্ঞানময় হে ভগবন! আপনি সৎকর্মকারিদের প্রতি প্রীতি-আতিশয্য-যুক্ত অর্থাৎ তাদের মধ্যে সৎ-ভাবের সংরক্ষক হন। অতএব আমি আপনার শরণ গ্রহণ করছি। (প্রার্থনা-আপনি অনুগ্রহ-পরায়ণ হয়ে আমাকে সৎ-ভাবের অধিকারী করুন)। অতএব হে দেব! কলুষ-কলঙ্ক-পরিম্লান আমার পাপপঙ্কিল যে দেহ, তা আপনার শরীরে বর্তমান হোক অর্থাৎ লয়প্রাপ্ত হোক (লীন হোক); এবং সঙ্কর্মের পালক আপনার যে পুণ্যময় শরীর আছে, আপনার সেই পবিত্রকারক পুণ্যময় শরীর আমাতে বর্তমান হোক অর্থাৎ লীন হোক। (মন্ত্রাংশটি প্রার্থনামূলক। এখানে প্রার্থনাকারী পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন)। প্রার্থনার ভাব এই যে,-কলুষ-কলঙ্কে পরিলিপ্ত পাপময় আমার এই ভৌতিক দেহ নাশ করে আমাতে আপনার পুণ্যপূত দেবদেহ স্থাপন করুন। (মর্মার্থ এই যে,আমাকে পাপ থেকে পরিত্রাণ করে পবিত্র সত্ত্বসমন্বিত করুন অর্থাৎ আপনার অনুগ্রহে পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমি যেন পবিত্র শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত এবং সৎ-ভাবযুক্ত হই)। হে সৎকর্মের পালক প্রজ্ঞানের আধার দেব! (আপনার ও আমার শরীর এইভাবে বিনিময় হলে) আমার অনুষ্ঠিত সকর্ম-সমুহ, আপনার ও আমার উভয়ের সাথে প্রবর্তিত থোক অর্থাৎ আমার কার্যে আমার ন্যায় আপনারও আদর বা প্রীতি হোক। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! রুদ্রভাবসম্পন্ন অর্থাৎ শত্রুনাশক আপনার যে পবিত্রকারক প্রসিদ্ধ শরীর আছে, পবিত্রকারক শত্রুনাশক সেই শরীরের প্রভাবে আপনি আমাদের পরিত্রাণ করুন। স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা আপনার সেই শরীর প্রার্থনা করছি। (ভাব এই যে, আপনার অনুগ্রহে আমি যেন শত্রুনাশ-সামর্থ্য এবং নির্মল সত্ত্বভাব লাভ করি)। প্রজ্ঞানময় হে ভগব! শ্রেষ্ঠতম অথবা ভক্তগণের অভীষ্ঠ-বৰ্ষণশীল, হৃদয়ের অতি নিগুঢ় প্রদেশে অবস্থিত, লৌহময় অথবা বজ্রের মতো অতি কঠোর অর্থাৎ তমোরূপ আপনার যে শরীর আছে, এবং হিরন্ময় অর্থাৎ সত্ত্বভাবাপন্ন আপনার যে প্রসিদ্ধ শরীর আছে বা অঙ্গ আছে, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ–এই তিনরকম ভাবময় আপনার সেই শরীর বা অঙ্গ শত্রুদের তীব্র বাক্যকে অর্থাৎ হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদির পাপ-সঙ্কল্পব্যঞ্জক কর্মকে সমূলে নাশ করে। অপিচ, শত্রুদের পৌরুষব্যঞ্জক বাক্যকে অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তরের শত্রুদের হৃদয়-অভিভবকারী শক্তিকে নাশ করে। অতএব স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে পূজা করি, আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম-উদ্বোধক। সত্ত্বরজস্তমঃ এই ত্রি-মূর্তিতে (বা ভাবে) ভগবান্ সকল শত্রুকে নাশ করেন। অতএব ত্রি-মূর্তির দ্বারা বা ত্রিভাবের সহায়তায় ভগবান্ আমাদের সকলরকম শত্রুকে নিরাকৃত করে আমাদের আরব্ধ কর্ম সুসিদ্ধ করুন এবং আমাদের ভগবৎ-সমীপে নিয়ে যান) ॥ ১১।
[সোম স্থাপিত হয়েছে। সেই সোমের দ্বারা যে যজ্ঞ সম্পন্ন হবে, সেই যজ্ঞের বিঘ্নকারী অসুরদের প্রথমে বিতাড়িত করতে হবে। সেই অসুরদের বিজয়ের জন্য উপসদ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান বিধেয়। একাদশ অনুবাকে সেই উপসদ নামা যজ্ঞের বিষয় পরিবর্ণিত হয়েছে। উপসদ-ইষ্টির প্রারম্ভেই অতিথি সোমের বন্ধন-উপদ্রব পরিহারকল্পে আপ্যায়ন ইত্যাদি উপচার কর্তব্য। সুতরাং কর্মকাণ্ড অনুসারে ভাষ্যকার কর্তৃক এই কণ্ডিকার। প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্য-সোম। প্রথম মন্ত্রের পর ঋত্বিকগণ সোমের পরিচর্যা করতে করতে দ্বিতীয় মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সেই অনুসারে ভাষ্যমতে মন্ত্রের যে অর্থ হয়, তা এই-এ শব্দে ইচ্ছাবন্ত দ্যাবাপৃথিবী অভিমানী দেবতাকে বোঝায়। দয়ালু বলে সেই দেবতা ভক্তের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ। হে তাদৃশ দেবতা। তুমি যজ্ঞবাদী আমাদের অমৃতের মতো যজ্ঞ প্রকৃষ্টভাবে প্রদান করো। কি জন্য? ধনের জন্য। আর অন্নের জন্য। এবং ভগায় অর্থাৎ ঐশ্বর্য ইত্যাদি ষড়গুণের জন্য। দ্যুলোক অভিমানী দেবতা নমস্কার প্রাপ্ত হোন। শুক্লযজুর্বেদে এই মন্ত্র দুটির কম-বেশী একই ধরনে মহীধর অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। সায়ণাচার্য মন্ত্রের সম্বোধ্য যে সোমকে নির্দেশ করেছেন, আমাদের মতে পূর্বাপর সে সোম-পার্থিব সোমলতা নয়; তাতে এক অনুপম স্বর্গীয় সামগ্রীর সূচনা রয়েছে। বেদ-মন্ত্রের ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে যেখানে সোম শব্দের প্রয়োগ দেখেছি, আমরা সেই সোম শব্দে সর্বত্রই সেই অমৃতময় স্বর্গীয় সামগ্রীরই পরিকল্পনা করেছি; আর তাতে (সেই আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে) মন্ত্রগুলিতে এক অভিনব ভাবের বিকাশ হয়েছে। সোম–হৃদয়ের অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব-হৃদয়ের সেই অনন্যা ভক্তিরসামৃত। তৃতীয় মন্ত্রের বিভিন্ন অংশে চরম প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। নিষ্কাম কর্মের চরম পরিণতি এখানেই আমরা দেখতে পেয়েছি এবং মর্মার্থে তা প্রকাশ করেছি। ভাষ্যমতে এই মন্ত্রের দ্বারা আহবনীয় উপস্থাপন করতে হয়। মন্ত্রের অর্থ,-হে ব্রতপতি অগ্নি! তুমি ব্রতের অধিপতি হও। একই মাত্র ব্রতের অধিপতি তুমি নও; পরন্ত অগ্নি বিশ্বের যাবতীয় ব্রতের পালক…।–ইত্যদি। শুক্লযজুর্বেদে, মহীধর ও উবটের ভাষ্যে, আরও একটু স্পষ্ট ভাবেই মন্ত্রের অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে। মহীধবের অর্থ-হে সকল ব্রতের পালক অগ্নি! তুমি আমাদের বর্তমান ব্রতের পালক হও।…..ইত্যাদি। ফলতঃ, ভাষ্যকারের মতে যজমান এই মন্ত্রের দ্বারা অগ্নির শরীরের সাথে নিজের শরীর বিনিময় এবং আহবনীয় অগ্নিতে সমিধ অর্পণ করছেন। আমরা চতুর্থ মন্ত্রটির সাথে তৃতীয় মন্ত্রের সম্বন্ধ রয়েছে মনে করি। তৃতীয় মন্ত্রে আমাদের মতে, আত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে, এই চতুর্থ মন্ত্রে সেই আত্মসম্মিলনের অন্তরায়মূলক শনাশের প্রার্থনা বিজ্ঞাপিত হয়েছে। এই অনুবাকের শেষ মন্ত্রের সাথে, কর্মকাণ্ড অনুসারে, একটি উপাখ্যান বিজড়িত দেখি। সে উপাখ্যান,-দেবগণ কর্তৃক পরাজিত হওয়ার পর অসুরবর্গ তপস্যা আরম্ভ করে; ফলে ত্রৈলোক্যে তাদের তিনটি পুর নির্মিত হয়–পৃথিবীতে লৌহময়, অন্তরিক্ষে রজতময় এবং স্বর্গলোকে হেমময়। তখন, সেই পুর দগ্ধ করবার জন্য, দেবগণ উপসদ অগ্নির আরাধনা আরম্ভ করেন। উপসদ দেবতারূপ অগ্নি যখন সেই তিন পুরে প্রবেশ করে দগ্ধ করেন, তখন তার তিনরকম–লৌহময়, রজতময় ও হিরন্ময়–দেহ উৎপন্ন হয়। মন্ত্রে অগ্নিদেবের সেই তিন রকম শরীরের বিষয় উল্লিখিত। ভাষ্যকার প্রথমেই সে বিষয় বিবৃত করেছেন। বলা বাহুল্য, আমরা ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারিনি; কারণ আমরা আধ্যাত্মিকভাবে এই মন্ত্রের অন্য ভাব বুঝতে পেরেছি এবং আমাদের মর্মার্থে তা প্রকাশ করেছি] ॥ ১১।
.
দ্বাদশ অনুবাক
মন্ত্র- বিত্তায়নী মেহসি তিক্তায়নী মেহস্যবতাম্মা নাথিতমবতান্মা ব্যথিতম। বিদেগ্নির্নভো নামাগ্নে অঙ্গিরো যোহস্যাং পৃথিব্যামস্যায়। নামেহি যত্তেহনাধৃষ্টং নাম যজ্ঞিয়ং তেন ত্বাহদধে। অগ্নে অঙ্গিরা যো দ্বিতীয়স্যাং তৃতীয়স্যাং পৃথিব্যামস্যায়ু নামেহি যত্তেহনাধৃষ্টং নাম যজ্ঞিয়ং তেন ত্বাহদধে। সিংহীরসি মহিষীরসি। উরু প্রথম্বোরু তে যজ্ঞপতিঃ প্রথতাং ধ্ৰুবাহসি দেবেভ্যঃ শুন্ধস্ব দেবেভ্যঃ শুম্ভ। ইন্দ্রঘোষা বসুভিঃ পুরস্তাৎ পাতু মনোজবাস্তা পিতৃভিক্ষিণতঃ পাতু প্রচেতাা রুদ্রৈঃ পশ্চাৎ পাতু বিশ্বকর্মা ত্বাহদিত্যেরুত্তরতঃ পাতু। সিংহীরসি সপত্নসাহী স্বাহা সিংহীরসি সুপ্রজাবনিঃ স্বাহা সিংহীঃ । অসি রায়ম্পোষবনিঃ স্বাহা সিংহীরস্যাদিত্যবনিঃ স্বাহা সিংহীরস্যা। বহ দেবাবেয়তে যজমানায় স্বাহা। ভূতেভ্যস্তা। বিশ্বায়ুরসি পৃথিবীং দৃংহ। ধ্রুবক্ষিদস্যন্তরিক্ষং দৃংহ। অচ্যুতক্ষিদসি দিবং দৃংহ। অগ্নের্ভস্মাস্যগ্নেঃ পুরীষমসি ॥১২৷
মর্মার্থ- হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! আমাকে অনুগ্রহ করবার নিমিত্ত (অথবা আমার সম্বন্ধে) দারিদ্র-দুঃখনাশিনী অথবা পরমধন-প্ৰদাত্রী অর্থাৎ শ্রেষ্ঠধন-সমূহের আধার-স্বরূপা হও। (অতএব আমাকে মোক্ষরূপ পরমধন প্রদান করো)। পুনশ্চ, হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি আমাকে অনুগ্রহ করবার জন্য (অথবা আমার সম্বন্ধে) পাপ-তাপ-নাশিনী অথবা পাপ-সন্তপ্তদের আশ্রয়ভূতা হও। (অর্থাৎ আমাকে পাপ হতে রক্ষা বা পরিত্রাণ করো)। অতএব (হে ভক্তিরূপিণি দেবি!) তুমি আমাকে দারিদ্র্যদুঃখ হতে অর্থাৎ পাপের প্রভাব হতে রক্ষা করো বা পরিত্রাণ করো। (অর্থাৎ পাপে যেন আমি অভিভূত না হই, তা-ই করো)। অপিচ, হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! আমাকে পাপের ভয় হতে অথবা পাপ-প্রলোভন ইত্যাদি জনিত পদস্খলন হতে অথবা পাপের সম্মোহ হতে রক্ষা অর্থাৎ পরিত্রাণ করো। [সমগ্র মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে পাপসন্তাপহারিণি ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি আমাকে পাপ-সম্বন্ধ হতে বিচ্যুত করো এবং মোক্ষপথে স্থাপন করো] হে ভক্তিরূপিণি দেবি! নভঃ-সংজ্ঞ অর্থাৎ নভঃ-অধিষ্ঠিত অথবা হৃদয়রূপ-নভোদেশে অধিষ্ঠিত প্রজ্ঞান-স্বরূপ ভগবান তোমাকে অবগত হোন অর্থাৎ গ্রহণ করুন। সর্বভূতের আধার-স্বরূপ, সর্বব্যাপী সর্বত্রগমনশীল অর্থাৎ নিখিল জ্ঞানের আধার প্রজ্ঞান-স্বরূপ হে ভগবন্! যে আপনি এই পরিদৃশ্যমান অর্থাৎ স্থলসূক্ষ্মাত্মিকা অথবা সকলের আধারভূতা পঞ্চভূতাত্মিকা পৃথিবীতে অর্থাৎ ইহলোকে অথবা আমাদের হৃদয়ে বর্তমান আছেন; সেই আপনি আয়ুঃ নামে অভিহিত হয়ে অথবা চিরায়ুঃ বা চিরনবীনরূপে (আমার হৃদয়ে) আগমন করুন। হে প্রজ্ঞান-স্বরূপ ভগবন্! অহিংসিত অনভিভূত অর্থাৎ সর্বসাফল্যপ্রদ যজ্ঞযোগ্য আপনার যে নাম বা স্থান আছে, সেই নামে ও সেই স্থানে আমি আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করছি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। জ্ঞান ও ভক্তির অভেদ-সম্বন্ধ। যেখানে জ্ঞান সেখানেই ভক্তি বর্তমান; আবার যেখানে ভক্তি, সেখানেই জ্ঞান বিদ্যমান। অতএব জ্ঞান ও ভক্তি সহকারে ভগবানকে আহ্বান করছি)। সকলের আধারভূত, সর্বব্যাপী সর্বতঃগমনশীল অথবা নিখিল জ্ঞানের আধার প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! যে আপনি অন্তরিক্ষলোকে এবং স্বর্গলোকে বর্তমান আছেন, সেই আপনি সেই স্থান হতে আয়ুঃ-নামে অভিহিত হয়ে অথবা চিরায়ু বা চিরনবীনরূপে (হৃদয়ে) আগমন করুন। হে প্রজ্ঞানময় ভগবন! আপনার যে প্রসিদ্ধ অহিংসিত অনভিভূত অর্থাৎ সর্বসাফল্যপ্রদ যজ্ঞযোগ্য সংজ্ঞা ও স্থান আছে, আমি আপনাকে সেই নামের ও সেই স্থানের দ্বারা অথবা সেই নামে ও সেই স্থানে আপনাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করছি। শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনি সিংহী-সমানা শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সকল শক্তির আধারভূতা হন; অপিচ, আপনি মহনীয়া অর্থাৎ অনন্ত শক্তিসম্পন্না, সকলের আধারস্বরূপ হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। এখানে সাধক শক্তিলাভের প্রার্থনা জানাচ্ছেন। ভক্তিই সকল শক্তির আধার ভূত এবং অশেষ-শক্তিসম্পন্ন। অতএব এখানে ভক্তির প্রভাবে পরমার্থ-লাভের সঙ্কল্প বর্তমান দেখতে পাই। বিশ্বব্যাপিন হে ভগব আপনি বিস্তীর্ণ-অনন্ত সত্ত্বসমুদ্রের দ্বারা আমাকে ব্যাপ্ত করুন। অপিচ, আপনার শরণাপন্ন সকর্ম সাধনকারী আমাকে আপনাতে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে আত্মার আত্ম সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আপনি আমাকে আপনাতে লীন করে আমাকে উদ্ধার করুন)। হে আমার চিত্তবৃত্তি! তুমি স্থিরা অবিচলিতা অর্থাৎ একৈকশরণ্য হও। (সেরকম হলে) সৎ-ভাব সংরক্ষণের নিমিত্ত পাপকলুষ পরিশূন্য হবে এবং অনন্ত শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে শোভিতা হতে পারবে। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাবার্থ এই যে,সৎ-ভাব লাভের নিমিত্ত সৎ-স্বরূপ ভগবানে আত্মাকে বিনিবিষ্ট করবার সঙ্কল্প বর্তমান)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! ভগবানের মাভৈঃ-রূপ অভয়-বাণী অর্থাৎ পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন স্বয়ং ভগবান, আপন পরমধনযুক্ত বিভূতির দ্বারা তোমাকে পূর্বদিকে অর্থাৎ সম্মুখভাগ হতে রক্ষা করুন। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! মনের ন্যায় গতিশীল অর্থাৎ প্রকৃষ্ট-মননশীল হৃদয়াধিষ্ঠিত ভগবান, পিতৃগুণের দ্বারা অর্থাৎ স্নেহকারণ্যপূর্ণ আপন বিভূতি-সমূহের দ্বারা তোমাকে দক্ষিণদিকে অর্থাৎ দক্ষিণভাগ হতে রক্ষা করুন। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! প্রকৃষ্টজ্ঞানসম্পন্ন চৈতন্য-স্বরূপ চিন্ময় ভগবান শত্ৰু-সংহারক উগ্র প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ কঠোরভাবাপন্ন আপন বিভূতি-সমূহের দ্বারা তোমাকে পশ্চিমদিকে অর্থাৎ পশ্চাৎ-ভাগ হতে রক্ষা করুন। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! নিখিলকর্মকুশল অর্থাৎ নিখিল-কর্ম-সমূহের আধারভূত অর্থাৎ সকল কর্মতত্ত্ববিৎ ভগবান, অজ্ঞানতা-নাশক প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞান-প্রদায়িকা আপন বিভূতি-সমূহের দ্বারা তোমাকে উত্তরদিকে অর্থাৎ বামভাগ হতে রক্ষা করুন। [সমগ্র মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, সকল বিভূতি পরিবৃত হয়ে ভগবান হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন এবং সকল দিক হতে আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন]। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীসমান-শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিশালিনী ও সকল শক্তির আধারভূতা এবং বাহিরের ও অন্তরের শত্রুদের (অর্থাৎ রিপুরূপ অন্তঃশত্রুর বা লোভ-মোহ-লোভন ইত্যাদির এবং হিংস্রক প্রাণী বা যজ্ঞবিঘাতকদের) অভিভবকারিণী হও; অতএব কর্মশক্তি-লাভের নিমিত্ত স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা তোমাকে উদ্বোধিত অর্থাৎ হৃদয়ে ধারণ করি; আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভক্তির সাহায্যে ভগবানের পূজার সামর্থ্য যেন লাভ করি–এখানে এইরকম সঙ্কল্প দ্যোতিত হচ্ছে)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর ন্যায় শক্তিসম্পন্না অথবা নিখিল শক্তির আধারভূতা সর্বশক্তিশালিনী এবং সৎ-ভাব-সমূহের জনয়িত্রী হও। অতএব সৎ-ভাব সংজননের জন্য তোমাকে স্বাহা মন্ত্রের দ্বারা উদ্বোধিত অর্থাৎ হৃদয়ে ধারণ করছি; আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পজ্ঞাপক। এখানে সৎ-ভাব-লাভের জন্য সাধকের সঙ্কল্প বিদ্যমান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে দেবি! আমাকে সৎ-ভাব এবং পরমার্থ প্রদান করুন)। হে আমার শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিশালিনী এবং সকল শক্তির আধারভূতা অপিচ প্রজ্ঞানময়ী বিবেকরূপিণী হও। অতএব প্রজ্ঞান লাভের নিমিত্ত স্বাহা মন্ত্রে তোমাকে উদ্বোধিত অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিস্থাপিত করি; আমার উদ্বোধন-যজ্ঞ সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। মন্ত্রে প্রজ্ঞানলাভের জন্য সাধক ভগবানের অনুগ্রহ কামনা করছেন)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিশালিনী এবং সকল শক্তির আধারভুতা হও। অতএব তুমি আপন শক্তির প্রভাবে যজমান আমার অর্থাৎ আপনার শরণাগত আমার অভীষ্ট পূরণের জন্য দেবভাব শুদ্ধসত্ত্বসমূহকে আমার হৃদয়ে আনয়ন করো অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাপিত করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সৎ-ভাব-সঞ্চয়ের জন্য সাধকের সঙ্কল্প বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে দেবি! আমি যাতে সৎ-ভাব-সম্পন্ন হতে পারি, তার বিধান করুন)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! ভূতসমূহের বা লোকসমূহের পালনের জন্য অর্থাৎ জগতের উপকারের নিমিত্ত বিশ্বসেবায় তোমাকে স্বাহা মন্ত্রে নিয়োজিত করি অর্থাৎ উদ্বোদিত করি। (বিশ্বসেবায় বা লোকহিত সাধনের জন্য এই মন্ত্রে সঙ্কল্প বিদ্যমান। জগতের উপকারের নিমিত্ত অর্থাৎ বিশ্বসেবায় আমি আমার হৃদয়-গত শুদ্ধসত্ত্ববিমিশ্র ভক্তিকে নিয়োজিত করি। মন্ত্রটি এমনই সঙ্কল্পমূলক)। হে ভগবন! আপনি বিশ্বের সকলের আয়ুঃ-স্বরূপ অর্থাৎ বিশ্বের জীবন-স্বরূপ হন। অতএব আপনি আধারক্ষেত্রকে অর্থাৎ আমার সৎ-বৃত্তি-মূল হৃদয়কে দৃঢ় করুন। (অবিচলিত-চিত্তে সৎ-বৃত্তি সঞ্চয় করব-মন্ত্রে এমনই সঙ্কল্প বর্তমান)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত! তুমি সত্ত্বে–সৎস্বরূপে বাসয়িতা অথবা সত্যের সৎস্বরূপের আধারভূতা হও। অন্তরিক্ষের মতো অনন্ত-প্রসারিত তোমার সৎকর্মমূলকে দৃঢ় করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মার্থ-হে দেব! আমাকে সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিনাশরহিত ভগবানে বাসয়িতা অথবা অক্ষর পরব্রহ্মের আধারস্বরূপ হও। তুমি হৃদয়রূপ দেবস্থানকে অথবা পরমসুখমূলকে দৃঢ় করো। (শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ এবং পরমসুখনিদান। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে যাতে অমি পরমসুখনিদান ভগবানকে প্রাপ্ত হই, হে দেব! তার বিধান করুন)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের অথবা আত্মদৃষ্টির প্রকাশ হও এবং তুমি জ্ঞানাধার ভগবানের অথবা আত্মদৃষ্টির বা অন্তদৃষ্টির পূরক অর্থাৎ পূর্ণতা-সাধক হও। (অতএব আমাকে পূর্ণজ্ঞান প্রদান করো)। ১২।
[অনুক্রমণিকায় ভাষ্যকার বলেছেন, একাদশ অনুবাকে উপসদ ইষ্টি কথিত হয়েছে। সেই উপসদ ইষ্টির মধ্যম উপসদ দিনে ষট্ত্রিংশৎ অর্থাৎ ছত্রিশ পদ পরিমিত বেদী নির্মিত হয়। সেই বেদীর পূর্বভাগে দ্বাদশ অনুবাকে উত্তর-বেদী বিনিবিষ্ট হচ্ছে। এইরকম অনুক্রমণে মন্ত্রের অর্থ-নিষ্কাশনে প্রবৃত্ত হয়ে বিনিয়োগ সংগ্রহ থেকে ভাষ্যকার মন্ত্রগুলির কর্মকাণ্ডানুসারী বিনিয়োগ নির্দেশ করেছেন। ভাষ্যানুসারে প্রথম মন্ত্রের অর্থ-হে উত্তরবেদি! তুমি আমার বিত্তায়নী অর্থাৎ বহ্নিরূপ বিত্তের প্রাপিকা হও। তিক্তায়নী অর্থাৎ বহ্নিতেজের যে জ্বালা-রূপ, তুমি তারই প্রাপিকা হও। নাথিতং অর্থাৎ বহ্নিাচক আমাকে রক্ষা করো। ব্যথিতং অর্থাৎ বহ্নিলাভ হতে ভীত আমাকে রক্ষা করো। দ্বিতীয় মন্ত্রের অর্থ–এই অগ্নি সোমাহুতির আধার-স্বরূপ। সুতরাং গার্হপত্য দক্ষিণা প্রভৃতি নামধেয় অগ্নির মধ্যে সার শ্রেষ্ঠ। হে অঙ্গিররা! তুমি এই চাত্বালগত মৃত্তিকারূপ পৃথিবীর স্বরূপ হও অথবা পৃথিবীতে বর্তমান হও। তথাবিধ তুমি আয়ুষ্পদ নভোনামের সাথে উত্তরবেদীতে আগমন করো। যেহেতু তোমার অতিরস্কৃত নাম যজ্ঞসম্বদ্ধ, তোমার সেই নামে তোমাকে উত্তরবেদীতে স্থাপন করছি। তৃতীয় মন্ত্রের অর্থ-হে অগ্নি! আপনি এই বেদিগত দ্বিতীয় ও তৃতীয় পৃথিবীতে আয়ুঃ নামে আগমন করুন। আপনার যে অনাধৃষ্ট যজ্ঞযোগ্য নাম আছে, সেই নামের দ্বারা এই বেদিতে আপনাকে স্থাপন করছি। আমরা কিন্তু অঙ্গিরঃ পদের অশেষপ্রজ্ঞামার অর্থ সর্বত্রই গ্রহণ। চতুর্থ মন্ত্রের সাথে গ্রন্থান্তরে একটি উপাখ্যানের অবতারণা করা হয়। সে উপাখ্যানটি এই, অসুরদের ক্রমাগত অত্যাচারে ক্রুদ্ধা হয়ে, পুরাকালে বাক্-দেবতা সিংহীরূপ ধারণ করে অসুরদের সংহার করেছিলেন..।-ইত্যাদি। ভাষ্যমতে মন্ত্রটি উত্তর বেদির সম্বোধনমূলক। আমরা এই উপাখ্যানের অথবা উত্তরবেদির সম্বোধন বিষয়ে কোনও যৌক্তিকতা দেখতে পাই না। আমাদের মতে, মন্ত্রটি হৃদয়নিহিতা শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতা ভক্তির সম্বোধনে বিনিযুক্ত। ভাষ্যমতে পঞ্চম মন্ত্রের যে অর্থ হয়, তা থেকে বোঝা যায়, মন্ত্রে লৌকিক ঐশ্বর্যলাভের বিষয়ই সূচিত হয়েছে। কর্মকাণ্ডের দিক দিয়ে লক্ষ্য করলে হয়তো সে সম্বন্ধে মতভেদ না হতে পারে; কিন্তু আমাদের পরিগৃহীত পন্থার অনুসরণে আমরা এরকম অর্থের সাথে একমত হতে পারিনি। ভাষ্যকার স্থলভারে অনুবাকের ষষ্ঠ মন্ত্রের যে অর্থ করেছেন তা এই,–ইন্দ্রঘোষ ইত্যাদি নামক দেবগণ, অনুচরগণ পরিবৃত্ত হয়ে বসু প্রভৃতি আপন আপন গণ সমভিব্যাহারে সেই দেবগণকে রক্ষা করুন। মন্ত্রটি উত্তরবেদি সম্বন্ধে প্রযুক্ত। ভাষ্যকার এই মন্ত্রের সঙ্গেও একটি উপাখ্যানের সম্বন্ধ খ্যাপন করেছেন-দেবাসুরের সংগ্রামকালে দেবতাগণ উত্তরবেদির আনুকূল্যে অসুরদের পরাজিত করবার অভিপ্রায় করলে, অসুরগণ বজ্রের দ্বারা দেবগণকে প্রহার করতে প্রস্তুত হয়। ইন্দ্রঘোষ ইত্যাদি দেবগণ সেই অসুরদের দিকসমূহ হতে বিতাড়িত করেন। সেই অনুসারে, অসুরগণ যাতে যজ্ঞবেদিকে হিংসা করতে না পারে, এই জন্য মন্ত্রে বেদি-রক্ষার প্রার্থনা সূচিত হয়েছে। শুক্লযজুর্বেদের ভাষ্যকার উবট এবং মহীধরও মন্ত্রের সাথে উপাখ্যানের সম্বন্ধ স্বীকার করেছেন। কর্মকাণ্ড অনুসারে এই অনুবাকের সপ্তম মন্ত্র উত্তরবেদি সম্বোধনে বিনিযুক্ত। আর অষ্টম মন্ত্র জুহু সম্বোধনমূলক। এক একটি মন্ত্র উচ্চারণ করে বেদির এক একটি পরিধি অভিমন্ত্রিত করতে হয়। আমরা বোঝবার সুবিধার জন্য সপ্তম মন্ত্রটিকে পাঁচটি বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করেছি। সেই পাঁচটি বিভাগেরই সম্বোধ্য-ভক্তিরূপিণী দেবী। অষ্টম মন্ত্রের অন্তর্গত ভূতেভ্যঃ পদের অর্থ–ভাষ্যমতে ভূতেদ্দেশেন অথবা চিরন্তনেভ্যঃ দেবেভ্যঃ। কিন্তু আমরা মনে করি,এখানে ঐ পদে জরায়ুজ অণ্ডজ প্রভৃতি চাররকম ভূতগ্রামের প্রতি লক্ষ্য আছে। ভূতসমষ্টি নিয়েই জগৎ। সেই সব ভূতের বিলয় ঘটলে জগতেরও বিলয় হয়। আবার তাদের স্থিতিতেই জগতের স্থিতি। এই জন্যই আমরা ভূতেভ্যঃ পদে জগতের উপকারের জন্য–জনহিতসাধনের নিমিত্ত, অর্থাৎ বিশ্বসেবায় অর্থ গ্রহণ করেছি। নবম দশম ও একাদশ মন্ত্রের কর্মকাণ্ডানুসারী দেবতা–পরিধি। মধ্যম, উত্তর ও দক্ষিণ–এই পরিধি তিনটি যথাক্রমে মন্ত্র তিনটির সম্বোধ্য। দ্বাদশ বা শেষ মন্ত্রটিরও লৌকিক বা ব্যবহারিক বিষয়ে আমাদের কোনই বক্তব্য নেই। তবে আমরা মনে করি, এই মন্ত্রেও হৃদয়ের অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্বকেই অগ্নে ভস্ম এবং অগ্নে পুরীষং বলা হয়েছে। শুদ্ধসত্ত্বই যে অন্তরে জ্ঞানবহ্নি প্ৰদীপ্তি করে, আর শুদ্ধসত্ত্বই যে পূর্ণজ্ঞান প্রদান করে থাকে, তাতে সন্দেহ আছে কি? জ্ঞানের অধিকারী হতে হলে শুদ্ধসত্ত্বভাব সঞ্চয়ের আবশ্যক হয়। জ্ঞানের উদয় না হলে, সৎ-অসৎ বিচারের সামর্থ্য না জন্মালে, সৎ-ভাবের বিকাশ কি ভাবে সম্ভবপর হবে? তাই তখনই অন্তরে জ্ঞান-বহ্নি প্রজ্বলিত হয়, তখনই সে জ্ঞানের পূর্ণতা সাধিত হয়ে থাকে, যখন হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের উদয় হয়। এই হিসাবেই শুদ্ধসত্ত্বকে অগ্নির (জ্ঞানাগ্নির) ভস্ম অর্থাৎ দীপক বা প্রকাশক এবং পুরীষং অর্থাৎ পূর্ণর্তাসাধক বলা হয়েছে বলেই আমরা মনে করি] । ১২।
.
ত্রয়োদশ অনুবাক
মন্ত্র- যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য। বৃহততা বিপশ্চিতঃ বি হোত্রা দধে বয়ুনাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিস্তুতিঃ। সুবাদেবদুর্যাং আ বদ দেবশ্রুতৌ দেবেম্বা ঘোষেথাম। আ নো বীরো জায়তাং কৰ্মণ্যো যম সৰ্বেৰ্তনুজীবাম মো বহুনামসদ্বশী। ইদং বিষ্ণুর্বিচক্রমে ত্রেধা নি দধে পদম সমূঢ়স্য পাসুর। ইরাবতী ধেনুমতী হি ভূতং সূর্যবসিনী মনবে যশস্যে। ব্যভদ্রোদসী বিষ্ণুরেতে দাধার পৃথিবীমভিতো ময়ুখৈঃ। প্রাচী প্রেতমবরং কল্পয়ন্তী উর্বৎ যজ্ঞং নয়তং মা জহুরতম্। । অত্র রমেথাং বৰ্মন্ পৃথিব্যা। দিবো বা বিষ্ণবুত বা পৃথিব্যা মহো বা বিষ্ণবুত বাহন্তরিক্ষাদ্ধস্তেী পৃণস্ব বহুভিসব্যৈ রা প্র যচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাৎ। বিষ্ণোনুকং বীর্যাণি প্র বোচং যঃ পার্থিবানি বিমমে রাজংসি যো অস্কভায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্ৰমাণধোগায়ঃ। বিষ্ণো বরাটমসি। বিষ্ণোঃ পৃষ্ঠমসি। বিষ্ণোঃ শ্যপত্রে স্থ। বিষ্ণোঃ সরসি বিষ্ণোধ্রুবমসি বৈষ্ণবমসি বিষ্ণবে ত্বা ॥১৩।
মর্মার্থ- মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণোপেত, সর্ব-সাধনক্ষণ, সর্বতত্ত্বজ্ঞ, ত্রিকালজ্ঞ, প্রাপ্তকর্মশক্তি, ধর্মতত্ত্ববিৎ, ত্রিকালদর্শীর পরমার্থতত্ত্বপ্রকাশক হে সৎ-গুণাবলি! তোমাদের অনুগ্রহে অন্তঃকরণ নির্মল হয়ে পরমাত্মায় যুক্ত হয়; আরও, তোমাদের অনুগ্রহে চিত্তবৃত্তসমূহও পরমাত্মায় যুক্ত হয়; সকর্মসাধক দেবভাবমূহের আনয়নকর্তা হে বিপ্ৰগুণাবলি! তোমাদের অনুগ্রহে মনঃ ও ধী, সর্বসাক্ষী সকলের মনস্তত্ত্ববিৎ অন্তর্যামী সেই ভগবান যে অদ্বিতীয়-এ তত্ত্ব ধারণ করে অর্থাৎ জানতে সমর্থ হয়; আরও, তোমাদের অনুগ্রহে জ্ঞানপ্রেরক, জ্ঞানময় জ্ঞানাধার অর্থাৎ বিশ্বপ্রসবিতা দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত ভগবানের মহতী অর্থাৎ সকলের বরণীয় নিত্যস্তুতি বা নিত্যাৰ্চনা স্বাহামন্ত্রে উদ্যাপিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-তত্ত্বপ্রকাশক। সাধু সৎ-জনই পরমার্থ পথের প্রদর্শক। মানুষ যদি তাঁদের আদর্শ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হয়, তাদের অভীষ্টসিদ্ধি হয়ে থাকে)। অথবা,-মহৎ অর্থাৎ সৎকর্মের ফলপ্রদাতা সর্বতত্ত্বজ্ঞ অন্তর্যামী জ্ঞানময় বিরূপী ভগবানের সৎ-ভাব প্রেরক সত্ত্বভাবজনক বিভূতি-সমূহ, অজ্ঞানজনের –আত্মাকে ভগবানের সাথে সংযোজিত বা সংবদ্ধ করে; অথবা, ভগবপ্রাপ্তির নিমিত্ত সুন্বত বা পবিত্র করে; আরও, অজ্ঞানজনের চিত্তবৃত্তিসমূহকে (ভগবৎপ্রীতির জন্য) নিয়মিত (সংযত) পবিত্র করে। অজ্ঞান জনে অনুগ্রহের জন্য, দেবভাবসমূহের জনয়িতা অর্থাৎ সর্বসিদ্ধিপ্রদ ভগবৎ-বিভূতিসমূহ, অদ্বিতীয় অন্তর্যামী ভগবানকে ধারণ করায় অর্থাৎ অজ্ঞানদের উপলব্ধি করায়; তাদের অনুগ্রহে প্রজ্ঞানাধার ভগবানের মহৎ স্তুতি বা পূজা স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা সম্পাদিত হয় অথবা সাধকগণ কর্তৃক উদ্যাপিত হয়। (মন্ত্রটি সত্যতত্ত্ব প্রকাশ। ভগবৎ-প্রেরণা ভিন্ন মানুষ কোনও সৎকর্মসাধনেই সমর্থ হয় না। অতএব সকর্ম সাধনের জন্য ভগবানের অনুগ্রহ লাভ কর্তব্য। তার দ্বারা সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হয়)। বাশক্তির অধিপতি হে ভগবন্! আপনি আমার হৃদয়রূপ শ্রেষ্ঠ আধারস্থানকে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হোন। দেবগণের আহ্বানকারী হে আমার হৃদয়নিহিত জ্ঞানভক্তি! সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য-প্রদানকারী তোমরা (আমার হৃদয়ে) দেবভাব– শুদ্ধসত্ত্বসমূহ আনয়ন করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয়ে ভগবৎ-অনুগ্রহ লাভের জন্য মন্ত্রে প্রার্থনা বিদ্যমান)। হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমাদের এইরকম কর্ম-সামর্থ্য উপজিত হোক, যার দ্বারা আমরা বিশ্ববাসী সকলকে সৎকর্মসাধনশীল জীবনের দ্বারা প্রবর্ধিত করতে পারি; অপিচ, সে কর্মসামর্থ্য আমাদের সবরকম শক্রর নিয়ামক অর্থাৎ অভিভবকারী হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সাধক আত্মশক্তি লাভের প্রার্থনা করছেন। আত্মশক্তি লাভে জগতের উপকার সাধনের জন্য সঙ্কল্প প্রকাশ পেয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাকে এমন কর্মসামর্থ্য এবং আত্মশক্তি প্রদান করুন, যে শক্তির দ্বারা আমি বিশ্ব-সেবায় আত্মসমর্পণে সমর্থ হই)। বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বর বিষ্ণু এই সমগ্র জগৎকে বিশেষভাবে ব্যেপে আছেন; অতীত অনাগত বর্তমান–তিন কালেই তার ঐশ্বর্য ধৃত (অক্ষুণ্ণ) রয়েছে; অথবা তিনি ধারণ করে আছেন; সেই বিষ্ণুর জ্যোতির্ময় পদে (প্রভুত্বে) এই নিখিল জগৎ সম্যকভারে অবস্থিত আছে। সেই বিষ্ণুকে স্বাহা-মন্ত্রে পূজা করি; আমার অনুষ্ঠান সুহুত হোক। (এই মন্ত্রে বিষ্ণুর স্বরূপ পরিবর্ণিত রয়েছে। বিশ্বব্যাপক বিষ্ণুর প্রভুত্বে নিখিল জগৎ সদাকাল অবস্থিত। বিষ্ণুই বিভূতিস্বরূপে অনু-পরমাণুক্রমে বিদ্যমান সকলকে অধিকার করে আছেন)। অথবা, বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বর বিষ্ণু বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বিশেষভাবে ব্যেপে আছেন অর্থাৎ স্থাবরজঙ্গমাত্মক সকল প্রার্থীর মন ও জীবভাবসকলের মধ্যেই অনুপ্রবিষ্ট রয়েছেন; অগ্নি, বায়ু ও সূর্যরূপে পৃথিবীতে অন্তরিক্ষে এবং স্বর্গলোকে তার মাহাত্ম্য নিরন্তর বিধৃত বা নিহিত রয়েছে; সেই বিষ্ণুর বিজ্ঞানধনানন্দ-অজ-অদ্বৈত-অক্ষর-লক্ষণযুক্ত পরম পদ বা স্বরূপ, অতি নিগুঢ় প্রদেশে নিহিত অর্থাৎ অজ্ঞানের নিকট অপরিজ্ঞাত। (মন্ত্রটি ভগবানের স্বরূপ বর্ণন করছে। বিশ্বব্যাপক বিষ্ণুর মাহাত্ম্য জগৎ-বিশ্রুত। সেই বিষ্ণুর অদ্বৈত অক্ষর স্বরূপ সূরিগণই দর্শন করতে পারেন; অজ্ঞজন তা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় না)। যেহেতু হে বিষ্ণো! তোমার প্রশাসনে এই দ্যাবাপৃথিবী শস্যবতী, গো-অশ্ব ইত্যাদি পশুসমুহযুক্ত, শোভন-অন্নবতী বা সুশস্যবতী এবং মানবগণের উপকারের জন্য যজ্ঞসাধনের দ্রব্য ইত্যাদির প্ৰদাত্রী হয়; সেই হেতু হে বিশ্বব্যাপক ভগব! তুমি এই দ্যাবাপৃথিবীকে বিশেষভাবে স্তম্ভিত বা ব্যাপ্ত করো; অপচি, আপন তেজের, শক্তির বা মাহাত্মের দ্বারা এই পৃথিবীকে সবরকমে ধারণ করো। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। সকল বস্তুতেই ভগবান্ সমভাবে করুণাসম্পন্ন। ভগবান্ তাদের অভ্যন্তরে অবস্থিত আছেন। তাদের সৃষ্টি-স্থিতি- লয়ও ভগবানের লীলা-সাপেক্ষ। বিশ্বব্যাপক সেই ভগবান সকলেরই পূজনীয়,-এটাই ভাবার্থ)। অথবা, হে বিশ্বব্যাপক দেব! তোমার অনুগ্রহেই হৃদয়নিহিত জ্ঞান ও ভক্তি স্নেহকারুণ্যরূপিনী, সৎ-ভাব-রূপ শোভন অপত্যের জনয়িত্রী, প্রজ্ঞানবর্তী, সৎকর্মের সুফল বা মোক্ষ প্ৰদাত্রী, মানবের উপকারের জন্য বা বিশ্বহিতের নিমিত্ত সৎকর্মের সাধনে সামর্থ্য-প্ৰদাত্রী হয়। অতএব, সেই জ্ঞান ও ভক্তিকে তুমি বিশেষভাবে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ ব্যেপে অবস্থিতি করো; অপিচ, আপন তেজের বা মহিমার দ্বারা সেই জ্ঞানভক্তির আধারমূলকে সর্বতোভাবে ধারণ করো। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। সকল সৎ-ভাবের আধারস্থানীয় ভগবানের কৃপায় আমাদের মধ্যে সৎ-ভাবের উন্মেষ হোক,-মন্ত্রের এটাই ভাবার্থ)। হে হৃদয়-নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা প্রাঙ্মুখে অর্থাৎ ভগবানের সকাশে প্রকৃষ্টভাবে গমন করো অথবা আমাকে নিয়ে যাও। অপিচ, হে হৃদয়নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা আমার অনুষ্ঠিত সঙ্কর্ম দেবগণের অর্থাৎ ভগবানের প্রতি সংবাহিত করো অথবা ভগবানকে প্রাপ্ত করাও। (ভাব এই যে, আমার কর্ম ভগবানে যুক্ত হোক)। আরও, হে হৃদয়নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা কুটিল হয়ো না অর্থাৎ আমাকে পরিত্যাগ করো না, অথবা বিচলিত হয়ো না, অর্থাৎ অবিচলিতভাবে আমার হৃদয়ে অবস্থিতি করো! সমগ্র মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। জ্ঞান ও ভক্তি উভয়েই সৎকর্মের সহায়ক। তাদের অনুকম্পায় ভগবৎ-প্রাপ্তি সুগম হয়। ভাব এই যে,হে জ্ঞান ও ভক্তি! তোমরা আমাকে সৎকর্মপরায়ণ করো এবং ভগবৎ-প্রাপ্তির সামর্থ্য প্রদান করো। হে আমার হৃদয়নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা এই শরীরভূত দেব্যজনে অর্থাৎ আমার এই সৎকর্মে অথবা আমার হৃদয়ে ক্রীড়া করো অর্থাৎ সর্বদা বর্তমান রও।(মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; আমাতে জ্ঞানভক্তি অবিচলিতভাবে অবস্থিত থাকুক এবং তার দ্বারা আমার অভীষ্ট লাভ হোক,মন্ত্রে এমনই প্রার্থনা দ্যোতিত)। হে বিশ্বব্যাপক ভগবান! আপনি দুলোক বা স্বর্গলোক হতে, অপিচ পৃথিবী বা ভূলোক হতে এবং মহৎ অনন্তপ্রসারিত অন্তরিক্ষলোক হতে সমানীত ধনের দ্বারা আপনার উভয় হস্তই পূর্ণ করুন এবং দক্ষিণ ও বাম উভয় হস্ত হতে (হস্তের দ্বারা) অর্থাৎ মুক্তহস্তে বা কৃপণতা-রহিত হয়ে (সেই ধন) আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবান্ কার্পণ্যরহিত হয়ে আমাদের প্রতি তার করুণাধারা বর্ষণ করুন এবং সর্বলোক হতে শুদ্ধসত্ত্যরূপ পরমধন আনয়ন করে আমাদের মধ্যে স্থাপন করুন,-মন্ত্রে এই ভাবই পরিব্যক্ত)। যে বিষ্ণু পৃথিবী সম্বন্ধী পঞ্চভূতাত্মক সারভূত কারণগুলি অর্থাৎ নিখিল অণুপরমাণুজাত সৃষ্টির উপকরণগুলি নির্মাণ করেছেন, সেই বিশ্বব্যাপক ভগবানের অলৌকিক কার্যের মাহাত্ম্যের বিষয় আমরা নিত্যই কীর্তন করছি বা করে থাকি। (ভাব এই যে, ভগবৎ-মহিমা আমাদের নিত্যপ্রত্যক্ষীভূত)। সকল প্রাণীর মনোজীবভাব-সমূহের মধ্যে অনুঃপ্রবিষ্ট, অথবা অগ্নি-বায়ু-সূর্য রূপে পৃথিবী-অন্তরিক্ষ-দ্যুলোকে আপন মহিমা-বিজ্ঞাপক, মহাত্মগণের আরাধনীয় সেই বিষ্ণু অর্থাৎ ভগবান্ শ্ৰেষ্ঠস্থানীয় ত্রিলোকের আশ্রয়ভূত অন্তরিক্ষকে অর্থাৎ দেবভাবসমূহের আধারস্থান সাধনসম্পন্নগণের হৃদয়কে মন্থন করেন অর্থাৎ অজ্ঞান-মোহে স্থানভ্রষ্ট হয়ে যাতে অধঃপতিত না হয়, এমনভাবে তিনি ধারণ করেন। [ সমগ্র মন্ত্রটির তাৎপর্যার্থ এই যে,–বিশ্বপ্রকাশক ভগবান সকলের আরাধনীয়। তিনি সকল প্রাণীর মনোজীবভাবের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে তাদের সর্বদা সকল সময়ে নিয়মিত করেন। কেবল তারই অনুগ্রহে মানুষ চিত্তের উৎকর্ষতা লাভ করে। মোক্ষেছু ব্যক্তি সেই ভগবানের প্রীতির জন্য সারভূত শুদ্ধসত্ত্বকে নিবেদন করেন]। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের ললাটরূপ শ্রেষ্ঠ স্থানবর্তী (অথবা হৃদয়রূপ শ্ৰেষ্ঠস্থানে) অধিষ্ঠিত হও। অথবা তুমি আত্মজ্ঞান সম্পন্ন সাধকের ললাটের মতো উচ্চস্থানবর্তী অর্থাৎ হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হও। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে লাভ করা যায়)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের মেরুদণ্ডস্থানীয় অর্থাৎ সাধকদের হৃদয়ে সংরক্ষক হও। অথবা তুমি আত্মজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির জ্ঞানদৃষ্টির বা আত্মদৃষ্টির সংরক্ষক হও। (এই মন্ত্রটিও নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বই আত্মদর্শিগণের জ্ঞানেদৃষ্টির এবং আত্মদৃষ্টির সংরক্ষক এবং ভগবৎ-প্রাপক)। হে আমার জ্ঞানভক্তি! তোমরা বিশ্বব্যাপক ভগবানের কর্মের অর্থাৎ আমার অনুষ্ঠিত সৎকর্মের সাথে লিপ্ত থাকো; অথবা বিশ্বব্যাপক ভগবানের সাথে, আমার অনুষ্ঠিত সক্কর্মের সংযোজক হও। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক। আমার অনুষ্ঠিত সৎকর্মের সাথে জ্ঞান ও ভক্তি অবিচলিত থাকুক এবং জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে আমার কর্ম ভগবানের সাথে যুক্ত থোক,-মন্ত্রে এই ভবেই সূচিত)। হে আমার হৃদয়নিহিত ভক্তি! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের গ্রন্থি-স্বরূপা অর্থাৎ বন্ধনহেতুভূতা হও। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভক্তির দ্বারাই ভগবানকে পাওয়া যায়। অতএব ভক্তি-সামর্থ্যের দ্বারা ভগবানকে যেন লাভ করতে পারি, মন্ত্রে এমনই প্রার্থনা দ্যোতিত)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের নিত্য-সত্যরূপ হও। (ভাব এই যে,–সত্যের দ্বারাই সৎ-স্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। সুতরাং শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে লাভ করো)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎসম্বন্ধী অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। অতএব ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে নিয়োজিত করি। (সৎ-ভাবের দ্বারা ভগবৎ-প্রাপ্তি সুগম হয়। ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য নিখিল সৎ-ভাব প্রদান করা কর্তব্য) ॥ ১৩।
[ভাষ্যমতে এই অনুবাদকের মন্ত্রগুলিতে উত্তরবেদির নিকটবর্তী হবিধান-প্রক্রিয়া পরিবর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ভাষ্যের প্রারম্ভেই ভাষ্যকার হবির্ধান অর্থাৎ যজ্ঞশালা প্রস্তুতের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেছেন। ভাষ্যমতে প্রথম মন্ত্রের অর্থ; যথা,-ব্রাহ্মণ-যজমানের যজ্ঞার্থী ব্রাহ্মণ ঋত্বিকগণ লৌকিক চিন্তা হতে মনকে নিবৃত্ত করে যজ্ঞচিন্তায় মনোনিবেশ করছেন। আরও, যজ্ঞের নিমিত্ত তাদের ইন্দ্রিয়-সমূহকেও সংযত করে নিয়োগ করছেন। কিরকম বিপ্রগণের? মহৎ ও বিপশ্চিতঃ অর্থাৎ সর্বজ্ঞ।–ইত্যাদি। এখানে কেবলমাত্র লৌকিক ব্যবহার অনুসারেই ভাষ্যকার মন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন; নিগুঢ় উদ্দেশ্যের বিষয়ে মনোনিবেশ করেননি। আমরা অলৌকিক বেদমন্ত্রে লৌকিক অর্থ ব্যতিরিক্ত যে এক লোকাতীত ভাবের সমাবেশ আছে, তা প্ৰকটেরই প্রয়াস করেছি। এই মন্ত্রের আমরা যে দুটি অন্বয় দিয়ে মর্মার্থ সাজিয়েছি, প্রকারান্তরে দুটিতেই একই ভাব পরিব্যক্ত। তৃতীয় মন্ত্রের ক্ষেত্রে ভাষ্যমতে পত্নী এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে তিন পদ অগ্রসর হয়ে, আজ্যমিশ্রিত উপানক্তের দ্বারা অগ্নিতে আহুতি দিবেন। সেই অনুসারে ভাষ্যমতে মন্ত্রের অর্থ হয়,–আমাদের কর্মকুশল আলস্যরহিত পুত্র জন্ম গ্রহণ করুক। সেই পুত্র বহু লোকের নিয়ামক-শক্তিযুক্ত মন ধারণ করুক–ইত্যাদি। মন্ত্রের বীর পদে বীর পুত্রের কামনা করা হয়েছে বলে ভাষ্যকারের ধারণা। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যায় ঐ বীর পদের অর্থ হয়েছে–কর্মসামর্থ্য। প্রকৃত বীরত্ব কর্মের দ্বারাই সপ্রমাণ হয়। চতুর্থ মন্ত্র প্রসঙ্গে ভাষ্যের মত–দক্ষিণ হবিধান শকটের পশ্চৎ ভগস্থিত অক্ষ-চক্র-গমন-পথে হরিণ্য স্থাপন করে হোমকালে এই মন্ত্রটি পাঠ করতে হবে। আমরা এই মন্ত্রে ভগবানের স্বরূপ পরিবর্ণিত বলে মনে করি। পঞ্চম মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। ভাষ্যেও মন্ত্রের ভাষ্যানুতে শট। তুমি কুটিল হরেকর্ম বাধরহিত করা অনেকাংশে সেই ভাবই পরিব্যক্ত। কিন্তু এরই মধ্যে যে এক নিগুঢ় তত্ত্ব প্রচ্ছন্ন রয়েছে, আমরা তারই বিশ্লেষণে প্রয়াস পেয়েছি। আমাদের দুরকম অন্বয়েই মর্মার্থের ভাব একই। ভাষ্যমতে ষষ্ঠ মন্ত্রের সম্বোধ্য শকট। সেই অনুসারে অর্থ–হে শকট! প্রাঙ্গুখে গমন করো। কি রকম শকট? দেবকর্ম বাধরহিত করতে সমর্থ এবং উপরিবর্তী দেবগণের প্রতি যজ্ঞ-নয়নে সমর্থ। হে শকট! তুমি কুটিল হয়ো না অর্থাৎ অসুরদের যজ্ঞ প্রাপ্ত করিয়ে দিয়ো না। সপ্তম মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী অর্থ–হে শকট! তুমি দেবযজনাখ্য পৃথিবীর শরীররূপ উত্তরবেদির পশ্চিমদিকে প্রক্ৰমত্ৰয়াবশেষ যে স্থান বিদ্যমান আছে, সেই স্থানে ক্রীড়া করো। আমাদের মতে, মন্ত্রের সম্বোধ্য–হৃদয়নিহিত জ্ঞান-ভক্তি। শকট যেমন যজ্ঞের দ্রব্য-সম্ভার বহন করে; হৃদয়ে সঞ্চিত ভগবৎপূজার উপকরণরাজিকেও তেমনি জ্ঞান ও ভক্তি ভগবানের কাছে সংবাহিত করে নিয়ে যায়। ফলতঃ জ্ঞান ও ভক্তির সাহায্যে ভগবানকে প্রাপ্তির কামনাই–মন্ত্র দুটিতে প্রার্থনার মধ্যে সূচিত হয়েছে বলেই মনে করি। অষ্টম মন্ত্রে শকটের দক্ষিণ বন্ধন-সন্ধিতে স্থণা নিখনক করতে হয়। যুপের দক্ষিণোত্তর ভাগকে শকটের কর্ণ-স্থানীয় বলা হয়। বিনিয়োগ অনুসারে ভাষ্যমতে মন্ত্রের যে অর্থ হয়, তা এই–হৈ বিষ্ণু! দ্যুলোক, ভূলোক, মহলোক অথবা অন্তরিক্ষ লোক হতে ধন আনয়ন করে আপনার উভয় হস্ত পূর্ণ করুন। এবং হে বিষ্ণু! দক্ষিণ ও বাম উভয় হস্তের দ্বারা বহু পরিমাণে প্রকৃষ্ট মণি-মুক্তা ইত্যাদি ধন প্রদান করুন। নবম মন্ত্রের প্রচলিত অর্থে এবং ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা ইত্যাদি থেকে বোঝা যায়, কোনও ব্যক্তিবিশেষ যেন বলছেন,–আমি পৃথিবী অন্তরিক্ষ এবং দ্যুলোকের নির্মাণকারী বিষ্ণুর পূর্বকৃত বীর্যের বিষয় বলছি। তিনি পৃথিবী অন্তরিক্ষ এবং দুলোকে তিনি পদ স্থাপন করে আছেন, দেবগণের বাসস্থান দুলোক অধঃপতিত না হয়,–এইভাবে তিনি ধারণ করে আছেন। ভাষ্যে দশম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ মন্ত্রের যে সব সম্বোধ্যপদের প্রয়োগ দেখা যায়, তাতে জটিলতা দেখি। মন্ত্রগুলির মধ্যে কোনই সম্বোধ্য পদ না থাকলেও হে দর্ভময় মালাধার বংশ, হে মধ্যম ছেদি, হে রোট্যন্তদ্বয়, হে বন্ধহেতো লসজনি কিংবা হে রঞ্জুগ্রন্থি, হে হবিধান ইত্যাদি সম্বোধন আনয়ন করা হয়েছে।] । ১৩।
.
চতুর্দশ অনুবাক
মন্ত্র- কৃণুষ পাজঃ প্রসিতিং ন পৃথীং যাহি রাজেবামবাং ইভেন। তৃৰীমনু প্রসিতিং দ্ৰণানোহস্তাহসি বিধ্য রক্ষসস্তপিষ্ঠৈঃ। তব ভ্ৰমাস আশুয়া পতন্ত্যনু স্পশ ধৃষতা শশাশুচানঃ। তপূংষ্যগ্নে জুহু পতঙ্গানসন্দিতো বি মৃজ বিম্বগুষ্কাঃ। প্রতি স্পশশা বি সৃজ তুর্ণিতমো ভবা পায়ুব্বিশে অস্যা অদব্ধ। যো নো দুরে অঘশংসঃ যো অত্যগ্নে মাকিষ্টে ব্যথিরা দধষীৎ। উদয়ে তিষ্ঠ প্ৰত্যা তনুম্ব নমিত্ৰাং ওষতাত্তিগুহেতে। যো নো অরাতিং সমিধান চক্রে নীচা তং ধক্ষ্যসং ন শুষ্ক। উর্ধো ভব প্রতি বিধ্যাখ্যম্মদাবিষ্কণু দৈব্যান্যগ্নে। অব স্থিরা তনুহি যাতুজুনাং জামিমজামিং প্রমূণীহি শত্রু। স তে জানাতি সুমতিং যবিষ্ঠ য ঈবতে ব্ৰহ্মণে গাতুমৈরৎ। বিশ্বান্যস্মৈ সুদিনানি রায়ো দুস্নান্যৰ্য্যো বি দূরো অভি দ্যৌৎ। সেদগ্নে অস্তু সুভগঃ সুদানুর্যা নিত্যেন হবি য উথৈঃ। পিপ্রীষতি স্ব আয়ুষি দুরোণে বিশ্বেদস্মৈ সুদিনা সাহসদিষ্টিঃ। অৰ্চ্চামি তে সুমতিং ঘোষ্যৰ্বাক্সং তে বাবা জরোম ইয়ং গীঃ। স্বশ্বাস্তুা সুরথমজ্জয়েমাস্মে ক্ষত্রাণি ধারয়েরনু দ্যু। ইহ ত্বা ভূৰ্য্যা চরেদুপ অন্দোবস্তীদিবাংসমনু দ্যু। ক্রীড়া সুমনসঃ সপেমাভি দুম্ন তস্থিংসো জনানা। যা স্বশ্বঃ সুহিরণ্যো অগ্ন উপযাতি বসুমতা রথেন। তস্য ত্রাতা ভবসি তস্য সখা যস্ত আতিথ্যমানুষজুজোষৎ। মহো রুজামি বন্ধুতা বচোভিস্ত পিতুর্গোতমাদম্বিয়ায়। ত্বং নো অস্য বচসশ্চিকিদ্ধি হোতর্যবিষ্ঠ সুক্ৰতো দমূনাঃ। অস্বপ্রজস্তরণয়ঃ সুশেবা অতন্দ্রাসোহবুকা অমিষ্ঠাঃ। তে পায়বঃ সখ্রিয়ঞ্জো নিষদ্যাগ্নে তব নঃ পান্তুমূর। যে পায়বো মামতেয়ং তে অগ্নে পশ্যন্তো অন্ধং দুরিতাদর। ররক্ষ তালুকৃতো বিশ্ববেদা দিন্সন্ত ইদ্রিপবো না হ দেভুঃ। ত্বয়া বয়ং সধন্যস্তোতাস্তব প্রণীত্যশ্যাম বাজা। উভা শংসা সূদয় সত্যতাতেহনুয়া কৃণুহ্যহয়াণ। অয়া তে অগ্নে সমিধা বিধেম প্রতি স্তোমং শস্যমানং গৃভায়। দহাশসো রক্ষসঃ পাহম্মা হো নিদো মিত্ৰমহো অবদ্যাৎ। রক্ষোহণং বাজিনমা জিঘর্মি মিত্রং প্রথিষ্ঠমুপ যামি শৰ্ম্ম। শিশানো অগ্নিঃ ক্রতুভিঃ সমিদ্ধঃ স নো দিবা সরিষঃ পাতু নক্ত। বি জ্যোতিষা বৃহতা ভাত্যগ্নিরাবিৰ্বিশ্বানি কৃণুতে মহিত্বা। প্রাদেবীৰ্মায়াঃ সহতে দুরেবাঃ শিশীতে শৃঙ্গে রক্ষসে বিনিক্ষে। উত স্বানাসসা দিবি যন্ত্রগ্নেস্তিষ্মায়ুধা রক্ষসে হন্তবা উ। মদে চিদস্য প্র রুজন্তি ভামা ন বরন্তে পরিবাধো অদেবীঃ ॥১৪৷ (আপ উন্দাক্ত্যৈ দৈবীমিয়ং ব্যস্যংশুনা সোমমুদায়ু। প্র চ্যবস্বাগ্নেরাতিথ্যমংশুরংশূৰ্বিত্তায়নী মেহসি যুঞ্জতে কৃণুম্ব পাজশ্চচুর্দশ ॥১৪)।
মর্মার্থ- প্রজ্ঞানস্বরূপ হে শুদ্ধসত্ত্ব অথবা ভগবন্! পক্ষিগ্রহণ অথবা মৃগবন্ধনের জন্য মৃগয়ু ব্যাধ যেমন গহনবনে জাল বিস্তার করে, সেই রকম রিপুশত্রুদের বিনাশের জন্য অজ্ঞানতমসাচ্ছন্ন অরণ্যের মতো আমার হৃদয়ে মহৎ তেজঃরূপ জাল বিস্তার করুন অর্থাৎ আমার অজ্ঞানতমসাচ্ছন্ন হৃদয়ে জ্ঞান-জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত করুন! অপিচ, অমাত্য অর্থাৎ সৈন্যসমূহপরিবৃত শত্ৰুসন্তাপক রাজার মতো অর্থাৎ রাজা যেমন সৈন্য-পরিবৃত হয়ে গজসমভিব্যাহারে (প্রভুবলের সাথে) পবরল অর্থাৎ শক্রর প্রতি গমন করে তাদের ধর্ষণ করেন, সেইরকম আপনিও জ্ঞানভক্তির সহযুত তেজঃসঙ্ঘরূপ অমাত্যযুক্ত হয়ে, শত্রুনাশের নিমিত্ত গমন করুন। তারপর ক্ষিপ্রগমনকারী জ্ঞান ভক্তি-রূপ প্রকৃষ্ট সৈন্যের সহায়তায় শত্রুদের নাশক হোন। অপিচ, হে প্রজ্ঞানাধার ভগবন্! আপনার শত্ৰুসন্তাপজনক তেজঃসমূহের দ্বারা সর্বরকম বহিঃ-অন্তঃ-শত্রুদের বিতাড়িত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। জ্ঞান-জ্যোতির সাহায্যে শত্রুনাশের প্রার্থনা মন্ত্রে বর্তমান। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! অজ্ঞান-তমসায় আমার হৃদয় চিরসমাচ্ছন্ন, আমাকে প্রজ্ঞানসম্পন্ন করুন; এবং জ্ঞানধনদানে বাহিরের এবং অন্তরের শত্রু বিনাশ করুন)। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে শুদ্ধসত্ত্ব বা ভগবন্! আপনার সর্বত্রগামী ত্বরিত গতিবিশিষ্ট রশ্মিসমূহ সাধক-হৃদয়েই প্রসৃত হয়। অতএব দীপ্যমান আপনার শত্রুধর্ষক তেজঃ-সমূহের দ্বারা অনুক্রমে আপনি শত্রুসমূহকে নাশ করুন। অপিচ, প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! শত্রুগণের অনভিভাব্য আপনি আমাদের প্রদত্ত ভক্তিরূপ হবির সাথে অবিচ্ছিন্ন হয়ে (অর্থাৎ ভক্তিরূপ হবিঃ গ্রহণ করে আমাদের সহযুত হয়ে) শত্রু-সন্তাপক, আত্ম-উৎকর্য-সম্পন্নদের হৃদয়ে পতনশীল (আপনার) জ্বালারূপ তেজঃ-সমূহ আমাদের হৃদয়ে সর্বতোভাবে প্রসারিত অর্থাৎ উৎপাদিত করুন। (মন্ত্রটির প্রথম অংশে নিত্যসত্য-প্রখ্যাপিত এবং দ্বিতীয় অংশে প্রার্থনা সংসূচিত। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগব! শত্রুর উপদ্রবে আমি আত্ম বিস্মৃত হয়ে আছি। কৃপা করে আমার অন্তরে শত্ৰু-সন্তাপক জ্ঞানের জ্যোতিঃ বিচ্ছুরণ করে আমাকে উদ্ধার করুন)। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগব! সর্বত্র ত্বরিতগমনশীল আপনি আমাদের সত্য-অন্ত-বিবেক-জ্ঞানের জন্য আপনার শত্রুনাশক রশ্মি-সমূহ (আমাদের মধ্যে) বিস্তার করুন। অপিচ, সকলের অহিংসিত শত্রুনাশক আপনি আপনার শরণাগত আমার বিশ্বহিতসাধিকা শক্তির পালক হোন। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আমাদের হৃদয়ের বহিঃপ্রদেশে প্রলোভন ইত্যাদি রূপ যে পাপশত্রু বিদ্যমান আছে এবং আমাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে কামক্রোধরূপ যে অন্তঃশত্রু বর্তমান, আপনি সেই উভয়রকম শক্রর পালক হোন। অপিচ, আপনার শরণাপন্ন আমাদের, সৎ-ভাব অবরোধক কোনও শত্রুই যেন অভিভূত করতে না পারে অর্থাৎ সৎসম্বন্ধ হতে বিচ্ছিন্ন না করে। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক/মন্ত্রে জ্ঞান-জ্যোতির সাহায্যে শত্রুনাশের প্রার্থনা বর্তমান। ভাব এই যে, হে ভগবন! আপনার অনুগ্রহে আমাদের বাহিরের ও অন্তরের শত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হোক)। তীক্ষ্ণতেজঃসম্পন্ন অমিততেজ প্রজ্ঞানস্তরূপ হে ভগবন্! আপনি উদ্বুদ্ধি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রবৃদ্ধ (আর্বিভূত) হোন; এবং শত্রুর প্রতি আপনার শত্ৰু-নাশক-তেজ (শক্তি) সমুহ বিস্তার করুন। অপিচ, সেই তেজঃসমূহের দ্বারা (আমাদের) বাহিরের ও অন্তরের শত্রুকে নিঃশেষে দগ্ধ করুন। জ্ঞানভক্তিরূপ সমিধসমূহে দীপ্যমান প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগব! যে শক্র আমাদের আরতি অর্থাৎ সৎ-ভাব অবরোধ করে, অগ্নি যেমন শুষ্ক কাষ্ঠকে দহন করে, সেইরকমভাবে আপনি সেই শত্রুকে নিঃশেষে দগ্ধীভূত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক)। ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের সৎ-ভাব অবরোধক শত্রু-সমূহকে নিঃশেষে বিনাশ করুন এবং সৎ-ভাব ও জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা আমাদের প্রবর্ধিত বিনাশ করুন এবং সৎ-ভাব ও জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা আমাদের প্রবর্ধিত করুন)। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনি শত্রুনাশের জন্য আমাদের হৃদয়ে প্ৰদ্দীপিত (প্রবর্ধিত) হোন। অপিচ, আমাদের সকাশ (হৃদয়) হতে সকল শত্রুকে একে একে বিতাড়িত করুন; এবং দেব-সম্বন্ধি জ্ঞান বা শক্তি আমাদের অন্তরে উৎপাদন করুন। তারপর আমাদের বাহিরের ও অন্তরের শত্রুদের অবিচলিত লক্ষ্য বা বীর্যসমূহকে বিনষ্ট করুন; এবং বিজিত ও অবিজিত–সবরকমের বাহিরের ও অন্তরের শত্রুদের প্রকৃষ্টভাবে বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রে সবরকমের শত্রুনাশের প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের বহিঃ-অন্তঃ-শত্রু বিনাশ করে আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। যুবতম চিরনবীন অথবা দেবগণের মধ্যে হবিঃসমুহের মিশ্রণকারী প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন! যে ব্যক্তি বিশ্বহিত-সাধনে উদ্বুদ্ধ শরণাগত-হৃদয়ে গমনকারী পরব্রহ্ম আপনার উদ্দেশ্যে স্তোত্র-মন্ত্র প্রেরণ করে অর্থাৎ ভগবানের মাহাত্ম কীর্তন করে, সে আপনার কল্যাণকারী অনুগ্রহাত্মিকাবুদ্ধি অর্থাৎ আপনার অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়। আপনিও সেই অর্চনাপরায়ণ প্রার্থনাকারীকে সবরকম অভ্যুদয়কারণ মঙ্গলসমূহ প্রদান করেন। অপিচ, সেই সৌভাগ্যশীল বা সঙ্কর্মের অনুষ্ঠাতা ব্যক্তি আপনার অনুগ্রহে পরমধন এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণসমূহ প্রাপ্ত হয়। অপিচ, আপনার শরণাগত অৰ্চনাকারী (আপনার) পরমাশ্রয়কে লক্ষ্য করে বিশিষ্টভাবে দ্যুতিসম্পন্ন হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তির প্রতি ভগবানের করুণা আপনা-আপনিই সঞ্চারিত হয়। একাগ্রচিত্তে ভগবানের আরাধনায় পরমমঙ্গল লাভ হয়ে থাকে। অতএব একৈকশরণ্য হয়ে ভগবানের পুজার সঙ্কল্প এবং তার শরণ গ্রহণ করে আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা মন্ত্রে দ্যোতিত হচ্ছে)। অশেষ প্রজ্ঞানের আধার হে ভগবন্! আপনার শরণাগত যে ব্যক্তি নিত্যকাল জ্ঞানভক্তিরূপ হবিঃ দ্বারা এবং জ্ঞানভক্তিসহযুত স্তোত্রমন্ত্রে আপনার প্রীতি সম্পাদন করে, শরণাগত সেই ব্যক্তি (আপনার অনুগ্রহে) পরমধনরূপ শোভনধনে সৌভাগ্যবান্ এবং শোভনদানযুক্ত হয়; অপিচ, সেই ভগ্যবান্ ব্যক্তি আপন সকর্মশীল জীবনের প্রভাবে শত্রুর উপদ্রবরহিত পরমপদে অধিষ্ঠিত থাকে। আপনিও সেই সকর্মশীল শরণাগত ব্যক্তির জন্য সবরকম পরমার্থ ধন এবং অভ্যুদয়কারণসম্পন্ন শোভন দিন (সুদিন) সাধন করেন। অপিচ, আপনার অনুগ্রহে সৎকর্মসাধনরত সেই ব্যক্তির সৎকর্মরূপ অনুষ্ঠান ফলসাধন-সমর্থ অর্থাৎ কর্মফলপ্রসূ হয়। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক এবং নিত্যসত্য-জ্ঞাপক। ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমাদের সুমতি উপজিত হোক এবং সৎ-ভাব-সমূহ সঞ্জাত হোক। আপনার প্রভাবে সুমতি এবং সৎ-ভাব লাভ করে, আপনাতে যাতে আত্মসমর্পণে সমর্থ হই, হে ভগবন্! তা বিহিত করুন)। প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! আমি আপনার সম্বন্ধি শোভন অনুগ্রহাত্মিকা বুদ্ধি অর্থাৎ আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। পুনঃ পুনঃ আপনার প্রতি গমনকারী অর্থাৎ আপনার উদ্দেশ্যে নিত্যকাল অনুষ্ঠিত আমাদের উচ্চারিত স্তুতিরূপ বাক্য আপনার মাহাত্ম বিঘঘাষিত করুক; (এবং আপনার অভিমুখী হয়ে, সম্যক রকমে আপনার স্তুতি করুক;) অর্থাৎ আপনাকে পরিত্যাগ করে অন্যের উদ্দেশ্যে যেন গমন না করে। (ভাব এই যে, ভগবানের গুণ অনুকীর্তন ভিন্ন যেন অন্য বাক্য উচ্চারণ না করি)। তাতে জ্ঞান ও ভক্তিরূপ অশ্বসহযুত সৎকর্মরূপ রথ-সমন্বিত হয়ে, আমরা যেন আপনাকে অলঙ্কৃত অর্থাৎ পরিচর্যা করতে পারি অর্থাৎ আপনাতে সংন্যস্তচিত্ত হই। আপনিও আমাদের মধ্যে যেন নিত্যকাল কর্মসাধন-সামথ্য-রূপ শ্রেষ্ঠ-বীর্য-সমূহ সংরক্ষণ করেন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের কর্ম ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক হোক। অপিচ জ্ঞান ও ভক্তির সহযুত কর্মরূপ রথে ভগবাকে যাতে সংবাহন করে আনতে পারি, সেই সামর্থ্য যেন আমরা প্রার্থনা করি)। প্রজ্ঞানের আধার হে ভগবন! আপনার সম্বন্ধযুত এই কর্মে (অথবা ইহলোকে) আমরা দিবারাত্রি নিত্যকাল অথবা অজ্ঞান-অন্ধকার-নাশক দীপ্যমান আপনাকে সর্বক্ষণ আত্ম-উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রভূত পরিমাণে যেন পরিচর্যা অর্থাৎ অর্চনা করি। আরও, আপনার প্রসাদে বিশ্ববাসী সকলের মধ্যে আমার কর্মফলরূপ পরমার্থধন পরিবৃদ্ধির জন্য অথবা তাদের মধ্যে ভগবৎ-মাহাত্ম্য বিজ্ঞাপনের নিমিত্ত, পরমানন্দলাভে হৃষ্টমনা, সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা শোভন মনস্ক এবং আত্ম-উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে, আমরা যেন আপনাকে পরিচর্যা করতে পারি অর্থাৎ আপনার পূজায় সমর্থ হই। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং সঙ্কল্পসূচক। আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনশীল ব্যক্তিই ভগবানের পূজায় সমর্থ হয়। অতএব সঙ্কল্প–সৎ-ভাবসমন্বিত এবং আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হয়ে আমি যেন ভগবানের পূজায় সমর্থ হই)। প্রজ্ঞানাধার হে ভগবন্! যে ব্যক্তি জ্ঞানভক্তিরূপ অশ্বদ্বয়ে এবং সুবর্ণের মতো আকাক্ষণীয় পরমধনোপেত সৎ-ভাবসমন্বিত কর্মরূপ রথে যুক্ত হয়ে, আপনাকে অৰ্চনার জন্য একাগ্রভাবে আপনার শরণাপন্ন হয়; আপনি সকল দুরিত হতে তার রক্ষক বা পরিত্রাণকারী হন অর্থাৎ তাকে পরিত্রাণ করেন। (অতএব প্রার্থনা–শরণাগত আমাকে পাপ-ভয় হতে পরিত্রাণ করুন। ভাব এই যে, পরাৎপর বুদ্ধির দ্বারা যে আপনাকে উপাসনা করে, সে আপনারই সমীপবর্তী হয়)। আরও, যে জন প্রীতিভক্তিসমন্বিত হৃদয়ে প্রতিদিন (নিত্যকাল) অতিথির মতো আপনার অর্চনা করে, আপনি শরণাগত সেই ব্যক্তির মিত্রের মতো কর্মফলদাতা হন অর্থাৎ মঙ্গল সাধন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। একৈকশরণ্য হয়ে ভক্তিভাবে যে ব্যক্তি সদাকাল ভগবানের অনুধ্যানে রত থাকে, সে ভগবানের অনুগ্রহ লাভে সমর্থ হয়)। দৈবগণের আহ্বানকারী, চিরনবীন অথবা দেবতাগণের সাথে হবিঃ-মিশ্রণকারী শোভনপ্রজ্ঞ শোভনকর্মসম্পাদক প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত স্তোত্রমন্ত্রের প্রভাবে অথবা আপনার উদ্দেশ্যে সম্পাদিত সৎকর্মের দ্বারা সঞ্জাত (শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে) আপনার সখিত্ব প্রাপ্ত হয়ে, আমি যেন (আমার) রাক্ষসরূপ অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করতে সমর্থ হই। সেইরকম স্তোত্র বা সৎকর্ম, সকর্মসমূহের ক্রমাভিজ্ঞ, আত্মজ্ঞানসম্পন্ন জনের নিকট হতে আমাকে প্রাপ্ত করুন। (ভাব এই যে, আত্মদর্শিগণের সৎ-দৃষ্টান্তের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি যেন সকামের সাধনে উদ্বুদ্ধ হই)। অপিচ, প্রকৃষ্টপ্রজ্ঞ আপনি অথবা শত্রুদের উপক্ষয়িতা আপনি, আমাদের উচ্চারিত বা অনুষ্ঠিত স্তোত্রের বা সৎকর্মের রহস্য বিজ্ঞাপিত করুন; অথবা আপনি আমাদের অনুষ্ঠিত বা উচ্চারিত সৎকর্ম বা স্তোত্রমন্ত্র অবগত হোন অর্থাৎ গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে-হে ভগবন্! আমাদের কর্মে পরিতুষ্ট হয়ে আমাদের সেই কর্মের ফল প্রদান করুন)। সর্বজ্ঞ অথবা সর্বত্র অপ্রতিহতগমনশীল প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার সম্বন্ধি জ্ঞানরশ্মিসমূহ সদা-জাগরুক ও সত্যস্বরূপ এবং আপদ অর্থাৎ দুরিতরূপ তামস হতে ত্রাণকারী; অপিচ সুখসেবনযোগ্য, অর্থাৎ সর্বদা উদ্বুদ্ধ, অহিংসক শ্রমক্লান্তিরাহিত পরস্পর-সঙ্গত অর্থাৎ ভক্তকে ভগবানের সাথে সংযোজক ও শরণাগতপালক। সেই রশ্মিসমূহ আমাদের কর্মে অথবা হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের পরিত্রাণ সাধন করুক। (মন্ত্রটি ভগবৎ-মাহাত্ম-প্রকাশক এবং প্রার্থনামূলক। মন্ত্রের প্রথমাংশে ভগবানের মহিমা পরিব্যক্ত এবং শেষাংশে প্রার্থনা সংসূচিত। প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবান কৃপা করে দিব্য-দৃষ্টি দান করে আমাদের পরিত্রাণ-সাধন বা উদ্ধারসাধন করুন)। প্রজ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার সম্বন্ধি জ্ঞানরশ্মিসমূহ, জ্ঞানদৃষ্টি–দিব্যদৃষ্টিদানে মায়ামোহসঞ্জাত অন্ধতমসাচ্ছন্ন জনকে পারূপ মোহসম্মোহ হতে রক্ষা করুন অর্থাৎ উদ্ধার করুন। মোহ-সম্মোহ হতে রক্ষাকারী সর্বদ্রষ্টা অর্থাৎ দিব্যদৃষ্টি-বিধায়ক সেই রশ্মিসমূহ কৃপাদৃষ্টিতে আমাকে দর্শন করুন। (ভাব এই যে, আমি যেন সেই জ্ঞানদৃষ্টির প্রভাবে দিব্যদৃষ্টি লাভ করি)। বিশ্বপ্রজ্ঞ অর্থাৎ প্রজ্ঞানের আধার আপনি, শোভনকর্মকারী অর্থাৎ সৎকর্মের উদ্বোধক সেই জ্ঞান-রশ্মিসমূহকে আমাদের মধ্যে স্থাপন করুন। সৎ-ভাবের অবরোধক রিপু-শত্রুসমূহ, দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন আমাদের যেন পরিভব করতে সমর্থ না হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। অজ্ঞানতাই মায়ামোহের মূল। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে ভগবন্! জ্ঞানজ্যোতিঃবিচ্ছুরণে অজ্ঞানমূল নাশ করে আমার মায়ানমাহের বন্ধন ছেদন করুন)। প্রজ্ঞানের আধার হে ভগব। ভক্তের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ আপনি, আপনার প্রসাদে সমানধন অর্থাৎ আত্মজ্ঞানসম্পন্ন এবং আপনার দ্বারা রক্ষিত হয়ে, প্রার্থনাকারী আমরা আপনার প্রেরণায় যেন সৎ-ভাব ইত্যাদি রূপ অন্ন প্রভৃতি প্রাপ্ত হই। সত্যের প্রজ্ঞাপক অর্থাৎ সত্যস্বরূপ হে ভগবন্! আপনি আমাদের ঐহিক আমুষ্মিক উভয় রকম পুরুষার্থ প্রদান করুন। অপিচ, আমাদের সাধনা-অনুষ্ঠানের দ্বারা সমৃদ্ধ করুন। অথবা, হে সত্যস্বরূপ সত্যপ্রকাশক ভগবন্! ভক্তজনের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ আপনি, পাপসমূহের সংশয়িতা বহিঃ-অন্তঃ-শত্রু প্রভৃতিকে বিনাশ করুন। অপিচ, অনুষ্ঠানক্রমে অর্থাৎ আমাদের সকর্মসাধনের দ্বারা আমাকে সৎ-ভাবসম্পন্ন এবং আত্মদৃষ্টিসম্পন্ন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যেন আমি সৎ-ভাব এবং জ্ঞানদৃষ্টিলাভে সমর্থ হই। সত্যপ্রকাশক সত্যস্বরূপ আপনি আমাদের ঐহিক ও আমুষ্মিক পুরষার্থ বিধান করুন এবং পাপশত্রুদের বিনাশ করে সাধন-অনুষ্ঠানের দ্বারা সমৃদ্ধ করুন)। জ্ঞানস্বরূপ হে ভগবন্! আপনার শরণাগত আমি, যেন আমার হৃদয়ে প্রদীপ্ত জ্ঞানভক্তি বিমিশ্র শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ দ্বারা আপনার পরিচর্যায় সমর্থ হই। (মন্ত্রাংশটি সঙ্কল্পমূলক)। আপনিও যেন কৃপাপরবশ হয়ে আমাদের প্রদত্ত সেই স্তোত্ররূপ হবিঃ গ্রহণ করেন। আর সেই হবিঃ গ্রহণে প্রবৃদ্ধ হয়ে নৃশংস বহিঃ ও অন্তঃ শত্রুদের বিনাশ করুন। শরণাগতদের মিত্রভূত মহৎ-উপকারক অর্থাৎ শরণাগতপালক হে প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবন্! সৎ-ভাব অবরোধকারী নিন্দক শত্রুদের সৎ-ভাব নাশন-রূপ দ্রোহ হতে প্রার্থনাপরায়ণ আমাদের পরিত্রাণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! আমাদের মধ্যে সৎ-ভাব সংরক্ষণ করুন। বাহিরের ও অন্তরের শত্রু বিনাশ করে জ্ঞানভক্তি-বিমিশ্র শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ গ্রহণ করে আমাদের পরমার্থরূপ পরমধন প্রদান করুন)। বাহিরের ও অন্তরের শত্রুরূপ রক্ষোহননকারী শুদ্ধসত্ত্বের উৎপাদনকর্তা প্রজ্ঞানময় ভগবানকে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ দ্বারা হৃদয়ে উদ্দীপিত অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত করছি। তাতে মিত্রের মতো জগতের উপকারক সৰ্ববরেণ্য পরমার্থরূপ পরমাশ্রয়কে যেন প্রাপ্ত হই। শক্ৰসন্তাপক মোক্ষদায়ক প্রজ্ঞানময় ভগবান্ আত্মদৃষ্টিসম্পন্নদের সৎ-ভাব সৎকর্মরূপ সমিধ ইত্যাদির দ্বারা হৃদয়ে উদ্দীপিত হন (হোন)। তীক্ষ্ণ-তেজসম্পন্ন অর্থাৎ সর্বশক্তিমান্ সেই অগ্নিরূপী ভগবান সদাকাল আত্মজ্ঞানসম্পন্ন জনকে হিংসক শত্রুর আক্রমণ রূপ অজ্ঞানতমঃ হতে রক্ষা করেন। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক এবং প্রার্থনাজ্ঞাপক। মন্ত্রের প্রথমার্ধে সঙ্কল্প এবং দ্বিতীয়ার্ধে প্রার্থনা বর্তমান। আত্মদৃষ্টি-লাভের জন্য এবং আত্মদৃষ্টির দ্বারা শত্রুনাশের নিমিত্ত প্রার্থনা মন্ত্রে সংসূচিত। প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে ভগবান! আমাদের অনুষ্ঠিত কর্মের প্রভাবে আমাদের হৃদয়ে অবির্ভূত হোন। তারপর আত্মদৃষ্টি-সম্পাদনে আমাকে উদ্ধার করুন)। প্রজ্ঞানের আধার ভগবান্ জ্ঞানাগ্নিরূপে হৃদয়ে প্রজ্বলিত হয়ে জগৎপ্রকাশিকা তেজঃ পুঞ্জের দ্বারা বিশিষ্টভাবে প্রদীপ্ত হন। সেইভাবে প্রদীপ্ত হয়ে সেই জ্ঞানদের আপন মাহাত্মের দ্বারা বিশ্বকে অর্থাৎ বিশ্বের যাবতীয় ভূত-জাতকে প্রকট অর্থাৎ প্রকাশ করেন। এই ভাবে হৃদয়ে প্রবৃদ্ধ হয়ে, সেই জ্ঞানদেব অদেবনশীল সর্বদুঃখমূল আসুরী মায়া অর্থাৎ অবিদ্যাকে প্রকৃষ্টভাবে বিনাশ করেন। অপিচ, সেই জ্ঞানদেব বাহিরের ও অন্তরের শত্রুনাশের নিমিত্ত শৃঙ্গরূপ তীক্ষ্ণ-জ্বালাসমূহকে তীক্ষ্ণীকৃত করেন অর্থাৎ শত্রুনাশের নিমিত্ত সাধকের হৃদয়ে প্রজ্বলিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক এবং ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। জ্ঞানের দ্বারা উদ্ভাসিত নির্মল অন্তঃকরণেই ভগবান্ অধিষ্ঠিত হন। দিব্যজ্ঞানের দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। অপিচ, প্রজ্ঞানস্বরূপ জ্ঞানময় হে ভগব। শত্রুনাশক পরম তেজঃ সম্পন্ন আপনার প্রভাবসমূহ শত্রুনাশের নিমিত্ত দুলোকের মতো পবিত্র আমাদের হৃদয়ে প্রাদুর্ভূত হোক অর্থাৎ সমুদ্ভুত হোক। পরাজ্ঞান লাভ করে পরমানন্দ উপজিত হলে পরমতেজঃসম্পন্ন জ্ঞানদেব ভগবানের সর্বপ্রকাশক রশ্মিসমূহ প্রকৃষ্টভাবে শত্রুসমূহকে বিনাশ করে। হে জ্ঞানাধার ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমাদের পরাগতিরোধিকা অবেদনশীলা আসুরী মায়া আমাদের যেন বন্ধন করতে সমর্থ না হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-জ্ঞাপক ও প্রার্থনামূলক। জ্ঞানই শত্রুনাশকারী। হৃদয়ে পরাজ্ঞান উপজিত হলে কাম-ক্রোধ-হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদি অন্তরের ও বাহিরের শত্রু কর্তৃক উৎপাদিত মায়া-বন্ধন বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অতএব বন্ধন-মোচনের নিমিত্ত সাধক এখানে পরাজ্ঞান প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে,-হে ভগবন্! পরাজ্ঞান দান করে মায়া-বন্ধন-মোচনে আমাকে উদ্ধার করুন) ॥১৪৷৷
এই অনুবাকে দ্বিতীয় প্রপাঠক পরিসমাপ্ত হলো। এই অনুবাকের আঠোরোটি মন্ত্রের সবগুলিই ঋগ্বেদ সংহিতায় পরিদৃষ্ট হয়। (যথা–৩ অষ্টক ৪ ও ৮ অধ্যায়, ৮ অষ্টক ৪ অধ্যায়)। সায়ণাচার্যের ভাষ্য ঋগ্বেদেও আছে। কিন্তু সেখানকার এবং এখানকার ভাষ্যের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। কেবল ভাষ্যের ভাষার পার্থক্য নয়; ভাবেরও যথেষ্ট পার্থক্য বর্তমান। তাই মনে হয়, সায়ণাচার্যের নামে প্রচলিত হলেও, ভাষ্যকার বিভিন্ন। নচেৎ, একই মন্ত্রের ভাষ্য এবং ব্যাখ্যা স্থান-বিশেষে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কেন হবে? ভাবের এবং ভাষার বিভিন্নতাই বা কেন ঘটবে? আমরা কৃষ্ণ-যজুর্বেদের এবং ঋগ্বেদের উভয়রকম ভাষ্য মিলিয়ে মন্ত্রগুলির অর্থ নিষ্কাশন করেছি। বলা বাহুল্য, আমাদের ব্যাখ্যার ভাব উভয়রকম ভাষ্য থেকে স্বতন্ত্র হয়েছে। আমাদের আদর্শ (আধ্যাত্মিকভাবে বিশ্লেষণ); এই পার্থক্য। ভাষ্যানুক্রমণিকায় ভাষ্যকার এই মন্ত্রগুলির প্রয়োগবিধি সম্বন্ধে যে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন তা এই–এই অনুবাকে কাম্য, সামিধেনী, যাজ্যা, পুরোনুবাক্যা প্রভৃতি ব্যাখ্যাত হয়েছে। এয়োদশ অনুবাকে হবির্ধান-মণ্ডপ নির্মিত হয়েছিল। চতুর্দশ অনুবাকের এই মন্ত্রগুলির দ্বারা পূর্বোক্ত মণ্ডপ-নির্মাণমূলক বিশেষ কোনও কার্যই সম্পন্ন হয় না বটে; কিন্তু তা হলেও অধ্যাপকসম্প্রদায়-পরম্পরাক্রমে প্রপাঠকের শেষ অনুবাকের দ্বারা তার পরিসমাপ্তি সাধিত হয়। সেইজন্য, চতুর্দশ অনুবাক, দ্বিতীয় প্রপাঠকের শেষ বলে, এই অনুবাকে কাম্য, সামিধেনী, পুরোনুবাক্যা এবং যাজ্য উক্ত হয়েছে। ইষ্টিকাণ্ড-মতে ব্রাতপত্য ইষ্টর আগে রক্ষোঘ্ন ইষ্টির বিধান আছে। চতুর্দশ অনুবাকে সেই রক্ষোঘ ইষ্টির মন্ত্রগুলি ও তার প্রয়োগ-বিধি উল্লিখিত…।-ইত্যাদি।যাই হোক, এই অনুবাকের মন্ত্রগুলির ব্যাখ্যায় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভাষ্যের ভাবেরই অনুসরণ করেছি। ভাবার্থ-নিষ্কাশনে মতান্তর যে আদৌ সংঘটিত হয়নি, তা নয়; সে মতান্তরে কারণ আর অন্য কিছুই নয়; সে কেবল আমাদের অনুসৃত পন্থার অনুগমন মাত্র। কর্মকাণ্ড ছাড়াও আধ্যাত্মিকতামূলক উচ্চভাব প্রকটনই সে মতান্তরের একমাত্র কারণ। অবশ্য তাতে আমরা কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করিনি। বেদমন্ত্র কামধেনু। জ্ঞানবুদ্ধির তারতম্য অনুসারে মন্ত্রার্থেতর তারতম্য–ইতরবিশেষ হওয়া স্বাভাবিক। তাই আমাদের পন্থার এইরকম পার্থক্য। আমাদের বিশ্লেষণ রীতি প্রসঙ্গে একটু বলা যাক।–প্রথম মন্ত্রে (কৃণুম্ব পাজঃ প্রভৃতি) প্রার্থনা সূচিত হয়েছে। প্রার্থনা করা হয়েছে,-হে ভগব! জ্ঞানধনদানে আমাদের বহিঃরন্তঃ-শত্রু বিনাশ করুন; এবং শত্রুনাশে আমাদের পরমার্থধন প্রদান করুন। মন্ত্রের মধ্যে দুটি উপমাবাক্য আছে,প্রসিতিং ন পৃথ্বীং এবং রাজের অমবান্। উপমা দুটির তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম হলেই মন্ত্রের অর্থবোধ-বিষয়ে কোনও সংশয় থাকবে না। প্রসিতিং পদে যজুর্বেদে এবং ঋগ্বেদে, ভাষ্যকার পক্ষী বা মৃগ বন্ধনের হেতুভূত পাশ বা জাল অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন। তাতে প্রসিতিং ন উপমা-বাক্যের অর্থ হয়েছে-পক্ষী বা মৃগ-বন্ধনের জন্য জালের মতো প্রসারিত অর্থাৎ ব্যাধ যেমন গহন কাননে পক্ষী বা মৃগ বন্ধনের জন্য পাশ বা জাল বিস্তার করে। আর রাজেব অমবান উপমার ভাষ্যকার অর্থ করেছেন,–অমাত্যযুক্ত রাজার ন্যায়। আমাদের হিসাবে, ব্যাধের সাথে ভগবানের (অগ্নির), জালের সাথে জ্ঞানরশ্মির (পাজঃ), মৃগ বা পক্ষীর সাথে কাম-ক্রোধী ইত্যাদির এবং গহন কাননের সাথে অজ্ঞানতমসাচ্ছন্ন হৃদয়ের উপমা সংসূচিত হয়েছে। ঐ দুই উপমাবাক্যের সাথে কৃনুষ পাজঃ পদ দুটির সংযোগে মন্ত্রের প্রথমাংশের অর্থ হয়েছে,-হে প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবন্! ব্যাধ যেমন পক্ষী বা মৃগবন্ধনের জন্য গহনবনে জাল বিস্তার করে এবং রাজা যেমন সৈন্য পরিবৃত হয়ে অমিতপরাক্রমে শক্রদলকে ধর্ষণ করে, আপনিও সেইরকম গহন কাননের মতো আমার অজ্ঞানতমসায় আচ্ছন্ন হৃদয়ে আপনার তীক্ষ্ণ-তেজঃরূপ জাল বিস্তার করুন এবং আমার অন্তর্নিহিত জ্ঞান-ভক্তি-রূপ অমাত্যে পরিবৃত হয়ে অমিততেজে আমার বাহিরের ও অন্তরের শত্রুদের ধর্ষণ করুন। অর্থাৎ জ্ঞান ও ভক্তি সহযুত কর্মের প্রভাবে আপনি আমার অজ্ঞানতমসাচ্ছন্ন হৃদয়ে জ্ঞানের দিব্যজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণ করুন। আর সেই জ্ঞানের প্রভাবে অর্থাৎ দিব্যদৃষ্টির প্রভাবে আমার অন্তরের সকল শত্রু বিনষ্ট হোক।-চতুর্দশ অনুবাকের মন্ত্রসমূহ পাঠ করলে আপনা-আপনিই মনে হয় যে,-যজ্ঞ-কুণ্ডস্থিত হোমাগ্নিকে লক্ষ্য করেই মন্ত্রগুলি প্রবর্তিত হয়েছে, আর সেই অগ্নির কাছেই অর্চনাকারী যজমান শত্রুনাশের, পরমধনলাভের এবং কর্মফলসাধনের প্রার্থনা জ্ঞাপন করেছেন। তাতে ভিন্নদৃষ্টিসম্পন্ন জন দাহিকা শক্তিসম্পন্ন প্রজ্বলিত পরিদৃশ্যমান লৌকিক অগ্নির পুজার বিষয়ই প্রখ্যাত করেন। ভাষ্যমতও সেইভাবেরই দ্যোতক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের মতে এ অগ্নি-সম্মুখে পরিদৃশ্যমান জ্বালামালাময় ঐ জড় অগ্নির পূজা নয়; অগ্নিপূজা বলতে, অগ্নি যাঁর বিভূতির বিকাশ, আমরা তারই পূজা বুঝে থাকি। ঐরকম উপাসনার উদ্দেশ্য এই যে, ঐ অগ্নির পূজা করতে করতে, ঐ অগ্নি যাঁর বিভূতি–তার পূজায় প্রবৃত্তি জাগবে। প্রকৃতপক্ষে অগ্নিরূপে আমরা কার পূজা করি? সে কি এই জড় অগ্নির?–সে কি এই সামান্য অগ্নির উপাসনা? যিনি অগ্নির অগ্নিত্ব, যিনি বায়ুর বায়ুত্ব, যিনি বরুণের বরুণত্ব, যিনি ব্রহ্মর ব্রহ্মত্ব, যিনি ইন্দ্রের ইন্দ্ৰত্ব, যিনি সূর্যের সূর্যত্ব–সে কি সেই অগ্নির উপাসনা নয়? যিনি বিশ্বের আদি, যিনি বিশ্বের বীজ, যিনি বিশ্বের প্রাণ, যিনি বিশ্বেশ্বররূপে বিশ্বে বিরাজমান; যিনি মাতা, যিনি পিতা, যিনি দয়িতা; যিনি দেব, যিনি অসুর, যিনি দানব, যিনি গন্ধর্ব; যিনি সর্বরূপে সকলের মধ্যে অবস্থান করছেন, আমরা মনে করি, এ অগ্নি তাঁরই নামান্তর। এ অগ্নি সেই প্রজ্ঞানাধার শুদ্ধসত্ত্ব বা ভগবান।–আমরা এইভাবেই আমাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে মর্মার্থে তা প্রকাশ করেছি । ১৪।