১.২ গনিমতের মাল

‘যুদ্ধ শেষ।” একথা বলতে বলতে তীরন্দাজ দলটি পাহাড়ের ঘাঁটি থেকে নিচে নেমে আসে–“গনিমতের মাল আমাদের। আমরা বিজয়ী হয়েছি”

কমান্ডারের সাথে থাকে মাত্র নয়জন তীরন্দাজ।

স্যাটেলাইটের মত খালিদের দৃষ্টিতে বিষয়টি সাথে সাথে ধরা পড়ে যায়। তার কাছে এটা স্বপ্নের মত মনে হয়। তিনি এমনই একটি সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তা যে এত তাড়াতাড়ি অতি সহজে হাতের মুঠোয় এসে যাবে তা ছিল কল্পনাতীত।

তিনি অবস্থান ছেড়ে যাওয়া তীরন্দাজদের উপর গভীর দৃষ্টি রাখেন। যখন তিনি নিশ্চিত হন যে, তারা কুরাইশ বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যাস্ত তখন তিনি অশ্বারোহী দল নিয়ে গিরিপথে অবস্থানরত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর অধীনস্থ নয় তীরন্দাজের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। খালিদ ইচ্ছা করলে তাদের এড়িয়েও যেতে পারতেন, কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা তাকে উন্মাদ করে তুলে। তার অশ্বারোহী দলটি পাহাড়ের উপরে উঠতে থাকলে উপর থেকে তীরন্দাজগণ তাদেরকে তীর মেরে আহত করতে থাকে।

খালিদকে গিরিপথে আক্রমণ করতে দেখে ইকরামা নিজেও বাহিনী নিয়ে উদ্দেশ্যস্থলে এসে পৌঁছে। তার অশ্বারোহী বাহিনীও চতুর্দিক দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। তাদের কাছেও তীর ছিল। তারাও তীরের জবাব তীর দ্বারাই দিতে থাকে। মাত্র ৯ জনের পক্ষে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর গতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। অশ্বারোহীরা এক সময় সুড়ঙ্গ মুখে চলে যায়। তীর রেখে এবার তারা তরবারি নেয়। কিছুক্ষণ পাল্টা-পাল্টি হামলা চলে। এক সময় সবাই আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। খালিদ আহতদেরকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করে। তীরন্দাজ কমান্ডার আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুও শহীদ হয়ে যান।

গিরিপথ দখলের পর খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও ইকরামা নিজ নিজ বাহিনীকে নিচে অবতরণ করায়। মুসলিম বাহিনী যেখান থেকে যুদ্ধের সূচনা করে সেখানে গিয়ে তারা একত্রিত হয়। খালিদের নির্দেশে উভয় কমান্ডার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এ সময় মুসলমানরা মূলত যুদ্ধের অবস্থায় ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কিছু সংখ্যক মুজাহিদ তখনও ছিলেন। এ জানবাজ মুজাহিদগণ ঈগলের মত ছুটে গিয়ে অশ্বারোহীদের মোকাবিলায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কুরাইশদের সাথে আহত নারীরাও পালাচ্ছিল। কিন্তু উমরা নাম্নী মহিলা পলায়ন করতে না পেরে নিকটবর্তী এক স্থানে আত্মগোপন করেছিল। মুসলিম বাহিনীর উপর কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর পুনঃ আক্রমণ করতে দেখার সময় কুরাইশদের ভূলুণ্ঠিত পতাকার উপর তার নজর পড়ে। এক সুযোগে সে পতাকাটি উঠিয়ে উঁচু করে তুলে ধরে।

এদিকে আবু সুফিয়ানও পলায়নপর পদাতিক সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল। হঠাৎ সে পেছন দিকে তাকালে পত পত করে বাতাসে উড়া কুরাইশদের পতাকাটি সে দেখতে পায়। “হুবল জিন্দাবাদ, উযযা জিন্দাবাদ” শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সে পদাতিক সৈন্যদেরকে সংগঠিত করে রণাঙ্গনে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসে মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলে।

খালিদের আরেকটি কথা আজ ভীষণভাবে মনে পড়ে। সেদিন তিনি হত্যার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তালাশ করে ফিরেন। আর আজ চার বছর পর সে তাঁরই নিকট মদীনা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে তার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় সত্তা বিরাজমান।

♣♣♣

পাহাড়ের বাহিনী আকাশ ভেদ করে বের হতে থাকে। অশও চলছিল শ্লথ গতিতে। খালিদ বাস্তব জগৎ ছেড়ে ভাবের জগতে চলে যান। এই ভাবরাজ্যে কখনো তাঁর চলার গতি হয়ে পড়ছিল মন্থর আবার কখনো বা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন খুব কষে। তিনি আপন মনে চলতে থাকেন। অথচ গন্তব্য তার নিকট এখনো স্পষ্ট নয়, গন্তব্যস্থল অনির্ধারিত। কখনো তার মনে হয়, এক মোহনী শক্তি তাকে সম্মুখপানে টেনে নিয়ে চলছে আর সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তার অনুসরণ করছে। আবার কখনো অনুভব করেন যে, দেহের ভিতর থেকে সৃষ্ট একটি শক্তি যেন তাকে পশ্চাতে হটিয়ে দিচ্ছে।

“খালিদ!” একটি আওয়াজ তার কর্ণকুহরে তরঙ্গের মত আঘাত হানে এটা তাঁর ভেতরের-ই একটি কাল্পনিক আওয়াজ। কিন্তু তার নিকট এটা বাস্তব মনে হয়। তিনি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে সম্মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে আওয়াজের উৎস খোঁজ করেন। অথচ সেখানে বালুরাশি বিনে আর কিছুই ছিল না। আবারো তিনি শুনতে পান–“খালিদ! যা শুনেছি তা কি সত্য?” এবার তিনি কণ্ঠ চিনে ফেলেন। নিশ্চিত হয়ে যান যে, এটা তার সাথি ইকরামার কণ্ঠস্বর। মাত্র একদিন আগে ইকরামা তাকে বলেছিল–“তুমি যদি মনে কর যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত নবী, তাহলে এই ধারণা মন থেকে মুছে ফেল। সে আমাদের অসংখ্য আত্মীয়-স্বজনকে নিধনকারী। তোমার গোত্রের মানসিকতা অনুভব কর। তারা সূর্যাস্তের পূর্বেই মুহাম্মাদকে হত্যা করতে চায়।”

খালিদ লাগাম মৃদু টান দেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া ইঙ্গিত মোতাবেক অগ্রসর হয়। চার বছর পূর্বের স্মৃতিতে তিনি পুনরায় ফিরে যান। মনে পড়ে যায়, উহুদ ময়দানে তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হন্যে হয়ে খুঁজেছিলেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, যে কোন মূল্যে সূর্যাস্তের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করে কুরাইশদের শপথ তিনি পূরণ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানবাজ মুজাহিদদের অসীম সাহসের কারণে তার ইচ্ছা আর পূরণ হল না।

মুসলিম বাহিনী বিপর্যস্ত। খালিদ বাহিনীর কৌশলী ও অতর্কিত আক্রমণে মুজাহিদরা দিশেহারা হয়ে যায়। বল চলে যায় মুসলমানদের দখল থেকে কুরাইশদের দখলে। নিশ্চিত বিজয় হাতের মুঠোয় এসেও ছুটে যায়। এটা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ না মানার ফল। অর্জিত বিজয় দ্বারা সামান্য ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।

দুর্ধর্ষ বাহাদুর। খালিদ এবং ইকরামা সমরবিদ্যায় ছিল অতুলনীয়। মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করতে এখন তাদের আর কোন বাধা ছিল না। আল্লাহ ব্যতীত তাদের সাহায্য করারও ছিল না কেউ। খালিদ দেখতে পান যে, মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত। বড় অংশটি সর্বাধিনায়ক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মুষ্টিমের কতক সাহাবী নবীজীর সাথে ছিলেন। এ ক্ষুদ্র দলটি গনিমতের মালের পেছনে না পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকেন। সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন বিশজনের মত। হযরত আবু দুজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত তালহা বিন আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত মুসআব বিন উমাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আহতদের সেবা-শুশ্রুষার উদ্দেশে আগত চৌদ্দজন মহিলাদের মধ্যে দু’জন ছিলেন রাসূলের সাথে। একজন হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা এবং অপরজন হযরত উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা নাম্মী এক হাবশী মহিলা। হযরত উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভূমিষ্ঠের সময় ধাত্রী ছিলেন। অবশিষ্ট বারজন মহিলা তখনও পর্যন্ত জখমিদের উদ্ধার এবং তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

খালিদ সন্ধানী দৃষ্টি হেনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খুঁজতে থাকেন। তার পক্ষে রণাঙ্গনে বেশিক্ষণ ঘোরাফেরা করা সম্ভব ছিল না। কারণ তার অধীনে একটি অশ্বারোহী দল ছিল। তার উপস্থিতিই তাদেরকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করে রাখে।

তিনি অজ্ঞের মত আক্রমণের পক্ষপাতি ছিলেন না। তার নীতি ছিল শত্রুর দুর্বল পয়েন্টে এমন আঘাত হানো, যেন দ্বিতীয় আঘাত করার পূর্বেই তারা মুখ থুবড়ে পড়ে।

আজ চার বছর পর যখন তিনি একাকী মরুভূমি মাড়িয়ে যাচ্ছেন, তখন তার মন-মস্তিষ্কে ঘোড়া দৌড়াচ্ছিল। মুসলিম বাহিনীর তকবীর-ধ্বনি তার স্মৃতিতে ঝংকার তোলে। এই তকবীর-ধ্বনি শুনে তার মনে হয়েছিল, নিজেদেরকে সাহসী, নির্ভীক ও মৃত্যুভীতিমুক্ত প্রকাশ করতে মুসলমানরা এভাবে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। একবার ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যতায়, আরেকবার তার অধরদ্বয় মুচকি হেসে ওঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মুসলমানদের হত্যা করা হবে বেশি, রাজবন্দি বানানো হবে কম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান তিনি এখনও শনাক্ত করতে পারেননি। ইতোমধ্যে রণাঙ্গনের অপর প্রান্তে চেয়ে দেখেন, আবু সুফিয়ান পলায়নপর কুরাইশদের সুসংহত করেছে আবার। সে এসেই কমান্ডার-বিচ্ছিন্ন মুসলিম বাহিনীর বড় দলটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলমানরাও বীরবিক্রমে জীবনবাজি রেখে লড়ে চলছে। জীবনের শেষ যুদ্ধ মনে করে তারা অমিত তেজ আর বীরত্বের এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করে যে, সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও কুরাইশরা আবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

কুরাইশদের বিপদ আঁচ টের পেয়ে খালিদ রীতিমত অগ্নিগোলকে পরিণত হন। তিনি তার বাহিনীকে মুসলমানদের উপর তুফান সৃষ্টির নির্দেশ দেন। নিজের তরবারি কোষবদ্ধ করেন। হাতে তুলে নেন ভয়ংকর বর্শা। তিনি পার্শ্বদিক হতে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে তিনি নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। বীরত্ব প্রদর্শনকারী মুজাহিদদের বেছে বেছে বর্শা ছুড়তে থাকেন। তার বর্শায় কোন মুজাহিদ নিহত হলে আনন্দ প্রকাশের জন্য চিৎকার করে বলতেন– ‘আমি আবু সুলাইমান’ –প্রতিটি বর্শার সাথে তার উচ্চকিত আওয়াজ শুনা যেত আমি আবু সুলাইমান।

চার বছর পর মদীনা যাত্রাকালে আজ আবার তার কর্ণকুহরে ঝংকার তোলে– “আমি আবু সুলাইমান” তিনি সঠিকভাবে মনে করতে পারেন না যে তার বর্শা সেদিন কয়জন মুসলমানের দেহ ভেদ করে যায়। তিনি সেদিন কিছু সময়ের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা ভুলে যান। অল্পক্ষণ পরই খবর পান যে, মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং ইকরামা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান শনাক্ত করে তার নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে।

খবর সত্য। আসলেও মুসলমানদের উপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, বিক্ষিপ্ত বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে যুদ্ধকে আবার অনুকূলে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ও সাথিদের জীবন বাঁচাতে রণাঙ্গন ছেড়ে চলে যাওয়া সঙ্গত মনে করেননি। অথচ বাস্তবতার দাবি ছিল এ মুহূর্তে ময়দান ছেড়ে যাওয়া। তিনি একটি ভাল অবস্থান খুঁজছিলেন। যেহেতু তার জানা ছিল যে, কুরাইশরা তাকে তালাশ করছে এবং খোঁজ পেলেই তাকে কেন্দ্র করে ভয়ানক সংঘর্ষ বেঁধে যাবে। সর্বদিক বিচার করে শেষে একটি পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হন। সাথে অবস্থানরত সাহাবায়ে কেরাম নিরাপত্তার জন্য তাঁকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখেন।

অতর্কিত হামলা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটবর্তী পাহাড়ের উদ্দেশে কিছু দূর অগ্রসর হতেই ইকরামা তার উপর অশ্বারোহী ইউনিট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ইকরামার আক্রমণের সংবাদ জনৈক পদাতিক সৈন্য জানতে পেরে সেও হামলা শুরু করে। এতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ কারো বেঁচে থাকার আশা সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়ে যায়। ত্রিশজন পুরুষ আর দুজন মহিলা সর্বমোট বত্রিশজন জানবাজ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেফাজতের জন্য তার চারপাশে মানব প্রাচীররূপে দণ্ডায়মান হয়ে যান।

অনেক পিছনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালিদের স্মরণ হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শারীরিক শক্তির বিচারেও অনন্য ছিলেন। তার জ্বলন্ত প্রমাণ, আরবের নামকরা মুষ্টিযোদ্ধা রুকানাকে তিনি তিন তিনবার উর্ধ্বে তুলে আছাড় দিয়েছিলেন। যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে তার শক্তি প্রদর্শনের আরেকবার সুযোগ হয়ে যায়। মানববর্মের ঐ প্রাচীর যা নিবেদিত প্রাণ সাহাবায়ে কেরাম তার চারপাশে লৌহ প্রাচীরবৎ স্থাপন করেছিল তা তিনি নিজেই ভেঙ্গে ফেলেন। তার হাতে তখন শোভা পাচ্ছিল ধনুক। তুমীর তীরে ভরা ছিল। এ সময় খালিদ মুসলমানদের বড় অংশটির সাথে লড়াইয়ে রত ছিলেন। তাকে যখন পরবর্তীতে জানানো হয় যে, ত্রিশজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা যোদ্ধা নিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সাথে মরণপণ যুদ্ধ করছেন, তখন তার মুখ হতে আবার এ কথা বেরিয়ে আসে যে, এটা দৈহিক শক্তি হতে পারে না; অদৃশ্য কোন শক্তি হবে। এ সময় থেকে একটি প্রশ্ন তাকে খুব তাড়া করে ফেরে– দৃঢ় বিশ্বাস কি কখনো শক্তির রূপ ধারণ করতে পারে? তার গোত্রের কারো থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কেননা এ প্রসঙ্গ তুলতেই তার প্রতি এ অপবাদ দেয়া হত যে, সে মুহাম্মাদের জাদুর শিকার। মুহাম্মাদ তাঁকে জাদু করে দেয়া এ ধরনের অযৌক্তিক প্রশ্ন তারই প্রতিক্রিয়া মাত্র।

আজ মদীনাতে যাবার সময় সেই প্রশ্নটি আবার তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। উহুদ পর্বতের সারি ক্রমে তার সম্মুখে বৃদ্ধি পেতে থাকে। চার বছরের পেছনের স্মৃতি তাকে আবার এ পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যায় যেখানে তার নিজের নাম গুঞ্জরিত হচ্ছিল–“আবু সুলাইমান। আবু সুলাইমান!”

তিনি কল্পনায় অনুধাবন করতে চেষ্টা করছিলেন যে, মাত্র ত্রিশজন পুরুষ আর দুইজন মহিলা কি করে বিপুল সংখ্যক অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের মোকাবিলা করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃত্ত ভেঙ্গে নিজ হাতে তীর নিক্ষেপ করেন। সাহাবায়ে কেরাম দৌড়ে গিয়ে আবার তাঁকে বৃত্তের মাঝে নিয়ে নিতেন। এক সমর ঐতিহাসিকের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁকে ঘিরে রাখা বৃত্ত তিনি বারবার ভেঙ্গে যেদিক হতে দুশমন অগ্রসর হত সেদিকে তীর ছুরতেন। তাঁর দৈহিক শক্তি সাধারণ মানুষ থেকে কয়েক গুণ বেশি ছিল। তিনি ধনুক এত জোরে টানতেন যে, তীরের ফলা শরীরের এপাশ দিয়ে প্রবেশ করে ওপাশ দিয়ে বের হয়ে যেত। সেদিন তিনি অনেক তীর ছুড়েন। এত তীর ছুড়েন যে, এক সময় একটি তীর নিক্ষেপ করার সময় ধনুকই ভেঙ্গে যায়। তখন তিনি তুনীরের বাকী তীর হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে দিয়ে দেন। সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিশানা এড়ানো কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তার নিশানার কথা স্বীকার করতেন।

এদিকে আবু সুফিয়ান এবং খালিদের হাতে মুসলমানরা শহীদ হতে থাকে আর মুসলমানরা জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত মোকাবিলা করে যায়। আর এদিকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য উৎসর্গপ্রাণ ত্রিশজন পুরুষ আর দুইজন মহিলা এমন বেপরোয়া হামলা প্রতিহামলা চালায়, যেন তাদের দেহ নয়; আত্মা বিরামহীন লড়ে চলেছে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক তাবারী লিখেন যে, প্রতিজন মুসলমান একই সাথে চার-পাঁচজন কুরাইশের মোকাবিলা করেন। সে লড়াইয়ের চিত্র এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে, হয়তবা সাহাবী তাদের পিছু হটতে বাধ্য করতেন না হলে তিনি একাকী আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে লুটিয়ে পড়তেন।

♣♣♣

কুরাইশরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ সাহাবায়ে কেরামের অসাধারণ বীরত্বের সামনে টিকতে না পেরে একটু পিছু হঁটে তীরের আর পাথরের অবিরাম বর্ষণ শুরু করে। অতি উৎসাহী কিছু অশ্বারোহী দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হামলা করতে চাইলে সাহাবায়ে কেরামের নিক্ষিপ্ত তীর তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কুরাইশরা সম্মুখ যুদ্ধ বাদ দিয়ে দূর থেকে মুষলধারায় তীর এবং পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে।

ইকরামা খালিদকে এক ফাঁকে জানিয়ে দেয় যে, আবু দাজানা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠ শত্রুদের দিকে। তিনি একই সাথে দু’দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। প্রথমত হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তীর যোগান দিচ্ছিলেন। আর সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্ষিপ্রতার সাথে সে তীর ছুড়ছিলেন। দ্বিতীয়ত হযরত আবু দাজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তীর থেকে রক্ষা করতেও চেষ্টা করছিলেন। তীর এবং পাথর বৃষ্টির কারণে হযরত আবু দাজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর করুণ অবস্থা কারো নজরে পড়ে না। এক সময় তিনি লুটিয়ে পড়লে দেখা যায় যে, তার পিঠ অসংখ্য তীরের আঘাতে চালনীর মত হয়ে গেছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বাঁচাতে সেদিন কয়েকজন সাহাবী নিজের জীবন দিয়ে দেন। সাহাবায়ে কেরামের দুর্বার প্রতিরোধ ক্ষমতা ও রণমূর্তি দর্শনে ইকরামার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর উপর এমন ভীতি নেমে আসে যে, তারা পিছু হঁটে যায়। দীর্ঘ যুদ্ধে কুরাইশরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা জানতে চেষ্টা করেন। চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে শুধু রক্ত আর রক্তই তিনি দেখতে পান। আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার কোন পরিবেশই ছিল না। কোরাইশরা আরেকবার আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিল।

“কুরাইশদের আরেক ব্যক্তির ইন্তেজার করছি আমি।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বলেন।

“হে আল্লাহর রাসূল! কে সে?” জনৈক সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেন– “সে কি আমাদেরকে সাহায্য করতে আসছে?”

“না।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বলেন – “সে আমাকে কতল করতে আসবে। এতক্ষণ তার চলে আসার দরকার ছিল।”

“উবাই ইবনে খল্‌ফ” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপীষ্ঠের নাম বলে দেন।

উবাই ইবনে খল্‌ফ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কট্টর বিরোধী। সে ছিল মদীনার অধিবাসী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতের কথা জানতে পেরে সে একদিন তাঁর কাছে আসে এবং নানা ভাবে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তিনি অতি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে তা সহ্য করে বিনয়ের সাথে তাকে ইসলামের প্রতি আহবান জানান।

“তুমি কি আমাকে এতই দুর্বল মনে কর যে, তুমি বললেই তোমার ভিত্তিহীন মতবাদ মেনে নেব।” উবাই ইবনে খল্‌ফ ধৃষ্টতামূলক ভঙ্গিতে বলছিল– “আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখ মুহাম্মাদ! একদিন আমার ঘোড়াটি দেখে নিও। আমি তাকে যত্ন করে লালন-পালন করছি। কুরাইশদের সাথে আবার কখনো তোমার লড়াই হলে সেদিন আমি এই ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করে ফিরব। দেবতাদের নামে কসম করে বলছি, তোমাকে স্বহস্তে সেদিন কতল করব।”

“উবাই!” আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে তাকে জবাবে বলেছিলেন– “জীবন-মৃত্যু সে সত্তার হাতে, যিনি আমাকে নবুওয়াত দান করেছেন এবং পথহারা লোকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পণ করেছেন। এমন কথা বলো না যা আমার আল্লাহ ব্যতীত কেউ পূরণ করতে পারে না। এমনও তো হতে পারে যে, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসে নিজেই নিহত হবে।

উবাই ইবনে খল্‌ফ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই কথা অতি হালকাভাবে উড়িয়ে দেয় এবং বিদ্রূপের হাসি হেসে চলে যায়।

উবাই ইবনে খল্‌ফের সেই কথা যুদ্ধের এই শেষ পর্যায়ে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মনে পড়ে যায়। তিনি সাহাবায়ে কেরামের নিকট তার নাম নিতেই দূর থেকে এক অশ্বের পদধ্বনি শোনা যায়। সকলের দৃষ্টি আওয়াজের উৎসের দিকে নিবদ্ধ হয়।

“আমার প্রিয় সাথিগণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলেন– “আমার মন বলছে আগন্তক এ অশ্বারোহী সেই হবে। যদি সে উবাই হয় তাহলে তাকে বাধা দিবে না। তাকে আমার কাছাকাছি আসতে সুযোগ করে দিও।”

ঐতিহাসিক ওয়াকিদী এবং ইবনে হিশাম লেখেন আসলেও সে অশ্বারোহী সেই ইবনে খল্‌ফই ছিল। সে হুঙ্কার ছেড়ে বলছে– “প্রস্তুত হও মুহাম্মাদ। উবাই এসে গেছে।”

“দেখ আমি ঐ ঘোড়ায় চড়ে এসেছি, যা তোমাকে একদিন দেখিয়েছিলাম।”

“হে আল্লাহর রাসূল। তিন-চারজন সাহাবী সম্মুখে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন– “অনুমতি দিন, আপনার পর্যন্ত পৌঁছার আগেই তাকে শেষ করে দিই।”

“না।” জবাবে তিনি বলেন –“তাকে আসতে দাও। আমার কাছাকাছি আসুক… পথ খালি করে দাও।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথায় জিঞ্জির বিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ শোভা পাচ্ছিল। জিঞ্জিরগুলো মাথার নড়াচড়ায় তাঁর মুখমণ্ডলের সামনে এবং আগে পিছে ঝুলছিল। হাতে ছিল বর্শা, তরবারি ছিল কোষবদ্ধ। উবাইয়ের ঘোড়া চলে আসে একেবারে নিকটে।

“সামনে আয় উবাই।” গর্জে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “আমি ছাড়া কেউ তোর গায়ে হাত দেবে না।”

উবাই কাছে এসে ঘোড়া থামিয়ে বিদ্রূপাত্মক অট্টহাসি মারে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, তার বিশ্বাস ছিল যে, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অবশ্যই হত্যা করবে। তার তরবারিও কোষবদ্ধ ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকটে চলে আসেন। সে বড় শক্তিশালী ঘোড়ায় আসীন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মাটিতে দণ্ডায়মান। সে তরবারি কোষমুক্ত করছিল কিন্তু কোষমুক্ত হওয়ার আগেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তীব্র গতিতে তার প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করেন। একদিকে ঝুঁকে সে আঘাত এড়াতে চাইলেও আঘাত তাকে এড়ায়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিক্ষিপ্ত বর্শার ফলা তার ডান স্কন্ধের গলার পাশের হাড্ডির নীচে গিয়ে বিদ্ধ হয়। এতেই সে ঘোড়ার উপর থেকে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে এবং তার পাঁজরের হাড্ডি ভেঙ্গে যায়।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আঘাত তত ভারী ছিল না যে, উবাইয়ের মত শক্তিশালী লোক সোজা হতে পারবে না। সে ঘোড়ার অপর পার্শ্বে ভূপাতিত হয়েছিল। হয়তবা তার উপর ভীতি আপতিত হয়েছিল নতুবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আঘাতটি তার জন্য প্রত্যাশিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার তাকে আঘাত করতে অগ্রসর হলে সে উঠে ঘোড়া সেখানে ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। সে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিল যে – মুহাম্মাদ আমাকে হত্যা করেছে…। মুহাম্মাদ আমাকে মেরে ফেলেছে।”

কুরাইশরা কয়েকজন মিলে তার আহত স্থানটি পরীক্ষা করে তাকে সান্ত্বনা দেয় যে, তাকে কেউ হত্যা করেনি। আঘাত খুবই মামুলী। কিন্তু তার মধ্যে অদৃশ্য হতে এমন এক ভীতি জেঁকে বসে যে, সকল সান্ত্বনা প্রত্যাখ্যান করে শুধু এ কথাই বলতে থাকে যে, “আমি বাঁচব না। মুহাম্মাদ একদিন বলেছিল, আমি তাঁর হাতে নিহত হব।

ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম আরো লিখেন যে, উবাই এ কথাও বলছিল যে, “মুহাম্মাদ যদি আমার উপর কেবল থুথু নিক্ষেপ করত, তবুও আমি মরে যেতাম।”

শেষ পর্যন্ত উবাইয়ের কথাই সত্যে পরিণত হল। উহুদ যুদ্ধ শেষে উবাই কুরাইশদের সাথে মক্কা রওনা হয়। পথিমধ্যে এক জায়গায় তারা যাত্রাবিরতি করলে উবাই সেখানেই মারা যায়।

♣♣♣

স্মৃতি কথা বলে। চার বছর পূর্বের ঘটনা গতকালের ঘটনার মত খালিদের স্মরণ হতে থাকে। তার ধারণা ছিল, কুরাইশরা আজ মুসলমানদের পিষেই ফেলবে। কিন্তু মুসলমানরা যেভাবে জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাতে তিনি নিজেই কেঁপে ওঠেন। পদাতিক মুসলমানদের দেখে কুরাইশদের অশ্বগুলোও যেন ভয় পাচ্ছিল। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে খালিদ নিজের ঘোড়ায় পদাঘাত করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যেও আবু সুফিয়ানকে তালাশ করে তার কাছে পৌঁছে যান।

“আমরা কি মুসলমানদেরকে চুড়ান্তভাবে পরাস্ত করার যোগ্যতা রাখি না?” খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলেন– “কুরাইশ মায়েদের দুধ কি খাঁটি ছিল না যে, তারা এই কয়েকজন মুসলমানদের ভয়ে ভীত হচ্ছে?”

আবু সুফিয়ান বলে– “শোন খালিদ!” “মুসলমানদের সাথে মুহাম্মাদ যতক্ষণ থাকবে আর তারা জীবিত থাকবে, দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত তারা পরাজিত হবে না।

“তবে এই দায়িত্ব কেন আমার উপর অর্পণ করছ না?” খালিদ বললেন।

আবু সুফিয়ান বলে কখনও নয়।” “তুমি তোমার সৈন্যদের কাছে ফিরে যাও। তোমার নেতৃত্ব ছাড়া তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে। মুহাম্মাদ আর তাঁর সাথিদের উপর আক্রমণ করার জন্য পদাতিক বাহিনী পাঠাচ্ছি।”

আজ মদীনার উদ্দেশে যাত্রাকালে তাঁর সেদিনের পুরাতন অনুশোচনার কথা মনে পড়ে যে, আবু সুফিয়ান তার একটি বড় আশায় গুড়েবালি দিয়েছিল। রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করাকে তিনি নিজের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করে শীর্ষ দেবতা হুবল এবং উযযার সন্তুষ্টি লাভ করা ছিল তার ইচ্ছা। তবুও রণাঙ্গনে অধিনায়কের আদেশ শিরোধার্য মনে করে তিনি নিজ বাহিনীর নিকট চলে যান। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মাত্র কয়েকজন সাহাবী রয়েছেন। অতএব এ অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা মোটেও কঠিন হবে না। আর তাঁকে হত্যা করতে পারলে মুসলমানরা কোন দিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। রণাঙ্গনের দৃশ্য তার ভালভাবেই মনে ছিল। তিনি একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে রণাঙ্গনের দিকে চাইলে বহু দূর পর্যন্ত উহুদ-ভুমি রক্তের গাঢ় আস্তরণে আবৃত থাকতে দেখেন। ভূ-ভাগকে যেন কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিল। কোথাও ঘোড়া আহত হয়ে ছটফট করছিল আবার কোথাও রক্তস্নাত আহত সৈন্য কাতরাচ্ছিল। আহতদের উদ্ধার করার মানসিকতা এ মুহুর্তে কারো ছিল না।

এক সময় তিনি দেখতে পান যে, কুরাইশ পদাতিক সৈন্যরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তারা প্রচণ্ড আক্রমণ করে সাহাবায়ে কেরামের বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলেছে। উতবা ইবনে আবী ওয়াক্কাস, আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব এবং ইবনে কুময়া এ তিন নরাধম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে লক্ষ্য করে পাথর বর্ষণ শুরু করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এক ভাই উতবা যাঁর প্রাণনাশে লিপ্ত অপর সহোদর ভাই সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ঠিক তারই প্রাণ রক্ষার্থে নিবেদিত। এ সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অবস্থানরত সাহাবায়ে কেরামগণ না থাকার মতই ছিল। হয়তোবা তাঁরা লড়তে লড়তে বিক্ষিপ্ত হয়ে দূরে সরে গিয়েছিলেন।

উতবার নিক্ষিপ্ত একটি পাথরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিচের দন্তপাটির দু’টি দাঁত শহীদ হয়। নিচের ঠোঁটও কেটে যায়। আব্দুল্লাহর পাথরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কপালে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ইবনে কুময়া একদম নিকট থেকে স্বজোরে পাথর মারায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিরস্ত্রাণের সাথে ঝুলন্ত জিঞ্জিরের দু’টি কড়া ভেদে গণ্ডদেশে প্রবেশ করে। এতে চেহারা মুবারকের হাড়ও মারাত্মক আক্রান্ত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্শার সাহায্যে শত্রুকে আক্রমণ করতে খুব চেষ্টা করেন। কিন্তু শত্রু তাঁর নাগালের মধ্যে আসছে না। অসংখ্য আঘাতে জর্জরিত শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে তিনি ভূতলে লুটিয়ে পড়েন। হযরত তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রু সৈন্যের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে লুটিয়ে পড়তে দেখে দ্রুত তার কাছে আসেন। তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আহবানে ইতোমধ্যে আরেক সাথি চলে আসেন। পাথর নিক্ষেপে আহতকারী কুরাইশ পাপিষ্ট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্যে তরবারি উত্তোলন করতে উদ্যত হলে হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সহোদর ভাই উতবাকে আক্রমণ করেন। উতবা ভাইয়ের ক্রোধ ও রূদ্রমূর্তি দেখে পেছনে সরে যায়।

আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ধরে উঠান। তিনি পুরোপুরি হুঁশেই ছিলেন। এ সময় অন্যান্য মুসলমানরা আক্রমণকারীদের সরিয়ে দেয়। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার একটাই কথা “যে ভাই আমার সম্মুখে আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আক্রমণ করেছে, আমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করে তার দেহ টুকরো টুকরো করে ক্ষান্ত হবো। তিনি একাই কুরাইশদের প্রতি এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। বড় কষ্টে তাঁকে শান্ত করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শান্ত হওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি কখনোই শান্ত হতেন না।

♣♣♣

সম্ভবত কুরাইশরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এ সময় সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমাগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে সুযোগ পান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জখম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সাথে থাকা নারীগণ তাকে পানি পান করায়, ক্ষত পরিস্কার করে। শিরস্ত্রাণের জিঞ্জিরের ভাঙ্গা কড়া তার গণ্ডদেশে তখনো বিদ্ধ ছিল। প্রখ্যাত আরব সার্জনের ছেলে হযরত আবু উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু এগিয়ে এসে কড়া দু’টি খুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু হাত দ্বারা বের করতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি দাঁত দ্বারা একটি কড়া টেনে বের করে আনেন। দ্বিতীয় কড়াও এভাবে দাঁত দ্বারা টেনে উঠান। কিন্তু কড়ার সাথে তার দু’টি দাঁতও ভেঙ্গে যায়। এ কারণে মানুষ তাঁকে “আল্-আছরাম” বলে ডাকতে থাকে। আছরাম অর্থ যার সামনের দু’টি দাঁত নেই। পরবর্তীতে এ নামটি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভূমিষ্ঠকালীন নার্স হযরত উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেহের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন কোন তীর যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরীরে বিদ্ধ হতে না পারে। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে সামলে নেন। হঠাৎ করে একটি তীর এসে উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর পৃষ্ঠদেশে বিদ্ধ হয়। এর সাথে সাথে দূর থেকে এক অট্টহাসির শব্দও ভেসে আসে। সবার দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে গেলে দেখা যায় যে, হাব্বান ইবনে আরাকা নামক এক কুরাইশ নরাধম দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার হাতে ছিল ধনুক। সদ্য বিদ্ধ তীরটি সেই ছুঁড়েছিল। সে হাসতে হাসতে ফিরে যেতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একটি তীর দিয়ে বলেন, এ নরাধম এখান থেকে তীর নিয়েই ফিরবে। সবার মাঝে তীরন্দাজিতে সেরা ব্যক্তি হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু ধনুকে তীর সংযোজন করে হাব্বানকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেন। তীর হাব্বানের গলায় গিয়ে বিদ্ধ হয়। এতে সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথের সাহাবীগণ জোরে হেসে উঠে তার যথার্থ প্রতিশোধ গ্রহণের কথা মনে করিয়ে দেন। হাব্বান রাগে-ক্ষোভে চোখ বড় বড় করে কয়েক কদম সামনে এসে লুটিয়ে পড়ে।

খালিদ মদীনার দিকে যতই এগিয়ে যেতে থাকেন, উহুদের পর্বতগুলো ততই যেন উর্ধ্বে উঠতে থাকে। এ সময় পুরাতন কিছু সঙ্গী সাথির কথা তার মনে পড়ে যায়। আকীদা-বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে ভাইকে ভাইয়ের দুশমনে পরিণত করেছিল। সাথে সাথে এ বিষয়টিও তার চিন্তায় ধরা পড়ে যে, কতক লোক শুধু আনসারী হওয়ার কারণেই নিজ আকীদা-বিশ্বাসকে সত্য বলে মনে করে। সত্য-মিথ্যা ও আসল-নকলের ব্যবধান করা যে কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার গভীর জ্ঞান এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব।

জিজ্ঞাসার আলামত নিয়ে একটি বাক্য বারবার তার সামনে এসে দাড়ায়–“মদীনায় যাচ্ছি কেন?… নিজের আকীদা-বিশ্বাসে মদীনাবাসীকে দীক্ষিত করতে না-কি তাদের আকীদা-বিশ্বাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে?” ঠিক এ মুহূর্তে আবু সুফিয়ানের একটি বেসুরা কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে, যা এর পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বলেছিল– “এ সংবাদ কি সত্য যে, তুমি মদীনায় যাচ্ছ? তোমার ধমনীতে প্রবাহিত ওলীদের লাল রক্ত কি তাহলে সাদা হয়ে গেছে?”

মরুভূমি পাড়ি দেয়ার সময় অনেক দূর পর্যন্ত এ আওয়াজ তার পেছনে ধাওয়া করে তারপর এক সময় তিনি স্বাভাবিক হয়ে ঐসব বন্ধুদের চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান, যাদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ব্যবহার করেন এবং যাদের রক্ত তার চোখের সামনে দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অন্যতম।

রণাঙ্গনকে পিছনে ফেলে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়। কিছুদূর অগ্রসর হতে না হতেই খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে আবু সুফিয়ানের পথ রোধ করে দাঁড়ান। অপূর্ণতার বেদনা এবং চাপা ক্ষোভ নিয়ে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেন, যুদ্ধকে মাঝপথে রেখে তোমরা কোথায় যাচ্ছো? মুসলমানদের সৈন্য-বল নিঃশেষ হয়ে গেছে। চুড়ান্ত পরাজয় তাদের সুনিশ্চিত। চলো, তাদের মূলোৎপাটন করেই আমরা ফিরব। আবু সুফিয়ানের ইচ্ছা ছিল, এ যুদ্ধে একটি চূড়ান্ত ফলাফলে উপনীত হওয়া। কিন্তু সৈন্যদের অবসন্নতা দেখে সে আর ঝুকি নিল না। খালিদের প্ররোচনায় কয়েকজন অশ্বারোহী ফিরতি পথ থেকে পুনরায় উহুদ অভিমুখে ঘুরে দাঁড়ায়। খালিদ ইতোপূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান তখন তাকে সেখানে যেতে না দিয়ে কতক পদাতিক সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরো কিছু সাহাবী চলে আসেন।

ইবনে কুময়া মানব বৃত্ত ভেঙ্গে আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করে। হযরত মুসআব ইবনে উমাইয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে দণ্ডায়মান। হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা আহত দু’সৈনিককে পানি পান করাচ্ছিলেন। কুরাইশদেরকে পুনরায় হামলা করতে দেখে তিনি আহতদের ছেড়ে তাদেরই একজনের তরবারি নিয়ে দুশমন নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুশমনরা অশ্বারোহী থাকায় তার পক্ষে সরাসরি শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য তিনি তীব্রবেগে তলোয়ার চালান শত্রুবহনকারী অশ্বকে লক্ষ্য করে। এতে অশ্ব যেমনি লুটিয়ে পড়ে তেমনি আরোহীও অন্য পাশে ছিটকে পড়ে। আরোহী ছিটকে পড়তেই হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেন। এতে সে মারাত্মক আহত হয়ে দৌড়ে পালায়।

গঠনশৈলী এবং চেহারার দিক দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বেশ মিল ছিল। ইবনে কুময়া হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করে তার উপর হামলা চালায়। তিনি প্রস্তুত ছিলেন। বীরবিক্রমে তার মোকাবিলা করেন। কিছুক্ষণ উভয়ের মধ্যে অস্ত্রের তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। এক সময় ইবনে কুময়ার তলোয়ার হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মারাত্মক আঘাত করলে তিনি ভূ-তলে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে যান। হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ঢলে পড়তে দেখে তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ইবনে কুময়ার উপর হামলা করেন। কিন্তু তার হামলা সফল হয়নি। কারণ ইবনে কুময়া বর্ম পরিহিত ছিল আর হামলাকারিনী ছিল এক মহিলা। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে ইবনে কুময়া উম্মে আম্মারার কাঁধে আঘাত করে। এতে তিনি মারাত্মক আহত হয়ে পড়েন।

এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছেই ছিলেন। তিনি ইবনে কুময়ার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু সে প্রান্ত বদল করে খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরেই আঘাত করে বসে, যা তার শিরস্ত্রানে গিয়ে চোট লাগে। শিরস্ত্রাণ পিচ্ছিল থাকায় তরবারি সেখান থেকে স্কন্ধের উপর গড়িয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঠিক পশ্চাতে একটি গর্ত ছিল। কঠিন আঘাতে পিছনে সরে গেলে তিনি উক্ত গর্তে পড়ে যান। ইবনে কুময়া সেখান থেকে ফিরে এসে চিৎকার করে করে বলতে থাকে– “আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।” সে রণাঙ্গনে ঘুরে ফিরে চিৎকার করে এ কথাই বলতে থাকে। তার এই গগনবিদারী আওয়াজ মুসলমানরাও শুনতে পান কুরাইশদেরও কানে পৌঁছে।

কুরাইশরা এ খবরে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। কিন্তু বিরাট সর্বনাশ মুসলমানদের হয়। এ সংবাদে তাদের মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। তারা মনোবল হারিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যেতে থাকে।

“নবী-প্রেমিক মুজাহিদ বাহিনী।” পলায়নপর মুজাহিদদের কর্ণে একটি আওয়াজ গুঞ্জরিত হয়– “নবী বেঁচে না থাকলে যে জীবন বাঁচাতে আমরা পালাচ্ছি তার প্রতি অভিসম্পাত হোক। তোমরা কেমন নবী-প্রেমিক যে, তাঁর শাহাদাতের সাথে সাথেই মৃত্যু ভয়ে পালাচ্ছ?”

থমকে দাঁড়ায় মুসলমানরা। এই আহ্বান তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনে পরিণত করে। তারা পদাতিক হওয়া সত্ত্বেও কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সে বাহিনী ছিল খালিদ ও ইকরামার দুর্ধর্ষ বাহিনী।

খালিদ এর আজ একের পর এক মনে পড়ছিল। পিছনের স্মৃতি। সেদিন তার হাতে অসংখ্য মুসলমান মারাত্মকভাবে আহত-নিহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে হযরত রেফায়া রাযিয়াল্লাহু আনহুও ছিল। সেদিনের কথা স্মরণ হতেই তার অন্তরে এক ধরনের বেদনা অনুভূত হয়। নির্বিচার রক্তপাত তার নিকট অর্থহীন মনে হলেও সেদিন মুসলমানরা ছিল তার সর্বনিকৃষ্ট শত্রু।

এক সময় সত্যই মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। পদাতিক হয়ে কতক্ষণ অশ্বারোহীদের মোকাবিলায় টেকা যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পাহাড়ের দিকে চলে যেতে থাকে। গনিমতের মালের আশায় মুসলমানরা যেমনিভাবে তাদের মোর্চা ত্যাগ করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তেমনি কুরাইশরাও এ সময় গনিমত সংগ্রহ করতে নিহত ও আহত মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কতক কুরাইশ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পশ্চাদ্ধাবনে যায়। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তাদেরকে এমন শিক্ষা দেয় যে, অধিকাংশই সেখানে মারা যায়। আর যে কয়জন জীবিত ছিল তারা কোন রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসে। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যান। তিনি সেখান থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। নিবেদিত প্রাণ ত্রিশজন সাহাবীর ষোলজন শহীদ হয়ে যান। অবশিষ্ট চৌদ্দজনের অধিকাংশই ছিল আহত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের উপর থেকেই পুরো রণাঙ্গনের খবর সংগ্রহ করে চতুর্দিকে নজর বুলান। কিন্তু কোন মুসলমান তিনি দেখতে পাননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাহাদাতের খবর শুনে অত্যন্ত হতাশ হয়ে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। অনেকে মদীনায় চলে যায়। কেউ কেউ কুরাইশদের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকান।

যুদ্ধ প্রায় শেষ। হামলার আর আশঙ্কা নেই। এই অবসরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জখমের প্রতি মনোনিবেশ করেন। নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা পিতার খোঁজে চারদিকে ঘুরে ঘুরে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এখানে এসে তিনি পিতার সন্ধান পান। নিকট দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটি ঝর্ণা আপন মনে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে পানি এনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পান করান। হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা নিজ হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জখম পরিষ্কার করতে থাকেন। এ সময় তিনি পিতার কষ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।

♣♣♣

খালিদের স্মরণ হয়, সেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাহাদাতের সংবাদ তাকে আত্মিক প্রশান্তি দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী আরেকটি আওয়াজে তিনি চমকে ওঠেন। তার আত্মিক প্রশান্তি হাওয়ায় মিশে যায়। উপত্যকার এই আওয়াজের ওজন বহু দূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কেউ চিৎকার করে বলছিল– “মুসলমানগণ! সুসংবাদ শোন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে এবং নিরাপদে আছেন” এই ঘোষণায় খালিদের যেমনি হাসি পায় তেমনি আফসোস হয়। মন্তব্যস্বরূপ তিনি মনে মনে বলেন, হয়ত কোন মুসলমান উন্মাদ হয়ে প্রলাপ বকছে।

প্রকৃত ঘটনা হল, মুসলমানরা যেরূপভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, হযরত কাব বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহুও ঠিক তেমনি একা একা ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের ঐ স্থানে গিয়ে পৌঁছান, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জীবিত দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। আনন্দের আতিশয্যে তিনি শ্লোগান দিতে থাকেন–“আমাদের নবী বেঁচে আছেন। তাঁর এই শ্লোগান মুসলমানদের জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। মুহুর্তে তাদের হতাশা কেটে যায়। একজন, দুইজন, চারজন করে করে যারা এতক্ষণ বিক্ষিপ্ত বিষন্ন মনে ইতস্তত ফিরছিল এ আওয়াজ শুনে তারা দ্রুত আসে। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুও এই আওয়াজ শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে পৌঁছান।

এর পূর্বে আবু সুফিয়ান রণাঙ্গনে পড়ে থাকা লাশ ওলট-পালট করে দেখে সে খুঁজছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর লাশ। অনেকক্ষণ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে এবার সে যাকেই সামনে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, তুমি মুহাম্মাদের লাশ দেখেছ? এক পর্যায়ে খালিদের সাথে তার দেখা হয়।

আবু সুফিয়ান সোৎসাহে জিজ্ঞেস করে “খালিদ!” “তুমি মুহাম্মাদের লাশ দেখেছ কি?”

“না।” খালিদ অল্পকথায় জবাব দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে পাল্টা প্রশ্ন করে– মুহাম্মদ নিহত হয়েছে তুমি নিশ্চিত?

আবু সুফিয়ান জবাবে বলে “হ্যাঁ।” সে নিহত না হলে আমাদের হাত থেকে কোথায় গিয়ে বাঁচতে পারে?… কেন, এ ব্যাপারে তোমার কোন সন্দেহ আছে?

“হ্যাঁ, আবু সফিয়ান!” খালিদ জবাব দেন– “আমি ততক্ষণ সন্ধিহান থাকব যতক্ষণ না নিজের চোখে তার লাশ দেখব। মুহাম্মাদ এত সহজে নিহত হবার লোক নন।”

“তোমার কথা থেকে কেমন যেন মুহাম্মাদের জাদুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।” “মুহাম্মাদ কি এক সময় আমাদেরই মানুষ ছিল না?” তুমি কি তাকে চেন না? যে ব্যক্তি এত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী সে একদিন নিহত হবেই। নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। যাও, তার মরদেহ শনাক্ত কর। আমরা তার মস্তক কেটে মক্কায় নিয়ে যাব।”

ঠিক এই সময় পাহাড়ের বুক চিরে কা’ব বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কণ্ঠ বেজে উঠে– “হে মুসলিম ভাইয়েরা। সুসংবাদ শোন, আমাদের নবী জীবিত এবং নিরাপদ।” এই আওয়াজ বজ্রধ্বনির মত প্রতিধ্বনি তোলে। পাহাড়ের গা বেয়ে উপত্যকার ভাঁজে ভাঁজে এবং রণাঙ্গনের কোনায় কোনায় এ গুরুগম্ভীর গুঞ্জন বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে।

‘শুনেছ আবু সুফিয়ান।” খালিদ বলেন– “মুহাম্মাদ কোথায় তা আমি জানি। আমি তার উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছি। কিন্তু এ নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে, অবশ্যই তাকে হত্যা করে আসতে পারব।”

কিছুক্ষণ পূর্বে খালিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সাহাবায়ে কেরামকে পাহাড়ের মধ্যভাগে আশ্রয় নিতে দেখেন। তিনি দূর থেকে ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন। পরাজয় মেনে নেয়া কিংবা ইচ্ছা অপূর্ণ রাখার মত লোক তিনি ছিলেন না। তিনি কয়েকজন অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের ঐ স্থানের দিকে যেতে থাকেন, যেখানে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যেতে দেখেছিলেন।

ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদকে অশ্বারোহী নিয়ে এই ঘাঁটিতে অপারেশন চালাতে আসতে দেখে তৎক্ষণাৎ তার মুখ থেকে এ দুআ বের হয়– “ইলাহী! এখানে পৌঁছার পূর্বেই পথিমধ্যে কোথাও তাকে থামিয়ে দিন।”

খালিদ অশ্বারোহীদের নিয়ে ঘাঁটির উদ্দেশে পাহাড়ের গা ঘেষে উপরে উঠতে থাকে। এটা মূলত একটি গিরিপথ ছিল, যা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছিল। সৈন্যদের পাশাপাশি চলা আর সম্ভব হচ্ছিল না। লাইন দিয়ে চলতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু খালিদ বাহিনীকে আসতে দেখে নাঙ্গা তরবারি হাতে কিছুটা নিচে নেমে আসেন।

“ওলীদের পুত্র। ক্রুদ্ধ স্বরে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন–“লড়াই সম্বন্ধে একটু জ্ঞান থাকলে গিরিপথের এই সংকীর্ণ রাস্তা অবলোকন কর। পথের ক্রম-উর্ধ্বতার কথাও ভাব। এমন নাজুক স্থানে কি তোমার বাহিনী আমাদের হাত থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে?”

যুদ্ধের ব্যাপারে খালিদ ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ। তিনি হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কথায় সংকীর্ণ গিরিপথটি আরেকবার তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। অশ্বকে ইচ্ছামত ঘুরিয়ে যুদ্ধ করার জন্য জায়গাটি মোটেও উপযুক্ত ছিল না। বরং অত্যন্ত বিপদসংকুল ছিল। বিচক্ষণতার বিচারে অবস্থা অনুকূলে না থাকায় তিনি অশ্ব ঘুরিয়ে সৈন্যদের নিয়ে নিচে চলে আসেন।

যুদ্ধ শেষ। কুরাইশরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের প্রাধান্য দাবি করতে পারে যে, তারা মুসলমানদের প্রচুর ক্ষতি করেছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের তারা দাবি করতে পারে না। কারণ এক প্রকার অমীমাংসিতভাবেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

“না, সেদিন আমাদেরই পরাজয় হয়।” খালিদের মনের ভিতর থেকেই একটি আওয়াজ ওঠে– “মুসলমানরা মাত্র ৭০০ আর আমরা ছিলাম ৩,০০০। তাদের মাত্র দু’টি ঘোড়া আর আমাদের ঘোড়া ছিল ২০০। মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারলে তবেই আমাদের চুড়ান্ত বিজয় হত।

খালিদ নিজের মধ্যে এক প্রকার কম্পন অনুভব করে। তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তিনি দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকেন। যুদ্ধের শেষ দৃশ্যগুলো তার কল্পনায় একটা একটা করে পাখা মেলে তার চোখের সম্মুখে উড়তে থাকে। তিনি এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে মাথা ঝাঁকি দেন। কিন্তু স্মৃতিগুলো মাছির ন্যায় তাঁর মাথায় ভন ভন করে ঘুরতে থাকে। তিনি এ ভেবেও মনে মনে লজ্জা অনুভব করেন যে, একজন যোদ্ধার জন্য এমনটি শোভা পায়না। অতীতের স্মৃতি যোদ্ধাকে কখনো তাড়িয়ে ফেরে না।

হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সতর্কের ভিত্তিতে গিরিপথ থেকে ফেরার সময় খালিদের চোখ দ্রুত একবার রণক্ষেত্রে ঘুরে আসে। বিক্ষিপ্ত আর ছিন্ন ভিন্ন লাশে তার চোখ দু’টি ভরে উঠে। এদের মধ্যে অচেতন সৈন্যের সংখ্যাও কম ছিল না। কি লাশের সৎকার ও আহতদের উদ্ধার করার কোন উদ্যোগ কোন পক্ষ থেকেই লক্ষ্য করা যায়নি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার প্রতি আটকে যায়। খঞ্জর হাতে সে দ্রুতবেগে রণাঙ্গনে ঘুরছিল। তার ইশারায় অন্যান্য কুরাইশ নারীরাও তার পিছু পিছু দৌড়ে আসে। হিন্দা দীর্ঘকায় এবং বলিষ্ঠ বীরের ন্যায় মহিলা ছিল। সে প্রত্যেকটি লাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। কোন লাশ নিম্নমুখী হয়ে পড়ে থাকলে সে পদাঘাতে লাশের মুখ সোজা করে চিনতে চেষ্টা করছিল। সে তার সঙ্গী মহিলাদের জানায় যে, আমি হামযার লাশ তালাশ করছি।

হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর লাশ এক সময় সে দেখতে পায়। লাশ শনাক্ত করা মাত্রই সে তাঁর উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোপাথাড়ি কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে। কয়েকটি অঙ্গ কেটে দূরে নিক্ষেপ করে। কাছে দাঁড়ানো মহিলাদের দিকে একবার চোখ বুলায়।

“দাঁড়িয়ে কি দেখছ?” হিন্দা উন্মাদের মত মহিলাদের বলে–“দেখলে তো আমার পিতা, চাচা এবং পুত্র হত্যাকারী লাশের অবস্থা কি করে ছাড়লাম। তোমরাও যাও, মুসলমানদের প্রত্যেকটি লাশের অবস্থা অনুরূপ কর এবং সকলের নাক, কান কেটে নিয়ে এস।”

মহিলারা মুসলমানদের লাশ কাটতে গেলে হিন্দা খঞ্জর দিয়ে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পেট ফেঁড়ে ফেলে। সে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কি যেন তালাশ করে।

হাত বের করে নিয়ে আসলে হাতে ছিল হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কলিজা। সে খঞ্জর দ্বারা কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করে। এতেও তার হিংসা নিবৃত্ত হল না। এক টুকরা কলিজা মুখে দিয়ে হিংস্র জন্তুর ন্যায় চিবাতে থাকে। এই টুকরাটি গিলতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। বাধ্য হয়ে তা উদগিরন করে দেয়। এভাবে সে তার দীর্ঘ দিনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে।

খালিদ এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে যান। তিনি দেখতে পান অল্প দূরেই আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দার এই পশুসুলভ আচরণে তাকে দারুণ পীড়া দিচ্ছিল। খালিদ একজন বীর যোদ্ধা। সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়াই ছিল তার নেশা ও পেশা। শত্রুর লাশের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করা তার কেবল অপ্রিয়ই ছিল না, বরং তিনি এ আচরণকে সম্পূর্ণ ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন।

আবু সুফিয়ানকে দেখেই খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা তার সামনে এসে দণ্ডায়মান হন।

“আবু সুফিয়ান!” খালিদ ক্রোধ এবং তাচ্ছিল্য মিশ্রিত ভঙ্গিতে বলেন– “তোমার স্ত্রী এবং অন্যান্য মহিলাদের এই হিংস্র আচরণ তুমি কি সমর্থন কর?”

আবু সুফিয়ান খালিদের প্রতি এমন দৃষ্টিতে তাকায়, যার মধ্যে বুঝা যাচ্ছিল সে সম্পূর্ণ অসহায় এবং তার এই দৃষ্টিই বলে দেয় যে, লাশের সাথে তার স্ত্রীর এই আচরণ আদৌ তার পছন্দ নয়।

“চুপ রইলে কেন আবু সুফিয়ান? কথা বলো।” আবু সুফিয়ানের মনোভাব সম্পর্কে স্পষ্ট হতে খালিদ ঝাঁঝালো স্বরে জানতে চান।

“খালিদ! হিন্দার চরিত্র তোমার অজানা নয়।” আবু সুফিয়ান থমথমে আওয়াজে বলে– “ওর অবস্থা এখন উন্মাদ থেকে খারাপ। আমি কিংবা তুমি তাকে নিবৃত্ত করতে গেলে সে আমাদের পেট ফেঁড়ে ফেলবে।”

খালিদ হিন্দাকে ভাল করেই চিনতেন। তিনি আবু সুফিয়ানের অসহায়ত্ব বুঝতে পারেন। আবু সুফিয়ান মাথা নত করে থেকে এক সময় ঘোড়ার লাগাম টেনে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। খালিদও বেশিক্ষণ এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি।

হিন্দা হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কলিজা চিবিয়ে পরে যখন উদগিরণ করে দেয় তখন পিছনে কারো পদধ্বনি শুনে ফিরে তাকায়। তার পেছনে ওয়াহশী দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে আফ্রিকী বর্শা। এই বর্শার আঘাতেই সে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করে।

“ইবনে হারব! এখানে কি করছ।” হিন্দা নির্দেশের সুরে তাকে বলে– “যাও, অন্যান্য মুসলমানের লাশও এভাবে টুকরো টুকরো কর।”

ওয়াহশী মুখে খুবই কম কথা বলত। সে তার বেশির ভাগ প্রয়োজন ইশারায় পূরণ করত। সে হিন্দার নির্দেশ পালনের পরিবর্তে স্বীয় হস্ত হিন্দার সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়। ওয়াহশীর দৃষ্টি ছিল হিন্দার গলায় শোভিত স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি। এতেই পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা হিন্দার মনে পড়ে যায়। সে যুদ্ধের শুরুতে ওয়াহশীর সাথে এ ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ হয় যে, তুমি আমার পিতা, চাচা ও পুত্রের নিধনকারীকে হত্যা করতে পারলে আমার সকল অলঙ্কার তোমার হবে। এখন ওয়াহশী সেই পূর্ব ঘোষিত পুরস্কার নিতে এল। তার আগমনের কারণ বুঝতে পেরে হিন্দা তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার গায়ের সমস্ত অলঙ্কার খুলে ওয়াহশীর প্রসারিত হাতে তুলে দেয়। মূল্যবান পুরস্কার পেয়ে ওয়াহশী মুচকি হেসে হেসে চলে যায়। হিন্দার বিবেক-বুদ্ধি এ সময় বিজয় এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় আচ্ছন্ন ছিল।

হিন্দা ভাবাবেগে ওয়াহশীকে ডাক দেয় দাড়াও ইবনে হারব।” সে নিকটে এলে হিন্দা বলে– “আমি তোমাকে এ কথা দিয়েছিলাম যে, আমার অন্তর শান্ত করতে পারলে আমার যাবতীয় অলঙ্কার তোমাকে দিয়ে দিব। কিন্তু তুমি এর চেয়েও বেশি পুরস্কারের যোগ্য।” অতঃপর হিন্দা কুরাইশ রমণীদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে– তুমি জানো এদের মধ্যে দাসী কে কে? সকলেই যুবতী এবং রূপসী। এদের যাকে তোমার পছন্দ হয় নিয়ে যাও।”

ওয়াহশী চিরাচরিত অভ্যাস মত নীরবে কিছুক্ষণ হিন্দার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তবুও তার দৃষ্টি দাসীদের দিকে ফিরেনা। সে হিন্দার প্রস্তাব সমর্থন না করার ভঙ্গিতে মাথা দোলায় এবং সেখান থেকে চলে যায়।

রণাঙ্গনের এহেন বীভৎস অবস্থায়ও এক সময় হিন্দার উচ্চ সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসে। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে হিন্দা সুরেলা কণ্ঠে যে গানের আওয়াজ তুলে তার কিছু কথা ছিল এমন :

বদর প্রশ্নে এখন আমরা সমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি।

এক ভয়ানক যুদ্ধের প্রতিশোধ আরেক ভয়ানক যুদ্ধের মাধ্যমে নিয়েছি।

উতবার বেদনা আমার সহ্যের বাইরে ছিল;

সে আমার পিতা ছিল।

চাচার ব্যথায় আমি মুহ্যমান, পুত্রের শোকে আমি উন্মাদ।

এখন আমার অশান্ত মন শান্ত; তপ্ত হৃদয় শীতল।

আমি আজীবন ওয়াহশীর প্রতি কৃতজ্ঞ;

আমার হাড্ডিগুলো কবরে মাটির সাথে মিশে একাকার না হওয়া অবধি।

♣♣♣

আবু সুফিয়ান তার স্ত্রীর পশু সুলভ আচরণ ও দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। সে প্রথম দর্শনেই মুখ ফিরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। আবু সুফিয়ান এক সময় তার দুই সাথিকে বলে, তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, মুহাম্মাদ এখনও বেঁচে আছে।

“খালিদ হয়তবা দূর থেকে অন্য কাউকে দেখে মনে করেছে যে, সে মুহাম্মদ।” একজন আবু সুফিয়ানকে বলে।

“আমি স্বচক্ষে দেখে আসব” এই কথা বলে আবু সুফিয়ান ঐ গিরিপথের দিকে যেতে থাকে, যার কাছ থেকে খালিদ অশ্বারোহীদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। সে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে উঠতে ঐ স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়, সেখান থেকে মুসলমানদের বসে থাকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল।

আবু সুফিয়ান জোর আওয়াজে বলে “মুহাম্মাদ ভক্তবৃন্দ।” –“মুহাম্মাদ জীবিত আছে?”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আওয়াজ শুনে নিকটস্থ মুসলমানদের ইশারায় চুপ থাকতে বলেন। আবু সুফিয়ান উচ্চঃস্বরে পুনরায় মুসলমানদের লক্ষ্যে প্রশ্নটি ছুঁড়ে মারে। এবারও সে কোন জবাব পেলনা।

“আবু বকর জীবিত আছে?” আবু সুফিয়ান জানতে চায়। কিন্তু তিন তিনবার এভাবে জিজ্ঞাসা করার পরও প্রতিপক্ষ থেকে কোন জবাব এলোনা।

“ওমর জীবিত আছে?” আবু সুফিয়ান তৃতীয় প্রশ্ন করে। মুসলমানগণ পূর্বের মতই নীরব রইলেন।

আবু সুফিয়ান কোন জবাব না পেয়ে ঘোড়ার দিক পরিবর্তন করে। সে নীচে অবতরণ করে দেখে, সেখানে কুরাইশদের উপচে পড়া ভীড়। সকলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সঠিক সংবাদ জানতে ভীষণ উদগ্রীব।

“হে কুরাইশ সম্প্রদায়।” আবু সুফিয়ান উপস্থিত জনতার মাঝে উচ্চঃস্বরে ঘোষণা করে– “তোমরা নিশ্চিত হও। মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। আবু বকর এবং ওমরও বেঁচে নেই। এখন মুসলমানরা তোমাদের ছায়া দেখেও ভয় পাবে। আনন্দ কর। নাচ।”

আবু সুফিয়ানের এ ঘোষণা শুনে কুরাইশরা আনন্দে ফেটে পড়ে। তারা নেচে গেয়ে উল্লাস করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে পাহাড়ের বুক চিরে এক আওয়াজ তাদেরকে নীরব করে দেয়। তাদের আনন্দ-উল্লাস মুহূর্তেই নিরানন্দে পরিণত হয়।

গিরিশৃঙ্গ হতে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গুরুগম্ভীর স্বর ভেসে আসে “আল্লাহর দুশমন!” “এতগুলো মিথ্যা বলো না, এভাবে নগ্ন মিথ্যাচার করো না। নাম ধরে ধরে যাদেরকে মৃত বলছ, তারা সবাই জীবিত। জাতিকে ধোঁকা দিও না। তোমার পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য আমরা তিনজনই বেঁচে আছি।”

আবু সুফিয়ান ঠাট্টাচ্ছলে অট্টহাসি দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে– “ইবনে খাত্তাব! তোমার আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুক। তুমি এখনও আমাদের শাস্তির কথা বলছ? তুমি নিশ্চিত করে বলতে পার যে, মুহাম্মাদ বেঁচে আছে?”

‘আল্লাহর কসম! আমাদের নবী জীবিত।” হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জবাব আসে– “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের প্রতিটি শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।”

আরবের প্রথা ছিল, যুদ্ধ শেষে দু’পক্ষের অধিনায়ক একে অপরের প্রতি ব্যঙ্গোক্তির তীর ছুড়ত। আবু সুফিয়ান সে প্রথা অনুযায়ী দূরে দাঁড়িয়ে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে কথা চালাচালি করতে থাকে।

“তোমরা হুবল এবং উযযার সম্মান জান না।” আবু সুফিয়ান বলে।

হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে তাকান। জোরে কথা বলার মত পরিস্থিতি তাঁর ছিল না। তিনি হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জবাব শিখিয়ে দেন।

‘বাতিলের পূজারী শোনে রাখ” হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চঃস্বরে বলেন– “আল্লাহ্‌র বড়ত্ব ও মহত্ব সম্পর্কে জেনে নে; যিনি সুমহান এবং সর্বশক্তিমান।”

“আমাদের হুবল দেবতা এবং উযযা দেবী আছে।” আবু সুফিয়ান বলেতোমাদের কি এমন কেউ আছে?”

“আমাদের আছেন আল্লাহ।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জবানে জানিয়ে দেন, যা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চঃস্বরে বলেন–“তোমাদের কোন আল্লাহ নেই।”

আবু সুফিয়ান বলে–“যুদ্ধের ফলাফল বেরিয়ে গেছে” “তোমরা বদরে বিজয় লাভ করেছিলে। আমরা এই পাহাড়ের পাদদেশে তার উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছি। আগামী বছর আমরা তোমাদেরকে বদরের রণাঙ্গনে আবার মোকাবিলার জন্য আহবান করব।

“ইনশাল্লাহ্!” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাগুলো উচ্চঃস্বরে শুনিয়ে দেন–“তোমাদের সাথে আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎ বদর প্রান্তরেই হবে।”

আবু সুফিয়ান সেখানে আর বিলম্ব করেনি। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত চলে যেতে থাকে। কিন্তু দু’কদম গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়।

“ওমর, আবু বকর এবং মুহাম্মাদ।” আবু সুফিয়ান একটু ক্ষীন আওয়াজে বলে–“মৃতদেহ উদ্ধার করতে গেলে কিছু লাশ বিকৃত পাবে। আল্লাহর কসম করে বলছি, লাশ বিকৃত করতে আমি কাউকে আদেশ দেইনি। আর এমন আচরণ আমি পছন্দ করিনা। তারপরেও এর জন্য আমাকে দায়ী করা হলে কিংবা এ জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হলে সেটা আমার অপমানই হবে।” এ কথাগুলো বলে আবু সুফিয়ান ঘোড়া ছুটিয়ে নিজ বাহিনীর কাছে চলে আসে।

পথ চলতে চলতে এক সময় খালিদের ঘোড়া নিজেই নিজের গতি পরিবর্তন করে। তিনি ঘোড়ার এই ইচ্ছায় বাধা দেননি। বুঝতে পারলেন ঘোড়া পানির সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু দূরে গিয়ে সে নিচের দিকে অবতরণ করতে থাকে। তিনি জায়গাটি চিনতে পারেন। উহুদ যুদ্ধ শেষে প্রত্যাবর্তনকালে কুরাইশরা এস্থানে কিছুক্ষণ অবস্থান করেছিল। নিচে পানির প্রচুর মজুদ ছিল। ঘোড়া দ্রুততার সাথে পাথুরে জমিন মাড়িয়ে পানির নিকট এসে দাঁড়ায়। খালিদ লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে চোখে-মুখে ঝাপটা মারেন। একটু আরামের জন্য ধূসর এক স্থানে বসে যান। উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তন সময়ের একটি ঘটনা এখানে তাঁর স্মরণ হয়। তারা যখন উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তন করে এই স্থানে এসে যাত্রাবিরতি করে তখন একটি বিষয় তাদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করে। বিষয়টি হচ্ছে যে, মক্কায় চলে যাওয়া ভাল হবে না-কি মুসলমানদের উপর আরেকবার আক্রমণ করা হবে।

সফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলে– “আমরা পরাজিত নই। মুসলমানদের বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে ফায়দা লুটতে চাইলে নিজেদের অবস্থারও একটু পর্যালোচনা কর। আমাদের জোশ-শক্তিও নিস্তেজ প্রায়। এমতাবস্থায় পুনরায় মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। ভাগ্য আমাদের বিপক্ষে চলে যেতে পারে।”

এই বিতর্ক চলার সময় কুরাইশ সৈন্যরা দু’জন মুসাফিরকে টেনে হেঁচড়ে তাদের অধিনায়কের সামনে এনে দাঁড় করায়। তাকে জানানো হয়, তারা নিজেদেরকে মুসাফির হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের তাঁবুর আশে-পাশে সন্দেহজনকভাবে এদেরকে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায় এবং চার-পাঁচজনের নিকট তাদের গন্তব্যস্থল জানতে চায়। মুসাফিরদ্বয় আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য নেতাদের কাছেও নিজেদের মুসাফির বলে পরিচয় দেয়। একটি স্থানের নাম বলে সেদিকে যাচ্ছে বলে জানায়। আবু সুফিয়ানের নির্দেশে তাদের পরিহিত ছেঁড়া-ফাটা পোশাক খুলে ফেলা হলে অভ্যন্তরে লুকানো খঞ্জর এবং তরবারি বেরিয়ে যায়। তাদেরকে এই গোপনীয়তার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা সন্তোষজনক কোন উত্তর দিতে পারে নি। খালিদের গভীর সন্দেহ হলো যে, ধৃত মুসাফির মুসলমান গোয়েন্দা। তাদেরকে সকলের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কেউ তাদের চেনে কি-না জিজ্ঞেস করা হয়।

দুই-তিন জন জানায়, তারা তাদের চেনে। তারা মদীনার লোক।

“একজনকে আমি ভাল করে চিনতে পেরেছি।” এক কুরাইশ দাঁড়িয়ে বলল – “সে আমার বিরুদ্ধে লড়েছিল।”

“তোমরা নিজেরাই বলো যে, তোমরা মুহাম্মাদের গোয়েন্দা।” আবু সুফিয়ান তাদের দু’জনকে বলে– “এবং যাও, আমি তোমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিলাম।”

একজন নিজেকে গোয়েন্দা বলে স্বীকার করে।

“যাও।” আবু সুফিয়ান বলে– “আমরা তোমাদের মাফ করে দিলাম।”

ধৃত দু’মুসাফিরদ্বয় বাস্তবেই মুসলমানদের গোয়েন্দা ছিল এবং কুরাইশদের গতিবিধি জানতে আসে, তারা খুশি মনে নিজেদের উটের দিকে যেতে থাকে। আবু সুফিয়ানের ইশারায় কয়েকজন তীরন্দাজ তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে। প্রত্যেকের গায়েই একই সাথে একাধিক তীরবিদ্ধ হয়।

“তোমরা এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ?” আবু সুফিয়ান পাশে দাঁড়ানো নেতাদের লক্ষ্য করে বলে– “গোয়েন্দা পাঠানোর অর্থ হলো মুসলমানরা পরাস্ত হয়নি। তারা এখনই অথবা কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের উপর আক্রমণ করতে চায়। বাঁচতে চাইলে এখনই মক্কায় চল এবং পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।”

পরের দিন এক দূত এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানায় যে, কুরাইশদের যাত্রাবিরতি স্থলে দু’গোয়েন্দার মৃতদেহ পড়ে আছে। আর কুরাইশরা মক্কায় চলে গেছে।

এটা ছিল খালিদের সর্বপ্রথম বড় যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধে পর তার প্রতিক্রিয়া ছিল যে, তিনি মুসলমানদের পরাস্ত করতে পারেননি। চার বছর পর আজ আবার তিনি চিন্তা করেন যে, মুসলমানদের এ শক্তি কোন সাধারণ শক্তি নয়, অবশ্যই কোন গোপন রহস্য আছে যা অদ্যাবধি তিনি উদ্ধার করতে সক্ষম হননি। কুরাইশদের কিছু ত্রুটিও তার মনে পড়ে। কিছু কথা এবং কিছু কাজ তার ভাল লাগে নি। দুই ইহুদী রূপসী নারীর কথাও তার মনে পড়ে, নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের কাছে যাদের হামেশা চলাচল ছিল। তিনি জানতেন ইহুদীরা নারী-রূপের জাদুতে কুরাইশদের মোহাবিষ্ট এবং এ প্রক্রিয়ায় তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে উস্তাদ। এ হীন প্রক্রিয়া তিনি মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু এমনি এক নারীর সাথে একবার খালিদের সাক্ষাৎ হলে তিনি উপলদ্ধি করেন যে, তার মধ্যে যথেষ্ট জ্ঞান ও বিচক্ষণতা রয়েছে। মহিলাটির রূপ এবং যৌবনের প্রভাব তো ছিলই। অধিকন্তু তার কথার মাঝেও যে এক ধরনের মাদকতা রয়েছে তা খালিদও বুঝতে পারেন। মহিলাটি কিছুক্ষণ তার কল্পনারাজ্য দখল করে বসে থাকে। এক সময় ঘোড়া ডেকে উঠলে খালিদ-এর ঘোরকাটে। তিনি দ্রুত উঠেন এবং ঘোড়ায় চড়ে মদীনার পথ ধরেন।

♣♣♣

খালিদ ইবনে ওলীদ ছিলেন বিলাসী লোক। সৌখিনতা ও বিলাস-উপকরণেরও অভাব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহের নেশা এমনই যে, এর সামনে সকল প্রকার সৌখিনতা ও বিলাসিতা তুচ্ছ। মদীনার পথে গমনকালে ইউহাওয়া নাম্নী এক ইহুদী রূপসীর কথা তার মনে পড়ে। তিনি এই নারীকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেন। কিন্তু সে নানারূপের প্রজাপতি সেজে তার মাথার উপর উড়তে থাকে। তিনি তার কথা অন্তর থেকে মুছতে পারেন না।

খালিদের স্মৃতিতে উড়ন্ত প্রজাপতির রঙ মোহনীয় হয়ে আবার এক সময় সব রঙ রক্তিম রঙে রূপ নেয়। রক্তের মত টকটকে লাল। এটা ছিল এক ভয়ঙ্কর অতীত। যা তিনি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেন। রঙিন প্রজাপতি এক সময় বিষাক্ত ভীমরুলে পরিণত হওয়ায় তিনি তা মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলতে নাকাম হন।

এটি ছিল উহুদ যুদ্ধের তিন-চার মাস পরের এক ঘটনা। এটাকে দুরভিসন্ধি বলা চলে। এতে তার কোন ভূমিকা না থাকলেও কুরাইশদের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। সেজন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও এ বিষয় এড়িয়ে যাওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।

উহুদের রণাঙ্গনে আহত কোন কোন কুরাইশের জখম এখনও পুরোপুরি ভাল হয়নি। ইতোমধ্যে হঠাৎ একদিন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, ছয় সদস্যের এক মুসলিম দল ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে রযী নামক স্থানে যাওয়ার সময় আসফানের অনতিদূরে এক অমুসলিম কওম তাদের বাধা দেয়। তাদের মধ্যে থেকে দু’জনকে মক্কায় নিয়ে নিলাম করা হচ্ছে।

খালিদ দ্রুত নিলাম স্থলে চলে যান। নিলামকৃত দু’মুসলমানের একজন হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আরেকজন হযরত যায়েদ বিন দাছানা রাযিয়াল্লাহু আনহু। উভয়ে খালিদের ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত লোক। তারা তারই গোত্রের লোক। ইসলাম গ্রহণ করে তাঁরা মদীনায় চলে যান। রাসূল-প্রেমে তারা খুবই উজ্জীবিত ছিলেন। যে কোন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে খুব মহব্বত করতেন। তারা একটি চত্বরের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন আর তাদের আশে-পাশে ছিল কুরাইশদের প্রচণ্ড ভীড়। চার ব্যক্তি তাদের কাছে দণ্ডায়মান ছিল। উভয়ের হাত ছিল রশি দ্বারা বাঁধা।

জনৈক ব্যক্তি চত্বরের পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছিল “এরা মুসলমান।” “এরা উহুদে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের হাতে তোমাদের আত্মীয়-স্বজন নিহত হয়েছে। প্রতিশোধের আগুন নির্বাপিত করার কেউ আছ কি?… তাদের কিনে নিয়ে যাও। নিজ হাতে হত্যা করে রক্তের প্রতিশোধ নাও।.. সবচে বেশী মূল্য যে দিবে তার হাতেই তাদের তুলে দেয়া হবে।..দাম বলো।”

“দু’টি ঘোড়া” একজন বলে।

“বলো… বেশি করে বলো।” নিলামদার লোকটি পুনরায় বলে।

“দুটি ঘোড়া আর একটি উট।” আরেকজন বলে।

“ঘোড়া-উট নয়, স্বর্ণের কথা বল।… স্বর্ণ নিয়ে এসো.. দুশমনের রক্তে প্রতিশোধের তৃষ্ণা মিটাও।” নিলামদার কড়া স্বরে বলে।

যাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন উহুদে নিহত হয়, তারা পালাক্রমে মূল্যের অংক বাড়াতে থাক। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের চেহারায় ভয় ভীতির কোন লক্ষণ ছিল না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও ছিল না। খালিদ ভীড় ঠেলে সামনে যান।

এসো কুরাইশ নেতার বাহাদুর পুত্র।” খালিদকে আসতে দেখে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু সজোরে বলেন–“হেরা গুহা থেকে উত্থিত বিপ্লবের যে আওয়াজ আমাদের দুজনের রক্ত প্রবাহিত করে তোমার জাতি কখনোই তা রোধ করতে পারবে না। তোমার গোত্রের যে কোন বীর-বাহাদুর নিয়ে এসো এবং আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও, দেখবে কে কার রক্ত দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ করে।”

হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বলেন– “রণাঙ্গনে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী।” “পরাজয়ের প্রতিশোধ তোমরা আমাদের ভাইদের লাশ থেকে নিয়েছ। তোমাদের নারীরা আমাদের লাশের নাক-কান কর্তন করে এগুলো দ্বারা হার বানিয়ে গলায় পড়েছে।”

আজ চার বছর পর মদীনা যাওয়ার সময় হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কঠোর তিরস্কারের আওয়াজ খালিদের কানে বাজতে থাকে। তিনি হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তিরস্কার সহ্য করতে পারছিলেন না। দীর্ঘ চার বছর পূর্বের সেই তিরস্কারের কথা মনে পড়ায় আজও তার শরীর ভীষণ কেঁপে ওঠে। সাথে সাথে তার স্মরণ হয় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার পৈশাচিক অমানবিক আচরণের লোমহর্ষক দৃশ্য। হিন্দা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কলিজা বের করে এনে মুখে পুরে চিবিয়ে পরে উগরে দেয়। নিহত মুসলমানদের নাক-কান কেটে আনতে সে অন্যান্য নারীদের নির্দেশ দেয়। তারা নাক-কান কেটে এনে তার সম্মুখে স্তুপ করলে হিন্দা তা সুতায় গেথে মালা তৈরী করে তা গলায় দিয়ে উন্মাদের ন্যায় সারা ময়দান জুড়ে নেচে-গেয়ে ফিরতে থাকে। এ দৃশ্য তার স্বামী আবু সুফিয়ানের আদৌ পছন্দনীয় ছিল না। আর খালিদ তো ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেন।

তিন-চার মাস পর গ্রেফতারকৃত এবং হাত বাঁধা দুমুসলমান তাকে তিরস্কারের পর তিরস্কার করে চলছিল। খালিদ ঘৃণ্য পন্থায় প্রতিশোধ গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যান। যারা দু’মুসলমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে ঘটনাক্রমে তাদের একজনের সাথে খালিদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়।

খালিদ তাকে জিজ্ঞেস করেন, তাদেরকে কিভাবে বন্দি করা হল? “আল্লাহর কসম!” লোকটি বলে, “তোমরা চাইলে তাদের রসূলকেও বন্দি করে এই নিলাম স্থলে নিয়ে আসতে পারি।”

“যা কোন কালেও পারবে না তার কসম করো না।” খালিদ বলেন– “তাদেরকে বন্দি করার বিস্তারিত তথ্য আমাকে জানাও।”

লোকটি বলতে থাকে। তারা ছিল ছয়জন”। আমরা উহুদে নিহতদের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। ভবিষ্যতেও এ ধারা যথারীতি অব্যাহত থাকবে। আমাদের কওমের কয়েকজন লোক মদীনায় মুহাম্মাদের নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছে বলে জানায়। তারা তাকে একথাও জানায় যে, তাদের গোত্রের সমস্ত লোক ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের সকলের পক্ষে মদীনাতে আসা সম্ভব নয়। তারা মুহাম্মাদের কাছে বিনীত অনুরোধ করে, যেন তাদের সাথে কয়েকজন মুসলমান প্রেরণ করেন যারা গোত্রের সবাইকে মুসলমান করবে এবং তাদেরকে ধর্মীয় দীক্ষায় দীক্ষিত করতে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করবে।

আমাদের লোকেরা ছয়জন মুসলমানকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তারা আসতে থাকে। এদিকে আমাদের সর্দার ‘শারযা বিন মুগীছ’ একশ সৈন্য রযী নামক স্থানে প্রেরণ করে। মুসলিম দলটি এ স্থানে পৌঁছা মাত্রই আমাদের একশ সৈন্য তাদের ঘিরে ফেলে।.. তুমি হতবাক হবে যে তারা সংখ্যায় ছয়জন হওয়া সত্ত্বেও একশ সৈন্যের মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং অন্য তিনজন বন্দি হয়। তাদের হাত রশি দিয়ে বাঁধা হয়। আমাদের সর্দার নির্দেশ দেয় যে, এরা মদীনার প্রতারিত মুসলমান। তাদেরকে মক্কায় নিয়ে গিয়ে প্রতিশোধেছুদের নিকট উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিবে।…

আমরা তিনজনকে মক্কায় নিয়ে আসছিলাম। পথিমধ্যে একজন কৌশলে বন্ধনমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে মুক্ত হয়ে পালায়নি বরং অস্ত্রহীন থাকায় ভেল্কিবাজির মত আমাদেরই একজনের তরবারি কেড়ে নিয়ে চোখের পলকে আক্রমণ করে আমাদের দু’ব্যক্তিকে হত্যা করে। এত মানুষের সাথে কতক্ষণই বা লড়তে পারে। এক সময় সে মারা যায়। আমরা তাকে কেটে টুকরো টুকরো করেছি। এরা দু’জন রয়ে যায়। আমরা তাদের হাত আরো শক্ত করে বেঁধে নিয়ে এসেছি।”

“তোমরা খুবই খুশি।” খালিদ তিরস্কারের ভঙ্গিতে তাকে বলে– “কিন্তু মুহাম্মাদ এ ঘটনাকে কি করে মেনে নেবে?.. কুরাইশ এবং তাদের মিত্র গোত্র এমন কাপুরুষ হয়ে গেছে যে, তারা এখন ধোঁকা এবং ছয়জনের মোকাবিলা একশ জন দ্বারা করা শুরু করেছে। ঘৃণ্য এ প্রতারণামূলক গল্প শুনাতে তোমার একটুও লজ্জা হয়নি? একশ সৈন্য কি তাদের দুগ্ধপানকারিণী মাকে শরমিন্দা করেনি?”

“ওলীদের পুত্র। তুমি রণাঙ্গনে মুসলমানদের কি করতে পেরেছিলে?” লোকটি খালিদকে বলে, “তোমরা মুহাম্মাদের শক্তির মোকাবিলা করতে পার? এদের ১০০০ হাজার কুরাইশ মাত্র ৩১৩ জনের হাতে চরমভাবে মার খেয়ে আসে। উহুদের যুদ্ধে মুহাম্মাদের অনুসারীর সংখ্যা কত ছিল?… ৭০০ থেকে কম, বেশী নয়। অপরদিকে কুরাইশরা কতজন ছিল?… হাজার.. হাজার।.. শোন খালিদ। মুহাম্মাদের কাছে জাদু আছে। যেখানে জাদুর ভেল্কিবাজি চলে সেখানে তরবারি চলে না।”

“তাহলে তোমাদের তরবারি কিভাবে চলল?” খালিদ পাল্টা প্রশ্ন করেন– “যদি মুহাম্মাদের কাছে সত্যই যাদু থাকে, তাহলে সে তোমাদের সর্দার শারযার প্রতারণার ফাঁদে কিভাবে পরল? চার ব্যক্তিকে কি করে হত্যা করলে? গ্রেফতারকৃত এ দু’জনকে মুহাম্মাদের যাদু কেন ছাড়িয়ে নেয়না? মুক্ত করে না?… যাদু-টাদু কিছু নয়; আসল কথা হলো, তোমরা যার মোকাবিলার সাহস রাখ না তাকে যাদু বলে পাশ কাটিয়ে যাও।”

লোকটি বলে– “আমরা যাদু দ্বারা যাদু কেটেছি।” “আমাদের কাছে ইহুদী যাদুকর এসেছিল। তাদের সাথে তিনজন মহিলা যাদুকরও ছিল। এদের একজনের নাম ‘ইউহাওয়া’। আমরা তাদের যাদু-নৈপুণ্য স্বচক্ষে দেখেছি যে, ঘন ঝোঁপ থেকে একটি বর্শা বেরিয়ে আসে। বর্শাটি নিজে নিজেই ফিরে যায় এবং সাপ হয়ে আবার বেরিয়ে আসে। একটু পরে পুনরায় ঘন জঙ্গলে চলে যায়।

একদিকে ঘোড়া রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে আর অন্যদিকে খালিদের স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। তিনি বেদনামাখা অতীত সম্মুখে আনতে চান না, কিন্তু বিষাক্ত ভীমরুলের ন্যায় অতীত তার স্মৃতিপটে ভাসতে থাকে। স্মৃতির পর্দা ইউহাওয়ার ছবি ভেসে ওঠে। সে জাদুকর ছিল কি-না, সে ব্যাপারে তিনি অনিশ্চিত। তবে তার রূপে, অঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে, মুচকি হাসি এবং আলাপের ভঙ্গিতে অবশ্যই যাদু ছিল। তিনি শারযা বিন মুগীছের কওমের লোকটির কাছে ইউহাওয়ার নাম শুনেই চমকে ওঠেন। উহুদ যুদ্ধ শেষে কুরাইশরা মক্কা ফিরে গেলে মক্কার ইহুদীরা এমন ভাঙ্গা মন নিয়ে আবু সুফিয়ান, খালিদ এবং ইকরামার কাছে আসে, যেন ইহুদীদেরই উহুদে পরাজয় হয়েছে। ইহুদীদের সর্দার আবু সুফিয়ানকে বলে, মুসলমানদের পরাজয় হয়নি এবং কোন চূড়ান্ত ফলাফল ব্যতীত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। অতএব এটা কুরাইশদেরই পরাজয়। ইহুদীদের চরম ব্যর্থতা…। ইহুদীরা কুরাইশদের নিকট এমনিভাবে সমবেদনা করে, যেন কুরাইশদের ব্যর্থতার বেদনায় তারা একেবারে মরে যাওয়ার উপক্রম।

এ সময় ইউহাওয়ার সঙ্গে খালিদের প্রথম দেখা হয়। তিনি তার অশ্বকে পায়চারি করানোর জন্য আবাসিক এলাকার বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় রাস্তায় ইউহাওয়ার সাথে সাক্ষাৎ হয়। ইউহাওয়ার মুচকি হাসি তাকে থামিয়ে দেয়।

“আমি মানতে পারছি না যে, ওলীদের পুত্র যুদ্ধ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে।” ইউহাওয়া মুখে এ কথা বলে খালিদের অশ্বের গলায় হাত বুলাতে থাকে। আবার বলে– “ঐ ঘোড়া আমার খুবই প্রিয় যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল।”

খালিদ ঘোড়া থেকে এমনভাবে নিচে নেমে আসেন, যেন ইউহাওয়ার যাদুই তাকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে এনে দাঁড় করায়।

এর চেয়ে ব্যর্থতা আর কি হতে পারে যে, তোমরা মুসলমানদের পরাস্ত করতে পারনি।” ইউহাওয়া বলে– “তোমাদের পরাজয় মানে আমাদেরই পরাজয়। এখন আমরা তোমাদের সঙ্গ দিব বটে কিন্তু আমরা সাথে থাকলেও তোমরা আমাদের দেখা পাবে না।”

খালিদ অনুভব করেন, তার জবান কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। তরবারি, বর্শা এবং তীরের আঘাত মোকাবিলায় নিপুণ খালিদ ইউহাওয়ার মুচকি হাসির মোকাবিলা করতে পারে না।

খালিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন। “ইহুদীরা যদি রণাঙ্গনে আমাদের সাথে সাথেই না থাকে তাহলে তাদের দ্বারা আমাদের আর কি কাজ হবে?”

“মানুষের দেহে শুধু তীরই বিদ্ধ হয় বলে মনে হয়?” ইউহাওয়া দার্শনিক ভঙ্গিতে বলে– “নারীর অধরের এক চিলতে হাসি তোমার মত বীর-বাহাদুরের হাত থেকে তরবারি ফেলে দিতে পারে।”

খালিদ তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান, কিন্তু সুযোগ পান না। ইউহাওয়া তার নয়নে নয়ন রাখে এবং অধরে ফুলের পাপড়ির মত মুচকি হাসির ঝলক তুলে চলে যায়। খালিদ অপলক নেত্রে তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকেন। শত চেষ্টা করেও চোখ ফিরাতে পারেন না। তিনি স্বীয় দেহে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এক সময় তার অশ্বটি মাটিতে ক্ষুরাঘাত করলে তিনি বাস্তবজগতে ফিরে আসেন। তিনি দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। কিছুদূর এসে পিছনে তাকিয়ে দেখেন যে, ইউহাওয়া ঠায় দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চার চোখের মিলন ঘটলে ইউহাওয়া হাত বিদায়ের ভঙ্গিতে হাত নাড়ায়।

♣♣♣

নিলামকৃত দু’মুসলমানের প্রতারণামূলক আটকের কথা এবং এর সাথে ইউহাওয়ার জড়িত থাকার কথা জানতে পেরে খালিদ এ রহস্য উদ্ধারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে, ইউহাওয়া তার এ জাদু কি করে কার্যকর করল। হঠাৎ করে তারই গোত্রের এক নেতাগোছের লোকের সাথে তার দেখা হয়। সেই তাকে পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত বলেছে।

তিন-চারজন নেতৃস্থানীয় ইহুদী ইউহাওয়াসহ অন্য তিন ইহুদীকে নিয়ে শারযা বিন মুগীছের নিকট যায়। এই কওম দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ হলেও তাদের উপর মুসলমানদের প্রভাব যাদুর ন্যায় প্রভাবিত হয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জাদু আছে একথা এই গোত্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা যুদ্ধবাজ হওয়ায় ইহুদীরা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য এই গোত্রকে বেছে নেয়।

ইহুদী জাতটাই খুবই বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী। তারা চিন্তা করে মুসলমানদের জাদুর ধারণা এভাবে ছড়াতে থাকলে অন্যান্য গোত্রেও তার প্রভাব দেখা দিবে। এটা ঠেকাতেই মূলত ইহুদীরা গোত্রপ্রধান শারযার নিকট যায়। তাকে বিভিন্ন যুক্তি-তর্কে এই ধারণা ভিত্তিহীন ও অসত্য বলে বোঝাতে চেষ্টা করে কিন্তু শারযা তাদের কথা বিশ্বাস করে না। ইহুদীদের অনুরোধে শারযা একটি খোলা ময়দানে রাতে তাদের পানাহারের ব্যবস্থা করে। ইহুদী অতিথিরা ধন্যবাদস্বরূপ মেজবানদের শরাব পান করায়। শারযাসহ নেতৃস্থানীয় লোকদের শরাব ছিল উন্নতমানের। এতে ইহুদীরা আবার হাশীশ নামক নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে দেয়। এরপর ইহুদীরা কিছু ভেল্কিবাজিও তাদের দেখায়।

ইউহাওয়া তার রূপের যাদু চালাতেও ত্রুটি করেনি। তাকে উপলক্ষ্য করে একটি নৃত্যানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ইউহাওয়া প্রায় অর্ধউলঙ্গ ছিল। নামমাত্র তার কমনীয় শরীরে পোশাক ছিল। নাচতে নাচতে এক সময় এ অর্ধউলঙ্গ পোশাকটুকুও শরীর থেকে খসে পড়ে। ইহুদীরা প্রযোজকও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।

পরের দিন শারযার চোখ খুললে এই মাত্র সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখে জাগ্রত বলে তার মনে হয়। মুসলমানদের সম্পর্কে তার পূর্বধারণা বদলে গিয়েছিল। অল্পক্ষণ পর গোত্রের অন্যান্য নেতাদের সাথে সে ইহুদীদের কাছে বসা ছিল। ইউহাওয়াও সেখানে ছিল। শারযা তাকে দেখেই অস্থির হয়ে ওঠে। হুড়মুড় করে উঠে গিয়ে ইউহাওয়ার হাত ধরে নিজের পাশে এনে বসায়।

শত্রুকে খোলা ময়দানে ডেকে এনে পরাস্ত করতে হবে, এটা মোটেও আবশ্যক নয়।” এক ইহুদী বলে– “আমরা মুসলমানদেরকে অন্যান্য উপায়ে নিঃশেষ করে দিতে পারি। একটি পদ্ধতি বলছি শোন।”

খালেদকে জানানো হয় যে, ছয় মুসলিম মদীনা থেকে এভাবে প্রতারণা করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ইহুদীরাই পেশ করেছিল। তাদের কথা মত মুসলমানদের প্রতারিত করতে শারযা যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট প্রেরণ করে তাদের মধ্যে একজন ইহুদীও ছিল। খালিদ মুসলমানদেরকে নিকৃষ্ট দুশমন মনে করতেন ঠিক কিন্তু তাই বলে এই জঘন্য ও অনৈতিক পন্থা তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।

খালিদ বিস্তারিত তথ্য জেনে বাড়িতে ফিরে এসে চাকরানীকে নির্দেশ দেন, এখনই যেন সে ইউহাওয়া, ইহুদী মহিলাকে ডেকে নিয়ে আসে। ইউহাওয়া এত তাড়াতাড়ি তার কাছে উপস্থিত হয় যেন সে তারই ডাকের অপেক্ষায় আশেপাশে কোথাও অপেক্ষমাণ ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *