মহালয়ার পর থেকে দিনগুলো যেন পাখায় ভর করে উড়তে লাগল। দেখতে দেখতে চতুর্থী, পঞ্চমী, এমন কি ষষ্ঠীও পেরিয়ে গেল।
কদিন আগে হঠাৎ হঠাৎ ঢাক বেজে উঠত, সেটা ছিল মহড়া। এখন প্রায় সারাদিনই রাজদিয়ার আকাশ বাতাস জুড়ে কখনও ঢিমে তালে, কখনও দ্রুতলয়ে ঢাকের শব্দ শোনা যায়। প্রতিমাগুলোর অঙ্গরাগ কবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মার্জনার পর ঘামতেল লাগিয়ে তাদের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। তারপর খুব যত্ন করে পরানো হয়েছে রঙিন পাটের শাড়ি আর জরির অলঙ্কার। মাথায় তাদের কারুকার্যময় মুকুট, হাতে গোছ গোছা চুড়ি, কঙ্কণ এবং অঙ্গদ। নাকের পাটায় প্রকান্ড নথ, কানে কর্ণভূষণ, কণ্ঠ বেষ্টন করে চিক এবং সাতলহর হার। পায়ে মঞ্জীর। এ বেশ দেবীমূর্তিগুলির। কার্তিক এবং গণেশের চুড়ি কঙ্কণ নথ বা কণ্ঠবেষ্টনী নেই। তবে বীরবৌলি আছে।
পূর্ব বাংলার প্রতিমাগুলি কলকাতার মতো নয়। কলকাতার বেশির ভাগ জায়গায় নকল পাহাড় বানিয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ এবং দুর্গাকে আলাদা আলাদ বসানো হয়। এখানকার সব মূর্তিই কিন্তু এক চালির ভেতর।
পেছনে নকশা করা প্রকান্ড চালচিত্র। তার মাথায় মহাদেবের ছবি। সামনের দিকে প্রতিমা। পূর্ব বাংলার মূর্তিগুলি বিরাট বিরাট, সাত আট হাতের মতো লম্বা। বড় বড় বিশাল চোখ তাদের, সেদিকে তাকালে ভয়ও করে, ভক্তিও হয়।
রাজদিয়ায় এখনও বিজলি আলোর দাক্ষিণ্য এসে পৌঁছয় নি। কাজেই রাত্তিরবেলায় পুজোমণ্ডপগুলিতে হ্যাঁজাক কি ডে-লাইট জ্বলতে থাকে। ডাকের সাজে ঝলমলে দেবীমূর্তিগুলিকে তখন কী সুন্দরই না দেখায়।
সাতখানা তো মোটে প্রতিমা।
সেই এক-মেটে দু-মেটে তে-মেটের সময় থেকেই দেখে আসছে বিনু। তার চোখের সামনে মূর্তিগুলিতে রং লাগানো হল, রঙিন পাটের শাড়ি এবং ডাকের সাজ পরানো হল, চালচিত্র আঁকা হল।
কতবার দেখেছে, তবু বিস্ময় আর মুগ্ধতা যেন কিছুতেই কাটছে না বিনুর। পঞ্চমীর দিন প্রতিমাগুলিকে পুজোমন্ডপে আনবার পর থেকে বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকছে না সে। ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখতে চলে আসছে।
.
আজ সপ্তমী।
আশ্বিনের শুরু থেকে ঝকমকে নীলাকাশ, নরম তুলোর মতো থোকা থোকা মেঘ, নদীতীরের কাশ ফুল, হলুদ বোঁটার মাথায় রাশি রাশি হাসিমুখ শিউলি, অল্প অল্প শিশির-যার জন্য এত আয়োজন তা যেন আজ শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে গেছে। সকাল থেকে ঢাকের শব্দে কান আর পাতা যায় না। রাজদিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে দত্তদের বাড়ি, বংশ পরম্পরায় সেখানে পুজো হয়ে আসছে। এবার তাদের পুজোর ঘটা কিছু বেশি। ঢাকা থেকে তারা ব্যান্ডপার্টি আনিয়েছে। চারদিকের ঢাকের শব্দের সঙ্গে ব্যান্ডপার্টির বাজনা মিশে আকাশ বাতাস উৎসবময় হয়ে উঠেছে।
রাজদিয়ার কোনও মানুষই, বিশেষ করে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আজ আর বাড়িতে নেই। দল বেঁধে তারা বেরিয়ে পড়েছে, মন্ডপে মন্ডপে ঘুরছে।
বিনুরা সারাদিন সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেড়াল। বহুবার দেখা প্রতিমাগুলি আরও বহুবার দেখল। তারপর সন্ধের আগে আগে বাড়ি ফিরে এল।
বাড়িতে তখন সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। হেমনাথ সুরমা সুধা সুনীতি ঝিনুক অবনীমোহন, স্নেহলতা, সবাই বেরুবার জন্য প্রায় প্রস্তুত। বিনুর জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন।
বিনুকে দেখে সকলে একসঙ্গে চেঁচামেচি জুড়ে দিল, কী ছেলে রে তুই! সেই পঞ্চমীর দিন থেকে দু’দন্ড যদি বাড়িতে পা পেতে বসছে!
অবনীমোহন শুধোলেন, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
বিনু বলল, ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলাম।
ঠাকুর, ঠাকুর, ঠাকুর! দিন রাত খালি ঠাকুর—
হেমনাথ সস্নেহে বললেন, পুজোর এই ক’টা দিনই তো। আহা, দেখুক দেখুক—
অবনীমোহন আর কিছু বললেন না।
হেমনাথ এবার বিনুর দিকে ফিরলেন। এক পলক তাকে দেখে নিয়ে বললেন, জামা-প্যান্টগুলো তো চটকে মটকে নোংরা করে ফেলেছিস। শিগগির ওগুলো বদলে ভাল জামা-প্যান্ট পরে নে।
বিনু বলল, কেন।
কেন আবার, আমাদের সঙ্গে যাবি।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বিনু। এক্ষুনি আর বেরুবার ইচ্ছা ছিল না তার। তবু বলল, কোথায় যাব তোমাদের সঙ্গে?
হেমনাথ বললেন, বা রে, তোর কিছুই দেখি মনে থাকে না দাদাভাই। আজ শ্যামা’ নৃত্যনাট্য হবে না?
বিনুর মনে পড়ে গেল। আগে থেকেই ঠিক করা আছে সপ্তমীর দিন রাত্তিরবেলা হবে শ্যামা, অষ্টমীর রাত্রে ‘বিজয়া’। স্টিমারঘাট পেরিয়ে সারি সারি মাছের আড়ত এবং বরফকল পেছনে ফেলে একটুখানি গেলেই রাজদিয়ার সব চাইতে বড় আরওয়ারি পুজো। সেখানেই নাটক টাটকগুলো হবে। পঞ্চমীর দুপুর থেকে পুজোমন্ডপের সামনের মাঠে স্টেজ বাঁধা শুরু হয়েছিল, আজ সকালবেলা শেষ হয়েছে। হিরণই দলবল নিয়ে ওটা বেঁধেছে। নাটক নির্বাচন, রিহার্সাল, স্টেজ বাঁধা–সব কিছুর পেছনেই একটি মানুষ। সে হিরণ।
শুধু রিহার্সাল টিহার্সালই নয়, রাজদিয়ার সদর রাস্তার দু’ধারে বড় বড় গাছগুলো রেহাই পায় নি। তাদের গায়ে কত যে রঙিন পোস্টার পড়েছে, হিসেব নেই। পোস্টারগুলোতে লেখা আছেঃ
আসুন আসুন, দলে দলে যোগদান করুন।
স্থান : রাজদিয়া বারোয়ারি পূজামন্ডপ।
সময় : মহাসপ্তমী, রাত্রি আটটা।
ও
মহাষ্টমী, রাত্রি সাতটা।
বিষয় : সপ্তমীর রাত্রে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য।
অষ্টমীর রাত্রে ‘বিজয়া’ নাটক।
অভিনয়ে অংশ গ্রহণ ও কলিকাতার নৃত্যগীত পটীয়সী শ্ৰীমতী সুধা ও শ্রীমতী সুনীতি বসু। (হেমকর্তার নাতনী)। তৎসহ আরও অনেকে।
এ সবই হিরণের কাজ। বিনু শুনেছে, শুধু রাজদিয়াতেই নয়, সুজনগঞ্জ কমলাঘাট, ওদিকে বেতকা আউটশাহী, সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে যাকে পেয়েছে তাকেই নিমন্ত্রণ করে এসেছে হিরণ। ফলে নৃত্যনাট্য এবং নাটকের ব্যাপারে চারদিকে সাড়া পড়ে গেছে।
বিনুকে আর তাড়া দিতে হল না। এক ছুটে ঘরে গিয়ে জামা প্যান্ট বদলে তক্ষুণি ফিরে এল। হেমনাথ বললেন, তা হলে এবার বেরিয়ে পড়া যাক।
সবাই সায় দিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আর দেরি করে কী হবে!
ঘরে ঘরে তালা লাগানো হল। পুজোর দিনে কেউ বাড়িতে বসে থাকবে, তা হয় না। তা ছাড়া নাটকের ব্যাপার আছে। সুধা সুনীতি অভিনয় করবে, রাজ্যের মানুষ দেখবে আর যুগল টুগলরা দেখতে পাবে না, তা কী করে হয়? শখ টখ তাদেরও তো আছে। কাজেই কাউকে আর বাদ দেন নি হেমনাথ, বাড়ি ফাঁকা করেই বেরিয়ে পড়েছেন।
রাস্তায় এসে কী মনে পড়তে তাড়াতাড়ি সুরমাকে ডাকলেন হেমনাথ, অ্যাই রমু, অ্যাই–
কী বলছ মামা?
তুই কি হেঁটে হেঁটে অতখানি পথ যেতে পারবি?
পারব।
অনেকখানি রাস্তা কিন্তু—
কতখানি আর, স্টিমারঘাটের কাছাকাছি তো?
খুব কাছাকাছি না, স্টিমারঘাট পেরিয়ে বেশ খানিকটা। এক কাজ করি বরং–
কী?
সবাই নৌকোয় করে যাই।
সুরমা জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, না মামা, নৌকোর দরকার নেই। রাজাদিয়ায় এসে বেশ ভাল আছি। এই রাস্তাটুকু হেঁটেই যেতে পারব। তা ছাড়া–
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন হেমনাথ।
সুরমা বলতে লাগলেন, কতকাল দেশের পুজো দেখি না। নৌকোয় করে গেলে ঘুরে ঘুরে দেখতে পাব না।
তবে হেঁটেই চল।
হইচই করতে করতে হেমনাথরা এগিয়ে চললেন। সবাই প্রায় কথা বলছে। হেমনাথ-সুধা-সুনীতি অবনীমোনহ–সব্বাই। এলোমেলো, টুকরো টুকরো, বিচ্ছিন্ন কোলাহল। ফাঁকে ফাঁকে ফস করে আলো জ্বলে ওঠার মতো হাসি।
চলতে চলতে উঁচু গলায় হেমনাথ বললেন, তোদের নৃত্যনাট্য ক’টার সময় রে?
সুধা বলল, আটটায়।
তা হলে তো ঢের সময় আছে। ঠাকুর টাকুর দেখে ধীরে সুস্থে গিয়ে পৌঁছলেই হবে।
উঁহু উঁহু—
কী?
সাড়ে ছ’টার ভেতর না গেলে—
না গেলে কী?
সুধা উত্তর দিল না। তার পাশ থেকে চোখের পাতা নাচাতে নাচাতে চাপা সকৌতুক সুরে সুনীতি বলে উঠল, হিরণবাবু একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাবেন।
বিনু কাছেই ছিল। লক্ষ করল, সবার আগোচরে সুনীতিকে চোরা চিমটি কষাল সুধা।
সুনীতি আধফোঁটা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, উ-হুঁ-হুঁ-হুঁ—
হেমনাথ বললেন, কী হল রে?
সুনীতি মুখ খুলবার আগেই সুধা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কিছু হয়নি দাদু।
চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন হেমনাথ। বুঝতে চেষ্টা করলেন দুই বোনের ভেতর কিছু একটা চলছে–গভীর এবং গোপন। বললেন, কিছু হয় নি মানে? নিশ্চয় হয়েছে। সুনীতিদিদি কী যেন বলছিল! সাড়ে ছ’টার ভেতর না পৌঁছলে হিরণটার যেন কী হবে?
সুধা হকচকিয়ে গেল। বিব্রত মুখে বলল, বা রে, হিরণবাবু কতবার করে দুপুরবেলা বলে গেলেন না, তুমি তো তখন শুনলে। সাড়ে ছ’টার ভেতর না গেলে কখনও হয়? মেক-আপ টেক-আপ নিতে সময় লাগবে না?
ঠিক ঠিক– গম্ভীর চালে মাথা নাড়লেন হেমনাথ। কিন্তু তার ভেতর কোথায় একটা ধারাল কৌতুক কাটার মতো মাথা তুলে থাকল।
আরও কিছুটা যাবার পর হঠাৎ একটা গাছের দিকে আঙুল বাড়িয়ে হেমনাথ বললেন, দ্যাখ দ্যাখ–
নাটক আর নৃত্যনাট্যের পোস্টারগুলোর দিকে সবার দৃষ্টি ফিরল। হেমনাথ বললেন, নিশ্চয়ই হিরণটার কাজ।
বিনু এই সময় বলে উঠল, ছোটদি আর বড়দির নাম লেখা আছে, দেখেছ দাদু?
তা আর দেখি নি! ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ– চারদিকের গাছগুলো বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ, আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেগুলো দেখাতে লাগলেন হেমনাথ। বলতে লাগলেন, চারদিকে সুধা সুনীতির নামাবলী লাগিয়ে রেখেছে। হতচ্ছাড়াটার কান্ড দেখেছ!
হতচ্ছাড়াটা কে, সবাই বুঝতে পারল।
নিজের নামের দিকে তাকিয়ে সুধা সুনীতি প্রথমে অবাক। তারপর চেঁচামেচি জুড়ে দিল, এ মা, আমাদের নাম এইরকম করে লিখে রেখেছে!
হেমনাথ হাসলেন, ভালই তো করেছে। কেমন ফেমাস হয়ে গেছিস বল দেখি। তোদের দাদু হিসেবে আমিও বিখ্যাত হয়ে গেলাম।
হিরণবাবুর সঙ্গে একবার দেখা হোক না—
.
এদিককার প্রতিমা দেখে স্টিমারঘাটের কাছে যখন হেমনাথরা পৌঁছলেন, আশ্বিনের সন্ধে ধীর পায়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই নদীপাড়ের সারি সারি দোকানগুলিতে, স্টিমারঘাটে, বরফ-কলে আলো জ্বলে উঠেছে। বেশির ভাগই গ্যাসবাতি, তবে হ্যাঁজাক এবং ডে লাইটও আছে। নদীর খাড়া পাড়ের তলায় নৌকোঘাট। নৌকোগুলোতে মিটমিটে জোনাকির মতো হয় হেরিকেন, নয়তো কোরোসিনের ডিবে জ্বলছে। চারদিকের এত আলো নদীর কালো জলে প্রতিফলিত হয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোল খেয়ে চলেছে।
হেমনাথ যতই ঠাট্টা টাট্টা করুন, আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তাড়াতাড়ি একটু পা চালাও সবাই। আর দেরি করলে সত্যি সত্যিই কিন্তু হিরণ ভিরমি খাবে।
একটু পর বরফকল, মাছের আড়ত পেছনে ফেলে সবাই বারোয়ারি পুজোমন্ডপে এসে পড়ল।
সামনের দিকের খোলা মাঠটায় যেখানে বাঁশ টাশ পুঁতে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি হয়েছে সেখানে ইতিমধ্যেই ভিড় জমতে শুরু করেছে। দূরদূরান্ত থেকে হেরিকেন ঝুলিয়ে দলে দলে আরও অনেক লোক আসছে। তাদের বেশির ভাগই জেলে-মাঝি, চাষী কৃষাণ ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষ। একধারে, খানকতক চেয়ার পাতা। সেগুলো রাজদিয়ার সম্ভ্রান্ত মানুষদের জন্য নির্দিষ্ট। দেখা গেল দত্তবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, গুহবাড়ি, সোমেদের বাড়ি-এমনি নানা বাড়ি থেকে বৌ-ঝিরা সেজেগুঁজে এসে চেয়ার দখল করে বসেছে। এমনকি রুমা ঝুমারাও এসে গেছে। আনন্দ-স্মৃতিরেখা-শিশিরকেও দেখা গেল।
চারধারে খুঁটি পুতে সেগুলোর মাথায় হ্যাঁজাক টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটা হ্যাঁজাকের তলায় দলবল নিয়ে উদ্গ্রীব দাঁড়িয়ে ছিল হিরণ আর বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল। হেমনাথদের দেখতে পেয়ে ছুটে এল। স্বস্তির সঙ্গে খানিক অনুযোগ মিশিয়ে বলল, আসতে পারলেন তা হলে!
হেমনাথ বললেন, পারলাম।
ক’টার সময় আসবার কথা ছিল?
সাড়ে ছ’টায়।
এখন কটা বাজে বলুন তো?
সাড়ে ছ’টা।
মোটেও না। সাতটা বেজে গেছে।
আধঘন্টার জন্যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বলেই আরও কাছে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে হিরণকে দেখতে লাগলেন হেমনাথ।
হিরণ অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, কী দেখছেন অমন করে?
তোকে।
আমাকে যেন আগে আর কখনও দেখেন নি?
সে দেখা নয়।
তবে?
দেখছি তুই ভিরমি খেয়েছিস কিনা– আড়ে আড়ে সুধা সুনীতির দিকে তাকিয়ে হেমনাথ বলতে লাগলেন, সুধাদিদি-সুনীতিদিদি বলছিল–
অন্যমস্কের মতো হিরণ শুধলল, কী বলছিলেন ওঁরা?
সাড়ে ছ’টার ভেতরে আমরা না এলে তুই অজ্ঞান হয়ে যাবি।
লক্ষ্যভেদ যেখানে হবার সেখানে ঠিকই হল। হেমনাথকে চোরা চোখের অগ্নিবাণে বিদ্ধ করে দ্রুত অন্যদিকে মুখ ফেরাল সুধা। সুনীতি ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল।
নেপথ্যে কী আছে, কোন গভীর সঙ্গোপন কৌতুক, অতশত জানে না হিরণ। জানবার কথাও নয়। একটু খেয়াল করলে হেমনাথের চোখেমুখে কিছু একটা ষড়যন্ত্র অনায়াসেই ধরে ফেলতে পারত সে, অন্তত তার আভাস পেত। কিন্তু সে সব লক্ষ করবার সময় এখন নেই। ব্যস্তভাবে হিরণ বলল, আরেকটু দেরি হলে সত্যিই ভিরমি খেতাম। আটটায় শো আরম্ভ করার কথা। ঠিক সময় আরম্ভ করতে না পারলে–
না পারলে কী?
এ ধারের জনতাকে দেখিয়ে হিরণ বলল, ওরা আমার গর্দান নেবে।
লঘু সুরে হেমনাথ বললেন, ওরা তো ঘন্টা-সেকেণ্ড মিলিয়ে চলে! আটটার এক মিনিট দেরি হলে বাবুদের সম্পত্তি নিলামে চড়ে যাবে।
হিরণ আর কথা বাড়াল। ব্যস্তভাবে বলল, আসুন, আসুন– সবাইকে নিয়ে স্টেজের পেছন দিকে গ্রীনরুমে চলে গেল সে। .
স্টেজের মতো গ্রীনরুমটা অস্থায়ী। সেখানে আরও ক’টি ছেলেমেয়েকে দেখা গেল। যেমন দত্তদের বাড়ির যমুনা, সোমেদের বাড়ির লতিকা, গুহদের বাড়ির মাধুরী। রুমাও কখন চলে এসেছে এখানে। ছেলেদের মধ্যে আছে আচার্যবাড়ির নরেন, সেনেদের বাড়ির শৈলেন, এমনি আরও অনেকে। সবাই এরা কলকাতা-প্রবাসী, পুজোর ছুটিতে রাজদিয়ায় এসেছে। ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে কারোর ভূমিকা নর্তকীর, কারোর গায়কের।
সমস্ত কান্ডখানা যার নির্দেশে চলছে সে হিরণ। যারা ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে নাচবে গাইবে, তারা বাদে বাকি সবাইকে তাড়া দিয়ে স্টেজের সামনের দিকে পাঠিয়ে দিল সে। তারপর নাচিয়ে গাইয়েদের বলল, আর সময় নেই। তাড়াতাড়ি সবাই রেডি হয়ে নিন।
আজকের নৃত্যনাট্যে বিনুর কোনও ভূমিকা নেই। কালকের ‘বিজয়া’ নাটক থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। দিনকয়েক রিহার্সালের পর দেখা গেছে তার অভিনয় ঠিক হচ্ছে না। যাই হোক, হিরণের তাড়া সত্ত্বেও সে গ্রীনরুম থেকে যায় নি। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার নজরে পড়ল, সুধা সুনীতি হিরণকে ঘিরে ধরেছে। সুধা বলল, এটা কিরকম হল?
তার গলায় এমন কিছু ছিল যাতে চকিত হয়ে উঠল হিরণ। বলল, কোনটা?
এতক্ষণ হেমনাথরা ছিলেন, তাই সুযোগ পাওয়া যায় নি। পাওয়ামাত্র সুধারা আক্রমণ করে বসেছে।
সুধা বলল, ওই যে গাছে গাছে আমাদের নামে বিজ্ঞাপন লাগিয়েছেন—
ঢোক গিলে হিরণ বলল, ভালই তো হয়েছে। দেশসুদ্ধ লোক একদিনে আপনাদের চিনে ফেলবে।
রাতারাতি বিখ্যাত হবার কথা হেমননাথও বলেছিলেন। সুধা বলল, খুব অন্যায় করেছেন। আমাদের বুঝি লজ্জা করে না?
কিসের লজ্জা?
এবার সুনীতি বলল, বা রে, আমরা দু’বোনই শুধু অভিনয়-টভিনয় করছি নাকি? আরও অনেকেই করছে। তাদের নাম কোথায়? লোকে কী বলবে জানেন?
কী? হিরণ তাকাল।
আমাদের ব্যাপারে আপনার পক্ষপাতিত্ব আছে। বলতে বলতে সুনীতির মাথায় হঠাৎ দুষ্টুমি ভর করল। আড়চোখে বোনকে একবার দেখে নিয়ে সে বলতে লাগল, সুধার নামটা রেখে আমার নামটা বাদ দিলে পারতেন।
সুধা এমনভাবে সুনীতির দিকে তাকাল, যেন ভস্মই করে ফেলবে।
দুই বোনের ভেতর কী হয়ে গেল, হিরণ খেয়াল করে নি। চিন্তাগ্রস্তের মতো সে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। যারা যারা অভিনয় করছে, কালই তাদের নাম দিয়ে নতুন পোস্টার লাগাব।
এই সময় সুধা বলল, আগেভাগে নাম দিয়ে আমাদের ভারি বিপদে ফেলে দিয়েছেন। এটা ভীষণ অন্যায়।
হিরণ ভীরু, সংশয়ের চোখে তাকাল। আক্রমণটা আবার কোন দিক থেকে আসছে সে বুঝতে পারল না।
সুধা বলল, আমাদের নামে অত ঢাক পিটিয়েছেন। লোকে ভাবছে না জানি আমরা কী ওস্তাদ গাইয়ে বাজিয়ে। যখন সত্যি সত্যি নাচতে গাইতে দেখবে, ঠিক ঢিল ছুড়বে। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে।
শো আরম্ভ হবার সময় হয়ে আসছে। মনে মনে বুঝিবা অস্থির হয়ে উঠল হিরণ। তাড়াতাড়ি সে বলল, ঢিল ছুড়বে কি ফুল ছুড়বে, দেখা যাবে’খন। যান যান, শিগগির মেক-আপ নিয়ে নিন।
একটু দূরে দত্তবাড়ির যমুনা বসে ছিল। সুধাদের আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে হিরণ তার দিকে ছুটল। মনে হল, পালিয়েই যেন গেল সে।
তাকিয়ে তাকিয়ে একটু দেখল সুধা। আজকের নৃত্যনাট্যের ব্যাপারে খুব মনোযোগ দিয়ে যমুনাকে তালিম দিচ্ছে হিরণ। এখন কোনও দিকে তার নজর নেই। মৃদু হাসল সুধা। সে জানে শেষ মুহূর্তে এত তালিমের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনটা কেন, তার অজানা নয়।
হিরণ যমুনাকে নিয়ে ব্যস্ত। অগত্যা সুধা আর কী করে? সাজসজ্জায় মন দিল সে। শ্যামা নাটকে নাম-ভূমিকা তার। সুনীতির মেক-আপের দরকার নেই, সে নেপথ্যে বসে গান গাইবে।
এদিকে চঞ্চল পায়ে আরও কিছুক্ষণ গ্রীনরুমে ঘোরাঘুরি করল বিনু। তারপর পাখির মতো ফুড়ত করে স্টেজের সামনে চলে এল।
ইতিমধ্যে ভিড় আরও বেড়েছে। একটা চেয়ারও আর খালি পড়ে নেই। ভিড়ের প্রতিটি মানুষ কথা বলছে, ফলে চারদিকে জুড়ে গুঞ্জন উঠছে।
স্টেজের তলায় এত ভিড় যে একটুও জায়গা নেই। চারধার থেকে জনতা চাপ বেঁধে স্টেজটাকে ঘিরে ধরে আছে।
কোথায় বসবে, কোথায় বসলে ভাল করে দেখা যাবে, ঠিক করতে পারল না বিনু। এদিকে সেদিকে হতাশভাবে তাকাচ্ছিল সে। হঠাৎ একটা গলা কানে ভেসে এল, বিনুদা, অ্যাই বিনুদা–
মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিনু দেখতে লাগল। গলাটা আবার শোনা গেল, এই যে, এখানে–
এবারে দেখতে পাওয়া গেল, স্টেজের ঠিক তলায় বসে আছে ঝুমা। চোখাচোখি হতেই সে হাতছানি দিল।
বিনু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, যাব কী করে? এত ভিড়।
ঝুমাটা আস্ত ডাকাত। সে পরিচয় আগেও পেয়েছে বিনু, আজও আরেক বার পেল। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে একে সরিয়ে, ওকে ধাক্কা মেরে, তাকে কাত করে একটা রাজপথ বানিয়ে ফেলল সে।
প্রথমটা বিনু বিমূঢ়। তারপর পায়ের সামনে একটা রাস্তা পেয়ে গেলে কে আর দাঁড়িয়ে থাকে? চোখের পলকে ঝুমার কাছে গিয়ে বসে পড়ল সে।
বিনু বসবার পর ঝুমাও বসল। চারদিকে হইচই চেঁচামেচি চলছে। সে সব ছাপিয়ে ঝুমার গলা উঁচুতে উঠল, তুমি একটি হাবা গঙ্গারাম–
এমন একটি সম্ভাষণে খুশি হবার কথা নয়। রাগের গলায় বিনু বলল, হাবা টাবা বলবে না।
নিশ্চয় বলব। হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে আর বলবে না! কী করে রাস্তা করে নিতে হয় বুঝেছ?
অপ্রসন্ন মুখে মাথা নাড়ল বিনু, অর্থাৎ বুঝেছে।
একটু চুপ। তারপর মা আবার বলল, তুমি বড্ড মিথ্যেবাদী।
বিনু হকচকিয়ে গেল, কেন?
সেদিন বললে আমাদের বাড়ি যাবে। খুব গেলে তো!
বিনু মনে মনে বানিয়ে নিয়ে বলল, একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
খালি খালি তুমি ভুলে যাও। সেবারও গেলে না, এবারও এলে না। ঝুমা বলতে লাগল, একা একা আমাদের বাড়ি আসতে ভয় করে নাকি?
ভয়ের কথাটা আরেক দিনও বলেছিল ঝুমা। বীরের মতো মুখ করে বিনু বলল, মোটও না। একা একা অমি সব জায়গায় যেতে পারি আজকাল। দেখবে কালই তোমাদের বাড়ি চলে গেছি।
ঠিক তো?
ঠিক।
ঝুমা আবার কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় পর্দা সরে গিয়ে নৃত্যনাট্য শুরু হয়ে গেল। শ্যামা, উত্তীয়, বসেন, কোটাল, শ্যামার সহচারীরা দৃশ্যের পর দৃশ্যে মনোহর নৃত্যভঙ্গিমায় সবাই এক রমণীয় স্বপ্নলোক সৃষ্টি করতে লাগল। নেপথ্যে বসে গাইছে সুনীতিরা। নাচ আর গান, একই তালে একই সুচারু ছন্দে চলছে। অগণিত মানুষ আচ্ছন্নের মতো পলকহীন তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে দর্শকদের মধ্যে থেকে মুগ্ধ কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসছে, কুন দুইজন হ্যামকত্তার নাতিন?
আরেক জন বলল, কে বা জানে!
কইলকাত্তার মাইয়ারা কিবা নাচে!
হ।
কিবা গীত গায়।
হ।
একসময় নৃত্যনাট্য শেষ। দূরদূরান্তের দর্শকরা চলে যেতে লাগল। ভিড় পাতলা হলে বিনু আর ঝুমা গ্রীনরুমের দিকে ছুটল। সেখানে আসতেই পেছন দিকের নিরালা অন্ধকারে একটা নিভৃত দৃশ্য চোখে পড়ে গেল।