প্রত্যানীত – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ
তামা নদীটা যেখানে গঙ্গাধর নদীর বুকে এসে পড়েছে, আর ফাল্গুনেরশুখা তাকে দয়িতের সঙ্গে মিলতে না দিয়ে একটি দহ মতন সৃষ্টি করে তাকে বিরহযাতনাতে ক্লিষ্ট করেছে, ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়েছিল দীপ। তামা নদীর বিরহর জ্বালাই যেন রাশ রাশ মাদার ফুল হয়ে নদীপারের পাতা-ঝরা হরজাই বনে ফুটে রয়েছে। এখন থাকবে কিছুদিন। মাঝে মাঝে বাঁশবন। গোরু চরছে একরামুদ্দিন মিয়ার। গোয়ালে ফেরার সময় হল তাদের।
একটা একলা গো-বক তার খয়েরি-রঙা ডানা মেলে কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করতে না পেরে ক-গক-গক শব্দ করে মোনো-সিলেবল-এ তার বুকের কষ্টটা তামা নদীর বুকের কষ্টের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে।
ধু ধু চর ফেলা এবং একটি মস্ত বাঁক নেওয়া গঙ্গাধর নদীর পারের মস্ত বটগাছের তলায় বসে রাখাল-বাগাল গোয়ালপাড়িয়া গান গাইছে। গান গাইছে তার প্রেমিকার কথা মনে করে, গলা ছেড়ে।
কে জানে!
দীপের মতন তার কোনো প্রেমিকা আদ আছে কি না! এই সন্ধেই হয়তো তার প্রেমিকা। প্রতি দিন-রাতের অনেকই মুহূর্ত থাকে যখন প্রত্যেক একলা নারী এবং পুরুষের মনই বিবাগি হয়ে যায়। এই বৈরাগ্য কিন্তু দূরে যাওয়ার জন্যে নয়, কারও কাছে আসারই জন্যে। বুকের কাছে, খুবই কাছে।
সে গান গাইছে তো গাইছেই। বড়োই লম্বা গান। তবে ছাওয়ালের গলাখানা ফাসকেলাস। কিন্তু এ গান শুনে মন যেন গঙ্গাধরের চরেরই মতন বিবাগি হয়ে ওঠে। রাখাল গাইলে, সে জায়গা ছেড়ে পা আর নড়ে না কারোরই।
প্রেম জানে না রসিক কালাচান্দ
কালা ঝুরিয়া থাকে মন
আর কতদিনে হব বন্ধু দরিশন, বন্ধুরে।
অ বন্ধুরে তোমার বাড়ি আমার বাড়ি
যাওয়া আইসা অনেক দেরি
যাব কি রব কি সগায় করে মানা
হাটিয়া গেইতে নদীর পানি খাপলাং কী খুপলুং
কী খালাউ খালাউ করে রে হায়
হায় পরানের বন্ধুরে।
অ বন্ধুরে তোমার আশায় বসিয়া আছং
বটবৃক্ষের তলে
ভাদর মাসীয়া দেওরার ঝরি
টিপ্পিস কি টাপ্লাস
কী ঝম ঝমেয়া পড়ে রে।
হায় হায় পরানের বন্ধুরে।
অ বন্ধুরে একলা ঘরে শুইয়া থাকং
পালঙ্গের উপরে
মন মোর উরাং বহিরার করে
কট ঘুরিতে মরার পালং
কেরবেত কী কুবরুত
কি কাবাও কাবাও করে রে
হায় হায় পরানের বন্ধুরে।
গান শেষ হলে দীপও পা বাড়াল বাড়ির দিকে। সে যে কেন এমন উদ্দেশ্যহীনভাবে নদীপারে এসেছিল এই ফাল্গুনের রুখু-লাগা বিকেলে, তা ও নিজেও জানে না। সেও যদি রাখালের মতন গান গেয়ে নিজের কথা আকাশকে, বাতাসকে, নদীকে বলে মনের ভার একটু হালকা করতে পারত!
সন্ধে হয়ে আসছে। গঙ্গাধর নদীর উপরের আকাশে গেরুয়া রং লেগেছে। বৈষ্ণব-গেরুয়া। একঝাঁক পরীযায়ী হাঁস ডিঙ্গডিঙ্গার মরনাই চা-বাগানের দিক থেকে উড়ে আসছে দুলতে দুলতে মালার মতন। হয়তো তারা গুমা রেঞ্জের গভীরের কোনো জলাভূমি থেকে আসছে। ঠিক জানে না দীপ। তারা চর-ফেলা আঁকাবাঁকা নদীর বিধুর আঁচলের বুক তাদের ডানার সপাসপ শব্দে চমকে দিয়ে শিমুল বনের দিকে উড়ে গেল।
মাদারের বনে ফুল এসেছে। তিব্বতি লামাদের বসনের রঙের মতন লাল ফুল ভরে গেছে গাছে গাছে। এই মাদারের ফুলেরাও এক ধরনের আকাশমণি বা সূর্যমুখী। এরা এদের মুখ আদৌ আনত করে না পৃথিবীর দিকে। ঋজু, আকাশমুখো হয়ে, আদ্যিকালের প্রতিষ্ঠান মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে হেলায় যেন অপ্রমাণ করে এরা।
ভালো লাগে দীপের।
নদীপারের হরজাই বনে একটা হাওয়া ওঠে। তার পায়ে পায়ে, নূপুরের মতনই, কিন্তু তাতে ঝুনুঝুনু নয়, ঝুরুঝুরু শব্দ ওঠে একটা। নারীর চুলের মতন বিস্রস্ত হয়ে যায় ঘন বুনোটের বন।
পরমুহূর্তেই হাওয়াটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা স্বগতোক্তি করেই কোনো ভিখিরি বুড়ির মতনই মরে যায়। গাছেরা টানটান হয়ে দাঁড়ায়, যেন অ্যাটেনশানেই; কোনো অদৃশ্য সেনানায়কের নির্দেশের অপেক্ষায়।
একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। আজ ইদ। শুক্লপক্ষ। একুশে ফেব্রুয়ারি। এখনই না উঠলে অন্ধকারে বাড়ি পৌঁছোতে অসুবিধে হবে। ভাবল দীপ।
এমনিতে কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু গরম পড়েছে। সাপখোপ-এর ভয় আছে। যদিও দীপ মিত্রর জীবনের দাম বিশেষ নেই, অন্যর কাছে বা তার নিজের কাছেও, তবুও হয়তো নিছক অভ্যেসবশেই মাঝে মাঝে বড় বাঁচতে ইচ্ছে করে। এই বাঁচার ইচ্ছেটা, ওর মতন সর্বার্থে এক অপদার্থের পক্ষে বড়োই হাস্যকর যে, তা ও জানে। কিন্তু বাঁচার ইচ্ছে যতই হাস্যকর হোক না কেন, সব মানুষই এই দুর্মর রোগে ভোগে।
দীপ, নানা কারণে ঘেন্না করে নিজেকে, আবার ভালোও বাসে, যদিও জানে যে, এই ঘৃণাটা করা উচিত সমাজকে, সমাজব্যবস্থাকে, যারা এবং যে-ব্যবস্থা ওর মতন নির্বিরোধী, টগবগে, উচ্চাশাসম্পন্ন একজন যুবকের মনের মধ্যে এমন অস্থিরতা এবং অবসাদ এনেছে। কিন্তু এই সমাজ, এই ব্যবস্থাটা তো কোনো মানুষ বা প্রাণী নয়, এমনকী একটা গাছও নয় যে, ও ইচ্ছে করলেই ওর একক চেষ্টাতে কেটে ফেলবে কুড়ুল দিয়ে।
তামাহাটে ওদের বাড়ির দিকে আসতে আসতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতে শিক্ষিত না হলেও উচ্চশিক্ষিত এবং চিন্তাভাবনাতে অত্যাধুনিক দীপ ভাবছিল যে, ওর বাবার কথা শুনে, চাষ বাস করলেই হয়তো ভালো করত। জমি-জমা ওদের নেহাত কম নেই। তা ছাড়া, এখানের অনেকেই তো, পাটের ব্যাবসা উঠে যাওয়ার পরে চাষবাস নিয়েই সংসার চালিয়ে নেন। সচ্ছল না হলেও অভাবও নেই কোনো তাঁদের।
কেন যে ও গৌরীপুরে পড়াশুনো করতে গেল। আর কেনই যে সাহিত্য পড়তে গেল। কেন যে ও মাদারকে এমন করে ভালোবাসল! সমস্ত জীবনটাই দীপের ভুলে ভরা। মাদারের গর্বের রং ওই মাদার ফুলেরই মতন। ও জানে যে, কোনোদিনও পাবে না মাদারকে। তবু…
ভুল, ভুল, সবই ভুল!
.
নদীপারের তিনকড়ি মিত্র হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল-এর পাশের পায়ে-হাঁটা পথ বেয়ে তামাহাটের মোড়ে এসে পৌঁছে দোকানঘরগুলোর আলোতে চোখ যেন আরওই বেঁধে গেল।
এমন সময়ে অন্ধকারে প্রায় মাটি খুঁড়ে উঠে হামিদ ওর হাত ধরে বলল, কী রে! তোর হইছেটা কী কত? আলি না ক্যান রে? আম্মা তর লইগ্যা বইস্যা আছে। চল চল।
লজ্জিত হল দীপ। সত্যিই তো! হামিদের আম্মা ফতিমা বিবি, দীপ-এর মাসিমাকে তো ও নিজেই বলেছিল। মাসিমা ওকে ইদের দিনে লংক্লথের পায়জামা-পাঞ্জাবিও দেন প্রতিবছর। ওর লজ্জা করে। বদলে কিছুই তো ও দিতে পারে না! এবারেও সেই আন্তরিক দাওয়াতের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। অথচ কী যে হয়ে যায় দীপের আজকাল। মাদারের বিরক্ত মুখটার কথা বার বারই মনে পড়ে যায়।
হামিদ বলল, তগো বাড়ি গিয়া মাসিমাকে জিগাইলাম। তা তিনি ত কইবার পারলেন না তুই কোন চুলায় গ্যাছস। তবে আমি ঠিকই বুঝছিলাম কোথায় গ্যাস।
কোথায়? আর কী করে? বুঝলি কী করে?
মাদার বনে। মাদারের ফুল ফুটছে যা না! ইরে! ইনসাল্লা। এরশাদ। এরশাদ। চাইরধারে চোখ চাওন নারে হালা। আহা! মন কয়, যেন জন্নাত নাইম্যা আইছে নিচোত।
কোন জন্নাত? তোদের স্বর্গের, মানে, জন্নাতের আবার অনেকরকম হয় তো।
হয়ইতো!
বলেই বলল, জন্নাতুল ফিরদৌস, জন্নাতুল মোয়াল্লা, জন্নাতুল নাইম, জন্নাতুল মাবা।
বলেই বলল, আরও আছে। বোধ করি, আম্মি কইবার পারে সবগুলানের নাম। তবে মাদারের মতন জন্নাত আর নাই। যাই ক তুই দীপ। ভাব ভাব মাদারের ফুল।
দীপের মনটা ভালো নেই। ভালো থাকে না আজকাল। অন্যসময় হলে প্রতিবাদ করত হয়তো। হয়তো ঝগড়াও হয়ে যেত। কিন্তু এখন উচ্চবাচ্য করল না। তা ছাড়া আজকে ইদের দিন। ভালোবাসার দিন। ঝগড়ার নয়।
প্রতিবাদী হতেও যতটুকু জোরের, মনোবলের এবং উদ্যোগের প্রয়োজন হয় তা জড়ো করার মতন জোর এই বসন্তকে পৃথ-দেখানো সন্ধেতে দীপ নিজের মধ্যে জড়ো করে উঠতে পারল না। তা ছাড়া হামিদ তার বন্ধুই শুধু নয়, তার হিতার্থীও। ডিঙ্গডিঙ্গার মাদার নামী মেয়েটিকে যে দীপ ভালোবেসে ফেলেছে তা হামিদ বিলক্ষণই জানে। যদিও দীপের সেই বিফল ভালোবাসাতে হামিদ কোনো মদতও দেয় না আবার তার সক্রিয় বিরোধিতাও করে না। দীপের মনে হয়, হামিদের স্বভাবটা যেন অনেকটা তামাহাটের এই গঙ্গাধর নদীরই মতন। নিজের মনেই সে বয়ে চলে। তার দু-পারের কোনো ঘটনার ঘনঘটাই তাকে ছোঁয় না। আলোড়িত করে না। অথচ হামিদের মধ্যে নদীরই মতন এক অঘটনঘটনপটিয়সী ক্ষমতা আছে।
হামিদের পূর্বপুরুষেরা চরুয়া ছিল। এই অঞ্চলের মানুষেরা যাদের বলেন, ভাটিয়া মুসলমান। তাই ওর রক্তে প্রচন্ড রাগ যেমন আছে, রক্তের মধ্যে চর-ফেলা নদীর খামখেয়ালিপনাবাহী জলও বোধ হয় কিছু মিশে আছে। কখন যে হামিদ কোন দিকে বাঁক নেয়, কোথায় চর ফেলে আর কোথায় পাড় ভাঙে, তা সে নিজেও জানে না। সে-কারণেই হাদিম ওর বন্ধু হলেও, ওর হিতার্থী হলেও, দীপ ওকে সমীহ করে চলে। সম্ভবত ভয়ও পায়। যদিও সেই ভয়ের কথা কখনো মুখে বা চোখে প্রকাশ করে না বা করেনি হামিদের কাছে।
হামিদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দীপ বলল, তুই আউগাইয়া যা। আমি হাত-মুখ ধুইয়া আর মারে একবার কয়্যাই আসতাছি।
ক্যান? আমাগো বাড়ি কি ইন্দারা নাই নাহি? না একখান গামছাও নাই তর হাত-মুখ পোছনের লইগ্যা?
না রে। হে কথা নয়। মারে কইয়াই আসুমানে। দেখিস দৌড়াইয়া যামু আর আমু।
দেইখ্যা লইস। জানিসই ত! মায়ে আমার নাই-চিন্তার রানি!
তা ত অইবই। ছোট্ট পোলা যে তুই! আমাগো আট ভাইয়ের মধ্যে কারে কুমিরে লইল আর কারে বাঘে খাইল হে লইয়া আমার আম্মার কুনই মাথাব্যথা নাই।
হ। তাই ত! নিমকহারাম আছস তুই বড়ো। মাসিমা সবসময়ই হামিদ হামিদ করেন আমি দেখি নাই য্যান। থো তোর মিথ্যাকাহন।
দীপ আর কথা না বাড়িয়ে বলল, যা যা, তুই আউগাইয়া যা। আমি যাম আর আম।
হামিদ এবারে এগিয়ে গেল। শুক্লপক্ষে সন্ধ্যায় ডিঙ্গডিঙ্গার পথে যেন মুছে গেল সে অকস্মাৎ।
হাটের পাশ দিয়ে গিয়ে দীপ গদিঘরের পাশের চ্যাগারের ছোটো দরজা দিয়ে ঘুরে গদিঘরের পাশ দিয়ে ভেতর-বাড়িতে ঢুকল।
সন্ধের পরে পরেই এই ফাল্গুনে গাছগাছালিরা কেমন যেন গন্ধ ছাড়ে একটা তাদের গা মাথা, হাত-পা, পাতা-পুতা থেকে। একটা মিশ্র গন্ধ। সকলে সে গন্ধ পায় কি না তা দীপ বলতে পারবে না। কিন্তু সে পায়। যেমন পায়, মাদারের গা থেকে, বগলতলি থেকে। ও একটা গন্ধগোকুল। গন্ধময় ওর জগৎ, শব্দময়ও বটে। আর বর্ণময় তো অবশ্যই!
কামরাঙা গাছটা মস্ত বড়ো হয়ে গেছে। জলপাই গাছটাও। কৃষ্ণপক্ষের রাতেই যেন তাদের এই কিশোরী শরীরের বাড়ের মতন বাড়টা তারকাখচিত আকাশের পটভূমিতে বেশি করে চো পড়ে। কেন, জানে না দীপ।
নীহার শিবমন্দিরের মধ্যে মূর্তির সামনে বসেছিলেন। সামনে গৌরীপুরের কাছের আশারিকান্দি থেকে ফরমাশ দিয়ে বানানো মস্ত পিদিমদানে রেড়ির তেলের পিদিম জ্বলছে বারোটি। শীর্ণ কিন্তু জ্যোতির্ময়ী একটি উজ্জল দীপশিখারই মতন দেখাচ্ছে দীপের মা নীহারকে।
মাকে আড়াল থেকে দেখতে ভারি ভালবাসে দীপ কিন্তু মা ঠিকই বুঝে ফেলেন যে দীপ তাঁকে দেখছে।
কে জানে! হয়তো সব নারীরাই বোঝেন।
কিন্তু যখন পুজোতে বসেন নীহার তখন তাঁর কোনোই বাহ্যজ্ঞান থাকে না।
অনেকক্ষণ ধরে দীপ পিদিমদানের বারো পিদিম-এর উজ্জ্বল আলোর পটভূমিতে তার বৃদ্ধা মায়ের নিষ্কম্প শিলটটি দেখল। বাইরে এমন উথাল-পাতাল হাওয়া অথচ আশ্চর্য, এই ছোট্ট শিবমন্দিরের অভ্যন্তরে হাওয়ার রেশমাত্র নেই।
হঠাৎ নীহার মুখ না ঘুরিয়েই বললেন, দীপ এলি?
হ্যাঁ, মা।
কোথায় থাকিস যে সারাদিন! চানু এসেছিল। চখা নাকি আসছে কলকাতা থেকে। আগামীকাল নাকি ধুবড়িতে প্রথম বইমেলা হবে। তাই উদবোধন করতে আসছে চখা অন্য আর একজন লেখকের সঙ্গে।
অন্য লেখক কে?
তা জানি না। আমাদের জেনে লাভই বা কী! তবে চানু বলছিল যে দু-তিন জনের আসার কথা আছে।
আসছে কোথা থেকে? ধুবড়ি?
আরে না না। কলকাতা থেকে আসছে প্লেনে। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিয়ে মেলা কতৃপক্ষই ওকে তামাহাটেই পৌঁছে দেবেন। তারপর আগামীকাল আবার বিকেলে এসে নিয়ে যাবেন ধুবড়ি। বইমেলা তো ধুবড়িতেই! এই নাকি প্রথম হচ্ছে বইমেলা ধুবড়িতে। শুধু বাংলা বইয়েরই মেলা নয় রে, বাংলা, অসমিয়া এবং ইংরেজি বইও থাকবে। তবে আমার মনে হয়, মেলার নাম দেওয়া উচিত ছিল গ্রন্থমেলা। অসমিয়া ভাষাতে বই বলে তো কোনো শব্দ নেই।
ভালো। ধুবড়িতে যে কত শিক্ষিত বাঙালি ও অহমিয়ারা থাকেন, তাঁদের খোঁজ আর কে রাখেন! কলকাতার খবরের কাগজগুলো তো মাঝে মাঝে ব্রহ্মপুত্রের বন্যার খবর ছেপেই ধন্য করে ধুবড়ি শহরকে। আর কী!
তা ঠিক। কাগজগুলোর এমনই রকম। যেন ধুবড়ি বলে কোনো জায়গার অস্তিত্বই নেই।
তারপরেই কথা ঘুরিয়ে বলল, চখাদা সত্যিই এখানে আসবেন? এল কী মা? কতদিন পরে আসবেন?
তা প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর হবে। তোর জন্মের বছর পনেরো আগে শেষ এসেছিল। তখন কড়ি ছিল এখানে। ঝন্টু আর বাপ্পও এসেছিল কুচবিহারের হস্টেল থেকে ছুটিতে। তখন তোর বাবা তো বটেই, জ্যাঠাবাবুও বেঁচে। যাই হোক, এখন চখার নাম-ডাক হয়েছে। চখা চক্রবর্তী বললেই চোখাচোখা মানুষেও একডাকে চেনে। সে যে অতীতকে ভুলে যায়নি, তার এই প্রাচীন পিসিমার কাছে একরাতের জন্যে হলেও যে, তামাহাটে সে আসছে, এটাই আনন্দের কথা।
তা আসছেনই যদি তো এত দেরি করে খবর পাঠালেন কেন?
তারপর নীহার বললেন, চখার নাকি আসার ঠিক ছিল না। ব্যাঙ্গালোর না ম্যাড্রাস কোথায় যেন গেছিল। শেষমুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই খবর দিতে এত দেরি হল।
তোমাকে খবর দিল কে?
চানু।
চানুদাকেই বা এ খবর দিল কে? মিথ্যে খবর নয় তো?
মিথ্যে খবর দিয়ে কার লাভ? তোর যত উদ্ভট চিন্তা। উদ্যোক্তারা ধুবড়িতে রাজাদের ছাতিয়ানতলার বাড়িতে ফোনে খবর দিয়েছেন। রাজাই ধুবড়ি থেকে এখানে মুংগিলালের কাছে ফোন করে দিয়েছিল। চখা বলেই দিয়েছে যে, বাগডোগরাতে নেমে সে তামাহাটেই আসবে। ফোন যখন আসে, চানু তখন সেখানেই বসে গল্প করছিল। দাতুও ছিল। ওরা দুজনে দৌড়ে খবর দিতে এসেছিল। একজনকে পাঠলাম ঘোষের দোকান থেকে গরম রসগোল্লা আনতে, যদি পায়, চখা খুব ভালোবাসত।
চখাদা যখন শেষবারে এসেছিল তখনও কি ঘোষের দোকান ছিল?
থাকবে না কেন? গদাই ঘোষের বাবা নিমাই ঘোষ তখন বসত দোকানে। সেও তো ফওত হয়ে গেছে তোর জন্মেরও আগে। বড়ো ভালো রাবড়ি বানাত নিমাই ঘোষ। আর রসমালাইও। ফকিরাগ্রাম, গোঁসাইগঞ্জ, বক্সির হাট, পাগলা হাট হয়ে মটরঝার, কচুগাঁও থেকেও মানুষে সেইসব কিনতে আসত। রাবড়ি খাওয়ার যম ছিল তোর জ্যাঠাবাবুর বন্ধু রতুবাবু।
মানে, পচার দাদু?
হ্যাঁরে। উনি খুব বড়ো শিকারিও ছিলেন। টি মডেল ফোর্ড গাড়ি ছিল তাঁর একটা। তোরা সেসব গাড়ি চোখেও দেখিসনি। পথেও চলত, মাঠেও চলত। উনি তো হিরো ছিলেন এই অঞ্চলের। আর ছিল আবু ছাত্তার।
আবু ছাত্তারের কথা শুনেছি। শুধু বাঘই মারেনি এন্তার, একদিনে এগারো জন মানুষও মেরেছিল নাকি?
হ্যাঁ। তা মেরেছিল। ফাঁসি হয়ে গেছে মানুষটার। বদরাগি ছিল ঠিকই কিন্তু মানুষ ভালো ছিল। ভালোমানুষদের রাগই প্রকাশ পায়। যারা রাগ প্রকাশ করে না, তাদের থেকে দূরে থাকবি।
ঘোষের দোকানে কাকে পাঠিয়েছ?
কথা ঘুরিয়ে বলল দীপ।
নীহারের আজকাল এরকমই হয়েছে। এককথা বার বার বলেন। স্মৃতিশক্তিও চলে গেছে। বয়েসও তো প্রায় আশি হল। তারপর পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুই পুত্র বিয়োগে তাঁর মাথাটা সম্ভবত কাজই করে না আর।
আর চানুদাকে?
ডিম জোগাড় করে আনতে। আজ ইদের দিন। মিয়াদের দোকানপাট সবই তো বন্ধ। তাদের বাড়িতেও কি আর আজ কিছু বাকি আছে! চানু বলল, ওদের বাড়ির এক হাঁসীর নাকি ডিম পাড়ার কথা আজ। দেখুক, যদি থাকে চখার কপালে ডিম খাওয়া।
হেসে ফেলল দীপ সেকথা শুনে। বলল, বাবা:! কবে তাদের বাড়ির কোন হাঁসী ডিম পাড়বে সে খবরও রাখে নাকি চানুদা?
তারপরই বলল, শুধুই ডিমের ঝোল খাওয়াবে মা? চখাদাকে?
না রে। ফেনাভাত খাওয়াব। চখা তামাহাটের ফেনাভাতের খুব ভক্ত ছিল। ফেনাভাত, মধ্যে শিম, বাঁধাকপি আর পালংশাক সেদ্ধ। এবং হাঁসের ডিম সেদ্ধ। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা।
হাঁসের ডিম-এ ক্লোরোস্টাল বাড়ে। বাত হয়।
দীপ বলল।
ছাড় তো! হোক গিয়ে। একদিন খেলে হার্ট-অ্যাটাক হবে না। তোর বাবা নেই, জ্যাঠা নেই, জেঠিমা নেই, যাঁরা সবচেয়ে বেশি আদর করতেন তাঁরাই নেই, আমি অন্তত যেটুকু পারি করব তো! তা ছাড়া, ছেলেটা থাকবে তো মোটে চব্বিশ ঘণ্টারও কম!
দীপ মনে মনে বলল, ছেলেটাই বটে! বাঙালি মা-মাসি-পিসির চোখে ঘাটের মড়াও ছেলেমানুষ!
নীহার পুজোর আসন থেকে উঠে, আসনটি ভাঁজ করে তুলে রেখে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে বাইরে আসতে আসতেই চানুদা আর দাতু দুজনেই এসে হাজির। চানুদার এক হাতে সার্ক-এর বাক্সে ডিম আর অন্যহাতে একটা পাথরের বাটি। আর দাতুর হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি।
বাটিতে কী আনলি?
নীহার বললেন।
আজ চুমকির জন্মদিন ছিল। পায়েস রান্না হইছিল বেশি কইর্যা। বউদি কইল, পাথরবাটিতে জমানোই আছে, লইয়া যা চখার লইগ্যা। ও খুবই ভালো পাইত মায়ের হাতের পায়েস খাইতে। মা ত নাই! তার আর কী করন যাইব? আমি যে মনে রাখছি ও কী ভালো পাইত না পাইত সেকথা জাইন্যাও ত চখাদার ভালো লাগব অনে।
কোন ঘরে শুতে দিই ওকে? কলকাতাইয়া বাবু। ওদের তো আবার অ্যাটাচড বাথ ছাড়া শোয়ার অভ্যেস নেই। আমার ঘরেই ওকে থাকতে দেব। তা ছাড়া কমোড তো ওই…
স্বগতোক্তি করলে নীহার।
আর তুমি?
দীপ বলল। অবাক হয়ে।
একরাত তোর সঙ্গেই শুয়ে যাব।
আর রাতে বাথরুম পেলে?
মধ্যের দরজাটা খুলে রাখলেই হবেখন। নয়তো বাথরুমের উঠোনের দিকের দরজাটা খুলে রাখতে বলব ওকে। প্রয়োজন হলে উঠোন দিয়েই যাব।
বলেই বললেন, তুই যা দীপ। বাপোই আর বউকে খবর দে গিয়ে। আর মণিকাটা কোথায় গেল? নিশ্চয়ই টি ভি-র সামনে বসে আছে। ডাক তো ওকে। ঘর-বাড়ি সাফ-সুতরো করতে হবে। আমার ভাইপো আসছে এত যুগ পরে। কেউ-কেটা ভাইপো।
দীপ জিজ্ঞেস করল চানুকে, বাগডোগরা থেকে তামাহাটে এসে পৌঁছোতে কতক্ষণ সময় লাগবে? ধুবড়ি হয়ে আসবে কি?
না। তা কেন! সোজা এসে ঢুকে পড়বে বাঁয়ে। তারপর পাগলা হাট, কুমারগঞ্জ হয়ে আসবে।
শিলিগুড়ি আর জলপাইগুড়ি পেরোতেই তো লেগে যাবে অনেকই সময়।
চানু বলল, কেন? হোড়াই আসবে সে শহরের মধ্যে দিয়ে। সেভক রোড ধরে বেরিয়ে এসে বাইপাস দিয়ে এসে তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে নেবে। এন. জি. পি.-তেও ঢুকবে না।
তাই? তবু ক-টা নাগাদ এসে পৌঁছোবে?
তামাহাটের কূপমন্ডুক দীপ বোকার মতন বলল।
ভাবছিল ও যে, ওর জগটা বড়োই ছোটো। ওর দৌড় এদিকে ডিঙ্গডিঙ্গা আর অন্যদিকে কুমারগঞ্জ-গৌরীপুর হয়ে ধুবড়ি। ব্যাস।
চানুদা বলল, তা ঠিক বলা যায় না। এখন তো শুনতে পাই ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ছাড়াও অন্য প্রাইভটে-এর ফ্লাইটও আসে বাগডোগরাতে। প্লেন যদি লেট না করে তাহলে এখান থেকে ঘণ্টা পাঁচেক লাগার কথা। তার মানে, আটটা নাগাদ পৌঁছোবে হয়তো।
নীহার যেন হঠাৎ-ই উত্তেজিত হয়ে উঠে বললেন, সময় একেবারেই নেই। মণিকা! এই মণিকা, মণিকা! কোথায় যে যায় মেয়েটা!
মণিকাকে ডাকতে ডাকতে ভেতর-বাড়িতে গেলেন তিনি।
চানুদা আর দাতু বলল, আমরাও যাই এখন। গিয়া আটটা নাগাদ আবার আসুমানে। বলিস কাকিমারে। সকলকেই খবরটা দিতে ত লাগে। কী কইস? চখাদা এত বছর পরে আসতাছে তামাহাটে, ওয়েলকাম করন লাগে ত!
দীপ বলল, আমি তো তাঁকে দেখেছি মাত্র একবার। পুঁচকির বিয়েতে যখন কলকাতায় গেছিলাম তখন। এসে পড়লে তো চিনতেই পারব না।
চেনবার দরকারটাই বা কী? তামাহাটে কি আমাগো বা তগো বাড়িত গন্ডা গন্ডা গাড়িওয়ালা অতিথি আসতাছে রোজ রোজ? গাড়ি আইস্যা থামলেই বুঝবি যে চখা আইল।
চখাদার তো লম্বা-চওড়া চেহারা। শুনেছি ইদানীং মোটাও হয়েছে খুব। মাথার চুলও পাতলা হয়ে গেছে।
মনে আছে এখনও, মাঝে মাঝেই বাঁ-হাত দিয়া মাথার চুল আঁচড়াইবার বাতিক ছিল। এখনও আছে কি না কে কইতে পারে?
মোটা হয়েছে কেন?
মোটা হইব না ত কী? মায়ে মোটা ছিলেন, বাবাও মোটা, মোটারই ধাত অগো। জল খাইয়া থাকলেও মোটা হইয়া যাইব। গড়ন বইল্যা কথা!
দীপ বলল না কিন্তু কথাটা মুখে এসে গেছিল। ও শুনেছে লোকমুখে যে, শুধু জলই নয়, লাল জলও নাকি খায় চখাদা প্রায়ই।
তারপর বলল, এদিকে বলছ চুল-ই নেই, তার আঁচড়াবেটা আর কী?
আরে যাদের চুল থাকে না তারাই দেহিস সবসময়েই পকেটে একখান চিরুনি লইয়া ঘঘারতাছে।
ওরা হেসে উঠল।
দাতু বলল, সত্যি বলছি। কিন্তু কেন ঘোরে, তা বলতে পারব না।
তারপর দাতু আর চানুদা চলে গেল যার যার বাড়ি।
এমন সময়ে দীপের মনে পড়ল হামিদের কথা। বাড়ির ভেতরে দৌড়ে গিয়ে বলল, যাঃ একদম ভুলে গেছিলাম মা। ফতিমা মাসির বাড়ি আজ ইদের নেমন্তন্ন ছিল যে! পায়জামা পাঞ্জাবি নিয়ে, বিরিয়ানি নিয়ে মাসি বসে আছে। হামিদ পাকড়াও করেছিল হাটের মোড়ে। তাকে কথা দিয়ে এসেছি, না গেলে খুবই খারাপ হবে।
দাওয়াতই যদি ছিল তবে ইদের নমাজের পরেই গেলি না কেন? ইদগা থেকে ওরা আসার পরপরই? ফতিমা তো তোকে এই প্রথমবার দাওয়াত খাওয়াচ্ছে না? এটা কী ধরনের অসভ্যতা? এমনটা কোনো শিক্ষিত মানুষের কাছে আশা করার নয়। এখন কী করবি? এদিকে চখাও কতদূর থেকে আসছে আমাদের সঙ্গে মাত্র ক-টি ঘণ্টা কাটাবে বলে আর তুই ঠিক এখনই চলে যাবি? বাগডোগরাতে কখন প্লেন নামবে তা তো আমরা জানি না। ও তো আগেও চলে আসতে পারে! তুই ফিরে আসার আগেই যদি সে এসে পৌঁছে যায়?। কী লজ্জার কথা হবে। এখন ওর পিসির বাড়ি বলতে তো তুই আর আমি! অন্যেরা তো কেউ-ই নেই এখানে। তোর দাদারা তো একজন রায়গঞ্জে, একজন ধাবাদ আর হাজারিবাগের ঘেটো টাঁড়ের মধ্যে মাকুর মতন যাওয়া-আসা করছে আর অন্যেরা কলকাতাতে। আগে দোল দুর্গোৎসবে একসঙ্গে হত সবাই। এখন আর কে এই নিম্ন আসামের গোয়ালপাড়ার ধ্যাড়ধেড়ে তামাহাটে আসে! ডিশ অ্যান্টেনা নেই, কেবল টি ভি নেই, বার নেই, এয়ার-কণ্ডিশনড সেলুন নেই, সিনেমা হলও নেই, এখানে শহুরেরা কীসের জন্যে আসতে যাবে? মোটে আসেই না কেউ, তার থাকা। এই কারণেই আমার ভীষণই আনন্দ হচ্ছে চখা আসছে বলে। দেখ ছেলেটার কত ভালাবাসা আছে আজও তামাহাট-গৌরীপুর-ধুবড়ির জন্যে।
বলেই বললেন, অতখানি রাস্তা। ভালোয় ভালোয় এসে পৌঁছকই আগে।
ছেলেটা ছেলেটা কোরো না তো মা। আজ বাদে কাল চিতায় উঠবে। এই বাঙালি মা পিসিদের কাছে বুড়োরাও চিরদিন থোকা আর খোকন হয়েই থাকে। সাধে কি জাতের এই হাল!
এমন সময় বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ানোর শব্দ হল। তামাহাটের পথে বাস-ট্রাকের যাতায়াত আছে মাঝে-মধ্যে কিন্তু গাড়ি দিনে হয়তো চার-পাঁচটি ডিঙ্গডিঙ্গার দিকে যায় এবং ধুবড়ির দিকেও।
তুমি ভেতরে যাও মা। আমি দেখছি।
দীপ বাইরে বেরিয়েই দেখে একটা মস্ত গাড়ি। সাদা-রঙা ঠিক এমন গাড়ি আগে দেখেনি কখনো।
গাড়ির সানের বাঁ-দিকের দরজা খুলে নামল দীপের ছোড়দা, ঝন্টু।
তুমি! চখাদা নাকি আসবে আজই। একটু আগেই চানুদা খবর দিয়েছে এসে মাকে। ধুবড়ি থেকে রাজাদা মুংগিলালের গদিতে ফোন করেছিল।
জানি, ঝন্টু বলল, আমিও তো তাই এই সময়েই এলাম। নইলে, পরের সপ্তাহে আসতাম।
ততক্ষণে ছোটোবউদি আর ছোটোবউদির দাদা-বউদিও নামলেন। ছোড়দার ড্রাইভার কাম-কম্বাইণ্ড হ্যাঁণ্ড পান্ডেও নামল ড্রাইভিং সিট থেকে। ভেতর থেকে নীহারের সঙ্গে মণিকাও গদিঘরে এলেন।
কুশল জিজ্ঞাসাবাদ করে নীহার বললেন, বাঁচালি ঝন্টু, তুই এসে পড়ে। কী টেনশনে যে ছিলাম।
ঝন্টু বলল, টেনশন-এর কী আছে? চখাদা তো আর বাইরের লোক নয়।
এটা কী গাড়ি নিলি? মারুতি ভ্যানটা নেই?
সেটাও আছে মা তোমার আশীর্বাদে। এটা টাটা মোবিল।
বাঃ। ভারি সুন্দর তো গাড়িটা!
চখাদা বইমেলা উদবোধন করতে আসছে ধুবড়িতে, তুমি যাবে তো? তাইতো নতুন বড়ো গাড়ি নিয়ে এলাম যাতে তোমার কোনো কষ্ট না হয়।
তাই? তা ভলো। তবে বড়োলোক না হয়ে বড়ো মানুষ হও, এই আশীর্বাদ করি। চিরদিন তাই চেয়েছি।
দীপ বলল, ছোড়দা এসে গেছে, আমি হাত-মুখটা ধুয়েই একটু ঘুরে আসি হামিদদের বাড়ি থেকে। তোমার টর্চটা নিয়ে যাচ্ছি মা।
বলেই ছুটে ভেতর-বাড়িতে গেল।
.
০২.
এটা কী নদী পার হলাম?
চখা টাইয়ের নটটা একটু ঢিলে করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, যে ছেলেটি তাকে নিয়ে এসেছিল বাগডোগরা থেকে, তাকে।
কে জানে!
নদীর নাম জানো না?
কী হইব জাইন্যা?
চখা চুপ করেই রইল।
ভাবছিল, এই আমাদের বিশেষত্ব। এখানে শিক্ষিত মানুষদের কাছেও কোনো গাছ শুধুমাত্র গাছই।কোনো পাখিও শুধু পাখি। নদী, নদী। জন্মাবধি গাছ, পাখি, নদীর প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও এদের কারওকেই জানার এতটুকু আগ্রহ নেই অধিকাংশ মানুষেরই।
ভাবলেও খারাপ লাগে ওর।
পাইলট, অর্থাৎ ড্রাইভার খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। কোনো মদের কোম্পানির ফ্রি-গিফট দেওয়া একটা গল্ফ-ক্যাপ মাথায় চড়িয়ে। ভাড়ার গাড়ি। গাড়ির মালিকও গাড়ির সামনের সিটে বসেছিলেন।
কতক্ষণ লাগবে তামাহাটে পৌঁছোতে?
চখা আবার প্রশ্ন করল।
দেখা যাউক। রাস্তা এতই খারাপ যে, কহনযোগ্য নয়।
কিছুক্ষণ পরেই একটি পেট্রোল পাম্প-এ পাইলট গাড়িটাকে ঢোকাল। পাইলট বলেই সম্বোধন করছিল চখা তাকে। তাতে সেও খুশি হচ্ছিল। তাকে নিতে-আসা ছেলেটিও নামল। তার নাম প্রান্তিক। তার পর পেট্রোল যখন নেওয়া হচ্ছে তখন ফিরে এসে জানলা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে লজ্জামাখা হাসি হেসে বলল, একশত টাকার একখান নোট হইব কী? টাকা কম পইড়্যা গেছে গিয়া।
চখা বলল, হবে।
টাকাটা নিতে নিতে ভদ্র ও অপ্রস্তুত ছেলেটি আরও লজ্জিত হয়ে বলল, খারাপ পাইলেন না ত?
না না। খারাপ পাইমু ক্যান? ওরকম তো হতেই পারে। নিজে গাড়ি না চালালে বা নিয়মিত যাওয়া-আসা না করলে কত তেলে কত কিমি যাবে, কত ধানে কত চাল-এরই মতন, জানা থাকবে কী করে! এই নাও।
বলে টাকাটা বের করে দিল পার্স থেকে।
একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা নেই কিন্তু হাওয়ার দুচোলো মুখে ঠাণ্ডার তির আছে। ফাল্গুনেরউত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গের আর নিম্ন আসামের প্রকৃতি, ঘরবাড়ি, এমনকী কথ্য ভাষাতেও বিশেষ তফাত নেই। পথের দু-পাশেই চষা খেত। মাঝে মাঝে পাট লেগেছে, সরষে, শিমুল গাছে ফুল এসেছে গোলাপি ও লাল, বৈষ্ণব ও শাক্তদের পোশাকের রঙের মতন। মাদারগাছে আর অশোকগাছেও ফুল এসেছে বৌদ্ধ ও তিব্বতি লামাদের পোশাকের রঙের। হিন্দিতে এইসব লালকেই মিলিয়ে মিশিয়ে বলে ভগুরা। অর্থাৎ গেরুয়া। রাগ-রাগিণীর রং বিচারে ভগুয়া চার রকমের হয় : বৈষ্ণব, শাক্ত, বৌদ্ধবাদী ও তিব্বতি লামার পোশাকের রং। বেগম আখতার সম্বন্ধে ঋতা গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা পড়ে এই তত্ত্ব সম্বন্ধে সাম্প্রতিক অতীতে সচেতন হয়েছে চখা।
ভাবছিল চখা যে, চোখে আমরা কত কীই দেখি, কিন্তু ঠাহর করা আর দেখা, দেখার মতন দেখাতে কতই না তফাত! গেরুয়ার এই শ্রেণিবিভাগ সম্বন্ধে ও অবশ্যই অবহিত ছিল অবচেতন মনে কিন্তু সচেতন আদৌ ছিল না। দেখার চোখের এই তফাতটুকুতেই একজন মানুষের, বিশেষ করে লেখকের সঙ্গে অন্য মানুষ বা লেখকের পার্থক্য।
তেল নিয়ে গাড়ি স্টার্ট করার পরেই পাইলট একটা মস্ত হাই তুলল।
চখা বলল, ব্যাপারটা কী পাইলট? সিগারেট খাও নাকি? খেলে খাও। আমার বিল্টুমাত্র আপত্তি নেই। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে তো আমারই চিরঘুম হয়ে যাবে।
পাইলট সেকথার উত্তর না দিয়ে বলল, ক্ষুধা লাগছে বড়ো।
তাই?
অবাক হয়ে বলল চখা।
তারপর বলল, খিদে পেয়েছে তো কিছু খেয়ে নাও।
সকালত ছ-টার সময় বারাইছিলাম দুগা মুড়ি আর চা খাওনের পর। আপনার প্লেন আইব তিনটায়, ওদিকে এয়ারপোর্টে গাড়ি লইয়া আইস্যা পৌঁছাইছিলাম প্রায় দুইটায়। খামু কখনে? আর খামুই বা কুথায়?
কেন? এয়ারপোর্টেই তো রেস্তোরাঁ ছিল।
কয়েন কী স্যার? সিখানে কি আমাগো মতন মাইনষে খাইবার পারে নাকি? দাম শুইন্যাই ত হার্ট-ফেইল হবার লাগে।
তাহলে, দাঁড়াও এখন, কোথাও ধাবা-টাবাতে। না খেলে, এতপথ গাড়ি চালাবে কী করে? সকলেই অভুক্ত আছ? চমৎকার। টাকাও নেই বুঝি?
থাউক। খাওনের দরকার নাই। অনেকই দেরি হইয়া যাইবনে আপনের।
হলে হবে। দাঁড়াও কোথাও।
ড্রাইভার ও মালিক মুখচাওয়াচাওয়ি করল। চখাকে নিতে-আসা ছেলেটি, যার নাম প্রান্তিক, চাপা হাসি হাসল। তারপর বলল, আপনের দেরি হইয়া গ্যালে শ্যাষে আমাগো গালাইয়েন না য্যান।
চখা হাসল কথা শুনে।
তারপর হেসেই বলল, না, না, গালাই না তোমাগো। নারে বাবা, না! আমি কিছুই বলব না। তোমাদের সারাদিন অভুক্ত রাখিয়ে কি মহাপাতক হব?
গাড়িটা ধাবাতে দাঁড় করিয়ে চখা ওদের তিনজনকে ভালো করে খাওয়াল। নিজে প্লেনে লাঞ্চ করেছিল বলে চা ছাড়া আর কিছুই খেল না। পাইলটের জন্যে সিগারেটও কিনল এক প্যাকেট। চার্মস ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেই ধু-ধু প্রান্তরের মাঝের ধাবা সংলগ্ন দোকানে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে অন্ধকার হয়ে গেল প্রায়। একঝাঁক কমোন ইগ্রেট গেরুয়া আকাশের পটভূমিতে উড়ে যাচ্ছিল ঘনসন্নিবিষ্ট বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে।
কলকাতা কী যে দরিদ্র! একটা বাঁশঝাড় পর্যন্ত নেই সেখানে। ফাগুন-চৈত্রের হাওয়ায় পর্ণমোচী বনে পাতা-খসার মিষ্টি মুচমুচে আওয়াজটুকু পর্যন্ত শোনা যায় না। হাওয়া সেখানে জমাদারের মতন ঝাঁট দিয়ে নিয়ে যায় না গা-শিরশির করা শব্দে সেই পাতার রাশকে।
কলকাতা ছেড়ে বাইরে এলেই কলকাতার বহুতল বাড়িময় ইট-কংক্রিট আর পিচ-এর কদর্যতা যেন বেশি করে প্রতিভাত হয় ওর কাছে। কলকাতার প্রশ্বাসে বিষ। আওয়াজে কানের সমস্ত কোমল পর্দাগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মনে হয় চখা বোধ হয় আর কোনো দিন কড়িমা বা কোমল রেখাবের মাধুর্যে মুগ্ধ হতে পারবে না। বাড়ির পাশের মাড়োয়ারিদের বহু কোটি টাকা খরচ করে তৈরি মন্দিরে ঘ্যাসঘেসে গলায় গগননিনাদী ভজন হয় রোজ সন্ধেতে অ্যাম্পলিফায়ারে, শুনতেই হয়, বাধ্যতামূলকভাবে ভোর চারটেতে বিজাতীয় ভাষাতে অ্যাম্পলিফায়ারে শোনা ঘুমভাঙানো আজানের আওয়াজেরই মতন। খালি গলাতে শোনা ভজন অথবা আজান দুই-ই কিন্তু সুন্দর।
তার বাড়ির পাশের মন্দিরের পন্ডিত পুরোহিতদের গলাতেও তেমন লালিত্য বলতে কিছুমাত্রই নেই। মাঝে মাঝেই একথা ভেবে মনে মনে হাসে চখা যে, দেবী লক্ষ্মী এবং দেবতা গণেশ দু-হাত উপুড় করে মাড়োয়ারিদের সবকিছুই ঢেলে দিয়েছেন বটে, সরস্বতীও হয়তো কিছু দিয়েছেন তাদের কারও কারওকে কিন্তু তাদের গলাতে সুর একটুও তো দেননি। যুগ-যুগান্ত ধরে শেয়ার বাজারে গলার শির ফুলিয়ে শেয়ারের ভাও হাঁকাহাঁকি করে করে আর পাইকারি বাজারে চাল-ডাল আলুপটলের দর-দাম করে করে তাদের গলাগুলি বোধ হয় চিরতরে চিরেই গেছে। দু-হাতে তাদের সবকিছু অঢেল দেওয়া সত্ত্বেও ন্যূনতম সুরজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করেছেন মা সরস্বতী, লক্ষ্মীর এবং গণেশের পর্যাপ্ত ও বেহিসাবি দানের সঙ্গে সমতা রাখতেই বোধ হয়।
পাইলট, প্রান্তিক এবং গাড়ির মালিক খাওয়া-দাওয়া করার পরে যখন গাড়ি ছাড়ল আবার, তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছিল। ধাবার হাতাতে যে মস্ত সজনেগাছটা থেকে ফিনফিনে খুদে খুদে পাতা ঝরছিল ফাগুনের শেষবিকেলের হাওয়াতে বসন্তের আগমনি গাছের বাণী বহন করে, সেই পাতাগুলোকেএখন দেখা যাবে না। হেড-লাইটের আলোর সামনে যতদুর দেখা যায় তাতে ক্ষত-বিক্ষত পিচরাস্তা আর নীচের পথপাশের পাটকিলে-রঙা ধুলোর ডাঙা আর ড্যাশবোর্ডের নানা মিটারের লাল-সবুজ আলোগুলো ছাড়া পৃথিবী সম্পূর্ণই মসীলিপ্ত।
কলকাতা থেকে গরম স্যুট পরে এসে এতক্ষণ অস্বস্তি বোধ করছিল কিন্তু এখন আরামই বোধ করছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেই আসত কিন্তু মনু বলল, উত্তরবঙ্গে এখন দারুণ ঠাণ্ডা, তার কোনো এক ছাত্রী নাকি শিলিগুড়ি থেকে ফোন করেছিল। কিন্তু বাগডোগরাতে নেমেই বুঝতে পেরেছিল যে, মনুর ছাত্রীর সাবধানবাণী মিথ্যে Bombscare-এর মতনই একটি Hoax। কিন্তু তখন কী আর করা যাবে! কোট-টাই নাহয় খুলে ফেলতে পারত কিন্তু পেন্টুলুন তো আর খুলতে পারত না।
এখন চুপচাপ। বাইরে এবং গাড়ির ভেতরেও। স্প্রিং-এর সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা বলতে গাড়িটার পেছনের সিটের স্প্রিং-এ কিছুমাত্রই নেই। চখার মনে হচ্ছে শালকাঠের তক্তার ওপরে বসেই চলেছে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে। রাস্তা যতই খারাপতর হচ্ছে ততই ঘনঘন বিনা নোটিশের Hump আসছে আর মনে হচ্ছে তার টেইল-বোন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল।
তবে এইসব অসুবিধে, সামনের মোড়ে গিয়ে পাইলট কোন পথ ধরবে, কোন দিকে গেলে পথ অপেক্ষাকৃত ভালো পাবে এবং দূরত্বও কম হবে, এইসব আলোচনাতে যখন ওর সহযাত্রীরা ব্যস্ত তখন চখা বহুযুগ আগে শেষবার যাওয়া ধুবড়ি-তামাহাটের স্মৃতিতে বিভোর হয়ে গেল।
অতীতের স্মৃতিমাত্রই মধুর। তিক্ততা যদি কিছুমাত্র থেকেও থাকে, সময়, বনমধ্যের ঝরনাতলায় ঝুড়িতে করে রেখে-দেওয়া বনমূল, খাম আলুর তিক্ততারই মতন তা অবলীলায় ধুয়ে দিয়ে যায়। সময়ের মতন দুঃখহারী এবং তিক্ততাহারী উপাদান আর কিছুই নেই। কিছু মানুষ অবশ্য সংসারে চিরদিনই থাকেন যাঁরা তিক্ততাকে জিইয়ে রাখতে ভালোবাসেন, কোনো সৌন্দর্যের, কোনো মাধুর্যের সঙ্গেই সহবাস নেই। সেইসব মন্দভাগ্য নষ্ট মানুষদের কথা স্বতন্ত্র।
অনেকই বছর আগে ব্রহ্মপুত্রের তীরের যে ধুবড়ি শহরকে দেখেছিল, এতদিনে তার বোধ হয় আমূল বদল হয়ে গেছে। ভাবছিল চখা। নেতা-ধোপানির ঘাট, ম্যাচ-ফ্যাক্টরি, উইমকো কোম্পানির, স্টিমারঘাট, ছাতিয়ানতলাতে তার পিসেমশাই-এর দাদা পূর্ণ পিসেমশাই-এর নদীপারের বাড়ি। পিসেমশাই-এর দাদাদের মধ্যে একমাত্র পূর্ণ পিসেমশাই-এর গায়ের রংই ছিল ফর্সা। ঝন্টুরা সবাই ওঁকে ডাকত ধলাকাকা বলে। তাঁর দাদা সুরেন মিত্র। তাঁদের একজনের আট মেয়ে এক ছেলে, অন্য জনের আট ছেলে এক মেয়ে। তখনকার দিনে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারেই আট-দশ সন্তান স্বাভাবিক ছিল।
তামাহাট থেকে ধুবড়ি যেতে গৌরীপুর পড়ত পথে। কুমারগঞ্জ। কুমারগঞ্জের প্রায় উলটোদিকে আলোকঝারি, রাঙামাটি পাহাড়, পর্বতজুয়ার।
আলোকঝারি নামটি উচ্চারিত হলেই যেন মনের চোখের সামনে অদেখা ঝরনার এক চিত্রকল্প ফুটে উঠত। আলোকঝারি পাহাড়ে প্রতিবছরই সাতই বোশেখে সাতবোশেখির মেলা বসত। এই নিম্ন আসামের বৈশাখ মাসের বন-পাহাড়ের রূপের কথা ভাবলে চখা এখনও আচ্ছন্ন বোধ করে। পর্ণমোচী গাছেদের পত্রশূন্য ডালে ডালে বসন্তের শিমুলগাছের ফুলের মতন সোনালি লাল মুরগি ফুটে থাকত। কালো প্রস্তরাকীর্ণ পাহাড়ি ঝরনার শুকনো সাদা বুকে কবুতর বলি দিয়ে ডিঙ্গডিঙ্গার মনরাই চা-বাগানের সাঁওতাল কুলি-কামিনেরা বনদেওতাকে পুজো দিত। গোঁসাইগঞ্জ, ফকিরা গাঁও, মটরঝাড়, গোলোকগঞ্জ, গৌরীপুর, বক্সির হাট, ডিঙ্গডিঙ্গা এবং তামাহাট থেকে তো অবশ্যই, মেয়ে-পুরুষ গোরুর গাড়িতে করে পাহাড়ি পথ বেয়ে এই জঙ্গলের গভীরের মেলাতে আসতেন। পেছনে পেছনে আসত সাদা কালো বাদামি গৃহপালিত কুকুরেরা।
মেলা ভাঙতে ভাঙতে রাত নামত। প্রজাপতি উড়ত নানা-রঙা। ঝাঁকে ঝাঁকে। কোনো কিশোরীর গায়ে বসলে অন্যরা চেঁচিয়ে উঠত, এবারে তর বিয়া হইব রে।
বিয়ে ব্যাপারটা যে কী তা না জেনেই উত্তেজনা আর লজ্জাতে সেই কিশোরীর গাল আর কান লাল হয়ে যেত।
শুক্লপক্ষের ফুটফুটে জ্যোৎস্না মাড়িয়ে, চাকায় চাকায় পায়ে পায়ে আমাদের এই বড়ো সুন্দর দেশের মিষ্টি-গন্ধ ধুলো উড়িয়ে বলদেরা গাড়িগুলো টেনে নিয়ে ফিরে যেত যার যার গন্তব্যে। ওই ডাইনি জ্যোৎস্নায় যেন ছইওয়ালা গাড়িগুলো ভেসে ভেসে চলত। বলদদের পাগুলো যেন শূন্যেই পড়ত মনে হত।
মরনাই চা-বাগানের ম্যানেজারের, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের, ইঞ্জিনিয়রের স্ত্রী ও মেয়েরা চাঁদের বনে আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে কোরাসে গাইতে গাইতে হেলা-দোলা গোরুর গাড়ির ছইয়ের নীচে পোয়ালের ওপরে শতরঞ্চি বিছোনো নরম গদিতে বসে বাড়ি ফিরতেন। গোরুর গাড়ির মাথার ওপরে ধবধবে সাদ লক্ষ্মীপেঁচা ঘুরে ঘুরে উড়তে উড়তে কিছু পথ গিয়ে চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে-ওঠা পর্ণমোচী বনের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যেত।
মেয়েরা কলকল করে উঠত, দেখেছিস? দেখেছিস? আমি দেখেছি।
কেউ বলতে, ইশ, আমি দেখতে পেলাম না যে।
এইসব ভাবতে ভাবতে ঘোর লেগে গেছিল চখার। কত যে ছবির পরে ছবি, একের পর এক মনের পর্দাতে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল।
গৌরীপুরের বড়য়া রাজারা ছিলেন বিখ্যাত। প্রমথেশ বড়ুয়া সেই পরিবারের। তাঁর ছোটোভাই প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া, ডাকনাম লালজি, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাতি-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। শোনপুরের মেলাতে যেবারে উনি যেতেন, লালজিকে না দেখিয়ে কেউই হাতি কিনতেন না। হাতির মুখ-চোখ, দাঁত, পায়ের নখ, শুড়, ল্যাজ দেখে, আগেকার দিনের শাশুড়ি ঠাকুরুনরা যেমন করে পুত্রবধূ নির্বাচন করতেন, প্রায় সেই প্রক্রিয়াতেই হাতি নির্বাচন করে দিতেন চেনা-জানা হাতির খরিদ্দারদের।
সকলেই তাঁকে বলতেন রাজা অথবা বাবা। যৌবনে অত্যন্ত ভালো শিকারিও ছিলেন তিনি। পরবর্তী জীবনে শিকার আর করতেন না। খেদা করে হাতি ধরতেন। শেষজীবনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে তিস্তা উপত্যকায়, ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গাতে ক্যাম্প করে থাকতেন তাঁর নিজের শিক্ষিত মস্ত এক গণেশ এবং এক কুনকি নিয়ে। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে গোরুমারার অভয়ারণ্যের কাছের মূর্তি নদীর বিট-অফিসারের বাংলোতে তাঁর সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল চখার। ভারি জিন্দা-দিল, রসিক এবং মন-মৌজি মানুষ ছিলেন তিনি। চোদ্দোটি ভাষা জানতেন।
বড়য়া পরিবারের Summer Palace ছিল মাটিয়াবাগ। গৌরীপুরেই। একটি টিলার ওপরে। মাটিয়াবাগ প্যালেসেরই সামনে প্রমথেশ এবং লালজির প্রিয় হাতি প্রতাপ সিং-এর কবর আছে। Anthrax রোগে মারা গেছিল প্রতাপ সিং। আগের প্রজন্মের যেসব মানুষ প্রমথেশ বড়য়ার মুক্তি ছবিটি দেখেছিলেন, তাঁরা জানেন প্রমথেশ বড়ুয়া, অমর মল্লিক, কাননবালা, পঙ্কজকুমার মল্লিক ছিলেন সেই ছবিতে। কাননদেবী ও পঙ্কজবাবুর গানও ছিল–দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া। তখনও নায়ক-নায়িকারা নিজেরাই গাইতেন। তাঁরা সেই ছবিতে জং বাহাদুর হাতিকেও অবশ্যই দেখে থাকবেন। ওই পাহাড়ের মতন হাতিটিই প্রতাপ সিং।
গৌরীপুরে চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে রাণু-বউদির হাতে বানানো কাঁচা আমপাড়া শরবত খেয়েছিল চখা, কাগজিলেবু গাছের পাতা ও পোড়া শুকনো লঙ্কা দেওয়া। আহা! সেই স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। অথচ রাণু-বউদি যে কার স্ত্রী, তাঁদের বাড়িটা যে গৌরীপুরের ঠিক কোথায় ছিল এবং কার সঙ্গে যে গেছিল সেখানে ও, সে-কথাটাই আজ আর মনে নেই। কিন্তু চমৎকার ফিগারের কুচকুচে কালো অসাধারণ দুটি চোখসম্পন্ন কালকেউটের মতন একবিনুনি-করা একটি সাদা ব্লাউজের সঙ্গে সাদা-কালো খড়কে ডুরে শাড়ি-পরা, এবং গলাতে মটর-মালা পরা রাণু-বউদিকে চখা আজও এক হাজার নারীর মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে পারবে। সুযোগ পেলে।
হাতঘড়িটা দেশলাই জ্বেলে দেখে প্রান্তিক স্বগতোক্তি করল, তামাহাটে পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে নয়টা বাজব অনে।
কইস কী তুই!
গাড়ির মালিক বললেন।
তার আগেই পৌঁছাইয়া যামুনে।
তর মাথাডা গ্যাছে এক্কেরে। এখনও ত কুচবিহারই আস্যে নাই।
তাই ত! আমি ঘুমাইয়া পড়ছিলাম। খাওয়া এটু বেশি হইয়া গেছিল শ্যাষবেলায়।
তারপরই বলল, তবে আর কী। কমপক্ষে এগারোটা বাজব।
ঘোর ভেঙে, সুন্দর স্বপ্ন-রাজ্য ছেড়ে চখা বলল, বলেন কী? আমার আশি বছরের বৃদ্ধা পিসিমা অপেক্ষা করে থাকবেন আমার জন্যে। আরও অনেকই। এগারোটা তো গ্রাম-গঞ্জে অনেকই রাত।
হে ত ঠিকই কথা।
তবে?
কী করন যাইব কয়েন। আপনে ট্রেনে আইলে সকালে নিউ কুচবিহারে নাইম্যা ভাত খাওয়নের আগেই তামাহাট পৌঁছাইয়া যাইতে পারতেন।
হ। তরে কইছে!
পাইলট বলল।
ক্যান?
কুন গ্যারান্টিডা আছে টেরেনের? কাইলই ত আট ঘণ্টা ল্যাট আসছে।
আট ঘণ্টা কইস কী তুই! ওরে ফাদার!
ঠিকই কইতাছি।
চখা বলল, কী প্রান্তিক? পথের বাঁ-দিকে যে শয় শয়ে ট্রাক দাঁড়ানো লাইন করে। ব্যাপারটা কী?
বর্ডার না! বাংলাদ্যাশে যাইব এইসব ট্রাকগুলান। তাই খাড়াইয়া আছে। শয়ে শয়ে কী কন স্যার, হাজারেরও বেশি হইব।
তাহলে এদিক দিয়ে এলে কেন?
রাস্তাডা ভালো। হেইর লইগ্যা। অন্য রাস্তাত গ্যালে আপনার পিছনের হাড্ডিগুলান একখানও আস্ত থাকনের কথা আছিল না।
চখা বিরক্ত গলাতে বলল, যেন এই রাস্তাতে এসেও আস্ত আছে! একে সরু রাস্তা, তায় একটা পাশ তো ট্রাকের লাইনেই ভরতি, বাকি পথ দিয়ে কি আপ-ডাউনের ট্রাক-বাস চলতে পারে?
সে আর কী হইব। আমাগো আসামের কথা ভাবে কেডায়? উলফাঁদের মতন আমাগোও একটা দল করন লাগব। অনুনয়, বিনয়, কোর্ট-কাছারি কইর্যা, ভোট দিয়া কিসই হইল না। হে মাও ডে জং-এ কইছিল না? সমস্ত শক্তির উৎসই হইতাছে বন্দুকের নল। ঠিকোই কথা!
চখা মুখে চুপ করে থাকলেও মনে মনে ভাবল যে, কথাটা বোধ হয় ঠিকই। কোনো ব্যাপারেই আর কিছুতেই কিছু হবার নয়। দেশের সামনে বড়োই দুর্দিন।
তারপর নিজের হাতঘড়ির রেডিয়াম দেওয়া কাঁটার দিকে চেয়ে ভাবল, এখন মোটে সাতটা। বাগডোগরা থেকে চার ঘণ্টা হল বেরিয়েছে। আরও চার ঘণ্টা!
আবারও চোখ বন্ধ করে চখা বহুবছর পেছনে ফিরে গেল।
গঞ্জের নাম তামাহাট তামা নদীরই জন্যে। নদীটা হেজে-মজে গেছে অনেকই দিন হল। এসে পড়েছে গঙ্গাধরে। গঙ্গাধর নদী আসলে সংকোশ। ভুটানের হিমালয় থেকে বেরিয়েছে। ভুটান, অসম আর পশ্চিমবঙ্গের সীমানাতে যমদুয়ার বলে একটা জায়গা আছে। চখা গেছিলও সেখানে একবার পিসেমশাই আর রতু জেঠুর সঙ্গে রতু জেঠুর টি মডেল ফোর্ড গাড়িতে চড়ে। কী নিচ্ছিদ্র বন! কীসব শাল গাছ! পাঁচ-সাত জন প্রমাণ সাইজের মানুষও বেড় দিতে পারবে না তাদের গুঁড়ির–দু-হাত প্রসারিত করেও। এমনই মোটা গুঁড়ি। প্রথম শাখাই বেরিয়েছে পাঁচ-ছ-হাত বা আরও ওপর থেকে। দোতলা কাঠের বাংলো ছিল বনবিভাগের। উত্তর বাংলা ও অসমের সব বন-বাংলোই দোতলা। হাতিরই কারণে।
যমদুয়ার-এর বন-বাংলোর সামনে দিয়ে বয়ে গেছে সংকোশ নদী। মানাস অভয়ারণ্যর মানাস নদীর মতন অত বড়ো আর সুন্দর না হলেও সংকোশ রূপসি অবশ্যই। আর কোন জানোয়ার না ছিল সেখানে! হাতি, বাঘ, বুনো মোষ, চিতা, হরিণ, কতরকমের পাখি। ঘরেয়া নামের একরকমের মাছ পাওয়া যেত এই নদীতে। নাকি শুধুমাত্র এই নদীতেই! ছোটোমাছ। মানে, খুব বড়ো হলে সোয়া কেজি মতন। কালো রং। কিন্তু কী তেল তাতে! অমন স্বাদু মাছ বড়ো একটা খায়নি চখা। ধুবড়িতে ব্রহ্মপুত্রের চিতল আর মহাশোলও খেয়েছে। কী পেটি! আধ হাত চওড়া। আর মুইঠ্যাও।
ভুটান থেকে তখন শীতকালে কমলালেবু আসত ঝুড়ি ঝুড়ি। তখন তো সর্বত্রই পথ আর যানবাহন মানুষের অগ্রগতির নামে তার শান্তিকে এমন বিঘ্নিত করেনি! কমলালেবু ঝুড়িতে করে নিয়ে আসত ভুটানি মেয়েরা। তারপর গোরুর গাড়িতে করে আসত তামাহাটে। তামাহাটে কী না পাওয়া যেত তখন!
গঙ্গাধর নদী গিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। সেখানে অন্য নাম হয়েছে কি না বলতে পারবে না। সিরাজগঞ্জ থেকে দেশভাগের আগে বড়ো বড়ো মহাজনি নৌকা করে পাট আসত। পাটের জন্যেই তামাহাটের রমরমা ছিল। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির বার-বাড়িতে একটি করে গদিঘর, তার পেছনে গুদামঘর, তারও পরে নিভৃতিতে ভেতর-বাড়ি। অর্থাৎ অন্দরমহল। পাট কাঁচা হয়ে গেলে পাট গাঁট বেঁধে তোলা থাকত গদিঘরে। ব্লণ্ড, ব্রুনেট, কতরকমের মেমসাহেবদের চুলের মতন সেইসব পাটের রং ছিল। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরোত। গুদামঘরের পাশ দিয়ে যাতায়াতের সময়ে ওই গন্ধ নাকে আসতই।
অনেক উদবেড়াল ছিল গঙ্গাধর নদীতে। কড়িদা আর আবু ছাত্তারের সঙ্গে চখা শিকারে যেত, চখা চক্রবর্তী, পূর্ণ জ্যাঠার বন্দুক নিয়ে? আর সারাদুপুর উদবেড়ালদের খেলা দেখত। নদীর পাড়-এর অনেক ওপর থেকে জলে ঝাঁপ দিত তারা তাদের পাড়ের বালির মধ্যের বাসা থেকে। তারপর কখনো মুখে মাছ নিয়ে, কখনো-বা খালি মুখে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতাতে জল ছেড়ে ভিজে, মসৃণ, চকচকে শরীর নিয়ে উঠে যেত তাদের ঘরের দিকে খাড়া পাড় বেয়ে।
সোনালি চখা-চখি ডাকত গম্ভীরস্বরে লম্বা গলা তুলে কোঁয়াক কোঁয়াক করে নিস্তব্ধ দুপুরে। জলের ওপরে তাদের ডাক দৌড়ে যেত অনেকদূর। বালির সঙ্গে হাওয়া খেলা করত সহস্র হাতে। বালুবেলাতে শিশুরা যেমন খেলে। বালির ওপরে কত কী গড়ে তুলত সেই সৃজনশীল এবং খামখেয়ালি হাওয়া। পরমুহূর্তে ভেঙেও ফেলত। কত আকুবুকি, ডিজাইন বালির ওপরে। শুশুক ভেসে উঠত নৌকার পাশে হুসস করে। জলের ফোয়ারা তুলে শ্বাস নিয়ে আবার ডুবে যেত। নানা-রঙা মাছরাঙারা যেন কী সর্বনাশ হল তাদের, এমন করে বুকে চমক-তোলা ডাক ডেকে জলের সাদা, বালির সাদা, রোদের হলুদ এবং তাদের রঙ্গিবিরঙ্গি কবুর ডানাতে রং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার করে দিত, মাঝিরা দাঁড় ফেলত আর দাঁড় ওঠাত, ছপছপ শব্দ হত বিলম্বিত লয়ে। একই ছন্দে। ক্যাঁচোর-ক্যাঁচোর শব্দের পরেই একবার ঘটাং করে শব্দ হত। ঠোকাঠুকি হত নৌকোর সঙ্গে দাঁড়ের কাঠের। বুড়ো মাঝি দু-হাতে হুঁকো ধরে বসে থাকত হাল পা দিয়ে ধরে। নৌকা চলত কোনো বিশেষ গন্তব্যহীন জলপথে, শীতের মিষ্টি দুপুরে।
কী নিস্তরঙ্গ, শ্লথগতি, লোভ আর জাগতিক উচ্চাশাহীন ছিল সেইসব দিন। মানুষ বড়োলোক ছিল না কিন্তু সুখী ছিল। কত সামান্যতেই যে পরমসুখে হেসে-খেলে একটি জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়, তখন তা জানত গ্রাম-গঞ্জের মানুষে, তামাহাটের, ডিঙ্গডিঙ্গার, কুমারগঞ্জের, পাগলাহাটের, গৌরীপুরের এবং ধুবড়িরও। সত্যিই জানত।
টি ভি ছিল না, লাগাতার বিজ্ঞাপন সব মানুষেরই মনে হাজারও মিথ্যা প্রয়োজনের বোধ জন্ম দিয়ে তার মনের শান্তি এমন করে পুরোপুরি নষ্ট করেনি। আত্মীয় বা প্রতিবেশীর ভালোতে তখন মানুষ খুশি হত, মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দর বোধ ছিল। ঈশ্বর নামক কোনো এক আপাত-অলীক শক্তির অস্তিত্ব তাদের প্রত্যেককেই সততা এবং ন্যায়ের পথে চালিত করত।
কে জানে। অনেকগুলো বছর পরে তামাহাটে, ডিঙ্গডিঙ্গায়, কুমারগঞ্জে, গৌরীপুরে অথবা ধুবড়িতে গিয়ে কী দেখবে চখা?
ধুবড়ির বইমেলা উদবোধন করতে এসে ও কি ভুল করল?
ভাবছিল ও।