১.০২ ঐ বছরের আগষ্ট মাসের এক গভীর রাতে

ঐ বছরের আগষ্ট মাসের এক গভীর রাতে মানো মাজরার নিকটবর্তী কিকার তরুবীথি থেকে পাঁচজন লোক বেরিয়ে এলো। তারা নীরবে এগিয়ে চলল। নদীর দিকে। তারা ছিল ডাকাত, ডাকাতি তাদের পেশা। তাদের একজন ছাড়া সবাই ছিল সশস্ত্ৰ। দুজনের কাছে ছিল বল্লম। অপর দুজনের কাঁধে ঝুলে ছিল হালকা ধরনের বন্দুক। পঞ্চম ব্যক্তির কাছে ছিল একটা টর্চ লাইট। নদীর তীরে এসে সে একবার টার্চ জ্বালাল। বিরক্তিকর ধ্যাত্‌তর ধরনের একটা শব্দ উচ্চারণ করে সে টর্চ নিভিয়ে দিল।

আমরা এখানেই অপেক্ষা করব, সে বলল। সে বালির ওপর বসল। অন্যরা তাদের অন্ত্রের ওপর ভর দিয়ে তার চারপাশে হামাগুড়ি দিয়ে রইল। টর্চধারী লোকটি বল্লমধারী একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কাছে জুগ্‌গার জন্য চুড়ি আছে তো?

হ্যাঁ। এক ডজন লাল ও নীল চুড়ি। এগুলো গ্রামের যে কোন মেয়েকেই খুশি করবে।

কিন্তু জুগ্‌গাকে তো খুশি করাবে না, একজন বন্দুকধারী বলল।

দলনেতা হাসল। হাতের টর্চটা বাতাসে ছুড়ে দিয়ে আবার ধরে ফেলল। আবার সে হাসল। টর্চের মুখটা নিজের মুখে নিয়ে সুইচ টিপল। ভিতরের আলোয় তার দুই গালে হালকা লাল আভা দেখা দিল।

জুগ্‌গা চুড়িগুলো তার প্রেমিকা তাঁতীর মেয়েকে দিতে পারে, একজন বল্লমধারী ফোঁড়ন কাটল।

স্ফীত স্তন ও টানা টানা চোখ, মেয়েটির হাতে এগুলো মানাবে ভাল। তার নামটা যেন কি?

দলনেতা মুখ থেকে টর্চ সরিয়ে সুইচ টিপে নিভিয়ে দিল। বলল, নূরান।

আহ্‌, বল্লমধারী লোকটি বলল, নূরান। বসন্ত মেলায় তাকে কি তুমি দেখেছ? আঁটো সাঁটো পোশাকে তার স্ফীত স্তন, চুলের খোঁপায় বাঁধা কাঁটার টুং-টাং মিষ্টি আওয়াজ, রেশমী কাপড়ের হিসহিস শব্দ। আহ!

আহ! বল্লমধারী লোকটি চুড়ি হাতে চিৎকার করে উঠল, হায়! হায়!

জুগ্‌গাকে সে নিশ্চয়ই উজাড় করে দেবে তার যৌবন, এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা বন্দুকধারী লোকটি বলল। দিনের বেলায় তাকে এমনই নিরীহ মনে হয় যেন তার দুধ দাঁত এখনও পড়েনি। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। অথচ রাতে সে চোখে কালো সুরমা লাগায়।

সুরমা চোখের জন্য খুব ভাল। তাদের মধ্যে একজন বলল। সুরমা লাগালে চোখ ঠাণ্ডা থাকে। অন্যের চোখের দৃষ্টিতেও এটা ভাল, বন্দুকধারী লোকটি জবাব দিল। যৌন উত্তেজনার আবেগ নিবৃত্তির জন্যও এর জুড়ি নেই।

কার, জুগ্‌গার? দলনেতা বলল।

অন্যরা হাসল। তাদের মধ্যে হঠাৎ একজন সোজা হয়ে বসল।

শোন! সে বলল। মাল ট্রেস আসছে।

হাসি বন্ধ করল। সবাই। তারা সবাই নীরবে অগ্রগামী ট্রেনের শব্দ শুনল। গড় গড় শব্দ করে ট্রেনটা থেমে গেল, দুই ওয়াগনের মধ্যে ধাক্কা লাগারও শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিন আগে-পিছে করার এবং ওয়াগন খুলে রাখার শব্দ। শোনা গেল। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াগনের সাথে ছেড়ে দেয়া ওয়াগনের ধাক্কা লাগার বিকট শব্দ শোনা গেল। ট্রেনের সাথে ইঞ্জিন লাগাবার শব্দও শোনা গেল।

এখনই রামলালের সাথে দেখা করার সময় দলনেতা বলল। অতঃপর সে উঠে দাঁড়াল।

তার সঙ্গীরাও উঠে দাঁড়াল এবং কাপড়ে লাগা বালি ঝেড়ে ফেলল। তারা লাইন করে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল। একজন বন্দুকধারী একটু এগিয়ে এসে অস্পষ্টভাবে কি যেন বলতে শুরু করল। তার কথা, শেষ হলে সবাই হাঁটু গেড়ে বসল এবং মাটিতে তাদের কপাল ঠেকাল। তারপর তারা দাঁড়িয়ে পাগড়ির খোলা অংশ দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। খোলা রইল তাদের চোখ দু’টো। ইঞ্জিন থেকে দুবার দীর্ঘ হুইসেল শোনা গেল এবং তারপর ট্রেনটি ব্রিজের দিকে যাত্রা শুরু করল।

এখনই সময়, দলনেতা বলল।

অন্যরা তাকে অনুসরণ করল। নদীতীর ছেড়ে মাঠ অতিক্রম করার পর তারা বুঝতে পারল, ট্রেনটি ব্রিজের কাছে পৌঁছেছে। লোকগুলো একটা পুকুরের ধার দিয়ে ছোট রাস্তা ধরল। ঐ রাস্তাটিই এসে শেষ হয়েছে গ্রামের মাঝে। তারা লালা রাম লালের বাড়িতে এসে থামল। দলনেতা মাথা নাড়িয়ে একজন বন্দুকধারীকে কি যেন বলল। লোকটা কয়েক পা এগিয়ে বন্দুকের বট দিয়ে দরজায় আঘাত করল।

ঐ লালা! সে চিৎকার করে উঠল।

কোন জবাব এলো না। আগন্তুকদের চারপাশে কয়েকটা কুকুর জমায়েত হয়ে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করল। একজন বল্লমের ধারালো অংশ দিয়ে একটা কুকুরকে আঘাত করল, অন্য একজন শূন্যে গুলি ছুঁড়ল। কুকুরগুলো সরে গিয়ে-নিরাপদ দূরত্বে থেকে উচ্চ স্বরে ডাকতে লাগল।

 

লোকগুলো তাদের অস্ত্র দিয়ে দরজায় আঘাত করতে লাগল। একজন তার বল্লম দিয়ে দরজায় এমন জোরে আঘাত করল যে, দরজা ছিদ্র হয়ে বল্লম ঢুকে গেল।

দরজা খোল, শালার ব্যাটা। না হলে তোদের সবাইকে খুন করে ফেলব, লোকটি চীৎকার করে উঠল।

মেয়েলী কণ্ঠে উত্তর এল, তোমরা কে এই রাতে ডাকছ? লালজি শহরে গেছে।

আগে দরজা খোল, তারপর বলব আমরা কে। তা না হলে দরজা ভেঙ্গে ফেলব, বলল দলনেতা।

তোমাদের তো বললাম। লালাজি ঘরে নেই। তিনি সাথে করে চাবি নিয়ে গিয়েছেন। ঘরে আমাদের কিছুই নেই।

লোকগুলো দরজায় পিঠা, লাগিয়ে জোরে ধাক্কা দিল, হাত দিয়ে দরজা টানল। প্রাচীনকালে অবরুদ্ধ নগরীর দেয়াল ভাঙ্গার জন্য কাঠের গুড়ির মুখে লোহা বাঁধার মত বন্দুকের বাট দিয়ে দরজায় তারা আঘাত করতে লাগল। দরজায় দেয়া খিল ভেঙ্গে গেল এবং দরজা খুলে গেল। বন্দুকধারী একজন লোক খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। অন্য চারজন ভিতরে ঢুকল। একটা কামরার এক কোনায় দুজন মহিলা হামাগুড়ি দিয়ে ছিল। ঐ দুই মহিলার মধ্যে অধিকতর বয়স্ক মহিলার গলা জড়িয়ে ছিল সাত বছরের কালো লম্বা চোখের অধিকারী একটা ছেলে।

বয়স্ক মহিলাটি অনুনয় করে বলল, খোদার নামে বলছি, আমাদের যা আছে সব কিছু নিয়ে যাও, সব অলঙ্কার, সব কিছু। সোনা ও রূপার চুড়ি, মল ও কনের দুল হাতে করে মহিলাটি তাদের দিকে এগিয়ে ধরল।

একজন লোক তার হাত থেকে সব ছিনিয়ে নিল।

লালা কোথায়?

গুরুর নামে শপথ করে বলছি, লালা বাইরে গেছে। আমাদের যা আছে সবই তোমরা নিয়েছ। তোমাদের দেয়ার মত আর কিছুই লালজির কাছে নেই।

বারান্দায় চারটি খাটিয়া একই লাইনে পাতা ছিল।

ছোট বন্দুকধারী লোকটি ছোট ছেলেটিকে তার দাদীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপর সে তার মাথার কাছে বন্দুকের নল তাক করে রইল। বয়স্ক মহিলাটি লোকটির পায়ে পড়ে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল।

ওকে মের না ভাই, গুরুর নামে, ওকে মের না।

বন্দুকধারী লোকটি মহিলাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল।

তোর বাপ কোথায়?

ছেলেটি ভয়ে কাঁপতে লাগল। ভয়ে ভয়ে সে বলল, ওপরের তলায়।

বন্দুকধারী লোকটি ছেলেটিকে মহিলার কোলে ফিরিয়ে দিল। তারপর লোকগুলো বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। ছাদে মাত্র একটিই কামরা ছিল। তারা অপেক্ষা না করে দরজায় ধাক্কা দিল। দরজার কাজা ভেঙে তারা ভিতরে ঢুকাল। ঘরে ছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত স্টীলের বাক্স, একের ওপর অন্যটা। ঘরে ছিল দু’টো চারপাই, তার ওপর কয়েকটা লেপ ভাঁজ করা ছিল। টর্চের আলোয় দেখা গেল একটা চারপাই-এর নিচে মহাজন হামাগুড়ি দিয়ে আছে।

মহিলার স্বর নকল করে তাদের মধ্যে একজন বলল, গুরুর নামে বলছি, লালাজি বাইরে গেছে। লোকটি রামলালের পা ধরে টেনে আনল।

দলনেতা তার হাতের উল্টো দিক দিয়ে মহাজনকে চপেটাঘাত করল। তোর অতিথিদের সাথে তুই এমন আচরণ করিস? আমরা এলাম আর তুই চারপাই-এর নিচে লুকিয়ে রইলি।

রামলাল দু’হাত দিয়ে।মুখ ঢেকে নাকী সুরে অস্পষ্টভাবে কথা বলতে শুরু করল। সিন্দুকের চাবি কোথায়  দলনেতা তাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

আমার যা কিছু আছে তোমরা সব নিয়ে যাও-অলঙ্কার, নগদ টাকা, হিসাব খাতা, কিন্তু কাউকেই খুন করো না। দলনেতার পা দুহাতে জড়িয়ে ধরে মহাজন অনুনয় করতে লাগল।

পকেট থেকে সে টাকার কয়েকটা বান্ডিল বের করল। এগুলো নাও, পাঁচজন লোককে টাকা ভাগ করে দেয়ার সময় সে বলল, বাড়ীতে এছাড়া আর কিছু নেই। যা আছে সব তোমাদের।

তোমার সিন্দুকের চাবি কোথায়?

সিন্দুকে আর কিছুই নেই। আছে শুধু হিসাবের খাতা। আমার যা আছে সবই তোমাদের দিয়েছি। আমার যা আছে সবই তো তোমাদের। শুরুর নামে আমাকে ছেড়ে দাও। রামলাল দলনেতার পায়ের হাঁটুর ওপর ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। গুরুর নামে! গুরুর নামে!

একজন লোক মহাজনকে ধাক্কা দিয়ে দলনেতার কাছ থেকে সরিয়ে দিল। বন্দুকের বাট দিয়ে তার মুখে জোরে আঘাত করল।

রামলাল উচ্চ স্বরে চীৎকার করে উঠল, হায়! তার মুখ দিয়ে রক্তঝরাতে লাগল।

মহিলারা আঙিনা থেকে রামলালের চীৎকার শুনে ভয়ে তীক্ষ্ম কণ্ঠে চোঁচাতে লাগল, ডাকাত, ডাকাত।

বাড়ীর চারদিকে কুকুর ডাকতে লাগল বিরামহীনভাবে। কিন্তু কোন গ্রামবাসী বাড়ীতে এল না।

মহাজনকে তারা ছাদের ওপর বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটালো, বল্লমের হাতল দিয়ে খোঁচা দিল, লাথি ও ঘুসি মারল। সে বসে কান্নাকাটি করতে লাগল। তার দেহ থেকে রক্ত ঝরছিল। তার দু’টো দাঁত ভেঙে গেলেও সে তাদের কাছে সিন্দুকের চাবি দিল না। উত্তেজিত হয়ে একজন লোক পশুর মত শুয়ে থাকা লোকটার পেটে জোরে খোঁচা মারল তার হাড়ের অন্ত্র দিয়ে। রামলাল একটা মরণ চীৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝোয় পড়ে গেল। তার পেট দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। লোকটা বাইরে বেরিয়ে এলো। তার একজন সঙ্গী শূন্যে দুবার গুলি ছুঁড়ল। মহিলারা কাতর চীৎকার বন্ধ করল। কুকুরের ডাকাডাকি বন্ধ হলো। গ্রামটি হয়ে গেল একেবারে নীরব।

ডাকাতরা লাফ দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গলিরাস্তা ধরল। তারা বিশ্বকে যেন অবজ্ঞা করল বীরদৰ্পে এবং এগিয়ে গেল নদীতীরের দিকে।

আয় তারা চীৎকার করে বলল, তোদের যদি সাহস থাকে তাহলে বাইরে আয়! তোদের মা ও বোনদের বেইজ্জতি দেখতে চাস, তাহলে বেরিয়ে আয়। সাহস থাকে তো বেরিয়ে আস্য তোরা।

কেউ তাদের কথার জবাব দিল না। মানো মাজরায় কোন শব্দ শোনা গেল না। তারা হাসতে হাসতে এবং চীৎকার করতে করতে গলিপথ দিয়ে এগিয়ে চলল গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা কুঁড়েঘর পর্যন্ত। দলনেতা দাঁড়িয়ে পড়ল এবং একজন বল্লমধারীর দিকে ফিরে তাকাল।

এটাই জুগ্‌গার বাড়ী, সে বলল, তাকে আমরা যে উপহার দিতে চেয়েছিলাম তার কথা ভুলে যেও না। তাকে চুড়িগুলো দাও।

বল্লমধারী লোকটি তার কাপড়ের টোপলা থেকে চুড়িগুলো বের করে তা ঘরের দেয়ালের ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। আঙিনায় শোনা গেল চুড়ি ভাঙার শব্দ।

ও জুগিয়া, অস্বাভাবিক স্বরে সে ডাকল, জুগিয়া। সে তার সঙ্গীদের দিকে মিটু মিটু করে তাকাল। চুড়িগুলো পরো জুগিয়া। এগুলো হাতে পরে হাতের তালুতে রঙ মেখো।

ওগুলো না হয় তাঁতীর মেয়েকে দিয়ে দিও। বন্দুকধারী একজন উচ্চ স্বরে বলল।

আহ্‌, অন্যরা চীৎকার করে উঠল। তারা দুই ঠোঁট এক করে দীর্ঘ কামাসক্ত চুম্বনের শব্দ করল। হায়, হায়!

তারা হাসতে হাসতে গলিপথ ধরে নদীর দিকে চলল। কেউ কেউ ঠোঁটে হাত ঠেকিয়ে বাতাসে চুম্বন উড়িয়ে দিল। জুগ্‌গাত্ সিং তাদের কথার জবাব দিল না। সে তাদের কথা শুনতে পায়নি। সে ঘরেই ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *