০২. এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে কোরান
“এক হাতে শাস্ত্র অন্য হাতে শস্ত্র” কিংবা “এক হাতে তলোয়ার অন্য হাতে কোরান”– এই লবজলি গোলাম আহমেদ মুর্তাজা মানেন না। তিনি তাঁর ‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’ এবং ইতিহাসের ইতিহাস’ এই দুটি গ্রন্থেই বলেছেন –“এক হাতে তলওয়ার অন্য হাতে কোরআন, হয় মুসলমান হও নতুবা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও, এটা ইসলাম ধর্মে আছে বলে যাঁরা লিখেছেন এবং শেখাচ্ছেন তাঁরা সত্যবাদী নন। যদি মেনেই নেওয়া যায় ইসলাম ধর্মে তাই আছে, আর আলমগির বা আওরঙ্গজেব কোরআন বর্ণে বর্ণে মানতেন তাহলে পঞ্চাশ বছর রাজত্ব করার পর ইসলামি প্রশাসনে ভারতে একটিও হিন্দু থাকা সম্ভব কি? … বাবরের শাসনকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসে কখন কোন্ বছরে মুসলমানদের অত্যাচারে হিন্দুর সংখ্যা কমে গিয়েছিল আর মুসলমানের সংখ্যা বেশি হয়েছিল? মনে রাখা উচিত, আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি হিন্দু ছিলেন। তা ছাড়া বড়ো বড়ো সেনাপতি যাঁদের হাতের ইঙ্গিতে হাজার হাজার সৈন্য প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত থাকত তাঁরা কি অমুসলমান ছিলেন না? … মন্দির ভাঙ্গা যদি ইসলামী নীতি হয় তিনি যদি ইসলামের কথা বর্ণে বর্ণে মেনে চলার লোক হন তাহলে ভারতে একটি মন্দিরেরও অস্তিত্ব থাকা কি সম্ভব ছিল?” মুর্তাজা দুটি প্রশ্ন ছুঁড়েছেন। (১) আটশো বছর রাজত্ব করার পর ইসলামি প্রশাসনে ভারতে একটিও হিন্দু থাকা সম্ভব? (২) মন্দির ভাঙা যদি ইসলামী নীতি হয় তিনি যদি ইসলামের কথা বর্ণে বর্ণে মেনে চলার লোক হন তাহলে ভারতে একটি মন্দিরেরও অস্তিত্ব থাকা কি সম্ভব? (৩) আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি হিন্দু ছিলেন। তা ছাড়া বড়ো বড়ো সেনাপতি যাঁদের হাতের ইঙ্গিতে হাজার হাজার সৈন্য প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকত তাঁরা অমুসলমান ছিলেন।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর –ভারতীয় উপমহাদেশে এত কোটি কোটি মুসলমান এলো কোত্থেকে? আকাশ থেকে পড়েছে, নাকি আরব দেশ থেকে এসেছে? হয় হিন্দু, নয় বৌদ্ধ, নয় শিখেরা ধর্মান্তরিত হয়ে আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমান। তবে সবাই মৃত্যুর ভয়ে অত্যাচারের ভয়ে মুসলিম ধর্মগ্রহণ করেছেন একথা বলা যায় না। তাহলে কেন ভারতের আদিবাসীরা দলে দলে ইসলাম ধর্মে চলে গেলেন সে বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
অনেকে বলে থাকেন ভারত ‘ইসলাম রাষ্ট্র হতে হতেও হতে পারেনি। এটা কি মুসলিমদের চরম ব্যর্থতা? হিন্দু সম্প্রদায় ও ব্রিটিশদের সাফল্য? সেই অতৃপ্ত আত্মা কি পাকিস্তান বানিয়ে খুশি থাকল? তবে বৈরিতাটা কিন্তু রয়েই গেছে। সকলেই ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে নিজধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হয়েছেন একথা সর্বৈব বিশ্বাসযোগ্য নয়। হিন্দুধর্মের প্রতি ঘৃণা থেকেও এক শ্রেণির মানুষ ইসলামে এসেছে। যেমনভাবে বৌদ্ধধর্মে ও খ্রিস্টধর্মে এসেছে। পরের কোনো অধ্যায়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর –প্রচুর মন্দির ভাঙা হয়েছে। মন্দির ভেঙে মসজিদ বা বিভিন্ন সৌধ হয়েছে। মূর্তিও ভেঙেছে প্রচুর। তবে মন্দির ভাঙার পিছনে যত-না কাফেরদের নিকেশ করা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ধনসম্পদ লুঠ করা। সে সময় ধর্নাঢ্য ব্রাহ্মণ ও হিন্দু রাজারা প্রচুর ধনসম্পদ মন্দিরগুলোতে গচ্ছিত রাখতেন নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু লুঠেরাদের কাছে সে তথ্য গোপন থাকত না। সেই সম্পদের শেয়ার পাওয়ার জন্য এদেশে বিভীষণেরও অভাব ছিল না। সুলতান মামুদ সোমনাথ মন্দির লুঠ করেছিলেন অনেকবার। দেবতার মূর্তি ধ্বংসের জন্য নয়, ধনরত্ন লুঠ করার জন্য সোমনাথ মন্দির তছনছ করেছে মামুদ। মুসলমান মামুদকে এসব লুঠপাটে সাহায্য করেন লাহোরের হিন্দুরাজা আনন্দপাল। সুলতান মামুদের হয়ে যারা সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেছিল তাঁদের অর্ধেকই ছিল হিন্দু– ছিল বারোজন হিন্দু সেনাপতি, এঁদের মধ্যে আবার দুজন ছিলেন বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ। অর্থাৎ সোমনাথ মন্দির ধ্বংসকার্যে যে হিন্দুদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল সে কথা ভুললে গৌরব থাকে! হিন্দু ঐতিহাসিক কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে আনন্দপালের কীর্তির কথা স্বর্ণাক্ষরে বর্ণিত আছে। আবার দেখুন– পুরীর জগন্নাথ মন্দির কোন্ ধর্মের মন্দির ছিল? হিন্দু জাগরণ নেতা স্বামী বিবেকানন্দ বলেন –ওটা ছিল একসময় প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির। … আমরা, হিন্দুরা তা দখল করেছি।… উই শ্যাল হ্যাভ টু ডু মেনি থিঙ্কস লাইক দ্যাট ইয়েট।… হিন্দু ব্রাহ্মণ নয়, বৌদ্ধ লামারাই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্বে ছিলেন।
যতই বারবার বলুন মুসলমান শাসনকালে সব মুসলমানরা হিন্দুদের মন্দিরগুলি ধ্বংস করেছে, তাহলে তা যাচাই করা প্রয়োজন। কবে, কারা, কেন মন্দিরগুলি ভেঙেছিল সেটাও জানা প্রয়োজন। মন্দিরগুলি যে সবসময় ধর্মবৈষম্যের কারণে ভাঙা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বুঝতে হবে ভারতে সে সময় মন্দিরগুলি ছিল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র। সেসময় মন্দির ছিল রাজবিদ্রোহীদের যোগাযোগস্থল এবং আশ্রয়স্থল। সেই শক্তি ধুলোয় গুঁড়িয়ে দিতেই এই মন্দির ধ্বংসের অভিযান চলত। তা সে হিন্দু রাজাই হোক কিংবা মুসলমান সুলতান, উদ্দেশ্য একই –মন্দির আক্রমণ এবং ধ্বংস। রাজনৈতিক এবং সামরিক কারণে শিখদের অমৃতসরে অবস্থিত। স্বর্ণমন্দিরও আক্রমণ হয়েছিল, মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আক্রমণের কারণ এই মন্দিরে ভিন্দ্রেনওয়ালা ও সন্ত্রাসবাদী উগ্রপন্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল, ভয়ানক সব অস্ত্রশস্ত্র মজুত ছিল। ওই আক্রমণটি না-করলে খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষদাঁত ভাঙা যেত না! তখন শাসক ছিলেন হিন্দুই, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি– এটা ভুলে গেলে চলবে না। তবে এখনও সুযোগ পেলে মন্দির মসজিদ ভাঙা হয়। এখন ভাঙা হয় ভিন্ন কারণে, সেটি হল ধর্মীয় দাদাগিরি –সংখ্যাগুরুর শক্তি প্রদর্শন। সেই শক্তি প্রদর্শনে যেমন বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানগণ মন্দির ভাঙেন, মূর্তি ভাঙেন— তেমনই ভারতেও সংখ্যাগুরু হিন্দুবাদীরাও শক্তি প্রদর্শনে নেমে বাবর-ই-মসজিদ গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেন, তাজমহলও ভাঙতে চান। ১৯৯২ সালে তখন শাসক ছিলেন হিন্দুই, দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমান নরসিংহ রাও, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং– এটা ভুলে গেলে চলবে না।
শৈবরা সেযুগে কত যে জৈনদের, বৌদ্ধদের, বৈষ্ণবদের মন্দির ভেঙেছে তার হিসাবও অনেক। সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, মহেন্দ্র বর্মা, অজাতশত্রু, সুভাত বর্মন, দ্বিতীয় পুলকেশী, কাশ্মীরের রাজা শ্রীহর্ষ, রাজেন্দ্র চোল, পুষ্যমিত্র শুঙ্গ–এইসব ইতিহাস-প্রসিদ্ধ রাজারাও যথেষ্ট মন্দির ধ্বংস করেছেন। কাশ্মীরের রাজা শ্রীহর্ষের কথাই বলা যাক– তাঁর একটা বাহিনীই ছিল মন্দির ধ্বংস করে সেখান থেকে ধনরত্ন সংগ্রহ করা। সেই বাহিনীর নাম ছিল ‘দেববাৎপাটক’। কাশীর মন্দির, অর্থাৎ বিশ্বনাথের মন্দির আওরঙ্গজেব ভেঙেছিলেন –একথা অবশ্যই সত্য। কেন ভেঙেছিলেন তারও একটা ইতিহাস আছে। বাংলা অভিমুখে যাত্রাপথে আওরঙ্গজেব যখন কাশীর কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর অধীনস্থ হিন্দুরাজারা অনুরোধ করেন যদি একদিনের যাত্রাবিরতি ঘটানো যায় তাহলে রাজমহিষীরা গঙ্গাস্নান করে প্রভু বিশ্বনাথকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে পারেন। আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কাশী থেকে পাঁচ মাইল দূরে আরঙ্গজেব এক সেনা-শিবির স্থাপন করেছিলেন। মহিযী, অর্থাৎ রানিরা শিবিকারোহণে যাত্রা করলেন। স্নান সেরে পুজো দিয়ে রনির সঙ্গীসাথীরা ফিরে এলেন মন্দিরের বাইরে। ফিরে এলেন না একজন –কচ্ছের মহারানি। আওরঙ্গজেব ক্রুদ্ধ হলেন, রানির খোঁজে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের পাঠালেন। খুঁজতে খুঁজতে পরে দেখা গেল দেয়াল-সংলগ্ন গণেশ মূর্তিটিকে নড়ানো যায়। ভূগর্ভে যাওয়ার জন্য মূর্তিটি সরিয়ে তাঁরা একাধিক সিঁড়ি দেখতে পেলেন। ভূতল-কক্ষটি ছিল প্রভু বিশ্বনাথের বেদির ঠিক নীচেই। প্রধান মহান্ত কর্তৃক মহারানি ধর্ষিতা হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হিন্দুরাজাদের সোচ্চার দাবি মন্দির অপবিত্র, নোংরা হয়ে গেছে, বিগ্রহ সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আওরঙ্গজেবও হিন্দুদের সংগত দাবি মেনে নেন। তাঁর হুকুমমতো বিগ্রহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মন্দির ভেঙে ফেলেন। অন্য এক সংগত কারণে তিনি জামা মসজিদও ভেঙে ফেলার আদেশ দেন। তখনকার রাষ্ট্রনীতিতে প্রয়োজন হলে মন্দির-মসজিদ সবই ভাঙা যেত নির্দ্বিধায়। শাস্তি পেতে হয় মহন্তকেও। আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছিলেন এটি একটি অতিরঞ্জিত কাহিনি। ইংরেজরা এক ধর্মনিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ সুযোগ্য শাসককে ইতিহাসের ‘ভিলেন’ বানিয়ে ছেড়েছেন। স্বাধীন ভারতেও প্রচুর মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হিন্দুশাসকরা, নগরায়নের জন্য।
যে দেশে কোনো সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলে সংখ্যালঘুদের উপাসনাগৃহ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে? পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মসজিদ ভেঙে দিচ্ছে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে? কিংবা ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মন্দির ভেঙে দিচ্ছে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে? না, এমন ঘটতে পারে না। বরং উল্টোটাই ঘটবে এবং ঘটেছে। ১৯৯২ সালে ভারতের সংখ্যাগুরুরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে, উল্টোদিকে প্রতিক্রিয়া হিসাবে বাংলাদেশে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির সহ অন্যান্য মন্দিরে হামলা চালিয়েছিল সংখ্যাগুরুরা। এমনটা প্রথম ঘটেছে তা তো নয়। একদা সংখ্যাগুরু হিন্দুরা সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের অসংখ্য মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে কিংবা আত্মসাৎ করেছিল। মুসলমান শাসনামলে মুসলিমরা তো সংখ্যালঘুই ছিল। সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মন্দির ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে, এটা কতটা বাস্তবোচিত হতে পারে? সংখ্যালঘু হিন্দুদের কচুকাটা করে, উপাসনাগৃহ ভেঙে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শাসক শত শত বছর রাজত্ব চালিয়ে যেতে পারে?
যত দোষ নন্দ ঘোষ –মন্দির ধ্বংসকারী মুসলমান। হিন্দুই, তবে তিনি একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম, কালাপাহাড় নামে পরিচিত। ধর্ম পরিবর্তনের পূর্বে কালাপাহাড় হিন্দুই ছিলেন। কালাপাহাড়’ ছিলেন বাংলা-বিহারের শাসনকর্তা সুলায়মান খান কররানির এক দুর্ধর্ষ সেনাপতি। তাঁর আসল নাম রাজীবলোচন রায়, মতান্তরে কালাচাঁদ রায়। ডাকনাম রাজু। বাড়ি ছিল রাজশাহির বীরজাওন গ্রামে। তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল নয়নচাঁদ রায় (ইনি গৌড় বাদশাহের ফৌজদার ছিলেন)। তিনি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নিয়মিত বিষ্ণু পুজো করতেন। সুলায়মান খান কররানি যখন গৌড়ের শাসক সেসময় তিনি গৌড়ের সেনানীতে যোগদান করেন এবং অতি অল্পকালের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সুনজরে। ইতোমধ্যে সুলায়মান খান কররানির কন্যা দুলারি বিবি তাঁর প্রণয়ে পড়লে শর্তসাপেক্ষে ইসলাম ধর্ম অনুসারে সুলেমান কন্যার পাণিগ্রহণ করেন এবং সুলায়মানের প্রধান সেনাপতির পদ অলংকৃত করেন। কিন্তু ইসলাম কন্যা বিবাহের সুবাদে হিন্দুসমাজ থেকে পরিত্যক্ত হয়। অপমান বোধ করেন কালাচাঁদ এবং সেই কারণে প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মোহম্মদ ফর্মুলি নাম ধারণ করে প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। আর তখন থেকেই কালাচাঁদ ‘কালাপাহাড়’ নামে পরিচিত হলেন। ১৫৬৮ সালে তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির আক্রমণ করেন এবং মন্দির ও বিগ্রহের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন। ১৫৬৪-৬৫ সালে আকবর বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে ওড়িশার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম বন্দর অধিকার করে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন সেই অবসরে সুলায়মান খান কররানি ওড়িশা আক্রমণ করেন। মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সুলায়মান কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্যসংকুল পথে ওড়িশা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠান। এইসময় মুকুন্দদেব তাঁরই এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হন। এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটরায় ওড়িশার সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। কোচরাজ নরনারায়ণ, সুলায়মান খান কররানির রাজত্বকালে গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু কালাপাহাড় একাধারে রাজা নরনারায়ণের ভাই এবং সেনাপতি শুক্লধ্বজকে পরাজিত করে আসামের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে নিয়েছিলেন। এইসময়ে কামাখ্যা ও হাজোর প্রাচীন মন্দিরগুলিতে কালাপাহাড় নির্বিচারে ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিলেন।
মুসলিম কন্যা বিবাহের কারণে কালাপাহাড় সমাজচ্যুত হন। মায়ের অনুরোধে কিছুদিন পর তিনি বাংলার ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তাঁরা কোনো বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং তাঁর কোনো প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে জানিয়ে দেন। এতে কালাপাহাড় আরও মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাই ওড়িশা অভিযানকালে তিনি ওড়িশার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ নেন। ১৫৬৭-৬৮ সালে মুকুন্দদেবের বিরুদ্ধে সুলাইমান কররানির পুত্র বায়েজিদ খান কাররানি ও সেনাপতি সিকান্দার উজবেকের যুদ্ধে মুকুন্দদেবের পতন হলে কালাপাহাড় ওড়িশা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলিতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা যায়, কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলির তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন।
মোহম্মদ ফর্মুলি ওরফে কালাপাহাড় ওড়িশার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনারক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরও কিছু মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। শোনা যায়, কালাপাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গোরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড়ো বড়ো ঘণ্টা মন্দিরের ভিতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমাদের হাতগুলি খসে পড়ত। এতে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। কালাপাহাড় মন্দির সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালাপাহাড় সম্বলপুরের মা সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। সম্বলেশ্বরী মন্দিরের পূজারীরা মন্দির রক্ষার্থে এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন। একজন নারীকে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালাপাহাড়ের ছাউনিতে পাঠানো হয়। তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিষমিশ্রিত দুধ, দই, ছানা, বিক্রি করেন। পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালাপাহাড়ের বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যান। কালাপাহাড়ের মন্দির ধ্বংসের ঘটনা ওড়িশা ও মেদিনীপুরেই (অবশ্য সেসময় মেদিনীপুর ওড়িশারই অন্তর্ভুক্ত ছিল) সীমাবদ্ধ ছিল না। কাররানিদের কোচবিহার আক্রমণকালে কালাপাহাড় আসামের কামাখ্যা মন্দিরসহ আরও কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালাপাহাড় কররানিদের শেষ শাসক দাউদ খান কররানির আমল পর্যন্ত কররানিদের সেনাপতি ছিলেন এবং মোগলদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৫৭৬ সালে কররানিদের পতনের পর কালাপাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলির দলে যোগ দেন এবং মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। সম্ভবত ১৫৮৩ সালে মোগল সেনাপতি খান-ই-আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলি পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত (এপ্রিল ১৫৮৩ সাল) হন। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পর তাঁকে ওড়িশার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। এরকম হাজার হাজার কালাপাহাড়ের জন্ম যে ভারতে হয়েছিল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
(৩) তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর— আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি হিন্দু ছিলেন। তা ছাড়া বড়ো বড়ো সেনাপতি যাঁদের হাতের ইঙ্গিতে হাজার হাজার সৈন্য প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকত তাঁরা অমুসলমান ছিলেন। আওরঙ্গজেবে সেনাবাহিনীতে হিন্দু ও অমুসলমান সেনা ছিলেন বলে মন্দির ভাঙা যাবে না, এটা কোনো শর্ত হতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের মানুষদের বাদ দিয়ে কখনোই রাষ্ট্রপরিচালনা সম্ভব নয়। আওরঙ্গজেব হিন্দু ও অমুসলমানদের ভালোবেসে তাঁর সরকারে নিযুক্ত করেছে, একথা বিশ্বাস করতে বলছি না। তা ছাড়া সেনাপতি, সেনাবাহিনী, সরকারি কর্মচারী, সে যে ধর্মেরই হোক না-কোনো শাসকের হুকুম পালন করাই তাঁদের কাজের অন্যতম শর্ত। যেমনভাবে ব্রিটিশ-ভারতের সরকারের প্রশাসনে একটা বড়ো অংশই ছিল ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম শিখনির্বিশেষে। তাঁরা ব্রিটিশ বাহাদুরদের সবরকম হুকুম তালিম করতেন। ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত সব প্রশাসনিক দপ্তরে ভারতীয়রা নিযুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে যত দুষ্কর্ম, হত্যা, অত্যাচার, গুপ্তচরবৃত্তি ব্রিটিশরা কতটা করেছে, যতটা ভারতীয়রা করেছে? জমিদাররা তো কম অত্যাচার করেননি প্রজাদের উপর! ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় জমিদারেরা ভয়ানক পিশাচ ও অত্যাচারী হয়ে পড়েছিল। এক্ষেত্রেও ভারতীয়রা দুষ্কর্ম, হত্যা, অত্যাচারের সব দোষ ব্রিটিশদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা কলুষমুক্ত থাকতে চাইলেন। যেসময় ভারতীয় (বিশেষ করে বাঙালি ও পাঞ্জাবিরা) বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে দেশকে ব্রিটিশমুক্ত করতে, সেসময় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনারা (হিন্দু-মুসলিম-শিখনির্বিশেষে) মিত্রশক্তি তথা ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। এই ভারতীয় সেনারাই ভারত-ভাগের পর একটা অংশ রাতারাতি পাকিস্তানের হয়ে গেল, পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকল। আর ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকল। অতএব সেনা ও সেনাপতিদের কোনো ধর্ম-পরিচয় হয় না –সেনা রাষ্ট্রের, শাসকের।
যে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল, সেই যুদ্ধে মৃত সেনাদের আমরা তো আজও স্মরণ করি! ইন্ডিয়া গেট প্যারিসের আর্ক দে ত্রিস্ফের আদলে ১৯৩১ সালে তৈরি হয়। স্যার এডউইন লুটিয়েন্সের নকশা করা এই ইন্ডিয়া গেটই ভারতের স্মৃতিসৌধ। পূর্বে এই সৌধের নাম ছিল অল ইন্ডিয়া ওয়ার মনুমেন্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত ৯০,০০০ ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতিরক্ষার্থেই এই সৌধ। এই সেনারা কখনোই ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে শহিদ হননি। শহিদ হয়েছেন ব্রিটিশদের স্বার্থরক্ষার্থেই। ভারতের স্বাধীনতার পর এই অজ্ঞাতনামা সেনাদের সমাধি হিসাবে পরিচিত ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ স্থাপিত হয়েছে। এই স্মৃতিসৌধের ছাউনির নীচেই ছিল পঞ্চম জর্জের একটি মূর্তি। পাছে স্বাধীন ভারতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, সেই কারণেই মূর্তিটি করোনেশন পার্কে সরিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করা সেনাদের কেন আমরা স্মরণ করি, তার ব্যাখ্যা পাই না।