১.২ আর্তনাদ করে উঠল বনওয়ারী

সেই দিনই, শেষরাত্রে, তখন ভোরবেলা।

ঘুমের ঘোরের মধ্যে আর্তনাদ করে উঠল বনওয়ারী। তার স্ত্রী গোপালীবালা চমকে জেগে উঠে তাকে ঠেলা দিয়ে ডাকলে–ওগো, বলি–ওগো! ওগো!

ফাল্গুন মাসের শেষ, বিশ তারিখ পার হয়ে গিয়েছে। কঠিন মাটির দেশ। এরই মধ্যে এখানে বেশ গরম পড়েছে, সন্ধ্যাবেলা বেশ গরম ওঠে; কিন্তু শেষরাত্রে শীত শীত। বনওয়ারী বলে গাশিরশির করে। সমস্ত রাত্রি বনওয়ারীর ভাল ঘুম হয় নাই। শেষত্রে গায়ে কথাটা টেনে নিয়ে আরামে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ বু-বু করে চিৎকার করে উঠল। গোপালীবালা তাকে ঠেলে তুলে দিলে–ওগো! ওগো!

বনওয়ারী ঘুম ভেঙে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর উঠে বসল।

গোপালীবালা জিজ্ঞাসা করলে—কি হয়েছিল? স্বপন দেখছিলা নাকি গো? এমন করে চাঁচালা কেনে গো!

সেও কাঁপছিল ভয়ে।

–হুঁ। একবার তামুক সাজ দেখি।

—কি স্বপন দেখলা বল দি-নি? এমন করে তরাসে বুবিয়ে উঠলে কেনে গো?

-কত্তা আইছিলেন। হাত দুটো জোড় করে কপালে ঠেকালে বনওয়ারী।

–কত্তা! শিউরে উঠল গোপালী।

–হুঁ কত্তা। পিসির কথাই ঠিক গোপালী। একটু চুপ করে থেকে আবার বললে—লে, শিগগির তামুক সাজু। খেয়ে আটপৌরে-পাড়া হয়ে তবে যাব নদীর ধারে। লইলে হয়ত ওদের কারোর দেখা পাব না।-বাবার পুজো দিতে হবে। আটপৌরে-পাড়ার চাঁদা চাই।

পরম কাহার আটপৌরে-কাহারপাড়ার মাতব্বর। তার কাছে যাবে বনওয়ারী।

বাঁশবাঁদি পুরোপুরি কাহারদের গ্রাম গ্রাম ঠিক নয়, ওই জাঙল গ্রামেরই একটা পাড়া। তবে জমিদারি সেরেস্তায় মৌজা হিসেবে ভিন্ন বলে—ভিন্ন গ্রাম বলেই ধরা হয়। দুটি পুকুরের পাড়ে দুটি কাহারপাড়া। বেহারাকাহার এবং আটপৌরে-কাহার। বেহারাকাহারপাড়াতেই চিরকাল লোকজন বেশি, প্রায় পঁচিশ ঘর বসতি; পুব দিকে নীলের মাঠের বড় সেচের পুকুর, নীলের বাঁধের চার পাড় ঘিরে বেহারাদের বসবাস। কোশকেঁধে-বাড়ির বনওয়ারী বেহারাপাড়ার মুরব্বি। বেহারা-কাহারেরা পালকি বয়। বনওয়ারীর পূর্বপুরুষ এক কাঁধে পালকি নিয়ে এক ক্ৰোশ পথ চলে যেত, কাঁধ পর্যন্ত বদল করত না—তাই ওদের বাড়ির নামই কোশ-কেঁধেদের বাড়ি। ওদের বংশটাই খুব বলশালীর বংশ। লম্বা চওড়া দশাসই চেহারা, কিন্তু গড়ন-পিটনটা কেমন যেন মোটা হাতের; অথবা গড়নের সময় ওরা যেন অনবরত নড়েছে, পালিশ তো নাই-ই।

বেহারাপাড়া থেকে রশিখানেক পশ্চিমে আটপৌরে-কাহারদের বসতি। গোরার বাঁধ বলে মাঝারি একটা পুকুরের পাড়ের উপর ঘর কয়েক আটপৌরে-কাহার বাস করে। আটপৌরেরা পালকি কাঁধে করে না, ওরা বেহারাদের চেয়ে নিজেদের বড় বলে জাহির করে। খুব ভাল কথা ব্যবহার করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে। বলে-আটপৌরে হল অট্টপহরী।

অর্থাৎ অষ্টপ্রহরী।

আসল অর্থ পাওয়া যায় চৌধুরীদের বাড়ির পুরনো কাগজে। সেসব কাগজ এখন প্রায় উইয়ে খেয়ে শেষ করে এনেছে। উইয়ে-খাওয়া কাগজের স্তুপের মধ্যে কিছু কিছু এখনও পুরো আছে। তার মধ্যে ১২২৫-২৬ সালের থোকা জমাওয়াসিল বাকি থেকে পাওয়া যায়—গোটা বাঁশবাঁদি মৌজাটাই ছিল পতিত ভূমি। ওখানে কোনো পুকুরও ছিল না, বসতিও না। জাঙল গ্রামে মোটমাট দশ ঘর বাস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়, সবাই তারা ছিল চাষী সদ্‌গোপ। ১২৫০ সালের কাগজে দেখা যায়—এক নতুন জমাপত্তন-নীলকর শ্রীযুক্ত মেস্তর জেনকিন্‌স সাহেবের নামে। সেই জমার মধ্যে সেই জাঙলের যাবতীয় পতিত ভূমি, তার সঙ্গে গোটা বাঁশবাঁদি মৌজাটাই প্রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। জাঙলের পশ্চিম দিকে উঁচু ডাঙার উপর এখনও কুঠিবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং হ্রদের পুকুর বলে একটা পুকুর দেখা যায়। ওই হ্রদের পুকুরের জল পাকা নালা বেয়ে এসে নীল। পচানোর পাকা চৌবাচ্চাগুলি ভর্তি করে দিত। সেখানটা এখন জঙ্গলে ভরে গিয়েছে এবং ওইখানেই বুনো শুয়োরের একটা উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। বাঁশবাঁদি মৌজা বন্দোবস্ত নিয়ে সায়েবরাই ওখানে পুকুর কাটায় এবং বাঁশবাঁদির সমস্ত পতিতকে নীলচাষের জন্য হাসিল করে তোলে। সেই হাসিল করবার জন্যই এই কাহারপাড়ার লোকেরা বাঁশবাঁদিতে আসে। এসেছিল। অনেক লোক। তার মধ্যে এই কাহার কয়েক ঘরই এখানে বসবাস করে। কয়েকজন পেয়েছিল। কুঠিবাড়িতে চাকরি, লাঠি নিয়ে ঘুরত ফিরত, আবার দরকারমত সাহেব মহাশয়দের ঘরদোরে। কাজ করত; এজন্য তাদের জমি দেওয়া হয়েছিল, এবং এখানকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টার কাজের জন্য চাকরানভোগী হিসেবে খেতাব পেয়েছিল—অষ্টপ্রহরী বা আটপৌরে। বেহারা-কাহারেরা নীলের জমি চাষ করত এবং প্রয়োজনমত সাহেব-মেমদের পালকি বইত। নীলের জমি সেচ করবার জন্য পুকুরটা কাটানো হয়েছিল বলে ওটার নাম নীলের বাঁধ, আর গোরার বাঁধ নামটা হয়েছে গোরা অর্থাৎ সাহেবদের বাঁধ বলে। পুকুরটার জল ভাল—ওই পুকুরে সেকালে কারও নামবার হুকুম ছিল না, ওখান থেকেই যেত সাহেবের ব্যবহারের জল, মধ্যে মধ্যে কুঠিয়াল সাহেবের কাছে সমাগত বন্ধুবান্ধব গোরা সাহেবেরা এসে স্নান করতে নামত। স্নান করত নাকি উলঙ্গ হয়ে। সেই আমল থেকে কাহারদের কয়েকটা ঘরে রূপ এসে বাসা বেঁধেছে। পরম কাহারদের গুষ্টিটার রঙই সেই আমল থেকে ধবধবে ফরসা। সুচাঁদপিসির কর্তাবাবা অর্থাৎ বাবার বাবার রঙ একেবারে সাহেবের মত ছিল। সুচাঁদপিসির রঙও ফরসা। মেয়ে বসন্ত খুব ফরসা নয়। কিন্তু ওর মেয়ে পাখী তো একেবারে হলুদমণি পাখি; চৌধুরী বাড়ির কর্তার ছেলে অকালে মরে গেল মদ খেয়ে, নইলে যুবতী পাখীর এখনকার মুখের সঙ্গে তার মুখের আশ্চর্য মিল দেখা যেত। তেমনিই বড় বড় চোখ, তেমনিই সুডৌল নাক, চুলের সামনেটা পর্যন্ত তেমনিই ঢেউখেলানো। চৌধুরীকর্তা আজ নিঃস্বও বটে, তার উপর হাড়কৃপণও বটে, তবু তিনি বসন্তের মেয়ে পাখীকে মায়ামমতা করেন। বসন্তের ও-বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ। আজও ঘোচে নাই, সে আজও ও-বাড়ি যায়, যোজখবর করে, দুধের রোজ দেয়, কিন্তু টাকার তাগাদা করে না।

এই চৌধুরীকর্তার বাবার বাবা ছিলেন সাহেবদের নায়েব। তিনি নাকি ছিলেন লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ, আর তেমনিই নাকি ছিলেন জবরদস্ত জাহাবাজ বেটাছেলে; তার দাপে নাকি বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খেত। তাঁকেই দয়া করেছিলেন এই বেলবনের মহারাজ যিনি নাকি এখানে কর্তা বলে পরিচিত—গেরুয়া কাপড় পরে, খড়ম পায়ে, দণ্ড হাতে, গলায় রুদ্ৰাক্ষ আর ধবধবে পৈতের শোভায় বুক ঝলমলিয়ে, ন্যাড়া মাথায় যিনি রাত্রে চারদিকে ঘুরে বেড়ান। চন্দনপুরের ভদ্রলোকেরা বলেও কথাটা নেহাতই কাহারদের রচনা করা উপকথা। আসল কথা নীলকুঠি সব জায়গায় যেমনভাবে উঠেছে এখানেও তেমনভাবেই উঠেছে, তবে কোপাইয়ের বান আর। কুঠি-ওঠা ঘটেছে একসঙ্গে। সে সময় কুঠিয়াল সাহেবদের খারাপ সময় চলছিল, কারবার। উঠিয়ে দেবার কথা হচ্ছিল, সেই সময় হঠাৎ একদিন রাত্রে কোপাই ভাসল। তেমন ভাসা কোপাই নাকি কখনও ভাসে নাই। সে বান কুঠিবাড়ি পর্যন্ত ড়ুবিয়ে দিয়েছিল। লোকে বলে, সাহেব-মেম সেই বানে ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু সুচাঁদপিসি যে-কথা বললে, সেইটাই হল আসল কথা। সেই কথাটাই বিশ্বাস করে বনওয়ারী। ওই কর্তার কথা অমান্য করতে গিয়েই সাহেব মহাশয় মেমকে নিয়ে তলিয়ে গেল ঘুরনচাকির মধ্যে পড়ে। নইলে সাহেব-মেম—যারা সাত সমুদ্দর পার হয়ে ভাসতে ভাসতে আসে, তারা কোপাইয়ের বানে মরে যাবে? কর্তার লীলা, কর্তার ছলনা সব। চৌধুরীকর্তা দেবতার দয়ায় শুধু যথের ধনই পেলেন না, সাহেব কোম্পানির তামাম সম্পত্তিও পেয়ে গেলেন জলের দামে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।

চৌধুরীকর্তাদের আমলেও কাহাররা বেহারার কাজ করেছে। চৌধুরীদের পালকি ছিল দুখানা। ড়ুলি ছিল খানচারেক। আটপৌরেরা তাদের বাড়িতেও আটপৌরের কাজ করেছে।

* * * *

পুরনো কথা যাক; আজকের কথাই বলি। বনওয়ারী পরমের বাড়ি এসে দেখলে, এই ভোরবেলায় পরম বেরিয়ে গেছে। পরমের বউ কালোশশী এই গায়েরই দৌহিত্রী। আটপৌরেদের গোরাচাঁদের বেটীর বেটী। এই গায়েই মানুষ হয়েছে কালোশশী। গোরাচাঁদের ছেলে ছিল না–বড় মেয়ের মেয়েকে নিয়ে মানুষ করেছিল। সুতরাং কালোশশীর সঙ্গে কথা বলতে বউমানুষের সঙ্গে কথা বলার সঙ্কোচ ছিল না। তার উপর এককালে বনওয়ারীর সঙ্গে তার নাকি মনে মনে রঙ চুঁই যুঁই এমন অবস্থা হয়েছিল। সে অনেক কথা। কাহার-কন্যে কালোশশীর জন্যে সেকালে বোধহয় দেবতারাও পাগল হয়েছিল। কিন্তু তার মন কেউ পায় নাই। পেয়েছিল। বনওয়ারী। কিন্তু হায় রে নেকন! আটপৌরে-কাহার-কন্যে বেহারা-কাহারের ঘরে আসে কি করে? হায় রে নেকন!

সেদিনের কথা মনে পড়লে বনওয়ারীর এই বয়সেও বুকের ভিতর তোলপাড় করে ওঠে। রাত্রে উঠে দুজনে গিয়ে মিলত কোপাইয়ের কূলে। গান গাইত কালোশশী। আকাশে উঠত চন্দ্ৰশশী।

আটপৌরে-পাড়ার ঘোড়ারা পাহারা দিত; বনওয়ারীকে পাকড়াও করবার জন্যে তাদের সে। কি চেষ্টা! কিন্তু লবডঙ্কা! একদিনও ধরতে পারে নি তারা। বনওয়ারী হাসত আর গান করত সুরু করে চলে যাব গিরগিটির মতন, চোখে চোখে রাখবি কতক্ষণ। ওরা আক্ৰোশে জ্বলত। ওদের সর্দার পরম পথে-ঘাটে ছুতোনাতা করে ঝগড়াও করত। কতবার যে দু-চারটে করে কিল চড় আদান-প্রদান হয়েছে পরমের সঙ্গে তার ঠিক নাই। শেষে পরমের হাতে পড়ল কালোশশী। কপাল কালোশশীর। পরমের হাতে পড়ে ওর আর দুর্গতির শেষ নাই। কালোবউকে বিয়ে করে পরম ভালবাসলে এক ভিনজাতের কন্যাকে; তার উপর মন্দ-সঙ্গে মিশে ধরলে ডাকাতি। কালো-বউ মনের আক্ৰোশে চন্দনপুরে রেজা খাটতে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে লাগল। পরমের দ্বীপান্তরের সময় চন্দনপুরে বাবুদের বাড়ির ঝি-বৃত্তি করলে, আর বাবুদের চাপরাসী সিংজীর অনুগৃহীত হয়ে রইল।

পরম দ্বীপান্তর থেকে ফেরার পর কালোশশী গাঁয়ে এসেছে। কালোশশীর অনেক দুর্নাম, অনেক কলঙ্ক,মানুষটা যত বড়, তার চেয়েও বড় তার কলঙ্ক।

আজ কালো-বউ একগাল হেসে সাদরে অভ্যর্থনা করে বললে—কি ভাগ্যি, সকালেই তোমার মুখ দেখলাম! বস।

পরমদাদা গেল কমনে, তাই কওঁ।

—দাদার তরেই আইছিলা তা হলে? হাসলে কালোশশী।

–সে তো তোমার এই খানিক আগে বেরিয়ে গেল। ওই হুঁকোর মাথায় কল্কিতে আগুনও নেবে নাই এখনও। খাও কেনে তামুক।

—কি বেপদ দেখ দি-নি!

—কেন? বেপদটা কি হল? বস, আমার সাথে খানিক গল্প কর নিশ্চিন্দি। মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগল কালোবউ।

—বলি, হাসি তোমার আসছে?

—কেনে? তোমাকে দেখে হাসি আসবে না কেনে?

—বলি কাল আতে সনজেকালে শিস শোন নাই?

কালোবউ এবার শঙ্কিত হয়ে উঠল। হা, তা শুনেছি ভাই।

—তবে?

তবের ব্যাপারটা হলরাত্রির অন্ধকার কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবনাটা কালো-বউ ভুলে গিয়েছে।

বনওয়ারী এবার বসল। কোটা নিয়ে টানতে টানতে সবিস্তারে কালোশশীকে বললে করালীর কুকুরটার রোমাঞ্চকর ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কথা। বললে—তোমাকে বলব কি ভাই, একেবারে মুখে অ তুলে মাথা কাছড়ে মরে গেল। শেষকালে হল কি–

মুখের কাছ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে ধরলে বনওয়ারী—তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল অপরিসীম আতঙ্ক, গায়ের রোমগুলি কাটার মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

কালোশশী মুখ হ করে শুনছিল। হাতে আঁটা নিয়ে সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বনওয়ারী বললে কুকুরটার চোখ ফেটে যাওয়ার কথা। বললে—ফোসকার মত ফুলে উঠে ফ-টা-স করে ফেটে গেল। আর গলগল করে অক্ত।

শিউরে উঠল কালোশশী—ওঃ, মাগো!

বনওয়ারী বললে—তাই এয়েছিলাম পরমদাদার কাছে; পিতিবিধেন তো করতে হবে।

–তা হবে বৈকি! কত্তার আশ্চয়ে বাস করে কত্তার কোপে পড়ে বাঁচব কি করে?

—সেই তো। তা তোমরা করছ কি?

—আমরা? হঠাৎ কালোশশী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল তার স্বামীর উপর।–আমার কপালে ঝাঁটা আর তার কপালে ছাই–বুঝলা দেওর, তার কপালে ছাই। এ পাড়ার অদেষ্টই মন্দ। বুঝলা না? মাতব্বর যদি মাতব্বরের মত হয় তো দশের জন্য ভাবে। সে কি আর তুমি ভাই! সে হল–ফরম আটপৌরে। আতদিন নিজের ভাবনা, জমি-পয়সা আর ওই পয়সা-জমি। কাল আতে সবাই শুনেছে শিস। ভয়ও সবাই পেয়েছে। কিন্তু কি হবে? মাতব্বর গেল চন্ননপুরে, বড়বাবুদের কাছারিতে। তামাম সাহেবডাঙ্গা কিনেছে বাবুরা, শুনেছ তো?

চমকে উঠল বনওয়ারী। কথাটি তার কাছে একটা মূল্যবান কথা। সে প্রশ্ন করলে—সকলে উঠে সেখানেই গিয়েছে বুঝি?

—আবার কোথাও বলব কি দেওর, আতে স্বপন দেখে কথা কয়—বিড়বিড় করে ওই কথা। নয়ানজুলি, ছেচের জল, দে কেটে দে, কোদালে করে মাথা কুপিয়ে দোব-এই কথা।

বনওয়ারী অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গেল। চন্ননপুরের বড়বাবুরা রাজাতুল্য লোক, মস্ত কয়লার ব্যবসা। তারা হঠাৎ জমির উপর নজর দিয়েছেন। পতিত জমি যেখানে যা আছে কিনে চলেছেন। জমি কাটাবেন। কতক নিজেরা কাটিয়ে চাষ করবেন, কতক প্রজাবিলি করবেন। পরমদাদা ভারি। বুদ্ধিমান লোক। খাজখবর অনেক রাখে। সে ঠিক গিয়ে হাজির হয়েছে বাবুদের দরবারে। আর সে কি করছে? নাঃ, ছি ছি ছি!

বনওয়ারীর সমস্ত বৈষয়িক কাজগুলি মনে পড়ে গেল। জাঙলে মনিব-বাড়ি যেতে হবে। ধান পিটানো শেষ হয়ে গিয়েছে—এখনও বছরের দেনা-পাওনার হিসাব হয় নাই। সেখানে একবার যাওয়া উচিত। তারপর একবার চন্ননপুর যেতেই হবে। কালো-বউয়ের কথাগুলি বনওয়ারীর কানে আর যাচ্ছেই না প্রায়!

কালোশশী বলেই চলেছিল-পাশে আমি যে একটা মানুষ শুয়ে থাকি, তা অসুখবিসুখ কি দেহ খারাপ হলে যদি কাতরে কাতরে মরেও যাই, তবু তার ঘুম ভাঙে না। বললে বলে কি জান? বলেনাক ডাকে, তাতেই শুনতে পাই না। সে নাক ডাকা যদি শোন।

কালোশশী মুখে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগল।

বনওয়ারী হঠাৎ উঠে পড়ল। হুঁকোটা ঠেসিয়ে রেখে দিয়ে বললে—আমি ভাই তা হলে ওঠলাম।

—বস বস। আর একবার না হয় তামুক সেজে দি।

আমারও তো কাজকৰ্ম্ম আছে ভাই। মুনিব-বাড়ি যেতে হবে। তা, পরে থেমে গেল বনওয়ারী। চন্ননপুর যাওয়ার অভিপ্ৰায়ের কথাটা আর বললে না সে। হাজার হলেও কালোশশী পর।

কালোশশী তার মুখের দিকে চেয়ে হেসে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আক্ষেপের একটা শব্দ করে বললে–হা-রে, হা-রে! সব পুরুষই এক! ওই কাজ কাজ আর কাজ! মুখে তার এক বিচিত্র অভিব্যক্তি ফুটে উঠল।

বনওয়ারী একটু অপ্রস্তুত হল। সে হাসতে চেষ্টা করে বললে—তা ভাই, কাজ করলেও সে তো সবই তোমাদের জন্যেই। ওজগার করে সমপ্পন তো তোমাদের হাতেই।

বলতে বলতে সে বেরিয়ে এল পরমের বাড়ি থেকে। নইলে এ কথাতেও কালোশশীর কথায় ছেদ পড়বে না।

কাজ অনেক। বনওয়ারীর একদণ্ড বসে থাকলে চলে? ভাই কালোশশী, তোমাকে ভাল তো বারি, কিন্তু উপায় কি? রঙের ছাপ একবার মনে লাগলে কি আর ওঠে? হোক না দেখা এক যুগ পরে, দেখা হলেই দুজনের ঠোঁটেই হাসি ফোটে। ওই রঙটার রকমই হল পাকা। একবার লে, ঘষে ঘষে হিয়ে ক্ষয়ে ফেললেও ওঠে না। কিন্তু যার উপায় নাই, তার জন্যে কেঁদেকেটে মন খারাপ করেই বা লাভ কি? তোমার মায়ের বাপ যে তখন বেহারা-কাহার বলে তোমাকে দিলে না বনওয়ারীর হাতে! আর পরমের সঙ্গে যখন তোমার বিয়ে হয়ে গেল, তখন বনওয়ারী আর হেসে দুটো কথা কয়ে করবে কি? আর তেমন জাতের মানুষ নয় বনওয়ারী। কৰ্তব্যধর্ম বলে একটা কথা আছে। একটা পাড়ার মাতব্বর সে। হরিবোল! হরিবোল! পভু, তুমিই বনওয়ারীকে বাঁচিও। বাঘ-শুয়োর-সাপ-ঝড়-বান—এসব থেকে বাঁচাতে বলে না বনওয়ারী, বনওয়ারীকে তুমি এইসব অন্যায় কারণ থেকে বাঁচিও।

কাজ অনেক। পাড়ায় ফিরে সুচাঁদপিসিকে বলতে হবে—যেন প্রতি বাড়ি ঘুরে পুজোর চাঁদা আর চাল তুলে রাখে। যে মেয়েগুলান ঘুটে মাথায় করে দুধ নিয়ে চন্ননপুরে যাবে, দুধ ও ঘুটে বেচে তারপর সারাদিনটা সেখানে বাবুদের ইমারতে মজুরনী খাটবে, তাদেরই বলে দিতে হবে অবসর করে কেউ যেন কাছারিতে পরমের সঙ্গে দেখা করে সকাল সকাল তাকে বাড়ি ফিরতে বলে। যদি তার চন্ননপুরে যাওয়া আজ না-ই হয়, মুনিব-বাড়িতে যদি আটক পড়েই যায় কোনো রকমে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা ঠাওরালে সে। মুনিব-বাড়িতে তো রকমের অভাব নাই। খামারটা সাফ কর, নয়ত কাঠের গুঁড়িটা থেকে কতকগুলো কাঠ ছাড়িয়ে দিয়ে যা; নয়ত গরুর জাব-খাওয়া ডাবরগুলোর গায়ে মাটি লেপন দে; নিদেন কলার ঝাড়ের মধ্যে পুরনো এটে পচেছে, খুঁড়ে তুলে ফেল। আর হিসেবে? হিসেবে বসলেই তো এক বেলা।

 

আটপৌরে-পাড়া থেকে নিজেদের পাড়ায় ফিরে প্রথমেই তাকে দাঁড়াতে হত, করালীর বাড়ির উঠানে। করালী উঠানেই একটা গর্ত খুঁড়ছে, আর পাখী করালীকে তিরস্কার করছে।

—পচে গন্ধ উঠবে যে!

করালী মাটি কুপিয়েই চলেছে। ছোঁড়াটার দেহখানা শক্ত বটে। আচ্ছা জোয়ান হয়ে উঠেছে! এরই মধ্যে শরীরের বিশেষ করে বুকের পিঠের হাতের পায়ের পেশিগুলো ফুলে উঠেছে, তার উপর ঘেমেছে–চকচক করছে সর্বাঙ্গ। আজ রবিবার-ছোঁড়ার ছুটি, তাই চন্ননপুর না গিয়ে কালুয়া কুকুরটার জন্যে সমাধি খুঁড়তে আরম্ভ করেছে।

পাখী চেঁচিয়েই চলেছে—কথা শুনছিস? না কানে যেছে না?

চেঁচাস না মেলা বকবক করে। করালী মাটি কোপাতে কোপাতেই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিবে। কালুয়া কুকুরটাকে সে এইখানেই সমাধি দেবে। কালুয়ার হাড়মাস যে চিল শকুন শেয়ালে ছিঁড়ে খাবে, সে করালীর সহ্য হবে না।

–বাড়িতে টেকা দায় হবে। ভাতের গরাস মুখে তুললে বমি আসবে বদ ঘেরানে।

–তা তোর কি? আমার বাড়ি আসিস না তুই!

–ওরে মুখপোড়া, ওরে নেমকহারাম! তোর মতন নেমকহারাম বজ্জাত কেউ আছে নাকি? বলে যে সেই—যার লেগে মরি, তার ঘা সইতে নারি, তাই তোর বিত্তান্ত। তা আমার ঘেরান। না লাগুক, আমি তোর বাড়িতে না আসি, নসুদিদিও তো মানুষ। সে থাকতে পারবে কেনে?

বনওয়ারী করালীর বাড়ি না ঢুকে পারলে না। বনওয়ারীকে দেখেই পাখী বলে উঠল–এই দেখ মামা; কি করছে দেখ! বাড়িতে কুকুর পুঁতবে সামাজ দেবে। বারণ কর তুমি। নদিদি নাই, উ যা-খুশি তাই করছে।

বনওয়ারী বলে—এই, বলি হচ্ছে কি? বাড়ির উঠোনে ভাগাড় করে কে? তুই কি ক্ষ্যাপা না পাগল?

করালীর টামনার কোপে মাটিতে একটা ফাট দেখা দিয়েছিল ফাটলে টামনার চাড় দিয়ে সেই মাটির একটা চাপ ছাড়াবার চেষ্টা করছিল পাঁতে দাঁত টিপে, প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করে! সে কোনো উত্তর দিলে না। পাখী বললে আবার বলছে কুকুর পুঁতে যাবে বাঁশবেড় খুঁজতে।

–বাঁশবেড় খুঁজতে। বিস্ময়ের সীমা রইল না বনওয়ারীর।

–হ্যাঁ। কিসে শিস দেয়, কিসে মেরেছে ওর কালুয়াকে, তাই খুঁজে দেখবে।

সর্বনাশ! হে ভগবান! হে বাবা কত্তাঠাকুর—তোমার লীলাখেলার নিরাকরণ করতে চায় ছোঁড়া! একের পাপে দশ নষ্ট হবে! মুহূর্তে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল।

—করালী!

করালী এ আওয়াজ শুনে চমকে উঠল, টামনাটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে খানিকটা সরে দাঁড়াল। ঘুরে তাকালে সে বনওয়ারীর দিকে।

বনওয়ারীর এই কণ্ঠস্বরকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। বনওয়ারী সহজে অত্যন্ত ভালমানুষ লোক, পাড়ার মাতব্বর হলেও মাতব্বরির কোনো কঁজ নাই, কোনো অহংকার নাই। হাসি-খুশি নাচ-গান মিষ্টি কথা নিয়েই আছে। কারও সঙ্গে কারও ঝগড়া-বিবাদ হলে দুজনকেই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে দেয়; দেখে মনে হয় গরজ যেন বনওয়ারীরই। কিন্তু আর এক বনওয়ারী আছে; কালেকস্মিনে সে দেখা দেয়। সে দেখা দেবার আগে প্রথমেই এই আওয়াজ তুলে সে সাড়া দেয়, সেই বনওয়ারী জাগছে।

সে বনওয়ারী জাগলে বিদ্রোহীকে তৎক্ষণাৎ অসুরের মত শক্তিতে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে, বুকে চেপে বসে, বাঁ হাতে গলা টিপে ধরে, ডান হাতে টেনে ধরতে চেষ্টা করে জিভ। তখন পাঁচ-সাত জন জোয়ান ভিন্ন সে বনওয়ারীকে টেনে সরানো যায় না।

বনওয়ারীর চোখ লাল হয়ে উঠেছে। সে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলে করালীর দিকে। পাখী এবার সামনে এসে ভয়ার্ত স্বরে বললে–না, মামা, না। ও আর সেসব করবে না।

করালী কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্থিরদৃষ্টিতে বনওয়ারীকে দেখছে।

মুহূর্তে চোখে ফুটছে শঙ্কা, আবার পরমুহূর্তে জ্বলে উঠছে বিদ্ৰোহ।

বনওয়ারী পাখীকে ঠেলে সরিয়ে দিলে। পাখী পিছন থেকে তার হাত ধরতে চেষ্টা করলে–মামা! মামা! তবু বনওয়ারী নীরবে এগুচ্ছে।

শেষে নিরুপায় হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল পাখী—ও দিদি, দিদি গো! ও দিদি! দিদি অর্থাৎ সুচাঁদ। এ সময়ে এক সুদ পারে বনওয়ারীর সামনে দাঁড়াতে।

বনওয়ারী উত্তরোত্তর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, এমনভাবে আজও কেউ তাকে অপমান করে নাই। সে এগিয়ে চলল। তবু করালী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।

করালী কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হঠাৎ যেন সাহস তার ভেঙে পড়ল, মুহূর্তে সে লাফ দিয়ে উঠানের বেড়াটা ডিঙিয়ে ওপাশে পড়ে ছুটে পালাল মাঠে। বনওয়ারী খানিকটা ছুটল, কিন্তু বয়স হয়েছে বনওয়ারীর, ছুটলে হাফ ধরে। এমনি পালকি কাঁধে সওয়ারী বহনের অভ্যস্ত চালে কাঁধ বদল করে মধ্যে মধ্যে বিশ্রাম নিয়ে দশ ক্ৰোশ হাঁটতে পারে, কিন্তু এমনভাবে ছুটতে আর পারে না। থামতে হল বনওয়ারীকে। ওদিকে গায়ের ধারে দাঁড়িয়ে সুচাঁদপিসি হাঁকছে। মেয়ে ছেলে সব জমে গিয়েছে। প্রহ্লাদ রতন এগিয়ে আসছে। বনওয়ারী অগত্যা ফিরল। যাক হারামজাদার বাচ্চা এখন যাক; কিন্তু যাবে কোথা? ফিরতে হবে, না ফিরতে হবে না? কার এলাকায় ফিরবে?

* * * *

ফাল্গুন মাসের সকালবেলা, তাই কাহারেরা বাড়িতে ছিল। কাহারপাড়ায় কাজকর্মের চাপ এখন কম; মাঠে ক্ষেতে চাষ-কর্ম এখন বন্ধ, খামারে ধান মাড়াইও শেষ হয়ে গিয়েছে; রবি ফসলের পালাও প্রায় শেষ; গম কারও পেকেছে, কারও পাকতে শুরু করেছে, ছোলা-মসুরসরষে এ সবেরও ওই অবস্থা। আলুর জমির কাজও আর নাই। কেবল তুলতে বাকি। চৈত্রের প্রথম থেকে একদফা ভিড় লাগবে আবার। কারও কারও আখ আছে নাবি চাষের আখ, সেও মাড়াই হবে চৈত্র মাসে। এখন একমাত্র কাজ মুনিব-বাড়ির দেনা পাওনার হিসেব—সে হিসেব মুনিবদের হাতে। কাজেই পুরুষেরাও সকলে বাড়িতেই ছিল। তাই রক্ষা হল।

প্ৰহ্লাদ রতন বনওয়ারীর সমবয়সী। ওরা এগিয়ে এসে বনওয়ারীর হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। প্রহ্লাদ বললে—করালীর বিহিত যদি না হয় অতন, তাহলে তো কাণ্ড খারাপ। কেউ আর কাউকে মানবে না।

রতন বললে—তা হলে গেরামের পিতুল নাই—এ একেবারে ধ্রোব কথা।

বনওয়ারী কোনো কথা বললে না।

যে দিক দিয়ে ওরা পাড়ায় ঢুকল, সে দিক দিয়ে নিমতেলে পানুর ঘর সামনেই পড়ল। পান্ত নিমতলার পশ্চিম দিকে ছায়াটি যেখানে পড়ে, সকালবেলা সেইখানটিতে তালপাতার চাটাই বিছিয়ে তামাক সেজে মাতব্বরদের অভ্যর্থনা করলে।—বস বনওয়ারীদাদা, অতনদাদা, পেল্লাদখুড়ড়া,বস, তামুক খাও।

একে একে জুটল সকলেই। সুচাঁদও এসে দাঁড়াল। বললে—বেশি আগ করি না বাবা বনওয়ারী, ঘোড়াকে এনে তোর পায়ে ফেলে দিছি আমি।

বনওয়ারী এতেও কোনো কথা বললে না।

সুচাঁদ বললে—আমার হয়েছে এক মরণ, বুঝলি বাবা—এই বুড়ো বয়সে হারামজাদী বেটীর বেটী নিয়ে এ এক বেপদ। গলায় কাটা বিধেছে, সে কাটা ওঠেও না, নামেও না, তাই। সর্বনাশীর করালী ছাড়া সারা তিভুবন খাঁখাঁ-খা করছে। বুড়ির সে হাতনাড়া দেখে এবার সবাই হেসে উঠল। শুধু হাত নাড়াই নয়, খানিকটা নেচে দিলে বুড়ি। সে দেখে বনওয়ারীর মুখেও এবার অল্প একটু হাসি দেখা গেল। পানু ঘরের ভিতর থেকে একটা পাঠার কান ধরে টেনে এনে বললে—এই দেখ বনওয়ারীদাদা, এইটি। কাল আতে এসেই আমরা স্তি-পুরুষে এইটিকে কত্তার পুজোয় দোব ঠিক করেছি। এইটিই তোমার সবচেয়ে বড়, আর গায়েও বেশ আছে। বেশ তেজালো পাঠা।

বনওয়ারী পিঠার গায়ে হাত বুলিয়ে মেরুদণ্ডটা টিপে দেখে বললে, বেশ সাবধানে যতন করে আখিস বাপু দুটো দিন। পুজো পরশু দোবই। শনিবার আছে; বারও পাব।

রতন বললে—আটপৌরেপাড়ায় বলবে না?

বনওয়ারী ঘাড় নেড়ে হতাশা প্রকাশ করে বললে—তবে আর মেজাপ খারাপ হল কেনে! সকালে, সেই ধর পেথম-কাক কোকিল ডাকতে ঘুম ভেঙেছে। সমস্ত আত ভাবনায় ঘুম হয় নাই। ভোর আতে চোখ লেগেছিল খানিকতা তোমার, সঙ্গে সঙ্গে স্বপন হয়ে গেল। দেখলাম যেন, ঠিক কত্তা এসে দাঁড়িয়েছেন মাথার ছিয়রে। বু-বু করে ঘুম ভেঙে গেল। উঠলাম। উঠেই গেলাম পরমের বাড়ি। তা পরম সেই ভোরেই বেরিয়েছে। তা বলে এলাম কালো-বউকে–বলি বোলো পরম এলে।

রতন প্রহ্লাদ দুজনেই একটু হাসলে বনওয়ারীর মুখের দিকে চেয়ে। মজলিসের সকলে–স্ত্রী-পুরুষ সকলে হাসলে। তারা অবশ্য গোপন করে হাসলে।

বনওয়ারী অনুভব করতে পারলে গুপ্ত হাসির ধারার সরস স্পর্শটুকু। সে কথাটাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যই বললে—সে গিয়েছে তোমার চন্ননপুরে বাবুদের বাড়ি। বাবুরা নাকি গোটা সায়েবডাঙা কিনেছে। ডাঙা ভেঙে জমি করবে। খানিক আধেক জমি বিলিও করবে শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে সবার মন ঘুরে গেল; বনওয়ারীও কালো-বউয়ের কথা থেকে লুব্ধ হয়ে ছুটল জমির দিকে।

এটা একটা খবর বটে। নীলকুঠির সাহেবদের সেই ডাঙাটা, যেখানে বন্যা থেকে বাঁচবার জন্য তারা ঘর-দোর করেছিল, কুঠি করেছিল, সেই ডাঙাটা ভেঙে জমি হবে? বিলিও করবে কিছু জমি? এবং তাদেরই একজন সে জমি বিলি নেবার জন্য ভোরবেলায় গিয়ে ধরনা দিয়ে বসে আছে? মুহূর্তে সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠল। জমি! জমি!

বনওয়ারী বললে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। শুনছ অতন-ভাই, পেল্লাদ-খুড়ো!

রতন প্রহ্লাদ উৎসুক হয়ে বনওয়ারীর মুখের দিকে চেয়ে বসে বসেই খানিকটা কাছে এগিয়ে এল। কি বল দি-নি? কথা কিন্তু সকলেই বুঝতে পেরেছে। এক চাপ ছোলা-কলাই যখন ভিজে ফুলে ওঠে, তখন যেমন সবগুলি ছোলা থেকেই অঙ্কুর বার হয়ে মাটি ফাটিয়ে উপরের দিকে একসঙ্গে ওঠে, তেমনিভাবে এই খবরের অন্তর্নিহিত আশার সরসতায় সকল কাহারের অন্তর থেকে একই আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুর একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাছাকাছি বসে পরস্পরের মনের খবর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে পরস্পরকে ছুঁয়ে বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। কিন্তু তবু কথাটা বনওয়ারীর কাছ থেকে আসাই ভাল। বনওয়ারীরও কথাটা বলাই ভাল। কথাটা একদিন প্রকাশ পাবেই, এবং নিজে জমি নিয়ে সে যদি কথাটা কাহারদের কাছে গোপন করে। রাখে, তবে সেটা তার অধর্ম হবে এবং মাতব্বরেরও যোগ্য হবে না। সে বললে, আমাদেরও সব চল কেনে চন্ননপুর। জাঙলের সায়েবডাঙার জমি তো তোমার ধরগা চেয়ে কম লয়; সেরেস্তায় তিন শো বিঘের ডাক। আমরা সবাই মিলে দু বিঘে এক বিঘে করে। বনওয়ারী সকলের মুখের দিকেই তাকালে।

সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, চোখগুলি জ্বলজ্বল করছে—কয়লার মধ্যে পড়া আগুনের ফিনকির মত।

—কি বল?

সুচাঁদ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে নাই। সে দূরে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে, করালীর আচরণের সকল বিরক্তি এবং রাগ মুছে গিয়ে সকলের মুখে হঠাৎ যেন একটি প্রসন্ন দীপ্তি ফুটে উঠল। কোন সে বিস্ময়কর সংবাদ, যার মধ্যে সর্বজনীন প্রসন্নতার কারণ লুকানো আছে? তার উপর বনওয়ারীর কথা বলবার ভাবের মধ্যে বেশ একটি সলাপরামর্শ করার ভঙ্গিও সে দেখতে পেলে।

এগিয়ে এসে সে বললে—কি? কি রে বনওয়ারী? কি বলছিস তোরা?

প্ৰহ্লাদ হেসে বললে, লাও ঠ্যালা! এখন ঢাকঢোল বাজিয়ে পাড়া গোল করে বল।

সুচাঁদ তার মুখের দিকে চেয়ে বললে—মশকরা করছিস আমার সঙ্গে পেল্লেদে, মুখপোড়া

ছুঁচো?

শুনতে না পেলেও বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখড়া এবং মুখভঙ্গি দেখে সুচাঁদ নির্ভুল ধরতে পারে যে তাকেই তারা ঠাট্টা করছে। এবার নিশ্চয় চিৎকার করে কেলেঙ্কারি করবে বুড়ি। একমাত্র উপায় ব্যাপারটা বলা। বললে বুড়ি মশকরার জ্বালাটা ভুলতে পারে। সুতরাং কথাটা তাকে বলতে হয়, তাই বললে বনওয়ারী। কাছে বসিয়ে চিৎকার করে হাত নেড়ে বুঝিয়ে বললে সব। সুচাঁদ বললো, তা ভাল যুক্তি বটেন। ওই নদীর উ পারে বুঝলি কিনা—

বনওয়ারী উঠে পড়ল। সুচাঁদপিসির বুঝলি কিনা বুঝতে গেলে এ বেলা কাবার হয়ে যাবে। এমনিতেই করালী-শয়তানের পাল্লায় পড়ে দেরি হয়ে গিয়েছে। ভেবেচিন্তে হঠাৎ সে উঠে পড়ল। তারপর চিৎকার করে সুচাঁদকে বললে—তুমি তা হলে পুজোর পয়সা চাল আদায় কোরো পিসি, বুঝলে?

পুজোর? কত্তার পুজোর? হ্যাঁ গো। না হলে কল্যেণ নেই।

অ্যাঁ—আই! না হলে কল্যেণ নাই। সে কথা বুঝবে কে? তা শোন, আর একটি কথা বলি।

কি?

—জমি যদি লিবি, তবে পুজোতে আর একটি পাঁঠা জুড়ে দে। কত্তার আজ্ঞে নিয়ে করবি; আখোড়া পিথিবীর অঙ্গে চোটাবি–কত কি না-জানা না-চেনা না-শোনা রোপোদ্দরব আছে বুঝলি কিনা—না কি বলিস।

কথাটা মনে নিলে সকলের। সকলে বনওয়ারীর দিকে চাইলে। সুচাঁদও চেয়ে রয়েছে তার মুখের দিকে। বনওয়ারীও ঘাড় নেড়ে বললেহা হা, এই একটা কথার মত কথা। হ্যাঁ। ভাল বলেছ পিসি।

—কি বলছিস?

চিৎকার করে বনওয়ারী বললে—তাই হবেন গো।

সুচাঁদ খুশি হয়ে বললে—আ-চ্ছা। এই দে, সে তো বাপের আমলের কথা—

বনওয়ারী চিৎকার করে বাধা দিয়ে বললে—সাতটার টেন পুল পেরিয়ে গেল। উ বেলায় শুনব।

রেলের লাইনটা চলে গিয়েছে গায়ের পুবদিক দিয়ে। চন্ননপুর স্টেশন ছাড়িয়ে লাইনটা কোপাই নদীর উপর ব্রিজ বেঁধে পার হয়ে চলে গিয়েছে। সুলীর বাঁকে বাঁশবাঁদির নীলের-বধ পুকুরের পাড় থেকে বেশ দেখা যায় ব্রিজটা। ওই ব্রিজে যে গাড়িগুলো পার হয়, তাই ধরে চলে কাহারপাড়ার জীবনের ঘড়ি। সকালে ছয়টায় একটা গাড়ি। তারপর সাতটায় গাড়ির সিগনাল পড়লেই পুরুষেরা কাজে বের হয়। আজ তাদের দেরি হয়ে গিয়েছে। তারপর যেই ওই সিগনাল দেখে সাতটার গাড়ি আসে অমনি মেয়েরা বের হয়, খাটতে যায়, ঘুটে বেচতে যায়, দুধ বেচতে যায়।

সুচাঁদ ট্রেনের দিকে চেয়ে রইল। পুলে গাড়ি চাপলে যে শব্দ ওঠে, সে শব্দও তাকে কান পেতে মনোযোগসহকারে শুনতে হয়। গুরুগম্ভীর ঝুমঝম শব্দের যে ক্ষীণ ধ্বনি তার কানে প্রতিধ্বনি তোলে, সেটুকু ভারি মিষ্টি বলে মনে হয় সুচাঁদের। সুচাঁদ বলে—আতে যখন গাড়ি পুল পেরোয়, ঘরে চোখ বুজে শুয়ে আমার মনে হয় কেত্তনের দলের খোল বাজছে।

পুরুষেরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল।

বনওয়ারী বলে দিল সকলকে পরশু আসতে পারব না, আগাম আজ থেকে বলে এখো যেন, হ্যাঁ। নইলে আবার মনিবেরা বলবে—আগে বলিস নাই কেনে, আমার কাজ চলবে কি করে?

***

জাঙলের ঘোষ-বাড়ির ভাগজোতদার বনওয়ারী। বনওয়ারীর বাপের আমল থেকে দু পুরুষ ধরে সম্বন্ধ। জাঙলের ঘোষ-বাড়ির যখন নিতান্তই সাধারণ গৃহস্থের অবস্থা, তখন থেকে বনওয়ারীদের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ। বুড়ো ঘোষকৰ্তা যিনি এই সেদিন মারা গিয়েছেন, তখন তার অল্প বয়স ছোকরা মানুষ, তখন তিনি সদ্য পিতৃহীন হয়ে বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়াতেন আর ওই চন্ননপুরে বড়বাবুদের নতুন শখের থিয়েটারে মেয়ে সেজে বক্তৃতা করতেন। বাড়িতে ছিল বিধবা মা আর অল্পবয়সী স্ত্রী ও বিধবা বোন। কিন্তু দিন গুজরানের কোনো উপায় ছিল না। জমি না, জেরাত না, কোনো চাকরি না। ছেলে ভাবে না, ভাববার সময় নাই; তাই দিন চালানোর জন্য অনেক ভেবে বিধবা মা বনওয়ারীর বাপের কাছে একটি টেকি পাতবার কাঠ চেয়ে নেয়। এই হল সম্বন্ধের সূত্র। বনওয়ারীর বাপ সেবার কোপাইয়ের বানে একটা বেশ বড় কাঠ ধরেছিল, তারই একটা অংশ সে নিয়েছিল। বউয়ের কানের মাকড়ি বিক্রি করে ছুতোর ডেকে সেই কাঠে ভেঁকি পেতে ধানোনার কাজ নিয়েছিল ঘোষ-গিনি। এ কাজেও তাকে মধ্যে মধ্যে সাহায্য করত বনওয়ারীর মা। এই অবস্থায় ছেলেকে বারবার রোজগারে মন দেওয়ার জন্য অনেক মিনতি করে হতাশ হয়ে অবশেষে সে পাগলের মত এক কাণ্ড করে বসল। একদিন অনেক রাত্রে। থিয়েটারের আডড়া থেকে ছেলে গান গাইতে গাইতে ফিরে এসে যখন ভাত চাইলে, তখন মা একখানা ভাঙা থালায় এক মুঠো সত্যি সত্যি ছাই এনে নামিয়ে দিয়ে বলেছিল-খাও! ছেলে মায়ের মুখের দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর উঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

গেল তো গেল পাঁচ বছরের মত। সেই অবস্থায় বনওয়ারীর বাপ-মা ঘোষ-সংসারের দুঃখের সঙ্গে আরও জড়িয়ে পড়ল। আগে বনওয়ারীর মা, তারপর স্ত্রীর টানে বনওয়ারীর বাপ। বনওয়ারীর বাপ চন্ননপুরের বাবুদের বাড়ি থেকে চাল করে দেবার জন্য ধান আনত এবং ঘোষেরা চাল তৈরি করলে চন্ননপুরে চাল পৌঁছে দিয়ে আসত। নিতান্তই একতরফা ব্যাপার। কারণ ধান থেকে চাল করার মজুরি চাল ঘোষেরাই পেত। এ ছাড়াও যে কোনো দরকারে ঘোষ মা, ঘোষ-দিদি নিজেরাই যেত বনওয়ারীর বাবার কাছে। কাঠ তালপাতা মাঠের মাছ ঝুড়িভর্তি গোবর ঘোষ-বাড়িতে দিয়ে আসত আর কি দিতে পারে বনওয়ারীর মত লোকেরা? তাই দিত তারা এবং তাই ছিল ঘোষেদের সংসারের পক্ষে প্রচুর সাহায্য। ঘোষ-মা দিত বন্নন। মায়ের হাতের রান্না অম্রেতো। তারপর ঘোষ একদিন ফিরল রোজগার করে। সেই ঘোষেদের ঘরে লক্ষ্মী এলেন। ঘোষ একটি জোত কিনলেন-জাঙলের ওই চৌধুরীদের কাছে। নদীর ধারের জমি, গোপথের ধার; বান এলে তো ড়ুবে যায়ই, তার উপর গোপথের গরুর পাল নিত্য মুখ দেয়। ফসলে। দশ বিঘে জমি, তার দু বিঘে জমির ধান গরুর পেটেই যেত চিরকাল। তবে রক্ষা এইটুকু যে, খাজনাটা ঠাণ্ডা—দশ বিঘে জমির বছরসাল খাজনা সাড়ে বার টাকা, বিঘাপিছু পাঁচ সিকি নিরিখ। ঘোষের মা বললেন—তারিণী আমার বড় ছেলে। ওই করবে জমি। ওকেই ভাগে জমি দাও।

বনওয়ারীর বাপের নাম ছিল তারিণী।

সংসারে লক্ষ্মী হলেই নাকি সব হয়, শ্রীভ্রষ্ট কুৎসিত মানুষও শ্ৰীমন্ত হয়—একটা রূপ দেখা দেয় তার চেহারায়, কুমতি ঘুচে সুমতি হয়, বিষমাখা জিভের বিষ ঘুচে মধুর মত অমৃত উথলে ওঠে। মায়ের কথায় ঘোষ তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললে—তোমার কথার কি না হতে পারে। তারিণী আমার দাদা। তারিণীদাদাই আমার জমি করবে, বুঝেছ, তারিণী?

তারিণী হেসে বলেছিল—এই দেখেন না, আমাকে কি ফ্যারে ফেলেছেন দেখেন। আমার হাল-বলদ কোথা গো? আপনারা বরং হাল-বলদ করেন, আমি কৃষাণ থাকব।

-হাল-বলদ কর। আমি টাকা দিচ্ছি তোমাকে। ভয় কি, ক্ৰমে শোধ দেবে—ঘোষ বলেছিলেন।

অবাক হয়ে গিয়েছিল তারিণী; সৰ্জাতিকে সেবা করে অমন পুরস্কার পেয়ে সে ধন্য হয়ে গিয়েছিল, বাড়িতে এসে কেঁদেছিল সেদিন। সেই অবধি বনওয়ারীদের ঘরে হাল-বলদ। সেই অবধি বনওয়ারীরা ঘোষেদের জমি চাষ করছে। বাপ তারিণী মারা গিয়েছে, ঘোষকৰ্তাও নাই, ঘোষকৰ্তার ছেলেদের এখন জমজমাট সংসার। মেজ ছেলে ব্যবসা করে দেশ-দেশান্তরে ছুটে বেড়ায়, দু হাতে টাকা রোজগার করে বেঙ্কে জমিয়ে রাখে। ঘোষেদের বাড়িতে বনওয়ারী যে বনওয়ারী তারও এখন কেমন ভয়-ভয় করে। এখন আগের মত সরাসরি বাড়ির ভিতর গিয়ে ঢুকতে পারে না, বড় ঘোষকে এখন আর তেমন উপদেশ দিতে পারে না। সারের টাকার জন্য সেভাবে জোর করে দশটা কথা বলতে পারে না। হিসেবের জন্য তাড়া, তাইবা কেমন করে দেয়? বনওয়ারী সেখানে গিয়ে দেখলে, বড় আর মেজ দুজনে চা খাচ্ছে আর খুব মন দিয়ে সলাপরামর্শ করছে। সে প্রণাম করে বসল উবু হয়ে দাওয়ার উপর। কিছুক্ষণ পর একটা থামে ঠেস দিয়ে ভাল করে বসল। তারপর ঢুলতে লাগল। সারারাত্রি ভাল ঘুম হয় নাই—সকালের মিঠে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুম আসছিল। দক্ষিণ দিক থেকে ভারি আমেজী হাওয়া দিচ্ছে। সকালে সূর্য উঠে এরই মধ্যে ভোরের শীতশীত ভাবটা কেটে গিয়েছে। পাতলা ঘুমের মধ্যেই নানা এলোমেলো স্বপ্ন দেখছে সে। কালোশশী, করালী, পরম আরও কত লোক সায়েবডাঙায় জমেছে সব। সায়েবডাঙার কুঠিবাড়ির জঙ্গল থেকে বেরিয়েছে এক মহিষের বাচ্চার মত বড় এবং কালো বুনো পাঁতাল শুয়োর, ঘোৰ্ঘোত করে তীরের মত ছুটে আসছে। দিলে ফেঁড়ে করালীকে। পরম পালাচ্ছে। বনওয়ারীকে জড়িয়ে ধরেছে কালোশশী। বনওয়ারী কি কালোশশীকে ঝাপটা দিয়ে ফেলে পালাতে পারে! খটখট শব্দ করে পিছনে কে এল? বনওয়ারী বুঝতে পারলে, তিনি কে। কর্তা আসছেন। আর ভয় নাই। ভয়ের মধ্যে আশ্বাস পেয়ে বুনো শুয়োরটাকে ধমক দিয়ে সে বিক্রমভরে হাঁক মেরে উঠল, আ—প্‌।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের আমেজ ছুটে গেল। সে প্রথমটা ফ্যালফ্যাল করে চারিদিকে দেখে তাল সামলে নিয়ে বসল। ঘোষ-ভাইয়েরা হাসছেন।

—কি রে বনওয়ারী, চেঁচিয়ে উঠলি কেন?

অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বনওয়ারী বললে—আজ্ঞে, উ একটো হয়ে গেল আর কি!

একটো হয়ে গেল আর কি! কি হয়ে গেল?

চুপ করে রইল বনওয়ারী। লজ্জা লাগে বৈকি স্বপ্ন দেখে অমনি চিৎকার করেছি এ কথা বলতে।

—কি রে? স্বপ্ন দেখেছিলি বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

হা-হা করে হেসে উঠলেন মেজ জনা। প্রশ্ন করলেন—কি স্বপ্ন রে?

আজ্ঞে, স্বপ্ন দেখেছিলাম, দাতাল শুয়োরে তাড়া করেছে। আবার দুজনে হো-হো করে হেসে উঠলেন। বনওয়ারীও হাসতে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে মাথা চুলকাতে লাগল। বললেদাতাল বেটারা ভারি পাজি গো! আপনারা জানেন না। তারপর তাদের হাসি থামলে সুযোগ পেয়ে বললে—আমার হিসেবটা আজ্ঞে, একবার দেখে মিটিয়ে দ্যান। আবার নতুন চাষকৰ্ম এসে গেল।

–হিসেব! তা হবে। কাল আসিস। না হয় পরশু।

—কাল পরশু আসতে পারব আজ্ঞে।

—কেন? কাল পরশু কি করব?

–আজ্ঞে, পাড়াতে চাঁদা তুলে কত্তার পুজো দোব।

—কর্তার পুজো! অসময়ে? কি ব্যাপার?

বনওয়ারী সবিস্তারে বলতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা। ইচ্ছে—কিছু চাদাও আদায় করবে মেজ ঘোষের কাছ থেকে। কিন্তু মেজ ঘোষই খানিকটা শুনেই বললেন—তোদের সেই—অন্ধ। জাগো! না, কিবা রাত্ৰি কিবা দিন! সেই এক কালই চলেছে রে তোদের। হুঁ, কর্তাবাবা শিস দিচ্ছে! যত সব-হুঁ!

দমে গেল বনওয়ারী। কিন্তু সামলে নিয়ে সে আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হল না, দুই কানের পাশে হাত দিয়ে উৎকণ্ঠ হয়ে উঠে বসল। হঠাৎ দূরে একটা কোলাহল উঠছে। বলে মনে হল।—আগুন! আগুন!

আগুন! ছুটে বেরিয়ে এল বনওয়ারী। কোথায় আগুন? কোলাহলের দিক লক্ষ্য করে সে ছুটে এল গ্রামের বাইরে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঁশবাঁদির ওই দক্ষিণ মাথা থেকেই তো প্রচুর ধোঁয়া উঠছে। আকাশে। বাঁশবেড়ের বাঁশের মাথাগুলি ঢেকে গিয়েছে কুণ্ডলী পাকানো রাশি রাশি ধোঁয়ার মেঘে। আষাঢ়ের মেঘের মত জমাট ধোঁয়ার মেঘ।

বনওয়ারীর বুকটা তোলপাড় করে উঠল—কত্তার কোধ!

****

নাঃ-কাহারদের ভাগ্য ভাল। কোধের মধ্যেও কত্তা কিঞ্চিৎ দয়া করেছেন।

গ্রামে আগুন নয়। আগুন লেগেছে বাঁশবেড়ের বাঁশবনের তলায়। মাঘে পাতা ঝরেছে। বাঁশের। নিবিড় বাঁশবনের অজস্র পাতা স্থূপীকৃত হয়ে জমে আছে তলায়। সেই ঝরা শুকনো পাতায় আগুন লেগেছে। কি করে লাগল কে জানে? বেলা প্রখর হয়ে উঠেছে, পাতাগুলির উপরে রাত্রের শিশির শুকিয়ে গিয়েছে; আগুন খোরাক পেয়েছে ভাল। সবুজ দেওয়ালের মত যে বাঁশবন, সে বাঁশবন ধোঁয়ায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে।

বাঁশবাদির ধারে লোকজন স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতে কারও সাহস নাই। নিমতেলে পানু, প্রহ্লাদ জাঙল থেকে বনওয়ারীর আগেই ফিরে এসেছে। তারা ঢুকেছিল, কিন্তু পালিয়ে এসেছে ভয়ে এবং যন্ত্রণায়। ভয়—সেই শিস উঠছে। যন্ত্রণা-ধোঁয়ার।

কর্তার রোষ শেষে আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে গায়ের ধারে, সাবধান করে দিচ্ছেন। বনওয়ারী থমকে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে পাতে বললেকত্তার কোপ! কত্তার কোধ।

প্রহ্লাদ বলে–না, করালী আগুন লাগিয়েছে, বাঁশের পাতায় কেরাচিনি ত্যাল ঢেলে আগুন। লাগিয়েছে। সে রয়েছে ওই ধোঁয়ার মধ্যে।

মুহূর্তে ক্ষেপে গেল বনওয়ারী, নেমে গেল ধোঁয়ায় ভরা বাঁশবনের মধ্যে।

হ্যাঁ, শিসও উঠছে। কৰ্তাও ক্ষেপেছেন। এগিয়ে গেল বনওয়ারী শব্দ লক্ষ্য করে।

যেখানে শব্দটি উঠছে, তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে করালী। বুক চিতিয়ে নিৰ্ভয়ে একদৃষ্টে উপরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মুছছে আর উপরের দিকে চেয়ে দেখছে। নিচে আগুন নাচছে শুকনো পাতার স্থূপে। উত্তাপে বাঁশবেড় যেন অগ্নিগড় হয়ে উঠেছে, আঁচ লাগছে গায়ে, করালীর সেও গ্রাহ্য নাই।

বনওয়ারী এগিয়ে গেল ভয়ঙ্কর মূর্তিতে।–হে কত্তা, মাপ কর তুমি। আমি হতভাগাকে ফেলে দিচ্ছি ওই আগুনে। তুমি নিজের মহিমায় আগুন নিবিয়ে দাও। বাঁচাও তুমি বাঁশবাঁদিকে, বাঁচাও হাঁসুলীর বাককে বচাও। সে সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠে ডাকলে—করালী!

করালী তার দিকে চকিতের মত চেয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে বনওয়ারীকেই ইশারা করে ডাকলে—এস, এস। এতটুকু নড়ল না সে। বনওয়ারীর ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। সে অগ্রসর হল, মনে মনে বলল—যাই যাই, দাঁড়া।

দূরে পিছন থেকে ভেসে আসছে আর একটা আওয়াজমামা! মামা! মামা! পাখীর গলা। আর্ত-উৎকণ্ঠা যেন ফেটে পড়ছে কণ্ঠস্বরে। কিন্তু বনওয়ারী আজ নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। কাহারপাড়ার বিচারকর্তা সে। ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের মত সর্বময় কর্তা–দণ্ডদাতা।

বনওয়ারী দুর্দান্ত ক্ৰোধে করালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোশকেঁধের বাড়ির ছেলে, বিধাতার মোটা হাতে পাথর কেটে গড়া বনওয়ারী।

করালী কিন্তু নড়ল না, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বনওয়ারীর হাত থেকেও মোচড় দিয়ে ছাড়িয়ে নিলে একটা হাত। সেই হাতে সে দুর্দান্ত বিক্ৰমে আক্রমণ করলে বনওয়ারীকে। আশ্চর্য, বনওয়ারী অনুভব করছে—করালীর শক্তি যেন তার চেয়ে বেশি। না, বনওয়ারীর পায়ের তলায় বাঁশের পাতাগুলি পিছলে সরে যাচ্ছে। সেই অসুবিধার জন্যই করালী তাকে বাগে পেয়েছে। হঠাৎ করালী চিৎকার করে উঠল—ছাড়–ছাড়পড়ছে। ছাড়।

উৎসাহের প্রাবল্যে তার শক্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেল। সে অনায়াসে বনওয়ারীকে নিচে ফেলে দিয়ে তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নাচতে লাগল সে। ওই ওই ওই শালা পড়ছে। বনওয়ারী উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে করালী এসে তার হাত ধরে টেনে আঁকি দিয়ে বলল—ওই ওই দেখ, তোমার কর্তা পড়ছে বশের ডগা থেকে। হুই-হুইয়ো!

বঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নিচে পড়ছে। একটা প্রচণ্ড সাপ। পাহাড়ে চিতির মত মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়। পাহাড়ে চিতির সঙ্গে ওইখানেই সেটার পার্থক্য।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে বনওয়ারী বললে—পে-কা-ণ্ড চন্দ্রবোড়া! হ্যাঁ, ওদের গৰ্জন খুব বটে।

—এটা কত বড় দেখছ না? তাতেই শিসের শব্দ হয়। শালা!

আগুনের মধ্যে পড়ে সাপটা ছটফট করছে। মরছে। করালী তারই উপর দমাদম ঢেলা ছুঁড়ে মারছে। অব্যর্থ তার লক্ষ্য।

মামা! মামা! এদিক থেকে পাখী ডাকছে। ধোঁয়ার মধ্যে বুঝতে পারছে না সে, এরা কোন দিকে রয়েছে। উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সে ডাকছে। ডাকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখী ওদের খুঁজে ফিরছে।

চিৎকার করে সাড়া দিলে করালী—এই দিকে এই দিকে। আয়। আয়। ডাক্‌ সব পাড়ার নোককে! দেখে যা তাদের কত্তা পুড়ছে। দেখে যা। ডাক্‌ সব লোককে। ডাক্—ডাক্।

ওদিকে সাপটার পেটটার একটা মোটা অংশ ফেটে গেল আগুনের আঁচে। বেরিয়ে পড়ল একটা কি। এগিয়ে গেল করালী, বনওয়ারীও গেল। অঁকে দেখতে লাগল, ওটা কি? ওঃ, একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা। ওটাই কাল রাত্রে সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার করেছিল।

পাখী ছুটে এসে করালীর হাত ধরলে। সে হাঁপাচ্ছে।

করালী বললেওই দেখৃ। সাপটা দেখে পাখী অবাক হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ভেঙে এল গোটা কাহারপাড়ার লোক। বিস্ময়ে কৌতূহলে অবাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর কলকল করে বাঁশবাঁদি মুখরিত করে তুললে।

করালী হাসতে হাসতে বলে উঠল–মুরুবি, কত্তার পুজোটা সব আমাকে দিয়ো গো। সে হা-হা করে হাসতে লাগল।

পাখী ধমক দিয়ে বললে—চুপ কর।

করালী তবুও হাসতে লাগল। সে যেন এক অপার কৌতুক।

পাখী করালীর পিঠে একটা কিল মেরে বললে—ডাকাবুকো, ডারপাড়, লঘুগুরু জ্ঞান নাই তোমার?

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ May 16, 2022 at 7:20 pm

অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *