১-২. টিকলু

ঝাঁকি দর্শন – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

০১.

আমার নাম টিকলু।

জীবনে যারা সফল, আমি অনেকেরই মতো; তাদের দলের নই। পড়াশুনোয় আমি মাঝামাঝি ছিলাম। চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে যে, লক্ষ লক্ষ লোক পে-অর্ডার ভরে, অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম জমা দিয়ে এ দরজা থেকে ও দরজায় ঘুরে বেড়িয়ে যৌবনের জীবনীশক্তির প্রায় সবটাই অলক্ষ্যে ও নিঃশেষে খরচ করে ফেলে আমি তাদেরই একজন। আমার স্টেট ব্যাঙ্কে চাকরি হয়নি, হয়নি ইনকাম ট্যাক্সে। সরকারি, আধা-সরকারি এমনকী বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেও কোনো চাকরির মতো চাকরি আমার আজ অবধি হয়নি।

আমার বয়স প্রায় তিরিশ হতে চলল।

আমরা তিন ভাই এক বোন। দিদি বড়োেজামাইবাবু কৃতী পুরুষ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড়োচাকরি করেন তিনি, উর্দিপরা টুপি-চড়ানো ড্রাইভার তাঁর গাড়ি চালায়। দিদির একমাত্র কাজ শপিং করা। এবং দু-জনেরই কাজ আমি যে, একটা অপদার্থ, কুঁড়ে, হতভাগা এ সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করা।

আমার বড়োদাদা প্রায় আমার-ই মতো কুঁড়ে। আমি যে, কুঁড়ে– একথা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু এই কুঁড়েমিটা কিছু করতে চেয়েও কিছু করতে না পারার কারণে। অব্যবহৃত তানপুরার ওপরে যেমন পরতে পরতে ধুলো জমে, তেমনি করে পরতে পরতে আমার অস্তিত্বর ওপর কুঁড়েমি বসে গেছে। একদিন বা এক-শো বছরের চেষ্টাতেও সে-ধুলো, সে আস্তরণ আর উঠবে না।

আমি যদি তানপুরা হতাম, তবে দোকানে দিয়ে আমরা খোলনলচে বদলে, নতুন করে রং করে, মরচে-পড়া তার-টার সব বদলে নিলে আমি হয়তো আবার কোনো সুন্দর সুর-সোহাগি আঙুলে দারুণ বাজতাম। কিন্তু আমি যে, একজন মানুষ। আমার খোলনলচে বদলাবার, নিজেকে নতুন করে রং বা বার্নিশ করার উপায় নেই কোনো।

বাবা অবস্থাপন্ন ছিলেন। ছেলেবেলায় বড়োলোকির মধ্যে মানুষ হয়েছিলাম। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আমরা গরিব। বাবার অন্য অনেক ব্যাবসার মধ্যে একটা চা-এর দোকান ছিল, ভালো রাস্তায়, ভালো পাড়ায়; দাদা সেই দোকানে সকাল-বিকেল যায়–দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোয়। দোকানদারিতে যে, ব্যবহারের চাকচিক্য লাগে ও সদাসর্বদা জাগ্রত দৃষ্টির দরকার হয় আমার ঘুমকাতুরে দাদার তার কিছুই ছিল না।

আমার বউদি খুব ভালো। সুন্দরী, সুরচিসম্পন্না; ভারি ভালো মেয়ে। আমার দাদার হাতে পড়ে বউদির বড়োই হেনস্থা। তার কোনো শখ-ই এ জীবনে পূরণ হয়নি। হবে না। আমার বউদির সঙ্গে আমার একটা বাবদে মিল ছিল। রুচির বাবদে। চরিত্রের নরম দিকটার বাবদে। ফলে, ভ্যাগাবণ্ড আমি ও আমার বউদির মধ্যে কখন যে, অনবধানে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল; একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি, সমবেদনা সব মিলেমিশে কবে কখন কোন মুহূর্তে যে, বউদিকে আমি এবং বউদি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ও ভালোবেসেছিল তা আমরা কেউ-ই বুঝতে পারিনি।

আমাদের পরিবারে আমার ছোটোভাই একমাত্র তালেবর। সে বিদেশি কোম্পানিতে একটা মোটামুটি চাকরি করত, ছেলেবেলা থেকেই ফটফট করে ইংরিজি বলত, ইংরিজি গান গাইত। আমাদের পরিবারের সেই কর্তা ছিল বলতে গেলে।

আমার সঙ্গে বউদির সম্পর্কটা আত্মীয়স্বজন সকলেই জানতেন–কিন্তু বেচারি-বউদি ও হতভাগা-আমি জীবনের আর সমস্তক্ষেত্রে এমন-ই বঞ্চিত ছিলাম যে, আমাদের একে অন্যের কাছে থেকে এই সামান্য প্রাপ্তিতে কেউই আপত্তি করত না। দাদার মানসিকতায় ভালোবাসা, শখ, রুচি এইসমস্ত ব্যাপারগুলোই সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। তাই আমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো মস্তিষ্ক ও হৃদয় কোনোটাই তার ছিল না। দিনে-রাতে চোদ্দো ঘণ্টা ঘুম এবং খাওয়ার সময় খাওয়া পেলেই সে সুখী ছিল। জীবনে ডাল-ভাত শাড়ি-শায়া ছাড়াও যে, বেঁচে থাকতে হলে একজন নারীর অন্যকিছুর প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন থাকে; তা বোঝার মতো ক্ষমতা দাদার ছিল না।

মনে হয়, বোঝার ইচ্ছেও ছিল না।

বউদির ছেলে-পিলে হয়নি। ডাক্তাররা বলেছেন, হবেও না। তাই আমার ওপরে বউদির মনের অপত্য স্নেহ ও প্রেম সমস্তই বড়ো নরমভাবে বর্ষিত হত। আমার জীবনে বউদিই একমাত্র আনন্দ ছিল।

যখন-ই মাঝেমধ্যে একমাস দু-মাসের জন্যে কোনো একটা কাজ পেতাম–যে-কাজকে অ্যান অ্যাপলজি ফর আ জব বলাই ভালো–সেই টাকা দিয়ে বউদিকে শাড়ি কিনে দিতাম। কোনো হুহু-হাওয়া গরমের সন্ধেয় হয়তো বউদির জন্যে এক প্যাকেট ধূপকাঠি বা একগোছা রজনিগন্ধা নিয়ে আসতাম।

আমার কাছ থেকে বউদির কোনো দাবি ছিল না, আশাও না। আমারও একটু সমবেদনা বা ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই পাওনা ছিল না বউদির কাছ থেকে। আমাদের সম্পর্কটা আশ্চর্যরকম পবিত্র ছিল, যদিও তা যেকোনো মুহূর্তে অপবিত্র হতে পারত। হতে পারত, অথচ হয়নি বলেই যেন, সেই সম্পর্কের একটা আলাদা দাম ছিল, মোহ ছিল আমাদের দু জনেরই কাছে।

শরীর বড়োস্থূল। শরীর এসে পড়লেই বোধ হয় অধিকাংশক্ষেত্রে ভালোবাসার সূক্ষ্মতা মরে যায়। বউদির যে, কিছু অদেয় ছিল আমাকে এমন নয়। কিন্তু সে-কথা দু-জনেই মনে মনে জানতাম বলেই হয়তো কেউই তা পাওয়ার বা দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করিনি।

আমার তালেবর ছোটোভাইয়ের বিয়ে হল এক বড়োলোকের মেয়ের সঙ্গে। তার বিয়ের পর-ই আমার ভাদ্র-বউ, ভ্যাগাবণ্ড ভাসুরঠাকুর ও তার বউদির মধ্যে এমন ভাবটা ভালো চোখে দেখল না। নানারকম কথা উঠতে লাগল। সেই থেকেই, নিজের ও বউদির দুজনের সম্মানের জন্যেই আমি কলকাতার বাইরে বাইরে কাটাতে লাগলাম। যেকোনো একটা কাজ পেলেই তা নিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসতাম বাইরে। কানাঘুসো থেকেও বাঁচতাম; আবার অনেক অনেক দিন পর, বাইরে থেকে ফিরে এসে, বউদির সঙ্গ, বউদিকে দেখতে পেয়ে খুব ভালোও লাগত।

পাটনায় কাটালাম কিছুদিন। শিলিগুড়ি, মাল, কৃষ্ণনগর-বাঁকুড়া, যেকোনো কাজে যে কেউর ডাকে অমনি চলে যেতাম, যেকোনো মাইনেয়! এমনকী বেগার খাটতেও!

সবে বাঁকুড়া থেকে ফিরেছি দিনকয় হল, এমন সময় আমার মামাতো ভাই শশী একদিন এসে হাজির।

শশীর চেহারাটা খুব সুন্দর ছিল। আমার বড়োমামা একসময় কলকাতার শীর্ষস্থানীয় ক্লাবের হর্তাকর্তা ছিলেন, তারপর ফুটানির অনেক ফোটো ও বাড়ি মর্টগেজ রেখে তিনি মারা যান। শশী তার পিতৃবন্ধুদের ধরে সেই ক্লাবেই স্টুয়ার্ডের চাকরি পায় সুন্দর চেহারার গুণে। আমরা দু-জনে একসঙ্গে পড়তাম। শশী আমাকে খুব পছন্দ করত। ও সিরিয়াসলি নানারকম চাকরির চেষ্টা করত আমার জন্যে।

শশী একদিন সকালে এসে বলল, তোর একটা দারুণ চাকরি ঠিক করেছি তোকে আইডিয়ালি স্যুট করবে।

–কীসের চাকরি?

সন্দিগ্ধ গলায় শুধোলাম আমি।

কারণ এর আগে অনেক চাকরি-চাকরি খেলা খেলোম, পঞ্চাশ-একশো টাকা মাইনেতেও–। কিন্তু হয় মাইনে কম, নয় মালিক মনোমতো নয়, নয়তো নিজের কুঁড়েমির জন্যে কোনো চাকরিও টেকাতে পারলাম না। আমার কুষ্টিতে কোথাও স্থির হয়ে বসা লেখা ছিল না।

আমি কিছু বলার আগেই শশী বলল, এমন মালিক পাবি না। একেবারে রাজা লোক। অংশুমান মিত্তিরকে কলকাতায় সবাই চেনে। সকলে ডাকে স্যার এ এম।

–স্যার মানে? নাইটেড নাকি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 তারপর বললাম, বাহাত্তুরে বুড়ো বুঝি? পুরোনো স্যারেরা কি আজও আছেন? ভারতীয় গন্ডারের মতো তাঁরাও তো নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

শশী একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, আরে না, না, স্যার ঠাট্টা করে বলে লোকে। বয়স কত হবে? বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। কিন্তু এমন সত্যি ঠাট্টা আর হয় না। ক্লাবে তো কত অ্যান্টিক হয়ে-যাওয়া রাজা-মহারাজা,রায়-সাহেব, রায়-বাহাদুর দেখি, কিন্তু এমন দিলদার লোক আর কখনো দেখিনি।

আমি বললাম, লোকে বলে, বড়োমামাও এমনিই দিলদার ছিলেন।

শশী সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে আমাকে তার চোখের চাবুক মেরে বলল, ছিলেন। কিন্তু দিলদারি করতে গিয়ে গুচ্ছের ছেলে-মেয়েকে পথের ভিখিরি করে রেখে স্বর্গে যান তিনি। স্যার এ এম-এর সঙ্গে আমার স্বৰ্গত পিতৃদেবের তফাত এইটুকুই।

আমি শুধোলাম, চাকরিটা কীসের?

 শশী চোখে-মুখে উৎসাহ ঝরিয়ে বলল, হাউসকিপিং-ম্যানেজারের।

অবাক হয়ে শুধোলাম, সেটা আবার কী?

–মানে বুঝলি না? মানে ঘর-গেরস্থালি দেখাশোনার চাকরি। কলকাতায় নয়, সাঁওতাল পরগনায়।

আমি তখনও ভাবছিলাম।

বললাম, অংশুমান মিত্তিরের স্ত্রী নেই?

-থাকবেন না কেন?

জোরের সঙ্গে বলল শশী।

তারপর বলল, নিশ্চয়ই ওঁর ঘর-গেরস্থালির ব্যাপারটা এমন-ই কমপ্লিকেটেড যে, মেমসাহেবের পক্ষে এটা সেটা ম্যানেজ করে ওঠা মুশকিল।

যাই-ই হোক আজ সন্ধে সাতটার সময় সাহেবের সঙ্গে তোর অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। তোকে সাড়ে ছটায় নিয়ে যাব। আজ আমার অফ-ডে। তৈরি হয়ে থাকিস কিন্তু।

এই অবধি বলে, সিগারেটটা শেষ করেই শশী বলল, এবার পালাই, নমিতার সঙ্গে দুপুরে সিনেমা যাব।

আমি হাসলাম। বললাম এবার শাঁখা-সিঁদুর লাগা। কতদিন আর ছুপকে-ছুপকে চালাবি?

শশী বলল, শাঁখা-সিঁদুর লাগালেই তো থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড়। যতদিন ছুপকে-ছুপকে চলে, ততদিন-ই তো মজা। আমি বাবা ছুপা-রুস্তম-ই থাকতে চাই– যে-ক দিন পারি।

শশী ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় ওর স্কুটার নিয়ে এসে হাজির।

আমিও তৈরি ছিলাম। শশী স্যুট পরতে মানা করেছিল। বেঁচে গেলাম। ইন্টারভর জন্যে সেজোকাকার কাছ থেকে চেয়ে-আনা, পুরোনো একটা স্যুট অল্টার-টল্টার করে নিয়ে ইস্ত্রি করিয়ে রাখতাম। কিন্তু এই পুরোনো স্যুটটাও বোধ হয় সেজোকাকা ভালো মনে দেননি। এ স্যুট পরে গিয়ে একটা চাকরিও আমার এপর্যন্ত হয়নি। তাই স্যুটটা পরতে হবে না জেনে আশ্বস্ত হলাম।

শশীর স্কুটার মে-ফেয়ারে একটা বিরাট মালটি-স্টোরিড বাড়ির সামনে গিয়ে থামল।

স্কুটারটা পার্ক করিয়ে, ঘড়ি দেখে নিল শশী একবার। একেবারে রাইট-অন-টাইমে। তারপর লিফটের সামনে গিয়ে বোতাম টিপল।

লিফটটা নামতে-না-নামতে, আমাদের পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলেন, একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় এসেছ দেখছি।

পাশে তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি।

গ্রেগরি পেক কবে থেকে বাংলা শিখলেন?

অপলকে তাকিয়ে রইলাম–ভদ্রলোকের দিকে। হুবহু গ্রেগরি পেকের মতো দেখতে এমনকী চুলটা পর্যন্ত–শুধু গায়ের রংটা অতখানি ফর্সা নয়। সাড়ে ছ-ফুট লম্বা। এমন বাঙালি তো আগে দেখিনি।

ভদ্রলোককে দেখেই, শশী হাতজোড় করে নমস্কার করে নিল, এই আমার ভাই স্যার!

স্যার এ.এম, প্রতিনমস্কার করলেন আমার নমস্কারে।

ইতিমধ্যে লিফট এসে গেল। লিফটে উঠে দশতলায় পৌঁছোলাম।

দশতলায় পৌঁছে সাহেব নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে বেল টিপলেন।

বেয়ারা এসে দরজা খুলল–পেছন-পেছন বাঘের মতো দেখতে একটা ফিকে-হলুদ অ্যালসেশিয়ান কুকুর।

টাইয়ের নটটা ঢিলে করে কোটটা বেয়ারার হাতে দিয়ে সাহেব বললেন, বলো শশী।

শশী ও আমি দাঁড়িয়েছিলাম।

 সাহেব বললেন, বোসো বোসো। কী খাবে বলো? গরম না ঠাণ্ডা?

 শশী বলল, ঠাণ্ডা।

 সাহেব বেয়ারাকে বললেন, বউরানিকে খবর দে, কোকাকোলা মিষ্টি সব নিয়ে আয়।

তারপর বউরানি আসার আগে সাহেব আমার দিকে চেয়ে বললেন, কাজটা কী শুনেছ তো?

ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাস আছে পুরোপুরি বিধান রায়ের মতো–অচেনা লোককে তুমি বলতে একটুও আটকায় না এবং এমনভাবে তা বলেন যে, যাকে বলা হল তার কিছু মনে করারও থাকে না।

আমি বললাম, পুরোটা শুনিনি।

-তবে শোনো।

বলেই, সাহেব বললেন, ঝোলে-ঝালে-অম্বলে সবকিছু করতে হবে। দরকার হলে মালও বইতে হবে। কখনো-কখনো সারারাত কাজ করতে হবে। একসঙ্গে আটচল্লিশ ঘণ্টা ননস্টপও কাজ করতে হতে পারে যখন আমার গেস্ট-টেস্ট থাকবেন। যখন কাজ থাকবে না, তখন ঘুমোতে পারো। মানে নিয়মকানুন কিছু নেই। য্যায়সা কাজ ত্যায়সা ডিউটি। তোমাকে কতগুলো দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হবে–কেউ খবরদারি করবে না তোমার ওপর–এক বউরানি ছাড়া। নিজের দায়িত্ব বুঝে সব কাজ নিজেকে করতে হবে–নিজের ইনিসিয়েটিভে।

মাথা নাড়ছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম, কাজের ফিরিস্তি তো শুনছি, এখন মাইনের কথাটা শুনি। এরকম বড়ো বড়ো সাহেব আমি এপর্যন্ত অনেক দেখেছি। কাজের বেলা শোলে আর মাইনের বেলা অ্যাড-শর্টস।

আমার চোখের ভাষা হয়তো সাহেব বুঝে থাকবেন। ভদ্রলোককে দেখেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলে মনে হল।

সাহেব বললেন, পাঁচশো টাকা মাইনে পাবে–তার সঙ্গে খাওয়া পাবে, থাকার কোয়ার্টাস। মাসে তিনদিনের জন্যে কলকাতায় আসার ছুটি পাবে। ট্যাঁ-ফো করলে চলবে না, কোনো অজুহাত চলবে না। খাটতে পারবে কি না ভালো করে চিন্তা করে নিয়ে জানিয়ো। কাজের বেলা কোনো ফাঁকি বরদাস্ত করব না আমি।

খাওয়া-দাওয়া সমেত পাঁচ-শো টাকা আমার কাছে অনেক টাকা কিন্তু আমি বাঙালির ছেলে–খাটনিটা জোর হলে আমার একটু অসুবিধে। হালকা খাটুনি, ফাঁকি মারার সুযোগ বেশি অথচ মাইনে ভালো এমনি চাকরি হলে আমার পোয় কিন্তু ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্বটা এমন-ই ও মাইনের অঙ্কটা এতই লোভের যে, বার বার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানানো ছাড়া তখন আমার আর কিছুই করণীয় রইল না।

এমন সময় বউরানি এলেন। বউরানির মতোই দেখতে। চাঁপাফুলের রং যেন ফুটে বেরোচ্ছে। মুখে একটি প্রশান্ত অথচ ভাবিত ভাব। খুব আস্তে কথা বলেন, আস্তে হাঁটেন, নরম করে তাকান। রানির মতোই নরম মোম-মোম। একটু মোটার দিকে চেহারা।

বউরানি আসতেই স্যার এ. এম বললেন, এই যে ভ্রমর, তোমাকে যে ছেলেটির কথা বলেছিলাম, এই-ই সেই শশী–আর শশীর কাজিন–হ্যাঁ, তোমার নাম কী যেন?

আমি বললাম, যবন-দমন দত্ত।

বড্ড বড়োনাম। সাহেব বললেন।

তারপর বললেন, বাড়ির নাম কী?

 টিকলু। বললাম আমি।

ফার্স্ট-ক্লাস। সাহেব বললেন।

তারপর বউরানির দিকে চেয়ে আমার সামনেই বললেন, পছন্দ ভ্রমর?

বউরানি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন।

সাহেব বললেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওখানে গিয়ে পৌঁছেলেই কাজকর্ম–মানে জুতো-সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব-ই একে একে শিখে নেবে। আরও অনেক লোকজন আছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর বললেন, ভালো করে কাজ করে আমরা বাঙালিরা যে কুঁড়ে ফাঁকিবাজ, এই অপবাদটা ঘুচাও তো দেখি সকলে মিলে।

আমি চুপ করে রইলাম।

তারপর কোকাকোলা আর মিষ্টি খেয়ে আমরা যখন উঠলাম, তখন সাহেব বললেন, আগামী শুক্রবার রাতে এখান থেকে রওনা হবে। রাত দশটা পনেরোতে গাড়ি। হাওড়া থেকে। আমিও ওই গাড়িতেই যাব। আর যা কথা হওয়ার তা ওখানেই হবে। তোমার টিকিট আমি শশীর হাতে দিয়ে দেব। মঙ্গল বুধের মধ্যেই, ক্লাবে।

তারপর বললেন, ঠিক আছে?

–হ্যাঁ স্যার।

 নমস্কার করে বললাম আমি। তারপর বউরানিকে নমস্কার করলাম।

শশী বলল, চললাম স্যার।

এসো। বলেই, সাহেব ভেতরে চলে গেলেন জামাকাপড় ছাড়তে।

লিফটে শশী বলল, কেমন বুঝলি?

-কাজটা খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।

শশী বলল, তোর বসকে আমি চিনি। তোর ঝামেলা বসকে নিয়ে হবে না; হবে বউরানিকে নিয়ে।

আমি চমকে উঠে বললাম, কেন একথা বলছিস?

শশী বলল, একে রাজার মেয়ে, রাজার স্ত্রী, তার ওপর কেমন মুডি-মুডি দেখলি না। ওঁর মন বুঝে চলতে পারলেই তোর চাকরি খায় কোন শালা। কিন্তু আমরা চাষাভুসো লোক; রাজা-রাজড়াদের মুড বোঝা মুশকিল।

দেখাই যাক। বললাম আমি।

শশী বলল, জয় সাঁইরাম।

ইদানীং শশী এবং মামাবাড়ির সকলে সাঁইবাবার খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। ওর চাকরিতে উন্নতি হয়েছে, নমিতার সঙ্গে প্রেম গাঢ় হয়েছে, ওদের বাড়িতে মাসিমার ঘরে সাঁইবাবার ফোটোর ওপর বিভূতি জমেছে।

আমিও সঙ্গে সঙ্গে বললাম, জয় সাঁইরাম।

 চাকরিটা এ যাত্রা টিকে গেলে সাঁইবাবার দয়াতে টিকবে–ভাবলাম আমি।

.

০২.

সবে পুব আকাশে আলোর রেখা ফুটেছে। চারদিক দেখা যায়। কিন্তু সূর্য ওঠেনি। এমন সময় মিথিলা এক্সপ্রেস ট্রেনটা স্টেশনটাতে ঢুকল।

থ্রি-টায়ারের ওপরতলা থেকে রবারের বালিশটা ফাঁপিয়ে নিয়ে, সুজনি সমেত সড়াৎ করে নেমে এলাম। তারপর সুটকেসের মধ্যে ফেঁসে-যাওয়া বালিশ ও সুজনি পুরে নিয়ে, সুটকেসটা হাতে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম।

তাকিয়ে দেখি, ফার্স্টক্লাসের সামনে গন্ধমাদন পর্বত নেমেছে। বিরাট-বিরাট চ্যাপটা করে ভাঁজ করে রাখা পিচবোর্ডের প্যাকিং বক্স, টিউব লাইট, বাক্স, প্যাঁটরা, পোঁটলা-পুটলি, সাহেব, মেমসাহেব এবং আরও একটি দম্পতি।

এমন মালিকের চাকরি করে আরাম। ভিড়ের মধ্যেও এ মালিক কখনো হারিয়ে যাওয়ার নয়। লক্ষ লোকের মধ্যেও সাহেবের সাড়ে ছ-ফিট চেহারা সকলের মাথা ছাড়িয়ে থাকবে।

কুলির প্রসেশানের পেছনে পেছনে ওভারব্রিজ পেরিয়ে দেখি একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি, একটা স্কুটার-টেম্পো এবং টাঙার সারি দাঁড়িয়ে।

সাহেব একজন রোগা-সোগা কালো-কালো ভদ্রলোককে ডাকছিলেন, ভজন, ভজন বলে। বোঝা গেল, সেই ভজনবাবু মালপত্র তদারকি করে সামলে-সুমলে নিয়ে আসবেন।

সাহেবরা আগেই চলে গেলেন গাড়িতে যাওয়ার আগে ভজনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে গেলেন সাহেব।

বললেন, এর নাম টিকলু। আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট।

 স্কুটার-টেম্পো এবং টাঙাবাহিনী আগে রওনা করিয়ে দিয়ে শেষের টাঙায় আমাকে নিয়ে ভজনবাবু উঠলেন।

টাঙা ছাড়তেই বললেন, সামনের দিকে চোখ রাখবেন একটু–টাঙাগুলো মাল ছড়াতে ছড়াতে যাবে–প্রতিবারই এমন-ই হয়। আর আমরা সেগুলো কুড়োতে কুড়োতে যাব। সেজন্যেই আমাদের টাঙায় মাল বলতে আমরা শুধু দু-জনই আছি।

বলেই, পকেট থেকে নস্যির ডিবে বের করে একটিপ নস্যি নিলেন।

বললেন, বে-শাদি হয়েছে?

-আজ্ঞে না।

 –তবে তো মুশকিলে ফেললেন। দেখবেন, পানুই-এর ক্যাজুয়ালটি হবেন না আবার।

–আজ্ঞে?

আমি না বুঝতে পেরে শুধোলাম।

ভজনবাবু উত্তর দিলেন না।

টাঙা একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, ভজনবাবু বললেন, জিলিপি-শিঙাড়া

খাবেন। গরম-গরম ভাজছে।

বলেই, টাঙা থেকে একলাফে নেমে গিয়ে একঠোঙা জিলিপি-শিঙাড়া নিয়ে এলেন।

আমার সামনে ধরে বললেন, খান।

বললাম, মুখ ধুইনি।

ধমক দিয়ে ভজনবাবু বললেন, থামুন তো মশাই। জীবনে কখনো কি মুখ না ধুয়ে কিছু খাননি? যা-কিছু খেয়েছেন, সব-ই মুখ ধুয়ে? খান, খান, এমন স্বাদের জিলিপি-শিঙাড়া হয় না আর।

–ভজনবাবু আমার ইমিডিয়েট বস। কিছু কথাবার্তা বলতে হয়–তাই-ই বললাম, আপনি কি এখানে অনেকদিন?

-ইয়েস। জন্ম থেকে।

সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন ভজনবাবু।

আমি আবার শুধোলাম, পরিবার-টরিবার এখানেই?

-ইয়েস। ঝামেলা এড়াবার জন্যে আমি ডি-অ-এস বিয়ে করেছি।

-মানে?

জিলিপি-মুখে আমি বোকার মতো শুধোলাম।

ভজনবাবু বললেন, ইয়েস, ডটার অব দ্য সয়েল। আমি সাঁওতাল মেয়ে বিয়ে করেছি। থার্ড ওয়াইফ। ফাস্টক্লাস আছি মশাই। আমার বিধবা মা আমার কাছে এসে রয়েছেন, আমার ওয়াইফ তাঁর যা সেবাযত্ন করছে তা দেখলে বামুনের মেয়ে ভিরমি খাবে।

বলেই, বললেন, আজকাল অবশ্য শহরের শিক্ষিত লোকেদের ঘরেই এসব উঠে গেছে বরং গ্রামের লোক, উপজাতিদের মধ্যে এখনও ভালোটুকু আছে।

আমি শুধোলাম, ছেলে-পেলে?

–নান। ভবিষ্যতে মে বি।

তারপর জিলিপি খেতে খেতে শুধোলেন, আমাদের সাহেবকে কতদিন জানেন?

বললাম, পাঁচদিন আগে পাঁচ মিনিটের জন্যে প্রথম দেখা।

এ্যাই সেরেছে। বললেন, ভজনবাবু।

তারপর বললেন, কোথায় কাজ করতে এয়েছেন জানেন কি?

আজ্ঞে না। আমি বললাম।

তারপর ভয় পাওয়া গলায় বললাম, ভালো করিনি?

-মোটেই না মশায়। পাগল হয়ে যাবেন, বে-থা করেননি, এখনও খাদ্য-খাদক ভূত ভবিষ্যৎ আছে, পাগলের পাল্লায় পড়ে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবেন। এ তো একটা পাগলাগারদ। এই ভজন ভড় বলেই কোনোক্রমে টিকে রয়েছে এখানে।

ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, কেন, উনি কি পাগল নাকি?

–সার্টেনলি ইয়েস। কোনো সন্দেহই নেই তাতে। আমি যে এখনও পাগল হইনি, তার কারণ আমার বাবা পাগল ছিলেন। আমারও পাগল হওয়ার কথা ছিল। পাগলে-পাগলে কাটাকুটি হয়ে গিয়ে আমি বেঁচে গেছি। কিন্তু আপনার বাঁচার কোনোই চান্স নেই।

টাঙাটা একটা লেভেল ক্রশিং পেরোল।

 ভজনবাবু তারস্বরে চেঁচালেন, ওরে ও জংলি, সামান গিড় গিয়া।

সামনের টাঙা থেকে একটা পুটলি গড়িয়ে রেললাইনের ওপর পড়েছিল। জংলি নামক একটি খোঁড়া ছেলে খুঁড়িয়ে নেমে সেটাকে উদ্ধার করে আবার যথাস্থানে রাখল।

রেললাইনটা পেরোলে পর আমি বললাম, আচ্ছা! আমার কাজটা কী?

ভজনবাবু প্রচন্ড শক পেলেন।

বললেন, কাজটা কি এখনও জানেন না? আজব লোক মশায় আপনি।

তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি কি জানেন যে,সাহেবের একটি চিড়িয়াখানা আছে। তাতে নেই, এ হেন জানোয়ার, পাখি নেই। গ্রিনহাউস আছে–তাতে রকমারি গাছগাছালি। ডেয়ারি আছে, পোলট্রি আছে। সে-পোলট্রিতে দিনে দু-হাজার ডিম হয়। সাহেবের নিজের বাড়ির মধ্যে আবার জাপানি-বাড়ি, হাওয়াইয়ান বাড়ি, কামাচ কাটকান-বাড়ি, শান্তিনিকেতনি বাড়ি আছে। গাছে গাছে হ্যামক আছে, গাছে চড়ে জিরোবার জায়গা আছে, আফ্রিকায় চিতাবাঘেরা যেমন জিরোয়। ব্যাপার-স্যাপার দেখে আপনার জামগাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যেতে ইচ্ছা হবে। আর লোকজন? প্রায় জনা তিরিশ লোক কাজ-ই করে এই কুরুক্ষেত্রে। তাও একটি চিড়িয়াখানা।

আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। হাউসকিপিং ম্যানেজারের যে, চিড়িয়াখানার ম্যানেজারি করতে হবে, তা ঘুণাক্ষরেও জানা যায়নি। এ আমার কী সর্বনাশ করল শশী!

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, তাহলে তো সর্বনাশ হল!

জিলিপির ঠোঙাটা সজোরে ছুঁড়ে ফেলে ভজনবাবু বললেন, ইয়েস। সার্টেনলি। এতবড়ো। সর্বনাশ যেন কারোর-ই না হয়।

কিছুক্ষণ বাদে টাঙার প্রসেশন একটি বন্ধ লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।

দেখলাম হিন্দিতে লেখা আছে চিড়িয়াখানা শনিচ্চর ঔর এতোয়ার কি দিন বন্ধ রহেগি।

 ভজনবাবু টাঙা থেকে লাফিয়ে নেমে চিৎকার করতে লাগলেন, রামস্বরূপ গেট খোলো; গেট খোলো।

লম্বা-চওড়া এক গ্লুফো দারোয়ান এসে ঠেট হিন্দিতে শুধোল, গেটপাস?

ভজনবাবু বললেন, তুমহারি গুষ্টিনাশ। সাহাবকা সামান লে আয়া হ্যায়, হামকা শ্বশুরাল মে ঘুষতা হ্যায়? জলদি খোল গেট।

আমি অবাক গলায় বলাম, গেট-পাস কীসের?

-আরে গেট দিয়ে মোরগা, আণ্ডা, মায় গোরু-বাছুর অবধি হাওয়া হয়ে যাচ্ছিল, সাহেবের পেয়ারের লোকেরাই করছিল। তারপর একবার রাস্তার ষাঁড়েরা প্রসেশান করে ঢুকে পড়েছিল।

আমি অবাক হয়ে শুধোলাম, কেন?

ভজনবাবু বললেন, আরে এখানে লাল লাল বিলিতি মেমসাহেব গোরু আছে কত্ত ডেয়ারিতে! তবে? বিপত্তি কি একটা? তাই সাহেব এই ব্যবস্থা করেছেন। যতবার ঢুকবে বেরুবে ততবার-ই গেটপাস। এ ব্যাটা দারোয়ান অবশ্য নতুন, এখনও ভজন ভড়ের স্ট্যাটাস সম্বন্ধে জ্ঞান হয়নি।

ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমি তক্ষুনি মনস্থির করে ফেললাম, এই যে ঢুকলাম, আর বেরুচ্ছি না।

গেট খুলতেই, সামান নামিয়ে নেওয়া হল। ভাড়াগাড়ির ভেতরে ঢোকা নিষেধ। গেটে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম যে, এ একটা যে-সে জায়গা নয়। লাল মোরামের পথ চলে গেছে অনেক দূরে-ভেতরে। দু-পাশে কত যে গাছ, কত যে লতা, কত পাথরের মূর্তি, কাঠের কাজ, গাছে-গাছে বাতি ঝুলছে, পথের দু-পাশে–সবুজ বালব লাগানো আছে তাতে।

দূর থেকে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। সামনের দিকে রঙিন টাইল বসিয়ে ফ্রেসকো করা হয়েছে।–। বাড়ির মাথায় লাল খাপরার সুন্দর ডিজাইন। সৌন্দর্যবোধ ও সুরুচির ছাপ চারদিকে পরিপুষ্ট।

চোখ জুড়িয়ে গেল।

আস্তে আস্তে ভেতরে এগিয়ে গেলাম।

বাড়ির কাছে আসতেই দেখি মেমসাহেব ইতিমধ্যে একপাল দেহাতি ছেলে নিয়ে পাঠশালা বসিয়েছেন। গোলাকৃতি মার্বেলের টেবিলে আমগাছের ছায়ায়–চতুর্দিকে বসার বেতের চেয়ার–তাতে নানারঙা গদি আঁটা।

মেমসাহেব বলছেন, বোলো, অ। বোলো আ। বোল্লো বাচ্চে।

পড়াশুনা এগোতে-না-এগোতেই দেখি বালতি করে একজন লোক গরম দুধ আর ডিমসেদ্ধ এনে ছেলেগুলোকে খাওয়াতে আরম্ভ করল।

তারা ডিমসেদ্ধ-ভরা মুখে গবগবে গলায় বলতে লাগল, অ, আ। ডিমের হলুদ-কুসুম লাগা দাঁত বের করে বলল, ই-ই।

এমন সময় সাহেবের গলা শোনা গেল।

বাড়ির সামনে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে। ঝোলানো টবে-টবে অর্কিড ঝুলছে। তার সামনে মিউজিক্যাল টাইম। বাজনা। হাওয়ায় দোলাদুলি করে টুংটাং শব্দ হয়। সেই বাজনাগুলো সারি করে লাগানো আছে।

সাহেব বলছেন, মধ্যের অতগুলো বাজনা কোথায় গেল?

ভজনবাবু স্মার্টলি উত্তর দিলেন, চুরি হয়ে গেছে সাহেব।

সাহেব বললেন, নাইটগার্ড কী করছিল?

ভজনবাবু বললেন, সে তো নিজেকেই নিজে ধমকে বেড়ায় সারারাত। চোরেরা তার ধমক শুনলে তো! তা ছাড়া, চুরি নাইটে হয়নি স্যার ডে-তে হয়েছে। কিন্তু চোর ধরা পড়েছে। রোহিণী বস্তির দুটো ছেলে। তাদের ধরে রামস্বরূপ গাছে বেঁধে রেখেছে। কাল-ই বিকেলে ধরা পড়েছে।

সাহেব বললেন, কখন থেকে বেঁধে রেখেছে?

কাল বিকেল থেকে।

কী অন্যায়। কী অন্যায়। সাহেব বললেন।

তারপর বারান্দার সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, এখুনি তাদের নিয়ে এসো, দুধ খাওয়াও। আহা! বেচারিদের এমন করে কষ্ট দেয়?

সাহেবের গলার স্বরে চুরির দায়ে ধরা-পড়া বজ্রসেনের প্রতি শ্যামার যে দরদ, সেই দরদ ই যেন ঝরে পড়ল।

আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়েছিলাম।

সাহেব ডাকলেন, মেহবুব, মেহবুব।

একটি অল্পবয়সি ছেলে আমার চেয়ে অনেক ভালো পোশাক পরে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। ছেলেটি খুব স্মার্ট। পরে জেনেছিলাম, সাহেবের খাস বেয়ারা।

সাহেব বললেন, মেহবুব, চোররা কোথায়? নিয়ে এসো।

পরক্ষণেই আমাকে বললেন, টিকলু যাও তো ভাইডি, মেহবুবের সঙ্গে নিয়ে চোরদের নিয়ে এসো।

মেহবুবের পেছন-পেছন গিয়ে দেখি ইউক্যালিপটাস গাছের গুঁড়িতে বাঁধা দুটি বছর বারো- তেরোর ছেলে মাথা নুইয়ে আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় লেপটে আছে গাছের সঙ্গে।

দড়ি খুলে আমি ও মেহবুব যখন সাহেবের কাছে তাদের নিয়ে এলাম, তখন সাহেবের রাগ কে দেখে? চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন উনি।

বললেন, এক্ষুনি এদের দুধ খাওয়াও।

তারপর মেমসাহেবকে বললেন, ভ্রমর, এদের একটু ওমলেট আর টোস্ট করে দিতে বলো রামকে।

মেমসাহেব সাহেবের মুখের দিকে একবার অপাঙ্গে চেয়ে, পড়ুয়াদের ছেড়ে উঠে গেলেন ভেতরে।

দুধ এবং খাবার খাইয়ে চোরদের গায়ে জোর করিয়ে নেওয়ার পর সাহেব বললেন, ভাই, কাজটা কি তোমরা ভালো করলে? চুরিই যদি করলে তো সবগুলো বাজনাই চুরি করলে না কেন? অর্ধেক নিয়ে গেলে, তোমাদের বাড়িতেও ভালো বাজবে না, আমার বাড়িতেও তাই। তার চেয়ে বাকিগুলোও খুলে দিচ্ছি, নিয়ে যাও। নয়তো যেগুলো নিয়ে গেছ, সেগুলো ফেরত দিয়ে দাও আমাকে। বাজনা বাজা নিয়ে কথা–তোমাদের ঘরেই বাজুক, কী আমার ঘরেই বাজুক, ভালো করে বাজবে তো?

চোরেদের মধ্যে একটি ছেলে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটতে-খুঁটতে বলল, বাজনা শোনার জন্যে আমরা চুরি করিনি–টাকার জন্যে করেছিলাম। গাঁয়ের এক দোকানে দশ টাকা দিয়ে ওগুলোবেচে দিয়েছি।

–টাকা দিয়ে কী করলে?

-খেলাম সাহেব। বাড়িতে বাবা-মায়ের বেমার। নোকরি-ধান্দা নেই। তাই চুরি করেছিলাম।

সাহেব ডাকলেন, ভজন।

 ভজনবাবু এগিয়ে এলেন।

সাহেব বললেন, এক্ষুনি পনেরা টাকা দিয়ে কাউকে ওদের সঙ্গে পাঠাও। আমার বাজনাগুলোর কাছে বিক্রি করেছে ওরা, তার কাছ থেকে আবার কিনে নিয়ে আসুক। আর এ ছেলে দুটোর কাজের দরকার–আজ থেকে এদের চাকরির বন্দোবস্ত করো।

চাকরি খালি নেই। ভজনবাবু বললেন।

–খালি করো।

কাকে ছাড়াব?

-আহা ছাড়াবে কেন?

-তাহলে ওদের কোন কাজের জন্যে বহাল করব?

কোনো কাজ নেই?

–না সাহেব।

-তাহলে ওরা আমার লনে জল দেবে। গরম পড়ে গেল–এখন জল দেওয়ার লোকের দরকার। মালিরা ফুলগাছ দেখাশোনা করেই সময় পায় না–এরা লন দেখাশোনা করবে। দিনমজুর হিসেবে এরা আজ থেকে বহাল হল।

ভজনবাবু বললেন, আচ্ছা স্যার।

সাহেব এই বন্দোবস্ত করে, বাড়ির ভেতরে গেলেন।

ভজনবাবু বললেন, টিকলুবাবু, আপনি এদের সঙ্গে যান। নিজকানে সব শুনলেন তো! এই নিন পনেরো টাকা।

বলেই, বুকপকেট থেকে পনেরো টাকা বের করে আমায় দিলেন।

তারপর গলা নামিয়ে বললেন, কেমন বুঝছেন? চোরের এমন শাস্তি কোথাও শুনেছেন, না পড়েছেন?

আমি জবাব না দিয়ে ছেলে দুটোকে নিয়ে চললাম।

এই হল আমার নতুন চাকরির প্রথম অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট।

টাঁড় পেরিয়ে ধুলোভরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ছেলে দুটো বলল, নেহাতই পেটের দায়ে চুরি করেছি। নইলে এ পাগলাসাহেবের বাড়ির কোনো জিনিস বাইরে পড়ে থাকলেও আমরা কেউ নিই না। পাগলা সাহেব মানুষ নয়; দেবতা।

মানুষ যে নন মনে মনে, আমারও তেমন একটা সন্দেহ হচ্ছিল। তবে ভূত-প্রেত না দেবতা সে-বিষয়ে এখনও নিঃসংশয় নই।

ভাগ্যি ভালো, বাজনা যার কাছে বিক্রি করেছিল, সে পেতল ভেবে কিনেছিল। পনেরো টাকা পেয়ে সে খুশি হয়েই সেগুলো দিয়ে দিল।

ছেলে দুটোকে নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসতেই দেখি সাহেব একটা লালরঙা স্যুট-প্যান্ট পরা বাঁদরের হাত ধরে বাড়ির সামনের বাগানে পায়চারি করছেন আর তার সঙ্গে অনর্গল গল্প করছেন।

আমি ব্যাপার দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হঠাৎ সাহেব আমাকে দেখেই মেহবুবের ওপর রেগে উঠে হুংকার দিয়ে বললেন, এ্যাই! টিকলুবাবুকে কোয়ার্টার দেখিয়ে দাও, নাস্তা-পানির বন্দোবস্ত করো।

তারপর আমাকে বললেন, যাও টিকলু, হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে-দেয়ে ঠিক ন-টার সময় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

মেহবুবের সঙ্গে আমার কোয়ার্টারে যাওয়ার সময় পথে ভজনবাবুর সঙ্গে দেখা। একটা ছোট্ট টবে-লাগানো অর্কিডকে প্রেমিকার মতো বুকে আঁকড়ে ধরে কোথায় যেন চলেছেন।

ভজনবাবু বললেন, বুদ্ধকে দেখেছেন?

-কে বুদ্ধ?

 আমি অবাক হয়ে শুধোলাম।

-ওই যে বাঁদরটা। ওর বউয়ের নাম ছিল গোপা। গোপা মারা যাওয়ার পর বউয়ের শোকে ওর টি-বি হয়েছে। তাই সাহেব ওকে নিজে অতযত্ন করেন।

আমি বললাম, কিন্তু বাঁদরের গায়ে স্যুট কেন? এ কি সাহেবের শখ?

ভজনবাবু আমার দিকে এমন মুখ করে তাকালেন যেন, আমি একেবারেই অর্বাচীন।

বললেন, কখনো কোনো বাঁদরকে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখেছেন? ওদের যন্ত্রপাতি তো সব মানুষের মতো। বড়োঅশ্লীল দেখায়। স্যুটটা শখে নয়, প্রয়োজনে। আমরা তো চিরদিন বাঁদরদের চার পায়ে বুকে হাঁটতেই দেখেছি-বাঁদর মানুষের হাতে-হাত রেখে হাঁটলে এইসব ডিফিকাল্টি হয়।

তারপর একটু থেমে বললেন, এখানে মেমসাহেব থাকেন, সাহেবের গেস্টদের মধ্যে কত মহিলা থাকেন–তাদের সামনে বাঁদরকে অমন বেলেল্লাপনা করে ঝুলঝুল করে ঘুরতে দেওয়া যায় না।

বাঁদরকে স্যুট পরাবার অকাট্য যুক্তিটা মানতেই হল।

মেহবুব আমার কোয়ার্টারে এনে আমাকে পৌঁছে দিল।

ছিমছাম, দুটো ঘর, বাড়ির সামনে পেঁপে গাছ কয়েকটা, চারধারে বড়ো বড়ো গাছ নানারকম পাখি ডাকছে। বেশ পছন্দ হল কোয়ার্টার।

আমি বললাম, রান্না-বান্না করার জায়গা নেই?

মেহবুব বলল, সাহেব তো বলেছেন আপনি বাড়িতেই খাবেন চারবেলা। রাম বাবুর্চি আছে, অশোক আছে-সাহেব মেমসাহেবদের জন্যে যা রান্না হয় আপনিও তাই-ই খাবেন। আমি বেয়ারা। সাহেবের খাস-বেয়ারা।

বুঝলাম, কমিশনারের পি-এর মতো মেহবুবকেও একটু খাতিরে রাখতে হবে। নইলে এই পাগলাসাহেবের কাছে কখন চাকরি নট হয়ে যায় কে জানে!

বাথরুমে গিয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে, জামা-কাপড় ছেড়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, রাতে ট্রেনে ভালো করে ঘুম হয়নি, এমন সময় একটা কালো-কালো পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে এসে ডাকল আমাকে। বলল, নাস্তা লাগা দিয়া।

তারপর বলল, রোজ সকালে আপনাকে এখানে বেড-টি দিয়ে যাব। সকাল নটায় বাড়িতে এসে বাবুর্চিখানায় নাস্তা করে নেবেন, দুটোয় দুপুরের খাওয়া, বিকেলে পাঁচটায় চা, রাত দশটায় রাতের খাওয়া।

তারপর বলল, চলুন।

 আমি শুধোলাম, তোমার নাম কী?

-আমার নাম অশোক।

বেশ মিষ্টি কাটা-কাটা চোখ-মুখ।

 শুধোলাম, তুমি কি সাঁওতালি?

-না আমি বিহারি।

–কী যেন বললে, তোমার নাম? অশোক?

-না, আমার আসল নাম আসোয়া, রানিমা আমার নাম দিয়েছেন অশোক। এখানে সকলের নাম রানিমাই দিয়েছেন। আপনার নামও দেবেন।

-মানে? আমার নাম আমার থাকবে না?

অশোক হাসল মিষ্টি করে। বলল, বোধ হয় না। সাহেব ঠিক-ই আপনার নামেই ডাকবেন। কিন্তু মেমসাহেব আড়ালে অন্য নামে ডাকবেন।

আমি নার্ভাস হয়ে গিয়ে বললাম, ভজনবাবুর কী নাম?

দাঁড়কাক। অশোক বলল।

অ্যাঁ? আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম।

আর আমার নামও দিয়ে ফেলেছেন নাকি?

 অশোক হাসল। বলল, হ্যাঁ।

কী? কী? আমি উদগ্রীব গলায় শুধোলাম।

অশোক বলল, পাতিকাক।

–কেন? পাতিকাক কেন?

–দাঁড়কাকের অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে।

অশোক বলল।

–আহা! বউদি আমার এমন হেনস্থা জানলে হয়তো আমাকে এক্ষুনি চাকরি ছেড়ে চলে। আসতে বলত কলকাতায়। কিন্তু এসে-অবধি এই চিড়িয়াখানার ব্যাপার-স্যাপার এতই ইন্টারেস্টিং লাগছে যে, এই আমার তিরিশ বছরের জীবনে এই-ই প্রথমবার মনে হচ্ছে যে, চাকরিতে এবার আমার মন লেগেছে। আমি হলাম গিয়ে ভার্সেটাইল জিনিয়াস-কোনো এক-ই কাজ কি আমার ভালো লাগে? এইরকম বিভিন্নমুখী কাজ তো আমার-ই জন্যে!

নাস্তা করা হলে সাহেব ডেকে পাঠালেন।

 বললেন, চলো টিকলু, তোমাকে তোমার কাজের জায়গা ঘুরিয়ে দেখাই।

সাহেবের সঙ্গে যে দম্পতি এসেছিলেন, তাঁরা বাঙালি নন। কোথাকার মহারাজ আর মহারানি। ভদ্রমহিলা দেখতে পাঞ্জাবি-পাঞ্জাবি। ভদ্রলোককে সাহেব গ্রেগরি বলে ডাকছিলেন; আর ভদ্রমহিলাকে পম্পা।

গ্রেগরি সাহেব আমাদের সঙ্গে চললেন।

বললেন, লেট মি হ্যাভ আ স্ট্রল উইথ ইউ।

সাহেব বললেন, কাম এলং।

প্রথমেই আমরা বাড়ির সামনেই একটা জায়গায় এলাম। ওই পাথুরে জমিতে ডিনামাইট দিয়ে পুকুর খোঁড়া হয়েছে ঘোড়ার খুরের আকৃতির। তার ওপর হ্যাঁঙ্গিং ব্রিজ। অর্কিডে অর্কিডে ও নানা লতা ও ঝোপে ছেয়ে রয়েছে জায়গাটা। সেই জায়গাটার ওপরে, জলের ওপরে বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা জাপানি কায়দার বিরাট ঘর। কাঠের টুকরো রং করে দু পাশের পর্দা বানানো হয়েছে। বাঁশের গায়ে হলুদ রং করা। ঘরটাতে উঠতে হলে বাঁশের মজবুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। ঘরের মধ্যে মোটা-মোটা ডানলপিলো মাইসোরিয়ান মিহি মাদুর দিয়ে ঢাকা। জাপানিজ কায়দায় বাঁশের মেঝে।

সাহেব বললেন, জাপানে এইরকম মেঝেকে বলে টাটামি-ফ্লোর। এটা হচ্ছে জাপানিজ টি-হাউস। তবে এখানে চা খাওয়া হয় না, আমার গেস্টরা দুপুরে বিয়ার খান। গরমের দিনে রাতে গল্প-টল্প করেন। হানি-মুনিং কাপল এলে রাতে শোন।

দেখলাম, দু-দিকে, বিশেষ করে, পশ্চিমের দিকে চিক ফেলা আছে। সুন্দর রং করা। যাতে পশ্চিমি লু না ঢুকতে পারে ঘরে। দেওয়াল থেকে টেবিলফ্যানও ঝুলছে দু-পাশে। আলোও আছে। কোনোকিছুর-ই ত্রুটি নেই।

সাহেব বললেন, এই ঘর ভালো করে যত্ন করে রাখবে। বাঁশের মিস্ত্রি এখানে আছে। পার্মানেন্ট স্টাফ। যখন যা মেরামতের দরকার তাকে দিয়ে করিয়ে নেবে। তার নাম নীলমোহন।

জাপানিজ টি-হাউসের পাশেই একটা ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যাণ্ডিফোরা গাছের গুঁড়ির চারদিকে লাগানো সাদা রট-আয়রনের গ্লাসটপের টেবিল, রট-আয়রনের চেয়ার। লেখাপড়ার করার জন্যে।

বাগানের মাঝে মাঝেই গাছগাছালির তলায় নানান বসার জায়গা–নানা ধাঁচের, নানা মাপের, নানা রঙের। গাছে-গাছে হ্যামক ঝুলছে, হ্যামকের সঙ্গে বেঁধে-রাখা বালিশ, যাতে হাওয়ায় উড়ে না পড়ে যায়।

বাঁদিকে আরও কিছুদূর গিয়ে সাহেবের লাইব্রেরি তৈরি হচ্ছে। একটা বড়ো জামগাছের একটা ডালও না কেটে-তার নীচে দোতলা বাড়ি। ছাদটা পুরো কাঁচের। এখনও শেষ হয়নি।

সাহেব বললেন, কার্পেন্টার, রাজমিস্ত্রি সব এখানে পার্মানেন্ট স্টাফ–তুমি শুধু একটু দেখাশোনা করবে–ভজনবাবু একা সময় পান না সব দেখাশোনা করবার। তা ছাড়া চিড়িয়াখানাটা তাঁর-ই দায়িত্বে।

লাইব্রেরি ছাড়িয়ে আর একটু এগোলেই, বাঁদিকে নীল রঙা সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের পাশেই একটা মাটির ঘর। তার বারান্দায় বসে একজন দর্জি পা-মেশিন চালিয়ে ঝাঁই-ঝাঁই করে গদির নানা রঙা নতুন কুশানের কভার সেলাই করে চলেছে। এবং ছিঁড়ে-যাওয়া কুশানেরও কভার মেরামতি করছে।

সাহেব বললেন, যখন-ই যে কুশান-এর কভার ছিঁড়ে যাবে, একে বলবে, এ খুলে সেলাই করে দেবে। যেখানে নতুন বানাতে হবে তাও একেই বলবে। এর নাম হামিদ।

আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একটা বিরাট গভীর কুয়ো। তার ওপর লোহার জাল বিছানো। সেই কুয়োর ওপরে বাঁশের সাঁকো। সেই সাঁকো বেয়ে গিয়ে একটা মাটির বাড়ি। সাঁওতালদের বাড়ির মতো দেখতে–কিন্তু দোতলা–মধ্যে স্যানিটারি বাথরুম-টাথরুম সব আছে। বাড়িটা একটা বড়ো তালগাছকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে। সিঁড়ি তৈরি হয়েছে কাঠের তক্তা দিয়ে তালগাছটিকে ঘিরে ঘিরে।

এক-একটা জিনিস দেখছি, আর এই মানুষটার, আমরা নতুন মালিকের শখ, রুচি, ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার সেজোকাকা, যিনি ইন্টারভিউর জন্যে আমাকে অপয়া পুরোনো স্যুট দিয়েছিলেন, এবার আমেরিকায় ডিজনিল্যাণ্ডে গেছিলেন–ফিরে এসে গল্প করেছিলেন যে, মানুষের পয়সা, বিজ্ঞান আর কল্পনা এবং পরিশ্রম একসঙ্গে মিললে যে, কী অসাধ্য সাধন করা যায়, তা নাকি ডিজনিল্যাণ্ড-এ না গেলে অনুমান করা মুশকিল। আমি কিন্তু আমার সাহেবের এই চিড়িয়াখানায় এসে ডিজনিল্যাণ্ডের আস্বাদ পেলাম। মানুষটার প্রতি ভক্তি আমার শতগুণে বেড়ে গেল।

হঠাৎ সাহেব আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি ভাবছ, আমার পয়সা আছে, তাই বাপ-ঠাকুরদার উপার্জন করা পয়সায় আমি ফুটানি করছি। তা কিন্তু নয়। পরে তোমাকে আমার ডেয়ারি, পোলট্রি, এগ্রিকালচারাল ফার্ম সব সময়মতো ঘুরে দেখাব। অত্যন্ত কমপিটেন্ট সব লোক নিয়ে পার্টনারশিপ করেছি তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা প্রত্যেকে নিজের নিজের ক্ষেত্রে খুব দক্ষ ও কৃতী লোক। পুরো ব্যাপারটার সাকসেসের মূলে তাঁদের কন্ট্রিবিউশন-ই অনেকখানি। শতকরা ষাটভাগ প্রফিট তাঁরা পান-আমি পাই চল্লিশ ভাগ। ডেয়ারির আলাদা পার্টনার, পোলট্রির আলাদা পার্টনার, এগ্রিকালচারের আলাদা পার্টনার। আমি নিজে যদিও অ্যাকাউন্টেন্ট, তবু নিজের হিসেব আমি নিজে রাখি না তাতে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। সবচেয়ে বড়কথা মানুষ নিজের চিকিৎসা নিজে করলে বায়াসড় হয়ে যায়। তাই কলকাতার এক প্রসিদ্ধ অডিটর ফার্ম থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টটেন্ট এসে প্রতি উইক-এণ্ডে আমার সমস্তকিছুর অ্যাকাউন্টস চেক করে যান। উইকলি ট্রায়াল-ব্যালান্স ও প্রফিট-অ্যাণ্ড-লস অ্যাকাউন্ট বানানো হয়। কোথায় কত লাভ হচ্ছে, কী হচ্ছে না, তা ধরা পড়ে। আমার পার্টনারেরা সকলেই দেড় দু-হাজার টাকা মাসে ড্রইং করেন প্রফিটের এগেইনস্টে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝলে টিকলু, সব-ই নিজে খাব, অন্য কাউকে কিছু দেব না এবং সব-ই একাই করতে পারব এই ভুল ধারণার জন্যেই আমাদের কিছু হয় না।

আমি বললাম, স্যার, কতদিন আগে আপনি এসব আরম্ভ করেছিলেন?

স্যার এ এম বললেন, তুমি আমাকে অংশুদা বলেই ডেকো। স্যার স্যার কোরো না।

তারপর বললেন, আজ থেকে ন-বছর আগে আরম্ভ করেছিলাম। তখন আমার বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ।

কথাটা শুনে আমার থুথু ফেলে মরতে ইচ্ছে করল। মানে আজ আমার যে বয়স, প্রায় সে-বয়সে এই মানুষটা একটা এতবড়ো প্রোজেক্ট ভিজুয়ালাইজ করে, ভেবে, নিজে হাতে সব করেছেন। বডোলোকের শখ হিসেবে নয়, অ্যামেচারিশভাবে নয়, একেবারে প্রফেশনাল কায়দায়। তার ফল : আজ অতলোকের চাকরি হয়েছে এখানে, এতকিছু উৎপাদন হচ্ছে, পাথুরে মাটিতে বছরে দুটো করে ফসল ফলছে।

সাহেব বললেন, তিনটে ক্রপ করার চেষ্টা করছি, কিন্তু মাটি তো নয় যেন পাথর; কিছুতেই করতে পারছি না। এই পুরো ব্যাপারটা আমি কো-অপারেটিভ বেসিসে ডেভালাপ করছি সত্যিকারের কালেকটিভ প্রচেষ্টা–বুঝেছ টিকলু। আমি দেখিয়ে দেব যে, কাজ করার ইচ্ছা থাকলে করা যায়, অসুবিধে, পাথুরে মাটি, জলকষ্ট, এসব কোনো বাধাই নয়।

তারপর একটু থেমে বললেন, জানো ভাইডি, একবার ইজরায়েলে গেছিলাম, দেখে এলাম। ওরা মরুভূমিতে ফসল ফলাচ্ছে। আমাদের এতবড়ো দেশ, এত সুন্দর দেশ, আমরা সকলে মিলে যদি মাথা লাগাতাম, হাত লাগাতাম, তবে এদেশ নিয়ে আমরা কীই-না করতে পারতাম!

আমার নতুন মালিকের কথা শুনতে শুনতে আমার ইচ্ছে করল তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। মনে মনে বললাম, শশী! তোর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এখানে আমি বিনি-মায়নাতেও কাজ করতে পারি। আমার তিরিশ বছরের জীবনে আমি এমন একটা মানুষের মতো মানুষ দেখিনি। আমার বন্ধ্যা, অসফল ভ্যাগাবণ্ড কালো মেঘাচ্ছন্ন জীবনে এই কাজ-ই যেন প্রথম একটা রুপোলি আলোর রেখা। হঠাৎ করে এতদিন বাদে, যৌবন প্রায় শেষ করে এনে বুঝলাম যে, অন্য কেউই কারও জন্যে কিছু করতে পারে না। একজন মানুষ নিজে, সে যদি মানুষের মতো মানুষ হয়, তবে শুধু তার নিজের জন্যেই নয়, নিজের জন্যে করেও, আরও দশজনের বোঝা ও দায়িত্ব সে হাসিমুখে বইতে পারে। ভাবছিলাম, অনেক নোটবই পড়ে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা পাশ করেছি, মরা পাঁঠার গায়ে কর্পোরেশনের ছাপের মতো ইউনিভার্সিটির ছাপ পেয়ে ভেবেছি, কত কীই-না শিখলাম, জানলাম। কেন জানি না, আজ আমার হঠাৎ মনে হল, আজ যা শিখলাম, বুঝলাম, তেমন শেখা, বোঝা বা জানা এতদিনে কখনো জানিনি। আমার বুকের মধ্যে কী যেন একটা অপ্রকাশ্য, অনামা অনুপ্রেরণার অনুরণন শুনতে পেলাম, রক্তের মধ্যে নদীর ঢেউয়ের মতো হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ করে বাজছিল।

সাহেব বললেন, ডেয়ারি, পোলট্রি বা চিড়িয়াখানা নিয়ে তোমার দায়িত্ব বা মাথাব্যথা নেই –তুমি আমার এই বাড়িঘরগুলো ঠিক করে রাখবে। অতিথিদের স্টেশনে গিয়ে রিসিভ করবে, স্টেশনে তুলে দিয়ে আসবে, কোনোরকমের খাতির-যত্নর কমতি না হয় দেখবে। হুইস্কি ফুরিয়ে গেলে, বিয়ার ফুরিয়ে গেলে আমাকে জানাবে। আমার স্টোররুমের চাবি আজ থেকে তোমার হাতে। আমি নিজে থাকলে সব যেমনটি চলে, আমি এখানে না থাকলেও আমার অবর্তমানে সবকিছু ঠিক তেমনটিই চালিয়ো। এই তোমার কাজ। তা ছাড়া তোমার কাছে আমার কিছুই চাইবার নেই।

তারপর একটু থেমে বললেন, এ কাজ তোমার পছন্দ হয়েছে তো? আমাকে, বউরানিকে, পছন্দ হয়েছে তো? কারণ আমাদের পছন্দ না হলে, তুমি কাজ করে আনন্দ পাবে না।

আমি অনেকক্ষণ সাহেবের মুখের দিকে মুখ উঁচু করে চেয়ে রইলাম।

তারপর আস্তে বললাম, খু-উ-ব।

সব দেখানো হয়ে গেলে সাহেব আমাকে বউরানির জিম্মায় দিয়ে অফিসে চলে গেলেন। রীতিমতো অফিস আছে এখানে। টাইপিস্ট, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ক্লার্ক সব নিয়মমাফিক কাজ করছে। এখন সাহেব লাঞ্চ অবধি অফিসে বসেই কাজ করবেন। তারপর বিকেলে পোলট্রি, ডেয়ারি ও এগ্রিকালচারাল ফার্ম দেখতে বেরোবেন।

সাহেব চলে গেলেন।

বউরানি ছায়াঢাকা বারান্দায় বসে কী যেন লেখাপড়া করছিলেন।

বললেন, প্রথম দিন-ই বেশি রোদ লাগিয়ো না, আগুনে পুড়ে যাবে, লু-ও লাগতে পারে। চা খাবে নাকি এককাপ?

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই মেহবুব ট্রেতে বসিয়ে টি-পটে করে চা নিয়ে এল।

বউরানি নিজে হাতে চা বানিয়ে দিলেন।

চা খেতে খেতে বউরানি বললেন, চলো, চা খেয়ে নিয়ে ঘরগেরস্থালি তোমাকে বুঝিয়ে দিই।

আমি বললাম, তার আগে আপনাকে বলি, আপনার দেওয়া নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

কী নাম?

বউরানি সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন।

আমি বললাম, পাতিকাক।

বউরানির যে-ধরনের সেন্স অব হিউমার, তা বোঝা সাধারণ লোকের কর্ম নয়। নিজে অত্যন্ত রসিক হলে তবেই বউরানির ফন্তুধারার মতো অন্তঃসলিলা রসবোধের হদিশ পাওয়া যায়।

এমন সময় ভেতর থেকে চান-টান সেরে সাহেবের গেস্ট–মহারানি এলেন। একটা ফিকে হলুদ-রঙা বেল-বটস পরেছেন। ওপরে হালকা সবুজ পাঞ্জাবি। দারুণ ভালো ফিগার, খুব বুদ্ধিমতী, সুশ্রী চেহারা।

উঠে দাঁড়ালাম।

বউরানি হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন, বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে বের করতে হবে।

বউরানি বললেন, পম্পা, চা খাবে এককাপ?

-নো, থ্যাঙ্ক ইউ।

বলেই, চুল-ভরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে মহারানিকে ধন্যবাদ জানালেন।

তারপর আমাকে বসতে বললেন।

ভদ্রমহিলা খুব ছটফটে স্বভাবের। একটু পরেই বললেন, হোয়ারস আওয়ার হাজব্যাণ্ডস গান? লেট মি গো অ্যাণ্ড হ্যাভ আ লুক।

বলেই, মহারানি দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে বাগানে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

বউরানি অপলকে অপস্রিয়মাণ মহারানির দিকে চেয়ে রইলেন।

তারপর অস্ফুটে বললেন, খুনি।

মানে? আমি আঁতকে উঠে বললাম।

 বউরানি বললেন, আমাকে একবার প্রায় খুন-ই করে ফেলেছিল একটু হলে।

আমি উত্তেজিত বোধ করলাম। রাজা-মহারাজাদের ব্যাপার খুন-খারাবি হলেই হল আর কী? কিন্তু আর ঔৎসুক্য দেখানো ঠিক কি না বুঝলাম না।

চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে বউরানি নিজেই বললেন, তবে শোনো সে-গল্প।

এমন সময় বউরানির পাঠশালার এক পোড়ো এসে অন্য পোডড়াদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাল–তারা তাকে মেরেছে, তার শ্লেট ভেঙে দিয়েছে, তার পেনসিল কেড়ে নিয়েছে।

বউরানি মেহবুবকে সরজমিনে তদন্ত করতে পাঠিয়ে বললেন, সে প্রায় বছর পাঁচেক আগেকার কথা। আমার দু-ছেলে জানো তো? বড়ছেলের বয়স একুশ। সে লানডান স্কুল অফ ইকনমিক্সে পড়ে লানডানে-আর ছোটোছেলের বয়স, এগারো–সে পড়ে আজমীরের পাবলিক স্কুলে। আমার বড়োছেলে তখন পরীক্ষার পর এখানে এসে রয়েছে। তোমার দাদা তো তাকে একটা ঘোড়া কিনে দিয়েছেন। ঘোড়া সহিস সব-ই আছে। সে তো ঘোড়া দাপিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায় পাঁচ-দশ মাইল। এমনি সময়, গ্রেগরি আর পম্পা এল এখানে বেড়াতে।

তারপর একটু থেমে বললেন, দেখতেই পাচ্ছ আমার শরীরে মজ্জার চেয়ে মেদ একটু বেশি। বরাবরই বেশি। পম্পা গলফ খেলে, রাইডিং করে, ঘোড়া দেখে পম্পা তো খোঁড়া সাজল। দিনরাত ঘোড় চেপে বেড়ায়। দু-দিন পর চলে যাওয়ার সময় আমায় বিশেষ করে বলে গেল যে, তুমি রাইডিং কোরো, নির্ঘাত রোগা হয়ে যাবে। বুঝলে টিকলু…

আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, পাতিকাক।

বউরানি বললেন, ওই হল। পম্পা চলে যাওয়ার পর আমি ছেলেকে বললাম, হ্যাঁরে, তোর ঘোড়াটা একটু দিবি। আমি রোগা হতাম!

ছেলে বলল, নিশ্চয়ই দেব মা। ঘোড়া চড়ে দ্যাখো। খুব সোজা চড়া। সহিস তোমাকে শিখিয়ে দেবে।

ইতিমধ্যে তোমার সাহেবের দু-জন গেস্ট এসে হাজির। একটু যে, নিরিবিলিতে ঘোড়া চাপব বা কিছু করব, তা এ-বাড়িতে হওয়ার উপায় নেই। একদিন সকালে সহিস তো ঘোড়াকে সাজিয়ে-টাজিয়ে এনে সিঁড়ির সামনে দাঁড় করাল। ভেবেছিলাম, সে-সময়ে গেস্টরা ঘরের ভেতরে থাকবেন। সে-সময় তাঁরা স্নানও করতে পারতেন, ঘরে বসে দাড়িও কামাতে পারতেন, তা না, তাঁরা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসলেন। বসে, দাঁড়িয়ে-থাকা ঘোড়াটির দিকে আগ্রহের চোখে চেয়ে রইলেন। কিন্তু, তখন আমি রোগা হব বলে বদ্ধপরিকর। ছোটোবেলায় ঠাকুরের বাণী পড়েছিলুম, লজ্জা মান ভয়–তিন থাকতে নয়। অতএব ঘোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। কিন্তু উঠি কী করে? ছেলে ও সহিস দু-ধারে দাঁড়িয়ে ছিল ঠায়। আমার ঘোড়ার প্রতি যত না মনোযোগ ছিল তাদের; আমার প্রতি মনোযোগ ছিল তার চেয়েও বেশি।

আমি বললুম ছেলেকে, একটা চেয়ার আন তো বাবা, উঠি কী করে?

ছেলে একটা চেয়ার নিয়ে এল।

চেয়ারে উঠেও দেখি পা পাই না। তখন তাকে বললুম, একটা পিঁড়ে নিয়ে আয়। ছেলে দৌড়ে বাবুর্চিখানা থেকে পিঁড়ে নিয়ে এল।

সেই চেয়ারের ওপর পিঁড়ে রেখে, অনেক কষ্টে তো ঘোড়ার ওপর চেপে বসলাম।

 কিন্তু আমি যেই তার পিঠে বসলাম, ঘোড়া সেই সটান বসে পড়ল। চার-পা মুড়ে।

ছেলে ও সহিস হাঁ-হাঁ করে উঠল।

পাছে আমি আমার পাখির মতো হালকা শরীরের কারণে লজ্জা পাই, তাই সহিস সঙ্গে সঙ্গে বলল, মেমসাব ইয়ে তো পাঁচ-পাঁচ মন সওয়ারি ইতনি নানসে লে লেতা, আপ তো পাঁচ মন নেহি হ্যায়, আপকো জরুর উঠানে শেকেগা। ভেবে দ্যাখো, বারান্দায় বসা, গেস্টদের সামনে কী হেনস্থা আমার!

তারপর সহিস সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আপ জেরা লাগাম খিঁচিয়ে, ঘোড়া বিলকুল খাড়া হো যায়গা।

ঠাকুরের নাম স্মরণ করেই যেই-না লাগাম টেনেছি, সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া উঠে তো দাঁড়াল, কিন্তু দাঁড়িয়ে খ্যামা দিল না। সামনের পা-দুটো সটান শূন্যে তুলে দিয়ে চিহি চিহি রবে প্রবল প্রতিবাদ করে পেছনের দু-পায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

তারপর? আমি উত্তেজিত হয়ে শুধোলাম।

বউরানি বললেন, তারপর আর কী? ঘোড়াও স্ট্রেট লাইন হয়ে গেল আর আমিও অতউঁচু ওয়েলার ঘোড়ার ল্যাজ গড়িয়ে স্ট্রেট পপাতঃ ধরণিতলে।

ব্যাপারটা পুরো হৃদয়ংগম করার আগেই বউরানি বললেন, বুঝেছ, শাড়ি পরেছিলাম আমি। এমন পড়া পড়লুম যে, কী বলব।

তারপর একটু থেমে বললেন, কিন্তু সেই মেদ, যে মেদ ঝরাবার জন্য ঘোড়ায় চড়তে গেছিলুম, সেই মেদ-ই শেষপর্যন্ত বাঁচাল আমায়। আমার শরীরে মেদ না থাকলে সেদিন আমার হাড়গোড় ভেঙে চুরচুর হয়ে যেত।

একটু থেমে বউরানি বললেন, সেই রোগা হওয়ার প্রথম ও শেষ চেষ্টা।

এই গল্প শেষ হওয়ার পর আমার ওপর গল্পের প্রতিক্রিয়া কী তা না দেখেই বউরানি বললেন, চলো, বাড়িটা তোমাকে ঘুরে দেখাই। আমি আর তোমার দাদার অনুপস্থিতিতে অনেক অতিথি যাবেন-আসবেন, তাঁদের যেন কোনোরকম অসুবিধা না হয়।

একতলায় অনেকগুলো ঘর। দুটো এয়ার-কণ্ডিশানড। অন্যগুলো গুলমার্গ এয়ারকুলার লাগানো। নীচে দু-টি বাথরুম। বাথরুমে ফ্লোর লেভেলের নীচে বাথটাব-কমোড, মায় বিদে পর্যন্ত। আগে আমাদের দেশে বিদে তৈরি হত। আজকাল হচ্ছে।

বাবুর্চিখানা। চাকর-বেয়ারাদের থাকার ঘর–দু-দুটো ফ্রিজ, স্টোর।

বউরানি স্টোররুম খুলে দেখালেন, বিলিতি হুইস্কি, নানারকম দেশি-বিদেশি মদ, সিগার, সিগারেট ও আরও নানারকম জিনিস ভরতি। ফ্রিজের মধ্যে চিজ, মাখন, ডিম, হ্যাম, সসেজ –সেই হেন জিনিস নেই।

বউরানি আমাকে নিয়ে তারপর দোতলায় উঠলেন।

দোতলা থেকে বহুদূর অবধি দেখা যায়। বাড়ির সামনে দিয়ে মেইন লাইন। ক্ষণে ক্ষণে ট্রেন যাচ্ছে। রেললাইনের ওপারে লাল মাটির খোয়াই চলে গেছে। মাঝে মাঝে সবুজের ছোপ, শালের চারা, ঝাঁটি জঙ্গল, মিলিয়ে গেছে দূরের ছায়াঘেরা সাঁওতালদের গ্রামে, তারপর টিগরিয়া পাহাড়। একটা নদী গেরুয়া শরীরে গরমের সকালে ন্যাতানো সাপের মতো পড়ে আছে।

বউরানি নাম বললেন নদীর; কুতনিয়া।

ওই গ্রামগুলোর নাম কী? শুধোলাম আমি।

 বউরানি বললেন, সুজানী। বড়ড়াগ্রামটা। তার চারপাশে ছড়ানো আছে কুকরিবাগ, বদলাডি, বাবুডি সব টিগরিয়া পাহাড়ের কোলে-কোলে।

তারপর বললেন, জানো তো, ওইসব গ্রাম থেকে ছেলে-মেয়েরা রোজ কাজ করতে আসে। ওই সুজানী গ্রামে একটা খুবসুন্দর মেয়ে আছে, সে এখানে কাজ করে। তার নাম পানুই।

পানুই নামটা শুনেই আমার বুকটা ধক করে উঠল।

স্টেশন থেকে আসবার সময় ভজনবাবু যেন কী বলেছিলেন? বে-শাদি করেননি, পানুই এর ক্যাজুয়ালটি না হয়ে যান।

কথাটা মনে পড়ে এতক্ষণে তার মানে বুঝলাম।

মেমসাহেব বললেন, এই পানুইকে নিয়ে তোমার সাহেবের চিন্তা। এতলোকে মেয়েটার পেছনে লাগছে যে, মেয়েটা খারাপ না হয়ে যায়। মেয়েটা নিজে পাজি–তো লোক কী করবে? তোমার সাহেব বর ঠিক করে লোক খাইয়ে শাড়ি-গয়না দিয়ে পানুই-এর বিয়ে দিলেন। কিন্তু হলে কী হয়– সে বরকে ছেড়ে চলে এল।

ওপরেও অনেকগুলো বেডরুম–দু-টি বারান্দা। মানে এই বাড়ির একতলা, দোতলা, জাপানি টি-হাউস, শান্তিনিকেতনি শ্যামলীর মতো মাটির বাড়ি, কামাচ কাটকান, হাওয়াইয়ান সব মিলিয়ে এখানে একসঙ্গে একশো-জন অতিথিও অনায়াসে থাকতে পারেন।

আমি বউরানিকে বললাম, সেকথা।

বউরানি বললেন, থাকতে পারে মানে? থাকেও অনেক সময়।

তারপর বললেন, তোমার চাকরিটা যত সহজ ভেবেছ তত সহজ নয়। তুমি এখানে তিষ্ঠোতে পারলে হয়। তোমার সাহেবের গেস্টদের তো দ্যাখোনি। কতরকম চিজ-ই যে আসে, এই চিড়িয়াখানার জন্তুরাও হার মানে তাদের কাছে।

আমার মনে হল, ইতিমধ্যেই যেন একটু পাগল-পাগল ভাব লাগছে। চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে পারলে হয় শেষপর্যন্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *