অভিন্ন ঔরসের দুই গর্ভজাত : দুই পথ
সুলতান সুবক্তগীনের মৃত্যুর পর মাহমূদ পিতার দাফন কাফন সেরে পুনরায় নিশাপুর চলে গেলেন। পিতার অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন মাহমূদ। তাছাড়া তাদের মোকাবেলায় চতুর্দিকের রণপ্রস্তুতি সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিলেন তিনি। পিতার রেখে যাওয়া মিশন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পিতৃহারা শোককে তিনি শক্তিতে পরিণত করতে সৈন্যবাহিনীর প্রতি নজর দিলেন। গজনী গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের রুটিন ওয়ার্ক করাটাকে তিনি গৌণ মনে করলেন। তার বিশ্বাস ছিল, প্রশাসনিক যন্ত্র ঠিকমতই কাজ করবে। কেননা তার পিতার জীবদ্দশায় প্রশাসনের কোথাও উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ঘটতে তিনি দেখেননি। তাই রাজধানীতে গিয়ে রাজকীয় আয়েশে বিভোর হওয়ার কথা তার চিন্তায় মোটও স্থান পায়নি। তার মনে হয়নি, কারো পক্ষ থেকে প্রশাসনে কোন ঝামেলা কিংবা অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। গজনী যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন মাহমুদ।
মাহমুদ ছোটবেলা থেকেই বিলাস বিমুখ। পরিশ্রমী, সত্যাশ্রয়ী। মিথ্যা, প্রতারণা, ধোকাবাজি ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন মাহমূদ। সমকালীন বিখ্যাত সূফী ও বুযুর্গ আবুল হাসান খারকানীর প্রিয়ভাজন মুরীদ ছিলেন মাহমূদ। আবু সাঈদ আব্দুল মালেক নামের একজন বিশিষ্ট বুযুর্গ, আলেম ব্যক্তির সাথেও তার হৃদ্যতা ছিল। তিনি প্রায়ই কিরখানীর দরবারে উপস্থিত হতেন উপদেশ ও নসীহত নিতে। আর আবু সাঈদ প্রায়ই মাহমূদ-এর সাক্ষাতে আসতেন। বস্তুত আলেম, বুযুর্গ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিদের সংশ্রব ও সান্নিধ্য তিনি পছন্দ করতেন। তার সময়ে অস্থিরতার মধ্যেও ইলম্ ও জ্ঞানের চর্চায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল অবারিত। ইলম্ তথা কুরআন-হাদীস-ফেকাহ ও ইসলামী তাহযীব-তমদ্দন চর্চায় তাঁর সাহায্য ছিল মুক্তহস্ত। তাঁর দরবারে সর্বক্ষণ। জ্ঞানী-গুণী ও আলেম-বুযুর্গ ব্যক্তিদের সরব পদচারণা ছিল । তাদের যথার্থ মর্যাদা ও সম্মান করা হতো। মাহমূদ কোন বুযুর্গ আলেমের সম্মানে সিংহাসন ছেড়ে রাস্তায় এসে তাকে স্বাগত জানাতেন।
পিতৃবিয়োগে শোকাতুর হওয়ার অবকাশ হয়নি মাহমূদের। রাজা জয়পাল ও জয়পালের প্রতিশোধ গ্রহণে মাহমূদ ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি জানেন, মূর্তিপূজারীরা শেষ লড়াইয়ে সকল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকে প্রতিরোধ ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হল। তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি যে, তোষামোদ ও মোসাহেব গোষ্ঠী সালতানাতের ভিত কুরেকুরে ঘুণ পোকার মতো খেয়ে ফেলছে। তারা ভেতর থেকে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে গজনীর সুলতানী, আর রাজকোষ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি যখন খবর পেলেন, গজনীর ক্ষমতায় এখন মাহমূদের বৈমাত্রেয় ভাই ইসমাঈল সমাসীন এবং সে নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেছে আর মোসাহেবদের জন্য সে রাজভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছে, রাষ্ট্রের সম্পদ তারা দু’হাতে লুটে নিচ্ছে। তখন পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। এক গোয়েন্দা তাকে এ সংবাদ জানিয়েছিল।
ইসমাঈল ছিলেন সুলতান সুবক্তগীনের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান। সুবক্তগীনের মৃত্যুশয্যায় পাশে ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী। অন্তিম মুহূর্তে আপন পুত্রের পক্ষে সুলতানীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তির উইলে সুলতানের দস্তখত করিয়ে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী। মাহমূদ পিতার দাফন কাফন সেরে নিশাপুর চলে গেলে সুলতানের দ্বিতীয় স্ত্রী উইলপত্র দেখিয়ে কতিপয় মোসাহেব, আমলা ও স্বার্থপর শ্রেণীর যোগসাজশে মাহমূদকে অবহিত না করেই ইসমাঈলকে সুলতানের আসনে বসিয়ে দেয়া হল। উইলপত্রে সুলতানের মোহরাংকিত প্রমাণ ও স্বাক্ষর দেখে অনেকেই অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ দ্বিতীয় পুত্রকে সুলতানের উত্তরাধিকার হিসেবে বিনা বাধায় মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অজ্ঞতার পর্দা উন্মোচিত হতে বেশি দিন লাগেনি। কিছুদিনের মধ্যেই স্বরূপে আবির্ভূত হল ইসমাঈল।
প্রমাণ হয়ে গেল, একই পিতার ঔরসজাত হলেও দু’মায়ের গর্ভজাত দু’ভাইয়ের মত ও পথ ভিন্ন। ভিন্ন তাদের দৃষ্টি, রুচি এবং লক্ষ্য।
একদিকে মাহমূদ পিতার পদাংক অনুসরণ করে হিন্দুস্তান আক্রমণ ও হিন্দু আগ্রাসন প্রতিরোধে সৈন্যবাহিনী তৈরিতে রাত-দিন ব্যস্ত আর অপরদিকে ইসমাঈল বলখে তখতে আসীন হয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানের ধুমধামে ব্যস্ত, মোসাহেবদের নিয়ে ভোগবিলাসে নিমজ্জিত।
সুলতান আলী মাকাম! গজনী থেকে আগত এক প্রবীণ গোয়েন্দা অফিসারের সম্বোধন।
খবর কি জনাব! গজনী থেকে কি জরুরী কোন খবর নিয়ে এসেছেন? আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলেন মাহমুদ।
জ্বী হ্যাঁ! আমি গজনী থেকে জরুরী সংবাদ নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আমাদের দুশমনদের বিরুদ্ধে আপনি রাত-দিন যুদ্ধ প্রস্তুতিতে লিপ্ত রয়েছেন। ওরা আমাদের দেশ কজা করতে চায়, আমাদের ধ্বংস করতে চায়, কিন্তু এখন আর হিন্দুস্তানের রাজাদের হামলা করার দরকার হবে না, আমরাই আমাদের ধ্বংসের সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফেলেছি। আপনি আর আপনার মরহুম পিতা হিন্দুদের নাকানি চুবানি খাইয়েছেন। ওরা এখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে। জাতি এখন কঠিন সন্ধিক্ষণ অতিবাহিত করছে।
অথচ ইন্তেকালের আগে আপনার পিতা নিজেই আমাদের সালতানাত ধ্বংসের সব ব্যবস্থা করে গেছেন।
“আপনাকে মরহুম সুলতানের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আমি সুলতান বলে সম্বোধন করেছি, কিন্তু আপনি জানেন না, আমাদের সুলতান আপনি নন আপনার বৈমাত্রেয় ভাই ইসমাঈল এখন গদীনসীন। আমি আপনাদের একজন নগণ্য খাদেম। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে আমার নাক গলানো হয়তো অনুচিত। কে ক্ষমতায় আসীন হলো, ছোট ভাই না বড় ভাই তা মনোনীত করার দায়িত্ব হয়তো আমার কর্তব্যের আওতা বহির্ভূত। কিন্তু দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে দরবারে আগে সেনাপতি ও জেনারেলগণ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুলতানের দিক-নির্দেশনা ও শলা-পরামর্শের জন্য আসতেন, বর্তমানে সেই নিবেদিতপ্রাণ সেনাপতি জেনারেলদের স্থান দখল করেছে মোসাহেব, চাটুকার ও স্বার্থান্বেষী আমলাশ্রেণী । আপনার পিতার সময় থেকে হক ও সত্যের পথের যাত্রী এবং বিশ্বস্ত খাদেম হিসেবে বলছি, জানি না আপনার ছোট ভাইয়ের মূল পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টা কে, তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছি যে, তার ঘাড়ে চেপে বসেছে স্তাবক, স্তুতিবাজ ও কুচক্রীমহল। ধান্ধাবাজ ও স্বার্থান্বেষী মহল এখন দরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে, কর্তব্যপরায়ণ ও যোগ্য লোকদের পরিবর্তে ধূর্ত ফাঁকিবাজরা পাচ্ছে পদোন্নতি, সৈনিকদের বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর কমান্ডিং পদে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমাকে ট্রেজারীর এক বিশ্বস্ত কর্মকর্তা বলেছে, রাজকোষ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।”
অনাকাক্ষিত সংবাদের ভয়াবহতা ও গুরুত্ব মাহমূদের মাথায় যেন আসমান ধসিয়ে দিল। তিনি প্রবীণ এই কর্মকর্তাকে দিক নির্দেশনা এবং আরো গভীরের বাস্তবচিত্র সগ্রহ করে দ্রুত সংবাদ প্রেরণের নির্দেশ দিয়ে গজনী যেতে বললেন। নিজে দ্রুত হাজির হলেন মায়ের কাছে। ঘটনার ইতিবৃত্ত তাকে শোনালেন। মাহমূদ বললেন, “মা! গজনী ত্যাগ করাই আমার উচিত হয়নি। কিন্তু মসনদের লালসা আমার মনে ছিল না, আমি তো সুলতানীর গদি দখলের চেয়ে জাতির মর্যাদা ও নিরাপত্তা বিধান গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছি।”
“না মাহমূদ! গজনী যাওয়া তোমার ঠিক হবে না। তোমার ভাই তোমাকে হত্যাও করতে পারে। ক্ষমতার লালসা আর নেতৃত্বের মোহ মানুষকে অন্ধ, উন্মত্ত করে তোলে। একথাও ভেবে দেখো, সেও তোমার পিতার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। তুমি তাকে সুলতান হিসেবে থাকতে দাও, তবে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিজের হাতে রাখ।”
“সে যদি সালতানাতের দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতো তাহলে আমি এতো পেরেশান হতাম না। মা! আপনি কি জানেন না, সে কত দুর্বল চরিত্রের মানুষ। আমাকে আমার পীর ও মুর্শিদ বলেছেন, অযোগ্য ও অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের পাপের সাজা গোটা জাতিকে ভুগতে হয়। আমি সুলতান হতে চাই না মা! কিন্তু সালতানাতকে আমার বাঁচাতে হবে। আমার দেশকে একটি ইসলামী অপরাজেয় দুর্গে পরিণত করে হিন্দুস্তানের ভূতখানাগুলোতে ইসলামের আলো পৌঁছাতে হবে।
আমার ভাই কল্যাণকামী ও বুদ্ধিমান হলে তার অভিষেক অনুষ্ঠানে অবশ্যই আমাকে দাওয়াত জানাত। সে আমাকে দাওয়াত দেওয়া তো দূরের কথা এ সংবাদ আমার জানার সব পথও বন্ধ করে দিয়েছে। তাতেই বোঝা যায়, তার উদ্দেশ্য সৎ নয়। আমাকে গজনী যেতেই হবে। আমার কাছে সংবাদ এসেছে, এ মুহূর্তে ইসমাঈল গজনী নয় বলখে রয়েছে।”
“তুমি তাকে এ মর্মে খবর পাঠাও- তুমি জানতে চাও, তুমি যে সংবাদ পেয়েছে তা সঠিক কি-না। অভিষেক অনুষ্ঠানে তোমাকে দাওয়াত না দেয়ার কারণ কি।” বললেন মাহমূদের মা। এরপর জবাবের অপেক্ষা কর।
“মাহমূদের দূত যখন ইসমাঈলকে তার পয়গাম পৌঁছাল তখন তিনি বলখে অবস্থানরত। ইসমাঈল পয়গাম লেখা কাগজটি না খুলেই তার এক অনুগতের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, পড়ে শোনাও, আমার ভাই কি লিখেছে
নির্দেশ পেয়ে ইসমাঈলের অমাত্য কাগজ খুলে উচ্চকণ্ঠে পড়তে লাগল, প্রিয় ভাই! এতটুকু শুনে ইসমাঈল ক্ষোভে উরুতে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘অ্যাঁ! সে আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করল! সুলতান বলেনি?”
না! জিল্পে এলাহী! বলল-অমাত্য।
এই হতশ্রী চেহারাধারীর এতো বড় স্পর্ধা! ধৃষ্টতা!
এই অপমানের জন্যে তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত, সুলতান আলী মাকাম! বলল এক অনুগত অমাত্য।
“এমন গোস্তাখির জন্য তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া অপরিহার্য।”
আল্লাহ ও রাসূলের পরেই সুলতানের মর্যাদা। জিলে এলাহীর সওয়ারী যে পথে যায় মানুষ সম্মানে মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়, শত্রু আপনার নাম শুনে কাঁপতে থাকে।
“হু, সামনে পড়” বলল ইসমাঈল। মাহমূদ লিখেছে, “এ ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই যে, তুমি সালতানাতের মসনদে বসেছো। আল্লাহ তোমার এ মর্যাদাকে মোবারক করুন। কিন্তু সালতানাতের যে সব সমস্যা ও ঝুঁকি রয়েছে, দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার পর যে সব কর্তব্য অবশ্যম্ভাবী কাঁধে বর্তায়, হয়তো তুমি সে সম্পর্কে অবহিত নও। যদি অবগত হতে তবে মসনদকে ফুলশয্যা মনে করে আরাম-আয়েশে ডুবে যেতে না। সবার আগেই আমার কাছে আসতে, না হয় আমাকে ডেকে নিতে। তুমি যদি আমাকে যোগ্য মনে করতে, তাহলে একই পিতার সন্তান হিসেবে আমাকে অবশ্যই তোমার অভিষেক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে। অথচ তুমি মসনদে বসে অভিষেক অনুষ্ঠান করেছে, সবই আমার অজ্ঞাতে। এতে করে আমার সন্দেহ হয়, হয়তো তোমার মধ্যে কোন দুরাকাঙ্ক্ষা রয়েছে অথবা তোমার দরবারের কুচক্রীরা তোমার মধ্যে দুরাকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। ওরাই তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। তুমি তো জানো যে, সালতানাতের অভ্যন্তরেও আমাদের দুশমনরা ঘাপটি মেরে রয়েছে। তোমার সামনেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছে। হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকরা আমাদের উপর দু’বার আক্রমণ করেছে, পুনরায় আক্রমণ চালানোর পায়তারা করছে। এই ক্রান্তিকালে আমাদের উচিত হবে না, মোসাহেব ও চাটুকারদের মুখে নিজেদের স্তুতি ও প্রশংসা শোনা। এ মুহূর্তে আমাদের ময়দানের তাঁবুতে থাকা কর্তব্য।
তুমি যদি মনে কর, সালতানাতের কাজকর্ম চালাতে সক্ষম হবে, তবে আমি যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখছি। যুদ্ধপ্রস্তুতির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া সময়ের দাবী। তোমাকে আমি এই শর্তে সুলতানী দায়িত্ব অর্পণ করতে পারি, তুমি ভালো-মন্দ, দোস্ত-দুশমন, সৎ-অসতের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু আমার ধারণা, তুমি এখনও সে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারনি। তুমি অযোগ্য লোকদের পদোন্নতি দিয়েছো শুধু চাটুকারিতার যোগ্যতা বিবেচনা করে। তুমি সেনাবাহিনীর বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিয়ে রাজকোষের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছো। তুমি ভুলেই গেছো যে, আমাদের উপরেও এক খলীফা রয়েছে, তুমি শুধু একটি ইসলামী রাজ্যের সুলতান মাত্র।
আমার একটি পরামর্শ মেনে নাও। তাহলে আমি মরহুম আব্বাজানের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হবো। তুমি যদি নিজেকে সুলতানীর যোগ্য মনে কর, তবে বলখ ও খোরাসানের দায়িত্ব আমি তোমার হাতে ন্যস্ত করতে পারি কিন্তু তোমাকে কেন্দ্রের আসন ত্যাগ করতে হবে। আশা করি তুমি আমার কথার গুরুত্ব অনুধাবনে সক্ষম হবে।”
ইতি
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ভাই
মাহমুদ।
হুকুমবরদার যখন এই কথাগুলো পড়ছিল, ইসমাঈল ক্ষোভে টলছিল। পড়া শেষ হলে সে থেমে দরবারী পরামর্শদাতাদের দিকে তাকাল।
জিল্লে এলাহী! আমরা আপনার এই অপমান সহ্য করতে পারি না। বলল উজীরে আজম।
আপনি যদি শাসকের যোগ্য না হন তবে আর কে? বলল অপর অমাত্য।
ইসমাঈলের সকল দরবারী মাহমুদের বিরুদ্ধে ইসমাঈলকে উত্তেজিত করার জন্য যা যা বলা দরকার তা-ই বলল।
অবশ্য এদের সবাইকে ইসমাঈল পদোন্নতি দিয়ে নিজের উপদেষ্টা, উজীর, নাজির ইত্যাদি পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। এদের সম্পর্কেই মাহমূদ ইসমাঈলকে সতর্ক করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু ইসমাঈল তার বড় ভাইয়ের পয়গামকে গোপনে একাকী পড়ার প্রয়োজনই বোধ করেনি। দরবারী উমেদাররা চিঠির ভাষা অনুধাবন করে ইসমাঈলকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে তীব্র তোষামোদের ঝড়ে উত্তেজিত করে তুললো।
আপনার ভাই সৈনিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে আপত্তি করেছে। অথচ আপনার এই মহানুভবতায় গোটা বাহিনী আপনার ভক্ত হয়ে গেছে। আপনার একটু ইঙ্গিতে সারা ফৌজ জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছে। বলল উজীরে আ’লা।
আপনার বড় ভাই পয়গামে লিখেছে, সালতানাতের ভেতরে দুশমন রয়েছে এবং হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকরাও আমাদের দুশমন। জিলে এলাহী! শপথ করে বলতে পারি, দেশের অভ্যন্তরে আমাদের কোন দুশমন নেই। আপনার আব্বা যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শত্রু বানিয়েছেন এতে আপনার বড় ভাইয়ের মুখ্য ভূমিকা ছিল। সে চায় ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে নিজের কজায় নিয়ে নিতে। হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকরা আমাদের শত্রু হবে কেন? আমরা তাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে নিশ্চয়ই তারা আমাদের বন্ধুতে পরিণত হবে। কেন আমরা যুদ্ধ গ্রিহের পথে অগ্রসর হব? এতে ক্ষতি ছাড়া লাভ কি?
উজীরের সমর্থনে আরো কিছু মুখের হু হা রব শোনা গেল। কিন্তু এক বৃদ্ধলোক আগাগোড়াই নীরব ছিলেন। তিনি নীরবে ইসমাঈল এবং অমাত্যবর্গের নির্লজ্জ চাটুকারিতা দেখছিলেন। উজীর যখন বলল, “যুদ্ধ বিগ্রহের পথে কেন
অগ্রসর হব?” তখন বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন
“যে নিজের ইজ্জত, মর্যাদা ও ঈমান বিক্রি করে দেয় তার আবার শত্রুর সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ করার দরকার কি?” গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বৃদ্ধ বললেন, ইসমাঈল বিন সুবক্তগীন! তোমার জন্ম হতে আমি দেখেছি, আমার চোখের সামনে তুমি ছোট থেকে বড় হয়েছ। তুমি এখনও ছোট এবং যেসব ঈমান বিক্রেতাদের খেলার খুঁটিতে পরিণত হয়েছ, তারা তোমাকে পুতুল সুলতান বানিয়েছে। এরা দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে গেছে, তোমাকেও অন্ধ বানাতে চাচ্ছে। তুমি নিজে সালতানাতের সিংহাসন জবর দখলে নিয়েছ, তোমাকে কেউ সুলতানী সোপর্দ করেনি। জাতিও তোমাকে সুলতান হিসেবে বরণ করেনি। আল্লাহর পক্ষ থেকেও মনোনীত নও তুমি। তোমার মধ্যে যদি জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে থাকে, সেই বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করে আস্তিনে মুখ রেখে বল, সত্যিকার অর্থে কি তুমি সুলতানী মসনদের জন্যে যোগ্য? তোমার ভাই ঠিকই লিখেছেন, সে সব লোকদের জন্য তুমি প্রসন্ন যারা তোষামুদে ও চাটুকার, এরা তোমাকে ধ্বংসের শেষপ্রান্তে নিয়ে যাবে। এরা নিজের উদরপূর্তির জন্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার উজাড় করছে, এরা তোমাকে আজন্ম শত্রু হিন্দুস্তানের ভূতপূজারীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের পরামর্শ দিচ্ছে। এরা চায়, যুদ্ধ না করে আরামে জীবন কাটাতে।” কথাগুলো তীব্র আক্রোশে বলে হাঁফাতে লাগলেন বৃদ্ধ। এই বৃদ্ধ লোকটি ছিলেন কোষাগারের প্রধান কর্মকর্তা ফররুখ জাদ ইবরাহীম।
“সুলতান আলী মাকাম! এই বৃদ্ধ অকর্মণ্য হয়ে গেছে। তার মাথা ঠিক নেই। যেখানেই যায় এমন অলক্ষুণে বকতে শুরু করে। তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দেয়া উচিত।” বলল উজার।
“একে নিয়ে যাও!” গর্জে বলল ইসমাঈল!
ইসমাঈলের হুকুমে কয়েক অমাত্য বৃদ্ধের উপর হামলে পড়ল। তারা বয়োজ্যেষ্ঠ এই প্রবীণকে টেনে হেঁচড়ে দরবার থেকে বের করে দিল। বৃদ্ধের কণ্ঠে শোনা গেল, “ক্ষমতার লিপ্সায় যেখানে ভাই ভাইয়ের দুশমন হয় রহমত সেখান থেকে বিদায় নেয়। মিথ্যার পরাজয় ও সত্যের জয় হবেই।”
মাহমূদ নিশাপুরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ইসমাঈলের কাছে প্রেরিত পয়গামের উত্তরের জন্যে। দূত্রে আনা জবাবপত্র, পড়ে তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। ইসমাঈলের জবাব ছিল সংক্ষিপ্ত, ইসমাঈল লিখেছিল, “আমাকে আব্বা সালতানাতের দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন। সে পিতৃদত্ত দায়িত্ব অন্য কাউকে অর্পণ করবে না। এবারের গোস্তাখি ক্ষমা করা হল। আগামীতে সুলতানের বিরুদ্ধে এমন অবমাননাকর কিছু করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।”
ইতি
সুলতান গজনী
ইসমাঈল।
মাহমূদ তার মা ও মামা বু আজীজ ও ছোট ভাই নাসিরুদ্দীন ইউসুফকে এ ডেকে পরিস্থিতি অবহিত করে বললেন, আপনারা ইসমাঈলকে জানেন, সে স্ত্র আমার পয়গামের যে লিখিত জবাব দিয়েছে তা তার কথা নয়। এমন কথা বলার খ্র মতো জ্ঞান-বুদ্ধি তার নেই। দূত আমাকে বলেছে, আমার চিঠি বলখ দরবারে ৪ প্রকাশ্যে পড়া হয়েছে এবং চরম অবমাননাকর হাসি-ঠাট্টা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়েছে আমার চিঠি নিয়ে। এরা ফররুখ জাদ ইবরাহীমের মতো বিশ্বস্ত ও প্রবীণ কর্মকর্তাকে সত্য বলার অপরাধে টেনে হেঁচড়ে অপমান করে দরবার থেকে বের করে দিয়েছে। তাকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করেছে। অথচ আব্বাজানও তাকে সম্মান করতেন। এর অর্থ হলো, গজনীর কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে ইনসাফের জায়গায় এখন জুলুম ঠাই করে নিয়েছে। আমি কোন দরবারী লোকের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেই না। আমার বড় উপদেষ্টা আপনারা। আমাদের সবার দেহে একই রক্ত প্রবাহিত। একই চেতনার ধারক-বাহক আমরা। আমার সন্দেহ হয়, ইসমাঈলের রক্তে কোন বদকারের মিশ্রণ রয়েছে।
“ও যদি আমার গর্ভজাত সন্তান হতো তাহলে ক্ষমতালিন্দুদের পরামর্শ না শুনে আল্লাহর নির্দেশমতো চলতো। ইসমাঈল তোমার বাবার ঔরসজাত হলেও ওর মা ওর মধ্যে ক্ষমতার লোেভ ও নেতৃত্বের খাহেশ পয়দা করেছে।” বললেন বেগম সুবক্তগীন। তিনি আরো বললেন, মাহমূদ! আমি তোমার দুধের দাবী সে দিন ত্যাগ করব যেদিন তুমি হিন্দুস্তানে অভিযান চালিয়ে জালেমদের ধ্বংস করবে। আগ্রাসী হিন্দুদের পরাজিত করে ইট-পাথরের মূর্তিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ধুলায় মিশিয়ে দেবে।
“মা! আমাদের অধিকাংশ সৈনিক এখন ইসমাঈলের অধীনে রয়েছে। সৈনিকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিয়ে সব সৈনিককে তার ভক্ত বানিয়ে নিয়েছে। সন্ধি-সমঝোতার পথও বন্ধ করে দিয়েছে। মা! আপনি কি আমাকে অনুমতি দেবেন, যে অল্প সংখ্যক সৈন্য আমার অধীনে রয়েছে তাদের নিয়ে আমি বলখ আক্রমণ করি?”
‘এছাড়া আর কোন উপায় নেই।’ বললেন মাহমুদের মামা বু আজীজ। তবে তোমার সৈন্য স্বল্পতা একটা বড় সমস্যা। হামলার আগে দেখে নেয়া দরকার গজনী ও বলখের সৈন্যরা কার প্রতি অনুগত ও সহনশীল!
‘আমার হাতে যাচাই বাছাই করা ও কালক্ষেপণের সময় নেই, মামা! হিন্দুস্তান থেকে যে সব খবর পাচ্ছি তা খুবই ভয়াবহ। হিন্দুস্তানের সৈন্যদের সাথে সে দেশের সাধারণ নাগরিকরা পর্যন্ত আমাদের মোকাবেলায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে গণবাহিনী। মন্দিরগুলোতে পণ্ডিত-পুরোহিতেরা গজনী দখলের জন্য নাগরিকদের সর্বক্ষণ উদ্বুদ্ধ করছে। কথা চালিয়ে আর দূতিয়ালি করে সময় নষ্ট করার অবকাশ আমার নেই।
“আহ, মামা! এ মুহূর্তে আমাদের হিন্দুস্তানের পথে থাকা উচিত ছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের, এই জাতির, আমার আব্বার মতো বীর শাসককেও স্বজাতির গাদ্দারদের মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে করতে কবরের পথে যাত্রা করতে হলো। সীমানার বাইরে নজর দেয়ার সুযোগ তার হলো না। তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো না। আমাকেও পিতার মতই গৃহযুদ্ধের ফাঁদে পড়তে হলো?”
‘বেটা! ক্ষমতালিন্দুদের পরাজয় অনিবার্য। এতে কোন সন্দেহ নেই, ইসমাঈল সালতানাতের ভীষণ ক্ষতি করেছে। দেশ আমাদের রক্ষা করতেই হবে। অল্পসংখ্যক সৈনিক যা-ই আছে এদের ব্যবহার করা ছাড়া আমাদের বিকল্প পথ নেই। বললেন মামা।
বলখে ইসমাঈলের কাছে খবর পৌঁছল মাহমুদ নিশাপুর থেকে সৈন্য নিয়ে গজনীর পথে রওয়ানা হয়েছে। নিশাপুরের তুলনায় বলখের অবস্থান গজনীর কাছে। ইসমাঈল তার সেনাপতি, কমান্ডার ও অমাত্যবর্গকে ডেকে বলল, ‘আমার ভাই বিদ্রোহ করে গজনীর পথে সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হয়ে এগিয়ে আসছে। সে গজনী দখল করতে চাচ্ছে। আমি সৈনিকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয়ায় সে খুব ক্ষুব্ধ। সে গজনীর সেনাবাহিনীকে গোলাম বানিয়ে রাখতে চাচ্ছে। সকল সৈনিকের একথা জানিয়ে দাও এবং সকলে যুদ্ধের জন্যে তৈরি হও।
ইসমাঈলের অমাত্যবর্গ এই উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনীর বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিয়েছিল যে, এভাবে সৈনিকদের কজা করে তাদেরকে সালাতানাতের শত্রু দমনের চেয়ে ইসমাঈলের ব্যক্তি-শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহী করতে পারবে। উজীর ও অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহল সাধারণ নাগরিক ও সৈনিকদের মধ্যে প্রচার করল, মাহমূদ গজনী কর্তৃত্ব নিজের অধীনে নিয়ে হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে চাচ্ছে। হিন্দুস্তান আক্রমণ করে সে তথাকার সোনা-দানা, মণি-মুক্তা দিয়ে নিজের কোষাগার বোঝাই করতে চায়। মাহমূদের অধীনে কোন সৈনিকের জীবন আর নিরাপদ নয়।
ইসমাঈলের সৈন্যরা গজনীর কাছে মাহমূদের সেনা অবস্থানের কাছে পৌঁছে গেল। মাহমূদের বড় দুর্বলতা ছিল, তার সৈন্য সংখ্যা অল্প। তাছাড়া মাহমূদের ইচ্ছে ছিল, ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে লোকয় না করে সমঝোতার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির মীমাংসা করা। মাহমূদ ইসমাঈলের কাছে এই প্রস্তাব দিয়ে দূত, পাঠালেন, লড়াই ত্যাগ করে দুজনের মধ্যে একটা আপোস-রফার জন্যে উভয়ের একান্ত মোলাকাত হওয়া দরকার। গৃহযুদ্ধের দ্বারা শত্রুরাই বেশি উপকৃত হবে। আল্লাহ না করুন, আমাদের যুদ্ধকালে যদি দুশমনরা রাজধানী আক্রমণ করে বসে তবে তো দেশটাই শক্রর দখলে চলে যাবে। এমতাবস্থায় রাজত্ব নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই অর্থহীন। আমাদের উচিত, পারস্পরিক এ ভ্রাতৃঘাতী লড়াই এড়িয়ে যাওয়া।
“আমি কেন তার কাছে যাব, সে একজন বিদ্রোহী। ওকে গ্রেফতার করে আমি বিদ্রোহের অপরাধে এমন মর্মন্তুদ শাস্তি দেবো, ভবিষ্যতে আমার দেশে কেউ বিদ্রোহের দুঃসাহস দেখাবে না।” দূতের পয়গামের জবাবে বলল ইসমাঈল।
‘তিনি উভয়ের কল্যাণার্থেই এই প্রস্তাব করেছেন এবং আমাকে এই অধিকার দেয়া হয়েছে যে, আপনাদের সাক্ষাতের জন্যে আমি আপনাকে উৎসাহিত করব।’ আমাকে বার্তাবাহক হিসেবে নয় দূত করে পাঠানো হয়েছে। বলল মাহমূদের দূত। “আপনি তাকিয়ে দেখুন! গৃহযুদ্ধের দ্বারা আমাদের ক্ষতি ছাড়া কি উপকার হবে? গৃহযুদ্ধ এ দেশের রেওয়াজে পরিণত হতে যাচ্ছে। আজ এক বাপের দু’ছেলে ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ের মুখোমুখি। এই উন্মত্ত খুন পিপাসা আমাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করছে বৈ কি! আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, গভীরভাবে মাহমূদের প্রস্তাব চিন্তা করে দেখুন। তার এই প্রস্তাবের মধ্যে কোন কুটিলতা নেই।” বলল মাহমুদের দূত।
“হু”, আমি তার সমঝোতা-প্রস্তাবের রহস্য ভাল করে জানি। তার সৈন্য সংখ্যা সীমিত এজন্য সে সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়েছে, নয়তো সে সন্ধি প্রস্তাব কেন পাঠাবে? সে তো নিশ্চিত পরাজয় ও মৃত্যুর বিভীষিকা দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। আমি তার সৈন্য পিষে ফেলব আর তাকে বন্দী করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করবো। যাও, তাকে গিয়ে বল, আমার আর তার সৈনিকদের মোলাকাত হবে ময়দানে, আমার সাথে তার মোলাকাত নয়।”
দূত তার ঘোড়ায় এক লাফে চড়ে ইসমাঈলের উদ্দেশে বলল, ক্ষমতার লালসা আর মসনদের আকাঙ্ক্ষা বহু ক্ষমতাবান রাজা-মহারাজাকেও পরাজয়ের তকমা পরিয়েছে। মনে রাখা উচিত, অহঙ্কারীর পতন অনিবার্য– একথা বলেই। সে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিল।
পিতার মতো, ময়দানে দু’রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে মোনাজাত করলেন মাহমুদ। বললেন, “আয় প্রভু! আমি যদি ভ্রান্তপথে থাকি তবে এখনই আমাকে ধসিয়ে দিন, আর যদি আমি সঠিক পথে থাকি, আপনার কাছে যদি আমার আকাক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে, আমি যদি দুনিয়ার যশ-খ্যাতি ও ক্ষমতার লোভে এখানে না এসে থাকি, হিন্দুস্তানের ভূতখানাগুলোতে ইসলামের আলো পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা যদি আমার সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে পথের সকল বাধা দূর করার তৌফিক দিন। আমার ভাই আমার পথে বড় বাধা, এ বাধা আমাকে অপসারণ করার শক্তি দিন। যাতে আমি অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারি।”
“আয় আল্লাহ! মুহম্মদ বিন কাসিম ভারতের মাটিতে ইসলামের যে চেরাগ জ্বালিয়েছিলেন তা আজ নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমি নিজের রক্ত দিয়ে বিন কাসিমের জ্বালানো প্রদীপ প্রজ্জ্বল করতে চাচ্ছি। আপনি আমাকে আপনার পথে কবুল করুন, আমাকে কামিয়াব করুন!”
মাহমূদ নিজের সিপাহসালার, কমান্ডার ও কর্মকর্তাদের ডেকে বললেন, “দৃশ্যত দু’ভাই আজ পরস্পরের শত্রু। একে অন্যের রক্তপিপাসু। বিষয়টা মূলত এমন নয়। প্রত্যেক সিপাহীর হৃদয়ে একথা গেঁথে নাও, তোমরা কোন ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছে না, ইসলাম ও জাতির বেঈমান-বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। প্রতিপক্ষে তোমাদের ভাই-চাচা, মামা-ভাতিজা অনেকেই থাকতে পারে, তোমরা ওদের আক্রমণের আগে বলবে, বদর যুদ্ধে আপন ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে পিতা পুত্রের বিরুদ্ধে চাচা ভাতিজার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করেছে। সেই লড়াইয়ে সত্যের পক্ষে ছিলেন আমাদের নবীজী (সা.)। আর মিথ্যার পক্ষে ছিল আৰু জাহেল বাহিনী। সেদিন মাত্র তিনশ’ তেরো জন মুজাহিদ এক হাজার কাফির সেনাকে পরাজিত করেছিল। আজ তোমরা সত্যের পক্ষে আর ওরা মিথ্যার পতাকাতলে। আমরা ইসলামের ঝাণ্ডা কুফরীস্থান পর্যন্ত উড়াতে চাচ্ছি। ওরা চাচ্ছে ইসলামের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে বিজয়ের ঝাণ্ডা ভূলুণ্ঠিত করতে। ইসলামের জন্যে, সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে রাসূল (সা.) আত্মীয়তা পরিহার করে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বীরদর্পে তার কমান্ডে সামনে এগিয়ে গেছেন। ফলে আজ আমরা আল্লাহর নাম নিতে পারছি, নিজেদের মুসলিম হিসেবে ভাগ্যবান ভাবতে পারছি। সংখ্যাধিক্য ও আসবাবের ঘাটতি সত্ত্বেও সত্যাশ্রয়ীরা চিরদিন বিজয়ী হয়েছে, আজও আমরাই জয়ী হব-ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। তিনি আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা পূর্ণ করবেন অবশ্যই।”
মাহমূদ কমান্ডারদের বললেন, তোমরা অধীনস্ত প্রত্যেক সৈনিকের মধ্যে এ ঈমানী শক্তি উজ্জীবিত কর । সাহসে ভরে দাও তাদের হৃদয়-বুক।’
মাহমূদ সেনাপতিকে ও কমান্ডারদের যুদ্ধ কৌশল বলে দিয়ে নিবৃত্ত হলেন। সেনা স্বল্পতা তাকে পেরেশান করছিল। এতো অল্পসংখ্যক সৈনিক নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে পেরে ওঠা মুশকিল। তাই তিনি নতুন রণকৌশলের উপর মনোযোগী হলেন।
তিনি একটি উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে ইসমাঈলের সেনাবাহিনীর দিকে তাকালেন। বুকের মধ্যে অনুভূত হলো হাতুড়ির-আঘাত। ইসমাঈলের বিশাল বাহিনী রণসাজে সজ্জিত। প্রায় শ তিনেক হবে তার জঙ্গী হাতি। হাতির শূড়গুলো লোহার খোলে ঢাকা। এই হাতিগুলো রাজা জয়পালকে পরাজিত করে তার আব্বা লাভ করেছিলেন। সবগুলো ছিল গজনীতে।
রাজা জয়পাল যখন ইসমাঈলের চেয়েও বিশাল বাহিনী নিয়ে সুবক্তগীনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তখন তার বাহিনীতে এমন জঙ্গী হাতির সংখ্যা হাজারেরও বেশি ছিল। কিন্তু মাহমূদ সেদিন সেই বিশাল বাহিনী কিংবা হাতিবহর দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। কারণ, সেই বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার নৈতিক শক্তি ছিল অত্যুচ্চ, মনোবল ছিল আকাশচুম্বি, আল্লাহর বিশেষ রহমতের আশা ছিল। কিন্তু আজ নিজ ভাই ও জাতির বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হচ্ছে। দুঃখে ও যন্ত্রণায় কেঁপে উঠল মাহমুদের হৃদয়। ইসমাঈলের সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠল মাহমূদের মন। এরাতো তার শত্রু নয়। তারই পিতার সযত্নে গড়া সৈনিক দল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যাদের কাছে মাহমুদ ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় ও ভবিষ্যতের কাণ্ডারী- ভাইয়ের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতার লোভ আর কুচক্রীদের প্ররোচনায় তারাই আজ মাহমূদের বিরুদ্ধে উদ্যত খড়গ হাতে দণ্ডায়মান।
মাহমূদ আশঙ্কা করছিলেন, এরা তো তার মরহুম পিতার যুদ্ধ চাল সম্পর্কে অবগত। এরা যুদ্ধের ময়দানে মরতে ও মারতে অভ্যস্ত। এরা মাহমূদের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত। আজ এরাই তার প্রতিপক্ষ। শুধুমাত্র বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয়ার কারণে এরা আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে যুদ্ধ করতে। অবশ্য মাহমূদ মনে মনে এই ভেবে আশ্বস্ত হলেন, তিনি দেখলেন, আজ এদের মধ্যে পূর্বের জাতিত্ববোধ ও কওমী মর্যাদার উত্তাপ নেই, এরা এখন টাকায় বিক্রিত। আগের মনোবল এদের অন্তর থেকে দূরীভূত । কিন্তু মাহমূদের সৈন্য-স্বল্পতা এতই প্রকট যে, তার এই আকাক্ষা ও আশা নিজ সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই উবে গেল। হতাশা তাকে গ্রাস করতে চাইল। তবুও তিনি দমলেন না।
সৈন্যদেরকে চারভাগে ভাগ করলেন মাহমুদ। বেশি সংখ্যক নিজের কমান্ডে রিজার্ভ রাখলেন। দু’ অংশকে দু প্রান্তে ছড়িয়ে দিলেন এবং চতুর্থ অংশকে শত্রু সেনাদের মুখোমুখি দাঁড় করালেন।
তিনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, গেরিলা আক্রমণের কৌশল-ই এ যুদ্ধে তাকে প্রয়োগ করতে হবে। মুখোমুখি যুদ্ধ করার জন্যে ন্যূনতম সেনাবল তার নেই। তিনি কমান্ডারদের বলে দিলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তোমরা দুশমনকে তোমাদের দিকে অগ্রসর হতে আকৃষ্ট করে ছড়িয়ে পড়বে, যাতে ইসমাঈলের সৈন্যরা ব্যুহ ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে আসে।
জায়গাটিতে ছোট ঘোট টিলা ছিল অনেক। মাহমূদ এগুলোর সুবিধা নিতে চাচ্ছিলেন। এজন্যই তিনি কমান্ডারদের বললেন, তোমরা প্রতিপক্ষের সৈন্যদের বিক্ষিপ্ত করে টিলাগুলোর আড়ালে চলে যাবে, যাতে উভয় পক্ষের মধ্যে টিলা আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। যেন ওরা টিলার প্রান্ত ঘুরে তোমাদের দিকে ধাবিত হয়।
রাতের গুপ্ত হামলার সুযোগ এক্ষেত্রে নেই। এ কাজে উভয় বাহিনী সিদ্ধহস্ত। রাতের আক্রমণ প্রতি আক্রমণের কৌশল তাদের সবার জানা আছে। এজন্য উভয় বাহিনী তাঁবুর ভিতরে-বাইরে বহু দূর পর্যন্ত বড় বড় মশাল জ্বালিয়ে সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। ফলে কারো পক্ষে রাত্রিকালীন আক্রমণের খুব বেশি সুযোগ নেই।
মাহমূদ তাঁবু থেকে বের হবেন, ঠিক এ সময় তাঁর মা সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন মাহমুদ। পায়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, “মাঃ আব্দুর আত্মা আমাকে অভিশাপ দেবে না তো? আব্বর ইন্তেকালের পর আমি জীবনের প্রথম যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি। আলুকে ছাড়া এটাই আমার প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আমার প্রথম এই যুদ্ধটি আমি ভাইয়ের বিরুদ্ধে করতে বাধ্য। মা! আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি কখনও এ যুদ্ধে জড়াতে চাইনি। কারণ, হয়ত ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাকে বলবে, সুবক্তগীনপুত্র মাহমূদ ক্ষমতার জন্যে ভাইয়ের মোকাবেলায় লড়াই করে নিহত হয়েছিল।”
“বেটা! এখন এসব বাজে চিন্তা করো না। রক্ত দূষিত হয়ে গেলে দৃষ্টিও দূষিত হয়ে যায়। তোমার ভাইয়ের রক্তে ক্ষমতা ও ভোগবাদের নেশা। এখন এসব নিয়ে ভেবো না। মাথা থেকে এসব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দাও। যে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি তা-ই কর। গত রাত আমি আল্লাহর দরবারে সেজদায় কাটিয়েছি। যাও বেটা! আমি তোমাকে দুআ-দিচ্ছি। মায়ের দু’আয় তুমিই বিজয়ী হবে-ইনশাআল্লাহ।”
ইসমাঈল বিপুল সৈন্য সম্ভারে গর্বিত এবং বেপরোয়া ছিল। সে আগ বেড়ে আক্রমণের হুকুম দিল। মাহমূদের নির্দেশ মতো তীরন্দাজরা তীর বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগল হাতির দিকে। প্রতিপক্ষের বেশি দম্ভ ছিল হাতি নিয়ে। হাতি যখন মাহমদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর ও বর্শার আঘাতে আহত হতে লাগলো তখন যুদ্ধের ধারা বদলে গেল। ইসমাঈলের সৈন্যদের আহত ও ভীত হাতির ভয়াবহ পদদলনের বাস্তব ধারণা ছিল না। আহত হাতি চিৎকার দিয়ে নিজ বাহিনীর জন্যে বিপদ ডেকে আনল। আহত হাতির দিগ্বিদিক ছোটাছুটিতে অশ্ববাহিনীর ঘোড়াগুলোও বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি শুরু করল।
মাহমূদ উঁচু টিলা থেকে দেখছিলেন, তাঁর নির্দেশনামতে সৈনিকেরা অধিকাংশ হাতি আহত করে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। তবুও ইসমাঈল বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছিল না। তারা হাতির উপর নির্ভর না করে অগ্রাভিযান আরো তীব্র করল মাহমূদের নির্দেশমতো তার সৈনিকেরাও এক জায়গায় স্থির থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তবুও শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তাদের অবস্থানক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছিল। মাহমূদ দেখছিলেন, তার সৈনিকদের পশ্চাদপসারণ ছাড়া উপায় নেই। দৃশ্যত মাহমূদের পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা আর সম্ভব নয়।
ইত্যবসরে ইসমাঈল মাহমূদকে জীবিত গ্রেফতার করতে তার বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। এ ঘোষণায় উভয় পক্ষে ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি উচ্চকিত হয়। একই পতাকা বহন করছিল উভয় দল। মাহমূদ বাহিনীর তাকবীর ধ্বনি ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসছিল। ঘোরতর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উভয় পক্ষ। দ্রুত লাশের স্তূপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
মাহমুদকে জীবিত কয়েদ করার জন্যে কমান্ডারদের নির্দেশ দিল ইসমাঈল। উভয় বাহিনী অরণপণ আক্রমণ প্রতিআক্রমণ চালাল। নারায়ে তাকবীরের আওয়াজ আর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ময়দান কেঁপে উঠছে। একই পতাকা উভয় বাহিনীর হাতে ঝাণ্ডবরদারদের পোশাক আর অস্ত্র ও সাজসজ্জার ব্যবধান ছাড়া চেনার উপায় ছিল না। প্রতিপক্ষকে মাহমূদ-বাহিনীর বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নকরণের চালও কোনই কাজ দিল না। মাহমুদের মুষ্টিমেয় সৈন্য একই জায়গায় জমা হয়ে প্রতিরোধ করছিল।
ইসমাঈলের সৈন্যরা তখন লড়ছিল তাদের আভিজাত্য বজায় রাখতে এবং বিজয়ের জন্যে। আর মাহমূদ-বাহিনী লড়ছে নিশ্চিত মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে। লাশের পর লাশ পড়ে ময়দান ভরে উঠেছে। যুদ্ধের তীব্রতা তখন তুঙ্গে। মাহমূদ দেখছিলেন, তার বাহিনী দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
নিজের সৈন্যদের বাঁচানোর তাকিদে মাহমূদ ইসমাঈল বাহিনীর উভয়, বাহুতে আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিলেন। বললেন, আক্রমণ করেই তারা যেন আরো ডানে এবং বামে সরে আসে। এ চাল কিছুটা ফলপ্রসূ হলো। ইসমাঈল বাহিনী ডান ও বামদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। মাহমূদের কথামতো তার দু বাহুর সৈন্যরা হঠাৎ আক্রমণ করে আবার ডানে-বামে সরে যেতো। এবার মাহমূদ তার মুখোমুখি লড়াইরত সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন তোমরা পিছনের দিকে সরতে থাক। পশ্চাদপসারণ করতে গিয়ে মাহমূদ বাহিনীর বহু সদস্য হতাহত হলো। কিন্তু তারপরও প্রায় বেষ্টনির মধ্যে পড়ে যাওয়া সৈন্যদের অধিকাংশই পিছনে চলে আসতে সক্ষম হল।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে আকাশ রাঙিয়ে বিদায় নিচ্ছে আজকের সূর্য। মাহমূদ দেখতে পেলেন, প্রতিপক্ষের সৈন্যবাহিনীর প্রায় মাঝখানে হাতির উপরে রাজকীয় আসনে উপবেশন করে ইসমাঈল কমান্ড দিচ্ছে। মাহমূদ আরো দেখলেন, ইসমাঈলের সৈন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে সারা ময়দানে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি প্রথমে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি সন্ধ্যার আগেই যুদ্ধের পরিণতি টানার সংকল্প করলেন। তীরন্দাজ সৈন্যদেরকে টিলাগুলোর শীর্ষে অবস্থান নিতে এবং তার নিরাপত্তারক্ষীদের আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন। সমরবিশারদদের দৃষ্টিতে মাহমুদের এ সিদ্ধান্ত চরম আত্মঘাতী ছিল।
নিজের জীবন ও অবশিষ্ট সৈন্যদের প্রাণঘাতী ফয়সালা নিলেন মাহমুদ। মাহমূদের রক্ষীদল ছিল অক্লান্ত। এখনো তাদের মোকাবেলায় নামানো হয়নি। এবার তারা দুশমনের মধ্যভাগে বিজলীর তীব্রতা নিয়ে আক্রমণ শানাল। মাহমুদ নিজেই তাদের কমান্ড দিচ্ছিলেন। তার প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত অশ্বারোহীর সংখ্যা ছিল বেশি এবং তারা তখনও ছিল রিজার্ভ। তিনি তীরন্দাজদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা টিলার উপরে অবস্থান নাও এবং তোমাদের আয়ত্তের ভিতরে শত্রু পৌঁছামাত্রই ওদের নিশানা বানাও। লক্ষণীয় বিষয় হলো, মাহমূদের রক্ষী বাহিনীর মোকাবেলায় ইসমাঈলের কোন রিজার্ভ ফোর্স ছিল না। এদের সব সৈন্য সারা দিনের রণক্লান্ত। মাহমুদের তাজাম সৈন্যরা তার নির্দেশমতো “বৃতপূজারীদের মিত্র সৈন্যদের পিষে ফেলো” ধ্বনি তুলে সিংহের গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মাহমুদের এই হামলা ছিল ইসমাঈল বাহিনীর ধারণাতীত। তাছাড়া ‘বুতপূজারী মিত্রদের পিষে ফেল’ শ্লোগানে ইসমাঈল বাহিনীর মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। আত্মদুর্বলতা তাদের গ্রাস করে নিল। বাহিনীর সেনারা উচ্চধ্বনিতে আরো বলছিল, “আল্লাহর সৈনিকেরা ভাতার জন্যে যুদ্ধ করে না, ইসলামের জন্যে জিহাদ করে তারা”। ইসমাঈলের কমান্ডাররা মধ্যভাগকে বাঁচানোর জন্যে বাহুর সাহায্য চাইল। কিন্তু মাহমূদের সৈন্যরা হামলা কর এবং পালিয়ে যাও’ কৌশল অবলম্বন করে প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। যার ফলে ইসমাঈল বাহিনীর মধ্যভাগের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা তার বাহুর সৈন্যদের জন্যে সম্ভব হলো না।
ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেন, মাহমূদ গযনবী সে দিন এক প্রচণ্ড রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন। তিনি যখন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে হামলা করেছিলেন, তখন শত্রু-সৈন্যদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শত্ৰু-বাহিনীর সৈন্যরা মাহমূদের মোকাবেলা থেকে জীবন বাঁচানোর জন্যে পিছু হটতে তৎপর হয়ে উঠলো। ইসমাঈলের রক্ষণভাগের ওপর আক্রমণে মাহমূদ এতই বেপরোয়া ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন যে, বিশাল বাহিনীটাকে তিনি একাই যেন কচুকাটা করে ছাড়বেন। তিনি নিজেই নিজের পরিণতি ভুলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেন। তাঁর জীবনপণ লড়াই দেখে তার সৈন্যরাও জীবনের শেষ যুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষায় আখেরী হামলা চালায়। মুহূর্তের মধ্যে ময়দানের চিত্র পাল্টে যায়।
তখনও পশ্চিমাকাশে ক্ষীণ সূর্যরশ্মি দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসতে এখনো সামান্য দেরী আছে। ময়দানে ইসমাঈল বাহিনীর দাপট কমে গেছে। ইসমাঈল-বাহিনীর রক্ষণভাগের প্রতিরক্ষা ব্যুহ তছনছ হয়ে গেছে। ইসমাঈল-বাহিনীর সৈন্যদের শৃঙ্খলা ও কমান্ড এলোমেলো হয়ে গেছে। অধিকাংশ সিপাহী কমান্ডার নিরাপদ আশ্রয়ের প্রত্যাশায় টিলার দিকে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। টিলার উপরে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া মাহমূদের তীরন্দাজ বাহিনীর দুশমনদের জন্যে আশ্রয়ের পরিবর্তে মৃত্যুদূত হয়ে দেখা দিল। শত্রুবাহিনী টিলার দিকে অগ্রসর হতেই মাহমুদের তীরন্দাজরা তীর বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। অবস্থা বেগতিক দেখে ইসমাঈল বাহিনীর রক্ষণভাগের এক কমান্ডার হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করে।
মাহমূদ কয়েকজন অশ্বারোহীকে নির্দেশ দিলেন, “তোমরা গোটা ময়দানে প্রচার করে দাও, ইসমাঈল-বাহিনীর আর কোন সৈনিককে যেন হত্যা না করা হয়। ওরা যদি যুদ্ধ করে কিংবা সারেন্ডার করতে অস্বীকার করে তবেই তাদের কয়েদ কর। আর যারা বশ্যতা স্বীকার করবে তাদের অস্ত্র নিয়ে ছেড়ে দাও।” মাহমুদের এই ঘোষণা শুনে ইসমাঈল-বাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের যুদ্ধের শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। শত্রুবাহিনীর যে কমান্ডার প্রথমে হাতিয়ার ফেলে দিয়েছিল তার কাছে মাহমূদ জিজ্ঞেস করলেন, ইসমাঈল এখন কোথায়? কমান্ডার বলল, সে নিহতও হয়নি আহতও হয়নি।
আপনার আক্রমণের তীব্রতায় ভীত হয়ে সৈন্যদের কিছু না বলেই হয়ত পালিয়ে গেছে। কমান্ডার ইসমাঈলের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য দিকও বলে দিল । মাহমূদ কয়েকজন অশ্বারোহীকে নির্দেশ নিলেন, ‘তোমরা ইসমাঈলকে খুঁজে বের কর এবং নৈতিক অপরাধীর মতো ওকে নজরবন্দী করে আমার কাছে নিয়ে এসো।
রাতের ঘন আঁধার ঘনিয়ে আসার আগে ভ্রাতৃঘাতী এই গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। ইসমাঈলের বাহিনী বন্দী অবস্থায় সারি বেঁধে বসে থাকল আর মাহমূদের সৈন্যরা তাদের পাহারা দিচ্ছিল। রাত বাড়ার সাথে সাথে আহত সৈন্যদের আহাজারি, চিৎকার আর রোদন বাড়তে থাকল। ক্ষত-বিক্ষত ঘোড়া, জখমী হাতি আর হাত-পা কাটা সৈন্যদের আর্ত চিৎকারে রাতের ময়দান বিভীষিকাময় হয়ে উঠল। মাহমূদ নির্দেশ দিলেন, উভয় দলের আহত সৈন্যদের তাঁবুতে এনে চিকিৎসা করো। শত্রু-মিত্র বিচার না করে সবার ক্ষতস্থানে যথাসম্ভব পট্টির ব্যবস্থা করো।
মশাল জ্বালিয়ে দেয়া হল চতুর্দিকে। সেবক দল ময়দান থেকে খুঁজে আহতদের চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিল। মাহমূদ ময়দান জুড়ে লাশ আর আহতদের মধ্যে টহল দিচ্ছিলেন। পরিচিত কমান্ডার ও সিপাহীদের লাশ দেখে অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। এমন সময় দূর থেকে একটি মেয়েলী কণ্ঠে ভেসে এলো–মাহমূদ! মাহমূদ!
পরিচিত কণ্ঠের আওয়াজ শুনে মাহমূদ সে দিকে দৌড়ে গেলেন। তার পা জড়িয়ে ধরলেন। তাঁকে চুমু দিলেন। মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দীর্ঘক্ষণ কারো মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না।
যুদ্ধের ভয়াবহতা ও আশাতীত সাফল্যে মা ও ছেলে উভয়ে ছিলেন আবেগাপ্লুত, আত্মহারা কিন্তু বেদনাক্লান্ত। অনেকক্ষণ পর মা’কে তাঁবুতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে মাহমূদ ময়দানে-ই টহল দিতে লাগলেন। প্রতিটি শবদেহের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াতেন, মশালের আলোতে গভীরভাবে তাকে দেখে নিতেন। এভাবে প্রতিটি শবদেহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি যেন পরখ করছিলেন মাহমূদ। হঠাৎ তার মায়ের মতোই এক মেয়েলী কণ্ঠের ডাক তার কানে এলো-মাহমূদ! তিনি দাঁড়ালেন। দুই মশালবাহীর মধ্যদিয়ে শাহী পোশাক পরিহিতা এক মহিলা আরোহীকে তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখলেন। চেহারা, পরিচ্ছদ আর ঠাটবাটে রাজকীয় ভাবসাব। মহিলা আর কেউ নয়, মাহমুদের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, ইসমাঈলের মা। মাহমূদ তাকে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ইসমাঈলের মা তার সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
আপনি কি এসব দেখতে এসেছেন– আপনার ছেলে আব্বার রেখে যাওয়া সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে কতোজনকে হত্যা করেছে? আপনি কি কানে শোনেন? ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত সৈন্যদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন? কেন এসেছেন আপনি? কি চাই আপনার? ক্ষুব্ধকণ্ঠে ইমাঈলের মায়ের প্রতি প্রশ্ন করলেন মাহমুদ।
‘আমি কোন কিছু দেখতে আসিনি, কোন কিছু শোনার ইচ্ছেও আমার নেই। আমি এসেছি আমার পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইতে।’
‘কোথায় আপনার ছেলে? আমি তো ওকে এখনও দেখিইনি।’
‘সে তার তাবুতে আছে, তার পালিয়ে যাওয়ার সকল পথ তোমার সিপাহীরা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যেরা তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে।’
“ওরাও কি ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে, যাদেরকে যোগ্যতা বিচার না করেই শুধু তোষামোদির কারণে আপনার ছেলে কমান্ডার থেকে সালার বানিয়ে দিয়েছিল? ওই কাফিরেরাও ওকে একা ফেলে চলে গেছে যাদেরকে সে উজীর আমীরের পদে আসীন করেছিল? ‘জিল্পে এলাহী’, আর ‘সুলতানে আলী লকব গ্রহণ করা যত সহজ জিল্লে এলাহী আর সুলতানে আলীর মর্যাদা রক্ষা করা অতো সহজ নয়।” বললেন মাহমুদ।
ইসমাঈলের মা বলল, ‘মাহমূদ! তুমি যা ইচ্ছে তা বলতে পার, কিন্তু আমাকে বল, আমি আমার একমাত্র ছেলের জীবন ভিক্ষা চাইতে এসেছি, আমার দরখাস্ত মঞ্জুর করেছ কি?
“আপনি যদি আজ আমার স্থানে হতেন তাহলে যার কারণে এতোগুলো প্রাণ বধ হলো তার বিচার আপনি কী করতেন? আপনি পারতেন, এতগুলো নিরপরাধ মানুষের খুনীকে ক্ষমা করতে?” মাহমূদ বললেন, আপনার মর্যাদা আর অবস্থানের কথা একটু ভেবে দেখুন! নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, যাদের তাজা রক্তে আপনার পা ডুবে গেছে, যাদের তপ্ত খুনের ছিটায় আপনার কাপড় রক্তিম হয়ে গেছে, তারা কারা? আপনি এক মর্যাদাবান ন্যায়পরায়ণ সুলতানের বিধবা। রাণী হোক কিংবা সাধারণ মহিলা হোক বৈধব্য সবার-ই জন্যে সমান কষ্টদায়ক। সুলতানের বিবি হোক বা বিধবা হোক কওমের প্রতিটি নাগরিক তার কাছে নিজ সন্তানের মত। যেসব সিপাহীর লাশ মাড়িয়ে আপনি নিজ সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইতে আমার কাছে এসেছেন, যার কারণে এই রক্ত ঝরল, তার কী শাস্তি হতে পারে বলুন? এমন অপরাধীর পক্ষে কোন্ মুখে আপনি ক্ষমা চাইতে এসেছেন বলুন? এমন জিঘাংসু, জঘন্য কোন মানুষের বেঁচে থাকার কি অধিকার আছে? আপনার ছেলে এখন শত শত মানুষ হত্যার অপরাধী, সে খুনী।
মাহমূদ! দুর্ভাগ্য আমি তোমার মতো যোগ্য সন্তানের মা হতে পারিনি, কিন্তু আমি তোমার মরহুম পিতারই স্ত্রী। তোমার পিতার রুহের মর্যাদার দোহাই দিয়ে বলছি, আমার ছেলের প্রাণভিক্ষা দাও। আমি ছেলেকে নিয়ে তোমার রাজ্য ছেড়ে দূর দেশে চলে যাব। আমার এই শেষ আবেদনটি তুমি কবুল কর। তোমার পিতা আমাকে অতটুকুই স্নেহ করতেন যতটুকু স্নেহ তোমার মাকে করতেন। বলল ইসমাঈলের মা।
মৃত্যুপথযাত্রী পিতার স্নেহের মূল্য আপনি দিয়েছেন আপনার অযোগ্য ছেলের নামে সালতানাতের বাদশাহী লিখিয়ে নিয়ে, তাই না? আর আজ আপনার সেই ছেলে সালতানাতকে ধ্বংস করে ছাড়ল। আপনি কি সে সব মায়ের মতো অধিকার রাখেন যারা নিজেদের তরুণ ছেলেদের রণসাজে সজ্জিত করে আমার মরহুম পিতার ইসলামী পতাকাতলে জিহাদের জন্যে বিদায় জানাতেন? আপনি কি আমার বিধবা মায়ের মতো একমাত্র ছেলেকে বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ময়দানে মৃত্যুর মুখোমুখি কওমের জন্যে জীবনবাজি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন? আপনি কি দাবী করতে পারেন তার মতো অধিকার? আপনি আপনার অযোগ্য ছেলেকে মসনদে বসিয়েছেন সিংহাসনের মজা লুটতে, নিজে রাজমাতা হয়ে বিলাসিতা চরিতার্থ করতে। আপনি আপনার ছেলেকে পরিণত করেছেন সালতানাতের ধ্বংসকারী রূপে, সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করে অগণিত মানুষের জীবন সংহার করতে। আপনার ছেলে খুনী, বিশ্বাসঘাতক! আর আপনি হলেন তার প্রধান মন্ত্রণাদায়ী, কুচক্রী।
মাহমূদ তার পাশে দাঁড়ানো দু’জন সৈন্যকে বললেন, যাও! এই মহিলার সাথে গিয়ে তার ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে এসো।
ইসমাঈল তার তাঁবুতে অবনত মস্তকে উপবিষ্ট। তাঁবুতে দু’ সিপাহীকে ঢুকতে দেখে সে কেঁপে উঠল। সে থতমত খেয়ে সিপাহীদের অনুরোধ করল, “তোমরা আমাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দাও! আমি তোমাদের যা চাও তাই পুরস্কার দেবো!”
কমান্ডার সিপাহীকে বললেন, ‘ওকে সুলতানের কাছে নিয়ে চল। এর ফয়সালা করবেন সুলতান। অগত্যা ইসমাঈল নিজেই সিপাহীদের সাথে রওয়ানা হল । তার মা ইসমাঈলের পিছনে পিছনে চলতে লাগল।
ইসমাঈলকে যখন মাহমূদের সামনে এনে দাঁড় করানো হল, মাহমূদ তীর্যক দৃষ্টিতে একবার তার আপাদমস্তক দেখে বললেন, তোমার মা আমার কাছে তোমার জীবন ভিক্ষা চেয়েছে, আমি তোমার জীবন ভিক্ষা দিলাম, তোমাকে জীবিত রাখা হবে।
ঐতিহাসিক কাসিম ফেরেশতা এ প্রেক্ষিতে লিখেছেন, ইসমাঈল মাহমুদের মুখোমুখি নীত হলে মাহমূদ ইসমাঈলের উদ্দেশে বলেন, “আজ যদি আমি তোমার নিকট বন্দী হতাম, যদি তুমি বিজয়ী হতে তবে তুমি আমার সাথে কী ব্যবহার করতে’? ইসমাঈল বলল, “আমি তোমাকে যাবজ্জীবন কয়েদখানায় বন্দী কারে রাখতাম। তবে স্বাভাবিক জীবনের সব উপকরণের ব্যবস্থা করে দিতাম।
‘ঠিক আছে, আমিও তোমার সাথে এর চেয়ে খারাপ আচরণ করব না। তুমি যাবজ্জীবন বন্দী হিসেবে থাকবে এবং জীবনযাপনের সব কিছুই সাধারণ মানুষের মতই পাবে। ইচ্ছে করলে তোমার মাকেও সাথে নিয়ে যেতে পার।
ইসমাঈল সারা জীবনের জন্যে মাকে নিয়ে জ্বরজান কয়েদখানায় বন্দী জীবন গ্রহণ করল। তাকে এর চেয়ে বেশি শাস্তি সুলতান মাহমূদ দিলেন না। অথচ ইসমাঈল বিজয়ী হলে মাহমূদের মৃত্যু ছিল অবধারিত। সুলতান মাহমূদ এই। বিজয়ের মাধ্যমে এক আত্মঘাতী লড়াই থেকে নিষ্কৃতি পেলেন। সালতানাতের ক্ষতিকারী সবচেয়ে বড় ক্রীড়নকের অবসান ঘটল। কঠিন এক আপদকে সামনে চলার পথ থেকে অপসারণ করতে সক্ষম হলেন মাহমূদ।
সুলতান মাহমুদ যখন ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে উপনীত আর গজনীতে প্রশিক্ষিত ও চৌকস বহু সৈন্য হতাহতের ঘটনা ঘটল তখন লাহোরে রাজা জয়পালের কাছে খবর পৌঁছে, সুলতান সুবক্তগীনের মৃত্যু হয়েছে। জয়পাল তার জেনারেলদের ডেকে সুসংবাদ দেন, আমার সবচেয়ে বড় শত্রু সুলতান সুবক্তগীন আজ দুনিয়া থেকে তিরোহিত। এখন আমরা সহজেই গজনী জয় করতে পারব। আমাদের বাহিনী হামলার জন্যে তৈরি আছে তো?’ জয়পাল জেনারেলদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসুনেত্রে বললেন।
আগের মতো তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না মহারাজ। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এক ব্যক্তির মৃত্যু হলেও গজনীর কওম মরে যায়নি। বলল এক জেনারেল। গজনীর সৈন্যদের মধ্যে যে দেশ ও জাতিপ্রেম রয়েছে তা এক সুলতানের মৃত্যুতে মরে যাবে না। আমাদের সৈন্যরা অভিযানের জন্যে প্রস্তুত ঠিকই কিন্তু এদের মধ্যে এখনও মুসলমানদের মতো মৃত্যুপণ লড়াইয়ের প্রেরণা সৃষ্টি হয়নি। সৈন্যদের মধ্যে আমরা ধর্মীয় আবেগ ও জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করছি। মন্দিরে মন্দিরে পণ্ডিত- পুরোহিতরা সাধারণ প্রজাদের মনে এই চেতনা জাগাতে চেষ্টা করছেন যে, “মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ লড়াই দেবদেবীর ইজ্জত রক্ষার লড়াই, আমাদের ধর্ম-অর্চনা টিকিয়ে রাখার লড়াই। এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।”
সুবক্তগীনের ছেলে মাহমূদ এখন যুবক। বলল এক জেনারেল। তবে আমি নিশ্চিত বলতে পারব না, সে দেশের সেনাবাহিনীর কমান্ড সামলাতে পারবে কি না। তবে দুটি যুদ্ধে আমি তার মধ্যে যে বীর বীর্য দেখেছি তাতে বাপ মারা যাওয়ার পরও সে শক্ত হাতে দেশের হাল ধরতে সক্ষম হবে। ছেলের মোগ্যতা অনেক সময় বাপকেও ছাড়িয়ে যায়।
এখানে থেকেই আমি এ সব বিষয়ে খবর নিতে পারব। বলল রাজা জয়পাল। তোমরা জান যে, আমার কাছে গজনীর দুই সেনা কর্মকর্তা বন্দী রয়েছে। আমি এদের কাছ থেকে সুবক্তগীন পুত্রের খবর নিয়ে নিব। তোমরা সৈন্যদেরকে অভিযানের জন্যে তৈরি কর। আমি খুব শীঘ্রই গজনী রওয়ানা করতে চাই। সুবক্তগীনের কোন ছেলেরই তার মতো যোগ্য সেনানায়ক ও কৌশলী যোদ্ধা হওয়ার কথা নয়। আমি আশা করি, অতীতের দু’ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়ে এবার আমরা গজনী দখল করতে সক্ষম হব। এক কুমারী বলিদানের ব্যবস্থাও আমি করেছি। পণ্ডিতেরা ইতোমধ্যে কুমারী সংগ্রহ করেছে। বিশেষ ব্যবস্থায় কুমারীকে তৈরি করার পরই তাকে বলি দেওয়া হবে।
রাজা জয়পাল নেজাম ও কাসেম বলখীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিল। কাসেম ও নেজাম তাকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছিল এই বলে যে, তারা গজনীর সুলতানের বিজয়ের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে তাকে অবহিত করবে। রাজা জয়পাল মুসলিম সৈন্যদের বিজয়ের রহস্য উদঘাটনের লোভে বন্দী গজনী সৈন্য কর্মকর্তাদেরকে রাজমহলের পাশেই একটি সুরক্ষিত কক্ষে নজরবন্দী করে রেখেছিল এবং একজন মুসলিম কর্মচারীকে নিয়োগ করেছিল তাদের আহার সরবরাহ করার জন্য। এই আহার সরবরাহকারী রাজকর্মচারী ছিল গজনীর সুলতানের নিয়োগকৃত গোয়েন্দা। মায়াবী চেহারা, সৎস্বভাব আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই যুবক নিজের নাম পরিচয় গোপন রেখে দক্ষতার সাথে তার গুরুদায়িত্ব। পালন করছিল। জয়পালের রাজ্যের কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব হয়নি যে, রাজপ্রাসাদেই রয়েছে গজনীর চর। কয়েদীদের কক্ষের বাইরে সশস্ত্র প্রহরী সদা দণ্ডায়মান থাকতো। রাজা জয়পাল দু’বার পরাজিত হয়ে গজনী দখলের জন্যে এতই ক্ষিপ্ত ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, এই দু’ বন্দীর প্রতি বহুদিন দৃষ্টি দেয়ার সময়ই পায়নি। রণপ্রস্তুতি ও নতুন সৈন্য রিকুটের ব্যস্ততায় আর গজনী দখলের উন্মাদনায় রাজা গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজও ভুলে গিয়েছিল।
বন্দীদের আহার সরবরাহকারী মুসলিম রাজ কর্মচারী তাদের বলেছিল, তোমরা রাজাকে কৌশলী কথা বলে ধোকায় ফেলবে। গজনী বাহিনীর বিজয়ের সঠিক রহস্য যে কোন মূল্যে গোপন রাখবে। রাজাকে ধোকায় না ফেললে তোমাদেরকে কয়েদখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করবে। বালাজুরীর উদ্দেশ্য ছিল, এরা যদি কৌশলী কথায় রাজাকে আশ্বস্ত ও বিভ্রান্ত করতে পারে, তবে এরা যেমন কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পাবে, জেলখানার যন্ত্রণা থেকেও রক্ষা পাবে। ফলে এদের মুক্তির ব্যবস্থা করার চিন্তা করা যাবে। অপর দিকে রাজা পেশোয়ার না ভিন্ন কোন পথ দিয়ে গজনী আক্রমণ করবে তাও জানা সম্ভব হবে। যেটা তার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“রাজা যদি তোমাদের ডাকে তবে তোমরা তাকে আশ্বস্ত এবং বিভ্রান্ত করবে।” ইমরান বালাজুরী বন্দীদেরকে বলে দিল, আমি শীঘ্রই তোমাদেরকে এখান থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি। এজন্যে তোমরা তৈরি থেকো। হতে পারে এজন্যে আমাকে এখান থেকে গায়েব হয়ে যেতে হবে।
“তুমি কোথায় যাবে?”
সালতানাতের পক্ষ থেকে আমার উপর যে গুরুদায়িত্ব রয়েছে তাও আমাকে পালন করতে হবে। সেই সাথে ব্যক্তি হিসেবে আমার মধ্যে যেহেতু মানবিকতাবোধ রয়েছে সেহেতু আমি নিজ কাঁধে একটি দায়িত্ব চাপিয়ে নিয়েছি সেটিও পালন করতে হবে। তোমাদের সাথে এখন আর কোন কথা লুকানোর নেই। এ ব্যাপারে তোমাদের সহযোগিতা আমার প্রয়োজন হতে পারে।
ঘটনা হলো, জয়পাল দুবার পরাজিত হওয়ার পর পণ্ডিতেরা তাকে দেবতা রুষ্ট হয়েছে বলে বোঝাতে সক্ষম হয় এবং বলে, দেবতার অসন্তুষ্টি থেকে তাকে বাঁচতে হলে এক নির্মল চরিত্রের কুমারীকে বলি দিতে হবে। তাহলে দেবতা খুশি হবে এবং রাজা বিজয়ী হবে। পৌত্তলিক এই জাতিটা জঘণ্য স্বভাবের। কোন স্বামী মারা গেলে তার স্ত্রীকে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় সহমরণ করতে হয়। এই হলো এদের শাস্ত্রীয় বিধান। এরা দেব-দেবীকে খুশি করতে ঠাণ্ড মাথায় মানুষ বলি দিতে পারে। বলছিলাম, বিজয় লাভ ও দেবতাকে খুশি করার জন্যে পণ্ডিতরা এক কুমারী মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বিশেষভাবে এই কুমারীকে বলিদানের জন্যে প্রস্তুত করে কিছুদিন পর বলিদান করা হবে। এই মেয়েটিকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে।
‘এ কুমারীকে বাঁচালে আমাদের ফায়দা কি? বেঈমান কাফের-মুশরিকরা স্বজাতির সব কুমারীকে বলি দিলেও তাতে আমাদের কি?’ বলল নেজাম।
‘এই মেয়েটি আমাকে হৃদয় দিলে ভালবাসত এবং সে আমার সাথে আমাদের দেশে যেতেও রাজী ছিল।’ বলল ইমরান। সে মুসলমানও হতে চেয়েছিল। আমি অনেক আগেই ওকে নিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু গোয়েন্দাবৃত্তির কঠিন দায়িত্ব আমার প্রবৃত্তি চরিতার্থের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ গুরুদায়িত্ব এড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি রাজা জয়পালের ভবিষ্যত পরিকল্পনা এবং তার অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে গজনী যেতে চাচ্ছিলাম। মেয়েটি আমার সাথেই চলে যাবে বলে বায়না ধরেছিল। আর এ সময়ে তোমরা বন্দী হয়ে এলে। তোমাদের ছাড়িয়ে নেয়াও গোয়েন্দা হিসেবে আমার দায়িত্ব। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, তোমাদের এখান থেকে বের করে এক সাথেই আমরা চলে যাবো। কিন্তু একদিন খবর পেলাম, মেয়েটিকে মন্দিরের পণ্ডিতেরা বাড়ি থেকে ওদের বিশেষ বলিদান পর্ব পালনের জন্যে তুলে নিয়ে গেছে। তোমরা আমাকে অপরাধী বল আর জালেম বল– যা ইচ্ছে বলতে পারো, কিন্তু তোমাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, তোমাদেরকে এখান থেকে বের করে কোথাও লুকিয়ে রাখবো এবং ক’দিন পরে এক সাথেই আমরা চলে যাবো। দোয়া করো, আমার দায়িত্ব পালনের চেয়ে এই মেয়ের মহব্বত যেন আমার কাছে বড় হয়ে। দেখা না দেয়।
তার অর্থ হলো, তুমি আমাদের মুক্তির দায়িত্ব থেকে তাড়াতাড়ি অবকাশ পেতে চাচ্ছো, তাই না? বলল কাসেম।
“হ্যাঁ, তাই। যত দ্রুত সম্ভব। মেয়েটির জন্যে আমার রাতে ঘুম হয় না। আর মাত্র কয়েক দিন আছে। এরপর নরপশু মেয়েটিকে জবাই করে ফেলবে।”
ইমরান বালাজুরী বন্দীদশা থেকে মুক্ত করা ও তার প্রেমিকাকে পণ্ডিতদের ৪ আখড়া থেকে বের করে আনার পরামর্শের দুদিন পরই রাজা জয়পাল বন্দীদের তলব করল।
“তোমরা কি আমার জিজ্ঞাসার জবাব দিতে প্রস্তুত? আশা করি তোমরা ০ নিজেদের জীবনের উপর দয়া করবে।” বলল রাজা।
“হ্যাঁ মহারাজ! আপনি আমাদের সাথে যে সৎ ব্যবহার করেছেন, এর প্রতিদানে আপনার যে কোন প্রশ্নের জবাব দিতে আমরা প্রস্তুত।” বলল কাসেম।
“তোমাদের সুলতান সুবক্তগীন মারা গেছে”। বলল রাজা। আকস্মিক সুলতানের মৃত্যু সংবাদে তারা বিমর্ষ হয়ে গেল। কিন্তু ত্বরিৎ তারা নিজেদের সামলে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
“এখন গজনীকে রক্ষা করার মতো আর কেউ নেই। এখন তোমরা আমার সাথী হলে আমার সেনাবাহিনীতে তোমাদের বড় দায়িত্বও দিতে পারি। তবে তোমরা কি বলতে পার, বাবার অবর্তমানে সুলতানের ছেলে মাহমূদ কি গোটা ফৌজের কমাণ্ড দেয়ার যোগ্যতা রাখে? যুদ্ধ পরিচালনায় সে কতটুকু দক্ষ?”
‘সে যুদ্ধে সুলতানের মতো পারদর্শী নয়।’ বলল নিজাম। সে যুদ্ধক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কয়েকটি চালই চালে। এগুলো যদি আপনাকে বলে দেয়া হয় তাহলে সহজেই আপনি তাকে পরাজিত করতে পারবেন। মাহমুদের কৌশলই ছিল আপনার দ্বিতীয়বার পরাজয়ের কারণ।
এরা দুজন রাজা জয়পালকে মাহমূদের রণকৌশল সম্পর্কে যা বলল বাস্তবের সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই। রাজা ওদের কথা শোনার জন্যে জেনারেলদেরও ডেকে আনল। নিজাম ও কাসেম মাহমূদের রণকৌশল জেনারেলদের কাছে ব্যাখ্যা করতে শুরু করল।
কাসেম একটু অগ্রসর হয়ে বলল, আমরা আপনাদের এসব কৌশল হাতে-কলমেও দেখিয়ে দিতে পারব। কিন্তু বন্দী অবস্থায় হাতে-কলমে তা দেখানো কি সম্ভব?
রাজা জয়পাল তখনি বন্দীদের ঘরের পাশ থেকে পাহারা তুলে নেয়ার নির্দেশ দিল । রাত এলো এবং সকাল হলো। পরের দিন ইমরান তাদের জন্য দিনভর অপেক্ষা করল। বসেই রইল সে। বিকেল বেলা রাজমহল থেকে বন্দীদের ডেকে পাঠাল রাজা। ইমরান বার্তাবাহককে বলল, আমি সকাল থেকে তাদের জন্য খানা নিয়ে বসে আছি, কিন্তু তাদের তো দেখছি না!
আসলে ইমরান নিজেই ওদেরকে ঘর থেকে বের করে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল। তাকে কেউ যাতে সন্দেহ না করে কিংবা এর প্রতিক্রিয়া কি হয় তা জানার জন্যে খাবার পরিবেশনের আড়ালে সে-ই তথ্যই সংগ্রহ করছিল ইমরান।
গজনীর কয়েদী নিজাম ও কাসেমকে ইমরানই কৌশল করে ফেরার করিয়েছে এ সন্দেহ কেউ করেছে বলে মনে হয়নি ইমরানের। এই অপারেশনে সে সফল হলো বটে কিন্তু ইমরানের প্রেমিকা হিন্দু কুমারীকে পণ্ডিতদের দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে মুক্ত করার কঠিন কাজটা রয়ে গেল। এমন একটি মেয়ে যে ইমরানের প্রেমে নিজের ধর্ম, দেশ ও জাতিকে ত্যাগ করতেও আগ্রহী, তাকে নিশ্চিত পণ্ডিতদের বলির খড়গাঘাত থেকে রেহাই করা তার জন্যে যেমন জরুরী তেমনই কঠিন।
ইমরান সুদর্শন, পরিপাটি, অমায়িক যুবক। সে নানা রূপ ধারণ করতে পারে এবং সে নানা ঢংয়ে কথা বলতে ওস্তাদ। ভাষাও জানে একাধিক। ওর কথা যাদু মাখা। প্রকৃতপক্ষে ইমরান ছিল সে সব সুপুরুষের মতো আল্লাহ প্রদত্ত সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী বিপরীত লিঙ্গের মানুষ যাদেরকে দেখতে বারবার পিছন ফেরে তাকাতে বাধ্য হয়। ইমরান কোন শাহাজাদা ছিল না বটে, সামান্য এক রাজকর্মচারী। কর্মচারীর পোশাক পরতো, তাদের মতই কথা বলতো, কিন্তু রাজকর্মচারীর আড়ালে সে ছিল গজনীর দক্ষ গোয়েন্দাদের অন্যতম। সে পাঞ্জাবী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতো। কখনো কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি যে, এই আত্মপরিচয়হীন লোকটি রাজা জয়পালের জন্যে ভয়ঙ্কর এক বিপদ ডেকে আনতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরে সে লাহোর থাকছে। শহরের একটি ঘরে একাকী থাকে। তার প্রতিবেশীরা তার সম্পর্কে জানত, সে রাজমহলের এক বিশেষ কর্মচারী। এছাড়া বেশি কিছু জানতো না। আর জানতো, সে মুলতানের অধিবাসী। অনেক রাত করে সে বাড়ি ফিরতো। তার সমবয়স্ক এক ব্রাহ্মণ হিন্দু জগমোহনের সাথে ছিল তার সখ্য। জগমোহনের বাবা ছিল ব্যবসায়ী।
গভীর রাতেও জগমোহনকে ইমরানের ঘরে আসতে দেখেছে প্রতিবেশীরা। ইমরান-জগমোহনের মতো এমন হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্ব প্রতিবেশীরা দ্বিতীয়টি দেখেনি। এলাকাটি ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে সাধারণত হিন্দুরা ঘৃণা করতো। হিন্দু পণ্ডিতেরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রজাদের মনে ঘৃণা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই জগমোহন ইমরানের আচরণে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিল। ধীরে ধীরে তাদের মনে সৃষ্টি হয় এক গভীর হৃদ্যতা। প্রতিদিন দুজনের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ না হলে, কথা না হলে পেরেশান । হয়ে যায় তারা। জগমোহন রাত দুপুরে এসেও ইমরানের ঘরে হানা দেয়। কখনও সে ইমরানের ঘরে রাত কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফেরে।
পরিচয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি ঘটনা। একদিন ইমরান জগমোহনের বাড়িতে তাকে খুঁজতে গেল। দেখে, মোহন কাঁদছে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে মোহন বলল, “আজ আমার বড় বোনটিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।”
“কে পুড়িয়ে মারল?” জিজ্ঞেস করল ইমরান।
“আমার ধর্ম!”
বোনটির বিয়ে হয়েছিল এক বছরও হয়নি। ওর স্বামী ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়। কিছু দিন রোগে ভুগে আজ মারা গেল। ওর লাশ চিতায় রেখে ওর ভাইয়েরা আমার বোনটিকেও চিতায় দাঁড় করিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। তুমি হয়তো চিতা দেখনি ইমরান। চৌকোণা বিশিষ্ট একটি লোহার পাকা ভিটিতে এক মানুষ সমান কাঠখড়ি পরতে পরতে বিছিয়ে দিয়ে মধ্যে শবদেহ রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আমি শবদেহ পোড়ানোর দৃশ্য সহ্যই করতে পারতাম না, কিন্তু আজ আমার বোনকে জীবন্ত দগ্ধ হতে দেখলাম!
হিন্দু মেয়েরা পূত চরিত্রের অধিকারী দাবী করে বলা হয়, মৃত স্বামীর চিতায় জীবিত স্ত্রীকেও জ্বলতে হয় । মৃত স্বামীর চিতায় জীবিত স্ত্রীর মরে যাওয়াকে ‘সতীদাহ’ বলা হয়। কোন মহিলা যদি সহমরণে অনীহা দেখায় তবে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে থেকেও বিরত থাকতে হয়।
হিন্দু ধর্মের লোকেরা মনে করে, স্ত্রী যদি সহমরণ না করে তবে স্বামীর অবর্তমানে মানবিক দুর্বলতার সুযোগে সে যে কোন সময় অসতী হয়ে যেতে পারে। এজন্য মেয়েরাও সহমরণকেই গ্রহণ করে। আমি নিজেও সতীদাহ প্রথার পক্ষে ছিলাম, কিন্তু আদরের বোনটিকে জীবন্ত পুড়ে মারতে দেখে এটা মেনে নিতে পারছি না। আমার কাছে এই রীতি জঘন্য এক বর্বরতা। প্রকৃত প্রস্তাবে কোন মহিলা-ই সাগ্রহে স্বামীর চিতায় জ্বলে মরতে চায় না। আমার বোনও চিতায় জ্বলতে চায়নি। তাকে টেনে হেঁচড়ে চিতায় তোলা হয়েছে। তার দুটো পা রশি দিয়ে চিতার সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে, যাতে সে চিতা থেকে পালাতে না পারে। আমাকে বোনটি খুব আদর করতো। কিন্তু আমি বোনটির জীবন রক্ষায় কিছুই করতে পারিনি। প্রায় দেড়-দু’শ লোক চিতার পাশে দাঁড়িয়েছিল। কেউ । তার বাঁচার আকুতি শুনে এগিয়ে যায়নি। এই মানুষগুলো ধর্মের শিকলে বাঁধা এক একটি হিংস্র জীব। চিতার আগুনে যখন কাঠ ও বাঁশগুলো পোড়ার শব্দ হচ্ছিল ক্ষোভে-দুঃখে আমার হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। আমি আমার বোনের চিতার দিকে তাকাতে পারছিলাম না, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম অন্যদিকে। আমার বোনের আর্তনাদ ও চিৎকার আমার হৃদপিণ্ডে বারবার ধাক্কা দিতে থাকে।
ওর চিৎকার শুনে আমি চকিতে চিতার দিকে তাকিয়ে দেখি, বোন বাঁচার জন্যে ছটফট করছে, বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছে। ওর চিৎকারের পর বেশি করে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হল। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় ওর সারাদেহ জ্বলে গেল, ওর বেঁচে থাকার আকুতি চিরদিনের জন্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিল, চেতনা হারিয়ে যাচ্ছিল। দ্রুত কোন মতে শরীরটাকে টেনে সেখান থেকে চলে এসেছি। এখনও আমার কানে বোনটির চিৎকার ভেসে আসছে। এই বর্বর ধর্মের প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মেচ্ছে। যে ধর্ম জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারে তা কি কোন ধর্ম হতে পারে? ধর্ম মানুষকে উন্নত জীবনের পথ দেখায়। নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারার নাম ধর্ম নয়- এটা ধর্ম হতে পারে না কক্ষণও।”
“ধর্ম মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেয় না। ধর্মে বর্বরতার কোন প্রশ্রয় নেই। আমি তোমাকে আমার ধর্মের দাওয়াত দিচ্ছি না কিন্তু এটা সত্য যে, আমার ধর্মে নারীকে সম্মান করা হয়। কারো স্বামী মারা গেলে চার মাস পরই সে ইচ্ছে করলে আবার বিয়ে করতে পারে। বিধবার বিয়ের বয়স থাকলে সমাজের লোকেরা-ই তার পুনঃ বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। বিধবার প্রতি সকলে সহমর্মিতা দেখায়।” বলল ইমরান।
আমাদের পণ্ডিতেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরও বলি দেয়। বলল মোহন। দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা বা অনাবৃষ্টি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছলে ছোট মেয়েদের ধরে এনে পণ্ডিতেরা বলি দিয়ে, লাশ জ্বালিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্যে দেবতাদের খুশি করে। বলে, এক কুমারী মেয়েকে বলি দিলে বড় দেবতা খুশি হবে, রাজাও বিজয়ী হবে। এই কুমারী বলি দানের আয়োজন চলছে। যার ফলে কোন কুমারী মন্দিরমুখী হতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে।
‘কুমারী বলীদান কখন হবে?’
‘পণ্ডিত বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কুমারী তালাশ করছে। জগমোহন বলল। পণ্ডিতেরা বিশেষ গুণের কুমারী বাছাই করার জন্যে সবাইকে তাদের কুমারী মেয়েকে মন্দিরে পাঠাতে বলেছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত পণ্ডিতেরা পছন্দনীয় কুমারী পায়নি বলে শুনেছি।’
‘তোমাদের কি কোন কুমারী বোন আছে?
‘আমার একটি কুমারী বোন আছে। কিন্তু আমি তাকে মন্দিরে যেতে দেই না। আমার বাবাও বলেছে ও যেন মন্দিরে না যায়। আমার বোন খুব সুন্দরী। আমার ভয় হয় পণ্ডিতেরা দেখলে ওকেই পছন্দ করবে।
জগমোহনের মন দুঃখভারাক্রান্ত ছিল। ইমরানের সাথে কথা বলে আনন্দ পেল।
“তুমি তোমার বোনকে মন্দিরে যেতে বারণ করে ভাল করেছ। রাজা জয়পালের পরাজয় হয়েছে তার ভুলের কারণে। সে আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছে। সেই সাথে জাতিকেও ধোঁকা দিচ্ছে। এর চেয়েও মারাত্মক হলো, তোমাদের ধর্মীয় পণ্ডিতেরা গোটা জাতি ও রাজাকে প্রতারণা করছে। তারা শুধু রাজার সন্তুষ্টিতে ব্যস্ত। রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে এরা সব রকম প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। অবশ্য এ ধরনের ধোকাবাজি মুসলমানদের মধ্যে আছে। এক ধরনের ভণ্ড প্রতারক পীর ও ফকিরেরা ধর্মের লেবাসে এসব করে থাকে। খৃস্টান ধর্মেও ওদের পাদ্রীরা ধর্মের প্রকৃত বিধানকে বিকৃত করে শাসকদের মন জয় করার জন্যে নানা উপাচারের জন্ম দিয়েছে। পণ্ডিতদের বলা উচিত ছিল, রাজা যাতে নিজের ত্রুটি এবং সুলতান সুবক্তগীনের সাফল্যের নেপথ্য কারণগুলো উদঘাটন করে। কিন্তু পণ্ডিতেরা সেই অপ্রিয় সত্য কথাটি বলেনি, যাতে রাজা নারাজ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরা রাজাকে খুশি করার জন্যে দেবতা নারাজের গল্প ফেঁদেছে। আর কুমারী বলি দানের আজগুবী সমাধান দিয়েছে।
তোমার ধর্মের যে খারাপ দিকটির কথা বলেছো তা ধর্মীয় বিধান নয়, ধর্মগুরুদের সৃষ্টি। মানুষের সৃষ্ট বিদআতে আমাদের ধর্মে অনেক বিকৃতি দেখা দিয়েছে। রাজা-বাদশাহ ও ক্ষমতাবানদের খুশি করার জন্যে আমাদের কিছু মৌলভী-ইমাম সাহেবরা ধর্মের বিধান বিকৃত করছে। অথচ না ধর্মীয় বিধানে এমন আছে, না মানুষের বিবেক এমনটি করতে বলে। কিন্তু লোভী ধর্ম ব্যবসায়ীরা বিকৃতিগুলোতে ধর্মের লেবেল এঁটে দিয়েছে। শাসকরা যদি নিজেদের ক্ষমতা রক্ষায় ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তবে কিছু ধর্মীয় পণ্ডিত ধর্মের বিধান বিকৃত করে ক্ষমতাবানদের আশ্রয় দেয়। যদি ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে প্রজাপীড়ন শুরু করে, প্রজাদের সাথে জুলুম, অত্যাচার, ধোকা, প্রতারণা শুরু করে, তবে একদল ধর্মীয় লেবাসধারী লোক শাসক শ্রেণীর জুলুমকে ধর্মীয় বৈধতা দিতে এগিয়ে আসে। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম প্রবর্তিত হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু বিকৃতির কারণে আজ ধর্মের প্রতি মানুষের অনীহা সৃষ্টি হয়েছে।”
“আচ্ছা, তোমাদের ধর্মেও কি নরবলীর বিধান আছে?” ইমরানকে জিজ্ঞেস করল মোহন।
“না! আমাদের ধর্মে এমন কর্মকাণ্ডকে হত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আমাদের কোন ধর্মীয় পণ্ডিত যদি কাউকে বলী দেয় তবে তাকে অবশ্যই হন্তারক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
হ্যাঁ। মুসলমানরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে শুধু জিহাদের ময়দানে ধর্মের সুরক্ষার জন্যে। সুলতান সুবক্তগীন এ কাজটিই করেছেন। তার বিজয়ের নেপথ্য কারণও এটি। তিনি ইসলামের জন্যে সাধারণ মুসলমান ও সৈন্যদের এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, তারা জাতির ও ধর্মের মর্যাদা রক্ষার্থে যুদ্ধ-ময়দানে জীবন ত্যাগ করতে সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকে। আমি তোমাদের ধর্মকে হেয় করার উদ্দেশে বলছি না, প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করার জন্যে বলছি, আমরা এক প্রভুর ইবাদত করি। আমাদের ধর্মে একাধিক প্রভু নেই। একটু জ্ঞান খাটালে এ সত্য তুমিও উপলব্ধি করতে পারবে। এসব ভূত যেগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো তো মাটির তৈরি। এগুলো মন্দিরের শোভা বর্ধন ছাড়া কিছুই কি করতে পারে? ওদের গায়ে মশা-মাছি বসলেও, পশুরা পেশাব পায়খানা করলেও তাদের এতটুকু শক্তি নেই যে ওদের তাড়াবে। এরা নিষ্প্রাণ। একটু সাহস করে এসব ভূতকে যদি তুমি টুকরো করে ফেলো, এরা পারবে না এদের ভগ্নাংশগুলো জোরা দিয়ে নিজেদের পূর্বের অবয়ব ফিরিয়ে আনতে। এই যদি হয় দেবতাদের অবস্থা, তাহলে এরা পূজারীদের কিই বা উপকার-অপকার করতে পারবে! এর বিপরীতে আমাদের প্রভু শুধু মসজিদে থাকেন না, সব জায়গায় সব সময় তিনি উপস্থিত রয়েছেন। তিনি আমাদের অন্তরে বিরাজ করেন। তিনি কোন মানুষের রক্ত পিপাসু নন, কোন কুমারীকে তার সন্তুষ্টির জন্যে বলী দেয়ার দরকার হয় না।”
ইমরানের কথাগুলো বিপর্যস্ত ভগ্ন হৃদয় মোহনের হৃদয়রাজ্যে সান্ত্বনার ছোঁয়া দিচ্ছিল। সেই সাথে তার জীবন্ত বোনকে অগিভস্ম করায় হিন্দু ধর্মের প্রতি তার ঘৃণা সৃষ্টি হলো।
তোমার কষ্ট ভাগ করে নেয়ার মতো নয়। আমি সহমর্মিতা ও দুঃখ প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু তোমাদের দুঃখ লাঘব করার সাধ্য আমার নেই। তবে তোমাকে এই আশ্বাস দিচ্ছি, যদি তোমার কোন প্রয়োজনে আমাকে স্মরণ কর তবে কাছে পাবে- বলল ইমরান।
দুঃখক্লিষ্ট মানুষের জন্যে এতটুকু সান্ত্বনার কথাও অনেক বড় সাহায্য। মানুষের মন যখন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন মানুষের কাছে বৈষয়িক সাহায্যের চেয়ে আন্তরিকতার ছোঁয়া অনেক বেশি উপকারে আসে। এটা কষ্টের উপর সুখের প্রলেপ দেয়। হৃদয়বান ব্যক্তিদের পক্ষেই দুঃখী মানুষের এরূপ উপকার করা সম্ভব হয়। দুঃখের এই মুহূর্তে ইমরানের উপস্থিতি ও সান্ত্বনায় জগমোহনকে ইমরানের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত করল। একদিন ইমরানের ছুটি ছিল, সেদিন মোহন তাকে শিকারে নিয়ে গেল। ইমরান তীর ধনুক সাথে নিয়ে গিয়েছিল। দুজন মিলে বহু পাখি শিকার করে বাড়ি ফিরল।
ফেরার পথে মোহন ইমরানকে বলল, তুমি অনর্থক আমাকে দিয়ে এই সব পাখি বধ করালে। তুমি জান আমি বামুনের ছেলে। আমাদের জন্য প্রাণীবধ নিষেধ, দ্রুপ গোত খাওয়া নিষিদ্ধ।
‘গোশত খেলে তোমাদের ধ্যান-ধারণাও বদলে যাবে। আজ আমি তোমাকে গোশত্ খাইয়ে ছাড়ব। দেখো, এতে যদি তোমাদের দেবদেবী আমাকে কোন বিপদে ফেলে তবে সেই বিপদ ও শাস্তি আমি বরণ করে নেব।’
ইমরান পাখিগুলোর পালক ছাড়িয়ে মসলা দিয়ে চুলোর আগুনে সেঁকে কাবাব তৈরি করল। মোহন এসবে হাত দিতেই ভয় পাচ্ছিল। বেশি সাধাসাধি না করে ইমরান নানাভাবে এগুলোর স্বাদ ও উপকারিতা বলে যাচ্ছিল। বলছিল, আমাদের প্রভু মাত্র কয়েকটি ঘৃণিত জিনিস ছাড়া সব জিনিস খাওয়া বৈধ করে দিয়েছেন। মানুষের জন্যে আমাদের ধর্ম এমন কঠিন কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি যা মানুষের জীবন ধারণে কষ্ট সৃষ্টি করে। মোহন কাঁপা হাতে পাতিল থেকে একটু করে গোশত মুখে পুড়ে নিল। জীবনে এই প্রথম সে গোশতের স্বাদ নিল। কিন্তু নিমিষেই গোটা একটি পাখি খেয়ে ফেলল মোহন। বলল, ‘দাও! আরো খাব।’
আরো একটি পাখি খেল মোহন। বলল আরেকটি খাব। এভাবে কয়েকটি ভুনা পাখি খেয়ে মোহন গোশতের স্বাদে যখন মত্ত হয়ে পড়েছে, তখন ইমরান তাকে বারণ করল। না, আর খাবে না। হঠাৎ করে এসব গুরুপাকে বেশি আহার করলে তোমার পেট খারাপ হতে পারে। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে হবে। আমার ঘরে তো যাতায়াত আছেই। আমি তোমাকে মাঝে মধ্যে গোত দিয়ে আপ্যায়িত করব।
ইমরানের নিষেধ সত্ত্বেও সে আরো দুটি পাখি গলাধঃকরণ করল এবং এই যুক্তি দিলো যে, কতক্ষণ দৌড়ালে হজম হয়ে যাবে।
এরপর মোহন যতবার ইমরানের ঘরে যেতে, গোশতের বায়না ধরতো। ইমরান তার চাহিদানুযায়ী গোশতের ব্যবস্থা আগেই করে রাখতো। ইমরানের
কথার যাদুই হোক বা গোশতের স্বাদই হোক মোহন পুরোপুরিই ওর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠল।
‘তুমি কি মন্দিরে যাও?’ একদিন মোহনকে জিজ্ঞেস করল ইমরান।
“মাঝে মধ্যে যাই। অবশ্য কিছুদিন ধরে নিয়মিত একটি রীতি পালনের জন্যে যাওয়া হয়।” বলল মোহন।
তুমি যেসব মূর্তির সামনে পূজা-অর্চনা কর একদিন ওদের কানে কানে বলবে যে, তুমি গোশতখোর হয়ে গেছে। খেয়াল করো তোমাদের হাতে তৈরি এসব দেবদেবী তোমাকে কি জবাব দেয়। বলল ইমরান।
দেখবে ওরা কিছুই বলবে না। এতদিন যাবত তুমি গোশত খাও, কোন শাস্তি কি তোমাকে দিতে পেরেছে হা! যদি দুর্ভাগ্যক্রমে তোমাদের কোন পণ্ডিত পুরোহিতের কানে এ খবর চলে যায় তবে গোটা পরিবারের উপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেবে।
এসব শুনে মোহন নিজ ধর্মের প্রতি আরো বিদ্বেষী হয়ে উঠল।
এক সন্ধ্যাবেলা। ইমরান একাকী ঘরে বসে রয়েছে। অনিন্দ্য সুন্দরী এক তরুণী তার দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল। কিশোরীর গায়ের রঙ দুধে আলতা । দীঘল কালো চুল, তার পিঠ জুড়ে যেন কৃষ্ণ বন্যা। একজোড়া চোখ যেন সাগরের মতো উচ্ছল, দীঘির পানির মত স্বচ্ছ। তার কথা, চাওনি, হাটা-চলাও দৃষ্টি কাড়া।
মোল সতের বছরের এই তরুণী এতই মোহনীয় যে, তার চেহারা থেকে
পুরুষের জন্যে কঠিন পরীক্ষা। অপরিচিত এই যুবতাঁকে ঘোর সন্ধ্যায় ঘরে দেখে ইমরান ভাবনায় পড়ে গেল।
‘আপনিই কি ইমরান বালাজুরী?
‘হ্যা! আমিই।‘
“আমি জগমোহনের ছোট বোন। আমার নাম ঋষি। আমি দাদার খোঁজে এসেছি। বাবার অবস্থা খুব শোচনীয়। ঘরে কোন পুরুষ নেই যে কোন ডাক্তার-বৈদ্য ডেকে আনবে। আমি জানতাম, দাদা আপনার এখানে আসে।”
“হ্যাঁ! আসে। তবে অনেক রাতে আমার এখানে আসে। আচ্ছা, আমি তোমার সাথে আসছি, চেনা পরিচিত কোন বৈদ্যকে ডেকে নিয়ে আসব।”
“আপনি কি এখানে একাই থাকেন?” জিজ্ঞেস করল ঋষি।
“বিলকুল একা।”
“আপনার বিবি নেই।” “এখনও বিয়ে করিনি।” হিন্দু মেয়েটির চেহারার নিরুদ্বেগ ভাব আর মুচকি হাসি দেখে ইমরান বুঝে ফেলল, বাবার অসুখের কথা বললেও এই মেয়ে এতো সকাল সকাল উঠবার নয়। ইমরানের চেহারা ও কথা মেয়েটিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসিয়ে রাখল।
“আপনি বিয়ে করেননি কেন?”
“ঋষি তোমার বাবা অসুস্থ। তোমার জলদি ঘরে ফেরা দরকার। আজ নয় অন্য দিন এসব ব্যাপারে কথা বলব।” বলল ইমরান।
“অসুখটা ততো গুরুতর নয়। এমনিতেই আপনার ঘরে একটু বেশি সময় বসলাম। আপনার ভাল না লাগলে উঠি। দাদার কাছে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। এজন্যে আপনাকে দেখার খুব শখ ছিল। সত্যিই আপনি সুন্দর, চমৎকার। আমার দাদাটা অধিকাংশ সময় উদাস থাকে। ইদানীং আহারাদিও ঠিকমত করে না।”
ইমরানের একবার ইচ্ছে করছিল, ঋষিকে বলে দেবে যে, মোহন প্রতিরাতেই তার ঘর থেকে গোশত খেয়ে বাড়ি ফেরে, তাই সে আহার তো কম করবেই। কিন্তু এটা ছিল খুবই গোপন একটি ব্যাপার। গোপনীয়তা রক্ষার্থে সে বিষয়টি চেপে বলল, যে নিজের আদুরে বোনকে জীবন্ত পুড়ে মরতে দেখেছে তার মধ্যে উদাসীনতার ভাব আসাটা স্বাভাবিক। তুমিও মনে হয় বোনের মৃত্যতে অনেক কষ্ট পেয়েছে, তাই না ঋষি
কষ্টের কথায় ঋষির কণ্ঠ থেকে ‘আহ’ বেরিয়ে এলো। তার চোখে ছলছল করছে পানি। ধরা গলায় বলল, “জানিনা, আমার ভাগ্যেও হয়তো জীবন্ত পুড়ে মরাই রয়েছে। এজন্য ইচ্ছে করে জীবনে বিয়েই করব না।”
ইমরান তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিল ঋষির দিকে। ঋষিও মুগ্ধের মতো ইমরানের চেহারায় কি যেন খুঁজে ফিরছিল। ইমরান অনুভব করছিল, হতাশার সাথে সাথে কি যেন এক স্বপ্ন ঋষির হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে। শরীরের সৌন্দর্য আর ধর্মের সীমানার মাঝে আশা-দুরাশার দোলাচলে ঋষিদের গোটা পরিবার আজ দুলছে। ঋষিও বিধি-নিষেধে বাঁধা বামুন পরিবারের এক অসহায় তরুণী। যার পক্ষে এই বিধি-নিষেধের দেয়াল টপকানো সত্যিই বড় কঠিন। ঋষি হয়তো ইত্যবসরে ইমরানকে দেখে এসবই ভাবছিল। তার স্বপ্নের পায়রারা অনেক দূর উড়াউড়ি করে কোন নীড় খুঁজে না পেয়ে ক্লান্তি ও হতাশায় ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল।
“না, ঋষি না। তোমাকে জ্বলতে হবে না । আমি তোমাকে কখনও জ্বলতে দেবো না। তুমি যদি মরেও যাও, তবুও আমি তোমার লাশ চিতা থেকে তুলে নিয়ে আসব।” আবেগের আতিশষ্যে ঋষির কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল ইমরান।
ইমরানের স্পর্শে ঋষি ভরকে গেলো। ইমরান নিজেকে সামলে স্মিতহাস্যে বলল, দুঃখিত ঋষি। আমাকে ভুল বোঝ না। সত্যিই আমি বুঝে উঠতে পারছি না, তোমাদের ধর্মে নিরপরাধ মহিলাদের কেন জ্বালিয়ে মারা হয়। তোমাদের পণ্ডিত পুরোহিত ও সমাজের মানুষেরা কেন এতো নির্দয় ও পাষাণ!
তুমি আমার ভাগ্য বদলাতে পারবে না, ইমরান। ঋষি ইমরানকে আপনি থেকে তুমি সম্বোধনে নেমে এল। ইমরান তন্ময় হয়ে ঋষির দিকে তাকিয়ে আছে। উভয়ের কণ্ঠ নীরব। কারো মুখে কথা নেই। ইমরান ঋষির আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলল, “আমি তোমার ভাগ্য বদলে দেবো ঋষি।” ক্ষীণকণ্ঠে ইমরান বলল, “তুমি যদি আমার সাথে থাকো, তবে যে কোন অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা প্রভু আমাকে দেবেন।”
“আগামীকাল কি আসব?” জিজ্ঞেস করল ঋষি।
“ঠিক এ সময়ে। তবে কেউ যেন দেখতে না পায়। ধর্মের বৈপরিত্য আমাদের জন্যে কঠিন বাধা। কেউ তোমার আসা আঁচ করতে পারলে কেলেঙ্কারী বেধে যাবে। জগমোহন আমাকে বলেছে, তোমাকে মন্দিরে যেতে দেয়া হয় না। এর কারণও সে আমাকে বলেছে।”
“আমি কোন দেবতার জন্যে বলী হতে চাই না। আমি দিনে ঘরের বাইরে বের হই না। কোথাও যেতে হলে রাতেই যাই।”
“আগামীকাল এলে কথা হবে। তুমি বাড়ি যাও। আমি কোন হেকিম না হয় বৈদ্য নিয়ে তোমাদের বাড়িতে আসছি।”
ঋষিকে বিদায় জানাতে ইমরান দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল। ঋষি থমকে দাঁড়াল। উভয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পাশাপাশি।
“আমি কোন অপরিচিত পুরুষের সান্নিধ্যে কখনও এত ঘনিষ্ঠ হইনি। তোমারও ঘনিষ্ঠ হতে ভয় করে। আমরা মুসলমানদের সম্পর্কে কখনও ভাল কিছু শুনিনি। দাদা যদি তোমার সম্পর্কে না বলতো, তবে এখানে আসার দুঃসাহস কখনও হতো না। তোমার সাথে কথা বলে আমি মুগ্ধ।”
উভয়ে হাতে হাত ধরে দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এল। তার মধ্যে চলে যাওয়ার কোন তাড়া নেই। ইমরান ইচ্ছে করেই তার হাতটা ধরেছিলো। ঋষিও তার হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে না। ঋষি পরম স্বস্তিতে যেন এক সাহসী নিষ্ঠাবান মুসলিম যুবকের হাত ধরে পৌত্তলিক ধর্মের মৃত্যু সাগর পাড়ি দিতে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই ঋষি ইমরানের হাত ছাড়িয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। ঋষি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ইমরান ঘর থেকে বেরিয়ে এক হেকিমের কাছে রওয়ানা হল।
হেকিমকে জগমোহনদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই ইমরান ঘরে চলে এলো। বাড়িতে প্রবেশ করে বারান্দায় পা রাখতেই ইমরান টের পেল কে যেন গেটের দরজা খুলে আবার বন্ধ করেছে। কেউ প্রবেশ করছে কি-না দেখতে পিছন ফিরে তাকাতেই ইমরানের মনে হল কোন নারী। ভাবল আবার ঋষি আসেনি তো? কাছে আসতেই দেখল জামিলা। তুমি এই সময় কি করে এলে? জিজ্ঞেস করল ইমরান।
“আগে বল এই হিন্দু পেত্নী এখানে এলো কেন?”
শুধু এটাই জানতে এসেছি, এই হিন্দু মেয়েটি এখানে কেন এসেছিল? আমি কি এতই নচ্ছার যে, শুধু দূর থেকেই আমার সালামের জবাব দিয়ে চলে যাবে। আমার প্রস্তাবের জবাবে তুমি বারবার একথাই বলছো, তোমার স্বামীকে আমার ভয় করে, দয়া করে তুমি আমার ঘরে এসো না।
ইমরান গেটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে জামিলাকে ঘরে নিয়ে এল। এ ঘরেই একটু আগে ঋষি বসেছিল।
সে তার ভাইকে এখানে খুঁজতে এসেছিল। জামিলাকে বলল ইমরান। আজই আমি তাকে দেখলাম। ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, পরিচয়ও নেই। জামিলা! আমি তোমার সাথেও কোন সম্পর্ক রাখতে পারব না। তুমি একজন বিবাহিতা মুসলিম মহিলা। তোমার স্বামী আছে। তোমার সালাম ও পয়গাম তো উদ্দেশ্যমূলক। তুমি চাও শারীরিক সম্পর্ক। তোমার পয়গাম গ্রহণ করে গুনাহগার হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
“যাকে তুমি আমার স্বামী বলছো, সে আমার একার স্বামী নয়। তার তিন বিবি বর্তমান। আমি তন্মধ্যে ছোট। আমার বয়স এখনো বিশের কোঠা পেরোয়নি। স্বামীর বয়স আমার তিনগুণ। সে টাকার জোরে তিন বিবি পুষছে। আল্লাহ টাকা ছাড়া তাকে তিন বিবি রাখার মতো না দিয়েছে সৌন্দর্য, আর তার আছে দৈহিক সামর্থ্য। তার মতো নির্বীজ পুরুষ যদি টাকার জোরে তিন বিবি রাখতে পারে তবে একজন সামর্থ্যবান নারীর কি দুই স্বামী রাখা দোষণীয়? মেয়েদেরকে কেন তাদের পছন্দনীয় পুরুষের সংস্পর্শে যেতে নিষিদ্ধ করা হল। পুরুষদের এই অধিকার কেন দেয়া হলো যে, তারা ইচ্ছেমত তিন-চারজন করে যুবতী স্ত্রী-বিবি রাখতে পারে।
“এতে আমার কি অপরাধ? আমি তো পুরুষদেরকে তিন চার বিবি রাখার অনুমতি দেইনি। ঠিক মেয়েদেরকেও একাধিক স্বামী গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আমি, আরোপ করিনি। আমি তোমার সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখতে অপারগ এতটুকু বলেছি। দয়া করে তুমি চলে যাও। তোমার স্বামী যদি জানতে পারে যে, তুমি এখানে আসো, তবে আমার খুব বিপদ হবে।”
সে এখানে নেই! পেশোয়ার গেছে ব্যবসায়িক কাজে। এক মাসের মধ্যে সে ফিরবে না। সে আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমি এমন অসুখের অজুহাত দেখলাম যে, সে ভড়কে গেলো। সে অন্য এক বিবিকে সাথে নিয়ে গেছে, সেটি আমার থেকে তিন বছরের বড়। এর বড়টা কোথায় যেন গেছে। অনেক রাত পর বাড়ি ফিরবে। সে আমাকে কোথাও যেতে বাধা দেয় না, আমিও তাকে যেতে বাধা দেই না। তুমি আমাকে মুসলমান বলছো। আমি নামে মাত্র মুসলমান। আমার বাবা-মার ঈমান হলো সোনা চাদি। মোটা অংকের পণ নিয়ে তারা আমাকে এই বুড়োটার হাতে তুলে দিয়েছে। ধর্মের প্রতি আমার আদৌ কোন আগ্রহ নেই। আমাকে শিখানো হয়েছে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নারীর জন্ম। আমি পুরুষের প্রমোদ সামগ্রী হয়েছি, তাই আমিও আমার জীবনের প্রমোদ সঙ্গী খুঁজে নেয়ার অধিকার রাখি। আমি তোমাকেই বানাতে চাই আমার সুখের সঙ্গী। তুমি বল! কি তোমার চাই। এর জন্যে কি মূল্য দিতে হবে তোমাকে। আমি কি এই হিন্দু মেয়েটার চেয়ে কম সুন্দরী?
“আমি তোমার স্বামীর কাতারের লোক নই। তোমার রূপ-লাবণ্য আর সৌন্দর্যের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। নারীর প্রতি আসক্তি থাকলে একাধিক না হলেও এ পর্যন্ত অন্তত একটি বিয়ে ভো করতে পারতাম। কারো রূপ-লাবণ্যের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই, নিজের চেহারার প্রতিও আমার লক্ষ্য নেই। তুমি আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। মুসলিম নারীর সম্পদ হলো সতীত্ব। মনের কালিমা দূর করে নিজেকে পবিত্র কর।”
“তুমি একটা গবেট, ভীতু। নিজেকে বঞ্চিত এবং প্রতারিত করছ তুমি। আমার শরীরের আত্মা বলতে কিছু নেই। যেসব মেয়ে বাজারে টাকার মূল্যে বিক্রি হয় এদের কোন প্রাণ থাকে না, মরে যায়। তুমি কি আমার মৃত জীবনটাকে জীবিত করতে পার ইমরান?”
“তাহলে স্বামীর কাছ থেকে তুমি তালাক নিয়ে নাও। তারপর আমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হও।”
এটা সম্ভব নয় ইমরান! আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাই। যতো টাকা-পয়সা লাগে আমি সাথে নিব। তুমি যেখানে নিয়ে যেতে চাও সেখানেই যাব। তবুও তুমি আমাকে রক্ষা কর। একটু সুখ তুমি আমাকে দাও। জামিলা কামোদ্দীপ্ত হয়ে ইমরানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার জিঞ্জির থেকে ছুটতে পারো না ইমরান। স্বামী ছাড়া আমি কারো সাথে মিলিনি। কিন্তু বহুদিন যাবত পিপাসার্ত আমি। আমার হৃদয় তোমাকে পেতে পাগল হয়ে গেছে। আমার শরীর কামনার আগুনে জ্বলে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে, তুমি আমাকে বাঁচাও ইমরান!
“তুমি প্রবৃত্তির আগুনে নয়, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছ। এই আগুনে তোমার বাবাকে জ্বালাও। যে লোক টাকার বিনিময়ে বুড়ো লোকের কাছে তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। এরপর একইভাবে স্বামীকেও সেই আগুনে নিক্ষেপ কর।”
“আচ্ছা বল, তুমি আমার সঙ্গী হবে?”
“কি করতে চাও তুমি?”
“আমি স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব। কিন্তু তুমি আমাকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে।” গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলে ইমরান। এ সুযোগে জামিলা একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। চরম উদ্দীপ্ত জামিলা। ভাবল এবার শিকার কজায় এসে গেছে।
ওকে দুহাতে সরিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাকে সঙ্গ দেবো। কিন্তু স্বামীকে সে দিন বিষ খাওয়াবে যে দিন আমি বলব। এর মধ্যে আমি কোথাও জীবিকার ব্যবস্থা করে নেব।
“ধোকা দিচ্ছ না তো?”
“না।“
“আমাকে তোমার ঘরে আসতে বাধা দেবে না তো?”
“না আসলেই ভাল হবে। কারণ তোমার আমার সম্পর্কের ব্যাপারে কারো সন্দেহ সৃষ্টি হোক তা আমার কাম্য নয়।” বলল ইমরান।
আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল জামিলা। এবার ইমরান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেল। জামিলা ঋষির মতোই সুন্দরী এবং কামনাদীপ্ত একটি আগুনের কুণ্ডলী। অতৃপ্ত বাসনা তাকে অন্ধ করে দিয়েছে।
জামিলার স্বামীর বাড়ি ইমরানের বাড়ির একেবারে কাছে। জামিলার বাড়ি গড়া নবাবী ধাঁচে। ইমরানকে সে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বহুদিন যাতায়াত করতে দেখেছে। জামিলা বহুবার ইমরানকে মুখোমুখি সালাম করেছে। কিন্তু ইমরানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর সে কয়েকবার এক গরীব অসহায় মহিলার মাধ্যমে সাক্ষাত প্রার্থী হওয়ার পয়গাম পাঠিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। সব ব্যাপারেই ইমরান নির্বিকার থেকেছে। এরপর থেকে জামিলা ইমরানের ঘরের দিকে দৃষ্টি রাখছিল, ওখানে কে কে যাতায়াত করে। আজ একটি হিন্দু মেয়েকে ইমরানের ঘর থেকে বের হতে দেখে ওর মধ্যে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে। নিজেকে সামলাতে না পেরে সে ইমরানের ঘরে হানা দেয় নিজের ইচ্ছা চরিতার্থের ব্যাপারটিকে চূড়ান্ত করতে। জামিলাকে দেখে ইমরানের মনে হচ্ছিল, জামিলা তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে গিলে ফেলবে। জামিলা যখন স্বামীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার কথা বলে, তখন ইমরানের এখান থেকে চলে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসে। জামিলা যখন ওর স্বামীর আসার এক মাসের বিলম্বের কথা বলে তখন ইমরান ফন্দি আঁটে এক মাস এই কামিনীকে ধোকায় রাখা যাবে।
বাস্তবে ঋষির মন মগজে ইমরান স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। ইমরানের সান্নিধ্যের জন্যে ঋষির মন সময় সময় আনচান করে। ঋষির তুলনায় জামিলাও রূপ-সৌন্দর্যে কম নয়, কিন্তু মন বলে কথা। ঋষির বিপরীতে জামিলার প্রতি তার মনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। পক্ষান্তরে ঋষি তার হৃদয়ে বারবার দ্বাদশীর চাঁদের মতোই উঁকি দিচ্ছে। অপরদিকে ঋষি ইমরানের সান্নিধ্যে আসার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠছে। ইমরানের সৌম্য কান্তি ঋষির মনে বারবার ভেসে উঠছিল। সে কিছুতেই তাকে বিস্মৃত হতে পারছে না।
জামিলা চলে যাওয়ার পর ইমরানের দায়িত্বের গুরুভারের কথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ইমরান ভাবল, গোয়েন্দাবৃত্তির গুরুদায়িত্ব তাকে দৃশ্যত পাথর বানিয়ে রেখেছে। গোয়েন্দা দায়িত্ব পালনে নিজের আত্মপরিচয় গোপন রাখতে সফল হয়েছিল সে। দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থেই সে রাজমহলে নৌকরি নিয়েছে।
রাজকর্মচারী হিসেবে জয়পালের কার্যক্রম সম্পর্কে ভেতরের খবর অতি সহজে সংগ্রহ করতে পারছিল। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংবাদ সে গজনীর সুলতান সুবক্তগীনের কাছে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আকস্মিকভাবে ঋষি ও জামিলা তার মধ্যে মানবিক তাড়না উত্সকে দেয়। মানব-মানবীর জৈবিক তাড়না তাকে এখন ছিঁড়ে খাচ্ছে। একাকী সে দায়িত্বের গুরুভার অনুভব করছিল এবং এই সমীকরণে পৌঁছতে সক্ষম হয়, ঋষি ও জামিলার কামনার ঝড় তাকে দায়িত্বের কঠিন অনুশীলন ও একাগ্রতা থেকে বিচ্যুত করতে পারে। আজকের পরিস্থিতিতে বুঝতে পারল, এখন থেকে তার ঘরে রীতিমত ঋষি ও জামিলার আগমন ঘটবে এবং এরা তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করবে। সে একাকী ঠিক করল, তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হওয়া একটা জাতির সাথে বেঈমানীর নামান্তর। তাই সে ওদের কিছু না জানিয়েই দূর এলাকায় ঘর দেখার সিদ্ধান্ত নিল। সেই সাথে এও ঠিক করল, অচিরেই সে লাহোর থেকে গজনী চলে যাবে।
সিদ্ধান্ত যাই নিক, দায়িত্বজ্ঞান যতই থাক, রক্ত-মাংসেই গড়া একজন মানুষ ইমরান। নারীর রূপ-সৌন্দর্য যে কোন কঠিন পুরুষকেও কাবু করতে সক্ষম। ইমরানের বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটল না। দুই নারীর যন্ত্রণায় পিষ্ট হতে লাগল ইমরান। ভিতরে ভিতরে তার মধ্যে নারী ও গোয়েন্দা কর্তব্য দারুণ সংঘাতের জন্ম দেয়।
পরদিন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই ইমরানের ঘরে হানা দিল ঋষি। এটা ছিল ঋষির দ্বিতীয়বার ইমরানের সংস্পর্শে আসা। ঋষির ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ছোটবেলা থেকেই ইমরান তার পরিচিত, দুজন একসাথে হেসে খেলেই বড় হয়েছে যেন।
‘গতকাল তুমি বলেছিলে আমার শবদেহকে তুমি জ্বলতে দেবে না। একথা কেন বলেছিলে’? জিজ্ঞেস করল ঋষি।
প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে ইমরান বলল, ‘গতকাল তুমি এখানে এসেছিলে তোমার ভাইয়ের খোঁজে। আজ কেন আসলে?
“তোমাকে দেখতে এসেছি।”
“কেন?”
‘তুমি আমাকে জ্বলতে দেবে না কেন তা জানতে। গতকাল তোমাকে বলতে পারিনি। একসেনা কর্মকর্তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে।‘
“আর সে গজনী অভিযানে যাবে। তোমার জীবনও বোনের মতই চিতার আগুনে জ্বলে ভম হয়ে যাবে।”
“এসব লোকগুলো নারীকে মানুষই মনে করে না। দেবতাদের জন্যে শুধু মেয়েদের কেন বলী দেয়া হবে, বলী কি কোন পুরুষ মানুষকে দিতে পারে না?” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ঋষি।
“তোমাদের ধর্মে তোমার প্রশ্নের কোন জবাব নেই ঋষি। আমার ধর্মে মানুষ বলিদানের কোন রীতি নেই।”
“আমি পুড়ে মরতে চাই না। আর পালিয়ে বাঁচার কোন পথও নেই, কোন আশ্রয় নেই।” এক বুক হতাশা ও ভীতকণ্ঠে বলল ঋষি।
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে ইমরান-ঋষি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। উভয়েই ভুলে গেল ধর্মের ব্যবধান, সামাজিকতার দেয়াল। নিজের দায়িত্বজ্ঞানের কথাও ভুলে গেল ইমরান। রাত কত হয়েছে তারও কোন খেয়াল নেই। সেও যাওয়ার জন্যে উঠি উঠি করেও উঠতে পারছিল না। ইমরানের মধ্যে সে খুঁজে পেল তার জীবনের নিরাপত্তা, নিরাপদ আশ্রয়। ইমরানের সান্নিধ্যই যেন তার পরম ঠিকানা। সে উঠতেও চাচ্ছিল না, কিন্তু যেহেতু এখানে থাকা সম্ভব নয় তাই অগত্যা গাত্রোখান করল ঋষি। দু তিন দিন পর ঋষি আবার ইমরানের ঘরে এল। কথা শুরু করতে যাবে এমন সময় বাইরে জগমোহনের হাক শোনা গেল।
“তোমার দাদা এসেছে ঋষি। তুমি পাশের কামরায় লুকিয়ে পড়।”
জগমোহন ঘরে প্রবেশের আগেই ঋষি অপর কামরায় লুকিয়ে গেলো।
“তুমি আমাকে মাংস খাইয়ে এমন করে ফেলেছে যে, ঘরের সজি-তরকারী দেখলে আমার খাবার আগ্রহ দমে যায়। কোন খাবার আছে কি?”
ইমরান গোশত রান্না করে আগে থেকেই রেখেছিল। হাড়িসহ রান্না করা গোত সে মোহনের সামনে এনে দিল। জগ এটা দেখার প্রয়োজনবোধ করেনি, ইমরান খেয়েছে কি খায়নি। সে হাড়ির সবটুকু গোশত খেয়ে সাবাড় করল।
“ওরা বলী দানের জন্যে কোন মেয়ে কি ছিনিয়ে এনেছে?”
“না এখনও পায়নি। জানি না, পণ্ডিতেরা কোন ধরনের কুমারী তালাশ করছে।”
“তোমাদের বোন কি মন্দিরে যায়?”
“না! তবে আমার আশঙ্কা হয়, আর কতদিন ওকে লুকিয়ে রাখতে পারব।”
ইমরান চেষ্টা করছিল জগমোহনকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিতে। সে মোহনের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছিল না। তার অবসাদ ও ঘুমের ভান কার্যকর ভূমিকা রাখল। মোহন চলে গেল দেরী না করে। জগমোহনের চলে যাওয়া আঁচ করে পাশের কামরা থেকে বেরিয়ে এলো ঋষি। তার চোখে-মুখে রাজ্যের ভীতি।
“দাদা কি গোশত খেয়েছে?” বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল ঋষি।
আমি কখনও তোমার কাছে এই রহস্য ভেদ করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু এটাও মোহনকে বলা সম্ভব ছিল না যে, পাশের কামরায় একজন তোমার কথা শুনছে। বলল ইমরান। যেদিন থেকে মোহন আমার বন্ধু হয়েছে, সেদিন থেকে গোত খেতে শুরু করেছে। কিন্তু এ জন্যে কি তোমাদের দেবদেবীরা মোহনকে কোন শাস্তি দিয়েছে? ধর্ম শুধু নেশাজাতীয় জিনিষগুলোই নিষেধ করে যেগুলো মানুষের জ্ঞান-শক্তি লোপ করে দেয়। ঋষি আবার তুমি কবে আসবে, তোমাকেও আমি গোশত খাওয়াব।”
দুদিন পর ঋষি আবার এলো। ইমরান তার জন্যে মুরগী ভুনা করে রাখল। ঋষি ভয়ে ভয়ে প্রথমে একটু একটু করে ভুনা মুরগীর গোশত মুখে দিল। এরপর বেশ মজা করেই খেল। খাওয়া শেষে বলল, “এরপর যেদিনই আসব, আমাকে গোশত্ খাওয়াতে হবে।”
এরপর থেকে ঋষি ঘনঘন ইমরানের ঘরে আসতে শুরু করল। ঋষি এসেই দুটি বায়না ধরতো, একটি গোশত খাওয়ানোর আর দ্বিতীয়টি যত তাড়াতাড়ি . সম্ভব তাকে লাহোর থেকে কোথাও নিয়ে চলে যাওয়া।
কেননা, বাড়িতে তার বিয়ের আয়োজন জোরেশোরে চলছে। নিজাম ও কাসেম বন্দী হয়ে না এলে হয়তো এতোদিন ইমরান ঋষিকে নিয়ে লাহোর ত্যাগ করে চলে যেতো। সে প্রতিদিন ঋষিকে নতুন নতুন অজুহাত তুলে ভুলিয়ে রাখছিল। ঋষি ওর সাথে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে উঠছিল।
ইমরান ঋষিকে তার প্রকৃত পেশার কথা বলতে পারছিল না। একদিকে কাসেম ও নিজামের মুক্তির দায়িত্ব, রাজা জয়পালের তৎপরতার খবর যথা সময়ে গজনী পৌঁছানো, অপর দিকে ঋষির প্রেম- ত্রিমুখী ফাঁদে আটকে গিয়েছিল ইমরান।
ঋষির প্রেম নিবেদন তাকে কয়েকবার পালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু নিজাম ও কাসেমের চেহারা দেখার পর তাদের জীবন ও কর্তব্যনিষ্ঠা তার পলায়নে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। নিজাম ও কাসেমের পক্ষে সশস্ত্র প্রহরা ফাঁকি দিয়ে পালানো সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্যে ঋষিকে নিয়ে তার পালানো হয়ে উঠছিল না। কিন্তু ঋষির বাঁচার আকুতি, তার প্রেম ও চোখের পানি বারবার ইমরানের কর্তব্য নিষ্ঠায় বিচ্যুতি ঘটাচ্ছিল।
একদিন ঋষি বেরিয়ে যেতেই ইমরানের ঘরে প্রবেশ করল জামিলা। এ সময়ে ঋষির স্পর্শ-সান্নিধ্য ও স্বপ্নিল অনুভূতিতে জাবর কাটছিল ইমরান। শিহরিত হচ্ছিল উল্পে। এ মুহূর্তে জামিলা এসে তার সুখানুভূমিতে বাদ সাধে। ক্ষেপে গেল ইমরান। জামিলা হয়তো এসেছিল তার কামনার যন্ত্রণা প্রশমিত করতে। কিন্তু বিধিবাম। ইমরান তার উপস্থিতিতে ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলল
“আমি তোমাকে এখানে আসতে নিষেধ করিনি? এখানে আসলে কেন, তোমার স্বামী আসার আগে এখানে তোমার কি কাজ?”
“তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছো ইমরান। তোমার কত টাকা লাগে বল?”
“তুমি ভুল করছো জামিলা। আমি টাকায় বিক্রি হবার পাত্র নই, তোমার কাছে আমার কিছুই চাওয়ার নেই।”
“আচ্ছা! এই হিন্দু পেত্নীটাই তবে তোমার কাম্য? তুমি কি ভুলে গেছো, এটা হিন্দু রাজার দেশ। আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে ধরিয়ে দিতে পারি। হিন্দুরা তোমার লুকোচুরি ধরতে পারলে তোমার ঠিকানা হবে জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।”
“কয়েদ হবার আগেই আমি ঋষিকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তুমি আমার কাছে যা প্রত্যাশা কর তা কখনও সফল হবার নয়। ঋষির জন্যে তোমার মতো ডজন ডজন মেয়েকেও আমি ত্যাগ করতে পারি।” বলল ইমরান।
জামিলাকে এভাবে বিগড়ে দেয়া ছিল ইমরানের মস্ত বড় ভুল। সে জানতে, কামনা মেয়েদেরকে ডাইনী করে তুলে। নিজের যৌবন ও জীবনের প্রতি এই বঞ্চনা জামিলাকে বেপরোয়া করে তুলে। শরম-লজ্জা আর মুসলিম মহিলাদের কমনীয়তা হারিয়ে জামিলা এক ভয়ঙ্কর কমিনীর রূপ নেয়। ইমরানের আঘাত ও প্রত্যাখ্যানে জামিলা প্রতিশোেধ যন্ত্রণায় হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
হিন্দু মহিলাদের কাছ থেকে জামিলা জানতে পেরেছিল, রাজা জয়পালের জয়ের জন্যে পণ্ডিতেরা একটি কুমারী বলীদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু কাক্ষিত কুমারী তারা তালাশ করে পাচ্ছে না। বহু কষ্টে দিনটা সে কাটালো। সন্ধ্যা নামতেই রওয়ানা হল মন্দিরে। হিন্দু মেয়েদের সাথে কথায় কথায় সে জানতে পেরেছিল বড় পণ্ডিত কোথায় থাকে। সে সোজা মন্দিরের প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করে বড় পণ্ডিতের কাছে চলে গেল। পণ্ডিত বেশভূষায় খান্দানি মুসলিম মহিলাকে মন্দিরে দেখে হতবাক হয়ে গেল। তাকে নিজের কাছে খুব খাতির করে বসাল।
“আপনি কবে কুমারী বলীদান পর্ব সম্পাদন করবেন!” পণ্ডিতের নিকট জানতে চাইল জামিলা।
“বিশেষ গুণের কুমারী পেলেই কাজটি আমরা সমাধা করব। কিন্তু তুমি এ ব্যাপারে জানতে চাচ্ছো কেন- মা!”
আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনি হয়তো জানেন না যে শহরের সব হিন্দু কুমারী মেয়ে মন্দিরে আসে না। আমি আপনাকে বলীদানের জন্য একটি উপযুক্ত মেয়ের সন্ধান দিতে পারি। আশা করি এই মেয়ে আপনাদের ইচ্ছে পূরণে যথার্থ প্রমাণিত হবে। জামিলা ঋষির বাবার নাম বলল। সেই সাথে জিজ্ঞেস করল, আপনি তার কুমারী মেয়েটাকে কখনও মন্দিরে আসতে দেখেছেন?।
“আমি তো তোমাকেও কখনও দেখিনি। তুমি কার মেয়ে?”
“আমি অমুক ব্যবসায়ীর স্ত্রী।”
“আমাদের ধর্ম আর বলীদানের ব্যাপারে তোমার আগ্রহের হেতু কি? তোমার মনে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে বল”- অনুনয়ের স্বরে বলল পণ্ডিত।
মূল মন্দিরের লাগোয়া একটি সুরক্ষিত কামরায় বড় পণ্ডিত থাকে। সেখানে সাধারণ হিন্দুদেরও যাওয়ার অনুমতি নেই। মুসলমানের প্রবেশ তো প্রশ্নাতীত। কোন মুসলমানের মন্দিরে প্রবেশ করার ব্যাপারে সঠিক নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমন কি কোন হিন্দুর বাড়ির বসত ঘরেও মুসলমানেরা যাওয়া বারণ ছিল। হিন্দুদের দৃষ্টিতে মুসলমানরা অস্পৃশ্য, অপবিত্র। কিন্তু জামিলার মতো বনেদী মুসলিম বণিকের স্ত্রীর কথা পণ্ডিত অতি আগ্রহের সাথে শুনল। সুন্দরী এই রমণীর মন্দিরাগমনকে সে রহস্যাবৃত মনে করে। পণ্ডিতেরা রমণ ও রমণীয় কর্মকাণ্ডে দারুণ দক্ষ। মেয়েদের চেহারা দেখলেই তারা বলতে পারে তার ভেতরের খবর। পণ্ডিত জামিলার মধ্যে আঁচ করল হিন্দু শুভাকাঙ্ক্ষী, হওয়ার ভিন্ন সূত্র। আর সেটিই উদঘাটন করতে তৎপর হলো পণ্ডিত। পণ্ডিতের তুলনায় জামিলা অনভিজ্ঞ এবং গবেট। সে অতৃপ্ত কামনা আর ইমরানের প্রত্যাখ্যানের আগুনে পুড়ছিল। ওর জ্ঞানবুদ্ধি যাও কিছু ছিল তাও প্রতিহিংসা ও উন্মাদনায় লোপ পেয়ে বসেছিল। সে তার মা-বাবা, স্বামী, ঋষি এবং ইমরানের প্রতিশোধ জিঘাংসায় কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলের মতো টগবগ করছিল। তার সংহারী মূর্তি সব কিছুকেই তছনছ করে বেসামাল করে দিয়েছিল। সে পণ্ডিতের জিজ্ঞাসার জবাবে নিজের কাপড়ের নীচ থেকে একটি পুটলি বের করে পণ্ডিতের সামনে রেখে খুলে দেখাল। পুটলিতে বহু স্বর্ণমুদ্রা। পণ্ডিতের চোখে চোখ রেখে জামিলা বলল–
“আমি যে মেয়ের নাম বলেছি তাকেই আপনি বলী দেবেন।” গোপন রহস্যের মতো করে বলল জামিলা।
এই মেয়ে যদি রোগী কিংবা আমাদের চাহিদাসম্পন্ন না নয়?
সে কুমারী। ষোল-সতের বছরের সুন্দরী। আপনাদের উদিষ্ট গুণসম্পন্ন না হলেও এটিকেই বলী দিতে হবে। এটাই আমার শর্ত।
আমাদের ধর্মীয় কাজে দখলদারি করো না মেয়ে। এটা আমাদের পূজা-অর্চনার ব্যাপার। গম্ভীর কণ্ঠে বলল পণ্ডিত।
‘পণ্ডিতজী মহারাজ! কোন ধর্ম কুমারী বলী দিতে বলে না। এটা তো ধর্মীয় ঠিকাদারদের বানানো প্রথা। যদ্বারা তারা মহারাজকে খুশি করে উপহার-উপঢৌকন লাভ করে। এর দ্বারা তারা এটাও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চায়, তারা দেব-দেবীদের এতই প্রিয়ভাজন যে, তারা যে কাউকে বদ করলেও করতে পারে। আপনারা সাধারণ মানুষ থেকে নিজেদের অনেক উঁচুতে রাখতে ভালবাসেন। একটু ঝাঁঝালো স্বরে বলল জামিলা ।
“আমার ধর্মের প্রতি ভর্ৎসনা করো না বেটি। তুমি জান না, ধর্মের প্রতি কটুক্তি করার শাস্তি কতো কঠিন।” অস্পষ্ট আওয়াজে বলল পণ্ডিত।
“আমি শুধু আপনার ধর্ম নিয়ে বলছি না মহারাজ! আমাদের ধর্মেও এমন বাড়াবাড়ি আছে। আমাদের অনেক ইমাম, মৌলভী ও পীর সাহেব নিজেদের সুবিধামতো ধর্মকে ব্যবহার করেন। নিজেদের প্রবৃত্তিকে তারা আল্লাহর বিধান বলে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়। নিজেদের ক্রটিগুলো চেপে রেখে অন্যের উপর শাস্তির বিধান প্রয়োগ করেন। নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দারূপে প্রকাশ করেন, সাধারণ মানুষ থেকে নিজেদেরকে অনেক উঁচু মনে করেন। এরা ধর্মের খোলস পরে অন্যদের চেয়ে নিজেদের উত্তম দাবী করেন। প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাও বড় বড় অপরাধে লিপ্ত। ধর্মের মূল চেতনা বিনষ্ট করে এরা সাধারণ মানুষের জন্য ধর্মকে কঠিন করে তুলেছেন। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
পণ্ডিতজী! আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন, আপনাদের মন্দিরের বহু রহস্য আমার জানা আছে। অন্যরা যদিও এ সম্পর্কে বেখবর। আপনি বুঝেন, কারো ব্যথা হলে সে ব্যথার যন্ত্রণায় কোঁকাতে থাকে, আর ব্যথিতের যন্ত্রণা যারা বুঝতে চেষ্টা করে তারা ঠিকই তা অনুভব করে।”
“তোমার বয়স কম হলেও তোমার কথাগুলো বয়স্ক মানুষের মতো। কথাগুলো এত মূল্যবান যা নিয়ে খুব কম মানুষই ভাবে। স্বীকার করতে হবে, তুমি যথেষ্ট প্রাজ্ঞ ও মেধাবী।” পণ্ডিতের কণ্ঠে আভিজাত্য ও আত্মমর্যাদার ছাপ।
‘আমার মনের দুঃখ আমাকে বয়স্ক বানিয়ে দিয়েছে। এসব আমার কথা নয়, আমার ভগ্ন হৃদয়ের অভিব্যক্তি মাত্র। আমার হৃদয় ব্যথাভরা, দুঃখ-যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট।
‘কি রহস্য জান তুমি?
রহস্যের কথা আর কি বলবো। আমি অল্প বয়স্কা আর সুন্দরী না হলে মুসলমান পরিচয় দেয়ার পর এতক্ষণে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আপনি বের করে দিতেন অবশ্যই। কামরা ধুয়ে এখানে আগর-লোবান জ্বালাতেন; ধূপ দিতেন, ভজনা গাইতেন, আরো কতো শত করে মন্দির পবিত্র করতেন। কিন্তু আমার রূপ দেখে আপনি ভুলেই গেছেন, মুসলমান ঢুকলে হিন্দুর ঘর অপবিত্র হয়ে যায়!
আপনি সোনার মুদ্রাগুলো ধরে দেখেছেন, আমাকে কাছে বসিয়েছেন। এসব সোনার মুদ্রা আর আমার যৌবন উথলে পড়া শরীর দেখে আপনার চোখ ও মন থেকে পাণ্ডিত্য দূর হয়ে গেছে। আপনার মুখে শুধু পণ্ডিতের স্বরটা রয়ে গেছে। অন্তরের দিক থেকে এখন আপনি আমার স্বামীর মতই। সে টাকার বিনিময়ে আমাকে কিনে নিয়েছে। আমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি বিক্রিত পণ্য। এখন আমি বিক্রি হতে কিংবা কাউকে খরীদ করতে একদণ্ড ভাবি না। আমার মন যাকে চায় তাকে আমি খরিদ করতে পারি সব কিছুর বিনিময়ে।
তুমি কিন্তু রহস্যের কথা বলছিলে?
আপনি বুকে হাত রেখে শুনুন তাহলে। দু’জন ধনাঢ্য লোকের মেয়েকে আপনারা বলীদানের জন্যে নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু টাকার বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়েছে তার অভিভাবকরা। আমার স্বামী অনেক বড় ব্যবসায়ী। সে ধর্মের একটি বিধানই শুধু জানে যে, একজন মুসলমান একসাথে চারটি বিয়ে করতে পারে। তার ওঠাবসা, চলাফেরা সবই হিন্দুদের সাথে। তাই আমিও আমার ধর্মকে একপাশে রেখে দিয়েছি। এখন আপনিও আপনার ধর্মকে দরজার বাইরে রাখুন। সোনার মুদ্রাগুলো শুনে বুঝে নিন, আমার কথামতো কাজ করুন। আরও কিছুর চাহিদা থাকলে তাও বলুন।
পণ্ডিত সুযোগের সদ্ব্যবহারে স্মিত হেসে বললো, এতো অধৈর্য হচ্ছো কেন তুমি!
‘তুমি কিভাবে নিশ্চিত হবে যে, আমার কাজ হবে এবং আমার সাথে কোন ধরনের প্রতারণা করা হবে না!
আমি সেই মেয়েটিকে তোমার পথ থেকে দূরে সরাতে চাও, তাই না?
পণ্ডিত মাদকাসক্ত লোকের মতো বলল। ঠিক আছে তোমার পথের কাঁটা সরে যাবে।
যদি তার মা-বাবাও আপনার হাত ভরে টাকা দিয়ে দেয়, তাহলে কি হবে?
সেটিই হবে, যা তুমি চাচ্ছ।
মন্দিরের শাখার বাজনা বন্ধ, ঘণ্টাও স্তব্ধ। ঋষি নিজের বিছানায় আর ইমরান তার ঘরে গভীর ঘুমে সচেতন। হয়তো একে অন্যকে স্বপ্নে দেখছে। তারা মিলনের নেশায় ঘুমের গভীরে শিহরিত হচ্ছে। কিন্তু এদিকে রাতের আঁধারে জামিলা ও পণ্ডিতের সমঝোতায় তাদের অমলিন ভালবাসা সোনা ও কামনার দামে কেনা বেচা হয়ে গেল।
পরদিন বেলা ওঠার পর একটু দেরী করে ইমরান কাজে যাওয়ার জন্যে ঘর থেকে বের হল। জামিলার স্বামীর হাভেলীর সামনে দিয়েই তার রাজবাড়ি যাওয়ার পথ । হাভেলী অতিক্রম করতে যাবে তখন চাপাস্বরে কে যেন তাকে ডাকল। পিছনের কাউকে না দেখে উপরের বারান্দার দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল জামিলা। চোখাচুখি হতেই জামিলা বলল, ইমরান! তোমার ওয়াদা মনে থাকে যেন।’ ইমরানের দৃষ্টিতে জামিলার মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন গোচরীভূত হলো না।
গা জ্বলতে লাগল ইমরানের। কিছু না বলে নীরবে চলতে লাগল সে। রাজমহলে গিয়ে প্রথমেই সে কাসেম ও নিজামের ঘরে গেল। ঘরের বাইরে ছাড়া ভেতরে তাদের হাঁটা-চলায় কোন বিধি-নিষেধ ছিল না। রাজা তাদের কাছ থেকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল উদঘাটনের জন্যে হাত-পা বেঁধে ওদের কয়েদখানায় না রেখে মুক্ত কক্ষে নজরবন্দী করে রেখেছিল। তাদের খাতির-যত্ন ছিল রাজমেহমানদের মত। ইমরান এদের মুক্ত করার চিন্তায় বিভোর। ইমরান তাদের বলেছিল, তারা যেন রাজাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আস্থাভাজন হয়ে ওঠে, যাতে করে রাজা তাদের কথা বিশ্বাস করে তাদের ঘরের কাছ থেকে প্রহরা তুলে নেয়।
নিজাম ও কাসেম রাজাকে বিভ্রান্ত করার কৌশল ঠিক করে রেখেছিল। তারা রাজাকে এই প্রস্তাব দেয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে যে, রাজাকে তারা প্রস্তাব করবে, তারা রাজার সেনাবাহিনীতেই থেকে যেতে চাচ্ছে। গজনী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ের জন্যে নিজেদের সব অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা শক্তিশালী এক সেনা ইউনিট গড়ে তুলবে।
কিন্তু রাজা জয়পাল লাহোর থেকে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরের নেশায় রাজা পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। প্রতিবেশী রাজাদের কাছ থেকে সৈন্য সাহায্য আর নতুন সৈন্য রিকুটের কাজে সে এতই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল যে, বন্দীদের সাথে যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিস্তারিত মত বিনিময়ের অবসর তার ছিল না। যে কোন মূল্যে গজনীর পতন ঘটানোই ছিল জয়পালের লক্ষ্য।
সেদিনও ইমরান তাদের কামরায় গিয়ে রাজাকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের মুক্ত করার পথ সুগম করার পরামর্শ দিল। সে যখন বন্দীদের মুক্ত করতে তৎপর ঠিক সেই সময়ে তার ভালবাসার ময়নার উপর শুরু হয়েছে হায়েনার আক্রমণ। পণ্ডিতের সাঙ্গপাঙ্গরা মৃত্যু-বিভীষিকা হয়ে দেখা দেয় ঋষিদের উপর।
রাতেই ঋষিকে ছিনতাই করে বলীদানের ব্যবস্থা পাকা করে এসেছিল জামিলা। ঋষি নিজের ঘরেই ছিল। বাড়ির সব কিছু অন্য দিনের মতই ছিল স্বাভাবিক। এমন সময় ঘণ্টা ও শাঁখের আওয়াজ শোনা গেল। বাড়ির বাইরে ঢাক-ঢোলের বাজনা শোনা গেল। কানে ভেসে এল অনেক মানুষের কলরব। গলির ভেতরে পলায়নপর নারী-কিশোরীদের ভয়ার্ত চাপা কথাও ভেসে আসল। বাচ্চাদের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছিলো। ঋষিও তো ছোট্টই। সেও তামাশা দেখার জন্যে দরজা দিয়ে উঁকি মারল। মিছিল গলির মধ্যে এসে পৌঁছেছে। মিছিলের অগ্রভাগে বড় মন্দিরের বড় পণ্ডিত। তার হাতে ছোট্ট একটি ঘন্টি। সেটিকে বাজিয়ে বাজিয়ে সে আসছিল গলির ভিতরের দিকে।
বড় পণ্ডিতের পিছনে চার-পাঁচটি পালকি। অন্যান্য পণ্ডিত শিঙা ও ঘন্টি বাজাতে ব্যস্ত ছিল। তাদের পিছনে সাজানো একটি পালকি বহন করছিল চার বেহারা। পণ্ডিত গুনগুনিয়ে ভজন গাইছিল। তাদের পিছনে বিরাট মিছিল।
ঋষি গলির মধ্যে না নেমে তাদের দরজায় দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলো। বড় পণ্ডিত তার সামনে এসে দাঁড়াল, তার নাম জিজ্ঞেস করল। পণ্ডিতের নাম জিজ্ঞাসায় ঋষি ভড়কে গেল। তার মনে পড়ল, তার ভাই ও বাবা তাকে পণ্ডিতদের দৃষ্টির আড়ালে রাখার জন্যে শত বায়না ধরলেও তাকে কোন দিন মন্দিরে যেতে দেয়া হয়নি। সে তার নাম বলল না।
ওর নাম ঋষি। অচেনা একটি কণ্ঠ ভেসে এল। ঋষির ভাই-বাবা-মা সবাই বেরিয়ে এসেছিল। ঋষি পিছনের দিকে সরে যেতে চাচ্ছিল। পণ্ডিতের চেহারায়, বিস্ময় ও আনন্দ খেলা করছিল। ঋষি তার ধারণার চেয়েও অনেক স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী।
ইন্দ্রদেবী একেই প্রার্থনা করেছেন।’ বলল পণ্ডিত।
‘না-না মহারাজ!’ চিৎকার দিয়ে পণ্ডিত ও ঋষির মাঝে এসে দাঁড়াল ঋষির মা। আপনারা যে মেয়েকে তালাশ করছেন আমার ঋষি সেটি নয়। ঋষি দরজা থেকে ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছিল। এক পণ্ডিত এগিয়ে এসে তার হাত ধরে ফেলল। বড় পণ্ডিত পালকি আনার জন্যে হুকুম দিলে পালকি এনে বেহারারা দরজায় দাঁড়াল।
এ নির্দেশ দেবী ও রাজা উভয়ের । ইন্দ্রদেবী যে কুমারীকে চান, সেই কুমারী কারো ঘরে থাকলে সেই ঘরে সকল দেব-দেবীর অভিশাপ হতে থাকে। ওকে দেবীর জন্যে উৎসর্গ না করলে যে মা তাকে জন্ম দিয়েছে সেই মার কুষ্ঠ হয়ে সারা এলাকা ধ্বংস করে দেবে।
এই মেয়ে তোমাদের নয়। সে দেবীর আমানত। তাকে আমরা নিয়ে যাব। ঋষিকে টেনে হেঁচড়ে পালকিতে ভোলা হল। সে চিৎকার করে হাত-পা ছুঁড়ে মুক্ত, হতে ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। পণ্ডিতদের সাথে আসা এক লোক রুমালের মতো এক প্রস্থ কাপড় দিয়ে ঋষির নাক-মুখ মুছে দিল। ঋষি একটু কেঁপে উঠে নীরব হয়ে গেল। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। তাকে পালকিতে ভরে দরজা বন্ধ করে দেয়া হল। শাখা ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ভজন গাইতে গাইতে ফিরে গেল পণ্ডিতেরা। মিছিলের লোকেরা মন্দির ও দেব-দেবীর জয়ধ্বনি করল। মহল্লার মানুষ ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেল। কানা-ঘুষা ও ফিসফিসানি শুরু হলো গলির লোকদের মুখে।
মহল্লার কিছু লোক ঋষির মা-বাবাকে আশীর্বাদ ও ধন্যবাদ দিতে লাগল– দেবী তাদের মেয়েকে কবুল করেছে এই সৌভাগ্যের জন্যে। হিন্দু ধর্মের গোড়া ভক্তরা ঋষির মা-বাবাকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখছিল– দেবীর পছন্দনীয় পরিবার বলে। কিন্তু যাদের কলজের টুকরো মেয়েটিকে পণ্ডিতেরা জবাই করতে নিয়ে গেল, এদের মনের অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা কারোরই মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। মা-বাবার কানে তখনও ভেসে আসছিল ঋষির করুণ আর্তনাদ, বাঁচার আকুতি। কিছুদিন আগে তাদের অপর মেয়েটির জ্বলন্ত দগ্ধ হওয়ার দৃশ্য ও তার কান্না এখনও তারা ভুলতে পারেনি- সেই শোকের ধকলে এখনও গোটা পরিবার বিধ্বস্ত। এর উপর একমাত্র চোখের মণি তরুণী মেয়েটিকেও পণ্ডিতেরা জবাই করতে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ঋষির মা-বাবার মনের অবস্থা যদি হিন্দুরা বুঝত তাহলে হয়তো পণ্ডিত আর মহল্লার লোকদের মধ্যে শুরু হয়ে যেতো তুমুল যুদ্ধ। কিন্তু মূর্খ এই লোকগুলো পণ্ডিতদের মিথ্যা ও প্রবঞ্চনায় এতই মত্ত যে, দেবী মেয়েটি গ্রহণ করেছে– এই বিশ্বাস তাদের মধ্যে বদ্ধমূল।
সন্ধ্যায় ইরমান ঘরে ফেরার একটু পরই জগমোহন তার ঘরে প্রবেশ করে। বসেই কান্নায় ভেঙে পড়ল মোহন। সে বলল, ঋষিকে পণ্ডিতেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। অভাবিত এই দুঃসংবাদে ইমরানের অবস্থাও শোচনীয়। তার বুক ভারী হয়ে এলো। মোহন আরো বলল, কে জানি পণ্ডিতদের বলেছে, ঋষি মন্দিরে যায় না। বলীর জন্যে সেই উপযুক্ত।
তোমরা কি খবর নিতে পারবে ওকে কোথায় রাখা হয়েছে এবং কখন তাকে বলী দেয়া হবে। এ খবরটি জানতে চেষ্টা কর মোহন! আমি তাকে বাঁচানোর সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করব। বলল ইমরান। সম্ভবত বড় মন্দিরেই ওকে রাখা হয়েছে। আমরা কখনও এমন শুনিনি যে, কোন কুমারীকে ধরে নিয়ে সাথে সাথেই বলী দেয়া হয়েছে। পণ্ডিতেরা সেই কুমারীকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণে রাখে, তাকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়, পাক-ছাফ করে। জানা নেই আরো কি কি আমল করে। এক পর্যায়ে কুমারী নিজেই বলতে থাকে, আমাকে দেবীর চরণে বলী দাও, উৎসর্গ করে দাও। আমি জানতে চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু তুমি ওকে বাঁচাতে পারবে না ইমরান! ছিনিয়ে আনলেও ওকে আবার ওরা নিয়ে যাবে। এটা করতে গিয়ে আমাদের সাথে তোমার জীবনেও বিপদ নেমে আসবে। এই বলে সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। নিজেকে সামলে বলল মোহন, এদেশ ছেড়ে আমার চলে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার ধর্মের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মেছে।
“তোমাদের ধর্মে অনাচার ছাড়া আর কিই-বা আছে? ভগবত, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত তোমাদের ধর্মীয় কিতাবাদি পড়ে দেখ, এসব কিতাবে প্রবৃত্তির দাসত্ব আর বর্বরতার কাহিনীই লেখা আছে। এসব ধর্মীয় পুস্তকে ধোকা, প্রতারণা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকে উৎসাহিত করা হয়েছে। দেব-দেবীর রমণক্রিয়া চিত্রায়িত করে দেখানো হয়েছে এসব গ্রন্থে। মেয়ে ও শিশু হত্যাকেও বৈধতা দেয়া হয়েছে।
তোমার বোনকে যদি সাথে সাথে হত্যা করা হয় তবে ভাল। আমি জানি ও যতক্ষণ জীবিত থাকবে ততক্ষণ পণ্ডিতেরা কত পাশবিক ব্যবহার করবে ওর সাথে । জগমোহনের চোখ কপালে উঠে এলো। ওর চেহারা রক্তিম হয়ে গেল।
হুঁ, তোমরা এসব কাদা-মাটি আর পাথরের মূর্তির পূজা কর। এগুলোর মুখোমুখি হতেও তোমরা ভয় কর। আমি মুসলমান। এসবে আমার কোন ভয় নেই। আমি যদি তোমাদের দেবদেবীর আখড়া থেকে তোমার বোনকে উদ্ধার। করতে পারি তবে কি তোমরা আমার সাথে যাবে
কোথায়?
সেটা তখনই বলা যাবে। তবে তোমাদেরকে আমার ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। বলল ইমরান।
হ্যাঁ, আমি তোমার ধর্ম গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আমি তোমাকে শপথ করে ওয়াদা দিচ্ছি, তুমি আমাদেরকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে চল, তাহলে আমরা তোমার ধর্ম গ্রহণ করব এবং ঋষিই হবে তোমার বধূ। বলল মোহন।
এই লোভে আমি ঋষিকে উদ্ধার করতে যাবে না যে, তোমরা ঋষিকে আমার হাতে তুলে দিবে। আমার লক্ষ্য এটাই– আমি উদ্ধার অভিযানে তোমাদের দেব-দেবীদের পরাভূত করতে চাচ্ছি।
আমি বাঘের মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য আমি জীবনবাজী রাখতে প্রস্তুত। আমি তোমাদের রাজাকে বুঝিয়ে দিতে চাই, কাদামাটি আর পাথরের দেবতারা মাটি আর পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়। মুসলমানদের নিকট এগুলো নিতান্তই পাথরের স্তূপ। তুমি নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমাও মোহন। ঋষির মুক্তির ব্যাপারটি আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম।
জগমোহন চলে গেল। ইমরানের দিকে আগ্নেয়গিরির মতো যন্ত্রণার লাভা উদ্গিরণ শুরু হল। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ইমরানের মধ্যে প্রতিশোধ ও কর্তব্য-কর্ম সম্পাদনের ঝড় সৃষ্টি করল। দ্রুত বন্দী দু’জনকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করল ইমরান। বন্দী দুজনকে মুক্ত করার গুরুত্বটা হলো, যদি রাজা রাজমহলের অসংখ্য সুন্দরী রক্ষিতার একটিকেও ওদের ঘরে ঢুকিয়ে দেয়, তবে নারীর কাছে ফেঁসে গিয়ে ওরা স্বজাতি ও দেশের কথা ভুলেও যেতে পারে। ভুলে যেতে পারে সৈনিকের কর্তব্য ও দায়িত্বের কথা। ফলে ওরা জাতিধ্বংসের কারণ হতে পারে। এরা নারী ও অর্থের ধোঁকায় পড়ে এবং রাজার ধন-সম্পদ ও খাতির-যত্নে ভুলে গিয়ে গজনীর মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্যে বিরাট হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। ইমরান বন্দীদের মুক্ত করার বিষয়টির খুঁটিনাটি চিন্তা করছিল। এদিকে ঋষিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা তার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিল। সে ঋষিকে ইতোমধ্যে মনের মানসীরূপে হৃদয়ে জায়গা দিয়ে ফেলেছিল। উভয় সংকেটর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ইমরান। পরিকল্পনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাথা গরম হয়ে গেলো তার। নিজের ঘরে আবেগ, উত্তেজনা আর প্রতিশোধ
স্পৃহায় জ্বলে উঠছিল বারবার। শুধু দায়িত্ববোধ ও প্রেমঘটিত ব্যাপার নয়, গোটা পরিস্থিতিটাকে সে আল্লাহর একক সত্তা ও মনুষ্যসৃষ্ট মূর্তির মধ্যে চিরায়ত সংঘাতের রূপ দিল। এই চ্যালেঞ্জকে সে গ্রহণ করল ঈমানের দাঁড়িপাল্লায় মেপে কঠিন চ্যালেঞ্জপে। যে করেই হোক পরিস্থিতির মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সে দৃঢ় পতিজ্ঞাবদ্ধ।
একাকী ঘরে সে ছাদের দিকে তাকাল। মনের অজান্তেই আল্লাহর জন্য তার দু’হাত উঠে এলো। কায়মনোবাক্যে দু’আ করল ইমরান। তার দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেল। দু’চোখে অঝোর ধারায় অশ্রু বইতে লাগল। নিজের অজান্তেই তার মুখে উচ্চারিত হলো, ‘খোদায়ে যুলজালাল! আমি যা কিছু করছি আপনার বান্দাদের ইজ্জত ও মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে করছি। আমাকে শক্তি, সাহস ও তৌফিক দিন। আমাকে এ সব মিথ্যা ভূতপূজারীদের কর্মকাণ্ডে ধৈর্য ধারণ ও বিজয়ী হওয়ার তৌফিক দিন। আপনি ও আপনার মনোনীত ধর্ম সত্য, ইসলাম সত্যের পথ, সত্যপন্থীদের পথ। আমাকে এই সত্যকে এই জমিনে প্রমাণ করার তৌফিক দিন।
আয় আল্লাহ! আমার মনে কোন গুনাহর ইচ্ছে নেই। গুনাহ করার ইচ্ছে থাকলে জামিলা আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হতো না। আপনি তো দেখছেন, এই সুন্দরী নারী আমাকে কতো কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছিল। আমি আপনার দয়ায় এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি।
আয় প্রভু! আমাকে পথ দেখান, আমাকে সাহায্য করুন। আমি যদি নিজের নফসের জন্য কিছু করে থাকি তবে আমাকে মৃত্যু দিন! আপনার পবিত্র নামের দোহাই, আপনার নামের ইজ্জত বুলন্দির জন্যে অধমকে কবুল করুন।
মোনাজাত শেষে চোখে মুখে হাত বুলাল ইমরান। তার মাথা থেকে বিরাট দুশ্চিন্তার বোঝা যেন নেমে এল। স্বস্তিতে স্থির ও অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। হঠাৎ বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে সে ঘরের বাক্স খুলে একটি খঞ্জর বের করে আস্তিনে পুরে নিল এবং বাক্স বন্ধ করে দরজায় তালা দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে পড়ল।
ইমরানের চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল, তার পা স্বয়ংক্রিয় উঠছে নামছে। সে ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে। সে গলির শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নিতে গিয়ে দেখল, এখানে কোন মোড় নেই, পথই শেষ হয়ে গেছে। পিছনে ফিরে সে ঘন বনবীথির মাঝ দিয়ে চলতে চলতে গাছের সাথে ধাক্কা খেল। সম্বিত ফিরে আবার উল্টো পথে চলতে শুরু করল। এক পর্যায়ে ইমরান মাথার পাগড়ী খুলে মাথা ও চেহারা এমনভাবে পেঁচিয়ে বেঁধে নিল যে, এখন তাকে দেখে কারো পক্ষে চেনার কোন উপায় নেই। দুটো চোখ ছাড়া আর কিছুই অবমুক্ত নয়। ইমরান ছিল পেশাদার গোয়েন্দা। শহরের সব অলিগলিই তার চেনা। গোয়েন্দাদের প্রথম কাজই থাকে আবাসন ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা। ইমরান মন্দিরের দিকে রওয়ানা হয়। মন্দিরের কোথায় কি তা ইমরানের মুখস্থ। সে চুপিসারে প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রধান পণ্ডিতের ঘরের দিকে গেল। তার ধারণা ঋষিকে এখানেই রাখা হয়েছে।
থমকে দাঁড়াল ইমরান। ভাবল, ঋষিকে এখান থেকে উদ্ধার করতে পারলে এখান থেকেই পেশোয়ারে চলে যাবে আর ঘরে ফিরে যাবে না। কিন্তু পা বাড়াতেই কোন অদৃশ্য শক্তি যেন থামিয়ে দিল তাকে। নিজাম ও কাসেমের কথা তার মনে পড়ল। মনে একথাও উদয় হলো, ঋষিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু যে জাতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সে এখানে দীর্ঘ দিন যাবৎ সফলতার সাথে কাজ করছে এখন এভাবে চলে গেলে দায়িত্বে চরম অবহেলা হবে, বিশেষ করে নিজাম ও কাসেমের মুক্তি অসম্ভব হয়ে উঠবে। সেই সাথে রাজার গতিবিধি সম্পর্কেও সুলতান আগাম কোন সংবাদ পাবেন না আর।
চিন্তায় তার শরীর ঘেমে ওঠে। ধীরে ধীরে সর্পিল গতি ও সতর্কে বড় পণ্ডিতের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল ইমরান। ইমরানের মনে হলো, আবেগ তাড়িত হয়ে কিছু করা তার ঠিক হবে না, তাকে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
বিড়ালের মতো অতি সন্তর্পণে বড় পণ্ডিতের ঘরের কাছে চলে গেলো। ইমরান। এলাকাটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইমরান বড় পণ্ডিতের ঘরের অতি কাছে চলে গেল। দরজা থেকে একটু আগে দাঁড়িয়েছে ইমরান। এমন সময় পণ্ডিতের দরজা খুলে গেল। ভিতরের আলো দরজার ফাঁক গলিয়ে বাইরে পড়ল। এই আলোতে দেখা গেল, ভেতর থেকে একজন মহিলা বের হচ্ছে, সাথে বড় পণ্ডিতও বের হল। জায়গাটি ছিল ঝোঁপঝাড় ও ঘন গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ। সে দ্রুত একটি ঝোঁপের আড়ালে চলে গেল। পরিষ্কার দেখতে পেল, মহিলাটি আর কেউ নয় জামিলা।
‘এখন নিশ্চিন্ত থাক, তোমার কাজ হয়ে গেছে’ বলল পণ্ডিত।
‘এখানে আমি ওকে দেখতে পেলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। দেখলেন তো আপনার চাহিদা মতো আমি আপনার প্রাপ্য উসুল করেছি।’ বলল জামিলা।
‘এরপরও তুমি সন্দেহে ভুগছে। ওকে এখানে রাখা সম্ভব নয়। তাকে টিলার উপরে অবস্থিত মন্দিরে পৌঁছে দিয়েছি। তুমি চাইলেও আমি ওকে আগামীকালই. বলী দিতে পারব না। আমাদের অনেক রীতিনীতি আছে। এগুলো পালন করতে হবে। এটাই তো প্রথম নয়। আমার জীবনে আমি চারটি কুমারী আর দুটি শিশু বলীদান করেছি। এই মেয়েকে অন্তত এক চাঁদ আমরা টিলার মন্দিরে রাখব। তাকে এভাবে তৈরি করব, তার বলাচলা সব বদলে যাবে। রঙ ঢঙে পরিবর্তন ঘটবে। এক সময় সে নিজে থেকেই বলতে থাকবে- “আমাকে দেবীর চরণতলে বলি দিন”। সে তার মুখেই বলীদানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করবে। আমি তোমার উদ্দেশ্য সাধন করে দিয়েছি। সে আর তোমার পথের কাঁটা হতে আসবে না। যাও মাঝে মধ্যে এখানে এসো।’
উদ্দেশ্যের মাত্র অর্ধেক আমার পূরণ হয়েছে।’ বলল জামিলা।
বাকীটাও পূর্ণ করে দেব। বলল পণ্ডিত। তোমাকে এমন জিনিস দেব, সে তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। একা যেতে পারবে, কিছুদূর এগিয়ে দেব?
“না। এগিয়ে দিতে হবে না। একাই যেতে পারব।”
খুব কাছে থেকে জামিলা ও পণ্ডিতের সংলাপ শুনছিল ইমরান। একটি ঝোঁপের আড়াল ছাড়া তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল খুবই কম। ইমরানের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, ঋষিকে জামিলাই পণ্ডিতের হাতে তুলে দিয়েছে। এ কাজ করতে জামিলা পণ্ডিতকে কি বিনিময় দিয়েছে তাও বুঝতে বাকী রইল না তার।
জামিলা ইমরানের পাশ দিয়ে চলে গেল। গাছের মতোই দাঁড়িয়ে রইল ইমরান। পণ্ডিত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পণ্ডিত দরজা বন্ধ করতেই জামিলার পিছু নিল ইমরান। জামিলার ধৃষ্টতা আর দুঃসাহসের জন্যে আশ্চর্য হলো ইমরান। ঘন বৃক্ষঘেরা চত্বর পেরিয়ে নির্বিকার চিত্তে বাড়ি ফিরছে জামিলা। ইমরানের ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে এখনই হত্যা করে ফেলবে। কিন্তু নিজের ক্ষোভ রাগ নিয়ন্ত্রণ করে জামিলার দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়। কাছে পৌঁছতেই। পিছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ভয়ে থমকে দাঁড়াল জামিলা।
“তোমার অপূর্ণ আশা পূর্ণ হবে না জামিলা! তোমার পথের কাঁটা মনে করে নিরপরাধ একটি মেয়েকে জীবন্ত মেরে ফেলতে যে ভয়ঙ্কর চক্রান্ত তুমি করেছো, এর শাস্তি তোমাকে ভোগ করতেই হবে।”
উহ্! আমি তো ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম। ভয়ার্তকণ্ঠে বলল জামিলা।
কোথাও গিয়েছিলে বুঝি?
হ্যাঁ! যেখান থেকে তুমি ফিরছো আমিও সেখান থেকেই ফিরছি।
জামিলা! এখন ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে হত্যা করতে পারি। তোমাকে গায়েব করে দিতে পারি। তোমার স্বামীকে তোমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানিয়ে দিতে পারি। তুমি কি মনে কর, এসব করে তুমি আমাকে বশে আনতে পারবে?
জামিলা নীরব। ভয় শঙ্কায় তার কণ্ঠ থেকে কোন শব্দ বেরুচ্ছিল না।
বল! আমার কথার জবাব দাও, জামিলা!
একটা হিন্দু মেয়ের জন্যে তুমি এতটাই পাগল হয়ে গেলে অনেক কষ্টে শরীরের সব শক্তি দিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল জামিলা।
আমার কথা শোন! যদি দ্বিতীয়বার আর কোন দিন তুমি এই মন্দিরের দিকে পা বাড়াও তাহলে তোমার টুকরোটাও কেউ খোঁজে পাবে না। আর কোন দিন আমার ঘরে ঢুকলে তোমাকে জ্যান্ত করব দিয়ে ফেলব। শোনে রাখ, মন্দির থেকে ফেরার পথে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে, একথা পণ্ডিত কিংবা অন্য কেউ জানতে পারলেও কিন্তু তোমার অবস্থা খুবই শোচনীয় হবে।
“এই সব কিছুই তো আমি. করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য।” বলে ইমরানের পা জড়িয়ে ধরল জামিলা। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, “তোমার মধ্যে আমি জীবনের সুখ দেখতে পাচ্ছিলাম, আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম। ভেবেছিলাম, এই হিন্দু মেয়েটাকে সরিয়ে দিলে তুমি সম্পূর্ণ আমার হয়ে যাবে । মনে হয়েছিল, এই হিন্দু মেয়েটিকে তুমি বিনোদনের সঙ্গী হিসেবেই কেবল কাছে পেতে চাচ্ছো। ভাবতে পারিনি তুমি ওকে এতোটা ভালবাসো, ওর জন্যে তুমি এতোটা পাগল।”
“এখান থেকে যাও! দূর হও!”
“আমাকে মাফ করে দাও ইমরান!” ডুকরে কেঁদে উঠল জামিলা। পা জড়িয়ে থেকেই বলল, একটা হিন্দু মেয়ের জন্যে অসহায় এই মুসলমান অবলার মন ভেঙে দিও না। অসহায়ের প্রতি একটু দয়া কর।
“মজলুম নও বড় জালেম তুমি।” একথা বলে রাগে ক্ষোভে পা ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য জামিলাকে ধাক্কা দিলে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল জামিলা। ইমরান বলল, “আমি মাফ করলেও খোদা তোমাকে মাফ করবে না। ধুকে ধুকে তোমাকে মরতে হবে। এই অপরাধের শাস্তি তোমাকে ভুগতেই হবে। জীবনে কোন দিন তুমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। ন্যাংটা হয়ে রাস্তায় চিল্লাবে আর কেঁদে কাটাবে।”
ছিটকে পড়া জামিলাকে হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে দিল ইমরান। কালবিলম্ব না করে রওয়ানা হল ঘরের দিকে। একটু অগ্রসর হতেই জামিলার চিৎকার ভেসে এলো। সেই সাথে শুনতে পেল জামিলার ডাক … ইমরান! ইমরান!
দাঁড়াল ইমরান। পরি মরি করে দৌড়ে এসে ইমরানের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কবুতরের বাচ্চার মতো ভয়ে কাঁপছিল জামিলা। ধরা গলায় বলল, আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও ইমরান! আমার ভয় করছে। আমি যেতে পারব না। আগুনের মতো কি একটা দেখেছি সামনে- হঠাৎ করে জ্বলে উঠেছে আবার নিভে গেছে। তুমিও কি কোন আলো দেখেছিলে? আকাশে কোন বিজলি চমকায়নি তো?”
“কোন নারীকে ভয় দেখানো আমার রুচিবিরুদ্ধ। এখানে তোমাকে একা ফেলে রেখে যেতেও বিবেকে বাধছে। কিন্তু জেনে রেখো, নিরপরাধ মেয়েটির প্রতিটি রক্তের ছিটা তোমার জন্য ভীতিকর বিজলীর মতো চমকাবে, ওর মৃত্যুর আওয়াজ তোমার মাথায় বজ্রাঘাতের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে দেখা দিবে। মৃত্যু তোমাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরবে, কিন্তু তুমি মরতে পারবে না।”
“আমার ভয় করছে!” ইমরানকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আবার পড়ে গেল জামিলী। কোন মতে উঠতে উঠতে বলল, আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দাও। আমাকে একা ফেলে গেলে এখানেই মরে যাবো। আমার উপর একটু দয়া কর ইমরান!
চল!
জামিলার বাড়ির দিকে রওয়ানা হল ইমরান। জামিলা লাফিয়ে উঠে ইমরানের বাহু ঝাঁপটে ধরল। ইমরানের বাহু শক্ত করে ধরে এদিক ওদিক টলতে টলতে কোন মতে বাড়ির সীমানা পর্যন্ত পৌঁছল জামিলা। পথে কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়ে ইমরানকে ঝাঁপটে ধরে রেহাই পেয়েছে। দেয়ালের কাছে পৌঁছে ইমরান থেমে গেল।
“আমি কী করব ইমরান!” জামিলা এভাবে উচ্চারণ করল যেন ঠাণ্ডায় দাঁতে খিল ধরে গেছে তার।
“পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর!”
“কী ভাবে?”
কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবে সময় এলে বলব। এখন যাও।
ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল ইমরান।
পরদিন প্রতিদিনের মতো কাসেম ও নিজামের জন্যে সকালের নাশতা নিয়ে গেল ইমরান। রাজ মহলের গেটে দিয়েই সে বুঝতে পারল, রাজা প্রাসাদে ফিরেছে। একটু পরেই রাজার ফরমান এলো। রাজ মহলে ডাক পড়েছে কয়েদীদের। কাসেম ও নিজাম রাজার চাহিদা অনুধাবন করে মাহমূদের যুদ্ধ জয়ের ভুল চাল রাজার সৈনিকদের শিখিয়ে দেয়ার নাম করে রাজাকে আশ্বস্ত করে ফেলল। তারা বললো, তাদেরকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিলে তারা তাদের যোগ্যতা ও কৃতজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখবে। রাজা এদের কথা বিশ্বাস করে তাদের অনুরোধ মতে কামরার বাইরে থেকে পাহারা তুলে নিল।
কাসেম ও নিজাম তাদের কক্ষে ফিরে এসে ইমরানকে জানাল, রাজা বলেছে, সুলতান ইন্তেকাল করেছেন। বর্তমানে তার ছেলে মাহমূদ ক্ষমতাসীন। রাজার কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল, খুব তাড়াতাড়ি তারা গজনী আক্রমণ করতে চাচ্ছে। সুলতানের মৃত্যুতে রাজা গজনী বিজয়ের খুবই আশাবাদী। সে ভাবছে, খুব সহজেই মাহমূদকে পরাজিত করতে পারবে। সুলতানের মৃত্যু সংবাদ এদেরকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল। বেশি ভাবনার বিষয় হলো, সুলতানের অবর্তমানে গজনী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে কে থাকবে? কাসেম ও নিজাম মাহমূদকে মাত্র দু’তিন ডিভিশন সৈন্যের কমাণ্ড দিতে দেখেছে। কয়েকটি যুদ্ধে বাবার সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করতে দেখেছে। মাহমূদ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না– সেনাপতির কমাণ্ড সামলানোর কতটুকু যোগ্যতা রাখেন তিনি। তিনি কি তার পিতার মতো অল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়ে বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবেন? এ সংবাদ শোনার পর তাদের কাছে এখান থেকে ফেরার হয়ে জলদি সুলতান মাহমূদকে রাজার সৈন্যবল ও আক্রমণ প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করাটা অত্যন্ত জরুরী মনে হয়েছে।
এদিকে ইমরান তাদেরকে বলেছিল, ঋষি নামের যে হিন্দু মেয়েটি মুসলমান হয়ে তার সাথে গজনী চলে যেতে আগ্রহী ছিল তাকে ইতিমধ্যে পণ্ডিতেরা এ বলীদানের জন্য ধরে নিয়ে গেছে। ইমরান তাদের একথাও বলেছে, তাদের ও দুজনকে এখান থেকে মুক্ত করে ওই মেয়েটিকেও সে মন্দির থেকে মুক্ত করে # গজনী নিয়ে যাবে। বিষয় দুটিকে সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।
ওদের কক্ষের বাইরে থেকে পাহারা তুলে নেয়ায় সে রাতেই এদের ফেরার করানোর সংকল্প করল ইমরান।
অন্য দিনের চেয়ে আজ রাতের খাবার অনেক বিলম্বে নিয়ে এলো ইমরান। কিছুক্ষণ বন্দীদের এখানে কাটিয়ে রাতের বেলা থালা-বাটি নিয়ে সে রাজমহলের প্রহরীদের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেল। যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে যে, “ ইমরান রাতের খাবার দিয়ে আর বাসায় যায়নি।
দৃশ্যত প্রহরীদের সামনে দিয়ে রাজমহল ত্যাগ করলেও সে ঘরে ফিরেনি। রাজবাড়ির গেট পেরিয়ে পিছনের দিকের বাগানে চলে গেল ইমরান। রাজবাড়ির পিছনে বিরাট বাগান। গাছ-গাছালিতে ভরা। নানা রঙের ফল-ফুলের ছোট বড় অসংখ্য গাছ। ঘন বৃক্ষের ছায়ায় রাজবাড়ির পেছন দিকটা অন্ধকার। রাতে ওদিকটায় কেউ যায় না। গা ছম ছম করে। নিশাচর পাখি, হুতুম পেচার ডাক ও জংলী পশুদের চেঁচামেচি শোনা যায়। দেয়ালের বাইরে ওই জঙ্গলের দিকে রাতের অন্ধকারে একাকী আলো ছাড়া পা বাড়ানোর সাহস ইমরানের থাকলেও কোন পৌত্তলিকের নেই। নির্ভয় চিত্তে ইমরান জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
রাজবাড়ির প্রাচীর ঘেঁষেই বাগান। প্রাচীর খুবই উঁচু। কোন অবলম্বন ছাড়া কারো পক্ষে লাফ দিয়ে দেয়ালের উপর উঠা অসম্ভব। দিনের বেলায় একটি জানালার ফাঁক দিয়ে কাসেম ও নিজামকে দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিল, ওখান দিয়ে দেয়ালের উপর উঠা সম্ভব। ওখানে গাছের ডাল ঝুলে একেবারে দেয়ালের উপরে এসে পড়েছে।
নির্দিষ্ট সময়ে নিজাম ও কাসেম ঘর থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে চুপিচুপি পালানোর জন্যে এগুতে লাগল। সন্ধ্যা নামতেই রাজমহলের কর্মচারীরা নিজ নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। আর এদিকে মহলের অভ্যন্তরে রাতের অন্ধকার নিয়ে এসেছে আমোদ ফুর্তির আবেশ। আশ-পাশের রাজ-রাজাদের আগমনে রাজমহলের আলোকসজ্জা বেড়ে গিয়েছে। ঘোড়ার গাড়ী হরদম প্রাসাদে, ঢুকছে। বাদকদল অতিথিদের স্বাগত জানতে বাজনা বাজাচ্ছে। নাচঘরের সাজসজ্জা শুরু হয়েছে। টুংটাং নর্তকীদের ঘুঙুর পায়ের নূপুর আর ঢাক-ঢোলের আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। দাসদাসীদের হুল্লোড়ও ভেসে আসছে মাঝে মধ্যে। অতিরিক্ত মশালের আলো বেলায়ুরী ও আওরিযীর জন্যে কাল হয়ে দেখা দিল। সোজা পথে যাওয়া তাদের পক্ষে সহজ ছিল না। কেউ বন্দী হিসেবে তাদের শনাক্ত করতে পারলে আরো কঠিন প্রাচীরে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল তাদের। তবুও দুচারজনের সামনে দিয়েই গোবেচারার মত প্রাসাদের অন্য অগন্তুকের মতো হাবভাব রেখে রাজপ্রাসাদের পিছনের দিকে যেতে লাগল। অতিকষ্টে একটি দালানের আড়ালে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যেও মূল প্রাচীরের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হল। এরপর আন্দাজ করে খুব সতর্কতার সাথে দুটি ঢিল ছুড়ল আরিফী। ইত্যবসরে দেয়ালের উপর থেকে একটি রশি ঝুলে পড়ল তাদের সামনে। দ্রুত রশি বেয়ে উভয়ে দেয়ালের উপরে উঠল। দেয়ালের বাইরে নীচ থেকে আওয়াজ দিল ইমরান- রশিটা দেয়ালের বাইরে ফেলে দাও। গাছ বেয়ে জলদি নেমে পড়। কাসেম ও নিজাম গাছের ডাল বেয়ে সহজেই নীচে নেমে আসল। ইমরান রশিটা পেঁচিয়ে থলের মধ্যে ভরে নিল। থলে থেকে দুটা চোগা বের করে এগিয়ে দিল। তারা গলা থেকে পায়ের নীচ পর্যন্ত লম্বা চোগা গায় দিয়ে চলতে শুরু করল। অতি সতর্কতার সাথে রাজবাড়ির সীমানা পেরিয়ে এল। রাজ প্রাসাদের বাইরের জগৎ তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। নিজের ঘরে এদের নিয়ে এলো ইমরান।
“এখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের চলে যাওয়া উচিত।” বলল নিজাম। আচ্ছা, দুটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করা যাবে?
“এত তাড়াতাড়ি তোমরা এখান থেকে যেতে পারবে না।” বলল ইমরান। সকালে রাজা যখন তোমাদের ফেরার হওয়ার কথা শুনবে, তখনই চতুর্দিকে লোক পাঠাবে তোমাদের খোঁজে। অবশ্য না পাঠানোর সম্ভাবনাও আছে। দু’বারের পরাজয়ের গ্লানি রাজাকে অন্ধ বানিয়ে ফেলেছে। এখনও সে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তায় বিভোর। অহর্নিশি ব্যস্ত যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে। আশপাশের সব হিন্দু রাজা দু’হাতে আর্থিক সহযোগিতা করছে। যুদ্ধব্যয়ের জন্যে রাজার ভাবতে হয়নি। কিন্তু বড় ভাবনা সৈন্য নিয়ে। প্রশিক্ষিত সৈনিকের বড়ই অভাব। অন্যান্য রাজা সৈন্য দিতে গড়িমসি করছে। এ জন্য রাজা দূরদূরান্তের রাজ্যগুলোতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে সৈন্য আনছে। এখানকার হিন্দুরাজাদের একটা জটিল নিয়ম হলো, কেউ পরপর দু’বার যুদ্ধে পরাজিত হলে ক্ষমতা উত্তসূরীর হাতে বুঝিয়ে দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয়। জয়পাল ইতিমধ্যে দু’বার পরাজিত হয়েছে। তার উত্তরসূরী তার ছেলে তাকে তৃতীয়বার যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছে। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে জয়পাল জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
হতে পারে এসব ঝামেলার কারণে রাজার মধ্যে তোমাদের ফেরার হওয়ার ঘটনায় কোন প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হবে না। অথবা তোমাদের ধরার জন্যে শহরে খানা তল্লাশী বা চতুর্দিকে লোকও লাগাতে পারে। কাজেই আগামীকাল রাজপ্রাসাদের প্রতিক্রিয়া দেখে এরপর আমি তোমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করব। এর আগে এখানেই তোমরা লুকিয়ে থাক।
নিজাম ও কাসেম ছিল পদস্থ সেনা। যুদ্ধের কলাকৌশলে তারা সিদ্ধহস্ত। রাজ্য ও রাজাদের কূটচাল-ববালের সাথে তারা কম পরিচিত। কিন্তু ইমরান চৌকস গোয়েন্দা। কূটচালে সিদ্ধ হস্ত। পরিকল্পনায় পটু। অপরদিকে নিজাম ও কাসেম রাতের গেরিলা আক্রমণে পারদর্শী। এরা আর ইমরানের চিন্তা-ভাবনায় তাই অনেক পার্থক্য। ইমরান অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। সে বলল, তোমাদের যদি কয়েকদিন এখানে লুকিয়ে থাকতে হয়, তবে চাচ্ছি, রাজার সৈন্য শিবিরে আমরা আগুন লাগিয়ে দিব।
এটাও কি সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়। এটা রাজার দ্বিতীয় হামলার আগেও হতে পরত। কিন্তু এখানে আমাদের যে দু’জন সৈন্য ছিল তারা একটি মেয়েকে কেন্দ্র করে লড়াই করে মারা গেল। এজন্য আমরা আক্রমণ চালাতে পারিনি এবং সময় মতো সংবাদও পৌঁছাতে পারি নি যে, গজনী আক্রমণের মুখোমুখি।
“তুমিও তো এখন এক মেয়ের চক্করে পড়েছে।”
“তা ঠিক। কিন্তু আমি কর্তব্যকে প্রেমের ফাঁদে আটকাবো না। একটি মেয়ের জন্যে আমি গজনীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দেবো না। এজন্যে আমি তোমাদের হয়তো কুরবান করে দিতে পারি কিন্তু এর আগে যদি রাজা জয়পাল গজনী আক্রমণে বেরিয়ে পড়ে তবে গজনী থেকে দূরে পেশোয়ারেই যাতে গজনী বাহিনী তার সাধ মিটিয়ে দিতে পারে সে ব্যবস্থা আমি করব। সময় মতো সুলতানের কাছে খবর পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। এ নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।”
“চিন্তার ব্যাপার হলো, সুলতান মাহমূদ সেনাবাহিনীর কমাণ্ড করতে পারবেন কি-না। তাছাড়া তিনি প্রতিবেশী মুসলিম রাজ্যগুলোর সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারেন। সুলতানের অবর্তমানে সালতানাতে বিশৃঙ্খলাও দেখা দিতে পারে।” বলল কাসেম বলখী।
“গজনীর অবস্থা সম্পর্কে বর্তমানে আমরা একেবারেই বেখবর।” বলল নিজাম।
বাস্তবেও গজনীর অবস্থা ছিল শোচনীয়। সুলতানের মৃত্যুতে প্রতিবেশী মুসলিম রাজ্যগুলোর হিংসুটে শাসকরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। সুলতানের জীবদ্দশায় এরা কখনও মথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। গজনীর প্রতি শ্যেনদৃষ্টিতে তাকানোর সাহসও পেত না যারা, সুলতানের অবর্তমানে গজনীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ল তাদের। প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসকেরা সবাই মিলে গজনীর ক্ষমতা করায়ত্ত করার ফন্দি আঁটতে শুরু করল। কিন্তু সুবক্তগীন ক্ষমতালিম্পু কপট মুসলিম প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেয়ে আলোচনার মাধ্যমে তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। একান্তই দায়ে পড়ে যুদ্ধ করতে হলেও তিনি অগ্রপশ্চাৎ গভীরভাবে ভেবে নিতেন। কিন্তু সুলতান মাহমূদের কাছে শত্রু-মিত্র আর সহায়ক ও চক্রান্তকারীদের ব্যাপারটি ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তিনি ছোট বেলা থেকে দেখে আসছিলেন, কোন প্রতিবেশী রাজ্যের কোন শাসক সত্যিকার ইসলামী চেতনা ধারণ করে এবং সুলতানের ন্যায়-নীতির সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই সুবক্তগীনের মত ভাবনার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত এ্যাকশনের মাধ্যমে চিন্তার চেয়েও তীব্র গতিতে সমাধানে পৌঁছায় ব্যক্তি মাহমূদ! তারুণ্য এবং পিতার মতো ইসলামী চেতনার জন্য তার কাজকর্মে ছিল প্রচণ্ড গতি।
গজনীর এক দিকে কাশগরের এলিখানী মুসলিমদের শাসন। অপরদিকে বুখারার সামানী শাসন। অন্যদিকে জিয়াত বংশের শাসন আর পূর্বে-গোরীদের রাজত্ব। এভাবে গজনী সালতানাত বেষ্টিত। দৃশ্যত চতুর্পাশের রাজ্যগুলো মুসলিম শাসনাধীন এবং অঙ্গরাজ্যের মতো হলেও এগুলোর কোনটিতেই ন্যায়পরায়ণ ইসলামী চেতনাসম্পন্ন শাসক ছিল না একটিও। নামেমাত্র এরা মুসলমান হলেও ঈমানী চেতনা হারিয়ে বেঈমানী মোনাফেকী আর ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল । গজনীর শাসকদের প্রতি এরা সবাই ছিল ঈর্ষাপরায়ণ। গজনীর চিহ্নিত শত্রু ও পৌত্তলিকদের সাথেই এসব ভোগবাদী মুসলিম শাসকদের ছিল বেশি দহরম মহরম।
মাহমূদ একদিন খবর পেলেন, বুখারার বাদশাহ খোরাসান অঞ্চল তওবুন বেগ নামের এক আমীরকে দান করে দিয়েছেন। খবর পেয়ে সুলতান মাহমুদ বুখারার বাদশাহকে পয়গাম পাঠালেন, আপনার সাথে আমাদের মৈত্রী চুক্তি রয়েছে। এ অবস্থায় কি করে আপনি গজনী সালতানাতের অধীনস্ত অঞ্চল আমীর তওবুন বেগকে দান করতে পারলেন! এ খবর পাওয়ার পর আমরা মৈত্রী চুক্তি কিভাবে বহাল রাখতে পারি? খোরাসান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিন। যাতে আমাদের মৈত্রী অক্ষুণ্ণ থাকে। আপনি হয়তো জানেন, হিন্দুস্তানের পৌত্তলিক বাহিনী আমাদের উপর আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমতাবস্থায় মুসলিম মিল্লাতের স্বার্থেই আমাদের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন অটুট রাখতে হবে।’
সুলতানের পয়গামের জবাবে বুখারা থেকে যে প্রতিক্রিয়া এল তাতে বোঝা গেল, তারা মাহমূদকে মোটেও গণ্য করে না। তারা লিখল, “বলখ, তিরমিজ ও হেরাত আপনার অধীনেই রয়েছে। আর বাকী অঞ্চলগুলো আমরা আমাদের আস্থাভাজন আমীরদের মধ্যে বণ্টন করে দিচ্ছি।”
সুলতান মাহমূদ এই অবজ্ঞাসূচক প্রতিউত্তরের পরও হাকীম আবুল হাসানকে বহুমূল্য উপটৌকনসহ বুখারার শাসকের কাছে পাঠালেন এবং লিখে জানালেন “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, যে দোস্তি ও সদ্ভাব আমাদের মধ্যে বংশ পরম্পরায় বিদ্যমান রয়েছে সেখান থেকে আমি এমন অপমানজনক প্রতিউত্তর পাব। আমার দুঃখ হচ্ছে, মিত্রতা ও প্রতিবেশীর সাথে সৌহার্দ্যভাব হয়তো অক্ষুণ্ণ রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। আমাকে চুক্তি ভঙ্গে বাধ্য করা হচ্ছে।”
সুলতানের এই সমঝোতা চেষ্টা তো ব্যর্থ হলোই বরং দূত আবুল হাসানও আর ফিরে এলো না। কিছু দিন পর গোয়েন্দার মাধ্যমে সুলতানের কাছে খবর পৌঁছল, আবুল হাসানকে বুখারার উজীর করা হয়েছে। যার জন্যে কোন সংবাদ পাঠানোও প্রয়োজন মনে করেনি সে। সংবাদ পেয়েই সুলতান মাহমূদ তার নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকস কমান্ডোকে বুখারার কেন্দ্রীয় শহর নিশাপুরের দিকে অগ্রাভিযানের নির্দেশ দিলেন। ধারণার চেয়ে দ্রুত সুলতানের বাহিনী নিশাপুরের উপকণ্ঠে গিয়ে হাজির হল। নিশাপুরের আমীর তওবুন বেগের কাছে যখন সুলতানের বাহিনীর খবর পৌঁছল তখন সুলতানের সৈন্যরা নিশাপুরের সীমানার ঢুকে পড়েছে। তওবুন বেগ প্রতিরোধের সাহস না পেয়ে’ বুখারীয় পালিয়ে গিয়ে শাহ মনসুরকে খবর দিল। খবর পেয়ে শাহ মনসুর সুলতানের মোকাবেলায় ময়দানে সৈন্য সমাবেশ করল।
তওবুন বেগ ক্ষমতার স্বাদে বিভোর। সে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা ও যন্ত্রণায় সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্তে নেমে গেল। সে আর এক কুচক্রী আমীর ফায়েককে গিয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে যুদ্ধ সহায়তায় রাজী করাতে সক্ষম হল। আমীর ফায়েক সুবক্তগীনের জীবদ্দশায় বহু চক্রান্ত করেও টিকতে পারেনি। সে চক্রান্ত করে ব্যর্থ হয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। সেই জেদে আমীর ফায়েক সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শাহ মনসুরের সহযোগী হল।
তওবুন চক্রান্তে ওস্তাদ। আমীর ফায়েককে সে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে শাহ মনসুরকে বন্দী করে তার অযোগ্য অপ্রাপ্ত বয়স্ক ভাই আব্দুল মালেককে মসনদে বসিয়ে অন্তরালে নিজেরা ক্ষমতা ও দণ্ডমুণ্ডের মালিক হয়ে গেল। দৃশ্যত এরা, সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধাচারী ও পরস্পরে বন্ধু হলেও পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্রই ছিল এদের চরিত্র।
মাহমূদ কৌশলে এদেরকে কঠিন একটা জায়গায় মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করলেন। মাহমূদের আতঙ্কে এদের কেউই যুদ্ধে মোকাবেলা করার সাহস পেল না। মাহমূদের ভয়ঙ্কর আক্রমণের ভয়ে তওবুন বেগ যে কোথায় পালিয়ে গেল আর পাত্তাই পাওয়া গেল না। আমীর ফায়েকও পালাতে গিয়ে আহত হয়ে সেই যে বিছানা নিল আর দাঁড়াতে পারল না। কিছুদিন পর ফায়েকের মৃত্যু সংবাদ পেলেন সুলতান।
কাশগরে তখন এলীখ খান ক্ষমতাসীন। সে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চিন্তা না করেই সুবক্তগীনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অবনতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বুখারায় আক্রমণ করে বসল। ক্ষমতাসীন বালক আব্দুল মালেককে হত্যা করল। আব্দুল মালেককে হত্যা করে এলীখ খানের কোনই লাভ হলো না। সুলতান মাহমুদের আতঙ্কে এলীখ খান বুখারায় অবস্থান করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস পেল না। সুলতান মাহমূদের আক্রমণের ভয়ে সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সুলতান বলখ ও খোরাসানকে গজনীর অধীনে নিয়ে এলেন।
আব্দুল মালেক নিহত হওয়ায় বুখরায় সামান শাসনের ইতি ঘটল। সুলতান সুবক্তগীনের অবর্তমানে গজনী ও আশপাশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গৃহযুদ্ধ ও অবনতিশীল পরিস্থিতি এতই শোচনীয় হয়ে উঠেছিল যে, তা ভাষায় ব্যক্ত করা। মুশকিল। এই অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সুলতান মাহমুদের উল্লেখযোগ্য লোকবল ও সমর সম্পদ ব্যয় করতে হয়। হিন্দুস্তানের রাজা-মহারাজাদের আক্রমণ প্রতিরোধে সুলতান যে সমর আয়োজন ও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এর বড় অংশই গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে লেগে যায়। গৃহযুদ্ধের বিষবাষ্প রোধ করতে মাহমূদ যে মুসলিম সৈন্য ও যোদ্ধাদের কাজে লাগিয়েছেন এরাই পৌত্তলিকদের আগ্রাসন ঠেকানোর প্রধান শক্তি। আত্মকলহ ও প্রাসাদ চক্রান্ত দমনে এই অপরিমেয় জীবন ও সম্পদ ক্ষয় করতে না হলে মাহমূদের বিজয় অভিযান এবং হিন্দুস্তানের পৌত্তলিক দুঃশাসকদের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো।
বিদ্রোহী, জাতিদ্রোহী, বিলাসী, ক্ষমতালি যে সব আমীর-উমারা মাহমূদের প্রতিরোধের মুখে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল এদের ঘরবাড়িতে ইহুদী-খৃষ্টান ও হিন্দু যুবতী, মদ-মাতলামী আর নৃত্যগীতের বিপুল উপকরণ পাওয়া গেল। বেরিয়ে আসে কুচক্রীদের অন্তরালের জীবন চিত্র আর সুলতানের বিরোধিতার প্রকৃত কারণ। সাধারণ সৈনিক ও জনতা জানতে পারে, এসব আমীর-উমারার সাথে মাহমুদের আদর্শিক ব্যবধান কত। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঐসব আমীরদের ঘনিষ্ঠজনেরা সুলতানকে জানায়, সুলতান-বিরোধী প্রত্যেক আমীরের সাথে ছিল হিন্দুস্তানের হিন্দু মহারাজার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইহুদী ও খৃষ্টানরা দামী দামী উপঢৌকন আর সুন্দরী তরুণী পাঠাতো এদের হেরেমে। প্রত্যেক আমীরের বাড়িতে রাতে বসত নৃত্যগীত আর সুরা পানের আসর। ইহুদী সৃষ্ট হিন্দুস্তানের একটি কেরামতি গোষ্ঠীর প্রধান মুসলিম পরিচয়ে এদের কাছে সুন্দরী তরুণীদেরকে উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতো। দৃশ্যত এরা মুসলিম দাবী করলেও প্রকৃত পক্ষে এরা ছিল ইহুদীদের চর। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আমলেও ইহুদী গোষ্ঠী বিভিন্ন মুসলিম ফেরকা সৃষ্টি করে ইহুদী-খৃষ্টান চক্রান্ত অব্যাহত রাখতে মুসলমানদের হেরেমে মেয়েদের পাঠাতে নির্যাতিতা ও আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। প্রশিক্ষিত এই সব সুন্দরী গোয়েন্দা মেয়েদের রূপ-সৌন্দর্যের ফাঁদে অধিকাংশ ক্ষমতাবান লোক আটকা পড়ে যেত। তারা এদের জায়গা দিতো নিজেদের হেরেমে খাদেমা হিসেবে। নিজেদেরকে মালিকের কাছে মোহনীয় করে উপস্থাপন আর নিবেদিতা প্রমাণ করে এরাই প্রকারান্তরে খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হেরেমগুলোকে দুশমনদের দুর্গে পরিণত করতো। দেহবল্লরী আর যাদুময় নাটকীয়তায় এসব নারী শুধু আইয়ুবকেই নয়; যুগে যুগে মুসলিম খেলাফত ও শাসন ব্যবস্থায় যে কতো অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তার প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেলে পৃথিবীর মানুষ হতবাক হয়ে যাবে। মাহমূদের সময়েও মুসলিম শাসকদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটাতে আমীর-উমারার ঘরে ঘরে তারা রমণীয় ফাঁদ বিছাতে সক্ষম হয়েছিল। বহুসংখ্যক আমীর শ্রেণীর লোক এদের পাতা ফাঁদে আত্মাহুতিও দিয়েছিল। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মাহমুদকে অসংখ্যবার গৃহযুদ্ধ ও বিশৃংখলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সব সময় তাকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছে।
রাজা জয়পালের গোয়েন্দা তৎপরতা তেমন জোরদার ছিল না। যার ফলে সুবক্তগীনের মৃত্যু সংবাদ ছাড়া জয়পালের বর্তমান গজনী সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না। সুলতান যখন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যস্ত আর প্রতিবেশীদের আক্রমণ রোধে ব্যাপৃত এ সময় যদি জয়পাল গজনী আক্রমণ করে বসত তাহলে হয় তো সুলতানের বিরোধীরা জয়পালের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতো। তখন ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে সুলতানের পক্ষে গজনী দখলে রাখা হয়ত কঠিন হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ যে, জয়পাল ও সুলতান বিরোধী কারোরই প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা ছিল না। এরা সুলতানের ক্ষমতা ও প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটেও জ্ঞাত ছিল না। এদের কাছে কেউ সুলতানের দূরবস্থার কথা বলেওনি। এদের তেমন কোন গোয়েন্দা তৎপরতাও ছিল না, যাতে প্রতিপক্ষের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারে। পক্ষান্তরে জয়পালের প্রধান সামরিক কেন্দ্র লাহোরে সুলতানের গোয়েন্দা কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।
* * *
ইমরান দুই কয়েদী কাসেম ও নিজামকে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখে অন্যান্য দিনের মতো পর দিন সকাল বেলা নাশতা নিয়ে যথাসময়ে রাজ প্রাসাদে কয়েদীদের ঘরে হাজির হল। ঘরে বন্দীদের না দেখে সে ঘরের দরজার পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। ইমরান রাজ প্রাসাদের কয়েক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল, কয়েদীরা কোথায় গেছে কেউ তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর রাজার ফরমান এলো কয়েদীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইমরান রাজার ফরমানবাহীকে বলল, সকাল থেকে সে বন্দীদের জন্যে নাশতা নিয়ে বসে রয়েছে কিন্তু তাদেরকে সে দেখছে না। বন্দীরা ঘরে নেই।
“হু, মুসলমানদের বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি। কয়েদীদের লাপাত্তা হওয়ার সংবাদ শুনে বলল রাজা। “ওদের কামরা থেকে পাহারা তুলে দেয়াই ছিল মারাত্মক ভুল। এরা শহরে থাকবে না। যাও! শহর থেকে বের হওয়ার সব পথে চেকপোষ্ট বসিয়ে ওদের খোঁজ কর। পেশোয়ারের দিকে অশ্বারোহী পাঠিয়ে ওদের ধরে আন।”
“দু’জন বন্দী পালিয়ে যাওয়ায় আমাদের এমন কি ক্ষতি হয়েছে যে, সব জরুরী কাজ ফেলে রেখে ওদের পিছনে দৌড়াতে হবে!” বলল এক উজীর। “এই মুহূর্তে অভিযান প্রস্তুতিতে আমাদের পুনঃ মনোযোগ দেয়া উচিত। দুজন ফেরারীকে ধরে আনতে বিপুল সংখ্যক লোককে এদিক ওদিক পাঠিয়ে অভিযান প্রস্তুতির কাজে বিঘ্ন ঘটানো ঠিক হবে কি?”
“ওদের ফেরার হওয়াতে আমার হারানোর কিছু নেই। ওদের কাছ থেকে যা পাওয়ার তা আমি পেয়ে গেছি। কিন্তু ওদের ফেরার হওয়ার শাস্তি ওদের দিতে চাই। তাই জলদি ওদের পাকড়াও-এর ব্যবস্থা কর।” পরক্ষণেই রাজাকে মন্দির থেকে সংবাদ দেয়া হল, বলীদানের জন্যে উপযুক্ত মেয়ে পাওয়া গেছে। আগামী পনের দিনের মধ্যেই মেয়েটিকে বলী দিয়ে ওর রক্ত রাজার মাথায় দেয়া হবে। এতে রাজার বিজয় নিশ্চিত হবে। এখন যে কোন দিন রাজা অভিযান শুরু করতে পারেন।
“শীঘ্রই আমরা অভিযানে বের হব।” বলল রাজা।
এসব সংবাদ সংগ্রহ করতে ইমরানের মতো ঝানু গোয়েন্দার মোটেও বেগ পেতে হল না। সারা দিন সে রাজ প্রাসাদে ডিউটি করে সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরে এল তখন তাকে অনেকটাই উদ্বেগ ও চিন্তামুক্ত মনে হল। বন্দীদের ফেরার হওয়ার ব্যাপারে ইমরানের উপর রাজপ্রসাদের কেউ সন্দেহ করল না। কাসেম ও নিজাম তাড়াতাড়ি গজনী রওয়ানা হওয়ার জন্যে তাকে পীড়াপীড়ি করছিল। ইমরান তাদের পরিস্থিতি জানিয়ে বলল, আরো কয়েকদিন তোমাদের এখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে। এ মুহূর্তে বের হলেই মহাবিপদ। শহরের প্রতিটি বহিগর্মন পথে চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। দূরদূরান্ত পর্যন্ত অনুসন্ধানীদল পাঠানো হয়েছে। এখন ঘর থেকে বের হলে নিশ্চিত ধরা পড়তে হবে।
ইমরানের দরজায় সাংকেতিক কড়া নাড়ানোর শব্দ হলো। ইমরান হেসে বললো, দোস্ত এসেছে! দরজা খুলে দিলে দু’জন লোক ভেতরে প্রবেশ করল। ইমরান ভেতরের ছিটকানি লাগিয়ে আগন্তুকদের ঘরে নিয়ে এল। কাসেম ও নিজামদের ঘরে এদের নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল।
এরা দুজন ছিল পেশোয়ারের বাসিন্দা। তারা বলল, রাজা জয়পাল শীঘ্রই গজনী অভিযানে রওয়ানা হবে। এ মুহূর্তে আমাদের দুটি কাজ করতে হবে।
প্রথমতঃ কাউকে দ্রুত পাঠিয়ে সুলতানকে জয়পালের আক্রমণের খবর দিতে হবে। যাতে রওয়ানা হওয়ার আগেই সুলতান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন । দ্বিতীয়তঃ শহরের বাইরে রাজা যুদ্ধসামগ্রী ও রসদপত্রের বিরাট মওজুদ গড়ে তুলেছে। সমরসামগ্রী সংগ্রহ ও জমার আজ শেষ দিন। ওখানে বিপুল খাদ্য, যুদ্ধাস্ত্র, ঘোড় আর গরুরগাড়ী রয়েছে। এসবে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে।
আগুন লাগানোর কি কৌশল হতে পারে? লাহোরের লোকদের এসবের কোন ধারণা নেই। বলল ইমরান।
এক আগন্তুক বলল, শোনেননি এর আগেরবার লাহোরবাসী কি খেলা দেখেছে। একটা মেয়েকে কেন্দ্র করে গোটা লাহোরবাসী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এখন বাটাভাবাসীরাও গজনীর বিরুদ্ধে সমরায়োজন করেছে। তাই তাদেরও সে ধরনের কোন খেলা দেখাতে হবে।
বাটাভা জয়পালের রাজধানী। এজন্য এখানেই গজনীর গোয়েন্দাদের আড্ডা। যেদিন থেকে জয়পাল গজনী আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করল সেদিন থেকেই যাবতীয় সামরিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র বানিয়েছিল লাহোরকে। লোহোরে গজনীর গোয়েন্দা ছাড়াও স্থানীয় লোকেরাও তাদের তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছিল। হিন্দুরাজা ও শাসকদের অত্যাচার উৎপীড়নে বহু সংখ্যক স্থানীয় বাসিন্দা গজনীর গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। বয়সে তরুণ, মেধাবী ও সাহসী অনেক যুবক লাহোরে গজনীর সুলতানের পক্ষে রাত দিন কাজ করে যাচ্ছিল।
রাজা জয়পাল যখন গজনী আক্রমণের চূড়ান্ত লক্ষ্যে লাহোরে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম, সমরাস্ত্র ও গাড়ী ঘোড়ার সমাবেশ করে, তখন এগুলো ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে গজনী গোয়েন্দাদের কুড়িজনের একটি স্পেশাল টিম মুসাফির বেশে দুজন দুজন করে বিভক্ত হয়ে বাটাভা থেকে লাহোর প্রবেশ করে। এরা লাহোরের স্থানীয় এজেন্টদের সংবাদটি পৌঁছে দিয়েই অপারেশন শুরু করবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে এসেছে দু’ গোয়েন্দা।