আগে যা বলিতেছিলাম ।
– এ শিল্পী মহাকালের তাণ্ডব- নৃত্য আঁকিতে পারে না । পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ- শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না । এ শিল্পী মেঘনা-পদ্মা-ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করে ।
এ শিল্পী যে ছবি আঁকে তা বড় মনোরম । তীর ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট গ্রাম । গ্রামের পর জমি । অগ্রহায়ণে পাকা ধানের মরসুম । আর মাঘে সর্ষেফুলের হাসি । তারপর আবার গ্রাম । লতাপাতা গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা সবুজ গ্রাম । ঘাটের পর ঘাট । সে ঘাটে সব জীবন্ত ছবি । মা তার নাদুস-নুদুস শিশু ছেলেমেয়েকে চুবাইয়া তোলে । অল্প একটু দূর দিয়া নৌকা যায় একের পর এক …।।
তিতাস একটি নদীর নাম । এ নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ তার তীরের লোকেরা জানে না । জানিবার চেষ্টা কোনদিন করে নাই, প্রয়োজন বোধও করে নাই । নদীর কত ভাল নাম থাকে – মধুমতী। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সরস্বতী, যমুনা । আর এর নাম তিতাস । সে কথার মানে কোনোদিন অভিধানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না । কিন্তু নদী এ-নামে যত প্রিয়, ভালো একটা নাম থাকিলে তত প্রিয় হইতই যে, তার প্রমাণ কোথায় !
ভালো নাম আসলে কি ? কয়েকটা আখরের সমষ্টি বৈত নয় । কাজললতা মেয়েটিকে বৈদূর্যমালিনী নাম দিলে, আর যাই হোক, এর খেলার সাথীরা খুশি হইবে না । তিতাসের সঙ্গে নিত্য যাদের দেখাশুনা, কোনো রাজার বিধান যদি এর নাম চম্পকবতী কি অলকনন্দা রাখিয়া দিয়া যায়, তারা ঘরোয়া আলাপে তাকে সেই নামে ডাকিবে না, ডাকিবে তিতাস নামে ।
নামটি তাদের কাছে বড় মিঠা । তাকে তারা প্রাণ দিয়া ভালবাসে, তাই এর নামের মালা তাদের গলায় ঝুলানো ।
শুরুতে কে এই নাম রাখিয়াছিল, তারা তা জানে না । তার নাম কেউ কোনোদিন রাখিয়াছে, এও তারা ভাবে না । ভাবিতে বা জানিতেও চায় না । এ কোনোদিন ছিল না, এও তারা কল্পনা করিতে পারে না । কবে কোন্ , দূরতম অতীতে এর পারে তাদের বাপ পিতামহেরা ঘর বাঁধিয়াছিল একথা ভাবা যায় না । এ যেন চির সত্য, চির অস্তিত্ব নিয়া এখানে বহিয়া চলিয়াছে । এ সঙ্গী তাদের চিরকালের । এ না হইলে তাদের চলে না । এ যদি না হইত, তাদের চলিতও না । এ না থাকিলে তাদের চলিতে পারে না । জীবনের প্রতি কাজে এ আসিয়া উঁকি মারে । নিত্যদিনের ঝামেলার সহিত এর চিরমিশ্রণ ।
নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে । নদী বহিয়া চলে । কালও বহিয়া চলে । কালের বহার শেষ নাই । নদীরও বহার শেষ নাই । কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বহিয়াছে ! তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে । কত মানুষ মরিয়াছে । কত মানুষ বিশ্রী-ভাবে মরিয়াছে – কত মানুষ না খাইয়া মরিয়াছে – কত মানুষ ইচ্ছা করিয়া মরিয়াছে – আর কত মানুষ মানুষের দুষ্কার্যের দরুণ মরিতে বাধ্য হইয়াছে । আবার শত মরণকে উপেক্ষা করিয়া কত মানুষ জন্মিয়াছে । তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে । তার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের কত কান্নার রোল উঠিয়াছে । কত অশ্রু আসিয়া তার জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে । কত বুকের কত আগুন, কত চাপা বাতাস তার জলে নিবিয়াছে । কতকাল ধরিয়া এ-সব সে নীরবে দেখিয়াছে, দেখিয়াছে আর বহিয়াছে । আবার সে দেখিয়াছে কত শিশুর জন্ম, দেখিয়াছে আর ভাবিয়াছে । ভাবী নিগ্রহের নিগড়ে আবদ্ধ এই অজ্ঞ শিশুগুলি জানে না, হাসির নামে কত বিষাদ, সুখের নামে কত ব্যথা, মধুর নামে কত বিশ তাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে ।
ওরা কারা ? ওরা মালোদের ছেলেরা । আর মালোদের মেয়েরা । ওরা তারা নয় যাদের দেয়াল-ঘেরা বাড়ি, সামনে আছে পুষ্করিণী , পাশে আছে কুয়া, যাদের আঙ্গিনার পাড় থেকেই শুরু হইয়াছে পথ – সে পথ গিয়াছে শহরের দিকে, পাশের গাঁগুলিতে এক একটা শাখাপথ ঢুকাইয়া দিয়া । সে পথে ঘোড়ার গাড়ি চলে ।
আর মালোদের ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ সে-সবই গিয়া মিশিয়াছে তিতাসের জলে । সে-সব পথ ছোট ছোট । পথের এধার থেকে বুকের শিশু কাঁদিয়া উঠিলে ওধার থেকে মা টের পায় । এধারের তরুণীর বুকের ধুক্ ধুকানি ওপারের নৌকার মাচানে বসিয়া মালোদের তরুণরা শুনিতে পায় । এপথ অতি খর্ব । দীর্ঘপথ গিয়াছে মাঝ-তিতাসের বুক চিরিয়া । সেপথে চলে কেবল নৌকা ।
তিতাস সাধারণ একটা নদী মাত্র । কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না । কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই । কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই ?
পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়েদের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে । সেই ইতিহাস হয়ত কেউ জানে, হয়ত কেউ জানে না । তবু সে ইতিহাস সত্য । এর পারে পারে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র আঁকা হইয়াছে । হয়ত সেগুলি মুছিয়া গিয়াছে । হয়ত তিতাসই সেগুলি মুছিয়া নিয়াছে ! কিন্তু মুছিয়া নিয়া সবই নিজের বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে । হয়ত কোনোদিন কাহাকেও সেগুলি দেখাইবে না, জানাইবে না কারো সেগুলি জানিবার প্রয়োজনও হইবে না । তবু সেগুলি আছে । যে-আখর কলার পাতায় বা কাগজের পিঠে লিখিয়া অভ্যাস করা যায় না, সে-আখরে সে-সব কথা লেখা হইয়া আছে । সেগুলি অঙ্গদের মতো অমর । কিন্তু সত্যের মতো গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পর্শপ্রবণ । কে বলে তিতাসের তীরে ইতিহাস নাই !
আর সত্য তিতাস-তীরের লোকেরা ! তারা শীতের রাতে কতক কতক কাঁথার তলাতে ঘুমায় । কতক জলের উপর কাঠের নৌকায় ভাসে ।। মায়েরা, বোনেরা আর ভাই-বৌয়েরা তাদের কাঁথার তলা থেকে জাগাইয়া দেয় । তারা এক ছুটে আসে তিতাসের তীরে । দেখে, ফরসা হইয়াছে; তবে রোদ আসিতে আরও দেরি আছে । নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ জলের উপর মাঘের মৃদু বাতাস ঢেউ তুলিতে পারে না । জলের উপরিভাগে বাষ্প ভাসে – দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া । তারা সে ধোঁয়ার নিচে হাত ডোবায়, পা ডোবায় । অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয় । কাঁথার নিচের মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকু না পাইলে তারা যে কি করিত ।
শরতে আকাশের মেঘগুলিতে জল থাকে না । কিন্তু তিতাসের বুকে থাকে ভরা-জল । তার তীরের ডুবো মাঠময়দানে সাপলা সালুকের ফুল নিয়া, লম্বা লতানে ঘাস নিয়া, আর বাড়ন্ত বর্ষাল ধান নিয়া থাকে অনেক জল । ধানগাছ আর সাপলা সালুকের লতাগুলির অনেক রহস্য নিবিড় করিয়া রাখিয়া এ জল আরও কিছুকাল স্তব্ধ হইয়া থাকে । তারপর শরৎ শেষ হইয়া আসে । কে বুঝি বৃহৎ চুমুকে জল শুষিতে থাকে । বাড়তি জল শুকাইয়া গিয়া তিতাস নিচে থাকিয়া মাখনের মত নরম হইয়া গিয়াছিল, সে মাটি আবার কঠিন হয় । আসে হেমন্ত ।
হেমন্তের মুমূর্ষু অবস্থায় কখন ধানকাটার মরসুম শুরু হইয়া গিয়াছিল । পারে সব খানেই গ্রাম নাই । এক গ্রাম ছাড়াইয়া আরেক গ্রামে যাইতে মাঝে পড়ে অনেক ধানজমি । জমির চাষীরা ধানকাতা শেষ করিয়া ভারে ভারে ধান এদিক ওদিকের গ্রামগুলিতে বহিয়া নিয়া চলে । তারা তিতাসের ঠিক পাড়ে থাকে না । থাকে একটু দূরে । একটু ভিতরের দিকে । সেখান হইতে মাঘের গোড়ায় আবার তারা তীরে তীরে সর্ষে বেগুনের চারা লাগায় । তীরের যেখানে যেখানে বালিমাটির চর, সেখানে তারা আলুর চাষ করে । এ মাটিতে সকরকন্দ আলু ফলায় অজস্র ।
জোবেদ আলীর জোয়ান ছেলেরা ওপারে আলু লাগাইয়া তিন ভাইয়ে এক-সমানে আলী আলী আলী বলিয়া তাদের লম্বা ডিঙ্গিখানা ভাসাইয়া তাতে উঠিয়া পড়িল । বেলা পড়িয়া আসিয়াছে । হালের চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড় পার করাইতে হইবে । সে কাজ করিবে তাদের মুনীস-দুইজন । সাঁরা বছর তারা জোবেদ আলীর বাড়িতে জন খাটে । খায় দায়, মাহিনা পায় । সারাদিন – ভোর হইতে রাত-অবধি খাটে, রাতের খানিকটা সময় নিয়া নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সান্নিধ্য লাভ করিয়া আসে । দিনমানে আর দেখা হয় না । পরিবারেরাও এর বাড়ি ওর বাড়ি ধান ভানিয়া পাট গুটাইয়া কিছু-কিঞ্চিৎ উপায় করে । এইভাবে দিন গুজরায় তারা । কাজেই জোবেদ আলীর ছেলেরা যখন আলী আলী আলী বলিয়া নৌকায় নদী পার হইতে থাকে, মুনীস-দুইজন তখন চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড়ের অনিচ্ছুক দেহমন শীতের জলে নামাইয়া মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া গরুদের ল্যাজে ধরিয়া আল্লা আল্লা মোমিন বলিয়া সাঁতার দেয় । সকালে এপার হইতে ওপার যাইবার বেলা লাঙ্গল কাঁধে করিয়া সর্ষে ক্ষেত-গুলির আলের উপর দিয়া গিয়াছে । তীর-অবধি সর্ষেফুলের হলদে জৌলুষে হাসিয়া উঠিয়াছিল । মনে হইয়াছিল কে বুঝি তিতাসের কাঁধে নক্সা-করা উড়ানি পরাইয়া রাখিয়াছে । অর্বাচীন গরুগুলি পাছে তাতে মুখ দেয়, তার জন্য কত না ছিল সতর্কতা । এখন এ-পারে উঠিয়া গায়ের জল মুছিতে মুছিতে চারিদিক আঁধার হইয়া আসে । আঁধারে সব একাকার, গরু কোথায় মুখ দিবে ! দিনের শ্রমে শ্রান্ত গরু । আর শ্রান্ত আ দুইজন মানুষ সারাদিন অসুরের বল নিয়া ক্ষেতে খাটিয়াছে । এবার বাড়িতে যাইবে । তাই এত ব্যস্ততা । কিন্তু কার বাড়িতে যাইবে ! তাদের প্রভু জোবেদ আলীর বাড়িতে । নিজের বাড়িতে নয় । পাখিরাও এ সময় নিজের বাসায় যায় । তারা যাইবে মুনিবের বাড়িতে । গিয়া গোয়ালে গরু বাঁধিবে । ঘাস কাটিবে । মাড় দিবে, খইল ভুষি দিবে । জোতদার চাষীর বাড়িতে কত কাজ । এটা সেটা টুকিটাকি কাজ করিতে করিতে হাজারগণ্ডা কাজ হইয়া যায় । প্রকাণ্ড চওড়া উঠান । চার ভিটায় বড় বড় চারিটা ঘর । বাহিরের দিকে গোয়ালসুদ্ধ আরো তিন-চারিটা ঘর । দড়ি পাকানো হইতে বেড়াবাঁধা পর্যন্ত এই এতবড় বাড়িতে কত কাজ যে এই দুইজনের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকে । কাজ করিতে করিতে রাত বাড়িয়া চলে । এক দময় ডাক আসে – ‘অ করমালী অ বন্দালী খাইয়া যাও !’
খাওয়ার পর কাঁধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দেআলী বলে, ‘ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম্ ঝাগুর মাছের ঝোল । আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাক-ভাত আজ জুটল নি, কি জানি ?’
করমালী বলে, ‘বন্দালী ভাই, কইছ কথা মিছা না । তোমার আমার ঘরের মানুষ! তোমার আমার ঘরই নাই, তার আবার মানুষ। দয়া কইরা রাইতে থাকতে দেয়-থাকি; ফজরে উইঠ্যা মুনিবের বাড়ি গিয়া ঘুমের আলস ভাঙ্গি । ঘরের সাথে এইত সমন্দ। – কি খায়, কি পিন্ধে কোনোদিন নি খোঁজ রাখতে পারছি? তা যখন পারছি না তখন তোমার আমার কিসের ঘর আর কিসের মানুষ।’
বন্দেআলী খানিক ভাবিয়া নিয়া বলে, ‘বেবাকই বুঝি করমালী ভাই। তবু মুনিবের ঘরে পঞ্চ সামিগ্রী দিয়া খাইবার সময় ঘরের কথা মনে হয়; গলায় ভাত আইটকা যায় আর খাইতে পারি না।’
শুনিয়া করমালী বলে, ‘আমার কিন্তু তাও মনে পড়ে না। হ, আগে মাঝে মাঝে পড়ত। এখন দেখি, পড়ে না যে, ইটাই ভাল।’
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বন্দেআলী বলে, ‘সারাদিনের মেহ্ নতে নাস্তানাবুদ হইয়া ঘরে যাই, গিয়া দেখি ছিঁড়া চাটাইয়ে শুইয়া আছে। ঝুপ কইরা তার পাশে শুইয়া পড়ি; জাগাই না। – একদিন তার একখানা হাত আইয়া আমার বুকের উপর পইড়া যায়। হাতখানা হাতে লইয়া দেখি, কি শক্ত! কড়া পড়ছে পরের বাড়ির ধান ভানতে ভানতে।’
করমালীর বউ ধান ভানে না। লোকের বাড়ি-বাড়ি কাঁথা সেলাই করিয়া দেয়। কাঁথা সেলাইয়ের ধুম পড়িয়াছে। তার মোটে অবসর নাই। ডান হাতের সূঁচের ফোঁড় বাঁ হাতের আঙ্গুলের ডগায় তুলিতে তুলিতে আঙ্গুলে হাজার কাটাকাটি দাগ পড়িয়াছে। করমালী প্রায়ই ঘরে গিয়া দেখে বিছানা খালি।
একটু বিমর্ষ হাসি হাসিয়া করমালী বলিল, ‘বন্দালী ভাই, তুমি ত গিয়া দেখ, বউ ঘুমাইয়া রইছে। আমি ছিঁড়া খাঁথায় গাও এলাইয়া দিয়া পথের পানে চাইয়া থাকি। সে তখন পরের বাড়ির খাঁথা সিলাই করে, আর সে সুঁইচের ফোঁড় আমার বুকে আইয়া বিন্ধে। তার আইতে আইতে রাইত গহীন হয় – আগ-আন্ধাইরা রাইত – দেখি আন্ধাইর গিয়া চাঁদ উঠছে- ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে দিয়া রোশনি ঢুকে, কেডায় যেমুন ফক ফক কইরা হাসে!’
কথা শেষ হইলেও করমালীর মুখের ম্লান হাসিটুকু মিলাইয়া যায় না । বন্ধেআলীর বুক ছাপাইয়া আর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বাহির হয়। কোনোরকমে সেটা চাপা দিতে দিতে বলে, ‘করমালী ভাই, আছ ভাল। কামে-কাজে থাক, খাও দাও। তার কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে খালি শুইবার সময়। আমার হইছে বিষম জ্বালা! উঠতে বইতে খালি মনে হয় তারে আমি দুখ দিতাছি। একটু সুখ না, শান্তি না- আমরা কি অভাইগ্যা ভাই করমালী?’
করমালী প্রায় দার্শনিক নির্লিপ্ততার সঙ্গে বলিল, ‘আমার ভাই অত কথায় কথায় শ্বাস পড়ে না! তুমি আমি বড় মুনিবের কাম করি, ভাল খাই! বউরা ছোট মুনিবের কাম করে, ভাল খাইতে পারে না। – আমরার জমি নাই, জিরাত নাই, পরের জমি চইয়া জান কাবার করি। যদি জমি থাকত তা’ অইলে বৌরা নিজেরার ঘরে খাটত, তোমারে আমারে মুনিবের মতো দেখত।’
বন্দেআলীর মন এই ধরণের চিন্তায় সায় দেয় না! সে ভাবে, করমালীর প্রেমিক মন বড় নিষ্ঠাহীন। তার মোটে স্ত্রীর প্রতি প্রেম ভালবাসা এসবের বুঝি কোনো দাম নাই। হাঁ দাম নাই-ই তো। তার মতো ভূমিহীন চাষীর কাছে এসবের কোনো দাম নাই। জীবনে যদি বসন্ত আসে তবেই এসবের দাম চোখে ধরা পড়ে। তাদের জীবনে বসন্ত আসে কই!
আসে বসন্ত। টি সময় মাঠের উপর রঙ্ থাকে না। তিতাসের তীর ছুঁইয়া যাদের বাড়িঘর তারা জেলে। তিতাসে মাছ ধরিয়া তারা বেচে, খায়। তাদের বাড়িপিছু একটা করিয়া নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। বসন্ত তাদের মনে রঙের মাতন জাগায়।
বসন্ত এমনি ঋতু- এই সময় বুঝি সকলের মনেই প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। জেলেরা নিজে রঙ্ মাখিয়া সাজে – তাতেই তৃপ্তি পায় না। যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে, তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। যাদের প্রিয় বলিয়া মনে করে তারাও তাদের এমনি করিয়া রঙ্ মাখাইয়া সাজাক তাই তারা চায়। তখন আকাশে রঙ, ফুলে ফুলে রঙ্, পাতায় পাতায় রঙ্ । রঙ্ মানুষের মনে মনে। তারা তাদের নৌকাগুলিকেও সাজায়। বৌ-ঝিরা ছোট থালিতে আবির নেয়, আর নেয় ধানদূর্বা। জলে পায়ের পাতা ডুবাইয়া থালিখানা আগাইয়া দেয়। নৌকাতে যে পুরুষ থাকে সে থালির আবির নৌকার মাঝের গুরায় আর গলুইয়ে নিষ্ঠার সহিত মাখিয়া দেয়। ধানদূর্বাগুলি দুই অঙ্গুলি তুলিয়া ভক্তিভরে আবির-মাখানো জায়গাটুকুর উপর রাখে। এই সময়ে বৌ জোকার দেয়। সে-আবিরের রাগে তিতাসের বুকেও রঙের খেলা জাগে। তখন সন্ধ্যা হইবার বেশি বাকি নাই। তখনো আকাশ বড় রঙিন। – তিতাসের বুকের আরসিতে যে-আকাশ নিজের মুখ দেখে, সেই আকাশ।
চৈত্রের খরার বুকে বৈশাখের বাউল বাতাস বহে। সেই বাতাসে বৃষ্টি ডাকিয়া আনে। আকাশে কালো মেঘ গর্জায়। লাঙ্গল চাষা মাঠ-ময়দানে যে ঢল হয়, ক্ষেত উপচাইয়া তার জল ধারা-স্রোতে বহিয়া তিতাসের উপর আসিয়া পড়ে। মাঠের মাটি মিশিয়া সে-জলের রঙ্ হয় গেরুয়া। সেই জল তিতাসের জলকে দুইএক দিনের মধ্যেই গৈরিক করিয়া দেয়। সেই কাদামাখা ঠাণ্ডা জল দেখিয়া মালোদের কত আনন্দ। মালোদের ছোট ছোট ছেলেদেরও কত আনন্দ। মাছগুলি অন্ধ হইয়া জালে সহজে আসিয়া ধরা দেয়। ছেলেরা মায়ের শাসন না মানিয়া কাদাজলে দাপাদাপি করে। এই শাসন-না-মানা দাপাদাপিতে কত সুখ! খরার পর শীতলের মাঝে গা ডুবাইতে কত আরাম।