প্রথম অধ্যায় । নবি মুহাম্মদ । নবির বাল্যকাল
মুহাম্মদের বাল্যকাল সম্পর্কে তথ্য অত্যন্ত অপ্রতুল। একজন পিতৃমাতৃহীন শিশু হিসাবে তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের গৃহে লালিতপালিত হন। আবু তালিব ছিলেন হৃদয়বান কিন্তু বিষয়সম্পত্তিহীন। জীবিকার তাগিদে মুহাম্মদ তাঁর চাচা এবং প্রতিবেশীদের উট চরানোর কাজ করতেন। তাই মুহাম্মদের দিন কাটতো রুক্ষ মরুভূমিতে একাকী।
মুহাম্মদ ছিলেন স্পর্শকাতর ও বুদ্ধিমান। মুহাম্মদের কয়েক বছরের মরুভূমির অভিজ্ঞতা পারস্যের ভাষায় এক তেতো গাছের ডাল চিবানোর সাথেই তুলনীয়। স্বাভাবিকভাবে তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন কেন এই পৃথিবীতে এসেছেন এক পিতৃহীন শিশু হিসেবে; আর তিনি যখন তাঁর মায়ের কাছে স্নেহ-ভালবাসা চেয়েছিলেন তখনই কেন তাঁর তরুণী মাতা মারা গেলেন। মুহাম্মদ আরও চিন্তা করলেন কেন নিষ্ঠুর ভাগ্য তাঁর প্রভাবশালী ও উদার পিতামহকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং তাঁকে দরিদ্র চাচার গৃহে ফেলে দিল। মুহামদের চাচা আবু তালিব ছিলেন উদার এবং উপকারী। কিন্তু আবু তালিবের ছিল বিশাল পরিবার। তাই মুহাম্মদ তাঁর চাচাতো ভাই-বোনদের মতো স্নেহ-মমতা পাননি। মুহামদের অন্যান্য চাচা যেমন আব্বাস ও আব্দুল ওজা (আবু লাহাব নামে পরবর্তীতে পরিচিত হন) আরাম-আয়েশে বসবাস করলেও তাঁরা মুহাম্মদকে লালন-পালনে উপেক্ষা করলেন। দীর্ঘ দুঃখকষ্টের দিনগুলিতে মুহাম্মদের মনে নিশ্চয় এইসব ঘটনা বাজতে থাকতো।
বৈচিত্র্যহীন, শুষ্ক মরুভূমিতে উটের দল তাদের গ্রীবা ঘষিয়ে চলে একগুচ্ছ তৃণলতা বা এক কঙ্কটপূর্ণ ডালপালার খোঁজে। এহেন পরিবেশে এলোমেলো চিন্তা করা ছাড়া আর কী-ই থাকতে পারে? দুর্ভাগ্য মানুষের মনকে তিক্ততায় ভরে দেয়। যখন কোনো উপায় থাকে না তখন সে দুঃখ-বেদনার প্রতি সচেতন হয়ে পড়ে। নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে বাল্যকালের এই পরিবেশ থেকে মুহাম্মদ চিন্তা করতে শুরু করলেন তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে এবং বুঝতে পারলেন যে, তাঁর জীবনের দুঃখ-কষ্টের প্রধান কারণ হচ্ছে তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থা। মুহাম্মদের সমবয়সী অন্যান্য বালকের পিতারা কাবা ঘরের পরিচর্যায় নিয়োজিত ছিল। তাদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। তাই ঐ বালকেরা সুখে দিনযাপন করতো। তাদের পিতারা কাবায় যে বাৎসরিক তীর্থযাত্রীরা আগমন করতো তাদেরকে পানি, রুটি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবারহ করতেন। সিরিয়া থেকে নিয়ে আসা পণ্যসামগ্রী তারা অতি উচ্চদামে বিক্রি করতো তীর্থযাত্রীদের কাছে। আর তীর্থযাত্রীদের আনা সামগ্রী তারা অতি নিম্নমূল্যে ক্রয় করতো। এইভাবে অর্জন করতো প্রচুর মুনাফা। এই বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ছিল তাদের ছেলে-মেয়েদের সুখের কারণ।
প্রশ্ন হতে পারে অনেকগুলো গোত্র কেন কাবায় আসতো এবং কুরাইশদের ক্ষমতা ও প্রভাবকে সহ্য করতো? এর উত্তর হচ্ছে কাবা ঘরে তখন ছিল অনেক দেবদেবীর প্রতিমা। আর ছিল একটি কৃষ্ণ পাথর যাকে আরবেরা পবিত্র বলে গণ্য করতেন। তারা মনে করতেন ঐ পাথরের চতুর্দিকে ঘুরে আসলে সুখ এবং মুক্তি পাওয়া যায়। সাফা ও মারওয়া পাহড়ের মাথায় ছিল আরও দুই মূর্তি। তাই তারা এই দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, এমন করলে তাদের প্রার্থনা ফলপ্রসু হবে। প্রত্যেক দলই তাদের মূর্তির কাছে এসে চিৎকার করে অনুনয়-বিনয় করতেন, কাবাকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে এবং সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দৌড়দৌড়ি করতেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী মুহাম্মদের বয়স যখন এগারো কি বারো তখনই তিনি চিন্তা করলেন, কৃষ্ণপাথরের কি সত্যিই কোনো গুপ্তশক্তি আছে? আরও চিন্তা করলেন, নিম্প্রাণ মূর্তিগুলো কি কোনো কাজ করতে পারে? তাঁর এই সন্দেহের উৎপত্তি হয় ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা থেকে। এটা হয়তো বলা যাবে না যে, দুঃখ ও আধ্যাতিক সংশয়ে মুহ্যমান মুহামদ কখনো কাবার মূর্তিগুলোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেননি; এবং তাঁর সাহায্য-প্রার্থনা যে, পরবর্তীতে নিস্ফল হয়েছিল তাও বলাবাহুল্য। এই ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায় কোরানের দুটি আয়াত থেকে। এই দুটি আয়াত মুহাম্মদের মুখে শোনা যায় ত্রিশ বছর পরে। প্রথম আয়াতটি হচ্ছে সুরা মুদ্দাসসির এর ৫ নম্বর আয়াত : ‘আর অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। (৭৪:৫)। দ্বিতীয় আয়াতটি উল্লেখ আছে সুরা দোহা’য় ; তিনি কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পাননি, আর তোমাকে আশ্রয় দেননি?”(৯৩:৬)।
কুরাইশ নেতাদের এ-ব্যাপারে অজানা থাকার কথা নয়। তারা কাবার উপাসনালয়ের কাছাকাছি থাকতেন এবং জানতেন পাথরের তৈরি মূর্তিগুলো না-পারে নড়াচড়া করতে, না-পারে কোনো অনুগ্রহ বা কৃপা প্রদর্শন করতে। এ-সম্পর্কে নীরবতা পালন ও লাত, মানাত এবং ওজা দেবীদের পূজো করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের অর্থনৈতিক লাভ। পারস্যের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে একজন ঋষির পুণ্যতা নির্ভর করে তার সমাধির তত্ত্বাবধায়কের উপর। কুরাইশরা ভালো করেই জানতেন যে, তারা যদি কাবার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব হারিয়ে ফেলেন তাহলে তাদের বিশাল আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। আর সিরিয়ার সাথে তাদের যে বর্ধিত বাণিজ্য চলছিল তাও কমে যাবে। কারণ কোনো বেদুইন তীর্থযাত্রীরা আর কাবায় আসবে না এবং কুরাইশরাও তাদের পণ্য উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন না এবং তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকেও পণ্যসামগ্রী অতি অল্পমূল্যে ক্রয় করতে পারবেন না।
সূর্যস্নাত রুক্ষ মরুভূমিতে একাকী দুঃসহ অবস্থায় মুহাম্মদ দেখেছেন কত কষ্ট করে উটগুলি তাদের সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে। এই অবস্থা জাগিয়ে তোলে মুহাম্মদের কল্পনাবিহারী মনকে। সূর্য ডোবার সাথে মুহাম্মদ যখন উটেরপাল হাঁকিয়ে শহরে নিয়ে আসতেন তখন আবার বাস্তবে ফিরে যেতেন। উটগুলিকে বারেবারে হাঁক দিয়ে তাদেরকে সঠিকভাবে চালিত করতে হতো যাতে তারা হারিয়ে না যায়। এভাবে উটগুলিকে নিশ্চিতভাবে তাদের মালিকদের খোঁয়াড়ে দিয়ে আসতেন রাতের বেলায়। রাতে মুহামদ চিন্তায় মগ্ন থাকতেন এবং তাঁর সামনে ভেসে উঠতো অনেক মানসচিত্র। প্রত্যুষে সূর্যের আলোকের পুনরাবৃত্তি ঘটলে আবার সেই বৈচিত্র্যহীন মরুভূমিতে চলে যেতেন। ধীরে ধীরে এসব বিভিন্নমুখী চিন্তাভাবনা তাঁর মানসকোঠরে দানা বাঁধতে শুরু করল।
একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি ভাবুক এবং স্বপ্নবিলাসী হয়ে থাকে। বাইরের কোনো শোরগোল বা স্বাভাবিক কোনো আনন্দ তাদের বিচলিত করে না, বরং সময়ের সাথে তারা আরও অন্তর্মুখী হয়ে যায়। তাই বলা যায় দীর্ঘদিন ধরে মরুভূমিতে একাকী সময় কাটানোর জন্য মুহাম্মদও একসময় অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন। ফলে আকস্মিকভাবে অনেক সময় তাঁর ভূত দেখার অথবা সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শোনার বিভ্রম হতো।
এভাবেই গতানুগতিক কয়েক বছর চলে গেল। মরুভূমির অভিজ্ঞতা মুহাম্মদের মনে গভীর রেখাপাত করে। এগারো বছর বয়সে মুহাম্মদ তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে বাণিজ্য-ভ্রমণে সিরিয়া গমণ করেন। সিরিয়াতে মুহামদ অন্য এক বিশ্বের সাথে পরিচিত হন। এই বিশ্ব ছিল উজ্জ্বল, অজ্ঞানতাবিহীন এবং কুসংস্কারমুক্ত। মক্কার আরবেরা ছিল অতিশয় রূঢ় এবং অমার্জিত। সিরিয়ার জীবনযাত্রা ভিন্ন।
সিরিয়ার যেখানেই মুহাম্মদ কারো দেখা পেলেন সেই-ই তাঁর সাথে ভদ্রতা রক্ষা করল। সিরিয়ার সমাজে বিরাজমান ছিল খুশির আমেজ এবং তাদের সামাজিক রীতিনীতি ছিল অনেক উঁচুমানের। সিরিয়া-ভ্রমণ মুহাম্মদের অন্তর আলোড়িত করে। এ-অভিজ্ঞতার দ্বারাই হয়তো তিনি উপলদ্ধি করলেন তাঁর নিজের লোকেরা আদিম, অমার্জিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তখন তাঁর মনে ভাবনা আসে তাঁর সমাজও উন্নতির পথে আসুক, সমাজে শৃঙ্খলা থাকুক, কুসংস্কারমুক্ত হোক। মক্কার সমাজ যেন আরও মানবিক হোক। তবে এটা পরিষ্কার নয় যে, এই ভ্রমণে মুহাম্মদ প্রথমবারের মতো কোনো একেশ্বরবাদীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন কি না। তখন মুহাম্মদের এ-বিষয়গুলি বুঝার জন্য খুব অল্পবয়স্ক ছিলেন। তাই এধরনের কোনো সংস্রব হলেও তাতে তাঁর চিন্তাধারায় রেখাপাত হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মুহাম্মদের সংবেদনশীল ও চঞ্চল মনে ছাপ ফেলেছিল। হয়তো এজন্যই মুহাম্মদ দ্বিতীয়বার ভ্রমণে আগ্রহী হন। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় ভ্রমণের সময় মুহামদ অল্পবয়স্ক ছিলেন না। তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে ধর্মের কথা শুনলেন।
মুহাম্মদের বাল্যকাল এবং তরুণ বয়স সম্পর্কে এত অপ্রতুল তথ্যের কী কারণ তা কেউ জানেন না। হয়তো বলা যেতে পারে, এক অনাথ বালক যে তার চাচার গৃহে লালিত-পালিত হয়েছে তার জীবন কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফলে বাল্যকালে এবং যৌবনে মুহাম্মদ কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। কেউ মুহাম্মদের স্মৃতিও মনে রাখেননি। এখানে যা লেখা হচ্ছে তার বেশির ভাগই অনুমানভিত্তিক। বলা হয় যে মরুভূমির একাকীত্ব এবং এক ঘেয়েমিপূর্ণ জীবন বালক-মুহামদকে কল্পনাবিলাসী, অন্তৰীক্ষণিক এবং দর্শনশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে।
কোরানের প্রারম্ভিক আয়াতগুলো পড়লে মনে করা যেতে পারে এই আয়াতগুলো আসছে এক যুবক মুহাম্মদের নিদারুণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট মন থেকে। এই আয়াতগুলিতে প্রকৃতি ও নৈসর্গিক বিষয়ে অনেক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। এখানে সুরা গাশিয়ার কয়েকটি আয়াত উদাহরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে ; তবে কি ওরা লক্ষ করে না, উট কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? কীভাবে আকাশ উর্ধ্বে রাখা হয়েছে? পৰ্বতমালাকে কীভাবে শক্ত করে দাঁড় করানো হয়েছে, আর পৃথিবীকে কীভাবে সমান করা হয়েছে? ( ৮৮:১৭-২০)।
কোরানের মক্কি সুরাতে দেখা যায় একজন ভাবুক মানুষের মানসচরিত্র। মনে হবে যেন এই ব্যক্তি নিজেকে সংসারের আকর্ষণ থেকে দূরে রেখে প্রকৃতির আশীৰ্বাদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন আর নিজেকে সমর্পণ করেছেন প্রকৃতির কাছে। এই সুরাগুলিতে দাম্ভিক এবং অহঙ্কার ব্যক্তিদের প্রতি রোষ দেখানো হয়েছে। সে-সময়ে এধরনের ব্যক্তিরা হলেন আবু লাহাব’ এবং আবুল আসাদ ১৩।
পরে মুহাম্মদ যখন ধর্ম প্রচারে সফল হলেন এবং সামাজিক সমান ও মর্যাদা বিশাল পরিমাণে বৃদ্ধি পেল, তখন তাঁর অনুগ্রাহীরা নিজস্ব কল্পনা-ভাবনা দিয়ে নবির জীবন নিয়ে অনেক কাহিনী তৈরি করেন। এই অতিমানবীয় কাহিনীগুলো লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে তাবারি এবং ওয়াকেদির লেখনীতেও একসময় স্থান পেয়ে যায়।
আরেকটি বিষয়ে এখানে স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা দরকার। মুসলিম লেখকেরা হয়তো ইচ্ছে করে নবির ধর্মপ্রচারণার পূর্বের সময়ের হেজাজ (মক্কা ও মদিনা শহরকে একত্রে হেজাজ নামে অভিহিত করা হয়), বিশেষ করে মক্কাকে এক অন্ধকার যুগের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু বাস্তব তেমন ছিল না। অনেক মুসলিম লেখকের তথ্য মতে তৎকালীন মক্কার আরবেরা বর্বরতা এবং পৌত্তলিকতার অন্ধকারে চরমভাবে নিমজ্জিত ছিল। তাদের মাঝে না ছিল কোনো উচ্চ চিন্তাভাবনা, না ছিল কোনো ধর্মের পরিচর্যা। ধারণা করা যায় এই ধরনের অতিরঞ্জিত বর্ণনা দেয়া হয় মূলত নবি মুহাম্মদের উত্থান ও তাঁর শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়ার জন্য। অবশ্য আধুনিক যুগের একাধিক আরব চিন্তাবিদ যেমন আলি জায়াদ, আবদুল্লাহ সামান, তাহা হোসেন’, মুহাম্মদ হোসেন হায়কল, মুহাম্মদ ইজ্জাত দারওয়াজা, অধ্যাপক হাঁদাদ প্রমুখ মতামত দেন যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর হেজাজে কিছুটা সভ্যতা বিরাজমান ছিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মবিশ্বাস ও আস্তিকতাও প্রচলিত ছিল সেখানে যা কোনোমতেই খাটো করে দেখা উচিৎ নয়। এছাড়া এই আধুনিক আরব চিন্তাবিদদের গবেষণা এবং আরও প্রাচীন সূত্র থেকে জানা যায় পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হেজাজে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
প্রথমদিকে হেজাজে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয় তার বিকাশ ঘটে কিছুটা ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রভাবে। ইহুদিরা ইয়াসরিবে (পরবর্তীতে মুসলমান জয়ের পর এই শহরের নাম হয় মদিনা) খুব প্রভাবশালী ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল। আর খ্রিস্টানরা সিরিয়া থেকে হেজাজে এসে বসতি স্থাপন করে। এছাড়াও হেজাজে ধর্মতান্ত্রিক তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক একটি দল ছিল যারা ‘হানিফ নামে পরিচিত। মক্কায় হানিফেরা পৌত্তলিকতা এবং বহুঈশ্বরবাদের প্রতি প্রার্থনার বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল। এ
ওজ্জাকে পূজা করার জন্য তায়েফের এক পাম-বাগানে সমবেত হন। ওজা ছিলেন বানু সাকিফদের প্রধান দেবী। এসময় চারজন ব্যক্তি পূজারী ও ভক্তদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করেন, মক্কার লোকেরা ভুল পথে আছে। তারা আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে। এরপর এই চারজন অন্যান্য পূজারীদের প্রতি চিৎকার করে বলেন, ‘একি হলো, তোমরা অন্য-ধর্ম পালন করছ! একটি পাথর, যা না পারে দেখতে, না পারে শুনতে, আর যা তোমাদের সাহায্যও করে না এবং অনিষ্টও করে না, তোমরা কেন তাকে বৃত্ত করে ঘুরে বেড়াও?’ এই চারজন ব্যক্তি হচ্ছেন ওয়ারাকা বিন নওফল,
ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাস, উসমান বিন আল-হুয়ারিস এবং জায়েদ বিন ওমর। এই ঘটনার পর থেকে এই চারজন নিজেদেরকে হানিফ মতাবলম্বী হিসেবে পরিচিতি প্রদান করেন এবং তাঁরা ইব্রাহিমের ধর্মের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাঁদের মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তি (জায়েদ বিন ওমর) নিজস্ব রীতিতে প্রার্থনার সময় উচ্চারণ করতেন : ‘এখানে আমি সত্যে আছি, সত্যে আছি উপাসনায় এবং বিনম্রতায়। ইব্রাহিম যেখানে আশ্রিত ছিলেন আমিও সেই আশ্রয়ে। আমি আপনার থেকে উদাসীন ছিলাম। আমার ভাগ্যে যা ঘটবে তা আমারই প্রাপ্য। এরপর জায়েদ নতজানু হতেন এবং মাটিতে তাঁর মাথা ঠেকিয়ে দিতেন।”
সন্দেহ নাই যে, আরবে তখন অজ্ঞানতা এবং কুসংস্কার বিরাজমান ছিল। সংখাগরিষ্ঠ আরবেরা মূর্তিপূজারী ছিলেন। তবু একেশ্বরবাদ তাদের কাছে কোনো অভিনব বিষয় ছিল না। হেজাজ, বিশেষত মদিনা এবং হেজাজের উত্তরাঞ্চলে যেখানে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা বসবাস করতেন, সেখানে একেশ্বরবাদ অনেক আগে থেকে প্রচলিত ছিল। মুহাম্মদের পূর্বেও অনেকে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। যাদের সম্পর্কে কোরানে কিছু কিছু উল্লেখ আছে। যেমন আদ সম্প্রদায়ের হুদ নবি, সামুদ সম্প্রদায়ের সালেহ নবি, মিদিয়ান (উত্তর-পশ্চিম আরব-উপসাগরীয় অঞ্চল) সম্প্রদায়ের শুয়েব নবি। আবার আরবইতিহাসে একাধিক ধর্মপ্রচারক ব্যক্তির কথা জানা যায়, যেমন হানজালা বিন সাফওয়ান, খালেদ বিন সিনান, আমির বিন জারিব আল-আদওয়ানি এবং আবদুল্লাহ বিন আল-কোদাই। এছাড়া সুন্দর বাচনভঙ্গির অধিকারী এবং সুবক্তা কাসা বিন সায়িদা আল-ইয়াদি নামের একজন কবির নাম জানা যায়। ইসলাম-পূর্ব যুগে মক্কার পূর্বে নাখালা উপত্যকার পাশে বাণিজ্য নগরী ‘ওকাজ’- এ বিশাল পরিসরে বার্ষিক মেলা হতো যাকে সারা আরবে ওকাজের মেলা বলতো। এই মেলার সবচেয়ে আকষণীয় দিক ছিল বার্ষিক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান। সারা আরব থেকে খ্যাতিমান কবিরা এসে এখানে নিজস্ব কবিতা আবৃত্তি করতেন। জিলকদ মাসের সাতদিনব্যাপী (ভিন্নমতে বিশদিন) ওকাজে মেলার আয়োজন করা হতো। এই সময় আরববাসীর মধ্যে হত্যা-মারামারিহানাহানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। ওকাজের মেলা সম্পর্কে প্রচলিত প্রবাদ ছিল এরকম : ওকাজ আজকে যা বলে, সারা আরবে আগামীকাল তার পুনরাবৃত্তি হয়। ওকাজের মেলা ছিল আরবের বিভিন্ন সম্প্রদায়-গোত্র ও বহু ধর্মের মানুষের সমন্বয়শীল মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলন মেলা। মুক্ত আলোচনা, বিতর্ক, জনপ্রিয় কবিদের কাসিদা ( গীতিকবিতা) প্রতিযোগিতা ছিল মেলা বা সাহিত্য সম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। স্বাভাবিকভাবে এই সাহিত্য সমেলনের ফলাফল সারা আরব জাহানে মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো। এখানে এসে কবিতা পাঠ করা কবিদের কাছে অত্যন্ত সমানের ও জীবনের আরাধ্য একটি বিষয় ছিল। কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে বিজয়ী কবিতাকে পুরস্কারস্বরূপ স্বর্ণীক্ষরে পর্দার কাপড়ে লিখে কাবা ঘরসহ দেব-দেবীর মন্দিরের দেয়ালে টানিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। তখন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইমরুল কায়েসসহ আমর ইবনে কুলসুম, তারাফা, অন্তরা, নাবিঘা, জুহাইর, আশা প্রমুখ শ্রেষ্ঠ কবিদের স্বর্ণীক্ষরে লিখিত মোয়াল্লাকাত বা ঝুলন্ত কবিতায় কাবা ঘরের দেয়াল অলংকৃত হতো।-অনুবাদক)।
ওকাজের কবিতা সম্মেলনে কবি কাসা বিন সায়িদা প্রকাশ্যেই কবিতা এবং ধর্মোপদেশ দ্বারা লোকজনকে মূর্তি পূজা পরিহার করার আহ্বান জানাতেন। তায়েফের সাকিফ গোত্রের ওমায়া বিন আবু-সালাত মুহাম্মদের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি সে-সময়ের বিখ্যাত হানিফ এবং একশ্বরবাদের প্রবক্তা ছিলেন। ওমায়া বিন আবু-সালাত প্রায়ই সিরিয়ায় যেতেন এবং সেখানকার খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ও ইহুদি পণ্ডিতদের সাথে সংলাপে বসতেন। একদা সিরিয়াতে অবস্থানকালে তিনি মুহাম্মদের উত্থানের সংবাদ শুনতে পান। অনেকে বলেন ওমায়া এবং মুহাম্মদের মধ্যে সাক্ষাত হয়েছিল। কিন্তু ওমায়া ইসলাম গ্রহণ করেননি, মুসলিম হননি। জানা যায় যে তায়েফ প্রত্যাবর্তনের পর ওমায়া তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন : অন্যান্য ধর্ম এবং প্রথার উপর আমার জ্ঞান মুহাম্মদের চাইতে অনেক বেশি। আমি আরমেনীয় এবং হিব্রুভাষাও জানি। কাজেই নবি হবার দাবি আমার অধিকতর।’ বুখারির মতে, পরবর্তীতে মুহামদ একথা শুনে বলেছিলেন ; ওমায়া বিন আবু-সালাত মুসলমান হবার কাছাকাছি এসেছিলেন।
তৎকালীন তরুণ কবিদের লেখা কবিতায় এক জাতির সচেতনতা এবং সামাজিক রীতিনীতি প্রাণবন্তভাবে প্রকাশিত হয়। প্রাকইসলামি যুগের কিছু আরবি কবিতা আছে। তখনকার একটি কবিতা খুব সম্ভবত কবি জোহাইর’ এর লেখা হতে পারে। এই কবিতা এখানে দেয়া হলো :
তোমার আতুীয় যা আছে তা আল্লাহর কাছে গোপন করবে না,
কেন-না তুমি যেমনভাবেই তা ঢাকার চেষ্ট্র কর না কেন আল্লাহ তা জেনে যাবেন/
হয়তো বা স্থগিত থাকবে, অথবা এক বইতে লিখিত হবে এবং জমা হবে
হিসাবের দিন, অথবা শীঘ্রই তা পরিশোধ করা হবে।’
অথবা আবদুল্লাহ বিন আল-আবরাসের লেখা এই কবিতা :
জনতা চায় তারই উপাসনা করতে
কারণ ঈশ্বর-সন্ধানীরা হতাশ হবে না।
ঈশ্বরের মাধ্যমে সকল আশীৰ্বাদ নাগাল পাওয়া যায়,
যে কিছুর উল্লেখ করলেই বিজয় প্ররোচতে হয়ে যায়।
ঈশ্বরের কোনো অংশীদার নাই
এবং হৃদয়ে যা গোপন আছে তা তিনি অবগত।
শোনা যায় একদা নবি মুহামদ কবি লাবিদের এই কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন :
আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই প্রথা
সমস্ত সাফল্য একদিন অবসান পাবে/
লক্ষণীয় যে লাবিদসহ প্রাক-ইসলামি যুগের কবিরা স্রষ্টা বা ঈশ্বরকে ‘আল্লাহ বলেই সম্বোধন করতেন। মুহাম্মদের পিতাসহ অনেক পৌত্তলিক কুরাইশদের নাম রাখা হতো আবদুল্লাহ-যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর দাস। মুহাম্মদের অনেক পূর্বকাল থেকে মক্কাবাসীদের কাছে আল্লাহ নামটি পরিচিত ছিল, তারা মনে করতেন তাদের দেবদেবী হচ্ছেন আল্লাহর সান্নিধ্য পাবার মাধ্যম। তাদের এই ধারণা কোরানের সুরা ইউনুসে বর্ণিত হয়েছে : ‘ওরা আল্লাহ ছাড়া যার উপাসনা করে তা তাদের ক্ষতি করে না, উপকারও করে না। ওরা বলে, এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলো, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশ ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না? তিনি পবিত্র, মহান। আর তারা যাকে শরিক করে তিনি তার উর্ধ্বে।’ ( ১০:১৮)। আমর বিন ফজল নামের আরেকজন প্রাক-ইসলামি যুগের আরব কবি মূর্তিপূজাকে সরাসরি প্রত্যাখান করেছেন। তিনি লিখেছেন:
আমি তো লাত এবং ওজ্জাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছি,
যে কোনো বলিষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এই রকমই করবে।
আমি কোনোমতেই ওজা এবং তার দুই কন্যাকে দেখতে যাব না
অথবা বানু ঘনমের দুটি মৃতিকে।
আর আমি তো হুবালকেও বার বার দর্শন দিব না,
ভাগ প্রতিকুল হতে পারে, আমার ধৈর্য সামান্য।
কাজেই মক্কাবাসীর কাছে পৌত্তলিকতা ছেড়ে এক ঈশ্বরের উপাসনা করার আহ্বান নতুন কিছু ছিল না। যেটা অভিনব সেটা হলো এই উপাসনাকে আশু করার জন্য পীড়াপীড়ি করা। মুহাম্মদের অসামান্য কাজ ছিল, তিনি দৃঢ়ভাবেই সমস্ত অপমান, হয়রানি এবং প্রতিরোধের মোকাবেলা করে গেছেন। আরব-উপদ্বীপে ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত মুহাম্মদ ক্ষান্ত হননি; এবং আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একই পতাকাতলে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আরবের বিভিন্ন গোত্রের জীবনযাপন ছিল খুব সেকেলে। তারা ছিলেন অনেকাংশে বস্তুবাদী এবং একমাত্র বাস্তব ও দৃশ্যমান বস্তু নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আধ্যাতিক ব্যাপারে তারা ছিলেন উদাসীন। তাৎক্ষণিক মুনাফার প্রতি তাদের ছিল তীব্র আকর্ষণ। অন্যের বিষয়-সম্পত্তি জব্দ করতে তারা কুষ্ঠাবোধ করতেন না। ক্ষমতা লাভের জন্য তারা যা খুশি তাই করতেন। তাদের এই মানসিকতার পরিচয় পূর্বেই আকনাস বিন শারিকের কাছে আৰু জেহেলের উক্তিতে ফুটে উঠেছে। আবু জেহেলের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ নবুওতির ভান করছিলেন আবদে মনাফ বংশের প্রাধান্যতা প্রতিষ্ঠা করতে। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার (৬০ হিজরি বা ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ-৬৪ হিজরি বা ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ) মন্তব্যে একই ধারণার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। মুহাম্মদ যেভাবে তাঁর বিরোধীপক্ষকে বদর যুদ্ধে (২ হিজরি বা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) পরাজিত করেছিলেন ঠিক একইভাবে উমাইয়া বংশের সৈন্যরা বানু হাশেমি গোত্রকে পরাজিত করে এবং কারবালার যুদ্ধে (৬১ হিজরি বা ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) হোসেন বিন আলিকে হত্যা করেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এই ঘটনার পর ইয়াজিদ এক পঙক্তি কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন :
‘হাশেমিরা ক্ষমতার জুয়া খেলে, কিন্তু কোনো শব্দ আসলো না, কোনো দৈববাণীও নামলো না।’
পরিচ্ছেদটি শেষ করার পূর্বে এখানে না বললেই নয় যে, আধুনিক যুগের কোনো কোনো আরব পণ্ডিত প্রাক-ইসলামি যুগের কবিতা সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। যাহোক, প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরবে পৌত্তলিকতার উপর মোহমুক্ত হয়ে একাধিক ব্যক্তির হাত ধরে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে ওঠে।