০৬. আবার রহস্য
আবার সেই নিঃসঙ্গ দুপুর।
সকালবেলায় সঞ্জয় চলে গেছে। তারপর রীণা পুপুকে স্নান করাল, খাওয়ালো, ঘুম পাড়াল। এক ফাঁকে নিজের নাওয়া-খাওয়াও সেরে নিল। সব চুকতে ঢুকতে বেলা একটা। এই পর্যন্ত বেশ কাটে। এর পরের চারটে ঘণ্টাই এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দুপুরে একটু ঘুমোত কিংবা বন্দনার মায়ের সঙ্গে গল্প করত। কিন্তু এখন ঘুম তেমন আসে না। দোতলায় যেতেও ইচ্ছে করে না। বন্দনার মা মানুষটি খুবই ভালো। সরল সাদাসিধে। অনেক মহিলার যেমন পরের সংসারের ব্যাপারে অহেতুক কৌতূহল থাকে এঁর সেরকম কিছু নেই। যে যা বলে শুনে যান। নিজের সংসারের সাধারণ ব্যাপার অকপটে বলেন। তাই এঁকে ভালো লাগে। মনে প্যাঁচ নেই। কিন্তু ইদানীং তার কাছেও আর যাচ্ছে না। সঞ্জয় বলে দিয়েছে, সাবধান, ওসব কথা যেন বলে ফেলো না। রীণার ভয়, কথায় কথায় যদি বলে ফেলে।
ফলে দুপুরটা কাটানো এখন সমস্যা হয়ে উঠেছে। অবশ্য নতুন একটা অবলম্বন পেয়েছে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের সেই ছবিখানা।
ইচ্ছে ছিল ওটা বাঁধিয়ে রাখবে। কিন্তু পরের জিনিস। হয়তো ফেরত দিতে হবে। তাই বাঁধাতে পারেনি।
না বাঁধালেও ছবিটা টেবিলের কাছে একটা তাকের ওপর রেখে রোজ দুপুরে ফুল-পাতা দিয়ে পুজো করে। কেন পুজো করে তা ও জানে না। তবে ওর কেমন মনে হয় এ মানুষ সাধারণ লোক নয়।
এই নিয়েও সঞ্জয় তাকে খুব ঠাট্টা করে। রীণা চুপ করে থাকে। পুরুষমানুষের সব কথায় কান দিলে চলে না।
কিন্তু নির্বাক ছবি নিয়েই বা কতক্ষণ ভুলে থাকা যায়? এক সময়ে শ্রান্তি আসে। তখনই আবার মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আজও তেমনি হল। হঠাৎই একটা অস্থিরতা মনের ভেতর যেন কিরকম করছে। মনে হচ্ছে কিছু বুঝি ঘটতে চলেছে। বুঝি এখনই কারো জুতোর শব্দ পাওয়া যাবে সিঁড়িতে। কেউ বুঝি ভারী পা ফেলে ফেলে উঠে আসবে।
রীণা তখনই নিজেকে ঝটকা মেরে ঠিক করে নিতে চায়। এ সব কি আবোলতাবোল চিন্তা? কবে একদিন কী দেখেছিল সেই ভুলটাই শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসল নাকি? শেষ পর্যন্ত একটা মানসিক ব্যাধির শিকার হয়ে দাঁড়াবে?
তখনই মনে পড়ল সেদিন রাত্তিরের ব্যাপারটা। সেটাও কি ভুল? সেটাও কি মানসিক বিকার?
ভাবতে ভাবতে রীণার হাত দুটো কিরকম ঠাণ্ডা হয়ে এল। কপালে চিনচিনে ঘাম। ও তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
সামনেই যশোর রোড। শে আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ। বাস ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। লোক হাঁটছে ফুটপাথ উপচে।
একটা নীল রঙের বাস চলে গেল। ওটা বোধহয় কোনো ইস্কুলের বাস। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কলকাকলি। আঃ! রীণা যেন নিশ্বাস নিয়ে বাঁচল। বাচ্চারাই সংসার ভরে রাখে, একমাত্র ওরাই পারে শোক-দুঃখ ভুলিয়ে দিতে। তার পুপুসোনাও একদিন এমনি করে বাসে চেপে ইস্কুলে যাবে।
এমনি সময়ে দরজায় শব্দ হলো–টুক-টুক। কে যেন অতি সন্তর্পণে দরজার কড়া নাড়ছে। রীণা চমকে উঠল।
কে? বলে সাড়া দিতে গেল। কিন্তু প্রথমে গলা থেকে স্বর বেরোল না।
তারপর অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল–কে?
–আমি বন্দনা।
তাও ভালো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল হঠাৎ বদনা কেন? ও তো বড়ো-একটা ওপরে আসে না। তবে কি কোনো ফোন–কোনো খারাপ খবর
রীণা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
–আপনার চিঠি।
চিঠি। চিঠি আবার এখানে কে দেবে? কেন দেবে?
চিঠি নিতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল।
–কার চিঠি?
কথাটা স্বগতোক্তি। কিন্তু বন্দনার মনে হল যেন তাকেই জিজ্ঞেস করছে। সে অবাক হয়ে রীণার দিকে একবার তাকাল। তারপর নিচে নেমে গেল।
এবার চিঠি খোলার পালা। কিছুতেই আর রীণা চিঠিটা খুলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল কে লিখেছে? কী লিখেছে?
শেষ পর্যন্ত চিঠিটা খুলল। প্রথমেই দেখে নিল নামটা।–ও মান্তু! বাবাঃ। যা ভয় করেছিল।
চিঠিটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল।
ভাই রীণা,
তোর চিঠি পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি তা লিখে বোঝাতে পারব না।
কিছুদিনের জন্যে আমরা সকলে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেইজন্যে চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। জানি আমার এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যে কিছু মনে করবি না।
যাক, শেষ পর্যন্ত তুই কলকাতায় এলি। অনেক দিন পর আবার আমাদের দেখা হবে। অনেক গল্প জমে আছে।
কিন্তু তোর চিঠির শেষ দিকটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। কলকাতার মতো জায়গায় নির্জন দুপুরে কিসের এত ভয়? এ তো আর আমাদের দেশের বাড়ি নয়! তবু তো বাঙ্গুরের মতো জায়গায় চট করে বাড়ি পেয়ে গেছিস। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।
একটা ভয় অবশ্য আছে, চোর-ডাকাতের। তার চেয়েও ভয় ঠগ-জোচ্চোরদের। কত ছুতো করেই-না ওরা বাড়ি বাড়ি ঢোকে। এসব ভয় এখন সব জায়গাতেই। খুব সাবধান। দরজা সব সময়ে বন্ধ করে রাখবি। সাড়া না নিয়ে দরজা খুলবি না। দরজায় আই-হোল নেই? না থাকলে ব্যবস্থা করে নিবি।
হ্যাঁ, তারপর লিখেছিস ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। সেটা নিশ্চয় স্বাভাবিক কোনো কারণে। হয়তো তোর লো প্রেসার আছে। কিংবা অন্য কিছু। সে তো ভালো বলতে পারবে তোর নিজের ডাক্তার।
ছোটোবেলায় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে নররাক্ষসের কথা হঠাৎ এতদিন পর মনে পড়ল কেন? নররাক্ষসের খেলা তো আমিও দেখেছিলাম। সত্যিই বীভৎস খেলা…
এই পর্যন্ত পড়েই রীণা আর পড়তে পারল না। শরীরটা কিরকম করে উঠল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।
.
সেই দিনই
মাঝরাতে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে জেগে উঠল রীণা। এ সেই কান্না। যেন কিছুতে কামড়েছে।
রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে বুকে টেনে নিল। মায়ের বুকে নির্ভয় আশ্রয়ে থেকে কান্নাটা একটু কমল কিন্তু একেবারে থামল না।
রীণা পুপুকে চাপড়াতে চাপড়াতে ঘুম পাড়াতে লাগল বটে কিন্তু কান ছিল সজাগ। প্রতি মুহূর্তে একটা কিছুর প্রতীক্ষা।
কিসের প্রতীক্ষা?
একটু পরেই সেই শব্দ! নিচে কোথায় যেন কার ঘরের দেওয়ালে কে পেরেক পুঁতছে ঠকঠকঠক্–
ক্রমশ সেই শব্দটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। কে যেন পেরেক নয়–কিছু একটা পুঁততে পুঁততে ওপরে উঠে আসছে।…
তারপরেই সব চুপ।
কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই পরিষ্কার শুনতে পেল জুতোর শব্দ। বাইরের বন্ধ দরজার কাছে এসে শব্দটা থামল। সঙ্গে সঙ্গে পুপু আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
আজ কিন্তু রীণা এতটুকু আত্মহারা হয়ে যায়নি। পুপুর এই যে কান্না এটা যে স্বাভাবিক নয় তা সে বুঝে নিয়েছে। যে এসেছে তার সঙ্গে এই কান্নার যোগ আছে। সে এও জানে বাইরে যে এসে দাঁড়িয়েছে বাইরে থেকেই সে চলে যাবে না। সে ভেতরে আসবেই।
রীণা তাই পুপুর কান্না শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারছিল।
এবার রীণা দুরু দুরু বুকে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল। অন্ধকার বাইরের ঘরে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ল সেটা হচ্ছে দুটো জ্বলন্ত চোখ। অন্ধকারে ভাসছে।
রীণা চেঁচাল না–কিংবা চেঁচাতে পারল না। এক হাতে পুপুকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে রইল।
রীণা দেখছে তো দেখছেই। সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেবার উপায় নেই।
একটু পরেই অন্ধকারের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম শরীর ভেসে উঠল। ক্রমে সেই শরীরের ওপর দেখা দিল কোট প্যান্ট। কালো পোশাকটা অন্ধকারে যেন মিশে ছিল। এতক্ষণে ফুটে উঠল। …।
এই অবস্থাতেও–আশ্চর্য রীণা তুলনা করছিল আগের রাতে দেখার সঙ্গে আজকের এই দেখা। সেদিন যেন সবই বড়ো তাড়াতাড়ি। সবই যেন অতর্কিতে। আর আজ? আজ যা ঘটছে সব ধীরে ধীরে সময় মেপে মেপে।
কিন্তু এ দেখাও কি চোখের ভুল?
না, সে স্বপ্ন দেখছে না। জেগে আছে। এই তো পুপু বুকের মধ্যে মুখ গুঁজেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই তো মশারি টাঙানো। মেঝেতে মশারির মধ্যে পুপুর বাবা শুয়ে। ঐ তো রাস্তায় শরীর শব্দ…কোনোটাই তো ভুল নয়। তাহলে?
হঠাৎই দেখল মূর্তিটা টেবিলের কাছে পাক খাচ্ছে। এক বার, দুবার, তিন বার। তারপরেই জ্বলন্ত চোখ দুটো শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসতে লাগল। রণা আর চুপ করে থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল–ওগো! শু-ন-ছ–
ধড়মড় করে উঠে বসল সঞ্জয়।
–আঁ, কি হয়েছে?
–আবার এসেছে-আবার এসেছে।
বলতে বলতে রীণা কেঁদে উঠল। পুপুও ঠিক তখনই ককিয়ে কাঁদতে লাগল।
মুহূর্তমাত্র।
সঞ্জয় টর্চ হাতে মশারি তুলে বাইরের ঘরে ছুটে গেল। সুইচ অন করার সময়ও পেল না।
অন্ধকারের মধ্যে ডাক্তারের হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ছিটকে পড়ল।
-না, কেউ কোথাও নেই।
এবার সঞ্জয় সব ঘরের সুইচ অন করে দিল। দুখানা ঘর আলোয় ভরে গেল। দেখা গেল দরজা যেমন ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তেমনই বন্ধ রয়েছে।
কই? কোথায় কে? বিরক্তির সঙ্গে বিদ্রূপ ঝলকে উঠল সঞ্জয়ের গলায়। রোজ রোজ এইভাবে Scene create করবে? ঘুম নষ্ট তাছাড়া লোকেই বা কী বলবে? তোমার বোঝা উচিত
রীণা শুধু ক্লান্ত স্বরে বলল–ও এসেছিল গো–সত্যিই এসেছিল। তুমি বিশ্বাস করো। উঃ! বুকের মধ্যে এখনো কিরকম করছে।
বলতে বলতে রীণা হঠাৎ মেঝেতে শুয়ে পড়ল।
কী হল? রীণা-রীণা—
রীণার বুকের ভেতর থেকে একটা ঘড়ঘড়ে স্বর বেরিয়ে এল। তারপর সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করল।
সঞ্জয় তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে এল। রীণা কোনোরকমে সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরে উঠে বসে গেলাস নিঃশেষ করে জল খেল। তারপর দেহ এলিয়ে খনখনে গলায় বলল, আমি মরে যাব। ও আমাকে মারবে। বেশ বুঝতে পারছিলাম লোকটা চোখে ইশারা করে আমাকে ডাকছিল। আমি জানি ওটা হচ্ছে মরণডাক। আমাকে বোধহয় মরতে হবে।
সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল, কী যা তা বকছ! এরকম করলে কালই তোমায় হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসব।
–তোমার যা ইচ্ছে তাই করো, যেখানে খুশি পাঠাও, আমি এখানে আর টিকতে পারব না।
–বেশ, তাই হবে। এখন বলো তো ঠিক কি দেখেছিলে।
সঞ্জয় একটা সিগারেট ধরাল।
রীণা সব ঘটনা বলে গেল।
ধৈর্য ধরে সঞ্জয় সব শুনে গেল। কথার মধ্যে নিজে একটি কথাও বলেনি।
রীণার কথা শেষ হলে বলল, টেবিলের কাছে ঘুরছিল?
-হ্যাঁ। টেবিল থেকে দেওয়াল। একবার মনে হল যেন দেওয়ালের মধ্যে মিশে গেল। তারপরেই দেখি আবার বেরিয়ে এসেছে। তারপরেই আমার দিকে চোখের ইশারা করতে করতে তাড়া করে এল।
শেষের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সঞ্জয় শুধু জিজ্ঞেস করল, আগের দিনও টেবিলের কাছে ঘুরছিল না?
হ্যাঁ
আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল।
দুটো ঘরেই এমনকি বাথরুমেও আলো জ্বলছিল। ভাড়াটেদের ঘুম ভেঙে থাকলে হয় তো ছুটে আসবে। সঞ্জয় তাই তাড়াতাড়ি সব আলো নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে শুধু জ্বলতে লাগল সঞ্জয়ের সিগারেটের আগুন।
মনে মনে বলল, নাঃ, একেবারে Psychopathic Patient হয়ে গেল! একই জনকে একজনেই প্রায় দেখছে। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত কি আমাকে অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করতে হবে?
পরের দিন সকালে বেশ একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙল সঞ্জয়ের। দেখল রীণা তখনো ঘুমোচ্ছ। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে মশারির ওপর। এত বেলা পর্যন্ত রীণা কখনো ঘুমোয় না।
কিন্তু এই কি ঘুমন্ত চেহারা?
মেয়েদের স্বাভাবিক ঘুমের মধ্যেও একটা সুন্দর আকর্ষণী শক্তি থাকে। শোয়ার ভঙ্গিটি, শরীর জড়িয়ে শাড়ির বিন্যাস, শান্ত স্নিগ্ধ মুখের ওপর বন্ধ চোখের নিবিড় পাতা দুটি–কেমন যেন মোহ সৃষ্টি করে। গভীর রাতে এই রীণাই যখন ক্লান্ত, পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমোয় তখন কতদিন সঞ্জয় অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে নিঃশব্দে লোভীর মতো দেখেছে। আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।
আর আজ? সেই রীণাই ঘুমোচ্ছ। কিন্তু পাণ্ডুর মুখের ওপর কিসের যেন ছায়া। হঠাৎ দেখলে মনে হবে রীণা যেন তার দেহটা ফেলে কোথায় কত দূরে চলে গেছে।
সঞ্জয়ের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ঠিক করল আজই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ডাঃ রুদ্রের সঙ্গে পরামর্শ করবে।
পুপু তখন জেগে। বিছানায় শুয়ে বেচারি একাই খেলা করছিল। তাকে একটু আদর করে সঞ্জয় মুখ ধুতে গেল।
মুখ ধুয়ে এসে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। পুপুর জন্যেও দুধ তৈরি করল।
বেলা যখন সাড়ে আটটা-সঞ্জয় যখন হাসপাতালে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, তখন রীণা আলিস্যি ভেঙে পাশ ফিরল।
ঘুম ভাঙল? আজ বেশ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ। বলে সঞ্জয় এক পেয়ালা চা নিয়ে এল।
–ইস্! কত বেলা হয়ে গেছে! বলে রীণা ধড়মড় করে উঠে বসল।
–চা তুমি করলে?
তাছাড়া আর কে করবে? ভূতে আর যাই পারুক চা করতে পারে না। দ্যাখো, চিনি ঠিক হয়েছে কি না।
রীণা ধীরে ধীরে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিল।
–তোমার আজ দেরি হয়ে যাবে। আমি এখুনি যাচ্ছি।
সঞ্জয় কাছে বসে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমি এদিকের সব গুছিয়ে নিয়েছি। তুমি বরং হাত মুখ ধুয়ে আর একটু শুয়ে থাকো।
–হ্যাঁ। শরীরটাও যেন কেমন লাগছে।
–ও কিছু নয়। রাত্তিরে একটা ধকল গেছে। স্নানটান করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কী জানি? বলে চোখ নিচু করে অন্যমনস্কভাবে চা খেতে লাগল।
আধ ঘণ্টা পরে নিচে নেমে সঞ্জয় একবার এদিক ওদিক দেখল। নাঃ, ভাড়াটেরা কেউ চড়াও করতে আসছে না। তখনকার মতো নিশ্চিন্ত হয়ে হাসপাতাল রওনা হলেও মনে মনে অস্বস্তি থেকেই গেল। বিকেলে নিশ্চয় ওরা এসে বলবে, কাল রাত্তিরেও আপনার ঘরে গণ্ডগোল হচ্ছিল ডাক্তারবাবু!
সঞ্জয়ের মনটা কুঁকড়ে গেল। সত্যি! রোজ রাত্তিরে রীণা যা কাণ্ড করতে আরম্ভ করেছে!
বিকেলে সঞ্জয় কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল চোখ কান বুজে। না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল মহিমাবাবু-বিভূতিবাবুরা রোজকার মতো লোহার বেঞ্চিতে পা তুলে বসে গল্প করছে। বোধহয় তাকে দেখেছে। তারপর এখনই হয়তো মধুর সম্ভাষণ করবে—ডাক্তারবাবু, নমস্কার। ভালো আছেন তো?
সেই সম্ভাষণটুকু কানে পৌঁছবার আগেই সঞ্জয় মুখ নিচু করে হহ করে সিঁড়িতে গিয়ে উঠল।
যাক, আজকের মতো ফাঁড়া কাটল।
সঞ্জয় জোরে জোরে পা ফেলে ওপরে উঠতে লাগল। রীণা কেমন আছে? আজ দুপুরে আর ভয় পায়নি তো?
ফেরার পথে ডাক্তার রুদ্রের সঙ্গেও দেখা করে এসেছে। উনি ঠিকই বলেছেন–অ্যাডজাস্ট করার স্বাভাবিক শক্তির অভাব থেকেই এটা হচ্ছে। মফস্বল থেকে শহরে কিংবা শহর থেকে মফস্বলে নতুন পরিবেশে এসে পড়লে সে পরিবেশ যদি মনের মতো না হয় তা হলে বিশেষ করে মেয়েদের নার্ভের ওপর চাপ পড়ে। তা থেকেই এইরকম অনেক কিছু হয়। পরে জায়গাটা অভ্যস্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যায়।
–কিন্তু বাড়িটা তো ওর প্রথম থেকেই পছন্দ হয়েছিল।
ডাক্তার রুদ্র হেসেছিলেন। ওটা তোমাকে খুশি করার জন্যে।
সঞ্জয় চুপ করে ছিল। কথাটা তার মনঃপূত হয়নি।
ওপরে দরজার মুখেই পুপুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রীণা।
–কেমন আছ?
রীণা তার উত্তর না দিয়ে একটু ভারী গলায় বলল, কম্পাউন্ডে ঢুকে ওপরে তাকালে না যে?
কথাটার মানে সঞ্জয় প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝল তখন মনে মনে খুশিই হল। অনেকদিন পর যেন সেই কুমারী রীণাকে দেখছে। সে-সব সময়ে নবদ্বীপে মামার বাড়ি এলে রীণার সঙ্গে একদিনও চোখের দেখাটুকু না হলে চলত না। মফস্বল শহরে খুব স্বাভাবিক কারণেই রীণার বাড়িতে এই অনাত্মীয় যুবকটির কারণে-অকারণে যাওয়া, গল্প করার কিছুটা বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। অগত্যা রাস্তার ধারে দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো রীণাকে। কখন সঞ্জয় রাস্তা দিয়ে যাবে।
ওই রাস্তা দিয়েই যখন-তখন কারণে-অকারণে সঞ্জয়কেও যেতে-আসতে হতো। তখনই হতো মিষ্টি হাসি-বিনিময়ের সঙ্গে চার চক্ষের গোপন মিলন। নিরুপায় নীরব প্রেমের এই মুষ্টি-ভিক্ষাটুকুই তখন ছিল যথেষ্ট।
একদিন ঠিক ঐ বিশেষ মুহূর্তেই সামনে এসে পড়েছিল পাড়ার চক্রবর্তীমশাই। সঞ্জয় ওপরের দিকে আর তাকাতে পারেনি।
পরের দিন গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে রীণার সঙ্গে নিরিবিলিতে দেখা হয়েছিল। সঞ্জয় স্বভাবমতো হেসেছিল। রীণা কিন্তু হাসেনি। অভিমানক্ষুব্ধ স্বরে শুধু বলেছিল–কাল তাকালে না যে বড়ো?…
এ-সব অনেক দিনের কথা। তখন রীণা স্কুলে পড়ছে। সঞ্জয় পড়ছিল ডাক্তারি। সেই রীণা বহুদিন পর আজ সেই একই সুরে জিজ্ঞেস করল, ওপরে তাকালে না যে?
সঞ্জয় হেসে বলল, তাকাবার ফুরসত পেলাম কই? নিচে তখন মহিমাবাবুরা আমাকে পাকড়াবার তালে। ধরতে পারলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করত, ডাক্তারবাবু, কাল রাত্তিরে আপনার ঘরে কিসের চেঁচামেচি হচ্ছিল? আগের দিন বেড়ালের ওপর দোষ চাপিয়েছি। আজ আর হাতের কাছে তেমন কিছু খুঁজে পেতাম না। তাই অধোবদনে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি।
বলেই রীণার কোল থেকে পুপুকে কেড়ে নিল।
রীণার মুডটা ভালো দেখে সঞ্জয় খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার এমন সরস বাচনভঙ্গী শুনে রীণা না হেসেই রান্নাঘরে চলে গেল। সঞ্জয়ের ঠিক ভালো লাগল না।
চা-জলখাবারের পাট চুকল একরকম নিঃশব্দেই। মন-মেজাজ ভালো থাকলে এই সময়ে রীণা বেশ গল্প করে। ও একাই বকে যায়। শ্রোতাকে শুধু মাঝে-মধ্যে হু হা বলে সাড়া দিয়ে গেলেই হল। সেটাও খারাপ লাগে না।
কিন্তু আজ কেমন ব্যতিক্রম। রীণার হঠাৎ এরকম বাংযম দেখে সঞ্জয় অবাক হল।
কথা না বললেও রীণার মুখে কিন্তু এক টুকরো হাসি লেগেই ছিল। গল্প করছিল না, কিন্তু পুপুকে আদর করার মাত্রাটা একটু অস্বাভাবিক হচ্ছিল। আদরের সঙ্গে হাসি। শিশুর সঙ্গে এই রকম হাসির অর্থ কী? এই হাসির অন্য মানে আছে। এ একরকম উপেক্ষা।
রীণার এই উপেক্ষা-নীতির সঙ্গেও সঞ্জয়ের পরিচয় ছিল।
মান্তু রীণার বন্ধু। নবদ্বীপে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। সঞ্জয়ের মামা থাকত রীণাদের বাড়ির কাছাকাছি। সঞ্জয় মাঝেমাঝেই মামার বাড়ি নবদ্বীপে আসত। এই আসা-যাওয়ার সুযোগেই রীণা আর রীণার বান্ধবীটির সঙ্গে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা।
বাড়িতে কথা বলার সুযোগ হতো না। তাই রীণাই একদিন সঞ্জয়কে মান্তুর বাড়ি যাবার জন্যে বলেছিল।
রীণা গিয়েছিল যথাসময়ের অনেক আগে। সঞ্জয়ের যেতে দেরি হয়েছিল। এই হলো তার অপরাধ! ব্যাস! শ্রীমতী রীণা হলেন ভীষণ ক্রুদ্ধ। রাগটা অবশ্য মুখে প্রকাশ করল না। করল বিচিত্রভাবে। চৌকিতে বসে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে অনর্গল কথা বলে গেল মান্তুরই সঙ্গে। সামনে যে আর একজন বসে আছে যাকে নাকি বিশেষ করে ডেকে আনা হয়েছে–তাকে যেন চিনতেই পারল না।
রীণার আজকের আচরণটাও অনেকটা সেইরকম। সঞ্জয় যেন কেউ না।
-কী ব্যাপার? আজ যে আমার সঙ্গে বড়ো কথা বলছ না? রীণার মুখে ফুটে উঠল আবার বিচিত্র হাসি।–আমি রুগী, তুমি ডাক্তার। ডাক্তারের সামনে রুগীকে রুগীর মতোই থাকতে হয়। তাই না? কথাগুলো রীণা বলল যেন দাঁতে কেটে কেটে।
যা বাবাঃ! আজ হল কী?
–হাসপাতালে–মানে মেন্টাল হসপিটালে কোনো বেডটেডের ব্যবস্থা করতে পারলে নাকি?
রীণার কথায় যেন বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, কার জন্যে?
–সে কি! এরই মধ্যে ভুলে গেলে? তোমার স্ত্রীর জন্যে গো! যার মাথার ব্যামো হয়েছে, নার্ভ ফেল করে। বলেই পুপুকে রেখে রীণা হঠাৎ উঠে চলে গেল।
এক-একটা সময়ে এই-সব মান-অভিমান স্বামীদের ভালোই লাগে। কিন্তু তাই বলে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে এই মানসিক কসরৎ আর ভালো লাগে না।
সঞ্জয় একটু রাগ করেই পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল।
–কোথায় যাচ্ছ?
–পুপুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।
–এই সন্ধেবেলায়?
–কি করব? রুগীর সামনে বসে থাকতে থাকতে সুস্থ মানুষও রুগী হয়ে যায়।
রীণা আবার একটু হাসল। সেই কেমন-কেমন হাসি। নিচে যাবে তো? কিন্তু মহিমাবাবুরা এখনও বসে আছেন।
–মাই গড! সঞ্জয় এক লাফে সিঁড়ি থেকে ঘরে এসে ঢুকল।
কফি খাবে?
–আবার কষ্ট করে করবে?
–আমিও খাবো। বলেই রীণা চলে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পর দু কাপ কফি নিয়ে এসে বসল। একটা কাপ যেন একটু অতিরিক্ত যত্নে সঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিল। চোখাচোখি হল।
তখন থেকে তুমি অমন ঠোঁট টিপে টিপে হাসছ কেন বলো তো।
রীণা হেসেই বলল, বাঃ রে! রুগী বলে কি হাসতেও মানা নাকি?
–তা নয়। হাসিটা যেন কেমন-কেমন লাগছে।
রীণা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে উদাস সুরে বলল, তা হবে। মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ।
কফিতে আরাম করে একটা চুমুক দিয়ে সঞ্জয় সিগারেট ধরাল।
না, ও হাসি আর যাই হোক মাথা খারাপের লক্ষণ নয়।
তবে? রীণা খুব হালকা করে কফিতে চুমুক দিল।
–মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাইছ। এমন-কিছু যা শুনে আমি অপ্রস্তুতে পড়ি।
–ও মা! সে কী কথা! ইস্! কফিতে চিনি কম হয়েছে। আমার সত্যি মাথার ঠিক নেই। বলে রীণা হঠাৎই উঠে গেল। তারপর বেশ একটু দেরি করে সুগার-পটটা এনে টেবিলে রাখল। তা থেকে সামান্য একটু চিনি তুলে কফিতে মিশিয়ে নিয়ে বলল, তুমি ডাক্তারমানুষ! তোমায় আমি অপ্রস্তুতে ফেলতে পারি? না হয় আমি মানসিক রুগীই। তা বলে নিজের স্বামীকে অপ্রস্তুতে ফেলা। ছিঃ!
সঞ্জয়ের পক্ষে ধৈর্য ধরা অসম্ভব হয়ে উঠল। বলল, দোহাই তোমার। আর রহস্য কোরো না। ব্যাপারটা কি আমায় খুলে বলো।
ব্যাপার আবার কি? যথা পূর্বং তথা পরম্।
–সারা দুপুর কি করলে?
রীণা আবার একটু হাসল।–অ-নে-ক কাজ। তুমি চলে গেলে দরজায় ভালো করে খিল দিলাম। তারপর পুপুকে চান করালাম, খাওয়ালাম। নিজে চান করলাম, খেলাম। একটু ঘুমোলাম।
–ঘুম হল?
—হু-উ। বলে আদুরে মেয়ের মতো মাথা দোলাল। তারপর ঘুম থেকে উঠে ট্রানজিস্টারটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম।
–ভয়টয় পাওনি তো?
–ভয়? কি জানি। মনে নেই।
–ভেরি গুড! মনে না থাকাই ভালো।
–ততক্ষণে পুপু উঠে পড়েছে। ওকে নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে দোতলায় গেলাম। বন্দনার মায়ের সঙ্গে একটু গল্পও করলাম। তারপর ওপরে এসে জলখাবার করতে বসলাম। জলখাবার হয়ে গেলে পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তুমি এলে। ব্যস্! আমার কথাটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়ল। ও হ্যাঁ, এর মধ্যে মান্তুকে একটা চিঠিও লিখলাম।
–কি লিখলে?
–সে-সব আমাদের প্রাইভেট কথা। তোমায় বলব কেন? বলে কফির পেয়ালাটা সরিয়ে রাখল।
–অবশ্য তোমার কথাও ছিল। হাসপাতালের ডিউটির পর পেশেন্ট দেখতে গিয়েছিলে। মহিলা পেশেন্ট বোধহয়, নইলে রাত নটা পর্যন্ত থাকবে কেন? বুক, পেট, তলপেট ভালো করে দেখতে হয়েছিল তো।
-ইস! এইসব বাজে কথা লিখেছ?
–হু-উ। তারপর লিখেছি, কে একজন তোমাকে একটা বুড়োর ছবি দিয়েছিল। সেই ছবির কথাও লিখেছি। সাংঘাতিক চোখ, যেন ত্রিকালদর্শী তান্ত্রিক!
–সেই ছবিটা পুজো করছ লিখেছ নাকি?
–ইস্! অ্যাসট্রে রয়েছে তবু কাপে ছাই ফেলছ! কী যে বদ অভ্যেস! বলে তাড়াতাড়ি কাপটা সরিয়ে নিল।
–সরি।
-হ্যাঁ, পুজো করছি, ফুলের মালা পরাচ্ছি সবই লিখেছি। বন্ধুর কাছে কিছুই লুকনো উচিত নয়।
–তা বেশ করেছ। কিন্তু ছবিটা নিয়েও তুমি একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছ। কি এমন আছে ছবির মধ্যে?
–তা দেখার চোখ তোমার নেই। থাকলে একথা বলতে পারতে না।
–ছবিটা নিয়ে এসো তো। ভালো করে দেখি. একবার।
–কি হবে দেখে?
–নিয়েই এসো না।
রীণা চেয়ারে দুপা তুলে হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকলো।
–তুমি নিয়ে এসো।
–আমি ছুঁলে ছবিটা অশুদ্ধ হবে না তো? বলে সঞ্জয় হাসতে হাসতে উঠে গেল। রীণা কোনো উত্তর দিল না। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল।
বাইরের ঘর থেকে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ছবিটা কোথায়?
রীণা উত্তর দিল না।
–এই শুনছ? ছবিটা তো তুমি তাকের ওপর রেখেছিলে। দেখছি না তো।
–তাহলে নেই।
–নেই মানে? অন্য কোথাও রেখেছ?
–জানি না।
সঞ্জয় যেন হোঁচট খেল–জানি না মানে?
রীণা এবার চেয়ার থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে গেল–বলো কী বলছ?
–ছবিটা কোথায় গেল?
রীণা উত্তর না দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ওটা আর পাওয়া যাবে না। হারিয়ে গেছে।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, হারিয়ে গেছে মানে?
রীণা ধীর স্থিরভাবে বলল, হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।
–অসম্ভব। আগের দিন ছবিটা তাকের ওপর রাখলে, এরই মধ্যে হারিয়ে গেল? আর হারাবেই বা কোথায়?
রীণা গম্ভীর গলায় বলল, তাহলে চুরি গেছে।
–চুরি! কে চুরি করল? বাড়িতে কে-ই বা আসে? কেনই-বা চুরি করবে? রীণা হালকা মেজাজে টেবিল থেকে ট্রানজিস্টারটা তুলে নিয়ে কাটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, গেলাসটা সেদিন কে ভাঙল? কি করে ভাঙল?
সঞ্জয় যেন অন্ধকারে চলতে চলতে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেল।
মিনিট কয়েক দুজনেই চুপচাপ। তারপর রীণা ট্রানজিস্টারটা রেখে দিয়ে যেন আপন মনেই বলল, শুধু একটা গেলাস ভাঙা বা ছবি চুরি যাওয়া নয়। আরো কিছু যাবে। তার মধ্যে আমার প্রাণ একটি। অবশ্য তাতে তোমার কিছু এসে যাবে না। পুপুটারই কষ্ট হবে।
বাজে কথা ছাড়ো তো। ছবিটা কি সত্যিই কেউ নিল?
-আমায় জিজ্ঞেস করছ? রীণা এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকে। তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে?
–তাহলে আমি বলছি–হ্যাঁ, ছবিটা সত্যিই কেউ নিল। যে নিতে এসেছিল সে নিয়ে গেল।
–কিন্তু কেন নিয়ে গেল?
রীণার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি। –কে নিয়ে গেল ভাবছ না?
সঞ্জয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, না হয় ধরেই নিলাম ভূতে নিয়েছে। কিন্তু কেন? এত জিনিস থাকতে শিবানন্দর ছবিটার ওপরই তেনার দৃষ্টি পড়ল!
রীণা বলল, তুমি বোধহয় ভুলে যাওনি আমি বলেছিলাম–আগের দিনও সে টেবিলের কাছে ঘুরছিল। অসাবধানেই হোক বা ভয় দেখাবার জন্যেই হোক সেদিন গেলাসটা ভেঙেছিল।
এই পর্যন্ত বলে রীণা একটু থামল। সঞ্জয়ও চুপ করে রইল।
–তুমি কি বলতে চাইছ সেদিনও ছবিটা নেবার জন্যেই এসেছিল।
–হ্যাঁ।
–নিল না কেন?
–বোধহয় ওটা টেবিলে বা টেবিলের কাছে ছিল না।
–হ্যাঁ, ওটা ভুল করে ব্যাগেই থেকে গিয়েছিল।
সঞ্জয় আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল, বেশ। না হয় প্রেতাত্মাটি ছবিটার জন্যেই এসেছিল। কিন্তু কেন? নিশ্চয় বৃদ্ধের প্রেমে পড়েনি?
রীণা কষ্টে একটু হাসল। বলল, এখনো রসিকতা করতে পারছ! ভাবতে পারছ না, কী সর্বনাশ এগিয়ে আসছে।
সঞ্জয় হাসল না। বলল–আমি যা জানতে চাইলাম ওটা তার উত্তর হল।
রীণা বলল, ঠিক উত্তর আমিই বা কি করে জানব?
–আচ্ছা, ছবিটার পেছনে কি যেন লেখা ছিল? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
–পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে স্নেহোপহার।
–আরও যেন কিছু লেখা ছিল মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ, শিবানন্দর স্বাক্ষর।
—-আর কিছু ছিল না?
—-ছিল। শিবানন্দ ভট্টাচার্যর ঠিকানা।
সঞ্জয় হঠাৎ বলে উঠল তাহলে কি ঠিকানার জন্যেই? কিন্তু ঠিকানা নিয়ে ও কি করবে? শিবানন্দর সঙ্গে দেখা করবে! বলে একটু হাসবার চেষ্টা করল।
রীণা শান্ত গলায় বলল–অন্যরকমও হতে পারে। তুমি যেন দেখা করতে না পার।
সঞ্জয় বিছানায় একটা ঘুষি মেরে বলল–দেখা করি এটাই বা চায় না কেন? তোমার ঐ প্রেতাত্মাটির সঙ্গে শিবানন্দর সম্পর্ক কী?
রীণ কোনো কথা বলল না। একটা রহস্যময়ী ছায়ার মতো ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ভেতরের ঘরে চলে গেল।
.
০৭.
ঝড় হাওড়ার পঞ্চাননতলা-কদমতলার মধ্যে ক্ষীরোদতলা। মনেই হয় না এটা কলকাতার লাগোয়া জায়গা। জীবন এখানে ধীরে-সুস্থে, জিরিয়ে, ঢিমেতালে চলেছে। বাসিন্দারা সকলেই প্রায় সকলের পরিচিত।
এই ক্ষীরোদতলাতেই একতলা একটা বাড়ি। দরজায়, জানলায় চমৎকার রঙীন পর্দা, গেটের ওপরে মাধবীলতার বাহার। একনজর দেখলেই বোঝা যায় অন্য আর সব বাড়ির মধ্যে এ বাড়িটি একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আর এটা সম্ভব হয়েছে রুচি আর যত্নের গুণে। বাড়ির গৃহিণী স্বয়ং অক্লান্ত পরিশ্রমে বাড়িটিকে সুন্দর করে রেখেছেন।
বেলা তখন প্রায় সাড়ে চারটে। কাজের লোকের সঙ্গে সে-বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি ইস্কুল থেকে গুটিগুটি ফিরল। বইয়ের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে দিয়ে বললে, মা, আজ সন্ধের পর ভয়ানক ঝড় হবে।
মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে মা বললে, অসময়ে ঝড়!
কে বললে?
মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল-শ্যামলীদি।
শ্যামলীদি বলেছে! মা কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে, তবে তো সাংঘাতিক কথা। ঝড় হবেই।
–হ্যাঁ, শ্যামলীদি রেডিওতে শুনেছেন। বলে দিলেন, খবরদার কেউ সন্ধের পর বাড়ি থেকে বেরিও না।
ঠিকই তো। ঝড় এলে কেউ কি বেরোয়? আচ্ছা যাও, এখন হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও গে।
মেয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
মেয়েটির বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে টাইমটেবল দেখছিলেন। বয়েস বেশি নয়, কিন্তু ভারিক্কি চাল। তার ওপর একটু মোটা আর ধুতির সঙ্গে গোল গলা ঢিলে-হাতা পাঞ্জাবি পরেন বলে একটু বেশি বয়েস মনে হয়। টাইমটেবল ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ভ্রমণের ভারি নেশা। প্রতি বছরই কোথাও-না-কোথাও বেরোন। মাস কয়েক হল সপরিবারে পুরী ঘুরে এসেছেন। এখনই বেরোবার আর সম্ভাবনা নেই। তবুও নতুন কোথাও যাবার জন্যে এখন থেকেই প্ল্যান-পরিকল্পনা করছিলেন।
কলকাতায় ওঁর পৈত্রিক ব্যবসা মদের। এ এমন ব্যবসা যার মার নেই। মদের ব্যবসা কিন্তু জীবনে কখনো উনি ও জিনিসটি আস্বাদন করেননি।
ভদ্রলোক টাইমটেবলটি মুড়ে রেখে বললেন, কই? তোমার বান্ধবীটি তো এখনো এলেন না?
মান্তু মেয়ের ব্যাগ থেকে বইগুলো বের করে গুছিয়ে রাখছিল। বললে, আসবে। বলে ঘড়ির দিকে তাকাল।
কিন্তু তোমাকে আজ অন্য ঘরে শুতে হবে বলে রাখছি। আমি রীণার সঙ্গে শোব।
ভদ্রলোক যেন বিষণ্ণভাবে বললেন, উনি কি আজ থাকবেন?
–আমি তো থাকার জন্যে বলেছি। ও বলেছে, থাকতে পারবে না। তবু যদি থেকে যায়–তাছাড়া সত্যিই যদি ঝড় ওঠে, ফিরবে কি করে?
ভদ্রলোক বিরক্তির ভান করে বললেন, বুঝতে পারছি, মাঝে-মাঝেই এখন তোমার আমার মধ্যে এই তৃতীয় জনটি বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।
মান্তু হেসে বলল, তা ঠিক। ওকে এখন প্রায়ই এখানে এনে রাখব।
ভদ্রলোক গাম্ভীর্যের ভান করে বললেন, বোধহয় পারবে না। ওঁরও তো একজন দাবীদার আছেন। তিনি আবার ডাক্তার! ডাক্তারদের অনেক এক্সট্রা সুবিধে আছে। বৌকে তাই তাঁরা চট করে কাছছাড়া করতে চান না।
শেষ কথাটার প্রচ্ছন্ন রসিকতা এড়িয়ে গিয়ে মান্তু বলল, থাকুক দাবীদার। ওকে মাঝে-মাঝে এনে না রাখলে ওর মনটা ঠিক হবে না।
ললিতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর ব্যাধিটা কী?
কে জানে! ছোটোবেলা থেকে তো ওকে জানি। একেবারে সুস্থ, হাসিখুশি। কোনোদিন ভারী অসুখ হতে দেখিনি। সেই মেয়েরই কী যে হল!
অসুখ-বিসুখের কথা শুনতে ললিতবাবুর ভালো লাগে না। তিনি আমোদপ্রিয় মানুষ। মদ না খেয়েও সদাই ফুরফুরে। পাছে মান্তু তার বান্ধবীর রোগের জের টানে তাই তিনি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, আর এক কাপ চা sanction করো না!
মান্তু মৃদু ধমক দিয়ে বললে, একটু আগেই চা খেয়েছ। এখন আর নয়। রীণা তো এখুনি এসে পড়বে। তখন পাবে। হা, কি বলছিলাম যেন? রীণার কথা। ওর মনটা কিরকম ছিল বলি। একদিন কী একটা উপলক্ষে রীণা, রীণার মা, ঠাম্মার সঙ্গে আমিও যাচ্ছিলাম গঙ্গাস্নান করতে। হঠাৎ আমার দাদাও এসে জুটল। রীণা ছিল আমার দাদার খুব ভক্ত। দাদা পাটি করত। পড়াশোনাও ছিল খুব। কিছু মানত না। বলত, বুঝলি রীণা, লেখাপড়া শিখছিস, সংস্কারমুক্ত হবি। ঠাকুর-দেবতা, গুরু-পুরোহিত, ভূত-প্রেত স্রেফ বোগাস।
শুনে রীণার ঠাম্মা চটতেন। বলতেন, নীরেনই মেয়েটার মাথা খেল।
শ্মশানের পাশ দিয়েই স্নানের ঘাটে যেতে হয়। না তাকালেও বুঝতে পারছিলাম মড়া পুড়ছে। বিশ্রী চামসিটে গন্ধ। তার সঙ্গে ফটফট শব্দ বাবারে! ভাবলে এখনও গা কিরকম করে।
তা দাদা হঠাৎ রীণাকে বলল, পাঁচিলের গায়ে ঐ ছাইগুলো কিসের বলতে পারিস?
রীণা একনজর দেখে নিয়ে বলল, চিতাভস্ম।
–পারিস ঐ ছাই এক মুঠো নিয়ে আসতে?
সবাই চমকে উঠল।
–এ আবার কী কথা! ছিঃ!
দাদা নেহাৎ মজা করেই কথাটা বলেছিল। কিন্তু রীণা করল কি–সবাইকে হকচকিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে এক মুঠো ছাই নিয়ে এল।
দাদা যে দাদা, সেও তাজ্জব হয়ে গেল। রীণার সাহস দেখে বলল-সাবাস! এই তো চাই।
দাদা তো খুব বাহবা দিল। কিন্তু আর সবার মুখ হাঁড়ি। গঙ্গাস্নানের আনন্দ মাথায় উঠল। রীণা সেদিন সবার কাছে খুব বকুনি খেল। দাদা লজ্জায় পালালো।
ভাবতে পারা যায় সেই মেয়েই এখন নাকি বোজ ভূত দেখছে! শুধু ভূত দেখাই নয়–ভূতের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইছে!
শুনে ললিতবাবু মন্তব্য করলেন, কলকাতা শহরে ভূত!
–বোঝো, তাহলে ওর মানসিক অবস্থাটা কিরকম হয়েছে। আমি ওকে একটার পর একটা চিঠি দিয়ে, নিজে ওর সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ঐ এক কথা–না, ভুল দেখি না। মানসিক রোগও নয়। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার!
মান্তু একটু থামল। তারপর বলল–এই কমাসের মধ্যে মূর্তিটা বেশ কয়েকবার নাকি দেখা দিয়েছে। দেখা দেওয়াই শুধু নয়, নাকি হুমকিও দিয়েছে।
–আবার হুমকিও দিয়েছে। বাবাঃ! ললিতবাবু হাসলেন।
মান্তু রাগ করে বলল, ওর হাজব্যান্ডের মতো তোমারও দেখছি অবিশ্বাস। মেয়েটার জন্যে তোমাদের কারো এতটুকু ভাবনা হয় না!
স্ত্রীর এই তিরস্কার ললিতবাবু নিঃশব্দে হজম করতে পারলেন না। বললেন, ও-সব ভয়ের কোনো মানে হয় না। তাছাড়া যে মেয়ে হাসতে হাসতে মড়ার ছাই মুঠোয় ভরে আনতে পারে সে আবার নররাক্ষস দেখে অজ্ঞান হয় কি করে?
মান্তু বলল, দুটো আলাদা ব্যাপার না? একটা বীভৎস জিনিস সহ্য করতে না পারা। আর একটা কুসংস্কার না মানা। দুটোয় গুলিয়ে ফেললে কি করে হবে?
–কি জানি। তোমার বান্ধবীর মনস্তত্ত্ব বুঝি না। আমার মনে হয় স্রেফ মানসিক ব্যাধি।
বেশ! মানসিক ব্যাধি হলেও তো তার প্রতিকার করতে হবে।
–স্বামী যখন ডাক্তার তখন ব্যবস্থা তিনিই করছেন।
–ছাই করছে। শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রূপ।
ললিতবাবু আলিস্যি ভেঙে উঠে পড়লেন, যাই একটু ঘুরে আসি।
ওমা! যাবে কী! এখুনি রীণা এসে পড়বে।
ললিতবাবু উঠছিলেন, বসে পড়লেন। টাইমটেবলটা আবার তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। একসময়ে বললেন, এবার আমরা রাজস্থানের দিকে যাব। কি বলো?
মান্তু বললে, তার তো এখনো ঢের দেরি। পরে ভাবলেও চলবে। বলে আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের মনেই বলল, সাড়ে পাঁচটা বাজতে চলল। এখনো এল না!
এমন সময়ে পিওন এসে লেটার-বক্সে চিঠি ফেলে গেল।
মান্তু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে লেটার-বক্স খুলে চিঠিটা বের করে নিয়ে এল। খামে চিঠি। অপরিচিত হাতে ইংরিজিতে ঠিকানা লেখা।
কার চিঠি?
মান্তু খামটা ললিতবাবুর হাতে দিয়ে পাশে বসল।
চিঠি পড়ে ললিতবাবু নড়েচড়ে বসলেন। খুশি-খুশি গলায় বললেন, মিস থাম্পিকে মনে আছে?
-খুব আছে। কেন?
–তিনি কলকাতায় আসছেন।
–ওমা! কবে?
পড়ে দেখো।
মান্তু চিঠিটা নিয়ে এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলল। মিস থাম্পি লিখছেন, আগামী ২৭ নভেম্বর ম্যাড্রাস মেলে কলকাতা পৌঁছচ্ছেন। সেখান থেকে সোজা ললিতবাবুর বাড়ি চলে আসবেন। দু-তিন-দিন থাকবেন। কলকাতায় থিওফিক্যাল সোসাইটি এবং আরও কয়েকটি জায়গায় ঘুরবেন। সেসময়ে এদের সাহায্য দরকার হবে। কেন-না কলকাতার রাস্তাঘাট তাঁর ভালো জানা নেই।
মান্তু আনন্দে লাফিয়ে উঠল–মিস থাম্পি তাহলে কথা রেখেছেন।
তারপর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল, ২৭শে নভেম্বর মানে সামনের বুধবারের পরের বুধবার। ওদিন তোমার কোথাও বেরোনো হবে না।
ললিতবাবু হেসে বললেন, বেরোতে হবে না মানে? বেরোতে আমায় হবেই, অন্তত হাওড়া স্টেশনে ওঁকে রিসিভ করতে।
মান্তু রসিকতাটা বুঝল। এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুজনেই মিস থাম্পির কথা ভাবছিলেন। অনেক কথাই মনে পড়ছিল।
দুবছর আগে তিরুপতির পাহাড়ে এই মহিলার দর্শন পান ওঁরা।
তিরুপতি পাহাড়টা ছিল বেশ উঁচু। দীর্ঘ পিচঢালা বাস-রাস্তাটা ওপরে উঠে গেছে পাহাড়টাকে ঘিরে ঘিরে–মেয়েরা যেমন পাক দিয়ে শাড়ি পরে তেমনিভাবে। রাস্তার দুধারে পাহাড়ে ঝোপ-জঙ্গল। সে-সব জঙ্গলে কেউ বোধহয় কোনদিন যায় না। যাবার দরকারও হয় না।
কিন্তু পাহাড়ের ওপর উঠে মান্তুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শহর! ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। দু পাশে হালফ্যাশানের বাড়ি, বাজার, দোকান। এমনকি বিখ্যাত একটি ব্যাঙ্ক পর্যন্ত।
দু-একদিন আগে কী একটা বিশেষ উৎসব হয়ে গিয়েছে বলে তিরুপতির মন্দিরে তেমন ভিড় ছিল না। তাই তিরুপতি দর্শন হয়ে গেল বেলা তিনটের মধ্যেই। পাহাড় থেকে নামার লাস্ট বাস পাঁচটায়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে নিচে নামতে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মান্তুদের বাস। সেটা ছাড়বে সন্ধে ছটায়। কাজেই হাতে যথেষ্ট সময়।
মান্তুদের সঙ্গে আরো যারা ছিলেন তাঁরা পাহাড়ের ওপরে কেনাকাটা করতে লাগলেন। মান্তুরা সামান্য কিছু কিনে জায়গাটা ঘুরতে বেরোল। ললিতবাবুর কি খেয়াল হল টাউন ছেড়ে নেমে এলেন পাহাড়ের ধারে। বললেন, লোকে তো এদিকে বড়ো একটা আসে না, চলো আমরা ওদিকটা দেখে আসি।
একটু নেমেই ওঁদের নজরে পড়ল একটা ছোটোখাটো আশ্রম।
এখানে আবার আশ্রম কিসের!
কৌতূহলী হয়ে ওঁরা একটু এগোতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে ওঁরা ভয় পেয়ে গেলেন। দেখলেন আশ্রমের পিছনে একটা গাছের ডালে অনেকগুলো মড়ার মাথার খুলি ঝুলছে। খুলিগুলো নানা আকারের। সবচেয়ে ছোটোটা হাতের মুঠোয় ধরা যায়। আর সবচেয়ে বড়োটা যে মানুষের মাথা তা ভাবা যায় না।
এঁরা যখন অবাক হয়ে খুলিগুলো দেখছেন তখনই একজন মহিলা আশ্রম-কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মান্তু আঁতকে উঠেছিল। কালো লম্বা চেহারা। একটা দাঁত ঠোঁট থেকে সামান্য একটু বেরিয়ে। পুরু ঠোঁট। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এক মাথা পাকা চুল। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গায়ে কালো সোয়েটার। গলায় লাল পাথরের মালা। মোটামোটা আঙুলে দামী পাথর। সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ে তা হচ্ছে তার ঝকঝকে চোখ দুটো।
মিস থাম্পি ওদের সাদর অভ্যর্থনা করলেন। এইভাবেই আলাপ হল।
ভদ্রমহিলা ইংরিজিতেই কথা বললেন। জানা গেল, উনি সেখানে আছেন চল্লিশ বছর। একাই থাকেন।
কী করেন জিজ্ঞাসা করলে প্রথমে একটু হেসেছিলেন মাত্র। শেষে তিনি যা বললেন তার অর্থ হলো প্রেতচচা!
শুনে তো মান্তুর বাকরোধ হবার যোগাড়। সে থিওজফিস্টদের কথা শুনেছে বটে কিন্তু কখনো থিওজফিস্ট চোখে দেখেনি। তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, বা তাদের চর্চার বিষয় ঠিক কি জিনিস, সে সম্বন্ধে তার কোনো স্পষ্ট ধারণাই ছিল না। এই প্রথম একজন থিওজফিস্ট-এর সঙ্গে আলাপ হলো।
দেখতে যেমনই হোক, ক্রিয়াকলাপ যাই হোক, মানুষটি ভাল। খুবই অতিথিপরায়ণ। তিনি তাঁদের সাদরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আসন পেতে বসালেন। কফি খাওয়ালেন। মান্তুর ইচ্ছে ছিল প্রেতচর্চার ব্যাপারটা একটু শোনে। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারল না। ললিতবাবুও অবশ্য দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে কেবলই উঠি-উঠি করছিলেন। তারা কলকাতায় থাকেন জেনে ভদ্রমহিলা বললেন, আমার একবার কলকাতা যাবার দরকার হবে।
মান্তু তখনই ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল, যদি যান তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়ি উঠবেন। আমরা খুশি হব।
ধন্যবাদ। বলে মিস থাম্পি ঠিকানাটা রেখে দিলেন।
ব্যস এই পর্যন্ত। তারপর আর যোগাযোগ নেই। অমন একজন বিচিত্র মহিলার সঙ্গে কে আর যোগাযোগ রাখতে চায়!
প্রায় আড়াই বছর পর সেই মিস থাম্পি কলকাতায় আসছেন। আর আসছেন কিনা তাদেরই বাড়ি! এ খবরে যেমন আনন্দ পেল তেমনি কেমন ভয়-ভয়ও করল। ভূত-প্রেত নিয়ে কারবার তো মহিলাটির!
মান্তুদের এক বিশেষ প্রতিবেশীবন্ধু আছে। দক্ষিণভারত থেকে ফিরে এসে মান্তু তাদের কাছে মিস থাম্পির গল্পও করেছিল। মিস থাম্পি সম্বন্ধে তাদেরও খুব কৌতূহল। বলেছিল, কোনোদিন উনি কলকাতায় এলে যেন তাদেরও জানানো হয়। তারা দেখা করবে।
মান্তু ঠিক করল খবরটা ওদের কালই দেবে।
মিস থাম্পি আসছেন। কিভাবে তাকে অভ্যর্থনা করা হবে, কোন ঘরে থাকার ব্যবস্থা করবে–ওঁর খাবার ব্যবস্থাই-বা কিরকম হবে এই নিয়ে অনেকক্ষণ স্বামী-স্ত্রীতে আলোচনা হল। কিছুক্ষণের জন্যে রীণার কথা ভুলেই গিয়েছিল। তারপর হঠাৎই মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মান্তুর দুর্ভাবনা বাড়ল রীণা তো এখনো এল না!
ললিতবাবু বললেন, উনি একাই আসবেন?
–হ্যাঁ, ভালো করে ডিরেকশান দিয়ে দিয়েছি। অসুবিধে হবে না।
–পথ হারিয়ে ফেলবেন না তো?
-নাঃ। খুব চালাক-চতুর মেয়ে। তাছাড়া একই বাসে বাঙ্গুর থেকে টানা হাওড়া। তারপর আবার একটা বাসে হাওড়া স্টেশন থেকে টানা ক্ষীরোদতলা। ভুল হবার তো কোনো কারণ নেই।
ললিতবাবু বললেন, তবে হয়তো কাজে আটকে গেছেন। কিংবা বাচ্চাটার শরীর খারাপ।
মান্তু আর কিছু বলল না। আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল। তারপর যখন মনে হল আসার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই তখন ধীরে ধীরে সোফায় এসে বসল।
ললিতবাবু পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বললেন, মাঝখান থেকে আমার বেরোনো হল না।
পাশের ঘরে মেয়ে পড়ছিল। বললে, বেরোবে বৈকি। এখুনি না ঝড় উঠবে!
কথা শেষ হতে-না-হতেই হঠাৎ দিদিগন্ত কাঁপিয়ে প্রচণ্ড একটা ঝড় শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজ্যের ভেঁড়া কাগজ আর রাস্তার ধুলো যেন মুহূর্তে তাণ্ডব নৃত্যে মেতে উঠল।
.
০৮.
রাত নটায় ফোন
হাসপাতাল থেকে ফিরে কম্পাউণ্ডে ঢুকেই সঞ্জয় অভ্যাসমতো ওপর দিকে তাকাল।
না, রীণা আজ আর পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নেই। ঘরে আলোও জ্বলছে না।
এখনো ফেরেনি নাকি?
সঞ্জয় ওপরে উঠে এল। দরজায় তালা ঝুলছে। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।
অন্ধকার ঘরে ঢুকতেই এই প্রথম হঠাৎ ওর গা ছমছম করে উঠল। অন্য কোনো কিছুর ভয়ে নয়, রীণা ফেরেনি বলে।
সুইচ অন করে জামা প্যান্ট না ছেড়েই বিছানায় গিয়ে বসল। মিনিট কয়েক চুপ করে বসে রইল। হিসেব করে দেখল বেলা একটা নাগাদ বেরিয়ে থাকলে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে নিশ্চয়ই এসে পড়বে।
সঞ্জয় খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেই চায়ের জল চড়িয়ে দিল। মিটসেফ খুলে দেখল রীণা দুখানা পরোটাও করে রেখে গেছে।
ধীরে সুস্থে চা খেতে খেতে সঞ্জয়ের মনে হল কলকাতায় এসে পর্যন্ত এই প্রথম রীণা ঘরে নেই। একটা মানুষের মাত্র কয়েক ঘণ্টার অনুপস্থিতি যে এতখানি শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে সঞ্জয়ের সে অভিজ্ঞতা ছিল না। সে যেন হাঁপিয়ে উঠল।
সাতটা বাজল! রীণার দেখা নেই।
সঞ্জয় মনকে বোঝাতে লাগল–এত ভাবনা কিসের? হাওড়া তো বিদেশ-বিভুঁই। নয়। বাসের নম্বর জানা থাকলে—
তবু অস্বস্তি যায় না। যে কথাটা বার বার তাকে খোঁচাচ্ছিল তা এই যে, রণা কলকাতায় নতুন। সঙ্গে আবার বাচ্চা। পথ ভুল করতে পারে, এক বাসে উঠতে অন্য বাসে উঠতে পারে। অবশ্য তাতেই-বা এমন আর কি বিপদ হতে পারে। ট্যাক্সি নয় যে ভুলিয়ে কোথাও নিয়ে যাবে। ট্রামে, বাসে কেউ পথ হারায় না। লোককে জিজ্ঞেস করলেই ঠিক রুট দেখিয়ে দেবে। কাজেই বাড়ি ফিরে আসা কঠিন নয়। ভয় একটাই–অ্যাক্সিডেন্টের। রাস্তা পার হওয়ার অভ্যেস নেই—-ভিড় বাসে ওঠা-নামা করতেও অনভ্যস্ত। ভয়টা সেইজন্যেই।
সঞ্জয় সময় দেখল–সাড়ে সাতটা। সকালে বেরোবার আগে সে রীণাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল–তোমার বন্ধু আটকে দেবে না তো?
–আটকালেও থাকব না। সন্ধের আগেই ফিরে আসব।
সন্ধে তো কখন উৎরে গেছে!
সঞ্জয় আর ঘরে বসে থাকতে পারছিল না। একবার ভাবল বাস-স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালেই কি রীণা তাড়াতাড়ি এসে পড়বে? তা তো নয়। আসলে মানুষ দুশ্চিন্তায় যখন ছটফট করে তখন আর হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। সঞ্জয় দরজায় তালা বন্ধ করে নামতে যাচ্ছে এমনি সময়ে ঝড় উঠল।
প্রথমে সঞ্জয় বুঝতেই পারেনি ঝড় উঠছে। নভেম্বরের এই পরিষ্কার আকাশ খুঁড়ে এমন ঝড় উঠবে এ যে কল্পনার বাইরে! একটা গোঁ গোঁ শব্দের পরই ধুলোয় ধুলোয় চারিদিক ছেয়ে গেল। ব্যালকনি থেকেই দেখতে পেল রাস্তার লোক ছুটছে। আশ্রয় খুঁজছে। বাড়ির দরজা জানালা ফটাফট বন্ধ হচ্ছে।
এবার সত্যিই ভয় হল। রীণা এই মুহূর্তে কোথায় আছে কে জানে! যদি বাসে থাকে তো একরকম। তাও সমস্যা–এই ঝড়ে ঠিক স্টপেজে নামতে পারবে কি না। নামবেই বা কি করে? পুপুটাই বা কি করবে?
আর যদি রাস্তায় থাকে
সঞ্জয় আর ভাবতে পারল না। ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে লাগল।
ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য চলল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে। ঝড় যখন থামল রাত তখন নটা। ভাগ্য ভালো। বৃষ্টি নামেনি।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সঞ্জয় দেখল যশোর রোড একদম ফাঁকা। খাঁ-খাঁ করছে। লোক চলাচল তো নেইই, বাস-ট্যাক্সিও চোখে পড়ল না।
দারুণ দুর্ভাবনায় পড়ল সঞ্জয়। নিশ্চয় রীণার কিছু বিপদ হয়েছে। আর পুপুটা? ভাবতে ভাবতে সঞ্জয় অস্থির হয়ে উঠল।
এখন কি করবে? কোথায় খবর নেবে? পরামর্শ করে এমন কেউ কাছের মানুষ নেই। একবার ভাবল দোতলায় গিয়ে খবর নেয় নিখিলবাবু ফিরেছেন কিনা। এবাড়িতে যত ভাড়াটে আছেন তাদের মধ্যে নিখিলবাবুই একমাত্র সিরিয়াস লোক। ওঁর সঙ্গেই কথা বলা চলে। তবু সঞ্জয় গেল না। কে জানে ভদ্রলোক কী মনে করবেন!
অনেক ভেবে সঞ্জয় ঠিক করল মান্তুদের বাড়িই যাবে। হয়তো ওকে আটকে দিয়েছে।
কিন্তু মান্তুদের বাড়ি তো চেনে না। ঠিকানা? না, ঠিকানাও জানা নেই।
কি মনে হল উঠে ড্রয়ার টেনে মান্তুর চিঠিগুলো খুঁজতে লাগল।
একটা চিঠি পেল।–ভাই রীণা….।
নাঃ, ঠিকানা নেই। শুধু ক্ষীরোদতলা, হাওড়া।
শুধু ক্ষীরোদতলা বললে কি এই রাত্তিরে কারো বাড়ি খোঁজ করা যায়? অসম্ভব।
সঞ্জয় আবার চিঠি খুঁজতে লাগল।
আরো একটা চিঠি।
ভাই রীণা….।
আহা, ঠিকানা ছিল কিন্তু খাম খুলতে গিয়ে ঐ জায়গাটা ছিঁড়ে গেছে।
সঞ্জয় পাগলের মতো ড্রয়ার টেনে খুলে সব কাগজ হাতড়াতে লাগল।
এই যে আরো চিঠি রয়েছে।….
নাঃ–কোনোটাতেই পুরো ঠিকানা নেই।
সঞ্জয় যখন একেবারে হতাশ তখন ড্রয়ারের কোণ থেকে বেরোল দুমড়োনো একটা খাম। তাড়াতাড়ি চিঠিখানা বের করল। এইটে বোধহয় মান্তুর প্রথম চিঠি।
হ্যাঁ, এই যে ঠিকানা রয়েছে।
ঠিকানা লিখে নেবার ধৈর্য তখন আর নেই। চিঠিটা পকেটে পুরেই সঞ্জয় ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দরজায় তালা লাগাচ্ছে, মনে হল কেউ দ্রুত পায়ে ওপরে আসছে।
সঞ্জয় শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াল। নিশ্চয় কোনো বিপদের
কাকু, আপনার ফোন।
সঞ্জয় দৌড়ে নেমে গেল।
.
০৯.
রীণা কি ফেরেনি
সকাল হতে না হতেই মান্তু কাপড় পরে নিল। কাল সারা রাত রীণার কথা ভেবে ঘুমোতে পারেনি। অমন তো কত জনেই আসবে বলে আসে না বা। আসতে পারে না। তখন মোটেই ভাবনা হয় না। রীণা বলেই এত দুর্ভাবনা। প্রথমত, ও কলকাতায় নতুন। কে জানে কোন বাসে চড়তে কোন্ বাসে চড়ল। কোথায় আসতে কোথায় গিয়ে পড়ল। দ্বিতীয়ত, ও যেন ঠিক সুস্থ নয়। আর যে-মানুয মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।
অথচ একথাটা আগে মনে হয়নি। মনে হলে নিশ্চয় একা আসতে বলত না।
ভাবতে ভাবতে মান্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী যে হলো মেয়েটার!
ললিতবাবু বললেন, চা খেয়ে যাবে না?
-না। বলেই মান্তু তখনই বেরিয়ে পড়ল। ওর শরীরের ওপর যেন অসময়ে ভারী গরম কোট চাপানো রয়েছে। খুলে ফেললেই আরাম। কিন্তু খুলব বললেই খোলা যাচ্ছে না। মনের মধ্যে কেবলই খারাপ চিন্তা ঘুরে ফিরে আসছে। গিয়ে কি দেখবে! কি শুনবে!
যদি দেখে, রীণা বাড়ি নেই? যদি শোনে রীণা কাল দুপুরে সেই যে হাওড়া যাবে বলে বেরিয়েছিল এখনো পর্যন্ত ফেরেনি?
তাহলে কি করবে?
যদি দেখে বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে? লোকে ভিড় করে আছে থমথমে মুখে?
তাহলে কি বুঝবে?
কী বুঝবে তা আর কল্পনা করতে হয় না।
মান্তুর বুকের মধ্যে কিরকম করতে লাগল।
একবার ভাবল–গিয়ে দরকার নেই। ফিরেই যাবে। প্রিয়জনের কোনো মর্মান্তিক খবর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শোেনার শক্তি তার নেই।
তারপরেই ভাবল রীণা না হয়ে যদি তার বাড়ির কেউ হতো তাহলে কি পারত পালিয়ে থাকতে?
না, পারত না। কাজেই এখানেও তাকে মুখোমুখি হতেই হবে, যত খারাপ ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন।
মান্তু এবার যেন মনে জোর পেল।
ক্ষীরোদতলার মোড়ে আসতেই বাস পেয়ে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ময়দানে এসে পৌঁছল। বঙ্গবাসী সিনেমাহলের কাছ থেকে নাগেরবাজারের টানা বাস ছাড়ছিল। বাসটা কালিন্দি, লেকটাউন, বাঙ্গুর হয়ে যাবে। ছুটে এসে হাত তুলে বাস থামিয়ে কোনোরকমে উঠে পড়ল।
এক ঘণ্টার পথ। এত সকাল বলেই বাসে ভিড় ছিল না। জানলার ধারে ভালো সীট পেয়ে গেল। অন্য সময় হলে এইরকম সীটের জন্যে খুশি হতো। কিন্তু আজ মনটাই অন্যরকম হয়ে আছে।
…লেকটাউন, বরাট পার হয়ে গেল। পরের স্টপেজটাই রীণাদের। মান্তু রড ধরে উঠে দাঁড়াল। পা দুটো তখন ওর কাঁপছে।
বড়ো রাস্তা পার হয়ে সরু রাস্তা। মিনিট পাঁচেক পরেই দেখা গেল ওদের বাড়ির গম্বুজটা। মান্তু সমস্ত শক্তি নিয়ে হনহন করে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকল।
.
১০.
অদৃশ্য মানুষ-দৃশ্য চোখ
সঞ্জয়ের ইচ্ছে ছিল না মান্তুদের বাড়ি রীণা একা যায়। মান্তু অবশ্য দুজনকেই যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু সঞ্জয়ের তো সপ্তাহে একটি দিনই ছুটি। আর সপ্তাহে এই একটি দিন সঞ্জয় কোথাও নড়তে চায় না। তাই ছমাসের বেশি হল ওরা এখানে এসেছে, অথচ একদিনও মান্তুর কাছে যাওয়া হয়নি। শেষে মান্তুই একদিন সকালে এসে রীণাকে নিয়ে গিয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। দুই সখীতে ঠিক করেছিল–এরপর রীণা একাই যাবে-আসবে। মান্তুও মাঝে-মাঝে আসবে।
এই প্রস্তাব শুনে সঞ্জয় মান্তুকে হেসে বলেছিল–বেশ তো আপনি এসে নিয়ে যাবেন। শুনে রীণা ফোঁস করে উঠেছিল–আহা, আমি কচি খুকি! যেন একা যেতে পারি না।
হয়তো পারে কিন্তু মহাজাতি সদনে সেই ঘটনার পর রীণার সম্বন্ধে সঞ্জয় খুব সতর্ক। একা ছেড়ে দিতে ভরসা পায় না। আবার একটু-আধটু ছেড়ে না দিলে মনটাও ঠিক হবে না। এইসব ভেবে শেষ পর্যন্ত একা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল।
সকালে বেরোবার সময়ে সঞ্জয় রীণাকে বার বার করে বলল, সাবধানে যেও। বাসের নম্বর ভালো করে দেখে উঠো। কোলে বাচ্চা। তাড়াহুড়ো করে উঠো না। ভিড় থাকলে সে বাস ছেড়ে দেবে। বাস থেকে নামার সময়ে পেছন দিকে তাকিয়ে নামবে। সাবধানে রাস্তা ক্রশ করবে। আচ্ছা, দাঁড়াও। টাকা কটা রেখে দাও। দরকার হলে ট্যাক্সি করবে। তবে ফেরার সময়ে করো না। তখন সন্ধে হয়ে যাবে। ট্যাক্সিতে–একা–অচেনা–
উত্তরে রীণা মুখ টিপে একটু হাসল। বলল, আমি বোধহয় একেবারে গেঁয়ো মেয়ে নই। লেখাপড়াও জানি একটু-আধটু।
.
বেরোতে বেরোতে শেষ পর্যন্ত বেলা দেড়টা হয়ে গেল।
নভেম্বর মাস। অল্প অল্প শীত পড়েছে। বেলা দুপুরেও রোদের তাত তেমন। অসহ্য নয়। ফিরতে ফিরতে যদি সন্ধে হয়ে যায় ভেবে ব্যাগের মধ্যে পুপুর একটা সোয়েটার আর নিজের একটা শালও ভাঁজ করে নিয়েছে।
রীণা বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ওর বেশ ভালো লাগছিল। বন্ধুর কাছে যাচ্ছে বলেই নয়, বাড়িটা থেকে বেরোতে পারলেই যেন বাঁচে।
রীণা ফুটপাথ থেকে নেমে বাস-স্টপেজের দিকে চলল। হঠাৎ একেবারে পিছনে গাড়ির শব্দ শুনে এক লাফে ফুটপাথে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মিনিবাস শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে আর-একটা বাসকে ওভারটেক করে বেরিয়ে গেল।
উঃ! হয়েছিল এখুনি! আশ্চর্য, বাসটা হর্ন পর্যন্ত দেয়নি।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পথচারী দাঁড়িয়ে পড়েছে। রীণাকে বললে, খুব বেঁচে গেলেন দিদি! কাউকে কিছু বলার নেই। নিজে সাবধানে যাবেন।
রীণা কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মনটা খচ্চ্ করতে লাগল–কেন এমন হল?
তারপরেই নিজেকে বোঝাল সাবধানে না চললে দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে। ফুটপাথ থেকে নামা উচিত হয়নি।
একজন মহিলা স্টপেজে দাঁড়িয়েছিলেন। রীণার হাবভাব দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন?
–হাওড়া।
–এই তো চলে গেল হাওড়ার বাস। লক্ষ্য করেননি।
অন্য রুটের একটা বাস এসে পড়ায় ভদ্রমহিলা তাতে উঠে চলে গেলেন।
রীণার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা তাকে লক্ষ্য করছিলেন কেন? তবে কি সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে? কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছে?
ঘড়ির দিকে তাকাল। সোয়া দুটো। অর্থাৎ আধঘণ্টারও বেশি দাঁড়িয়ে আছে। একশো উনিশ নম্বর বাসও এসেছিল। খেয়াল করেনি।
মনটা ঠিক করে নিয়ে রীণা বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই আর একটা একশো উনিশ নম্বর এল। বেশ ভিড়। তবু রীণা উঠল। লেডিজ সীট একটাই খালি ছিল। রীণা বসে পড়ল।
বাস চলেছে। লোক নামছে, উঠছে। যত লোক নামছে তার চেয়ে ঢের বেশি উঠছে। রীণা জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। এসব রাস্তা সে চেনে না। বাসটা কোন কোন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে তাও জানে না। শুধু এটুকুই জানে বাসটা হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে।
পুপু এতক্ষণ বেশ শান্ত হয়েছিল। এখন দুষ্টুমি শুরু করেছে। তার আর দোষ কী? মায়ের কোলে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে থাকা কতক্ষণ আর সম্ভব? একবার ও হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোল থেকে পড়ে যায় আর কি! রীণা জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে পুপুকে জোর করে কোলে তুলে নিল।
সামনে লোক সার সার দাঁড়িয়ে। লেডিজ সীটের সামনেই রড ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাসেঞ্জাররা। বাসের ওদিকেও একই অবস্থা।
বাবাঃ! সবাই হাওড়া ময়দান পর্যন্ত যাবে নাকি? তাহলে ঐ ভিড় ঠেলে পুপুকে নিয়ে নামবে কি করে?
তারপরেই ভাবল অসুবিধে আর কি? সবাই নেমে গেলে ধীরে সুস্থে নামবে।
হঠাৎ রীণা দেখল বাসের সামনের দিকে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন তাকে লক্ষ্য করছে।
কয়েকবারই চোখ পড়েছিল, তখন বুঝতে পারেনি। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারলা, তাকেই দেখছে। কিন্তু লোকটিকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ে আড়াল পড়ে গেছে। এমন-কি মাথা মুখও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের ভাষায় বলতে চাইছে–আমায় চিনতে পারছ না?
রীণারও মনে হল ঐ চোখ যেন তার খুব পরিচিত। কোথায় যেন দেখেছে।
রীণা কয়েক বার তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল লোকটি কে হতে পারে? ঐ চাউনি যে তার খুবই চেনা।
বাসটা প্রথমে বেশ জোরেই চলছিল। তারপর ক্রমশ কেমন টিকিয়ে টিকিয়ে চলতে লাগল। প্যাসেঞ্জারেরা তো চেঁচামেচি শুরু করে দিল।বাস চলছে, না গোরুর গাড়ি?
বাসটা একটা বড়ো ক্রসিং-এর স্টপেজে এসে থামল। অনেক প্যাসেঞ্জার নামল, উঠল। কন্ডাক্টার দুবার ঘন্টি বাজাল। কিন্তু হঠাৎই বাসটার ইঞ্জিন থেমে গেল। আর স্টার্ট নিল না।
কন্ডাক্টার বলল, গাড়িটা ঠেলার দরকার।
কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নেমে গিয়ে কন্ডাক্টরের সঙ্গে গাড়ি ঠেলতে লাগল। গাড়ি একবার স্টার্ট নিল। তারপর আবার থেমে গেল।
গতিক সুবিধে নয় দেখে অনেকেই নেমে পড়ে অন্য বাস ধরতে গেল। কেউ কেউ কন্ডাক্টারের কাছে টিকিটের পয়সা ফেরত চাইতে লাগল। বাস খালি হয়ে গেল। শুধু রীণা চুপ করে বসে রইল। বুঝতে পারছিল না–কি করবে?
কন্ডাক্টার এসে বলল, আপনি বসে আছেন কেন? বাস যাবে না।
রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে কোলে নিয়ে উঠে পড়ল।
কন্ডাক্টারটি বোধহয় হৃদয়বান। বলল, টিকিটের পয়সা ফেরত নিন।
বলে টিকিটটা নিয়ে পয়সা ফেরত দিল। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?
ক্ষীরোদতলা।
–সেটা আবার কোথায়?
–হাওড়ায়।
পিছনে তখন অনেকগুলো বাস এসে পড়েছিল। কন্ডাক্টার ঝুঁকে পড়ে একটা বাস দেখিয়ে দিয়ে বলল, ঐ বাসে চলে যান।
রীণা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। এক বার সেই লোকটিকে খুঁজে দেখার কথা মনে হল। চারদিকে তাকাল। কিন্তু এমন কাউকে দেখতে পেল না যে তাকে দেখছে। বুঝল–যে দেখছিল সে এতক্ষণে নেমে অন্য বাসে চলে গেছে।
কাছেই বাসটা দাঁড়িয়ে ছিল। রীণা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।
এ বাসটাতেও ভিড় কম ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় আরো বেড়ে গেল। সেই ঠাসাঠাসি ভিড়।
বাস যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ যেন আর শেষ হয় না। বসে বসে রীণার ঘুম এল। দু একবার ঢুলুনি। তার পর কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল ঠিক নেই। পুপুর কান্নায় ঘুম ভেঙে গেল। রীণা পুপুকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল সেই অদৃশ্য মানুষটার চোখ। আগের মতোই দূর থেকে তাকে একদৃষ্টে দেখছে। এবারও তার মুখ বা দেহ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভিড়ের আড়ালে অদৃশ্য।
রীণা খুব অবাক হল। লোকটা এ গাড়িতেও উঠেছে। তাহলে আগের বাসটা খারাপ হলে সে যখন নেমেছিল তখন লোকটাকে দেখা গেল না কেন?
রীণা চোখ সরিয়ে নিয়ে জানলার বাইরে দেখতে লাগল।
একটু পরে বাসটা এক জায়গায় এসে থামল। রাস্তাটা আগের মতো চওড়া নয়। খুব ঘিঞ্জি। একপাশে দোকানপাট। অন্য পাশে বোধহয় মিনিবাস, সাইকেল-রিকশার স্ট্যান্ড। লোকজন ব্যস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। মিনিবাসের কন্ডাক্টার কর্কশ গলায় হাঁকছে–ঢাকুরিয়া–পার্কসার্কাস–সল্টলেক। সাইকেল-রিকশওয়ালা ঘন ঘন হর্ন বাজিয়ে সোয়ারি ডাকছে।
বাস এখানে থামতেই প্যাসেঞ্জাররা নেমে গেল। এখানে সবাই নামল কেন? এই কি হাওড়া ময়দান? যাই হোক পুপুকে কোলে নিয়ে রীণাও নামল।
নেমেই হকচকিয়ে গেল। না, এ তো হাওড়া ময়দান নয়, হাওড়া স্টেশনও নয়।
তাহলে?
তাহলে কোথায় এল?
ওরই মধ্যে একবার সেই চোখ দুটোকে খুঁজল। না, কেউ তাকে দেখছে না।
রীণার কিরকম ভয় করতে লাগল। সেই অদৃশ্য মানুষটার জন্যে নয়, তার মনে হতে লাগল নিশ্চয় ভুল বাসে উঠে পড়েছিল। নিশ্চয় অন্য কোথাও এসে পড়েছে।
কিন্তু জায়গাটা কি?
ভাবল কাউকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু যাকে-তাকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করল। তাছাড়া আনাড়ি মেয়ে ভেবে যদি কেউ তাকে ফলো করে? রীণা ঠিক করল কোনো প্রবীণ মানুষ দেখতে পেলে তাকে জিজ্ঞেস করবে।
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সে দেখতে পেল একটা দোকানের বোয়াকে বসে একজন বৃদ্ধ খবরের কাগজ পড়ছেন।
রীণা পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বৃদ্ধ চোখ তুলে তাকালেন। রীণা জিজ্ঞেস করল, এটা কোন জায়গা?
বৃদ্ধ বললেন, যাদবপুর।
যাদবপুর! রীণা থমকে গেল।
রীণার মুখের অবস্থা লক্ষ্য করে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কোথায় যাবে মা?
রীণা লজ্জায় সংকোচে ইতস্তত করতে লাগল। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এটা যাদবপুর স্টেশন রোড। এখানেই কোনো নম্বর খুঁজছ?
রীণা মাথা নাড়ল।
–তবে?
রীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি হাওড়া যাব।
–হাওড়া যাবে! আসছ কোথা থেকে?
রীণা বলল, বাঙ্গুর থেকে।
-বাঙ্গুর মানে?
লেকটাউন, বাঙ্গুর।
–সেখান থেকে এখানে!
রীণা তখন সব ঘটনা বলল।
শুনে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কি হাওড়া স্টেশনেই যাবে?
না, হাওড়া ময়দান।
–তাহলে তো তুমি অনেকটা এগিয়ে এসেছ মা। যেখানে নেমেছিলে সেখানেই বাস পেতে। তুমি ওখানেই চলে যাও।
রীণা একটু ভেবে বলল, আমি বাঙ্গুরেই ফিরে যাব ভাবছি।
বৃদ্ধ বললেন, সেই ভালো। তুমি নতুন। সন্ধের পর হয়তো জায়গা চিনতে পারবে না। অবশ্য এখান থেকে বাঙ্গুর যাবার টানা বাসও নেই। বাস চিনে বদলাতে পারবে?
রীণা মাথা নাড়ল।
বৃদ্ধ বললেন, আমারও তাই মনে হয়।
একটু ভেবে বললেন, তুমি এক কাজ কর। সামনেই যাদবপুর স্টেশন। ওখান থেকে শিয়ালদা চলে যাও। তিনটে স্টেশন–ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ, পার্কসার্কাস। যেখানে নামবে সেটা সাউথ স্টেশন। সেখান থেকে নর্থ স্টেশনে এসে যে কোনো গাড়িতে উঠলেই উল্টোডিঙ্গি পৌঁছে যাবে–একটাই স্টেশন। তারপর ওখান থেকে একটা রিকশা নিয়ে নেবে–আমার ধারণা উল্টোডিঙ্গি থেকে বাঙ্গুর রিকশা যায়।
রীণা খুশি হয়ে বৃদ্ধকে নমস্কার করে যাদবপুর স্টেশনে গেল। দুদিকে প্ল্যাটফর্ম।
তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। পুপুকে কোলে নিয়ে রীণা আর চলতে পারছিল না। কোনোরকমে শিয়ালদার একটা টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল।
একটু পরেই একটা ট্রেন এল। রীণা গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়িতে এত ভিড় যে রীণা বসার জায়গা পেল না। দাঁড়িয়ে থাকতে হল। একে মানসিক উদ্বেগ,কত দূরে শেয়ালদা স্টেশন, সেখান থেকে কোন ট্রেনে উল্টোডিঙ্গি; তারপর কোথায় পাবে বাঙ্গুর যাবার রিকশা! এসব চিন্তা তো আছেই, তার ওপর পরিশ্রম। রীণার শরীর ঝিমঝিম্ করতে লাগল। তবু অনেক কষ্টে এক হাতে পুপুকে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
ট্রেন ছুটছে। কোন স্টেশন কখন যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেছিলেন, মাত্র তিনটে স্টেশন পরেই শিয়ালদা। তিনটে স্টেশন কি এখনও যায় নি? একজনকে জিজ্ঞেস করতে গেল কিন্তু গলায় ভালো করে স্বর ফুটল না। ট্রেনের মধ্যে গোলমালে কেউ তার কথা শুনতে পেল না। ট্রেনটা একটা স্টেশনে থেমেই আবার চলতে শুরু করল। কেমন একটা দম-আটকানো কষ্ট হচ্ছে। পুপুকেও আর কোলে রাখতে পারছে না। পুপু যেন কোল থেকে পড়ে যাচ্ছে। রীণা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। রড ধরে মেঝেতেই বসে পড়ল…
এক সময়ে তার কানে এল কে যেন বলছে–আপনি কোথায় যাবেন?
রীণা অতিকষ্টে চোখ মেলে তাকাল। দেখল সে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে আছে।
–পুপু! বলে ধড়মড় করে উঠে বসল।
একজন ভদ্রলোক সম্ভবত তাঁর স্ত্রীকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এই যে এঁর কোলে।
–আমি কোথায়?
–এটা মল্লিকপুর স্টেশন।
–মল্লিকপুর!
–হ্যাঁ, ডায়মন্ড হারবার লাইনে। এর পরেই বারুইপুর। আপনি কোথায় যাবেন?
–শেয়ালদা।
শেয়ালদা! তো এদিকে এলেন কি করে?
রীণা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, জানি না।
–আপনি তো উল্টোদিকে এসে পড়েছেন।
রীণা বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ভদ্রলোকের স্ত্রী পুপুকে রীণার কোলে তুলে দিয়ে বললেন, আজ আপনি আমাদের বাড়ি চলুন। আমরা এখানেই থাকি। কাল সকালে উনি না হয় আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন।
রীণা একটু চুপ করে থেকে ছেলেমানুষের মতো বললে–আমি বাড়ি যাব।
বাড়ি কোথায়?
বাঙ্গুর।
তখন ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে চলুন, আপনাকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।
পরের ট্রেনে ভদ্রলোক রীণাকে নিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশনে এলেন। এই সময়ে উঠল প্রচণ্ড ঝড়।
ভদ্রলোক এমনও ভেবেছিলেন রীণাকে না হয় বাঙ্গুর পৌঁছে দিয়েই আসবেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড় ওঠায় এত দেরি হয়ে গেল যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হল না। তিনি রীণাকে নিয়ে এলেন বালিগঞ্জ থানায়।
সেখানে পুলিশ রীণাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করল। স্বামীর নাম, ঠিকানা। রীণার তখন ঘোর কেটে গিয়েছিল। সব কিছুই বলতে পেরেছিল।
ভদ্রলোক ও. সি.কে বললেন, যদি আপনারা অনুগ্রহ করে এঁকে বাড়িতে পোঁছে দেন।
ও. সি. বললেন, অনুগ্রহ কেন বলছেন, এ তো আমাদের কর্তব্য। তবে একটু দেরি হবে। পুলিশ ভ্যানগুলো–
বলেই রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়িতে ফোন আছে?
রীণা বললে, দোতলায় এক ভদ্রলোকের ঘরে আছে।
নম্বর?
নম্বর! রীণা মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগল।
–মনে নেই?
রীণা চোখ বুজিয়ে একটু ভাবল। তারপর ভেবে ভেবে খুব আস্তে গুনে গুনে ঢিল ছোঁড়ার মতো একটি একটি সংখ্যা বলে গেল।
ও. সি. তখনই রিসিভার তুললেন।
.
মান্তু দারুণ উদ্বেগে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে পুরুষের সাড়া পাওয়া গেল।
কে?
–আমি মান্তু
ব্যাকুল কণ্ঠস্বর যেন বন্ধ দরজার ওপরে আছড়ে পড়ল।
দরজা খুলে দিল সঞ্জয়। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল মান্তু। রীণা কোথায়? ভালো আছে তো?
উত্তর পাবার দরকার ছিল না। মান্তু দেখল স্লান ক্লান্ত মুখে বিহ্বলদৃষ্টিতে রীণা তাকিয়ে আছে।
সঞ্জয় হেসে বলল, আসুন, কাল অনেক রাত্তিরে আপনার বান্ধবীকে উদ্ধার করে এনেছি।