১-২. অমু ঘোষের ডায়েরি-১

কুর্চিবনে গান – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

অমু ঘোষের ডায়েরি

স্টিল এক্সপ্রেস ধরে জামশেদপুর এসেছিলাম সোমবার সকালে।

নিশির ডাকের-ই মতো জামশেদপুর আমাকে ডাকছিল কিছুদিন ধরেই। কিছু কিছু স্থান মাঝে মাঝে, এমন করে ডাক পাঠায়। যখন পাঠায়, তখন অগ্রাহ্য করা যায় না।

ঘুমের মধ্যে জেগে উঠছিলাম। তারাভরা আকাশে চেয়ে, জানলার সামনে বসে মনে হচ্ছিল, কত্তদিন একটু রোদ লাগেনি গায়ে, কত্তদিন বদগন্ধ কর্মব্যস্ত পুরুষদের ধাক্কাধাক্কি, ধুলো, বিকট আওয়াজ আর ফিরিওয়ালার চিৎকার এড়িয়ে, একটু নির্জন-পথে গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় হাঁটিনি একটুও। কত্তদিন! দমবন্ধ হয়ে আসছিল একেবারে।

রোজ সকালে কাগজ খুললে এক-ই খবর। দাম বেড়েছে। সব জিনিসের-ই দাম বাড়ছে ‘হু হু’ করে প্রতিদিন। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে একেবারেই। হাত ফসকে যাওয়া গ্যাস-বেলুন যেমন, উড়ে যায় উপরে, নীচে দাঁড়িয়ে-থাকা শিশুকে হতভম্ব করে, ঠিক তেমনি করেই দাম বাড়ছে। আর দাম কমছে মানুষ আর টাকার। টাকা একদিন অনেক-ই রোজগার করেছি, ট্যাক্সও দিয়েছি অনেক।

একদিন ছিল, যখন লোকে আমাকে বড়লোক বলেই জানত। কিন্তু নিজের-ই স্বভাব দোষে (না, মদ খেয়ে বা জুয়া খেলে নয়) সব টাকা নষ্ট করেছি। নষ্ট করেছি না-বলে, বলা ভালো, নষ্ট হয়েছে। সত্য-মিথ্যা নানা অজুহাতে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বহুলোকে। তার চেয়েও বেশি নষ্ট হয়েছে, নিজের মধ্যের-ই নষ্ট করার তাগিদে। যারা ঠকিয়েছে, সে-আত্মীয়ই হোক, কী বন্ধু, কী কর্মচারী, তারা সবাই ভেবেছে বোকাটাকে ঠকিয়ে নিলাম। কিন্তু তারা কেউই জানেনি যে, এ-বোকা জেনেশুনেই ঠকেছে বার বার।

আমার বহু দূরসম্পর্কের-পিসতুতো ভাই গবু এখানেই আছে। শুনেছি, বড়োচাকরি করে। তার মূল পড়াশোনার খরচাটা পুরো আমিই দিয়েছিলাম। বাড়িওয়ালা একবার উৎখাত করতে চেয়েছিলেন, বহু হাজার টাকা ভাড়া বাকি পড়াতে, তাদের সমস্ত পরিবারের সেই দায়, আমি উদ্ধার করেছিলাম। তার বিয়ের সময়, গবু পণ নিয়েছিল এবং আমার কাছ থেকেও লোক খাওয়ানোর জন্যে, কিছু টাকা নিয়েছিল। যে, শিক্ষিত মানুষ বিয়েতে ‘পণ’ নেয়, তাকে শিক্ষিত বলে মানা অসম্ভব। মিছিমিছিই ওর পড়াশোনার জন্যে টাকা নষ্ট করেছিলাম। এখন মনে হয়।

একদিন বড়োলোক এবং কবি বলে অগণ্য মানুষ-ই খাতির করত। আজকে যে, খাতির যত্নটুকু পাই, তা শুধু মাত্র কবি বলেই! এই খাতিরের দাম অন্য।

আজ আমার কাউকেই দেওয়ার মতো কিছু নেই। তবে থাকলেও, আজ হয়তো কাউকেই কিছু দিতামও না। কারণ, যে-ডানহাতটি নিয়ে দান করতাম সকলে মিলে নির্মম মোচড়ে মোচড়ে সেই ডান হাতটিকেই ভেঙে দিয়ে গেছে। ভাঙা হাতের যন্ত্রণা তো আছেই, তার চেয়েও অনেক বেশি বাজে অকৃতজ্ঞতা আর কৃতগ্নতার আঘাত। আমার স্ত্রী রানি বলে, যা কিছুই যা-কারো জন্যেই করেছ, তা মনে করো নিজের আনন্দর জন্যই করেছিলে। প্রত্যাশা করবেই বা কেন?

যখন করেছিলাম, তখন কিন্তু আনন্দের জন্যেই করেছিলাম। এখন তাদের কৃতঘ্নতাতে কেন যে, কষ্ট পাই, জানি না।

আমি কবি। যেহেতু আমি কোনো রাজনৈতিক দলের-ই পোস্টার লিখিনি, লিখব না; তাই আমি এখনও লিটল ম্যাগাজিনের-ই কবি। পাঠকসমাজ আমাকে কবি বলে মেনে নিয়েছিল, এইটে ভেবেই আনন্দে থাকি শত দুঃখের মধ্যেও। কবিরা প্রায় কেউই মানেননি যদিও। আমি তাঁদের মতে ‘রোমান্টিক মহিলাদের মদতপুষ্ট কবি’। অতএব কবি নই।

রানির আত্মাটি খুব ভালো। এবং ওর ভেতরে এক, প্রচন্ড শক্তি আছে। নইলে আর্থিক অবস্থার এই সাংঘাতিক পরিবর্তন, ওর পক্ষে মানিয়ে নেওয়াই সম্ভব হত না। কৃতঘ্নতা, এবং অকৃতজ্ঞতার আঘাত, ওকে সইতে হয় আমার চেয়ে অনেক-ই বেশি। কিন্তু রানি স্বীকার করে না  কিছুমাত্র। অনুযোগও করে না। আমি বলব যে, ওর সবচেয়ে বড়োকৃতিত্ব এই যে, ও, আমার মতো স্বামী নিয়ে এতদিন ঘর করে এল। শিশু অথবা সেনাইল বৃদ্ধকে সামলানোও, এর চেয়ে অনেক-ই সোজা!

রানিই আমার জীবনে একমাত্র নারী নয়। অথচ রানি নিজে প্রকৃতার্থে সতী। বারংবার অনুরোধ-উপরোধ করেও, ওকে একবারটির জন্যেও অসতী করতে পারলাম না। জানি না, অসতী হলে তো ও আমাকে বলে হবে না। না হওয়াই ভালো। তবে এ-ব্যাপারে আমার কোনো মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা নেই। বিয়ে যে, একটা চুক্তি সে-কথা আমিও মানি। কিন্তু যেকোনো চুক্তিই যদি, ধনুক ভাঙা-পণ হয়ে ওঠে তাহলে তা তো প্রহসন-ই। চুক্তির দু পাশেই বিদেশের হাইওয়েতে যেমন থাকে, তেমন-ই ‘soft Shoulder থাকা উচিত। Parking Lane। হু হু করে ছুটে যেতে যেতে, ক্লান্তি লাগলে পথপাশে একটু থেমে থাকলে বা হোটেলে পছন্দসই কারো সঙ্গে একটি রাত কাটালে সেই, দামামা-বাজানো চুক্তি আরও ঔজ্জ্বল্য পায়। ঘর না ভেঙেও ঘরকে নতুন করা যায়।

কিন্তু আমাদের দেশের পুরুষেরা সেই শ্বেতকেতু আর উদ্দালকের দিন থেকেই নারীকে গাভীর চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতে নারাজ। নারীরা নিজে হাতে এই অধিকার তুলে না নিলে, তারা দেবেনও না কোনোদিন।

তবে আমার ব্যাপারে রানির কোনো দ্বিধা নেই। ও বলে, তুমি কবি। এই নিখিলবিশ্ব তোমার চারণভূমি। চারণভূমি’ কথাটার মধ্যে একটু খোঁচা যে, নেই তা-নয়। তবু আমি হাসি।

রানি বলে, তোমার জীবনে যে-অভিজ্ঞতাই হোক-না-কেন তা, তোমার নিজের একার নয়, নিজের নিজস্ব করে রাখবারও নয়। তাই তার ভালোত্ব-মন্দত্ব তোমাতে বর্তায় না। পাঠক-পাঠিকাকে তা দিয়ে দিলেই তুমি ফুরিয়ে যাবে। তারপর নতুন করে ভরে নেবে নিজেকে আবার। ও হাসতে হাসতে বলে, বাচ্চাদের যেমন যখন তখন স্টম্যাক-আপসেট হয়, তোমারও যখন তখন প্রেম হয়। শিশুদের অনেক দোষ ক্ষমা করে দিতে হয়। আর ক্ষমার কথাই যখন ওঠে তখন, মা অথবা স্ত্রীই যদি ক্ষমা না করে অথবা বাবা এবং স্বামী; তবে ক্ষমা করবেটা কে?

রানির এই মহীয়সী, প্রকৃত শিক্ষিত, প্রখর বুদ্ধিমতী চরিত্রই হয়তো, কোনোদিন আমাকে সত্যিকারের বড়োকবি করে তুলবে। তুলবে কি? এই অমু ঘোষকে?

লক্ষ্মী যতদিন ছিলেন, সরস্বতীর বোধ হয় পা ফেলতে দ্বিধা হচ্ছিল। অন্যান্য অনেক কবিদের কথাও জানি যে, লক্ষ্মী যখন ছিলেন না তখন, ঘরে সরস্বতী জাঁকিয়ে ছিলেন। লক্ষ্মী যেই এলেন অমনি সরস্বতী নীরবে চলে গেলেন। লক্ষ্মী-সরস্বতীর সহাবস্থান বড়ো একটা দেখা যায় না। গেলে, সুখের কথা হত। লক্ষ্মীর প্রাচুর্য বোধ হয়, অধিকাংশ মানুষের সূক্ষ্ম বৃত্তিগুলিকে স্থূল করে দেয়।

তবে আমি খুশি। এক দেবীকে এক স্ত্রীকে ভজনা করাই যথেষ্ট কষ্টের কাজ। তার ওপর আবার দু-নম্বর। অথবা ততোধিক। সরস্বতী আর রানিকে নিয়েই আমি খুশি। আপাতত।

এখানে যে, মান-সম্মান, অকৃত্রিম প্রীতি ও ভালোবাসা পেলাম ও পাচ্ছি আসার পর থেকেই যে, সত্যিই অভিভূত হয়ে গেছি। স্টেশনে নেমে সাইকেল-রিকশা নিয়ে কুটুর কুটুর করে ছবিদের বাড়ি পৌঁছে বললাম, এই যে ছবি! আমি এসেছি। আমি এসেছি’ এই সামান্য শব্দ দু-টি যে, নীলডির ছবির মতো পরিবেশে ছবির মনে এবং অনেকের-ই মনে, এমন ঢেউ পর পর ঢেউ তুললে তা অভাবনীয় ছিল। কবিতা পড়ন কী, না পড়ন সকলেই যে, আমাকে এমন আপন করে নেবেন তা ধারণারও বাইরে ছিল। ঈশ্বরের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা আমার। জানি না, যাওয়ার দিনে কেমন করে, কী বলে বিদায় নেব এদের কাছ থেকে। চলে যাব কীভাবে এদের সকলকে রেখে না বলেই পালিয়ে যাব কি? সরস্বতীর মতন? না, তা কেন? জাগতিক দুঃখ থেকে পালানোর প্রবৃত্তিও যেমন খারাপ, ভালোবাসা এবং প্রাপ্তি থেকে অমন চোরের মতো পালানোও খারাপ। জানি না, চোখে জল এসে যাবে না তো? যাঁরা আমাকে অন্তরের মধ্যে ঠাঁই করে দিলেন তাঁদের নিরন্তর অন্তরে রাখাও তো কর্তব্য। কিন্তু পারব না। আমি জানি। কলকাতায় থেকে কোনো মানবিক বৃত্তির লালন সম্ভব নয় আর। সে-কৃতজ্ঞতাই হোক কী প্রেম।

আবার বলি, ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। নীলডির সকলেই ভালো থাকুক। ভালো থেকো, তোড়া। তুমি বড়ো-বিস্রস্ত করেছ আমাকে। বাঁচা দায় এখন।

.

০২. তোড়া

কী অদ্ভুত সব নাম তোমাদের নীলডির রাস্তার। ভিয়াস রোড। ভিসুভিয়াসও আছে নাকি?

না, না। নদীর নামে নাম যে! ভিয়াস, রবি, ঝিলম, সুবর্ণরেখা, খড়কাই। পাহাড়ের নামেও আছে। যেমন দলমা। জার্মান সাহেবরা যখন, এক্সপ্যানশনের সময়ে এসেছিল, কাইজার বাংলোতে ছিল, তখন কিছু নাম তাদের খাতিরেও হয়েছিল। যেমন স্টুটগার্ট রোড।

এটা কী গাছ?

গাছ-ফাছ-আমি চিনি না। আমি কি বটানিস্ট?

অমনোযোগী গলায় উত্তর দিল কবি অমু ঘোষ।

বটানিস্ট না হলেও গাছ ভালোবাসেন তো।

তো? গাছ ভালোবাসলেই কি, তাদের নাম বলে বলে বিদ্যে জাহির করতে হবে?

ভালোবাসেন অথচ নাম জানেন না, চেনেন না, কখন ফুল আসে, খোঁজ রাখেন-না? অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!

মানুষ কি না সে-সম্বন্ধে এখনও নিঃসন্দেহ নই। তবে আশ্চর্যজনক জীব যে, সে-কথা নিশ্চয়ই মানি। অনেককিছুই, অনেককিছুকেই ভালোবাসি, আবার বাসিও না।

না কেন? এটা ভালো না।

তোমার নাম কী?

আমার নাম তো আপনি জানেন-ই।

সে তো তোড়া! মা-বাবার দেওয়া নাম। সে তো পোশাকি নাম। যে-নামে, নামি হয়ে অন্নপ্রাশনের দিনে, মামার কোলে বসে চামচে করে পায়েস খেয়েছিলে। যে-নাম লিখিয়ে দিয়ে এসেছিলেন কিণ্ডারগার্টেন স্কুলে, তোমার দাদু বা দিদা। সেই নাম কী নাম? নাম-ই নয় সেটা।

কেন সে-নাম, নাম নয়, কেন?

ওটা একটা চাপিয়ে-দেওয়া নাম। তোমার মেজোজ্যাঠা বা ন-পিসি বা বাড়িওলি দিদা, যাঁর প্রচন্ড স্নেহ ছিল, তোমার মায়ের প্রতি, তাঁর মনোমতে নাম। যে-নামে তিনি নিজেকে ডাকতে পারলে খুশি হতেন, বা তাঁর প্রিয়তমা কাউকে, তা না, পেরে তোমার অবোধ ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। অথবা তোমার মায়ের নিজের নাম, নিজে দিলে, যে-নাম দিতেন তিনি অথবা তোমার বাবার বিয়ের আগে প্রেমিকার নাম।

সেটা ঠিক নয়।

বললে কী হয়। সে নাম, নাম-ই নয়। তোমার বাবার অফিসের বড়োসাহেবের দেওয়া নাম অথবা তোমার দোর্দন্ডপ্রতাপ বড়োমামা বা বড়োজ্যাঠা বা কুঁদুলে বড়োপিসির দেওয়া নামের ভারে নিশ্চয়ই তুমি চাপা পড়ে আছ জন্ম থেকেই ইট-চাপা ঘাসের-ই মতো। সে-নামে বিকশিত, পুষ্পিত হওনি কখনো।

আমার কোনো জ্যাঠা বা মামা নেই। আমার মা এবং বাবাও একমাত্র সন্তান।

আগেই বোঝা আমার উচিত ছিল। নইলে এমন টোটালি স্পয়েল্ট তুমি হতে না। তার ওপর স্বামীও মোটে একজন। তুমি ছাড়া স্পয়েল্ট আর হবেটা কে?

আপনার নিজের নামটাও কি চাপানো নাম নয়? অমুদা?

এই বঙ্গভূমে একটি বড়ো বদভ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। চলচ্চিত্রাভিনেতা, লেখক, গায়ক, বাদক, আবৃত্তিকার, কবি, সকলকেই তাঁদের জ্যাঠামশায় অথবা ঠাকুরদার বয়সি মানুষেরাও দাদা বা দিদি বলে ডাকেন—’অ্যাজ আ রুল।‘ এতে ঠিক কী ধরনের ভক্তি দেখানো হয় বুঝি না। কিন্তু আমি এইরকম সম্বোধন মানতে রাজি নই। এ-কথা সবাইকে বলেও দিতে পারো। তবে তুমি ‘দাদা’ ডাকলে আপত্তি নেই।

নাম সম্বন্ধে একটি ভারি ভালো গপ্পো আছে। হিতুদাদের বাড়ি পৌঁছে বলব সে-গপ্পো। নামের নামাবলির কথা।

অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটল দু-জনে। ডিনার খেতে খেতেই বলা যাবে।

কী হল? কথা বলুন।

অমু বলল, সত্যি! ভাবতেই ভালো লাগছে। কত্তদিন পর যে, কটা দিন ছুটি পেলাম। এ, ক-টা দিন শুধু আমার-ই দিন। খেয়ালখুশির নিয়মভাঙার দিন। তোমাদের এখানে প্রত্যেকে যে, এই ঠাণ্ডাতে উঠে তৈরি হয়ে সাতটার মধ্যে কারখানায় পৌঁছোচ্ছে এ-কথা ভাবলেই আনন্দে মূৰ্ছা যাচ্ছি আমি। আমার একার-ই ছুটি। আর সকলের-ই কাজ। আঃ। বাঙালি হয়ে জন্মেছি তো! শুধুমাত্র নিজে সুখী হলেই সুখী হতে পারি না। আমার সুখের প্রেক্ষিতে অন্যদের দুখি দেখতে না পারলে নিজের সুখটা যেন, সম্পূর্ণ হয় না।

তোড়া হাসল অমুর কথা শুনে।

আঃ। কী সুন্দর রাত। কী সুন্দর গাছগাছালিতে-ভরা সব নির্জন পথ। কী সুন্দর তুমি। আমার হাত ধরে নিয়ে চলেছ অচেনা পথে।

আমি সুন্দর নই।

সৌন্দর্যের বিচার করে অন্যের ‘চোখ’। নিজের চোখ নয়। ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে, পথ জানি না, তোমার উপর করিনু নির্ভর তোমা বই কিছু মানি না।’ অমু আবৃত্তি আর গানের মাঝামাঝি গোছের কিছু একটা করল। আবার বলল, গাছটা কী?

এটা সোনাঝুরি।

হ্যাঁ। তোমাদের জামশেদপুর তো সোনাঝুরির জন্যে বিখ্যাত। সোনারি লিঙ্কের দু-পাশে তো অনেক-ই সোনাঝুরি গাছও আছে-না? একসময় প্রতিসপ্তাহে এসে কাইজার বাংলোতে থাকতাম। একটি কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলাম। আদিত্যপুরের কারখানায় যেতাম ভোরে উঠে। সন্ধেবেলা এসে দু-পাত্তর হুইস্কি চড়িয়ে ডিনার খেয়ে লাইনিং-এ কেটে রাখা রাউরকেল্লা এক্সপ্রেসে লাগবার জন্যে আলাদা যে, ডিট্যাচট কোচ থাকত, তাতে উঠে ঘুমিয়ে পড়তাম। সেসব সুখের দিন ছিল! স্বপ্নর মতো মনে হয়। জামশেদপুরের আর জানতাম না কিছুই। স্টেশন-কাইজার বাংলো-কারখানা বাংলো স্টেশন। ব্যস। মাঝে-মাঝে লাঞ্চে ‘বেলদি’ ক্লাবে যেতাম অবশ্য। ফর অ্যান অকেশনাল পিংক-জিন। অথবা ভদকা। অথবা টু স্পিন্ট আ বিয়ার উইথ সামওয়ান।

আপনি বড়োবেশি কথা বলেন।

জানি। সবার কাছে বলি না। যাদের ভালো লাগে, পছন্দ হয়, তাদের কাছে বলি। জানি, এটা আমার মস্ত দোষ। মার্জনা কোরো নিজগুণে।

অমুদা, আপনি যেমন কথা বলেন তেমনি চিঠিও লেখেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, কোনো মানুষ এই টেলিফোন-টেলেক্স-টেলিফ্যাক্স-এর দিনেও এমন চিঠির ভাষায় কথা আর কথার ঢঙে চিঠি লিখতে পারেন। এই অভ্যেস হল কী করে?

কু বলছ না সু? অভ্যেসটাকে? যাত্রা করি বলছ কি?

হেসে ফেলল তোড়া। বলল, দুটোর একটাও নয়। এটা একটা আশ্চর্য অভ্যেস। এ যুগে বেমানান। অলমোস্ট প্রাগৈতিহাসিক। কী করে হল এই অভ্যেস?

ব্যর্থ প্রেমের চিঠি লিখে লিখে, ও পাঠিয়ে। অথবা নিজের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে বলে!

তাই?

হ্যাঁ তাইতো।

কিন্তু প্রকৃত প্রেম মানেই তো ব্যর্থ।

তোড়া বলল।

যে-প্রেম পূরিত হয়েছে তারমধ্যে নিলামে কেনা ফার্নিচারের-ই মতো, পরে অনেক-ই ফাঁকফোকর বেরোয়; ফাটাফুটি। পুডিং দিয়ে অনেক জায়গা মেরামত করা থাকে। যতই দিন যেতে থাকে, ততই সেসব ছিদ্র গহ্বর, চিড়, ফাটল নগ্নভাবে প্রকট হতে থাকে। অপূরিত প্রেম বা ব্যর্থপ্রেম-ই তো আসল প্রেম। যা থাকে, নীরব মুহূর্তে, জানলা দিয়ে চাওয়া তারাভরা আকাশে, নিজের গায়ের শালের নীচের ওম-এ, দুঃখময় একাকীরাতের সুন্দর সব স্বপ্নে।

বাঃ। তুমি খুব সুন্দর কথা বলেছ। সুন্দর করেও। চমৎকার খড়কাই নদীর মতো তোমার কথার চাল। যার বোঝার সেই বুঝবে।

আরে এটা কী গাছ? দাঁড়িয়ে পড়ে অমু বলল। কী সুন্দর সটান শরীর, ছিপছিপে। ঠিক তোমার-ই মতো। আমি দেখেছি আকাশমুখী আগুনবরণ ফুল, কোমল সবুজ পাতার মোড়কে ফোটে এই গাছেই। বসন্তকালে। নাম কী এর জান?

অগ্নিশিখা।

অমু মাথা উঁচু করে দেখল। গাছটির দিকে বার বার তাকাল। তারপর বলল, কী স্নিগ্ধ গাছটি। আর ফুল যখন ফোটে তখন এই স্নিগ্ধতার মধ্যেই জমিয়ে তোলা বছরভরের সব জ্বালা নরম আগুন হয়ে নিবাত নিষ্কম্প হয়ে থাকে। নিঃশব্দে হাতছানি দেয়। বুকের মধ্যেটা কেমন যেন, করে। আমি তোমার পুরোনো নাম বদলে নতুন নাম দিলাম অগ্নিশিখা। পছন্দ?

তোড়া দাঁড়িয়ে পড়ে, গাছটির দিকে চাইল একবার। তারপর মাথা হেলাল।

বলল, যে-নামেই ডাকতে ভালো লাগে ডাকবেন। সাড়া দেব। দেখবেন। কাছেই দারুণ কুর্চিবন আছে। যাবেন একদিন? আমি আর আপনি। পূর্ণিমার রাতে? গান শোনাতাম আপনাকে।

অমু তোড়ার বাঁ-হাতখানি তুলে নিয়ে ওর হাতের পিঠে চকিতে চুমু খেল।

একটু লজ্জা, একটু উত্তেজনায় গাল লাল হয়ে উঠল তোড়ার। বলল, কেউ দেখে ফেলবে। চারধারে বাড়ি। কী যে, করেন! আপনার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।

কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এইসব মোটা মোটা গাছের-ই কান্ডের মতো অচল হয়ে যায়। তাদের একজায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ‘আজীবন’। কান্ডজ্ঞানকে আমি সযতনে এড়িয়ে চলি।

নিশ্চয়ই কেউ দেখেছে। গাছগাছালির মধ্যের বাংলোগুলো থেকে হাজার চোখ চেয়ে থাকে। এসব পথে যে-লোক চলে না।

দেখলেই-বা। গোপনে কতটুকু আর ঘটে একজন নারী বা পুরুষের মধ্যে। যেটুকু ঘটে বন্ধ দরজার ঘরের মধ্যে সেটুকুও অনুমান করেই নেওয়া যায়। গোপন আসলে থাকে না। কিছুই গোপন থাকে না। কিন্তু যা-কিছু ঘটে দু-জন মানুষের মনে মনে, তার একটুও কি কেউ আঁচ করতে পারে? প্রতিপক্ষ লোকে ভুল দেখে ভুলে বোঝে এবং এক-অষ্টমাংশ ভেসে-থাকা হিমবাহর টুকরোটুকু দেখেই সব-ই দেখেছে এবং জেনেছে বলে ভাবে! রাজেশ খান্নার মুখে সেই বিখ্যাত গান শোনোনি? ও ছোঁড়া বেকার বাঁতে। লোগো কো কহেগা লোগোকো যো কাহনা”।

আপনার মতো মানুষের মুখে এইসব ভাষা, গান ভালো লাগে না।

মস্ত ভুল। ‘আমার মতো’, তোমার মতো’ বলে কোনো আলাদা মানুষ নেই। সব মানুষ-ই সমান। ভাগ শুধু দুই। ভালো আর মন্দ। তা ছাড়া, ভাষা নানারকম হয়, মনের ভাবকে প্রকাশ করার জন্যে। যে-অভিব্যক্তি, যে-শব্দ বা বাক্য ছাড়া প্রকাশ করা যায় না, তা ব্যবহার না করলে সে-অভিব্যক্তি অব্যক্তই থাকে। প্রকাশিত হয় না। ভাষা নিয়ে বাতিকগ্রস্ততা সুস্থমনের পরিচায়ক নয়।

বলেই, অমু থেমে পড়ে বলল, বাঃ। সামনের এই বিস্তীর্ণ মাঠটি তত বেশ। এ কি গলফ এর কোর্স নাকি?

হ্যাঁ। কী দারুণ দেখেছেন আমাদের গোলমুড়ি!

মুড়িকে কোনোদিন চৌকো হতে দেখিনি বটে। তবে তোমাদের গোলমুড়ি নীলডি সত্যিই সুন্দর। কিন্তু তোমাদের গলফ কোর্সটি যাচ্ছেতাই।

তাই?

হ্যাঁ।

কেন?

মজফফরপুরের কোনো সান-ট্যানড় মধ্যবয়সি মানুষের মাথার টাকের মতো এ-মাঠ। গলফ-লিঙ্কস দেখবে তো কলকাতায় এসো ‘আর. সি. জি. সি.’ বা ‘টলি’-তে। অথবা চলে যাও শিলঙে। বা ডিগবয়ে। পূর্বী না হলে, চাপ চাপ দুব্বো ঘাস না হলে, খেলার মজাই হয় না। তা সে কোর্স, নাইন হোলের-ই হোক আর কম হোলের-ই হোক। একসময় তো আমিও গলফ খেলতাম। যখন বড়োলোক ছিলাম।

কী জানি! আমি তো গলফ খেলি না। ও খেলে, ওই জানে।

ম্যাচ খেলার সময় আসো তো দেখতে? তোমার স্বামী দুর্বার যখন খেলে? চ্যাম্পিয়নশিপে? তোমার স্বামীর নামটা ভারি পছন্দ আমার। কিন্তু মানুষটি একেবারেই তোমার আঁচলধরা। সে-দিক দিয়ে ওর নামটিও একটি ট্র্যাজেডি। কই বললে না, গলফ খেলা দেখতে আসে কি না?

তা আসি।

কী দ্যাখো?

মানে?

ম্যাচ? না কাঁচাপাকা জুলফির ছোটোশর্টস পরা নানা পুরুষের সুগঠিত পা।

অসভ্য আপনি।

আমি সবচেয়ে বেশি সভ্য। তোমাদের অভ্যেসের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে সাহায্য করি আমি। সত্যি স্বীকার করতে বড়োভয় তোমাদের। কী করবে না করবে–কী করা উচিত না উচিত ভাবতে ভাবতেই আঁজলা গলে তোমাদের জীবন গড়িয়ে পড়ে যায়। যা বাকি থাকে তা একঘেয়েমি, হা-হুঁতোশ, পেছন ফিরে তাকানো। জীবন এক ধরনের জলীয় পদার্থ। আঁজলা গলে গড়িয়ে গেলে তা আর কুড়োনো যায় না। তারপর বেলা বাড়ে। বেলা পড়ে। কী দুরন্ত গতিতে যে, আমাদের এই একটামাত্র জীবন ফুরিয়ে আসে, তা ফুরিয়ে এলেই শুধু বোঝা যায়। বাইরে ধুলো ওড়ে। ধুলোয় খড়কুটো। আর তারমধ্যে ঘূর্ণির মতো ওপরে উঠে নাগালের বাইরে চলে যায় তোমাদের অতীত। আমাদের অতীত। সবাকার অতীত। যে-অতীত তামাদি হয়ে গেছে! বড়োদুঃখ হয় তখন। অথচ করার কিছুই থাকে না। দ্যাখো। সুপুরুষের সুগঠিত পা দেখলে পাপ নেই। কিছুতেই পাপ নেই। পাপ নিজেকে বেঁধে রাখায়; নিজেকে কষ্ট দেওয়ায়। এই ছোট্টজীবনে পরিতাপ করার সময় নেই। বাঁচো। প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচার মতো বাঁচো।

বড্ড মন খারাপ করে দেন আপনি, অমুদা।

মানুষের-ই মন থাকে। এবং থাকে বলেই, সে-মন মাঝে মাঝে খারাপ হয়। যা-কিছুই সত্যি তারমধ্যেই মিথ্যেও সুপ্ত থাকে। কখনো সত্যিটা মন খারাপ করায়; কখনো মিথ্যেটা। কী করা যাবে!

দামুদা কিন্তু দলমা পাহাড়ে পিকনিকের বন্দোবস্ত করেছেন আপনার অনারে। রবিবারে।

তাই?

তুমিও যাবে তো? শ্রেয়া, শ্রমণা, জ্যোৎস্না, জয়িতা এবং তাদের স্বামীরা?

স্বামীরা যে আমাদের, আপনার সঙ্গে একা ছাড়বার মতো বুদ্ধিহীন এমন মনে করবেন না। তবে মজার কথা এই যে, আমাদের প্রত্যেকের স্বামীরাও আপনার প্রেমে পড়েছেন। এটা একটা ফ্যান্টাসটিক ব্যাপার! এমনটি ঘটে না সচরাচর।

সে কী? সে তো ভালো কথা নয়। মন্দলোকে এর খারাপ মানে করতে পারে।

খুব-ই মজা লাগছে ভাবলেই যে, একটা পুরোদিন একসঙ্গে কাটানো যাবে আপনার সঙ্গে। দলমাতে।

তারপর-ই বলল, জানেন, সেদিন দলমা থেকে একটি হাতি নেমে হাইওয়েতে একটি মারুতি গাড়িকে চেপটে দিয়েছে। বাস তাড়া করেছে। পরে নাকি হাতিটাকে মারাও হয়েছে। কী অন্যায়।

তুমি বুঝি হাতি খুব ভালোবাসো?

খুব।

আমাকে কি হাতির মতোই ভালোবাসো? না তার চেয়ে একটু কম?

ইয়ার্কি ভালো লাগে না সবসময়। ভালোবাসার মতো সূক্ষ্ম একটা ব্যাপারের মধ্যে, কবি হয়ে আপনার হাতি এনে ফেলতে লজ্জা করল না?

আমার নাম ষষ্ঠীচরণ, যিনি হাতি লোফেন যখন-তখন। জানি না, তোমরা সকলেই আমাকে হাতির মতো ভালোবাসলে কেন?

আমরাও ঠিক জানি না। কালকে শ্ৰমণার সঙ্গে আপনার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। সত্যি! আপনি একজন পূর্ণ মানুষ।

হাঃ হাঃ খুব জোরে হেসে উঠল অমু ঘোষ। বলল, জোক অফ দ্যা ইয়ার ইনডিড। আমার স্ত্রী রানি তো বলেন আমি একটি বিদূষক। ভাঁড়। এন্টারটেইনার। ওইটুকুই আমার দাম। আর কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই আমার, এ-সংসারে। যদি বিদূষকের বা ক্রাউনের দরকার হয় কখনো, ডেকো তাকে। পূর্ণ পুরুষ! আর এখন মরলেও আমার কোনো দুঃখ নেই। এই উপাধিটি আমার বুকে বাঁধিয়ে দিতে বোলো শ্রমণাকে।

মিথ্যে কথা বলেন বড়োই আপনি বানিয়ে বানিয়ে। মিথ্যে কথা বলাটাই আপনার অবসর বিড়োদন। আপনি বিদূষক, একথা কোনো মানুষ-ই বলতে পারেন না। আপনার স্ত্রী তোনন ই। আপনার মতো স্বামী পেলে যেকোনো মেয়েই…।

আমার স্ত্রী মস্ত বড়ো মানুষ। ভালো মানুষ। কবির এই কাছা-খোলা বাউণ্ডুলে অবাস্তব স্বভাবের কারণে তাকে অনেক-ই দুঃখ দিয়েছি। তাই হয়তো বলে। তবে আমি কবি। আমার জাত আলাদা। তাই কুজাত বা বজ্জাতও অনেকে বলেন। সত্যিটাকেও এমন সুন্দর করে বলি যে, তা মিথ্যের মতো শোনায়। অথবা উলটোটাও বলতে পারো। একজন গোলা কাঁঠালের মহাজন বা কালোয়ারের কথার সঙ্গে আর একজন কবির কথার সঙ্গে তফাত তো কিছু থাকবেই! নাকি থাকবে না?

মোটেই না। আপনি সবসময়-ই সুন্দর করেই বলেন। ঈশ্বরের দান এ। আপনার কথা। দুর্বার তো চমৎকার ছেলে। কৃতী। বড়োলোক। বড়ো চাকুরে। প্র্যাকটিকাল। দায়িত্ববান। স্ত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সবসময়। তার তো হীনম্মন্যতা থাকার কথা নয় কোনোরকম, তারও আমাকে ভালোলাগার কারণ তো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যাপারটা সন্দেহজনক।

সব-ই ঠিক। তবু।

অগ্নিশিখা, তোমার নিজের কখনো দুর্বার ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগেনি? বিয়ের পর? কারো জন্যে একটু দুর্বলতা? না দেখতে পেলে মন খারাপ হওয়া? চিঠির জন্যে বার বার শূন্য লেটার বক্সে কারো চিঠির আশায় হাত ঢুকিয়ে নিজেকে অভিশাপ দাওনি কি কখনো? সত্যি করে বলবে?

একটুক্ষণ চুপ করে থাকল তোড়া। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বলল, আপনাকে মিথ্যে বলব না। কারণ মিথ্যে বলা যায় না আপনাকে। অদ্ভুত বাজে লোক আপনি একটা! আপনি র‍্যাসপুটিন!

কী বললে? র‍্যাসপুটিন! হাঃ হাঃ। তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ক। এ-কথা যদি কখনো সত্যি হত!

তবে র‍্যাসপুটিনের মতো হতে হয়তো সব পুরুষের-ই সাধ যায়। তাতে তার যে, শাস্তিই হোক-না-কেন। কিন্তু আমি র‍্যাসপুটিন নই। হতে পারব না কখনো। হতে চাইও না। হলে, বড়োজোর হতে পারি কোনোদিন ডরিয়ান গ্রে। যে-মানুষের বিবেক, বাড়ির গভীরের ঠাণ্ডা অন্ধকার সেলারে তার মুখের ওপরে, তার প্রকৃত চরিত্রর ছাপ এঁকে দিয়ে দিয়ে তাকে। বাঁচিয়ে রাখে, নষ্ট হলেও নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে।

অগ্নিশিখা, এমন কে কবি আছে বলো যে, একা ঘরে নীরবে কেঁদে বলে না যে, প্রভু নষ্ট হয়ে যাই। এমন কোন কবি আছে যে, ঠোঁট কামড়ে নিজের দাঁতে তা রক্তাক্ত করে চোখের ধারা বওয়ায় না? আমরা তো সব ভেতো বাঙালি! এখানে পিকাসো, গঁগা, বোদলেয়র, সেজান, হুইটম্যান, হেমিংওয়ে, রবার্ট ফ্রস্ট, এমনকী রিচার্ড বাখও নেই। সে-রক্ত, সে-জেদ, সেই রক্তক্ষরণের সাহস আমাদের কারোরই নেই। হবেও না আগামী পঞ্চাশ বছরে। হবে না, যতদিন, এ-দেশের মেয়েরা কবিদের যোগ্য মর্যাদা দেবে। তোমাদের জন্যেই একটি প্রজাতির পুরুষজাত পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। তবু শেষে বলি, র‍্যাসপুটিন হওয়ার বাসনা আমার নেই। যাই-ই পাই, তাই-ই আমি গ্রহণ করি না। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আমি কবি হইনি। অন্যের কষ্টকে ‘ফুল’ করে ফুটিয়ে তোলাই আমার সাধনা। সব কবির-ই সাধনা।

এবার বলো, তুমি কি দুর্বার ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসোনি? বিয়ের পরে? তার কথা বলো, যার কথা বলছিলে।

একবার-ই হয়েছিল। মুম্বইতে। তখন মুম্বইতেই থাকতাম। একটি পাঞ্জাবি ছেলে। ব্যাচেলার। ওদের-ই কোম্পানির। ভাবি’ ‘ভাবি’ করত। একসঙ্গে খেতে বসে আমার জন্যে মাছ, কী ভালো রান্না, যথেষ্ট পরিমাণে রইল কি-না, তা দেখা থেকে আমাকে কোন শাড়িতে কেমন দেখায়, কোন জামা, শাড়িতে। কোন ফুল যায়, এইসব-ই নজর করা, প্রায় ওর প্রি অকুপেশানই ছিল বলতে পারেন। অথচ দুর্বার কখনো কোনোদিন মাথা ঘামায়নি এসব ব্যাপার নিয়ে। সব স্বচ্ছল মানুষের জীবন-ই এখন যেমন হয়, গাড়ি, ভি সি আর, কালার টি ভি, ইত্যাদি ইত্যাদি; প্রতি শুক্রবার বা শনিবারে পার্টি। আমার হাতে যখন যা-চাই, তা দেওয়া। এসব-ই দুর্বার করে। স্বচ্ছল ও সচ্চরিত্র স্বামীদের যে, অন্য কোনো দোষ বা অপূর্ণতা থাকতে পারে, এমন কথা আমি কেন, অন্য কোনো মেয়েই ভাবে না অমুদা। কারণ ভাবনার কোনো অবকাশ-ই ঘটে না। সংসারের জাল এমন-ই। তবে যখন-ই একটু ফাঁক পাই, তখন-ই একটি বই নিয়ে হয়তো বসি। বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগত। আপনিও আমার প্রিয় কবি ছিলেন। আপনার কিছু কিছু কবিতা পড়ে মন, বড়োখারাপ হয়ে যায়। ঝড় ওঠে মনে। আপনি মানুষটি মানুষ হিসেবেও যেমন ডিস্টার্বিং কবি হিসেবেও তেমন-ই।

পাঞ্জাবি ছেলেটির কথা বলো। একটি সিগারেট ধরিয়ে অমু বলল।

ছেলেটির কাছে আমার কখনো কিছু চাইতে হয়নি। ও বুঝতে পারত নিজে থেকেই, আমার কখন, কী দরকার! কখন আমার পারফুম ফুরিয়ে গেছে, কখন আমার উইকএণ্ডে একটু কাছাকাছি বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে করছে, কখন লং-ড্রাইভে যেতে ইচ্ছে করছে, ও সব-ই বুঝতে পারত। কখন আমার মাথা ধরেছে বা কখন আমি বিরক্ত হয়েছি তাও ও, আমার মুখ দেখেই বুঝতে পারত।

ছোকরা নিশ্চয়ই খুব ফাঁকিবাজ ছিল। দুর্বারের মতো অত খাটতে হলে আর পরস্ত্রীর পরিশ্রম আর মাথাধরা নিয়ে নিজের মাথা খাটাবার সময় থাকত না। কী বল?

একদম-ই ভুল কথা। আর অমুদা, আপনি ওকে ‘ছোকরা’ বলবেন না।

কেন?

‘ছোকরা’ কথাটার মধ্যে একধরনের অপমান এবং তাচ্ছিল্য জড়ানো আছে।

আছে বলেই তো বলেছি। প্রিসাইসলি, সেই কারণেই।

এটা অন্যায়।

একটুও নয়। যে তোমাকে ভালোবেসেছে, সে আমার শত্রু। প্রয়োজনে তার সঙ্গে আমি ডুয়েলও লড়তে পারি।

হেসে উঠল তোড়া জোরে। পথ-পাশের গাছগাছাল, চতুর্থীর চাঁদ নড়ে-চড়ে উঠল যেন, হাসিতে। ঠিক সেইসময়ে একটা কালো বেড়াল হঠাৎ ডান-দিক থেকে বাঁ-দিকে গেল, পথ পেরিয়ে সামনে দিয়ে।

ও মাঃ গো! বলে জড়িয়ে ধরল তোড়া অমুকে মুহূর্তের জন্যে।

তারপর-ই লজ্জা পেয়ে ছেড়ে দিল।

বলল, বিচ্ছিরি। অলুক্ষণে। বাঘের মতো দেখতে। কীরকম ভূতুড়ে-হলুদ চোখ।

বুদ্ধদেবটা থাকলে ভালো হত। অমু বলল।

ওঁরা তো আসবেন পঁচিশে শুনেছি! ছাব্বিশে কী একটি অনুষ্ঠানে।

হুঁ।

আমাকে ডাকেনি কমল।

উনি কি সত্যিই শিকার-টিকার করেছেন কখনো?

কার কথা বলছ?

বুদ্ধদেব গুহর।

জানি না। তবে ও নিজে বলে, শহরে শিকার হল না বলে, প্রায় শিশুকাল থেকেই বনেজঙ্গলে ঘোরে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, কেন? তুমি বুদ্ধদেবের লেখার ভক্ত?

একদম না। এখানে কিছু বোকা বোকা মহিলা আছেন, তারা খুব ভক্ত। আসলে সাহিত্যের কিসসু বোঝেন না।

এবারে আমার কথাটির উত্তর দাও। বুদ্ধদেব-ফুদ্ধদেব ভুসিমালের নাম এনে আমার কনসেনট্রেশান নষ্ট কোরো না। আমি কিন্তু সত্যিই ডুয়েল লড়তে পারি সেই ছেলেটার সঙ্গে।

তোড়া বলল হাঃ। আপনি আমাকে ভালোবাসেন এ-কথা বিশ্বাস করব। আপনি আসলে একটি ফ্লার্ট। সকলকেই আপনি দেখান যে, ভালোবাসেন। আপনি জীবনে একজনকেও ভালোবেসেছেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। আসলে আপনি নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।

কী জানি! বুঝে উঠতে পারলাম না এখনও।

আমি ওকেও, মানে ওই ছেলেটিকেও ঠিক ভালোবেসেছিলাম কি না জানি না। জানেন অমুদা।

ভালোবাসা ব্যাপারটা তো এককথার নয়। কত্তরকম থাকে ভালোবাসার। প্রত্যেক বিবাহিতা মহিলার-ই, এক বা একাধিক প্রেমিক থাকা ভালো কিন্তু সবদিক বিচার করেই বলছি।

জানি না। তবে ওর কথা এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়। চিঠিও লেখে মুম্বই থেকে মাঝে মাঝে। আমাকে বলে, লিখলে যেন, অফিসের ঠিকানাতে লিখি। এখন বিয়ে করেছে তো। স্ত্রী সব চিঠি খুলে পড়েন।

একবার লিখেছিল, ভাবি, ভেবেছিলাম বিয়ে যদি কখনো করি তো তোমার মতো মেয়েই বিয়ে করব। আমার বউ বাইরে থেকে চেহারা-ফিগারে প্রায় তোমার-ই মতো। কিন্তু আর কোনোই মিল নেই। জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল। ডিভোর্স করার মতো মনের জোর, সমাজকে তোয়াক্কা না করার জোর আমার নেই। ছেলেটা এসে গেছে। ওর কী দোষ? ওর মুখ চেয়েই পারব না। তবে সোনিয়া, আমার বউ হয়তো পারবে। ওর চরিত্র নুড়ির মতন। পাহাড়ি নদীর নুড়ি। মাটি লাগে না। ঘাস, পাতা, কাদা কিছুই লেগে থাকে না তাতে। সে কোনোরকম পিছুটান ছাড়াই গড়িয়ে যায় নদীর স্রোতের সঙ্গে এক বাঁক থেকে অন্য বাঁকে! আমার স্ত্রীর এক প্রেমিক আছে। হরবিন্দর। ছেলেটা ভালো। বিয়ে করলে ও মরবে। সোনিয়া বহলতা নদী। সোঁতা নয়। প্রেম করা এক আর বিয়ে করা অন্য। তবে ছেলেকে আমার কাছে রেখে দিতে রাজি থাকলে, আমি কাল-ই সোনিয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। শুনেছি, উকিলের বাড়ি যাওয়া-আসাও করছে। খবর শিগগিরই হবে। খবর হলে জানাব। মন ভালো লাগে না। তোমার যে, ফোটো ক-খানি আছে তাই মাঝে মাঝে একা বাড়িতে বসে দেখি। ভালো আছ তো ভাবি?

ওর চিঠি পড়ে বড়ো মন খারাপ হয়ে যায়, আপনার কবিতা পড়ে যেমন হয়। জানেন, প্রত্যেক চিঠির শেষে ও লেখে; “তোমার চিরদিনের খিদমদগার’। ও উত্তীয় যেন, আমার। আমি শ্যামা। একবার ওর এখানে, মানে জামশদেপুরে, ট্রান্সফার হয়ে আসার কথা হয়েছিল। পরে শুনেছিলাম বলতে লজ্জা করছে কথাটা যে, দুর্বার-ই কলকাঠি নেড়ে তা বানচাল করে দেয়। আমার স্বামী আসলে উদার নয়। খুব কম স্বামীই উদার। ঔদার্যের মুখোশ পরে থাকেন সবাই।

বজ্ৰসেন কেউ আসেনি জীবনে তাহলে?

একটু চুপ করে থেকে বলল অমু। সিগারেটের ধুয়ো ছেড়ে।

নাঃ। যার জন্যে, সব ছেড়ে ভেসে চলে যাওয়া যায়, তেমনি পুরুষ এই জন্মে দেখলাম-ই না! সেসব পুরুষ স্বপ্নেই থাকে। ভাগ্যিস।

সামনের বাড়িতে বোধ হয় কোনো পার্টি-টার্টি আছে। অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। অমু বলল।

বাঃ। এটাই তো হিতুদার বাংলো। আপনার-ই অনারে তো পার্টি।

‘আমার অনারে পার্টি’ –কথাটা শুনলে কেমন, সুড়সুড়ি লাগে।

তা লাগলেও কথাটা সত্যি। আপনি তো অনারেবল বটেই।

কারা আসছেন?

তা হিতুদা নিশ্চয়ই অনেককেই বলেছেন।

এই রে!

কেন? এই রে কেন?

যাদের চিনি, শুধু এখানেই নয়, সবখানেই, তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে পারি না। সময়ের-ইএত অভাব। সত্যিই অভাব। তাই জানা-চেনার পরিধি আর বাড়াতে ভালো লাগে না। অথচ জেনুইনলি আমি মানুষজন ভালোবাসি। গল্প করতে মজা পাই। মানুষেরা, মনে হয় স্ত্রী-পুরুষ-শিশুনির্বিশেষে আমাকে পছন্দও করেন। তবু শুধুই সময়াভাবেই গুটিয়ে রাখি নিজেকে। অন্যে, অসভ্য অসামাজিক এমনকী অভদ্রও বলেন। দুঃখও কম পাইনি জীবনে নানা-জনের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ করতে মন চায় কিন্তু আমার অপরাগতার কথা আমি জানি আর ঈশ্বর-ই জানেন। প্রতিবাদ করিনি, করি না কারণ, করলে অন্যকে আহত করা হয়। সব অসামাজিকতা, অভদ্রতা, অসভ্যতার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই বয়ে বেড়াই। এতসব কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। কাউকে। বললেও বোঝে না কেউ। তোমাকে বললাম। হয়তো তুমি বুঝবে।

তোড়া দারুণ হাসি-খুশি মজার প্রাণবন্ত এই পুরুষটির বুকের মধ্যে কোথাও যে, পাথর চাপা কিছু আছে সে-সম্বন্ধে বুঝতে না পারলেও অনুমান করতে পারল। এই প্রথমবার দুঃখও হল মানুষটার জন্যে। যে, মানুষটা এখানে তিন-চারদিন এসে ওঠার পর থেকে তারমধ্যে সম্পূর্ণতার সংজ্ঞা খুঁজে পেয়েছেন যাঁরাই মিলিত হয়েছেন, তার সঙ্গে তার সত্তাও যে, অখন্ড নয় এ-কথা জেনে মন খারাপ হয়ে গেল। দুঃখ নেই, এমন মানুষ-ই বোধ হয় নেই। তবে প্রত্যেকেরই দুঃখের রকম আলাদা আলাদা।

ভাঙাচোরা আছে যে, অমু ঘোষ-এর হৃদয়েরও ভেতরে, এ-কথা হৃদয়ে উপলব্ধি করে বড়োই মন খারাপ লাগতে লাগল তোড়ার। আবার আনন্দও হল। সকলের বুকেই যখন পাথর চাপা দুঃখ থাকে তখন, এই মানুষটাই বা অন্যরকম হবে কেন? তোড়ার এবং অগণ্য নারী-পুরুষের দুঃখের সেও ভাগীদার হোক। তা ছাড়া এতবড়ো কবি, দুঃখ ছাড়া কবিতা লিখবেন-ই বা কী করে? দুঃখ ছাড়া কী, কিছু হয়? তোড়া যখন-গান গাইত এবং মোটামুটি ভালোই গাইত তখন একথা বুঝেছিল। কখনো-কখনো বাথরুমে গায় এখনও। নগ্ন শরীর, সাবান, শ্যাম্পুর ফেনা, খোলা কলের একটানা ঝরঝরানি, বাগানের বুলবুলির শিস তাকে যখন, ক্ষণকালের জন্যে উন্মনা করে তোলে তখন তোড়া গান গায়। গান গাইবার পরিবেশ চাই। শোনবার মতো আগ্রহী মানুষ চাই। দুর্বার গান একেবারেই ভালোবাসে না। এমনকী ওর সামনে কেউ গান গাইলে ও বিরক্ত হয়। মনে পড়ে গেল তোর, ওদের বাড়ির বেডরুমের দরজায় চাপা পড়েছিল একটি টিকটিকি। সে তিল তিল করে দেওয়ালের এক-ই জায়গাতে ঝুলে থেকে শীর্ণ হতে হতে একদিন প্রায় উবেই গেল। তেমন-ই গেছে তোড়ার গান।

হঠাৎ-ই, একেবারেই হঠাৎ, বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছাড়াই বুকের মধ্যেটা দুমড়ে উঠল তোমার এই দীর্ঘদেহী, অসুন্দর মানুষটির জন্যে। হিতুদার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে এখন ওরা। মধ্যে থেকে অ্যালসেশিয়ান ডাকছে গম্ভীর গলায় ঘাউ ঘাউ করে। গেটেও কুকুরের ছবি। লেখা আছে ‘Beware of Dogs বিখ্যাত কবি অমু রায়ের মুখের দিকে মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের কৃত্রিম বাদামি ঔজ্জ্বল্য এবং মানুষের পদদলিত চাঁদের স্নান নীলচে আলোয় তাকাল তোড়া একবার। তারপর বলল, চিঠি লিখলে চিঠির জবাব দেবেন তো? অমুদা?

ঘোর ভেঙে অমু বলল, নিশ্চয়ই। আমি প্রত্যেককেই জবাব দিই চিঠির। তোমাকে দেব না? তবে লেখার কিছু থাকলেই লিখো।

‘আমি ভালো আছি। আপনি কেমন? এখানে গরম পড়িতেছে। নমস্কার জানিবেন।‘

এইরকম লিখো না।

যদি ভালো থাকো তো কতখানি ভালো আছ এবং কতখানি নেই এবং কেন নেই তাও জানিয়ো। যদি গরম পড়ার কথা লেখো, তাহলে পলাশ, শিমুল ফুটল কি না এবং কোকিল ডাকছে কি না তাও জানাতে ভুলো না। কথা সাজালেই চিঠি হয় না; ‘হৃদয়ের পাঞ্জার ছাপও যেন তাতে থাকে। বুঝেছ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *